ভাস্কর ও পৃথা

ভাস্কর ও পৃথা

পৃথা বলে—আমার কোন বর প্রয়োজন নেই বিপ্রর্ষি। আমার আচরণে অতিথিরূপী দেবতা আপনি সুখী হয়েছেন, পিতা কুন্তীভোজও সুখী হয়েছেন, আমার বরলাভ হয়েই গিয়েছে। এর চেয়ে বড় আর কোন উপহারে প্রয়োজন নেই।

বিপ্রর্ষি দুর্বাসা বিদায় নেবার আগে সস্নেহ দৃষ্টি তুলে কুমারী পৃথার দিকে তাকিয়েছিলেন, এইবার হেসে ফেললেন—প্রয়োজন আছে পৃথা।

সত্যই বুঝে উঠতে পারে না পৃথা, তার জীবনে আর কোন বরের কি প্রয়োজন আছে? অনপত্য কুন্তীভোজের পিতৃস্নেহের এই সুখময় নীড়ের বাইরে জীবনের এমন আর কি সুখ থাকতে পারে, বুঝতে পারে না কুন্তীতভাজের পালিতা কন্যা পৃথা। বুঝবার মত বয়সও হয়নি। এখন মাত্র কৈশোর, ঊষালোকের স্নিগ্ধতা দিয়ে রচিত এক কন্যকার মূর্তি। পরিপূর্ণ প্রভাতের যে লগ্ন আসন্ন হয়ে উঠেছে, যে লগ্নে মুদ্রিত কলিকার মত এই সুশান্ত রূপ আলোকের পিপাসায় উন্মুখ হয়ে উঠবে, তার আভাস কুমারী পৃথার অঙ্গে অঙ্গে ফুটে উঠলেও এখনও মনের মধ্যে ফুটে ওঠেনি। পিতা কুন্তীভোজের স্নেহে লালিতা ঐ লীলাচপলা মৃগললনার মত এই আলয় ও আঙিনায় ছুটাছুটির খেলা, দেবপূজা আর অতিথিসেবার খেলা, এর চেয়ে বেশি আনন্দের জীবন আর কি আছে? কুঞ্জলতিকার সাথে ক্ষণে ক্ষণে অভিমানের খেলা, সরোবরজলে বিম্বিত ছায়ার সাথে কৌতুকের খেলা, আর কবরীপুষ্পলুব্ধ দুরন্ত ভ্রমরের সাথে ভ্রূকুটির খেলা এর চেয়ে বেশি মায়ার খেলা দিয়ে গড়া অন্য কোন জগৎ কি আছে?

ঋষি দুর্বাসা প্রীতস্বরে আবার বলেন—প্রয়োজন আছে পৃথা। আজ না হোক কাল না হোক, কিন্তু বেশি দিন আর নেই, তোমাকে জীবনসঙ্গী বরণ করতে হবে। আশীর্বাদ করি, প্রিয়দর্শিনী পৃথা প্রিয়দর্শন সঙ্গী লাভ করুক।

মানুষের আচরণে কোন না কোন ত্রুটি দেখতে পেয়েই থাকেন দুর্বাসা। সে ত্রুটি সহ্য করতে পারেন না দুর্বাসা। অসুখী হন এবং অভিশাপ দিয়ে থাকেন। সংসারের রীতিনীতির কোন দুর্বলতাকে ক্ষমার চক্ষু দিয়ে দেখতে পারেন না দুর্বাসা, কারণ সাংসারিকতার জন্য কোন মমতাও তাঁর নেই।

কিন্তু এতদিন কুন্তীভোজের আলয়ে থেকে একটি দিনের জন্যও অসুখী বোধ করেননি ঋষি দুর্বাসা। কুমারী পৃথা অহর্নিশ অতিথি দুর্বাসার সেবা করেছে। পৃথার আচরণে কোন ত্রুটি দেখতে পাননি দুর্বাসা।

মানুষের সামান্য ক্রটিতে ঋষি দুর্বাসা ক্ষুব্ধ হন বড় বেশি এবং তাঁর অভিশাপও হয় মাত্রাছাড়া। কিন্তু জীবনে আজ এই প্রথম প্রীত হয়েছেন দুর্বাসা, তাই পৃথাকে আশীর্বাদ করছেন। জীবনে বোধ হয় মানুষকে এই প্রথম আশীর্বাদ করলেন দুর্বাসা।

এই আশীর্বাদের অর্থ বুঝতে পারে না পৃথা। কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে পৃথা—সে প্রিয়দর্শন কোথায় আছেন ঋষি?

দুর্বাসা—তোমার মনে। মন যাকে চাইবে, তাকেই আহ্বান করো।

চলে গেলেন বিপ্রর্ষি দুর্বাসা। যাবার আগে এক কুমারী কিশোরিকার মনে কি মন্ত্র তিনি দিয়ে গেলেন, তার পরিণাম কি হতে পারে, দুর্বাসার পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। কারণ, তিনি সংসার ও সমাজকে দূর থেকে দেখেছেন। তাঁর অভিশাপ যেমন মাত্রাছাড়া, আশীর্বাদ বা বরদানও তেমনি মাত্রাছাড়া। মন যাকে চাইবে তাকেই জীবনে আহ্বান করা, এত বড় ইচ্ছা-বিলাসের মন্ত্র পার্থিব দুর্বলতা দিয়ে রচিত মানুষের সমাজ সহ্য করতে পারে কি না, সেটুকুও বিচার করলেন না, এবং কুমারী পৃথা এই মন্ত্রের কি অর্থ বুঝল, তাও জানবার প্রয়োজন বোধ করলেন না দুর্বাসা।

বিস্মিত কুন্তীভোজ শুধু জেনে সুখী হলেন যে, দুর্বাসার মত রোষপ্রবণ ঋষি প্রসন্নচিত্তে পৃথাকে আশীর্বাদ করে বিদায় নিয়েছেন; পৃথা জেনে সুখী হলো, তারই কৃতিত্বের গুণে দুর্বাসা তুষ্ট হয়েছেন, পিতার সম্মান রক্ষা পেয়েছে। এই আনন্দে পিতা কুন্তীভোজের আলয়ে লীলাচঞ্চল কুরঙ্গীর জীবনের মত কিশোরিকা পৃথারও জীবনের মুহূর্তগুলি চাঞ্চল্যে লীলায়িত হতে থাকে।

এই চঞ্চলতা ধীরে ধীরে তার নিজেরই অগোচরে কবে যৌবনভারে মন্দীভূত হয়ে এসেছে, নিজেই অনুভব করতে পারেনি পৃথা। শুধু সরোবরনীরে মৃদুকম্পিত প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে চকিতপ্রেক্ষণা পৃথা তার মনের নিভৃতে অভিনব এক বেদনা অনুভব করে। মনে হয়, এই পৃথিবীর আলোছায়ার খেলা শুধুই খেলা নয়, যেন এক সুন্দরের অন্বেষণ। এই শিশির রৌদ্র জ্যোৎস্না, তৃণ পুষ্প লতা, কেউ যেন একা পড়ে থাকতে চায় না। জগতে যেন শব্দ বর্ণ ও সৌরভ শিহরিত ক’রে জীবনের সঙ্গী অন্বেষণের এক অহরহ খেলা চলেছে। নিজের দেহের দিকে তাকিয়ে আরও বিস্মিত হয় পৃথা। মনের গভীরে যেন এক স্বপ্ন নীহারনদের মত ঘুমিয়ে ছিল, সেই স্বপ্ন আজ তার শোণিতের উত্তাপে তরলিত স্রোতের মত জেগে উঠে সারা অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। কেন, কিসের জন্য?

জীবনে এই প্রথম ভাবনার ভার অনুভব করে পৃথা। নিজেরই নিঃশ্বাসের শব্দে অকারণে চমকে ওঠে। নিশীথসমীরণের মৃদুলতাও উপদ্রব বলে মনে হয়, সুখতন্দ্রা ভেঙে যায়। আকাশের তারার মত রাত জাগে পৃথা। ভোর হয়।

সেদিনও ভোর হলো, তখনও নভঃপটের শেষ তারকা বিদায় নেয়নি, প্রাচীমূলে ঊষারাগ যেন প্রথম লজ্জায় কুণ্ঠিত হয়ে আছে। তেমনই নিজ দেহের প্রথম লজ্জায় পুষ্পবতী পৃথা ছায়াচ্ছন্ন নিশান্তের মুহূর্ত শেষ হবার আগেই উদ্যান-সরোবরের জলে স্নান সমাপন করে।

পূর্ব গগনের দিকে একবার নয়নসম্পাত করতেই মনে হয় পৃথার, যেন নবোদিত দিবাকরের মত রশ্মিমান এক দিব্যকায় পুরুষপ্রবর তরুবীথিকার মধ্যে দাঁড়িয়ে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। কি নয়নাভিরাম মুখচ্ছবি! তারুণ্যে মণ্ডিত এক প্রিয়দর্শন। ঐ চিবুক যেন ঊষালোকে জাগ্রত সমস্ত সংসারের চুম্বনে রঞ্জিত হয়ে রয়েছে। ওষ্ঠাধরে সমুদ্রের কামনা স্পন্দিত, নয়ন আকাশের নীলিমায় প্লাবিত।

কে ইনি? প্রশ্ন মনে জাগলেও তার পরিচয় অনুমান করতে পারে না পৃথা। এক প্রিয়দর্শন বিস্ময় যেন আজিকার প্রভাতে পৃথার হৃদয়কুটিরের সম্মুখপথে ক্ষণিকের জন্য এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আর কতক্ষণ? হয়তো এখনি চলে যাবে, এই ভূলোকের অপার রহস্যের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাবে ঐ রূপ।

মন চায় একবার কাছে ডাকি, কিন্তু লজ্জা বলে—ডেকো না। চক্ষু চায় অনেকক্ষণ দেখি, কিন্তু ভয় বলে—দেখো না। এই অদ্ভুত লজ্জা ও ভয়ের মধ্যেও যেন রহস্যময় এক মধুরতা লুকিয়ে আছে। এই লজ্জা রাখতে ইচ্ছা করে, ভাঙতেও ইচ্ছা করে।

অকস্মাৎ, যেন এক খরকিরণের স্পর্শে পৃথার নয়ন-মনের সকল কুণ্ঠা দীপ্ত হয়ে ওঠে। সুগীত মন্ত্রের মত এক আশীর্বাণীর ধ্বনি যেন পৃথার অন্তরে হর্ষের কল্লোল জাগিয়ে তুলেছে। মনে পড়েছে ঋষি দুর্বাসার উপদেশ।

মন যাকে চায় তাকেই তো আহ্বান করতে হবে, এই প্রগলভ মুহূর্তে দুর্বাসার উপদেশ সবচেয়ে বড় সত্য বলে মনে হয় পৃথার। হোক না অপরিচিত, এই তো জীবনের প্রথম প্রিয়দর্শন, মণিদীপ্ত কুণ্ডলে আর রত্নখচিত কবচে শোভিত এক নয়নমোহন তনুধর।

যেন এক কৌতূহলের খেলার আবেগে সব ভয় ও লজ্জা সরিয়ে কুমারী পৃথা তার জীবনের প্রথম প্রিয়দর্শনের প্রতি আহ্বান জানায়।—এস।

সে আসে, সম্মুখে দাঁড়ায়, অংশুপুঞ্জে রচিত সেই যৌবনবান অপরিচিতের বদনপ্রভার দিকে বিস্ময়ভরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে পৃথা। তার পর প্রশ্ন করে—কে আপনি?

—আমি দেবসমাজের ভাস্কর। তুমি কে?

—আমি মর্ত্যের মেয়ে পৃথা, কুন্তীভোজের কন্যা।

—কাছে ডেকেছ কেন?

—ইচ্ছা হলো।

—কেন ইচ্ছা হলো?

—কাছে ডাকবার জন্য।

পৃথার কথায় ভাস্করের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ইচ্ছার অর্থ জানে না, ইচ্ছার অর্থ বলতে পারে না, অথচ ইচ্ছার হাতেই আপন সত্তাকে সঁপে দিয়ে ফেলেছে নবোদ্ভিন্নযৌবনা এই মর্ত্যকুমারী। শুক্তির তৃষ্ণা যদি স্বাতীসলিলের হর্ষ নিকটে আহ্বান করে, জলকুমুদিনীর আকুলতা যদি পূর্ণ শশধরের রশ্মিধারা নিকটে আহ্বান করে, এলালতা যদি চন্দনতরুকে কাছে ডাকে, পরাগবিধুরা পদ্মিনী যদি মত্ত ভ্রমরের সান্নিধ্য আহ্বান করে, তবে তার কি পরিণাম হতে পারে, কল্পনা করতে পারেনি পৃথা। তবু আহ্বান করেছে পৃথা।

ভাস্করের স্মিতমুখের বিচ্ছুরিত মায়া অপার্থিব আলোকের মালিকার মত পৃথার চেতনার চারিদিকে এক মেখলা সৃষ্টি করে, তারই মধ্যে যেন এক রমণীয় মূর্ছায় অভিভূত হয় পৃথার সব কৌতূহল আর আগ্রহ। প্রতিদিনের নিয়ম থেকে কতগুলি মুহূর্ত হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে সমাজ ও সংসারের অগোচরে এক গোপনমিলনের লগ্ন রচনা করে।

ভাস্কর বলে—চপলকিশোরিকা, তুমি যে আমাকে কাছে ডেকেছ, তার অর্থ তুমি জান না কিন্তু আমি জানি।

মুহূর্তের জন্য সন্ত্রস্ত হয় পৃথা—আপনি এইবার চলে যান দেব ভাস্কর, আমার দেখা হয়ে গিয়েছে।

—কি?

—দেখেছি আপনি প্রিয়দর্শন। মন চেয়েছিল আপনাকে কাছে ডাকি। কাছে ডেকেছি, আপনি কাছে এসেছেন, আমার কৌতূহল মিটে গিয়েছে।

—কিন্তু আমার নয়নের পিপাসা মিটে যায়নি, পৃথা।

সুভীরু বাসনার শিহরের মত যেন এক অবশ ও অসহায় আপত্তির ভাষা পৃথার আবেদনে শিহরিত হয়—মা করুন, চলে যান ভাস্কর।

—চলে যেতে পারি না, প্রিয়দর্শিনী।

দক্ষিণ বাহু প্রসারিত ক’রে নিবিড় সমাদরে পৃথার চিবুক স্পর্শ করে ভাস্কর। দক্ষিণসমীর চঞ্চল হয়, পুঞ্জ পুঞ্জ লবঙ্গকেশর সৌরভ ছড়িয়ে উড়ে যায়। ক্রৌঞ্চনিনাদিত সরোবরতট অকস্মাৎ নিস্তব্ধ হয়। ভাস্করের আলিঙ্গনে সমর্পিততনু কুমারী পৃথার সত্তা এক পরম স্পর্শমহোৎসবে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।

ভাস্কর বিদায় নিয়ে চলে যান।

রাজা কুন্তীভোজের আলয়ে আর একটি প্রভাতবেলা। কর্ণে নবকর্ণিকার, নয়নে কৃষ্ণাঞ্জন, কালাগুরুধূপিত কেশস্তবকে কবরীচ্ছন্দ রচনা করছিল কুমারী পৃথা। পৃথাকে দেখতে পেয়ে সহাস্যমুখে সম্মুখে এসে দাঁড়ায় ধাত্রেয়িকা।

পৃথা বলে—স্বপ্নের অর্থ বলতে পার, ধাত্রেয়িকা?

ধাত্ৰেয়িকা—পারি।

পৃথা—অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছি কিন্তু তার অর্থ বুঝতে পারছি না।

ধাত্রেয়িকা—বল, কি স্বপ্ন দেখেছ?

পৃথা—দেখলাম, রাত্রির আকাশ থেকে প্রতিপদের চন্দ্রলেখা এসে আমার বুকের ভিতর মিলিয়ে গেল। জেগে উঠেও কেমন ভার ভার মনে হচ্ছে, যেন সে আমার বুকের ভিতরেই রয়েছে, আর প্রতিমুহূর্তে বড় হয়ে উঠছে।

ধাত্রেয়িকার হাস্যময় মুখে সংশয়ের বিষণ্ণ ছায়া পড়ে। পৃথার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর আতঙ্কিতের মত চমকে ওঠে—এ কি পৃথা?

পৃথা বিরক্তিভরে বলে—কি হয়েছে?

ধাত্রেমিকা—গোপনে কাকে বরণ করেছ, বল?

পৃথা—দেব ভাস্করকে।

ধাত্রেয়িকা অসহায়ভাবে আক্ষেপ করে—মন্দভাগিনী কন্যা, কোন্ এক অধম প্রণয়ীর ছলনায় ভুলে নিজের সর্বনাশ করে বসে আছ।

পৃথা—তাঁর নিন্দা করো না, ধাত্রেয়িকা। মন যাকে চেয়েছে, তাকেই বরণ করেছি কোন ভুল করিনি।

—এই মন্ত্র কোথায় শিখলে পৃথা?

—তোমার চেয়ে যিনি শতগুণে জ্ঞানী, তাঁর কাছে শিখেছি।

—কে তিনি?

—বিপ্রর্ষি দুর্বাসা। তিনি আমাকে আশীর্বাদ করে এই মন্ত্র দিয়ে গিয়েছেন।

—বড় ভয়ানক মন্ত্র পৃথা। তুমি ভুল বুঝেছ। মানুষের সমাজ এই মন্ত্র সহ্য করতে পারে না। তুমি কুমারী অনূঢ়া অসীমন্তিনী, নিজের ইচ্ছায় অথবা গোপনে কিংবা মন যাকে চায় তাকে আত্মদান করে সন্তানবতী হওয়ার অধিকার তোমার নেই।

—কেন?

—তুমি গোপনের প্রাণী নও পৃথা, তুমি সমাজের মেয়ে। তোমার জন্মমুহূর্তে শঙ্খধ্বনি হয়েছে, সংসারকে সাক্ষী করবার জন্য। তুমি প্রথম অন্ন গ্রহণ করেছ মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে, সংসারকে সাক্ষী রেখে। সকলের সাক্ষ্যে, সবাকার স্নেহ ও আশীর্বাদের স্বীকৃতিরূপে তুমি বড় হয়ে উঠেছ। তোমার ভাল-লাগা ভাল-বাসা ও প্রিয়-সহবাস, সবই যে সংসারের আশীর্বাদ নিয়ে সার্থক করতে হবে, সংসারকে গোপন করে নয়।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে ধাত্রেয়িকা, তারপর শোকার্তের মত ক্রন্দনের সুরে বলে—কিন্তু এ কি ভয়ংকর ভুল করেছ। সে আশীর্বাদের অপেক্ষা না ক’রে স্বেচ্ছায় ও গোপনে নির্বোধের মত এক খেলার আবেগে তোমার কুমারী জীবনের সম্মান, পিতার সম্মান, নিজ সম্মান নাশ করে দিলে!

পৃথা—এত ধিক্কার দিও না। আমার ভালবাসার সত্যকেও অসম্মান করবার অধিকার কারও নেই। তবে আমি যখন তোমাদের ঘরের মেয়ে, তখন তোমাদের ঘরের সম্মান একটুও মলিন হতে দেব না।

ধাত্রেয়িকা রূঢ় অথচ বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করে—কি করে?

পৃথা—আমার গোপন প্রণয়ের পরিণাম আমিই গোপনে ভাসিয়ে দেব।

ধাত্রেয়িকা—কি বললে পৃথা?

পৃথা—কুমারীর কোলে আসুক না সেই সন্তান, তার জন্য আমার মনে কোন উদ্বেগ নেই। কেউ জানতে পারবে না তার পরিচয়।

ধাত্রেয়িকা—কেমন করে?

পৃথা—তাকে শুধু পরিচয়হীন করে এই পৃথিবীর কোলে ছেড়ে দেব। এই পৃথিবীর কোন না কোন ঘরে নতুন পরিচয়ে নিয়ে সে বেঁচে থাকবে। তার জন্য আমার একটুকু দুঃখ হবে না।

ধাত্রেয়িকা ভ্রূকুটি ক’রে ওঠে—সে কাজ কি এতই সহজ পৃথা? তাও কি গোপন প্রণয়ের মত একটা খেলা?

ধাত্রেয়িকা আর কিছু বলতে পারে না। পৃথাও কোন উত্তর দেয় না। হয়তো খেলাই মনে করে পৃথ। প্রিয়সঙ্গীর সাথে খেলার আনন্দে বনতলে কুড়িয়ে পাওয়া একটি ফুলের কুঁড়িকে শুধু ইচ্ছা করে হারিয়ে ফেলতে হবে। এর চেয়ে বেশি কঠিন কিছু নয়। এর চেয়ে বেশি দুঃখের কিছু নয়। ধাত্ৰেয়িকার এত বড় ভ্রূকুটির কোন অর্থ হয় না।

রাত্রিশেষের অন্ধকার। শুকতারার আলোক। কুন্তীভোজের প্রাসাদ হতে বহু দূর। নদীর কিনারায় জলপদ্মের বন। জলের উপর ক্ষুদ্র একটি নৌকা। নৌকার ভিতরে অনাবৃত একটি পেটিকা। পেটিকার মধ্যে ঘুমন্ত কুসুমকোরকের মত সদ্যোজাত এক শিশুর ঘুমন্ত মুখের কাছে মুখ নামিয়ে দেখতে থাকে পৃথা। একটি ক্ষুদ্র হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ শোনা যায়, ক্ষুদ্র ছন্দে স্পন্দিত ছোট ছোট শ্বাসবায়ুর মৃদু উত্তাপ পৃথার মুখে এসে লাগে।

নদীর তরঙ্গস্রোতে কলরোল জাগে। তটরজ্জু ছিন্ন ক’রে এই মুহূর্তে এই নৌকা ভাসিয়ে দিতে হবে। রজ্জু ছিন্ন করবার জন্য হাত তোলে ধাত্ৰেয়িকা। আর্তনাদ ক’রে ধাত্রেয়িকার হাত চেপে ধরে পৃথা। ধাত্রেয়িকা ভ্রূকুটি করে—এ কি?

পৃথা—এ কি সর্বনাশ করছ, ধাত্ৰেয়িকা!

ধাত্ৰেয়িকার মুখে শ্লেষাক্ত হাসির রেখা ফুটে ওঠে।—তোমার গোপন প্রেমের পরিণাম গোপনে ভাসিয়ে দিচ্ছি, এর জন্য আবার আর্তনাদ কেন পৃথা?

ধাত্রেয়িকার হাত আরও কঠিন আগ্রহে চেপে ধরে রাখে পৃথা, নইলে তার বক্ষঃপর যেন বিদীর্ণ হয়ে যাবে।

করুণ হয়ে ওঠে ধাত্ৰেয়িকার মুখ। সান্ত্বনার স্বরে বলে—দুঃখ করো না, তোমার গোপনের কলঙ্ক এইভাবে গোপনে ভাসিয়ে না দিয়ে তো উপায় নেই।

কলঙ্ক? পৃথার যৌবনের শোণিতে প্রথম মধুরতার পুলকে স্ফুটিত করুণার এক রক্তকমল, যার স্পর্শে পীযূষধন্য হয়েছে পৃথার কুমারীদেহ, সে কি আজ এইভাবে ভেসে চলে যাবে লক্ষ্যহীন ভবিষ্যতে, এই অন্ধকারে, তরঙ্গের ক্রীড়নকের মত দূর হতে দূরান্তরে? এই তো জীবনের প্রথম প্রিয়দর্শন, মন যাকে কাছে চায় সে তো এই, যাকে বিদায় দিতে পৃথার ইহকালের সমস্ত অদৃষ্ট কেঁদে উঠেছে।

পৃথা বলে—কলঙ্ক বলো না, ও আমার সন্তান।

দুর্দম ক্রন্দনের উচ্ছ্বাস রোধ করে পৃথা। কিন্তু রোধ করতে পারে না দুর্বার এক স্পৃহা। দুর্বহ বেদনারসভারে বিহ্বল বক্ষের কলিকা নিদ্রিত শিশুর স্পন্দিত অধরে অর্পণ করবার জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠে পৃথা। বাধা দেয় ধাত্রেয়িকা!—না, কাছে যেও না। শান্ত হও।

শান্ত হয় পৃথা।

ধাত্রেয়িকার চক্ষু বাষ্পায়িত হয়ে ওঠে। দেখতে পেয়েছে, আর দেখে বিস্মিত হয়েছে ধাত্ৰেয়িকা, এতদিনে যেন পৃথা তার নারীজীবনের ইচ্ছার অর্থটুকু বুঝতে পেরেছে। প্রগল্ভা কৌতুকিনী নয়, আজ নিশান্তের অন্ধকারে বসে আছে এক মমতার মাতৃকা, যার শূন্যবক্ষের যাতনা অশ্রুস্রোত হয়ে জলপদ্মের বনে ঝরে পড়ছে।

অনেকক্ষণ নিঃশব্দে বসে থাকে পৃথা। তারপর যেন উৎকর্ণ হয়ে দূরান্তের জলরোলের মূৰ্ছনা শুনতে থাকে।

—শুনতে পাচ্ছ, ধাত্রেয়িকা?

পৃথার প্রশ্নে ধাত্ৰেয়িকা বিস্মিত হয়—কি পৃথা?

পৃথা—নূপুরের শব্দ। এই পৃথিবীর কোন মানুষের ঘরের আঙিনায় ক্রীড়াচঞ্চল এক শিশুর ছুটাছুটি, তার পায়ের ছোট ছোট নূপুরের ঝংকারে সে আঙিনার বাতাস মধুর হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে তো আমার ঘরের আঙিনা নয়।

ধাত্রেয়িকা উত্তর দেয় না।

দূরান্তের ঘন অন্ধকারের দিকে স্থিরদৃষ্টি তুলে কি-যেন দেখতে থাকে পৃথা। ধাত্রেয়িকা বলে—অমন করে কি দেখছ পৃথা?

পৃথা—দেখছি, এই পৃথিবীর কোন গৃহে, প্রাসাদে কিংবা কুটীরে, এক নারীর কোলে পরিচয়হীন এক শিশুর কোমল কণ্ঠের কলস্বরে মাতৃসম্বোধন ধ্বনিত হয়ে চলেছে। সে মাতা কিন্তু আমি নই।

পৃথার মুখের দিকে অপলক হয়ে তাকিয়ে থাকে ব্যথিতা ধাত্রেয়িকার দুই বাষ্পায়িত চক্ষু। হঠাৎ চমকে ওঠে পৃথা। ধাত্রেয়িকা ভয়ার্ত স্বরে বলে, কি হলো পৃথা?

পৃথা—উৎসবের শঙ্খ বাজছে, ধাত্রেয়িকা। এখান থেকে বহু দূরে, বহু বৎসর পরে, এই রাত্রি যেন ভোর হয়ে গিয়েছে। সুন্দরতনু এক যুবক বরবেশে চন্দ্রমুখী বধূ সঙ্গে নিয়ে মঙ্গলকলসে সজ্জিত এক ভবনের দ্বারে এসে দাঁড়িয়েছে। ধান্যদূর্বা হাতে নিয়ে এক মাতা এসে বরবধূকে আশীর্বাদ করছে। পুত্র নত হয়ে মাতার পদধূলি নিয়ে শিরে ধারণ করছে। সুন্দর হাস্যে প্রসন্ন হয়ে উঠেছে মাতার আনন। সে মাতাও কিন্তু আমি নই।

পৃথার সজল দৃষ্টি কিছুক্ষণের মত যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মনে হয়। ধাত্রেয়িকা অনুযোগের সুরে বলে—এখনও দূরের দিকে তাকিয়ে বৃথা আর কি দেখছ, পৃথা?

পৃথা বলে—দেখছি ধাত্রেয়িকা, দীপাবলীর শোভা জেগেছে এক নগরে। উৎসবের হর্ষে আকুল পথজনতার মাঝখান দিয়ে কে আসছে দেখ। তেজোদৃপ্ত এক শত্ৰুঞ্জয় বীর রণযাত্রা সমাপ্ত করে ঘরে ফিরে আসছে। পুত্রগর্বে গরীয়সী মাতা এসে সেই বীর পুত্রের ললাটে জয়তিলক এঁকে দিলেন। সে বীরমাতা কিন্তু আমি নই।

নীরব হয় পৃথা। নিস্তব্ধ অন্ধকারের বাতাস হঠাৎ বীতনিদ্র বিহগের রবে সাড়া দিয়ে শিউরে ওঠে। ধাত্রেয়িকা ব্যস্তভাবে বলে—ভোর হয়ে এল পৃথা।

ধাত্রেয়িকার হাত ছেড়ে দিয়ে পৃথা নিজেরই দুই চক্ষু দুই হাতে আবৃত করে। নৌকার রজ্জু ছিন্ন করে ধাত্রেয়িকা। এক পরিচয়হীন শিশুর জীবনস্পন্দন বহন করে একটি তরণী নিশান্তের নদীস্রোতে দূরান্তরে চলে যায়।

ধাত্রেয়িকার ছায়া অনুসরণ করে অবসন্ন দেহ নিয়ে ধীরে ধীরে রাজপ্রাসাদের দিকে ফিরে যেতে থাকে পৃথা। পূর্ব দিগন্তে তখন নবারুণের উদয়চ্ছটা নয়নহরণ শোভা ছড়িয়ে দিয়েছে। পৃথা মুহূর্তের মত সেদিকে একবার শুধু তাকিয়ে যেন অভিমানভরে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এই তো সেই ভয়ংকর ভুলের সুন্দর লগ্ন, যে লগ্নে মন যাকে চায় তাকেই গোপনে কাছে ডেকেছিল পৃথা। তারই পরিণাম এই নিঃশব্দ ক্রন্দনের ভার, চিরজীবন গোপনে বহন ক’রে ফিরতে হবে, অতি সাবধানে, যেন কেউ শুনতে না পায়।

পৃথা বলে—বুঝতে পেরেছি, ধাত্রেয়িকা।

ধাত্রেয়িকা—কি?

পৃথা—ঋষি দুর্বাসা আমাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *