গালব ও মাধবী

গালব ও মাধবী

সহস্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছেন এবং কত সহস্র প্রার্থীকে গো ভূমি কাঞ্চন ও শস্য দান করেছেন রাজা যযাতি! তাঁর কাছে দানই হলো মানলাভের একমাত্র ব্রত এবং মানই হলো মানবজীবনের একমাত্র পুণ্য।

পুণ্যের প্রয়োজন হয়েছে রাজা যযাতির; কারণ তিনি সেই সব রাজর্ষির মধ্যে স্থানলাভ করতে চান, যাঁরা পুণ্যবলে স্বর্লোকে অধিষ্ঠান লাভ করেছেন। এই আকাঙক্ষাই তাঁর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন। কিন্তু কবে এই স্বপ্ন সফল হবে?

বৈভব ক্ষয় হয়ে গিয়েছে অনেক, কিন্তু ক্ষয় হয়নি তার আরও দান করবার স্পৃহা। রত্নাগার শূন্য হয়ে এসেছে, কিন্তু এখনও শূন্য হয়নি তাঁর আরও মান লাভের আকাঙক্ষা। কারণ, দানের গর্বে ও গৌরবে তিনি সব রাজর্ষির মহিমা খর্ব করে দিতে চান। স্বর্লোকের রাজর্ষিদের মধ্যে একজন সাধারণ হয়ে নয়, অসাধারণ হয়ে, প্রধান হয়ে এবং সর্বোচ্চ হয়েই তিনি আসন লাভ করবার সংকল্প গ্রহণ করেছেন। তাই সব চেয়ে বেশি পুণ্যবল সঞ্চয়ের প্রতীক্ষায় রয়েছেন রাজা যযাতি।

প্রতিদিনের মত সেদিনও সভাকক্ষে বসেছিলেন রাজা যযাতি। তখনও প্রার্থীর সমাগম আরম্ভ হয়নি।

সভাকক্ষের চারিদিকে তাকালেই বোঝা যায়, রাজা যযাতির মনে দান করবার আকাঙক্ষা যত বড়, দান করবার মত রাজৈশ্বর্য তত বড় নয়। রাজচ্ছত্র মৌক্তিকে খচিত নয়। রাজদণ্ড মণিবিচিত্রিত নয়। সিংহাসনে রত্নধাতুপ্রভা নেই। স্তম্ভে ও বেদিকায় বিদ্রুমশোভা নেই। নেই কোন চারণসুন্দরীর কণ্ঠোৎসারিত চিত্তহারী গীতস্বর; নেই কোন চঞ্চরীকনয়না চামরগ্রাহিণীর চারুকটাক্ষ। সিংহাসনের পার্শ্বে এক ক্ষুদ্র অগুরুগর্ভিত বর্তিকার শিখা হতে বিচ্ছুরিত রশ্মি যযাতির মুকুট স্পর্শ করে, কিন্তু রত্নহীন সে মুকুট উদ্ভাসিত হয় না।

সভাকক্ষে প্রথমে প্রবেশ করলেন এক তপস্বী। রাজা যযাতি কয়েকটি তাম্রমুদ্রা হাতে তুলে নিয়ে তপস্বীকে দান করবার জন্য বলেন—দান গ্রহণ করুন যোগিবর।

তপস্বী মৃদুহাস্যে বলেন—আমি বিষয়ী নই রাজা যযাতি, তাম্রমুদ্রায় আমার কোন প্রয়োজন নেই।

রাজা যযাতি পরক্ষণে ভূর্জপত্র ও লেখনী হাতে নিয়ে বলেন—তবে আপনাকে একখণ্ড ভূমি দান করি। দানপত্র লিখে দিই।

তপস্বী আবার আপত্তি করেন—আমি গৃহী নই রাজা যযাতি, আমার কোন ভূমিখণ্ডের প্রয়োজন নেই।

একমুষ্টি যবকণা তুলে নিয়ে রাজা যযাতি বলেন—তবে এগিয়ে আসুন যোগিবর, আপনার ঐ চীরবস্ত্রের অঞ্চল বিস্তারিত করুন। আপনাকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ শস্য দান করি।

তপস্বী বলেন—শস্যকণায় আমার প্রয়োজন নেই, আমি ক্ষুধার্ত নই।

যযাতি—তবে কি চান আপনি? বলুন, আপনাকে কি বস্তু দান করব?

তপস্বী—যদি নিতান্তই দান করতে চান, তবে আমাকে আপনার সভায় কিছুক্ষণ উপবেশন করতে অনুমতি দান করুন।

যযাতি বিস্মিত হয়ে বলেন—আসন গ্রহণ করুন, কিন্তু আমার কাছ থেকে মাত্র এইটুকু দানেই কি আপনি পরিতুষ্ট হবেন যোগিবর? আমার কাছ থেকে কি আর কোন অনুগ্রহ প্রার্থনা করবার নেই?

আসন গ্রহণ করবার পর তপস্বী বলেন—আমি আপনাকে একটি দিব্য লোকনীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে এসেছি রাজা যযাতি। যদি শ্রবণ করেন, তবেই আমার প্রতি অনেক অনুগ্রহ করা হবে।

যযাতি—বলুন যোগিবর।

তপস্বী—পূণ্যার্জন লোকজীবনের একটি লক্ষ্য সন্দেহ নেই। কিন্তু স্মরণে রাখবেন, পুণ্যার্জনের পথটিও পুণ্যময় হওয়া চাই।

যযাতি—আপনার উপদেশের তাৎপর্য বুঝলাম না, যোগিবর।

তপস্বী—মহৎ পন্থা ছাড়া মহদভীষ্ট লাভ হয় না, রাজা যযাতি। সদাচরণে সদ্‌বস্তু, সম্মানের পথে সম্মান লাভ হয়, অন্যথায় হয় না।

যযাতি—কেন হয় না?

তপস্বী—যেমন মহিষের শৃঙ্গাঘাতে পুষ্পদ্রুম মঞ্জরিত হয় না, হয় বসন্তানিলের মৃদুল স্পর্শে। নিষাদের করধৃত কাষ্ঠাগ্নির প্রজ্বলন্ত আলোকে নিদ্রিত বিহঙ্গ জাগে না, জাগে প্রাচীপটে অভ্যুদিত নবার্কের আলোকাপ্লুত ইঙ্গিতে। শোণিতজলা বৈতরণীর তরঙ্গে স্বর্গমরাল কেলি করে না, তার জন্য চাই মানসহ্রদের স্বচ্ছোদক।

যযাতি—শুনলাম যোগিবর।

তপস্বী—স্মরণে রাখবেন, নৃপতি।

যযাতি—বনবাসীর লোকনীতি বনের জীবনেই সত্য হতে পারে যোগিবর, নৃপোত্তম যযাতির পক্ষে এমন নীতি স্মরণ করে রাখবার কোন প্রয়োজন নেই। সংকল্প যে-কোন পন্থায় সিদ্ধ করাই রাজসিক ধর্ম। যদি একটি বিষদিগ্ধ শরের আঘাতে হত্যা করে মাতঙ্গের মস্তক-মৌক্তিক লাভ করা যায়, তবে কোন্ মূর্খ শতবর্ষ প্রতীক্ষায় থাকে, কবে কোন্ পূর্বাষাঢ়া নক্ষত্রের পুলকিত জ্যোতির আবেদনে সে গজমৌক্তিক আপনি স্খলিত হবে বলে? এক মুষ্টি ধুলি নিক্ষেপ করে পাতালভুজঙ্গের চক্ষু এক মুহূর্তে অন্ধ করে দিয়ে যদি ফণামণি লাভ করা যায়, তবে শতবর্ষ ধরে নাগপূজা করবার কি সার্থকতা?

তপস্বী আর প্রত্যুত্তর দিলেন না। গাত্রোত্থান করলেন এবং রাজসভা ছেড়ে চলে গেলেন। রাজা যযাতি লক্ষ্য করলেন, সভাপ্রান্তে আর একজন প্রার্থী এসে বসে আছেন, কান্তিমান এক ঋষিযুবা।

যযাতি আহ্বান করেন—আপনার প্রার্থনা নিবেদন করুন ঋষি।

ঋষিযুবা বলেন—আমি অর্থের প্রার্থী।

রাজা যযাতি এক শত তাম্রমুদ্রা হাতে তুলে নিয়ে বলেন—গ্রহণ করুন ঋষি।

ঋষিযুবা হেসে ফেলেন—ঐ যৎসামান্য অর্থের প্রার্থী আমি নই, রাজা যযাতি।

যযাতি—আপনার কি পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন?

ঋষিযুবা—নিশাকরসদৃশ শুভ্রদেহ এবং শ্যামৈককর্ণ অষ্ট শত অশ্ব সংগ্রহ করতে হলে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তাই আমাকে দান করুন।

ঋষিযুবার কথা শুনে রাজা যযাতির হর্ষোৎফুল্ল বদন মুহূর্তের মধ্যে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। বৈভবহীন যযাতির রত্নাগার শূন্য করে দিলেও নিশাকরসদৃশ শুভ্রদেহ ও শ্যামৈককর্ণ অষ্ট শত দুর্লভ অশ্ব ক্রয় করবার মত অর্থ হবে না। ঋষি হয়েও এমন অপরিমেয় অর্থ প্রার্থনা করেন, কে এই ঋষি?

রাজা যযাতি সসঙ্কোচে জিজ্ঞাসা করেন—আপনার পরিচয় জানতে ইচ্ছা করি ঋষি।

ঋষিযুবা—আমি বিশ্বামিত্রের শিষ্য গালব।

রাজা যযাতি সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ান এবং আগ্ৰহাকুল স্বরে বলেন—আপনি বিশ্বামিত্র-আশ্রমের বিখ্যাত জ্ঞানী গালব?

গালব—আমাকে জ্ঞানী গালব বলে সংবর্ধনা করবেন না, রাজা যযাতি। এত বড় সম্মান-সম্ভাষণ লাভের অধিকার আমার এখনও হয়নি। আমি এখনও ঋণমুক্ত হতে পারিনি।

যযাতি—কিসের ঋণ?

গালব—গুরুঋণ। গুরুকে এখনও দক্ষিণা দান করতে পারিনি। জ্ঞানী গালব নামে মর্ত্যলোকে খ্যাত হবার মত গৌরবের অধিকারী হতে পারব না, যতদিন না গুরুকে দক্ষিণা দান করে মুক্ত হতে পারি।

যযাতি—শুনেছি, বিশ্বামিত্রের মত উদারস্বভাব তপোধন শিষ্যের একটি মাত্র প্রণামে তুষ্ট হয়ে থাকেন, তার চেয়ে বেশি বা অন্য কোন দক্ষিণা তিনি গ্রহণ করেন না।

গালব—গুরু বিশ্বামিত্র আমার কাছে কোন দক্ষিণা চাননি রাজা যযাতি। আমিই তাঁকে দক্ষিণা দিতে চেয়েছি, কারণ আমি কারও কাছে ঋণী হয়ে থাকতে চাই না। গুরু আমাকে জ্ঞান দান করেছেন, আমি যথোচিত দক্ষিণাদানে তাঁর গুরুত্বের মূল্য শোধ করে দেব। আমারই নির্বন্ধাতিশয়ে শুরু আমার কাছ থেকে দক্ষিণা গ্রহণে স্বীকৃত হয়েছেন।

যযাতি—কি দক্ষিণা চেয়েছেন আপনার গুরু?

গালব—পূর্বেই বলেছি নৃপতি, শশিসদৃশ সিতদেহ এবং এক কর্ণ শ্যামবর্ণ এইরূপ অষ্টশত অশ্ব।

যযাতি—কী দারুণ দক্ষিণা! গুরু আপনার উপর অদাক্ষিণ্য প্রদর্শন করেছেন ঋষি।

গালব—হ্যাঁ রাজা যযাতি, আমার নির্বন্ধাতিশয়ে তিনি ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং আমার মানগর্ব খর্ব করবার জন্যই এই দুঃসংগ্ৰহণীয় দক্ষিণা চেয়েছেন।

কুণ্ঠিত স্বরে যযাতি বলেন—ঋষি গালব, ধনপতি কুবের ছাড়া বোধ হয় এমন ঐশ্বর্যশালী আর কেউ নেই, যাঁর পক্ষে এইরূপ অষ্টশত অতিদুর্লভ সুজাত অশ্ব সংগ্রহের মত উপযুক্ত পরিমাণের সম্পদ দান করা সহজসাধ্য। আমার পক্ষে তো অসাধ্য।

গালব—শুনেছিলাম, আপনি দানের গৌরবে গরীয়ান হয়ে স্বর্লোকের সকল রাজর্ষির মধ্যে মানিশ্রেষ্ঠ হবার সংকল্প করেছেন।

যযাতি—হ্যাঁ ঋষি, এই সংকল্পই আমার জীবনের স্বপ্ন।

গালব—আপনার এই স্বপ্ন সফল করবার সুযোগ আমি এনেছি রাজা যযাতি। বিশ্বামিত্রের শিষ্য গালবের প্রার্থনা আপনি পূর্ণ করতে যদি পারেন, তবেই আপনার খ্যাতি সকল দানীর খ্যাতি ম্লান করে দেবে। আপনি মানিশ্রেষ্ঠ হতে পারবেন, আপনি স্বর্লোকের সকল রাজর্ষির মধ্যে সর্বোচ্চ আসন লাভ করতে পারবেন।

যযাতি—আপনি ঠিকই বলেছেন ঋষি।

গালব—তা হলে অবিলম্বে আমার প্রার্থনা পূর্ণ করবার ব্যবস্থা করুন।

চঞ্চল হয়ে উঠলেন রাজা যযাতি। ঋষি গালবের প্রার্থনা পূর্ণ করতেই হবে। মানিশ্রেষ্ঠ হবার সুযোগ এসেছে এতদিনে, এই সুযোগ বিনষ্ট হতে দিতে পারবেন না যযাতি। প্রার্থী ঋষি গালব যদি আজ বিমুখ হয়ে চলে যান, দানশক্তিহীন যযাতির অপবাদ ত্রিভুবনে রটিত হয়ে যাবে। স্বর্গে যাবার পথ অবরুদ্ধ হবে চিরকালের মত। মানহীন সে জীবনের চেয়ে বেশি অভিশপ্ত জীবন আর কি হতে পারে?

কিন্তু উপায়? উপায় চিন্তা করেন রাজা যযাতি। সঙ্গত বা তসঙ্গত, সৎ বা অসৎ, কূট কিংবা সরল, করুণ অথবা নির্মম, যে কোনও উপায়ে তাঁকে আজ তাঁর দানশীল জীবনের গর্ব ও গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখতেই হবে।

কিছুক্ষণ চিন্তার পর যযাতি বলেন—আমার রত্নাগার যদিও শূন্য, কিন্তু আমার প্রাসাদে একটি দুর্লভ ও অনুপম রত্ন আছে ঋষিবর। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, আশা করি, আপনার প্রার্থনা পূর্ণ করতে পারব।

সভাগৃহ ছেড়ে ব্যস্তভাবে রাজা যযাতি প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন।

রাজা যযাতির কাছ থেকে প্রার্থিত অর্থের প্রতিশ্রুতি পেয়ে আশ্বস্ত মনে শূন্য সভাগৃহের একপ্রান্তে বসে রইলেন গালব। এতদিনে গুরুঋণ থেকে মুক্ত হয়ে জ্ঞানী গালব নামে যশস্বী হতে পারবেন, কল্পনা করতেও তাঁর অন্তর উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। ত্রিভুবন জানবে, ঋষি গালব এক অতিকঠিন ও অসাধ্যপ্রায় দক্ষিণা দান করে গুরুদত্ত জ্ঞানের মূল্য শোধ করে দিয়েছেন। গালবের কীর্তিকথা প্রতি জনপদের চারণের মুখে সঙ্গীতের মত ধ্বনিত হবে। গালবও বিশ্বাস করেন, ত্রিলোকের জনসমাজে মানী হওয়াই একমাত্র পুণ্যকর্ম এবং মানবলই একমাত্র পুণ্যবল।

নিজের সৌভাগ্যের কথা ভেবেও মনে মনে ধন্য হচ্ছিলেন গালব। নৃপতি যযাতির কাছ থেকে প্রার্থিত অর্থের প্রতিশ্রুতি পেয়ে গিয়েছেন। এই বৈভবহীন রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে একটি দুর্লভ ও অনুপম রত্ন আছে, সেই রত্ন দান করবেন যযাতি। দুর্লভ রত্নের বিনিময়ে অষ্টশত দুর্লভ অশ্ব সংগ্রহ করা কঠিন হবে না। সভাগৃহের প্রান্তে বসে অধীর আগ্রহে রাজা যযাতির জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন ঋষি গালব।

চমকে উঠলেন গালব। শূন্য সভাগৃহের বক্ষ যেন হঠাৎ পরিমলবিধুর সমীরের স্পর্শে মদির হয়ে উঠেছে। সভাগৃহে প্রবেশ করেছেন রাজা যযাতি, তাঁর সঙ্গে পুষ্পাভরণে ভূষিতা এক কুমারী। মঞ্জুলগতি সে নারীর পায়ে নূপুর আছে, কিন্তু কি আশ্চর্য, তার পদচ্ছন্দে নূপুর নিক্বণিত হয় না! সৌরভ্যে রমিতা ও সৌবর্ণ্যে বন্দিতা, পুষ্পান্বিতা ব্রততীর মত এক নারীর মূর্তি রাজা যযাতির সঙ্গে সভাগৃহে এসে ব্রীড়াকুণ্ঠিত হয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে রইল।

রাজা যযাতি বলেন—ঋষি গালব, আমার এই একটিমাত্র রত্ন আছে, আমার কন্যা মাধবী। এই রত্ন ছাড়া আপনাকে দান করবার মত আর কোন রত্ন নেই।

রত্ন? ঋষি গালব তাঁর দুই চক্ষুর দৃষ্টিতে সুতীব্র কৌতূহল নিয়ে কুমারী মাধবীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু কোথায় রত্ন?

রত্নের চিহ্ন কোথাও দেখতে পেলেন না গালব। যযাতিনন্দিনী মাধবীর কুন্তলস্তবক থেকে পদনখ পর্যন্ত দেহের কোথাও কোনও রত্নভূষণের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। স্বর্ণনূপুর নয়, শুধু স্বর্ণযূথিকার কোরক সেই রূপমতী তরুণীর কিশলয়কোমল চরণের স্পর্শপ্রণয়ে যেন মূৰ্ছিত হয়ে আছে।

যযাতি বলেন—আমার এই রত্নকে আপনার কাছে সমর্পণ করলাম ঋষি। আপনি তৃপ্ত ও তুষ্ট হোন। আমার দান সিদ্ধ হোক এবং আমার দানবলে অর্জিত পুণ্যের বলে আমি স্বর্গে গিয়ে ত্রিলোকবিশ্রুত রাজর্ষিদের মধ্যে আমার কাঙ্ক্ষিত স্থান গ্রহণ করি।

যযাতিনন্দিনী মাধবী ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে এবং গালবকে প্রণাম করে। কিন্তু গালব বিব্রত ও বিচলিতভাবে যযাতিকে লক্ষ্য করে বলেন—আপনি আমাকে অর্থের প্রতিশ্রুতি দিয়েও কেন বঞ্চিত করছেন রাজা যযাতি? আমি অর্থ প্রার্থনা করেছি, আমাকে অর্থ দান করুন। পুষ্পান্বিতা বনলতিকার মত সুন্দর অথচ মূল্যহীন এই কুমারীকে দানস্বরূপ গ্রহণ করে কি লাভ হবে আমার?

যযাতি দুঃখিতভাবে বলেন—চন্দ্রমণিরও অধিক রূপপ্রভাশালিনী এই কন্যাকে মূল্যহীন কেন মনে করছেন ঋষি? এই ভুবনের যে-কোন দিকপাল নরপতি তাঁর রত্নাগারের বিনিময়ে আমার এই কন্যাকে গ্রহণ করতে দ্বিধা করবেন না।

—পিতা!

অবনতমুখিনী মাধবী হঠাৎ মুখ তুলে পিতা যযাতির মুখের দিকে তাকায়। মাধবীর কণ্ঠস্বরে আতঙ্ক, অসিতনয়নে যেন চকিত বিদ্যুতের জ্বালা, এবং ভীরু ভ্রূলতায় যেন খর গ্রীষ্মবায়ুর আঘাত এসে লেগেছে।

পিতা যযাতির কথার অর্থ এতক্ষণে স্পষ্ট করে বুঝতে পেরেছে কুমারী মাধবী। ঐ সুন্দরতনু তরুণ ঋষির কাছে তাঁর স্নেহের কন্যাকে সম্প্রদান করছেন না পিতা যযাতি। এক মুষ্টি তাম্রমুদ্রা অথবা যবশস্যকণা হাতে তুলে নিয়ে প্রার্থীকে যেমন অকাতরচিত্তে দান করেন দাতা যযাতি, এই দানও তেমনই দান। এই দানের অনুষ্ঠান যযাতিনন্দিনী মাধবীর পতিলাভের আয়োজন নয়; ঋষি গালব শুধু দাতা যযাতির কাছ থেকে মূল্যবান একটি বস্তু লাভ করছেন, যে বস্তুর বিনিময়ে রত্ন ও অর্থ সংগ্রহ করা যায়।

—কিসের জন্য, কার কাছে এবং কি সম্বন্ধে আমাকে দান করছেন পিতা?

প্রশ্ন করতে গিয়ে কুমারী মাধবীর চক্ষু বাষ্পায়িত হয়ে ওঠে। এই তো মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত আগে তার কুমারী-জীবনের সকল আগ্রহ নিয়ে যেন এক পরিণয়োৎসবের আলিম্পিত অঙ্গনভূমিতে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল মাধবী, গালব নামে কুবলয়নয়ন ঐ পুরুষপ্রবরের বরতনু বরণ করবার জন্য। কিন্তু বৃথা, সে কল্পনা এক ক্ষণিকা মরীচিকার চিত্র মাত্র।

শান্তস্বরে এবং অবিচলিতভাবে রাজা যযাতি প্রত্যুত্তর দেন—প্রার্থীকে বিমুখ করতে পারি না কন্যা। নৃপতি যযাতির কাছ থেকে দান চেয়েও প্রার্থী ফিরে যাবে দান না পেয়ে, এই অপযশের চেয়ে আমার কাছে অগ্নিকুণ্ডে আত্মাহুতিও কম ক্লেশকর। রাজা যযাতি যদি সবচেয়ে বড় দানবলে সবচেয়ে বেশি মানবান ও পুণ্যবান হয়ে স্বর্গলোকের রাজর্ষিদের মধ্যে উচ্চাসন লাভ না করতে পারে, তবে যযাতির জীবনে শত ধিক। সারা জীবন ধরে, প্রতি মুহূর্তের নিঃশ্বাসে ও প্রশ্বাসে লালিত আমার আকাঙক্ষাকে আজ বিফল করতে পারি না তনয়া। গুরুদক্ষিণার দায় হতে মুক্ত হবার জন্য ঋষি গালব আমার কাছে প্রার্থনা করেছেন, আমিও অর্থের পরিবর্তে তোমাকে ঋষি গালবের হস্তে প্রদান করে দায়মুক্ত হতে ও আমার দানগৌরব রক্ষা করতে চাই। বৈভবহীন এই যযাতিকে বাৎসল্যহীন পিতা বলে মনে করো না কন্যা। এই পিতৃহৃদয়কে কুলিশবৎ কঠোর করে, আমার সকল মমতার মণিস্বরূপিণী তোমাকে আজ প্রার্থীর হস্তে পণ্যবস্তুর মত প্রদান করতে হচ্ছে। কল্পনা করতে পার কন্যা, আমার এই ত্যাগের চেয়ে বড় ত্যাগ, আমার এই দানের চেয়ে বেশি দুঃসাধ্য দান আর কি হতে পারে?

মাথা হেঁট করে মাধবী। বাষ্পায়িত চক্ষু আবার শুষ্ক হয়ে ওঠে। আর কোন প্রশ্ন করার ইচ্ছা হয় না। পিতা যযাতির হৃদয় কুলিশ না হোক, কিন্তু তাঁর সংকল্প যে সত্যই কুলিশবৎ কঠোর।

অন্য কথা ভাবছিল মাধবী। সূর্যালোকস্নাত নব দেবদারুর মত যৌবনসিঞ্চিত দেহশোভা নিয়ে যে ঋষির মূর্তি নিকটে দাঁড়িয়ে আছে, তার সংকল্পও কি কুলিশবৎ কঠোর? ঐ বিস্তৃত বক্ষঃপটের অন্তরালে কি অনুরাগ নেই? ঐ ফুল্ল কুবলয়সদৃশ চক্ষু দুটি কি অকারণে নীলিম হয়ে রয়েছে? যযাতিতনয়া মাধবীর প্রণামের অর্থ বুঝতে পারবে না, সে কি এমনই অবুঝ? যে নারীকে পুষ্পান্বিতা ব্রততীর মত সুন্দর মনে হয়েছে, তাকে কি সত্যই মূল্যহীন বলে মনে করতে পারে এই মনসিজগঞ্জন সুন্দর ঋষি?

কিন্তু, নিজেরই মনের মোহে বৃথা এক মরীচিকার চিত্র দেখছে মাধবী। এবং পরক্ষণেই সে চিত্র যেন এক তপ্ত ধূলিবাত্যার তাড়নায় ছিন্নভিন্ন হয়ে মিলিয়ে গেল, যখন কথা বললেন ঋষি গলব।

—চন্দ্রমণিসমা রূপশালিনী নারী আমি চাই না নৃপতি যযাতি, আমি চাই চন্দ্রমণি। আমি গুরুদক্ষিণার দায় হতে মুক্ত হতে চাই, তার জন্য উপযুক্ত পরিমাণ অর্থ চাই। এ ছাড়া অন্য কোন দানে আমি তৃপ্ত হতে পারব না নৃপতি যযাতি। যদি আপনার কন্যা প্রতিশ্রুতি দেয় যে, সে আপনার দানের মর্যাদা রক্ষা করবে, এই ভুবনের যে কোন দিকপাল নরপতির কাছ থেকে আমার আকাঙ্ক্ষিত গুরুদক্ষিণার সামগ্রী অথবা মূল্য সংগ্রহের প্রযত্নে সহায়িকা হবে, তবেই আমি আপনার কন্যাকে সমুচিত মূল্যযুক্ত দান বলে গ্রহণ করতে পারি, নচেৎ পারব না।

—ঋষিবর!

মৃদুভাষিণী কুমারী মাধবীর দৃপ্ত কণ্ঠস্বরে চমকিত ঋষি গালব ক্ষণিকের মত অপ্রস্তুত হয়ে মাধবীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। মুখ তুলে ঋষি গালবের দিকে তাকিয়ে মাধবী বলে—আপনার গুরুদক্ষিণার সামগ্রী অথবা মূল্য সংগ্রহের প্রযত্নে সহায়িকা হব আমি, প্রতিশ্রুতি দিলাম।

গালব বলেন—শুনে সুখী হলাম।

কৃতার্থচিত্তে রাজা যযাতির দিকে তাকিয়ে গালব বলেন—আমি আপনার এই কন্যাকে দানস্বরূপ গ্রহণ করলাম।

পিতা যযাতিকে প্রণাম করে মাধবী। তারপর বিদায় গ্রহণ করে কুণ্ঠাহীন ও স্বচ্ছন্দ পদক্ষেপে সভাগৃহ ছেড়ে ঋষি গালবের সঙ্গিনী হয়ে চলে যায়।

কাশীশ্বর দিবোদাসের প্রাসাদ। স্ফটিক শিলায় নির্মিত চূড়া দূর থেকে পথিকের নয়নে সূর্বাংশুগঠিত দণ্ডের মত প্রতিভাত হয়। মরকতে মণ্ডিত স্তম্ভ ও প্রবালে খচিত সোপান। রত্নাঢ্য রাজা দিবোদাস কুবেরের ঈর্ষা সমুৎপন্ন করে রাজসিক ঐশ্বর্যে সমাসীন হয়ে আছেন।

দিবোদাসের স্ফটিকশিলার প্রাসাদ হতে কিঞ্চিৎ দূরে সীধুগন্ধ বকুলে আকীর্ণ একটি উদ্যান, মাঝে মাঝে নীলাঙ্গী অতসীর কুঞ্জ। তারই মধ্যে প্রিয়ঙ্গুলতিকায় মণ্ডিত এক অতিথিবাটিকায় এসে আশ্রয় নিয়েছেন ঋষি গালব ও তাঁর সাথে যযাতিনন্দিনী মাধবী।

গালব ও মাধবী, একজনের হৃদয় শুধু অর্থের প্রার্থনা এবং আর একজনের জীবন অর্থসংগ্রহে সহায়তার প্রতিশ্রুতি মাত্র। এ ছাড়া দুজনের মধ্যে আর কোন সম্পর্ক নেই।

এই মাত্র পরস্পরের বন্ধন। তবু যখন গালব ও মাধবী, এক তরুণ ঋষি আর এক সুযৌবনা কুমারী, অতিথিবাটিকার অলিন্দে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন উদ্যানের বকুলসৌরভ অকস্মাৎ মদিরতর হয়; প্রিয়ঙ্গুলতিকা হঠাৎ আন্দোলিত এবং অলিচুম্বিত অতসী হঠাৎ শিহরিত হয়। ভুল করে উদ্যানের প্রণয়-প্রগলভ লতা কিশলয় ও পুষ্পের দল কিন্তু ভুল করে না গালব ও মাধবী।

গালব বলেন—শোন যযাতিতনয়া।

মাধবী—বলুন।

গালব—আমার গুরুদক্ষিণার জন্য প্রয়োজন সেই শ্যামৈককর্ণ শুক্লাশ্ব এই ভুবনের কোথায় কার কাছে কত সংখ্যক আছে, তার সন্ধান পেয়েছি।

মাধবী—কোথায় আছে?

গালব—এই কাশীশ্বর দিবোদাসের ভবনে এইরূপ দুই শত শুক্লাশ্ব আছে অথচ আমার গুরুদক্ষিণার জন্য প্রয়োজন এইরূপ অষ্টশত শুক্লাশ্ব।

মাধবী—আর ছয় শত?

গালব—দুই শত আছে অযোধ্যাপতি হর্ষশ্বের ভবনে।

মাধবী—আর চারি শত?

গালব—ভোজরাজ উশীনরের ভবনে দুই শত আছে।

মাধবী—আর দুই শত?

গালব—ত্রিভুবনে কোথাও নেই। দুঃসংবাদ পেয়েছি, বিতস্তার সলিলে নিমজ্জিত হয়েছে আর নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে এই দুর্লভ শুক্লাশ্বের যূথ। এইবার তোমার কর্তব্য অনুমান করে নাও কুমারী।

মাধবী ব্যথিতভাবে তাকায়—অনুমান করতে পারছি না ঋষি।

গালব—নৃপতি দিবোদাস হর্ষশ্ব আর উশীনরের তুষ্টি সম্পাদন করে আমার গুরুদক্ষিণার সামগ্রীস্বরূপ এই ছয় শত শুক্লাশ্ব তুমি উপহার-স্বরূপ অর্জন কর।

মাধবী—অর্জন করব ঋষি, আপনার নির্দেশের অমান্য করব না। কিন্তু তবুও যে আপনার গুরুদক্ষিণার পরিমাণ পূর্ণ হয় না। এই খণ্ডিত পরিমাণের দক্ষিণায় কেমন করে তুষ্ট হবেন আপনার গুরু রাজর্ষি বিশ্বামিত্র?

গালব—রাজর্ষি বিশ্বামিত্রেরও তুষ্টি সম্পাদন করে দক্ষিণার এই অদত্ত অংশের মূল্য পূর্ণ করে দেবার দায় তোমাকেই গ্রহণ করতে হবে, এবং পালন করতেও হবে মাধবী।

মাধবী—বুঝতে পেরেছি ঋষি।

বুঝতে পেরেছে যযাতিদুহিতা মাধবী, পর পর চারটি কঠোর পরীক্ষার সম্মুখে গিয়ে ভিক্ষার্থিনীর মত দাঁড়াতে হবে। বিশ্বাস করে মাধবী, বিফল হবে না সেই ভিক্ষার্থনা। তার অশ্রুসিক্ত চক্ষুর আবেদনের দিকে তাকিয়ে গালবানুরাগিণী যযাতিতনয়ার হৃদয়ের অনুরোধ কি দেখতে পাবেন না রাজা দিবোদাস, হর্ষশ্ব ও উশীনর, এবং রাজর্ষি বিশ্বামিত্র? বুঝতে পারবেন না কি পৃথিবীর এই তিন ঐশ্বর্যবান ও এক পুণ্যবান মহানুভব, পৃথিবীর এক দীনা রত্নলেশবিহীনা প্রেমিকা তার বাঞ্ছিতের মুক্তিপণ প্রার্থনা করবার জন্য তাঁদের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে? জাগবে না কি অনুকম্পা, আর্দ্র হবে না কি চক্ষু?

সংশয়াপন্ন স্বরে পুনরায় প্রশ্ন করেন গালব—সত্যই কি বুঝতে পেরেছ যযাতিতনয়া?

মাধবী—কী?

গালব—পৃথিবীর এই তিন ঐশ্বর্যবান ও এক পুণ্যবান যদি তুষ্ট হন, তবেই তাঁরা তোমার প্রার্থনা পূর্ণ করবেন।

মাধবী—আমি বুঝেছি ঋষি; তাঁরা আমার প্রার্থনা পূর্ণ করে তুষ্ট হবেন।

—বুঝতে পারনি যযাতিতনয়া। অপ্রসন্ন স্বরে প্রতিবাদ করেন গালব, এবং মাধবীর মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হন। কি-এক মিথ্যা আশ্বাসে ও বিশ্বাসে যেন মুগ্ধ হয়ে এই লতাবাটিকার ছায়াচ্ছন্ন শান্তির মধ্যে শান্ত হয়ে রয়েছে রূপবতী এই কুমারী। ভুলে গিয়েছে মাধবী, পিতা যযাতির নির্দেশে এক প্রতিশ্রুতির কাছে বিক্রীত হয়ে গিয়েছে পুষ্পান্বিতা ব্রততীর মত যযাতিতনয়ার যৌবনকমনীয় দেহ।

লক্ষ্য করেন গালব, জীবনের একমাত্র প্রতিশ্রুত কর্তব্যের জন্য কোন আগ্রহ প্রকাশ না করে মাধবী যেন দিন দিন আরও অন্যমনা ও উদাসীনা হয়ে উঠছে। কখনও বা লক্ষ্য করেছেন, কুঞ্জের অন্তরালে শীতভীরু মল্লিকার মত মুখ লুকিয়ে বসে থাকে মাধবী। সুপ্তির মাঝখানে হঠাৎ জাগরিত হয়ে অন্ধকারের মধ্যে অনুভব করেছেন গালব, তাঁর শিয়রে দাঁড়িয়ে কে যেন তার পরাগবাসিত চেলাঞ্চল আন্দোলিত করে এতক্ষণ তাঁকে ব্যজন করছিল, হঠাৎ অন্তর্হিত হলো। উদ্যানের তৃণভূমিতে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যাকাশের চন্দ্রের দিকে যখন তাকিয়েছেন গালব, তখনও অনুভব করেছেন, যযাতিনন্দিনী মাধবী তার অসিত নয়নের নিবিড়দৃষ্টি তাঁরই দিকে নিবদ্ধ করে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে।

ভীত বিরক্ত এবং আরও অস্থির হয়ে উঠেছেন গালব। কি চায় মাধবী? কৈতবিনী এই নারী কি বিশ্বামিত্র-শিষ্য গালবকে প্রতিজ্ঞাভ্রষ্ট করতে চায়? পিতা যযাতির দানগৌরব বিনষ্ট করতে চায়? নিজ মুখে উচ্চারিত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে চায়? নইলে, নিঃসম্পর্কিতা এই নারী ঋষি গালবের সঙ্গে প্রিয়াসুলভ লীলাকলাপের প্রয়াস করে কেন?

গালব বলেন—আমি আর অপেক্ষায় থাকতে পারি না মাধবী। প্রতিশ্রুতি পালন কর। তারপর তুমি দায়মুক্ত হয়ে তোমার পিতার কাছে ফিরে যাও, আমিও গুরুদক্ষিণা দান করে আমার গৃহে ফিরে যাই।

মাধবী—কেন গালব?

চমকে উঠলেন গালব। আর সন্দেহ নেই সকল কুণ্ঠা ও লজ্জা বর্জন করে যযাতিকন্যা আজ প্রণয়াভিলাষিণী প্রিয়ার মতই মধুর সম্ভাষণে গালবকে ডাকছে।

গালব বলেন—ভুল করো না মাধবী। অঙ্গীকার পালন করা ছাড়া আমার সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করো না। নারীর প্রেমের চেয়ে লোকসম্মান আমার কাছে অনেক বেশি মূল্যবান।

মাধবী—এমন নির্মম কথা বলো না, গালব। তোমার প্রেমিকা মাধবীর দিকে একটি মুহূর্তের জন্যও মুগ্ধ হয়ে তাকালে তোমার সম্মান বিনষ্ট হবে না।

গালব—তা হয় না মাধবী।

মাধবী—তোমার শুভার্থিনী ও কল্যাণকামিকা, তোমার চরণের স্পর্শের জন্য প্রণামনমিতা এই মাধবীর জন্য একটুও মমতা আর একটুও লোভ হয় না গালব?

গালব—ক্ষমা কর কুমারী মাধবী, এমন লোভে আমার প্রয়োজন নেই।

পরুষস্পর্শে আহত বীণাতন্ত্রীর মত বেজে ওঠে মাধবীর কণ্ঠস্বর—দুঃসাহসী ঋষি, সন্ধ্যাকাশের ঐ সুন্দর শশাঙ্কের দিকে তাকিয়ে বল দেখি, কোন প্রয়োজন নেই?

গালব—প্রয়োজন নেই।

শান্ত স্বরে মাধবী বলে—তবে আজ্ঞা করুন।

গালব—আর অকারণ এই লতাকুঞ্জের জ্যোৎস্নাময় নিভৃতে কালক্ষেপ না করে নৃপতি দিবোদাসের সন্নিধানে গমন কর। তিনি তোমারই প্রতীক্ষায় কালযাপন করছেন। আমি যথাবিহিত সংস্কারে ও মন্ত্রবচনে তাঁর কাছে তোমাকে প্রদান করে এসেছি।

মাধবীর দুই নয়নে দুরন্ত বিস্ময় অকস্মাৎ উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে।—আমাকে প্রদান করেছেন?

গালব—হ্যাঁ, প্রদান করবার অধিকার আমার আছে। তোমার পিতা আমাকে সেই অধিকার দিয়েছেন।

মাধবী—এইভাবেই কি একে একে আরও দুই ঐশ্বর্যবান নৃপতি ও এক পুণ্যবান রাজর্ষির কাছে আমাকে প্রদান করবেন আপনি?

গালব—হ্যাঁ কুমারী।

মাধবী—আমি কি বিক্রেয়া পণ্যা ও সত্তাবিহীনা এক যৌবনসামগ্রী?

গালব—তুমি প্রতিশ্রুতি।

যন্ত্রণাক্ত ধিক্কারধ্বনির মত সুতীক্ষ্ন স্বরে চিৎকার করে ওঠে মাধবী—হীনা বারযোষার মত এক হতে অন্য জনের, বহু হতে বহুতরের, এক একজন প্রবলকাম রাজা ও রাজর্ষির মদোৎসবের নায়িকা হবার প্রতিশ্রুতি আমি নই ঋষি। নারীধর্মাপহ আচরণে আমাকে কখনই প্রবৃত্ত করতে পারেন না আপনি। অবিধিবশ হবার কোন অধিকার আপনার নেই।

গালব—আমি একান্তই বিধিবশ, এবং তোমাকে এক প্রথানুকূল জীবনের আনন্দ বরণ করবার জন্য প্রস্তুত ও প্রবৃত্ত হতে বলেছি।

বিস্মিত হয় মাধবী—প্রথানুকূল জীবন?

গালব—হ্যাঁ কুমারী।

মাধবী—তোমার প্রদত্তা এক কুমারী নারীকে কোন অভীষ্টলাভের জন্য গ্রহণ করবেন পৃথিবীর তিন ঐশ্বর্যবান ও এক পুণ্যবান?

গালব—বিবাহের জন্য।

মাধবী—এ কেমন বিবাহ?

গালব—অস্থেয় বিবাহ। এই বিবাহ এক নর ও এক নারীর জীবনে অচিরমিলনের অঙ্গীকার যে অঙ্গীকার ব্রতাচারের মতই উদ্‌যাপিত হয়ে নির্দিষ্ট কালের অন্তে শেষ হয়ে যায়। পরিসীম পরিণয়ের এই রীতিও জগতে প্রচলিত আছে। যথানির্দিষ্ট কাল অতিক্রান্ত হলে পরিণীতা নারী পুনরায় কন্যকাদশা লাভ করে সমাজে কুমারীরূপে স্বীকৃতা ও পরিচিতা হয়ে থাকে।

মাধবী—কবে সমাপ্ত হবে আমার এই অস্থেয় বিবাহের জীবন?

গালব—পরিণেতাকে যেদিন তুমি এক পুত্রসন্তান উপহার দিতে পারবে সেইদিনই পত্নীত্বের সকল দায় হতে মুক্ত হয়ে যাবে তুমি।

মাধবীর ওষ্ঠপ্রান্তে যেন এক মূঢ় বিস্ময়ের হাসি বেদনায় পুড়তে থাকে। —সুন্দর এক বৈধ ব্যভিচারের কথা বলছেন!

গালব—আমার বক্তব্য বলেছি, আর কিছু বলবার নেই। এইবার তুমি তোমার কর্তব্য বুঝে দেখা।

শান্তভাবে দুই চক্ষুর উদ্‌গত অশ্রুবারি হস্তাবলেপে মোচন করে মাধবী বলে— বুঝেছি ঋষি, আমার জীবনের এক একটি দশ মাস ও দশ দিনের যাতনাসঞ্জাত পুষ্প আমারই বক্ষ হতে ছিন্ন করে নিয়ে, আমার বক্ষের উচ্ছ্বসিত পীযূষকে অধন্য করে দিয়ে, পৃথিবীর তিন ঐশ্বর্যবান ও এক পুণ্যবান আমাকে আমারই শূন্য সংসারের কাছে পুনরায় ফিরিয়ে দেবেন।

গালব—হাঁ।

মাধবী—তারপর?

গালব—তারপর তুমি মক্ত।

মাধবী—আর তুমি?

গালব—আমিও গুরুঋণ হতে মুক্ত হব।

মাধবী—তারপর?

ক্রূরবায়ুবিমর্দিতা ব্রততী যেন তার আশাভঙ্গে ভগ্ন দেহভারের বেদনা সহ্য করে তবু এক আশ্বাসের স্বপ্ন দেখতে চাইছে। দুই হাতে সিক্ত চক্ষু আবৃত করে ব্যাকুল স্বরে মাধবী প্রশ্ন করে।—বল, ঋষি, তারপর কি হবে?

নীরব হয় মাধবী। জ্যোৎস্নালিপ্ত লতাকুঞ্জও যেন হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যায়।

মাধবী আবার বলে—বল ঋষি, যেদিন স্বাধীন হবে আমার দেহ, আমার হৃদয় ও আমার হাতের বরমাল্য, সেদিন কোথায় থাকবে তুমি?

মাধবীর প্রশ্নের কোন উত্তর লতাকুঞ্জের নিভৃতের বক্ষে আর ধ্বনিত হয় না। অনেকক্ষণের স্তব্ধতার পর, যেন হঠাৎ মূৰ্ছা হতে জেগে ওঠে মাধবী, চমকে চোখ মেলে তাকায়। দেখতে পায় মাধবী, কেউ নেই, তার নিকটে দাঁড়িয়ে এই ব্যাকুল প্রশ্ন কেউ শুনছে না। চলে গিয়েছেন গালব। দেখা যায়, দূরের লতাবাটিকার এক কক্ষের বাতায়নের কাছে সন্ধ্যাপ্রদীপের নিকটে ঋষি গালবের মূর্তি শান্ত আনন্দের ছায়ার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে।

নৃপতি দিবোদাসের স্ফটিকভবনের দিকে তাকায় মাধবী।

মধ্য রাত্রি, নিশাবসানের এখনও অনেক বাকি। উদ্যানের কোকিল কূজন বন্ধ করেছে। অতিথিবাটিকার নিভৃতে একাকী বসেছিলেন গালব; গন্ধতৈলের প্রদীপে আলোকশিখার চাঞ্চল্য ছাড়া আর কোন চাঞ্চল্য কোথাও ছিল না। প্রতিশ্রুতির নারী মাধবী রাজা দিবোদাসের স্ফটিকশিলার প্রাসাদে চলে গিয়েছে।

অকস্মাৎ রত্ননূপুরের শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে অতিথিবাটিকার নিভৃত। দেখে বিস্মিত হন গালব, কুমারী মাধবী এসে সম্মুখে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পুষ্পান্বিতা ব্রততীর মূর্তি নয়, যেন অমরেশ্বর ইন্দ্রের শতরত্নভূষিতা এক প্রমদার মূর্তি।

অট্টহাস্যনাদে বিস্মিত গালবকে উদ্‌ভ্রান্ত করে মাধবী প্রশ্ন করে—চিনতে পারেন কি ঋষি?

গালব—চিনেছি।

মাধবী—পুষ্পাভরণে ভূষিতা সেই মাধবীকে এখন এই রত্নভূষণে বেশি সুন্দর মনে হয় কি?

গালব—না।

মাধবী—বেশি মূল্যবতী মনে হয় কি?

গালব—মনে হয়।

মাধবী—আপনারই পায়ে প্রণামাবনতা সেই মাধবীকে এখন আরও বেশি সম্মানিনী বলে মনে হয় কি ঋষি?

দৃষ্টি নত করেন নিরুত্তর গালব। মাধবী যেন তার নারীজীবনের এক সুগভীর বেদনাকে বিদ্রূপে ছিন্নভিন্ন করবার জন্য আরও তীক্ষ্ণ অট্টহাস্যে বলে ওঠে—চোখ তুলে তাকান ঋষি, বলুন দেখি, এই নারীকে দেখে লোভ হয় কি না?

তবু নিরুত্তর থাকেন ঋষি গালব। মাধবী বলে—আপনার লোভ না হোক, রাজা দিবোদাস লুব্ধ হয়েছেন। তিনি আজ আমাকে তাঁর রাজ্যশ্রীরূপে গ্রহণ করবেন। এই রত্নভূষণ তাঁরই উপহার; আজ আমার আশ্রয় হবে রাজা দিবোদাসের বৈদূর্যখচিত শয়নপর্যঙ্ক।

যেন নিজেরই অজ্ঞাতসারে চমকে উঠলেন ঋষি গালব এবং মাধবীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকালেন।

অট্টহাসিনী প্রগলভা মাধবী হঠাৎ বাণবিদ্ধা কুরঙ্গীর মত যন্ত্রণায় চঞ্চল হয়ে ওঠে, উদগত অশ্রুধারা নিরোধের জন্য দু’হাতে চক্ষু আবরিত করে। পরমুহূর্তে দুর্বলা লতিকার মত ঋষি গালবের পায়ে লুটিয়ে পড়ে।—একবার লুব্ধ হও ঋষি, মুগ্ধ হও নিমেষের মত। পিতা যযাতির দান এই কুমারীর অনুরাগ প্রতিদানে সম্মানিত কর, ঋষি সুকুমার! এখনও সময় আছে, কথা দাও তুমি, তাহলে এই মুহূর্তে এই রাজ্যশ্রীর রত্নাভরণ দিবোদাসের সম্মুখে অবহেলাভরে নিক্ষেপ করে চলে আসি।

গালব—তারপর?

মাধবী—তারপর এই ভুবনে শুধু আমরা দু’জন।

গালব—তা হয় না মাধবী। জ্ঞানী গালব তার প্রখ্যাতি ক্ষুণ্ণ করতে পারবে না। গুরুদক্ষিণাদানে অপারগ গালব জীবনব্যাপী অপবাদ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না। বেঁচে থাকলেও সে অপবাদের জ্বালা যযাতিকন্যার বিম্বাধরের চুম্বনে শান্ত হবে না।

ধীরে ধীরে গালবের পদপ্রান্ত হতে লুণ্ঠিত দেহভার তুলে উঠে দাঁড়ায় মাধব। শান্ত দৃষ্টি তুলে তাকায়। অবসন্ন দীর্ঘশ্বাসের ধ্বনির মত ক্লান্ত স্বরে বলে—ঠিকই বলেছেন, ঋষি। আপনার জীবনের শান্তি ও সম্মান নষ্ট করতে পারি না। দয়িতের সুখের জন্য প্রণয়িনী নারী মৃত্যুবরণও করে। দুর্ভাগিনী যযাতিনন্দিনী না হয় কয়েকটি রাত্রির মত মৃত্যুবরণ করবে। আপনি প্রসন্ন হোন।

অতিক্রান্ত হয়েছে বৎসরের পর বৎসর। আনন্দহীন বনবাসব্রতের মত অস্থেয় বিবাহের বন্ধন বরণ করে তিন ঐশ্বর্যবান ও এক পুণ্যবানের অভিলাষের সহচরী হয়েছে মাধবী। তিন রাজা ও এক রাজর্ষির সংসারে তার সুন্দর তনুর স্নেহনির্যাসের মত এক একটি পুত্রসন্তান উপহার দিয়ে দায়মুক্ত হয়েছে মাধবী।

গুরুঋণ হতে মুক্ত হয়ে সসম্মানে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছেন গালব। জ্ঞানী গালবের সুকীর্তিকথা দেশে দেশে প্রচারিত হয়ে গিয়েছে।

দায়মুক্ত হয়েছেন যযাতি। জ্ঞানী গালবের মত ঋষির প্রার্থনা যিনি পূর্ণ করতে পেরেছেন, তাঁর দানের গৌরববার্তা স্বর্লোকের রাজর্ষিসমাজেও পৌঁছে গিয়েছে!

আর মাধবী? বৈভবহীন রাজা যযাতির আলয়ে মাধবী ফিরে এসেছে।

ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন রাজা যযাতি। আর বিলম্ব করতে পারেন না। দানিশ্রেষ্ঠ নামে সর্বখ্যাত যযাতি স্বর্লোকে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন।

রাজা যযাতির বৈভবহীন এই মর্ত্য-প্রাসাদের জীবনে একটি মাত্র কর্তব্য যা বাকি আছে, তাই পালন করবার জন্য আয়োজন করলেন যযাতি, স্বর্গধামে যাবার আগে। কন্যা মাধবীকে উপযুক্ত পাত্রে সম্প্রদানের জন্য স্বয়ংবরসভা আহ্বান করলেন।

মাধবীর স্বয়ংবরসভা! সংবাদ শুনে ও আয়োজন দেখে মাধবী তার কক্ষের নিভৃতে অশ্রুসিক্ত চক্ষু মুছতে গিয়েও হাস্য সংবরণ করতে পারে না। কোথায় তার স্বয়ং এবং কোথায়ই বা তার বর? যার জীবনের কোন ইচ্ছার সম্মান কেউ দিল না, যার কামনার বরমাল্য অবাধ অবহেলায় তুচ্ছ করে চলে গিয়েছে জীবনের একমাত্র বাঞ্ছিত, তার জন্য প্রয়োজন স্বয়ংবরসভা নয়, প্রয়োজন বধ্যমঞ্চ।

মনে পড়ে মাধবীর, ঋণমুক্ত হয়ে গালব তাঁর গৃহাশ্রমে চলে গিয়েছেন। সে ঋষির জীবনে সম্মান ও শান্তি এসেছে। ভালই হয়েছে। কিন্তু একবারও কি সেই কুবলনয়ন জ্ঞানিবরের মনে এই প্রশ্ন জাগে, পৃথিবীর আর কারও কাছে তাঁর কোন ঋণ রয়ে গেল কি না?

নৃপতির স্ফটিকপ্রাসাদের এবং রাজর্ষির আশ্রমভবনের এক একটি নিশীথের ঘটনা মনে পড়ে মাধবীর। ওই স্মৃতি সহ্য করতে পারে না মাধবী, গৃহের নিভৃত হতে ছুটে এসে প্রাসাদের বাহিরের উপবনবীথিকার কাছে দাঁড়ায়। চোখে পড়ে, তারই স্বহস্তে রোপিত সেই শিশু রক্তাশোকে কত বড় হয়ে উঠেছে, কিন্তু অযত্নে শীর্ণ হয়ে গিয়েছে। বারিপূর্ণ ভৃঙ্গারক নিয়ে এসে রক্তাশোকমূলে জলসেক দান করে মাধবী।

তবু বুঝতে পারে মাধবী, তার নয়ন-ভৃঙ্গারকের বারিধারা থামছে না। কাকে প্রশ্ন করবে মাধবী, যযাতিনন্দিনী তার প্রেমাস্পদের শান্তি আর সম্মান রক্ষার মোহে যে দুঃসহ ব্রত পালন করেছে, তার কি কোন মূল্য নেই? এই রক্তাশোকের মুখে যে ভাষা নেই, নইলে জিজ্ঞাসা করা যেত, সত্যই কি ঘৃণ্য হয়ে গিয়েছে মাধবী, স্ফটিকপ্রাসাদ আর আশ্রমভবনের কামনার কক্ষে ধনাঢ্য রাজা ও রাজর্ষির আলিঙ্গনে তার দেহ উপঢৌকন দিয়েছে বলে? নইলে মাধবীর এই নয়নের আবেদন বিস্মৃত হয়ে কেমন করে নিশ্চিন্ত চিত্তে দিনযাপন করছে মাধবীর প্রেমের আস্পদ সেই তরুণ ঋষি গালব?

জগৎ ঘৃণা করুক মাধবীকে, কিন্তু জগতের মধ্যে একজন তো ঘৃণা করতে পারে না। কারণ, আর কেউ না জানুক, সে-ই তো জানে, কেন ও কিসের জন্য অদ্ভুত এক অস্থেয় বিবাহের রীতি বরণ করে মাধবী তার রূপ ও যৌবনকে রাজা ও রাজর্ষির আসঙ্গবাসনার কাছে নিবেদন করতে বাধ্য হয়েছে। যযাতিকন্যার সেই ভয়ংকর আত্মাহুতির বিনিময়ে ঋণমুক্ত হয়েছে যে জ্ঞানী গালব, সেই জ্ঞানী কি আজ যযাতিকন্যাকেই ঘৃণা করে দূরে সরে থাকবে? মাধবীর স্বয়ংবরসভার সংবাদ কি সে এখনও শুনতে পায়নি?

কোথায় তুমি গালব? আজ তুমি মুক্ত, আমিও মুক্ত। এস তোমার কুবলয়সদৃশ নীলনয়নের দ্যুতি নিয়ে; তোমারই জন্য সমর্পিত তনুমনপ্রাণ, তোমারই জন্য পণ্যায়িতা হয়ে অনেক বেদনা সহ্য করেছে যার যৌবন, সেই যযাতিকন্যা মাধবীর স্বাধীন হৃদয়ের বরমাল্য কণ্ঠে গ্রহণ করে তাকে তোমার জীবনসহচরী করে নিয়ে চলে যাও। তুমি তো এখন ঋণমুক্ত, শান্ত সম্মানিত ও সুখী, তবে এখন এই বৈভবহীন প্রাসাদ থেকে পুষ্পান্বিতা ব্রততীর মত মূল্যহীনাকে উদ্ধার করে নিয়ে তোমার প্রেমের স্পর্শে অমূল্য করে তুলতে বাধা কই তোমার?

উপবনবীথিকার কাছে দাঁড়িয়ে শুনতে পায় মাধবী, প্রাসাদের দূর দক্ষিণে কলস্বরা এক স্রোতস্বতীর কূলে শ্যামদূর্বাদলে আকীর্ণ প্রান্তরে স্বয়ংবরসভার হর্ষ জেগে উঠেছে। চন্দ্রাতপের বর্ণশোভা দেখা যায়। শোনা যায়, রূপবতী যযাতিকন্যার পাণিগ্রহণের আশায় সমাগত বহু প্রিয়দর্শন রাজপুত্র ও বীরোত্তমের বিশ্রান্ত অশ্বের হ্রেষাধ্বনি।

অপরাহ্ণের রক্তাভ সূর্য অস্তাচলের পথে ধাবমান। বিষণ্ণ হয়ে ওঠে মাধবীর অসিতনয়নশ্রী। তবু যেন এক ক্ষীণাশার গুঞ্জরণ ক্লান্ত নূপুরের মত মাধবীর মনের নেপথ্যে বাজে—সে কি আজও না এসে থাকতে পারবে? যযাতিকন্যার সেই প্রণমিত আত্মনিবেদনের কথা কি সে ভুলে গিয়েছে? অঋণী মানী ও জ্ঞানী গালব কি অকৃতজ্ঞ হতে পারে?

কিন্তু আর এই উপবনবীথিকার নিভৃতে রক্তশোকের পাশে দাঁড়িয়ে ভাবনা করবার সময় ছিল না। পিতা যযাতি এসে আহ্বান করলেন এবং স্বচ্ছন্দ পদক্ষেপে অগ্রসর হয়ে রাজা যযাতির সঙ্গে স্বয়ংবরসভায় এসে দাঁড়াল মাধবী।

বরমাল্য হাতে তুলে নিয়ে সভার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত অসিতেক্ষণা মাধবীর দৃষ্টি কিছুক্ষণের মত কাকে যেন অন্বেষণ করে। কিন্তু কুবলয়নয়ন কোন স্নিগ্ধদর্শন তরুণ ঋষির মূর্তি কোথাও দেখা যায় না। নবীনকুসুমে গ্রথিত বরমাল্য কঠোরভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে পাণিপ্রার্থী রাজপুত্রদের পংক্তি পরিক্রম করে মাধবী। কোন দিকে এবং কারও দিকে ভ্রূক্ষেপ করে না। শুধু এগিয়ে যেতে থাকে পুষ্পান্বিতা ব্রততীর মত সুচারুদেহা এক যৌবনবতীর অন্যমনা ও উদাসিনী মূর্তি। রাজা যযাতি কন্যার অনুসরণ করে চলতে থাকেন। দুন্দুভির উল্লাসে দিগ্‌বায়ু প্রকম্পিত হয়।

অগ্রসর হতে হতে সভার শেষপ্রান্তে এসে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মাধবী। কারণ, আর এগিয়ে যাবার কোন অর্থ হয় না। কারণ, তার পরেই স্রোতস্বতীর সুতরল জলরেখা; ওপারে তৃণপ্রান্তর এবং তার পর বনভূমির আরম্ভ।

সুহরিৎ বনশীর্ষে অস্তোন্মুখ সূর্যের লোহিতাভ বেদনার ছায়া পড়েছে। অকস্মাৎ যেন দুই হস্তের চকিতক্ষিপ্ত আগ্রহের একটি কঠোর টানে বরমাল্য ছিন্ন করে ভূতলে নিক্ষেপ করে মাধবী। মত্তা পলাতকার মত ত্বরিত পদে ছুটে চলে যায়, এবং স্বয়ংবরসভার শেষ প্রান্তও পার হয়ে স্রোতস্বতীর কূলে এসে দাঁড়ায়।

যযাতি চিৎকার করে ডাকেন—কোথায় যাও মাধবী?

মাধবী—অরণ্যের ক্রোড়ে।

যযাতি—রাজপ্রাসাদের মেয়ের অরণ্যে কি প্রয়োজন?

মাধবী—আমাকে ক্ষমা কর পিতা, ক্ষমা করুক তোমার রাজপ্রাসাদ আর রাজ্যজনপদ। অরণ্যই আমার যথার্থ আশ্রয়।

স্রোতস্বতীর ক্ষীণ জলরেখা পার হয়ে শরাহত হরিণীর ত্রস্তগতি ছায়ার মত, যেন পিছনের যত করাল দান-মান-পুণ্যের ভয়ে অরণ্যের দিকে চলে গেল মাধবী। সন্ধ্যা নামে, অন্ধকারে মাধবীকে আর দেখা যায় না।

যযাতির প্রাসাদ শূন্য। দাতা যযাতি স্বর্লোকে গিয়ে পুণ্যশীল রাজর্ষি সমাজে উচ্চাসন অধিকার করেছেন। আর, বনবাসিনী হয়েছে পুণ্যহীনা মাধবী।

এই বনে দাবানল নেই। মাসান্তের পর মাস, তারপর বৎসরান্ত। রক্তপুনর্নবার সঙ্কেত পেয়ে শুরু হয় কুসুমিত নূতন বৎসর। কিন্তু বরবর্ণিনী সেই যযাতিনন্দিনী মাধবীর কর্ণ ও কবরী নবকুসুমের স্তবকে আর শোভিত হয় না। সেই স্নিগ্ধ চিকুরনিকুর আজ কঠিন জটাভার, কণ্ঠাভরণ শুধু একটি রুদ্রাক্ষের মালিকা। উপবাস বল্কলবাস এবং অধোশয্যা, রূপযৌবনের সকল অভিমান ক্লিষ্ট করে স্নান ব্রত পূজা ও তপস্যায় দাবানলহীন এই বনের দিনযামিনীর প্রতি মুহূর্ত উদযাপন করেছে মাধবী এবং তার অন্তরের নিভৃতে এক পরম শান্ত সত্তার সাক্ষাৎ লাভ করেছে। রাজপ্রাসাদের পুণ্যতত্ত্ব কোনদিন বুঝে উঠতে পারেনি যে মাধবী, সেই মাধবী আজ তার বনবাসিনী তপস্বিনীর জীবনে উপলব্ধি করেছে—কামনাহীন চিত্তের এই আনন্দই তো পুণ্য। অতীতের সকল ঘটনার কথা আজও মনে পড়ে; আজও বিস্মৃত হয়নি মাধবী সেই পরিচিত মুখগুলি—সুন্দর ও অসুন্দর, রূঢ় ও কোমল। সেই আঘাত ও অপমানের সকল ইতিহাস আজও স্মরণ করতে পারা যায়। কিন্তু স্মরণ করলেও মাধবীর মনে অভিমানের কোন সাড়া জাগে না। সিদ্ধসাধিকা মাধবীর ভাবনা আজ বেদনাহীন হয়েছে, কারণ ক্ষয় হয়ে গিয়েছে সকল কামনা।

এই বনে দাবানল নেই, মাধবীর মনেও কোন মোহানল নেই। বিশাল শাল শাল্মলী মুচুকুন্দ ও কোবিদারের ছায়াঘন গহনে বনাধিষ্ঠাত্রী দেবতার নীরাজনদীপিকার একটি পুণ্যশিখার মত ভাস্বর হয়ে উঠেছে তপস্বিনী মাধবীর জীবন।

সেদিন দিবাবসানের পর বনসরসীর জলে স্নান সমাপন করে বনাধিষ্ঠাত্রী দেবতার পূজার জন্য যখন প্রস্তুত হয় মাধবী, তখন দেখতে পায়, ঊর্ধ্বাকাশ হতে একটি নক্ষত্র স্খলিত হয়ে ভূপতিত হলো। দেখে দুঃখিত হয় মাধবী। কে জানে, কোন্ মহাজনের পুণ্য ক্ষয় হয়েছে, তারই লক্ষণ। পরক্ষণে শুনতে পায় মাধবী, দূর জনপদে অদ্ভুত এক কোলাহল জেগেছে।

কিছুক্ষণ কি যেন ভাবতে থাকে মাধবী। তারপরেই বনাধিষ্ঠাত্রীর পূজা সমাপন করে এবং ধীরে ধীরে সুদীর্ঘ বনপথ ধরে অগ্রসর হয়ে বনের উপান্তে এসে দাঁড়ায়। তখন রাত্রি শেষ হয়ে এসেছে এবং জনপদের সকল কোলাহলও ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়েছে।

অকস্মাৎ সেই অদ্ভুত কোলাহলের উচ্চরোল শুনতে পায় আর বিস্মিত হয় মাধবী।—ধিক পুণ্যহীন রাজা যযাতি! ধিক মানহীন রাজা যযাতি! রাজা যযাতির নামে প্রবল অপযশ নিন্দা ও ধিক্কারের ধ্বনি সহস্র কণ্ঠ হইতে উৎসরিত হয়ে ক্ষুব্ধ ঝটিকানিনাদের মত জনপদের প্রত্যুষসমীরের শান্তি মথিত করছে।

হর্ষারুণ উদিত আদিত্যের রশ্মিপাতে প্রাচীপট আলোকিত হয়। অরণ্যের প্রান্ত অতিক্রম করে আরও অগ্রসর হয় মাধবী। তারপর স্রোতস্বতীর ক্ষীণ জলরেখা পার হয়ে সুশ্যাম তৃণপ্রান্তরের পথরেখার উপর এসে দাঁড়ায় তপস্বিনীর মূর্তি। শান্ত পদক্ষেপে ধীরে ধীরে যযাতির প্রাসাদের অভিমুখে এগিয়ে যেতে থাকে।

স্বর্গ হতে বিতাড়িত হয়েছেন যযাতি। পুণ্যক্ষয়ে আকাশভ্রষ্ট নক্ষত্রের মত স্বর্গ হতে স্থানচ্যুত হয়েছেন রাজা যযাতি। স্বর্লোকাশ্রিত দেব মানব ও রাজর্ষির কেউ যযাতিকে পুণ্যবান বলে স্বীকার করেননি। যযাতির দান যথার্থ দান নয়, যযাতির পুণ্য যথার্থ পুণ্য নয়। যযাতির সকল প্রখ্যাতি বিনষ্ট হয়েছে, কারণ স্বর্লোকের রাজর্ষি সমাজ এতদিনে জানতে পেরেছেন, কি উপায়ে রাজা যযাতি জ্ঞানী গালবের প্রার্থনা পূর্ণ করেছেন। ধিক্কৃত নিন্দিত ও অপমানিত রাজা যযাতি স্বর্গ হতে ফিরে এসে বিষণ্ণ বদনে সভাগৃহে একাকী বসেছিলেন। তাঁর মানের গৌরব অপহৃত হয়েছে, তাঁর দানের গর্ব চূর্ণ হয়েছে।

সভাগৃহে প্রবেশ করলেন চীরধারী এক তপস্বী। রাজা যযাতি বিস্মিত হয়ে দেখলেন, সেই তপস্বী।

তপস্বী মৃদুহাস্যে বলেন—আজ আমি আবার আপনাকে লোক-নীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে এসেছি নৃপতি।

যযাতি আর্তস্বরে নিবেদন করেন—বলুন যোগিবর। আমার এই মানহীন ও পুণ্যহীন দগ্ধমরুবৎ জীবনের শান্তির জন্য আপনার সান্ত্ববাদ দান করুন।

তপস্বী—সর্বলোকনীতির সারভূত এই সত্যবাদে আজ বিশ্বাস করুন রাজা যযাতি, পুণ্যাজর্নের পথটিও পুণ্যময় হওয়া চাই। আপনি কর্মব্রতের এই নীতি অস্বীকার করেছেন, তাই আপনার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়নি।

যযাতি—আপনার বাণীর সত্যতা আজ বিশ্বাস করি, তপস্বী। কিন্তু পুণ্যভ্রষ্ট ও মানহীন জীবনের গ্লানি নিয়ে আর বেঁচে থাকতে চাই না।

তপস্বী করুণামিশ্রিত স্নিগ্ধ দৃষ্টি তুলে বলেন—কিন্তু আর একটি কথা বিশ্বাস করবেন কি?

যযাতি—অবশ্যই বিশ্বাস করব।

তপস্বী—আজ আপনার এক প্রখ্যাতি ত্রিভুবনে রটিত হয়েছে।

যযাতি—আপনার কথার অর্থ বুঝতে পারলাম না।

তপস্বী—জনপদের কোলাহল কি শুনতে পাননি?

যযাতি—শুনেছি। তুষানলের জ্বালা বরণ করে বরং মৃত্যুও সহ্য করা যায়, কিন্তু ঐ ধিক্কার-কোলাহলের জ্বালা বরণ করে জীবন সহ্য করা যায় না।

তপস্বী বলেন—আর একবার ঐ কোলাহল শ্রবণ করুন।

উৎকর্ণ হয়ে শুনতে থাকেন নৃপতি যযাতি। অকস্মাৎ যযাতির বিষণ্ণ দুই নেত্র প্রবল বিস্ময়ে চমকিত হয়। সহস্র কণ্ঠ হতে উৎসারিত হর্ষ ও আনন্দনাদ জনপদের বায়ু শিহরিত করছে।—ধন্য পুণ্যবতী তাপসিকা মাধবী! ধন্য মাধবীপিতা রাজা যযাতি!

তপস্বী বলেন—যে সিদ্ধসাধিকা পুণ্যবতী মাধবী আজ জনপদে আবির্ভূতা হয়ে আপনার এই রাজ্য ও জনপদ ধন্য করেছে আপনি যে তারই পিতা। সে পুণ্যবতী যদি আপনাকে প্রণাম করে, তবেই সম্মানে ও গৌরবে ধন্য হবেন আপনি, স্বর্গলোকের রাজর্ষি সমাজ আপনাকে সাগ্রহে ও সানন্দে স্থান দান করবেন।

রাজা যযাতি চিৎকার করে ওঠেন—আমার বনবাসিনী কন্যা মাধবী! সে কি বেঁচে আছে?

কোন উত্তর না দিয়ে নীরবে প্রস্থান করেন অভ্যাগত তপস্বী। যযাতি ব্যাকুল দৃষ্টি তুলে দ্বারপ্রান্তের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, মূর্তিমতী পুণ্যশিখার মত তপস্বিনী মাধবী দাঁড়িয়ে আছে।

ব্যাকুল পদক্ষেপে পিতা যযাতি ছুটে গিয়ে কন্যা মাধবীকে বক্ষোলগ্ন করলেন। কন্যার শির চুম্বন করে অশ্রুসিক্ত নয়নের আবেদন আরও করুণ করে যযাতি বলেন—ক্ষমা কর কন্যা। যে অপমান ও তুচ্ছতার জ্বালা নিয়ে প্রাসাদ বর্জন করে অরণ্যের আশ্রয় নিয়েছিলে, সে জ্বালা আজ আমাকে দান কর। চাই না পুণ্য, চাই না স্বর্গ।

পিতা যযাতিকে প্রণাম করে মাধবী বলে—আমার তপশ্চর্যার পুণ্য গ্রহণ করুন পিতা।

বেদনা বিস্ময় ও আনন্দ যেন একই সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে। যযাতি ডাকেন— কন্যা!

মাধবী— বিচলিত হবেন না পিতা। আমার অনুরোধ, আপনি নিশ্চিন্ত চিত্তে স্বর্গলোকে গমন করুন।

বিদায় নেয় মাধবী। সভাগৃহের দ্বারপ্রান্তে এসে রাজা যযাতি কন্যা মাধবীর শির চুম্বন করে বিদায় দান করেন।

স্বর্গধামে প্রস্থানের পূর্বে শূন্য সভাগৃহে প্রসন্ন অন্তরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন রাজা যযাতি। তাঁর শিক্ষা আজ সম্পূর্ণ হয়েছে। দিব্য লোকনীতির সারভূত সত্য আজ তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন।

রাজা যযাতিকে আর একটু বিলম্ব করতে হলো। সুন্দরদর্শন এক তরুণ ঋষিযুবা অকস্মাৎ সভাগৃহে প্রবেশ করেন। রাজা যযাতি সবিস্ময়ে দেখতে পেলেন, জ্ঞানী গালব এসে তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়েছেন।

উদ্‌ভ্রান্ত অশান্ত দাবানলতাড়িত প্রাণীর মত বেদনার্ত দৃষ্টি, জ্ঞানী গালব বলেন— জ্ঞানী গালবের সকল মান ও পুণ্য আপনি গ্রহণ করুন রাজা যযাতি, আমি পুণ্যহীন হতে চাই।

যযাতি—কেন ঋষি গালব?

গালব—জ্ঞানী গালবের সকল মান ও পুণ্য তার জীবনের অভিশাপ হয়েছে, রাজা যযাতি। শান্তি পাই না, পুষ্পান্বিতা ব্রততীর মত শুচিস্মিতা এক নারীর মুখচ্ছবি ভুলতে পারছি না। তার দুই সিতনয়নের শোভা আমারই মূঢ়তার আঘাতে অশ্রুসিক্ত হয়েছে। চাই না মান, চাই না পুণ্য, আজ আমি এক প্রেমিকা নারীর বরমাল্য লাভ করে ধন্য হতে চাই।

যযাতি—কার কথা বলছেন জ্ঞানী গালব?

গালব—যযাতিকন্যা মাধবীর কথা।

সস্নেহ স্বরে যযাতি বলেন—তার কথা জিজ্ঞাসা করে আপনার কোন লাভ হবে না জ্ঞানী গালব। আমার আমন্ত্রণের বার্তা পেয়েও আপনি সেদিন যে স্বয়ংবরসভায় আসেননি, সেই স্বয়ংবরসভায় কুমারী মাধবীর বরমাল্যের পরিণাম সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে।

গালব—অসম্ভব, সে যে আমারই দয়িতা!

যযাতি—বড় বিলম্ব করেছেন জ্ঞানী গালব।

গালব আর্তনাদ করে ওঠেন।—এমন নির্মম কথা বলবেন না। বিশ্বাস করতে পারি না, রাজা যযাতি। বলুন, গালবের হৃদয়হীন জীবনের সকল স্বপ্ন তৃষ্ণার্ত করে দিয়ে কোথায় গিয়েছে সেই সুধাময়ী নারী, কার কণ্ঠে বরমাল্য দান করেছে মাধবী?

যযাতি—তপস্বিনী হয়েছে মাধবী।

পাষাণবৎ স্তব্ধীভূত গালব তাঁর কুবলয়নয়নের অসহায় হতাশ ও বেদনাভিভূত স্বপ্ন অশ্রুসলিলে ভাসিয়ে দিয়ে শুধু নীরবে তাকিয়ে থাকেন।

যযাতি বলেন—ঐ যে তৃণাঞ্চিত প্রান্তর দেখতে পাচ্ছেন জ্ঞানী গালব, তারই শেষ প্রান্তে এক বিষণ্ণ অপরাহ্ণের আলোকে ক্ষণিকের মত দাঁড়িয়ে, স্বয়ংবরসভার হর্ষ স্তব্ধ করে দিয়ে, নিজের হাতে বরমাল্য ছিন্ন করে এবং ভূতলে নিক্ষেপ করে চলে গিয়েছে মাধবী।

সভাগৃহ ছেড়ে ধূলিলিপ্ত পথের উপর এসে দাঁড়ান গালব। তারপর অবসন্নভাবে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকেন; তৃণাঞ্চিত প্রান্তরের শেষ প্রান্তে স্রোতস্বতীর কিনারায় এসে দাঁড়ান। দিগ্ভ্রান্তের মত কি যেন অন্বেষণ করতে থাকেন গালব।

বোধ হয় ছিন্ন বরমাল্যের একটুকু অবশেষ খুঁজছিলেন গালব। অনেক অন্বেষণের পর দেখতে পেলেন গালব, স্রোতস্বতীর তটলগ্ন দূর্বাদলের উপর খণ্ড খণ্ড হয়ে পড়ে আছে জগতের এক স্থিরপ্রেমা নারীর অভিমানদগ্ধ বরমাল্যের স্বর্ণসূত্র।

স্বর্ণসূত্রের মলিন ও তপ্ত খণ্ডগুলির দিকে তাঁর শূন্য দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন গালব; প্রেমিকার চিতাবশেষ অঙ্গারখণ্ডের দিকে প্রেমিক যেমন স্তব্ধ দৃষ্টি তুলে দাঁড়িয়ে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *