উনিশ শতকের বাংলা উপন্যাসে গণিকা
উনিশ শতক বাংলা উপন্যাসের প্রতিষ্ঠাপর্ব৷ ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ‘দুর্গেশনন্দিনী’-র মধ্য দিয়ে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে বাংলা উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের জগতে যথার্থ স্বরূপে আবির্ভূত হয়৷ শুধু বঙ্কিমচন্দ্রই নন এই সময়কার আরও বহু ঔপন্যাসিকের কলমে বিভিন্ন আঙ্গিকে বাংলা উপন্যাস তার বিচরণক্ষেত্রকে বিস্তৃত করে৷ সময়ের বিবর্তনের ধারায় নবজাগরণের কালপর্ব হিসেবে উনিশ শতক এক গুরুত্বপূর্ণ সময়পর্ব৷ গণিকা জীবনের বহু উত্থান-পতনের ইতিহাস এর পর্বে পর্বে৷ সাহিত্যিকের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের করুণাঘন জীবনের যন্ত্রণাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি৷ তাই উনিশ শতকের বহু উপন্যাসে গণিকা-স্বৈরিণী চরিত্রের অনুপ্রবেশ এক উল্লেখযোগ্য বিষয়৷ এই সময়পর্বের গণিকাচরিত্র সম্বলিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ (১৮৫৭), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫), ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮), ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২), ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘এই এক নূতন’ বা ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ (১৮৭০-৭৩), বিবি মেরী ই লেসলির ‘এলোকেশী বেশ্যা’ (১৮৭৬), গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘চন্দ্রা’, নবকুমার দত্ত সম্পাদিত অজ্ঞাতনামা লেখকের ‘স্বর্ণবাই’ (১৮৮৮), সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’ (১৮৭৭), দুর্গাচরণ রায়ের ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’ (১৮৮০), শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘নয়নতারা’ (১৮৯৯) ইত্যাদি৷ গণিকাচরিত্র তথা গণিকা প্রসঙ্গ উপস্থাপনায় উক্ত উপন্যাসগুলির গুরুত্ব অপরিসীম৷
অঙ্গুরীয় বিনিময় :
ইতিহাস ও কল্পনার মেলবন্ধনে রচিত ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের এই ঐতিহাসিক উপন্যাসের রচনাকাল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ৷ শিবাজী, আরংজেব, শাহজাহান, রোসিনারা, জয়সিংহ, রামদাস স্বামী ইত্যাদি ঐতিহাসিক চরিত্রগুলির নানা কাহিনির সঙ্গে এমনভাবে কিছু কাল্পনিক বিষয়ের অবতাড়না করেছেন রচয়িতা যেখানে ইতিহাসের সত্যনিষ্ঠা ও কল্পনারসের সিদ্ধি যুগপৎ সার্থক হয়েছে৷ এই উপন্যাসে রয়েছে এক নামহীনা গণিকার কথা৷ উপন্যাসের নাম ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’৷ এখানে শিবাজী-রোসিনারার প্রণয়ে অঙ্গুরীয় বিনিময়ের মহৎ কর্তব্যটি সাধিত হয়েছে এক গণিকা নারীর দ্বারা৷ শিবাজী আরংজেব কর্তৃক বন্দি হয় দেওয়ান-ই-আম এ৷ সেই সময় আবার মোঘল সম্রাটের জন্মদিনের আমোদপূর্ণ সমারোহ৷ অনুষ্ঠান পার হলেই শিবাজীকে দেওয়া হবে চরমতম দণ্ড৷ সেই আমোদের সমারোহের মাঝেই শিবাজী পলায়নের ফন্দি আঁটে৷ সংবাদ জানাতে হবে রোসিনারাকে কারণ সে আরংজেব বা ঔরঙ্গজেবের কন্যা, শিবাজীর প্রণয়িনী; সেও শিবাজীর সঙ্গে যেতে চায় কিনা৷ সংবাদদাতার ভূমিকা নেয় এক গণিকা৷ সে দেহপসারিণী নারী৷ সর্বত্র অবাধ যাতায়াত তার৷ জন্মদিনের উৎসবমুখর সময়ে শিবাজী-রোসিনারার মিলন ঘটাতে দেহের বদলে শিবাজীর উষ্ণীষ ও অঙ্গুরীয়ের পসরা সাজায়৷ বিরহী রোসিনারা পিতামহ শাহজাহানের সঙ্গে উৎসবের সমারোহ দেখতে দেখতে উপস্থিত হয় সেই বারবনিতার সাজানো দোকানে৷ বারবনিতা তার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য—‘‘একটি অঙ্গুরীয় এবং উষ্ণীষ প্রদর্শনান্তর সহাস্যবদনে কহিল, ‘‘বাদসাহনন্দিনী! এই সকল দ্রব্যের মধ্যে কিছু ক্রয় করিতে ইচ্ছা হয়?—ইহা অনেক দূর হইতে আসিয়াছে, তুমি গ্রহণ করিলেই সার্থক হয়৷’’১ বারনারীর সেই ইঙ্গিতবাক্য বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না রোসিনারার৷ কারণ একবার দেখেই সে চিনতে পেরেছে শিবাজীর অঙ্গুরীয় এবং উষ্ণীষ৷ সেগুলির মূল্য নির্ধারণের জন্য তাকে নিভৃতে ডেকে নিয়ে সব কথা জানতে পারে রোসিনারা৷ গণিকা রোসিনারাকে বলে—‘‘যাহার এই সকল সামগ্রী তিনিই আমাকে এই স্থলে প্রেরণ করিয়াছেন এবং কহিয়া দিয়াছেন যে, যদি আপনি এতদিনেও তাহাকে বিস্মৃত না হইয়া থাকেন, তবে তাহার সহিত প্রস্থানের উপায় করুন৷ এইক্ষণে সকলই আপনার হাত, তাহার হাত কিছুই নাই৷’’২ সমাজে যে সমস্ত নারীরা সকলের ঘৃণার পাত্রী, পদে পদে যাদের মিথ্যার বেসাতি করে জীবন ধারণের রসদ জোগাতে হয় সেই রকম এক দুশ্চারিণী নারীকে এমন গোপনীয় বিষয়েও যে ভরসা করা যায় তা দেখে রোসিনারা বিস্ময়াভূত হয়ে যায়৷ কারণ শিবাজী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামি, সে আবার পালিয়ে যাচ্ছে, যাওয়ার সময় প্রণয়িনীকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়৷ তাই কোনো এক নিভৃত স্থানে সে অপেক্ষা করছে এবং সেই অপেক্ষারত স্থানের হদিস জানে সেই পতিতা৷ সমাজ পরিত্যক্ত এহেন নারীদের এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দিয়ে স্বয়ং রচনাকার গণিকা নারীদের প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেছেন৷ যদিও শেষ পর্যন্ত পিতামহের অনুমতি পেয়েও রোসিনারা সেই বারবনিতার সঙ্গে শিবাজী নির্ধারিত স্থানে যায়নি কারণ আরংজেব এবং শিবাজীর হিন্দু জাতি-ভাইরা তাহলে শিবাজীকে তিষ্ঠতে দেবে না এবং দুই দিকে শত্রুতা দমন করাও তার পক্ষে সম্ভব নয়৷ বারযোষিৎ রোসিনারার মনের অভিব্যক্তি ঠিকঠাক না বুঝলেও সে তার কথা মত অপেক্ষা করে৷ কিছুক্ষণ পর একটি চিঠি এবং অঙ্গুরীয় এনে বারবনিতার হাতে দিয়ে তার হাত থেকে শিবাজীর অঙ্গুরীয়টি নিয়ে নেয় রোসিনারা৷ তারপর সেই চিঠি ও আংটি শিবাজীর হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে সংকেত স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে তা যেমন দুর্গম তেমনি ভয়ানক৷ লেখকের বর্ণনায়—‘‘সেই দিন নিশীথ সময়ে পূর্বোক্ত বারাঙ্গনা একাকিনী সেতু দ্বারা যমুনা উত্তীর্ণ হইয়া দক্ষিণাভিমুখে গমন করিতে লাগিল৷ সে দিক প্রাচীন দিল্লী, তথায় অনেকানেক ভগ্ন প্রাসাদ এবং বৃহৎ বৃহৎ দেবালয় সকল অদ্যপি দৃষ্ট হইয়া থাকে৷ তৎকালে এক্ষণকার অপেক্ষা আরও অধিক ছিল৷ ঐ স্থানে একটি মনুষ্যেরও গমনাগমন নাই৷ কেবল স্থানে স্থানে শৃগালদি হিংস্রজন্তুরই উপদ্রব আছে৷’’৩ সেই অন্ধকার রাত্রে জনমানবহীন ধ্বংসাবশেষের মধ্যে অত্যন্ত দুঃসাহসে সংবাদ নিয়ে যেতে হয়েছে সেই বারবনিতাকেই৷ তাকে একা দেখে অপেক্ষারত শিবাজী যখন বিফলতার খবর শোনার জন্য ব্যাকুল হয়েছে তখন অত্যন্ত সংযমী ভাষণে সে জানিয়েছে—‘‘হাঁ মহারাজ! আপনার চেষ্টা বিফল হইয়াছে বটে, কিন্তু যাহা দেখিয়াছি এবং শুনিয়াছি তাহা মুখে বর্ণন করিয়া আর কি জানাইব, এই পত্র এবং অঙ্গুরীয় গ্রহণ করিয়া সমুদায় অবগত হউন৷’’৪
শিবাজী কিছুটা লিপি পাঠ করে কিছুটা গণিকার মুখে শুনে রোসিনারার মহত্ত্বে এবং তারও বেশি আকর্ষণে যন্ত্রণাদগ্ধ হয়েছে তখন সেই রূপজীবা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়েছে—‘‘মহারাজ! যাহা বলুন কিন্তু বাদসাহ-পুত্রী উচিৎ কর্ম্মই করিয়াছেন এবং তিনি উচিৎ করিয়াছেন বলিয়াই তাহার সমুদায় গুণ আপনার অনুভূত হইতেছে৷’’৫ একজন দেহপোজীবিনী নারীও এখানে সমাজের সম্মানশীল বাদশাহপুত্রী মহানুভবতায় অভিভূত হয়ে মহারাজা শিবাজীকে সেই গুণাবলীর কথা বলতে পারছে৷ শুধু শিবাজী নয় সেই বারযোষিৎ-এর মুখে সব কথা শুনে শিবাজীর গুরুদেব রামদাস স্বামীও রোসিনারার প্রতি সমস্ত ক্ষোভকে শান্ত করেছেন এবং অনুমতি দান করে বলেছেন—‘‘মহারাজ আমি অনুমতি করিতেছি আপনি ঐ অঙ্গুরীয় গ্রহণ করুন—এবং যদি শাস্ত্র সত্য হয়, তবে পরজন্মে এই বাদসাহ-কন্যাই আপনার সহধর্ম্মিনী হইবেন ইহার সন্দেহ নাই৷’’৬ একজন গণিকার সহায়তায় শিবাজী তার যথার্থ জীবনসঙ্গীকে খুঁজে পেয়েছে৷
গণিকা সমাজবিবর্জিতা৷ তারা সকলের ঘৃণার পাত্রী হলেও ঔপন্যাসিক ভূদেব মুখোপাধ্যায় অঙ্গুরীয় বিনিময়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার এবং নায়ক-নায়িকার মিলনের মধ্যস্থতাকারিণী হিসেবে এক বারবনিতাকে বেছে নেওয়া যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন৷ তারা স্বাধীনযৌবনা, কুলস্ত্রীর মতো সংকোচের বালাই, নিষেধের বেড়াজাল নেই তাদের মধ্যে এবং যত্রতত্র বিচরণের অপার দক্ষতা বারবনিতার পক্ষেই সম্ভব৷ শিবাজী রোসিনারার দূতী হিসেবে বারবনিতাকে নির্দিষ্ট করায় গণিকা সমাজের প্রতি তাঁর কিছুটা হলেও সহানুভূতি ফুটে উঠেছে৷ কিন্তু গণিকারা জীবনধারণের জন্য দেহ বিক্রয় করে, অর্থের জন্য নির্মম যৌনখেলায় নিজেকে মত্ত করে কিন্তু এই উপন্যাসের সেই নামহীনা গণিকা যাকে লেখক প্রণয়ী-প্রণয়িনীর মিলন ঘটানোর জন্য জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব দিতেও দ্বিধাবোধ করেননি৷ নিশ্চয় অর্থ রোজগার তার জীবনের উপরে নয়৷ কোনো মহৎ আদর্শ বা গুণরাজী না থাকলে কোনো মানুষই তার জীবনকে এভাবে বাজি রাখতে পারে না৷ যে কোনো সময় নিশ্চিত মৃত্যু ঘটতে পারে তার৷ তার পরেও সে পিছপা হয়নি৷ লেখক তাকে দিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করেছে৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তার দ্বারা উপন্যাসের এতবড় কর্মটি সাধিত করলেও রচনাকার তার নামটুকু দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি৷ উপন্যাসে সে নামহীনাই থেকে গেছে৷
দুর্গেশনন্দিনী :
‘দুর্গেশনন্দিনী’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস৷ ১৮৬৫ সালে এটি লেখা হয়৷ এখানে মোঘল-পাঠান যুদ্ধ বৃত্তান্ত বর্ণিত হলেও মূলত তিলোত্তমা-জগৎসিংহের প্রেমকাহিনিই মুখ্য৷ ইতিহাস-কল্পনার যুগল সহাবস্থানে নানা প্রসঙ্গে গণিকা জীবনের প্রতিও আলোকপাত ঘটেছে এই উপন্যাসে যদিও তার পরিমাণ খুব কম; স্বতন্ত্র কোনো চরিত্র হিসেবে তো নয়ই৷
উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র হিসেবে অবস্থান করছে বিমলা চরিত্রটি৷ সে বীরেন্দ্রসিংহের কন্যা তিলোত্তমাকে লালনপালন ও রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত৷ কিন্তু তার মধ্যে দাসী বা পরিচারিকার কোনো লক্ষণ ছিল না৷ সে সধবা না বিধবা তাও কারও জানা নেই৷ তার স্বামীর হদিস নেই অথচ সধবাদের মত অলঙ্কার পড়তো, একাদশী করতো না৷ সকলে অনুমান করতো যে বিমলা বহুকাল মোঘল সম্রাটের পুরবাসিনী ছিল৷ বিমলা কোনো দিন তার সম্পর্কে কেউকে কিছু জানতে দেয়নি৷ কিন্তু কতলু খাঁর অন্তঃপুরে বন্দি বিমলা তার সমস্ত কথা যুবরাজকে (জগতসিংহকে) জানিয়ে পত্র লিখেছে৷ যে পত্র পাঠ করে কতলু খাঁর সেনাপতি ওসমান৷ বিমলার জীবনটা ছিল বীরেন্দ্রসিংহের রক্ষিতার মতো৷ তার পত্র থেকে জানা যায় বিমলা আসলে বীরেন্দ্রসিংহের পত্নী৷ শূদ্রীমাতার গর্ভজাত বলে সে বীরেন্দ্রসিংহের গৃহে রক্ষিতার মতো কাটিয়েছে৷ সকলের ঘৃণা সহ্য করে এসেছে কারণ সে স্বামীর কাছে প্রতিশ্রুত ছিল যে স্বামীর মৃত্যুর পূর্বে নিজের পরিচয় কারও কাছে প্রকাশ করবে না৷ কতলু খাঁর হাতে বন্দি বীরেন্দ্রসিংহের মৃত্যুদণ্ডের পর সে তার সকল কথা ব্যক্ত করেছে যুবরাজ জগৎসিংহের কাছে যাতে তাকে কলঙ্কিনী হয়ে মৃত্যুবরণ না করতে হয়৷ তাই সে বলেছে—‘‘যখন লোকে বলিবে বিমলা কুলটা ছিল, দাসী বেশে গণিকা ছিল, তখন কহিবেন, বিমলানীচ-জাতি সম্ভবা, বিমলা মন্দভাগিনী, বিমলা দুঃশাসিত রসনা-দোষে শত অপরাধে অপরাধিনী; কিন্তু বিমলা গণিকা নহে৷’’৭ কি করুণ জীবন বিমলার৷ বিবাহিত স্বামীর সংসারে তাকে গণিকার মত থাকতে হয়েছে কিন্তু গণিকার ঘৃণ্য পরিচয় সে মরতে চায় না৷ বিমলার মধ্য দিয়ে সমাজে গণিকা নারীদের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়৷
পাঠান বীর কতলু খাঁর ভোগ-বিলাসের চিত্র বর্ণনায় উঠে এসেছে গণিকা জীবনের কথা৷ কতলু খাঁ দুর্বৃত্ত এবং ইন্দ্রিয়পরবশ৷ তার নিয়ম ছিল কোন দুর্গ বা গ্রাম জয় করলেই সেখানকার উৎকৃষ্ট সুন্দরী নারীদের সে তার নিজের ভোগতৃষ্ণা নিবারণ করার জন্য বাছাই করে নিত৷ সেই ভাবেই গড় মান্দারণ জয় করার পরদিনই বন্দিদের সম্মুখে গিয়ে তার বিধিব্যবস্থা করে এবং ‘‘বন্দীদিগের মধ্যে বিমলা ও তিলোত্তমাকে দেখিবামাত্র নিজ বিলাসগৃহ সাজাইবার জন্য তাহাদিগকে পাঠাইলেন৷’’৮
কতলু খাঁ তার জন্মদিনে বিলাসগৃহে বিলাসগৃহবাসিনীদের সঙ্গে নৃত্যগীত-কৌতুকে মত্ত৷ ‘খোজা’ ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই৷ রমণীদের কেউ নাচছে, কেউ গাইছে, কেউ বাদ্য বাজাচ্ছে কেউ বা তাকে বেষ্টন করে জীবনসুধা পান করছে৷ কতলু খাঁর বিলাস গৃহেরও সুন্দর বর্ণনা করেছেন লেখক৷ যথা—‘‘ইন্দ্রিয়মুগ্ধকর সামগ্রী সকলই তথায় প্রচুর পরিমানে বর্ত্তমান৷ কক্ষমধ্যে প্রবেশ কর; প্রবেশ করিবামাত্র অবিরত সিঞ্চিত গন্ধবারির স্নিগ্ধ ঘ্রাণে আপাদমস্তক শীতল হয়৷ অগণিত রজত দ্বিরদরদ স্ফটিক শামাদানের তীব্রোজ্জ্বল জ্বালায় নয়ন ঝলসিতেছিল; অপরিমিত পুষ্পরাশি, কোথাও মালাকারে, কোথাও স্তূপাকারে, কোথাও স্তবকাকারে, কোথাও রমণী-কেশপাশে, কোথাও রমণীকন্ঠে, স্নিগ্ধতর প্রভা প্রকাশিত করিতেছে৷ কাহার পুষ্পব্যজন, কাহার পুষ্প আভরণ কেহ বা অন্যের প্রতি পুষ্পক্ষেপণী প্রেরণ করিতেছে; পুষ্পের সৌরভ; সুরভি বারির সৌরভ; সুগন্ধ দীপের সৌরভ; গন্ধদ্রব্যমার্জ্জিত বিলাসিনীগণের অঙ্গের সৌরভ; পুরীমধ্যে সর্ব্বত্র সৌরভে ব্যাপ্ত৷ প্রদীপের দীপ্তি, পুষ্পের দীপ্তি, রমণীগণের রত্নালঙ্কারের দীপ্তি, সর্ব্বোপরি ঘন ঘন কটাক্ষ-বর্ষিণী কামিনীমণ্ডলীর উজ্জ্বল নয়নদীপ্তি৷ সপ্তসুরসম্মিলিত মধুর বীণাদি বাদ্যের ধ্বনি আকাশ ব্যাপিয়া উঠিতেছে, তদধিক পরিষ্কার মধুরনিনাদিনী রমণীকন্ঠগীতি তাহার সহিত মিশিয়া উঠিতেছে; সঙ্গে সঙ্গে তাললয়মিলিত পাদবিক্ষেপে নর্ত্তকীর অলঙ্কারশিঞ্জিত শধ মনোমুগ্ধ করিতেছে৷’’৯ নারীদেহ ভোগের কত না উপাচার৷ গন্ধে-বাদ্যে-পুষ্পে নারীদেহ মথিত করার সুস্পষ্ট বর্ণনা কতলু খাঁর বিলাস গৃহে বর্ণিত হয়েছে৷
জগতসিংহের পিতা মানসিংহ৷ বিমলা তার পত্রের মধ্য দিয়ে মানসিংহ সম্পর্কে যা জানিয়েছে৷ সেখানেও উল্লেখ করা হয়েছে মানসিংহের বহুনারী সম্ভোগের চিত্রকে৷ সে লিখেছে—‘‘আমি তোমার পিতৃভবনে অনেক দিন পৌরস্ত্রী হইয়া ছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে চেন না৷… কুসুমের মালার তুল্য মহারাজ মানসিংহের কন্ঠে অগণিতসংখ্যা রমণীরাজি গ্রথিত থাকিত;’’১০
নারীর জীবন ঠুনকো কাচের মতো৷ সেই জীবনের ভিত নির্ভর তার সতীত্বের উপর৷ সেই সতীত্ব যদি বলপূর্বকও কেউ অপহরণ করে সঙ্গে সঙ্গেই সে অসতী৷ শুধু তাই নয় নারী অন্য পুরুষের হাতে বন্দি হলেও সে সমাজের চোখে অসতী; সে ধর্ষিত হোক চাই না হোক৷ এমন দৃশ্যেরও অবতাড়না রয়েছে আলোচ্য উপন্যাসে৷ পাঠানদের কাছে পরাজিত হয়ে কতলু খাঁর হাতে বন্দি হয় বিমলা ও তিলোত্তমা৷ প্রশাসনিক ব্যস্ততার কারণে তাদের রূপে লালায়িত হলেও ভোগ করার সময় পেয়ে ওঠেনি৷ কিন্তু যেহেতু তিলোত্তমা, বিমলা বন্দিনী হয়েছে তাই তিলোত্তমার পিতা বীরেন্দ্র সিংহ ও প্রেমিক জগৎসিংহ তাদের কতলু খাঁর উপপত্নী ভেবে নিয়েছে৷ তাদের স্নেহ-ভালবাসা মুহূর্তেই তীব্র ঘৃণায় পর্যবসিত হয়েছে৷ বীরেন্দ্রসিংহ তার স্নেহের ধন তিলোত্তমার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে চায়নি৷ বিমলার পত্রকে বিরক্তির সঙ্গে দূরে ছুড়ে দিলে কেউ যখন বলেছিল যে সেটা বোধ হয় তার কন্যার পত্র তখন সে সুস্পষ্ট করে জনান্তিকে বলেছে—‘‘কে বলে আমার কন্যা? আমার কন্যা নাই৷’’১১ তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তার কন্যা কতলু খাঁর উপপত্নী হয়েছে৷ আবার জগৎসিংহও যে কিনা তিলোত্তমাকে পাওয়ার জন্য জীবন পণ করেছিল সেই আবার অন্য প্রতিজ্ঞা করে প্রেমিকা অপহৃতা হওয়ার পর—‘‘বিধর্ম্মীর উপপত্নীকে এ চিত্ত হইতে দূর করিব;’’১২ আর মনে মনে বার বার গুরুদেবকে স্মরণ করে বলেছে—‘‘দেখ গুরুদেব! তুমি অন্তর্যামী, অন্তস্থল পর্য্যন্ত দৃষ্টি করিয়া দেখ, আর আমি তিলোত্তমার প্রণয়াপ্রার্থী নহি, আর আমি তাহার দর্শনাভিলাষী নহি৷’’১৩ অর্থাৎ উক্ত উপন্যাসে অভিজাত সমাজের গণিকা-বিলাস, বহুপত্নীগ্রহণ, উপপত্নী প্রথা কোনো কিছুই বাদ পড়েনি৷ এই সমস্ত নারীরা সামাজিক ভাবে কতটা ঘৃণ্য ছিল তা বিমলার পত্র, বীরেন্দ্রসিংহের কন্যাকে অস্বীকার করা, জগৎসিংহের তিলোত্তমাকে পরিত্যাগ করার সংকল্প থেকেই বোঝা যায়৷
কপালকুণ্ডলা :
‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬) উপন্যাসের স্বৈরিণী চরিত্র লুৎফউন্নীসা৷ মতিবিবি নামটি সে ছদ্মবেশকালে গ্রহণ করত৷ তার আসল নাম পদ্মাবতী৷ নবকুমারের পূর্বপত্নী সে৷ প্রথমাবধিই সে স্বাধীন প্রবৃত্তির৷ স্বামীর প্রতি বিরূপ হয়ে বাল্য বয়সেই সে স্বামীকে পরিত্যাগ করেছিল৷ তার পিতা যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তখন পদ্মাবতীর নাম হয়ে যায় লুৎফউন্নীসা৷ পরে যখন তার পিতা উচ্চপদস্থ হয়ে আগ্রার প্রধান ওমরাহ হিসেবে গণ্য হয় তখন সে পদার্পণ করেছে যৌবনে৷ পারসিক, সংস্কৃত, নৃত্য, গীত ইত্যাদিতে পারদর্শী হয়ে রাজধানীর অসংখ্য রূপবতী গুণবতীদের মধ্যে অগ্রগণ্য হয়ে ওঠে৷ লেখক তার সম্পর্কে বলেছেন—‘‘দুর্ভাগ্যবশতঃ বিদ্যাসম্বন্ধে তাঁহার যাদৃশ শিক্ষা হইয়াছিল, ধর্মসম্বন্ধে তাঁহার কিছুই হয় নাই৷ লুৎফ-উন্নীসার বয়স পূর্ণ হইলে প্রকাশ পাইতে লাগিল যে, তাঁহার মনোবৃত্তি সকল দুর্দ্দমবেগবতী৷ ইন্দ্রিয়দমনে কিছুমাত্র ক্ষমতাও নাই৷ ইচ্ছাও নাই৷ সদসতে সমান প্রবৃত্তি৷’’১৪ স্বৈরিণী লুৎফ-উন্নীসার নিজেকে সংযত করার কোনোরকম ইচ্ছা বা প্রবৃত্তি ছিল না৷ যৌবনকালে দুর্দমনীয় মনোবৃত্তির জন্য যা যা দোষ জন্মায় লুৎফ-উন্নিসা সবগুলোর অধিকারিণী হয়েছিল৷ তার পূর্ব স্বামী বর্তমান থাকায় কোনো আমির ওমরাহরা তাকে বিবাহ করতেও স্বীকৃত হয়নি৷ যদিও তা নিয়ে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না কারণ—‘‘তিনিও বড় বিবাহের অনুরাগিণী হইলেন না৷ মনে মনে ভাবিলেন, কুসুমে কুসুমে বিহারিণী ভ্রমরীর পক্ষচ্ছেদ কেন করাইব?’’১৫ ভ্রমরীর মতো ফুলে ফুলে বিচরণ করে যুবরাজ সেলিম সহ বহুপুরুষের কন্ঠলগ্না হয়ে জীবনের মৌতাত রচনা করে গেছে৷ কিন্তু বর্ধমান যাওয়ার পথে আকস্মিকভাবে দেখা হয় নবকুমারের সঙ্গে৷ নবকুমার তখন কপালকুণ্ডলার সাথে সদ্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাড়ি (সপ্তগ্রামে) ফিরছিল৷ মতিবিবি বা লুৎফ-উন্নীসা ও কপালকুণ্ডলা উভয়ে দস্যুদ্বারা পীড়িত৷ বহুদিন পর স্বামী সন্দর্শনে (তাও আবার সুন্দরী স্ত্রী সমেত) বিহ্বল হয়ে পড়ে সে৷ অন্তঃকরণে পূর্ব প্রেমের জোয়ার এসে তাকে প্রতিস্পর্ধী করে তোলে৷ বহু অনুনয়-বিনয় করে নবকুমারকে অনুরোধ করে তার পায়ে তাকে স্থান দেওয়ার জন্য৷ নবকুমার তা প্রত্যাখ্যান করলে উপস্থিত হয় সপত্নী কপালকুণ্ডলার সমীপে৷ বিনা শর্তে কপালকুণ্ডলা তার প্রস্তাবে রাজী হয়৷ তারপরেও চুপ থাকেনি লুৎফ-উন্নীসা কাপালিকের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে মারার সংকল্প করেছে কিন্তু তার ভেতরকার নারীসত্তা হত্যাকে মেনে নিতে পারেনি তাই নিজেই কাপালিকের সেই চক্রান্তের কথা কপালকুণ্ডলাকে জানিয়ে দিয়েছে৷ এভাবে স্বেচ্ছাচারিতায়, কামনায়, ভালোবাসায় লুৎফ-উন্নীসা বা মতিবিবি চরিত্রটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে৷
বিষবৃক্ষ :
‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩) বঙ্কিমচন্দ্রের প্রকৃত পূর্ণাবয়ব সামাজিক উপন্যাস৷ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র হীরা৷ হীরা প্রচলিত অর্থে দেহব্যবসায়ী নয়; তার পরিচয় দিতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র তার চারিত্রিক শুদ্ধতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট মন্তব্য রেখেছিলেন৷ কিন্তু সেই চারিত্রিক শুদ্ধতাকে শেষপর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনি এই যুবতী৷ লম্পট দেবেন্দ্রর দ্বারা প্রলোভিত হয়ে তার মধ্যে ব্যভিচার দোষ প্রবেশ করেছে৷
বিশ বছরের যুবতী হীরা নগেন্দ্র সূর্যমুখীর গৃহের প্রধানা দাসী৷ জাতিতে কায়স্থ সে৷ বয়সে অন্য সব দাসীদের চেয়ে কনিষ্ঠা হলেও ‘‘তাহার বুদ্ধির প্রভাবে এবং চরিত্রগুণে সে দাসীমধ্যে শ্রেষ্ঠা বলিয়া গণিত হইয়াছিল৷’’১৬ জমিদার নগেন্দ্রনাথের পিতা তার মাতামহীকে অন্য গ্রাম থেকে গৃহপরিচর্যার জন্য নিয়ে এসেছিলেন৷ হীরা তখন বালিকা৷ পরে হীরা উপযুক্ত হয়ে মাতামহীকে ছুটি করিয়ে নিজে দাসীবৃত্তি গ্রহণ করে৷ তার দিদিমা বৃদ্ধা বয়সের সামান্য সঞ্চয় দিয়ে গোবিন্দপুরে গৃহনির্মাণ করে বসবাস করতে থাকে—যা কিনা হীরারও বাড়ি৷ সে বালবিধবা হিসেবে পরিচিত হলেও কেউ কখনো তার স্বামী প্রসঙ্গে কিছু শোনেনি৷ হীরা নিজেও অকলঙ্ক৷ তবে অত্যন্ত মুখরা সে৷ রূপচর্চা সম্পর্কেও তার বিশেষ একটা আগ্রহ ছিল৷ যে কারণে আতর, গোলাপ দেখলেই সে চুরি করতো৷ বিংশতি বৎসরের হীরার রূপ বর্ণনা দিয়েছেন লেখক এইভাবে—‘‘হীরা আবার সুন্দরী—উজ্জ্বল শ্যামাঙ্গী, পদ্মপলাশলোচনা৷ দেখিতে খবর্বাকৃতা; মুখখানি যেন মেঘঢাকা চাঁদ; চুলগুলি যেন সাপ ফণা ধরিয়া ঝুলিয়া রহিয়াছে৷’’১৭ তার স্বভাব সম্পর্কে লেখক বলেছেন—‘‘হীরা আড়ালে ব’সে গান করে; দাসীতে দাসীতে ঝগড়া বাধাইয়া তামাসা দেখে; পাচিকাকে অন্ধকারে ভয় দেখায়; ছেলেদের বিবাহের আবদার করিতে শিখাইয়া দেয়; কাহাকে নিদ্রিত দেখিলে চুণ কালি দিয়া সং সাজায়৷ কিন্তু হীরার অনেক দোষ৷’’১৮
হীরার মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার কোনো জায়গা ছিল না বরং এসব থেকে সে দূরেই থাকতো কিন্তু দত্ত বাড়িতে ভিক্ষায় আসা হরিদাসী বৈষ্ণবীর প্রকৃত পরিচয় উদ্ধার করতে গিয়ে হরিদাসী ছদ্মবেশী দেবেন্দ্রকে দেখে নিজেই প্রণয়ফাঁদে পতিত হয়৷ তার মনপ্রাণ সমর্পণ করে ফিরে আসে সে৷ হীরা দাসী হলেও নিজেকে কখনো হীন মনে করতে পারতো না৷ সূর্যমুখী মনিব বলে তার প্রতি ছিল জাত ক্রোধ৷ আর সেজন্য সূর্যমুখী তাকে ভালো বাসলেও সূর্যমুখীর ক্ষতি করতে উদ্যত হয় সে৷ সূর্যমুখীকে শত্রু হিসেবে প্রতিপন্ন করতে যে কারণগুলি দেখিয়েছে সে তা হল—‘‘সূর্য্যমুখী সুখী, আমি দুঃখী, এই জন্য আমার রাগ৷ সে বড়, আমি ছোট,—সে মুনিব, আমি বাঁদী৷ সুতরাং তার উপরে আমার বড় রাগ৷’’১৯ আবার দরিদ্র, অসহায়, ভাগ্যপীড়িত কুন্দনন্দিনীর প্রতি অপার মমতা অনুভব করতো হীরা৷ কিন্তু যেদিন দেখল তার প্রেমাস্পদ নগেন্দ্রনাথ সেই বিধবা কুন্দনন্দিনীতেই অনুরক্ত এবং তাকে দূতী করেই সে প্রণয়িনী লাভ করতে চায় তখন সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে কুন্দর উপর৷ তার অপ্সরাতুল্য রূপের খুঁত বের করে নিজের সম্পর্কে বলে—‘‘আমরা গতর খাটিয়ে খাই; আমরা যদি ভাল খাই, ভাল পরি, পটের বিবির মত ঘরে তোলা থাকি, তা হলে আমরাও অমন হতে পারি৷ আর এটা মিনমিনে ঘ্যানঘেনে, প্যানপেনে, সে দেবেন্দ্রবাবুর মর্ম্ম বুঝিবে কি?’’২০ আর এইভাবে দুই নারীর ক্ষতিসাধন করতে গিয়ে নগেন্দ্র-সূর্যমুখীর সুখের সংসার ভেঙ্গে তছনছ করে দেয়৷
জীবনের জ্বালা থেকে সে একদিকে যেমন উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রগুলির মধ্যে সমস্যা ডেকে আনে তেমনি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গেও তার সম্পর্ক জটিলতর হয়ে উঠে৷ দেবেন্দ্র বুঝেছিল হীরার মানস অভিলাষ৷ বুঝে ছিল কোন মন্ত্র প্রয়োগ করলে প্রণয়মুগ্ধা হীরা তার পদতলে পতিত হবে, তাকে মুঠোর মধ্যে পুরে পুতুলের মতো নাচানো যাবে৷ কিন্তু তারপরেও সে হয়তো পুরোপুরি হীরার আক্রোশকে জানতে পারেনি তাই কুন্দনন্দিনীর সাক্ষাৎ করতে গিয়ে হীরার প্ররোচনায় দ্বারোয়ান দ্বারা প্রহৃত হয়ে পলায়ন করে; ক্রোধে অন্ধ হয়ে হীরার ক্ষতি করার সংকল্প নেয়৷ যে প্রেম হীরার সবচেয়ে দুর্বলতম স্থান সেই প্রেমের গান গেয়ে তাকে বশীভূত করে ধর্ষণ করে৷ তারপর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতেই ধর্মভ্রষ্ট হীরা প্রত্যাখ্যাতা ও পদাঘাত পুরস্কার পেয়ে তার গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়৷ হীরা চুপ করে থাকে না৷ যে সতীত্ব হারিয়ে সে আত্মহত্যার সংকল্প নিতে বাধ্য হয়েছিল ক্রমে সেই মৃত্যু চিন্তাই কুন্দ ও দেবেন্দ্রকে বিষ প্রয়োগে হত্যার সংকল্পে ঠেলে দেয়৷ তার মানসিক রূপান্তরকে, ভেতরে অদম্য জ্বালাকে লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন৷ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন—‘‘অপমানিত হীরা পদাহতা সর্পিণীর ন্যায়ই ফণা ধরিয়া উঠিল; তাহার আত্মহত্যার ইচ্ছা দেবেন্দ্র বা কুন্দকে বিষ প্রয়োগের দ্বারা হত্যার সংকল্পে পরিণত হইল৷ একদিকে প্রবল নৈরাশ্যের আঘাত তাহাকে উন্মাদগ্রস্ত করিয়া তুলিল; অপর দিকে প্রকৃত শয়তানোচিত দুষ্টবুদ্ধি তাহাকে কুন্দের চরম দুঃখের মুহূর্তে তাহাকে আত্মহত্যার মন্ত্রণা দিতে, তাহার হাতের নিকট আত্মহত্যার অস্ত্র প্রস্তুত রাখিতে প্রণোদিত করিল৷ হীরার হৃদয়-মন্থনজাত, ঈর্ষা-ফেনিল বিদ্বেষ-হলাহলই সে কুন্দের মুখের নিকট আনিয়া ধরিল, এবং কুন্দ সেই বিষপান করিয়াই মরিল৷’’২১ শেষ পর্যন্ত ভ্রষ্টা হওয়ার যন্ত্রণা, প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা হীরাকে উন্মাদ করে দেয়৷ মৃত্যু পথযাত্রী দেবেন্দ্রর সামনে তার উন্মত্ত অট্টহাসি—মিলন মুহূর্তের সেই গান
‘‘স্মরগরলখণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং
দেহি পদপল্লবমুদারং’’২২
বিভৎসরূপে তার নগ্নপাপরূপকে সামনে নিয়ে আসে৷ উপন্যাসে হীরা কোথাও বেশ্যাবৃত্তি করেনি, দেবেন্দ্র ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের অঙ্কশায়িনীও হয়নি৷ তার পরেও অনেক সমালোচক তাকে গণিকার তুল্য করে দেখিয়েছেন৷ আসলে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন পাপের প্রতি সর্বোতভাবে বিতৃষ্ণ৷ আর হীরার পাপ হল সে কুমারীই হোক—বিধবাই হোক আর সধবা—দেবেন্দ্রর প্রতি তার প্রেম জাগ্রত হওয়া মানেই অবৈধ এক প্রণয়ের দিকে যাওয়া৷ শেষ পর্যন্ত তার প্রেম মানসিক স্তরে বদ্ধ হয়ে থাকেনি—শরীরীভাবে যৌনাচারে পর্যবসিত হয়েছে৷ দেবেন্দ্রর কাছে নিজেকে বিকানোর মূলেই ছিল দেবেন্দ্রর প্রতি তার লুব্ধ প্রণয় পিপাসা৷ আর এ জন্যই তার কপট প্রণয়ে নিজের এতকালের রক্ষিত নারীত্বকে বিলিয়ে দিয়ে সে ব্যভিচার দোষে দুষ্ট হয়েছে৷
কৃষ্ণকান্তের উইল :
বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম উল্লেখযোগ্য উপন্যাস কৃষ্ণকান্তের উইল৷ রচনাকাল ১৮৭৮৷ রোহিণী, গোবিন্দলাল, ভ্রমর; কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুতে এই তিনটি প্রধান চরিত্র৷ এই উপন্যাসে স্বৈরিণী চরিত্র হিসেবে অবস্থান করছে রোহিণী৷ বালবিধবা রোহিণী সম্পর্কে লেখক বর্ণনা করেছেন—‘‘রোহিণীর যৌবন পরিপূর্ণ—রূপ উছলিয়া পড়িতেছিল—শরতের চন্দ্র ষোল কলায় পরিপূর্ণ৷ সে অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছিল, কিন্তু বৈধব্যের অনুপযোগী অনেকগুলি দোষ তাহার ছিল৷ দোষ, সে কালা পেড়ে ধুতি পড়িত, হাতে চুড়ি পড়িত, পানও খাইত৷ এদিকে রন্ধনে সে দৌপদীবিশেষ বলিলে হয়; ঝোল, অম্ল, চড়চড়ি, সড়সড়ি, ঘন্ট, দালনা ইত্যাদিতে সিদ্ধহস্ত; আবার আলেপনা, খয়েরের গহনা, ফুলের খেলনা, সূচের কাজে তুলনারহিত৷ চুল বাঁধিতে, কন্যা সাজাইতে, পাড়ার একমাত্র অবলম্বন৷’’২৩
স্বৈরিণী রোহিণী তার রূপ সম্পর্কে সচেতন, গুণ সম্পর্কেও কিন্তু ভাগ্যের বঞ্চনায় বিশুষ্ক সে৷ তাই ঘাটে বসে এই ভেবে সে ক্রন্দন করতে থাকে যে—‘‘কি অপরাধে এ বালবৈধব্য আমার অদৃষ্টে ঘটিল? আমি অন্যের অপেক্ষা এমন কি গুরুতর অপরাধ করিয়াছি যে, আমি এ পৃথিবীর কোনো সুখভোগ করিতে পাইলাম না৷ কোন দোষে আমাকে এ রূপ যৌবন থাকিতে কেবল শুষ্ক কাষ্ঠের মত ইহজীবন কাটাইতে হইল? যাহারা এ জীবনের সকল সুখে সুখী—মনে কর, ঐ গোবিন্দলাল বাবুর স্ত্রী—তাহারা আমার অপেক্ষা কোন গুণে গুণবতী—কোন পুণ্যফলে তাহাদের কপালে এ সুখ—আমার কপালে শূন্য?’’২৪ রোহিণী তাপিত; রোহিণী এক পরিপূর্ণ জীবনের প্রতি লালায়িত৷ ভাগ্যের বঞ্চনায় তার বিক্ষুব্ধচিত্ত ঈষৎ প্রগলভ আচরণে, বৈধব্যের নীতি-নিয়মের কাছে আত্মসমর্পণের অনিচ্ছায় কিছুটা প্রকাশিত৷ তার যন্ত্রণার সিংহভাগই তার অন্তরের অন্তস্থলে জমা৷ তার জীবনযন্ত্রণা দেখে লেখক তার চরিত্রের প্রতি প্রথমে সহানুভূতিশীল হতে বলেও শেষ পর্যন্ত নিজেই বিরূপ হয়েছেন৷
রোহিণীর জীবনের তিনটি পর্যায়ে তিনজন পুরুষ তার মনের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে৷ প্রথমে হরলাল৷ কৃষ্ণকান্ত রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র৷ রোহিণীর প্রতি তার বিধবা বিবাহের ইঙ্গিত নিমেষেই রোহিণীর মনের ভেতরকার বারুদস্তূপে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ হরলালের অসৎ উদ্দেশ্য সে ভালো করেই জানে৷ তাকে বিশ্বাসও করে না৷ কিন্তু তার মনে যে সীমাহীন তৃষ্ণা৷ যে কোনো পানীয় দিয়েই সেই তৃষ্ণা সে নিবারণ করতে চায়৷ ভোগ ও বাসনায় পূর্ণ পৃথিবীর অধিকার পেতে যে কোনো মূল্য দিতে সে প্রস্তুত, কোনোরকম দুঃসাহসী কর্মতৎপরতায় তার ভয় নেই৷ তাই কৃষ্ণকান্তের সিন্দুক হতে উইল চুরি করতে সম্মত হতেও তার বাধে না৷ হরলালকে উদ্দেশ্য করে বলে—‘‘কাগজখানা না হয় রাখিয়া যান, দেখি, কি করিতে পারি৷’’২৫ রোহিণীর অবরুদ্ধ কামনাকে হুতাসনে প্রজ্জ্বলিত করে হরলাল৷ দ্বিতীয় পুরুষ গোবিন্দলালের মধ্য দিয়ে সেই অগ্নিশিখা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে তার শতসহস্র লেলিহান শিখাকে বিস্তৃত করে দেয়৷ গোবিন্দলালের মোহ তার দুর্বার বাসনাকে প্রেমে রূপান্তরিত করে৷ তার ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের কথা ভেবে বারুণীর পুকুরঘাটে বসে সে যখন ক্রন্দনরত গোবিন্দলাল যায় তার দুঃখের কারণ জানতে—‘‘যে রোহিণী হরলালের সম্মুখে মুখরার ন্যায় কথোপকথন করিয়াছিল—গোবিন্দলালের সম্মুখে সে রোহিণী একটি কথাও কহিতে পারিল না৷ কিছু বলিল না—গঠিত পুত্তলীর মত সেই সরোবরসোপানের শোভা বর্দ্ধিত করিতে লাগিল৷’’২৬ রোহিণীর অন্তকরণ গোবিন্দলালের প্রতি কামনায়-ভালোবাসায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷ সেই থেকে প্রত্যহ বারুণী পুকুরে সে জল আনতে যায়, প্রতিদিনই কোকিলের কুহুরব ও পুষ্পকাননের মধ্যে গোবিন্দলালের দর্শনে তার প্রেমাকাঙ্খা নব নব পল্লবে পল্লবিত হয়ে ওঠে৷ রোহিণী চরিত্রবান গোবিন্দলালকে জানে৷ সে যদি ঘুণাক্ষরেও তার প্রণায়াসক্ত মনের কথা জানতে পারে তবে তার ছায়া তো মাড়াবেই না উল্টো তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেবে৷ তাই অতি যত্নে সে তার মনের কথা মনের মধ্যেই লুকিয়ে রাখে৷ এ সম্পর্কে রোহিণীর অবস্থা বর্ণনা করে লেখক জানিয়েছেন—‘‘যেমন লুক্কায়িত অগ্নি ভিতর হইতে দগ্ধ করিয়া আইসে, রোহিণীর চিত্তে তাহাই হইতে লাগিল৷ জীবনভার বহন করা, রোহিণীর পক্ষে কষ্টদায়ক হইল৷ রোহিণী মনে মনে রাত্রিদিন মৃত্যুকামনা করিতে লাগিল৷’’২৭ সে তার ভেতরের অবস্থা না পারে কেউকে বলতে না পারে চাপিয়ে রাখতে৷ মৃত্যু ছাড়া তার গতি নাই৷ ঈশ্বর তাকে দুর্ভাগ্য দিয়েছেন, ঈশ্বরই তার অবসান করুক৷ সে মৃত্যুকামনা করলেও মৃত্যুর কোনো পথ অবলম্বন করতে পারে না৷ এ দিকে কৃষ্ণকান্তের সিন্দুকে জাল উইল পড়ে আছে৷ আসল উইল তার হাতে৷ জায়গা মত আসল উইল রেখে আসতে হবে৷ নইলে গোবিন্দলালের সর্বনাশ হবে৷ পুনরায় উইল বদলাতে গিয়ে ধরা পরে সে৷ কিন্তু কাজ হাসিল করতে পেরেছে৷ কৃষ্ণকান্তের করায়ত্ত হওয়ার আগেই আসল উইল সস্থানে রেখে জাল উইল পুড়িয়ে ফেলে রোহিণী৷ বিচারে শত ভয় দেখালেও সত্যকার ঘটনা সে উন্মোচিত করে না৷ কৃষ্ণকান্ত মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গ্রাম থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত জানালেও না৷ গোবিন্দলালের হস্তক্ষেপে সে মুক্ত হয়৷ কলঙ্কের মধ্যদিয়ে গোবিন্দলালকে তার মনের কথা জানাতে সক্ষম হয়৷ যদিও তা সরাসরি নয়৷ গোবিন্দলালের উইল চুরি সংক্রান্ত জেরায় রোহিণীর মনের কথা উঠে এসেছে এই ভাবে—
‘‘রোহিণী বলিল, ‘‘কি জানিতে চাহেন, জিজ্ঞাসা করুন৷’’
গো৷ তুমি যাহা পোড়াইয়াছ, তাহা কি?
রো৷ জাল উইল৷
গো৷ কোথায় পাইয়াছিলে?
রো৷ কর্ত্তার ঘরে, দেরাজে৷
গো৷ জাল উইল সেখানে কি প্রকারে আসিল?
রো৷ আমিই রাখিয়া গিয়াছিলাম৷ যে দিন আসল উইল লেখাপড়া হয়, সেই দিন রাত্রে আসিয়া, আসল উইল চুরি করিয়া, জাল উইল রাখিয়া গিয়াছিলাম৷
গো৷ কেন তোমার কি প্রয়োজন?
রো৷ হরলাল বাবুর অনুরোধে৷
গোবিন্দলাল বলিলেন, ‘‘তবে কাল রাত্রে আবার কি করিতে আসিয়াছিলে?’’
রো৷ আসল উইল রাখিয়া, জাল উইল চুরি করিবার জন্য৷
গো৷ কেন? জাল উইলে কি ছিল?
রো৷ বড় বাবুর বার আনা—আপনার এক পাই৷
গো৷ কেন আবার উইল বদলাইতে আসিয়াছিলে, আমি ত কোনো অনুরোধ করি নাই৷
রোহিণী কাঁদিতে লাগিল৷ বহু কষ্টে রোদন সংবরণ করিয়া বলিল, ‘‘না—অনুরোধ করেন নাই—কিন্তু যাহা আমি ইহজন্মে কখনও পাই নাই-যাহা ইহজন্মে আর কখনও পাইব না—আপনি আমাকে তাহা দিয়াছিলেন৷’’
গো৷ কি সে রোহিণি?
রো৷ সেই বারুণী পুকুরের তীরে, মনে করুন৷
গো৷ কি রোহিণি?
রো৷ কি? ইহজন্মে বলিতে পারিব না—কি৷ আর কিছু বলিবেন না৷ এ রোগের চিকিৎসা নাই—আমার মুক্তি নাই৷ আমি বিষ পাইলে খাইতাম৷ কিন্তু সে আপনার বাড়ীতে নহে৷ আপনি আমার অন্য উপকার করিতে পারেন না—কিন্তু এক উপকার করিতে পারেন,—একবার ছাড়িয়া দিন, কাঁদিয়া আসি৷ তার পর যদি আমি বাঁচিয়া থাকি, তবে না হয়, আমার মাথা মুড়াইয়া ঘোল ঢালিয়া দেশছাড়া করিয়া দিবেন৷
গোবিন্দলাল বুঝিলেন৷ দর্পণস্থ প্রতিবিম্বের ন্যায় রোহিণীর হৃদয় দেখিতে পাইলেন৷ বুঝিলেন, যে মন্ত্রে ভ্রমর মুগ্ধ, এ ভুজঙ্গীও সেই মন্ত্রে মুগ্ধ হইয়াছে৷ তাঁহার আহ্লাদ হইল না—রাগও হইল না—সমুদ্রবৎ সে হৃদয়, তাহা উদ্বেলিত করিয়া দয়ার উচ্ছ্বাস উঠিল৷ বলিলেন, ‘‘রোহিণি মৃত্যুই বোধ হয় তোমার ভাল, কিন্তু মরণে কাজ নাই৷ সকলেই কাজ করিতে এ সংসারে আসিয়াছি৷ আপনার আপনার কাজ না করিয়া মরিব কেন?’’
গোবিন্দলাল ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন৷ রোহিণী বলিল, ‘‘বলুন না?’’
গো৷ তোমাকে এ দেশ ত্যাগ করিয়া যাইতে হইবে৷
রো৷ কেন?
গো৷ তুমি আপনিই তো বলিয়াছিলে, তুমি এ দেশ ত্যাগ করিতে চাও৷
রো৷ আমি বলিতেছিলাম লজ্জায়, আপনি বলেন কেন?
গো৷ তোমায় আমায় আর দেখা শুনা না হয়৷
রোহিণী দেখিল, গোবিন্দলাল সব বুঝিয়াছেন৷ মনে মনে বড় অপ্রতিভ হইল—বড় সুখী হইল৷ তাহার সমস্ত যন্ত্রণা ভুলিয়া গেল৷ আবার তাহার বাঁচিতে সাধ হইল৷ আবার তাহার দেশে থাকিতে বাসনা জন্মিল৷ মনুষ্য বড়ই পরাধীন৷’’২৮ তার মনের কথা অবশেষে গোবিন্দলালকে বোঝাতে পেরে রোহিণী হাল্কা হয়েছে৷ নতুন করে বাঁচার প্রেরণা লাভ করেছে৷ প্রেমাস্পদকে নয়নের আড়াল করতে পারবে না জন্য সে গোবিন্দলালকে কথা দিয়েও গ্রাম ত্যাগ করতে পারেনি৷ অন্যদিকে গোবিন্দলালের কাছে তার স্ত্রী ভ্রমর রোহিণীকে ভালোবাসার, রোহিণীর ভালোবাসার কথা শুনে তার কাছে ক্ষীরি চাকরানিকে দিয়ে বারুণীর পুকুরে ভুবে মরার আদেশ পাঠিয়েছে এবং রোহিণী সেই সিধান্তই নিয়েছে৷ অপূর্ব রূপবতী রোহিণী জলে ডুবে কাচতুল্য স্বচ্ছ জলের তলে ‘স্বচ্ছস্ফটিক মণ্ডিত হৈম প্রতিমার ন্যায়’২৯ অন্ধকার জলতল আলো করে শুয়ে থাকলে গোবিন্দলাল তাকে উদ্ধার করে ‘ফুল্লরক্তকুসুমকান্তি অধরযুগলে ফুল্লরক্তকুসুমকান্তি অধরযুগল স্থাপিত করিয়া’৩০ রোহিণীর মুখে ফুৎকার দিয়ে বাঁচিয়ে তোলে৷ কিন্তু রোহিণী তিলে তিলে জ্বলে পুড়ে মৃত্যুর চেয়ে একবারে মরা শ্রেয়ষ্কর মনে করে প্রেমাস্পদকে জানায়—‘‘রাত্রিদিন দারুণ তৃষ্ণা, হৃদয় পুরিতেছে—সম্মুখেই শীতল জল, কিন্তু ইহজন্মে সে জল স্পর্শ করিতে পারিব না৷ আশাও নাই৷’’৩১ শেষপর্যন্ত ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে রোহিণী গোবিন্দলালকে লাভ করেছে৷ কিন্তু সে লাভের মধ্যে সম্মান নেই, ভালোবাসা নেই; আছে শুধু দুর্বার প্রবৃত্তির খেলা৷ স্বৈরিণী রোহিণী তার অপরিতৃপ্ত কামনা চরিতার্থ করতে গিয়ে গোবিন্দলালের সঙ্গে রক্ষিতার মতো জীবন কাটিয়েছে৷ গোবিন্দলাল তাকে বিয়ে করেনি, কোনো সামাজিক স্বীকৃতিও দেয়নি শুধুমাত্র রূপমুগ্ধতার জোয়ারে ভেসে গিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে তাকে নিয়ে ভোগের মন্দির সাজিয়েছে৷ রোহিণীর স্বৈরিণী নারীসত্তা তাকে পেয়েও তৃপ্ত হয়নি, গোবিন্দলালকে সম্পূর্ণরূপে পেয়েও তার মধ্যে সর্বদা ক্রিয়া করেছে না পাওয়ার যন্ত্রণা, এক অসুরক্ষিত ভবিষ্যৎ৷ আর এই চোরাপথেই রোহিণীর জীবনে তৃতীয় পুরুষ হিসেবে জায়গা নিয়েছে নিশাকর দাস৷ গোবিন্দলালের স্ত্রী ভ্রমরের পিতা মাধবীনাথ সরকারের আত্মীয় নিশাকর দাস৷ মাধবীনাথ তার সঙ্গে যুক্তি করে রোহিণীকে ফাঁদে ফেলতে যত্নবান হয় যাতে গোবিন্দলাল ও ভ্রমর তাদের সুখী দাম্পত্য জীবন পুনরায় শুরু করতে পারে, ভ্রমরের দুর্দশার অবসান হয়৷ নিশাকর দাসের সঙ্গে জানালার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি বিনিময় হলে রোহিণী ভাবে—‘‘এ কে? দেখিয়াই বোধ হইতেছে যে, এ দেশের লোক নয়৷ বেশভূষা রকম সকম দেখিয়া বোঝা যাইতেছে যে, বড় মানুষ বটে৷ দেখিতেও সুপুরুষ—গোবিন্দলালের চেয়ে? না তা নয়৷ গোবিন্দলালের রঙ ফরশা—কিন্তু এর মুখ চোখ ভাল৷ বিশেষ চোখ—আ মরি৷ কি চোখ! এ কোথা থেকে এলো?’’৩২ নিশাকর দাসকে দেখে রোহিণীর এ মনোভাব তার বহুপুরুষ লালসার দ্যোতক৷ পরে নিশাকর দাস রাসবিহারী দে ছদ্মনামে গোবিন্দলালের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে ভ্রমরের বিষয়ের ভাবী পত্তনিদার হয়ে, সেখানে গোবিন্দলালের সম্মতি আবশ্যক বলে সে মনে করে৷ এবং সেই অনুমতির জন্যই সে সেখানে এসেছে৷ রোহিণী আড়াল থেকে সব শোনে এবং নিশাকর দাস ওরফে রাসবিহারী দে’কে পর্যবেক্ষণ করে তার অতৃপ্ত হৃদয় তার সঙ্গে মিলনের জন্য ব্যাকুল হয়ে যায়৷ রূপো নামক চাকরকে পাঁচটাকা বকশিশের লোভ দেখিয়ে গোবিন্দলালের অজ্ঞাতে সাক্ষাতের বার্তা দিয়ে নিশাকর দাসের কাছে পাঠায়৷ চাকরকে বলে—‘‘তুই গিয়ে তাকে বসা৷ এমন জায়গায় বসা, যেন বাবু নীচে গেলে না দেখতে পান৷ আর কেহ না দেখিতে পায়৷ আমি একটু নিরিবিলি পেলেই যাব৷ যদি বসতে না চায়, তবে কাকুতি মিনতি করিস৷’’৩৩ রোহিণীর চরিত্র বোঝাতে, তার ভেতরকার কামনা-বাসনাময় প্রবৃত্তির অন্ধকার দিকটিকে তুলে ধরতে লেখক তার সম্পর্কে আরও বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন—‘‘রোহিণী যে ব্রহ্মানন্দকে এত ভালবাসিত যে, তাহার সংবাদ লইবার জন্য দিগ্বিদিগজ্ঞানশূন্য হইবে, এমন খবর আমরা রাখিনা৷ বুঝি আরও কিছু ছিল৷ একটু তাকাতাকি, আঁচাআঁচি হইয়াছিল৷ রোহিণী দেখিয়াছিল যে, নিশাকর রূপবান—পটোলচেরা চোখ৷ রোহিণী দেখিয়াছিল যে, মনুষ্যমধ্যে নিশাকর একজন মনুষ্যত্বে প্রধান৷ রোহিণীর মনে মনে সঙ্কল্প ছিল যে, আমি গোবিন্দলালের কাছে বিশ্বাসহন্ত্রী হইব না৷ কিন্তু বিশ্বাসহানি এক কথা—আর এ আর এক কথা৷ বুঝি সেই মহাপাপিষ্ঠা মনে করিয়াছিল, ‘‘অনবধান মৃগ পাইলে কোন ব্যাধ ব্যাধব্যবসায়ী হইয়া তাহাকে না শরবিদ্ধ করিবে?’’ ভাবিয়াছিল নারী হইয়া জেয় পুরুষ দেখিলে কোন নারী না তাহাকে জয় করিতে কামনা করিবে?’’৩৪ লেখক বালবিধবা যৌবনমদে মদমত্তা রোহিণীর প্রতি যে বক্তব্য পেশ করেছেন তাতে তার গণিকাসুলভ মানসিকতাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ রোহিণী রূপোর মধ্য দিয়ে সংবাদ নিয়ে সবদিক সচকিত দৃষ্টি রেখে সংকেত স্থানে কিছু বিলম্বে পৌঁছলে এবং তা নিয়ে নিশাকর ছদ্ম অভিমান দেখালে তার প্রতি রোহিণী যে বক্তব্য পেশ করে তাতেও তার বহুপুরুষগামী মনোভাবটি সুস্পষ্ট হয়৷ যেমন—‘‘আমি যদি ভুলিবার লোক হইতাম, তা হলে, আমার দশা এমন হইবে কেন? একজনকে ভুলিতে না পারিয়া এদেশে আসিয়াছি; আর আজ তোমাকে না ভুলিতে পারিয়া এখানে আসিয়াছি৷’’৩৫ তাদের সংকেত স্থানে গোবিন্দলাল এসে আক্রমন করে রোহিণীকে৷ পিস্তল তাক করে সে বলে একদিন যে তার জন্য মরতে চেয়েছিল আজ সে মরতে রাজী আছে কিনা৷ কিন্তু রোহিণী মরতে চাইবে কেন৷ নিশাকর দাসকে দেখে সে আবার নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পেয়েছে৷ যে দুঃখে একদিন বারুণীর জলে ডুব দিয়েছিল সেই দুঃখ আজ তার নেই৷ জীবনের সুখের সময়গুলিকে মনে করে হলেও সে বাঁচতে চায়৷ তাই গোবিন্দলালের পিস্তলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সে কেঁদে ওঠে—‘‘মারিও না! মারিও না! আমার নবীন বয়স, নূতন সুখ৷ আমি আর তোমায় দেখা দিব না, আর তোমার পথে আসিব না৷ এখনই যাইতেছি৷ আমায় মারিও না৷’’৩৬
কিন্তু মৃত্যু যে তার ভবিতব্য৷ ভোগে-বিলাসে-কামনা-বাসনায় পরিপূর্ণ স্বৈরিণী রোহিণী জীবনের পরিপূর্ণ স্বাদ পাওয়ার আগেই সমাজ থেকে নিশ্চহ্ন হয়ে যায়৷ সমাজ এই বঞ্চিত বালবিধবাদের মনের যন্ত্রণা বোঝার কোনো চেষ্টা করে না উল্টো নানা বিধি নিষেধ চাপিয়ে তাকে অবদমিত করে রাখার চেষ্টায় সর্বদা রত থাকে৷ রোহিণীর মত নারীকে তাই স্বেচ্ছাচারিণী হতে হয়৷ স্বেচ্ছাচারিণীদের বাস তো সমাজ মেনে নেবে না বা নেয় না তাই তাদের রোহিণীর মতো গুলিবিদ্ধ করে জীবন ও যন্ত্রণার অবসান ঘটানো হয়৷
রাজসিংহ :
বঙ্কিম উপন্যাসে অভিজাত গৃহের পদস্থ নন্দিনীদের বহুপুরুষের প্রতি আসক্তি একটা বহুচর্চিত বিষয়৷ তাঁর অন্যতম ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২)-তে রৌশনারা, জাহানারা, জেব-উন্নীসা, উদিপুরী বেগম প্রমুখরা স্বেচ্ছাচারিতায় নিজেদের ডুবিয়ে রাখে৷ জাহানারা ও রৌশনারা ঔরঙ্গজেবের দুই বোন৷ জাহানারা শাহজাঁদার বাদশাহীর প্রধান সহায় ছিল৷ তার পরামর্শ ব্যতীত কোনো রাজকার্য সম্পন্ন হত না৷ সে পিতার বিশেষ হিতৈষিণী ছিল৷ কিন্তু সে যে পরিমানে রাজনীতি বিশারদ তার থেকে বেশি ইন্দ্রিয়পরবশ৷ ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির জন্য অসংখ্য লোক তার অনুগৃহীত পাত্র ছিল৷ অন্যদিকে রৌশনারা পিতৃবিদ্বেষিণী এবং ঔরঙ্গজেবের পক্ষপাতি৷ সেও রাজনীতিতে সুদক্ষ এবং জাহানারার মত বিচারশূন্য, তৃপ্তিশূন্য এবং বাধাশূন্য ইন্দ্রিয়পরায়ণ ছিল৷ ঔরঙ্গজেবকে সহায়তা করে পিতাকে পর্যন্ত পদচ্যুত ও অবরুদ্ধ করে রাজ্য অপহরণ করেছিল সে৷ ঔরঙ্গজেবের বাদশাহীতে রৌশনারা দ্বিতীয় বাদশাহ৷
জেব-উন্নীসা ঔরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠা কন্যা৷ অবিবাহিত থেকে ইন্দ্রিয় পরায়ণতায় এবং প্রশাসনিক কাজে সে রৌশানারার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয় এবং ক্রমে তার প্রচেষ্টা ও পরামর্শে রৌশনারা পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়৷ তার সম্পর্কে লেখক বলেছেন—‘‘পিতৃস্বসাদিগের ন্যায় বসন্তের ভ্রমরের মত পুষ্পে পুষ্পে মধুপান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন৷’’৩০ এই জেব-উন্নীসা কালে কালে রঙমহলের (বাদশাহের অন্তঃপুর) সর্বকর্ত্রী হয়৷ বাদশাহের অন্তঃপুরে খোজা ভিন্ন অন্য কোনো পুরুষ প্রবেশ করতে পারতো না কিন্তু জেব-উন্নীসা যাকে ইচ্ছা তাকে মহালের মধ্যে আসতে দিত৷ তার প্রণয়ভাজনেরা নির্বিবাদে তার কক্ষে প্রবেশ করতে পারতো৷ এই স্বেচ্ছাচারিণী স্বৈরিণী নারীদের বিলাসগৃহ একেকটা জীবন্ত পাপাগার৷ রাজপ্রাসাদমালার প্রাণকেন্দ্র যে রঙমহল তাও আসলে কুবের ও মদনের যৌথ রাজত্ব৷ চন্দ্র, সূর্য্য সেখানে প্রবেশ করতে পারে না, বায়ুর গতিও রুদ্ধ৷ যমরাজ তার কার্য করেন অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে৷—‘‘তথায় গৃহসকল বিচিত্র; গৃহসজ্জা বিচিত্র; অন্তঃপুরবাসিনী সকল বিচিত্র৷ এমন রত্নখচিত, ধবলপ্রস্তরনির্ম্মিত কক্ষরাজি কোথাও নাই; এমন নন্দনকানননন্দিনী উদ্যানমালা আর কোথাও নাই—এমন উর্ব্বশী মেনকা রম্ভার গর্ব্বখর্ব্বকারিণী সুন্দরীর সারি আর কোথাও নাই, এত ভোগবিলাস জগতে আর কোথাও নাই৷ এত মহাপাপ আর কোথাও নাই৷’’৩৮ পৃথিবীর সমস্ত ভোগ, সমস্ত কামনা, সমস্ত বিলাসিতার উপকরণ এই স্বৈরিণীদের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল৷ নিজেদের সুকুমার নারীত্বকে লালসার বহ্নিতে নিজেই দগ্ধ করে মেরেছিল৷
‘রাজসিংহ’ উপান্যাসের আরেকজন স্বেচ্ছাচারিণী হল উদিপুরী বেগম৷ তার নাম উদিপুরী হলেও উদয়পুরের সঙ্গে কোনো যোগ নেই৷ সে আসলে পাশ্চাত্যদেশের জর্জিয়া যা রুশিয়া রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত সেখানকার মানুষ৷ বাল্যকালে একজন দাস ব্যবসায়ী তাকে ভারতবর্ষে নিয়ে আসে বিক্রয় করার জন্য৷ ঔরঙ্গজেবের অগ্রজ দারা তাকে কিনে নেয়৷ বয়ঃকালে সেই বালিকা অসামান্য রূপবতী হলে দারা তার বশীভূত হয়ে পড়ে তার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হয়৷ উদিপুরী মুসলমান ছিল না, ছিল খ্রিস্টান৷ দারাকে যুদ্ধে পরাজিত করে ঔরঙ্গজেব শুধু সিংহাসনই লাভ করে না সঙ্গে সঙ্গে উদিপুরীকেও বেগম হিসেবে গ্রহণ করে৷ দারা অপর আরেক স্ত্রী ঔরঙ্গজেবের অঙ্কশায়িনী না হতে বিষ পান করে জীবন রাখে৷ উদিপুরী সানন্দে দেবরকে বরমাল্য প্রদান করে৷ এ প্রসঙ্গে লেখকের আক্ষেপ—‘‘খ্রিষ্টিয়ানীটা সানন্দে ঔরঙ্গজেবের কন্ঠলগ্না হইল৷ ইতিহাস এই গণিকার নাম কীর্ত্তিত করিয়া জন্ম সার্থক করিয়াছেন, আর যে ধর্ম্মরক্ষার জন্য বিষ পান করিল, তাহার নাম লিখিতে ঘৃণা বোধ করিয়াছেন৷ ইতিহাসের মূল্য এই৷’’৩৯ কথক উদিপুরীর মত নারীদের যারা সরাসরি দেহের দর হাকেনি কিন্তু দেহকে ভোগের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে যেতেও দ্বিধা করেনি—তাদের গণিকা হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন৷ উদিপুরীর যেমন অতুল্য রূপ, তেমনি ছিল তার মদ্যাসক্তি৷ দিল্লীর বাদশাহদের মত মদ্য এবং পুরুষ তার প্রধান সঙ্গী৷ তার রূপসায়রে সদা অনুগৃহীত পুরুষের আনাগোনা৷
বঙ্কিমচন্দ্রের এই উপন্যাসগুলিতে দেহজীবা, বহুভোগ্যা, স্বৈরিণী নারীদের যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে এটুকু বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে উনিশ শতকীয় রক্ষণশীল ধ্যানধারণায় নারীর সতীত্বকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছিল তাতে বহুগামী নারীর প্রতি সমাজ খড়গহস্ত হবেই৷ অভিজাত গৃহের নারীরা বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যতই প্রশাসনিক দক্ষতা দেখাক না কেন তাদের চারিত্রিক কলুষতা তাদের আর সব গুণাবলীকে ছাপিয়ে দিয়েছে, সমাজে তাদের অপযশই বিধৃত হয়েছে৷ তাদের স্বেচ্ছাচারিণী ও স্বৈরিণীর কলঙ্কমুকুটই জুটেছে৷
হরিদাসের গুপ্তকথা :
উনিশ শতকের এক অন্যতম উপন্যাস ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’৷ ১৮৭০ থেকে ১৮৭৩ সালে যখন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় তখন এর নাম ছিল ‘এই এক নূতন’৷ পরবর্তীসময়ে ১৯৮০-র দশকে এর পৃথক বটতলা সংস্করণ বের হয়৷ বিভিন্ন সংস্করণের মধ্য দিয়ে নাম পরিবর্তিত হতে হতে লেখকের জীবৎকালের শেষ সংস্করণ ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ নামে প্রকাশিত হয়৷ ‘এই এক নূতন’ নাম পাল্টে ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ নামেই পরিচিত লাভ করে৷ উপন্যাসটির রচনাকার হিসেবে ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাম থাকলেও লেখাটি কুমার উপেন্দ্রকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ যেহেতু বইটি ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাম দিয়েই প্রকাশিত তাই তাঁকেই রচনাকার ধরে নিয়ে উপন্যাসটির গভীরে প্রবেশ করা যেতে পারে৷
রচনাটিতে বর্ণিত হয়েছে এক আত্মপরিচয়হীন জমিদারপুত্রের বাল্য, শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের কাহিনি, উত্থান-পতনের কাহিনি৷ কাহিনির নায়কের নাম হরিদাস৷ জীবনে বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতায় সাতঘাটের জল খাওয়া এই বালক প্রত্যক্ষ করেছে সমগ্র ভারতবর্ষের এক বৃহত্তর জটিল রূপকে৷ যেখানে চোর-ডাকাত-বোম্বটে-জলদস্যু, ঠক-জোচ্চর, বদমাশ, মোসাহেব, জমিদার, স্বৈরিণী, বেশ্যা, সৎ-অসৎসহ জীবনের বহুবিচিত্র ধারাকে৷ শিবের ত্রিশূলের ডগায় অবস্থিত কাশী হল সর্বপাপ মুক্তির কেন্দ্র৷ হরিদাস সেই কাশীতে গিয়ে লক্ষ করেছে যে সেই কাশী হয়ে উঠেছে সর্ব পাপচক্রের মূল পীঠস্থান৷ সেখানে প্রতারক, স্বৈরিণী গণিকাদের জমজমাট নিরাপদ বিচরণ৷
এই রচনায় লেখক সমাজের নানা অন্যায়, কুরুচিপূর্ণ অনৈতিক নীতিবোধ প্রকাশ করতে গিয়ে অজস্র পতিতা নারীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন৷ পঞ্চদশ কল্পে ‘এ আবার কি কাণ্ড?’ অংশে হরিদাস কলকাতায় অবস্থানকালীন সময়ে কোনো এক কোজাগরী পূর্ণিমার বিকেলে চিৎপুর রোড ধরে বেড়াতে বেড়াতে গরাণহাটা থেকে কলুটোলা রাস্তা পর্যন্ত লক্ষ করে দুধারি বারান্দায় বারান্দায় রকমারি মেয়েমানুষে ভর্তি৷ নানা বর্ণের কাপড় পড়া, নানা ধরনের ধাতুর গহনা পড়া, রকমারি ধরনের খোঁপাবাঁধা তাদের৷ কেউ কেউ টুলের উপর বসে আছে, কেউ কেউ আবার চেয়ারে, কেউ কেউ রেলিঙের উপর বুক রেখে ভানুমতী ধরনের মুখ বাড়িয়ে রাস্তার দিকে ঝুলছে; ‘‘কারো বুকে রংদার কাঁচুলী, কারো কারো মুখে রংমাখা, কারো খোঁপা নাই, পৃষ্ঠদেশে দীর্ঘবেণী, কেহ কেহ এলোকেশী৷’’৪০ বালক হরিদাস এদের দেখে বিস্ময়াপন্ন হয়৷ কারণ পূর্বে সে শুনেছিল কলকাতা শহরের বেশ্যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা৷ সে মনে মনে ভাবে—‘‘লোকমুখে শুনেছিলেম, কলিকাতা সহরে বেশ্যা অনেক; যে সকল পণ্ডিত সাধুভাষায় কথা কন, তাঁরা বলেন, বেশ্যা মানে নগরবিলাসিনী বারাঙ্গনা; সুখবিলাসী মতিচ্ছন্ন যুবাদলের চিত্তমোহিনী-বিলাসিনী; এরা সব জঘন্য বিলাস-রসিক যুবাপুরুষের ইহকাল পরকাল ভক্ষণ করে৷’’৪১ এখানে গণিকাপল্লীর জলজ্যান্ত চিত্র হরিদাসের দৃষ্টি দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন লেখক৷ যেখানে পতিতা নারীরা দেহের পসরা সাজিয়ে তাদের শরীরী ভালোবাসা বিক্রয়ের জন্য পথের দুপাশে বসে আছে৷ তাদের আকার-অবয়ব, দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা অর্থাৎ শরীরী ভঙ্গিমা, পোশাক-পরিচ্ছদ, সাজসজ্জা, কটাক্ষ-চাহনি কোনো কিছুই রচয়িতার নজর এড়ায়নি৷ তারা তাদের চাকচিক্যময় অতুলনীয় রূপ-বৈভব দিয়ে যুবাদলের মনকে পতঙ্গবৎ আকর্ষণ করে৷ লেখক এদের প্রতি অনুকম্পাহীন৷ তাই এই পণ্যাঙ্গনাদের ইহকাল পরকালের কোনো সুস্পষ্ট শুভ ইঙ্গিত না দিয়ে এদের প্রতি আরোপ করেছেন ঘৃণার প্রলেপ; মন্তব্য করেছেন তারা যুবাদলের ইহকাল পরকালের খাদক৷ শুধু এটুকুই নয় রচয়িতার চোখে তার পিশাচী; মানবীর রূপ ধারণ করে সমাজ-সংসারকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে৷ প্রকাশ্য জনপদে গণিকাদের অবস্থান দেখে চমকে ওঠে হরিদাস৷ ঘৃণ্য এক অনুভূতি তার সমস্ত শরীরে কাঁটা দেয়৷ সে তার এই অনুভবকে ব্যক্ত করে এইভাবে—‘‘নগরের বিলাসিনীর স্ত্রী-জাতিসুলভ লজ্জাসম্ভ্রমের মস্তকে পদার্পণ কোরে, হেসে হেসে সদররাস্তার ধারে বাহার দিচ্ছে! আকার-অবয়বে ঠিক মানবী, কিন্তু ব্যবহারে এরা জানবা—পিশাচী! কলিকাতা সহর কলুষে পরিপূর্ণ! সিঁতিকাটা, গন্ধমাখা, সাজপরা ফুলবাবুরা রাস্তা দিয়ে চোলে যাচ্ছেন, চক্ষু আছে উর্দ্ধ দিকে! বারান্দার চক্ষুরা তাঁদের দিকে ঘুরে ঘুরে ঘন ঘন কটাক্ষবাণ সন্ধান কোচ্ছে৷’’৪২ শহরের একজন পক্ষীকবি গণিকাদের ‘খদ্দের’ ধরার কৌশলের অন্তর্গত কটাক্ষচাহনিকে ব্যক্ত করে বলেছিলেন যে বারান্দার সেই চোখগুলো পাখিধরা ফাঁদ এবং পুরুষের মন মাতানোর মোহন মন্ত্রের বাঁশী৷
হরিদাস কলকাতা শহরের অভ্যন্তরে সকলের সঙ্গে বেশ্যালয়গুলির অবস্থান সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট মতবাদ ব্যক্ত করেছে৷ যেমন—‘‘কলিকাতার বেশ্যানিবাসের প্রণালীটী অতি জঘন্য৷ গৃহস্থের বাড়ীর কাছে বেশ্যা, ছেলেদের পাঠশালার পাশে বেশ্যা, ডাক্তার-কবিরাজের আবাসের পাশে বেশ্যা, কোথাও বা ভালোমানুষের মাথার উপর বেশ্যা; অধিক কথা কি, ব্রাহ্ম-সমাজ-মন্দিরের আষ্টে-পৃষ্ঠে বেশ্যা৷’’৪৩ হরিদাসের এই বিরূপ মন্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, পূর্বে অর্থাৎ যে সময়ে ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ উপন্যাসটি লেখেন সে সময় পতিতা নারীদের সকলেই স্বতন্ত্র কোনো পল্লীতে অবস্থান করতো না৷ সমাজ মানসিকতায় তারা যতই ঘৃণিত হোক না কেন নিষিদ্ধ পল্লীর বাসিন্দারূপে তখনো একেবারে সমাজচ্যুত হয়নি৷ সমাজে সকলের সঙ্গেই বাস করতো৷ কিন্তু সমাজে সকলের সঙ্গে তাদের অবস্থান নিয়ে বিরূপ মানসিকতার সূত্রপাত হয়েছিল, সমালোচনার কালোমেঘ তাদের আস্তাকুঁড়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার জল্পনা শুরু করে দিয়েছিল৷ অর্থাৎ সমাজে তাদের অবস্থান যে কতটা সর্বনাশের পরিচায়ক হয়েছিল তা হরিদাসের জবানিতেই সুস্পষ্ট৷—‘‘যে সহরের এমন দৃশ্য, সে সহরের পরিণাম কি হবে, সহরবাসী ভদ্রলোকেরা সেটা কি একবারও চিন্তা করেন না?’’৪৪ গণিকাদের সমাজমধ্যে অবস্থান নিয়ে হরিদাস সকলকে সচেতন করে দিতে চাইছে, যাতে পতিতা নারীদের ব্যভিচারের কালো ছায়ায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়৷
কলকাতা বিলাস-বৈভবের কেন্দ্রস্থল৷ এর প্রাচুর্য ও বিকাশে মানুষেরা মহিমান্বিত৷ শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি এবং রুজি-রোজগারের মধ্যমণি কলকাতায় তাই নানা শ্রেণীর মানুষের বাস৷ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষজনের সুবিধা নিয়ে গণিকারাও আস্তানা নিয়েছে এই নগরীর বুকে৷ যেখানে মানুষজন বেশি, যেখানে মানুষজনের রুজি-রোজগারের উপায় বেশি, সেখানে গণিকাদের পসার ও প্রয়োজন বেশি৷ জীবিকা নির্বাহের সুলভ ব্যবস্থার জন্য বারাঙ্গনাদের গ্রামের চেয়ে শহরের প্রতি আকর্ষণ তীব্র৷ ইংরেজি শিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাই সগৌরবে বলেন—‘‘যেখানে সহর, সেইখানেই পাপ৷ সহরমাত্রেই বেশ্যা বেশী, মদ বেশী, বদমাস বেশী রাজধানীতে আরো বেশী৷ রাজধানীতেই পাপের রাজত্ব৷’’৪৫ ভাগ্যের চাকায় ঘুরতে ঘুরতে হরিদাস কাশীতে আশ্রয় পেয়ে সেখানে প্রত্যক্ষ করে গণিকাজীবনের আরেকচিত্র৷ সারাটা দিন নানাভাবে কাটালেও সন্ধ্যার পর লাস্যময়ী হয়ে উঠে সেখানকার বারবনিতারা৷ গ্রাহক সংগ্রহ করার এটাই তাদের উপযুক্ত সময়৷ এই সময় তাদের শোভা আরও অধিক পরিমাণে বেড়ে যায়৷ তাদের বারান্দাগুলিতে মনোমুগ্ধকর সেতার-বেহালার সঙ্গীতময় সুরলহরী অন্য এক জগতের বাতাবরণ তৈরি করে৷ এই পণ্যাঙ্গনারা অর্থবান বাবুদের অবসর বিনোদনের সামগ্রী৷ মাসের পর মাস এদের সহবাসে অভিসার করে, কপট বধূ সেজে বাবুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে হয় তাদের৷ এখানে উল্লেখ রয়েছে বাবু মোহনলাল ঘোষ নামে একটি চরিত্রের৷ বহুনারী সংসর্গকারী এই ধনবান বাবুর কপট বধূর পরিচয়ধারী সমরকুমারীর কাশীতে মৃত্যু হলে শোক-দুঃখকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মনের আনন্দে কাশীর বাইজিমহলের আরেক সুন্দরী নারীকে সঙ্গিনী করে কাশীধাম পরিত্যাগ করে৷ কাশীধাম থেকে মোহনলাল বাবুর সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া এই বারবনিতাই তার অন্তঃপুরে স্ত্রী পরিচয়ে স্থান পায়৷ হরিদাস তার নিজের পরিচয় জানতে পারে এবং এও অবগত হয় যে রাজাবাহাদুর মোহনলাল ঘোষ তার কাকা৷ মোহনলালের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার বলে সমস্ত সম্পত্তি এবং রাজাবাহাদুর উপাধি প্রাপ্ত হয়ে যখন কাশীর সেই বারনারীকে অন্তঃপুরে প্রত্যক্ষ করে, দেওয়ানজীকে জানায়—‘‘কুমারীর মৃত্যুর পর কাশীর একটি বাঈজীকে নিয়ে তিনি পাটনায় আসেন, সেই বাঈজীকেই নূতন রাণী বোলে জেনেছিলেন; রাজাই সেই পরিচয় জানিয়েছিলেন৷ বাস্তবিক পূর্ব্বোক্তা কুমারী যেমন নূতন পরিবার, কাশীর সেই বাঈজীটি ও সেইরূপ নূতন রাণী৷’’৪৬
উনিশ শতকে বাবুয়ানার এক উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হল বাইনাচের মজলিশ করা৷ বাবুদের ইয়ার-বন্ধুরা তাতে যোগদান করত৷ কাশীতে হরিদাস নীরেন্দ্রবাবুর আয়োজিত বাইনাচের মজলিশে অংশ নিয়েছিল৷ সেখানে সে প্রত্যক্ষ করেছে টাকা থাকলে বাইমহলে যেমন প্রতিপত্তি বেশি হয় তেমনি ইয়ার-বন্ধুদেরও সংখ্যাহানি ঘটে না৷ নীরেন্দ্রবাবু সম্পর্কে সে বলে—‘‘বাবুটীর বাড়ী কলিকাতায়৷ সাত আট মাস পূর্ব্বে তিনি কাশীতে এসেছেন, পরিবার সঙ্গে নাই, টাকা আছে, বাইমহলে কিছু বেশী প্রতিপত্তি৷ একঘন্টা মাত্র নাচ৷’’৪৭ বাইনাচের মজলিশে বাইজিরা চুক্তিভিত্তিক লেনদেন করত৷ নীরেন্দ্রবাবুর মজলিশে নাচনেওয়ালী বাইজির সময় চুক্তি ছিল এক ঘন্টা৷
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কুলটা হয়, পুরুষরা তা বানায়৷ যে হয় তার যত দোষ কিন্তু বানায় যে তার সাত খুন মাপ৷ কলকাতায় বাসকালে হরিদাস জেনেছিল কুলটা সৌদামিনীর কথা৷ যে স্বামী-সংসারের আবেষ্টনীর মধ্যে থেকেও প্রতিবেশী যুবক জয়হরি বড়ালের সঙ্গে পালিয়ে কাশীতে বসবাস করতে শুরু করে৷ বহু নারীদেহ আস্বাদনে অভ্যস্ত জয়হরি সৌদামিনীকে গৃহত্যাগী করিয়েও তার সঙ্গে সহবাসের সাথে সাথে কাশীর গণিকামহলের মধ্যেও আনাগোনায় সাবলীল থাকে৷ প্রেমাস্পদের সঙ্গে যে আশা-স্বপ্ন নিয়ে সে স্বামী সংসার ছেড়ে এসেছিল তা ধূলিসাৎ হয়ে তার দ্বারা ধীরে ধীরে অত্যাচারিত হতে থাকে সৌদামিনী৷ তাই হরিদাসকে একটি চিঠির মধ্য দিয়ে জানায়—‘‘এখানে না কি অনেক রকম বাইজী থাকে; তাহাদের পাঁচজনের সঙ্গে জয়হরি মিলিয়া গেল; সকল দিন তাহারে আমি দেখিতে পাইতাম না; এক এক রাত্রে মদ খাইয়া আসিয়া আমাকে প্রহার করিত’’৪৮ নিজের কৃতকর্মে অনুতপ্ত হয়েছিল সৌদামিনী তাই হরিদাসের কাছে অঙ্গীকার করেছিল তার সেই স্বেচ্ছাচারিণীর জীবন থেকে সরে গিয়ে সুখী স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হবে৷ সমাজ তাকে মুলস্রোতে ফিরিয়ে নেয়নি৷ কুলটা নারীদের কুলে ফেরাতে সমাজ কোনোদিনই দাক্ষিণ্য দেখায় না৷ কিন্তু হরিদাস যখন রাজা হয় তখন নিজের জীবনের একটা সৎগতি চেয়ে সে হরিদাসকে নিবেদন করে—‘‘ভগবান তোমারে রাজা কোরেছেন, এখন তুমি আমার একটা কিনারা কোরে যাও৷ চিঠি লিখে তোমাকে আমি জানিয়েছিলেম, ইহজন্মে আর আমার পাপকর্ম্মে মতি হবে না৷ সেই অবধি চিঠির সেই কথাই আমি পালন কোরে আসছি, যতদিন বাঁচবো, চিরদিন পালন কোরবো৷’’৪৯ সে আরও জানায় যে শত চেষ্টা করেও সে তার কলঙ্ক ঘোচাতে পারেনি৷ সকলেই তাকে বলে ‘কলঙ্কিনী সৌদামিনী’৷ সে তাই কলকাতায় থাকতে চায় না৷ হরিদাসকে সে অনুরোধ করেছে সে যেন তাকে কাশীতে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়৷ ইহকালে তাকে পাপ পথ থেকে সরিয়ে এনেছে; পরকালের জন্যও যেন বিশ্বেশ্বরের পায়ের কাছে একটু স্থান করে দেয়৷ হরিদাস সৌদামিনীর প্রতি মুখ ফিরিয়ে থাকেনি৷ তথাকথিত ভদ্র সমাজে কুলটার কালিমা ঘুচিয়ে রাখতে না পারলেও কাশীতেই তার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেয়৷ এক কুলত্যাগী নারী ঘরে ফেরার পথ না পেলেও ঈশ্বরের পদমূলে মুক্তির দিশা খুঁজে পেতে চেষ্টা করে৷ সৌদামিনীর মুখেই উঠে আসে বারবনিতা চন্দ্রকলার নাম যার মোহনমায়ায় জয়হরি তাকে অবজ্ঞা ও অত্যাচার করতে শুরু করেছিল৷ সৌদামিনীই জয়হরি খুনের সাক্ষী দিতে কলকাতায় এসে উপস্থিত হয় সুদূর কাশীধাম থেকে৷ কিন্তু পুনরায় সে কাশীতেই চলে যায়৷ জন্মস্থানে তাকে ধরে রাখার মতো মনোবৃত্তি কারুরই ছিল না সে কুলটা হয়েছিল বলে৷ এখানে এই ঘটনা থেকে বিভিন্ন অঘটন ঘটানোয় পারদর্শী বাবুদের কুকার্যের সাক্ষী হিসেবে বারাঙ্গনাদের জবানবন্দির গুরুত্বকেও স্বীকার করা হয়েছে৷
হরিদাস কামরূপ দর্শনে গিয়ে তার আশ্রয়দাতার কাছে শুনেছে ডাকিনীদের কথা৷ বক্তার উদ্ধৃত ডাকিনী আসলে গণিকারাই৷ কমবয়সি পুরুষেরা কামাখ্যায় গিয়ে এই ডাকিনীদের পাল্লায় পড়ে আর ঘরে ফিরে যেতে পারে না৷ সে প্রসঙ্গে তার স্পষ্ট স্বীকারোক্তি—‘‘তিনি রহস্যচ্ছলে গণিকাদলকেই ডাকিনী বোল্লেন, সেটা আমি বেশ বুঝতে পাল্লেম৷ ডাইনী, ডাকিনী, রাক্ষসী, পেত্নী ইত্যাদি যে সকল কুৎসিত কুৎসিত উপাধি আছে, চক্ষে না দেখলেও সে সকল উপাধিধারিণীকে ভয়ঙ্করী মনে হয়৷’’৫০ এই উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে গণিকাদের অশুভ শক্তির দ্যোতক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে৷ এখানে ভেল্কি দেখাতে আসা দুজন নারী অদ্ভূত নৃত্যকৌশলকে হরিদাস তুলনা করেছে ‘খোট্টা খেমটাওয়ালী’-র নাচের সঙ্গে কিন্তু পরক্ষণেই তার সেই ভ্রম ভেঙে যায়৷ গণিকাদের মতো খেমটাওয়ালিরাও নর্ত্তকী গায়িকা৷
নাচঘরের উল্লেখ আছে বাবু দীনবন্ধু চট্টোপাধ্যায়ের জমিদারি পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গে৷ নাচঘরে বাইনাচের আসর বসত৷ নাচঘরটি প্রায় ষাট হাত দীর্ঘ এবং ত্রিশ হাত প্রশস্ত৷ মেঝে কার্পেটমোড়া, দেওয়ালে বড় বড় সব ছবি, ছবির মাথায় দেওয়ালগিরি৷ কড়িকাঠে বড় বড় বেলোয়ারি, সারি সারি তাকিয়া বালিশ৷ রক্ত বর্ণ ঝাড়বুটোকাটা আবরণে বালিশগুলি আচ্ছাদিত৷ তবে পূর্বে সেই ঘরে বাইনাচের মজলিশ বসলেও চরিত্রদূষণের আশঙ্কায় দীনবন্ধুবাবু বেশ্যানর্ত্তন বন্ধ করে দিয়েছেন৷ পতিতা রমণীদের গৃহে অনুপ্রবেশ ঘটালে তা যে খাল কেটে কুমীর আনার সামিল হবে তা বিচক্ষণ দীনবন্ধু চট্টোপাধ্যায় অনুভব করতে পেরে বাইনাচ তুলে দিয়েছেন এবং সেই কারণে সেখানে হরিদাস বাইনাচের মজলিশ দেখতে পায়নি৷
বেশ্যাতোষণকারী পুরুষেরা প্রকাশ্যে বেশ্যাগমন করলেও সমাজ বিচ্যুত হয় না কিন্তু বেশ্যাবৃত্তিকারিণী নারীটিকে সমাজ পরিত্যাগ করে৷ এক সম্ভ্রান্ত গৃহের কন্যা পিসতুতো দাদার প্ররোচনায় ব্যভিচারিণী হয়ে ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে ধর্ষিতা হয় ডাকাতদলের সর্দার দ্বারা৷ অবশেষে ডাকাতদলেই সে জায়গা করে নেয়৷ নাম হয় রঙ্গিণী, কিন্তু হরিদাসের চোখে তার ছদ্মরূপ ধরে রাখতে পারে না৷ ঘটনাক্রমে সেখান থেকে বেড়িয়ে রঙ্গিণী দাক্ষিণ্য লাভ করে বর্ধমানের যুবরাজ রণেন্দ্ররাও-এর৷ ছদ্মবেশী ডাকাত ভূষণ তথা রণেন্দ্ররাও হরিদাসের কাছে রঙ্গিণীর সব কথা জানতে চাইলে হরিদাস জানায়—‘‘রঙ্গিণী স্বেচ্ছা পূর্ব্বক ব্যভিচার-পাপে লিপ্ত হয় না, প্রকাশ্যে বেশ্যাবৃত্তিও অবলম্বন করে নাই, রঙ্গিণীর সে পাপের ক্ষমা আছে,—এখানেও আছে, উপরেও আছে৷’’৫১ তবুও রঙ্গিণী অসহায়৷ যুবরাজ যদি তাকে আশ্রয় বা সাহায্য না করে তাহলে তাকে বেঁচে থাকতে হলে বাধ্য হয়ে বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করতে হবে৷ রঙ্গিণীকে বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে যাতে গণিকাজীবনে প্রবেশ করতে না হয় এজন্য রাজপুত্র রণেন্দ্ররাও এক বিপত্নীক প্রজার সঙ্গে তার বিবাহ দিয়ে সংসারের মূলস্রোতে ফিরিয়ে দিয়েছে৷ পরিণামে রঙ্গিণীকে তার নিজের পরিচয়, অতীত সব কিছুকে ভুলে যেতে হয়েছে৷ তবুও মন্দের ভালো রঙ্গিণী একটা স্থায়ী সম্মানিত জীবন ফিরে পেয়েছে৷
গণিকাদের আশ্রয় করে সমাজের ইতর সন্তানেরা সুখ-শান্তি খোঁজার চেষ্টা করে৷ লক্ষণীয় যে চোর, জোচ্চোর, মাতাল, বাটপার, গুণ্ডা, বদমাশ থেকে শুরু করে অনেক ধনী বাবুরা বারবনিতার অঞ্চলতলে নিজেদের জীবনের সার্থকতা খুঁজে বেড়ায়৷ হরিদাস সৎ পন্থার পথিক৷ খুন সংক্রান্ত মামলায় হরিদাসের বুদ্ধিতে যখন সব অপরাধীরাই আইনের চোখে চিহ্নিত হয়ে যায় তখন তাদের বেশিরভাগই আত্মগোপনের জন্য আশ্রয় নেয় কোনো না কোনো পতিতালয়ে৷ যেমন কৃষ্ণনগরের এক বেশ্যালয় থেকে ধরা পড়ে ঘনশ্যাম বিশ্বাস৷ অন্য আর এক বারাঙ্গনার আস্তানা থেকে শৃঙ্খলিত হয় জয়হরি৷ এই অপরাধী মানুষগুলো গণিকালয়ে আশ্রয়গ্রহণ করার ফলে তাদেরও নানা অসুবিধা, বিপদের সম্মুখীন হতে হতো৷ খুন, দাঙ্গা, প্রতারণা সংক্রান্ত মামলায় যেমন বিপর্যস্ত হত তারা, আবার কখনো কখনো প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটত৷ এছাড়া আরও বহু স্বৈরিণী নারীর ভিড়ে ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ উপন্যাসটি পরিপূর্ণ ছিল৷ যেমন—নবীনশশী, রাঙামামি, রূপসী এদের মধ্যে অন্যতম৷ এদের কেউ বালবিধবা, কেউ পরিচারিকা, কেউ বা কুলকামিনী কিন্তু ঘটনাচক্রে ব্যভিচারিণী হয়ে ঘৃণ্য অমর্যাদার শিকার৷
হরিদাসের গুপ্তকথা উপন্যাসে উনিশ শতকীয় ধ্যানধারণায় নারীচরিত্রের মূল্যায়ন করেছেন লেখক৷ নারীর সতীত্ব, নিষ্ঠা, আত্মত্যাগ ইত্যাদিই তাদের চরিত্রে উৎসারক; ব্যভিচার, ভ্রষ্টাচার বা অসংযমী যৌন পিপাসা নয়৷ আর এ কারণেই গণিকারা মূল্যহীন, পাপীয়সী, সমাজ থেকে বিচ্যুত৷ গণিকাদের সামাজিক অবস্থান নির্ণয়ে উপন্যাসটির বড় ভূমিকা রয়েছে৷
এলোকেশী বেশ্যা :
গণিকা জীবনের সুস্পষ্ট ও সামগ্রিক চিত্রকে খুঁজে পাওয়া যায় এই উপন্যাসে ৷ এর রচয়িতা মিশ মেরী ই লেসলি বা বিবি মিশ লেসলি৷ রচনাকাল ১৮৭৬৷ বই-এর প্রচ্ছদে রয়েছে—‘‘বিবি মিশ লেসলি কর্ত্তৃক প্রকাশিত৷’’৫২ ‘এলোকেশী বেশ্যা’ উপন্যাসটি এক বাল বিধবা বালিকার জীবনের ক্রমিক পরিণতি৷ এর মূল উপজীব্য এক পতিতা নারীর গ্লানিময় নিষ্ঠুর জীবন এবং পরিণতিতে ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সুস্থ সমাজের মূল স্রোতে ফিরে এসে নিষ্কলুষ জীবনযাপন৷ খ্রিস্টধর্মের উদার ছায়ায় এক রূপাজীবা নারীর পুনরায় স্বাভাবিক জীবনের ফিরে এসে মানুষের মতো বাঁচা এই শতকের এক ব্যতিক্রমী বিষয়৷ উপন্যাসটির শুরুতেই দেখা যায় আটবছর বয়সি এলোকেশী নামে এক বালিকাবধূর চরম বিপর্যয়ের কথা—‘‘ওগো তোমরা একটি সর্ব্বনাশের কথা শুনেছ? গত রাতে ওলা ওঠায় এলোকেশীর স্বামী মারা পড়েছে!’’৫৩ কিন্তু আটবছরের বালিকাবধূ এলোকেশী স্বামীবিরহ বা স্বামীসুখ কি তা বোঝে না৷ বোঝার কথাও নয়৷ তাই স্বামী মারা গেলে তার ক্ষতি হল তার কিছুই জানে না সে৷ শুধু—‘‘তার মা তার বালা দুগাছী খুলে নিলে বলে, সে অমনি গহনার শোকে কেঁদে উঠলো৷ ছেলেমানুষ বৈ ত নয়, স্বামী কাকে বলে তাই জানে নি, তা আবার তার জন্য কাঁদতে জানবে৷’’৫৪ পুতুল খেলারত এলোকেশীর এত বড় সর্বনাশে সকল আত্মীয়পরিজনেরা যখন হায় হায় করে ওঠে, তার হাতের বালা খুলে নিয়ে সিঁথির সিঁদুর তুলে এয়োস্ত্রীর চিহ্নসকল মুছে দেয় তখন সে শুধু ভয় পেয়ে কেঁদে উঠে শিশুসুলভভঙ্গিতে৷ এলোকেশী এই আচরণকে লেখিকা বিবৃত করেছেন এইভাবে—‘‘এই সব দেখে শুনে, ছেলেমানুষ বৈ ত নয়, তার মনে একটু ভয় হল এবং কাঁদতে লাগলো৷ কিন্তু তার যে কি সর্ব্বনাশ হয়েছে, তার যে কপাল ভেঙ্গেছে, আহা সে তার কিছুই বুঝতে পারলে না৷’’৫৫ স্বামীর বিরহ যন্ত্রণা এলোকেশীকে অনুভব করতে হয়নি, বুঝতে পারেনি স্বামী বিচ্ছেদ যাতনা৷ কিন্তু ধীরে ধীরে যতই তার বয়স বেড়েছে, তার বালিকা বয়সের কলি প্রস্ফুটিত হয়ে সৌরভ ছড়িয়েছে ততই অপূর্ব রূপবতী এলোকেশীর চাওয়া-পাওয়া, ভালোলাগা-না লাগার সীমাগুলি অনেকদূর বিস্তৃত হয়ে পড়েছে৷ তার যৌবনদশায় উদয় হওয়া নানাবিধ সুখের ইচ্ছার মধ্যে অন্যতম হল লেখাপড়া শেখা৷ ভাইদের সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার ভাইদের দ্বারা লেখাপড়া শেখার পথকে সুগম করেছিল৷ তারপরে প্রতিবেশীদের কাছে শেখে শিল্পকর্ম৷ তাদের বাড়ির খিড়কির দিকে একটি বাগান ও তার মধ্যে একটি পুকুর ছিল৷ নানাবিধ ফুলে, ভ্রমরের গুঞ্জনে অপূর্ব শোভা সেই বাগানের৷ এলোকেশীর ফুল খুব প্রিয় ছিল৷ এই বাগানের মনোরম পরিবেশ তার মনের গোপনস্তরে বাসনার জন্ম দিতে শুরু করেছিল৷ সে প্রায় সর্বদাই বাগানে থাকত৷ গ্রীষ্মকালের এক বিকেলে সে কতগুলি ফুল তুলে ঘাটের উপর একটি বকুলগাছের তলায় বসে এক মনে মালা গাঁথছিল সেই সময় প্রেমপূর্ণবাক্যে ভায়ের বন্ধুর পরিচয় দিয়ে এক যুবক তাকে প্রণয় সম্ভাষণ করে৷ লেখাপড়া শেখা সভ্য সমাজে বড় হওয়া শিক্ষিতা, রূপবতী, যৌবনমদে পরিপূর্ণ এলোকেশী সেই অপরিচিত যুবকের প্রণয়সম্ভাষণে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে৷ ভাইয়ের বন্ধুর সামান্য স্তুতিবাদেই মন বিগলিত হয়ে যায়৷—‘‘কারণ একে যুবতী, তাহাতে আবার প্রেমপূর্ণ বাক্য, তাহাতে কাহার মন না চঞ্চল হয়?’’৫৬ সে যৌবন যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে প্রবৃত্তির তাড়নায় সহজেই সেই যুবকের কাছে ধরা দেয় এবং পুনরায় তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার বাসনা জানিয়ে বলে—‘‘আপনি কল্য অবশ্য অবশ্য আসিবেন৷’’৫৭ এভাবে এলোকেশী সকলের অগোচরে সেই যুবকের সঙ্গে মিলিত হতে থাকে৷ সেই সময় সমাজে বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল কিন্তু তার বাবা মা বালবিধবা কন্যার পুনরায় বিবাহে মত দেয়নি৷ কিছুদিন পর যৌবনযন্ত্রণায় দগ্ধ এলোকেশী হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়৷ বহু অনুসন্ধানের পর জানা যায় পুর্বোক্ত যুবক তাকে লোভ দেখিয়ে নিয়ে চলে গেছে৷ সেই যুবক এক ধনী পরিবারের সন্তান৷ নাম ক্ষেত্রবাবু৷ ছোট বালিকার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল বলে স্ত্রীর প্রতি তার কোনো অনুরাগ ছিল না৷ এলোকেশীকে ভুলিয়ে এনে তাকে উপপত্নী হিসেবে স্থান দেয়৷ শুধুমাত্র প্রবৃত্তির তাড়নায় পরিবার পরিজনের স্নেহ-ভালোবাসার নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে সে হয়ে ওঠে রক্ষিতা৷ বিবাহিত ক্ষেত্রবাবু তাকে পুনরায় বিয়ে করে ঘরে তুলতে পারে না৷ ধনী বাবা-মায়ের সন্তান হওয়ার জন্য এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের বহুগামীতার কোনো অপরাধ না থাকায় অনায়াসে সে তাকে উপপত্নী হিসেবে রাখতে সক্ষম হয়৷ সে—‘‘এলোকেশীকে লইয়া গিয়া একটি উত্তম বাটীতে রাখিয়াছিলেন৷ মণিমুক্তাযুক্ত অনেক অনেক দামী গহনা, উত্তম উত্তম কাপড়, প্রভৃতি নানাবিধ জিনিসপত্র দিয়াছিলেন, এবং সেবার জন্য দাসদাসী নিযুক্ত করিয়া দিয়াছিলেন, এবং আপনিও প্রায় সর্ব্বদাই তার কাছে থাকিতেন৷’’৫৮ বাড়ি, বিত্ত-বৈভব, গহনা-অলঙ্কার, দাস-দাসী, কাপড়-চোপর সবই পেয়েছিল শুধু নারীত্বের সম্মানটুকু ছাড়া৷ ক্ষেত্রবাবু তাকে ভোগ করার দাম দিয়েছে মাত্র আর কিছু নয়৷ এখানে উঠে এসেছে তখনকার সমাজে ধনী বাবুদের রক্ষিতাপোষণের এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি৷ বিলাসী বাবুরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করতো এই রক্ষিতাদের পেছনে৷ সেই পুরুষের প্রতি সমাজের কোনো বিরূপতা ছিল না কিন্তু সেই রক্ষিতা নারীর শেষ পর্যন্ত কি পরিণতি তা উপন্যাসে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনারাজীর মাধ্যমে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এলোকেশীর জীবন পরিণতির মধ্য দিয়ে৷ তার জীবনে স্ত্রীর বৈধ অধিকার ছাড়া কিছুরই অভাব ছিল না৷ ক্ষেত্রবাবুর সঙ্গে আমোদ-প্রমোদে কোথাও কোনো খাদ ছিল না তার তবুও ভেতরের নারীসত্তাটি বোধ হয় গুমরে গুমরে মরতো নইলে এত ভোগবিলাসের মধ্যেও, সুখ-ঐশ্বর্যের মধ্যেও এক খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারিকার ধর্মীয় বাণী তার মনে পাপবোধ জাগ্রত করবে কেন! সেই ধর্ম প্রচারিকা তাকে বাইবেলের অন্ত্যভাগ দিয়ে বলেন যে সেখানে তার মতো এক স্ত্রীলোকের কথা আছে যে যীশুর কৃপায় পাপ পথ থেকে সরে আসতে সক্ষম হয়েছিল৷ ধর্ম্মসংক্রান্ত কথাবার্তা এলোকেশীর মনে ঈশ্বরের কৃপার আলোকস্পর্শ দিতে আরম্ভ করেছিল৷ কিন্তু ঐ পর্যন্তই৷ গণিকা জীবনের ক্লেদ মুক্ত হওয়ার আগেই ক্ষেত্রবাবু তার রাশ টেনে ধরে৷ সেই ধর্মপ্রচারিকা ও এলোকেশীর যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়৷ ধর্মের আলো প্রবেশের সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়ে পুনরায় তাকে পাপের পথে ঘুরিয়ে নেয়৷ ‘‘বাইবেল এবং অন্যান্য পুস্তক সকল তফাতে রাখা হইল৷ পুনরায় আবার পূর্ব্বের ন্যায় আমোদ প্রমোদ চলিতে লাগিল৷’’৫৯
এলোকেশীকে ক্ষেত্রবাবু রক্ষিতা হিসেবে গ্রহণ করলেও এলোকেশীর কাছে সে স্বামীতুল্য৷ শুধু স্বামীতুল্য নয় স্বামীই৷ বাল্যকালে যে স্বামী মারা গিয়েছিল তার প্রতি কোনোরকম বোধ জাগ্রত হয়নি তার৷ পুরুষ হিসেবে প্রথম সে পেয়েছিল তাকেই৷ নিজের জীবন-যৌবন সমর্পণ করেছিল তার কাছেই৷ তাই কায়মনোবাক্যে সে তার স্বামী৷ সেই ক্ষেত্রবাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে এলোকেশী পাগলিনি হয়ে যায়৷ তাকে অসুস্থতার সময়ে সে দেখতে পর্যন্ত পায় না কারণ ক্ষেত্রবাবু তখন নিজগৃহে৷ একজন রক্ষিতার সেখানে প্রবেশাধিকার নেই৷ তাই তাকে দেখতে না পেয়ে, তার শুশ্রূষা করতে না পেরে, দিনরাত্রি মহাদুর্ভাবনায় আহার নিদ্রা ত্যাগ করে মৃতবৎ বাস করতে থাকে৷ কিছুদিন এভাবে কাটানোর পর হঠাৎ শুনতে পায় যে ক্ষেত্রবাবুর মৃত্যু হয়েছে৷ আর সে সংবাদ পাওয়ামাত্রই—‘‘ছিন্ন কদলীগাছের ন্যায় ভূমিতে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেন, উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করিতে লাগিলেন, বুক চাপড়াতে লাগলেন, চুল ছিঁড়তে লাগলেন, গায়ের গহনা সব দূর ফেলিয়া দিলেন এবং শোকে অধীর হইয়া বলিতে লাগিলেন, ‘‘আমি আর এ প্রাণ রাখব না, আমি আর কি সুখে প্রাণ-ধারণ করিব, আমার আর এ ছার জীবনে কাজ কি! হে মৃত্যু, আমি তোমায় মিনতি করিয়া বলিতেছি, তুমি এখনই আমাকে আমার নামের সঙ্গিনী কর!’’৬০ এলোকেশী বৈধব্যদশা প্রাপ্ত হয়েছিল বহুদিন আগে, তার আটবছর বয়সে; তখন তার সে বোধ হয়নি কিন্তু ক্ষেত্রবাবুর মৃত্যু হওয়ার পর সে নিজেকে সত্যসত্যই বিধবা ভাবতে থাকে৷ ক্ষেত্রবাবুর দুঃখে বিলাপ করে করে কিছুদিন কাটলে তারপর মাথায় ভর করে ভরণ-পোষণের চিন্তা৷ বাবা-মা তাকে আর ঘরে তুলবে না, ক্ষেত্রবাবুর পরিবারেও তার কোনো জায়গা নেই, কি করে বাকি জীবনটা চলবে তার৷ কিছুদিন ক্ষেত্রবাবুর দেওয়া গয়নাগুলি বিক্রয় করে তার দিন গুজরান হয়৷ পরে আর কোনো উপায় নেই৷ এদিকে রূপ উথলে পড়ছে তার শরীরে, চারিদিক থেকে দেহলোভী শ্বাপদেরা নানাভাবে তাকে প্রলোভিত করতে আরম্ভ করছে; জীবনে আর কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে তার মনে হয়—‘‘আর কী, আমারও দুর্নাম হয়েছে, আমার ত স্বভাব একবারে নষ্ট হয়ে গেছে, আর সকলেই আমাকে বেশ্যা বলিয়া জানে, তবে কেন এরূপ গোপনে থেকে মিছে কষ্ট পাই৷’’৬১ শোকে মুহ্যমান হয়ে জীবন কাটানোর অধিকার একজন বিধবার থাকলেও রক্ষিতার নেই; কারণ সমাজে কলঙ্কিনী নারীদের কোনো স্থান হয় না৷ এলোকেশীরও হল না৷ কঠোর বাস্তবকে খুব ভালোভাবে চিনে গিয়েছে সে৷ বুঝে গিয়েছে কোথায় তার অবস্থান৷ আর—‘‘এই ভেবে এলোকেশী পেটের ভাতের জন্যে সাধারণ-সমক্ষে বেশ্যাবৃত্তি করিতে লাগিলেন৷’’৬২
এলোকেশী অত্যন্ত সুন্দরী৷ আর এই রূপের ছটায় অল্পদিনেই দেহজীবিকার পসার বেড়ে যায়৷ রূপবহ্নিতে মোহিত হয়ে সর্বদাই তার বাড়িতে লোক যাতায়াত করতে আরম্ভ করে৷ আবার—‘‘খুব আমোদ প্রমোদ চলতে লাগল, টাকাকড়ির কিছুমাত্র অভাব রহিল না৷’’৬৩ আমোদে-আহ্লাদে, টাকাপয়সায় তার ভাণ্ডার ভরে উঠলেও নারীত্বের চিরন্তন আহ্বান, সুন্দর জীবনের হাতছানিকে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারে না সে৷ স্বাভাবিক জীবনের অদম্য পিপাসা হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে৷ তার অন্তরে কিছুমাত্র সুখের অবকাশ থাকে না৷ এলোকেশী—‘‘সর্ব্বদাই মনাগুনে দগ্ধ হতেন; তিনি আপনাকে ঘোর পাতকিনী বলিয়া জানিতেন তজ্জন্য সর্ব্বদাই আপনাকে আপনি ঘৃণা করিতেন এবং আপনার মৃত্যু কামনা করিতেন৷’’৬৪ তার সব সময় মনে হত যে, তার কৃতকর্মের জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়ানক বিচার; বিচারকের প্রজ্জ্বলিত ক্রোধাগ্নি৷ মনের পাপবোধের গভীর ভাবনা থেকেই একসময় বেড়িয়ে আসে মুক্তির পথ, তার মনে পড়ে যায় পূর্বেকার সেই খ্রিস্টধর্ম প্রচারিকার কথা, তার দেওয়া বাইবেলের অংশখানির কথা৷ তারপর অনেক খুঁজে বের করে ক্ষেত্রবাবুর লুকিয়ে রাখা বাইবেলখানি৷ তার পাতা ভাঁজ করা অংশগুলো মুক্তির স্বর্গকে সামনে এনে দেয়৷ বইটির বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোহন লিখিত সুসমাচারের অষ্টম অধ্যায়ের ছয় নম্বর পদ থেকে এগারো সংখ্যক পদ পর্যন্ত পড়তে শুরু করে, যেখানে রয়েছে এক ব্যভিচারিণী নারীর কথা৷ সেই নারী ‘ব্যভিচার কর্ম্ম’ করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়েছে৷ শাস্ত্রাধ্যাপক ও ফরীশিগণ মোশির উপদেশ মতো তাকে ব্যভিচারকর্ম করার অপরাধে প্রস্তরাঘাত করে মৃত্যু দান ঠিক করে যীশুর কাছে তা জানাতে এসেছে৷ যীশু অনেক ভাবনাচিন্তার পর বলেছিলেন যে তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি নিষ্পাপ সে তাকে প্রথম প্রস্তরাঘাত করুক৷ বলেই আবার মাথা নত করে তিনি ভূমিতে লিখতে লাগলেন৷ কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে দেখেন সেখানে সেই স্ত্রীলোকটি ব্যতীত কোনো জন-মানব নেই৷ যীশু তাকে কোনোরকম শাস্তি না দিয়ে শুধু বলেন—‘‘যাও আর পাপ করিও না৷’’৬৫ বাইবেলের অংশদ্ধৃত যীশুর এই বাণী এলোকেশীর কাছে মহামন্ত্র হয়ে যায়৷ বারাঙ্গনা এই নারী বহুভোগ্যার গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে এই একটি মাত্র বাক্যকেই জপের মালা করে কায়মনোবাক্যে ভগবান যীশুর প্রতি আত্মনিবেদন করে৷ বাইবেল পাঠ করে তার মনে উপস্থিত হয় ধর্মীয় দ্বন্দ্ব৷ হিন্দু-ধর্মের কঠোর অনুশাসনে কোন কুলটা নারীর বা দেহজীবিনীর ঘরে ফেরার অধিকার নেই, নেই কোনো প্রায়শ্চিত্ত কিন্তু খ্রিস্টধর্মে রয়েছে তাদের প্রতি ক্ষমা৷ অসৎ পথ থেকে সরে এলে পুনরায় সে সমাজে আশ্রয়লাভ করতে পারে৷ তাই খ্রিস্টধর্মের উদারতায় মোহিত হয়ে সে ভাবে—‘‘কি আশ্চর্য্য আমি অনেক অনেক হিন্দুশাস্ত্র পড়িয়াছি বটে কিন্তু কিছুতেই কখন আমার মন এত ব্যাকুল হয় নাই; কিন্তু এই বইখানি (বাইবেলখানি) পড়িয়াই আজ আমার মন এমন হল কেন, এবং আমি আপনাকেই বা এত অপবিত্র জ্ঞান করিতেছি কেন?’’৬৬ তার মনে বিষম উদ্বেগ উপস্থিত হয়৷ মনে মনে স্থির করে যে আর বইখানি পড়বে না কিন্তু কি একটা দুর্নিবার আকর্ষণে নিজের অজান্তেই বই-এর পাতা খুলে বসে৷ আবার পড়তে শুরু করে লুক লিখিত সুসমাচারের পঁচাত্তর অধ্যায়ের ছত্রিশ সংখ্যক পদ থেকে পঞ্চাশ সংখ্যক পদ পর্যন্ত৷ সেখানে ফরীশিদের মধ্যে একজন যীশুকে ভোজনে নিমন্ত্রণ করলে তিনি যখন ভোজনে বসেন তখন দেখেন সেই নগরের একজন পাপিষ্ঠা স্ত্রী তাঁর ভোজনে বসা লক্ষ করে নানা উপাচারে পদসেবা করার জন্য প্রতীক্ষা করে আছে৷ তার চোখের জলে যীশুর পা ভিজিয়ে, মাথার চুল দিয়ে ভেজা পা মুছে সুগন্ধি তৈলে চরণ মর্দ্দন করে৷ তার নিষ্পাপ ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে তিনি তাকে সর্ব পাপ থেকে মুক্তি প্রদান করেন৷ এই অংশটুকু পড়ার পর এলোকেশী মনোবেদনায় অস্থির হয়ে কাঁদতে থাকেন৷ আত্মপীড়নে আহত এই বারবনিতার স্বগোতক্তি—‘‘হায় কোথায় গেলে আমি, সেই দয়াময় প্রভুর দর্শন পাইব? যদি এখন একবার তাঁহার দেখা পাই তবে তাঁহার কাছে গিয়ে চরণে ধরে আমিও কাঁদি তাহা হইলে সেই দয়াল প্রভু আমাকেও ক্ষমা করিবেন; এই যে স্ত্রীটির কথা আমি এইমাত্র পড়লাম, ইনিও আমার মত হতভাগিনী পাপীষ্ঠা ছিলেন, এবং প্রভু তাঁহাকে ক্ষমা করিয়াছেন৷ আমি সেই স্ত্রীলোকটীর (সেই খ্রিষ্টধর্মপ্রচারিকা যাঁহার সহিত ক্ষেত্র বাবুর বাটীতে এলোকেশীর প্রথম দেখা হয়) মুখে শুনেছি যে যীশু সর্ব্বদাই জীবিত আছেন, এবং সর্ব্বদাই পাপীজনের পাপ মার্জ্জনা করেন৷ হায় কোথায় গেলে আমি তাঁহার দেখা পাইব?’’৬৭ ধর্মীয় চেতনায়, মুক্তির বাসনায় উদ্বুদ্ধ এলোকেশীর দেহবিক্রয় করে জীবনধারণ ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠে কিন্তু কি করবে! তাছাড়া তার যে অন্য কোনো উপায় নেই৷ দেহব্যবসা না করলে কি করে তার খাওয়া পড়া চলবে, ভরণ-পোষণ চলবে৷ কোনো ভদ্রবাড়িতে তার মত পণ্যাঙ্গনার চাকরিও জুটবে না আবার অসৎ সংসর্গীয় লোকের বাড়িতে থাকাও পাপ৷ সে বিষম সংকটের মধ্যে পড়ে৷ কি করবে কোথায় যাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না৷ অবশেষে পতিতপাবন যীশুর উদ্দেশ্যে ক্রন্দন করে বলে—‘‘হে দয়াময়, তুমি যেমন সেই আমার ন্যায় হতভাগিনীকে কহিয়াছিলে ‘যাও আর পাপ করিও না’ এবং তার প্রতি কৃপা করিয়া তাহাকে পরিত্রাণ করিয়াছিলে, তেমনি নাথ আমিও আর পাপ করিব না, তুমি দয়া করে আমাকে পথ দেখাইয়া দাও; দয়াময়, অনাথিনীর প্রতি একবার কৃপাদৃষ্টি কর, একবার সদয় হও৷’’৬৮ গণিকাবৃত্তি থেকে মুক্তির চিন্তায় যীশুর কাছে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করে নিজের প্রতি উদাসীন হয়ে মনের গহনে তলিয়ে যায় সে৷ থাকে না শরীরের প্রতি কোনো নজর৷ ফল স্বরূপ প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে সেখানে তার অসুখ আরও বেশি পরিমাণে বেড়ে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়৷ ক্রমে ঈশ্বরের কৃপায় আরোগ্যলাভ করলে হাসপাতালে থাকতে থাকতে সাক্ষাৎ হয় এক ধার্মিকা স্ত্রীর সঙ্গে৷ তার বিনম্র ব্যবহার এলোকেশীর কাছে স্বর্গীয় দূতের মতো মনে হয়৷ নিজের সমস্ত কথা অকপটে তার কাছে ব্যক্ত করে এলোকেশী তাকে জানায় তার হৃদয়ের সত্য কথাটি—‘‘যদি তিনি কোন উপায় পান তবে এ পাপকার্য্য একেবারে পরিত্যাগ করিবেন এই তাহার একান্ত ইচ্ছা৷’’৬৯ খ্রিস্টকে হৃদয়ে ধারণ করে সৎ সংসর্গে এবং সৎ চিন্তায় তার মনের সমস্ত পাপ দূর হয়ে যায়৷ শান্তির সুখানুভূতিতে হৃদয় আচ্ছাদিত হয়ে যায়৷ হাসপাতালে সাহচর্যদানকারী সেই স্ত্রীলোকটির সঙ্গে নতুন জীবনে প্রবেশ করে অতীতের সকল ক্লেদাক্ত কালিমাকে ধুয়ে৷ সেই স্ত্রীলোকটির সহায়তায় স্বহস্তে পরিশ্রম করে নিজের খাওয়াপরার ব্যবস্থা নিজেই করে নেয়৷ আর নিজের পরিশ্রমলব্ধ উপার্জন দেখে প্রবল আত্মতৃপ্তি অনুভব করে সে৷ সে সম্পর্কে তার নিজেরই স্বীকারোক্তি—‘‘আমি এতদিন বেশ্যাবৃত্তি দ্বারা যে এত টাকা উপার্জ্জন করিয়াছিলাম তাহাতে একদিনের জন্যও আমার এমন সুখ ও এমন আনন্দ কখন হয় নাই৷ এতদিন যত কিছু উপার্জ্জন করিয়াছিলাম, সকলই কুকার্য্যের বেতন স্বরূপ৷ আজ এই আমার প্রথম দিন যে আমি আনন্দের সহিত পয়সা উপার্জ্জন করিলাম৷ আর আমি আজ কত সুখী হইলাম! আঃ আজ কি আনন্দ!’’৭০ শরীর বিক্রয়ের অপমানজনক জীবিকা থেকে বেড়িয়ে এসে সুস্থ পরিবেশে সম্মানজনক কাজের মধ্য দিয়ে উপার্জন করে এলোকেশী যে আত্মসুখ লাভ করেছে তা বারবধূদের জীবনের প্রতি এক স্বর্ণোজ্জ্বল দিকনির্দেশ; তাদের মুক্তির মহামন্ত্র৷
এভাবে উপন্যাসটিতে দেখানো হয়েছে একজন রূপাজীবার সত্যকার আত্মদাহকে৷ নিজের জীবনধারণের নিরুপায় প্রক্রিয়ায় যে তার নিজের কাছে সর্বদা অসম্মানিত৷ নিষ্ঠুর সমাজব্যবস্থা তাকে আটবছরে বিধবা করেছে, ক্রমে সেই বালবিধবা যৌবনের পরশমণির স্পর্শে উজ্জীবিত হয়ে চারিদিকের আকর্ষণীয় পরিবেশের হাতছানিতে বৈধব্যজীবনের শুচিস্মিত আস্বাদন থেকে দূরে গিয়ে পাপপঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে রক্ষিতার ঘৃণ্য জীবন উপহার পেয়েছে৷ যার সঙ্গে ঘর ছেড়ে রক্ষিতা হয়েছিল সেই ক্ষেত্রবাবুর মৃত্যুর পর সরাসরি দেহের দর হেকেছে নিজের রূপ-যৌবনকে কাজে লাগিয়ে অর্থাৎ প্রকাশ্যে বেশ্যাবৃত্তি করেছে কোনো উপায় না দেখে৷ অবশেষে খ্রিস্টধর্মের ছত্রছায়ায় মুক্তি পেয়েছে বহুভোগ্যার গ্লানি থেকে৷ ‘এলোকেশী বেশ্যা’ উপন্যাসে একদিকে যেমন বর্ণিত হয়েছে হিন্দুত্বের সমাজ অনুশাসনে আবদ্ধ হয়ে এক নারীর গণিকা হয়ে যাওয়ার চিত্র তেমনি অন্যদিকে খ্রিস্টধর্মে উদার ছায়ায় ঘটেছে তার আত্মজাগরণ৷
চন্দ্রা :
গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘চন্দ্রা’ উপন্যাসটি ‘কুসুমমালা’ নামক এক স্বল্পজীবী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ১২৯১ সালে বা ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে৷ এর গ্রন্থরূপে আত্মপ্রকাশ ১২৯৪ সাল বা ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে, প্রকাশক ‘বন্দ্যো ও মুখার্জি’৷ রচনাকার একে ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন৷ কারণ এর পটভূমিকায় তিনি ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের কথা, মঙ্গল পাঁড়ে, নানা সাহেব, লর্ড ও লেডি ক্যানিং, পাদ্রী আলেকজান্ডার ডাফ ইত্যাদি ঐতিহাসিক চরিত্রগুলিরও উপস্থাপন করেছেন৷
‘চন্দ্রা’-য় আলাদা করে কোনো গণিকা চরিত্রের উল্লেখ নেই কিন্তু উপন্যাসের নায়িকা চন্দ্রা ও তার সতী সাধ্বী মা তারা সমাজের নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে গণিকা না হয়েও সমাজের চোখে গণিকা হিসেবে প্রতিবিম্বিত হয়৷ চন্দ্রার পিতা জনার্দ্দন যুবা বয়সেই সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিল৷ পারস্যরাজ্যের পাৎসাহের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার সময় পাঞ্জাবে এক বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করে৷ সেখানে দর্শন পায় তারার৷ অসামান্য রূপবতী এই রমণী সেই পাঞ্জাবি গৃহকর্তার কন্যা৷ তারার মনেও প্রণয় সঞ্চার হয়৷ সেই যুবক সন্ন্যাসীর প্রেমে নিজেকে উৎসর্গ করে তার সঙ্গে গৃহত্যাগ করে৷ সন্ন্যাসীও সন্ন্যাসধর্ম ভুলে গৃহী জীবনে পদার্পণ করে৷ তারার জীবন সুখে ভরে যায়৷ সমাজ তারাকে সহজ চোখে দেখেনি৷ সে মহারাষ্ট্রীয় পরিচয়ে স্বামীর সংসারে বসবাস করলেও পরে তার পাঞ্জাবি পরিচয় সকলের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ে৷ তাকে সমাজের চোখে জনার্দ্দনের স্ত্রী হয়েও রক্ষিতা পরিচয়ে থাকতে হয়৷ জনার্দ্দনের কথায় এর প্রতিধ্বনি—‘‘প্রথমে মহারাষ্ট্রীয় বলিয়া পরিচয় দিই৷ পাঞ্জাবী প্রকাশ হওয়ায় সকলে ভাবিল, বিবাহ করি নাই৷’’৭১ যাইহোক সমাজের অসহায়তা এবং স্বামীর সহায়তায় দিন কেটে যাচ্ছিল তারার৷ তার সেই সুখের সংসারে আগুন লাগে স্বামীর মিথ্যা সন্দেহে৷ এক অত্যাচারী ইংরেজ কর্মাধ্যক্ষকে বধ করে আত্মগোপন করে থাকার সময় স্ত্রীর সঙ্গে রাত্রি দুই প্রহরে দেখা করতে এসে স্ত্রীকে তার বসার ঘরে এক ইংরেজের সঙ্গে কথা বলতে দেখে মিথ্যে সন্দেহ প্রজ্জ্বলিত হয় জনার্দ্দনের মনে৷ প্রবল ঘৃণায় বেশ্যাজ্ঞানে তাকে পরিত্যাগ করে চলে যায় জনার্দ্দন৷ ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতা আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন তারা স্বামীর সেই অপমান মেনে নিতে পারে না৷ তাই স্বামীর ঔরসজাত তার গর্ভস্থ সন্তান চন্দ্রার বয়স দশ বৎসর হলে নিজেকে সকলের চোখে মৃত প্রতিপন্ন করে ভিখারিনিবেশে প্রতিশোধ স্পৃহায় ঘুরতে থাকে৷ অবশেষে ইংরেজবিদ্বেষী স্বামী গোঁসাইজীর জীবনে চরম পরাজয় সাধিত করে পুনরায় সকলের সামনে নিজের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করে স্বামীর সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে৷
চন্দ্রাও তার মায়ের মতো সমাজের চোখে হীন৷ সেও শিক্ষিতা, সুন্দরী এবং সর্বকর্মে সুনিপুণা৷ মিশনারিদের যত্নে মানুষ হলেও, ইংরেজদের সঙ্গে ওঠা-বসা করলেও কোনোভাবেই সে তার ধর্ম ও নারীত্বকে বিসর্জন দিতে পারেনি৷ সমাজের কোনো কোনো মানুষের তার প্রতি হীন আচরণ ও মনোভাব তাকে ব্যথিত করত—‘‘পিতামাতা কেহই নাই, কুলবধূর ন্যায় লজ্জা সরম ছিল না৷ কেহ কেহ তাঁহাকে বেশ্যা মনে করিত; অনেকে পত্র লিখিত৷ ইহাতে তিনি আপনাকে অতিশয় হতভাগিনী বিবেচনা করিতেন৷’’৭২ তারপর একদিন জলমগ্ন হয়ে এক নবীন সন্ন্যাসীর সেবা-যত্নে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসে—‘‘নূতন আশা, নূতন ভরসা মনে স্থান পায়, জীবন সম্পূর্ণ রসশূন্য নয়, জ্ঞান হয়৷’’৭৩ তার কোমল নারী হৃদয়ে অচিরেই অধীশ্বর হয়ে বসে সে৷ ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশা করে চন্দ্রা বুঝতে পারে তার প্রেমাস্পদের জীবন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ৷ সে তার সমস্ত সাধ্য প্রয়োগ করে তাকে সেই পথ থেকে ফেরানোর জন্য৷ প্রথমে অনুনয় বিনয় করে বলে—‘‘সন্ন্যাসী, কেন প্রাণ দিবে? ইংরাজ-বিরোধী কি নিমিত্ত হইতেছ? আমায় কৃপা কর, আমায় রক্ষা কর, দুরভিসন্ধি পরিত্যাগ কর, এপথে আর চলিও না৷… দেখ, আমার চক্ষে ধারা বহিতেছে—দেখ, আমি কাতর হইয়াছি৷ আমায় কাতর দেখিলে ত তুমি কথা কও! সন্ন্যাসি, কথা কও, যে পথে চলিতেছ সে পথে আর চলিও না৷ আমায় হতভাগিনী শুনিয়া দুঃখিত হইয়াছিলে, কেন আরও হতভাগিনী কর? আমায় রক্ষা কর, আমায় প্রাণদান দাও—সন্ন্যাসী, আমার জীবনদাতার প্রাণদান মাগিতেছি, নির্দ্দয় হইও না, অবলা অনাথিনীকে কৃপা কর৷’’৭৪ এভাবে আরও বহু কথা বলে চন্দ্রা যখন প্রেমাস্পদকে নিরস্ত করার চেষ্টা করতে থাকে এবং তার উত্তরে সন্ন্যাসী যখন বলে যে, বেশি অনুনয় করলে সে সেই স্থান পরিত্যাগ করে চলে যাবে তখন চন্দ্রাকে বাধ্য হয়েই চুপ করতে হয়৷ পরে সন্ন্যাসী চন্দ্রার থেকে বিদায় নিয়ে তার গৃহ পরিত্যাগ করলে সেই সুযোগে চন্দ্রাকে আক্রমন করে লম্পট রমানাথ৷ চন্দ্রার আর্তনাদ সন্ন্যাসীর কর্ণে পৌঁছাতে দেরি হয় না৷ তাকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রবলভাবে আহত হয় সেই সন্ন্যাসী৷ আহত অবস্থাতেই পাহারাওয়ালা কর্তৃক ধৃত হয়ে বিচারাধীন আসামি হিসেবে হাসপাতালে স্থান পায়৷ আর রমানাথও ধরা পরে টাকার জোরে সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়েও হাসপাতালে রোগী সেজে দিন গুজরান করে৷ সন্ন্যাসীকে দেখতে চন্দ্রা হাসপাতালে উপস্থিত হলে তাকে অনুসরণ করে প্রণয়বাক্য বলে রমানাথ৷ সন্ন্যাসী লম্পট, নারীলোলুপ রমানাথকে চন্দ্রার সঙ্গে দেখে চন্দ্রার চরিত্র সম্পর্কে নিঃসন্দিগ্ধ হয়ে ভাবে যে—‘‘এ স্ত্রীলোকটা ভ্রষ্টা৷’’৭৫ তার গুরুদেব যথার্থই বলেছিলেন যে সে একজন পিশাচিনী৷ আর সে কথা মনে হতেই চন্দ্রাকে অপমান করে সেখান থেকে দূর করে দেয়৷ চন্দ্রার মধ্যেও ছিল তার মায়ের মতো আত্মমর্যাদাবোধ সে তার সমস্ত ভালোবাসা নিজ হৃদয়ে পুঞ্জিভূত করে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যতদিন না সন্ন্যাসীর সেই ভুল ভাঙিয়ে দেবে ততদিন তার মুক্তি নেই৷ আর তাই সব দিক দিয়ে সে রক্ষয়িত্রীর ভূমিকা নেয় সন্ন্যাসীর৷ যেখানেই বিপদের সম্ভাবনা দেখে সেখানেই ছুটে যায় তাকে রক্ষা করতে৷ সন্ন্যাসী অহিতকারী দুর্বৃত্ত রামচাঁদকে অনুসরণ করতে গিয়ে তার দ্বারা ধৃত হয়ে নিক্ষিপ্ত হয় মুসলমান বদমায়েশদের যৌনখোরাক হিসেবে৷ সেখান থেকে রমানাথের কৌশলে উদ্ধার পেয়ে সৎপথে ফিরে আসা রমানাথের প্রণয়বাক্যের উত্তরে তার সন্ন্যাসীর প্রেমে উৎসর্গীকৃত অবস্থার কথা ব্যক্ত করে করজোড়ে জানুপেতে নিবেদন করে—‘‘মহাত্মন! নিজগুণে মার্জ্জনা করুন৷ আমি আমার নহি, আপনার হইব কি?’’৭৬ চন্দ্রার সেই বিনম্র প্রত্যাখ্যান রমানাথকে বিহ্বল করে দেয়৷ সে সন্ন্যাসীর অনুসারী হয়ে যুদ্ধ করে নিজেকে উৎসর্গ করতে চায়৷ সন্ন্যাসীর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে সে ইচ্ছা ব্যক্ত করলে সন্ন্যাসীর মনের মধ্যে তাকে দেখা মাত্রই ঘৃণ্য এক অনুভূতির অনুরণন হয়৷ রচনাকার সন্ন্যাসীর সেই মনোবিকারকে ব্যক্ত করেছেন এইভাবে—‘‘দেখিবামাত্র সোমনাথ চিনিলেন; চন্দ্রার কথা মনে পড়িল, মনে বিষ উদয় হইল৷’’৭৭ তারপর এক্কাওয়ালার চন্দ্রার নামাঙ্কিত সোনার ফুল রমানাথকে ফেরত দেওয়া দেখে প্রবল শ্লেষে সন্ন্যাসী বা সোমনাথকে বলতে শোনা যায়—‘‘চন্দ্রাকে রাখিয়া যুদ্ধ করিতে আসিয়াছ? …যাহার মাথার এই ফুলটী, যাহার সহিত এক্কা চড়িয়া মাঠে বেড়াইতে গিয়াছিলে, তিনি কি তোমার সঙ্গে আছেন?’’৭৮ সন্ন্যাসীর মনের বিকার রমানাথের বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ সে আদ্যপান্ত চন্দ্রার সমস্ত ঘটনা তার সকাশে ব্যক্ত করে মনের ভ্রম ভাঙাতে চেষ্টা করে কিন্তু পুরুষের পৌরুষের গর্বে গর্বিত সোমনাথের সে সকল কথায় প্রত্যয় জন্মে না৷ চন্দ্রা তো কুলটা নয়, ব্যভিচার দোষেও দুষ্ট নয়; তার হৃদয়ের অধীশ্বর সন্ন্যাসীর জীবন রক্ষার্থে এবং মিথ্যা সন্দেহ ভঞ্জন করতে বদ্ধপরিকর সে৷ তাই ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধলে সন্ন্যাসীর তত্ত্ব নিতে সমস্ত বিপদ মাথায় নিয়ে পথে বের হয়, রামচাঁদ ও নানা সাহেবের গোপন শলা শুনে নানাসাহেবকে প্রকৃত সত্য অবগত করায়, তারপর সন্ন্যাসীর দেখা পেয়ে তাকে আসন্ন ভয়ঙ্কর বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে প্রবলভাবে তিরস্কৃত হয় তার দ্বারা৷ তার কর্কশবাক্যে আহত হয়ে চন্দ্রা সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েও গোরার দলকে তার দিকে আসতে দেখে পুনরায় সে সন্নাসীর সমীপে উপস্থিত হয়ে অনুনয় করতে থাকে—‘‘সন্ন্যাসি পলাও! গোরায় তোমার প্রাণ বধ করিবে৷ পলাও!’’৭৯ সন্ন্যাসী তার কথা শোনে না৷ গোরার গুলিতে বিদ্ধ হয়ে চন্দ্রা মূর্ছিত হয়ে ভূলুন্ঠিত হয়৷ এক ইংরেজ রমণীর অনুরোধে সে মৃত্যু মুখ থেকে রক্ষা পেয়ে বিচারাধীন আসামি হিসেবে কলকাতায় চালান হয়৷
আহত চন্দ্রা তিন দিন পর চৈতন্যপ্রাপ্ত হয় সেই রক্ষয়িত্রী বিবির যত্নে৷ জ্ঞান ফিরতেই সে ব্যাকুলভাবে সেই বিবিকে বলে—‘‘যদি বন্ধু হন, আমার প্রাণরক্ষা করুন—সন্ন্যাসীর কি হইল বলুন?’’৮০ বার বার তিরস্কৃত অপমানিত হয়েও চন্দ্রা তার তত্ত্ব নিতে ভোলে না৷ বিবির কাছে তার কলকাতায় চালান হওয়ার খবর শুনে সেও কলকাতায় যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে৷ উঠে বসতে গিয়ে পুনরায় মূর্ছিত হয়ে পড়ে৷ তারপর টানা দুই পক্ষকাল জ্বরে অচৈতন্য হয়ে থেকে কিছুটা সুস্থ হলে ডাক্তারকে অনুরোধ করে কলকাতায় যাওয়ার অনুমতি দিতে কারণ সন্ন্যাসীকে না দেখলে, তার কুশল না শুনলে সে বাঁচবে না৷ ডাক্তার বুঝতে পারেন চন্দ্রার যা মনের অবস্থা তাকে যাওয়ার অনুমতি দিলে যতটা আশঙ্কা না যেতে দিলে তার চেয়ে বেশি আশঙ্কা৷ সুতরাং তিনি অনুমতি দিতে বাধ্য হন৷ চন্দ্রা কলকাতায় উপস্থিত হয়ে লর্ড ক্যানিং-এর সামনে উপস্থিত হয়ে ইংরেজদের কাছে কঠিন অপরাধে অপরাধী সন্ন্যাসীর জন্য নাছোড়ের মতো প্রাণ প্রার্থনা করে বলতে থাকে—‘‘একজনের অপরাধে দুইজনের প্রাণবধ কি নিমিত্ত করিবেন? সেই বিদ্রোহী, আমি আপনার প্রজা-কন্যা, আমার প্রাণবধ কি নিমিত্ত করিবেন? পিতঃ, আপনি দয়াগুণে শ্রেষ্ঠ, কেবল কি অভাগিনীর প্রতি প্রসন্ন হইবেন না? জগৎ আপনাকে দয়াবান বলিবে—সুমেরু হইতে কুমেরু পর্য্যন্ত আপনার গুণ-গানে প্রতিধ্বনিত হইবে, কেবল কি এই অবলা জানিবে, আপনার হৃদয়ে দয়া নাই? কেবল কি আমার প্রতি কঠিন হইবেন? পিতঃ, অভাগিনী পিতার মুখ দেখে নাই, বাল্যকালে মা মমতা-ত্যাগ করিয়া গিয়াছেন, সমাজে স্থান দেয় নাই, কখনও কোন সাধ পূর্ণ হয় নাই, অভাগিনী কেবল দুঃখ পাইয়া আসিতেছে৷ পিতঃ, তুমিই এই দুঃখময় জীবন সুখময় করিতে পার৷ রাজ্যেশ্বর, ঈশ্বরের প্রতিনিধি, আমার প্রতি দয়া কর!’’৮১ লর্ড ক্যানিং এবং লেডি ক্যানিং-এর সহৃদয়তায় এবং তার কাতরোক্তিতে সন্ন্যাসী মুক্ত হয়৷ লেডি ক্যানিং চন্দ্রাকে অনুরোধ করে সে যেন নিজে গিয়ে সন্ন্যাসী ও তার মাকে মুক্ত করে আনে৷ তার সেই প্রস্তাবে চন্দ্রা অস্বীকৃত হলে বিস্মিত হয়ে যায় লেডি ক্যানিং৷ কারণ যে তার ভালোবাসাকে রক্ষার জন্য জীবন পণ করে বসে আছে সে-ই আবার তার সম্মুখে যেতে চাইছে না! সে লেডি ক্যানিংকে জানিয়েছে—‘‘মাগো! স্ত্রীলোকের প্রাণে কত সয়? আমার যা বলিবার ছিল, কার্য্যে বলিয়াছি—আর দেখা করিব না৷’’৮২
সন্ন্যাসী এবারে তার ভুল বুঝতে পারে৷ সে যথার্থই অনুধাবন করতে পারে চন্দ্রা সতী এবং তার যথার্থই অনুরাগিনী৷ এবারে সে তাকে গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত৷ ভিখারিনীবেশী চন্দ্রার মায়ের তার হাতে দেওয়া চন্দ্রার উদ্দেশ্যে পত্রখানি নিয়ে সে তাই উপস্থিত হয়েছে চন্দ্রার বাড়িতে৷ উদ্দেশ্য স্বহস্তে সেই পত্রখানি চন্দ্রার কাছে দিয়ে নিজের সমস্ত দৈন্যতাকে স্বীকার করে নেবে৷ সেখানে দ্বারোয়ানের হাতে স্বনামাঙ্কিত পত্র প্রেরণ করে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ভেবেছে যে, চন্দ্রা তার আগমনের সংবাদ পেয়ে আহ্লাদিত হয়ে সাগ্রহে তাকে আপ্যায়ন করবে৷ কিন্তু চন্দ্রা আসে না৷ আসে দ্বারোয়ানের হাত দিয়ে তার লেখা একখানি পত্র৷ সেখানে সে তাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে—‘‘সন্ন্যাসী, আমার প্রয়োজন সিদ্ধ হইয়াছে৷ তোমার সহিত আর আমার কার্য্য নাই৷ জেলে তোমার নিকট শুনিয়াছিলাম, তোমারও আমার সহিত কার্য্য নাই৷ পত্রের দ্বারা এই শেষ কথা৷—চন্দ্রা৷’’৮৩ এখানেই অনন্য গিরিশচন্দ্র৷ তিনি নারীর আত্মমর্যাদাবোধকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যে চন্দ্রাকে বেশ্যা জ্ঞানে সর্বদা বিষনজরে প্রত্যক্ষ করেছে সন্ন্যাসী, যে তারাকে ব্যভিচারিণী ভেবে মুহূর্তে পরিত্যাগ করেছিল জনার্দ্দন তারা কেউই পুনরায় তাদের নারীত্বকে সেই গর্বিত পুরুষের কন্ঠলগ্না করেনি বরং নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণিত করে সেই পুরুষদের থেকে বহুদূরে সরে গিয়েছে৷
রামেশ্বরের অদৃষ্ট :
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোট্ট উপন্যাস ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে৷ গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে এটি প্রথম ভ্রমর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল৷ এর নায়ক রামেশ্বর শর্মা ভাগ্যবিড়ম্বিত যুবক৷ পিতৃবিয়োগের পর পিতৃকর্তব্য পালনার্থে পিতার সমস্ত সঞ্চয় ব্যয় করে পিতার শ্রাদ্ধে৷ শুরু হয়ে যায় কপর্দকহীন মর্মান্তিক জীবন যুদ্ধ৷ স্ত্রী-পুত্র নিয়ে অনাহারে দিন কাটে তার৷ ক্ষুধার্ত পুত্রের মুখে অন্ন তুলে দিতে গিয়ে আট আনা চুরি করে সাময়িক খুন্নিবৃত্তি নিবারণের জন্য৷ অবশেষে চলে যায় ভিন গায়ে, সেখানেও একই অবস্থা৷ জমিদারের নায়েব জমিদারিতে অন্যের চুরির দায় তাকে গ্রহণ করার জন্য পঞ্চাশটাকা অগ্রিম দেয়৷ চুক্তিমত চুরির দায়ে আবদ্ধ হলে শোকে উন্মাদিনী স্ত্রীকে দেখার জন্য রক্ষকের কাছ থেকে পালিয়ে এসে সাক্ষাৎ করে নায়েববাবুর সঙ্গে স্ত্রীর একত্রে ঘরে অবস্থান৷ অবরুদ্ধদ্বার ঘর স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে তার মনে সন্দেহ বদ্ধমূল করে৷ আসলে নায়েববাবু এসেছিল রামেশ্বরের চুরির প্রমাণস্বরূপ চুরির মাল তার স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে ঘরে রাখার জন্য৷ যাতে রামেশ্বর কোনো অবস্থাতেই সেই মিথ্যা চুরির দায়কে অস্বীকার করতে পারে না৷ রামেশ্বর শুধু নায়েববাবুকে দরজা বন্ধ করতেই দেখেছিল কিন্তু কোনো কথা শুনতে পায়নি৷ রামেশ্বরের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে স্ত্রীর পরপুরুষ সম্ভোগের ধারণায়৷ এইভাবে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রামেশ্বরের সন্দেহের মধ্য দিয়ে গণিকা প্রসঙ্গের অবতাড়না করেন৷ চরম ক্রোধে বন্ধ দ্বারে পদাঘাত করে রামেশ্বর বলে—‘‘আমি আসিয়াছি, তুমি যাহার জন্য কাঁদিতেছিলে, সেই আমি আসিয়াছি—তোমার উপপতি তোমার ঘরে আছে, এখন আমি চলিলাম৷’’৮৪ স্বৈরিণীজ্ঞানে স্ত্রীকে ফেলে, পুত্রকে ফেলে চুরি, স্ত্রীহত্যাসহ জমিদারির যত অপরাধ আছে সবকিছুর দায় শিরোধার্য করে বিশবছরের সাজা নিয়ে দ্বীপান্তরে চলে যায়৷
উপন্যাসের দ্বিতীয়পর্বের ঘটনা বিশ বছর পরের৷ এখানে উল্লেখ আছে এক নামহীনা গণিকার প্রসঙ্গ৷ স্ত্রীকে গণিকা জ্ঞানে ত্যাগ করে গিয়েছিল রামেশ্বর৷ তার প্রতি সেই ধারণাই বদ্ধমূল রয়েছে৷ কিন্তু সন্তানকে তো অস্বীকার করতে পারে না পিতার স্নেহ৷ তাই বিশ বছর সাজা কাটানোর পর আবার উপস্থিত হয় তার স্বদেশ ভাতিপুরে৷ সেখানে এসে দেখতে পায় এক গণিকাকে৷ তার আকার অবয়ব দেখে নিশ্চিত যে সে বেশ্যা৷ কিন্তু তার বয়স তাকে চমকে দেয়৷ গণিকার বয়স চল্লিশ হবে৷ বিশবছর পূর্বে যখন সে দ্বীপান্তরে গিয়েছিল তখন তার স্ত্রী পার্বতীর বয়সও বিশ বছর ছিল৷ সুতরাং সেই গণিকাকে পার্বতী ভেবে তার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়৷ দেহব্যবসায়ী নারীরা কি ধরনের পোশাক পরিধান করে, পরপুরুষ ভোলানোর জন্য কি ধরনের সাজগোজ করে সে সম্পর্কে লেখকের স্বচ্ছ ধারণা ছিল৷ সেই চল্লিশ বছর বয়স্কা বিগত যৌবনা গণিকা—‘‘রক্তবর্ণ বস্ত্র পড়িয়া, শুষ্ক বনফুলের মালা গলায় দিয়া তামাক খাইতে খাইতে একজন মুসলমানের সহিত কথা কহিতেছে৷’’৮৫ এই বারবনিতার রূপ বিরূপ হয়েছে, যৌবন গত হয়েছে, শরীরের সব রস-লাবণ্য শুকিয়ে গেছে তাই তার গলার বেলফুলের মালাটিও শুষ্ক; বিগত যৌবনের সাক্ষী হয়ে গলার মধ্যে ঝুলে রয়েছে৷ সেই গণিকা রূপ-রস-রঙ হারিয়েও মুসলমান পুরুষের সঙ্গে কথা বলছে বা খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলে দেহের বিকিকিনির জন্য, জীবনধারণের জন্য৷ শুষ্ক মালাটি সেই বিগতযৌবনা গণিকার জীবনের প্রতীক৷ রামেশ্বর তাকে পার্বতী ভেবে তার কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়, গম্ভীরভাবে সন্ধান চায় ছেলে আনন্দদুলালের৷ কিন্তু গণিকা তো গণিকাই৷ সে কত পুরুষকে শয্যা দিয়েছে, কত পুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়েছে৷ তাই রামেশ্বরের মুখে ছেলের কথা শুনে স্বাভাবিক লাস্যভঙ্গিতে—‘‘বেশ্যা আকাশমুখী হইয়া হাসিয়া উত্তর করিল, ‘‘কে তোর ছেলে?’’৮৬ রামেশ্বর পার্বতী ভেবে অটল বিশ্বাসে আনন্দদুলালের নাম করলে নটী তার স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব দেয়—‘‘মরণ আর কি! তোমার দড়ি কলসী জোটে না?’’৮৭ তারপরেও বিরত হয় না রামেশ্বর৷ বরং বেশ্যার তাচ্ছিল্যপূর্ণ উত্তরে তার ক্রোধ আরও বেড়ে যায়৷ সে যখন ক্রোধান্বিত হয়ে পুনরায় সেই গণিকার কাছে ছেলের সন্ধান চায় তখন গণিকার দেওয়া উত্তর ঠিক বেশ্যাসুলভ ভাবেই প্রকাশিত হয়—‘‘চুলায় পাঠাইয়াছি—নদীর ধারে তারে পুঁতিয়া আসিয়াছি—তাহার ওলাওঠা হইয়াছিল সে গিয়াছে, এক্ষণে তুমি যাও৷’’৮৮ রামেশ্বর আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না৷ সরাসরি তাকে আক্রমণ করে৷ বিনাদোষে তার পদাঘাতে বিপর্যস্ত হয় বছর চল্লিশের সেই নারী৷
আসলে গণিকাদের জীবনই অমন৷ তাদের ভালোবাসা বিক্রয়ের খেলায় সত্যিকারের ভালোবাসার কোনো স্থান থাকে না৷ যখন যেভাবে খুশি যে কেউ তাদের আঘাত করতে পারে৷ তার প্রতিকার হয় না৷
দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন :
দুর্গাচরণ রায়ের লেখা ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’ উপন্যাসটি ১৮৮০ খ্রিস্টব্দে (১২৮৭ বঙ্গাব্দে) প্রথম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ‘কল্পদ্রুম’ পত্রিকায়৷ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে৷ তখনও পর্যন্ত রচনাকার অজ্ঞাত৷ পরবর্তী সময়ে ১৮৮১ সালে ঐ ‘কল্পদ্রুম’ পত্রিকাতেই দুটি লেখার সন্ধান পাওয়া যায় যা দুর্গাচরণ রায়ের স্বাক্ষরিত৷ সেই রচনাদুটির রচনাশৈলী এবং বিবরণের সঙ্গে ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এর সাদৃশ্য লক্ষ করে এর রচয়িতা যে দুর্গাচরণ রায়ই সে বিষয়ে নিঃসন্ধিগ্ধ হয়েছেন সমালোচকেরা৷ উপন্যাসটিতে তৎকালীন সময়ের ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিবেশের এক জীবন্ত ছবি ব্রহ্মা, নারায়ণ, ইন্দ্র এবং বরুণের মর্ত্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় চিত্রিত হয়েছে৷ দেবতারা স্বর্গের অলসপ্রিয় বিস্তৃর্ণ অবসরের ক্লান্তিকর একঘেয়েমি থেকে মুক্তির জন্য সংকল্প নেন কলকাতা ভ্রমণের৷ কলকাতা বিলাসপ্রিয়তা, আরামপ্রিয়তা, আনন্দ-বিনোদনের বিস্তির্ণ সুযোগ-সুবিধার জন্য চিরকালই তাঁদের আকর্ষণীয় এক স্থান৷ ইংরাজ, বাবু শ্রেণীর আগমনের ফলে তার আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে৷ জলধিপতি বরুণ তাই কলকাতা সম্পর্কে ইন্দ্রকে জানান—‘‘যদি একবার ইংরাজ-রাজধানী কলিকাতা দেখ, অমরাবতীতে আর আসিতেও চাহিবে না৷ এখানে তুমি সামান্য সুন্দরী শচীকে পাইয়া ভুলিয়া আছ; কিন্তু কলিকাতায় যাইয়া যদি আরমানি বিবি দেখ, হয়তো আর শচীর প্রতি ফিরেও তাকাইবে না৷ এখানে তুমি সামান্য বন নন্দন-কাননে যাইয়া অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত বসিয়া থাক, কিন্তু কলিকাতায় যাইয়া যদি একদিন ইডেন গার্ডেনে প্রবেশ কর, তাহলে হয়তো আর ফিরে আসতে চাইবে না৷ তুমি স্বর্গীয় ধেনো মদকে সুধা বল, কিন্তু ইংরাজ রাজ্যে যাইয়া যদ্যপি সেরি, স্যাম্পেন, ব্রাণ্ডি পান কর, হয়তো আর এ সুধা মুখেও করবে না৷ ইংরেজরা তৈল-শলিতা-বিহীন লন্ঠনে আলো জ্বালে৷ লৌহ-তারে খবর আনে৷ জলে কলের তরী চালায়৷ কুইনাইন নামক ঔষধে সদ্যঃ জ্বর আরাম করে৷ ইংরাজকৃত কুইনাইনের শিশি সম্বল করিয়া কত শত গণ্ডমূর্খ ধন্বন্তরি হইয়া পথে পথে ডিসপেন্সরি খুলে বিরাজ করিতেছে৷’’৮৯ অমরাবতী থেকে কলকাতা আসার পথে ভ্রমণ করেন ভারতবর্ষের আরও বহু বিখ্যাত স্থান৷ আর এই অনুসঙ্গেই বিস্তারলাভ করেছে সমগ্র উপন্যাসের কাহিনি৷
যদিও সমগ্র উপন্যাসটিই ভ্রমণবৃত্তান্তে পরিপূর্ণ তথাপি একে ঠিক ভ্রমণ উপন্যাস বলতে চাননি এর প্রকাশক৷ এ সম্পর্কে তার স্পষ্ট বক্তব্য—‘‘এই গ্রন্থ ভ্রমণ উপন্যাস নয়, ক্ষমতার হস্তান্তরের (কোম্পানি পর্ব থেকে ইংরাজ সরকার) আরও এক আখ্যান৷ আপাত হালকা, মজলিসি চালে লেখা হলেও এই আখ্যানের অন্তর্লীনতা আমাদের আজকের এই সংকট ও সম্ভাবনাময় দিনে জিজ্ঞাসার নানান উৎসমুখের সঞ্চার করে : ঐতিহাসিকদের হাত ছাড়িয়ে ভাবনা চালিত হয় ইতিহাস নির্মাণের আখ্যানে৷’’৯০ উপন্যাসটির সম্পূর্ণ অবয়বের পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গণিকা জীবনের কথা৷ ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে একটা গুরুতর দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এই গণিকা সমাজের উপর৷ রচয়িতার কলমে এরা অঙ্কিত হয়েছে চরিত্রস্খলনের প্রধান হাতিয়াররূপে৷ রচনাটি বিষদ বিশ্লেষণ করলে উনিশ শতকের সমাজজীবনে গণিকাদের অবস্থানগত ধারণাটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়৷
ব্রহ্মা, ইন্দ্র, নারায়ণ, বরুণ প্রমুখ দেবগণ কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে হরিদ্বার হয়ে দিল্লীতে পৌঁছান তখন নবাব-বাদশাদের বেগমদের পর্দাসীন হয়ে থাকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বরুণদেব তাদের বোঝান যে দিল্লীতে কোথাও কোথাও বিবিদের পর্দাসীন হয়ে থাকার দৃশ্য দেখা গেলেও কলকাতার নিয়ম স্বতন্ত্র৷ সেখানকার বাবুরা তাদের স্ত্রীদের শুধু একাধিক জানালাযুক্ত দোতলা-ত্রিতলা ঘরে রেখেই তৃপ্ত হয় না কখনো কখনো খোলা গাড়িতে তাদের বিবি সাজিয়ে লোকচক্ষুর সম্মুখ দিয়ে হাওয়া খাইয়ে আনে৷ বরুণের মুখে নারীস্বাধীনতার এহেন বাড়াবাড়ির কথা শুনে পিতামহ ব্রহ্মা ঘোর কলিযুগ যে আগত প্রায় তার আভাস দেন৷ কারণ বিধাতার লিখন অনুযায়ী কলির অন্তিম দশায় স্বেচ্ছাচারিণী হয়ে স্ত্রীলোকেরা তাদের অন্দরমহলের আবেষ্টনী ত্যাগ করে যেখানে সেখানে ভ্রমণ করবে৷ এখানে নারীস্বাধীনতার—নারীমুক্তির বিরোধিতা করেছেন পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ পিতামহ ব্রহ্মা৷ দেবতাদের দিল্লী ভ্রমণ প্রসঙ্গে উঠে আসে সেখানকার বাইদের কথা৷ তাদের নৃত্যগীত-পারদর্শিতার কথা আগেই বরুণদেবের জানা ছিল এবং তিনি এজন্য তাদের অনুরক্ত হয়েছিলেন৷ কিন্তু প্রকাশ্যে তাদের তামাক সেবনের দৃশ্য দেখে জলধিপতির অশ্রদ্ধা বেড়ে যায়৷ তাই বিরক্তসহকারে তিনি বলেন—‘‘দিল্লীর বাঈ ভাল শোনা ছিল; কিন্তু মাগীরা বারাণ্ডায় ব’সে যে গুড়ুক তামাকে খাচ্চে, দেখে অশ্রদ্ধা হয়ে গেল৷’’৯১
উপন্যাসটিতে উল্লেখ রয়েছে সেবাদাসী প্রথার৷ এই নির্মম প্রথার মধ্য দিয়ে নারীদেহকে ভোগ করার উত্তম সুযোগ বের করেছে মহাত্মাগণ৷ সেবাদাসী সম্ভোগদৃশ্য দেবতাদের নজরে আসে বৃন্দাবন ভ্রমণ করতে এসে৷ সেখানকার চৈতন্যদাস বাবাজী সত্তর-পঁচাত্তর বছর যার বয়স তার অধীনে রয়েছে ষাট-সত্তর জন সেবাদাসী৷ এদের সহবাসে এবং তাদের ভিক্ষালব্ধ অন্ন ও সেবাযত্নে বয়সের ভারে নুয়ে পরা অশীতিপর বৃদ্ধ চৈতন্যদাস মহারঙ্গে দিনাতিপাত করে৷ শুধু চৈতন্যদাস বাবাজীই নয় তার মতো অনেক বাবাজীই সেবাদাসীদের সেবা নিয়ে ভোগে-কামনায়-বাসনায়-সুখে-আহ্লাদে দিন কাটায়৷ সমস্ত দেখে শুনে রাতে শয্যাগ্রহণ করার সময় সুরগণ লক্ষ করেন বৃন্দাবনে সেবাদাসী জীবনের আরেক অভিনব নিয়ম৷ সেখানকার বিধি অনুযায়ী নারীসঙ্গ ব্যতীত রাত্রিবাস মহাপাপের৷ সেবাদাসীদের আহ্বানে তাদের সঙ্গে শয্যাগ্রহণে অসম্মত হলে এক সেবাদাসীর কথায় ফুটে উঠে গণিকাসুলভ বাক্যভঙ্গি—‘‘মিন্সেরা বলে কি—বৃন্দাবনে কি যুগলরূপ না হয়ে রাত্রি বাস ক’রতে আছে! ওতে যে পাপ হয়৷’’৯২ বৃন্দাবনের সেবাদাসীদের এইরূপ বাক্যবন্ধ থেকে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় তাদের বহুপুরুষে অভ্যস্ত জীবনের নারকীয় এক যাপনের৷ ধর্মীয় বাতাবরণের মধ্যে থেকে ধর্মের দোহাই দিয়ে এই নারীরা নিজের অজান্তেই যুগিয়ে যায় পুরুষদের ভোগ-পিপাসার রসদ৷
উত্তরভারতের লক্ষ্ণৌ বাইজিদের মূল আবাসভূমি৷ নৃত্যগীতপটিয়সী গণিকারা সেখানকার আকর্ষণীয় বিষয়৷ সেখানে গিয়ে বরুণদেব তাঁর সঙ্গী দেবতাদের কাছে সেখানাকার প্রসিদ্ধ বাইনাচ দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেন কারণ লক্ষ্ণৌ গিয়ে যদি বাইনাচ না দেখা হয় সে স্থান ভ্রমণই বৃথা৷ সেখানকার বাইজিদের সৌন্দর্য স্বর্গের মেনকা, ঊর্বশী, তিলোত্তমার সৌন্দর্যকেও হার মানায়৷ তাদের নৃত্যগীত দক্ষতা অপ্সরাদের দক্ষতাকেও ছাপিয়ে যায়৷ তাদের দেখে দেবগণ বিহ্বল হয়ে পড়েন৷ দেবরাজ ইন্দ্র রূপমুগ্ধ হয়ে তাদের দেবপুরীতে নিয়ে যেতে চাইলে স্বর্গের অভিভাবক ব্রহ্মা তরুণ দেবতাদের সতর্ক করে বলেন যে, যে দেশে বাইনাচ, যাত্রা, থিয়েটারের যত বেশি প্রভাব সে দেশ তত বেশি নিম্নগামী৷ স্বর্গরাজ্যে গণিকাদের নিয়ে গিয়ে স্বর্গের পরিবেশকে কলুষিত করতে চান না পিতামহ৷ এরপর দেবতারা উপস্থিত হন কাশীধামে৷ শিবের ত্রিশূলের ডগায় অবস্থিত পবিত্র কাশী৷ সেখানে তাঁদের নজরে আসে এক বাঙালি স্ত্রীলোকের খেমটা নাচ৷ সেই খেমটাওয়ালির জীবন-ইতিহাস দেবতাদের শোনান বরুণ; অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিল সেই খেমটাওয়ালি৷ ভাশুরের দুর্বার কামনায় আহুতি হয় তার৷ কলঙ্কিত জীবনে অন্য কোনো উপায়অন্তর না দেখে তার সঙ্গেই ঘর ছাড়ে সে৷ তখনো হয় তো ঘর বাঁধার স্বপ্ন লেগেছিল তার চোখেমুখে৷ কিন্তু ভোগই যার উদ্দেশ্য, যে তার ভ্রাতৃবধূর প্রতি লালায়িত হতে পারে সে ঘর বাঁধতে যাবে কোন স্বার্থে! তাই জীবনধারণের জন্য সেই নারীকে খেমটা নাচের সাথে সাথে দেহের পসরা সাজাতে হয়েছে৷ নারীত্বের সমস্ত লজ্জাসম্ভ্রমকে বিসর্জন দিয়ে তাকে হতে হয়েছে কুলবধূ থেকে বারবধূ৷ এভাবে বহু কামনার, বহু পাপের কেন্দ্রস্থল হিসেবে কাশী রমরমা হয়ে উঠেছে৷ দেবাদিদেব মহেশ্বরের বহু যত্ন ও সাধনায় প্রতিষ্ঠিত কাশী বেশ্যা-লম্পটের আশ্রয়ে অবাধ যৌনাচারের চারণক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
গণিকা মানেই ভিন্ন এক পরিচিতি; গণিকা জীবন মানেই কদর্য এক জীবনের যাপন৷ সেখানে না আছে সম্মান না আছে শান্তি৷ অথচ তাদের সঙ্গে ভোগ-বিলাসে রপ্ত হয়ে কখনো যশক্ষুন্ন হয় না চরিত্রবান পুরুষসমাজ৷ পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি ব্রহ্মার ভাষায় তাই পতিতারা ‘খারাপ স্ত্রীলোক’৷ দেবতাদের পথ প্রদর্শক বর্ষণের অধিরাজ তাই ব্রহ্মদেবকে বোঝান—‘‘আপনি খারাপ স্ত্রীলোক ব’লে ভয়ে ভয়ে আড়ষ্ট হ’লেন! আজকাল পৃথিবীর সর্ব্বত্রই খারাপ স্ত্রীলোক দেখিতে পাওয়া যায়৷ অতএব বেশ্যার নিকট দিয়া যাইলে পাপ হয়, যে নগরে বেশ্যা থাকে তথায় বাস করিলে পাপ হয়, এত বিচার ক’রে চ’লতে হ’লে আর মর্ত্ত্যে আগমন হয় না৷’’৯৩ গয়ায় গয়ালীগুরু কর্ত্তৃক সুফল প্রদানের দৃশ্য প্রতিবিম্বিত হয়েছে মিরজাপুরে৷ সেখানে উপস্থিত হয়ে দেবতারা লক্ষ করেন সেখানে গয়ালীগুরুদের দারুণ প্রভাব৷ গয়ালীগুরুদের সন্তুষ্ট করতে না পারলে গয়ায় গিয়ে পিণ্ডদান অসম্ভব৷ দেবতারা দেখেন গোলাপী নামের এক বেশ্যা গয়ালীগুরুর কাছে সুফল প্রার্থনা করে৷ সেই গুরু তাকে পাঁচশত টাকার সুফল কিনতে বলে৷ সে গণিকা; অত টাকার সুফল কিনতে যাবে কেন, যদি তা তার গণিকাবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে কম পয়সায় করতে পারে! সে তার লম্পট প্রেমিকত্রয়ের সাহায্য নিয়ে সেই গুরুকে জব্ধ করে পাঁচশত টাকার স্থানে দু’টাকায় সুফল লাভ করে৷ অন্যদিকে আর এক সহায়-সম্বলহীনা গৃহবধূ অনেক সাধ্য-সাধনা করেও গয়ালীগুরুর মন গলাতে পারে না৷ এখানে বর্ণিত হয়েছে ধর্মের নামে সমাজপ্রভুদের চরম শোষণের দৃষ্টান্ত৷ সেখানে সাধারণ গৃহবধূ থেকে পতিতা কেউই বাদ পড়ে না৷ আর তা দেখে ব্রহ্মা উগরে দেন তার ক্ষোভ৷ তিনি তার সহযাত্রী দেবগণকে জানান যে, যেখানে বেশ্যার দান গ্রহণ করে সুফল প্রদান করা হয় সেখানে তিনি এক মুহূর্তও থাকবেন না৷ গণিকারা সমাজে এতটাই অপাংক্তেয় যে তাদের অর্থজাত সুফলও পিতৃপুরুষের নামে উৎসর্গীকৃত হয় না৷
জামালপুরে বর্ণিত হয়েছে বিবাহিত বাবুদের ঘরে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও উপপত্নী রেখে ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে জীবন কাটানোর ছবি৷ সেখানে মেজবাবু নামের এক চরিত্রের ঘরে দুজন পত্নী থাকতেও নিজের কামনাকে চরিতার্থ করার জন্য উপপত্নী রেখেছে আলাদা করে৷ রাতের পর রাত বিবাহিত স্ত্রীদের উপেক্ষা করে সময় কাটায় সেই রক্ষিতার সাথে৷ কিন্তু রক্ষিতারা তো বহুগামী৷ নিয়ম অনুযায়ী যতদিন ভরণপোষণ জোগাবে ততদিন তাদের রক্ষকবাবুর অধীনে থাকতে হয়, একমাত্র সেই বাবুরই অঙ্কশায়িনী হতে পারে৷ যখন বাবু অক্ষম হবে তখন আর তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না৷ যদিও থাকাটা তাদের স্বভাব নয়৷ তাই বেশিরভাগ সময়ই বাবুকে ফাঁকি দিয়ে তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে মধুচক্রের মোহন বাসর গড়ে তোলে৷ এখানে মেজবাবুর অধীনস্ত রক্ষিতার অন্য গুপ্ত পুরুষ হল বাবুর দুই কেরানি৷ কেরানিদের জীবনও অদ্ভুত ছাঁচে ফেলা৷ সে প্রসঙ্গেও উঠে এসেছে গণিকাদের জীবনালেখ্য৷ সামান্য বেতনের বিনিময়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির চাকরি করে তারা৷ ঘরভাড়া বাঁচানোর জন্য অনেকে মিলে মেসভাড়া নিয়ে থাকে৷ জীবনের দৈন্যতা ভুলতে গুলি, গাঁজা, চরস, চণ্ডু, তাস, পাশার সঙ্গে বেশ্যা নিয়ে জীবন কাটায়৷ স্ত্রী-পরিজন কাছে না থাকায় তাদের দুর্দান্ত যৌনপিপাসাকে পরিতৃপ্ত করে বারবিলাসিনীরা৷ জীবনের চরম অবসাদে গণিকাগৃহে গিয়ে বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করে৷ কেরানিদের মধ্যে যারা সরকারি অফিসের কেরানি তাদের তো কোনো কথাই নেই৷ তারা ভবিষ্যতে পেনশনভোগী হয় বলে অর্থসঞ্চয়ে তাদের তেমন তাগিদ দেখা যায় না৷ বেতনের বেশিরভাগ অর্থ (ভবিষ্যতে পেনশনের ব্যবস্থা থাকায়) বিনা দ্বিধায় খরচ করে ফেলে গণিকাদের পেছনে৷ সেই অর্থ নিয়েই পণ্যাঙ্গনারা বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করে৷
মর্ত্যভূমিতে মানুষজনের নাস্তিক জীবনযাত্রা দেবগণকে ব্যথিত করে৷ তাঁরা প্রত্যক্ষ করেন সেখানকার মানুষজনের পুণ্যের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই৷ তারা শুভ কাজে অর্থ ব্যয় না করে তার সৎব্যবহার করে ভোগ-বিলাসের আনন্দ-মেলায়৷ যার জন্য ভাগলপুরের বুড়াশিবের মন্দির ভগ্নদশা প্রাপ্ত হয়েছে, তা মেরামত করার পয়সা জোটে না৷ তাই নারায়ণ ব্যঙ্গ করে বলেছেন—‘‘যখন মুসলমান বাইওয়ালি সুমধুর সুরে গান ধরে এবং বেশ্যারা অঙ্গভঙ্গীর সহিত নৃত্য করিতে করিতে হাত নাড়ে, সেই আসনে বসিয়া পান চিবাইতে চিবাইতে তামাক টানার যে সুখ, তাহা শত শত বুড়ানাথের মন্দির প্রস্তুত করিয়া দিলেও হয় কি না সন্দেহ৷’’৯৪ বরুণ ভাগলপুরের বারাঙ্গনাদের আমোদ প্রদান বা ‘খদ্দের’ সংগ্রহের কৌশল বলতে গিয়ে তুলে আনেন দিল্লীর প্রসঙ্গ৷ কারণ দিল্লীর মতো রূপে আলো করে অনেক বাইউলি সেখানেও আছে যারা সন্ধ্যাকালে সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে যৌবনমন্দিরে উপবেশন করে, নৃত্য শিক্ষা করে, বিভিন্ন অঙ্গচালনা করে মনের গুপ্ত ইঙ্গিতে মনের গোপন বাসনাকে প্রকাশের কৌশল প্রয়োগ করে৷ বাবুশ্রেণীর বাহাদুরি প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম এই বাররামারা৷ সমাজে সেই ব্যক্তির গৌরবই সবচেয়ে বেশি যে ব্যক্তি তার রক্ষিতার পেছনে যত বেশি খরচ করতে পারে৷ ভাগলপুরের এক বাবুর তার দুই-তিনজন মোসাহেবের কাছে সেজো খুড়ো সম্পর্কে যে কথাগুলি বলেছে তাতে এই দিকটি পরিষ্কার হয়ে যায়৷ যেমন বাবু বলে—‘‘সেজো খুড়ো যে অহঙ্কার করেন—আমার চাইতে তিনি বড়—কিসে? বিষয় উভয়েরই সমান, পরিবারকে গহনা—বরং তাঁহার অপেক্ষা আমি বেশী দিইছি৷ কোম্পানীর কাগজও আমার চাইতে তাঁর বেশী হবে না৷ কিন্তু তা বলি, তাঁর মত কৃপণ হ’লে আমি আরো এক লক্ষ টাকা সঞ্চয় ক’রতে পারতাম৷ যে মদ খায় না, বেশ্যা রাখে না, সে আবার কিসের অহঙ্কার করে? রাখুন দেখি, আমার মত বেতন দিয়ে বেশ্যা রাখুন দেখি, তবে বাহাদুরী বুঝবো৷’’৯৫
কোনো নারী জন্মমাত্রই গণিকা হয় না৷ সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতি তাকে গণিকা তৈরি করে৷ ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে বাধ্য হয়ে প্রবেশ করে গণিকাজীবনে৷ এখানে সম্ভ্রান্ত জমিদারবাড়ির এক কুলবধূর গণিকা হয়ে ওঠার করুণ কাহিনি বর্ণিত হয়েছে৷ স্বামী কর্তৃক অত্যাচারিত হতে হতে তার জীবন বিষিয়ে যায়৷ সেখানেই থেমে থাকে না; তার চোখের সামনে স্বামী অন্য নারী গ্রহণ করে৷ নারীজীবনের শেষ সম্মানিত আশ্রয় আত্মহত্যার দিকে না গিয়ে সংকল্প নেয় শ্বশুর কুলে কালি দেওয়ার, যাতে লোকে তার শ্বশুর-স্বামীর দিকে আঙ্গুল তুলে বলতে পারে অমুক বাবুর স্ত্রী বা পুত্রবধূ পরপুরুষের সঙ্গে বাড়ি ভাড়া করে থাকে৷ তার মতো বহু কুলস্ত্রী স্বামীকর্তৃক লাঞ্ছিতা হয়ে চরম ক্ষোভ ও বিতৃষ্ণায় নিমজ্জিত হয় কলঙ্কিত জীবনের গভীর পঙ্কে৷ এরপরে দেবতারা আসেন বর্ধমানে৷ সেখানে প্রত্যক্ষ করেন এক বেশ্যাসক্ত ব্যক্তির জীবনের শোচনীয় পরাজয়৷ ব্রহ্মা বরুণের কাছে জানতে পারেন যে বাবুটি বেশ্যা খুব ভালোবাসে৷ বেশ্যাকে রক্ষিতা করার অভিপ্রায়ে সে তার সর্বস্ব খুইয়ে বসে; তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিলামে ওঠে৷ বরুণ সমগ্র ঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনা করে বলেন সেই বাবুটি গণিকাপ্রেমের বাড়াবাড়িতে একজন বেশ্যাকে নিজের রক্ষিতা করেন৷ সেই বারাঙ্গনা ভালোবাসার মন্ত্র জপে জপে তার সমস্ত পুঁজি, সম্পত্তি গ্রাস করে৷ সব শেষে যখন বুঝতে পারে যে বাবুটি অর্থ প্রদানে সম্পূর্ণ অপারগ তখন প্রত্যেক রাত্রে দেহবিক্রির পারিশ্রমিক স্বরূপ বাবুটির কাছ থেকে একটি করে ‘খত’ লিখে নিত, সেখানে তার ঋণের পরিমাণ লেখা থাকত৷ যখন খতের সংখ্যা অনেক হয়ে যায় তখন বাবুর থেকে সমস্ত পাওনাগণ্ডা বুঝে নেওয়ার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয় সেই রক্ষিতা৷ এই অংশে দেবতারা গণিকার বিচার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন৷ শুধু যে ঠকিয়ে, মিথ্যা বচনে, খত লিখিয়ে গণিকারা বাবুদের বিপর্যস্ত করত তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে গণিকারাও শোষিত, প্রতারিত হত বাবুদের দ্বারা৷ এমন প্রতারিত হওয়ায় অভিযোগের হদিসও উনিশ শতকে কম পাওয়া যায় না৷ গণিকামহলে আভিজাত্যের মিথ্যা গৌরবকে জাহির করে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তিকে অক্ষুন্ন রাখতে বর্ণিত হয়েছে আরেক বাবুর মিথ্যা আস্ফালন৷ উপপত্নীকে খুশি রাখার জন্য সেই বাবু তার মোসাহেবের দ্বারা পাঠিয়েছিল পাঁচশত টাকার একজোড়া শাল৷ উপপত্নী তা ফেরত পাঠায়৷ ফলে উপস্ত্রীর মন রাখতে ব্যর্থ বাবু সংকল্প করে—‘‘যা হউক, হাজার টাকা কর্জ্জ ক’রে আমাকে অদ্যই এক জোড়া শাল খরিদ ক’রে দিতে হবে; নচেৎ বেশ্যা-মহলে আমার মান-সম্ভ্রম থাকবে না৷’’৯৬ বরুণদেব প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করে তাঁর সহযাত্রীদের উদ্দেশে বলেন যে,—সেই বাবুর একজন রক্ষিতা আছে যে কিনা তার কাছে দামি একজোড়া শাল আবদার করেছিল৷ বাবুর অর্থসামর্থ কম থাকায় তুলনামূলক কম দামে একজোড়া শাল কিনে মোসাহেবের দ্বারা তার কাছে পাঠিয়েছিল৷ আশাহত সেই বাররামা অসন্তুষ্ট হয়ে তা খণ্ড খণ্ড করে মোসাহেবের দ্বারাই ফেরত পাঠিয়েছে৷ একজন গণিকা নারীর এ হেন আচরণ থেকে সেই সময়ে তাদের চাহিদা ও আধিপত্যের দিকটিও সুস্পষ্ট হয়ে যায়৷
রূপাজীবাদের পাপের ভার এত বেশি যে কোনোভাবেই সেই বোঝা তাদের মস্তকচ্যুত হয় না৷ বলা হয় হরিনাম সর্বপাপ মুক্তির উপায় কিন্তু এই নাম শত জপ করেও তারা দেহজীবিকার কলুষতা থেকে কোনোভাবেই পাপমুক্ত হয় না৷ এদের ফেরার পথ একেবারে রুদ্ধ; কোনোরকম ফাঁক-ফোকর নেই৷ ব্রহ্মার মুখে ধ্বনিত হয় এমন কথারই প্রতিধ্বনি—‘‘বেশ্যারা নিজের উপজীবিকার জন্যই হরিনাম করে; অতএব তাহাদের মুক্তি হইবে না৷’’৯৭ আর এত কঠিন জীবন বলেই তারাও সমাজ-কুল-চূড়ামণি পুরুষদের কাছ থেকে দেহ বিক্রির রসদ নিংড়ে নিতে ছাড়ে না৷ সেজন্যই যে বাবু তথা পুরুষেরা তাদের মোহনমায়ায় আবদ্ধ হয় তারা সর্বস্বান্ত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি পায় না৷ পূর্বোক্ত যে বাবুটি তার রক্ষিতাকে সর্বস্ব দান করেছে, বিষয়-সম্পত্তি নিলামে গিয়ে কপর্দকহীন অবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে সেই বাবুর আর গণিকামহলে স্থান হয় না অথচ কর্জ্জ করে শাল এনে যে গণিকার পদতলে অর্পণ করতে পারে তার জন্য থাকে সাদর অভ্যর্থনা৷ এমন দৃশ্যের অবতরণ ঘটে দুজন পাগড়িপরা উকিলের বেশধারী বাবু বেশ্যালয়ে উপস্থিত হলে৷ দুজনের মধ্যে একজনের হাতে শাল থাকায় তাকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় আর অপরজন বহু সাধ্যসাধনা করেও, অনেক চোখের জল ফেলেও শুধুমাত্র হাত খালি বলে সেখানে প্রবেশের অধিকার পায় না৷ বারবধূ তাকে অপমান করে বলে—‘‘তোর আর আছে কি? নীলামে যথাসর্ব্বস্ব বিক্রী ক’রে নিয়েছি৷ তুই দূর হ৷’’৯৮ এই বিলাসী বাঙালি সম্প্রদায় যেমন স্ত্রী অপেক্ষা উপস্ত্রী ভালোবাসে তেমন সৎকার্য অপেক্ষা পোষ্যপুত্র গ্রহণকরাকে মহৎ কাজ বলে মনে করে৷ তাদের ধারণা পরবর্তীসময়ে সেই পোষ্যপুত্ররা তাদের মুখ উজ্জ্বল করবে৷ কিন্তু আসল ঘটনায় দেখা যায় যতদিন পোষ্যপুত্র গ্রহণকারী ব্যক্তি জীবিত থাকে ততদিন তার মরণ কামনা করে সেই পুত্র আর একটু বড় হলেই মদ, গাঁজা ও বেশ্যার প্রিয় পাত্র হয়ে স্ফূর্তির জোয়ারে জীবনকে ভাসিয়ে দেয়৷
বৈধব্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরেও নারীরা যে ভুল পথে চালিত হয়ে স্বৈরিণী বা দেহজীবিকার পথে অগ্রসর হয় এমন ঘটনাও ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ বিরল নয়৷ কোনো সম্ভ্রান্ত পিতা মৃত্যুকালে তার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি দিয়ে যান দুই বিধবা কন্যার হাতে৷ যুবতি বিধবা কন্যাদের বৈধব্যের যন্ত্রণা এবং প্রচুর সম্পদের প্রভাবে অভিভাবকহীন হওয়ায় তাদের জীবন স্বেচ্ছাচারে ভরে যায়৷ তারা আকন্ঠ পাপপঙ্কে নিমজ্জিত হয়৷ বড়জন গৃহে থেকেই উপপতি জুটিয়ে অবাধ কামতরঙ্গে ভেসে যায় আর ছোটোজন বাড়ির খানসামার সঙ্গে গৃহত্যাগী হয়৷ সেই খানসামার ভোগ-পিপাসা মিটে গেলে সে তাকে সর্বস্বান্ত করে অকূলে ভাসিয়ে পালিয়ে যায়৷ জীবনধারণের জন্য ‘ঘেসুরে উপপতি’ গ্রহণ করে ছোটজন৷ বাবুরা যেমন রক্ষিতা পোষণ করে তেমনি সম্পদশালী নারীরাও যে কাম চরিতার্থ করার জন্য উপপতি রাখে তার দৃষ্টান্ত এই ঘটনা৷ এখানে প্রথমোক্ত বিধবা নারীটি সরাসরি অর্থ উপার্জনের জন্য দেহের দর হাকেনি বরং গৃহে থেকে নিজের অর্থ দিয়েই উপপতি ধারণ করেছে৷ কিন্তু এই পুরুষ উপপতিরা উপপত্নীর মত সমাজবিচ্যুত হয় না৷ সমাজের নিয়মকানুন তাদের জন্য শিথিল৷ আরেক স্থানে উল্লিখিত হয়েছে স্বৈরিণী স্ত্রীর দ্বারা স্বামী লাঞ্ছনার ঘটনা৷ ভাইদের ফাঁকি দেওয়ার অভিপ্রায়ে কোনো বাবু তার সমস্ত বিষয় স্ত্রীর নামে গচ্ছিত রাখে৷ স্বামীর সেই বোকামির সুযোগ নেয় স্ত্রী৷ বহুল সম্পত্তির অধিকারিণী হয়ে পরপুরুষগামী হয়ে উঠে এবং সেই উপপতির পরামর্শে স্বামীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে অবৈধ প্রেমাকাঙ্খাকে জোরদার করে তোলে৷ ধনসম্পদের আভিজাত্যে এবং অধিক স্বাধীন মনোবৃত্তির ফলে পুরুষের মতো নারীরাও যে অধঃপাতে যেতে পারে তার সুনিপুণ অভিব্যক্তি উপরোক্ত দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে৷ এর আরও একটি নমুনা হল—এক সম্ভ্রান্ত বাবু স্ত্রীকে নিয়ে পশ্চিমে বেড়াতে যায়৷ ইতিমধ্যে বিলাসবহুল জীবন ও বেশ্যাসম্ভোগে সে তার সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে৷ ট্রেনে উঠে সেই বাবুর অকাতর নিদ্রার সুযোগ নিয়ে তার স্ত্রী সেই ট্রেনেরই আরেক যুবকের সঙ্গে হৃদয় বিনিময় করে ফেলে৷ তারা পলায়নের উদ্যোগ করতেই বাবুটির নিদ্রা ভেঙ্গে যায়৷ স্ত্রী স্বামী দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়৷ শোরগোলের মধ্যে উপস্থিত হয় পুলিশ৷ তখন সেই স্ত্রী তার সদ্যপ্রণয়কে অক্ষুন্ন রাখতে স্বামীকে অস্বীকার করে সেই যুবকটির হাত ধরে তাকে স্বামী পরিচয় দেয়৷ লেখক এই ঘটনাবলীর মধ্যদিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে নারী যদি সম্পদশালিনী হয় বা তাদের যদি স্বাধীনতা প্রয়োগ করে ঘরের চারদেওয়াল থেকে বের করা হয় তাহলে সেই নারী হয়ে উঠবে অঘটনপটিয়সী৷ কোনো অসৎকাজ তার পক্ষে অসম্ভব হবে না৷ সমাজবাদী লেখক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় নারীর বিচার করেছেন৷ নারীকে বন্দিনী করে, সম্পদহীন করে নিজেদের মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখার কথা বলেছেন৷
বৈদ্যবাটীতে এসে দেবতারা দেখেন প্রকাশ্য রাস্তায় সগর্বে পতিতাদের দলবেঁধে চলা৷ সেই চলনের ভঙ্গিতে কামনার আগুন ছিটকে ছিটকে পড়ছে৷ তাদের চলার মুখে কোনো পুরুষ কিংবা যুবক পড়লে তো কোনো কথাই নেই৷ লাস্যভঙ্গিমায়, ইয়ার্কি-ঠাট্টায় তাকে নাজেহাল না করে ছাড়ে না৷ বেশ্যাগণের নিমাই তীর্থের ঘাটে স্নান করতে যাওয়ার সময় পথে এক যুবক তাদের দ্বারা চরম নাজেহাল হয়৷ যুবকটি কলকাতা থেকে বাবুরা আসবেন বলে এক মস্তকহীন পাঁঠা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল বাবুদের আপ্যায়নের জন্য৷ রূপোপজীবিনীর দল তার সম্মুখে গিয়ে সেই পাঁঠাখানা দাবি করে৷ ভায়ার্ত যুবক তার দাদার শাসনের কথা বলে তাদের বিরত করতে চায়৷ গণিকারা তখন মজা দেখার জন্য সেই মাথাহীন পাঁঠাটা নিয়ে কপট টানা-হিঁচরা শুরু করে৷ যুবকটিকে যারপরনাই হেনস্তা করে অশ্লীল বাক্যবাণে বিদ্ধ করে বলতে থাকে—‘‘দূর গুয়োটা, একটা পাঁটা দিতে পারলিনি?’’৯৯ গণিকাদের অশালীন বাচনভঙ্গির বাস্তব রূপকে উপস্থাপন করেছেন দুর্গাচরণ রায়৷ দেহবিক্রি করে চোর, বদমাশ, গুণ্ডা, লুচ্চাদের সঙ্গে সহবাসের দ্বারা জীবন অতিবাহিত হয় বলে বারবনিতারা যেমন দৈহিক শুচিতাকে ধরে রাখতে পারে না তেমনি মার্জিত ভদ্রসমাজের উপযোগী বচন প্রয়োগও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না৷ প্রকৃত শিক্ষার অভাব, অসামাজিক পরিবেশ এবং উত্তেজক কথা বলে ব্যবসায়িক প্রয়োজন সিদ্ধ করতে হয়৷ আর এর জন্যই পুরুষরা ফাঁদে পড়ে তাদের৷ সেই কারণে গণিকাদের কাছে ভব্যতা-সভ্যতা আশা করা যায় না; তাদের কথা লাগামছাড়া, কামোদ্দীপক এবং অশ্লীল৷ তারকেশ্বরে উপস্থিত হয়ে দেবগণ লক্ষ করেন এক অসহায় নারীর জীবনের ভয়াবহ পরিণতি৷ সে অঞ্চলে মহন্তরাই সর্বেসর্বা৷ গয়ার গয়ালীগুরুদের মত তারকেশ্বর পীঠস্থানে গিয়ে মহন্তদের সন্তুষ্ট করতে না পারলে পুণ্য অর্জন অসম্ভব৷ এই মহন্তরা ভণ্ডামির চূড়ান্ত শিখরে অবস্থান করে৷ ধর্মীয় বাতাবরণের মধ্যে আবদ্ধ থেকে নারীলোলুপতায় এরা বিপথগামী৷ মহন্তের চরম নারীলোলুপতার চিত্র দেখা যায় মহন্ত-এলোকেশী ঘটনায়৷ তারকেশ্বর কাছাকাছি কুমরুল নামক গ্রামের দরিদ্রকন্যা এলোকেশীর বিয়ে হয় নবীন নামে এক যুবকের সাথে৷ নবীনের পিতৃকুলে কেউ না থাকায় উপযুক্ত ভরণ-পোষণ দিয়ে স্ত্রীকে বাপের বাড়িতেই রেখে দেয়৷ এলোকেশীর সৎমা একজন স্বৈরিণী৷ তার প্রণয়ী মহন্ত এলোকেশীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়৷ বিমাতার সঙ্গে পরামর্শ করে সেই মহন্ত মাদক দ্রব্য খাইয়ে তাকে অজ্ঞান করে অচৈতন্য অবস্থায় ধর্ষণ করে৷ ছেলে হওয়ার নাম করে সেই মাদকদ্রব্য বিমাতা যখন তার হাতে দিয়েছিল অত্যন্ত সরলমনে এলোকেশী তা ভক্ষণ করেছিল কিন্তু তার পরিণতিতে যে সে ধর্ষিত হতে পারে তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি৷ যে রূপের তৃষ্ণা মহন্তের চোখে তা তো একদিন ভোগ করে মিটবার নয় তাই পরবর্তী সময়ে অজস্র স্বর্ণালঙ্কার দ্বারা সে বশ করে নেয় এলোকেশীকে৷ ঘটনাক্রমে সেখানে উপস্থিত হয় তার স্বামী৷ স্ত্রীর স্বীকারোক্তিতে সব জানতে পেরে স্ত্রীকে মহন্তের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাকে নিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ার পরিকল্পনা করে৷ মহন্ত তা বুঝতে পেরে নিজ-ক্ষমতাবলে সে পথ বন্ধ করে দিলে স্বামী কোনো উপায়ন্তর না দেখতে পেয়ে স্ত্রীকে খুন করে পুলিশে আত্মসমর্পণ করে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে দেয়৷ মহন্তের কুকীর্তি প্রকাশ হয়ে পড়ায় সে শাস্তি ভোগ করে৷ কিন্তু তার কামাগ্নিতে দগ্ধ হয়ে যে গৃহবধূটি নির্মমভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয় তার ক্ষতিপূরণ সমাজ দিতে পারে না৷
এরপর দেবতারা উপস্থিত হন শ্রীরামপুরে৷ পিতামহ ব্রহ্মা সেখানে এক ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব বা শুচিতা রক্ষার অদ্ভূত প্রয়াস দেখে মুগ্ধ হয়ে যান৷ সেই ব্রাহ্মণ অস্পৃশ্য দ্রব্যের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলার জন্য লাফিয়ে লাফিয়ে চলছিল৷ কিন্তু রাতের অন্ধকারে তাকেই দেখা যায় গণিকাগৃহে গালাগাল খেতে৷ সেই ব্রাহ্মণ তার রক্ষিতার দরজায় করাঘাত করলে সেই বারনারীর মুখের কদর্য বাক্যভঙ্গি ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্বকে যেমন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় তেমনি রূপাজীবাদের স্বাভাবিক বাচনভঙ্গিটিও সহজভাবে প্রতিফলিত করায়৷ যেমন সেই বারবধূ বলে—‘‘পোড়ারমুখো! কাল রাত্রে ছিলি কোথায়? আমি তোর জন্যে রুটি আর বেগুনভাজা ভেজে এক বোতল মদ এনে সমস্ত রাত্রি ব’সে ব’সে কাটিয়েছি৷’’১০০ এখানে শুধু গণিকাদের ভাষা ব্যবহার নয়, নারী শরীরের সাথে সাথে মদ-মাংস, ভাজা-ভুজিও যে পরম উপাদেয় তাই নির্দেশিত হয়েছে৷ সেই ব্রাহ্মণ অতঃপর সেই রক্ষিতার হাত ধরে গৃহাভ্যন্তরে চলে গেলে জলধিপতি ব্যঙ্গ করে ব্রহ্মদেবকে বোঝান তার কপট শুচিমনস্কতাকে—‘‘ঠাকুরদা! এই বামুনকে দেখিয়া এক সময় আপনার বড় ভক্তি হইয়াছিল; এক্ষণে ইহার কার্য্য দেখুন৷ এটি বেশ্যাবাড়ী৷ ঐ বামুনের বামী নামে একটি রক্ষিতা বেশ্যা এই বাড়ীতে বাস করে৷ ঠাকুর রজনীতে সেই বামীর নিকট এসেছেন৷’’১০১ এই শ্রীরামপুরের কাছেই বিখ্যাত মহেশের রথ ও স্নানযাত্রা৷ কলকাতার অনেক বিলাসীবাবু এখানে বোট ভাড়া করে রক্ষিতা-গণিকা সমভিব্যাহারে সময় কাটায়৷ মদ খেয়ে বিভোর হয়ে বেশ্যার হাত ধরে জগন্নাথের সামনে উদোম নৃত্য করা তাদের অন্যতম ‘ফ্যাশন’৷ অর্থাৎ অর্থবান বাবুদের হাত ধরে সমাজপতিত এই নারীরা সর্বত্র বিচরণ করতে পারে৷ যতক্ষণ বাবু সাথে থাকে কেউ তাদের কোথাও প্রবেশে বাধা দিতে পারে না৷
বহুস্থানে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার পর সুরগণ অবশেষে পৌঁছতে সক্ষম হন তাঁদের চিরাকাঙ্খিত-চিরাভিলাষিত কলকাতা নগরীতে৷ পূর্বাভিজ্ঞতায় তিতিবিরক্ত সমভিব্যাহারী দেবতাদের কলকাতার জন-জীবন সম্পর্কে তাই আগে থাকতেই সতর্ক করে দিয়ে বলেন—‘‘চুরি, জুচ্চুরি, মিথ্যা কথা—এই তিন নিয়ে কলিকাতা৷’’১০২ এখানে প্রবেশ করেই সুরগণ প্রত্যক্ষ করেন এক গৃহবধূর ব্যভিচারময় কাণ্ডকীর্তি৷ তাঁরা দেখেন তিনতলা থেকে সুতোবাঁধা হয়ে নেমে আসছে প্রেমপত্রসহ মিষ্টান্ন পরিপূর্ণ ঠোঙা৷ দুর্ভাগ্যবশতঃ তা ঐ স্বৈরিণী গৃহবধূর গুপ্তপ্রণয়ীর হাতে না গিয়ে পৌঁছয় দেবতাদের হাতে৷ পত্রটি খুলে দেবতারা দেখেন সেখানে সেই নারী তার প্রেমাস্পদকে লিখেছে যে তাদের বাড়ির সকলে রাত্রিবেলায় বাগানে যাবে এবং সে যদি আসে তাহলে নিরাশ না হয়ে অনায়াসে রাত্রিযাপন করতে পারবে তার সঙ্গে৷ তৎকালীন সমাজে নারীর অবমূল্যায়ন, বিধবাদের সংখ্যাধিক্য, পুরুষের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, ফুলে-ফেঁপে ওঠা ধনবৃদ্ধির কারণে উনিশ শতকের কলকাতা শহর স্বৈরিণী, ব্যভিচারিণী, বারবিলাসিনী নারীতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়৷ সেই সমাজে ধনবান পুরুষদের গণিকা তোষণ ছাড়া পুরুষত্ব মূল্যহীন৷ বারাঙ্গনারাও তাদের পৌরুষত্ব জাহিরের গৌরবময় আড়ম্বরের সদব্যবহার করতে ছাড়তো না৷ অধিক রোজগারের আশায় কখনো কখনো তাদের পৌরুষকে বিঁধে নিক্ষেপ করতো তাদের তীব্র বাক্যবাণ৷ বেশ্যা কর্তৃক কেরানিদের তিরস্কারের ঘটনায় গণিকাদের পুরুষ ধরার এমনই এক দিক তুলে ধরেছেন দুর্গাচরণ রায়৷ জীবনধারণের জন্য স্বল্পতম বেতনের বিনিময়ে হারভাঙা খাটুনির পর চূড়ান্ত অপমান সহ্য করে চিৎপুর রোড ধরে সন্ধ্যার সময় ঝিমোতে ঝিমোতে কেরানিরা যখন বাসার দিকে ফেরে তখন তাদের দেখে দোতলা-তিনতলা বাড়ির বারান্দা থেকে ঝংকৃত হয় বেশ্যাদের নির্মম হাস্য ধ্বনি এবং গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো কথাবার্তা৷ তারা কেরানিদের পরিশ্রান্ত দেহমনকে শূলের মতো বিদ্ধ করতে থাকে৷ কেউ যদি গণিকাদের সেরূপ ব্যবহারের প্রতিবাদ করতে যায় তাহলে খিলখিল হাস্যধ্বনিতে জবাব আসে—‘‘আ মর মিন্সে৷ যাচ্ছেন কেরাণীগিরি ক’রে, আবার রাগটুকু আছে৷ আজিও বাবুদের সখ মেটেনি—গোঁপ রাখা হয়েছে৷ আমরা বেশ্যা, বেশ্যাবৃত্তি করি বটে, কিন্তু তোদের মত সাতটা কেরাণীকে পুষতে পারি৷ এই তো সমস্ত দিন কলম পিষে এলি—কি আনলি? আমরা ঘরে ব’সে ঘন্টায় আট দশ টাকা উপায় করি৷ তোর তিন পুরুষে চাকরী ক’রে যা না ক’রতে পারবে, আমরা এক পুরুষে তা ক’রেছি৷ কলিকাতায় ঈশ্বর ইচ্ছায় দুই তিন খানা বাড়ীও আছে, আর গায়েও এই দেখ, দুই তিন হাজার টাকার গহনা রয়েছে৷ তোরা আমাদের চাকর হবি? অফিসে যে মাইনে পাস—দেব৷’’১০৩ এই ধরনের কথা থেকে বোঝা যায় যে দেহ জীবিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যখন ক্রমে ক্রমে পেশাটি সম্পর্কে অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন অনেক গণিকাই গর্বের সঙ্গে দিনাতিপাত করে৷ অনেক সময় প্রচুর উপার্জন তাদের পেশাটির সম্পর্কে বিশ্বস্ত করে তোলে, তাদের মনের মধ্যে পাপবোধের লেশমাত্র চিহ্ন থাকে না৷ তারা আত্মগরবে গরবিনি হয়ে ওঠে৷ যে সমাজ তাদের কলঙ্কিত করে দেহজীবিকার নির্মম পেশাটির মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে সেই সমাজ প্রতিভূ পুরুষদের তাই তারা নিজেদের আবেষ্টনীর মধ্যে জড়িয়ে রাখতে এতটুকু কুন্ঠাবোধ করে না৷ তারা তাদেরকে ঘরছাড়া, পরিবার-পরিজনের সঙ্গছাড়া করে তাদের কাছ থেকে অর্থ সম্পদ নিংড়ে নিংড়ে বের করে নেয়৷
এই রচনায় উল্লেখ রয়েছে লক হাসপাতালের নাম৷ গণিকা নারীদের দৈহিক সুস্থতার পরীক্ষাকেন্দ্র এই হাসপাতাল৷ ইংরেজ সিবিলিয়ানরা এদেশের বারাঙ্গনাদের সঙ্গে যৌনসংসর্গ করে সিফিলিস, গনেরিয়া সহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হলে ইংরেজ সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এক আইন পেশ করে৷ সেই আইন ‘চৌদ্দ আইন’ নামে পরিচিত৷ চৌদ্দ আইন অনুযায়ী গণিকারা সুস্থতার শংসাপত্র ছাড়া দেহব্যবসা করতে পারবে না৷ লক হাসপাতালে সেই পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়৷ জলধিপতি দেবরাজ ইন্দ্রকে তাই বলেন—‘‘ঐ স্থানে চৌদ্দ আইনের পরীক্ষা লওয়া হইত৷ যে বেশ্যার রোগ থাকিত, এই স্থানে রাখিয়া আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত্য তাহাকে চিকিৎসা করা হইত৷’’১০৪ কিন্তু পরীক্ষার নাম করে গণিকাদের উপর চলতে থাকে অকথ্য অত্যাচার৷ ফলে বহু গণিকা দেশছাড়া হয় আইনের এবং পরীক্ষার হাত থেকে বাঁচার জন্য৷ কলকাতা ঘুরতে ঘুরতে বহুস্থানে দৃষ্টিগোচর হয় গণিকাদের নানা অভিযোগ অনুযোগের বিচার পর্বের৷ যারা সীমাহীন কষ্ট সহ্য করে বেঁচে থাকার সম্বল জোগাড় করে, সেই কষ্টার্জিত সম্পদের ছল-জোচ্চুরির মধ্য দিয়ে আত্মসাতের ঘটনা, সম্ভোগ করে চুক্তিবদ্ধ অর্থ প্রদান না করা, পুলিশের অপরাধ দমনের নাম করে তদের প্রতি অত্যাচার, ভয় দেখিয়ে বলপূর্বক সম্ভোগ ইত্যাদি নানাবিধ পীড়নের শিকার হয় তারা৷ অনেক সময় বিচার পাবার আশায় মামলা করতেও বাধ্য হয়৷ এই নানাবিধ বিচারের দৃশ্য দেবতাদের নজরে আসে৷ গণিকাদের আসামিদের বেশিরভাগই ভদ্র ঘরের সন্তান৷ তাদের অভিযোগ কোথাও খোরাকির দাবি জানিয়ে, কোথাও দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধানোর জন্য নালিশ৷ কোথাও চুরি, কোথাওবা জোচ্চুরি৷ জুয়াচোরেরা অনেক সময় পুলিশের পোশাক পড়ে পুলিশ সেজে তাদের সবকিছু নিয়ে নেয়৷ এক বিচারকেন্দ্রের বিচার্য বিষয় গণিকার উপপতি সংক্রান্ত নালিশ৷ কোনো এক বারাঙ্গনা নাকি ‘খত’ লিখিয়ে নিয়ে উপপতিকে সঙ্গসুখ প্রদান করতো৷ দুই তিন মাস খত লিখে লিখে সম্ভোগ করার পর সে আর তার কাছে আসে না৷ গণিকাটি বাবুকে ফিরিয়ে আনার কোনো উপায় না দেখে এবং দুই-তিনমাসের রোজগার আদায়ের আশায় আইনের দ্বারস্থ হয়েছে৷ তাহলে বোঝাই যায় সর্ব দিক থেকে বঞ্চিতা এই পুণ্যাঙ্গনারা জীবনভর শুধু প্রবঞ্চিতাই হয়ে যায়, প্রতিকারের আশায় বিচার-ব্যবস্থার কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে হয় তাদের৷
গণিকারা তাদের রোজগার, বিলাসী জীবন ইত্যাদির দ্বারা অনেক মানুষের ঈর্ষার কারণও হয়ে ওঠে৷ আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার উন্নতির ফলে মাঝি, তাঁতি, কোচম্যান, ভিস্তি, মুটে, মেথর প্রভৃতি নিম্নবর্গের মানুষগুলো যখন কর্মহীন হয়ে জীবন-যন্ত্রণায় ব্যতিব্যস্ত তখন তারা দেখে গণিকাদের মনোসুখে হাতে টিয়াপাখি নিয়ে গঙ্গাস্নানে যাওয়ার দৃশ্য৷ গণিকাদের সেই আপাতসুখী জীবন দেখে ঈর্ষাকাতর কন্ঠে নিম্নশ্রেণীর সেই মানুষগুলির আক্ষেপ—‘‘সুখী এরা; কোম্পানী বাহাদুর কলে কতকগুলো মাগী বানাতে পারেন, তাহ’লে এরা জব্ধ হয়৷’’১০৫ অর্থাৎ যন্ত্রচালিত বাররামা আবিষ্কৃত হলে গণিকারা তাদের মত কর্মহীন হয়ে পড়বে এবং তাদের দুঃখের দিনে এভাবে টিয়াপাখি হাতে নিয়ে মনোসুখে গঙ্গাস্নানে যেতে পারবে না৷
কলকাতার অলিতে-গলিতে এমন অনেক নিম্নবর্গের নারীদের সন্ধান পাওয়া যায় যারা তাদের নিজস্ব কিছু বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত থেকেও গোপনভাবে দেহব্যবসাও চালিয়ে যায়৷ যেমন মেছুনি, নাপতিনি, গোয়ালিনি, ফুলওয়ালী ইত্যাদি৷ মেছুনিরা স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা হয়ে বাজারে মাছ বিক্রি করে৷ দেবতা নারায়ণ দরিদ্র মেছুনিদের গহনা প্রাপ্তির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বরুণদেবের মুখে উচ্চারিত হয়—‘‘অনেক বাবু উহাদের সঙ্গে…’’১০৬ জলধিপতির এই অসম্পূর্ণ বাক্যবন্ধে উহ্য থেকে যায় দেহবিক্রির প্রসঙ্গটি৷ তিনি যতটুকু উচ্চারিত করেছেন তাতে সম্পূর্ণ বাক্যটির সারমর্ম কি হবে তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না কারও৷ তাদের মাছ বিক্রির পাশাপাশি গোপন বৃত্তিটি কি তা জলের মতো পরিস্কার হয়ে যায়৷ এর পরে তাঁরা উপস্থিত হন কলকাতার বিখ্যাত চুনাগলিতে৷ স্থানটি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে ফিরিঙ্গিদের বসবাসের জন্য৷ কিন্তু বরুণদেবতার মতে শুধু ফিরিঙ্গি নয় খালাসিদের মদ খেয়ে বেশ্যাদের সঙ্গে স্ফূর্তি করার প্রসিদ্ধ স্থানও সেই চুনাগলি৷ তার পর তাঁরা পৌঁছান কলকাতার বিখ্যাত বেশ্যাবাজার হাড়কাটা গলিতে৷ বৃষ্টির দেবতা হাড়কাটা গলিকে বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন যে স্থানটি বদমায়েশির জন্য বিখ্যাত এবং তাদের সৌভাগ্য যে সেখানকার বারবধূরা সেই সময় ঘুমিয়ে আছে নইলে তাদের অত্যাচারে সেখানে দাঁড়ানো মুস্কিল হত৷ তিনি গণিকাদের রোজনামচা সম্পর্কে তাঁর সহযাত্রী দেবতাদের বোঝান—‘‘আমাদের সৌভাগ্য যে বেশ্যামাগীরা এক্ষণে ঘুমাইতেছে৷ সমস্ত রাত্রি জাগিয়া এই সময়ে মাগীগুলো ঘুমায়; আবার সন্ধ্যাকালে উঠিবে এবং যাহারা যেমন সম্বল সাজ গোজ করিয়া এই রাস্তাগুলোয় ছুটাছুটি করিয়া তোলপাড় করিবে৷ ঐ সময়ে ইহারা কি ভদ্র কি ইতর যাহাকে পায় হাত ধরিয়া টানাটানি করে৷’’১০৭ বরুণদেবতার এই উক্তি রূপাজীবাদের জীবনাচারণের বিশেষ দিকগুলিকে সুবিশেষ বিশেষায়িত করে৷ যেমন বাররামাদের নিকষ অন্ধকার জীবনে উপার্জনের অন্যতম সময় সূর্য ডোবার পরে৷ রাত্রি যত এগিয়ে যাবে তাদের শরীরী সৌরভে মধুমক্ষিকার মত খদ্দেররা তাদের ঘিরে ধরবে৷ আর দেহই যেহেতু উপার্জনের প্রধান এবং একমাত্র সহায় তাই তাকে সজীব ও পুষ্ট রাখার জন্য দিনভর দেওয়া হয় বিশ্রামের অবসর৷ রূপ-যৌবনকে সহায় করে যৌবনসূর্য মধ্য গগণে থাকাকালীনই করে নিতে হয় যথাসাধ্য সঞ্চয় নতুবা শেষ জীবনে পথের কুকুরের মত অবধারিত নির্মম মৃত্যু৷ এদের কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না, থাকে না কোনো যোগ্য উত্তরসূরী; যারা শ্রদ্ধা ভক্তিতে সুখময় করে তুলবে জীবনের শেষ ধাপকে; বার্ধক্য হয়ে উঠবে বারাণসী৷ তাই দৈহিক সামর্থ রূপ-যৌবন থাকতে থাকতেই যথার্থ সঞ্চয় করার মানসে তাদের বাছ-বিচারের অবকাশ থাকে না৷ ইতর ভদ্র যেই হোক না কেন হাত ধরে টানাটানি করে ঘরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ কারণ ঘরে গেলেই উপার্জন; উপার্জন হলেই জমবে ভবিষ্যতের সঞ্চয়৷ তাই কোনো রাত যেন বৃথা না যায়৷
গণিকারাও তো মানুষ৷ অস্থি-মজ্জা-রক্ত-মাংস-বিবেক-বুদ্ধি-মন-আর যা সব থাকে মানুষের মধ্যে সবই তাদের আছে৷ তাই তারাও সকলের সঙ্গে সমাদরে মানুষের মতো বাঁচতে চায়৷ শুধু দেহ-সম্ভোগের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে নয়; পূজা-পার্বণ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নিজেকে মেলে ধরতে চায়৷ কিন্তু সমাজ তো তাদের মেনে নেয় না৷ তাই নিজেদের মতো করে কালীপূজা করে, দোল-দুর্গোৎসবে মেতে ওঠে৷ হাড়কাটা গলিতে দেবতারা দেখে এক শিখাধারী ব্রাহ্মণকে নানা দানসামগ্রীসহ পুত্রের হাত ধরে বেড়িয়ে আসতে৷ সেই পুরোহিত একশত গৃহে যজমানি করে যা না পায় এক গণিকাগৃহেই লাভ করে তার চেয়ে অনেক বেশি৷ এখানে এর থেকে বোঝা যায় যে পূজা-পার্বণে গণিকারা উদার হস্তে দান করতো অথবা তাদের অশুচি গৃহে কোনো ব্রাহ্মণ পদ স্পর্শ করতো না বলে অধিক দানের বিনিময়ে তাদের পুরোহিত সংগ্রহ করতে হত৷ যাইহোক অর্থপ্রতিপত্তি না থাকলে সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর ক্ষমতা কারও থাকে না৷ ধনী বাবুরা গণিকার সঙ্গে গণিকাগৃহে গিয়ে যা করতে পারে দরিদ্র ব্রাহ্মণের পক্ষে তা তো সম্ভবই না উপরন্তু গণিকা গৃহে যজমানি করাটাও সমাজের চোখের অসম্মানজনক৷ তাই সেই দরিদ্র যজমান ছেলেকে সাবধান করে দেয়, যাতে পাড়াগাঁয়ে প্রচার না করে সেও সেই উপায়ে অধিক অর্থ রোজগার করতে শেখে৷
বাবুরা রক্ষিতা রাখবে, বেশ্যাগমন করবে তা চিরাচরিত প্রথা কিন্তু এই উপন্যাসে আলোকপাত হয়েছে গণিকাজীবনে এক অভিনব দিকের প্রতি, তা হল বেশ্যা কর্তৃক বাবু পোষা৷ কয়েকজন গৃহবধূর বিলাপের মধ্য দিয়ে অর্থ-খোরাকি, ভরণ-পোষণ দিয়ে বেশ্যাদের বাবু রাখার বিষয়টিকে লেখক উপস্থাপিত করেছেন৷ সেই কুলনারীদের তাদের বাবা-মায়েরা কুলীন দেখে বিয়ে দিয়েছিল কিন্তু তাদের স্বামীরা বেশ্যার অঞ্চলবন্দি হওয়ায় তারা স্বামীসঙ্গ লাভে বঞ্চিত৷ স্বামী বিরহে তালাবন্দি অবস্থায় তাদের দিনগুজরান হয়৷ রাতভর বেশ্যাসহবাসে থেকে ভোরের দিকে সেই স্বামীরা ফিরতে শুরু করে৷ কোঁচা ভরা থাকে চালে, হাতে মাছ ও তরকারি এবং বগলে শালপাতা৷ এই নারী তিনজন তিনভাই-এর স্ত্রী৷ তাদের স্বামীরা তিনজন বেশ্যার সখের উপপতি৷ বরুণদেব সেই তিন উপপতি সম্পর্কে দেবতাদের বুঝিয়ে বলেন যে—‘‘উহাদের বেশ্যাকে কিছু দিতে হয় না; বরং বেশ্যারা প্রত্যহ একটি করে সিদে কাপড় দেয়৷ আর মাস মাস ২০৷২৫ টাকা করিয়া মাসহারা দেয়৷ তদ্ভিন্ন বেটাদের জুতা যখন যাহা আবশ্যক, ঐ মাগীরা কিনে দেয়৷ বড়টাকে ৫০০ টাকা দিয়া তার বেশ্যা কাপড়ের দোকান ক’রে দিয়াছে৷’’১০৮ বারবনিতার অর্থগৌরবে এই তিন যুবকের বাবুয়ানার শেষ নেই৷ তাদের মাথার চুল সদৃশ্য আচড়ানো; গায়ের জামার উপরে চেন, হাতে ঘড়ি ব্যতীত তারা কখনো ঘরের বাইরে যায় না৷ তিন বেশ্যার খিদমদগারি তিন উপপতি নিজের নিজের গণিকাপ্রভুর কাছে প্রত্যহ ছুটি পেয়ে বড় জন রাত দুটোয় বাড়ি ফেরে, মেজো জন তিনটায় এবং ছোটো জন ভোরবেলায়৷ তাদের ফিরে আসার সময় থেকে দরজায় ঘন ঘন ঘা মারার শধে, ডাকাডাকি, চিৎকারে পাড়ায় লোকের আর ঘুমোবার উপায় থাকে না৷ উপপত্নীরা যেমন যে বাবুর নিয়ন্ত্রণে থাকে তার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, এই উপপতিত্রয়ও সর্বাংশে নির্ভর করে থাকে তাদের পোষক বেশ্যাগণের কাছে৷
বেশ্যা, মদ ও বাগানবাড়ি উনিশ শতকের বাবুয়ানার প্রধান লক্ষণ৷ এই বাবুদের সর্বদা শনির বলয়ের মতো ঘিরে থাকে মোসাহেবরা৷ বাবুয়ানা প্রয়োগের চাবিকাঠি হল অর্থ; বয়সের কোনো বালাই থাকে না৷ ইন্দ্রদেব এই বাবুদের সম্পর্কে বলেন যে—‘‘বাবুরা মোসাহেব ও বেশ্যা লইয়া গিয়া আমোদ করেন৷ কলিকাতার ধনীবাবুদের মধ্যে যাঁহার বাগান নাই বা যিনি বাগানে যান না, তিনি বাবুই নন৷ ঐ বাগানে বাবু যান, বাবুর রক্ষিতা বেশ্যা যান ও মোসাহেবরা যান৷ মোসাহেবদের সেবার জন্য মাছ মাংস ও খাদ্য দ্রব্যের সহিত ২৷ ৪টে ভাড়াটে বেশ্যাও লইয়া যাওয়া হয় এবং সমস্ত রাত্রি মদ, মাংস, বেশ্যা, তামাক, তাস ও পাশা খেলার শ্রাদ্ধ হয়৷’’১০৯ বাবুরা অর্থবান, ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি৷ মোসাহেবরা তাদের চাটুকার, অনুগামীও প্রায় বিত্তহীন৷ তাই বাবুদের সম্ভোগার্থে নিয়ে যাওয়া বেশ্যারা মোসাহেবদের সঙ্গ দিতে পারে না৷ সেইজন্য বাবুরা তাদের জন্য নিজ নিজ রক্ষিতা বেশ্যা যেমন নিয়ে যায়, সঙ্গে দু-চারজন ভাড়াটে বেশ্যা নিয়ে যাওয়া হয় মোসাহেবদের জন্য৷
কলকাতার চিৎপুর রোডের শাখাগলি সিন্দুরেপটির গণিকাদের কার্যকলাপে তাদের পুরুষ ধরার বা খদ্দের ধরার কৌশল উঠে এসেছে৷ জলধিপতির ব্যাখ্যা অনুসারে—‘‘এখানে ২৷৪ পয়সা মূল্যের সস্তা বেশ্যারা বাস করে৷ সন্ধ্যার সময় এই পাপিষ্ঠারা দলবদ্ধ হইয়া রাস্তায় দাঁড়াইয়া থাকে এবং কোন ব্যক্তি রাস্তা দিয়া যাইলে ‘ও মানুষ’ ‘ও মানুষ’ শব্দে চীৎকার করিয়া ডাকে৷ ভদ্রলোকেরা মান সম্ভ্রমের ভয়ে পালায়, নষ্ট লোকেরা হাস্য করিয়া নিকটে যায় এবং যখন দেখে, মাগীগুলো ছুটিয়া আসিয়া ‘আমার বাড়ী চল’ ‘আমার বাড়ী চল’ বলিয়া টানাটানি আরম্ভ করে৷’’১১০ এখানে লেখকের কথায় গণিকাদের শ্রেণীবৈষম্যের দিকটি উঠে এসেছে৷ তাঁর বর্ণনায় সিন্দুরেপটির গণিকারা সস্তা৷ তারা অত্যন্ত কম দামে তাদের শরীর বিক্রয় করে৷ ইতর-ভদ্রের কোনো বাছ-বিচার নেই৷ সন্ধ্যাকালে দলবদ্ধ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুরুষমানুষ দেখামাত্রই চিৎকার করে ডাকতে থাকে৷ ভদ্রলোকে এড়িয়ে গেলেও নষ্টলোকেরা তাদের কাছে আসে৷ আসামাত্র তাকে নিয়ে তারা টানাটানি শুরু করে তাদের যার যার ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য৷ জোর করে টেনে হিঁচরে পুরুষ সংগ্রহ করতে হয় বলে এদের শরীরের দামও অনেক কমে যায়৷ গণিকাদের মধ্যেও নানা কুসংস্কার বদ্ধমূল৷ সিন্দুরেপটির বেশ্যারা রামভদ্র খুড়োর নাম উচ্চারণ করে না, শ্রবণও করে না৷ কেউ সে নাম উচ্চারণ করলে তারা গালাগালি দিতে শুরু করে৷ তাদের কাছে রামভদ্র খুড়ো নামটি অমঙ্গলসূচক৷ কারণ কোনো একদিন সেখানকার কোনো এক বারাঙ্গনা তার কাজের সময় রামভদ্রখুড়োর নাম করেছিল, সেদিন তার পসার জমেনি৷ আর সেই দিন থেকে তাদের কাছে রামভদ্রখুড়ো নামটি অশুভ হিসেবে স্থির হয়ে আছে৷ এরপর বর্ণিত হয়েছে মেছুয়াবাজারের গণিকাদৃশ্য৷ সেখানে রাস্তার দুধারে সারি সারি বেশ্যালয়৷ বারবধূরা সুসজ্জিত হয়ে লাসবেশে বারান্দায় বসে তামাকু সেবন করতে করতে লোক দেখলেই ডাকাডাকি শুরু করে৷ আহ্বানে সারা না দিলে থুথু ছিটিয়ে গালিগালাজ করে পাড়া মাথায় করে৷ ছোট ছোট ফেরারি ছেলেরা কম বয়সেই গণিকাদের প্রতি অপার কৌতুহলে তাদের সম্ভোগের তালিম নেওয়ার জন্য এখানে-সেখানে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে থাকে৷ কাছে যাওয়ার সাহস হয় না তাদের কারণ বয়স এবং অর্থ কোনো কিছুতেই তারা গণিকাদের উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি৷ এই বারযোষিৎদের গৃহে প্রতি সন্ধ্যায় শ্রুতিগোচর হয় তবলার চাটি৷ ক্রমে জমে উঠে সঙ্গীতের আসর৷ শোনা যায় কোনো বেশ্যার উত্তেজক সঙ্গীত ধ্বনি—
‘‘আবার কি বসন্ত এল! অসময়ে ফুটলো কুসুম, সৌরভে প্রাণ, (যাদু আমার) সৌরভে প্রাণ আকুল হ’ল৷৷’’১১১
এই বারাঙ্গনাদের গৃহে আট টাকা বেতনের কেরানিরা পোশাক ভাড়া করে বাবু সেজে খরিদ্দার হিসেবে যায় সঙ্গসুখ লাভের আশায়৷ গণিকাগৃহে চাকচিক্য বাড়িয়ে বেশি সমাদর লাভের আসায় পোশাক ভাড়া পাওয়ার দৃষ্টান্ত দেখে ধারণা করা যায় যে গণিকাগমন পুরুষদের কাছে কতটা অবশ্যম্ভাবী ছিল৷
‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ খোট্টা গণিকাদের উপপতি বরণের অদ্ভূত নিয়মের উল্লেখ আছে৷ খোট্টা গণিকাদের বিধি অনুযায়ী কোনো রক্ষিতা বা বেশ্যাকে যদি তার উপপতি ছেড়ে দিয়ে চলে যায় তখন সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্য বহু বাবু সেই বারবনিতার উমেদারি শুরু করে৷ সেই ‘বহু’-র মধ্য থেকে একজন হবে সেই গণিকার বাঁধা বাবু৷ সেই ‘বাবু’ নির্বাচনের জন্য বৃহদাকার এক ফর্দ তৈরি করা হয়৷ সেই ফর্দে উল্লিখিত হয় তার পেছনে খরচের দীর্ঘ তালিকা৷ সেই তালিকা অনুযায়ী অর্থ ব্যয়ের সামর্থ যে বাবুর থাকে সে-ই উপপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়৷ খোট্টা গণিকাদের এরূপ নিয়মের কারণ ব্যাখ্যা করে বরুণদেব বলেন যে, তারা ফর্দপূরণ উপলক্ষ করে পরীক্ষা করে নেয় তাদের পোষক বাবু দাতা হবে না কৃপণ হবে৷ নির্বাচিত বাবুরা উপপতি হয়ে রক্ষিতার পেছনে খরচ করতে করতে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়৷ গণিকারা সমাজ থেকে যেমন একঘরে বা পৃথক তেমনি তাদের আরাধ্য দেবতারাও আলাদা হন৷ কলকাতার নানা জায়গায় লম্পটেরা বেশ্যাদের আরাধনার জন্য কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেয়৷ বিস্তর পাঁঠা বলি দেওয়া হয় সে পূজায়৷ গণিকা ও তাদের সহায়ক লম্পটেরা মহাসমারোহে পূজা সম্পন্ন করে মহানন্দে প্রসাদ ভক্ষণ করে৷ কলকাতায় এমনি বেশ্যা ও লম্পটদের প্রতিষ্ঠিত কালী হলেন ‘কসাই কালী’৷ কলকাতা নগরীতে বাবু ‘কালচার’ এবং গণিকাবৃত্তিকে সতেজ রেখেছে মোসাহেবরা৷ বাবুর যত স্ত্রীলোক প্রয়োজন এরা বিভিন্ন কৌশলে তা জোগাড় করে দেয়৷
ব্রহ্মা, নারায়ণ, ইন্দ্র, বরুণ ঘোষপাড়ায় উপনীত হয়ে দেখেন কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধনপ্রণালী৷ আউলচাঁদ নামে এক উদাসীন ব্যক্তি এই ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা৷ ঘোষপাড়ার রামশরণ পাল সেই ধর্মের প্রচারক৷ এই ধর্মানুগামীদের মধ্যে ধর্মীয় কোনো বাছবিচার নেই৷ সেখানে বহু নারী সেবাদাসী হিসেবে আত্মনিয়োগ করে দিনাতিপাত করে৷ এই ধর্মসম্প্রদায় সম্পর্কে প্রচলিত কথায় বলা হয়—‘‘মেয়ে হিজড়ে, পুরুষ খোজা, তবে হয় কর্ত্তাভজা৷’’১১২
দুর্গাচরণ রায়ের এই উপন্যাসটিতে সমগ্র ভারতবর্ষের গণিকাজীবনের নানা চিত্র চিত্রিত হয়েছে৷ দেবতারা অমরাবতী থেকে কলকাতা পর্যন্ত যাত্রা পথে বরুণদেবকে ‘গাইড’ করে যেখানে যেখানে অবতরণ করেছেন সেখানে সেখানেই গণিকা নারীদের একটি করে অবয়ব তুলে ধরেছেন৷ দিল্লীর অপ্সরাতুল্য বাইজিরা, বৃন্দাবনের সেবাদাসী, লক্ষ্ণৌর নৃত্যগীতপটিয়সী বাইজি, কাশীর স্বৈরিণী, বেশ্যা, রক্ষিতা; মির্জাপুরের বেশ্যারা, জামালপুরের উপপত্নী, বেশ্যা, ভাগলপুরের বেশ্যাসক্ত জীবন, রক্ষিতা পোষণের বাহাদুরিতা, কুলবধূর অত্যাচারী স্বামীর অপযশ আনতে গণিকাবৃত্তি গ্রহণ, বর্ধমানের গণিকাবিলাস, শ্রীরামপুরের গণিকা সমাজ এবং কলকাতার অলিতে গলিতে গণিকাপল্লীর বাড়বাড়ন্ত চিত্র, খোট্টা গণিকা, ফিরিঙ্গি গণিকা, যবনী গণিকা, গণিকাদের উপপতি পোষা ইত্যাদি নানা দিক বর্ণিত হয়েছে৷ শুধু গণিকা নয় তাদের সাজসজ্জা, খদ্দের ধরার কৌশল, খাদ্য প্রণালী, ভাষাব্যবহার, সমাজের নানা স্তরের মানুষের দ্বারা অত্যাচারিত হওয়া, বিচারের আশায় অভাব-অভিযোগ-নালিশ জ্ঞাপন, প্রতারিত হওয়া, গণিকাদের বিভিন্ন স্তরবিভাগ কোনো কিছুই বাদ পড়েনি৷ এই চরিত্রগুলির মধ্যে স্নেহ,প্রেম, মমতার বিকাশ না ঘটিয়ে লেখক শুধুমাত্র যৌনবিনোদনের যন্ত্রমানবী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন৷ এরা সকলেই অর্থ এবং সম্পদ সংগ্রহের মহাযুদ্ধে খল নায়িকা৷ ছলে-বলে-কৌশলে জীবনধারণের রসদ সংগ্রহই এদের একমাত্র অবলম্বন৷
স্বর্ণবাই :
‘স্বর্ণবাই’ উপন্যাসটির রচনাকাল ১৮৮৮৷ এর রচয়িতা অজ্ঞাত৷ প্রকাশিত হয়েছে নবকুমার দত্ত মহাশয়ের সম্পাদনায়৷ ব্রিটিশ সৈন্যদের ভারতীয় গণিকাদের সঙ্গে অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত হওয়ার ফলে তাদের মধ্যে সিফিলিস, গনোরিয়া ইত্যাদি জটিল যৌনরোগগুলি ক্রমবিস্তার লাভ করে এবং কালক্রমে এত ব্যাপকহারে বিস্তৃত হয় যে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়৷ তাই সেনাদের রোগের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ১৮৬৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘Indian Contagious Diseases Act’ বা ‘চৌদ্দ আইন’ জারি করে৷ সেই আইনে ‘ফিট সার্টিফিকেট’ ছাড়া রূপাজীবাদের দেহব্যবসাকে অবৈধ এবং অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়৷ শারীরিকভাবে সুস্থতার বা নীরোগের শংসাপত্র প্রদানের পরীক্ষার নাম করে শুরু হয় তাদের প্রতি অকথ্য অত্যাচার ও অসম্মান৷ শংসাপত্র না হলে ব্যবসা চলবে না আবার পরীক্ষা দিতে গেলে যে পাশবিক সব ‘টেষ্ট’-এর যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় তাতে কলকাতার সব গণিকা আতঙ্কে একশেষ হয়ে যায়৷ হাসপাতালের কর্মী, ডাক্তাররা গণিকাদের প্রতি অবমাননা এবং বিকারগ্রস্ত মানসিকতায় যৌনরোগের পরীক্ষা করতে গিয়ে যৌনাঙ্গ কেঁটে, ছিঁড়ে, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ যৌনাঙ্গে প্রবেশ করিয়ে গণিকাদের নরকযন্ত্রণা প্রদান করতে থাকে৷ স্বেচ্ছায় লক হাসপাতালে পরীক্ষা না করাতে এলে বলপূর্বক ধরে আনা হত তাদের৷ ফলে বহু গণিকা আত্মহত্যা করে৷ অনেকে পালিয়ে যায় যেখানে চৌদ্দ আইনের ভয়াবহতা নেই৷ (গণিকারা পালিয়ে উপস্থিত হয় চন্দন নগরে৷ কারণ চন্দননগর ইংরেজ শাসনের বাইরে ফরাসী শাসনের অধীনে ছিল৷) উনিশ শতকের ভয়াবহ ‘চৌদ্দ আইন’-র প্রেক্ষাপটে লেখা ‘স্বর্ণবাই’ উপন্যাসটি৷
উপন্যাসে স্বর্ণর আসল নাম কাত্যায়নী৷ দশ বছর বয়সে বৈধব্যদশা প্রাপ্ত হয় উপন্যাসের নায়িকা কাত্যায়নীর৷ তখন সে বালিকামাত্র৷ কালক্রমে বাল্যাবস্থা কাটিয়ে প্রবেশ করে যৌবনের কুঞ্জবনে৷ অসামান্য রূপবতী কাত্যায়নী বাবা-মায়ের সঙ্গে তীর্থ যাত্রা করে সঙ্গীভ্রষ্ট হলে হস্তগত হয় প্রমোদ নামক এক যুবকের৷ কাত্যায়নী মুগ্ধ হয় তার প্রতি কিন্তু বিবাহিত চরিত্রবান প্রমোদ অনুসন্ধান চালিয়ে তার বাবা-মায়ের সন্ধান করে মেয়েকে তাদের হাতে তুলে দেয়৷ প্রমোদের প্রতি অনুরাগ হৃদয়ের মধ্যে স্থায়ী বাসা বাঁধে৷ এই অনুরাগ এবং কুসুম নাম্নী প্রতিবেশিনীর মুখে শোনা দাম্পত্য প্রণয়ের গল্প তাকে ধীরে ধীরে অগ্রসর করে যৌনলালসার দিকে৷ নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে সতেরো বছরের এক কিশোরকে প্রলুব্ধ করে সে এবং তাকে নিয়েই গৃহত্যাগী হয়৷ সেই কিশোর রমেশ কিছুদিন পর তাকে একা ফেলে গৃহে প্রত্যাগমন করে৷ কাত্যায়নী দমবার পাত্রী নয়৷ তাই ভাড়াটে গৃহের গৃহকর্ত্রীর প্ররোচনায় এক বৃদ্ধের সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হয়৷ বৃদ্ধ তার উদ্দাম যৌবনকে তাতিয়ে তুললেও মাতিয়ে তুলতে পারে না৷ আর এই অপরিতৃপ্ত কামনার যন্ত্রণায় বৃদ্ধের দেওয়া দামি পোশাক, অলঙ্কার সর্বোপরি সমস্ত সুযোগ সুবিধা ত্যাগ করে এক যুবক ভৃত্যকে সঙ্গী করে পালিয়ে যায়৷ সেই ভৃত্য তার যথাসর্বস্ব হরণ করে পালিয়ে গেলে সহায়-সম্বলহীন কাত্যায়নী উপায়ান্তর না দেখে দেহব্যবসা করে দিনাতিপাত করতে থাকে৷ তারপর আক্রান্ত হয় যৌনরোগে৷ চিকিৎসার জন্য ভর্তি হতে হয় লক হাসপাতালে৷ হাসপাতালে কাত্যায়নীর চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে ‘চৌদ্দ আইনে’র ভয়াবহ দিক সুস্পষ্টভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছে৷ কাত্যায়নীর চিকিৎসা প্রণালীতে দেখা যায় সেখানে তাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে বিভিন্ন যন্ত্রাদির দ্বারা অকথ্য অত্যাচারে এবং কটু ঔষধ সেবন করিয়ে চিকিৎসা চলতে থাকে৷ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হাসপাতাল থেকে পালানোর ফন্দি আঁটে সে৷ তার কাছে অর্থ অলংকার কিছু নেই যা দিয়ে কেউকে প্রলুব্ধ করতে পারবে৷ থাকার মধ্যে আছে শরীর এবং সেই শরীরের রূপ৷ হাসপাতালের কর্মীদের শরীর ও রূপ দিয়েই প্রলুব্ধ করতে হয়৷ সেখানকার কোনো এক কর্মী তার সঙ্গে বিনা পয়সায় শরীরী সংসর্গ করে পালানোর উপায় বের করে৷ অবশেষে এক জমাদারকে টাকা ঘুষ দিয়ে বেড়িয়ে আসে সেই অত্যাচারের কারাগার থেকে৷
কাত্যায়নীর নতুন জীবন শুরু হয়৷ গণিকাসমাজে নৃত্যগীতের একটা বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে৷ হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে নৃত্যগীত শিক্ষা করে নিজেকে আমূল বদলে ফেলে সে৷ নিজের নাম পাল্টে রাখে স্বর্ণবাঈ৷ স্বর্ণবাঈ এর পসার দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে৷ জীবনে এত পুরুষের সংসর্গ করেছে কাত্যায়নী তবুও প্রমোদকে ভুলতে পারে না কিছুতেই৷ প্রমোদই স্বর্ণর কামনার প্রথম ইন্ধনকাঠি৷ একদিন এক জমিদারের বাগানবাড়িতে মুজরা করতে গিয়ে মুখোমুখি হয় প্রমোদের৷ তার ছলা কলা এবং নিজের জানা সমস্ত কৌশল প্রয়োগ করে বশ করে তাকে৷ সচ্চরিত্রের প্রমোদ হয়ে উঠে এক দেহবিনোদিনীর হাতের পুতুল৷ কিন্তু প্রমোদ যখন স্বর্ণবাঈ-এর সত্যকার পরিচয় জানতে পারে তখন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে তাকে৷ প্রবল অপমানবোধে জর্জরিত হয় স্বর্ণবাঈ৷ তার প্রতি প্রবল প্রতিশোধস্পৃহায় সর্বনাশ করে তার বন্ধুর৷ একদিন যেমন করে বালবিধবা কাত্যায়নী যৌবনের দীপ্তিতে জ্বলে উঠেছিল তেমনি করেই সময়ের প্রবহমান ধারায় সেই যৌবনে ভাটা পড়তে থাকে৷ দেহব্যবসার পসার স্তিমিত হয়ে আসে৷ বেঁচে থাকার জন্য এবার তার সঙ্গী হয় যুবক চাকর-বাকররা৷ বহুবার তাদের দ্বারা লাঞ্ছিতাও হয় সে৷ তার ব্যবসা আর চলে না৷ শরীরের দিকে কেউ তাকিয়েও দেখে না৷ কিন্তু বেঁচে থাকতে গেলে তো অর্থ চাই৷ অর্থের বিনিময়ে খাদ্যের সংস্থান হবে৷ তাই অর্থ রোজগারের আশায় পথে-ঘাটে ঘটক সেজে অল্পবয়সি মেয়েদের গণিকা বৃত্তির দিকে প্রলোভিত করতে থাকে৷ তার উদ্দেশ্য সফল হয়৷ এক অল্পবয়সি বালবিধবাকে গণিকা বানিয়ে তার রোজগারেই স্বর্ণর জীবন চলতে থাকে৷ কিন্তু স্বর্ণ ক্রমশ অত্যাচারী হয়ে উঠলে মেয়েটি পালিয়ে যায়৷ হতাশায়—ভয়ে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর স্বপ্ন তার অবচেতন স্তর থেকে বেড়িয়ে আসতে থাকে৷ সে উন্মাদ হয়ে যায়৷ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে এক স্নেহশীলা মহিলার সেবা যত্নে সে সুস্থ হয়ে ওঠে৷ সেই মিশনারি নারী হয়ে যায় তার ‘নতুন মা’৷ সেবায়, যত্নে, সৎসংসর্গ স্বর্ণবাইকে তার দেহজীবিকার কালিমা থেকে মুক্ত করে৷ মিশনারিদের সাহায্যেই এক ধনী ব্যক্তির বাড়িতে নার্সের কাজ জোটে তার৷ সেবিকার ব্রতধারিণী স্বর্ণবাই ক্রমে জানতে পারে সেই ধনী ব্যক্তি আর কেউ নয় তার চিরবাঞ্ছিত, চিরকাঙ্খিত প্রমোদ৷ প্রমোদ তাকে চিনতে পারে কিন্তু কিছু করার আগেই স্বর্ণ তার সতীলক্ষ্মী স্ত্রীর দয়ায় সেখানে স্থায়ী আশ্রয় অর্জন করে নিয়েছে৷ প্রমোদের স্ত্রী-সন্তানদের নিষ্পাপ জীবনের ছায়ায় স্বর্ণবাঈ-এর জীবনে আরেক অধ্যায়ের সূচনা হয়৷ তাদের উদ্যোগেই সে শেষজীবনে কাশীতে আশ্রয়লাভ করতে পারে৷ তীর্থের সেই মুক্ত পবিত্র পরিবেশে বিশ্বেশ্বরের চরণতলে পরম শান্তিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে৷ একজন দেহজীবী নারী তার জীবনের সকল পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি পেয়ে সাধারণ জীবনের সীমাকে স্পর্শ করে চিরমুক্তি লাভ করে৷
গণিকাদের প্রতি ঘৃণা ও অবমাননার জন্য তারা চিরটাকাল অস্পৃশ্য ও পতিতা থেকে যায়৷ কিন্তু প্রকৃত সহানুভূতি পেলে তারাও যে সাধারণ মানুষের মতো সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে স্বর্ণর জীবন পরিণতি তারই ইঙ্গিত দেয়৷
নয়নতারা :
শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘নয়নতারা’ (১৮৯৯) উপন্যাসের মূল উপজীব্য উনিশ শতকের সামাজিক নানা অসঙ্গতির মধ্যে চরিত্রবতী, সাধ্বী নয়নতারার জীবনাদর্শ৷ সৎ, নিষ্ঠাবতী, তেজস্বিনী, ধর্মপ্রাণা এই নারীচরিত্রের চারিত্রিক শুচিতাকে আরও বেশি দৃঢ় করার অভিপ্রায়ে আরেক শ্রেণীর নারীচরিত্রের উপস্থাপন করা হয়েছে; তারা গণিকা চরিত্র৷ উপন্যাসের এক অন্যতম চরিত্র গোবিন রঙ্গালয়ের মধ্যমণি এবং বিলাসবহুল জীবনাচারণে অভ্যস্ত৷ হিন্দুধর্মের নিষ্ঠাবতী নারীদের সংস্পর্শে সে সৎপথে ফিরে আসে স্বেচ্ছাচারী জীবন-পরিবেশ থেকে৷ পতিতা নারীদের নৈকট্য পরিত্যাগ করে৷ এমতাবস্থায় রঙ্গালয়ের ম্যানেজার হরিশ্চন্দ্র ঘোষ তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করলে তার মুখে উচ্চারিত হয়—‘‘কতকগুলো বাজারের মেয়ের সঙ্গে বৈ ত নয়, এই উঁচুদরের মেয়েরা যে কি জিনিস তা ত জান না, সে মেয়ে যদি দেখতে তা হলে পায়ে পড়ে পুজো করতে৷’’১১৩ গোবিনের এই উক্তির মধ্য দিয়ে নিম্নবিত্তের পতিতা নারীদের সঙ্গে তথাকথিত উচ্চঘরের চরিত্রবান নারীদের বৈপরীত্য বোঝাতে গিয়ে গণিকাদের প্রতি অবমাননাকর মানসিকতা তুলেছেন লেখক৷ এই উপন্যাসে পতিতা নারীরা ‘বাজারের মেয়ে’ হিসেবে বিশেষিত৷ তাদের মান, ইজ্জত, জীবন-যাপন সবকিছুকে রচনাকার সংকীর্ণ মানসিকতায় ব্যক্ত করেছেন৷ এরা প্রকাশ্য রাস্তায়, থিয়েটার মহলে নির্দ্বিধায় পরপুরুষের সান্নিধ্য গ্রহণ করে, ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে৷ তাদের সাহচর্যে পুরুষেরা বিপথগামী হয়ে উশৃঙ্খলায় পর্যবসিত হয়৷ রচনাকারের কলমে তারা ঘৃণিত৷
নয়নতারার ছোট দাদা যোগেশ যখন পতিতা নারীদের সাহচর্যে মদ-মাতাল হয়ে তার পিতার বন্ধুস্থানীয় পরিবারের সঙ্গে অভব্য আচরণ করে তখন নয়নতারার মুখে ব্যক্ত হয়—‘‘বাজারের কতকগুলো মেয়ে কি তোমার ইয়ারকি দেবার লোক, তুমি কি করে তাদের সঙ্গে মাখামাখি করতে গেলে?’’১১৪ স্নেহশীলা, মমতাময়ী, পরদুঃখে কাতর নয়নতারাও সামান্যতম সহানুভূতি দিয়ে সমাজপতিতা এই নারীদের যন্ত্রণাকে বোঝার প্রয়োজন মনে করেনি৷ যোগেশের এই ধরনের নারীদের সঙ্গে মেলামেশাকে বিষদৃষ্টিতে দেখেছে সে৷ তাই তাকে বলে—‘‘ভদ্রলোকের ছেলেরা যেখানে বাজারের মেয়েদের সঙ্গে কোমর দুলিয়ে নাচে ভদ্রলোকের সেখানে যাওয়াই উচিৎ নয়৷… কেবল গিয়েছ তা নয়, সেই সব মেয়ে মানুষের সঙ্গে মাখামাখি করেছ, আমি ভেবে উঠতে পারছি না কিরূপে তোমার এত অধোগতি হলো৷’’১১৫
উপন্যাসটিতে গণিকারা কোন স্বতন্ত্র চরিত্র হিসেবে স্থান না পেলেও প্রধান চরিত্র নয়নতারার চারিত্রিক শুদ্ধতাকে গাঢ়তর করতে এই ধরনের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছেন রচনাকার শিবনাথ শাস্ত্রী৷ ‘বাজারের মেয়ে’ বিশেষিত পতিতারা ঘৃণ্য, সমাজ দূষক হিসেবে চিহ্নিত এবং নিন্দিত হয়েছে৷ তাদের সংসর্গ, সংস্পর্শ সবই আদর্শ সমাজের কাছে পরিত্যাজ্য৷
তথ্যসূত্র :
১. প্রমথনাথ বিশী সম্পাদিত ভূদেব রচনাসম্ভার, পৃ-৩২৯৷
২. তদেব, পৃ-৩২৯৷
৩. তদেব, পৃ-৩৩৭৷
৪. তদেব, পৃ-৩৩৭৷
৫. তদেব, পৃ-৩৩৭৷
৬. তদেব, পৃ-৩৩৯৷
৭. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, উপন্যাস সমগ্র, পৃ-৬৪৷
৮. তদেব, পৃ-৬২৷
৯. তদেব, পৃ-৯৩৷
১০. তদেব, পৃ-৬৮৷
১১. তদেব, পৃ-৬০৷
১২. তদেব, পৃ-৭৭৷
১৩. তদেব, পৃ-৭৭৷
১৪. তদেব, পৃ-১৩৫৷
১৫. তদেব, পৃ-১৩৫৷
১৬. তদেব, পৃ-২৭৭৷
১৭. তদেব, পৃ-২৭৭৷
১৮. তদেব, পৃ-২৭৭৷
১৯. তদেব, পৃ-২৮৮-২৮৯৷
২০. তদেব, পৃ-২৮৮৷
২১. তদেব, পৃ-৬৭৷
২২. তদেব, পৃ-৩৪২৷
২৩. তদেব, পৃ-৭৫৯৷
২৪. তদেব, পৃ-৭৬৬৷
২৫. তদেব, পৃ-৭৬১৷
২৬. তদেব, পৃ-৭৬৭৷
২৭. তদেব, পৃ-৭৬৯৷
২৮. তদেব, পৃ-৭৭৮-৭৭৯৷
২৯. তদেব, পৃ-৭৮৪৷
৩০. তদেব, পৃ-৭৮৬৷
৩১. তদেব, পৃ-৭৮৬৷
৩২. তদেব, পৃ-৮১৪৷
৩৩. তদেব, পৃ-৮১৬৷
৩৪. তদেব, পৃ-৮১৭-৮১৮৷
৩৫. তদেব, পৃ-৮১৯৷
৩৬. তদেব, পৃ-৮২১৷
৩৭. তদেব, পৃ-৮৪৫৷
৩৮. তদেব, পৃ-৮৪৬৷
৩৯. তদেব, পৃ-৮৫২৷
৪০. ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হরিদাসের গুপ্তকথা, পৃ-৮১৷
৪১. তদেব, পৃ-৮১৷
৪২. তদেব, পৃ-৮১৷
৪৩. তদেব, পৃ-৮১-৮২৷
৪৪. তদেব, পৃ-৮২৷
৪৫. তদেব, পৃ-৮২৷
৪৬. তদেব, পৃ-৪২৬৷
৪৭. তদেব, পৃ-১৩২৷
৪৮. তদেব, পৃ-১৩৯৷
৪৯. তদেব, পৃ-৪৪৯৷
৫০. তদেব, পৃ-১৪৮৷
৫১. তদেব, পৃ-২২৭৷
৫২. মৌ ভট্টাচার্য, বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ, পৃ-১২৫৷
৫৩. তদেব, পৃ-১২৭৷
৫৪. তদেব, পৃ-১২৭৷
৫৫. তদেব, পৃ-১২৭৷
৫৬. তদেব, পৃ-১২৯৷
৫৭. তদেব, পৃ-১২৯৷
৫৮. তদেব, পৃ-১২৯৷
৫৯. তদেব, পৃ-১৩২৷
৬০. তদেব, পৃ-১৩৩৷
৬১. তদেব, পৃ-১৩৩৷
৬২. তদেব, পৃ-১৩৩৷
৬৩. তদেব, পৃ-১৩৩৷
৬৪. তদেব, পৃ-১৩৩৷
৬৫. তদেব, পৃ-১৩৪৷
৬৬. তদেব, পৃ-১৩৫৷
৬৭. তদেব, পৃ-১৩৬৷
৬৮. তদেব, পৃ-১৩৬৷
৬৯. তদেব, পৃ-১৩৭৷
৭০. তদেব, পৃ-১৩৭-১৩৮৷
৭১. গিরিশ রচনাবলী, পঞ্চমখণ্ড, পৃ-১৬১৷
৭২. তদেব, পৃ-১৫৫৷
৭৩. তদেব, পৃ-১৫৫৷
৭৪. তদেব, পৃ-১৩৪৷
৭৫. তদেব, পৃ-১৩৭৷
৭৬. তদেব, পৃ-১৫৮৷
৭৭. তদেব, পৃ-১৬২৷
৭৮. তদেব, পৃ-১৬২৷
৭৯. তদেব, পৃ-১৬৯৷
৮০. তদেব, পৃ-১৭০৷
৮১. তদেব, পৃ-১৭১৷
৮২. তদেব, পৃ-১৭২৷
৮৩. তদেব, পৃ-১৭৩৷
৮৪. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদক) সঞ্জীব রচনাবলী (সম্পূর্ণ), পৃ-৯৷
৮৫. তদেব, পৃ-১২৷
৮৬. তদেব, পৃ-১২৷
৮৭. তদেব, পৃ-১২৷
৮৮. তদেব, পৃ-১২৷
৮৯. দুর্গাচরণ রায়, দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন, পৃ-১০৷
৯০. তদেব, পৃ-৬৷
৯১. তদেব, পৃ-২৯৷
৯২. তদেব, পৃ-৩৯৷
৯৩. তদেব, পৃ-৯৯৷
৯৪. তদেব, পৃ-১৫৮৷
৯৫. তদেব, পৃ-১৬৩৷
৯৬. তদেব, পৃ-১৮৮৷
৯৭. তদেব, পৃ-১৯৭৷
৯৮. তদেব, পৃ-১৯৭৷
৯৯. তদেব, পৃ-২৪২৷
১০০. তদেব, পৃ-২৫৭৷
১০১. তদেব, পৃ-২৫৭৷
১০২. তদেব, পৃ-২৬৯৷
১০৩. তদেব, পৃ-২৯৫৷
১০৪. তদেব, পৃ-৩১০৷
১০৫. তদেব, পৃ-৩২৫৷
১০৬. তদেব, পৃ-৩৪৯৷
১০৭. তদেব, পৃ-৩৫২৷
১০৮. তদেব, পৃ-৩৫৪৷
১০৯. তদেব, পৃ-৩৫৫৷
১১০. তদেব, পৃ-৩৬৫৷
১১১. তদেব, পৃ-৩৬৬৷
১১২. তদেব, পৃ-৪২৮৷
১১৩. শ্রীগোপাল হালদার (প্রধান সম্পাদক), শ্রীবারিদবরণ ঘোষ (সম্পাদক), শিবনাথ রচনাসংগ্রহ, পৃ-১৫৯৷
১১৪. তদেব, পৃ-১৭৬৷
১১৫. তদেব, পৃ-১৭৬৷