অসাধু সিদ্ধার্থ – ১০

॥ দশ ॥

―বিমল, কোথায় কোথায় বেড়াস তুই? খুব দূরে দূরে যাস, না ভয়ে ভয়ে বাড়ীর কাছাকাছি ঘুরিস ফিরিস?

―কাছাকাছি বেড়াব আমি? দিগ্বিদিকে ঘুরে আসি―রাস্তাঘাট সব নখদর্পণে।

বলিয়া বিমল চক্রাকারে হাত ঘুরাইয়া দিক এবং বিদিকের বিস্তীর্ণতা দেখাইয়া দিলো।

―সিদ্ধার্থ বাবুর সঙ্গে দেখা হয় না?―বলিয়াই অজয়া ঈষৎ আরক্ত হইয়া উঠিল।

সিদ্ধার্থ কয়েকদিন আসে না-তাই অজয়ার এই তল্লাস। কিন্তু তার নির্বিকার সকৌতুক প্রশ্নের সুরটা নিজেরই কানে যাইয়া তাহার মনে হইল, তল্লাসে যেন উদ্বেগ সুপ্রকট উৎকীর্ণ হইয়া দেখা দিয়াছে। পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তার মনে সিদ্ধার্থর সম্বন্ধে আদৌ উদ্বেগ ছিল কি-না সহসা তাহা সে মনে করিতে পারিল না। কিন্তু প্রশ্নটা করিয়া এই যে সে বিমলের মুখের দিকে চাহিয়া আছে―এই দৃষ্টিও যেন অনুকূল উত্তরের প্রতীক্ষায় উৎকর্ণ! অজয়া অনুভব করিল, তার এই দৃষ্টি আর যাই হোক, স্বাভাবিক কিছুতেই নয়।

বিমল বলিল,―কই, না! আর দেখা হলেই বা কে কাকে চেনে!

শুনিয়া অজয়া ক্রুদ্ধ হইয়া বিমলকে যাচ্ছে-তাই ভর্ৎসনা করিয়া ছাড়িয়া দিলো। বলিল,―লেখাপড়া শিখে বুঝি তোমার এই জ্ঞান হচ্ছে, মানুষকে তুচ্ছ করতে শিখছ! তিনি তোর দাদার বয়সী―দেখা হলে নমস্কার করবি, কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করবি।

ননী আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল,-কাকে?

অজয়া বলিল,―যাকেই হোক। বয়সে যিনি বড় তাঁকে শ্রদ্ধা করতে হবে এই শিষ্টাচারটাও অত বড় ছেলেকে শেখাতে হচ্ছে এই আশ্চর্য!

বিমল পলায়ন করিল।

কিন্তু তাহার পালা হাতে নিলো ননী, বলিল,―অনুমানে বুঝেছি ব্যাপারটা। নির্বান্ধব বিদেশে একটা বন্ধু জুটেছিল―এম্‌নি হাড়-মোটা বলিষ্ঠ চেহারা যে দেখলে সাহস জন্মে। মনে হয়, বিপদে-আপদে তার ওপর নির্ভর করলে সে বুক দিয়ে বাঁচাবে। তাকেও তোমরা ষড়যন্ত্র ক’রে তাড়ালে। এখন বিমলকে

অজয়া অবাক হইয়া গেল। বলিল-আমরা তাড়ালাম কি রে?

তা বৈ কি! ভদ্রলোককে কার্যোধারের গরুর মতো মনে করলে সে সেখানে আর দাঁড়ায়? দাবা খেলতে হবে―আসুন, সিদ্ধার্থ বাবু। পাহাড়ে উঠে ফুল তুলতে হবে―এগোন, সিদ্ধার্থ বাবু। ঝরণার জলে নাইতে হবে―আগ্‌লে থাকুন, সিদ্ধার্থ বাবু। তারপর সেদিন তাঁর কথা বন্ধ ক’রে দিয়ে চূড়ান্ত কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে দিলে! রাগ ক’রো না দিদিমণি, আমরা তাঁর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করিনি।―–বলিয়া সে অজয়ার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

মুখখানা কি কারণে কে জানে বড় বিষণ্ন দেখাইতেছিল। সিদ্ধার্থ তখন কাছাকাছি কোথাও ছিল না। ননীর কথাগুলি সে শুনিতে পাইল না। কিন্তু শুনিতে পাইলে সে যে কি করিত তাহা নিঃশেষ করিয়া অনুমান করাও যায় না।

অজয়া বলিল,-তাঁর অসুখও ত’ করতে পারে!

―সেইজন্যেই আমাদের আরো উচিত, যে ক’রে হোক তাঁর একবার খোঁজ নেয়া।

―কাকে দিয়ে নিই বল ত? কোথায় থাকেন তিনি তাই বা কে জানে! আমার ভয় হচ্ছে ননী, তাঁর অসুখই করেছে। বিদেশে―

বলিতে বলিতে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনিয়া তার মুখের শব্দ থামিয়া গেল বটে; কিন্তু কথায় কথায় যে উৎকণ্ঠা ক্রমশ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়া তার চোখ-মুখ দিয়া ঝরিয়া পড়িতেছিল তাহার কিছুমাত্র নিবৃত্তি হইল না। সেইদিকে চাহিয়া কৌতুকের বিস্তৃত হাসিতে ননীর মুখ ভরিয়া উঠিল।

রজত হাঁপাইতে হাঁপাইতে উঠিয়া আসিয়া দাঁড়াইল, এবং তার পশ্চাতেই যে ব্যক্তিকে দেখা গেল, সে-ই অজয়া-ননীর আলোচনাধীন সিদ্ধার্থ।

ননীর সম্মুখে উৎকণ্ঠা যে কি অর্থ লইয়া আত্মপ্রকাশ করিতেছে, অজয়া এতক্ষণ তাহা ঘুণাক্ষরেও অনুভব করিতে পারে নাই।

কিন্তু সিদ্ধার্থকে দেখিয়াই তার সম্বিৎ ফিরিল। অজয়া চোখ নত করিল।

রজত লক্ষ্যও করিল না যে, অজয়ার মুখ উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। নিজের আবেগেই সে বলিতে লাগিল, –সিদ্ধার্থ বাবুর সঙ্গে রীতিমতো মল্লযুদ্ধে ক’রে তাঁকে পরাস্ত ক’রে বন্দী ক’রে নিয়ে এলাম। কতই যেন কাজে ব্যস্ত এমনিভাবে হন্ হন্ ক’রে ছুটছিলেন। আমাদের ওপরের দিকে চোখ তুলে নামিয়ে আনতেই আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। তারপর তাঁকে ওপরে তুলতে আমাকে এমনি টানাটানি করতে হয়েছ যেন পাঁকের ভেতর থেকে হাতী টেনে তুলছিল। তুমি আমাদের বসতে বললে না যে, অজয়া?

কিন্তু বসিতে বলিবার যে প্রয়োজন আছে, রজতের ত্রুটি নির্দেশেও অজয়ার তাহা মনেও হইল না। যাহা মনে হইল তাহাই সে বলিয়া গেল,―কেন ধ’রে আনলে কাজের ক্ষতি করে! যে যা ভালবাসে না―

অজয়ার রাগ হইয়াছিল―কতক নিজের উপর, কতক সিদ্ধার্থর উপর। সিদ্ধার্থর সম্বন্ধে উৎকণ্ঠা অনুভব করিবার হেতু ছিল বলিয়া এখন তাহার মনেই হইল না। কিন্তু মুহূর্ত-পূর্বের সেই উৎকণ্ঠাবোধটি ত’ সত্য-অস্বীকার করিবার ক্ষমতা তার নাই। অহেতুকী যন্ত্রণা-সৃষ্টির কারণটাকে সে অমান্য করিতে কেন চাহিতেছে, তাহার কাছে তাহাও ঠিক স্পষ্ট নয়।

নিজের ভিতরকার এই অস্পষ্টতার ধোঁয়া এবং নিজকে বুঝিতে না পারার অসহিষ্ণুতাই হঠাৎ তাহার কন্ঠে ক্রোধের আকারে দেখা দিলো। কিন্তু ক্রোধবশে আত্মবিস্মৃতির প্রান্তে আসিয়াই সে নিজের দুর্বলতা এবং ভুল বুঝিতে পারিয়া থামিয়া গেল।

রজত বলিল, –ছুটিতে আবার মানুষের কাজ কি? আট-দশদিন আসেননি কেন, রাগ করেছেন কি-না জিজ্ঞাসা করবো, রাগ করে থাকলে ক্ষমা চাইব―এই-সব ভেবে ধরে নিয়ে এলাম। অন্যায় করেছি?―বলিয়া সে সিদ্ধার্থর মুখের দিকে চাহিয়া হাসিতে হাসিতে তাহাকে টানিয়া আনিয়া বসাইল।

সিদ্ধার্থর কাছে এ সবই নূতন। সহসা উদ্ঘাটিত বিশ্বরহস্যের মত নূতন―আর কেমন মনোরম তাহা না বলিলেও চলে।

সিদ্ধার্থ নির্বাক হইয়া রজতের আড়াল হইতে বিমূঢ়ের মত চাহিয়া অজয়াকেই লক্ষ্য করিতেছিল। কিন্তু রজত তাহাকে বসাইয়া দিতেই দৃশ্য-সংস্থানের পরিবর্তনেই যেন তাহার মনের সুবিন্যস্ত সম্ভোগটিও ছত্রভঙ্গ হইয়া গেল। কোনদিকে না চাহিয়া রজতের প্রশ্নের উত্তরে সে কেবল বলিল,―অন্যায় দিকটা দেখা আমি ছেড়ে দিয়েছি।

―বেশ করেছেন। বলুন ত’ এ ক’দিন আসেননি কেন? ননী, চা!

মনে খটকা লাগিয়া সিদ্ধার্থ কষ্টকর একটা কম্পন অনুভব করিতেছিল।

অজয়া তাহার দিকে চাহিয়াও দেখে নাই। বট্‌কা এই যে, কেন? অজয়ার রাগটা সে ধরিতে পারে নাই; তাহারই কথা কহিতে কহিতে কেন সে অমন করিয়া থামিয়া গিয়াছিল তাহাও সে বুঝিতে পারে নাই। কেবল বুঝিতে পারিয়াছে, অজয়া আহার দিকে চোখ ফিরায় নাই।

সিদ্ধার্থর দৌর্বল্য সর্বত্র।

সেই সর্বব্যাপী দুর্বলতাকে অহরহ আবৃত করিয়া আঘাতের হাত হইতে রক্ষা করিয়া চলা যেমন অসম্ভব, আঘাতের ভয়ে সে অনুক্ষণ তেমিন কাতর। তার শশঙ্ক সতর্কতার অন্ত নাই যে, কোথায় একটু অসাবধানতা ঘটিবে অনি সেই ছিদ্রপথে দেহে কলিঅ প্রবেশ করিয়া তার সকল আশা আয়োজন পণ্ড করিয়া দিয়া তাহাকে একেবারে নিরস্ত্র নিঃসহায় করিয়া রাখিয়া যাইবে।

সর্বদাই তাহার মনে হয়, কখন সে আনমনে গন্ডীর বাহিরে পা বাড়াইয়া দিবে, আর সঙ্গে সঙ্গে স্থানচ্যুত হইয়া তার নিষ্কৃতির রন্ধ্র আর কোনোদিকেই রহিবে না।

তাই অজয়া তাহার দিকে না চাওয়ায় হঠাৎ অবলম্বনের অভাবেই তার মনে যে কত বিষাদ আর শঙ্কা জমিয়া উঠিল তাহার ইয়ত্তা নাই। অজয়ার মনে বুঝি তাহার জন্য একটুও স্থান নাই।

রজতের প্রশ্নের জবাব তবু সে অবিলম্বেই দিলো। বলিল,―ছিলাম না এখানে।

―কোথায় গিয়েছিলেন?

―আমাদের মণ্ডলীর কাজে।

―কোথায়?

―পল্লীগ্রামে। পল্লীগ্রামে গিয়েছেন কখন?

―না; হ্যাঁ, গিয়েছিলাম একবার, কিন্তু ফিরে এসেছিলাম কেঁদে। প্রথম রাত্রেই যেখানে মাথা রেখে শুয়েছিলাম তারই ঠিক সিকি ইঞ্চি তফাতে অর্থাৎ বেড়ার ঠিক ও―পিঠেই আচমকা এমন একটা বিকট আওয়াজ হয়ে উঠল যে আমি ভয়ে কেঁপে কেঁদে যাই আর কি! মা বলতে লাগলেন―ভয় নেই, ভয় নেই শেয়াল। ―বাড়ীর সবাই মিলে, ‘শেয়ালকে মেরে দেবো’ ব’লে তর্জন ক’রে আমায় সাহস দিলেন বটে, কিন্তু মা আমায় নিয়ে তার পরদিনই পালিয়ে এলেন। শেয়ালের ডাক ছাড়া সেখানে উপলব্ধি করবার মত কি আছে জানিনে। তবে আজকাল মশকের উৎপাতের কথা কাগজে বেরোয় দেখতে পাই।

সিদ্ধার্থ চমৎকার একটি ভ্রভঙ্গী করিল। রজতের এই অজ্ঞতা যেন তাহারই উপর নির্যাতন!

বলিল,―মাত্র এই? শেয়াল আর মশার উৎপাত ছাড়া সেখানকার অনেক খবর অনেকই জানেন না। কিন্তু বিশেষ খবরটিও রওনা হয়েছে―একদিন এসে সে পৌঁছবেই ―তখন চমকে উঠে দেখবেন, রসাতলের তলদেশে এসে পা ঠেকেছে―কোথাও ছিদ্র নেই, অবলম্বন নেই।

―সর্বনাশ, এমনি দূরদৃষ্ট আমাদের হবে!

―হবে বৈকি!

―খবরটি কবে পাবো ব’লে আন্দাজ করেন?

―এখনো সাবধান না হলে অচিরেই পাবেন। আমরা হেঁটে বেড়াচ্ছি যে-অঙ্গ আশ্রয় ক’রে সে-ই শুকিয়ে উঠেছে―ভেঙে-চুরে পড়লাম ব’লে। কিন্তু ভরসার কথা―

―বাঁচা গেল। ভরসার কথাও আছে তাহলে?

―আছে। এই জ্ঞানটা ফিরিয়ে আনতে হবে যে, সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, পুণ্য―এর কোনোটাই হাত-ধরা নয়! আত্মদানের প্রেরণা যখন দুর্বল হয়ে আসে তখনই অধঃপতিতের মনে হয়, পরিত্রাণ সাধনা-নিরপেক্ষ এবং সুলভ। একটু হরিণাম ক’রেই, গঙ্গায় একটি ডুব দিয়ে উঠে, হাত-পা ছুঁড়ে একটু আস্ফালন ক’রেই তার মনে হয়, যথেষ্ট করা হচ্ছে। সভ্যজগৎ তাই দেখে হাসে। পৃথিবীকে আমাদের দেবার কিছু আছে কিনা জানিনে, থাকে ত’ ভালই; কিন্তু জিজ্ঞাসা কিছু নেই। অথচ ঐ জিজ্ঞাসারই তত্ত্বটুকু সভ্যতার নিদর্শন―আগেও ছিল, এখনো আছে।

রজত কষ্টবোধ করিতেছিল। সংক্ষেপে বলিল,–কিন্তু হচ্ছিল পল্লীর কথা।

―আমার তা মনে আছে। পল্লীকে ভিত্তি ক’রে যাঁরা দেশকে গ’ড়ে তুলতে চান, ঐগুলি তাঁদের সম্বন্ধে। পল্লীর দিক দিয়ে ভরসার কথা এই যে, সে শিক্ষাপটু। উপকার কিসে হয়, বুঝিয়ে বললে সে তা বুঝতে পারে কিন্তু শেখাবার লোক নেই।

―অশিক্ষিতকে শিক্ষিত ক’রে তাকে বর্ধিষ্ণু, বৈজ্ঞানিক ক’রে তোলবার সহিষ্ণুতা আর অপর্যাপ্ত সময় মানুষের কই?

―আপনার নেই, কিন্তু আমার আছে। আর, তারা অশিক্ষিত নয়, নিরক্ষর। তাদের মধ্যে জন্মার্জিত শিক্ষার একটা ধারা বইছে। তারা সভ্য এবং সাধক―জগতের সম্মুখে নিজস্ব প্রশ্ন নিয়ে যে প্রথমে দাঁড়িয়েছিল, সে আমাদের পল্লী। ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েই আছে―গা তুলে অগ্রসর হলে বীঝ বপন করতে পাথরে লাঙল বসাতে হবে না―অবশ্য যদি সহিষ্ণুতা আর অপর্যাপ্ত সময় মানুষের থাকে।

সিদ্ধার্থর বাগ্মিতা শুনিতে শুনিতে অজয়া একটি আত্মনিপীড়িত তপোশীর্ণ সাধকের মূর্তি সম্মুখে দেখিতেছিল।

মূর্তিটা সিদ্ধার্থ নয়; কাহারোই নয়―

তবু সে একটা মূর্তি―অক্ষয়, আর তেজে গর্বে এবং প্রতিষ্ঠার আনন্দে দুঃসহ চঞ্চল। সিদ্ধার্থ দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতেছিল।

অজয়া আগুনে ঘৃতাঞ্জলি নিক্ষেপ করিল; বলিল,―সময় আছে, নেই ইচ্ছা।

―ঠিক, নেই ইচ্ছা, ব্যাপক অর্থে। অনেকে ওজর দেখান, আমরা অসহায়; কিন্তু ইচ্ছার অভাব ছাড়া অন্য কোনো কারণই স্বীকার করা কঠিন। বড় বড় ক্ষেত্রে আমরা যত বড় অনাথই হই না কেন, নিতান্তই এই ঘরের কথাটিতে তত নিরূপায় আমরা নই।―বলিয়া সিদ্ধার্থ মাথা নত করিল―যেন, অজয়ার মুখ দিয়া যে সত্যটা নির্গত হইয়াছে তাহারই সম্মুখে।

রজত বলিল,―কিন্তু একটি দু’টি লোক এতবড় বিরাট একটা কাজে হাত দিলে নিজেকে একা আর অসহায় মনে করা ত’ স্বাভাবিক। উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবারও ভয় আছে।

―কাল্পনিক ভয়। একটি পল্লীর সুখ-দুঃখ সর্বসাধারণের সুখ-দুঃখ বোধে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে সে আপনার উদ্দেশ্য ব্যর্থ করবে না―সার্থকই করবে। আপনার কাজের মাঙ্গল্য তাকে আকর্ষণ করবে, মুগ্ধ করবে, উন্নত করবে―কারণ সে শিক্ষিত এবং সভ্য। একটুখানি এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবেন, যাদের সাহায্য করতে এসেছেন তারাই আপনার সহায়।

রজতের দৈব্যৎ মনে পড়িয়া গেল, কি একখানা গল্পের বহিতে যেন সে পড়িয়াছিল, পল্লী-সমাজপতিরা বড় দুর্দান্ত, চক্ষু-লজ্জা আর কাণ্ডজ্ঞানবিবর্জিত। বলিল,―যদি আমি কখনও যাই ও-কাজে তবে বোধ হয় সমাজপতিদের অতিবুদ্ধির দৌড়াত্মেই আমায় পালিয়ে আসতে হবে।

―সঙ্কীর্ণতার সঙ্গে বুঝতে হবে স্বীকার করি। যারা মতলব ছাড়া কথা কয় না, তারা মতলব খুঁজবেই ঠিক অমানুষের মত। কিন্তু কর্মের সম্মুখে যদি নির্বোধ প্ৰতিকূল শক্তি না রইল তবে অসাড়তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবেন কি করে! নেশা ধরিয়ে দেবে তারাই, যারা আপনাকে চাইবে না।

অজয়া বলিল,―কিন্তু নিজের কল্যাণের দিকে নিশ্চেষ্টতার ফলে যে কলুষ জ’মে উঠেছে, কতদিনের অক্লান্ত চেষ্টায় তা দূর হবে!

সিদ্ধার্থ কৃতার্থ বোধ করিয়া অজয়ার দিকে চাহিয়া বলিতে লাগিল,―বহুদিনের আবর্জনা দেখতে দেখতে ছাই হয়ে যেতে পারে যদি আলস্য ত্যাগ ক’রে কেউ আগুন লাগিয়ে দেয়। গতির এমন একটি নিজস্ব শক্তি আছে যা আনন্দ দেয়। ঝড়ে ছোটে―মানুষ ভয় পায়; কিন্তু অনন্ত আতঙ্কের মধ্যেও অদ্ভূত একটা আনন্দের সঙ্গে সে ঝড়ের গতির দিকে চেয়ে থাকে। এই আনন্দটা দিতে পারলেই মানুষ অন্ধ হয়ে অনুসরণ করে; যেমন―

―আপনি কি করেন?

প্রশ্ন শুনিয়া সিদ্ধার্থ রজতের দিকে ফিরিল।

বেশ ভাবটা আসিয়াছিল। বাধা পাইয়া তার ইচ্ছা করিতে লাগিল, রজতকে দুই হাতে চড়াইয়া দেয়। বলিল,―যা পারি তা করি।―বলিয়া সিদ্ধার্থ যখন পুনরায় অজয়ার দিকে চোখ ফিরাইল তখন অজয়ার চোখের সেই তীব্র দৃষ্টিবিচ্ছুরণ ক্ষান্ত হইয়া গেছে।

রজত বলিল,―সে কাজটা কি?

―নিরুপিত কাজ কিছু নেই। আতরক্ষা, পল্লীতে পল্লীতে দেশাত্মবোধ জাগরিত করা, সংস্কারকে মোহনিমুক্ত করা।

অজয়া বলিল,―শিক্ষাবিস্তার?

–তাও করি। আমরা জানি যে, যারা নিম্নস্তরে আছে তাদের উচ্চস্তরে তুলে আনবার একমাত্র বাহন শিক্ষা। জল-চল হলেই কেউ স্তর পর্যায় উত্তীর্ণ হতে পারে না―শিক্ষায়তনেই সব একাকার হয়ে যাবে―জলে আর দুধে যেমন। মেশবার একটা আধার চাই। সেটা ফরাস নয়, শিক্ষা।

শুনিয়া অজয়া সিদ্ধার্থর মুখের দিকে চাহিয়াই রহিল―যেন সিদ্ধার্থর কথাগুলির সমগ্র অর্থ অতিশয় ধীরে ধীরে সে গ্রহণ করিতেছে।

কিন্তু রজত আজ আর হাই তুলিল না।

সেদিন সবাই তাকে ভুল বুঝিয়াছিল। আজ সে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে চার―পাঁচবার গাত্রোত্থান করিবার উপক্রম করিয়াও উঠিল না―তারপর এখন সঙ্গত অবসর লাভ করিয়া বলিল,―সিদ্ধার্থ বাবুর কাছে আমার একটি কৃপাভিক্ষা আছে। আপনার কথা যদি শেষ হয়ে থাকে তবে বলি।

সিদ্ধার্থ বলিল,―কথার শেষ নেই, তবু বলুন; কিন্তু বিনয়ের বহর দেখে ভয় হচ্ছে, কাজটা হয়তো দুঃসাধ্য।

―দুঃসাধ্য হলে সাধ্যানুসারে চেষ্টা করবেন।

–অসাধ্য হলে?

―অস্বীকার করবেন।

―এখন কাজটা কি শুনি?

―একটি গান শোনাতে হবে।

–শোনাবো। আপনাদের শেষ অনুরোধটা না রাখলে নিজের কাছেই আমরণ অপরাধী হয়ে থাকতে হবে।–বলিয়া সিদ্ধার্থ কঠিন পরীক্ষকের মত মুখ করিয়া কোনোদিকেই চাহিল না।

চির-বিচ্ছেদের এই ইঙ্গিতটা যতদূর না রাখলে নিজের কাছেই আমরণ অপরাধী হয়ে থাকতে হবে।―বলিয়া সিদ্ধার্থ কঠিন পরীক্ষকের মত মুখ করিয়া কোনোদিকেই চাহিল না।

চির-বিচ্ছেদের এই ইঙ্গিতটা যতদূর নির্লিপ্ত কণ্ঠে প্রদান করা সম্ভব তাহা সে করিয়াছে। কিন্তু উদ্দেশ্যটা সফল হইল কি না তাহা প্রত্যক্ষ করিবার সুযোগ তাহার ভাগ্যে ঘটিয়া উঠিল না। বিদায়ের বেলা একেবারে আসন্ন―অকস্মাৎ এই ঘোষণায় অতর্কিতে আক্রান্ত হইয়া অজয়া যদি ভালবাসিয়া থাকে―তবে নিশ্চয়ই প্রামাণিক এমন কিছু করিয়া ফেলিবে যাহা আত্মসম্বরণে সচেষ্ট, বেদনায় কাতর, অথবা রুদ্ধবাষ্পে অস্থির। কিন্তু, যেখানে সার্থকতা ফলরূপে দেখা দিবার কথা, সেখানে দু’টি একটি মুহূর্তের মধ্যে কি ঘটিয়া গেল তাহা তাহাকে দেখিতে দিলো না ঐ রজত।

রজত তাহার দিকে চাহিয়া কি দেখিতেছে তাহার ঠিক নাই।

কিন্তু এমন করিয়া চাহিয়া আছে যেন সে একটা কি! রজতের সেই হাভাতে দৃষ্টি ঠেলিয়া অজয়ার দিকে চাহিতে সিদ্ধার্থর সাহস হইল না।

কিন্তু অজয়ারই প্রশ্নে যখন তাহার সাহসিকতার প্রয়োজনই রহিল না, তখন অজয়ার মুখে কোনো মানসিক বিকারের বাঞ্ছিত রেখালিপির চিহ্নও নাই।

অজয়া জিজ্ঞাসা করিল,―শেষ অনুরোধ মানে?

―আমি আজ শেষ রাতেই যাচ্ছি।

রজত বলিল,―কোথায় যাবেন মনস্থ করেছেন? অবশ্য বলতে যদি রাষ্ট্রীয় আপত্তি না থাকে।

-–কলকাতায় আপাতত, তারপর ভগবান যেদিকে নিয়ে যান।

―আপনার সঙ্গে পরিচয় হ’ল, কিন্তু পরিচয় সম্পূৰ্ণ হ’ল না।–বলিয়া অজয়া উঠিল ।

অজয়ার কথা শুনিয়া সিদ্ধার্থর মন সিরসির্ করিতে লাগিল,―মনে হইল, এ যেন সুদূরাগত একটি আহ্বান। কে জানে কোথায় বাঁশী বাজিয়াছে―রব কানে যাইয়া আত্মার সম্বিৎ সচকিত হইয়া উঠিয়াছে―অতি ক্ষীণ অস্পষ্ট সুর―তবু মন সুরের স্রোত বাহিয়া ছুটিয়া যাইতে চায় যহার অধরে বাঁশী, তাহারই সন্নিকটে। কাহারো নাম ধরিয়া সে ডাকে নাই, তবু সে-সুর সবারই আপন-নামে ভরা।

যে নাম জানে না―কেবল চেনে উন্মুখ প্রাণটিকে―সে ত’ ঐ সুরেই ডাকে।

সিদ্ধার্থর মনে হইল, বাহিরে নিঃসৃত কথা ক’টি চতুর্দিক হইতে যেন তাহার ত্বক―মর্মকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিয়াছে। দৈবদত্ত কৃতজ্ঞতাসূত্রে যে পরিচয়ের উদ্ভব, তাহার পরিণতি কোথায় তাহা অনুমান করা ত’ মানুষের পক্ষে শক্ত কাজ নয়।

তাহা জানিয়া শুনিয়াও যে আরো বেশী করিয়া পরিচয় পাইতে অভিলাষ করে, সিদ্ধার্থর মনে হইল, তাহার মনের ধারাটি ত’ ঊর্ধ্বের ঐ আকাশ আর নিম্নের এই মৃত্তিকার মত চোখের একেবারে সম্মুখবর্তী জিনিস।

পরিচয় সম্পূর্ণ হইল না, ইহার জন্য বন্ধুভাবে ভদ্রোচিত একটু ক্ষোভ প্রকাশ করিবার ইচ্ছা সিদ্ধার্থর যথেষ্ট ছিল; কিন্তু হঠাৎ উল্লাসে আত্মহারা হইয়া তাহার মুখে কথা ফুটিল না।

রজত অজয়াকে প্রস্থানোদ্যত দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল,―কোথায়?

–সিদ্ধার্থ বাবুর পণ ভাঙতে। উনি প্রতিজ্ঞা করেছেন আমাদের জলগ্রহণ করবেন না। দেখি, টলাতে পারি কি না।

অজয়ার সুরে শ্লেষ ছিল।

কিন্তু সিদ্ধার্থ তাহার হেতুটা সঠিক নির্ণয় করিতে পারিল না―হইতে পারে আক্রোশ, কিম্বা নারীসুলভ অতিথিবাৎসল্য, অথবা জিতিবার ঝোঁক। অত্যন্ত কুণ্ঠিতভাবে সে বলিল,―মাপ করবেন; বৃথা―

অজয়া যেন দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল; বলিতে লাগিল,―আপনি কি মনে করেন, আপনাকে জলগ্রহণ করাতে না পারলে আমরাও জলগ্রহণ ত্যাগ করবো! তা নয়―এটা শুধু বাঙালীর ঘরের শিষ্টাচার। বারবার শিষ্টাচার প্রত্যাখ্যান করা কোন্ দেশী শিষ্টাচার তাই আমি শুনতে চাই। আপনি বনের মানুষ নন, নিশ্চয়ই জানেন, আপনি যে ব্যবহার করছেন তাতে মানুষ অপমান বোধ করে।

―আমি―

–কৈফিয়ৎ আমি চাচ্ছিনে। আপনি বেকার অবস্থায় এখানে দিন কাটিয়েছেন। আমাদের সময় কাটাবার উপলক্ষ ক’রে নিয়ে নিজেকে প্রচার করে গেলেন―আসল কথা, এই নয়?―বলিয়া অজয়া চলিয়া গেল।

সিদ্ধার্থ যথার্থই বিস্মিত হইয়াছিল।

স্বল্পভাষিণী অনস্থির ঐ নারী যে এমন তীব্র উক্তি করিতে পারে তাহা সে স্বকর্ণে না শুনিলে কখনো বিশ্বাস করিতে পারিত না। নিরুদ্যমের মত মুখ ছোট করিয়া ঐ কথাগুলিকে মনে মনে ধ্যান করিতে করিতে হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল,–আমার সামান্য কথার উপর এতবড় একটা অভিযোগ যে খাড়া করা যেতে পারে, তা আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।―বলিয়া সিদ্ধার্থ একটু হাসি ফুটাইল।

হাসিটি কারুকার্যে চমৎকার। ওষ্ঠদ্বয়ের দক্ষিণ প্রান্তে সমুদিত হইয়া মধ্যপথে খানিক ঢেউ খেলিয়া বাম প্রান্তে মিলাইয়া গেল। যেন বলিয়া গেল, এ কি অবাক কাণ্ড!

কিন্তু ভিতরের বার্তা বড় গভীর।

এমনি করিয়া অনাচার দেখাইয়াই ত’ সে নিজেকে অদ্ভুত করিয়া তুলিতে চায়! অসাধারণ না হইলে সে ত লক্ষ-লক্ষের আসা-যাওয়ার স্রোতে ভাসিয়া নিশ্চিহ্ন হইয়া দৃষ্টি-পরিধির বাহিরে চলিয়া যাইবে। মনে দাগ কাটিবার উপায়ই ত’ ঐ।

অজয়ার রাগ দেখিয়া তাই সে খুশীই হইল।

রজত বলিল,–বিস্ময়ের কথা বটে। কিন্তু স্বপ্নেরও অগোচরে এমন সব ব্যাপার ঘ’টে থাকে যা নিতান্তই সাধারণ। আজ যখন জাগ্রত অবস্থাতেই গোচরে এসেছে তখন আর অলকি ব’লে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই।

সিদ্ধার্থর খেদ নানাদিক দিয়া বাহির হইতে লাগিল; বলিল,―মানুষ কেমন ক’রে আর কেন যে নিজেকে এমন পরবশ ক’রে তোলে তা বোধ হয় কখনো সে ভেবে দেখতে চায়নি। আমার এই সূত্রপাত।

―অর্থাৎ?

―কোনোদিন আমি আশা করিনি যে বন্ধুত্বের সম্মান রাখতে পরবশ হতে হবে। অথচ দেখুন, এক মুহূর্তেই আমি চিরদিনের অভ্যাস, সঙ্কল্প আর আদর্শ ত্যাগ ক’রে প্রস্তুত হয়ে বসেছি, কেবল একটি মানুষকে তৃপ্ত করতে।―বলিয়া সেই একটি মানুষের উল্লেখ করিতে সক্ষম হইয়া সে-ও অসামান্য তৃপ্তি বোধ করিতে লাগিল।

রজত বলিল,―আপনার উদারতা খুব।

.

অজয়া এবং ননী উভয়ে মিলিয়া জলখাবার ও চা লইয়া আসিল। কিন্তু ননী সেখানে দাঁড়াইল না–দিদিমণির বাড়াবাড়ি আগ্রহ দেখিয়া তাহার ব্রহ্মাণ্ড জ্বলিয়া গেছে।

একবার কোথায় ভোজে সিদ্ধার্থ প্রচুর পরিমাণে মিষ্টান্ন প্রভৃতি ভোজন করিয়াছিল।

তারপর দোকানের সাজানো মেঠাইয়ের পর্বত সে প্রায় প্রত্যহই দেখে।

কিন্তু অজয়াদের নিজের হাতে প্রস্তুত ঐ খাদ্যদ্রব্যগুলি দেখিয়া বমনোবেগে তাহার পাকস্থলী যেন তোলপাড় করিতেছে এমনি করিয়া সেগুলির দিকে চাহিয়া এবং রজত সে চাহনিটা দেখিল তাহা লক্ষ্য করিয়া সিদ্ধার্থ বলিল,―কৈফিয়ৎ আপনি শুনতে চাননি; কিন্তু শুনলে এতগুলি উত্তপ্ত কথার সৃষ্টি হত না। আমি দরিদ্র―

–আমরা ধনী। ধনীর সঙ্গে যখন বন্ধুত্ব করেছেন তখন ধনের অত্যাচার সহ্য করতেই হবে।–বলিয়া অজয়া খাবার সাজাইতে লাগিল।

সিদ্ধার্থ বড় কাতর হইয়া বলিতে লাগিল,―যা নিতান্তই না হ’লে চলে না, খোরাক-পোষাক সম্বন্ধে আমি সেই যৎকিঞ্চিতেই অভ্যস্ত। তার বেশী আমি স্বচ্ছন্দচিত্তে গ্রহণ করতে পারিনে।

কেহ কথা কহিল না।

রজত মনে মনে বলিল, ন্যাকা।

অজয়া ভাবিল, মহাশয়ের কাতরতা নিষ্ফল।

কিন্তু সঙ্কট দেখা দিলো।

সিদ্ধার্থ ও চা খাইতে বসিয়া গেছে। সুতরাং প্রথম পেয়ালাটি মাটি হয়ে দেখিয়া রজত বলিল,-অজয়া বোধ হয় জানে না যে, অতিশয় শারীরিক আলস্যের প্রশ্রয় দেয় ব’লেই বৈরাগ্যসাধনে যে মুক্তি তা একরকম অবাঞ্ছনীয় হয়ে উঠেছে এবং জাতি হিসাবে সেটা আমাদের পক্ষে এখন অনধিকার-চর্চা। কি বলো?

অজয়া বলিল,―পৃথিবীর লোক কিন্তু তাই চাইছে আজকাল।

―এদিকে ভারতবর্ষের গুরুগিরির দাবি যাঁরা অকাট্য ক’রে তুলেছেন তাঁরা আমাদের সমস্যা। কিন্তু আমাদের অন্তরের ভাববস্তুটি যতদিন পরের পদানত থাকবে, ততদিন সে সফল হবার আশা বৃথা।

শুনিয়া সিদ্ধার্থ অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল।

সংসর্গ হিসাব সে নিজেকে অপাংক্তের অচল মনে করে। মনে মনে তার কুণ্ঠার অবধি নাই। সৎ-সাহচর্যের ফলে যে বৃত্তিগুলির অনুশীল ঘটে, তা তার ঘটে নাই এবং তাহা সে জানে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তার সম্বিৎ অতিশয় তীক্ষ্ণ হইয়া সূক্ষ্মতম আঘাতেই বাজিয়া উঠিতে যেন অনুক্ষণ উদ্যত হইয়াই থাকে।

অতি অল্পদিনেই এই পরিবর্তনটা ঘটিয়াছে।

সে বৈরাগ্যের পরাকাষ্ঠার ভান করিতেছে―তাই রজতের কথাগুলি সে তাহারই বিরুদ্ধে উচ্চারিত মনে করিয়া হঠাৎ উচ্ছ্বাসিত হইয়া বলিয়া উঠিল,―ভাববস্তু কোনোদিন পরাধীন হয়ে যেতে পারে ব’লে আমি মনে করিনে।

কিন্তু তর্ক উঠিল না।

রজত হাসিতে লাগিল; বলিল,–আপনি শুনে ফেলেছেন আমার কথা? ননী, আমার কোনো অপরাধ নেই দিদি―

অজয়া প্রথমে ধরিতে পারে নাই। কিন্তু রজতকে চপলকণ্ঠে হাসিতে দেখিয়া এবং তার কথার সুরে সে অনুভব করিল যে, রজত ক্রূর একটা সঘর্ষ বাধাইয়া তুলিয়াছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে পরম মমতার সহিত তাহার ইহাও মনে হইল যে, এইপ্রকার মানসিক সংঘর্ষ-ব্যাপারে সিদ্ধার্থ বাবু নিতান্তই অক্ষম প্রতিপক্ষ। ওরা কেবল পশ্চাতে সর্ববিধ আকর্ষণ অক্লেশে অতিক্রম করিয়া সম্মুখের দিকে ছুটিতে জানে। ওদের প্রধান সম্বল তেজস্বিতা, একনিষ্ঠ উগ অনুরাগ। তীক্ষ্ণধার গুপ্ত অস্ত্র লইয়া কে কোথায় উহাদের মনের কায়াক্ষেত্র রক্তাক্ত করিতে বসিয়া গেছে, তাহা ওরা ধরিতেই পারে না―এমনি ওরা অসহায়। ভাবিতে ভাবিতে যখন সে সিদ্ধার্থর দিকে চোখ ফিরাইয়া চাহিল, তখন তাহার সেই সুকোমল দৃষ্টি-পাত্রে করুণা যেন ধরে না।

চারি চক্ষুর মিলন হইল। সিদ্ধার্থ শিহরিয়া উঠিল। তাহার মনে হইল, তার অষ্টাঙ্গ আর পঞ্চেন্দ্রিয় অপূর্ব একটা বৈদ্যুতিক আকর্ষণে একটি কোষের আকার ধারণ করিল এবং দেখিতে দেখিতে সেই দৃষ্টির অমৃত-দানে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হইয়া তাহা অচিন্ত্যনীয় সুখের মাঝে চিরজীবনের জন্য মুদ্রিত হইয়া গেল।

.

রজত দ্বিতীয় পেয়ালাটি সম্মুখে করিয়া সিদ্ধার্থর গান শুনিল এবং গান শেষ হইলে বলিল,―সংগীতকে সুধা কেন বলে আজ তা হৃদয়ঙ্গম হ’ল। সমগ্ৰ মনটা ডানা মেলে সুরের ভেতর হুল ফুটিয়ে স্থির হয়ে ব’সে রস শোষণ ক’রে নিচ্ছিল, আর রসের মাধুর্যে তার অভ্যন্তরটা তোলপাড় করছিল। আজ আমার চা খাওয়া বৃথা আর সার্থক এক―সঙ্গে হয়ে গেল।

সিদ্ধার্থ হাসিয়া বলিল,-পরস্পর-বিরোধী দু’টি শব্দের একত্র প্রয়োগ―

–ন্যায়শাস্ত্রে চলে না সত্য। কিন্তু চেয়ে দেখুন―দ্বিতীয় পেয়ালার চা এক চুমুকও খাইনি, সুতরাং বৃথা হয়েছে। এদিকে চা-পান উপলক্ষ ক’রে এমন গান শোনা গেল যাতে আসাম পর্যন্ত সার্থক হয়ে উঠেছে।

কিন্তু অজয়ার মন ভিজিয়া উঠিয়াছিল, সিদ্ধার্থর গানের ‘মা’ আহ্বানগুলিতে।

তাহার মনে হইল, অশন করিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া মাকে আর কেহ ডাকিতে পারে না।

বলিল,―আপনার মা কি বেঁচে নেই?

স্বদেশের হিতকল্পনা সিদ্ধার্থর প্রথম বিভাগ।

মাতৃপিতৃ-বিষয়ক আলোচনা তার দ্বিতীয় বিভাগ।

কাজেই অজয়ার প্রশ্নে সে মুখ-চোখ কাঁদো-কাঁদো করিয়া বলিল,–না। তিনি এ হতভাগ্যের মুখ দেখেননি, আমিও তাঁর মুখ দেখিনি। তাঁর মূর্ছিত অবস্থায় আমি ভূমিষ্ঠ হই―তাঁর সে মূর্ছা ভাঙেনি।

অজয়া বলিল,―আমাদেরও মা বেঁচে নেই।

–তবু আপনাদের সম্মুখে স্বর্গীয়ার মুখের মায়াটুকু ছবিতে অমর হয়ে আছে। আমার সে সম্বলও নেই।

বলিয়া সিদ্ধার্থ থামিল। নিঃসম্বল অবস্থা যেন সর্বদা তার সহ্য হয় না।

আবার বলিল,–আর পিতৃস্নেহ-বঞ্চিতে যে দুর্দশা অনিবার্য, আমারও তাই হয়েছে―কৃত্রিম অসার হয়ে উঠেছিল। আমি যখন মাতৃগর্ভে, পিতা তখনই―

মাতৃগর্ভে অবস্থানকালেই যে অভাগা পিতৃহারা হয়, পিতাকে স্মরণ করিয়া মানুষের সম্মুখে তার কান্না পাওয়ারই কথা। উদ্‌গত অশ্রু রোধ করিতেই সিদ্ধার্থ চুপ করিতে বাধ্য হইল।

ব্যাপার শোচনীয় হইয়া অজয়ার আপশোষের সীমা রহিল না; বলিল,―সিদ্ধার্থ বাবু, আমায় মাপ করুন। আমি না জেনে আপনার ব্যথার স্থানটি স্পর্শ করেছি।

সিদ্ধার্থ অজয়ার ব্যাকুলতাটুকু উপভোগ করিল―কিন্তু কথা তেমন কানে তুলিল না ঢের বড় বড় ব্যথার কথা সে এখনো বলিয়া শেষ করে নাই। কন্ঠে বেদনা ঘনীভূত করিয়া লইয়া সে বলিল,–ব্যথাটা বড় বেশী আলোড়িত হয়ে উঠেছিল সেইদিন, যেদিন শুনলাম আপনি বাপ-মা-হারা অনেকগুলি ছেলেমেয়ের মা। মায়ের অভাব মানুষ ইহজন্মে ভুলতে পারে না। আজন্ম যে মাতৃস্নেহ পায়নি তার তৃষ্ণাটা সেদিন বুকে হাহাকার ক’রে উঠেছিল। একটি মাতৃমূর্তির পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়া যে জীবনের কত বড় সার্থকতা―তা-ই সেদিন দিবাচক্ষে প্রথম দেখতে পেয়েছিলাম।–বলিয়া সিদ্ধার্থ বিষণ্ণ চক্ষে দরজার দিকে চাহিয়া কি দেখিতে লাগিল তাহা সে-ই জানে।

কিন্তু সকলের চেয়ে আশ্চর্য এই যে, সিদ্ধার্থর সুচিন্তিত বিলাপের পরই সভাস্থ তিনজনেরই নিঃশব্দ একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস একসঙ্গেই পড়িল।

রজত বলিল,―গান শুধু আনন্দ দেয় না, ব্যথাও দেয়। আমি আনন্দের আতিশয্য যাকে মনে করেছিলাম সে ব্যথা। নিজের মন বুঝতেও বাহিরের সাহায্য চাই, আমি এই প্রথম উপলব্ধি করলাম।–বলিয়া সে ভোজন-কক্ষের উদ্দেশে উঠিয়া পড়িল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *