॥ পনের ॥
লাহোর হইতে রজত ফিরিয়াছে।
বলিতেছিল,―সিদ্ধার্থ বাবু যা যা বলেছেন তার একটি বর্ণও মিথ্যে নয়, পিসিমা। হেমন্তপুরে তাঁদের ভিটে প’ড়ে আছে। লাহোরে তাঁর পিতৃবন্ধু অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে―তাঁরা এক-একজন দিপাল লোক। তাঁরা সবাই ত্রৈলোক্যবাবুর অকালমৃত্যু স্মরণ ক’রে তার অশেষ গুণগান আর সিদ্ধার্থবাবুর জন্য অত্যন্ত আক্ষেপ ক’রে বললেন,―অমন গুণবান ছেলে দুটি দেখা যায় না। কিন্তু একটি মহোদোষ তাঁদের সমুদয় আশা আর সিদ্ধার্থ বাবুর জীবন মাটি ক’রে দিয়েছে।
–কি মহাদোষ?
―নিজের স্বার্থ চিন্তা না করা। যতদিন তাঁদের মধ্যে সিদ্ধার্থবাবু ছিলেন, ততদিন একা একা বিষণ্নমুখে সর্বদাই কি ভাবতেন। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একদিন তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তখন তিনি বয়ঃপ্রাপ্ত। আমার মুখে তাঁর কুশল-সংবাদ পেয়ে সকলেই মহা আহ্বলাদিত হলেন। এখন তোমার পরীক্ষার ফল কি বলো।
পিসিমা হঠাৎ একটু হাসিলেন। বলিলেন,―প্রথম যেদিন দেখা হ’ল সেদিন আমি একা ছিলাম। সিদ্ধার্থ ঘরে ঢুকতেই আমার চোখে পড়ল তার চোরের দৃষ্টি।
― চোরের দৃষ্টি? মানে?
অভ্যস্ত চতুর দৃষ্টি―যা একপলকেই দেখে নেয়, কোথায় কোন্ জিনিষটা রাখা আছে, কোন্টা ভারি, কোন্টা হাল্কা―প্রত্যেকটির মূল্য কত!
প্রথমটা চম্কিয়া উঠিলেও রজত ইহার একটি অক্ষরও বিশ্বাস করিল না।
নৃ-চিরত্রে এই সূক্ষ্ম অনুপ্রবেশ আদৌ সম্ভব নহে―পিসিমা নিজের কৃষ্ট-কল্পনাকে সাজাইয়া একটা চমকপ্রদ আকার দিবার ব্যর্থ চেষ্টা করিয়াছেন। রজত মনে মনে একটু হাসিয়া তাঁহাকে একেবারে অগ্রাহ্য করিয়া দিলো। সিদ্ধার্থ দরিদ্র বটে, পিতা দানাতিরিক্ততার ফলে, কিন্তু চোর সে হইতেই পারে না। পিসিমা নিজেকে বড় চক্ষুষ্মান মনে করিতেছে। ছিঃ!
বলিল,―তারপর?
―তারপর গল্প। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলাম―সে নির্বিকারে উত্তর দিতে লাগল। কোন্টা অশিষ্ট, কোটা অনাবশ্যক, কোটা অন্যায়, কোনটা লজ্জাকর সে বিষয়ে তার কোন চেতনাই দেখা গেল না।
―কি বুঝলে তাতে?
―এমন সমাজে সে মিশেছে যেখানে কথার শিষ্ট-শোভনতা সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করা হয় না।
–তা তিনি মিশেছেন সত্যিই। চিরকাল ছোটলোককে আস্কারা দিয়ে বেড়িয়েছেন। কথার অপরাধ নেয়াটা অভ্যাসের বাইরে চ’লে গেছে।
–কিম্বা মনের ওপর দকল খুব। তার গান শুনেছ?
―শুনেছি মধুর।
–চোখ দুটি বড় বিষণ্ণ। অজয়া যে তাকে ভালবেসেছে তাতে আমি কিছুমাত্র বিস্মিত হইনি।
–কেন?
অজয়া তখন দশ বছরের। তার পড়বার বইয়ে একটা গল্প ছিল যে, এক পর্যটক হঠাৎ একদিন দেখলে একপাল নেকড়ে তার তাঁবুর চারিদিকে জিব বার ক’রে ঘুরছে। অন্য উপায় না দেখে তাঁবুর চারিদিক্কার ঘন জঙ্গলে সে আগুন লাগিয়ে দিলে। নেকড়ের দল সেই বেড়া আগুনে একটি একটি ক’রে পুড়ে ম’লো। অজয়া তাই প’ড়ে কেঁদে আকুল। আমি ছিলাম কাছে ব’সে―ভাবলাম, বুঝি সেই ভদ্রলোকের কষ্ট দেখেই সে কাঁদছে। শুনে দেখি, আদৌ তা নয়। বেচারা নেকড়েগুলো যে পুড়ে ম’লো, কাঁদছে সে তারই দুঃখে। নেকড়ের হয়ে অজয়া চিরকাল লড়বে যদি তারা অনাহারে শীর্ণ হয়। –একটু হাসিয়া পিসিমা আবার বলিলেন,–অজয়ার মুখে সিদ্ধার্থর কথা ধরে না। কিন্তু সিদ্ধার্থ আমার সামনে অজয়ার নামটিও একবার উচ্চারণ করেনি।
–সেটা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তিনি কেবল মায়ের নামে কেঁদে ফেলেন, দেশের নামে জ্ব’লে ওঠেন। শুনে এলাম, উৎসাহের বাড়াবাড়ি নিয়ে তাঁকে কেউ বিদ্রূপ করলে তিনি বলতেন, অতিরিক্ত উৎসাহ নিয়ে যাত্রা করাই শ্রেয়; কারণ পথে তার এত ক্ষয় আছে যে, তা নইলে ঠিকানায় পৌছবার আগেই বুক খালি হয়ে যায়।
―সকলের চেয়ে ভারি কথাটা এখনো বাকি আছে, রজত। সিদ্ধার্থ বিয়ে করবে না।
―করবে না?―বলিয়া রজত যেন কাঁপিয়া উঠিল।
সিদ্ধার্থর প্রতি তাহার মনে মনে যে অভক্তির ভাবটা ছিল, লাহোর এবং হেমন্তপুরে ঘুরিয়া আসার পরও তাহা সম্পূর্ণ কাটিয়া যায় নাই এই হিসাবে যে, সিদ্ধার্থ সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলে হইলেও সে দরিদ্র। ধনী গৃহস্থ হইয়া স্বেচ্ছায় দারিদ্র-ব্রত গ্রহণ বরণীয় বটে―কুলমর্যাদা তার প্রাপ্য। কিন্তু সে ধন ত্যাগ করিয়া আসে নাই। কেবল অতীত―গৌরবের একটা বেষ্টনীর মধ্যে অবস্থান করিতেছে―বর্তমানে তুলনাগত লৌকিক দাবী তার কতটা! নাই বলিলেও বোধ হয় চলে।
অথচ, সিদ্ধার্থ বিবাহ করিবে না শুনিয়া রজত নিষ্কৃতির আনন্দ পাইল না।
সিদ্ধার্থ নিজেই কর্তা সাজিয়া তাহাদের উপর স্বেচ্ছাচারীর মত যথেচ্ছ ব্যবহার করিয়া যাইবে ইহাও অসহ্য। সিদ্ধার্থ বিবাহ করিবে না শুনিয়া তাহার মনে হইল, সগোষ্ঠী তাহাদের একটা শোচনীয় পরাজয় ঘটিতেছে।
পিসিমা বলিলেন,―কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলাম, বে-থা ক’রে সংসারী হবার কথা কখনো সে ভেবেছে কি না। শুনে সে হেসে বললে,-ভিক্ষুক দেশে যথেষ্ট আছে
―তাদের সংখ্যা বাড়াবার আগ্রহ আমার নেই। তারপর বললে, আমার মা নেই, মাতৃজ্ঞানে আপনার সম্মুখে বলছি, পরকাল আমি মানিনে। কিন্তু মানি যে ইহকালের সুখ নিশ্চেষ্ট ত্যাগে নয়, নিরঙ্কুশ ভোগে নয়, নিরলস কাজে।
রজতের রাগ হইল; বলিল,–জ্যাঠা ছেলে! অজয়া শুনেছে?
―না।
–তুমি কেন বললে না, এমন বিয়েও ত’ মানুষের করে যাতে ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়ে না।
পিসিমা তাহা বলিয়াছিলেন। উপরন্তু ইহাও বলিয়াছিলেন যে, বিবাহ করিয়া উপার্জনে মন দিলেও ত’ চলিতে পারে।
সিদ্ধার্থর গৃহ নাই―সেই দুঃখে সে একদিন রজত ও অজয়ার সম্মুখে অশ্রুমোচন করিয়াছিল। কিন্তু পিসিমার কাছে সে বলিয়া গিয়াছিল, সে যে-ব্রত গ্রহণ করিয়াছে, বন্ধন মানিলেই তাহার চ্যুতি ঘটে। বন্ধননির্মুক্ত অখণ্ড প্রাণই দেশের জন্য আবশ্যক।
দেশের এই প্রয়োজনটির উল্লেখে রজতের মুখ বিদ্বেষে বিকৃত হইয়া উঠিল। বলিল―দেশের গয়ায় পিন্ডি দিতে। আবার উভয়সঙ্কট উপস্থিত। সিদ্ধার্থ বাবু এখন মুখ বুজে চ’লে গেলে অজয়া ভেঙে পড়বে। আমাদের পক্ষ থেকে নির্লজ্জের মত কথটা তুললে তিনি ভাববেন, গছিয়ে দিচ্ছি।
―কি দেখে? ও রকম ভাবনার দিক দিয়ে সে যাবে না।–বলিয়া পিসিমা মনে মনেই একটু হাসিলেন।
রজত জানে না। কিন্তু পিসিমা জানেন, পুরুষের পক্ষে এই লোভটা কত উগ্ৰ। তিনি দেখিতে পাইয়াছেন, মানুষের ভিতরকার সর্বাগ্রবর্তী সান্দ্র ছায়াটি।
ছায়াপাত হয়। ধীরে ধীরে গাঢ় হইয়া আসে। তারপর শুরু হয় আলো-ছায়ার খেলা। মুহুর্মুহুঃ পট পরিবর্তন।
তারপরই সেই যবনিকাখানি নামিয়া আসে যাহা নিষ্কম্প আর আলোকে উজ্জ্বল।
রজত ছাড়া আর যে কেহ ইহা দেখিতে পাইত, কিন্তু মহা একটা উৎপাতের বিরক্তিতে বিভ্রান্ত হইয়া নিজেরই দায়িত্ব ছাড়া আর কিছুই তাহার চোখে পড়িল না। সে দেখিল, সিদ্ধার্থ যাহা বলিয়া গেছে কেবল তাই। বলিল-আমি নিজের হাতে এই সঙ্কট গ’ড়ে তুলেছি। সিদ্ধার্থ বাবুর প্রতি অজয়ার ব্যথার ব্যথীর ভাবটা যদি বাড়তে না দিতাম!―বলিয়া, কোন্ পর্যন্ত আসিলেই সে সিদ্ধার্থকে তাড়াইতে পারিত তাহাই, গালে হাত দিয়া ভাবিতে লাগিল।
অজয়া চা লইয়া আসিল।
এবং তাহার দিকে চাহিয়া রজতের এমন একটা মমতা জন্মিল যাহা নিতান্তই অভিনব এবং যাহা অকস্মাৎ উদ্গত একটা প্রস্রবণের মত―চতুর্দিকের ধূ ধূ কঠিন মৃত্তিকার সঙ্গে তার কোন সংস্পর্শই নাই। যেন বাতাসের উপর ভাসিয়া বেড়াইতেছে। মনের কোথাও দুশ্চিন্তার ম্লান রেখাটি পর্যন্ত নাই। সে কি নির্মম কাজই হইবে, যদি বিভোর সুখের এই লালিমা আঘাত পাইয়া বিবর্ণ হইয়া ওঠে।
সঙ্গে সঙ্গে রজত সিদ্ধার্থকেও ক্ষমা করিল। হোক তার মূর্ছা ভান, থাক তার চোখে চোরের দৃষ্টি।
অজয়ার দিক চাহিয়াই, সিদ্ধার্থর বিরুদ্ধে সমুদয় অ-ক্ষমা অনিচ্ছার বাষ্প কাটিয়া তার মনের আকাশ সুপ্রসন্ন হইয়া উঠিল।
অজয়া বলিল, –দাদা, চা।
রজত বলিল,–দিদি, গান। ননী কোথায়?
―তার অসুখ করেছে। (পিসিমার প্রতি) পিসিমা, এবারকার মন্ত্রণাসভা কাকে ডিমিস্ করল? তোমাদের আমি দোষ দিইনে! ধারণার যা বাইরে ছিল, তাকে চোখের সামনে দেখলে তাকে অসঙ্গত অস্বাভাবিক অদ্ভূত ব’লে কষ্টিপাথরের ওপর উদ্যত করা মানুষের স্বধর্ম―মানুষ তাকে সন্দেহ ক’রে বর্জন করতেই চায়।
রজত বলিল, –মানুষজাতটার ওপরেই খড়গহস্ত হয়ে উঠেছ দেখছি। রত্ন কুড়িয়ে পেলেই তাকে মহার্ঘ জ্ঞানে ঘরে তুলতে হবে এমনধারা বাঁধা নিয়ম নেই, রত্নের মধ্যে ঝুটা আছে ব’লেই। তা যাই হোক, ডিস্মিস্ আমরা কাউকে করিনি―সবাই স্ব স্ব স্থানে বজায় আছে, এবং যাতে আরো থাকে তারই আয়োজন চলছে। তোমার বর্তমান স্থান―
বলিয়া হার্মোনিয়ামটা দেখাইয়া দিলো।
―যাই। কিন্তু তোমরা আমায় ভুল বুঝলে কেন? তোমরা ভেবেছিলে, আমি তোমাদের বিঘ্ন হয়ে দাঁড়াব―
―ঘুণাক্ষরেও তা ভাবিনি।
―ভেবেছ। তা নইলে আমায় গোপন ক’রে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে এলে কেন? আর দিবা-রাত্র এই গোপন আলোচনাই বা কিসের? তোমরা সিদ্ধার্থ বাবুকেও চেননি, আমাকেও চেননি। তিনি ভদ্রলোক-তিনি তা নন জানা গেলে আমি অক্লেশেই তাঁকে ত্যাগ করবো। অতএব পরামর্শ মজলিসে আমাকেও ডেকো। দাদার চা কি মাটি হ’ল?
–না হয়ে আর করে কি! যে রকম তলোয়ার ঘুরিয়ে এসে দাঁড়ালে তুমি-পিসিমা ত’ একেবারে থমকে গেছেন। আমি ভাবছিলাম, এ যাত্রা যদি বেঁচে যাই তবে চায়ের নামটি আর মুখে আনব না।
অজয়া হাসিমুখে যন্ত্রটার দিকে অগ্রসর হইয়া গেল।