৩. বাংলা উপন্যাসের পটভূমি

বাংলা উপন্যাসের পটভূমি

বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের আবির্ভাব একেবারেই নতুন সাধারণত ইংরাজি সাহিত্যের হাত ধরে৷ উনিশ শতকে নবজাগরণের ছোঁয়ায় মানুষের চিন্তা-চেতনায়, বিশ্বাসে-সংস্কারে যে আমূল পরিবর্তনের জোয়ার আসে তার পললরূপে স্থিতিলাভ করে বাংলা উপন্যাস৷ এই সাহিত্য উপকরণটি পশ্চিমি নবোদিত সূর্যের আলোকবিক্ষেপে অভিষিক্ত৷ এর প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য সমাজবাস্তবতা৷

উপন্যাস নামাঙ্কিত বা উপন্যাসের অন্যরূপ কোনো সাহিত্যকৃতি প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যরূপগুলির মধ্যে খুঁজে পাওয়া না গেলেও, ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবজাত হিসেবে একে অনুরঞ্জিত করলেও, বাংলা উপন্যাসের নানাবিধ বৈশিষ্ট্যের ছাপ আমাদের ভারতীয় সাহিত্যের তথা প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পরতে পরতে লুকিয়ে ছিল৷ যদিও সমকালীন যুগ-পরিবেশের, সমাজ-ধর্মের গণ্ডি কাটিয়ে উপন্যাস হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি; পারা সম্ভবও ছিল না৷ যা সম্ভব হয়েছে নবজাগরণের ছোঁয়ায়, পাশ্চাত্য জ্ঞান-তৃষ্ণায় পরিতৃপ্ত মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তিক মর্যাদা প্রকাশের মধ্য দিয়ে৷ দৈব প্রভাব বা দৈবানুগ্রহ কাটিয়ে মানুষের আত্মশক্তির পুনরুজ্জীবনই উপন্যাসের স্থায়ী ভিত্তিপ্রস্তর রচনা করেছে৷ অর্থাৎ সময়ের প্রবহমান ধারায় উপন্যাসের সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল সেই প্রাচীন যুগ থেকেই; সেখানে পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব অগ্নি সংযোগ করেছে মাত্র৷ তাই বাংলা উপন্যাসের উৎস ও পটভূমিকে সঠিকভাবে জানতে গেলে প্রয়োজন উপন্যাসের বিশিষ্ট লক্ষণগুণ সম্পর্কে নুন্যতম উপলব্ধি৷ যার দ্বারা বাংলা উপন্যাসের প্রকৃত ইতিহাসকে জানতে সঠিক পথ নির্ণিত হবে বলে মনে হয়৷ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসের গুণাবলী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন যে—

ক) উপন্যাস হবে সর্বাপেক্ষা গণতন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত অর্থাৎ সেখানে মানুষ হবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিশিষ্ট এবং মধ্যযুগের সামাজিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত৷

খ) উপন্যাসে থাকবে তীব্র জীবনমুখিতা ও বাস্তব ঘনিষ্ঠতা৷ এর সঙ্গে উপলব্ধ হবে সামাজিক মানুষের আত্মাধিকারবোধ, আত্মমর্যাদাবোধ এবং সামগ্রিক জীবনবোধ৷

গ) চরিত্রচিত্রণের সুদক্ষ ক্ষমতায় এবং কাহিনি-উপকাহিনির যথার্থ প্রয়োগ সেই আখ্যানটিকে করে তুলবে উপন্যাসের নতুন কলেবর রূপে৷

ঘ) চরিত্র, ঘটনা, কাহিনি-উপকাহিনির জাদুস্পর্শে বাস্তব রসসিক্ত জীবনালেখ্যে যথার্থ নিপুণতার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে রচিত হবে উপন্যাস৷

কোনো দেশের সাহিত্য সেখানকার বাস্তব জীবন এবং ঐতিহাসিক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে তার পরিপূর্ণরূপ লাভ করে৷ বাংলার প্রাচীন সাহিত্য নিদর্শন থেকে শুরু করে প্রাচীন সংস্কৃত ও বৌদ্ধ সাহিত্য এবং উপন্যাস সৃষ্টির পূর্বপর্যায় পর্যন্ত সাহিত্যের উপকরণাদির মধ্যে যেখানে কাহিনি, চরিত্র ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবতার উপস্থাপনা ঘটেছে সেখানেই শোনা গেছে বাংলা উপন্যাসের আগমনী ধ্বনি৷ যদিও কখনো তা স্পষ্ট কখনো বা অস্পষ্ট৷ কিন্তু ধরে নিতে অসুবিধা হয় না যে বাংলা উপন্যাস তার আবির্ভাবের প্রস্তুতির দিনগোনা শুরু করে দিয়েছিল৷

প্রাচীন সংস্কৃত কাব্য ও আখ্যায়িকার মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে উপন্যাসের পদধ্বনি শোনা যায়৷ সংস্কৃত গদ্যসাহিত্য পঞ্চতন্ত্র, কথাসরিৎসাগর, হিতোপদেশ, দশকুমারচরিত, কাদম্বরী, বেতালপঞ্চবিংশতি এগুলি তাদের নিজস্ব আঙ্গিকের বাইরেও উপন্যাসের আদি লক্ষণগুলিকেও চিনিয়ে দেয়৷ এগুলির প্রায় সবই খ্রিঃ পঞ্চম শতক থেকে দশম-একাদশ শতকের মধ্যে রচিত হয়েছিল৷

পঞ্চতন্ত্র নীতিকথামূলক গল্প৷ নীতিকথা প্রচারের জন্যই যেন এর জন্ম৷ লেখক যেন নীতি-উপদেশগুলিকে খাপে ফেলার জন্যই জীবনের দিকে চোখ তুলে চেয়েছেন৷ গল্পগুলি অধ্যয়ন করলে অবাধ্য দুর্দান্ত রাজপুত্রদের নীতিশিক্ষা দেওয়ার জন্যই যে এর সৃষ্টি তা কিছুতেই বিস্মৃত হওয়া যায় না৷ এর প্রয়োজনীয়তা নীতি-উপদেশ পরিবেষ্টিত; এর বাস্তবতা উপন্যাস সৃষ্টির ভিত্তিভূমিতে তেমন কোনো রসদ জোগান দেয়না৷

হিতোপদেশের গল্পগুলোও নীতি প্রতিপাদক নানা শ্লোকের দ্বারা গতিরুদ্ধ৷ গল্পগুলিও মৌলিক নয়৷ পঞ্চতন্ত্র ও অন্যান্য কোষগ্রন্থ থেকে সংগৃহিত৷ উপন্যাস সাহিত্যের আলোচনায় এর প্রয়োজন নেতিবাচক৷

কথাসরিৎসাগরে ইন্দ্রজালঘটিত ব্যাপারই নৈতিক শৈথিল্যের প্রমাণ৷ অন্যদিকে দশকুমারচরিত দিগ্বিজয় অভিযানে নির্গত দশজন রাজকুমারের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের কাহিনি, তাদের শৌর্য-বীর্য, ছলনা, শঠতা, প্রণয়, সমাজের অভ্যন্তরস্থিত ব্যভিচার, ঘৃণ্য দাম্পত্যজীবন এখানে উপস্থাপিত হয়েছে৷ প্রকৃতপক্ষে দশকুমারচরিত রাজ-ধর্ম-বিশ্বাসের ছলনাময় দৃষ্টান্তে রাজনৈতিক আদর্শের অপমৃত্যুর ছবি৷ এখানে রাজনৈতিক পরিস্থিতির নানাবিধ চিত্র বাস্তবতার সুস্পষ্ট সাক্ষীকে বহন করে৷

বৌদ্ধসাহিত্যও বাস্তবজীবনাশ্রয়ী বিভিন্ন কাহিনিসম্ভারে পরিপূর্ণ৷ এগুলি সাধারণতঃ সংস্কৃত ও পালিতে লেখা৷ সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করলে বৌদ্ধ সাহিত্যে বাস্তবতার সুরটি অধিক প্রকটিত৷ এর কারণ হয়তো বৌদ্ধধর্ম মানবতাধর্মী বলে৷ হিন্দু ধর্মের রক্ষণশীলতা ও সনাতন শ্রেণীবিভাগগুলিকে ভেঙ্গে মানুষকে এক নতুন ঐক্য ও সাম্যের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চেয়েছে এই সাহিত্যগুলি৷ রাজরাজড়া, অভিজাতদের সংযোগ-সংকর্ষ ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের মননভূমিতে বিচরণ করার চেষ্টা করেছে এবং সেগুলিকেই সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেছে৷ বৌদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে বাস্তব জীবনের সজীবতায়, বাস্তব সমস্যার নানা জটিলতায় জাতকের গল্পগুলিই শ্রেষ্ঠ৷ প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধধর্ম আবির্ভাবগত দিক থেকে অনেকটা অর্বাচীন আর সেকারণেই আধুনিক জীবন বৈশিষ্ট্যের ছাপ তার মধ্যে যতটা স্পষ্ট অনুভব করা যায় আর কোথাও ততটা নয়৷ এর রীতি-নীতি, অনুশাসন, প্রাত্যহিকতা, কার্যপ্রণালী ও ধর্ম বিস্তারের চেষ্টা, গার্হস্থ্য জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সবকিছু সুপরিচিত দৃশ্য৷ হিন্দু ধর্মের সুবিশাল ঔদাসীন্য, প্রবল অনাসক্তি, দেব-ঋষিদের জীবনের কঠোর কৃচ্ছসাধন, ও ত্যাগ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে; তার প্রতি শ্রদ্ধা জাগ্রত হয়, ভক্তি জন্মে কিন্তু তাকে নিজের জীবনরসে সম্পৃক্ত করে তোলা সাধ্যাতীত হয়ে পড়ে৷ আর সেদিক দিয়ে বৌদ্ধজাতক অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি৷ বৌদ্ধভীক্ষুদের জীবনের নানাবিধ সমস্যা, তাদের লোভ, ঈর্ষা, আদিম ও স্বাভাবিক প্রবৃত্তির ঘাত-প্রতিঘাত, নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করতে গিয়ে নানারূপ শঠতার আশ্রয় নেওয়া এবং গার্হস্থ্য জীবনে বণিকশ্রেণীর লোভ, হতাশা, সাধারণ গৃহস্থের মদ্যপান, বিত্তহীন ও বিত্তবান, উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের প্রণয় দৃশ্য কিছুই বাদ পড়েনি৷ লেখক গল্পগুলিকে নীতি-প্রচারের মোড়কে না বেঁধে মনোহর ও চিত্তাকর্ষক করে তোলার চেষ্টা করেছেন৷ আর তাতেই গল্পগুলি হয়ে উঠেছে প্রাঞ্জল ও স্বাভাবিক৷

অন্যদিকে ঈষপের গল্প নীতিগল্প৷ সংক্ষিপ্ত নীতিকথনভঙ্গিতে লেখক তাঁর কথাকে উপস্থাপন করেছেন৷ এর ভাষা সরল, অলংকার বাহুল্যে ভারাক্রান্ত নয়৷ গল্পের মধ্যে বাস্তবতার ক্ষীণ একটা আভাস পাওয়া গেলেও দু-একটি গল্প ছাড়া সেই বাস্তবতার সঙ্গে জীবনের নিবিড় কোনো সম্পর্ক নেই৷

প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপাদান চর্যাপদ৷ চর্যাপদে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকেরা বাস্তব সমাজের নিদর্শন দিয়ে রূপকের মোড়কে তাঁদের গুহ্য সাধনার কথা বলেছেন৷ এগুলি মূলত ধর্মীয় সাধনসঙ্গীত৷ একেবারে ধর্মীয় নানা বিধিনিষেধ বা তত্ত্বের প্রথাগত অভিব্যক্তি বলেই এই পদগুলির মধ্যে সাহিত্যলভ্য জীবনরসের সন্ধান অনেকখানি ব্যর্থ৷ এঁদের রচনার পেছনে কাজ করেছিল প্রত্যক্ষ জীবনবোধের পরিবর্তে প্রথাসিদ্ধ সাম্প্রদায়িক দায়-দায়িত্ব৷ তাঁদের আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে যে সমস্ত গুহ্য সাধনপ্রণালী প্রচলিত ছিল তা অদীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে আড়াল করার জন্য রূপকচিত্র ও সাংকেতিক ভাষার মাধ্যমে গীতিরূপ দিয়েছিলেন৷ সাহিত্যে মানবজীবনের যে লৌকিক স্তরকে অবলম্বন করে জীবনসত্য অন্বেষণ করা হয় বাস্তব সংসারের সেই স্তরটিকে উপেক্ষা করাই ছিল চর্যাকারদের অন্যতম ধর্মীয় লক্ষ্য—যার জন্য যে জীবন সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন তাই তাঁদের কাছে অস্তিত্বহীন বলে প্রতিপন্ন হয়েছে৷ তারপরেও কিন্তু উপকরণ সংগ্রহের জন্য তাঁদের হাত দিতে হয়েছে লৌকিক জীবনের নানা অভিজ্ঞতা থেকে৷ অর্থাৎ তত্ত্বের দিক থেকে তাঁরা জীবনকে অস্বীকার করলেও তার রূপাভিব্যক্তির দিক থেকে বাস্তবজীবনকে অবহেলা করতে পারেননি—যা পদগুলিকে জীবনরসে সিক্ত করে অনন্যমাত্রা দান করেছে৷ যদিও এই জীবনরসাভিব্যক্তি এর সব পদের মধ্যে উপস্থিত নয়; যেখানেই মানবজীবনের অসঙ্গতিবোধ এবং সুখদুঃখ প্রেমমিলনের বিচিত্র অনুভূতিকে তত্ত্বকথার উপমান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সেখানেই জীবনরসের তীর্যক অনুভূতি সজীব ও সরস হয়ে উঠেছে৷ পদকর্তাদের বাস্তব সমাজ অভিজ্ঞতার সুস্পষ্ট দলিল হয়ে উঠেছে৷

জীবনের দিক থেকে দেখলে জীবনের দুটি ভাবকে চর্যাপদে বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়৷ তা হল—বিষাদ ও শৃঙ্গার৷ পদকর্তারা তাদের জীবনের সীমাহীন বিষাদকে সামাজিক অত্যাচার, সাংসারিক অশান্তি বা পারিপার্শ্বিক চাপ ইত্যাদির দ্বারা উৎসারিত করেছেন৷ ভুসুকপাদ একটি পদে নির্দয় জলদস্যুর দ্বারা লুন্ঠিত ও সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষের রিক্ততার অনুভূতিকে অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছেন৷—

 ‘‘বাজণাব পাড়ী পঁউআ খালেঁ বাহিউ৷

 অদঅ দঙ্গালে দেশ লুড়িউ৷৷ ধ্রু৷৷

 আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী৷

 ণিঅ ঘরিণী চণ্ডালে লেলী৷৷ ধ্রু৷৷

 … … …

 সোণ রুঅ মোর কিম্পি ণ থাকিউ৷

 নিঅ পরিবারে মহানেহে থাকিউ৷৷ ধ্রু৷৷

 চউকোড়ি ভণ্ডার মোর লইআ সেস৷

 জীবন্তে মইলেঁ নাহি বিশেষ৷৷ ধ্রু৷৷ ’’ (৪৯ নং পদ)

এর অর্থ বজ্র নৌবহর পদ্মাখালে বাওয়া হল৷ নির্দয় দঙ্গালে (বাঙ্গালে) দেশ লুঠ করল৷ ভুসুকু, চণ্ডালে-নেওয়া নিজের ঘরনি আজ বাঙালি৷… সোনা-রূপা, আমার কিছুই থাকল না৷ নিজ পরিবারে মহাপ্রেমে থাকলাম৷ চতুষ্কোটি ভাণ্ডার আমার নিঃশেষে লুন্ঠিত৷ বাঁচা-মরায় কোনো প্রভেদ নেই৷

এখানে সমাজের ভয়ঙ্কর অরাজকতার ছবি চিত্রিত৷ জলদস্যুর দ্বারা নির্মম লুন্ঠনে ভুসুকুর চারকোটির বিষয় যেমন নিঃশেষ তেমনি জলদস্যুরা তার স্ত্রীকেও ছেড়ে দেয়নি৷ তার গৃহিণীকে চণ্ডালে হরণ করায় সে ভ্রষ্টা হয়েছে৷ দেহনির্ভর সতীত্ব নষ্ট হওয়ায় সেই অপহৃতা রমণীকে সমাজ গ্রহণ করেনি—বরং তার সঙ্গে সঙ্গে স্বামী ভুসুকুকেউ জাতিচ্যুত করেছে৷ ধনসম্পদ, জাতিগৌরব হারিয়ে ভুসুকু তাই জীবন্মৃতের মত অবস্থান করছে৷ এখানে জলদস্যুর আক্রমনে সমাজের বিপর্যয়ের ছবি যেমন স্পষ্ট তেমনি অপহৃতা নারীকেও যে এ যুগের মতো সে যুগেও সমাজ গ্রহণ করতো না, নারীর সেই অবস্থানগত দিকটিও ফুটে উঠেছে৷ ভুসুকুর সেই রিক্ততা, তার স্ত্রীর সেই অবমাননা—সর্বজনীনতা লাভ করেছে৷ শুধুমাত্র সামাজিক নিরাপত্তার অভাবই নয়, তার সঙ্গে নানা সাংসারিক অসঙ্গতিজনিত বিপর্যয়ও বিস্ময়বিমূঢ় করে তুলেছে কোনো কোনো পদকর্তাকে৷ ৩৩ নং পদে ঢেন্ঢনপাদ সেই অসংগতির চিত্রকেই তুলে ধরেছেন—

 ‘‘টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী৷

 হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী৷৷ ধ্রু৷৷

 বেঙ্গসঁ সাপ বডহিল জাঅ৷

 দুহিল দুধু কি বেন্টে ষামাঅ৷৷ ধ্রু৷৷

 বলদ বিআএল গবিআ বাঝেঁ৷

 পিটা দুহিএ এ তিনা সাঁঝে৷৷ ধ্রু৷৷

 জো সো বুধী সৌ নিবুধী৷

 জো যো চৌর সৌ দুষাধী৷৷ ধ্রু৷৷

 নিতে নিতে ষিআলা ষিহে যম জুঝঅ৷

 টেন্ঢণ পাএর গীত বিরলেঁ বুঝঅ৷৷ ধ্রু৷৷’’ (৩৩ নং পদ)

অর্থাৎ লোকালয়ে আমার ঘর প্রতিবেশী নেই৷ হাঁড়ীতে ভাত নেই নিত্যই প্রতিবেশীর আগমন৷ ব্যাঙের দ্বারা সাপ কাটা পড়ে৷ দোহন করা দুধ বাঁটে ঢুকে যায়৷ বলদ প্রসূতি গাই বন্ধ্যা, তিন সন্ধা দোহন করা হয়৷ যা সেই বুদ্ধি তা-ই নিঃকৃষ্ট বুদ্ধি৷ যে চোর সে-ই কোটাল৷ নিত্য নিত্য শিয়াল সিংহের সঙ্গে যুদ্ধ করে৷ ঢেন্ঢন পার গীত কদাচিৎ বোঝা যায়৷ এই যে মূল বক্তব্য তা শুধু তত্ত্বের আধার নয় সমাজ বৈষম্যের দ্বারা বিচলিত ব্যক্তিত্বের মূল্যবোধের চিরকালীন অবক্ষয়ের চিত্র৷ সমাজে বিপর্যয় দেখা দিলে সব বিপরীত কার্য দেখা যায়—যারা বুদ্ধিমান তারা বোকা হয়ে যায় আর বোকারা বুদ্ধিমান হয়৷ ন্যায়বোধের বিচারে যে সাধু সে-ই অসাধু হয় আর অসাধুরা সাধু বলে ঘোষণা করে নিজেদেরকে৷ বহুযুগ পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘দুই বিঘা জমি’-তে এই বক্তব্যই প্রতিফলিত হতে দেখা যায়—যখন উপেনের সমস্ত সম্পত্তি ডিক্রি জারি করে নিজের কুক্ষিগত করার পর জমিদার উপেনকেই চোর সাব্যস্ত করে৷ তাই উপেন ব্যঙ্গ করে বলে—

 ‘‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে৷’’

অর্থাৎ ঢেন্ঢন পাদের এই পদ জীবনরস পরিবেশনে, বাস্তবতার পরাকাষ্ঠায় সর্বজনীনতা লাভ করেছে৷

অকর্মণ্য বা অসাধু স্বামী তার রতিসুখ চরিতার্থ করে গর্ভিণী স্ত্রীকেও পরিত্যাগ করে চলে যায়—তার পর সেই অসহায় নারীর যে দুঃসহ জীবন যন্ত্রণা তা কুক্করীপাদ ২০ নং পদে তুলে ধরেছেন৷

 ‘‘হাঁউ নিরাসী খমণ ভতারি৷

 মোহর বিগোআ কহণ ন জাই৷৷ ধ্রু৷৷

 ফেটলিউ গো মাএ অন্তউড়ি চাহি৷

 জা এথু বাহাম সো এথু নাহি৷৷ ধ্রু৷৷

 পহিল বিআণ মোর বাসনয়ূড়া৷

 নাড়ি বিআরন্তে সেব বায়ূড়া৷৷ ধ্রু৷৷

 জা ণ জৌবণ মোর ভইলেসি পূরা৷

 মূল ম খলি বাপ সংঘারা৷৷ ধ্রু৷৷’’

অর্থাৎ স্বামী আমার বিবাগী, আমি তাই নিরাশ—আমার দুঃখ অবর্ণনীয়৷ মাগো আমি প্রসব করলাম, তাই আঁতুর খুঁজি, কিন্তু যা খুঁজি তা পাই না৷ প্রথম প্রসব আমার বহু বাসনার ধন কিন্তু নাড়ী কাটার সঙ্গে সঙ্গে সে মিলিয়ে গেল৷ যখন আমার নবযৌবন পূর্ণ হল, আমার দ্বারা মূল স্খলিত হল, বপন ক্ষেত্র নষ্ট হল৷

যৌনতা, যৌনব্যভিচার, নারীর বহুগামিতা, পুরুষের নারী সম্ভোগ ইত্যাদি প্রত্যেক সমাজ বা যুগের সবচেয়ে বেশি বাস্তব দিক৷ চর্যাপদের পদকারেরা সেদিককেউ উপেক্ষা করতে পারেননি বা করা সম্ভব হয়নি৷ তাছাড়া সহজপন্থী পদকর্তাদের ধর্মানুষ্ঠানে যৌনাচারের বিশেষ স্থান ছিল৷ তাঁরা মহাসুখের প্রতি সাধকচিত্তের আসক্তি ও সাধকচিত্তের সঙ্গে মহাসুখের মিলনকে নরনারীর পারস্পারিক আসক্তি যৌনমিলনমূলক শৃঙ্গার চেষ্টার রূপকে বর্ণনা করেছেন৷

কাহ্নপাদের ১৮ সংখ্যক পদে দেখা যায় কবির প্রেমিকা নিম্ন শ্রেণীর এক ডোমরমণী৷ অস্পৃশ্যতার কারণে নগরের বাইরে সে বাস করে৷ উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণরা তার যৌবনচাঞ্চল্যে বিভ্রান্ত হলেও অস্পৃশ্য বলে তাকে স্পর্শ করতে পারে না৷ সে নগরের বাইরে চাঙাড়ী তৈরি, তাঁত বোনা ইত্যাদি ক্ষুদ্র বৃত্তির মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে৷

 ‘‘কইসণি হালো ডোম্বী তোহোরি ভাভরিআলী৷

 অন্তে কুলিণজন মাঝেঁ কাবালী৷৷ ধ্রু৷৷

 তঁই লো ডোম্বী সঅল বি টলিউ৷

 কাজ ণ কারণ সসহর টলিউ৷৷ ধ্রু৷৷

 কেহো কেহো তোহোরে বিরুআ বোলই৷

 বিদুজণলোঅ তোরেঁ কন্ঠ ণ মেলঈ৷৷ ধ্রু৷৷

 কাহ্নে গাইতু কামচণ্ডালী৷

 ডোংবিত আগলি ণাহি চ্ছিণালী৷৷ ধ্রু৷৷’’

এর বাংলা অর্থ ওলো ডোমনী, কিরকম তোর চতুরালি৷ একপাশে কুলীনজন মাঝখানে কাপালিক৷ ডোমনী লো তোর দ্বারা সব কিছুই নষ্ট হল৷ কাজ নেই, কারণও নেই শশধর টলানো হল৷ কেউ কেউ তোকে মন্দ বলে৷ বিদ্বজ্জনেরা তোকে কন্ঠ থেকে ছাড়ে না৷ কাহ্নের দ্বারা-ই কামচাঁড়ালী গাওয়া হল৷ ডোমনীর বাড়া ছিনাল নেই৷

ডোমনীকে পদকর্তা ছিনাল বলে প্রতিপন্ন করেছেন৷ ‘ছিনাল’ শব্দটি বহুপুরুষভোগ্যা গণিকার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷ নিম্নশ্রেণীর এই কুলনারী তার স্ব-বৃত্তির সাথে সাথে দেহব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত৷ আর তার জন্যই কুলীনজন, কাপালিক এমনকি পদকর্তা স্বয়ং তার প্রেমপ্রার্থী হয়ে তার সঙ্গে মিলিত হতে পারে৷ সে বহুভোগ্যা বলে কারও কারও কাছে মন্দ নারী হিসেবে প্রতিপন্ন হলেও তার শরীরী মোহে বিদ্বজ্জনেরা তাকে কন্ঠলগ্ন করে রাখে৷ অর্থাৎ এই পদে নিম্ন শ্রেণীর ডোম রমণীদের বাস্তব জীবনছবি ফুটে উঠেছে৷ শুধু তাই নয় এই স্বৈরিণী নারীর প্রেম প্রত্যাশায় কাহ্নপাদের মতো বহু পুরুষ নিজের জাত-ধর্ম পরিত্যাগ করে তার অনুসারী হয়; নিজের সর্বস্ব পণ করে বসে৷ কিন্তু তারপরেও নিজের স্বভাবজ বৈশিষ্ট্যে ডোমনী তাকে নিজের একক প্রেমের পরাকাষ্ঠায় বাঁধতে পারে না৷ ডোমনীর সেই ব্যবহার তাই কবিকে ব্যথিত করে৷ সে অনুযোগ করে বলে—

 ‘‘নগর বাহিরেঁ ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ৷

 ছোই ছোই জাহ সো ব্রাহ্মনাড়িআ৷৷ ধ্রু৷৷

 আলো ডোম্বী তোএ সম করিব ম সাঙ্গ৷

 নিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাগ৷৷ ধ্রু৷৷

 … … …

 হা লো ডোম্বী তো পুছমি সদভাবে৷

 আইসসি জাসি ডোম্বি কাহরি নাবেঁ৷৷ ধ্রু৷৷

 তান্তি বিকণঅ ডোম্বি অবর না চঙ্গেড়া৷

 তোহর অন্তরে ছাড়ি নড়এড়া৷৷ ধ্রু৷৷

 তু লো ডোম্বী হাঁউ কপালী৷

 তোহোর অন্তরে মোএ ঘলিলি হাড়েরি মালী৷৷ ধ্রু৷৷’’

অর্থাৎ নগরে বাইরে ডোমনী, তোর কুঁড়েঘর৷ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাস সেই ব্রাহ্মণ বালককে৷ ওলো ডোমনী, তোর সঙ্গে আমি সাঙ্গা করব৷ আমি কাহ্ন ঘৃণাহীন, নগ্ন কাপালিক যোগী৷ ওলো ডোমনী তোকে সদভাবে জিজ্ঞাসা করি, তুই আসিস যাস কার নায়ে৷ ডোমনী তুই না তাঁত আর চাঙাড়ী বিক্রয় করিস৷ তোর তরে নটের ঝাঁপি ত্যাগ করলাম৷ ওলো তুই ডোমনী আমি কাপালিক৷ তোর তরে আমি হাড়ের মালা গলায় পড়লাম৷

ডোমনীর তার প্রেমকে উপেক্ষা করে পরপুরুষের প্রতি অব্যাহত সেই আসক্তি দেখে প্রবল ঈর্ষা কুটিল কন্ঠে তাকে হত্যা করার কথাও ঘোষণা করে৷—

‘মারমি ডোম্বী লেমি পরাণ৷’’

অর্থাৎ ডোমনী তোকে মারব, প্রাণ নেব৷ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম রূপের মধ্যে প্রেমের এমন ঈর্ষামিশ্রিত অভিব্যক্তি প্রাচীন বাংলার আর কোনো সাহিত্যে আছে কিনা বলা যায় না৷

সামাজিক ভ্রষ্টাচারের আরও চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় কুক্করীপাদের পদে৷ সেখানে বর্ণিত হয়েছে এক গৃহবধূর চিত্র৷ যে তার সরল অভিব্যক্তি দিয়ে দিবসে সর্বসমক্ষে নিজেকে প্রকাশ করলেও অন্ধকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে জেগে উঠে ঘুমন্ত জৈবপ্রবৃত্তি৷ আর তার বশবর্তী হয়েই দিবসে যে কাকের ডাক শুনে ভীত হয়ে পড়ে; রাত্রে তাকেই দেখা যায় কামপূরণের জন্য অভিসারে যেতে৷—

 ‘‘দিবসই বহুড়ী কাউই ডরে ভাঅ৷

 রাতি ভইলেঁ কামরু জাঅ৷৷ ধ্রু৷৷’’ (২ নং পদ)

যে সময় পদকর্তারা চর্যাপদ রচনা করেন তখন বাংলার শাসনকর্তা ছিল পরধর্ম অসহিষ্ণু সেন রাজারা৷ তাদের সময়ই অস্পৃশ্যতা মারাত্মক রূপ নেয়৷ অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষেরা শবর, ডোম, চণ্ডাল প্রমুখরা স্থান নেয় নগরের প্রান্ত সীমায় বা জনপদ থেকে দূরে—ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে৷

বিভিন্ন ধরনের পেশাধারী মানুষের বাস সে সময়কার অনুন্নত অর্থনৈতিক অবস্থাকে চিনিয়ে দেয়৷ ডোম, ব্যাধ, শুঁড়ি, সূত্রধর, পাটনি ইত্যাদি নিম্নবৃত্তির মানুষেরা অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা ভোগ করত৷ কিন্তু উচ্চবিত্তের পেশাগত কোনো দিক প্রকাশিত না হলেও তাদের জীবনধারণ প্রণালী যতটুকু আভাষিত করেছেন রচনাকারেরা তাতে মনে হয় আর্থিক অসাচ্ছল্য তাদের তেমন ছিল না৷ এছাড়া বিবাহ উৎসব, আমোদ-প্রমোদ, সমাজের নানা নিয়মকানুন, ব্যভিচার, বিশৃঙ্খলা, নরনারীর দাম্পত্যজীবন চিরন্তনী সুরধারাকে অবলম্বন করেই প্রতিফলিত হয়েছে৷ সে সময়ও বিবাহে বাজনা-বাদ্য নিয়ে যে আড়ম্বর ছিল—বর্তমানেও তার ব্যতিক্রম নয়৷ যেমন—কাহ্ন পাদের একটি পদে—

 ‘‘ভবনির্ব্বাণে পড়হমাদলা৷

 মণপবণ বেণি করন্ড কসালা৷৷

 জঅ জঅ দুংদুহি সাদ উছলিআঁ৷

 কাহ্ন ডোম্বি বিবাহে চলিআ৷৷

 ডোম্বি বিবাহিআ আহারিউ জাম৷

 জউতুকে কিঅ আণুতু ধাম৷৷

 অহিণিসি সুরাঅ পসংগে জাঅ৷’’ (১৯ নং পদ)

অর্থাৎ ভবনির্বাণ যেন ঢাক ও মাদল৷ মন ও পবন দুটি কাড়া (ঢোল) ও কাঁসি৷ দুন্দুভিতে জয় জয় সাড়া ছড়িয়ে পড়ল৷ কাহ্ন ডোমনীকে বিয়ে করতে চলল৷ ডোমনীকে বিয়ে করে খাওয়া হল৷ অনুত্তর ধর্মকে যৌতুক করা হল৷ দিনরাত্রি সুরত প্রসঙ্গে কাটে৷ এই যে ঢাক, ঢোল, মাদল, কাসি, দুন্দুভি বাজিয়ে—ভোজের আয়োজন করে বিবাহ নির্বাহ তা আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক৷ এভাবে নানাভাবে জীবনরস তথা সমাজ বাস্তবতাকে ছুঁয়ে গেছে চর্যাপদের পদকারেরা৷ আর এই যে সমাজের নানাবিধ উপকরণ তাঁরা নিয়েছেন তা একেবারে প্রত্যক্ষ বাস্তব সমাজের অভিজ্ঞতা৷ সেখানে শবর, ডোম, চুরি-ডাকাতি, পরকীয়া, চরিত্রস্খলন, নৌকাচালনা, নাট্যাভিনয়, দারিদ্র্যতা, আনন্দ-বিনোদন, বর্ণবৈষম্য কোনোকিছুই বাদ পড়েনি৷ এর গুহ্য অর্থ যাই হোক না কেন সহজ সরলভাবে বিচার করতে গেলে একেবারে বাস্তব সমাজ ঘেষা৷ সমাজের মানুষজন ও তার পারিপার্শ্বিক উপাদান এত সুনিপুণভাবে চর্যাপদের মধ্যে উঠে এসেছে যে তাকে একেবারে জীবন্ত মনে হয়৷ তবুও চর্যাপদ উপন্যাস নয়৷ বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ের এক সুনিপুণ সাহিত্য উপকরণ—বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের প্রথমতম ফসল৷

অনুবাদ সাহিত্যের ধারায় অন্যতম নিদর্শন রামায়ণ ও মহাভারত৷ এর মধ্যে তৎকালীন বাঙালি জীবনের ছাপ সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত হলেও সেগুলি ছিল রাজরাজড়াদের কাহিনি৷ সাধারণ মানুষ সেখানে ব্রাত্য৷

চৈতন্য জীবনী বা বৈষ্ণবমোহান্তদের জীবনী নিয়ে রচিত জীবনী কাব্যের মধ্যেও মনীষীদের জীবনবর্ণনাকে স্বাভাবিক করতে যতটুকু বাস্তব জীবনের উপাদান দরকার জীবনীকারেরা ততটুকুই গ্রহণ করেছেন৷ তাই সেগুলি জীবনীই; উপন্যাস লক্ষণাক্রান্ত হয়ে উঠেনি৷

নাথপন্থীদের সাহিত্য ময়নামতি গোপীচন্দ্রের গান এবং গোরক্ষ বিজয়ে সমাজ-বাস্তবতার স্পষ্ট ছবি উঠে এলেও অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত এর কোনো লিখিত অবয়বই খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ ফলে বাংলা উপন্যাসের ভিত প্রস্তুতিতে এর কোনো দাবিকে মেনে নেওয়া যায় না৷ আবার মৈয়মনসিংহ গীতিকা কিন্তু অনেক বেশি বাস্তবধর্মী৷ বাস্তবতার রসসমৃদ্ধ এই উপকরণে উপন্যাসে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য দৃষ্টিগোচর হয়৷ মৈমনসিংহ গীতিকার রচনাকাল ষোড়শ-সপ্তদশ শতক বলে অনুমিত৷ উপন্যাস সাহিত্যের পথপ্রদর্শকরূপে এর কিছুটা স্থান রয়েছে৷ এর মধ্যে যেমন জেলে-মাঝি, চাষি-রাইয়ৎ, বণিক, সদাগর ইত্যাদির বিচিত্র শ্রেণীসংঘবদ্ধ বাংলার আর্থ-সামাজিক রূপকে প্রতিফলিত করেছে তেমনি বাংলার পল্লীপ্রকৃতির নিসর্গরূপে তার সমগ্র সৌন্দর্য নিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে৷ এখানে যেমন কাহিনিকারেরা সমাজের সমস্যা-সংঘাত মানবজীবনের বিকাশ ও পরিব্যাপ্তিকে গুরুত্ব দিয়েছেন তেমনি মানুষের শত সমস্যার মধ্যেও তাদের স্বাধীন মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করেননি৷ এর মধ্যে মানবজীবনের বলিষ্ঠ নিরঙ্কুশ মহিমা স্বীকৃতি পেয়েছে—দৈবী পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে মানবজীবনের সমাজশাসিত বেপরোয়া লীলারূপকে আধ্যাত্মদৃষ্টিতে সমাচ্ছন্ন করা হয়নি৷ নদীকেন্দ্রিক দেশের বাস্তব প্রাণ-প্রকৃতিকে মনুষ্যপ্রকৃতির সহজাত স্বাভাবিক রসবৈশিষ্ট্যে বাস্তবানুগ করে তোলা হয়েছে৷

উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ঘনসংবদ্ধ ঘটনাজাল; মানবিক বৃত্তির দ্বন্দ্ব, জীবনরূপের নানা সূক্ষ্ম সংঘর্ষ এগুলি মৈমনসিংহ-গীতিকার মধ্যেও বীজাকারে বর্তমান৷ এর চরিত্রগুলি দেব-দেবীর নিষ্ঠুর পীড়নে ধর্মের কাছে মাথা নোয়ায়নি বরং দুর্বল মানুষ সবলের অত্যাচারে আমরণ লড়াই করে চরম ট্র্যাজিক পরিণতি লাভ করেছে৷ এই সবল কখনো কন্যার পিতা, নানা ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ, স্বামী, কাজী প্রমুখরা৷ যেমন ‘মহুয়া’ পালায় মহুয়া বেদে দলপতি হুমরার চুরি করে আনা পালিতা কন্যা৷ কালক্রমে সে বেদের দলেই খেলা দেখিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে৷ খেলা দেখানোর উদ্দেশ্যেই বামনকান্দা গ্রামে উপস্থিত হলে সেখানকার ব্রাহ্মণ তালুকদারের পুত্র নদের চাঁদ তার রূপে বিমোহিত হলে তারা পরস্পরের প্রণয়ভাগিনী হয়৷ কিন্তু তার পালকপিতা হুমরা নদের চাঁদকে মারার দায়িত্ব দেয় মহুয়ার হাতেই৷ সে প্রেমাস্পদের বুকে বিষছুরি না মেরে তাকে সব অবগত করায়; তারপর তেজী ঘোড়ায় চড়ে দুজনে পালিয়ে যায়৷ কিন্তু ঘটনাক্রমে পুনরায় তারা মুখোমুখি হয় হুমরার৷ সেই অসহায় দম্পত্তি সামনে প্রত্যক্ষ মৃত্যুকে দেখতে পায়৷ কবির বর্ণনায়—

 ‘‘চৌদিকেতে চাইয়া দেখে শিকারী কুকুর৷

 সন্ধান করিয়া বাদ্যা আইল এত দূর৷৷

 সামনেতে হুমরা বাদ্যা যম যেন খারা৷

 হাতে লইয়া দাঁড়াইয়াছে বিষলক্ষের ছুরা৷৷

 আক্ষিতে জ্বালিছে তার জ্বলন্ত আগুনি৷

 নাকে নিশ্বাস তার দেওয়ার ডাকি শুনি৷৷

 প্রাণে যদি বাঁচ কন্যা আমার কথা ধর৷

 বিষলক্ষের ছুরি দিয়া দুশমনেরে মার৷৷’’১০

কিন্তু এতদিন লড়াই করে টিকে থাকা মহুয়া দেখতে পায় তার দুই পাশে দুই জন৷ একদিকে পালক পিতা অন্যদিকে স্বামী নদের চাঁদ৷ মাঝখানে তার হাতে মৃত্যুরূপী ছোরা৷ তার দ্বন্দ্ব মুখর মন কাউকেই মারতে পারে না৷ তাই শেষ পর্যন্ত নিজের বুকেই বসিয়ে দেয় সেই বিষাক্ত ছোরা৷ আর মৃত্যুর আগে তার বলে যাওয়া কথাগুলি বড়ই মর্মস্পর্শী৷—

 ‘‘শুন শুন প্রাণপতি বলি যে তোমারে৷

 জন্মের মতন বিদ্যায় দেও এই মহুয়ারে৷৷

 শুন শুন পালং সই শুন বলি কথা৷

 কিঞ্চিৎ বুঝিবে তুমি আমার মনের বেথা৷৷

 শুন শুন মাও বাপ বলি যে তোমায়৷

 কার বুকে ধন তোমরা আইনাছিলা হায়৷৷

 ছুট মা-বাপের কুল শূন্য করি৷

 কার কুলের ধন তোমরা কইরে ছিলে চুরি৷৷

 জন্মিয়া না দেখলাম কভুবাপ আর মায়৷

 কর্ম্মদোষে এত দিনে প্রাণ মোর যায়৷৷’’১১

কাহিনিটি যদি এখানেই শেষ হত তাহলে একরকম হত৷ কাহিনিকারেরা পাষণ্ড হুমরার মনে অনুশোচনার আগুন জ্বেলে তার প্রায়শ্চিত্ত করিয়েছেন৷ আর হুমরা তার স্নেহ-কদর্যতায়, ভালো-মন্দে মিশ্রিত মানুষ হয়ে চূড়ান্ত মানবীয় গুণের পরিচায়ক হয়েছে৷—

 ‘‘ছয় মাসের শিশু কন্যা পাইল্যা করলাম বড়৷

 কি লইয়া ফিরবাম দেশে আর না যাইবাম ঘর৷৷

 শুন শুন কন্যা আরে একবার আঁখি মেইলা চাও৷

 একটি বার কহিয়া কথা পরাণ জুড়াও৷৷

 আর না ফিরিব আমি আপনার ভবনে৷

 তোমরা সবে ঘরে যাও আমি যাইবাম বনে৷৷’’

 … … …

 হুমরা বাদ্যা ডাক দিয়া কয় ‘মাইনক্যা ওরে ভাই৷

 দেশেতে ফিরিয়া মোর আর কার্য্য নাই৷৷

 কয়বর কাটীয়া দেও মহুয়ারে মাটী৷

 বাড়ীঘর ছাইড়া ঠাকুর আইল কন্যার লাগি৷

 দুইয়েই পাগল ছিল এই দুইয়ের লাগি৷৷’’১২

‘মলুয়া’ পালাটিতেও দুর্বৃত্ত কাজীর ষড়যন্ত্রে মলুয়ার জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে৷ চান্দ বিনোদের সঙ্গে তার মধুর দাম্পত্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে৷ কাজী মলুয়াকে দেখে মুগ্ধ লালসায় তাকে পাওয়ার জন্য দূতী প্রেরণ করেছিল মলুয়ার কাছে৷ মলুয়া তাকে অপমান করে তাড়ালে প্রতিশোধ নিতে মলুয়ার স্বামীর উপর পরওয়ানা জারি করে—

 ‘‘বিনোদের উপরে কাজী পরণা জারি করে৷

 হুকুম লিখিয়া দিল পরণা উপরে৷৷

 সাদি কইরাছ তুমি গেছে ছয়মাস৷

 নজর মরেচা রইছে তোমার অপরকাশ৷৷

 আজি হইতে হপ্তা মধ্যে আমার বিচারে৷

 নজর মরেচা তুমি দিবা দেওয়ানেরে৷৷

 নজর মরেচা যদি নাহি দেও তুমি৷

 বাজেপ্ত হইব তোমার যত বাড়ী জমি৷৷’’১৩

একবার নয় একাধিকবার কাজীর দেওয়া পরওয়ানা এবং লালসাপূর্ণ প্রতিশোধস্পৃহা মলুয়াকে নির্মম পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে৷

মানবিক জীবনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য যেমন দুর্ধর্ষ হুমরাকে মানুষ করে তুলেছে তেমনি মহুয়া, চন্দ্রবতী, মলুয়া, লীলা, মদিনা—র জীবনের ট্র্যাজিক পরিচয়ই বাস্তবতার অভিনব ছায়া সম্পাদে শিল্পরূপ লাভ করেছে৷ সমস্ত কিছুকে অদৃষ্ট বা দৈব বলে মাথা নত না করে তাদের ব্যক্তিত্বকে ঢাল করে শেষ পর্যন্ত যুঝতে সক্ষম হয়েছে৷ ব্যক্তিত্বের পূর্ণতম বিকাশ দেখা যায় মলুয়ার মধ্যে৷ তা যেন একে বারে শুরু থেকেই৷ ঘাটের পারে বিনোদকে অঘোরে নিদ্রা যেতে দেখে তার মনে প্রণয়ের সঞ্চার হয় ঘাটে জল আনতে গিয়ে—

 ‘‘একবার লামে কন্যা আরবার চায়৷

 সুন্দর পুরুষ এক অঘুরে ঘুমায়৷৷’’১৪

সেই সুপুরুষ বিনোদ চান্দ-ই যখন তার তৎপরতায় জাগরিত হয়ে তার অপ্সরীতুল্য রূপে মুগ্ধ হয় প্রণয় নিবেদন করে তখন নারীসুলভ লজ্জায়—

 ‘‘ভিন দেশী পুরুষ দেখি চান্দের মতন৷

 লাজ-রক্ত হইল কন্যার পরথম যৌবন৷৷’’১৫

তার রূপমুগ্ধ চাঁদ কাজী দূতী হিসেবে নেতাই কুটুনিকে দিয়ে প্রেম প্রস্তাব পাঠালে পরম সাহসিকতায় দুর্বৃত্ত ক্ষমতাবান সেই পুরুষের লালসার জবাব দিয়ে পাঠায়—

 ‘‘আমার সোয়ামী যেমন আসমানের চান৷

 না হয় দুষমন কাজী নউখের সমান৷৷

 অপমান্যা বুড়ি তুমি যাও নিজের বাড়ী৷

 কাজীরে কহিও কথা সব সবিস্তারি৷৷

 দুষমন কুকুর কাজী পাপে ছিল মন৷

 ঝাটার বাড়ী দিয়া তারে করতাম বিরম্বন৷৷

 বাচ্যা থাকুন সোয়ামী আমার লক্ষ পরমাঈ পাইয়া৷

 থানের মোহর ভাঙি কাজীর পায়ের লাথি দিয়া৷৷’’১৬

কাজীর ষড়যন্ত্রে মলুয়া নায়েবের গৃহে বন্দি হলে নিজের নিষ্ঠা ও সততার জোরে পুনরায় স্বামীর সংসারে ফিরে আসে৷ কিন্তু প্রবল বাধার সৃষ্টি করে সমাজ৷ তাকে অসতী, কলঙ্কিনী বলে বিনোদকে একঘরে করার চেষ্টা করে৷ পতিপরায়ণা মলুয়া সমাজ দ্বারা স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে বহির্বাড়িতে নিজের জায়গা করে নেয়৷ স্বামীকে আবার বিয়ে করিয়ে দাসীর মতো সকলের সেবা করতে থাকে৷ তারপর বিনোদ সর্পদংশিত হলে নিজের জীবন বাজি রেখে মুখ দিয়ে বিষ তুলে স্বামীর জীবন বাঁচায়৷ তবুও তাদের জ্ঞাতিগুষ্টির দল তাকে স্বীকার করে না৷ সমাজকে শিক্ষা দিতে, স্বামীর কলঙ্ক ঘোচাতে সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়৷ ভরা নদীতে ভাঙা নৌকায় চেপে পাল ছেড়ে দেয়৷ স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলে—

 ‘‘গত হইয়া গেছে দিন আরত নাই বাকী৷

 কিসের লাইগ্যা সংসারে কাজ আর বা কেন থাকি৷৷

 আমি নারী থাকতে তোমার কলঙ্ক না যাবে৷

 জ্ঞাতি বন্ধু জনে তোমায় সদাই ঘাটিবে৷৷’’১৭

সমাজকে সে ভালো করেই চিনে গেছে৷ সমাজ যদি একবার নারীর দোষ খুঁজে পায় তাহলে তার চেয়ে উপাদেয় আর কিছুই নেই তার কাছে৷ মলুয়া নৌকাডুবি হয়ে তাই পাতালপুরে চলে যেতে চায় সীতার মতো৷ তাই শেষবারের মতো তার কন্ঠে ধ্বনিত হয়—

 ‘‘ডুবুক ডুবুক নাও আর যা কত দূর৷

 ডুইব্যা দেখি কতদূরে আছে পাতালপুর৷৷’’১৮

মলুয়া জলে ডুবে তার ব্যক্তিসত্তাকে জাহির করে গেছে—শুধু তাই নয় তার সেই মৃত্যু যেন তীব্র প্রতিবাদের সুস্পষ্ট গর্জন৷

বাঙালি সমাজের নানা রীতি-নীতি, নারীর প্রতি পুরুষের লালসা, নানা অন্যায় অত্যাচার, দেহনির্ভর সতীত্ব, প্রেম-ভালোবাসা-প্রতিবাদ কোনো কিছুই বাদ পড়েনি এহ গীতিকায়৷ মহুয়া নদের চান্দকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে অতিথি সৎকারের যে বিবরণ দিয়েছে তার আচার-নিয়মগুলি যেমন চমৎকার তেমনি স্থায়ীত্বের দিক দিয়েও চিরন্তন৷—

 ‘‘আমার বাড়ীত যাইও রে বন্ধু বসতে দিয়াম পিরা৷

 জল পান করিতে দিয়াম সালি ধানের চিরা৷৷

 সালি ধানের চিরা দিয়াম আরও সবরী কলা৷

 ঘরে আছে মইষের দইরে বন্ধু খাইবা তিনো বেলা৷৷’’১৯

বাংলা উপন্যাসের পটভূমি নির্মাণে এই পালাগুলির গুরুত্ব অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য৷ প্রকৃতি পরিবেশ-প্রতিবেশ যা কিছু উঠে এসেছে এই গীতিকায় সবই বাস্তব সমাজ ঘেষা৷ ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সেই সহজ স্বাভাবিকতা অতিক্রম করেননি কাহিনিকারেরা৷ এখানেও গণিকা চরিত্র বা গণিকা জাতীয় চরিত্র বাদ পড়েনি৷ বারবিলাসিনী নারীরা জীবনের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়ে কুট্টনীবৃত্তির দ্বারা যে জীবন অতিবাহিত করতো তার প্রমাণ রয়েছে মলুয়া পালায়৷ মলুয়াকে প্রলোভিত করার জন্য লম্পট কাজী যে দূতীকে প্রেরণ করেছিল সে আসলে বিগত-যৌবনা এক ভ্রষ্টা রমণী৷ কাহিনিকার তার সম্পর্কে স্পষ্টই বলেছেন—

 ‘‘বয়সেতে বেশ্যামতি কত পতি ধরে৷

 বয়স হারাইয়া অখন বসিয়াছে ঘরে৷৷

 বয়স হারাইয়া তবু স্বভাব না যায়৷

 কুমন্ত্রণা দিয়া কত কামিনী মজায়৷৷

 চুল পাকিয়াছে তার পড়িয়াছে দাঁত৷

 এতেক করিয়া অখন জুটায় পেটের ভাত৷৷’’২০

‘কমলা’ পালায় উপস্থাপিত হয়েছে চিকন গোয়ালিনীর কথা৷ নিম্নশ্রণীর এই নারীও দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এবং কুট্টনী বৃত্তির দ্বারা অর্থ উপার্জনে পারঙ্গম৷ দুষ্ট নিদান কারকুন কমলাকে পাওয়ার জন্য এই গোয়ালিনীকে পত্রসমেত দূতী হিসেবে প্রেরণ করে৷ তার স্বভাব চরিত্রেও সেই বহুপুরুষগামী দিক তুলে ধরেছেন কাহিনির রচয়িতা৷—

 ‘‘গেরামে আছয়ে এক চিকন গোয়ালিনী৷

 যৌবনে আছিল যেন সবরি-কলা-চিনি৷৷

 বড় রসিক আছিল এক চিকন গোয়ালিনী৷

 এক সের দৈয়েতে দিত তিন সের পানি৷৷

 সদাই আনন্দ মন করে হাসিখুশী৷

 দই-দুধ হইতে সে যে কথা বেচে বেশী৷৷

 যখন আছিল তার নবীন বয়স৷

 নাগর ধরিয়া কত করত রঙ্গরস৷৷

 রসেতে রসিক নারী কামের কামিনী৷

 দেশের লোকেতে ডাকে চিকন গোয়ালিনী৷৷

 যদিও যৌবন গেছে তবু আছে বেশ৷

 বয়সের দোষে মাথার পাকিয়াছে কেশ৷৷

 কোন দন্ত পড়িয়াছে কোন দন্তে পোকা৷

 সোয়ামী মরিয়া গেছে তবু হাতে শাখা৷৷

 চলিতে ঢলিয়া পড়ে রসে থলথল৷

 শুখাইয়া গেছে তার যৌবন-কমল৷৷

 তবু মনে ভাবে যে সে চিকন গোয়ালিনী৷

 বৃদ্ধ বয়সে যেম ভাবের ভামিনী৷৷

 সংসারেতে আছে কত লুচ্চা লোকন্দরা৷

 গোয়ালিনীর বাড়িত গিয়া করে ঘুরাফেরা৷৷’’২১

অন্দর মহলে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ নিয়ে এই শ্রেণীর নিম্নবৃত্তির নারীরা বহু নারীকে গণিকা বৃত্তির পথ নির্দেশ করত৷

‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ লিখিত সাহিত্য হিসেবে বহুদিন সার্বজনীন স্বীকৃতিলাভে বঞ্চিত ছিল৷ পরবর্তী কালে গ্রন্থমধ্যে কাহিনিগুলি সম্পৃক্ত হলে সংস্কার বহির্ভূত বাস্তব অনুসারী দৃষ্টিভঙ্গী সহজেই মানুষের মনোলোক অধিকার করে৷ যে শাস্ত্রীয় অনুশাসন বা দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার চরিত্রগুলির উপর ট্রাজিক পরিণতি ডেকে এনেছে তা সমাজকেন্দ্রিক চিরন্তনতার প্রতীক৷ এর প্রাসঙ্গিক আলোচনা প্রসঙ্গে রত্নদ্যুতি গিরি বলেছেন—‘‘হয়তো গীতিকাগুলির সমাজচিত্রের মধ্যে আংশিকতার অতিপ্রাধান্য সামগ্রিকতাকে তুলে ধরতে পারেনি৷ কিন্তু প্রকৃতি বর্ণনা, রূপবর্ণনা কিংবা চরিত্র চিত্রণে গীতিকাগুলির সর্বাঙ্গে বাস্তব উপদেশ কিংবা তথ্যবিন্যাসের যে প্রাচুর্য আছে আধুনিক উপন্যাসের উপাদান তার মধ্যে প্রচুর পরিমাণেই সংসক্ত হয়ে আছে৷’’২২ আর দীনেশচন্দ্র সেন এর ভূমিকা লিখতে গিয়ে বলেছেন—‘‘এই ভাষার ঐশ্বর্য্যের কথা ছাড়িয়া দিলে, জাতীয় আদর্শ সংস্থাপনে কবিত্বে ও কারুণ্যে, মর্মকথার অভিব্যক্তিতে ও চরিত্রমর্যাদা-রক্ষণে—ঐতিহাসিকতায় ও কল্পনার শোভায়, এই গাথাগুলি বঙ্গসাহিত্যকে এক নব জয়শ্রী পরাইবে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই৷’’২৩ এই গীতিকবিতার ধারা আধুনিক উপন্যাসের প্রস্তুতি পর্বে অপ্রত্যক্ষভাবে যে ভূমিকা নেয়নি তা নয়; বাংলা উপন্যাসের কর্ষণক্ষেত্রকে বহুপরিমানে উর্বর করে তুলেছিল৷ বাংলা উপন্যাসের জগতে এই মৈমনসিংহ গীতিকার গুরুত্ব তাই কোনো অংশেই কম নয়৷

আবার মুসলিম রোমান্টিক প্রণয় আখ্যানগুলি এর ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট নিয়ে সাহিত্যজগতে অন্য এক ধারার প্রবর্তন করে৷ দৈবানুগ্রহহীন স্বাধীন আঙ্গিকে এটি বাংলা সাহিত্যে নবদিগন্ত খুলে দেয়৷

উপন্যাস সৃষ্টির পূর্বে উপন্যাসের আদি ভূমিটিকে সর্বাধিক স্পর্শ করেছিল মঙ্গলকাব্যগুলি৷ মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল ইত্যাদির কাহিনি, ঘটনা, নানাশ্রেণীর চরিত্র, চরিত্রগুলির ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-যন্ত্রণা, প্রতিকূলতা সমস্ত সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে প্রতিফলিত হয়েছে মঙ্গল কাব্যগুলির মধ্যে৷ দৈবানুগ্রাহী হলেও পৌরাণিক দেবতারা সকলেই যেন মাটির মানুষের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে৷ মানুষের ঈর্ষা, শঙ্কা, কলহপরায়ণতা, আত্মসংকট প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যগুলি সেখানে দেবতাদের স্বভাবে প্রবেশ করে মর্ত্যলোক ও স্বর্গলোককে অভিন্ন করে দিয়েছে৷ মঙ্গলকাব্যধারার কবিদের মধ্যে এই বাস্তবতাকে সর্বাপেক্ষা বেশি করে যিনি তুলে ধরতে পেরেছেন তিনি হলেন; কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী, চণ্ডীমঙ্গলের রচয়িতা৷ জন্মসূত্রে মধ্যযুগের হলেও মুকুন্দ চক্রবর্তী মননধর্মীতায় ছিলেন আধুনিক মানুষ৷ তাঁর সৃষ্টিশীল আধুনিক মনস্কতার গুণে তিনি বৈচিত্র্য আনতে সক্ষম হয়েছিলেন মঙ্গলকাব্যের গতানুগতিক কাহিনির মধ্যেও৷ তিনি তাঁর কাব্যে যেখানে যখনই সুযোগ পেয়েছেন জীবনরসের সঞ্চার করেছেন ফলে, চরিত্রগুলি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে৷ সমাজবাস্তবতা, চরিত্রসৃষ্টির নিপুণতা, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশীলতা, সুগভীর জীবনপ্রত্যয় ও জীবন রস পরিবেশনের অসামান্য ক্ষমতা মুকুন্দের কাব্যে ও তাঁর লেখনী প্রতিভায় বর্তমান ছিল যা তাকে ঔপন্যাসিকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে৷

আখ্যানধর্মী রচনায় শিল্পগুণ নির্ভর করে কবির চরিত্রসৃষ্টির দক্ষতায়৷ এক্ষেত্রে তিনি গতানুগতিকতা থেকে বাইরে বেড়িয়ে এসে নতুন ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আরোপ করে চরিত্রগুলিকে শিল্পগুণসম্পন্ন করে তুলেছেন৷ প্রচুর চরিত্রের উপস্থাপন রয়েছে তাঁর ‘নৌতন মঙ্গলে’৷ বৈশিষ্ট্যের নিরিখে চরিত্রগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে৷ যথা—দেব-দেবীর চরিত্র, মানব-মানবী চরিত্র৷ মানব চরিত্রের মধ্যে স্বভাবজ বৈশিষ্ট্যে সাধারণ মানবগুণ সম্পন্ন চরিত্র এবং ধূর্ত বা খল চরিত্র এই দুইটি শ্রেণী বর্তমান৷ অর্থাৎ সার্বিকভাবে তিন শ্রেণীর চরিত্র দাঁড়াচ্ছে—দেব-দেবী চরিত্র, সাধারণ মানবগুণসম্পন্ন চরিত্র এবং ধূর্ত বা খল চরিত্র৷

দৈবী চরিত্রের মধ্যে প্রধান শিব ও পার্বতী৷ রচনাকারের শৈল্পিক দক্ষতায় তারা তাদের দৈব গুণাবলী ছাপিয়ে সাধারণ মানব-মানবীতে রূপায়িত হয়েছে৷ এছাড়া মেনকা, নারদ ইত্যাদি চরিত্রগুলিও সাধারণতায় মনুষ্যগুণ প্রাপ্ত হয়েছে৷ দেবাদিদেব মহাদেব শিব একদিকে যেমন ত্রিকালদর্শী অন্যদিকে আবার অলস, খাদ্যরসিক, পত্নীপরায়ণ এবং ভিক্ষুক গোত্রীয়৷ শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই হয়ে থাকা অকর্মণ্য শিব শাশুড়ীর খোটা শুনে গৌরীর সঙ্গে যুক্তি করে শ্বশুরের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে নানা চিন্তা করে ভিক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়—

 ‘‘ভবনে সম্বল নাহি চিন্তিলেন গোসাঞি

 ভিক্ষার উপদেশ কৈল মতি৷

 ত্রিদশের ঈশ্বর ভিক্ষা মাগেন হর

 আরোহণ করি বৃষবরে

 বাজন ডম্বুর শৃঙ্গ শুনিয়া বাড়য়ে রঙ্গ

 নগরিয়া জোগান ধরে৷’’২৪

মহাদেব কোঁচপাড়ায় ভিক্ষা কার্য করে প্রচুর ভিক্ষান্ন প্রাপ্ত হয়ে সোৎসাহে তা গৃহিণীর নিকট অর্পণ করে৷ কিন্তু অলস প্রকৃতির শিব দ্বিতীয় দিন আর ভিক্ষায় বের হতে চায় না৷ শিব এখানে সেই শ্রেণীর মানুষের মতো যারা কোনোভাবেই পরিশ্রম করতে চায় না এবং একদিন যদি একটু পরিশ্রম করে দ্বিতীয়দিন আর কাজমুখো হয় না৷ তাই গৃহিণীকে বলে—

 ‘‘কালি দুঃখ পাইআ ফিরিলাঙ নানা ধাম

 আজি সকালে ভোজন করিয়া থাকিব বিশ্রাম৷’’২৫

ভোজন করার জন্য মহাদেব স্ত্রীকে যে সমস্ত ব্যঞ্জনাদি রন্ধনের উপদেশ দিয়েছে তাতে খাদ্যরসিক ব্যক্তি হিসেবে তার পরিচয় মেলে৷—

 ‘‘আজি গণেশের মা রান্ধিবে মোর মত

 নিমে শিমে বাগ্যনে রান্ধিআ দিবে তিত৷

 সুকুতা শীতের কালে বড়ই মধুর

 কুমুড়া বাগ্যন দিআ রান্ধিবে প্রচুর৷

 নটিআ কাঁঠাল বিচি সারি গোটা দশ

 ফুলবড়ি দিহ তায় আর আদারস৷’’২৬

সংসারের অভাব-অনটন, উপার্জনের জন্য স্ত্রী গৌরীর পীড়াদায়ক কথা অকর্মণ্য শিবের মনে বৈরাগ্য নিয়ে আসে৷ সেই বারোভূতের সংসারে সে আর থাকতে চায় না৷ তাই গনেশের মাকে বলে—

 ‘আমি ছাড়িব ঘর জাইব দেশান্তর

 কি মোর ঘরকরণে

 হইয়া সতন্তর তুমি করহ ঘর

 লইআ গুহ গজাননে৷

 কতেক ঘরে আনি লেখা নাঞি জানি

 ডেড়ি অন্ন নাহি থাকে

 কতেক ইন্দুর করয়ে দুবদুর

 গনারি মূষার পাকে৷’

পার্বতী একদিকে দেবী অন্যদিকে পিতৃ-মাতৃ স্নেহ কাঙাল কন্যা৷ দীর্ঘদিন স্বামীর সংসারে থেকে মর্ত্য মানবীর মতো মায়ের হাতের রান্না অন্ন-ব্যঞ্জন খাবার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে৷ তাই দেবী সাধারণ গৃহবধূর মতো স্বামীর পায়ে ধরে পিতৃগৃহে যাওয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করছে—

 ‘‘চরণে ধরিয়া সাধি কৃপা কর কৃপানিধি

 জাব পঞ্চ দিবসের তরে

 চিরদিন আছে আশ জাইব বাপার পাশ

 নিবেদন নাঞি করি ডরে৷

 সুমঙ্গল-সূত্র করে আইলাঙ তোমার ঘরে

 পূর্ণ হইল বৎসর সাত

 দূর কর বিবাদ পুরহ আমার সাধ

 মাএর রন্ধনে খাব ভাত৷’’২৭

ত্রিকালদর্শী মহাদেব ভবিষ্যৎ অমঙ্গলের কথা অনুমান করে স্ত্রীকে যেতে বাধা দিলে স্বামীর উপর ক্ষোভে ফেটে পড়ে সে৷ রাগ করে নিজেই পিতৃগৃহের পথ ধরে—

 ‘‘জাইবারে অনুমতি নাহি দিলা পশুপতি

 দাক্ষায়ণী হইলা কোপমতি

 সভারে হইআ বামা চলিলা ভ্রূকুটী ভীমা

 একাকিনী বাপের বসতি৷’’২৮

বাপের বাড়িতে পিতার আয়োজিত মহাযজ্ঞে স্বামীকে নিমন্ত্রণ না করার জন্য পিতাকে অনুযোগ করলে পিতৃমুখে উচ্চারিত হয় তার স্বামীর উদ্দেশে প্রবল নিন্দা৷ মর্ত্যপৃথিবীর বিবাহিতা কন্যার মতো সে অপমান সহ্য করতে পারে না পতিব্রতা সতী৷ তাই পিতাকে বলে যে তার মুখে অমন নির্মম অপবাদ ধ্বনিত হয়েছে আর তার ঔরসজাত বলে নিজের দেহকেই আর জীবিত রাখবে না৷—

 ‘‘শিবনিন্দা শ্রবণে করিব প্রতিকার

 তোমার অঙ্গজ তনু না রাখিব আর৷’’২৯

তাই পিতার সামনে আত্মহত্যা করে স্বামী নিন্দার শোধ নেয়৷

এরপর উমার সংসারে দেখা যায় উমার সাংসারিক জীবনের আরেক রূপ৷ অলস, অকর্মণ্য, নেশাখোর, দরিদ্র স্বামীর গৃহিণী সে৷ দারিদ্র্যের সঙ্গে যুঝতে না পেরে বহুদিন স্বামী-সন্তানসহ পিত্রালয়ে অবস্থান করে৷ সেখানে মায়ের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় মুখরা মেয়ের মত ঝগড়া করে স্বামীর সঙ্গে বাপের বাড়ি ত্যাগ করে আবার দুরন্ত অভাব অনলে ঝাঁপ দেয়৷ তার মা মেনকা বাপের ঘারে বসে বসে খাওয়ার খোটা দিলে সে বলে—

 ‘‘রাঁধ্যা বাড়িয়া মাতা কত দেহ খোঁটা

 আজি হইতে তোমার দ্বারে দিল কাঁটা৷

 মৈনাক তনয় লইয়া সুখে কর ঘর

 কত না সহিব খোঁটা জাই অন্যত্তর৷’’৩০

সংসার প্রতিপালনের জন্য শিব ভিক্ষা করতে বাধ্য হলে হাসিমুখে সেই ভিক্ষান্ন গ্রহণ করে রেঁধে-বেড়ে স্বামী পুত্রকে খাওয়ায়, কার্তিক গনেশ খাবার নিয়ে ঝগড়া করলে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে বুঝিয়ে শান্ত করে দুই ভাইকে খাবার ভাগ করে দেয়৷ স্বামী একদিন কাজ করে দ্বিতীয় দিন যখন আর কাজে না গিয়ে ভালোমন্দ খেয়ে বিশ্রাম নিতে চায় তখন কৃতাঞ্জলী পুটে গৌরী তাকে হাড়ির হাল জানিয়ে বলে পুরোনো ধার-দেনা শোধ করতেই তার অতিরিক্ত অন্ন শেষ হয়ে গেছে৷ তাই—

 ‘‘আজিকার মত যদি বান্ধা দেহ শূল

 তবে সে আনিতে নাথ পারি হে তন্ডুল৷’’৩১

অর্থাৎ শূল বাঁধা দিয়ে তাকে চাল আনতে বলে৷ নিজের ভাগ্য নিয়ে আক্ষেপ করতেও দেখা যায় সাধারণ ভাগ্যবিড়ম্বিত গৃহবধূদের মতো—

 ‘‘কি জানি তপের ফলে হর মেল্যাছে বর

 সই সাঙ্গাতিন নাঞি আইসে দেখিআ দিগম্বর৷

 বাপের সাপ পোএর মউর সদাই করে কলি

 গনার মূষা ঝুলি কাটে আমি খাই গালি৷

 বাগ বলদে সদাই দ্বন্দ্ব নিবারিব কত

 অভাগি গৌরীর কপালে দারুণ দৈবে হত৷’’৩২

মেনকাচরিত্রটি সামান্য একঝলক উপস্থিতিতেই অসামান্য হয়ে উঠেছে৷ সেও দৈবী বাতাবরণ কাটিয়ে সাধারণ মানবী৷ মেয়ে, স্বামী, দুই পুত্র, তাদের নিজেদের বাহনগুলিকে নিয়ে বাপের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্ত মনে প্রতিবেশী সখিদের সঙ্গে পাশা খেলে দিন গুজরান করে৷ ফলে বিশাল সংসারের সমস্ত দৈনন্দিন কর্মভার মেনকাকে একাই করতে হয়৷ হাতে হাতে সাহায্য না করে, সমস্ত সংসারের দায়কে উদাসীন উপেক্ষায় অবহেলা করে চললে মায়ের তা সহ্য হয় না৷ পরিণামে মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে সে৷—

 ‘‘তোমায় ঝি হইতে মোর মজিল গার‍্যাল

 ঘরে জাওঙাঞি রাখিআ পুষিব কতকাল৷

 প্রভাতে ভাতেরে কান্দে কার্তিক গণাই

 চারি কড়ার সম্ভাবনা তোমার ঘরে নাঞি৷

 মিথ্যা কাজে ফিরে পতি নাঞি চাষবাস

 ভাত কাপড় কত না জোগাব বার মাস৷’’৩৩

আবার পার্বতীর আরেক রূপ দেবী চণ্ডীও ছলনায়, কপটতায়, ভক্তবাৎসল্যে, অলৌকিকতায় পরিপূর্ণা৷ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ছলনার আশ্রয় নিয়ে শিবকে দিয়ে নীলাম্বরকে অভিশাপ দেওয়াতে বাধ্য করেছে, লঘুদোষে গুরুদণ্ড দিয়েছে রত্নমালা ও মালাধরকে, কালকেতুকে রাজা করার জন্য কলিঙ্গ রাজ্য প্লাবিত করে অসহায় প্রজাদের শাস্তি দিয়েছে, ভক্তের জন্য যুদ্ধও করেছে৷

অর্থাৎ পার্বতীর তিনটি স্তরে প্রথমটিতে গিরিরাজের কন্যা রূপে শিবকে পাওয়ার অদম্য জেদ, দ্বিতীয় স্তরে শিবের গৃহিণী পার্বতী রূপে মধ্যবিত্ত বাঙালি চরিত্রের মতো প্রেমে-কলহে-ঘরকন্নায় সাধারণত্ব অর্জন করেছে৷ তৃতীয় স্তরে চণ্ডীরূপে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ছলনায়-স্বার্থপরতায় নানা শঠ চক্রান্তে সর্বোপরি ভক্তজনের মঙ্গলাকাঙ্খায় দেবীধর্ম ও মনুষ্যধর্ম একাকার হয়ে গেছে৷

মানব চরিত্র নির্মাণে মুকুন্দ যেন মনের সবটুকুকে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন৷ তাঁর বেশিরভাগ চরিত্রগুলি দ্বন্দ্ব-মুখর হয়ে উঠেছে পারিপার্শ্বিকতার কারণে৷ কালকেতু চরিত্রটি আদিম শিকারজীবী৷ তার শারীরিক আকৃতি, বন্যপ্রকৃতি, শক্তি ও সাহসিকতা, শয়ন, ভোজন ইত্যাদি বর্ণনায় আদিম রূপটিকেই তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন৷ কালকেতুর ভোজন-শয়ন সম্পর্কে তাই রচনাকার তুলে ধরেছেন—

 ‘‘মুচুড়িয়া গোফ দুটা বাঁন্ধে নিঞা ঘাড়ে

 এক শ্বাসে তিন হাণ্ডি আমানী উজাড়ে৷

 চারি হাঁড়ি মহাবীর খায় খুদ-জাউ

 সুপ ছয় হাঁড়ি তায় মিসাইয়া লাউ৷

 … … …

 শয়ন কুচ্ছিত বীরের ভোজন বিটকাল

 ছোট গ্রাস তোলে বীর জেন হাড়িয়া তাল৷

 ভোজনসময়ে গলা করে ঘড়ঘড়

 কাপড় ঊষাষ করে জেন মরাই-বড়৷’’৩৪

কালকেতু যেমন বীর বিক্রমে বনের পশুদের সঙ্গে লড়াই করে, তাদের হত্যা করে বন উজাড় করে দিতে পারে তেমনি তার চরিত্রের মধ্যে বিবেচনা বোধটিকেও একেবারে বাদ দেননি রচনাকার৷ সেই বিবেচনাবোধে ফুল্লরার বাক্যবাণে পীড়িত হয়ে গৃহে এসে ষোড়শী কন্যাকে দেখে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি ফেরাতে চেষ্টা করে৷ ঈষৎ কোপিত হয়েও করজোড়ে তাকে অনুরোধ করে—

‘‘মাতা ছাড় এই স্থান মাতা ছাড় এই স্থান

আগুনি সে রক্ষা করি আপনার মান৷

একাকিনী যুবতি ছাড়িলে নিজ ঘর

উচিত বলিতে কেনি না দেহ উত্তর৷

বড়ার বহুআরী তুমি বড় লোকের ঝি

তোমার মোহন রূপে মোর লাভ কি৷’’৩৫

দেবী চণ্ডীর কৃপায় কালকেতু দেবীর হাতের আংটি সহ সাত ঘড়া ধন পায়৷ দুই দুই চার ঘড়া দুবারে গৃহে রেখে এসে বাকি তিন ঘড়ার দুঘড়া কাধের দুদিকে নিলেও এক ঘড়া অবশিষ্ট থেকে যায়৷ তখন দেবীকে অনুরোধ করে এক ঘড়া তার কাখে করে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য৷ পরে আবার এসে একঘড়া নেওয়ার মতো ধৈর্য তার নেই৷ দরিদ্রের চেয়েও দরিদ্র সে৷ পশুশিকার করে সেই মাংস বিক্রি করে স্বামী-স্ত্রীর দুজনের পরিশ্রমের দ্বারা কোনোমতে সংসার চলে৷ সেই গরিব মানুষ হঠাৎ করে বিপুল ধন পেয়েছে৷ কার ভরসাতে একঘড়া ধন রেখে যাবে মাঝ-বনের মধ্যে! আবার দেবী তাকে ধন দিলেও দেবীকে ভরসা পায় না সে৷ কলসি কাখে সেই ধন নিয়ে দেবী তার পিছু পিছু পথ চললেও কালকেতুর মনে হয় দেবী যদি সেই ধন নিয়ে পিছন থেকে পালিয়ে যায়—

 ‘‘আগে আগে মহারীর করিল গমন

 পশ্চাত পার্বতী জান লইআ তার ধন৷

 মনে মনে মহাবীর করেন জুগতি

 ধন-ঘড়া লইআ পাছে পালায় পার্বতী৷’’৩৬

এই যে ধনদাতাকে ধন চুরি করতে পারে বলে সন্দেহ করা—তার মধ্যে কিছুটা হলেও কালুর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন৷ উপন্যাসে চরিত্র নির্মাণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব৷ যা অল্প হলেও কালকেতুর চরিত্রে ফুটে উঠেছে৷

ফুল্লরা চরিত্রটিও সাধারণ পতিব্রতা রমণীর মতো নানা গুণপনায় উজ্জ্বল৷ সে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির পরিচর্যা করে হাটে গিয়ে মাংস বিক্রি করে আবার সমস্ত গৃহকর্মও একাহাতে নিয়ন্ত্রণ করে৷ বেশ সুখেই কাল কাটছিল তার৷ কিন্তু হঠাৎই তার গৃহে ছদ্মবেশী ষোড়শী পার্বতীকে দেখে তাকে সতিন ভেবে সংসারে নিজের স্থানটি হারাবার ভয়ে আকুল হয়ে উঠে৷ প্রগলভা নারীর মতো সংসারের বারোমাসের দৈন্যকে তুলে ধরে, পুরাণের নানা কথা বলে, নানা নীতি উপদেশ দিয়ে বিদায় করার চেষ্টা করে৷ ছদ্মবেশিনী সেই নারীর মুখে স্বামীর অবহেলা সতিনের জ্বালা ইত্যাদি নানাবিধ কথা শুনে ফুল্লরা তাকে বোঝায়—

 ‘‘স্বামী বনিতার পতি স্বামী বনিতার গতি

 স্বামী বনিতার বিধাতা

 স্বামী পরম ধন বিনে স্বামী অন্যজন

 কেহ নহে সুখ মোক্ষ দাতা৷’’৩৭

সতিন সম্পর্কে বলে—

 ‘‘সতিনি কন্দল করে দুগুণ বলিবে তারে

 অভিমানে ঘর ছাড় কেনি

 কোপে কইলে বিষ পান আপনি তেজিবে প্রাণ

 সতিনির কি হইবে হানি৷’’৩৮

আর কোনো চেষ্টাতেই যখন সেই রূপবতী কন্যাকে গৃহ থেকে বিদায় করতে পারে না তখন সমস্ত ক্ষোভ উগড়ে দেয় গোলাহাটে মাংস বিক্রয়রত স্বামীর কাছে গিয়ে—

 ‘‘পিপিড়ায় পাক উঠে মরিবার তরে

 কাহার সোলস্যা কন্যা আনিআছ ঘরে৷

 এতদিনে মহাবীর পাপে গেল মন

 আজি হইতে হইলে তুমি লঙ্কর রাবণ৷’’৩৯

অর্থাৎ নারী সংসারে যতই মঙ্গলময়ী রূপে অবস্থান করুক না কেন নিজের সেই একমাত্র অবস্থানস্থল স্বামী এবং তার কাছে নিজের মর্যাদা টলে উঠলে তারা যে কতটা অস্থির হয়ে উঠে তা ফুল্লরার স্বভাবজ বৈশিষ্টর মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে৷ ফুল্লরার নারীজনোচিত স্বাভাবিক কোমল মনের চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে দেবীর মহিষমর্দিনী রূপ দর্শন করে মূর্ছা প্রাপ্ত হওয়ার মধ্যে৷ গৃহে এবং বাইরের পরিবেশে বিচরণশীল নারীরা তুলনামুলকভাবে বেশি সাহসী হয়৷ ফুল্লরা শেষ পর্যন্ত সাহস ধরে রাখতে পারেনি৷ মূর্ছিত হয়ে সে মাটিতে পড়ে যায়৷ তার পর দেবী তাদের মূর্ছাভঙ্গ করিয়ে দুঃখ বিমোচনের জন্য অঙ্গুরীয় প্রদান করলে অতিসাধারণ সংসার অভিজ্ঞ রমণীর মতো তা স্বামীকে নিতে নিষেধ করে৷ কারণ সামান্য একটা অঙ্গুরী প্রদান করে দেবী তাদের ধন দানের গর্ব জাহির করে যাবে তা সে মানতে পারে না৷ এ যেন ‘ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করা’ প্রবাদ বাক্যের সামিল সেই ব্যাধ রমণীর কাছে৷—

 ‘‘বীর হস্তে দেন চণ্ডী মানিক-অঙ্গুরি

 লইতে নিষেধ করে ফুল্লরা সুন্দরী৷

 একটী অঙ্গুরি হইতে হব কোন কাম

 সারিতে নারিবে প্রভু ধনের দুর্নাম৷’’৪০

দেবী সেই মানিক-অঙ্গুরীয়ের প্রকৃত মূল্য যে সাতকোটি টাকা তা যখন বলে তখন—

 ‘ফুল্লরা শুনিঞা মূল্য মুখ কৈল বাঁকা৷’৪১

অর্থাৎ দেবীর সেই বাক্য ফুল্লরার মনঃপূত হয় না৷ নারী চরিত্রের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যে মুখ বাঁকা করে সেই নেতিবাচক উপলব্ধিকে ব্যক্ত করে৷

কলিঙ্গরাজের সঙ্গে দ্বিতীয়বার যুদ্ধে অত্যন্ত সাধারণ রমণীর মতো সে কালুকে ঘরে ধানের ঘড়ার পিছনে লুকোতে বলে৷ ভাড়ুদত্ত প্রহরীদের সঙ্গে মিলে কথার প্যাঁচে কালুকে রক্ষা করার মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ধানের ঘড়ার পিছনে লুকিয়ে থাকা কালুর সন্ধান জানতে চায় তখন সরল চিত্তে সেই স্বামীচিন্তায় অধীর রমণী—

 ‘‘ঠকের মধুর বাণী একচিত্তে রামা শুনি

 ধানঘরা কৈল বিলোকন’’৪২

আর তক্ষুণি কোটাল কালকেতুর বাড়ি ঘিরে ফেলে খণ্ডযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে তাকে বন্দি করে৷ স্বামীকে কোটালের হাতে বন্দি হতে দেখে তার আশঙ্কিত নারীমন কিছুতেই স্থির থাকতে পারে না৷ কোটালকে আর্ত হাহাকারে অনুরোধ করে—

 ‘‘না মার না মার বীরে নিদআ কোটাল

 গলার ছিঁড়িআ দিমু সতেশ্বরি হার৷

 চুরি নাহি করি কোটাল ডাকা নাহি দি

 ধন দিআ গেলা দূর্গা হেমন্তের ঝি৷’’৪৩

ফুল্লরার কাছে স্বামী মুক্তির জন্য ধনসম্পদ কিছুই নয়৷ তাই নিরাপদ দারিদ্র্য যন্ত্রণাক্লিষ্ট ব্যাধজীবনই বেশি ভালো মনে হয়৷ সে কোটালকে সবকিছু নিয়ে শুধু মাত্র তীর-ধনুক সঙ্গে দিয়ে ছেড়ে দিতে বলে—

 ‘‘গো-মহিষ লহ মোর অমূল্য ভাণ্ডার

 নফর করিআ রাখ স্বামী আমার৷

 দিআ কুলিতার ধনূ তিন গোটা বাণ

 ধন লৈয়া তুমি মোর কর পরিত্রাণ৷’’৪৪

প্রসঙ্গত বলা যায় যে কালকেতুরও ধনপ্রাপ্তির পর নগর বসাতে গিয়ে বীতরাগ চলে এসেছিল৷ তারও মনে হয়েছিল বর্তমান দায়-দায়িত্ব থেকে পূর্বেকার ব্যাধ জীবন অনেক সহজ এবং নিরাপদ৷ কলিঙ্গ রাজের কারাগারে বন্দি অবস্থায় সে তাই আক্ষেপ করে—

 ‘‘তোর বাক্য নাঞি ধরি চণ্ডিকার অঙ্গুরি

 আমি লইনু আপন মাথা খায়্যা

… … …

 মাঁস বেচ্যা ছিনু ভাল এবে সে পরাণ গেল

 বিবাদ সাধিল কাত্যায়নী৷

 কুলিতার ধনুখান তিন গোটা ছিল বাণ

 আছিলাম আপনার দম্ভে

 কেবা চাহে সম্পদ ধন দিআ কৈলে বধ

 ভগবতী আমারে বিড়ম্বে৷’’৪৫

অর্থাৎ জীবনভর শিকার জীবনে অভ্যস্ত দুই নর-নারী দৈব বলে হঠাৎ করে প্রচুর ধন-সম্পদের ফলে রাজা হয়ে নাগরিক জীবনে নিজেদের মেলাতে পারে না৷ তাদের দুটি ভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে চলার যে সংকট ও মানসিক দ্বন্দ্ব তা রচনাকার এই খেদ-আক্ষেপের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছেন৷

বণিক খণ্ডের লহনা ও খুল্লনা সাধারণ নারী জীবনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থাপিত৷ এই অংশের নায়িকা খুল্লনা হলেও মানসিক যন্ত্রণায় দ্বন্দ্বমুখর হয়েছে লহনা৷ চোখের সামনে বন্ধ্যাত্বের ধুয়া তুলে স্বামী সতিন করে এনেছে নিজের খুড়তুতো বোনকে৷ নিজের বিগতযৌবন অন্যদিকে সপত্নীর ঢলঢলে তরতাজা রূপ তাকে পীড়িত করেছে৷ তার মনে স্বামী প্রেম হারানোর আশঙ্কা দানা বেধেছে৷ তার সেই আশঙ্কার মূলে দিনের পর দিন জল সিঞ্চন করে গেছে দাসী দুবলা৷ সে তার মনের যন্ত্রণা প্রকাশ করে বশীকরণ বিদ্যায় পারদর্শী লীলাবতীকে ডেকে বলেছে—

 ‘‘জিজ্ঞাস কি আর কুশল বিচার

 কহিতে বিদরে বুক

 ঘরে নাহী পতি সতার উন্নতি

 দুখের উপরে দুখ৷’’৪৬

তারপর লীলাবতীর দ্বারা সাধু ধনপতির নাম করে জাল পত্র লিখে সমস্ত গৃহসুখ বঞ্চিত করে সতিনকে বনে ছাগল চরিয়ে উদরপূরণের শর্তে নিক্ষেপ করে৷ তার এই হিংস্র রূপটি দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক৷ আবার দৈব কৃপায় যখন খুল্লনা সমস্ত অবগত হয়ে গৃহে ফিরে সাধুকে সমস্ত জানাতে সংকল্প করে তখন দেখা যায় অত্যন্ত তোষামোদে তার পরিচর্যা করছে লহনা৷ কারণ সে জানে তার সেই অন্যায় ধনপতির কর্ণগোচর হলে তার আর রক্ষা থাকবে না৷ আর এর মধ্য দিয়েই চরিত্রটি অনন্যতা লাভ করেছে৷

ঔপন্যাসিক তাঁর উপন্যাসে জীবনের সংগতি-অসংগতির নানা দিক তুলে ধরে বা কৌতুকরসের অভিসিঞ্চনে সাহিত্য রূপটিকে জীবন্ত করে তোলেন৷ চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে মুকুন্দ মুরারি শীল, ভাড়ুদত্ত, দুবলা ইত্যাদি খল চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে সেই দিকটিকে সুস্পষ্ট করেছেন৷ তাদের মতো কপট, সুবিধাবাদী, প্রবঞ্চক, পরশ্রীকাতর, ছিদ্রান্বেষী চরিত্রগুলি না থাকলে কাব্যখানির সার্থকতা অনেকাংশে ব্যহত হত৷ তাঁর কাব্যের সবচেয়ে জীবন্ত চরিত্র ভাড়ুদত্ত৷ এর মতো ধূর্ত পাষণ্ড চরিত্র মুকুন্দের আগে একজনও রচনা করতে পারেননি বোধ হয়৷ ভাড়ুদত্ত হরিদত্তের পুত্র এবং জয়দত্তের নাতি৷ লোক ঠকানোর জন্যই যেন তার জন্ম৷ তার ধূর্ততা তুলনারহিত৷ কালকেতুর দরবারে হাজির হয়েই বাক্যজাল তৈরি করে খুড়া সম্পর্ক পাতিয়ে নিজেকে স্বতন্ত্রভাবে পরিচায়িত করে৷ কপালে চন্দনের ফোটা, ছেঁড়া ধূতির লম্বা কোঁচা, কানে কলম গোঁজা ভাড়ু বলে—

 ‘‘খুড়া আইলাঙ প্রতিআসে বসিতে তোমার দেশে

 আগেতে ডাকিবে ভাঁড়ুদত্তে

 জতেক কায়েস্ত দেখ ভাঁড়ুর পশ্চাতে লিখ

 কুলে শীলে বিচারে মহত্ত্বে৷’’৪৭

তার গোছানোর মিথ্যা কথাকে সত্য মনে করে কালকেতু তাকে মান্যগণ্য ব্যক্তি ভেবে আদর-সমাদর করে৷ সে কালকেতুর রাজ্যে স্বঘোষিত মহামণ্ডল সেজে হাটে গিয়ে কালকেতুর নাম করে দোকানিদের কাছ থেকে তোলা আদায় করতে থাকে৷—

 ‘‘পসার লুটিআ ভাঁড়ু ভরয়ে চুপড়ি

 জত দ্রব্য লয় ভাঁড়ু নাঞি দেয় কড়ি৷

 লণ্ডে ভণ্ডে দেয় গালি বলে শালামালা

 আমি মহামণ্ডল আমার আগে তোলা৷’’৪৮

তার অত্যাচারে অতিষ্ট হাটুয়ারা কালকেতুর কাছে নালিশ করলে সে যখন ভাঁড়ুকে কৃতকর্মের জন্য অপমান করে তখন ভাঁড়ুর প্রতিহিংসাপরায়ণ রূপটি স্পষ্টভাবে পাঠকের দৃষ্টিগোচর হয়৷ সে প্রতিজ্ঞা করে—

 ‘‘হরি দত্তের বেটা হঙ জয় দত্তের নাতি

 হাটে বদি বেচাঙ বীরের ঘোড়া হাথি৷

 তবে সুবাসিত করঙ গুজরাট ধরা

 পুনুর্বার হাটে মাস বেচাঙ ফুল্লরা৷’’৪৯

আর সেই প্রতিজ্ঞাপূরণ করতে কাঁচকলা, পুইশাক, কলার মোচা ভেট নিয়ে উপস্থিত হয় কলিঙ্গরাজের দরবারে৷ রাজাকে খোঁচা দিয়ে তার ব্যক্তিত্বকে আলোড়িত করতে বলে—

 ‘‘দিন গোঙায় মিছা কার্যে মন নাহি দেহ রাজ্যে

 চোর খণ্ড না কর বিচার৷’’৫০

তার এই বাক্যে রাজা সচকিত হলে সে ধীরে ধীরে রসিয়ে রসিয়ে ব্যাধ থেকে কালকেতুর রাজ্যস্থাপনের কথা বলে—আর তার ধনপ্রাপ্তিকে অসৎপন্থার ফল হিসেবে ইঙ্গিত দান করে৷ তার কথায় ক্রুদ্ধ রাজা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কালকেতুকে আক্রমন করে চরমভাবে পরাজিত হয়৷ ভাঁড়ুর কোনো লাভ হয় না তাতে৷ রাজাকে খোঁচা দিয়ে যেভাবে দিক ভ্রান্ত করে দিয়েছিল একইভাবে কোটালের পৌরুষকে বিদ্ধ করে পুনরায় যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত করার চেষ্টা করে৷ কারণ ভাঁড়ুর মতো খলচরিত্র ভালো করেই জানে যে কোনোভাবে মানুষের যদি আঁতে ঘা দেওয়া যায় তাহলে তার ফল সম্পূর্ণভাবে ইতিবাচক হবে৷ তাই কোটালের আঁতে ঘা দিয়ে বলে—

 ‘‘গায়ের গরবে ডাক বিক্রমে সমসর

 বড়াঞি করিলি তুঞি রাজার গোচর৷

 সেনাপতি সামন্ত সভার বিদ্যমান

 বীর ধরিবারে বেটা আগে নিলি পান৷’’৫১

আর ভাঁড়ুর সেই কথায়—

 ‘‘কোটালে ভাঁড়ুর বোলে লাগিল ভেলকী৷

 তরাসে কোটাল পুনু গুজরাট বেড়ি

 রহ রহ বলিআ দামায় পড়ে বাড়ি৷’’৫২

দ্বিতীয়বার কোটালকে আক্রমন করতে দেখে ফুল্লরার নারী হৃদয় বড় এক বিপর্যয়ের কল্পনা করে স্বামীকে ধানের ঘরে লুকিয়ে রাখে৷ ভাঁড়ু দত্ত কালুর সন্ধান না পেয়ে কপট সহানুভূতি দেখিয়ে কালুকে রক্ষা করার নাম নিয়ে তার সন্ধান আদায় করে নেয়৷ পরিণামে বন্দি হয় কালকেতু বীর৷ দেবীর সহায়তায় দোষমুক্ত কালকেতু মহাসম্মানে পুনরায় যখন রাজ্যে ফিরে আসে ভাঁড়ু সঙ্গে সঙ্গেই একশআশি ডিগ্রি ঘুরে যায়৷ তার শঠতা দিয়ে কালুকে বোঝায় যে সে ধানের গোলা থেকে তাকে ধরিয়ে দিয়েছিল বলেই কালকেতু অত সম্মান পেয়েছে৷ কালুর সেই সম্মানের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব নিজ স্কন্ধে গ্রহণ করে সে বলে—

 ‘‘আছিলে গোপত বেশে প্রকাশ করাইলা দেশে

 সম্ভাষ করাইল নৃপমণি

 নিজ হস্তে নরপতি ধরিল ধবল ছাতি

 ভুঞা রাজার মধ্যে তোমা গণি৷

 কোথা বীর পাইলা ধন ঘুসিত সকল জন

 পরিবাদ ছিল লোক মাঝে

 প্রকাশ করাইল আমি বড় সুখ পাইবে তুমি

 খ্যাত হইব কলিঙ্গ-সমাজে৷

 জখন দুপর নিশা করি রাজা সম্ভাষা

 আনেক বুঝাইনু নরপতি

 ধরিআ রাজার পায় খণ্ডিল সকল দায়

 খুড়ি জানেন আমার প্রকৃতি৷’’৫৩

কিন্তু এবার ভাঁড়ু বীরের মন গলাতে পারে না৷ তাকে মাথা মুড়িয়ে, গালে চুনকালি মাখিয়ে, ঘোল ঢেলে গ্রাম থেকে বিদায় করে দেয়৷ শেষপর্যন্ত অবশ্য এই শঠতার শাঠ্যের জন্য চরম অপমান ভোগ করেও কালকেতুর দয়ায় পুনর্বার গুজরাট নগরে ঠাঁই পায়৷

মুরারি শীলও ঠক চরিত্র৷ কবি তার সম্পর্কে ‘দুঃশীল’ বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন—

 ‘‘বান্যা বড় দুঃশীল নাম মুরারি শীল

 লেখা-জোখা করে টাকা-কড়ি’’৫৪

দেবীর দেওয়া আংটি বিক্রির জন্য কালকেতু তার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে হাক দিতেই সে লুকিয়ে পড়ে৷ কারণ কালকেতুর কাছে ‘ডেড় বুড়ি’ কড়ি বাকি আছে তার৷ সে ভেবেছে কালকেতু মাংসের সেই ‘ডেড় বুড়ি’ কড়ি আদায়ের জন্য এসেছে৷ মুরারি সেই ধরনের চরিত্র যে কৃপণতার জন্য কালকেতুর মতো দরিদ্র ব্যাধেরও বকেয়া পরিশোধ করে না৷ বরং অর্থপ্রাপককে দেখলে গা ঢাকা দেয়৷ মনুষ্য জীবনে এ ধরনের চরিত্র কোনো যুগেই অপ্রাপ্ত নয়৷ মুরারি নিজে আত্মগোপন করে স্ত্রীর দ্বারা কালকেতুকে জানায় যে সে বাড়িতে উপস্থিত নেই৷ কিছুক্ষণ পরেই যখন আংটি বিক্রির প্রসঙ্গ ঘর থেকে শোনে এবং তার উপযুক্ত সহধর্মিনী যখন বুঝতে পারে সে আংটি মূল্যবান তখন—

 ‘‘ধনের পাইআ আশ জাইতে বীরের পাশ

 ধায় বান্যা খড়কির পথে’’৫৫

 দ্রুত ভিন্ন পথে কালুর সামনে উপস্থিত হয়ে আংটি হাতে নেয় এবং তা যে আসল রত্ন তা বুঝেও সরল ব্যাধকে ঠকিয়ে লাভবান হওয়ার জন্য মাংসের বকেয়া সমেত অষ্টপণ কড়ি মূল্য হাকে৷ সেই অর্থও নগদে দিতে মন সরে না তার৷ তাই ব্যাধনন্দনকে বলে—

 ‘‘একুনে হইল অষ্ট পণ আড়াই বুড়ি

 চালু ডালি কিছু লহ কিছু লহ কড়ি৷’’৫৬

কালকেতু পূর্বেই দেবীর কাছে শুনে নিয়েছে সেই আংটির সাতকোটি মূল্যের কথা৷ তাই ন্যায্য মূল্য না পেয়ে সে অন্য বণিকের কাছে যেতে চাইলে মুরারি মূল্যবান আংটিটিকে হারাতে চায় না৷ তাকে তার পিতার সঙ্গে অতীত সম্পর্কের কথা বলে ধরে রাখতে চায়—

 ‘‘বান্যা বলে দরে বাড়া হইল পঞ্চবট

 মোর সনে সদা করি না পাবে কপট৷

 ধর্মকেতু ভায়্যা সনে কইনু লেনা দেনা

 তাহা হইতে ভাইপো হইআছ অধিক সেয়ানা৷’’৫৭

যদিও শেষ পর্যন্ত দৈববাণী শুনে সাতকোটি মূল্য দিতেই বাধ্য হয় সে৷ আবার তার সেই কম মূল্য বলাকে পরিহাস বলে চালিয়ে দিয়ে নিজের ‘ইমেজ’টিকেও ধরে রাখে৷

মুরারি শীল যেমন সেয়ানা ব্যবসায়ী ,তার স্ত্রীও তেমনি যথার্থ সহধর্মিনী৷ কালকেতুর বকেয়া শোধ না দেওয়ার জন্য সেও অনায়াসে স্বামীর অনুসরণ করে মিথ্যে কথা বলে—

 ‘‘সকালে তোমার খুড়া গেছেন খাতকপাড়া

 কালি দিব মাংসের ধার৷’’৫৮

শুধু তাই নয় অত্যন্ত মিষ্টভাষে পরদিন কালকেতুকে একভার কাঠ, মিষ্টি ইত্যাদি দ্রব্যও নিয়ে আসতে বলতে ভোলে না৷ অর্থাৎ মানুষের কাছ থেকে ‘মুফতে’ কোনোকিছু আদায় করে নেওয়ায় দক্ষ এই বনিক ও বনিকগিন্নি৷ তারপর কালু যখন জানায় যে সে বকেয়া নিতে নয় আংটি বিক্রি করার জন্য এসেছে তখন মুহূর্তে তার কথার ধরন পাল্টে যায়৷ বণিকগৃহিণী বলে—

 দন্ড চারি করহ বিলম্বন

 সহাস করিআ বাণী আসি বলে বান্যানী

 দেখি বাপা অঙ্গুরী কেমন৷’’৫৯

বণিক খণ্ডের দুবলা দাসী নামে দুবলা হলেও চরিত্র হিসেবে অত্যন্ত সবলা৷ তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন এই নারী ধনপতির দুই পত্নী লহনা-খুল্লনার দাসী হিসেবে কাজ করে৷ বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দুবলা দুই সতিনের সৌহার্দ্য দেখে বিচলিত হয়ে যায়৷ সে দেখে এসেছে দুই সতিনের মধ্যে কলহ না থাকলে দাসীদের সুখ থাকে না৷ তাদের কাজও যেমন বেশি করতে হয়, তেমনি দুজনের মুখনাড়াও সমান তালে সহ্য করতে হয়৷ আর অমিল হলে একের নিন্দা অন্যের কাছে করে কাজ থেকে আরাম, স্নেহ এমনকি নানা উপহারও অর্জন করা যায়৷ তার এই মানসিক ভাবনাকে কবি প্রকাশ করেছেন এইভাবে—

 ‘‘প্রেমবন্ধ দু-সতিনে দেখিআ দুবলা

 হৃদে কালকুট বিষ মুখে জেন তুলা৷

 লহনা খুল্লনা জদি থাকে এক মেলি

 পাটী করি মরিব দুজনে দিব গালি৷

 জেই ঘরে দু-সতিনে না বাজে কন্দল

 সেই ঘরে রহে দাসী সে বড় পাগল৷

 একে কহিতে নিন্দা যাব অন্যস্থান

 সে ধনি বাসিব জেন পরান সমান৷’’৬০

অর্থাৎ দুজনের কাছে দুজনের নিন্দা করে দুইয়ের কাছেই ভালো হয়ে আরামে দিন কাটানোর সংকল্প করে৷ তৎপর হয় লহনা-খুল্লনার কানে বিষ ঢেলে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে৷ তাদের সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট করতে সে সিদ্ধান্ত নেয় লহনার যৌবনহীন দেহ এবং খুল্লনার ঢলঢলে কাঁচা অঙ্গের লাবণ্যকে ‘ইস্যু’ করার৷ কারণ বয়সের উপরে কারও হাত নেই৷ আর পুরুষরা সুন্দরের পূজারী৷ হাতের কাছে সুন্দর নারী পেলে অসুন্দরের দিকে ফিরে তাকানোর অবকাশ পায় না৷ ভবিষ্যতে লহনাও স্বামীর সেই অবমাননার শিকার হতে পারে৷ লহনার মধ্যে স্বামীপ্রেম বঞ্চিত হওয়ার আগাম সচেতনতা তৈরি করতে খুল্লনা সম্পর্কে বলে—

 ‘‘শুন গো শুন গো হের শুন গো লহনা

 আপনি করিলে নাশ ইবে সে আপনা৷

 শিশুমতি ঠাকুরাণী নাঞি জান পাপ

 কি কারণে দুগ্ধ দিআ পোষ কালসাপ

 নানা উপভোগ দিআ পোষহ সতিনী

 আপনার কার্য নাশ করিলে আপনি৷

 সাপিনী বাঘিনী সতা পোষ নাহি মানে

 অবশেষে অই তোমা বধিব পরানে৷

 কলাপির কলা জিনি খুল্লনার কেশ

 অর্ধ্বপাকা চুলে তুমি কি করিবে বেশ৷

 খুল্লনার মুখশশী করে ঢলঢল

 মাছাত্যায় মলিন তোমার গণ্ডস্থল৷

 কদম্বকোরক জিনী খুল্লনার স্তন

 গলিত তোমার কুচ হেলএ পবন৷

 খিন মাঝা খুল্লনার জেন মধুকরি

 যৌবন বিহনে তুমি হবে ঘটোদরী৷

 সাধু আসিবেন গৌড়ে থাক্যা কথো দিন

 খুল্লনার রূপে হব কামের অধীন৷

 অধিকারী হবে তুমি রন্ধনের ধামে

 মোর কথা তুমি গো জানিবে পরিণামে৷

 নেউটিয়া আইসে ধন সুত বন্ধুজন

 পুনুরপি নাহী আইসে জীবন যৌবন৷’’৬১

লহনাকে বলা এই উপদেশবাণীর ফল দুবলা হাতে হাতেই পায়৷ তার উপর খুশি হয়ে সে জানায়—

 ‘‘কানে সোনা দিআ তোর সাধিব সম্মান৷’’৬২

তার বুদ্ধিতে লহনা খুল্লনাকে নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়ে ছাগল চরাতে পাঠালে সে একদিকে যেমন ইন্ধন দেয় লহনাকে অন্যদিকে খুল্লনার দুঃখেও সহমর্মিতা জ্ঞাপন করে৷ বহু দিন পর সাধু ফিরে এলে খুল্লনার যৌবনের মোহ থেকে সাধুকে মুক্ত করে লহনার করতলে স্থাপন করার জন্য সে যেমন লহনাকে স্বামী বশের ঔষধ এনে দেয় আবার খুল্লনাকেও একেবারে নিকট আত্মীয়ের মত সংবেদনশীলতা দিয়ে প্রলোভিত করে৷

 ‘‘আর শুন্যাছ ছোট মা সাধু আইল ঘরে

 বারি হইআ শুন তুমি বাজনা নগরে৷

 আজি তোর পোহাইল দারুণ দুঃখনিশা

 আজি তোর ভবানী সফল কৈল আশা৷

 আপন বল্যা দুবলারে রাখিহ চরণে

 দুবলা আনের দাসী নহে তোমা বিনে৷

 তোমার প্রাণের বৈরি পাপমতি বাঁজি

 সাধুর সাক্ষাতে তার বারি কর্য পাঁজি৷’’৬৩

তার মিথ্যে সহানুভূতিতে গলে গিয়ে খুল্লনা—

 ‘‘প্রসাদ করিল তারে মানিক অঙ্গুরি৷’’৬৪

 দুবলা চরিত্রটি এতটাই সজীব যে সে নিজ কৌশলে একের কথা অপরের কাছে বলে যেমন দু’জনের কাছেই প্রিয় হয়ে উঠেছে তেমনি গর্বিত মননে বাড়ির বহু দায়িত্ব প্রধানা দাসীর মতো নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে৷ সাধুর জন্য বাজার করতে গিয়ে সে বহু কেনাকাটা করে৷ প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি টাকা খরচ হলে সাধুর জেরায় তার কৌশলী বক্তব্য দ্বারা সেই খরচের চুলচেরা হিসাবও সে বুঝিয়ে দেয়৷ তার সেই বাজারের হিসেব আধুনিক পাঠককেও বিস্মিত করে৷—

 হাটের কড়ির লেখা একে একে দিব বাপা

 চোর নহে দুবলার প্রাণ

 লেখা পড়া নাহি জানি কহিব হৃদএ গনি

 এক দণ্ড কর অবধান৷

 হাটমাঝে পরবেশি আসি হরি মহাঁজসি

 ডাকে মীন-রাশ্যের কল্যাণ

 আসিআ আমারে গঞ্জি শ্রবণ করাল্য পঞ্জি

 তারে দিল কাহনেক দান৷

 কান্ধেতে কুশের বোঝা আসিআ কুসাই ওঝা

 বেদ পড়ি করিল আশীষ

 ইছিআ তোমার যশ তারে দীল পণ দশ

 দক্ষিণা ধারিল বহু দিস৷

 বাজারে কর্পূর নাহী চাঞ্যা বুলি ঠাঞি ঠাঞি

 জতনে পাইল পাঁচ তোলা

 পাঁচ কাহনের দর পাঁচশ কাহন ধর

 চারি কাহনের নিল কলা৷

 আলু কচু সাক পাত আদি নানা বস্তুজাত

 নিল চারি কাহন আষ্ট পণে

 তৈল ঘি লবন ছেনা পাঁচ কাহনের কিন্যা

 খাসী নিল আষ্ট কাহনে৷

 প্রবেশ করিতে হাট আমি তথা রাজভাট

 কায়বার পড়ে উভহাথ

 ইছিআ তোমার যশ তারে দিল পণ-দশ

 কানা পড়িল পণ সাত৷

 হাটে ফিরে অনুদিন সেক ফকীর উদাসীন

 ব্যয় তথি সপ্তদশ বুড়ি

 সঙ্গে ভারি দশ জন তারে দিল দশ পণ

 আমি খাইনু চারি পণ কড়ি৷

 প্রাণভয় দুয়া কয় সাধু বলে নাঞি হয়

 দুবলা করিল প্রাণপণ

 জদি মিথ্যা হয় ভাষা কাটিহ দুয়ার নাসা

 বিরচিল শ্রীকবিকঙ্কণ৷’’৬৫

সমাজ-সংসারের প্রতি সচেতন না হলে, মানব চরিত্রাভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা না থাকলে এ ধরনের বিচিত্র চরিত্র সৃষ্টির শক্তি কবিকঙ্কনের হত না৷ তাঁর ভাড়ু দত্ত, মুরারি শীল, দুবলা চরিত্রের মানুষ শুধু সে যুগে নয়—যুগ যুগ ধরে বর্তমান থাকে৷

উপন্যাসে রচয়িতা তাঁর সচেতন দৃষ্টির দ্বারা সমাজের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে আত্মসাৎ করে সাহিত্যরূপ দান করেন৷ ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ মুকুন্দ চক্রবর্তীও সেরূপ করেছেন৷ তিনি তাঁর কাব্যে ষোড়শ শতাধীর বাঙালি সমাজের যে ছবি একেছেন, বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার যে চিত্র উপস্থাপিত করেছেন তা ইতিহাসসম্মত৷ এই বাস্তবতা তাঁর পরিবেশন নৈপুণ্যে যেমন প্রকট তেমনি চরিত্রচিত্রনের অভিনবত্বেও অতুলনীয়৷ তাঁর সৃষ্ট দেব চরিত্রগুলোও সমকালীন বাঙালিজীবনের রসে পরিপুষ্ট; দেবতারা তাদের দেবত্ব পরিত্যাগ করে ধূলিধূসরিত গ্রাম-বাংলার জীবন্ত মানবমূর্তি লাভ করেছে৷

কবিকঙ্কনের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এর দেবখণ্ডে দেবতাদের বিভিন্ন কার্যকলাপ, কবির আত্মজীবনী অংশ, কালকেতুর জন্ম, বিবাহ, ভোজনবিলাস, ফুল্লরার বারমাসের দুঃখ-যন্ত্রণার কাহিনি, কালকেতুর নগর পত্তন, প্রজা স্থাপন, ধনপতির কাহিনি, তার দুই স্ত্রী লহনা-খুল্লনার জীবন সর্বত্রই ষোড়শ শতকের বাংলাদেশের বাস্তব জীবন নাট্যের প্রতিধ্বনি৷ যে সময়পর্বে তিনি কাব্য রচনা করেন তখন দেশে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বর্তমান৷ পাঠানশক্তি তখনও দেশ থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি আবার মোঘলরাও পুরোপুরি তাদের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি৷ জায়গিরদারেরা সেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে নিজেদের অধিকার নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয়; প্রজাদের উপর চলতে থাকে নির্মম অত্যাচার৷ তা থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র কারও নিস্তার ছিল না৷ অত্যাচারে অতিষ্ঠ প্রজারা যে দেশ ছেড়ে পালাবে তারও উপায় নেই কারণ তাদের উপর সর্বদাই পেয়াদাদের কড়া দৃষ্টি৷ এছাড়া নতুন জরিপ ব্যবস্থা চালু হয়—জমির দৈর্ঘ মাপা হয় কোণাকুণি হিসেবে৷ উর্বর জমির হিসেবে পতিত জমির উপরও খাজনা ধার্য হয়৷ টাকা ভাঙাতে গেলে পোদ্দারকে পয়সা দিতে হয়, ধার করলে প্রতিদিন টাকাপিছু এক পাই করে সুদ লাগে, মজুরি দিলেও কাজ করার লোক পাওয়া যায় না, অস্থাবর সম্পত্তি যথা ধান, গরু, কেউ ক্রয় করে না, বিক্রয়জাত দ্রব্যের মূল্য তলানিতে—এই পরিস্থিতিতে কলম ধরেন মুকুন্দ চক্রবর্তী৷ তাঁর আত্মজীবনীতে এর স্পষ্ট আভাস মেলে৷

 ‘‘অধর্মী রাজার কালে প্রজার পাপের ফলে

 খিলাত পাইল মামুদ সরিপ৷

 উজির হইল রায়জাদা বেপারি বৈশ্যের খদা

 ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবের হইল ঐরি

 মাপে কোণে দিয়া দড়া পনর কাঠায় কুড়া

 নাঞি মানে প্রজার গোহারি৷

 সরকার হইল কাল খিল ভূমি লিখে নাল

 বিনি উবগারে খায় ধুতি

 পোতদার হইল যম টাকা আড়াই আনি কম

 পাই লভ্য খায় দিন প্রতি৷

 ডিহিদার আবুদ খোজ টাকা দিলে নাঞি রোজ

 ধান্য গোরু কেহ নাঞি কেনে

 প্রভু গোপীনাথ নন্দী বিপাকে হইলা বন্দি

 হেতু কিছু নাহি পরিত্রাণে৷

 জানদার সভার আছে প্রজাগণ পালায় পাছে

 দুয়ার চাপিয়া দিল থানা

 প্রজা হইল বিকলিত বেচে ধান্য গোরু নিত্য

 টাকা দ্রব্য দশ দশ আনা৷’’৬৬

সমাজে উচ্চ-নীচের বৈষম্য প্রবল ছিল৷ তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর লোকেরা যেমন প্রবল আয়েস-বিলাসে জীবন কাটাতো তেমনি নিম্নশ্রণীর মানুষের দুর্দশার শেষ ছিল না৷ শিব-পার্বতীর দাম্পত্য জীবনে দারিদ্র্যক্লিষ্ট নিম্ন-মধ্যবিত্ত সমাজের ছবি ফুটে উঠেছে৷ অলস-অকর্মণ্য শিব সংসার চালাতে না পারলে সপরিবারে ঘরজামাই হিসেবে উপস্থিত হয়েছে ধনী শ্বশুরবাড়িতে৷ কিন্তু দরিদ্র জামাই ঘরজামাই হিসেবে শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করলে তার যে শ্বশুরবাড়িতে দাম থাকে না তা শাশুড়ি মেনকার কথার মধ্য দিয়ে বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছেন কবি৷—

 ‘‘দরিদ্র তোমার পতি পরে বাঘছাল

 সবে ধন বুড়া বৃষ গলে হাড়মাল৷

 প্রেত ভুত পিশাচ মেলিআ তার সঙ্গ

 অনুদিন কত না কিনিঞা দিব ভাঙ্গ৷

 লোক-লাজে স্বামী মোর কিছু নাঞি কয়

 জামাতার পাকে হইল ঘরে সাপের ভয়৷

 দুই পুত্র তিন দাসী স্বামী শূলপাণি

 প্রেত ভূত পিশাচের লেখা নাঞি জানি৷

 অনুদিন কতেক সহিব উৎপাত

 রাঁধিয়া বাড়িয়া মোর কাঁকালে হৈল বাত৷’’৬৭

কালকেতু-ফুল্লরার ব্যাধজীবনে দারিদ্র্যের নির্মম ছবি প্রতিভাত হয়৷ কালকেতু পশু শিকার করে আনে ফুল্লরা সেই পশুর মাংস, নানা দেহাংশ হাটে বিক্রি করে যা পায় তাতেই কোনোমতে সংসার চলে যায়৷ আর যদি শিকার না পায় তাহলে খুদকুড়ো যা ধার পেলে পেল নতুবা নিশ্চিত উপবাস৷ এমনি ঘটনা ঘটে দেবীর ছলনায় বীরের শিকার না মিললে৷ রাগ করে দেবীর ছদ্মরূপী স্বর্ণগোধিকাকেই সে বেঁধে নিয়ে আসে৷ তাকে খালি হাতে ফিরতে দেখে ফুল্লরা সভয়ে বলে যে ঘরে রাখা বাসি মাংস বাজারে বিক্রি হয় না তাহলে—

 ‘‘আজি মহাবীর বল সম্বল উপায়৷’’৬৮

অগত্যা প্রতিবেশী সই-এর কাছ থেকে খুদ ধার করতে পরামর্শ দিয়ে সেই বাসি মাংস নিয়েই হাটে চলে যায় কালকেতু৷ সই একদিনের জন্য ফুল্লরাকে যেমন চাল ধার দিতে সম্মত হয় তেমনি দরিদ্র এই রমণীকে কাছে পেয়ে মাথার উকুন বাছিয়ে রাখতেও দ্বিধাবোধ করে না৷—

 ‘‘ফুল্লরা দুকাঠা চালু মাগিল উধার

 কালি দিহ বল্যা সই কৈল অঙ্গিকার৷

 আইসহ প্রাণের সই বৈস গো বহিনি

 মোর মাথে গোটা কথো দেখহ উকিনি৷’’৬৯

এখানে ফুল্লরার দারিদ্র্য জ্বালা যেমন প্রকট তেমনি নিম্নশ্রেণীর নারীকুলের একটি অতি সাধারণ ঘটনা মাথার উকুন বাছতে বাছতে নারীমনের নানা সুখ-দুঃখের কথায় মগ্ন হয়ে যাওয়ার মতো চিত্রও ফুটিয়ে তুলেছেন রচনাকার৷

ফুল্লরার বারমাসের দুঃখ-কষ্টের বর্ণনাতে দরিদ্রজীবনের একটা সুস্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়৷ দরিদ্র রমণীরা ক্ষুদ্র দৈর্ঘের ‘খুঞার বসন’ পড়ে লজ্জা নিবারণ করলেও সেই খাটো কাপড়ে শীত-গ্রীষ্ম কিছুই নিবারিত হত না৷ কখনো কখনো ভাগ্যক্রমে শীতের হাত থেকে বাঁচতে ‘পুরান খোসলা’ জুটে যেত৷ খাদ্য হিসেবে বেশিরভাগই জুটতো খুদ—তাও আবার চেয়েচিন্তে ধারদেনা করে৷ খুদের জন্য কোনো কোনো সময় অন্নপাত্র বন্ধক রাখা হত৷ দরিদ্রদের প্রধান খাদ্য তালিকায় ছিল ‘আমানি’৷ জলযুক্ত আমানি পাত্রের অভাবে মাটিতে গর্ত করে সেখানে ঢেলে তারপর খাওয়া হত৷ ফুল্লরার কথায় তা উঠে এসেছে৷—

 ‘‘খুদ সেরে বান্ধা দিল মাটিয়া পাথরা৷

 ফুল্লরার আছে কত কর্মের ফল

 মাটিয়া পাথরা বিনে নাহি অন্য স্থল৷

 দুঃখে কর অবধান দুঃখে কর অবধান

 আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান৷’’৭০

মোট কথা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্ত সমস্ত ঋতুতেই দরিদ্রদের উদরের চিন্তা করতে হত৷

এই কালকেতুই যখন গুজরাটের রাজা হয় তখন তার জীবনধারা পাল্টে যায়৷ ভাঁড়ুদত্তের কলিঙ্গরাজের কাছে দেওয়া বর্ণনায় তা উঠে এসেছে৷—

 ‘‘কাননে বধিআ পশু উপায় করিত বসু

 ফুল্লরা বেচিত মাংস হাটে

 কোটাল ভ্রমিআ দেশ না দেখহ সবিশেষ

 কালকেতু রাজা গুজরাটে৷

 পূর্বে পিত ভাণ্ডে বারি এবে তার হেমঝারি

 ঘটি বাটী সব হেমময়

 চড়ে পর্বতিআ ঘোড়া পরিধান খাসা জোড়া

 ঘর তার কুবের-নিলয়৷

 … … …

 রঙ্ক দুঃখী নাহি চিনি হেমঘটে পিয়ে পানি

 নাটগীত সভাকার ঘরে

 ঘর ঘর জত আছে চলিব বীরের কাছে

 না থাকিব কলিঙ্গ-নগরে৷

 বীর কত ভাগ্যবান তথা লক্ষ্মী অধিষ্টান

 চারিদিগে পাথরের গড়

 দুআরেতে মাতা হাথি আছে তার দিবারাতি

 কেবা তার হইব নিয়ড়৷’’৭১

অর্থাৎ ধনী শ্রেণীর প্রতিভূ হিসেবে কালকেতু ‘সোনায় সোহাগা’৷ ফুল্লরা প্রাসাদতুল্য গৃহে দাসদাসী নিয়ে মহাসুখে সময় অতিবাহিত করে৷

হরগৌরীর দাম্পত্য জীবন নিম্নমধ্যবিত্ত দাম্পত্যের সহজ সুরকে আত্মস্থ করে অলৌকিক থেকে লৌকিক হয়ে উঠেছে৷ দুর্গা মায়ের কথা সহ্য করতে না পেরে ঝগড়া করে স্বামীর সঙ্গে বাপের বাড়ি ত্যাগ করে চলে এসেছে৷ শিবের ভিক্ষালব্ধ অন্ন সাদরে গ্রহণ করে রান্না করে স্বামী পুত্রকে খাইয়েছে৷ আবার শিব যখন ভিক্ষা করে গৃহে ফিরেছে তখন শিশুর সারল্য নিয়ে দৌরে গিয়ে পিতা তাদের জন্য কি ‘সত্তগাত’ এনেছে তা জানতে চেয়েছে৷ পিতার ঝুলি থেকে মুড়কি খই বেরোতে দেখে তা গ্রহণ করার জন্য দুই ভাই কাড়াকাড়ি শুরু করে দিয়েছে; পরে মায়ের মধ্যস্থতায় শান্ত হয়েছে দুজনে—এ চিত্র প্রত্যেক বাঙালি ঘরের৷ সংসারে অভাব অনটনের কথা শুনে উদাসীন বাঙালি পিতা বা স্বামীর মতো শিব যে গৃহত্যাগ করার সংকল্প নিয়েছে তাও সমাজে বিরল নয়৷

শিবের ভোজন তালিকায় বর্ণিত ব্যঞ্জনাদি, ধনপতির জন্য খুল্লনার রান্না করা তরকারি অথবা খুল্লনার জন্য লহনার রন্ধন করা ব্যঞ্জনের যে তালিকা কবি দিয়েছেন তা নিতান্ত বাঙালি সমাজের খাদ্য-সংস্কৃতির পরিপূরক৷ যেমন কাজে ছুটি নিয়ে শিব পার্বতীকে রান্না করতে বলে—নিম-শিম-বেগুন দিয়ে তিতা, কুমড়া, বেগুন কাঠালবিচি, ডালবড়ি, আদারস দিয়ে শুকুতা, সরষে শাক, বথুয়া শাক, মুসুরি ডাল, ছোলার ডাল, পালং ইত্যাদি নানা ব্যঞ্জন৷ লহনা খুল্লনার জন্য রান্না করে—ঘিয়ে ভাজা নালিতার শাক, তেলে ভাজা বথুয়া শাক, মুগের ডাল, চিতলের কোল, ছোলার ডাল, মাছ ভাজা, চিংড়ির বড়া, কুমড়া ভাজা, ডালের বড়ি দিয়ে কুমড়ার তরকারি এছাড়াও রয়েছে—

 ‘‘কটু তৈলে কই মৎস্য ভাজে গণ্ডা দশ

 মুঠ্যে নিঙ্গড়িআ তথি দিল আদারস৷

 বদরি শকুল মীন রসাল মুসরি

 পণ চারি ভাজে রামা সরল-শফরী৷’’৭২

আর খুল্লনা বহুদিন পর স্বামী বিদেশ থেকে ফিরে এলে তাকে ভোজন থালায় প্রথমেই দেয় সুক্তা, ঝোল, ঘন্ট, সাক, সুপ, তারপরে মাছ-মাংস৷ সেখানেই শেষ নয়—

 ‘‘ঘৃতে জব জব খায় মীন মাংস বড়ি

 বাদ কর‍্যা ভাজা কই খায় তিন কুড়ি৷

 অম্বল খাইআ পিলা জল ঘটী ঘটী

 দধি খায় ফেনি তার করে মটমটী৷’’৭৩

দেশে ন্যায়পরায়ণতা বা ধর্মবুদ্ধির বিশেষ অভাব দেখা দিয়েছিল৷ ধূর্ত শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য লোক ঠকিয়ে জীবন নির্বাহ করতো—মুরারি শীল, ভাঁড়ুদত্ত এই শ্রেণীর৷ সমাজে বলপূর্বক তোলা আদায়ের ব্যাপারটিও ভাঁড়ুর তোলা আদায়ের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়৷ এছাড়া কালকেতুর দরবারে এসে ভাঁড়ু যেভাবে লোক ঠকিয়ে বিত্ত বৈভবকে বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে তাকে, তাতেও সমাজে শোষণের একটা দিক স্পষ্ট হয়—

 ‘‘তাড়বালা দিবে মান দিবে হে বলদ ধান

 উচিত কহিতে কিবা ভয়

 জিনিতে প্রজার মায়া পত্র নিবে এক ছিয়া

 বন্দে বন্দে জেন প্রজা রয়৷

 জখন পাকিবে খন্দ পাতিবে বিষম ফন্দ

 দরিদ্রের ধানে নিবে নাগা

 খাইআ তোমার ধন না পালায় কোন জন

 অবশেষে নাহী পাও দাগা৷’’৭৪

সেই সময় সমাজে জাতিভেদপ্রথা বিশেষভাবে বর্তমান ছিল৷ কালকেতুর গুজরাট নগর প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষজন বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের বসত অঞ্চল গড়ে তোলে যা জাতিবৈষম্যের বা শ্রেণী বৈষম্যকেও স্পষ্ট করে৷ ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, গোপ, ধীবর, মুসলমান, এমন কি গণিকারা পর্যন্ত সে নগরের অধিবাসী হয়৷ যেমন—

 ‘‘বীরের পাইআ পান বৈসে যত মুসলমান

 পশ্চিম দিগ বীর দিল তারে৷’’৭৫

অথবা

 ‘‘পাইআ বীরের পান বৈসে জত কুলস্থান

 বীরের নগরে বিপ্রগণ

 শাস্ত্র বিচার করে আশিষ করিআ বীরে

 নিত্য পায় ভুষণ চন্দন৷’’৭৬

অথবা

 ‘‘গুজুরাট এক পাশে গ্রহবিপ্রগণ বৈসে

 বর্ণদ্বিজগণ মঠপতি’’৭৭

এছাড়া তেলি, চাষি, কামার, কুঠারি, তাম্বুলি, কুম্ভকার, তন্তুবায়, মালী, বারুই, নাপিত, আঘরি, গন্ধবণিক, শঙ্খবণিক, সুবর্ণবণিক, কাসারি, সাপুড়া ইত্যাদি বিবিধ কর্ম বা পেশা ভিত্তিক শ্রেণীর মানুষ তার নগরে বসতি স্থাপন করে সুখে কাল কাটায়৷

সে সময়ে পুরুষের দৈহিক প্রবৃত্তিকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার জন্য বারবনিতার প্রয়োজনও যে অবশ্যম্ভাবী ছিল তার বর্ণনা দিতেও কবি ভোলেননি৷ কারণ নগর মাত্রই নানা শ্রেণীর, নানা পেশার মানুষের বাস এবং তাদের যৌনতৃপ্তি গণিকা ছাড়া যে সম্ভব নয় সমাজসচেতক কবি তা ভালো করে বুঝতে পেরেছিলেন৷ তাই গুজরাট নগরের এক পাশে বারাঙ্গনারাও জায়গা করে নেয়৷—

 ‘‘লম্পট পুরুষ আশে বারবধূগণ বৈসে

 একভিতে তার অধিষ্ঠান

 নাটুআ কলন্ত সঙ্গে বসিল পরমরঙ্গে

 শ্রীকবিকঙ্কণ রস গান৷’’৭৮

ধনপতির উপাখ্যানে বণিক সমাজের শ্রেণীগত পরিচয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়৷ বানিজ্যের বর্ণনাতেও আমদানি ও রপ্তানিজাত দ্রব্যের যে বিবরণ লেখক ধনপতির সিংহল রাজের সম্মুখে বলা বক্তব্যের মধ্যে পরিস্ফুট করেছেন তা বাংলার নিজস্ব বানিজ্যিক রূপ৷

সমগ্র চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে নারীর সামাজিক অবস্থানের যে চিত্রটি ফুল্লরা, খুল্লনা, লহনা ইত্যাদি চরিত্রের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন তা বাস্তবসম্মত৷ সেই সময় সমাজে পুরুষের বহুবিবাহের ফলে নারীজীবনে সতিন সমস্যা প্রবল ছিল৷ স্বামী, শাশুড়ি, এমনকি সতিনের দ্বারা নারীদের নির্যাতিত হতে হত৷ ফুল্লরার গৃহে ছদ্মবেশিনী দেবী দ্ব্যর্থক ভাষায় তার ঘর ছাড়ার যে কারণ উপস্থাপন করেছিল ফুল্লরার কাছে, তাতে সে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে৷ যেমন—

 ‘‘দারুণ দৈবের গতি হইলাঙ অবলা জাতি

 অহি সঙ্গে হইয়া গেল মেলা

 বিষকন্ঠ মোর স্বামী সহিতে না পারি আমি

 তাহে হেন সতিন প্রবলা৷

 দারুণ দৈবের গতি উগ্র আমার পতি

 পঞ্চ মুখে মোরে দেন গালী

 তাহে সতীনের জালা কত সহে অবলা

 পরিতাপে হইয়া গেলাঙ কালী৷’’৭৯

ধনপতি কার্যপোলক্ষে বিদেশে গেলে লহনাও তার সতিন খুল্লনাকে তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে বনে ছাগল চরাতে পাঠিয়ে দেয়৷ ফুল্লরা ঘরে রূপসী কন্যাকে দেখে সতীন ভেবে কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর সম্মুখে উপস্থিত হলে তার মুখ দেখে কালকেতু যে মন্তব্য করে তাতেও শাশুড়ি-ননদ-সতিনের সঙ্গে নারীর কোন্দলের রূপটি পরিস্ফুট৷—

 ‘‘সাসুড়ি ননদি নাঞি নাঞি তোর সতা

 কা সনে কন্দল করি চক্ষু কৈলে রাতা৷’’৮০

সমাজে বিবাহিতা নারীদের জীবনের একমাত্র অবলম্বনই ছিল স্বামী৷ স্বামীর জন্য, স্বামীর প্রণয়ের জন্য বধূদের উৎকন্ঠা চরিত্রগুলির পরতে পরতে স্থান পেয়েছে৷

বস্তুত জীবনের প্রতি সুগভীর আস্থা, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশীলতা, সৃজনশীলতা, সংবেদনশীল হৃদয়ের অপার সহমর্মিতা, বস্তুরূপের প্রতিফলনের অলৌকিক ক্ষমতা মুকুন্দের কবি প্রকৃতিতে ঔপন্যাসিকের গুণাবলীকে প্রতিষ্ঠিত করেছে৷ আর এর দ্বারা সঞ্জীবিত হয়েই চিরন্তন বাঙালির সহজ জীবনধর্ম তাঁর সৃষ্টিতে শ্বাশত কাব্যরূপ লাভ করেছে৷ তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি কালের গণ্ডি পেরিয়ে সার্বজনীনতা লাভ করেছে মানুষের বিশ্বাসে, প্রত্যয়ে এবং জীবন অভিজ্ঞতার বাস্তবিক স্পর্শে৷ তাঁর গুণাবলী ও কাব্য সম্পর্কে তাই শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন—‘‘দেবতা মানুষের অধীন হইয়াছেন—দেবকীর্তিবর্ণনা উজ্জ্বল বাস্তবচিত্রের নিকট নিষ্প্রভ হইয়া পড়িয়াছে৷ এই শ্রেণীর প্রধানকাব্য মুকুন্দরামের ‘কবিকঙ্কণ—চণ্ডী’তে স্ফুটোজ্জ্বল বাস্তবচিত্রে, দক্ষচরিত্রাঙ্কনে, কুশল ঘটনাসন্নিবেশে, ও সর্বোপরি, আখ্যায়িকা ও চরিত্রের মধ্যে একটি সূক্ষ্ণ ও জীবন্ত সম্বন্ধ স্থাপনে, আমরা ভবিষ্যৎকালের উপন্যাসের বেশ সুস্পষ্ট পূর্বাভাষ পাইয়া থাকি৷ মুকুন্দরাম কেবল সময়ের প্রভাব অতিক্রম করিতে, অতীত প্রথার সহিত আপনাকে বিচ্ছিন্ন করিতে, অলৌকিকতার হাত হইতে সম্পূর্ণ মুক্তিলাভ করিতে পারেন নাই বলিয়াই একজন খাঁটি ঔপন্যাসিক হইতে পারেন নাই৷ দক্ষ ঔপন্যাসিকের অধিকাংশ গুণই তাঁহার মধ্যে বর্তমান ছিল৷ এ যুগে জন্মগ্রহণ করিলে তিনি যে কবি না হইয়া একজন ঔপন্যাসিক হইতেন, তাহাতে সংশয়মাত্র নাই৷’’৮১ অন্নদামঙ্গলের কবি ভারতচন্দ্রকেও এই বৈশিষ্ট্য থেকে বাদ দেওয়া যায় না৷ বাংলা উপন্যাসের জীবনাবির্ভাবের সলতে পাকানোর কাজ প্রায় সমাপ্ত হয়ে এসেছিল মঙ্গলকাব্যের মধ্যেই৷ ইতিমধ্যে দেশের অভ্যন্তরে নানা পরিবর্তন ঘটে গেছে৷ হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের গোঁড়ামির কঠিন বন্ধনে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল মানুষের ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনা, বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা৷ ভারতের বিপুল ঐশ্বর্যকে কুক্ষিগত করার অভিলাষে ভারতীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে ইংরেজ, ফরাসীদের পদসঞ্চারণ শুরু হয়ে যায়৷ ক্রমে ক্রমে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হয়ে মাথা তোলে ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে; অবসান হয় মুসলিম শাসনের৷ ইংরেজদের ভারত শাসনে এদেশের জনগণ বহু কলঙ্কিত অধ্যায়ের সাক্ষী থাকলেও একটি বিষয়ে তারা প্রভূত উপকার করেছিল তা হল ভারতীয়দের সুপ্ত চেতনায় করাঘাত৷ তাদের আগমন শাপে বর হয়ে উঠেছিল৷ নানাধরনের ভূমি বন্দোবস্তে, শোষণে-নিপীড়নে ভারতীয় অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিলেও ভারতবাসীর হৃদয় মন্দিরে জোগাচ্ছিল অমিত শক্তির রসদ৷ আর সে শক্তি প্রতিরোধের শক্তি, যুক্তি-বিচার-বিশ্লেষণের শক্তি৷ বাইরে থেকে এত বড় আঘাত না পেলে হয় তো ভিতর থেকে সেই ঘুমন্ত ধুর্জটির আবির্ভাব সম্ভব হত না৷

ইংরেজরা নিজেদের শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য এবং সিভিলিয়ানদের দেশীয় ভাষা বাংলা শেখানোর জন্য যেদিন (১৮০০ খ্রিঃ ৪ঠা জানুয়ারি) ভারতবর্ষের মাটিতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ নামে এক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন ( এর কিছুদিন আগে খ্রিস্ট্রধর্মপ্রচার ও ধর্ম সংক্রান্ত বই ছাপানোর জন্য গঠিত হয়েছিল শ্রীরামপুর মিশন ও তার প্রেস বা ছাপাখানা৷ এটি মিশনারিরা স্থাপন করেন৷ পাশ্চাত্য জ্ঞান অর্জন এবং বাংলায় শিক্ষার প্রসারে এর অবদানও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সঙ্গে সমানগুরুত্বপূর্ণ৷) সেদিন থেকে ভারতীয় সভ্যতায় নতুন এক যুগের সূচনা হয়৷ সে যুগ আলোকের যুগ—মুক্তির যুগ৷ বাঙালির বুদ্ধি ও চেতনায় জ্ঞানদীপ্ত রাজটীকা অঙ্কনের শুভলগ্ন ঘোষিত হয়ে যায়৷ এই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হাত ধরেই বাংলা গদ্য তার পূর্ণ অবয়ব নিয়ে মাথা তুলতে থাকে৷ এর পরে আসেন রাজা রামমোহন রায়, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর৷ তাঁদের হাতে বাংলা সাহিত্য হাজার বছরের আঙ্গিক (পদ্য আঙ্গিক) ত্যাগ করে নবরূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে৷ বাঙালি মনন ও চেতনায় নবচেতনার ঢেউ আছড়ে পড়ে৷ মধ্যযুগের দৈবী মহিমা, প্রাচীনের সেই অন্ধ-বদ্ধ সংস্কার তার অসারতা দিয়ে চিন্তাভাবনার পথকে আর গতিরুদ্ধ করে রাখতে পারে না৷ তা যেন মুক্তির উচ্ছ্বাসে মেতে উঠে৷ এই সময় সমাজে দুটি শ্রেণী তৈরি হয়৷ একদল যাঁরা নতুন আলোর অপার সম্ভাবনাকে সাদরে গ্রহণ করে আরেক দল পুরোনো অন্ধসংস্কারকেই আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে৷ একদল মুক্তির উচ্ছ্বাসে ভেসে যায় আরেক দল অন্ধ আবেগে স্থবির হয়ে রয়৷ একদল নবীন আরেক দল প্রবীণ৷ এই নবীন-প্রবীণের দ্বন্দ্বে বাংলা সাহিত্য বিকাশে নানা শ্রেণীর পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে৷ যেমন সম্বাদ প্রভাকর, সমাচার দর্পণ, সমাচার পত্রিকা, সম্বাদ কৌমুদী, সম্বাদ রসরাজ ইত্যাদি৷ এগুলিতে নানা ধরনের, নানা রসের লেখা প্রকাশ পেতে থাকে৷ বাঙালি লেখকসত্তা আত্মপ্রকাশের নতুন পথ খুঁজে পায়৷

ইংরেজদের উদ্যোগে কলকাতা, সুতানুটি, গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হয় কলকাতা নগরী৷ প্রশাসনিক নানা সুবিধা কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভারে সমৃদ্ধ হতে থাকে এই স্থান৷ গ্রামীণ জীবনে অভ্যস্ত সাধারণ মানুষ, জমিদার-মহাজনদের শোষণ-পীড়নে, দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তরের মতো ঘটনায় দিশেহারা হয়ে জীবনধারণের আশায় ভিড় জমাতে থাকে কলকাতায়৷ নানা শ্রেণীর, নানা পেশার মানুষে ভরে যায় নতুন শহর৷ এই সময় কলকাতায় তৈরি হয় এক উঠতি ধনিক শ্রেণী৷ জাতিগত দিক থেকে তারা কুলিন না হলেও প্রবল ধনপ্রাচুর্যে সমৃদ্ধ হয়ে তারাই সমাজের মাথা হিসেবে পরিগণিত হয়৷ নানা ধরনের ব্যবসায় হঠাৎ অর্থাগমের প্রবল প্লাবনে তারা নিজেদের টাল রাখতে পারে না—বিলাসিতার প্রবল জোয়ারে ভাসিয়ে দেয় নিজেদেরকে৷ এদিকে নানা শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে সঙ্গে শহর কলকাতা গণিকাদেরও অন্যতম বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়৷ রাজা রামমোহনের উদার ও উন্মুক্ত চিন্তা-ভাবনায় সতীদাহ প্রথা রদ হলে অগণিত নারীজীবন রক্ষা পায় সতীদাহের নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে৷ কিন্তু এর পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যায় এই পতিহারা নারীরা সতীদাহ থেকে মুক্তি পেল ঠিকই কিন্তু জীবনে স্বাভাবিক পরিণতি পেল না৷ অল্প বয়সে বৈধব্যের তীব্র জ্বালায়—একাদশীর পীড়নে, পরিবারের গলগ্রহতায়, যৌবনের স্বপ্নভঙ্গের নিদারুণ দীর্ঘশ্বাসে কমবয়সি বিধবারা জীবনে বেঁচে থাকার সীমাহীন যন্ত্রণা উপভোগ করেছে তিলে তিলে৷ আর এই যন্ত্রণা নিবৃত্তির উপায় খুঁজতে গিয়ে অথবা সামান্যতম পদস্খলনে বহু নারী গণিকা হয়ে উঠেছে৷ এছাড়া স্বামীর অনাদরে এবং নিম্নশ্রেণীর ফুলওয়ালী, নাপিতিনি গোয়ালিনি ইত্যাদির নারীদের পরামর্শেও বহু গৃহবধূ গণিকাজীবনের অন্ধকারে নিজেকে আহুতি দিয়েছে৷ গ্রামবাংলা থেকে আগত নিপীড়িতা নারীরাও কলকাতায় এসে রুজি-রোজগারের পথ না পেয়ে শরীর বিক্রি করে পেট ভরাতে বাধ্য হয়েছে৷ ধনবান নব্য ধনিক শ্রেণীর ‘বাবু’-দের বিলাসিতার অন্যতম উপকরণ এই গণিকারা৷ এসময় গণিকাদের নিয়ে প্রকাশ্য সমাজে অকপটে মেলামেশা কোনোরকম দোষের ছিল না৷ বরং তা ছিল চরম বাহাদুরির কাজ৷ গণিকাগমনে বিরত পুরুষেরা পুরুষ বলেই বিবেচিত হত না৷ সমাজে বাবু হিসেবে পরিচিত এই ধণিক শ্রেণীর লাগামহীন বিলাসী জীবন, গণিকা শ্রেণীর কঠোর জীবনসংগ্রাম, সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর (কেরানি) মানুষের পোরখাওয়া জীবনাচারণের সঙ্গে যুক্ত হয় নিম্নশ্রেণীর অতি সাধারণ (মুটে, মজুর) মানুষের মরে বেঁচে থাকার জঙ্গমতা৷ পরস্পর ভিন্ন রুচি ও মানসিকতায় সমাজের অভ্যন্তরে চরম দুরবস্থা তৈরি করে৷ অপরাধ প্রবণতাও বেড়ে যায় বহুগুণে৷ বিভিন্ন পত্রিকার পাতায় পাতায় মানুষের নীচতার, নৈতিক অধঃপতনের মুখোরোচক খবর প্রকাশিত হতে থাকে৷ এর সঙ্গে আত্মপ্রকাশ করে বাবুশ্রেণীর জীবনাচারণ নিয়ে নানা ধরনের লেখা৷ যেমন ‘সমাচার দর্পণ’-এর সম্পাদক ১৮২১ খ্রিঃ ২৪ শে ফেব্রুয়ারি এবং ৯ই জুন দুটি সংখ্যায় প্রকাশ করেন ‘বাবুর উপাখ্যান’ নামে বাবু চরিত্রের দুটি আলোচনা৷ রচনাটি ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেনামে প্রকাশ করেন৷ কাহিনিটিতে চরিত্র চিত্রণ বা আদি-মধ্য-অন্ত্য যুক্ত কোনো সুসংবদ্ধ কাহিনি অপেক্ষা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে স্থূল বাস্তবতা৷ বড়লোকের আদুরে ছেলে তিলকচন্দ্রবাবু পিতার অত্যধিক স্নেহ ও প্রশ্রয়ে বিগড়ে গিয়ে প্রকৃত আয়েশিবাবু হয়ে ওঠে৷—‘‘বাবু ঘুড়ী বুলবুলি প্রভৃতি খেলাতে সদা মগ্ন থাকেন লেখা পড়ার দোকান আছে কিন্তু করেন না৷ অর্থী ও স্বার্থপর খোশামুদে মিষ্টমুখো কতক গুলিন দেওয়ানজীর পারিষদ লোক বাবুর নানাবিধ গুণ ও বিদ্যাসূচক প্রশংসা করে৷’’৮২ বাবু তিলকচন্দ্র পিতার মৃত্যুর পর প্রভুত ধনসম্পদের প্রভূত্ব পেয়ে স্থূল জীবন পিপাসায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয়—চাটুকার খোশামোদকারীরা তার ইন্ধন জোগায়৷ ‘বাবুর উপাখ্যান দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ’-এ দেখানো হয়েছে দুর্দমনীয় বিলাসবহুল জীবনাচারণের সঙ্গে সঙ্গে বাবু শ্রেণী কীভাবে ইংরেজদের ব্যর্থ অনুকরণে নিজের ব্যক্তিত্ব-অস্তিত্ব সব বিসর্জন দিয়ে বসে—‘‘সাহেব লোক রবিবার’’ গ্রিজায় গিয়া থাকেন অন্যবারে বিষয়কর্ম্ম করেন৷ বাবু এই বিবেচনা করিয়া সন্ধ্যা আহ্নিক পূজা দান তাবৎ পরিত্যাগ করিয়া রবিবারে বাগানে গিয়া কখন নেড়ীর গান কখন শকের যাত্রা খেঁউড় গীত শুনিয়া থাকেন৷’’৮৩ এই রচনাটিতে সামাজিক বিশৃঙ্খলতাকে মূল উপজীব্য করে রচনাকার কাহিনির অসংবদ্ধতা, অসামঞ্জস্যতাকে দূরে সরিয়ে খণ্ডচিত্রগুলিকে নায়ক তিলকচন্দ্রের ঐক্যসূত্রে গ্রন্থিত করেছেন৷ এই বাবু তিলকচন্দ্র শুধু উনিশ শতকের প্রথম পর্বের বিলাসী ধনবান বাবু সমাজের প্রতিনিধিই নয় যে কিনা ইংরেজি শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ; সে কাহিনিকেন্দ্রিক বাংলা গদ্যরচনা এবং বাংলা উপন্যাস সাহিত্য সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ের আদি নায়কও৷

‘বাবুর উপাখ্যান’ রচনার পরপরই ‘সমাচার দর্পণ’-এর পাতায় প্রকাশিত হতে থাকে—‘শৌকীন বাবু’ ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন, ৩০শে জুন ‘বৃদ্ধের বিবাহ’, ‘ব্রাহ্মণ পণ্ডিত’ ৭ই জুলাই, ‘বৈদ্য সংবাদ’ ১লা সেপ্টেম্বর এবং ‘বৈষ্ণব সংবাদ’ ২রা মার্চ৷

‘শৌকীন বাবু’-তে স্থান পেয়েছে এমন এক বাবুর গল্প যে কিনা প্রতিবছর পারমার্থিক স্নানযাত্রায় নানা স্থানের বাবুদের মনোরঞ্জনের নানাবিধ উপকরণ নিয়ে যায় যথা, গায়ক-গুণী নিয়ে যাওয়া, বেশ্যা বা ভাঁড় নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি৷ বাই-বারাঙ্গনার সঙ্গে স্নানযাত্রা দেখে উৎসাহিত হয়ে নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে করে ‘হাপ বজরা’ ভাড়া করে নিজেও স্নানযাত্রায় বের হন বিলাসীবাবু৷ কিন্তু ঘটনাক্রমে বাবুর সেই ‘বিবিঠাকুরাণী’ স্নানের নিমিত্ত বজরা থেকে বের হয়ে গঙ্গায় নামলে গঙ্গাবক্ষে জোয়ার দেখা যায় এবং ভ্রান্তিবসত সে নিজেদের বজরা চিনতে না পেরে অন্যবাবুর বজরায় গিয়ে ওঠে চিরতরে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়৷ আর ‘‘বাবু সেই ঘাটেই মঙ্গল গাইয়া বেড়াইলেন এবং ঐ নগরের মধ্যে দ্বারে২ অন্বেষণ করিলেন সাক্ষাৎ হইল না৷’’৮৪

দক্ষিণদেশের ফরকাবাজ নামে এক গ্রামের অবুঝচন্দ্র নামে এক বৃদ্ধের বিবাহাকাঙ্খা উপজীব্য হয়েছে ‘বৃদ্ধের বিবাহ’ রচনায়৷ বৃদ্ধ তার বিবাহ ইচ্ছাকে চরিতার্থ করার জন্য বার্ধক্যকে আড়াল করতে ঘটকের কাছে বলেছে৷ ‘‘ছেহত্তরের মন্বন্তরের সময়ে আমার বয়স বৎসর পঁচিশ ছাব্বিশ হইবেক আর এই যে দেখিতেছে দন্তগুলা পড়িয়াছে সে শুদ্ধ জল দোষের কারণ আর বেয়ে ধাতু-প্রযুক্ত চুল পাকিয়াছে কিন্তু শক্তি এমত অদ্যাপি ত্রিশ পঁচিশ দণ্ড রোজ২ করি৷’’৮৫ বাবু অবুঝচন্দ্র ঘটকদের রাজী করিয়ে পাঁচশত টাকা পণ ও পর্যাপ্ত স্বর্ণলঙ্কারের দাবিসহ পাত্রী নির্বাচন করে এবং বিবাহও সম্পন্ন হয়৷ অবশেষে সেই নববধূ সমস্ত টাকা ও গহনা নিয়ে পালিয়ে গেলে হৃতসর্বস্ব অবুঝচন্দ্র হাহাকার করতে থাকে৷

‘ব্রাহ্মণ পণ্ডিত’ রচনায় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের অন্তঃসারশূন্য পাণ্ডিত্য এবং অযৌক্তিক যুক্তিবিলাস বর্ণিত হয়েছে—‘‘কখন বাবু জিজ্ঞাসা করেন ভট্টাচার্য্য মহাশয় সুরাপানে কি পাপ হয়৷ উত্তর৷ ইহাতে পাপ হয় যে বলে তাহারিই পাপ হয় ইহার প্রমাণ আগম ও তন্ত্রের দুইটা বচন অভ্যাস ছিল পাঠ করিলেন এবং কহিলেন মদ্য ব্যতিরেকে উপাসনাই হয় না৷’’৮৬

‘বৈদ্য সংবাদ’-এ বৈদ্যদের অর্থলোলুপতা এবং ‘বৈষ্ণব সংবাদে’ বৈষ্ণবদের ভোগাকাঙ্খা বর্ণিত হয়েছে৷

এভাবে ‘সমাচারদর্পণ’-এ প্রকাশিত উক্ত রচনাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় উনিশ শতকের দোরগোড়ায় বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার যে প্রস্রবন বইতে শুরু করেছিল তা পরবর্তী সময়ে উপন্যাসের ভিত্তিভূমিকে সুদৃঢ় করেছিল৷ তিলকচন্দ্র, বিবাহ পাগল অবুঝচন্দ্র, বৈষ্ণব, বৈদ্য শ্রেণীর লোকেরা সকলেই বাস্তব সমাজের প্রতিনিধি৷

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরেক অন্যতম রচনা ‘কলিকাতা কমলালয়’৷ ১৮২৩ খ্রিঃ এর প্রকাশকাল৷ এখানে বর্ণিত হয়েছে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলকাতা নগরীর প্রধানতম বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পরিণত হওয়া এবং তার সূত্র ধরে ইংরেজ প্রভুদের অসৎ উপায়ে বল্গাহীন লুণ্ঠনের অবাধ তাণ্ডবের সুযোগ নিয়ে হঠাৎ ধনী হওয়া বাঙালির নৈতিকতার অধঃপতনে সমাজ ব্যবস্থার সুশৃঙ্খল বন্ধন ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়ার কাহিনি৷ বিভিন্ন জাতি সম্প্রদায়ের ন্যায়-অন্যায় বা সৎ-অসৎ পথে সংগৃহিত অর্থবল শ্রেণী বিভাগের মানদণ্ড হয়ে পড়ে৷ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ধনীর দল শিক্ষা-সংস্কৃতির ভিত্তিভূমিকে পাদাঘাত করে সমাজের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ায়৷ অর্থের ‘হরির লুঠে’ কলকাতা কমলালয়ের রূপ লাভ করে; যদিও কমলা অর্থাৎ লক্ষ্মীপুরের অপার ধনসম্পদের বাহার থাকলেও সেই শ্রী আর থাকে না৷ মধ্যযুগের বাঙালিসমাজ আধুনিক যুগের সূচনাপর্বে এসে ধনপ্রাচুর্য্যে সংযম হারিয়ে ফেলে এক বিপর্যস্ত ইতিহাস তৈরি করে যার বিস্তারিত বর্ণনা এই রচনায় প্রস্ফুটিত হয়েছে৷ একজন বিদেশী এবং একজন নগরবাসীর কলকাতা, তার মানুষজন, ভাষা, রীতি-নীতি, আচার নিয়ম সম্পর্কে প্রশ্ন-উত্তরের ভঙ্গিতে এটি লেখা হয়েছে৷ যেমন কলকাতা নগরে জাতিগত উৎকর্ষতাকে ছাপিয়ে অর্থনীতির মানদণ্ডে শূদ্র ব্রাহ্মণের দলপতিরূপে অবস্থান করে, এমন একটি প্রশ্ন পাওয়া যায় বিদেশীর মুখের কথায়—‘‘আপনকার অনুগ্রহেতে দলাদলের বিষয় তাবৎ অবগত হইলাম কিন্তু শূদ্রে ব্রাহ্মণের দলপতি হইয়া থাকেন ইহা শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়াছি তাহাতে ব্রাহ্মণঠাকুর মহাশয়রা কি আপন স্বেচ্ছাপূর্ব্বক তাঁহারদিগের দলভুক্ত থাকেন কি তাঁহারা ভয় কিম্বা লোভ দর্শাইয়া আপন দলভুক্ত করেন৷’’৮৭ উপন্যাসের নানাবিধ লক্ষণের মধ্যে বাস্তবতা একটা প্রধান লক্ষণ৷ ‘কলিকাতা কমলালয়’ বাস্তবরস সমৃদ্ধ রচনা হলেও এখানে চরিত্র বা ঘটনা কোনটাই পরিণতি লাভ করতে পারেনি৷ তাই বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের আবির্ভাবের কালগত সীমাটাকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায় না৷

১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে ‘বাবুর উপাখ্যান’-এর পরিবর্ধিত রূপ ‘নববাবু বিলাস’ রচনা করেন প্রমথনাথ শর্মা ছদ্মনামে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বাংলা সাহিত্য জগতে অন্য মাত্রা সংযোজন করেন তিনি৷ গদ্য-পদ্যের মিশ্রণে ‘নববাবু বিলাস’-এ বর্ণিত হয়েছে পারিবারিক স্নেহ-প্রশ্রয়ে, খোশামুদে স্তাবকজাতীয় অমাত্যগণের বাক্যের নিষ্পেষণে এবং বেশ্যাসম্ভোগের অমিতাচারিতায় বাবু দুর্ল্লভচন্দ্রের প্রকৃত বাবু হয়ে ওঠার কাহিনি৷ যেখানে বাবুদের স্বভাব বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে ব্যক্ত করেছেন—

 ‘‘মনিয়া বুলবুল আখড়াই গান,

 খোষ পোষাকী যশমী দান,

 আড়িঘুড়ি কানন ভোজন

 এই নবধা বাবুর লক্ষণ৷’’৮৮

খলিফা বাবু শ্রেণীর গণিকা বিলাস সম্পর্কে বলেছে—‘‘যত প্রধানা নবীনা গলিতা যবনী বারাঙ্গনা আছে ইহাদিগের বাটীতে মধ্যে মধ্যে যাতায়াত করিবা ঐ বারাঙ্গনাদিগের সর্ব্বদা ধনাদি দ্বারা তুষ্ট রাখিবা কিন্তু যবনী বারাঙ্গনাদিগকে বাই বলিয়া থাকে তাহা সম্ভোগ করিবা কারণ পলাও অর্থাৎ পেঁয়াজ ও রশুন যাহারা আহার করিয়া থাকে তাহারদিগের সহিত সম্ভোগে যত মজা পাইবা এমন কোন রাঁড়েই পাইবা না৷’’৮৯

নববাবু ভোগে কামনায় লাম্পট্যে-বিলাসিতায় শেষপর্যন্ত সর্বস্ব হারিয়ে অত্যন্ত দীনহীনভাবে কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করতে থাকে৷ তার উশৃঙ্খলতার অত্যধিক প্লাবনে ঐশ্বর্য-সম্পদ-সম্মান সমস্ত তলিয়ে যায়৷

এখানে অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বাবু দুর্লভচন্দ্রের জীবনের ভয়াবহ পরিণতিকে৷ কাহিনি ঘটনার সূত্র ধরে নির্দিষ্ট গতিতে এগিয়ে গেলেও তার একমুখী সরলরৈখিক গতিতে অন্য সব চরিত্রেরা নিষ্প্রভ হয়ে গেছে৷ নববাবু ছাড়া খলিপা, সুরবাবু এবং নববাবুর পিতা কিছুটা ব্যক্তিত্বমণ্ডিত হলেও চরিত্রগুলির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, ঘাত-প্রতিঘাত তেমন সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত না হওয়াতে এই রচনাটিও প্রথম বাংলা উপন্যাসের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি৷

১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে ভবানীচরণের আরেকটি লেখা প্রকাশিত হয় নাম ‘দূতী বিলাস’৷ সমাজ মধ্যস্থিত দুর্দমনীয় ব্যভিচার ও বিলাসকেলিকে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে তিনি ‘দূতী বিলাস’ রচনা করেন৷ মালিনী, নাপতিনি, উড়েনি, দাসী ইত্যাদি নিম্নবিত্ত নারীদের প্ররোচনা ও সহায়তায় ভদ্র-গৃহস্থ ঘরের কুলবধূ, বিধবা কন্যারা নির্দ্বিধায় পরকীয়ায় মত্ত হয়ে জীবনের জটিলতাকে কণ্ঠে ধারণ করতো৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সেই নিম্নবৃত্তির মালিনী, নাপতেনি শ্রেণীর দূতীরা অন্দরমহল ও বহির্মহলে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ নিয়ে সমাজে ব্যভিচার, উশৃঙ্খলতাকে ভয়াবহ করে তুলেছিল৷ উনিশ শতকের সামাজিক ইতিহাসকে পর্যালোচনা করলে এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী মেলে যেখানে নাপতিনি, মেছুনি, ফুলওয়ালী, গোয়ালিনি ইত্যাদি নারীদের পরামর্শে বহু-কুলবধূ ও বিধবাকন্যারা গণিকা হয়ে অন্ধকার জীবনে পা বাড়িয়েছে৷

নাপতিনির কুপরামর্শে পতিপ্রেমবঞ্চিতা কুলবধূর গণিকা হয়ে ওঠার করুণ কাহিনি ও ভয়ঙ্কর পরিণতি উপস্থাপিত হয়েছে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববিবি বিলাস’-এ৷ ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে রচিত এই রচনায় লেখক কোনো নাম ব্যবহার করেননি৷ পরে তৃতীয় সংস্করণে ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন৷

‘নববিবি বিলাস’ ‘নববাবু বিলাস’-এর সমগোত্রীয়৷ এখানে গৃহত্যাগী কুলবধূর দেহব্যবসায় যোগদান এবং গণিকা মাতার পরামর্শে নববিবি হয়ে নিজের প্রকৃত পরিচয়কে হারিয়ে ফেলা মূল উপজীব্য৷ জীবনে জটিল পথে নানা চড়াই-উতরাই পেড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ভিক্ষার থালা হাতে নিয়ে প্রাণ ধরে রাখতে হয় তাকে৷ নববিবি বা নববিবির মতো নারীদের জীবনের গতিপথ বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক শুরু ও শেষে একটি কথা ব্যবহার করেছেন যা যথার্থভাবে প্রযোজ্য হয়েছে নববিবির জীবনে—

 ‘‘অগ্রে বেশ্যা পরে দাসী মধ্যে ভবতি কুট্টনী৷

 সর্ব্বশেষে সর্ব্বনাশে সারম্ভবতি টুককনী৷৷’’৯০

নববিবি গৃহত্যাগ করে প্রথমে বেশ্যা হয়ে দেহবিক্রয় করেছে, তারপর গণিকাগৃহে দাসীবৃত্তি করে অর্থ উপার্জনের অপর্যাপ্ততায় ‘কুট্টনী’ হয়েছে৷ ‘কুট্টনী’কে সোজা কথায় বলে ‘দালাল’৷ দীর্ঘদিন গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত থাকায় তার পরিচিত বাবুদের কমবয়সি সুন্দরী পারদর্শী গণিকার সন্ধান দিয়ে উপার্জন করা হল ‘কুট্টনী’ বৃত্তি৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে কার্যেও সফলতা না পেয়ে নিজের সবকিছু হারিয়ে ভিক্ষারপাত্র হাতে পথে নেমেছে৷

‘নববাবু বিলাস’-এর মতো এখানেও কাহিনি ও ঘটনার একমুখী গতিতে উপন্যাসের অন্য সব বৈশিষ্ট্য ম্লান হয়ে গেছে৷

এই রচনাগুলিতে অতিমাত্রায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সরস চটকভাব বাংলা ভাষার নবনির্দেশিত শিল্পশ্রীকে স্পর্শ করতে পারেনি যা কিনা উইলিয়াম কেরি, বিদ্যাসাগর, রামমোহন প্রমুখদের হাত দিয়ে শৈশব থেকে যৌবনে পথ চলা শুরু করেছিল৷ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপকে ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি যে কথ্যভাষার সাহায্য নিয়েছিলেন তা সামাজিক উপন্যাসের অন্যতম গুণ৷ তথাপি সমাজ বাস্তবতার সুস্পষ্ট ছাপ থাকলেও কাহিনি, চরিত্র, ঘটনা তথা উপন্যাসের অন্যান্য লক্ষণগুলিকে স্পর্শ করতে পারেনি৷

তবে এত কিছুর পরেও মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যের আঙ্গিকগত কৌশলকে অতিক্রম না করে আধুনিক উপন্যাসের ভিত্তিভূমিকে এড়িয়ে গেছে ‘নববাবু বিলাস’-এর মতো রচনা৷ যেমন গঠনশৈলীতে দেখা যায়—

 শ্রী শ্রীদূর্গা

 শরণং

 অথ বন্দনা—গণপতি বন্দনা—সরস্বতী বন্দনা—ভূমিকা৷

 অঙ্কুর খণ্ড—শিরোনামসহ সাতটি পরিচ্ছেদ

 পল্লবখণ্ড—শিরোনামসহ তিনটি পরিচ্ছেদ

 কুসুম খণ্ড—শিরোনামসহ তিনটি পরিচ্ছেদ

 ফল খণ্ড—শিরোনামসহ তিনটি পরিচ্ছেদ

 চতুর্থ খণ্ড শেষে লেখকের স্বনাম প্রকাশ৷

যতি বা বিরাম চিহ্নের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে মধ্যযুগীয় এক দাড়ি (৷ ) ও দুই দাড়ি (৷৷ ) ব্যবস্থা৷

‘নববিবি বিলাস’-এ সরস্বতী বন্দনা, গণপতি বন্দনা ইত্যাদি না থাকলেও পয়ার, দ্বিপদী, ত্রিপদীর প্রাচুর্য দৃষ্টি এড়ায় না৷

তবে একথা অবশ্যই বলা যায় ভবানীচরণ সাহিত্যের সূত্র মেনে কোনো শিল্প তৈরি করতে চাননি অর্থাৎ শৈল্পিকগুণমণ্ডিত সাহিত্য উপকরণ তৈরি করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন তৎকালীন সমাজের মানুষের নৈতিক বিপর্যয়কে, ব্যভিচার-ভোগবিলাসকে উপস্থাপন করতে৷ আর রঙ্গ-ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের আকারে সেই ছবিকেই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি—যার সাহিত্যিক তকমা ‘নকশা’ নামে৷ নকশা রচনা করতে গিয়েই তিনি বাংলা উপন্যাসের জন্মলগ্নকে একেবারে চূড়ান্ত মুহূর্তে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর নিজেরই অগোচরে৷

হান্না ক্যাথেরিন ম্যলেন্স এর ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’-এর রচনাকাল ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ৷ অনেক সাহিত্য সমালোচকের মতে এটি ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর পূর্ববর্তী প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা উপন্যাস৷ কেরীর ‘কথোপকথন’ ও বাইবেলের অনুবাদের যুগ্ম আদর্শে পরিকল্পিত করে কয়েকটি খ্রিস্টান বাঙালি পরিবারের জীবনাচারণের কাহিনি বিবৃত করেছেন লেখিকা এই রচনায়৷

লেখিকা বাংলাদেশের মফসসলে নদীতীরবর্তী এক অঞ্চলে কিছুকাল অবস্থান করে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে রচনা করেছেন ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’-এর কাহিনি৷ প্রধান কাহিনি ও উপকাহিনির মোড়কে আবৃত এটি৷ যেমন প্রধান কাহিনি হল ফুলমণি ও করুণা নাম্নি দুজন চরিত্রের দুটি পরিবারের কাহিনি৷ উপকাহিনির মধ্যে সুন্দরীর কলকাতা যাত্রার কাহিনি, প্যারীর জীবন কাহিনি, মধু ও রাণীর কাহিনি এবং মুসলমান আয়ার কাহিনি৷

ফুলমণির পরিবার খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত৷ যীশুর প্রতি ঐকান্তিক বিশ্বাসে-শ্রদ্ধায় তারা জীবন অতিবাহিত করে এবং যীশুর কৃপায় সুখ-স্বাচ্ছন্দে ভরপুর তারা৷ অন্যদিকে করুণার পরিবার খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হলেও আন্তরিকভাবে প্রভু যীশুর প্রতি আস্থা রাখতে পারে না৷ তাদের সেই দৈন্যতায় যীশু তাদের প্রতি করুণা প্রদর্শনে কার্পণ্য করেন৷ তাদের সাংসারিক জীবন অশান্তির কালোছায়ায় ম্লান৷ লেখিকা এখানে দেখাতে চেয়েছেন খ্রিস্টধর্মের প্রতি আন্তরিক আত্মসমর্পণই সংসারে সুখের উচ্চ চূড়ায় পৌঁছানোর মূল সিঁড়ি৷ অন্য ধর্ম যা পারে না খ্রিস্টধর্ম তা অনায়াসে পারে৷

কাহিনি, ঘটনা, চরিত্রের ঘাত-প্রতিঘাত, সমাজবাস্তবতা উপন্যাসের প্রায় সকল গুণাবলীই এর মধ্যে থাকা সত্ত্বেও ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ প্রথম বাংলা উপন্যাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি৷ কারণ লেখিকা খ্রিস্টধর্ম প্রচারকে মূল উদ্দেশ্য করে তাঁর লেখনিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ফলে চরিত্রগুলি তাদের জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা, ঘাত-প্রতিঘাতগুলোকে জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে সমাধান না করে ধর্মগ্রন্থের বাণী আওড়ে তাকে এড়িয়ে গিয়েছে৷ তারা হয়ে পড়েছে নিষ্প্রভ ও নির্জীব৷ যেমন করুণা একদিন ফুলমণির মেয়ে সুন্দরীর হাতের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন একটি চিনা গোলাপের চারাগাছকে নষ্ট করে ফেললে ফুলমণি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে৷ কিন্তু পরক্ষণেই খ্রিস্টধর্মগ্রন্থের একটি সান্ত্বনাদায়ক পদ তার স্মরণ হওয়ায় তার অন্তর্যন্ত্রণা লাঘব হয়ে যায়৷ যেমন—‘‘তৃণ শুষ্ক হয়, ও পুষ্প ম্লান হয়, কিন্তু আমাদের ঈশ্বরের বাক্য নিত্যস্থায়ী৷’’৯১ করুণার দ্বারা গাছটির ক্ষতি হওয়াতে অনুতপ্ত করুণাকে ফুলমণি বলে—‘‘ক্ষতি নাই৷ ইহাতে ধর্ম্মপুস্তকের একটি অতি সান্ত্বনাদায়ক পদ আমার স্মরণ হইতেছে৷ হায় করুণা! তুমি যদি আপন মনে ঐ কথার বহুমূল্যতা জ্ঞাত হইতা, তবে তোমার দুঃখ অনেক ন্যূন হইত৷’’৯২ করুণার স্বামী অত্যাচারী৷ মদ্যপান, বেশ্যাগমন ইত্যাদি তার প্রাত্যহিক কর্ম৷ নানা কারণে সে করুণার উপর মানসিক, শারীরিক নির্যাতন চালায়৷ লেখিকা করুণার সংসারের শান্তির জন্য বলেন—‘‘হায় করুণা! তুমি যদি সত্য খ্রীষ্টীয়ান হইতা, তবে আমার মনে কিঞ্চিত ভরসা জন্মিত, যে তোমার স্বামী দুষ্টতা ত্যাগ করিয়া ক্রমে২ ভালো হইবে;৷’’৯৩ কারণ ‘‘ধার্ম্মিক ব্যক্তির একান্ত প্রার্থনা অতি সফল হয়’’৯৪, যাকুবের পত্র ৫৷১৬৷

হান্না ক্যাথেরিন ম্যলেন্স শুধুমাত্র ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্য নিয়েই রচনাটা সম্পন্ন করেছিলেন৷ ফলে সমগ্র রচনাটি নীতিবাক্যে ভারাক্রান্ত এবং শুধু ধর্মপ্রচারই নয় নিজের ধর্ম অর্থাৎ খ্রিস্টধর্মকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করতে গিয়ে অন্য ধর্মের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করতেও দ্বিধাবোধ করেননি৷ যেমন—ফুলমণির সন্তান সাধুর মুখে তাদের সুষ্ঠু ধর্মাচারণার বিবরণ শুনে লেখিকা মনে মনে ভাবে যে ফুলমণির পরিবারের মতো ধার্মিক বাঙালি খ্রিস্টান লোক থাকলে তাদের ধর্ম আরও বেশি প্রশস্ত হতো৷ ‘‘কিন্তু দুঃখের বিষয় এই, যে অনেক ভক্ত খ্রীষ্টিয়ান লোকেরা হিন্দু ও মুসলমানদের ন্যায় মন্দ আচার ব্যবহার করিয়া খ্রীষ্টের নামে কলঙ্ক দেয়৷’’৯৫ তিনি নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এবং পরধর্মের হীনতা প্রকাশ করতে গিয়ে আরও বলেন—‘‘হিন্দুদের সহিত আমাদের প্রতিদিন সাক্ষাৎ হয়, অতএব তাহাদিগকে কিছু শিক্ষা দেওয়া খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রীলোকদের উচিত৷ তাহারা যদি এমত করিত, তবে বোধ হয় হিন্দুরা ইংরাজদের কথা অপেক্ষা স্বদেশীয় লোকদের কথা উত্তমরূপে শুনিত; সুতরাং তাহারা মনে করিবে, পূর্ব্বে ইহারা আমাদের ন্যায় হিন্দু ছিল, এখন বুদ্ধি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছে যে নূতন ধর্ম্ম পুরাতন ধর্ম্ম হইতে উত্তম৷’’৯৬ আর এই অতিরিক্ত ধর্মীয় ভাবাবেগের মোড়কে বাঁধতে গিয়ে রচনাটির উপন্যাসগুণ তথা শিল্পগুণকেউ খণ্ডিত করেছেন এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হওয়ার পথে অন্তরায় হয়েছে৷ এছাড়াও গ্রন্থটি যে তাঁর মৌলিক গ্রন্থ নয় সে বিষয়ে অনেক সমালোচকই সহমত পোষণ করেছেন৷

তবুও ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ উপন্যাস না হলেও সেখানে প্রায় চরিত্রপোযোগী সংলাপ সৃষ্টি, সামাজিক নানা কুসংস্কারের স্বরূপ উদ্ঘাটন, স্ত্রী শিক্ষা, নারীস্বাধীনতা, বিধবা বিবাহ এবং স্বামী নির্বাচনে নারীর স্বাধীনতা ইত্যাদি নানা শুভ ভাবনার প্রয়োগকুশলতা উনিশ শতকের সামাজিক পটভূমিকে যেমন চিনিয়ে দেয় তেমনি আধুনিক পাঠক-সমালোচকদের মননকেউ আলোড়িত করে৷

বাংলা সাহিত্য জগতে বাবুশ্রেণীকে কেন্দ্র করে তিনটি রচনা বিশেষ তাৎপর্যবাহী৷ ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবু বিলাস’ (১৮২৩), প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮) এবং কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ (১৮৬২) তিনটি রচনাতেই বাবুচরিত্র এবং বাবুকেন্দ্রিক সমাজজীবন আলোচিত হয়েছে৷ ‘নববাবু বিলাস’-এর কথা পূর্বেই বলা হয়েছে৷ ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ও ঠিক উপন্যাস নয়৷ এটি নবপ্রতিষ্ঠিত কলকাতা নগরীর বাবুশ্রেণীর উশৃঙ্খল গণিকাসক্ত জীবনের বাস্তব চিত্র৷ তৎকালীন সমাজজীবনকে খণ্ড চিত্রের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন লেখক৷ ঐশ্বর্য বিলাসের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেওয়া বাবুদের রুচিবিকারে ও সামাজিক নানা অসঙ্গতিতে লেখক তীব্র শ্লেষপূর্ণ কষাঘাত হেনেছেন ঠিকই কিন্তু কোনো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চরিত্র সৃষ্টি করতে পারেননি৷ ফলে বাস্তবতার সুষ্ঠু প্রয়োগ থাকলেও চরিত্র-চিত্রণের মতো প্রধানগুণই সেখানে অনুপস্থিত থেকেছে৷

এক্ষেত্রে ‘আলালের ঘরের দুলাল’-কেই সর্বশ্রেষ্ঠ ও সমধিক উপন্যাসগুণবিশিষ্ট বলা যায়৷ এর পরিবেশ বর্ণনা, পূর্ণাঙ্গ ও তথ্যবহ জীবনের নানাচিত্র, চরিত্র, চরিত্রপোযোগী সংলাপ সকলই উপন্যাসের সাহিত্যাঙ্গনে গ্রন্থটিকে প্রতিষ্ঠালাভ করাতে স্থায়ী ভূমিকা নেয়৷ কলকাতার রাস্তাঘাটের কর্মব্যস্ত জীবনপ্রবাহের বাস্তবচিত্র, পারিবারিক জীবন, নব প্রতিষ্ঠিত ইংরেজ শাসনের নানা ব্যবস্থা কীভাবে ব্যক্তিজীবনের নিয়ামক হয়ে ওঠে, আদালতের নানা কৌতুহলপূর্ণ কার্যপ্রণালী সমস্ত কিছুই নবরসোন্মাদনার পরিচায়ক৷ যেমন অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে লেখক বৈদ্যবাটির বাজারের বর্ণনা দিয়েছেন—‘‘রাস্তার দোধারি দোকান—কোনখানে বন্দিপুর ও গোপালপুরের আলু স্তূপাকার রহিয়াছে—কোনখানে মুড়ি মুড়কি ও চাল ডাল বিক্রয় হইতেছে—কোনখানে কলুভায়া ঘানিগাছের কাছে বসিয়া ভাষা রামায়ণ পড়িতেছেন—গরু ঘুরিয়া যায় অমনি টিটকারি দেন, আবার আল ফিরিয়া আইলে চীৎকার করিয়া উঠেন ‘‘ও রাম আমরা বানর রাম আমরা বানর’’—কোন খানে জেলের মেয়ে মাছের ভাগা দিয়া নিকটে প্রদীপ রাখিয়া ‘‘মাছ নেবেগো’’ বলিতেছে—কোনখানে কাপুড়ে মহাজন বিরাট পর্ব্ব লইয়া বেদব্যাসের শ্রাদ্ধ করিতেছে৷’’৯৭ শুধু ঘটনা, পরিবেশ ও প্রতিবেশই নয় চরিত্র অঙ্কনেও এর শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য৷ যেমন নায়ক মতিলাল, তার বাবা বাবুরাম বাবু, দুই সহোদরা এবং দুষ্কর্মে সহযোগী বন্ধুবর্গ সকলেই জীবন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ৷ সবথেকে জীবন্ত ও উৎকর্ষ চরিত্র ঠকচাচা৷ তার সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন—‘‘ঠকচাচা উপন্যাসের মধ্যে সর্বাপেক্ষা জীবন্ত সৃষ্টি; উহার মধ্যে কূটকৌশল ও স্তোকবাক্যে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতার এমন চমৎকার সমন্বয় হইয়াছে যে, পরবর্তী উন্নত শ্রেণীর উপন্যাসেও ঠিক এই রূপ সজীব চরিত্র মিলে না৷’’৯৮ এছাড়া রয়েছে বেচারাম, বেণী, বাঞ্ছারাম, বক্রেশ্বর ইত্যাদি চরিত্রগুলি৷ প্রতিটি চরিত্রই তাদের নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল৷ নায়ক মতিলালের জীবনেরও একটা পূর্ণাঙ্গ পরিণতি দেখানো হয়েছে৷

 অতীতের নানা রচনার সোপান বেয়ে প্যারীচাঁদ মিত্রের হাত দিয়ে বাংলা উপন্যাস প্রথম ১৮৫৮ সালে ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর মধ্য দিয়ে মুক্তির আলো গ্রহণ করে৷ রচনাকার এক্ষেত্রে উপন্যাস রচনা করতেই চেয়েছিলেন যা ইতিপূর্বে কোনো বাঙালি লেখক করেননি৷ এ প্রসঙ্গে এর ইংরেজি ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন—The above original Novel in Bengali being the first work of the kind, is now submitted to the public with considerable diffidence. It chiefly treats of the pernicious effects of allowing children to be inproperly brought up, with remarks on the existing system of education, on self-formation and religious culture and is illustrative of the condition of hindu society, manners, customs &c. and partly of the state of things in the moffussil… ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে কৈশোর-যৌবনের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে নতুন জোয়ার নিয়ে আসে৷ সম্পূর্ণ সার্থকরূপে প্রথম শ্রেণীর উপন্যাস না হতে পারলেও এটিই প্রথম বাংলা উপন্যাস৷ এর সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য—‘‘আলালের ঘরের দুলাল’-এ প্রথম সম্পূর্ণাবয়ব উপন্যাসের বিবর্তন বহুদিনের প্রত্যাশিত সম্ভাবনাকে সার্থক রূপ দিয়াছে৷’’৯৯ পরবর্তীকালে বাংলা উপন্যাসের কলেবরে যৌবনের প্রাণশক্তিকে দুর্বার রূপে সঞ্চারিত করেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দুর্গেশনন্দিনী’-এর (১৮৬৫) মধ্যে দিয়ে৷ বাংলা উপন্যাস সাহিত্য জগতে নিজস্বগুণাবলীতে চিরস্থায়ী এবং সর্বজনস্বীকৃতি লাভ করে ভবিষ্যতের গতিমুখী হয়৷

তথ্যসূত্র :

 ১. নির্মল দাশ, চর্যাগীতি পরিক্রমা, পৃ-২২১৷

 ২. তদেব, পৃ-১৯০৷

 ৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সঞ্চয়িতা, পৃ-১৬৬৷

 ৪. নির্মল দাশ, চর্যাগীতি পরিক্রমা, পৃ-২২১৷

 ৫. তদেব, পৃ-১৬২৷

 ৬. তদেব, পৃ-১৩৭৷

 ৭. তদেব, পৃ-১৩৮৷

 ৮. তদেব, পৃ-১১৫৷

 ৯. তদেব, পৃ-১৬৪৷

১০. মৈমনসিংহ গীতিকা, পৃ-৬০৷

১১. তদেব, পৃ-৬১৷

১২. তদেব, পৃ-৬১৷

১৩. তদেব, পৃ-৯০৷

১৪. তদেব, পৃ-৬৮৷

১৫. তদেব, পৃ-৭০৷

১৬. তদেব, পৃ-৮৯৷

১৭. তদেব, পৃ-১০৯৷

১৮. তদেব, পৃ-১১০৷

১৯. তদেব, পৃ-৪০৷

২০. তদেব, পৃ-৮৬৷

২১. তদেব, পৃ-১৯৫৷

২২. তদেব, পৃ-৩৪-৩৫৷

২৩. তদেব, পৃ-২৮৷

২৪. সুকুমার সেন (সম্পাদিত), চণ্ডীমঙ্গল, পৃ-২৫৷

২৫. তদেব, পৃ-২৬৷

২৬. তদেব, পৃ-২৬৷

২৭. তদেব, পৃ-১১৷

২৮. তদেব, পৃ-১১৷

২৯. তদেব, পৃ-১২৷

৩০. তদেব, পৃ-২৫৷

৩১. তদেব, পৃ-২৬৷

৩২. তদেব, পৃ-২৭৷

৩৩. তদেব, পৃ-২৫৷

৩৪. তদেব, পৃ-৪৫-৪৬৷

৩৫. তদেব, পৃ-৬৩৷

৩৬. তদেব, পৃ-৩৬৷

৩৭. তদেব, পৃ-৬০৷

৩৮. তদেব, পৃ-৬০৷

৩৯. তদেব, পৃ-৬২৷

৪০. তদেব, পৃ-৬৪৷

৪১. তদেব, পৃ-৬৪৷

৪২. তদেব, পৃ-৯৫৷

৪৩. তদেব, পৃ-৯৬৷

৪৪. তদেব, পৃ-৪০৷

৪৫. তদেব, পৃ-৯৮৷

৪৬. তদেব, পৃ-১৩৩৷

৪৭. তদেব, পৃ-৭৭৷

৪৮. তদেব, পৃ-৮৪৷

৪৯. তদেব, পৃ-৮৫৷

৫০. তদেব, পৃ-৮৬৷

৫১. তদেব, পৃ-৪৭৷

৫২. তদেব, পৃ-৯৩৷

৫৩. তদেব, পৃ-১০৫৷

৫৪. তদেব, পৃ-৬৬৷

৫৫. তদেব, পৃ-৬৬৷

৫৬. তদেব, পৃ-৬৭৷

৫৭. তদেব, পৃ-৬৭৷

৫৮. তদেব, পৃ-৬৬৷

৫৯. তদেব, পৃ-৬৬৷

৬০. তদেব, পৃ-১৩১-১৩২৷

৬১. তদেব, পৃ-১৩২৷

৬২. তদেব, পৃ-১৩২৷

৬৩. তদেব, পৃ-১৫৩৷

৬৪. তদেব, পৃ-১৫৪৷

৬৫. তদেব, পৃ-১৫৮-১৫৯৷

৬৬. তদেব, পৃ-৩৷

৬৭. তদেব, পৃ-২৫৷

৬৮. তদেব, পৃ-৫৫৷

৬৯. তদেব, পৃ-৫৫৷

৭০. তদেব, পৃ-৬২৷

৭১. তদেব, পৃ-৮৬৷

৭২. তদেব, পৃ-১৫০৷

৭৩. তদেব, পৃ-১৬১৷

৭৪. তদেব, পৃ-৭৭৷

৭৫. তদেব, পৃ-৭৮৷

৭৬. তদেব, পৃ-৭৯৷

৭৭. তদেব, পৃ-৮০৷

৭৮. তদেব, পৃ-৮৩৷

৭৯. তদেব, পৃ-৫৯৷

৮০. তদেব, পৃ-৬২৷

৮১. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, পৃ-৮৷

৮২. সৌমেন্দ্রনাথ সরকার, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাংলা সাহিত্য, পৃ-৬৷

৮৩. তদেব, পৃ-১০৷

৮৪. তদেব, পৃ-১১৷

৮৫. তদেব, পৃ-১২৷

৮৬. তদেব, পৃ-১৫৷

৮৭. তদেব, পৃ-৪৫৷

৮৮. তদেব, পৃ-৬৬৷

৮৯. তদেব, পৃ-৬৮৷

৯০. তদেব, পৃ-১৯৯৷

৯১. বকুল রোজারিও, ম্যলেন্স হান্না ক্যাথেরিন, ফুলমণি ও করুণার বিবরণ, পৃ-১৪৷

৯২. তদেব, পৃ-১৪৷

৯৩. তদেব, পৃ-৫৫৷

৯৪. তদেব, পৃ-৫৫৷

৯৫. তদেব, পৃ-২৭৷

৯৬. তদেব, পৃ-৭১৷

৯৭. মিত্র, প্যারীচাঁদ, আলালের ঘরের দুলাল, পৃ-৬০৷

৯৮. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, পৃ-১৭৷

৯৯. তদেব, পৃ-১৯-২০৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *