বাংলা উপন্যাসে গণিকা – প্রীতিলতা রায়
বাংলা উপন্যাসে গণিকা – প্রীতিলতা রায়
প্রথম প্রকাশ – বইমেলা, ২০২১
আমার জীবনের পথনির্দেশক
সম্মানীয় প্রফেসর
দীপককুমার রায় মহাশয়ের করকমলে
.
ভূমিকা
‘বাংলা উপন্যাসে গণিকা’ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন প্রীতিলতা রায়৷ সন্দেহ নেই বিষয় হিসেবে এটি মোটেই সহজসাধ্য, সাধারণ নয়৷ প্রথমেই এমন একটি বিষয় নির্বাচন করার জন্য গবেষিকাকে অভিনন্দন জানাই৷ এই ধরণের বিষয় নিয়ে গবেষণা করলে সমাজ জীবনের বিবর্তন, সমাজের নীতিবাগীশতার আড়ালে দুর্নীতি, অসমদৃষ্টি, প্রান্তিক মানুষের উপর নানা ধরণের নিপীড়নকে আলোচনার বাইরে রাখলে চলে না৷ গবেষকের সমাজদৃষ্টি স্বচ্ছ ও সহানুভূতিশীল হওয়া খুবই প্রয়োজন৷ প্রীতিলতা তাঁর পরিশ্রমী তথ্যনিষ্ঠ গবেষণায় মানবতাবোধকে মিলিয়ে নিয়েছেন—এখানেই এই গবেষণাগ্রন্থের স্বাতন্ত্র্য৷
গণিকাবৃত্তির ইতিহাস অতি প্রাচীন, সমাজ, পরিবার, ধর্মীয় অনুশাসন সবই যখন পুরুষের করতলগত হয়ে পড়ল, পিতৃতন্ত্রের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে নারীর অবস্থান হীনতর হয়ে গেল৷ এঙ্গেলসের বিখ্যাত বিশ্লেষণ সবাই জানেন, ‘the woman was degraded and reduced to servitude, she became the slave of [the man’s] lust and a mere instrument for the production of children.’ গণিকার সম্পর্ক রইল পুরুষের সম্ভোগ ও চিত্ত বিনোদনের সঙ্গে৷ প্রীতিলতা ইতিহাসটি সংক্ষেপে তুলে এনে ভারতে গণিকাবৃত্তির বিবর্তনরেখাটি তুলে এনেছেন৷ এইসূত্রে তিনি প্রাচীন থেকে মধ্য হয়ে আধুনিককাল পর্যন্ত কী কী নামে এই নারীরা পরিচিত হয়ে চলেছেন তার তথ্যপূর্ণ বিবরণ সংযুক্ত করেছেন৷ স্বভাবতই তাঁর কলমে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে দেবদাসীপ্রথা, সেবাদাসী সম্ভোগ—একেবারে আধুনিক কাল পর্যন্ত তিনি এইসব বহু প্রচলিত প্রথার শিকড় সন্ধান করেছেন৷
নারীকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাত্রস্থ করাই যখন শাস্ত্রের নির্দেশ ছিল, তখন রাষ্ট্রের ব্যয়ে নানাবিধ বিদ্যা ও চৌষট্টিকলায় পারঙ্গমা করে তোলা হত গণিকাদের৷ তার কারণ কর্মক্লান্ত পুরুষকে সঙ্গদানে আনন্দিত করার ক্ষমতা যেন তাদের থাকে৷ যৌবন অপগত হলে অবশ্য কানাকড়িও দাম পেত না তারা৷ প্রীতিলতা ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন৷ বসন্তসেনার দুর্লভ সৌভাগ্যের পাশে চারুদত্তপত্নী ধূতার অসহায় সামাজিক অবস্থান তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়নি৷ মহাকাব্য, পুরাণ, বৌদ্ধসাহিত্য, নাটক—সাহিত্যের ভিন্ন ভিন্ন ধারাতে চিত্রিত গণিকাচরিত্র থেকে তিনি সমাজঅন্বেষার একটি ধারাবাহিক ভাষ্য রচনা করেছেন৷ প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের আলোচনাসূত্রে অত্যন্ত দক্ষভাবে বিভিন্ন শব্দের আদি উৎস নির্দেশ গবেষণাগ্রন্থের মর্যাদা বাড়িয়েছে৷
প্রীতিলতা বিশেষ জোর দিয়েছেন উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে গণিকা চরিত্রচিত্রণে৷ নতুন গড়ে ওঠা শহরে বিভিন্ন বৃত্তিজীবীর সঙ্গে গণিকাবৃত্তিধারিণীদেরও পল্লী গড়ে উঠতে দেরি হয়নি৷ বিভিন্ন নকশা, প্রধান এবং অপ্রধান উপন্যাসে পতিতা চরিত্রচিত্রণ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বালবৈধব্য, কৌলীন্যপ্রথা এবং পিতৃ ও স্বামীগৃহের সম্পত্তিতে অধিকার না থাকার ফলে অভাবের তাড়নায় কিশোরী ও যুবতী মেয়েদের কীভাবে নিছক বেঁচে থাকার জন্য দেহব্যবসা গ্রহণ করতে হত৷ উনিশ শতকের নবজাগরণের আলোকছটার পাশে অবক্ষয়ী বাবুসমাজ প্রকাশ্যে কীভাবে বারাঙ্গনাপ্রীতিকে সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি করে তুলল তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা গ্রন্থটিতে আছে৷ তুলনায় কম আলোচিত উপন্যাসসমূহ ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’, ‘এলোকেশী বেশ্যা’, ‘চন্দ্রা’, ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’, ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’, চৌদ্দ আইনের প্রতিক্রিয়ায় লেখা ‘স্বর্ণবাই’ উপন্যাস বিস্তৃতভাবে আলোচনা করে প্রীতিলতা জরুরি একটি কৃত্য সম্পাদন করেছেন৷ গণিকাদের প্রতি মূলধারার মানুষের দৃষ্টিকোণকে এইসব গ্রন্থে লেখকরা নানাভাবে উপস্থাপিত করেছিলেন৷
সমাজের সীমান্তে অবস্থিত এই নারীরা বিংশ শতাব্দীর বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার শর্তপূরণ করে বহুল সংখ্যায় দেখা দিয়েছে৷ নীতিবাগীশের নাসিকা কুঞ্চনের বদলে তাদের অবস্থার প্রতি মানবিক দরদের পরিচয় দিয়েছেন লেখকরা৷ প্রীতিলতা বিংশশতাব্দীর সম্পূর্ণ পরিসর আলোচনায় আনতে পারেননি গ্রন্থের আয়তন বেড়ে যাবার ভয়েই হয়তো৷ তবে প্রধান উপন্যাসগুলি প্রায় সবই তাঁর আলোচনায় এসেছে৷
গবেষণা গ্রন্থটির সবথেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল প্রীতিলতা পতিতাদের সার্বিক দুরবস্থার কথা কখনো বিস্মৃত হননি৷ বস্তুত তাঁর গবেষণার প্রধান লক্ষ্যই হল গণিকাদের অবহেলিত, প্রান্তিক জীবনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা৷ বহুবছর আগে সিমোন দ্য বোভোয়া তাঁর বিখ্যাত ‘দি সেকেন্ড সেক্স’ গ্রন্থে পতিতাজীবনের সংকটগুলির অসামান্য বিশ্লেষণ করেছিলেন,
‘It is not their moral and psychological station that makes the prostitutes’ lot hard to bear. It is their material condition that is more often deplorable. Exploited by their pimps and their madams, they live in a state of insecurity and threefourths of them are penniless. After five years of the life, about seventy-five percent have syphilis,… Inexperienced minors, for example are fearfully susceptible to infection. ….Common prostitution is a miserable occupation in which women exploited sexually and economically, subjected arbitrarily to the police, to a humiliating medical supervision, to the caprices of the customers, and doomed to infection and disease, to misery, is truly abased to the level of a thing.’
প্রীতিলতার গবেষণাগ্রন্থ এই নির্মম জীবনযাত্রাকে বারবার প্রেক্ষণে নিয়ে আসে৷ শুধু সাহিত্য নয় সমাজতত্ত্বের দিক দিয়েও তাঁর এই পুস্তক যথার্থ মূল্যবান হয়ে উঠেছে৷ গণিকাবৃত্তির বিলোপসাধন অথবা তাঁদের জীবনযাপনের উন্নতিসাধন—কোনদিকে মন দেওয়া উচিত, গ্রন্থটি সেই ভাবনা উসকে দেয়৷ মানবাধিকার কর্মীরা বর্তমানে এই পেশা যাতে ন্যূনতম মর্যাদা পায় তা নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন৷
ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, গণিকারা অনেকেই সন্তানলাভ করেন৷ প্রীতিলতার গবেষণায় সমাজ কর্তৃক অবহেলিত এই পুত্রকন্যাদের প্রসঙ্গ এসেছে৷ ‘বাংলা উপন্যাসে গণিকা’ পড়বার সময় একটি অনতিপরিচিত বইয়ের কথা মনে পড়ে গেল৷ ‘যৌনকর্মীদের জীবনসত্য’ বইটি লিখেছিলেন মৃণালকান্তি দত্ত৷ তিনি গোপন করেননি যে তিনি একজন যৌনকর্মীর সন্তান৷ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মন্থন করে মৃণাল গণিকাজীবনের আলোআঁধারির অসামান্য ডকুমেন্টেশন করেছিলেন৷ আজ বইটি বিস্মৃত৷
সামাজিক ছুঁৎমার্গ এখন অনেক প্রশমিত৷ গণিকাদের মানবীরূপে দেখে, মূল্য দিয়ে, তাঁদের জীবনের সমস্যাগুলি সমাধানের একটি সৎচেষ্টা দেখা দিচ্ছে৷ প্রীতিলতা রায়ের বইটি তথ্যসংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও সত্যপ্রতিষ্ঠার জোরে পাঠকের অনুরাগধন্য হবে এই আশা রাখি৷
নমস্কার
গোপা দত্তভৌমিক
প্রাক্তন উপাচার্য, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়
৫ই ডিসেম্বর ২০২০
Leave a Reply