৫. বিশ শতকের বাংলা উপন্যাসে গণিকা

বিশ শতকের বাংলা উপন্যাসে গণিকা

গণিকা চরিত্র পর্যালোচনায় বিশ শতক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে৷ উনিশ শতকের উপন্যাসগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গণিকারা ঘৃণ্য ও নিন্দিত৷ সমাজের এতটুকু সহানুভূতি নেই তাদের প্রতি৷ তারা প্রচলিত অর্থে ডাইনি, পিশাচিনী, ডাকিনী স্বরূপ; সর্বোপরি সমাজদূষক৷ কিন্তু পরবর্তী শতাব্দীর আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে গণিকাদের অবস্থানগত তারতম্য ঘটে৷ ঘৃণ্য সমাজদূষক থেকে তাদের প্রতি আরোপিত হয় সহানুভূতির পেলব স্পর্শ৷ মমতায়-ভালোবাসায়-ত্যাগে-মহত্ত্বে তারা মহীয়ান হয়ে ওঠে৷ যন্ত্রণাকর পেশার সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও সমাজ তাদের আর ঘৃণা করতে পারে না—রক্তমাংশের মানবী হয়ে ছিটকে পড়া প্রান্তসীমা থেকে পুনরায় আমাদের ঘরের মেয়ে হয়ে উঠে ৷ প্রথম পর্বের বাংলা উপন্যাসে তাদের না ছিল কোনো নাম, না ছিল কোনো সম্মান বা সহানুভূতি কিন্তু বিশ শতকে তারা স্বনামে, স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে লেখকের মরমি দৃষ্টিভঙ্গির গুণে৷ কোনো কোনো উপন্যাসে আবার মুখ্য চরিত্র হিসেবেও দেখা যায় তাদের৷ দেহজীবিকার গ্লানি নারীত্বের উজ্জ্বল বিভায় ম্লান হয়ে যায়; স্নেহে-প্রেমে-মহত্বে উচ্চতম শিখর স্পর্শ করে তারা৷ বাংলা উপন্যাসের আঙিনায় এই বারযোষিৎদের প্রথম পঙ্ক থেকে উদ্ধার করে সম্মান ও সহানুভূতিতে সুমহান মর্যাদা দান করেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ তাঁর ‘চরিত্রহীন’-এর সাবিত্রী, কিরণময়ী, ‘শ্রীকান্ত’-এর পিয়ারীবাই, ‘দেবদাস’-এর চন্দ্রমুখী, ‘শুভদা’-এর কাত্যায়নী, ললনা বা মালতী সমাজ পরিত্যক্ত বারবনিতা হলেও তাদের ভেতরকার চিরপবিত্র স্নেহরসধারার প্রস্রবনে কোথাও যেন এতটুকু খামতি নেই৷ তাদের প্রতি কোনোভাবেই পাঠকের ঘৃণা জন্মে না বহুপুরুষভোগ্যা বলে বরং পরম সহানুভূতিতে চিত্ত আবিষ্ট হয়ে উঠে৷ তারপরে কল্লোল-কালিকলম-প্রগতির হাত ধরে বহু সাহিত্যিক গণিকা চরিত্র চিত্রিত করেছেন, সেখানেও তারা স্বাধীকারবোধসমন্নিত স্নেহ মমতার পরিপূর্ণ প্রতিমূর্তি৷ যেমন জগদীশ গুপ্তের উত্তম, টুকী (লঘুগুরু), নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের শুভা (শুভা), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুন্তা (আরণ্যক), পান্না (অথৈ জল), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসন্ত (কবি), দুর্গা (গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম), রমা (প্রেম ও প্রয়োজন), বনফুলের মুক্তো (জঙ্গম), আসমানী (বৈতরণীর তীরে), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্গা, চাঁপা (শহরবাসের ইতিকথা), সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বনানী (বৃত্ত) ইত্যাদি চরিত্রগুলি৷

পাঁচকড়ি দে :

বাংলা সাহিত্যে ডিটেকটিভ উপন্যাস যাঁর হাত ধরে স্থায়ীরূপ লাভ করেছিল তিনি পাঁচকড়ি দে (১৮৭৩-১৯৪৫)৷ তাঁর রহস্য উপন্যাসগুলিতে নানাভাবে গণিকা চরিত্রের রেখাঙ্কন করেছেন তিনি যার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সময়ে গণিকাদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যেতে পারে৷

ক. নীলবসনা সুন্দরী :

পাঁচকড়ি দে-এর সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘নীলবসনা সুন্দরী’ প্রকাশিত হয় ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে৷ উপন্যাসটির বিষয়বস্তু ডিটেকটিভ দেবেন্দ্রবিজয়ের গোয়েন্দাগিরিতে মেহেদীবাগানের অত্যাশ্চর্য নারী হত্যা রহস্যের উদ্ভেদ৷ আর সেই অনুসঙ্গেই উঠে এসেছে নর্তকী গুলজার-মহল, লতিমন বাইজি, দিলজান প্রমুখ গণিকার নাম৷ এছাড়া স্বৈরিণী সৃজানও তার লোভ ও ঈর্ষায় বহুগামী হয়ে জীবন কাটাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে৷

গুলজার-মহল :

উপন্যাসটির শুরু হয়েছে এক ধনীগৃহে বাইনাচের মজলিশ দিয়ে—‘‘রাত দুইটা বাজিয়া গিয়াছে৷ এখনও প্রসিদ্ধ ধনী রাজাব-আলির বহিবর্বাটীর বিস্তৃত প্রাঙ্গণ সহস্র দীপালোকে উজ্জ্বল৷ সেই আলোকোজ্জ্বল সুসজ্জিত প্রাঙ্গণে নানালঙ্কারে সুসজ্জিতা, সুবেশা, সুস্বরা নর্ত্তকী গায়িতেছে—নাচিতেছে—ঘুরিতেছে—ফিরিতেছে—উঠিতেছে—বসিতেছে, উপস্থিত সহস্র ব্যক্তির মন মোহিতেছে৷’’ তাদের উন্নত গ্রীবার ভঙ্গি, নয়নের নানারকম ভঙ্গি, মুখের, হাত নাড়ার, পা ফেলার ভঙ্গিতে তন্ময় হৃদয়ে সকলে তাদের দিকে চেয়ে আছে৷ কারও উঠার ক্ষমতা নেই৷ মোহিনী মায়ায় আবিষ্ট হয়ে রাত বহুদূর গড়িয়ে গেলেও নিজেদের আবেশবিহ্বল মনকে কিছুতেই গণিকার মায়াডোর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছে না৷ এখানে গণিকার বীণা নিক্বণের সুমধুর শব্দরাজী নানা তানে দর্শকের চেতনাকে আবিষ্ট করে৷ নানা মধুর তানের উল্লেখ করেছেন লেখক যথা—কখনো তা বেহাগের সুমিষ্ট আলাপ, কখনো মীড়ে, গমকে, মূর্ছণায়, গিটকারীতে, উদারা মুদারা তারা তিনগ্রামে, প্রক্ষেপে ও বিক্ষেপে ষড়জ রেখার, গান্ধার পঞ্চম, ধৈবত প্রভৃতি সপ্তস্বরে অনাস্বাদিতপূর্ব সুরধারা বর্ষণ করছে৷ নয়নমনোহর ঝলমলে বাইজির পোশাক-আশাক, নৃত্যপ্রাঙ্গণ ও সুসজ্জিত বসন্তের মধুরবায় চিরযৌবনের সুর বহন করে আনে৷ ধনাঢ্য গৃহের বাইজিবিলাসের পারিপাট্যে লেখক মজলিশগৃহের বর্ণনা করেছেন এইভাবে—‘‘ঊর্ধ্বে বহু শাখাবিশিষ্ট ঝাড় ঝুলিতেছে তাহাতে অগণ্য দীপমালা৷ লাল, নীল, পীত, শ্বেত—বর্ণবিচিত্র পতাকাশ্রেণী৷ নিম্নে বহুমূল্য গলিচা বিস্তৃত, রজত-নির্ম্মিত আতরদান গোলাপপাশ, আলবোলা, শটকা এবং তাম্বুল-এলাইচপূর্ণ রজতপাত্রের ছড়াছড়ি৷ চারিপার্শ্বে গৃহ-প্রাচীরে দেয়ালগিরি, তাহাতে অসংখ্য দীপ জ্বলিতেছে৷ অলিন্দে অলিন্দে—লাল, নীল, সবুজ, জরদ বিবিধ বর্ণের স্ফটিক-গোলকমালা দুলিতেছে, তন্মধ্যস্থিত দীপশিখা বিবিধ বর্ণে আলোক বিকীর্ণ করিতেছে৷ স্তম্ভে স্তম্ভে দেবদারুপত্র, চিত্র, পতাকা ও পুষ্পমাল্য শোভা পাইতেছে৷ আলোকে-পুলকে সকলই উজ্জ্বলতর দেখাইতেছে৷ উর্দ্ধে নিম্নে, মধ্যে, পার্শ্বে সহস্র দীপ জ্বলিতেছে…৷’’ এত বিলাস এত বৈভব এত সমারোহের মাঝখানে যে বাইজিকে কেন্দ্র করে সহস্র লোক সবকিছু ভুলে গিয়ে আবেশবিহ্বল হয়ে বসে আছে তার নাম গুলজার-মহল৷ সে কলকাতার প্রসিদ্ধ বাইজি৷ শ্রোতৃগণের পুষ্প, পুষ্পমাল্য, পুষ্পস্তবকে গুলজার-মহলের আসর ভরে গিয়েছে৷ রাত দুটা বেজে গেলেও শ্রোতারা ওঠার নাম করছে না৷ গুলজার-মহলও তার গান থামাতে পারছে না কারণ পাঁচশত টাকা চুক্তির বিনিময়ে সে মুজরা করতে এসেছে৷ থামলে তো তার চলবে না৷ তাছাড়া মুন্সী জোহিরুদ্দীন মল্লিকের স্ত্রী এবং নাজিব-উদ্দিন চৌধুরীর কন্যা জোহেরা বাইজিকে দুটি হীরার আংটি বকশিশ দিয়েছে৷ তার মূল্য স্বরূপও তাকে অন্তত দুটো গান বেশি গাইতে হবে৷ মোটা অঙ্কের টাকা এবং দামি বকশিশে গুলজার-মহলের মধ্যেও উৎসাহের সঞ্চার করেছে৷ গুলজার তার প্রসিদ্ধ নৃত্যগীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে৷ মোবারকের কথায় সেই রকমই দিক নির্দেশ হয়৷ সে সুজাত-এর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তাই বলে—‘‘এমন লোক দেখিনা গুলজার-মহল বাইজীর গান যাহার ভাল না লাগে৷’’ অর্থাৎ সৌন্দর্য, নৃত্যগীত পারদর্শিতায় গণিকারা সমাজে সম্মান না পেলেও অর্থপ্রতিপত্তি লাভ করতো৷ ধনী গৃহে গণিকাবিলাসের চিত্রও ফুটে উঠেছে রাজাব-আলির বাড়িতে মুজরার আয়োজন দৃশ্যের মধ্য দিয়ে৷ বাইজির গান শুনতে অভিজাত গৃহের নারীরাও যে উপস্থিত হতো মুন্সী জোহিরুদ্দিন মল্লিকের স্ত্রী এবং নাজিব-উদ্দীন চৌধুরীর কন্যার উপস্থিতির মধ্য দিয়ে তার প্রমাণ পাওয়া যায়৷

লতিমন বাইজী :

গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয় অজ্ঞাত পরিচয় সেই নীলবসনা সুন্দরীর মৃতদেহের পরিচয় উদ্ধার এবং রহস্য উদ্ঘাটন করার অভিপ্রায়ে মৃতের গলায় জড়ানো রেশমের সূচি-কার্যের সুদৃশ্য ওড়না নিয়ে সূচিশিল্পী করিমের মায়ের কাছে উপস্থিত হলে তার মেয়ের কাছ থেকে জানতে পারে লতিমন বাইজির নাম৷ লতিমন বাইজি বামুনবস্তিতে থাকে৷ সেই করিমের বোনের কাছ থেকে সেই সুদৃশ্য ওড়না তৈরি করিয়ে নিয়েছে৷ লতিমনবাইজিও প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারিণী৷ সে এবং তার প্রকাণ্ড দ্বিতল বাড়ি বামুনবস্তির আবালবৃদ্ধবনিতার পরিচিত৷ পাড়াপড়শীদের কাছ থেকে গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয় লতিমন সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ করে৷ তা থেকে জানা যায় যে লতিমন বাইজি সবসময় বাড়ির বাইরে আসে না৷ প্রভূত খ্যাতি থাকায় দেশে-বিদেশে তাকে মুজরা করতে যেতে হয়৷ তার বাড়িতে দিলজান নামের এক ষোড়শী সুন্দরী কন্যা বাস করে৷ তার সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যেই মনিরুদ্দীনের সেখানে যাতায়াত আছে৷ লতিমনের গৃহে বিত্ত-বৈভবের চিহ্ন সুপ্রকটিত৷ লেখক দেবেন্দ্রবিজয়ের দৃষ্টিতে সেই গৃহের প্রাচুর্যের দিকটি তুলে ধরেছেন এইভাবে—‘‘গৃহটী মূল্যবান আসবাবে পূর্ণ৷ গৃহতলে গালিচা বিস্তৃত৷ গৃহ-প্রাচীরে উৎকৃষ্ট তৈল-চিত্র ও দেয়ালগিরি৷ একপার্শ্বে একখানি প্রকাণ্ড দর্পণ—সম্মুখে গিয়া কেহ দাঁড়াইলে তাহার মাথা হইতে পা পর্য্যন্ত তাহাতে প্রতিবিম্বপাত হয়৷ অপরপার্শ্বে গবাক্ষের নিকটে একটি হারমোনিয়ম রহিয়াছে, নিকটে একখানি মখমলমণ্ডিত চেয়ার ও একখানি কৌচ৷’’

দেবেন্দ্রবিজয়ের স্পষ্ট ধারণা হয়েছিল সেই নীলওড়না-নীলবসন পরিহিত বেওয়ারিশ মৃতদেহ লতিমন বাইজিরই হবে৷ সে তদন্ত করতে লতিমনের গৃহে উপস্থিত হলে তার সম্মুখে একজন স্ত্রীলোক বেড়িয়ে আসে৷ লেখকের বর্ণনায় সেই স্ত্রীলোকটি দেখতে তেমন সুন্দরী নয়, শ্যামবর্ণা, মুখে বসন্তের ক্ষতচিহ্ন এবং বয়সও ত্রিশের কাছাকাছি৷ জড়ির চটিজুতা পায়ে দিয়ে সর্বালঙ্কারে ভূষিতা হয়ে সেই স্ত্রীলোক গোয়েন্দার সঙ্গে কথপোকথন চালাতে থাকে৷ গোয়েন্দা নিজের পরিচয় দিয়ে তাকে লতিমন খুনের প্রসঙ্গ বললে সেই ভ্রম ভেঙ্গে দেয় সেই স্ত্রীলোকটিই৷ সে নিজের পরিচয় দিয়ে বলে সে-ই লতিমন৷ গোয়েন্দা বিস্মিত হয়ে তাকে নীলওড়না দেখালে একটা ভাবী দুশ্চিন্তায় মুখাবয়ব উদ্বেগপূর্ণ হয়ে ওঠে লতিমনের এবং যখন শোনে নীলরঙের সিল্কের তৈরি সাঁচ্চার কাজ করা কাপড় পরিহিতা সেই মৃতদেহের কথা তখন গভীর আশঙ্কায় কেঁদেই ফেলে৷ ‘‘আমাদের দিলজানই খুন হয়েছে৷’’ বলে সে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলে৷ লতিমন স্নেহপরায়ণ এক নারী৷ দিলজানকে মনিরুদ্দীন তার কাছে নিয়ে এলে সে তাকে সহোদরা ভগ্নীর মতই ভালোবাসে৷

লতিমন বাইজির মধ্যে ছল-চাতুরীর বালাই নেই৷ সাধারণ একজন নারীর মতো করেই লেখক চরিত্রটিকে উপস্থাপন করেছেন৷ খুনের রহস্য উদ্ঘাটনে শেষ পর্যন্ত দেবেন্দ্রবিজয় যেভাবে চেয়েছে সেভাবে সাহায্য করেছে সে৷ তার মনের মধ্যে সর্বদাই একটাই আদর্শ কাজ করেছে অপরাধী যাতে শাস্তি পায়৷ গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয় তথ্য সংগ্রহের জন্য দিলজানের ব্যক্তিগত বাক্স-দেরাজ খুলে তল্লাশি করতে চাইলে লতিমন ইতস্তত করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেয়৷ শুধু তাই নয় তালাবন্ধ বাক্স-দেরাজের চাবি না থাকায় লোহার তার, ছাতা ভাঙ্গা লোহার শিক সংগ্রহ করে দেয় যাতে সেগুলির সাহায্যে বাক্সগুলি খোলা যায়৷ মুন্সী জোহিরুদ্দীন মল্লিকের বাড়ির অন্দরমহলের খবর নেওয়ার জন্য সাখিয়াকে ডেকে পাঠায়৷ সাখিয়া মুন্সী পত্নী সৃজানবিবির প্রধান দাসী৷ লতিমন তাকে মনিবের সুরে প্রথমেই সচেতন করে দিয়ে বলে—‘‘সাখিয়া, ইনি তোকে গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করতে চান৷ যা, জানিস সত্য বলবি৷’’ সাখিয়া গোয়েন্দার মুখে খুনের কথা শুনে তার বিবি সাহেবা খুন হয়েছে ভেবে আর্তনাদ করে ওঠে কিন্তু যখন শোনে তার বিবি সাহেবা সৃজান নয় দিলজান খুন হয়েছে তখন হাল্কা তাচ্ছিল্য করে বিষয়টাকে উড়িয়ে দেয়৷ একজন ‘বেশ্যামাগী’ খুন হয়েছে শুনে সে নিশ্চিন্ত হয় এবং তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্য করে৷ একজন দাসীর মুখে এ হেন তাচ্ছিল্যসূচক মন্তব্য শুনে রেগে যায় লতিমন বাইজি৷ প্রতিবাদ করে তার কথার৷ লতিমন বাইজির সহৃদয়তায়ই দিলজান বা মৃজান এর পরিচয় উদ্ধার করে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয় উপন্যাসের গোয়েন্দা৷

দিলজান :

উপন্যাসের প্রথম পর্যায়ে লেখক দিলজানকে উপস্থিত করেছেন মনিরুদ্দীনের রক্ষিতা রূপে৷ গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয় মেহেদী-বাগানের মৃত্যুর রহস্যমোচন করার জন্য লতিমন বাইজির বাসস্থান বামুনবস্তিতে উপস্থিত হলে সেখানে পড়শীদের মুখে উঠে আসে দিলজানের নাম৷ সে শোনে—‘‘লতিমনের বাড়ীতে দিলজান নামে আর একটি ষোড়শী সুন্দরী বাস করে; মনিরুদ্দীন কোথা হইতে তাহাকে এখানে আনিয়া রাখিয়াছে৷’’ লতিমনের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারে দিলজান মনিরুদ্দীনের সঙ্গে ভিনদেশে বেড়াতে গেছে৷ সেই নীল ওড়নার মালিক লতিমন জীবিত প্রমাণিত হলে সকলে স্থির সংকল্প হয় সেই নীলবসনা সুন্দরী নারীর মৃতদেহ দিলজানেরই৷ কারণ দিলজান নীলবসন ও লতিমনের নীল ওড়না পড়ে মনিরুদ্দীনের সন্ধানে শেষবারের মতো বের হয়েছিল৷ তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে লতিমন গোয়েন্দাকে জানায় যে দিলজান কারও সঙ্গে মিশত না; কারও সঙ্গে তার বাদ-বিসংবাদও ছিল না৷ মনিরুদ্দীনকেই সে একমাত্র ভালোবাসতো৷ মনিরুদ্দীন তাকে বিবাহ করবে আশা দিয়ে নিয়ে এসেছিল৷ ক্রমে তার সে সম্ভাবনা স্তিমিত হয়ে আসে৷ দিলজানের পীড়াপীড়িতেও সে মুখ ফিরিয়ে থাকে৷ দিলজান মনিরুদ্দীনের উপেক্ষা বুঝতে পারে৷ অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে যে তার প্রেমাস্পদ অন্য আরেক সুন্দরীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে ভুলতে বসেছে এবং তার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার সংকল্প করেছে৷ দিলজান এমনি শান্ত স্বভাবের হলেও রেগে গেলে ভয়ঙ্করী হয়ে যায়৷ তখন তার মত উগ্র স্বভাবের কেউ নয়৷ সে রেগে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করে মনিরুদ্দীন যদি তাকে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে সে খুন করে তার অপমানের প্রতিশোধ নেবে৷ দিলজানকে সকলে গণিকা হিসেবেই দেখে৷ মল্লিকবাড়ির দাসী সাখিয়া দিলজানের মৃত্যু সম্পর্কে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করলে তার প্রতি গভীর সহানুভূতিতে লতিমন বাইজি তার সম্পর্কে সাখিয়া দাসীকে যে কথা বলে তাতে দিলজান চরিত্রের আরেকটি দিক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে—‘‘রেখে দে তোর বিবি সাহেবা—সে আবার বেশ্যার অধম; নৈলে সে এমন কাজ করে?’’ তার আবার মান! ‘‘আমাদের দিলজানের সঙ্গে তার তুলনা? যদিও মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দিলজানের বিবাহ হয় নাই; তা’ না হ’লেও, সে মনিরুদ্দীন ভিন্ন আর কিছু জানিত না৷ তোর বিবি সাহেবা কি নামটাই কিনলে বল দেখি? তোর বিবি সাহেবা যদি মনিরুদ্দীনের মাথাটা একেবারে না খেয়ে দিত, তা’ হ’লে আমাদের দিলজানই বা খুন হবে কেন?’’ অর্থাৎ গণিকার গৃহে বসবাস করে, প্রেমাস্পদের হাত ধরে বেড়িয়ে এসে তাকে দেহমন সমর্পন করার কারণে দিলজান সমাজের চোখে গণিকা হলেও সে আদতে গণিকা নয়—প্রেম ভালোবাসায় পরিপূর্ণ নারী৷ পরবর্তী সময়ে দেবেন্দ্রবিজয় রহস্যের গিঁট খুলতে খুলতে তার প্রকৃত পরিচয় উদ্ধার করে৷ সে আসলে মৃজান, মুন্সী মোজাম হোসেনের কন্যা৷ মুন্সী জোহেরুদ্দীন মল্লিকের স্ত্রী সৃজান যে কিনা মনিরুদ্দীনের সঙ্গে পরকীয়ায় আবদ্ধ আসলে দিলজান বা মৃজানের যমজ বোন এবং আরও পরে জানা যায় যে সেই নীলবসনা সুন্দরী দিলজান ছিল না, ছিল সৃজান৷ মৃজান বা দিলজান তার একরোখা ভালোবাসা দিয়ে মনিরুদ্দীনকে জয় করে নেয়৷ সে যখন খুনের দায়ে অভিযুক্ত মনিরুদ্দীনের সকল দোষ নিজ স্কন্ধে নিয়ে সৃজানকে নিজে খুন করেছে বলে স্বীকার করে তখন মনিরুদ্দীন বুঝতে পারে প্রকৃত প্রেম কি৷ সে তার লাম্পট্য-মদ্যপান পরিত্যাগ করে শেষপর্বে উন্মাদ হয়ে যাওয়া মৃজানের শূশ্রূষায় আত্মনিয়োগ করে৷ বারবনিতা পরিচয়ধারী এক নারী তার সমস্ত কলঙ্ক মুছে সুখী দাম্পত্যের সন্ধান পায়৷

সৃজান :

সৃজান স্বৈরিণী চরিত্র হিসেবে আলোচ্য উপন্যাসে প্রতিবিম্বিত হয়েছে৷ সৃজান চরিত্রটিকেও প্রথম থেকেই স্বৈরিণী হিসেবে প্রতিবিম্বিত করেছেন লেখক৷ উপন্যাসের শুরুতেই সেই ইঙ্গিত পাওয়া যায় সুজাত আলির কথায়৷ সে মোবারককে জানায়—‘‘সৃজান বিবির স্বভাবে কিছু দোষ আছে৷ ইহারই মধ্যে তাহার একটা নিন্দাপবাদও বাহির হইতে আরম্ভ হইয়াছে৷ শুনিয়াছি, স্বভাবটা ভালো নহে—মনিরুদ্দীনের উপরেই না কি তাহার নজরটা পড়িয়াছে৷’’১০ সৃজান বিবাহের পূর্বে খিদিরপুরে তার পিত্রালয়ে অবস্থান কালে মোবারক আলির সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷ কিন্তু সৃজান ছিল উচ্চাভিলাষী৷ তার কাম্য প্রেম নয় সম্পদ৷ তাই একই সঙ্গে মোবারকের সাথে সম্পর্ক জীবিত রেখেও অনুসন্ধান চালাতে থাকে কোনো ধনবান যুবকের৷ উদ্দেশ্য তাকে হাতে রাখা৷ শেষ পর্যন্ত যদি কোনো ধনবান জমিদার-আমীর-ওমরাও না জোটে তাহলে মোবারককেই বরমাল্য প্রদান করবে৷ মোবারক অর্থোপার্জনের চেষ্টায় নেপালে গেলে সেই অবসরে ধনী মুন্সী সাহেবের সঙ্গে বয়সের বিশাল ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তার বিয়ে হয়৷ মুন্সী জোহিরুদ্দীন মল্লিকের গৃহিণী হয়েও তার মনোবৃত্তি পূর্ববৎ লোভী ও ঈর্ষাপরায়ণ থাকে৷ সে তার প্রলোভন দিয়ে মনিরুদ্দীনকে বশ করে তার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে৷ অবশেষে মোবারক প্রতিহিংসায় পালাতে গিয়ে খুন হয় সে৷

এছাড়া এই উপন্যাসে মোবারকের স্বীকারোক্তির মধ্যে কাওয়াল জাতির স্ত্রীলোকদের স্বেচ্ছাচারের কথা উঠে এসেছে৷ তার কথায়—‘‘কাওয়াল জাতির স্ত্রীলোকেরা অত্যন্ত সুন্দরী; কিন্তু তাহাদিগের স্বভাব অত্যন্ত কলুষিত—সকলেই স্বেচ্ছাচারিণী—সতীত্ব বলিয়া যে কিছু আছে, তাহা তাহারা জানে না৷’’১১ এই কাওয়াল জনজাতির বাস নেপালের দক্ষিণপ্রান্তস্থ পর্বতমালায়৷ মোবারক অবসর পেলেই তাদের সঙ্গে মিশতো৷ তাদের মধ্যে মানিয়া নামের এক রমণীর ঘনিষ্ঠতা বেশি হয়েছিল৷ মানিয়াই ভালোবাসার প্রতীক স্বরূপ তাদের নিজেদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য বিষাক্ত তীরের ফলা মোবারককে উপহার দিয়েছিল৷

খ. মায়াবিনী :

‘মায়াবিনী’ উপন্যাসটি ‘গোয়েন্দার গ্রেপ্তার’ সাময়িকপত্রে ‘জুমেলিয়া’ নামে প্রকাশিত হতে থাকে৷ তিন ফর্মা ছাপা হওয়ার পর পাঁচকড়ি দে একেবারে বই আকারে প্রকাশ করে নাম বদল করে রাখেন ‘মায়াবিনী’৷ এ সম্পর্কে প্রথমবার বিজ্ঞাপনে গ্রন্থকার লিখেন—‘‘গতবর্ষে ‘গোয়েন্দার গ্রেপ্তার’ নামক সাময়িক পত্রিকায় ‘জুমেলিয়া’ নামে এই পুস্তকের ৩ ফর্ম্মা বাহির হইয়াছে৷ এক্ষণে অবশিষ্ট ফর্ম্মাগুলি মুদ্রাঙ্কিত করিয়া পুস্তক সম্পূর্ণ করা গেল৷ ‘জুমেলিয়া’ নামের পরিবর্ত্তে ‘মায়াবিনী’ নামে সম্পূর্ণ পুস্তক স্বতন্ত্র আকারে বাহির হইল৷’’১২

এই উপন্যাসে মায়াবিনী বলা হয়েছে জুমেলিয়াকে৷ সে তার পৈশাচিক অভিব্যক্তি দিয়ে বহুমানুষ হত্যা করেছে, গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয়কে বার বার বিপদের মধ্যে ফেলেছে৷ পুরুষদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে নিজের কাজ হাসিল করেছে৷ জুমেলিয়ার অঘটন ঘটিয়ে আত্মগোপন প্রসঙ্গে উঠে এসেছে থিরোজা বাইজির নাম৷ থিরোজার বাড়ি খিদিরপুর মেটেবুরুজ-এ৷ ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সি থিরোজাবাই অসামান্য সুন্দরী৷ তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন প্রণালী পরিপাটি ও সুন্দর৷ তার বেশবাশের বর্ণনায় লেখক সেই সৌন্দর্যকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন—‘‘কৃষ্ণতার নয়নের নিম্নপ্রান্তে অতি সূক্ষ্ণ কজ্জলরেখা তাহার প্রচুরায়ত নয়ন যুগলের সমধিক শোভাবর্দ্ধন করিতেছে৷ পরিধানে প্রশস্ত সাঁচ্চাজরীর কাজ করা, সাঁচ্চা সল্মা-চুমকী বসান, ঘন নীলরঙ্গের পেশোয়াজ৷ উন্নত ও সুঠাম বক্ষোদেশে সবুজ রং-এর সাটিনের কাঞ্চলী৷ তাহার উপরে হরিদ্বর্ণের সূক্ষ্ণ ওড়না৷ টিকল নাসিকায় একটি ক্ষুদ্র নথ, একগাছি সরু রেশম দিয়া নথ হইতে কর্ণেও টানা-বাঁধা৷’’১৩ থিরোজাবাই-এর গাত্রবর্ণ চম্পক বর্ণ সদৃশ৷ নীল বর্ণের বসন পড়ে তার সৌন্দর্যরাশি অনন্ত শোভায় শোভামান৷ গণিকালয়ে যে অপরাধীরা অপরাধ করে আস্তানা নেয় তার গৃহে জুমেলিয়ার সাময়িক অবস্থান সে বিষয়ে দিক নির্দেশ করে৷

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) :

বাংলা উপন্যাসের জগতে আবেগ-ভাবালুতাকে আঁকরে ধরে আবির্ভূত হয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ তিনি তার নিজস্ব ভালোলাগার-মন্দলাগার অনুভূতি দিয়ে সমাজ-সংসারকে দেখেছিলেন৷ সেই সেন্টিমেন্টলি আবেদন ও রোমান্টিক পরিমণ্ডলেই তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসের বিভিন্ন দেহজীবী নারীরা ঘৃণ্য দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থেকেও সহানুভূতির পেলব স্পর্শে অসামান্য হয়ে উঠেছে৷ বস্তুত নারীকে শরৎচন্দ্র চিরকালই শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখেছেন তা থেকে দেহব্যবসায়ী, স্বৈরিণী, কলঙ্কিনী নারীরাও বাদ যায়নি৷ তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কি ভয়ানক পরিস্থিতিতে নারীরা যৌনপেশার শিকার হয়—সমাজ পরিত্যক্ত হয়৷ তাঁর সেই উপলব্ধির রসে জারিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন উপন্যাসের কিরণময়ী, চন্দ্রমুখী, পিয়ারীবাই, কাত্যায়নীর মতো নারীরা৷

ক. চরিত্রহীন :

‘চরিত্রহীন’ শরৎচন্দ্রের ঝড় তোলা উপন্যাস৷ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে৷ এখানে তিনি কামনা-অধীর চরিত্রের জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন৷ কামনার তীব্রদাহ কীভাবে মানুষের নৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করে, মূল্যবোধের অপসারণ ঘটায়, আদর্শবাদের সব মহিমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে হৃদয়কে কীভাবে পাপের আবর্তে আকন্ঠ নিমজ্জিত করে তারই কাহিনি ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাস৷

উপন্যাসে প্রধান দুই চরিত্র সাবিত্রী এবং কিরণময়ী৷ তারা তাদের চারিত্রিক স্খলনের মধ্য দিয়ে সমাজে পতিতা৷ সরাসরি তারা দেহের দর না হাকলেও, ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে, লোভে-কামনায় চরিত্রভ্রষ্ট হয়েছে৷ দুজনের জীবনেই মর্মান্তিক এক দাহ, ভয়ঙ্কর এক শূন্যতা তাদের ভুলপথে নিয়ে গেছে৷ লেখকের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তারা সেই গ্লানি থেকে সরে আসতে পারলেও সমাজের চোখে তারা পতিতাই৷

সাবিত্রী :

সাবিত্রী বালবিধবা৷ নয় বছর বয়সে নিজের জ্ঞান হওয়ার আগেই তাকে বরণ করে নিতে হয়েছিল চরম বৈধব্য যন্ত্রণা৷ যৌবনের মদনানিলে রঙ লাগে তার মনে৷ স্বপ্ন দেখে সুখী জীবনের৷ ফলে বড় ভগ্নিপতি ভুবন মুখোপাধ্যায়ের প্ররোচনায় ঘর বাঁধার আশায় কুলত্যাগ করতে দ্বিধা করে না কুলীনকন্যা সাবিত্রী৷ কিন্তু ভুবনের উদ্দেশ্য ছিল অন্য৷ সে শুধু তাকে ভোগই করতে চায়৷ বিবাহ না করেই সম্পন্ন করতে চেষ্টা করে তার ভোগ পিপাসা৷ নিজের ভুল বুঝতে পারে সাবিত্রী৷ বিবাহের পূর্বে দেহ দিতে অস্বীকার করায় তার শরীরলোভী ভুবন মুখুজ্জে তাকে পরিত্যাগ করে৷ সে আশ্রয় নেয় এক ভাড়াবাড়িতে—ঝি মোক্ষদার সহায়তায়৷ তার বসবাস করা বাড়িটি আসলে এক বেশ্যালয়েরই নামান্তর৷ বিপিনের মতো লম্পট মদ্যপ যুবকেরা যেখানে অহরহ যাতায়াত করে, সেখানকার ভাড়াটিয়াদের মদ খাইয়ে বশ করে অকাতরে নিদ্রা যেতে পারে সাবিত্রীর ঘরে তার অবর্তমানে৷ মদ্যপ মোক্ষদার কথায় সেই প্রচ্ছন্ন দেহব্যবসার দিক উঠে এসেছে—‘‘আমারো একদিন ছিল লো, আমারো একদিন ছিল৷ আমিও একদিন চব্বিশ ঘন্টা মদে ডুবে থাকতুম! তুই তার জানবি কি—কালকের মেয়ে!’’১৪ ভুবন মুখুজ্জের সংস্পর্শ থেকে বাঁচতে গণিকা গৃহে ভাড়া থেকেও অন্যের বাড়িতে ‘ঝি গিরি’ করে তার দিনাতিপাত হতে থাকে৷ সেখানে পরিচয় হয় সতীশের সঙ্গে৷ সতীশের সাথে তার ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা, তার প্রতি সেবাপরায়ণতা সমস্ত কিছুই আসলে ‘‘এক মদ্যাসক্ত লম্পটের সঙ্গে এক কুলটা-বারবনিতা জাতীয় নারীর পারস্পরিক আসক্তির চেয়ে বেশি কিছু নয়৷’’১৫ কারণ সতীশের দৃষ্টিতে সে তার বাসাবাড়ির ঝি, সতীশ তার লম্পট চরিত্রের গুণে সহজেই তার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে৷ মেসের রাখালবাবু থেকে উপেন্দ্র পর্যন্ত সেই হিসেবেই তাদের সম্পর্ককে দেখে৷

উপন্যাসে সাবিত্রীর আখ্যান শুরু করেছেন লেখক তার বর্ণনা দিয়ে—‘‘সাবিত্রী বাসার ঝি এবং গৃহিণী৷ চুরি করিত না বলিয়া খরচের টাকাকড়ি সমস্তই তাহার হাতে৷ একহারা অতি সুশ্রী গঠন৷ বয়স বোধ হয় একুশ-বাইশের কাছাকাছি, কিন্তু মুখ দেখিয়া যেন আরও কম বলিয়া মনে হয়৷ সাবিত্রী ফরসা কাপড় পরিত এবং ঠোঁট-দুটি পান ও দোক্তার রসে দিবারাত্রি রাঙা করিয়া রাখিত৷’’১৬ তার সঙ্গে সে যে সবার সাথে হেসে কথা বলতো এবং সতীশ নামক আরেক যুবক ভাড়াটের প্রতি একটু বেশি সহানুভূতি প্রকাশ করতো সেই বিবরণটিও লেখক দিতে ভোলেননি, যার মধ্য দিয়ে সতীশের সঙ্গে একটা আলাদা সম্পর্কের সূত্রপাত এবং তার রাঙা ঠোঁটের মধ্যে কামনা-বাসনার রঙিন ভাবনাকে পূর্বেই উৎসারিত করে দিয়েছেন রচনাকার৷ বিধবা কুলত্যাগিনী সাবিত্রীর প্রশ্রয়ে সতীশের মধ্যেও ধীরে ধীরে ভালোবাসার বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে৷ কিন্তু সাবিত্রী যে কিনা পুরুষের দ্বারা চরম প্রতারণার শিকার এবং পুরুষের প্রবৃত্তির সংযমহীনতাকে খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছিল; তার পুরুষের কোনো বাক্যেই আর তেমন কোনো বিশ্বাস থাকে না বা নিজের অধঃপতনে নিজেকেও তেমনি করে হীন প্রতিপন্ন করে সকলের খেলো করে ভাবতেও দ্বিধা নেই তার৷ তাই সাবিত্রীর সঙ্গে কথপোকথন কালে সাময়িক আবেগে সতীশ তার আঁচল টেনে ধরলে এবং পরবর্তী কালে তাতে নিজেকে সংকুচিত করে রাখলে সে সতীশকে বলে—‘‘আমার মত নীচ স্ত্রীলোকের আঁচল ধরে এই কি নূতন টেনেছেন যে, লজ্জায় একেবারে মরে যাচ্ছেন৷’’১৭ সাবিত্রীর মধ্যে পূর্ণ নারীসত্তা ছিল—তার প্রতিটি কোষ অযাচিত মমতায় পরিপূর্ণ৷ ত্যাগে-ভালোবাসায়-সেবায়-মমতায় সে অনন্যা৷ লেখক নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে সাবিত্রী দৈহিক ভাবে নষ্টা হয়নি, তার সেই পুণ্যফলেই সতীশের জীবনের মহৎ সাধনে ব্রতী হয়েছে৷ উপীনবাবুর দশহাজার টাকার বিনিময়ে রক্ষিতা হতে সে পারেনি৷ বিত্ত-বৈভবের মধ্যে নিজেকে সঁপে দেওয়ার চেয়ে সতীশের প্রতি উৎসর্গীকৃত প্রেমকে মহৎ জ্ঞান করে অন্যের বাড়িতে ‘ঝিগিরি’ করে জীবনধারণ করাকে শ্রেয় মনে করেছে৷ তার ভালোবাসা হৃদয়ের পবিত্রতম প্রস্রবন হয়ে সর্বদা তার মনকে সতেজ রেখেছে কিন্তু কখনোই তা আত্মহারা হয়ে আছড়ে পড়েনি প্রেমিকের সামনে বরং সতীশের দুর্বার আহ্বানকে উপেক্ষা করে গেছে শুধুমাত্র সামাজিক অপমান থেকে তাকে বাঁচাতে৷ পরিণামে দুজনেই কষ্ট পেয়েছে৷ সে কখনোই সতীশের সামনে ধরা দেয় নি—বার বার ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়ে তাকে বশে আনতে পারেনি সতীশ৷ তার সেবা সংযম দেখে মুগ্ধ হয়েছে কিন্তু মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ শব্দটাকে বের করতে পারেনি৷ তাই সতীশের একসময় মনে হয়েছে সাবিত্রী তাকে বড়শিতে গেঁথে খেলিয়ে চলছে৷ এবং এ নিয়ে তাকে কঠিন বাক্যবাণে বিদ্ধ করলে সাবিত্রী বলেছে—‘‘অসচ্চরিত্র! আমার মত একটা স্ত্রীলোককে ভালবেসে ভালবাসার বড়াই করতে তোমার লজ্জা করে না? যাও তুমি—আমার ঘরে দাঁড়িয়ে আমাকে মিথ্যে অপমান করো না৷’’১৮ প্রেমাস্পদকে অপমান করে দূরে ঠেলে দিয়ে লজ্জায় দুঃখে শেষ পর্যন্ত মূর্ছিত হয়ে গেছে সাবিত্রী নিজেই৷ সতীশ তাকে জলসেচন করে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলে সে বিনম্রভাবে তাকে অনুরোধ করে বলেছে—‘‘তোমার দেহটাকে ত তুমি পূর্বেই নষ্ট করেছ, কিন্তু সে না হয় একদিন পুড়েও ছাই হতে পারবে, কিন্তু একটা অস্পৃশ্য কুলটাকে ভালবেসে ভগবানের দেওয়া এই মনটার গালে আর কালি মাখিয়ো না৷’’১৯

সাবিত্রী সারাজীবন নিজের সঙ্গে লড়াই করে সতীশের প্রেমকে লাঞ্ছিত করে গেছে৷ নিজেকে দুশ্চরিত্র বিপিনবাবুর রক্ষিতা হিসেবে প্রতিপন্ন করেছে সতীশের কাছে৷ যাতে সতীশ মনে-প্রাণে কলঙ্কিত না হয় তার সংস্পর্শে৷ আবার সতীশের মদ খাওয়া, বাগানবাড়ি গিয়ে গণিকাসঙ্গমে মত্ত হওয়া, নিজের প্রতি চরম অবহেলা সব কিছুকে নিজ হাতে নিয়ন্ত্রণ করে আর অদম্য ব্যক্তিত্ব দিয়ে তাকে বশ করে রেখেছে৷ সতীশের কাছে অপমানিত হয়ে কাশী চলে গেলে চাকর বিহারীকে বলে গিয়েছে সে সেখানে গিয়ে নিজের ঠিকানা অবশ্যই জানাবে যাতে সতীশের কোনো বিপদের সম্ভাবনা হলে সময় মতো তার কাছে চলে আসতে পারে৷ কিরণময়ী যখন সতীশের মুখে তার সমস্ত বৃত্তান্ত শুনেছিল তার নারীমন নিমেষেই বুঝে নিয়েছিল সত্যিকারের সাবিত্রীকে৷ তাই অভিমানহত হয়ে তার সঙ্গে ইহজন্মে সাক্ষাৎ করতে না চাইলেও দুঃখের দিনে অথবা বিপদের দিনে তার সাক্ষাৎ যে সে পাবেই সে কথা জোর দিয়ে বলতে পেরেছিল সতীশকে৷ সতীশকে সচেতন করতে বলেছে—‘‘তোমার নিজের চেয়েও সে তোমার অধিক মঙ্গলাকাঙ্ক্ষিণী, এ কথা যেন কোনদিন ভুলো না৷’’২০ সতীশের প্রতি তার গোপন ভালোবাসার সত্যস্বরূপটি যাতে সতীশের সামনে প্রকাশ হয়ে না পড়ে সে বিষয়ে সে চাকর বিহারীকেও শপথ করিয়ে নিয়েছে৷ অবশেষে সতীশ প্রবল অসুস্থতায় মৃত্যু মুখে পতিত হলে বিহারীর আহ্বানে কাশী থেকে ফিরে এসে সেবা শূশ্রূষায় তাকে ভরিয়ে দিয়েছে কিন্তু তার বিয়ের প্রস্তাবকে সে কোনোভাবে মেনে নেয়নি কারণ সে মনে করে তার দেহের শুচিতা নষ্ট না হলেও মনের দিক থেকে সে পবিত্র নয়—‘‘এই দেহটা আমার আজ্য নষ্ট হয়নি বটে, কিন্তু তোমার পায়ে দেবার যোগ্যতাও এর নেই৷ এই দেহ নিয়ে যে আমি ইচ্ছে করে অনেকের মন ভুলিয়েচি, এ ত আমি কোনমতেই ভুলতে পারব না! এ দিয়ে আর যারই সেবা চলুক, তোমার পূজা হবে না৷’’২১ শেষ পর্যায়ে যক্ষ্মারোগী উপেনের সেবার মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সতীশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছে৷ মৃত্যুর পূর্বে উপন্যাসের চরিত্রবান যুবক উপেন্দ্র সাবিত্রীর চিরপূজ্য সতীশকে সরোজিনীর জন্য নির্বাচিত করে তাকে উপদেশ দিয়ে গেছে, যে দুর্ভাগ্য তাকে কুলত্যাগী করে কুলের বাইরে এনে ফেলেছে সে যেন আসক্তির বন্ধনে জড়িয়ে তার ভেতরে না যায়; চির দিন বাইরে থেকেই তাকে যেন বুকে আগলে রাখে৷ উপেনের কথায় সতীশের সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্য সাবিত্রীকে তার জীবনের সর্বোত্তম বস্তুটি পরিত্যাগ করতে হয়৷ প্রেমের আদর্শে কুলত্যাগিনী, পুরুষ ভোলানো এক নারী তার জীবনে চরম উৎকর্ষতা লাভ করে৷ সমাজ পতিতা হওয়ার কারণে সমাজ তাকে গ্রহণ না করলেও উপন্যাসের শেষে লেখকের কলমে তার কলুষমুক্তির স্বচ্ছ পথ আবিষ্কার হয়৷

কিরণময়ী :

কিরণময়ী উপন্যাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল চরিত্র৷ সে প্রথাসিদ্ধ গণিকা নয় তবে তার অভীষ্ট সিদ্ধি করতে গিয়ে সে হয়ে উঠেছে অঘটনপটিয়সী সমাজদূষক৷ উপন্যাসে কিরণময়ী অতৃপ্ত কামনা-বাসনাময় নারী৷ সে তার স্বামী মৃত্যুশয্যায় জেনেও পরিপাটী করে চুল বাঁধে, কপালে কাঁচপোকার টিপ পড়ে এবং তার ওষ্ঠাধরে হাসির রেখা কখনোই ম্লান হয় না৷ উপন্যাসের নীতিবান যুবক উপেন্দ্র অযত্নলাঞ্ছিত হারাণের রোগসজ্জা এবং তার স্ত্রীর সেইরূপ রূপের বাহার ফোটানোতে বিরক্ত হয়ে ওঠে৷ কিরণময়ী বুদ্ধিমতি, সকলের সঙ্গেই তার যুক্তিতর্কের সুন্দর ভাষণ শোনা যায়৷ দার্শনিকতা, নাস্তিক্য, নৈয়ায়িক বুদ্ধি, প্রথানুগ সতীত্ব এবং ত্যাগের বিরোধিতা তাকে অনন্য করে তুলেছে৷ স্বাভাবিক মানুষের মতো সে কামনা বাসনাকেও অস্বীকার করে না, তত্ত্বভাবের সঙ্গেও বিরোধিতা নেই আবার তাকে তত্ত্বসর্বস্বও বলা চলে না৷ স্বামী হারাণ তার তত্ত্বভারাক্রান্ত বিদ্যাচর্চা দিয়ে অবদমিত করে রেখেছিল কিরণময়ীর প্রথম যৌবনের দুরন্ত বাসনাকে৷ পরে সে অসুস্থ হয়ে শয্যা নিলে কিরণের সেই অবরুদ্ধ প্রবৃত্তির গর্জন তাকে দিশেহারা করে তোলে৷ তার স্বামীর ডাক্তার অনঙ্গের সঙ্গে অবৈধ প্রণয়পাশে আবদ্ধ হয়ে বাসনা চরিতার্থ করার উপায় খোঁজে৷ তাদের সাংসারিক অসচ্ছলতায় ছেলের প্রাণ ফিরে পেতে শাশুড়ি অঘোরময়ীও তাকে সেই দিকে অগ্রসর হতে মদত দিয়ে চলে; জীবনের সেই কামনার অবরুদ্ধ প্রাচীরে প্রথম আঘাত হানে উপেন্দ্র ও সতীশ৷ উপেন্দ্রর সুখী জীবনে তার স্ত্রী সুরবালার কর্তৃত্ব অথবা বলতে গেলে উপেন্দ্র-সুরবালার মধুর দাম্পত্য সম্পর্ক তার মধ্যে নুতন ভাবনার বীজ বপন করে৷ সে স্বামীকে অবহেলার মধ্য দিয়ে যেভাবে উপেন্দ্রর বিরক্তি আদায় করেছিল ঠিক সেই ভাবে পতিব্রতা সাধ্বীর মতো নিজেকে উজাড় করে দেয় তার সেবায়৷ তার অক্লান্ত স্বামীসেবা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় উপেন্দ্র৷ স্বামীর আসন্ন মৃত্যু সামনে জেনেও ধীর স্থির ভাবে যেমন সেই বিপদের মোকাবিলা করতে পারে তেমনি শ্রান্ত ক্লান্ত উপেন্দ্রকেও বিশ্রামের অবসর করে দেয়৷ যে কিরণময়ীকে প্রথম সাক্ষাতে উগ্রস্বভাব কঠিনমূর্তির নারী হিসেবে দেখেছিল সেই কিরণময়ীর শান্ত স্নিগ্ধ মূর্তি উপেন্দ্রর মনে আলোড়ন তোলে৷ তাই সে মনে মনে স্বীকার করে ‘‘স্ত্রীলোক সম্বন্ধে তাহার জ্ঞানের মধ্যে মস্ত ভুল ছিল৷ এমন নারীও আছে, যাহার সম্মুখে পুরুষের অভ্রভেদী শির আপনি ঝুঁকিয়া পড়ে৷ জোর খাটে না, মাথা অবনত করিতে হয়৷ এমনি নারী কিরণময়ী৷’’২২ উপেনকে দেখে কিরণময়ী নারীহৃদয়ের অন্তস্থলের সত্যিকারের প্রেমকে উপলব্ধি করতে পেরেছিল৷ সেই প্রেমে গদ গদ হয়ে অদৃশ্য ঈর্ষায় কাতর হয়ে পড়ে তার প্রতি৷ অসামান্য রূপবতী কিরণময়ী তাই নিজের প্রণয় প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে নিজের অজ্ঞাতেই নিজেকে টেনে এনে হাজির করে৷ উপেন্দ্র-সুরবালার দুষ্টুমিপূর্ণ দাম্পত্য এবং সতীশের মুখে তাদের দাম্পত্যের সুগভীর রসাস্বাদ তাকে উপেন্দ্রর দিকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়৷ সে পরম যত্নে স্বামীকে হারিয়েও সেই সদ্য বৈধব্যের ম্লানিমাকে উজ্জ্বলরূপ দান করে নব প্রেমের বিভায়৷

কিরণময়ীর মধ্যে বরাবরই কাজ করেছে সুবৃহৎ তর্কপ্রবণতা৷ সে তার নিজের যুক্তি-বিচার-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সর্বদাই তার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রস্তুত৷ তার ভেতরে অদম্য সাহসিকতা সেই শক্তির জোগানদার৷ সেই সাহসিকতার জোরেই সে প্রণয় নিবেদন করে উপেন্দ্রকে৷ তাকে তার নিজের জীবন যন্ত্রণা শোনাতে গিয়ে জানায় অনঙ্গ ডাক্তারের প্রতি দুর্বলতা৷ সে দুর্বলতা মনের নয় শরীরের অপরিতৃপ্ততার৷ সে তার সেই কলঙ্কের কথা অকপটে স্বীকার করে উপেন্দ্রকে বলে—‘‘তবু ত সেই অনঙ্গ ডাক্তারকে তুমি চেন না৷ চিনলে বুঝতে পারতে, কত বৎসরের দুর্দান্ত অনাবৃষ্টির জ্বালা আমার এই বুকের মাঝখানে জমাট বেঁধে ছিল বলেই এমন অসম্ভব সম্ভব হতে পেরেছিল৷ কি জানো ঠাকুরপো, যে তৃষ্ণায় মানুষ নর্দমার গাঢ় কালো জলও অঞ্জলি ভরে মুখে তুলে দেয়, আমারও ছিল সেই পিপাসা৷’’২৩ বহু দিনের উপোসী কামনা তাকে অনঙ্গ ডাক্তারের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল৷ তার সেই বিষাক্ত প্রেমানুভূতিতে কিরণময়ীকে আজও শিউরে উঠতে হয়৷ সংসারে অর্ধেক ভার বহন করতে রাজী হয়েছিল সেই ডাক্তার শুধুমাত্র তার অনুগ্রহ পাবে বলে৷ ক্রমে তার প্রতি বিরক্তি জন্মালেও শাশুড়ির তৎপরতায় সে তার থেকে মুক্তি পায়নি৷ নিজের স্বার্থের জন্য শাশুড়ি পুত্রবধূকে কীভাবে পরপুরুষের লালসায় সমর্পণ করতে পারে তারই নির্দেশক কিরণের এই বক্তব্য৷ কিরণময়ী সেই পথ থেকে সরে যাওয়ার অনেক পথ খুঁজেছে কিন্তু পায়নি৷ শেষে উপেন্দ্রকে দেখে তার জীবনের সমস্ত লোভ অপসারিত হয়েছে৷ তার প্রাণতুল্য গহনা যত ছিল তা অনঙ্গের পায়ে ছুড়ে দিয়ে সে তার স্বামীর চিকিৎসার দেনা মিটিয়েছে, নিজের শরীরকে রক্ষা করেছে৷ কিরণময়ী তার উদ্ধারকারী হিসেবে বার বার উপেন্দ্রকে অভিনন্দিত করে৷ সে অকপটে তার মনের সেই গোপন সত্যটিকে তার সামনে প্রকাশ করে দিলে উপেন্দ্রর মুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়৷ কিরণময়ী এ বিষয়ে তাকে মৃদু তিরস্কার করে জানায় ছেলে মানুষকে লজ্জা পেতে নেই৷ এবং তার মনের কথা তাকে জানিয়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বলে—‘‘যাক, তোমাকে যে ভালবাসি তা জানিয়ে দিয়ে আমি বাঁচলুম৷’’২৪ কিরণময়ী তার ঔদার্য, তার চিন্তাভাবনা দিয়ে জয় করতে পেরেছিল উপেন্দ্রকে৷ নারীর প্রণয়ই যে পুরুষের পরম সম্পদ! উপেন্দ্রও সেই সুন্দরী বিদুষী নারীর মুখে স্পষ্ট প্রণয়সম্ভাষণ শুনে গলে গিয়েছিল বললে অতুক্তি হবে না৷ কারণ সে সময় তার মুখে কোনোভাবেই কিরণের প্রতি তিরস্কার বা কোনো কঠিন বাণী উচ্চারিত হয়নি৷ বরং পরম ভরসায় তাকে বিশ্বাস করে তার অত্যন্ত আদরের পোষ্য ভাতৃতুল্য দিবাকরকে তার হাতে তুলে দিয়েছে দেখাশোনা করার জন্য৷ কিন্তু কিরণ তো উপেনের কাছে এমন অনুগ্রহ চায়নি৷ সে চেয়েছিল তার বিদ্যা বুদ্ধি রূপ দিয়ে তাকে সুরবালার প্রভাব মুক্ত করতে৷ আর সেই সময়ই ঘটে দুর্ঘটনা৷ উপেন্দ্র দিবাকরকে তার তত্ত্বাবধানে রেখে কলকাতায় গেলে সে তার চটুল যুক্তি-বাক্য-ব্যবহারে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে দিবাকরকে৷ অবশেষে দিবাকরকে নষ্ট করবার অভিযোগে তাকে অপমানিত করে উপেন্দ্র৷ কিরণ তার চরিত্র বলে দিবাকরকে মুগ্ধ করেছিল ঠিকই কিন্তু প্রণয়জালে আবদ্ধ করেনি—করার সংকল্পও করেনি৷ শাশুড়ি, বাড়ির ঝি এবং উপেনের তিরস্কারে আহত সর্পিণীর মতো সে গর্জে উঠে৷ চরম তিক্ততায় উপেনকে বলে—‘‘তোমার রাগ বল, ঘৃণা বল ঠাকুরপো, সমস্ত দিবাকরকে নিয়ে ত? কিন্তু বিধবার কাছে সেও যা, তুমিও ত তাই৷ তার সঙ্গে আমার সম্বন্ধটা কতদূর গিয়ে দাঁড়িয়েচে, সেটা শুধু তোমাদের অনুমান মাত্র৷ কিন্তু সেদিন যখন নিজের মুখে তোমাকে ভালবাসা জানিয়েছিলুম, তখন ত আমার দেওয়া খাবারের থালাটা এমনি করে ঘৃণায় সরিয়ে রাখোনি! নিজের বেলা বুঝি কুলটার হাতের মিষ্টান্নে ভালবাসার মধু বেশী মিঠে লাগে ঠাকুরপো?’’২৫ উপেন্দ্রর জন্য কিরণময়ী খাবার নিয়ে এলে দিবাকরের সঙ্গে সম্পর্ক অনুমান করে তার ছোঁয়া খাবারে ঘৃণায় অবহেলা করলে চরম অপমানে উপেন্দ্রর পৌরুষকে চরমভাবে বিদ্ধ করতে থাকে সে৷ আর সেই আসন্ন অপমানের প্রতিশোধ নিতে ঝি কে হাত করে দিবাকরকে সঙ্গে নিয়ে সকলের মুখে কালি ছিটিয়ে আরাকানে যাত্রা করে৷ সেখানে যাত্রাকালে জাহাজে পরিচিত হয় আরাকানের বাসিন্দা এক বাড়িউলির৷ সে তাদের কাছে প্রতিশ্রুত হয় কম দামে ঘর ভাড়া দেওয়ার এবং দিবাকরকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার৷ জাহাজের কেবিনে বসে কিরণময়ী তার উষ্ণ চুম্বন দান করলে বৌঠানের সঙ্গে দেশ ত্যাগের কালিমায় দিবাকরের তা বিষাক্ত মনে হয়৷

তারপরে ধীরে ধীরে লক্ষ্য করা যায় দিবাকরের প্রতি তার তীব্র অনিহা৷ সে তার সংযম দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে রাখে৷ ধীরে ধীরে দিবাকর তাকে ভালোবাসতে আরম্ভ করলেও সে প্রণয়ে সংকুচিত হয়ে পড়ে; তাদের সম্পর্ক চরম তিক্ততায় পর্যবসিত হয়৷ পারিপার্শ্বিক পরিবেশের চাপে তাদের জীবনধারাও পাল্টে যায়৷ তারা আরাকানে গিয়ে যে বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল তা যে আসলে একটা গণিকাগৃহ তার মালকিনের বর্ণনা এবং সেখানকার পরিবেশ সে চিত্রকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত করে৷ এবং শেষে দেখা যায় কিরণময়ী গণিকা হতে হতে বেঁচে যায়৷ তখনো তার দেহলোভীবাবু তার বিছানায় বসে প্রণয় প্রতিক্ষা করছে আর চরম অপমানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় কিরণের মূর্ছা প্রাপ্তি হয়েছে৷ সেই মুহূর্তে সতীশ তাদের আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধার করে৷ উপেনের অসুস্থতার বার্তা দিতে সে উপস্থিত হয়েছে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য৷ কিরণময়ী সেই সংবাদ শুনে পুনরায় মূর্ছা গেলে দিবাকরের বুঝতে অসুবিধা হয় না কেন তাকে কিরণ এতদিন ধরে উপেক্ষা করে এসেছে৷ সে তাই কিরণময়ীর সংজ্ঞাহীন দেহটার কাছে গিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরে বলে—‘‘আমি সমস্ত বুঝেচি বৌদি, তুমি আমার পূজনীয়া গুরুজন, তবে, কেন এতকাল গোপন করে আমাকে নরকে ডোবালে৷’’২৬ কিরণময়ী তার প্রেমের অপমান সহ্য করতে পারেনি তার বাঞ্ছিতের কাছ থেকে, তাই তার প্রতিশোধ নিতে তার প্রিয়জনের সর্বনাশ করেছে৷ উপন্যাসের শেষে তার জন্য অপার দয়া বর্ষিত হয়েছে৷ প্রেমিকের আসন্ন মৃত্যুর ভাবনা তাকে উন্মাদ করে ফেলেছে৷ সে তার লোভে কামনায় ঈর্ষায় যথার্থ স্বৈরিণী নারী হয়ে উঠেছে৷ যদিও লেখক বার বার প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন সাবিত্রীর মতো কিরণময়ীরও দৈহিক শুচিতার কথা৷ কিন্তু বহুদিনের অপার পিপাসা যাকে অনঙ্গের প্রতি ধাবিত করেছিল, সুরবালার সতীত্বকে পরাজিত করতে প্রণয় সম্ভাষণ করেছিল উপেন্দ্রকে এবং পরিশেষে জাহাজের কেবিনে যে নারী তার উষ্ণ চুম্বন নিবেদন করতে পিছপা হয়নি সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত যুবক দিবাকরকে; যে দিবাকর কিনা কিছু না জেনেবুঝেই তার সঙ্গে তার কথামত আরাকানে পাড়ি দিয়ে সমস্ত কলঙ্ককে মস্তকে ধারণ করেছিল৷ সেই কিরণময়ী সুদীর্ঘকাল একই ঘরে তার সঙ্গে পারস্পারিক সহবাসের মধ্যে কতটা শুচিতা রাখতে পারে তা সন্দেহের বিষয়৷ যাই হোক কিরণময়ীকে স্বৈরিণী নারী হিসেবে বিবেচিত করা যেতে পারে৷

কামিনী বাড়িউলি :

লেখক বেশ ফলাও করে আরাকানের কামিনী বাড়িউলির ব্যবসাকে বর্ণনা করেছেন৷ সে নিজে একজন গণিকা এবং বেশ্যালয়ের কর্তৃ৷ তার বাড়িটি আসলে একটা বেশ্যালয়৷ সে জানায় আরাকানে সে বিশ বছর ধরে আছে৷ উপন্যাসে বাড়িউলির বিবরণ দেওয়া হয়েছে এইভাবে—তার কথা বাঁকা বাঁকা, কপালে উলকি, সীমন্তে মস্ত সিঁদুরের দাগ, দুই কানে বিশ-ত্রিশটা মাকড়ি, নাকে নথ৷ বাড়িউলি দিবাকরকে কিরণের স্বামী ভেবে জাহাজে বসেই তার সঙ্গে বাড়ির দাম-দর করে নিয়ে তবে তাদের রেহাই দেয়৷

কিরণময়ী রূপবতী৷ প্রথম থেকে তাকে কাজে লাগানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে সেই বাড়িউলি৷ সে এক মাড়োয়ারি বাবুর কাছ থেকে টাকা খেয়ে তাকে প্রলোভিত করার চেষ্টায় থাকে৷ দিবাকরের সামনে সেই মাড়োয়ারি বাবুর আসক্তির কথা প্রকাশ করলে তা নিয়ে যখন সে নিজের সংযম হারিয়ে কিরণকে কঠিন বাক্য দ্বারা পীড়িত করে তার জবাব দিয়ে বাড়িউলি বলে—‘‘আমরা হলুম সুখের পায়রা—বেবুশ্যে! যেখানে যার কাছে সুখ পাব, সোনা-দানা পাব, তার কাছেই যাব৷ এতে লজ্জাই বা কি, আর ঢাকাঢাকিই বা কিসের জন্য!’’২৭ বাড়িউলি কামিনী পাকা ব্যবসায়ী৷ সে তার যৌনপেশাকে কারও কাছে রাখঢাক করে রাখতে চায় না৷ তাছাড়া অর্থ ও সম্পদে অসাধারণ কর্তৃত্ব তার৷ দিবাকর তার কথায় সম্বিত হারিয়ে সেই অন্ত্যজ গণিকার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া শুরু করে দেয় এবং কিরণ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভেবে তাকেও আঘাত করে৷ কিরণময়ী তার জন্য দিবাকরকে কামনায় পীড়িত বুঝে তাকে অনুরোধ করে সম্মুখস্থ কালীবাড়ীতে পাঠিয়ে দেয় আপাত রাত্রিবাসের জন্য৷ পরদিন দিবাকরের অনুপস্থিতির অবসরে আবার তার সামনে চুপি চুপি এসে উপস্থিত হয় সেই কামিনী বাড়িউলি৷ সে নানাভাবে প্রলোভিত করতে থাকে তাকে৷ সে তাকে উপদেশ দিয়ে বলে—তার মতো নারীদের জীবনের মূল কথাই হল—‘‘খাও, পরো, মাখো, সোনা-দানা গায়ে তোলো, সঙ্গে সঙ্গে পীরিতও কর৷’’২৮ অর্থাৎ তাদের ভালোবাসায় মনোবৃত্তির কোনো স্থান নেই সেখানে শুধু প্রযোজ্য অর্থ আর অলঙ্কার এবং দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্য৷ সে তাকে আরও বোঝায় যে তার সেই বয়সটাই হল পীরিত করবার বয়স৷ সে তার ‘সোমত্ত’ বয়সটাকে শুধু দুহাতে লুটেপুটে উপভোগ করবে, করবে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়৷ তবেই রানি হয়ে সেই সম্পদ নির্বিঘ্নে উপভোগ করতে পারবে সুদূর ভবিষ্যতে৷

বাড়িউলি তার কৌশল খাটিয়ে কিরণের জন্য খদ্দেরও জোগাড় করে ফেলে৷ কিরণকে সে কথা জানিয়ে সে বলে—‘‘খোট্টা মিনসেকে ত সকালেই খবর পাঠিয়েছিলুম৷ ব্যাটার আর তর সয় না, বলে, লোকজন কাজে বেরিয়ে গেলে দুপুরবেলাতেই আসব৷’’২৯ সে তার ঘরে কোনো পরপুরুষ তার দেহের লোভে খদ্দের হয়ে আসবে ভেবে সন্ত্রস্ত হয়ে গেলে তার সেই ভাব দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ে বাড়িউলি৷ সে কিরণকে তার সমগোত্রীয় করে পরম আত্মীয়তায় ‘তুই’ সম্বোধন করে বসে৷ তার সেই কথার স্পষ্ট ইঙ্গিত কিরণময়ীকে তীরের মতো বিদ্ধ করতে থাকে কিন্তু ভদ্রতার বশে চুপ করে থাকলে বাড়িউলি আপন ঝোকেই তাকে বলে—‘‘তুই দেখিস দিকিন বৌ, ছ’মাসের মধ্যে যদি না তোর বরাত ফিরিয়ে দিতে পারি ত, আমার কামিনী বাড়িউলী নাম নয়৷ তুই শুধু আমার কথামত চলিস—আর আমি কিছুই চাইনে৷’’৩০ বাড়িউলি তার সুদক্ষ বাক্যজালে কিরণের জন্য ঠিক করা খদ্দেরের অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি জাহির করে—তার রূপের প্রশংসা করে তাকে তৈরি করার চেষ্টা করে—কিন্তু তাতে আপত্তি করে কিরণ জানায়, তার ঘরে যেন না আসে কেউ৷ সে কথায় অবাক হয়ে সেই বাড়িউলি বলে—‘‘তুই ত আর কারো কুলের বৌ ন’স! মানুষ-জন তোর ঘরে আসবে, বসবে, তাতে ভয়টা কাকে শুনি? তুই হলি বেবুশ্যে৷’’৩১ বাড়িউলির মুখে বেবুশ্যে বা বেশ্যা সম্বোধন শুনে কিরণের আত্মজ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে যায় আর সেই অবসরে সেই মাড়োয়ারি খদ্দের তার গৃহে উপস্থিত হলে সমস্ত সহিষ্ণুতা হারিয়ে মূর্ছিত হয়ে যায় সে৷ বাড়িউলির চিৎকারে তাকে সুস্থ করার জন্য সকলে ছোটাছুটি শুরু করে দেয়৷

এই বাড়িউলি চরিত্রকে একবারে বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপিত করেছেন লেখক৷ শিক্ষা সংস্কার বর্জিত এই অন্ত্যজ গণিকা তার যথার্থ দোসর বানাতে নানা রকম প্ররোচনামূলক বাক্য প্রয়োগ করে কিরণের উদ্দেশ্যে তা যথার্থই তার চরিত্রপোযোগী৷ একজন নারীকে গণিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে আখেরে যে তারই লাভ সেই দিকটিকেও লেখক তার লোলুপ মনোবৃত্তির মধ্যে প্রকাশ করেছেন৷ বাড়িউলি সেই মারোয়ারি খদ্দেরকে কিরণময়ীর ঘরে প্রবেশ করাতে করাতে আবদার রাখে তার বাড়িটি মেরামত করে দেওয়ার জন্য৷ অর্থাৎ নিজে হাতে গণিকা তৈরি করে তাকে কাজে লাগিয়ে দু-পয়সা উপার্জন করার প্রচেষ্টা যে বাড়িউলিদের মধ্যে সদা জাগ্রত থাকে তাও লেখকের দৃষ্টি এড়ায়নি৷

খ. দেবদাস :

‘দেবদাস’ (১৯১৭) উপন্যাসের অন্যতম গণিকা চরিত্র চন্দ্রমুখী৷ সে উপন্যাসের আসল নায়িকা নয়—সহনায়িকা৷ তথাপি লেখক এই বারবিলাসিনী নারীটিকে তাঁর অপার সহানুভূতি দিয়ে গড়ে চরিত্রমহিমায় নায়িকার সমকক্ষ করে দিয়েছেন৷ এই চরিত্র চিত্রণে শরৎচন্দ্রের আধুনিক বাস্তববাদী অথচ রোমান্টিক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে৷ এখানে চন্দ্রমুখীর দেহব্যবসায়ী হওয়ার কোনো ইতিহাস ব্যক্ত করেননি, চেষ্টাও করেননি তার দৈহিক শুচিতা প্রমাণের৷ শুধু দেবদাসের সঙ্গে তার কথার ছলে নিজের পূর্বজীবন সম্পর্কে একটুখানি কথা তার মুখে তুলে ধরেছেন—‘‘সে আজ দশ বছরের কথা—যখন আমি ভালবেসে ঘর ছেড়ে চলে আসি৷ তখন মনে হতো কত না ভালবাসি, বুঝি প্রাণটাও দিতে পারি৷ তারপর একদিন তুচ্ছ একটা গয়না নিয়ে দু’জনের এমনি ঝগড়া হয়ে গেল যে, আর কখনো কেউ কারো মুখ দেখলাম না৷’’৩২ তার পরের কথা স্পষ্টতই বোঝা যায় তার বর্তমান অবস্থা দেখে৷ চন্দ্রমুখী গণিকা হয়ে তার পরবর্তী জীবন অতিবাহিত করেছে৷ সে তার সেই গণিকাজীবনের মাঝখানে দেবদাসকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছে কিন্তু সেই ভালোবাসা একপাক্ষিক৷ দেবদাসের প্রবল ঘৃণার মধ্য দিয়ে তার সত্যিকারের প্রেমে অভিষেক ঘটেছে৷ তাই সে তাকে বলতে পেরেছে যে যেদিন কৈশোরের কাঁচা প্রেমকে সামান্য গয়নার কারণে অনায়াসে পরিত্যাগ করে চলে এসেছিল সেদিন তার জানা ছিল না সীতা-দময়ন্তীর ব্যথা, বিশ্বাস করতো না জগাই-মাধাই-এর কথা এবং সেদিন তার ধারণার মধ্যেও ছিল না প্রেমাস্পদের সামান্য একটু মাথাধরা সারাতে গিয়েও অকাতরে নিজের প্রাণটা পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়া যায়৷

উপন্যাসের আরেক চরিত্র চুনিলাল মদ্যাসক্ত এবং বেশ্যাভক্ত৷ তার সঙ্গেই প্রথম পার্বতী বিরহের বেদনাভুলতে দেবদাস উপস্থিত হয়েছিল চন্দ্রমুখীর দরজায়৷ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতাহীন দেবদাস তার গৃহে উপস্থিত হলে গণিকা নারীর সংস্পর্শজনিত প্রবল ঘৃণায় সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠে তার৷ সেই নিবিড় ঘৃণা গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের মতো চোখের ভ্রূকুটির মধ্যে দিয়ে বেড়িয়ে আসে তার মুখে—‘‘চুনিবাবু, এ কোন হতভাগা জায়গায় আনলে?’’৩৩ সেই বাক্যবাণে হতভম্ব হয়ে যায় চুনি ও চন্দ্রমুখী৷ নিজেকে সামলে চুনি তাকে চন্দ্রমুখীর ঘরে নিয়ে বসায়৷ সেখানে সেই বাক্যহীন পরিবেশে কারও মুখে কোনো কথা জোগায় না৷ দেবদাসের প্রচণ্ড ঘৃণা যেন সবকিছুকে চেপে ধরে থাকে৷ আর চন্দ্রমুখী যাকে ইতিপূর্বে কেউ কখনো কথায় ঠকাতে পারেনি, কখনো নিজের কৌশলীবুদ্ধি দিয়ে কারও কাছে অপ্রতিভ হয়নি, তার অন্তরের মধ্যে দেবদাসের আন্তরিক ঘৃণা এবং কঠোর উক্তি প্রবল আঘাত হানে৷ সেও জীবনে প্রথম হতবুদ্ধি হয়ে বসে থেকে গড়গড়ায় তামাকু সেবন করতে থাকে৷ চুনিলাল সেই অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে কাজের অছিলায় বেড়িয়ে গেলে অনেকক্ষণ পর দেবদাস চন্দ্রমুখীকে জিজ্ঞেস করে, সে টাকা নেয় কি না৷ হঠাৎ তার সেই কথায় কোনো উত্তর জোগাড় হয় না চন্দ্রমুখীর মুখে৷ তার চব্বিশ বছর বয়স হয়েছে, গণিকা জীবনের নয়-দশ বছর সময়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রকৃতির লোকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছে কিন্তু দেবদাসের মত অমন আশ্চর্য মানুষ সে একটিও দেখেনি, তাই একটু ইতস্তত করে সে যখন বলে—‘‘আপনার যখন পায়ের ধূলো পড়েচে—’’৩৪ তার মুখের কথা শেষ করতে না দিয়েই দেবদাস পুনরায় সেই টাকার কথা জিজ্ঞেস করলে সে স্পষ্টভাবে স্বীকার করে৷ কারণ টাকা না হলে তাদের চলবে কি করে৷ সঙ্গে সঙ্গে সে একটা নোট দিয়ে তার ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়৷ চন্দ্রমুখীর ইচ্ছে হচ্ছিল সেই টাকা তখনি ফিরিয়ে দেয় কিন্তু সংকোচের বশে তা আর পারে না৷ নিস্পন্দের মতো চৌকাঠ ধরে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে৷ পরে চুনি ফিরে এলে তাকে অনুরোধ করে দেবদাসের টাকা তার হাতে ফিরিয়ে দিতে কিন্তু চুনিও রাজী হয় না৷ সে চুনির মুখে আভাস পায় দেবদাসের ভিতরের অব্যক্ত যন্ত্রণার৷ তাই চুনিকে সে মাথার দিব্যি দিয়ে রাজী করায় আরেকবার দেবদাসকে তার ঘরে আনার জন্য৷

চুনি চন্দ্রমুখীর রোজকার অতিথি৷ তার হাত ধরে দেবদাস পুনরায় উপস্থিত হয় চন্দ্রমুখীর ঘরে৷ আকন্ঠ মদে নিমজ্জিত হয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত তার জ্ঞান লোপ না পায় ততক্ষণ চন্দ্রমুখীর প্রতি ঘৃণা বর্ষণ করতে থাকে৷ তারপর যখন নেশার ঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে শান্ত হয়ে যায় তার প্রলাপ তখন পরম মমতায় সেই বহুপুরুষবিনোদিনী চন্দ্রমুখী তার কাছে গিয়ে বসে, আঁচল ভিজিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়, মাথার ভেজা বালিশ পাল্টে দেয়৷ শেষে পাখা নিয়ে বাতাস করতে করতে অবরুদ্ধ এক যন্ত্রণায় গুমরে মরতে থাকে৷ দেবদাসকে দেখে সে দুঃখ পেয়েছে, করুণা অনুভব করেছে এবং সেই ছিদ্রপথ বেয়েই দানা বেঁধেছে তার প্রতি নিষ্কলুষ ভালোবাসা৷ আর ভালোবাসার জোরেই নিজের বহুদিনের পুরোনো পেশা ছেড়ে বরণ করে নিয়েছে দুঃখ কষ্টময় সাধারণ জীবন৷ দেবদাস পিতৃশ্রাদ্ধ সমাপন করে পুনরায় চন্দ্রমুখীর গৃহে উপস্থিত হয়ে দেখেছে তার গৃহের সেই জৌলুস লুপ্ত৷ অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকির পর ভেতর থেকে উত্তর আসে ‘এখানে নয়’৷ চন্দ্রমুখী তার কোনো দেহলোভী ভ্রমর ভেবে ‘এখানে নয়’ বলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে পুরুষ গ্রাহকদের৷ অর্থাৎ সে যে আর গণিকা হিসেবে নিজেকে হেয় করতে চায় না৷ কিন্তু পরক্ষণে যখন জানতে পারে সে-ই দেবদাস তখন সাগ্রহে দরজা খুলে দেয়৷ দেবদাসের তার কন্ঠস্বর পরিচিত মনে হলেও সেই দ্বার খুলে দেওয়া নারীটিকে চিনতে পারে না৷ তারপর উপরে গিয়ে বিস্মিত হয়ে যায় চন্দ্রমুখীর বেশভূষা দেখে৷ তার পরণে কালোপেড়ে ধুতি, দুহাতে দুগাছি বালা, মাথার চুল এলোমেলো, শরীর পূর্বের তুলনায় কৃশ৷ ঘরের ভিতরে একটিও আসবাব অবশিষ্ট নেই৷ দেবদাস এসবের কিছুই বুঝতে পারে না৷ সে নানা কথা জিজ্ঞেস করে আসল ঘটনা জানার জন্য৷ চুনিবাবুর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে তার সঙ্গে দুমাস ধরে চন্দ্রমুখীর কোনো যোগাযোগ নেই৷ চুনিবাবু চন্দ্রমুখীর উপপতি করার জন্য একজন বাবু ধরে এনেছিল, সে তাকে মাসে দু’শ করে টাকা একরাশ অলঙ্কার এবং সুরক্ষার জন্য একজন সিপাই দিতে রাজী ছিল৷ চন্দ্রমুখী চুনিবাবুর আনা সেই বাবু এবং তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে৷ অতবড় সুযোগ সে শুধু হেলায় অবহেলা করেছে দেবদাসকে ভালোবেসে৷ সব কিছু বিক্রয় করে নয়শত টাকা সম্বল ছিল তার৷ এক দোকানির কাছে তা জমা দিয়ে মাসে মাসে কুরি টাকা করে সে পায়৷ তা দিয়েই জীবনধারণের চেষ্টা করে গেছে চন্দ্রমুখী৷ যে দীর্ঘ দিন আরাম-আয়েস বিলাসিতায় রানির মতো জীবন কাটাতে অভ্যস্ত তার কুড়ি টাকায় জীবন চালানোর কথা শুনে অবাক হয়ে গেছে দেবদাস এবং তার সেই বিস্ময় আরও বেড়ে যায় যখন সে শোনে চন্দ্রমুখী শুধু তাকে দেখার জন্য সেই শ্রীহীন বাড়িতে শ্রীহীন হয়ে উন্মুখ অপেক্ষায় বসে আছে৷ সে দেবদাসের প্রতি নিঃস্বার্থ প্রেমকে একবার দেখাতে চায় দেবদাসকে৷ হয় তো তার গণিকা জীবনে অভ্যস্ত যে নারীসত্তা বহুদিন ভালোবাসা বেচা-কেনার মধ্যে দিয়ে সময় অতিবাহিত করে এসেছে আর যখন সত্যিকারের ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছে তা প্রেমাস্পদকে না জানিয়ে থাকতে পারেনি৷ সে তার সেই প্রেমানুভূতিকে প্রেমাস্পদের কাছে ব্যক্ত করার সুযোগটিকেও হারাতে চায় না কারণ এর পূর্বে দেবদাসকে কখনো সজ্ঞানে পায়নি৷ যতক্ষণ তার জ্ঞান থাকতো ততক্ষণ তাকে ঘৃণা করে দূরে ঠেলে রাখত আর যখন জ্ঞান হারাত তখন নিজের কথা বলার মতো অবকাশ থাকতো না৷ আর আজ দেবদাস তাকে ঘৃণা না করে কাছে বসে দুটো কথা শুনছে সে কি করে তার ভেতরের দুর্বার প্রেমাবেগকে দমন করবে! সে দেবদাসকে জানিয়েছে দেবদাসকে একবার দেখার জন্য প্রতীক্ষায় থাকা তার একটা খেয়াল৷ সে প্রথম যখন একরাশ ঘৃণা নিয়ে তার সামনে উপস্থিত হয়েছিল তখন থেকেই চন্দ্রমুখী তার দিকে দৃষ্টি দিয়েছিল৷ সে ধনের আশায় তার দিকে আকৃষ্ট হয়নি৷ সে আকৃষ্ট হয়েছে তার তেজ দেখে৷ সে এসে তাকে প্রথম আঘাত করে তার অযাচিত রুঢ় ব্যবহার দিয়ে, ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে থেকে শেষে তামাশার মতো একটা নোট দিয়ে কোনো কথা না বলে চলে যায় তখন চন্দ্রমুখীর মনে হয়েছিল দেবদাস সকলের চেয়ে আলাদা—‘‘সেই অবধি তোমার প্রতি দৃষ্টি রাখলাম৷ ভালবেসে নয়, ঘৃণা করেও নয়৷ একটা নূতন জিনিস দেখলে যেমন খুব মনে থাকে, তোমাকেও তাই কিছুতেই ভুলতে পারিনি—তুমি এলে বড় ভয়ে ভয়ে সতর্ক হয়ে থাকতাম, কিন্তু না এলে কিছুই ভাল লাগত না৷ তারপর আবার কি যে মতিভ্রম ঘটল—এই দুটো চোখে অনেক জিনিসই আর একরকম দেখতে লাগলাম৷ পূর্ব্বের ‘আমি’ র সঙ্গে এমন করে বদলে গেলাম—যেন সে ‘আমি’ আর নয়৷ তার পরে তুমি মদ ধরলে৷ মদে আমার বড় ঘৃণা৷ কেউ মাতাল হলে তার উপর বড় রাগ হত৷ কিন্তু তুমি মাতাল হলে রাগ হত না, কিন্তু বড্ড দুঃখ পেতাম৷’’৩৫ তারপর মাতাল দেবদাসের মুখে যেদিন গণিকার অপার যন্ত্রণার কথা উঠে আসে সেদিন থেকে সব ছেড়ে দেয় চন্দ্রমুখী৷ আর সে সম্পর্কে তার স্পষ্ট সিদ্ধান্ত—‘‘এ জীবনে ভালবাসার ব্যবসা অনেকদিন করেচি কিন্তু একটিবারমাত্র ভালবেসেচি৷ সে ভালবাসার অনেক মূল্য৷’’৩৬ দেবদাসকে ভালোবেসে সে শুধু তার সমস্ত কিছু ছেড়ে দিয়ে আড়ম্বরহীন জীবনযাপনকে বরণ করেই নেয়নি—নিজের কলঙ্কিত দেহের জন্য নিজেকেই ঘৃণা করতে শুরু করে দিয়েছে৷ নিজের সমস্ত কথা দেবদাসকে বলে নিজেকে হাল্কা করে শেষে তার পদধূলি নিয়ে নিজের তাগিদে সম্বলহীন হয়ে নিঃসঙ্গ চন্দ্রমুখী অশ্বত্থঝুরি গ্রামে ঘর বেঁধেছে৷ সে বিদায় কালে দেবদাসকে অনুরোধ করেছিল কোনোদিন যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তার মতো দাসীকে যেন মনে করে সে৷ সেখানে বহুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর দেবদাসের কোনো খোঁজ না পেয়ে উদ্বিগ্ন মনে সে উপস্থিত হয় তালসোনাপুর গ্রামে দেবদাসের বাড়িতে৷ কথার ফাঁদ পেতে বড়বৌ-এর কাছ থেকে সব খবর নিয়ে স্বেচ্ছাচারী অসুস্থ দেবদাসের খবর পাওয়ার জন্য কলকাতায় উপস্থিত হয়ে নকল গহনা-বস্ত্রাদিতে পুনরায় দেহের পসরা সাজায়৷ উদ্দেশ্য যদি ভ্রমক্রমেও সেখানে দেবদাস এসে উপস্থিত হয়৷ অচেনা লোকদের দুয়ার থেকে তাড়িয়ে দিয়ে চেনা লোকদের ডেকে ডেকে ঘরে বসায়৷ দেবদাসের কথা জিজ্ঞেস করে৷ অবশেষে দেড়মাস পর সন্ধান পায় দেবদাসের ৷ মদ্যপ, অসংলগ্ন কথাবার্তায়রত দেবদাসকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে ঘরে নিয়ে যায়৷ মাসাধিককাল শয্যাশায়ী দেবদাসকে সেবায় যত্নে চিকিৎসায় সুস্থ করে তোলে৷ সে যেভাবে তাকে বেশ্যা সেজে পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে গেছে, যেভাবে অক্লান্ত সেবা করে সুস্থ করে তুলেছে মৃত্যুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে—তাতে তার ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিমত্তাও প্রকাশিত হয়েছে৷ চন্দ্রমুখী বুঝেছিল যে যতই সে দেবদাসের দিকে দৃষ্টি রাখার চেষ্টা করুক কিছুতেই তাকে ধরে রাখতে পারবে না, সে অধিকার তার নেই৷ সে উশৃঙ্খল অনাচারী জীবন থেকে তাকে সরিয়েও আনতে পারবে না৷ নিঃস্বার্থ সেবা দিয়ে তার মন জয় করেছিল; ভালোবেসে বুকে টেনে না নিলেও বারবধূ চন্দ্রমুখী, দেবদাস তাকে আর ঘৃণা করতে পারেনি অন্তত৷ গণিকার নিঃছিদ্র ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘বৌ’ ডেকে ধন্য করেছিল, যা চন্দ্রমুখীর প্রেমবুভুক্ষ অন্তরের সবচেয়ে বড় পাওয়া৷ চন্দ্রমুখী তার একপাক্ষিক ভালোবাসায় দেবদাসকে নিজের করে পাওয়ার মতো দুঃসাহস পর্যন্ত দেখায়নি কোনোদিন৷ দেবদাস যখন তাকে বলে যে মৃত্যুর পরে যদি কোনো মিলন থাকে তবে সেখানে সে চন্দ্রমুখীর থেকে দূরে থাকবে না৷ তার এইটুকু স্বীকারোক্তিতে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেয় নিম্নপেশাত্তীর্ণ চন্দ্রমুখী৷ ভগবানের কাছে শুধু প্রার্থনা করে—‘‘ভগবান, কোনকালে, কোন জন্মে যদি এই পাপিষ্ঠার প্রায়শ্চিত্ত হয়, আমাকে যেন এই পুরস্কার দিয়ো!’’৩৭ দেবদাস তার সদ্য আরোগ্যপ্রাপ্ত দেহটি নিয়ে বায়ুপরিবর্তনের জন্য শুধুমাত্র চাকর ধর্ম্মদাস সহ এলাহাবাদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে চন্দ্রমুখী তার সেবার জন্য যেতে চায়৷ কিন্তু সে যখন সমাজের সম্ভ্রমের কথা বলে তার সামনে সমাজে গণিকার অবস্থানগত এক জীবন্ত ছবি ফুটে উঠে৷ চন্দ্রমুখী জানে ‘‘এ জগতে তাহার সম্মান নাই৷ তাহার সংস্পর্শে দেবদাস সুখ পাইবে, সেবা পাইবে, কিন্তু কখনো সম্মান পাইবে না৷’’৩৮

চন্দ্রমুখী সেবায় মমতায় ভালোবাসায় তৈরি এমন একজন নারী যে দেবদাসের মতো মানুষের সহানুভূতি অর্জন করেছে৷ যে দেবদাস কোনোদিন গণিকাদের ঘৃণ্য জীব ছাড়া আর কিছু মনে করতো না তার কাছে নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে ‘বৌ’ এর অভিধা অর্জন করেছে৷ জীবনের শেষ লগ্নে দেবদাসের মানসপটে তার মায়ের মুখচ্ছবির সঙ্গে চন্দ্রমুখীর মুখের ছবিও ফুটে উঠেছে৷ একজন বেশ্যা হয়ে সে তার শ্রদ্ধা-ভালোবাসার রসে দ্রবিভূত করেছিল প্রেমাস্পদের প্রস্তরকঠিন মনকে৷ পার্বতীও চন্দ্রমুখীর সংস্পর্শ থেকে দেবদাসকে মুক্তির জন্য তার কাছে গিয়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল৷ নিজের জীবনের প্রিয় মানুষটিকে একজন বারাঙ্গনার তত্ত্বাবধানে রাখতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল৷ চন্দ্রমুখী তার হীন জীবনে কোনোদিন কোনোকিছু প্রত্যাশা করেনি তার কাছে৷ তবু যতটুকু পেয়েছে ততটুকুই নিঙড়ে গ্রহণ করেছে, নিজেকে ধন্য মনে করেছে তাতেই৷ দেবদাসকে তার স্বভাব অনুযায়ী মেনে নিয়ে তার ভালো করার সাধনায় তিলে তিলে নিজেকে ক্ষয় করেছে; ভেঙ্গে নতুন করে গড়েছে৷

এছাড়া আরেকজন গৌন গণিকার সন্ধান পাওয়া যায় সে ক্ষেত্রমণি৷ সে চন্দ্রমুখীর প্রতিবেশী পণ্যাঙ্গনা৷ চন্দ্রমুখী তার বৈরাগ্যের সূচনায় বিক্রির অতিরিক্ত জিনিস ক্ষেত্রমণিকে দিয়ে এসেছিল৷ তার পরে দীর্ঘ আড়াই বছর পর যখন পুনরায় বেশ্যা সেজে দেবদাসকে ধরার পরিকল্পনা করে তখনও ক্ষেত্রমণির উল্লেখ রয়েছে৷ উপন্যাসে আলাদা করে ভূমিকা নেই তার৷ চন্দ্রমুখীর মধ্য দিয়েই তাকে একটু-আধটু করে তুলে ধরেছেন লেখক৷

গ. শ্রীকান্ত :

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি চারটি পর্বে সমাপ্ত৷ ১৩২২ সালের মাঘ মাস থেকে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় এটি যখন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে তখন এর নাম ছিল ‘শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনী’ এবং প্রথম দিকে লেখকের নামের জায়গায় নাম ছিল শ্রী শ্রীকান্ত শর্মা৷ পরবর্তীকালে ‘শ্রীকান্ত’র চারটি পর্ব আলাদা আলাদা সময়ে প্রকাশিত হয়৷ যথা ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম পর্ব-১৯১৭, দ্বিতীয় পর্ব ১৯১৮, তৃতীয় পর্ব ১৯২৭, চতুর্থ পর্ব ১৯৩৩৷

বাংলা সাহিত্যের জগতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতেই গণিকারা প্রথম মনুষত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়৷ স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসায়, ত্যাগে, মহত্ত্বে উচ্চতম শিখর স্পর্শ করে তাদের মহিমা৷ অন্তরের সংবেদনশীলতা ও স্বচ্ছ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে লেখক স্বয়ং প্রকৃত সমাজতাত্ত্বিকের মতো নারীর পদস্খলন ও পতিতাবৃত্তি গ্রহণের কারণ অনুসন্ধান করতে তৎপর হয়েছিলেন এবং তার ভিত্তিতেই পরম সহানুভূতি ও শ্রদ্ধায় অঙ্কিত করেছিলেন পতিতা নারীদের জীবন৷

পিয়ারীবাই :

‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি শ্রীকান্তের কলমে লেখা৷ শ্রীকান্ত তার সুদীর্ঘ জীবন অভিজ্ঞতার পরতে পরতে যে সকল মানুষের সংস্পর্শ লাভ করেছিলেন এবং যা যা দেখেছিলেন তারই নথিবদ্ধ বিবরণ৷ শ্রীকান্তের কথায় এখানে আলোচিত হয়েছে পিয়ারীবাঈ-এর প্রসঙ্গ৷ শ্রীকান্ত যদি উপন্যাসের নায়ক হয় তাহলে উপন্যাসটির নায়িকা রাজলক্ষ্মী বা পিয়ারীবাই৷ চরিত্রটির মধ্য দিয়ে লেখকের আধুনিক বাস্তববাদী অথচ রোমান্টিক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে৷

পিয়ারীর কাহিনি শুরু হয়েছে উপন্যাসের প্রথম পর্বের মাঝামাঝি আসার পর৷ শ্রীকান্ত তার কেন্দ্রহীন ভবঘুরে জীবনে জমিদার বন্ধুর আমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত হয় বিহারের জঙ্গলে শিকারের উদ্দেশ্যে বন্ধুর তাবুতে৷ পাটনার স্বনামধন্য বাইজি পিয়ারীবাই বহু অর্থের বিনিময়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছে তাদের মনোরঞ্জন করার জন্য৷ সে সম্পর্কে শ্রীকান্ত জানিয়েছে—‘‘এই বাইজীটি পাটনা হইতে অনেক টাকার শর্তে দুই সপ্তাহের জন্য আসিয়াছেন৷ এইখানে রাজকুমার যে বিবেচনা এবং যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়াছেন, সে কথা স্বীকার করিতেই হইবে৷ বাইজী সুশ্রী, অতিশয় সুকন্ঠ এবং গান গাহিতে জানে৷’’৩৯ রূপ যৌবন সম্পন্না নৃত্যগীতে পারদর্শিনী বারবধূরাই যে তাদের উপপতি, বাবুদের পছন্দের প্রধান সামগ্রী তা শ্রীকান্তের উক্তি থেকে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়৷ পিয়ারী রাজকুমারের আদেশে এবং শ্রীকান্তের অনুরোধে তার সুরেলা কন্ঠের জাদুকরি মহিমায় সকলকে আপ্লুত করে এবং শ্রীকান্তের মনে হয় এতক্ষণ টাকার লোভে সে তার গান পরিবেশনে বাধ্য থাকলেও তার মত সমজদার শ্রোতা পাওয়ার ফলে বাইজি তার গানের রাজ্যে সুরের তরীটিকে ভাসিয়ে দিতে পেরেছে নিজের খেয়ালে৷ গান শেষে অভিভূত শ্রীকান্ত তার ‘তারিফ’ করলে বাইজি তাকে সেলাম না ঠুকে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম জানায়৷ তারা দুজনেই দু-সপ্তাহের জন্য রাজকুমারের তাবুতে এসেছে৷ সেই দু-সপ্তাহ শ্রীকান্ত তার গান শুনতে পাবে বাইজির সামনে তা নিজের সৌভাগ্য বলে জাহির করলে সে তার কাছে সরে এসে পরিষ্কার বাংলায় জানায়—‘‘টাকা নিয়েছি, আমাকে ত গাইতেই হবে, কিন্তু আপনি এই পনর-ষোল দিন ধ’রে এঁর মোসাহেবি করবেন? যান, কালকেই বাড়ি চ’লে যান৷’’৪০ বাইজির মুখে এধরনের খোঁচা খেয়ে মনটা বিকল হয়ে যায় তার৷ বন্ধুর সঙ্গে শিকারে গিয়েও সেখান থেকে ফিরে এসে বাইজির খানসামা রতনের মধ্য দিয়ে বাইজির আমন্ত্রণ পেয়ে তার তাবুতে উপস্থিত হয়৷ সেখানে গিয়ে দেখে বাইজি তার প্রতীক্ষা করে বসে আছে৷ তার আকৃতি প্রকৃতি বাঙালি নারীর মতোই৷ একটা মূল্যবান কার্পেটের উপর গরদের একটা শাড়ি পড়ে বসে আছে৷ ভিজে এলোচুল পিঠের উপর ছড়ানো; হাতের কাছে পানের সাজ-সরঞ্জাম, সামনে গুড়গুড়িতে তামাক সাজা, বাইজি তামাক খাচ্ছিল৷ শ্রীকান্তকে দেখে সৌজন্যবশত তার তামাক খাওয়া বন্ধ করে একেবারে নিকট আত্মীয়ের মতো তার সকল খোঁজ-খবর করতে থাকে৷ বাইজির সেই অতি পরিচিত জনের মতো কাথায় তাকে চিনতে না পেরে শ্রীকান্ত বিরক্ত হয়ে গেলে সেই বাইজি—‘‘হাসিল; কহিল, লাভ-ক্ষতিই কি সংসারে সব? মায়া, মমতা, ভালবাসাটা কি কিছু নয়? আমার নাম পিয়ারী, কিন্তু, আমার মুখ দেখেও যখন চিনতে পারলে না, তখন ছেলেবেলার ডাকনাম শুনেই কি আমাকে চিনতে পারবে? তা ছাড়া আমি তোমাদের—ও গ্রামের মেয়েও নই৷’’৪১ কথক শ্রীকান্ত কোনোভাবেই তার জীবনের সমস্ত অতীত পাতাগুলি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পিয়ারীর সন্ধান পায় না৷ তিন-চারদিন উভয়ের উভয়কে এড়িয়ে চলার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়ে যায়৷ হঠাৎ কথক রাজকুমার ও তার অপর বয়স্যদের সঙ্গে বাজি ধরে শনিবারে অমাবস্যার নিশুতিরাতে একাকী সাহসিকতার পরিচয় দিতে শ্মশানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে আবার তার পথ আগলায় পিয়ারী৷ অদৃশ্য একটা অধিকারের বন্ধন দিয়ে সে কথকের সঙ্গে অত্যন্ত আপনজনের মতো নিষেধ জ্ঞাপন করতে থাকে৷ কথক তার বারণ না শুনলে সে নিজেও তার সঙ্গে যেতে চায়৷ তার পরে কথক যখন তাকে সঙ্গে যেতে বলে তখন তার সামাজিক অবস্থানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপে জ্বলে উঠে সে বলে—যে দেশ-বিদেশে তা হলে তার সুখ্যাতির আর সীমা-পরিসীমা থাকবে না! সকলে বলবে বাবু শিকারে এসে একটা বাইউলি সঙ্গে করে দুপুর রাত্রে ভূত দেখতে গিয়েছিলেন৷ পিয়ারীর জেদ, তার জোর করার ভঙ্গি এবং আপনজনের মতো ব্যবহার কথকের স্মৃতির পথের অনুসন্ধানের কার্যটিকে ক্রমাগতই এগিয়ে নিয়ে আসছিল; হঠাৎই তা যেন সফলতা স্পর্শ করে৷ তা হল পিয়ারীর একটা অভ্যেস৷ সে রাগলেই তার দাঁত দিয়ে অধর চেপে ধরতো৷ সেই অভ্যেস সে ছোটবেলায় আরেকজনের কাছে দেখেছে সে হল রাজলক্ষ্মী৷ তাই কথক সেই রাজলক্ষ্মী এই হয়ে গেছে দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যায়৷ এখানে কথকের অভিভূত হয়ে যাওয়া শুধুমাত্র একজন গ্রাম্য মেয়ের বারবধূ হয়ে উঠার মধ্যে নয় তার বিস্ময়ের আর এক কারণ হল তার শারীরিক পরিবর্তন৷ কারণ রাজলক্ষ্মীর ছোটবেলায় গায়ের রঙ ফরসা হলেও ম্যালেরিয়া ও প্লীহার কারণে তার পেটটা ছিল ধামার মতো, হাত-পা কাঠির মতো, মাথার চুলগুলো তামার শলার মতো—কতগুলো তা গুণে বলা যেতে পারতো৷ সেই রূপহীন শ্রীহীন ছোট্ট মেয়েটি রূপবতী নৃত্যগীত পারদর্শী ছলাকলাপটিয়সী একজন বিত্তবান বারবনিতা!

পিয়ারীর সেই স্নিগ্ধ অতীত সর্বদাই তার মনকে মাধুর্য দান করেছে৷ তার ও শ্রীকান্তর অতীত ছিল প্রায় একই ডোরে গাঁথা৷ শ্রীকান্তর মারের ভয়ে সে প্রতিদিন বঁইচির বনে ঢুকে একছড়া পাকা বঁইচিফলের মালা গেঁথে তাকে এনে দিত৷ কোনোদিন ছোটো হলে পুরোনো পড়া জিজ্ঞেস করে প্রাণভরে শ্রীকান্ত তাকে চপেটাঘাত করতো৷ রাজলক্ষ্মী মার খেয়ে ঠোঁট কামড়ে গোঁজ হয়ে বসে থাকতো কিন্তু কোনো দিন তা আনার কথা অস্বীকার করতো না৷ পিয়ারীর কথায় সেদিন সেই বঁইচির মালা দিয়েই রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে স্বামীত্বে বরণ করে নিয়েছিল৷ তার সেই স্থান, সেই সম্মান সে চিরদিন শত প্রতিকূলতার মধ্যেও অক্ষয় করে রেখেছে৷

পিয়ারীবাই-এর এই অতীত নারীজীবনের কঠিন অনুশাসনে বাঁধা৷ ধীরে ধীরে উপন্যাসটির সমগ্র পর্ব জুড়ে নানা ঘটনার অভিঘাতে সে তার রাজলক্ষ্মী থেকে পিয়ারীবাই হয়ে ওঠার কাহিনি উন্মোচন করেছে৷ একজন সরল-সাদা গ্রাম্য মেয়ে কীভাবে সমাজের কঠোর নিষ্পেষণ ও উদাসীনতায় বহুবল্লভা হয়ে সমাজের প্রান্তদেশে পতিত হয় রাজলক্ষ্মীর পিয়ারী হয়ে ওঠার কাহিনির মধ্যে তা পরিস্ফুট৷ রাজলক্ষ্মীর দুই পুরুষে কুলীন বাবা যখন আরেকটি বিয়ে করে সে ও তার বোন সুরলক্ষ্মীসহ তার মাকে তাড়িয়ে দেয়, তখন স্বামী পরিত্যক্তা অসহায় মাতা কোনো উপায়ন্তর না দেখে উপস্থিত হয় বাপের বাড়িতে৷ সে মামার বাড়িতে শ্রীকান্তের নানা পীড়ন সহ্য করে কিছুকাল কাটানোর পর পুনরায় সমস্যার সম্মুখীন হয় বিয়ে নিয়ে৷ ভাগ্নীরা বিয়ের উপযুক্ত হচ্ছে মামার দুশ্চিন্তার শেষ নেই৷ অথচ কুলীন পাত্রই বা পাবে কোথায়৷ এই মহাসংকটে তার মামা ধরনা দেয় বিরিঞ্চি দত্তের বাড়িতে৷ তার পাচক ব্রাহ্মণ যাকে সে বাঁকুড়া থেকে বদলি হয়ে আসার সময় সঙ্গে নিয়ে এসেছিল তাকে দায় উদ্ধারের জন্য৷ যথা সময় হাবাগোবা সেই পাচক ঠাকুর বেশি পণের জন্য বেঁকে বসে জানায়—‘‘অত সস্তায় হবে না মশায়—বাজারে যাচিয়ে দেখুন পঞ্চাশ-এক টাকায় একজোড়া ভাল রামছাগল পাওয়া যায় না—তা জামাই খুঁজচেন৷ একশ-একটি টাকা দিন—একবার এ পিঁড়িতে ব’সে আর একবার ও পিঁড়িতে ব’সে দুটো ফুল ফেলে দিচ্চি৷’’৪২ অনেক দর কষাকষির পর সত্তর টাকায় রফা করে একসঙ্গে সুরলক্ষ্মী ও রাজলক্ষ্মীকে বিয়ে করে সত্তর টাকা আদায় করে দুজনকে ফেলে স্বস্থানে গমন করে৷ সমাজে নারীর অবমূল্যায়নের নারকীয় দৃশ্য শরৎচন্দ্রের মতো বিচক্ষণ সাহিত্যিকের পক্ষেই এমন প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরা সম্ভব৷ ঘটনার দেড়বছর পরে সুরলক্ষ্মী প্লীহার জ্বরে প্রাণ ত্যাগ করে জীবনযন্ত্রণা থেকে চিরমুক্তি লাভ করে আর জীবনভর অসম্মান আর অপযশ বহন করার জন্য বেঁচে থাকে রাজলক্ষ্মী৷ যদিও তার ক্রমিক পরিণতি তার আরেক মৃত্যুই—অর্থাৎ রাজলক্ষ্মী মরে গিয়ে সেখানে নবজন্ম লাভ করে পাটনার নগরনটী পিয়ারীবাই৷ সুরলক্ষ্মীর মৃত্যুর পর তার মা তাকে কাশীতে নিয়ে গিয়ে সেখানে এক মৈথিলি রাজপুত্রের হাতে বিক্রি করে দেয় একহাজার টাকার বিনিময়ে৷ কিন্তু রাজলক্ষ্মী তা মেনে নেয়নি৷ মাকে আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে সেখান থেকে বিদায় করে দেয় এবং কথা দেয় তার মায়ের নেওয়া অগ্রিম হাজার টাকা সে যেমন করে পারবে শোধ করবে৷ তার মা সেই টাকা নিয়ে দেশে ফিরে এসে প্রচার করে যে কাশীতে রাজলক্ষ্মীর মৃত্যু হয়েছে৷ একজন বৃদ্ধ বাঙালি ওস্তাদ রাজলক্ষ্মীকে গানবাজনা শেখাত এবং সেই ওস্তাদের মুসলমানী স্ত্রী শেখাত নাচ৷ রাজলক্ষ্মী তাদের দাদামশাই দিদিমা ডাকতো৷ তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে রাজপুত্রকে ফাঁকি দিয়ে সে তাদের সঙ্গে পালিয়ে যায়৷ এলাহাবাদ, লক্ষ্ণৌ, দিল্লী, আগ্রা, জয়পুর, মথুরা ইত্যাদি বহুদেশ ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে উপস্থিত হয় পাটনায়৷ সেখানে তার জমানো অর্ধেক টাকা জমা রাখে এক মহাজনের গদিতে আর বাকি অর্ধেক দিয়ে খোলে এক মনোহারী ও এক কাপড়ের দোকান৷ তারপর বাড়ি কিনে স্বামীর বাড়ি খোঁজ করে লোভী পাচকঠাকুরের পুত্র অর্থাৎ তার সতীনপুত্র বঙ্কুকে নিজের কাছে এনে পড়াশুনা চালাতে থাকে আর জীবিকার জন্য পিয়ারীবাই হয়ে মজলিশে যায় মুজরা করতে৷

রাজলক্ষ্মী তার জীবনের জটিল আবর্তে একাধিক পুরুষের হস্তগত হয়েছে, বেঁচে থাকার জন্য গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করেছে তবুও তার ছেলেবেলার ভালোবাসাকে কোনোভাবেই ভুলতে পারেনি ৷ মনের রাজসিংহাসনে বঁইচির মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া মানুষটিকে জীবনভর শ্রদ্ধা করে এসেছে৷ তাই তো অকপটে তাকে বলতে পেরেছে—‘‘কি বিশ্রী এই মেয়েমানুষ জাতটা, একবার যদি ভালোবেসেচে ত মরেচে৷’’৪৩ রাজলক্ষ্মীর কাছে তার ভালোবাসা ঈশ্বরদত্ত ধন৷ তাই শ্রীকান্তের শত অপমান, সহস্র খোঁচা এবং ততধিক ‘বাইজি’ সম্বোধনেও সে বিব্রত বোধ করে না৷ সে স্বেচ্ছায় তাকে ভালোবেসেছে৷ স্বেচ্ছায় বরমাল্য পরিয়েছে এবং সেই সাধ ও ভালোবাসাকে স্ব-ইচ্ছেতেই নিজের মধ্যে লালন পালন করেছে৷ সেখানে সেই ভিতকে নড়িয়ে দেওয়ার সাধ্য কারও নেই; তার সেই ভালোবাসার মানুষটিরও নয়৷ পিয়ারীর এই সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি শ্রীকান্তর মনের চিন্তাস্রোতকে বাধাহীনভাবে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে৷ তাই শ্মশানের পথে চলতে চলতে ভেবেছে—‘‘এ কি বিরাট অচিন্তনীয় ব্যাপার এই নারীর মনটা৷ কবে যে এই পিলেরোগা মেয়েটা তাহার ধামার মত পেট এবং কাঠির মত হাত-পা লইয়া আমাকে প্রথম ভালবাসিয়াছিল, এবং বঁইচি ফলের মালা দিয়া তাহার দরিদ্র পূজা নীরবে সম্পন্ন করিয়া আসিতেছিল, আমি টেরও পাই নাই৷ যখন টের পাইলাম তখন বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না৷ বিস্ময় সেজন্যেও নয়৷ নভেল নাটকেও বাল্যপ্রণয়ের কথা অনেক পড়িয়াছি৷ কিন্তু এই বস্তুটি, যাহাকে সে তাহার ঈশ্বরদত্ত ধন বলিয়া সগর্বে প্রচার করিতেও কুন্ঠিত হইল না, তাহাকে সে এতদিন তাহার এই ঘৃণিত জীবনের শতকোটী মিথ্যা প্রণয়-অভিনয়ের মধ্যে কোনখানে জীবিত রাখিয়াছিল? কোথা হইতে ইহাদের খাদ্য সংগ্রহ করিত? কোন পথে প্রবেশ করিয়া তাহাকে লালন-পালন করিত?’’৪৪ শ্মশানের সেই ভয়ঙ্কর পরিবেশে নিজের আসন্ন বিপদের সম্ভাবনার মধ্যে আশার আলো নিয়ে উপনীত হয় রতন—রাজলক্ষ্মীর নির্দেশে৷ রাজলক্ষ্মীর নির্মল ভালোবাসা তাকে বিপদের মুখে যেতে দিয়ে চুপ করে থাকেনি৷ তাই খানসামা রতন ও দারোয়ানকে একমাসের বেতন বকশিশ দিয়ে পাঠিয়েছে তাকে সাহায্য করতে৷ পরের দিনও কথক একাকী শ্মশানে উপস্থিত হয়েছে নিজের অজ্ঞাতসারেই৷ সারারাত কীভাবে সেখানে অতিবাহিত হয়েছে তা কথকের নিজেরও জানার বাইরে৷ সেখানে আবার দেখা হয় পিয়ারীর৷ সে তার দলবল নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল৷ পিয়ারী তার পথ রোধ করে হাত ধরে প্রায় জোর করেই গাড়িতে ওঠায়৷ তাকে তার সঙ্গে ফিরে যেতে অনুরোধ করে৷ কিন্তু শ্রীকান্তের পক্ষে তা সম্ভব নয়৷ পিয়ারী একজন গণিকা; পরপুরুষের মনরঞ্জনকারিণী৷ তার সঙ্গে হঠাৎ করে কাউকে না বলে চলে গেলে সে সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না৷ গণিকার সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে সহবাস চলে; ভালোবাসা চলে না, তা সমাজবিরুদ্ধ৷ সেই নৈতিক পতনের কুৎসাভার শ্রীকান্ত নিতে অপারগ৷ রাজলক্ষ্মী তার প্রেমাস্পদের আসন্ন বিপদটাকে দেখে মুহূর্তের জন্য নিজের অবস্থানকে ভুলে গিয়েছিল কিন্তু শ্রীকান্তের কুৎসা রটনার কথা শুনে তার সম্বিত ফিরে আসে; নিমেষেই সে ম্লান হয়ে যায়৷ তার পরে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে—‘‘কি জানো কান্তদা, যে কলম দিয়ে সারা-জীবন শুধু জালখত তৈরি করেচি, সেই কলমটা দিয়েই আজ আর দানপত্র লিখতে হাত সরচে না৷ যাবে? আচ্ছা যাও! কিন্তু কথা দাও—আজ বেলা বারোটার আগেই বেরিয়ে পড়বে?’’৪৫ রাজলক্ষ্মীর সুখ-দুঃখের একমাত্র সম্পদ তার অন্তরের নিগুঢ় ভালোবাসা৷ যে কিনা এক অদৃশ্য হাতছানিতে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে নিজের অজান্তে শ্মশানে উপস্থিত হয়েছে৷ আর তার মুখে সেই বিবরণ শুনে আশঙ্কায় নীল হয়ে গেছে তার নারীমন৷ সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে সে ভয়ে তাকে আর তাবুতে ফিরতে দিতে চাইছিল না৷ অনুরোধ করেছিল সে দেশে যাক, অথবা যেখানে খুশি সেখানে যাক তথাপি তাবুতে নয়৷ কিন্তু রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ করে তাবু থেকে তারও অন্তর্ধান তার চরিত্রে কালি লেপন হবে সেই সম্ভাবনা শ্রীকান্তর মুখে শুনে আর কঠোর হতে পারে না সে৷ তাই নিজের হাতে বহুপুরুষ সম্ভাষণকারী নারীটি আশঙ্কায় দুরুদুরু বক্ষে তাকে সেই বিপদের মধ্যেই ফেলে যেতে বাধ্য হয়৷ তার মিথ্যে প্রণয়ের জালখত লেখার কলম দিয়ে সত্যিকারের ভালোবাসার জালখত লেখা শুরু হয়ে যায়৷

পিয়ারীবাই স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা-মায়া-মমতার জীবন্ত বিগ্রহ৷ রাজকুমারের তাবু থেকে বিদায় নেওয়ার পর পুনরায় সে শ্রীকান্তের সংবাদ পায় যে প্রবল জ্বরাক্রান্ত হয়ে শ্রীকান্ত আরা স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চলে পড়ে আছে৷ মুহূর্তে অভয়দাত্রীর ভূমিকা নিয়ে উপস্থিত হয় সেখানে৷ সন্ন্যাসীর দলে মিশে সন্ন্যাসী সেজে থাকা অসুস্থ শ্রীকান্তকে সেখানকার একটা ঘর ভাড়া নিয়ে ভালো ভালো ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাতে থাকে৷ বসন্ত আক্রান্ত স্থানে ওভাবে জ্বরে বেহুঁশ শ্রীকান্তর সেবা করতে তার একটুও বাধে না৷ তার পর তাকে নিয়ে আসে পাটনার বাড়িতে৷ পিয়ারীর পাটনার বাড়িঘরের সাজ-সজ্জা দেখে বিস্মিত হয়ে যায় শ্রীকান্ত৷ সে তার জীবন অভিজ্ঞতায় বহু বাইজিবাড়ি দেখেছে—যার সর্বত্র বিলাস-ভোগের উপকরণে ঠাসা৷ সেখানে কামনা আর বাসনা হাত ধরাধরি করে সর্বদা যেন যৌবনের গান গায়—মদিরারক্ত দৃষ্টিতে প্রিয়সম্ভাষণ করে৷ তার কল্পনায় পিয়ারীর গৃহসজ্জাও সেরূপ কল্পিত ছিল৷ পিয়ারীর ঘর সম্পূর্ণ আভরণহীন৷ মেঝেটি সাদাপাথরের, দুধের মতো সাদা ঝকমকে দেওয়াল৷ ঘরের একধারে একটি তক্তপোষের উপর একটি ছোটো আলমারি৷ এই বিলাসিনী নারীর সকল কিছুই যেন কথককে বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়৷ এই পাটনাতেই কয়েকদিনের বিশ্রামের অবসরে সে আবিষ্কার করে তার মাতৃত্বের আর এক সুবিস্তৃত তটভূমি৷ যার সম্পূর্ণ জায়গা জুড়ে রয়েছে বঙ্কু—তার সতীনের ছেলে৷ পিয়ারী তার মাতৃত্বকে নিষ্ফলা হতে দেয়নি৷ সতীনের ছেলেকে দিয়ে নিজের স্নেহতৃষ্ণাকে মিটিয়ে নিয়েছে৷ আর মা হয়ে সে যেন আরও বেশি কর্তব্যপরায়ণ৷ তাই সে নির্দ্বিধায় শ্রীকান্তকে বলতে পেরেছে যে সে তো সুস্থ হয়ে গেছে, কবে বাড়ি ফিরবে৷ বঙ্কুর সামনে সে নিজেকে খেলো করে দিতে চায় না৷ শ্রীকান্ত তার কথায় যেতে অস্বীকার করলে সে সুস্পষ্টভাবে নিজের ভাবনাকে প্রকাশ করে—‘‘কিন্তু আমার ছেলে প্রায়ই আজকাল বাঁকিপুর থেকে আসচে৷ বেশিদিন থাকলে সে হয়ত কিছু ভাবতে পারে৷’’৪৬ পিয়ারীর তার সন্তানকে ভালোবাসা যতটা জীবন্ত তার চেয়েও জীবন্ত তার প্রতি বঙ্কুর ভালোবাসা৷ মায়ের প্রতি নিষ্পাপ ভক্তি তার৷ বঙ্কুর সে ছাড়া আরও চারটি বোন রয়েছে৷ তার মায়ের প্রতি উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় কথক জানতে পারে যে রাজলক্ষ্মী নিজে সেই চার বোনের বিয়ে দিয়েছে৷ শুধুমাত্র রাজলক্ষ্মীর অন্নে প্রতিপালিত বলে বঙ্কুদের ‘একঘরে’ করে রেখেছে গ্রামের লোকজন৷ তাদের চোখে পিয়ারী পতিতা৷ অথচ সেই গায়ের ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ, শীতকালে কাপড়-কম্বল দিয়ে কত উপকার করে পিয়ারীবাই৷ বঙ্কুর ভাবনায় তার মায়ের গানবাজনা করাতে কোনো দোষ নেই তথাপি গ্রামের লোকেরা তার মাকে দোষী করে রেখেছে৷ শুধু তাই নয় পিয়ারীবাই গ্রামের জলকষ্ট দেখে নিজেই উদ্যোগী হয়ে তিন-চার হাজার টাকা খরচ করে একটি পুকুর খোদাই করিয়ে তা বাঁধিয়ে দেয়৷ কিন্তু গ্রামের লোকেরা বারাঙ্গনা পিয়ারীকে সেই পুকুর প্রতিষ্ঠা করতে দেয় না৷ তারা অনায়াসে লুকিয়ে লুকিয়ে সুদৃশ্য পুকুরের জল ব্যবহার করতে পারে কিন্তু প্রকাশ্যে পতিতার শরীরের মতো পতিতার হাতের কোনো জিনিস তাদের কাছে দূষণীয়ই৷ রাজলক্ষ্মীর সে জন্য দুঃখের শেষ নেই৷ বঙ্কু তার সরল স্নেহবুভুক্ষায় রাজলক্ষ্মীকে আপন করে নিয়েছেন তার ভালোমন্দও বুঝতে তার অসুবিধা হয় না৷ তাই বঙ্কু সলজ্জভঙ্গিতে শ্রীকান্তকে জানায় যে সে যেন আরও কিছুদিন থেকে যায় কারণ সে থাকলে তার মা খুব আনন্দে থাকে৷ বঙ্কুর কথায় পিয়ারী সম্পর্কে আরেক দিগন্ত খুলে যায় শ্রীকান্তর৷ সে স্পষ্টত অনুধাবন করতে পারে কেন পিয়ারী ছেলে সম্পর্কে সচেতন হয়ে তাকে চলে যেতে বলছে৷ আর তাই—‘‘মাতৃত্বের এই একটা ছবি আজ চোখে পড়ায় যেন একটা নূতন জ্ঞান লাভ করিলাম৷ পিয়ারী হৃদয়ের একাগ্র বাসনা অনুমান করা আমার পক্ষে কঠিন নয়; এবং সে যে সংসারে সব দিক দিয়া সর্বপ্রকারেই স্বাধীন, তাহাও কল্পনা করা বোধ করি পাপ নয়৷ তবুও সে যে-মুহূর্তে এই একটা দরিদ্র বালকের মাতৃপদ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করিয়াছে, অমনি সে নিজের দুটি পায়ে শত পাকে বেড়িয়া লোহার শিকল বাঁধিয়া ফেলিয়াছে৷ আপনি সে যাই হোক, কিন্তু সেই আপনাকে মায়ের সম্মান তাহাকে ত এখন দিতেই হইবে! তাহার অসংযত কামনা, উশৃঙ্খল প্রবৃত্তি যত অধঃপথেই তাহাকে ঠেলিতে চাউক, কিন্তু এ কথাও সে ভুলিতে পারে না—সে একজনের মা! এবং সেই সন্তানের ভক্তিনত দৃষ্টির সম্মুখে তাহার মাকে ত সে কোনমতেই অপমানিত করিতে পারে না!’’৪৭ কথকের ভাবনায় উঠে অসে তার পিয়ারী নামটি৷ যে রসিকবাবু কোনো যৌবনের লালসামত্ত বসন্তদিনে তার নামটিকে রাজলক্ষ্মী থেকে পিয়ারীবাইতে প্রতিস্থাপিত করেছিল সেই নামটিও ছেলের সামনে সে গোপন করতে চায়৷ তার সেই সারল্যে পরিপূর্ণ স্নেহকাতর মাতৃহৃদয়কে শ্রীকান্তের আর বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না৷ যে বাসনার জালে বন্দি হয়ে সে ও রাজলক্ষ্মী পরস্পরের অভিমুখে অগ্রসর হতে শুরু করেছিল ঠিক তার মাঝখানটিতে বঙ্কুর মাকে দেখে শ্রদ্ধায় অভিভূত হয়ে যায় সে৷ তাই রাজলক্ষ্মীকে কামনার ধন ভেবে আর ছোটো করতে পারে না৷ তার চোখে রাজলক্ষ্মী এক পরিপূর্ণ মাতৃমূর্তি৷

আবার শ্রীকান্তের প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষণ, সেবা, প্রেমাবেগ কোনোকিছুকেই যেন অতিক্রম করা যায় না৷ শ্রীকান্ত জানে সে চলে গেলে মাতৃত্বের গৌরব রক্ষায় জয়ী হলেও প্রেমিকের অদর্শনে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে রাজলক্ষ্মীই তার পরেও তাকে তার বন্ধনপাশ উপেক্ষা করে চলে যেতে হবে৷ তাই তো কথক বলেছে রাজলক্ষ্মীর জন্যই রাজলক্ষ্মীকে ছেড়ে যেতে হবে; সেখানে দ্বিধা করলে চলবে না৷ আর এখানেই ফুটে উঠেছে লেখকের গভীর জীবন দর্শন—‘‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না—ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে৷’’৪৮

উপন্যাসের কথক শ্রীকান্ত ভেবেছিল হয় তো আর কোনোদিন তাদের দেখা হবে না৷ যে সম্পর্কের গ্রন্থি তৈরি হয়েছিল নিজেদের সামায়িক দুর্বলতায় তীব্র সংযম দিয়ে তা ছিন্ন করে চলে আসতে পেরেছে, কিন্তু তা নয়৷ পিয়ারীর ভালোবাসার শিকর বহুদূর প্রোথিত৷ তা ছিঁড়লেও ছিঁড়ে না৷ তাই তো নিজের মাতৃ প্রতিশ্রুতি রক্ষার দ্বিধা থেকে রক্ষা করতে সে নিজেই উপস্থিত হয় পিয়ারীর পাটনার বাড়িতে৷ এবারেও বিস্ময়াপন্ন হতে হয় কথককে৷ সে যখন পিয়ারীর সঙ্গে প্রথমবার পাটনায় আসে তখন তার কল্পিত বাইজিবাড়ি আকাশকুসুম হয়ে সাধারণ আড়ম্বরহীন গৃহসজ্জার রূপ নিয়ে প্রতিভাত হয়েছিল দ্বিতীয়বার তার পাটনার গৃহসজ্জার কল্পনা উল্টোরূপ পরিগ্রহণ করে৷ সেই সাদামাঠা গৃহসজ্জা পুনরায় গণিকার নূপুরনিক্বণে বিলাসমন্দির হয়ে উঠেছে৷ তাকে হঠাৎ গৃহে উপস্থিত দেখে মুজরারত পিয়ারীবাই-এর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়৷ সে নিজেকে সংযত করে মুখে জোর করে হাসি আনার চেষ্টা করে৷ শ্রীকান্তও ততক্ষণে সামলে নিয়েছে নিজেকে৷ মজলিশের আয়োজক পূর্ণিয়া জেলার বাবুটির অনুরোধে শ্রীকান্ত সেখানে আসন গ্রহণ করে গান বাজনার ‘ফরমাশ’ করলে হতবুদ্ধি পিয়ারী রাগে-দুঃখে-অভিমানে হারমোনিয়াম দূরে ঠেলে দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়৷ সেই বাবুটির কাছ থেকে জানা যায় তার নাম রামচন্দ্র সিংহ, দ্বারভাঙ্গা জেলার একজন জমিদার, পিয়ারীবাইকে সে সাত-আট বছর থেকে চেনে৷ সে তার পূর্ণিয়ার বাড়িতে তিন-চারবার মুজরা করতে গিয়েছিল৷ সে নিজেও অনেকবার তার এখানে গান শুনতে এসেছে, কখনো কখনো দশ-বারোদিন থেকেও গেছে; মাস তিনেক পূর্বে এসেও এক সপ্তাহ থেকে গেছে৷ পিয়ারী গণিকা হলেও তার সুখ-দুঃখ সমস্তই শ্রীকান্তকে নিয়ে৷ তাই শ্রীকান্তের সামনে অন্যপুরুষের জন্য গান পরিবেশন করতে তার অন্তরাত্মার প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে রাগের রূপ নিয়ে৷ সে নানা কথা বলে শ্রীকান্তকে অপদস্ত করার চেষ্টা করতে থাকে—শ্রীকান্তও সবকিছু বুঝতে পেরে তাকে জব্দ করতে সচেষ্ট হয়৷ শ্রীকান্ত বোঝে তার অচিন্ত্যপূর্ব আগমনে রাজলক্ষ্মী হতবুদ্ধি হয়ে যে ব্যবহারই করুক না কেন তার নির্বিকার ঔদাসীন্যে শঙ্কিত হয়েই গিয়েছিল৷ তারপরে তার মধ্যে ঈর্ষা জাগ্রত করতে নানাভাবে আঘাত হানতে থাকলে শ্রীকান্ত তার কৌশলী জবাব দিয়ে সে আঘাত তাকেই ফিরিয়ে দেয়৷ প্রেমিকের জন্য অতি যত্নে বিছানা পেতে পরম যত্নে তাকে আপ্যায়ন করলে কথকের আবেগবিহ্বল মন সংযম হারিয়ে নিজের হৃদয় উন্মোচন করে ফেলে৷ বর্মা যাত্রী শ্রীকান্ত জানায় সে বর্মা থেকে যদি কোনোদিন ফিরে আসে তাহলে তার জন্যই আসবে৷ পিয়ারী তার দেবদুর্লভজনের এ হেন কথায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নিজের অপরাধী মন ধরা দেয় প্রেমাস্পদের কাছে৷ তাই সে জিজ্ঞাসা করে—‘‘আগে বল ও লোকটা এখানে থাকাতে তুমি আমাকে কোন মন্দ মনে করনি?’’৪৯ তার পরে বর্ষিত হয় কঠিন মর্মদাহী এক প্রশ্ন যা শুধু কথকের উদ্দেশ্যে নয় সমস্ত সমাজের জন্য৷ রাজলক্ষ্মীর ভেতরকার নারীসত্তার বিদ্রোহ ধ্বনিত হয় এই বাক্যবন্ধের দ্বারা—‘‘আচ্ছা, জিজ্ঞেস করি তোমাকে, পুরুষমানুষ যত মন্দই হয়ে যাক, ভাল হ’তে চাইলে তাকে ত কেউ মানা করে না; কিন্তু আমাদের বেলায়ই সব পথ বন্ধ কেন? অজ্ঞানে, অভাবে প’ড়ে একদিন যা করেচি, চিরকাল আমাকে তাই করতে হবে কেন? কেন আমাদের তোমরা ভাল হতে দেবে না?’’৫০ এরপর রাজলক্ষ্মী শোনে শ্রীকান্তের বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা৷ তার সঙ্গে পরামর্শ না করে তাকে না দেখিয়ে তার প্রেমাস্পদ যে নিজের বিয়ে ঠিক করতে পারে তা বুঝে তার প্রদীপ্ত মুখ ম্লান হয়ে যায়৷ কিন্তু পরক্ষণেই যখন শোনে শ্রীকান্তের মায়ের প্রতিশ্রুতির কথা তখনই বুদ্ধিমতী রাজলক্ষ্মী শ-পাঁচেক টাকা পাঠিয়ে দিয়ে মেয়েটির অন্যত্র বিবাহের ব্যবস্থা করে দেয়৷ শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর প্রণয় গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলেও তা পরিণতির সীমা স্পর্শ করতে পারে না৷ তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুখী দাম্পত্য অতিবাহিত করতে পারে না৷ প্রথমত রাজলক্ষ্মী পরস্ত্রী-বিধবা তার উপর সে গণিকা৷ কোনো দিক থেকেই সে শ্রীকান্তের সঙ্গে থাকার উপযোগী নয়৷ তাই বর্মা যাওয়ার পূর্বে তাকে সে দুর্বলতা প্রকাশ করলে, শুধু পিয়ারীকে নয় পিয়ারীর বিত্ত-বৈভব সমস্ত অস্বীকার করলে তার পায়ের উপর ক্রন্দনরতা রাজলক্ষ্মীর হাত ধরে শ্রীকান্ত ভাবতে থাকে যে—একদিন এই পিয়ারীই মাতৃত্বের দোহাই দিয়ে তাকে প্রায় জোর করে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছিল, সেদিন তার ধৈর্য ও মনের জোর দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সে আর আজ তার সকরুণ কণ্ঠের এতবড় দুর্বলতায় তার বুক ফাটতে থাকে৷ কিন্তু কিছুতেই তার কোনোকিছুকে গ্রহণ করার স্বীকৃতি দিতে পারে না৷ তাই নিজেকে সংযত করে তাকে কথা দেয়—‘‘তোমাকে সঙ্গে নিতে পারিনা বটে, কিন্তু যখনি ডাকবে, তখনি ফিরে আসব৷ যেখানেই থাকি, চিরদিন আমি তোমারই থাকব রাজলক্ষ্মী!’’৫১

বহুদিন পর পিয়ারী কলকাতার জাহাজঘাটে তার প্রেমিকের দর্শন পায়৷ বর্মা থেকে ফিরে এলে সে তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে৷ সে সকল চক্ষুলজ্জাকে উপেক্ষা করে বহুদিন পর নিজের মানুষটির সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটাবে বলে তার সঙ্গে একাই গরুর গাড়িতে করে বৌবাজারের বাসাবাড়ির সামনে উপস্থিত হয়৷ সমস্ত রাস্তা উভয়ের দীর্ঘ অদর্শনের শূন্যতাকে উপভোগ করতে থাকে৷ শ্রীকান্ত তার জন্য নির্ধারিত ঘরে প্রবেশ করে দেখে সেখানকার সমস্তই তার জন্যই পরিপাটী করে সাজিয়েছে রাজলক্ষ্মী৷ তার প্রত্যেক পছন্দের জিনিসপত্রে সুসজ্জিত সেই ঘর৷ রাজলক্ষ্মীর সেবায় যত্নে মুগ্ধ শ্রীকান্ত তার সেই নির্লোভ প্রেমকে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারে না৷ কথক যত দেখে রাজলক্ষ্মীকে তত বিভোর হয়ে যায়৷ নানা রূপে নানা আঙ্গিকে সে ধরা দেয় তার সম্মুখে৷ এই কলকাতার বাসায় সে নতুনভাবে দেখছে তাকে৷ অসুখ ছাড়া সে কোনোদিনও তার বিছানার অত কাছে গিয়ে বসেনি, অত কাছে বসে বাতাস পর্যন্ত করেনি৷ কিন্তু এবার সে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না৷ চাকর-বাকর এমনকি বঙ্কুর সামনেই দর্পভরে নিজেকে প্রকাশ করে দিল৷ যে কি না একদিন বঙ্কুর জন্যই পাটনার বাড়ি থেকে তাকে বিদায় করে দিয়েছিল সে ভিন্ন আরেক মানুষ হয়ে, ভিন্ন ভাবনা নিয়ে তার সামনে উপস্থিত হতে চায়৷ অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে রাজলক্ষ্মী ধীরে ধীরে তার নিজের গণিকাসত্তা ভুলে আত্মপ্রত্যয়ী হতে আরম্ভ করেছে৷ যার ফল স্বরূপ সে তার সত্যকারের ভালোবাসাকে আর কারও সামনেই আড়াল করতে চায় না৷

রাজলক্ষ্মীর মন অত্যন্ত অনুভূতিশীল৷ শ্রীকান্তকে নিয়ে কাশীতে যাওয়ার পথে কেরানিদের জীবন আলোচনা প্রসঙ্গে তার অনুভূতিপরায়ণ, পরদুঃখে কাতর হওয়া মন নিমেষেই অপার সহানুভূতিতে সিক্ত হয়ে গেছে৷ কেরানিদের পশুবৎ জীবনযাপনের বর্ণনা শুনে তার চোখ জলে ভেসে গেছে৷ তার সেই করুণ মুখচ্ছবি শ্রীকান্তকে ব্যথিত করেছে ফলে সে কেরানিদের একশো-দেড়শো টাকা বেতন, উপরি পাওনা ইত্যাদি বিষয় কল্পনা করতে বাধা দেয়নি রাজলক্ষ্মীকে৷ এবং এই কথা প্রসঙ্গে উপরি রোজগার হিসেবে শ্রীকান্ত ‘প্যালা’-র কথা বলে ব্যঙ্গ করলে বাইজি পিয়ারী আহত হয়েছে এবং মুখ ভার করে জানালার দিকে চেয়ে অনুযোগ করে বলেছে—‘‘তোমাকে যতই দেখচি, ততই তোমার ওপর থেকে আমার মন চলে যাচ্চে৷ তুমি ছাড়া আর আমার গতি নেই জানো ব’লেই আমাকে তুমি এমন ক’রে বেঁধো৷’’৫২ রাজলক্ষ্মীর অনুভূতিপ্রবণ হৃদয়ের সংবাদ পাওয়া যায় পাঁড়েজীর প্রসঙ্গে৷ হতদরিদ্র পাঁড়েজী তার অসুস্থ মেয়ের জন্য একটা মাটির পুতুল কিনে নিয়ে যাচ্ছিল৷ প্লাটফর্মে আড়াইটের লোকাল ট্রেন ছাড়ে ছাড়ে অবস্থায় দৌঁড়ে গিয়ে ট্রেন ধরার চেষ্টা করলে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার কারণে রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে ধাক্কা লেগে তার হাতের সেই পুতুল ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়৷ সে ট্রেন ছেড়ে দেবে জেনেও পুতুলের টুকরোগুলো কুড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে৷ ফলস্বরূপ ট্রেন ছেড়ে দেয়৷ সে ফিরে এসে পুনরায় মাটির পুতুলের দেহাংশগুলি সংগ্রহ করতে থাকলে শ্রীকান্ত তার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে, তার অসুস্থ মেয়ের বায়না রাখতে অনেক কষ্ট করে দু-আনা দিয়ে মাটির পুতুলটা কিনেছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা ভেঙ্গে যাওয়ায় মেয়ের বিশ্বাস অর্জনের জন্য সেই ভাঙ্গা টুকরোগুলি দেখিয়ে বলবে যে সে তার ইচ্ছে পূরণ করার জন্য কিনেছিল কিন্তু তা ভেঙ্গে গেছে এবং পরের মাসে তাকে আরেকটা কিনে দেবে৷ লোকটি জানায় তার পুতুলও গেল, ট্রেনও পেল না৷ ঐ ট্রেনে গেলে দুঘন্টা আগে পৌঁছত এবং দুঘন্টা আগেই মেয়েকে দেখতে পেত৷ পাঁড়েজীর এই কাহিনি রাজলক্ষ্মীর দু’চোখে শ্রাবণের ধারা নামায়৷ সে অত্যন্ত মমতায় পাঁড়েজীকে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়, তার অসুস্থ মেয়ের জন্য উপহার পাঠায় দামি একটি শাড়ি৷ শ্রীকান্ত লক্ষ্য করছে একটু একটু করে রাজলক্ষ্মীর জীবনের পরিবর্তনের চোরা স্রোতকে৷ তার ভেতরকার পিয়ারীবাই যতই মরে যাচ্ছিল ততই যেন সে নারীত্বের মহিমায় পূর্ণমানবীতে রূপান্তরিত হচ্ছিল৷ এ প্রসঙ্গে কথকের অভিব্যক্তি—‘‘রাজলক্ষ্মীকে আমি চিনিয়াছিলাম৷ তাহার পিয়ারী বাইজী যে তাহার অপরিণত যৌবনের সমস্ত দুর্দাম আক্ষেপ লইয়া প্রতি মুহূর্তেই মরিতেছিল, সে আমি লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছিলাম৷ আজ সে নামটা উচ্চারণ করিলেও সে যেন লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতে থাকে৷’’৫৩ রাজলক্ষ্মী শান্ত ও স্থির৷ তার ভেতরের কামনা-বাসনাগুলোও কোথায় যেন ডুব দিয়েছে তার তল পাওয়া যায় না আর সেখান থেকে জাগ্রত হয়েছে তার মাতৃত্ব৷ তার সেই সর্বগ্রাসী মাতৃত্ব প্রকাশের পথ না পেয়ে যেন কুম্ভকর্ণের মতো বিরাট ক্ষুধায় ক্ষুধার্ত৷ আর সে বিশাল মাতৃত্বের ক্ষুধাই শ্রীকান্তের মধ্যে আশঙ্কায় বীজ বপন করেছে৷ সে পাটনা শহরে একদিন বঙ্কুর প্রতি স্নেহ দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু ‘‘আজ তাহার সেই মূর্তি স্মরণ করিয়া আমার অত্যন্ত ব্যথার সহিত কেবলি মনে হইতে লাগিল, তত বড় আগুনকে ফুঁ দিয়া নিভানো যায় না বলিয়াই আজ পরের ছেলেকে ছেলে কল্পনা করার ছেলেখেলা দিয়া রাজলক্ষ্মীর বুকের তৃষ্ণা কিছুতেই মিটিতেছে না৷ তাই আজ একমাত্র বঙ্কুই তাহার কাছে পর্যাপ্ত নয়, আজ দুনিয়ার যেখানে যত ছেলে আছে, সকলের সুখদুঃখই তাহার হৃদয়কে আলোড়িত করিতেছে৷’’৫৪

রাজলক্ষ্মী তার নিজের জীবনের সব অনিষ্টের মূলে যে টাকার লোভ দায়ী তা তার জীবন অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুধাবন করেছে৷ পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছে গণিকা হতে, তার সঙ্গে কাজ করেছে তার মায়ের টাকার লোভ৷ সে তার জীবনের সেই পরিণতি মেনে নিতে পারেনি৷ নিজেকে শোধরানোর শত চেষ্টা করেও সমাজের স্বাভাবিক স্রোতে নিজেকে ফেরাতে পারে না৷ সমাজ তাকে গ্রহণ করে না৷ তাই সে প্রবল আত্মগ্লানিতে বলতে পারে—‘‘আজ ত আমার টাকার অভাব নেই, কিন্তু আমার মত দুঃখী কি কেউ আছে? পথের ভিক্ষুক যে সেও বোধ হয় আজ আমার চেয়ে ঢের ঢের বেশি সুখী৷’’৫৫ রাজলক্ষ্মী নিজের যন্ত্রণা ভুলে সমস্ত টাকা-পয়সা-ধন-সম্পত্তিকে অবহেলা করে শুধুমাত্র সুখে ঘর বাঁধতে চায়৷ যেমন করে বর্মাতে অভয়া-রোহিণী ঘর বেঁধেছে৷ তার কথার সেই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না শ্রীকান্তর৷ সে তাই বলে—‘‘তোমার জন্য আমি সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু সম্ভ্রম ত্যাগ করি কি ক’রে?’’৫৬ তার এ কথার জবাবে রাজলক্ষ্মী তার হাত দুখানি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলতে থাকে—‘‘তোমাকে কিছুই বিসর্জন দিতে হবে না৷ কিন্তু, তুমি কি মনে কর শুধু তোমাদেরই সম্ভ্রম আছে, আমাদের নেই? আমাদের পক্ষে সেটা ত্যাগ করা এতই সহজ? তবু তোমাদের জন্যেই কত শত-সহস্র মেয়েমানুষ যে এটাকে ধুলোর মত ফেলে দিয়েচে, সে কথা তুমি জানো না বটে, কিন্তু আমি জানি৷’’৫৭ রাজলক্ষ্মীর এই কথার মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি তীব্র খোঁচা৷

তারা কাশীতে উপস্থিত হয়ে আশ্রয় নেয় রাজলক্ষ্মীর নিজের বাড়িতে৷ উপরের দুটো ঘর ছাড়া পুরো বাড়িটাই নানা বয়সের বিধবায় পরিপূর্ণ৷ সকলেই রাজলক্ষ্মীর আশ্রিতা এবং পালিতা৷ অপার স্নেহ-মমতায় একবাড়ি সহায়-সম্বলহীনা বিধবা নারীদের প্রতিপালন করে যাচ্ছে রাজলক্ষ্মী যাতে অবস্থার বিপাকে পড়ে তাদের পিয়ারীবাই না হতে হয়৷ সেখানে থাকাকালীন সময়ে সে শ্রীকান্তকে প্রয়াগে স্নান করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে শ্রীকান্ত মুশকিলে পড়ে৷ সেখানে কর্মোপলক্ষে তার এক জ্ঞাতিখুড়ো বসবাস করে৷ একজন গণিকার সমভিব্যাহারে তাকে দেখলে তার যে আর দুর্নামের শেষ থাকবে না তা তৎক্ষণাৎ তাকে আশঙ্কিত করে ফেলে৷ শ্রীকান্তের সেই ভাবনা বুঝে নিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না রাজলক্ষ্মীর৷ তাই প্রবল অভিমানে তীব্র শ্লেষে সে প্রশ্ন করে—‘‘আমি সঙ্গে থাকলে হয়ত কেউ দেখে ফেলতেও পারে, না?’’৫৮ সে শ্রীকান্তের বিপদে বার বার রক্ষা করেছে, সেবায় যত্নে তাকে বার বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে—তার সঙ্গস্পর্শকে স্বীকার করেও তবু শ্রীকান্তের সংকোচের শেষ নেই৷ সে মেয়েদের শ্রদ্ধা করে নারীদের খুব সহজে খারাপ ভাবতে পারে না তথাপি এক গণিকা নারীকে তার ভালোবাসার গভীরতা বুঝেও সামাজিক স্বীকৃতি দিতে তার কুন্ঠার অন্ত্য নেই৷ শ্রীকান্তের সেই মনোবৃত্তি রাজলক্ষ্মীর আত্মাভিমানে আঘাত হানে ফলে সে বহুদিন পর তাকে উপেক্ষা করে বেড়িয়ে যায় মুজরা করতে৷ তার পোশাক-পরিচ্ছদ সমস্তই নগরবিনোদিনীসুলভ৷ তাকে শাস্তি দিতে শ্রীকান্ত নিজেই তার পথ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়৷ শ্রীকান্ত বোঝে পিয়ারীর দুর্বলতা কোথায়৷ শত রাগ অভিমান সত্ত্বেও পিয়ারী কিছুতেই তার অনুপস্থিতি মেনে নিতে পারে না৷ তার জীবন উৎসর্গ করা ভালোবাসা দিয়েও সে নিজেকে শ্রীকান্তের উপযোগী করে তুলতে পারেনি, নিজের গণিকার খোলস ত্যাগ করেও সেই গ্লানি থেকে কেউ তাকে মুক্তি দেয়নি তাই আহত অভিমানে সে বের হয় পুনরায় মুজরা করতে৷ তার এই মুজরাকে শ্রীকান্ত অভিজ্ঞানিত করে লোভ নাম দিয়ে৷ সে রাজলক্ষ্মীকে জানায় যে সে কিছুতেই তার সেই লোভ ত্যাগ করতে পারবে না৷ তার অনেক টাকা, অনেক রূপগুণ, অনেক প্রভূত্ব৷ সংসারে এগুলোই সব থেকে লোভের জিনিস৷ সে তাকে ভালোবাসতে পারে, শ্রদ্ধা করতে পারে, তার জন্য অনেক দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে কিন্তু সেই মোহ কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারবে না৷ রাজলক্ষ্মী তাকে অনুরোধ করে তাকে সেই নীচ প্রবৃত্তি থেকে উদ্ধার হতে সহায়তা করার জন্য৷ শ্রীকান্ত তাকে তার সমাজ সম্পর্কে সচেতন করে৷ কারণ সমাজ মনসা পণ্ডিতের পাঠশালার রাজলক্ষ্মীকে ভুলে গেছে, সে শুধু চেনে পাটনার প্রসিদ্ধ বাই পিয়ারীবাইজিকে৷ ফলে শ্রীকান্ত যে রাজলক্ষ্মীর প্রতি অনুরক্ত পিয়ারীর প্রতি নয়, সমাজ সেটা বুঝবে না—শুধু শ্রীকান্তকে ছোটো করেই যাবে৷ সংসার সমাজের কথা বলে রাজলক্ষ্মীকে থামিয়ে দিয়ে শ্রীকান্ত বিদায় নেয় সেখান থেকে৷ বহুদিন পর উপস্থিত হয় তার ফেলে যাওয়া গ্রামে৷ সেখানে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হলে স্বয়ং রাজলক্ষ্মী উপস্থিত হয়ে তার পরিচর্যা শুরু করে দিলে তাকে সশরীরে গ্রামে উপস্থিত দেখে শ্রীকান্তের আর সংকোচের পরিসীমা থাকে না৷ তার মান-সম্মান-সম্ভ্রম হারানোর মহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত জেনেও রাজলক্ষ্মী তাতে এতটুকু বিচলিত হয় না৷ কারণ সে স্থির চিত্তে জবাব দেয় তার লজ্জা-শরম, মান-সম্মান সমস্ত শ্রীকান্ত এবং পৃথিবীতে তার বাড়া কিছু নাই৷ শ্রীকান্ত তার কথা শুনে মৃতবৎ পড়ে থাকে প্রতিবেশীগণের ভাবী প্রতিক্রিয়া স্মরণ করে৷ সেখানে কিছুক্ষণ পড়ে ডাক্তারবাবুকে সঙ্গে নিয়ে প্রসন্ন ঠাকুরদা উপস্থিত হলে রাজলক্ষ্মীর সমস্ত দর্প, জেদ, মনের জোর নিমেষেই কর্পূরের মতো উবে যায়; তার মুখ মরার মতো ফ্যাকাশে হয়ে যায়৷ তার সেই মুখচ্ছবি মুহূর্তেই শ্রীকান্তের বিবেকশক্তিকে জাগ্রত করে৷ তার জন্য সমস্ত দুঃখ কষ্ট স্বেচ্ছায় বরণ করা মেয়েটিকে চূড়ান্ত ক্ষণে স্বীকৃতি জানিয়ে বলে—‘‘তুমি স্বামীর সেবা করতে এসেচ, তোমার লজ্জা কি রাজলক্ষ্মী! ঠাকুরদা, ডাক্তারবাবু এঁদের প্রণাম কর৷’’৫৯ গ্রামের মানুষজন পিয়ারীবাইকে চেনে না, চেনে পাচকঠাকুরের সঙ্গে বিয়ে হওয়া রাজলক্ষ্মীকে৷ সে পাচকঠাকুরের মৃত্যুতে তাদের চোখে বিধবা৷ আর গ্রামীণ সমাজে পুনর্বিবাহিত বিধবারা বারাঙ্গনা অপেক্ষা বেশি সম্মান পায় না৷ শ্রীকান্তের দেওয়া সেই মিথ্যে পরিচয় রাজলক্ষ্মীকেও নতুন কোনো সম্মান দিতে পারেনি, তেমনি নিজেও তেমন কোনো উচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত হয়নি৷ আর সেই আত্মপীড়া থেকেই সমাজ প্রতিবেশীদের থেকে মুখ লুকোতে অসুস্থ শ্রীকান্তকে নিয়ে সে রাতের গাড়িতেই কলকাতা রওনা হয়৷ শ্রীকান্ত নিঃশেষে নিজেকে রাজলক্ষ্মীর হাতে সঁপে দেয়৷ রাজলক্ষ্মীর শুচিতায়, ত্যাগে, সংযমে, করুণায় সে যেন অন্য আরেক সত্তা আবিষ্কার করতে পেরেছে তার মধ্যে৷ তাই তার মনে হয়—‘‘যে রাজলক্ষ্মীর অন্তর-বাহির আমার কাছে আজ আলোর ন্যায় স্বচ্ছ হইয়া গেছে, সে কেমন করিয়া এতদিন বৎসরের পর বৎসর ব্যাপিয়া পিয়ারীর জীবন যাপন করিতে পারিল!’’৬০ শ্রীকান্ত বরাবরই লক্ষ্য করেছে যে সমস্ত বিষয়ে রাজলক্ষ্মীর অপরিসীম কর্তৃত্ব ক্ষমতা৷ সে কর্তৃত্বে শাসন নেই; তা ভালোবাসার অদৃশ্য গ্রন্থিতে বাঁধা৷ তার আদেশ তার উপদেশের মধ্যে এমন একটা জোর থাকে যে তা উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারও নেই৷ চাকর-বাকর থেকে শুরু করে শ্রীকান্ত পর্যন্ত সে আদেশ মানতে বাধ্য৷ রতনের কথায় তেমনই অভিব্যক্তি৷ রাজলক্ষ্মীর বীরভূমের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গঙ্গামাটি গ্রামে নতুন ক্রয় করা জমিদারিতে যেতে ইচ্ছে নেই রতনের৷ তার পরেও তাকে যেতে হবে৷ সে বিষয়ে শ্রীকান্ত তার নিজের ইচ্ছের প্রাধান্য দিতে বললে সে বলে যে মা পারেন৷ কি জানি কি জাদুমন্ত্র সে জানে, যদি বলে যমের বাড়ি যেতে হবে তাহলেও অতগুলো লোকের মধ্যে কারও সাহস হবে না তাতে আপত্তি করার৷ রাজলক্ষ্মী তার গণিকা জীবনের মধ্যে রক্ষা করে গেছে তার শুচিবায়ুগ্রস্ততাকে; বিশেষ করে তার খাবার নিয়ে৷ যে নারী পরপুরুষের সামনে মুজরা করে, গুড়গুড়ি টেনে তামাক খেতে পারে, সাত ঘাটের জল খাওয়া সেই নারীর সেই আচার-নিয়ম ইত্যাদির বৈসাদৃশ্য শ্রীকান্তের মনকে যেন নতুন করে আঘাত করে৷ তার সেই শুচিবায়ুগ্রস্ততা অনেক সময় কথককে পীড়া দিয়েছে, নিরর্থক জ্ঞান হয়েছে, এমন কি অত্যাচার বলেও মনে হয়েছে কিন্তু মুহূর্তে সমস্ত কিছু যেন ধুয়ে মুছে গিয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে৷ একদিন তার মনে হয়েছিল শৈশবে রাজলক্ষ্মী যাকে ভালোবেসেছিল, তাকে পিয়ারী তার উন্মত্ত যৌবনে কোন অতৃপ্ত লালসার পঙ্ক থেকে এমন করে সহস্রদল বিকশিত পদ্মের মতো বের করে দিতে পারল? তাই তার মনে হয় সে তো পিয়ারী নয়; সে যে রাজলক্ষ্মীই৷ রাজলক্ষ্মী ও পিয়ারী নামের মধ্যে যে তার জীবনের কতবড় ইঙ্গিত গোপন ছিল তা কথকের চোখে এতদিন ধরা পড়েনি৷ গঙ্গামাটি যাওয়ার প্রাক্কালে রাজলক্ষ্মীর নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শ্রীকান্ত তার সত্যকার রূপটিকে চিনে নিয়েছে৷ তাই দৈহিক কলুষতাকে ছাপিয়ে নারীর মনকে বিচার করতে পেরেছে সে৷ সে মনে মনে বলেছে—‘‘মানুষ ত কেবল তাহার দেহটাই নয়! পিয়ারী নাই, সে মরিয়াছে৷ কিন্তু একদিন যদি সে তার ওই দেহটার গায়ে কিছু কালি দিয়াই থাকে ত সেইটুকুই কি কেবল বড় করিয়া দেখিব, আর রাজলক্ষ্মী যে তাহার সহস্র-কোটি দুঃখের অগ্নিপরীক্ষা পার হইয়া আজ তাহার অকলঙ্ক শুভ্রতায় সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, তাহাকে মুখ ফিরাইয়া বিদায় দিব৷’’৬১ কথক তাকে, তার শুদ্ধতাকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি৷ আর শ্রীকান্তের সেই কথার মধ্য দিয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নারীর চিরন্তন পবিত্রতাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছেন৷ তার চিন্তায় নারীর সতীত্ববোধ তার দেহে নয়; মনে৷ মন যদি দেহের কলুষতাকে ছাপিয়ে শুদ্ধ হতে পারে তাহলে সেই মসীলিপ্ত দেহও চির পবিত্রতা অর্জন করে৷ শ্রীকান্ত নারীর সেই রূপটাকে যথার্থ উপলব্ধি করতে পেরেছে৷

শ্রীকান্তকে নিজের করে পেয়ে রাজলক্ষ্মীর দায়িত্ব যেন আরও বহুগুণে বেড়ে যায়৷ সে তার নিজের মানুষটিকে একান্ত করে পাওয়ার অভিলাষে এবং গঙ্গামাটিতে কেনা নতুন জমিদারির কার্যপোলক্ষে তাকে নিয়ে উপস্থিত হয় বীরভূমের সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে৷ সেখানে ধীরে ধীরে তার মধ্যে নানা পরিবর্তন লক্ষ্য করে শ্রীকান্ত৷ তার সাজ-পোশাকের যেমন সাধারণত্ব চলে আসে তেমনি নায়েব কুশারী মহাশয়ের ভ্রাতৃবধূ সুনন্দার সংস্পর্শে ধর্মপরায়ণ হয়ে ব্রতধর্মে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়৷ তার সেই নতুন ধর্মবোধের জোয়ারে উপেক্ষিত হতে থাকে শ্রীকান্ত৷ যে ভালোবাসার সীমাহীন আপ্যায়নে শ্রীকান্তের মত একজন পথিক মনোবৃত্তির মানুষকে নিজের করায়ত্ব করতে সক্ষম হয়েছিল সেই রাজলক্ষ্মীর নিরব ঔদাসীন্যে নিজেকে তার জীবনে বড় খাপছাড়া মনে হয়৷ সে বর্মা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে রাজলক্ষ্মী সেখানেও জোরালো কোনো আপত্তি তোলে না৷ শুধু তার বিদায় মুহূর্তে প্রতিশ্রুতি আদায় করতে ভোলে না যে সে যেন বর্মা যাওয়ার আগে তার সঙ্গে একবার দেখা করে যায়৷ শ্রীকান্ত প্রায় উদাসীন হয়েই সেখান থেকে চলে আসে৷ চিঠির মধ্য দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে রাজলক্ষ্মী৷ তার পর বর্মা যাওয়ার প্রাক মুহূর্তে সোজা কাশী গিয়ে উপস্থিত হয় তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে৷ যাত্রাপথে তাকে নিয়ে নানা রোমান্টিক কল্পনা তার চিত্তকে উদবেল করে রাখে৷ কিন্তু কাশীর বাড়িতে রাজলক্ষ্মীর নতুন রূপ দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় সে৷ সে দেখে—‘‘সে যে শুধু থানকাপড় পরিয়া দেহের সমস্ত অলঙ্কার খুলিয়া ফেলিয়াছে তাই নয়, তাহার সেই মেঘের মত পিঠজোড়া সুদীর্ঘ চুলের রাশিও আর নাই৷ মাথার পরে ললাটের প্রান্ত পর্যন্ত আঁচলটানা, তথাপি তাহারই ফাঁক দিয়া কাটা-চুলের দুই-চারিগোছা অলক কন্ঠের উভয় পার্শ্বে ছড়াইয়া পড়িয়াছে৷ উপবাস ও কঠোর আত্মনিগ্রহের এমনি একটা রুক্ষ শীর্ণতা মুখের ’পরে ফুটিয়াছে যে হঠাৎ মনে হইল, এই একটা মাসেই বয়সেও সে যেন আমাকে দশ বৎসর অতিক্রম করিয়া গিয়াছে৷’’৬২ রাজলক্ষ্মীর সেই বৈধব্যবেশ শ্রীকান্তের হৃদয়ে স্থান পাওয়া সমস্ত রঙীন কল্পনাসৌধকে নিমেষে ধূলিসাৎ করে দেয়৷ সে মনে মনে শুধু জোর সঞ্চয় করার চেষ্টা করে যে সে যেন চিরদিনের মতো তাকে পরিত্যাগ করে যেতে পারে৷ সে যেন আর কোনোদিন রাজলক্ষ্মীর কোনো বন্ধনে আবদ্ধ না হয়৷ পিয়ারীবাই নিজের খোলস ত্যাগ করে সত্যসত্যই রাজলক্ষ্মী হয়ে উঠেছে৷ সেখানে শুধুই বিধবার নিষ্ঠা আর সংযম; প্রণয়ের কোনো স্থান নেই৷ কিন্তু সেই ধর্মীয় নিষ্ঠা, বৈধব্যের সংযম বেশিদিন রাজলক্ষ্মীকে বেঁধে রাখতে পারেনি৷ শ্রীকান্তের প্রতি তার নিবেদিত প্রাণ মন বিদ্রোহ করে উঠেছে এবং সেখানে জয় হয়েছে তার নিষ্পাপ ভালোবাসার৷ সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তার প্রেমাস্পদের সন্ধান নিতে উপস্থিত হয়েছে শ্রীকান্তের কলকাতার বাসা বাড়িতে৷ কিন্তু সেখানে উপস্থিত নেই তার কাঙ্খিতধন৷ তাই ফিরে আসার অনির্দেশ্য অপেক্ষায় বাসার নিকটবর্তী আরেকটা বাসা নিয়ে অহরহ তার প্রতীক্ষার প্রহর গুণেছে৷ ঈশ্বর তাকে নিরাশ করেনি, চারদিন অপেক্ষার পর সে দেখতে পেয়েছে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে৷ শ্রীকান্ত যত দিন তাকে দেখছে তার মধ্যে দেখেছে এক অভাবনীয় জোর করার ক্ষমতা৷ তার সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে তার ভাবনায়৷ সে দেখেছে বন্ধুর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে সাহাসিকতার পরিচয় দিতে শ্মশানঘাটে রওনা দিলে রাজলক্ষ্মী তার পথরোধ করেছিল৷ তখনো শ্রীকান্ত তাকে চেনে নি সে যে রাজলক্ষ্মী তবু বলেছিল—‘‘যাবে বললেই তোমাকে যেতে দেব নাকি? কৈ যাও ত দেখি! এই বিদেশে বিপদ ঘটলে দেখবে কে? ওরা, না আমি? এবার তাহাকে চিনিলাম৷ এই জোরই তাহার চিরদিনের সত্য পরিচয়৷ জীবনে এ আর তাহার ঘুচিল না—এ হইতে কখনো কেহ তাহার কাছে অব্যাহতি পাইল না৷ আরায় পথের প্রান্তে মরিতে বসিয়াছিলাম, ঘুম ভাঙ্গিয়া চোখ মেলিয়া দেখিলাম শিয়রে বসিয়া সে৷ তখন সকল চিন্তা সঁপিয়া দিয়া চোখ বুজিয়া শুইলাম৷ সে ভার তাহার, আমার নয়৷ দেশের বাড়িতে আসিয়া জ্বরে পড়িলাম৷ এখানে সে আসিতে পারে না—এখানে সে মৃত—এর বাড়া লজ্জা তাহার নাই, তথাপি যাহাকে কাছে পাইলাম—সে ওই রাজলক্ষ্মী৷’’৬৩ শুধু সেখানে নয় নানা পারিপার্শ্বিক চাপে যখন সে প্রায় বাধ্য হতে যাচ্ছিল পুটুকে বিয়ে করতে তখনো তার সামনে প্রবল সাবধানবাণী উচ্চারণ করে তাকে সচেতন করে দিয়ে সে বলেছে—‘‘যদি কখনো অসুখে পড়ো দেখবে কে—পুঁটু? আর আমি ফিরে আসব তোমার বাড়ির বাইরে থেকে চাকরের মুখে খবর নিয়ে? তার পরেও বেঁচে থাকতে বলো নাকি?’’৬৪ তার সেই রাজলক্ষ্মী প্রতীক্ষার প্রহর গুণে তার জন্য চার দিন থেকে অপেক্ষা করে রয়েছে৷ সেখানে রাজলক্ষ্মীকে যেন নতুন চোখে আবিষ্কার করলো সে৷ তার দেহে রূপ আর ধরে না৷ পিয়ারীকে মনে পড়ে গেল কথকের৷ সে যেন নবকলেবর ধরে পুনরায় তার সামনে ফিরে এসেছে৷ রাজলক্ষ্মী যেন নিজেকে নতুন করে ভেঙ্গে আবার গড়েছে৷ আগে সে অনেক গয়না পড়তো, মাঝখানে সব খুলে ফেলেছে, যেন সে সন্ন্যাসিনী৷ তারপর পুনরায় সেই সকল পরিধান করতে আরম্ভ করেছে সে৷ সাধারণ আটপৌরে শাড়ি পড়েও তাকে অসাধারণ সুন্দরী ভাবতে কথকের সামান্যতম দ্বিধাবোধও হয় না৷ রাজলক্ষ্মী নিজেকে একটু একটু করে মেলে ধরছে তার সামনে আর সেখানে উঠে আসছে তার কৃচ্ছসাধন ব্রত-উপবাসের কথা, অবশেষে চরম অপ্রাপ্তির জ্বালা৷ সে নিজে থেকে একদিন অসম্মান করেছিল শ্রীকান্তকে সেই যন্ত্রণাই বিদ্ধ করছে তাকে৷ তাই সে বলে—‘‘এত পাপ করেও সংসারে এত ভাগ্য আমার মত কারো কখনো দেখেচো? কিন্তু আমার তাতেও আশা মিটলো না, কোথা থেকে এসে জুটল ধর্মের বাতিক, আমার হাতের লক্ষ্মীকে আমি পা দিয়ে ঠেলে দিলুম৷ গঙ্গামাটি থেকে চলে এসেও চৈতন্য হ’লো না, কাশী থেকে তোমাকে অনাদরে বিদায় দিলুম৷… বিষের গাছ নিজের হাতে পুঁতে এইবার তাতে ফল ধরল৷ খেতে পারিনে, শুতে পারিনে, চোখের ঘুম গেল শুকিয়ে, এলোমেলো কত কি ভয় হয় তার মাথামুণ্ডু নেই—গুরুদেব তখনো বাড়িতে ছিলেন, তিনি কি একটা কবজ হাতে বেঁধে দিলেন, বললেন, মা, সকাল থেকে এক আসনে তোমাকে দশ হাজার ইষ্টনাম জপ করতে হবে৷ কিন্তু, পারলুম কৈ? মনের মধ্যে হু-হু করে, পুজোয় বসলেই দু’চোখ বেয়ে জল গড়াতে থাকে—এমনি সময়ে এলো তোমার চিঠি৷ এতদিনে রোগ ধরা পড়ল৷’’৬৫ এ থেকে বোঝা যায় শ্রীকান্তকে তার সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে কম চেষ্টা করেনি৷ তার কলঙ্কিত জীবনে যুক্ত হয়ে সে যে চরম সামাজিক বয়কটের মধ্যে পড়বে তাও তার অজানা নয় তবু তার সমস্ত সাধ্যসাধনা ব্যর্থ হয়ে যায়৷ তার খাওয়া-পড়া, শোওয়া-বসা, ব্রত-উপবাস সমস্তই বৃথা মনে হয়৷ অবশেষে তার চিঠি পেয়ে বুঝতে পারে তার প্রকৃত শান্তি কোথায়—মুহূর্তেই তার উদ্দেশ্যে বাকি সব কিছুকে হেলায় অবহেলা করে চলে আসে সে৷

রাজলক্ষ্মীর মুখে বার বার ধ্বনিত হয়েছে সমাজের প্রতি, সমাজ ব্যবস্থার প্রতি প্রতিবাদ৷ সে যেমন তার জীবনের চরম দুর্গতির জন্য তার মায়ের অর্থলিপ্সাকে দায়ী করেছে তেমনি সে প্রসঙ্গে সমাজের নিষ্ঠুর নিয়ম-কানুনকেও ছেড়ে কথা বলেনি৷ তার মতে তার জীবনের সেই চরম পরিণতি তার একার নয়, তাদের দুইবোনের মতো বহু নারীর জীবনে ঘটে এবং তার মনে হয় কুকুর-বেড়ালের প্রতিও এমন দুর্গতি করতে মানুষের বাধে কিন্তু নারীর জন্য তাদের কোনো ক্ষমা নেই৷ সেই প্রসঙ্গে তার আশ্রিতা বিধবাদের কথাও সে বলতে ভোলে না যাদেরকে তাদের বাবা-মা আত্মীয় স্বজনেরা তারই মত হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিয়েছিল৷ তাই সে প্রবল যন্ত্রণার সঙ্গে বলতে পারে—‘‘যে-দেশে মেয়ের বিয়ে না হলে ধর্ম যায়, জাত যায়, লজ্জায় সমাজে মুখ দেখাতে পারে না—হাবা-বোবা-অন্ধ-আতুর কারও রেহাই নেই—সেখানে একটাকে ফাঁকি দিয়ে লোকে অন্যটাকেই রাখে, এ ছাড়া সে-দেশে মানুষের আর কি উপায় আছে বলো ত? সেদিন সবাই মিলে আমাদের বোন দুটিকে যদি বলি না দিত, দিদি হয়ত মরত না, আর আমি—এজন্মে এমন করে তোমাকে হয়ত পেতুম না, কিন্তু মনের মধ্যে তুমিই চিরদিন এমনি প্রভু হয়েই থাকতে৷’’৬৬ রাজলক্ষ্মীর কন্ঠে যেমন প্রতিবাদ তার কলঙ্কিত জীবনের প্রতি আক্ষেপ তেমনি সে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সেই গ্লানি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে৷ তার পেশার কারণেই হোক আর নারীসুলভ স্বভাবধর্মেই হোক পরকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা অপরিসীম৷ সে খানসামা রতনকে বাড়ির কাজের লোক হওয়া সত্ত্বেও পরম মমতায় যেমন আগলে রাখতে পারে তেমনি মানবসেবায় আত্মনিয়োগকারী আনন্দকে ভ্রাতৃস্নেহে তার অকৃত্রিম স্নেহভালোবাসা দিয়ে বুকে টেনে নেয়, নিজের হাতে পরম মমতায় রান্না করে খাওয়ায়৷ আনন্দ যে কোনো মায়ের বুক খালি করে দেশমাতার সেবায় সন্ন্যাস জীবন যাপন করছে রাজলক্ষ্মীর কোমল হৃদয় সেই মায়ের কথা, ঘরের কথা ভেবেও আদ্র হয়ে ওঠে এবং শ্রীকান্তকে জানায় কোনোদিন যদি সে আনন্দকে নিজের আয়ত্তের মধ্যে পায় তাহলে তাকে অবশ্যই সংসারে ফিরিয়ে দেবে৷ আর তার অনুরোধ, আহ্বান সংসার বন্ধনহীন সন্ন্যাসীকেও মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ করে দিতে পারে৷ এ প্রসঙ্গে আনন্দ শ্রীকান্তকে জানায়—‘‘ওঁর অনুরোধ ত অনুরোধ নয়, যেন মায়ের ডাক৷ পা আপনি চলতে শুরু করে৷ কত ঘরেই তো আশ্রয় নিই, কিন্তু ঠিক এমনটি আর দেখিনে৷’’৬৭ আর কমললতা যে তার প্রথম জীবনে ‘শ্রীকান্ত’ নামটিকে জীবনের জপমন্ত্র করেছিল, পরবর্তীকালে বৈষ্ণব জীবনে প্রবেশ করে সেই নামধারী শ্রীকান্তকে সশরীরে পেয়ে নিজের প্রেম নিবেদন করতে দ্বিধা করে না—সেই বৈষ্ণবী কমললতাও রাজলক্ষ্মীর মমতাপূর্ণ হৃদয়ে দিদির আসনে অধিষ্ঠিত হয়৷ আর তার মানুষ বশ করার এরূপ স্বভাব ধর্মের কথা শ্রীকান্ত বার বার নানা কথার ছলে ব্যক্ত করেছে তার সামনে৷

রাজলক্ষ্মী তার তপস্যা দিয়ে শেষ পর্যন্ত লাভ করেছে তার প্রেমাস্পদকে৷ সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতায় সে তার সঙ্গে কোনো বৈবাহিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারেনি—কারণ শ্রীকান্তকে বিবাহ করে সমাজের চোখে তাকে ছোটো করে দিতে তার হৃদয় সায় দেয়নি তথাপি ভালোবাসার বিনিসুতোর বন্ধনে বাঁধা পড়ে তার সমস্ত দায়ভার সে গ্রহণ করেছে, পুনরায় গঙ্গামাটিতে গিয়ে চেনা-জানা জগৎ থেকে অনেক দূরে তারা দুই নর-নারী সুখের ঘরকন্না শুরু করতে পেরেছে৷ যেখানে আর কোনো বিচ্ছেদের ব্যথা বাজেনি, কোনো হারানোর ভয় থাকেনি৷ শ্রীকান্তও তার চিরন্তনী মূর্তির কাছে নিরবে মাথা নত করেছে৷ তার চিন্তায় তার রাজলক্ষ্মী নামটি তার চরিত্রপোযোগী করে তৈরি করেছিলেন বিশ্বপিতা৷ তাই সব শেষে রাজলক্ষ্মীর চরিত্রের ঐশ্বর্য রূপটি শ্রীকান্তর মুখ দিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে এইভাবে—‘‘সকলের সকল শুভ-চিন্তায় অবিশ্রাম কর্মে নিযুক্ত—কল্যাণ যেন তাহার দুই হাতের দশ অঙ্গুলি দিয়া অজস্র ধারা ঝরিয়া পড়িতেছে৷ সুপ্রসন্ন মুখে শান্তি ও পরিতৃপ্তির স্নিগ্ধ ছায়া; করুণায় মমতায় হৃদয়-যমুনা কূলে কূলে পূর্ণ—নিরবচ্ছিন্ন প্রেমের সর্বব্যাপী মহিমায় আমার চিত্তলোকে সে যে-আসনে অধিষ্ঠিত, তাহার তুলনা করিতে পারি এমন কিছুই জানি না৷’’৬৮

এভাবে সমগ্র উপন্যাসটিতে একজন রূপাজীবা ত্যাগে, ভালোবাসায়, প্রেমে, নিষ্ঠায়, কর্তব্যে অসাধারণ নারীমূর্তি হিসেবে চিত্রিত হয়েছে৷ রাজলক্ষ্মী শুধু উপন্যাসে মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়—সে উপন্যাসটির নায়িকাও৷ লেখক অসীম শ্রদ্ধার সঙ্গে তার জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা-বিশ্লেষণ করে একজন গণিকা থেকে নারীত্বের শ্রেষ্ঠ সম্মানে অধিষ্ঠিত করেছেন তাকে৷

কমললতা :

‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের আরেকজন পদস্খলিতা নারী কমললতা৷ তার আসল নাম ঊষাঙ্গিনী৷ সিলেটে ছিল তার আদি বাসস্থান৷ কারবারি বাবা কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকতেন বলে তার পরম আদরের একমাত্র কন্যা ঊষাঙ্গিনীকেও সেখানে এনে মানুষ করতে থাকে৷ কলকাতাই তার প্রিয় স্থান৷ তাই কোনো কারণে দেশে গিয়ে থাকতে হলে বেশিদিন থাকা তার মনের পক্ষে সম্ভব হত না৷ সেই কলকাতাতেই সতেরো বছর বয়সে তার বিয়ে হয় এবং কলকাতাতেই সেই জীবনের প্রথম সঙ্গীটিকে হারায়৷ তার নামও ছিল শ্রীকান্ত৷ তারপর কমললতা যখন গহরগোঁসাই-এর কাছে প্রথম শ্রীকান্ত নাম শোনে, সে চমকে ওঠে এবং মনের নিভৃতে তাকে একটিবার দেখার জন্য প্রবল বাসনার জন্ম নেয়৷ মুরারিপুরের সেই আখড়ার বৈষ্ণবী কমললতা তার জীবনের কথা শোনাতে গিয়ে শ্রীকান্তকে আরও বলে যে কলকাতায় বিবাহের অব্যবহিত পরেই সে তার স্বামীকে হারিয়ে তাদের সরকার মন্মথর সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়৷ যার ফলস্বরূপ একুশ বছর বয়সে তার গর্ভসঞ্চার হলে সেই দায় নিতে অস্বীকার করে প্রণয়ী মন্মথ৷ সে তার পিতৃহীন ভাইপো যতীনের উপর সেই দোষ আরোপ করে৷ ফলে যতীন আত্মহত্যা করে৷ অবশেষে তার লজ্জায় কাতর বাবা স্থির করে নবদ্বীপে গিয়ে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা দিয়ে মন্মথ ও ঊষাঙ্গিনীর বিয়ে দেবে যাতে মেয়ের জীবনের সমস্ত যন্ত্রণা মুছে যায়, তার গর্ভের সন্তানের সুন্দর এবং নিরাপদ ভবিষ্যৎ পায়৷ বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পর তার নতুন নামকরণ হয় কমললতা৷ কিন্তু সময় উত্তীর্ণ হতে চললেও মন্মথ সেখানে আসে না৷ অবশেষে তাদের বিয়ে দিনকতক পিছিয়ে যায় মন্মথর নিজের কোনো ব্যক্তিগত কারণের জন্য৷ নবদ্বীপের বাসায় কমললতার অসীম প্রতীক্ষায় দিনগুজরান হয়৷ অবশেষে শুভদিন উপস্থিত হলে বিবাহের প্রাক্কালে সে বাড়ির পুরোনো দাসীর কাছে জানতে পারে মন্মথর প্রকৃত রূপ৷ মন্মথ নিজের দোষ ভাইপো যতীনের স্কন্ধে আরোপ করে যতীনকে তো মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেই তৎসঙ্গে নিজের দায় নিতে অস্বীকার করে কুরি হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে বিবাহ করতে সম্মত হয়েছে৷ কারণ সেই দুর্বৃত্ত সকলের কাছে বলেছে যতীনের দোষে সে পরের পাপ নিজ স্কন্ধে ধারণ করতে চলেছে, সেই জন্য বিশ হাজার টাকার বিনিময়ে সে তা করতে পারবে৷ সেই দাসীর মুখেই জানতে পারে সেই অপবাদে যতীনের গলায় দড়ি দেওয়ার কথা৷ কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় কমললতা৷ সে বলে—‘‘সেদিন ঠাকুরের প্রসাদী মালা ঠাকুরের পাদপদ্মে ফিরিয়ে দিয়ে এলুম৷ মন্মথর অশৌচ গেল কিন্তু পাপিষ্ঠা ঊষার অশৌচ ইহজীবনে আর ঘুচল না নতুনগোঁসাই৷’’৬৯ ঊষাঙ্গিনী অবশেষে মরা ছেলের জন্ম দিয়েছিল৷ পিতাকে পুনরায় গৃহে পাঠিয়ে তার মাকে জানাতে বলেছিল তার নিজের মৃত্যু সংবাদ কারণ মেয়ে মরে গেলে যতটা দুঃখ, মেয়ে কুলটা হয়ে বেঁচে থাকলে তার চেয়ে অধিক দুঃখ৷ সে তাই তার মায়ের কাছে মৃত হয়েই থাকতে চায়৷ অবশেষে কলকাতার পাট মিটিয়ে সে গৃহত্যাগী হয়৷ সঙ্গী পেয়ে যায় শ্রীবৃন্দাবন ধাম দর্শনের৷ তারপর বহু তীর্থ, গাছতলায় দিন কাটিয়ে সে উপস্থিত হয় মুরারিপুরের আখড়াতে৷ শ্রীকান্ত তার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছে বৈষ্ণবদের সেবাদাসী প্রসঙ্গ, বাবাজীদের পরকীয়া সাধনাতত্ত্ব সম্পর্কে৷ সবকিছুর পেছনেই ছিল তার চাপা ব্যঙ্গ৷ কমললতাও বিচক্ষণ, সেও তার ঠাট্টা তামাশা দিয়ে সেই জিজ্ঞাসা প্রসঙ্গকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে৷

কমললতা জীবনের বহুঘাট পেরিয়ে বৈষ্ণব জীবন বরণ করেছে৷ যৌবনের সামান্য একটু পদস্খলন তাকে নির্বাসন দিয়েছে সংসার সীমানা থেকে৷ তার পরেও তার মধ্যেকার সেই চিরন্তনী নারীসত্তাটিকে উপেক্ষা করেননি রচনাকার৷ নারীর পরম ধর্ম সেবা, নিষ্ঠা দিয়ে সে অধিষ্ঠিত হয়েছে অনেক উচ্চ আসনে৷ সেবায়-যত্নে আখড়ায় ঘুরতে আসা শ্রীকান্তকে ভরিয়ে রেখেছে৷ আশ্রমের রীতিবিরুদ্ধ হলেও তার সখের দিকে লক্ষ্য রেখে ‘চা’ এর ব্যবস্থা করেছে৷ তার আশ্রমে আগত সকল অতিথিদেরই সে সেবা যত্নে মোহিত করে রাখে৷ কথকের বাল্যবন্ধু গহর তার উদাসী কবিমন দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আত্মসমর্পণ করে তার কাছে৷ তার সম্পর্কেও লেখক মানুষ বশ করার অপার ক্ষমতার কথা ব্যক্ত করেছেন৷ আসলে নারীরা তাদের স্বাভাবিক গুণাবলী দিয়ে সকল কিছু জয় করার ক্ষমতা রাখে৷ গহরের মৃত্যুশয্যায় তার নিরবচ্ছিন্ন সেবার দ্বারা নিজের নারীত্বকে ধন্য করেছে সে৷ যার জন্য আখড়ার বৈষ্ণবেরা তাকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেয় না, পূজার উপকরণে হাত দিতে দেয় না৷ সমস্ত কিছু ঈশ্বরের ইচ্ছা ভেবে নিজেকে ঈশ্বরের নামে সমর্পণ করে দিয়েছে বৈষ্ণবী কমললতা৷

কমললতার মধ্যে ছিল গভীর এক মননশীলতা৷ জীবনের সবকিছুকে সে গভীরভাবেই যাচাই করতে চায়৷ নারী পুরুষের প্রেম নিয়েও তার ভাবনা স্বতন্ত্রতা পেয়েছে৷ সে প্রেমের সেই সুগভীর বৈপরীত্য প্রকাশ করে শ্রীকান্তকে বলেছে—‘‘প্রেমের বাস্তবতা নিয়ে তোমরা পুরুষের দল যখন বড়াই করতে থাকো তখন ভাবি আমাদের জাত যে আলাদা৷ তোমাদের ও আমাদের ভালোবাসার প্রকৃতিই যে বিভিন্ন৷ তোমরা চাও বিস্তার, আমরা চাই গভীরতা; তোমরা চাও উল্লাস, আমরা চাই শান্তি৷’’৭০

চারপাশের নানা জটিল অভিজ্ঞতা শেষ পর্যন্ত কমললতার জীবনে বৈরাগ্য এনেছে৷ আশ্রমে তার পালাই পালাই মন বৈষ্ণবদের অসন্তোষে সত্যসত্যই পালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ কিন্তু সেখানকার আরেক অসহায় বৈষ্ণবী পদ্মার অশ্রুপূর্ণ স্নেহ সম্ভাষণ সে সূত্রটাকে এতদিন পর্যন্ত অখণ্ড রেখেছিল অবশেষে গহরের মৃত্যুর পর তার জন্য রেখে যাওয়া অনেক পরিমাণ টাকা, যা দিয়ে জীবনের সুখ বৈভব অনায়াসে খরিদ করতে পারতো সে, সবকিছুকে হেলায় অবহেলা করে সকলের অগোচরে সে স্থান থেকে এক কাপড়ে বিদায় নিয়েছে৷ শুধুমাত্র বিদায় বেলায় স্টেশনে শ্রীকান্ত তাকে দেখলে সে তাকে অনুরোধ করে বৃন্দাবনে যাওয়ার টিকিট কিনে নিয়েছে৷ কমললতা সংসারের সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্তি চায়—বিদায় বেলায় সে শ্রীকান্তের সঙ্গে সম্পর্কসূত্রকেও আর ধরে রাখতে চায় না৷ জীবনের সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিঃস্ব রিক্ত হয়ে ঈশ্বরের চরণে তার সব কিছু সঁপে দিতে চায়৷ তাই সে শেষ প্রার্থনা করে শ্রীকান্তর কাছে কিছু পাওয়ার দাবি করে৷ তার সে চাওয়া বড় মর্মান্তিক৷ সে শ্রীকান্তকে বলে—‘‘আমি জানি, আমি তোমার কত আদরের৷ আজ বিশ্বাস করে আমাকে তুমি তাঁর পাদপদ্মে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হও—নির্ভয় হও৷ আমার জন্যে ভেবে ভেবে আর তুমি মন খারাপ ক’রো না গোঁসাই, এই তোমার কাছে আমার প্রার্থনা৷’’৭১

সমাজের চোখে পতিতা কমললতা শেষ পর্যন্ত সমাজের সব বন্ধন উপেক্ষা করে ‘তাঁর’ পাদপদ্মে নিজেকে সমর্পণ করেছে৷ পরম সহানুভূতিতে কমললতা চরিত্রটি চিত্রিত করেছেন রচনাকার৷

ঘ. শুভদা :

‘শুভদা’ উপন্যাসটির প্রকাশকাল ১৯৩৮ কিন্তু এর রচনাকাল অনেক পূর্ববর্তী সময়ে৷ এম. সি সরকার প্রকাশিত রচনা সমগ্রের অষ্টম সম্ভারে গ্রন্থপরিচয় অংশে বলা হয়েছে বইটি নাকি ১৮৯৮ সালে লেখা৷ শরৎচন্দ্র জীবদ্দশায় বইটিকে ছাপতে চাননি ফলে তা প্রকাশিত হয়েছে মৃত্যুর পরে৷ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে একটি দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের এক কুলবধূর করুণ জীবন যন্ত্রণার ছবি৷ এখানে নানা ঘটনার অভিঘাতে কয়েকজন পতিতা নারীর জীবন উঠে এসেছে৷ একজন কাত্যায়নী, সে পুরোদস্তুর নিম্নশ্রেণীর দেহব্যবসায়ী, অপরজন মালতী ও জয়াবতী৷ দুজনেই জমিদার সুরেন্দ্রনাথ রায়ের রক্ষিতা৷

মালতী :

মালতীর পূর্বনাম ললনা৷ সে বালবিধবা৷ চরিত্রহীন পিতার চরম প্রতিকূলতায় তাদের সংসারে চরম অর্থকষ্ট দেখা দিলে সেই জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করে আশ্রয় পায় সুরেন্দ্রনাথ রায়ের নৌকায়৷ তার রূপ-যৌবনে মুগ্ধ হয়ে সেই জমিদারতনয় তাকে তার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে সে তাতে রাজী হয় না৷ তার ইচ্ছে কলকাতা যাওয়ার৷ সেখানে রূপের পসরা সাজিয়ে উপার্জন করতে চায় প্রচুর অর্থ৷ তাই বলা হয়েছে—‘‘মালতী রূপবতী; শরীরে তাহার রূপ ধরে না একথা সে টের পাইয়াছে; কলিকাতা বড় শহর৷ সেখানে এ রূপ লইয়া গেলে বিক্রয় করিবার জন্য ভাবিতে হইবে না, হয়ত আশাতীত মূল্যেও বিক্রয় হইতে পারে, তাই কলিকাতা যাইতে এত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়াছে৷ সেখানে তাহার আদর হইবে, দরিদ্র ছিল ধনবতী হইবে, ক্লেশে জীবন কাটিতেছিল এইবার সুখে কাটিবে৷’’৭২ ললনা অর্থের জন্য মালতী হয়েছে; অর্থ উপার্জনের পথও আবিষ্কার করেছে তথাপি তার মনে শান্তি নেই, যন্ত্রণার শেষ নেই৷ তার মনের কথা, তার অর্থের প্রয়োজনের কথা মুখে না বললেও বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না বিচক্ষণ সুরেন্দ্রর৷ সে তাই তাকে বলে—‘‘যেজন্য তুমি কলিকাতায় যাইতে চাহিতেছ তাহা তুমি পারিবে না৷ এ বৃত্তি বোধ হয় তুমি পূর্বে কখন কর নাই, এখনও পারিবে না৷’’৭৩

সাধারণ সরল গ্রাম্য মেয়েটিকে ঠিকই বুঝেছিল সুরেন্দ্রনাথ রায়৷ সে প্রায় জোর করেই তার ভালোবাসা ও টাকার অভাব মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে মালতীকে তার কাছে রেখে দেয়৷ মালতীও তার সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হয়৷ অবশেষে মালতী তার কোমলতা দিয়ে মন জয় করে সুরেন্দ্রর৷ বাগানবাড়িতে সে রক্ষিতার পরিচয়ে থাকলেও সুরেন্দ্র তাকে জাত-কুল-মান বিসর্জন দিয়ে বিবাহ করতেও রাজী হয়৷ কিন্তু প্রবল আত্মগ্লানিতে তাকে বাধা দিয়ে মালতী বলে—‘‘বিধবাকে বিবাহ করিতে আছে, কিন্তু বেশ্যাকে নাই৷’’৭৪ মালতী তাকে জানিয়েছে সে ছাড়া তার দেহ কখনো কেউ স্পর্শ করেনি কিন্তু তার পূর্বেই সে আরেকজনকে মনপ্রাণ সমস্ত সমর্পণ করেছিল৷ সেই অশুচি মনপ্রাণ সে কিছুতেই অন্য জনকে দান করতে পারবে না৷ তাই সে সেই কথার সূত্রধরে বলে—‘‘আমি বেশ্যা—বেশ্যায় সব পারে৷’’৭৫ অর্থাৎ যে ভাবে একদিন অপর আরেকজনকে ভালোবেসে প্রাণমন সমর্পন করেছিল, সেই সে আবার পুনরায় সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে ভালোবাসার বাসর সাজিয়েছে৷

ললনার প্রবল ইচ্ছে সে তার দুঃখী মাকে সহায়তা করে৷ যতদিন গৃহে ছিল ততদিন করেও ছিল৷ তারপর মালতী হয়ে সুরেন্দ্রর হৃদয়রাজ্যের একচ্ছত্র অধীশ্বরী হয়ে বসেছে৷ তাকে বিয়ে না করে তার সঙ্গে লিপ্ত হয়েছে অবৈধ শরীরী সংসর্গে৷ কিন্তু একমুহূর্তের জন্য সে তার ভেতরকার ললনা নারীটিকে ভুলে যেতে পারেনি৷ ভেতরে ভেতরে সর্বদাই চলেছে তার অশ্রুক্ষরণ৷ সুরেন্দ্রও মালতীর ভেতরকার সেই সাধারণ রূপকে ভয় করেছে৷ আভরণহীন সাধারণ বেশবাসে মালতীকে তার মনে হয়েছে কোনো পবিত্র জ্যোতির্ময়ী রূপ; তাকে স্পর্শ করতেও ভয় হয় তখন৷ এরকমই কথার প্রতিধ্বনি—‘‘তোমার এ নিরাভরণা মূর্তি বড় জ্যোতির্ময়ী—স্পর্শ করিতেও সময়ে সময়ে কি যেন একটা সঙ্কোচ আসিয়া পড়ে—দেখিলেই মনে হয় যেন আমার পাপগুলা ঠিক তোমারি মত উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে৷ তোমাকে বলতে কি—তোমার কাছে বসিয়া থাকি, কিন্তু কি একটা অজ্ঞাত ভয় আমাকে কিছুতেই ছাড়িয়া যাইতেছে না বলিয়া মনে হয়৷ আমি তেমন সুখ পাই না—তেমন মিশিতে পারি না; তাই তোমাকে অলঙ্কার পরাইয়া একটু ম্লান করিয়া লইব৷’’৭৬ সুরেন্দ্র তাকে রক্ষিতা করে সুসজ্জিত বাগানবাড়িতে স্থান দিয়েছে, তাকে রক্ষিতার মতোই উপভোগ করতে চায়৷

অবস্থার বিপাকে পড়ে ললনাকে মালতী হতে হয়েছে৷ তার সংবেদনশীল হৃদয় তাই দুঃখী মানুষের দুঃখ দেখে আঁতকে ওঠে৷ সুরেন্দ্রনাথের আরেক রক্ষিতা জয়াবতীর মৃত্যুর পর তার মাকে সে আপন করে নেয়, দশটাকা অর্থ সাহায্য দিয়ে তার দারিদ্র্যতা নিবারণ করার চেষ্টা করে৷ আবার সেই সংবেদনশীল মনের জোরেই সুরেন্দ্র মালাচন্দনে ভূষিত হয়ে বাগানবাড়িতে এসে বিলাসচ্ছলে তার গলায় মালা পড়িয়ে তাকে সেই স্থান থেকে স্বগৃহে নিয়ে যেতে চাইলে মালতী তা অস্বীকার করে৷ সে তার রক্ষিতা হিসেবে প্রথম স্থান পেয়েছিল, রক্ষিতা হিসেবেই জীবন পাড়ি দিতে চায়৷

এই চরিত্রটির মধ্য দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে পিতার উদাসীনতা, মায়ের জীবনযন্ত্রণা, পারিবারিক অনটন, ভাই-এর অসুস্থতা একজন সরল বিধবাকে কুপথে যেতে প্ররোচিত করে৷ ললনা তার পরিবারকে আর্থিক অনটনের হাত থেকে বাঁচাতেই গণিকাবৃত্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা ছাড়া একজন বিধবা নারীর কিই বা পথ থাকতে পারে৷

জয়াবতী :

জয়াবতী আরেকজন রক্ষিতা, যাকে প্রথম দেখা যায় সুরেন্দ্রনাথের নৌকায়৷ অসুস্থ শরীরকে সুস্থ করার জন্য ডাক্তার বায়ু পরিবর্তনের নিদান দিলে সুরেন্দ্র জয়াবতী সমভিব্যাহারে জলপথে দিন যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়৷ জয়াবতী সুরেন্দ্রর যথেষ্ট অনুগ্রহ অর্জনে সক্ষম হয়েছিল৷ মালতীকে উদ্ধার করার পর এবং বজরায় সে অসুস্থ হয়ে পড়লে জয়াবতী গৃহিণীর মতো পরিচর্যা করে তাকে সুস্থ করে তোলে৷ শেষে জয়াবতী নৌকাডুবি হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়৷ জয়াবতী উপন্যাসের নিতান্তই এক গৌণ চরিত্র৷ হয়তো সুরেন্দ্রর মনে মালতীর অবস্থান পাকা করতে জয়াবতীকে তার রক্ষিতা হিসেবে দেখানো হয়েছে৷

কাত্যায়নী :

কাত্যায়নী নিম্নশ্রেণী দেহজীবি নারী৷ বামুনপাড়ার একটা গলিপথ ধরে দরমাঘেরা এক ঘরে বাস করে সে৷ ললনার পিতা হারাণচন্দ্রের সে প্রণয়িনী৷ লম্পট, গাঁজাখোর, প্রতারক হারাণ স্ত্রীর শেষ সম্বলটুকুও বিনা দ্বিধায় আত্মসাৎ করে তার বিলাস-ব্যসনে ব্যয় করে৷ কাত্যায়নীর বয়স পঁচিশ বছর, ‘‘কালোকোলো মোটাসোটা সর্বাঙ্গে উলকিপরা মানানসই যুবতী’’৭৭ সে৷ জীবনে সে অনেক অর্থই সংগ্রহ করেছে হারাণচন্দ্রের কাছ থেকে৷ ইদানিং জুয়াড়ি হারাণ তার দিকে অতটা দেখে না৷ অনেকদিন পর এসে উপস্থিত হলে সে বিরক্ত হয়ে জানায়—‘‘আসতে হয় একটু সকাল সকাল এসো৷ রাত্তির নেই, দুপুর নেই, যখন-তখন যে অমনি করে চেঁচাবে—তা হবে না, অত গোলমাল আমার ভাল লাগে না৷’’৭৮ হারাণচন্দ্র তাকে শান্ত করে তার কাছে দুটাকা ধার চাইলে সে সঙ্গে সঙ্গে তার সেই প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করে৷ সে চাবি খুলে সিন্দুকে টাকা আছে কি না তা দেখতে চাইলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে কাত্যায়নী৷ হারাণচন্দ্রের মুখে ভালোবাসার নাম শুনে তার আর হিতাহিত জ্ঞান থাকে না৷ সে গণিকা৷ গণিকাকে ভালোবাসার মূল্য দিতে নেই তা সে অক্ষরে অক্ষরে মানে৷ তাই হারাণের ভালোবাসার কৈফিয়তে বারনারীর মতো ঝংকৃত হয় তার কথা৷ আর তার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয় গণিকা নারীদের জীবনের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি—‘‘আমাদের যেখানে পেট ভরে সেইখানে ভালবাসা৷ এ কি তোমার ঘরের স্ত্রী যে গলায় ছুরি দিলেও ভালবাসতে হবে? তোমা ছাড়া কি আমার গতি নেই? যেখানে টাকা সেইখানে আমার যত্ন, সেইখানে আমার ভালোবাসা৷ যাও, বাড়ি যাও—এত রাত্তিরে বিরক্ত ক’রো না৷’’৮৯

কাত্যায়নী তার তীব্র বাক্যবাণে আহত করার চেষ্টা করেছে প্রণয়ী হারাণচন্দ্রকে৷ আপাত দৃষ্টিতে তাকে যতটা হিংস্র অর্থলোভী মনে হয় আদতে সে তা নয়৷ আসলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নারীর কঠিন-পাশবিক রূপে কখনোই বিশ্বাস করতেন না, তার কাছে নারীরা বরাবরই শ্রদ্ধেয়৷ তাই অর্থলোভী নিম্নশ্রেণীর বারবনিতা কাত্যায়নীর মধ্যেও তিনি মাধুর্যরস সিঞ্চন করতে ভোলেননি৷ কাত্যায়নী হারাণচন্দ্রের স্বভাব সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল৷ সে সকলের অলক্ষ্যে গিয়ে তার পরিবারের দুরবস্থা চোখে দেখে এসেছে৷ হারাণের উদাসীনতায় তার বাড়ির সদস্যদের দুঃখজনক জীবনযাপন দেখে সে চুপ থাকতে পারেনি৷ তার ভেতরকার সেই কোমল নারীসত্তাটি জেগে ওঠে তাদের দুঃখে অশ্রুপাত করেছে৷ তাই সে তার গচ্ছিত ধনের থেকে দশটি টাকা নির্দ্বিধায় তুলে দিয়েছে তার প্রণয়ীর হাতে৷ পরিতৃপ্তির হাসি হেসে সে তাকে বলেছে—‘‘এই টাকাগুলো তোমার স্ত্রীর হাতে দিও—তবুও দুদিন স্বচ্ছন্দে চলবে৷ নিজের কাছে কিছুতেই রেখো না৷ শুনচ?’’৮০ কাত্যায়নী জানে হারাণের স্বভাব৷ তার পরিবার যে উপোস করে দিন কাটাচ্ছে সেটাও তার অজানা নয়৷ কিন্তু হারাণ টাকা পেলেই জুয়ায়-গাঁজায় মেতে ওঠে, তার বাহ্যজ্ঞান-বিবেকবোধ লোপ পায় তাই সে সেই টাকা তার স্ত্রী শুভদার হাতে দিতে বলেছে, যাতে দু-একদিন তাদের মুখে অন্নের জোগান হয়৷

সমাজ কাত্যায়নীকে ‘খারাপ মেয়েমানুষ’ বলে জানে৷ সকলে তার প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করে হারাণের মতো মানুষদের কুপথে চালিত করার জন্য৷ কিন্তু যারা কুপথগামী তাদের কাত্যায়নীর মতো নারীরাও কখনোই সৎপথে ফিরিয়ে দিতে পারে না৷ তাই কাত্যায়নী তার সংস্পর্শ থেকে মুক্তি দিয়ে হারাণকে বলতে পেরেছিল—‘‘ঠাকুর করুন তোমার যেন চোখ ফোটে৷ আমরা ছোটলোকের মেয়ে, ছোটলোক—কিন্তু এটা বুঝি যে, আগে স্ত্রী-পুত্র বাড়িঘর, তারপর আমরা; আগে পেটের ভাত, পরবার কাপড়, তারপর শখ, নেশা-ভাঙ৷ তোমার আমি অহিত চাইনে, ভালর জন্যই বলি—এখানে আর এস না, গুলির দোকানে আর ঢুকো না—বাড়ি যাও, ঘরবাড়ি স্ত্রী-পুত্র দেখ গে, একটা চাকরি-বাকরি কর, ছেলেমেয়ের মুখে দুটো অন্ন দাও, তারপর প্রবৃত্তি হয় এখানে এসো৷’’৮১ কাত্যায়নীর সেই কথা তার মহত্ত্বকে প্রকাশিত করে৷ সে আরেকটি পরিবারের আসন্ন দুর্যোগ রক্ষা করতে নিজের প্রতিদিনের খরিদ্দারকেও হাতছাড়া করতে দ্বিধাবোধ করে না৷ তবুও সমাজের সমস্ত অভিশাপ বর্তায় তার উপরই৷

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৫-১৯৩০) :

ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসের জগতেও বিশেষ কৃতিত্ব রেখে গিয়েছেন৷ তিনি ভারতীয় ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্বে গভীর গবেষণা করেছিলেন এবং তাঁর অন্বীক্ষায় এবং কল্পনায় আমাদের দেশের পুরোনো ইতিহাসকে প্রত্যক্ষবৎ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন৷ সেই উপলব্ধির উষ্ণতা সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে৷ গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধ্বংসের সূত্রপাতে লিখিত ‘করুণা’ (১৯১৭) এবং বাদশা ফররুখসিয়রের আমলে বাংলা দেশের অবস্থা চিত্রণের উদ্দেশ্যে ‘অসীম’ (১৯২৪) উপন্যাসদুটি লিখিত হলেও এগুলির মধ্যে গণিকা জীবনের এক সুস্পষ্ট আলেখ্য উঠে এসেছে৷ ত্যাগে-মহানতায়, ঈর্ষা-স্বার্থপরতায় তাঁর সৃষ্ট গণিকাচরিত্রগুলি অন্যান্যমাত্রা লাভ করেছে৷

ক. করুণা :

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘করুণা’ (১৯১৭) উপন্যাসে পাটালিপুত্রের নর্তকী ইন্দ্রলেখা, ইন্দ্রলেখা-কন্যা অনন্তা, সখি মদনিকাসহ রাজসভার উৎসব অনুষ্ঠানে নৃত্যগীত পারদর্শী বহু নামহীনা গণিকার উল্লেখ রয়েছে৷ গুপ্তসাম্রাজ্যের ধ্বংস এবং বৌদ্ধশক্তির উত্থানে এই গণিকাত্রয়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা লক্ষণীয়৷

ইন্দ্রলেখা :

অঘটনপটিয়সী বিগতযৌবনা ইন্দ্রলেখা এককালে পাটলীপুত্রের প্রধান নর্তকী ছিল৷ গণিকাবৃত্তিতে তার পসার তাকে পাটলিপুত্রের প্রধান ধনবান হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে৷ তার চক্রান্তেই গুপ্তবংশের সর্বনাশ সাধিত হয়৷ লোভে, হিংসায়, বিদ্বেষে, ছলনায়, সর্বোপরি উপস্থিত কুবুদ্ধির প্রাবল্যে ইন্দ্রলেখা চরিত্রটি অনবদ্য৷ উপন্যাসে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে অনন্তার মা হিসেবে৷ উত্তরপথের রাজধানী পাটলিপুত্রের মহারাজাধিরাজ শ্রীমৎ কুমারগুপ্তকে তার কন্যার বশে এনে বৃহৎ গুপ্তসাম্রাজ্যকে নিজের করায়ত্ব করাই ইন্দ্রলেখার প্রধান উদ্দেশ্য৷ এই উদ্দেশ্যপূরণে তাকে সহায়তা করেছে তার অনুগৃহিত বীট চন্দ্রসেন, মহাবিহারস্বামী হরিবল৷ কিন্তু ইন্দ্রলেখার উদ্দেশ্যপূরণে প্রথম বাধা হয় দ্বিতীয়চন্দ্রগুপ্তের পুত্র গোবিন্দগুপ্ত৷ ইন্দ্রলেখার নবীন যৌবনে গোবিন্দগুপ্ত ‘মন্দমলয়ানিল’ হয়ে তার সর্বস্ব পাটলিপুত্রের সেই প্রধান রূপসীর হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল৷ রাজসিংহাসন ত্যাগ করে তার প্রেমে মত্ত গোবিন্দগুপ্ত বিশবছর পূর্বে পর্ণকুটিরে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল; কিন্তু গণিকার প্রেম তো এক পুরুষে সীমাবদ্ধ নয়! তাই নির্দ্বিধায় তাকে ত্যাগ করে নট ফল্গুযশের সঙ্গে প্রেমডোর বেঁধেছিল ইন্দ্রলেখা৷ সেই গোবিন্দগুপ্ত এসেছে তার উদ্দেশ্যপূরণে বাধা দিতে৷ ইন্দ্রলেখার গোবিন্দগুপ্তর স্বভাব-চরিত্র-বুদ্ধিমত্তা, যুদ্ধক্ষমতা সকল নখদর্পণে৷ নর্তকীগৃহে বিবাহসভা থেকে বৃদ্ধ মহারাজা কুমারগুপ্তকে সে যখন কৌশল করে প্রাসাদে ফিরিয়ে আনতে যায় তখন ইন্দ্রলেখা তাকে উদ্দেশ্য করে ইতরভাষায় বাক্য প্রয়োগ করে—‘‘তুই কে? কোন সাহসে, বিনা অনুমতিতে আমার গৃহে প্রবেশ করিয়াছিস? জানিস, এখনই তোকে কুকুর দিয়া খাওয়াইতে পারি?’’৮২ গোবিন্দগুপ্ত তার হবু জামাতা পাটালিপুত্রের অধীশ্বর কুমারগুপ্তকে কৌশল করে তার গৃহ থেকে নিয়ে যাওয়ার পর তার এক চর যখন পুনরায় অজ্ঞতাবশত গোবিন্দগুপ্তের আগমনের সংবাদ জ্ঞাপন করে তখন সম্মার্জনী হাতে গণিকাসুলভ স্বভাব ভঙ্গিতে সে সেই সংবাদদাতাকে পীড়ন করে বলতে থাকে—‘‘বড় সংবাদ লইয়া আসিয়াছিস, গোবিন্দগুপ্ত আসিয়াছে, গোবিন্দগুপ্ত আসিয়া যে আমার সর্বনাশ করিয়া গেল, এতক্ষণ কোথায় ছিলি—?’’৮৩

ইন্দ্রলেখার ভাবী জামাতাকে কৌশলে তার থেকে সরিয়ে নিয়েছে গোবিন্দগুপ্ত, তার সসাগরা আর্যপট্টের অধীশ্বরী হওয়ার স্বপ্ন কিছুতেই ভাঙতে দেবে না সে তাই পুনরায় প্রেমের ফাঁদ রচনা করে, উদ্দেশ্য ছলনা করে গোবিন্দগুপ্তকে হত্যা করা৷ তাই তারই একজন দাসীর হাতে পঁচিশ বছর পূর্বে গোবিন্দগুপ্তের দেওয়া প্রেমের চিহ্নস্বরূপ রাজনামাঙ্কিত অঙ্গুরী দিয়ে দাসীকে পাঠায় তাকে আমন্ত্রণ জানাতে৷ সেই সাক্ষাতে রাজী হয় গোবিন্দগুপ্ত৷ বিশবছর পূর্বেকার সেই সংকেতস্থানে উভয়ে মিলিত হয়৷ তাকে দেখামাত্রই কপট অনুশোচনায় নয়নবারিতে ভেসে গিয়ে ইন্দ্রলেখা বলতে থাকে—‘‘মহারাজপুত্র মার্জনা কর৷… সত্যই,—সত্যই—দেখিব বলিয়া—আসিতে অনুরোধ করিয়াছিলাম; মহারাজ-পুত্র—তুমি—এত নিষ্ঠুর,—যদি অপরাধ করিয়া—থাকি—মার্জনা করিও৷—’’৮৪ তার চোখের জল দেখেও মন গলে না গোবিন্দগুপ্তর৷ বরং তার গণিকাসুলভ অভিনয় দক্ষতা, বারবনিতাসুলভ অভীষ্ট পুরুষকে ছেড়ে পরপুরুষের হস্ত ধরে পলায়ন করা, প্রেমিককে হত্যার প্রচেষ্টা ইত্যাদি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে তিরস্কার করলে তাতে ইন্দ্রলেখার মন সামান্যতম বিচলিতও হয় না৷ বরং অবলীলাক্রমে সে চালিয়ে যায় তার প্রেমাভিনয়৷ গোবিন্দগুপ্তের সব কথা অবনত মস্তকে শুনতে শুনতে চোখের জলে গাল ভাসিয়ে দেয়৷ তারপর বলে—‘‘মহারাজপুত্র, যৌবনে যে অপরাধ করিয়াছি—আজীবন তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিতেছি, ইচ্ছা করিয়া রাজ্যসম্পদ জলাঞ্জলি দিয়াছি৷ আমার বহু অনুরোধ রক্ষা করিয়াছ একটি অনুরোধ রক্ষা কর৷ এই শেষ অনুরোধ, আর একবার তেমন করিয়া তোমার মুখখানি দেখিব৷’’৮৫ ইন্দ্রলেখার সুনিপুণ অভিনয় দক্ষতা মুহূর্তের মধ্যে বিচলিত করে গোবিন্দগুপ্তকে৷ সুযোগ বুঝেই ইন্দ্রলেখা তার হস্তধারণ করে কাছে দাঁড়াতেই গোবিন্দগুপ্ত বিচলিত হয়ে যায়৷ কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে তিরস্কার করলে ইন্দ্রলেখা শেষবারের জন্য একবার তার আলিঙ্গন প্রার্থনা করে৷ অঙ্গুরীয় ফিরিয়ে দিলে আলিঙ্গন পাবে শর্ত রাখে গোবিন্দগুপ্ত৷ ইন্দ্রলেখার উদ্দেশ্য আলিঙ্গন মুহূর্তে ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করা৷ শর্তে রাজী হয়ে আংটি ফিরিয়ে দিয়ে সে আলিঙ্গনাবস্থায় কন্ঠে ছুরিকাঘাত করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে বন্দিনী হয়৷ সঙ্গে বন্দি হয় তার সঙ্গে সহায়তাকারী মহাবিহারস্বামী হরিবল৷

ইন্দ্রলেখা ছলনাময়ী৷ সে তার বুদ্ধির জোরে ছলনা করে সহস্র সুবর্ণ দীনার-এর বিনিময়ে রক্ষীদের বশ করে হরিবলকে নিয়ে গবাক্ষপথে পলায়ন করে৷ রক্ষীদের সম্মতিতে বুদ্ধি করেই তাদের হাত পা বেঁধে রেখে যায় যাতে রক্ষীদ্বয়ের উপর তাদের পলায়নের দায় না পড়ে৷ অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায় গবাক্ষ দিয়ে জল পথে উপপতি চন্দ্রসেনের নৌকায় বসে তারা পরামর্শ করে সন্ন্যাসীবেশে দিন কাটানোর জন্য৷ হরিবল তাকে ভিক্ষুসাজার পরামর্শ দিলে অত্যন্ত বিচক্ষণতায় সে জানায়—‘‘মহাবীরস্বামী হরিবল পলায়ন করিয়াছে শুনিলে কৃষ্ণগুপ্ত নগরের সমস্ত ভীক্ষু বন্দী করিবে৷ তাহা হইবে না, ভাগবত সন্ন্যাসী সাজিতে হইবে৷’’৮৬ চন্দ্রসেন তাদের জন্য সন্ন্যাসীবেশ আনতে গেলে ইন্দ্রলেখা হরিবল আবার বিপদের সম্মুখীন হয়৷ ততক্ষণে তাদের পলায়নের খবর চারিদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেছে৷ মহাপ্রতিহারের সেনারা তাদের অন্বেষণে তাদের দিকেই উল্কার উজ্জ্বল আলো নিয়ে এগিয়ে আসছে৷ মহাবিহারস্বামী হরিবল নিশ্চিত মৃত্যুর সম্ভাবনায় কাঁপতে থাকলে গণিকার উপস্থিত বুদ্ধিতেই সে যাত্রায় তারা রক্ষা পায়৷ সৈনিকদের আসতে দেখেই ইন্দ্রলেখা হরিবলের হাত ধরে সমুখের প্রাচীন পুষ্করিণীর হিমশীতল জলে নেমে শ্যাওলা সংগ্রহ করে উভয়ের মাথা আচ্ছাদিত করে জলের মধ্যভাগে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ সেনারা সম্মুখে এসেও তাদের উপস্থিতি টের পায় না৷ তারা অধরাই থেকে যায়৷ অবশেষে সন্ন্যাসীবেশে সকলের চোখের সামনেই বসবাস করতে থাকে৷ কেউ চিনতে পারে না৷

কুমারগুপ্তকে কিছুতেই নাগালের মধ্যে না পেয়ে ইন্দ্রলেখা মরিয়া হয়ে ওঠে৷ এবারে সে সহায়তা নেয় মন্ত্রতন্ত্রের৷ বশীকরণের মন্ত্র দিয়ে তার মেয়ের প্রতি মহারাজকে অনুরক্ত করতে বদ্ধপরিকর হয়৷ ইন্দ্রলেখা, হরিবল ও চন্দ্রসেন তিনজনে উপস্থিত হয় মহারানি পট্টমহাদেবীর সম্মুখে৷ তার সামনে গিয়ে বলে যে তারা বিষয়-বাসনাত্যাগী সন্ন্যাসী, ধন-সম্পদের প্রয়োজন রাখে না৷ গণনা করে জানতে পেরেছে যে সম্প্রতি সমুদ্রগুপ্তের বংশের মহাদুঃসময় উপস্থিত৷ আর তা নিবারণের জন্য মহারানির মাথার একটি কেশ দিয়ে যজ্ঞ করতে হবে৷ বংশের মঙ্গল কামনায় মহারানি তৎক্ষনাৎ তার একটি কেশ তাদের হাতে দিয়ে দিলে তারা অভিষ্ট সিদ্ধ হতেই দ্রুতপদে প্রস্থান করে৷ পরে জানা যায় তারা সেই কেশ দিয়ে মারণ যজ্ঞ করবে; তাতে মহারানির মৃত্যু হবে, ইন্দ্রলেখার কন্যা পট্টমহাদেবী হবে এবং গুপ্তবংশ নির্মূল হবে৷

ইন্দ্রলেখা তার মেয়ের প্রতি মহারাজকে বশীভূত করতে দ্বারস্থ হয় কাপালিকের৷ অমাবশ্যার ঘোর অন্ধকারে অশোক গাছের তলে যজ্ঞ সমাপন করে কাচের পাত্রে গাছের লতাবিশেষের রস পান করায় মেয়েকে৷ তারপর কাপালিক তাকে বলে—‘‘যা, তোর কন্যার অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে৷ এখন হইতে উহার নয়ন বন্ধন করিয়া রাখ, যাহাকে তোর কন্যা কামনা করিয়াছে, তাহাকে দেখিতে পাইলে দূর হইতে নয়নের বন্ধন মোচন করিয়া দিস৷’’৮৭ তারপর পুনর্বার মন্ত্রপাঠ ও যজ্ঞানুষ্ঠান করে মন্ত্রপুত অর্ধদগ্ধ জবাফুল ইন্দ্রলেখার কন্যার হাতে দেয় বশীকরণের জন্য৷ ইন্দ্রলেখার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়৷ কুমারগুপ্ত তার কন্যাকে বিবাহ করে৷ ইন্দ্রলেখা তার দুষ্টবুদ্ধি খাটিয়ে গোবিন্দগুপ্তের বাধা কাটিয়ে চরম আত্মপ্রসাদে যখন উপপতি চন্দ্রসেনকে জানায় যে তার বুদ্ধি বেশি না সেই বুড়োশেয়ালের বুদ্ধি বেশি তখন তার সম্পর্কে চন্দ্রসেনের অভিমত তার চরিত্রকে আরও বেশি করে ফুটিয়ে তোলে৷ যেমন—‘‘ইন্দ্রলেখা, আমি ত চিরদিন বলিতেছি যে, তুমি যদি পুরুষ হইতে তাহা হইলে কুমারগুপ্তের কান ধরিয়া আর্যপট্ট হইতে নামাইয়া দিয়া সসাগরা ধরণীর অধীশ্বর হইতে?’’৮৮

কন্যাকে মহারানি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিলেও তার মনে শান্তি নেই৷ কারণ চারিদিকে শত্রু৷ মহামন্ত্রী, মহাপ্রতিহার, যুবরাজভট্টারক, মহাবলাধিকৃত কেউই তার কন্যাকে পট্টমহাদেবীরূপে মানতে পারেনি৷ মেয়ের জীবনকে নিষ্কন্টক করতে তাই সে আবার কাপালিকের দ্বারস্থ হয়৷ তাকে জানায় যে তার কন্যা এক রমণীর কারণে স্বামীসঙ্গলাভ করতে পারছে না৷ সেই কাপালিকের সামনে অগ্নি শপথ করে প্রতিজ্ঞা করতে হয়৷ আর যদি কেউ মিথ্যা বলে শপথ করে তাহলে জীবিতাবস্থায় শেয়াল কুকুর তাকে খণ্ড খণ্ড করবে৷ ইন্দ্রলেখা দেহব্যবসায়িনী নারী৷ সারাজীবন তার মিথ্যার সঙ্গে কারবার৷ তাই সন্ন্যাসীর কথায় তার হৃদয় কম্পিত হলেও সে তার বাম হাত দিয়ে অগ্নিকুণ্ড স্পর্শ করে, শপথ করে—‘‘অগ্নিদেবতা স্পর্শ করিয়া কহিতেছি, অনন্তার বাঞ্ছিতের ধর্মপত্নী কলহপ্রিয়া ও ক্রুরস্বভাবা, সে অনন্তাকে হত্যা করিতে চাহে৷’’৮৯ কিন্তু পরক্ষণেই ইন্দ্রলেখা ভয়ে অস্থির সেখান থেকে পলায়ন করে তার মনুষ্যসুলভ স্বাভাবিকতায়, কারণ সে মিথ্যা শপথ করেছে৷ গণিকার পেশার মিথ্যা বলা একটা অঙ্গ৷ সেই প্রবণতায় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অগ্নিকুণ্ডে হাত রেখে মিথ্যা বলতেও তার বাধে না৷ কিন্তু তার মনুষ্যপ্রকৃতি তাকে ভীত করে তোলে৷

ইন্দ্রলেখা প্রথম জীবনে নর্তকী ছিল৷ পরে দেহব্যবসা তার সঙ্গে যুক্ত হয়৷ আজীবন সে রাজ্যের উৎসব অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করে রাজপুরুষদের মনোরঞ্জন করে এসেছে৷ সেই ইন্দ্রলেখাই যখন মেয়েকে সামনে রেখে দণ্ডমুণ্ডের কর্তৃ হয়ে পূর্বোক্ত রাজঅমাত্যদের অপমান করতে থাকে তখন মহামন্ত্রী দামোদর শর্মা তাকে কঠোর ব্যঙ্গোক্তিতে বিদ্ধ করে বলে—‘‘ইন্দ্রলেখে, অগ্রসর হও, তোমার জয় আমার পরাজয়৷ সম্রাট তোমার, সাম্রাজ্য তোমার, তুমি সম্রাটের শিরে আসিয়া উপবেশন কর৷ তোরণে দাঁড়াইয়া আছ কেন?’’৯০ ইন্দ্রলেখা খল হোক, কুমতলবি হোক; বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের তীব্র দৃষ্টি সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব নয়৷ সে নিমেষেই সেখান থেকে পলায়ন করে৷

অনন্তাকে পুত্তলিবৎ বৃদ্ধ রাজার পাশে পট্টমহাদেবী করে বসিয়েছে ইন্দ্রলেখা, সঙ্গে সহায়তা করেছে হরিবল৷ অনন্তার রাজকার্য চালানোর ক্ষমতা নেই, সে মিথ্যা আক্রোশের প্রতিশোধ নিয়ে রাজ্যের সর্বনাশে বদ্ধপরিকর৷ ইন্দ্রলেখা সে ভাবনায় ভাবিত৷ হরিবলের সাথে পরামর্শ করে সে শুনতে পায় হরিবল গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধ্বংস সাধনে দৃঢ়সংকল্প তখন তার মতো ছলনাময়ী নারীও তার আশৈশব কাটানো সেই রাজ্য ধ্বংস করতে সহমত পোষণ করতে পারে না৷ সে আক্ষেপ করে বলে—‘‘প্রাচীন বিশ্ববিখ্যাত গুপ্তসাম্রাজ্য এমন করিয়া নষ্ট করিব?’’৯১ সে গুপ্তসাম্রাজ্যের অধীশ্বরী হতে চায় কিন্তু তা সাম্রাজ্যের বিনাশ সাধন করে নয় আর হরিবল হিন্দুধর্মের সম্পূর্ণ বিনাশ করে প্রতিষ্ঠা দিতে চায় বৌদ্ধ ধর্মের৷ তাই সে বলে যে বৈষ্ণব-অভিজাত সম্প্রদায়ের সর্বনাশ না করে সে ক্ষান্ত হবে না এবং যদি গুপ্তসাম্রাজ্য শেষ হয়ে যায় তাহলে যেমন করে গোবিন্দগুপ্তের বদলে ফল্গুযশ, ফল্গুযশের বদলে চন্দ্রসেন জুটেছে ইন্দ্রলেখার তেমন করে অনন্তার নতুন নতুন স্বামী জুটিয়ে দেবে৷ তখন ইন্দ্রলেখার কথায় ফুটে উঠে মাতৃহৃদয়ের সহজসরল আক্ষেপবাণী—‘‘আমি যাহা করিয়াছি তাহা করিয়াছি, অনন্তাকে যেন আর তাহা করিতে না হয়৷’’৯২ ইন্দ্রলেখা নিজে গণিকা৷ দেহব্যবসার মধ্যে দিয়ে জীবনকে চালিত করেছে৷ অনন্তা তার গর্ভের সন্তান৷ তার মাতৃহৃদয় কোনোভাবেই চায় না যে তার মেয়ে পুরুষের পর পুরুষের অঙ্কশায়িনী হোক৷ সে চায় তার মেয়ে পতিব্রতা হয়ে জীবন অতিবাহিত করুক৷ তার এই বাসনাই সমস্ত খলতাকে দূরে সরিয়ে তাকে মহানতায় পর্যবসিত করে৷ এই আক্ষেপ বাণী থেকেই বেড়িয়ে আসে হরিবলের প্রতি প্রবল ঘৃণা৷—‘‘দেখ হরিবল, আমি সামান্য গণিকা, বহু পাপ করিয়াছি, বহু মহাপাতকী দেখিয়াছ কিন্তু তোমার ন্যায় দেশদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী, মহাপাতকী কখনও দেখি নাই৷ ত্রিকালে ত্রিভুবন তোমার যশোগান করিবে না, তোমার নামে নিষ্ঠীবন পরিত্যাগ করিবে৷ তুমি অনায়াসে স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বিশাল আর্যাবর্ত, বিস্তৃত গুপ্তসাম্রাজ্য, পবিত্র পিতৃভূমি বর্বর, হূণের হস্তে তুলিয়া দিতে চাও, নরকেও তোমার স্থান হইবে না৷’’৯৩

ইন্দ্রলেখার সহায়তায় অনন্তার পুত্রসন্তান জন্ম নিয়েছে৷ সে চায় তার কন্যা, দৌহিত্র নিষ্কন্টক জীবন অতিবাহিত করুক৷ তাই সখি মদনিকার কাছে প্রতিজ্ঞা করে—‘‘হয় অনন্তার কন্টক দূর করিব, না হয় মরিব৷’’৯৪ হরিবলের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে কুমারগুপ্তের জ্যেষ্ঠপুত্র স্কন্দগুপ্তকে হত্যা করার জন্য৷ কন্যা, বৃদ্ধজামাতা রাজ্য পরিচালনায় অপারগ হলে দেখা যায় রাজা-রানির দুটি সিংহাসনের স্থানে চারটি সিংহাসন স্থাপন করে রাজা-রানি-ইন্দ্রলেখা-মদনিকা রাজ্য পরিচালনা করতে শুরু করে৷ কিন্তু ক্রমে দেবধর-অমিয়া অপমানিত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে রাজ-অমাত্যদের সকলের প্ররোচনায় সম্বিত ফিরে আসে বৃদ্ধরাজা কুমার গুপ্তের৷ দামোদর শর্মা তাকে সবিস্তারে জানায় যে মহারাজাধিরাজ মহানায়ক চন্দ্রধরের পুত্র, মহানায়ক গুল্মাধিকৃত দেবধর পাটলীপুত্রের প্রকাশ্য রাজপথে মদনিকার অশিষ্ট আচরণের জন্য তাকে অপমান করায় গণিকার কন্যা অনন্তা পট্টমহাদেবীর অধিকার বলে নিদ্রিত সম্রাটের অনুমতির অপেক্ষা না করে মহামুদ্রানামাঙ্কিত আদেশপত্র প্রেরণ করে দেবধরকে বন্দি করে বিচার করার জন্য৷ সেই অপমানেই দেবধর প্রাণত্যাগ করে৷ মহারাজ কুমারগুপ্ত সব শুনে বিচার করতে না পেরে লজ্জিত হয়ে সিংহাসন ছেড়ে পালিয়ে যায়৷ তখন বারোজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বিচার করে মূল অপরাধীদের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন৷ অবশেষে অমিয়া-দেবধরের শব সৎকার করতে গিয়ে দেখা হয় সেই কাপালিকের৷ তার মুখ থেকে সকলে জানতে পারে গুপ্তকুলধ্বংসের প্রধান তিনজন কথা৷ যথা—ইন্দ্রলেখা, হরিবল ও চন্দ্রসেন৷ নির্মম শাস্তি পায় ইন্দ্রলেখা৷ ‘‘কাপালিকরচিত চিতার উপরে শৃঙ্খলাবদ্ধ ইন্দ্রলেখা ও চন্দ্রসেনকে স্থাপিত করিয়া, তাহাদিগের মস্তকে নরকপালের মুকুট ও গলদেশে নর-অস্থির মাল্য দিয়া, বৃদ্ধ কাপালিক স্বয়ং তাহাতে অগ্নিসংযোগ করিল, শতশত কলস ঘৃত সংযোগে চিতা জ্বলিয়া উঠিল৷ বিট ও প্রৌঢ়া গণিকার আর্তনাদে গগন বিদীর্ণ হইল৷’’৯৫ এভাবে ইন্দ্রলেখা তার কৃতকর্মের জন্য চরম শাস্তি ভোগ করে৷

অনন্তা :

অনন্তা ইন্দ্রলেখার কন্যা৷ উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ে জানা যায় যে বৃদ্ধ মহারাজা কুমারগুপ্ত কোনো গণিকা কন্যার পাণিগ্রহণ করতে চলেছে৷ বৃদ্ধ মন্ত্রী তাই বলেন—‘‘কল্য নর্তকী ইন্দ্রলেখার কন্যার সহিত চন্দ্রগুপ্তের পুত্র সমুদ্রগুপ্তের পৌত্র পরমেশ্বর পরমবৈষ্ণব পরমমাহেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ শ্রীমৎ কুমারগুপ্তের বিবাহ হইবে৷’’৯৬ কিন্তু গণিকাদের সমাজে সম্মান কোথায়৷ মহারাজ অন্য কোনো নারীকে বিবাহ করতে চাইলে কোনো অসুবিধা হত না কিন্তু যেহেতু সে গণিকা কন্যা তাই সেখানে সকলের বিরোধিতা৷ তাই বৃদ্ধ মন্ত্রী বিকট হাস্যে ব্যঙ্গ করে রামগুপ্তকে বলে যে—‘‘রাম, উৎসবের জন্য প্রস্তুত হইয়াছ ত? কল্য যুবরাজ-ভট্টারক স্কন্দগুপ্তের মাতা সিংহাসনচ্যুতা হইবেন, নর্তকী ইন্দ্রলেখা—ফল্গুযশ নটের কন্যা তাহাতে উপবেশন করিবে৷ কল্য গুপ্তসাম্রাজ্যের অভিজাতসম্প্রদায় তাহার সম্মুখে নতজানু হইবে৷ তুমি না কুমারগুপ্তের জ্ঞাতি, প্রথম চন্দ্রগুপ্তের বংশজাত?’’৯৭

অনন্তা হরিবলের প্ররোচনায় তার অসামান্য রূপ-যৌবনের দ্যুতি নিয়ে মায়ের নৃত্যপোলক্ষে তার সঙ্গে যখন বিলাসগৃহে উপস্থিত হয়েছিল সেদিন থেকেই তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল কুমারগুপ্ত৷ যেভাবেই হোক অনন্তাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিল স্বয়ং পাটলিপুত্রের বৃদ্ধ রাজাধিরাজ৷ রাজার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মায়ের প্ররোচনায় অনন্তা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল সে যদি রাজ্যের পাটরানি হয় এবং তার পুত্র যদি রাজ্যের সিংহাসনের অধিকারী হয় তাহলেই মহারাজাকে অনুগৃহীত করবে৷ নারীর নবযৌবনের মোহে পড়ে সমস্ত মেনে নিয়েছিল মহারাজ৷ কিন্তু গোবিন্দগুপ্তের কৌশলে কুমারগুপ্ত কিছুটা স্থির হয়ে গেলে ইন্দ্রলেখা বশীকরণের ফুল দিয়ে ভুবনমোহিনী বেশে মেয়েকে সাজিয়ে উদ্যান-তোরণে রথে উপবিষ্ট বৃদ্ধ রাজার সম্মুখে প্রেরণ করে৷ আবেশ বিহ্বল অনন্তা ছুটে গিয়ে লম্ফ দিয়ে রথাহোরণ করে তার কন্ঠলগ্ন হয়ে নিজেকে প্রকাশ করে৷ তার চূর্ণ কুন্তলের স্পর্শ, অঙ্গরাগ-গন্ধলেপ ও কেশতৈলের সুগন্ধ এবং সুকোমল স্পর্শ পুনরায় মহারাজকে বিহ্বল করে তোলে৷ অনন্তার কপট অশ্রুপাত, চুম্বনে সংযম হারিয়ে মহারাজ প্রতিজ্ঞা করে তাকে কোনোদিনও ত্যাগ করবে না, পট্টমহাদেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেবে৷ শূন্য সভামন্ডপে অনন্তা কুমারগুপ্তের হাত ধরে অবশেষে পট্টমহাদেবীপদে অভিষিক্ত হয়৷ সিংহাসনে বসেই সে তার পিতার অপমানের কথা শ্রবণ করে গুপ্তবংশের রীতি-নীতির তোয়াক্কা না করে মহাদণ্ডনায়ক রামগুপ্ত এবং মহাপ্রতীহার কৃষ্ণগুপ্তের প্রতি দণ্ড জারি করে৷ দণ্ড পূর্ণ করতে কিছু বাধ্যবাধকতার কথা কুমারগুপ্ত তাকে জানালে স্বার্থপর কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো সে রাজাকে জানায়—‘‘প্রজা অসন্তুষ্ট হইবে তাহাতে কি আসে যায়? তোমার যাহা ইচ্ছা হইবে তাহা যদি করিতে না পার, তবে তুমি কিসের সম্রাট?’’৯৮ এখানে এই উক্তির মধ্যে দিয়ে অনন্তার বালিকাসুলভ চপল মনোভঙ্গিটিও দৃষ্টিগোচর হয়৷

অনন্তা পট্টমহাদেবী হয়ে প্রবল দম্ভে নিজেকে হারিয়ে ফেলে৷ বৃদ্ধ মন্ত্রী দামোদর শর্মাকে প্রকাশ্য সভায় নিজের পদমর্যাদা বুঝিয়ে অভিবাদন না করার জন্য চরম অপমান করে৷ পরিণামে দামোদর শর্মা তাকে বেশ্যাকন্যা বলে পট্টমহাদেবীর অভিধা অমান্য করলে সে শিবনন্দীকে আদেশ দেয় তাকে বন্দি করার জন্য এবং মহারাজাকে বলে যে সে যদি মন্ত্রীকে বন্দির আদেশ না দেয় তাহলে সে আত্মহত্যা করবে৷ কুমার গুপ্ত তরুণী ভার্যার বিরহের চেয়ে মন্ত্রীর অপমানই শ্রেয়ষ্কর মনে করে৷ অনন্তার ক্ষমতার বড়াই সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে না৷ তার কুটচালে অর্থাৎ মদনিকাকে অপমান করার শাস্তি স্বরূপ রাজার অজান্তে রাজার নামাঙ্কিত আদেশনামা পেশ করে দেবধরকে অপমান করায় দেবধর তার ভাবী স্ত্রী অমিয়াকে নিয়ে আত্মহত্যা করলে অসন্তোষ আরও তীব্র হয়ে ওঠে৷ এই ধৃষ্টতার সীমা আরও চূড়ান্ত রূপ নেয় যখন পাটলিপুত্রের রাজসভায় একযোগে চারটি সিংহাসন স্থাপন করা হয় রাজাকে বসিয়ে তিনজন গণিকা দ্বারা রাজ্য পরিচালনার জন্য৷ সকলের বিদ্রোহে কুমারগুপ্ত সিংহসন ছেড়ে পলায়ন করলে বারোজন উচ্চপদস্থ রাজঅমাত্যরা মিলে অপরাধের বিচার করে৷ গুপ্তকুল ধংসকারিণী বারবনিতাকন্যা অনন্তা ভয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়ে৷ চারিদিকের গভীর ষড়যন্ত্রে ভীত অনন্তা তাই চেতনা প্রাপ্ত হয়েই যুবরাজের দিকে অঙ্গুলি সঞ্চালন করে বলে—‘‘উহাকে দূর কর, দূর কর৷ মাতাকে হত্যা করিয়াছে, এখন আমাকে হত্যা করিবে৷’’৯৯ ভীতসন্ত্রস্তা এই গণিকাকন্যা নিজের ভয়াবহ পরিণতি আসন্ন বুঝে বার বার অনুরোধ করে মহারাজের মনোযোগ আশ্রয় করে নিজের আসনটি পুনরায় মজবুত করে নেয়৷ পরে কুমারগুপ্ত স্বেচ্ছায় বিচারক্ষম হয়ে সিংহাসন থেকে পালিয়ে গেলে এবং তার সহায়কারী মাতা, মাতৃসহচরী মদনিকা, পিতা চন্দ্রসেন, সকলে চরম শাস্তি লাভ করলে তাকে বন্দি করা হয়৷ অনন্তা তার শিশুপুত্র পুরগুপ্ত সহ বন্দিনী হয়ে থাকে৷ পরবর্তীকালে তার পুত্র পুরগুপ্তই মগধের সিংহাসনে আসীন হয়৷

মদনিকা :

মদনিকা ইন্দ্রলেখার সখি৷ ইন্দ্রলেখার কন্যা অনন্তা পাটলিপুত্রের পট্টমহাদেবীরূপে অধিষ্ঠিত হলে মদনিকা পাটলিপুত্রের মহানায়িকার মর্যাদা পায়৷ মদনিকার পরিচয় প্রকাশ করতে গিয়ে স্বয়ং রচনাকার বলেছেন—‘‘বারবনিতা মদনিকা যে কাহার কন্যা তাহা তাহার গর্ভধারিণী পর্যন্ত অবগত ছিল না৷’’১০০ পাটলিপুত্রে অনন্তা ও ইন্দ্রলেখার রাজত্বে গণিকাদের মহাসম্মান৷ মদনিকা প্রাসাদের শিবিকায় চলাফেরা করে৷ মদনিকা রাজপথের সন্ধিস্থলে শিবিকা দাঁড় করিয়ে তার পূর্ব পরিচিত পানওয়ালীর সঙ্গে রহস্যলাপে মগ্ন হলে পথচলতি মানুষেরা প্রবল সমস্যার সম্মুখীন হয়৷ এমন স্থানে সেই শিবিকা দাঁড়ানো যাকে অতিক্রম করা কোনো কিছুর পক্ষেই সম্ভব না৷ তাই মহানায়ক গুল্মাধিকৃত দেবধর দেখে যে বহু রথ, অশ্ব, গজ, উষ্ট্র ও শিবিকা গতিরোধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে৷ মদনিকাকে সেখান থেকে শিবিকা সরাতে বললে মদিরাবিহ্বলা সেই বারবনিতা অশিষ্ট বাক্য প্রয়োগ করে দেবধরকে উদ্দেশ্য করে—‘‘তুই কি মনে ভাবিয়াছিস? তোর কি প্রাণের ভয় নাই? জানিস তোকে কুক্কুর দিয়া খাওয়াইতে পারি৷’’১০১ দেবধরের কোন শিষ্ট বাক্যই তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না৷ অবশেষে গণিকা সম্বোধন করে তাকে সাবধান হতে বললে মহাকলরবে সে তাকে আক্রমন করে—‘‘তোর মাতা বেশ্যা, পিতামহী বেশ্যা, প্রপিতামহী বেশ্যা৷ আমি গণিকা৷’’১০২ মদনিকা তার উগ্রস্বভাবের কারণে আক্রান্ত হয় দেবধর দ্বারা৷ কুমার হর্ষগুপ্ত তাকে শিবিকায় বন্ধন করে কশাঘাতে জর্জরিত করে তার অন্যায়ের শাস্তি দেয়৷ সেখানে শেষ নয়; তার কোপানলে দগ্ধ হয়ে যায় দেবধর-অমিয়ার নিষ্পাপ জীবন৷ মদনিকা তার সহচরীর সহায়তায় সিংহাসনেও উপবিষ্ট হয়৷

মদনিকার পরিণাম ভয়াবহ৷ তার শাস্তি কুকুরের ভক্ষ হয়ে৷ উগ্রস্বভাব, দেহব্যবসায়ী মদনিকাকে লেখক স্নেহমায়া বিবর্জিত দানবীরূপে উপন্যাসে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন৷

এই তিনজন গণিকা চরিত্রের বাইরেও রাজবাড়ির নানা উৎসব অনুষ্ঠানে নৃত্য-গীত, মদ্য পরিবেশনের জন্য অনেক নামহীনা গণিকার উল্লেখ আছে৷ যেমন কুমারগুপ্তের ভাই ও ছেলে হুণ আক্রমণ প্রতিরোধ করে জয়ী হয়ে ফিরে এলে বিজয়োৎসবে রয়েছে গণিকা বিলাসের চিত্র৷—‘‘সন্ধ্যা হইল; মহোদয়-নগরে অসংখ্য দীপমালা জ্বলিয়া উঠিল, তরুণী পাটলিপুত্রিকা গণিকাগণ পথে পথে নৃত্য আরম্ভ করিয়া দিল৷’’১০৩

সম্রাটের উদ্যান-বিলাসেও থাকে গণিকার সমাবেশ৷ জনৈক সেনার কথায়—‘‘সম্রাট উদ্যান-বিলাসে আসিলে তরুণী নর্তকী আসে, সুন্দরী গায়িকা আসে…৷’’১০৪

গণিকারা সমাজে বিলাস-বৈভবের প্রধান মাধ্যম ছিল৷ নগরের শ্রেষ্ঠ নর্তকীরা প্রচুর ধনসম্পদের অধীশ্বরী হতো৷ নগরের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী এমন কি পট্টমহাদেবীর চেয়েও বেশি ধনরত্ন তাদের থাকতো৷ তবে গণিকাদের সম্মান ছিল না৷ তারা আনন্দ দিতে পারতো বিনোদন করতে পারতো কিন্তু কারও বধূ হয়ে সংসার জীবনে প্রবেশ করতে পারতো না৷

খ. অসীম :

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অসীম’ (১৯২৪ প্রথম প্রকাশ ভারতবর্ষ পত্রিকায়) ঐতিহাসিক উপন্যাস৷ এখানে বর্ণিত হয়েছে হতভাগ্য ফররুখসিয়রের শোচনীয় পরিণামের মর্মান্তিক চিত্র৷ এটি ঐতিহাসিক হলেও এর বেশিরভাগ আখ্যানই কল্পনা এবং উৎকল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত৷ উপন্যাসে গণিকাচরিত্র হিসেবে মনিয়াবাই, সরস্বতী বৈষ্ণবী, মনিয়ার মাতা মতিয়া বিশেষভাবে উল্লেখ্য৷

মতিয়া :

মতিয়া দেহজীবী কসবি৷ উপন্যাসের বিংশ পরিচ্ছেদের ‘নর্তকী’ অধ্যায়ে তার আবির্ভাব৷ অধ্যায়ের সূচনাতেই লেখক সুন্দরভাবে তার পরিচয়কে ব্যক্ত করেছেন৷ যথা—‘‘পাটনা সহরের এক প্রান্তে ভদ্র-পল্লীর মধ্যে এক বৃদ্ধা গণিকা বাস করিত৷ তাহার নাম মতিয়া৷ সে গণিকা হইলেও, পল্লীর সকলেই তাহার উপর সন্তুষ্ট ছিল৷ কারণ তাহার গৃহে অসদাচারণ দেখিতে পাওয়া যাইত না৷ যৌবনান্ত হইবার পূর্বেই মতিয়া গণিকা-বৃত্তি পরিত্যাগ করিয়াছিল’’১০৫ তাহলে দেখা যাচ্ছে গণিকাবৃত্তি ছেড়ে দেওয়ার ফলে ভদ্রসমাজে তাকে নিয়ে কোনো আশঙ্কা না থাকায় সে সকলের সঙ্গে ভদ্র পল্লীতেই বাস করতে পারতো৷ বিগতযৌবনা এই বারাঙ্গনার জীবনধারণের প্রধান মাধ্যম ছিল মুজরা কিন্তু সবসময় মুজরা জুটতো না ফলে সেই অবসর সময়ে নিজের জীবন নির্বাহের জন্য নতুন গণিকাদের নৃত্যগীত শিক্ষা দিত৷ এভাবে চলতে চলতে পাটনার অধিবাসীগণ দেহপসারিণী মতিয়াকে ভুলে ওস্তাদনী মতিয়াতে অভ্যস্ত হয়ে যায়৷ মতিয়ার যৌবন অস্তমিত হওয়ার আগেই তার একজন প্রণয়ী তার প্রেমে মজে তারই গৃহে আশ্রয় নেয়৷ সে সকলের কাছে সেই আহদী পাঠান প্রেমিককে তার নেকা করা স্বামী বলে পরিচয় দিলেও সেই পুরুষটি কখনো তার সেই দাবিকে সমর্থন করতো না কিন্তু কখনো তাকে ছেড়েও যায়নি৷ তার সঙ্গে থাকাকালীন মতিয়ার এক কন্যা সন্তান জন্ম নেয়৷ যার নাম রাখা হয় মনিয়া৷ তার সেই কন্যা অপূর্বসুন্দরী৷ তাকে নিয়ে অনেক আশা-স্বপ্ন মায়ের৷ সে নিজে একসময় গণিকাবৃত্তি অবলম্বন করে জীবন অতিবাহিত করেছে, পরে যৌবন গত হলে পুরুষসমাজের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ায় তার সেই পসার আর নেই৷ তাই সে তার উত্তরসূরী করে তুলতে চায় আত্মজাকে৷ বহু যত্নে বহু পরিচর্যায় তাকে মানুষ করতে থাকে যাতে তার দ্বারা বিগতযৌবনের সমস্ত খামতিগুলোকে অনায়াসে ভরিয়ে নিতে পারে৷ সঙ্গীতশাস্ত্রে পারদর্শিনী মতিয়া স্বহস্তে কন্যাকে নৃত্যগীত শিক্ষা দিয়ে সুর ও ছন্দের অপরিমিত উৎসমুখ অর্জনের গৌরব নিজকন্যার মস্তকে আরোপ করেছে৷ আঠারোবছর বয়সি মনিয়া মায়ের পরিচর্যায় এবং ঈশ্বরপ্রদত্ত অশেষ রূপরাশি ও গুণাবলীর দ্বারা পাটনা নগরীর হৃদয়েশ্বরী হয়ে উঠেছে৷ তার যখন মুজরার বায়না আসে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে মা তা বিচার-বিবেচনা করে তবেই সে বায়না গ্রহণ করে মেয়েকে পাঠায়৷ মেয়েকে নিয়ে সর্বদা একটা সুখী ও সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন দেখে৷ মেয়েকে নিয়ে গড়া তার স্বপ্নসৌধে প্রবল আঘাত হানে সেই মেয়েই৷ মেয়ে গণিকাবৃত্তি ছেড়ে অসীম নামের এক যুবকের প্রেমে আত্মহারা হয়ে যায়৷ শাহাজাদার দরবারে মুজরা করতে গিয়ে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া কন্যার শোকে মুহ্যমান হয়ে মতিয়া নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়৷ পরে যখন তার সন্ধান মেলে তার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ককে অস্বীকার করে মেয়ে৷ মতিয়া চরম নৈরাশ্যে নিমজ্জিত হয়৷ আবার হঠাৎই যখন মেয়ে গৃহে ফিরে আসে তখন তার আর আনন্দ ধরে না৷ মেয়ের মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করেছে মতিয়া৷ তার মেয়ে পায়জামা ছেড়ে শাড়ি পড়েছে, সমস্ত অলংকার ত্যাগ করেছে৷ তবুও সে কিছু জিজ্ঞাসা করতে সাহস পায় না৷ মেয়ে ফিরে এসেছে এটাই তার শান্তি৷ মনিয়া আমিষ আহার পরিত্যাগ করে সহস্তে নিরামিষ রন্ধন করে নিরামিষ আহার করে৷ মা শুধু বিস্মিত হয়ে সেই দৃশ্য পর্যবেক্ষণই করে যায়৷ তারপর সন্ধ্যাবেলায় ফরীদ খাঁ মুজরার জন্য তাকে নিতে এলে সে যথাযোগ্য বেশভূষা করে চলে যায়৷ এ দৃশ্য দেখে চিন্তিতা মা হাফ ছেড়ে বাঁচে এবং পাড়ার দরগায় গিয়ে পীড়ের পূজা দিয়ে আসে ও কতকটা নিশ্চিন্ত হয়৷ এখানে মতিয়ার সহজসরল মাতৃরূপটি চিত্রিত হয়েছে৷ মতিয়া অসহায়৷ তার শেষ পারানির একমাত্র সম্বল মেয়ে মনিয়া৷ আর সেই মেয়ে তাদেরকে যখন অস্বীকার করেছিল তখন তার অন্ধকার জীবনের নিদারুণ ভবিষ্যতের চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল৷ সেই মেয়ে যখন পুনরায় গৃহে প্রত্যাবর্তন করে নিয়মিত মুজরা করতে থাকে তখন তার সাবধানী মানবাত্মা তাকে আর ঘাটাতে সাহস পায় না৷ নির্বিবাদে সব কিছু মেনে নিয়ে পীড়ের পূজা দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে৷ এখানে মাতৃহৃদয়ের আবেগ, মায়া, মমতা উৎকন্ঠা থেকে এক অসহায় সাবধানী মায়ের ভবিষ্যৎ চিন্তাই বেশি প্রকটিত হয়েছে৷ যা সব দিক থেকে বাস্তবসম্মত৷

মেয়ে ঘরে ফিরে এলেও ক্রমে ক্রমে তার আচরণ মতিয়াকে আবার চিন্তিত করে৷ অবশেষে মেয়ের খেয়ালিপনা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলে দিশেহারা মা কবিরাজ, হাকিম, রোজা, জ্যোতিষী, গণক, মুসলমান বুজরুক কারুরই দ্বারস্থ হওয়া বাকি রাখে না৷ হাকিম নাড়ী টিপে রোগ নির্ণয়ের কথা বলে, জ্যোতিষী গণকেরা বলে যে তার মেয়ের কোনো বিপদ নেই; অথচ মেয়ের ব্যবহার তা বলে না৷ জ্যোতিষীর মুখে শোনে সেও যেমন উপপতির সহবাসে জীবন কাটাচ্ছে বিবাহ না করেও তেমনি তার মেয়েরও কোনোদিন বিয়ে হবে না৷—‘‘যবনী তুমি কসবী৷ তোমার কন্যা সুগায়িকা হইবে; কিন্তু বেশ্যাবৃত্তি করিবে না৷’’১০৬ এই কথা শুনে মতিয়া অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে গিয়ে তাকে তিরস্কার করতে থাকে৷ কিন্তু তাকে তো মেয়ের বিষয়ে সমস্তটা জানতে হবে৷ তাই পুনরায় হাতখানা মেলে দেয় তার দিকে৷ বলে—‘‘আমার কন্যা রূপসী, সে সুগায়িকা; কিন্তু সম্প্রতি তাহাকে দানো পাইয়াছে; না হয় সে পাগল হইয়াছে৷ কিন্তু কি হইয়াছে বুঝিতে না পারিয়াই আমি তোমার নিকট আসিয়াছি৷’’১০৭ তারপরেও সকল বিষয়ে মেয়ের সুস্থতার বিষয়ে জ্যোতিষী অটল থাকলে মতিয়া আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না৷ চরম বিরক্তিসহকারে সে বলে—‘‘আরে পাগল, ঘরেই যদি ফিরিয়া যাইব, তবে তোর নিকট মরিতে আসিয়াছি কেন? মেয়ে আমার আপন মনে হাসে, আপন মনেই কাঁদে; বিড় বিড় করিয়া কি বলিতে থাকে, তাহার কিছুই বুঝিতে পারি না৷ জিজ্ঞাসা করিলে বলে, কৈ, কিছুই না৷ লোকে বলে উপদেবতা যাহাদিগকে আশ্রয় করে, তাহারা নাকি এইরকম আচরণ করিয়া থাকে৷’’১০৮ সেই জ্যোতিষীর মুখ থেকে যখন জানতে পারে যে তার মেয়ে একজন হিন্দু যুবকের প্রেমে পড়েছে, এবং সেই জন্য সে তার সকল উপদেশ অগ্রাহ্য করবে, কথামত বেশ্যাবৃত্তি করবে না তখন মতিয়ার মনে কন্যার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্নচিহ্ন উঁকি দেয়৷ সে তাকে বলে—‘‘সর্বনাশ! তবে আমার কি হইবে কাফের?’’১০৯ তাবিজ মাদুলি দিয়ে সে মেয়েকে বশে আনার চেষ্টা করে৷ একজন গণিকামাতার তার উপার্জনক্ষম মেয়ের পাগলামির দুশ্চিন্তা এবং ভবিষ্যতের খুন্নিবৃত্তির ভাবনা এই অংশে তার কথামত প্রতিভাত হয়েছে৷

পাটনার বিগতযৌবনা বাইজি মতিয়াকে এর পর দেখা যায় এক হাকিমের চিকিৎসালয়ে৷ হাকিম শহীদ উল্লাহ সেখানকার নানা অবৈধ চিকিৎসার শিরোমণি৷ তার চিকিৎসালয়ে তাই রোগীর ভিড় রাতের অন্ধকারে৷ মতিয়াও সেইমত রাতের আধাঁরে সেখানে উপস্থিত হয় মেয়ের চিকিৎসার জন্য৷ তার রূপগুণসম্পন্ন কন্যা স্ববৃত্তিতে আত্মনিয়োগ না করে নিজের খেয়ালে দিন কাটাচ্ছে৷ মেয়ের খামখেয়ালির চিকিৎসা করাতে সে মনিয়ার সকল লক্ষণ হাকিমকে ব্যক্ত করে—‘‘আমার বেটী তয়ফাওয়ালী; দেখিতে খুব সুন্দরী৷ তাহার এই প্রথম বয়স সুতরাং খোদার মর্জিতে বিলক্ষণ দু’পয়সা রোজগার হইত৷ বুড়া বয়সে আমার নসীব ফিরিয়া গিয়াছিল৷ হঠাৎ কোথা হইতে কি হইল, বেটী আমার এক কাফেরকে দেখিয়া পাগল হইয়া গেল৷ তাহাকে দেখিবা অবধি মুজরা করা ছাড়িয়া দিল; পাগলের মত পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইতে আরম্ভ করিল; অনুনয় বিনয় কিছুই শুনিল না৷ লোকে বলিল দানো পাইয়াছে৷ রোজা আসিয়া কত মন্ত্র বলিল; ওস্তাদ আসিয়া ঝাড়িল, তাবিজ পরাইল; কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না৷ আপনি ছাড়া পাটনা সহরের যত নামজাদা হাকিম, সকলকেই ডাকিয়া দেখাইয়াছি; কিন্তু কেহই বলিতে পারে নাই বেমারটা কি? এই একমাস হইল কোথায় চলিয়া গিয়াছিল, আজি সকালে ফিরিয়া আসিয়াছে৷ আমি সেইজন্য এখন আপনার নিকটে আসিয়াছি৷’’১১০ হাকিম সমস্ত শুনে দীর্ঘ্যসময়ব্যাপী সেবনের জন্য ঔষধ দিলে মতিয়া তার মূল্য শুনে ঘাবড়ে যায়৷ মেয়ের চিকিৎসার জন্য দিনের পর দিন অর্থ ব্যয় করতে করতে প্রায় নিঃশেষ সে৷ নিজের অস্তমিত যৌবনের স্তিমিত রশ্মির প্রভাবে তার রোজগারও তলানিতে৷ কিন্তু হাকিম সে কথা বুঝবে কেন! অগ্রিম কিছু অর্থের বিনিময়ে সে ঔষধ ক্রয় করে কিন্তু তার পরেও সমস্যামুক্ত হয় না সে কারণ তার কন্যা কিছুতেই ঔষধ সেবন করতে চায় না৷ তখন হাকিম একটা সুস্বাদু ঔষধ সরবতের সঙ্গে মিশিয়ে পান করানোর জন্য দিলে তা সেবন সংক্রান্ত নির্দেশ বুঝে নিয়ে মতিয়া প্রত্যাবর্তন করে৷ উপন্যাসটিতে যেখানে যেখানে মতিয়ার উপস্থিতি রয়েছে সেখানে সেখানেই তার মেয়ের জন্য, পেশাটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এবং ভবিষ্যতে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক সচ্ছলতা অবলম্বনের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার সম্বল সঞ্চয়ের জন্য দুশ্চিন্তা ফুটে উঠেছে৷ মতিয়া চরিত্রটি চরম অর্থলোভী এক চরিত্র যে মেয়ের আবেগ-অনুভূতির তত্ত্ব-তালাশ না করে তাকে দিয়ে বেশ্যাবৃত্তি করিয়ে উপার্জন করতে চায়৷ শঠতাও তার মধ্যে কম নেই৷ সে জিনের কথা বলে সুদর্শনকে গ্রেফতার করায়, হাকিম, জ্যোতিষীদের হাত দেখিয়ে পয়সা দিতে চায় না যেখানে যেখানে সে তার মেয়ের জন্য উৎকন্ঠিত-চিন্তিত সেখানেই সেখানেই তার ভবিষ্যৎ রোজগারের চিন্তা কাজ করেছে৷ অর্থাৎ ভবিষ্যতের অর্থের জোগানদার হিসেবে মেয়েকে সুস্থ রাখার, স্বপথে ফিরিয়ে আনার জন্যই সে যত্নবান হয়েছে৷ তার মায়া-মমতার কোনো গভীর বন্ধন সেখানে নেই৷ রূপবতী মেয়েকে পরম যত্নে গান নাচ শিখিয়েছে বিত্তবান সমাজে বেশ্যাবৃত্তির উপযুক্ত করে তোলার জন্য আর কিছু নয়৷ এদিক থেকে মতিয়া চরিত্রটি একটি সুবিধাবাদী চরিত্র হিসেবে পরিগণিত হয়েছে৷

মনিয়াবাই :

মনিয়াবাই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র৷ তাকে কেন্দ্র করে সমগ্র উপন্যাসের কাহিনি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে৷ মনিয়ার মায়ের কথা অনুসারে জানা যায় তার বয়স আঠারো বছর৷ সে তার সঙ্গীতমূর্ছনা, রূপ-যৌবন দিয়ে সবেমাত্র গণিকা জীবনে প্রবেশ করেছে৷ শাহাজাদার দরবারে মুজরা করতে গিয়ে ঘটনার বিক্ষেপে সংস্পর্শ লাভ করে উপন্যাসের নায়ক আদর্শবান যুবা অসীমের; সেই থেকে তার ভাবান্তর; সেই থেকে তার রূপান্তর৷ সে গণিকা মায়ের কন্যা৷ উপন্যাসে কোথাও তাকে সরাসরি দেহের দর হাকতে দেখা যায়নি কিন্তু বিভিন্ন সময়ে তার নিজের স্বীকারোক্তি, মায়ের উক্তির মধ্য দিয়ে তার পণ্যাঙ্গনা রূপটি প্রকটিত হয়েছে৷ আর গণিকা গর্ভজাত বলে সমগ্র উপন্যাসে তার যন্ত্রণার শেষ নেই৷ আবার এই বারবধূর কলুষিত পরিচয় দিয়েই সে অসাধ্য সাধনে সক্ষম হয়েছে৷ লেখক মনিয়ার পরিচয় উদ্ঘাটন করেছেন এইভাবে—‘‘মতিয়ার কন্যার নাম মনিয়া৷ মনিয়াকে দেখিলে কেহই বিশ্বাস করিতে পারিত না যে, সে গণিকার কন্যা; সকলেই কহিত, ‘‘গোময়ে পঙ্কজিনীর আবির্ভাব সম্ভব নহে৷’’ মতিয়া সঙ্গীত-শাস্ত্রে পারদর্শিনী ছিল; এবং সে অতি যত্নে কন্যাকে নৃত্য-গীত শিক্ষা দিয়াছিল৷ প্রথম যৌবনে রূপসী কলাবতী মনিয়া পাটনা নগরের সকলেরই প্রিয়পাত্রী হইয়া উঠিয়াছিল৷ যে সময়ের কথা বলিতেছি, সে সময়ে মনিয়া অষ্টাদশ বর্ষে পদার্পণ করিয়াছে; এবং মাত্র এক বৎসর মুজরা করিতে আরম্ভ করিয়াছে৷’’১১১

মায়ের যথার্থ উত্তরসূরী হওয়ার বা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি পারদর্শী হওয়ার কথা অনিন্দ্যসুন্দর মনিয়ার ছিল৷ তার কমনীয় সৌন্দর্যে, বিকশিত যৌবনশ্রীতে আর নিষ্কলুষ মনোবৃত্তিতে হঠাৎ নির্মল প্রেমের ছটা এসে লাগে৷ শাহাজাদার দরবারে মুজরা সেরে ফেরার সময় এক দুর্বৃত্তের কামোন্মত্ত আহ্বানে ভীতচকিতা হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে৷ কিন্তু মনিয়া যদি যৌনতার নিয়ত পীড়নে সুঅভ্যস্ত গণিকা হত তাহলে সেই কামাসক্ত পুরুষটির নির্লজ্জ আহ্বানে সে হেসে ফেলতো কিন্তু গণিকাপুত্রী হলেও তার সুন্দর দেহ তখনও কলুষিত হয়নি তাই সে না হেসে ভয়ে শিউড়ে ওঠে৷ ভয়ে ঘৃণায় আসন্ন বিপদের ভয়ঙ্করতাকে উপলব্ধি করতে পেরে যখন তার দুচোখ জলে প্লাবিত, তখন সেই দুরাত্মা তার রূপরাশির মোহে উন্মত্ত হয়ে তাকে বলপূর্বক হস্ত ধারণ করে অপহরণের চেষ্টা করলে মনিয়ার মুখে উচ্চারিত হয় কাতর অনুনয়—‘‘আমাকে ছাড়িয়া দাও, তুমি মেহেরবান, আল্লা তোমার মঙ্গল করিবেন৷ আমি কসবী নহি, আমাকে ছাড়িয়া দাও৷’’১১২ এক বারবনিতার কন্যার, এক পেশাদার বাইজির অনুনয় কর্ণে তোলার মতো মহানুভব কামান্ধ আফরাসিয়র খাঁ-এর নেই, তাই সে সুরাবিজরিত অবস্থায় মনিয়ার দুহাত চেপে ধরলে উপায়ন্তর না দেখে মনিয়া চিৎকার করে৷ সেই দুর্বৃত্তের হাত থেকে উদ্ধার পায় অসীমের কৃপায়৷ মনিয়া সসম্মানে তার তাবুতে স্থান পায়৷ অসীম অচিরেই তার অপাপবিদ্ধা নিষ্পাপ নারীহৃদয়ের রাজ-রাজেশ্বর হয়ে বসে৷ মনিয়ার নির্মল জীবনের প্রসঙ্গ তার অনুপস্থিতিতে পিতা গুলশের খাঁ ও তার বন্ধু রুস্তম দিল খাঁ এর কথপোকথনে উঠে এসেছে৷ গুলশের খাঁ মনিয়াকে চেনে তাই যখন শাহাজাদার দরবার থেকে মেয়ে ফিরে আসছে না দেখে আশঙ্কিত হয় তখন রুস্তম দিল খাঁ বলে—‘‘কসবীর কন্যা কসবী,—আশনাই করা যাহার পেশা, তাহার জন্য চোখের জল ফেলিলে কি হইবে? তাহার হয় ত মাশুক জুটিয়াছে; সে দুই দিন ফুর্তি করিতে সরিয়া পড়িয়াছে৷’’১১৩ গুলশের খাঁ বন্ধুর এ হেন কথার প্রতিবাদ করে যখন জানায় যে তার মেয়ে বেশ্যার মত চারিত্রিক গুণাবলীর নয় তখন গুলশের খাঁ তার কথাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলে—‘‘রাখ তোমার কথা, কসবীর কন্যা, সতী, তোমার পূর্বে তোমার ন্যায় অনেক আহম্মক দেখিয়াছি,—তুমি প্রথম নহ৷’’১১৪ মনিয়ার পালক পিতা গুলশের খাঁ জন্মাবধি মনিয়াকে জানে তাই তার অন্তঃকরণ তাকে গণিকার মতো শরীরী উত্তেজনায় মত্ত হয়ে পুরুষ বিহারে রত বলে মেনে নিতে পারে না কিন্তু রুস্তম দিল খাঁ তা নয়৷ তার চোখে মনিয়া শুধুমাত্র গণিকাকন্যা এবং দেহবিক্রয় করাই তার অনিবাহ্যতা৷ তার কথায় গণিকাজীবনের বিভিন্ন দিকগুলোও প্রতিভাত৷ যেমন তাদের আশনাই অর্থাৎ প্রেম করা পেশা৷ ফূর্তি করতে পরপুরুষের সঙ্গে চলে যেতেও দ্বিধাবোধ হয় না বা তাদের জন্য তা দোষের নয়৷ অবশেষে গুলশের খাঁ যখন মেয়ের সন্ধান পেয়ে অসীমের তাম্বুর সামনে উপস্থিত হয় তখন তাকে দেখে মনিয়া শিহরিত হয়ে উঠে; মুখে-চোখে ভীতির চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়৷ তার অন্তরাত্মা অসীমকে ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না৷ অসীমের সঙ্গে থাকার অভিলাষে সে তার পিতাকে বলে—‘‘আব্বা, আমি কসবীর বেটী কসবী, কসব আমার পেশা৷ বাল্যকাল হইতে পিতা-মাতা যাহা শিখাইয়াছে, তাহাই করিতে এখানে আসিয়াছি৷’’১১৫ মেয়ের মুখে এহেন কথা শুনে স্তম্ভিত গুলশের খাঁ তাকে বলে—‘‘মনিয়া, তুমি কসবী, এ কথা ত প্রথম শুনিলাম মা! লোকে জানুক, বা না জানুক আমি তোমার পিতা৷ আমি কি কখনও তোমাকে কসব করিতে শিখাইয়াছিলাম? তুমি কসবীর কন্যা বটে, কিন্তু আমি আজীবন তোমাকে ভদ্র গৃহস্থকন্যার মত রাখিতে চেষ্টা করিয়াছি৷ তওয়াইফ হইলেই কি কসবী হইতে হয় মা!’’১১৬ গুলশের খাঁর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মনিয়া চরিত্রের মধ্যে যে স্বচ্ছতা-নির্মলতা-পবিত্রতার দৃঢ় অবস্থান তার ভিতটিকে খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না৷ পিতার গৃহে ফিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ-উপরোধ তাকে এমন কঠিন করে তোলে যে শেষ পর্যন্ত সে সকলের সামনে পিতাকেই অস্বীকার করে যাতে অসীম তাকে পুনরায় গৃহে না পাঠাতে পারে৷ তবু মনিয়া বারাঙ্গনা কন্যা৷ সে মুজরা করে নিজের যশ-খ্যাতিকে বহুদূর বিস্তির্ণ করেছে৷ তার জাত নেই৷ মা হিন্দু বাবা মুসলমান৷ তাকে কোনো উচ্চবংশীয় হিন্দু যুবা পত্নী হিসেবে মেনে নিতে পারে না; সমাজে তার প্রচলনও নেই৷ সে উচ্চবংশের পুরুষদের শরীরী ক্ষুধা মেটাতে পারে কিন্তু সামাজিকভাবে কোনো গৃহের গৃহিণীরূপে তার স্থান নেই৷ তাই অসীম তার প্রণয়সম্ভাষণকে দৃঢ়ভাবে উপেক্ষা করলে সে প্রবল আত্মাভিমানে সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে দেহব্যবসার আবর্তে আবর্তিত হওয়ার জন্য তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে চেয়ে অসীমকে জানায়—‘‘বাবুসাহেব, আপনি নিশ্চিন্ত মনে চলিয়া যান,—আমার মুহূর্তের জন্য চিত্তবিভ্রম হইয়াছিল, এখন তাহা কাটিয়া গিয়াছে৷ আমি মনিয়া,—পাটনা সহরের কসবী, মুজরা করিয়া খাই,—এখন আমার কসবী মায়ের ঘরে আবার কসব করিতে ফিরিয়া যাইতেছি৷ ভয় করিও না বাবুসাহেব, আমি মরিব না৷ আমার জাতির কি মরণ আছে?’’১১৭ অসীম দুর্বৃত্ত নয়, সে এক হৃদয়বান যুবক৷ দুষ্টের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই সে মনিয়াকে উদ্ধার করেছে, নিজের তাম্বুতে আশ্রয় দিয়েছে৷ মনিয়ার পিতা মেয়ের ঘরে না ফেরার দায় সমস্ত তার উপর ন্যস্ত করলে বাধ্য হয়েই সে মনিয়াকে ঘরে ফেরার জন্য অনুরোধ করেছিল৷ কিন্তু তার দৃঢ় এবং স্পষ্ট প্রেম সম্ভাষণের মধ্যে সে যখন নারী হৃদয়ের গভীর বেদনাকে অনুভব করতে পারে তখন তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তার দুহাত নিজ হস্তে ধারণ করলে মনিয়া আতকে ওঠে—‘‘স্পর্শ করিলে কেন? আমার বেশ্যা জননী জীবনে যে পথ আমার জন্য নির্দেশ করিয়াছিল, সেই পথ অবলম্বন করিতে যাইতেছিলাম দিলের৷ তুমি আমাকে স্পর্শ করিলে কেন? তোমার পবিত্র করস্পর্শে হীনা, যবনী, বেশ্যাকন্যা যে পবিত্রা হইয়া উঠিল! কেন তুমি আমার উদ্দেশ্য বিফল করিলে? যে দেহ তোমার পবিত্র স্পর্শে পুত হইয়াছে দিলের, তাহা আর কামুকের পাপ-করস্পর্শে কলুষিত হইবে না—তাহা উৎসর্গকৃত শুভ্র-পুষ্পের ন্যায় চির-নির্মল থাকিবে৷’’১১৮ সে অসীমের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে যেতে চেয়েছিল তার মায়ের নির্দেশিত কসবি জীবনে কিন্তু অসীমের করস্পর্শে সে পবিত্র হয়ে উঠে৷ এই পবিত্রতাই তাকে শক্তি জোগায় দেহজীবিকার গ্লানিময় জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে৷ অসীমের সংস্পর্শ থেকে পূর্ণ পবিত্রতার উপলব্ধি নিয়ে সে ঘরে ফিরে যেতে চাইলে হৃদয়বান সচ্চরিত্রের যুবক অসীমও তাকে বিপদসংকুল পথে একা ছাড়তে চায় না৷ সে তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য যত্নবান হলে মনিয়া তার পাপসংস্পর্শ থেকে অসীমকে মুক্ত রাখতে হাত জোড় করে হলে—‘‘ঐটি মাফ করিও৷ আমার বিশেষ প্রয়োজন আছে, একাই যাইতে হইবে৷ দোহাই তোমার দিলের,—’’১১৯ মনিয়ার ছিল অসীমের প্রতি নিষ্পাপ ভালোবাসা৷ সে প্রেমাস্পদকে সম্বোধন করতো ‘জানি’, ‘দিলের’ ইত্যাদি দ্বারা৷ তার জীবন থেকে সে বহু দূরে চলে যেতে চায় যাতে, তার বেশ্যা পরিচয়ে অসীম বিব্রত না হয়৷ কিন্তু হৃদয় তো তা চায় না৷ তাই বিদায় মুহূর্তেও তার মুখ থেকে যখন ‘দিলের’ সম্বোধন বেড়িয়ে আসে তখন নিজেকে সংযত করতে সে বলে—‘‘মাঝে-মাঝে ঐ সম্বোধনটা এখনও আসিতেছে; কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানের একমাত্র ঈশ্বরের নাম লইয়া শপথ করিতেছি, কাল হইতে আর আসিবে না৷’’১২০

মনিয়া বেশ্যা-কন্যা৷ হিন্দু মা ও মুসলিম পিতার ঔরসে তার জন্ম৷ চোখধাঁধানো প্রখর তার সৌন্দর্য৷ বেশ্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যথার্থ তালিম দিয়ে তার যৌবনাবেগকে আরও খানিকটা উস্কে দিয়েছে তার মা৷ কিন্তু অসীমকে ভালোবেসে ওসবের কিছুই চায় না সে৷ মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় হিন্দু হয়ে সে অসীমের যোগ্য হিসেবে নিজেকে তৈরি করবে৷ এই উদ্দেশ্য নিয়ে সে উপস্থিত হয় মহেন্দ্রূতে এক পুষ্করিণীর তীরে; যেখানে একদিকে ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসীরা অপরদিকে ফকিরেরা সংসার থেকে বৈরাগ্য নিয়ে বসবাস করে৷ মনিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ঈশ্বরের সেবাব্রত ধারণকারী ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসীরা তার অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারবে৷ এই অংশে লেখক নারীলোলুপ ভণ্ড তপস্বীদের কামগন্ধময় জীবনচিত্রের সুষ্ঠু বর্ণনা দিয়েছেন৷ সেখানকার প্রত্যেকেই মনিয়ার অপ্সরীতুল্য রূপ দেখে প্রবৃত্তির তাড়নায় তাকে উপভোগ করতে চেয়েছে৷ মনিয়া প্রথমেই তিন্তিড়ীবৃক্ষমূলে বৃহজ্জটাজুটধারী এক সন্ন্যাসীকে ধুনি জেলে বসে থাকতে দেখে তার সামনে গিয়ে প্রণাম জানিয়ে কিছু বলতে চাইতেই সন্ন্যাসী তার রূপ দেখে বুঝতে পারে যে সে একজন তওয়াইফ৷ তাই প্রথমেই তার উপর শর্ত আরোপ করে ‘দো-চার রোজ’ ভজন গাওয়ার৷ বিরক্তচিত্তে সে স্থান ছেড়ে এক ব্রহ্মচারীর সামনে দাঁড়াতেই সেই ব্রহ্মচারী লালসাসিক্ত নয়নে ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের ন্যায় তাকে গিলে ফেলতে চায়৷ সকলের ভাবগতিক বুঝতে পেরে অবশেষে পুকুরের এক কোণে বসে থাকা এক বৃদ্ধ ব্রহ্মচারীর সম্মুখে গিয়ে নিজের মনোবাঞ্ছা জ্ঞাপন করতে পারে৷ তাকে অকপটে নিজের পরিচয় দান করে বলে—‘‘আমি বেশ্যাকন্যা,—কিন্তু আমার পিতা মুসলমান৷… বাবা, আমি কি হিন্দু হইতে পারি?’’১২১ সন্ন্যাসী তাকে উপদেশ দেয় মুসলমানের আচার-ব্যবহার পরিত্যাগ করে কায়-মনো-বাক্যে হিন্দুর অনুকরণ করতে৷ সেই অনুসারে সে পায়জামা ত্যাগ করে শাড়ি পরিধান করে, বিলাস-ব্যসনের চিহ্নস্বরূপ সব আভরণ ত্যাগ করে নিরাভরণ হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয় মুজরা ঠিকই করবে কিন্তু কখনো পরপুরুষের কন্ঠলগ্ন হবে না; ঈশ্বরের দেওয়া নিজের সুরেলা কন্ঠে ঈশ্বরের ভজন গাইবে৷

মনিয়ার প্রেমাকাঙ্খী ফরীদ খাঁ৷ সে মনিয়াকে তার উদ্যানে মুজরা গাওয়ার প্রস্তাব রাখে৷ সেই মতো সে যখন ‘রূপার তাঞ্জামে’ চড়ে মুজরা করার জন্য উদ্যানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে তখন পথে দেখা হয় অসীমের সঙ্গে৷ অসীম লক্ষ করে তার পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার সমস্তই বারনারীসুলভ৷ তওয়াইফ-এর কায়দাতেই সে অসীমকে কুর্নিশ জানায়৷ তারা দুজনে যে পূর্বপরিচিত তা তাদের ব্যবহারে কারও বোধগম্য হয় না৷ তাই মনিয়াবাইকে দেখে কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় অসীম হঠাৎ হাসতে শুরু করলে তার সেই হাসির কারণও কারও বোধগম্য হয় না৷ এক পথচারী তাকে মনিয়াবাইয়ের পরিচয় জানিয়ে বলে যে পাটনার মনিয়াবাইকে যে না চেনে সে পাটনাশহরে নবাগত৷ মনিয়া তার রূপ যৌবন ও সুরেলা কন্ঠ দিয়ে পাটনা শহরের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিকার স্থান দখল করে নিয়েছিল৷ যেখানে যেখানে তার মুজরা হত সেখানকার প্রত্যেক ব্যক্তিই তার রূপের বহ্নিতে পতঙ্গের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মসুখ চরিতার্থ করতে চাইত৷ পাটনার প্রত্যেক পুরুষের হৃদয়েশ্বরী তাই মনিয়াবাই৷ ফরিদ খাঁ তাকে ‘পাটনা সহরের বুলবুল’ বলে অভিজ্ঞানিত করেছে৷ মনিয়ার মুজরা কক্ষে কৌতুহল্লোদ্দীপক হয়ে অসীম উপস্থিত হলে তার প্রতি নিক্ষিপ্ত মনিয়ার নয়ন কটাক্ষে অসীম লজ্জায় রক্তবর্ণ হলে তাকে উদ্দেশ্য করে এক বৃদ্ধ রসিক বলে—‘‘জনাব, আপনার মত নসীব কয়জনের হয়? মনিয়া ইচ্ছা করিয়া যাহার দিকে অমন করিয়া চাহে, সে খোদার বড়ই প্রিয়পাত্র৷ কত আমীর-ওমরাহ ঐ গোলাপী চরণে আশ্রয় পাইবার জন্য বাদশাহের দৌলৎ লুটাইয়া দিয়া গিয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই৷ আজ যে চাহনি মনিয়াজান বিনামূল্যে তোমার উপর বর্ষণ করিল তাহার লক্ষ অংশের জন্য কত রাজার রাজ্য গিয়াছে৷ দোস্ত, তুমি আমার তুলনায় এখনও বালক, এমন মওকা হেলায় হারাইও না৷’’১২২ সেই মজলিশে অসীম মনিয়াবাইয়ের গান শুনে চলে গেলে প্রেমে গরিয়সি সেই বাইজি অনায়াসে সকলের সামনে নিজেকে অসীমের প্রেমপ্রার্থিনী হিসেবে স্বীকার করে৷ আর বৃদ্ধ রসিকের কথার মধ্য দিয়ে উচ্চবিত্ত আমীর ওমরাহদের গণিকা তোষণের চিত্রটিও সকলের সম্মুখে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়৷

মনিয়া চায় অসীম তার সংস্পর্শরহিত হয়ে ভালো থাকুক৷ সে অসীমের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি৷ তাই সংকল্প নিয়েছিল অভিসারিকা বেশে তার প্রবলরূপবহ্নির কাছে অসীমকে পরাস্ত করতে, তার সম্মুখে পরপুরুষের সামনে মুজরায় গিয়ে তার ঈর্ষা জাগ্রত করতে৷ কিন্তু অসীম নিরুত্তাপ৷ তার ভুবনমোহিনী রূপেও অসীমের সংযম এতটুকু টলে না৷ সে বার বার মনিয়ার ভালো করতে চাইলেও প্রেমালিঙ্গনে কখনো কাছে টেনে নেয় না৷ তাই সংকল্প নেয় সন্ন্যাসী হওয়ার৷ বিলাসের সব বেশ পরিত্যাগ করে গৈরিক বসন ধারণ করে সে৷ তার নবসন্ন্যাসীবেশকে লেখক বর্ণনা করেছেন এইভাবে—‘‘সন্ন্যাসিনী যুবতী, রূপসী৷ গৈরিক বসনে তাহাকে ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নির ন্যায় দেখাইতেছিল৷ কেহ যদি সে সময় লক্ষ্য করিয়া দেখিত, তাহা হইলে বুঝিতে পারিত যে, সন্ন্যাসিনী অতি অল্প দিন বিলাস-বাসনা পরিত্যাগ করিয়াছে৷ কারণ, তাহার আকর্ণ-বিশ্রান্ত নয়নযুগ্মের কোণ হইতে কজ্জলের রেখা বহু চেষ্টা সত্ত্বেও সম্পূর্ণরূপে মুছিয়া যায় নাই; এবং হস্তের ও পদের নখে মেহেদীর বর্ণ তখনও স্পষ্ট ছিল৷ এমন কি, হস্তের দশ অঙ্গুলিতে গুরুভার অঙ্গুরীয়কগুলির দাগ তখনও মিলাইয়া যায় নাই৷’’১২৩ অসীম মনিয়ার কখনো বারবধূ কখনো সন্ন্যাসিনীর বেশ এই প্রহেলিকাময় আচরণে বিস্মিত৷ তাই সে মনিয়ার সম্মুখে নারীচরিত্রের রহস্যময়তা সম্পর্কে কিছু কথা বললে উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে উঠে মনিয়া৷ অসীম তার সেই হঠাৎ কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে মনের অবরুদ্ধ আবেগে জানায়—‘‘কাঁদি কেন? তাহা পুরুষে বুঝিবে না৷ যদি রমণী হইতে, তাহা হইলে জিজ্ঞাসা করিতে না৷’’১২৪ মনিয়া ভেবেছিল তার রূপের মোহে তার চোখের সম্মুখে অন্যপুরুষের যখন আকৃষ্ট হবে তখন ঈর্ষান্বিত হয়ে সে হয় তো তাকে ভালোবাসবে, তার প্রেমকে স্বীকৃতি দেবে৷ কিন্তু তার সে ভুল অসীম ভেঙে দিয়েছে; সে হিন্দু সন্ন্যাসিনী হয়ে হিন্দুধর্ম অনুশীলন করতে শুরু করে দিয়েছে৷ কারণ সে শুনেছে হিন্দুরা পুনর্জন্ম লাভ করে৷ হিন্দুকন্যারা এক জন্মে যার উপাসনা করে পরজন্মে তাকে লাভ করে৷ তাই সে অসীমকে বলে—‘‘এ জন্মে যাহা আমার অসাধ্য, পরজন্মে তাহা পাইবার ভরসায় হিন্দু হইয়াছি৷ আমার এ সাধে বাধা দিও না দিলদার৷’’১২৫

মনিয়া প্রেমের অনলে পুড়ে যোগিনী হয়ে প্রেমিকের আরাধনায় আত্মবিস্মৃত হয়েছে৷ প্রবল রৌদ্রকে মস্তকে ধারণ করেও প্রেমিকের ভাবনায় বিভোর মনিয়ার কোনো হুশ থাকে না৷ নগরোপকন্ঠে প্রেমের যোগিনীভাবে বিহ্বল তপস্বিনীকে পুড়তে দেখে সরস্বতী বৈষ্ণবী এগিয়ে এসে তাকে মুখে-চোখে জল সেচন করে সুস্থির করে তোলে৷ ছায়ায় নিয়ে গিয়ে তার প্রলাপবাক্যে সান্ত্বনা সুধা বর্ষণ করে৷ মনিয়া যে কারও প্রেমে যোগিনী হয়ে এভাবে তপস্বিনী হয়েছে তা বিচক্ষণ সরস্বতীর বুঝতে বাকি থাকে না৷ মনিয়া তার কাছে ‘আশনাই’ জহর না অমৃত এরূপ প্রশ্ন করলে সরস্বতী তাকে জানায় যে যেহেতু মনিয়ার বয়স কম এবং রূপবতী তাই তার কাছে ‘আশনাই’ মিঠা৷ কিন্তু যখন সেই রূপ ও যৌবন সূর্যের মতো পশ্চিমে ঢলে পড়বে তখন মধুর স্বল্পতার কারণে ভ্রমর আর কাছে ঘেষবে না, তখন বোঝা যাবে প্রেম বিষ এবং সেই বিষ যাকে গ্রাস করে তার আর উদ্ধার নেই৷ তাই সে তাকে উপদেশ দিয়ে বলে যে বোন এমন দিন চিরকাল থাকবে না৷ তার চম্পকবর্ণ গায়ের রঙ জ্বলে কালো হয়ে যাবে৷ চোখের কোলে সেই তীব্র বিষের জ্বালা কালির দাগ টেনে দেবে৷ তার ঐ কোকিল কুজনের মতো কন্ঠস্বর হয় তো দাঁড়কাকের আওয়াজ ধরবে৷ সে মনিয়াকে তার কম বয়সে জ্বলে পুড়ে মরতে দেখে অনুরোধ করে বলে—‘‘বহিন, ফিরিয়া যা; গেরুয়া ধরিবার অনেক সময় আছে,—এই ত তোর প্রথম যৌবন, সারাটা জীবন দীর্ঘ পথের মত সম্মুখে পড়িয়া আছে৷ ফিরিয়া যা৷ যতদিন যৌবন আছে, ততদিন উপার্জন করিয়া নে; তাহা হইলে বুড়া বয়সে আর সরস্বতীর মত খঞ্জনী বাজাইয়া মুরশিদাবাদ ও পাটনার পথে-পথে ভিক্ষা করিয়া উদর পূরণ করিতে হইবে না৷’’১২৬ কিন্তু মনিয়া তো প্রেমের কাছে জীবনকে, জীবনের সুখ-দুঃখকে সমর্পণ করে বসে আছে৷ সে বুঝতে পেরেছে তার প্রেমাস্পদ তার কাছে দুষ্প্রাপ্য নয়—অপ্রাপ্য৷ সরস্বতী তাকে প্রেমিকের কঠোরতায় কঠিন হতে উপদেশ দিলে সে উত্তর দেয়—‘‘শোন বহিন, আমি বেশ্যাকন্যা, বেশ্যবৃত্তি আমার পেশা৷ আমার পিতামাতা ইচ্ছা করিয়া আমাকে এই বৃত্তি অবলম্বন করাইয়াছে, সুতরাং স্বভাবতঃ আমার মন সচরাচর পুরুষ অপেক্ষা সহস্রগুণ কঠিন৷ কিন্তু আমি ত কঠিন হইতে পারি নাই৷’’১২৭ অর্থাৎ মনিয়া বেশ্যা জীবন-পরিবেশে লালিত৷ পুরুষের প্রতি কপট ভালোবাসা, ছলা-কলা-কৌশল কিছুই তার অজানা নয়৷ তার পরেও সে তার বেশ্যাবৃত্তির কৌশলকে প্রয়োগ করতে পারে না অসীমের প্রতি৷ সে তার কাছে দেবদুর্লভ৷ সদবংশজাত, উচ্চপদস্থ কর্মী অসীমকে স্পর্শ তো দূর দর্শন করাই তার কাছে দুরাকাঙ্খা৷ কারণ সে নিজে নীচ৷ তার প্রেমিক অনেক উচ্চে এবং সে পরম পবিত্র৷ সে তার জীবনের কালিমা দিয়ে অসীমকে মসীলিপ্ত করতে চায় না৷

মনিয়ার জীবনে নতুন করে প্রাণসঞ্চার করে হরিনারায়ণ বিদ্যালঙ্কার৷ সে অসীম রায়ের পিতৃবন্ধু এবং তার পিতার অন্নে প্রতিপালিত৷ সে বুঝতে পারে মনিয়ার প্রেমের সত্যকার রূপকে৷ তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, কষ্ট সহ্যের ক্ষমতা এবং সীমাহীন সংযম বিদ্যালঙ্কারকে অভিভূত করে৷ সেও মনিয়াকে পরামর্শ দেয় কঠোর সংযমের৷ কারণ হিন্দু সমাজে বেশ্যার গর্ভে এবং যবনের ঔরসে জন্ম নেওয়া নারী অস্পৃশ্য৷ সে তাকে বলে যে অসীমকে তার লৌকিক জীবনে লাভ করা সম্ভব না হলেও তাকে উপাস্য করে আকাঙ্খা বর্জনের মধ্য দিয়ে সত্যকার প্রেমকে লাভ করা তার পক্ষে অসম্ভব নয়৷ তাই এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য—‘‘মা, যদি মানুষিক প্রেম পবিত্র করিয়া, কামনা পরিত্যাগ করিয়া ঈপ্সিতকে ভজনা করিতে পার, তাহা হইলে জগতের পথে তোমার ও তাহার পদে কুশাঙ্কুরও বিঁধিবে না৷’’১২৮ মনিয়া তার কথা শুনে প্রতিজ্ঞা করে সে তার সমস্ত কামনা বাসনা পরিত্যাগ করে ঐশ্বরিক সাধনায় অসীমের আরাধনা করবে৷ বিদ্যালঙ্কার তার ত্যাগ-মহানতায় এই গণিকা কন্যাকেও নিজের কন্যার সমতুল করে কন্যা হিসেবে গ্রহণ করে৷ মনিয়া যেন মুহূর্তেই সমস্ত আত্মগ্লানি ভুলে পবিত্র হয়ে যায়৷ সে তার কাছে প্রতিশ্রুত হয় অসীমের হিতসাধনে তার অনিষ্টকারী সরস্বতী বৈষ্ণবীর অনুসরণ করবে এবং বিদ্যালঙ্কারের অনুমতি ব্যতীত কখনোই অসীমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে না৷

বারবনিতা মনিয়া অসীমের হিতকল্পে তার সকল হিতকারীর বন্ধু হয় এবং অহিতকারীর শত্রু হয়৷ সরস্বতীকে অনুসরণ করে সে নাপিত নবীনের ষড়যন্ত্র থেকে তার পিতৃতুল্য বিদ্যালঙ্কারের প্রাণ রক্ষা করে৷ কাফ্রী বালকের রূপ ধরে নবীনের সম্মুখে গিয়ে নিজেকে মনিয়াবাইয়ের দূত হিসেবে পরিচয় দেয় এবং তার সকল খবর সংগ্রহ করে৷ নবীন ও সরস্বতী ষড়যন্ত্র করে যখন বিদ্যালঙ্কারের কন্যা ও পুত্রবধূকে অপহরণ করে নিয়ে বন্দি করে রাখে তখন মনিয়া তার উপস্থিত বুদ্ধির সাহায্যে তাদের উদ্ধার করতে সচেষ্ট হয়৷ নবীনের সঙ্গে মেলামেশা করে এবং তাদের অনুসরণ করে সমস্ত ঘটনা সে আগেই বুঝতে পেরেছিল৷ তাই ব্রাহ্মণ কন্যার ছদ্মবেশে দুর্গা ও তার ভ্রাতৃজায়ার বন্দি কক্ষের সম্মুখস্থ এক দীর্ঘিকায় বসে নবীনকে ভোলাবার জন্য তার সুরেলা কন্ঠে ভজন শুরু করে—

 ‘‘মাহ কি জ্যোছনা হোয়ে আঁধিয়ার৷

 যব তুঁহু ছোড়ি গয়ে হমারে পিয়ার৷৷’’১২৯

মনিয়া তার হাবভাব, কটাক্ষ, অনুগ্রহ দেখিয়ে নবীনকে প্রথম থেকেই নিজের হস্তগত করে রেখেছিল৷ তাই মনিয়ার সেই সুরেলাকন্ঠ নবীনের বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ সে মুগ্ধ বিস্ময়ে তার কন্ঠের অনুসরণ করে আর সম্মুখে উপস্থিত হলে মনিয়ার ছলনায় বন্দি হয় এক কবরের মধ্যে৷ তাকে বন্দি করে সরস্বতীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে উদ্ধার করে অসীমের দুই হিতৈষিণীকে৷ সসম্ভ্রমে তাদের পৌঁছে দেয় আপনজনদের হাতে৷ সেই সময় ত্রিবিক্রমের মুখে অসীমের বিবাহের কথা শুনে নিজের আবেগকে দমন করে নিরবে প্রেমাস্পদকে নতুন জীবনের অভিমুখে ছেড়ে দিয়ে বাল্যবন্ধু, সুহৃদ ফরিদ খাঁর সঙ্গে পাটনার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়৷ ফরীদ প্রথমাবধিই মনিয়ার প্রণয়প্রার্থী৷ তার সহবাসেই সে তার যৌবনের প্রথম পর্যায় বিলাস-বাসনায় অতিবাহিত করেছে৷ সে মদ্যপ, উশৃঙ্খল, লম্পট৷ তার প্রথম প্রণয়ী মনিয়াকে জীবনভর নিজের করে নিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরতে চায় সে৷ মনিয়াকে নিয়ে গৃহকন্নায় শান্তি পেতে চায় শ্রান্ত-ক্লান্ত ফরীদ৷ তার সেই প্রস্তাব দৃঢ়স্বরে প্রত্যাখ্যান করে মনিয়া বলে—‘‘তোমার পিতা হিন্দুস্থানের একজন বিখ্যাত বীর,—আলমগীর বাদশাহের একজন বিখ্যাত কর্মচারী;—আর আমি হিন্দু বেশ্যার মুসলমান উপপতির কন্যা,—উদরের জন্য পাটনার পথে-পথে দেহ বিক্রয় করিয়া বেড়াই! ফরীদ, আমি কি তোমার যোগ্যা জীবনসঙ্গিনী?’’১৩০ ফরীদ মনিয়াকে পেয়ে জীবনের মুক্তির পথ খুঁজেছিল কিন্তু মনিয়া তো অপারগ৷ তার জীবনের শতদল সে উৎসর্গ করে দিয়েছে অসীমের পদতলে; অন্য কারও জীবনসঙ্গিনী সে হতে পারে না তাই ফরীদকে ভাই বলে সম্বোধন করে, সহোদরা ভগিনীর মতো বিপদে-আপদে সে ফরীদের সঙ্গে থাকতে চায়৷ ভালোবাসার মানুষের মুখে ভাই সম্বোধন মেনে নিতে পারে না ফরীদ খাঁ৷ তাই রাত্রির অন্ধকারেই মনিয়ার অজ্ঞাতে সে রথ থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়৷ মনিয়া যখন বুঝতে পারে রথে ফরীদ নেই সে পাগলের মতো ছুটতে থাকে ফরীদকে খোঁজার জন্য৷ সে আশৈশব ফরীদকে দেখে এসেছে৷ সে ধনীর পুত্র, আরাম আয়াসে ভোগে-সুখে তার জীবন৷ তাকে মুহূর্তে দেখতে না পেলে তার পিতামাতা অন্ধ হয়ে যায়৷ আশঙ্কিত হৃদয়ে তার সন্ধান করতে করতে সে উপনীত হয় এক জনশূন্য মন্দিরে৷ তার শ্রান্ত দেহ মন্দিরের দুয়ারে এলিয়ে দিয়ে অচিরেই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়৷ হঠাৎ নিদ্রাভঙ্গ হলে সে দেখতে পায় এক স্থূলকায় খর্বাকৃতি বৃদ্ধ তার দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে৷ মনিয়া ভয় পেয়ে গেলে বৃদ্ধ তাকে আশ্বস্ত করে নিজের পরিচয় দিয়ে বলে সে সেই মন্দিরের পূজারী; তাকে কোনো ভয় নেই৷ বৃদ্ধের কোমল ব্যবহারে মনিয়া ধীরে ধীরে ধাতস্থ হয়৷ বৃদ্ধের মুখে গোপাল, শ্রীচন্দ, গোবিন্দ ইত্যাদি নাম শুনে সন্ন্যাসিনীবেশী মনিয়া তার অর্থ বুঝতে না পারলে বৃদ্ধের বিস্ময়ে সে জানায়—‘‘বাবা, আমি মুসলমানী, নর্তকীর কন্যা নর্তকী৷ বেশ্যাবৃত্তি পরিত্যাগ করিব বলিয়াই সন্ন্যাসিনী সাজিয়াছি৷’’১৩১ সেই বৃদ্ধ বৈষ্ণবের সাহায্যেই মনিয়া পরিচিত হয় হিন্দু দেবতা গোপালের সঙ্গে৷ অবগত হয় পৃথিবীতে যত কার্য সম্পন্ন হয় তার চক্রী স্বয়ং গোপালই৷ তারই নির্দেশে মনিয়া তার সঙ্গে পূর্বদেশে যাত্রা করে উপস্থিত হয় অসীমের বিবাহ মণ্ডপে৷ বিবাহের নান্দীমুখ শ্রাদ্ধের সময়ে অবগুন্ঠনবতী এক নারীকে দেখে নিজের অজ্ঞাতেই অসীমের মুখে উচ্চারিত হয় ‘মনিয়া’ নামটি৷ মনিয়ার প্রেমের স্পর্শ অসীমের হৃদয়কেও রোমাঞ্চিত করেছিল তা অস্বীকার করা যায় না৷ মনিয়ার জন্য বার বার তার হৃদয় কেঁদে উঠেছে কিন্তু জাতি ও সমাজের অদৃশ্য বন্ধনে সে মনিয়াকে গ্রহণ করতে পারেনি৷ মনিয়াও সমস্ত প্রবৃত্তিকে সুদৃঢ় করে বাঁধতে পেরেছিল৷ লেখক মনিয়ার সেই কঠিন কাজকে সহজ করে উপস্থাপন করে দিয়েছেন৷ বাস্তবে হয়তো তা সম্ভব হত না৷ কারণ যে মনিয়া অসীমের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছে, অসীমের ভালোর জন্য অসাধ্য সাধনের সংকল্প নিয়েছে; অসীমের প্রেমে পাগলিনী হয়ে যোগিনী হয়েছে; অসীমের বিবাহ সভায় প্রেমাস্পদকে অপর এক নারীর হস্তগত হতে দেখে তার সামান্যতম বিচলিত হওয়া স্বাভাবিক ছিল৷ কিন্তু তার নির্বিকার ঔদাসীন্য, প্রতিক্রিয়াহীনতা চরিত্রটির সজীবতা কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ণ করেছে বলে মনে হয়৷ বিবাহের পর সে অসীমকে সম্বোধন করেছে হুজুর, জনাব ইত্যাদি শব্দ দ্বারা৷ মনিয়ার এহেন সম্বোধনে বিরক্ত হয়েছে অসীম, কারণ মনিয়াকে সে বহুদিন দেখেছে এবং জানে৷ তার সঙ্গে মনিয়ার সেই নতুন সম্বোধনে সে অভ্যস্ত নয়৷ অসীমের প্রতি তার অনুরাগের কথা জানতে পেরে নববধূ যখন মনিয়াকে তার সঙ্গ ছাড়ার হুকুম দিয়েছে তখন মনিয়া বিনাবাক্যব্যয়ে তা শিরোধার্য করেছে৷ তার সেই প্রখর রূপ নিয়ে একাকী অনির্দেশের পথে যাত্রার সঙ্কল্প দেখে অসীম শঙ্কিত হয়েছে, ব্যথিত হয়েছে৷ এর প্রেক্ষিতে মনিয়া তাকে বলেছে—‘‘হুজুর, অলঙ্কার, পোষাক খুলিয়া ফেলা যায়, কিন্তু রূপ ত মুখোসের মত খুলিয়া ফেলা যায় না৷ দুনিয়ার হাওয়ার সঙ্গে মনের হাওয়াও বদলাইয়া যায়; কিন্তু চেহারা যিনি দিয়াছেন, তিনি না বদলাইলে আর কেহ পরিবর্তন করিতে পারে না৷’’১৩২ অসীম মনিয়াকে অনুরোধ করে পাটনায় তার পিতা-মাতার কাছে ফিরে যেতে৷ মনিয়ার ইচ্ছে না থাকলেও অসীমের আদেশ হিসেবে তা মেনে নেয়৷ সহসা মনিয়ার জীবনযন্ত্রণায় কাতর হয়ে অসীমের চোখ থেকে জল গড়িয়ে আসে কারণ সে জানে ভুবনমোহিনী রূপ, সুরেলা কন্ঠের জাদুকারীতায় পাটনার হৃদয়েশ্বরী মনিয়াবাই আজ তারই জন্য ভিখারিনি হয়েছে অথচ সে কিছুই করতে পারেনি তার জন্য৷ তার চোখের অশ্রুবিন্দু মনিয়াকে বিহ্বল করে দেয়৷ মুহূর্তে সমস্ত সংযম ভুলে তার পদদ্বয় আলিঙ্গন করে সে বলে ওঠে—‘‘তুমি কাঁদিতেছ! আমার দুনিয়ার দৌলৎ, তুমি কাঁদিতেছ কেন! তোমার কিসের দুঃখ বল? তুমি যাহা বলিবে, আমি তাহাই করিব৷’’১৩৩ অসীমের দুঃখের কারণ শুনে মনিয়া তাকে সান্ত্বনা দিয়ে তার জীবনের সমস্ত প্রাপ্তির কথা শোনায়৷ তাকে বোঝায়—‘‘মনে করিও না যে, তোমার জন্য আমার অবস্থা হীন হইয়াছে, আমি আজ তোমার জন্য কত উচ্চ, তা কি তুমি জান? দিলের তুমি ভাবিতেছ আমি কি ছিলাম কি হইয়াছি—শাটিন-মখমলের পেশোয়াজ না পরিয়া, হীরা-মুক্তার অলঙ্কার না পরিয়া, এই গেরুয়া কাপড় পরিয়া বেড়াইতেছি বলিয়া মনে করিও না যে, মনিয়া ছোট হইয়াছে৷ লোকের চোখে এ বেশ হীন দেখাইতে পারে; কিন্তু তুমি জান না দিলের, এ বেশে আমি আমার কাছে কত উচ্চ৷ এখন আমি আমার৷ এখন পথের কুকুরের মত ডাকিলেই আমাকে লোকের কাছে যাইতে হয় না৷ যাহাকে মনে মনে ঘৃণা করি, অর্থের জন্য তাহার সঙ্গে হাসিমুখে কথা কহিতে হয় না;—সে যে কত বড় সুখ, কত উচ্চতা, তাহা বেশ্যা ভিন্ন কেহ বুঝিতে পারে না৷’’১৩৪ মনিয়া অসীমের কাছে তার জীবনের সত্যটিকেই তুলে ধরেছে৷ তার কাছে তাই সুখ, ঐশ্বর্য, সম্পদ না থাকলেও সে আত্মতৃপ্ত৷ পরের গৃহে গৃহে মুজরা করে, দেহ-মন দান করে পরপুরুষকে আনন্দ দেওয়ার মধ্যে নারীর কোনো গৌরব নেই; সেখানে শুধুই অপমান৷ মনিয়া অসীমকে ভালোবেসে সে অপমান থেকে মুক্ত হয়েছে৷ নিজের কাছে নিজের মুখ লুকিয়ে আর তাকে থাকতে হয় না৷ অসীমের প্রতি মনিয়ার সেই অসংযত হৃদয়-উন্মোচন দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে হরিনারায়ণ তাকে তার সংযমব্রত নিয়ে তিরস্কার করলে মনিয়া তাকে জানায়—‘‘বাপজান, আমি আপনার উপদেশ ভুলি নাই,—সংযম-ব্রত পরিত্যাগ করি নাই৷ এক মুহূর্ত দেবতার চোখে জল দেখিয়া আত্মহারা হইয়া গিয়াছিলাম৷ খোদার কসম বলিতেছি বাপজান, আমি ইচ্ছা করিয়া এদেশে আসি নাই৷’’১৩৫ মনিয়া তো অসীমকে পরিত্যাগ করেই গিয়েছিল কিন্তু বিধাতার নির্বন্ধ পুনরায় তাকে তার প্রেমাস্পদের সম্মুখবর্তী করেছে৷ এবারে বিদ্যালঙ্কার আরও কঠিন উপদেশ দান করে বলে যে এমন কঠোর সংযমী হতে হবে তাকে যে অসীমের চোখের জল কেন অসীমকে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখেও তার বিচলিত হওয়া যাবে না৷ শুধু তাই নয় ইচ্ছে করে অসীমকে দেখা যাবে না, তার কথা কানে তোলা যাবে না এবং তার রূপ মনে আনা যাবে না৷ মনিয়া সব শর্ত মেনে নেয় শুধুমাত্র শেষেরটি ছাড়া৷ কারণ অসীম তার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা; তার আরাধ্য দেবতা৷ সেই দেবতাকে হৃদয়মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে অহরহ তাকে দর্শন করে সে৷ সেই দেবতার রূপ মনে না আনলে সে তো মরে যাবে৷ তথাপি সে চেষ্টা করবে তার প্রিয়তমকে সর্বোতভাবে উপেক্ষা করার কৌশল অর্জন করতে৷

সত্যকারের ভালোবাসা মানুষের মনে স্বর্গীয় সুখানুভূতি এনে দেয়৷ সংসারের কোনো কিছুর প্রতি তখন তার আর কোনো আকর্ষণ থাকে না৷ ধনসম্পদ, বৈভবের প্রতি তো নয়ই; এমন কি নিজের রূপ, যৌবন, দেহের প্রতিও নয়৷ মনিয়ারও সেই একই অবস্থা৷ সে অসীমকে ভালোবেসে পাটনা নগরে অভিজাত সমাজের হৃদয়ের বুলবুল থেকে পথের ভিখারিনি হয়েছে; নিজের পক্ষে যতখানি ত্যাগ করা সম্ভব সব করেছে৷ কিন্তু ঈশ্বরপ্রদত্ত রূপরাশি তো ত্যাগ করতে পারে না৷ সেই রূপের জন্য সে বার বার বিপদের মধ্যে পড়েছে, রূপের ভয়েই অসীমের স্ত্রী শৈল অসীমের সংস্পর্শ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে৷ তাই সে সংকল্প নিয়েছে সেই রূপ পরিত্যাগ করার; হাকিমের সাহায্য নিয়ে চোখঝলসানো অপরূপ রূপরাশিকে জ্বালিয়ে দেওয়ার৷ তাই নিশুতি রাতে সকলের অগোচরে হাকিম শহীদুল্লাহের কাছে উপস্থিত হয়ে বলে—‘‘জনাব, আমার বেমার রূপ৷ রূপ কেমন করিয়া জ্বলিয়া যায় বলিতে পারেন?’’১৩৬ তার বেণুনন্দিত কন্ঠে সেই অভাবনীয় প্রস্তাব শুনে আশ্চর্য হয়ে যায় হাকিম৷ মনিয়া তার রূপের প্রতি সম্পূর্ণ বিতৃষ্ণ৷ রূপের জ্বালায় মানুষের লালসা থেকে, মায়ের লোভ থেকে, অসীমের দুশ্চিন্তা থেকে বেড়িয়ে আসতে চায় সে চিরতরে৷ তাই হাকিমকে অবাক হতে দেখে পুনরায় তাকে উদ্দেশ্য করে বলে যে; সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিকে নিজের ইচ্ছেতে সে রূপ পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ তার কারণ দর্শিয়ে জানায়—‘‘এই রূপ আমার কাল; এই রূপের জন্য আমার সমস্ত সুখ-সম্পদ দূর হইয়াছে৷ আমার এই রূপ আমার সুখের ঘরেও দুঃখের আগুন জ্বালাইয়া দিয়াছে৷’’১৩৭ হাকিম তার অর্ধশতাব্দীব্যাপী জীবনে বহুধরনের ভালো-মন্দ চিকিৎসা করেছে কিন্তু স্বেচ্ছায় নিজের রূপ জ্বালিয়ে দেওয়ার অদ্ভূত প্রস্তাব সে কখনো শোনেনি৷ সে মনিয়াকে বোঝায় যে রূপ হল ঈশ্বরের দান, তা মানুষের সাধ্যায়ত্ত নয়৷ হয় তো তার প্রেমিক তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে এবং সেই অভিমানে মর্মাহত হয়ে সে তার রূপ পরিত্যাগ করতে চাইছে৷ কিন্তু প্রথম যৌবনের সামান্য বিরাগে স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে নিজের রূপ জ্বালিয়ে দেওয়া কখনোই যুক্তিযুক্ত নয়৷ আর মানুষ যদি নিজের আত্মাভিমানে বিভোর হয়ে ঈশ্বরের দেওয়া পরমরূপরাশিকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নষ্ট করে দেয় তাহলে শত চেষ্টা করলেও সেই রূপ পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়৷ হাকিমের এই কথা শুনে মনিয়ার মুখে প্রতিফলিত হয় সমগ্র বারাঙ্গনাদের জীবনালেখ্য এবং গণিকা হিসেবে তার নিজের জীবনদর্শন৷—‘‘জনাব, আমি কসবী; শুধু কসবী নহি; কসবীর বেটী কসবী৷ আজি দশ বৎসর ধরিয়া এই পাটনা সহরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মুখে শুনিয়া আসিতেছি যে, আলমগীর বাদশাহের মত আমার রূপ জগজ্জয়ী৷ রূপের গুণ-ব্যাখ্যান শুনিয়া কর্ণ বধির হইয়াছে৷ জনাব, বেশ্যার কি মাশুক থাকে? বেশ্যার মাশুক আশরাফি৷ শুনিয়াছি দুই একজন বেশ্যার মাশুক থাকে; কিন্তু তাহারা তখন আর বেশ্যা থাকে না, তাহারা তখন রমণী হইয়া যায়৷ এই রূপে জগৎ জয় করিয়াছি, পুরুষ জাতিকে অবহেলায় পদে দলন করিয়াছি; কিন্তু সেই রূপই এখন আমার কাল হইয়া দাঁড়াইয়াছে; রূপ আমার সদ্গতির অন্তরায়, রূপ আমার কুপথ প্রদর্শক আর কেবল আমার সর্বনাশের কারণ নহে, অনেক গৃহস্থের গৃহদাহের কারণ৷ জনাব, বেশ্যার রূপ জ্বালাইয়া দিলে দুনিয়ার মঙ্গল হইবে—আল্লাহ প্রসন্ন হইবেন৷ কত সতী দুই হাত তুলিয়া আপনাকে দোয়া করিবেন৷’’১৩৮ এরপর মনিয়া লোভ দেখিয়ে, অনুনয় করে বলে—‘‘আমি আমার পাপের ধন দিয়া আপনার দুই হাত আশরফিতে ভরিয়া দিব৷ জনাব, আপনি আমার বাপের বয়সী; মনে মনে বিচার করিয়া দেখুন, যে বেশ্যা স্বেচ্ছায় নিজ রূপ ধ্বংস করিতে চাহে, সে কি কখনও সে রূপ আর ফিরিয়া পাইবার চেষ্টা করে?’’১৩৯

মনিয়া নিজে রূপাজীবা৷ গণিকাজীবনের পঙ্কিল পরিবেশে তার বেড়ে ওঠা৷ তাই সে ভালো করেই জানে একজন কসবির কাছে রূপের মূল্য কি; অর্থের মূলই বা কি৷ তারপরেও সে তার পরমসুন্দর রূপকে পরিত্যাগ করতে চায়৷ অর্থের বিনিময়ে দেহ-বিক্রয় করা নারীদের সর্বদা মিথ্যা প্রেমের গান গাইতে হয়, তাদের সেই কপট ভালোবাসায় সত্যিকারের প্রেম থাকে না, থাকে না হৃদয়বাঞ্ছিত প্রেমাস্পদ৷ কিন্তু যদি কখনো কারও মনে প্রেম জাগ্রত হয় তখন সে আর পণ্যাঙ্গনা থাকে না; সে তখন রমণী হয়ে যায়৷ তার দেহজীবিকার সমস্ত কলুষতা প্রেমের পরশমণির ছোঁয়া পেয়ে পবিত্র হয়ে ওঠে৷ মনিয়ারও তাই হয়েছে৷ তাই সে নিজেকে আর গণিকা করে রাখতে চায় না, পুরুষের প্রবৃত্তিকে উস্কে দেওয়ার মতো রূপেও তার আর প্রয়োজন নেই৷ আবার বারাঙ্গনাদের জন্য যে সমাজ কুপথগামী হয়, পুরুষেরা পত্নীর একনিষ্ঠ সেবাকে উপেক্ষা করে নিষিদ্ধপল্লীতে গণিকাঙ্গনে জীবন কাটায় সেই দিক থেকে সমাজে তাদের অমঙ্গলের দ্যোতক, অঘটন-ঘটনপটিয়সী হিসেবেও দেখিয়েছেন লেখক৷ তাই তো মনিয়া হাকিমকে বলতে পারে যে তার রূপ জ্বালিয়ে দিলে দুনিয়ার মঙ্গল হবে, আল্লাহ প্রসন্ন হবেন এবং সতী-সাধ্বীরা দুহাত তুলে তার জন্য দোওয়া প্রার্থনা করবে৷ দেহজীবীরা দেহজীবিকার গ্লানিমুক্ত হলে গণিকার মুক্তির পথ আছে নতুবা তারা সমাজের কাছে পাপীয়সীই; লেখকের এই ভাবনারই প্রতিধ্বনি মনিয়ার সেই উক্তির মধ্যে৷ হাকিম বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেছে মনিয়ার মতো পরমাসুন্দরী নারীর কথা শুনে৷ তার চাপা পড়ে থাকা বিবেকবোধ জাগ্রত হয়ে বার বার মনিয়াকে নিষেধ করছে তার সংকল্প রক্ষায়৷ কিন্তু মনিয়ার ছুড়ে দেওয়া পাঁচটি সুবর্ণমুদ্রা তার ভেতরের বিবেককে পুনরায় দাবিয়ে দিয়ে চিরকালীন লোভকে চাঙ্গা করে তোলে৷ সে তাকে রূপ জ্বালিয়ে দেওয়ার ঔষধ দিতে রাজী হয় এবং সঙ্গে এও বলে যে সেই ঔষধের অসহ্য জ্বালা মানুষে সহ্য করতে পারে না৷ কারণ ঔষধ প্রয়োগ করার পর সমস্ত শরীরে গভীর ক্ষত তৈরি হবে, পরে ক্ষত শুকিয়ে গেলে সেই স্থান কুৎসিত হয়ে সমস্ত রূপকে গলিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেবে৷ তারপরেও মনিয়া তার সংকল্পে অটুট থাকে৷ সে বলে—‘‘হজরৎ, আমি অসহ্য নরক যন্ত্রণা সহ্য করিতেছি৷ ইহা হইতে অসহ্য যন্ত্রণা আর কিছুই হইতে পারে না!’’১৪০ মনিয়াকে অনুসরণ করে আড়াল থেকে সমস্ত কথা অবগত হয় বৃদ্ধ বৈষ্ণব৷ পরে তারই হস্তক্ষেপে সে তার রূপজ্বালানোর সংকল্প পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়৷ রূপ জ্বালানোর পরিবর্তে সমস্ত অঙ্গে মসীলেপন করে নিজেকে আড়াল করে সে বৃন্দাবনের পথে বের হয়৷

এর দুই তিনমাস পরে মনিয়াকে দেখা যায় ঘোর কৃষ্ণবর্ণা এক নারীরূপে বৃদ্ধ বৈষ্ণবের সঙ্গে রোজবাহানী গ্রামে এক পানের দোকানের সম্মুখে৷ গ্রামটি আগ্রা থেকে মথুরা ও দিল্লী যাওয়ার পথে অবস্থিত৷ পানের দোকানি তার ব্যবসার আসন্ন ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে স্মরণাপন্ন হয়েছিল বৈষ্ণব ও মনিয়ার যাতে মনিয়া কোনো গান গেয়ে তার দোকানে খদ্দের নিয়ে আসতে পারে৷ দোকানির বিনীত অনুরোধে মনিয়া তার সুরেলা কন্ঠের গান শুরু করলে মুহূর্তেই দোকানের সম্মুখভাগ নানা শ্রেণীর শ্রোতায় ভরে যায়৷ এক শ্রোতার মুখে তার গানের ব্যাখ্যান এইরূপ—‘‘মাগীটা যেন কোকিল রে!’’১৪১ এই শ্রোতার উক্তিকে বিশ্লেষণ করে লেখক বলেছেন—‘‘সত্যই গায়িকা সুশ্রী হইলেও মসীকৃষ্ণবর্ণা৷’’১৪২ অর্থাৎ এতদিন যে প্রখর রূপৈশ্বর্যের বর্ণনা লেখক মনিয়া সম্পর্কে দিয়ে এসেছেন রোজবাহানী গ্রামে সেই কনকবর্ণ রঙ কালিমালিপ্ত৷ যার জন্য তার কন্ঠ চিনতে পেরে উপস্থিত ফরীদ খাঁ ভিড় ঠেলে ব্যাকুল হয়ে ছুটে এসে তার সন্ধান পায় না—পরিণামে অবগুন্ঠনবতী কৃষ্ণবর্ণের রমণীকে দেখে পিছু হটে যায়৷ তাকে দেখে তার কন্ঠ শুনে ফরীদের মনে হয়—‘‘গায়িকা মনিয়ার মত বটে কিন্তু তাহার দৃষ্টি চাঞ্চল্যবিহীন, স্থির, তাহাতে বারবণিতাসুলভ নৃত্য নাই, অঙ্গ-ভঙ্গিতে লালিত্য আছে কিন্তু লজ্জাহীনতা নাই৷’’১৪৩ মনিয়া শুধু তার পূর্বের জীবনধারণ প্রণালী পোশাক-পরিচ্ছদকে পরিত্যাগ করেনি, সুদীর্ঘ সংযম অভ্যাসে তার যে সহজাত আচরণগত বারবনিতাসুলভ ভঙ্গিমা তাও দূরে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে৷ তার দৃষ্টির চাঞ্চল্য, লজ্জাহীন অঙ্গভঙ্গিমা সমস্তই সেখানে অবলুপ্ত৷ বৃষ্টি এবং ঘন কুয়াশার কারণে অন্ধকার হয়ে এলে তারা আর মথুরার পথে অগ্রসর হতে পারে না৷ বাধ্য হয়েই আশ্রয় নেয় রোজবাহানীর অনতিদূরে এক ভাঙা কবরের মধ্যে৷ সেখানে আশ্রয় নেওয়া তিনজন সিপাহির মুখে শুনতে পায় যে কিছুক্ষণের মধ্যে ফররুখসিয়র ও বাদশাহ জাহান্দর শাহর মধ্যে প্রাণঘাতী যুদ্ধ শুরু হবে৷ ফলে বৃষ্টি কমে যাওয়ার পরও তারা সেখান থেকে বের হতে পারে না৷ যোদ্ধাদের কোলাহল ও আহতদের আর্তচিৎকারে রাত শেষ হয়ে এলে যুদ্ধফলের কলরবের মধ্য দিয়ে মনিয়া ও হরিদাস বৈষ্ণব মথুরার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে৷ মনিয়ার কোমল মন মুহূর্তপূর্বে ঘটে যাওয়া যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতিস্বরূপ চারিদিকে চাপচাপ রক্ত ও রাশি রাশি মৃতদেহের স্তূপ দেখে আঁতকে ওঠে৷ মুমূর্ষ সেনানীদের আর্তচিৎকারে ও করুণ গোঙানিতে সে তাদের অসহায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে বেড়িয়ে যেতে পারে না৷ কোথাও না থেমে যদি তারা ক্রমাগত হাটতে থাকে তাহলে সন্ধ্যার আগেই অভীষ্টস্থানে পৌঁছতে পারবে জেনেও সে না থেমে থাকতে পারে না৷ সে সঙ্গী বৈষ্ণবের পরামর্শ উপেক্ষা করে তার হাতের কমণ্ডলু কেড়ে নিয়ে এক আহত মোগল সেনার মুখে জলসিঞ্চন করতে থাকে এবং বৈষ্ণবকে উদ্দেশ্য করে বলে—‘‘লোকটা এখনো বাঁচিয়া আছে বাবা, যতক্ষণ আছে ততক্ষণ ছাড়িয়া যাইতে পারিব না৷’’১৪৪ পরক্ষণেই সেই আহত ব্যক্তি যে ফরীদ খাঁ সে চিনতে পেরে ‘‘ফরীদ, ফরীদ ভাই!’’১৪৫ বলে আর্তনাদ করে ওঠে৷ ফরীদের কানে কানে নিজের পরিচয় প্রদান করলে সে তাকে চোখ মেলে দেখে তার কালোকুৎসিত রূপ সম্পর্কে বলে—‘‘তুমি দোজখের বাঁদী, আর আমার মনিয়াজান বেহেস্তের চামেলী ফুলের মত সফেদী৷’’১৪৬ মনিয়ার সেই কালো রূপ তখনো ফরীদ চিনতে পারে না৷ তখন সমস্ত বিষয় বুঝিয়ে দিতে সে বলে—‘‘ফরীদ, ভাই! আমি যে আত্মগোপন করিবার জন্য রং মাখিয়া আসিয়াছি, আমি সত্যসত্যই মনিয়া, বাঁদীই বল আর পরীজাদীই বল—আমিই সেই মনিয়া৷’’১৪৭ মনিয়া সমাজের হিংস্র শ্বাপদদের হাত থেকে নিজেকে রেহাই দিতে তার মোহিনীরূপকে কালি দিয়ে ঢেকে আত্মরক্ষায় ব্রতী হয়েছে৷ তার অভীষ্ট গোপাল লাভ৷ গোপাল সেবার মধ্য দিয়েই সে অসীমের প্রতি দুর্বার প্রেমপিপাসাকে অবদমিত করতে চায়৷ সেই গোপালের পথে যাওয়ার সময়ই সে ফরীদের দেখা পেয়েছে৷ ফরীদ তাকে তার মৃত্যুর খবর পাটনায় তার বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছানোর ভার দিলে মনিয়া প্রবলক্রন্দনে মাথা নেড়ে তা অস্বীকার করে বলে—‘‘ফরীদ, তুই যে বাপ-মায়ের নয়নের মণি, আমি তোকে মরিতে দিব না৷’’১৪৮ আর ঠিক এই সময় মনিয়ার সঙ্গী তার কাছে আর একটু জল চাইলে মনিয়া মুখ তুলে দেখে রাশি রাশি মৃতদেহের মধ্যে আরেক পরিচিত মুখ৷ সেই মুখ আর কারও নয় স্বয়ং অসীমের৷ মনিয়া আবার আর্তনাদ করে ওঠে৷ মনিয়া ফরীদকে ছেড়ে ছুটে এসে তাকে আলিঙ্গন করে৷ আহত দুই আত্মার আত্মীয়কে তার অক্লান্ত সেবা দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তোলে৷ হাকিম ফরীদের নিদ্রা আবশ্যক জানালে সে এস্রাজ বাজিয়ে তার সুমধুর কন্ঠের জাদুকরি স্পর্শে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়৷ অসীম সুস্থ হয়ে ফরীদকে হরিদাস বৈষ্ণবের তত্ত্বাবধানে রেখে মনিয়াকে দেশে তার বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে মনিয়ার মুখে উচ্চারিত হয় বিনম্র অস্বীকার—‘‘তসলিমৎ হুজুর, এখন ফরীদভাইকে ফেলিয়া স্বর্গে যাইতেও পারিব না৷’’১৪৯ এখানেই মনিয়া অনন্যা৷ সে তার কর্তব্য সম্পর্কে দৃঢ়৷ আর এই কর্তব্যের বশেই বন্ধুর প্রতি দায়িত্বজ্ঞানে অটল থেকে প্রেমিকের সঙ্গে গিয়ে তার সান্নিধ্যলাভের সুখটাকেও অনায়াসে পরিত্যাগ করতে পারে৷ মনিয়ার প্রেম আর সেই রূপজ মোহে আবদ্ধ নেই৷ সে মনের অন্তরস্থলে অসীমের মূর্তি কল্পনা না করেও অসীমকে ভালোবাসতে পারে৷ সে দেহাতীত প্রেমস্বরূপকে আত্মস্থ করতে পেরেছে৷ অসীম সামনে না থাকলেও তার হৃদয় সিংহাসন কখনো আর খালি থাকে না৷ সেই রত্নসিংসনে অসীমের দিব্যমূর্তি চিরস্থায়ীত্ব লাভ করেছে৷ তাই অসীম মনিয়াকে ফরীদের কাছে রেখেই চলে যেতে বাধ্য হয়৷

এরপর ছয় বৎসর গত হয়েছে৷ এবার মনিয়ার উপস্থিতি দিল্লীতে৷ অসীম রাজকার্য সম্পাদন করতে এসে আলাউদ্দীন খলজীর নির্মিত বিরাট মসজিদ প্রাঙ্গণে শুভ্র-মর্মরের ক্ষুদ্র সমাধি-মন্দিরে শুনতে পায় সুমধুর সঙ্গীতধ্বনি৷ সে আশ্চর্য হয়ে এগিয়ে যায়, কারণ সেই কন্ঠ, সেই সুরমূর্ছনা মনিয়ার না হয়ে পারে না৷ সেখানে এগিয়ে এসে এক সুশ্রী বালকের সঙ্গে সত্যসত্যই মনিয়াকে দেখতে পায়৷ মনিয়ার কাছে বৃন্দাবন ছেড়ে তার দিল্লীতে থাকার কারণ জানতে চাইলে মনিয়া জানায়—‘‘বৃন্দাবন গিয়া বিবেচনা করিয়া দেখিলাম যে, আমি পরিত্যাগ করিলে ফরীদ ভাই সংসারে স্থির হইয়া থাকিবে না, সেই জন্য বাবাকে বলিয়া, চারি পাঁচ বৎসর পূর্বে দিল্লী চলিয়া আসিয়াছি৷’’১৫০ শুধু বন্ধুর হিতৈষী নয়, তার জীবন বাঁচিয়েও ক্ষান্ত হয়নি সে৷ তাকে রীতিমত সংসারী করে উচ্চ পদমর্যাদায় অভিষিক্ত করে তবেই নিশ্চিন্ত হয়েছে৷ তার সঙ্গে থাকা সেই সুশ্রী বালক ফরীদ খাঁর সন্তান৷ মনিয়ার অনুরোধে অসীম তাদের সঙ্গে আতিথ্য নিতে সম্মত হয়৷ সেখানে উপস্থিত হয়ে ফরীদ খাঁর মুখে জানতে পারে বাদশাহ ফররুখসিয়রের শত্রুবেষ্টিত হওয়ার কথা৷ ফররুখসিয়র তার বন্ধু৷ সে বন্দি বন্ধুর উদ্ধারের জন্য বদ্ধপরিকর হয়৷ এখানেও মনিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে৷ সে গুপ্তচর হয়ে ভিখারির ছদ্মবেশে অসীমকে সাহায্য করে৷ অসীম আজমীর শহরের ফটকের কাছে এসে দেখে যে ফটকের ভিতর আপাদমস্তক বোরখামণ্ডিত এক ভিখারিনি গান গেয়ে ভিক্ষা করছে৷ অসীম সুর শুনে বুঝতে পারে তা মনিয়ার৷ তাকে আহ্বান করলে মনিয়া না চেনার ভান করে দীর্ঘ সেলাম ঠুকে বলে যে সে গত দিন থেকে কোনো ভিক্ষা পায়নি, আটপ্রহর ধরে না খেয়ে আছে৷ আল্লার দিব্যি দিয়ে বলে যে অসীম যেন তাকে একখানা রুটি কিনে দেয়৷ মনিয়ার এহেন আচরণে বিস্মিত হয়ে যায় আমীর অসীম রায় কিন্তু তার বোঝার বাকি থাকে না যে মনিয়ার ভিক্ষায় বার হওয়ার পিছনে নিশ্চয় কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে৷ সে ফটকের কাছে এসে এক রুটির দোকান থেকে তাকে চারখানি বড় রুটি কিনে দিলে সেখানকার একটা রুটি মুখে দিয়ে কিছুক্ষণ পর তা বের করে অসীমের শরীরের মধ্যে ছুড়ে মারে এবং বাকি তিনখানা পথের কুকুরের দিকে ছুড়ে দেয়৷ কিন্তু যেটা অসীমের দিকে ছুড়ে দিয়েছিল সেটা অসীম তুলে না নিলে তার উদ্দেশ্যে কটুক্তি বর্ষণ করতে থাকে৷ অসীম বুঝতে পারে নিশ্চয় রুটির মধ্যে কিছু রয়েছে৷ সে ঘোড়া থেকে নেমে তার দিকে দেওয়া রুটিটা তুলে নিলে সেখানে শক্তমত কোনো পদার্থের উপস্থিতি অনুধাবন করে সেটাকে লুকিয়ে এক পুরাতন কবরের কাছে এসে তা খুলে দেখে সেখানে তামার তাবিজের মধ্যে একটি চিঠি৷ পত্রটি বন্দি ফররুখসিয়রের লেখা৷ সে বন্দি অবস্থায় নিদারুণ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তাকে উদ্দেশ্য করে উদ্ধারের অনুরোধ জানিয়েছে৷ ইতিমধ্যে মনিয়া সেখানে উপস্থিত হলে অসীম পত্রসম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে জানায়—‘‘কিল্লার লাহোর ফটকে ভিক্ষা করিতে গিয়া পাইয়াছি৷ তুমি এখন চলিয়া যাও; দ্বিপ্রহর রাত্রিতে ফরীদের সহিত দুইটা ঘোড়া লইয়া লাহোর-ফটকের বাহিরে থাকিও৷ আজমীর ফটকের পাহারা ঘুষ দিয়া বশ করিয়াছি৷’’১৫১ এই গোপন বার্তা জানিয়ে পুনরায় অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করতে করতে মনিয়া সেই স্থান ত্যাগ করলে অসীমের তাকে দেখে বিস্ময়ের সীমা থাকে না৷ শত্রুবেষ্টিত স্থানে বন্দি বাদশাহকে উদ্ধার করার জন্য চরের কাজের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ দুঃসাহস না হলে হয় না৷ সে বন্দি গৃহের কঠিন বুহ্য ভেদ করে ভেতরকার সবরকম খবর সংগ্রহ করে, তা অসীমের কাছে জ্ঞাপন করে; পাহারাদারদের ঘুষ খাইয়ে বশ করে অসীমের কর্মে সহায়তা করে যাতে অসীম নির্বিঘ্নে তার সমস্ত কর্তব্যকর্ম সুষ্ঠুভাবে সমাধান করতে পারে৷ অসীম যখন সমস্তদিন অপেক্ষায় থেকে সন্ধ্যাকালে বেশ-ভূষা পরিধান করে সংকেতস্থানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে সেই সময় ভিখারিনিবেশী মনিয়া তার সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে জানায়—‘‘হুজুর, আপনি এখন বাহির হইবেন না৷ ফরীদ ও আমি সমস্ত ঠিক করিয়া আপনাকে ডাকিতে আসিব৷… অনেক কষ্টে পাঠান আব্দুল্লা খাঁকে বশ করিয়াছি কিন্তু রতনচাঁদের কসবী গোলাপ বাঈ খবর দিয়াছে যে বাদশাহকে কাল হত্যা করা হইবে সুতরাং আজ রাত্রিতে যদি কিছু না করিতে পারা যায় তাহা হইলে এত যত্ন, আয়োজন ও চেষ্টা সমস্তই বৃথা হইবে৷’’১৫২

মনিয়া তার মতো আরেক গণিকা গোলাপবাঈ এর সাহায্য নিয়ে ভেতরের সব খবর সংগ্রহ করে, বাদশাহকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করে, নির্দিষ্ট সময়ে অসীমকে বেরোনোর সংকেত দিয়ে বংশীধ্বনি করেও শেষ রক্ষা করতে পারে না অসীমের সাময়িক দুর্বলতার জন্য৷ তার স্ত্রী বিষ পান করার মিথ্যা অভিনয় দিয়ে বেরোনোর মুখে অসীমকে নিজের পীড়িত বাহুর দ্বারা আবদ্ধ করে রাখে৷ মৃতপ্রায় স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য করতে গিয়ে সে নিজের স্থলে প্রেরণ করে অন্ধ ভাই ভূপেন্দ্রকে৷ নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলে সে তার স্ত্রীর হৃদয়বিদারক হাস্যধ্বনিতে বুঝতে পেরেছে যে তার সকল অসুস্থতা শুধুমাত্র ঈর্ষাপ্রযুক্ত অভিনয়৷ সে স্ত্রীকে ফেলে ছুটে গিয়ে আবিষ্কার করে তার ভাই ও ফররুখসিয়রের মৃতদেহ৷

বাদশাহের অন্তিম সংস্কারের পর মোগল সম্রাটবংশের প্রাচীন রীতি অনুযায়ী সৈয়দগণের আদেশে সহস্র রুটি, তাম্র ও রৌপ্য মুদ্রা যখন ভিক্ষুককুলের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং তা সংগ্রহের জন্য বিশহাজার ভিক্ষুকদের মধ্যে কোলাহল শুরু হয়ে যায় তখন সেখান থেকে একখানা তুলে নিয়ে মনিয়া চিৎকার করতে থাকে—‘‘ভাই সব, নিমকহারামের রুটী নিমকহালালের হারাম৷’’১৫৩ তা দেখে বিশহাজার ভিক্ষুকও মনিয়ার অনুরূপ কার্য করতে থাকলে সেই সম্মিলিত প্রতিবাদে সৈয়দগণ ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়৷ এখানে মনিয়ার মধ্যে স্বাধীনবৃত্তির জনকল্যাণকামী এক প্রতিবাদী নারীরূপ প্রতিবিম্বিত হয়েছে৷

অসীমের শেষ সময়ের বন্ধুও মনিয়া৷ প্রথম জীবনে যার হাত ধরে সে একদিন ঘর ছেড়েছিল, যার বদান্যতায় দিল্লী দরবারে একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী হয়ে তার বড়ভাই-এর দ্বারা প্রতারিত হয়ে সহায়-সম্বলহীন হওয়ার পরেও প্রচুর বিত্ত-বৈভব সম্পদ লাভ করেছিল এবং যে তাকে তার শত বিপদে-আপদে এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে দিয়ে কোথাও যায়নি, সেই অন্ধ ভাই ভূপেন্দ্রকে নিশ্চিত মৃত্যুমুখে পতিত করে তার চিতার আগুনের সামনে জীবনের সবকিছুর মানে হারিয়ে ফেলে ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে থাকে৷ মনিয়া তাকে গৃহে ফিরে যাবার অনুরোধ জানালে সে তার শূন্য জীবনে ঘর-সংসারের কোনো ভিত্তি খুঁজে পায় না৷ বিচক্ষণ মনিয়া বুঝতে পারে তার আরাধ্য দেবতার জীবনেও তার মতো বৈরাগ্য এসে গেছে৷ তাই সে তাকে সস্নেহ আলিঙ্গন দিয়ে বলে—‘‘বুঝিয়াছি ভাই, বুঝিয়াছি, গোপাল তোমাকেও ডাকিয়াছে৷ চল গোপালের ঘরে যাই৷’’১৫৪ মনিয়ার সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে অসীম তার সঙ্গেই গোপাল লাভে অর্থাৎ জীবনের অতৃপ্তি থেকে তৃপ্তি লাভে যাত্রা করে৷

উপন্যাসটিতে দেখা যায় মনিয়া শেষ পর্যন্ত তার প্রেমাস্পদ অসীমকে নিজের কাছে পায়৷ কিন্তু যখন সে অসীমকে লাভ করে তখন সে আর পাটনা শহরে বুলবুলও নয়, অসীমের পদপ্রান্তে দেহ-মন উৎসর্গ করে দেওয়া মনিয়াও নয়৷ তখন সে গোপালের কাছে তার সমস্ত কামনা-বাসনা, চাওয়া-পাওয়া সঁপে দেওয়া এক আকাঙ্খাবর্জিতা বৈরাগী৷ তার সম্পূর্ণ বৈরাগ্য প্রাপ্তি হয়েছে৷ অসীমের প্রতি নিবেদিত প্রেম তার নিষ্কলুষ সাধনার দ্বারা ঐশ্বরিক প্রেমে উত্তীর্ণ হয়েছে৷ তখন আর তার প্রেমিক হিসেবে অসীমের কোনো অস্তিত্ব নেই; তখন তার প্রেমিক গোপাল৷ বিদ্যালঙ্কার যে সংযমের কথা বলেছিল, ফরীদ যে চাঞ্চল্যহীন নিরুত্তাপভাব লক্ষ্য করেছিল, তার মধ্যেই ছিল তার কামনাবাসনাহীন গোপাল সেবার ভূমি কর্ষণের চিত্র৷ তাই উপন্যাসের শেষে ‘দিলের’ নয়, ‘হুজুর’ নয়, ‘জানি’ নয় , ‘ভাই’ সম্বোধন করে তার সস্নেহ আলিঙ্গন দিয়ে তার চিরবাঞ্ছিত প্রেমাস্পদকে চিরবৈরাগ্যের দোসর করে নেয়৷ লেখক সমগ্র উপন্যাসটিতে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে একটু একটু করে নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে মনিয়াকে এই পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়েছেন৷ তার শ্রদ্ধা ভক্তি ও সাধনার মধ্য দিয়ে গণিকাবৃত্তি থেকে উচ্চতর সম্মানীয় স্থানে অভিষিক্ত করেছেন৷

সরস্বতী বৈষ্ণবী :

সরস্বতী বৈষ্ণবী জাতিবৈষ্ণবের কন্যা৷ তার যৌবন অতীত হয়ে গেলে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে৷ যৌবন ও যৌবনের সঙ্গে বৈষ্ণবের প্রেম তার সঙ্গ পরিত্যাগ করলেও তখন পর্যন্ত তার সুকন্ঠ তাকে পরিত্যাগ করেনি, যার জন্য অন্নের অভাবও কোনোদিন হয়নি তার৷ তার সংসারের সেই সুখ স্বাচ্ছল্য দেখে শেষ বসন্তের কোকিলের মতো বিগতযৌবন কোনো প্রেমিক প্রেমের ফাঁদ পাতার চেষ্টা করলে সে তার অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাদের জানিয়ে দিত যে, সে পুরুষজাতির দ্বারা যৌবনে যে শিক্ষা লাভ করেছে স্নিগ্ধ প্রৌঢ়ে এসেও তা ভুলতে পারেনি৷ সরস্বতী বেশ্যা না হলেও বহুগামী৷ বৈষ্ণবীয় ধর্মের সাধনা করতে গিয়ে বহুপুরুষের কন্ঠলগ্না হতে হয়েছে তাকে৷ উপন্যাসের খলনায়ক অসীমের দাদা হরনারায়ণের দ্বারা প্রেরিত হয়ে নরসুন্দর নবীন অসীমের ক্ষতিকরার মতলব নিয়ে তার গৃহে এসে তাকে বশ করতে কথার জাল রচনা করে বলে—‘‘ইচ্ছা করিয়া কেন এত কষ্ট পাও দিদি,—একটা মালাচন্দন করিলেই পার৷ তোমার কি বৈষ্ণবের অভাব হয়! তোমার বয়সটা কি! তার উপর তুমি গুণী লোক৷’’১৫৫ নবীনের এই কথার মধ্য দিয়ে বৈষ্ণব সমাজে মালাচন্দন অর্থাৎ কন্ঠী বদলের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, যার মধ্য দিয়ে দুটি নরনারীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়৷ কিন্তু বৈষ্ণবীয় সমাজের এই শুদ্ধ ধর্মাচার কারও কারও কাছে স্বেচ্ছাচারের নামান্তর হয়ে পরোক্ষভাবে দেহব্যবসায় রূপান্তরিত হয়৷ সরস্বতী বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ৷ তার চিরশত্রু নবীনের কথায় সে যে তার শরণ নিতে এসেছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার৷ তাই নিজের পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের ধুয়া তুলে সে নবীনকে বলে—‘‘তোমরা পুরুষ মানুষ, ভোমরার জাতি৷ যতক্ষণ মধু থাকে, ততক্ষণ তোমরা থাক৷ আমার যৌবনের মধু ফুরাইয়াছে; সুতরাং এখন আর তোমরা আসিবে কেন?’’১৫৬ বৈষ্ণবী সরস্বতীর যৌবনের মধু শুকিয়ে গিয়েছে৷ পীতাম্বরের মতো মানুষদের প্রতারণায় সংসারী জীবনের মায়া পরিত্যাগ করে তাকে একাকিত্বময় একটা জীবন মেনে নিতে হয়েছে৷ পরে অসীমের অনিষ্ট করতে নবীনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সে পাড়ি দেয় মুর্শিদাবাদের ডাহাপারা গ্রাম থেকে সুদূর পাটনা শহরে৷ উপস্থিত হয় বিনা দোষে গ্রাম থেকে বিতাড়িত হওয়া বিদ্যালঙ্কারের আবাসভূমিতে৷ টাকার বিনিময়ে সে বরাত নিয়েছে বিদ্যালঙ্কারের বিধবা কন্যা শুদ্ধাচারী দুর্গার চারিত্রিক ত্রুটি বের করতে এবং সমাজের চোখে তাকে পতিত করতে৷ সেই উদ্দেশ্যে সে যখন দীর্ঘ রসকলি কেটে, খঞ্জনী হস্তে, নামাবলী অঙ্গে দিয়ে উপনীত হয় দুর্গাদের নতুন ঘরকন্নার মধ্যে তখন তার সেই অসৎ উদ্দেশ্য সেই গ্রাম বিতাড়িত সহজ সরল মানুষগুলো কিছুতেই অনুধাবন করতে পারে না বরং বহুদিন পর প্রতিবেশী চেনা মানুষটার দর্শন পেয়ে সাদর অভ্যর্থনায় তাকে আপন করে নেয়৷ সে তাদের বোঝায় শেষ জীবনে বৃন্দাবনে কাটানোর উদ্দেশ্যেই সে বৃন্দাবনের উদ্দেশে বের হয়ে পাটনায় উপস্থিত হয়েছে৷ সেখানে এসে সুযোগ্য ‘স্পাই’ এর মতো সে অসীম-দুর্গা-বিদ্যালঙ্কারকে অনুসরণ করতে থাকে৷

মনিয়া-সরস্বতীর কথোপকথনেও সরস্বতীর প্রেমবঞ্চিত জীবনের অনুসঙ্গ উঠে এসেছে৷ সংসারের নানা অভিজ্ঞতা সামান্য একজন নারীকেও চরম দার্শনিক জ্ঞান দান করতে পারে, সরস্বতীর নানা কথার মধ্যে সেই ইঙ্গিত প্রতিভাত৷ অসীমের প্রেমে উদভ্রান্ত মনিয়া প্রখর রৌদ্রের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ ভাবলেশহীন হয়ে বসে থাকলে সরস্বতীর মুখে শোনা যায় সহানুভূতির তরল সুর৷—‘‘আহা, বহিন, তোমার দেহটা যে জ্বলিয়া গেল, এমন সোনার অঙ্গ মলিন হইয়া গেল?’’১৫৭ সে মনিয়াকে যত্ন করে সেখান থেকে ছায়ায় নিয়ে গিয়ে তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলে যে প্রেম বিষ যাকে জরজর করে ফেলে তার বাহ্যজ্ঞান থাকার কথা নয়৷ মনিয়ারও ছিল না তাই প্রখর রৌদ্রে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হলেও কিছুই বুঝতে পারেনি৷ সরস্বতী জীবনের নানা অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক৷ সে বোঝে মানুষের জীবনে প্রেম এলে কি হয়৷ কিন্তু যখন নবীন যৌবন থাকে তখন কখনো প্রেম বিষ হয় না তখন তা আশনাই বা আনন্দ৷ মনিয়া প্রেমের বিষাক্ত রূপ সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করলে তার মুখ দৃঢ় হয়ে ওঠে৷ সে উত্তেজিত হয়ে প্রেমের সেই মারণ পরিণতি বোঝাতে চেষ্টা করে মনিয়াকে৷ তার অভিজ্ঞতায় প্রেম মানুষের সুন্দর জীবনকে ধ্বংস করে দেয়৷ মনিয়ার মতো নবীন বয়সে প্রেম আশনাই হয়ে আবির্ভূত হলেও সে আশনাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না; বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের উত্তাপ কমে আসে এবং ক্রমে তা বিলুপ্ত হয়ে জীবনকে তছনছ করে দেয়৷ তাই সে মনিয়াকে বলে—‘‘দেখ বহিন, এই সরস্বতী বৈষ্ণবী এমন চেহারা লইয়া দুনিয়ায় আসে নাই৷ এমন দিন ছিল, যে দিন কত-কত রাজা-রাজড়া তাহাকে দেখিবার আকাঙ্খায় দরিদ্র বৈষ্ণবের কুটিরের আশে-পাশে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে৷ সে দিন গিয়াছে; এখন আর সরস্বতী মাটিতে পা দিলে তাহার পায়ের তলে পদ্মবর্ণ ফুটিয়া উঠে না, হাসিলে গণ্ডস্থলে গোলাপের আভা দেখা দেয় না; সেইজন্য সরস্বতীও এই ফুলের বাস ছাড়িয়া গৈরিক ধরিয়াছে, কারণ তাহার চারিদিকে তাহার যৌবনের রূপমাধুর্যের আকর্ষণে যে শত-শত ভ্রমর গুঞ্জন করিয়া বেড়াইত, কালধর্মে তাহারা ছাড়িয়া দূরে চলিয়া গিয়াছে৷ বহিন, এমন দিন চিরদিন থাকিবে না৷ এই চাঁপার বরণ জ্বলিয়া কাল হইয়া যাইবে; ঐ চোখের কোলে বিষের জ্বালা কালির দাগ টানিয়া দিবে; ঐ কোকিল-কুজনের মত কন্ঠস্বর হয় ত দাঁড়কাকের আওয়াজ ধরিবে৷—তখন বুঝিবে এ বাঙ্গালী সরস্বতী বৈষ্ণবী কেন এ কথা বলিয়াছিল৷’’১৫৮ সে বার বার বিকশিত চাঁপাকলির মতো মনিয়াকে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে—‘‘বহিন, ফিরিযা যা; গেরুয়া ধরিবার অনেক সময় আছে,—এই তো তোর প্রথম যৌবন, সারাটা জীবন দীর্ঘ পথের মত সমুখে পড়িয়া আছে৷ ফিরিয়া যা৷ যতদিন যৌবন আছে ততদিন উপার্জন করিয়া নে; তাহা হইলে বুড়া বয়সে আর সরস্বতীর মত খঞ্জনী বাজাইয়া মুরশিদাবাদ আর পাটনার পথে-পথে ভিক্ষা করিয়া উদর পূরণ করিতে হইবে না৷’’১৫৯ সে জীবনে যা ভুল করেছে কেউ তার মতো সেই ভুল করুক তা সে চায় না৷ যৌবনে প্রণয়ীর কপট প্রেমসম্ভাষণে আত্মনিবেদিত হয়ে সে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিল যৌবন ফুরানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রেমকে আত্মঘাতী করে প্রেমিক তাকে ছেড়ে চলে গেছে৷ তাই সরস্বতীর বেঁচে থাকার সম্বল ভিক্ষাবৃত্তি৷ সে তার জীবনে মিথ্যা প্রেমের ফাঁদে পড়ে বেঁচে থাকার সম্পদ সঞ্চয় করতে পারেনি, গৈরিক বসন পড়ে ভিক্ষাবৃত্তিই সার হয়েছে, তাই মনিয়াকে বুঝিয়েছে যে সেও গেরুয়া পরার অনেক সময় পাবে, সেটা তো তার হাতেই রইলই কিন্তু তার আগে সে যেন ভবিষ্যতে বেঁচে থাকার মতো রসদ সংগ্রহ করে নেয়৷ কারণ মানুষের রূপ-যৌবন চিরস্থায়ী নয়৷ সে তার অতীত কথা বলতে গিয়ে নিজের অজান্তেই আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে৷ তার দুচোখ বেয়ে দু-বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়লে মনিয়া তা মুছিয়ে দিয়ে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে—‘‘কাঁদি কেন? বহিন, তাহা এখন বুঝতে পারিবে না, যতদিন উপায় থাকে মানুষ ততদিন বুঝিতে পারে না৷’’১৬০ সরস্বতীর মধ্য দিয়ে শুধু গণিকা নয় সমগ্র মানব সমাজের, জীবনের গভীর সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে৷ মানুষ যতদিন উপায় থাকে ততদিন ভাববার সময় থাকে না কিন্তু যখন ভাবনার সময় আসে তখন তার কাছে আর কোনো উপায় থাকে না৷

সতী নারীর ধর্ম এক পুরুষের অনুগামী হয়ে জীবনকে অতিবাহিত করা৷ মনিয়াও অসীমকে পেয়ে সেই আদর্শ গ্রহণ করেছিল৷ আর যার মধ্যে সেই লক্ষণ থাকে সে জীবনে কোনোদিন শান্তি পায় না৷ নারীরা একজন পুরুষকে ভালোবেসে জীবনের সার্থকতা খোঁজে এবং তা না হলে তাদের জীবন যন্ত্রণাময়; পুরুষরা নারীদের সেই দুর্বলতা জানে বলেই পদে পদে তাদের অবদমিত করে রাখতে পারে, নির্দ্বিধায় অপমান করতে পারে৷ এই কথা বোঝাতে গিয়ে সে মনিয়াকে বলে—‘‘পুরুষ তোমাকে যে চোখে দেখে, তুমি আমি ত তাহাকে সে চোখে দেখিতে পারি না; পুরুষ জানে যে আমরা তাহা পারি না এবং এই সন্ধিস্থল জানে বলিয়াই কঠিন পুরুষ চিরদিন অবলা নারীজাতিকে হেলায় পদদলিত করিয়া থাকে৷’’১৬১ মনিয়ার প্রতি সরস্বতীর এই উক্তির মধ্যে আধুনিক নারীমনস্তত্বের এক গভীর দ্যোতনা ফুটে উঠেছে৷

সরস্বতী যে আখড়ায় আশ্রয় নিয়েছে সেখানকার মহন্তের সেবাদাসী, চেলা-চেলি পরিবৃত্ত জীবনের পরিচয় দিয়েছেন ঔপন্যাসিক৷ সেবাদাসীর মধ্য দিয়ে বৈষ্ণব-মহন্তদের নারীদেহমন্থনের বৃত্তান্ত কারও অজানা নয়৷

সরস্বতী উপন্যাসে খলনারী৷ অর্থের লোভে সে দু-দুবার দুর্গা ও তার আত্মীয়দের অপহরণ করায়, শ্রীমতি ছদ্মনামে অসীমের স্ত্রী শৈলর মনে দুর্গা ও মনিয়াকে উদ্দেশ্য করে বিষবৃক্ষের বীজ রোপণ করে তাতে নিয়মিত জলসেচন করে, তারপর সময় বুঝে সেখান থেকে সরে পড়ে৷ অসীমের সংসারজীবনে অশান্তির ঝড় তুলে উপন্যাসটিকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় সে৷ স্বৈরিণী এই নারী উপন্যাসের গতিপথ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে৷

নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত :

উপন্যাস সাহিত্যে যাঁরা নতুন পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য প্রবর্তনের জন্য চেষ্টা করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত৷ তাঁর প্রথম দিককার উপন্যাসে যৌন ও অপরাধতত্ত্ব বিশ্লেষণকেই মুখ্য উদ্দেশ্য করেছেন তিনি৷ আর এর ধারা বেয়েই গণিকা, স্বৈরিণী, স্বেচ্ছাচারিণী নারীরা ভিড় করেছে তাঁর উপন্যাসে৷ তাঁর যে সমস্ত উপন্যাসে গণিকা চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—‘শুভা’ (১৯২০), ‘পাপের ছাপ’ (১৯২২), ‘রক্তের ঋণ’ (১৯২৩), ‘লুপ্তশিখা’ (১৯৩০)৷

ক. শুভা :

নরেশচন্দ্রের সাহিত্যিক জীবনের প্রথমদিকে লেখা উপন্যাস ‘শুভা’ (১৯২০)৷ এটি শুভা নাম্নী এক নারীর আখ্যান৷ ছোটোবেলায় লেখাপড়া শেখা শুভা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবীচৌধুরাণী’ পড়ে যখন জানে জীবন ভোগের জন্য নয়, কেবল অন্যের জন্য আত্মসমর্পণই কর্তব্য তখন শুভার মনে হয় যে সাহিত্যিকরা সব কথা বেচে খায়, সত্যিকারের জীবনের খোঁজ রাখে না৷ সমগ্র উপন্যাস জুড়ে তার একটাই প্রশ্ন জীবন কিসের জন্য৷

চৌদ্দো বছর বয়সের কিশোরী শুভার বিয়ে হয় অপদার্থ অত্যাচারী নিবারণের সঙ্গে৷ সাত বছর সংসার করে অত্যাচার ও গ্লানিবোধ ছাড়া সে আর কিছুই পায়নি৷ তার আত্মস্বতন্ত্রতাবোধ তাকে স্বামী সংসার থেকে বাইরে টেনে এনেছে৷ বাইরের জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞা শুভা একটা কথাকে মাথায় নিয়ে বাইরে পা দিয়েছে তা হল ঘরে থাকলেও শরীর বেচে থাকতে হবে বাইরেও না হয় তাই করব৷ দেহ-বেচার মধ্য দিয়ে জীবনধারণকে তার ঘৃণ্য মনে হয় না৷ অন্য জীবিকা যদি না জোটে তাহলে শরীর বেচে জীবনধারণ কখনো অন্যায় নয় তার কাছে কিন্তু তার স্বাধীনতা চাই, মুক্তি চাই, জীবনটাকে উপভোগ করা চাই৷ সংসারের বৃত্ত থেকে বাইরে এসে সে কখনো হয়েছে থিয়েটারের অভিনেত্রী, পতিতা চাঁপার গৃহসঙ্গিনী, কখনো থিয়েটারের পরিচালক সুরেশবাবুর আশ্রিতা৷ প্রাক্তন প্রেমপ্রার্থী নগেনের গৃহসঙ্গিনী হয়েও তাকে থাকতে দেখা গেছে৷ আবার আত্মসম্মানের জেরে সেই আশ্রয় পরিত্যাগ করে পুনরায় থিয়েটারে আত্মনিয়োগ করেছে সে৷

তার জীবন নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বারবনিতা চাঁপার৷ জীবনে নানাঘাটের জল খেয়ে সে বার বার আশ্রয় নিয়েছে গণিকা চাঁপার কাছে৷ অবশেষে মাদার ক্রিশ্চিয়ানার প্রভাবে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে সেবিকার ব্রত নিয়ে হাসপাতালে আশ্রয় নেয়৷ এভাবে দেখা যায় স্বৈরিণী শুভা জীবনের বিচিত্র আবর্তনে নিজেকে বহন করে নিয়ে গেছে একূল থেকে ওকূলে৷

খ. লুপ্তশিখা :

এই উপন্যাস (১৯৩০)-র কথক বটুক৷ তার আত্মকথন রীতিতে অতীতচারণার মধ্যে উঠে এসেছে সমাজের তমসাবৃত ‘অবহেলিত’ চিরবঞ্চিত বারবনিতাদের কথা৷ সমাজের সভ্য বাবুরা এদের পরিচায়িত করেছেন ‘বেশ্যা’ হিসেবে৷ এদের জীবনে আলোর চেয়ে আঁধার বেশি, সেই আঁধারেই তাদের জীবন আরও বেশি কলঙ্কিত হয়, ক্লেদাক্ত হয়৷

কলকাতাবাসী বটুকের মামার অজপল্লীতে খুব সমাদর৷ স্ত্রীকে পল্লীগ্রামে রেখে সে কর্মসূত্রে বাসা নিয়ে থাকে কলকাতায়৷ মায়ের পীড়াপীড়িতে মামার সঙ্গে কলকাতায় পড়তে এসে বটুক দেখে তার মামার আশ্রিত বিমলাকে৷ পরে বুঝতে পারে বিমলা দেহব্যবসায়িনী, তার মামার রক্ষিতা; কামনাপূরণের মাধ্যম৷ বিমলা বা তার শ্রেণীর নারীদের মোহেই বটুকের মামা তার লক্ষ্মীস্বরূপা স্ত্রীকে পল্লীগ্রামে অবাধে ফেলে রাখে৷

উপন্যাসের আরেক অন্যতম বারবনিতা মালতী৷ সে শিক্ষিতা৷ দেহব্যবসায়ী হলেও তার মধ্যে থেকে শুভবোধ সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়নি৷ কলকাতার এক বেশ্যাপল্লীতে তার বাস৷ মামার সঙ্গে মতানৈক্যে ঘটনাক্রমে তথাকথিত সেই ‘বাজেপাড়াতেই’ তার সঙ্গে দেখা হয় বটুকের৷ মালতী উপবিষ্টা হয় তার দিদির আসনে৷ মালতীর শিক্ষা, সংস্কার রুচিবোধ ইত্যাদি দেখে বটুকের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সে ভদ্রবংশের কন্যা৷

মালতীর মা এককালে তাকে কোলে নিয়েই স্বামী ত্যাগ করে কুলত্যাগিনী হয়েছিল৷ মায়ের পাপের বোঝা উত্তরসূরীরূপে আরোপিত হয় মালতীর মধ্যে৷ সে পাপবোধ তাকে দেহব্যবসায়িনী হিসেবে গড়ে তুললেও তার শুভবোধকে সম্পূর্ণ শেষ করতে পারেনি যার ফলে সে নিরাশ্রয় বটুককে আশ্রয় দেয়, লেখাপড়া করায়৷ তার স্নেহাশ্রয়ে বটুক নতুন জীবন খুঁজে পায় ঠিকই কিন্তু তার ত্রাণকর্তৃ এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে আরও পঙ্কিলতায় ডুবে যেতে থাকে৷ অবশেষে একদিন বটুক হারিয়ে ফেলে তার মালতীদিদিকে৷ সুদূর ভবিষ্যতে সে স্বনামধন্য উকিল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলে তার হাতে এক ‘কেস’ আসে এবং সেই সূত্র ধরে পুনরায় খুঁজে পায় তার হারানো দিদিকে কিন্তু অত্যন্ত বিকৃত রূপে৷ পাপের আবেষ্টনে তখন সম্পূর্ণ বাঁধা মালতী৷ শত চেষ্টা করেও সে ও তার পিতৃপরিচয়হীন কন্যাকে বাঁচাতে পারে না বটুক৷ একজন বারবনিতার স্নেহধন্য সেই উকিল চির ঋণী থেকে যায় তার আশ্রয়দাত্রীর কাছে৷

এভাবে দেখা যায় একজন নারী তার সর্বস্ব দিয়ে পুরুষের আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে কিন্তু পুরুষের নীতি শাসনের শৃঙ্খলে তাকে হতে হয় কখনো কুলটা, কখনো পাপিষ্ঠা, কখনো কলঙ্কিনী৷ আদালতের চোখে মালতী আসামি হলেও তার ভিতরে বটুক খুঁজে পেয়েছিল এক মহামানবীকে৷ মালতী নিজে মন্দ হয়েও বটুকের কাছে মাতৃরূপী কারণ ঔপন্যাসিক নারীর বাইরে সামাজিক খোলসটুকু খুলে দিয়ে সেই নারীর মনের গহনে ডুব দিয়ে ছিলেন৷ আবিষ্কার করেছিলেন পঙ্কের ভেতরকার সেই পঙ্কজিনীকে৷

ভাইয়ের কাছে তার জীবনের অন্ধকার দিকটিকে বহুদিন আড়াল করে রেখেছিল মালতী৷ কিন্তু নিজের অবশ্যম্ভাবী পতনে সে আড়াল একদিন উঠে গেছে৷ সে নিজের কাছে হেরে গেলেও সার্থকতা পেয়েছে অজানা-অচেনা সহায়হীন এক কিশোরের মধ্যে৷ উপন্যাসের শেষে তাই সমাজের ভদ্রলোক হয়ে ওঠা বটুক আক্ষেপ করেছে তার সে ঋণের এক কণাও সে শোধ করতে পারল না বলে৷

উপন্যাসটিতে এক দেহপসারিণী নারীকে মনুষত্বের মহিমায় উজ্জ্বল করে তুলেছেন রচনাকার৷

গ. পাপের ছাপ :

‘পাপের ছাপ’ (১৯২২) উপন্যাসটিতে নানা ঘটনাবাহুল্য শ্বাসরুদ্ধকর জটিলতা সৃষ্টি করেছে৷ নানা বিশৃঙ্খল ঘটনার সুযোগে লেখক যৌনবাসনার অসংযত বিক্ষোভ এবং ফ্রয়েডাদি কথিত লিবিডোর বিচিত্র গতির পরিচয় দেওয়ার জন্য নানা প্রসঙ্গ উপস্থাপিত করেছেন৷ উপন্যাসে নায়ক মেঘনাদের অতৃপ্ত শরীরীক্ষুধা এবং মনের দুর্মর গ্লানির যে সংঘাত ও সমন্বয়ের রূপ তিনি অঙ্কন করেছেন তাতে দেহের আধারে বাঁধা মানুষের অদ্ভুত জীবনরহস্যই ধরা পড়েছে৷

উপন্যাসের অন্যতম নারীচরিত্র মনোরমা উগ্র ও দুর্দমনীয় লালসার অধিকারী৷ তার সঙ্গে মিশেছে স্বভাব অপরাধীর রক্ত৷ মেঘনাদ সব বোঝে কিন্তু তার দুর্বার আকর্ষণ থেকে সরে থাকতে পারে না৷ নানাভাবে মনোরমা থেকে নিবৃত্ত হতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়৷ আত্মগ্লানিতে জর্জর হয়েও তার দেহের কাছে, তার দুর্বার কামনার কাছে নিজেকে আহুতি না দিয়ে পারে না৷

উপন্যাসে মনোরমা যৌন ও অযৌন অনেক অপরাধ করেছে৷ লক্ষ্য পূরণের জন্য খুনের মতো অপরাধ করতেও তার সামান্যতম হাত কাঁপেনি৷ সে জন্য পাপবোধ বা অনুশোচনার সামান্য অনুভূতিটুকুও তার নেই৷ লেখকের হাতে সৃষ্ট মনোরমার মত লালসাসিক্ত, উগ্রমস্তিষ্ক মায়ামমতাহীন নারীচরিত্র অনন্য মাত্রা লাভ করেছে৷ মনোরমা সম্পূর্ণ নারীস্বভাব বর্জিত৷

ঘ. রক্তের ঋণ :

বহুবল্লভা সিদ্ধেশ্বরী ‘রক্তের ঋণ’ (১৯২৩) উপন্যাসের এক অন্যতম চরিত্র৷ জমিদার কালিদাস চৌধুরীর রক্ষিতা সে এবং জমিদারবাড়ির দাপটশালিনী রাঁধুনিও৷ জমিদারগৃহে যথেষ্ট প্রতিপত্তি তার৷ শুধু জমিদার নয় অন্যপুরুষের সঙ্গেও যৌন সম্পর্কে লিপ্ত সে৷ লেখক তাকে দেহের ক্ষুধায় বন্দিনী নারী হিসেবেই কল্পনা করেছেন৷ তার ব্যভিচারের ফলস্বরূপ কালিদাস চৌধুরীর ঔরসে তার গর্ভে জন্ম নেয় নাগানন্দ৷ সত্য পরিচয় জানতে পেরে মাকে পাপ থেকে মুক্ত করতে সে জমিদারবাড়ির ছায়া থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় কিন্তু ফল হয় বিপরীত৷ মায়ের কামলীলার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হয়৷ স্বেচ্ছাচারিতার মুক্তাঙ্গন পেয়ে সে সম্পূর্ণ পাপপঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে যায়৷ গণিকার সন্তান নাগানন্দ হয় চরিত্রবান এবং লেখাপড়ায় ভালো৷ কিন্তু মাতা-পিতার অসংযত যৌনতার পাপ তার মধ্যেও নিহিত রয়েছে সে আশঙ্কা তার প্রবল৷ আর সেই পূর্বসূরীর যৌনপাপকে অবলম্বন করেই এক যৌবনবতী সন্তানের মা বিবাহিত সাঁওতাল রমণীকে ভোগ করে সে৷ মাতা পিতার দুষিত রক্তের বাহক হয়ে সেও যৌন পাপে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়৷

কীভাবে ব্যভিচারিণী সিদ্ধেশ্বরীর যৌনতার কামার্ত রক্তধারা তার অবৈধ সন্তানের মধ্যে প্রবাহিত হয় এ উপন্যাস তারই আলেখ্য৷

জগদীশ গুপ্ত :

জগদীশ গুপ্ত বাংলা সাহিত্যে একজন মুখ্য ফ্রয়েড প্রভাবিত লেখক৷ তিনি উপন্যাসে যে জগৎ তৈরি করেছেন তাতে বিকার ও বিভীষিকার প্রাধান্য; পাপ, কাম, হিংসা, অকল্যাণ আর অসুন্দরের রাজত্ব৷ চারিদিকের ঘনায়মান অন্ধকারের পীড়নে চরিত্রগুলি পিষ্ট—বিকারগ্রস্ত৷ আর এর সঙ্গে নানাভাবে উঠে এসেছে গণিকাজীবনের কথা; তাদের বাধ্যবাধকতা, আত্মশোধনের নানা দিক৷

ক. লঘুগুরু :

‘লঘুগুরু’ (১৯৩১) উপন্যাসে উত্তম, সুন্দরী এবং টুকী তিনজন চরিত্রের তিনটি জীবনালেখ্য আলোচিত হয়েছে৷ উত্তম গৃহস্থ, সংসার বিমুখ হয়ে একদিন গণিকা হয়েছিল৷ পুনরায় সেই পুরোনো গৃহাকাঙ্খা প্রবলাকার হলে নিজেকে শুধরে বিশ্বম্ভরের স্ত্রী ও টুকীর মা হয়ে উঠেছে৷ তার জীবনের মধ্যকালীন সময়ের সমস্ত পাপ ভুলে লক্ষিত হয়েছে আলোর পথন্বেষা৷ সমাজ তাকে গ্রহণ করেনি৷ টুকী গণিকা মাতার স্নেহধন্যা বলে সংসারের ষড়যন্ত্রে নৈতিকতা থেকে ভ্রষ্টা হতে পা বাড়িয়েছে অন্ধকার পথে৷ সুন্দরী জন্ম সূত্রেই দেহব্যবসায়ী৷ সে তার লোভ, ঈর্ষা, হিংস্রতা নিয়ে বেশ্যা হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত রেখেছে নিজেকে—টুকীকেও অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছে৷

উত্তম :

‘লঘুগুরু’ উপন্যাসের মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র উত্তম৷ লেখক তার নিপুণ সৃজনীক্ষমতায় সৃষ্টি করেছেন এই চরিত্রটিকে৷ তাকে উপন্যাসে মা-মরা টুকীর স্নেহময়ী সৎমা হিসেবে তুলে ধরেছেন৷ সে পূর্বে দেহব্যবসায়ী ছিল৷ গণিকা জীবনের একঘেয়েমি তিক্ততা থেকে মুক্তির জন্য তার ছিল দুর্দান্ত বাসনা৷ সেই বাসনাকে লেখক ব্যক্ত করেছেন এইভাবে—‘‘মানুষকে হাতে পাইয়া তাহাকে বশীভূত করিয়া খেলাইয়া খেলাইয়া পিশাচ করিয়া তুলিবার বিদ্যাটা সে চেষ্টা করিয়া, ভিতরকার বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া শিক্ষা করিয়াছিল—তখন তার নাম ছিল বনমালা—তারও আগের নাম তার যূথী৷ মানুষ সেই যূথীর শত্রু৷ কিন্তু যেদিন ঐ কাজে দুরন্ত ঘৃণা ধরিয়া গেল, আর যেদিন তার বিশ্বম্ভরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল, ঐ দু’দিনের ব্যবধান খুব অল্প—তার হিংস্র পুরুষ-বুভুক্ষা লুপ্ত হইয়া তখন পুরাতন গৃহ-বুভুক্ষা জাগরিত হইয়াছে৷ মনে মনে সে কল্পনা করিত, বিপরীত পথে চলিয়া শয়তানকে শাসন করিয়া মানুষ করিয়া তুলিতেও না জানি কত আনন্দ—ভালবাসা দিয়া সুখী করাও বুঝি সুখের৷’’১৬২ উপন্যাসে আবির্ভূত হওয়ার পর কখনো উত্তমকে দেহের দর হাকতে দেখা যায়নি বরং তখন তার একমাত্র ব্রত ছিল নিজেকে শোধন করা৷ লেখকের ভাষণ এবং চরিত্রগুলির নানা কথার প্রেক্ষিতে উঠে এসেছে তার গণিকা বৃত্তির কথা৷ উত্তম দীর্ঘকাল শরীর বিক্রির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিল৷ কবে কেন কীভাবে সে দেহব্যবসার মতো একটা পেশায় নিজেকে অঙ্গীভূত করেছে তার কোনো হদিস লেখক দেননি৷ তবে একসময় যে সুকোমল নারীত্ব তার মধ্যে অধিষ্ঠিত ছিল, সেই বৃত্তিতে প্রবেশের পূর্বে ছিল কোনো গৃহস্থের গৃহিণীপনা তার ইঙ্গিত লেখক দিতে ভুল করেন নি৷ তাই তিনি বলেছেন যে যৌনতার মধ্য দিয়ে মানুষকে বশীভূত করে প্রবৃত্তির দাসানুদাস হিসেবে প্রতিপন্ন করার পৈশাচিক বিদ্যেটা তাকে কষ্ট করেই আয়ত্ত করতে হয়েছে৷ তার ভিতরকার বিরুদ্ধ শক্তির প্রতিবাদে মানুষকে নিয়ে খেলার কৌশল অর্জন করতে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল অনেক ধৈর্যের৷ তারপরে দেহব্যবসায় সফলতার স্বাদ পেয়েছে সে৷ যুথী, বনমালা ইত্যাদি নামের আড়ালে থেকে বহুদিন নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছে বারবধূ করে৷ তার পরে একদিন তার সেই বৃত্তিতে ধরে গেছে তীব্র ঘৃণার ঘুণ৷ সেই ঘৃণা আরও ভয়ানক হয়ে গেছে নদীর ঘাটে বিশ্বম্ভরকে প্রথম দেখে৷ তার প্রবল পুরুষ বুভুক্ষ মন কাতর হয়েছে নিরিবিলি গৃহসুখ অর্জনের আশায়৷ তার মনে হয়েছে গৃহের চারদেওয়ালে আবদ্ধ হয়ে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে প্রবৃত্তি তাড়িত পুরুষ সমাজকে বশীভূত করে সংসারের মঙ্গলময় মূর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা না জানি কত না সুখের! দুর্দান্ত পুরুষকে স্নেহ-মাধুরী দিয়ে সংসার অভিমুখী করে তোলার মধ্যে নারীজীবনের চিরন্তন সার্থকতাকে ধরতে চেয়েছে সে৷ তাই নিজের প্রচুর ‘পসার’-কে অবহেলায় পদদলিত করে বিশ্বম্ভরের গৃহের গৃহিণী হতে দ্বিধা করেনি৷ বিপত্নীক বিশ্বম্ভরের প্রথম পক্ষের সন্তান টুকীকে আপন করে নিয়েছে নিজের অপরিতৃপ্ত মাতৃত্বকে আস্বাদন করতে৷ সে নতুন স্বামীর সংসারে অধিষ্ঠিত হলে প্রতিবেশিনীদের প্রশ্নবাণে নিজেকে আড়াল করেনি—আড়াল করবার মতো সংকোচ বা সংকীর্ণতা কোনোটাই ছিল না তার৷ তাই প্রতিবেশীরা যখন তার সম্পর্কে কৌতুহলী হয়ে নানা কথা উপস্থাপন করে তার পরিচয় এবং পূর্ব জীবন সম্পর্কে তখন সে উত্তর দেয় অস্পষ্ট অথচ সুনির্দিষ্ট এক বাক্যবন্ধে—‘‘ধরন দেখে, বা না দেখেই যা ভেবেছ তা-ই ঠিক৷’’১৬৩

উত্তমকে চোখে দেখে মোহিত হয়ে গিয়েছিল বিশ্বম্ভর৷ তার প্রতি আন্তরিক আকর্ষণ অনুভব করে তাকে পাবার আশায় মনের সকল শান্তি-স্বস্তি লোপ পেয়েছিল৷ অবশেষে তার অন্যমনস্কতার সমস্ত কারণ ধরা পরে ভগিনীপতি লালমোহনের কাছে৷ সে উত্তমের চেহারার বর্ণনা করে বলে—‘‘রং ফর্সাও নয়, কালও নয়; শরীর মোটাও নয়, রোগাও নয়, তার স্বাস্থ্য ভাল, গড়ন লম্বাটে—সেইজন্যেই দোহারা দেখায়—পরণে ‘গঙ্গা-যমুনা’ পাড় শাড়ী, সাদা সেমিজ; নাকের অগ্রভাগ একটু চাপা, টানা টানা ভুরু, বড় বড় চোখ ইত্যাদি৷’’১৬৪ লালমোহনের সহায়তায় বিশ্বম্ভর গৃহসুখ বুভুক্ষ উত্তমকে লাভ করেছিল৷ কিন্তু একজন গণিকা গৃহবধূ হলে সমাজ তাকে মেনে নেবে কেন! উত্তম টুকীর প্রতি আন্তরিক বাৎসল্যে নিজের পূর্বজীবনের সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করতে থাকে৷ শুধু অবশিষ্ট রাখে নিজের সৎ সংকল্প এবং অসীম ধৈর্য৷ বিশ্বম্ভর তাকে ঘরে তুলেছিল নিজের মুঠোর মধ্যে পুরে তাকে সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ব করতে, তার প্রথম স্ত্রী হিরণ যেমন করে তার মুঠোর মধ্যে আবদ্ধ থাকত৷ কিন্তু দু-একদিনেই তার সে ভ্রম ভেঙ্গে যায়৷ উত্তম স্বাধীন৷ লাজ-লজ্জা-সংকীর্ণতার বালাই নেই তার৷ বহুপুরুষ পরিচর্যাকারিণী এই নারীর জীবন সংসারের নানাবিধ অভিজ্ঞতায় পূর্ণ৷ তাই তাকে দেখে বিশ্বম্ভরের মনে হয়—স্ত্রীর নবতর এবং উৎকৃষ্টতার রূপ সে৷ স্ত্রীকে গণ্ডির মধ্যে ফেলে ইচ্ছামত নিষ্পেষণ করা যায়—স্ত্রী সেই পেষণের প্রতিবাদ করে কখনোই ছেড়ে যেতে পারবে না কিন্তু এই স্বাধীন বিহঙ্গ জীবনের অবাধ স্বাধীনতাসুখ উপভোগ করে স্বেচ্ছায় ডানাগুটিয়ে পিঞ্জরে ঢুকেছে৷ এর বন্দিত্ব চিরকালের নয়৷

উত্তম স্বেচ্ছায় নতুন করে ঘর বাঁধার বাসনায় বিশ্বম্ভরের ঘরে স্থান নিয়েছে৷ কিন্তু তার মনের যে দুর্দান্ত কামনায় বন্যপশুকে পোষ মানিয়ে সংসারী করার বাসনা প্রকট ছিল তা তার আর পূর্ণ হয়নি৷ বিশ্বম্ভরের তাণ্ডবে প্রাণ হারাতে বাধ্য হয়েছিল ভীতা-সন্ত্রস্ত হিরণ৷ স্ত্রীর সেই নির্মম মৃত্যুতে মদ্যপান ছেড়ে দিয়ে, চেষ্টা করেছিল সংসারী হওয়ার৷ আগে থেকেই এই হারমানা মানুষটির আচরণ উত্তমকে দুর্বৃত্তদমনের আস্বাদ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করেছে, হতাশ করেছে৷ হিরণের নির্মম মৃত্যু তার নারীহৃদয়কে আদ্র করে অশ্রুপাত করালে তা নিয়ে স্বামী তাকে ঠাট্টা করে৷ একজন গণিকার একজন সাধারণ নারীর জীবন-দুর্দশায় কাতর হওয়া বিশ্বম্ভরের মত মানুষের কাছে হাস্যকরও বটে৷ কারণ সে গৃহিণী হলেও বহুপুরুষ ভোগ্যা৷ স্বামীর সেই ব্যঙ্গোক্তিকে উত্তম নিজের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবেই গ্রহণ করেছে৷ কারণ তার জীবনে এমন বহুদিন বিগত হয়েছে যখন সে মানুষের শোকে কাঁদেনি; মানুষকে শুধু কাঁদিয়েই গেছে৷ সে বহুপুরুষ ভোগ্যা বারবিলাসিনীরূপে জীবনের বহু সময় অতিবাহিত করেছে৷ সেখানে প্রায় প্রতিনিয়তই শুনে এসেছে পুরুষের পৌরুষের মিথ্যে বড়াই৷ আর সেই পৌরুষহীন পুরুষত্বের অধিকারীরা নিজের স্ত্রীকে কৃপাভিক্ষু করে পদদলিত করে আত্মসুখ চরিতার্থ করে বারাঙ্গনাগৃহে গিয়ে৷ তার মতে বিশ্বম্ভরও সেই দলের৷ উত্তম গণিকা হলেও তার মধ্যেকার সংস্কার সংযম নীতিবোধ কোনো কিছু উবে যায়নি৷ সে তার নতুন ঘরকন্নার আশ্রয়ে নিজেকে সর্বদা ভুলিয়ে রাখতে চায়৷ স্বামীর সেবা করে, মেয়েকে শিক্ষা-সংস্কার দান করে আদর্শ জননীর স্নেহধন্য শিষ্টাচারসম্পন্ন করে তুলতে চায়; কিন্তু তার সেই সংসার গোছানোকে ব্যঙ্গ করে প্রতিবেশীগণ, স্বামীর ইয়ারবক্সীর দল এমন কি স্বামী নিজেও৷ স্বামীর ইয়ার বন্ধুর দল তাদের বাড়িতে মদ-মাংসের আসর বসাতে চাইলে এবং সেখানে উত্তমকে মধ্যমণি হিসেবে উপস্থাপিত করতে চাইলে উত্তম স্বামীর কাছে জানতে চায় তার পূর্বস্ত্রী সেরূপ করতো কি না৷ উত্তমের সেই কথায় স্বামী জিব কেটে জবাব দেয়—‘‘না, না; সে ছিল বউমানুষ—’’১৬৫ মদের আসরে বসতে অস্বীকার করে উত্তমের সেই ব্যবহারে তার স্বামীর বন্ধুরা তাকে ‘নিষ্ঠাবতী খাণ্ডরী’ অপভাষণে অভিষিক্ত করলেও তার স্বামীর সেখানে কিছু বক্তব্য থাকে না৷ তার বন্ধুরা তারপরে সময়ে অসময়ে উত্তমকে দেখার অছিলায় তার সঙ্গে কথা বলার অছিলায় তাদের বাড়ি উপস্থিত হলেও মেরুদণ্ডহীন বিশ্বম্ভর কিছু বলতে পারে না৷ সে উত্তমকে বিয়ে করে স্ত্রীর অধিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত করলেও তাকে উপভোগ করেছে গণিকা হিসেবে৷ বন্ধুদের সামনে মদের আসর বসিয়ে বেশ্যার সঙ্গদান কামনা করেছে দ্বিতীয় পক্ষের এই স্ত্রীর কাছে৷ তারপরে সে যখন মেয়ে টুকীকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে হিন্দু ঘরের নানা আচার-নিয়ম পালনে কর্তব্যরত তখন তার সেই কর্তব্য কর্মকে অবহেলা করেও বর্ষিত হয় বিশ্বম্ভরের অপমানকর বাক্যবাণ—‘‘তোমার শুচিবাই দিন দিন বাড়ছে দেখছি৷ গেরস্তের ঘরে ওটা কিছু কিছু থাকা ভাল; কিন্তু তুমি অনেক গেরস্তের বৌকেও হার মানিয়ে দিতে পার৷’’১৬৬ প্রতিবেশীদের মুখে টুকীর অকল্যাণকর মন্তব্যও বিশ্বম্ভরের চিত্তকে চঞ্চল করে তোলে৷ তারা যখন বলে বেশ্যার হাতে লালিত বলে কেউ টুকীকে বিয়ে করবে না অথবা উত্তম তার ভবিষ্যতের রাস্তা পরিষ্কার রাখার জন্য তাকে পুরদস্তুর গণিকা বানিয়ে ছাড়বে, বা তাকে নিয়ে পালিয়েও যেতে পারে তখন তাদের মুখের সেই কথা উত্তমের প্রতি বিশ্বম্ভরকেও অবিশ্বাসী করে তোলে৷ কিন্তু দুর্বলচিত্তের বিশ্বম্ভরের কোনো এক দুর্বলতা তাকে বিশ্বাসঘাতিনী, টুকীর অনিষ্টকারিণী ভাবতে সায় দেয় না বরং ভরসাদাত্রীই মনে হয়৷ সে তার মনের সেই দোলাচলতা গোপন রাখেনা স্ত্রীর কাছে৷ উত্তম তার স্বার্থহীন ভালোবাসার নজির দিয়ে তার বহুদিন ধরে জমানো তাড়া তাড়া নোট এবং রাশি রাশি অলংকার দেখায় স্বামীকে৷ সে যে টাকা রোজগারের জন্য আসেনি এবং তার নিজেরও যে টাকার অভাব নেই তা বুঝতে অসুবিধা হয় না বিশ্বম্ভরের৷ উত্তমের সেই বিপুল সম্পদ তার মনের সমস্ত সংশয়কে দূরে ঠেলে দেয়৷ উত্তম তার বেশ্যাজীবনে প্রচুর অর্থ কামিয়েছে যা দিয়ে তার বাকি জীবন অনায়াসে অতিবাহিত করতে পারতো; প্রতিবেশীদের সন্দেহপ্রবণতা, অপমানকর কথাবার্তা, বিশ্বম্ভরের ভালোবাসার সঙ্গে দেহভোগের কামনা কিছুই তাকে ভোগ করতে হত না৷ দেহব্যবসা না করলেও তার নিজের একটা জীবন নিয়ে কোনো অসুবিধা ছিল না৷ তারপরেও সে যে কেন পুনরায় সংসারে আবদ্ধ হওয়ার জন্য সতৃষ্ণ হয়ে উঠলো সে খবর সে নিজেও জানে না৷ তার ভেতরে বাইরে কোথাও বিশ্বম্ভরের স্থান তেমন উচ্চ নয় তথাপি তাকে প্রথম যেদিন চাক্ষুষ দর্শন করে সেদিন থেকেই—‘‘গৃহবাসিনী হইয়া লালিত হইবার, লালন করিবার ইচ্ছার উত্তেজনা তাহাকে বোধ হয় অসহিষ্ণু চক্ষুহীন করিয়া দিয়াছিল৷ সে আকাঙ্খা আর ইচ্ছা আজও তেমনই অখণ্ড ও অটুট আছে, গঞ্জনার প্রহারে তাহার গায়ে দাগ পড়ে নাই; কিন্তু তার সেই ইচ্ছাকে বিশ্বম্ভর যেন দুস্তর অগ্নিপরীক্ষায় ফেলিয়া যাচাই করিয়া লইতেছে৷’’১৬৭ স্বামী যখন বার বার মনে করিয়ে দেয় তার পূর্বের জীবনের কথা তখন বিরক্ত হয়ে উত্তমকে বলতে শোনা যায় সে যে কি ছিল তা সে কখনো ভুলে যায় না এবং তাকে বার বার মনে করিয়ে দেওয়াও অনাবশ্যক, তারপরেও বিশ্বম্ভর তার অভ্যাস ভোলে না৷ প্রতিবেশীরাও গণিকা জীবন নিয়ে খোঁটা দেওয়া নিজেদের কর্তব্য মনে করে, আর সেই কর্তব্যের বশেই মাতৃস্নেহে অন্ধ কিশোরী টুকীর মনে বিষ ঢেলে দিতে জিজ্ঞেস করে তার মায়ের গহনা প্রাপ্তির ইতিহাস৷ টুকী সেই গহনা তার বাবা দিয়েছে বললে অশ্লীল ঠাট্টা-বিদ্রুপে তাকে বিদ্ধ করতে বলে—‘‘এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট নয় দশ—বিশ—ত্রিশ—শ—দুশো—অঙ্গদ রায়বারের রাবণ রাজা—যেদিকেই চাই সেদিকেই তোর—হা হা হা ৷’’১৬৮ সংসারজীবনে অনভিজ্ঞ টুকী মোক্ষদার মায়ের সেই অশ্লীল ইঙ্গিত বুঝতে না পারলে বোঝানোই যার উদ্দেশ্য সে ছাড়বে কেন! তাই সেই রমণী আড়ালে নিয়ে গিয়ে তাকে বোঝায় যে তার মা বেশ্যা ছিল৷ শুধু সেটুকুই নয় বেশ্যার প্রকৃত স্বরূপ কি তা ভালোভাবে অবগত হতে টুকীকে প্রায় জোর করে পাঠায় তার মায়ের কাছে৷ উত্তম তার অতীত জীবন নিয়ে কোনো রাখ-ঢাক রাখতে চায়নি৷ বিশ্বম্ভর তো আরও নয়৷ কিন্তু বাড়ন্ত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারেনি এতদিন৷ প্রতিবেশীদের দ্বারা ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ মেয়ের মুখ দেখে শিউরে ওঠে সে৷ সে তার ক্লেদাক্ত জীবনের কোনো কথাই টুকীর সামনে উপস্থাপন করার সাহস পায় না৷ তাকে সদা সন্ত্রস্ত থাকতে হয় পাছে তার আচরণে গণিকাসুলভ কিছু প্রকটিত হয়ে টুকীকে সংশয়ী করে তোলে৷ সে তার সম্পূর্ণ জীবনে একমাত্র সম্পদ হিসেবে পেয়েছে টুকীকে৷ কোনো সুদূর অতীতে কেন গৃহস্থের সুখী পরিবেষ্টনী থেকে বেড়িয়ে গিয়ে তাকে গণিকা হতে হয়েছিল সে ইতিহাস অব্যক্ত৷ বিশ্বম্ভর তাকে ঘরে তুলেছে যে খেয়ালে সেখানে ভালোবাসা ও স্বার্থ পরিব্যাপ্ত৷ প্রথম দিকের স্বার্থ ছিল যৌনক্ষুধা, বিপত্নীক জীবনের শূন্যতা, শেষের দিকে বিপুল অর্থ৷ কিন্তু টুকীর সঙ্গে মা-মেয়ের সখ্যতায় কোনোরকম স্বার্থ আরোপিত নয়৷ সেখানে সীমাহীন বাৎসল্য ও শ্রদ্ধায় পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত৷ সেই বন্ধনই তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি৷ তাই প্রথম থেকেই তার সেই অপার মমতা সীমাহীন ধৈর্যের সঙ্গে বর্ষিত হয়েছে টুকীর প্রতি৷ তার জীবন টুকীময়৷ সে কোনোভাবে হারাতে চায় না তার জীবনের সেই বড় প্রাপ্তিকে৷ কোনোভাবে আঘাত করতে চায় না টুকীর সুকুমার হৃদয়বৃত্তিকে৷ তাই টুকী এসে যখন মোক্ষদার মায়ের সমস্ত কথা মায়ের সামনে ব্যক্ত করে ‘বেশ্যে’ শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করে তখন সেই শব্দটা কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সীমাহীন আশঙ্কায় তার কান রুদ্ধ হয়ে যায়৷—‘‘যে অতীত সে প্রাণপণে মুছিয়া দিয়াছিল, তাহাই যেন নবারুণের স্নিগ্ধ আলোক গায়ে মাখিয়া সুসজ্জিত হইয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইল৷ জীবনের প্রবাহ তখন অবিচ্ছিন্ন স্বচ্ছ গৃহগোমুখীতে তার উৎস৷ কিন্তু যেদিন সেই প্রবাহ পঙ্কিল হইয়া উঠিল, সেইদিন আকাশের আলোক প্রবাহবক্ষে একবার জ্বলিয়া উঠিয়াই অদৃশ্য হইয়া গিয়াছিল৷ সে ভুল যেমন চিরসঙ্গী তেমনই অমার্জনীয়—তারপরের কথাগুলি সে ভাবিতে পারিল না—বুকে যেন কাঁটা বিঁধিতে লাগিল৷’’১৬৯ সে বহুদিন গৃহকন্নার মধ্যে নিজেকে আটকে রেখেছিল৷ তারপরে আসে সেই চরম মুহূর্ত যখন পঙ্কিল জীবনের আষ্টেপৃষ্ঠে সম্পূর্ণ বদ্ধ সে ৷ আর যে কর্দম গায়ে মেখে জীবনের স্বচ্ছ প্রবাহকে জটিল করে তুলেছিল সে কর্দম কোনোদিনই তার জীবন থেকে মুছবার নয় তা ভালো করে বুঝে গেছে উত্তম ৷ তার শেষ জীবনে একমাত্র সুখের আশ্রয় মেয়ে টুকী মায়ের সেই মানসিক পরিস্থিতির কথা ভেবে আতঙ্কে কন্টকাকীর্ণ হয়েছে৷ বিশ্বম্ভর মেয়ের কাছে সেই কথা শুনে লঘু হাস্য-পরিহাসে তা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে শোনা যায় উত্তমের মুখে কঠিন তিরস্কার—‘‘আমার নাম সবাই জানে, মোক্ষর মা যা বলেছে তাই বলে৷ কিন্তু টুকীর কাছে ও কথাটি গোপন রাখতে চেয়েছিলাম, তুমি তা রাখতে দিলে না৷’’১৭০

টুকীকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই উত্তমের৷ সে জানে তার শরীরের কালিমা কোনোদিনও সমাজ অপসারিত হতে দেবে না—সাধারণ গৃহবধূর মতো কোনোদিনও তার ঠাঁই হবে না কিন্তু তার মেয়ে টুকী? তার হাতে তার স্নেহে লালিত বলে টুকীর প্রতিও যদি আরোপিত হয় কলঙ্কের কর্দম তা হলে সে নিজেকে মুখ দেখাবে কি করে৷ টুকী সুশ্রী, সুস্থির, সুলক্ষণা, শিক্ষিত, গৃহকন্নায় সুনিপুণা৷ এমন কন্যার ভবিষৎ ভেবে আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখতে থাকে মা৷ যে মেয়েটি তার পেটের মেয়ে নয়—একেবারে পর—তার দিকে তাকিয়ে একটা অজানা ভয়ে তার সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে৷ তার দেওয়া অর্থকে পুঁজি করে দোকান করে বিশ্বম্ভর অর্থবান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়৷ প্রতিবেশীরা টাকাওয়ালা বলে তাদেরকে আর বেশি ঘাটাতে সাহস পায় না৷ সকলেই কম-বেশি মুখাপেক্ষি তাদের৷ উত্তম আদর করে তাদের আপ্যায়ন করে, ধার দেয়, বিনিময়ে কোনোদিন স্বতোপ্রণোদিত হয়ে সেই ধারের কথা মুখেও উচ্চারণ করে না—কিন্তু সেই সুখী নির্বিবাদ ঘরকন্নার মধ্যেও টুকীর ভবিষ্যৎ ভাবনা থেকে কখনোই মুক্তি পায় না সে৷ অবশেষে তার সেই দুর্ভাবনা বাস্তবরূপ নিয়ে আঘাত হানতে শুরু করে৷ গোপন শত্রুর চরম শত্রুতায় টুকীর পরপর বিয়ে ভেঙে যেতে থাকে৷ চার-পাঁচবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে উত্তম ও বিশ্বম্ভর দিশেহারা হয়ে পড়ে৷ চরিত্রবতী উপযুক্ত শিক্ষাপ্রাপ্ত সুন্দরী কিশোরী কন্যার শুধুমাত্র গণিকার স্নেহধন্যা বলে কোনো গৃহস্থ বধূ করে নিতে দাক্ষিণ্য করে না৷ তাকে সংসারে প্রতিষ্ঠা করার মতো হৃদয়বত্তার সন্ধান মেলেনা৷ মেয়ের অন্ধকারময় জীবনের ভাবনা ভয়ে বিহ্বল করে দেয় উত্তমকে৷ সে জানে সংসারের পীড়ন কাকে বলে৷ সে জানে একজন বারবনিতার সমাজে কোথায় স্থান৷ টুকী দেহব্যবসায়িনী নয়, গণিকা নারীর স্নেহে লালিত হলেও গণিকা হওয়ার শিক্ষাও সে পায়নি কোনোদিন৷ শুধুমাত্র মা-মরা মেয়েটি বারাঙ্গনার বাৎসল্যে বড় হয়েছে বলে সমাজের চোখে সে গণিকাতুল্য৷ কোনো গৃহস্থ গৃহবধূরূপে তাকে বরণ করতে রাজী নয়৷ সমস্ত ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় উত্তমকেই৷ বিশ্বম্ভর যারপরনাই তিরস্কার করতেও দ্বিধা করে না—সবটা জেনে বুঝেও৷ নিজের প্রতি নিজের আত্মগ্লানিতে বিপর্যস্ত উত্তম সমগ্র স্নেহবাৎসল্য দিয়ে গড়া তার সোনার প্রতিমার সেই ভয়াবহ দুর্ভোগের জন্য নিজেকেই দায়ী করে৷ সে তার চির আদরের ধন টুকীকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে যখন বলে—‘‘টুকী, আমায় তুই ক্ষমা কর—আমি তোকে সুখ দেব ব’লে আসিনি, কিন্তু তোর সুখ ইচ্ছে করেছি, ভগবান তা জানেন৷ কিন্তু অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালাম আমিই৷’’১৭১ তখন উত্তমের সেই নিদারুণ আত্মপীড়া তার হৃদয়ের পবিত্র মাতৃধারাকে উদ্ভাসিত করে তোলে৷ শেষ পর্যন্ত এক চরিত্রহীন, বয়স্ক, মদ্যপ পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হয় উত্তম-বিশ্বম্ভর৷ সেই অপাত্রে সোনার পুত্তলিকে সমর্পণ করে নিদারুণ বিষজ্বালা বহন করে গণিকা থেকে গৃহিণী—উত্তম৷ টুকীকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে জীবনের উদ্দেশ্যশূন্য হয়ে যায় উত্তমের৷ তার মায়ের মন উপলব্ধি করতে পারে তার মর্মযন্ত্রণা৷ বিশ্বম্ভর তাকে কোনোদিনও বোঝেনি তার স্থূলবোধে নারীত্বের মান-অপমানের কোন ভিত্তিভূমি নেই৷ টুকীর বিয়ের পর উত্তম আর সরাসরি হাজির হয়নি উপন্যাসটিতে৷ বিশ্বম্ভরের শ্লেষ উক্তির মধ্য দিয়ে তার কন্যাবিহনে অসুস্থতার কথা, অশ্রুবিসর্জনের কথা উঠে এসেছে মাত্র৷ এর মধ্য দিয়েও এক স্নেহাতুরা মাতার স্নেহবুভুক্ষ হৃদয়ের বার্তা প্রতিফলিতই হয়েছে যা উত্তমকে অনবদ্য করে তুলেছে৷

টুকী :

‘লঘুগুরু’ উপন্যাসে যেমন উত্তম গণিকাবৃত্তিকে সমূলে উৎপাটন করে গৃহিণী হয়ে উঠার চেষ্টা করেছে তার বিপরীত চরিত্র টুকী৷ সীতা-সাবিত্রীর আদর্শে আদর্শায়িত সুলক্ষণা, গৃহকর্মে সুনিপুণা এবং নম্র-মার্জিত চরিত্রের টুকী জীবনের জটিল আবর্তে পা বাড়িয়েছে গণিকা জীবনে৷ উত্তম আগে বেশ্যা ছিল—সমগ্র উপন্যাস জুড়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করেছে আর টুকী সারাজীবন সতীর সাধনা করেও সমাজের নিষ্পেষণে অনির্দেশ্য অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেছে৷

টুকী জন্মলগ্নে তার মাকে হারিয়ে প্রতিপালিত হয়েছে উত্তমের দ্বারা৷ উত্তমকে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী করে ঘরে তুলেছে টুকীর বাবা বিশ্বম্ভর৷ উত্তম বেশ্যা থেকে গৃহিণী হয়ে—তার শিক্ষা-সংস্কার রুচিশীলতা দিয়ে বড় করেছে টুকীকে৷ সেই রুচি গণিকার নয় তা অবশ্যই সুস্থ সুন্দর মাতৃত্বের৷ কিন্তু গণিকার দ্বারা প্রতিপালিত বলে তার স্থান হয়নি কোনো আদর্শবান ভদ্র পরিবারের গৃহিণীরূপে৷ পাঁচবার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর তার বাবা-মা বাধ্য হয়ে তাকে বিয়ে দেয় বাহান্ন বছরের পরিতোষের সঙ্গে৷ তার পরেও আপত্তি ছিল না টুকীর৷ মায়ের আদেশ ও সীতা-সাবিত্রীর আদর্শেই সে মেনে নেয় বয়স্ক স্বামীসঙ্গকে৷ অনেক পণসামগ্রী সহযোগে সে যখন স্বামীগৃহে পদার্পণ করে তাকে আপ্যায়ন করে ঘরে নিয়ে যায় আরেক যুবতী—নাম সুন্দরী৷ টুকী প্রথমে তাকে স্বামীর আত্মীয়ই ভেবেছিল, পরে বুঝতে পারে তার সঙ্গে স্বামীর সম্পর্কের অন্য কোনো যোগসূত্রের কথা৷ তাই যখন স্বামীকে জিজ্ঞেস করে ‘দিদি তোমার কে?’’১৭২ স্বামী নিরুদ্বিগ্ন মনে জবাব দেয়—‘‘তোমার মা তোমার বাবার যা হয়৷’’১৭৩ টুকী চিরকাল মায়ের মুখে স্বামী পরম দেবতা কথাটি শুনে এসেছে, সতীনারীদের আদর্শ বহন করে এসেছে কিন্তু স্বামীর সেই ঘৃণ্যরূপ সে কোনো দিন কল্পনা করতে পারেনি৷ পরিতোষ তার সম্মুখেই তার রক্ষিতার সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশায় মেতে ওঠে, তাকে অবহেলা করে—এমনকি সুন্দরীর দ্বারাও পীড়িত হতে হয় তাকে৷ সে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখেছে তার বাবা তার মাকে অতীত জীবন নিয়ে খোঁটা দিয়েছে, আর তার মায়ের সেটাই ছিল সবচেয়ে যন্ত্রণার জায়গা৷ তাই তার উপলব্ধি হয় যে তার মা সকল ধৈর্যশক্তি ও স্নেহ দিয়ে ঢেকে রেখেছিল তার বাবার কুৎসিত রূপটাকে যার জন্য টুকী তা ধরতে পারেনি৷ নইলে সে কোনোদিনই তার বাবাকে অতটা ভক্তি করতে পারতো না৷ তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে সীতা-সাবিত্রী যে স্বামীর জন্য জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করেনি সেই স্বামীরা পরিতোষ বিশ্বম্ভরের মতো কখনো ছিল না৷ তার পরেও সে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে সতীর আদর্শেই স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়৷ স্বামীর নির্দেশ মতো বাড়ি থেকে টাকা আনিয়ে স্বামীকে তুষ্ট রাখে৷ তার বাবা তাকে দেখার জন্য তাদের বাড়ি উপস্থিত হলে সে সুন্দরীকে দিদি বলে পরিচয় দেয় কিন্তু স্বামী পরিতোষ সুন্দরীর সঙ্গে সত্যিকারের সম্পর্ক অকপটে প্রকাশ করে দেয়৷ সেই অপমানের মর্মজ্বালায় স্বামীকে রেহাই দেয় না টুকী৷ চরম অপমানে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সে সুন্দরীর নীচতা ও উত্তমের মহানুভবতাকে সদর্পে ঘোষণা করে বলে তার মা ও সুন্দরীর সঙ্গে বিস্তর তফাত সে যেন তার তুলনা করতে না যায়৷ যত সময় গেছে ততই টুকীর সামনে উপস্থিত হয়েছে পরিতোষ, সুন্দরীর কুৎসিত জীবন-যাপন, তাদের শিক্ষাহীন, রুচিহীন ইতর মন-মানসিকতা৷ মার্জিত রুচির টুকী সহজে তা মেনে নিতে পারেনি৷ অশ্রুবিসর্জন করে সব কিছুর সঙ্গে আপোষ করতে না পেরে অহরহ নিজের মৃত্যু কামনা করেছে৷ তারপর একসময় তার দেহের প্রতি তীব্র ঈর্ষা ও লোভকে প্রকটিত হতে দেখেছে সুন্দরীর চোখে৷ সে সেই দেহকে কাজে লাগিয়ে উপার্জন করার অস্ফুট ইঙ্গিত জ্ঞাপন করতে ভোলেনি৷ সরলমনের টুকীর সেই ইঙ্গিতের তাৎপর্য বোধগম্য হয়নি৷

টুকীর জীবনে জটিলতা যত বেড়েছে সে তত তার মায়ের মুখ মনে করার চেষ্টা করেছে—পালন করার চেষ্টা করেছে তার আদেশ৷ সুন্দরী তার কাছ থেকে তার কোমল মনের সুযোগ নিয়ে গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে অর্থ উপার্জনের জন্য সে যা বলবে টুকী তা করবে৷ সেই ঘটনার সূত্র ধরেই সুন্দরী তার ঘরে অতিথি করে এনেছে অচিন্ত্য বাবুকে৷ উপন্যাসের চূড়ান্তভূমি স্পর্শক স্থান এই অংশটিই৷ সুন্দরী অচিন্ত্যবাবুর কাছে অগ্রিম টাকা নিয়ে টুকীর জন্য বেশ্যাবৃত্তির দালালি করতে এসেছে৷ যখন সে বুঝতে পারে—লজ্জায় ঘৃণায় পাথর হয়ে যায় সে৷ শেষবারের মতো চেষ্টা করে মায়ের নাম উচ্চারণ করে শক্তি সঞ্চয় করার৷ কিন্তু তা আর হয়ে উঠে না৷ মা বলতে গিয়ে মুখ দিয়ে নিরর্থক একটু শব্দহীন বাতাস বেড়িয়ে যায়৷ অবশেষে নিজের সমস্ত শক্তিকে একত্রিত করে প্রতিস্পর্ধী হয়ে সে অচিন্ত্যবাবুকে বলে—‘‘আসুন৷… আমার সঙ্গে৷… একাজ যদি করতে হয়, তবে আমি আপনাকে দেব দেহ, আপনি আমাকে দেবেন টাকা৷ মাঝখানে ওরা কে?’’১৭৪ অচিন্ত্যবাবু হতভম্ভ হয়ে যায়৷ এক সরলা গ্রাম্যবধূর মুখে এহেন তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে সে শোনেনি বোধহয় কোনোদিন৷ আর সুন্দরী! সেও অত বিস্মিত কোনোদিন হয়নি৷ অবশেষে দুজনকে চরম অপমান করে নিজে বেড়িয়ে যেতে চেয়েও সুন্দরীর নিয়ে আসা সেই খদ্দেরকে বের হতে বললে তাকে আক্রমণ করে সুন্দরী কিন্তু ততক্ষণে টুকী বাড়ির চৌকাঠ পার হয়ে ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে৷

টুকী তার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে এসেছে তার মায়ের চরম অপমানকর জীবন-যাপন৷ তার বাবা ভালোবেসে ঘরে তুলেও তাকে সেই অপমান জ্বালা থেকে মুক্তি দেয়নি৷ কীভাবে পুরুষের কাছে নারীর জীবন খেলো হয়ে যায় বিমাতার কাছে সাংসারিক জ্ঞান নিতে নিতে সেই পাঠটিও সে পরিবেশ থেকে নিপুণভাবে অধ্যয়ন করতে পেরেছে৷ শ্বশুরবাড়িতে স্বামীর লাম্পট্য, গণিকার কর্তৃত্ব তার সুকুমারবৃত্তিকে আঘাত করে নারীত্বের চিরন্তন অস্তিত্বকে নষ্ট করে দিয়েছে৷ সে বার বার ভয়ে ভেঙে যাওয়ার মুহূর্তেই ধরে নিয়েছিল জীবন কোথায় যেতে পারে৷ মাকে বলে বিয়ের চেষ্টা থেকে বিরত হয়ে সেই অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যৎ থেকে নিজেকে সরাতে চেয়েছিল৷ যদিও জানে গণিকা প্রতিপালিত বলে বিয়ে হলেও তার মুক্তি নেই, না হলেও নয়৷ তারপরেও চরিত্রহীন, লম্পট স্বামীর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে প্রাণপণে কিন্তু শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়েছে৷ যে গ্লানিময় জীবন থেকে বেড়িয়ে এসে উত্তম টুকীর জন্য সুস্থ ঘরকন্নার স্বাদ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিল সেই অপযশেই টুকীকে পা বাড়াতে হয়েছে উত্তমের পূর্বজীবনে৷ লেখক টুকীকে দিয়ে সরাসরি দেহের দর হাকাতেই বাধ্য করেননি তাকে ঠেলে দিয়েছেন সীমাহীন অনির্দেশ্য অন্ধকারে৷ বাড়ির চৌকাঠ অর্থাৎ নিরাপত্তার আবেষ্টনী এবং গৃহ-সংসারের বন্ধনী থেকে অন্ধকার বিশ্বের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে দেহব্যবসার অসংশোধনযোগ্য পাপপঙ্কে নিমজ্জিত করেছেন তাকে৷ যে জীবনে কোনোদিন আলোর সূর্য উঠেনা—সমাজ যেখান থেকে চাইলেও বেড়িয়ে আসতে দেয়না; লেখক টুকীর জন্য নির্দিষ্ট করেছেন সেই পথ৷

সুন্দরী :

সুন্দরী টুকীর স্বামী পরিতোষের রক্ষিতা৷ নিম্নশ্রেণীর দেহজীবী সে৷ তার সঙ্গে পরামর্শ করেই পরিতোষ বিপুল অর্থ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছিল গণিকা বিমাতার দ্বারা প্রতিপালিত টুকীকে৷ কিন্তু টুকীর বিমাতা উত্তমের ছিল আলোর সাধনা, পঙ্ক থেকে মুক্ত হয়ে পঙ্কজ হয়ে ওঠার সাধনা৷ সুন্দরীর তা নয়৷ সে লোভী৷ মা-ঠাকুমার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে সে অর্জন করেছে দেহব্যবসায়ের পেশা৷ তার কামনা শুধু অর্থ এবং কায়িক সুখ৷ টুকী যখন নববধূবেশে আঠারোশত টাকা নিয়ে সুন্দরীর ডোমপাড়ার বাসভবনে প্রবেশ করে তখন লণ্ঠন হাতে তাকে ঘরে নিয়ে যায় সুন্দরী৷ বধূর সুন্দর মুখশ্রী তার মনে অপার সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দেয়৷ টুকীকে ঘরে বসিয়েই সে পরিতোষের কাছ থেকে পণের হিসেব বুঝে নিতে ভুল করে না৷ পরিতোষকে হাত মুখ ধোওয়ার অবকাশ না দিয়েই সে হস্তগত করে পণের পনেরো’শ এবং গহনার জন্য দেওয়া তিনশত টাকা৷ কিন্তু সেই বিশাল অঙ্কের টাকা ভোগ করার ভাগ্য হয় না সুন্দরীর৷ তার শত সচেতনতার মধ্যেও সাময়িক নিদ্রার সুযোগে সিঁদ কেটে টাকার বাক্স চোরের হস্তগত হয়ে গেলে ভয়ানক চিৎকারে সে পাড়া মাথায় করে তোলে৷ সুন্দরীর জীবনে অর্থই সব৷ তাই অর্থের শোকে নাওয়া-খাওয়া ভুলে শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়ে থাকে সে৷ লেখক তাঁর শোকসন্তপ্ত চেহারার বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে—‘‘সুন্দরীর চোখের পাতা ফুলিয়া আমড়ার মত দেখাইতেছে৷ যেন দুনিয়ার শোক একত্র হইয়া বটিকাকারে সুন্দরীর চোখের পাতায় আসিয়া বসিয়াছে৷’’১৭৫

সুন্দরী লক্ষ্য করে টুকীর সংসারের জন্য গভীর নিষ্ঠাকে৷ তুলসীমঞ্চ, লক্ষ্মীপ্রতিমা প্রতিস্থাপন এবং নানা দেব-দেবীর আরাধনার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চায়৷ তার সেই মাঙ্গলিক ধর্মানুষ্ঠান নিয়ে ব্যঙ্গ করতে গিয়ে তার নারীসত্তা শিউরে ওঠে৷ সে লক্ষ করে তার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছে৷ তারপর যখন সে টুকীর মুখে শোনে যে টুকী তার জীবনের সমস্ত আদর্শ তার মায়ের কাছ থেকে আয়ত্ত করেছে তখন তার বহুপুরুষ আসক্ত জীবন এক বারবনিতার আদর্শ বহন করা এক নারীর নিষ্ঠা দেখে খিল খিল করে হেসে ওঠে৷ তার সেই হাসি কঠিন ও বিভৎস৷ সে টুকীকে দেহব্যবসার ইঙ্গিত দিয়ে বলে—‘‘টাকা কিছু জমিয়ে নিয়ে ধর্ম্মনিষ্ঠে করলে দু’কালেরই উপায় হয়৷’’১৭৬ সুন্দরীর এই উক্তি দ্ব্যর্থক৷ একদিকে যেমন টুকীকে বেশ্যাবৃত্তিতে ইন্ধন জোগানো অন্যদিকে উত্তমের বেশ্যাবৃত্তি ছেড়ে প্রচুর অর্থ নিয়ে পুনরায় গৃহিণী হওয়ার জন্য তীব্র খোঁচা৷ তার সেই বাক্যভঙ্গি তার বিভৎস ভয়ানক মুখচ্ছবি দেখে টুকীর মনে হয় সুন্দরী তার মায়ের সঙ্গে নিজের তুলনা করে পরাভবের জ্বালায় দমফেটে মরছে৷

নতুন সংসারে টুকীকে সে দিদি বলে পরিচয় দিয়েছিল৷ কিন্তু সময়ের সঙ্গে তার আসল অবস্থান বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না টুকীর৷ সে বরাবরই লক্ষ্য করেছে সুন্দরী তার কর্তৃত্ব দিয়ে বশ করে রেখেছে স্বামীকে, এমনকি তাকেও মুঠোর মধ্যে নেওয়ার জন্য তার আমরণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে৷ অবশেষে স্বামীর কাছে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তার স্পষ্ট স্বীকারোক্তিতে সে জানতে পারে সুন্দরী তার স্বামীর রক্ষিতা৷ সুন্দরীও তার অবস্থা সম্পর্কে সচেতন কম নয়৷ তাই টুকী ও পরিতোষকে একা কথা বলতে দেখলে সে যেমন তার স্বাভাবিক ঈর্ষায় প্রজ্জ্বলিত হয়৷ তেমনি সুন্দরী ষোড়শীর অনিন্দ্যসুন্দর রূপে পরিতোষকে বিমোহিত হয়ে উঠতে দেখলে আশঙ্কায় আঁতকে উঠে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে৷ লম্পট পরিতোষের কাছে যথেষ্ট আস্কারাও পেয়ে থাকে সে৷

সুন্দরী ব্যভিচারিণী হলেও তার মধ্যেও রয়েছে একটি সুন্দর মন৷ যে মন দিয়ে সে মানুষের বিচার করতে পারে৷ তবে লেখক উপন্যাসে সুন্দরীর সেই সুকুমার মনোবৃত্তিকে কখনোই স্থায়িত্ব দিতে চাননি৷ তাই মাত্র দুবার তা উত্থিত হয়ে পুনরায় তার চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে তারপরে আর একবারও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি৷ একবার টুকীর ঘরের দেওয়াল জুড়ে ঠাকুরের ছবি লাগানো নিয়ে ব্যঙ্গ করলে তার শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে৷ সেই কন্টককীর্ণ হওয়া হিংস্র অর্থলোভী দেহব্যবসায়ী সুন্দরীর মনের নয় তা সেই গোপন সুকুমারী মানবীসত্তার দ্বারাই ঘটেছে৷ আরেকবার তার সুমনোবৃত্তি জাগ্রত হয় বিশ্বম্ভর তার বাড়িতে মেয়েকে দেখতে এলে৷ বিশ্বম্ভর মেয়ের কাছে জানতে পেরেছে যে সুন্দরী পরিতোষের বোন এবং মালক্ষ্মী সম্বোধনে বিশ্বম্ভর তাকে আহ্বান করলে সে পুত্রের বয়সি কিন্তু পিতৃস্থানীয়ের আত্মীয় সম্ভাষণের জন্য প্রস্তুত হলেও বিশ্বম্ভরের মুখে যখন শোনে উত্তমের প্রতি ভয়ঙ্কর শ্লেষ বাক্য তখন তার আর পা চলে না৷ ‘‘উত্তমকে সে দেখে নাই—টুকী এবং বঙ্কু কেবল দু’একবার তাহার নামোচ্চারণ করিয়াছে মাত্র—সুন্দরীর সম্মুখে সে ছায়া নিক্ষেপ করে নাই; কিন্তু এখন তাহার মনে হইয়াছে, উত্তম স্বাভাবিক নয়, অনুকুল নয়, অপরিচিত নয়, সুদূর নয়৷ সুন্দরী আরো অনুভব করিল, এই লোকটি প্রণয়িনীর মর্মবাণী কিছুমাত্র হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে নাই৷’’১৭৭ কিন্তু তার এই উপলব্ধি ক্ষণিকের৷ তারপরে টুকী যখন জানায় তার বাবা তার যথার্থ অবস্থান অনুধাবন করতে পারবে না এবং পরিতোষ যখন শ্বশুরের সম্পর্কে নির্দ্বিধায় তার রক্ষিতা পরিচয়কে জাহির করে তখন সমস্ত ভয়-সংকোচ ভুলে অম্লানবদনে তাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়৷ টুকী লজ্জায় অপমানে যাওয়ার সময় বাবার দেওয়া দশটি টাকা মাটিতে ছুড়ে দিয়ে কাঁদতে থাকলে অর্থলোভী সুন্দরীর সেই দুঃখ উপলব্ধি করায় ক্ষমতা থাকে না৷ সে টুকীর ছুড়ে দেওয়া পয়সাগুলি কুড়িয়ে আঁচলে বেঁধে নেয়৷ পরিতোষকে তার বাবার সামনে নিজের রক্ষিতা পরিব্যাপ্ত জীবনকে প্রকাশ করা নিয়ে অপমানে জর্জরিত টুকী সেই অপমানের কারণ জানতে চাইলে পরিতোষও সহাস্যে ইঙ্গিত করে শ্বশুরের বেশ্যাদ্বার হওয়ার কথা৷ উত্তম ও সুন্দরীর তুলনায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য টুকী সুন্দরীর নোংরামোকে কটাক্ষ করলে সুন্দরী ধীর মস্তিষ্কে তাকে উদ্দেশ্য করে শোনায় এক প্রবাদবাক্য—‘‘আছে বোন, তফাৎ মানুষে মানুষে, তার উপায় নেই—হাতের পাঁচটা আঙুল সমান করে’ ত’ ভগবান গড়েননি৷’’১৭৮ সুন্দরী বিগত যৌবনা, সম্পদহীন আর টুকী বহু সম্পদের অধিকারী বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান; তার সঙ্গে রূপবতীও৷ সে জানে ‘‘যে গরু দুধ দেয় তার চাঁট খাওয়া যায়৷’’১৭৯ তাই টুকীর শত অপমানেও কোনো কিছুর প্রতিবাদ করে না সে৷ টুকী তার ভবিষ্যতের পেট ভরানোর প্রধান মাধ্যম৷ কিন্তু তাকে ‘নোংরা’ বলার অপমান সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না৷ প্রকাশ্যে তাকে না বোঝালেও টুকীর প্রতি তার আক্রোশের সীমা পরিসীমা থাকে না৷ জীবনে অনেক কটুক্তি তাকে সহ্য করতে হয়েছে, তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে সে কটুক্তিকারীকে দংশন করেছে কিন্তু টুকীর সেই কথার মতো তীক্ষ্ণ হয়ে আর কোনো কটুক্তি তাকে বিদ্ধ করেনি উপরন্তু সে প্রতিবাদটুকুও করতে পারেনি৷ জীবনে তার প্রবল অভাব৷ দু-বেলা দু-মুঠো অন্নও ঠিকঠাক জোটে না তাদের৷ যে উদ্দেশ্যে প্রচুর টাকা সমেত টুকীকে ঘরে এনেছিল—চোর এসে সব মাটি করে দিয়েছে৷ সে তার মনের প্রবল ঘৃণায় আসক্তি প্রকাশ করে টুকীর দেহটার প্রতি৷ তাই টুকীকে দেখে—‘‘কেমন একটা লালসা সুন্দরীর মনে দুর্দমনীয় হইয়া উঠিল, যেন ইহাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া সহস্র লম্পটের রিরংসা-দাহ তৃপ্ত করিতে দু’হাতে বিলাইয়া দেয়—সুন্দরীর যৌবনোল্লাসের সুপ্ত প্রেতমূর্তি একবার দাঁড়াইয়া উঠিল—যেন অতৃপ্তির ঢেউ এখনো বহিতেছে—প্লাবনের আকাঙ্খা বুকে বহিতেছে৷’’১৮০ যে তীব্র ঘৃণায় গণিকাবৃত্তির জন্য টুকী তাকে অবজ্ঞা করে—তার মায়ের সঙ্গে তুলনা করে তাকে নোংরা বলে অভিজ্ঞানিত করে সেই ঘৃণার পরিবর্তে টুকীর দেহকে সহস্র লম্পটের ভোগে উৎসর্গ করতে চেয়ে আত্মতৃপ্তি বোধ করে সে৷ আর তার মতোই দেহজীবিকার পেশায় ধীরে ধীরে ঠেলতে থাকে টুকীকে৷ সুন্দরীর মতে শরীরের সুখই সুখ—মনের সুখও আসে সেই শরীরের সুখের মধ্য দিয়ে৷ সে তাই টুকীকে ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্যে বলে তার মতো নবযৌবনবতীর ষাটবছরের বৃদ্ধ স্বামীতে প্রকৃত দেহসুখ উপলব্ধি করার ক্ষমতা নেই৷ তার জন্য প্রয়োজন অন্য কোনো সক্ষম মানুষ৷ টুকীকে দেখে তার ক্লেশের সীমা থাকে না৷—‘‘টুকীর রূপ আর যৌবন তার চোখের সম্মুখেই অনুপভুক্ত হইয়া অস্পৃশ্য আবর্জনার মত অপচয়িত হইতেছে দেখিয়া সুন্দরীর গণিকাচিত্ত যেন নিজেই সর্বস্ব লুন্ঠনের যন্ত্রণা অহরহ সহ্য করে—তার বিরাম নাই৷’’১৮১ টুকীর যৌবন সমৃদ্ধ দেহ দেহব্যবসায় লাগছে না বলে তার কাছে তা চরম অপচয় বলে মনে হয়৷ আর সে পরিতোষের রক্ষিতা হয়ে জীবন কাটাবে, টুকী তাকে বেশ্যা বলে ঘৃণা করে সমাজের কাছে সতী হয়ে থাকবে এটাও তার সহ্যের বাইরে৷ তার এই তীব্র ঘৃণার প্রতিশোধ নিতে সে সংকল্প করে টুকীকে দিয়ে দেহব্যবসা করানোর৷ স্বামীর মনে সুখ ফিরিয়ে দিয়ে সংসারে শান্তি প্রতিস্থাপনের জন্য যা করার টুকীকেই করতে হবে এবং সে যেভাবে বলবে সেভাবে করলেই সবকিছু ঠিক করা সম্ভব বলে অসীম মমতার অভিনয় করে টুকীকে রাজী করায়৷ যেমন—

‘‘—আমাদের দিন আর চলে না, টুকী৷

— দেখছি ত, দিদি; কিন্তু উপায় কি৷ বাবার কাছে টাকা চাইতে লজ্জা করে৷

— তা ত’ করবেই; বাবা যে এখন পর৷—তুই কিন্তু পারিস কিছু টাকা আনতে৷

— কোত্থেকে, দিদি?

— যা বলি তাই যদি করিস তবে হয়৷

— করবো৷

— করবি?

— হ্যাঁ৷

সুন্দরীর উত্তেজনা ক্রমশ বাড়িতেছিল৷

টুকীর গায়ের উপর দুই হাতের সম্পূর্ণ থাবা তুলিয়া দিয়া সে বলিল,—আমার গা ছুঁয়ে বল—

যেন স্পৃষ্ট স্থান যত বৃহৎ হয় শপথ তত শক্ত হয়৷

… কিন্তু টুকীকে এই অনতিক্রম্য শপথে বাঁধিয়াও সুন্দরীর চিত্ত নিঃসন্দেহ সুস্থির হইল না৷ সুন্দরীর মাতামহী মরিয়াছিল পালঙ্কে শুইয়া, তার মা মরিয়াছিল পালঙ্কে শুইয়া, কিন্তু তার মত হতভাগীর সে অদৃষ্ট নয়৷’’১৮২

সুন্দরী কীভাবে একটু একটু করে সংসারের অভাব অনটন দেখিয়ে গ্রাস করার চেষ্টা করছে টুকীকে তার সুস্পষ্ট বর্ণনা উপরোক্ত উদ্ধৃতির মধ্যে উপস্থিত৷ এছাড়া তার মা-মাতামহীরা দেহব্যবসায়ের মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ জীবন যাপন করেছে—মৃত্যুকালেও তাদের সেই সমৃদ্ধির এতটুকু হ্রাস হয়নি৷ তাদের পালঙ্কে শুয়ে মৃত্যুবরণ সেই সমৃদ্ধিকে প্রকাশ করে৷ কিন্তু সুন্দরীর জীবনে ঠিকমত অন্নসংস্থানও হয় না৷ টুকীকে দেহব্যবসায়ে লিপ্ত করলে তার সেই মাতা-মাতামহীর জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কতটা তার জীবনে ফিরে আসবে তা নিয়েও সংশয়াকীর্ণ সে৷ সুন্দরী ধীরে ধীরে যেমন টুকীকে সংসারের দায় মনে করিয়ে দেহব্যবসার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তেমনি তার মন থেকে স্বামীভক্তির আদর্শটাকেও ছিন্ন করতে তার কৌশলের অন্ত্য নেই৷ সে পরিতোষ সম্পর্কে তাকে বলে—‘‘পেট ভরাবার সোয়ামী নয়; পিঠ পাতাবার কত্তা! অমন সোয়ামীর মুখে আগুন—দুশোবার দুশোবার৷’’১৮৩

পরিতোষের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সে বাড়িতে টুকীর দেহের বিকিকিনি করতে ডেকে আনে অচিন্ত্যবাবুকে৷ চা দেওয়ার নাম করে টুকীকে তার সামনে ডেকে এনে অচিন্ত্যবাবুর সামনে তার নানা গুণের পরিচয় দিতে থাকে৷ সেখানে সে দেহব্যবসায়ী থেকে পর্যবসিত হয়েছে দেহবিক্রির দালালে৷ দালালের মতোই টুকীর শরীর, তার গুণাবলীর বর্ণনা করতে থাকে আগত খদ্দেরের কাছে৷ তার হাতে দালালির বকশিশ বাবদ অগ্রিম পয়সা৷ তারপর টুকী যখন সুন্দরীর সমস্ত উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে দেহব্যবসায় স্বেচ্ছায় নিজেকে বিকিয়ে দিতে চায় মাঝখানে তার মতো কোনো দালালকে না রেখে তখন বংশপরম্পরায় দেহব্যবসা করে আসা সুন্দরী এতটাই বিস্ময়াপন্ন হয় যতটা সে তার সারাজীবনে হয়নি৷ তারপর সুন্দরীকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বললে হিংস্র উন্মদনায় জ্ঞানশূন্য হয়ে তীব্র বাক্যবর্ষণে বিধ্বস্ত করতে থাকে টুকীকে৷ কিন্তু ততক্ষণে তার আশার মূলে বিষ ঢেলে গৃহ ছেড়ে অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেছে টুকী৷ তার সেই অন্ধকার জীবনের ছিটে এসে সুন্দরীরও ভবিষ্যতের রুজি-রোজগারের পথটিকে তমসাচ্ছন্ন করে দেয়৷

খ. অসাধু সিদ্ধার্থ :

‘অসাধু সিদ্ধার্থ’-তে (১৯২৯) নটবর এক ভণ্ড দেশ সেবক৷ সিদ্ধার্থ বসুর ছদ্মবেশে নিজেকে আত্মগোপন করে রেখেছে৷ সে চোর, জারজ৷ তার নৈতিক স্খলনকে আরও সুদৃঢ় করতে তাকে দেখানো হয়েছে বেশ্যার দাসত্মকারী হিসেবে৷ এক বৃদ্ধা বারাঙ্গনা—যার কাছে নটবর বহুদিন নিজেকে সঁপে রেখেছিল৷ শেষে সেই বারাঙ্গনাকে হত্যা করে তার সঞ্চিত অর্থ নিয়ে নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করে৷ উপন্যাসে স্বতন্ত্র কোনো চরিত্র হিসেবে গণিকার উপস্থিতি নেই৷ তার পরেও যতটুকু উপস্থিতি তার মধ্য থেকেও পণ্যাঙ্গনার জীবনের কিছু ধারণা পাওয়া যায়৷ গণিকারা যে পুরুষের অধঃপাতের কারণ তা নটবরের অসৎ জীবন বোঝাতে তাদের সঙ্গে সহবাসকে ব্যক্ত করে৷ এছাড়া পুরুষেরা যে গ্রাহক সেজে, শুভাকাঙ্খী হয়ে গণিকাদের চরম ক্ষতি করতো তা নটবরের সেই বৃদ্ধা বারাঙ্গনাকে খুন করে টাকা-পয়সা আত্মসাতের ঘটনা প্রমাণ করে৷

গ. গতিহারা জাহ্নবী :

‘গতিহারা জাহ্নবী’-র কেন্দ্রীয় বিষয় অসার্থক ও ব্যর্থ দাম্পত্য৷ বাবা-মায়ের আদরে বখে যাওয়া বিকৃত রুচির আকিঞ্চন এবং তার স্ত্রী কিশোরীর নষ্ট হয়ে যাওয়া দাম্পত্য জীবনই এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু৷ হাতের বাইরে বেড়িয়ে যাওয়া জোয়ান লম্পট ছেলেকে বিয়ে দিয়ে মতিগতি ফেরাতে চেয়েছিল বাবা-মা৷ কিন্তু তার সে দোষ কাটেনি৷ স্ত্রীকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে অন্য নারীর সঙ্গে নিজের পৌরুষকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেছে সে৷ বহু নারীদেহের স্বাদ আস্বাদন করতে তাকে যেতে হয়েছে বাগ্দী পাড়ায়৷ সেখানকার নারীদের বেশিরভাগই দেহবিনোদিনী৷ আকিঞ্চনের অধঃপাতের সুত্র ধরে উঠে এসেছে কিছু রূপাজীবাদের কথা৷ যেমন বিন্দু, চম্পা, পাঁচী, ভামিনী৷ এরা সকলেই নিম্ন শ্রেণীর দেহজীবী৷ সামাজিক নীতিবোধের বালাই নেই এদের৷ সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে স্বামী-সংসার সকলের মধ্যে থেকেও দেহব্যবসা চালিয়ে যায়৷ স্বামী বা পরিবারের কারুরই বাধা দেওয়ার প্রয়োজন নেই, নিয়মও নেই৷ দেহপসারিণীদের দেহের সেই হাট আকিঞ্চনের মতো মানুষদের প্রিয় স্থান৷ সেই স্থান আছে বলেই তার রক্ষা৷ নতুবা তার তীব্র পশুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উপায় খুঁজে পেত না৷ এ প্রসঙ্গে তার নিজের অভিমত—আনন্দের ক্ষেত্রটা তার বড় সীমাবদ্ধ৷ সেই পাড়াটা ছিল বলেই রক্ষা, নইলে মরুভূমিতে পড়ে বালি চেটে তাকে মরতে হত৷ এই দেহজীবী বাগ্দীবধূদের দেহসুধা পান করতে গিয়ে আকিঞ্চনের মাসে ত্রিশ-বত্রিশ টাকা ব্যয় হয়ে যায়৷

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) :

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাবুক ও অন্তর্মুখ৷ তাঁর সাহিত্যমনস্তত্ত্ব সম্পর্কে সুকুমার সেন বলেছেন—‘‘বিভূতিভূষণের বস্তু অভিজ্ঞতালব্ধ হইলেও বাস্তব নয়, তাঁহার দৃষ্টি স্বচ্ছ নয় বলিয়া তাহা রোমান্টিক৷ সে দৃষ্টিতে প্রকৃতি মানবজীবনের খেলাঘর অথবা পটভূমিকা নয়, মানবজীবনই প্রকৃতির খেলাঘর অথবা পটভূমিকা হইয়া প্রতিভাত৷’’ (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ৫ম খণ্ড, পৃ-৩৪৬) নিসর্গের গহন সৌন্দর্যে ডুব দিয়ে অথবা পল্লীর সাধারণ দারিদ্র্য-জর্জরিত জীবনে অবগাহন করে তাঁর চরিত্রগুলি অসামান্য হয়ে উঠেছে৷ মানুষের অত্যন্ত সরল রূপগুলিকেই তিনি তাঁর রোমান্টিক উপলব্ধি দিয়ে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন৷ যেমন ‘আরণ্যক’-এর কুন্তা, ‘বিপিনের সংসার’-এর কামিনী, ‘অথৈ জল’-এর খেমটাওয়ালি পান্না সকলেই তাদের সারল্যে, অকুন্ঠ আত্মপ্রকাশে পাঠকের মনকে মুগ্ধ করে ৷

ক. আরণ্যক :

বিভূতিভূষণ ‘আরণ্যক’-এ (১৯৩৯) বাঙালির দৈনন্দিন বাস্তবতায় ক্লিষ্ট নন, নিসর্গ বন্দনার নতুন মন্ত্র পেয়ে উল্লসিত৷ এখানে প্রকৃতি একটি বিশাল গহন অরণ্য৷ উপন্যাসের একটি বড় অংশ অরণ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের রূপবৈচিত্র্য, ঋতুবৈচিত্র্যে প্রকৃতির রূপের বদল, এর শান্ত কোমলতা আবার রুক্ষ-শুষ্ক বিরূপতা৷

এই উপন্যাসের অন্যতম এক চরিত্র কুন্তা৷ উপন্যাসে চরিত্র হিসেবে এর উপস্থিতি কম কিন্তু গুরুত্ব অপরিসীম৷ কুন্তা কাশীর বিখ্যাত বাইজির মেয়ে৷ সে নিজে কখনো গণিকাবৃত্তি করেনি—একাধিক পুরুষের কন্ঠলগ্নও হয়নি কোনোদিন তারপরেও অসহ্য নরক যন্ত্রণা ভোগ করে তাকে জীবন কাটাতে হয়েছে শুধুমাত্র বাইজির মেয়ে বলে৷ সমাজে গণিকাদের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে অবগত হবে কুন্তা চরিত্রটি অধ্যয়ন করলে৷ প্রবল প্রতাপশালী দেবী সিং রূপে মুগ্ধ হয়ে তার বাইজি মায়ের কাছ থেকে তাকে ভুলিয়ে নিয়ে এসেছিল—ঘর বেঁধেছিল৷ কিন্তু বাইজির মেয়ে হওয়ার দরুণ তাদের একঘরে হতে হয় এবং দেবী সিং-এর মৃত্যুর পর তার জীবনে চরম দারিদ্র্য নেমে আসে৷

খ. বিপিনের সংসার :

‘বিপিনের সংসার’-এ (১৯৪১) বর্ণিত বিষয় দাম্পত্য বহির্ভূত প্রেম৷ বিপিনের প্রতি মানী বা শান্তির প্রেম শুচিস্মিত প্রদীপ শিখার মতো৷ ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণের হাতে প্রেমের উগ্ররূপ যৌনতার রসে সিক্ত হতে খুবই কম দেখা যায়৷ উপন্যাসে দুজন স্বৈরিণী নারীর কথা আছে৷ একজন কামিনী গোয়ালিনি৷ অপরজন মতিবাগ্দী৷

কামিনী :

কামিনী উপন্যাসের নায়ক বিপিনের পিতা দুর্ধর্ষ নায়েব বিনোদ চাটুজ্জের প্রণয়িনী৷ সে গোয়ালা ঘরের মেয়ে—বালবিধবা, সুন্দরী৷ নিজের জীবন, যৌবন, প্রেম সব কিছু নির্দ্বিধায় সঁপে দিয়েছিল বিনোদ চাটুজ্জের পায়ে৷ বিনোদের সমস্ত প্রয়োজন-অপ্রয়োজন সবই সিদ্ধ করেছে সতী-সাধ্বীর মতো৷ সমাজে তাকে নিয়ে কানাঘুষো ছিল কিন্তু দুর্দান্ত চরিত্রের বিনোদের বিরুদ্ধে কারও মুখ খোলার সেদিন সাহস ছিল না৷ বিনোদের ভালোবাসার পাত্রী হয়ে সে কালোপেড়ে কাপড় পরতো, পান খেয়ে ঠোঁট রাঙা করে রাখতো, হাতে সোনার বালা ও অনন্ত পরতো এবং কালোচুলে খোঁপা বেঁধে সুসজ্জিত হয়ে থাকতো৷ অবৈধ হলেও, স্ত্রীর মর্যাদা না পেলেও সত্যিকারের ভালোবাসায় উদ্বেল ছিল তার হৃদয় তাই—‘‘বিনোদ চাটুজ্জে মহাশয় পরলোকগমন করিলে পর আর সে ভাল করিয়া হাসে নাই, ভাল করিয়া আনন্দ পায় নাই জীবনে৷’’১৮৪

বিনোদের সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে সে তার ছেলে বিপিনকেও পুত্রবৎ স্নেহ করত৷ বিপিন পিতৃপদে উপবিষ্ট হয়ে কর্মস্থলে এলে কামিনী তার খাবার তত্ত্বাবধান করেছে, বিপদে অর্থ সাহায্য করেছে এবং বিনা বাধায় পুত্রের সম্মুখে প্রণয়ীর যশোগান করে নিজের চিত্ত ব্যাকুলতাকে প্রকাশ করেছে৷ সে সমাজে সুস্থ কোনো সম্পর্কের মর্যাদা না পেলেও প্রেমে, ভালোবাসায় দায়িত্বে-কর্তব্যে মহীয়ান হয়ে উঠেছে৷

মতি :

মতি বাগ্দিনীও অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিল৷ তার বাবা ভাসানপোতার বাগ্দী পাড়ার মধ্যে সচ্ছল লোক৷ বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে থাকলেও তার সচ্ছলতার অভাব হত না৷ সেখানকার মাইনর স্কুলের মাস্টার বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তীর সঙ্গে হৃদয় বিনিময় হয় তার বাবার জমা নেওয়া স্কুলের কাঁঠাল গাছ থেকে কাঁঠাল পারতে গিয়ে৷ আর সেই ভালোবাসার জোরেই সমস্ত সুখ-সচ্ছলতাকে দূরে ফেলে এককাপড়ে তার সঙ্গে ঘর ছাড়ে সে৷ যে বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তী একদিন নারীর ভালোবাসা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ও উদাসীন ছিল, তার ভালোবাসায় নিজেকে সম্পূর্ণ নিমগ্ন করে সে অকপটে বিপিনকে বলে—‘‘আপনি তো জানেন আপনাকে বলেছিলাম মেয়েমানুষের ভালোবাসা কি জীবনে কখনও জানিনি৷ কিন্তু এখন আর সে কথা বলতে পারি নে ডাক্তারবাবু৷ ও বাগদী হোক, দুলে হোক ওই আমায় সে জিনিস দিয়েছে—যা আমি কারু কাছে পাইনি কোনো দিন৷’’১৮৫

মতি তার নিরাপদ আশ্রয় ত্যাগ করে শাক তুলে, মাছ ধরে তা বাজারে বিক্রি করে তাদের ভালোবাসায় গড়া ছোট্ট সংসারটিকে সচল রাখতে চায়৷ অন্ত্যজ শ্রেণীর হলেও তার হাতের রান্না বিশ্বেশ্বরের খেতে অরুচি হয় না৷ আর সে সম্পর্কে বলে—‘‘যে আমায় অত ভালবাসে, তার হাতে খেতে আমার আপত্তি কি?’’১৮৬ বিশ্বেশ্বর তার জন্য সব করেছে৷ নিজের অক্ষমতার মধ্যেও মতির অসুস্থতায় ডাক্তার দেখিয়েছে, নিজে আপ্রাণ সেবা করেছে৷ কিন্তু তার পরেও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি তাকে৷ এত গভীর যে সম্পর্ক দুই নরনারীর মধ্যে তার পরেও মতি তার রক্ষিতা৷ বিশ্বেশ্বর তাকে ভালোবাসার সর্বোচ্চ আসনে বসিয়েছিল কিন্তু সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে বসাতে পারেনি—বিয়ে করে তাকে স্ত্রীর মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে পারেনি৷

এছাড়া পিতৃসম্পত্তি হাতে পেয়ে কুসঙ্গে পড়ে বিপিনের গণিকা বিলাসের কথাও তুলে ধরেছেন৷ বিপিন মানীর কাছে তার অতীত জীবনের স্বেচ্ছাচারকে তুলে ধরতে গিয়ে বলেছে যে সে তার স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে গণিকা নারীর টাকার ব্যবস্থা করেছে, তাদের আহ্লাদ পূরণ করতে গিয়ে চুরি করারও পরিকল্পনা করেছে৷

গ. দম্পতি :

‘দম্পতি’ উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৪৩৷ পরস্ত্রীর মোহে ছকে বাঁধা দাম্পত্যজীবনের ধ্বংসের এক চিত্র৷ সহজ সরল গ্রাম্য জীবনে পাটের আরতদার গদাধর বসু ও তার স্ত্রী অনঙ্গর মধ্যে সম্পর্কের কোনো খাদ ছিল না৷ বারবধূদের প্রতি বা চরিত্রহীনদের প্রতি ছিল তাদের তীব্র অশ্রদ্ধা৷ অনঙ্গের দাদা টাকা ধার নেওয়ার জন্য তাদের বাড়িতে একজন নারীকে নিয়ে উপস্থিত হলে অনঙ্গের মনে হয় সেই মেয়েটি নষ্ট চরিত্রের৷ চরম অশ্রদ্ধায় সেই মেয়েটির সম্পর্কে সে স্বামীকে বলে—‘‘আমি তাকে ঘরে দোরে ঢুকতে দিই নি৷ অমন ধরনের মেয়েমানুষ দেখলে আমার গা ঘিন ঘিন করে৷’’১৮৭ মেয়েটিকে তাই অনঙ্গ বাইরেই বসিয়ে রাখে৷ ভদ্রতার খাতিরে চা জলখাবার বাইরেই পাঠিয়ে দেয়৷

সেই অনঙ্গই স্বামীর ব্যবসার সুবাদে স্বামী সন্তানসহ যখন কলকাতায় বাস নেয় তখন নিজের চোখে ধীরে ধীরে স্বামীর অধঃপতনের চিত্র দেখতে থাকে৷ এখানে আছে সিনেমা অভিনেত্রীদের কথা৷ যেমন শোভারাণী মিত্র, সুষমা, রেখা ইত্যাদি নারীরা৷ লেখক এদের গণিকা হিসেবে দেখাননি গণিকার কোনো বৈশিষ্ট্যও এদের মধ্যে নেই৷ এই নারীসঙ্গ লাভের প্রত্যাশাতেই নিজের ব্যবসা জলাঞ্জলি দিয়ে সিনেমার কোম্পানি খুলে তার ও অনঙ্গের পরিপাটী করে গোছানো দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে তছনছ করে দেয় স্বামী গদাধর৷ এবং শেষে দেখা যায় শোভারাণীর ঘনিষ্টতা অর্জন করে জি. বোস নামে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মোটর গাড়িতে ঘুরে বেড়ায়—এবং তার স্ত্রী সন্তান গ্রামে অনাহারে অর্ধাহারে মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে থাকে৷

ক্ষেত্রগুপ্ত বিভূতিভূষণ সম্পর্কে বলেছেন ‘‘লাম্পট্য ও বেপরোয়া স্ফূর্তিতে ধনসম্পদ নাশের চিত্রাঙ্কনও বিভূতির জন্য নয়’’১৮৮ অর্থাৎ গদাধরের লাম্পট্যের চরমতম দিক তুলে ধরা বিভূতিভূষণের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য নয় কিন্তু তার মধ্য দিয়েও তিনি যতটা তুলে ধরেছেন তাতে এতটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে শোভারাণী মিত্র শেষ পর্যন্ত গদাধরের সঙ্গে স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হয়ে তার সঙ্গে সিনেমা জগতে ভেসে গিয়েছে—সেখানে অনঙ্গের প্রবেশাধিকার নেই৷

ঘ. অথৈ জল :

পান্না :

‘অথৈ জল’-এর (১৯৪৭) নায়িকা পান্না খেমটাওয়ালি৷ লেখক তাঁর কল্পনাবিলাসের সোনার কাঠির স্পর্শে তাকে ত্যাগে, মহত্ত্বে, ভালোবাসায়, অকপট সরলতায় অনন্যমাত্রা দান করেছেন৷ তার যতটুকু পরিচয় লেখক তুলে ধরেছেন তাতে দেখা যায় পান্না মুজরাওয়ালি মায়ের সন্তান৷ তার প্রকৃত নাম সুধীরাবালা৷৷ বয়স ষোলো-সতেরো, অপূর্ব মুখশ্রী, টানা টানা ডাগর চোখদুটি স্বপ্নমাখা৷ সে খেমটা দলে মুজরা করে বেড়ায়৷ থাকে দমদমা, সিঁথি, এক বাড়িউলির বাগানবাড়িতে৷ বাড়িউলি মাসির নিয়ন্ত্রণে থেকে রুজি-রোজগার করে৷

উপন্যাসের নায়ক শশাঙ্ক ডাক্তার৷ বয়স চল্লিশের কাছাকাছি৷ ডাক্তারি করে প্রচুর রোজগার এবং পসার৷ চরিত্রবান সেই ডাক্তার সমাজে ভ্রষ্টাচারকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেয় না৷ স্ত্রী, দুই সন্তান নিয়ে সুখের জীবন তার৷ মঙ্গলগঞ্জে খেমটার আসরে পান্নাকে দেখে পরম মুগ্ধতায় তার নীতিবোধ সংস্কার সবকিছু মুহূর্তেই ওলোটপালট হয়ে যায়৷ মেয়েটির শরীরের গঠন, তার লীলায়িত অঙ্গভঙ্গি, চোখেমুখে বুদ্ধির দীপ্তি, সর্বোপরি সমবেত সকল দর্শকাদির মধ্যে থেকেও শুধু তার প্রতি পান্নার বিশেষ অনুরাগের চাহনি কথক শশাঙ্ককে আত্মহারা করে তোলে৷ অদ্ভুত এক আকর্ষণ ও মোহে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, পান্নাকে দেখবার জন্য উতলা হয়ে ওঠে তার মন৷ সেই আকর্ষণ আরও দৃঢ় হয় যখন আসরে প্যালা নিতে গিয়ে পান্না স্বেচ্ছায় তার অঙ্গুলিস্পর্শ করায় তার লীলায়িত ভঙ্গিতে৷ কথক সেই অনুভূতিকে ব্যক্ত করে বলে—‘‘ওর অঙ্গুলীর স্পর্শে আমার অতি সাধারণ একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন জীবন ভূমার আনন্দ আস্বাদ করল৷ অতি সাধারণ আমি অতি অসাধারণ হয়ে উঠলাম৷ আরও কি কি হোল, সে সব বুঝিয়ে বলবার সাধ্য নেই আমার৷… আমি হঠাৎ একি পেয়ে গেলাম? কোন অমৃতের সন্ধান পেলাম আজ এই খেমটা নাচের আসরে এসে? আমার মাথা সত্যিই ঘুরচে৷ উগ্র মদের নেশার মতো নেশা লেগেচে যেন হঠাৎ৷ কি সে নেশার ঘোর, জীবনভোর এর মধ্যে ডুবে থাকলেও কখনো অনুশোচনা আসবে না আমার৷’’১৮৯ পান্না একটু একটু করে তার মোহিনী মায়ায় ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে মধ্যবয়সি শশাঙ্ক ডাক্তারকে৷ এরপর পান্না তার স্বভাবতভঙ্গিতে ডাক্তারের ডিসপেনসারিতে অভিসারে আসে৷ আসরে নাচের সময় ডাক্তারের দুচোখের মুগ্ধ দৃষ্টি বুঝে নিয়েছিল এই কিশোরী পণ্যাঙ্গনা৷ ডাক্তারের প্রতি তারও আকর্ষণ কম ছিল না৷ জীবনে পুরুষ নিয়েই তার কারবার৷ উগ্রকামনায় পুরুষের তার শরীরকে ভোগের জন্য আত্মনিবেদন করা সে বহু দেখেছে কিন্তু ডাক্তারের মতো অমন মুগ্ধ বিস্ময় তার চোখে পড়েনি হয় তো৷ তাই খেমটার আসরে তার মন-প্রাণ-সত্তা সমর্পণ করে দিয়েছে ডাক্তারেরই পাদপদ্মে৷ নির্জন-নিভৃত-গভীর রাতে উদোম শরীরী বাসনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে তার ডিসপেনসারিতে৷ সলজ্জভঙ্গিতে, অসম্পূর্ণ বাক্য দ্বারা প্রকাশ করেছে নিজেকে সমর্পণের কথা৷ পান্নাকে গ্রহণ করেনি ডাক্তার কিন্তু পান্না যখন যাওয়ার সময় বার বার তাকে বলে গেছে—‘‘সন্দের পর কাল আরম্ভ হবে তো? আপনি আসবেন, কেমন তো? তার পরেই মাথা দুলিয়ে বললে—ঠিক, ঠিক, ঠিক৷ যাই—’’১৯০ তখন তার সঙ্গে নিজের মনটাকেও বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে৷ গল্পের কথক ডাক্তার তার সেই লাগামছেঁড়া মনের অবস্থাকে সুন্দরভাবে বর্ণনা করে বলেছে—‘‘নৌকো ছাড়লো, আমি শুয়ে রইলাম চোখ বুজে কিন্তু কেবলই পান্নার মুখ মনে পড়ে,—তার সেই অদ্ভুত হাসি, সকুন্ঠ চাউনি৷ লাবণ্যময়ী কথাটা বইয়ে পড়ে এসেছি এতদিন, ওকে দেখে এতদিন পড়ে বুঝলাম নারীর লাবণ্য কাকে বলে, কি যেন একটা ফেলে যাচ্ছি মঙ্গলগঞ্জের বারোয়ারি-তলায়, যা ফেলে আমি কোথাও গিয়ে শান্তি পাবো না৷’’১৯১ মঙ্গলগঞ্জের বারোয়ারি তলার শেষ খেমটার আসরে পান্নার সত্যিকারের মানসিক অবস্থাটা জানার জন্য নিজেকে একটু আড়াল করে রাখে ডাক্তার৷ পান্না আসরে উঠে চারিদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে খুঁজতে থাকে তাকে৷ নাচ ও গান করার সময়ও পান্না তাকেই খুঁজতে থাকে অবশেষে দেখতে না পেয়ে তার চোখের দৃষ্টি নিষ্প্রভ হয়ে যায়—সব কিছুর যেন মানে হারিয়ে যায় তার কাছে৷ কথক নিজেকে আড়াল করেই সরে আসে তার ডিসপেনসারিতে৷ হঠাৎ দরজায় করাঘাত শুনে দরজা খুলে দেখে আসরের সেই ঝলমলে চোখভোলানো সাজেই সে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে৷ তার আত্মনিবেদনের আকুতিতে, সস্তা সেন্টের তীব্র গন্ধ ঘরটাকে ভরিয়ে দিয়েছে৷ এভাবে পান্না সময়ে-অসময়ে তার ঘরে উপস্থিত হয়ে তার কিশোরীর সলজ্জভঙ্গিতে ডাক্তারকে মুগ্ধ করে শেষপর্যন্ত তাকে অনুরোধ করে তার সঙ্গে কলকাতায় যাওয়ার জন্য৷ ডাক্তার অপার মুগ্ধতায় কোনো দ্বিরুক্তি না করেই বেড়িয়ে যায় তার সঙ্গে৷

পান্নার কলকাতার মাসির বাড়িতে আসার পর তার আরেক রূপ স্পষ্ট হয় মাসির কথার মধ্য দিয়ে৷ সে তার রূপ-জৌলুসে পতঙ্গের মতো পুরুষকে আকর্ষণ করে৷ কত ধনী-যুবা, প্রৌঢ় তার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত৷ সে যেমন মুজরা করে অর্থ উপার্জন করে তেমনি মাসির বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে দেহের পসরা সাজিয়ে নিজের ঘরে খদ্দের ডেকে আনে৷ অর্থাৎ খেমটার দলের নর্তকী গায়িকার বাইরে সে পাকা দেহব্যবসায়ী৷ মাসির ডাক্তারকে বলা কথার মধ্য দিয়ে সে দিক স্পষ্ট—‘‘এ ঘরে তুমি থাকতে পারবে না৷ ওকে রোজগার করতে হবে, ব্যবসা চালাতে হবে৷ ওর এখানে লোক যায় আসে, তারা পয়সা দেয়৷ তুমি ঘরে থাকলে তারা আসবে না৷’’১৯২ শুধু তাই নয় পান্না তার সুন্দর রূপবান দেহটিকে নিয়ে যেখানেই গিয়েছে খেমটাওয়ালি হিসেবে সেখানেই তার পিছনে মাছির মত ভনভন করেছে শরীরলোভী স্তাবক দল৷ ডাক্তারকে নিয়ে জীবন শুরু করার পর সে যখন খেমটা নেচে উপার্জন অব্যাহত রেখেছে বেঁচে থাকার জন্য তখন বেথুয়াডহরি গ্রামের বারোয়ারি যাত্রায় খেমটাওয়ালি হিসেবে দল নিয়ে উপস্থিত হলে সেখানকার নায়েব জোয়ারদার মশাই তাকে দেখে প্রৌঢ়ত্বের মধ্যেও লালসায় অধীর হয়ে উঠেছে৷ দলের রসুই বামুন পরিচয়ধারী ডাক্তারকে উপঢৌকন দিয়ে বলেছে—যে ভাবেই হোক সে যেন পান্নাকে রাজী করিয়ে তার সঙ্গলাভের ব্যবস্থা করে দেয়৷ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় কেশবডাঙা নামে এক গঞ্জের বারোয়ারির আসরে৷ সেখানে পল্লীকবি হিসেবে খ্যাত ঝড়ু মল্লিক পান্নাকে দেখে তাকে ভোগের জন্য লালসায় অধীর হয়ে ডাক্তারকে ডেকে পাঠায় দালালি করার জন্য৷ মেয়েটিকে ভোগের জন্য পঁচিশ টাকা পর্যন্ত দর হাকে৷ পান্না নিজেও যে সতী নয়, অর্থের জন্য দেহবিক্রয় করেছে সে কথা অকপটে স্বীকার করে নিজের জীবনের এক কাহিনি শোনায় ডাক্তারকে৷ সেখানেও তার প্রতি এক জমিদারকুমারের লোলুপতার ছবি৷ ভবনহাটি তালকোলার জমিদার-বাড়িতে জমিদারের ভাইপোর বিয়েতে মুজরা করতে গেলে বিয়ের বরই তাকে পাওয়ার জন্য ক্ষেপে ওঠে৷ সে তার হাতে নিজেকে সমর্পণ করে, সারারাত তার সঙ্গে নৌকাবিহারে কাটায়৷ ছেলেটি তাকে তার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বহু অনুনয়-বিনয় করে৷ সদ্য বিবাহিত যুবক, তখনো বোধ হয় তার ফুলশয্যা হয়নি তার সঙ্গে পালিয়ে যেতে মন সরে না পান্নার৷ তাই সে হাজার টাকা খোরপোষ চায় মাসে৷ অর্থাৎ হাজার টাকার বিনিময়ে তার রক্ষিতা হয়ে থাকতে রাজী সে৷ বাবা-কাকার জমিদারিতে সে টাকা দিতে অপারগ সেই যুবক৷ শেষে নববধূর গায়ের থেকে তিনহাজার টাকার গহনা চুরি করে এনে তাকে দিতে চায়৷ নব পরিণীতার শরীর থেকে গয়না চুরি করে এক বারবনিতাকে খুশি করার মানসিক প্রবণতায় তার উপর গা ঘিনঘিন করে পান্নার৷ নির্দ্বিধায় তাকে ছেড়ে চলে আসে সে৷ তারপর মাসির মুখে শুনেছে পরেশ বাবুর প্রসঙ্গ৷ পান্নার মোহে আকৃষ্ট হয়ে সে তার পিছু পিছু চলে এসেছিল পান্নার বাসায়৷ পনেরোদিন পার হয়ে গেলেও তার সেখান থেকে নড়ার নাম নেই৷ পান্নাকে বিয়েও করতে চায় সে৷ শেষ পর্যন্ত পান্না আমল না দেওয়ায় তাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় সে৷ মাসি পান্নার সেই পুরুষ আকর্ষণের মোহময়ী ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নিজে উপার্জন করে৷ তার প্রতি পুরুষদের আকৃষ্ট হওয়া সম্পর্কে মাসি বলে—‘‘ও ছুঁড়ি যখনই বাইরে যায়, তখনই ওর পেছনে কেউ না কেউ… তা অমন কত এল, কত গেল৷’’১৯৩

এই রূপবতী খেমটাওয়ালি তার শরীরের হিল্লোলে যেমন সহজেই পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে তেমনি তার নিজের উপার্জনও কম নয়৷ পান্নার জন্যই তাদের খেমটা দলের অত পসার, অনেক বেশি টাকা বায়না দিয়ে তাদের দলকে বড় বড় জায়গা থেকে আমন্ত্রণ করে৷ তার মতো একজন সরলমনের উপার্জনকারিণী মেয়েকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা দেখে নীলিমা ডাক্তারকে বলে—‘‘পান্নাকে গেঁথেচেন ভাল মাছ৷… তবে আপনার ক্ষমতা আছে৷ অনেকে ওর পিছনে ছিল, গাঁথতে পারে নি কেউ৷ আমি তো সব জানি৷ হরিহরপুরে একবার মুজরো করতে গিয়েছিলাম, সেখানকার জমিদারের ছেলে ওর পেছনে অনেক টাকা খরচ করেছিল৷ তাকে ও দূর করে দিয়েছিল এক কথায়৷ তাই তো বলি, আপনার ক্ষমতা আছে৷’’১৯৪ অর্থাৎ একজন উঠতি বয়সি সুন্দরী বারাঙ্গনার ভালোবাসা অর্জন করাও সবার পক্ষে সম্ভব হয় না; টাকা থাকলেও নয়৷ পান্না দলের জন্য অপরিহার্য আসরে নৃত্যগীত পরিবেশনের সময়ও প্রচুর প্যালা লাভ করে ৷ বেথুডহরির নায়েব মশাই তো রুমালে বেঁধে দশ টাকা প্যালাই দেয়৷ দলের সবচেয়ে বেশি প্যালা সে পায়৷ তার প্যালার অংশ তার নিজেরই, সেখানে কেউ ভাগ বসাতে পারে না৷ সে তার শরীরী ক্ষমতায় নিজে ঠিকঠাক পরিশ্রম করলে নব্বই টাকা থেকে একশত টাকা রোজগার করতে পারে৷ এবং সেই গরবে অনায়াসে ডাক্তারকে নিজের করে পেতে, ডাক্তারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সব নিজের কাঁধে নেয় এবং ডাক্তারকে সে প্রসঙ্গে বলে—‘‘যদি ঠিক-মত বায়না হয়, খাটি, তবে মাসে নব্বই টাকা থেকে একশো টাকা৷ তোমার ভাবনা কি?’’১৯৫

পান্নার মধ্যে লেখক সবচেয়ে বেশি করে দেখিয়েছেন তার অকপট সরলতা৷ যে শ্রেণীতের মানুষ, যে পরিবেশে বড় হয়েছে, তা সবই স্বার্থ ও প্রবৃত্তির ঘেরাটোপে আবদ্ধ৷ বারবনিতা হওয়ার সুবাদে সেই বুদ্ধিটুকুও অজ্ঞাত নয় যে যতক্ষণ তার রূপ থাকবে ততদিনই কদর—শরীর ভেঙ্গে গেলে, যৌবন অতিক্রান্ত হলে তার শরীরকে, তাকে কেউ ফিরেও দেখবে না৷ তারপরেও ভবিষ্যতের জন্য যেন তার কোনো ভাবনা নেই৷ সে এক মুজরার আসরে ডাক্তারকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে তার কলকাতার বাসায়৷ মাসির সাথে বিরোধ করতেও তার বাধে না৷ ডাক্তার যতবার তাকে বাস্তবজীবন সম্পর্কে সচেতন করে দিতে চেয়েছে—ততবারই সে আপন স্বপ্নবলয়ের মধ্যে আরও বেশি করে ডাক্তারকে জড়িয়ে ফেলেছে৷ কোথায় থাকবে, কি খাবে, কি করে চলবে তা নিয়ে যেন তার কোনো ভাবনা নেই—চিন্তা নেই৷ ডাক্তারের সঙ্গে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভেসে বেরানোতেই যেন তার আনন্দ৷ সে এক ব্যতিক্রমী৷ তার ব্যতিক্রমী সত্তাকে তুলে ধরতে কথক বলেন—‘‘আমাকে অবাক করে দিয়েচে পান্না৷ ওর শ্রেণীর মেয়েরা শুনেচি কেবলই চায়, পুরুষের কাছ থেকে শুধুই আদায় করে নিতে চায়৷ কিন্তু ও তার অদ্ভুত ব্যতিক্রম৷ নিজের কথা কিছুই কি ও ভাবে না৷ আমার মত একজন বড় ডাক্তারকে গেঁথে নিয়ে এল, এসে কিছুই দাবি করলে না তার কাছে, বরং তাকে আরও নিজেই উপার্জন করে খাওয়াতে চলেচে৷’’১৯৬

ডাক্তারের কাছে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পণ করেছে সে৷ অকূলে ভাসার জন্য তৈরি হয়ে ডাক্তার যখন বলে তাকে না খাইয়ে গাছতলায় রাখার কথা তাতেও আপত্তি নেই তার৷ শুধু সেটুকুই নয় প্রেমের আবেশে অকপটে বলে ওঠে সে যদি নিজের হাতে তাকে মেরেও ফেলে তারপরেও সে টু’শব্দটি করবে না৷ পান্নার বাড়িতে এসে গণিকাপল্লীর সংকীর্ণ পরিবেশে এবং মাসির বাক্যবাণে ডাক্তার যখন সেখান থেকে চলে যেতে চায় পান্নাকে নিয়ে তাতেও সে যেমন বারণ করে না তেমনি মুজরা, দেহব্যবসা বন্ধ করতে বললেও সে জিজ্ঞেস করে না ‘খাবো কি’ বা ‘চলবে কিসে’৷ সে যেভাবে পান্নাকে চলতে বলে পান্না সেভাবেই চলতে রাজী, উল্টো কোনো প্রশ্ন করে না—প্রশ্ন করে বিরক্ত করে না৷

মাসির বাক্যবাণ থেকে রেহাই পেতে পান্না ডাক্তারের সঙ্গে বেড়িয়ে যায় লেবুতলার এক ক্ষুদ্র গলির বাসায়৷ সেখানে অগোছালো ঘরকন্নায় সে নিজের হাতে তার বহুকষ্টের উপার্জিত অর্থ নিঃশেষে দান করতে থাকে৷ সেই ‘নেই’ এর সংসারেও তার আনন্দের শেষ থাকে না৷ সবতাতেই তার যেন আনন্দ৷ জল খাওয়ার জন্য গ্লাস নেই তাতেও তার ভারি মজা৷ আবার কথক তার দূরদর্শিতা দিয়ে যখন তাকে বোঝায় তখন সে পাকা গিন্নির মতোই সচেতন হয়ে ওঠে৷ বলে—‘‘তাইতো কি করা যায় তাই ভাবচি৷’’১৯৭ মাদুরে ঘুমিয়ে, শালপাতায় খাবার খেয়ে তাদের নতুন ঘরকন্না অভাব-অনটনের মধ্যেও জমে ওঠে৷ সব শূন্যতা পূরণ করে দেয় তাদের পরস্পরের নির্ভরযোগ্য ভালোবাসা৷ সেই ভালোবাসায় সচ্ছল গৃহস্থের ছেলে, ডাক্তার হিসেবে প্রভূত অর্থের উপার্জনকারী হয়েও পান্নার সঙ্গে মাদুরের উপর বসে শালপাতার ঠোঙায় কচুরি খেয়ে যে আনন্দ পেয়েছিল সে আনন্দও তৃপ্তি সে তার সারা গৃহস্থ জীবনে কখনো কোথাও পায়নি৷ পান্না খেমটাদলে নাচ-গান করে, মুজরা করে তার প্রণয়ীকে চালাবার সাহস রাখে৷ তার দলের অপর নারী নীলিমা যখন তাদের সাংসারিক দুরবস্থা দেখে ডাক্তারকে তিরস্কার করে পান্নাকে দলছাড়া করে এনে কষ্ট দেওয়ার জন্য তখন পান্না নিজের সারল্য দিয়ে ডাক্তারের সে দোষ ঢেকে ফেলে৷ নীলিমাকে অনুযোগ করে বলে—‘‘ওর ওপর কোনো কথা বলবার তোমার দরকার কি নীলি? ধরো ও পুরুষ মানুষকে আমি নড়তে দেবো না৷ আমাকে মুজরো করে চালাতে হবে৷ এখন কি দরকার তাই বলো৷’’১৯৮ সে নীলিমা যা বলে করেও তাই৷ নীলির সঙ্গে গিয়ে মুজরা করে অর্থ রোজগার করে, সেই অর্থ দিয়ে তাদের দুজনের নতুন পাতা সংসার দিব্যি চালিয়ে নেয়; পূরণ করে ডাক্তারের নানা শখ আহ্লাদ৷

প্রণয়ী সঙ্গে থাকলে পান্না নিজেকে তার নৃত্যকলায় উজাড় করে দিতে পারে৷ তার নাচের জন্য ডাক্তারের প্রশংসা করে বলে—‘‘নীলি কি বলচে জানো? বলচে তোমার জন্যেই নাকি আমার নাচ ভাল হচ্চে৷’’১৯৯ রসুইঠাকুর হিসেবে সে তাদের দলের সঙ্গী হয়ে গেলেও তার কষ্ট হবে জন্য রান্না করতে দেয় না পান্না৷ দর্শকের মনোরঞ্জন করে আসর শেষ করার পর ক্লান্ত শরীরে রান্না করতে রাজী তবু প্রেমাস্পদকে সামান্য কষ্ট দেবে না৷ শুধু তাই নয় বাসাবাড়িতেও সে কি খাবে কি পড়বে নিজের পয়সায় নিজে তাগিদ নিয়ে তত্ত্বাবধান করে৷ কোনো কিছুর জন্য পয়সার দরকার হলেই সে নির্দ্বিধায় দেখিয়ে দেয় তার ক্যাশবাক্স অর্থাৎ একটা পাউডারের খালি কৌটো৷ অচেনা অজানা একজন মানুষ তার ক্ষতি করে সমস্ত পুঁজি-উপার্জন নিয়ে চলে যেতে পারে বলেও তার কোনো ভয় নেই—নিলেও যেন কোনো আক্ষেপ নেই৷ এ প্রসঙ্গে ডাক্তার তাকে সাবধান করে দিলে সে সাবলীলভাবে জবাব দেয়—‘‘তোমার মত পুরুষ মানুষে পারে না৷’’২০০ কতখানি ভরসা একজন আরেকজনকে করলে এরকম কথা বলতে পারে—তা পান্নার নিজের অভিজ্ঞতার একটা গল্পতে আরও স্পষ্ট হয়৷ পান্নার বয়স কম হলেও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা কম নয়৷ নিজে বারবনিতা; হীনরুচির মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ৷ ফলে একজন অচেনা-অজানা মানুষকে বিশ্বাস করার ফল কি হতে পারে তাও জানে৷ তবুও বিশ্বাসই সে করে৷ নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করেছে যার কাছে তাকে যদি সে ভরসা-বিশ্বাস না করে তো কাকে করবে! সে শোনায় তাদের পাড়ার শশীমুখী পিসির গল্প৷ রামবাবু বলে একজন লোক ছিল তার প্রণয়ী৷ অনেকদিন থেকেই সে শশীমুখীর সঙ্গে থাকতে শুরু করেছে৷ সে মদ খেত, পিসির জন্য বাজার থেকে হিংয়ের কচুরি আনতো৷ সেই রামবাবুই এক কালীপুজার রাতে তাকে খুন করে তার সর্বস্ব নিয়ে পালিয়ে যায়৷ তাদের জীবনের সেই অস্তিত্বহীনতায় পান্নারও যে বুক কাঁপে না তা নয়, তার পরেও তার অন্তরাত্মা সর্বদা বলতে থাকে ডাক্তার যতক্ষণ তার সঙ্গে আছে তার কোনো ভয় নেই৷

পান্না জানে সে তার সাতপাঁকের বৌ নয় তাই স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্যের মতো সে তার নিজের দায়িত্ব কিছুতেই দিতে চায় না ডাক্তারকে৷ ডাক্তারের রোজগারহীনতার হীনমন্যতায় তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে—‘‘আমি কি তোমাকে কষ্টে রেখেছি? সুখে রাখতে পারচি নে? হ্যাঁ গা, সত্যি করে বলো৷ আমি আরও পয়সা রোজগারের চেষ্টা করবো৷’’২০১ সে আরও বলে সে তার সাতপাঁকের বৌ নয়—যেখানে তার দায়িত্ব ডাক্তারকে নিতেই হবে৷ বিনম্র বচনে তাকে বলে—‘‘তুমি ও সব নিয়ে মাথা ঘামিও না লক্ষ্মীটি৷ বোলো যখন যা দরকার, আমি চেষ্টা করবো যুগিয়ে দিতে৷ আমার মাসিক আয় কত বলো দিকি? আশি নব্বুই কি একশো টাকা৷ দু’টো প্রাণীর রাজার হালে চলে যাবে৷’’২০২ সে দায়িত্বশীল অভিভাবকের মতো প্রণয়ীকে সুখে রাখতে সর্বদা বদ্ধপরিকর৷ শুধু এটুকুই নয়, পান্নার যেন অগাধ বিশ্বাস সে পুরুষদের খুব ভালো করে চেনে—ওদের শখ, আহ্লাদ ভালো করে বোঝে; তাই জুতো, জামা, নানারকম খাবার দিয়ে ডাক্তারের অভাব মোচনের চেষ্টা করে এবং সব সময় বলে—‘‘তোমরা কি চাও, আমি সব জানি—’’২০৩

কিন্তু পান্নার ভালোবাসার ভিত্তির উপর সাজানো ঘরকন্না বেশিদিন স্থায়ী হয় না৷ হঠাৎ পুলিশের অঘোষিত আগমনে তছনছ হয়ে যায় সেই সুখের ঘর৷ ডাক্তারের উপর চূড়ান্ত অভিযোগ তার মায়ের৷ সে নাকি তার নাবালিকা মেয়েকে আটকে রেখেছে তার নিজের কাছে৷ পান্না সমস্তটা শোনে ডাক্তারের কাছে৷ যখন বোঝে সে স্বেচ্ছায় চলে গেলে পুলিশ প্রণয়ীর কোনো ক্ষতি করবে না তখন অনায়াসে রাজী হয়ে যায় ফিরে যেতে৷ সে যথার্থ ভালোবাসে; ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে৷ প্রণয়ীকে কোনো অসম্মান সে করতে দিতে পারে না৷ তাই যাওয়ার সময় তার সমস্ত টাকা পয়সা রেখে যায় প্রণয়ীর জন্য৷ যে মুগ্ধ আকর্ষণে পান্নার সঙ্গে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল ডাক্তার সেই মুগ্ধতার মধ্যে নারীমনকে, নারীমনের ভালোবাসাকে বোঝার ক্ষমতা হয় তো ডাক্তারের ছিল না৷ তাই পান্নার সেই আত্মত্যাগ অনুভব করতে পারে না সে৷ পান্না চলে গেলে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে থেকে সে ভাবে—‘‘যাকগে৷ প্রলয় মন্থন করে আমি জয়লাভ করবো৷ ঘর ভাঙুক, দীপ নিবুক, ঘট গড়াগড়ি যাক৷ ও সব মেয়ের ওই চরিত্র৷ কি বোকামি করেছি আমি এতদিন৷’’২০৪

নীলিমা :

নীলিমা বা নীলি পান্নার খেমটাদলের সহগায়িকা৷ তার বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের কম নয় বরং বেশিই হতে পারে৷ গায়ের রং এর জৌলুস অনেকটা কমে এসেছে৷ মঙ্গলগঞ্জের বারোয়ারি অনুষ্ঠানে সে পান্নার সহগায়িকা হয়ে গিয়েছিল৷ নীলিও দরিদ্র৷ পান্নার সঙ্গে তুলনা করলে তার চেয়ে গরিবই সে৷ নীলির বড়দিদি সুশীলা; মুখে বসন্তের দাগ কটা বাদ দিলে তাকেও সুশ্রী বলা চলে৷ এছাড়া বিধবা মা রয়েছে নীলির সংসারে৷ নীলি খেমটা নাচের পাশাপাশি দেহব্যবসাও চালায়৷ বেথুয়াডহরির নায়েববাবু কামনা পরিতৃপ্তির জন্য পান্নাকে চাইলে পান্না নীলির কথাই বলে৷ অর্থাৎ আসর শেষ হয়ে পুরুষের লালসা মিটিয়ে কিছু উপরি উপার্জনও নীলি করে থাকে৷ দলে নীলির কদর কম৷ নীলিও স্বীকার করে যে পান্নার জন্যই ওদের দলের বায়না আসে—পান্নাকে সকলেই চায়৷ নিজের স্বল্পতম উপার্জন দিয়ে তার পরিবারটিকে সে প্রতিপালন করে৷ আসরে তার নামে প্যালা পড়ে না বললেই চলে৷ বায়নার অর্ধেক টাকা সে পেলেও প্যালা না পাওয়ায় তার উপার্জনও কম হয়৷

নীলিমা পান্নার যথার্থই হিতকারিণী৷ পান্নার সমস্ত খবর শুনে মুজরার বায়নার মিথ্যে অজুহাত বলে সে ডাক্তারের সঙ্গে তার নতুন বাসায় উপস্থিত হয়—সংসারের দৈন্য দুর্দশা দেখে ডাক্তারকে তিরস্কার করতে তার বাধে না৷ সে বলে—‘‘এই অবস্থায় ওকে নিয়ে এসে রেখে দিয়েচেন?’’২০৫ পান্নাকে সে ভালো করেই চেনে৷ তার সরলতা সম্পর্কেও যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে তার৷ তাই ডাক্তারকে ব্যঙ্গ করে বলে—‘‘পান্নাকে গেঁথেচেন ভাল মাছ৷ আমি ওকে জানি৷ ভারি সাদা মন৷ নিজের জিনিসপত্তর পরকে বিলিয়ে দেয়৷’’২০৬ পান্নার চেয়ে নীলির জীবন অভিজ্ঞতা অনেক বেশি৷ তার চেয়ে বয়স বেশি ও রূপ কম হওয়ার দরুণ তার জীবনের লড়াইটা আরও বেশি কঠিন৷ তাই পান্নার ছেলেমানুষিকে সে প্রশ্রয় দিতে চায় না৷ তাকে সাবধান করে দিয়ে বলে—‘‘এ সব কি আবার ঢং৷ ও বাবু কি তোকে চিরকাল এমনি চোখে দেখবে? তুই নিজের পসার নিজে নষ্ট করতে বসেচিস—’’২০৭ পান্নার চেয়ে নীলি বাস্তবধর্মী৷ গণিকা জীবন অভিজ্ঞতার বাস্তব রূপটি তার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে৷

সুশীলা :

সুশীলাও নীলির মতো হিসেবি৷ বোনের রোজগারে জীবন চালাতে তার কোনো আক্ষেপ নেই৷ নীলির মুজরার বায়না এলে সে খুশি হয়৷ তাই যখন ডাক্তার তাকে মিথ্যে করে বলে যে সে মুজরার বায়না নিয়ে এসেছে তখন ডাক্তারকে সে খাতির করে এবং নীলিকে তার সঙ্গে পাঠানোর সময় পাকা ব্যবসায়ীর মতো দুটি টাকাও চেয়ে রেখে দেয় সে৷

মাসি :

এই উপন্যাসের আরেক অন্যতম চরিত্র বাড়িউলি মাসি৷ প্রচণ্ড হিসেবি ও ব্যবসায়ী মন তার৷ ব্যবসার কোনো ক্ষতি সে সহ্য করতে পারে না৷ পান্না তার বাড়িতে থাকে৷ তাদের ভাড়া খাটিয়ে মাসির উপার্জন৷ পান্নার মতো নারীদের এই স্বার্থেই খোরপোষ দিয়ে আটকে রাখে সে৷ মঙ্গলগঞ্জ থেকে মুজরা করে ফেরার সময় পান্নার সঙ্গে শশাঙ্ক ডাক্তার এসে উপস্থিত হলে মাসির বিরক্তির শেষ থাকে না৷ সে পান্নার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তার সমস্ত অভিপ্রায় জানার চেষ্টা করে৷ পান্নার ব্যবসার কথা ভেবে এবং সে থাকলে তার রোজগারের ক্ষতি হবে জেনে ডাক্তারকে সাবধান করে দিয়ে বলে—‘‘একটা কথা বলি৷ স্পষ্ট কথার কষ্ট নেই৷ এ ঘরে তুমি থাকতে পারবে না৷’’২০৮ সে তাকে আরও জানায় যে পাড়াগাঁয়ের মানুষ শহরে এসেছে—দু-চারদিন শহর ঘুরে যেন চলে যায়৷ পান্না তার কথায় বিরক্ত প্রকাশ করে প্রতিবাদ করলে বুড়ি হাত-পা নেড়ে তাকে জানায়—‘‘এখন অল্প বয়েস, বয়েস দোষ যে ভয়ানক জিনিস? হিত কথা শুনবি তো এই মাসীর মুখেই শুনবি—বেচাল দেখলে রাশ কে আর টানতে যাবে, কার দায় পড়েচে?’’২০৯ পান্নাকে নিয়ে গঙ্গায় নাইতে যাওয়ার কথা শুনে বুড়ি খিঁচিয়ে ওঠে৷ ব্যঙ্গ বিদ্রুপে তাকে জর্জরিত করে ফেলে৷ অবশেষে তাকে জানায়—‘‘অত দরদ যদি থাকে পান্নার ওপর, তবে মাসে ষাট টাকা করে দিয়ে ওকে বাঁধা রাখো৷ ওর গহনা দেও, সব ভার নাও—তবে ত তোমার সঙ্গে যেখানে খুশি যাবে৷ ফেলো কড়ি মাখো তেল, তুমি কি আমার পর?’’২১০

মাসি আপ্রাণ চেষ্টা করেছে পান্নার কাছ থেকে ডাক্তারকে সরাতে৷ সে চলে যাওয়ার পর যখন আবার ফিরে আসে পান্নার কাছে৷ তাকে বাড়িতে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে যায় মাসি৷ সে রেগে গিয়ে বলে—‘‘তোমরা সবাই মিলে ও ছুঁড়ীর পেছনে পেছনে অমন ঘুরচো কেন বলো তো? তোমাদের পাড়াগাঁ অঞ্চলে মেয়েকে পাঠালেই এই কাণ্ড গা? জ্বলে পুরে মনু বাপু তোমাদের জ্বালায়৷ আবার তুমি এসে জুটলে কি আক্কেলে?’’২১১ তার পর বুড়ি তাকে বলে যে তাকে এর আগে ভালো করে বোঝানোর পরেও সে কেন বার বার আসছে৷ এসব জায়গায় এলে বিস্তর টাকা-পয়সার দরকার৷ সে যথেষ্ট পরিণত মানুষ হয়েও কেনই বা একজন বহুবল্লভার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাইছে৷ তাছাড়া পাড়াগেঁয়ে মানুষ শহুরে বাবুদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে৷ সে যেন ভালোয় ভালোয় বাড়ি চলে যায়৷ কিন্তু সে মুহূর্তে পান্না উপস্থিত হয়ে তাকে তিরস্কার করলে বৃদ্ধা পান্নার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে—‘‘দ্যাখ পানু বাড়াবাড়ি কোন বিষয়ে ভাল না৷ দু’জনকেই হিত কথা শোনাচ্চি বাপু,—কষ্ট পেলে আমার কি, তোরা দুজনেই পাবি—’’২১২

পান্না মাসির সোনার ডিম পারা হাঁস৷ কিছুতেই সে তাকে হারাতে চায় না বা রাগাতে চায় না৷ তাই যতবারই সে ডাক্তারকে সাবধান করতে গিয়েছে, তিরস্কার করেছে সবই তার অনুপস্থিতিতে৷ অপরদিকে ডাক্তারকে না তাড়ালেও তার নয় নইলে পান্নার দ্বারা উপার্জন করা তার আর সম্ভব হবে না৷ রচনাকার দক্ষতার সঙ্গে অঙ্কন করেছেন মাসি চরিত্রটিকে৷ স্বার্থ রক্ষার চেষ্টায়, বাস্তববোধে চরিত্রটি বাস্তব রসসিক্ত হয়ে উঠেছে৷

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) :

বাংলা উপন্যাসের আঙিনায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবাদপ্রতিম ঔপন্যাসিক৷ বীরভূমের সাধারণ জনজীবন, অনতিপ্রাচীন স্থানীয় ঐতিহ্য, গল্পকাহিনি ও কিংবদন্তি ইত্যাদিকে অবলম্বন করে সাহিত্য জগতে তাঁর পদসঞ্চারণ৷ এই ধারাপথেই তিনি বিভিন্ন উপন্যাসাদির মধ্যে অঙ্কন করেছেন গণিকাজীবনের বিচিত্র চিত্র৷

ক. নীলকন্ঠ :

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকন্ঠ’ (১৯৩৩) উপন্যাস পারিবারিক জীবনের আলেখ্য৷ এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে এক গৃহবধূর গণিকা হয়ে উঠার নির্মম কথা৷ উপন্যাসের নায়ক শ্রীমন্ত বাল্যকাল থেকেই যেমন চাতুর্যহীন তেমনি বোকাটে৷ নিজের সুবিধা-অসুবিধা ভালোমন্দ বোধটুকুও যেন তার নেই৷ তার মধ্যে ভাবালুতা ও আবেগের বাড়াবাড়ি৷ তার স্ত্রী গিরিবালা বা গিরি৷ বাস্তব বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই নারী কীভাবে জীবনের নিষ্ঠুর পরিহাসে দেহব্যবসায় লিপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বনে নির্মম পরিণতি প্রাপ্ত হয় তা সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করেছেন রচনাকার৷

বাপ-মা মরা এবং খুড়ো-খুড়ির ঝাঁটা-লাথি খেয়ে মানুষ হওয়া গিরিবালা শ্রীমন্তের ঘরে লক্ষ্মী হয়ে এসেছিল বারো-তেরো বছর বয়সে৷ শ্বশুর-শাশুড়ি, মা-মরা—বাবার উপেক্ষিত ননদের চারবছরের মেয়ে গৌরীকে নিয়ে সুখী জীবন তার৷ স্বামীর প্রেম-সোহাগে পরিপূর্ণ তার দাম্পত্য জীবন৷ তার জীবনের একটাই অতৃপ্তি সে বাঁজা৷ মৃত্যুর আগে তা নিয়ে শাশুড়িরও আক্ষেপের শেষ ছিল না৷ তার সেই শূন্য নারীজীবনের বাৎসল্য রস পিপাসা কানায় কানায় পূর্ণতা পেতে শুরু করেছিল গৌরীকে ঘিরে৷ গৌরীই তাদের জীবনের সমস্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছিল৷ কিন্তু সেই সুখের জীবন তার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি৷ গৌরীর বাবার এক অন্ধ পাত্রের হাতে মেয়েকে সমর্পণ করাকে কেন্দ্র করে তার জীবনের সব কিছু রঙহীন হয়ে যায়৷ সমস্ত বিষয় সম্পদ বন্ধক রেখে শ্রীমন্তের গৌরীর জন্য নির্বাচিত সুপাত্রের খরচ বাবদ আড়াইশত টাকা নিয়ে সে যখন বাড়িতে ফেরে তখন শুনতে পায় গিরির মুখে গৌরীকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা৷ চরম ক্রোধে সে বিয়ে পণ্ড করতে এগিয়ে গিয়ে গৌরীর পিতা হরিলালের চক্রান্তে এবং নিজের নির্বুদ্ধিতায় মেয়েটির অন্ধপাত্রের সঙ্গে বিবাহও আটকাতে পারে না আবার নিজের জমি বন্ধক দেওয়ার টাকাও খোয়াতে হয়৷ যার খেসারত সবচেয়ে বেশি দিতে হয় গিরিবালাকে৷ পরাজিত শ্রীমন্ত যখন হরিলালের সমস্ত কারসাজি বুঝতে পারে তখন চরম ক্রোধে তার মাথায় আঘাত করে চলে আসে৷ হরিলালের ও বরপক্ষের সাক্ষ্যে শ্রীমন্তের পাঁচ বছরের জেল হলে সহায়-সম্বলহীন নিঃসঙ্গ গিরি অকূল সংসারে পতিত হয়৷ নারীর জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক তার শরীর, যদি সেই শরীরে রূপ থাকে তাহলে সেই বিপদের গতি আরও দ্রুত৷ গিরিবালা সুশ্রী৷ সন্তানহীন হওয়ার জন্য তার আঁটসাট শরীর গ্রন্থির কোথাও কোনো শিথিলতা আসেনি৷ তার স্বামী যখন বিচারের আসামি হয়ে উকিলের খরচ জোগাতে অপারগ তখন তার শরীরী সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যেচে তাদের উপকার করতে এসেছিল বিপিন নামের এক যুবক৷ সে গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধনবান৷ শ্রীমন্তের বাল্য বন্ধু৷ বিপিনের ইতর মনোভাব গিরিবালার অজ্ঞাত নয়৷ স্বামী জেলবন্দি হলে সেই ভয়ই তাকে গ্রাস করে৷ স্বামী তার কিছুই রেখে যায়নি৷ গৌরীর জন্য বা পরের মেয়ের ভালো করতে গিয়ে সংসারের সব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য হারিয়ে তাদের দাম্পত্য সম্পর্কেও প্রবেশ করেছিল দারিদ্র্যের কঠিন থাবা৷ সংসারে সম্বল তার কিছুই নেই৷ গ্রামের নিম্ন শ্রেণীর নারী পাঁচুর মায়ের কাছে সে বেঁচে থাকার উপায় খোঁজে৷ পাঁচুর মায়ের মুখেই শোনে তার মতো সহায় সম্বলহীন নারীদের জীবনযাপনের দুটি পন্থার কথা৷ প্রথম পথ দারিদ্র্যের চরম পীড়ন সয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটানো৷ আর দ্বিতীয় পথ দেহ ব্যবসা৷ এ সম্পর্কে পাঁচুর মা তাকে জানায়—‘‘ইজ্জত বিক্রি করে মা, তারা বলে খেয়ে-পড়ে তো বাঁচি—তার পর ধম্ম৷ ধম্ম আমায় সগগে দেবে—তা সগগে আমার কাজ নাই৷’’২১৩ বাগ্দি রমণী পাঁচুর মায়ের কাছে জীবনধারণের সেই ঘৃণ্য উপায় শুনে শিউরে উঠেছে গিরি৷ সে তিরস্কার করেছে তাকে৷ কিন্তু পথ তো তার সব বন্ধ৷ দেহলোভী বিপিনের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই তার কাছে৷ তাই সে সংকল্প করে মৃত্যুবরণ করবে৷ কারণ—‘‘এমন করিয়া আপনাকে বিক্রয় করিয়া বাঁচার অপেক্ষা মরাই সহস্র গুণে কাম্য৷’’২১৪ সে এমন ভাবে মরার সিদ্ধান্ত নেয় যাতে সমাজকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে পারে নারী জীবনের চরম অসহায়তাকে৷ তার মৃত্যুর দীর্ঘশ্বাস অর্থলোভী, নারীদেহলোভী পশুদের কাছে অভিশাপ হয়ে ঘুরতে থাকবে৷ আর সেই মৃত্যুর পন্থা হল অনাহার৷ পাঁচদিন সে খাবার না খেয়ে কাটিয়ে দেয়৷ তার দুরবস্থার শরীক হয়ে এগিয়ে আসা পাঁচুর মায়ের দেওয়া চাল, আনাজও চরম অবজ্ঞায় দূরে সরিয়ে দেয়৷ কিন্তু কত দিন? শেষ মুহূর্তে তাকে ক্ষুধার কাছে পরাজয় মানতেই হয়৷ মৃত্যুর নিঃশধ আক্রমন প্রতিহত করার শক্তি থাকে না তার৷ তাই শেষ পর্যন্ত মনে হয়—‘‘তার চেয়ে যে আপনাকে বিক্রি করাও ভাল আমার৷’’২১৫ ক্ষুধার জ্বালায় লেবু গাছ থেকে লেবু তুলে তা দাঁত দিয়ে কেটেই লেহন করতে থাকে সে৷ তারপর পাঁচুর মায়ের ফেলে যাওয়া কিছু চালের কণা জলে ভিজিয়ে খায়৷ কাঁচা মূলা খেতেও ভুল করে না৷ জঠরাগ্নির ভয়ঙ্কর দাহে মরিয়া হয়ে উঠেছে সে৷ আর মরা সম্ভব নয়৷ মরণ অতি ভয়ঙ্কর এবং বিভৎস৷ বাঁচার অভিলাষেই নিজের বক্ষ অনাবৃত করে অফলা যৌবন দেখিয়ে আমন্ত্রণ জানায় কামতাপিত লম্পট বিপিন বা মোটা মোড়লকে৷ তাকে বলে—‘‘আমি চাই টাকা—ভাল খাবার, গহনা, কাপড়—৷’’২১৬ লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন গিরির জীবনের এই পতনের চিত্রকে৷ এখানে সমাজ নিয়তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সব দিক থেকে চেপে ধরেছে তাকে৷ গিরি বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল৷ তার দ্বিতীয় চেষ্টা ছিল মরে গিয়ে নিজেকে বাঁচানো৷ কিন্তু মৃত্যু যন্ত্রণার কাছে হার মেনে পুনরায় তাকে আরেক মৃত্যু যন্ত্রণায় পতিত হতে হয়৷ গিরি তাই প্রবল সামাজিক পীড়নে বাধ্য হয়ে বিপিনের কাছে শরীর বিক্রির অঙ্গীকার করে মূর্ছিত হয়ে যায়৷ মূর্ছাভঙ্গ তার জীবনে নতুন স্বপ্ন সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে আসে৷ পাঁচুর মা তার জন্য ধানভানার কাজ জোগাড় করে দিয়েছে৷ বিপিনের হাত থেকে বাঁচার এই পথ তাকে নবজীবন দান করে৷ পরম কৃতজ্ঞতায় সে তাই পাঁচুর মাকে বলে—‘‘ইচ্ছে করছে তোমার গলাটা জড়িয়ে ধরে প্রাণ খুলে আজ কাঁদি; পাঁচুর মা, তুমি আমার আর-জন্মে মা ছিলে!’’২১৭ কিন্তু গিরির মতো সহায় সম্বলহীনা নারীরা বেঁচে থাকতে চাইলেই সমাজ তা দেবে কেন! তার নতুন করে সম্মান বাঁচিয়ে বাঁচার চেষ্টার মূলে কুঠারাঘাত করে বিপিন৷ সে গিরির দেওয়া কোনো এক অসংযত মুহূর্তের অঙ্গীকার মনে রেখে তাকে ভোগ করার জন্য উপস্থিত হয় শাড়ি, খাবার, তেল, সাবানসহ নানা প্রসাধনী নিয়ে৷ তার গিরিকে অগ্রিম টাকা দেওয়ার জন্য এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই সেখানে উপস্থিত হয় পাঁচু ও তার মা৷ পরে রামকেষ্টর মধ্য দিয়ে সমস্ত পাড়ায় রাষ্ট্র হয়ে যায় তার কলঙ্কের কথা৷ সমাজপতিরা বিপিনের পরস্ত্রীগমনকে রসে কৌতুকে আমোদিত করলেও গিরির জন্য সঞ্চিত থাকে অপমান ও লাঞ্ছনা৷ গিরি যে তখন পর্যন্তও বিপিনের অস্পৃশ্য ছিল হরিলালের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তা চাপা দিয়ে দেয় বিপিন৷ প্রকাশ্য পঞ্চায়েত সভায় সে সকলের সামনে স্বীকার করে গিরিবালার সঙ্গে অবৈধ যৌন সংসর্গের কথা৷ একজন নারীর জীবনে মিথ্যে কলঙ্কের কালিমা লেপন করে ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে প্রীতিভোজ সারে বিপিন৷ তার পর তার অসহায় নারীত্বের সুযোগ নিয়ে বলপূর্বক ধর্ষণ করে গিরিকে৷ সমাজ তার জন্য কোনো বিচার রাখেনি৷ বরং লম্পট বিপিনের মিথ্যা স্বীকারোক্তির উপর ভিত্তি করে পতিত হওয়ার আগেই পতিত করেছে তাকে৷ লেখক অল্প কয়েকটি কথায় এক নারীর চরম লাঞ্ছনার চিত্রকে তুলে ধরেছেন৷—‘‘সহসা বাড়ির গণ্ডিটুকুর ভিতরে রজনীর সুপ্তি বিচলিত করিয়া একটা অস্ফুট আর্ত চিৎকার ধ্বনিত হইয়া উঠিল—তারপর একটা চাপা ক্রন্দনের ধ্বনি৷’’২১৮ আর তারপর থেকে ‘‘অহল্যার মত গিরি পাথর হইয়া গেল৷ এমনি করিয়াই নারী পাষাণী হয়৷’’২১৯ লেখক গিরিকে পাথর করে তুলেছেন—সে পাথরে নারীত্বের লালিমা নেই আছে শুধু কঠিন জমাট নিস্পৃহ উদাসীনতা৷ তার লজ্জার বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দিয়েছে বিপিন৷ সে তার চক্ষুলজ্জা পাপ-পুণ্য সমস্ত ভাসিয়ে দিয়েছে৷ জীবনে যা প্রত্যাশা করেছিল দারিদ্র্যের চরম পীড়নে ব্যতিব্যস্ত হয়ে সব পেয়েছে বিপিনের কাছ থেকে৷ পরিপূর্ণ আহারে তার ক্ষুধাদীর্ণ শরীর কানায় কানায় ভরে উঠেছে৷ আর সেই পরিপূর্ণ শরীরকে ভোগ করতে তাকে গহনা, শাড়ির উপকরণে সুসজ্জিত করে নিয়েছে বিপিন৷ গিরি বসে বসে পান চিবিয়ে চিবিয়ে উঁচুতলার মানুষ বিপিনের পরিচর্যা করে৷ সমাজ প্রভুরা স্ত্রী-পরিবার থাকা সত্ত্বেও বিপিনকে পরস্ত্রী সম্ভোগের অবাধ ছাড়পত্র দিয়েছে৷

গিরি অন্ন-বস্ত্র-অলঙ্কার-প্রসাধনী এবং অর্থের বিনিময়ে রক্ষিতা হয়েছে বিপিনের কিন্তু তার মাতৃত্ব—যা তার অন্তরের চিরকালীন ক্ষুধার মতো বহমান তাকে শেষ করতে পারেনি৷ তাই ডোমপাড়ায় এক সদ্য সন্তান হারানো নারীর মর্মভেদী করুণ বিলাপে ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকতে হয় তাকে৷ কিন্তু তার কাছে বিপিন সম্পূর্ণ পেশাদার৷ সে বিপিনকে শরীর দেয় বিনিময়ে বিপিন তাকে দেয় অন্ন, বস্ত্র, অর্থ, গহনা৷ তার এবারের পাওনা গলার হার৷ সে তার কাছে আসতেই গিরি দাবি করে সেই হারের৷ বিপিন তাকে সংসারের টানাটানির কথা জানিয়ে হার দেওয়ার বিলম্বের কারণ বললে দক্ষ ব্যবসায়ীর মতো সে বলে—‘‘সে কি আমার দেখবার কথা? মনে আছে তোমার, আমি চেয়েছিলাম—টাকা, গয়না, কাপড়!’’২২০ গিরির বিপিনের প্রতি মায়া নেই৷ যে জটিল পরিস্থিতিতে তাকে দেহব্যবসায়িনী হতে হয়েছে, নারীত্বের শেষ সম্মানটুকু বিসর্জন করতে বাধ্য হয়েছে সেই বিপিনকে সে ক্ষমা করতে পারে না৷ তাই বিপিন যখন তাকে জানায় যে সে তার জন্য জমি পর্যন্ত বিক্রি করে দিচ্ছে তখন তার কথার উত্তরে গিরি বলে—‘‘তোমার আজ জমি গিয়েছে আবার কিনবে, যা ছিল তার চেয়েও বেশি হতে পারবে; কিন্তু আমার যা গিয়েছে তা কি ফিরবে, ফিরিয়ে দিতে পারবে?’’২২১ গিরির মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে উপন্যাসটির সবচেয়ে সত্যকার কথাটি৷ গিরি তার সতীত্ব ধর্ম সব কিছু হারিয়েছে, তা লুন্ঠন করেছে বিপিন৷ বিপিনের গিরির জন্য বিক্রয় করা জমি পুনরায় ফিরে পেতে পারে কিন্তু কোনো অবস্থার বিনিময়ে গিরির বিপিনের দ্বারা লুন্ঠিত সতীত্ব-সম্ভ্রম ফেরাতে পারবে না৷

তারপরে আরেক বাঁক আসে গিরির জীবনে৷ তার অতৃপ্ত মাতৃত্ব পরিতৃপ্তির পথে অগ্রসর হয় বিপিনের ঔরসে সন্তান গর্ভে ধারণের মধ্য দিয়ে৷ সন্তানই তার জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া৷ কি না করেছে সে একটি সন্তান প্রত্যাশায়৷ তার অফলবতী জীবনই তো তার ও শ্রীমন্তের সুখী দাম্পত্যকে ধ্বংস করে দিয়েছে৷ নিজের সন্তান ছিল না বলেই তো পরের সন্তানের জন্য সর্বস্ব হারিয়েছে তারা—সেই সন্তান তার গর্ভে এসেছে৷ তার আর আনন্দের সীমা পরিসীমা থাকে না৷ রতনের মুখে সে যখন সেই সন্তানের কন্টকাকীর্ণ ভবিষ্যতের কথা শোনে তখন—‘‘বুক চাপড়াইয়া তাহার কাঁদিতে ইচ্ছা করিতেছিল৷ ভবিষ্যতের বাস্তবতা তাহার চক্ষের উপর ভয়াবহ রূপ লইয়া ফুটিয়া উঠিল৷’’২২২ সে রতনকে দিয়ে বিপিনকে ডেকে আনিয়ে তার পায়ে আছাড় খেয়ে পড়ে ভবিষ্যতের কথা ভেবে৷ বিপিন সমাধানসূত্র বের করে পদা দাইকে দিয়ে গর্ভপাত করানোর মাধ্যমে৷ তার এই সমাধান মেনে নিতে পারে না গিরি৷ সন্তান তার সারাজীবনের কাঙ্খিত ধন৷ সেই সন্তানকে সে গর্ভে পেয়েছে৷ বিপিনকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজের পথ নিজেই খোঁজে৷ তারপর গভীররাত্রে নিজের ঘরে আগুন দিয়ে অলক্ষে গ্রাম থেকে বের হয়ে যায় সে৷ ‘‘ঘরের বন্ধন, সমাজের নাগপাশ নিজের হাতে আগুন ধরাইয়া নিঃশেষে ভস্ম করিয়া পৃথিবীর বুকে দাঁড়াইয়া আপনাকে সে মুক্ত অনুভব করিল৷’’২২৩

সে স্বামী হারিয়ে, সতীত্ব হারিয়ে, গ্রাম ছেড়ে সন্তানের নির্বিঘ্ন ভবিষ্যৎ ভেবে পথে নামলেও পদে পদে সেই প্রতিকূলতা জব্দ করেছে তাকে৷ পথের কুকুরের মতো রাস্তায় গাছতলায় পড়ে থেকেছে৷ এক ছোট শহরের প্রান্তদেশে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা এক পুরোনো বয়লারের মধ্যে আশ্রয় নেওয়া গিরি প্রবল প্রসব যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মূর্ছিত হয়ে গেলে সে জ্ঞান ফিরে পেয়েছে হাসপাতালে—সেখানে ছোট্ট ফুটফুটে সন্তান জন্ম দিয়েছে সে৷ তার নিজের গর্ভজাত সন্তান৷ তার জীবনের সব আশা-আকাঙ্খা সাধ-আহ্লাদ৷ সন্তান কোলে পেয়ে সে ভুলে গিয়েছে তার সব যন্ত্রণা৷ কোলে শিশুকে নিয়ে ভিক্ষা করতে করতে পেয়ে গেছে এক ধনী বাড়ির ঠাকুরদালানের এঁটোকাঁটা ঘোচানোর কাজ৷ কিন্তু সেখানেও বিধি বাম৷ তার ছোট্ট সন্তান নীলকন্ঠের অসুস্থতার কারণে একবেলা কাজ না করার অপরাধে গৃহকর্ত্রীর দ্বারা বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নেয় পথের পরে৷ সেখানে চলে নানা মানুষের তার শরীরের প্রতি শ্বাপদ দৃষ্টি বিনিময়৷ মন্দিরের পুরোহিত পর্যন্ত তার শরীরকে উপভোগ না করে ছাড়ে না৷ সন্তান এবং ক্ষুধা তাকে ভিখারিনি দেহব্যবসায়ী করে তুলেছে৷ লেখক তার বেশ্যাজীবনের ইতিহাসও বর্ণনা করেছেন দু-চারটি কথায় কিন্তু তার অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনার ব্যাপ্তি বহুদূর প্রশস্ত৷ ‘‘তারপর কত মানুষকেই সে দেখিল৷ অধিকাংশ পাষণ্ড নৃশংস৷’’২২৪ কামাতুর মানুষদের পশুবৎ যৌনপীড়নকেও লেখক তুলে ধরতে ভোলেননি৷ নারীর শরীরকে অর্থের বিনিময়ে ভোগ করার সুযোগ নিয়ে সে অর্থের মূল্য সুদ-আসলসহ পুষিয়ে নিতে ভোলেনা পশুবৎ মানুষেরা৷ গিরির গণিকা জীবনের অভিজ্ঞতায় বর্ণিত হয়েছে এক ড্রাইভারের প্রসঙ্গ৷ ধুলিধূসর, কালোরঙ এবং জবাফুলের মতো লাল চোখের অধিকারী সেই ড্রাইভার এতটা পাশবিক পীড়ন করেছিল তাকে যে গিরির তাকে হত্যা করতে ইচ্ছে করেছিল৷

জীবনে চারটি বছর গ্রামছাড়া গিরি৷ আবার গ্রামমুখো হয়েছে—ছোট্ট নীলকে হাতে ধরে৷ বৃষ্টির প্রবল বর্ষণে গ্রামের নদীর ঘাটে এসে নীলকন্ঠকে এবং নিজেকে জলের ছাঁট থেকে বাঁচাতে সে আশ্রয় নেয় ঘাটের মাথায় বটগাছ তলে৷ সম্পূর্ণ অতীতচারিতায় মগ্ন হয়ে জীবনের খেই হারিয়ে ফেলে সে৷ সে জন্য সেই ঘাটপাড়ে বসে মৃত্যুর প্রত্যক্ষ আহ্বান শুনতে পায়৷ সেই বিমূঢ় অবস্থা থেকে যখন সম্বিত ফিরে আসে তখন নদীতে বান এসেছে—ঝুপ ঝুপ করে পাড় ভেঙ্গে পড়ছে৷ নীলের কথা মনে হতেই সে ছুটে যেতে চায়—কিন্তু বিধাতা এবার সদয় তার প্রতি৷ পা পিছলে ভরা নদীতে তলিয়ে যায় সে৷ তার স্নেহের প্রিয় ধন নীলকন্ঠ আশ্রয় নেয় তারই গ্রামে তাদের সেই পরিত্যক্ত ভিটায়৷ পরবর্তী সময়ে শ্রীমন্ত যার প্রতি স্নেহের হাত বাড়িয়ে দেয়৷

লেখক গিরিবালার নিদারুণ জীবনযন্ত্রণার পরিসমাপ্তি করলেন তার মৃত্যুকে নিশ্চিত করে৷ গিরিবালার মতো মানষদের মৃত্যু ছাড়া কোনো গতিও নেই৷ তাই দেখালেন রচনাকার৷

খ. রাইকমল :

উপন্যাসটির প্রকাশকাল ১৯৩৪ হলেও লেখক পূর্বের লেখা দুটি গল্পকে প্রায় অবিকৃত রেখে সামান্য কলেবর বৃদ্ধি করেই উপন্যাসটিকে গঠন করেছেন৷ গল্পদুটি যথাক্রমে ‘রাইকমল’ (১৯২৯) এবং ‘মালাচন্দন’ (১৯৩১)৷ বৈষ্ণব ভাবপরিমণ্ডল, সামাজিক বিশিষ্ট রীতি-নীতি, ধর্মীয় আচার ও বিশ্বাস এই উপন্যাসের মূল কেন্দ্রভূমি৷

উপন্যাসটিতে আলোচিত হয়েছে ‘সেবাদাসী’ প্রথা৷ বৈষ্ণবীয় এই প্রথা তৈরির পেছনে পূর্বসূরীদের সাধনার কোনো গোপন তত্ত্ব ইতিবাচক দিক থাকলেও তা ক্রমে স্থূল দেহভোগের ইঙ্গিতকেই গ্রহণ করে৷ এখানে বর্ণিত হয়েছে ‘মালাচন্দন’-এর মাধ্যমে বৈষ্ণবদের বোষ্টম, বোষ্টমী গ্রহণ৷ নায়িকা কমলিনী মালাচন্দনের মাধ্যমে যেমন রসিকদাসকে গ্রহণ করেছিল তেমনি রসিকদাসের সেই মালা ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সেই বন্ধনও ছিন্ন হয়ে যায়৷ পুনরায় সে মালাচন্দন দিয়ে গ্রহণ করে রঞ্জনকে৷

উপন্যাসে রঞ্জনের গল্পে সেই সেবাদাসী প্রথার অপরিহার্যতা উঠে এসেছে৷ রঞ্জন কমলিনীর মানসপুরুষ৷ শৈশব থেকে ‘বর-বউ’ খেলতে খেলতে সেই খেলার সম্পর্কই কৈশোরে তাদের মনে প্রণয়ের সঞ্চার করে৷ কিন্তু তাদের সেই সম্পর্ককে মান্যতা দিতে চায় না রঞ্জনের বাবা-মা৷ কারণ বৈষ্ণবদের মধ্যে কোনো জাত-বিচার নেই, বহুগামীতা তাদের ধর্মীয় উপসর্গ৷ তাই কমলের মুখের এঁটো কুল খাওয়াকে কেন্দ্র করে রঞ্জনের মায়ের ক্রোধান্বিত কথা—‘‘রাক্ষুসী, রাক্ষুসী, মায়াবিনী গো, ওরা ছত্রিশ জেতে বোষ্টম—ওদের কাজই এই৷’’২২৫ বৈষ্ণবীরা পরপুরুষের সঙ্গকে কৃষ্ণসঙ্গ মনে করে এবং নিজেদের ভাবে রাধারাণী৷ সাধারণ মানুষজনের এদের প্রতি শ্রদ্ধা নেই৷ তাদের ধর্মের নামে ব্যভিচার সকল মানুষেরই জানা৷ কমলিনী বা রাইকমল রঞ্জনকে মুক্তি দিতে গ্রাম ছেড়েছিল৷ তার বহুদিন পরে রসিকদাসকে পতিত্বে বরণ করে সে যখন পুনরায় নিজগ্রামে উপস্থিত হয়ে পাড়ার যুবাদের নিয়ে এক মশগুল আখড়া গড়ে তোলে তখন তাকে কেন্দ্র করে পাড়ার নারী মহলের আক্রোশের সীমা থাকে না৷ কেউ শুনিয়ে শুনিয়ে কেউ বা আড়ালে তার ধর্মাচার নিয়ে কটু কথা বলতে থাকে৷

রাইকমলকে রঞ্জন বৈষ্ণব হয়ে বিবাহ করতে চেয়েছিল৷ তার আগেই সে চলে যায় গ্রাম ছেড়ে৷ গ্রামে এসে সে জানতে পারে রঞ্জন বৈষ্ণব হয়ে তাদের খেলাঘরের সঙ্গিনী বিধবা পরীকে নিয়ে দেশান্তরী হয়েছে৷ সেই রঞ্জনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় জয়দেবের শ্যামচাঁদের দরবারে যাত্রাকালে৷ সেখানে মালাচন্দনের মাধ্যমে পরস্পর একাত্ম হয়ে আখড়ায় ফিরে এসে দেখতে পায় পরীকে৷ কঙ্কালের উপর চামড়ার আচ্ছাদন দিলে যেমন হয় তেমনি রোগশীর্ণ পরী৷ পরীকে ভোগের জন্য তার সেবাদাসী করেছিল৷ কিন্তু সে যখন তার শরীরী ক্ষুধা মেটাতে অক্ষম হয় তখন মালাচন্দন করে সেবাদাসী বানায় কমলকে৷ মৃত্যুকালে পরীর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয় এই সব ভোগ্যা নারীদের জীবনের এক গুঢ় সত্য৷ সে কমলকে বলে—‘‘রূপ একদিন আমারও ছিল৷’’২২৬ তার রূপ শেষ হতেই এঁটো পাতার মতো তাকে ত্যাগ করেছে রঞ্জন৷ পরীর মৃত্যুর পর মিলনে উচ্ছ্বাসে তিনটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায় কমলের৷ তারপর থেকেই সে বুঝতে পারে তার প্রতি রঞ্জনের নিরাসক্তি৷ সেই উদাসীন অবহেলা আরও গভীর হয় রঞ্জনের সঙ্গে ঝুলনের স্বপ্নে মগ্ন হলে৷ তার সেই প্রেমস্বপ্নের মূলে কুঠারাঘাত করে রঞ্জন যখন বলে—‘‘বলি বয়স বাড়ছে, না কমছে?… নইলে এখনো তোমার ঝুলনে সাধ হয়! আয়নাতে কি মুখ দেখা যায় না, না নিজের রূপ খুব ভালই লাগে?’’২২৭ পরীর সেই বেদনার বিলাপ স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় তার চেতনায়৷ সে যেন বাস্তব থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছিল৷ রঞ্জন তার ব্যথিত চিত্তে এতটুকু সান্ত্বনা না দিয়ে তার কাজের কথা বলে দিনতিনেকের জন্য বেড়িয়ে যায়৷ সে আহত হয়ে আয়না ধরে তার মুখের উপর৷ চমকে উঠতে হয় তাকে—‘‘সত্যিই তো, কোথায় সেই প্রাণ-মাতানো রূপ তাহার? সেই চাঁপার কলির মতো রং এখনো আছে, কিন্তু সে চিক্কণতা তো আর নাই৷ চাঁদের ফালির মত সেই কপালখানি আকারে চাঁদের ফালির মত আছে, কিন্তু তাহাতে যেন গ্রহণ লাগিয়াছে, সে মসৃণ স্বচ্ছতা আর তাহাতে নাই৷ গালে সে টোলটি এখনো পড়ে, কিন্তু তাহার আশেপাশে সূক্ষ্ণ হইলেও সারি দিয়া রেখা পড়িতে শুরু করিয়াছে—এক দুই তিন৷ নাকের ডগায় কালো মেচেতার রেশ দেখা দিয়াছে৷’’২২৮ কমল বুঝতে পারে তার বিগতযৌবনের প্রতি রঞ্জনের অবহেলাকে৷ সে যে তাকে না জানিয়ে গোপনে গোপনে কোনো কার্য করে যাচ্ছে সেটাও বাকি থাকে না বুঝতে কিন্তু জিজ্ঞাসা করার ঔৎসুক্য যেন হারিয়ে ফেলেছে সে৷ তার দিন কয়েক পরে রঞ্জন উপস্থিত হয় আখড়ায়৷ তার পেছনে মালাচন্দনে চর্চিত এক তরুণী৷ সে নিজেই নিজের পরিচয় দিয়ে বলে—‘‘আমি নতুন সেবাদাসী গো৷’’২২৯ তার মুখেও প্রতিধ্বনিত হয় রাইকমলের বিগত যৌবনের জন্য ব্যঙ্গরসিকতা—‘‘তবে যে শুনেছিলাম গাইয়ে-বাজিয়ে বলিয়ে-কইয়ে—রূপে মরি মরি! ও হরি তুমি এই!’’২৩০

রঞ্জন স্থূল দেহভোগী৷ তার মধ্যে ফুটে উঠেছে প্রবল রূপতৃষ্ণা এবং নতুন নতুন নারীকে ভোগ করার তীব্র আকাঙ্খা৷ শুধু তাই নয় পুরোনোকে পরিত্যাগ করার মধ্যেও তার কোনো কুন্ঠা নেই বরং তীব্র নির্মমতা৷ পরীকে ত্যাগ করে একদিন সে গ্রহণ করেছিল কমলকে আবার কমলের যৌবনে ভাটা পড়তে শুরু করলে নিয়ে আসে আরেক সেবাদাসী৷ পুরুষের ভোগের শিকার হয়ে এক নিষ্ঠুর ধর্মীয় বাতাবরণে আবদ্ধ এই নারীদের জীবনভর পিষ্টই হতে হয়৷ রূপ থাকলে তারা নতুন বৈষ্ণব পায় আর যদি না থাকে তাহলে ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া কোনো উপায় থাকে না৷

গ. কালিন্দী :

‘কালিন্দী’ (১৯৩৪) উপন্যাসের পটভূমিতে আছে পড়ন্ত জমিদারি ব্যবস্থা, আভিজাত্যের লড়াই, যুথবদ্ধ কৌমসমাজ, ধনতান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশ ও পুঁজিবাদের আক্রমণ এবং বিপ্লবী রাজনীতি৷ উপন্যাসের এই দ্বন্দ্বমুখর পরিবেশের প্রাণচঞ্চল নারী সারী৷ সে সাঁওতাল কন্যা-সাঁওতালি নারীদের দলনেত্রী৷ সাহসে, ক্ষিপ্রতায় চমৎকারিত্বে ভরপুর সেই প্রাণবন্ত কিশোরী সামাজিক নিষ্পেষণে দেহব্যবসায়ী হতে বাধ্য হয়৷ চিনিকল মালিক বিমলবাবুর লোলুপ দৃষ্টিতে ছাই হয়ে যায় সে৷ তাদের নিজস্ব ব্রতনিয়মের মাঝে মেয়েদের দলের মধ্যমণি দলপতি কমল মাঝির নাতনি দীর্ঘাঙ্গী লতার মত সরস মেয়েটিকে প্রথম দেখেই বিমলবাবুর মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এসেছিল তাকে ভোগ করার প্রচ্ছন্ন বাসনা—‘‘বাঃ, মেয়েটির দেহখানি চমৎকার, tall, graceful,-youth personified.’’২৩১ তার কামনার তীব্র দহনেই সতেজ সবল বন্যলতাটি শুকিয়ে খড় হয়ে যায়৷ সে কালিন্দীর চর বরাত নিয়ে চিনিকল স্থাপন করে আস্তে আস্তে পুরো চরখানাই দখল করে৷ সাঁওতালদের কলের মজুরে পরিণত করে৷ তদের যূথবদ্ধতাকে ভেঙ্গে দিয়ে কৌশলী ষড়যন্ত্রে একঘরে করে কমলমাঝির পরিবারটিকে৷ তারপর রাতারাতি নিরুদ্দেশ হয়ে যায় সাঁওতাল দলপতি৷ সারী তার গৃহে স্থান পায় তার রক্ষিতা হিসেবে৷ উদ্যত ছুরি দেখিয়ে সে সারীর সঙ্গে তার স্বামীর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে তার শরীরটিকে নিজের ভোগের জন্য করায়ত্ত করে৷ তার দলের মেয়েরা তাকে তাই আজ ঘৃণা করে৷ বিমলবাবুর সঙ্গে তার বসবাস নিয়ে অহীন্দ্রকে জানায়—‘‘হেঁ, পাপ করলে; আপোন বরকে—মরদকে ছেড়ে উ ওই সায়েবটোর ঘরে থাকছে৷’’২৩২ অপর একটি মেয়ে বলে—‘‘উ এখুন ভালো কাপড় পরছে, গোন্দ মাখছে, উই সায়েব দিচ্ছে উকে৷’’২৩৩ কিন্তু বিমলবাবুর মতো নারীমাংসলোভী মানুষদের সারীর মতো সামান্য একজন সাঁওতাল মেয়েকে ভোগ করে তৃপ্ত থাকার কথা নয়—থাকেও না৷ তার কামনা পূরণ হয়ে গেলে সে নির্মমভাবে তার ঘর থেকে বের করে দেয় সারীকে৷ সেই কথা লেখক ব্যক্ত করেছেন এইভাবে—‘‘মুখার্জি সাহেব কাল হইতে সারীকে বাংলোর আউটহাউস হইতে তাড়াইয়া দিয়াছেন; তাঁহার শখ মিটিয়া গিয়াছে৷’’২৩৪ মুখার্জীসাহেব বা বিমল বাবুর শখ মিটে গেলেও রক্ত-মাংসের দেহধারী সারী তো মরে যায় না৷ সে বেঁচে থাকে৷ আর তার জন্য তাকে রসদ জোগাড় করতেই হয়৷ দেহ খাবার না হলে চলে না৷ দেহকে খাবার দিয়ে সচল রাখতে পুনরায় তাকে উপায় খুঁজতে হয়৷ তার সমাজ তাকে পরিত্যাগ করেছে, বিমলবাবুর তাকে প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে তারপরেও তার উচ্ছিষ্ট দেহটার জন্য মুখিয়ে আছে সরকারবাবু, শূলপাণি রায় প্রভৃতিরা৷ এতগুলো পুরুষের যৌনখোরাক জোগাতে গিয়ে সে হয়ে যায় রক্ষিতা থেকে বেশ্যা৷ কুলি ব্যারাকের মধ্যে বসতি স্থাপন করে দেহ ব্যবসা চালিয়ে যায়৷

পূর্বের সেই চপল চঞ্চল নারী বহু পুরুষের পীড়নে তার সরলতা হারিয়ে ফেলে৷ তার সেই সর্বস্বহারা মলিন রূপ পাঠকের মনে শুধু দাগ রেখে যায় না একটা প্রতীকের মতো হয়ে ওঠে৷—‘‘আদিম মাটির ঘাসের সজল সবুজ যেন নীরস শুকনো তৃণে পরিণত হল৷ চরের আদিবাসী চটুল প্রগলভ তরুণী কলে নিষ্পেষিত হয়ে ছিবড়ে হয়ে গেল, শোষণ-রিক্ত মজুরের মতো৷’’২৩৫ সাঁওতাল মেয়েগুলো ছিল যেন কলরব মুখর একঝাঁক রঙিন পাখি৷ তাদের নেত্রী সারীর জীবনের নিষ্ঠুর রূপান্তর সমাজের এক নগ্নরূপকে সামনে নিয়ে আসে৷

ঘ. প্রেম ও প্রয়োজন :

নলিনী :

তারাশঙ্করের ‘প্রেম ও প্রয়োজন’-এর (১৯৩৫) কেন্দ্রীয় চরিত্র নলিনী৷ সে লেডি ডাক্তার এবং ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শী৷ সেই সুবাদে জমিদার মহেন্দ্রবাবুর মাতৃহীন পুত্রকে লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করে৷ তা ছাড়া জমিদারের দাতব্যচিকিৎসালয়ে চুক্তিভিত্তিক ডাক্তার হিসেবেও তার নাম রয়েছে৷ ধর্মে সে খ্রিস্টান৷ অনেকে আবার তাকে মহেন্দ্রবাবুর রক্ষিতা হিসেবেও প্রতিপন্ন করতে চায়৷ অনেকে তাকে বলে বেশ্যাকন্যা৷ নলিনীর নিজের কথার মধ্যেও তার পরিচয় উঠে এসেছে৷ শহুরে, শিক্ষিত, স্বাধীনজীবী নলিনীর মধ্যে ছিল দুর্দান্ত সাহস ও প্রতিবাদ মনস্কতা৷ গ্রামের অসহায় বিধবা রমাকে মহেন্দ্রবাবুর লালসা থেকে বাঁচাতে মহেন্দ্রর হত্যার হুমকির প্রতিবাদে সাহসিকতার সঙ্গে বলে—‘‘আপনি তো আমার পরিচয় জানেন৷ বেশ্যার মেয়ে আমি৷ আপনাদের এই ধনী জাতদের সর্বনাশ করা আমার না হোক—আমার জাতের পেশা৷’’২৩৬ নলিনী নিজে উপন্যাসে কখনো শরীর বিক্রয় করেনি কিন্তু গণিকার সন্তান হয়েও সমাজে ডাক্তার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে চরিত্রটির গুরুত্ব রয়েছে৷

রমা :

রমা রমণদাসের বিধবা কন্যা৷ নিম্নশ্রেণীতে সৌন্দর্যের বাহার নিয়ে জন্মেছিল সে৷ তাকে দেখে মানুষের আশ মিটত না৷ সেই অপরূপা সুন্দরী নারী বিধবা হয়ে ভাই-ভাজের কাছে ফিরে এসে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ তাঁর বাবা-মাও তাকে গিলতে বা ফেলতে কিছুই করতে পারছিল না৷ এমতাবস্থায় তাঁর দিকে দৃষ্টি পরে জমিদারের৷ দালাল কড়ি গাঙ্গুলীর মধ্যস্থতায় পাঁচশত টাকার বিনিময়ে জমিদার তাকে কিনে নেয়৷ সে জমিদার বাড়ির অন্দরমহলে স্থান পায় জমিদারের রক্ষিতা হিসেবে৷ মাটি ও গরুর জন্য এবং নিজেকে জমিদারের সুনজরে রাখার জন্য একজন পিতা তার আত্মজাকে নির্দ্বিধায় বিক্রয় করে দিতে পারে এমন দৃশ্যের অবতাড়না করা হয়েছে আলোচ্য উপন্যাসে৷ রমার মধ্যেও ধনসম্পদের একটা সুপ্ত মোহ ছিল৷ সেই লোভে সেও নিজেকে জমিদারের লালসার কাছে বিকিয়ে দেয়৷ নলিনীর বুঝতে অসুবিধা হয় না জমিদারের প্রবৃত্তি বাসনাকে৷ রমা নলিনীর সহায়তায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ঘটনার আবর্তে পুনরায় নিজেকে সমর্পণ করে মহেন্দ্রবাবুর কাছে৷ সুদীর্ঘ অতৃপ্ত জীবনে পুরুষের সঙ্গ কামনা, মহেন্দ্রবাবুর ধনরাশিতে কর্তৃত্ব করার বাসনা এবং শিশুকে পালন করার বুভুক্ষ প্রত্যাশায় তার মায়ের মুখে মহেন্দ্রবাবুর কাছে পাঠানোর ইতিবাচক ইঙ্গিতে—‘‘বুকের মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন ঘন আবেগ গর্জনমান উতলা মেঘের মত মুখর হইয়া উঠিল৷ সে অনুভব করিল, বাহির পর্যন্ত তাহার সে গর্জনের প্রতিধ্বনিতে থরথর করিয়া কাঁপিতেছে৷’’২৩৭ যে আয়না ঘরে মহেন্দ্রবাবুর দুর্বার কামনা থেকে তাকে একদিন নলিনী রক্ষা করেছিল সেই ঘরেই পুনরায় সে মহেন্দ্র বাবুর বাহুবন্ধনে নিজেকে সমর্পণ করে৷

রমার তার পরের জীবন ব্যভিচারের এক সুদীর্ঘ কাহিনি৷ তার উন্মত্তভাবে বাবুর কাছে আত্মসমর্পণের পেছনে ছিল যৌবনের আকস্মিক জাগরণে পুরুষের শক্ত বাহুবেষ্টনী, সংসার, সন্তান—জীবজগতে কৈশোর-অতিক্রান্ত নারীর কল্পনার বস্তু যা তার সব৷ প্রেম সে বোঝেনি সেখানে ছিল শুধু প্রবৃত্তি আর কামনা৷ কিন্তু মহেন্দ্রবাবুর প্রয়োজনের হিসেবে একদিন রমার মূল্য কমে যায়৷ তাই তিনবছর ক্রমাগত ভোগ করার পর পুনরায় দালাল কড়ি গাঙ্গুলীকে ডেকে জানায় যে তার জবাব হয়ে গেছে—একটা বাড়ি এবং কিছু টাকা তাকে ভোগ করার দক্ষিণা স্বরূপ বুঝিয়ে দেয় কড়ি গাঙ্গুলীকে৷ রমার যে পুনরায় সমাজে স্থান হবে না সে কথা বোঝার মন জমিদারের নয়৷ কড়ি গাঙ্গুলী সে কথা জানালে জমিদার বলে যে সে তার প্রতাপ দিয়ে সমাজের মুখ বন্ধ করে দেবে৷ কড়ি তার কাছে প্রার্থনা করে অন্তত দাসী হিসেবে যদি মহেন্দ্র তাকে স্থান দেয় তাহলেও মেয়েটা সমাজের পীড়ন থেকে রক্ষা পাবে৷ তার উত্তরে জমিদার জানায়—‘‘না, তা হয় না এককড়ি৷ পুরাতন কাপড় বাক্সে তুলে রেখে পরিত্যাগ করা আমি পছন্দ করি নে৷’’২৩৮ কি ভয়ানক অবজ্ঞা নারীর প্রতি৷ একজন জলজ্যান্ত রক্তমাংসের মানুষ দিনের পর দিন যাকে দিয়ে দেহের উন্মত্ত পিপাসাকে পূরণ করেছে—তাকে পুরোনো কাপড়ের মতো পরিত্যাগ করতে কোনো দ্বিধা হয় না তার৷

সময় ধীরে ধীরে পাল্টে দেয় মানুষের জীবন৷ দুর্বৃত্ত লম্পট মহেন্দ্রবাবু কঠিন পীড়ায় পীড়িত হলে তার সেই রোগের ছোঁয়াচ থেকে বাঁচতে নিকট আত্মীয়ের কেউই সেবার দায়িত্ব নেয় না৷ পুনরায় প্রয়োজন পড়ে পরিত্যাগ করা সেই পুরোনো কাপড়ের প্রতীক রমাকে৷ কর্মচারীকে জানায় রমা নামের তার সেই পুরোনো ঝিটিকে নিয়ে আসতে৷ রমা আসে তাকে পরিচর্যা করতে—রোগের ছোঁয়াচের ভয়কে উপেক্ষা করেই আসে৷ মহেন্দ্রবাবু তার পরেও রমার মূল্য যাচাই করে টাকার হিসেবে৷ পাঁচহাজার টাকা সে উইল করে দিতে চায় তাকে৷ কিন্তু রমা তো আর সেই প্রবৃত্তি তাড়িত নয়—তার মধ্যে জীবনের সত্য স্বরূপকে—নিজের অবস্থানকে বোঝার বোধ জন্ম নিয়েছে৷ সে তাই টাকা নিয়ে সেবার দরকষাকষি করতে চায় না৷ মহেন্দ্র বাবুর ঈশ্বরের দিব্যিতেও তার মুখে ফুটে উঠে বিচিত্র তিক্ত হাসি৷

ঙ. আগুন :

‘আগুন’(১৯৩৭) উপন্যাসের গল্পে তিনটি পৃথক পূর্ণাবর্ত কাহিনি চন্দ্রনাথ, হীরু এবং নিশানাথের৷ চতুর্থ চরিত্র নরু বা নরেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় গল্পের কথক৷ হীরুর গল্প প্রসঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে যাযাবরী মুক্তোকেশীর নাম৷ যাযাবরদের জীবনযাত্রা বিচিত্র৷ কবে কেমন করে কথকদের গ্রামে তারা বাসা বেঁধেছে তা তার জানা নেই৷ অদ্ভুত মিষ্টভাষী সেই যাযাবর জাতিটি৷ বর্ষের প্রথমেই জাতিটা পথে বের হয় ফেরে একেবারে দুর্গাপূজার সময়৷ তারপর আবার পথে বেড়িয়ে গাজনের সময় গ্রামে ফিরে আসে৷ তাদের রহস্যময় জীবন ধারার সবচেয়ে বড় রহস্য হল নারীদের স্বাধীন জীবন৷ নারীরা স্বেচ্ছায় তাদের শরীরকে বিলিয়ে দেয় পুরুষের হাতে তারপর নারী পুরুষ উভয়ের প্রয়োজন ফুরালে যূথে ফিরে আসতেও কোনো বাধা নেই তাদের৷ কথক এ প্রসঙ্গে বলেছেন—‘‘সে আপনাকে স্বেচ্ছায় বিলাইয়া দেয়, বাপ দাবি করে শুধু টাকা৷’’২৩৯ অর্থাৎ কৌমের মেয়েদের শরীরের বিনিময়ে মেয়ের পিতার টাকা গ্রহণ করার মধ্যে এদের সমাজে অনৈতিকতার কোনো বাড়াবাড়ি নেই৷ সেই বাজিকর দলের কন্যা মুক্তোকেশীও স্বাধীন বৃত্তির৷ সেও তাদের জাতটার মতো রহসময়ী৷ পিঙ্গলবর্ণা তরুণী যাযাবরী, সুগঠিত দীঘল দেহে পশ্চিমা মেয়েদের মতো করে ছিটের কাপড় পরিধান করে একহাত কাঁচের চুড়ি এবং গলায় বেলের খোলের মালা পড়ে ঈষৎ বঙ্কিম ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে যখন গান শোনাতে এবং নাচ দেখাতে প্রার্থনা জানায় তখন সেই বর্বরা মোহময়ীর মোহমায়ায় নরু এবং হীরু উভয়কেই মুগ্ধ হতে হয়৷ নরু গল্পের কথক লেখক মানুষ সে নিজের প্রবৃত্তির সংযম জানে কিন্তু হীরু বিলেত ফেরত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং প্রচুর ধন সম্পদের অধিকারী৷ তার মধ্যে সংযমের কোনো বালাই নেই৷ অপার মুগ্ধতায় সে পান করে যাযাবরীর রূপ সৌন্দর্য৷ যাযাবরীও অভিভূত হয়ে যায় রূপবান হীরুকে দেখে৷ তার আদিম কামনার শিখা লেলিহান হয়ে উঠে৷ সে তার চোখের দৃষ্টি দিয়ে আকন্ঠ পান করতে চায় হীরুর রূপ সৌন্দর্য৷ অদ্ভুত নাচ পরিবেশন করার পরেও ক্লান্তির মধ্যেও সে বলে ওঠে—‘‘টুকচা বসি বাবু, তুমাকে দেখি৷ চোখের সার্থক ক’রে লিই গো চাঁদপারা বাবু৷’’২৪০ শুধু তাই নরু তার ঔদ্ধত্তের কথা তাদের মোড়লকে বলে দিতে চাইলে সেই যাযাবরী অকপটে বলতে পারে—‘‘কি বলবা বাবু? ওই বাবুটি যদি আমার বাবাকে টাকা দিয়ে কিনে লেয় তো দিয়ে দিবে বাবা৷’’২৪১

এরপর যাযাবরী আবার উপস্থিত হয় শঙ্খপতির বিলের ধারে হীরু নরুর শিকারের সময়৷ সেখানেও হীরুর প্রতি তার আসক্তির কথা অকপটে ব্যক্ত করেছে সে৷ হীরু যদি বলে তাহলে বিলের জলে পড়া গুলিবিদ্ধ পাখিগুলিকে সে অনায়াসে এনে দিতে পারবে বলে জানায় এবং তা করেও৷ সে তাদের সাপের খেলা দেখায়৷ বন্দুক দিয়ে শিকারের অভিলাষ ব্যক্ত করে৷ হীরু তার নাম দেয় চিত্রাঙ্গদা এবং অতিসংক্ষেপে চিত্রাঙ্গদার কাহিনি তাকে জানালে সে খিল করে হেসে জবাব দেয়—‘‘বড় মিঠ্যা নাম গো বাবু৷’’২৪২ হীরুর সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে তার সাহায্য নিয়ে পাখি শিকারও করে সে৷

যাযাবরী তার মোহের মায়ায় সত্য সত্যই বিদ্ধ করে হীরুকে৷ সেই আদিম বর্বর মেয়ে হীরুকে প্রলুব্ধ করে ঘর বাঁধে তারই জমিদারির এক নির্জন জঙ্গলমহলে৷ সে ঘর বাঁধা স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সংসার নয় তা আদিম আসক্তি ও কামনা দিয়ে ঘেরা৷ কথক বহুদিন পর হীরু সন্ধানে গিয়ে তাকে আবিষ্কার করে গভীর শালবনে বাঘ শিকারের উদ্দেশ্যে তার পাতা মাচায়৷ সেখানে আশ্চর্য হয়ে যায় তার সঙ্গিনী যাযাবরীকে দেখে৷ সেখানে লালসাময়ী যাযাবরীর জীবনের অদ্ভুত রূপান্তর৷ হীরুর সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে তার মধ্যে সঞ্চিত হয়েছে অমৃত মাতৃত্ব ধারার৷ তাই শিকারে আর তার প্রবৃত্তি নেই৷ হীরু তিনটি ছানা সহ বাঘিনীকে হত্যা করতে চাইলে সে তার আসন্ন মাতৃত্বের মমতায় চিৎকার করে ওঠে ‘না, না, মেরো না৷’২৪৩ তার চিৎকারে সচকিত বাঘিনী সন্তানসহ পালিয়ে যায়৷ কিন্তু হীরুর তো তা নয়৷ সে সন্তান চায় না, সংসার চায় না, বন্ধন চায় না—সে চায় কামনা-বাসনার কুঞ্জসজ্জিত অমৃতলোক৷ তাই সে নরুকে জানায়—‘‘যাযাবরীতে আমার অবসাদ এসেছে৷… আমার বিতৃষ্ণা এসেছে৷ আমি ওকে আর সহ্য করতে পারছি না৷ জানিস নরু, যেদিন প্রথম শুনলাম, চিত্রাঙ্গদা হবে জায়া, আমার সন্তানের জননী, সেদিন আমি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলাম, হত্যার সংকল্পও মনে মনে জেগে উঠেছিল৷’’২৪৪ যাযাবরী হীরুর রূপে মুগ্ধ হয়েছিল, তাকে কামনাও করেছিল৷ তার স্বপ্ন সার্থক হয়েছে, সে তার প্রেমের পুরস্কার স্বরূপ পেয়েছে তার গর্ভে হীরুর সন্তান৷ বুক দিয়ে আগলে রাখতে চায় সে সন্তানকে৷ রাঙা খোকার মা হওয়া তার জীবনে আরেক স্বপ্ন৷ কিন্তু সে যখন আড়াল থেকে হীরু-নরুর সমস্ত কথা শুনতে পায় তখন তার ভেতরকার মাতৃত্ব শিউরে ওঠে৷ সে যাযাবরী তার জীবনে প্রেমাস্পদের কাছ থেকে গভীর কোনো প্রত্যাশা নেই৷ তাই কোনো প্রতিবাদ করে না বরং হীরুর বুকে আছড়ে পড়ে উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়৷ তারপর কেউকে না জানিয়ে চুপচাপ চলে যায়৷ তার সেই নিরবে চলে যাওয়া হীরু নরুর কাছে ব্যক্ত করেছে এইভাবে—‘‘বর্বরা আপন সংস্কার অনুযায়ী কাজই করেছে নরু৷ কাল বোধ হয় আড়াল থেকে সব শুনেছে৷ শুনে সন্তানের মমতায় আদিম যুগের মায়ের মতই সন্তানের পিতাকে পরিত্যাগ ক’রে চ’লে গেছে;’’২৪৫

নিশানাথের কঠোর উপাসনায় তার মৃত্যুর প্রাক মুহূর্তে তাকে কেন্দ্র করে শ্মশানে মেলা বসে যায়৷ সেখানে বিভিন্ন দোকানের সমাবেশ যেমন অপরিহার্য, তেমনি মেলার আরেক অপরিহার্য অঙ্গ হল বেশ্যাপল্লী৷ বারবনিতারা দেহের পসরা সাজিয়ে মেলার এক প্রান্তে বসে গিয়েছে৷ তারাশঙ্করের বহু রচনায় মেলাতে বেশ্যাপল্লী বসার বিবরণ রয়েছে৷

চ. মন্বন্তর :

‘মন্বন্তর’ উপন্যাসে (১৯৪৪) ‘মন্বন্তর’ বলতে শুধু দুর্ভীক্ষকে বোঝাননি কথাকার—বুঝিয়েছেন মহাকালের পদধ্বনিকে৷ এর প্রেক্ষাপটে যতই অন্নাভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটুক এর কাল মহাকালের প্রলয় নৃত্যের একপদপাত মাত্র৷ এ সময়ে দেশে ও সমাজে যুগ বিপ্লবের দামামা বেজেছিল৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন ভারতবর্ষের পূর্ব সীমান্তের কাছাকাছি৷ যুদ্ধকালীন জীবনের বিচিত্র ও বহুমুখী সমস্যা, সংশ্লিষ্ট রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি৷ এর পটভূমিতে আছে বিবরণে, বর্ণনায়, সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে, আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রনায়কদের ঘোষণায় ও বক্তৃতায়৷ এছাড়া জমিদারি ব্যবস্থার ভাঙ্গন, বিলাস-ব্যসনের কদাকার রূপ, নানা যৌনব্যাধি উপন্যাসের অবয়বকে সমৃদ্ধ করেছে৷ আর এই সব ঘটনারাজীর পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে গণিকা জীবনের করুণ ইতিহাস৷

উপন্যাসের নায়ক কানাই চক্রবর্তী বংশের সন্তান৷ তাদের তৃতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি সে৷ সে বাদ দিয়ে সকলেই পূর্ব-পুরুষদের যৌনবিলাসের কদাচার রোগে জীর্ণ৷ তাদের অতীত ইতিহাস ব্যক্ত করতে গিয়ে উল্লিখিত হয়েছে তারা বাহির বাড়িতে নিয়মিত বাইজি এনে রূপসুধা পান করতো৷ দ্বিতীয়পুরুষ মেজকর্তার মুখে বর্ণিত হয়েছে চক্রবর্তী পরিবারের চরম ব্যভিচারময় জীবনের কথা৷ কানাই ছাত্রকে ভালো ‘রেজাল্ট’ করানোর গৌরবে একশত টাকা প্রণামী পেলে তা নিয়ে বাড়িতে যখন প্রায় একটা শোরগোল পড়ে যায় তখন মেজকর্তা জানায় কালীঘাটের বস্তি বিক্রি করে প্রাপ্ত দেড়লক্ষ টাকার সৎব্যবহারের কথা৷ ‘‘রতন-বাঈয়ের বাড়িতে সন্ধ্যে থেকে বারোটার মধ্যে দেড় হাজার টাকা পায়রার পালকের মত ফুঁয়ে উড়ে গেল৷’’২৪৬ অর্থাৎ নিজের পিতৃপুরুষের জমানো বিষয় বিক্রি করে তা দিয়ে বারবিলাসিনী নারীদের তোষামোদকারী হয়ে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা লক্ষণীয়৷ রতন বাঈ নাম্নী কোনো এক বারাঙ্গনার সান্নিধ্যে সে দেড়হাজার টাকা উড়িয়েও সেই পাপাচার নাতির সম্মুখে সগর্বে ঘোষণা করে৷ শুধু সেখানেই থেমে থাকেনি মেজকর্তা চিৎপুর রোড দিয়ে জুড়িগাড়িতে করে ফেরার সময় গ্যাসপোষ্টের আলোর নীচে দাঁড়িয়ে থাকা শীতে কাতর বেশ্যাদলের খদ্দের সংগ্রহের প্রচেষ্টা দেখে তার মনে দয়া জেগে উঠে এবং ‘‘পরের দিন রাত বারোটায় জুড়ী নিয়ে বেরুলাম—সঙ্গে একশোখানা আলোয়ান—সে আমলে একখানার দাম আট টাকা৷’’২৪৭ পরেরদিন নাকি কলকাতায় গুজব রটে দিল্লীর বাদশাহের কোন এক বংশধর কলকাতায় ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ মেজকর্তার এই কথা শুনে তৎকালীন সময়ে গণিকাদের একটা রূপ কল্পনা করে নিতে অসুবিধা হয় না৷ সমাজে উচ্চশ্রেণীর গণিকা রতন বাঈদের জীবনে আরাম-আয়েশ যতটা পরিমাণে ছিল নিম্নশ্রেণীর দেহজীবী যারা রাস্তায় বেড়িয়ে গ্যাসপোষ্টের আলোর নীচে দাঁড়িয়ে খদ্দের সংগ্রহ করে তাদের দুর্দশার অন্ত্য ছিল না৷ হয়তো শীতের কাপড় কেনার মতো সামর্থ্যও তাদের থাকতো না৷ মেজকর্তার মতো কিছু মানুষ যারা ভোগের উপকরণের মধ্যেও গণিকাদের প্রতি কিছুটা হলেও সহানুভূতিশীল তাদের দ্বারা গণিকারা কদাপি কশ্চিৎ উপকৃত হতো বলে মনে হয়৷

এছাড়া যুদ্ধের বাজারে দারিদ্র্যের ভয়াবহ পীড়নে বাবা-মায়েরা নিজেদের সন্তানকে বেচে দিতে দ্বিধা করে না এমন ঘটনাও বিরল নয়৷ গীতার জীবন এর প্রমাণ৷ গীতা দরিদ্র পিতার এবং ভদ্র বংশের কন্যা৷ সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পর বাবার চাকরি চলে যাওয়ায় তার আর পড়া হয়নি৷ পিতার পূর্বজীবনের তীব্র অনাচার-বিলাসিতায় শরীরে ভয়ানক মারণ রোগ বাসা নিয়েছে৷ সেই রোগের তাড়নায় এবং প্রবল আর্থিক অনটনে তার বাবা-মা ঘটকী প্রৌঢ়ের প্রলোভনে তাকে বিক্রি করে দেয়৷ সেই ঘটকী রমণী দেহব্যবসায়ের দালাল গোত্রীয়৷ বাবা-মায়ের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে সে গীতাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়৷ সেই ঘটকীর বাড়ি সম্পর্কে লেখক বলেছেন—‘‘তার সে বাড়ীতে চলে গোপন দেহ-ব্যবসায়৷ ঘটকী তাকে সেই ব্যবসায়ের পণ্য হিসেবে বিক্রী করেছে৷’’২৪৮ শুধু ঘটকী নয় সেখানে মেয়েকে এক ঘৃণ্য পেশায় নিয়োজিত করে আর্থিক সঙ্গতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় গীতার বাবা-মায়ের যে ভূমিকা রয়েছে তা গীতার কথাতেই স্পষ্ট৷—‘‘মা জানে কানুদা, মা জানে৷… নিশ্চয় জানে৷ নইলে যাবার সময় আমায় কেন সে বললে—বামুনদিদি যা বলবে, তাই শুনিস মা৷ তোর দৌলতে যদি দুটো খেতে পরতে পাই; নইলে না খেয়ে শুকিয়ে মরতে হবে৷’’২৪৯ গীতা সেদিন কানাই-এর তৎপরতায় তার দৈহিক শুচিতা হারিয়েও রক্ষা পেয়েছিল গণিকা হয়ে ক্রমাগত যৌন পীড়নের হাত থেকে কিন্তু যারা কানাই-এর মতো উদার ছত্রছায়া পায়নি তারা জীবনভর সেই নরকেই পচে মরেছে৷ যে সীমাহীন পাশবতায় বাবা-মা তাদের পেটের সন্তানকে বিক্রয় করে দিতে পারে সে পাশবতা যে ক্ষুধার চেয়ে বড় নয়৷ এই সহজ সত্যটির মধ্য দিয়ে রচনাকার তৎকালীন সময়ের নারীদের গণিকা হয়ে যাওয়ার নানা চিত্র উৎঘাটিত করেছেন৷ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র বিজয়বাবুর কথার ঔদাসীন্যের মধ্যে দিয়ে সে চিত্রকে অনুধাবন করা যায়—‘‘মেয়েরা বাল্যে বাপের সম্পত্তি—যৌবনে স্বামীর, তার পরে পুত্রের৷ দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে বাপ-স্বামী কন্যা পত্নী বিক্রী করে আসছে৷…আর পৃথিবীতে রাষ্ট্রবিপ্লব কদাচিৎ হলেও দুর্ভিক্ষ তো চিরস্থায়ী অবস্থা৷ ধনী আর দরিদ্র নিয়ে পৃথিবী—দরিদ্রের মধ্যে দুর্ভিক্ষ চিরকাল৷ সুতরাং কেনা বেচা চিরকাল চলছে৷ এই কলকাতা শহরে ওটা একটা চিরকেলে ব্যবসা৷ শুধু কলকাতা কেন, যে কোন দেশের পুলিস রিপোর্ট দেখ তুই, দেখবি ব্যবসাটা প্রাচীন৷’’২৫০

মেয়েদের গণিকা তৈরি করে, বিভিন্ন অলিগলির ভিতরে কোথায় কোন শ্রেণীর গণিকা বসবাস করে তার বিস্তারিত খোঁজ দিয়ে বহু পুরুষ ও দালাল কলকাতা শহরে জীবন-জীবিকা চালিয়ে যায় তার কথাও উঠে এসেছে ‘মন্বন্তর’ উপন্যাসে৷

ছ. কবি :

বসন্ত :

‘কবি’ (১৯৪২) উপন্যাসের বসন স্বৈরিণী, স্বেচ্ছাচারিণী৷ সে মাসি পরিচালিত ঝুমুরদলের নর্তকী গায়িকা৷ সে ঝুমুর গানের পাশাপাশি দেহ ব্যবসা করে৷ তার কাছে প্রেম দেহজ এবং পণ্য৷ ঝুমুর দলের সঙ্গে বসন্তের প্রথম আবির্ভাব উপন্যাসের অষ্টম পরিচ্ছেদে৷ ঝুমুরদলের সবচেয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল সে৷ পথশ্রমের ক্লান্তিতে সে যখন চা প্রার্থনা করে সামনে এগিয়ে আসে তখন নিতাই দেখে—‘‘একটি দীর্ঘ কৃশতনু গৌরাঙ্গী মেয়ে৷ অদ্ভুত দুইটি চোখ৷ বড় বড় চোখ দুইটার সাদা ক্ষেতে যেন ছুরির ধার,—সেই শাণিত-দীপ্তির মধ্যে কালো তারা দুইটা কৌতুকে অহরহ চঞ্চল৷’’২৫১ তার সেই চঞ্চল চোখের দৃষ্টি বৈশাখের মধ্যাহ্নে নেচে বেড়ানো মধুপ্রমত্ত মরণজয়ী দুটো কালো ভ্রমরের সঙ্গে উপমিত হয়েছে৷ বসন্তের কথার মধ্যে যেন একটা অনির্দেশ্য শ্লেষ, ব্যঙ্গ সদা প্রচ্ছন্ন থাকে৷ তার হাসির ধারে তার ভেতরকার অভিব্যক্তি ফুটে উঠে এবং মানুষের মনকে যেন কেটে টুকরো টুকরো করে ধুলোর মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়৷

তারা নিতাই এর বাসস্থান রেলওয়ে কুলি-ব্যারাকের বারান্দায় আশ্রয় নেয়৷ সেখানে নিজের রূপের গরবে গরবিনী বসন্তের সঙ্গে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-পরিহাসে নিতাই-এর গৃহপ্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে উঠে৷ নিতাই-এর কালো গাত্রবর্ণ ঘৃণার উদ্রেক করে সেই নিম্নশ্রেণীর পণ্যাঙ্গনার মনে৷ তার শাণিত ব্যঙ্গে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চায় নিতাইকে৷ লেখক ঝুমুর সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন—‘‘বহু পূর্বকালে ঝুমুর অন্য জিনিস ছিল, কিন্তু এখন নিম্নশ্রেণীর বেশ্যা গায়িকা এবং কয়েকজন যন্ত্রী লইয়াই ঝুমুরের দল৷ আজ এখানে, কাল সেখানে করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়, গাছতলায় আস্তানা পাতে৷ কেহ বায়না না করিলেও সন্ধ্যার পর পথের ধারে নিজেরাই আসর পাড়িয়া গান-বাজনা আরম্ভ করিয়া দেয়৷ মেয়েরা নাচে, গায়—অশ্লীল গান৷ ভনভনে মাছির মত এ রসের রসিকরা আসিয়া জমিয়া যায়৷’’২৫২ ঝুমুর দলের মেয়েরাও নিম্নশ্রেণীজাত৷ আক্ষরিক কোনো শিক্ষাই এদের নেই; কিন্তু সঙ্গীত ব্যবসায়িনী হিসেবে একটা অদ্ভুত সংস্কৃতি এদের আছে৷ পালাগানের মধ্য দিয়ে এরা পুরাণ জানে, পৌরাণিক কাহিনির উপমা দিয়ে প্রশংসা বা ব্যঙ্গ করলে সেটাও বুঝতে পারে৷ তাই বসন্তকে নিয়ে যখন নিতাই গান বাঁধে—

 ‘‘প্রেমডুরি দিয়ে বাঁধতে নারলেম হায়,

 চন্দ্রাবলীর সিঁদুর শ্যামের মুখচাঁদে!

 আর কি উপায় বৃন্দে—এইবার দে এনে দে—

 বশিকরণ লতা—বাঁধব ছাঁদে ছাঁদে৷’’২৫৩

নিতাই এর গানের গুঢ় অর্থ শুধু বসন্ত নয় দলের সকল মেয়েরাই বুঝতে পারে যা সকলের কাছে পীড়াদায়ক হয়ে উঠলে বসন্ত তার সহজাত ক্ষমতায় সকলের হয়ে জবাব দেয়—

‘‘উনোন-ঝাড়া কালো কয়লা—আগুন তাতে দিপি-দিপি! ছেঁকা লাগে!’’২৫৪

এভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে, শাণিত বাক্যবাণে উপন্যাসে আবির্ভাবেই বসন্ত তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে পাঠকের সামনে তুলে ধরে৷

বসন্ত নিম্নশ্রেণীর দেহজীবী হলেও তার রুচিবোধ দলের অন্যান্য মেয়েদের থেকে স্বতন্ত্র৷ সে নিজে পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে—সময়ে অসময়ে স্নান করে তার প্রমাণ দেয়৷ দলের প্রত্যেক মেয়ের নিজ নিজ প্রেমাস্পদজন থাকলেও তার রুচিবোধ দলের পুরুষগুলির মধ্য থেকে কেউকে কাছের মানুষ হিসেবে ভাবতে পারে না৷ সে সম্পর্কে লেখক জানিয়েছেন—‘‘সে কাহাকেও সহ্য করিতে পারে না৷ কেহ পতঙ্গের মত তার শাণিত দীপ্তিতে আকৃষ্ট হইয়া কাছে আসিলে মেয়েটার ক্ষুরধারে তাহার কেবল পক্ষচ্ছেদই নয়, মর্মচ্ছেদও হইয়া যায়৷’’২৫৫

বসন্ত নিতাই-এর নাম দিয়েছে কয়লামানিক৷ সে তার মৎসাসক্তির কথা জানিয়ে নিতাইকে চার পয়সার মাছ আনতে অনুরোধ করলে নিতাই যখন তার হাত ঈষৎ সরিয়ে তার স্পর্শ বাঁচিয়ে আলগোছে পয়সা গ্রহণ করে তখন বসন্তের ঠোঁটের দুই কোন তীব্র অপমানে গুণছেঁড়া ধনুকের মতো বেঁকে ওঠে৷ সে অস্পৃশ্যতার প্রসঙ্গ টেনে নিতাইয়ের কাছে জানতে চায় তার মতো দেহজীবিনীর হাতের ছোঁয়া পেলে তার স্নান করতে হবে কি না৷ তার সেই শাণিত ব্যঙ্গের জবাব নিতাই দেয় হাসিমুখে৷ সে কয়লার ময়লা বসন্তের রাঙা হাতে লাগাতে চায় না৷ তার সেই কথায় বসন্তের যে প্রতিক্রিয়া তাতে বসন্তর অদ্ভুত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছেন লেখক৷ বসন্তের হাতের পয়সা আপনিই খসে নিতাই-এর হাতে পড়ে যায়৷ মুহূর্তে ধনুকের গুণ যেন ছিঁড়ে যায়৷ তার অপর প্রান্ত থেকে থর থর করে কেঁপে উঠে৷ পর মুহূর্তে সে কম্পন তার বাঁকা হাসিতে রূপান্তর গ্রহণ করে৷ তার সেই রূপান্তর দেখে নিতাই-এর বিস্ময়ের সীমা থাকে না৷ তার মনে হয় বসন্ত যেন গল্পের মায়াবিনী; প্রতিদ্বন্দ্বী সাপ হলে সে বেজি হয়৷ আর প্রতিদ্বন্দ্বী যদি বিড়াল হয়ে সেই বেজিকে আক্রমণ করে তাহলে সে বেজি থেকে হয়ে যায় বাঘিনী৷ কান্না মুহূর্তে তার বাঁকা হাসিতে রূপান্তর গ্রহণ করে ৷ হেসে জানায় সেই জন্যই সে আলগোছে দিল৷ এই স্বৈরিণী নারী দেহের পসরা সাজায়—ভালোবাসার বিকিকিনি করে পুরুষের প্রবৃত্তির দাহ শান্ত করে—আর সেই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যেন তার সহজাত কৌশল হয়ে উঠে৷

তারপর সন্ধ্যাকালে শুরু হয় বসন্তর ঝুমুরের আসর৷ নিতাই তার নাম দিয়েছে শিমুল ফুল—যার শুধু রঙটাই সার৷ নিতাই সেই আসরে নিজের বানানো গান গেয়ে দর্শকদের মাত করে দিলে তার খোঁচা এসে লাগে বসন্তের গায়ে৷ সে চুক্তিবদ্ধ হয়েও প্রচণ্ড রাগে আসর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে চাইলে তার কাছে নতি স্বীকার করে নিতাই তাকে ফিরিয়ে আনে৷ বসন্ত মদ খেয়ে শুরু করে তার ছুরির ধারের মতো কন্ঠ দিয়ে অদ্ভুত সুরবিতান৷ সেই তালে তার সুন্দর কমনীয় দেহখানিও নৃত্যচাপল্যে উদ্বেল হয়ে ওঠে৷ চারিদিক থেকে প্যালা পড়ে আসর ভরে যায়৷ শরীরে প্রচণ্ড জ্বর নিয়েও নির্জলা মদ খেয়ে সে পুনরায় তার নৃত্য-গীত শুরু করে৷ তারপর কারও অনুমতি না নিয়েই নিজের খেয়ালে আসর থেকে বেড়িয়ে এসে নিতাই-এর বিছানায় শুয়ে পড়ে৷ নিতাই লক্ষ্য করে বসন্তদের আগমন দেখেই হিংস্র শাপদের মতো তাদের শরীরের লোভে চলে এসেছে পাড়ার কয়েকজন যুবক৷ তার মধ্যে কাসেদ শেখের ছেলে নয়ান প্রধান৷ বসন্ত জানে তাদের রাত্রির ভয়ানক অভিজ্ঞতা৷ তারা বাধা মানবে না—হয় তো পাঁচিল টপকে এসেই তার শরীরকে নির্মমভাবে উপভোগ করে যাবে৷ জ্বর এবং শরীরের ক্লান্তিতে সে তাদের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য নিতাইকে বলে দরজা বন্ধ করে দিতে৷ তার সঙ্গে কথোপকথনের সময় হঠাৎ সে বুঝতে পারে জানালা দিয়ে কোনো নারীমূর্তি তাদের অনুসরণ করছে৷ তার বুঝতে অসুবিধা হয় না সেই নারীর হৃদয়ের অভিব্যক্তি৷ নিমেষেই সে নিতাই-এর ঘর থেকে বেড়িয়ে গিয়ে কাসেদ শেখের ছেলের সঙ্গে দেহের দরাদরি করতে চলে যায় এবং তার সঙ্গেই পূর্বদিকের গভীরতম অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়৷ তার পর তারা বসন্তকে দেখে একজন পশুর জান্তব লালসার শিকার হয়ে ‘‘হতচেতনের মত অসম্বৃত দেহে পড়িয়াছিল৷… কেশের রাশ বিস্রস্ত অসম্বৃত, সর্বাঙ্গ ধুলায় ধূসর, মুখের কাছে কতকগুলো মাছি ভনভন করিয়া উড়িতেছে; পাশেই পড়িয়া আছে একটা খালি বোতল, একটা উচ্ছিষ্ট পাতা৷’’২৫৬ নিতাই-এর তৎপরতায় তার সম্বিত ফিরে আসে৷ নিতাই-এর মনের মানুষের কথা সবার কাছে ব্যক্ত করে প্রবল হাসির জোয়ারে সে তাদের দলের সঙ্গে সে স্থান ত্যাগ করে৷

তারপর আবার বসন্তের দূত হয়ে নিতাইয়ের কাছে যায় বেহালাদার৷ রাসপূর্ণিমায় আলেপুরে বিখ্যাত মেলা৷ সেখানে ঝুমুর দলের মুখপাত্র হিসেবে তাকে গান গাইতে হবে কারণ তাদের দলের গায়ক বসন্তর সঙ্গে ঝগড়া করে তার পদাঘাতে অপমানিত হয়ে দল ছেড়ে অন্য দলে চলে গেছে৷ নিতাই তাদের একমাত্র ভরসাস্থল৷ সে মেলায় প্রবেশ করেই দেখে মেলার বৈচিত্র্যময় রূপ৷ মেলার বিভিন্ন পটি অতিক্রম করে তারা একেবারে বিপরীত প্রান্তে চলে আসে৷ ‘‘এখানে আলোকের সমারোহটা কম, কিন্তু লোকের ভিড় বেশি৷ মেলার এই প্রান্তে একটা গাছের তলায় খড়ের ছোট ছোট খানকয় ঘর বাঁধিয়া ঝুমুরের দলটি আস্তানা গাড়িয়াছে৷ আশেপাশে এমনি আরও গোটাকয়েক ঝুমুরের দলের আস্তানা৷ একপাশে খানিকটা দূরে জুয়ার আসর৷ তাহারই পর চতুষ্কোণ আকারের একটা খোলা জায়গায় সারি সারি খড়ের ঘর বাঁধিয়া বেশ্যাপল্লী বসিয়া গিয়াছে৷ সে যেন একটা বিরাট মধুচক্রে অবিরাম গুঞ্জন উঠিতেছে৷’’২৫৭ অর্থাৎ আলেপুরের মেলার অন্ধকারময় সর্পিল পরিবেশে দেহকামনার পান্থশালা নারীদেহ ভোগের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে৷

ঝুমুর দলে নিতাই সাদর আমন্ত্রণে আপ্যায়িত হয়৷ দলের অন্য মেয়েরা সহোদরার মতো তাকে আপন করে নেয়৷ বসন্ত মদ খেয়ে মদ্যপ হয়ে দেহব্যবসার আসর পাতে৷ তার ঘরেই খদ্দেরের ভিড় বেশি৷ সে লক্ষ্য করে বসন্তর ঘর থেকে দুজন আগন্তুক ইতিমধ্যেই চলে গেছে৷ আবার নতুন আগন্তুক এসে উপস্থিত হয়েছে৷ পরদিন বসন্ত আরেক নারী৷ নিকানো মুছানো উঠানে লালপাড় শাড়ি পড়ে ভেজাচুল পিঠে এলিয়ে পুণ্যবতী নারী হিসেবে প্রতিভাত হয়৷ সেখানে তার প্রবল মদ্যাশক্তি, নিষ্ঠুর বাক্যবাণ কিছুই কূল পায় না৷ শুদ্ধ ব্রতচারিণীর ন্যায় লক্ষ্মীপূজা করে সে পরিপাটী করে ঠাঁই করে একটা পাতায় ফলমূল, সন্দেশ সাজিয়ে দেয়৷ নিতাই তার সেই রূপে মুগ্ধ হয়ে যায়৷ তার মনে হয়—‘‘সেই বসন এমন হইতে পারে৷’’২৫৮ শুধু এখানেই নয় ঝুমুরের আসরেও বসন্ত আরেক বসন্ত৷ সাধারণ সাজপোশাকে, চোখের সুস্থ সাদা দৃষ্টিতে তার অন্য আরেক রূপ৷ নিতাই তার সেই চোখ দেখে ভাবে—‘‘অদ্ভুত দৃষ্টি বসন্তের! চোখে মদের নেশায় আমেজ ধরিলে তাহার দৃষ্টি যেন রক্তমাখা ছুরির মতো রাঙা এবং ধারালো হইয়া ওঠে৷ আবার সুস্থ বসন্তের চোখ দেখিয়া মনে হইতেছে—এ চোখ যেন রূপার কাজললতা৷’’২৫৯ নিতাই-এর তত্ত্বগানে তাদের আসর ফিকে হয়ে মর্মান্তিক পরাজয় ঘটে৷ বসন তা মেনে নিতে পারে না৷ কারণ—‘‘নিম্নশ্রেণীর দেহব্যবসায়িনী রূপ-পসারিণী তাহারা, দেহ ও রূপ লইয়া তাহাদের অহংকার আছে, কিন্তু সে শুধু অহঙ্কারই—জীবনের মর্যাদা নয়৷ কারণ তাহাদের দেহ ও রূপের অহঙ্কারকে পুরুষেরা আসিয়া অর্থের বিনিময়ে পায়ে দলিয়া যায়৷ পুরুষের পর পুরুষ আসে৷ দেহ ও রূপকে এতটুকু সম্ভ্রম করে না, রাক্ষসের মত ভোগই করে, চলিয়া যাইবার সময় উচ্ছিষ্ট পাতার মত ফেলিয়া দিয়া যায়৷’’২৬০ তাই তাদের জীবনের সকল মর্যাদা পুঞ্জীভূত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে নৃত্য-গীতের অহংকারটুকুর মধ্যে৷ নৃত্য এবং গীতই তাদের জীবনের একমাত্র সত্য; তারা বোঝে ভাল নাচ গানের যে কদর তা মেকি নয়৷

ঝুমুরের আসরে শোচনীয় পরাজয়ে বসন্ত আকণ্ঠ মদে নিমজ্জিত হয়৷ নিতাই তাকে ডাকতে এসে তার সেই আগুনের ছটায় বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে বসন সক্রোধে চর বসিয়ে দেয় নিতাইয়ের গালে৷ আহত নিতাই তাদের দলের আগলদার লোকটির কাছ থেকে মদ্য পান করে মদের নেশায় অন্য আরেক মানুষ হয়ে উপস্থিত হয় আসরে৷ বিবেক বর্জিত বীরবংশী রক্তের বর্বরত্বের মৃতপ্রায় বীজানুগুলি মদের স্পর্শে জেগে উঠলে তার অশ্লীল গানে আসর মাতোয়ারা হয়ে যায়৷ আর নতুন উত্তেজনায় তখন বসন্তও পুনরায় আসরে এসে নাচতে শুরু করে৷

বসন্তের মনে ধীরে ধীরে অনুরাগের জন্ম হতে থাকে৷ যে বসন্ত একদিন মনে করেছিল প্রেম শুধুই দেহ, প্রেম শুধুই পণ্য, নিতাই-এর স্পর্শে সেই প্রেমানুভূতি অন্য মাত্রা লাভ করে৷ তার কাছ থেকে বিলাতি মদ খেতে খেতে নিতাই যখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার মুখটাকে ভালো করে দেখার অভিলাষ জানায় তখন সেই লজ্জাহীনা বসন্তর মুখও নবপ্রেমানুরাগে রাঙা হয়ে ওঠে৷ পরক্ষণে নিতাইয়ের থেকে এক পা পিছিয়ে গিয়ে তার গোপন রোগের কথা জানিয়ে তাকে সাবধান করতে চায়, যে তার কাশ রোগ আছে এবং মধ্যে মধ্যে কাশির সঙ্গে রক্ত ওঠে৷ পরম আবেগে তার চোখ থেকে ফোটা ফোটা জলও ঝরতে থাকে৷ কিন্তু নিতাই-এর যে বর্বর বিজানুগুলি অন্তরে ক্রিয়াশীল৷ কোনো বাধাই তার আর বাধা নয়৷ তাই পরম আবেগে সে যখন তাকে আবদ্ধ করেছে নিজের বাহুর বন্ধনে তখন তার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে পিষ্ট হতে হতে সে গেয়েছে—

 ‘‘বঁধু তোমার গরবে গরবিনী হাম গরব টুটাবে কে৷

 ত্যেজি’ জাতি-কুল বরণ কৈলাম তোমারে সঁপিয়া দে!…

 পরাণ-বঁধুয়া তুমি,

 তোমার আগেতে মরণ হউক এই বর মাগি আমি৷’’২৬১

নিতাইকে দেহ-মন সমর্পণ করে অন্য মানুষ হয়ে উঠেছে বসন্ত৷ নবপ্রেমের জোয়ারে তার মধ্যে জাগরিত হয়েছে সুন্দর এক সুখ স্বপ্ন৷ নানা রকম ছবি দিয়ে কয়েকদিনের জন্য নির্মিত ঘরটিকে সুসজ্জিত করে তুলেছে, নিজের হাতে নিতাই-এর বমি করে নোংড়া করা সমস্ত কাপড়-চোপড় কেচে দিয়েছে৷ নিতাইকে মদের আবেশ থেকে মুক্ত করতে কাঁচা চা করে দিয়েছে, নিজের বহু যত্নের ‘ফুলেল তেল’, সাবান বের করে দিয়েছে৷ কিন্তু সেই আপ্যায়ন, মদ্যপান, নাচ গান সমস্তই নিতাই-এর স্বভাব বিরুদ্ধ৷ সে সব কিছু ফেলে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়৷ বাজার ঘুরে আসার নাম করে বেড়িয়ে পড়তে চাইলে সমস্তটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না বিচক্ষণ বসন্তর৷ নিতাই-এর মনে হয় বসন্তর চোখের দৃষ্টি ছুরি নয় সূচ—যেন বুকের ভিতের বিঁধে ভিতরটাকে তন্ন তন্ন করে দেখতে পায়৷ নিতাই-এর যাওয়া হয় না—বসন্ত তার সঙ্গে যায়৷ সাধারণ গৃহস্থ নারীর মতোই সে নানা জিনিস কিনে পুরা একটা টাকাই খরচ করে ফেলে৷ তারপর মন্দিরের প্রাঙ্গণে কানা-খোঁড়াদের পয়সা দেওয়ার জন্য চারটি আধুলি তুলে রাখে৷ কানা-খোঁড়াদের প্রতি বসন্তর ভয়ঙ্কর সমবেদনা৷ সুস্থ মস্তিষ্কে একাকী নিতাইকে পেয়ে তার সমস্ত বেদনা—হৃদয়ের সমস্ত অভিব্যক্তি সুন্দর ভাবে ফুটে উঠে৷ একজন পতিতা নারীর জীবনের প্রকৃত পরিণতি যেন তার মুখ দিয়ে স্পষ্ট হয়ে বেড়িয়ে আসে৷ সে নিতাইকে জানায় তার জীবনেও কষ্টের শেষ হবে না৷ কারণ তার কাশির সঙ্গে রক্ত উঠে৷ সেই রক্তের ভয় কাটানোর জন্য সে বেশি করে পান-দোক্তা খেয়ে মুখ লাল করে রাখে৷ তার সেই অসুখের খবর জানে শুধু মাসি৷ অন্য কেউ জানে না৷ জানলে হয় তো তাদের দল ভেঙে যাবে৷ সে বলে—‘‘কিন্তু এখনও নাচতে গাইতে পারি, চটক আছে, পাঁচটা লোক দেখে বলেই দলে রেখেছে৷ যেদিন পাড়ু হয়ে পড়ব, সেদিন আর রাখবে না, নেহাৎ ভাল মানুষের কাজ করে তো নোক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে৷ নইলে যেখানে রোগ বেশি হবে, সেইখানেই ফেলে চলে যাবে, গাছতলায় মরতে হবে৷ জ্যান্ততেই হয়তো শ্যাল-কুকুর ছিঁড়ে খাবে৷’’২৬২ সে রোগটিকে দমিয়ে রাখার জন্য রোজ সকালে নিয়ম করে দুর্বা পাতার রস থেতো করে খায়৷ কখনো কখনো আবার ভুলেও যায়, উশৃঙ্খল জীবন যাপনে সে নিয়মের ব্যতিক্রম প্রায়ই হয় তখন মাসি তাকে মনে করিয়ে সচেতন করে৷ তার সৃজিত বিষন্নতার পরিবেশকে মুহূর্তেই আবার ঠাট্টা তামাশায় ভরিয়ে তোলে সে নিজেই৷ নিতাইকে ঠাট্টা করে বলে—‘‘গাঁটছড়া বাঁধবে নাকি? গাঁটছড়া?’’২৬৩ এবং সেই ঠাট্টাতে সত্যসত্যই নিতাই যখন তার শাড়ির আঁচলখানি টেনে নিজের চাদরের খুঁটের সঙ্গে বাঁধতে আরম্ভ করে তখন বসন্ত আর্তনাদ করে উঠে৷ নিতাই যখন তাকে জানায় যে ‘‘গিঁট আগেই পড়ে গিয়েছে বসন৷ টেনো না৷ আমি যদি আগে মরি, তবে তুমি সেদিন খুলে নিও এ গিঁট; আর তুমি যদি আগে মর, তবে সেই দিন আমি খুলে নোব গিঁট৷’’২৬৪ নিতাই-এর এই উক্তিতে বসন্ত থরথর করে কাঁপতে থাকে৷ তার রক্তাভ সুগৌর মুখটা যেন সঙ্গে সঙ্গে সাদা হয়ে যায়৷ দর্পিতা, গরবিনী বসন্ত যেন একমুহূর্তে কাঙালিনি হয়ে যায়৷ ঠাকুরের সামনে গাঁটছড়া বেঁধে নতুন জীবনের স্বাদ নিতে তারা আবার উপস্থিত হয় তাদের দলের কুটিরে৷

শুরু হয়ে যায় বসন্ত-নিতাই-এর নতুন অধ্যায়৷ নিতাইকে সম্বল করে তাদের দল নানা স্থানে ঘুরতে থাকে৷ তার সংস্পর্শে বসন্তের জীবনেও অনেক পরিবর্তন আসে—সে মদ খাওয়া কমিয়ে দেয়, দূর্বার রস নিয়মিত খায়, কথার ধার আছে কিন্তু জ্বালা কমে গিয়েছে, তেমন তীক্ষ্ণ কন্ঠে আর খিল খিল করে হাসে না—মুচকে মৃদু মৃদু হাসে৷ স্বাস্থ্যও তার আগের চেয়ে ভালো হয়েছে—শীর্ণ রুক্ষ মুখটা নিটোল হয়ে ভরে এসেছে, দীপ্ত গৌর বর্ণে শ্যাম আভাস দেখা দিয়েছে৷ শুধু তার পূর্ব রূপ ফিরে পাওয়া যায় সন্ধ্যার পর—‘‘সন্ধ্যার পর হইতেই সে উগ্র হইয়া উঠে৷ এটা তাহাদের দেহের বেসাতির সময়৷ সন্ধ্যার অন্ধকার হইলেই ক্রেতাদের আনাগোনা শুরু হয়৷ মেয়েরা গা ধুইয়া প্রসাধন করিয়া সাজিয়াগুজিয়া বসিয়া থাকে৷ তিনজনে তখন তাহারা বসে একটি জায়গায়৷ অথবা আপন আপন ঘরের সম্মুখে পিঁড়ি পাতিয়া বসে—মোট কথা, এই সময়ের আলাপ-রঙ্গরহস্য সবই মেয়েদের পরস্পরের মধ্যে আবদ্ধ৷’’২৬৫ এই কাজ থেকে তাদের নিষ্কৃতি নেই—মাসি মুক্তি দেয় না৷ আবার তারা নিজেরাও দেহব্যবসাটাকে ছাড়তে পারে না৷ সেই সন্ধ্যারাত্রিটুকু বাদ দিয়ে নিতাই-বসন্তর জীবন মাধুর্যে ভরা৷ নতুন নতুন গান বেঁধে ঝুমুরের আসর মাতিয়ে দিয়ে বসন্তর মনে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে নিতাই৷ নিতাই যেদিন আকন্ঠ মদ পান করে সেই দিনটি হয় বসন্তের সবচেয়ে প্রিয় দিন৷ কারণ ঐরকম এক দিনেই নিতাইকে সে দেহ-মনে লাভ করেছিল, সে আত্মসমর্পণ করেছিল তার কাছে৷ তারপর নিতাই-এর নতুন বাঁধা এক গানে বিহ্বল হয়ে যায় বসন৷ সে যখন তাকে শোনায়—

 ‘‘এই খেদ আমার মনে মনে৷

 ভালোবেসে মিটল না আশ—কুলাল না এ জীবনে৷

 হায়, জীবন এত ছোট কেনে?

 এ ভুবনে?’’২৬৬

মুহূর্তে যেন একটা কাণ্ড ঘটে যায়৷ গানটা শুনে মনে হয় সে যেন পাথর হয়ে গেছে৷ সে গভীর আশঙ্কায় তাকে বলে—‘‘এ গান তুমি কেনে লিখলে কবিয়াল?… আমি তো এখন ভাল আছি কবিয়াল—তবে তুমি কেনে লিখলে, কেনে তোমার মনে হ’ল জীবন এত ছোট কেনে?’’২৬৭

বসন্ত মদ খেয়ে তার পূর্ব নেশা পূর্ব প্রবৃত্তির বশে বিষহীন সর্পের মতো বিনা প্রতিবাদের নিজের ঘরে ‘খদ্দের’ ঢোকায়৷ নেশার বশে কামনার সলিলে সিক্ত করে তোলে সেই পুরুষটিকে কিন্তু নেশা কেটে গেলেই সে আত্মগ্লানিতে ডুবে যায়৷ তারপর নেশার ভান করে পড়ে থাকে, কান্না করে৷ মনে মনে কল্পনা করে পরদিনই সে নিতাইকে নিয়ে আর কোথাও চলে যাবে৷ কিন্তু বহুদিনের সহাবস্থানের ফলে ললিতা নির্মলা মাসির সঙ্গে যে আত্মার যোগসূত্র তৈরি হয়েছে তা ছিন্ন করে সে কিছুতেই যেতে পারে না৷ বসন্তর মনের এটা শুভ দিক৷ সে স্বৈরিণী ব্যভিচারিণী কিন্তু সম্পর্কে মূল্য দেওয়ার বোধটুকু তার কোনো সময়ই ক্ষয়ে যায়নি৷

তারপর বসন্ত আক্রান্ত হয় বসন্ত রোগে৷ নিজেই রোগের ছোঁয়াচে শিহরিত হয়ে ওঠে৷ নিতাই-এর পরিচর্যায় একমাস রোগশয্যায় কাটানোর পর কোনোমতে উঠে বসে৷ সেই রোগের তাণ্ডবে তার অনুপম সৌন্দর্য নিঃশেষ হয়ে যায়, রুক্ষ কেশভার, শরীরে উৎকট গন্ধ এবং কঙ্কালসার৷ তার গর্বিত রূপরাশির মধ্যে শুধু অবশিষ্ট থাকে তার চোখ দুটি৷ ভস্মরাশির মধ্যে জ্বলন্ত কয়লার মতো জ্বলজ্বল করে শুধু তার ডাগর দুই চোখ৷ নিতাই-এর সেবা শুশ্রুষায় সে বিহ্বল হয়ে যায়—অনর্গল চোখের জল ফেলতে থাকে৷ কিন্তু তারপর নিতাই যখন তার সুস্থ রূপটাকে দেখানোর জন্য আয়না এগিয়ে দেয় তখন প্রবল আত্মধিক্কারে সে আর ঠিক থাকতে পারে না৷ সেই আয়নাই নিতাইকে উদ্দেশ্য করে ছুড়ে মারে৷ নিতাই পাশ কাটিয়ে রক্ষা পেলে মাসির কঠিন শাসন তার দিকে এগিয়ে এলে নিতাই তার বিনয়বচন দিয়ে তাকে রক্ষা করে৷ পরম মমতায় তাকে আঁকরে ধরে৷ তার পর পুনরায় শুরু হয় তার ক্রন্দনধ্বনি৷ নিতাই তার কারণ জিজ্ঞেস করলে বসন্ত ভেঙ্গে পড়ে তাকে জানায়—‘‘কেনে তুমি দলে এসেছিলে তাই আমি ভাবছি৷ মরতে তো আমার ভয় ছিল না৷ কিন্তু আর যে মরতে মন চাইছে না৷’’২৬৮ বসন্ত দুর্দান্ত স্বেচ্ছাচারিণী কবিয়ালকে পেয়ে বাঁচার স্বপ্নে বিভোর কিন্তু তার মাথার উপর মারণ রোগ থাবা পেতে আছে৷ আর যেদিন নিতাই সেই মৃত্যুর গানটি বেঁধেছে সেদিন থেকেই তার সেই মৃত্যুভাবনা যেন প্রকট হয়ে উঠেছে৷ সে যেন চারিদিকে শুধু বিচ্ছেদেরই ধ্বনি শুনতে পায়, বেহালাদারের ধ্বনির মধ্যেও সেই একই মৃত্যুর সুর৷ সেই মৃত্যুই যেন সশরীরে এসে হাজির হয় তার দরবারে৷ তখন কাটোয়া শহরের একপ্রান্তে একটি জীর্ণ মাটির বাড়ি ভাড়া করে তাদের দলটি আশ্রয় নিয়েছে৷ সেখানে প্রবল জ্বরের উপসর্গ ধরে মৃত্যু এসে হাজির হয়৷ বসন্তের বারণের জন্য নিতাই ডাক্তার ডাকতেও যেতে পারে না৷ শেষ রাত্রে মরণ বিকার উপস্থিত হয় তার৷ সে যেন শুনতে পায় বিনিয়ে বিনিয়ে কান্নার মতো বেহালার বাজনা৷ নিতাই নাড়ী টিপে বুঝতে পারে তার সময় আসন্ন৷ সে যখন সকরুণ দৃষ্টিতে তাকে বলে গোবিন্দ নাম করতে, জীবনভর দুঃখ ভোগ করে সুখের মুখে ভগবানের এত বড় বঞ্চনা সে মেনে নিতে পারে না৷ তাই—‘‘ছিলা-ছেঁড়া ধনুকের মত বিছানার উপর লুটাইয়া পড়িয়া বসন্ত বলিল—না৷ কি দিয়েছে ভগবান আমাকে? স্বামীপুত্র ঘরসংসার কি দিয়েছে? না৷’’২৬৯ জীবনের পাওয়া না পাওয়ার সমস্ত ক্ষোভ আসন্ন মৃত্যুর মুখে উগড়ে শেষ মুহূর্তে সে নিবেদন করেছে—‘‘গোবিন্দ, রাধানাথ, দয়া করো৷ আসছে জন্মে দয়া করো৷’’২৭০ গোবিন্দের নাম নিতে নিতে সে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে৷ জীবনভর বঞ্চিত বসন্তর মৃত্যুর পরেও তার সামান্য কিছু অলঙ্কার তাও খুলে নেয় মাসি৷

‘কবি’-উপন্যাসের ভূমিকা লিখতে গিয়ে মোহিতলাল মজুমদার বসন্ত চরিত্রটির বাস্তব রূপের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন৷ তিনি বলেছেন—‘মেয়েটির নাম—বসন না বসন্ত৷ প্রথম হইতেই তাহার দেহে ও মনে একটা জ্বরতাপ, এবং তাহারই কারণে তাহার রূপেও একটা রক্তিমতা ফুটিয়া উঠিয়াছে, দেখা যায়৷ সে প্রেমকে—নরনারীর সহজ ধর্ম্মকে—হত্যা করিয়াছে, করিতে বাধ্য হইয়াছে; তার পর সে আর কিছুকে, কাহাকে বিশ্বাস করে না, শ্রদ্ধা করে না৷ তাহার নারীজীবন সর্ব্বস্বান্ত হইয়াছে—সে কথা সে কিছুতেই ভুলিবে না; সে নিজের প্রতিও যেমন নিষ্ঠুর, মনুষ্যজীবনের প্রতিও তেমনই উদাসীন৷… আত্মবিস্মৃতির জন্য সে দেহের লালসাকেও জীয়াইয়া রাখে৷… ঐ নারী যে-প্রেমকে হৃদয় হইতে চিরতরে নিবর্বাসিত করিয়াছিল, যে অমৃতের স্বাদ সে জীবনে কখনো পায় নাই, তাহাই যখন ধরা দিয়া তাহার প্রাণকে পিপাসার্ত করিয়াছে, তখনই,—যে-মৃত্যুকে সে এতদিন নির্ভয়ে তাহার দেহে বাসা বাঁধিতে দিয়াছিল, সেই মৃত্যু আর তর সহিল না, করাল মূর্ত্তিতে আসিয়া দাঁড়াইল৷ সেই অন্তিমকালে, এক দিকে প্রেম, অপর দিকে মৃত্যু—এই দুইয়ের মধ্যে পড়িয়া হতভাগিনীর সেই আর্ত্ত-চীৎকার—এবং মৃত্যু অপেক্ষা প্রেমই অসহ্য হইয়া উঠার যে অনিবার্য্য চেতনা—তাহাতে জীবনের বাস্তবই চিরন্তন কাব্য হইয়া উঠিয়াছে;’

দেহব্যবসার ক্লেদাক্ত পরিসরে থেকেও তার ভেতরের নারীসত্তা স্বাভাবিক জীবনের আস্বাদ নিতে চেয়েছে; নিতাই কবিয়ালের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তাকে আঁকড়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে৷ ভালোবাসার পবিত্র স্পর্শে ধুয়ে মুছে গেছে তার সব পাপ৷ সে লোহা থেকে নিতাই কবিয়ালের স্পর্শে সোনা হয়ে উঠেছে৷

মাসি :

মাসি চরিত্রটি তারাশঙ্করের বাস্তবসম্মত এক চরিত্র৷ তার মধ্য দিয়ে লেখক গণিকালয়ের কর্তৃর এক পূর্ণরূপ ফুটিয়ে তুলেছেন৷ ঝুমুর দলের কর্তৃ সে৷ তার স্নেহ-শাসনের অটুট বন্ধনে সে তার দলটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে—দলের সকলকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে৷ তার বচন অত্যন্ত বিনয়ী ধৈর্যও অপরিসীম৷ পরম ধৈর্য ও সুদৃঢ় শাসনের সঙ্গে মাসি শুধু ঝুমুর দলটিকেই নিয়ন্ত্রণ করে তা নয় তাদের নাচ-গানের বাইরে দেহব্যবসাটাকেও নিয়ন্ত্রণ করে৷ দুটো ক্ষেত্রেই দলের কর্তৃ হওয়ার সুবাদে সে উপার্জন গ্রহণ করে সে৷ আসরে প্যালার মধ্য দিয়ে যা উপার্জন হয় তা দলের প্রত্যেক সদস্যের কার্য অনুযায়ী ভাগ করে৷ তাদের দলে আটজন সদস্য৷ তিনজন মেয়ে বসন্ত, নির্মলা ও ললিতার জন্য তিন ভাগ, কবিয়ালের দুই ভাগ, মাসির এক ভাগ, বেহালাদারদের একভাগ এবং দোহার ও বাজনাদার পায় আধভাগ করে একভাগ৷ আর মেয়েদের শরীর বিক্রয়ের টাকাও তিনভাগ হয়৷ দুইভাগ পায় উপার্জনকারিণী আর একভাগ মাসি৷

মাসি বুদ্ধিমতী ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের মানুষ৷ দেহ ব্যবসায়িনী থেকেই সে আজ ঝুমুর দলে কর্তৃরূপে স্থান পেয়েছে৷ সে জানে দলের সদস্যদের মধুর বচনে ভুলিয়ে না রাখলে তার দল চলবে না—দল ভেঙে লোক বেড়িয়ে যাবে, তাই সর্বদা হাসি মুখে মধুর বচনে সকলকে তুষ্ট রাখে৷ নিতাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তার গান গাওয়ার ক্ষমতা জেনে তাকে দলে টানার জন্য মাসি তার সঙ্গে ছেলে সম্পর্ক পাতিয়ে বলে—‘‘ছেলেই বলবো তোমাকে৷ অন্য লোক বলে—ওস্তাদ! রাগ করবে না তো বাবা?’’২৭১ নিতাই তার দলের গায়ক কবিয়াল তাই সে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাকে ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে তোষামোদ করে গেছে৷ বসন্ত বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণ শ্রীহীন হয়ে আরোগ্য লাভ করলে সে নিজে উদ্যোগী হয়ে তেল-হলুদ মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিয়েছে৷ এমনকি তার ছোঁয়াচে-মারণ রোগ যক্ষার কথা জেনেও সে আর সকলের কাছে গোপন করেছে৷

শুধু যে বিনয়বচন, তোষামোদ করা তা নয়৷ তার মধ্যে লক্ষিত হয়েছে একজন দক্ষ কর্তৃত্বকারিণী৷ মেয়েরা যখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধায় তখন সে ধমকে-বুঝিয়ে তাদের বিচার করে সেই কোন্দল থামায়৷ সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সেই বিচার৷ তার মধ্যে রয়েছে অসীম শাসন দক্ষতা, দলের প্রতিটি সদস্য তার শাসনকে ভয় পায়৷ তার আদেশ আহ্বান অগ্রাহ্য করার মতো ক্ষমতা কারুরই নেই৷ দীর্ঘ এক মাস রোগশয্যা থেকে মুক্ত হয়ে মানসিক অবসাদ ও আসন্ন মৃত্যু ভয়ে কাতর বসন্ত মানসিক বিপর্যয়ে নিতাইকে আয়না ছুড়ে মারলে মাসি কঠোরতর স্বরে শাসনের ভঙ্গিতে ডাক দেয় তাকে৷ মাসির সেই রূপকে, শাসন পরায়ণতাকে লেখক বর্ণনা করেছেন এইভাবে—‘‘এ মাসী আলাদা মাসী৷ নিষ্ঠুর কঠোর শাসনপরায়ণা দলনেত্রী৷ মেয়েরা হইতে পুরুষ—এমন কি তাহার নিজের ভালবাসার জন—ওই মহিষের মত বিশালকায় ভীষণদর্শন লোকটা পর্যন্ত প্রৌঢ়ার এই মূর্তির সম্মুখে দাঁড়াইতে ভয় পায়৷ নিতাইও এ স্বর, এ মূর্তির সম্মুখে স্তব্ধ হইয়া গেল৷… এ মূর্তি সে আজ প্রথম দেখিতেছে৷’’২৭২

মাসির ধর্মজ্ঞান থাক বা না থাক ব্যবসায়ীক জ্ঞান প্রবল৷ কঠোর হাতে সে সেই ব্যবসার হাল পরিচালনা করে৷ মেয়েদের প্রত্যেকের কাছের মানুষ থাকা সত্ত্বেও, বসন্তের নিতাই-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার পরেও মাসির ইচ্ছানুসারে দেহের পসরা সাজাতে হয়৷ মাসির রাজত্বে তাদের না বলার উপায় নেই৷ সন্ধ্যা হলেই সে তার সম্পূর্ণ দলটা বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য বাইরে এসে বসে সুপুরি কাটতে থাকে৷ লোকজন এলে মেয়েদের ডেকে এনে দেখায়, দর-দস্তুর করে, টাকা আদায় করে, গোপনে মদ বিক্রি করে৷ সেই সময় তার মূর্তি আরেক৷ গম্ভীর, কথা খুব কম, চোখের ভ্রূ দুটি কুঞ্চিত হয়ে ভ্রূকুটি উদ্যত করেই রাখে৷ দলের প্রত্যেকটি লোক তখন সন্ত্রস্ত হয়৷ বসন্ত খরিদ্দারের সঙ্গে মদ খাওয়া নিয়ে ঝগড়া বাঁধালে মৃদু তিরস্কার সে বসন্তকেই করে ৷ সে বলে একটু আধটু মদ না খেলে ঘরে লোক আসবে না৷ বসন তার প্রত্যুত্তরে ঘরে লোক নিতে অস্বীকার করলে মাসি বলে—‘‘বেশ, কাল সকালে তুমি ঘর চলে যেয়ো৷ আমার এখানে ঠাঁই হবে না৷’’২৭৩ শুধু বসন্তই নয় নির্মলা ও ললিতাও মাঝে মাঝে হাপিয়ে উঠে ঘরে খদ্দের নিতে অস্বীকার করলে মাসির সেই একই উত্তর—‘‘তাহলে বাছা তোমাদের নিয়ে আমার দল চলবে না৷ তোমরা পথ দেখ৷ ঝুমুর দলের লক্ষ্মী ওইখানে৷ ও পথ ছাড়লে চলবে না৷’’২৭৪ আবার যদি বাজার খুব মন্দা হয় মাসি তখন নতুন পথ ধরে৷ তখন সে মেয়েদের সকলকে সাজগোজ করতে বলে৷ তাদের নিয়ে গাঁয়ের বাজারে বেড়াতে যায়৷ মেয়েরা তার কথা শুনে উৎসাহিত হয়ে পুকুরঘাটে যায় সাবান হাতে নিয়ে৷ তারপর স্নো, সিঁদুর, পাউডার নিয়ে সাজতে বসে৷ ধোওয়া ধবধবে কাপড় পড়ে মুখে একগাল পান নিয়ে মাসি মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে বের হয়৷

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে উপার্জনের পথের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ কোনো দিক থেকে ক্ষীণতম সাড়া পেলেই সে মিষ্টিমুখে সরস বাক্যে সাদর আহ্বান জানিয়ে বলে—‘‘কে গো বাবা? এস, এগিয়ে এস৷ নজ্জা কি ধন? ভয় কি? এস এস৷’’২৭৫ তারপর আগন্তুক এগিয়ে এলে সে মোড়া পেতে বসতে দেয়, পান দিয়ে সম্মান করে বলে—‘‘পানের জন্য দু আনা পয়সা দাও বাবা! দিতে হয়৷’’২৭৬ পয়সা আঁচলে বেঁধেই সে আহ্বান করে মেয়েদের৷ সঙ্গে সঙ্গে তাদের গহনা , সজ্জাবিলাস ইত্যাদিও গ্রাহকের সম্মুখে তুলে ধরে তার বিনয়ী কথার মাধ্যমে৷ মাসির কার্যবিবরণীর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন রচনাকার৷ যেদিন একজন লোক এসে বসনকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়৷ বসন্ত শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে তাতে অস্বীকৃত হলে মাসি কঠোর অথচ মোলায়েম আহ্বান করে তাকে বাইরে ডাকে৷ মাসির সে আদেশ অতিক্রম করার সাধ্য বসন্তর নেই৷ সে বাইরে এসে দেখে মাসির সম্মুখে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ মাসি স্নেহ সম্ভাষণে তাকে বলে—‘‘দেখি, তোর গা দেখি!… ওমা, গা যে দিব্যি—আমার গা তোর চেয়ে গরম৷ ওগো বাবা, মেয়ের আমার শরীর খারাপ, একটু মদ খাওয়াতে হবে৷ সহসা কন্ঠস্বর মৃদু করিয়া হাসিয়া বলিল—আমার কাছেই আছে৷’’২৭৭ মদ খেয়ে মাসির ইচ্ছে পূরণ করতে সানন্দে তার হাত ধরে বসন্ত ঘরে চলে যায়৷

তাদের দলের কারও ব্যাধি হলে মাসিই তার ডাক্তার; তার বিধানদাতা৷ গণিকা দেহজীবাদের এক ভয়ঙ্কর যৌনরোগের আভাস দিয়েছেন লেখক কিন্তু তার নাম উল্লেখ করেননি৷ হয় তো তা সিফিলিস হতে পারে৷ রোগে তারা ডাক্তার কবিরাজ দেখায় না নিজেরাই চিকিৎসা করে—সে রোগ বাহ্যিকভাবে অন্তর্নিহিত হলেও রক্তস্রোতের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে ফেরে৷ এরপর বসন্তর বসন্ত হলে মাসি তাকে পরামর্শ দেয় মাছ না খেয়ে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলার৷ সে ছোঁয়াচ গামছা-কাপড়-সাবান এবং স্পর্শের ছোঁয়াচ৷

মাসির আরেকটি রূপ প্রকাশিত হয় বসন্তর মৃত্যুর পর৷ শোকের মধ্যেও সে চিতায় ওঠানোর আগে তার মৃতদেহ থেকে সামান্য আভরণটুকু খুলে নিতে ভোলে না৷ নিতাই তা নিয়ে সামান্য প্রতিবাদ করলে সে তাকে তার যথাযথ বিনয় বচনে বোঝায়—‘‘বুকের নিধি চলে যায় বাবা, মনে হয় দুনিয়া অন্ধকার, খাদ্য বিষ আর কিছু ছোঁব না—কখনও কিছু খাব না৷ আবার এক বেলা যেতে না যেতে চোখ মেলে চাইতে হয়, উঠতে হয়, পোড়া পেটে দুটো দিতেও হয়, লোকের সঙ্গে চোখ জুড়তে হয়৷ বাঁচতেও হবে, খেতে-পরতেও হবে—ওগুলো চিতেয় দিয়ে কি ফল হবে বল৷’’২৭৮ মাসির বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন মন সংসারের বহু অভিজ্ঞতায় দীর্ণ হয়ে জীবনের এই দায়টুকু বুঝতে পেরেছে৷ জীবনে বেঁচে থাকার জন্য আবেগ-ভালোবাসার দরকার কিন্তু তার চেয়েও বেশি দরকার প্রাত্যহিক নানা প্রয়োজনীয় জিনিস৷ অর্থ তার অন্যতম৷ মাসির বিচার সেই প্রয়োজনানুসারী৷ তাছাড়া সে যেহেতু ঝুমুর দলের কর্তৃ তাই সেখানকার কোনো সদস্যের কিছু হলে সেইই হয় ওয়ারিশান এবং তার সব কিছুর মালিক৷

বসন্তের মৃত্যুর সন্ধ্যাতেও তাদের দলের আসর বসে৷ মাসি বসন্তের সমস্ত জিনিস নিজের ঘরে নিয়ে রেখে খাবার-দাবারের ব্যবস্থায় ব্যস্ত৷ তারা সকলে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে বসন্তের স্থানে আর কেউকে বসানোর জন্য৷ তারা সে স্থানে প্রভাতী নাম্নী এক ঝুমুর গায়িকাকেও মনোনীত করে ফেলে৷ বসন্তের সমস্ত কাপড়-চোপড় মাসি দরদাম করে এক পুরোনো কাপড় ব্যবসায়ীর কাছে বেঁচে দেয়৷ মদ, মাংস, সেদ্দ ডিম ইত্যাদি দিয়ে বশে রাখতে চায় নিতাইকে৷ সে নানাভাবে এমন কি বসনের গয়নাগাটি, কাপড়-চোপড় বেঁচে প্রাপ্ত অর্থের অর্ধাংশ দিতে চেয়েও তাকে যখন প্রলোভিত করতে পারে না তখন ভবিষ্যতে তাকে পুনরায় পাওয়ার আশায় সে বলে—‘‘চিরকাল তো মানুষের মন বিবাগী হয়ে থাকে না বাবা৷ মন একদিন ফিরবে, আবার চোখে রঙ ধরবে৷ ফিরেও আসবে৷ তখন যেন মাসীকে ভুলো না৷ আমার দলেই এসো৷’’২৭৯

এভাবে শাসনে-নিয়ন্ত্রণে-ভালোবাসায়-লোভে-স্বার্থপরতায় মাসি চরিত্রটিকে অনবদ্য করে তুলেছেন লেখক৷

নির্মলা ও ললিতা :

নির্মলা ও ললিতা উপন্যাসের আর দুই পণ্যাঙ্গনা৷ তারাও ঝুমুর দলের নর্তকী৷ দলে বসন্তর পরেই তাদের স্থান৷ নির্মলা নিতাই কবিয়ালের সঙ্গে দাদা-বোনের সম্পর্ক পাতে আর ললিতা বলে ঠাকুরঝি৷ দলে নাচ ছাড়াও তারা যেমন ঘরকন্নার কাজগুলি করে তেমনি সঙ্গে সঙ্গে দেহব্যবসার দ্বারাও অর্থাগম ঘটায়৷ নির্মলার মনের মানুষ বেহালাদার৷ মনের মানুষ থাকা সত্ত্বেও তাদের দেহব্যবসা করতে হয়—প্রেমাস্পদের সম্মুখ দিয়ে অন্যপুরুষের হাত ধরে ঘরের দরজা বন্ধ করতে হয়৷ মাঝে মাঝে তাদের জীবনে ক্লান্তি চলে আসে৷ তারা বেড়িয়ে যেতে চায় কিন্তু পারে না৷ নিজেদের যেমন দীর্ঘদিনের অভ্যাস তেমনি মাসিও তাদের ছাড়তে দেয় না৷ তারা দলের সকলের সঙ্গে একটা পরিবারের মতো বাস করে৷ বসন্তর মৃত্যুর পর যখন তার মৃতদেহটা চিতার আগুনে জ্বলতে থাকে তখন তার জন্য অকৃত্রিম শোকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেও সেই সঙ্গে তারা ভাবে নিজেদের কথা৷ নিজের জীবনের সেই পরিণতির কথা৷ তাদেরও হয়তো এমনি করে একদিন চলে যেতে হবে, এমনি করেই মাসি তাদের গা থেকে গয়না খুলে নেবে৷ আর বহুভাগ্যে যদি বৃদ্ধা হওয়া পর্যন্ত বাঁচে, তবে তারা হয়তো মাসির মতো কোনো দলের কর্তৃ হবে৷ কিন্তু কল্পনা তাদের অতদূর যেতে পারে না৷ কারণ—‘‘আশার চেয়ে নিরাশাই তাহাদের জীবনে বড়৷’’২৮০ বসন্তের মৃত্যুর শোককে চাপা দিতে সন্ধ্যা রাত্রেই তারা মদ খেয়ে বিভোর হয়ে থাকে, নিতাইকে আদর যত্নের মধ্য দিয়ে ভোলাতে চেষ্টা করে প্রিয় বিরহের যন্ত্রণা৷ তারপর নিতাই যখন তাদের দল ছেড়ে চলে যায় তখন ললিতা, নির্মলা ব্যথাভারাক্রান্ত হৃদয়ে চোখের জল ফেলে৷ যাওয়ার সময় নিতাই অনুধাবন করে মাসির তার প্রতি ভালোবাসা যেমন অকৃত্রিম তেমনি নির্মলার ভালোবাসা মায়ের পেটের বোনের মতো, আর রহস্যে-ঠাট্টায় ললিতা যেন তার শ্যালিকাই ছিল৷

নির্মলা ও ললিতার আলাদা কোনো ভূমিকা নেই উপন্যাসে কিন্তু উপন্যাসের তারা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে৷ ঝুমুরদলের চিত্র, দেহব্যবসার নির্মম নিষ্ঠুর দিক তাদের কেন্দ্র করে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে৷

জ. গণদেবতা ও পঞ্চগ্রাম :

‘গণদেবতা’ ও ‘পঞ্চগ্রাম’ উপন্যাসদুটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৪২ এবং ১৯৪৪ সালে৷ দুটিকে একটি উপন্যাস হিসেবেই ভাবা যায়৷ লেখকেরও তেমনি অভিপ্রায় ছিল৷ তিনি প্রথমটির নাম ‘চণ্ডীমণ্ডপ’ এবং দ্বিতীয়টির নাম ‘পঞ্চগ্রাম’ রাখার পরিকল্পনা করেছিলেন ,আর দুটিকে মিলে নাম দিতে চেয়েছিলেন ‘গণদেবতা’৷ দুটি উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরাও যেমন অভিন্ন তেমন দুটির মধ্যে ভাবগত রূপগতও কোনো প্রভেদ নেই৷ ব্যবধান শুধু ভৌগোলিক সীমায়৷ ‘গণদেবতা’-য় একটি গ্রাম শিবকালীপুরের কথা রয়েছে আর ‘পঞ্চগ্রাম’-এ কঙ্কণা, কুসুমপুর, মহাগ্রাম, শিবকালীপুর ও দেখুরিয়া এই পাঁচটি গ্রামের উপস্থিতি৷ উপন্যাসে গণিকা চরিত্র হিসেবে উপস্থিত হয়েছে দুর্গা মুচিনি, পাতুর বৌ, দুর্গার মা ইত্যাদিরা৷

দুর্গা :

প্রচলিত অর্থে ‘গণদেবতা’ এবং ‘পঞ্চগ্রাম’ উপন্যাসে কোনো নায়িকা নেই কিন্তু দুর্গা উপন্যাসের প্রধান রমণী৷ তার বসবাস গ্রামের প্রান্তসীমায় অবস্থিত হরিজনপল্লীতে৷ সেখানকার অন্ত্যজ শ্রেণীর নরনারীর মধ্যে সতীত্বের কোনো বাছবিচার নেই৷ চরিত্র স্খলনের জন্য কোনো কঠোর শাস্তি বা নিজেদের শোধরানোর জন্য কোনো আদর্শ-সংস্কার নেই৷ অল্প-স্বল্প উশৃঙ্খলতা স্বামী পর্যন্ত দেখেও না দেখার ভান করে থাকে৷ আর সেই উশৃঙ্খলতার সঙ্গে যদি উচ্চবর্ণের কোনো সচ্ছল পুরুষ যুক্ত থাকে তখন সেখানকার পুরুষেরা বোবা ও কালা হয়ে যায়৷ স্ত্রীর অতিরিক্ত রোজগারের এই পন্থা তারা গর্বের সাথে মেনে নেয় ও স্বীকার করে৷ এই নীতি-নৈতিকতার বাছ-বিচারহীন পরিবারে জন্ম দুর্গার৷ তার মধ্যে কোনো সংস্কারের বালাই নেই৷ হরিজনপল্লীর অন্যান্য নারীদের চেয়ে তার স্বভাব আরও বেশি দুর্দমনীয়৷ তার দেহ বেঁচে রোজগারের পেছনে একটা অতীত ইতিহাস তুলে ধরেছেন লেখক৷ তার মা-শাশুড়িদের ইন্ধনে সে প্রথম শরীরের বিনিময়ে আঁচলে অর্থ বাঁধতে সক্ষম হয়েছিল৷ দুর্গার বিয়ে হয়েছিল কঙ্কণায়৷ তার শাশুড়ি সেখানকার এক ধনী বাবুর বাড়িতে ঝাড়ুদারনীর কাজ করত৷ একদিন শাশুড়ির অসুখ করাতে দুর্গা যায় তার পরিবর্তে কাজ করতে৷ সব কাজ শেষ হয়ে গেলে সেই বাবুর বাড়ির চাকর তাকে ধমকে পাঠায় তার বাগানবাড়ি সংলগ্ন একটা নির্জন ঘরে ঝাঁট দেওয়ার জন্য৷ কিন্তু ঘরটা নির্জন ছিল না৷ স্বয়ং বাবু বসেছিল সেই ঘরের ভিতরে৷ দুর্গা ঘোমটা টেনে সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে দেখে ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ৷ ঘন্টাখানেকপরে কাপড়ের খুঁটে পাঁচটাকার একখানি নোট বেঁধে সে সোজা বাপের বাড়ি চলে আসে৷ সেই বাবুর কাছেই সে জানতে পারে তার দেহকে বাবুর ভোগ্য করার যোগসাজেশ তার শাশুড়িই করে গিয়েছে৷ সেই বাবুর দ্বারা ধর্ষিত হয়ে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জাগেনি দুর্গার মনে বরং আতঙ্কমিশ্রিত একপ্রকার আনন্দ অনুভব করেছিল সে৷ তাই—‘‘আতঙ্কে, অশান্তিতে ও গ্লানিতে এবং সেই সঙ্গে বাবুর দুর্লভ অনুগ্রহ ও এই অর্থপ্রাপ্তির আনন্দে—পথ ভুল করিয়া, সেই পথে পথেই সে পলাইয়া আসিয়াছিল আপন মায়ের কাছে৷’’২৮১ মেয়ের মুখে সব কথা শুনে জীবনে রুজি-রোজগারের সম্ভাবনাময় পথ আবিষ্কার করেছিল স্বৈরিণী দুর্গার স্বৈরিণী মা৷

দুর্গা সুশ্রী৷ সুগঠিত তার দেহ৷ নিম্ন শ্রেণীর মানুষ হয়েও তার দেহবর্ণ গৌর৷ তার রূপের মধ্যে একটা মাদকতা আছে যা দিয়ে মানুষের মনকে মোহাবিষ্ট করে তোলে—আর মুগ্ধ মত্ততায় তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে পতঙ্গের মতো তার রূপ-বহ্নির দিকে৷ তার মায়ের স্বৈরিণী জীবনের ফল দুর্গা৷ দুর্দান্ত তার স্বভাবও৷ কাউকে সে পরোয়া করে না৷ শাশুড়ির চক্রান্তে কঙ্কণার বাবুদের দ্বারা ধর্ষিত হয়ে পাঁচটাকার নোট আঁচলে বেঁধে সেই যে দেহ ব্যবসার সূচনা হয়েছিল তারপর থেকে তাকে আর থেমে থাকতে হয়নি৷ ফরসা কাপড় পরে, হাসি-ঠাট্টা-মস্করা দিয়ে পুরুষের চিত্তকে বিগলিত করতে তার জুড়ি নেই৷ লেখক তার সম্পর্কে বলেছেন—‘‘সে দুরন্ত স্বেচ্ছাচারিণী; ঊর্ধ্বে বা অধঃলোকের কোন সীমাকেই অতিক্রম করিতে তাহার দ্বিধা নাই৷ নিশীথ রাত্রে সে কঙ্কণার জমিদারের প্রমোদভবনে যায়, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টকে সে জানে; লোকে বলে দারোগা, হাকিম পর্যন্ত তাহার অপরিচিত নয়৷ সেদিন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ভাইস-চেয়ারম্যান মুখার্জী সাহেবের সহিত সে গভীর রাত্রে পরিচয় করিয়া আসিয়াছে, দফাদার শরীর-রক্ষীর মত সঙ্গে সঙ্গে গিয়াছিল৷ দুর্গা ইহাতে অহঙ্কার বোধ করে, নিজেকে স্বজাতীয়দের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করে;’’২৮২ অর্থাৎ দুর্গার নিজের দেহবিক্রয় নিয়ে কোনোরকম গ্লানি নেই; বরং গর্বিতই সে৷ তার চটুল প্রণয়পাশে উচ্চ থেকে নিম্নস্তরের অনেক মানুষই আবদ্ধ৷

মুচির মেয়ে দুর্গা ছলাকলাপটিয়সী, রূপবতী এবং সামাজিক-নৈতিক নীতিবোধগুলির প্রতি সম্পূর্ণ আস্থাহীন৷ সে তার বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন করেছে নিজের শরীরকে৷ তার দেহব্যবসা নিয়ে কেউ বিরূপ মন্তব্য করলে সে তা মেনে নিতে পারে না, গর্বভরে প্রতিপক্ষকে হেলায় অবনত করে৷ গ্রামের উঠতি ধনী ছিরুপাল তার লাম্পট্য এবং ক্রুর বুদ্ধিতে দুর্গার দাদা পাতুকে অপদস্ত করে, সেই ছিরুপালের দুর্গার ঘরে যাওয়া-আসা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করলে তা নিয়ে দুর্গার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় প্রতিস্পর্ধী বাক্যজাল৷—‘‘ঘর আমার, আমি নিজের রোজগারে করেছি, আমার খুশী যার ওপর হবে—সে-ই আমার বাড়ি আসবে৷ তোর কি? তাতে তোর কি?’’২৮৩ আবার শ্রীহরির চক্রান্তে যখন তাদের গোটা মুচি পাড়াটা পুড়ে ছাই হয়ে যায় তখন হরিজনপল্লীর সকল সদস্যরা সরকারি সাহায্য পাওয়ার আশায় ব্যস্ত সে সময় দুর্গাকে দেখা যায় সে সেই সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন৷ জগন ডাক্তার তাকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশায় টিপসই দিতে বললে সে তার নিজের পেশার গর্বে তা হেলায় অবহেলা করে বলে—‘‘আমি টিপ-সই দিতে আসি নাই গো৷… গতর থাকতে ভিখ মাঙব ক্যানে? গলায় দড়ি!’’২৮৪ শ্রীহরির সঙ্গে কথা বলে তার হঠাৎ আঁতকে ওঠা মুখচ্ছবি দেখে বিচক্ষণ এই স্বৈরিণী নারীর মনে মুহূর্তে দৃঢ় প্রত্যয়ের জন্ম নেয় যে তাদের পল্লীটিকে ছিরুপালই জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়েছে৷ সে সেকথা ছিরুপালকে জ্ঞাত করে ভয় দেখিয়ে মোটা টাকা প্রাপ্তির অঙ্গীকার করিয়ে নেয়৷ দুর্বৃত্ত ছিরুপালের সঙ্গে দুর্গার অনেক দিনের সম্পর্ক৷ কিন্তু সেটা সম্পূর্ণভাবে দেওয়া-নেওয়ার৷ তার প্রতি কোমলতা কোনোদিনও দুর্গার ছিল না৷ গ্রামের ভালো মানুষগুলোর সঙ্গে তার শত্রুতাপূর্ণ আচরণ ধীরে ধীরে দুর্গার মনে আক্রোশ ও ঘৃণার জন্ম দেয়৷ যে নির্দয় প্রতিহিংসায় শ্রীহরি তাদের সমগ্র পাড়াটিকে ছাই করে দিয়েছে সেখানকার মানুষজনের প্রতি বিশেষ করে তার দাদা পাতুর প্রতি হঠাৎ দুর্গা অপরিসীম মমতা অনুভব করে৷ সে সংকল্প নেয় ছিরুপালকে জব্দ করার—তার ক্ষতি করার৷ মদের সঙ্গে গরু মারার বিষ মিশিয়ে তাকে চরম শাস্তি দেওয়ার ভাবনাটিও তার মানসলোকে উঁকি দিয়ে যায়৷

দুর্গার অবরুদ্ধ মনে দেবুর প্রতি ভালোবাসাও প্রবল৷ উপন্যাসের নায়ক পাঠশালার পণ্ডিত সচ্চরিত্রের দেবু৷ বিলুদিদি, যাকে কোলে পিঠে করে এককালে দুর্গার মা মানুষ করেছিল দেবু দুর্গার সেই বিলুদিদির বর৷ কিন্তু দেবু দুর্গাকে দুই চোখে দেখতে পারে না৷ সে স্বৈরিণী, সে ভ্রষ্টা, সে পাপিনী—তার সঙ্গে আবার ছিরু পালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট৷ কিন্তু দেবুর প্রতি দুর্গার মানসিক দুর্বলতা স্পষ্ট৷ দেবুর প্রতি তার ভালোলাগাকে লেখক বর্ণনা করেছেন এইভাবে—‘‘পণ্ডিতকে তাহার ভাল লাগে—খুব ভাল লাগে৷… কিন্তু ছিরুর সহিত যখন তাহার ঘনিষ্ঠতা ছিল—তখনও তাহার পণ্ডিতকে ভাল লাগিত; ছিরু অপেক্ষা অনেক বেশী ভাল লাগিত৷ কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে, এই দুই ভাল লাগার মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব ছিল না৷ আজ পণ্ডিতকে পূর্বাপেক্ষা যেন আরও বেশী ভাল লাগিল৷’’২৮৫ সে দেবুর বাড়িতে উপস্থিত হয় তার স্ত্রীর মুখে অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির ‘ইতুলক্ষ্মী’র ব্রতকথা শুনতে৷ দেবুর প্রতি, বিলুর প্রতি, কামার অনিরুদ্ধ এবং তার স্ত্রী পদ্মর প্রতি মিষ্ট মনকাড়া আত্মীয়তার সুর শুনে স্বৈরিণী বৃত্তির জন্য ঘৃণা করলেও কিছুতেই যেন তার প্রতি রাগ করা যায় না৷ দেবুও তার সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হয়, আস্কারা দিতে বাধ্য হয়৷

‘ইতুলক্ষ্মী’ ব্রতকথার শেষ প্রার্থনা স্বামীর কোলে মাথা রেখে মৃত্যু কামনা৷ বিলু কামার বউ ব্রতকথা সাঙ্গ করে উলুধ্বনি দিয়ে প্রণাম করে ব্রত শেষ করে৷ দুর্গাও উলুধ্বনি দিতে পারদর্শী৷ তার গলার স্বর যেমন তীক্ষ্ণ তার জিহ্বাও তেমনি লঘু চাপল্যে চঞ্চল৷ সমস্ত বাড়িটা মুখরিত হয়ে যায় তার উলুধ্বনির আওয়াজে৷ সে ব্রতকথার সুপুরিটি দেবুর স্ত্রীর সামনে রেখে সহাস্যে লঘুচপলতায় বলে উঠে—‘‘বিলু দিদি, ভাই কামার-বউ, মরণকালে তোমারা কেউ আমাকে স্বামী ধার দিয়ো ভাই কিন্তুক৷’’২৮৬ দুর্গার এই পরিহাস শুধুমাত্র পরিহাস হলেও স্বৈরিণী নারীর মুখে এহেন পরিহাস কিন্তু সকলে মেনে নিতে পারে না৷ বিলু তার স্বামীর চরিত্র অবগত তাই সে হেসে ওঠে৷ পদ্মও রাগ না করে পারে না৷ রূপবতী এই গণিকা তার ছলা কলা হাস্য-পরিহাস দিয়ে পাড়ার সমস্ত পুরুষদের নাচিয়ে চলে৷ তার মান-অপমান বোধ কিছু নেই৷ লজ্জা নেই, ভয়ও নেই৷ পুরুষ দেখলেই সে দুই-চারটা রসিকতা করে সর্বাঙ্গ দুলিয়ে চলে যায়৷ তাই সে যখন তার মুখের মৃদু বাঁকা হাসিটি নিয়ে পথে বের হয় তখন পাড়ার প্রতিটি বধূই সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে৷ তার পরিহাস-রঙ্গ রসিকতা থেকে দেবু, অনিরুদ্ধ কামার কেউই বাদ যায় না৷ দেবু তার চারিত্রিক দৃঢ়তায় দুর্গাকে প্রতিরোধ করলেও সে দৃঢ়তা কামারের নেই৷ একটা দা গড়ানোর সূত্র ধরে সে নিয়মিত তার বাড়ি যায়, তার সঙ্গে রঙ্গ রহস্য করে হেসে ঢলে পড়ে৷ পদ্মর তা সহ্য না হলেও কিছু বলার থাকে না৷ ইদানিং একটা চরম ঔদাসীন্য তাকে ছেয়ে রেখেছে ফলে অনিরুদ্ধ-দুর্গার রহস্যলীলা সে চোখে দেখেও কিছু বলে না৷ তাই দুর্গা তাদের কাছে স্বামী ধার চাইলে সেও না হেসে পারে না৷ দুর্গা তার রূপের ফাঁদে পুরুষদের আবদ্ধ করে, অভিসম্পাতের শিকার হয় তাদের অন্তপুরীকাদের দ্বারা৷ দুর্গার কাছে ওটাই প্রায়শ্চিত্ত৷ কিন্তু দুশ্চরিত্র ছিরু পাল বা শ্রীহরি পালের স্ত্রী তার সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কোনো দিন কোনোরকম কটু কথা শোনায়নি৷ তার সেই প্রতিবাদহীন মৌনতায় দুর্গা তার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে লজ্জা বোধ করে৷

নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ দুর্গার দেহপসারিণী জীবন৷ সে-ই প্রথম পদ্মকে শোনায় শুধুমাত্র নারীরা নয় পুরুষরাও ‘বাঁজা’ হয়৷ সে প্রসঙ্গে বহু দৃষ্টান্ত তুলে ধরে৷ তার কচিকাঁচাদের প্রতি কোনোরকম বাৎসল্যবোধ নেই৷ সে পদ্মকে স্পষ্ট ভাষায় জানায় ছোট বাচ্চা দেখলেই তার নাকি গা ঘিন ঘিন করে৷ তার জীবনে তার শরীরই সব৷ সে শরীরের দেমাকে উপার্জন করে—শরীর বেচেই আত্মসুখ লাভ করে৷ কিন্তু সে যাকে ভালোবাসে বা যাকে তার ভালোলাগে তার জন্য অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে৷ অনিরুদ্ধের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেকদূর বিস্তৃত হয়েছে৷ সে যেমন অনিরুদ্ধর বিপদে তাকে টাকা ধার দিয়ে সহায়তা করে তেমনি পদ্ম ফিট হলে তার পরিচর্যা করে, বাড়িতে লক্ষ্মীপূজার জন্য নিজের পয়সা খরচ করে নানা উপকরণ কিনে নিয়ে এসে রাঙাদিদিকে জানায় যে পদ্ম তাকে পয়সা দিয়েছে জংশন থেকে কিনে আনার জন্য৷ তার দান গ্রহণ করে গৃহস্থবাড়িতে লক্ষ্মীপূজা হচ্ছে তা যদি পাড়াময় রাষ্ট্র হয়ে যায় তাহলে অনিরুদ্ধর প্রতি সমাজ বিরূপ হয়ে যাবে—তার সম্ভ্রমে ঘা লাগবে৷ পদ্ম তাকে দেখে নানা ভাবে অপমান করলেও সে লজ্জাহীনার মতো সব কথার হেসে উত্তর দেয়৷ তার পরিহাসপটুতায় পদ্মর নিদারুণ কথার শরকে ভেঙ্গে খান খান করে দিয়ে নিজেকে তাদের আপনজন হিসেবে দাবি করে৷ তার আপনজন হওয়ার প্রস্তাবে সে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেও দুর্গার হাস্য-পরিহাস কমে না৷ বরং সে অনিরুদ্ধর সঙ্গে তার সম্পর্ক তার সামনে ব্যক্ত করে হাসতে হাসতে বলে—‘‘আমি তোমার সতীন! তোমার কর্তা তো আমাকে ভালবাসে হে!’’২৮৭ নির্লজ্জের মতো পদ্মর সামনে সে কথা বলতে পারলেও রাঙাদিদির সামনে তা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয়৷ রাঙাদিদিকে যখন বলে যে পদ্ম তাকে জংশন থেকে লক্ষ্মীপূজার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে পয়সা দিয়েছিল তখন তার সেই ছোট্ট মিথ্যা কথাটিতে পদ্মর কঠিন মন যেমন গলে নরম হয়ে যায় তেমনি রাঙাদিদিও হাস্য-পরিহাস ছলে বিষয়টিকে হালকা করে নেয়৷

দুর্গা দেহব্যবসায়ী হলেও তার মধ্যে ধীরে ধীরে প্রেমপরায়ণা পবিত্র এক নারীসত্তা প্রকাশ পায়৷ যে দুর্গাকে শুরুতেই লেখক বর্ণনা করেছেন দুরন্ত স্বেচ্ছাচারিণী হিসেবে, যে তার রূপকে নিয়ে, তার পেশাকে নিয়ে গর্ববোধ করে সেই দুর্গার মানসলোকে দেবুকে ঘিরে ঘটতে থাকে নানা পরিবর্তন৷ একটু একটু করে প্রকটিত হতে থাকে তার ভেতরকার সেই নির্মল নারীমহিমা৷ কানুনগোর সাথে বচসার জেরে দেবু পণ্ডিতকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেলে বিলুর সান্ত্বনাস্থল হয় সে-ই৷ তারপর দেবুর যখন পনেরো মাসের কারাদণ্ডের শাস্তি হয় তখন সকলে সেই আসন্ন দুর্যোগের খবর চেপে গেলে দুর্গা বিলাসিনী বেশে সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে যায় সেখানকার কর্মচারীদের মনোরঞ্জন করার জন্য, উদ্দেশ্য তাদের অনুরোধ করে দেবুর শাস্তি মুকুব করা৷ সেখানেই সে জানতে পারে তার দীর্ঘ দিনের কারাদণ্ডের কথা৷ অস্থির পদবিক্ষেপে সেখান থেকে সেই অভিসারিকাবেশেই এসে উপস্থিত হয় বিলুর দুয়ারে৷ তাকে জানায় সেই মর্মান্তিক সংবাদ৷ দেবুর দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে বিলু ও খোকাকে সেই আগলে রাখে৷ জেলে বসে বিলুর চিঠির মধ্য দিয়ে দুর্গার সব খবর পায় দেবু৷ দীর্ঘ কারাবাসের পর গৃহে প্রত্যাবর্তনের পথে দুর্গার কোঠা-ঘর দেখে দুর্গার প্রতি দেবুর ভাবান্তর স্পষ্ট হয়—‘‘দুর্গা! আহা, দুর্গা বড় ভাল মেয়ে৷ পূর্বে সে মেয়েটাকে ঘৃণা করিত, মেয়েটার গায়েপড়া ভাব দেখিয়া বিরক্ত ভাব প্রকাশ করিত৷ অনেকবার রূঢ় কথাও বলিয়াছে সে দুর্গাকে৷ কিন্তু তাহার অসময়ে, বিপদের দিনে দুর্গা দেখা দিল এক নূতন রূপে৷ জেলে আসিবার দিন সে তাহার আভাস মাত্র পাইয়াছিল৷ তারপর বিলুর পত্রে জানিয়াছে অনেক কথা৷ অহরহ—উদয়াস্ত দুর্গা বিলুর কাছে থাকে, দাসীর মত সেবা করে, সাধ্যমত সে বিলুকে কাজ করিতে দেয় না, ছেলেটাকে বুকে করিয়া রাখে৷ স্বৈরিণী বিলাসিনীর মধ্যে এ রূপ কোথায় ছিল—কেমন করিয়া লুকাইয়া ছিল?’’২৮৮ শুধু দেবুর সংসারেই নয় ছিরু পালের চক্রান্তে এবং নিজের একগুয়েমিতে অনিরুদ্ধ কামারের সংসার তছনছ হয়ে যায়৷ সে বদ্ধ মাতাল হয়ে দিনরাত পড়ে থাকে হরিজনপল্লীতে দুর্গার বাসায় আর তার স্ত্রী প্রায় উন্মাদ হয়ে নিজের ঘরে৷ দুর্গা দুজনকেই বাঁচানোর চেষ্টা করেছে তার ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে৷ সে বিলুর মধ্য দিয়ে টাকা পাঠিয়েছে পদ্মর কাছে৷ তাকে পদ্ম ঘৃণা করে জেনেও সে পদ্মর উপকারে বিরত হয়নি৷ অনিরুদ্ধ তার উন্মত্ত দেহকামনা পূরণের আধাররূপে গ্রহণ করেছিল দুর্গাকে৷ পদ্মর মানসিক বিকারের সুযোগে দুর্গার প্রতি সে আরও বেশি নির্ভর করেছিল৷ দুর্গা তাকে দেহ দিয়েছিল, প্রেম দিয়েছিল, অর্থ দিয়েছিল—তার সমস্ত জ্বালাকে মিটিয়েছিল৷ কিন্তু একদিন দুর্গাই তাকে পরিত্যাগ করে৷ তার মদ-মাতাল ঔদ্ধত্য, পরিবারের প্রতি অনীহা ইত্যাদিতে বিরক্ত দুর্গা তাকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়৷ কিন্তু দুর্গা তাদের অনেক উপকার করেছে সে কথাও কামার একেবারে ভোলে না৷ দারোগাবাবুর সঙ্গে তার জানাশোনা আছে বলেই তাকে বলে কয়ে মাসিক দশটাকা ভাড়ায় নজরবন্দি যতীনকে তাদের বাড়িতে থাকার জায়গা করে দেয়৷ শুধু কি দেবু-অনিরুদ্ধের পরিবার! নিজের পরিবারও প্রতিপালন করে দুর্গা৷ দুর্গার মা ও দাদা তার ও তার ভ্রাতৃবধূর দেহবিক্রয়ের অন্নে প্রতিপালিত৷

দুর্গা সর্বতোভাবে সমস্ত ভালো মানুষগুলোর মঙ্গলাকাঙ্খিনী৷ তার উপস্থিত বুদ্ধিও প্রকট৷ যদিও পুরুষ ভোলানো তার রক্তের নেশা৷ বংশপরম্পরায় তার পরিবারের নারীরা দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত৷ তাই দেহব্যবসা তার অস্থি-মজ্জায়৷ সে অনিরুদ্ধকে ভালোবাসে, দেবুকে ভালোবাসে, এমনকি নজরবন্দি যতীনকে বশ করার জন্য উন্মুখ তার চিত্ত৷ মহুয়ার ফুলের মধ্য দিয়ে সে যতীনকে পেতে চায়, তার রক্তে নেশা ধরিয়ে দেয়৷ আর তার এই ভালোবাসার মানুষগুলিকে বাঁচাতে উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগ করে প্রাণের ঝুঁকি নিতেও দ্বিধাবোধ করে না৷ দুর্গা তার সন্ধ্যাকালীন অবসরে ভাবছিল দেবু পণ্ডিতের সুখ্যাতির কথা—নজরবন্দির মহুয়াফুলের নেশায় মদিরাসক্ত আবেশের কথা৷ সেই সময় সে তার কোঠাঘরের জানালা দিয়ে লক্ষ্য করে তাদের বায়েনপাড়ার প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে তিনজন মানুষ—ভূপাল থানাদার, জমাদারবাবু এবং হিন্দুস্থানী সিপাহি৷ সকলেই তাদের পদানুযায়ী পোশাকে সুসজ্জিত৷ ছিরু পালের নিমন্ত্রণে জমাদারের আসা বিচিত্র নয় কিন্তু তাদের মজলিশ কখনো প্রথমরাত্রে বসে না, তা মধ্য রাত্রির পর৷ দুর্গা চকিত হয়ে যায়৷ হঠাৎই তার মনের অজান্তেই দুটো নাম তার মানসপটে ভেসে উঠে একজন জামাই পণ্ডিত অর্থাৎ দেবু ঘোষ অপরজন নজরবন্দিবাবু অর্থাৎ যতীন৷ সে তাদের উদ্দেশ্য জানার জন্য তাদের পিছু নিয়ে জানতে পারে ছিরু পাল খবর পাঠিয়েছিল নজরবন্দির বাড়িতে প্রজা সমিতির কমিটি বসেছে৷ জমাদার সাহেবের কাছে সেলাম পাঠানো হয়েছিল, সেলামির ইঙ্গিতও ছিল৷ জমাদারের নিজেরও প্রত্যাশা আছে পদন্নোতি অথবা পুরস্কার কারণ নজরবন্দি যতীনকে আইন অমান্য বা গোপন ষড়যন্ত্র করার দায়ে হাতে নাতে ধরলে তার উপরমহল থেকে বাহবা প্রাপ্তির অশেষ সম্ভাবনা৷ তাদের সেই গোপন মতলবে দুর্গা শিউরে উঠে৷ মুহূর্তে বুদ্ধি বের করে দেবু যতীনের মতো সমাজের মঙ্গলাকাঙ্খীদের রক্ষা করার জন্য৷ সে নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ তুলে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে৷ তাদের আহ্বানে সেখানে উপস্থিত হলে জমাদারবাবু দুর্গার শ্রীহরিকে ত্যাগ করা নিয়ে খোঁচা দিলে সেই সুযোগে দুর্গা আলগোছে ব্যক্ত করে ছিরু পালের হরিজনপল্লী জ্বালানোর প্রসঙ্গ৷ দুর্গার বিশ্বাস ছিল জমাদারবাবু শ্রীহরির কোনো খুঁত পেলে সেখান থেকে অবশ্যই জরিমানা গ্রহণ করবে এবং এ নিয়ে শ্রীহরি ও জমাদারবাবুর বাগবিতণ্ডাও কম হবে না৷ সেই সময়টুকু কাজে লাগানোর জন্য ঘাট থেকে আসার নাম করে সেখান থেকে বেড়িয়ে যায়৷ পণ্ডিতজামাইকে সে খবর দিতে হবে৷ তাদের আসন্ন ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে রক্ষা করতে হবে৷ দুর্গার হাতে সময় কম৷ ঘাটের দিকে খিড়কির পুকুরের পাড় দিয়ে কম সময়ে পৌঁছানো যাবে তাদের প্রজাসমিতির মিটিংস্থলে৷ তাছাড়া শ্রীহরিদের আড়াল করারও ব্যাপার আছে৷ সে সেই পুকুর পাড় দিয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভয়ানক বিপদের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও৷ লেখক শ্রীহরির পুকুরপাড়ের সেই দুরতিগম্য স্থানকে বর্ণনা করেছেন এইভাবে—‘‘শ্রীহরির খিড়কীর পুকুরের পাড় ঘন জঙ্গলে ভরা৷ বাঁশের ঝাড়, তেঁতুল, শিরীষ প্রভৃতি গাছ এমনভাবে জন্মিয়াছে যে দিনেও কখনো রৌদ্র প্রবেশ করে না৷ নিচেটায় জন্মিয়াছে ঘন কাঁটাবন৷ চারিদিকে উই-ঢিবি৷ এই উইগুলির ভিতর নাকি বড় বড় সাপ বাসা বাঁধিয়াছে৷ শ্রীহরির খিড়কির পুকুর সাপের জন্য বিখ্যাত৷ বিশেষ চন্দ্রবোড়া সাপের জন্য৷ সন্ধ্যার পর হইতেই চন্দ্রবোড়ার শিস শোনা যায়৷’’২৮৯ সেই দুর্গম স্থান নির্ভয়ে নিশাচরীর মতো অতিক্রম করে উপস্থিত হয় অনিরুদ্ধর বাড়ি৷ সেখানে তার সংবাদ পেশ করেই আবার সেই জঙ্গল পথেই উপস্থিত হয় শ্রীহরির বৈঠকখানায়৷ জমাদারের তীব্র যৌনপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে পায়ে বেলকুড়ির কাঁটা দিয়ে সর্পদংশনের মত ক্ষতস্থান তৈরি করে তাদের গিয়ে জানায় তাকে সর্পদংশন করেছে৷ তার সুদক্ষ অভিনয় দিয়ে সকলকে তটস্থ করে তোলে৷ সকলে এসে দেখে যায় কৃত্রিম সর্পবিষে জরাজীর্ণ দুর্গাকে৷ কিন্তু দুর্গার সতৃষ্ণ চোখে দেবু ও যতীনের প্রতীক্ষা৷ যতীন না হয় নজরবন্দি কিন্তু দেবু তো নয়৷ অভিমানে তার চোখ ফেটে জল আসে৷ প্রবল অভিমানে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থেকে একসময় শুনতে পায় জামাইপণ্ডিতের কন্ঠস্বর৷ তাকে দেখে অভিমানাহত দুর্গা বলে—‘‘যদি এতক্ষণে মরে যেতাম জামাই-পণ্ডিত!’’২৯০ দুর্গার সাপেকাটার কৃত্রিম অভিনয় দেবুর জানা ছিল না কিন্তু যে বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সে তাদের সকলকে ভয়ঙ্কর আইনিপীড়নের হাত থেকে বাঁচিয়েছে তাতে দুর্গার প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই৷ যতীন সেখান থেকে ফিরে দুর্গার কথাই ভাবতে থাকে৷ তার মনে হয় দুর্গা বিচিত্র, দুর্গা অতুলনীয় এবং দুর্গা অদ্ভুত৷ বিলু সব কথা শুনে তার সম্পর্কে মন্তব্য করে বলে—‘‘গল্পের সেই নক্ষহীরে বেশ্যার মত—দেখো তুমি, আসছে জন্মে ওর ভাল ঘরে জন্ম হবে, যাকে কামনা করে মরবে সে-ই ওর স্বামী হবে৷’’২৯১ ঠিক সেই সময় পণ্ডিত মহমহোপাধ্যায় শিবশেখর ন্যায়রত্ন পদার্পণ করে তার বাড়িতে৷ সে উচ্চস্বরের ধার্মিক মানুষটিকে আপ্যায়ন করতে গিয়ে সে দুর্গার বিপদের কথা শুনেও তাকে দেখতে যেতে পারেনি৷ অনেক পরে জনসমাগম কমে গেলে সে উপস্থিত হয়েছিল দুর্গার বাড়ি৷

দুর্গার সমস্ত চালাকি পরে বুঝতে পারে ধুরন্ধর ছিরু পাল৷ সে তার প্রতিশোধ নিতে দেবু, অনিরুদ্ধ প্রমুখের গাছ কেটে নেয়৷ প্রতিবাদ করতে গেলে আহত হয় দ্বারিক চৌধুরী এবং দেবু৷ ছিরু পালের উপর প্রতিশোধ নিতে অনিরুদ্ধ তার শখের বাগান তছনছ করে দেয়৷ কিন্তু সেই অপরাধে দেবু গ্রেপ্তার হলে সকল দোষ স্বীকার করে অনিরুদ্ধ এবং দেবুর বদলে নিজে গ্রেপ্তার হয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করে৷ দুর্গাও পুলিশের রিপোর্টের ভিত্তিতে তলব পেয়ে থানায় উপস্থিত হয়৷ ইন্সপেক্টার তাকে দাগি বদমায়েশদের সঙ্গে সংশ্রবের কারণে সাবধান করে দিলে সে পুনরায় তার বিচক্ষণতা দিয়ে শ্রীহরির মতো শয়তানদের কথাই তুলে ধরে, তার সঙ্গে জমাদারবাবু, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ইত্যাদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথাও ব্যক্ত করে৷ যেমন—‘‘আজ্ঞে হুজুর, আমি নষ্ট-দুষ্ট—এ কথা সত্যি৷ তবে মশায়, আমাদের গাঁয়ের ছিরু পাল—৷ জিভ কাটিয়া সে বলিল—না, মানে ঘোষ মহাশয়, শ্রীহরি ঘোষ, থানার জমাদারবাবু, ইউনান বোর্ডের পেসিডেনবাবু—এঁরা সব যে দাগী বদমাস নোক—এ কি করে জানব বলুন৷ মেলামেশা আলাপ তো আমার এঁদের সঙ্গে৷’’২৯২ তার কথাশুনে ইন্সপেক্টর তাকে ধমকে দিলে অকুতোভয় দুর্গা তার কথাকে শেষ না করে থামে না৷ সে বলে—‘‘আপনি ডাকুন সবাইকে—আমি মুখে মুখে বলছি৷ এই সেদিন রেতে জমাদার ঘোষ মশায়ের বৈঠকখানায় এসে আমোদ করতে আমাকে ডেকেছিলেন—আমি গেছলাম৷ সেদিন ঘোষ মশায়ের খিড়কীর পুকুরে আমাকে সাপে কামড়েছিল—পেরমাইছিল তাই বেঁচেছি৷ রামকিষণ সিপাইজি ছিল, ভূপাল থানাদার ছিল৷ শুধান সকলকে৷ আমার কথা তো কারু কাছে ছাপি নাই৷’’২৯৩ দুর্গা তার কথার মধ্য দিয়ে জমাদার-শ্রীহরির গোপন সখ্যতাকে অত্যন্ত সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছে৷

গ্রামে দেখা দেয় মহামারী৷ প্রথম কলেরা হয় উপেনের৷ দুর্গা মৃত্যুভয়কে তোয়াক্কা না করে সেখানে উপস্থিত হয় তার সেবা করতে৷ পরে সেখানে যোগ দেয় দেবু৷ ধীরে ধীরে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে৷ দেবু তাদের সেবায় উদয়স্ত আত্মনিয়োগ করে৷ দুর্গা নিজের টাকা ধার দিয়ে নিজেই দেবুর ঋণ জংশনের দোকানে গিয়ে পরিশোধ করে আসে৷ দেবুর আর দুর্গার প্রতি কোনো রাগ নেই, ঘৃণা নেই, বিরক্তি নেই৷ সে দেহব্যবসায়ী হয়েও তার কর্মনিষ্ঠা, পরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ইত্যাদির দ্বারা মন জয় করে নিয়েছে দেবুর৷ বিচক্ষণ দুর্গা তার অত্যন্ত পছন্দের মানুষ দেবুর অকাতরে কলেরা রোগীর সেবায় নিয়োজিত দেখে আঁতকে উঠে৷ কি জানি কখন বা সেই মারণ ব্যাধির আক্রমণে তার জীবনে সংকট নেমে আসে৷ সে স্থির থাকতে না পেরে বিলুকে সাবধান করে দিয়ে বলে—‘‘একটুকুন শক্ত হও বিলু-দিদি, জামাই-এর একটু রাশ টেনে ধর৷ নইলে এই রোগের পিছুতে ও আহারনিদ্রে ভুলবে, হয়তো তোমাদের সর্বনাশ—নিজের সর্বনাশ করে ফেলবে!’’২৯৪ নিজের সর্বনাশই করে দেবু৷ সেই মারণব্যাধির ছোঁয়াচে প্রাণ হারায় খোকা ও বিলু৷ দেবু সংসারে একা হয়ে গেলে তার শোকনিমজ্জিত সান্ত্বনাহীন চিত্তদাহ দুর্গার অন্তকরণকেউ স্পর্শ করে৷ দুর্গার ভেতরকার চপল পুরুষভোলানো স্বৈরিণী নারীচিত্তটি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়৷ যে দুর্গা তার এত লোভ কামনা নিয়ে একে একে সকলকে বশ করার অভিলাষে আত্মমগ্ন সেই দুর্গা যেন দেবুর আসন্ন বিপর্যয়ে বিলুদিদি ও খোকার অকালমৃত্যুতে নিজেও মরে গেছে৷ তার বদলে জন্ম নিয়েছে আশ্চর্য রকমের শান্ত এক নারী৷ যে উদ্ধতভঙ্গিতে সে সমাজের কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করতো না, কারও ধার ধারতো না সেই দুর্গাই সংস্কারের চাপে বাঁধা পড়ে বিলু ও খোকার মৃত্যুর পর খুব বেশি আর দেবুর বাড়িতে যেতে পারে না৷ দেবু সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে জানায়—‘‘গাঁয়ের লোককে তো জান জামাই! এখন আমি বেশী গেলে-এলেই—তোমাকে জড়িয়ে নানান কুকথা রটাবে৷’’২৯৫ সে নিজে না গেলেও দেবুর ঘরে নিয়মিত দুধ পৌঁছে দিতে তার মাকে পাঠায়৷ তারই বন্দোবস্তে নিঃসঙ্গ দেবুর বাড়িতে তার দাদা পাতু গিয়ে রাত কাটায়৷

এভাবে ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে দেখা যায় দুর্গা ধীরে ধীরে নিজের স্বৈরিণীসত্তাকে ভুলে নারী হিসেবে আত্ম প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হয়৷

‘পঞ্চগ্রাম’-এ দুর্গার মধ্যে ভাঙা-গড়ার খেলা৷ বিলুর মৃত্যুতে পরিহাসপ্রিয় চপল স্বভাবের দুর্গা হঠাৎ শান্ত হয়ে গিয়েছিল ‘পঞ্চগ্রাম’-এ আবার সে ছন্দে ফিরতে থাকে৷ দেবুর বিপর্যস্ত সংসার, পদ্মর উন্মাদ নিঃসঙ্গ জীবনে সে-ই হয় প্রধান সহায়ক৷ এককালে অনিরুদ্ধের সঙ্গে মিতার সম্পর্ক পাতিয়ে শ্লেষ এবং ব্যঙ্গে বিদ্ধ করার জন্য পদ্মকে মিতেনি বলে সম্বোধন করেছিল তখন প্রচণ্ড ঘৃণায় তাকে অপমানে জর্জরিত করতো পদ্ম৷ কিন্তু অনিরুদ্ধ চলে যাওয়ার পর সেই সম্বন্ধটাই হয়েছে পরম সত্য৷ দুর্গা তার প্রতি প্রবল মমতায় দেবু ঘোষের কাছে তার হয়ে দরবার করেছে৷ কীভাবে অভিভাবকহীন সংসারে ছিরু পালের কামুক দৃষ্টি থেকে পদ্ম রক্ষা পাবে সেটাই ছিল দুর্গার প্রধান চিন্তা৷ দেবু তার খাওয়া-পরার ভার নিতে রাজী হলেও তার দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে অপারগ৷ কারণ তার সদস্যহীন সংসারে একা পদ্মবৌকে রাখবে সে কোন অধিকারে৷ একা পুরুষ মানুষ সে৷ তার খাওয়াপরার দায়িত্বের কথা শুনেই দুর্গা নিশ্চিন্ত হয়েছে৷ সে জানে মেয়েরা কেন ভুল পথে চালিত হয়৷ কোন নিদারুণ পরিস্থিতিতে তারা যৌনব্যবসায় মেতে উঠে৷ দুর্গার দেবুকে বলা কথার মধ্যে সেই জীবনসত্যের প্রতিধ্বনি—‘‘—জান জামাই! মেয়েলোক নষ্ট হয় পেটের জ্বালায় আর লোভে৷ ভালবেসে নষ্ট হয় না—তা নয়, ভালবেসেও হয়৷ কিন্তু সে আর ক’টা? একশোটার মধ্যে একটা৷ লোভে পড়ে—টাকার লোভে, গয়না-কাপড়ের লোভে মেয়েরা নষ্ট হয় বটে৷ কিন্তু পেটের জ্বালা বড় জ্বালা, পণ্ডিত৷ তুমি তাকে পেটের জ্বালা থেকে বাঁচাও৷’’২৯৬ সে দেবুকে বলে শুধু তার অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করেই খান্ত হয়নি সে চেষ্টা করেছে তার কর্ম সংস্থানের৷ কারণ পদ্মকে সাহায্য করতে গিয়ে দেবু ও পদ্ম দুজনকেই সামাজিক কুৎসা ভোগ করতে হবে জেনে সে পুনরায় তাকে অনুরোধ করে বলেছে—‘‘কামার-বউকে কিছু ধান ভানা-কোটার কাজ দেখে দাও, জামাই৷ একটা পেট তো, ওতেই চলে যাবে৷ তারপর যদি কিছু লাগে তা বরং তুমি দিও৷’’২৯৭ শুধু পদ্ম, দেবুই নয় গ্রামের বৃদ্ধা রাঙাদিদির শেষ সময়ে অস্পৃশ্য হয়েও সে সামনে থেকেছে, মাকে দিয়ে দুধ পাঠিয়ে দিয়েছে৷ তারপর রাঙাদিদির মৃত্যু হলে সেই মৃত্যুকে শ্রীহরি পাল (পরে যে নিজের পদবি পাল্টে ঘোষ করেছিল) ও জমাদারবাবুরা খুন বলে প্রতিপন্ন করে যখন দেবু, দুর্গা, পদ্মকে যারপরনাই হেনস্তা করতে থাকে তখন সে গ্রামের প্রধান ধনী শ্রীহরি ঘোষকে পাল বলে তাচ্ছিল্য করে৷ তা নিয়ে জমাদারবাবু তাকে ধমকে দিলে দুর্গা তার স্বভাবসুলভ সপ্রতিভতায় তৎক্ষণাৎ জবাব দেয়—‘‘লোকটি যে এককালে আমার ভালবাসার লোক ছিল, তখন পাল বলেছি, তুমি বলেছি, মাল খেয়ে তুইও বলেছি৷ অনেক দিনের অভ্যেস কি ছাড়তে পারি জমাদারবাবু? এতে যদি তোমাদের সাজা দেবার আইন থাকে দাও৷’’২৯৮ দুর্গা এমন একটা চরিত্র যে তার স্বৈরিণীবৃত্তিকে ধরে রেখেও নানা খল ইতর মানুষের সঙ্গে মিশেও তা সুমনোবৃত্তিকে কখনো দমিত করেনি৷ বরং ভালো মানুষগুলিকে বুক দিয়ে আগলে রেখে খারাপ মানুষগুলির প্রতিস্পর্ধী হয়েছে৷

দেবুর চোখে দুর্গা ধীরে ধীরে তার দেহব্যবসার কলুষতা ছাপিয়ে অন্যমাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়৷ তাকে নিয়ে ছিরুপালের চক্রান্তে কর্দম লিপ্ত হয়েছে দেবুর নামে৷ দুর্গা সেই কুৎসাকে ভয় পায় না বরং আনন্দিতই হয়৷ দেবু ছিরুকে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য দুর্গাকে অনুরোধ করে তার বাড়িতে থাকতে৷ অন্তত পঞ্চায়েত যতদিন না বসে ততদিন পর্যন্ত৷ সে যখন দুর্গাকে তার বাড়িতে থাকতে বলে ঘরদোর ঝাঁট দেওয়া, নিকোনো, দেখাশোনা করা ইত্যাদি কাজের কথা বলে এবং বিনিময়ে পয়সাও দিতে চায় তার সে কথায় চাবুক খাওয়া ঘোড়ার মত সচকিত হয়ে ওঠে দুর্গা৷ সে স্বাধীনবৃত্তির শৌখিন নারী৷ রূপের গরবে বহু পুরুষ তার পদানত৷ দাসীর কাজ বা ভিক্ষাবৃত্তিতে তীব্র ঘৃণা তার৷ গ্রামে ঝড় হলে সকলে যখন গাছের ডাল, পাতা কুড়োতে মত্ত হয়ে যায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য দুর্গা আলস্য চোখে তা শুধু দেখে৷ ওসব কাজ তার দ্বারা হয় না৷ আজীবন সে লাকড়ি কিনে জ্বালানি করে৷ নিজের ঘর ঝাঁট দেওয়ার কাজও সে করায় তার ভ্রাতৃবধূকে দিয়ে৷ বিনিময়ে প্রত্যহ সে পায় একসের করে চাল৷ তাই দেবুর সে কথায় সঙ্গে সঙ্গে সে প্রতিবাদ করে বলে ঝিয়ের কাজ সে করতে পারে না৷ পরক্ষণেই দেবু সামলে নেয় নিজেকে৷ সে যে আর দুর্গাকে ঘৃণা করে না, আর জাতপাত মানে না৷ দুর্গা তার মা বোনের চেয়ে কম নয়৷ সমস্ত সময়-অসময়ে গ্রামের অন্যলোকেরা যখন ছিরুপালের ভয়ে তার প্রতি অন্যায় হলে মুখ বুঝে থাকে তখন দুর্গা একক প্রতিবাদে তাকে আগলে রাখে৷ কোনোভাবেই সে দেবুর সঙ্গ ছাড়েনি৷ তাই দেবু তার হাতে জল খেতে চায় কিন্তু দুর্গা তাকে তা দিতে পারে না৷ দেবু তো আর সব মানুষের মতো তার শরীরলোভী নয়, দেবু পাথরের মত দিনের পর দিন তার ভালোবাসা উপেক্ষা করেছে, কোনো দিন কোন কামনাপূর্ণ অভিব্যক্তিও সে তার চোখে দেখেনি৷ সেই দেবু তার মতো স্বেচ্ছাচারিণী মুচিকন্যার হাতে জল খেতে চাইলে দুর্গা আঁতকে উঠে—‘‘—না৷ সে আমি পারব না জামাই-পণ্ডিত৷ আমার হাতের জল কঙ্কণার বামুন-কায়েত বাবুরা নুকিয়ে খায়, মদের সঙ্গে জল মিশিয়ে দিই, মুখে গ্লাস তুলে ধরি—তারা দিব্যি খায়৷ সে আমি দিই—কিন্তু তোমাকে দিতে পারব না৷’’২৯৯

গ্রামে বন্যার সময় বাঁধ রক্ষা করতে গিয়ে দেবু জলের তোড়ে ভেসে গিয়ে চরমভাবে আহত হলে উৎকন্ঠিত দুর্গা বন্যার জল উপেক্ষা করে এগিয়ে যায় দেবুর খোঁজ নিতে৷ দেবুর সংবাদের জন্য তার অন্তরের হাহাকার সাধ্বী প্রণয়িনীকেও হার মানায়৷ গ্রামের মানুষেরা জলের হাত থেকে বাঁচতে চণ্ডীমণ্ডপে ও ছিরুপালের বাড়িতে উপস্থিত হলে তাদের শুধু নিজেদের জন্য ভাবনা দুর্গাকে পীড়া দেয়৷ দেবুর অতবড় বিপদেও গ্রামের মানুষজন যে একবারও তার কথা জিজ্ঞেস করছে না সেই স্বার্থরূপ দেখে তার অন্তকরণ দুঃখে ভেঙে যায়৷ সে এককভাবে শুধু প্রার্থনা করতে থাকে সে যেন ভাল থাকে৷ তারপর বাঁধরক্ষা করতে যাওয়া ইরসাদের দল ফিরে এলে হঠাৎই যেন মৌচাকে ঢেলা নিক্ষেপ হয়৷ গ্রামবাসী সকলেই যেন হঠাৎ করে দেবুর জন্য সচকিত হয়ে ওঠে৷ সকলের মুখে শুধু একটাই প্রার্থনা—‘‘বাঁচিয়ে দাও মা, তুমি বাঁচিয়ে দাও৷’’৩০০ দুর্গাও তাদের সঙ্গে অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে প্রার্থনা করতে থাকে৷ মা কালীকে জোড়া পাঁঠা মানত করে শুধুমাত্র দেবুর প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে৷ এখানেও মানত-বিশ্বাসের মধ্যে দুর্গার স্বৈরিণীসত্তা চাপা পড়ে নারীসত্তা বেরিয়ে এসেছে৷ দেবু আহত অবস্থায় দেখুরিয়া গ্রামে তিনকড়ির বাড়িতে চিকিৎসাধীন থাকলে দুর্গা তাকে প্রত্যহ গিয়ে দেখে এসেছে৷ তিনকড়ির মেয়ে স্বর্ণ দেবুর সেবাযত্নের ভার নিলে দুর্গা তার বাড়িঘর তদবির করেছে৷ এছাড়া ন্যায়রত্ন ঠাকুরের নাতি বিশ্বনাথ পৈতে ছিঁড়ে তার ব্রাহ্মণত্বকে অস্বীকার করলে ন্যায়রত্ন ঠাকুরের জন্য তার যেমন দুঃখে হৃদয় আদ্র হয়েছে—তেমনি বিশ্বনাথের চিরতরে গ্রাম ত্যাগ করে যাওয়া, দ্বারিক চৌধুরীর বাস্তুদেবতা বিক্রি করা এবং এই মানুষগুলির পরিবেশ পরিস্থিতি, বাধ্যবাধকতা দুর্গার হৃদয়কে ব্যথিত করেছে৷ সমাজের সকলের দুঃখ কষ্ট ভালোমন্দ সে যেন দরদ দিয়ে অনুভব করতে পারে৷

দুর্গা হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে অনেকবার দেবুকে তার হৃদয়ের অভিব্যক্তি জানিয়েছে৷ সে শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে দেবু পাথর দিয়ে গড়া৷ পদ্মবৌকেও সে কথা বলেছে অনেকবার৷ দেবুকে কাছ থেকে, দেখে ও তাকে সেবা করার মধ্য দিয়ে দেবুর সবটুকু বুঝেছিল সে৷ দেবুই তার জীবনের আদর্শ হয়ে উঠেছিল৷ সত্যকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা দুর্গার দুর্দান্ত৷ দেবুও সেই সত্যেরই সেবক৷ দেবুর কাজে আত্মনিয়োগ এবং তাকে ইহজন্মে পাওয়ার প্রত্যাশা না করে শুধু ভালোবাসাই দুর্গার হৃদয়ের নিকষিত-হেম প্রেম৷ দেবু তার প্রেমকে উপেক্ষা করে তার প্রতি নিবেদিত দেহকে উপেক্ষা করে তাকে সত্যকার জীবনের সন্ধান দিয়েছে৷ দীর্ঘ প্রবাস যাপন করে ফিরে এসে সে যখন দুর্গাকে দেখেছে সে দুর্গা আর দুর্গা নেই৷ দেবু অবাক বিস্ময়ে দেখে গ্রামের ভিতর থেকে দুর্গা ছুটে আসছে—‘‘ক্ষারে-ধোওয়া একখানি সাদা থান কাপড় পরিয়া, নিরাভরণা, শীর্ণ দেহ, মুখের সে কোমল লাবণ্য নাই, চুলের সে পারিপাট্য নাই—সেই দুর্গা এ কি হইয়া গিয়াছে!’’৩০১ দুর্গার এই রূপ যেন শিবের তপসায় কঠিন ব্রতযাপনে অভ্যস্ত গৌরীর রূপ৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত শিব গৌরীর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে তাকে গ্রহণ করেছিল দুর্গার ভাগ্যে তা হয়নি৷ দান-ধ্যান পাড়ার অসুখে-বিসুখে-সেবায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে দুর্গা শেষ পর্যন্ত কিছুই পায়নি৷ দেবু তাকে কোনোদিন স্পর্শ পর্যন্ত করেনি—শুধু বিলু ভ্রমে নিজের অজ্ঞাতেই একদিন চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিয়েছিল তাকে৷ সেটা তো তাকে নয়—বিলুকে৷ গ্রামে ফিরে এসে দেবু নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছে স্বর্ণর হাত ধরে৷ সেখানেও দুর্গার প্রবেশাধিকার নেই৷ দেবু সেই ধনী-গরিবের জাত-পাতের ভেদাভেদহীন সমাজ ভাবনার স্বপ্নবিহ্বল মুহূর্তে সে শুধু ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিল—যদি কোনো দিন ছুত-অচ্ছুতের অচ্ছুত লুপ্ত হয়, ভালো-মন্দের মন্দ উঠে যায়—‘‘সে দিন যেন জামাই তোমাকে আমি পাই৷ বিলু দিদি মুক্তি পেয়েছে আমি জানি৷ স্বর্ণও যেন সেদিন মুক্তি পায়—নারায়ণের দাসী হয়৷ আমি আসব এই মর্ত্যে—তোমার জন্যে আসব, তুমি যেন এস৷ আমার জন্যে একটি জন্মের জন্যে এস৷ তোমার কথা আমি বিশ্বাস করলাম৷ করছি এই জন্যে৷ তোমাকে পাবার জন্যে৷’’৩০২ ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’-এ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নারী চরিত্র দুর্গা আর সবচেয়ে অবহেলিত হয়েছে দুর্গাই৷

দুর্গার মা :

দুর্গার মা-ও দুর্গার মতো দেহব্যবসায়ের মধ্য দিয়ে তার জীবন অতিবাহিত করেছে৷ দুর্গার মায়ের চরিত্র স্খলনের জীবন্ত প্রমাণ দুর্গা৷ মুচির ঘরে দুর্গার অমন রূপের আমদানি হয়েছে দুর্গার মায়ের বাবুদের সঙ্গে ব্যভিচারের ফলে৷ দুর্গার দাদা পাতু নিজেই তার মা সম্পর্কে দ্বারকা চৌধুরীকে বলেছে—‘‘আমার মা-হারামজাদীকে তো জানেন? হারামজাদীর স্বভাব আর গেল না!’’৩০৩ দুর্গার স্বেচ্ছাচারের জন্য অনেকে দায়ী করে তার মাকেই৷ সে-ই নাকি মেয়েকে স্বামী পরিত্যাগ করিয়ে দেহবৃত্তির পথে টেনে এনেছে৷ কিন্তু আসল কারণ অন্য৷ শাশুড়ির চক্রান্তে পাঁচটাকার বিনিময়ে সতীত্ব খুইয়ে দুর্গা যখন সোজা মায়ের কাছে উপস্থিত হয় তখন সব শুনে তার মায়ের চোখের সামনে সহসা এক উজ্জ্বল আলোকিত পথ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে৷

দুর্গার দেহব্যবসায়ের রোজগারে তার মায়ের জীবন চলে৷ মেয়ের সেই পেশা নিয়ে তারও কোনো রাখঢাক নেই৷ শ্রীহরির চক্রান্তে তাদের ঘর পুড়ে গেলে নতুন ঘর করার জন্য টাকার প্রয়োজন৷ গোরুর পাইকার হামদু স্যাখের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা ঘুষ নিয়ে মেয়েকে গোরু বেচার জন্য প্ররোচিত করলে তাকে আক্রমণ করে তার মেয়ে৷ তাদের মা মেয়ের ঝগড়ার মধ্যেও নিম্নশ্রেণীর অমার্জিত জীবনের ছাপ স্পষ্ট৷ দুর্গার দেহব্যবসার পসার নিয়ে তার মায়ের আহ্লাদের শেষ নেই৷ ছেলে পাতু যখন অকর্মণ্য হয়ে ঘরে থাকে তখন তার মা-ই তাকে উৎসাহ দেয় দুর্গার দেহপসারের সহায়ক হয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে যাওয়ার জন্য৷ সেখানে দুর্গা তার উপার্জিত অর্থের ভাগ তো দেয়-ই বকশিশও আদায় করে দেয় বাবুদের কাছ থেকে৷ কিন্তু দেবুর প্রতি অনুরক্ত হয়ে যখন সে অর্থ উপার্জনে ঢিলেমি দেয় তখন দুর্গার মায়ের আক্ষেপের শেষ থাকে না৷ এই অনুরাগের জন্যই যে তার হতভাগী মেয়ে হাতের লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলে তার রূপের অপব্যবহার করছে তাতে তার দুঃখের আর শেষ নেই৷ কঙ্কণার বাবুদের মালীরা অনেকদিন যাতায়াত করে অবশেষে বন্ধ করে দিয়েছে৷ তারা আর খোঁজ নেয় না৷ কন্যার উপার্জনে তার কোনো স্বার্থ নেই৷ দু-মুঠো ভাত হলেই চলে যায় তার তবু আক্ষেপ; মেয়ের রাজ-রাজেশ্বরী সম্পদ দেখে যেতে পারলো না সে৷

পাতুর বৌ :

উপন্যাসের কাহিনি প্রসঙ্গে হরিজনপল্লীর দুর্গার পরিবারকে বিশেষভাবে সামনে আনা হয়েছে৷ অন্ত্যজ হরিজনদের জীবনধারায় সতীত্বের কোনো বাছ-বিচার নেই৷ পাতুর বৌও স্বৈরিণী৷ তাকে নানা স্থানে ‘বেড়ালের মতো’ চলনভঙ্গির উপমায় উপমিত করেছেন রচনাকার৷ পাতু যখন দুর্গার সাগরেদ হয়ে নানা স্থানে রাত কাটাতে থাকে সেই অবসরে সে দক্ষতা অর্জন করে তার পতিতাবৃত্তিতে৷ অক্লান্ত পরিশ্রমী সে৷ একসময় দুর্গা এবং পাতুর বৌ-এর রোজগারেই তাদের পরিবার প্রতিপালিত হতে থাকে৷ হরেন ঘোষালের অবৈধ সন্তান গর্ভে ধারণ করেও সেই সন্তানের প্রতি তাদের সমাজের কারও অবহেলা থাকে না৷

এছাড়া উপন্যাসে বন্যার জন্য সাহায্য গ্রহণ কে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে গোঁসাইবাবার প্রসঙ্গ৷ যার বৃহৎকর্ম যজ্ঞকে এক খেমটাওয়ালির দ্বারা পণ্ড করে দিয়েছিল সেখানকার ধনীবাবুমশাইরা৷ ঘটনাটা অনেকটা তপস্বীদের অপ্সরা দ্বারা তপস্যাভঙ্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷

গৃহত্যাগী অনিরুদ্ধ বহুদিন পর গ্রামে ফিরে এলে তার কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে আরেক বারবনিতা চরিত্র৷ সেই পণ্যাঙ্গনা ছিল অনিরুদ্ধর কর্মস্থলের (কারখানার) বৃদ্ধ খাজাঞ্চির অনুগৃহীতা৷ বৃদ্ধের টাকা পয়সার প্রতি তার আসক্তি ছিল প্রবল কিন্তু বৃদ্ধের প্রতি নয়৷ অনিরুদ্ধর সঙ্গে তার আগে থেকেই জানাশোনা ছিল৷ বৃদ্ধের সঙ্গে ঝগড়া করে মেয়েটি শহরে এসে দেহব্যবসা শুরু করলে পুনরায় তার নজরে পড়ে অনিরুদ্ধ কামার৷ সে তাকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়৷ একদিন বুড়ো খাজাঞ্চি তাকে নিতে এলে তাকে ঘৃণা করে অনিরুদ্ধকে নিয়ে পালিয়ে যায়৷ জেলের সাজা কাটিয়ে এই বারবনিতার কুহকী মায়ায় তার আর ঘরে ফেরা হয় না৷ সাবি নামের সেই বারাঙ্গনা অবশেষে অনিরুদ্ধকেও ধরে রাখেনি৷ সেটা বারবনিতার স্বভাবও নয়৷ অন্য আরেক পুরুষের হাত ধরে নির্দ্বিধায় চলে গিয়েছিল আরেক স্থানে৷ এই দেহজীবা নারী শুধুই রূপজীবা—তার অন্য কোনো উত্তরণ নেই৷

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বা বনফুল (১৮৯৯-১৯৭৯) :

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম ‘বনফুল’-এও সমধিক পরিচিত৷ তিনি বহু উপন্যাস রচনা করেছেন এবং সবক্ষেত্রেই তা একই ছাঁচে না ঢেলে টেকনিকগত পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছেন৷ এছাড়া তাঁর অন্য বিশেষত্ব হল—বিষয়-অবিচলতা, অপ্রগলভতা ও প্রযত্ন৷ লেখায় যেমন তিনি শৈথিল্যের প্রশ্রয় দেননি তেমনি চরিত্রচিত্রণের ক্ষেত্রেও রাখেননি ভাবাবেগের প্রাধান্য৷ পরিচিত স্থান-কাল-পাত্রের মধ্য থেকেই তিনি তাঁর রচনার বিষয়কে নির্বাচন করেছেন৷ ফলে সংসারের অভিজ্ঞতা ও জীবনের স্বচ্ছ অনুধাবনে তাঁর অঙ্কিত বারযোষিৎরা অনেক বেশি বাস্তবানুসারী হয়ে উঠেছে৷

বাংলা উপন্যাসের জগতে নবমাত্রা যোগ করেছেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বা বনফুল৷ তাঁর রচনায় পরিকল্পনার মৌলিকতা, আখ্যানবস্তু সমাবেশে বিচিত্র উদ্ভাবনী শক্তি, নানারূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে মানবচরিত্রের যাচাই, তীক্ষ্ণ মননশীলতা পাঠকের বিস্ময় উৎপন্ন করে৷ তিনি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস রচনা করতে যতটা আগ্রহশীল, তার অপেক্ষা স্বল্পতম উপাদানে ও ক্ষীণতম ভাবসূত্রের অবলম্বনে উপন্যাস জাতীয় সৃষ্টি সম্ভব কিনা তা প্রমাণ করতে অনেক বেশি বদ্ধপরিকর৷ তাঁর উপন্যাস সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন—‘‘উপন্যাসের কঙ্কালের উপর রক্ত-মাংসের একটি সূক্ষ্ণ আবরণ দিয়া, নিজের মনোধর্মী প্রাচুর্যের ফুৎকার-বায়ু উহার নাসারন্ধ্রে সঞ্চার করিয়া, যবনিকার অন্তরাল হইতে পুতুলবাজির নিয়ন্ত্রণ-সূত্র আকর্ষণ করিয়া, উহাকে জীবন্ত ও প্রাণশক্তিসমৃদ্ধ করা যায় কি না এই পরীক্ষাই তাঁহার উপন্যাস-রচনার মুখ্য প্রেরণা বলিয়া মনে হয়৷’’৩০৪

তাঁর চরিত্র চিত্রণে গণিকারা এক বিশেষ মাত্রা লাভ করেছে৷ জীবনের প্রতিকূলতায়, সমাজ পরিবেশের চাপে বা কখনো নিজের সাময়িক পদস্খলনকে কেন্দ্র করে সীমাহীন দুঃখ যন্ত্রণার পঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে কি নিদারুণ বেদনা ভোগ করে তারা তা তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন৷

ক. তৃণখণ্ড :

‘তৃণখণ্ড’ (১৯৩৫) উপন্যাসের কথক ডাক্তার৷ ডাক্তারি জীবন অভিজ্ঞতার নানা পথ বেয়ে নানা ধরনের মানুষ সে দেখে চলেছে৷ মানুষের মতো বিচিত্র তাদের রোগ৷

উপন্যাসের রূপোপজীবিনী আসমানী৷ জীবনের বসন্ত দিনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে এক যুবকের সঙ্গে গৃহত্যাগ করেছিল৷ ‘ঝাঁকড়া-ভুরু’, মিথ্যে সার্টিফিকেট চাওয়া লোকটি উপন্যাসের শেষ অংশে আসমানীর পরিচয় দান করেছে৷ সে আসমানীর বাবা৷ আসমানী ঘর ছাড়ার পর কীভাবে দেহব্যবসায়ের সাথে যুক্ত হল, ছেলেটিই বা তাকে ছেড়ে গেল কেন তার কোনো ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি উপন্যাসটিতে৷ আসমানীর প্রথম আবির্ভাব সিফিলিসের রোগী হিসেবে৷ যদিও তার সেই রোগ সম্পর্কে সে নিজে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং ডাক্তার সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক হয়ে প্রায় আন্দাজেই তাকে ঔষধের প্রেসক্রিপসনসহ একটি টাকা দিয়ে ঔষধ কিনতে বলেছিল৷ কারণ তার সর্বাঙ্গে বড় বড় চাকা চাকা ঘা, ফোলা নাক, ঠোঁটের কোণে সাদা ঘা, দুইটি লাল চোখ নিয়ে সে যখন ডাক্তারের কাছে আসে চিকিৎসা করানোর জন্য তখন সে সম্পূর্ণ কপর্দকহীন৷ ঔষধ কিনে খাওয়ার ক্ষমতাও সেদিন তার ছিল না৷

তারপর সে যখন আবার ডাক্তারের মুখোমুখি হয় তখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ৷ ডাক্তারকে নিজের ঠিকানা দিয়ে জানায় যে সে রংবাজারে থাকে৷ আসমানী রূপবতী৷ সে যখন পূর্বে ডাক্তারের কাছে এসেছিল তখন তার সেই রূপ কদর্য সিফিলিস রোগে চাপা পড়ে ছিল৷ তার অবহেলায় দেওয়া ঔষধ খেয়ে সুস্থ আসমানীকে দেখে বিস্ময় মানে ডাক্তার৷ সে যখন ডাক্তারকে জানায় যে সে ঔষধ কিনে খেতে সক্ষম তখন ডাক্তারের মনে হয়—‘‘বুঝিলাম রূপোপজীবিনী সে৷ স্বাস্থ্য ও রূপ যখন সে ফিরিয়া পাইয়াছে, তখন তাহার পয়সার অভাব কি?’’৩০৫ আসমানী যখন চলে যায় তখন সৎ ডাক্তারের মনে জাগ্রত হয় বিবেকবোধ৷ সে ভাবে ‘‘এমন একটা মোহিনী অগ্নি-শিখাকে সমাজে ছাড়িয়া দিয়া কি সৎকার্য করিলে! এ তো নিভিয়া গিয়াছিল প্রায়৷ আমি তো আবার তাহাকে জ্বালাইয়া তুলিলাম! উচিত হইল কি?’’৩০৬ ডাক্তারের বিবেক দংশন সমাজে একজন বারবনিতার অবস্থানগত দিকটিকে নির্দিষ্ট করে৷

তারপর আবার কিছুদিন পর আসামানীকে পুনরায় ডাক্তারের চেম্বারে দেখা যায়৷ সে ভয়ানক অসুস্থ৷ খুক খুক করে কাশতে কাশতে সে জানায় মাসখানেক থেকে জ্বরে ভুগছে সে—তার কাছের লোক তেমন কেউ নেই যাকে দিয়ে তাকে একটা খবর দেওয়াতে পারে৷ তাছাড়া ডাক্তার দেখানোর মতো আর্থিক সঙ্গতিও তার নেই৷ চরম অসুস্থতা নিয়েও তাই নিজেকেই উপস্থিত হতে হয়েছে৷ ডাক্তার তার সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বুঝতে পারে তার যক্ষা হয়েছে এবং পৃথিবীতে আর বেশিদিন তার পক্ষে থাকা সম্ভবও নয়৷ ঔষধ নিয়ে যখন সে পুনরায় কবে আসতে হবে তা জানতে চায় তখন ডাক্তার তাকে বারণ করে নিজে যেতে প্রতিশ্রুত হয়৷ সে ঠিকানা দিয়ে বলে ‘‘রং বাজারে সেই যে শিবমন্দিরটা আছে—তারই সামনের গলিতে আমার বাসা৷’’৩০৭

আসমানীর শরীর দিনকেদিন খারাপ হতে থাকে৷ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আবার তাকে আসতে হয় ডাক্তারের কাছে৷ ব্যাকুলতার সঙ্গে সুস্থ হওয়ার আর্জি জানায়৷ সে সঙ্গে নিয়ে আসে তার সমস্ত গয়নাপত্র৷ সেগুলি ডাক্তারকে দিয়ে বলে—‘‘কতদিন আর বিনা-পয়সায় আপনাকে কষ্ট দেব! সেবার এক শিশি ওষধ খেয়েই আমার সেরে গেল—এবারে সারছে না কিছুতে! আপনি বরং ভাল করে দেখে একটা ওষধের ব্যবস্থা করুন৷’’৩০৮ আসমানী পাঁচির মা বলে একজনের কাছে শুনেছে ‘বদ্যির কড়ি না দিলে ব্যামো সারে না!’’৩০৯ সে সুস্থ হতে চায়৷ নিজের মতো করে সুস্থ দেহ নিয়ে আবার বাঁচতে চায়৷ তার মারণ রোগ সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ৷ ডাক্তারও তার চাল-চুলোহীন একক জীবনে সেই নির্মম কথাটা তাকে বলার সাহস পায়নি যার জন্য তার মনে হয়েছে ডাক্তারবাবু হয় তো বিনাপয়সায় চিকিৎসা করছে জন্য তার চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছে না৷

তারপর আসমানীর জীবনের অন্তিম লগ্নে আসমানীর বদলে ডাক্তারের সামনে আসে আসমানীর বাবা৷ দীর্ঘদিন খুঁজতে খঁজতে অবশেষে সে সন্ধান পেয়েছে মেয়ের৷ মেয়ের জীবনের সেই শোচনীয় পরিণতিতে ঝরঝর করে কেঁদে উঠে তার বাবা৷ খেয়ালের বসে যৌবনের মদমত্ততায় নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে আসমানী দেহপোজীবিনীর নির্মম পেশায় আত্মনিয়োগ করার পর নিষ্ঠুর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে৷

এই উপন্যাসে আসমানী চারবার ডাক্তারের সামনে উপস্থিত হয়েছে৷ তার মধ্যে তিনবারই সে রোগী৷ মাঝের একবার সিফিলিস সারার পর পরামর্শ নিতে এসেছিল৷ এই ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যেও আসমানীর জীবনের এক বৃহৎ ক্যানভাস তৈরি করে ফেলেছেন৷ একজন দরিদ্র গৃহস্থ কন্যা ভালোবাসার মোহ ফাঁদে পড়ে কীভাবে দেহবিনোদনের কারখানা হয়ে কদর্য জীবন ও কদর্য রোগের শিকার হয়ে সংসার থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয় এ তারই গল্প৷

খ. বৈতরণী তীরে :

‘বৈতরণী তীরে’ (১৯৩৬) গ্রন্থে ডাক্তারি অভিজ্ঞতার এক ভয়াবহ দিক উদ্ঘাটিত হয়েছে৷ যারা একদিন আত্মহত্যার নানা জ্বালাময় পথে নিজের জীবনকে শেষ করে দিয়েছিল, শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে ডাক্তারি ছুরির শাণিত আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছিল, সেই মৃত আত্মারাই এক দুর্যোগময় রাত্রে ডাক্তারের স্মৃতি-সমুদ্র আলোড়িত করে তার চারিদিকে ভিড় জমিয়েছে৷ এদের মধ্যে প্রেতলোকের রহস্যবোধের পরিবর্তে মানবিক অন্তর্জ্বালা ও কৌতুহলই বেশি পরিমাণে ফুটে উঠেছে৷ এই মৃত প্রাণগুলির মধ্যে একজন দেহপসারিণী নারী৷ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল সে৷ ‘‘খুলে দাও, বাঁধনটা খুলে দাও আমার—’’৩১০ বলতে বলতে সে হাজির হয় উপন্যাসের কথক ডাক্তারের সামনে৷ বিভৎস তার চিত্র৷ রক্তাক্ত চোখ দুটি যেন ঠিকরে বের হয়ে আসছে—গলার দড়িটা শক্ত করে বাঁধা৷ তার পর সে শুরু করেছে তার জীবনের বিচিত্র পুরুষ সম্ভোগের অভিজ্ঞতা৷ তাহার রূপপূর্ণ শরীরটিকে হিন্দু, মুসলমান, জৈন, খ্রিস্টান, বালক, বৃদ্ধ, যুবা সকলেই খাবলে খেয়েছে৷ ধনী টাকা দেখিয়েছে৷ কবি কবিতা লিখেছে, বলী বল প্রকাশ করেছে তার উপর৷ আর যার কিছু নেই সে অসহায় মিনতি করে পান করেছে তার তীব্র রূপসুধা৷ তারপর পরম কৌতুহলে সত্যিকারের প্রেম কি ও কেমন সে সম্পর্কে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছে—‘‘ছাপা কেতাবে যে সব প্রেমের গল্প লেখা থাকে সে সব কি সত্যি? ওরকম কি হয়! আমার জীবনে আমি তো দেখেছি পুরুষগুলো আমাকে নিয়ে লোফালুফি করেছে! আমি যেন একটা ফুটবল—আমায় ঘিরে সুদক্ষ একদল খেলোয়াড়; সবারই লোলুপ দৃষ্টি আমার ওপর—কিন্তু আমাকে কাছে পাওয়া মাত্র লাথি মেরে তারা দূর করে দিয়েছে! দূর করে দিয়ে আবার ছুটেছে আমার পেছনে আমাকে ধরবে বলে! একি আশ্চর্য ব্যাপার বলুন তো!’’৩১১ তার এই কথার মধ্য দিয়ে নারীদেহ লোলুপতার চূড়ান্ত একটি ছবি ফুটে উঠেছে—যেখানে প্রেম নেই ভালোবাসা নেই—আছে শুধু শরীর আর সেই শরীরকে ভোগ করার উদগ্র কামনা৷

সেই গলায় দড়ি দেওয়া রূপোপজীবিনীর প্রেত তারপরে শুরু করেছে নিজের জীবনের গল্প৷ এক সুকুমারী সত্তা থেকে বিভৎস হয়ে উঠার কাহিনি৷ নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণবংশের কন্যা সে৷ দরিদ্র হলেও তার মায়ের নিষ্ঠার কারণে যথেষ্ট খাতিরও ছিল তাদের৷ নয় বছর বয়সে এক ধনী যুবকের ঘরে তাকে গৌরীদান করে অসীম পুণ্য অর্জন করেছিল তার মা৷ গৌরীর মতো রূপবতী সেই সুকুমারী বালিকার স্বেচ্ছাচারী বিলাসী যুবকস্বামীর হাতে পড়ে দুর্দশার অন্ত্য থাকে না৷ তার স্বামীর কাছে তার রূপের কোনো দাম ছিল না—সে মদ্যপ ও গণিকাসক্ত৷ সে শুধু স্বামীর উপস্থিতি তখনই টের পেত যখন তার দুর্গন্ধযুক্ত বমি পরিষ্কার করতে হতো তাকে৷ তাই সে আক্ষেপ করে ডাক্তারকে বলেছে—‘‘কোনও গরিবের হাতে পড়লে বোধ হয় আমার এ দুর্দশা হত না!’’৩১২ যাইহোক সমস্ত বিষয় সম্পদ মদ ও বেশ্যাবাজিতে উড়িয়ে তার স্বামী যখন পচা লিভারটা নিয়ে স্বর্গে চলে যায় তখন আরেক যন্ত্রণা তাকে সবলে গ্রাস করে তা হল অর্থযন্ত্রণা৷ বৈধব্য জীবনের চরম যন্ত্রণা বোঝাতে সে তাই সতীদাহের সমর্থন করে বলে—‘‘আমাদের দেশে সতীদাহ প্রথাই ঠিক ছিল—স্বামীর সঙ্গে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলত—বাস নিশ্চিন্ত! এ রকম দগ্ধে দগ্ধে মরতে হত না! এই দেশে কখনও সতীদাহ প্রথা লোপ পেতে পারে? আজও এ দেশের ঘরে ঘরে বিধবা সতীরা পুড়ে মরছে৷ আগুনের চেহারাটা শুধু বদলেছে৷ আগে ছিল চিতানল—এখন হয়েছে তুষানল৷’’৩১৩ কি সুকঠিন বাক্য এই বারবনিতার৷ তার মধ্য দিয়ে লেখক সমাজকে যেন নগ্ন কুৎসিতরূপে তুলে ধরতে চাইছেন সকলের সামনে৷ বিধবা, নিঃসম্বল তাতে রূপবতী৷ জীবনে তার কোনো উপায়ই নেই৷ একদিকে চরম মৃত্যু আরেকদিকে হিংস্র স্বাপদদের লোলুপ দৃষ্টি৷ কিন্তু মৃত্যুকে বরণ করতে পারে কজন! সেও পারেনি৷ বৈধব্যের তৃষিত দাহকে সে শান্ত করেছে তার স্বামীর মামাতো ভাইকে দিয়ে৷ সে-ই প্রথম দেহের বিনিময়ে চেষ্টা করেছিল প্রেম দিতে৷ তার পর তার জীবনে এসেছে তুষানল অর্থাৎ অতৃপ্ত ভালোবাসাকে ভরাতে চেয়েছিল জল বা প্রেম দিয়ে কিন্তু সে প্রেম সে কারও কাছে পায়নি৷ তাই মর্ত্যলোকই তার কাছে নরক হয়ে উঠেছিল৷ তার কথায়—‘‘সে নরক আমি গুলজার করেও তুলেছিলাম!’’৩১৪ সেই বারবনিতা ভেবে পায় না কি করে তার সামান্য দেহটা দিয়ে অতলোককে মুগ্ধ করতে পেরেছিল—অত শত শত লোকের প্রবৃত্তির জ্বালা মিটিয়েছিল৷ বিনোদিনী থেকে সে হয়ে উঠেছিল সকলের বিন্দিবাইজি৷

গণিকা নারীদের টাকার বিনিময়ে প্রেম দেওয়া-নেওয়া চলে৷ বিনোদিনী তার সম্পূর্ণ জীবনে সামান্য ভালোবাসাও পায়নি—ভালোবাসার মতো কোনো মানুষও খুঁজে পায়নি কিন্তু টাকার লোভে তাকে যে কত ভালোবাসার ভান করতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই৷ তাই সে বলে—‘‘জীবনে আমার সব চেয়ে বেশি দুঃখ কি জানেন? কাউকে ভালোবাসি নি৷ ভালবাসবার মতো কেউ আমার কাছে আসে নি৷ অথচ টাকার লোভে অহরহ ভালবাসার ভান করতে হয়েছে!’’৩১৫ পুরুষের প্রবৃত্তি বর্ণনা করে সে বলেছে যে তারা ঘরে সতী স্ত্রী ফেলে চলে আসে তাদের মতো বারাঙ্গনার কাছে—নিজেদের স্ত্রীর একনিষ্ঠতা সেবা কোনোকিছুরই দাম নেই তাদের অথচ সেই একনিষ্ঠতা, সেই ভালোবাসা তারা দাবি করে বারবনিতার কাছ থেকে যদিও তাদের অজ্ঞাত নয় যে তারা অসতী—বহুপরিচর্যাকারিণী৷ তার স্বামীও একদিন তার সেবা নিষ্ঠাকে উপেক্ষা করে দেহপসারিণীর ভালোবাসায় উন্মুখ হয়ে থাকতো আর আজ সে যখন গণিকা তখন তার স্বামীর মতো বহু মানুষ তার কাছে সেই একনিষ্ঠতা সেবা দাবি করতে আসে৷ তাই সে বলে—‘‘পুরুষদের ষোল-আনা লোভ এই অসতী মেয়েগুলোর প্রতি!—অসতী জেনেই তারা আমাদের কাছে আসে অথচ এসেই একনিষ্ঠতা দাবি করে বসে৷ আর আমারও টাকার লোভে একনিষ্ঠতার অভিনয় করতে থাকি৷’’৩১৬

বিন্দির মধ্যে ছিল পরিশুদ্ধ প্রেমের প্রত্যাশা৷ যে প্রেম অন্তরের ধারায় উদ্বেল হয়ে উঠবে৷ সে প্রেমকে সে খুঁজে পায়নি৷ কদর্য দেহকামনায় তার পুষ্পিত প্রেমের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল৷ গলায় দড়ি দিয়ে প্রেমহীন জীবনের নিষ্ঠুরতা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল৷ মৃত্যুর পরেও চলে তার সেই প্রেম অন্বেষণ৷ সে বার বার ডাক্তারের সামনে জল প্রত্যাশা করেছে৷ সেই জল তার প্রেমের প্রতীকীরূপ৷ সেখানেই প্রেত রূপে অবস্থানকারী বোমার দলের ছেলেটিকে দেখে অবশেষে প্রেমকে খুঁজে পেয়েছে৷ সে তার নব প্রেমের অভিব্যক্তি জানিয়ে ডাক্তারকে বলেছে—‘‘জীবনে প্রেমের আবির্ভাব হলে ক্ষুদ্র জলাশয় সমুদ্র হয়ে ওঠে৷ লোহা সোনা হয়ে যায়৷ সেদিন সেই যে ছেলেটি দেখলাম আপনার কাছে—কোথায় সে!—আহা ঠিক যেন ঝরণা!’’৩১৭ লোকায়ত যে প্রেমপিপাসা তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর পর সেই তৃষ্ণা নিবারণের জন্য স্বচ্ছ জলের সন্ধান পেয়েছে সে৷ তার জীবনে সে একটাও নদী দেখতে পায়নি—শুধু দেখেছে নর্দমা৷ সেই নর্দমার জলই পিপাসায় আকন্ঠ পান করে করে শেষে গলায় দড়ি দেওয়ার পর ঝরণাধারার খোঁজ পেয়েছে৷ মৃত্যুর পরপারে এসে পুনরায় অভিসারিকা সেজেছে বোমার দলের ছেলেটিকে পাওয়ার জন্য৷ ডাক্তার অবাক বিস্ময়ে দেখে বিন্দির সে চেহারা নেই৷ সুন্দর খোঁপা বেঁধেছে—খোঁপায় বেলফুল গোঁজা৷ গালে রঙ, ঠোঁটে রঙ—সুন্দর টানা টানা চোখে কাজল রেখা টেনে আরও অপরূপা হয়ে উঠেছে৷ পরনে মখমলে ফিনফিনে শাড়ি৷ তার সেই মোহিনী বেশে পুরুষের মন মুগ্ধ না হয়ে পারে না৷ অপরূপ লাস্যভঙ্গিতে সে আহ্বান করছে সেই অ্যানার্কিষ্ট ছেলেটিকে যে ব্যর্থ প্রণয়ের যন্ত্রণায় সায়ানাইট খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল৷ কথক-ডাক্তার তাই তার সম্পর্কে বলে—‘‘যে হতভাগিনী বাঁচিয়া থাকিতে পুরুষের মনোযোগের জ্বালায় অস্থির হইয়া গলায় দড়ি দিয়াছিল, মৃত্যুর পর সে-ও দেখিতেছি অভিসারিকা সাজিয়াছে এবং ভুলাইতেছে সেই ব্যর্থ প্রণয়ীকে যে নারীর উপর অভিমান করিয়া সায়ানাইড গিলিয়াছিল শান্তির আশায়৷’’৩১৮

বিন্দিবাইজি মৃত্যুর পর যে শুধু প্রেমিকের সন্ধান পেয়েছে তা নয়, সে দেখে তার দেহভোগকারী এক পুরুষও মৃত্যুর পরে সেখানে উপস্থিত হয়েছে৷ বিন্দির গলার স্বর শুনে তার অশরীরী দেহ পুনরায় নারীসঙ্গ প্রাপ্তির আশায় লালায়িত হয়ে উঠেছে৷ সেও ডাক্তারের কাছে বার বার জিজ্ঞেস করেছে বিন্দির কথা৷ বিন্দিও সেই মাংসলোভী পাষণ্ডকে দেখে ভয় পেয়ে মুহূর্তেই অন্তর্হিত হয়ে গেছে ডাক্তারের সম্মুখ থেকে৷

উপন্যাসের শেষে দেখা যায় সেই কালো-কুৎসিত গলাকাটা লোকটা যখন বোমার দলের ছেলেটিকে আক্রমণ করে তখন ঝড়ের মতো বিন্দি ছুটে এসে লোকটার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকানি দিয়ে তাকে ছেড়ে দিতে বলে৷ তারপর সে নতজানু হয়ে প্রাণ ভিক্ষা চায় সেই অ্যানার্কিষ্ট ছেলেটির৷ অবশেষে তার জীবনের ‘ঝরণা’কে শত্রুর হাত থেকে উদ্ধার করে ছেলেটির মাথা কোলে নিয়ে বসে কাঁদতে থাকে—তার কাপড় রক্তে রাঙানো৷

বিনোদিনী জীবনের যে বিপুল তৃষ্ণা নিয়ে বিন্দিবাই হয়েছিল এবং শেষপর্যন্ত গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল সেই তৃষ্ণার জলের সন্ধান পেয়েছিল সে মৃত্যুর পরে৷ তাও সে পাওয়া তার সম্পূর্ণ নয়৷ পেয়েও সে আবার তাকে হারায় এক দুর্বৃত্তের নিষ্ঠুর পীড়নে৷ বিন্দির মধ্য দিয়ে সমাজের ভয়ঙ্কর কুৎসিত বাস্তব রূপটাকে তুলে ধরেছেন লেখক তার ‘বৈতরণী তীরে’ উপন্যাসে৷

গ. জঙ্গম :

মুক্তো :

বনফুলের জঙ্গম (১৯৪৩) উপন্যাসের অন্যতম গণিকা চরিত্র মুক্তো৷ মমতায় ভালোবাসায় ত্যাগে মহীয়ান সে৷ চরিত্রটিকে প্রথম দেখা যায় হাওড়া স্টেশনে মূর্ছিত অবস্থায়৷ নায়ক শঙ্কর তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার জন্য সংজ্ঞাহীন দেহটাকে পাঁজাকোলা করে কলের কাছে নিয়ে গিয়ে মুখে-চোখে জলসেচন করে৷ মুক্তোর সঙ্গিনী মাসি৷ তারা দুজনেই দেহজীবিনী৷ তাদের পরিচয় শঙ্করের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত৷ সে তাদের কোলকাতায় ফেরার জন্য ঘোড়ার গাড়ি ঠিক করে দিলে তার নিঃস্বার্থ সহযোগিতায় মুগ্ধ হয়ে যায় প্রৌঢ়া মাসি৷ সে আতিথ্যের জন্য আমন্ত্রণ জানায় তাকে৷ মুক্তো কেরানি বাগানের উনিশ নং বস্তির আঠার নং ঘরের বারবধূ৷ তার বয়স সতেরো-আঠারো৷ তারপর নানা ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে শঙ্কর ভুলে যায় তাদের নিমন্ত্রণ৷ মুক্তোর সংজ্ঞাহীন দেহের মধুর স্পর্শে সেদিন নড়ে চড়ে উঠেছিল তার ভেতরের নিভৃত কন্দরবাসী পুরুষটা; সেই যুবতী নারীর কথা তার অনেক দিন মনে পড়ে না৷ কিন্তু বহুদিন পড়ে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত শংকর নিজের কাছ থেকে নিজেকে লুকোতে প্রায় মনের অজ্ঞাতেই হাজির হয় কেরানিবাগানের বস্তিটিতে ৷ সেখানে উপস্থিত হয়ে সে দেখে—‘‘একটা ল্যাম্প-পোষ্টের ধারে একফালি সরু বারান্দার উপর রঙিন-কাপড়-পরা কয়েকটি মেয়ে হাসাহাসি করিতেছে৷ তাহাদের মধ্যে একজন কোমরে হাত দিয়া সিগারেট খাইতেছে৷’’৩১৯ লেখক সুস্পষ্টভাবে বেশ্যাদের ‘খদ্দের’ ধরার জন্য অপেক্ষার চিত্রটি বর্ণনা করেছেন৷ যে মেয়েটি সিগারেট খাচ্ছিল সে শঙ্করকে দেখে আরও একটু কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে৷ অন্য আরেকটি মেয়ে বঙ্কিম ভঙ্গিতে আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল, সে রাস্তায় নেমে এসে শঙ্করের দিকে চকিতে একবার চেয়ে সঙ্গিনীদের মুখপানে তাকিয়ে হেসে উঠে একজন সঙ্গিনীকে ডেকে লাস্যভঙ্গিতে বলে উঠে—‘‘আমার খোঁপাটা একটু ঠিক করে দে তো, বার বার এলিয়ে যাচ্ছে৷’’৩২০ সঙ্গিনী কথা মতো শঙ্করকে দেখিয়ে দেখিয়ে তার খোঁপা ঠিক করে দেয়৷ গণিকাদের উল্লিখিত হাবভাব, কটাক্ষ, পুরুষ ধরার কৌশল লেখক একেবারে বাস্তবসম্মত করে তুলে ধরেছেন৷ সমাজের এই সব পতিত নারীরা কখনো কারও সহানুভূতি পায় না৷ জীবন ধারণের জন্য তাদের পরিবেশ উপযোগী খিস্তি-খেউড় দিয়ে কর্ম-প্রয়োজন সম্পাদন করে৷ সেই চিত্রটিও লেখকের উপস্থাপনা থেকে বাদ পড়েনি৷ তাই তো শঙ্কর যখন সেই এলোখোঁপার মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে—‘‘আপনি কি ১৮ নম্বর কেরানিবাগানে থাকেন?’’৩২১ খদ্দেরের মুখে ‘আপনি’ সম্বোধন শুনে মেয়েটি গম্ভীর হয়ে যায়৷ কিন্তু গম্ভীর হয়ে থাকলে তো চলবে না৷ তাদের রোজগার করতে হবে৷ তাই মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে আবার চোখ মিটিমিটি করে হেসে সম্মতি জ্ঞাপন করলে শঙ্কর সেই হাওড়া স্টেশনের যুবতী নারীর সত্যকার পরিচয় পেয়ে দিশেহারা হয়ে যায়৷ তার তালু শুকিয়ে যায়, নিদারুণ তৃষ্ণায় বুক ফেটে যায়৷ সেই ষোড়শী নারী যে একজন বেশ্যা হতে পারে শঙ্কর তা কল্পনায়ও আনতে পারেনি৷ মেয়েটি শঙ্করের ভাব অনুধাবন করতে পেরে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে৷ হঠাৎ শঙ্কর তার কাছে জল পান করতে চাইলে মুক্তো তাকে জল দেওয়ার জন্য ভেতরে ডেকে নিয়ে যায়৷ একজন গণিকার খদ্দের জোটার সম্ভাবনায় অপর বারবধূদের কন্ঠে অক্ষমতার আক্ষেপ ধ্বনিত হয়—‘‘মুক্তোটার কপাল ভাল৷ আমাদের আর কতক্ষণ ভোগান্তি আছে, কে জানে বাপু!’’৩২২ আর একজন বারনারী লঘু হাস্য পরিহাসে তাকে জানায়—‘‘ওলো, মুক্তো, শুধু জল দিসনি, একটু মিষ্টিমুখ করিয়ে দিস বাবুকে৷’’৩২৩ শঙ্কর মুক্তোর ঘরে এসে তাদের পূর্ব পরিচয়ের সব বিবরণ দিলে সে সম্পূর্ণরূপে দক্ষ অভিনেত্রীর মতো ভুলে যাওয়ার ভান করে৷ কাঁচের গ্লাসে করে জল এনে শঙ্করের হাতে এনে দিলে সে ঢকঢক করে তা পান করে ফেললে মুক্তো তার স্বরূপে ফিরে আসে৷ বারবধূ সে৷ তার কাছে সময়ের অনেক দাম৷ তাই শঙ্করকে সচেতন করতে জিজ্ঞেস করে সে আর কতক্ষণ বসবে৷ শঙ্করের উত্তরে যখন বুঝতে পারে সে তখনই উঠতে চায় না তখন অত্যন্ত সাবলীলভাবে সময় হিসেবে তার দেহের দর হাকে—‘‘ঘন্টা পিছু দু-টাকা করে লাগবে, এই আমার রেট৷’’৩২৪ মুক্তোর প্রকাশ্যে দর হাকায় বিব্রত হয়ে তখনি নিজের মানিব্যাগ থেকে দশ টাকার নোট বের করে দিলে সেই বহুভোগ্যা অভিনয়দক্ষ নারী তার স্বভাবসুলভ খিল খিল হাসিতে লুটিয়ে পড়ে বলতে থাকে—‘‘বাবা! রাগ তো আপনার কম নয় দেখছি!’’৩২৫ তারপর গম্ভীর হয়ে আবার বলে—‘‘না, ছি, আপনি অতিথি মানুষ, আমাদের নেমন্তন্ন পেয়ে এসেছেন বলছেন, আপনার কাছে কি টাকা নিতে পারি? সব জায়গায় কি আর ব্যবসাদারি চলে? দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বিছানায় বসুন না, আমি আসছি এক্ষুনি৷’’৩২৬ এরপর মুক্তোর মনের অর্গলটাকে যেন একটু একটু করে উন্মুক্ত করছেন লেখক৷ গণিকার বহুপুরুষপিষ্ট জীবনের মাঝেও সহসা কোনো এক পুরুষ স্থায়ী আসন লাভ করে তাকে তার দুঃসহ জীবন যন্ত্রণার মধ্যেও মহিমান্বিত করে তোলে; এ যেন তারই চিত্র৷ তাই বাইরে কিছু সময় অতিবাহিত করে আসার পর ক্লান্ত শঙ্করকে তা বিছানায় অকাতরে নিদ্রা যেতে দেখে পরম মমতায় সে নির্নিমেষ নয়নে তার মুখের পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷

দেহব্যবসায়ী নারীদের প্রায় সকলেরই একজন বাঁধা বাবু থাকে৷ মুক্তোরও ব্যতিক্রম নয়৷ নির্জন দ্বিপ্রহরে শঙ্কর মুক্তোর পরিপাটী করে গোছানো ঘরে শুয়ে শুয়ে ঘরের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে করতে লক্ষ করে আলনায় রাখা মুক্তোর বাঁধা বাবুর লুঙ্গি ও গেঞ্জি৷ মুক্তোর সেই বাবু প্রত্যহ রাত্রি দশটায় আসে, সমস্ত রাত্রি থাকে৷ তার সঙ্গে মুক্তোর পাকাপাকি বন্দোবস্ত—‘‘রাত্রি দশটা পর্যন্ত মুক্তো ইচ্ছা করিলে অপর লোক বসাইতে পারে, কিন্তু দশটার পরে মুক্তোর কক্ষে অপর কাহারও প্রবেশ নিষেধ৷ তবে যদি কোনো দিন কোনো কারণে আসিতে না পারেন, সেদিন মুক্তোর ছুটি এবং সে ছুটি মুক্তোর নিজের ইচ্ছামত ব্যয় করিতে পারে৷’’৩২৭ মুক্তোর সেই বাঁধা বাবুর নাম দশরথ৷ শঙ্করের বন্ধু ভন্টুর ভাষায় অরিজিন্যাল৷ সে ব্যবসায়ী লোক তাই প্রকৃত ব্যবসাদারের মতোই তার বন্দোবস্ত৷ মুক্তোর সঙ্গে প্রৌঢ় দশরথ বাবুর হৃদয়ঘটিত কোনো সম্পর্ক নেই৷ লেখকের ভাষায়—‘‘সম্পর্কটা নিতান্তই আধিভৌতিক৷’’৩২৮ সোজাসাপটা গোছের দশরথ বাবু সমাজের সামনে তার গণিকাপল্লীতে আসা-যাওয়াটাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পছন্দ করে না৷ সে অকপটে তার এই গণিকাগমন প্রসঙ্গে ভন্টুর কাছে বলতে পারে—‘‘আপনাদের মত মর‍্যাল সেজে ভদ্দরলোকের বাড়ির জানালার পানে হাঁ করে চেয়ে থাকি না, সোজা বেশ্যাবাড়ি যাই৷ আমি ক্ষিদের সময় চাই খাবার, চা নয়৷ চটলে লাথি মারি, ভালবাসলে জড়িয়ে ধরি৷ ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় পছন্দ করি না৷’’৩২৯ দশরথ বাবুর ছেলে লক্ষণ পিতার এই গণিকাপল্লীতে যাওয়াটাকে মেনে নিতে পারেনি৷ নানা কারণে সে আত্মহত্যা করলে তার মুখ থেকে এমন হৃদয় বিদারি কথা বেড়িয়ে আসে৷ দশরথ বাবুর প্রকাশ্যে গণিকা গমন এবং ভদ্দরলোকের বাড়ির জানালায় উঁকিঝুকি মারার কথা প্রসঙ্গে লেখক এই দিকটার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে মনে হয় যে সমাজের স্ত্রী জাতির প্রতি পুরুষদের কামনার ভারসাম্য ঠিক রেখেছে গণিকারা৷ যদি গণিকাপল্লী না থাকতো তাহলে পুরুষেরা তাদের দুর্বার কামনায় ভদ্রবাড়ির মেয়েদের আক্রমণ করতো৷ সমস্যা আরও বেড়ে যেতো৷ দশরথ বাবু জানালা দিয়ে পরস্ত্রীকে দর্শন করে বাসনা পূরণ করার কৌশলকে ব্যঙ্গ করে প্রকাশ্যে গণিকালয়ে যাওয়াটাকেই শ্রেয় বলে মনে করেছে৷ পরের বাড়ির জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে প্রবৃত্তির জ্বালা মেটানো তার কাছে ক্ষুধার সময় চা খাওয়ারই সামিল৷

মুক্তো নামের এই দেহজীবিনী নারীটিকে শঙ্কর যত দেখে তত অবাক হয়ে যায়৷ সে আপন মনেই ভাবে—‘‘অদ্ভুত মেয়ে এই মুক্তো! এতদিন ধরিয়া শঙ্কর এখানে যাতায়াত করিতেছে, কিন্তু মেয়েটির স্বরূপটি যে কি, তাহা আজও সে বুঝিতে পারে নাই৷ কিছুতেই যেন ধরা-ছোঁয়া দেয় না৷ হাসে, নাচে, গান গায়, মদ খায়, বৈকালে গা ধুইয়া চুল বাঁধিয়া চোখে কাজল দিয়া রঙিন শাড়িটি কায়দা করিয়া পরিয়া গালে ঠোঁটে রঙ মাখিয়া খোঁপায় ফুলের মালা পরিয়া রাস্তার ধারে গিয়া দাঁড়ায়, ভঙ্গিভরে সিগারেট টানে, কথায় কথায় খিলখিল করিয়া হাসিয়া লুটাইয়া পড়ে, চটিয়া গেলে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে, অন্ধ-আতুর দেখিলে পয়সা দেয়, গঙ্গাস্নান করিতে যায়, মেনি বেড়ালকে আদর করে, দশরথের জন্য প্রত্যহ হাঁসের ডিমের ডালনা ও পরোটা বানায়, সামনের চপ-কাটলেটওয়ালার সঙ্গে দুই-এক পয়সার জন্য ইতরের মত কলহ করে, ঘরে লুকাইয়া মদের বোতল রাখে এবং তাহা সুযোগ মত শাঁসালো কাপ্তেনের নিকট দুর্মূল্যে বিক্রয় করে৷ কিন্তু শঙ্করের মনে হয়, আসল ব্যক্তিটি অন্তরালে আছে, সে কখনও ভুলিয়াও পাদ-প্রদীপের সম্মুখে আত্মপ্রকাশ করে না৷ তাহাকে একটু যেন চেনা যায়, যখন সে দুপুরে ফালি বারান্দাটুকুতে বসিয়া রোদে পিঠ দিয়া চুল শুকায়৷ মনে হয়, উহাই যেন তাহার জীবনের সত্য আকাঙ্ক্ষা, ও যেন আর কিছু চায় না, নিশ্চিন্ত চিত্তে নিজের ঘরের দাওয়াটিতে বসিয়া রোদে পিঠ দিয়া চুল শুকাইতে শুকাইতে প্রতিবেশিনীর সঙ্গে সুখদুঃখের আলোচনা করিতে চায়৷’’৩৩০ উদ্ধৃত কথাগুলির মধ্য দিয়ে গণিকা নারীর প্রাত্যহিক জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটির বিষদ বিবরণ দিয়েছেন বনফুল৷ অবশেষে সবকিছু ভুলে রোদে পিঠ দিয়ে বসে চুল শুকোতে শুকোতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলার মধ্য দিয়ে বারবনিতাদের দেহবিক্রির যন্ত্রণাময় চক্রবুহ্য থেকে বেড়িয়ে আসার আকাঙ্খাকে প্রকাশ করেছেন৷ সেখানে খদ্দের ধরার চিন্তা নেই, রসদ সংগ্রহের ভাবনা নেই শুধু নিশ্চিন্তমনে দিন যাপন করতে চায় তারা৷ শঙ্কর পঙ্কিলতার সেই ঘোর পঙ্ক থেকে মুক্তোকে উদ্ধার করে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে দিতে চায়৷ প্রথম যখন সে মুক্তোর সংস্পর্শ লাভ করেছিল, সে গণিকা সংস্পর্শের কলুষিত হয়ে নিজের প্রতি নিজেই ধিক্কার জানিয়েছিল; নিজের অধঃপতনের দরুণ ঘৃণা করেছিল নিজেকে৷ এর মধ্য দিয়ে গণিকার প্রতি লেখকের বা সমাজের ঘৃণিত মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে৷ কিন্তু ধীরে ধীরে সব দ্বন্দ্ব ঘুচে যায়, মুক্তোর মতো পণ্যাঙ্গনাদের তাদের সুখ, দুঃখ, বেদনা, ভালোবাসা, অপমান-লাঞ্ছনার অলিগলি ঘুরে, তাদের জীবন যন্ত্রণাকে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করে শঙ্কর৷ তার মনে হয়—‘‘মুক্তো গণিকা—এই কথাই বড় নয়, মুক্তো নারী—এই কথাই বড়৷ শুধু নারী নয়, লাঞ্ছিতা অবনমিতা নারী৷ সমাজের অত্যাচারে, পারিপার্শ্বিক ঘটনার চাপে নিতান্ত নিরুপায় হইয়া উদরান্নের জন্য দেহ-বিক্রয় করিতেছে৷’’৩৩১ অর্থাৎ লেখক শঙ্করের মধ্য দিয়ে স্বীকার করেছেন একজন নারীর দেহ-বিক্রয়ের পেছনে কতটা প্রতিকূল পরিস্থিতি কাজ করে, সমাজ কতটা ইন্ধন জোগায়৷ মুক্তোর মতো নারীরা সমাজেরই তৈরি, সমাজই তাদের গণিকা বানায়, আবার সমাজই তাকে ঘৃণ্য অবমাননায় দূরে ঠেলে দেয়৷ শঙ্কর তাই প্রতিজ্ঞা করে—‘‘উহাকে উদ্ধার করিতে হইবে৷ পঙ্ক হইতে পঙ্কজিনীকে আহরণ করিয়া প্রেমের মন্দিরে নির্মাল্য রচনা করিতে হইবে৷’’৩৩২ শঙ্করের তাই মুক্তোকে প্রয়োজন৷ তার সমস্ত মলিনতা সত্ত্বেও সে একান্তভাবে মুক্তোকে চায়৷ সে আর কোনো পুরুষকে মুক্তোর কাছে আসতে দেবে না, যেমন করে হোক দশরথকে তাড়িয়ে দেবে৷ মুক্তোও সমস্ত কলুষতার মধ্যেও, দেহজীবিনীর আবর্তে চালিত হলেও, তার নারীত্বকে ত্যাগ করতে পারেনি৷ শঙ্কর সেই অক্ষুন্ন নারীত্বের সন্ধান পেয়েছে৷ সেই নারীত্বের সম্মান যদি সে না করে তবে তার শিক্ষা-দীক্ষা সমস্তই ব্যর্থ৷ সে আরও অনুভব করে সমাজে এমন অনেক নারীরা আছে যারা প্রকাশ্যে দেহের দর হাকে না কিন্তু নিজের দেহকে পুরুষের পর পুরুষের অঙ্কশায়িনী করতেও দ্বিধাবোধ করে না৷ এমনই এক চরিত্র মিষ্টি দিদি৷ তাই সে মুক্তো সম্পর্কে ভাবে—‘‘মুক্তো গণিকা বটে, কিন্তু মুক্তোকে দেখিয়া তো ঘৃণা করিতে প্রবৃত্তি হয় না! সে রূপোপজীবিনী, ওই তাহার পেশা৷ মিষ্টিদিদির মত ছদ্মবেশী ঘৃণ্য জীব সে নয়৷… নিরপেক্ষ বিচারে মুক্তো ও মিষ্টিদিদির কোনো তফাত নাই৷’’৩৩৩ ঔপন্যাসিক বনফুল মুক্তো ও উচ্চবিত্ত ভদ্রসমাজের প্রতিনিধি মিষ্টিদিদির প্রবৃত্তির খেলাকে দেহব্যবসা ছাড়া কিছুই ভাবেননি৷ শুধুমাত্র দুজনের প্রেক্ষাপট আলাদা৷

মুক্তো রূপাজীবা হয়েও শঙ্করকে ভালোবাসে৷ সেই ভালোবাসা গণিকাদের কপট ভালোবাসা নয়; তা অন্তরের নির্মোহ স্তর থেকে উৎসারিত৷ তাই সে শঙ্করকে তার ঘৃণ্য জীবনের পঙ্কে নামিয়ে আনতে চায় না৷ নিজের একান্ত বাঞ্ছিতকে বার বার প্রত্যাখ্যান করে তাকে তার জীবনবৃত্তের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে দিতে চায়৷ তবুও হৃদয়ের দুর্দমনীয় প্রেমোচ্ছ্বাসকে বেশিক্ষণ দাবিয়ে রাখতে পারে না৷ তাই একদিকে সে যেমন তার প্রেমাস্পদকে উপেক্ষা করে, অপর দিকে তার সামান্য অনুপস্থিতেই তার মন হাহাকার করে ওঠে৷ সে যতক্ষণ তার ঘরে থাকে ততক্ষণ সে নানা অছিলায় তার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে কিন্তু থাকতে পারে না তাই পাশের ঘরের জানালা দিয়ে নির্নিমেষ নয়নে তার দিকে চেয়ে থাকে৷ আর তার সেই ভাব দেখে তার সহকর্মী টিয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে—‘‘ঢঙ দেখে আর বাঁচি না৷ ঘরে গিয়ে নয়ন ভরে দেখ না! উঁকি দেওয়া কেন?’’৩৩৪

মুক্তো শঙ্করকে ডাকে অতিথি বলে৷ কারণ শঙ্কর তার কাছে ‘খদ্দের’ নয়৷ এ বিষয়ে শঙ্কর তাকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়—‘‘অতিথি বলব না তো কি বলব, আপনি তো খদ্দের নন ঠিক৷’’৩৩৫ শঙ্কর তাকে ‘খদ্দের’ কথার মানে জিজ্ঞেস করলে মুক্তো গা দুলিয়ে হাত নাড়িয়ে বলে—‘‘ফেল কড়ি মাখ তেল, তুমি কি আমার পর—এই কথা যাকে বলতে পারা যায়, সেই হল খদ্দের৷’’৩৩৬ তার কথা শুনে শঙ্কর তার খদ্দের হতে চাইলে মুক্তো জানায় আজ সে তাকে খদ্দের ভাবতে পারছে না কিন্তু একদিন না একদিন তাকে খদ্দের ভাবতেই হবে৷ তার ভবিষ্যৎ আছে সে রোজগারের পথে নেমেছে; দানছত্র খুলে বসেনি৷ মুক্তো বোঝে তার মত গণিকার জীবনে ভালোবাসার কোনো জায়গা নেই, সমস্তই আপেক্ষিক, শুধুমাত্র রোজগারের জন্য৷ তার মত কলঙ্কিনী নারীর জীবনে সে আর শঙ্করকে জড়াতে চায় না৷ তাই তাকে উপেক্ষা করার জন্য তার পেছনে ঘুরঘুর করা কাঁচা পাকা দাড়িওয়ালা লোকটিকে দেখিয়ে শঙ্করকে চলে যেতে বলে, যাতে সে দু-পয়সা রোজগার করতে পারে৷ শঙ্কর চলে যেতেই সেই লোকটিকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতেই চোখে পড়ে শঙ্কর আবার ফিরে আসছে৷ আবার তার আচরণ বিপরীত হয়৷ তার সামনেই সেই লোকটিকে সমাদর করে ডেকে নিয়ে ঘরে খিল এঁটে দেয়৷ শঙ্কর তার ফেলে যাওয়া বইটি ফেরত নিতে এসেছে জানালে সে ভেতর থেকে কোনো সাড়া দেয় না৷ অবশেষে শঙ্কর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর চলে গেলে সে নিজের মনেই ভাবে—‘‘ভালই হইয়াছে, বইখানার জন্যও অন্তত আর একবার আসিবে৷’’৩৩৭

কেরানিবাগানের সেই গণিকাপল্লীতে শুধু মুক্তো নয় কালোজাম, টিয়া, আঙ্গুরসহ আরও বহু গণিকা৷ তাদের সবারই জীবন মুক্তোর মতো৷ শঙ্কর একদিন রাত্রি আটটার সময় মুক্তোর ঘরে গিয়ে দেখে মুক্তো সেখানে নেই৷ কালোজামের কাছে জানতে পারে আঙ্গুরের ঘরে একজন বড়লোক বাবু ইয়ার বন্ধু সমভিব্যাহারে স্ফূর্তি করতে আসায় দশবারোজন নর্তকীর প্রয়োজন হওয়াতে মুক্তো সেখানে গেছে৷ কালোজামের প্রচেষ্টায় শঙ্কর জানালা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে মুক্তোর মোহময়ী নৃত্য৷ সেখানে আরেক ভয়াবহ দৃশ্যে তার শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে৷ সে দেখে এক আসন্নপ্রসবা নারী দেহভারে ক্লান্ত হয়েও পুরুষের মতো মাথায় পাগড়ি বেঁধে, জুতা পড়ে প্রবল মদ্যপ অবস্থায় নেচে চলেছে৷ তার গালের হাড় উচু হয়ে আছে, চোখদুটো ঠিকরে বাইরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে৷ সামান্য কয়টা টাকার জন্য আসন্নপ্রসবা এক নারীর এহেন কার্যে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে সমস্ত তছনছ করার জন্য আঙ্গুরের ঘরের দিকে পা বাড়ালে মুক্তোর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়৷ নিমেষে শান্ত হয়ে সে লক্ষ করে মদ খেয়ে চোখে অপূর্ব মদিরা প্রাখর্যে সম্পূর্ণ অন্যরকম দেখাচ্ছে মুক্তোকে৷ মুক্তো তাকে আঁচলের তল থেকে বের করে এক ডিশ মেটেচচ্চরি খেতে দিলে শঙ্কর তা প্রত্যাখ্যান করে৷ সে মুক্তোকে জানায় তাকে গণিকাপল্লীর কদর্য নরক থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে৷ ‘নরক’ শব্দ শুনে মুক্তো উত্তেজিত হয়ে পড়ে৷ সে শঙ্করকে জানায় সে সমাজের সেই অপমানের স্বর্গে কখনোই ফিরে যেতে চায় না৷ কিন্তু মুক্তোর সেই উষ্মা দীর্ঘস্থায়ী হয় না৷ নিমেষেই সে শান্ত হয়ে স্নেহময়ী জননীর মত গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রেমিককে খাবার খাওয়ায়৷ শেষে পুনরায় আঙ্গুরের ঘরে যেতে চাইলে শঙ্কর তাকে বাধা দেয়৷ কিন্তু মুক্তোকে তো যেতেই হবে! কারণ সে অগ্রিম টাকা নিয়ে এসেছে৷ শঙ্কর সেই টাকা ফিরিয়ে দিতে বলে তার হাতে কিছু টাকা দিলে মুক্তো সুদক্ষ হিসেবির মতো সেই টাকা গুণে গুণে শেষে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে—‘‘এ কটা টাকায় আমার কি হবে? ওদের সাতদিন মাইফেল চলবে, একশো টাকা অগ্রিম দিয়েছে, বকশিশটা-আশটাও মিটবে৷ নিন আপনার টাকা, আপনি বাড়ি যান৷ গরিবের ছেলের এসব ঘোড়ারোগ কেন বাপু? সোন্দর দেখে বিয়ে করলেই পারেন একটা৷’’৩৩৮ মুক্তো এভাবে তার কঠিন বাক্য দ্বারা প্রকাশ্যে শঙ্করকে যতই উপেক্ষা দেখাক, অপমান করুক, ভেতরে ভেতরে সেই আঘাতটা নিজের মধ্যেই অনুভব করে৷ শঙ্করকে অপমান করে, কুকথা শুনিয়ে জানালার ফুটো দিয়ে তাকেই দেখতে থাকে অপলক নয়নে৷ প্রবল অভিমান নিয়ে তার চোখের সামনে দিয়ে যখন সে চলে যায় তখন তার বার বার ইচ্ছে করে তাকে অনুরোধ করে ফিরিয়ে আনে কিন্তু প্রতিবারই সে নিজেকে সংযত করে প্রেমিকের শুভকামনায়৷ কিছুতেই তার সঙ্গ সে ছাড়াতে পারে না৷ যতই অপমানই করুক সে বার বার তীর্থের কাকের মতো তার দুয়ারে এসে তারই অপেক্ষায় বসে থাকে৷ অবশেষে আরও কঠিন হয় সে৷ মুক্তো মনে প্রাণে ভালোবাসে তাকে৷ সে নিজে আকন্ঠ পাপে নিমগ্ন৷ কিছুতেই সেখানে তার প্রিয়তমকে নামাতে পারবে না৷ তাই বাঘা নামের এক গুণ্ডাগোছের লোক দিয়ে তাকে চরম অপমান করায়; বাঘাকে আপনার লোক বলে দাবি করে৷ অপমানে বজ্রাহত শঙ্কর তাকে ছেড়ে চলে গেলে পরম শূন্যতায় ‘‘যতক্ষণ দেখা গেল, মুক্তো শঙ্করের পানে চাহিয়া রহিল; কিন্তু বেশিক্ষণ দেখা গেল না৷ কতটুকুই বা গলি, শঙ্কর দেখিতে দেখিতে পার হইয়া গেল! মুক্তো তবু সেই দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল৷ তাহার পুণ্যলেশহীন অন্ধকার পতিতা-জীবনে একটিমাত্র পুণ্য-প্রেরণার শিখা জ্বলিয়াছিল৷ সেই শিখার ইন্ধন যোগাইতে গিয়াই সে নিঃস্ব হইয়া গেল৷ শঙ্করের মত ছেলেকে সে নষ্ট করিতে চাহে নাই৷ যেদিন তাহাকে প্রথম দেখিয়াছিল, সেই দিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল—যেমন করিয়া হউক, পঙ্কিলতা হইতে ইহাকে সে রক্ষা করিবে৷ অন্তর্দ্বন্দ্বে সে ক্ষত-বিক্ষত হইয়াছে, কিন্তু হার মানে নাই৷ শঙ্করকে পঙ্ককুণ্ড হইতে সত্যই রক্ষা করিয়াছে৷’’৩৩৯ তার ভেতরকার কোমল ভালোবাসায় বার বার তাকে ধিক্কার জানিয়ে বলতে থাকে যে সে কি করলো সে যে চলে গেলো৷ মুক্তো মনে মনে বুঝেছিল শঙ্কর আর কোনোদিন তার গৃহে আসবে না৷ প্রেমের জন্য—প্রেমিকের জন্য সেই বৃহৎ ত্যাগের স্বীকার শঙ্কর কিছুই বুঝতে পারে না৷ বরং দুর্বার এক বাসনা তার দেহমনকে উথাল-পাথাল করে দেয়৷ তবুও স্বস্তি প্রকাশ করে সে ভাবে—‘‘তাহার পঙ্কিল স্পর্শ হইতে সে যে মানে মানে দূরে চলিয়া আসিতে পারিয়াছে, এজন্য সে আনন্দিত৷ পঙ্কিল স্পর্শ! এখন মুক্তোর স্পর্শকে পঙ্কিল স্পর্শ মনে হইতেছে৷’’৩৪০ শঙ্কর মুক্তোর জীবন থেকে চিরতরে চলে যায়৷ প্রেমময়ী করুণাময়ী মুক্তো তার নির্মোহ প্রেমের অস্ত্রে তাকে সরিয়ে দেয় কামনার জতুগৃহ থেকে৷

প্রায় প্রত্যেক বারবনিতারই একটা অতীত ইতিহাস থাকে৷ সেখানে তার পরিচয় গণিকা হিসেবে নয় কারও মাতা, কারও বোন অথবা কারও পত্নী হিসেবে৷ কিন্তু পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাদের দেহজীবিকার ঘৃণ্য পঙ্কে নিমজ্জিত করে; তারা বলি হয়ে যায় সমাজের নির্দয় যূপকাষ্ঠে৷ মুক্তোর জীবনেরও এক অতীতকে তুলে ধরেছেন লেখক৷ উনিশ নং কেরানিবাগানের গণিকা হওয়ার আগে তার নিজের আরেকটা পরিচয় ছিল৷ সে ছিল যতীন হাজরার স্ত্রী৷ স্বামীর প্রতারণার শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত তার আশ্রয় হয় কেরানিবাগানের সেই নিষিদ্ধপল্লীতে৷ যক্ষাক্রান্ত যতীন হাজরা তার উপস্থিত মৃত্যুর প্রাক্কালে মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে সেই সব কথা ব্যক্ত করে গেছে শঙ্করকে—‘‘আমি তাকে ফেলে পালিয়ে এসেছিলাম৷ সে নিরপরাধ জেনেও তার মাথায় কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে ত্যাগ করে এসেছিলাম৷ সে এখনও বেঁচে আছে৷ আপনি একবার দয়া করে যাবেন তার কাছে?… বলবেন আমার পাপের পুরো প্রায়শ্চিত্ত করে জ্বলে পুড়ে অনুতাপ করতে করতে আমি মরেছি৷… জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারই কথা ভেবেছি, মনে মনে তার পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছি—৷’’৩৪১ যতীন হাজরা মুক্তোকে ত্যাগ করে চুনচুনকে বিয়ে করেছিল৷ তার নিজের পাপে নিজেই শেষ হয়ে গেছে৷ কিন্তু মুক্তোর তো পাপ ছিল না৷ মিথ্যা কলঙ্ক নিয়ে সে বেশ্যাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়েছে৷ সমাজের চির উপেক্ষিত স্থানে পতিত হয়েছে৷ নিরপরাধী মুক্তোর অন্যায় শাস্তি লাভের ফল কেউ ভোগ করেনি৷ সমস্তটাই মুক্তোকেই বহন করতে হয়েছে৷ যতীন হাজরা তার প্রথমা স্ত্রীর সম্পর্কে অত কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তার ঠিকানা দিয়ে যেতে পারেনি শঙ্করকে৷ মৃত্যু সেই অবসর তাকে দেয়নি৷ কিন্তু মুক্তো খুন হয়ে যাওয়ার পর স্বজন হারানো দশরথ বাবুর ঘরে তার তোরঙ্গটি চালান হলে সেই তোরঙ্গ থেকে শঙ্কর আবিষ্কার করে তার দেওয়া নীল রঙের চাদরখানি৷ সেখানেই সে দেখতে পায় যতীন হাজরার একটি ছবি৷ ছবির মুখটিকে আঁচড়ে কে যেন ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে৷ আঁকাবাঁকা অক্ষরে নীচে লেখা ‘‘স্বামী নয়—শয়তান৷’’৩৪২ এই কথাটি থেকেই মুক্তোর স্বামীর প্রতি প্রবল ঘৃণার চিত্রটি ফুটে উঠেছে৷ সে যতদিন বেঁচেছিল তার স্বামী নামক নরপশুটিকে ঘৃণা করে গেছে৷ তাকে হাতের কাছে না পেয়ে তার ছবিটিকে প্রবল আক্রোশে নখের আঁচড় দিয়ে আহত করতে চেয়েছে৷ নিজের স্ত্রীকে বেশ্যাবৃত্তির নির্মম জীবনে ঠেলে দেওয়া যতীন হাজরার মতো মানুষদের প্রতি অন্তরের অন্তস্থল থেকে বিদ্রোহ করে গেছে৷

এই উপন্যাসে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল রূপাজীবাদের অসুরক্ষিত জীবন-যাপন৷ মুক্তোর খুন হওয়ার মধ্য দিয়ে৷ দেহজীবিনী নারীকে বেঁচে থাকার জন্য অপমান-লাঞ্ছনা তো সারাজীবন ভোগ করতেই হয় তার পরও সর্বদাই তাদের পিছনে তাড়া করে প্রবল মৃত্যু ভয়৷ চোর-ডাকাত-গুণ্ডা-বদমাশ নিয়ে তাদের কারবার৷ বেশিরভাগ খদ্দেরই তাদের সেই শ্রেণীর৷ তাদের দেহের সঙ্গে তাদের প্রাণেরও কোনো মূল্য নেই সমাজের কাছে৷ তাই নিজের দেহের শেষ অনুভূতিটুকু নিংড়ে নিংড়ে দান করেও সামান্য কিছু অর্থ বা অলঙ্কারের বিনিময়ে তাদের মূল্যহীন প্রাণটিকেও আহুতি দিতে হয়; মুক্তোর মতো মেয়েগুলোকে খুন হতে হয় নির্মমভাবে৷ লেখকের এ চিত্র উত্থাপন শুধু মর্মস্পর্শী নয় বাস্তবসম্মত৷ বাস্তব সমাজেও যেমন বহু বারবনিতার খুনের ঘটনা অহরহ ঘটে যায় তদনুরূপ ঘটনাই উপস্থাপিত হয়েছে মুক্তো খুনের মধ্য দিয়ে৷ সমাজের পাপ নিজ দেহে ধারণ করে, প্রান্তবাসিনী এই নারীরা এভাবেই শেষ হয়ে যায়৷ তার কোনো বিচার হয় না৷

মাসি :

মাসি চরিত্রটির আবির্ভাবও মুক্তোর সঙ্গে সঙ্গেই৷ উপন্যাসের নায়ক শঙ্কর তার বিলেতগামী বন্ধু উৎপলকে হাওড়া স্টেশনে ‘সি অফ’ করে স্টেশন থেকে বাইরে বেরোনোর সঙ্গে লক্ষ করে বাইরে কি একটা বস্তুকে ঘিরে কতগুলি লোকের কোলাহল করা৷ সেখানে এগিয়ে গিয়ে দেখে ‘‘একটি রমণী মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে, এবং সেই মূর্ছিতা রমণীর মাথা কোলে করিয়া লইয়া আর এক নারী বিলাপ করিতেছে৷’’৩৪৩ এই বিলাপকারী নারী হল মাসি৷ মাসি যুবতী নয় বিগতযৌবনা৷ শঙ্কর মূর্ছিত মেয়েটিকে পাঁজাকোলা করে কলের কাছে নিয়ে গিয়ে জলসেচনের মধ্য দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলে বিপদগ্রস্ত এই নারী তার স্বাভাবিক নারীসুলভ ভঙ্গিমায় তাকে আশীর্বাদ করে বলে—‘‘বেঁচে থাক তুমি বাবা৷ মেয়েটির ফিটের ব্যায়রাম আছে৷ তুমি না থাকলে কি যে বিপদ হত আজ আমার!’’৩৪৪ অবশেষে তাদের বাড়ি যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজেদের ঠিকানাটাও বলে দেয় মাসি৷ বহুদিনপর শঙ্কর মাসির দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী উপস্থিত হয়ে বুঝতে পারে তা একটি বেশ্যাপল্লী৷ পরে মুক্তোর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়লে মাসি চরিত্রটির সম্পর্কে আরও বিশদ জানা যায়৷ মাসি সেই বেশ্যালয়ের কর্ত্রী৷ মুক্তোর মতো রূপাজীবাদের ভাড়া খাটিয়ে সে তাদের রোজগার করা অর্থের অংশভাগিনী হয়৷ মাসি চরিত্রের মতো নারীরা শুধু গণিকাপল্লীর অধীশ্বরীই নয় তারাও পূর্বে গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত ছিল৷ পরবর্তী সময়ে যৌবন অস্তমিত হলে উপার্জিত অর্থের জোরে তারা নিজেরাই কোনো নিষিদ্ধপল্লীর মালকিন হয়ে ওঠে৷ তাদের নিয়ন্ত্রণের থেকে বহু নারী তাদের দেহব্যাবসা চালিয়ে যায়৷ গণিকাপল্লীর এই মাসিরা তাদের নিয়ন্ত্রিতা পণ্যাঙ্গনাদের আয়-ব্যয়ের সম্পূর্ণ হিসেব রাখে৷ কোনোভাবেই তাদের বিপথে চালিত হতে দেয় না তাদের বৃত্তির আবর্তভূমি থেকে৷ মুক্তো ও শঙ্করের মধ্যে বেশ্যা-খদ্দের-এর সম্পর্কের বাইরে এক মধুর সম্পর্ক তৈরি হলে, মুক্তোর রোজগার ব্যহত হয়, সঙ্গে সঙ্গে দেহব্যবসায়িনীর খোলস ছিঁড়ে তার ভেতরকার প্রেমময়ী নারীসত্তাটিও বেড়িয়ে আসতে থাকে; মাসির বিচক্ষণ দৃষ্টিতে তা সহজেই ধরা পড়ে যায়৷ সে মুক্তোকে শঙ্করের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য তাকে সাবধান করতেও ভোলে না৷ মুক্তোর কথার মধ্য দিয়ে এমনই ভাবনার প্রতিধ্বনি—‘‘মাসিটিকে তো চেনে না! সেদিন তো মাসি তাহাকে বলিয়াই দিয়াছে, ওসব কাব্যি-মার্কা ছোঁড়াকে যেন আমল না দেয় সে৷ অথচ মাসি নিজের মুখেই তাহাকে আসিবার জন্য নিমন্ত্রণ করিয়াছিল, এখন বলিতেছে বিদায় করিয়া দিতে! কোনো দিন হয়তো মুখের ওপর কি বলিয়া বসিবে?’’৩৪৫ মাসি চরিত্রের মধ্যে সেটাই বাস্তব৷ মুক্তোর মতো নারীদের উপার্জিত অর্থাংশ হতে তার জীবন নির্বাহ হয়৷ তাই তাদের অর্থ রোজগারে ভাটা পড়লে মাসির মতো নারীরা মেনে নিতে পারে না৷

পানওয়ালী :

পানওয়ালী ঝামাপুকুরের সংকীর্ণ গলির মুখে পান বিক্রয় করে৷ সে বিগতযৌবনা কুৎসিতদর্শন৷ উপন্যাসের আরেক অন্যতম চরিত্র করালীচরণ বকসীর ভাবনায় তার রূপ বর্ণিত হয়েছে এইভাবে—‘‘সেই কাজল-পরা, মাথায়-ফুল-গোঁজা, দাঁতে-মিশি-লাগানো নীলাম্বরী-কাপড়-পরা বুড়িটা—ছুঁড়ি সাজিয়া লোক ভুলাইতে চায়!’’৩৪৬ লেখকের কথায় এই কুৎসিতদর্শনা পানওয়ালীই একমাত্র নারী যে করালীচরণকে ভালোবাসে৷ কিন্তু তার প্রেম নিতান্তই একপাক্ষিক৷ যতটা করালীর প্রতি তার ভালোবাসা ততটাই তার প্রতি ঘৃণা করালীর৷ যে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মস্তকে দীর্ঘ অবিন্যস্ত কেশ, শীর্ণ লম্বা দেহ, এক চোখ কানা, দপদপ করে জ্বলা প্রদীপ্ত আরেক চোখ, সম্মুখের দিকে বক্রভাবে এগিয়ে আসা সূচালো চিবুক, শ্মশ্রু, গুল্ফ এমন কি ভ্রূ হীন, বসন্তের দাগবিশিষ্টমুখমণ্ডল এবং অত্যাধিক সুরাপানে হেজে যাওয়া ঠোটের করালীকে সকলের সঙ্গে বেশ্যারাও ভয় পায়; বেশি অর্থ দিলেও আপ্যায়ন করতে পারে না, সেই বিকটদর্শন করালীর প্রতি সীমাহীন ভালোবাসায় আত্মনিবেদিত প্রাণ সেই পানওয়ালীর৷ তাই তার শত ঘৃণা, অবমাননার মাঝেও মনের নিভৃত কন্দর থেকে কখনো কখনো উঁকি দেয় পানওয়ালীর মুখ৷ যার কথা ভাবলেও তার গায়ে জ্বর আসে তার পরেও করালীচরণ না ভেবে থাকতে পারে না যে—‘‘ওই বোধ হয় একমাত্র নারী যে করালীচরণকে একটু মমতার চক্ষে দেখে৷ বাকী সবাই তো তাহাকে ত্যাগ করিয়াছে, কেহই তো তাহাকে আমল দিতে চায় না, টাকা দিতে চাহিলেও প্রত্যাখ্যান করে—এমনকি বেশ্যারাও৷’’৩৪৭ তবুও পানওয়ালীকে দেখলেই তার আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে৷ নাম-পরিচয়হীনা বিগতযৌবনা পানওয়ালী তার কুৎসিত রূপের মধ্যেও হৃদয়ে নির্মল স্তরে তার প্রতি সর্বদা প্রজ্জ্বলিত রাখে তার প্রেমের দীপশিখাটিকে৷ পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সি—এই নারীর প্রতি কোনো সহানুভূতি নেই করালীর৷ বরং তীব্র ঘৃণায় তাকে উদ্দেশ্য করে সে বলে—‘‘বেশ্যারা আবার মানুষ!’’৩৪৮ অবিবাহিত নারীসঙ্গ বঞ্চিত করালী বিগতযৌবনা এই গণিকার প্রেমকে উপেক্ষা করে খদ্দের ধরার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা দেহব্যবসায়িনীদের সঙ্গ কামনা করলে তারাও তাকে সভয়ে অস্বীকার করে৷ লেখকের কথায় এমনই কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায়—‘‘রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া যাহারা দেহ বিক্রয় করে, তাহারাও তাঁহাকে চাহে না৷ অর্থই যাহাদের পরমার্থ, করালীচরণের অর্থও তাহাদের নিকট নিরর্থক৷’’৩৪৯

পানওয়ালীর ভালোবাসায় কোনো ত্রুটি নেই৷ সে বিপদনাশিনী হয়ে নানা ছোটখাট বিপদের হাত থেকে তার প্রেমাস্পদকে রক্ষা করে; দূর থেকে সর্বদা ছন্নছাড়া, স্বজন-বান্ধবহারা করালীচরণের প্রতি নজর রাখে৷ এমনকি তার সমস্ত বিরক্তি ও বিতৃষ্ণাকে উপেক্ষা করেও করালীর কোনো কাজে লাগবার জন্য সে উন্মুখ হয়ে বসে থাকে৷ প্রচণ্ড ক্ষুধায় তার মনের মানুষটি যখন রাস্তার ধারের হোটেলের অখাদ্য খাবারগুলি গলাধকরণ করতে না পেরে ক্ষুধা সত্ত্বেও খাবার ফেলে উঠে আসে তখন পরম মমতায় নিম্নশ্রণীর এই বারাঙ্গনা হাঁসের ডিমের ডালনা ও কয়েকটা পরোটা তার অলক্ষ্যে ঘরের টেবিলের উপর ঢাকা দিয়ে রেখে যায়৷ করালী তার সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের খাবার কেউ ঘৃণা করে৷ তাই প্রচণ্ড আক্রোশে তা ছুড়ে ফেলে দিয়ে মদ পান করতে করতে তার স্বগোতক্তি ‘‘হারামজাদি!… মাগীর তাড়কা রাক্ষসীর মত চেহারা, সোহাগ জানাইতে আসিয়াছে! একটুও যদি রূপ থাকিত, দেমাকে মাটিতে পা পড়িত না, আমাকে দেখিয়া তখন হয়তো মুখ ঘুরাইয়া চলিয়া যাইত৷ এখন বোধ হয় কেউ পৌঁছে না, তাই আমার কাছে ভিড়িয়াছে৷ এবার আসিলে চাবকাইয়া পিঠের চামড়া তুলিয়া ফেলিব৷’’৩৫০

করালী কোষ্ঠী বিচার করে জ্যোতিষ গণনা করতে সক্ষম৷ কোষ্ঠী ছাড়া শুধুমাত্র হাতের রেখা দেখে জ্যোতিষ গণনার পারদর্শিতা অর্জনের জন্য সে দ্রাবিড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পানওয়ালী বুঝতে পারে সে কোথাও যাবে৷ সে তার আকাঙ্খিতের কাছে গন্তব্যস্থান জানতে চাইলে করালীচরণের দ্বারা চরম অপমানিত হয়৷ অবশেষে সে সাহসে ভর করে তার প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণার কারণ শুনতে চাইলে করালী প্রবল ঘৃণায় তাকে জবাব দেয়—‘‘হারামজাদী ছোটলোক বেশ্যা, তোর মুখদর্শন করলে যে পাপ হয়, তা তুই জানিস না?’’৩৫১ এত বড় নিষ্ঠুর অপভাষণে সে নিষ্প্রভ হয়ে গেলেও নিমেষে নিজেকে সংযত করে প্রায় তোষামোদের ভঙ্গিতে তার প্রতি ছুড়ে দেয় নির্মম প্রশ্নবাণ—‘‘ওমা, এইজন্যেই এত রাগ! আমি ভেবেছিলাম, বুঝি বা আর কিছু! মুখ দেখলে পাপ হয়, আর আমার কাছ থেকে সিগারেট পান নিলে বুঝি কিছু হয় না? ধন্যি শাস্তর তোমাদের!’’৩৫২

সত্যিই তো! রাতের অন্ধকারে লোকচক্ষুর আড়ালে যে সকল বিধাতাপুরুষেরা গণিকাদের দেহকে নিংড়ে নিংড়ে উপভোগ করে সামান্য ক’টি পয়সার বিনিময়ে তারাই আবার প্রকাশ্য দিবালোকে সেই উপভোক্তা রমণীকে পতিতা বলে ঘৃণা করে, অবজ্ঞায়-লাঞ্ছণায় ছুড়ে দেয় সমাজের প্রান্তসীমায়৷

করালীচরণ তার পোষ্য দাঁড়কাক এবং আহত বন্ধু মোস্তাকের দায়িত্বসহ সমস্ত বাড়িটার দেখাশোনার ভার ভন্টুকে দিয়ে গেলে ভন্টুর অনুপস্থিতিতে নির্দ্বিধায় সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় পানওয়ালী৷ ভন্টুকে শুধু অনুরোধ করে করালী যেন তার এ কথা জানতে না পারে৷ কারণ সে যে করালীর দুচক্ষের বিষ এটা তার নিজেরও অজ্ঞাত নয়৷ সে পরম নিষ্ঠার সঙ্গে করালীচরণের ঘর ও বন্ধুদের পরিচর্যা করতে থাকে৷ মোস্তাকের দুর্গন্ধময় পায়ের ক্ষতের জন্য ঔষধ ও ব্যাণ্ডেজ এনে দেয়৷ ভন্টু তাকে হাসপাতালে পাঠাতে চাইলে আঁতকে উঠে সে বলে—‘‘না তা আমি পারব না, হাসপাতালে শুনেছি বড় কষ্ট দেয় গরিবদের৷’’৩৫৩ কাকটিকে খাইয়ে-দাইয়ে পরিষ্কার করে স্নান করিয়ে তার অজস্র ঠোকর-আঁচর সহ্য করে দিব্যি হাসতে হাসতে বলে—‘‘কি দস্যি কাক! পরশু হলুদজল করে নাওয়াতে গেছি, এমন ঠুকরে দিয়েছে হাতে যে, জ্বলে মরি!’’৩৫৪ সে তার মানসপুরুষের অনুপস্থিতিতে তার সব কিছুর নিখুঁত তত্ত্বাবধান করে৷ তার বই-এর উই ঝেড়ে রোদে শুকোতে দেওয়া, পাগল মোস্তাকের সেবা করা, দাঁড়কাকের পরিচর্যা করা সবকিছুই বেশ্যার দৈহিক কলুষতা থেকে মুক্তি দিয়ে তার নারীত্বকে উদ্ভাসিত করেছে৷ তার অন্তরে বাইরে যে একটা সুন্দর ঘরকন্নার স্বপ্ন সদা বিরাজমান সেই দিকেও দিগনির্দেশ করেছেন লেখক৷ করালীর প্রতি ভালোবাসায় তার ঘরবাড়ি, দুর্গন্ধময় ক্ষতযুক্ত পাগল মোস্তাক, পোষ্য দাঁড়কাক সব কিছু আপন হয়ে উঠেছে৷ পানওয়ালীর সচেতন নারীআত্মা প্রেমাস্পদের সন্তুষ্টির জন্য ভন্টুকে একথা জানাতেও ভোলে না যে তার আসার খবর পেলে তা যেন তাকে আগে থাকতেই জানানো হয়৷ করালী এসে তাকে ফের দেখলে একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে৷

পানওয়ালীর এই নিখাদ প্রেমকে লেখক ব্যর্থ হতে দেননি৷ যে পরম যত্ন ও মমতায় সে এতকাল চরম উপেক্ষা সহ্য করেও করালীর সেবা করে গেছে অবশেষে তার নিজেরই শেষ মুহূর্তে সে লাভ করতে সক্ষম হয়েছে প্রেমিকের অনুগ্রহ৷ করালী নিজে এসেছে তাকে সেবার হাত বাড়িয়ে দিতে৷ ইতিমধ্যে করালীর ভাবনারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে৷ যে বারাঙ্গনাদের সে এতকাল শুধুমাত্র বেশ্যা বলে ঘৃণা করে এসেছে সে দ্রাবিড়ে গিয়ে জানতে পেরেছে সেও তেমনি এক বেশ্যামাতার সন্তান৷ মুহূর্তেই চোখের সম্মুখ থেকে পণ্যাঙ্গনাদের প্রতি ঘৃণার পর্দা উড়ে গেছে৷ আর গৃহে ফিরে এসে যখন মুমূর্ষু পানওয়ালীকে আবিষ্কার করেছে তখন তার সমস্ত যন্ত্রণা ক্ষোভ উপচে পড়েছে৷ জীবনের শেষবেলায় পানওয়ালী প্রেমিকের হাতের জল পেয়েছে৷ অবশেষে মৃত্যুর পর তার কাঁধে চড়েই অন্তিমযাত্রা করেছে৷ শুধু এটুকুই নয় এই উপেক্ষিতা কুল-মান আত্মীয়-স্বজনহীন বারনারীর শ্রাদ্ধক্রিয়াও করালী ধুমধাম করে সম্পন্ন করেছে৷ ভন্টুকে বলা করালীর সমস্ত কথার মধ্য দিয়ে এক সমাজ পরিত্যক্ত বারবধূর জন্য কারুণ্য ফুটে উঠেছে; তার হৃদয় উন্মোচিত হয়েছে—‘‘পারেন? কল্পনা করতে পারেন, একটা কঙ্কালসার কদাকার বুড়ি বেশ্যা অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মরছে, তার মৃত্যুর সময়ে মুখে এক ফোঁটা জল দেওয়ার লোককেউ কাছে নেই৷ কদাকার মুখ ভাল করে দেখেছেন কখনও? গালের হাড় উঁচু, কপালের শির বার করা, বড় বড় দাঁত, তাতে আবার মিশি লাগানো—… দেখেছেন কখনও কদাকার মুখ? শুধু কদাকার নয়, তৃষিত, মুমূর্ষু, যে তার কুৎসিত হাসি ও কদর্য কটাক্ষ দিয়ে আজীবন লোকও ভোলাবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু একজনকেও ভোলাতে পারেনি, একটা লোকও তার আপন হয়নি, তার মৃত্যুকালে কেউ কাছে আসেনি—দেখেছেন এরকম কখনও?… পৃথিবীতে কেউ ভাল চোক্ষে দেখত না মাগীকে৷’’৩৫৫ করালীর এই কথার মধ্য দিয়ে একজন বিগত যৌবনা রূপহীন বারনারীর জীবন-যন্ত্রণার সুনিপুণ জীবনছবি বুঝে নিতে কারও অসুবিধা হয় না৷

পানওয়ালীর দোকানে ছোকরা গোছের একটি ছেলেকে পান বেচতে দেখে, তার কাছেই ভন্টু পানওয়ালী সম্পর্কে আরও বিশদ জানতে পারে৷ সে শোনে দোকানটি পানওয়ালীর নিজের ছিল না৷ অপরের দোকানে সে চাকরি করত৷ অসুখের অজুহাতে মালিক তাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিলে সে করালীচরণের বাড়িতেই আশ্রয় নেয়৷ করালী যেদিন দ্রাবিড় থেকে ফিরে আসে সে দিনই তার হাতের জল পেয়ে পানওয়ালী সকল লৌকিক মায়া পরিত্যাগ করে৷ তার সারাজীবনের সকল যন্ত্রণা, রূপহীনতার যন্ত্রণা, প্রেমিকের প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা, দেহজীবিকার যন্ত্রণা, দারিদ্র্যের যন্ত্রণা নিমেষেই চরম সার্থকতা লাভ করে৷

এই উপন্যাসে শুধু মুক্তো, মাসি, টিয়া, কালোজাম, আঙ্গুর পানওয়ালীর মত দেহব্যবসায়ী পতিতা নারীরাই নয় রয়েছে পতিতা নারী তৈরি করার নানারকম সক্রিয় চক্রের প্রসঙ্গ৷ এই চক্রটি নারীহরণ এবং নারী পাচারের সঙ্গে যুক্ত৷ অচিনবাবু, খগেশ্বর বাবু এই অপহরণ চক্রের হাতিয়ার; মূল পাণ্ডা বৃদ্ধ ম্যানেজারবাবু৷ অশীতিপর বৃদ্ধ ম্যানেজারবাবু নিজের বিকৃত কাম-লালসাকে চরিতার্থ করার জন্য মুখোশের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকে৷ অনির্দেশ্য এক মালিকের নাম করে অচিনবাবু খগেশ্বর বাবুকে দিয়ে নারী অপহরণ করায় মোটা টাকার বিনিময়ে৷ তারা মেয়েদের কাজ দেওয়ার নাম করে বুদ্ধি ও বলের সাহায্যে (যেখানে যেটা দরকার) অপহরণ করে৷ যেমন শিক্ষয়িত্রীর বিজ্ঞাপন৷ এই বিজ্ঞাপন দেখেই মৃন্ময়ের স্ত্রী স্বর্ণলতা দুষ্কৃতিদের খপ্পরে পড়ে৷ বহুকাল পড়ে অচিনবাবু ধরা পড়লে খবরের কাগজে অপহৃত নারীর নামের তালিকা দেখে স্বর্ণলতা নামটি খুঁজে পাওয়া যায়৷ সেই অপহৃতা নারীদের সবার অলক্ষ্যে সর্বপ্রথম বলপূর্বক ধর্ষণ করে ম্যানেজারবাবু৷ অবশেষে ধর্ষিতা সেই নারীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোনো বেশ্যাপল্লীতে৷ সামাজিক পশুদের লালসার শিকার হওয়া সেই নারীরা যদি আত্মহত্যা নাও করে তথাপি পরবর্তী সময়ে দেহজীবিকাই তাদের প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়৷ যেমন সৌদামিনি৷ সৌদামিনি খগেশ্বরের স্ত্রী৷ টাকার লোভে সে তার স্ত্রী ও কন্যাকে অনায়াসে ম্যানেজারের হাতে তুলে দেয়৷ তার স্পষ্ট স্বীকারোক্তি—‘‘আপনার কাছে এনে দিলাম, আপনি বললেন, কর্তার দুজনকেই পছন্দ হয়েছে৷ নিজের চোখে দেখলাম৷ এখন বেশ সোনাদানা পরে দিব্যি জাঁকিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে মশাই,’’৩৫৬ অচিনবাবুর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে খগেশ্বর অচিনবাবুর মেয়েকেই ম্যানেজারের হাতে তুলে দিলে অচিনবাবু ক্রোধে অন্ধ হয়ে ম্যানেজারকে খুন করে এবং তার জেল হয়৷ পাপীর হাতেই পাপের শাস্তি হয়৷

ফুলশরিয়া :

‘জঙ্গম’ উপন্যাসে আরেকজন পতিতা নারী হল ফুলশরিয়া৷ তার শরীরের বিষাক্ত ঘা এর সংক্রমণে হরিয়া অসুস্থ হলে তাকে অক্লান্ত সেবা-শুশ্রুষা করে চলে৷ হাসপাতালে ঠিকঠাক ঔষধ দেয় না বলে হাসপাতালেও পাঠায় না৷ দারিদ্র্যের সঙ্গ লড়াই করে অকৃত্রিম সেবা-ভালোবাসায় শেষ পর্যন্ত তাকে সুস্থ করে তোলে ফুলশরিয়া৷ তার সঙ্গে হরিয়ার সম্পর্ক প্রেমের নয়—দেহের; তথাপি ফুলশরিয়া তার প্রতি কর্তব্যপরায়ণ৷ সে তার কর্তব্যের খাতিরেই শঙ্করকে বলতে পারে—‘‘ও যদি সুস্থ হইত, উহাকে অনায়াসেই ত্যাগ করিতে পারিতাম৷ এখন কিন্তু পারি না৷’’৩৫৭ ফুলশরিয়া বহুভোগ্যা৷ হরিয়া, রামু, জমাদার, গদাইসাহেব এরা তার গণিকা জীবনে পাথেয় সংগ্রহের মাধ্যম৷ সে তার ক্ষুদ্র জীবনে বহু পুরুষকে দেখেছে যারা তার দেহের প্রতি লালায়িত হতে দ্বিধা করেনি কিন্তু শঙ্করবাবুর মধ্যে নিষ্কাম সহায়তার মনোভাব তাকে তার কাছে শ্রদ্ধেয় করে তোলে কিন্তু নিজের আত্মসচেতন মনে নিমেষে তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে গ্রামে আগুন দেওয়ার ব্যাপারটিতে তার মনে বিরক্তি এসে বাসা বাঁধে৷ তার মনে হয় শঙ্কর বাবুর ঐ ভালোমানুষী লোক দেখানো ঢঙ৷ ফুলশরিয়ার মধ্যে প্রতিবাদিনী ও সেবাপরায়ণতার ভিন্ন দুটি সত্তা সদা বিরাজমান৷ শঙ্কর পলাশপুর থেকে হেঁটে ফেরার সময় রাস্তায় হোলির দলের মুখোমুখি হয়৷ আবিরে-রঙে-ধূলায়-নেশায় বুদ হয়ে তারা ফাগুয়া খেলতে খেলতে যাচ্ছে৷ সেখানেই মুখোমুখি হয় ফুলশরিয়ার৷ শঙ্কর তাকে দেখে বিব্রত হলে নিম্নশ্রেণীর দেহব্যবসায়ী এই পতিতা নারী তাকে প্রশ্ন করে বসে—‘‘তু হাম সেনিসে ঘিন করইছ, নেই বাবু?’’৩৫৮ ফুলশরিয়ার এই হৃদয়বিদ্ধ প্রশ্নে শঙ্কর স্থির থাকতে পারে না৷ সে তাকে এড়িয়ে দ্রুতপদে পা বাড়িয়ে হঠাৎ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ফুলশরিয়া তার দিকে নিনির্মেষে তাকিয়ে আছে৷ তার চোখ জ্বলছে, যেন বাঘিনীর চোখ! কিন্তু তার এই ঘৃণা দীর্ঘস্থায়ী হয় না৷ সমস্ত ক্ষোভ মুহূর্তে শান্ত হয়ে যায় শঙ্করের কাছে কলেরার সেবায় সহযোগিতার প্রার্থনা শুনে৷ সে কলেরার মৃতদেহ সৎকারের জন্য লোক সংগ্রহ করতে না পারলেও শঙ্করকে সাহায্য করতে খাটিয়া সংগ্রহ করে আনে কিন্তু শঙ্কর যখন মৃতদেহ ধরাধরি করে নেওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করে তখন স্বাভাবিক নারীসুলভ ভীতিতে সে তা অস্বীকার করে৷ পরে একার হাতে তার সকল কাজ করা দেখে ফুলশরিয়া মুগ্ধ বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় ভক্তিতে তার প্রতি নতমস্তক হয়৷ সে সত্যিকারের দেবতা হয়ে তার সামনে ধরা দেয়৷ তাই তো সামান্য এক পতিতা নারী গভীর রাত্রে তার পদধূলি নেওয়ার জন্য তার বাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকে৷ এ প্রসঙ্গে তার সশ্রদ্ধ উক্তি—‘‘মেথরের মড়া বাবু নিজে কাঁধে করিয়া বহিয়া লইয়া গেলেন! এ কি মানুষে পারে? এ লোককে প্রণাম না করিয়া থাকা যায়?’’৩৫৯ তার এই আত্মপোলব্ধি তার পতিতা চরিত্রের গ্লানিকে ছাপিয়ে তাকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে৷

দুলকি :

এই উপন্যাসে আরেকজন বহুবল্লভা দুলকি৷ সে জাতে মুসহর৷ মাঝে মাঝে মধু বিক্রয় করতে আসে৷ দুলকি পেশায় মধুবিক্রেতা হলেও প্রয়োজন হলে দেহবিক্রয় করতেও তার বাধে না৷ উপন্যাসের এক চরিত্র নিপুর কথায় তারই প্রতিধ্বনি৷—‘‘দেহের শুচিতা ইহাদের কাছে তত বড় নয়, মনের শুচিতা যতটা৷ প্রাণ ধারণ করিবার জন্য যেমন মধু বিক্রয় করিতে হয়, তেমনই দরকার পড়িলে দেহ বিক্রয়ও করিতে হয়৷ নারী-মাংসলোলুপ কুত্তার অভাব নাই পৃথিবীতে৷ তাহাদের লোভের খোরাক যোগাইয়া অর্থ উপার্জন করিতে হয় বই কি মাঝে মাঝে৷’’৩৬০

নিপু তার কামনার আগুনে দুলকিকে দগ্ধ করেছে৷ যতদিন থেকে সে দুলকির সংস্পর্শ লাভ করেছে সে কোনোদিনও তার মধ্যে কোনোরকম উচ্ছলতা লক্ষ করেনি৷ নির্ঝরের চাপল্য, অগ্নির প্রদাহ, মান, অভিমান, সোহাগ, আবদার কোনো কিছুই যেন তার মধ্যে নেই৷ তাই তার অহরহ মনে হয়েছে—‘‘দুলকি শুধুই যেন দেহ, কেবল মাংস খানিকটা, আর কিছু নয়৷ কিন্তু অপরূপ সে দেহের গঠন৷ ক্ষীণকটি কুচভর নমিতাঙ্গী নিবিড়নিতম্বিনী দুলকি যেন জীবন্ত অজন্তা-চিত্র৷’’৩৬১ দুলকির খদ্দের হয়ে সে সবসময় বুঝতে পেরেছে যে তার দৃষ্টিতে শঙ্কা নেই, লজ্জা নেই, আগ্রহ নেই, প্রেম নেই এমনকি দীপ্তিও নেই৷ সে যেন দেহ দান করে আর দেহের বিনিময়ে শুধু তার পাওনাটুকু বুঝে নেয়৷ একদিন নিপু তার কামনা পূরণের অবলম্বন করেছিল ফুলশরিয়াকে৷ পরবর্তী সময়ে ফুলশরিয়াকে অসুস্থ হরিয়ার সেবায় নিমজ্জিত দেখে সে সরে আসে দুলকির দিকে৷ কারণ—‘‘সে বায়োলজিকালি বাঁচিতে চায়, দুলকি ফুলশরিয়া যে কেহ একটা জুটিলেই হইল৷’’৩৬২ পুরুষের দুর্বার কামনায় নারী কীভাবে শুধুমাত্র শরীর হিসেবে উপস্থাপিত হয় নিপুর চিন্তায় তারই প্রতিধ্বনি৷

দুলকির একজন স্বামী আছে৷ স্বামী-স্ত্রীর প্রচলিত সম্পর্ক যা বোঝায় দুলকির সঙ্গে তার স্বামীর তেমন সম্পর্ক কি না জানা কঠিন৷ কিন্তু সেই দুলকির মালিক৷ দুলকি তারই পদানত৷ দুলকির সকল নৈশ-অভিযান সে-ই নিয়ন্ত্রিত করে, উপার্জনের সমস্ত টাকা তার হাতেই চলে যায়৷ এভাবে দুলকির মতো মেয়েদের পুরুষের পর পুরুষের পীড়ন সহ্য করে জীবন অতিবাহিত করতে হয়৷ নিপু সমাজসেবীর আদর্শ সামনে রেখে তার প্রবৃত্তিকে শান্ত করে ফুলশরিয়া, দুলকির মতো নারীদের দিয়ে৷ তার স্বামী নির্দ্বিধায় স্ত্রীকে নৈশঅভিসারে পরপুরুষের অঙ্কশায়িনী করতে পাঠায় নিজের অর্থলিপ্সা পূরণের জন্য৷

এইভাবে সম্পূর্ণ ‘জঙ্গম’ উপন্যাসটিতে দেখা যায় জীবনের এক চলমান রূপ৷ শঙ্করের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনের সেই রূপ প্রতিফলিত হয়েছে৷ আর সেই গতিময় পথেই পথিকরূপে এসেছে মুক্তো, মাসি, পানওয়ালী, সৌদামিনি, ফুলশরিয়া দুলকির মতো বারাঙ্গানারা৷ লেখকের অপার সহানুভূতিতে মাসি, সৌদামিনি ও দুলকি ছাড়া প্রায় সব চরিত্ররাই তাদের ত্যাগে ভালোবাসায় মহানতায় উজ্জ্বল৷ মুক্তো বেশ্যা হয়েও প্রেমিকের শুভকামনায় নিজের দুর্দমনীয় বাসনাকে সংযত করে তাকে সঙ্গচ্যুত করেছে, নির্দ্বিধায় শঙ্করের দেওয়া ঘর বাঁধার স্বপ্ন, সুস্থ জীবনে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন উপেক্ষা করে শঙ্করকে সম্মানিত জীবন উপহার দিয়েছে৷ কারণ সে জানে শঙ্কর তাকে ত্যাগ না করলেও তাকে বিবাহ করলে শঙ্কর সমাজচ্যুত হবে৷ পানওয়ালীর কুৎসিতদর্শন রূপের মধ্যেও অবস্থান করছে একটি নির্মল হৃদয়৷ আর সেই হৃদয়বৃত্তির বশবর্তী হয়ে সে ভালোবেসেছে বিকটদর্শন করালীকে৷ করালীর সমস্ত অপমান অবজ্ঞা অপবাক্য উপেক্ষা করে নিখুঁতভাবে তার ভালো-মন্দের খোঁজ রেখেছে৷ মুখ বুজে সমস্ত সহ্য করে দক্ষ গৃহিণীর মতো করালীচরণের অনুপস্থিতিতে তার গৃহের দেখভাল করেছে৷ তার দুই পোষ্য অসুস্থ মোস্তাক ও দাঁড়কাকটিকেও আপন করে নিয়েছে শুধু করালীকে ভালোবাসে জন্য৷ ফুলশরিয়া তার ঘৃণ্য দেহজীবিকার মধ্যেও তার শেষ উপার্জনটুকুও হরিয়ার জন্য ব্যয় করতে সংকোচ করেনি৷

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) :

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসল নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়৷ মানিক তাঁর ডাকনাম৷ তিনি তাঁর রচনায় ব্যক্তি ও ব্যষ্টিকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন তা অভিনব ও নিজস্ব৷ ফ্রয়েডীয় ভাবনার অনুসারী হয়ে তিনি ‘ক্ষুধা’ ও ‘রিরংসা’ মানুষের এই দুই আদিমতম প্রবৃত্তির মধ্য থেকে রিবংসাকেই প্রগাঢ়তর রূপে দেখিয়েছেন৷ মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের নানা অভিব্যক্তি এই যৌনপ্রবৃত্তির গৌণবৃত্তির পথেই সাধিত হয়৷ ব্যক্তিমানুষের এই অনবরুদ্ধ প্রবণতার উপরই তার সুস্থতা-অসুস্থতা, সফলতা-বিফলতা নির্ভর করে৷ এই দিক দিয়েই জীবনের তাৎপর্যের ইঙ্গিত দিতে চেষ্টা করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ দারিদ্র্যের ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য-অ-দারিদ্র্যের অবচেতন যৌনবিকার তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির নিয়তি৷ মানুষের যৌনকামনাপূরণের আধাররূপে তাঁর উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে গণিকা চরিত্র৷

ক. শহরবাসের ইতিকথা :

বাংলা উপন্যাসের জগতে একজন বলিষ্ঠ লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ফ্রয়েডীয় ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে মানুষের যৌনতার নগ্ন রূপকে তিনি টেনে বের করেছেন তার শৈল্পিক ক্ষমতায়৷ সেই প্রসঙ্গেই গণিকা চরিত্রের উপস্থাপন৷

‘শহরবাসের ইতিকথা’-য় (১৯৪০) দুজন দেহব্যবসায়ী নারীর পরিচয় উঠে এসেছে৷ একজন চাঁপা অপরজন দুর্গা৷

চাঁপা :

চাঁপা চরিত্রটি উঠে এসেছে মোহনের বাড়ির সতেরো টাকা মাইনের চাকর জ্যোতি এবং গ্রাম থেকে রোজগারের আশায় শহরে চলে আসা কামার শ্রীপতির অনুসঙ্গে৷ মোহনের ভাড়াবাড়ির পিছন দিকে এক অস্বাস্থ্যকর বস্তিতে চাঁপার ঘর৷ সেই বস্তিতে গেলেই—‘‘চেনা-অচেনা অতিথি অভ্যর্থনা করার জন্য দুয়ারে দুয়ারে সাজগোজ করিয়া খোঁপায় মালা জড়ানো মেয়েদের দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখা যায়৷’’৩৬৩ লেখকের বর্ণনাতেই স্পষ্ট স্থানটা পতিতাপল্লী৷ আর সেই মেয়েরা পণ্যাঙ্গনা—পুরুষ ধরার জন্য ওভাবে সাজগোজ করে ওদের সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা৷

চাঁপার ঘর সুসজ্জিত৷ সে উচ্চদরের সম্ভ্রান্ত গণিকা নয়৷ তার সামর্থ্য অনুযায়ী লন্ঠনের আলোকে সম্বল করে সে তার ঘরকে সাজিয়ে রেখেছে তার পারিপাট্যের দ্বারা৷ যে প্রবৃত্তির তাড়নায় কামদগ্ধ পুরুষ তার মতো নারীর দ্বারে উপস্থিত হয় তাদের যথাযথ আপ্যায়নের ব্যবস্থা না রাখলে তার চলবে কি করে৷ চাঁপা চপল চরিত্রের৷ গ্রামে স্ত্রীর সঙ্গে দুদিন কাটিয়ে এসে শ্রীপতি যখন যৌনকামনায় অস্থির তখন তাকে কাম নিবৃত্তির জন্য উপস্থিত হতে হয় চাঁপার ঘরে৷ চাঁপার ঘরের সন্ধান সে পেয়েছিল জ্যোতির কাছ থেকে৷ তারপর জ্যোতিকে ছেড়ে একা একদিন তার কাছে উপস্থিত হলে চাঁপা তাকে অপমান করে তার ঘর থেকে বের করে দেয়৷ শ্রীপতি বুঝতে পারে না ‘‘দেহ বেচা যার ব্যবসা তার এটা কোনদেশি নীতিজ্ঞান? কী মানে চাঁপার এই অদ্ভুত ব্যবহারের?’’৩৬৪ কিন্তু পরে যখন পুনরায় জ্যোতির সঙ্গে তার ঘরে আসে চাঁপা তাকে সাগ্রহে আপ্যায়ন করে—সেদিনের সেই অপমানের কথা বলে ঠাট্টা তামাশা করতেও ভোলে না৷

চাঁপা উচ্ছল প্রকৃতির৷ তার লাস্যভঙ্গিতে সে পুরুষকে বশ করতে সক্ষম৷ সঙ্গিনীকে চূড়ান্ত আনন্দ দিতে তার সঙ্গে বসে মদ খায়, ঠাট্টা তামাশা করে৷ তার সমস্ত আচার-আচরণ থেকে তার পেশাদারিত্বকে বোঝা যায়৷ কারণ ‘‘চাঁপা অনেকদিন এ লাইনে আছে,’’৩৬৫

দুর্গা :

গণিকা হওয়ার আগে দুর্গা ছিল একজন নিষ্ঠাবতী গৃহবধূ৷ স্বামীর নিষিদ্ধ কাজ তাকে অস্বস্তি দিত৷ তিনমাস পূর্বেও সে স্বামীর সঙ্গে ঘরকন্নায় রত ছিল৷ বছর দুই আগে সে কলকাতায় আসে স্বামীর সঙ্গে৷ দেশে থাকাকালীন স্বামী তাকে খুব ভালোবাসত—আদরযত্ন করতো কিন্তু শহরে আসার পর দিন দিন পাল্টাতে থাকে৷ মদ খেয়ে, জুয়া খেলে অশ্রাব্য গালিগালাজ সহযোগে স্ত্রীকে মারধোরও করতে থাকে৷ ঠিক মতো ঘরভাড়া দেয়না—শেষে তাদের খাওয়াও জোটে না৷ না খেয়ে স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়েও মুখ বুজে সংসার করতে থাকে৷ কিন্তু শেষে দুর্গার সমস্ত গয়না গাটি নিয়ে তাকে অকূলে ভাসিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় স্বামী৷ সহায়-সম্বলহীন দুর্গা অনুগ্রহ পায় স্বামীর বন্ধু অঘোরের৷ প্রায় দুইমাস দুর্গার সঙ্গে থেকে তাকে সাহায্য করার নামে তার শরীরকে ভোগ করে শখ মিটিয়ে বেপাত্তা হয়ে যায় অঘোর৷ বাধ্য হয়ে বাঁচার জন্য সে আশ্রয় নেয় দেহব্যবসার৷

দুর্গা মোটাসোটা, শান্ত ভালোমানুষের মতো চেহারা৷ চাঁপার মতো চপল নয়৷ বেশভূষা গৃহস্থ বৌদের মতো, মাথায় সিঁদুর পর্যন্ত রয়েছে৷ তার চেহারায়-সাজে-কথায়-কাজে একটা তেজ আর আত্মমর্যাদা ধরা পরে৷ সে চাঁপার প্রতিবেশিনী৷ জ্যোতিই তার পরিচয় করিয়ে দেয় শ্রীপতির সঙ্গে৷ দুর্গা তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই তার সব কিছু খুটিয়ে খুটিয়ে জেনে নেয়—রোজগার পর্যন্তও৷ সে তার মোটা চেহারার জন্য দুঃখ করে শ্রীপতিকে জানায় যে—ছেলেপিলে না হওয়াতে সে মুটিয়ে গিয়েছে—যার জন্য স্বামী তাকে ছেড়ে পালিয়েছে৷ স্বামীর বন্ধুও তার তন্বীর বদলে ভারী চেহারার জন্য সরে পড়েছে৷

দুর্গার শান্ত ঘরোয়া ব্যবহারে শ্রীপতি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল৷ এখন তাকে কেমন যেন ভোঁতা মনে হয় তার৷ ‘‘দুর্গার সরল সহজ কথা আন্তরিক সহানুভূতি আর তেমন মিঠা লাগে না৷’’৩৬৬ কারখানার টাকা পেয়ে শ্রীপতির স্ফূর্তি এসে যায়৷ সে ভাবে দুর্গার ঘরে চাঁপাকে নিমন্ত্রণ করে এনে হইচই করবে সারারাত৷ কিন্তু দুর্গার ঘরে যথার্থ স্ফূর্তি যে খুঁজে পাবে না তাও জানে কারণ—‘‘দুর্গা চাঁপার মতো নয়, গেলাসে চুমুক দেওয়ার বদলে সে শুধু ঠোঁটে ঠেকায়৷ অনর্গল হাসি, তামাসা ছলনা চাতুরীর উল্লাসে বিশ্বসংসার ভুলাইয়া দেওয়ার বদলে জড়োসড়ো হইয়া বসিয়া থাকে, উত্তেজনা ঠান্ডা করিয়া দেয়৷৷’’৩৬৭

গৃহবধূর সুনীতি-শালীনতার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে গণিকা বৃত্তিতে প্রবেশ করার বেশিদিন হয়নি তার৷ তাই গণিকাসুলভ চটকও আয়ত্ত করতে পারেনি৷ দেহপসারিণী হয়েও চাল-চলন,আচার-ব্যবহার সবই গৃহবধূ স্বরূপ৷ বেশ্যার হাবভাব আয়ত্ত করতে না পারলেও অর্থের প্রয়োজন সে বোঝে৷ অর্থের জন্যই তার শরীর বিক্রয়৷ জ্যোতি যখন শ্রীপতিকে জানায় দুর্গা তাকে যেতে বলেছে তখন দুর্গার সেই টাকা চেনার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে করে বলে—‘‘তা বলিবে বইকী, দুর্গা কি আর খবর রাখে না কবে সে মজুরি পাইয়াছে, আট দশ দিন খোঁজও নেয় নাই, এখন একেবারে তার জন্য ব্যাকুল হইয়া পড়িয়াছে৷ মন ভুলাইতে না জানুক দুর্গা পয়সা চেনে৷’’৩৬৮ শ্রীপতি তার বাড়িতে উপস্থিত হলে তার গায়ে পিঠে হাতবুলিয়ে হাতুড়ি পেটা স্প্রিং-এর মতো মাংসপেশীগুলিকে টিপে টিপে আমোদ পায় দুর্গা৷ সেই অবস্থাতেই তার কুশল জিজ্ঞেস করে, না আসার কারণ জানতে চায়৷ তাদের দুজনের আলাপ প্রসঙ্গে উঠে আসে গণিকার দায়বদ্ধ পয়সা আদায়ের বিবরণ৷—

‘‘আসো না কেন বলো দিকি? কী হয়েছে তোমার?…

পয়সাকড়ি নেই, আসব!

তোমার সঙ্গে আমার বুঝি শুধু পয়সার সম্পর্ক? তেমন মানুষ নই গো, নই!

নিতে তো ছাড় না৷

দিয়েছ, নিয়েছি৷ কেড়ে নিয়েছি তোমার ঠেঁয়ে?

কেড়ে নেবে কেন, তক্কে তক্কে থাকো কবে মজুরি পাই ওমনি ডাক পড়ে৷ কেড়ে নেওয়ার চেয়ে ভালো নিতে জানো তুমি৷

… না নিলে খাব কি? খেয়ে পরে বাঁচতে হবে না আমার?’’৩৬৯

পণ্যনারী দুর্গা শ্রীপতির কাছে পয়সা নেয়৷ না নিলে তাদের উপায় নেই৷ সে অকপটে সে কথা স্বীকারও করে যে না নিলে সে খেয়ে পড়ে বাঁচবে কি করে৷ পয়সার বিনিময়ে সে শ্রীপতিকে সঙ্গ দান করে৷ শ্রীপতি তাকে ভোগ করলেও পয়সার মায়া ছাড়তে পারে না৷ তাই মনে মনে তৈরি হয়েই থাকে যে সে দুর্গার সঙ্গে চিরতরে সম্পর্ক ছেদ করে দেবে৷ সে জানে যে স্বল্প পয়সায় সে দুর্গাকে ভোগ করে এসেছে তাতে দুর্গার লোকসানই হয়েছে—সুসম্পর্কের জন্যই দুর্গা তাকে প্রশ্রয় দিয়েছে তারপরেও তার আক্ষেপের শেষ নেই৷ কিন্তু দুর্গা যখন বলে—‘‘রাগ কোরো না বাবু৷ ঝগড়াঝাঁটি আমার সয় না৷ সাধ না গেলে একটি পয়সা তুমি আমায় দিয়ো না৷ আজ পর্যন্ত চাইনি, কখনও চাইব না৷’’৩৭০ তখন সে আরাম বোধ করে৷ জানতে চায় পয়সা না নিলে তার চলবে কিসে৷ দুর্গা অকপটে বলে যায় শ্রীপতির প্রতি তার সরল বিশ্বাসের কথা৷ সে জানে শ্রীপতি তার কষ্ট দেখে থাকতে পারবে না৷ সে একদিন যেচেই তাকে শাড়ি, গয়না দেবে, না নিতে চাইলে জোর করে দেবে৷ সেই দিনের প্রত্যাশায় সে বসে আছে৷ কারণ শ্রীপতির সঙ্গে মিশে সে বুঝতে পেরেছে সে নিষ্ঠুর নয়, অন্যান্য পুরুষদের মতো পাষণ্ড নয়৷ দুর্গার সেই কথা শ্রীপতিকে মনে করায় গল্পের রহস্যময় নারীদেরকে যারা পুরুষ পেলে নিজেদের বশীভূত করে রাখে, ঘরে ফিরতে দেয় না৷ দুর্গাও তেমনি করে ধীরে ধীরে তাকে বশ করতে চায়—তার পর নিজের খাওয়া পরার সব দায়িত্ব অর্পণ করতে চায় তার স্কন্ধে৷ সাবধানি শ্রীপতি সেদিনই সংকল্প করে সে আর দুর্গার কাছে আসবে না—তার স্তিমিত হয়ে আসা কামনার দাহ সে সংকল্প রক্ষায় তাতে সাহায্য করলেও দুর্গাকে সে ভুলতে পারে না৷ দুর্গাই একমাত্র নারী যে সিংপুরের হাতুড়িপেটা গেয়ো কামারকে, কারখানার সামান্য কর্মী শ্রীপতিকে সম্ভ্রম করেছে—সম্মান করেছে যা সে কারও কাছে পায়নি এমনকি নিজের স্ত্রী কদমের কাছেও নয়৷

চাঁপার কোনো অতীত কাহিনি তুলে ধরেননি রচনাকার৷ সে বহুদিনের পেশায় অভ্যস্ত বারবনিতা৷ কিন্তু দুর্গা তা নয়৷ সদ্য গণিকা হওয়া এক নারীর ভেতরকার দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন দুর্গার মধ্য দিয়ে৷ সে যেমন তার গৃহবধূর খোলসটিকেও সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারেনি তেমনি বেশ্যাজীবনের নিষ্ঠুরতাকেও সম্পূর্ণ আয়ত্ত করতে পারেনি৷ দুর্গা চরিত্রটি এ দিক থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনব সৃষ্টি৷

খ. ধরাবাঁধা জীবন :

‘ধরাবাঁধা জীবন’ (১৯৪২) উপন্যাসে গণিকা প্রসঙ্গ এসেছে উপন্যাসের নায়ক ভূপেনের স্ত্রীর মৃত্যুর পর৷ মৃত্যুশোক বা তার জীবনের শূন্যতাকে ভোলার জন্য বন্ধুদের সাহায্যে তাদেরই সঙ্গে গণিকালয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে৷ তারা ভূপেনকে আহ্বান জানিয়ে বলে ‘‘এখন তো বাইরে রাত কাটাতে বাধা নেই, এসো না?’’৩৭১ সংসারী মধ্যবয়সি ভূপেন দুই বন্ধুর সঙ্গে মদ ও মেয়েমানুষের সঙ্গ লাভের জন্য উপস্থিত হয় দেহপসারিণীর দোকানের মতো সাজানো ঘরে৷ ভূপেন তার প্রথম যৌবনেও কয়েকটি স্ফূর্তির রাত্রি যাপন করেছিল নিষিদ্ধপল্লীতে কিন্তু বন্ধুদের মতো অভ্যস্ত হতে পারেনি৷ তারা তাদের মধ্য বয়সেও স্ত্রীর একঘেয়ে সাহচর্য থেকে মুক্তির জন্য পতিতা নারীর দেহসুখ অন্বেষণ করে৷ কিন্তু গণিকালয়ে মদের নেশায় বিভোর ভূপেন যখন শশীতারা নাম্নি বারাঙ্গনাকে একরাত্রের জন্য ভাড়া করেও তার সঙ্গীত ও শরীর আস্বাদন করতে পারে না তখন তার বন্ধুদের মনে হয়—‘‘বড়ো একঘেয়ে জীবন, ফুর্তি কোনোদিন জমে না, ভূপেন সঙ্গে থাকায় আশা করিয়াছিল হয়তো আজ জমিবে৷ রাত্রির পর রাত্রি বৃথা গিয়াছে, আরেকটা রাত্রি আজ ব্যর্থ হইয়া গেল৷ এখন আবার অন্য একটি রাত্রির ভরসায় বুক বাঁধিতে হইবে৷’’৩৭২

গণিকাদের পয়সার বিনিময়ে ভাড়া করে তারপর তাকে উদোম ভোগের ইঙ্গিত রয়েছে উপন্যাসটিতে৷

সঞ্জয় ভট্টাচার্য (১৯০৯-১৯৬৯) :

সঞ্জয় ভট্টাচার্য উপন্যাস জগতে বিচরণ করলেও তাঁর মুখ্য পরিচয় একজন কবি এবং পূর্বাশা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে৷ তিনি তাঁর উপন্যাসের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন বুদ্ধিজীবীর অস্তিত্বকে এবং সেকারণেই উপন্যাসগুলি গতানুগতিক না হয়ে পরীক্ষামূলক হয়ে উঠেছে৷ তিনি একদিকে যেমন অনুসরণ করেছেন চেতনাপ্রবাহ বা মনস্তত্ত্বমূলকরীতিকে তেমনি অন্যদিকে জেমস্ জয়েস, প্রুস্ত বা অস্তিবাদী দর্শনের ধারা৷ সেই সঙ্গে পালন করেছেন কালমাকর্স এর মার্কসীয় চিন্তাচেতনাকে৷ ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে (দ্বিতীয় বর্ষ, ১৩৭২, আশ্বিন) উপন্যাসের বিষয় সম্পর্কে বলেছেন যে—ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে সমাজ জীবনের যে অবশ্যম্ভাবী সংঘাত এবং তার ফলে সমাজজীবনে বা ব্যক্তিজীবনে যে রূপান্তর তা যেমন কথা সাহিত্যের উপজীব্য হতে পারে তেমনি ইতিহাসেরও৷ তাঁর মতে সব উপন্যাসই ইতিহাস তা অতীত অথবা বর্তমানের৷ তাঁর এই মননচর্চা ও ইতিহাসবোধের যে বিশিষ্টতা তার প্রতিফলন যেন ‘বৃত্ত’ উপন্যাসটির পরতে পরতে৷

ক. বৃত্ত :

সঞ্জয় ভট্টাচার্য যুগ যন্ত্রণার এক খণ্ড রূপের রূপকার হিসেবেই ‘বৃত্ত’ (১৯৪২) উপন্যাসটি রচনা করেছেন৷ এর কেন্দ্রীয় আকর্ষণ যৌনমনস্তাত্ত্বিকতা ভিত্তিক৷ এখানে বর্ণিত হয়েছে এক মধ্যবয়স্ক অধ্যাপক সত্যবানের পনেরো বছর আগে পিতা-মাতার মতের বিরূদ্ধে যাওয়া দুঃসাহসিক নারী সতীকে বিয়ে করা৷ কিন্তু বিয়ের পর সতী দুঃসাহসী থেকে স্বামীর অনুবর্তনকারিণী নারীরূপে নিজেকে প্রতিভাত করে যা সত্যবানের উত্তপ্ত হৃদয় কামনাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না৷ তার কামনা পূরণের আধার হয় সুরমা ও তার মেয়ে বনানী৷ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সুরমা এবং যুদ্ধোত্তর যুগের সন্তান পিতার স্নেহ বঞ্চিত বনানী পেশাগত গণিকা নয়, দুরন্ত স্বেচ্ছারিণী৷ আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারায় এরা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত৷

সুরমা :

উপন্যাসের এক অন্যতম চরিত্র সুরমা৷ মতের অমিল হওয়ায় সে স্বামী থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে৷ শুধু নিজেকে নয় মেয়ে বনানীকেও পিতৃসান্নিধ্য থেকে দূরে সরিয়ে তার মতো করে মানুষ করতে শুরু করেছে৷ তার মধ্যে স্বাধীনতাবোধ প্রবল৷ প্রভূত সম্পদশালিনী এই নারী স্বাধীনতার জন্যই স্বামীকে অনায়াসে বলতে পারে—‘‘আপনার টাকাপয়সার জোর থাকলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন—কিন্তু আমি জানি আমাকে কেন, খুকিকেও আপনি নিতে পারবেন না৷’’৩৭৩

বৈবাহিক সম্পর্কের আদর্শ তার কাছে ভিত্তিহীন৷ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আত্মার মিল না থাকলে সে বিয়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এবং তা একটা শৃঙ্খলা৷ সে সত্যবানকে বলে—‘‘কেন জানি নে বিয়েতেই আমি বিশ্বাস হারিয়েছি৷’’৩৭৪ শুধু বিয়ে নয় যৌনতা সম্পর্কেও তার মনোভাব স্বাধীন৷ সে স্বামীকে ত্যাগ করেছে কিন্তু যৌনতাকে নয়৷ তাই বহুপুরুষের সঙ্গে রচনা করেছে অবৈধ যৌন সম্পর্ক কিন্তু তৃপ্তি পায়নি কোথাও৷ তার অন্তর্নিহিত বিশ্বাস ও বিচ্ছিন্নতাকে ভোলার জন্য কামনার প্রাসাদ রচনা করেছে; রজত, সত্যবান নির্দ্বিধায় সেই প্রাসাদের অতিথি হয়েছে৷ তার জীবনের কোনো দিকই অন্ধকার রাখেনি মেয়ের কাছে৷ তার ধারণা মেয়ে তার স্বাধীন হয়ে উঠুক, জীবনের সবটা নিজে দেখে, নিজের কানে শুনে জানুক৷

জীবনের শেষের দিকে উপস্থিত হয়ে সুরমা যখন বুঝতে পেরেছে তার মেয়েও সত্যবানের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত তখন মেয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারবে না জন্যই অসুস্থ শরীরে বায়ু পরিবর্তনের জন্য পুরীতে গিয়ে সেখানে থেকে মেয়ের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে৷ সুরমার অন্তর্ধানের কারণ সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন রচনাকার—‘‘বনানী যে ধীরে ধীরে সত্যবানের কাছে এগিয়ে গেছে তা কি সুরমা লক্ষ করে নি? একদিন নিজেও সুরমা তাই করেছিল—একদিন যা সে করেছিল, মনে হয়েছিল যা জীবনের একটা নিগূঢ় সত্য বলে—তা কি সে নিশ্চিহ্ন করে মুছে ফেলেছে আজ? কে বলবে যে আজও সুরমা সত্যবানকে ভালোবাসে না? কিন্তু তা-ই বলে সে বনানীর সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না, পারে শুধু সরে যেতে৷’’৩৭৫

বনানী :

বনানী যুদ্ধোত্তর যুগের সন্তান৷ তার চরিত্র আরও অদ্ভুত৷ সেও মায়ের মতোই স্বেচ্ছাচারে দুর্বার৷ উপন্যাসে যখন তাকে প্রথম দেখা যায় তখন তার বয়স বারো৷ সে সমাজতন্ত্রবাদের সমর্থক হয় তার ভরা যৌবনে৷ কর্মসহচর শিশির কিন্তু যৌনপরিতৃপ্তিকারী তার চেয়ে ষোলো বছরের বড় মধ্যবয়সি সত্যবান৷ তার সহপাঠী ও সম্ভাব্য প্রণয়ী সমাজনৈতিক মতবাদের অত্যুৎসাহে যখন প্রেম ভালোবাসা ইত্যাদি সুকোমল মনোবৃত্তিগুলিকে ঠেলে সরিয়ে রেখেছে এবং সমাজ পুনর্গঠন না হওয়া পর্যন্ত সেগুলিকে আপ্যায়ন করারও পক্ষপাতী নয় তখন হৃদয়াবেগের মোহ পরিতৃপ্তির জন্য সে আশ্রয় নিয়েছে সত্যবানের৷ অকপটে তার প্রতি অনুরাগের কথা যেমন প্রকাশ করতে পেরেছে তেমনি ক্ষুদ্র চিঠি লিখে নিবেদন করেছে তার প্রেমাকাঙ্খাকে৷ মানুষের যৌনবৃত্তির যে রূপান্তর হয় তা সে নির্দ্বিধায় সত্যবানকে জানায় এবং বলে—‘‘ওকে প্রাধান্য দেওয়াতেও ক্ষতি চেপে যাওয়াতেও ক্ষতি৷ পুরুষ-নারীর মধ্যে শুধু এ সম্বন্ধই আছে এ যেমন আমি ভাবতে পারি নে তেমনি পুরুষ-নারীর মেলামেশার ভেতর এ-বৃত্তিটাকে সতর্ক পাহারা দিয়ে রাখতে হবে তা-ও আমি মানতে রাজি নই৷’’৩৭৬ অর্থাৎ মানুষের যৌনপ্রবৃত্তি সম্পর্কে নিজস্ব একটা মত নিজস্ব একটা দর্শন তার মধ্যে বর্তমান৷ কিন্তু এই দ্বিধাবিভক্ত মন নিয়ে জীবনে কি চরিতার্থতা প্রত্যাশা করে তা বোঝা কঠিন৷ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন—‘‘যৌনবোধের পরিমিত অসংকোচ উপভোগ ও ইহাকে মানস-বিলাসের সহিত জড়িত না করার যৌক্তিকতা সম্বন্ধে তাহার মত তাহার মাতার মতের প্রতিধ্বনি; তাহার মাতারই জীবনাভিজ্ঞতা মতবাদরূপে তাহার অনভিজ্ঞ মনে সংক্রামিত হইয়াছে৷ তাহার স্বতঃস্ফূর্ত লীলা চঞ্চলতা ও নিশ্চিন্ত উপভোগস্পৃহা তাহার নব উন্মেষিত যৌবনের দুঃসাহসিকতারই বিচ্ছুরণ; ইহার মূল কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত মানস সাম্যে নিহিত নাই৷ মনে যৌবনের জোয়ারে ভাটা পড়িলে তাহার এই সরসতাও শুকাইয়া যাইবে; বয়োবৃদ্ধির সহিত সেও সুরমার দ্বিতীয় সংস্করণে রূপান্তরিত হইবে৷’’৩৭৭

তথ্যসূত্র :

১. পাঁচকড়ি দে রচনাবলী (১), পৃ-১৫৷

 ২. তদেব, পৃ-১৫৷

 ৩. তদেব, পৃ-১৬৷

 ৪. তদেব, পৃ-২৪৷

 ৫. তদেব, পৃ-২৬৷

 ৬. তদেব, পৃ-৬৫৷

 ৭. তদেব, পৃ-৬৬৷

 ৮. তদেব, পৃ-২৪৷

 ৯. তদেব, পৃ-৬৬৷

 ১০. তদেব, পৃ-১৬৷

 ১১. তদেব, পৃ-১২৮৷

 ১২. তদেব, পৃ-১৩৫৷

 ১৩. তদেব, পৃ-১৪৩৷

 ১৪. শরৎ রচনাসমগ্র (৩), পৃ-৩০০৷

 ১৫. ক্ষেত্র গুপ্ত, বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস (৩), পৃ-১৪০৷

 ১৬. শরৎ রচনাসমগ্র (৩), পৃ-২৭০৷

 ১৭. তদেব, পৃ-২৭৬৷

 ১৮. তদেব, পৃ-২৯৬৷

 ১৯. তদেব, পৃ-২৯৬৷

 ২০. তদেব, পৃ-৩৩১৷

 ২১. তদেব, পৃ-৪২৫৷

 ২২. তদেব, পৃ-৩৪২৷

 ২৩. তদেব, পৃ-৩৫৯৷

 ২৪. তদেব, পৃ-৩৬০৷

 ২৫. তদেব, পৃ-৩৮০৷

 ২৬. তদেব, পৃ-৪৩৩৷

 ২৭. তদেব, পৃ-৪২৬৷

 ২৮. তদেব, পৃ-৪২৯৷

 ২৯. তদেব, পৃ-৪২৯-৪৩০৷

 ৩০. তদেব, পৃ-৪৩০৷

 ৩১. তদেব, পৃ-৪৩০৷

 ৩২. সম্পাদক সুকুমার সেন, শরৎসাহিত্য সমগ্র, পৃ-৫৫৬৷

 ৩৩. তদেব, পৃ-৫৪৩৷

 ৩৪. তদেব, পৃ-৫৪৪৷

 ৩৫. তদেব, পৃ-৫৪৪৷

৩৬. তদেব, পৃ-৫৫৫৷

৩৭. তদেব, পৃ-৫৬৪৷

৩৮. তদেব, পৃ-৫৬৪

৩৯. শরৎ রচনাসমগ্র (৩), পৃ-৩১৷

৪০. তদেব, পৃ-৩২৷

৪১. তদেব, পৃ-৩৩৷

৪২. তদেব, পৃ-৩৮৷

৪৩. তদেব, পৃ-৩৯৷

৪৪. তদেব, পৃ-৩৯৷

৪৫. তদেব, পৃ-৪৭৷

৪৬. তদেব, পৃ-৫৬৷

৪৭. তদেব, পৃ-৫৭৷

৪৮. তদেব, পৃ-৫৯৷

৪৯. তদেব, পৃ-৬৪৷

৫০. তদেব, পৃ-৬৫৷

৫১. তদেব, পৃ-৬৬৷

৫২. তদেব, পৃ-১১০৷

৫৩. তদেব, পৃ-১১১৷

৫৪. তদেব, পৃ-১১২৷

৫৫. তদেব, পৃ-১১৫৷

৫৬. তদেব, পৃ-১১৫৷

৫৭. তদেব, পৃ-১১৫৷

৫৮. তদেব, পৃ-১১৬৷

৫৯. তদেব, পৃ-১২১৷

৬০. তদেব, পৃ-১২৫৷

৬১. তদেব, পৃ-১২৭৷

৬২.  তদেব, পৃ-১৮৭

৬৩.  তদেব, পৃ-২২৮৷

৬৪. তদেব, পৃ-১৯৭৷

৬৫. তদেব, পৃ-২৩১৷

৬৬. তদেব, পৃ-২৫৫৷

৬৭. তদেব, পৃ-২৫৬৷

৬৮. তদেব, পৃ-২৫৯৷

৬৯. তদেব, পৃ-২১৬৷

৭০. তদেব, পৃ-২১৮৷

৭১. তদেব, পৃ-২৬৪৷

৭২. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শুভদা, পৃ-৫৮৷

 ৭৩. তদেব, পৃ-৬৬৷

 ৭৪. তদেব, পৃ-৮৯৷

 ৭৫. তদেব, পৃ-৯০৷

 ৭৬. তদেব, পৃ-১০১৷

 ৭৭. তদেব, পৃ-২১৷

 ৭৮. তদেব, পৃ-২১৷

 ৭৯. তদেব, পৃ-২২৷

 ৮০. তদেব, পৃ-২৩৷

 ৮১. তদেব, পৃ-২৩৷

 ৮২. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী, (উপন্যাস), ২য় খণ্ড, পৃ-৩২৩৷

 ৮৩. তদেব, পৃ-৩২৪৷

 ৮৪. তদেব, পৃ-৩৭৭৷

 ৮৫. তদেব, পৃ-৩৭৭৷

 ৮৬. তদেব, পৃ-৪০৫৷

 ৮৭. তদেব, পৃ-৪২৬৷

 ৮৮. তদেব, পৃ-৪২৯৷

 ৮৯. তদেব, পৃ-৪৩৭৷

 ৯০. তদেব, পৃ-৪৬৯৷

 ৯১. তদেব, পৃ-৪৮২৷

 ৯২. তদেব, পৃ-৪৮২৷

 ৯৩. তদেব, পৃ-৪৮৩৷

 ৯৪. তদেব, পৃ-৫১৫৷

 ৯৫. তদেব, পৃ-৪৫৮৷

 ৯৬. তদেব, পৃ-৩১২৷

 ৯৭. তদেব, পৃ-৩১২৷

 ৯৮. তদেব, পৃ-৪৪৬৷

 ৯৯. তদেব, পৃ-৫৭১৷

 ১০০. তদেব, পৃ-৫৩৪৷

 ১০১. তদেব, পৃ-৫৩৫৷

 ১০২. তদেব, পৃ-৫৩৫৷

 ১০৩. তদেব, পৃ-৫৬৯৷

 ১০৪. তদেব, পৃ-৩৮৩৷

 ১০৫. তদেব, পৃ-৭৬৷

 ১০৬. তদেব, পৃ-১৪৩৷

 ১০৭. তদেব, পৃ-১৪৩৷

১০৮. তদেব, পৃ-১৪৩৷

১০৯. তদেব, পৃ-১৪৪৷

১১০. তদেব, পৃ-২৫৫৷

১১১. তদেব, পৃ-৭৬৷

১১২. তদেব, পৃ-৭৯৷

১১৩. তদেব, পৃ-৮৫৷

১১৪. তদেব, পৃ-৮৫-৮৬৷

১১৫. তদেব, পৃ-৮৮৷

১১৬. তদেব, পৃ-৮৮৷

১১৭. তদেব, পৃ-১০৯৷

১১৮. তদেব, পৃ-১০০৷

১১৯. তদেব, পৃ-১১২৷

১২০. তদেব, পৃ-১১২৷

১২১. তদেব, পৃ-১১৪৷

১২২. তদেব, পৃ-১৩৯৷

১২৩. তদেব, পৃ-১৪৬৷

১২৪. তদেব, পৃ-১৪৭৷

১২৫. তদেব, পৃ-১৪৮৷

১২৬. তদেব, পৃ-১৫৪৷

১২৭. তদেব, পৃ-১৫৫-১৫৬৷

১২৮. তদেব, পৃ-১৬৩৷

১২৯. তদেব, পৃ-২০৯৷

১৩০. তদেব, পৃ-২২০৷

১৩১. তদেব, পৃ-২২৮৷

১৩২. তদেব, পৃ-২৪৪৷

১৩৩. তদেব, পৃ-২৪৫৷

১৩৪. তদেব, পৃ-২৪৫৷

১৩৫. তদেব, পৃ-২৫১৷

১৩৬. তদেব, পৃ-২৫৬৷

১৩৭. তদেব, পৃ-২৫৬৷

১৩৮. তদেব, পৃ-২৫৭৷

১৩৯. তদেব, পৃ-২৫৭৷

১৪০. তদেব, পৃ-২৫৮৷

১৪১. তদেব, পৃ-২৬০৷

১৪২. তদেব, পৃ-২৬০৷

১৪৩. তদেব, পৃ-২৬২৷

১৪৪. তদেব, পৃ-২৬৪৷

১৪৫. তদেব, পৃ-২৬৪৷

১৪৬. তদেব, পৃ-২৬৫৷

১৪৭. তদেব, পৃ-২৬৫৷

১৪৮. তদেব, পৃ-২৬০৷

১৪৯. তদেব, পৃ-২৭৯৷

১৫০. তদেব, পৃ-২৮৯৷

১৫১. তদেব, পৃ-২৯৪৷

১৫২. তদেব, পৃ-২৯৬৷

১৫৩. তদেব, পৃ-৩০১৷

১৫৪. তদেব, পৃ-৩০১৷

১৫৫. তদেব, পৃ-১০৪৷

১৫৬. তদেব, পৃ-১০৪৷

১৫৭. তদেব, পৃ-১৫৩৷

১৫৮. তদেব, পৃ-১৫৪৷

১৫৯. তদেব, পৃ-১৫৪৷

১৬০. তদেব, পৃ-১৫৫৷

১৬১. তদেব, পৃ-১৫৫৷

১৬২. জগদীশ গুপ্ত, লঘুগুরু ও অসাধু সিদ্ধার্থ, পৃ-১৭৷

১৬৩. তদেব, পৃ-১৪৷

১৬৪. তদেব, পৃ-১০৷

১৬৫. তদেব, পৃ-২০৷

১৬৬. তদেব, পৃ-২৯৷

১৬৭. তদেব, পৃ-২৮৷

১৬৮. তদেব, পৃ-৩০৷

১৬৯. তদেব, পৃ-৩১৷

১৭০. তদেব, পৃ-৩৩৷

১৭১. তদেব, পৃ-৩৯৷

১৭২. তদেব, পৃ-৫১৷

১৭৩. তদেব, পৃ-৫১৷

১৭৪.  তদেব, পৃ-৬৯৷

১৭৫. তদেব, পৃ-৪৯৷

১৭৬. তদেব, পৃ-৫৯৷

১৭৭. তদেব, পৃ-৫৭৷

১৭৮. তদেব, পৃ-৫৭৷

১৭৯. তদেব, পৃ-৫৭৷

১৮০. তদেব, পৃ-৫৯৷

১৮১. তদেব, পৃ-৬০৷

১৮২. তদেব, পৃ-৬৩-৬৪৷

১৮৩. তদেব, পৃ-৬৭৷

১৮৪. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (দ্বিতীয় খণ্ড), পৃ-৩১৫৷

১৮৫. তদেব, পৃ-৩৬৪৷

১৮৬. তদেব, পৃ-৩৬৫৷

১৮৭. তদেব, পৃ-৮৪৭৷

১৮৮. ক্ষেত্রগুপ্ত, বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস (৩), পৃ-

১৮৯. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র, (দ্বিতীয় খণ্ড), পৃ-৪১৬৷

১৯০. তদেব, পৃ-৪২২৷

১৯১. তদেব, পৃ-৪২২৷

১৯২. তদেব, পৃ-৪৩৭৷

১৯৩. তদেব, পৃ-৪৩৮৷

১৯৪. তদেব, পৃ-৪৫৭-৪৫৮৷

১৯৫. তদেব, পৃ-৪৭৬৷

১৯৬. তদেব, পৃ-৪৫৮৷

১৯৭. তদেব, পৃ-৪৫৩৷

১৯৮. তদেব, পৃ-৪৫৭৷

১৯৯. তদেব, পৃ-৪৫৯৷

২০০. তদেব, পৃ-৪৭১৷

২০১. তদেব, পৃ-৪৭৮৷

২০২. তদেব, পৃ-৪৭৮৷

২০৩. তদেব, পৃ-৪৮০৷

২০৪. তদেব, পৃ-৪৮১৷

২০৫. তদেব, পৃ-৪৫৭৷

২০৬. তদেব, পৃ-৪৫৭৷

২০৭. তদেব, পৃ-৪৫৮৷

২০৮. তদেব, পৃ-৪৩৭৷

২০৯. তদেব, পৃ-৪৩৮৷

২১০. তদেব, পৃ-৪৩৯৷

২১১. তদেব, পৃ-৪৪৪৷

২১২. তদেব, পৃ-৪৪৫৷

২১৩.  তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রচনাবলী তৃতীয় খণ্ড, পৃ-২৩০৷

২১৪.  তদেব, পৃ-২৩১৷

২১৫.  তদেব, পৃ-২৩২৷

২১৬. তদেব, পৃ-২৩৪৷

২১৭. তদেব, পৃ-২৩৫৷

২১৮. তদেব, পৃ-২৪৩৷

২১৯. তদেব, পৃ-২৪৭৷

২২০. তদেব, পৃ-২৪৮৷

২২১. তদেব, পৃ-২৪৮৷

২২২. তদেব, পৃ-২৫২৷

২২৩. তদেব, পৃ-২৫২৷

২২৪. তদেব, পৃ-২৫৫৷

২২৫. তদেব, পৃ-২৬৯৷

২২৬. তদেব, পৃ-৩০৩৷

২২৭. তদেব, পৃ-৩০৬৷

২২৮. তদেব, পৃ-৩০৭৷

২২৯. তদেব, পৃ-৩০৭৷

২৩০. তদেব, পৃ-৩০৮৷

২৩১. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ-১৩৩৷

২৩২. তদেব, পৃ-১৭০৷

২৩৩. তদেব, পৃ-১৭০৷

২৩৪. তদেব, পৃ-১৮৭৷

২৩৫. ক্ষেত্রগুপ্ত, বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস, (৪), পৃ-৫৮৷

২৩৬. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড, পৃ-২৬৬৷

২৩৭. তদেব, পৃ-৩২৬৷

২৩৮. তদেব, পৃ-৩৩৩৷

২৩৯. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রচনাবলী, পঞ্চম খণ্ড, পৃ-৫৩৷

২৪০. তদেব, পৃ-৫৫৷

২৪১. তদেব, পৃ-৫৪৷

২৪২. তদেব, পৃ-৫৯৷

২৪৩. তদেব, পৃ-৯০৷

২৪৪. তদেব, পৃ-৯০৷

২৪৫. তদেব, পৃ-৯১৷

২৪৬. তদেব, পৃ-১৩৬৷

২৪৭. তদেব, পৃ-১৩৬৷

২৪৮. তদেব, পৃ-১৪১৷

২৪৯. তদেব, পৃ-১৪১৷

২৫০. তদেব, পৃ-১৪৪-১৪৫৷

২৫১. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি, পৃ-৬৫৷

২৫২. তদেব, পৃ-৬৬৷

২৫৩. তদেব, পৃ-৬৭৷

২৫৪. তদেব, পৃ-৬৭৷

২৫৫. তদেব, পৃ-৭০৷

২৫৬. তদেব, পৃ-৮১৷

২৫৭. তদেব, পৃ-৯৪৷

২৫৮. তদেব, পৃ-১০১৷

২৫৯. তদেব, পৃ-১০২৷

২৬০. তদেব, পৃ-১০৪৷

২৬১. তদেব, পৃ-১১১৷

২৬২. তদেব, পৃ-১১৭৷

২৬৩. তদেব, পৃ-১১৮৷

২৬৪. তদেব, পৃ-১১৮৷

২৬৫. তদেব, পৃ-১৩২৷

২৬৬. তদেব, পৃ-১৩১৷

২৬৭. তদেব, পৃ-১৩১৷

২৬৮. তদেব, পৃ-১৪৩৷

২৬৯. তদেব, পৃ-১৪৫৷

২৭০. তদেব, পৃ-১৪৬৷

২৭১. তদেব, পৃ-৭০৷

২৭২. তদেব, পৃ-১৪১৷

২৭৩. তদেব, পৃ-১৩৪৷

২৭৪. তদেব, পৃ-১৩৪৷

২৭৫. তদেব, পৃ-১৩৫৷

২৭৬. তদেব, পৃ-১৩৫৷

২৭৭. তদেব, পৃ-১৩৬৷

২৭৮. তদেব, পৃ-১৪৭৷

২৭৯. তদেব, পৃ-১৫৫৷

২৮০. তদেব, পৃ-১৪৭৷

২৮১. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৪১৷

২৮২. তদেব, পৃ-৪০৷

২৮৩. তদেব, পৃ-৩৬৷

২৮৪. তদেব, পৃ-৩৯৷

২৮৫. তদেব, পৃ-৬৬৷

২৮৬. তদেব, পৃ-৭৩৷

২৮৭. তদেব, পৃ-১০৪৷

২৮৮. তদেব, পৃ-১২১৷

২৮৯. তদেব, পৃ-১৮৩৷

২৯০. তদেব, পৃ-১৮৪৷

২৯১. তদেব, পৃ-১৮৭৷

২৯২. তদেব, পৃ-২১০৷

২৯৩. তদেব, পৃ-২১০-২১১৷

২৯৪. তদেব, পৃ-২২১৷

২৯৫. তদেব, পৃ-২৩৫৷

২৯৬. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড, পৃ-৩২৷

২৯৭. তদেব, পৃ-৩৩৷

২৯৮. তদেব, পৃ-৭৬৷

২৯৯. তদেব, পৃ-১৩৪৷

৩০০. তদেব, পৃ-১৫০৷

৩০১. তদেব, পৃ-২৪৫৷

৩০২. তদেব, পৃ-২৫৩৷

৩০৩. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৪০৷

৩০৪. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, পৃ-৩৭১৷

৩০৫. বনফুলের রচনাসমগ্র (প্রথম খণ্ড), পৃ-১১৯৷

৩০৬. তদেব, পৃ-১১৯৷

৩০৭. তদেব, পৃ-১৩২৷

৩০৮. তদেব, পৃ-১৩৬৷

৩০৯. তদেব, পৃ-১৩৭৷

৩১০. তদেব, পৃ-২৮৩৷

৩১১. তদেব, পৃ-২৮৩৷

৩১২. তদেব, পৃ-২৮৫৷

৩১৩. তদেব, পৃ-২৮৫৷

৩১৪. তদেব, পৃ-২৮৫৷

৩১৫. তদেব, পৃ-২৮৫৷

৩১৬. তদেব, পৃ-২৮৫৷

৩১৭. তদেব, পৃ-১০২৷

৩১৮. তদেব, পৃ-৩১৫৷

৩১৯. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-১৭৮৷

৩২০. তদেব, পৃ-১৭৮৷

৩২১. তদেব, পৃ-১৭৮৷

৩২২. তদেব, পৃ-১৭৮৷

৩২৩. তদেব, পৃ-১৭৮৷

৩২৪. তদেব, পৃ-১৭৯৷

৩২৫. তদেব, পৃ-১৭৯৷

৩২৬. তদেব, পৃ-১৭৯৷

৩২৭. তদেব, পৃ-১৯৩৷

৩২৮. তদেব, পৃ-১৯৩৷

৩২৯. তদেব, পৃ-১৭৬৷

৩৩০. তদেব, পৃ-১৯৩৷

৩৩১. তদেব, পৃ-১৯৪৷

৩৩২. তদেব, পৃ-১৯৪৷

৩৩৩. তদেব, পৃ-১৯৪-১৯৫৷

৩৩৪. তদেব, পৃ-১৯৫৷

৩৩৫. তদেব, পৃ-১৯৫৷

৩৩৬. তদেব, পৃ-১৯৫৷

৩৩৭. তদেব, পৃ-১৯৬৷

৩৩৮. তদেব, পৃ-২১২-২১৩৷

৩৩৯. তদেব, পৃ-২৩৫৷

৩৪০. তদেব, পৃ-২৩৬৷

৩৪১. তদেব, পৃ-২৫৮৷

৩৪২. তদেব, পৃ-৩২৯৷

৩৪৩. তদেব, পৃ-২৪৷

৩৪৪. তদেব, পৃ-২৪৷

৩৪৫. তদেব, পৃ-১৯৫৷

৩৪৬. তদেব, পৃ-১১৪৷

৩৪৭. তদেব, পৃ-১১৪৷

৩৪৮. তদেব, পৃ-২০৩৷

৩৪৯. তদেব, পৃ-২০১৷

৩৫০. তদেব, পৃ-২০৩৷

৩৫১. তদেব, পৃ-২৭৩৷

৩৫২. তদেব, পৃ-২৭০৷

৩৫৩. তদেব, পৃ-৩৩৩৷

৩৫৪. তদেব, পৃ-৩৩৩৷

৩৫৫. তদেব, পৃ-৪০০-৪০১৷

৩৫৬. তদেব, পৃ-২২৬৷

৩৫৭. তদেব, পৃ-৪৭৮৷

৩৫৮. তদেব, পৃ-৫৭৭৷

৩৫৯. তদেব, পৃ-৫৯৮৷

৩৬০. তদেব, পৃ-৫২০৷

৩৬১. তদেব, পৃ-৫১৮৷

৩৬২. তদেব, পৃ-৫১৯৷

৩৬৩. মানিক উপন্যাস সমগ্র (১ম খণ্ড), পৃ-৭৩০৷

৩৬৪. তদেব, পৃ-৭৫৯৷

৩৬৫. তদেব, পৃ-৭৭৩৷

৩৬৬. তদেব, পৃ-৭৭২৷

৩৬৭. তদেব, পৃ-৭৭৩৷

৩৬৮. তদেব, পৃ-৭৭৩৷

৩৬৯. তদেব, পৃ-৭৭৩৷

৩৭০. তদেব, পৃ-৭৭৩৷

৩৭১. তদেব, পৃ-৪২৮৷

৩৭২. তদেব, পৃ-৪২৯৷

৩৭৩. শাশ্বতী গাঙ্গুলী, সঞ্জয় ভট্টাচার্য : একটি পরিক্রমা, পৃ-১৫১৷

৩৭৪. তদেব, পৃ-১৫২৷

৩৭৫. তদেব, পৃ-১৯৬৷

৩৭৬. তদেব, পৃ-১৭৯৷

৩৭৭. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, পৃ-৩৬৬৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *