অগ্নি ও স্বাহা

অগ্নি ও স্বাহা

সপ্তর্ষির আলয় থেকে যজ্ঞের নিমন্ত্রণ এসেছে, আশ্রমকুটিরের দ্বার বন্ধ ক’রে অগ্নি যাত্রা করলেন।

নবোষার আলোক মাত্র স্ফুরিত হয়েছে, রক্তাধরা পূর্বদিগবধূর রাগময় চুম্বনে গগনকপোল রঞ্জিত হয়েছে। সেই প্রথমজাগ্রত প্রহরের স্নিগ্ধতার মধ্যে মনের আনন্দে একাকী পথ ধরে চলেছিলেন অগ্নি। শ্যাম বনভূমির উপান্ত পার হয়ে এক স্রোতস্বতীর কাছে এসে থামলেন। গন্ধপাষাণের উপর দিয়ে ক্ষুদ্র জলধারা সলজ্জকলহর্ষে পুন্নাগকেশরের পুঞ্জ পুঞ্জ উপহার ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। এই জলধারার ওপারেই চৈত্ররথ কানন, তারপর শিলাজতু ও স্ফটিকে আকীর্ণ এক কৃষ্ণশৈলস্থলী, তারই শীর্ষে নভঃপুরীর মত সপ্তর্ষির আলয়।

স্রোতস্বতীর কাছে দাঁড়িয়ে দূরে সপ্তর্ষিভবনের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন অগ্নি। কিন্তু নিকটেই বনচ্ছায়ার সঙ্গে যে মেঘবর্ণ প্রস্তরে রচিত একটি ভবনে শান্ত প্রতিচ্ছবি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার কথা একবারও মনে পড়ে না।

কিন্তু সবই জানেন অগ্নি। এই মেঘবর্ণ ভবনের অভ্যন্তরে মণিময় দীপিকার মত রূপরম্যা কুমারীর হৃদয় অনুরাগের আলোতে ভরে রয়েছে, কিসের জন্য এবং কা’র জন্য? এই পথেই তো কতবার এসে দেখা দিয়ে গিয়েছে সেই নারী। পদ্মপত্রে লেখা তার লিপিকা এই পথেই কতবার কুড়িয়ে পেয়েছেন অগ্নি। মুঞ্জ তৃণে আস্তীর্ণ এই সুকোমল পথতলে কতবার এসে অগ্নির পথরোধ ক’রে দাঁড়িয়েছে সে, তার আবেদন অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে কতবার। অগ্নিকে ভালবেসেছে ঐ মেঘবর্ণ দক্ষভবনের মেয়ে স্বাহা।

কিন্তু ভালবাসতে পারেননি অগ্নি। স্বাহা যেন অগ্নির অবাধ আগ্রহের জীবনকে স্তব্ধ ক’রে দিতে চায়। অগ্নির জীবনকে এই বৃহৎ জগতের সহস্র আনন্দের বৈচিত্র্য থেকে বঞ্চিত ক’রে যেন ঊর্ণতন্তু দিয়ে পরিবৃত একটি ক্ষুদ্র বৃত্তের মধ্যে বন্দী ক’রে রাখতে চায়, অগ্নি তাই মনে করেন। স্বাহার আহ্বান শুধু পিছনের আহ্বানের মত একটা বাধা বলে মনে হয়েছে অগ্নির। তাই আজ এত নিকটে দাঁড়িয়েও মেঘবর্ণ ভবনের দিকে এবার চোখ তুলে তাকাতেও ভুলে যান অগ্নি।

সেই প্রভাতী নীরবতার মধ্যে গন্ধপাষাণের উপর প্রবাহিত ক্ষুদ্র জলধারা পার হবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলেন অগ্নি, কিন্তু হঠাৎ চমকে ওঠেন আর উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কা’র মৃদুসঞ্চারিত পদধ্বনির ছন্দে তৃণময় পথতল যেন স্পন্দিত হয়ে উঠেছে। তারপরেই দেখলেন অগ্নি, চৈত্ররথ কাননের মৃগ নয়, মেঘবর্ণ ভবনের অন্তর্লোক থেকে সেই মৃগনয়নী যেন এক দুঃস্বপ্ন দেখে হঠাৎ জাগ্রত হয়ে এই পথে ছুটে চলে এসেছে। অপ্রসন্ন হয়ে তাকিয়ে থাকেন অগ্নি। দক্ষের কন্যা স্বাহা এসে অগ্নির পথরোধ ক’রে দাঁড়ায়।

কুমারী স্বাহার কপালের উপর একটি কস্তুরীতিলক, শেষরাত্রির তারকার মত শয়নঘোরে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, কিন্তু একেবারে মুছে যায়নি। এছাড়া আর কোন প্রসাধন ও আভরণ নেই স্বাহার। যেন বলতে চায় স্বাহা, ভালবাসার বিনিময়ে ভালবাসা পেল না যে, তার আর প্রসাধনের কিবা প্রয়োজন? তারও অন্তর যে বৈধব্যের মত এক আঘাতের বেদনায় ভরে আছে। মিথ্যা তার কনককেয়ূর, বৃথা তার মঞ্জুমঞ্জীর আর ক্বণৎকাঞ্চীদাম।

এই পথেরই এক পত্রচ্ছদ তরুতলে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষার যত ব্যাকুল মুহূর্তের মধ্যে একদিন এই সত্য বুঝেছিল স্বাহা, অগ্নিকে সে ভালবেসে ফেলেছে। সেই অনুরাগের প্রতীক এই কস্তুরীতিলক। জীবনের প্রথম প্রেমবিচলিত কামনার স্মৃতিচিহ্ন এই কস্তুরীতিলক। আশ্ৰমচারী ঐ সুন্দর পাবকের কাছে সেই দিন দক্ষদুহিতা স্বাহা তার জীবন ও যৌবনের আশা নিজমুখে নিবেদন করেছিল।

তারপর এক সায়াহ্নে এই পথ থেকেই ব্যর্থ আবেদনের বেদনা নিয়ে ফিরে গিয়েছিল স্বাহা। জেনে গিয়েছিল স্বাহা, অগ্নি তাকে ভালবাসে না। বুঝেছিল স্বাহা, তার সীমন্তের শূন্য সরণি কোনদিন সিন্দূর-বিন্দুর রক্তিমায় শোভিত হবে না। তবে আর কাজ কি এই কেয়ূরে মঞ্জীরে ও কাঞ্চীদামে?

তবু আজও আবার ছুটে এসেছে স্বাহা। বৈধব্যের চেয়ে বোধহয় ভালবাসার অপমানে বেশি জ্বালা আছে। প্রেমিকের মৃত্যুর চেয়ে বুঝি বেশি দুঃসহ প্রেমের মৃত্যু, প্রেমিকের কাছে!

স্বাহা বলে—এমন ক’রেই কি চলে যেতে হয়?

স্বাহার প্রশ্নের উত্তর দেন না অগ্নি। শুধু বিস্মিত হয়ে স্বাহার এই নিরাভরণ মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকেন, যেন স্বেচ্ছায় বনবাসব্রত গ্রহণ ক’রে প্রাসাদবাসিনী এই রূপমতী কুমারী অকারণে তপস্বিনীর মূর্তি ধরেছে।

অগ্নি প্রশ্ন করেন—এ তোমার কি বেশ, স্বাহা?

স্বাহা—এই তো আমার যোগ্য বেশ।

অগ্নি—কেন?

স্বাহা—বুঝতে পারেন না?

অগ্নি—না। রাজপ্রাসাদের কুমারী কেন এত প্রসাধনবিহীনা ও এত নিরাভরণা হয়ে রয়েছে, বুঝতে পারি না।

স্বাহা—ব্যর্থ অনুরাগের জ্বালা অঙ্গরাগের প্রলেপে শান্ত হয় না, অগ্নি। যার জীবনের নয়নানন্দ এমন ক’রে চক্ষুর নিকটপথ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়, তার নয়নে কৃষ্ণাঞ্জন শোভা পায় না। যার কণ্ঠে প্রিয়তমজনের বরমাল্য শোভা পেল না, মণিহার তার গলায় সাজে না।

অগ্নি বিচলিত হন না। বরং প্রতিবাদ ক’রেই বলেন—এ তোমারই ভুল, স্বাহা।

স্বাহা—কিসের ভুল?

অগ্নি—আমাকে ভালবাস কেন? যে রাজকুমারী ইচ্ছা করলেই ত্রিভুবনের যে কোন রত্নবান ও রূপবানের কণ্ঠে বরমাল্য অর্পণ করতে পারে…।

হেসে ফেলে স্বাহা—সে ইচ্ছাই যে হয় না।

অগ্নি—কেন?

স্বাহা—মনে হয়, ভালবাসা মধুপের ফুলবিলাস নয়। এক হতে অন্য জন, নিত্য নব অভিসার আর বল্লভসন্ধান নারীর প্রেমের রীতি নয়, নারীর ধর্মও নয়।

ঈষৎ ভ্রূকুটি করেন অগ্নি—নারীর ধর্ম কি?

স্বাহা—একপুরুষপ্রীতি।

অপ্রসন্ন হয়ে ওঠেন অগ্নি। কি হিংস্র এক ধর্মতত্ত্বের কথা এত শান্তভাবে বলে চলেছে স্বাহা। এক পুরুষের জীবনকে চিরকাল কারাগারের পাষাণপ্রাচীরের মত চারিদিক থেকে শুধু রুদ্ধ ক’রে রাখতে চায় যে ক্ষুদ্র সংকল্প, তারই নাম নারীর প্রেম আর নারীর ধর্ম।

অগ্নি বলেন—অতি অর্থহীন ও অতি অসুন্দর এই নারীর ধর্ম।

স্বাহা বলে—শুধু নারীর ধর্ম কেন, পুরুষের ধর্মও যে তাই।

অগ্নি বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করেন—কি?

স্বাহা—একনারীপ্রীতি।

অগ্নি—এই ধর্মতত্ত্ব তুমিই স্মরণ ক’রে রাখ স্বাহা। আমাকে বুঝতে বলো না।

স্বাহা—কেন?

অগ্নি—জীবনে কোন নারীকে ভালবাসবার প্রয়োজন আমার নেই।

স্বাহা—তাও যে পুরুষধর্ম নয়।

অগ্নি উষ্মা বোধ করেন—আমার ধর্ম আমি জানি।

স্বাহা—আপনার ধর্ম কি স্বতন্ত্র?

অগ্নি—হ্যাঁ।

চুপ ক’রে থাকে স্বাহা, হয়তো তাই সত্য। ভাস্বরতনু এই পাবকের ক্ষুধা তৃষ্ণা ও আনন্দ হয়তো সাধারণের মত নয়। তাই ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে স্বাহার আহ্বান। অন্তরে যার অনলশিখার আকুলতা, মণিময় দীপিকার প্রেম তার কাছে ক্ষীণদ্যুতি বলে মনে হবে বৈকি। দাহিকার জ্বালা পান করবার জন্য যার নয়নে খরতৃষ্ণা স্ফুরিত হয়, প্রেমিকা স্বাহার কম্রনয়নশ্রী তার কাছে মূল্যহীন বলেই তো মনে হবে। বক্ষে যার বেদনা নেই তার কাছে আবেদনের কি কোন অর্থ আছে?

অগ্নি বলেন—আমি যাই।

স্বাহা—কোথায়?

অগ্নি—সপ্তর্ষিভবনে যজ্ঞের নিমন্ত্রণ আছে।

স্বাহা যেন চমকে ওঠে, বেদনার্তস্বরে অনুরোধ করে—যাবেন না অগ্নি।

অগ্নি—কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না স্বাহা, কারণ স্বাহা নিজেই বুঝতে পারে না, কেন চমকে উঠেছে তার মন, কেন শঙ্কিত হয়েছে তার কল্পনা। মনে হয়, অনলশিখার আকুলতা অন্তরে বহন ক’রে অগ্নি যেন চিরকালের মত স্বাহার প্রেমের জগৎ হতে দূরে চলে যাচ্ছেন, আর ফিরবেন না। কিন্তু এই শঙ্কার অর্থও স্পষ্ট ক’রে বুঝতে পারে না স্বাহা।

যুক্তিবুদ্ধিহীনা বিমূঢ়ার মত শুধু অসহায় অশ্রু আরও সজল এবং শঙ্কাকুল স্বর আরও ব্যাকুল ক’রে স্বাহা বলে—যাবেন না। জানি না কেন শুধু মনে হয়, বিপন্ন হবে আপনার…।

ক্ষুব্ধ হয় অগ্নির কণ্ঠস্বর—কি বিপন্ন হবে? আমার প্রাণ?

স্বাহা—না।

অগ্নি—তবে কি?

বলতে ইচ্ছা করে, কিন্তু বলতে পারে না স্বাহা।

কিন্তু স্বাহার উত্তর শুনবার জন্য আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করেন না অগ্নি। চতুরা দক্ষদুহিতা স্বাহা যেন এক কপট ভয় নয়নে চমকিত ক’রে অগ্নির এই শুভযাত্রার আনন্দকে শঙ্কিত করতে চায়। অপাঙ্গে স্বাহার মুখের দিকে তাকিয়ে এবং নীরব ধিক্কার নিক্ষেপ ক’রে চলে যান অগ্নি। ক্ষুদ্র জলধারা পার হয়ে চৈত্ররথ-কাননের পথে অদৃশ্য হয়ে যান।

সপ্তঋষির সমাদরে, সপ্ত ঋষিপত্নীর অভ্যর্থনায়, এবং যজ্ঞে ও উৎসবে অগ্নির জীবনের কয়েকটি দিন হর্ষায়িত হয়েই যেন হঠাৎ শেষ হয়ে যায়। এইবার তাঁকে চলে যেতে হবে। কিন্তু বুঝতে পারেন অগ্নি, চলে যেতে মন চাইছে না।

সপ্তর্ষিভবনের যজ্ঞশালায় ধূমসৌরভ আর ছিল না। উৎসবের প্রদীপও নিভে গিয়েছে। কোন কাজ নেই, উদ্দেশ্য নেই, তবু সপ্তর্ষিভবনেই কালযাপন করেন অগ্নি।

জীবনে এই প্রথম বেদনা বোধ করেছেন অগ্নি। এই প্রথম অনুভব করেছেন, সপ্তর্ষিভবনের কিসের এক মায়া তাঁকে যেন পিছন থেকে ডাকছে আর ধরে রাখছে। তাই চলে যেতে পারছেন না অগ্নি। চিরজীবন এই ভবনের অন্তর্লোক সন্ধান ক’রে সেই মায়ার রহস্যকে উদ্ধার করতে ইচ্ছা করেন অগ্নি।

কিন্তু সে যে নিতান্ত অনধিকার, অতিথি অগ্নির পক্ষে আর এক মুহূর্তও সপ্তর্ষিভবনে থাকবার কোন প্রয়োজন নেই। বিদায়-সম্ভাষণ জানিয়ে গিয়েছেন সপ্তঋষি; মরীচি ও অত্রি, অঙ্গিরা ও পুলস্ত্য, পুলহ ও ক্রতু, এবং বশিষ্ঠ। বিদায়-প্রণাম নিবেদন ক’রে গিয়েছে সপ্ত ঋষিপত্নী; সম্ভূতি ও অনসূয়া, শ্রদ্ধা ও প্রতি, গতি ও সন্নীতি আর অরুন্ধতী। সপ্তসহচরীসেবিত সপ্তঋষির এই নভঃপুরীর অভ্যন্তরে, চন্দ্রতারায় অবকীর্ণ স্নিগ্ধ আলোকের এই সংসারে কিসের আশায় পড়ে থাকতে চান অগ্নি?

নিজেকে প্রশ্ন ক’রেও কোন উত্তর পেলেন না অগ্নি। অশান্ত মনের তাড়না থেকে যেন পালিয়ে যাবার জন্য দ্রুতপদে সপ্তর্ষিভবনের প্রাঙ্গণ পার হয়ে চলে যান। নিস্তব্ধ যজ্ঞশালার দ্বারপ্রান্তে এসে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। পরমুহূর্তে যেন এক স্বপ্নলোক থেকে উৎসারিত কলহাস্যের শব্দ শুনে চমকে ওঠেন।

যজ্ঞশালার পার্শ্বে এক লতাগৃহের অভ্যন্তরে বসে মাল্য রচনা করছিল সপ্ত ঋষিপত্নী। নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে থাকেন অগ্নি, এবং এতক্ষণে বুঝতে পারেন, এই স্বপ্নলোকেরই রূপামৃত পান করবার জন্য অন্তরের অনল তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে। যৌবনবতী সাতটি লীলায়িত অঙ্গশোভা। সাতটি শিথিল নিচোল, সাতটি বিগলিত বেণী ও চঞ্চল সমীরকৌতুকে উদ্বেলিত সাতটি অংশুক বসন। সপ্ততন্বীর হাস্যশিহরিত দেহ যেন সাতটি শিখা, যার বিচ্ছুরিত প্রভা প্রবল দাহিকা হয়ে অগ্নির ধমনীধারায় সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছে। সেই বেদনায় অস্থির হয়ে যজ্ঞশালার দ্বারপ্রান্ত হতে ছুটে চলে যান অগ্নি।

চৈত্ররথ কাননের অভ্যন্তরে এক অনলের তৃষ্ণা ঘুরে বেড়ায়। আশ্রমে ফিরে যেতে পারেননি অগ্নি। ফিরে যেতে ইচ্ছা করে না।

কল্পনায় দেখতে পান অগ্নি, দূর নভঃপুরীর অঙ্গনে এক লতাগৃহের নিভৃতে সাতটি রূপশিখাময়ী দাহিকা। যেন সপ্ত ঋষিপত্নীর তনুচ্ছবি ধ্যান করার জন্য চৈত্ররথ কাননের নিভৃতে নিজেকে নির্বাসিত ক’রে রেখেছেন অগ্নি। এক অসম্ভবের আশায়, অপ্রাপ্যের তপস্যায়, অনন্ত প্রতীক্ষার সংকল্প নিয়ে বসে থাকবেন অগ্নি। এই প্রতীক্ষায় যদি জীবন ফুরিয়ে যায়, ক্ষতি কি?

কি ক্ষতি, কেমন ক’রে বুঝবেন অগ্নি? কি ক্ষতি, সে বুঝবে কি ক’রে, স্নিগ্ধদ্যুতি স্বাহার আহ্বানকে জীবনের বাধা বলে মনে করেছে যে? বুঝবার মত হৃদয় কোথায় তার, সপ্ত ঋষিবধূকে অভিসারিকারূপে দেখবার আশায় চৈত্ররথ কাননের নিভৃতে যার আকাঙ্ক্ষা এক ভয়ংকর প্রতীক্ষার তপস্যায় বসে আছে? নারীকে প্রেমিকারূপে নয়, শুধু দাহিকারূপে লাভ করবার জন্য যে পুরুষের তৃষ্ণা আকুল হয়ে রয়েছে, সে বুঝবে কি করে, ক্ষতি কোথায়?

জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে যার, দক্ষদুহিতা সেই স্বাহাই একদিন শুনতে পায় সংবাদ, চৈত্ররথ কাননের নিভৃতে নিজেকে নির্বাসিত ক’রে রেখেছেন অগ্নি। দূর নভঃপুরীর দিকে তাকিয়ে এক ভয়ংকর প্রতীক্ষার তপস্যায় সেই সুন্দর পাবকের দিনযামিনীর মুহূর্তগুলি দুঃসহ এক দহনলালসার জ্বালা সহ্য ক’রে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারে স্বাহা, তার সেই আশঙ্কাই এতদিনে সত্য হয়েছে। দক্ষের মেঘবর্ণ ভবনের নিভৃতে কুমারী স্বাহার মন বেদনায় ভেঙে পড়ে।

পুরুষধর্ম বোঝে না, নারীর প্রেমের রীতিও বোঝে না এমন মানুষের জীবনে বনবাসের অভিশাপ লাগবে, তা’তে আর আশ্চর্য কি? মমতায় অসাধারণ নয়, প্রীতিতে অসাধারণ নয়, শুধু অনলভরা ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও কামনায় অসাধারণ, এমন মানুষকে সাধারণের সংসার সহ্য করতে পারে না, কোনদিন পারবেও না। এই সত্য উপলব্ধি করবার মত হৃদয় নেই অগ্নির।

অনুরাগিণী স্বাহার কস্তুরীতিলক যার কাছে কোন সম্মান পেল না, একনিষ্ঠার সুন্দর আবেদনকে লাঞ্ছিত ক’রে যে চলে গিয়েছে, তার জীবনের মূঢ়তা আজ বহুলিপ্সার অভিশাপরূপে চরম হয়েই দেখা দিয়েছে। এই পৌরুষ পৌরুষ নয়, এই পরদারকামনা কামনা নয়, এই প্রতীক্ষা প্রণয়ীর প্রতীক্ষা নয়, এ শুধু নিজের অনলে নিজেকে ভস্মীভূত করা, আত্মহত্যারই মত ভয়ানক এই আয়োজন থেকে অগ্নিকে কে নিবৃত্ত করতে পারে?

কেউ নয়, অগ্নিকে এই অভিশপ্ত নির্বাসন থেকে উদ্ধার করবার জন্য এই পৃথিবীর কোন হৃদয়ে কোন উদ্বেগ কৌতূহল ও আগ্রহ নেই, শুধু একটি হৃদয় ছাড়া। সেই হৃদয় আজ থেকে থেকে এক মেঘবর্ণ ভবনের নিভৃতে বেদনায় ভেঙে পড়ে, অসিতনয়নশোভা অশ্রুসজল মেদুরতায় ভরে ওঠে। এই ক্ষতি শুধু স্বাহারই ক্ষতি, আর কারও নয়। এতদিনে যেন প্রেমিকা স্বাহার জীবনে সত্যই এক বৈধব্যের রিক্ততা চরম হতে চলেছে।

কে উদ্ধার করবে অগ্নিকে? সুন্দর পাবকের জীবনের শুচিতাকে এই ভয়ানক কলুষের আক্রমণ থেকে কেমন ক’রে রক্ষা করা যায়? এই প্রশ্ন যেন স্বাহার ভাবনার অন্ধকারে রুদ্ধ স্বপ্নের মত সারাক্ষণ বেদনা সহ্য করতে থাকে।

শক্তি নেই স্বাহার। নিজেরই এই দুর্বলতাকে ক্ষমা করতে পারে না স্বাহা। প্রার্থনা করে স্বাহা—ক্ষমা কর অদৃষ্টের দেবতা, শক্তি দাও হে সকলকালপুরুষ। হরণ কর সকল ভয়, হে ভয়হরণ! কর নিঃসঙ্কোচ, কর নির্লজ্জ, প্রেমিকা স্বাহার জীবনে পরম দুঃসাহসের অভিসার এনে দাও। চৈত্ররথ কাননের কারাগার থেকে সকল অভিশাপের প্রাচীর চূর্ণ ক’রে স্বাহার জীবনবাঞ্ছিতকে উদ্ধার ক’রে আনতে চাই, সেই উদ্ধারের মন্ত্রটুকু বলে দাও এই প্রণয়ভীরু কুমারী স্বাহার কানে কানে, হে পরম দৈব!

প্রতি মুহূর্ত স্বাহার অন্তরে এই আকুল প্রার্থনা যেন নীরবে ধ্বনিত হতে থাকে, সেই অসহায় ভ্রান্তকে উদ্ধার করতে হবে, সংকল্পে অটল হয়ে ওঠে স্বাহার মন। কিন্তু মনের নিকটে কোন উপায় খুঁজে পায় না। মেঘবর্ণ ভবনের চূড়ায় সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনতর হয়ে দেখা দেয়।

নিজেরই মনের পথহীন অন্ধকারের মত বাহিরের ঐ চরাচরব্যাপ্ত অন্ধকারের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে স্বাহা। তার জীবনের স্মিগ্ধজ্যোতি প্রেম যেন এই বিরাট অন্ধকারের করাল নিঃশ্বাসের আঘাতে চিরকালের মত নিভে যেতে চলেছে। প্রেমিকা হয়ে যে সুন্দর পাবককে ভালবেসেছে স্বাহা, পতিরূপে যাকে পেয়ে জীবন ধন্য করতে চেয়েছে স্বাহা, তাকে উদ্ধার ক’রে আনবার মত শক্তি নেই স্বাহার। এই ভীরু প্রেমের দুর্বলতাকে ধিক্কার দেয় স্বাহা।

হঠাৎ জ্বালাময় আলোকের মত অদ্ভুত এক রক্তিম আভায় ভরে ওঠে স্বাহার মুখ। ঐ অন্ধকারের সমুদ্রে বহুদূরে যেন এক বড়বানলের দ্যুতি জ্বলছে, স্বাহার মুখের উপর তারই প্রতিচ্ছায়া পড়েছে।

নিষ্পলক নয়নে দেখতে থাকে স্বাহা, দূর বনগিরিশিরে এক দাবানলের জ্বালালীলা জেগেছে। কোন্ এক প্রেমিকার ব্যর্থ আবেদনের বেদনা যেন দাহিকা হয়ে আর সকল লজ্জা ভয় ও বাধা পুড়িয়ে দিয়ে প্রেমিকের বক্ষের কাছে যাবার জন্য জগতের এই অন্ধকারে পথ সন্ধান ক’রে ফিরছে।

দক্ষতনয়ার দ্যুতিময় দু’টি চক্ষু আরও প্রখর হয়ে জ্বলতে থাকে। যেন উপায় দেখতে পেয়েছে স্বাহা। ব্যস্ত হয় স্বাহা। প্রস্তুত হয় স্বাহা।

সফল হয়েছে আনলের জ্বালাময় তৃষ্ণার প্রতীক্ষা। চৈত্ররথ কাননের পথে দাহিকার অভিসার শুরু হয়েছে। যেন সত্যই অগ্নির কামনাময় স্বপ্নের কথা শুনতে পেয়ে সপ্তর্ষিভবনের হৃদয় থেকে এক একটি রূপের শিখা এসে অগ্নির আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণ করেছে।

অনলশিখ অগ্নির ভয়ংকর প্রতীক্ষা বনপথচারিণী অভিসারিকার মৃদু মঞ্জীরের নিক্বণে নিত্য চমকিত হয়। স্নিগ্ধবেণী, কজ্জলিত আঁখি, রঞ্জিত অধর, কেয়ূরকিঙ্কিণী-কাঞ্চীভূষিতা মনোহরা এক একটি মূর্তি আসে। স্বচ্ছ অংশুকবসনে আবরিত মদালসমন্থর একটি অঙ্গশোভা ঋষিবধূর মূর্তি ধ’রে চৈত্ররথ কাননের নিভৃতে প্রতি রজনীতে আসে আর রভসাকুল উৎসব সৃষ্টি ক’রে চলে যায়। অন্ধ ভৃঙ্গের মত সেই নারীদেহপুষ্পের মধু পান করেন অগ্নি। শুধু দেখতে পান না, সে মূর্তির সকল ছদ্মসজ্জার মধ্যে কপালের উপর একটি কস্তুরীতিলক স্পষ্ট ফুটে রয়েছে।

পরদারকামনার অশুচিতা হতে প্রেমাস্পদের জীবনকে রক্ষা করবার জন্য প্রেমিকা স্বাহার জীবনে বিচিত্র এক কপট অভিসার শুরু হয়েছে। ঋষিবধূর ছদ্মমূর্তি ধ’রে প্রতি রজনীতে চৈত্ররথ কাননের নিভৃতে অনলের কামনা তৃপ্ত করবার জন্য যেন দাহিকার উপটৌকন নিয়ে যায় স্বাহা।

কোথায় ভুল হল, ভাবতে পারে না স্বাহা। সকল লজ্জা কুণ্ঠা ও ভয় মন থেকে মুছে ফেলে এক কপট অভিসারের নায়িকা হয়ে ওঠে। হোক কপট আর কৃত্রিম অভিসার। জীবনে যার বক্ষের স্পর্শ চিরন্তন ক’রে রাখতে চেয়েছে স্বাহা, ছদ্মবেশে চৈত্ররথ বনের এক মেহকুহেলিকার আড়ালে মুখ ঢেকে তারই আলিঙ্গন বরণ করে স্বাহা। কোন অশুচিতা বোধ করে না।

ব্যর্থপ্রেমের বেদনায় ভরা জীবনের এক রঙ্গস্থলীতে যেন নাটকের নায়িকার মত অভিনয় ক’রে চলেছে স্বাহা। এই রঙ্গস্থলীর পথে পথে যে অকৃত্রিম অন্ধকার ছড়িয়ে রয়েছে, তার চেয়ে বাস্তব সত্য আর কিছু নেই; কিন্তু সেই অন্ধকারে যে ঋষিবধূর মূর্তি নিত্য অভিসারে আসে আর চলে যায়, তার চেয়ে মিথ্যা আর কিছু নেই। এইভাবেই এই রঙ্গস্থলীতে অভিসারিকার বেশে একে একে দেখা দিয়েছে ঋষিবধূ অনসূয়া ও সম্ভূতি, শ্রদ্ধা ও প্রীতি, গতি ও সন্নীতি। কিন্তু সব মিথ্যা, সব অলীক, সব কপট। ছয় ঋষিবধূর ছয় মূর্তির মধ্যে লুকিয়ে থাকে শুধু স্বাহা নামে এক প্রেমিকার তনু।

সম্ভূতি, অনসূয়া, শ্রদ্ধা, প্রীতি, গতি ও সন্নীতি—ছয় ঋষিবধূর মূর্তি ধারণ ক’রে, চৈত্ররথ কাননের নিশীথের অন্ধকার চলমঞ্জীরে চঞ্চলিত ক’রে ছদ্মবেশিনী অভিসারিকা স্বাহা অনলের কাছে এসেছে আর চলে গিয়েছে। তৃপ্ত হয়েছে অনলের জীবনের ছয়টি তৃষ্ণার্ত নিশীথ। হৃষ্টমানস অনল তবুও প্রতীক্ষায় রয়েছেন। কারণ, আজও আসেনি ঋষিবধূ অরুন্ধতী। বাকী আছে শুধু একজন, ঋষিবধূ অরুন্ধতী। সপ্তম নিশীথের আকাঙ্ক্ষা তৃপ্ত হলেই সমাপ্ত হবে চৈত্ররথ কাননের নিভৃতে অগ্নির এই প্রতীক্ষার জীবন, সফলকাম ব্ৰতীর মত আনন্দ নিয়ে চলে যেতে পারবেন অগ্নি।

দূরে চৈত্ররথ কাননের রাত্রি শিশিরবাষ্পে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। স্বাহার যাত্রালগ্ন এগিয়ে এসেছে, বশিষ্ঠপ্রিয়া অরুন্ধতীর রূপানুরূপিণী হয়ে ছদ্মসজ্জা ধারণ করেছে স্বাহা।

যাত্রা করে অভিসারিকা স্বাহা। যাত্রা করে এক মিথ্যা অরুন্ধতী। কিন্তু চলতে গিয়েই যেন বাধা পায় স্বাহা।

যা কোনদিন হয়নি, তাই হয়। মনের গভীরে কে যেন প্রতিবাদ ক’রে ওঠে—ভুল করছ স্বাহা।

তবু এগিয়ে যায় স্বাহা। কিন্তু পদমঞ্জীরে সুন্দর ধ্বনি আর বাজে না, গতি ছন্দ হারায়। চকিত বিস্ময়ে পথের উপর থমকে থাকে স্বাহা। মনে হয়, কানে কানে কে যেন হঠাৎ বলে দিয়ে চলে গেল—অন্যায় করছ স্বাহা।

তবু এগিয়ে চলে আর চৈত্ররথ কাননে প্রবেশ করে স্বাহা। পথের কণ্টকগুল্ম যেন পিছন থেকে স্বাহার চেলাঞ্চল টেনে ধরে—অপমান করো না স্বাহা।

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্বাহা। কা’র অপমান? কিসের অন্যায়? কোথায় ভুল? স্বাহার সমস্ত মন দুঃসহ এক শঙ্কায় শিহরিত হতে থাকে।

ভুল ক’রে এক ভয়ানক নির্লজ্জতা দিয়ে জগতের নারীধর্মকেই কি অপমানিত করছে না স্বাহা? তারই দেহমন কি এক অশুচি স্পর্শে কলুষিত হয়ে উঠছে না? বুঝতে পারে না স্বাহা, কেন আজ এই সন্দেহ বার বার প্রশ্ন ক’রে তার অভিসারের দুঃসাহস ছিন্ন ক’রে দিচ্ছে। বনপথের উপরে চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে স্বাহা।

নিজের ছদ্মসজ্জার দিকে তাকিয়ে অকস্মাৎ চমকে ওঠে স্বাহা। এ যে পতিপ্রিয়া অরুন্ধতীর রূপানুরূপিণী এক মূর্তি! এ যে এক শুদ্ধানুরাগিণী পতিব্রতার মূর্তি!

বনপথের উপরে অসহায়ের মত বসে পড়ে স্বাহা। না, আর পারবে না স্বাহা, আর শক্তি নেই স্বাহার, পতিপ্রাণা বশিষ্ঠপ্রিয়া অরুন্ধতীকে অপমান করতে পারবে না স্বাহা। লোকপূজ্যা সেই সতী নারীর কৃত্রিম মূর্তিকে অভিনয়ের ছলেও পরপুরুষের কামনার কাছে সঁপে দিতে পারবে না।

যেন এই ছদ্মবেশের নিবিড় বন্ধনের মধ্যে বন্দিনী হয়ে বসে থাকে স্বাহা। অনুভব করে, এই ছদ্মবেশের স্পর্শ যেন ধীরে ধীরে তার অন্তরের গভীরে বিপুল এক মোহ সঞ্চারিত করছে। এই রীতি প্রেমিকার রীতি নয় স্বাহা! যেন কা’র এক স্নিগ্ধ ধিক্কার শুনে লজ্জিত হয় অভিসারিকার অলজ্জ দুঃসাহস।

কেঁদে ফেলে স্বাহা। এমন করে কোনদিন কাঁদেনি স্বাহা। এত স্পষ্ট ক’রে নিজের ভুল আর ক্ষতিকে কোনদিন বুঝতে পারেনি। তার প্রেমাস্পদ সুন্দর পাবকের জীবনকে শুচিতাময় একপ্রেমের দীক্ষা দিতে পারেনি স্বাহা, বরং ভুল ক’রে বহু ছদ্মরূপে সঙ্গ দান ক’রে প্রেমিকেরই পৌরুষ কলুষিত ক’রে এসেছে। এই রীতি নারীপ্রেমের রীতি নয়, প্রেমাস্পদের প্রতি প্রেমিকার কর্তব্য নয়।

চৈত্ররথ কাননের বনপথের একান্তে এক কৃত্রিম অরুন্ধতীর অন্তর যেন অনুতাপে পুড়তে থাকে। একনিষ্ঠ প্রেমের নারী বশিষ্ঠপ্রিয়া অরুন্ধতীর মত এই রূপসজ্জা, আননের এই চন্দনরোচনা ও হস্তের এই শঙ্খবলয়, থালিকার এই অর্ঘ্যপুষ্প আর ভৃঙ্গারকের এই সলিল যেন আঘাত দিয়ে স্বাহার অন্তরের রূপ বদলে দিয়েছে। ভেঙে দিয়েছে ভুল, স্মরণ করিয়ে দিয়েছে নারীধর্মের রীতি। অভিনয়ের কাছেই আজ হেরে গিয়েছে স্বাহা।

চুপ ক’রে বসে থাকে স্বাহা। চৈত্ররথ কাননের এই অন্ধকার যেন তার সারাজীবনের পথ ভুল ক’রে দিয়েছে। মেঘবর্ণ দক্ষভবনের স্নেহনীড়ে আর ফিরে যাবারও পথ নেই। কারণ, এক শিশুপ্রাণের যে সঞ্চার স্বাহার অন্তর্লোকে এসে গিয়েছে, এই নিভৃতে বক্ষোবেদনার প্রতি স্পন্দনে তারই সাড়া আজ স্পষ্ট ক’রে শুনতে পায় কুমারী স্বাহা। সকল দিক দিয়ে ক্ষতি ও অখ্যাতি এসে আজ পূর্ণ ক’রে তুলেছে কুমারী স্বাহার জীবন।

মধ্যরজনীর ক্ষীণ চন্দ্রলেখা চৈত্ররথ বনের পুষ্প গুল্ম ও লতায় চূর্ণ জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আলোছায়ার মায়া সৃষ্টি করে। মুখ তুলে তাকায়, যেন পালিয়ে যাবার পথ খুঁজছে স্বাহা। রক্ষা করতে পারেনি অগ্নিকে, রক্ষা করতে পারেনি নিজেকে, কিন্তু সব ক্ষতি ও অপমানের অভিশাপ থেকে একটি শিশুজীবনকে মাতার স্নেহ দিয়ে রক্ষা করবার জন্য আজ আরও দূরান্তে সবাকার অগোচর এক নিবিড়তম বনবাসের অন্ধকারে স্বাহাকে চলে যেতে হবে। তারই জন্য যেন পথ খুঁজছে স্বাহার সিক্তচক্ষুর দৃষ্টি।

হঠাৎ চমকে ওঠে স্বাহা। কা’র পদশব্দ? বনেচর মৃগ নয়, মৃগয়াজীব ব্যাধ নয়, তবে কে ঐ অশান্ত? স্বপ্নোদ্‌ভ্রান্তের মত পথ ভুল ক’রে এই দিকে এগিয়ে আসছে?

চিনতে পারে স্বাহা, এবং বনপথের উপর শ্রান্তালস দেহ স্তব্ধ ক’রে নিয়ে অপলক দৃষ্টি তুলে দেখতে থাকে, হ্যাঁ, সে-ই আসছে। মঞ্জীরধ্বনি শুনতে না পেয়ে এক উৎকর্ণ আকুলতা যেন বনপথ ধ’রে কাউকে সন্ধান করবার জন্য এগিয়ে আসছে।

আরও নিকটে এগিয়ে আসে সেই অস্থির পদশব্দ, স্বাহার সম্মুখে এসে ক্ষণিকের মত শান্ত হয়ে দাঁড়ায়। তারপর আগ্রহভরে প্রশ্ন করে—কে তুমি?

স্বাহা—আমি অরুন্ধতী।

অগ্নির কণ্ঠস্বরে ব্যাকুল উল্লাস ধ্বনিত হয়—তুমি অরুন্ধতী!

স্বাহা—হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কে?

অগ্নি—আমি অগ্নি।

স্বাহা—তুমি অভিশাপ। তুমি অশুচি। হীনপৌরুষ প্রেমহীন পারদারিক তুমি। আমার সম্মুখে হতে দূরে সরে যাও।

প্রখর দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থাকেন অগ্নি। বুঝতে চেষ্টা করেন, চৈত্ররথ কাননের আলোছায়ার রহস্যের মধ্যে এ কোন নূতন ছলনা এসে প্রবেশ করেছে?

অরুন্ধতীরূপিণী স্বাহার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন অগ্নি। দুর্বোধ্য এক বিস্ময়ে আহত হয়ে তাঁর দুই চক্ষুর কৌতূহল কাঁপতে থাকে। হঠাৎ চমকে ওঠেন, আর চিৎকার করেন অগ্নি।—স্বাহা!

এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন অগ্নি, কপট অভিসারে ছলিত হয়েছে চৈত্ররথ কানন, ছলিত হয়েছে তাঁর প্রতীক্ষার তপস্যা। মিথ্যা উপহারে ছলিত হয়েছে তাঁর অনলশিখ বক্ষের আগ্রহ। চন্দনরোচনায় ও শঙ্খবলয়ে ভূষিতা এই নারীর কপালে অঙ্কিত ঐ কস্তুরীতিলক স্পষ্ট ক’রেই দেখতে পেয়েছেন অগ্নি। কঠোর স্বরে আবার আহ্বান করেন—স্বাহা!

অগ্নির ক্রুদ্ধ আহ্বান শুনে উঠে দাঁড়ায় স্বাহা।

অগ্নি বলেন—এত বড় ছলনা দিয়ে কেন আমাকে অপমানিত করলে, স্বাহা?

স্বাহা—জানি না কেন করেছি, ভুল করেছি! ক্ষমা করো।

অগ্নি—ক্ষমা হয় না।

স্বাহা—দাও অভিশাপ। শুধু একটি আশীর্বাদ করো…।

বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন অগ্নি। অগ্নিকে প্রণাম ক’রে স্বাহা বলে—শুধু একটি আশীর্বাদ করো, তোমার সন্তানকে যেন সকল ক্ষতি ও অখ্যাতি থেকে রক্ষা করতে পারি।

চৈত্ররথ কাননের আলোছায়া যেন দুর্বোধ্য এক স্বপ্নলোকের রূপ নিয়ে আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। তারই মধ্যে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন অগ্নি। যেন তাঁর জীবনের সকল অনলশিখ তৃষ্ণা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। তাঁর পথভ্রান্ত পৌরুষের জীবনকে শুচিতাহীনতার পাপ হতে রক্ষা করবার জন্য কুমারী হয়েও নিজ দেহ হতে দাহিকার উপহার দিয়ে সকল জ্বালা সহ্য করেছে যে, তাঁরই সন্তানের মা হতে চলেছে যে, তারই কপালে চিরন্তন হয়ে ফুটে আছে একটি প্রেমের কস্তুরীতিলক।

অগ্নি ডাকেন—স্বাহা!

কিন্তু কোথায় স্বাহা? অগ্নিকে প্রণাম ক’রে এই আলোছায়ার রহস্যের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে, চলে গিয়েছে অগ্নির প্রেমাভিলাষিণী স্বাহা। অসহায়ভাবে বেদনপীড়িত কণ্ঠস্বরে বনময় প্রতিধ্বনি তুলে অগ্নি ডাকেন—স্বাহা! স্বাহা!

চৈত্ররথ কাননে বৎসরের পর বৎসর শীত-গ্রীষ্ম আর বর্ষা-বসন্তের খেলা শেষ হয় তারই মধ্যে অহরহ একটি আকুল প্রতিধ্বনি শুধু আলো অন্ধকার ও বাতাস বেদনার্ত ক’রে ছুটাছুটি করে বেড়ায়—স্বাহা! স্বাহা!

সত্যই এক অনন্ত প্রতীক্ষার তপস্যা শুধু করেছেন অগ্নি। কপালে কস্তুরীতিলক, স্নিগ্ধদ্যুতিরূপিণী এক নারী এই পথে ফিরে এসে দেখা দেবে কবে? স্বাহা! স্বাহা! আগ্নেয়জননী স্বাহা! পিতৃহৃদয়ের শূন্যতা, শুদ্ধপৌরুষ পতিহৃদয়ের শূন্যতা দূর করবার জন্য এক বাঞ্ছিতার উদ্দেশে সাগ্রহ আহ্বানমন্ত্র চৈত্ররথ কাননের সমীরে নিরন্তর মন্দ্রিত হয়। স্বাহা! স্বাহা! আমার আশ্রমগেহিণী রূপে এস। আমার গার্হপত্যের একমাত্র শিখা রূপে এস। এস প্রিয়া স্বাহা।

সেই একপ্রেমিকা নারীর কামনার পুণ্য স্পর্শকেই অনন্তকাল আহ্বান করবেন অগ্নি—স্বাহা! স্বাহা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *