সুমুখ ও গুণকেশী

সুমুখ ও গুণকেশী

অবশেষে বাসুকিপরিপালিত ভোগবতী পুরীতে এসে ইন্দ্ৰসারথি মাতলির ম্রিয়মাণ মন আশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠল। এই সেই ভোগবতী পুরী, যে-স্থান শ্বেতাচলের মত কলেবর সেই মহাবল শেষ নাগের তপস্যায় পুণ্যময় হয়ে আছে। ঊর্ধ্বে মণিজালের দীপ্তি, আর নীচে শত প্রস্রবণের অবিরল ধারাসলিলে রত্নধাতুরেণুর প্রবাহ, এই ভোগবতী পুরীও বাসবের অমরাবতীর মত নয়নাভিরাম।

অনেক রাজ্য ঘুরে এসেছেন মাতলি, কিন্তু কোথাও এমন কোন রূপমান তরুণের সাক্ষাৎ পেলেন না, যাকে তাঁর রূপমতী কন্যা গুণকেশীর পরিণেতা হবার জন্য আহ্বান করা যেতে পারে। কি আশ্চর্য, যে অমরপুরে বাস করেন ইন্দ্রসখা মাতলি, পারিজাতের দেশ সেই অমরপুরেও গুণকেশীর পাণিগ্রহণের যোগ্য কোন পাত্র খুঁজে পেলেন না।

গিয়েছিলেন পাতালের বারণপুরে, যেখানে জগতের হিতসাধনের জন্য মেঘের বক্ষে বারিনিষেক করছেন ঐরাবত। যে বারণপুরের সলিলচারী মীণও চন্দ্রকিরণ পান ক’রে সুন্দর হয়ে আছে, সেই দেশেও কোন সুন্দর তরুণের সাক্ষাৎ পেলেন না মাতলি। পুণ্ডরীক কুমুদ ও অঞ্জন, সুপ্রতীককুলের সকল প্রধানের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মাতলি। কিন্তু কাউকেই গুণকেশীর পাণিগ্রহণের যোগ্য বলে মনে হয়নি। মাতলিতনয়া গুণকেশী, পারিজাতের মালা যার কণ্ঠের স্পর্শে আরও সুন্দর হয়ে ওঠে, সেই গুণকেশীর বরমাল্য গ্রহণ করার যোগ্য কোন সুকণ্ঠ সেই বারণপুরে নেই।

অবশেষে ভোগবতী পুরী। মণি স্বস্তিক চক্র ও কমণ্ডলুচিহ্নে খচিত বিবিধ রত্নময় আভরণ ধারণ ক’রে সভায় সমবেত হয়েছেন শত শত প্রবীণ নাগপ্রধান এবং তরুণ নাগকুমার। সভাস্থলের নিকটে এসে দেখতে পেলেন মাতলি, নাগপ্রধান আর্যকের সম্মুখে বসে আছে এক প্রিয়দর্শন কুমার। মনে হয়, দিব্যদেহ ঐ তরুণের মুখময়ূখের স্পর্শে উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছে নাগসভাস্থলীর মণিজাল। গুণকেশীর জীবনের প্রতিক্ষণের নয়নানন্দ হতে পারে, ঐ তো সেই রমণীয়তনু তরুণের মূর্তি। কে এই কুমার?

প্রীতমনা মাতলি নাগপ্রধান আর্যকের কাছে এসে সাগ্রহে নিবেদন করেন— আপনার সম্মুখে উপবিষ্ট এই কুমারের পরিচয় জানতে ইচ্ছা করি নাগপ্রধান আর্যক।

আর্যক বলেন—আমার পৌত্র সুমুখ।

মাতলি বলেন—আমার কন্যা গুণকেশীর পাণিগ্রহণের যোগ্য কেউ যদি ত্রিভুবনে থাকে, তবে একমাত্র একজনই আছে। সে হলো আপনারই এই পৌত্র সুমুখ।

আর্যক—আপনার ভাষণ শুনে খুবই প্রীত হলাম।

মাতলি অকস্মাৎ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেন।—কিন্তু প্রীত হয়েও কেন হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে গেলেন নাগপ্রধান আর্যক? দেখছি, আপনার পৌত্র সুমুখেরও সুন্দর আনন যেন হঠাৎ নিষ্প্রভ হয়ে গেল।

ব্যথিত স্বরে নিবেদন করেন আর্যক—আপনার উদ্দেশ্য অনুমান করতে পারছি, তাই বিষন্ন না হয়ে পারছি না।

মাতলি—কি অনুমান করছেন?

আর্যক—আপনার ইচ্ছা, আপনার কন্যা গুণকেশীর পাণিগ্রহণ করুক আমার এই নয়নান্দবর্ধন পৌত্র সুমুখ।

মাতলি—হ্যাঁ নাগপ্রধান আর্যক, সুরকামিনীর চেয়েও শতগুণ কমনীয়রূপা আমার কন্যা গুণকেশীর পতি হোক আপনার পৌত্র সুমুখ।

আর্যক—ইন্দ্রসখা মাতলির সঙ্গে সম্বন্ধবন্ধন কে না আকাঙ্ক্ষা করে? কিন্তু…।

মাতলি—তবু দ্বিধা কেন?

আর্যক—সুমুখের আয়ু প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

বেদনাহত মাতলি চমকে ওঠেন—আয়ু শেষ হয়ে এসেছে, এই কথার অর্থ কি?

অশ্রুসিক্ত চক্ষু তুলে আর্যক বলেন—আমার পুত্র চিকুরনাগকে সম্প্রতি হত্যা ক’রেও তৃপ্ত হতে পারেনি নাগবৈরী গরুড়। প্রতিজ্ঞা করেছে গরুড়, এক মাসের মধ্যে আমার পৌত্র সুমুখকেও হত্যা না ক’রে সে ক্ষান্ত হবে না। আপনি জানেন মাতলি, বিষ্ণুকৃপার আশ্রয়ে উৎসাহিত গরুড় কি নিষ্ঠুর সংহারামোদে মত্ত হয়ে নাগজাতিকে ধ্বংস ক’রে চলেছে। কি ভয়ংকর তার জাতিবৈর। মাতৃক্রোড়ে সুখসুপ্ত নাগশিশুর বক্ষ বিদীর্ণ করতেও কুণ্ঠা বোধ করে না গরুড়। আমার জীবনে আর একটি দুঃসহ শোকের আঘাত আসন্ন হয়ে উঠেছে। নাগদ্বেষী গরুড়ের হিংসার নখরাঘাতে ছিন্নভিন্ন হবে আমার জীবনের শেষ শান্তি এই প্রিয় পৌত্র সুমুখের জীবন। আপনার প্রস্তাব শুনে সুখী হয়েছি, কিন্তু প্রস্তাবে সম্মত হতে পারি না মাতলি৷ মৃত্যু যার আসন্ন, কি লাভ হবে তার জীবনে ক্ষণচঞ্চল এক উৎসবের আনন্দ আহ্বান ক’রে? শুভরাত্রির দীপ নিভে যাবার সঙ্গে সঙ্গে যার জীবনের দীপ নিভে যাবে, প্রিয়ার প্রেমান্বিত আননের শোভা দেখে মুগ্ধ হবার জন্য একটি দিনের মত সময়ও যে পাবে কি না সন্দেহ, তার কাছে আপনার কন্যাকে সম্প্রদান করতে আমি কখনই বলতে পারি না। এই আমার দুঃখ।

কিছুক্ষণ বিমর্ষভাবে আর চিন্তান্বিত হয়ে বসে থাকেন মাতলি। তার পরেই আশাদীপ্ত স্বরে বলে ওঠেন—আপনি সম্মতি দান করুন আর্যক।

আর্যক বিস্মিতভাবে বলেন—আপনার এই অতিশয় অনুরোধের অর্থ কি মাতলি? আপনি কি আপনার কন্যার অচিরবৈধব্য কামনা করেন?

মাতলি—না আর্যক, আমি নাগজাতিদ্বেষী গরুড়ের নিষ্ঠুর দর্পের বিনাশ কামনা করি।

আর্যক—কিন্তু…।

মাতলি—আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার পৌত্র সুমুখের আয়ু রক্ষার জন্য আমি কোন প্রযত্নের ত্রুটি করব না। আশা আছে, দেবরাজ ইন্দ্রের সহায়তায় আমার প্রযত্ন সফল হবে।

আর্যক—তবে তাই করুন।

মাতলি—কিন্তু আপনার পৌত্র সুমুখকে সঙ্গে নিয়েই আমি সুরপুরে যেতে চাই।

আতঙ্কিত দুই চক্ষুর দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থাকেন আর্যক—সুরপুরী অমরাবতীর কোথায় আর কার আশ্রয়ে থাকবে, আমার সুমুখ?

মাতলি—আমার আশ্রয়ে।

আর্যক—কিন্তু ভয় হয়, নাগবৈরী গরুড় তবু তার সংহারবাসনা চরিতার্থ করবার সুযোগ পেয়ে যাবে।

বাধা দিয়ে বলেন মাতলি—দুশ্চিন্তা করবেন না। আমার আশা আছে, এমন সুযোগ কখনই পাবে না গরুড়।

আর্যক—আশার কথা বলবেন না, প্রতিশ্রুতি দিন।

অকস্মাৎ উৎসাহিত স্বরে সুমুখই বলে ওঠে—দেবরাজসখা মাতলির কাছ থেকে বৃথা প্রতিশ্রুতি চাইছেন কেন পিতামহ? আপনার এই ভোগবতী পুরীতে এমন কেউ নেই যে, গরুড়ের আঘাত থেকে আমার প্রাণ রক্ষা করতে পারে। এখানে থাকলে আমার প্রাণরক্ষার কোন আশা নেই পিতামহ। অমরপুরীতে গিয়ে দেবরাজ সখা মাতলির সহায়তায় তবু আয়ুলাভের আশা আছে। আশা আছে দেবরাজ ইন্দ্র যদি তুষ্ট হন, তবে তিনি অমৃত দান ক’রে আপনার পৌত্রকে অমর ক’রে তুলবেন। আমাকে সেই আশার রাজ্যে যেতে অনুমতি দিন পিতামহ।

আর্যক বলেন—এস।

অমরাবতীর পুরদ্বার পার হয়ে পারিজাতকাননের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে নাগকুমার সুমুখ। অম্লান কুসুম পারিজাত, সুরপুরের পুষ্পের রূপের মধ্যেও যেন অমরতার আনন্দ ফুটে রয়েছে। ঐ কল্পপাদপের পল্লব কখনও শীর্ণ হয় না। জরা নেই, জীর্ণতা নেই, স্বর্গনগরীর প্রাণে কোন বিরহ ও বিচ্ছেদের বেদনা নেই। এখানে সবই চিরজাগ্রত ও চিরপ্রস্ফুটিত। চিরমধুনিষ্যন্দ মন্দারের মতই যৌবন এখানে চিরসরসিত। অমরপুরীর সমীরে শুধু সুস্মিত অধরের হাস্যস্বরলহরী ভেসে বেড়ায়। অশ্রুবাষ্প নেই, ক্ৰন্দন নেই, বেদনাহীন অমরপুরীর সুধাসিক্ত হৃদয় চিরহর্ষে তরঙ্গিত হয়ে রয়েছে।

অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে সুমুখ, যেন অমরতায় ধন্য এই সুরনগরীশোভা পান করার জন্য তার কল্পনা পিপাসিত হয়ে উঠেছে। লুব্ধ ও উৎফুল্ল হয়ে ওঠে ক্ষণায়ু জীবনের উদ্বেগে ব্যথিত ভোগবতী পুরীর একটি প্রাণ।

সুমুখ বলে—আমাকে একটি প্রতিশ্রুতি দান করুন অমরেন্দ্রসারথি মাতলি।

মাতলি—বল, কিসের প্রতিশ্রুতি চাও।

সুমুখ—আমি অমৃত চাই।

চমকে ওঠেন মাতলি—আমি কেমন ক’রে তোমাকে অমৃত দানের প্রতিশ্রুতি দিতে পারি সুমুখ?

সুমুখ—দেবরাজ ইচ্ছা করলেই তো আমাকে অমৃত দান করতে পারেন।

মাতলি—হ্যাঁ, দেবরাজ পারেন।

সুমুখ—আপনি অনুরোধে দেবরাজকে তুষ্ট ও প্রীত ক’রে আমার জন্য অমৃত সংগ্রহ ক’রে দিন।

মাতলি—কিন্তু দেবরাজ যদি আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন, তবে?

সুমুখ—তবে আমাকে বিদায় দান করবেন, আপনার কন্যার পাণিগ্রহণে আমার আর কোন আগ্রহ থাকবে না।

মাতলি বেদনাহত স্বরে বলেন—তোমার সংকল্পের কথা শুনে ব্যথিত হলাম।

সুমুখ—কেন?

মাতলি—গুণকেশীর পাণিগ্রহণে তোমার এই অনাগ্রহ দেখে দুঃখিত না হয়ে পারছি না।

হেসে ওঠে সুমুখ—আপনি কি চান?

মাতলি—আমি চাই, তুমি আয়ুষ্মান হও। আমি চাই তুমি গরুড়ের হিংস্র প্রতিজ্ঞার আঘাত থেকে রক্ষা পেয়ে আমার কন্যা গুণকেশীর পতি হও।

সুমুখ—কে আমাকে আয়ু দান করবেন? গরুড়ের আঘাত হতে কে আমার প্রাণরক্ষা করবেন?

মাতলি—আশা আছে, আমার অনুরোধে দেবরাজ তোমাকে আয়ু দান করবেন।

সুমুখ—যদি না করেন? যদি আপনি বুঝতে পারেন যে, ভোগবতীর এই ক্ষণায়ু নাগকুমারের প্রাণ আর একটি দিনের মধ্যেই নাগবৈরী গরুড়ের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, তবে?

মাতলি—তবে কি?

সুমুখ—তবে কি আপনি আপনার কন্যাকে আমার কাছে সম্প্রদান করবেন? আমাকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন?

সহসা লজ্জিত হয়ে এবং কুন্ঠিতভাবে উত্তর দান করেন মাতলি—না।

সুমুখ আবার হেসে ওঠে—আমার কাছে আপনার কন্যার পাণি সমর্পণে আপনার এই অনাগ্রহ কেন দেবরাজসখা?

মাতলি বলেন—জানি না অদৃষ্টে কি আছে। আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম, তোমার জন্য দেবরাজের কাছে অমৃত প্রার্থনা করব। যদি সুযোগ পাই, তবে ভগবান বিষ্ণুর কাছে গিয়েও বলব, আমার কন্যার জীবনসঙ্গী হবে যে প্রিয়দর্শন নাগকুমার, সেই সুমুখকে অমৃতদানে অমর করুন ভগবান।

তৃপ্তচিত্তে এবং আশাদীপ্ত নেত্রে সুমুখ বলে—আপনার এই চেষ্টার প্রতিশ্রুতিই যথেষ্ট। আমার বিশ্বাস, আপনার চেষ্টা সফল হবে।

ভবনে প্রবেশ ক’রেই পত্নী সুধর্মার কাছে শুনলেন মাতলি, ভগবান বিষ্ণু আজ অমরাবতীতে অবস্থান করছেন। শুনে প্রসন্ন হলেন মাতলি, কিন্তু পরক্ষণেই শঙ্কাপন্নের মত দুশ্চিন্তিত হয়ে ডাক দিলেন—গুণকেশী!

কন্যা গুণকেশী এসে সম্মুখে দাঁড়ায়—আজ্ঞা করুন পিতা।

মাতলি—এখনি যে অভ্যাগত অপরিচিতকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে মন্দারকুঞ্জের নিভৃতে ঐ লতাবাটিকায় পৌঁছিয়ে দিয়ে এসেছ, তার পরিচয় অনুমান করতে পার কন্যা?

গুণকেশী—না।

মাতলি—ভোগবতী পুরীর নাগ আর্যকের পৌত্র আর বিগতাসু চিকুরের পুত্র সুমুখ।

গুণকেশী—পাতাল দেশের কুমার সুরপুরে কেন এলেন?

মাতলি—তোমারই পাণি গ্রহণ ক’রে তোমার জীবনের সহচর হবে যে, সে হলো এই নাগকুমার সুমুখ। কিন্তু…।

গুণকেশীর লজ্জারাগে আরক্ত কপোলের দিকে তাকিয়ে স্নেহবিবশ স্বরে মাতলি আক্ষেপ করেন—কিন্তু সুমুখের আয়ু শেষ হয়ে এসেছে।

যেন হঠাৎ এক মরুঝটিকার জ্বালাবায়ু এসে গুণকেশীর দুই চক্ষু আঘাতে পীড়িত করে তুলেছে, ব্যথাহত নেত্রে তাকিয়ে থাকে গুণকেশী। কপোলের রক্তাভ প্রসন্নতা এক মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে যায়। আর, নীরব হয়ে এই দুঃসহ বার্তার অর্থ বুঝতে চেষ্টা করে।

মাতলি বলেন—নাগবৈরী গরুড়ের সংকল্প, এক মাসের মধ্যেই সে সুমুখের প্রাণ সংহার করবে। তাই দুশ্চিন্তিত হয়েছি কন্যা। ভগবান বিষ্ণুর কাছে কিংবা দেবরাজের কাছে গিয়ে সুমুখের জন্য অমৃত প্রার্থনা করতে হবে। এখনি যেতে হবে।

গুণকেশী—আপনার প্রার্থনা সফল হোক পিতা।

মাতলি—কিন্তু শুনতে পেয়েছি, ভগবান বিষ্ণু আজ সুরপুরীতে অবস্থান করছেন তাই নিশ্চিন্ত মনে যেতে পারছি না।

গুণকেশী—কেন?

মাতলি—ভগবান বিষ্ণু যখন এসেছেন, তখন তাঁর বাহন গরুড়ও নিশ্চয় এসেছে। ভয় হয়, যে-কোন মুহূর্তে এসে আমার স্নেহাশ্রিত সুমুখের প্রাণ বিনাশ ক’রে চলে যাবে ভয়ংকর জাতিদ্বেষপ্রমত্ত গরুড়, বিষ্ণকৃপায় আশ্রিত দর্পোন্মাদ গরুড়। তাই নিশ্চিত মনে যেতে পারছি না।

গুণকেশী—আপনি বিলম্ব করবেন না পিতা। নিশ্চিন্ত মনে প্রস্থান করুন।

মাতলি—যতক্ষণ না ফিরে আসি সুমুখের প্রাণ রক্ষার ভার তোমার উপর রইল।

গুণকেশী—হ্যাঁ, পিতা।

ইন্দ্ৰসন্নিধানে চলে গেলেন মাতলি, আর মন্দারকুঞ্জের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে বসে থাকে গুণকেশী।

এই তো কিছুক্ষণ আগে, যেন নিজেরই যৌবনান্বিত জীবনের এতদিনের সুস্বপ্ন দিয়ে রচিত একটি মূর্তিকে পথ দেখিয়ে ঐ মন্দারকুঞ্জের নিভৃতে রেখে এসেছে গুণকেশী। কিন্তু কল্পনা করতে পারেনি গুণকেশী, সত্যই ঐ সুন্দর দর্শন তরুণ হলো ক্ষণভঙ্গুর সুস্বপ্নের মত সুন্দর এক ক্ষণায়ু মাত্র। বাহু প্রসারিত করেছে মৃত্যু, ঐ তরুণের প্রাণ লুণ্ঠিত করার জন্য। তবু সে এসেছে প্রিয়ালাভের আশায়; সুরপুরবাসিনী গুণকেশীকে জীবনসহচরী ক’রে নিয়ে যাবার জন্য ভোগবতীর অতল হতে উঠে এসেছে সুন্দর এক বিশ্বাস।

অকস্মাৎ, যেন নিজের মনের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে গুণকেশী। হৃদয়ের গভীরে এক জলছলছল সরসীর বুকে ফুটে উঠেছে নাগকুমার সুমুখের মুখমলশোভা। আরও বুঝতে পারে গুণকেশী, তার দুই চক্ষু হতে বারিধারা ঝরে পড়ছে।

এরই নাম বোধহয় অশ্রু, এই বস্তু অমরপুরীর জীবনে নেই। তবে কোথা হতে আর কেন আসে এই অশ্রু সুরপুরবাসিনী গুণকেশীর নয়নে? প্রেমের প্রথম উপহার কি এই অশ্রু?

—অমর হও অথবা আয়ুষ্মান হও, কিংবা ক্ষণায়ু হও, যা’ই হও তুমি, তুমিই মাতলিতনয়া গুণকেশীর প্রেমের পুরুষ। গুণকেশীর অন্তরে যেন এক সংকল্পের সঙ্গীত সুধ্বনিত হতে থাকে।—বিফল হবে না তোমার বিশ্বাস। যদি মৃত্যু তোমাকে কেড়ে নিয়ে যেতে আসে, যদি বরণমাল্য দান করবার সুযোগ নাই বা আসে; তবু গুণকেশী তার প্রেমাকুল এই দুই বাহুর মালিকা তোমার কণ্ঠে উপহার না দিয়ে তোমাকে বিদায় দেবে না। অমৃত নই আমি, প্রাণদায়িনী নই আমি, কিন্তু তোমার মৃত্যুকেই মধুর ক’রে দিতে পারি আমি। সুরপুর যদি তোমাকে বঞ্চিত করে, দেবরাজ যদি তোমাকে অমৃত দান না করেন, তবে দুঃখ করো না নাগকুমার। মাতলিতনয়া গুণকেশী তোমাকে বঞ্চিত করবে না। ভঙ্গুরপ্ৰাণ দীপশিখার মত সত্যই যদি নিভে যাও, তবে নিভে যাবার আগে তোমার বক্ষে বরণ ক’রে নিও তোমার প্রেমিকা মাতলিতনয়ার কামনাবিহ্বল নিঃশ্বাস।

গুণকেশীর মনের বেদনাময় ভাবনাগুলি যেন এই অদ্ভুত অশ্রুর স্পর্শে মধুর আর চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কিন্তু মন্দারকুঞ্জের নিভৃতেও কি এমনই কোন বেদনাময় ভাবনা অশ্রুর স্পর্শে মধুর ও চঞ্চল হয়ে উঠেছে? জানতে ইচ্ছা করে, জেগে আছে না ঘুমিয়ে পড়েছে জীবনপ্রিয়ার মুখচ্ছবি অন্বেষণে ভোগবতী হতে অমরপুরে আগত ঐ পথিক।

ঘুমিয়ে পড়েছিল সুমুখ। যেন মন্দারকুসুমের সৌরভে অভিভূত স্বপ্ন দেখছিল সুমুখ। অমৃত দান করেছেন দেবরাজ, আর অমরত্ব লাভ করেছে চিকুরতনয় সুমুখ। শঙ্কা নেই, উদ্বেগ নেই, অশ্রুহীন চিরহর্ষের জীবন। বিদায়ে বেদনা নেই, বিরহে ব্যথা নেই, বক্ষে দীর্ঘশ্বাস নেই। জীর্ণ হয় না যৌবন, শ্রান্ত হয় না দেহ, মলিন হয় না কান্তি। কিন্তু হঠাৎ যেন কা’র কুন্তলসুরভির স্পর্শে মন্দারসৌরভে অভিভূত এই স্বপ্ন ভেঙে গেল। চোখ মেলে তাকায় সুমুখ।

সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে মাতলিতনয়া গুণকেশী। বিস্মিত সুমুখ বলে—তুমি? আজ এই অসময়ে এখানে কি উদ্দেশে এসেছ মাতলিতনয়া?

গুণকেশী—অসময় কেন বলছেন চিকুরতনয়? সন্ধ্যাতারকা যদি একটু আগে ফুটে ওঠে, তবে কি আকাশের হৃদয় ব্যথিত হয়? ঊষার অরুণাভা যদি একটু আগে জেগে ওঠে, তবে কি আপত্তি করে জলকমল? আপনি আমার পাণি গ্রহণ করবেন, আপনাকেই পতিত্বে বরণ ক’রে ধন্য হবে আমার পারিজাতের মালা; শঙ্খধ্বনি ও মন্ত্ৰরবের উৎসবের মধ্যে আমাকে চিরকালের প্রিয়া ক’রে গ্রহণ করবেন যিনি, আমি তাঁরই কাছে এসেছি।

সুমুখ—বল, কি উদ্দেশে এসেছ।

গুণকেশী—জানতে ইচ্ছা করে, এতক্ষণ কি স্বপ্ন দেখছিলেন নাগকুমার?

সুমুখ—দেখছিলাম, যে বিশ্বাস নিয়ে এই সুরপুরে এসেছি, আমার সেই বিশ্বাস সফল হয়েছে।

ফুল্ল প্রসূনের মত অকস্মাৎ গুণকেশীর দুই নয়নও যেন এক বিশ্বাসের স্পর্শে উৎসুক হয়ে ওঠে।—কি বিশ্বাস নিয়ে সুরপুরে এসেছেন চিকুরতনয়?

সুমুখ—এসেছি অমৃতলাভের জন্য।

আর্তনাদের মত বেদনাশিহরিত স্বরে প্রশ্ন করে গুণকেশী—অমৃতলাভের জন্য?

সুমুখ—হ্যাঁ।

গুণকেশী—অমৃতই কি আপনার অভীষ্ট?

সুমুখ—হ্যাঁ; যদি অমৃত পাই, যদি সুরোপম অমরতা লাভ করি, তবেই তোমাকে আমার জীবনের সহচরী হতে আহ্বান করব, আমার এই সংকল্পের কথা জানেন তোমার পিতা, বাসসুহৃদ্‌ মাতলি।

গুণকেশী—যদি অমৃত না পান, তবে?

অকস্মাৎ শঙ্কিতের মত বিষন্ন হয়ে ওঠে সুমুখ—এমন অশুভ বচন উচ্চারণও করো না।

গুণকেশী— আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, যদি আপনার স্বপ্ন বিফল হয়, তবে কি মাতলিতনয়া গুণকেশীর বরমাল্য প্রত্যাখ্যান ক’রে চলে যাবেন?

সুমুখ—তুমি বল পারিজাতসৌরভবিলাসিনী সুন্দরী; যদি বুঝতে পার যে, আর এক মুহূর্ত পরে চিকুরতনয় সুমুখের প্রাণ বিনাশ করবে হিংস্র ও ভয়ংকর নাগবৈরী গরুড়, তবে কি তুমি এই মুহূর্তে তার কণ্ঠে বরমাল্য দিতে পারবে?

গুণকেশী—পারব।

বিস্ময়ে শিহরিত হয়ে সুমুখ বলে—এ কেমন প্রণয়রীতি, কুমারী গুণকেশী?

গুণকেশী—এ অতি সহজ প্রণয়রীতি, চিকুরতনয়। গুণকেশী ভালবাসছে আপনাকে, আপনার অমরতাকে নয়। গুণকেশী ভালবাসে আপনার প্রাণকে, আপনার প্রাণের অনন্ততাকে নয়। আপনার আয়ুর চেয়ে আপনার হৃদয় আমার কাছে শতগুণ বেশী লোভনীয় ও স্পৃহনীয় ও মূল্যবান, হে নাগকুমার। আমি প্রেমিকা, আমার কাছে আপনার ঐ বক্ষের ক্ষণিক স্পর্শ অনন্ত হয়ে থাকবে, যদি আমার জন্য আপনার হৃদয়ে এক বিন্দু প্রেম থাকে।

সুমুখ—আমাকে ক্ষমা কর মাতলিতনয়া; যদি অমরতা লাভ করতে না পারি, তবে আমার আহত স্বপ্নের বেদনারুধিরে রঞ্জিত হয়ে যাবে আমার হৃদয়। সেই হতাশাব্যথিত হৃদয়ে প্রেমের পুষ্প কোনদিন ফুটে উঠবে না।

গুণকেশী—চিকুরতনয়!

সুমুখ—বল মাতলিতনয়া।

গুণকেশী—প্রেমহীন নয়নেই একবার শুধু তাকিয়ে দেখ তোমার প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী এই সুরপুরবাসিনীর যৌবনচ্ছবি।

সুমুখ—দেখেছি।

গুণকেশী—বল, কি বলে তোমার ঐ দেহের শোণিতকণিকার কামনা? পিপাসা জাগে না কি অধরে? চঞ্চল হয় না কি বক্ষের নিঃশ্বাস? বল, ভোগবতীর সলিলে লালিততনু নাগকুমার, এই সুরপুরললনার ললাটতিলকে অধর দান ক’রে মদামোদমধুর একটি মুহূর্তের বিহ্বলতা বরণ ক’রে নেবার জন্য তোমার শান্ত বক্ষঃপঞ্জরের অন্তরালে কোন স্পৃহা উন্মুখ হয়ে ওঠে না?

শান্ত রত্নশৈলের মত সুন্দর ও অচঞ্চল সুমুখ বলে—না গুণকেশী, অমরতাহীন জীবনে এই ক্ষণচঞ্চল ও অতিনশ্বর কামনার উৎসব নিতান্ত এক বিদ্রূপ। সে বিদ্রূপ দেখতে সুন্দর হলেও তার জন্য আমার মনে কোন মোহ নেই।

নীরবে আর অবনতশিরে দাঁড়িয়ে থাকে গুণকেশী। পূর্ব আকাশের ললাটে আসন্ন সন্ধ্যার ছায়া দেখা দিয়েছে। মন্দারকুঞ্জের সৌরভ স্নিগ্ধ সমীরে আরও মদির হয়ে ওঠে।

নিজেরই মনের কল্পনার আবেশে অন্যমনা হয়ে দূরান্তরের দিকে তাকিয়ে থাকে সুমুখ। মনে হয়, এতক্ষণে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর প্রিয়সখা মাতলির প্রার্থনায় প্রীত হয়ে অমৃত দান করেছেন। নাগকুমার সুমুখের অমরত্বলাভের স্বপ্ন সত্য করবার জন্য অমৃত নিয়ে আসছেন মাতলি। যেন পদধ্বনি শোনা যায়, বুঝি আসছেন মাতলি। উৎকর্ণ হয়ে আর অপলক নেত্রে মন্দারকুঞ্জের পথরেখার দিকে তাকিয়ে থাকে সুমুখ।

সেই মুহূর্তে শঙ্কিত শিশুর মত করুণকণ্ঠে আর্তনাদ ক’রে ওঠে সুমুখ।—রক্ষা কর।

কালানলের ঝটিকার মত যেন কা’র ক্রূরকরাল নিঃশ্বাস ছুটে এসে মন্দারকুঞ্জের নিকটে থেমেছে। লতাবাটিকার অভ্যন্তরে বাত্যাহত শীর্ণ বেতসপত্রের মত কেঁপে ওঠে সুমুখ। এসেছে, নাগবৈরী গরুড় তার ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা চরিতার্থ করার জন্য এসেছে। অমরত্বপ্রয়াসী সুমুখের হৃৎপিণ্ডের কাছে মৃত্যুর নখর এসে পৌঁছে গিয়েছে।

গুণকেশী বলে—শান্ত হও নাগকুমার।

সুমুখ—শান্তি দাও মাতলিতনয়া।

গুণকেশী বলে—আমিই তো তোমার শান্তি।

সুমুখ—তুমি?

গুণকেশী—হ্যাঁ, আমি।

সুমুখ—তুমি আমাকে মৃত্যু হতে রক্ষা করতে পারবে?

গুণকেশী বলে—আমি অমৃত নই চিকুরতনয়। আমি তোমার মৃত্যুপথে শুধু সহযাত্রিণী হতে পারি, আমি তোমার মৃত্যুর মুহূর্ত শুধু মধুর ক’রে দিতে পারি।

কালানলের ঝটিকার মত গরুড়ের নিঃশ্বাস উদ্দাম আক্রোশে মন্দারকুঞ্জের পথের উপর দাঁড়িয়ে ছটফট করছে। গুণকেশীর মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করে সুমুখ—মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ মুহূর্ত মধুর ক’রে দিয়ে তুমি কোন্ আনন্দ লাভ করবে মাতলিতনয়া?

গুণকেশী—সেই মধুরতা অমর হয়ে থাকবে আমার জীবনে, আমার প্রাণের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

সুমুখ বলে—তুমি বিচিত্রহৃদয় এই জগতের এক অতি অদ্ভুত বিস্ময়।

গুণকেশী—আমি এই বিস্ময়ভরা জগতের এক অতি সাধারণ হৃদয়।

সুমুখ—তুমি সুন্দর।

গুণকেশী—তুমি যদি সুন্দর বল, তবেই আমি সুন্দর।

উদ্‌গত অশ্রুবাষ্প নিরোধ করতে চেষ্টা করে সুমুখ। ব্যথিতের আবেদনের মত বিহ্বল স্বরে বলে—আমার একটি অনুরোধ আছে।

গুণকেশী—আদেশ করুন।

সুমুখ—গরুড়ের হিংসায় ছিন্নদেহ চিকুরতনয় যেন তার প্রাণের শেষ মুহূর্তে দেখতে পায়, সুরপুরনিবাসিনী গুণকেশীর নয়নে দু’টি অশ্রুবিম্ব ফুটে উঠেছে।

—চিকুরতনয়!

—বল সুন্দরহৃদয়া মাতলিতনয়া।

—অনতিনশ্বর দু’টি অশ্রুকণিকার জন্য এই মোহ কেন?

—বুঝতে পেরেছি, এই মৃত্যুর ছায়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বুঝতে পেরেছি গুণকেশী, অতিনশ্বর এই অশ্রুকণিকা অনন্ত হর্ষের চেয়েও কত বেশী মধুর। বুঝেছি, মৃত্যুর মুহূর্তকে মধুর ক’রে দিতে পারে যে-বস্তু, তাই তো অমৃত।

অস্থির হয়ে উঠেছে সংহারব্যাকুল গরুড়ের ছায়া। লতাবাটিকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করার জন্য এগিয়ে আসছে অনলোদ্‌গারী দু’টি চক্ষুর দৃষ্টি।

সুমুখের কণ্ঠে অসহায় আর্তস্বর ছলছল করে—অমরতার স্বপ্নে মুগ্ধ হয়ে ভুলে গিয়েছিলাম গুণকেশী, আজ গরুড়ের প্রতিভার শেষ দিন। এই সন্ধ্যাই আমার জীবনের শেষ সন্ধ্যা।

আর্তস্বরে চিৎকার করে ওঠে গুণকেশী—কিন্তু তুমি মরণ বরণ করো না চিকুরতনয়।

মৃদু হাস্যে উত্তর দেয় সুমুখ—উপায় নেই গুণকেশী, বিষ্ণুর কৃপায় আশ্রিত ঐ ভয়ংকরের আঘাত হতে কেমন ক’রে আত্মরক্ষা করবে ভোগবতীর সলিলে লালিত নাগ?

—এ কেমন বিষ্ণু, আর এ কেমন তাঁর কৃপা? গুণকেশীর অন্তর মথিত ক’রে এক উদ্ধত বিদ্রোহ যেন কঠিন প্রশ্ন হয়ে জেগে ওঠে।

নিখিল সৃষ্টির রক্ষক ও পালয়িতা বিষ্ণুর কৃপা, সে কৃপায় লালিত হয় নিখিলের ক্রোড়ে আবির্ভূত সকল প্রাণ। অন্যমনার মত নিষ্পলক নেত্রে যেন ধ্যান সঞ্চারিত ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে আর চিন্তা করে গুণকেশী। তারপর, নিগূঢ় এক সংকল্পের ছায়া গুণকেশীর ওষ্ঠাধর শিহরিত ক’রে কাঁপতে থাকে। তার ভাবনামগ্ন মূর্তি যেন অন্তরের গভীরে এক স্তবের ভাষা এবং শোণিতের কলরোলে এক প্রজায়িনী মহিমার সঙ্গীত উৎকর্ণ হয়ে শুনছে।—তোমার প্রাণপ্রিয় চিকুরতনয়ের প্রাণ হতে তোমার প্রাণের গভীরে নব প্রাণ আহ্বান কর, মাতলিতনয়া। প্রাণের আবির্ভাব ধ্বংস করবে, বিষ্ণুর কৃপায় আশ্রিত কোন উদ্‌ভ্রান্ত ভয়ংকরের সে সাহস নেই, স্বয়ং বিষ্ণুরও সে অধিকার নেই।

হিংস্র গরুড়ের ছায়া একেবারে লতাবাটিকার দ্বারে এসে দাঁড়ায়। সেই মুহূর্তে উৎক্ষিপ্ত পারিজাতস্তবকের মত মাতলিতনয়া গুণকেশী তার যৌবনিত তনুশোভা অপবৃত ক’রে সুমুখের বুকের উপর এসে লুটিয়ে পড়ে।—আমার স্বপ্ন সত্য ক’রে দিয়ে যাও, প্রিয় নাগকুমার।

সুমুখ—নিজেকে এমন ক’রে শাস্তি দিও না, কুমারী।

গুণকেশীর দুই চক্ষের কোণে মুক্তাফলের মত দু’টি মধুর ও উজ্জ্বল অশ্রুবিম্ব ফুটে ওঠে।—প্রশ্ন করো না, বিস্মিত হয়ো না, কুন্ঠিত হয়ো না গুণকেশীর প্রেমের পুরুষ, গুণকেশীর পিপাসিত শোণিতে তোমার সন্তানের প্রাণ অঙ্কুরিত ক’রে দিয়ে যাও।

—গুণকেশী! মধুরসান্দ্র প্রণয়ার্দ্র স্বরে আহ্বান করে সুমুখ। সুমুখের মৃত্যুর মুহূর্তগুলিকে যেন মধুরতায় ডুবিয়ে দেবার জন্য সুমুখের বাহুবন্ধনের মধ্যে আত্মহারা হয়ে লুটিয়ে পড়ে এক অশ্রুবিধুর ও স্বপ্নমধুর পারিজাতের স্তবক।

নক্ষত্র জাগে আকাশে। নিশীথবায়ুর চুম্বনে তন্দ্রাভিভূত হয় মন্দারসৌরভ। গরুড়ের নির্মম প্রতিজ্ঞায় উদ্বিগ্ন একটি মাসের শেষ দিনের মুহূর্তগুলি বিলীন হতে থাকে। এগিয়ে আসে রাত্রির শেষ যাম। সুমুখের বাহুবন্ধন বরণ ক’রে বিহ্বল হয়ে পড়ে থাকে কুমারী গুণকেশীর ফুল্ল যৌবনের উৎসর্গ।

ঊষাভাস জাগে আকাশপটে, জেগে ওঠে বিহগস্বর। সুমুখের বক্ষে নখরাঘাত করবার সুযোগ পেল না গরুড়। হতাশ হয়ে সরে যায় গরুড়ের ছায়া। মন্দারকুঞ্জের গন্ধমন্থর বাতাস দীর্ণ ক’রে বিফলমনোরথ গরুড়ের ধিক্কার ধ্বনিত হয়—ব্যভিচারিণী মাতলিতনয়া!

চলে যায় গরুড়। সুপ্তোত্থিত বিহগের কণ্ঠকাকলীর মত হেসে ওঠে গুণকেশীর কণ্ঠস্বর। সুমুখের বাহুবন্ধন হঠাৎ ছিন্ন ক’রে উঠে দাঁড়ায় গুণকেশী।

হাস্যস্বরে চমকে ওঠে সুমুখ, কিন্তু দেখতে পেয়ে বিস্মিত হয়, গুণকেশীর দুই চক্ষুর প্রান্তে সেই দু’টি অশ্রুবিম্ব ফুটে রয়েছে।—এ কি, গুণকেশী?

গুণকেশী—তোমার প্রাণের বৈরী ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকেই ধিক্কার দিয়ে চলে গেল।

সুমুখ—সে নির্মম তোমাকে ধিক্কার দিয়ে গেল কেন?

গুণকেশী—আমিই যে বিফল ক’রে দিলাম সে নির্মমের প্রতিহিংসার সব আশা। তুমি নিরাপদ, তুমি মুক্ত।

—গুণকেশী! প্রাণদায়িনী গুণকেশী! বিস্ময়ের আবেগ সহ্য করতে না পেরে চিৎকার ক’রে ওঠে সুমুখ।

গুণকেশী বলে—সুরপুরবাসিনী এক প্রগল্ভার এক রাত্রির মূঢ়তাকে ঘৃণা ক’রে এইবার পাতাললোকে চলে যাও নাগকুমার।

দুই হাতে মুখ ঢেকে, যেন ঐ সুন্দর মুখেরই এক দুঃসহ বেদনাচ্ছবি আচ্ছাদিত ক’রে দ্রুতপদে চলে যায় গুণকেশী। আকুল আগ্রহে আহ্বান করে সুমুখ—যেও না গুণকেশী।

ইন্দ্রসন্নিধান হতে ফিরে এসেছেন মাতলি। বিষণ্ণ হতাশ ও বেদনাভিভূত মাতলি। সুমুখের জন্য অমৃত দান করেননি দেবরাজ ইন্দ্র। শুধু অনুগ্রহ ক’রে এই মাত্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, গরুড়ের কোপ হতে রক্ষা পাবে সুমুখ। দেবরাজসখা মাতলির কন্যা গুণকেশীর পাণিপ্রার্থীকে শুধু আয় দান করেছেন দেবরাজ।

হেসে ফেলে সুমুখ—আমাকে অমৃত দিতে পারলেন না, তবে আমাকে বিদায় দেবার জন্য এইবার প্রস্তুত হোন, দেবরাজসখা মাতলি।

শূন্যদৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থাকেন মাতলি। চলে যেতে চাইছে নাগকুমার সুমুখ। সুরপুরে এসে পারিজাতের চেয়ে সুন্দর মাতলিতনয়ার মুখের দিকে তাকিয়েও যার বক্ষে কোন মোহ জাগল না, যার চোখে কোন লোভ লাগল না, চলে যাচ্ছে সেই নিতান্ত এক অমৃতলোলুপ আকাঙ্ক্ষার জীব, অকৃতজ্ঞতা ও অমমতার আশীবিষ।

আবার হেসে ফেলে সুমুখ—আমি কিন্তু একাকী ফিরে যাব না, বাসবসুহৃদ্ মাতলি।

হঠাৎ বিস্ময়ে অপ্রস্তুত হয়ে প্রশ্ন করেন মাতলি—কি বলছ সুমুখ?

সুমুখ—হ্যাঁ ইন্দ্ৰসারথি মাতলি, আপনাদের এই সুরপুরের সবই ছলশোভার পারিজাত, হৃদয়ের পারিজাত শুধু একটি আছে, আমার সঙ্গে তাকে চলে যাবার অনুমতি দিন।

—কে সে?

—আমার প্রাণদায়িণী সে। অমরপুরের অমৃত শুধু ছলনা করে, কিন্তু মৃত্যুর মুহূর্তকেও মধুরতায় অমর ক’রে দিতে পারে তারই দুই চক্ষুর দু’টি অতিনশ্বর অশ্রুবিন্দু।

—কা’র চক্ষুর অশ্রুবিন্দু?

—আপনার কন্যা গুণকেশীর।

ইন্দ্ৰসারথি মাতলির এতক্ষণের বিষন্ন বদন আনন্দে সুস্মিত হয়। অদূরের ভবনদ্বারদেশের পুষ্পমালঞ্চের একটি স্নিগ্ধচ্ছায় নিভৃতের দিকে তাকিয়ে প্রসন্নচিত্তে আহ্বান করেন মাতলি—কন্যা গুণকেশী!

গুণকেশী সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। মন্ত্র পাঠ ক’রে কন্যা গুণকেশীর পাণি সুমুখের হস্তে সমর্পণ করেন মাতলি।

আর অমরপুর নয়, অশ্রুহীন এই অনন্ত হর্ষের দেশ হতে ক্ষণায়ুব্যথিত ভোগবতী পুরীর পথে সানন্দে এগিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয় সুমুখ। স্নিগ্ধস্বরে আহ্বান করে— এস প্রিয়া গুণকেশী।

গুণকেশীর ব্যথিত দুই নয়নের কোণে সেই মধুর অশ্রুবিন্দু আবার ফুটে ওঠে— বল, তোমার মনে কোন দুঃখ নেই।

সুমুখ—কিসের দুঃখ?

গুণকেশী—অমরপুরীতে এসেও অমৃত পেলে না।

সাগ্রহে গুণকেশীর হাত ধ’রে সুমুখ বলে—পেয়েছি।

গুণকেশী—পেয়েছ? পিতা তবে এনেছেন অমৃত?

সুমুখ—তোমার পিতা আমাকে দিয়েছেন অমৃত।

গুণকেশী—কোথায় সেই অমৃত?

সুমুখ—এই তো আমার সম্মুখে।

গুণকেশী—কি?

সুমুখ—তুমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *