পরীক্ষিৎ ও সুশোভনা

পরীক্ষিৎ ও সুশোভনা

সেই নিদাঘের মধ্যদিনের আকাশ সেদিন তপ্ত তাম্রের মত রক্তাভ হয়ে উঠেছিল, বলাকামালার চিহ্ন কোথাও ছিল না। জ্বালাবিগলিত স্ফটিকের মত স্বচ্ছ সেই সরোবরসলিলে মীনপংক্তির চাঞ্চল্যও ছিল না। খর সৌরকরে তাপিত এক শৈবালবর্ণ শিলানিকেতন বহ্নিস্পৃষ্ট মরকতস্তূপের মত সরোবরের প্রান্তে যেন শীতলস্পর্শসুখের তৃষ্ণা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মণ্ডুকরাজ আয়ুর প্রাসাদ।

সরোবরের আর এক প্রান্তে ছায়ানিবিড় লতাবাটিকার নিভৃতে কোমল পুষ্পদলপুঞ্জের আসনে সুস্নাত দেহের স্নিগ্ধ আলস্য সঁপে দিয়ে বসেছিল মণ্ডুকরাজ আয়ুর কন্যা সুশোভনা। সম্মুখে নীলবর্ণ নিবিড় এক কানন, উত্তপ্ত আকাশের দুঃসহ আশ্রয় থেকে পালিয়ে নীলাঞ্জনের রাশি যেন ভূতলে এসে ঠাঁই নিয়েছে।

মণ্ডুকরাজ আয়ু বিষণ্ণ, তাঁর মনে শান্তি নেই। এই দুঃখ ভুলতে পারেন না মণ্ডুকরাজ, তাঁর কন্যা নারীধর্মদ্রোহিণী হয়েছে। সুশোভনাকে যোগ্যজনের পরিণয়োৎসুক জীবনে সমর্পণের আশায় কতবার স্বয়ংবরসভা আহ্বানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন মণ্ডুকরাজ। কিন্তু বাধা দিয়েছে, আপত্তি করেছে এবং অবশেষে অবমর্দিতা ভুজঙ্গীর মত রুষ্ট হয়েছে সুশোভনা।—তোমার স্নেহপিঞ্জরের শারিকার জন্য নূতন বীতংস রচনা করো না পিতা, সহ্য করতে পারব না।

স্বয়ংবরসভা আহ্বানের আর কোন চেষ্টা করেন না নৃপতি আয়ু। ভয় পেয়ে চুপ ক’রে থাকেন।

ভয়, অপযশের ভয়। লোকাপবাদের আশঙ্কায় ম্রিয়মাণ হয়ে আছেন মণ্ডুকরাজ আয়ু। কিন্তু কৌতুকিনী কন্যার গোপন মূঢ়তার কাহিনী লোকসমাজে নিশ্চয়ই চিরকাল অবিদিত থাকবে না। এই দুশ্চিন্তার মধ্যেও বিস্মিত না হয়ে পারেন না নৃপতি আয়ু, আজও কেন এই অগৌরবের কাহিনী জনসমাজে অবিদিত হয়ে আছে এবং তিনি কেমন ক’রে লোকধিক্কারের আঘাত হতে এখনও রক্ষা পেয়ে চলেছেন?

সে রহস্য জানে শুধু কিংকরী সুবিনীতা। কৌতুকিনী রাজতনয়ার ছললীলার সকল রীতিনীতি ও বৃত্তান্তের কোন কথা তার অজানা নেই।

অপযশ হতে আত্মরক্ষা করার এক ছলনাগূঢ় কৌশল আবিষ্কার করেছে সুশোভনা। প্রণয়াভিলাষী কোন পুরুষের কাছে নিজের পরিচয় দান করে না সুশোভনা। কেউ জানে না, কে সেই বরবর্ণিনী নারী, কোথা হতে এল আর চিরকালের জন্য চলে গেল? সে কি সত্যই এই মর্ত্যলোকের কোন পিতার কন্যা? সে কি সত্যই মানবসংসারে লালিতা কোন নারী? সে কি কোন বনস্থলীর সকল পুষ্পের আত্মমথিত সুরভি হতে উদ্ভূতা? অথবা কোন দিগঙ্গনার লীলাসঙ্গিনী, মুক্তা কুড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্য ধূলিময় মর্ত্যে নেমে আসে দু’দিনের জন্য? কিংবা এই ফুল্লারবিন্দের স্বপ্ন, অথবা ঐ নক্ষত্রনিকরের তৃষ্ণা? আকাশচ্যুত চন্দ্রলেখার মত কে সেই ভাস্বরদেহিনী অপরিচিতা, প্রমত্ত অনুরাগের জ্যোৎস্নায় প্রণয়িজনের হৃদয়াকাশ উদ্ভাসিত ক’রে আবার কোন এক মেঘতিমিরের অন্তরালে সরে যায়? শালীননয়না সেই পরিচয়হীনা প্রেমিকার বিরহ সহ্য করতে না পেরে এক নৃপতি উন্মাদ হয়েছেন, একজন তাঁর রাজত্বভার অমাত্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে বনবাসী হয়েছেন। আনন্দহীন হয়েছে সবারই জীবন। প্রিয়াবিরহক্লিষ্ট সেই সব নরপতিদের সকল দুঃখের বৃত্তান্ত জানে সুশোভনা, আর জানে সুবিনীতা। কিন্তু তার জন্য রাজতনয়া সুশোভনার মনে কোন আক্ষেপ নেই, আর কিংকরী সুবিনীতা সকল সময় মনে মনে আক্ষেপ করে।

—কেন এই মায়াবিনী বৃত্তি আর এই অপ্সরী প্রবৃত্তি? ক্ষান্ত হও রাজকুমারী! কিংকরী সুবিনীতার এই আকুল আবেদনেও কোন ফল হয়নি। সুবিনীতা আরও বিষণ্ণ হয়েছে, মণ্ডুকরাজ আয়ু আরও ম্রিয়মাণ হয়েছেন এবং শৈবালবর্ণ শিলা প্রাসাদের চূড়ায় হৈম প্রদীপ নীহারবাষ্পের আড়ালে মুখ লুকিয়ে আরও নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু সুশোভনার কক্ষে আরও প্রখর হয়ে দীপ জ্বলে। অভিসারশেষে ঘরে ফিরে এসে যেন বিজয়োৎসবে প্রমত্তা হয়ে ওঠে সুশোভনা। মাধুকী আসবের বিহ্বলতায়, সুতন্ত্রিবীণার স্বরঝংকারে, আর কেলিমঞ্জুল স্বর্ণমঞ্জীরের ধ্বনিতে সুশোভনার উৎসব আত্মহারা হয়। নৃত্যপরা সেই নিষ্ঠুরা নায়িকার জীবনের রূপ দেখে আতঙ্কে শিহরিত হয় সহচরী, তার করধৃত বীজনপত্র দুঃখে ও ত্রাসে শিহরিত হতে থাকে।

মুগ্ধ প্রেমিকের আলিঙ্গনের বন্ধন থেকে কি ক’রে এত সহজে মুক্ত হয়ে সরে আসতে পারে সুশোভনা? কোন মায়াবলে? কেউ কি বাধা দেয় না, বাধা দেবার কি শক্তি নেই কারও?

মায়াবলে নয়, ছলনার বলে। এবং সে-ছলনা বড় সুন্দর। বিভ্রমনিপুণা সুশোভনা পুরুষচিত্তবিজয়ের অভিযানের শেষে অদৃশ্য হয়ে যাবার এক কৌশলও আবিষ্কার ক’রে নিয়েছে।

প্রতি প্রণয়ীকে সঙ্গদানের পূর্বমুহূর্তে একটি প্রতিশ্রুতি প্রার্থনা করে সুশোভনা। কপট ভয় আর অলীক ভাবনা দিয়ে রচিত করুণামধুর একটি নিয়ম—তোমার জীবনের চিরসঙ্গিনী হয়ে থাকতে কোন আপত্তি নেই আমার, হে প্রিয়দর্শন নরোত্তম। কিন্তু একটি অঙ্গীকার করুন।

—বল প্রিয়ভাষিণী।

—আমাকে কোন মেঘাচ্ছন্ন দিনে কখনও তমালতরু দেখাবেন না।

—তমালতরুতে তোমার এত ভয় কেন শুচিস্মিতা?

—ভয় নয়, অভিশাপ আছে প্রিয়।

—অভিশাপ?

—হ্যাঁ, মেঘমেদুর দিবসের যে মুহূর্তে তমালতরু আমার দৃষ্টিপথে পড়বে, সেই মুহূর্তে আমাকে আর খুঁজে পাবেন না। জানবেন, আপনার প্রণয়কৃতার্থা এই অপরিচিতার মৃত্যু হবে সেদিন।

প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন প্রণয়ী—মেঘমেদুর দিবসের সকল প্রহর এই বক্ষঃপটের অনুরাগশয্যায় সুখসুপ্তা হয়ে তুমি থাকবে বাঞ্ছিতা। তমালতরু দেখবার দুর্ভাগ্য তোমার হবে না।

আর দ্বিধা করে না সুশোভনা। প্রণয়ীর আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণ করে এবং পরমুহূর্ত হতে অন্তরের গোপনে শুধু একটি ঘটনার জন্য কৌতুকিনীর প্রাণ অপেক্ষা করতে থাকে। এক প্রহর বা দুই প্রহর, এক দিন বা দুই দিন অথবা সপ্ত দিবানিশা, কিংবা মাসান্ত—-আসঙ্গমুগ্ধ এই পুরুষচক্ষুর দৃষ্টি হতে খরকামনার বহ্নিচ্ছায়া সরে গিয়ে কবে অন্তরের ছায়া নিবিড় হয়ে ফুটে উঠবে?

এই প্রতীক্ষা সেদিন সমাপ্ত হয়, যেদিন সুশোভনার করপল্লব সাগ্রহ সমাদরে বুকের উপর তুলে নিয়ে প্রাতঃসূর্যের কিরণকিশলয়ে অরুণিত উদয়শৈলের দিকে তাকিয়ে প্রণয়ী বলে—এত আনন্দের মধ্যেও মাঝে মাঝে বড় ভয় করে প্রিয়া।

—কিসের ভয়?

—যদি তোমাকে কখনও হারাতে হয়, সে দুর্ভাগ্য জীবনে সহ্য করতে পারব না বোধহয়।

সুশোভনার করপল্লব শিহরিত হয়, আনন্দের শিহরণ। প্রণয়ীর ভাষায় অন্তরের বেদনা ধ্বনিত হয়েছে। এতদিনে ও এইবার আন্তরিক হয়ে উঠেছে এই মূঢ় পুরুষের প্রেম। অন্তরজয়ের অভিযান সফল হয়েছে সুশোভনার।

তারপর আর বেশি দিন নয়। নবাম্বুদের আড়ম্বরে আকাশ মেদুর হয়ে ওঠে যেদিন, সেদিন কৌতুকিনী সুশোভনা বর্ণায়িত দুকূলে কুসুমে আভরণে ও অঙ্গরাগে সজ্জিত হয়ে, সুলীল আবেগে প্রণয়ীর হাত ধ’রে বলে—উপবনভ্রমণে আমায় নিয়ে চল গুণাভিরাম। আজ মন চায়, দুই চরণের মঞ্জীর নৃত্যভঙ্গে শিঞ্জিত ক’রে তোমার শ্রবণপদবী রম্যনিনাদে নন্দিত করি।

উপবনে প্রবেশ করতেই শোনা যায়, তমালতরুর পত্রান্তরাল হতে কেকারব ধ্বনিত হয়ে দিক চমকিত ক’রে তুলেছে। প্রণয়ীর হাত ধ’রে সুশোভনা, যেন সত্যই কেকোৎকণ্ঠা বর্ষাময়ূরীর মত আনন্দে চঞ্চল হয়ে তমালতরুর কাছে এসে দাঁড়ায়।

হঠাৎ প্রশ্ন করে সুশোভনা—শিখিবাঞ্ছিত এই পত্রালীসুন্দর তরুর নাম কি প্রিয়তম?

—তমাল।

—ভাল লক্ষণ দেখালেন!

দুই অধরের স্ফুরিত হাস্য লুকিয়ে কেলিকপটিনী সুশোভনা বেদনার্তভাবে প্রণয়ীর দিকে তাকায়।—অভিশাপ লাগল আমার জীবনে, এইবার আমাকে হারাবার জন্য প্রস্তুত থাকুন।

আর্তনাদ ক’রে ওঠেন প্রণয়ী। সুশোভনার অলক্তরঞ্জিত চরণদ্বয় দুই বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরবার জন্য লুটিয়ে পড়েন। সরে যায় সুশোভনা।—আজ আমাকে কিছুক্ষণ নির্জন নিভৃতে থাকতে দিন।

সন্ধ্যা হয়, তমালতলে অন্ধকার নিবিড়তর হয় ওঠে। একাকিনী বসে থাকে সুশোভনা। তার পর আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

প্রণয়ী জানেন, খুঁজে আর পাওয়া যাবে না। নীলবর্ণ বনস্থলীর সকল পুষ্পের আত্মমথিত সুরভি হতে উদ্ভূতা সেই পরিচয়হীনা বিস্ময়ের নারী এই মেঘাবৃত সন্ধ্যার অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে। মৃত্যু হয়েছে সেই সুন্দরীধরা আকস্মিকার অনামিকা প্রেমিকার।

নীলবর্ণ কাননের দিকে তৃষ্ণার্তের মত তাকিয়ে বসে থাকে রাজনন্দিনী সুশোভনা। সম্মুখে বসে থাকে ব্যজনিকা সহচরী সুবিনীতা।

নবীন কিশলয়ের বৃন্ত কুঙ্কুমরসে অনুলিপ্ত ক’রে সুশোভনার বক্ষঃপটে পত্রলিখা এঁকে দেয় সহচরী। বীজনপত্র আন্দোলিত ক’রে সুশোভনার স্বেদাঙ্কুরব্যথিত কপোলে সমীর সঞ্চার করতে থাকে। নিপুণা কলাবতীর মত ধীরসঞ্চালিত করাঙ্গুলি দিয়ে রাজনন্দিনী সুশোভনার কপাললগ্ন চিকুরনিকুরম্বে বিলোল ভ্রমরক রচনা করে সহচরী। স্তবকিত মেঘভারের মত কবরীবদ্ধ কেশদামের উপর একখণ্ড সুপ্রভ চন্দ্রোপল গ্রথিত ক’রে দেয়। তারপর এক হাতে সুশোভনার চিবুক স্পর্শ ক’রে দুই চক্ষুর সাগ্রহ দৃষ্টি তুলে দেখতে থাকে সহচরী, রাজকুমারীর মুখশোভা সম্পাদনে প্রসাধনের আর কিছু বাকি থেকে গেল কিনা।

সহর্ষে দুই ভ্রূধনু ভঙ্গুরিত ক’রে রাজকুমারী সুশোভনা সহচরীর দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে প্রশ্ন করে—কি দেখছ সুবিনীতা?

—তোমার রূপ দেখছি রাজনন্দিনী।

—কেমন লাগছে দেখতে?

—সুন্দর।

—কি রকম সুন্দর?

—রত্নখচিত অসিফলকের মত উজ্জ্বল, কনকধুতুরার আসবের মত বর্ণমদির, পুষ্পাচ্ছাদিত কণ্টকতরুর মত কোমল। বস্তুহীনা প্রতিধ্বনির মত তুমি সুন্দরস্বরা। তুমি শ্রাবণী দামিনীর মত ক্ষণলাস্যনটী বহ্নি।

সুশোভনা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে—তুমি ভাষাবিদগ্ধা চারণীর মত কথা বলছ সুবিনীতা, কিন্তু তোমার কথার অর্থ আমি বুঝতে পারছি না।

সহচরী সুবিনীতার কণ্ঠস্বরে যেন এক অভিযোগ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে— রূপাতিশালিনী রাজতনয়া, তোমার রূপ বড় নিষ্ঠুর। এই রূপ মুগ্ধপুরুষের হৃদয় বিদ্ধ করে, বিবশ করে, আর বিক্ষত করে। তোমার কণ্ঠস্বরের আহ্বান প্রতিধ্বনির ছলনার মত শ্রবয়িতার হৃদয় উদ্‌ভ্রান্ত ক’রে শূন্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। তুমি চকিতস্ফুরিত তড়িল্লেখার মত পথিকজননয়ন শুধু অন্ধ ক’রে দিয়ে সরে যাও। রূপের কৈতবিনী তুমি। সবই আছে তোমার, শুধু হৃদয় নেই।

সহচরীর অভিযোগবাণী শ্রবণ ক’রে ক্ষুব্ধ হওয়া দূরে থাক, উল্লাসে হেসে ওঠে সুশোভনা—তুমি ঠিকই বলেছ সুবিনীতা। শুনে সুখী হলাম।

—কিংকরীর বাচালতা ক্ষমা কর রাজকুমারী, একটি সত্য কথা বলব?

—বল।

—আমি দুঃখিত।

—কেন?

—তোমার এই রূপরম্যা মূর্তিকে রত্নাভরণে সাজাতে আর আমার আনন্দ হয় না। মনে হয়, বৃথাই এতদিন ধ’রে তোমাকে এত যত্নে সাজিয়েছি।

—বৃথা?

—হ্যাঁ, বৃথা। একের পর এক, তোমার এক একটি প্রেমহীন অভিসারের লগ্নে তোমার পদতল বৃথাই লাক্ষাপঙ্কে রঞ্জিত করেছি। বৃথাই এত সমাদরে পরাগলিপ্ত করেছি তোমার বরতনু। বৃথাই সুচারু কজ্জলমসিরেখায় প্রসাধিত ক’রে তোমার এই নয়নদ্বয়ে মৃগলোচনদর্পহারিণী নিবিড়তা এনে দিয়েছি।

—তোমার কর্তব্য করেছ কিংকরী, কিন্তু বৃথা বলছ কোন্ দুঃসাহসে?

—দুঃসাহসে নয়, অনেক দুঃখে বলছি রাজনন্দিনী। তুমি আজও কারও প্রেমবশ হলে না, কোন প্রণয়িহৃদয়ের সম্মান রাখলে না। আমার দু’হাতের যত্নে সাজিয়ে-দেওয়া তোমার প্রেমিকামূর্তি শুধু প্রণয়ীর হৃদয় বিদ্ধ বিক্ষত ও ছিন্ন ক’রে ফিরে আসে। আমার বড় ভয় করে, রাজনন্দিনী।

অবিচলিত স্বরে সুশোভনা প্রশ্ন করে—ভয় আবার কিসের কিংকরী?

—এক একটি ছলপ্রণয়ের লীলা সমাপ্ত ক’রে যখন তুমি ভবনে ফিরে আস কুমারী, তখন আমি তোমার ঐ পদতলের দিকে তাকিয়ে দেখি। মনে হয়, তোমার চরণাসক্ত অলক্ত যেন কোন্ এক হতভাগ্য প্রেমিকের আহত হৃৎপিণ্ডের রক্তে আরও শোণিম হয়ে ফিরে এসেছে।

প্রগল্ভ হাসির উচ্ছ্বাস তুলে, যৌবনমদয়িত তনু হিল্লোলিত করে সুশোভনা বলে—তোমার মনে ভয় হয় মূঢ়া কিংকরী, আর আমার মনে হয়, নারীজীবন আমার ধন্য হল। এক একজন মহাবল যশস্বী ও অতুল বৈভবগর্বে উদ্ধত নরপতি এই পদতললীন অলক্তে কমলগন্ধবিধুর ভৃঙ্গের মত চুম্বন দানের জন্য লুটিয়ে পড়ে, পরমুহূর্তে সে উদ্‌ভ্রান্তের জন্য শুধু শূন্যতার কুহক পিছনে রেখে দিয়ে চিরকালের মত সরে আসি। বল দেখি সহচরী, নারীজীবনে এর চেয়ে বেশি সার্থক আনন্দ ও গর্ব কি আর কিছু আছে?

—ভুল বুঝেছ রাজতনয়া, এমন জীবন কোন নারীর কাম্য হতে পারে না।

—নারীজীবনের কাম্য কি?

—বধূ হওয়া।

আবার অট্টহাসির শব্দে মূর্খা ব্যজনিকা কিংকরীর উপদেশ যেন বিদ্রূপে ছিন্ন ক’রে সুশোভনা বলে—বধূ হওয়ার অর্থ পুরুষের কিংকরী হওয়া, কিংকরী হয়েও কেন সেই ক্ষুদ্র জীবনের দুঃখ কল্পনা করতে পার না সুবিনীতা? আমাকে মরণের পথে যাবার উপদেশ দিও না।

—আমার অনুরোধ শোন কুমারী, পুরুষহৃদয় সংহারের এই নিষ্ঠুর ছলপ্রণয়বিলাস বর্জন কর। প্রেমিকের প্রিয়া হও, বধূ হও, গেহিণী হও।

বিদ্রূপকুটিল দৃষ্টি তুলে সুশোভনা আবার প্রশ্ন করে—কি করে প্রিয়া-বধূ-গেহিণী হতে হয় কিংকরী? তার কি কোন নিয়ম আছে?

—আছে।

—কি?

—প্রেমিককে হৃদয় দান কর, প্রেমিকের কাছে সত্য হও।

হেসে ফেলে সুশোভনা—আমার জীবনে হৃদয় নামে কোন বোঝা নেই সুবিনীতা। যা নেই, তা কেমন ক’রে দান করব বল?

ব্যজনিকা কিংকরীর চক্ষ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়। ব্যথিত স্বরে বলে—আর কিছু বলতে চাই না রাজনন্দিনী। শুধু প্রার্থনা করি, তোমার জীবনে হৃদয়ের আবির্ভাব হোক।

বিরক্ত দৃষ্টি তুলে সুশোভনা জিজ্ঞাসা করে—তাতে তোমার কি লাভ?

—কিংকরীর জীবনেরও একটি সাধ তাহলে পূর্ণ হবে।

—কিসের সাধ?

—তোমাকে বধূবেশে সাজাবার সাধ। ঐ সুন্দর হাতে বরমাল্য ধরিয়ে দিয়ে তোমাকে দয়িতভবনে পাঠাবার শুভলগ্নে এই মূর্খা ব্যজনিকার আনন্দ শঙ্খধ্বনি হয়ে একদিন বেজে উঠবে। এই আশা আছে বলেই আমি আজও এখানে আছি রাজকুমারী, নইলে তোমার ভর্ৎসনা শুনবার আগেই চলে যেতাম।

সুশোভনা রুষ্ট হয়—তোমার এই অভিশপ্ত আশা অবশ্যই ব্যর্থ হবে কিংকরী, তাই তোমাকে শাস্তি দিলাম না। নইলে তোমার ঐ ভয়ংকর প্রার্থনার অপরাধে তোমাকে আজই চিরকালের মত বিদায় ক’রে দিতাম।

সুশোভনা গম্ভীর হয়। সহচরী সুবিনীতাও নিরুত্তর হয়। স্তব্ধ নিদাঘের মধ্যাহ্নে লতাবাটিকার ছায়াচ্ছন্ন অভ্যন্তরে অঙ্গরাগসেবিত তনুশোভা নিয়ে বসে থাকে মণ্ডুকরাজপুত্রী সুশোভনা। সম্মুখে নীলবর্ণ কাননের উপান্তপথের দিকে অদ্ভুত তৃষ্ণাতুর দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থাকে। আর, ব্যজনিকা সুবিনীতা নিঃশব্দে বীজনপত্র আন্দোলিত ক’রে কিংকরীর কর্তব্য পালন করতে থাকে।

হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে সুশোভনা। কাননপথের দিকে নিবদ্ধদৃষ্টি সুশোভনার দুই চক্ষু মৃগয়াজীবা ব্যাধিনীর চক্ষুর মত দেখায়। কি যেন দেখতে পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে সুশোভনার নিবিড় কৃষ্ণপক্ষ্মসেবিত দুই লোচনের তারকা। সহচরী সুবিনীতাও কৌতূহলী হয়ে কাননভূমির দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে শঙ্কিতভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়। শিহরিত হস্তের বীজনপত্র আতঙ্কে কেঁপে ওঠে।

অশ্বারূঢ় এক কান্তিমান যুবাপুরুষ কাননপথে চলেছেন। বোধ হয় পথভ্রান্ত হয়েছেন, কিংবা পিপাসার্ত হয়েছেন। তাই শীতল সরসীসলিলের সন্ধানে কাননের অভ্যন্তরের দিকে ধীরে ধীরে চলেছেন। তাঁর রত্নসমন্বিত কিরীট সূর্যকরনিকরের স্পর্শে দ্যুতিময় হয়ে উঠেছে। কে এই বলদৃপ্ততন যুবাপুরুষ? মনে হয়, কোন রাজ্যাধিপতি নরশ্রেষ্ঠ।

উঠে দাঁড়ায় সুশোভনা। ঐ কিরীটের বিচ্ছুরিত দ্যুতি যেন সুশোভনার নয়নে খর বিদ্যুতের প্রমত্ত লাস্য জাগিয়ে তুলেছে। কিংকরী সুবিনীতা সভয়ে জিজ্ঞাসা করে— ঐ আগন্তুকের পরিচয় তুমি জান কি?

—জানি না, অনুমান করতে পারি।

—কে?

—বোধ হয় ইক্ষ্বাকুগৌরব সেই মহাবল পরীক্ষিৎ। শুনেছি, আজ তিনি মৃগয়ায় বের হয়েছেন।

সুবিনীতা বিস্মিত হয়ে এবং শ্রদ্ধাপ্লুত স্বরে প্রশ্ন করে— ইক্ষ্বাকুগৌরব পরীক্ষিৎ? অযোধ্যাপতি, পরম প্রজাবৎসল, মহাবদান্য, ভীতজনরক্ষক, আর্তজনশরণ সেই ইক্ষ্বাকু?

সুশোভনা হাসে—হ্যাঁ কিংকরী, সুরেন্দ্রসম পরাক্রান্ত ইক্ষ্বাকুকুলতিলক পরীক্ষিৎ। ঐ দেখ, ধনুর্বাণ ও তূণীরে সজ্জিত, কটিদেশে বিলম্বিত দীর্ঘ অসি, দৃপ্ত তুরঙ্গের পৃষ্ঠাসীন বীরোত্তম পরীক্ষিৎ। কিন্তু…কিন্তু তোমাকে আর আশ্চর্য ক’রে দিতে চাই না সুবিনীতা। তুমি মূর্খা, তুমি কিংকরী মাত্র, কল্পনাও করতে পারবে না তুমি, ঐ ধনুর্বাণতূণীরে সজ্জিত পরাক্রান্তের পুরুষহৃদয় একটি কটাক্ষে চূর্ণ করতে কি আনন্দ আছে!

কিংকরী সুবিনীতা সন্ত্রস্ত হয়ে সুশোভনার হাত ধরে।—নিবৃত্ত হও রাজতনয়া। অনেক করেছ, তোমার মিথ্যাপ্রণয়কৈতবে বহু ভগ্নহৃদয় নৃপতির জীবনের সব সুখ মিথ্যা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রজাপ্রিয় ইক্ষ্বাকুর সর্বনাশ আর করো না।

মদহাস্যে আকুল হয়ে কিংকরীর হাত সরিয়ে দেয় সুশোভনা। মণিময় সপ্তকী কাঞ্চী ও মুক্তাবলী তুলে নিয়ে নিজের হাতেই নিজেকে সজ্জিত করে। তারপর হাতে তুলে নেয় একটি সপ্তস্বরা বীণা। প্রস্তুত হয়ে নিয়ে সুশোভনা বলে—আমি যাই সুবিনীতা। বৃথা মূর্খের মত বিষণ্ণ হয়ো না। কিংকরীর কর্তব্য সদাহাস্য মুখে পালন কর, তাহলেই সুখী হবে।

লতাবাটিকার দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে সুশোভনা একবার থামে। কয়েক মুহূর্ত কি যেন চিন্তা করে। তার পরেই সুবিনীতাকে আদেশ করে।—প্রতি সন্ধ্যায় ইক্ষ্বাকুর প্রাসাদলগ্ন উপবনের প্রান্তে চর ও শিবিকা অতি সঙ্গোপনে প্রেরণ করতে ভুলবে না।

লতাবাটিকার নিভৃত থেকে বের হয়ে পান্থবিটপীর ছায়ায় ছায়ায় কাননভূমির দিকে অগ্রসর হতে থাকে সুশোভনা। মাথা হেঁট করে অশ্রুসিক্ত নেত্রে অনেকক্ষণ লতাবাটিকার নিভৃতে চুপ ক’রে বসে থাকে সুবিনীতা। আর একবার কাননপথের দিকে তাকায়; সুশোভনাকে আর দেখা যায় না। লতাবাটিকার নিভৃত হতে মৎকরাজের শৈবালবর্ণ প্রাসাদের কক্ষে একাকিনী ফিরে আসে সুবিনীতা।

সুন্দর কানন। বহুলবল্কল প্রিয়াল আর শিবদ্রুম বিল্বের ছায়ায় সমাকীর্ণ। লতাপরিবৃত শত শত নক্তমাল কোবিদার ও শোভাঞ্জন। চণ্ড নিদাঘের ভ্রূকুটি তুচ্ছ ক’রে এই নিবিড় বনভূভাগের প্রতি তৃণলতা ও পুষ্পের প্রাণ যেন বিহগস্বরলহরী হতে উৎসারিত নাদপীযূষ পান ক’রে সরসিত হয়ে রয়েছে। কমলকিঞ্জল্কে সমাচ্ছন্ন এক সরোবরের জল পান করে পিপাসার্তি শান্ত করলেন পরীক্ষিৎ। মৃণাল তুলে নিয়ে এসে ক্লান্ত অশ্বকে খেতে দিলেন। তারপর শ্রমক্লম অপনোদনের জন্য নবলবকুলপল্লবের ছায়াতলে তৃণাস্তীর্ণ ভূমির উপর শয়ন করলেন।

পরীক্ষিতের সুখতন্দ্রা অচিরে ভেঙে যায়। উৎকর্ণ হয়ে উঠে বসেন পরীক্ষিৎ। বীণার তন্ত্রিঝংকার, তার সঙ্গে রমণীকণ্ঠনিঃসৃত শ্রুতিরমণীয় সুস্বর, মন্থর বনবায়ু যেন সেই স্বরমাধুরীতে আপ্লুত হয়ে গিয়েছে।

উঠলেন রাজা পরীক্ষিৎ। বনস্থলীর প্রতি তরুতলে লক্ষ্য রেখে সন্ধান ক’রে ফিরতে থাকেন। অবশেষে দেখতে পান, সেই সরোবরের তটে শৈবালাসনে উপবিষ্টা চন্দ্রোপলপ্রভাসমন্বিতা এক নারী সলিলহিল্লোলিত রক্তকোকনদের মৃণালকে তার অলক্তলিপ্ত পদের মৃদুল আঘাতে আন্দোলিত ক’রে যেন উচ্ছল যৌবনের অভিমান লীলায়িত করছে। করধৃত বীণার তন্ত্রীকে চম্পককলিকাসদৃশ করাঙ্গুলির স্পর্শে সুস্বরিত ক’রে গান গাইছে নারী।

মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকেন রাজা পরীক্ষিৎ। ও কি কোন মানবনন্দিনীর মূর্তি? অথবা প্রমূর্তা বনশ্রী? কিংবা এই সরোবরের সলিলোত্থিতা দ্বিতীয়া এক সুধাধরা দেবিকা?

এগিয়ে যান রাজা পরীক্ষিৎ। অপরিচিতার সম্মুখবর্তী হন। গীত বন্ধ ক’রে অপরিচিতা নারী আগন্তুক পরীক্ষিতের দিকে অপাঙ্গে নিরীক্ষণ করে। এতক্ষণে স্পষ্ট ক’রে দেখতে পান পরীক্ষিৎ, নারীর কবরীগ্রথিত চন্দ্রোপলের রশ্মির চেয়েও কত বেশি সান্দ্র ও স্নিগ্ধ এই নারীর দুই এণলোচনের রশ্মি।

কথা বলেন পরীক্ষিৎ—পরিচয় দাও এণাক্ষী।

—আমার পরিচয় জানি না।

—তোমার পিতা? মাতা? দেশ?

—কিছুই জানি না।

—বিশ্বাস করতে পারছি না বিম্বোষ্ঠী। সপ্তকীমেখলা ঐ কৃশকটিতট, মুক্তাবলীশোভিত ঐ সুধাধবল কণ্ঠদেশ, কুঙ্কুমাঙ্কিত ঐ কোমল বক্ষঃপট; তোমার কবরীর ঐ চন্দ্রোপল আর এই সপ্তস্বরা বিপঞ্চী, এ কি পরিচয়হীনতার পরিচয়?

—আমার পরিচয় আমি। এছাড়া আর কোন পরিচয় জানি না।

নীরবে অপলক নেত্রে শুধু তাকিয়ে থাকেন পরীক্ষিৎ।

নারী প্রশ্ন করে—কি দেখছেন গুণবান?

—দেখছি, তুমি বিস্ময় অথবা বিভ্রম।

—আপনি কে?

—আমি ইক্ষ্বাকু পরীক্ষিৎ।

—এইবার যেতে পারেন নৃপতি পরীক্ষিৎ। বনলালিতা এই পরিচয়হীনার কাছে আপনার কোন প্রয়োজন নেই।

—কর্তব্য আছে।

—কি কর্তব্য?

—নৃপতির সুখসুন্দর মণিময় ভবনে তোমাকে নিয়ে যেতে চাই, এই বনবাসিনীর জীবন তোমাকে শোভা দান করে না সুনয়না।

—বুঝলাম, রাজার কর্তব্য পালন করতে চাইছেন মহাবদান্য প্রজাবৎসল পরীক্ষিৎ। কিন্তু রাজকীয় উপকারে আমার কোন সাধ নেই, নৃপতি।

ক্ষণিকের জন্য নিরুত্তর হয়ে থাকেন পরীক্ষিৎ। দুই চক্ষুর দৃষ্টি নিবিড় হয়ে উঠতে থাকে। তারপরেই প্রেমবিধুর কণ্ঠস্বরে আহ্বান করেন—মণিময় ভবনে নয়, আমার মনোভব ভবনে এস সুতনুকা। প্রণয়দানে ধন্য কর আমার জীবন।

সপ্তস্বরা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় নারী।—একটি প্রতিশ্রুতি চাই নৃপতি পরীক্ষিৎ।

—বল।

—আপনি জীবনে কখনও আমাকে সরোবরসলিল দেখাবেন না।

—কেন?

—অভিশাপ আছে আমার জীবনে, যদি আর কোন দিন সরোবরসলিলে প্রতিবিম্বিত আমার মূর্তিকে আমি দেখতে পাই, তবে আমার মৃত্যু হবে সেই দিন।

—অভিশাপের শঙ্কা দূর কর সুযৌবনা। তুমি আমার প্রমোদভবনের ক্ষান্তিহীন উৎসবে চিরক্ষণের নায়িকা হয়ে থাকবে। কোন সরোবরের সান্নিধ্যে যাবার প্রয়োজন হবে না কোন দিন।

মণিদীপিত প্রমোদভবনের নিভৃতে পরীক্ষিতের প্রণয়াকুল জীবনের প্রতি দিন-যামিনীর মুহূর্তগুলি সুশোভনার নৃত্যে গীতে লাস্যে ও চুম্বনরভসে বিহ্বল হয়ে থাকে। এইভাবেই একদিন, সেদিন বৈশাখী সন্ধ্যার প্রথম প্রহরে পূর্ণেন্দুশোভিত আকাশ হতে কুন্দধবল কৌমুদীকণিকা এসে প্রমোদভবনের ভিতরে লুটিয়ে পড়ে। সেদিন মণিদীপ আর জ্বাললেন না রাজা পরীক্ষিৎ। শান্ত জ্যোৎস্নালোকে প্রমোদসঙ্গিনী সেই মেঘচিকুরা নারীর মুখের দিকে মমতামথিত সুস্নিগ্ধ দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থাকেন। অনুভব করেন পরীক্ষিৎ, আকাশের ঐ শশাঙ্কচ্ছবির মত এই মুখচ্ছবিও কম সুন্দর নয়। পূর্ণচন্দ্রের মাঝে মৃগরেখার মত এই বরনারীর ললাটেও কৃষ্ণচিকুরের ভ্রমরক সুনিবিড় ছায়ালেখা অঙ্কিত ক’রে রেখেছে।

সযত্নে নারীর ললাটলগ্ন ভ্রমরক নিজ হাতে বিন্যস্ত করতে থাকেন পরীক্ষিৎ। সুশোভনার হাত ধরেন; মৃদুস্বন শঙ্খের অস্ফুট নিঃশ্বাসধ্বনির মত নারীর কানের কাছে মুখ এগিয়ে দিয়ে আহ্বান করেন পরীক্ষিৎ—প্রিয়া!

প্রমদা নারীর চক্ষু মণিপ্রদীপের মত হঠাৎ প্রখর হয়ে ওঠে।—কি বলতে চাইছেন রাজা?

—তুমি আমার মনোভাব ভবনের নায়িকা নও প্রিয়া, তুমি আমার জীবনভবনের অন্তরতমা। আমার কামনার আকুলতার মধ্যে এতদিনে এক প্রেমসুন্দর প্রদীপ জ্বলে উঠেছে, তাই মণিদীপ নিভিয়ে দিয়েও শুধু হৃদয় দিয়েই দেখতে পাই, তুমি কত সুন্দর।

কৌতুকিনীর অধর সুস্মিত হয়ে ওঠে। এতদিনে আন্তরিক হয়েছেন রাজা পরীক্ষিৎ। প্রমদাতনুবিলাসী নৃপতির আকাঙ্ক্ষা আন্তরিক প্রেমে পরিণাম লাভ করেছে। অপরিচিতা নারীকে হৃদয় দিয়ে চিরজীবনের আপন করে নিতে চাইছেন পরীক্ষিৎ।

পরীক্ষিতের হাত ধ’রে প্রমদা নারী হঠাৎ আবেগাকুল হয়ে ওঠে—চন্দ্রিকাবিহ্বল এমন বৈশাখী সন্ধ্যায় আজ আর ঘরে থাকতে মন চাইছে না প্রিয়। তোমার উপবনে চল।

নবকাশসন্নিভ সুশ্বেত ক্ষৌম পট্টবাসে সুতনু সজ্জিত ক’রে, শ্বেত স্ফটিককণিকায় খচিত শ্বেতাংশুকজালে কবরী আচ্ছন্ন ক’রে, শ্বেত পুষ্পের মালিকা কণ্ঠলগ্ন ক’রে, জ্যোৎস্নালিপ্ততনু সুধবলা কলহংসীর মত উৎফুল্লা হয়ে নৃপতি পরীক্ষিতের সঙ্গে উপবনে প্রবেশ করে সুশোভনা। পরীক্ষিতের মুখের দিকে তাকিয়ে আবেদন করে— আজ আমার মন চাইছে, রাজা, কলহংসীর মত জলকেলি ক’রে আপনার দুই চক্ষুর দৃষ্টি নন্দিত করি।

—তাই কর প্রিয়া।

উপবনের এক সরোবরের তটে এসে দাঁড়ালেন রাজা পরীক্ষিৎ, সঙ্গে সুশোভনা।

মৃণালভুক মরাল আর কলহংসের দল অবাধ আনন্দে সরোবরসলিলে সন্তরণ করে ফিরছে। উৎফুল্লা কলহংসীর মত হর্ষভরে জলে নামে সুশোভনা। কয়েকটি মুহূর্ত নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার পরেই হর্ষহীন বেদনাবিষণ্ণ মুখে পরীক্ষিতের দিকে তাকায়।—আমাকে এই সরোবরসলিলের সান্নিধ্যে কেন নিয়ে এলেন রাজা?

—তোমারই ইচ্ছায় এসেছি প্রিয়া।

—আপনার প্রতিশ্রুতি স্মরণ করুন।

প্রতিশ্রুতি? চমকে ওঠেন, এবং এতক্ষণে স্মরণ করতে পারেন পরীক্ষিৎ, প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে তিনি তাঁর জীবনপ্রিয়াকে সরোবরসলিলের সান্নিধ্যে নিয়ে এসেছেন।

সুশোভনা বলে—আপনি ভুল ক’রে আমাকে আমার জীবনের অভিশাপের সান্নিধ্যে নিয়ে এসেছেন রাজা। সলিলবক্ষে আমার প্রতিচ্ছবি দেখেছি। এখন আমাকে বিদায় দেবার জন্য প্রস্তুত হোন।

পরীক্ষিৎ বলেন—তোমাকে বিদায় দিতে পারব না প্রিয়া। এই জীবন থাকতে না।

ভগ্নহৃদয়ের আর্তনাদ নয়, অসহায়ের বিলাপ নয়, সংকল্পে কঠিন এক বলিষ্ঠের দৃঢ় কণ্ঠস্বর।

চমকে ওঠে সুশোভনা। জীবনে এই প্রথম শঙ্কাতুর হয়ে ওঠে শঙ্কাহীনা কৌতুকিনীর মন।

সুশোভনা—আবার ভুল করবেন না রাজা। দৈব অভিশাপের কোপ মিথ্যা করবার শক্তি আপনার নেই।

পরীক্ষিৎ—সত্যই অভিশাপ, না অভিশাপের কৌতুক?

পরীক্ষিতের প্রশ্ন শুনে সুশোভনার বুকের ভিতর নিঃশ্বাসবায়ু যেন হঠাৎ ভীরুতার বেদনায় কেঁপে ওঠে।

পরীক্ষিৎ এগিয়ে যেয়ে সুশোভনার সম্মুখে দাঁড়ালেন।—এস প্রিয়া, বাহুবন্ধনে তোমাকে বক্ষোলগ্ন করে রাখি সর্বক্ষণ, দেখি কোন্ অভিশাপের প্রেত তোমার প্রাণ হরণ ক’রে নিয়ে যেতে পারে।

সভয়ে পিছিয়ে সরে দাঁড়ায় সুশোভনা।—অনুরোধ করি রাজা পরীক্ষিৎ, কাছে আসবেন না। আমাকে এই স্থানে একাকিনী থাকতে দিন।

পরীক্ষিৎ—কতক্ষণ?

সুশোভনা—কিছুক্ষণ।

পরীক্ষিৎ—কেন?

সুশোভনা—বুঝতে চাই, ঐ অভিশাপ সত্যই একটি মিথ্যার কৌতুক! বিশ্বাস করতে চাই, মিথ্যা হয়ে গিয়েছে অভিশাপ। সরোবরতটের নির্জন একান্তে দাঁড়িয়ে আমাকে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করবার সুযোগ দান করুন নৃপতি।

পরীক্ষিৎ—কিসের প্রার্থনা?

সুশোভনার কণ্ঠস্বর অদ্ভুত এক আকুলতায় কাতর হয়ে ওঠে।—তোমারই প্রেমিকা মৃত্যুশঙ্কা পরিহার করবার জন্য প্রার্থনা করতে চায়, সুযোগ দাও প্রিয় পরীক্ষিৎ।

মিথ্যা ভয়ে বিহ্বলা নারী যেন এক ব্রত পালন ক’রে তার মিথ্যা বিশ্বাসের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করতে চাইছে। নারীর এই করুণ অনুরোধের অমর্যাদা করলেন না পরীক্ষিৎ। সরোবরতট থেকে সরে এসে উপবনের আম্রবীথিকার ছায়ায় বিচরণ ক’রে ফিরতে থাকেন।

আম্রমঞ্জরী হতে ক্ষরিত মধুবিন্দু ললাটচুম্বন ক’রে যেন সান্ত্বনা দেয়; মত্ত কোকিলের কুহুকূজনে ধরণী সঙ্গীতময় হয়ে ওঠে তবুও উদ্বেগ ভুলতে পারেন না পরীক্ষিৎ। সত্যই কি কোন অভিশাপের কৌতুকে এই বৈশাখী যামিনীর চন্দ্রিকা তাঁর জীবনে প্রিয়াহীন শূন্যতা সৃষ্টির জন্য দেখা দিয়েছে?

এই উদ্বেগ সহ্য হয় না, পরমুহূর্তে ত্বরিতপদে ফিরে গিয়ে আবার সরোবরতটে এসে দাঁড়ান পরীক্ষিৎ—প্রিয়া!

ডাকতে গিয়ে আর্তনাদ ক’রে ওঠেন পরীক্ষিৎ। শূন্য ও নির্জন সেই সরোবরতটে কোন প্রার্থনার মূর্তি নেই; শ্বেতাংশুকজালে কবরীর শোভা পুষ্পিত ক’রে কোন নারীর মূর্তি নেই।

পরীক্ষিতের দুই চক্ষুর দৃষ্টি সুতীক্ষ্ণ সায়কের মত চারদিকের শূন্যতা ভেদ ক’রে ছুটতে থাকে। সরোবরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সন্দেহ করেন, সরোবরের খলসলিল বুঝি তাঁর প্রিয়াকে গ্রাস করেছে। পরক্ষণে দেখতে পেলেন; সরোবরের অপর প্রান্তে যেন এক মৃতা কলহংসীর জ্যোৎস্নানুলিপ্ত দেহপিণ্ড তটভূমি স্পর্শ ক’রে ভেসে রয়েছে। একদল প্রেতচ্ছায়া এসে মুহূর্তের মধ্যে সেই সুশ্বেতা কলহংসীর মৃতদেহ তুলে নিয়ে চলে গেল।

বিশ্বাস করতে পারেন না। সমস্ত ঘটনা ও দৃশ্যগুলিকে সন্দেহ হয়। বুঝি তাঁর উদ্বিগ্ন চিত্তের একটা বিভ্রম, ব্যথিত দৃষ্টির প্রহেলিকা।

কিন্তু আর এক মুহূর্তও কালক্ষেপ করলেন না পরীক্ষিৎ। উপবনের প্রহরীদের ডাক দিলেন, সরোবরের বাঁধ ভেঙে দিয়ে সরোবর জলশূন্য করলেন। কিন্তু নিমজ্জিত কোন নারীদেহের সন্ধান পেলেন না।

ছুটে গিয়ে রাজভবনের মন্দুরায় প্রবেশ করেন এবং রণাশ্বের মুখে রজ্জুযোজিত ক’রে প্রস্তুত হন পরীক্ষিৎ। পরমুহূর্তে অশ্বারূঢ় হয়ে সরোবরের প্রান্ত লক্ষ্য ক’রে ছুটে চলে যান।

কিন্তু প্রান্তর আর বনোপান্তের সর্বত্র সন্ধান করেও সেই নারীমূর্তির সাক্ষাৎ কোথাও পেলেন না পরীক্ষিৎ। হতাশ হয়ে তাঁর শূন্য বিষয় ও দীপহীন মণিভবনের দিকে ফিরে যেতে থাকেন। যেমন ক্লান্ত অশ্বের অঙ্গ হতে স্বেদজলের ধারা, তেমনই পরাক্রান্ত পরীক্ষিতেরও দুই চক্ষু হতে অবিরল অশ্রুধারা ঝরে পড়ে।

আবার উপবনের পথে প্রবেশ করেন রাজা পরীক্ষিৎ। হঠাৎ দেখতে পান গোপনচর চরের মত এক ছায়ামূর্তি যেন বৃক্ষান্তরালে দাঁড়িয়ে আছে। কটিবন্ধ হতে খড়্গ হাতে তুলে নিয়ে গোপনচর ছায়ামূর্তির দিকে ছুটে যান পরীক্ষিৎ। কিন্তু ধরতে পারলেন না। সেই ছায়ামূর্তিও দৌড় দিয়ে এক সলিল-প্রবাহিকায় ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু চরের মূর্তিটিকে স্পষ্ট দেখে ফেললেন পরীক্ষিৎ। সে এক মণ্ডুক।

মণ্ডুকরাজের শৈবালবর্ণ শিলানিকেতনের কক্ষে রাজপুত্রীর কিঙ্কিণীক্বণলাঞ্ছিত চরণ তেমন ক’রে আর নৃত্যায়িত হয়ে উঠল না। সফল অভিসারের আনন্দও মাধুকীবারিতে তেমন ক’রে আর মত্ত হতে পারল না। কপটাভিসারিকা সুশোভনা যেন কণ্টকবিদ্ধ চরণ নিয়ে ফিরে এসেছে।

অপরাহ্ণ কাল। মণ্ডুক-জনপদের বাতাস হঠাৎ আর্তনাদে আর হাহাকারে পীড়িত হয়ে উঠল। প্রাসাদকক্ষের বাতায়নপথে দাঁড়িয়ে এই অদ্ভুত আর্তনাদের রহস্য বুঝতে চেষ্টা করে সুশোভনা, কিন্তু বুঝতে পারে না। মনে হয়, এক ধূলিলিপ্ত ঝঞ্ঝা যেন এই বৈশাখী অপরাহ্নকে আক্রমণ করার জন্য ছুটে আসছে।

—এ কোন্ নতুন সর্বনাশ করেছ রাজপুত্রী?

বাইরে নয়, কক্ষের ভিতরেই আর্ত কণ্ঠস্বরের ধিক্কার শুনে চমকে ওঠে সুশোভনা। মুখ ফিরিয়ে দেখতে পায়, রূঢ়ভাষিণী কিংকরী সুবিনীতা এসে দাঁড়িয়েছে। ভ্রূভঙ্গী উদ্ধত ক’রে সুশোভনাও রুষ্টস্বরে প্রশ্ন ক’রে।—কি হয়েছে?

—পরাক্রান্ত পরীক্ষিৎ মণ্ডুক-জনপদ আক্রমণ করেছেন। শত শত মণ্ডুকের প্রাণ সংহার ক’রে ফিরছেন। রাজ্যের প্রজা আর্তনাদ করছে, রাজা আয়ু অশ্রুপাত করছেন। শোণিতে ও দীর্ঘশ্বাসে ভরে উঠল মণ্ডুকজনসংসার। কোন্ নতুন কৌতুকসুখে রাজ্যের এই সর্বনাশ করলে নির্মমা? পরাক্রান্ত পরীক্ষিতের কাছে কেন তোমার পরিচয় প্রকট ক’রে দিয়ে এসেছ কপটিনী?

—মিথ্যা অভিযোগ করো না বিমূঢ়া। নিমেষের মনের ভুলেও নৃপতি পরীক্ষিতের কাছে আমি আমার পরিচয় প্রকট করিনি।

কিংকরী সুবিনীতা অপ্রস্তুত হয়।—আমার সংশয় মার্জনা কর রাজপুত্রী, কিন্তু…।

—কিন্তু কি?

—কিন্তু ভেবে পাই না, মহাচেতা পরীক্ষিৎ কেন অকারণে অবৈধ মণ্ডুকজাতির বিনাশে হঠাৎ প্রমত্ত হয়ে উঠলেন?… আমি রাজসমীপে চললাম কুমারী।

মণ্ডুকরাজ আয়ুর কাছে সংবাদ নিবেদনের জন্য ব্যস্তভাবে চলে যায় কিংকরী সুবিনীতা।

কক্ষের বাতায়নের কাছে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে সুশোভনা। নিষ্প্রভ হয়ে আসছে অপরাহ্ণমিহির। অদৃশ্য ও দুর্বোধ্য সেই বৈশাখী ঝাঞ্ঝার ক্রুদ্ধ নিঃস্বন নিকটতর হয়ে আসছে। মনে হয় সুশোভনার, মণ্ডুকজনপদের উদ্দেশে নয়, এই প্রতিহিংসার ঝড় তারই জীবনের সকল গর্ব আক্রমণ করবার জন্য ছুটে আসছে।

হঠাৎ আপন মনেই হেসে ওঠে সুশোভনা। জীর্ণপত্রের আবর্জনার মত এই মিথ্যা দুশ্চিন্তার ভার মন থেকে দূরে নিক্ষেপ করে। দীপ জ্বালে, মাধুকীবারির পাত্রে ওষ্ঠ দান করে। কনকমুকুর সম্মুখে রেখে তিলপর্ণীর তিলক অঙ্কিত করে কপালে। জনপদের আর্তস্বর আর অদৃশ্য ঝাঞ্ঝার ভ্রূকুটি আসবমধুসিক্ত অধরের উপহাস্যে তুচ্ছ ক’রে সুতন্ত্রিবীণ কোলের উপর তুলে নেয়। কিন্তু ঝংকার দিতে গিয়ে প্রথম করক্ষেপের আগেই বাধা পায় সুশোভনা।

—রাজকুমারী!

সুবিনীতা এসে দাঁড়িয়েছে। বিরক্তভাবে ভ্রূক্ষেপ করে সুশোভনা—আবার কোন্ দুর্বার্তা নিয়ে এসেছ সুমুখী?

—দুর্বার্তাই এনেছি সুব্রতা রাজকুমারী। তোমার ছলনায় ভুলেছেন রাজা পরীক্ষিৎ; কিন্তু মণ্ডুকজাতির দুর্ভাগ্য ভোলেনি। দৈবের ইঙ্গিতে তোমার অপরাধ আজ জাতির অপরাধ হয়ে ধরা পড়ে গিয়েছে।

ভ্রূকুটি করে সুশোভনা—একথার অর্থ?

—নৃপতি পরীক্ষিৎ দূতমুখে জানিয়েছেন, দৈব অভিশাপে ভীতিগ্রস্তা তাঁর প্রিয়তমা যখন মূৰ্ছিতা হয়ে সরোবরজলে ভেসে গিয়েছিলেন, সেই সময় দুরাত্মা মণ্ডুকেরা চন্দ্রোপলপ্রভাসমন্বিতা তাঁর জীবনবাঞ্ছিতা সেই নারীকে নিধন করেছে। তিনি স্বচক্ষে একজন মণ্ডুক চরকে পালিয়ে যেতে দেখেছেন।

সুতন্ত্রিবীণায় ঝংকার তুলে সুশোভনা বলে—তোমার সুবার্তা শুনে আশ্বস্ত হলাম।

—আশ্বস্ত?

—হ্যাঁ, আশ্বস্ত ও আনন্দিত। এই অক্ষিতারকার কটাক্ষে, এই স্ফুরিতাধরের হাস্যে, এই মধুমুখের চুম্বনের ছলনায় প্রখরবুদ্ধি ও পরাক্রান্ত পরীক্ষিও কত মূর্খ হয়ে গিয়েছে।

—তুমি কৃতার্থা হয়েছ কৌতুকের নারী, কিন্তু তোমার প্রেমিক যে আজ তোমারই বিচ্ছেদের দুঃখে কত নিষ্ঠুর হয়ে নিরীহের শোণিতে ভয়াল উৎসব আরম্ভ করেছে, তার জন্য একটুও দুঃখ হয় না তোমার? এই অগ্নিদেহা দীপশিখারও হৃদয় আছে, তোমার নেই রাজকুমারী।

কিংকরী সুবিনীতা কক্ষ ছেড়ে চলে যায়।

সন্ধ্যা নামে গাঢ়তরা হয়ে। অন্তরীক্ষে অন্ধকার। বাতায়নের কাছে এসে দাঁড়ায় সুশোভনা এবং দেখতে পায়, জনপদপরিখার প্রান্তে শত্ৰুশিবিরে প্রদীপ জ্বলছে। শুনতে পায় সুশোভনা, শত্রুর খড়্গাঘাতে ছিন্নদেহ প্রজার মৃত্যুনাদ করুণ হয়ে সন্ধ্যার বাতাসে ছুটাছুটি করছে।

বাতায়নপথ থেকে সরে আসে সুশোভনা। কক্ষের দীপশিখা যেন আপন হৃদয় পুড়িয়ে অন্তরীক্ষের সেই ভয়াল অন্ধকার বাতায়নপথে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। কিন্তু আজ যেন অন্ধকারের মধ্যেই লুকিয়ে কিছুক্ষণের মত বধিরা হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছা করে সুশোভনা।

আবার আর্তনাদ শোনা যায়। চমকে ওঠে সুশোভনা, যেন তার বক্ষঃপঞ্জরে এসে আঘাত করছে যত মর্মভেদী ধ্বনি, যত নিরপরাধ বিপন্ন প্রাণের বিলাপ। সহ্য হয় না এই বিলাপ। ফুৎকারে দীপশিখা নিভিয়ে দিয়ে কক্ষের বহির্দ্বারে এসে চিৎকার ক’রে ডাক দেয় সুশোভনা—সুবিনীতা!

কক্ষান্তর হতে ছুটে আসে কিংকরী সুবিনীতা। সন্ত্রস্ত স্বরে বলে—আজ্ঞা কর।

সুশোভনা—আজ্ঞা করছি কিংকরী, এই মুহূর্তে শত্রু পরীক্ষিতের শিবিরে দূত প্রেরণ কর। জানিয়ে দাও, কোন মণ্ডুক তাঁর আকাঙ্খার নারীকে নিধন করেনি। জানিয়ে দাও, সে নারী হলো মণ্ডুকরাজদুহিতা সুশোভনা, যে এই প্রাসাদের কক্ষে তার সকল সুখ নিয়ে বেঁচে আছে। ছলপ্রণয়ে মুগ্ধ মূর্খ ও উন্মাদ নৃপতিকে এই সংহারের উৎসব ক্ষান্ত ক’রে চলে যেতে বলে দাও।

সুবিনীতা—জানিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজকুমারী। স্বয়ং মণ্ডুকরাজ আয়ু ব্রাহ্মণবেশে পরীক্ষিতের শিবিরে গিয়ে এই কথা জানিয়ে দিয়ে এসেছেন।

সন্ত্রস্তের মত চমকে ওঠে সুশোভনা, দুই কজ্জলিত খরনয়নের দীপ্তি হঠাৎ যেন উদাস ও করুণ হয়ে যায়। সুশোভনা শান্তভাবে হাসে—শুনে সুখী হলাম। পিতা এতদিন পরে আমার উপর নির্মম হতে পেরেছেন। ভাবতে ভাল লাগছে কিংকরী, আমার অপরাধ প্রকাশ ক’রে দিয়ে পিতা আজ প্রজাকে উন্মত্ত পরীক্ষিতের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়েছেন। এক নির্বোধ প্রেমিক আজ ছলসর্বস্বা কপটিনীকে ঘৃণা ক’রে চলে যাবে, আমিও সেই মূঢ়ের প্রেমের গ্রাস থেকে বেঁচে গেলাম।

কিংকরী সুবিনীতার দুই চক্ষু হঠাৎ বেদনায় বিচলিত হয়—প্রজা বেঁচেছে রাজকুমারী, কিন্তু তুমি…।

সুশোভনা—কি?

সুবিনীতা—প্রেমিক পরীক্ষিৎ প্রতীক্ষার দীপ জ্বেলে তোমারই আশায় রয়েছেন।

চিৎকার ক’রে ওঠে সুশোভনা—না হতে পারে না। এমন ভয়ংকর আশার কথা উচ্চারণ করো না কিংকরী। সে নিবোর্ধকে জানিয়ে দাও, আয়ুনন্দিনী সুশোভনার হৃদয় নেই, হৃদয় দান ক’রে পুরুষের ভার্যা হতে সে জানে না। সুশোভনাকে ঘৃণা ক’রে এই মুহূর্তে তাঁকে চলে যেতে বল।

সুবিনীতা—যদি তিনি ঘৃণা করতে না পারেন? তবে?

দীপশিখার দিকে তাকিয়ে স্থিরস্ফুলিঙ্গের মত দুই চক্ষুতারকা নিশ্চল ক’রে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে সুশোভনা। তারপর, নিজ দংশনে আহতা ফণিনীর মত যন্ত্রণাক্ত দৃষ্টি তুলে কিংকরী সুবিনীতার দিকে তাকিয়ে বলে—তবে সে নির্বোধের মনে ঘৃণা এনে দাও। নারীধর্মদ্রোহিণী কৌতুকিনী নারীর গোপন জীবনের সকল ইতিহাস তাকে শুনিয়ে দাও। সুশোভনার অপযশ রটিত হোক ত্রিভুবনে। জানুক পরীক্ষিৎ, মণ্ডুকরাজ আয়ুর চন্দ্রোপলপ্রভাসমন্বিতা তনয়া হলো এক বহুবল্লভা পরপূর্বা ও ভ্রষ্টা নারী।

অশ্রুসিক্ত নেত্রে কিংকরী সুবিনীতা বলে—এতক্ষণে বোধ হয় সেকথাও জানতে পেরেছেন রাজা পরীক্ষিৎ।

আর্তস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে সুশোভনা—কেমন ক’রে?

সুবিনীতা—পিতা আয়ু আজ তোমার উপর সত্যই নির্মম হয়েছেন কুমারী; তিনি স্বয়ং অমাত্যবর্গকে সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষিতের শিবিরে চলে গিয়েছেন, ইক্ষ্বাকুগৌরেব কাছে নিজমুখে নিজতনয়ার অপকীর্তিকথা জানিয়ে দিতে। এ ছাড়া মহাবল পরীক্ষিৎকে তোমার প্রণয়মোহ হতে মুক্ত করার আর কোন উপায় ছিল না দুর্ভাগিনী কুমারী।

করতলে চক্ষু আবৃত ক’রে সবেগে কক্ষ হতে ছুটে চলে যায় কিংকরী সুবিনীতা।

মাধুকীবারিতে পরিপূর্ণ পাত্রে নীলগরলের বুদ্বুদ ভাসে। আজ এতদিন পরে সুশোভনার জীবনে শেষ অভিসারের লগ্ন দেখা দিয়েছে। বাতায়নপথে দেখা যায়, আকাশে ফুটে আছে অনেক তারা, সিদ্ধকন্যাদের সন্ধ্যাপূজার ফুলগুলি যেন এখনও ছড়িয়ে রয়েছে। এই তো ঘুমিয়ে পড়বার সময়।

অপযশ রটিত হয়ে গিয়েছে। জগতের কোন অন্ধও এই রঙ্গময়ী কপটিনীকে চিনতে আর ভুল করবে না। এত কালের সব গর্ব, সব উল্লাস আর সব সুযোগ হারিয়ে শূন্য হয়ে গেল জীবন। মৃত্যু তো হয়েই গিয়েছে। তবে আর কেন? একটা ঘৃণার কাহিনী মাত্র হয়ে এই পৃথিবীতে পড়ে থাকবার আর কোন অর্থ হয় না। ছলস্বর্গের অপ্সরীর মত ছদ্মচারিণী এক রূপের সর্পীকে, দেহহীনা প্রেতিনীর চেয়েও ভয়ংকরী এক হৃদয়হীনাকে এইবার ঘৃণা ক’রে ফিরে যেতে পারবেন পরীক্ষিৎ। জগতের সকল চক্ষের ঘৃণা সহ্য করার জন্য এবং বিনা হৃদয়ের এই জীবনটাকে শুধু শাস্তি দেবার জন্য আর ধরে রাখবার কোন প্রয়োজন নেই।

মাধুকীবারির পাত্রে গরলফেন টলমল করে, তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে সুশোভনার ওষ্ঠাধর। পাত্র হাতে তুলে নেয় সুশোভনা।

—রাজনন্দিনী!

কিংকরী সুবিনীতার আহ্বানে বাধা পেয়ে সুশোভনা মুখ ফিরিয়ে তাকায়।

সুবিনীতা বলে—পরীক্ষিতের কাছ থেকে বার্তা এসেছে।

—কি?

—তিনি তোমার আশায় রয়েছেন।

—এ কি সম্ভব?

—এ সত্য।

—তিনি কি শোনেননি, আমি যে এক শুচিতাহীনা মসিলেখা মাত্র?

—সব শুনেছেন।

গরলপাত্র ভূতলে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সুশোভনা। বাতায়নের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখতে পায়, শত্রুর শিবিরে একটি প্রদীপ জ্বলছে, ধীর স্থির শান্ত ও নিষ্কম্প তার শিখা।

অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে সুশোভনা। শত্রুশিবিরের সেই প্রদীপের বিচ্ছুরিত জ্যোতি যেন সুশোভনার হৃৎপিণ্ডের অন্ধকার স্পর্শ করছে। জাগছে হৃদয়, যেন মরু-অন্ধকারের গভীরে নির্বাসিত এক মল্লীকোরক ফুটছে। আর, যেন এই জাগরণের বিস্ময় আপন আবেগে সুশোভনার মৃদুকম্পিত অধরের ভীতি ভেদ ক’রে গুঞ্জরণ হয়ে ফুটে ওঠে।—কী সুন্দর শত্রু তুমি!

কিংকরী সুবিনীতা চমকে উঠে প্রশ্ন করে—কি বলছ রাজকুমারী?

সুবিনীতার কাছে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে সুশোভনা।—আজ আমার জীবনে শেষ অভিসারের লগ্ন এসে গিয়েছে সুবিনীতা। সাজিয়ে দাও কিংকরী, আর সুযোগ পাবে না।

যেন এক নূতন আকাশের শ্রাবণী বেদনার ধারাবারিবিধৌত নবশেফালিকা, সুশোভনার অশ্রুলুপ্ত সেই সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে যায় কিংকরী সুবিনীতা। সভয়ে প্রশ্ন করে—কোথায় যেতে চাও রাজনন্দিনী?

সুশোভনা—ঐ সুন্দর শত্রুর কাছে।

সুবিনীতা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে—কি বেশে সাজাব?

সুশোভনা—বধূবেশে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *