।। চৌদ্দ ।।
রজত হেমন্তপুর অভিমুখে রওনা হইয়াছে।
ক্ষুধা-তৃষ্ণায় বিস্তর ক্লেশ পাইয়া যখন সে হেমন্তপুর গ্রামে প্রবেশ করিল, তখন সেখানে এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটিতেছে।
সাধুচরণ দাস গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার দলপতি। এবং তাহার গৃহে যাহারা সমবেত হইয়াছে তাহারা তাহারই অনুগত। একটি মামলা সাজানো হইবে, তাহারই মহলা চলিতেছে।
উত্তর পাড়ার ছমির সেখ তাহাদের লক্ষ্য।
সাক্ষী তালিম দিয়া সাধুচরণ সুখ পাইয়াছে―সবাই প্রস্তুত―জেরার প্রত্যুত্তরে কি বলিতে হইবে তা পর্যন্ত সাধুচরণের শিক্ষায় সাক্ষীগণের কণ্ঠস্থ হইয়া গিয়াছে।
এমন সময় হামিদ হঠাৎ কি যে বলিয়া বসিল তাহার মাথামুণ্ডু কিছুই নাই। শুনিয়া সাধুচরণ হাসিবে কি কাঁদিবে তাহাই ঠিক করিতে পারিল না।
হামিদ বলিল,-আমায় মাপ করো, দাসমশাই; আমি পারবো না। দারোগা ধমক দিলেই আমার সব গুলিয়ে যাবে। শেষে কি উল্টো ফ্যাসাদে পড়বো?―বলিয়া হামিদ এখনই যেন ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়িতে লাগিল।
কিন্তু সাধুচরণের হামিদকেও চাই।
খানিক সে অবাক হইয়া হামিদের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল―যেন হামিদ যে এমন কথা বলিতে পারে তাহার স্বকর্ণে শুনিয়াও সে বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না। তারপর সে রাগিয়া উঠিল। বসিয়াছিল, উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিতে লাগিল,―দারোগা ধমক দেবে আমি থাকতে! হামিদ, তুই বলছিস কি! হুঁ, আশু বিশ্বেস আবার দারোগা―তাকে আবার ভয়! আরশোলাও পাখী, আশু বিশ্বেসেও দারোগা! কত বড় বড় জাঁদরেল দারোগা, যার চোখ দেখলে তোরা কুঁকড়ে আধখানা হয়ে যাবি, লাটসাহেবের খাস দারোগা―তাদের পর্যন্ত আমি এই―
বলিয়া লাটসাহেবের খাস দারোগাগুলিকে এক্রত করিয়া সাধু ট্যাঁকে পুঁজিতে যাইতেছিল, এমন সময় স্থানাভাবে নহে, অন্য কারণে কাজটা তার শেষ করা হইল না।
সাধুচরণের ছোট ছেলেটা কোথা হইতে দৌড়াইয়া আসিয়া খরব দিয়া গেল,―বাবা, দারোগা।―বলিয়াই সে পোঁ করিয়া সিটি বাজাইয়া যেন গাড়ী ছাড়িয়া দিয়া চলিয়া গেল।
–এ্যাঁ, দারোগা? কোথায় দেখলি?
কিন্তু ছেলে তখন বহুদূরে; লাটসাহেবের খাস দারোগা-গ্রাসকারীর ত্রাস দেখিবার জন্য সে দাঁড়াইয়া নাই।
―নিতাই, দেখ ত’ এগেয়ে কে।
কিন্তু নিতাই দেখিতে সুপুরুষ হইলেও ভিতরে কাপুরুষ। এতগুলি লোক উপস্থিত থাকিতে স্বয়ং তাহাকেই অগ্রসর হইতে বলায় সে সংকুচিত হইয়া উঠিল। বলিল,―আমি একা যাবো?
কাপুরুষতা সাধুচরণের একেবারে অসহ্য; ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল,-এ কি বুনো শুয়োর মারতে যাচ্ছো যে লোক-লস্কার-হাতিয়ার সঙ্গে না নিয়ে ফেঁড়ে ফেলবে? যা এরফান, নিতাইয়ের সঙ্গে যা।
সাধুর মন নক্ষত্রবেগে একবার ঘুরিয়া আসিল-কিন্তু দারোগার সরজমিনে এই গ্রামে আসিবার কোনো কারণই সে দেখিতে পাইল না।
–দারোগা নাকি সত্যি?
নিতাই বলিল,―না বোধ হয়, সঙ্গে সেপাই নেই। একা একাই আসছে। পেন্টুলান পরা আছে, টুপি আছে মাথায়।
―তবু সাবধানের মার নেই। তোরা একটু ওদিক পানে স’রে থাক।
নিতাই সরিয়া যাইতে যাইতে বলিয়া গেল,―ট্যাক খালি আছে ত’ দাসমশাই?
কিন্তু যে আসিল সে দারোগা নয়।
–সাধুচরণ দাস কার নাম?―বলিয়া রজত আসিয়া দাঁড়াইল।
সাধুচরণ বলিল,-আজ্ঞে, আমারই নাম সাধুচরণ দাস, আপনার দাসানুদাস।
সাধুচরণ মাথা চুলকাইতেছিল। সেইদিকে চাহিয়া রজত বলিল, –তুমিই এ গাঁয়ের বর্ধিষ্ণু লোক, তাই শুনে তোমার কাছেই এলাম।
―হুজুরের অনুগ্রহ। হুজুর বসলে কৃতার্থ হতাম।–বলিয়া জলচৌকিখানা কোঁচার খুঁট দিয়া পরিপাটি করিয়া মুছিয়া দিলো।
রজত বসিয়া বলিল,―তুমি চিরকাল এই গাঁয়েই বাস করছ?
–হুজুরের আশীর্বাদে এই গাঁয়েই বার-চৌদ্দ পুরুষের বাস। আমিও এই গাঁয়েই চিরকাল আছি; গাঁ ছেড়ে এক পা-ও কোথাও যাইনি কোন দিন।
সাধুচরণের বুকের ভিতরটা গুরগুর করিতেই লাগিল। কোনো বিশেষ দিনে এই গ্রামে থাকাটা ঠিক উচিত কিনা তাহা জানা নাই, প্রশ্ন করিয়া পেন্টুলধারী কোন্ ঘটনার সংস্রবে কি জানিতে চাহিতেছে―আর, গ্রামে পুরুষানুক্রমে থাকারই বা কি ফলাফল দাঁড়াইতে পারে।
জিজ্ঞাসা করিল,–হুজুর বুঝি আমাদের মহকুমার নতুন হাকিম? ―বলিয়া হাত জুড়িয়া রহিল।
রজত হাসিয়া ফেলিল; বলিল-হাকিম-টাকিম আমি নই; তোমাদেরই মত সাধারণ একজন।
শুনিয়া সাধুচরণের উৎকণ্ঠার নিবৃত্তি হইল।
এবং ওদিক হইতে নিতাই প্রভৃতি একে একে নির্গত হইয়া দেখা দিলো। রজত তাহাদের প্রতি একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল,-এ গ্রামে ত্রৈলোক্য বসু নামে কেউ বাস করতেন ব’লে তোমার মনে পড়ে?
–পড়বে না কেন, বাবু, খুব পড়ে। নিতাই, তোরা বোধ হয় জানিসনে, গ্রামের উত্তর সীমানায় তাঁদের বাড়ী ছিল। কিন্তু সে বাড়ীতে ত’ কেউ নেই বাবু, এখন। চারটে ভিটে প’ড়ে আছে। আহা, বড় ভাল লোক ছিলেন তাঁরা। স্বামী-স্ত্রীতে থাকত―এই মহাদেবের মত দেহ। তাঁর স্ত্রীও ছিল তেমনি ভগবতীর মত সুশ্রী।
–কোথায় গেছেন তাঁরা? সন্তানাদি কিছু ছিল তাঁদের?
–না, মনে ত’ পড়ে না। উঁহু, ছিল না। আমি তখন ছোট―তের-চৌদ্দ বছরের। তখন শুনেছিলাম, পশ্চিম মুলুকে কোথায় বড় চাকরী পেয়ে যাচ্ছে। বাবু বুঝি তাঁদের কেউ আপনার লোক?
–না, তবে তাঁদের ছেলের সঙ্গে সম্প্রতি আলাপ-পরিচয় হয়েছে। গ্রামের জমিদার কে?
জমিদারের কথা আর শুদোবেন না, বাবু। একটিবার চোখে দেখতে পেলাম না তাঁর চেহারাখানা কি রকম। তিনি বার-মাস কলকাতাতেই থাকেন। এখানে নায়েব―গোমস্তারা থাকে, হাঙ্গামা-হুজ্জৎ যা করবার তা তারাই করে।
রজতের মনে হইল, সিদ্ধার্থ বাবু গ্রামে কখনো পদার্পণ করেন নাই দেখিতেছি।
সেই সম্পর্কে দু’টি একটি প্রশ্ন চলিতে পারে। কিন্তু আর বেশী সময় নাই। বলিল,―তবে এখন উঠি, সাধুচরণ। পাঁচ মাইল হেঁটে আবার গাড়ী ধরতে হবে। ―বলিয়া পকেটে হাত দিয়া একটি টাকা বাহির করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
রজত শহরের মানুষ। কাজ করাইয়া লইয়া পয়সা দেওয়ার অভ্যাস আছে। কিন্তু সাধুচরণের লওয়ার অভ্যাস নাই। টাকাটা রজত দিতে গেলেই সাধুচরণ বিস্মিত হইয়া বলিল,―টাকা কেন, বাবু!
―তোমাদের কষ্ট দিলাম, মিষ্টি খেও।
―না, বাবু, দুটো কথা ক’য়ে মিষ্টি খেতে টাকা আমি নিতে পারবো না―আপনি ও রাখুন। বরঞ্চ যদি অনুমতি করেন ত’ একটা কথা বলি।
এবং অনুমতির জন্য সময়ক্ষেপ না করিয়াই সে বলিতে লাগিল,―আপনার আহারাদির যোগাড় ক’রে দিই। এ বেলা স্বপাকে সেবা ক’রে ও বেলা গাড়ী ধরবেন।
এ যাত্রা আর সে সুবিধে হ’ল না, সাধুচরণ। আবার যদি আসি তবে খেয়ে যাবো, তবে স্বপাকে নয়, তোমাদের পাকেই। আর জমিদার যাতে গাঁয়ে আসেন তার বন্দোবস্ত ত্রৈলোক্যবাবুর ছেলেকে দিয়ে করিয়ে দেবো।
টাকাটা পকেটে ফেলিয়া রজত পুনর্যাত্রা করিল।