অসাধু সিদ্ধার্থ – ৭

॥ সাত ॥

সিদ্ধার্থের রূপদর্শন ঘটিয়াছে।

সে মানেই তার রূপ; রূপের অসীমতা হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহাকে ভাবিতেই পারা যায় না।

পৃথিবীর অন্তরভূমির স্নিগ্ধ স্বচ্ছ জলধারা যেমন প্রস্রবণের আকারে নির্গত হয় তেমনি সে রূপ―যেন অকাল-শুষ্ক ধরিত্রীর বিস্তৃত বুকের উপর দিয়া সেই অপরিমেয় রূপের প্রবাহ বহিয়া চলিয়াছে―জীবনের মূরে সে প্রাণময় রসাঞ্জলি।

কিন্তু সে প্রবাহের উৎস যেন তাহার ঐ দেহে নয়।

আকাশের নীল রংটা যেমন আকাশের গায়ে নয়; গিরির ধূসর গাম্ভীর্য যেমন গিরির অঙ্গে নয়; তেমনি তার রূপ যেন বহুদূর হইতে বিচ্ছুরিত একটি অপরূপ মসৃণ লাবণ্যের বর্ণাশী।

অতি নিকটে, তবু অজানার গভীরতায় সে রহস্যময়―শুধু অনুভবের বস্তু।

সিদ্ধার্থ অতিশয় অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিতে করিতে রজতদের সান্নিধ্য ত্যাগ করিয়াছিল। কিন্তু পথে আসিয়াই তার আহলাদের অন্ত রহিল না।

উদ্দেশ্য-সিদ্ধির পথে পা দিয়াছে।

অন্তঃপুরে প্রবেশলাভ, চোখে চোখে চাহিয়া বাক্য বিনিময় ঘটিয়াছে। যাওয়া―আসার নিমন্ত্রণও পাইয়াছে।

এ-পর্যন্ত কল্পনার চরিতার্থতার কিছু বাকি নাই। কিন্তু পরক্ষণেই খচ্ করিয়া কোথায় যেন বিধিল।

সে অপবিত্র। মনে হইতেই তাহার সমগ্র চিত্ত একাগ্রতা ভাঙিয়া আর অগ্রসর হইতে চাহিল না। যে মন্দিরে সে প্রবেশ করিতে চায় অশুচি অন্তর লইয়া তথায় প্রবেশ করিবার অধিকার আছে বলিয়া তার কিছুতেই মনে হইল না―তার জন্মের উপর দেবতার আশীর্বাদ, মানুষের শুভ ইচ্ছা বর্ষিত হয় নাই।

কিন্তু সে অপরাধ তাহার নয়।

যে অপরাধ তার স্বকৃত তার ওজনও ত’ কম নয়; এবং তাহারই ভারে তাহার মন যেন কেবলই নুইয়া পড়িতে লাগিল―পাপের কলঙ্ক ইচ্ছামত ঝাড়িয়া ফেলিয়া অম্লানমুখে সুকী সাজা যায় না―প্রাণান্তকর এই কুণ্ঠাই বুঝি তাহার মত পাপীর তীব্রতম শাস্তি।

অসংখ্যপদ সরীসৃপের মত শরীর অবশ হইয়া আসে―তথাপি সাধ্য নাই যে, সেটাকে টানিয়া তুলিয়া সে আড়ালে কোথাও ফেলিয়া দেয়। নিজের লজ্জা চিরদিন নিজেকেই বহন করিতে হইবে এই কঠিন নিয়মটাকে কোন প্রকারে উল্টাইয়া দিবার উপায় একেবারেই নাই।

একদিকে সিদ্ধার্থর শিক্ষিত মন, অন্যদিকে তার বর্বরতার প্রগতি। একদিকে ভারোন্মাদনা, অন্যদিকে বস্তুমোহ। একদিকে কি করা যায় তৎসম্বন্ধে অসাধারণ দুশ্চিন্তা, অন্যদিকে প্রয়োজনের দুর্নিবার চাহিদা।

এইসব বিপরীতধর্মী প্রেরণার সঙ্কোচ ও প্রসারের মধ্যে পড়িয়া সিদ্ধার্থ অবিরাম হাঁপাইতে লাগিল―দাবিদার সকলেই―কিন্তু মানুষের ব্যবস্থাতন্ত্র তাহাকে পথ ছাড়িয়া দেয় না।

.

পরদিন।

সবিনয়ে নিজের পরাজয় সহস্রবার স্বীকার করিয়া ঘাড়ে গুঁজিয়া চলিতে চলিতে সিদ্ধার্থ যেখানে যাইয়া উঠিল সেটা রজতের বৈঠকখানা। সিদ্ধার্থ ঘাড় তুলিয়া প্রথমে বিস্মিত হইল―এখানে সে কেমন করিয়া আসিল! তারপর দেয়ালের দিকে চাহিল।

চার দেয়ালে আটখানা ছবি।

একখানার নীচে লেখা রহিয়াছে―অজয়া। দেখিবামাত্র নির্জন ঘরের ভিতর সিদ্ধার্থর কল্পনা ছুটিতে লাগিল,―চাঁপার কলির মত অঙ্গুলিগুলি লীলায়িত হইয়া এই ছবিখানি আঁকিয়াছে, সমস্ত কল্পনাশক্তি প্রাণপণে জাগ্রত আর সূচাগ্রের মত তীক্ষ্ণ হইয়া এই ছবির প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিয়াছে, চোখের দৃষ্টি নত হইয়া ইহার উপর ঢলিয়া পড়িয়াছিল―সেই প্রাণ কেমন মধুর, দৃষ্টি কত সূক্ষ্ম, আঙুলগুলি কত কোমল।

আরো কত তথ্য সে আবিষ্কার করিতে পারিত কে জানে; কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তির আগমনেই তার কল্পনার বিন্যাস হঠাৎ এলোমেলো হইয়া গেল।

যে আসিল সে ভৃত্য মাণিক।

সাধারণ ভদ্রলোক এরূপ অবস্থায় যেরূপ আচরণ করে, মাণিককে হঠাৎ সম্মুখে দেখিয়া সিদ্ধার্থর আচরণে সেই স্বাভাবিকতা ছাড়া আর সবই দেখা গেল।

থতমত খাইবার তার কথা নয়।

জবাবদিহিরও প্রয়োজন ছিল না।

অথচ অপরাধীর মত অতিশয় সঙ্কুচিত হইয়া সিদ্ধার্থ যে কি বলিতে বলিতে পাশ কাটাইয়া বাহির হইয়া গেল, মাণিক তাহার চোদ্দ আনাই বুঝিতে পারিল না। খানিক অবাক হইয়া থাকিয়া সে উপরে সেই খবরটাই দিতে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *