• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

ভারত প্রেমকথা – সুবোধ ঘোষ

লাইব্রেরি » সুবোধ ঘোষ » ভারত প্রেমকথা – সুবোধ ঘোষ
ভারত প্রেমকথা - সুবোধ ঘোষ

ভারত প্রেমকথা – সুবোধ ঘোষ

ভারত প্রেমকথা – সুবোধ ঘোষ
প্রথম সংস্করণ: এপ্রিল ১৯৫৫ (বৈশাখ ১৩৬২ বঙ্গাব্দ)

“বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিকাল রস” [ভুমিকা]

১

ইংরেজিতে একটা প্রবচন আছে, ‘ম্যান ডাজ নট লিভ বাই ক্লাসিক্‌স অ্যালোন’। কথাটি খুব সত্য। প্রাচীন সাহিত্য অশেষ গুণের আধার হওয়া সত্ত্বেও তাহাতে এমন কিছুর অভাব আছে যাহাতে আধুনিক মন সম্পূর্ণ তৃপ্তি পায় না। আধুনিক মন সাহিত্যে আধুনিক রস সন্ধান করে। এই সন্ধানের সূত্রেই প্রত্যেক যুগ নূতন সাহিত্য সৃষ্টি করে। এই সবই সত্য। কিন্তু ক্লাসিক বা প্রাচীন সাহিত্য বা সাহিত্যের ধ্রুবপদ অংশে এমন কিছু সর্বজনীনতা আছে যাহাতে প্রত্যেক যুগ তাহার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং সার্থকতাও লাভ করে। দুই ভাবে ইহা ঘটে। পুরাতনের নূতন ভাষ্য রচনা করিয়া মানুষের মন তৃপ্তি পাইতে পারে। হোমারের অডিসি কাব্যের নায়ক সমুদ্রবক্ষে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিল। টেনিসন তাঁহার ইউলিসিস কবিতাটিতে ইউলিসিসের অভিজ্ঞতাকে নূতন ভাষ্যে সঞ্জীবিত করিয়া আধুনিক মনের পক্ষে হৃদ্য করিয়া তুলিয়াছেন। হোমারের ‘তন্ময় জগৎ’ টেনিসনের হাতে ‘মন্ময় জগৎ’ হইয়া উঠিয়াছে। হোমারের অডিসিতে মহত্ত্ব, টেনিসনের ইউলিসিসে নৈকট্য; হোমারের পাত্রে সার্বজনীন সুধা, টেনিসনের পাত্রে আধুনিক মনের সুধা; হোমারের কাব্য ভাবী কালকে আনন্দ দান করিবে, টেনিসনের কবিতাটি পরবর্তী কালের হৃদ্য মনে না হইতেও পারে।

আর এক রকমে প্রাচীন সাহিত্য আধুনিক তৃষ্ণার পানীয় জোগাইতে পারে। নূতন ভাষ্য রচনা করিয়া নয়, নূতন যুগের উপযোগী পরিবর্তন সাধন করিয়া। পৃথিবীর সাহিত্যে সর্বকালেই এমন ঘটিয়াছে, এখনও ঘটিতেছে। ইহাকে বলা যাইতে পারে, প্রাচীনের নবীকরণ। টেনিসন কাহিনীকে অবিকৃত রাখিয়া নূতন ভাষ্যের দ্বারা আধুনিক মনের আসন রচনা করিয়াছেন। কিন্তু অনেক লেখক প্রাচীন সাহিত্যের উপরে হস্তক্ষেপ করেন। কাহিনী অংশের অদল বদল করেন, নূতন তথ্য সংযোজিত করেন এবং নূতন ভাষ্য ও নূতন প্রাণে সঞ্জীবিত করিয়া তাহাকে নূতন যুগের নাগরিক অধিকার প্রদান করিয়া দূরবর্তী মহত্ত্বকে আধুনিক মনের নিকটে আনিয়া দেন।

বাংলা সাহিত্যে এমন উদাহরণ অবিরল।

মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্যের কাহিনী সর্বাংশে আর্য রামায়ণকে অনুকরণ করে নাই। তাঁহার রাম, রাবণ, ইন্দ্রজিৎ নামে মাত্র বাল্মীকির রাম, রাবণ, ইন্দ্রজিৎ। বাল্মীকির নায়কদের চেয়ে ইহাদের বেশি মিল ও আন্তরিক মিল মধুসূদনের সমকালীন ইয়ং বেঙ্গলের সহিত। মধুসূদন পুরাতন পাত্রে নূতন নূতন রস সংগ্রহ করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। হেমচন্দ্র ঠিক এই কাজটি পারেন নাই বলিয়াই তাঁহার বৃত্রসংহার কাব্য পাঠ্যপুস্তকের জগতের বাহিরে জীবন লাভ করিতে পারিল না।

এবারে রবীন্দ্রনাথের কাব্য হইতে দুইটি উদাহরণ লওয়া যাইতে পারে। রবীন্দ্রনাথের ‘পতিতা’ কবিতার মূল মহাভারতে। মূলে ‘প্রথম রমণী দরশমুগ্ধ’ ঋষ্যশৃঙ্গই প্রধান পাত্র। তাহার বিস্ময়, তাহার উল্লাস, তাহার অননুভূতপূর্ব অভিজ্ঞতাই কবিতাটির প্রাণ। যে নারী তাহাকে প্রলুব্ধ করিয়াছিল সে সামান্য বারযোষিৎ মাত্র। রবীন্দ্রনাথে ইহার সাকুল্য পরিবর্তন ঘটিয়াছে। মহাভারতের বারযোষিৎ আধুনিক কবি কর্তৃক দেবীপদে অভিষিক্ত হইয়াছে। এই পরিবর্তনের দ্বারা কবিতাটিকে কবি আধুনিক মনের পক্ষে সুপেয় করিয়া তুলিয়াছেন। আধুনিক ‘সোফিস্টিকেটেড’ মন ঋষ্যশৃঙ্গের অভিজ্ঞতাকে হাসিয়া উড়াইয়া দিবে, নতুবা প্রহসনে পরিণত করিবে, কিন্তু নারীহৃদয়ের বেদনাকে অনায়াসে মর্যাদা দান করিয়া স্বীকার করিয়া লইবে। এখানে কাহিনীর পরিবর্তন তেমন হয় নাই যেমন হইয়াছে ভাষ্যের সংযোজন।

রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা নাটকের মূলও মহাভারতে। রবীন্দ্রনাথ মূলের কাহিনী ও ভাষ্য দুয়েরই পরিবর্তন করিয়াছেন। মূলের খনি হইতে তিনি ধাতু সংগ্রহ করিয়া নতুন যুগের ছাঁচে পাত্র গড়িয়া লইয়াছেন আর তাহাতে আধুনিক মনের আধেয় রক্ষা করিয়াছেন। প্রাচীন ছাঁচে ঢালা চিত্রাঙ্গদাকাহিনী যতই মনোরম হোক না কেন, আধুনিক মনকে সম্পূর্ণ তৃপ্তিদান করিতে সক্ষম হইবে না।

প্রাচীনের নবীকরণ প্রচেষ্টার ফলেই যুগে যুগে নূতন পুরাণের সৃষ্টি হইয়াছে। সংস্কৃত ভাষায় রচিত যাবতীয় পুরাণই এইরূপ প্রক্রিয়ার ফল। মহাভারতোক্ত ‘শকুন্তলা’ পুরাণের ‘শকুন্তলা’ নয়, আবার কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ এই দুই হইতেই ভিন্ন। আবার গ্যেটে ও রবীন্দ্রনাথ ‘শকুন্তলা’র যে ব্যাখ্যা দিয়াছেন, খুব সম্ভব ‘মহাকবির কল্পনাতে ছিল না তার ছবি।’

যাবতীয় ক্লাসিক সাহিত্য আরব্য রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতো আপন দেহ হইতে যুগে যুগে নবতর সৃষ্টি করিয়া মানুষের মনকে তৃষ্ণার বারি যোগাইয়া আসিতেছে। ক্লাসিক সাহিত্যে এমন কিছু সার্বজনীনতা, স্থিতিস্থাপকতা আছে যাহা নূতন ভাষ্য, নূতন সংযোজনা ও নূতন পরিবর্তন বহনক্ষম। এখানে তাহার বৈশিষ্ট্য ও অর্বাচীন সাহিত্য হইতে তাহার স্বাতন্ত্র্য। কাজেই ‘ম্যান ডাজ নট লিভ বাই ক্লাসিক্‌স অ্যালোন’—সর্বাংশে সত্য নয়, অনেক সত্যের মতোই অর্ধসত্য মাত্র।

২

মনীষী সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ কিছুকাল আগে মহাভারত হইতে প্রেমকাহিনী অবলম্বনে গল্প লিখিতে আরম্ভ করেন। এগুলি যখন ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হইতে থাকে তখনি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আমারও করিয়াছিল। তারপরে এখন গল্পগুলি ‘ভারত প্রেমকথা’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হইল। অনেক দিন হইতে নিজের বইয়ের ভূমিকা লিখিয়া হাত পাকাইতেছি, পরের বইয়ের ভূমিকা লিখিবার সুযোগ পাইব ভরসা ছিল না। কিন্তু সুবোধবাবু এমনি দুঃসাহসী যে প্রস্তাব করিবামাত্র রাজি হইলেন। রামায়ণ মহাভারত না জানিলে ভারতবর্ষকে জানা যায় না। সুবোধবাবুর ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্র ও সাহিত্য সম্বন্ধে জ্ঞান ও শ্রদ্ধা বাংলা সাহিত্যের একটি আশার বিষয়। আর সেই জ্ঞান ও শ্রদ্ধার দ্বারা চালিত হইয়া তিনি মহাভারতের কাহিনীকে নিজের শিল্পসৃষ্টির বিষয় করিয়া তুলিয়াছেন।

বলা বাহুল্য, শিল্পদৃষ্টির বলে সুবোধবাবু বুঝিয়াছেন যে, প্রাচীনের অনুকরণ করিলে চলিবে না, প্রাচীনকে নবীন করিয়া তুলিতে হইবে। মনে রাখা উচিত যে, ঐতিহ্যবিরহিত হইলেই সার্থকসৃষ্টি হয় না। সার্থক শিল্পসৃষ্টির মূলে দু’টি স্বতোবিরুদ্ধ শক্তির ক্রিয়া আবশ্যক, ট্রাডিশন ও ফ্রিডম, সংস্কার ও স্বাধীনতা। ভারত প্রেমকথার গল্পগুলিতে স্বাধীনতা ও সংস্কারের অতি অপূর্ব মিলন হইয়াছে, আর সেই জন্যই এই প্রেমকথাগুলি অতি উচ্চাঙ্গের শিল্পসৃষ্টি হইয়া উঠিয়াছে।

এই প্রেমকথাগুলির মধ্যে ট্রাডিশন বা সংস্কারের উপাদান খুব স্পষ্ট, ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনতার বা নূতনত্বের দিকটা অভাবিত, তাই তাহার ব্যাখ্যা করিতে চেষ্টা করিব।

সংবরণ ও তপতীর কাহিনীটি গ্রহণ করা যাক।

মূল কাহিনীতে সমদর্শিতার ভাবটি নিতান্ত বীজাকারে বর্তমান। ভগবান্ আদিত্য সমদর্শী। তাঁহার কন্যা তপতীও সমদর্শী—আর তাঁহার শিষ্যও সমদর্শী। এই পর্যন্ত। কিন্তু তপতী ও সংবরণের সমদর্শিতা সংসারের ও প্রণয়াবেগের দ্বন্দ্বে নিক্ষিপ্ত হইলে কি রূপ ধারণ করে, মূলে তাহার পরিচয় অল্পবর্ণনায় ব্যক্ত হইয়াছে। সুবোধবাবু পূর্ণতর রূপণার দ্বারা তাহাই আমাদের দেখাইয়াছেন। বস্তুত তপতী ও সংবরণের সমদর্শিতার মুলে সত্য অভিজ্ঞতার, সাংসারিক পরীক্ষার বাস্তব ভিত্তি ছিল না, তাই তাহাদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম সংঘাতেই সমদর্শিতার ভাব বিলোপ পাইল। প্রথম প্রেমের মোহে সমদর্শী সংবরণ আত্মা সুখদর্শী হইয়া সমস্ত রাজকর্তব্য বিস্মৃত হইয়া রাজ্যে অরাজকতা ডাকিয়া আনিবার হেতু হইল। তারপরে ধীরে ধীরে অনেক আঘাতে, অনেক তপস্যায়, অনেক দুঃখ বরণের দ্বারা তাহাদের মোহ ভাঙিয়াছে, আর তখনই তাহারা সমদর্শিতার যথার্থ মূল্য বুঝিতে পারিয়াছে। তপতী ক্ষণকালের মোহে ভুলিয়া গিয়াছিল যে, সে কেবল সংবরণের মহিষী নয়, তাহার রাজ্যের রাণী। ভুলিয়া গিয়াছিল যে, সে কেবল পত্নী নয়, লোকমাতা। অবশ্য সংবরণও সমকালেই ইহা স্বীকার করিয়াছে। তাই প্রেম কথাটির সুখাবসান। অন্যথা ইহা রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ও রাণী’ বা ‘তপতী’র মতো ট্রাজেডিতে পরিণত হইতে পারিত। সংবরণ ও তপতী কাহিনীটি খুব সম্ভব রবীন্দ্রনাথের মনে ছিল, তাঁহার কাব্যে একবার অন্তত তপতী-সংবরণের প্রেম-তপস্যার উল্লেখ আছে। আর রাজা ও রাণীর আমূল পরিবর্তিত রূপের তপতী নামকরণ নিশ্চয়ই বিশেষ অর্থ বহন করে।

নারীর পত্নী ও লোকমাতা-রূপ দ্বৈতমূর্তির ভাবটি সেকালেও ছিল, কিন্তু বীজাকারেই ছিল, কারণ সেকালে নারীর বিচরণক্ষেত্র স্বভাবতই স্বল্পপরিসর ছিল। কিন্তু একালে পুরুষ ও নারীর সঞ্চরণক্ষেত্র সমব্যাপক, অন্তত তাহাই হইতে চলিয়াছে। একালে নারীকে, প্রত্যেক নারীকে, কেবল মহীয়সীদের মাত্র নয়, যুগপৎ পত্নী ও লোকমাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হইতে হয়, পদে পদে তাহার পরীক্ষা। কাজেই সেকালে যাহা বীজ মাত্র ছিল একালে তাহা বনস্পতি হইতে চলিয়াছে। ইহা মডার্ণ আইডিয়া ও মডার্ণ সমস্যা। সুবোধবাবুর মনীষার প্রমাণ এই যে, মূল কাহিনীতে আরও পাঁচটা সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও যুগোপযোগী সম্ভাবনাটিকে গ্রহণ করিয়াছেন, আর তাঁহার শিল্পদক্ষতার প্রমাণ এই যে (এখনও যদি প্রমাণের আবশ্যক করে), সেই সম্ভাবনাটিকে হৃদয়স্পর্শী কাহিনীতে পরিণত করিয়াছেন। কথাটি যুগপৎ যুগস্পর্শী ও হৃদয়স্পর্শী হইয়াছে।

এইভাবে প্রত্যেকটি কাহিনী বিশ্লেষণ করিয়া সুবোধবাবুর মনীষার ও শিল্পকৌশলের পরিচয় দেওয়া যাইতে পারে। কাহিনীগুলি কেবল ভাবের বাহন মাত্র নয়, নিজ মূর্তিতে সমুজ্জ্বল, ও নিজ প্রাণে সঞ্জীবিত। প্রাচীন কাহিনীর আধারে সুবোধবাবু চিরকালীন সুখ-দুঃখের ও হাসি-অশ্রুর অমৃত পরিবেষণ করিয়াছেন। এগুলি জ্ঞানের বস্তু নয়, জীবনের সামগ্রী।

‘পরীক্ষিৎ ও সুশোভনা’ কাহিনীর সুশোভনার চেয়ে অধিকতর মডার্ণ উয়োম্যান তো বাংলা সাহিত্যে দেখি নাই। শেষের কবিতার কেটি সিসি লিসির দল ও শেষ প্রশ্নের কমল তাহার কাছে নিষ্প্রভ। মডার্ণ উয়োম্যানের চরিত্রে ‘প্যাশন’ বস্তুটির অভাব; তাহাদের হৃদয়ে প্যাশন নাই, হাবভাবে তাহার ছলনাটুকু মাত্র আছে। সেইজন্য তাহারা অসহ্য; আর প্যাশন-এর তড়িৎপুঞ্জচালিত সুশোভনা উল্কাপিণ্ডের ন্যায় মধ্যাহ্ন ভাস্করের ন্যায়, জ্বলন্ত বর্তিকার ন্যায় দুঃসহ। স্বাধীন, দুর্ধর্ষ, দুর্বার, সহজ জীবনের তিরোভাবের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়াবেগের প্রবল উত্থানপতনও বোধ করি লোপ পাইয়াছে।

অগস্ত্য-পত্নী লোপামুদ্রার তপস্বিনী মূর্তিতেই আমরা অভ্যস্ত, কিন্তু তাহার চরিত্রেও যে আরও একটা দিক আছে সুবোধবাবু তাহা দেখাইয়াছেন। সে চিরন্তনী নারী। অলংকার-পরিত্যাগে সে কী দুঃখ। আবার অলংকার-লোভেই বা কী আগ্রহ। কিন্তু স্বামী যখন বহুবাঞ্ছিত অলংকাররাশি তাহার পায়ের কাছে আনিয়া স্তূপীকৃত করিল, তখন সেইগুলির দিকে ফিরিয়াও চাহিল না। চিরন্তনী ছলনাময়ীর এ কেমন চিরন্তর ছলনা। ঐ লীলাটুকু নারী-চরিত্রে আছে বলিয়াই বোধ করি মানুষের সংসারে নারীর প্রেম সুন্দর ও সুসহ এক রহস্য।

আর, অগ্নির বহুনারী ও পরনারী স্বাদ পূরণের জন্য প্রেমিকা স্বাহার ছদ্মবেশে সে কী কপটাভিনয়! এ কাহিনীটি যেমন করুণ তেমনি মনোরম, তেমনি নাট্যরসে গম্ভীর।

আর, সেই যে সুলভা একবার আসিয়া জনকের আত্মজ্ঞানের পরীক্ষা করিয়া গেল! শান্ত সমুদ্রকে উদ্বেল করিয়া চন্দ্রমা যেমন নির্বিকারভাবে অস্তমিত হয়, তেমনি করিয়া সুলভা প্রস্থান করিল। জনক তাহাকে ভুলিতে পারে নাই, পাঠকও তাহাকে ভুলিবে এমন সম্ভাবনা দেখি না।

এমন করিয়া দৃষ্টান্ত দিতে গেলে পুঁথি বাড়িয়া যাইবে কাজেই প্রলোভন থাকা সত্ত্বেও, অন্য দু’একটি কথা বলিয়া প্রবন্ধের উপসংহার করিব।

ভাষাপ্রবাহ নদীপ্রবাহের মতো—একথা অনেকেই বলিয়াছেন। কিন্তু দু’য়ে প্রভেদ এই যে, নদীপ্রবাহের বিস্তার কেবল দেশে আর ভাষাপ্রবাহ বিস্তৃত দেশে ও কালে। সুবোধবাবু বিষয় ভেদে খিন্ন ভাষারীতি ব্যবহার করেন। তাঁহার আধুনিক জীবনের গল্পগুলিতে, ভারতীয় ফৌজের ইতিহাসে এবং অন্যান্য প্রবন্ধে যে ভাষারীতি তিনি ব্যবহার করিয়াছেন, এখানে সে ভাষারীতি নয়। এখানে তাঁহার ভাষাপ্রবাহ মহাভারতের দেশে কালে বিস্তারিত, তাই তাহার জল গভীর, ধ্বনি গম্ভীর এবং কলালাবণ্যে উচ্ছ্রিত শীকরকণায় ইন্দ্রধনুর লীলা। এখানে তাঁহার ভাষাপ্রবাহের নির্মল দর্পণে কোথাও বা হিমালয়ের ধবলিমার শুভ্র প্রতিবিম্ব, কোথাও বা প্রাচীন অরণ্যানীর শাখাজটিল অন্ধকারের গূঢ় প্রতিচ্ছায়া, আর কোথাও বা ঐশ্বর্যসুখী রাজরাজন্যগণের বিচিত্রবর্ণ রত্নসৌধচূড়ার প্রতিচ্ছবি। যে কোন স্থান হইতে উদাহরণ লওয়া যাইতে পারে।

“সেই নিদাঘের মধ্যদিনের আকাশ সেদিন তপ্ত তাম্রের মতো রক্তাভ হয়ে উঠেছিল, বলাকামালার চিহ্ন কোথাও ছিল না। জ্বালা-বিগলিত স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ সেই সরোবরসলিলে মীনপংক্তির চাঞ্চল্যও ছিল না। খর সৌরকরে তাপিত এক শৈবালবর্ণ শিলানিকেতন বহ্নিস্পৃষ্ট মরকতস্তূপের মতো সরোবরপ্রান্তে যেন শীতল স্পর্শসুখের তৃষ্ণা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মন্ডুকরাজ আয়ুর প্রাসাদ।”

কিংবা—

“আলোকে আপ্লুত হয়ে উঠেছে পূর্ব গগনের ললাট। সূক্ষ্ম অংশুক নীশারের মতো ধীরে ধীরে অপসৃত হয় ভিন্ন কুহেলিকা, আর বিগলিতদুকূলা কামিনীর মতোই শরীরশোভা প্রকট করে ফুটে ওঠে কুলমালিনী এক তটিনীর রূপ।”

কিংবা—

“পুষ্পমাল্য হাতে নিয়ে কুটীরের বাইরে এসে দাঁড়ায় সুকন্যা। দেখতে পায়, যৌবনাঢ্য দুই পুরুষের দুই মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে প্রাঙ্গণের বক্ষের উপর। উভয়েই সমান সুন্দর, একই তরুর দুই পুষ্পের মধ্যে যতটুকু রূপের ভিন্নতা থাকে, তাও নেই। কান্তিমান, দ্যুতিমান ও বিশাল বক্ষঃপট, নবীন শাল্মলীসদৃশ যৌবনান্বিত দুই দেহী।”

ভাষার মৃদঙ্গ বাজিতেছে। এমন বর্ণাঢ্য, রূপাঢ্য ধ্বনিসুন্দর ভাষা বাংলা ভাষারই এক নূতন পরিচয় এবং বিপুল উৎকর্ষের সম্ভাবনাময় পথটি দেখাইয়া দিতেছে। মহাভারতীয় পরিবেশ রচনা ও ভাষারীতি ছাড়া অসম্ভব। বাংলা সাহিত্যে যখনি ক্লাসিকাল রস সৃষ্টি করিয়াছেন তখনই এই ভাষারীতিকে গ্রহণ করিতে তিনি বাধ্য হইয়াছেন। ইদানীং কালে অধিকাংশ লেখক সে প্রয়োজন অনুভব করে না, তাই অব্যবহারে, অপরিচয়ে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেই অজ্ঞানে এ হেন ভাষারীতি নষ্ট হইতে বসিয়াছে। ভাষার নিজস্ব একটি মহিমা আছে, ভাষা কেবল ভাবের বাহন নয়।

বস্তুত প্রকৃত গণ-সাহিত্যের উপাদান সঞ্চিত আছে ওই রামায়ণ, মহাভারতে। ‘ভারত প্রেমকথা’ বঙ্গ-সরস্বতীর চিরকালীন অঙ্গভূষণ।

প্রমথনাথ বিশী

.

“মহাভারতের মাধুর্যকণা” [একটি পত্র]

স্নেহভাজনেষু,

আশীর্বাদ লও।…তোমার সর্ববিধ কল্যাণ কামনা করি।

আশীর্বাদ কি আজই জানাইলাম। বহুদিন পূর্ব হইতে প্রতিদিনই তোমাকে আশীর্বাদ জানাই। আগে আমাদের গুরুজনেরা আশীর্বাদ করিতেন “তোমার সোনার দোয়াত কলম হউক।” তোমার তো সোনার দোয়াত কলমই হইয়াছে। নহিলে মহাভারতের কথানকের এমন মধুরোজ্জ্বল মর্মানুবাদ বাহির হইবে কেন? এ তো লেখা নয়! জীবনালেখ্য লিখনের এমন শুচিস্মিত রম্যতা, চিত্রণের এমন ইন্দ্রধনুর বিচিত্রতা, সঙ্কলনের এমন শালীনতা, এত লালিত্য এত মাধুর্য কোথা হইতে আহরণ করিলে?

যা নাই ভারতে তা নাই ভারতে। মহাভারতে অরণ্যানী আছে, উপবন আছে। ফলোদ্যানও আছে। আবার সাগরের তরঙ্গরঙ্গ, তটিনীর নটনভঙ্গী এবং নির্ঝরিণীর কলগীতি আছে। মহাভারতে একদিকে আছে শান্তরসাস্পদ তপোবন, অন্যদিকে মৃত্যুসন্ধুক্ষিত রণভূমি। একদিকে দারিদ্র্যলাঞ্ছিত পর্ণকুটীর, অন্যদিকে ঐশ্বর্যসমৃদ্ধ রাজপ্রাসাদ। একদিকে শ্যাম শষ্পক্ষেত্র, অন্যদিকে বণার্ঢ্য রত্নভাণ্ডার। ত্যাগের সঙ্গে স্বার্থপরতার, মহত্ত্বের সঙ্গে নীচতার, স্বর্গের সঙ্গে নরকের এমন বিচিত্র সমাবেশ অন্যত্র দুর্লভ। তুমি একক এই ভারত পরিক্রমায় বাহির হইয়াছ। তোমার যাত্রা সার্থক হউক।

অচতুর্বদন ব্রহ্মা, দ্বিবাহু অপর হরি, অভাললোচন শম্ভু ভগবান বাদরায়ণ মহাভারতের মর্ত্য মৃত্তিকায় স্বর্গ-পাতাল একত্রিত করিয়াছেন। তিনি আদিকবি ব্রহ্মার সর্জনাকে সম্পূর্ণতা দান করিতে গিয়া এক অভিনব জগৎ রচনা করিয়াছেন। তাই তো সৃজন পালন সংহারের এমন বিস্ময়জনক অথচ সুমিত সমাহার! মর্ত্যকে অমৃতদানের মহান্ ব্রতে সাৰ্থক ব্ৰতী ব্যাসদেব দেবলোক এবং নাগলোক এই দুই লোক হইতেই অমৃত আনিয়া মরলোকে বিতরণ করিয়াছেন। শ্রীমদ্‌ভাগবতে যে কান্তা-প্রেমকে তিনি জীব-জগতের সাধ্যসার বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, এই সমস্ত কথানক তাহারই অধিষ্ঠান ভূমি। এই পার্থিব প্রেমেরই দিব্যরূপ নিকষিত হেম গোপী-প্রেম। এই সার্থক প্রেমের বৈচিত্র্য কত, রহস্যই বা কেমন! যেমন গভীর তেমনই কি বিশাল! সংসার ও সমাজের স্থিতিরূপা পালনকারিণী এবং বিলয়বিধাত্রী যে প্রেমাকাঙক্ষা, মহর্ষি শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন এই কথানকমালায় সেই প্রেমাকাঙক্ষরই কথা কহিয়াছেন। স্বর্গ মর্ত্য পাতাল সর্বত্রই ইহার অবাধ গতি, বিপুল প্রসার, প্রবল প্রভাব। মহর্ষির জীবনদর্শনের মহিমময় দৃষ্টিভঙ্গীর অনুসরণে তোমার একনিষ্ঠ প্রয়াস আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে। জীবনে যেমন সমস্যা আছে তেমনই সমাধানও আছে। সেই সমস্যা নিরূপণে এবং সমাধান নির্ধারণে ত্রিকালদর্শী মহর্ষির চরণাঙ্কিত সরণি হইতে তুমি পদস্খলিত হও নাই, তোমার পতন ঘটে নাই, এই দুর্দিনে ইহাই সর্বাপেক্ষা আশা এবং আশ্বাসের ভরসা এবং আনন্দের কথা।

মহাকবি মধুসূদনের বীরাঙ্গনায় ও কবিকুলতিলক রবীন্দ্রনাথের কচ ও দেবযানীতে এবং চিত্রাঙ্গদায় মহাভারতের মাধুর্যকণার অভিনব আস্বাদ লাভ করিয়াছি। তাহাতে পিপাসা বাড়িয়াছে মাত্র। সে পিপাসা প্রশমনের প্রয়াস আর কেহ করেন নাই। মধুসূদন এবং রবীন্দ্রনাথের রচনা কবিতায়। তোমার রচনা কবিত্বপূর্ণ কিন্তু কবিতা নয়, ইহা গদ্য কবিতা ও একটি অপূর্ব রচনা।

ফুলমালা দেখিয়াছি, মণিমালিকা দেখিবারও সৌভাগ্য ঘটিয়াছে। কিন্তু এমন কুসুমে রতনে গাঁথা মালা ইতিপূর্বে বাঙ্গলা সাহিত্যের আর কোথাও দেখি নাই। তুমি সেই অসাধ্য সাধন করিয়াছ। তোমার মালায় দেবলোকের মন্দার এবং সন্তানক পুষ্প আছে। তাহার সঙ্গে নাগলোকের মহাৰ্হসমুজ্জ্বল মণিরত্নের এমন সুসমঞ্জস সন্নিবেশ, এ এক বিস্ময়জনক সৃষ্টি! অমরোদ্যানের কুসুমসম্ভারের সঙ্গে ফণিফণার রত্ননিচয়কে কি কুশলতায় মিশাইয়া দিয়াছ, এ এক অদৃষ্টপূর্ব চমৎকৃতি। বর্ণে এবং আকারে একাকার হইয়া গিয়াছে। কুসুমের রূপ রং ও সুরভি এবং স্নিগ্ধতার সঙ্গে রত্ন বিচ্ছুরিত দ্যুতিবিম্বের মিলন মাল্যখানিকে অপূর্ব শ্রীমণ্ডিত করিয়াছে।

তুলনা করিতেছি না, তথাপি বলিতেছি তোমার রচিত মাল্যদাম শিল্পিশ্রেষ্ঠ ময়-রচিত ইন্দ্রপ্রস্থসভার কথা স্মরণ করাইয়া দিতেছে। তোমার রচিত এই মালা কিন্তু বিনি সূতায় গাঁথা মালা নহে। মাল্যগ্রন্থনে তুমি মর্ত্যের মানসলোক হইতে এই সূত্র সংগ্রহ করিয়াছ। মানবের অন্তরবেদনাবিমথিত অশ্রুবিরচিত সেই সূত্র। এই জন্যই রচনা সার্থক ও সুন্দর হইয়াছে। মহর্ষি হইলেও ব্যাসদেব মানুষ ছিলেন। তাঁহার অনুভূতি মানবহৃদয়েরই দিব্যানুভূতি।

শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়
সাহিত্যরত্ন

.

‘নতুন ক’রে পাব ব’লে” [মুখবন্ধ]

আদিযুগ আর নবতম যুগ, রূপের দিক দিয়ে এই দুয়ের মধ্যে ভিন্নতা আছে, কিন্তু এই ভিন্নতা নিশ্চয়ই বিচ্ছেদ নয়। নবতমের মধ্যে হোক, আর পুরাতনের মধ্যে হোক, শিল্পীর মন সেই এক চিরন্তনেরই রূপের পরিচয় অন্বেষণ ক’রে থাকে। শিল্পীর সাধনা হল নতুন ক’রে পাওয়ার সাধনা। শুধু পথ চাওয়াতেই আর চলাতেই শিল্পীর আনন্দ হয়, নতুন ক’রে পাওয়ার আনন্দও শিল্পীর আনন্দ। আদিযুগের রূপকে এই জগতে আর একবার পাওয়া যাবে না ঠিকই, কিন্তু আদিযুগের রূপকে নতুন ক’রে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা শিল্পী ছাড়তে পারেন না। কারণ, সেই পুরাতনের রূপের সঙ্গে একটি অখণ্ড আত্মীয়তার ডোরে বাঁধা রয়েছে নবতম যুগের মানুষেরও জীবনের রূপ।

জীবনের রূপ সম্বন্ধে এই অখণ্ডতার বোধ হল কবি শিল্পী ও সাধকের মহানুভূতি এবং এই মহানুভূতিই মানুষজাতির শিল্পে ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে যেখানে সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট ও সুন্দর আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে সেখানেই আমরা পেয়েছি ক্লাসিক গৌরবে মণ্ডিত সাহিত্য ও শিল্প। ক্লাসিক-এর রূপ ও ভাব খণ্ডকালের মধ্যে সীমিত নয়। কালোত্তর প্রেরণার শক্তিতে সঞ্জীবিত হয়ে আছে কবি বাল্মীকির রামায়ণ এবং ব্যাসদেবের মহাভারত। বিশেষ কোন জাতির জীবনের রীতিনীতি ও ঘটনা অথবা বিশেষ কোন যুগের ইতিহাসের উত্থান-পতনের ঘটনাকে আশ্রয় ক’রে রচিত হ’লেও বিশ্বের ক্লাসিক সাহিত্যকীর্তিগুলির মধ্যে মানবজীবনের চিরকালীন আনন্দ হর্ষ ও বেদনার ব্যাকুলতা বাঙ্ময় হয়ে রয়েছে। ভোরের সূর্যের মতো এই মহাপ্রাণময় কাব্য ও শিল্পরীতিগুলি মানুষের মনের আকাশে নিত্য নতুন আলোকের প্রসন্নতা ছড়ায়। তাই প্রতি জাতির সাহিত্যে দেখা যায় যে, নতুন কবি ও শিল্পীরা জাতির অতীতের রচিত মহাকাব্য গাথা সঙ্গীত ও শিল্পরীতি থেকে প্রেরণা আহরণ করেছেন।

কিন্তু ক্লাসিকের রূপ ও ভাবের ভাণ্ডার থেকে আহৃত উপাদান দিয়ে রচিত এই নতুন সুষ্টিগুলি সম্পূর্ণভাবে আধুনিকতম নতুন সৃষ্টিরূপে পরিণতি লাভ করে, পুরাতনের পুনরাবৃত্তি হয় না। ইউরোপীয় সাহিত্য ও শিল্পে বিভিন্ন কয়েকটি রেনেসাঁর ইতিহাস লক্ষ্য করলেও এই বিস্ময়কর নিয়মের সত্যতা আবিষ্কৃত হয় যে, আধুনিক কবি ও শিল্পীর হৃদয় পুরাতনেরই মহাপ্রাণময় কাব্য ও শিল্পের রূপগরিমার সাযুজ্য লাভ ক’রে বিপুল নূতনত্ব সষ্টির অধিকার লাভ করেছিল। এই সাফল্যের অন্তর্নিহিত রহস্য বোধ হয় এই যে, ক্লাসিকের অনুশীলনে কবি ও শিল্পী সহজেই সেই দৃষ্টিসিদ্ধি লাভ ক’রে থাকেন, যার ফলে জীবনের রূপকে যুগ হতে যুগান্তরে প্রবাহিত এক অক্ষান্ত ও অখণ্ড রূপের ধারা ব’লে সহজে উপলব্ধি করা যায়।

বিশ্বের ক্লাসিক সাহিত্য এই উপলব্ধির বাণীময় রূপ। তাই ক্লাসিক-এর অনুশীলন সহজে মানুষের চিত্তের ভাবনাকে প্রকৃত রূপসৃষ্টির রীতিনীতি ও পথ চিনিয়ে দেয়। এক কথায় বলতে পারা যায়, ক্লাসিক সাহিত্য ও শিল্পরীতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়া জীবনের রূপকে নতুন ক’রে নিকটে পাওয়ার উপায়।

মহাভারতের মূলকাহিনী ছাড়া আরও এমন শত শত উপাখ্যানে এই গ্রন্থ আকীর্ণ যার মূল্য সহস্র বৎসরের প্রাচীনতার প্রকোপেও মিথ্যা হয়ে যায়নি। কারণ, ব্যক্তির ও সমাজের মন এবং সম্পর্কের যে-সব সমস্যা মহাভারতীয় উপাখ্যানগুলির মূল বিষয়, সে-সব সমস্যা বিংশ শতাব্দীর নরনারীর জীবন থেকেও অন্তর্হিত হয়নি। নরনারীর প্রণয় ও অনুরাগ, দাম্পত্যের বন্ধন বাৎসল্য ও সখ্য—শ্রদ্ধা ভক্তি ক্ষমা ও আত্মত্যাগ ইত্যাদি যে-সব সংস্কারের উপর সামাজিক কল্যাণ সৌষ্ঠব মূলত নির্ভর করে, তার এক-একটি আদর্শোচিত ব্যাখ্যা এইসব উপাখ্যানের নায়ক-নায়িকার জীবনের সমস্যার ভিতর দিয়ে বর্ণিত হয়েছে। শত শত ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের যে-সব কাহিনী মহাভারতে বিবৃত হয়েছে তার মধ্যে এই বিংশ শতাব্দীর যে-কোনও মানুষ তাঁর নিজের জীবনেরও সমস্যার অথবা আগ্রহের রূপ দেখতে পাবেন। এই কারণে শতেক যুগের কবিদল মহাভারত থেকে তাঁদের রচনার আখ্যানবস্তু আহরণ করেছেন।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ক্লাসিক সাহিত্যের তুলনায় ভারতের ক্লাসিক এই মহাভারত কিন্তু একটি বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র। এই মহাভারতই বস্তুত ভারতের সাধারণ লোকসাহিত্যে পরিণত হয়েছে। ভারতের কোটি কোটি নিরক্ষরের মনও মহাভারতীয় কাহিনীর রসে লালিত। ভারতীয় চিত্রকরের কাছে মহাভারত হলো রূপের আকাশপট, ভাস্করের কাছে মূর্তির ভাণ্ডার। গ্রাম-ভারতের কথক ভাট চারণ ও অভিনেতা, সকল শ্রেণীর শিল্পী মহাভারতীয় কাহিনীকে তার নাটকে সঙ্গীতে ও ছড়ায় প্রাণবান ক’রে রেখেছে। মহাভারতের কাহিনী এবং কাহিনীর নায়ক-নায়িকার চরিত্র ও রূপ ভারতীয় ভাস্কর স্থপতি চিত্রকর নট নর্তক ও গীতকারের কাছে তার শিল্পসৃষ্টির শত উপাদান, ভাব, রস, ভঙ্গি, কারুমিতি ও অলংকারের যোগান দিয়েছে। মহাভারত গ্রন্থ প্রতিশব্দ উপমা ও পরিভাষার অভিধান। ভারতের জ্যোতির্বিদ্ মহাভারতীয় নায়ক-নায়িকার নাম দিয়ে তাঁর আবিষ্কৃত ও পরিচিত গ্রহ-নক্ষত্র-উপগ্রহের নামকরণ করেছেন। আকাশলোকের ওই কালপুরুষ অরুন্ধতী রোহিণী চন্দ্র বুধ ও কৃত্তিকা, কতগুলি জ্যোতিষ্কের নাম মাত্র নয়—ওরা সকলেই এক-একটি কাহিনীর, এক-একটি প্রীতি ভক্তি ও রোমান্সের নায়ক-নায়িকা। গঙ্গা নর্মদা যমুনা ও কৃষ্ণবেণা—কতগুলি নদীর নাম মাত্র নয়, ওরাও কাহিনী। ভারতের বট অশোক শাল্মলী করবী ও কর্ণিকার উদ্ভিদ মাত্র নয়, তারাও সবাই এক-একটি কাহিনীর নায়ক ও নায়িকা। নৈসর্গিক রহস্য ও মেরুজ্যোতির অভ্যন্তরে কাহিনী আছে, সামুদ্র বাড়বানলের অন্তরালে কাহিনী আছে, সপ্তাশ্বযোজিত রথে আসীন সূর্যের উদয়াচল থেকে শুরু ক’রে অস্তাচল পর্যন্ত অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে কাহিনী আছে। মহাভারতীয় কাহিনীর নায়ক-নায়িকার নাম হল ভারতের শত শত গিরি পর্বত নদ নদী ও হ্রদের নাম। ভারতীয় শিশুর নাম-পরিচয়ও মহাভারতীয় চরিত্রগুলির নামে নিষ্পন্ন হয়।

মহাভারতীয় প্রেমোপাখ্যানগুলির বৈচিত্র্য আরও বিস্ময়কর। উপাখ্যানগুলি যেন প্রণয়তত্ত্বেরই মনোবিশ্লেষণ। সাবিত্রী সত্যবান, নল-দময়ন্তী, দুষ্মন্ত-শকুন্তলা ইত্যাদি লোকসমাজের অতি পরিচিত উপাখ্যানগুলি ছাড়াও এমন আরও বহু উপাখ্যান মহাভারতে আছে, যেগুলি লোকসমাজে তেমন কোন প্রচার লাভ করেনি। এইসব অল্প-প্রচারিত উপাখ্যানও প্রেমের রহস্য বৈচিত্র্য ও মহত্ত্বের এক একটি বিশেষ রূপের পরিচয়। ভারত প্রেমকথার বিশটি গল্প এই রকমই বিশটি মহাভারতীয় প্রেমোপাখ্যানের পুনর্গঠিত অথবা নবনির্মিত রূপ। উপাখ্যানের মূল বক্তব্য অক্ষুন্ন এবং মূল বক্তব্যকে স্পষ্টতর অভিব্যক্তি দান করার জন্যই মাঝে মাঝে নতুন ঘটনা কল্পিত হয়েছে।

সুবোধ ঘোষ

Book Content

পরীক্ষিৎ ও সুশোভনা
সুমুখ ও গুণকেশী
অগস্ত্য ও লোপামুদ্রা
অতিরথ ও পিঙ্গলা
মন্দপাল ও লপিতা
উতথ্য ও চান্দ্রেয়ী
সংবরণ ও তপতী
ভাস্কর ও পৃথা
অগ্নি ও স্বাহা
বসুরাজ ও গিরিকা
গালব ও মাধবী
রুরু ও প্রমদ্বরা
অনল ও ভাস্বতী
ভৃগু ও পুলোমা
চ্যবন ও সুকন্যা
জরৎকারু ও অস্তিকা
জনক ও সুলভা
দেবশর্মা ও রুচি
অষ্টাবক্র ও সুপ্রভা
ইন্দ্র ও শ্রুবাবতী
লেখক: সুবোধ ঘোষবইয়ের ধরন: ধর্ম ও দর্শন
শতকিয়া (১৯৫৮) – উপন্যাস – সুবোধ ঘোষ

শতকিয়া – সুবোধ ঘোষ

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.