চ্যবন ও সুকন্যা

চ্যবন ও সুকন্যা

বল্মীক নয়, বল্মীকবৎ স্থানুক এক তপস্বীর শরীর। দীর্ঘ তপস্যার ক্লেশে অভিভূত দেহ, যেন জরাপ্রাপ্ত ত্বগস্থির একটি ধূলিক্লিন্ন স্তূপ। অপহত হয়েছে যৌবন; নিরাদক সরোবরের মত শুষ্ক সেই অবয়ব হতে অপসৃত হয়েছে তারুণ্যতরলিত কান্তির শেষ কল্লোল। আপন বক্ষের অগ্নিতে আপনি দগ্ধীভূত শমীবৃক্ষের দু’টি শাখার মত দু’টি অঙ্গারবর্ণ বাহু, ভৃগুতনয় চ্যবন সেই কাননের নিভৃতে শিলাসনে বসে ভাবছিলেন, এতদিনে তাঁর মনস্কামনা সিদ্ধ হয়েছে। ভাবছিলেন, বিপুল তপঃক্লেশের পুণ্যে এতদিনে ক্ষয় হয়ে গেল তাঁর ত্বগস্থিশোণিতের সকল কামনার অবলেশ। এই বক্ষে তৃষ্ণা নেই, এই চক্ষে কৌতূহল নেই, সংসারের কোন রূপ ও মায়াকে আলিঙ্গন দান করবার জন্য এই দুই বাহুতে কোন স্পৃহা নেই।

সহসা কানননিভৃতের সমীরে যেন কা’র দু’টি চলোচ্ছল চরণের মঞ্জীর ধ্বনিত হয়। আর সেই ধ্বনির স্পর্শে হঠাৎ আহত হয়ে শুষ্ক বল্মীকের পঞ্জর কেঁপে ওঠে। উৎকর্ণ হয়ে তরুচ্ছায়ামেদুর বনপথের তৃণাঞ্চিত রেখার দিকে তাকিয়ে থাকেন চ্যবন।

কিছুক্ষণ আগেই সহস্র মত্তকণ্ঠের উল্লাস এই শান্ত বনভূমির নীরবতা মথিত ক’রে চলে গিয়েছে। জানেন চ্যবন, নৃপতি শর্ষাতি আজ বসন্তমৃগয়ার আমোদ উপভোগের জন্য কাননে প্রবেশ করেছেন। সঙ্গে আছে লক্ষ্যভেদনিপুণ শত শত ধনুর্ধর সৈনিক। আছে চামরগ্রাহিণী কিংকরী ও করঙ্কবাহক কিংকর। আছে সঙ্গীতপরায়ণ সুত মাগধ ও চারণ। সৈনিকের হর্ষ কলরব ও জয়নাদ, আর সুত-মাগধ-চারণের সুমধুর গীতস্বর ও স্নিগ্ধ বেনুপ্রণাদ শুনেছেন চ্যবন। কিন্তু সেই ধ্বনি শুনে বল্মীকবৎ স্থানুক তপস্বীর বক্ষঃপঞ্জরের শান্তি শিহরিত হয়নি। তাঁর এই কৌতূহলহীন স্পৃহাহীন ও কামনাহীন নিভৃতজীবনের নেপথ্যকে শুধু ক্ষণকালের মত ক্ষুব্ধ ক’রে চলে গিয়েছে সেই ধ্বনি। চলঞ্চিত হয়নি চ্যবনের চিন্তার বিরাগ।

কিন্তু একি অদ্ভুত ধ্বনি! স্ফুটকুসুমের বর্ণে ও সৌরভে পরিকীর্ণ এই বনস্থলীর বসন্ত যেন শিঞ্জিত হয়ে উঠেছে। যেন পিকনাদপীযূষে মদিরায়িত এক যৌবনাবেগ মঞ্জীরিত হয়ে ছুটে আসছে। মনে হয়, খঞ্জনের চঞ্চলতা নিয়ে দু’টি কজ্জলিত নয়ন এই মধুমাসমদ কাননের অন্তর অন্বেষণ করবার জন্য এগিয়ে আসছে। কিংবা শ্যামশোভাবিহ্বলা এক মায়ামৃগবধূর চরণে কেউ নূপুর পরিয়ে দিয়েছে। চঞ্চল উদ্দাম ও মধুর সেই শব্দ।

যে চক্ষুতে কৌতূহল ছিল না সেই চক্ষু কৌতূহলে দীপ্ত হয়ে ওঠে। দেখলেন চ্যবন, বিপুল লাস্যে লীলায়িততনু ও রূপমঞ্জুলা এক নারী লতাকুঞ্জ হতে চয়িত পুষ্প দুই হস্তের হেলাবলীলায় বিক্ষেপ ক’রে নৰ্তিত পুষ্পোৎসবের মত এগিয়ে আসছে। যৌবনান্বিতা বনভূমির শোভাকে যেন রূঢ় রীঢ়াকটাক্ষে তুচ্ছ ক’রে এগিয়ে আসছে এক নারীর মত্ত যৌবনের অহংকার। বিলোলা ব্যালাঙ্গনার মত একটি বেণী সাগ্রহে জড়িয়ে ধরেছে সে নারীর কণ্ঠদেশ, যেন বিলোল হয়ে রয়েছে পুরুষহৃদয় দংশনের জন্য উৎসুক এক বাসনা। মনে হয়, দরদলিত কোকনদের রক্তাভ কোমলতা দিয়ে নির্মিত হয়েছে ঐ পদতল। লাবণ্যগরীয়সী নারীর নীলাংশুক বসনের অঞ্চল সমীরশিহরিত কেতনের মত উড়ছে।

নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে নারী। কিন্তু দেখেও বুঝতে পারে না নারী, যে বল্মীকের কাছে এসে সে এখন দাঁড়িয়েছে, সে বল্মীক সত্যই বল্মীক নয়। কল্পনাও করতে পারে না সে নারী, সে এখন দু’টি জীবন্ত চক্ষুর নিকটে এসে দাঁড়িয়ে আছে। বসনবন্ধন স্খলিত ক’রে অঙ্গে পুষ্পরজঃ লেপন করে পুষ্পাধিক কমনীয়দেহা নারী।

—কে তুমি কুমারী?

যেন নিভৃতের এক তরুচ্ছায়া হঠাৎ প্রশ্ন করেছে। চকিত হস্তে বিবৃত বরাঙ্গের শোভা নীলাংশুক আবৃত ক’রে এবং বিস্ময়াভিভূত নেত্রে চতুর্দিক নিরীক্ষণ করে নারী।

—কে তুমি অনুপমা?

আবার প্রশ্ন। মনে হয়, এই নিভৃতের এক বক্ষের কন্দর হতে ধ্বনিত হয়েছে এই প্রণয়সম্বোধন। আতঙ্কিতের মত আর্তনাদ ক’রে ওঠে নারী—কে তুমি অবয়বহীন?

—আমি তপস্বী চ্যবন।

এতক্ষণে বল্মীকের দিকে দৃষ্টিপাত করে নারী এবং বুঝতে পারে, এই বল্মীক সত্যই বল্মীক নয়। জীর্ণ বল্মীকবৎ জরাধূলিসমাচ্ছন্ন ও বিগতযৌবন এক তপস্বীর দেহ। তারই দিকে তাকিয়ে আছে সেই তপস্বীর চক্ষু। তপস্বী চ্যবনের দুই চক্ষুতে তীক্ষ্ণ এবং উজ্জ্বল দৃষ্টি জ্বলছে।

নারী বলে—আমি নৃপতি শর্যাতির দুহিতা সুকন্যা।

চ্যবন বলে—তুমি ধন্যা, তপস্বী চ্যবনের মনোহারিণী অয়ি বিপুলযৌবনা! তোমার নীলাংশুক বসনের অঞ্চল তোমারই অঙ্গসৌগন্ধ্যের স্পর্শ দান ক’রে আমার এই নিভৃতজীবনের নিঃশ্বাসসমীর সুরভিত করেছে।

ভ্রূভঙ্গী কঠোর ক’রে সুকন্যা বলে—আপনার ভাষণে বিস্ময় বোধ করছি ঋষি।

চ্যবন—কিসের বিস্ময়?

সুকন্যা—আপনি তপস্বী, আপনি বয়ঃপ্রবীণ, আপনি জরাগ্রস্ত। আপনার দেহ আছে, কিন্তু দেহে প্রাণ আছে বলে মনে হয় না। আপনার নিঃশ্বাস আছে, কিন্তু সে নিঃশ্বাসে সমীর আছে বলে বিশ্বাস করতে পারি না। দাবদগ্ধ বৃক্ষের মত অঙ্গার হয়ে গিয়েছে আপনার যৌবন। তবে কেন আর কিসের আশায় এক বিপুলযৌবনার প্রতি প্রণয় নিবেদন করছেন, ঋষি?

চ্যবন—তোমার বিস্ময় মিথ্যা নয়, সুকন্যা। দীর্ঘ তপঃক্লেশে ক্ষয় হয়েছে আমার দেহ, কিন্তু আজ বুঝতে পেরেছি, ক্ষয় হয়নি আমার কামনা। আমার দেহে জরা, কিন্তু আমার অন্তরে জরা নেই। আমার দেহে কামনা নেই, কিন্তু আমার মনে কামনা আছে, কামিনী শর্যাতিতনয়া।

সুকন্যা—কিন্তু সে কামনা যে নিতান্ত নিরর্থক। আপনি পক্ষহীন বিহগের মত, পত্রহীন বিটপীর মত ও তৈলহীন প্রদীপের মত অক্ষম কামনার আধার মাত্র। আমাকে প্রণয় নিবেদন ক’রে কি লাভ হবে আপনার? আমি আপনার উৎসঙ্গ শোভিত করলে কোন্ পরিতৃপ্তি লাভ করবেন আপনি?

চ্যবন—তোমার সান্নিধ্য আর তোমার স্পর্শই আমার পরিতৃপ্তি। আমি আমার নিমেষহীন চক্ষুর দৃষ্টি দিয়ে তোমার সুহাসিত বিম্বাধরপ্রভা আর কুন্দাভ দন্তরুচিজ্যোৎস্না চিরক্ষণ পান ক’রে পরিতৃপ্ত হব।

সুকন্যা—কেমন ক’রে পরিতৃপ্ত হবেন, হে জরায়িতদেহ তপস্বী? আপনার দেহ যে তৃষ্ণা ধারণেও অক্ষম।

চ্যবন—পরিতৃপ্ত হবে আমার মন। তৃষ্ণা আছে আমার মনে।

সুকন্যা—কুৎসিত এই তৃষ্ণা।

ভ্রূকুটি করেন চ্যবন—তপস্বী চ্যবনের প্রতি নিন্দাবাদ প্রকাশের দুঃসাহস সংবরণ কর, শর্যাতিতনয়া সুকন্যা!

ভ্রূকুটি করে সুকন্যা—আপনি আমার প্রতি আপনার জরাগ্রস্ত প্রণয় নিবেদনের উৎসাহ সংবরণ করুন, তপস্বী।

চ্যবন—ভার্গব চ্যবনের পত্নী হবে তুমি, তোমার এই সৌভাগ্য বিনষ্ট করো না।

হেসে ওঠে সুকন্যা—আপনার পতিত্ব স্বীকার ক’রে যৌবনিত জীবনের অপমান সহ্য করবার দুর্ভাগ্য বরণ করতে চাই না।

চ্যবন—ভুলে যেও না, তোমার এই অহংকার চুর্ণ করবার শক্তি তপস্বী চ্যবনের আছে।

সুকন্যা—থাকতে পারে, কিন্তু আমার অননুরাগ চুর্ণ করবার শক্তি নেই আপনার। ঘৃণ্য আপনার প্রস্তাব।

—ঘৃণ্য? ক্রোধোদ্দীপ্ত স্বরে চিৎকার ক’রে প্রশ্ন করেন চ্যবন।

সুকন্যা বলে—হ্যাঁ তপস্বী, জরাকে ঘৃণ্য বলে মনে না ক’রে পারে না যৌবন।

চলে যাচ্ছিল সুকন্যা। চ্যবন আহ্বান করেন—শুনে যাও, সুকন্যা।

—বলুন।

—একবার তাকিয়ে দেখ আমার দিকে।

—দেখেছি।

—কি দেখলে?

—ক্রোধোদ্দীপ্ত দু’টি চক্ষু।

—দেখতে ভয় করে না?

—দেখতে ঘৃণা বোধ করি।

সহসা দুই চক্ষু মুদ্রিত করেন চ্যবন। যেন এই যৌবনগর্বিতা নারী ঘৃণাভরে তাঁর দুই চক্ষু তীক্ষ্ণ কণ্টকে বিদ্ধ ক’রে দিয়েছে।

চ্যবন বলেন—যাও।

কাঁদছিল সুকন্যা। কিন্তু নৃপতি শর্যাতি বলেন—না, আর কোন উপায় নেই কন্যা। ভার্গব চ্যবনের রোষ আর অভিশাপ হতে রক্ষা লাভ করবার আর কোন উপায় নেই।

সুকন্যা—তনয়ার প্রতি কেন এত কঠোর হলেন, পিতা?

শর্যাতি—তোমারই আচরণে রুষ্ট হয়েছেন চ্যবন।

সুকন্যা—আমার আচরণে কি অপরাধ আর কিসের অন্যায় দেখলেন?

অকস্মাৎ অশ্রুধারায় প্লাবিত হয় শর্যাতির নয়ন। বেদনাভিভূত স্বরে বলেন— তোমার অপরাধ হয়নি সুকন্যা। কিন্তু, ক্রুদ্ধ চ্যবনের অভিশাপে আমার রাজ্যের সকল সৈনিক অকস্মাৎ ব্যাধি ও জরায় আক্রান্ত হয়েছে। তোমার দর্প পরাভূত করবার জন্য নৃপতি শর্যাতির ক্ষত্ৰবলদর্প চূর্ণ ক’রে দিয়েছেন চ্যবন। আমার রাজ্য লুপ্ত হবে, আমার এই গৌরবের কিরীটি ভূমিসাৎ হবে, আমার প্রজার সংসার হতে সকল হর্ষ ও আনন্দ চলে যাবে, এই ভয়ানক অভিশাপ তুমিই অপসারিত করতে পার।

সুকন্যা—যদি চ্যবনের কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করি, তবে কি তিনি আমাকে ক্ষমা ক’রে তুষ্ট হবেন না?

শর্যাতি—না, তনয়া, তিনি তোমাকে শাস্তি না দিয়ে তুষ্ট হবেন না।

সুকন্যা—শাস্তি?

শর্যাতি—হ্যাঁ, তুমি তাঁর পত্নী না হলে তিনি তুষ্ট হবেন না।

সুকন্যা—আমাকে শাস্তি দেবার জন্যই কি তিনি আমাকে তাঁর কাছে পত্নীত্ব গ্রহণে বাধ্য করতে চান?

শর্যাতি—হ্যাঁ।

কিছুক্ষণ চিন্তিত মনে অথচ শান্ত নেত্রে দাঁড়িয়ে থাকে সুকন্যা। তারপর বলে— আপনি কি ইচ্ছা করেন, পিতা?

শর্যাতি—সদসৎ বিবেচনা করবারও আর আমার কোন সাহস নেই। আমার রাজ্যের আনন্দ বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। চ্যবনের অভিশাপ হতে রক্ষা লাভের জন্য তোমাকে যদি…।

সুকন্যা—তাই হোক পিতা। আমার জীবনই অভিশপ্ত হোক, আর চ্যবনের অভিশাপ হতে মুক্ত হয়ে সুখী হোক আপনার রাজ্য ও আপনার ইচ্ছা।

জরাগ্রস্ত তপস্বীর জীবনের সঙ্গিনী হয়েছে বিপুলযৌবনা সুকন্যা। হ্যাঁ, শাস্তিই দান করেছেন চ্যবন। তাঁর ক্রোধোদ্দীপ্ত দুই চক্ষুর দৃষ্টি যেন কিরাতের জাল, এবং এই জালের বন্ধন শান্তচিত্তে জীবনে গ্রহণ করেছে এক সুন্দরদেহিনী মায়ামৃগী। প্রণয়সম্ভাষণ নয়, করুণাবচন নয়, সান্ত্বনা নয়, শুধু তপস্বী চ্যবনের রুষ্ট দুই চক্ষুর নির্দেশ। সেই নির্দেশ মান্য ক’রে আশ্রমদাসীর মত নিকেতকর্তব্য পালন করে সুকন্যা। দিন যায়, মাস অতীত হয়, বর্ষের পর বর্ষ অতিক্রান্ত হয়, কাননভূমির নিভৃতে বসন্তামোদ জাগে; কিন্তু চ্যবনপত্নী সুকন্যার জীবন যেন চিরনিদাঘে তাপিত জীবন।

এই শাস্তিভীরু জীবনের ভারে অবসন্ন সুকন্যার মন মাঝে মাঝে মুক্তির স্বপ্ন দেখে। মনে হয়, তপস্বী চ্যবনের ঐ দুই চক্ষু হতে ক্রোধজ্বালা অন্তর্হিত হয়েছে। শান্ত দৃষ্টি তুলে সুকন্যার দিকে তাকিয়ে আছেন চ্যবন।—এইবার আমাকে মুক্তি দান করুন তপস্বী। সাশ্রুনয়নে আবেদন করতে গিয়েই সুকন্যার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। দেখতে পায়, তেমনি ক্ষুব্ধ ও কঠোর দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে আছেন চ্যবন। না, ঋষি চ্যবনের মনে ক্ষমা নেই, সুকন্যার জীবনে এই শাস্তির শেষ নেই।

আবার এক একদিন সুকন্যার মনের ভাবনাগুলি যেন হৈমন্তী কুহেলিকার মত মায়াময় হয়ে ওঠে। তন্দ্রাচ্ছন্ন নয়নে দেখতে পায় সুকন্যা, সত্যই স্বামী চ্যবনের নয়নে সেই ক্রোধজ্বালা আর নেই। ব্যথিত দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে আছেন চ্যবন। প্রশ্ন করে সুকন্যা—এ কি? আপনি ব্যথিত হয়েছেন কেন তপস্বী?

কিন্তু প্রশ্ন করতে গিয়েই সুকন্যার তান্দ্রা ভেঙে যায়। দেখতে পায় সুকন্যা, তরুতলে দাঁড়িয়ে তারই দিকে শুষ্ক কঠোর ও বেদনাহীন দৃষ্টি তুলে দাঁড়িয়ে আছেন চ্যবন। না, বৃথা স্বপ্ন, বৃথা তন্দ্রা, বৃথা এই আশামুগ্ধ লোভ। ঐ ক্ষমাহীন তপস্বীর চক্ষু কোনদিন ব্যথিত হবে না।

দিবস-রজনীর প্রতি মুহূর্ত যেন এক বল্মীকের সেবা করে চলেছে শর্যাতিতনয়া সুকন্যা। এই বল্মীক যেন এক দেববিগ্রহ, এবং তার উপাসিকা হয়েছে বনবাসিনী নৃপতিতনয়া সুকন্যা। মাঝে মাঝে উৎসুক নেত্রে তাকিয়ে থাকে সুকন্যা, আর নীরবে আক্ষেপ করে। এই তপস্বীকে শিলাময় দেববিগ্রহের মত শ্রদ্ধেয় মনে হতো, যদি তাঁর দুই চক্ষুতে এই নির্মম ক্রোধের জ্বালাটুকু শুধু না থাকত। কঠিন শিলার বিগ্রহকে পূজা ক’রে যেটুকু আনন্দ লাভ করা যায়, চ্যবনের এই মূর্তিকে পূজা ক’রে সেটুকু আনন্দও পায় না সুকন্যা। নিতান্ত এক শাস্তার মূর্তি। দুর্ভাগ্য, প্রেমহীন জীবনের ক্রন্দন শান্ত করবার মত একটা ছলনাও খুঁজে পায় না সুকন্যা। কোন মুহূর্তে এক বিন্দু মিথ্যা হর্ষেরও স্পর্শে ঋষি চ্যবনের চক্ষু স্নিগ্ধ হয় না।

নববসন্তাগমের ইঙ্গিত ঘোষণা ক’রে একদিন কাননের তরু ও লতার বক্ষে জেগে ওঠে কিশলয়। জেগে ওঠে পিককলরব। কাননসরোবরের নিকটে এসে দাঁড়িয়ে থাকে সুকন্যা। মনে হয় সুকন্যার, সরোবরের ঐ সলিল যেন তৃষ্ণার্ত হয়ে তারই মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয়, পরাগভারে বিহ্বল কুসুমের স্তবক তারই যৌবনমদয়িত তনুচ্ছবির স্পর্শ পেতে চাইছে।

বল্কবসনের ভার ভূতলে নিক্ষেপ করে সুকন্যা। বিকচ শতদলের মত রাগবিহসিত বিহ্বল দেহভার সরোবরসলিলে লুটিয়ে দিয়ে স্নানামোদে তৃপ্ত হয় সুকন্যা। তারপর তীরতরুর ছায়ায় এসে দাঁড়ায়। অতনুবিমোহন সেই বরতনুর অনাবরণ কোমলতাকে পুষ্পপরাগের লেপনে আরও কমনীয় ক’রে তোলে সুকন্যা। যেন এক স্বপ্নলোকের বক্ষে দাঁড়িয়ে জীবনের নির্বাসিত কামনার বেদনাগুলিকে স্নিগ্ধ সলিলের ও পুষ্পপরাগের প্রলেপ দিয়ে শান্ত করছে সুকন্যা।

অকস্মাৎ নিকটাগত এক পদশব্দ শুনে চমকে উঠেই দেখতে পায় সুকন্যা, সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে সুন্দর এক পথিকপুরুষ।

আগন্তুক বলেন—আমি অশ্বিনীকুমার রেবন্ত।

অসম্বৃত বসন সম্বৃত ক’রে বিব্রতভাবে প্রশ্ন করে সুকন্যা—কিন্তু আমার সম্মুখে আপনার আগমনের হেতু কি?

রেবন্ত—হেতু তুমি।

সুকন্যা—আমার পরিচয় আপনি জানেন কি?

রেবন্ত—জানি, তুমি শর্যাতিতনয়া সুকন্যা, তুমি চ্যবনভার্যা সুকন্যা।

সুকন্যা—তবে?

রেবন্ত—তোমারই বিপুল যৌবনভার বক্ষে ধারণ করবার তৃষ্ণা নিয়ে আমি এসেছি, সুকন্যা।

সুকন্যার অন্তর যেন পিকসঙ্গীতের চেয়ে মধুরতর এক সুস্বরের স্পর্শে শিহরিত হয়।

মুগ্ধ রেবন্তের কণ্ঠে যেন বন্দনার সঙ্গীত ধ্বনিত হয়—এস লোকললামা বরারোহা, এস সুমধ্যমা বামোরু, এস নিতম্বগুর্বী কুচভারভীরুকটি সুভ্রূ, এস সুমধুরাধরা সুদতী, আজিকার পুষ্পময় বসন্তের মত যৌবনবান এই রেবন্তের পরিরম্ভনে এসে ধরা দাও সুকন্যা। তৃপ্ত রমিত ও প্রীত হোক তোমার সকল বাসনার অভিমান।

মুগ্ধভাবে রেবন্তের মুখের দিকে তাকিয়ে বিচলিতস্বরে সুকন্যা বলে—আপনি সুন্দর, আপনার আহ্বানও সুন্দর, কিন্তু আমাকে ক্ষমা করবেন রেবন্ত।

রেবন্ত—কেন সুকন্যা?

সুকন্যা—আমি ঋষি চ্যবনের ভার্যা, আপনার আহ্বানে যতই মধুরতা থাকুক, সে আহ্বান আমি গ্রহণ করতে পারি না।

রেবন্ত—জরাভিভূত ক্ষীণদেহ ও প্রণয়বিরহিত স্বামীর জীবনসঙ্গিনী নারী…

অকস্মাৎ বক্ষের গভীরে যেন তীক্ষ্ণ এক কণ্টকের আঘাত অনুভব করে সুকন্যা। সত্য বাক্য উচ্চারণ করেছেন রেবন্ত, এক জরাগ্রস্তের উদ্দেশে ঘৃণা নিবেদন করছে এক যৌবনের গর্ব। কিন্তু বিস্মিত হয় সুকন্যা, আর বেদনার্তভাবে অন্যমনার মত তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে, কেন ব্যথা বাজে অন্তরে?

—সুকন্যা!

রেবন্তের আহ্বানে সাড়া দেয় না সুকন্যা। যেন তার দুই বিষণ্ণ ও ভীত চক্ষুর দৃষ্টি অনেক দূরে ছুটে গিয়েছে। রেবন্তের ধিক্কার সেই জীর্ণ বল্মীকের কঠোর অহংকারের সব প্রসন্নতা চূর্ণ করতে চায়। সুকন্যার বুক কেঁপে ওঠে।

রেবন্তের ধিক্কারে সুকন্যার এক নিরর্থক গর্বও অপমানে আহত হয়েছে। সুকন্যা বলে—আমার স্বামী জরাভিভূত ও যৌবনহীন বলেই কি আপনি আমাকে সহজলভ্য বলে মনে করেছেন?

রেবন্তের প্রগল্ভ হর্ষও হঠাৎ আহত হয়। চিন্তান্বিতের মত সুকন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন রেবন্ত।

সুকন্যা বলে—ঋষি চ্যবন যদি যৌবনবান হতেন, তবে কি আপনি তাঁর ভার্যাকে এইভাবে প্রণয়াসঙ্গে আহ্বান করতে পারতেন?

রেবন্ত বলেন—বুঝেছি।

সুকন্যা—কি বুঝেছেন?

রেবন্ত—বুঝেছি, কোথায় তোমার দুঃখ, কিসের জন্য তোমার অভিমান, আর আমার প্রণয়ে কেনই বা তোমার সংশয়। কিন্তু আমি হীনপ্রেমিক নই শর্যাতিতনয়া। আমার প্রণয় কোন সুযোগের অনুগ্রহ গ্রহণ করে না। আমি ক্ষীণ খদ্যোৎ নই নারী, দীপহীন অন্ধকারের সুযোগ চাই না। আমি ক্ষুদ্র ভৃঙ্গ নই নারী, আমি নিদ্রিতা কমলকলিকার অসহায় অধর অন্বেষণ করি না। আমার অন্তরে কোন তস্করতা নেই। চ্যবনের জরাতুর দুর্বল হস্তের মুষ্টিবন্ধন হতে ঐ রূপরত্ন অনায়াসে ছিন্ন ক’রে সুখী হতে পারে না স্পর্ধিতযৌবন রেবন্তের স্পৃহা।

রেবন্তের ভাষণ যেন বিশালহৃদয় এক প্রেমিকের অন্তরে গম্ভীর মন্দ্র, মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে সুকন্যা। তপোবলে মন্ত্রবলে অথবা অস্ত্রবলে নারীর হৃদয় নিপীড়িত ও আতঙ্কিত ক’রে নারীর অনুৎসুক হস্তের বরমাল্য কণ্ঠে ধারণ করতে গৌরব বোধ করে না যে প্রেমিক, স্বয়ংবরার বরমাল্য ছাড়া তৃপ্ত হয় না যে প্রেমিকের অন্তর তেমনই এক প্রেমিক সুকন্যার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

রেবন্ত—আমি তোমার মনের সংশয় অপসারিত করতে চাই। আমি ভিষগীশ্বর রেবন্ত, আমি জরা অপহরণের বিজ্ঞান জানি, আমি রুগ্ন দেহে রূপ স্বাস্থ্য কান্তি ও পুষ্টি প্রদানের রহস্য জানি।

চকিত হর্ষে দীপ্ত হয়ে ওঠে সুকন্যার দুই চক্ষু—তবে ঋষি চ্যবনের জরা অপহরণ ক’রে তাকে যৌবন কান্তি প্রদান করুন, রেবন্ত।

হেসে ওঠেন রেবন্ত—তাই হবে সুকন্যা। এই কাননে যে সরোবরের জলে ওষধীশ চন্দ্রমা নিত্য স্নান করেন, সেই সরোবরের সন্ধান আমি জানি। যদি আমার সঙ্গে গিয়ে সেই সরোবরের জলে স্নান করেন ঋষি চ্যবন, তবে তিনি সুযৌবন ও দিব্য কান্তি লাভ করবেন।

সুকন্যা—আমার অনুরোধ…।

রেবন্ত—আমার অনুরোধ শোন, সুকন্যা। ঋষি চ্যবনের কাছে গিয়ে আমার এই প্রস্তাব নিবেদন কর।

চলে যাচ্ছিল সুকন্যা, রেবন্ত বলে—আমার আর একটি প্রস্তাব শুনে যাও, সুকন্যা।

—বলুন।

—আমি ও প্রাপ্তযৌবন চ্যবন, উভয়েই তোমার বরমাল্যের প্রার্থী হয়ে তোমার সম্মুখে এসে দাঁড়াব! অঙ্গীকার কর, যার মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হবে তোমার প্রাণ, তারই কণ্ঠে বরমাল্য অর্পণ করবে। হয় আমি নয় ঋষি চ্যবন, উভয়ের একজনের জীবনসঙ্গিনী হবে তুমি।

সুকন্যা বলে—অঙ্গীকার করলাম, রেবন্ত।

রেবন্ত—অঙ্গীকার কর, এই প্রস্তাবও ঋষি চ্যবনের কাছে নিবেদন করবে তুমি।

সুকন্যা—নিবেদন করব।

রেবন্ত—অঙ্গীকার কর, ঋষি চ্যবনকে এই প্রস্তাবে তুমি অবশ্যই সম্মত করাবে।

পুলকাঞ্চিতা বনকুরঙ্গীর মত চকিতহর্ষে নিবিড় নয়নের দৃষ্টি ক্ষণপ্রগল্ভতায় তরলিত ক’রে সুকন্যা বলে—অঙ্গীকার করলাম, রেবন্ত।

চলে গেল সুকন্যা, এবং আশ্রমকুটীরে এসে উল্লসিত স্বরে চ্যবনের কাছে শুভবার্তা জ্ঞাপন করে—আপনার জরা অপহরণ ক’রে যৌবন প্রদান করবেন অশ্বিনীকুমার রেবন্ত। হৃষ্টচিত্তে চ্যবন রেবন্তের উদ্দেশে আশীর্বাণী বর্ষণ ক’রে সেই মুহূর্তে যাত্রারম্ভের জন্য প্রস্তুত হন।

আবার স্বাধীন হবে শর্যাতিতনয়া সুকন্যার প্রণয়বাসনা; সুকন্যার হাতের বরমাল্য তারই পরিণয় বরণ ক’রে নেবে জীবনে, যার মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হবে সুকন্যার প্রাণ। এই পরীক্ষার প্রস্তাবেও সানন্দে সম্মত হয়ে চলে গেলেন চ্যবন।

আশ্রমকুটীরের নিভৃতে নীরব হয়ে বসে থাকে সুকন্যা। কি অদ্ভুত পরীক্ষা! এই পরীক্ষার পরিণামে সুকন্যা যে এক শাসনকঠোর ও হৃদয়হীন স্বামীর সান্নিধ্য ছেড়ে এক বিশালহৃদয় প্রবলপ্রেমিকের ব্যাকুল আহ্বানের কাছে চিরকালের মত চলে যেতে পারে। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও ব্যথিত হলেন না, শঙ্কিত হলেন না, বিষণ্ণ হলেন না কেন ঋষি চ্যবন?

ঝটিকাঘাতে একটি পল্লব শাখা হতে ছিন্ন হয়ে গেলে যতটুকু ব্যথা অনুভব করে বিশালদেহ দেবদারু, ততটুকু ব্যথাও বোধ হয় ঋষি চ্যবনের বক্ষে বাজবে না যদি সুকন্যা আজ প্রণয়াভিলাষী রেবন্তের কণ্ঠে বরমাল্য দান করে। শাস্তির দাসীকে চিরকাল কঠোর নেত্রে ঘৃণা ক’রেই দিনাতিপাত করলেন যে জরাভিভূত ঋষি, সে ঋষি যৌবনাঢ্য হয়ে সেই নারীর মুখের দিকে কি প্রেমদৃষ্টি দান করবেন? বিশ্বাস হয় না, তাই ভয় হয় সুকন্যার। কিন্তু কেন এই অদ্ভুত ভয়? অকারণে বিচলিত নিজেরই এই হৃদয়ের উপর রুষ্ট হয় সুকন্যা।

—ওঠ সুকন্যা, তাকাও দুই পাণিপ্রার্থীর মুখের দিকে, স্বয়ংবরার গর্ব নিয়ে বেছে নাও তোমার জীবনের সঙ্গী। কানের কাছে যেন এক মায়াস্বর গুঞ্জরিত হয়ে অবসন্নহৃদয়া সুকন্যাকে উৎসাহিত করে। কিন্তু তবু দুই হাতে অশ্রুপ্লুত চক্ষু আবৃত ক’রে বসে থাকে সুকন্যা। কেন, কিসের জন্য এই বেদনা, এবং কি চায় সুকন্যা, নিজের মনকেই প্রশ্ন ক’রে বুঝতে পারে না।

বুঝতে পারে না সুকন্যা, আজ এতদিন পরে তার মুক্তির মুহূর্ত যখন আসন্ন হয়ে উঠেছে, তখন কেন আবার বক্ষের স্পন্দনে ও নিঃশ্বাসে এই নূতন ও অদ্ভুত এক বেদনার সঞ্চার জাগে?

আশ্রমকুটীরের আঙ্গিনায় দই আগন্তুকের পদধ্বনি শোনা যায়। চমকে ওঠে সুকন্যা। আসছেন সুন্দরতনু রেবন্ত, আসছেন সুন্দরতনু চ্যবন।

—শর্যাতিতনয়া সুকন্যা! হর্ষাকুল রেবন্তের কণ্ঠস্বর আশ্রমের প্রাঙ্গণের বক্ষে ধ্বনিত হয়। কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর কই? নীরব কেন সুকন্যার যৌবনগর্বের শাস্তিদাতা সেই ঋষি, যিনি স্বয়ং আজ রেবন্তের অনুগ্রহে যৌবনান্বিত হয়ে ফিরে এসেছেন?

পুষ্পমাল্য হাতে নিয়ে কুটীরের বাইরে এসে দাঁড়ায় সুকন্যা। দেখতে পায়, যৌবনাঢ্য দুই পুরুষের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে প্রাঙ্গণের বক্ষের উপর। উভয়েই সমানসুন্দর, একই তরুর দুই পুষ্পের মধ্যে যতটুকু রূপের ভিন্নতা থাকে, তাও নেই। কান্তিমান দ্যুতিমান ও বিশাল বক্ষঃপট, নবীন শাল্মলী সদৃশ যৌবনান্বিত দুই দেহী।

রেবন্তের মুখের দিকে তাকায় সুকন্যা। দেখতে থাকে সুকন্যা, হর্ষে উজ্জ্বল ও আনন্দে সুস্মিত হয়ে উঠেছে রেবন্তের চক্ষু। রেবন্তের দুই সুন্দর নয়নে জ্যোৎস্নালিপ্ত সমুদ্রতরঙ্গের মত কী বিপুল প্রণয়োচ্ছল আহ্বান হিল্লোলিত হয়! মুগ্ধ হয় সুকন্যার দুই নয়ন।

চ্যবনের মুখের দিকে তাকায় সুকন্যা। চমকে ওঠে সুকন্যার হৃৎপিণ্ড।

ক্রোধজ্বালা নয়, অবহেলা নয়, অহংকার নয়, দুঃসহ ব্যথায় বিষণ্ণ হয়ে রয়েছে সুন্দরতনু ঋষিযুবা চ্যবনের চক্ষু। যেন এক হতাশ ও অসহায়ের দৃষ্টি। এতদিন পরে তাঁরই শাস্তিনিঃসারী দুই শুষ্ক চক্ষুর কঠোর শাসনে নিগৃহীতা নারীর উপর তাঁর সকল অধিকার একটি পুষ্পমাল্যের প্রতিহিংসার জ্বালায় ভস্মসাৎ হয়ে যাবে, সেই শাস্তি নীরবে সহ্য করবার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন চ্যবন। কিন্তু সুকন্যা যেন এক অকল্প্য দৃশ্য দেখছে; বিস্ময়াভিভূত অন্তরের উল্লাস সংযত ক’রে ব্যথিত নয়নে চ্যবনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

একই তরুর দুই পুষ্পের মত দুই সমানসুন্দর রূপ; কিন্তু একজনের নয়নে হর্ষ, আর একজনের নয়নে বেদনা। রেবন্তের সুস্মিত নয়নের দিকে তাকিয়ে নয়ন মুগ্ধ হয় সুকন্যার, কিন্তু চ্যবনের ব্যথিত চক্ষুর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায় সুকন্যার হৃদয়।

ফুল্লরুচি ফুলদলের মত সুস্মিত হয়ে ওঠে শর্যাতিতনয়া সুকন্যার অধর। যেন আজ এতদিন পরে নিজেকেই দেখতে পেয়েছে সুকন্যা। যেন ঋষি চ্যবনের চক্ষুতে ঐ বেদনার আবির্ভাব দেখবার আশায় এতদিন ধ’রে দুর্বহ এক প্রতীক্ষার ব্রত পালন ক’রে এসেছে সুকন্যা।

ধীরে ধীরে ঋষি চ্যবনের সম্মুখে এসে আহ্বান করে সুকন্যা।—ঋষি!

চ্যবন—বল।

সুকন্যা—কি ভাবছেন ঋষি?

চ্যবন—প্রতিশোধ গ্রহণ কর।

হেসে ওঠে সুকন্যা—সুযোগ পেয়েছি ঋষি, প্রতিশোধ গ্রহণ করাই উচিত।

চ্যবন—হ্যাঁ, সুকন্যা।

—এই লও প্রতিশোধ! চ্যবনের কণ্ঠে বরমাল্য দান ক’রে মুগ্ধ চক্ষু তুলে চ্যবনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সুকন্যা।

চমকে ওঠেন রেবন্ত, এবং নিজেরই মনের বিস্ময় সহ্য করতে না পেরে ধিক্কার ধ্বনিত করেন—ধন্যা—ছলনানিপুণা সুকন্যা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *