॥ তিন ॥
যাহাকে দর্শনমাত্রেই সিদ্ধার্থ ডিগবাজি খাইয়া মরণের তট হইতে জীবনের জোতির্মঞ্চে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, বলা বাহুল্য সে একটি নারী। প্রপাতের অদূরে সে রাস্তা দিয়া যাইতেছিল―সহসা তাহাকে দেখিয়াই সিদ্ধার্থর মরিবার সঙ্কল্প উল্টাইয়া সরাসরি একটা সহজবুদ্ধির উদয় হইল।
সঙ্গে পুরুষ আছে।
উহারা কে তাহা জানিবার দরকার আছে বলিয়াই সিদ্ধার্থর মনে হইল।
সিদ্ধার্থ অগ্রসর হইয়া গেল; এবং একটা বৃহৎ শিলাপিণ্ডের আড়ালে থাকিয়া অল্প একটু মুখ বাড়াইয়া দেখিল, দু’জনায় ঘাসের উপর বসিয়াছে।
সিদ্ধার্থ চেনে না, কিন্তু উহারা দুই ভাইবোন; নাম রজত ও অজয়া-স্বাস্থ্যানুসন্ধানে এই নিরালা পার্বত্য প্রবাসে আসিয়াছে।
সিদ্ধার্থ শুনিতে লাগিল―
অজয়া বলিতেছে,―কি সুন্দর! সামনে দেখো একটি ছোট্ট ফুল, ছোট্ট মুখখানি বের ক’রে আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে। ভয়ে ভয়ে সাবধানে বাইরে এসেছে―মানুষের সঙ্গে চোখোচোখি হ’লেই যেন চুপ ক’রে ভেতরে পালিয়ে যাবে।
রজত বলিল,–তুলে আনি ফুলটা?
বলিয়াই উঠিবার উপক্রম করিল।
অজয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিয়া বলিল,–না, না। তুমি কি! ফুলটা ত একফোঁটা চোখের জল নয় যে দেখতে হবে তাতে লবণের ভাগ কতটা!
প্রকাশ যে, রজত বৈজ্ঞানি প্রণালীতে বিশ্লেষণ করিয়া চোখের জলে লবণের অংশ শতকরা কত এবং সেই লবণসঞ্চয় সে কোথা হইতে করে তাহাই আবিষ্কার করিবার চেষ্টায় আছে। চোখের জলের মত সুলভ অথচ যুগপৎ সুকোমল ও সুকঠিন জিনিষ বস্তুজগতে আর কিছু নাই বলিলেও চলে।
এবং এক সঙ্গেই ব্যাখ্যাত ও অব্যাখ্যাত বলিয়া ওটা বড় আশ্চর্য জিনিষ।
মানুষের মনের গভীরতম বার্তাটি নিঃশব্দে অনাড়ম্বরে প্রকাশ করে ঐ স্বচ্ছ একবিন্দু জল।
কিন্তু কোথায় তার সৃষ্টি―কৌশলের সূক্ষ্ম যন্ত্রটি এবং কোথায় তার ভাবনিবিড়তা। এই প্রশ্নটিকে বাদ দিয়া রজত তার উপাদান লইয়া নিপুণ চর্চা সুরু করিয়া দিয়াছে।
লবণের কথাটি উল্লেখের সময় অজয়ার ওষ্ঠপ্রান্তে একটু হাসির উদয় হইয়াছিল, কিন্তু রজত যেন তাহা দেখিয়াও দেখিল না; বলিল,―বাস্তবিক, ফুল দেখবে ত এসো পাহাড়ে। ভূঁইচাঁপা আর স্থল-পদ্মই ফুটেছে কত! কিন্তু আমি তারিফ করছি ঝুলানো ঐ রাস্তাটার। উঃ, কত লোক যে ওটা তৈরীর সময় পড়েছে আর মরেছে তার ইয়ত্তাই নেই! আমাদের সুরেন―
―ওগুলো কি ফুল, দাদা, প্রকাণ্ড একটা গাছে থোপা থোপা ফুটেছে, থেকে থেকে এক একটা খ’সে পড়ছে?
―ইয়ে ফুল; নামটা কি ভুলে যাচ্ছি।
অজয়া হাসিল। বলিল,―জানো না তাই বল।
―ঝুলানো রাস্তাটার ওপর একটা মানুষ আমাদের দিকে সুমুখ ক’রে দাঁড়িয়ে আছে যেন আকাশের গায়ে ঠেস দিয়ে আরো দূর থেকে দেখলে মনে হবে, আকাশের গায়ে আঁকা। মানুষের স্বচক্ষে দেখাটাও অনেক সময় মিথ্যে হয়ে যায় এক দূরত্বের বিভ্রমের দরুন।
অজয়া কিছু বলিল না।
সেই রাস্তাটার দিকে চাহিয়াই রজত বলিতে লাগিল,–এ পাহাড়ের মাথা থেকে ও পাহাড়ের মাথা পর্যন্ত শূন্যের ওপর দিয়ে প্রায় মাইলটাক্ লম্বা ঐ রাস্তাটা গড়তে যেমন বুদ্ধি খরচ করতে হয়েছে, টাকা ঢালতে হয়েছেও তেমনি। এই রাস্তা তৈরীর কাজে আমাদের সুরেনেরও না কি হাত আছে।
অজয়া ভূভঙ্গী করিল। এবং রজত বক্রনয়নে অজয়ার মুখের উপর একটা কৌতুক-কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া বলিতে লাগিল,―সুরেনটা চিরকাল অকালপক্ক আর কাজ-পাগল। বড়লোকের ছেলে―অথচ দিনরাত কি পরিশ্রমটাই করে―মৌলিকতার বড় বড় ইংরেজ ইঞ্জিনীয়ারকে হার মানিয়া দিয়েছে। ব’সে খেলে যার নিন্দে নেই, লোকসানও নেই, সে যদি খাটে তাহ’লে বুঝতে হবে দারিদ্র্যকে সে স্বেচ্ছায় বরণ ক’রে নেয়। কি বল?
কথিত কারণে দারিদ্র্যকে স্বেচ্ছায় বরণ করিয়া ওয়া হয় কি না সে বিষয়ে অজয়ার কোনো লিপ্ততাই দেখা গেল না। একখানা পাথর দেখাইয়া বলিল,― এটা কি পাথর, দাদা? ইয়ে পাথর নয় ত?
―একরকম স্ফটিক পাথর, আত্-মেশানো ব’লে চিক্ চিক্ করছে। কিন্তু আমি বলছিলাম, ঐ রকম স্বেচ্ছাদারিদ্র্যকে আমি খুব প্রশংসা করি। তুমি―
অজয়া হাসিয়া বলিল,―তুমি প্রকারান্তরে আত্মপ্রশংসা করছ। তোমারও ত না খাটলে চলে: তুমি খাট কেন?
এমন কথা অজয়ার মুখে! বলিল,―আমার কথা বলছ! খুব কম সুরেনের তুলনায়―সে কাজ ক’রে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছুটে বেড়াচ্ছে, আমি টেবিলের ধারে ব’সে সৌখীন একটু রসায়ন শাস্ত্র আলোচনা করি। সুরেনের সঙ্গে আমার তুলনা! বাপরে!
বলিয়া, অজয়ার অযৌক্তিকতায় অবাক হইবার জন্য চোখ এবং হাঁ যতটা বড় করা যুক্তিযুক্ত ততখানিই বড় করিয়া রজত অজয়ার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
কিন্তু অজয়ার বুঝিতে বাকি রহিল না যে, চোখের জলে লবণের ভাগ যত থাক, দাদার এই অবাক হইবার মদ্যে কাতরাই পনর আনা।
দাদার চোখে-মুখে এই কাতরতা দেখা অজয়ার অভ্যাস হইয়া গেছে।
.
সুরেন রজতের বন্ধু।
রজতের ইচ্ছা, বন্ধুকে সে আরো আপনার করিয়া লাভ করে; তাহার উপায় অজয়া―
দু’টিতে যদি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইয়া যায় তবে―
রজত ভাবে, সে সুখ অনিবচনীয়।
কিন্তু অজয়া তাহাতে বারম্বার আপত্তি করিয়াছে, অথচ নির্দিষ্ট কোনো কারণ সে দেখায় নাই। তাই রজত যখন-তখন ভগিনীর মন বুঝিতে বসে।
এখনো রাজতের হাঁটা আর চোখ দু’টি প্রার্থনায় পরিপূর্ণ হইয়া দেখা দিল।
কিন্তু সে প্রার্থনায় আবেদন বড় দুর্বল–আপাতত কোনো কাজে আসিল না।
অজয়া খানিক ভাবিয়া বলিল,―সুরেনবাবুর নামটি আমার বারবার কেন শোনাচ্ছ, দাদা?
প্রশ্নের সুর শুনিয়াই রজত উপিস্ করিতে লাগিল; বলিল,―বিশেষ কোনো হেতু তার নেই, তবে তার কথা সর্বদাই আমার মনে পড়ে―সময় সময় না ব’লে পারিনে। তার হাতের এই রাস্তাটা দেখে আরো বেশী ক’রে মনে পড়ে গেছে―দু’দিন আগে তার চিঠিও পেয়েছি; আমরা কেমন আছি, মহা ব্যস্তভাবে তাই জানতে চেয়েছে।
–ঠিকানা দিয়ে বুঝি চিঠি লিখে এসেছিলে?
―তাকে এখানে আসতে নিমন্ত্রণ ক’রেই এসেছি। খেটে খেটে তারও শরীর ভাল নেই। তুমি মুখে কিছু বল না বটে, কিন্তু তুমি যে আমার শরীর দেখে সুস্থ বোধ করছ তা আমি তোমার চোখ দেখে বুঝতে পারি। তার শরীর ভাল দেখলেও কি তোমার আনন্দ হবে না?
প্রশ্নটি ভবিষ্যতে মানসিক অনিশ্চিত একটু পরিবর্তন সম্পর্কে।
কিন্তু তাহাতেই এমন একটা কঠিন দ্বিধার সুর বাজিল―যেন রজত নিশ্চয় জানে, তার এই অন্তরগত অকপটতা যেমন খাঁটি তেমনি নিষ্ফল।
এবং তাহার দুঃখ এইখানেই।
কিন্তু দাদার এই দুঃখটুকুই কেবল অজয়াকে বিচলিত করিতে পারে না―ঐ স্থানটিতে কঠোর হইতে তাহার বাধে না।
মাটির দিকে চোখ করিয়া বলিল,―কবে তুমি শোধরাবে, দাদা?
―প্রয়োজন হয় শীগিরই; কিন্তু আমার কি সংশোধন তুমি চাও, অজয়া?
―নিজের চোখ দিয়ে আমার সুখ খুঁজে বেড়ান―ঐটের সংশোধন চাই।
―তাহ’লে তাকে আসতে বারণ ক’রে দি?
―আমার সুখ খোঁজাখুঁজির কথায় তাঁকে আসতে বারণ করার কথা কি ক’রে আসে তা’ জানিনে। কিন্তু তার দরকার নেই। তিনি আসুন; তাঁর সঙ্গে কথাবার্তায় তুমি থাকবে ভাল। তবে তোমার মনে কোনো অভিসন্ধি আছে যদি বুঝতে পারি তবে তার সামনেই আমি বেরুবো না; তখন বারণ করতে পারবে না যে অভদ্রতা হচ্ছে। চক্ষুলজ্জার দোহাই দিয়ে তখন আমায় নিয়ে টানাটানি করতে আমি দেব না তা এখনই ব’লে রাখছি কিন্তু।
রজত অত্যন্ত বিমর্ষ হইয়া উঠিল।
সুরেনকে মাঝে রাখিয়া ভ্রাতা-ভগিনীর বাকযুদ্ধ এই নূতন নহে; তবু চিন্তাটা বড় মধুর বলিয়াই কোনোদিন তার নূতনত্ব ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া আলোচনাটি রজতের কাছে ক্লান্তি কর নীরস হইয়া ওঠে নাই।
বলিল,―সুরেনের প্রতি তোমার মন কেন এমন বিমুখ, সত্যি বলছি তোমায়, সেটা আমার বড় হেঁয়ালির মত ঠেকে। সে ত’ সব দিক দিয়েই তোমার যোগ্য! তোমাকে অত্যন্ত স্নেহ করে, এমন কি―
রজত জানে না যে, এক্ষেত্রে যোগ্যতা বিচারের দায়িত্ব তাহার নহে, এমন কি তাহাতে তাহার অধিকার আছে কি-না সন্দেহ।
অজয়া তাহা জানে।
তাই সে হাসিয়া বলিল,―তুমি সুরেনবাবুকে খুব ভালবাস, না?
যেন আশার আলোকে দেখা গেল―
রজত উজ্জ্বল হইয়া উঠিল; বলিল,―তোমাকে যার হাতে দিতে চাই, তাকে কেমন ভালবাসি সেটা অনুমান করা ত’ শক্ত নয়!
―–তবে আদেশ করো না কেন?
রজত মনে মনে আরো খানিকটা লাফাইয়া উঠিয়া বলিল,―যদি করি তবে আদেশের মান রাখবে?
―রাখতে পারি, উদ্ভটত্বের খাতিরে।―বলিয়া অজয়া হাসিয়া উঠিল। কিন্তু রজতের মুখের দিকে চাহিয়াই তার হাসি যেন আহত হইয়া নিবিয়া গেল; বলিল,―রাগ ক’রো না, দাদা, ক্ষমা করো। তোমার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে পারলে আমি করতুম। ―বলিয়া হাত বাড়াইয়া রজতের পায়ের ধূলা লইয়া মাথায় দিল।
এইখানেই এ আলোচনার সমাপ্তি ঘটা উচিত ছিল; কিন্তু রজত ঘটিতে দিল না। বলিল,―তোমার আপত্তি কি বলো, দেখি আমি খণ্ডন করতে পারি কি না।
―তুমি কি জজের সামনে দাঁড়িয়ে বিপক্ষের দলিল নাকচ্ আর আপত্তি খণ্ডন করছো, দাদা! এ ব্যাপারটা যে তার চাইতে ঢের বেশী জটিল! বড় দুঃখ হচ্ছে, তোমায় অসুখী করলুম।
―অসুখ একটু বোধ করছি বহই কি।
―তবে এই অপ্রীতিকর কথাটা এখন থাক?
―অপার দুর্ভাগ্য যে পৃথিবীর এত লোকের ভেতর অপ্রীতিকর সেই লোকটির কথাই আমার মনে পড়েছিল।
―অপ্রীতিকর সেই লোকটি নয়, আমাকে নুইয়ে নিয়ে তাঁর সঙ্গে বেঁধে দেবার গোপন ঐ চেষ্টাটাই অপ্রীতিকর।
অতিশয় ক্ষুণ্ণ হইয়া রজত অবশেষে ভবিষ্যদ্বাণী করিল,―টাকার লোভে যা তা একটা ভবঘুরে জুটে তোমার খেয়ালের সামনে প’ড়ে গেলেই ব্যাপার জটিল থেকে সঙ্কটজনক হয়ে দাঁড়াবে। তোমার মতামতের একটা মূল্য আছে তা স্বীকার করতে আমরা নিশ্চয়ই বাধ্য; কিন্তু এটাও যেন দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি আমায় তুমি দুঃখ দেবে।
―যেটুকু দুঃখ তোমায় বাধ্য হয়ে দিচ্ছি তার চেয়ে বেশী দুঃখ তোমায় আমি দেব না। বেলা নেই, চল এইবার ফিরি―বলিয়া জয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
.
রজত ও অজয়া উঠিয়া গেল।
এবং সিদ্ধার্থ অন্তরাল হইতে বাহির হইয়া লাফাইয়া সেখানে পড়িল। উভয়ের কথোপকথনের সবটাই সে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া গিলিয়াছ; কিন্তু ভিতরে যাইয়া সব চেয়ে পরিপাক পাইয়াছে রজতের ভবিষ্যদ্বাণীটি। কি ক্ষণে কথা উচ্চারিত হইয়াছে কে জানে ―গ্রহের কল্যাণে কথা ফলিয়া যাইতেও পারে। রজত বলিয়া গেল, “ভবঘুরে জুটে তোমার খেয়ালের সামনে প’ড়ে গেলেই―”
ঐ সামনেই তাকে পড়িতে হইবে।
দ্বিতীয় পর্যায় এই―যথার্থরূপে রূপদর্শন সিদ্ধার্থের ভাগ্যে এই প্রথম। জীবনে সে সংগ্রাম করিয়াছে বটে, কিন্তু বিচিত্র জীবনের দশদিকেই যে মানুষের রথচক্র ধাবিত হইতেছে তাহা তাহার যেমন অজ্ঞাত, তেমনি অজ্ঞাত ছিল নারী।
নারীর রূপ যে ছায়া নয়, তাহা রস-আবেদনে পরিপূর্ণ একটি সজীব গভীর সত্য বস্তু সে জ্ঞান তার জন্মে নাই। অজয়াকে দেখিয়া তাহার পরমাত্মা যেন সহসালব্ধ সেই জ্ঞানের অমৃতলোকে আজ প্রবৃদ্ধ হইয়া উঠিল।
তাহার মনে হইল, একটি প্রাণের অবরুদ্ধ স্পন্দন নিঃশ্বাসে মুক্তিলাভ করিয়া মুক্তির আনন্দে এই বাতাসেই উল্লসিত হইয়া আছে।
পা দু’খানি দীর্ঘকাল এইখানে রক্ত-কমলের মত ফুটিয়া ছিল।
সর্বাঙ্গের স্পর্শ মাটির দেহে বাতাসের গায়ে জড়াইয়া আছে―হাসিটি যেন বোঁটার উপর ফুলের দেহ ধারণ করিয়া এখনো হাসিতেছে।
হঠাৎ ছুটিয়া যাইয়া সে সেই ছোট ফুলটি তুলিয়া আনিল।
টানে পুট্ করিয়া বোঁটটি ছিঁড়িয়া গেল।
ফুলের মুখ দিয়া আর্তনাদ বাহির হইল না, একটি নিঃশ্বাসও বোধ হয় পড়িল না।
কিন্তু এমনি ব্যাপারে যে-ব্যথা অশ্রুর জন্মকোষে ঘা দিয়া তাহাকে বিদীর্ণ করে তাহা সিদ্ধার্থর ভাবানুগতিকতার কোনো স্তরেই নাই।
রজতেরও নাই।
কিন্তু অজয়ার আছে। তাই রজত তাহাকে ছিঁড়িতে পায় নাই। কিন্তু সিদ্ধার্থ তাহাকে ছিঁড়িয়া চোখের সামনে ধরিয়া বক্তৃতা করিতে লাগিল,―কেন হাসছিলি তুই ছোট ফুলটি? তার মুখের পানে চেয়ে চেয়ে, না তার পায়ে তলায় স্থান পেয়ে? তুই জানিসনে, তোর ফুলজন্ম সার্থক ক’রে দিয়ে কি মমতার চোখে সে তোকে দেখে গেছে। তোর প্রাণ থাকলে তুই আনন্দে মাতাল হয়ে লুটিয়ে পড়তিস। এই ফুলের রাজ্যে এত ফুল থাকতে তোকেই কে তার পায় অর্ঘ্য দিয়েছে! তুই আমার সাথী হয়ে থাক। আজ থেকে আমি বিরহী; তবু তোকে আমি হিংসা করবো না।–বলিয়া অক্লেশে সে ফুলটিকে পকেটের ভিতর গুঁজিয়া দিল।
.
তারপর কাজের কথা।
জানা গেল, নাম অজয়া; অবিবাহিতা। সুরেন নাম-ধারী এক ব্যক্তি উমেদার আছে ―তবে সে আমল পায়নি।
ভাবিতে ভাবিতে সহসা তার চিন্তা চপলতা ছাড়িয়া গম্ভীর হইয়া উঠিল।
ব্যূহ রচনা করিতে হইবে। এই নারী পৃথিবীর উপর মাত্র পা দু’খানি রাখিয়া দাঁড়াইয়া আছে―অন্তর তার গূঢ়ান্বেষী―কল্পলোকে সে ফুল ফুটাইতেছে। চোখে তার স্বপ্ন-কুহেলিকা; মনে অহমিকা। তাহার সম্মুখে স্পষ্ট হইয়া দাঁড়াইতে হইবে।
যে সুখ-দুঃখ এতদিন তাহাকে আলোড়িত করিয়াছে তাহা সিদ্ধার্থর কাছে আজ অতি সাধারণ, অতি তুচ্ছ হইয়া গেল। যার নাম আজ সে বহন করিতেছে, লোকচক্ষুর অন্তরালে তাহার প্রাণে যে ব্যথা নিরতিশয় নিবিড় হইয়া উঠিয়াছিল, সেই সীমাহীনতার আলেখ্যই এই যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র।
সিদ্ধার্থ মনে মনে প্রস্তুত হইতে লাগিল।
আগে চিন্তা, পরে কাজ।