অনল ও ভাস্বতী

অনল ও ভাস্বতী

মাহিষ্মতী নগরী। দূর হতে দেখে মনে হয়, যেন স্বর্ণপ্রাচীরে পরিবৃত শরৎ-মেঘের স্তবক। নিকটে এসে দাঁড়ালে দেখা যায়, কুসুমাকীর্ণ অরণ্যবলয়ে বেষ্টিত শঙ্খধবল ও শিল্পরুচিরম্য সৌধাবলী, পদ্ম স্বস্তিক ও বর্ধমান। এই মাহিষ্মতী নগরীর এক পুষ্পকাননের নিভৃতে মনঃশিলাময় পাষাণের অনুরাগে রঞ্জিত হয়ে আছে এক কলস্বনা স্রোতস্বিনী। এইখানে এসে প্রতি অপরাহ্নে একবার দাঁড়িয়ে থাকেন অনল এবং দেখে বিস্মিত হন, তাঁরই আসা-যাওয়ার পথের মাঝখানে কে যেন নানা মাঙ্গল্য উপাচার সাজিয়ে প্রত্যহের এক ব্রত উদ্‌যাপন ক’রে চলে গিয়েছে। সিতচন্দনে সিক্ত সহকার-কিশলয়ের একটি গুচ্ছ ও একটি দীপ। যূথিকার কোরক নয়, কিন্তু দেখতে সুশ্বেত যূথিকারই কোরকের মত, কা’র হৃদয়ের নিবেদিত শ্রদ্ধার লাজাঞ্জলি পথের উপর লুটিয়ে পড়ে আছে। এই কানননিভৃতের ক্ষিতিসৌরভ উশীরবাসিত সলিলে আরও সুবাসিত ক’রে দিয়ে কার ভৃঙ্গার এখনই চলে গিয়েছে।

প্রতি অপরাহ্নের মত আজও আবার বিস্মিত হয়েছেন অনল। কা’র পূজা এমন ক’রে তাঁরই আসা-যাওয়ার পথের উপর পড়ে থাকে? বুঝতে পারেন না এবং আজ পর্যন্ত জানতেও পারেননি, এই পূজা কিসের পূজা! মাহিষ্মতীর একটি দীপ কা’র নীরাজনের জন্য প্রতিদিন এই নিভৃতে আসে আর চলে যায়?

জানতে পারেন না কিন্তু জানতে ইচ্ছা করেন, তাই আজও এই মাহিষ্মতী নগরী ছেড়ে চলে যেতে পারছেন না অনল।

অকস্মাৎ বিপুল স্ফুর্জথুর মত প্রবল নিনাদের আঘাতে মাহিষ্মতীর অরণ্যবলয় শিহরিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। সে নিনাদ মেঘারাব নয়, অরণ্যের মদমত্ত মাতঙ্গযূথের বৃংহিতও নয়। শুনতে পেলেন অনল, চতুরঙ্গবলোপেত দিগ্বিজয়ীর ভীমল রণোল্লাস এসে মাহিষ্মতী নগরীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অনুমানও করতে পারেন অনল, কে এই দিগ্বিজয়ী। রণামোদে চঞ্চল যে বীরবাহিনীর করধৃত পতাকার প্রোৎফুল্ল কিঙ্কিণীজাল মাহিষ্মতীর প্রাসাদকেতনের গর্ব হরণ করবার সংকল্পে নিক্কণমুখর হয়ে উঠেছে, তার পরিচয় জানেন অনল।

এসেছেন দিগ্বিজয়প্রয়াসী পাণ্ডব সহদেব। নর্মদা অতিক্রম ক’রে রাজ্যের পর রাজ্য জয় ক’রে মহাশূর সহদেবের অভিষেণনাভিলাষী সৈন্য প্রভঞ্জনের বেগে ধাবিত হয়ে এসেছে। পরাজয় স্বীকার করেছেন অবন্তিরাজ। পরাভূত হয়েছে ভীষ্মকের ভোজ-কটকপুর। বিপর্যস্ত হয়েছে নিষাদভূমি। উৎসাদিত হয়েছে পুলিন্দ দেশ। এইবার মাহিষ্মতী। পাণ্ডবের গজযূথের কর্ণতালশব্দ পটহধ্বনির মত বাজে; সেই ধ্বনির আঘাতে মাহিষ্মতীর নগরদ্বারের লৌহকপাট কেঁপে উঠেছে। পাণ্ডববাহিনীর নিক্ষিপ্ত শরজালে আচ্ছন্ন মাহিষ্মতীর আকাশের নিবিড়ধবল বলাহক ভীত বলাকার মত আর্তনাদ ক’রে উঠেছে।

কিন্তু জানেন না পাণ্ডব সহদেব, এই মাহিষ্মতীর একটি দীপের দিকে এখন করুণাভিভূত নেত্রে তাকিয়ে আছেন জ্বলদর্চিতনু কৃশানু, যাঁর খরনেত্রের বিচ্ছুরিত ক্রোধ এই মুহূর্তে লক্ষ প্রজ্বলন্ত উল্কার জ্বালা নিয়ে পাণ্ডবের চতুরঙ্গবাহিনীকে দগ্ধ ক’রে ফেলতে পারে।

আতঙ্কিত মাহিষ্মতী নগরীকে দিগ্বিজয়ী সহদেবের আঘাত হতে রক্ষা করবার জন্য প্রস্তুত হলেন অনল। পুষ্পকাননের নিভৃত হতে অগ্রসর হয়ে নগরীর উপান্তে এসে দাঁড়ালেন। প্রচণ্ড জ্বালাময় স্বরূপ প্রকট করে দিলেন অনল। করালধূম জ্বালাবাষ্প আর উল্কাবৎ লক্ষ জ্বলদ্‌বহ্নিশিখা পাণ্ডব অনীকিনীর উপর ভয়ংকর এক আক্রোশের উৎসবে মত্ত হয়ে ওঠে। ভস্মীভূত হয় পাণ্ডবের রণরথ, নির্জিত হয় গজ অশ্ব ও পদাতিক। সহসা এই জ্বালালীলার উৎপাতে ভীত হয়ে অস্ত্রসংবরণ করেন সহদেব। বুঝতে পেরেছেন সহদেব, এ নিশ্চয় অনলদেবের লীলা। অনলের পরাক্রমে ও প্রসন্নতায় সুরক্ষিত মাহিষ্মতীকে অস্ত্রবলে নির্জিত করবার অভিলাষ বর্জন করেন সহদেব। স্তব্ধ হয় পাণ্ডবকটকের ধনু প্রাস ও ভল্ল, অঙ্কুশ পট্টিশ ও তোমর। অনলের অনুকম্পা প্রার্থনা ক’রে দূত প্রেরণ করেন দিগ্বিজয়ী সহদেব।

দূত এসে নিবেদন করে— দিগ্বিজয়প্রয়াসী পাণ্ডব আপনার সহায়তা প্রার্থনা করে, হে বায়ুসখা বৈশ্বানর। মাহিষ্মতী নগরীর অধিপতি নীল শুধু পাণ্ডবের বশ্যতা সুবিনীতচিত্তে ঘোষণা ক’রে ক্ষণকালের জন্য কিরীট অবনত করুক, এইমাত্র অভিলাষ। আপনি বাধা না দিলে পাণ্ডবের এই অভিলাষ অবশ্যই সিদ্ধ হবে। হে হিমারাতি হব্যবাহন, জানি না, যজ্ঞপ্রিয় পাণ্ডবের প্রতি আপনি কেন পরাঙ্মুখ হয়েছেন, আর আপনার সৌহার্দ্য লাভ ক’রে অপরাজেয় হয়েছে মাহিষ্মতীর অযাজ্ঞিক নরপতি নীল!

মাহিষ্মতীর শঙ্খধবল পাষাণের প্রাসাদে নৃপতি নীলের ঈষৎ প্রসন্ন ও ঈষৎ বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে নীলতনয়া ভাস্বতী—তবুও আপনি বিষণ্ণ কেন পিতা? প্রসন্ন হয়েছেন অনল, প্রচণ্ড সহদেবের বিকট সমরস্পর্ধার আঘাত হতে মাহিষ্মতীর সম্মান রক্ষা করেছেন অনল। আর দুশ্চিন্তা কেন পিতা?

নীল বলেন—এখনও নিশ্চিন্ত হতে পারছি না, তনয়া। অনলের অনুকম্পা প্রার্থনা ক’রে অনলের কাছে প্রচুর পূজোপচার আর রত্নরথ প্রেরণ করেছেন মাদ্ৰীসুত সহদেব। ভয় হয় কন্যা, তোমার শ্রদ্ধার ঐ সচন্দন সহকারকিশলয় ও দীপ ও লাজাঞ্জলির দিকে আর বেশিক্ষণ করুণাভিভূত নেত্রে তাকিয়ে থাকতে পারবেন না বহ্নিদেব অনল। সহদেবের অভিবাদনে বন্দিত অনল যদি এই মাহিষ্মতীর প্রতি তাঁর এতদিনের কৃপা প্রত্যাহার ক’রে পাণ্ডবশিবিরে চলে যান, তবে এই মাহিষ্মতীকে আর কে রক্ষা করবে?

ভাস্বতী—আমার বিশ্বাস হয় না পিতা। হিরণ্যকৃৎ অনল কি পাণ্ডবপ্রেরিত রত্নরথের ঔজ্জ্বল্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবেন, আর ভুলে যাবেন মাহিষ্মতীর অন্তরের এতদিনের পূজা?

নীল—কিন্তু অনল কি কখনও তোমার পূজার উপচার দেখে মুগ্ধ হয়েছেন?

ভাস্বতী—জানি না পিতা।

নীল—তুমি কি কখনও অনলকে দেখেছ?

ভাস্বতী—না।

নীল—অনল তোমাকে কোনদিন দেখেছেন?

ভাস্বতী—না।

নৃপতি নীলের নয়নে আরও গভীর বিষাদের ছায়া পড়ে।—তাই তো নিশ্চিন্ত হতে পারছি না।

পিতা নীলের কথা শুনে হঠাৎ ঔৎসুক্যে চঞ্চল হয়ে ওঠে ভাস্বতীর সুভঙ্গিম ভ্রূরেখা—আপনার কথার অর্থ কি?

নীল—যদি চিত্রিতা কেতকীর মত নয়নাভিরামা এই পূজাচারিণীকে, মাহিষ্মতীর অন্তরের জ্যোতির্লেখার মত নীলতনয়া এই ভাস্বতীকে কোন শুভ মুহূর্তে দেখতে পেতেন অনল, এবং দেখে মুগ্ধ হতেন, তবে নির্ভয় ও নিশ্চিন্ত হতে পারত মাহিষ্মতী। অনলপ্রিয়া ভাস্বতীর মাহিষ্মতীকে স্পর্শ করবার দুঃসাহস কোন দিগ্বিজয়ীর মনে আর দেখা দিত না। পাণ্ডব সহদেবের শত স্তুতিবাদ পূজোপচার আর উজ্জ্বল রত্নরথনেমির হর্ষ অনলের প্রত্যাখ্যানে বিফল হয়ে ফিরে চলে যেত চিরকালের মত।

ভাস্বতী বলে—আশীর্বাদ কর পিতা, যেন আমার ব্রত সফল হয়।

নীল—কিসের ব্রত, কন্যা?

সলজ্জ স্বরে ভাস্বতী বলে—আমারই জীবনের এক নূতন ব্রত।

প্রসন্নস্বরে পিতা নীল তাঁর অন্তরের আশা অভিব্যক্ত করেন—বুঝেছি কন্যা; আশীর্বাদ করি, তোমার এই ব্রত সফল হোক, অনলের ভার্যা হোক মাহিষ্মতীর কুমারী ভাস্বতী।

অপরাহ্নের আলোকে আলিম্পিত হয়ে আছে মাহিষ্মতীর পুষ্পকানন। মনঃশিলাময় পাষাণের ক্রোড়সঞ্চারিণী স্রোতস্বিনী, যেন তরলিত রক্তাভার প্রবাহ; যেন চুম্বনকেলিক্লান্ত গীর্বাণগণিকার দল নিশাবসানে নির্ঝরমূলে এসে অধররাগ ধৌত ক’রে চলে গিয়েছে, তাই শোণিত হয়ে গিয়েছে সলিল। নক্তমালের পল্লবভার আতপতাপিত তৃণভূমির উপরে ছায়া বিস্তার করে। অনলের আসা-যাওয়ার পথের মাঝখানে প্রতিদিনের মত আজও একটি পূজাদীপের শিখা জ্বলে। আর, দাঁড়িয়ে থাকে নীলতনয়া ভাস্বতী।

জীবনে স্বপ্নেও কখনও কল্পনা করেনি ভাস্বতী, এইভাবে অভিসারিকার মত উৎকণ্ঠা নিয়ে এক পুরুষের আসা-যাওয়ার পথের উপর এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কিন্তু এ কেমন অভিসার! জীবনে কোন মুহূর্তেও যার মূর্তি নয়নগোচর হয়নি, তারই দর্শনলাভের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা। নিদ্রা ও জাগরণের কোন ক্ষণে যার জন্য মনের কোন ভাবনা অনুরাগে চঞ্চলিত হয়ে ওঠেনি, তারই জন্য বিচলিতচিত্তে পথ চেয়ে থাকা। অদ্ভুত এই পরীক্ষা স্বেচ্ছায় বরণ ক’রে নিয়েছে ভাস্বতী।

মাহিষ্মতী নগরীর গর্ব ও সম্মানকে দিগ্বিজয়ী পাণ্ডবের কাছে বশ্যতা স্বীকারের অভিশাপ হতে রক্ষা করতে পারেন যে, এমনই এক পরম পরাক্রান্তের করুণা ও সহায়তা আহ্বান ক’রে এতদিন এক বন্দনাব্রত উদ্‌যাপন ক’রে এসেছে ভাস্বতী। এতদিন ছিল শুধু এক শ্রদ্ধেয়কে শ্রদ্ধা নিবেদনের ব্রত। শক্তিমানের কাছে প্রপন্নের আবেদনের ব্রত। কিন্তু আজ সেই পূজাস্থলীর কাছে প্রণয়াভিলাষিণী নায়িকার মত দাঁড়িয়ে আছে অবিদিতপ্রণয়া কুমারী ভাস্বতী। আসবেন অনল, এবং নীলতোয়দলালিতা তড়িল্লেখার মত তন্বী নীলতনয়ার তনুরুচি মুগ্ধনেত্ৰসম্পাতে অভিসিক্ত ক’রে আহ্বান করবেন—এস চিত্রভানুর চিত্তবিমোহিনী ভাস্বতী।

নিজেরই কল্পনার ভাষা শুনতে পেয়ে চমকে ওঠে ভাস্বতী। ক্লান্ত দ্রুমোৎপলের নিঃশ্বাসপরিমল হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়। শিহরিত হয় বনবায়ু। শিহরিত হয় ভাস্বতীর ভ্রূলতা। নবপরিণয়লজ্জাবিধুরা ও বাসকশয়নভীরু বধূর মত ভাস্বতীর আরক্তিম কপোলে স্বেদাঙ্কুরকণা ফুটে ওঠে। আজ এই পুষ্পবনের নিভৃতে এসে ভাস্বতীর জীবন যেন উদ্ভিন্ন শতদলের মত বিকশিত হয়ে উঠতে চায়। যেন নিখিলমধুরিমার উৎসেক লাভ ক’রে পুষ্পিত হতে চায় যৌবনবেদনা। হ্যাঁ, বুঝতে পারে ভাস্বতী, সে আজ এক প্রেমিকের দুই মুগ্ধ চক্ষুর দৃষ্টি বরণ করবার ব্রত উদ্‌যাপনের আশায় কলস্বনা এই স্রোতস্বিনীর তটে এসে দাঁড়িয়েছে।

—কে তুমি কুমারী?

দীপ্ততনু এক পুরুষসত্তম এসে নীলতনয়া ভাস্বতীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেন।

ভাস্বতী বলে—আমি নীলতনয়া ভাস্বতী। আপনার পরিচয় জানতে ইচ্ছা করি ধীমান্।

মৃদুহাস্যে অধর শিহরিত ক’রে ভাস্বতীর উৎসুক নয়নের দিকে তাকিয়ে দীপ্ততনু আগন্তুক বলেন—আমি অনল।

ভাস্বতী—মাহিষ্মতীর শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন অনলদেব।

অনল—শ্রদ্ধা কেন?

ভাস্বতী—আপনারই লীলা-পরাক্রমে বিপন্মুক্ত হয়েছে মাহিষ্মতী। আপনি সহায় থাকলে দিগ্বিজয়ী পাণ্ডব মাহিষ্মতীর প্রাসাদকেতন অবনমিত করার আশা বর্জন ক’রে ফিরে যাবে।

অনল—আমার সহায়তা হতে বঞ্চিত হতে পারে মাহিষ্মতী, এমন সংশয়ের কোন হেতু কি দেখতে পেয়েছে, নীলতনয়া?

ভাস্বতী—না অনলদেব, তবু পিতা শুনে নিশ্চিন্ত হতে চান, মাহিষ্মতীর পূজা গ্রহণ ক’রে আপনি তৃপ্ত হয়েছেন।

অনল—তৃপ্ত হয়েছি।

ভাস্বতী—কিন্তু আপনার আসা-যাওয়ার পথের মাঝখানে এই পুষ্পকাননের নিভৃতে প্রতি প্রভাতে এসে পূজার উপাচার সাজিয়ে রেখে গিয়েছে যে পূজাচারিণী তাকে আপনি কোনদিন দেখতে পাননি।

অনল—পাইনি। আশা আছে মনে, একদিন তাকে দেখতে পাব আর দেখে মুগ্ধ হব।

ভাস্বতী—আজ তাকে দেখতে পেয়েছেন।

বিস্মিত অনল বলেন—তুমি?

ভাস্বতী বলে—হ্যাঁ, আমি। আমারই সুবর্ণভৃঙ্গার উশীরবাসিত সলিল ঢেলে আপনার পদস্পর্শপূত পথের মৃত্তিকা নিত্য সুরভিত করেছে।

অনল বলেন—মাহিষ্মতীর প্রিয়কারিণী কন্যা, তোমার শ্রদ্ধায় তৃপ্ত হয়েছি আমি, আর বিস্মিত হয়েছি তোমাকে দেখে, কিন্তু…।

ভাস্বতী—বলুন।

অনল—কিন্তু মুগ্ধ হতে পারিনি।

ভাস্বতীর নয়নদ্যুতি বাত্যাহত দীপশিখার মত ব্যথিত হয়ে ওঠে। বুঝতে পারে ভাস্বতী, মিথ্যা বলেননি অনল। নীলতনয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন অনল, যেন কৌতুকামোদে কুতূহলী এক দহনদাতা এক মৃৎপ্রদীপের দিকে তাকিয়ে আছে। ঐ দৃষ্টি প্রেমবিবশ পুরুষের মুগ্ধ চক্ষুর দৃষ্টি নয়।

অনল প্রশ্ন করেন—ব্যথিত হলে কেন, নীলরাজতনয়া?

ভাস্বতী—আশা ছিন্ন হলে, স্বপ্ন চূর্ণ হলে, আর কল্পনা দগ্ধ হয়ে গেলে কে না ব্যথিত হয়?

অনল—কি বলতে চাও? তবে তুমি কি মাহিষ্মতীর রক্ষাকারী অনলের অনুরাগিণী?

ভাস্বতী—না।

অনল—তবে?

ভাস্বতী—আমি দুটি মুগ্ধ পুরুষনয়নের অনুরাগিণী। মন চায়, তারই কণ্ঠে বরমাল্য দান করি, যে এই নীলতনয়া ভাস্বতীর মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যাবে।

অনল—সুন্দর তোমার আকাঙ্ক্ষা! আশীর্বাদ করি, তোমার এই আকাঙক্ষা সত্য হয়ে উঠুক। তারপর একদিন সত্য হবে অনলের আকাঙ্ক্ষা।

ভাস্বতী—কি আশীর্বাদ করলেন, বুঝতে পারছি না, অনলদেব।

অনল—পরানুরাগিণী নীলতনয়ার সেই বরমাল্য জয় ক’রে নিয়ে আর কণ্ঠে ধারণ ক’রে একদিন তৃপ্ত হবে অনল।

আর্তনাদ ক’রে ওঠে ভাস্বতী—নিষ্ঠুর কৌতুকের অধীশ্বর, হে বৈশ্বানর!

অনল—বল, নীলতনয়া ভাস্বতী!

ভাস্বতী—আমার প্রেম কামনা করবেন যিনি, আমি শুধু তাঁকেই প্রেম দান করব।

অনল—করো।

ভাস্বতী—আমাকে দেখে মুগ্ধ হবেন যিনি, আমি শুধু তাঁরই কণ্ঠে বরমাল্য দেব।

অনল—দিও।

ভাস্বতী—প্রেমিকের কাছে সমর্পিতপ্রাণ ভাস্বতীর হাতের সেই বরমাল্য কেড়ে নিতে পারে, এমন শক্তি ত্রিলোকে কারও নেই হুতবহ অগ্নি, আপনারও নেই।

অনল বলেন—কিন্তু, যদি এই মুহূর্তে তোমারই প্রণয়বাসনায় চঞ্চল হয়ে তোমাকে আহ্বান করি ভাস্বতী, তবে? যদি পুষ্পাসবপিপাসী মধুপের মত লুব্ধ হয়ে তোমার সুন্দর মুখমলের কাছে এগিয়ে যায় অনলের বক্ষের তৃষ্ণা, তবে?

ভাস্বতী—তবে এই মুহূর্তে অনলের কণ্ঠে বরমাল্য দান ক’রে ধন্য হবে নীলরাজতনয়া ভাস্বতী।

কৌতুকভরে, পুনরায় হাস্য উচ্ছ্বসিত করে অনল বলেন—বিদায় দাও ভাস্বতী।

ভাস্বতী—বিদায় গ্রহণ করুন বৈশ্বানর।

চলে গেলেন অনল। আর, পুষ্পকাননের নিভৃতে দাঁড়িয়ে সুরভিশ্বাসী দ্রুমোৎপলের দিকে তাকাতে গিয়ে বুঝতে পারে ভাস্বতী, তার দুই চক্ষুর উদ্‌গত অশ্রুবাষ্পও যেন ঐ চূর্ণ মনঃশিলার মত তার আহত মনের ছায়াসম্পাতে রক্তিম হয়ে উঠেছে।

কি অদ্ভুত এই অনলের কামনা! রজনীহাস শেফালিকার মত অতাপস্পর্শিতা কুমারীর স্ফুটযৌবনের শুচিসুধার জন্য তাপদহনবিলাসী অনলের হৃদয়ে কোন তৃষ্ণা নেই। তাই নীলতনয়া ভাস্বতীর মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হল না অনলের চক্ষু। প্রেম দান ক’রে অবিদিতপ্রণয়া নারীর হৃদয়ে প্রেম সঞ্চার করতে জানে না, চায়ও না, লীলাপরাক্রমের আনন্দে উদ্‌ভ্রান্ত ঐ পাবকের হৃদয়। চিরজীবনের সঙ্গিনী হবার জন্য যে নারী বরমাল্য হাতে নিয়ে কাছে এগিয়ে যেতে চায়, তার আশা বিফল ক’রে দিয়ে সুখী হয় এই বিচিত্র জ্বালাস্বপ্নচারী বৈশ্বানর। অপরের প্রেমবন্দিত নারীর কামনামধুর অন্তরের নিষ্ঠা লুণ্ঠন করবার জন্য কৌতুকরঙ্গে চঞ্চল হয়ে রয়েছে জ্বলদর্চিপ্রভায় অর্চিততনু অনল।

চলে গিয়েছেন অনল, কিন্তু মনে হয় ভাস্বতীর, যেন এক হৃদয়হীন কৌতুকীর দৃষ্টি তার দেহ রূপ আর যৌবনের উপর অপমানের জ্বালা নিক্ষেপ ক’রে চলে গিয়েছে। নীলতনয়া ভাস্বতী কি সত্যই এত অমধুরা যে তার মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হতে পারে না জগতের কোন পুরুষের চক্ষু?

কণ্টকবিদ্ধা মৃগবধূর মত পুষ্পকাননের নিভৃতে সুচ্ছায় নক্তমালতলে বসে থাকে ভাস্বতী। অপরাহ্নের আলোক ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে আসে। স্নিগ্ধতর হয় নক্তমালের ছায়া। রাগময়ী সন্ধ্যার প্রথম দ্যুতি এসে ভাস্বতীর কপোল স্পর্শ করে। অকস্মাৎ এক আগন্তুকের পদধ্বনি শুনে উৎকর্ণ হয়ে ওঠে নীলতনয়া ভাস্বতী।

স্নিগ্ধদর্শন এক ব্রাহ্মণকুমার ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সন্ধ্যার বিষাদলীনা জলকমলিনীর মত অশ্রুমায়াময়ী ভাস্বতীর মুখের দিকে মুগ্ধ ও অপলক চক্ষুর দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থাকে। বিস্মিত হয় ভাস্বতী, যেন তারই অন্তরবেদনার ভাষা শুনতে পেয়ে অন্তরীক্ষ হতে এক অনিন্দ্যসুন্দর প্রেমিকের হৃদয় ছুটে এসে সম্মুখে দাঁড়িয়েছে। ঐ দুই চক্ষুর দৃষ্টি-পীযূষধারার উৎসেক পেয়ে যেন জেগে উঠেছে ভাস্বতীর যৌবনময় প্রাণের কামনা, হিমকর-দীধিতির স্পর্শে যেমন জেগে ওঠে তন্দ্রাভিভূত বনমল্লিকার কোরক। মনে হয়, এই পুষ্পকাননের আর এক নিভৃতে জেগে উঠেছেন নিখিলকামনার অধীশ্বর অতনু কুসুমেষু। জীবনের প্রথম অনুরাগের আবেগে স্মিতহাস্যজ্যোতি অধরে স্ফুরিত ক’রে ভাস্বতী প্রশ্ন করে—কে আপনি?

—আমি ব্রাহ্মণকুমার সুবর্চা। পুষ্পকাননচারিণী জ্যোতিৰ্লেখার মত কে তুমি কুমারী?

—আমি নীলতনয়া ভাস্বতী।

—কা’র পদধ্বনির উপাসনার জন্য এই কাননভূমিতে বসে আছ, রাজতনয়া ভাস্বতী?

—আপনি কা’র পদধ্বনি অন্বেষণের আশায় এই কাননের নিভৃতে এসেছেন, কুমার?

—কোন আশা নিয়ে আসিনি। আমার আশার অতীত প্রিয়দর্শিনী এক নারীর সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে আমার জীবন আজ ধন্য হলো। ঐ মুখচ্ছবি আমার জীবনের চিরকালের স্বপ্ন হয়ে থাকবে। অনাহত সঙ্গীতের মত তোমার ঐ মঞ্জীরিত চরণের ধ্বনি আমার সকল কল্পনার অন্তরে চিরকাল বাজবে। বরবর্ণিনী ভাস্বতী, তোমার হাতের বরমাল্যের দিকে তাকিয়ে শুধু ব্যর্থ পিপাসার বেদনা নিয়ে চলে যাবে সুবর্চা।

—নীলতনয়া ভাস্বতীর হাতের বরমাল্যের প্রতি এত মোহ কেন প্রকাশ করছেন, কুমার?

—সত্যই কি বুঝতে পার না?

—না।

—মন চায়, আমার জীবনের সকল মুহূর্তের কামনায় বন্দিত হও তুমি। হও চিরপ্রেয়সী। হও আমার সকল স্বপ্ন সুপ্তি তন্দ্রা ও কল্পনার তৃপ্তি। হও সুবর্চার সুখদুঃখভাগিনী গেহিণী!

ভাস্বতী বলে—তাই সত্য হোক, প্রিয় সুবর্চা।

সুবৰ্চা—তবে দাও তোমার বরমাল্য। আমার প্রণয় সফল কর, নীলতনয়া ভাস্বতী।

ভাস্বতী—একটি অনুরোধ আছে।

সুবৰ্চা—বল।

ভাস্বতী—পিতা নীলের স্নেহাভিষিক্ত হৃদয়ের আশীর্বাদ লাভ ক’রে যেদিন তুমি গ্রহণ করবে ভাস্বতীর এই হাত…।

সুবৰ্চা—সেদিন কবে আসবে ভাস্বতী?

ভাস্বতী—প্রার্থনা কর, সেই শুভদিন যেন অচিরাসন্ন হয়। সেই দিন, এক উৎসবমধুর সন্ধ্যার এক পুণ্যক্ষণে এই পুষ্পকাননের স্রোতস্বিনীর তটে এসে, তোমার কণ্ঠে তোমারই প্রিয়ার প্রেমব্যাকুল হাতের বরমাল্য নিও।

—ভাস্বতী!

রবরোষিত কেশরীর মত পিতা নীলের ক্রোধকম্পিত আহ্বান শুনে চমকে ওঠে ভাস্বতী।

মাহিষ্মতীর প্রাসাদের এক কক্ষের নিভৃতে পিতা নীলের সম্মুখে এসে বিস্মিতভাবে তাকিয়ে থাকে ভাস্বতী।

—মাহিষ্মতীর সর্বনাশ চাও, কন্যা?

—এই সন্দেহ কেন, পিতা?

—সন্দেহ নয়; সবই দেখেছি কন্যা। তুমি ব্রতভঙ্গকারিণী, তুমি এক কামতস্করের সঙ্গিনী। তোমার আচরণে কুপিত হয়ে অনল অদৃশ্য হয়েছেন। মাহিষ্মতীর রক্ষাকারী অনলের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা প্রেমে পরিণত হবে, তুমি হবে অনলভার্যা ভাস্বতী, আমার এই আশা তুমিই চুর্ণ ক’রে দিলে উদ্‌ভ্রান্তা কন্যা!

—আমি আমার প্রেমিকের কাছে হৃদয় দান করেছি।

—ঐ বনচারী ব্রাহ্মণ তোমার প্রেমিক?

—হ্যাঁ, পিতা।

—অনলের প্রেমলাভের জন্য তোমার মনে কোন আকাঙক্ষা নেই?

—না।

—কেন?

—অপ্রেমিক অনলের মনে আপনার কন্যা ভাস্বতীর জন্য কোন প্রেম নেই।

—সেই কারণেই তো ব্রতচারিণী হবে তুমি। মাহিষ্মতীর বিপদবারণ লোকপ্রবীর অনলের প্রেমাভিলাষে তুমি তপস্বিনী হবে। বিশ্বাস ছিল, সেই তপস্যা একদিন সফলও হবে। কিন্তু সামান্য এই প্রতীক্ষার ধর্মও বর্জন ক’রে তুমি কোন্ এক বনচারী ছলপ্রণয়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে আর মুগ্ধ হয়ে বরমাল্য দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছ দুরাচারিণী কন্যা। শোন তবে, তোমার এই দুরাশা সফল হবে না।

—পিতা! আর্তনাদ ক’রে পিতা নীলের মুখের দিকে তাকিয়ে বাষ্পায়িত নয়নে হৃদয়ের বেদনা নিবেদন করে ভাস্বতী—এমন অভিশাপ দেবেন না পিতা।

নীল—অভিশাপ শান্তচিত্তে সহ্য করার জন্য প্রস্তুত হও।

চিৎকার ক’রে ওঠে ভাস্বতী—স্পষ্ট ক’রে বলুন পিতা, কোথায় আছেন সুবর্চা।

নীল—এই প্রাসাদেরই এক লৌহকক্ষে কঠোর শৃঙ্খলে আবদ্ধ সুবর্চা এখন তার দুঃসাহসের শাস্তি সহ্য করছে।

—পিতা।

—আর্তনাদ স্তব্ধ কর, কন্যা।

কিন্তু এ কি বিস্ময়! নীলতনয়া ভাস্বতীর এই আর্তনাদের প্রতিধ্বনি যেন লক্ষ অগ্নিশিখা হয়ে প্রাসাদের চতুর্দিকে জেগে উঠছে। অন্তরীক্ষ হতে এক প্রজ্জ্বলিত দাবানল অকস্মাৎ মাহিষ্মতীর শঙ্খধবল পাষাণে রচিত প্রাসাদের শিরে লুটিয়ে পড়ছে। আতঙ্কিত হয়ে আর বিস্মিত হয়ে এই করাল ধূমপুঞ্জ ও অগ্নিজ্বালার বিভীষিকার লীলা দেখতে থাকেন মাহিষ্মতীর অধিপতি নীল। এ যে অনলেরই আক্রোশের মত অতিকরাল জ্বালালীলা।

কে এই ব্রাহ্মণবেশী সুবর্চা? অকস্মাৎ, যেন তার অন্তরের ভিতরে এক দাবদগ্ধ বিস্ময় আর কৌতূহলের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে দ্রুত ছুটে চলে যান নীল, এবং লৌহকক্ষের নিকটে এসেই হতবাক্ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। হ্যাঁ, সত্য হয়েছে তাঁর অনুমান। ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে লৌহকক্ষ, আর সহাস্যমুখে দাঁড়িয়ে আছেন সেই স্নিগ্ধতনু ব্রাহ্মণকুমার সুবর্চা।

কাতরস্বরে প্রশ্ন করেন নীল—আপনার পরিচয় প্রদান করুন ব্রাহ্মণকুমার। দৈব পরাক্রমে বলী, কে আপনি?

মৃদুহাস্য স্ফূরিত ক’রে সুবর্চা বলেন—আমি অনল।

অদৃশ্য হল অগ্নিজ্বালার বিভীষিকা। সান্ধ্য বায়ুর মৃদু শীতসঞ্চারে আবার শান্ত ও স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে মাহিষ্মতীর প্রাসাদ। কৃতাঞ্জলি করে এবং প্রসন্ন হাস্যে হৃদয়ের আনন্দ নিবেদন করেন নীল।—ধন্য হলো মাহিষ্মতী! ধন্য হলো মাহিষ্মতীর অধিপতি নীল ও নীলতনয়া ভাস্বতী! আপনার কৃপালীলায় আমার সকল আশা সফল হলো, দেব বীতিহোত্র।

অনল বলেন—নিশ্চিন্ত হোন নৃপতি নীল, আমার নির্দেশে দিগ্বিজয়ী পাণ্ডব শুধু আপনার দান গ্রহণ ক’রে তৃপ্ত হয়ে চলে যাবে।

নীল—মাহিষ্মতীর শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন, দেব বৈশ্বানর।

অনল বলেন—আর, আমারই বাঞ্ছিতা ভাস্বতীকে আমার কাছে সম্প্রদান করুন, ভাস্বতীপিতা নীল।

—ভাস্বতী! স্নেহাভিভূত কণ্ঠে আহ্বান করেন নীল।

অনল—একটি প্রস্তাব আছে নৃপতি নীল। ভাস্বতীর কাছে আমার পরিচয় এখনই প্রকাশ ক’রে দেবেন না।

নীল—তথাস্তু।

নৃপতি নীল পুনরায় আহ্বান করেন—ভাস্বতী!

ভাস্বতী এসে সম্মুখে দাঁড়ায়। মৃদু হাস্যে কৃতার্থ হৃদয়ের আনন্দ উদ্ভাসিত ক’রে নীল বলেন—এস কন্যা, এই দেখ, তোমার প্রেমধন্য জীবনের সহচর সুবৰ্চা তোমারই প্রতীক্ষায় রয়েছেন।

মন্ত্র পাঠ ক’রে তনয়া ভাস্বতীকে সুবর্চার কাছে সম্প্রদান ক’রে চলে গেলেন নৃপতি নীল। ভাস্বতীর পাণি গ্রহণ ক’রে কৃতার্থ সুবৰ্চা সাকাঙক্ষ স্বরে প্রশ্ন করেন—বরমাল্য কই, প্রিয়া ভাস্বতী?

স্নিগ্ধহাসিনী বনমল্লিকার মত সুষমা বিকশিত ক’রে স্মিতধারা ভাস্বতী বলে— আছে।

—কোথায়?

—পুষ্পকাননের নিভৃতে, সেই নক্তমালের ছায়ায়, সেই মনঃশিলার অলক্তকে রঞ্জিত স্রোতস্বিনীর তটে।

সন্ধ্যারাগে রঞ্জিত হয়ে আছে নক্তমালের ছায়া। উৎপল-পরিমলে বিহ্বল হয়েছে বনবায়ু। পুষ্প চয়ন করেছে ভাস্বতী, এবং মাল্য রচনাও সমাপ্ত হয়েছে। নিকটে এসে দাঁড়ায় ভাস্বতীর প্রেমিক সুবর্চা, ভাস্বতীর স্বামী সুবর্চা।

প্রণাম করে ভাস্বতী, এবং তার পরেই দুই হাতে বরমাল্য উত্তোলন ক’রে সুবর্চার মুখের দিকে তাকায়—প্রিয় সুবর্চা!

কিন্তু এ কি? এ কা’র মূর্তি? সেই মুহূর্তে যেন এক দুঃসহ শাস্তির আঘাতে ব্যথিত হয়ে যন্ত্রণাক্ত স্বরে চিৎকার ক’রে ওঠে ভাস্বতী—কে তুমি?

—আমি তোমারই প্রিয় প্রেমিক ও পতি সুবর্চা।

—মিথ্যা কথা! তুমি অনল, তুমি শুধু অনল, জ্বালালীলাবিলাসী অনল। তুমি সুবর্চা নও।

—সুবৰ্চার ছদ্মরূপ ধারণ ক’রে আমিই তোমার প্রেম কামনা করেছি ভাস্বতী। যে অনলের মুগ্ধ চক্ষুর দৃষ্টি বরণ করবার আশায় পুষ্পকাননের এই নিভৃতে সেদিন দাঁড়িয়েছিলে তুমি, সেই অনলই সুবর্চা হয়ে তোমাকে মুগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে বরণ করেছিল ভাস্বতী।

ভাস্বতী—নিষ্ঠুর কৌতুকের অধীশ্বর, হে বৈশ্বানর।

বিস্মিত হন অনল—নিষ্ঠুর বলছ কেন, ভাস্বতী? আমিই তো তোমার সুবর্চা।

ভাস্বতী—না, আমার সুবর্চা তুমি নও।

অনল—তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারছি না।

ভাস্বতী—কেন পারছেন না, অনলদেব? পরপুরুষের কণ্ঠে মাল্য দান করতে পারে না সুবৰ্চার ভার্যা ও প্রেমিক ভাস্বতী।

—পরপুরুষ?

—হ্যাঁ, আমার আশার স্বপ্ন উদ্ভাসিত করেছে যে, আমার কামনার আশা উদ্দীপিত করেছে যে, আমার অন্তরের স্তরে স্তরে মুদ্রিত হয়ে আছে যার মূর্তি সে হলো সুবর্চা। আমার কাছে আপনি পরপুরুষ মাত্র। অপরের প্রেমবন্দিতা নারীর হাতের বরমাল্য জয় করবার দুর্বাসনা বর্জন করুন অনলদেব।

—ভাস্বতী! উত্তপ্ত হয়ে ওঠে অনলের কণ্ঠস্বর।—জানেন নৃপতি নীল, সুবৰ্চার ছদ্মরূপে আমি অনল তাঁর তনয়া ভাস্বতীর প্রেম কামনা করেছি। তোমার পিতা নৃপতি নীল আমারই কাছে তাঁর দুহিতা ভাস্বতীকে সম্প্রদান করেছেন। তুমি তোমার পিতার মন্ত্রোচ্চারিত সম্প্রদান ব্যর্থ করতে পার না। সে অধিকার তোমার নেই।

ভাস্বতী—তুমি সুবৰ্চার রূপ ধারণ ক’রে পিতা নীলের সম্মুখে ভাস্বতীর যে হাত গ্রহণ করেছ, আজ এই সন্ধ্যারাগে অরুণিত পুষ্পকাননের নিভৃতের উৎসবে সুবৰ্চারই রূপ ধারণ ক’রে প্রেয়সী ভাস্বতীর হাতের সেই বরমাল্য গ্রহণ কর।

সকল জ্বালালীলার অধীশ্বর অনলের অন্তরে যেন এক অপমানের জ্বালা লাগে। বিষণ্ণস্বরে বলেন—তোমার কাছে আমি চিরকাল সুবর্চার রূপ ধ’রে দাঁড়িয়ে থাকি, এই কি তোমার ইচ্ছা?

ভাস্বতী—হ্যাঁ অনল। তুমি সুবৰ্চা হও।

অনল—না।

ভাস্বতী—এস অনল, আমার জীবনের একমাত্র প্রেমিক সেই সুবৰ্চার রূপ নিয়ে আমার জীবনের চিরসঙ্গী হয়ে থাক।

অনল—না, এই দুরাশা বর্জন কর, নীলকন্যা।

ভাস্বতী—তবে সুবর্চার প্রিয়া ভাস্বতীর বরমাল্য লাভের আশা বর্জন করুন, অনলদেব।

সেই মুহূর্তে বরমাল্য ছিন্ন ক’রে বিস্রস্ত কুসুমদাম স্রোতস্বিনীর সলিলে নিক্ষেপ করে ভাস্বতী।

বিদ্রূপকুটিল ভ্রূভঙ্গী ও কৌতুকতরল হাস্য শিহরিত ক’রে তাকিয়ে থাকেন অনল। আর, স্থির চিত্রলেখার মত দাঁড়িয়ে স্রোতস্বিনীর অস্থির সলিলের দিকে তাকিয়ে থাকে ভাস্বতী।

অনল বলল—তোমার সকল প্রলাপ ক্ষমা করলাম, ভাস্বতী।

উত্তর দেয় না ভাস্বতী।

অনল—সুন্দরাননা ভাস্বতী, তোমার ঐ চিবুক ও অধর, ঐ পীনবক্ষ ও ক্ষীণকটি, ঐ সুগ্রীবাভঙ্গী আর গুরুশ্রোণিভার, সকলই আমার অধিকার।

প্রাণহীনা ও ভাষাহীনা পাষাণের পুত্তলিকার মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ভাস্বতী।

অনল বলেন—অনলের বক্ষোলগ্ন হও, মাহিষ্মতীর দীপশিখা।

সাড়া দেয় না ভাস্বতী।

নিবিড় আলিঙ্গনে ভাস্বতীর অচঞ্চল মূর্তি বক্ষোলগ্ন করেন অনল। পুষ্পকাননের নিভৃতে সন্ধ্যারাগে অভিভূত নক্তমালের ছায়া অনলের বাসনাবাসিত উৎসবের মুহূর্তগুলিকে নীরবে সহ্য করতে থাকে।

—অনলের তৃষ্ণার তৃপ্তি, নীলতনয়া ভাস্বতী!

তৃপ্তপ্রাণ অনলের আহ্বানে যেন মূর্ছা ভেঙ্গে জেগে ওঠে ভাস্বতী। বিশ্লথ কবরীভার কম্প্রহস্তে বিন্যস্ত ক’রে অনলের মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু চমকে ওঠেন অনল এবং আর্তস্বরে বলেন—এ কি ভাস্বতী, তোমার নয়ন অশ্রুসিক্ত কেন?

ভাস্বতী—অন্যপূর্বা নারীকে বক্ষোলগ্ন করেছেন আপনি, আপনার সংকল্প সিদ্ধ হয়েছে। আপনার লীলা-পরাক্রমে উপকৃত মাহিষ্মতীর একটি কৃতজ্ঞতার দেহকে আপনি শুধু আপনার অধিকারের উল্লাসে উপভোগ করেছেন। তৃপ্ত হয়েছেন আপনি, কিন্তু আমার তৃপ্তি সুবর্চার সন্ধানে স্রোতস্বিনীর জলে ভেসে গিয়েছে।

আহত কণ্ঠস্বরে চিৎকার করেন অনল।—কি বললে, ভাস্বতী?

ভাস্বতী—যা শুনলেন তাই বলেছি, অনলদেব। আমার বরমাল্য, আমার মঞ্জীরধ্বনি, আমার নিঃশ্বাস আর অতৃপ্ত অধর অনন্তকাল আমার সুবর্চাকেই খুঁজে বেড়াবে।

অনল—তবে বৃথা কেন অনলের এই প্রণয়োৎসুক বাহুর আলিঙ্গন বরণ করলে, নীলতনয়া?

ভাস্বতী—বরণ করেছে নীলতনয়া ভাস্বতীর অসহায় দেহ। ভাস্বতীর মন আপনাকে বরণ করেনি, অনলদেব।

অনল—ভাস্বতী!

ভাস্বতী—বলুন।

অনল—এহেন কৃত্রিম জীবনই কি তোমার কাম্য?

ভাস্বতী—হ্যাঁ অনলদেব, ভাস্বতীর মন কখনও আপনার বক্ষের নিকটে যাবে না। আপনার কামনার জ্বালা চিরকাল নীরবে সহ্য করবে ভাস্বতীর দেহ, কিন্তু ভাস্বতীর মন চিরকাল তার স্বপ্নচারী প্রেমিক সুবর্চার বুকে লুটিয়ে থাকবে।

অনলের চক্ষু অকস্মাৎ খরবহ্নিশিখার মত জ্বলে ওঠে—এ যে অভিশাপ, অশুচি স্বৈরিণীর জীবন!

হেসে ওঠে ভাস্বতী—হ্যাঁ, আপনারই আশীর্বাদ, আপনারই কৌতুকের দান, হে সর্বশুচি বৈশ্বানর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *