২. ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে গণিকা

ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে গণিকা

‘গণিকা’ শব্দটি নারী সমাজের ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ৷ শব্দটির ব্যুৎপত্তি—‘‘স্ত্রী [গণ + ইক + (ঠন্) অস্ত্যর্থে + স্ত্রী-আ (টাপ্)]৷ এর অর্থ—গণ (সমূহ) যাহার ভর্ত্তৃরূপে আছে৷’’ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই অর্থনৈতিক দুরবস্থা বা দারিদ্র্যের বলি হয় নারীরা৷ তাদের শরীরকে পণ্য করে চলতে যাকে এক ঘৃণ্য বিকিকিনির খেলা৷ ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে চিরকাল অবহেলিত হয়ে আসছে এই গণিকারা৷ সমাজ এদের বেশি করে চেনে বেশ্যা নামে৷ অর্থাৎ ‘‘স্ত্রী [বেশ + য (যৎ) + স্ত্রী-আ (টাপ্)]৷’’ যুগ যুগ ধরে সমাজের ভোগতৃষ্ণা পূরণের জন্য এরা লালিত, লাঞ্ছিত এবং ব্যবহৃত৷ নারী হয়ে জন্মগ্রহণ করেও জীবনের প্রতিকূলতায় এরা ‘বারনারী’ বহু পুরুষকে যৌন-আনন্দ দানকারী৷ সমাজের ঘৃণ্য অবহেলাকে মস্তকে ধারণ করে থাকা এই পণ্যাঙ্গনারা জন্ম থেকেই বেশ্যা হয় না বা বেশ্যাবৃত্তিতে মাথা গলায় না বরং বাঁচার অভীপ্সা রাখে সকলের সঙ্গে; তবু হয়ে ওঠে গণিকা, ঘৃণিতার চেয়েও ঘৃণিতা—এক কলঙ্কিত জীবনের আকরভূমি৷ কবে, কোথায়, কীভাবে এই নির্মম বৃত্তির জন্ম হয়েছিল তার হদিস পান না সমাজতাত্ত্বিকেরা, তাই তার সূত্র খোঁজা হয় প্রাচীন সাহিত্য-উপাদানের রন্ধ্র রন্ধ্র থেকে৷ কারণ যে কোনো সভ্যতারই সামাজিক বৈশিষ্ট্যের বীজ লুকিয়ে থাকে তার নিজস্ব রচনাগুলির মধ্যে৷ প্রাচীন ভারতীয় রচনা ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় তিনহাজার বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ থেকে নবম শতাধীর মধ্যে৷ তার মধ্যে কোথাও বেশ্যাবৃত্তির উল্লেখ নেই কিন্তু তার কয়েকশত বছর পর যখন বেদের পরবর্তী অংশ ‘ব্রাহ্মণ’ রচিত হয় (অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে পঞ্চম শতধীর মধ্যে) তাতে বারাঙ্গনাদের উল্লেখ রয়েছে৷ যেমন ‘গণিকা’ ‘বেশ্যা’, ‘রুদ্রগণিকা’, ‘দেববেশ্যা’ ইত্যাদি শব্দের উল্লেখ৷ অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ থেকে নবম শতাব্দীর ‘ঋগ্বেদ’ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে পঞ্চম শতাব্দীর ‘ব্রাহ্মণ’-এর মধ্যবর্তী সময়কার বিভিন্ন সামাজিক কার্যকলাপ সমাজের বুকে গণিকাবৃত্তিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার ইন্ধন যুগিয়েছে৷ আমাদের সেই সমাজ নারীর প্রতি যত কঠোর হয়েছে, সতীত্ব বা নিয়ম-কানুন, নিষেধের পরাকাষ্ঠায় নারীর জীবনকে যত দৃঢ়ভাবে মূল্যায়নের চেষ্টা করেছে; তত দেখা গেছে নারীকে কলুষিত করার প্রচেষ্টা৷ পিঞ্জরাবদ্ধ নিষ্ঠুর জীবন-যাপনের নাগপাশ থেকে বেরোতে গিয়ে বহু নারী হয়ে উঠেছে গণিকা বা বেশ্যা৷ নারীদের গণিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশের কয়েকটা কারণ বাসাম তাঁর ‘ওয়াণ্ডার দ্যাট ওয়াজ ইণ্ডিয়া’ গ্রন্থে যুক্তিযুক্তভাবে প্রতিপন্ন করেছেন৷ যেমন—

১) স্বজাতি পাত্রের সন্ধান না পাওয়া৷

২) নারীর প্রতি আত্মীয় ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের দুর্ব্যবহার৷

৩) নানারকম ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শিশুকন্যাদের উপহার হিসেবে দান করা৷

৪) অকাল বৈধব্য৷

৫) ধর্ষিতা ও অপহৃতা নারীদের সামাজিকভাবে বহিষ্কার৷

অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপিয়ে দেওয়া নানাবিধ নিয়ম, কানুন, নিষেধ, নির্দেশ,অত্যাচার-অবিচার, অবহেলা ইত্যাদিই নারীর গণিকা হয়ে ওঠার প্রধান কারণ৷ এর সঙ্গে রয়েছে পারিবারিক ঔদাসিন্য, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন এবং দুমুঠো অন্ন সংস্থানের সুতীব্র প্রয়োজনীয়তা; যা শুধু কিশোরী-যুবতীদের নয় শিশুদেরকেও এই বৃত্তি গ্রহণে বাধ্য করে তুলেছে৷

গণিকা কারা :

দেহসম্ভোগ গণিকাবৃত্তির একটি প্রধানতম দিক৷ কিন্তু যদি কোনো নারী একাধিক পুরুষের সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হয় তাহলেও তাকে দেহজীবী হিসেবে নির্দিষ্ট করা যাবে না যদি না তার সঙ্গে অর্থ বা অন্য কিছু বিনিয়োগের কোনো যোগসূত্র থাকে৷ অর্থাৎ দেহ সম্ভোগের সঙ্গে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের বা অন্য কোনো দ্রব্য-বস্তুর আদান-প্রদানের একটা যোগসূত্র থাকতেই হবে যা সেই নারীর জীবন জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ সুতরাং গণিকা তাদেরই বলা যাবে, যে নারীরা দেহকে পণ্য করে জীবিকা নির্বাহ করে৷ পুঁজিবাদী সমাজে মজুরির ভিত্তিতে শ্রমবিভাজন ব্যবস্থায় এই গণিকারা সবসময় যৌনবিনোদনকারী হিসেবে চিহ্নিত এবং নিন্দিত৷ মানসিক এবং বৌদ্ধিক সবরকম অনুভূতিকে দূরে সরিয়ে রেখে এদের একমাত্র পরিচয় নারী শরীর৷

গণিকার বৈশিষ্ট্য :

সবরকম দিক বিচার করে দেহপসারিণী নারীদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যায়৷ যেমন—

১) এই বৃত্তিতে নারী ও পুরুষের দৈহিক সম্পর্কের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হল অর্থ বা অন্য কোনো বস্তুর বিনিয়োগ৷ অর্থাৎ পুরুষকে পণ্যাঙ্গনার কাছ থেকে যৌন আনন্দ পেতে গেলে অবশ্যই কিছু না কিছু বিনিয়োগ করতে হবে৷

২) যৌন আনন্দ দানকারী নারীকে বহুপুরুষভোগ্যা হতে হবে৷

৩) দেহকে অবলম্বন করে উপার্জন নারীটির প্রধান বা অপ্রধান জীবিকা হতে হবে৷ অর্থাৎ নারীটির অর্থনৈতিক সঙ্গতি কোনো না কোনোভাবে দেহ-বিক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকবে৷

৪) শরীরী সম্পর্কে লিপ্ত নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো মানসিক যোগ থাকবে না৷ তাদের সম্পর্ক একে অন্যের প্রতি প্রেম-ভালোবাসার নয়, শুধুমাত্র ব্যবসায়িক৷

গণিকার বিভিন্ন নাম :

দেহব্যবসায়ী এই নারীরা নানা নামে পরিচিত৷ নারীর প্রতি নির্মম-নিষ্ঠুর এ সমাজ তাদের অবজ্ঞায়-ঘৃণায় অবদমিত করে বিভিন্ন অভিজ্ঞানে অভিনন্দিত করেছে; নারী-পুরুষের মিথুনের সুখানুভূতিকে স্থূল দেহরুচিতে বেঁধে তাদের পরিণত করেছে কামনা পরিপূরণের শাণিত অস্ত্রে৷ সেখানে তারা মর্মসহচরী নয় নর্মসহচরী; উগ্রকামনা দমনের একমাত্র মাধ্যম৷ অর্থাৎ নারীর কমনীয় সৌন্দর্যকে স্থূলদেহরুচির তীব্র পেষণে পিষ্ট করে নারীদেহকে ভোগের মানসিকতা চিরকালের৷ তাই ‘‘যে মানসিকতায় হারেমে আবির্ভূত হয়েছিল উপপত্নী, রক্ষিতা, মাগ, রাখনী তারই সম্প্রসারণ দেখা দেয় দাসী, নটী, দেবদাসী, বাইজী, বারবধূ এবং শেষ পরিণামে গণিকা, বেশ্যা, বারাঙ্গনা৷’’

নারীদেহমন্থনের এই ঘৃণ্য খেলায় কিছু স্থূল রুচিবোধসম্পন্ন মানুষেরা তাদের বিভিন্ন নামে বিভূষিত করে কদর্য দেহকামনা নিরসনের উপায় খুঁজেছে৷ যেমন—‘বেশ্যা’, ‘পতিতা’, ‘বারাঙ্গনা’, ‘বারস্ত্রী’, ‘বারবধূ’, ‘বারবনিতা’, ‘পণ্যাঙ্গনা’, ‘রূপাজীবা’, ‘দেহজীবা’, ‘দেহপসারিণী’, ‘দেহব্যবসায়ী’ প্রত্যেকটি নামের সঙ্গেই মিশে আছে ভদ্র সমাজ থেকে বিচ্যুতির কথা৷ নামগুলিকে বিশ্লেষণ করলেই উঠে আসে এর প্রকৃত স্বরূপ৷ যেমন—‘বেশ্যা’ আভিধানিক অর্থ হল যে নারী অর্থের বিনিময়ে একাধিক জনকে দেহসঙ্গ দান করে৷ অর্থাৎ ‘বিশ্’ বা জনসাধারণের ভোগ্যা৷ ‘‘বৈদিক যুগে পতিতা রমণী ছিল,… পতিতারা বিশ বা আর্য্য শ্রেণীর লোক সাধারণের ভোগ্যা ছিল বলিয়া তাহাদের নাম হইয়াছিল ‘বিশ্যা’৷ শব্দটির ব্যুৎপত্তির কথা বিস্তৃত হওয়াতে সংস্কৃত ভাষায় বৈদিক শব্দের ই-কার স্থানে এ-কার হইয়া গিয়াছিল৷’’ ‘পতিতা’ শব্দটি সুনীতি ও শালীনতার নির্ধারিত মান থেকে যাদের পতন হয়েছে সেই নারীদের নির্দেশ করে৷ এর ব্যুৎপত্তি ‘‘পত্  + ত (ক্ত)-ক৷’’ ‘বার’ বা বহুপুরুষের অঙ্কশায়িনীরা হলেন বারবনিতা, বারাঙ্গনা, বারবধূ, বারস্ত্রী৷ পণ্যজ্ঞানে যারা নিজেদের উৎসর্গ করে তারা পণ্যাঙ্গনা৷ রূপ আজীব যার সে ‘রূপাজীবা’ আর দেহের পসরা সাজিয়ে যার বিকিকিনি সে দেহপসারিণী৷ দেহ ব্যবসায়ী তারা যারা দেহকেই রুজি-রোজগারের মাধ্যম করে জীবন অতিবাহিত করে৷ এছাড়াও গণিকাদের নামের সমার্থক আরও বহু নাম আছে যেগুলি তাদের বৃত্তি, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদিকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিবিম্বিত করে৷ যেমন অগ্রু, কুচনি, ইত্বরী, কামোরবাজ, কুম্ভদাসী, কুলটা, অতিস্কদ্বরী, অজ্জুকা, খানকি, খানসেনা, এজমালি, কঁড়ে, রাঁড়ি, কসবি, ঘুষ্কি, চুতিয়া, ছেনাল, ঘইতা, ঢেমনি, কামলেখা, কামিনা, কেপ্ট, গণেরু, গশতি, খাঁউ, গস্তানি, গুদমারানি, চুতমারানি, মাংমারানি, গ্যান, ছুটকোমেয়ে, জঙ্খাল, জঙ্খী, টানখাওয়া, জনপদবধূ, ঠুমকি, খালকুঠি, খেরেলি, খানু, চাবি, দুগগি, দো-তললি, দারী, চুদখানকি, চুসকি, ছানকি, চাটাইসার, চ্যাঙলা, ছাপকি, আধিয়া, সাই, ধর্ষকারিণী, ধর্ষণী, ছিটুয়া, কামিনী, ছুটো, নগ্নিকা, পউনি, পিসকুরি, প্রেষণী, বন্ধুরা, বারোযোষিৎ, বাঁদি, মঞ্জিকা, রাণ্ডি, রামা, রূপদাসী, রুণ্ডিকা, নটী, নগরবধূ, ধুমড়ি, নটিনি, নগরনটী, নটীদারী, নষ্টচরিত্রা, নগরশোভিনী, নেহনি, নগ্না, নৈশবালা, পুংশ্চলী, পরপুষ্টা, পুংস্কামা, প্রস, প্রস্টিটিউট, পিলকুরি, পাতুরিয়া, পাকটি, পেশাকর, বাজারি মেয়ে, রক্ষিতা, ফয়ার, ফেদড়ি, বাবোন, ফ্লাইং, বর্বটি, বারকানসি, বর্ণদাসী, বারবাণী, বারোভাতারি, বিল্লি, বিষকন্যা, ভণ্ডহাসিনী, ভুঞ্জিকা, বেবুশ্যে, বেশার্হা, বেশ্যে, ভোগ্যা, ভ্যাতা, মকর, রেণ্ডি, লঞ্জিকা, শালভঞ্জি বা শালভঞ্জিকা, লাইনের মেয়ে, লম্পটি, লিঙ্গামাকড়ি, লেদার, সঞ্চারিকা, সন্ধিজীবক, সাঙার, সিটউরি, সিটিয়া বা সেঠিয়া, সোধিয়া, সাঙার, সাধারণী, স্পর্শা, স্বতন্ত্রা, স্বাধীনযৌবনা, স্বৈরী বা স্বেরিণী, হট্টবিলাসিনী, স্বরবীথিকা, হস্রা, হাফগেরস্ত, হোর, সেক্সওয়ারকার, আর.পি (Registered Prostitute), ইট ওয়াট বা ইট হোয়াট (eat = খান what = কি, হল খানকি) মাগি—সংক্ষেপে এম. জি, রতায়নী, মুহূতির্কা, রজয়িত্রী, নানাখাতাই, যৌনকর্মী ইত্যাদি৷ নামগুলি সমস্তই অপমানজনক৷ গণিকাদের এই নাম প্রাচুর্যের সুষ্ঠু প্রতিফলন দেখা যায় নিম্নোক্ত কবিতাটিতে—

‘‘নিজের ঘরে হাতের মুঠোয়:

 পত্নী, ঘরণী, শয্যাসঙ্গিনী, অঙ্গলক্ষ্মী, সতী, পতিপ্রাণা, সুভগ৷

ভিন্ন ঘরে নিয়ন্ত্রণে:

 উপপত্নী, রক্ষিতা, মাগ, উপস্ত্রী, রাখনী৷

সবার ঘরে নিন্দা করে:

 অসতী, ভ্রষ্টা, ব্যাভিচারিণী, নষ্টা, দ্বিচারিণী, স্বৈরিণী৷

প্রমোদ ঘরে সবার তরে:

 নটী, নটদারী, সঞ্চারিকা, রূপজীবী, বাইজী৷

বেশ্যা ঘরে আটক করে:

 গণিকা, বেশ্যা, বারাঙ্গনা, বারবধূ, বারনারী, মঞ্জিকা৷

বিশ্বপটে নতুন নামে:

 বারড্যান্সার, ক্যাবারে ড্যান্সার, মডেল গার্ল, বিশ্বসুন্দরী, কলগার্ল৷’’

গণিকারা শুধু নামে অপমানিত, ঘৃণিত নয় তাদের পেশাটিও শ্রুতিকটু নানা অভিধায় অভিব্যক্ত৷ সেখানে অসম্মানজনক এক নির্মম বৃত্তিকে সামনে নিয়ে আসে৷ যেমন আদিম ব্যবসা, গণিকাবৃত্তি, কামিনাপনা, কশব, খানকিপনা, খানকিগিরি, গাণিক্য, গস্তানি, বেশ্যাগিরি, বেশ্যাবাজি, মাগিগিরি, মাগিবাজি, গুদামভাড়া, মাগিপনা, ছিনালি বা ছেনালি, খেমটা খেলা, ছেনালিপনা, নাগরালি, পতিতাবৃত্তি, বাঁধাই, বেশ্যাপনা, বেসাতি, লাইনে নামা, ভুতোলবাজি, ভোতোরবাজি, পতিতাবৃত্তি এবং বর্তমানে যৌনক্রিয়া বা এসকর্ট সার্ভিস৷

সমাজবঞ্চিতা পতিতা এই নারীদের অবস্থান সমাজ থেকে বহু দূরে; অন্য আরেক জগতে৷ সর্ব পাপকে বক্ষে ধারণ করে সমাজকে সুস্থ রেখে এই ‘নারী’ পরিচয়ধারী গণিকারা সমাজে স্থান পায় না—আস্তাকুঁড়ে পশুর মত মিথুনের জতুগৃহ তৈরি করে তিলে তিলে ছাই হয়ে যায়৷ তাদের সেই বসতখানাও রুচিবিকৃত বিভিন্ন নামে চিহ্নিত৷ যেমন—বেশ্যাপাড়া, বেশ্যাপটি, বেশ্যাপল্লী, বেশ্যালয়, আনোনদবাজার, কাপাখানা, কুততো, খাঁই খাঁই, কালি বাড়ি, ক্লাব-হাউস, খানকিবাড়ি, খানকিটোলা, খানকিপাড়া, খালিকুঠি, গণিকাপল্লী, গণিকালয়, তিরথো, গ্যান-ভ্যান, দলিজ, দোখিনপাড়া, দোকানিয়া, নিষিদ্ধপল্লী, নিষিদ্ধপাড়া, মাগিবাড়ি, মাগিপাড়া, পতিতাপল্লী, পতিতালয়, বিলাখানা, ভিয়েটনাম, নকিং সপ, ব্রথেল, সাঙগারবাড়ি, রাঁড়ের বাড়ি, লালবাতি অঞ্চল আর পুলিশি কেতায় রেড-লাইট এরিয়া৷

অর্থাৎ পুরুষেরা চিরকাল ধরে নারীকে সঙ্গিনী করে তার দেহকে যেমন উপভোগ করে এসেছে তেমনি তার ভালোলাগা না-লাগার অনুভূতিগুলিকে বিভিন্ন কৌশলে পর্যুদস্ত করেছে৷ আর সমস্ত ক্ষেত্রেই কাজ করেছে তার স্থূল দেহপিপাসা৷ গণিকাদের উপর আরোপিত নানা নাম, তাদের পেশা, তাদের বাসস্থান সবকিছুকে নানাবিধ ঘৃণ্য অভিধায় অভিজ্ঞানিত করে তাদেরকে অপমানের, লাঞ্ছনার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিয়েছে৷ আবার বর্তমান সময়ে গণিকাদের যে আধুনিক ‘যৌনকর্মী’ অভিধা প্রয়োগের প্রয়াস দেখা যাচ্ছে সেখানেও নারীত্বের অবমাননার আরেক রূপ প্রতিফলিত৷ যদিও বেশ্যা নামটি ব্যবহারের মধ্যে যে শালীনতাবোধের দ্বন্দ্ব দেখা যায় ‘যৌনকর্মী’ শব্দটি সেক্ষেত্রে শ্রুতি সুখকর৷ আর কিছু সুযোগ সন্ধানী মানুষ ‘যৌনকর্মী’ নামটি প্রয়োগ করে তাদের শ্রমিক বানিয়ে দেহব্যবসার মতো নারীদেহভোগ ও নির্যাতনের মতো ঘৃণ্য প্রথাকে টিকিয়ে রাখার প্রয়াস চালিয়ে বৈধ স্বীকৃতির দাবিতে মেতে উঠেছে, সঙ্গে সঙ্গে নারীদেহ মন্থনের আড়াল-আবডাল উঠিয়ে দিয়ে সামাজিক পরিবেশে তাকে অবাধ ভোগের পণ্য করে গণিকাবৃত্তিকে আরও বিস্তৃততর করতে যত্নবান হচ্ছে৷

গণিকার শ্রেণীবিভাগ :

গণিকার স্বরূপকে সহজরূপে পরিস্ফূট করতে গেলে কর্মের ধরন অনুযায়ী তাদের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভাজন করা অবশ্যই প্রয়োজন৷ কারণ বিষদভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় গণিকাদের কেউ পল্লীতে অবস্থান করে, খদ্দের তার বাড়িতে আসে৷ অনেককে আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে খদ্দের ধরতে হয়৷ কেউ কেউ আবার সামাজিকভাবে কারও স্ত্রী বা বোন হয়েও অর্থাৎ সুস্থ সামাজিক পরিবেশে থাকা সত্ত্বেও কখনো কখনো দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে৷ কর্মপদ্ধতির এই পার্থক্যের নিরিখে গণিকাদের কয়েকটি শ্রেণীতে বিভাজন করা যায়৷ যেমন—(১) অপ্সরী, (২) দেবদাসী, (৩) সভানারী, (৪) সেবাদাসী, (৫) বাইজি, (৬) বেশ্যা বা গণিকা, (৭) উপপত্নী, (৮) রক্ষিতা, (৯) কলগার্ল, (১০) ভ্রাম্যমান যৌনকর্মী, (১১) বারড্যান্সার, (১২) ক্যাবারেড্যান্সার, (১৩) শিশু গণিকা বা Child Prostitute. (১৪) স্বৈরিণী, (১৫) এসকর্ট, (১৬) স্ট্রিপার, (১৭) কোর্টসান৷

১) অপ্সরা :

‘অপ’ শব্দের অর্থ জল৷ ‘রামায়ণ’ মতে সমুদ্র মন্থন থেকে অপ্সরার উৎপত্তি হয়৷ ‘মহাভারতে’ কশ্যপপত্নী প্রধার গর্ভে অলম্বুষা প্রভৃতি চতুর্দশ অপ্সরার উৎপত্তি বর্ণিত হয়েছে৷ ‘কাদম্বরী’-তে মহাশ্বেতাকৃত অপ্সরাগণের বংশ বর্ণনায় ব্রহ্মার মানসদেব অনল জল প্রভৃতি থেকে চতুর্দশ কুলের উৎপত্তি উল্লিখিত হয়েছে৷ অভিধান চিন্তামণির টীকায় ব্রহ্মা বিষ্ণু যম থেকে প্রভৃতি একোনচত্বারিংশৎ অপ্সরার উৎপত্তি বিষয়ে ব্যাড়িধৃত বচন উদ্ধৃত হয়েছে৷ অপ্সরার উৎপত্তি বিষয়ে এইরূপ নানা মত আছে৷ মহাভারতে পাণ্ডবের উৎপত্তি বর্ণনায় অনুচানা, অনবদ্যা, গুণমুখ্যা প্রভৃতি বহু অপ্সরার নামোল্লেখ আছে৷ ঊর্বশী, মেনকা, ঘৃতাচি, রম্ভা, বিশ্বাচী ইত্যাদি বহুপরিচিত অপ্সরা নাম৷

২) দেবদাসী :

দেবদাসী হল দেবপরিচারিকা৷ মন্দিরের দেবতার উদ্দেশ্যে কুমারী মেয়েদের দান করা হয়, সেই দেবতাই হয় সেই বালিকার স্বামী৷ শুধু ভারতীয় কেন বহু সভ্যতাতেই এই প্রথা লক্ষণীয়৷ ব্যাবিলনে প্রায় চারহাজার বছর আগে দেবী ইশতারের মন্দিরে মেয়ে পুরোহিত সহ বহু দেবদাসী ছিল৷ গ্রীসের করিন্থ শহরে দেবী অ্যাফ্রোদিতির মন্দিরে একহাজার দেবদাসী ছিল বলে মনে করা হয়৷ দেবদাসীরা দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হলেও মন্দির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে দেহদান করতে বাধ্য হত৷ আবার কারও কারও সমাজে যথেষ্ট প্রতিপত্তিও ছিল৷

দেবদাসীর ধারণাও বহু প্রাচীন৷ বেদের পরবর্তীকালে যখন ইন্দ্র বৈদিক দেবতার স্থানে শিব, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতার পূজা শুরু হয় সঙ্গে সঙ্গে মন্দির স্থাপনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যায়৷ এই দেবতাদের সঙ্গীত-নৃত্যপ্রিয় হিসেবে কল্পনা করে তাদের মনোরঞ্জনের জন্য দেবদাসীদের মন্দিরে নিয়োগ করা হয়৷ ক্রমে পুরোহিত এবং সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা নিজেদের যৌনসুখ পরিতৃপ্তির জন্য দেবতার নামে উৎসর্গীকৃত এই নারীদের ব্যবহার করতে আরম্ভ করে৷ দেবদাসীরা সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে বিভিন্ন উপায়ে মন্দিরে আসত৷ তাদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য দেবদাসীদের বিবিধ শ্রেণীবিন্যাসের মধ্য দিয়ে নানা উপায় বের করে শোষক পুরুষসমাজ৷ যেমন—

(ক) দত্তা : যদি কোন পুণ্যলোভী গৃহস্থ স্ব-ইচ্ছায় কন্যাকে মন্দিরে দান করে তবে সেই কন্যা দত্তা৷

(খ) হৃতা : যে মেয়েকে হরণ করে এনে মন্দিরে উপহার দেওয়া হত৷

(গ) বিক্রেতা : যাদের মন্দিরে পাঠানো হত অর্থের বিনিময়ে৷

(ঘ) ভৃত্যা : যে মেয়েরা স্বেচ্ছায় মন্দিরে আত্ম উৎসর্গ করত৷

(ঙ) ভক্তা : যে সন্ন্যাসিনী মেয়েরা নিজের ইচ্ছেতে মন্দিরবাসিনী হত৷ অনেক রাজকন্যাও এভাবে দেবদাসী হয়েছে৷

(চ) সালংকারা : নৃত্য-গীত প্রভৃতি নানা কলাবিদ্যায় পারঙ্গম হওয়ার পর যে নারীকে অলংকৃত করে মন্দিরে দেবতার নামে অর্পণ করা হত৷

(ছ) গোপিকা বা রুদ্রগণিকা : এরা মন্দিরের বেতনভোগী দেবদাসী৷ নির্দিষ্ট দিনে বা সময়ে নৃত্যগীত করার জন্য এদের আহ্বান করা হত৷

দেবদাসীদের কথা তৃতীয় খ্রিস্টাব্দের আগে স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না৷ তারপরে রচিত পুরাণ৷ পুরাণগুলোতে দেবদাসীদের কথা অনেক পাওয়া যায়৷ যেমন যারা স্বর্গ কামনা করে তাদের বালিকা ক্রয় করে মন্দিরে উৎসর্গ করা উচিৎ—ভবিষ্য পুরাণে এমন কথা বলা হয়েছে৷ সপ্তম খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ওড়িশার মন্দিরগুলোতে দেবদাসী প্রথার এতটাই প্রসার ঘটেছিল যার সাক্ষ্য দেয় মন্দিরের গায়ে নৃত্যরত মেয়েদের ছবি৷ নানা ভ্রমণকাহিনি ও রচনারাজীও দক্ষিণভারতে এই দেবদাসী প্রথার প্রসারের সাক্ষ্য বহন করে৷ সপ্তম শতাব্দীতে মুলতানের সূর্যমন্দিরে হিউয়েন সাঙ দেবদাসীদের উপস্থিতি দেখেছিলেন৷ যে মন্দির যত ধনী ছিল সেখানকার দেবদাসীর সংখ্যা তত বেশি ছিল৷ এছাড়া তৎকালীন রাজারাও পুণ্যকামনায় মন্দিরে দেবদাসী দান করতেন৷ ভারতের নানা অঞ্চল থেকে পাওয়া শিলালিপি, তাম্রলিপি থেকে রাজা এবং অন্যান্য বিত্তবানদের মন্দিরে দেবদাসী উৎসর্গ করা, তাদের দিয়ে নৃত্যগীতের আয়োজন করা, সম্পত্তি দান ইত্যাদি বিবরণ পাওয়া যায়৷

প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’-এর বসন্তসেনা, ‘সুতনুকা প্রত্নলেখ’-তে উল্লিখিত সুতনুকা, কলহনের ‘রাজতরঙ্গিণী’-র কমলা এরা সকলেই দেবদাসী৷ সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর ‘রামচরিতমানস’-এ নৃত্যরত দেবদাসীর কথা লিখেছিলেন৷ এদের সামাজিক অবস্থান বেশ্যাদের মতো নয়৷ এরা বারভোগ্যা হলেও তাদের জীবনাচারণ সমাজের কাছে ঘৃণ্য ছিল না৷ দেবতার সেবায় নিয়োজিত হয়ে এরা যথেষ্ট সম্মানের অধিকারী হত৷

দক্ষিণ ভারতের নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে দেবদাসী প্রথার নানা ধরন রয়েছে৷ যেমন মাদ্রাজের দেবদাসীদের মধ্যে প্রধান দুটি সম্প্রদায়—ভালাঙ্গাই এবং ইদাঙ্গাই৷ ভালাঙ্গাইদের জাতের বাছবিচার রয়েছে কিন্তু ইদাঙ্গাইরা সকলকেই গ্রহণ করে৷ কোয়েম্বাটুরের কাইকোলন সম্প্রদায়ের মধ্যে নিয়ম হল পরিবারের অন্তত একটি মেয়েকে দেবমন্দিরে উৎসর্গ করতে হয়৷ কেরলাপুরম মন্দিরের দেবদাসীদেরও দুটি শ্রেণী৷ কুরাকুদ্দি ও চিরাপ্পুকুটি৷ কুরাকুদ্দিদের রোজ মন্দিরে উপস্থিত থাকতে হয় আর চিরাপ্পুকুটিদের বিশেষ বিশেষ দিনে মন্দিরে এলেই চলে৷ মহীশুর এবং ধারওয়ারের বয়া ও বেদারু সম্প্রদায়ের নিয়ম হল যে পরিবারে পুত্র না জন্মে শুধুমাত্র কন্যা জন্মেছে তাদের একজনকে দেবমন্দিরে উৎসর্গ করা হয়৷ সেই দেবদাসীর নাম ‘বাসবী’৷ পশ্চিম ভারতে দেবদাসীদের বলে ‘ভাবিন’ (রূপসী মহিলা), দেবলী (দেবতার দাসী), নাইকিন (রক্ষিতা) প্রভৃতি৷ মারওয়ারের দেবদাসীরা নিজেদেরকে বলে ‘ভগতান’ অর্থাৎ ভগবানে সমর্পিতপ্রাণ সন্ন্যাসীর পত্নী৷ তথাপি কালের গ্রাসে এদের যৌবন অতিক্রান্ত হলে দুর্দশার শেষ থাকতো না৷

দেবদাসীদের জীবনের শেষ পর্যায় মর্মান্তিক৷ মহিশুরে নিয়ম ছিল দেবদাসী বৃদ্ধ হলে অবসরের প্রতীক হিসেবে রাজসভায় সবার সামনে কানের গহনা ‘পম্পাদাম’ খুলে ফেলে পিছন দিকে না তাকিয়ে তাকে সভা ত্যাগ করতে হত৷ তিরুপতি মন্দিরের দেবদাসীকে বিদায় দেওয়ার সময় লোহা পুড়িয়ে তার উরু এবং বুকে বেঙ্কটেশ্বরের সিলমোহরের ছাপ দেওয়া হত৷ সেই দেবদাসীর নাম হত কলিযুগ লক্ষ্মী৷ অর্থাৎ তরুণী দেবদাসী বৃদ্ধ হলে, তার যৌবন অতিক্রান্ত হলে পুরুষ সমাজের তাকে আর কোনো প্রয়োজন থাকে না৷ মন্দিরের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা সকলের মনোরঞ্জনকারিণী দেবদাসী শেষ বয়সে পথের ভিখারি হয়ে বিভৎস মৃত্যুযন্ত্রণায় পচে মরে৷ দেবতার নাম করে মানুষের যৌনপিপাসাকে তৃপ্ত করার এক বৈধ ব্যবস্থা হল দেবদাসী প্রথা৷

(৩) সভানারী বা রাজনর্তকী :

সবাই যেখানে মিলিত ভাবে শোভা পায় তাই ‘সভা’৷ আর সভায় উপস্থিত ব্যক্তিদের আনন্দদানকারী নারীরা হল সভানারী৷ ভারতে বিবিধ রাজরাজড়াদের ইতিহাসে এমন চরিত্রের সন্ধান মেলে৷ এরা রাজনর্তকী নামেও পরিচিত৷ রাজসভায় নৃত্যগীত পরিবেশন করে পারিষদদের তুষ্ট করত৷ নিজের দেহকে উৎসর্গ করে দিত রাজা তথা রাজ-অমাত্যদের সেবায়৷

(৪) সেবাদাসী :

‘সেবাদাসী’ বৈষ্ণব-মহন্তদের পরিচর্যাকারিণী বৈষ্ণবী৷ বৈষ্ণব আখড়ায়, বৈষ্ণবের সেবায়, মনোরঞ্জনে, নিজের শ্রম, রূপ সবকিছুকে অকাতরে বিলিয়ে দিত৷ আর সেবার নাম করে পুরুষের দুর্বার শরীরী পিপাসাকে মিটিয়ে রাখে এই সেবাদাসীরা৷ এখানে পরপুরুষ সম্ভোগ আছে৷ কণ্ঠীবদল যদিও এই সেবাদাসী হওয়ার প্রধান শর্ত৷ এই প্রথায় ‘বৃত্তি’ বা জীবিকা তেমনভাবে প্রতিফলিত হয় না৷ সেবাদাসীরা অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় জীবনের এই ত্রিবিধ ভরসাতে মুখ বুজে নিজেদের উৎসর্গ করে দেয়৷ এরা পেশাদার গণিকার মতো মজুরির ভিত্তিতে প্রকাশ্যে দেহের দর হাকে না৷ সমাজ ভোগের জন্য, কামনা-বাসনার দরজাকে উন্মুক্ত রাখার জন্য ধর্মের দোহাই দিয়ে সেবাদাসীর মতো প্রথাকে জিইয়ে রেখেছে৷ এরা তাদের কদর্য দেহভোগের কালিমাকে আড়াল করে কিছুটা সামাজিক মর্যাদা পেলেও মানসিক মুক্তি পায় না, নিজের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বরং শিউরে ওঠে৷

(৫) বাইজি :

‘বাই’ শব্দটা বেশ্যার নামের সঙ্গে প্রযোজ্য; বাইজি অর্থ পেশাদার নর্তকী ও গায়িকা৷ বাইজির সমার্থ শব্দগুলি হল—নাচনি, নাচনেওয়ালি, তওয়াইফ, খঞ্জরি, খেমটাওয়ালি, কোর্টিসান, গশতি, জান, তরফাওয়ালি, নচ-গার্ল, পাতুর, বাইওয়ালি, রামজানি৷ তাদের বৃত্তিও নানা নামে ভূষিত৷ যথা—খেমটা নাচ, ঠুমকি, পাতুর-বাজি, তয়ফা, বাইনাচ, বাইজিনাচ এবং তাদের বাসস্থানকে কোঠা, বাইবাড়ি, বাইজিখানা ইত্যাদি নামে চিহ্নিত করা হয়৷ ‘বাঈ’ শব্দটির ব্যবহার সম্মানার্থেও হয় অর্থাৎ বড়বোন৷ যেমন মীরাবাঈ, লক্ষ্ণীবাঈ, রমাবাঈ ইত্যাদি৷

যে নারীরা নৃত্যগীতকে প্রধান অবলম্বন করে দেহপসারিণী হয়ে ওঠে তারা হল বাইজি৷ এরা প্রধানত মুসলিম ধর্মাবলম্বী এবং উত্তর ভারতের ধ্রুপদী সঙ্গীত ও নৃত্যে পারদর্শিনী৷ মুঘল রাজত্ব ও তার সঙ্গে দেশীয় রাজা-নবাবদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ভারতের বাইউলিরা কলকাতার বুকে এসে আশ্রয় নেয়৷ কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী, জমিদার শ্রেণীর লোকেরা সর্বোপরি উনিশ শতকে কলকাতায় গড়ে ওঠা ‘হঠাৎ বাবু’ সম্প্রদায় এদের সানন্দে গ্রহণ করে৷ কলকাতায় বাইনাচ প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে৷ দুর্গাপূজার সময় বাবুদের বাড়ির জৌলুসের প্রধান আকর্ষণ ছিল বাইনাচ৷ ১৮২৫ সালের ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায় পুজোর সংবাদের এক বিবরণ থেকে জানা যায় যে, উৎসবের তিনদিন রাজা কিষেণ চাঁদ রায়ের বাড়িতে নাচবে নিবি-দি বিলিংটন অব দি ইস্ট৷ নীলমণি মল্লিকের জলসা ঘরে নাচবে ঊষারানী, জয় কিষাণ রায়ের বাড়িতে নাচবে মিসরী৷ দিল্লী, বেনারস, লক্ষ্ণৌ এমনকি কাশ্মীর থেকেও বাইজিরা নাচার জন্য আসতো৷ সেই সময়কার প্রসিদ্ধ লোকরঞ্জনকারী বাইজিরা হল—নিকি, আশরুন, নুরবক্স, বন্নু প্রভৃতিরা৷ বাইজি তথা বাইনাচ বাংলার আনাচে-কানাচে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে৷

(৬) বেশ্যা বা গণিকা :

বেশ্যা শব্দটির ব্যুৎপত্তি হল—‘‘স্ত্রী [বেশ + য (যৎ) + স্ত্রী-আ (টাপ্)]৷’’ আর ‘গণ’ বা ‘সমূহ’ যার ভর্ত্তৃরূপে অবস্থান করে সে গণিকা৷ শব্দটির ব্যুৎপত্তি—‘‘স্ত্রী [গণ + ইক (ঠন্) অস্ত্যর্থে + স্ত্রী-আ (টাপ্)]৷’’ বেশ্যা বা গণিকারা কোনো নিষিদ্ধপল্লীতে অবস্থান করে দেহকে পণ্য করে তোলে; শরীরী সক্ষমতায় ‘খদ্দের’-কে সন্তুষ্ট করে উপার্জন করে৷ নানা পর্যায়ে এই শ্রেণীর গণিকারা বিভক্ত৷ যেমন—যারা সবচেয়ে নিম্নশ্রেণীর তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ‘খদ্দের’ সংগ্রহ করে৷ কুলি, মজুর শ্রেণীর মানুষেরা এই শ্রেণীর গণিকার সঙ্গে সংসর্গ করে৷ অর্থ সংস্থান কম হওয়ায় নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অসহ্য কষ্ট সহ্য করে এরা জীবন নির্বাহ করে৷ ‘মাঠকোঠা’ অর্থাৎ মাটির বাড়িতে থাকে মধ্যম শ্রেণীর রূপাজীবারা৷ এদের অবস্থা ‘মন্দের ভালো’৷ দোকানদার, ব্যবসায়ী প্রভৃতিরা এই শ্রেণীর বারাঙ্গনাদের খরিদ্দার৷ বেশ্যাদের মধ্যে যারা উচ্চ পর্যায়ের তারা অনেকটাই সুখী৷ রাস্তায় গিয়ে এদেরকে লোক ধরতে হয় না৷ পাকা বাড়িতে বাস করে এরা৷ কায়দা কানুন, শরীরী সৌন্দর্য সব উন্নতমানের৷ আর্থিক কৌলিন্যে অনেকটা সচ্ছল শ্রেণীর৷ কেরানিস্তরের কর্মচারীরা এই ধরনের বারবনিতার দেহ সম্ভোগ করে৷

(৭) উপপত্নী :

উপপত্নীরা অবৈধ প্রণয়াসক্ত নারী৷ এরা ঢেমনি বা গৌণপত্নী নামেও পরিচিত৷ যদি কোনো নারীকে কোনো পুরুষ বিয়ে না করেও তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন সেই নারী পুরুষটির উপপত্নী হিসেবে পরিচিত হয়৷ উপপত্নী নারীরা পোষক পুরুষের কাছে স্ত্রীর সম্পূর্ণ অধিকার লাভ করে শুধুমাত্র সামাজিক মর্যাদা ছাড়া৷ বিয়ে না করে পরপুরুষের সঙ্গে জীবনাচরণে অভ্যস্ত উপপত্নীর কোনো সামাজিক মূল্য নেই৷ পোষক বাবুর মোহ কেটে গেলে চরম লাঞ্ছনায় বাকি জীবন অতিবাহিত করতে হয়৷ সমাজ নির্মম পদাঘাতে তাকে ক্ষত বিক্ষত করে৷

(৮) রক্ষিতা :

‘রক্ষিতা’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি করলে দাঁড়ায় [রক্ষ + তৃ (তৃচ্)-ক ১ব; স্ত্রী-ত্রী]-এর অর্থ ‘পালিত’ বা নিজের উপভোগের জন্য পালিত৷ অর্থাৎ রক্ষিতা কোনো পুরুষের বাঁধা নারী৷ কোনো গণিকা যখন নির্দিষ্ট একজন পুরুষের অধীনে থেকে তার সবরকমের ইচ্ছে অনিচ্ছে পূরণ করে তখন সেই গণিকা হয় সেই পুরুষের রক্ষিতা৷ পুরুষটি বা রক্ষিতার বাঁধা বাবু তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দেয় জীবন যাপনের জন্য৷ রক্ষিতা সেই টাকা মাসোহারা হিসেবে পায়৷ রক্ষিতারা গণিকাদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের৷ এদের রোজগার অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি৷ গণিকা সমাজে এরা সম্মানীয়া৷ বাঁধাবাবুরা শুধু এদের অর্থপ্রদানই নয় স্বর্ণালঙ্কার থেকে শুরু করে আস্ত বাড়িই কখনো কখনো তাদের হাতে তুলে দিত৷ ধন-সম্পদে ভরিয়ে দিত৷ রক্ষিতাদের মধ্যে নিয়ম হল তারা তাদের পোষক বাবু ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না৷ বা অন্য কোনো খরিদ্দারকে গ্রহণও করতে পারবে না যতদিন রক্ষিতা সেই বাবুর অধীনে থাকবে৷ তবুও যদি কেউ পোষক পুরুষের বাইরে অপর কোনো ব্যক্তির সঙ্গে শরীরী সংসর্গ করে তাহলে গণিকা সমাজে তার পরিচয় হয় ‘ছুটু’ নামে৷

(৯) কলগার্ল :

গণিকাদের শ্রেণী বিভাজনে ‘কলগার্ল’ অনেকটাই নবীন৷ আমাদের দেশে কলগার্ল সম্পর্কে প্রথম গবেষণা করেন ড. প্রমীলা কপূর৷ তিনি বলেছেন ১৯২০ সাল নাগাদ শব্দটির উৎপত্তি হয় ব্রিটেনে৷ প্রাক-দূরভাষ যুগে ব্রিটেনে কিছু কল হাউস গড়ে উঠেছিল যেগুলিকে নিয়মিত গণিকালয় বলা হত না৷ যখন খদ্দের আসতো তখন মালিকের কাছ থেকে বার্তাবাহক পাঠানো হত মেয়েদের কাছে৷ আর সেই মত মেয়েরা এসে মিলিত হত৷ এরপর ১৯৪০ এর দশকে যখন টেলিফোনের প্রসার ঘটে তখন বার্তাবাহকের কাজ করে ফোন কল৷ আর সেই থেকে ‘কলগার্ল’ ধারণা তৈরি হয় এই হিসেবে যে, কলগার্ল একজন অদৃশ্য যৌনকর্মী যার সঙ্গে ‘ক্লায়েন্ট-কে টেলিফোনে ‘অ্যাপোয়েন্টমেন্ট’ নিতে হয়৷ অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটি এবং ন্যাশনাল হেলথ এণ্ড মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল এর সহযোগিতায় ২০০৭ সালে সমাজতত্ববিদ রবার্ট পারকিন্স ও ফ্রান্সের লাভজয় অস্ট্রেলীয় কলগার্লদের নিয়ে যে সমীক্ষা করেছেন তাতে ‘কলগার্ল’-এর কার্যপদ্ধতিতে টেলিফোনের যে প্রধান ভূমিকা আছে তা স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন৷ এদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা যায় যে ‘‘কলগার্ল একজন সাধারণ দৃষ্টিতে অদৃশ্য যৌনকর্মী যার সঙ্গে খদ্দেরের সংযোগ ঘটে টেলিফোনের মাধ্যমে৷’’১০ শুধুমাত্র যোগাযোগের পন্থায় নয় তার সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থানের মধ্যেও কলগার্লদের বিশেষত্ব নিহিত আছে৷ ১৯২০ সালের ব্রিটেনের কলগার্লদের সঙ্গে যৌনপল্লীতে থেকে দেহব্যবসা করে যে বারাঙ্গনারা তাদের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না কিন্তু আজকের সময়ে কোনও কলগার্লই নিতান্ত ব্যতিক্রম ছাড়া যৌনপল্লীর বাসিন্দা নয়৷ শ্রেণীগত ভাবে নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের মধ্যে তাদের অবস্থান৷ যৌনপেশার পাশাপাশি তাদের স্বতন্ত্র পেশাও থাকে, থাকে সামাজিক পরিচয়৷ ‘Prostitution And beyond’ বইতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে—‘‘She may be the seemingly self-confident executive, a company asset. Or she may be the typical middle-class housewife walking past you, leading a child by the hand. Or she may be just a college girl who usually ‘hangs out’ with her friends is discos. Yet, all it takes is a phone call. A ‘contact’ for a ‘programme’, and these housewife, executives, actresses, college students shift to there identity as call girls.’’১১ অর্থাৎ সামাজিক গোপনীয়তার আড়ালে থেকে যে যৌনকর্মী পেশায় লিপ্ত থাকে এক কথায় সেই কলগার্ল৷ এদের মধ্যস্থতা করে অন্য কোনো ব্যক্তি কারণ কলগার্লরা কখনোই সরাসরি ‘ক্লায়েন্ট’দের সঙ্গে মিলিত হয় না৷ এ সম্পর্কে ‘Prostitution And Beyond’ বইতে আরও বলা হয়েছে—‘‘In call girl terminology, a network is known as a line. Here, the agent plays a pivotal role in all transactions. They know not only the client’s requirements and his willingness to spend but also the profile of ‘his’ call girls or their ‘demand’. Demand in agent terminology is the valuation of a call girls beauty, physique, connection with the glamour world and so forth whereas ‘programme’ is the word used when referring to the actual encounter with the clent. It is always the agent’s responsibility to fix the ‘programme’ that is to negotiate the rate of the callgirls, the services required by the client, the venue and the time convenient to both the parties. often these ‘Programme’ are held in hotels or guesthouses. Sometimes residential units, like the agents house, are rented for the purpose.’’১২

বর্তমান মোবাইল-ইন্টারনেটের দুনিয়ায় কলগার্লদের পেশা আরও বহু বিস্তৃত৷ নিজেকে আড়াল করে সামাজিক পরিচয়ের আবেষ্টনীর মধ্যে থেকে অল্প সময়ে অধিক আয়ের এই বৃত্তিটি কমবয়সি উচ্চাকাঙ্খী নারীসমাজের কাছে সহজেই গ্রহণীয় হয়েছে৷ মনোজ দাশ তাঁর ‘ কলকাতার কলগার্ল’ বইতে এদের বলেছেন ‘হাফগেরস্ত’৷ দেবরাণী কর তাঁর ‘কলকাতার নগরনটী’ বইতে ‘Clandestine Prostitute’ বা ‘গোপন পতিতা’ বলে চিহ্নিত করেছেন৷

(১০) ভ্রাম্যমান যৌনকর্মী :

ভ্রাম্যমান যৌনকর্মীরা অনেকটা কলগার্লের মতো তবে কলগার্ল নয়৷ কলগার্লদের মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তি থাকে যাদের মাধ্যমে তারা ‘ক্লায়েন্ট’ পায়৷ ভ্রাম্যমান যৌনকর্মীরা নিজেরাই নিজেদের ‘খদ্দের’ ঠিক করে৷ এরা কোনো যৌনপল্লীর বাসিন্দা নয়৷ কোন শহর বা শহরতলীর দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা সকালবেলায় বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে বা সিনেমাহলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে; সরাসরি খদ্দের ঠিক করে এবং কোনো পরিচিত বাড়ি বা হোটেলে গিয়ে মিলিত হয়৷ নিজের এলাকায় এরা অফিস বা কলকারখানার কর্মী হিসেবে পরিচিত৷ সারাদিন তারা যেভাবেই কাটাক না কেন দিন শেষে যে যার মতো ঘরে ফিরে যায়৷

(১১) বারড্যন্সার :

বারড্যন্সার বেশ্যাবৃত্তির আধুনিক এক পর্যায়৷ অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এই বৃত্তির প্রধান কারণ৷ বহু সংখ্যক নৃত্যগীত পারদর্শী নারী ড্যান্সার হয়ে ‘বার’ বা পানশালাগুলিতে মদ্যপ, লম্পট ব্যক্তিদের যৌনবিনোদন দিতে গিয়ে নিজেকে পণ্য করে৷ পানশালার নর্তকীর ভূমিকা পালন তাদের বাহ্যিক আড়ম্বর, বেশিরভাগ বারড্যান্সারাই নৃত্য-গীত পরিবেশনের নাম করে দেহব্যবসা করে থাকে৷

(১২) ক্যাবারে ড্যান্সার :

‘ক্যাবারে’ শব্দটির ফরাসী অর্থ ‘সরাইখানা’৷ সমগ্র ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের বহুস্থানে এর অনুরূপ প্রতিষ্ঠান দৃষ্টিগোচর হয়৷ এই সরাইখানাগুলিতে বহু কমবয়সি পারদর্শিনী নারীরা পথিকদের মনোরঞ্জন করার জন্য নৃত্যগীত সর্বোপরি দেহব্যবসার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল হতে চেষ্টা করে৷ এরা ক্যাবারে ড্যান্সার হিসেবে পরিচিত৷ এদের পেশার সঙ্গে বেশ্যাবৃত্তি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত৷

(১৩) শিশু গণিকা :

নারীদেহ পুরুষের লোলুপ জৈবরসনায় সর্বদাই আস্বাদের সামগ্রী৷ তাই তাদের যৌনপিপাসা মেটাতে শিশুরাও বাদ পড়ে না৷ এই শ্রেণীর শিশু গণিকাদের বেশিরভাগই পথশিশু এবং অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের অন্তর্ভূক্ত বালিকা৷ যারা সামান্য কিছু খাদ্য বা অর্থের লোভে শরীর বিক্রয় করে৷ এছাড়া পরিচারিকার কাজ করতে যাওয়া শিশুরা বাড়ির মালিক বা অন্য কারও দ্বারা শরীরী খেলায় অভ্যস্ত হয়ে গণিকা হয়ে যায় অথবা পাচার হয়ে যাওয়া শিশুরা যৌনপল্লীতে বিক্রয় হয়ে দেহজীবী হতে বাধ্য হয়৷

(১৪) স্বৈরিণী :

‘স্বৈরিণী’-এর ব্যুৎপত্তি ‘‘স্ত্রী [ স্বৈরণ + স্ত্রী-ঈ (ঙীপ)]৷’’১৩ স্বেচ্ছাচারিণী, পাংশুলা, কুলটা প্রভৃতি এর সমার্থক৷ এই নারীরা পতি ত্যাগ করে স্বেচ্ছানুসারে অন্যপুরুষকে গ্রহণ করে৷ সমাজে স্বৈরিণীরা ঘৃণার পাত্রী৷ নানা কারণে স্বামীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে নারীরা স্বৈরিণী হয় বা পরপুরুষে লিপ্ত হয়৷ এদের সঙ্গে পরপুরুষের দৈহিক যোগের সাথে মানসিক যোগও বর্তমান থাকে৷ বাৎস্যায়ন তাঁর ‘কামসূত্র’-এর চতুর্থ প্রকরণের ষষ্ঠ অধ্যায়ে ৫৪ নং সূত্রে নয় ধরনের গণিকার মধ্যে স্বৈরিণীদেরও উল্লেখ করেছেন৷

(১৫) এসকর্ট :

এসকর্ট গণিকাদের আরেকটা শ্রেণী৷ এদের কর্মকে এসকর্ট সার্ভিস বলা হয়৷ আর ক্লায়েন্ট এবং এসকর্টের মধ্যে মধ্যস্থতা করে এসকর্ট এজেন্সি৷ এসকর্টরা শিক্ষিত, সুন্দরী, শরীরীভাবে সক্ষম, মিশুকে এবং পরিবেশ উপযোগী৷ ক্লায়েন্টরা এসকর্ট এজেন্সির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এসকর্টদের সঙ্গে সময় কাটায়৷ এরা এজেন্সির বেতনভূক্ত কর্মচারী৷ ঘন্টা, দিন, এমনকি সপ্তাহ হিসেবে এদের দর নির্দিষ্ট হয়৷ নারী পুরুষ নির্বিশেষে এসকর্ট হতে পারে৷

(১৬) স্ট্রিপার :

এরা এমন এক ধরনের যৌনকর্মী যারা অর্থের বিনিময়ে ক্লায়েন্টদের শরীর দেখায়৷ সাধারণত কোনো ‘পানশালা’ বা ‘কর্পোরেট’-এর অধীনে কাজ করে তাদের পেশাকে সচল রাখে৷

(১৭) কোর্টসান :

এই শ্রেণীর বারবনিতাদের রক্ষিতার আধুনিক রূপান্তর বললে অত্যুক্তি হয় না৷ এরা অর্থ, মান, যশসম্পন্ন কোনো উচ্চবিত্ত পুরুষের অর্থপ্রদত্ত যৌনসঙ্গী৷ ‘কোর্টসান’রা একজন বা দুজনের বেশি ক্লায়েন্ট রাখে না৷

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে এসকর্ট, স্ট্রিপার, ‘কোর্টসান’রা পণ্যাঙ্গনার আধুনিক রূপান্তর৷

প্রাচীন যুগের সমাজ ও সাহিত্যে গণিকার পর্যায়বাচক প্রায় পঞ্চাশটি নাম পাওয়া যায় যা দিয়ে তাদের পরিচয়, সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে অনেকটাই ধারণা করা যেতে পারে৷ সেই ‘ঋক’ বেদের যুগ থেকেই গণিকা শব্দের সমার্থক নানা শব্দ ওঠে এসেছে, যা থেকে বৃত্তিটির প্রাচীনতা সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়৷ ‘ঋক’ বেদে রয়েছে হস্রা, অগ্রু৷ (৪:১৬:১৯:৩০; ৪:১৯:৯); সাধারণী (১:১৬৭:৪; ২:১৩:১২, ১৫, ১৭) এর কিছু পরে ‘অথর্ব’ বেদে পাওয়া যায় পুংশ্চলী৷ (১৫:১:৩৬; ২০:১৩:৬;৫) ‘শুক্ল যজুর্বেদ’-এর ‘বাজসনেয়ী সংহিতা’য় এবং ‘কৃষ্ণ যজুর্বেদ’-এর ‘তৈত্তিরীয় সংহিতা’তে সাধারণী ও সামান্যা শব্দ দুটির (৩:১২) ও (৩:৪৭) উল্লেখ আছে৷ আরও কিছুকাল পরে ‘তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ’-এ অতিস্কদ্বরী ও অপস্কদ্বরী শব্দদুটি পাওয়া যায় (৩:৪:১১:১) অর্থাৎ যে নিয়ম উলঙ্ঘন করে এবং ব্রজয়িত্রী, যে আনন্দ দেয়৷ (‘বাজসনেয়ী সংহিতা’ (৩০:১), তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, (৩:৪:৭:১)৷ যে ক্ষণকালের সঙ্গিনী অর্থাৎ মুহূত্তিয়া শব্দটির উল্লেখ রয়েছে ‘বিনয়পিটক’-এ৷ জাতকে রয়েছে বন্নদাসী, নারিষের, রূপদাসী, বেশ্যা, গামনী, নগরশোভিনী, ইত্থি এবং জনপদ কল্যাণী৷ জাতকের এই গণিকাদের মধ্যে রূপদাসী ও বন্নদাসীরা প্রধানা গণিকার অধীনে থেকে অথবা স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থীকে আপ্যায়ন করতে পারতো৷ আরও পরবর্তীকালে সময় যত এগিয়ে যায় নারীর সামাজিক অবস্থান যত সংকুচিত হয়ে পড়ে ততই সমাজের বুকে গণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ মহাকাব্যে, পুরাণগুলিতে এবং অন্যান্য সাহিত্যিক উপাদানে অসংখ্য গণিকা নাম উঠে আসে৷ যেমন স্বৈরিণী, বারস্ত্রী, কুলটা, বারাঙ্গনা, বারবনিতা, স্বতন্ত্রা, স্বাধীন যৌবনা, নটী, শিল্পকারিকা, কুম্ভদাসী, পরিচারিকা ইত্যাদি৷ রূপাজীবা ও গণিকা নামদুটির উল্লেখ রয়েছে বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’-এ৷ জটাধরের ‘শব্দরত্নাবলী’-তে শালভঞ্জিকা, বাররাণী, বর্বটি, বারবিলাসিনী, শূলা, ভণ্ডহাসিনী, কামরেখা ইত্যাদি নামের উল্লেখ রয়েছে ‘শব্দমালা’ অভিধানে গণিকার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে লঞ্ছিকা৷ বৃষলী, পাংশুলা, লঞ্ছিকা, বন্ধুরা, কুন্তা, শূলা, কামরেখা, বর্বটি, রণ্ডা ইত্যাদি কিছু নাম ‘বৈশিকতন্ত্রে’-ও পাওয়া যায়৷ হেমচন্দ্রের ‘অভিধান চিন্তামণি’-তে সাধারণ স্ত্রী, পণ্যাঙ্গনা, ক্ষুদ্রা, ভুঞ্জিকা ও বারবধূ এই নামগুলির উল্লেখ আছে৷ এছাড়া ‘রাজনির্ঘন্ট’ অভিধানে ভোগ্যা ও স্মরবীথিকা, ‘অমরকোষ’-এ বেশ্যা, বারস্ত্রী গণিকা ও রূপজীবা এবং ‘ব্রহ্মবৈবর্ত’ পুরাণে কুলটা, বৃষলী বা পুংশ্চলী, বেশ্যা, যুঙ্গী, মহাবেশ্যা ইত্যাদি বহু গণিকার প্রতিশব্দ উঠে এসেছে৷ গণিকা শব্দের এই প্রতিশব্দের উদ্ভব এক সময়ে হয়নি৷ যুগ যুগ ধরে নারীদেহ সম্ভোগের যতরকম কৌশল তৈরি করেছে পুরুষসমাজ, যতভাবে নারীকে লাঞ্ছিত করার পথ খুঁজেছে, তারই ধারাবেয়ে নামগুলি উঠে এসেছে৷ সুতরাং বেশ্যাবৃত্তি অতিপ্রাচীন এক পেশা, ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে গণিকারা অনেকযুগ আগে থেকেই বিচরণ করছে৷ শুধু ভারতীয় কেন বিশ্ব ইতিহাসেও গণিকাবৃত্তি পুরোনো এক পেশা৷ কবে, কোথায়, কখন, কীভাবে নারীদেহ মন্থনের এমন এক বৃত্তি সমাজের বুকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল তার সন্ধান সমাজতাত্ত্বিকেরা খুঁজে পাননি তবে সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে ‘‘জীবনধারণের যতগুলি উপায় প্রাচীনতম, তার মধ্যে বেশ্যাবৃত্তি যে একটা, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷’’১৪

যে কোনো দেশের সামাজিক ইতিহাসের বীজ লুকিয়ে থাকে তার সাহিত্য উপকরণগুলির মধ্যে৷ কারণ যাঁদের হাত ধরে সাহিত্য তার পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয় সেই সব কথাকারেরা সামাজিক মানুষ৷ সমাজের বুকে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনারাজীর মধ্য থেকেই তাঁরা সাহিত্যের রসদ আহরণ করেন৷ তাই ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে গণিকাবৃত্তির আবির্ভাব, সমাজে তাদের অবস্থান কেমন ছিল, সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে সেই দিকগুলি ভারতীয় সাহিত্য উপকরণগুলির মধ্য থেকে আহরণ করার চেষ্টা করা হবে৷

বৈদিক যুগে গণিকা :

বৈদিক যুগের সাহিত্য উপকরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় ঋক, সাম, যজুঃ অথর্ব ইত্যাদি বেদগুলিকে৷ প্রত্যেকটি বেদের আবার চারটি করে অংশ সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ৷ চারটি বেদের প্রথম ঋকবেদ রচিত হয় প্রায় তিনহাজার বছর আগে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে৷ ঋকবৈদিক যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান তুলনামূলক ভালো ছিল বলে মনে করা হয়৷ পারিবারিক বন্ধনও ছিল দৃঢ়৷ এই যুগেই গণিকার বহু প্রতিশব্দ পাওয়া যায়—যেমন ঋগ্বেদে গণিকাবাচক যে সব শব্দ পাওয়া যায় সেগুলি হল—‘হস্রা’, ‘অগ্রূ’, ‘সাধারণী’, অথর্ববেদে রয়েছে ‘পুংশ্চলী’, ‘সাধারণী’ ও ‘সামান্যা’ ‘শুক্ল যজুর্বেদ’-এর ‘বাজসেনীয় সংহিতা’-য়৷ এই শব্দ দুটি ‘কৃষ্ণ যজুর্বেদ’-এর ‘তৈত্তিরীয় সংহিতা’-তেও পাওয়া যায়৷ আরও পরবর্তীকালে তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে উল্লেখ রয়েছে ‘অতিস্কদ্বরী’ ও ‘অপস্কদ্বরী’ অর্থাৎ যে নিয়ম উলঙ্ঘন করে এবং ‘ব্রজয়িত্রী’—যে আনন্দ দেয়৷

সমাজে অবৈধ প্রণয়ের সম্পর্কও সে যুগে ব্যতিক্রমী ছিল না৷ বিবাহের ব্যাপারে বা সম্পর্কের ব্যাপারে সমাজ কঠোর না হলেও ভাই-বোন ও বাপ-মেয়ের মধ্যে যৌনসম্পর্কে সেই সমাজ ছিল খড়্গহস্ত৷ ঋগ্বেদ-এ—‘‘জারো ন’ অর্থাৎ ‘অবৈধ প্রেমিকের মতো’এ উপমা বারে বারে ব্যবহার করা হয়েছে৷ তা ছাড়া ঋগ্বেদে-এই গণিকার বহু প্রতিশব্দ পাওয়া যায়৷ কাজেই সমাজে গণিকাবৃত্তি তখনই বেশ পরিচিত ছিল৷ সব দেশে সব কালে যে সব অপরাধ চলে এসেছে তার অনেকগুলিরই ঋগ্বেদ-এ উল্লেখ করা হয়েছে৷’’১৫ পুরুষের বহুবিবাহ, বহুগামিতা, নারীদের অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদি নারী শরীরকে ভোগ করার বহু উদাহরণ বৈদিক সাহিত্যের নানা অংশগুলিতে ছড়িয়ে রয়েছে৷ তবে এই যুগে মেয়েরা নিজের স্বাধীনতায় স্বামী নির্বাচন করতে পারতো অথবা বিবাহ না করে আজীবন কুমারী হয়েও জীবন কাটাতে পারতো৷ ‘‘বুদ্ধিমতী নারী হয়েও যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন কথা শুনি৷’’১৬

বৈদিক যুগে বেশ্যাবৃত্তি নিন্দার ছিল না৷ কিন্তু বেদের পরবর্তী অংশগুলোর মধ্যে সমাজে নারীর অবস্থান পাল্টাতে থাকে৷ যজুর্বেদ-এ বিভিন্ন যজ্ঞবিধিতে নারীর প্রতি অবমাননাকর দিকগুলি উদ্ঘাটিত হয়েছে৷ নারীকে লাঠি দিয়ে মেরে বশীভূত করার কথা বলা হয়েছে এই যুগে কারণ নিজের দেহ বা সম্পত্তিতে নারীর কোনো অধিকার নেই৷ ‘‘স্ত্রীলাভের আগে সন্তান আসে না, তাই স্ত্রী দরকার৷’’১৭ এই সমাজে শুধু স্ত্রীতে নয় পুরুষের কামনা পূরণের জন্য দাসী রাখার বা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দাসী উপহার দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে৷ এই দাসীরা গণিকার বিকল্প হিসেবে থাকতো৷ আসলে এ যুগে সাধারণ নারীর সাথে গণিকার তেমন কোনো ফারাক ছিল না৷ কারণ ঘরের স্ত্রীও শুধুমাত্র স্বামীর যৌনপিপাসা নিবারণ ও সন্তান উৎপাদনের সামগ্রী, গণিকার দ্বারাও সেই যৌনস্বাদ পূরণ হয়৷ আবার একজন পুরুষের এত স্ত্রী ও দাসী থাকতো যে আলাদা করে বেশ্যা সম্ভোগের দরকারই হত না৷

এই ব্রাহ্মণ সাহিত্যের যুগে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ থেকে খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দী) অশ্বমেধ যজ্ঞে পুরোহিতের জন্য দক্ষিণা থাকতো ‘‘চারশো গাভী, চার হাজার সোনার টুকরো (মুদ্রা), চারটি বিবাহিতা নারী, একটি কুমারী, চারশো দাসী ও প্রচুর খাবার জিনিস’’১৮ ‘কৌষীতকি ব্রাহ্মণ’-এ আছে;… ‘বহু স্ত্রীর পক্ষে এক স্বামীই যথেষ্ট’, হরিশ্চন্দ্রের একশোটি স্ত্রী ছিল৷ শতপথ ব্রাহ্মণ বলে ‘সমৃদ্ধ লোকের চারটি স্ত্রী থাকবে৷’ রাজারও তাই থাকত মহিষী, বাবাতা, পরিবৃত্তি ও পালাগলী—এ ছাড়াও একটি কুমারী ও চারশোটি দাসীও থাকবে৷ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এ পড়ি অঙ্গরাজ তাঁর পুরোহিত আত্রেয়কে দশ হাজার দাসী দিয়েছিলেন৷’’১৯ তাহলে দেখা যায় বৈদিক যুগে গণিকা নারীরা যেমন রয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চবিত্ত সম্ভ্রান্ত পুরুষেরা, পুরোহিত এবং রাজা-ব্রাহ্মণরা একযোগে গণিকার পরিপূরক বহু দাসী রেখে কাম চরিতার্থ করতো৷ বৈদিক সমাজ ও সাহিত্য এই দেহবিনোদিনীদের নিয়ে বিশেষ এক স্থান দখল করে আছে৷ সমাজে দেহজীবাদের উদ্ভবের কারণ হিসেবে তাই বলা যায়—কীভাবে কবে গণিকাবৃত্তি প্রথম মাথা তুলে দাঁড়ালো তার হিসেব পাওয়া মুশকিল৷ তবে সভ্যতার সেই আদিপর্বের সাহিত্যগুলোকে বিশ্লেষণ করলে এর উদ্ভবের কারণ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে৷ সম্ভবত বলা যেতে পারে সমাজের মধ্যে যখন বিবাহ বা পরিবার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পিতা, স্বামী, সন্তানের রক্ষণীয় হয়ে তাকে জীবন কাটাতে হয় অর্থাৎ নারী যখন সমাজের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে বিধি নিষেধের বেড়াজালে তার স্বতন্ত্রতা হারায় তখন পারিবারিক আবেষ্টনীর বাইরে যে নারীকে পাওয়া যায় সে-ই গণিকারূপে প্রতিভাত হয়৷ সমাজ যখন নারীর উপর পুরুষের স্বত্বাধিকার মেনে নিতে শুরু করেছে তখন থেকেই গণিকাবৃত্তি বিকাশ লাভ করেছে৷ এর আরেকটি বিষয় গণিকাবৃত্তির প্রসারের সাহায্য করেছে তা হল মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত বিত্তের সঞ্চয় যা জীবন ধারণের প্রয়োজন মেটানোর পর বিলাস-সম্ভোগে ব্যয় করার পথ তৈরি করেছে৷

পুরাণে গণিকা প্রসঙ্গ :

গণিকাদের পূর্বসূরী অপ্সরারা৷ তারা দেববেশ্যা, দেবগণকে আনন্দ দান করে৷ এরা দৈবপরিমণ্ডলেই বিচরণশীল৷ কিন্তু অনেক অপ্সরাই দেবতার নির্দেশে দৈবইচ্ছের পরিপূরক রূপে অথবা নিজেরাই প্রেমার্ত হয়ে পৃথিবীর ধূলিমলিন মৃত্তিকায় বিচরণ করেছে৷ পুরাণে অপ্সরাদের পরিচয় তারা ইন্দ্রের অনুচর; দেবসভার নর্তকী৷ পুরাণে যেভাবেই এদের বর্ণনা করা হোকনা কেন বৈদিক অপ্সরারা কিন্তু শরীরী জীব নয়, তাদের নামের গুঢ় অর্থ রয়েছে৷ অপ্সরা অর্থাৎ জলচারিণী—অপসারিণী৷ পণ্ডিতদের মতে সূর্যকিরণে সৃষ্ট জলীয় বাস্পই অপ্সরা৷ দেব-দেবীর রূপ বর্ণনায় লক্ষ করা যায় সেখানে মূল উৎস কিন্তু সূর্য৷ সূর্যই সকল প্রাণের সকল শক্তির উৎস৷ সূর্য পূজারই বিভিন্ন রূপ বিভিন্ন দেবতার জন্মদান করেছে৷ তাই অপ্সরা বা ঊর্বশী ভাবনাও সেখানে দেবী ভাবনার রূপক রূপে ব্যবহৃত হয়েছে৷ তাই পুরাণে ঊর্বশীকে নর্তকী হিসেবে দেখা হলেও বৈদিক সাহিত্যে সে সূর্যরশ্মি রূপে বন্দিত৷ সেখানে বলা হয়েছে উষাকালের সূর্যরশ্মি অর্থাৎ ঊর্বশী বা ঊষা নর্তকীর মতো নিজের রূপ প্রকাশ করছে৷

স্কন্দপুরাণ, কালিকাপুরাণ, পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, বামনপুরাণ ইত্যাদি পুরাণগুলিতে গণিকাদের বিভিন্ন অনুসঙ্গ প্রতিভাত হয়েছে৷ স্কন্দপুরাণ ও বামনপুরাণে ঊর্বশী সৃষ্টির এক কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে৷ যেমন বদরিকা আশ্রমে তপস্যায় রত নারায়ণের তপস্যাভঙ্গের জন্য দেবরাজ ইন্দ্র কয়েকজন অপ্সরাকে প্রেরণ করেন৷ তারা নারায়ণকে প্রলুব্ধ করতে বহুবিধ চেষ্টা করতে লাগলে তাদের আচরণে বিরক্ত হয়ে নারায়ণ নিজের উরু থেকে মঞ্জরীর সাহায্যে অপ্সরাদের থেকে বহুগুণ সুন্দরী এক রমণীর সৃষ্টি করলেন৷ সেই উরুজাত রমণীই পরিচিত ঊর্বশী নামে৷

পদ্মপুরাণে ঊর্বশী সৃষ্টির ভিন্ন কাহিনি বর্ণিত হয়েছে৷ পুরাকালে বিষ্ণু গন্ধমাদন পর্বতে গভীর তপস্যায় মগ্ন হলে ইন্দ্র বিষ্ণুর তপস্যায় ভীত হয়ে মধু (বসন্ত) ও মদন (কাম) কে আহ্বান করেন৷ মধু ও মদন এবং তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন অপ্সরা যুক্ত হয়েও বিষ্ণুকে তপস্যা থেকে টলাতে পারে না৷ তাদের ব্যর্থতার বিষন্নতা থেকে জন্ম হল ঊর্বশীর৷ এখানেও ঊর্বশীকে উরুজাত বলা হয়েছে৷ পরে দেবগণের সামনে বিষ্ণু ঊর্বশীর নামকরণ করেন৷

শুধু অপ্সরা বা দেবযোষিতরাই নয় পুরাণগুলিতে মনুষ্যযোনিজাত সাধারণ বারনারীদের সম্পর্কে নানাবিধ বিধি-নিষেধের কথা বলা হয়েছে৷ স্কন্দপুরাণে দেহজীবিনীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে—বেশ্যা এক স্বতন্ত্র জাতি, তার যদি সবর্ণ বা উচ্চতর বর্ণের কোনো পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ঘটে এবং সে যদি কারও রক্ষিতা না হয় তাহলে পুরুষটির কোনো দণ্ড হবে না৷ আর যদি গণিকাটি কারও রক্ষিতাও হয় তাহলেও তার সঙ্গে সম্পর্ককারী পুরুষটির প্রতি কোনো শাস্তি বা প্রায়শ্চিত্তের কথা বলেননি পুরাণকার৷ মৎস্যপুরাণের ৭০তম অধ্যায়ে রয়েছে ঋষি দালভ্যচৈকিতায়ণ ও অষ্টবক্র মদ্র অধ্যুষিত কুরু পাঞ্চাল ও সিন্ধসৌরীর অঞ্চলে কামশাস্ত্র শিক্ষা দিতেন৷ সেখানে গণিকা বিষয়ক পাঠও ছিল৷ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে পুরুষের সাথে সম্পর্কের নিরিখে নারীর নানা শ্রেণীর কথা বলা হয়েছে৷ সেখানে সামান্যতম ত্রুটিতেই নারীর চারিত্রিক মানের স্খলন ঘটিয়েছেন পুরাণকারেরা৷ যেমন—

ক) একপত্নী : নারী পতিব্রতা হলে৷

খ) কুলটা : স্বামী ছাড়া যদি দ্বিতীয় পুরুষের প্রতি আসক্ত হয়৷

গ) বৃষলী বা পুংশ্চলী : তিনজন পুরুষের সঙ্গে সম্ভোগকারী নারী৷

ঘ) বেশ্যা : চার থেকে ছয়জন পুরুষের অঙ্কশায়িনী হলে৷

ঙ) যুঙ্গী : সাত-আটজন পুরুষের সঙ্গে সংশ্রবকারী৷

চ) মহাবেশ্যা : যদি এগুলির চেয়েও বেশি পুরুষের সঙ্গে যৌনসংসর্গ করে৷

অর্থাৎ একাধিক পুরুষের সংসর্গ করলেই গণিকা হয়ে যায় নারীরা কিন্তু একাধিক নারীর সঙ্গে সম্ভোগকারী পুরুষের জন্য আলাদা কোনো নাম তৈরি হয়নি৷ বিষ্ণুপুরাণের ৩৭ সংখ্যক অধ্যায়ে জায়াজীবী ও জায়াপোজীবীর (যে পুরুষ স্ত্রীর উপার্জনে দিনাতিপাত করে) প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে৷ সেক্ষেত্রে স্ত্রীর উপার্জনের মাধ্যম ছিল শরীর৷ কিন্তু পুরাণকার বলেছেন যে—‘‘জায়াজীবীর পাপটা গুরুতর নয়, উপপাতক মাত্র৷ সামান্য চন্দ্রোয়ণ ব্রতেই তার প্রায়শ্চিত্ত হত৷’’২০ গণিকা সংসর্গের জন্যও এই পুরাণে প্রজাপত্য প্রায়শ্চিত্ত বিধানের কথা রয়েছে৷ এছাড়া এই পুরাণের ৭০ অধ্যায়ে গণিকাদের জন্য আলাদা একটি ব্রতেরও উল্লেখ রয়েছে যার নাম ‘অনঙ্গব্রত’৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে পুরাণগুলিতে গণিকাদের ঘৃণ্য এক রূপে পর্যবসিত করা হলেও তাদের দেহকে উপভোগ করা থেকে সমাজ কেউকে বিরত করেনি বরং অনঙ্গব্রতের মতো আচার চালু করে তারা গণিকাদের রূপবতী-যৌবনবতী-কামবতী হওয়ার ব্যবস্থা করেছেন যাতে পুরুষ মানুষের উপভোগের বাসনা চিরজাগ্রত থাকে৷

‘সংহিতা’ সাহিত্যেও গণিকা নামের পরিপূরক শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ যেমন ‘ব্রজয়িত্রী’ অর্থাৎ যে আনন্দ দেয়৷ বাজসনেয়ী সংহিতায় এর উল্লেখ রয়েছে৷ সংহিতার যুগে বেশ্যাবৃত্তিকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখা হয়৷ এই বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত ‘দালাল’ বা নারীদের জন্য ছিল সমাজের কঠোরতম আইন৷ ‘বিষ্ণু সংহিতা’য় ক্ষমাহীন অপরাধ হিসেবে দালালদের অপরাধকে ধার্য করা হয়েছে৷ এদের হত্যাকারীর কোনো প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন হয় না৷ ‘মনুসংহিতা’য় নারীর সমস্ত ধ্যান, জ্ঞান, স্বপ্ন, শিক্ষা-দীক্ষা সব কিছুই স্বামীসেবার মহত্বের উপর বর্ণিত হয়েছে৷ এখানে গণিকাদের শিক্ষা প্রণালী বা শিক্ষণীয় বিষয়ের উপরও আলোকপাত করা হয়েছে৷ মনুর ভাবনায় এই গণিকা নারীরা চোরের সমধর্মী৷ তিনিই আবার এই নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সকল মানুষকেই শাস্তিযোগ্য হিসেবে নির্ধারিত করেছেন৷ ‘যাজ্ঞবল্ক সংহিতা’য় গণিকার সংসর্গকারী পুরুষের জন্য নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে৷

যেমন—

(ক) কোনো বারাঙ্গনা তার খদ্দেরের কাছ থেকে দেহবিক্রির দক্ষিণা স্বরূপ অর্থ গ্রহণ করার পরও যদি সে বিষয়ে অস্বীকার করে তাহলে তাকে সেই দর্শনিমূল্য তো ফেরত দিতেই হবে সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিমান টাকা ক্ষতিপূরণও দিতে হবে৷

(খ) কোনো পুরুষ যদি দর্শনি প্রদান করার পর স্বেচ্ছায় মিলিত না হয় তাহলে গণিকাকে সেই টাকা ফেরত দিতে হবে না৷

(গ) যদি দেহসঙ্গলোভী পুরুষটি অর্থের বিনিময়ে গণিকা দেহকে একাধিক কৌশলে সম্ভোগ করতে চায় তাহলে তার দণ্ড হবে ২৪ পণা জরিমানা৷

প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে গণিকা :

ভারতীয় সভ্যতা মূলত গ্রাম নির্ভর হলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল রূপে যেখানে যেখানে নগর গড়ে ওঠে গণিকা তোষণের পরিধি সেখানে আরও বহুগুণ বিস্তৃত হয়৷ কারণ প্রাচীনকালে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার বিকাশ ঘটলে নগরবাসীর মধ্যে ঐশ্বর্য, বিলাস ও আড়ম্বরের ঘটা বহুগুণে বেড়ে যায়৷ নগরগুলি ব্যবসা-বাণিজ্যলব্ধ ধনের প্রধান সঞ্চয়কেন্দ্র হওয়ায় নগরবাসীই সেই ধন ভোগের সুযোগ ও অধিকার লাভ করতো৷ আর এগুলিই হল নাগরিক ঐশ্বর্য বিলাস আড়ম্বরের মূলে৷ এই নগর বিলাসিতার অন্যতম প্রধান উপকরণ ছিল দেহজীবা নারীরা৷ সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী, রাজা, রাজ অমাত্য, ভৃত্য সকলেরই গণিকাগমনের ছিল অবাধ স্বাধীনতা৷ সেই সময়কার নানা সাহিত্য উপকরণ, প্রত্নলিপি ইত্যাদিতে গণিকাগমনের বাড়বাড়ন্ত ছবি সুন্দর ভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে৷

রাজতরঙ্গিণী :

কলহন তাঁর ‘রাজতরঙ্গিণী’-তে অষ্টম শতকের পুণ্ড্রবর্ধন নগরীর নর্তকী বিলাসের সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন৷ এর ১১৪৯ সালে রচনারম্ভ এবং পরের বছরই তার পরিসমাপ্তি৷ গ্রন্থটি মূলত রাজরাজড়াদের কাহিনি হলেও এর নানা অংশে ছড়িয়ে রয়েছে দেহজীবী নারীর ঐশ্বর্য, বিলাস, বঞ্চনা এবং বাধ্যবাধকতার নানাবিধ চিত্র৷ এই সময় গণিকারা যেমন দেহব্যবসায়ী নারী হয়ে দেহের দর কষাকষি করতে পারতো তেমনি কোনো মন্দিরের দেবদাসী হয়ে অথবা নৃত্যগীত পারদর্শী সুন্দরী নারীদের দেবদাসী বানিয়ে সমাজ তাকে উপভোগ করতো৷ এরা বহুভোগ্যা হয়েও তাদের নিজস্ব স্বকীয়তায় আবার সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসতে পারতো৷ ‘রাজতরঙ্গিণী’-র চতুর্থ তরঙ্গে রয়েছে কমলা নাম্নি এক নর্তকীর কথা৷ পুণ্ড্রবর্ধন নগরীর কার্তিক মন্দিরের দেবদাসী কমলা তার রূপ ও নৃত্যগীতের পারদর্শিতায় প্রভূত সম্পদের অধিকারিণী হয়েছিল৷ ললিতাদিত্যের পৌত্র বাপ্পিয়কের কনিষ্ঠ পুত্র জয়াপীর কাশ্মীর রাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার পর দিগ্বিজয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে শ্যালক গুজ্জের বিশ্বাসঘাতকতায় রাজ্যচ্যুত হয়৷ নিজেকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার উপযুক্ত স্থান ও সময় খুঁজতে খুঁজতে সে উপস্থিত হয় পুণ্ড্রবর্ধন নগরীতে৷ সেখানে কার্তিক মন্দিরে দেবদাসীদের নৃত্যগীত দেখতে গিয়ে কমলার অপরূপ নৃত্যপটুতা ও সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে যায়৷ বুদ্ধিমতী, কামার্ত, মুগ্ধ পুরুষদের নিয়ে সহবাসে অভ্যস্ত কমলার জয়াপীড়ের মুগ্ধবিস্ময়কে বুঝতে কালবিলম্ব হয় না৷ তাই দাসীর দ্বারা মোহিত করে তাকে নিজের ঘরে উপস্থিত করে৷ এখানে উল্লেখ রয়েছে ছলাকলা পটিয়সী কমলার গণিকাসুলভ আচরণভঙ্গির৷ সে মদ্য পানে মত্ত হয়ে নিজের কাম উত্তেজনাকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করে৷ জয়াপীড়কে পরিপূর্ণ রতিসুখ দেওযার জন্য বার বার অনুরোধ করে তার পরিধানের বস্ত্র পরিত্যাগ করতে৷ রাজা তাতে সম্মত না হলে কামনার উগ্রমূর্তিতে আবিষ্ট হয়ে বলপ্রয়োগের চেষ্টা করে৷ পরে লজ্জিত কমলা আত্মগ্লানিতে অনুতপ্ত হলে তাকে দীর্ঘ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে জয়াপীড়ই শান্ত করে৷ পরবর্তীকালে কমলা দেবদাসী থেকে উত্তীর্ণ হয় রাজবধূরূপে অর্থাৎ জয়াপীড়ের পত্নীরূপে৷ গণিকা গৃহে রাত্রিবাস সেই সমাজে পুরুষের জন্য যেমন দোষের ছিল না তেমনি গণিকাদের স্ত্রী বা পত্নীরূপে সামাজিক সম্মান মিললেও সমাজ তার কোনো বিরোধিতা করেনি৷

কলহনের এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে গণিকাদের সামাজিক অবস্থানের এক জীবন্ত চিত্র৷ সমাজে তারা ঘৃণিত ছিল না, সম্মানের সঙ্গে বিভিন্ন মন্দিরের সেবাকার্যের জন্য তারা নির্বাচিত হত৷ আর্থিক ভাবে তারা ছিল যথেষ্ট সচ্ছল এবং ইচ্ছে করলেই সমাজের মূলস্রোতে ফিরে যেতে পারতো৷ আবার যদি সামগ্রিকভাবে বিচার করা যায় তাহলে শুধু গণিকা কেন সব নারীরাই ছিল পুরুষের কাম পরিপূরণের রক্তমাংস সম্বলিত পুত্তলিকা৷ এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে রাজা-বণিকদের বহুপত্নী সম্বলিত জীবন, অন্তপুরে দাসী রেখে যৌনপ্রবৃত্তিকে সচল রাখার সুব্যবস্থা এবং অভিজাত গৃহে রমণীদের বা রাজবধূদের পরপুরুষের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার মতো বহুবিধ ঘটনা৷ প্রকাশ্য সমাজে বেশ্যাবৃত্তিকে দেবদাসী প্রথার মধ্য দিয়ে স্বীকৃতি জানানো হয়েছে৷ অর্থাৎ সুন্দরী নৃত্যকলায় সক্ষম নারী দেখলেই তাদেরকে মন্দিরে দেবদাসী হিসেবে উৎসর্গ করে দিত যাতে সহজে সকলের ভোগে লাগতে পারে৷ উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে এমন একটি ঘটনা যেখানে এক গৃহবধূ সমাজনীতির অবমাননায় বহুভোগ্যা হয়ে উঠে৷ কাহিনিটি এরকম—রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রতাপপুর রাজ্য ব্যবসা-বাণিজ্যের উৎকৃষ্ট কেন্দ্র হওয়ায় সেখানে ব্যবসায়িক কারণে রোহতক দেশের নোন নামের এক বণিক এসে বসবাস শুরু করে৷ নোনের স্ত্রী ছিল পরমরূপবতী এবং নৃত্যগীতে পারদর্শী৷ রাজা এই বণিক-পত্নীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়৷ রাজার অন্তর্কামনা বুঝতে পেরে এবং রাজ অনুগ্রহ লাভের আশায় স্বয়ং নোনই তার স্ত্রীকে রাজার হাতে তুলে দিতে যত্নবান হয়৷ স্ত্রী এই প্রস্তাবে রাজী না হলে সে সকলের সামনে রাজসমীপে ঘোষণা করে—‘‘দেব! আমি এত অনুরোধ করিলেও যদি সহজে তাহাকে গ্রহণ না করেন, তবে সে তো নৃত্য-কার্য্যে অভিজ্ঞা, সুতরাং আমার সেই পত্নীকে কোন দেবালয়ে নর্ত্তকীশ্রেণীর্ভূক্তা করিয়া দিলাম, আপনি তথা হইতে অবাধে গ্রহণ করুণ৷’’২১ হায়রে সমাজ! হায়রে নারীর জন্য তার ব্যবস্থা! নারীর জীবন কীভাবে পদে পদে পুরুষের কাছে পিষ্ট হয়েছে, কীভাবে পুরুষের পর পুরুষ বিনা দ্বিধায় শুধুমাত্র মুখের কথাতেই তাকে দেবদাসী, সেবাদাসী, বেশ্যা, রক্ষিতা সর্বোপরি দাসী বানিয়ে নিঙড়ে নিঙড়ে উপভোগ করেছে ‘রাজতরঙ্গিণী’ তার যথার্থ উদাহরণ৷

বাৎসায়ণের কামসূত্র :

‘কামসূত্র’-এর রচনাকাল তৃতীয় শতক৷ বাৎস্যায়ণ ‘কামসূত্র’ রচনা করলেও তাঁর এই বইটি মূলত আগেকার সব কামসূত্রাবলীর সংক্ষিপ্ত সংকলন এবং বাৎস্যায়ণ তা নিজেই উল্লেখ করেছেন৷ অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে ভারতীয় সমাজ ঐতিহ্যে বাৎস্যায়ণের বহুপূর্বেই কাম কলা হিসেবে চিহ্নিত ছিল৷ এই গ্রন্থে গণিকারা কীভাবে, কি কৌশলে পুরুষদের খুশি করে অর্থ রোজগার করতে পারে তার যথাযথ বর্ণনা দিয়েছেন৷ নীহাররঞ্জন রায় একে ‘‘সমসাময়িক ভারতীয় নগর-সভ্যতার ইতিহাস এবং নাগর যুবক-যুবতীদের অনুশীলন গ্রন্থ’’২২ বলেছেন৷ গৌড় ও বঙ্গের রাজপ্রাসাদন্তপুরের নারীরা প্রাসাদের ব্রাহ্মণ, কর্মচারী, ভৃত্য ও দাসদের সঙ্গে কিরূপ কামতরঙ্গে লিপ্ত হত, কীভাবে অভিজাত গৃহগুলি নর্তকী বিলাসের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল ইত্যাদি বিষয় বাৎস্যায়ণের দৃষ্টি এড়ায়নি৷ ‘‘নাগর অভিজাত শ্রেণীর অবসর এবং স্বল্পায়াসলব্ধ ধনপ্রাচুর্য তাহাদিগকে ঐশ্বর্য-বিলাস এবং কামলীলার চরিতার্থতার একটা বৃহৎ সুযোগ দিত;’’২৩ বাৎস্যায়ণ গণিকাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন—গণিকাদের যৌনসঙ্গমই তাদের বৃত্তির অন্যতম উপায় তাই যখন সে কোনো পুরুষের সঙ্গে মিলিত হবে তাকে অবশ্যই পুরুষটির কাছে আনন্দ প্রকাশ করতে হবে৷ একজন আদর্শ বারবনিতাকে তরুণী, সুন্দরী, সুলক্ষণা এবং মধুর স্বভাবের অধিকারিণী হতে হবে৷ ব্যবহার হবে ভদ্র, বুদ্ধিমতী এবং চরিত্রবান হিসেবে সে বিবেচিত হবে৷ কৃতজ্ঞতা, সততা অর্থাৎ তাকে কামসূত্রে পারদর্শিনী হতে হবে৷ বিষাদগ্রস্ত মন, লোভ, মুর্খামি, অত্যধিক হাসি, পরনিন্দা-পরচর্চা, গালমন্দ করা, অস্থিরতা ইত্যাদি দোষ থাকলে চলবে না৷ ‘খদ্দের’-এর ইচ্ছা পূর্ণ করে তাকে পরিতৃপ্ত করাই গণিকাদের প্রধান সক্ষমতা৷ পুরুষের সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে তাকে এমন ভাব দেখাতে হবে যে সে পুরুষটিকে যারপরনাই ভালোবাসে৷ পুরুষকে আকৃষ্ট করে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করলেও একজন পণ্যাঙ্গনা কখনোই সেই প্রেমে নিজে বাঁধা পড়বে না৷ খদ্দেরের শত্রুকে শত্রু বলে বিবেচিত করে, তার সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনে তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে, ইহকাল-পরকালের সঙ্গী হিসেবে নিজেকে জাহির করার অভিনয় করবে একজন দেহব্যবসায়িনী৷

নানা ছলে, নানা উপলক্ষে খদ্দেরের কাছ থেকে টাকা আদায় করে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলবে একজন গণিকা৷ কখনো বলতে হবে সে বা তার কোনো উপকারী বন্ধু খুব বিপদে পড়েছে, কখনো বলবে চোর বা প্রহরী তার সমস্ত গহনা কেড়ে নিয়েছে ইত্যাদি গল্প বানাতে হবে সঙ্গলাভকারী পুরুষটিকে বলার জন্য৷ কখনো নিজের গৃহসজ্জার কোনো জিনিস বা বাসনপত্র বা গহনা পুরুষটিকে দেখিয়ে দেখিয়ে বিক্রয় করার ভান করবে যাতে সে মনে করে অভাবে পড়ে মেয়েটি তার সব বিক্রয় করে দিচ্ছে৷ অন্য গণিকারা তাদের প্রেমিকদের কাছ থেকে কি কি পায় তা কৌশল করে নিজের খদ্দেরের কানে তুলতে হবে৷

যদি কোনো গণিকা একই সঙ্গে একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে টাকা রোজগার করতে চায় তাহলে সে একটি পুরুষের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে না৷ সে ক্ষেত্রে স্থান কাল বুঝে সে নিজের দর হাকবে৷ প্রতি রাত্রের জন্য লোক হিসেবে সে দেহের মূল্য নির্ধারণ করবে৷ যদি একাধিক ধনাবান পুরুষ তার কাছে একই সময়ে আসে তখন যে তার প্রত্যাশার সমস্ত দিক পূরণ করতে পারবে গণিকা তাকেই সেই সময়ের জন্য সঙ্গ দিতে রাজী হবে৷ যে সকল গণিকারা প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী বাৎস্যায়ণ তাদের সেই অর্থকে নানা সেবামূলক কাজে ব্যয় করার উপদেশ দিয়েছেন৷ যেমন—বাগান ও পুকুর তৈরি, মন্দির তৈরি, আশ্রম স্থাপন ইত্যাদি৷

বারাঙ্গনাদের প্রতি বাৎস্যায়ণের নানাবিধ উপদেশাবলীর নিরিখে তাদের পেশাদারিত্বের প্রতিই বেশি দৃষ্টিদান করেছেন বলে মনে হয়৷ গণিকাদের শুধু মাত্র যৌনপিপাসা নিবারণকারী শরীরী মাংসপিণ্ড হিসেবে নয়; তাদের দক্ষ, শিক্ষিত ও বুদ্ধিমতী হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন৷ তারা সুচতুর ব্যবসায়ীর মতো নিজের পরিশ্রমের রোজগার পুরুষের কাছ থেকে আদায় করে নিতেও দক্ষ৷ যৌনবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েও গণিকারাও যে বৃহত্তর জনকল্যাণে অংশ নিতে পারে বাৎস্যায়ণ তাঁর গ্রন্থে সে ইঙ্গিতও দিয়েছেন৷

তিনি গণিকাদের কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন—

১. গণিকা : এরা সব থেকে বেশি আয়ের শিক্ষিত দেহব্যবসায়ী৷

২. রূপজীবা : যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা তুলনামূলকভাবে কম; মূলত রূপ ও গুণের জন্য দেহজীবিকাকে বেছে নিয়েছে তারা রূপজীবা৷

৩. কুম্ভদাসী : কুম্ভদাসীরা হল প্রাক্তন দেহজীবী, যৌনসঙ্গমে, শরীরী-সক্ষমতায় অক্ষম হয়ে তারা এই শ্রেণীতে অন্তর্ভূক্ত হয়৷ দেহব্যবসায়ী নারী ও খদ্দেরের সঙ্গে মেলবন্ধনের জন্য এরা ঘটকের কাজ করে৷ শিক্ষিত ধনবান পুরুষকে নিয়ে আসা এদের প্রধান কাজ৷

৪. পরিচারিকা : স্বামীর বা বাবুর ব্যক্তিগত স্বার্থে যে নারীরা খদ্দেরের মনোরঞ্জন করে৷

৫. কুলটা : যে নারী স্বামীর ভয়ে নিজের দেহজীবিকার পরিচয় গোপন করেও বৃত্তিটির সঙ্গে যুক্ত সে কুলটা৷

৬. স্বৈরিণী : স্বামীর ভয়কে তুচ্ছ করে যে স্ত্রীরা বাড়িতে খদ্দেরদের মনোরঞ্জন করে৷

৭. নটী : নাচ, গান, অভিনয় ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থেকে যে নারী দেহব্যবসাও করে থাকে সে নটী নামে খ্যাত৷

৮. শিল্পকারিকা : ধোপানি বা সমগোত্রীয় পেশায় থেকেও যারা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করে তারা শিল্পকারিকা৷

৯. প্রকাশ বিনষ্টা : যদি কোনো সধবা বা বিধবা নিজের ইচ্ছেয় দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয় তারা প্রকাশ বিনষ্টা৷

শুধু গণিকারাই নয় এই বৃত্তির সহায়তাকারী বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গও বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছে কামসূত্রে৷ যেমন—

১. বিট : যে ব্যক্তি নিঃসহায় হয়ে নিজের দেশেই স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে আছে এবং যার অন্য কোনো উপায় না থাকায় বেশ্যা ও নাগরকের মিলনকে জোরালো করে জীবন যাপন করতে চায় সে বিট নামে পরিচিত৷

২. পীঠমর্দ : যে ব্যক্তি উপনাগরিকবৃত্তে (ঐশ্বর্যহীন কিন্তু কাম-কলা বিদ্যায় রপ্ত ব্যক্তি) নিজেকে যোগ্য করে তুলেছে, সে কলা বিদ্যার উপদেশ নিয়ে নিজেকে নাগরকদলের আচার্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করবে; তখন তার পরিচয় হবে পীঠমর্দ৷

৩. বৈহাসিক : সংসারী নয় কিন্তু সঙ্গীতের সমঝদার, লোককে হাসাতে জানে—এরকম লোক বৈহাসিক নামে পরিচিত৷ এরা বেশ্যা ও নাগরকদের মৈথুন যাতে শান্তিপূর্ণ হয় সেই ব্যাপারে উপদেশ দান করে৷ দেশকাল অনুসারে সন্ধিকৌশলী বা সন্ধি-বিগ্রাহিক নামেও এরা পরিচিত৷

৪. কুট্টনী : যে সব স্ত্রীলোকেরা বেশ্যা এবং নাগরক উভয় পক্ষের মধ্যে কথার আদান প্রদান করে তারা কুট্টনী৷

এছাড়া কোনো বারাঙ্গনাগৃহে বা নাগরকের গৃহে বেশ্যাদের সাথে সমমিলন, সমস্বভাব, সম ধনসম্পন্ন ও সমবয়স্কদের সঙ্গে একত্রিত অবস্থানকে বলা হয় গোষ্ঠী সমবায়৷ গণিকা সম্ভোগে স্ত্রীজাতির মন সম্বন্ধে জানা যায় তাই গোষ্ঠী বা শ্রেণীর মধ্যে গণিকাদেরকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷

বাৎস্যায়ণের যুগে গণিকাগমন যেহেতু নাগরিক বিলাসের অঙ্গ তাই সেই সময়ে শুধুমাত্র দেহভোগের সময়ে গণিকারা যথেষ্ট মর্যাদার অধিকারী ছিল৷ নায়করা সুরা পান করার আগে গণিকাদের দিয়ে পান করাতো এতে তার সম্মান বাড়ে৷ পালাক্রমে নায়ক ও বারাঙ্গনা উভয়ের বাড়িতে মধু, মৈবের, সুরা ইত্যাদি পানকে বলা হয় আপানক৷ আর এই অনুষ্ঠিত আপানক বা পানগোষ্ঠীকে বলে সমাপান৷ এত দিক বিচার করে দেখা যায় গণিকাগমন বা গণিকা তোষণ সে যুগে নিন্দার ছিল না৷ দেহব্যবসার মতো অমানবিক একটা পেশায় সে সমাজ ছিল সাবলীল৷ সেই সামাজিক বর্ণনার বিভিন্ন দিক উঠে আসে নীহাররঞ্জন রায়ের কথায়—‘‘খ্রীষ্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতক হইতেই বাঙলাদেশ, স্বল্পাংশে হইলেও, উত্তর ভারতীয় সদাগরী ধনতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল এবং উত্তর ভারতের নাগর-সভ্যতার স্পর্শও তাহার অঙ্গে লাগিয়াছিল; বাৎস্যায়নীয় নাগরাদর্শ বাঙলার নগর-সমাজেরও আদর্শ হইয়া উঠিয়াছিল৷ গৌড়ের যুবক-যুবতীদের কামলীলার কথা, তাহাদের বাসনা ও ব্যসনের কথা এবং গৌড়-বঙ্গের রাজান্তঃপুরের মহিলারা যে নির্লজ্জভাবে ব্রাহ্মণ, রাজকর্মচারী ও দাস-ভৃত্যদের সঙ্গে কাম-ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইতেন তাহার বিবরণ বাৎস্যায়নই রাখিয়া গিয়াছেন৷’’২৪

বাৎস্যায়ণ তাঁর এই রচনায় গণিকারা কি ধরনের প্রার্থী খুঁজবে তারও বিবরণ দিয়েছেন৷ যেমন—তরুণ, ধনী, পারিবারিক দায়িত্ব যার নেই, উচ্চ পদস্থ, সদ্বংশজাত, প্রাণবান, শিক্ষিত, কবি, গাথাকাব্য কাহিনিতে কুশল, বাগ্মী, নানা কথায় পারদর্শী, সুরাসক্ত, বন্ধুভাবাপন্ন, নারীসঙ্গমে দক্ষ কিন্তু কারও বশ নয় এ ধরনের পুরুষরাই গণিকার উপযুক্ত নাগর৷ তিনি বিভিন্ন অলংকারাদি সুগন্ধিসহ আরও নানা উপকরণে সুসজ্জিত হয়ে গণিকাদেরকে নাগরদের মনোরঞ্জন করার কথা বলেছেন কারণ তারা পণ্যাঙ্গনা৷ পণ্যকে সুসজ্জিত রাখলেই তো নাগরক বশ হবে৷ গণিকালয়ের কর্ত্রী বা গণিকামাতার প্রতিও তাঁর উপদেশ রয়েছে৷ গণিকা যাতে কোনোভাবে লাঞ্ছিত বা প্রতারিত না হয় সে দিকে গণিকামাতাকে লক্ষ্য রাখতে হবে৷ তার উচিৎ যথাসম্ভব সর্বপ্রকারে গণিকার স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করা৷ প্রার্থী পছন্দ না হলে বা প্রার্থীর থেকে অধিক পরিমানে অর্থ রোজগারের আশায় তাকে নানা কৌশলে, কন্যা অসুস্থ, পরিশ্রান্ত, বিমর্ষ, ঋণগ্রস্ত বা কেউ আরও বেশি অর্থালঙ্কার দিতে প্রস্তুত ইত্যাদি জানিয়ে তাকে বিরত করা বা অধিক অর্থ আদায়ের চেষ্টা করতে হবে৷ আর বাৎস্যায়ণের এই দীর্ঘ উপদেশাবলীর পিছনে যে সক্রিয় চেতনা ছিল তা হল—‘‘গণিকার প্রবঞ্চিত হওয়ার সম্ভবনা—তাকে যে নিজের স্বার্থ নিজেকেই দেখতে হবে সর্ব উপায়ে যথাসম্ভব বেশি অর্থাগমের চেষ্টা করতে হবে তার বর্তমানের দিনপাতের জন্যে এবং অসমর্থ বার্ধক্যের জন্যেও এই বোধ৷’’২৫

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র :

‘অর্থশাস্ত্র’-এর রচয়িতা কৌটিল্যও গণিকাদের নিয়ে বহু উপদেশাবলী নিয়ম-নীতির কথা বলেছেন৷ এই ‘অর্থশাস্ত্র’-তেই প্রথম গণিকাদের সহায়ক কিছু আইন লিখিতরূপে স্থান পায়৷ বাৎস্যায়ণের ‘কামসূত্র’-এর মতো এখানেও রাজা, বণিক, নাগরক, ধনী ব্যক্তিদের অবাধে গণিকা সম্ভোগের নির্দেশ রয়েছে৷ ‘অর্থশাস্ত্র’-তে কৌটিল্য উপদেশ দিয়েছেন গণিকাদের কোনো এক পুরুষের প্রতি দীর্ঘকাল আসক্ত না থাকতে৷ কারণ গণিকার সঙ্গে খদ্দেরের দেহমিলন ব্যবসায়িক সম্পর্কমাত্র—এ সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হলে তাতে যে মমতা ও প্রীতি জন্মাবে তা গণিকার ব্যবসায়ের পক্ষে হানিকর৷ কৌটিল্য নির্দেশিত বিধি-বিধানগুলি গণিকাদের কেন্দ্র করে রচিত হলেও তার সুবিধা গ্রহণ করতো রাষ্ট্রই৷ কারণ গণিকা পীড়নের জন্য যে সমস্ত শাস্তির উল্লেখ ছিল তা বেশিরভাগই অর্থমূল্য৷ অপরাধী আর্থিক জরিমানা দিয়ে রেহাই পেয়ে যেত৷ গণিকা সেই জরিমানার অর্থের প্রাপক হলেও তা কিন্তু রাজস্ব হিসেবে আবার রাজকোষাগারেই জমা পড়তো৷ যেমন—গণিকাকে প্রকাশ্যে অপমান করার দণ্ড ২৪ পণ, শারীরিক অত্যাচারে ৪৮ পণ ইত্যাদি৷ রাস্ট্রের বিপদ হলে গণিকার আয়ের অর্ধেকই বাজেয়াপ্ত হত, প্রয়োজনে তাকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়ারও ব্যবস্থা ছিল৷ কৌটিল্য আরও নির্দেশ করেছেন যে রক্ষিতা বা অবরুদ্ধার উপরে একজন পুরুষেরই অধিকার; যে তাকে ভরণপোষণ করছে৷ তার অন্যথা হলে দণ্ড ভোগ করতে জরিমানা হবে ৪৮ পণ অর্থমূল্য৷

মৃচ্ছকটিক :

শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে গণিকাজীবনের সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায়৷ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে তৃতীয় শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বেঁচেছিলেন ‘মৃচ্ছকটিক’-এর রচনাকার৷ উজ্জয়িনীর নগরলক্ষ্মী বসন্তসেনার জীবনকাহিনি বর্ণনার মধ্য দিয়ে সেই সময়কার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় জীবনের সম্পূর্ণ ছবিকে সুন্দর ভাবে চিত্রিত করেছেন নাট্যকার৷ তখনকার রূপবতী-কলাবতী নগরবধূরা প্রচুর বিত্তবৈভবে দিন কাটাতে পারতো, প্রচুর বিত্তবৈভবের অধিকারিণীও হত এবং সমাজের কারও অনুগ্রহ পেলে সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে সামাজিক মর্যাদায় আসীন হতে পারতো৷ তবুও বেশ্যা বেশ্যাই৷ তার যত বৈভবই থাকনা কেন৷ তাই বসন্তসেনার বীট বারবার তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে রূপে-যৌবনে-শিক্ষায়-রুচিতে-মহানুভবতায়-বৈভবে সে যতই অতুলনীয় হোকনা কেন সে শ্মশানের জুঁই গাছের ফুলের মতোই, যা কোনো শুভকাজে লাগেনা৷ কাহিনিতে রয়েছে—নর্তকী বসন্তসেনার ছিল প্রাসাদতুল্য আটমহলা বাড়ি, অগণিত স্বর্ণালংকার এবং প্রচুর দাসদাসী৷ একদিন কামদেব মন্দিরে পূজা সেরে ফেরার সময় বণিকশ্রেষ্ঠ চারুদত্তকে দর্শন করে তার মোহে মোহিত হয়ে যায় সে৷ বসন্তসেনা বহুভল্লভা৷ বহুজনকে প্রেমদানই তার কর্ম এবং সে সম্পর্কে সচেতনও সে, তথাপি নিজের মনের এহেন আচরণে নিজেই বিস্মিত হয়ে সে ভাবে—‘‘একি হ’লো আজ তার! বহুজনবল্লভা নটী সে৷ কত শত শ্রেষ্ঠ পুরুষেরা তার পায়ের নীচে গড়াগড়ি যায়!’’২৬ বসন্তসেনার নারীহৃদয় প্রেমবিকিকিনির খেলা ছেড়ে সত্যকারের প্রেমকে উপলব্ধি করতে পেরেছে তাই অন্য পুরুষ আর সহ্য হয় না তার৷ রাজশ্যালক শকার তাকে একবার ভোগের জন্য দশহাজার টাকার গহনাসমেত গাড়ি পাঠালে এত বড় অঙ্কের টাকাকেও সে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে৷ একদিন তাকে একা পেয়ে প্রেম অর্জনের প্রত্যাশায় শকার তার পিছু নিলে বসন্তসেনা তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে অনুনয়-বিনয় করলে শকারের শিক্ষকপণ্ডিতকে বলতে শোনা যায়—‘‘বসন্তসেনা! এটা তুমি কেমন কথা বললে? নটীর গৃহ তো যুবকদেরই আশ্রয়স্থান৷ গণিকা হল গিয়ে পথের ধারে জন্মানো লতার মত৷ উপযুক্ত ধনের বিনিময়ে বিক্রেতা যেমন শত্রুমিত্র সকলকেই পণ্য বিক্রয় করতে বাধ্য, তেমনি গণিকাও প্রিয় অপ্রিয় সকলকেই সমভাবে সেবা করতে বাধ্য৷ দীঘিতে যেমন ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ, বিজ্ঞ বা মুর্খ সকলেরই স্নান করার অধিকার; নৌকাতে যেমন পারাপার হবার অধিকার ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সকলেরই, তেমনই গণিকাও সকলের সেবা করবে অনুরাগের সঙ্গে!’’২৭ পণ্ডিতের এই উক্তি থেকে গণিকাদের জীবন-জীবিকার সুস্পষ্ট দিক প্রতিভাত হয়৷ গণিকারা যেহেতু সর্বজনভোগ্যা তাই দেহসম্ভোগের ক্ষেত্রে—প্রেম বেচা-কেনার ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো মূল্য থাকে না; যে অর্থ দেবে তাকে সে গ্রহণ করতে বাধ্য৷ সেই পণ্ডিতের কৌশলেই বসন্তসেনা শকারের হাত থেকে পালিয়ে উপস্থিত হয় চারুদত্তের গৃহে৷ এ যেন বিনা মেঘেই বৃষ্টি৷ যার ধ্যানে চিত্ত বিবশ তার গৃহেই এই বিনোদিনী৷ দ্বিতীয় এই সাক্ষাৎ তার প্রেমবিগলিত চিত্তে আলোড়ন তোলে এবং এবারে চিরকালের জন্য চারুদত্তের কাছে সমর্পিতা হয় সে৷ পরবর্তীসময় দেখা যায় চারুদত্তের গৃহে তার স্ত্রী-পুত্রের উপস্থিতিতেই তাদের সম্ভোগমিলন৷ তৎকালীন সমাজে পুরুষের গণিকা সম্ভোগ বা বহু নারীদেহ আস্বাদন দোষের ছিল না, চারুদত্তের এহেন বিলাসিনী সংসর্গ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি বা তিরস্কার করেনি বরং পুত্র রোহসেনের কাছে বসন্তসেনা মাতৃপরিচয়ে পরিচিত হয়৷ এরপর দুশ্চরিত্র কামার্ত শকারের প্রবল ষড়যন্ত্রে বসন্তসেনা তার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে চরমভাবে আহত হলে তার সমস্ত দোষ বর্তায় চারুদত্তের উপর৷ উজ্জয়িনীর নগরবধূ গণিকারত্ন বসন্তসেনার হত্যার নিষ্ঠুর চক্রান্তে দোষীসাব্যস্ত হয়ে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয় চারুদত্ত৷ তাকে উপস্থিত করা হয় বধ্যভূমিতে৷ এদিকে বসন্তসেনার অনুগৃহীত ছিল সংবাহক৷ সে চোর থেকে উত্তীর্ণ হয়েছে বৌদ্ধ শ্রমণকে৷ তার সেবাযত্নে পীড়িত বসন্তসেনা নতুন জীবন ফিরে পেয়ে সমস্ত খবর শুনে উপস্থিত হয় বধ্যভূমিতে৷ তার সাক্ষ্যে চারুদত্ত সাজামুক্ত হয়৷ তারপর মিলনের পালা৷ পরস্পর পরস্পরের আলিঙ্গনাবদ্ধ মিলনের মুহূর্তে সংবাদ আসে স্বামীর দণ্ডাদেশে কাতর ধূতাদেবীর অগ্নিআহূতির প্রচেষ্টার কথা৷ সকলে গিয়ে ধূতাকে উদ্ধার করে৷ এই চরম পরিস্থিতিতেও স্বামীর সঙ্গে বহুবল্লভা নারীকে দেখে বিস্মিত হয় না চারুদত্তের গৃহিণী৷ বরং তথাকথিত সেই পতিব্রতা নারী সাগ্রহে তার কুশলবার্তা শুনে আপন করে নেয়৷ আর এই পরিবেশেই শর্বিলকের উত্তরীয় দিয়ে স্ত্রী-পুত্র সকলের সামনে বসন্তসেনাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে চারুদত্ত৷ বারভোগ্যা এক নারী পায় গৃহবধূর পূর্ণ সম্মান; বহুপরিচর্যাকারিণী নারীর ভাগ্যে জোটে একক স্বামীর সাহচর্যে সুখী দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন৷ আর এর প্রধান সাক্ষী হয় পরম সতী—স্বামীর মঙ্গলকারিণী পতিব্রতা ধূতা৷ সানন্দে নিজের সম্পূর্ণ জীবনের সঙ্গী, একমাত্র অবলম্বন স্বামীরত্নটিকে অন্য আরেক নারীর হাতে তুলে দিতে তার চিত্ত এতটুকু বিচলিত হয় না৷ কিন্তু সত্যিই কি বিচলিত হয় না? নারীর এই অনুভূতিগুলি তুলে ধরার দাক্ষিণ্য নাট্যকার করেননি, অবশ্য তখনকার সমাজে তার দরকারও হত না৷ কারণ নারী মানেই মাংসপিণ্ড৷ ধূতা সেই সমাজের নারী যে সমাজে তাদের কিছু বলার থাকে না৷ সমাজের হাতের পুতুল সে৷ তাদের ইচ্ছেই ধূতার ইচ্ছে৷ আর এ দিক দিয়ে বসন্তসেনা তার চেয়ে অনেক সুখী৷ সে বহুপুরুষের ভোগ্যা হয়ে প্রবল বিত্ত-বৈভবে স্বাধীনভাবে জীবন কাটিয়েছে, উজ্জয়িনীর প্রধান গণিকা হওয়ার সুবাদে জীবনের স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে পেরেছে, নিজের আভিজাত্যের গৌরবে গর্বিত হতে পেরেছে৷ আর এত সবের মধ্যে থেকে সে যা পেয়েছে তা হল তার ব্যক্তিত্ব৷ আর এর জোরেই শেষ পর্যন্ত সে গণিকা থেকে কুলবধূ হয়ে উঠতে পেরেছে—বারবনিতা থেকে রূপান্তরিত হয়েছে প্রেয়সী-পত্নীতে৷ প্রাচীন সাহিত্যেগুলিতে বসন্তসেনার মতো পূর্ণাঙ্গ গণিকা চরিত্র সাহিত্য ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া বিরল৷

এই নাটকে বসন্তসেনার প্রেমকাহিনির সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি ক্ষুদ্র প্রেমকাহিনি প্রতিফলিত হয়েছে তা হল বসন্তসেনার দাসী গণিকা মদনিকা ও শর্বিলকের প্রেমকাহিনি৷ সেই সমাজে গণিকারা গণিকালয় থেকে বেড়িয়ে যেতে চাইলে তাকে নিষ্ক্রয়মূল্য দিয়ে সেখান থেকে বেরোতে হতো৷ এখানে গণিকা মদনিকার প্রেমিক শর্বিলক নিষ্ক্রয়মূল্য জোগাড় করতে অক্ষম হলে চারুদত্তের গৃহে অলংকার চুরি করে নিষ্ক্রয়মূল্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছে৷

এছাড়া গণিকার পুত্র-কন্যাদেরও জীবনেও যে লাঞ্ছনা-বঞ্চনা সবসময়ের সঙ্গী হত তার বর্ণনাও রয়েছে এই নাটকে৷ গণিকার কন্যারা গণিকাই হত৷ আর পুত্ররা পরিচিত হত বন্ধুল নামে৷ নাটকটিতে তারা তাদের আত্মপরিচয় দিয়ে বলেছে যে তারা পরের গৃহে লালিত, পরের অন্নে পুষ্ট এবং পরপুরুষের দ্বারা পরনারীতে জন্ম তাদের৷ গণিকা কন্যারও এই পরিচয়৷ লেখক মর্মস্পর্শীভাবে এই বন্ধুলদের আত্মপরিচয় দিয়েছেন৷

সুতনুকা প্রত্নলেখ :

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে অশোক অনুশাসনের সমসাময়িক এক প্রত্নলেখ হল সুতনুকা প্রত্নলেখ৷ বর্তমান উত্তরপ্রদেশের অন্তর্ভূক্ত রামগড় পাহাড়ের যোগীমারা গুহায় তিনছত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে এক দেবদাসীর কথা৷ তার নাম সুতনুকা৷ বারাণসীবাসী রূপবান যুবক দেবদিন্ন তাকে কামনা করেছিল৷ লেখটি হল—

 ‘‘শুতনুক নম দেবদশিক্যি

 তং কময়িথ বলনশেয়ে

 দেবদিনে নম লুপদখে৷

সুতনুকা নামে দেবদাসী৷ তাহাকে কামনা করিয়াছিল বারাণসীবাসী দেবদিন্ন নামে রূপদক্ষ৷’’২৮

‘কথাসরিৎসাগর’-এর মদনমালা সর্বজনবিদিত বারবনিতা৷ বৎসরাজ উদয়ন পুত্র নরবাহনদত্তকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করার সময় নানা বন্ধুবর্গকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন৷ প্রধান বয়স্য গোমুখের স্ত্রীচরিত্র বিষয়ক কথকতার প্রসঙ্গে মন্ত্রীপদে নিয়োজিত মরুভূতি শোনায় এক বারবধূর কাহিনি৷ গণিকা হলেও ত্রিগুণের শ্রেষ্ঠগুণ সত্ত্বগুণ যার মধ্যে অতিশয় প্রবল ছিল৷ বারাঙ্গনা হয়েও এরকম শুদ্ধসত্ত্ব পরম পতিব্রতাদের মধ্যেও পাওয়া যায় না৷ তার পবিত্র অন্তকরণের পরিচয় সকলকে বিমোহিত করে৷ এই পরমপবিত্র গণিকা হল মদনমালা৷ নগরবনিতা সে৷ রাজা বিক্রমাদিত্য তার পরম শত্রু নরসিংহের সঙ্গে প্রকাশ্য সমরে না পেরে অন্তর্ঘাতের মতলবে দীনহীন বেশে চাকরিপ্রার্থী হয়ে প্রবেশ করেন নরসিংহের রাজ্য প্রতিষ্ঠান নগরীতে৷ আশ্রয় নিলেন মদনমালার গৃহে৷ রণকৌশল ও রমণকৌশলে দক্ষ দুই নরনারীর মিলন-সম্ভোগে মত্ত হয়ে উঠলো মদনমালার বিলাসপুরী৷ বিক্রমাদিত্য লক্ষচ্যুত হলেন, ভুলে গেলেন শত্রু নরসিংহের কথা৷ আর মদনমালা ভুলে গেল সে একজন দেহবিকিকিনির পসরামাত্র৷ যথাসময়ে মন্ত্রীর মাধ্যমে বিক্রমাদিত্যের চৈতন্যোদয় হলে তিনি ভিখারী ছদ্মবেশী প্রপজ্ঞবুদ্ধিকে হত্যা করে কুবেরের কাছ থেকে প্রাপ্ত অক্ষয় পঞ্চকাঞ্চন মূর্তি মদনমালার জন্য মন্দিরে রেখে প্রতিষ্ঠান নগর থেকে নিজরাজ্যে ফিরে আসেন৷ মদনমালা বিক্রমাদিত্যের প্রকৃত পরিচয় জানতো না, তবু ভালোবেসে ফেলেছে তাকে৷ সেই প্রেমাস্পদবিনা তার জীবন অন্ধকার, বেঁচে থাকা দুষ্কর৷ তাই প্রতিজ্ঞা করে ছয়মাসের মধ্যে যদি তার প্রেমিকপুরুষ ফিরে না আসে সে তার জীবন অগ্নিআহুতি করবে এবং মৃত্যুপূর্ব ছয়মাস সে তার অর্জিত সকল ধনরাশি মানুষের মধ্যে বিতরণ করতে থাকবে৷ মদনমালার ধনসম্পদও কম নয়৷ দুহাতে দান করার ফলে সেই সুবিপুল ধনরাশিও একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়৷ তখন পঞ্চকাঞ্চন মূর্তি থেকে হাত কেটে নিয়ে মানুষকে দান করে দেয়৷ পরদিন এসে দেখে যেমন মূর্তি তেমনি রয়ে গেছে৷ একেবারে অক্ষত৷ তার বুঝতে বাকি থাকে না যে সেই মূর্তিগুলি অক্ষয় স্বর্ণমূর্তি৷ প্রতিদিন সে সেই অক্ষয়মূর্তির অঙ্গ কেটে দান করতে থাকে৷ তার সেই প্রাণনাশী প্রতিজ্ঞার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে৷ বিক্রমাদিত্যের পাটলিপুত্র নগরের বেদজ্ঞ পণ্ডিত সংগ্রামদত্ত মদনমালার দানের খবর শুনে সেখান থেকে চারটি ভারী ভারী সোনার হাত হাতির পিঠে চাপিয়ে নিয়ে আসে এবং বিক্রমাদিত্যের কাছে মদনমালার সেই অদ্ভুৎ প্রতিজ্ঞা ও দানের কথা ব্যক্ত করে৷ বিক্রমাদিত্য জীবনে বহুনারী সম্ভোগ করেছেন কিন্তু একজন বেশ্যানারীর প্রেম যে এমন নিকষিত হেম হতে পারে তা ছিল তাঁর অভিজ্ঞতার বাইরে৷ তিনি ফিরে আসেন মদনমালার কাছে৷ তার কাছে নরসিংহকে পরাজিত করার জন্য সাহায্য ভিক্ষা করেন৷ অবশেষে এক বারবনিতার সহায়তায় পৃথিবীবিজয়ী মহাবীর বিক্রমাদিত্য নরসিংহকে আয়ত্তে আনেন৷ মদনমালা তার নিষ্পাপ প্রেম দিয়ে বিক্রমাদিত্যের স্ত্রী হয়ে শেষ পর্যন্ত পাটলিপুত্রের রানি হয়ে বাকি জীবন অতিবাহিত করে৷

এই ‘কথাসরিৎসাগর’-এই আছে আরেকজন বারাঙ্গনার কথা৷ সে অপ্সরা অলম্বুষের মেয়ে কলাবতী৷ ইন্দ্রকর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে মর্ত্যমানবের সম্ভোগের অধিকারী হয়েছিল৷ সারারাত প্রেমিক ঢিণ্ডারকরালকে তুষ্ট করতো বিচিত্র সম্ভোগ কৌশলে আর দিন হলে স্বর্গে ফিরে গিয়ে দেবসভায় দেবলোকের মনোরঞ্জন করত সে৷

কলাবিলাস :

‘কলাবিলাস’-এ রয়েছে গণিকা বিলাসবতীর কথা৷ বিলাসবতী বিত্তশালিনী এবং রূপবতী৷ রাজা বিক্রম রাজ্যচ্যুত হয়ে নিরাশ্রয় অবস্থায় ঠাঁই নেয় বিলাসবতীর আশ্রয়ে৷ বিলাসবতীর নারীসত্তা রাজা বিক্রমের প্রেমে উন্মত্ত হয়ে ওঠে৷ সে তার নিঃস্বার্থ প্রেম দিয়ে রাজাকে যেমন আগলে রাখে তেমনি তার সকল ধন-সম্পদের বিনিময়ে সাহায্য করে বিক্রমের লুপ্ত রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে৷ কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সে পায় রাজমহিষীর মর্যাদা৷ একদিন তাকে বিমর্ষ দেখে রাজা তার কারণ জানতে চাইলে বিলাসবতী জানায় তার পূর্ব-প্রণয়ীর কথা, যার স্মৃতিতে সে ম্লান হয়ে আছে৷ রাজা নিজে অগ্রণী হয়ে সেই প্রণয়ীর সঙ্গে মিলন ঘটায় সেই নতুন রানির৷ যখন সে গণিকা ছিল তখন তার বহুপরিচর্যায় কোনো বাধা ছিল না৷ কিন্তু রাজমহিষী হওয়ার পরেও স্বামী তাকে আকাঙ্খিত পুরুষ এনে দেয়৷ এর থেকে বোঝা যায় যে গণিকা নারীকে গৃহবধূর সাম্মানিক জীবন দিলেও অনেক ক্ষেত্রে সে যে পূর্বে গণিকা ছিল তা তার স্বামী বিস্মৃত হয় না৷ তাই বিলাসবতীর অন্যপুরুষের সম্ভোগের ব্যবস্থা স্বামী বিক্রম নিজেই করে দিয়েছে৷ রাজমন্ত্রীও বহুভোগ্যার পাণিগ্রহণ করা নিয়ে রাজা বিক্রমকে সতর্ক করে দিয়েছিল যে গণিকাদের কখনো বিশ্বাস করা যায় না৷ এ কথা মনে পরার মধ্যে রাজা বিক্রমের দ্বন্দ্ব-মুখর চিত্তের ছবি ফুটে উঠেছে৷ এখানে রাজা, রাজমন্ত্রীর গণিকা নিয়ে নেতিবাচক ধারণাগুলির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত থাকলেও কাহিনির কোথাও যৌনসম্ভোগকারী পুরুষ যাদের কিনা গণিকাদের জীবনে পথের পথিকের মতো সতত আশা-যাওয়া, তার জন্য একজন গণিকা নারীর সর্বস্ব ত্যাগ করার মহানুভবতার কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত হয়নি৷ এমনই জীবন ছিল গণিকাদের৷

বৌদ্ধ যুগে গণিকা :

ভারতীয় সমাজ ইতিহাসে বৌদ্ধযুগ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ৷ খ্রিস্টপূর্ব ৬৪০ থেকে ৫৬০ পর্যন্ত সময়কালকে বৌদ্ধযুগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সমাজতাত্ত্বিকেরা৷ বুদ্ধের আবির্ভাবের প্রায় এক শতাব্দী পরে বৌদ্ধ সাহিত্যগুলি রচিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়৷ এই যুগের সাহিত্যকীর্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতক অর্থাৎ বুদ্ধের বিভিন্ন জন্মের কাহিনি; অবদান শতক অর্থাৎ প্রশস্তিমূলক রচনা ও গাথা সাহিত্য৷ সে যুগের ভারতের নগর সভ্যতার পরিচয়, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ, তাদের বৃত্তি ইত্যাদি সুস্পষ্টরূপে লিপিবদ্ধ হয়েছে৷ আর এই প্রসঙ্গে এসেছে বহু গণিকাচরিত্র৷ রাজকীয় এবং সামাজিক জীবনে তাদের অস্তিত্ব ছিল সর্বব্যাপী৷ গণিকারা অনেকেই সমাদৃত ছিল৷ তাদের পরিচয় ছিল ‘নগর শোভা’ হিসেবে৷ আবার সবক্ষেত্রেই যে তারা নগর শোভা ছিল তা নয় তাদেরকে অনেকেই ঘৃণার চোখে দেখতো৷

মহাবস্তুর বিভিন্ন কাহিনিতে, কান্তিবাদী জাতক, গমনীচন্দ জাতক, ইন্দিয় জাতক, আত্থন জাতক, কানবের জাতক, অবদান শতক ইত্যাদিতে গণিকাশ্রেণীর জীবনচর্যার সবিস্তার বর্ণনা পাওয়া যায়৷ এই জাতক মালার গল্পগুলি আয়তনে ক্ষুদ্র কিন্তু দোষে-গুণে নিজেদের বৃত্তিপোযুক্ত কার্যকলাপে এর অনেক গণিকাই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে৷ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—আম্রপালি, শ্যামা, বাসবদত্তা, শলানতি বা শলাবতী, সুলসা, কালি, কাশিসুন্দরী, অদ্ধকাশী প্রমুখরা৷

আম্রপালী বা অম্বপালীর সঙ্গে ইতিহাসের দুই প্রবাদপ্রতিম পুরুষ জড়িত—একজন রাজা বিম্বিসার অপরজন স্বয়ং বুদ্ধদেব৷ কাহিনিটি ঐতিহাসিক৷ বিনয়বস্তুতে সবিস্তারে এবং মহাব>তে সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণিত আছে এই কাহিনি৷ বৈশালী নগরের সর্বশ্রেষ্ঠ নারীরত্ন হল আম্রপালী৷ আম্রবৃক্ষের তলায় তাকে পাওয়া গেছে বলে নাম হয় আম্রপালী৷ বাগানের এক মালী তাকে সযত্নে লালন-পালন করে উপযুক্ত বয়সে নগরে নিয়ে আসে৷ তার অপরূপ সৌন্দর্য, নৃত্যগীতের পারদর্শিতায় মুগ্ধ হয়ে বৈশালী নগরের প্রতিজন যুবক পাণিগ্রহণের জন্য উন্মত্ত হয়ে ওঠে৷ এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে নগরের ‘গণপরিষদ’ নির্ণয় করে যে কোনো যুবকই একে এককভাবে লাভ করতে পারবে না, তাকে সকলের ভোগ্যা হয়ে থাকতে হবে৷ আম্রপালীর প্রতি রাত্রে পুরুষকে সঙ্গদানের মূল্য ছিল ৫০ কার্যাপণ৷ তার আয়ের উপর ধার্য করে বৈশালীর অর্থভাণ্ডার স্ফীত হয়ে উঠতে থাকে৷ একদিন সে খবর পায় যে বুদ্ধদেব আসবেন ধর্ম উপদেশ দিতে৷ নগরবধূ সে৷ বিলাসিনী নারী৷ এক সুদৃশ্য যানে চেপে যাত্রা করে বুদ্ধ-দর্শনে৷ কিন্তু পথ দুর্গম৷ মনের মধ্যে দেবদর্শনের প্রবল পিপাসা—পদব্রজেই বাকি পথ অতিক্রম করে উপনীত হয় বুদ্ধ সমীপে৷ বুদ্ধদেবের খুব কাছে বসে সে শুনতে থাকে তাঁর অমৃতময় উপদেশবাণী৷ চরম মুগ্ধ সে৷ হৃদয়ের পরম শুদ্ধতায় দেবতাকেই তার ঘরে আহারের নিমন্ত্রণ জানায় এবং দেবতা বুদ্ধও তা সানন্দে স্বীকার করেন৷

বিনয় বস্তুতে এই কাহিনি একটু অন্যরকম৷ বৈশালী নগরে লিচ্ছবি মহানামের এক আম্রকুঞ্জ ছিল৷ সেই কুঞ্জের মাঝখানে হঠাৎ একটি কলাগাছ গজিয়ে ওঠে৷ একজন ভবিষ্যৎ বক্তা গণনা করে মহানামকে বলেন যে, ঐ কলাগাছ থেকে সপ্তম দিনে একটি কন্যার আবির্ভাব হবে৷ নির্দিষ্ট সপ্তমদিনে মহানাম তার স্ত্রীদের নিয়ে সেই কলাগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ যথাসময়ে কলার মোচা ফেটে এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান বেড়িয়ে এলে সন্তানহীনা মহানাম তাকে সানন্দে গ্রহণ করে লালন-পালনের দায়িত্ব নেয়৷ আমবাগানের মধ্যে তার জন্ম হয়েছে বলে নাম হয় আম্রপালী৷ ধীরে ধীরে নানা বিদ্যায় বিশেষ করে কলাবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে সে৷ তার চোখ ঝলসানো রূপ-লাবণ্যে চারিদিক মোহিত হয়ে যায়৷ দেশ-বিদেশ থেকে রাজপুত্র, শ্রেষ্ঠী, ধনী বণিকারা তার পাণি গ্রহণের আকাঙ্খায় উন্মত্ত হয়ে ছুটে আসতে থাকে৷ মহানাম ভীত হয়ে নগরের ‘গণ’-এর শরণাপন্ন হয়৷ বহু আলোচনার পর ‘গণ’-রা সিদ্ধান্ত জানায় যে ‘অনির্বহ স্ত্রীরত্নম’ অর্থাৎ স্বাধীনা নারী সম্পূর্ণ ‘গণ’-এর ভোগ্যা৷ আর সেইজন্য আম্রপালী কারও সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না৷ ‘গণ’-এর এহেন রায়ে মহানাম নিরাশ হলেও আম্রপালী পাঁচটি শর্তের বিনিময়ে সেই দুর্বহ জীবন বরণ করতে রাজি হয়৷ শর্তগুলি হল—

১) শহরের শ্রেষ্ঠ অংশে তাকে বাসস্থান দিতে হবে৷

২) তার নিজের প্রেমিক নির্বাচনের অধিকার থাকবে৷ আর যত বড় লোকই আসুক না কেন একজন প্রেমিক এলে আরেকজনের প্রবেশ নিষিদ্ধ৷

৩) তার সঙ্গে সম্ভোগকারী ব্যক্তিকে পাঁচশত কার্যাপণ দিতে হবে৷

৪) গণ যদি কোনো উদ্দেশ্যে তার গৃহ তল্লাশী করার আদেশ দেয় তবে আদেশ জারি হওয়ার সাতদিন পরে তা কার্যকর হবে৷

৫) তার গৃহে কে আসছে বা যাচ্ছে তার উপর কোনও নজরদারি চলবে না৷

আম্রপালীর সমস্ত শর্তই ‘গণ’ মেনে নেয়৷ সে হয়ে ওঠে বৈশালী নগরের প্রধান গণিকা৷

আম্রপালী বুদ্ধিমতী সুচতুর এবং রুচিশীল৷ বেছে বেছে ধনী পুরুষদের আহ্বান করে সে দেখলো যে তাদের মধ্যে অনেকেই কুৎসিতদর্শন এবং সঙ্গমে অক্ষম৷ তারপর সে অন্যপন্থা অবলম্বন করে৷ নানা দেশ থেকে অঙ্কনশিল্পীদের এনে বিভিন্ন রাজা, রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, মন্ত্রী, শ্রেষ্ঠ বণিক ইত্যাদিদের চিত্র অঙ্কন করিয়ে যাদের গ্রহণীয় বলে মনে হয় তাদেরই আহ্বান করে৷ এভাবে চলতে চলতে একদিন মগধের রাজা বিম্বিসারের চিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় এবং তাঁর প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়৷ এদিকে বিম্বিসারও অমাত্যদের কাছ থেকে চৌষট্টিকলায় পারদর্শিনী পরম রূপবতী আম্রপালীর নাম শুনে কৌতুহলী হয়ে লিচ্ছবিদের শত্রুতা উপেক্ষা করে আম্রপালীর গৃহে প্রবেশ করেন৷ শত্রুরা তা বুঝতে পেরেও কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না; বাধা হয় আম্রপালীর শর্ত৷ কিছুদিন পরে আম্রপালীর এক পুত্র জন্মায়৷ নাম অভয়৷ সে বড় হয়ে অজ্ঞাত পিতৃপরিচয়হীনতায় বিব্রত হয়ে পড়লে মায়ের কাছ থেকে মগধরাজ বিম্বিসারের কথা জানতে পারে৷ বিম্বিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সে রাজকুমার আখ্যায় ভূষিত হয় এবং আরও পরে ভগবান বুদ্ধের শরণ নিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব লাভ করে৷

বারবধূ শ্যামার উল্লেখ আছে কানবের জাতক এবং মহাবস্তু অবদানে৷ রাজনটী শ্যামা বারাণসীর শ্রেষ্ঠ গণিকা৷ রূপ ও নৃত্যগীতে অসামান্যা৷ তক্ষশীলার অশ্বব্যবসায়ী বজ্রসেন বারাণসীতে অশ্ববিক্রয়ের উদ্দেশ্যে এসে সর্বস্ব খুইয়ে আহত অবস্থায় এক ভগ্নবাড়িতে আশ্রয় নেয়৷ সেখান থেকে নগরক্ষকেরা তাকে চোর সন্দেহ করে ধরে নিয়ে গেলে বিচারে প্রাণদণ্ড হয় তার৷ বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়ার কালে বারাঙ্গনা শ্যামা তার রূপে আকৃষ্ট হয়ে যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে ছাড়িয়ে আনার জন্য সখিকে রক্ষীদের কাছে প্রেরণ করে৷ রক্ষীরা প্রাণের বদলে প্রাণ চায়৷ তখন শ্যামা তার অনুগত এক প্রণয়ীকে পাঠায় বজ্রসেনের বিকল্প হিসেবে৷ তার প্রাণের বিনিময়ে বজ্রসেন রক্ষা পেয়ে শ্যামার কাছে চিরকৃতজ্ঞতায় নিজেকে ধরা দেয়৷ তাদের প্রণয়লীলায় উন্মত্ত পরস্পরের হৃদয়৷ বজ্রসেন শ্যামার কাছে তার মুক্তির রহস্য জানতে চাইলেও কোনো উত্তর পায় না৷ তারপর একদিন শ্যামার সকল ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে, সমস্ত অলঙ্কার আত্মসাৎ করে তাকে মদ্যপানে বিহ্বল ও আহত করে বারাণসী ঘাটে ফেলে পালিয়ে যায় বজ্রসেন৷ মায়ের ঐকান্তিক শুশ্রূষায় সে যাত্রা শ্যামা রক্ষা পেলেও তার নিকষিতহেমতুল্য হৃদয়নিঃসারিত প্রেমকে কিছুতেই ভুলতে পারে না৷ এক পরিব্রাজিকা ভিক্ষুণীকে তক্ষশীলায় পাঠায় বজ্রসেনকে ফিরে আসার অনুরোধ জানিয়ে কিন্তু এক বারবধূর প্রেমের কি মূল্য আছে এক সম্ভ্রান্ত অশ্বব্যবসায়ীর কাছে৷ শ্যামার একক নিঃসঙ্গতায় কাহিনির পরিসমাপ্তি৷

অবদান সাহিত্যের ‘দিব্যবদান’-এ রয়েছে মথুরার নগরনটী বাসবদত্তার কথা৷ সে গন্ধবণিক উপগুপ্তের প্রতি আকৃষ্ট হয় তার ভৃত্যের মুখের কথা শুনে৷ ভৃত্যের মাধ্যমে উপগুপ্তের কাছ থেকে নানা রকম সুগন্ধীদ্রব্য ক্রয় করত বাসবদত্তা কিন্তু ভৃত্য যখন সেই দ্রব্য নিয়ে ফিরে আসত তখন অর্থ অনুযায়ী জিনিস কম দিয়েছে বলে ভৃত্যের কাছে উপগুপ্তের নামে প্রতারণার অভিযোগ তুলত৷ ভৃত্য তা তীব্রভাবে অস্বীকার করে উপগুপ্তের সততা, অমলিন দিব্যকান্তি রূপের প্রশংসা করতো৷ এই ভাবে ক্রমাগত চরিত্র ও রূপের প্রশংসা শুনে বাসবদত্তা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ভৃত্যকে দিয়ে তাকে গৃহে আমন্ত্রণ জানায়৷ উপগুপ্ত তা অস্বীকার করে জানান যে বাসবদত্তার কাছে তাঁর যাওয়ার সময় হয়নি, যখন সময় হবে তখন তিনি নিজের থেকেই উপস্থিত হবেন৷ এমতাবস্থায় মথুরায় আসে এক অশ্বব্যবসায়ী৷ বারনারী বাসবদত্তার খ্যাতি তার অগোচর থাকে না৷ পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা অগ্রিম পাঠিয়ে সে তার সঙ্গ কামনা করে৷ টাকার লোভ পেয়ে বসে বাসবদত্তাকে৷ সে বণিকের সবকিছু আত্মসাৎ করার অভিপ্রায়ে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ডেকে পাঠায় এবং সে এসে পৌঁছলে তাকে হত্যা করে শৌচাগারে লুকিয়ে রাখে৷ এই ঘৃণ্য কাজের জন্য রাজা তার হাত পা নাক ছেদন করে নগর পরিখার বাইরে শ্মশানে ফেলে রাখবার আদেশ দেন৷ এই সংবাদ উপগুপ্তর কাছে পৌঁছলে সে ভাবে যে, এই বার তার বাসবদত্তার কাছে যাওয়ার সময় হয়েছে৷ শ্মশানে হতচেতন বাসবদত্তার কাছে এসে জানায় এতদিন তার রূপগর্বিত আহ্বানকে সে অস্বীকার করলেও তার দুঃখময় পরিণতিতে কাছে আসার সময় উপস্থিত হয়েছে তার৷ এখানে বাসবদত্তার চারিত্রিক কোনো মহত্ত্ব নয় তার স্বভাবজ লোভ এবং অর্থলোলুপতার একটি দিক সুন্দরভাবে উন্মোচিত হয়েছে৷

শলানতীর কাহিনিটি রয়েছে ‘মহাবগ্গ’-তে৷ রাজগৃহের প্রধান গণিকা শলানতী বা শলাবতীর প্রতি রাত্রের মূল্য ছিল পাঁচশত কার্যাপণ৷ যৌনসঙ্গমে পারদর্শী হয়েও একবার সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে৷ সকলের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে অসুস্থতার ভান করে থাকে৷ যথাসময়ে এক পুত্রসন্তান প্রসব করলে ক্রুর হিংসায় দাসীর দ্বারা তাকে ফেলে আসে আবর্জনার স্তূপে৷ গণিকা নারীর বিকৃত যৌনপিপাসার কাছে কলুষিত হয়ে যায় পবিত্র মাতৃত্ব৷ গণিকা আম্রপালীর পুত্রের দ্বারা উদ্ধার ও লালিত-পালিত হয়ে পরবর্তীকালে সেই নিষ্পাপ শিশুসন্তানটি হয়ে ওঠে বিখ্যাত চিকিৎসক জীবক কুমারভৃত্য৷

বারাঙ্গনা সুলসাও বারাণসীর আরেক প্রসিদ্ধ দেহব্যবসায়ী৷ প্রভূত সম্পদের অধিকারিণী সুলসার এক রাত্রের শরীর মূল্য ছিল এক হাজার মুদ্রা৷ পাঁচশত দাসী সর্বদা এর সেবায় নিযুক্ত থাকতো৷ তার প্রণয়ী ছিল এক দস্যু৷ কয়েকমাস তার সঙ্গে মধুমাস অতিক্রান্ত করার পর সুলসার নির্মল প্রেমসত্যকে উপেক্ষা করে তার সকল অলঙ্কারাদি আত্মসাৎ করার ফন্দি আঁটে৷ পাহাড়ে উপর বৃক্ষদেবতাকে পূজা উৎসর্গ করার অছিলায় সর্বঅলঙ্কারে সুসজ্জিত করে সুলসাকে নিয়ে যায় পাহাড় চূড়ায়৷ সেখানে গিয়ে তার অভিপ্রায়ের কথা ব্যক্ত করলে ভয়ে ভীত হয়ে উঠে সুলসা৷ কিন্তু তার উপস্থিত বুদ্ধি ছিল ক্ষুরধার৷ নিজেকে সংযত করে দস্যুকে তাদের ভালোবাসার সত্যতা বোঝানোর চেষ্টা করে, দস্যু ভোলে না৷ তারপর তার সমস্ত অলঙ্কারাদি নির্বিঘ্নে তার হাতে দিয়ে প্রাণটুকু ভিক্ষা চায়, তাতেও মন গলে না পাষণ্ড দস্যুর৷ তখন সুলসা মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো প্রিয়তমকে আলিঙ্গন করার অনুমতি চায়৷ এবারে দস্যু রাজি হয়৷ তারপর আলিঙ্গনের অছিলায় সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা মেরে দস্যুকে পাহাড়ের উপর থেকে নীচে ফেলে দিয়ে নিজগৃহে ফিরে আসে৷ এক সামান্য দেহজীবী পতিতাকে তার সামর্থ্য ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অসামান্য করে তুলেছেন জাতকের কথাকার৷

তক্করীয় জাতকে বারাণসীর আরেক প্রসিদ্ধ গণিকা কালির কথা জানা যায়৷ কালির প্রণয়ী কালির অপদার্থ ভাই তুণ্ডিল্লকে মাঝে মাঝে অর্থ সাহায্য করতো৷ কালির সেটা পছন্দ ছিল না তাই সে স্পষ্ট করে ভাইকে জানিয়ে দেয় যে প্রেমিক ইচ্ছে করলে তাকে সাহায্য করতে পারে কিন্তু সে তার নিজের দেহবিক্রির রোজগার থেকে সামান্য অর্থও দেবে না৷ সেই সময় গণিকাগৃহের গণিকাদের জন্য অদ্ভূত নিয়ম ছিল যে দেহবিক্রয়কারী নারী তার দেহবিক্রি করে যে অর্থ উপার্জন করবে তার অর্ধেক সে পাবে এবং বাকি অর্ধেক প্রেমিকের পোশাক, পুষ্পমালা, গন্ধদ্রব্য ইত্যাদিতে খরচ করবে৷ প্রেমিক যেদিন গণিকাগৃহে আসবে সেদিন তার নিজের পোশাক খুলে গণিকার দেওয়া বহুমূল্য বস্ত্রাদি পরিধান করবে আর চলে যাওয়ার সময় সেই বস্ত্রাদি খুলে রেখে নিজের পড়ে আসা বস্ত্রটি পরিধান করে ফিরে যাবে৷ কালির প্রেমিক তুণ্ডিল্যের দুঃখে কাতর হয়ে তার সেই মহার্ঘ্য বস্ত্র দিয়ে দিয়েছিল তাকে৷ তাতে অপমানিত হয় কালি৷ পরের দিন যখন নিজের বস্ত্র খুলে রেখে আরেক প্রস্থ বস্ত্র দাবি করে তখন ক্রুদ্ধ বারবধূ ভৃত্যদের দিয়ে বিবস্ত্র অবস্থাতেই তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়৷ এই কাহিনিকে কেন্দ্র করে সেই সময় গণিকা সমাজের অনেক তথ্যাদিও উঠে আসে৷ শরীর নিঙড়ে নিঙড়ে উপার্জন করা অর্থের সম্পূর্ণ অংশ যে গণিকা নারীরা পেত না তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত যেমন রয়েছে তেমনি বাররামার প্রেমিকপুরুষেরা যে প্রেম-ভালোবাসা-সেবায় পরিপূর্ণ হয়ে গণিকার কাছ থেকে যৌনপরিসেবা লাভ করতো তাও অস্পষ্ট নয়৷

‘ব্রতবদানমালা’-য় রয়েছে গণিকা কাশিসুন্দরীর পেশার জন্য গভীরতম আত্মগ্লানি৷ কাশিসুন্দরী দেহজীবী হলেও তার ভেতরের নারীসত্তা বরণ করতে চায় সুবর্ণবর্ণকে৷ আর এর জন্য সে প্রত্যাখ্যান করে মগধের রাজা অজাতশত্রুর মন্ত্রী প্রচণ্ডকে৷ কিন্তু সুবর্ণও তাকে উপেক্ষা করে দেহপসারিণী বলে৷ পঞ্চস্বরে কাতর কাশিসুন্দরী সুবর্ণকে জয় করার উদ্দেশ্য নিয়ে তার বাগানবাড়িতে প্রবেশ করে৷ তাকে পেছন থেকে অনুসরণ করে মন্ত্রী প্রচণ্ড৷ সে কাশিসুন্দরীর অভিপ্রায় বুঝতে পেরে তাকে প্রবল প্রহার করে মুমূর্ষ অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায়৷ আঘাতে জর্জরিত কাশিসুন্দরী একটি সাপের উপর পড়ে গেলে সাপ তাকে দংশন করে৷ প্রচণ্ড উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বুঝে কাশিসুন্দরীর মনের মানুষ সুবর্ণবর্ণের উপর হত্যার দায় চাপিয়ে দেয়৷ তার বাড়িতে কাশিসুন্দরীর মৃতদেহ পাওয়া যায়৷ বিচারে প্রাণদণ্ড হয় সুবর্ণবর্ণের৷ পরে ভিক্ষুশ্রেষ্ঠ আনন্দ অগ্রণী হয়ে তাকে রক্ষা করে এবং কাশিসুন্দরীর প্রাণ ফিরিয়ে দেয়৷ পুনরুজ্জীবন লাভ করে সে তার অপরূপ সৌন্দর্য, গণিকা জীবনের কলুষতা এবং নারী মাংসের প্রতি পুরুষের প্রবল লালসা থেকে মুক্তি চায়৷ আনন্দের কাছে প্রার্থনা করে পুরুষ শরীর৷ আনন্দের তত্ত্বাবধানে তার নারীত্ব লোপ পায়৷ সে সর্বস্ব ত্যাগ করে বুদ্ধের শরণ নেয়৷ দেহলোভী পুরুষ সমাজের নারীত্বের অবমাননার চূড়ান্ত পরিণতিতে এক রূপ-যৌবন সম্পন্না নারী কীভাবে আত্মধিক্কারে তার নারীত্বকে বিলুপ্ত করতে পারে কাশিসুন্দরী তার জীবন্ত প্রমাণ৷ তার শরীর বদল শুধু মাত্র নারী শরীর ধারণকারী এক অবলার আপোষ পরিণতি নয় নারী দেহভোগকারী সমাজের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদও৷

কাশীর বারবনিতা অদ্ধকাশি সর্বগুণে গুণান্বিতা স্বনামধন্য গণিকা৷ তার দর্শনী অর্ধেক কাশীর নগর করের সমান৷ তার প্রতি আকৃষ্ট পুরুষেরা সেই বিরাট অঙ্কের অর্থ দর্শনী দিতে পারত না বলে ধীরে ধীরে গ্রাহকসংখ্যা কমতে থাকে৷ শেষে বাজার ঠিক রাখতে সে তার দর্শনী অর্ধেক করে দেয়৷ এভাবে বহুদিন অতিক্রান্ত হলে দেহজীবিকার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বুদ্ধের শরণ নিয়ে সংঘে চলে যায়৷

‘দিব্যবদান’ এবং ‘বাত্তাক জাতক’-এ দুজন নামহীনা গণিকার উল্লেখ রয়েছে৷ প্রথমটির নায়িকা কামার্ত৷ ছলে-বলে কৌশলে সে প্রেমাস্পদকে কাছে পেতে চায়৷ কাহিনিটি এই রকম বৌদ্ধভিক্ষু পদ্মক একদিন সেই গণিকার আলয়ে ভিক্ষার জন্য এলে তার প্রশান্ত রূপ-মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে নারীটি তার সঙ্গ কামনা করে৷ পদ্মক বিরক্ত হয়ে সেই স্থান ত্যাগ করে চলে গেলে সেই কামার্ত বারবনিতা তাকে বশে আনার জন্য এক চণ্ডালিনির দ্বারস্থ হয়, যে কিনা উচাটন, বশীকরণ ইত্যাদি তন্ত্রবিদ্যার দ্বারা অনিচ্ছুক মানুষকে কাছে টেনে আনতে পারে৷ মন্ত্রের প্রভাবে বিহ্বল নতমস্তক পদ্মক তার সামনে উপস্থিত হলেও ঘটনাক্রমে সম্বিৎ ফিরে এলে সে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করতে উদ্যত হয়৷ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে সেই গণিকা তার চরণে পতিত হয়ে নিজের আত্মগ্লানিকে স্বীকার করে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলে পদ্মকের আশীর্বাদে সে পরিণত হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুণীতে৷

দ্বিতীয়টিতে এক কোষাধ্যক্ষের পুত্রকে সাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক জীবন থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য কার্তিক উৎসবের সময় তার ঘরে এক সুন্দরী বারাঙ্গনাকে পাঠিয়ে দেয়৷ গণিকার সবরকম কলাকৌশল তাকে প্রলোভিত করতে ব্যর্থ হলে নিরাশ হয়ে আরেক ধনবান পুরুষের সঙ্গে সে চলে যায়৷ গণিকার মা নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলেও মেয়েকে ফিরতে না দেখে কোষাধ্যক্ষের ছেলের নামে নগরপালকের কাছে নালিশ জানায়৷ নগরপালক বিচারের জন্য রাজার সম্মুখে উপস্থিত করলে সে নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে থাকে৷ রাজা তার মুখ খোলাতে না পেরে প্রাণদণ্ডের আদেশ দেয়৷ বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়ার কালে বাইরের শোরগোলে সেই গণিকা বেড়িয়ে এসে সব কথা শুনে তাকে বাঁচানোর জন্য দ্রুত গিয়ে সত্যিকারে কি ঘটেছিল তা বিবৃত করলে যুবকটি রক্ষা পায়৷ একজন গণিকা, দেহবিক্রির মতো দুঃসহ পেশায় লিপ্ত অতিসাধারণ ঘৃণিত নারীও যে সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ হতে পারে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ এই কাহিনি৷ এছাড়া যে পুরুষটি তার সমস্ত ছলাকলাকে ব্যর্থ করে তার রূপ-যৌবনের অবমাননা করেছে তার প্রতি ক্ষুব্ধ না হয়ে তাকে রক্ষা করে নিজের মহত্ত্বে নিজেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে৷

এই বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে এরকম অনেক গণিকার সন্ধান মেলে যাদের কেউ কেউ গণিকাবৃত্তির ক্লেদের মধ্যে থেকেও নিজের মহত্ত্বে, বুদ্ধিমত্তায়, সাত্বিকতায় উচ্চতর শিখরে অবস্থান করেছে যেমন—আম্রপালী, সুলসা, বাত্তাক জাতকের সেই নামহীনা বারবনিতা৷ আবার অনেক আছে যারা শঠতায়, নিষ্ঠুরতায় অমানবিক, তীব্রকামের দহনে জর্জরিত প্রাণ৷ যেমন বাসবদত্তা, শ্যামা, কালী৷ তারা যেমন কদর্যজীবন যাপনে হিংস্র মানসিকতায় প্রাণঘাতকরূপে প্রকাশিত হয়েছে তেমনি আবার বৌদ্ধ ধর্মের উদার ছত্রছায়ায় প্রশান্ত জীবন আস্বাদন করে সকল পাপ ধুয়ে মুছে নির্মল জীবনে উত্তীর্ণও হয়েছে৷ দেহজীবিকার গ্লানি বহন করে জীবনের শেষ প্রান্তে গিয়ে ধুকে ধুকে মরতে হয়নি তাদের৷ এই কাহিনিগুলির মধ্যে মগধের বারবনিতা কাশিসুন্দরীর কাহিনিটি অনবদ্য এক সম্পদ৷ কীভাবে একজন নারীর নিজ জীবনের প্রতি বীতরাগ এসে তার মননকে আমূল পাল্টে দেয়, কীভাবে নারীত্বকে বিলুপ্ত করে শরীর পাল্টে অন্য আরেক জীবনে প্রবেশ করে, নারী জন্মের সমস্ত বঞ্চনা থেকে রক্ষা পেতে এবং পুরুষের লালায়িত রসনা থেকে বাঁচতে সমাজের জন্য তীব্র এক প্রতিবাদ রেখে যায় তার মহামূল্য দৃষ্টান্ত এই কাশিসুন্দরী৷

বৌদ্ধ সাহিত্যগুলিতে তৎকালীন সময় ও সমাজের প্রেক্ষিতে এই চরিত্রগুলি নিজেদের পৃথকভাবে দাঁড় করাতে পেরেছে৷ বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে মূলত চরিত্রগুলির উপস্থাপনা৷ এই ধরনের রচনায় সমাজপতিতা, দেহপসারিণী নারীদের দেখানো হয়েছে নীচতার চরম পর্যায়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত তাদের পরম মুক্তিকে৷ তাদের আত্মসচেতন অস্তিত্ব, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি, বিভিন্ন কার্যকলাপ এযুগের মানুষকে বিস্মিত করে৷ সেই সময়কার সমাজে গণিকা নারীরা অনেকেই সম্মানের শীর্ষ শিখরে আরোহন করতে পারতো তাদের কৃতকর্ম অনুযায়ী৷

জৈন সাহিত্যে গণিকা :

বৌদ্ধ সাহিত্যের মতো জৈন সাহিত্যেও লক্ষ্য করা যায় শিক্ষিতা ও সর্বাঙ্গসুন্দরী দেহবিনোদিনীদের সহস্রাধিক সম্ভোগ মূল্যের কথা৷ পুন্যবিজয়থি ভাবনগর রচিত (১৯৩৩-৩৮) জৈনগ্রন্থ ‘বৃহৎকল্প’-এ উল্লেখ রয়েছে গণিকাদের শিক্ষা-দীক্ষার কথা৷ এদের শিখতে হত সঙ্গীত, বাদ্যযন্ত্র, গণিত, নানারকম শিল্প, দ্যুতক্রীড়া, অক্ষক্রীড়া, সুলক্ষণ ও দুর্লক্ষণযুক্ত পুরুষ নারীর বিচার, অলংকরণ, অলংকার নির্মাণ, সজ্জা, অশ্ববিদ্যা, হস্তীবিদ্যা, রন্ধনবিদ্যা, রত্নপরীক্ষা, বিষনির্ণয় ও প্রতিবিধান, স্থাপত্য, সেনা-সন্নিবেশ, শিবির নির্মাণ, যুদ্ধবিদ্যা, ধনুর্বিদ্যা এমন বাহাত্তরটি বিষয়৷ বৌদ্ধসাহিত্যের গণিকাদের মতো ধর্মের ছত্রছায়ায় গিয়ে এদেরও মুক্তিলাভ ঘটতো ঘৃণ্যজীবনের গ্লানি থেকে৷ অনেকে তার অবশিষ্ট ধন-রত্নাদি অর্থসমূহও দান করে দিত ধর্মের নামে৷ জৈনগ্রন্থ ‘বৃহৎকল্পভাত’-এ লক্ষিত হয়েছে এক গণিকা চিত্রশালা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ অনেকে আবার দরিদ্রদের মধ্যেও তাদের ধনরত্ন বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি৷ জৈনগ্রন্থ ‘বসুদেবহিণ্ডি’-তে রয়েছে পুরুষের জন্য স্ত্রীর বিকল্পের কাহিনি৷ সেখানে কৌমপতি ভরতের প্রাসাদে স্ত্রী ছাড়া একটি ভোগ্যা নারী থাকতো৷ একবার কৌমের অধীনের সকলেই তাদের নিজের নিজের মেয়েকে ভরতের প্রাসাদে ভোগের জন্য পাঠায়৷ কিন্তু অত নারীর অন্তঃপুরে স্থান সংকুলান হবে৷ তাই ঠিক হয়, এরা অন্তঃপুরের বাইরে রাজার পরিচর্যা করবে এবং এদের নিয়ে রাজার ভোগতৃষ্ণা মিটে গেলে এরা ঠাঁই পাবে ‘গণ’ বা গোষ্ঠীর কাছে; তখন এরা হয়ে উঠবে প্রকৃত গণিকা৷

মহাকাব্যে গণিকা :

হিন্দুদের অন্যতম ধর্মগ্রন্থ রামায়ণ ও মহাভারত৷ ধর্মীয় এই মহাকাব্যদ্বয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে উঠে এসেছে বহুলগণিকা প্রসঙ্গ৷

রামায়ণ :

রামায়ণের সাতটি কাণ্ডকে বিশদ পর্যবেক্ষণ করলে কাণ্ডগুলির কাহিনির সূত্র ধরে উঠে আসে ঊর্বশী, ঘৃতাচী, রম্ভা, মেনকা, হেমা ইত্যাদি বহুবিধ গণিকার নাম৷ এরা দেববেশ্যা৷ এদের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে নগরবিলাসিনী বারবধূদের প্রসঙ্গও৷

দেবযোষিৎ-অপ্সরারা দেবতাদের আনন্দ দান করে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজের জীবন দিয়ে দেবতাদের রক্ষা করে৷ কিন্তু পরিণতিতে তাদের শুধু অপমান ও লাঞ্ছনাই ভোগ করতে হয়৷

আদিকাণ্ডে অযোধ্যারাজ দশরথ পুত্রকামনায় অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলে অমাত্য সুমন্ত্রর মাধ্যমে অবগত হন ঋষ্যশৃঙ্গের কাহিনি৷ বিভাণ্ডক ঋষির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকে যজ্ঞের ঋত্বিক পদে বরণ করে যজ্ঞসমাপন করলে দ্রুত উদ্দীষ্ট ফল পাওয়া যাবে শুনে তিনি অতি শীঘ্র লোমপাদের রাজ্য থেকে তাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন৷ রাজা লোমপাদের রাজ্যে অনাবৃষ্টিজনিত বিপর্যয় দেখা দিলে তিনি—‘‘মুনি বেশধর বারাঙ্গনাগণ দ্বারা তপোবন হইতে ঋষ্যশৃঙ্গকে ভুলাইয়া আনিয়া, রাজা তাহাকে শান্তানাম্নী কন্যা সম্প্রদান পূর্বক গৃহে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তখন হইতে তাহার রাজ্যে সুবৃষ্টি হইতে থাকে৷’’২৯ এখানে বারাঙ্গনা রক্ষাকারিণীর ভূমিকায় অবতীর্ণ৷ সে যদি ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রলুব্ধ না করতো তাহলে লোমপাদের রাজ্য অনাবৃষ্টিতে ছারখার হয়ে যেত৷ অর্থাৎ অঙ্গদেশ গণিকার হাত ধরে রক্ষা পায়৷ রাম ও তার অন্যান্য ভাইদের জন্মকে কেন্দ্র করে আনন্দ উৎসব মুখরিত অযোধ্যার বর্ণনাতেও অপ্সরা-গণিকাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়৷ বানরদের জন্মকে কেন্দ্র করেও অপ্সরা প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে৷ যেমন—‘‘প্রধান প্রধান কিন্নরী, অপ্সরা, বিদ্যাধরী ও নাগ কন্যাগণের গর্ভে যে সকল পুত্র জন্মিল, তারা সকলেই কামরূপী, কামাচারী ও সিংহতুল্য পরাক্রমশালী৷’’৩০ বিশ্বামিত্র রামচন্দ্রকে কান্যকুব্জ নামের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অপ্সরা ঘৃতাচীর কথা বলেন৷ ঘৃতাচী অপ্সরার গর্ভে রাজর্ষি কুশনাভের একশত কন্যা জন্মগ্রহণ করেছিল৷ তারা অভিশপ্ত হয়ে কুব্জীকৃত হয় বলে কান্যকুব্জ হয় সেই স্থানটির নাম৷ এই কাণ্ডেরই একটি অংশে পরমাসুন্দরী ষাটকোটি স্ত্রীর উত্থানের কথা সমুদ্রমন্থন প্রসঙ্গে বিশ্বামিত্র রামের কাছে উল্লেখ করেছেন৷ বিশ্বামিত্র-মেনকার কাহিনিতে দেখা যায় ব্রাহ্মণত্ব লাভের আশায় বিশ্বামিত্রের কঠিন তপস্যা শুরু হলে—দেবগণ ভীত হয়ে তপোভঙ্গের উদ্দেশ্যে তপস্যাস্থলে মেনকা নামের পরম রূপবতী অপ্সরাকে প্রেরণ করেন৷ ধ্যান ভেঙ্গে মেনকাকে দর্শন করে মোহিত হয়ে যান বিশ্বামিত্র এবং সেই মুগ্ধতার পরিণতি স্বরূপ দশ বছর তার সঙ্গে সহবাস করার পর বুঝতে পারেন সমস্তটার দেবতাদের চক্রান্ত৷ তাই মেনকাকে পরিত্যাগ করে উত্তর পর্বতে গিয়ে পুনরায় তপস্যায় রত হন৷ সেই তপস্যা সহস্র বছর অতিক্রম করে৷ এবার ইন্দ্র হাতিয়ার করেন রম্ভাকে৷ বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভঙ্গের জন্য নির্বাচিত হয়ে ভীতা রম্ভা ইন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে—‘‘শচীপতে! বিশ্বামিত্র অতিশয় ক্রোধপরায়ণ৷ তিনি ক্রোধাগ্নি দ্বারা আমাকে ভস্মীভূত করিবেন৷ সুতরাং আমি এই কার্য সাধন করিতে পারিব না৷’’৩১ গণিকার বারণ কে কবে শুনেছে! তা স্বর্গ মর্ত্য যাই হোক না কেন৷ ইন্দ্র কন্দর্পের সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাকে যেতে রাজি করান৷ অবশেষে কন্দর্প মধুমাস তৈরি করে তাদের প্রেমশরে জর্জরিত করে সমস্ত পরিবেশ কামোপযোগী করে তুললে কন্দর্পবাণে মুগ্ধ বিশ্বামিত্র রম্ভার নিকটবর্তী হলেন কিন্তু পরক্ষণেই সমস্ত বুঝতে পেরে তাকে অভিশাপ দেন—‘‘তুমি এই তপোবনে দশ সহস্র বৎসর যাবৎ পাষাণমূর্তি হইয়া অবস্থান কর৷’’৩২ পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি স্বরূপ দেবতাদের মঙ্গল করতে গিয়ে নিজের জীবনে চরম অমঙ্গল ডেকে আনে রম্ভা৷ আর এই রম্ভা যে দেবতাদের অভীষ্টসিদ্ধ করতে গিয়েই দশ সহস্র বছর পাষাণ হয়ে পড়ে থাকলো তার খোঁজ নেওয়া কারও দরকার মনে হয় না৷

অযোধ্যাকাণ্ডে রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের সময়ে নর্তকী ও বিলাসিনী রমণীদের উল্লেখ আছে৷ বনে গমনের সময় শারীরিক অসুবিধাবোধে রামচন্দ্র যাতে কাতর না হয় সেই দিকে লক্ষ রেখে স্বয়ং রামচন্দ্রের পিতা সুমন্ত্রকে বলেন—‘‘রামের অনুরক্ত বন্ধুগণ ও বিলাসিনী রমণীরা প্রভূত ধন লইয়া অনুগমন করুক৷’’৩৩ অরণ্যকাণ্ডে বনগমনের সময় রামচন্দ্র সীতাকে নিয়ে তপোবনের ভিতর দিয়ে চলতে গিয়ে একটি ‘তরাগ বা দীর্ঘিকা’ দেখতে পান৷ মানুষজনহীন সেই স্থানে মধুর বাদ্য ধ্বনি শ্রবণ করে আশ্চর্যাম্বিত হয়ে রাম ধর্ম্মভৃৎ নামক মুনিকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সেই মুনি রামকে এক কাহিনি শোনান৷ তিনি বলেন ‘‘এই তরাগ মাণ্ডকর্ণী মুনির নির্মিত৷ এই জলাশয় মধ্যে তিনি কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন ছিলেন৷ পরে দেবগণ তাঁহার তপোভঙ্গের জন্য পাঁচজন অপ্সরাকে পাঠাইয়া দেন৷ মুনি সেই অপ্সরাগণের রূপে মুগ্ধ হইয়া জলাশয়ের মধ্যে গৃহনির্মাণ পূর্বক তাহাদের সহিত বিহার করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন৷ এইজন্য এই জলাশয়ের নাম পঞ্চাপ্সর৷ জলমধ্যস্থ সেই অপ্সরাগণের মধুর সঙ্গীত ও বাদ্যধ্বনি শুনা যাইতেছে৷’’৩৪

কিস্কিন্ধাকাণ্ডে মহাপরাক্রমশালী বানররাজ বালী, তার মৃত্যুর পর সুগ্রীব রাজা হলে সুগ্রীবের ভোগ-বিলাসময় রমণী সম্ভোগের দৃষ্টান্ত রামায়ণে লক্ষ করা যায়৷ এই অধ্যায়েই অপহৃতা সীতার অনুসন্ধান করতে গিয়ে হনুমান অঙ্গদ ইত্যাদি পরাক্রমী বানরবীরেরা ঋক্ষবিলে উপস্থিত হলে সেখানে উঠে আসে হেমা নামক এক অপ্সরার প্রসঙ্গ৷ সেই স্থানের রক্ষিয়ত্রী হেমার সখী স্বয়ম্প্রভা৷ নর্তকী স্বয়ম্প্রভা বানরগণকে জানায় দীর্ঘদিন আগে তপস্যায় ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে তার বরে ময়দানব দানবদের বিশ্বকর্মা হয়েছিল৷ সেই ঋক্ষবিল সংলগ্ন স্থানে কাঞ্চনবর্ণের বন, গৃহ এবং প্রাসাদ নির্মাণ করে৷ পরে অপ্সরী হেমার প্রতি আসক্তির কারণে ইন্দ্রের হাতে তার প্রাণ গেলে ব্রহ্মার মধ্যস্থতায় ময়দানবের সবকিছু হেমার অধিকারে আসে৷ আর হেমাই সে কাঞ্চনপুরীর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয় স্বয়ম্প্রভার হাতে৷

সুন্দরকাণ্ডে হনুমান সীতার খোঁজে লঙ্কায় হাজির হলে সেখানে রাবণের প্রাসাদে, কক্ষে, ভোজনগৃহে সর্বত্রই নারী-সম্ভোগের এক বিচিত্র লীলা লক্ষ করে৷ লঙ্কাকাণ্ডে রাবণের স্ত্রীসঙ্গমে অক্ষমতা প্রসঙ্গে উপস্থাপিত হয় রম্ভার অভিশাপের কথা৷ ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় উত্তরকাণ্ডে৷ বরলাভে বলীয়ান হয়ে অহঙ্কারী রাবণের ঔদ্ধত্য যে কি পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল তা বোঝাতে গিয়ে অগস্ত্যমুনি রামকে শোনান রম্ভার সেই কাহিনি৷ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল জয়গর্বী রাবণ মধুদৈত্যের পুরী থেকে আতিথ্য সেরে ফেরার পথে কৈলাস পর্বতে সেনা সন্নিবেশ করে সামান্য ক্লান্তি অপনোদনের জন্য৷ সৈন্যদের বিশ্রামের অবসরে গিরিশিখরে একাকী বসে স্নিগ্ধ চন্দ্রমার সুমধুর আমোদে কামাতুর হয়ে পড়ে বলীয়ান রাবণ৷ আর ঠিক ঐ সময়েই অভিসারিকা রম্ভা ওই পথে প্রিয়সঙ্গমের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল৷ রাবণ তার পথ রোধ করে তাকে আহ্বান করে কাম তৃপ্তির জন্য৷ রম্ভা তা প্রত্যাখ্যান করে রাবণকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বলে যে, সে তার ভাই কুবেরের পুত্র নলকুবেরের প্রেমিকা এবং তার পুত্রবধূ৷ কিন্তু কামোন্মত্ত রাবণ ভ্রাতুষ্পুত্রের প্রেমিকাকেও তার দুর্বার কামনা থেকে রেহাই দেয়নি৷ আর দেবেই বা কেন! রম্ভা বহুপুরুষ পরিচর্যাকারী৷ পুরুষকে যৌন আনন্দ দেওয়াই তার কাজ৷ তাই রাবণ তাকে বলে—‘‘তুমি যদি এক ব্যক্তিতেই নিষ্ঠাবতী হইতে, তবে তোমাকে পুত্রবধূ মনে করিতে পারিতাম৷ বিশেষতঃ অপ্সরাগণের নির্দিষ্ট পতি নাই৷’’৩৫ এ কথা বলেই কামার্ত রাবণ শিলাতলে স্থাপন করে বলপূর্বক রম্ভাকে ধর্ষণ করে৷ বহুপুরুষ পরিচর্যাকারী রমণীর ভালোলাগা-না লাগার, ইচ্ছে-অনিচ্ছে ও সম্পর্কের মূল্য সমাজরক্ষক পুরুষ মানুষের নেই৷ তাই রম্ভা তার খুল্লতাত শ্বশুরের কামনা থেকে রেহাই পায় না৷ উত্তরকাণ্ডেই অশোকবনে রাম-সীতার প্রমোদ উদ্যানে সুন্দরী রমণী, কিন্নরী, অপ্সরীদের নৃত্যগীত পরিবেশনের কথা আছে৷ আর এইভাবে রামায়ণের বিভিন্ন কাণ্ডের বিভিন্ন অংশে দেবযোষিৎ নারীদের সঙ্গে সাধারণ গণিকাশ্রেণীর নারীদের কথা বর্ণিত হয়েছে৷

রামায়ণের নায়ক রাম আদর্শ পুরুষচরিত্র৷ সেখানে সৎ, ধার্মিক, চরিত্রবান রাজা দশরথ, রামচন্দ্র ইত্যাদি চরিত্রগুলি গণিকাসম্ভোগের বাধাহীন অধিকার এবং বিধি-নিষেধহীন নিরঙ্কুশ কালযাপন প্রসঙ্গে ‘প্রাচীন ভারতে গণিকা’ প্রবন্ধে কঙ্কর সিংহ বলেছেন—‘‘রামের সাথে ধর্মপত্নী সীতা ছিলেন৷ তারপরেও পুত্রের গণিকার প্রয়োজন হতে পারে মনে করার মধ্যে আদি কবি বাল্মীকি কোনও অধর্ম খুঁজে পাননি৷ কারণ এটাই ছিল তখন রাজা এবং রাজপুত্রদের জীবন ধারণের প্রথা৷’’৩৬

মহাভারত :

রামায়ণের মতো মহাভারতেও নর্তকী অপ্সরা থেকে শুরু করে প্রচুর বারবনিতা, দাসী গণিকার উল্লেখ রয়েছে৷ অর্জুনের জন্মকে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে নর্তকী, গায়িকা এবং দেবতাদের মনোরঞ্জনকারী ঊনচল্লিশজন অপ্সরার নাম৷ তাদের মধ্যে সদ্যজাত অর্জুনকে ঘিরে নৃত্য পরিবেশন করেছিল অনুচানা, অনবদ্যা, গুণমুখ্যা, গুণাবরা, অদ্রিকা, সোমা, মিশ্রকেশী, অলম্বুষা, মারীচি, শুচিকা, বিদ্যুৎপর্ণা, তিলোত্তমা, অম্বিকা, রম্ভা প্রমুখরা৷ গায়িকা হিসেবে সঙ্গীত পরিবেশন করেছে মেনকা, ঊর্বশী, পুঞ্জিকস্থলা, ঋতস্থলা, কর্ণিকা, ঘৃতাচী, বিশ্বাচী, পূর্বচিত্তি, উম্লোচা, প্রম্লোচা প্রমুখরা৷ এরা সকলেই দেবসভার বিনোদিনী৷ কখনো কোনো অসুর অশুভ ইচ্ছায় ক্রমশক্তিশালী হয়ে দেবতাদের পরাজিত করার অভিপ্রায়ে যদি কঠিন তপস্যায় মগ্ন হয়, তাদের অভিলাষকে ব্যর্থ করে দিতে দেবতাদের দ্বারা প্রেরিত হয় এরা৷ ঊর্বশী, রম্ভা, মেনকা, তিলোত্তমা এদের ক্ষেত্রে বহুবার এমন ঘটনা ঘটেছে৷ দেবতাদের মনোরঞ্জনকারিণী এই দেবযোষিৎরা নিজেদের সামান্যতম ভুল হলেই দৈবকোপে মর্ত্যে নিক্ষিপ্ত হয়৷ আবার কখনো কখনো দেখা যায় দেবতারা উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তাদেরই গুপ্ত ষড়যন্ত্রে পদস্খলন ঘটিয়ে অপ্সরীদের মর্ত্যে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করেছে৷ ঊর্বশী, মেনকা, অদ্রিকার সঙ্গে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছিল৷

নিজস্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে দেবকুল কীভাবে এই নারীদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে এমন দৃশ্য দেখা যায় মেনকা-বিশ্বামিত্রের কাহিনিতে৷ পুরাকালে ব্রাহ্মণত্ব অর্জনের জন্য মহর্ষি বিশ্বামিত্র তপস্যা আরম্ভ করলে ইন্দ্র শঙ্কিত হয়ে উঠে৷ মেনকাকে তাঁর তপস্যা ভঙ্গ করে প্রদেয় ফল থেকে বঞ্চিত করতে আদেশ করে৷ মহাতেজস্বী ও কোপনস্বভাব ঋষি বিশ্বামিত্র রুষ্ট হলে চরম থেকে চরমতম দণ্ড দিতে পারেন৷ এই চিন্তায় বিচলিত হয়ে উঠে দেববেশ্যা এই নারী৷ তাই সে কাতরভাবে ইন্দ্রকে জানায় ‘‘যিনি আপন তেজে ত্রিজগৎ দগ্ধ করতে পারেন, পদাঘাতে পৃথিবীকে বিচলিত করতে পারেন, মহামেরু পর্বতকে ক্ষুদ্র পর্বত করে দিতে পারেন এবং দিক সকলকেও হঠাৎ পরিবর্তিত করে দিতে পারেন৷… সেই বিশ্বামিত্রকে আমার মতো রমণীই বা কীভাবে স্পর্শ করবে?… আমার মতো তুচ্ছ নারী তাঁকে ভয় পাবে না কেন?’’৩৭ মেনকার কাতর সংশয় ইন্দ্রকে বিচলিত করে না৷ সে তার সংকল্পে স্থির থাকে৷ তখন নিজের সুরক্ষার জন্য মেনকা নিবেদন করে—‘‘দেবরাজ আপনি আদেশ করলে আমাকে বিশ্বামিত্রের কাছে যেতেই হবে৷ অতএব আপনি আমার রক্ষার বিষয় স্থির করুন৷ যাতে আমি রক্ষিত অবস্থায় আপনার কার্যসম্পাদন করতে সমর্থ হই৷ আমি যখন বিশ্বামিত্রের কাছে গিয়ে নৃত্যরত অবস্থায় খেলা করব, তখন যেন বায়ু আমার অঙ্গ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে বস্ত্র সরিয়ে দেন এবং আপনার আদেশে কামদেব আমাকে যথেষ্ট সহায়তা করেন৷ আর, আমি যখন মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে প্রলুব্ধ করতে থাকব, তখন বন থেকে যেন যথেষ্ট পরিমাণে সুগন্ধ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকে৷’’৩৮

অপ্সরা তিলোত্তমার কথা জানা যায় সুন্দ-উপসুন্দের কাহিনিতে৷ সুন্দ-উপসুন্দ ব্রহ্মার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে দেবগণের ত্রাস হয়ে উঠে৷ অত্যন্ত সৌহার্দ্যপরায়ণ এবং পরস্পরের প্রতি অনুগত দুইভাই নিজেদের আত্মকলহে হত না হলে কেউ তাদের বধ করতে পারবে না এই ছিল তাদের প্রতি ব্রহ্মার আশীর্বচন৷ পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষহীন অভিন্ন হৃদয়ের দুই ভাই-এর কলহের কোনো কারণও ছিল না৷ ধরতে গেলে তারা অমরই৷ আর এই সুবিধা নিয়ে মহানন্দে দেবকুলকে বিধ্বস্ত করে তারা জীবন কাটাতে থাকে৷ অসহায় স্বর্গবঞ্চিত দেবতারা উপায়ন্তর না দেখে ব্রহ্মার স্মরণাপন্ন হলে তাঁরই নির্দেশে—‘‘ত্রিলোকী মধ্যে দর্শনীয় পরম রমণীয় যে সমস্ত স্থাবর-জঙ্গম পদার্থ আছে; বিশ্বকর্মা তৎসমুদয় আহরণপূর্বক দেবরূপিণী এক কামিনী সৃজন করিয়া তাহার অঙ্গপ্রতঙ্গ সমুদয় গাত্রে কোটি কোটি রত্নে অলঙ্কৃত করত তাহাকে রত্ন সংঘাতময়ী নির্মাণ করিলেন৷… মূর্তিমতী লক্ষ্ণীর ন্যায় কামরূপিণী সেই সীমন্তনী প্রাণী মাত্রেরই নয়ন মনের অপহারিণী হইল৷’’৩৯ বিশ্বকর্মা জগতের সকল রত্ন সংগ্রহ করে তিল তিল করে তার কায়ানির্মাণ করেছিলেন বলে তার নাম হয় তিলোত্তমা৷ নামকরণ করার পর ব্রহ্মা তাকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বলেন—‘‘তিলোত্তমা! তুমি সুন্দ ও উপসুন্দ, দুই অসুরের নিকট গমন কর; তথায় যাইয়া তোমার কমনীয় রূপ দ্বারা তাহাদিগকে প্রলভ জন্মাইতে যত্নবতী হও৷’’৪০ ব্রহ্মার আদেশমত তিলোত্তমা তার অসামান্য রূপের বাহার নিয়ে সুরাগ্রস্ত দুই ভাই-এর সম্মুখে উপস্থিত হলে তাকে স্ত্রীরূপে পাওয়ার জন্য দুই ভাই আত্মকলহে লিপ্ত হয়৷ শেষপর্যন্ত দুজন দুজনকে হত্যা করে খান্ত হয়৷ তিলোত্তমার কৃতকর্মের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দেবগণ শ্রেষ্ঠ অপ্সরার সম্মান দিয়ে তাকে সূর্যলোকে পাঠিয়ে দেয়৷ দেবতাদের রক্ষাকারিণী রূপান্তরিত হয় তাদের মনোরঞ্জনকারিণীতে৷ এখানে কামরূপিণী দুই দৈত্যের মধ্যে প্রবল কামতৃষ্ণা জাগ্রত করেছে তিলোত্তমা তার অপরূপ সৌন্দর্য দিয়ে৷ আর কামান্ধতা অর্থাৎ সৌন্দর্যময়ী নারীর দেহ সুধা পানের তীব্র বাসনাই হিতাহিত জ্ঞান লোপ করে তাদের মৃত্যু ডেকে এনেছে৷ মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডবের সাথে দ্রৌপদীর বিয়ে হলে পাঁচ ভাই-এর এক স্ত্রীকে সুষ্ঠুভাবে বন্টনের পরামর্শ দিয়ে নারদ যুধিষ্ঠিরকে এই কাহিনি শুনিয়েছিলেন৷

‘মহাভারত’-এ অপ্সরাদের স্থূলদেহকামনার সঙ্গে বাছবিচারহীন যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চিত্র ফুটে উঠেছে ঊর্বশী-অর্জুনের সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে৷ স্বর্গরাজ্যে ত্রাস সৃষ্টিকারী অসুর কলিকেয় ও নিবাতকবচকে বধ করার জন্য অর্জুন ইন্দ্রের সন্তুষ্টি লাভ করে ইন্দ্রপুরীতে আতিথ্য নিলে তার মনোরঞ্জনের জন্য ইন্দ্রদেব আয়োজন করে নৃত্য-গীতের৷ নৃত্যসভার নৃত্য-বর্ণনায় উঠে এসেছে বহু অপ্সরার নাম৷ সেখানে নৃত্য পরিবেশনকালে অর্জুন ঊর্বশীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে ইন্দ্র রূপমুগ্ধতার আভাস পেয়ে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের দ্বারা ঊর্বশীকে অর্জুনের সেবার জন্য অর্জুনের কক্ষে প্রেরণ করে৷ ঊর্বশী দেহসুখের বাঞ্ছা নিয়ে অর্জুনকে বলে—‘‘আমি তোমার শুশ্রুষা করিবার নিমিত্ত সমাগত হইয়াছি, তোমার গুণসমূহে আমার চিত্ত আকৃষ্ট হইয়াছে; অতএব তোমাকে শুশ্রুষা করা আমার চিরাভিলাষিত মনোরথ৷’’৪১ ঊর্বশী তার কামনারাজি নিয়ে হাজির হলেও অর্জুন তাকে পৌরববংশীয় আদি জননী জ্ঞানে প্রত্যাখ্যান করলে কামতাপিত ললনা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে—‘‘হে বীর দেবরাজ নন্দন! আমরা সকলে কাহারও আবৃতা নহি, অতএব আমাকে গুরুস্থানে নিযুক্ত করা তোমার উচিৎ হয় না৷ পুরুরাজার বংশে যে সকল পুত্র বা নপ্তা তপস্যা দ্বারা এখানে আগমন করিয়াছেন, তাহারা সকলেই আমাদিগের সহিত ক্রীড়া করিয়া থাকেন, আমাদিগের প্রতি তাহাদিগের ব্যতিক্রমা ভাব নাই৷ অতএব তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও৷ হে মানপ্রদ! আমি মন্মথানলে সন্তপতা ও পীড়িতা হইয়াছি, আমাকে পরিত্যাগ করা তোমার উচিৎ হয় না৷’’৪২ এর পরেও অর্জুন যখন তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে সীমাহীন শ্রদ্ধা দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে রাখে তখন কামজর্জর নারীর স্থূল দেহকামনা হিংস্ররূপে প্রতিভাত হয়ে অর্জুনকে অভিশাপ দেয়—‘‘হে পার্থ আমি তোমার পিতার অনুজ্ঞাহেতু স্বয়ং তোমার গৃহে আসিয়াছি, বিশেষত আমি কন্দর্পের বশবর্তিনী হইয়াছি; এমতস্থলে তুমি আমার প্রতি অভিনন্দন করিলে না, অতএব তুমি পুরুষত্বহীন রূপে বিখ্যাত, মানহীন ও নর্তক হইয়া স্ত্রীগণ মধ্যে ক্লীবের ন্যায় বিচরণ করিবে৷’’৪৩

এছাড়াও মহাভারতের আদিপর্বে দ্রৌপদীর বিবাহের যৌতুকের সঙ্গে একশত সুন্দরী তরুণী দেওয়া হয়েছিল, সুভদ্রার বিবাহে অতিথিদের স্নান, সুরাপান, সেবাযত্নের জন্য এক হাজার সুন্দরী তরুণী নির্দিষ্ট ছিল৷ গান্ধারী গর্ভবতী হয়ে স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের শুশ্রূষা থেকে বিরত হলে বিকল্প হিসেবে রাজা ধৃতরাষ্ট্র গণিকা পরিবেষ্টিত হয়৷ উদ্যোগপর্বে যুদ্ধের আগে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির গণিকাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন৷ যুধিষ্ঠির যখন অশ্বমেধপর্বে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন সেই যজ্ঞে তিনি নিজে দানে, দক্ষিণায় বহু নারীকে রাজ অতিথি ও পুরোহিতের সেবার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন৷ দ্রোণপর্বে ভগীরথের হাজারে হাজারে নারীদান কথা যেমন আছে তেমনি রাজা শশবিন্দু তাঁর অশ্বমেধ যজ্ঞেও বহু সহস্র নারী দান করেছিল৷ এই পর্বেই যুদ্ধক্ষেত্রে কর্ণ ঘোষণা করেছিল যে কেউ যদি অর্জুনকে চিনিয়ে দেয় তাহলে তাকে একশত সুন্দরী দান করবে৷ বনে যাওয়ার সময় পাণ্ডবদের সাহচর্যের জন্য, সৈন্যদের বিনোদনের জন্য অনেক গণিকা সঙ্গে গিয়েছিল, বনপর্বে এর উল্লেখ আছে৷ বীরের মতো যুদ্ধ করে প্রাণ ত্যাগ করলে স্বর্গে গিয়ে বহুসংখ্যক সুন্দরী নারী ভোগ করা যায় তার কথাও এই পর্বে ব্যক্ত হয়েছে৷ আর অনুশাসন পর্বেও প্রায় এ ধরনের কথাই আছে, যথা ব্রাহ্মণকে সুন্দরী তরুণীদান করলে স্বর্গে বহু সংখ্যক অপ্সরার দ্বারা সে পরিতৃপ্ত হবে৷ বনপর্বে অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পরাজিত পক্ষের স্ত্রীদের জয়লব্ধ অন্যান্য সম্পদের মতোই সঙ্গে করে নিয়ে আসে৷ অর্জুনের জয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বিরাট পর্বে রাজা বিরাট তাকে পারিতোষিক দিয়েছিল বহুসংখ্যক নারী৷ মহাভারতের শান্তি পর্বে রয়েছে নারী দান না করা রাজাদের নিন্দার কথা৷ ‘‘যে রাজা সুন্দরী নারী দান করেন না তাঁর নিন্দাসূচক নাম ‘রাজকলি’, অর্থাৎ রাজাদের মধ্যে কলিস্বরূপ৷’’৪৪

এভাবে রামায়ণ মহাভারতের বিভিন্ন অংশে লক্ষিত হয় যে উৎসবে, যুদ্ধ জয়ে, যজ্ঞে নারীকে বস্তুর মতোই দান করা হত৷ আর যাদের দান করা হত তারা স্বাভাবিকভাবেই গণিকানারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতো৷ আর এদের দেহের বিনিময়ে, জীবনের মান-সম্মানের বিনিময়ে পুণ্য অর্জন করতো তৎকালীন রাজা-মহারাজা তথা সমাজপতিরা৷ এই অসহায়া নারীদের শেষপর্যন্ত কি পরিণতি হত তা ভেবে দেখার অবকাশ তাদের ছিল না৷ পুণ্যবান পুরুষেরা ইহলোকে নারীভোগ করে, নারী দান করে পরলোকে অপ্সরারূপী নারীদের লাভ করতো তাদের ভোগবাসনাকে সচল রাখার জন্য৷ আর এ থেকে সহজেই বোঝা যায় পৃথিবীর গণিকাদের কাল্পনিক রূপায়ণ স্বর্গের অপ্সরাদের মধ্যেই৷ আর এই দান হয়ে যাওয়া নারীদের মর্মান্তিক পরিণতির কি হত তা কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ ‘‘বোঝা যায় ঋত্বিক-পুরোহিতদের সাধ্য ছিল না এতগুলি নারীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়ার৷ অতিশয়োক্তি বাদ দিলেও তো এদের সংখ্যা শঙ্কাবহরূপে বেশি, কাজেই কিছুদিন পরেই এরা ক্রীতদাসী বা গণিকায় পরিণত হত৷ এবং ব্যাপারটা ঘটত ধর্মযাজকদের মাধ্যমেই, কারণ, এ সব দক্ষিণার গ্রহীতা তাঁরাই৷ অন্য যাঁরা, অতিথি বন্ধু প্রিয়জন, উৎসবে বা কোনও উপলক্ষে দানস্বরূপে অনেক নারী লাভ করতেন তাঁরাও নিশ্চয়ই এদের অনেককেই বিক্রি করতেন দাসীত্বে বা গণিকাত্বে৷ এ ছাড়াও অন্য বহু সূত্র ধরে নারী আসত গণিকালয়ে৷’’৪৫

মঙ্গলকাব্যে গণিকা প্রসঙ্গ :

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে মঙ্গলকাব্যগুলি৷ এই সাহিত্য ধারাতেও গণিকা চরিত্রের উপস্থিতি কম নয়৷

মনসামঙ্গলকাব্যে উল্লেখ রয়েছে দেবাপ্সরা ঊষার প্রসঙ্গ৷ মনসার প্রভাব-প্রতিপত্তি তথা পূজাকে মর্ত্যলোকে প্রচার করার জন্য ঊষাকে দৈব ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজের প্রেমাস্পদ অনিরূদ্ধকে ছেড়ে মর্ত্যে জন্ম নিতে হয়৷ এখানে দেবতা কর্তৃক বিতাড়িত নির্দোষ ঊষাকে সীমাহীন লাঞ্ছনা-যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে৷

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে নারীর সতীত্ব সম্পর্কিত উপদেশ দিতে গিয়ে ফুল্লরা ছদ্মবেশিনী চণ্ডীকে শুনিয়েছে বেদবতী-লক্ষহীরার কাহিনি৷ এটি এক পৌরাণিক কাহিনি৷ বেদবতী পতিব্রতা সাধ্বী স্ত্রী৷ তার গলিতদেহ স্বামীর মনস্কামনা সিদ্ধ করতে স্বামীর রোগজর্জর দেহ কাঁধে করে গণিকা লক্ষহীরার অঙ্গনে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ বারবধূ লক্ষহীরাকে বহুপরিচর্যাকারিণী হওয়ার সুবাদে গ্রহণ করতে হয়েছিল রোগজর্জ্জরিত সেই গলিত পুরুষদেহটিকেও৷

‘‘বেদবতী নামে দারা পতি যার শতশিরা অবিরাম শরীর গলিত৷

পতিব্রতা হয় যেবা তেন মতি করে সেবা স্বামীর পালন করে নিত৷৷

একদিন বেদবতী কান্দে করি নিজপতি গঙ্গাস্নান করিবারে যায়৷

গঙ্গার ওকুল ধারে অঙ্গ মার্জন করে বারবধূ দেখিবারে পায়৷৷

দৈবযোগে এক দিনে দেখাদেখি দুইজনে হাস্যরসে দুজনে কথনে৷

বেদবতী বলে বাণী হর্ষ বারনিতম্বিনি ভাগ্য করি সে মানিল মনে৷৷

মুনি বলে শুন সতী যদি বা ভুঞ্জাহ রতি বারবধূ লক্ষহীরা সনে৷

সতী নিতি দাবীঘরে অঙ্গ মার্জন করে বেশ্যা বিস্ময় ভাবে মনে৷৷

মানিল মানসম্পূর্ণ নিজাগারে যায় তূর্ণ কান্দে করি স্বামী লয়্যা যায়৷

পতির পূরিতে আশ বারবনিতার পাশ পতিব্রতা লয়্যা যায়স্বামী৷৷’’৪৬  

মধ্যযুগীয় সমাজ পরিবেশে সতী রমণীদেরও যেমন সতীত্বের পরীক্ষা দিতে দিতে দুর্দশার অন্ত থাকতো না তেমনি গণিকা নারীরাও সমাজে সর্বস্তরের সর্বশ্রেণীর মানুষের সঙ্গে সঙ্গমে বাধ্য হত৷

যৌন চাহিদা পূরণের জন্য তখনও যে গণিকার প্রয়োজন হত বা গণিকারা নির্দিষ্ট পল্লীতে অবস্থান করে পুরুষের প্রবৃত্তির দাহকে শান্ত করতো অর্থের বিনিময়ে তার উল্লেখ রয়েছে কবিকঙ্কনের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ৷ যেমন—

 ‘‘লম্পট পুরুষ আশে বারবধূগণ বৈসে

 একভিতে তার অধিষ্ঠান’’৪৭

বাংলা মঙ্গল কাব্যধারায় ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের মধ্যেও লক্ষ করা যায় গণিকা চরিত্রের অবাধ বিচরণ৷ ষোড়শ-সপ্তদশ শতাধীতে মূলতঃ এই কাব্যধারার সূচনা৷ পরবর্তীসময়ে বহু কবির হাত ধরে এ কাব্য বিকাশ লাভ করে৷ এর আদি কবি হিসেবে ময়ুরভট্টের নাম পাওয়া গেলেও রূপরাম চক্রবর্তী এবং ঘনরাম চক্রবর্তী এঁরা ‘ধর্মমঙ্গল’-এর আদর্শ কবি৷ সমগ্র ধর্মমঙ্গল কাব্য পর্যালোচনা করলে গণিকা চরিত্র ও তাঁদের জীবনাচরণ এবং সামাজিক অবস্থানের যে রূপ ফুটে ওঠে তা স্বাভাবিক ও বাস্তবসম্মত৷ আলোচ্য কাব্যে ধর্মঠাকুরের পূজা প্রচারের উদ্দেশ্যে ঘটনা ও চরিত্রের সাজুয্য বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন চরিত্ররা এসে ভিড় করেছে৷ কাহিনির শুরুতেই দেখা যায় ইন্দ্রপুরের অপ্সরী অম্বুবতীকে৷ স্বর্গের দেবতাদের মনোরঞ্জন করে যার জীবন অতিবাহিত এবং দেবইচ্ছা পূরণের জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও মর্ত্ত্যে জন্ম নিতে হয়৷ কীভাবে ছল করে দেবতারা তাঁকে মর্ত্ত্যে পাঠানোর ষড়যন্ত্র করে তার উল্লেখ রয়েছে এইভাবে—

 ‘‘অম্ববতী নামে আছে ইন্দ্রের নাচনী৷৷

 তারে যদি অভিশাপ দেহ কোন ছলে৷

 তবে সে প্রকাশ পূজা অবনীমন্ডলে৷৷

 ধরণীমন্ডলে নাম হব রঞ্জাবতী৷

 রূপে আল দশদিগ প্রকাশিব ক্ষিতি৷৷’’৪৮

এখানে দেবতাদের কার্যকলাপে বাধ্য হয়ে মনুষ্য জীবনে প্রবেশ করা অপ্সরী অম্বুবতী প্রতিনিধিত্ব করছে সমাজের বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকার অসহায় নারীকুলের আর দেবতারা শোষক-পীড়ক৷ তবুও অম্বুবতীকে রঞ্জাবতী বানানোর জন্য দেবতাদের দরকার কোনো না কোনো অছিলার নতুবা তাদের দেবত্ব কলুষিত হতে পারে৷ তাই তাঁরা যত্নবান হয় অপ্সরীর দোষ খুঁজতে৷ আর এক্ষেত্রে জগতজননী দেবী পার্বতী জরাতী ব্রাহ্মণীর বেশে তাকে ছলনা করতে যায়৷ স্বর্গ সভায় নৃত্যের জন্য লাসবেশ ধারণের পূর্বে নর্মদার ঘাটে স্নান করতে গিয়ে নটী অম্বুবতী ঘাট আগলে বসে থাকতে দেখে সেই জরাতী ব্রাহ্মণীকে৷ সে নৃত্যের দেরি হয়ে যাবে বলে তাকে ঘাট ছাড়তে বললে তখন ব্রাহ্মণী তা অস্বীকার করে৷ বাধ্য হয়ে তাঁকে উপেক্ষা করে যৌবনের গর্বে হাসতে হাসতে ঘাট অতিক্রম করে জলে ঝাঁপ দিলে অপ্সরীর পায়ের জল বৃদ্ধার শরীরে এসে লাগে আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বৃদ্ধাবেশী গণেশের মা বলে উঠে—

 ‘‘অভিশাপ দিলুঁ আমি চল বসুমতী৷

 বুড়া দেখি হাসিলে পাইবে বুড়া পতি৷৷

 মানবের ঘরে জন্ম পাবে বড় দুখ৷

 সাত জন্ম মরিলে দেখিবে পুত্র মুখ৷৷’’৪৯

এরপর অদৃশ্য হয়ে যায় ছদ্মবেশী বৃদ্ধা৷ সামান্য এক ভুলে গুরুদণ্ড পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অম্বুবতী নৈরাশ্য ও শঙ্কায় চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দেয়৷ তবু বসে থাকলে তার চলবে না৷ তাই মনে যন্ত্রণার পাহাড় চাপিয়েও তাকে ধারণ করতে হয় নয়ন মনোহর বেশ, মুখে ফুটাতে হয় হাসি, পায়ে ছন্দের নূপুরনিক্কণ৷ কারণ তাদের ব্যক্তিত্বের কোনো মূল্য নেই, দুঃখ কষ্টের কোনো পরোয়া নেই৷ একমাত্র মূল্য তাদের রূপ, কামনা উদ্রেককারী লাস্যভঙ্গির৷ ভগ্নমনোরথ হয়ে লাসবেশে কৃত্রিম কটাক্ষ নিয়ে যখন সে দেবসভার উদ্দেশ্যে বের হয়, অনুভব করে চারিদিকের অমঙ্গল জনক সংকেত, যেমন ঘরের চাল মাথায় ঠেকে যাওয়া, পায়ে কাপড়ের জট লাগা, ডান চোখ নাচা, সে অনুভব করে ভয়ানক এক পরিণতির৷ এভাবে সমস্ত বাধা বিঘ্নকে দূরে সরিয়ে তাকে সুরের মূর্ছনায় অঙ্গচালনা করতে হয়৷ কিন্তু কতক্ষণ! যেখানে তার মন অস্থির হয়ে আছে পূর্বের সেই অভিশাপবাণীতে, বিভিন্ন অশুভ ইশারায়, সেখানে কতক্ষণ ধরে রাখতে পারা যায় নিজের মনোসংযোগকে! তাই শত চেষ্টা সত্ত্বেও একসময়—

 ‘‘তালভঙ্গ হৈল তার দেখিতে দেখিতে৷

 আপনা হারাল্য নটী নাচিতে নাচিতে৷৷’’৫০

দেবরাজ্যে এহেন ভুলের কোনো ক্ষমা হয় না তাই অম্বুবতী তার তালের সঙ্গে সঙ্গে চ্যুত হয় স্বভূমি৷ নেমে আসে মর্ত্যের সমস্যাদীর্ণ ধুলোমাটির মধ্যে৷

এরপর অভিশপ্ত অম্বুবতীর রঞ্জাবতী রূপে জন্মগ্রহণ, বৃদ্ধ স্বামী কর্নসেনের সঙ্গে বিবাহ, ‘শালেভর’ দিয়ে সন্তান লাভ ইত্যাদি নানা ঘটনা৷ রঞ্জার সেই সন্তানই হল ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের নায়ক চরিত্র লাউসেন, যে কিনা ধর্মঠাকুরের আশীর্বাদপুষ্ট এবং সদা ধর্মব্রতধারী৷ আলোচ্য কাব্যের ‘আখড়া পালা’-য় বর্ণিত হয়েছে দেবী পার্বতীর লাউসেনকে ছলনা করার জন্য বেশ্যা রূপ ধারণ প্রসঙ্গ৷ আশ্বিন মাসে শারদোৎসবে যখন ত্রিভুবন মেতে উঠে তখন দেবী দূর্গা পদ্মাকে সঙ্গী করে নিজের পূজা দেখতে বের হয়৷ বিভিন্ন স্থানে সন্তুষ্ট চিত্তে পূজা পর্যবেক্ষণ করে লক্ষ্য করে ময়না নগরের সুসজ্জিত রূপকে৷ কিন্তু এই নগরের কোথাও দেবীর আরাধনার লেশমাত্র চিহ্ন দেখতে পায় না এবং পদ্মার কাছে জানতে পারে ময়না নগর সম্পূর্ণভাবে ধর্ম ঠাকুরের উপাসক৷ সেখানকার কুমার লাউসেন ধর্ম ঠাকুরের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় সে ধর্মঠাকুর ছাড়া আর কারো আরাধনা করে না৷ ঈশ্বরী পদ্মার মুখে এহেন কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেয় লাউসেনকে ছলনা করার৷ তাই পদ্মাকে বলে—

 ‘‘বেউশ্যার বেশ ধরি করিব গমন৷

 অবশ্য ছলিব আজি লাউসেনের মন৷৷’’৫১

সমাজে গণিকাদের ভালবাসার যথার্থ মূল্য নেই৷ দেহ জীবিকার জন্য তাদের সর্বদা আশ্রয় নিতে হয় ছলনার৷ কপট ভালবাসা দেখিয়ে বশ করতে হয় পুরুষকে৷ আর একাজে তাদের সহায়তা করে দৈহিক সৌন্দর্য্য, বিভিন্ন অলংকার-প্রসাধনী ও কাম উদ্রেক করার মত পোশাক পরিচ্ছেদ ও অঙ্গচালনা৷ দেবীও তাই যথার্থ গণিকারূপ ধারণ করার উদ্দেশ্যে সুসজ্জিতা হয়েছেন লাউসেনের চোখে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য৷ যেমন—

 ‘‘শঙ্খের উপর বাজুবন্ধ ছড়া ছড়া৷

 নাপান করিতে চান দিয়া হাথ নাড়া৷৷

 কৌতুকে পরিল অপূর্ব কাঁচলি৷৷’’

অথবা

 বাছিয়া বসন পরে নাম গুয়াঠুটি৷

 বাইশ গজ বসন বাঁ হাথে হয় মুঠি৷৷

 লাসের উপরে বেশ তায় দিল চুয়া৷

 নাপান করিয়া খান গোটা দশ গুয়া৷৷

 চরনে নূপুর দিল অঙ্গে সুধাকর৷

 লাউসেন ছলিতে যান আখড়ার ঘর৷৷’’৫২

দেবী আখড়ার ঘরে ঘুমন্ত লাউসেন এর সন্নিধানে গিয়ে রূপের ছটায় মোহিত করে তার কাছে নিজের পরিচয় দান করে বলেন—

 ‘‘মন দিয়া শুন অহে ময়নার ঠাকুর৷৷

 সনকা বৈউশ্যা আমি গোলাহাটে ঘর৷

 বড় বনি আমার সুরীক্ষা বানেশ্বর৷৷

 তার ছোট বনি আমি কহিল তোমারে৷

 নাগর খুঁজিয়া আমি বুলি ঘরে ঘরে৷৷’’৫৩

এইভাবে নিজের পরিচয় দান করে তিনি লাউসেনকে প্রলোভিত করতে থাকেন বিভিন্ন কথার স্বপ্নজাল রচনা করে৷ কিন্তু তাতেও যখন লাউসেন তাকে উপেক্ষা করতে থাকে, অপমানিত করে সূর্পণখার মতো নাক কান কেটে ফেলার কথা বলে, তখন দেবী উপস্থাপন করেন বিভিন্ন পুরাণ প্রসঙ্গ৷ যেমন অহল্যা, কামতাড়িত ঊর্বশীকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য অর্জুনের অভিশপ্ত হওয়ার কাহিনি, মন্দোদরী, অহল্যা, চিন্তামণি, অঞ্জনা, তারা, দ্রৌপদী প্রমুখ নারীদের প্রসঙ্গ৷ এরা প্রত্যেকেই পরপুরুষ বন্দনা করেও ঘৃণিত হননি তবে তার প্রতি লাউসেনের বিরূপতা কেন! এখানে এক সাধারণ বেশ্যার প্রসঙ্গে দেবী শুনিয়েছেন জীবনের বৃহৎ বাস্তবসম্মত এক রূপকে৷ মানুষের সমাজে পাপ পুণ্যের বিচার ব্যবস্থা অর্থনীতির উপরও কোনো না কোনোভাবে প্রতিষ্ঠিত৷ কুন্তি, দ্রৌপদী, চিন্তামণি, মন্দোদরী, তারা এরা সকলেই উচ্চকুলের নারী৷ তাদের কষ্ট যন্ত্রণা যদিও সাধারণ নারীর মতোই সজীব তথাপি সমাজে অবস্থানগত দিক থেকে তাদের অবস্থান শোষক শ্রেণীর অন্দরমহলে৷ এরা বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্র হয়েও প্রতিনিধিত্ব করছেন উচ্চবিত্ত সমাজের৷ তাই পুরুষ নির্দেশিত শাস্ত্রে কুন্তি, অহল্যা, তারা, মন্দোদরীর যে মর্যাদা সনকা বেশ্যার মতো সাধারণ নারীদের তা নয়৷ সনকার মতো নারীরা বেশ্যাবৃত্তিতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেছে কিন্তু দ্রৌপদীরা শাস্ত্রকারের নির্দেশে জীবনের এই সাময়িক জটিলতাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন৷ তাই তাদের জীবনের প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে কাজ করেছে দৈব ইচ্ছা অথবা কোনো মঙ্গলময় দিক৷ অপরদিকে সনকা বেশ্যার যে জীবন তা সমাজের কলুষতা বহনেরই দৃষ্টান্ত৷ এখানে গণিকার সমস্ত গুণাবলী প্রকাশ পেলেও সনকা রূপধারী পার্বতী শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় লাউসেনকে ছলনা করতে৷ তার স্বরূপ প্রকাশ হয়ে যায়৷

স্বৈরিণী, ব্যভিচারিণী, বেশ্যাসুলভ মানসিকতায় পরিপূর্ণ নারী চরিত্ররা ভিড় করেছেন ‘জামতি পালা’ অংশে৷ কুমির বধ করার পর লাউসেন কর্পূর সহযোগে গৌড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলে সম্মুখে দেখতে পায় সুন্দর সুসজ্জিত এক পুরী৷ কর্পূরের কাছে জানতে পারে নগরটির নাম জামতি, অগস্ত্য মুনির আশীর্বাদে যেখানে সারা বছর বসন্তকাল বিরাজ করে৷ কর্পূর লাউসেনকে অনুরোধ করে গৌড়ে যাওয়ার জন্য অন্য পথ নির্বাচিত করতে৷ কারণ সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে সুসজ্জিত হলেও জামতির প্রায় সকল নারীই অসতী৷ পরপুরুষ বশ ও সম্ভোগে তারা সিদ্ধহস্তা৷ তাই তারা দুই ভাই সেই ছলনাময়ী নারীদের কিছুতেই অতিক্রম করে যেতে পারবে না৷ কারণ মুনি-ঋষিদেরও তা অসাধ্য৷—

 ‘‘স্বর্গ বিদ্যাধরী কিবা সিংহল পদ্মিনী৷

 দরশনে ধৈরজ ধরিতে নারে মুনি৷৷

 বচনে পীযুষ মাখা মুনি মোহ যায়৷

 তোমারে দেখিলে পাছে কড়চে লুকায়৷৷

 চাঁপাফুল বলিয়া শ্রবণে পাছে পরে৷

 এ দেশ ছাড়িল যতী অসতীর ডরে৷৷’’৫৪

কিন্তু লাউসেন কর্পূরের অনুরোধ উপেক্ষা করে৷ নিজের চরিত্র ও সংযমের অসীম বাহাদুরিতে সে ঠিক করে জামতি নগর দিয়েই গৌড়ে যাবে এবং কর্পূরকে নিয়ে জামতি প্রবেশ করে৷ নগরের দক্ষিণ প্রান্তে রম্য-সরোবরের কাছে এসে তার ধারের কদমগাছ এবং পদ্মপুষ্প শোভিত সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়৷ সেখানে বসে বিশ্রামের সংকল্প করে৷ সেই সরণীতেই পূর্বে বহু মুনি তাদের পৌরুষ বিসর্জন দিয়েছে৷ সেই ঘাটই জামতি সুন্দরীদের জল নেওয়া, গাত্র মার্জনা, স্নান সমাপণ করার প্রিয় স্থান৷ কিছুক্ষণ পরে দুই ভাই লক্ষ্য করে দলবেধে নারীকুলের ঘাটে আগমন৷ এরাই সেই ব্যভিচারিণীর দল৷ সোনার কলসিতে জল ভরতে ভরতে তারা মুগ্ধ হয়ে যায় লাউসেন ও কর্পূরের রূপে৷ তাদের স্বামীদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খাদগুলিও প্রকট হয়ে ওঠে লাউসেনের নিষ্কলুষ দেহসৌষ্ঠবে৷ তারা লাউসেনকে প্রত্যাশা করে বলতে থাকে—এমন পুরুষ পেলে নিজের রূপ যৌবনকে অকপটে বিলিয়ে দিতে পারে৷ অনেকে আবার স্বামীর অকাল মৃত্যু কামনা করেও লাউসেনকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়৷ কানা, খোঁড়া, বোবা, গোদা, কালা, বৃদ্ধ, নপুংসক, ছানিপড়া, কুঁজো ইত্যাদি বহু বিশেষণে নিজেদের স্বামীদের চিহ্নিত করে তৎক্ষণাৎ তাদের পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয় তার সঙ্গে যৌবন তরঙ্গে ভেসে গিয়ে কাম চরিতার্থ করার জন্য৷ এদের মধ্যে চতুরা হল নয়নী৷ যে সম্ভ্রান্ত শিবা বারুই-এর স্ত্রী এবং হরিপালের কন্যা৷ লাউসেনকে দেখে সে ভাবে—

 ‘‘বৈদেশী কুমার বিনে না রয় পরাণ৷

 বিলক্ষণ বেশে যাব তার বিদ্যমান৷৷

 বিরলে বলব হিত উপদেশ বাণী৷

 ভুলাইয়া বৈদেশীরে আনিব আপনি৷৷’’৫৫

অন্যান্য নারীদের তার ধারে কাছে ঘেষতে না দেওয়ার জন্য বুদ্ধি করে বিভিন্ন কথার জালে তাদের ঘরে পাঠিয়ে দেয় নয়নী৷ একা বিরলে সঙ্গসুখ উপভোগ করার জন্য ঘরে গিয়ে মোহিনী বেশ ধারণে যত্নবান হয়৷ সুবর্ণের চিরুনি দিয়ে কেশ পরিচর্যা করে তৈরি করে মনোহর কবরী এবং ফুলে ফুলে সুসজ্জিত করেন তা৷ চোখে মোহন কাজল, কপালে সিঁদুর, বিভিন্ন ধরনের অলংকার—টাড়, বালা, পাসুলি বউলি, বাজুবন্ধ, অঙ্গুরী, বুক পর্যন্ত ঝোলানো সোনার হার, কামনা উদ্রেককারী অঙ্গ আচ্ছাদনের মোহন বেশ, তার সৌন্দর্য—

‘পূর্ণিমার চাঁদে পড়ে টসটস মৌ৷’৫৬—এর সঙ্গে উপমিত৷ কামে জর্জরিত হয়ে, চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য নিয়ে সে যখন লাউসেনের কাছে গিয়ে বলে—

 ‘‘আজি কর বিলম্ব ময়নার গুণমণি৷৷

 ঘরে নিব টাকাকড়ি প্রবাল কাঞ্চন৷

 নিরবধি খায়াইব শুন প্রাণধন৷৷

 কড়চে রাখিব তোমা চাঁপাফুল বলি৷

 আমি হব পদ্মফুল তুমি হবে অলি৷৷

 বড় সুখে রজনী বঞ্চিব বাসঘর৷’’৫৭

কিন্তু লাউসেনের এই গণিকা মনষ্ক নারীর প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই তাই সে যখন ঘৃণাভরে তাকে প্রত্যাখ্যান করে তখন লক্ষিত হয় পতিতা নারীর ভয়ানক মূর্তি৷ সন্তানের জননী এই নয়নী৷ তথাপি তার মাতৃত্ব কলুষিত৷ নিজের বাসনা পূরণের জন্য সে স্নেহশীলা মাতৃমূর্তির বদলে হয়ে উঠে ভয়ঙ্করী ডাকিনীতে৷ লাউসেনকে জধ করে নিজের হাতের মুঠোয় পাবার জন্য সহস্তে নিজের গর্ভজাত শিশুসন্তানকে কূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে চিৎকার করতে থাকে এই বলে যে লাউসেন তার সন্তানকে হত্যা করেছে তাকে ভোগ করার জন্য৷ নয়নীর এই ঘৃণ্য কাজে হতভম্ব দুই ভাই গ্রামবাসীদের আক্রমনে বন্দি হয়৷ নয়নী সবার অলক্ষ্যে তাদের অভয় দেয় এই বলে—

 ‘‘একবার দেহ যদি আলিঙ্গনদান৷

 রাজাকে বলিয়া তোমার করিব ছোড়ান৷৷’’৫৮

এখানে বর্ণিত হয়েছে গণিকা চরিত্রের আরেক ভয়াবহ রূপ৷ যেখানে পতিতারা তাদের পেশাকে টিকিয়ে রাখার জন্য, উপার্জনকে নিষ্কন্টক করার জন্য অবহেলা করে নিজেদের মাতৃত্বকে৷ কারণ সন্তানের উপস্থিতি ভাটা এনে দেয় তাদের ব্যবসায়৷ পুরুষ খদ্দের অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের গৃহ মাড়াতে চায় না৷ নয়নীর ক্ষেত্রেও তার প্রেমের পথে বাঁধা হয়েছিল তার সন্তান৷ যদিও সে পেশাদারী বেশ্যা নয়, দেহজীবীর মতো অর্থ উপার্জনই তার পরপুরুষ সম্ভোগের উদ্দেশ্য নয় তবুও নিজের আকাঙ্খা পূরণে সন্তানের উপস্থিতিকেও মানতে পারেনি৷ এখানে সে হিংস্র এবং আসক্তি জর্জরিত৷ তার এই কুৎসিত আচরণকে মেনে নেওয়া যায় না৷ সে জন্য লেখক চরম শাস্তি নির্দেশ করেছেন; সর্বসমক্ষে সভার মধ্যে কেটে নেওয়া হয় তার নাক, কান, মাথার চুল৷ এরপর জামতি নগর ত্যাগ করে দুই ভাই এসে পৌঁছায় গোলাহাট নগরে৷ কর্পূর লাউসেনের কাছে এর বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে বলে গোলাহাট জামতি নগরের মতো বেশ্যাদের চারণভূমি৷ সেখানকার অধীশ্বরী সুরিক্ষা সুন্দরী যে সর্বদা ছকুড়ি নাগর বেষ্টিত হয়ে থাকে৷ ভিনদেশের কোনো পুরুষ সে নগর অতিক্রম করে যেতে পারে না৷ পান, সুপুরি, রূপ, যৌবন দিয়ে বশ করে সুরিক্ষার সহচরীরা তাকে তার দাস করে রাখে যাতে প্রয়োজন মতো তারা সুরীক্ষা সুন্দরীর প্রবৃত্তি দমন করতে পারে৷—

‘‘পথে বস্যা থাকে সখী বৈদেশী নন্দনে দেখি ভুলাইয়া রাখে দেশাচার৷৷

ষোলো শত ঘর নটী গোলাহাটে পরিপাটি বিস্তর দিবস ইথে আছে৷

সঙ্গে খোল করতাল বিনোদ জরপ জাল মদনে মাতাল হয়্যা নাচে৷৷

পুরুষের কাছে কাছে উলঙ্গ হইয়া নাচে চঞ্চল বসন কেশপাশ৷

বৈদেশী রাজার বেটা পথে পাইলে দেই নেটা কোনজনে নাহিক তরাস৷৷

লতা গুল্ম থরে থরে শোভা করে ঘরে ঘরে সদাই ওষধ কারখানা৷

চন্দন কস্তুরী চুয়া উপহার পানগুয়া এ সব এদেশে খাত্যে মানা৷৷’’৫৯

কর্পূরের মুখে বশীকরণের পান, সুপুরি ও বিভিন্ন উপহার গ্রহণের বিধি-নিষেধ শুনে সচেতন হয়ে যায় কুমার লাউসেন৷ নগরের প্রান্ত ভাগে এই প্রান্তবাসিনীদের অবস্থান৷ এখানে—

‘রাজা নাঞি লয় কর নটী সব করে ঘর লুট কর‍্যা খায় রূপগুনে৷’৬০

আর এহেন গণিকা রাজ্যে এসে দুই ভাই সম্মুখিন হয় ভাজন বুড়ির৷ ভাজন বুড়ি বয়স্কা গণিকা৷ বয়সের কারণে পুরুষের মন ভোলাতে না পারলেও চিরায়ত স্বভাবকে একেবারে পরিত্যাগ করতে পারেনি, তাই লাউসেনকে দেখে তার মনে হয়—

 ‘‘ইহার সহিত যদি বসি একাসন৷

 এখনি ফিরাত্যে পারি নহলী যৌবন৷৷

 যৌবন বালির বাঁধ গেল কোন দেশে৷

 অল্পদিনে বঞ্চিত হইনু পঞ্চরসে৷৷’’৬১

যৌবনের প্রখর রূপরাশি হারিয়েও ভাজনবুড়ি আবার মত্ত হয়ে ওঠে পুরুষ ভোলানো খেলায়, নিজের যৎসামান্য সম্পদ বিক্রি ও বন্ধক রেখে অর্জন করে দশপন কড়ি৷ তাই নিয়ে মালীর ঘরে উপস্থিত হয় শোলার অষ্ট আভরণের জন্য৷ শোলা নির্মিত বিভিন্ন অলংকারাদিতে সুসজ্জিত হয়ে বুড়ি নিজের ঘরে এসে ‘তিন কড়ার তেল’ মাখে নিজের সিঁথিতে৷ চোখে লাগায় কালো হাঁড়ির কাজল৷ এভাবে বিভিন্ন প্রসাধনী ও বসনে সাজ সম্পন্ন করে লাসবেশের নামে ধারণ করে উদ্ভট এক সজ্জা৷ তার এহেন রূপকে স্বয়ং রচনাকার তুলনা করেছে ‘পিশাচির’ সঙ্গে৷ কিন্তু ভাজন বুড়ির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই৷ সে নিজের রূপের গরবে গরবিনী হয়ে লাউসেন-কর্পূরের সম্মুখে প্রেম নিবেদন করে—

 ‘‘কর্ণসেনের পুত্র যদি আমার হয় নাতি৷

 তোমা আমা বিলাস করিব সারারাতি৷৷

 সভে জানে মোর নাম বটে চন্দ্রকলা৷

 শর্বরী সময়ে এই রূপ হয় আলা৷৷

 ষোলো বৎসরের হয়্যা রব তোমার কাছে৷

 সকল রজনী রম মনে সাধ আছে৷৷’’৬২

বৃদ্ধার এহেন প্রণয় সম্ভাষণে অসন্তুষ্ট কর্পূর চড় বসিয়ে দেয় ভাজনবুড়িকে৷ বুড়ি প্রত্যাখ্যাতা হয়ে পলায়ন করে, অপমানের জ্বালায় উপস্থিত হয় সুরীক্ষার সম্মুখে এবং তাদের রূপও ঔদ্ধতকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে উত্তেজিত করে তোলে গোলাঘাট অধীশ্বরীকে৷ সুরীক্ষরানি বশীকরণের পান ও সুপুরি দিয়ে দাসী সনকা ও গুরীক্ষাকে প্রেরণ করে দুই ভাইকে মোহোজালে বিদ্ধ করার জন্য৷ কিন্তু লাউসেন ও কর্পূরের পরামর্শে নগরের বালকেরা সেই পান লুঠ করে নিয়ে গেলে—

 ‘‘সনকা গুরীক্ষা চলে পায় কর‍্যা ভর৷

 লাউসেনে আগুলিল পথের উপর৷৷

 চন্দ্রে যেন বেষ্টিত করিল আস্যা রাহু৷

 আলিঙ্গন মাগে নটী পসারিয়া বাহু৷৷’’৬৩

এই দুই নারী তাদের লুঠ হয়ে যাওয়া পানের বিনিময়ে উপযুক্ত কড়ি অথবা আলিঙ্গন প্রার্থনা করে৷ এমন পরিস্থিতিতে ধর্ম ঠাকুরের সহায়তায় কপর্দক হীন দুই ভাই মানিক রত্ন দিয়ে তাদের বিদায় করে৷ এই অলৌকিক ক্ষমতায় গুরীক্ষা ও সনকা দাসী ক্ষিপ্রগতিতে উপস্থিত হয় সুরীক্ষা সন্নিধানে, আদ্যপান্ত ব্যক্ত করে সমস্ত ঘটনা৷ রানি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না৷ তাই—

 ‘‘না করে বিলম্ব নটী করে লাসবেশ৷

 সুবর্ণ চিরনি দিয়া আঁচড়িল কেশ৷৷’’৬৪

নানাভাবে সুরীক্ষা তার লাসবেশ সম্পন্ন করে ‘গুয়াপানে বশ’ করা ছ-কুড়ি নাগরদের নিয়ে উপনীত হয় লাউসেন সন্নিধানে৷ তার আলিঙ্গন প্রার্থনা করে দেহ-মনের কামনার বহ্নিকে নির্বাপিত করতে চায় বেশ্যাসুন্দরী৷ লাউসেন তাতে রাজী না হলে কথার মোহজালে তাকে বন্দি করতে বলে—

 ‘‘শুন রাজা লাউসেন কর্পূর পাতর৷

 আজি বাসা নিতে চল মোর বাসঘর৷৷

 একবার আমা প্রতি দিবে আলিঙ্গন৷

 নিরবধি অঙ্গে দিব কস্তুরী চন্দন৷

 নিরবধি বুকে থুব করিয়া মাদুলি৷

 আমি হব পদ্মফুল তুমি হবে অলি৷৷

 চামর বিয়নী বায়ে সুখে নিদ্রা যাবে৷

 নানা পুষ্প পারিজাতে শয়ন বঞ্চিবে৷৷

 ঘৃত অন্ন বিলাস করিবে সুধা ক্ষীর৷

 রতিরসে বিলাস করিবে মহাবীর৷৷’’৬৫

সুরীক্ষার এমন কথায় মর্মাহত হয়ে যায় দুই ভাই কারণ শাস্ত্রমতে—

 ‘বেউশ্যা পরশে পাপ না যায় খণ্ডন৷’৬৬

যে সমাজের সক্রিয় উদাসীনতায় সৃষ্টি হয় গণিকার মতো নারীরা সেই সমাজের দ্বারাই আবার ঘৃণিতা হয় তারা৷ তাদের স্পর্শ হয়ে ওঠে প্রায়শ্চিত্তহীন অপরাধ৷ সুরীক্ষা সম্পর্কে লাউসেনের এই উক্তির মধ্য দিয়ে প্রান্তবাসিনী পতিতা নারীদের জীবনের এমনই এক বাস্তবসম্মত চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে৷ এখানে বেশ্যার প্রতি কোনো সহানুভূতি নয় উঠে এসেছে স্বৈরিণী এই নারীদের পাপময় ঘৃণ্য জীবনালেখ্য৷ তাই সুরীক্ষা সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ছলনা করতে চেষ্টা করলেও সমাজ প্রতিভূ লাউসেন অনড়, শাস্তি পায় সুরীক্ষাই৷ নয়নী, গুরীক্ষা, বেশ্যাবেশী পার্বতী সকলের প্রতি লাউসেনরূপী সমাজপতিরা পরামর্শ দিয়েছে একপতি অর্থাৎ নিজ স্বামী সেবা করার অথচ পরবর্তী সময়ে দেখা যায় লাইসেনকে তিনটি বিবাহ করতে৷ চরিত্রবান লাউসেনের বহু পত্নী গমনে পাপ নেই—গণিকা গমন সাত জন্মের পাপ! আলোচ্য কাব্যে বর্ণিত হয়েছে গণিকা নারীদের কামপ্রবণতা, তীব্র লাস্যরূপ, পরপুরুষ সম্ভোগের নিষ্ঠুর প্রসন্নতা৷ রচনাকার এদের প্রতি সহানুভূতির এতটুকু উপকরণ দেননি যা দিয়ে তাদের নারীত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া যায়, সম্মান করা যায়৷ তাদের সব অনুভূতিকে ছাপিয়ে ব্যভিচারিণী ও কামার্ত মানসিকতার দিকেই দৃষ্টি আরোপ করেছেন রচয়িতা৷ আর লেখকের এরূপ চিন্তা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় তৎকালীন সময়ে গণিকাদের সামাজিক অবস্থান৷

প্রাচীন যুগের সমাজে গণিকার স্তরবিভাগ :

প্রাচীন যুগে এই বহুবল্লভাদের সামগ্রিকভাবে বিচার করলে নানা স্তরবিভাগ রয়েছে তাদের সামাজিক অবস্থানের নিরিখে রাষ্ট্রের সবচেয়ে নিচু স্তরের কর্মচারী যে দারোয়ান গণিকারা তার থেকেও নিম্নস্তরের৷ আবার এই দেহব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত সর্বনিম্নস্তরের এই নারীদের মধ্যে সর্বোচ্চস্থানে রয়েছে ‘গণিকা’৷ তাদের আরেক নাম ছিল নগরশোভিনী বা জনপদকল্যাণী৷ একটা সম্পূর্ণ জনপদের মানুষেরা যাকে স্বাধীনভাবে ভোগ করতে পারে তাকে বলে জনপদকল্যাণী৷ রূপে-যৌবনে-শিক্ষায়-কলায় এরা সর্বশ্রেষ্ঠ৷ এদের পরবর্তী স্তরে থাকে রূপাজীবা৷ রূপাজীবারা শিক্ষা-দীক্ষা-বিদ্যা-বুদ্ধিতে গণিকাদের চেয়ে নিচে৷ এদেরও নিচে বেশ্যা৷ এদের প্রধান মূলধন বস্ত্রালঙ্কার ও সাজগোজ৷ এই বেশ্যাদের থেকে নিম্নস্তরে ছিল সৈরিন্ধ্রী, শিল্পকারিকা বা শিল্পদারিকা, কুম্ভদাসী, রূপদাসী, বন্নদাসী, কৌশিকাস্ত্রী, নটী, ক্ষুদ্রা, ভূঞ্চিকা৷ এরা রাজ-প্রাসাদে বা সম্ভ্রান্ত কোন ব্যক্তির আলয়ে নিজের ক্ষমতানুসারে কায়িক শ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতো, গৃহস্বামীদের যৌনআনন্দও এরা দিত৷ এদের বাইরে ছিল অশিক্ষিতা, অর্ধশিক্ষিতা, দরিদ্র, রূপহীনা, বিগতযৌবনা দেহজীবীর দল৷ সংখ্যায় তারাই বেশি৷ এদের জীবন-যাপন অত্যন্ত কষ্টকর৷ এদের পরিচয় কুলটা, স্বৈরিণী, পুংশ্চলী, বারবনিতা ইত্যাদি নামে৷

রাষ্ট্র ও গণিকা :

প্রাচীন কালের নগর নটীরা প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হত৷ রাষ্ট্রের সঙ্গে গণিকাদের সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছেদ্য কিন্তু রাষ্ট্রের তাদের প্রতি কোনো কৃতজ্ঞতা ছিল না৷ সেই নগরশোভিনী-জনপদবধূরা রাষ্ট্রের ব্যয়ে তাদের শিক্ষা সম্পন্ন করত অর্থাৎ রূপ-গুণ-ছলা-কলায় পারদর্শিনী করে একজন আদর্শ যৌনআনন্দ দানকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার তালিম রাষ্ট্রই দিত৷ কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন যে গণিকা রাজকোষ থেকে মাসোহারা পেত৷ শুধু গণিকাই নয় তার প্রতিনিধি প্রতিগণিকা, গণিকার প্রাসাদ, দাস-দাসী, সংসার সবই ছিল রাষ্ট্রের সম্পত্তি৷ রাজকোষ থেকে গণিকাদের ৫০০ থেকে ২০০০ পণ বার্ষিক বেতন দেওয়া হত৷ এছাড়া গণিকাদের নিজেদের রোজগারও কম ছিল না যেমন—গণিকা সলাবতীর একরাত্রের দর্শনী ছিল ১০০০ কাহাপন (কার্যাপণ সমান স্বর্ণমুদ্রা), কাশীর গণিকা সামার ৫০০ জন অনুচারিণীই ছিল৷ রোজগার না থাকলে এত দাসী রাখার সামর্থ কয়জনের হয়! আম্রপালীর দর্শনী ছিল ৫০ কার্যাপণ৷ তা নিয়ে তো রাজগৃহ ও বৈশালীর মধ্যে বিবাদই বেঁধে গিয়েছিল৷ তার আয়ে বৈশালীর অর্থ ভাণ্ডার স্ফীত হয়ে উঠেছিল৷ কাশীর আরেক গণিকা অর্ধকাশীর দর্শনী মূল্য শুরু হয়েছিল সমগ্র কাশীর আয়করের অর্ধেক দিয়ে৷ এছাড়া কোনো নগরবধূ যদি স্বেচ্ছায় তার বৃত্তি থেকে সরে যেতে চাইতো তাহলে তার কাছ থেকে রাষ্ট্র ২৪০০০ পণ নিষ্ক্রয় মূল্য নিত৷ গণিকাকে ধর্ষণ করলে ৫৪ পণ এবং তার মায়ের আয়ের ১৬ গুণ অর্থদণ্ড জরিমানা স্বরূপ দিতে হত৷ গণিকার বিদেশী ‘খদ্দের’-কে তার নির্দিষ্ট মূল্য ছাড়া পাঁচ পণ অর্থমূল্য বেশি দিতে হত৷ অভিনেতা, মাংসবিক্রেতা বা বৈশ্যের সঙ্গে সম্পর্ককারী রূপাজীবাদের বার্ষিক বৃত্তি ছিল ৪৮ পণ৷ কোনো গণিকা বা রূপজীবা যদি টাকা নেওয়ার পরে সম্পর্কে আপত্তি প্রকাশ করে তাহলে তাকে তার প্রাপ্যের দ্বিগুণ অর্থ দণ্ড দিতে হত আর যদি সেই অস্বীকৃতি টাকা নেওয়ার আগে হয় তখন সে সমগ্র প্রাপ্য থেকেই বঞ্চিত হত৷ ‘যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি’ অনুসারে গণিকার শারীরিক নিরাপত্তার জন্য নানা দণ্ড ব্যবস্থা চালু ছিল৷ তাদের প্রতি অত্যাচারকারীকে ১০০০ থেকে ৪৮০০০ পণ পর্যন্ত অর্থদণ্ড ভোগ করতে হত৷ গণিকাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে সম্ভোগ করলে ৫০ পণ এবং বহুজন দ্বারা গণধর্ষিত করলে ধর্ষণকারীর প্রত্যেকের ২৪ পণ দণ্ড ছিল৷ কৌটিল্য তাঁর রচনায় (অর্থশাস্ত্রে) উল্লেখ করেছেন গণিকা পীড়নের নানা দণ্ডাদেশ৷ যেমন গণিকাকে প্রকাশ্যে অপমান করার শাস্তি ২৪ পণ, শারীরিক অত্যাচার করলে ৪৮ পণ, কান কেটে নিলে পৌনে ৫২ পণ ও কারাবাস৷

গণিকা কন্যারা গণিকাই হত আর পুত্রের পরিচয় ‘বন্ধুল’৷ কোথাও গণিকার মাতা গণিকালয়ের কর্তৃ হত৷ তার বোন হত প্রতিগণিকা৷ গণিকার ভাইকে গীতবাদ্যে কুশল হয়ে আটবছর রাষ্ট্রের অধীনে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মঞ্চে কাজ করতে হত, যদি বিবাহিতা গণিকা হত তাহলে তার স্বামীকেও অনুরূপ কাজ করতে হত৷ তাদের নৃত্যগীত-শিক্ষার ব্যবস্থা রাষ্ট্রের ব্যয়েই হত৷ আট বছর সম্পন্ন না হলে সেখান থেকে মুক্ত হতে গণিকার ভাইকে প্রচুর মুক্তিপণ দিতে হত, যা রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা হত৷ যুদ্ধের সময় গণিকার সম্পত্তি রাষ্ট্র-কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হত৷

রাষ্ট্রের অধীনে, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে গণিকারা প্রচুর সম্পত্তির অধিকারিণী হলেও সেই সম্পত্তিতে তার কোনো স্বত্ব ছিল না৷ অর্থাৎ গণিকার নিজের শরীর খাটিয়ে আহরিত সম্পত্তি—‘‘বেচবার, বাঁধা দেওয়ার বা দান করারও তার অধিকার ছিল না৷’’৬৭ গণিকালয়ে বাসকারী বারবনিতাদের জন্য এই নিয়ম কার্যকর ছিল৷ আবার যারা কিছু সময়ের জন্য পুরুষের রক্ষিতা হয়ে দেহসুখ দান করতো তাদের যা উপার্জন রাজকোষে কর দিয়ে তার থেকে যা বাকি থাকতো তা সে স্বাধীনভাবে ভোগ করতে পারতো৷ দ্বাদশ শতকের রচনা ‘মৃন্ময়সুন্দরী কথা’ তে উল্লেখ আছে গণিকার আয়ের শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ছিল রাষ্ট্রের প্রাপ্য৷

গণিকাশ্রেণীকে নিয়ে রাষ্ট্র নানা ভাবে সুবিধা আদায় করে নিয়েছে৷ গণিকার শিক্ষাতালিকা যেমন প্রকাণ্ড ছিল—(শিল্পকলা, রন্ধন, গীত, বাদ্য, গণিত ইত্যাদি নানা বিষয়ে) রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে ব্যয়বহুল সেই শিক্ষার মানও ছিল অনেক উন্নত৷ রাষ্ট্র গণিকার কাছ থেকে উচ্চহারে রাজস্ব যেমন পেত তেমনি চরের কাজও তাদের রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের মধ্যে ছিল৷ তারা তাদের শিক্ষা-রুচি-রূপ-যৌবনকে হাতিয়ার করে রাষ্ট্রের শত্রুপক্ষের অনেক গুপ্ত সংবাদ সংগ্রহ করে রাষ্ট্রকে জানিয়ে দিত এবং সেই অনুযায়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিত৷

কোনো কোনো স্থানে আবার গণিকার মাতাই গণিকালয়ের কর্ত্রী হিসেবে অবস্থান করতো আর তার বোন হত প্রতিগণিকা৷ অর্থাৎ সুবিধা-অসুবিধায় সে গণিকার বিকল্প হিসেবে যৌন আনন্দ দিত৷ গণিকার ভাইকেউ গীতবাদ্যে বা অভিনয়ে দক্ষ হয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত মঞ্চে আট বছর অভিনয় বা গীতবাদ্য পরিবেশন করতে হত৷ তারও শিক্ষার ব্যবস্থা এবং আর্থিক সবরকম দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করতো৷ গণিকার ভাইয়ের নিষ্ক্রয়মূল্য ছিল গণিকার চেয়েও বেশি৷ বাৎস্যায়ণের ‘কামসূত্র’-এর কোথাও কোথাও আবার গণিকার বিবাহের কথাও আছে৷ সেক্ষেত্রে বিবাহিত গণিকার স্বামীকে রাষ্ট্রের ব্যয় ও পরিচালনায় চালিত মঞ্চে শ্রম দিতে হত৷ কখনো কখনো সে বিবাহ প্রতীকী অনুষ্ঠান মাত্র ছিল৷ বাৎস্যায়ণে গণিকার প্রেমের সম্ভাবনাকেও তাত্ত্বিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে৷ ‘শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক’-এ গণিকার প্রেমের উল্লেখ আছে৷

রাষ্ট্রের জন্য গণিকারা দায়বদ্ধ থেকে অনেক কিছু করতো অথচ তাদের প্রতি রাষ্ট্রের তেমন কোনো দায় ছিল না৷ যতদিন শরীরীভাবে সে সক্ষম ততদিনই তার কদর৷ আর ঐ সময়ের মধ্যে যদি সে কারও বধূ বা কোনো মঠ বা সংঘে স্বেচ্ছায় চলে না যেত তাহলে যৌবনের মদমত্ত বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত সেই নারী বিগতযৌবনে পথের ভিখারিনি হয়ে নিঃশেষ হয়ে যেত৷

তথ্যসূত্র :

 ১. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, ১ম খণ্ড, পৃ-৭৬১৷

 ২. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, ২য় খণ্ড, পৃ-১২৬১৷

 ৩. সমীরণ মজুমদার (সম্পাদিত) গণিকা মুক্তি ও মর্যাদা, পৃ-১১৷

 ৪. বিজয়চন্দ্র মজুমদার, বৈদিক যুগের জাতিভেদ, কার্তিক ১৩২০, পৃ-৫৷

 ৫. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, ২য় খণ্ড, পৃ-১২৬১৷

 ৬. সমীরণ মজুমদার (সম্পাদিত) গণিকা মুক্তি ও মর্যাদা, পৃ-১৩৷

 ৭. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, ১ম খণ্ড, পৃ-৭৬১৷

 ৮. তদেব, পৃ-৭৬১৷

 ৯. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, ২য় খণ্ড, পৃ-১৮৮১৷

 ১০. কাজল ভট্টাচার্য, কলগার্লের দুনিয়া, পৃ-১০৷

 ১১. Ishita Majumder and Sudipta Panja, The invisible A study Kolkata’s call girls, Rohini Sahni, V. Kalyan Shankar etc. Prostitution and beyond, page-156.

 ১২. Ishita Majumder and Sudipta Panja, The invisible A study Kolkata’s call girls, Rohini Sahni, V. Kalyan Shankar etc. Prostitution and beyond, page-157.

 ১৩. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, ২য় খণ্ড, পৃ-২৩১৬৷

 ১৪. দেবদাসী থেকে যৌনকর্মী, মণি নাগ, পৃ-১৷

 ১৫. সুকুমারী ভট্টাচার্য, প্রবন্ধ সংগ্রহ (১), পৃ-১৮৷

 ১৬. তদেব, পৃ-২১৷

 ১৭. তদেব, পৃ-২৯৷

 ১৮. তদেব, পৃ-২৭৷

 ১৯. তদেব, পৃ-২৯৷

 ২০. তদেব, পৃ-২৮০৷

 ২১. মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজতরঙ্গিণী, পৃ-২৫৭

 ২২. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব), পৃ-৩১০৷

 ২৩. তদেব, পৃ-৩১০৷

 ২৪. তদেব, পৃ-৪৬৫৷

 ২৫. সুকুমারী ভট্টাচার্য, প্রবন্ধ সংগ্রহ (১), পৃ-২৮৪৷

 ২৬. উৎপল ভট্টাচার্য, মৃচ্ছকটিক (কাহিনি রূপান্তর) পৃ-১৷

 ২৭. তদেব, পৃ-৬৷

 ২৮. সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত, পৃ-১০১৷

 ২৯. শ্রীতারাপ্রসন্ন দেবশর্ম্মা কর্তৃক অনুদিত ও সম্পাদিত বাল্মীকি রামায়ণ (সরল বাংলা অনুবাদ), পৃ-৪৬৷

 ৩০. তদেব, পৃ-৪৭৷

 ৩১. তদেব, পৃ-১৭০৷

 ৩২. তদেব, পৃ-২৮০৷

 ৩৩. তদেব, পৃ-৪০০৷

 ৩৪. তদেব, পৃ-৪০০৷

 ৩৫. তদেব, পৃ-৪০১৷

 ৩৬. কঙ্কর সিংহ, ধর্ম ও নারী : প্রাচীন ভারত, পৃ-৮২৷

 ৩৭. ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, মহাভারতে নারী, পৃ-৩০৷

 ৩৮. তদেব, পৃ-৩০৷

 ৩৯. মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাস বিরচিত মহাভারত (আদিপর্ব), প্রথম খণ্ড, বর্ধমান রাজবাটী বঙ্গানুবাদ, পৃ-৪১৩৷

 ৪০. তদেব, পৃ-৪১৩৷

 ৪১. তদেব, পৃ-৭১৭-৭১৮৷

 ৪২. তদেব, পৃ-৭১৮৷

 ৪৩. তদেব, পৃ-৭১৮৷

 ৪৪. সুকুমারী ভট্টাচার্য, প্রবন্ধ সংগ্রহ (১), পৃ-২৮১৷

 ৪৫. তদেব, পৃ-২৮১৷

 ৪৬. সুকুমার সেন (সম্পাদিত) চণ্ডীমঙ্গল, পৃ-৭৮৷

 ৪৭. তদেব, পৃ-৮৩৷

 ৪৮. রূপরাম চক্রবর্তী বিরচিত ধর্মমঙ্গল, পৃ-৫৪৷

 ৪৯. তদেব, পৃ-৫৫৷

 ৫০. তদেব, পৃ-৫৭৷

 ৫১. তদেব, পৃ-১৪৪৷

 ৫২. তদেব, পৃ-১৪৫৷

 ৫৩. তদেব, পৃ-১৪৬৷

 ৫৪. তদেব, পৃ-২০০৷

 ৫৫. তদেব, পৃ-২০২৷

 ৫৬. তদেব, পৃ-২০৪৷

 ৫৭. তদেব, পৃ-২০৪৷

 ৫৮. তদেব, পৃ-২০৬৷

 ৫৯. তদেব, পৃ-২১১৷

 ৬০. তদেব, পৃ-২১১৷

 ৬১. তদেব, পৃ-২১৪৷

 ৬২. তদেব, পৃ-২১৬৷

 ৬৩. তদেব, পৃ-২১৯৷

 ৬৪. তদেব, পৃ-২২০৷

 ৬৫. তদেব, পৃ-২২৩৷

 ৬৬. তদেব, পৃ-২২৩৷

 ৬৭. সুকুমারী ভট্টাচার্য, প্রবন্ধ সংগ্রহ (১), পৃ-১৩০৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *