বাংলা উপন্যাসে গণিকা চরিত্রের বিবর্তন
গণিকাচরিত্র সম্বলিত যে সমস্ত বাংলা উপন্যাসের আবির্ভাব ঘটেছে তার সিংহভাগেরই প্রচ্ছদপট হল কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলি৷ এর পিছনে রয়েছে গভীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ৷ ১৬৯০ সালে জব চার্ণক যখন কলকাতা নগরীর পত্তন করেন সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছ থেকে সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং কলকাতা এই তিনটি গ্রাম পত্তনি নিয়ে তখন তা ছিল জেলে, মালো, কলু, ধাঙর প্রভৃতিদের দ্বারা অধ্যুষিত গণ্ডগ্রামমাত্র৷ ব্রাহ্মণদের বাস ছিল না বললেই চলে৷ তারপর ইংরেজরা একে রাজধানী করে প্রশাসনিক সকল কাজকর্ম চালানোর আয়োজন করলে ধীরে ধীরে কলকাতার অবস্থা পাল্টাতে থাকে৷ রাজকর্মচারীদের বাসস্থান, অফিস-কাছারি নির্মাণ, কলকারখানা স্থাপন, বন্দর তৈরি এবং ব্যবসা-বানিজ্যের বিস্তার ইত্যাদির ব্যাপক আয়োজনে কলকাতা নগরীতে মানুষের ভিড় উপচে পড়তে থাকে৷ পলাশীযুদ্ধে সহায়তা করে ইংরেজদের আস্থা অর্জনকারী মানুষজন নানা খেতাব, অর্থসম্পত্তি, প্রতিপত্তি প্রাপ্ত হয়ে যেমন কলকাতায় বসবাস শুরু করে দেয় তেমনি জমিদার শ্রেণীর মানুষজনও গ্রামের জমিদারির ভার নায়েব-গোমস্তার হাতে সমর্পণ করে আয়াস-বিলাসে জীবন কাটানোর জন্য কলকাতায় আস্তানা গারে৷ এছাড়াও একটু চালাক-চতুর ধরনের মানুষেরা বুদ্ধি খাটিয়ে ব্যবসা করে প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হয়ে উঠে৷ নব্যশহরের কাঁচা পয়সায় তাদের ভাণ্ডার উছলে উঠে৷ তাদের না ছিল শিক্ষা, না ছিল রুচি—কিন্তু পয়সার দাপটে ধরাকে সরা জ্ঞান করে চরম উশৃঙ্খলতায় গা ভাসিয়ে দেয়৷ এইসব প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধনসম্পদের অধিকারী মানুষজনের বিকৃত বিচারশূন্য চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় মনোরঞ্জিকার৷ দেহজীবী নারীরা তাদের কামনা পূরণের হাতিয়ার হয়৷
আবার দেশের শাসনভার ইংরেজদের হস্তগত হওয়ায় দেশীয় শাসন-ব্যবস্থায় ভাঙ্গন দেখা দেয়৷ নবাবি শাসনের পতন হওয়ায় নবাব, আমীর, ওমরাহদের মনোরঞ্জনকারী উচ্চশ্রেণীর বাইজিরা কলকাতার অর্থশালী ধনী মানুষদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে অথবা পৃষ্ঠপোষকতার আশায় দলে দলে কলকাতায় পাড়ি জমাতে থাকে৷ এদের বেশিরভাগই বনেদি, নৃত্যগীত পারদর্শিনী এবং আদব-কায়দা সম্পন্ন উচ্চপর্যায়ের গণিকা৷ সম্ভবত এদের দ্বারাই কলকাতায় বাইজি সমাজের সৃষ্টি হয়৷ এছাড়া কলকারখানা, সওদাগরি অফিস, বন্দর ইত্যাদিতে কাজ করা বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী, চাকুরিজীবী মানুষজন যারা দেশে স্ত্রী-পরিবারকে ফেলে মেসে ভাড়া থেকে রুজি-রোজগারের উপায় খুঁজছিল তাদের সুবিপুল শরীরী ক্ষুধার চাহিদা মেটাতেও প্রয়োজন হয় দেহপসারিণী নারীর৷ কলকাতায় পর্যাপ্ত খদ্দের পাওয়ার সম্ভাবনায় পণ্যাঙ্গনাদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে৷ এদের বেশিরভাগই ছিল বালবিধবা, কুলত্যাগিনী অত্যাচারিত নারী৷ পুরুষদের বহুবিবাহ, কৌলিন্যপ্রথা, বিলাস-বহুল অসংযমী জীবন এবং সতীদাহ প্রথা রদ, তার সঙ্গে বিধবাদের প্রতি নানা কঠিন-কঠোর বিধিনিষেধ নারীকুলকে দেহব্যবসার জন্য ইন্ধন দান করে৷ এদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠে দালালদের সিণ্ডিকেট, নারীপাচারচক্র৷ ‘সুলভ দৈনিক’-এ ১৪.০২.১৮৯৬ এবং ‘রিপোর্ট অন নেটিভ পেপারস’-এ ২২.০২.১৮৯৬-তে নারীপাচার নিয়ে একটি রিপোর্ট বের হয়৷ রিপোর্টটি এইরূপ ‘‘The Sulabh Dainik of the 14th February complains that a brisk traffic in immorality is going on in Calcutta and its neighbourhood. Young girls, married and unmarried, are being bought and sold by the prostitutes. Recently a young married girl, enmeshed by a prostitute, was going to be sold when she was rescued by a kind-hearted gentleman…’’১ সমাজের নানা জটিল আবর্তে পাক খেতে খেতে কলকাতায় গণিকার সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে৷ শুধু কলকাতা নয় ঠুনকো সতীত্বের ফাঁসকে অনায়াসে ছিঁড়ে ফেলে সমাজের নানাদিক থেকে বঞ্চিত অত্যাচারিত নারীরা কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে ঘাঁটি গারতে থাকে৷ কলকারখানা, নানারকম ক্ষুদ্র শিল্প ইত্যাদি স্থাপিত হয়ে হাওড়া, চব্বিশ পরগণা, বর্ধমান, হুগলি প্রভৃতি জায়গাও গণিকাপল্লীর ভিত রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়৷
শ্রেণীভেদে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে গণিকাদের অবস্থানক্ষেত্র হয়ে উঠে৷ যেমন মুঘল নবাব-বাদশাহের পোষকতা হারানো বাইজিরা লক্ষ্ণৌ, আগ্রা, বেনারসের পাট উঠিয়ে কলকাতার বউবাজার অঞ্চলে বাসা বাঁধে৷ দেশ-বিদেশের নাবিকদের মনোরঞ্জন করার জন্য বন্দর এলাকায় আস্তানা নেয় অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান সহ নানাদেশের গণিকারা৷ উচ্চবিত্ত ধনকুবেরদের জন্য বেশ্যালয় গড়ে উঠে শেঠবাগান, সোনাগাছি, রামবাগান, গরাণহাটা ইত্যাদি অঞ্চলে৷ হাড়কাটাগলি, মেছুয়াবাজার, চিৎপুর, আহিরীটোলা, কেরমবাগান, দরমাহাটা এই সমস্ত অঞ্চলে কুলিমজুর, শ্রমজীবী শ্রেণীর মানুষজনদের যৌনআনন্দ দেওয়ার জন্য সাধারনতঃ কম মূল্যের বারবিলাসিনীরা বাস করতে থাকে৷
কলকাতার যে সম্প্রদায় গণিকাদের নিয়ে বিলাস-ব্যসনে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল তারা বাবু অভিধায় ভূষিত হয়৷ বাবু চরিত্রের পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে৷ তিনি তাদের পরিচায়িত করে বলেছেন—‘‘যাঁহার বুদ্ধি বাল্যে পুস্তকমধ্যে, যৌবনে বোতলমধ্যে, বার্দ্ধক্যে গৃহিণীর অঞ্চলে, তিনিই বাবু৷ যাঁহার ইষ্টদেবতা ইংরাজ, গুরু ব্রাহ্মধর্ম্মবেত্তা, বেদ দেশী সম্বাদপত্র এবং তীর্থ ‘ন্যাশানেল থিয়েটার’ তিনিই বাবু৷ যিনি মিসনরির নিকট খ্রীষ্টিয়ান, কেশবচন্দ্রের নিকট ব্রাহ্ম, পিতার নিকট হিন্দু এবং ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের নিকট নাস্তিক, তিনিই বাবু৷ যিনি নিজগৃহে জল খান, বন্ধুগৃহে মদ খান, বেশ্যাগৃহে গালি খান, এবং মুনিব সাহেবের গৃহে গলাধাক্কা খান, তিনিই বাবু৷ যাঁহার স্নানকালে তৈলে ঘৃণা, আহারকালে আপন অঙ্গুলিকে ঘৃণা এবং কথোকপথনকালে মাতৃভাষাকে ঘৃণা, তিনিই বাবু৷ যাঁহার যত্ন কেবল পরিচ্ছদে, তৎপরতা কেবল উমেদারিতে, ভক্তি কেবল গৃহিণী বা উপগৃহিণীতে, এবং রাগ কেবল সদগ্রন্থের উপর, নিঃসন্দেহে তিনিই বাবু৷’’২ অর্থাৎ আরামে, আয়াসে, বিলাসিতায়, নৈতিকপতনে এবং নারীদেহ ভোগের চূড়ান্ত উৎসাহে মুখরিত হয়ে ছিল উনিশ শতকের কলকাতা নগরী৷ কলকাতার এই সমাজচিত্রই এই সময়কার লেখকদের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠে৷ বিভিন্ন নাটক, নকশা জাতীয় রচনায় বাবু ও গণিকাসক্তি বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়৷ যেমন প্রসন্ন কুমার পালের ‘বেশ্যানুরক্তি নিবারণ নাটক’ (১৮৬০) প্যারীমোহন সেনের ‘রাঁড় ভাড় মিচেকতা, এই নিয়ে কলকেতা’ (১৮৬৩), শ্রীগিরীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘বেশ্যা গাইড’ (১৮৬৮), রাধামাধব হালদারের ‘বেশ্যানুরক্তি বিষমবিপত্তি’ (১৮৬৩), শ্রীঅঘোরচন্দ্র ঘোষের ‘পাঁচালী কমলকলি’ (১৮৭২), চণ্ডীচরণ ঘোষ লিখেছেন ‘বেশ্যাই সর্ব্বনাশের মূল’ (১৮৭৩) ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবু বিলাস’, ‘নববিবি বিলাস’ কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’, প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘মদ খাওয়া বড় দায়/জাত থাকার কি উপায়’ ইত্যাদি৷
উনিশ শতকের বাংলা উপন্যাসে গণিকাদের সামাজিক মর্যাদা একেবারে তলানিতে৷ তারা সে সময়কার সমাজমনস্কতায় সম্পূর্ণভাবে দূষিত মানবী৷ মানবী বললে তবু মানুষের মর্যাদার মধ্যে পড়ে যায় ; তাই সে যুগের প্রেক্ষিতে তাদের পিশাচী বললে অত্যুক্তি হবে না৷ প্রাচীন যুগের সমাজব্যবস্থার পর্যালোচনায় দেহজীবিকার ঘৃণ্য পঙ্কে অবস্থান করলেও যে সামান্যতম মূল্যটুকু অবশিষ্ট ছিল উনিশ শতকে তা যেন একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়৷ উনিশ শতকে উপন্যাসগুলি পর্যালোচনা করলে সে জায়গাটা সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হবে বলে আশা করা যায়৷
গণিকাচরিত্র উপস্থাপন করতে গিয়ে উনিশ শতকের যে সমস্ত উপন্যাস আলোচিত হয়েছে সেগুলি হল—ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রাজসিংহ’, ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘এই এক নূতন’ বা ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’, বিবি মেরী ই লেসলির ‘এলোকেশী বেশ্যা’, গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘চন্দ্রা’, নবকুমার দত্তের সম্পাদনায় অজ্ঞাতনামা লেখকের ‘স্বর্ণবাই’, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’, দুর্গাচরণ রায়ের ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’, শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘নয়নতারা’ ইত্যাদি৷
‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র একজন পণ্যাঙ্গনা৷ লেখক তাকে দিয়ে অসাধ্য সাধন করেছেন কিন্তু উপন্যাসে কোথাও তার নামোল্লেখমাত্র নেই৷ মোঘল-মারাঠা দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাস৷ মারাঠাবীর শিবাজী প্রণয়প্রার্থী ঔরঙ্গজেবের কন্যা রোসনারার৷ রোসনারারও সেই বিধর্মীর প্রতি মন-প্রাণ সমর্পিত৷ মোঘল সম্রাটের চক্রান্তে দেওয়ান-ই-আম এ বন্দি শিবাজী পলায়নের বুদ্ধি এঁটে রোসনারাকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ কিন্তু রোসনারাকে তার মনের গোপন কথাটি জানাবে কে৷ সে নিজেই বন্দিত্ব থেকে পালিয়ে যাচ্ছে! যার মধ্য দিয়ে প্রণয়িনীর কাছে সংবাদ পাঠানো যাবে তাকে হতে হবে বিশ্বাসী, সাহসী, বুদ্ধিমান সর্বোপরি কর্মের প্রতি দৃঢ় মনস্বতাসম্পন্ন৷ কারণ সে-ই একমাত্র জানবে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকা শিবাজীর গোপন ঠিকানা৷ সেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়লে কোনো অবস্থাতেই যেন সে আসল সত্য প্রকাশ না করে ফেলে৷ অতএব অনেক বুদ্ধি খরচ করে সেই মারাঠাবীর তার দূতী রূপে নির্বাচন করে এক বারাঙ্গনাকে৷ যে শিবাজীর অভিজ্ঞানস্বরূপ অঙ্গুরীয় নিয়ে রোসনারার বিশ্বাস অর্জন করবে এবং সমস্ত খবর জানার পর যদি রোসনারাও শিবাজীর অনুসরণে যেতে চায় তাহলে তাকে পৌঁছে দেবে শিবাজীর ঠিকানায় আর না এলে নিজেই ফিরে এসে সে সংবাদ জানাবে তাকে৷
এই বহুপুরুষভোগ্যা রমণী শিবাজীর দূতী হয়ে ঔরঙ্গজেবের জন্মদিনের উৎসবমুখর সমারোহের মধ্যে দেহের পসরার বদলে অন্য নানাবিধ বস্তুরাজী দিয়ে সঙ্গে শিবাজীর উষ্ণীষ ও অঙ্গুরীয়সহ দোকান সাজিয়ে বসে থাকে; উদ্দেশ্য রোসনারার দৃষ্টি আকর্ষণ করা৷ তা সম্ভবও হয়৷ পিতামহ সাহজাহানের সঙ্গে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সেই দোকানের সামনে উপস্থিত হয়ে এবং দোকানের বিক্রেতার সঙ্গে আড়ালে কথা বলার পর সব বুঝতে পারে সে৷ শিবাজীর অঙ্গুরীয় উষ্ণীষ গ্রহণ করে নিজের হাতের অঙ্গুরীয় তুলে দেয় বারাঙ্গনার হস্তে৷ সঙ্গে লিখে দেয় একখানি পত্র৷
আশ্চর্যের বিষয় হল একজন পালিয়ে যাওয়া বন্দি যার ধরা পড়লে নির্মম মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো শাস্তি হতে পারে না সে কি করে একজন সামান্য বারবনিতাকে বিশ্বাস করতে পারে৷ যে বারবনিতাদের অর্থ হয় পরমার্থ এবং শঠতা, কপটতা, মিথ্যাচার, অভিনয়ই হল জীবন-জীবিকার প্রধান মূলধন! রোসনারাও শিবাজীর এই ব্যবহারে বিস্মিত না হয়ে পারেনি৷ যাই হোক শেষ পর্যন্ত সে শিবাজীর প্রণয়বার্তার যথাযথ উত্তর পাঠিয়েছিল সেই গণিকার দ্বারাই৷
শিবাজী সেই বারবনিতাকে যে কর্মের দায়িত্ব দিয়েছে তা সেই রমণীর পক্ষে যেমন ভয়ঙ্কর ঝুঁকির কাজ তেমনি যে পথে সেই মহানায়ক অবস্থান করছে সেই গন্তব্যস্থানও ভয়ানক দুর্গম; পদে পদে বিপদের সম্ভবনা৷ লেখক সেই পথের বর্ণনা করে বলেছেন—‘‘সেই দিন নিশীথসময়ে পূর্ব্বোক্ত বারাঙ্গনা একাকিনী সেতুদ্বারা যমুনা উত্তীর্ণ হইয়া দক্ষিণাভিমুখে গমন করিতে লাগিল৷ সে দিক প্রাচীন দিল্লী, তথায় অনেকানেক ভগ্ন প্রাসাদ এবং বৃহৎ বৃহৎ দেবালয় সকল অদ্যপি দৃষ্ট হইয়া থাকে৷ তৎকালে এক্ষণকার অপেক্ষা আরও অধিক ছিল৷ ঐ স্থানে একটি মনুষ্যেরও গমনাগমন নাই৷ কেবল স্থানে স্থানে শৃগালাদি হিংস্র জন্তুরই উপদ্রব আছে৷ যাহা হউক ঐ স্ত্রী একাকিনী নিঃশঙ্কহৃদয়ে ঐ স্থান দিয়া গমন করত কিয়ৎ দূর অন্তরে এক ভগ্ন দেবালয়ে প্রবেশ করিল৷’’৩ এই পণ্যরমণী দেহবিকিকিনি করে জীবন কাটালেও তার যে একটা কোমল হৃদয় আছে এবং যে হৃদয়ে মানুষের প্রতি বিশ্বাস, কর্তব্য এবং কৃতজ্ঞতা বোধ আছে তা শিবাজীর দূতীরূপে তাকে নির্বাচন করার মধ্যে দিয়ে যেমন প্রমাণিত হয় তেমনি রোসনারার সমস্ত আচরণ, কথা শিবাজীর সম্মুখে ব্যক্ত করার মধ্য দিয়েও ধরা পড়ে৷ যার মনে অনুভবশক্তি আছে সে সহজেই অন্যের মন বুঝতে পারে সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না৷ সে শিবাজীকে বলে—‘‘মহারাজ! সেই বাদসাহ-পুত্রীর ন্যায় উদার-চরিত্রা কামিনী কখনো দেখি নাই শুনি নাই—যাহা ঘটিয়াছে তাহা আনুপূবর্বীক্রমে বর্ণনা করিতেছি শ্রবণ করুন৷’’৪ বাদশাহকন্যা শিবাজীর প্রতি প্রণয়পাশে আবদ্ধ হলেও, তার উদ্দেশে তার দেহ-মন সমর্পণ করলেও ঔরঙ্গজেবের বিরোধিতায় তার জন্য ক্ষুদ্র মারাঠাবীরের ভয়ানক সর্বনাশ করে প্রেমিকের পদমূলে নিজেকে সশরীরে সঁপে দিতে পারেনি৷ কিন্তু পত্রে তার উদ্দেশে লিখেছে—‘‘তুমিই আমার স্বামী, তাহার চিহ্নস্বরূপ আমার হস্তাঙ্গুরীয় তোমার অঙ্গুরীয়ের সহিত বিনিময় করিলাম—অতএব অদ্যাবধি আমাদিগের বিবাহ সম্পন্ন হইল৷’’৫ শিবাজীর গুরু রামদাস স্বামী তাকে আদেশ করে বলেন—‘‘মহারাজ! আমি অনুমতি করিতেছি আপনি ঐ অঙ্গুরীয় গ্রহণ করুন—এবং যদি শাস্ত্র সত্য হয়, তবে পরজন্মে বাদসাহ-কন্যাই আপনকার সহধর্মিণী হইবেন ইহার সন্দেহ নাই৷’’৬
পরজন্মে রোসনারা শিবাজীর যথার্থ সহধর্মিণী হয়েছিল কিনা জানা নেই কিন্তু ইহজন্মে অঙ্গুরীয় বিনিময় করে যে বিবাহকার্য সম্পন্ন হল তাদের তাতে পৌরহিত্য করল একজন রূপাজীবা৷ সমাজে যারা ঘৃণিতা এবং বেশ্যা বলে সমাজপ্রতিনিধিরা লোকসংযোগ থেকে যাদের সহস্রযোজন দূরে সরিয়ে রাখে লেখক তেমনি এক পণ্যরমণীকে বোধ-বুদ্ধি-বিচারক্ষমতা দিতে কার্পণ্য করেন নি; কোথাও কোথাও সে যে স্ত্রীলোক সেই কথাটিও ব্যক্ত করেছেন কিন্তু মানুষ কতটা ভেবেছেন তা ভাববার বিষয়৷ একজন মেয়ে মানুষকে দিয়ে এতটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করাতে পেরেছেন শুধুমাত্র সে একজন অঘটনপটিয়সী বারবনিতা বলে! উপন্যাসের নাম অঙ্গুরীয় বিনিময়৷ কাহিনি ও ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুও এই অঙ্গুরীয় বিনিময়৷ অথচ যে নিজের প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করে দুজন মহান নর-নারীর মধ্যে এই মহৎ কার্যটি সম্পন্ন করল রচনাকার তার নামটুকু নির্দিষ্ট করারও প্রয়োজন মনে করেননি৷ কারণ মানুষের একটা নাম থাকে আর তা যদি উপন্যাসের কোনো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের একজন হয় তাহলে তো একটা নাম থাকা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়৷ সেই পণ্যরমণীকে কোনোভাবেই উপন্যাসের গৌণ চরিত্র বলা যায় না৷ অথচ তার কোনো নাম নেই৷ নাম মানুষের থাকে; গণিকারা আবার মানুষ নাকি! এই বোধটাই যেন আলোচ্য উপন্যাসে গণিকাদের সামাজিক অবস্থানকে চিনিয়ে দেয়৷
বাংলা উপন্যাসের জগতে বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাব নতুন এক দিকনির্দেশনা৷ তিনি বৈশিষ্টগুণসম্পন্ন আদর্শ উপন্যাসে প্রতিষ্ঠাতাও৷ মানুষের জীবনের নানা ঘটনারাজীকে তিনি বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন৷ সাধারণ মানবজীবনের ছোটো-বড় আশা-আকাঙ্খাকে ফ্রয়েড-ইয়ুং-এর তত্ত্ব ছাড়াই নিপুণভাবে রূপায়িত করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তার মধ্যে পাপ-পুণ্যের একটা সূক্ষ্ণ পর্দা, নীতির অদৃশ্য আচ্ছাদন চরিত্রগুলিকে আবৃত করে রেখেছিল৷ তাই তাঁর উপন্যাসে পতিতা নারীরা এসেছিল ঠিক গণিকা হিসেবে নয়; তারা প্রবঞ্চিতা-স্বৈরিণী-ব্যভিচারিণী হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করেছে৷ ‘কপালকুণ্ডলা’-র মতিবিবি, ‘বিষবৃক্ষ’-র হীরা, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর রোহিণীরা নানা কারণে সমাজ থেকে পতিত হতে বাধ্য হয়েছে৷
এছাড়া ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে গণিকাচরিত্র বা তথাকথিত স্বৈরিণী চরিত্র না থাকলেও সেখানেও পতিতা নারীদের প্রতি সমাজের কেমন মনোভাব তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না৷
‘দুর্গেশনন্দিনী’-তে ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে প্রাধান্য পেয়েছে তিলোত্তমা জগৎ সিংহের প্রেম কাহিনি৷ এছাড়া বীরেন্দ্র সিংহের গৃহে দাসী বা রক্ষিতার বেশে বসবাসকারী বিমলাও আসলে বীরেন্দ্রর সতী-সাধ্বী সহধর্মিণী৷ বিমলার প্রসঙ্গে আর কেউ কিছু না জানলেও বীরেন্দ্র সিংহের কিছু অজানা ছিল না৷ তার মৃত্যুর পর এ বিষয়ে নিঃসন্দিগ্ধ হয়েছে সকলে৷ যাই হোক এই সম্পর্কগুলির মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে ব্যভিচারের কোনো প্রশ্ন নেই৷ কিন্তু ঘটনা জট পাকে বীরেন্দ্র সিংহের কন্যা তিলোত্তমা এবং পত্নী বিমলা কতলু খাঁর অন্তপুরে বন্দি হলে৷ পাঠান বীর কতলু খাঁ দুর্বৃত্ত লম্পট৷ যুদ্ধে জয়লাভ করে সবচেয়ে সুন্দরী রমণীদের সে নিজের হারেমে বন্দি করে নির্দ্বিধায় তার ভোগ-লালসা প্রশমিত করে৷ সেই দৃষ্টিতে তিলোত্তমা ও তার বিমাতা বিমলাও অনিন্দ্যসুন্দরী বঙ্গরমণী৷ তারা হারেমে বন্দি হলে তিলোত্তমার প্রেমিক জগৎ সিংহ এবং পিতা বীরেন্দ্র সিংহ ধরেই নেয় যে কতলু খাঁ তাদের সতীত্ব হরণ করেছে এবং তারা তার উপপত্নীত্ব স্বীকার করে নিয়েছে৷ সেই ধরে নেওয়াকে কেন্দ্র করে একজনের দুর্বার প্রেম পিপাসা এবং আরেকজনের সীমাহীন বাৎসল্য মুহূর্তেই কর্পূরের মতো উবে যায়৷ বন্দি অসহায় দুজন কুলনারীর পরিস্থিতি বিচার না করেই তাদের হীন প্রতিপন্ন করতে দুই বীরপুরুষের সামান্যতম অনুকম্পাও হয় না৷ বীরেন্দ্র সিংহ মৃত্যুদণ্ড গ্রহণের পূর্বে তার একমাত্র স্নেহ পুত্তলিকা তিলোত্তমার সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্যন্ত করতে চায় না৷ সে সম্পর্কে কতলু খাঁকে বলে—‘‘যদি আমার কন্যা তোমার গৃহে জীবিতা থাকে, তবে সাক্ষাৎ করিবনা৷ যদি মরিয়া থাকে, লইয়া আইস, কোলে করিয়া মরিব৷’’৭ এবং সে সময় একজন তার হাতে বিমলার পত্র তুলে দিলে জনতার মধ্য থেকে কেউ যখন বলে উঠে যে সেটা মনে হয় তার কন্যার পত্র ছিল তখন প্রবল ঘৃণায় সুস্পষ্টভাবে জনান্তিকে জানায়—‘‘কে বলে আমার কন্যা? আমার কন্যা নাই৷’’৮ মেয়েকে শত্রুর হাত থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা রাখেনা যে পিতা তার শত্রু হাতে বন্দি কন্যাকে অসতী ভেবে ঘৃণা করাতে সামান্য লজ্জাবোধও হয় না৷ এই হল সমাজ! তিলোত্তমা স্বেচ্ছায় বিধর্মীর গৃহে উপস্থিত হয়নি, তাকে বলপূর্বক অপহরণ করা হয়েছে এবং সে কথা তার পিতার অজানাও নয়৷ তার পরেও তাকে ঘৃণা করার মধ্য দিয়ে সমাজের নগ্ন কুৎসিত দিকটাই প্রকটিত হয়ে উঠে৷ সেখানে বীরেন্দ্র সিংহ পিতা নয়, যে সমাজ নষ্টসতীত্বের নারীদের ঘৃণা করে তাদের একজন প্রতিনিধিমাত্র৷ জগৎ সিংহের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য৷ তিলোত্তমার পিতার বিরোধ জেনেও সে পিছপা হতে পারে না প্রণয়িনীর দুর্বার প্রেমাকর্ষণ থেকে৷ মৃত্যুর মুখের কাছে পৌঁছেও তার একই ধ্যান সে তিলোত্তমা৷ তার সম্মুখেই বন্দি হয় তার হৃদয়েশ্বরী৷ নিজের বীরত্ব দিয়ে তাকে যেমন রক্ষা করতে পারে না তেমনি নিজেকেও নয়৷ সেও চূড়ান্ত আহতাবস্থায় কতলু খাঁর হাতে বন্দি৷ তার পরিচর্যায় রাতকে দিন করে চলেছে কতলু খাঁর কন্যা আয়েষা৷ সেখানে থাকাকালীন সময়ে সে যখন জানতে পারে কতলু খাঁর অন্তপুরে বন্দি রয়েছে প্রেমিকা, তারও দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে সে নিশ্চয় সেই পাঠান দুর্বৃত্তের উপপত্নী হয়ে অবস্থান করছে৷ মুহূর্তে সেই সীমাহীন ভালোবাসা রূপান্তরিত হয় তীব্র ঘৃণায়৷ যাকে পাওয়ার জন্য একদিন সে জীবনপণ করতে দ্বিধা করেনি সেই আবার অন্য প্রতিজ্ঞা করে প্রেমিকা বন্দিনী হওয়ার খবর পেয়ে—‘‘বিধর্ম্মীর উপপত্নীকে এ চিত্ত হইতে দূর করিব;’’৯ মনে মনে গুরুদেবকে স্মরণ করে বার বার বলেছে—‘‘দেখ গুরুদেব! তুমি অন্তর্যামী, অন্তস্থল পর্য্যন্ত দৃষ্টি করিয়া দেখ, আর আমি তিলোত্তমার প্রণয়প্রার্থী নহি, আর আমি তাহার দর্শনাভিলাষী নহি৷’’১০ হায়রে নারীর সতীত্ব! ইচ্ছে-অনিচ্ছে কোনোভাবেই তা নাশ হলেই, শুধু নাশ নয় নাশ হওয়ার কল্পনা করেই সমাজ তাকে পতিত করে৷ অথচ কতলু খাঁর গৃহে বন্দি রয়েছে জগৎ সিংহ নিজেও এবং রাত-দিন কতলু খাঁর কুমারী কন্যা আয়েষার সেবা গ্রহণ করেও নিজেকে পতিত ভাবে না৷ এই উপন্যাসে বীরেন্দ্র সিংহ, জগৎ সিংহ প্রমুখের ভাবনার মধ্য দিয়ে সমাজে অসতী বা গণিকা নারীরা যে কতটা ঘৃণ্য ছিল তা অনুমান করা যায়৷ এখানে নারীর দৈহিক শুদ্ধতার প্রতি নজর দিয়ে কোন পরিস্থিতিতে তাদের সতীত্বের হানি হচ্ছে সে দিকে দৃষ্টিপাত পর্যন্ত করে না৷
এছাড়া কতলু খাঁর অন্তঃপুরে ভোগ বিলাসচিত্র, তার লাম্পট্য, নারীলোলুপতা ইত্যাদি থেকেও স্পষ্ট হয় অভিজাত সমাজের গণিকা তোষণের চিত্র৷ সেখানেও পুরুষের প্রবৃত্তির জ্বালা মেটানোর জন্য তাদের যন্ত্রবৎ ব্যবহার করা হয়েছে৷ তাদের প্রতি কোনো মানবিক আবেদনের অবকাশ রাখেননি রচনাকার৷
মতিবিবি বা লুৎফউন্নীসা ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের স্বৈরিণী৷ তার পূর্বনাম পদ্মাবতী৷ বাল্য থেকেই সে স্বাধীন প্রবৃত্তির এবং উচ্চাকাঙ্খী যার জন্য স্বামীর অনুগামিনী হয়ে স্বামী সেবার দ্বারা জীবন অতিবাহিত করা তার পক্ষে দুষ্কর হয়েছিল৷ ফলস্বরূপ বাল্য বয়সেই স্বামী পরিত্যাগ করেছিল সে৷ পদ্মাবতীর বাবা রামগোবিন্দ ঘোষালের মধ্যেও ছিল দুর্দমনীয় উচ্চাকাঙ্খা৷ এই উচ্চাকাঙ্খা তাকেও স্বাধীন প্রবৃত্তির করে তুলেছিল যা রক্তবাহিত হয়ে আত্মজার মধ্যে বহমান হয়েছিল বোধ হয়৷ এবার যদি প্রশ্ন আসে যে রামগোবিন্দ ঘোষাল তো পুরুষ মানুষ তার আবার পরাধীনতা কোথায়? তার উত্তরে বলা যায় যে প্রত্যেকটি মানুষই কোনো না কোনো শক্তির বশীভূত থাকে যা তাকে, তার ইচ্ছেকে নিয়ন্ত্রণ করে৷ সেগুলো ধর্ম, বিবেক ইত্যাদিও হতে পারে৷ পদ্মাবতীর পিতা এই সকল দিক থেকেও স্বাধীন৷ তাই উচ্চ পদ অর্থ প্রতিপত্তির আশায় বিবেক-বুদ্ধি-ধর্ম বিসর্জন দিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে৷ সেখানেই থেমে না থেকে আরও বেশি কিছু পাওয়ার আশায় স্বদেশ ত্যাগ করে আগ্রা চলে যায়৷ পিতা ধর্মান্তরিত হলে তার সঙ্গে ধর্মান্তরিত হয়ে যায় কন্যাও৷ তার নাম হয় লুৎফউন্নীসা৷ ক্রমে পিতা আগ্রার প্রধান ওমরাহদের একজন হয়ে উঠলে যৌবনবতী লুৎফউন্নীসা পারসিক, নৃত্য, গীত ইত্যাদিতে পারদর্শী হয়ে রাজধানীর অসংখ্য গুণবতী ও রূপবতীদের একজন হয়ে উঠে৷ নানা শিক্ষায় সে শিক্ষিত হয় ঠিকই কিন্তু ধর্মশিক্ষা, বা নীতিশিক্ষা যা জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে সে শিক্ষা অর্জন করার সৌভাগ্য সে পায়নি৷ ফলে ইন্দ্রিয় দমন করার ক্ষমতা হারিয়ে প্রবৃত্তির দাস হয়ে কুৎসিত যৌনাচারে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়৷ তার উশৃঙ্খলতা এতটাই দুর্দমনীয় হয়ে উঠে যে লুৎফউন্নীসার বিবেকবোধ বর্জিত পিতাও তাকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়৷ তার বিবাহ এবং পূর্বস্বামী যে জীবিত একথা কারও অজানা নয়, তাই শরীরকে ভোগ করতে পারলেও বা রক্ষিতা হিসেবে তার সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করতে পারলেও কেউ তাকে বিয়ে করতে চায় না৷ তারও প্রবৃত্তি দমন করে কারও স্ত্রী হয়ে জীবন কাটানোর ইচ্ছা বিন্দুমাত্র ছিল না৷ তাই আমীর-ওমরাহরা তাকে বিবাহ করতে অস্বীকৃত হলে সে মনে মনে ভাবে ‘‘কুসুমে কুসমে বিহারিণী ভ্রমরীর পক্ষচ্ছেদ কেন করাইব?’’১১ সে যা ভেবেছে তাই করেছে৷ নিজের জীবন-যৌবনকে বহুপুরুষের পায়ে দলিত করে আত্মসুখ লাভ করেছে৷ এখানেই যদি শেষ হয়ে যেত মতিবিবির উপাখ্যান তাহলে তার জন্য উদ্বেগের কোনো কারণ ছিল না৷ লেখক আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন তার কাহিনিকে৷ যেখানে সে আত্মদহনে পীড়িত হয়েছে; সমাজ তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে৷ এই উশৃঙ্খল ইন্দ্রিয়পরায়ণ স্বৈরিণীর মনে প্রেমের সঞ্চার ঘটেছে বর্ধমানে যাওয়ার পথে সস্ত্রীক তার পূর্ব স্বামীকে দেখে৷ স্বামীর পায়ে স্থান পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সে৷ কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়! সমাজ তাকে সবই দিয়েছিল৷ সে-ই তো তার মর্যাদা রাখতে পারেনি৷ স্বামী সংসারের মুখে পদাঘাত করে নাম লিখিয়েছে অসতীদের খাতায়৷ অসতীর স্থান সমাজে কোথায়! তাই স্বামী নবকুমার সতীর অনুসরণ করলে সমাজপতিত পদ্মাবতী পতিতই থেকে যায়৷
রচনাকার মতিবিবি বা লুৎফউন্নীসা বা পদ্মাবতীর যতটুকু পরিচয় উদ্ঘাটন করেছেন ততটুকুই তার চরিত্র বিশ্লেষণের পক্ষে যথেষ্ট৷ তার পিতা, পরিবেশ, শিক্ষা, রুচি সব এক যোগে তাকে অধঃপতিত করেছিল৷ স্নেহে রসসিক্ত করে শাসনের ডোরে কেউ কোনোদিন বাঁধেনি বা জীবনে ভালো সংস্পর্শ পেয়েছে বলেও উপন্যাসের কোথাও দেখা যায় না৷ পিতার স্বভাব বৈশিষ্ট্য জন্মসূত্রে প্রাপ্ত হয়েছিল পদ্মাবতী যা তাকে পরবর্তী জীবনে ইন্দ্রিয় পরবশ ও উশৃঙ্খল হতে সাহায্য করে৷ এছাড়া লেখক স্পষ্ট করেই বলেছেন যে দুর্ভাগ্যবশতঃ বিদ্যাসম্বন্ধে যতটা শিক্ষা হয়েছিল—‘‘ধর্ম্ম সম্বন্ধে তাঁহার কিছুই হয় নাই৷’’১২ অর্থাৎ ধর্মশিক্ষা বা নীতি শিক্ষা কিছুই পায়নি সে৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে তার পরিবার, পরিবেশ, ইত্যাদি কোনো না কোনোভাবে তাকে বহুগামীতায় পর্যবসিত করেছে৷ এই পরিবার-পরিজন পরিবেশও যে মানুষের চরিত্র গঠনে, জীবন নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা অর্জনে কতটা সহায়ক তা ‘শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত’-এ কুমারী শ্রীমতি মানদা দেবী সুস্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন—‘‘আমি সুশিক্ষা ও সৎসঙ্গ কিছুই পাই নাই৷ স্কুলে শিক্ষার ফলে কাব্য-কবিতা-গল্প উপন্যাস প্রভৃতি তরল সাহিত্যই পড়িতে শিখিয়াছি৷ তাহাতে আমার হৃদয়ে কল্পনার উত্তেজনায় দুষ্প্রবৃত্তিই সকলের আগে মাথা তুলিয়া উঠিয়াছে৷ সদগ্রন্থ কখনও পড়ি নাই—যাহাতে সংযম শিক্ষা হয়, যাহাতে ধর্মভাবের উদয় হয় এমন কোন পুস্তক কেহ আমার হাতে দেয় নাই৷ আমোদ-প্রমোদ যাহা ভোগ করিয়াছি, তাহা সমস্তই অতি নিম্ন স্তরের৷’’১৩ মানদা সম্ভ্রান্ত ঘরে রাজকীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বড় হয়েও প্রবৃত্তির তাড়নায় বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করেছে৷ তার ইন্দ্রিয়পরায়ণতা শতমুখে প্রবৃত্তির অগ্নি উদ্গার করে সেই পাপ পথে টেনে নিয়ে গেছে৷ এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য—‘‘আমাকে টানিয়া রাখিবার জন্য শাসন, মাতৃস্নেহ, আদর যত্ন ছিল না৷ আজ মনে হয়, আমার মা বাঁচিয়া থাকিলে হয়ত এ-পথে আসিতাম না৷ আমার বাবা যদি একদিনও একটু আদর করিয়া আমার দিকে মুখ তুলিয়া চাহিতেন, অথবা শাসন করিতেন তবে বোধ হয় এ জীবনের গতি ফিরিয়া যাইত৷’’১৪ তাহলে দেখা যাচ্ছে যে কারণে মানদা দেহবৃত্তির আকণ্ঠ পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছিল পদ্মাবতীর স্বেচ্ছাচারের পিছনেও প্রায় সেই একই কারণ৷ কায়িক সুখ, অর্থ খাবার ইত্যাদির জন্যেই যে মেয়েরা পতিতা হয় তা নয়, পরিবারের অসচেতন ঔদাসীন্যেও বহু নারী দেহজীবিকার পথে পা বাড়ায়৷ সমাজ পরোক্ষভাবে সে পথে যাবার জন্য ইন্ধন জোগালেও পরে তার কোনো দায় গ্রহণ করে না৷ তাই পদ্মাবতী সমাজের চোখে পতিতা ও ঘৃণিতা৷
হীরাকে দেবেন্দ্রনাথ কুন্দকে প্ররোচিত করার জন্য না লাগালে বা তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে যৌনাচারে লিপ্ত না করালে হীরা পতিত হত না৷ হীরা ‘বিষবৃক্ষ’-এর সবচেয়ে জটিল চরিত্র৷ ঈর্ষায়-প্রতিহিংসায়-বুদ্ধিচাতুর্যে-আত্মগর্বে-প্রেম-প্রণয়-ব্যর্থতায় উজ্জ্বল করে রচনা করেছেন তাকে তার রচয়িতা৷ হীরার মধ্যে লক্ষণীয় কিছু দিক হল ধনীর বিরুদ্ধে দারিদ্র্যের এক গুঢ় অভিমান এবং অকারণ বিদ্বেষ৷ সেই কারণে সে সূর্যমুখীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে৷ দেবেন্দ্রর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে এই আত্মাভিমান ও কঠোর সংযম তাকে প্রেমের পথেও অগ্রসর হতে দেয়নি৷ দেবেন্দ্রকে দেখার পর তার যৌবনের ঝরণাধারা প্রেমের আবেগে উছলে উঠে৷ আর যখনই তার মনে প্রেম জাগ্রত হয়েছে সেই মুহূর্তেই মদ্যপ-লম্পট দেবেন্দ্র তাকে দাসী ভেবে কুন্দের প্রতি তার অনুরাগ ব্যক্ত করেছে এবং তাকে পাওয়ার বিষয়ে হীরারই সাহায্যপ্রার্থী হয়েছে৷ তার ধনী বিদ্বেষের মধ্যে এতদিন কুন্দ অনুপস্থিত ছিল কিন্তু দেবেন্দ্রর অভিসন্ধি জানার পর কুন্দের প্রতিও এক বিজাতীয় হিংসায় ভেতরে ভেতরে গর্জাতে থাকে৷ ধীরে ধীরে দেবেন্দ্রর সঙ্গে তার সম্পর্ক জটিলরূপ ধারণ করে৷ হীরার কোন এক আবেশ-বিহ্বল মুহূর্তে দেবেন্দ্রর প্রতি গোপন ভালোবাসা মুখের ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার পর তার যখন চৈতন্য হয় তখন যেন তার মাথা ঘুরে যায়৷ প্রাণপণে দেবেন্দ্রকে ঘর থেকে চলে যেতে বলে কারণ সে জানে দেবেন্দ্র লম্পট; কোনো যুবতী নারীর শরীর উপভোগ করার সুযোগ পেলে সে সুযোগের সৎব্যবহার না করে ছাড়ে না এবং মদের আসরে ইয়ারবন্ধুদের সকাশে তা রসিয়ে রসিয়ে প্রকাশ করতেও তার বাঁধে না৷ ‘‘আপনি যুবতী স্ত্রী হাতে পাইলে কখন ছাড়েন না, এজন্য আমার পূজা গ্রহণ করিলেও করিতে পারেন, কিন্তু কালে আমাকে হয়ত ভুলিয়া যাইবেন, নয়ত যদি মনে রাখেন, তবে আমার কথা লইয়া দলবলের কাছে উপহাস করিবেন—এমন স্থানে কেন আমি আপনার বাঁদী হইব?’’১৫ সে স্পষ্টভাবেই স্বীকার করেছে যে দেবেন্দ্রনাথের দেবকান্তি রূপ দেখে সে তাকে ভালোবেসেছে৷ সে ভালোবাসা তার একান্ত নিজের৷ সে তার জন্য দেবেন্দ্রকে শরীর দিতে পারবে না৷ তারপরেও সে আরও ভালো করে জানে যে সে তাকে ভালোবাসেনা—মুগ্ধ কুন্দর প্রতি এবং যদি তাকে গ্রহণ করে তাহলে শরীরী ক্ষুধা মেটানোর জন্যই করবে তাই শুধুমাত্র কাম পূরণের জন্য ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও তার অঙ্কশায়িনী হয়ে কুলটা হতে পারবে না৷ হীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করলেও ভাবী মিলনের সম্ভাবনার আশা দিয়ে দেবেন্দ্রর কামপ্রবৃত্তি বিমোচনের একটা পথ খোলা রাখে৷ সে বলে—‘‘কিন্তু যে দিন আপনি আমাকে ভালবাসিবেন, সেই দিন আপনার দাসী হইয়া চরণসেবা করিব৷’’১৬ হীরার সমস্ত কথা আচার-আচরণ অনুধাবন করে লম্পট দেবেন্দ্র মনে মনে ভাবে—‘‘আমি তোমাকে চিনিলাম, এখন কলে নাচাইতে পারিব৷ যেদিন মনে করিব, সেই দিন তোমার দ্বারা কার্য্যোদ্ধার করিব৷’’১৭
দেবেন্দ্র হীরাকে পুত্তলিবৎ পরিচালিত করতে চেয়েছিল কিন্তু হীরার জটিল মনস্তত্ত্বকে অনুধাবন করতে পারেনি৷ তাই হীরার দ্বারা কুন্দনন্দিনীর সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য নগেন্দ্রনাথের বাড়িতে উপস্থিত হলে হীরার প্ররোচনায় দ্বারোয়ান দ্বারা চরম অপমানিত হয়ে প্রতিজ্ঞা করে হীরাকে তার প্রতিফল অবশ্যই ভোগ করাবে৷ গুরুতর প্রতিফলই প্রদান করেছিল দেবেন্দ্র৷ বলা হয় নারীজাতির সতীত্বের বড় রত্ন নেই; দেবেন্দ্র সেই সতীত্বই লুন্ঠন করেছিল৷ তবে বলপূর্বক নয়; বুদ্ধি খাটিয়ে৷ সে জানতো হীরা তাকে ভালোবাসে, সে জানতো তার প্রণয় আহ্বান হীরা কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারবে না৷ তাই প্রেমেরই ফাঁদ পাতে তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য৷ মালতী নামের এক স্ত্রী দ্বারা হীরাকে আহ্বান করলে দুই-একদিন ইতস্তত করার পর সে ধরা দেয়৷ দেবেন্দ্রর সেই প্রণয়ফাঁদ সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে রচনাকার বলেছেন—‘‘দেবেন্দ্র কিছুমাত্র রোষ প্রকাশ করিলেন না—ভূতপূর্ব্ব ঘটনার কোন উল্লেখ করিতে দিলেন না৷ সে সকল কথা ত্যাগ করিয়া তাহার সহিত মিষ্টালাপে প্রবৃত্ত হইলেন৷ যেমন ঊর্ণনাভ মক্ষিকার জন্য জাল পাতে, হীরার জন্য তেমনি দেবেন্দ্র জাল পাতিতে লাগিলেন৷ লুদ্ধাশয়া হীরা-মক্ষিকা সহজেই সেই জালে পড়িল৷ সে দেবেন্দ্রর মধুরালাপে মুগ্ধ এবং তাহার কৈতববাদে প্রতারিত হইল৷ মনে করিল, ইহাই প্রণয়; দেবেন্দ্র তাঁহার প্রণয়ী৷’’১৮ সে দেবেন্দ্রর বাহুমূলে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিল৷ এক লম্পটের পায়ে নিজের মহামূল্যবান সতীত্ব বিসর্জন দিয়ে পদাঘাতে তার প্রমোদ উদ্যান থেকে বিতাড়িত হয় হীরা৷ বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন—‘‘হীরা পাপিষ্ঠা—দেবেন্দ্র পাপিষ্ঠ এবং পশু৷ এইরূপ উভয়ের চিরপ্রেমের প্রতিশ্রুতি সফল হইয়া পরিণত হইল৷’’১৯ হীরাও এই অপমানের শোধ নিয়েছে দেবেন্দ্রর মানসী কুন্দনন্দিনীকে বিষ খাইয়ে মেরে৷ শেষে উন্মাদিনী বেশে শতচ্ছিন্ন মলিন বসন পড়ে রুক্ষ কেশে এবং অযত্ন লাঞ্ছিত খড়ি উঠা দেহ নিয়ে দেবেন্দ্রর মৃত্যুর পূর্বে তার সামনে গিয়ে সকল কথা ব্যক্ত করে দেবেন্দ্রনাথের তার পা ধরে গাওয়া সেই প্রণয়সম্ভাষণ উচ্চস্বরে কীর্তন করেছে—
‘‘স্মরগরলখণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং
দেহি পদপল্লবমুদারং৷’’২০
সমগ্র উপন্যাসটি অধ্যয়ন করলে সহজেই বোঝা যায় কীভাবে হীরার মতো দাসীবৃত্তি করা এক নারী শেষ পর্যন্ত প্রলোভিত হয়ে পতিত হয়৷ বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং তাকে ‘পাপিষ্ঠা’ বলে উল্লেখ করেছেন৷ তার সতীত্ব হারানোর পাপের শাস্তি দিয়ে লেখক তাকে উন্মাদিনী করে পথে ছেড়ে দিয়েছেন৷ হীরার সেই সাময়িক দুর্বলতাকেও ক্ষমা করতে পারেননি নীতিবাদী লেখক৷
‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ পতিত হয়েছে রোহিণী৷ বালবিধবা সে৷ রূপবতী এই বিধবার গুণের অন্ত্য নেই৷ গৃহকন্নার সবরকম কাজ, নানাধরনের হাতের কাজ, সেলাইকাজ, রন্ধনবিদ্যা, চুলবাঁধা কি জানে না সে৷ রচনাকার তাকে সর্বগুণবতী বলে তুলে ধরতে চেয়েছেন৷ আবার রোহিণীর দোষও অনেক৷ সে কালোপেড়ে ধুতি পরতো সাদা থানের বদলে, নিরাভরণ না থেকে হাতে চুড়ি পড়তো, পান খেয়ে ঠোঁট রাঙা করে রাখতো৷ এই কালোপেড়ে শাড়ি পরা, হাতে চুড়ি পরা এবং পান খাওয়ার মধ্য দিয়ে তার মধ্যে সমাজ বিধিকে অমান্য করার প্রবণতা শুরু থেকেই যেন ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন রচয়িতা৷ তার বৈধব্য এবং অপ্রয়োজনীয় রূপ (যা কি না পুরুষের সেবায় লাগতে পারবে না কোনোদিন) নিয়ে সর্বদাই অনুতপ্ত সে৷ তাই ভাগ্যের বঞ্চনায় ক্রন্দন করতে করতে সে বলে—‘‘কি অপরাধে এ বালবৈধব্য আমার অদৃষ্টে ঘটিল? আমি অন্যের অপেক্ষা এমন কি গুরুতর অপরাধ করিয়াছি যে, আমি এ পৃথিবীর কোন সুখভোগ করিতে পাইলাম না৷ কোন দোষে আমাকে এ রূপ যৌবন থাকিতে কেবল শুষ্ক কাষ্ঠের মত ইহাজীবন কাটাইতে হইল? যাহারা এ জীবনের সকল সুখে সুখী—মনে কর, ঐ গোবিন্দলালবাবুর স্ত্রী—তাহারা আমার অপেক্ষা কোন গুণে গুণবতী—কোন পুণ্যফলে তাহাদের কপালে এ সুখ—আমার কপালে শূন্য?’’২১
রোহিণী জীবনরসিক৷ জীবনকে সে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে চায় কিন্তু পথ নেই৷ তার মনের সেই সুপ্ত আশার মূলে বিধবা বিবাহের কথা বলে জলসিঞ্চন করে হরলাল৷—
‘‘রো৷ আপনার স্ত্রীর নামে সেই বিধবাবিবাহের কথা মনে পড়িল৷ আপনি না কি বিধবাবিবাহ করিবেন?
হর৷ ইচ্ছা ত আছে—কিন্তু মনের মত বিধবা পাই কই?…
হর৷ দেখ রোহিণী, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত৷
রো৷ তা ত এখন লোকে বলিতেছে৷
হর৷ দেখ, তুমিও একটা বিবাহ করিতে পার—কেন করিবে না?…
দেখ, তোমাদের সঙ্গে আমাদের গ্রাম সুবাদ মাত্র—সম্পর্ক বাধে না৷’’২২
হরলাল কৃষ্ণকান্তের জেষ্ঠ্যপুত্র৷ তার সেই কথা রোহিণী বিশুষ্ক অন্তরে শ্রাবণের মেঘ নিয়ে আসে৷ যদিও সে জানে হরলাল অসৎ৷ তাকে দিয়ে উইল পরিবর্তিত করিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলে সে কথা নাও রাখতে পারে৷ কিন্তু তারপরেও তৃষ্ণা যে অসীম! যে কোনোভাবেই সেই তৃষ্ণার পরিতৃপ্তি চায় সে৷ হরলালের কথামত কাজও করে সে কিন্তু তার সঙ্গে ঝগড়া করে সেই আসল উইল হরলালের হাতে তুলে দেয় না৷ তারপর রোহিণীর জীবনে আসে দ্বিতীয় পুরুষ গোবিন্দলাল৷ গোবিন্দলালের প্রতি হৃদয়ের টান প্রথম অনুভব করেছিল রোহিণীই৷ তার ভেতরকার সেই অবরুদ্ধ কামনা—যেখানে হরলাল ঢিল ছুড়ে দুলিয়ে দিয়ে গেছে; গোবিন্দলালকে দেখে তা সহস্র গুণে আলোড়িত হতে থাকে৷ বারুণীর পুকুরঘাটে জল আনতে গিয়ে গোবিন্দলালের মিষ্ট ব্যবহারে সে প্রণয়পিপাসায় অস্থির হয়ে উঠে৷ সে জানে চরিত্রবান গোবিন্দলাল ঘুণাক্ষরেও তার মনের কথা জানতে পারলে গ্রামছাড়া করে ছাড়বে—তারপরেও মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না৷ প্রেমাস্পদকে দেখার জন্য মনে অস্থির পদবিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়৷ অবশেষে হৃদয়ের দায়ভার বহন করতে না পেরে নিজের মৃত্যুকামনা করতে থাকে৷ মৃত্যু তো সহজ নয়৷ আর যার জীবনের আশা প্রবল সে মরতে চাইলেও সহজে মরতে পারে না৷ এই দুশ্চিন্তার মাঝে আরেক বড় দুশ্চিন্তা—উইল৷ সে নিজের হাতে আসল উইল সরিয়ে হরলালের দেওয়া জাল উইল রেখে এসেছে—যেখানে গোবিন্দলালের প্রাপ্য শূন্য৷ সে উইল সরাতে না পারলে গোবিন্দলাল যে ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বে তা বিচিত্র কি৷ কৃষ্ণকান্তের মৃত্যু হলে সেই জাল উইলই আসল উইল বলে চালিত হবে আর সেই আসল উইল যা সে হরলালকে না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে তা জাল বলে প্রমাণিত হবে৷ উপরন্তু তার কাকা ব্রহ্মানন্দ ঘোষও নিস্তার পাবে না৷ এতসব চিন্তা করে পুনরায় সে উইল পাল্টাতে যায়৷ কার্য সিদ্ধি হয় বটে কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না৷ ধরা পড়ে যায়৷ বিচারে যখন চরম অপদস্ত হতে থাকে তখন গোবিন্দলালের তৎপরতায় রক্ষা পায় এবং নির্জনে গোবিন্দলালের জিজ্ঞাসাবাদে নিজের হৃদয়ের কথা ব্যক্ত করে—‘‘কি? ইহজন্মে বলিতে পারিব না—কি৷ আর কিছু বলিবেন না৷ এ রোগের চিকিৎসা নাই—আমার মুক্তি নাই৷ আমি বিষ পাইলে খাইতাম৷ কিন্তু সে আপনার বাড়ীতে নহে৷’’২৩ গোবিন্দলালকে তার মনের ভাব বোঝাতে পেরে নিজেকে হাল্কা মনে করেছে সে৷ গোবিন্দলাল কথাচ্ছলে স্ত্রী ভ্রমরকে রোহিণীর তাকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিলে বালিকা স্বভাবা ভ্রমর ক্ষীরি দাসীকে দিয়ে রোহিণীকে মৃত্যুর বার্তা পাঠায়৷ রোহিণী নিজেও বোঝে তার নিজের জীবন কতটা যন্ত্রণাময় হয়ে উঠেছে৷ তার নিজের পক্ষেও সেই গুরুভার বহন করা অসম্ভব হলে সে বারুণীর পুকুরে ডুবে মরার চেষ্টা করে৷ পুকুরের স্বচ্ছ জলতল থেকে দীব্যকান্তি রোহিণীকে উদ্ধার করে তার ‘ফুল্লরক্তকুসুমকান্তি অধরযুগলে ফুল্লরক্তকুসুমকান্তি অধরযুগল স্থাপিত করিয়া’২৪ মুখে ফুৎকার দিয়ে গোবিন্দলাল তার জীবন বাঁচালে যৌবনের অসহ্য যন্ত্রণাকে ব্যক্ত করতে সে বলে—‘‘রাত্রিদিন দারুণ তৃষ্ণা, হৃদয় পুরিতেছে, সম্মুখেই শীতল জল, কিন্তু ইহজন্মে সে জল স্পর্শ করিতে পারিব না৷ আশাও নাই৷’’২৫ নানা কুৎসা, অপভাষণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তার ও গোবিন্দলালের প্রেম যেন আরও বেশি ইঙ্গিতময় হয়ে উঠেছে৷ শেষ পর্যন্ত নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে গোবিন্দলালকে পেয়েছে সে৷ নিজ এলাকা থেকে বহুদূরে প্রসাদপুরে দুজনে ভালোবাসার নীড় রচনা করেছে৷ কিন্তু সত্যিই কি সেখানে ভালোবাসা ছিল! সে গোবিন্দলালকে চেয়েছিল, পেয়েছে৷ কিন্তু তার মর্যাদা সেখানে কি৷ রক্ষিতা ছাড়া তো অন্য কিছু মনে হয় না৷ যে দুর্বার প্রেম পিপাসা তাকে দুঃসাহসী করে নারীমনের সংস্কার পরিত্যাগ করে প্রেমিকের সামনে হৃদয় উন্মোচন করতে বাধ্য করেছিল; যে দুর্দমনীয় প্রেমভার বহন করতে না পেরে বারুণীর জলে আত্মহত্যার শয্যা পেতেছিল, সেই প্রেম কেনই বা তা হলে এক বছরের মধ্যে বিরক্তির স্তরে নেমে আসে! রোহিণীর জীবনে নতুন পুরুষের প্রয়োজনই বা কেন দেখা দেয়!
গোবিন্দলালের শ্বশুর জামাতাকে সৎপথে ফিরিয়ে এনে মেয়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তার রূপবান বন্ধু রাসবিহারী দে কে পাঠায় রোহিণী-গোবিন্দলালের সংসারে৷ সে নিশাকর দাস ছদ্মনামে ভ্রমরের বিষয়ের ভাবী পত্তনিদার হয়ে প্রায় জোর করে গোবিন্দলালের সম্মুখে উপস্থিত হয়৷ আড়াল থেকে নিশাকর দাস নামের সেই যুবককে দেখে পুনরায় রোহিণীর মনে মোহের সঞ্চার হয়৷ চাকরকে বশ করে তার সঙ্গে গোপন সাক্ষাতের ব্যবস্থাও করে ফেলে৷ নিশাকর দাসকে দেখে রোহিণীর যে মনোভাব লেখক প্রকাশ করেছেন তা নিঃসন্দেহে একজন বহুভোগ্যার আচরণকে ইঙ্গিত করে—‘‘রোহিণী যে ব্রহ্মানন্দকে এত ভালবাসিত যে, তাহার সংবাদ লইবার জন্য দিগ্বিদিগজ্ঞানশূন্য হইবে, এমন খবর আমরা রাখি না৷ বুঝি আরও কিছু ছিল৷ একটু তাকাতাকি, আঁচাআঁচি হইয়াছিল৷ রোহিণী দেখিয়াছিল যে, নিশাকর রূপবান—পটোলচেরা চোখ৷ রোহিণী দেখিয়াছিল যে, মনুষ্যমধ্যে নিশাকর একজন মনুষ্যত্বে প্রধান৷’’২৬ রোহিণীর মনে মনে সংকল্প ছিল ‘‘আমি গোবিন্দলালের কাছে বিশ্বাসহন্ত্রী হইব না৷ কিন্তু বিশ্বাসহানী এক কথা—অর এ আর এক কথা৷ বুঝি সেই মহাপাপিষ্ঠা মনে করিয়াছিল, ‘‘অনবধান মৃগ পাইলে কোন ব্যাধ ব্যাধব্যবসায়ী হইয়া তাহাকে না শরবিদ্ধ করিবে?’’ ভাবিয়াছিল নারী হইয়া জেয় পুরুষ দেখিলে কোন নারী না তাহাকে জয় করিতে কামনা করিবে?’’২৭ তারপরে নির্দিষ্ট সময়ের কিছু বিলম্বে সংকেত স্থানে পৌঁছলে নিশাকরের ছদ্ম অভিমানের কৈফিয়ত দিয়ে যে বক্তব্য পেশ করে তাতেও তার বহুচারিণী মানসিকতাটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে—‘‘আমি যদি ভুলিবার লোক হইতাম, তা হলে, আমার দশা এমন হইবে কেন? একজনকে ভুলিতে না পারিয়া এ দেশে আসিয়াছি; আর আজ তোমাকে না ভুলিতে পারিয়া এখানে আসিয়াছি৷’’২৮ ঘটনাক্রমে গোবিন্দলাল অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে রোহিণীর কাহিনিতে চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে আসে৷ পিস্তল উঠিয়ে তাকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে বললে তার মুখে উচ্চারিত হয় বেঁচে থাকার চিরকালীন আর্তি—‘‘মারিও না! মারিও না! আমার নবীন বয়স, নূতন সুখ৷ আমি আর তোমায় দেখা দিব না, আর তোমার পথে আসিব না৷’’২৯ তার এই কাতর অনুনয় ছাপিয়ে গোবিন্দলালের পিস্তল গর্জে উঠে৷ নবীন বয়স, নতুন আশার একবুক স্বপ্ন নিয়ে রোহিণী চিরতরে লুপ্ত হয়ে যায়৷
বঙ্কিমচন্দ্র যে মানবিকতা দিয়ে, যে সহানুভূতি দিয়ে রোহিণীকে উপন্যাসের প্রারম্ভে অঙ্কন করেছিলেন উপন্যাসের শেষে সেই সহানুভূতি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হয়ে চরম ঘৃণায় পর্যবসিত হয়েছে৷ সেই ঘৃণা এতটাই প্রবল যে তাকে পৃথিবীর আলো-বাতাসের মধ্যে জীবন্ত রাখাও নিরাপদ মনে করেননি৷ একজন বালবিধবা রমণী যে যৌবনের মধুমাসে শরীরী উন্মাদনায় দিশেহারা হয়ে উঠবে তা মানব-শরীরের স্বাভাবিক ধর্ম৷ অথচ পুরুষ সঙ্গ সে পায়নি—পাবার সম্ভাবনাও সমাজ তার জন্য রাখেনি৷ কিন্তু উপচে পড়া রূপ, অতুলনীয় গুণরাশি কোনো কিছুরই অভাব নেই তার৷ হরলাল তার অতৃপ্ত বাসনায় বারুদ নিক্ষেপ করে যায়; গোবিন্দলালের সংস্পর্শে সেই বারুদে অগ্নিসংযোগ ঘটে৷ সেই বিস্ফোরণে প্রণয়ীর হাত ধরে ঘরের বার হতেও তার বাধে না৷ প্রসাদপুরে প্রায় একবছর সময় অতিবাহিত করে তার সঙ্গে৷ সেখানে কতটা আত্মতৃপ্তি লাভ করেছিল গোবিন্দলালের সঙ্গে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে৷ নইলে গোবিন্দলালের সঙ্গে থেকেও নিশাকরের প্রতি মুগ্ধ হতে যাবে কেন? নাকি গোবিন্দলালের রক্ষিতা হয়ে জীবন কাটাতে গিয়ে সে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল? রোহিণী কেন শেষ পর্যায়ে গিয়ে অমন আচরণ করল তা নিয়ে নানাজনে নানান ব্যাখ্যা দিয়েছেন৷ নীতিবাগীশ বঙ্কিমের বিধবার নিজের ব্রতধর্ম ভুলে পরপুরুষের অনুরক্তি ও শেষে কুলটা হওয়া মেনে নেওয়া হয়তো সম্ভব হয়নি৷ তাই যতদূর সম্ভব নীচে নামিয়ে তাকে বেশ্যার সমগোত্রীয় করে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে আাত্মতৃপ্ত হয়েছেন৷ তাঁর মতে রোহিণী পাপিষ্ঠা৷ আর সমাজে পাপিষ্ঠার কোন স্থান হয় না৷ বঙ্কিমের এই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন—‘‘পাপ-সম্বন্ধে বঙ্কিমের একটা সহজ সংকোচ, একটা স্বাভাবিক বিমুখতা ছিল; সুতরাং কোথাও তিনি ইহার সবিস্তার বর্ণনা করেন নাই, আধুনিক বাস্তব লেখকদের ন্যায় প্রতিদিনকার গ্লানি ও কলঙ্কচিহ্ন পুঞ্জীভূত করিয়া চিত্রকে মসীময় করিয়া তোলেন নাই, সর্ববিধ তথ্যবিস্তার সযত্নে বর্জন করিয়াছেন৷ কেবল পাপস্খলনের পূর্ববর্তী অবস্থাগুলিকে, আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও প্রাণপণ প্রলোভন-দমনের চেষ্টাটিকে সুরুচি ও রসজ্ঞানের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ফুটাইয়া তুলিতে চাহিয়াছেন; পাপের পঙ্কিল প্রবাহের প্রত্যেক ক্ষুদ্র বীচিবিক্ষেপ, প্রত্যেক ক্ষণস্থায়ী আবর্তসৃজন অনুসরণ করেন নাই৷ কেবল স্বল্পকালব্যাপী চেষ্টার পর এই পঙ্কিল প্রবাহকে সূর্যালোকে তুলিয়া, তাহার পর এক অবিশ্রান্ত দ্রুতগতিতে তাহাকে মরণের উপকূলে লইয়া গিয়া, প্রায়শ্চিত্তপর্বতের শিখরদেশ হইতে মৃত্যুর অতল শূন্যতার মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছেন৷’’৩০
অভিজাতগৃহের স্বেচ্ছাচারিণী রমণীদের তীব্র ইন্দ্রিয়পরায়ণতা বর্ণিত হয়েছে ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে৷ রৌশনারা, জাহানারা, জেব-উন্নীসা, উদিপুরী বেগম প্রভৃত নারী স্বেচ্ছাচারিতায় নিজেদের ডুবিয়ে রাখত৷ বঙ্কিম উপন্যাসে অভিজাতগৃহের উচ্চপদস্থ নন্দিনীদের বহুপুরুষগামিতা একটি চর্চিত বিষয়৷ তাদের বিলাস গৃহ বঙ্কিমের মতে জীবন্ত পাপাগার৷ এদের সম্পর্কে লেখক বলেছেন—‘‘এমন উর্ববশী মেনকা রম্ভার গর্ব্বখর্ব্বকারিণী সুন্দরীর সারি আর কোথাও নাই, এত ভোগবিলাস জগতে আর কোথাও নাই৷ এত মহাপাপ আর কোথাও নাই৷’’৩১ অভিজাত গৃহের এই রমণীরা রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যত বড় কৃতিত্বই দেখাক না কেন সমাজ তাদের অপযশই কীর্তন করেছে তাদের ইন্দ্রিয়াসক্তির জন্য এবং মস্তকে রাজমুকুটের তুলনায় কলঙ্কমুকুটই বেশি প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে৷
‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ হরিদাসের জবানিতে লেখা৷ এই রচনায় লেখক হরিদাসের মুখ দিয়ে সমাজের অন্যায়, অত্যাচার, কুরুচিকর আচরণ, অনৈতিক নীতিবোধ ইত্যাদি প্রকাশ করতে গিয়ে উত্থাপন করেছেন অজস্র স্বৈরিণী পতিতা দেহব্যবসায়ীর প্রসঙ্গ৷ এই উপন্যাসে ভদ্রপল্লীতে বেশ্যানিবাস নিয়ে যেমন সমালোচনা রয়েছে তেমনি রয়েছে নানা স্থানের দেহজীবী নারী তার সঙ্গে অপরাধজগতের যোগসূত্রের প্রসঙ্গ৷ সম্পূর্ণ নেতিবাচক দৃষ্টিতে গণিকাদের দেখানো হয়েছে যদিও চরিত্র হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে কোনো বারযোষিৎ-এর কথা নেই এই রচনায়৷
হরিদাস কলকাতায় বসবাসের সময়ে চিৎপুর রোড ধরে বেড়াতে বেড়াতে গরাণহাটা থেকে কলুটোলা পর্যন্ত রাস্তায় লক্ষ করে রকমারি সজ্জা ও ভঙ্গিতে রকমারি মেয়েমানুষদের৷ বলাবহুল্য এরা দেহব্যবসায়ী নারীদল৷ তাদের দেখে বিস্ময়াপন্ন হয়ে যায় হরিদাস৷ কারণ সে পূর্বে কলকাতা শহরে গণিকাদের সংখ্যাধিক্যের কথা শুনেছিল৷ তারা যে পুরুষদের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক তা হরিদাসের জবানীতেই স্পষ্ট হয়—‘‘লোকমুখে শুনেছিলেম, কলিকাতা সহরে বেশ্যা অনেক; যে সকল পণ্ডিত সাধুভাষায় কথা কন, তাঁরা বলেন, বেশ্যা মানে নগরবিলাসিনী বারাঙ্গনা; সুখবিলাসী মতিচ্ছন্ন যুবাদলের চিত্তমোহিনী-বিলাসিনী; এরা সব জঘন্য বিলাস-রসিক যুবাপুরুষের ইহকাল পরকাল ভক্ষণ করে৷’’৩২ রচনাকার অনুকম্পাহীন দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করেছেন এই বারবিলাসিনীদের জীবনকে৷ তাদের প্রতি কোনো রকম মর্যাদা না রেখে যুবক-পুরুষদের ইহকাল-পরকাল ভক্ষণকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন৷ শুধু এখানেই নয় রচনাকার আরও বলেছেন—‘‘আকার-অবয়বে ঠিক মানবী, কিন্তু ব্যবহারে এরা জানবা—পিশাচী! কলিকাতা সহর কলুষে পরিপূর্ণ!’’৩৩ এই নারীশ্রেণীর প্রতিনিধিরা যে মানুষ, তাদেরও যে হৃদয় বলে পদার্থ থাকে এবং পরিস্থিতির পরিণতিতে এদের বেশিরভাগ অংশই যে বাধ্য হয়ে এই পেশাকে আঁকরে ধরে আছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করার প্রয়োজন মনে করেন না সমাজপ্রতিভূরা৷ শুধু তাই নয় এই পণ্য রমণীদের মানবিক অস্তিত্বটুকুকেও স্বীকার করতে চাননা ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’-র কথাকার তাই চূড়ান্ত অবজ্ঞায় বলতে পারে যে তারা আকার অবয়বে মানবী হলেও ব্যবহারে সম্পূর্ণ পিশাচী৷
এই সময় সমাজে গণিকারা সর্বোতভাবে ঘৃণিত হলেও, মানুষ হিসেবে মর্যাদা না পেলেও তাদের অবস্থান যে ভদ্রপল্লীর মধ্যেই ছিল তা হরিদাসের জবানিতেই স্পষ্ট৷ ‘‘কলিকাতার বেশ্যানিবাসের প্রণালীটী অতি জঘন্য৷ গৃহস্থের বাড়ীর কাছে বেশ্যা, ছেলেদের পাঠশালার পাশে বেশ্যা, ডাক্তার-কবিরাজের আবাসের পাশে বেশ্যা, কোথাও বা ভালমানুষের মাথার উপর বেশ্যা; অধিক কথা কি, ব্রাহ্ম-সমাজ-মন্দিরের আষ্টে-পৃষ্ঠে বেশ্যা৷’’৩৪ কিন্তু দেহ-পসারিণীদের তথাকথিত ভদ্রপল্লীতে সকলের সঙ্গে বসবাস নিয়ে যে সমাজ মধ্যে আলোড়ন শুরু হয়ে গেছে তা হরিদাসের ‘কলিকাতায় বেশ্যানিবাসের প্রণালীটী অতি জঘন্য’ কথাটুকুর মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়৷ সমাজের প্রায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যেই গণিকাগমন প্রচলিত থাকলেও তাদের সকলের সঙ্গে বাস করার অধিকার নেই৷ তাদের প্রান্তিক মানুষে পরিণত করার চক্রান্ত এর বহুদিন আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল৷ ১৩.১১.১৮৫৬ সংবাদ প্রভাকরের একটি রিপোর্টে ভদ্রপল্লীতে এই শ্রেণীর নারীদের বসবাসের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে বলা হয়—‘‘অভিনব পুলিস নিয়মের মধ্যে আমারদিগের ব্যবস্থাপক মহাশয়েরা নির্দ্ধারণ করিয়াছেন যে নগরের সকল পল্লীতে বেশ্যারা বাস করিতে পারিবেক না এবং এক পল্লী মধ্যে সকলের বাস হইবারও সম্ভাবনা নাই, এবং তাহারদিগের নিমিত্ত ভিন্ন ভিন্ন কয়েক পল্লী নিরূপিত হইবেক, সেই স্থানেই তাঁহারা অবস্থান করিবেক, দুর্জ্জন, দুরাত্মা, চোর, লম্পটেরা বেশ্যালয়েই অবস্থান করে, এবং সেই স্থানেই নানাপ্রকার অসদ্বৃত্তির আতিশয্য হয়, অতএব পুলিস প্রহরিরা বিশেষ সতর্কভাবে বেশ্যাপল্লীর তত্ত্বাবধারণ করিবেক, প্রধান শান্তিরক্ষকগণ সময়ে সময়ে ঐ সকল পল্লীর নিমিত্ত কঠিনতর নিয়মাদি নির্দ্ধারণ করিতে পারিবেন৷’’৩৫ ১৯.১১.১৮৫৬-তে সংবাদ প্রভাকরে বিদ্যোৎসাহিনী সভার সম্পাদক কালীপ্রসন্ন সিংহ নগরপ্রান্তে বেশ্যাদের বসতি স্থানান্তরের জন্য স্মারকলিপি জমা দেন৷ এছাড়াও এই সংবাদ প্রভাকরেই ১১.০৩.১৮৫৭, ০২.০৪.১৮৫৭, ১৪.০১.১৮৭৯, ২৫.০৪.১৮৬৯-এ ঢাকাপ্রকাশে, ১৫.০৯.১৮৭৪ তারিখে রাজসাহী সংবাদে, ১৮.০৯.১৮৮৫ এডুকেশন গেজেটে এবং এপ্রিল, ১৮৯৫ সেবক পত্রিকায় গণিকাদের স্বতন্ত্র পল্লিতে সরানোর দাবিতে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ পায়৷ তথাকথিত ভদ্রসমাজ থেকে তাদের সরানোর জন্য সমাজপ্রভূদের যে দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টা ছিল তা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলি থেকেই স্পষ্ট৷ নীতিবোধ পরায়ণ হরিদাস কলকাতায় সকলের সঙ্গে বেশ্যাবাসের কুফল সম্পর্কে যা বলে—‘‘যে সহরের এমন দৃশ্য সে সহরের পরিণাম কি হবে, সহরবাসী ভদ্রলোকেরা সেটা কি একবারও চিন্তা করেন না?’’৩৬ তাতে যেন সুবিধাভোগী নীতিবাগীশ পুরুষসমাজের কথার প্রতিধ্বনিই শোনা যায়৷
কলকাতা শহর বিলাস-ব্যসনের কেন্দ্রভূমি৷ এর প্রাচুর্য ও বাহারে এবং কর্মসংস্থানের সুজোগ থাকায় নানা শ্রেণীর মানুষের আস্তানা হয়ে উঠেছে৷ তাদের শরীরী ক্ষুধা মেটানোর জন্য দেহের পসরা সাজিয়ে বসেছে পণ্যাঙ্গনারা৷ যেখানে রুজি-রোজগারের উপায় বেশি, সেখানে মানুষ বেশি;যেখানে মানুষ বেশি সেখানে বেশ্যা বেশি; আর যেখানেই বেশ্যা বেশি সেখানেই পাপ বেশি—এমনি ইঙ্গিত ধ্বনিত হয় শিক্ষিত পণ্ডিতগণের মুখে৷—‘‘যেখানে সহর, সেখানেই পাপ৷ সহরমাত্রেই বেশ্যা বেশী, মদ বেশী, বদমাস বেশী৷ রাজধানীতে আরো বেশী৷’’৩৭ ভাগ্যের চাকায় ঘুরতে ঘুরতে হরিদাস কাশীতে উপস্থিত হয়ে দেখে সেখানেও দেহব্যবসার রমরমা কারবার৷ শিবের ত্রশূলের ডগায় অবস্থিত মনোরম কাশী পণ্যাঙ্গনাদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে৷ গণিকা-ব্যভিচারীদের পদচারণায় সেখানকার পরিবেশ কলুষিত৷
উনিশ শতকের বাবুয়ানার প্রধান লক্ষণ হল বাইনাচের মজলিশে টাকা ওড়ানো অথবা বাইজি সমভিব্যাহারে দিন গুজরান করা৷ বাইজিরা চুক্তিভিত্তিক লেনদেন করতো৷ হরিদাস কাশীতে নীরেন্দ্রবাবুর সঙ্গে বাইনাচের মজলিশে গিয়ে এসব ব্যাপার জানতে পারে৷ হরিদাসের কাকা বাবু মোহোনলাল ঘোষ বাইজি সমভিব্যাহারে দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেছে৷ সেই বাইজিকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে অন্তঃপুরেও স্থান দিয়েছিল৷ হরিদাস নিজের পরিচয় জানার পর তার কাকার সকল কথা প্রকাশ করে৷
এছাড়া এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে এক কুলকামিনীর কথা৷ যে স্বামী-সংসারের নিরাপদ আবেষ্টনী থেকে কুলটা হয়েছিল প্রতিবেশী এক যুবকের হাত ধরে৷ কিন্তু ভোগের পিপাসা মানুষের কতদিন থাকে! যেখানে প্রেম শুধু লালসা৷ সেই যুবক জয়হরি শেষ পর্যন্ত সৌদামিনীর উপর শারীরিক-মানসিক পীড়ন করতে শুরু করে; অন্য বারনারীর আশ্রয় নিয়ে তাকে অবজ্ঞা করতে থাকে৷ নিজের ভুল বুঝতে পারে সৌদামিনী৷ কিন্তু সমাজের কি এসে যায় তাতে! পরপুরুষের হাত ধরে বেড়িয়ে যাওয়া কুলনারীর কুলে ফেরার তো কোনো পথই সমাজ রাখেনি৷ তাই হরিদাসের মধ্যস্থতায় বিশ্বেশ্বরের পায়ে নিজেকে সমর্পণ করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে থাকে৷
হরিদাস কামরূপ দর্শন করতে গিয়ে যে ডাকিনীদের কথা শোনে তা যে গণিকারই প্রতিশধ তা তার ব্যাখ্যায় সুন্দরভাবে প্রতিভাত হয়৷ সে শুনেছে কামরূপে ডাকিনীদের পাল্লায় পড়ে কমবয়সি পুরুষেরা আর ঘরমুখো হতে পারে না৷ এ প্রসঙ্গে হরিদাস স্পষ্ট করেই বলে—‘‘তিনি রহস্যচ্ছলে গণিকাদলকেই ডাকিনী বল্লেন, সেটা আমি বেশ বুঝতে পাল্লেম৷ ডাইনী, ডাকিনী, রাক্ষসী, পেত্নী ইত্যাদি যে সকল কুৎসিত কুৎসিত উপাধি আছে, চক্ষে না দেখলেও সে সকল উপাধিধারিণীকে ভয়ঙ্করী মনে হয়৷’’৩৮ রাক্ষসী পেত্নী কি রকম, এখনকার দিনে সে দুই মূর্তি দেখা যায় না; ডাইনী ডাকিনীর আকৃতি বিভিন্ন নয়; সাধারণ স্ত্রীলোকেরা যেমন, তাদের আকৃতিও সেই প্রকার; কেবল কার্য্য দ্বারা তাদের পরিচয় হয় মাত্র; কার্য্যশ্রবণে ভয়ের সঞ্চার হয়ে থাকে৷ এই বিশেষণাদির দ্বারা গণিকাদের যে কি পরিমাণ হেয় করা হয়েছে তা জলের মতোই স্বচ্ছ৷
পূর্বে জমিদারবাড়িতে বাইজিদের জন্য নির্বাচিত নাচঘরে বাইনাচের জমজমাট মজলিশ বসানোর প্রচলন থাকলেও বাবু দীনবন্ধু চট্টোপাধ্যায় ছেলেদের চরিত্র খারাপ হবে বলে বাইজিদের সংস্পর্শ কাটানোর জন্য জমিদারির উৎসব অনুষ্ঠান থেকে বাইনাচকেই তুলে দিয়েছেন৷ এমন কথাও হরিদাসের জবানিতে উঠে এসেছে৷ এর মধ্য দিয়েও প্রতিভাত হয়েছে বাইজিদের অপকারি দিক৷
এই রচনায় বর্ণিত হয়েছে আরেকজন সমাজপতিতা রঙ্গিণীর কথা৷ রঙ্গিণী পিসতুতো দাদার প্ররোচনায় ব্যভিচারী হয়েছিল৷ পরে ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে ডাকাত দলের সর্দার কর্তৃক ধর্ষিত হয়ে সেই ডাকাত দলেই ঠাঁই করে নেয়৷ সেখান থেকে সান্নিধ্য লাভ করে বর্ধমানের যুবরাজ রণেন্দ্ররাওয়ের৷ ছদ্মবেশী ডাকাত ভূষণ তথা রণেন্দ্ররাও হরিদাসের কাছে রঙ্গিণীর বিষয়ে সমস্ত কথা জানতে পারে৷ সেই লাঞ্ছিতা রমণীর অসহায়তা এক নৈতিক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায় বর্ধমানের যুবরাজকে৷ কারণ তার সাহায্য না পেলে বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া বেঁচে থাকার দ্বিতীয় কোনো উপায় থাকবে না সেই সহায়-সম্বলহীন নারীর৷ নিজের অতীত জীবনের সবকিছুকে ভুলে যাওয়ার শর্ত রেখে রণেন্দ্ররাও রঙ্গিণীকে এক বিপত্নীক প্রজার সঙ্গে বিবাহ দিয়ে সংসার আবর্তে নিক্ষেপ করেছে৷ তবুও মন্দের ভালো রঙ্গিণী স্থায়ী সংসারী একটা জীবন তো পেয়েছে৷ সমাজে পতিতা নারীর এর চেয়ে বেশি কি-ই বা প্রাপ্তি হতে পারে৷
গণিকাদের আশ্রয়ে ও সাহচর্যে অপরাধপ্রবণ মানুষের মনোশুদ্ধি ঘটানোর চেষ্টা করে এবং পুনরায় পরের অপরাধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে এমন দৃষ্টান্তও ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’-য় উল্লিখিত৷ আসলে চোর, ডাকাত, গুণ্ডা, বদমাশ শ্রেণীর লোকেরা কোনো অপরাধ করার পর তার মানসিক ক্লান্তি দূর করতে বেশ্যালয়ে উপস্থিত হয়৷ নারীসঙ্গ এবং নানারকম আনন্দজনক কর্মকাণ্ডে তাদের মানসিক গ্লানি দূর হয়৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করানোর চেষ্টা করেছেন তৎকালীন সমাজপ্রভুরা৷ আলোচ্য রচনায় দেখা যায় এক খুন সংক্রান্ত মামলায় হরিদাসের বুদ্ধিতে প্রায় সব অপরাধীই ধরা পড়ে এবং বেশির ভাগই গ্রেপ্তার হয় বারাঙ্গনাগৃহ থেকে৷ যেমন কৃষ্ণনগরের এক বেশ্যালয় থেকে ধরা পড়ে ঘনশ্যাম বিশ্বাস৷ বহরমপুর আদালতের উকীল রজনীবাবু হরিদাসকে এ সম্পর্কে জানায়—‘‘খোসখবর৷ দুই নামে দুখানা ওয়ারীণ ছিল—জটাধর আর ঘনশ্যাম৷ সম্প্রতি একটা লোক ধরা পড়েছে; হুলিয়া মিলিয়ে পুলিশের লোকেরা কৃষ্ণনগরকে এক বেশ্যালয়ে সেই লোকটাকে গ্রেপ্তার কোরেছে৷’’৩৯ অন্য আর এক গণিকার আস্তানা থেকে আবদ্ধ হয় জয়হরি বড়াল৷
উপন্যাসটিতে আরও কিছু কিছু চরিত্রের উল্লেখ আছে যারা পেশাদার গণিকা না হলেও ব্যভিচারদোষে দুষ্ট গৃহললনা৷ যেমন নবীনশশী, রাঙামামি, রূপসী এদের মধ্যে অন্যতম৷
দেখা যাচ্ছে উনিশ শতকীয় ধ্যান-ধারণায় রচিত হয়েছে ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ উপন্যাসটি৷ সতীত্বের নিক্তিতে ওজন করা হয়েছে নারীদের নানাবিধ আচার-আচরণকে৷ এর একটু এদিক ওদিক হলেই তারা হয়ে যায় কুলটা, স্বৈরিণী ব্যভিচারিণী অবশেষে বেশ্যা৷ আর যে সমস্ত ইতর শব্দের দ্বারা গণিকাদের বিশেষিত করা হয়েছে যেমন পিশাচী, রাক্ষসী, ডাইনি, পেত্নি সবতাতেই তাদের প্রতি অবমাননাকর মানসিকতা স্পষ্ট৷ রচনাকার অত্যন্ত রক্ষণশীল মানসিকতায় গণিকা চরিত্র সম্বলিত বিধি-নিষেধের কথাগুলি ব্যক্ত করেছেন৷ সমাজের চোখে তাদের অবস্থান মনুষ্যত্বের পরাকাষ্ঠায় নয় অশুভশক্তির দ্যোতক হিসেবে৷
‘এলোকেশী বেশ্যা’ উপন্যাসে গণিকাদের সামাজিক অবস্থানগত দিক পর্যালোচনা করতে গেলে প্রথমেই মনে রাখতে হবে এর রচয়িতা একজন ইংরেজ মহিলা, নাম বিবি মেরী ই লেসলি এবং ধর্মে খ্রিস্টান৷ তার সংস্কার, জীবনদর্শন বাংলার রচনাকারদের চেয়ে স্বতন্ত্র এবং ধর্মবোধও স্বতন্ত্র৷ উপন্যাসটি তাই উনিশ শতকের গতানুগতিক গণিকা ভাবনা থেকে সরে এসেছে৷
এর নায়িকা এলোকেশী৷ যে বয়সে সে বিধবা হয় সে সময় তার স্বামী, সংসার, পুরুষ সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না৷ তাই পুতুল খেলারত আটবছর বয়সি বালিকা বধূর শরীর থেকে এয়োস্ত্রীর লক্ষণস্বরূপ বালা দুগাছি খুলে নিলে ‘‘সে অমনি গহনার শোকে কেঁদে উঠলো৷’’৪০ মা, পাড়া-পড়শীরা তার জীবনের ভয়াবহ দুর্বিপাকে হায় হায় করতে থাকে তখন শিশুসুলভ ভয়ে বড়দের মধ্যে ভীতি এবং আশঙ্কার ক্রন্দন শুনে সেও কেঁদে উঠে৷ লেখিকা তার আচরণকে বিবৃত করে বলেন—‘‘এই সব দেখে শুনে, ছেলেমানুষ বৈ ত নয়, তার মনে একটু ভয় হল এবং কাঁদতে লাগলো৷ কিন্তু তার যে কি সর্ব্বনাশ হয়েছে, তার যে কপাল ভেঙ্গেছে, আহা সে তার কিছুই বুঝতে পারলে না৷’’৪১ স্বামীর বিরহ যাতনা সহ্য করতে হয়নি এলোকেশীকে; তখন তার সে বয়স হয়নি কিন্তু ধীরে ধীরে যখন বয়োবৃদ্ধি ঘটতে থাকে, জীবনের নিকুঞ্জবনে ভ্রমরের গুঞ্জন শুরু হয়ে যায় তখন সর্বোতভাবে উপলব্ধি করতে থাকে সত্যকারের মন্মথ জ্বালা৷ তাই তার বালিকা বয়সের কলি প্রস্ফুটিত হয়ে যত সৌরভ ছড়িয়েছে ততই সে মধুপের গুঞ্জন শোনার জন্য ব্যাকুলিত হয়ে পড়েছে৷
এলোকেশী সুন্দরী এবং ভাইদের তত্ত্বাবধানে লেখাপড়াও শিখে নিয়েছিল৷ তার জীবনে ফুল ছিল অত্যন্ত প্রিয়৷ তাই তাদের বাড়ির খিড়কি সংলগ্ন বাগান ওপুকুরের চারধারে অজস্র ফুলের সমারোহে নিজেকে ভরিয়ে রাখত৷ এই ফুল ভালোলাগাটাও তার উচ্ছল যৌবনের সংকেতবাহী৷ এরপর এলোকেশীর চঞ্চল যৌবনদীপ্ত মন সন্ধান পায় ক্ষেত্রবাবুর৷ সে তার ভাই-এর বন্ধু৷ তার প্রণয়পূর্ণ বাক্যে আত্মহারা হয়ে যায় সে৷ সে সময় বিধবা বিবাহের প্রচলনও শুরু হয়েছিল৷ তার বাবা-মা যদি ইচ্ছে করতো তাহলে পুনরায় মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঘরবসাতে পারতো৷ কিন্তু সেদিকে তার বাবা-মায়ের মত নেই৷ সে মদনের নিষ্ঠুর পীড়নে তাই নিজের পথ নিজেই বেছে নেয়৷ ক্ষেত্রবাবুর হাত ধরে সংসারের নিরাপদ আবেষ্টনী থেকে বেড়িয়ে পড়ে৷ হঠাৎ একদিন মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর যখন জানাজানি হয়ে যায় যে সেই যুবকের প্রলোভনে পড়ে ঘর ছেড়েছে বাড়ির মেয়ে তা তার বাড়ির সদস্যদের মনে তেমন গুরুতর আঁচড় বসায় না৷ লেখিকা বলেছেন—‘‘এই প্রকার ঘটনা নাকি প্রায়ই ঘটিয়া থাকে, এইজন্য তার মা বাপ বড় একটা মনোযোগ করিলেন না৷’’৪২ ঘরের বিধবা মেয়ে পরপুরুষের প্রলোভনে ঘরের বাইরে চলে গেল বাবা-মা ইচ্ছে করলেই তাকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে পারতো কিন্তু তা তারা পারলো না৷ মেয়ের পরবর্তী জীবন কোন দিকে বাঁক নেবে তা বুঝেও শুধুমাত্র মান অপমানের ভয়ে মেয়ের খোঁজটুকুও নিতে পারেনি তারা৷ সমাজ তার বাবা-মাকে হাত ধরে টেনে রেখেছে—কুলটা নারীর প্রতি অনমনীয় সে৷
ক্ষেত্রবাবু এলোকেশীকে নিয়ে গেছে ঠিকই ধন-রত্ন, কাপড়-চোপড়, দাস-দাসী, উত্তম বাড়ি সর্বোপরি তার সীমাহীন প্রেম দিয়ে তাকে ভরিয়ে রাখলেও বিয়ে করে সত্যকার যে সম্মান দান করা তা কিন্তু করেনি৷ একজন বিধবা রমণীকে সর্বোতভাবে ভোগ করা যায় কিন্তু তাকে বিয়ে করে গৃহিণীর মর্যাদা দেওয়ার উদারতা কজন দেখাতে পারে৷ যদিও ধনী ক্ষেত্রবাবু ইচ্ছে করলেই তাকে বিয়ে করতে পারতো৷ ক্ষেত্রবাবুর ঘরে বৌ ছিল ঠিকই, কিন্তু সে নিতান্ত বালিকা৷ কোনো যুবকের দুর্দমনীয় প্রবৃত্তি বালিকাতে তৃপ্ত হতে পারে না তাই তার প্রয়োজন হয়েছিল এলোকেশীর৷ ঘরে স্ত্রী বাইরে রক্ষিতা—আর সমাজ তো দুহাত তুলে এগিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র দিয়েই রেখেছে; কত সুবিধা!
কিন্তু এলোকেশী? তার জ্ঞান-বোধ-বুদ্ধিতে ক্ষেত্রবাবুই তো তার জীবনের একমাত্র সত্য৷ যে স্বামী দেবতা তাকে বৈধব্যের ধু-ধু শূন্যতা উপহার দিয়ে স্বামীর মহান কর্তব্য পালন করে গেছে—তাই স্বামী হোক আর প্রথম পুরুষ—সব সেই ক্ষেত্রবাবুই৷ এলোকেশী তাকে স্বামী বলেই জ্ঞান করতো৷ কিন্তু স্বামী ভাবা আর স্বামী হওয়া এক জিনিস নয়৷ অচিরেই সে তা বুঝতে পারে৷ তার কিছুদিনের রঙিন মধুর স্বপ্ন বাস্তবের ঘা খেয়ে হঠাৎ যেন জেগে উঠে তার প্রাণপ্রিয় স্বামীতুল্য ক্ষেত্রবাবু অসুস্থ হলে৷ এতদিন দিন রাত তার সঙ্গে সময় কাটালেও অসুস্থতার কারণে সে নিজগৃহে আটকে পড়ে৷ একজন সমাজপতিত রক্ষিতার সাধ্য থাকে না তার গৃহে গিয়ে প্রেমাস্পদকে সেবা করার বা একবার দুচোখ ভরে দেখার৷ তাই ক্ষেত্রবাবুর অসুস্থতায় সে পাগলিনীর ন্যায় হয়ে উঠে৷ লেখিকা বলেছেন—‘‘তিনি তাঁহাকে দেখিতে যেতেও পেতেন না, এবং সেবা শুশ্রূষা করিতেও পাইতেন না৷ দিবা নিশি মহা দুর্ভাবনায় মগ্ন ছিলেন, সময়ে আহার ও রাত্রে নিদ্রা ছিল না, সর্ব্বদাই মৃতবৎ বাস করিতেন৷’’৪৩ কয়েকটি কথার মধ্য দিয়ে লেখিকা তার অবস্থা বর্ণনা করলেও শাঁখের করাতের মতো এলোকেশীর সেই দুরবস্থা কল্পনা করে নিতে কোনো অসুবিধা হয় না৷ তারপর যখন সেই প্রিয় মানুষটির মৃত্যু সংবাদ শোনে তখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না৷ চূড়ান্ত অসহায়তায় কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে, চুল ছিঁড়ে, বুক চাপড়ে, গায়ের গয়নাগাটি সমস্ত দূরে ফেলে দিয়ে বিলাপ করতে থাকে—‘‘আমি আর এ প্রাণ রাখব না, আমি আর কি সুখে প্রাণ-ধারণ করিব, আমার আর এ ছাড় জীবনে কাজ কি! হে মৃত্যু, আমি তোমায় মিনতি করিয়া বলিতেছি, তুমি এখনই আমাকে আমার নামের সঙ্গিনী কর!’’৪৪ এলোকেশীর সেই বিলাপ হৃদয় বিদারক৷ বাল্যের সেই বৈধব্যকে অনুধাবন করতে না পারলেও যৌবনের উচ্ছল সময়ে ক্ষেত্রবাবুর মৃত্যুতে বাস্তবিকই নিজেকে বিধবা জ্ঞান করতে থাকে৷
তবু দুঃখ চিরস্থায়ী নয়৷ সময়ের সাথে সাথে দুঃখের ভার হালকা হয়ে আসে তখন নিজের দিকে তাকাতে হয়, নিজের কথা ভাবতে হয়৷ ইচ্ছে না থাকলেও বাধ্য হয়েই করতে হয়৷ এলোকেশীরও তাই হল৷ মৃত্যুকে ডাকলেই তো মৃত্যু ধরা দেয় না৷ তাই প্রেমাস্পদের শোকে কিছুদিন মুহ্যমান হয়ে মৃত্যুকে ডেকে ডেকে অবশেষে নিজের দিকে তাকাতে হল তাকে৷ এবারে জীবনের চরম সত্যকে বুঝে গেছে সে৷ মদনের দাহ সহ্য করতে না পেরে ক্ষণিক সুখের আশায় কোন নরকের পথে পা দিয়েছে তাও বোঝার বাকি নেই৷ কিন্তু বেঁচে তো থাকতে হবে৷ ক্ষুধার মুখে অন্নও তুলে দিতে হবে৷ মা-বাবাও আর বাড়িতে স্থান দেবে না আর ক্ষেত্রবাবুর বাড়ির লোকজনের তো কথাই নেই৷ কিছুদিন গয়নাগাটি বিক্রয় করে জীবন-ধারণের চেষ্টা করলেও অবশেষে তাও শেষ হয়ে আসে৷ নিরুপায় অবস্থায় নানা পাপ ইঙ্গিত সর্বদা হাতছানি দিতে থাকে৷ পাপের হাতছানিতে পাপকে গ্রহণ করেই মনে মনে ভাবে—‘‘আর কী, আমারও দুর্নাম হয়েছে, আমারত স্বভাব একবারে নষ্ট হয়ে গেছে, আর সকলেই আমাকে বেশ্যা বলিয়া জানে, তবে কেন এরূপ গোপনে থেকে মিছে কষ্ট পাই৷’’৪৫ এলোকেশী পেটের ভাতের জন্য সাধারণ সমক্ষে বেশ্যাবৃত্তি করতে শুরু করে দেয়৷
কোনো নারী একবার কুলটা হলে কোনো অবস্থাতেই যে তারা সৎপথে ফিরে যাওয়ার পথ পায় না৷ পতিতা মানদা দেবীও তাঁর আত্মচরিতে একথা বলেছেন৷ তিনি যেমন কুলটা হয়ে কোনো রকম সৎসংসর্গ বা সৎ সাহায্য পাননি সংসারের মূলস্রোতে ফিরে আসার জন্য তেমনি এলোকেশীও পায়নি৷ ক্ষেত্রবাবুর মৃত্যুর পর কেউ যদি একটু দয়াপরবশ হয়ে তাকে সম্মানিত জীবনের জন্য আহ্বান করতো তাহলে হয় তো প্রকাশ্যে দেহের দর হাকতে হতো না৷ মানদা দেবীর মতো তাকেও পাপই আশ্রয় দিয়েছে৷ পাপের ইন্ধনে মানদা তার সহচরী কালিদাসী ও রাজবালাকে বলেছিল—‘‘যদি রূপ-যৌবন বেচতে হয়, তবে লুকিয়ে চোরের মত কেন—একেবারে বাজারে নেমে দর যাচাই করে উপযুক্ত মূল্যে বিক্রয় করব৷’’৪৬ তেমনি এলোকেশীও বেশ্যা হওয়ার জন্য নিজের জীবনের কলঙ্ক, অসহায়তা এবং পেটের দায়কে কারণ দর্শিয়ে পূর্ণ নিমজ্জিত হয়েছে৷ এছাড়া শোকে বিহ্বল হয়ে জীবন অতিবাহিত করা একজন বিধবার নৈতিক কর্তব্য হলেও রক্ষিতার সে অধিকারই নেই৷ অভিভাবকহীন জীবনে হিংস্র শ্বাপদদের লুব্ধ রসনাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল না৷ বাধ্য হয়েই সে দেহব্যবসার পথ অবলম্বন করে৷ শরীরে রূপ-যৌবন থাকলে পণ্যাঙ্গনার খদ্দেরের অভাব হয় না; তারও হয়নি৷ তার রূপবহ্নিতে পুরুষেরা পতঙ্গের মত ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে৷ এলোকেশীর শূন্য ভাণ্ডার টাকা পয়সায় ভরে যায়৷ কিন্তু তার পরেও কোনো শান্তি নেই মনে৷ দেহজীবিকার গ্লানি সর্বদাই বিদ্ধ করতে থাকে তার অন্তকরণকে৷ ক্ষেত্রবাবুর সঙ্গে থাকার সময় তার মধ্যে খ্রিস্টধর্মের উদার দোলা দিয়ে গিয়েছিল একজন খ্রিস্টান মহিলা৷ তার উপহার দেওয়া ‘বাইবেল’ গ্রন্থটি সেই সময় বিহ্বল করে তুলেছিল তাকে, যদিও ক্ষেত্রবাবুর তৎপরতায় সেই ধর্মের বীজ পুনরায় প্রবৃত্তির মাটির তলে চাপা পড়ে গিয়েছিল৷ বহুদিন পর হঠাৎ করে সেই ‘বাইবেল’-খানার কথা মনে পড়ে যায় তার৷ গ্রন্থের পাতা ভাঁজ করা অংশগুলি পড়ে পাপের পরিত্রাণের পথনির্দেশ পায়৷ নিজের কৃতকর্মের জন্য আত্মগ্লানির অনুশোচনায় বিভোর হয়ে ধীরে ধীরে কঠিন পীড়ায় পতিত হয়৷ বিতৃষ্ণা এসে যায় বেশ্যাবৃত্তিতে৷ অসুস্থ এলোকেশী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে এক ধর্মপ্রাণা নারীর সংস্পর্শে আরোগ্যলাভ করে৷ দূর হয়ে যায় তার মনের ক্ষতও৷ সৎপথে রোজগার করে আত্মসুখ লাভ করে৷ লেখিকার বর্ণনায় এলোকেশীর সেই উপলব্ধি—‘‘স্বহস্তে পরিশ্রম করিয়া আপনার খাওয়া পরা চালাইতে লাগিলেন৷ নিজের পরিশ্রমের প্রথম বেতন পাইয়া তাহার কত আনন্দ, কত সুখ বোধ হইল৷ তিনি বলিলেন যে আমি এতদিন বেশ্যাবৃত্তি দ্বারা যে এত টাকা উপার্জ্জন করিয়াছিলাম তাহাতে এক দিনের জন্যও আমার এমন সুখ ও এমন আনন্দ কখন হয় নাই৷ এতদিন যত কিছু উপার্জন করিয়াছিলাম, সকলই কুকার্য্যের বেতন স্বরূপ৷ আজ এই আমার প্রথম দিন যে আমি আনন্দের সহিত পয়সা উপার্জ্জন করিলাম৷ আর আমি আজ কত সুখী হইলাম! আঃ আজ কি আনন্দ!’’৪৭ সেই কলঙ্কিত পেশা থেকে সেই প্রতিদিন মরা থেকে মুক্তি পেয়েছিল এলোকেশী এবং যৌনতার বদলে শরীরীশ্রম দিয়ে যে উপার্জন করেছিল তাতে কোনো প্রবঞ্চনা নেই কোনো পাপ নেই৷
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে উনিশ শতকীয় পরিবেশ যেখানে মেয়েদের জন্য সমাজপ্রভুরা সতী-অসতীর মাঝখানে কোনো শব্দ রাখেনি সেখানে এলোকেশীর পেশা থেকে মুক্তি, আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি এক শুভ সংকেত৷ আসলে এলোকেশীর রচয়িতা পাশ্চাত্যের নারী বলে এটা সম্ভব করেছেন এবং সেখানে অবশ্যই ধর্ম প্রচারের একটা উদ্দেশ্য রয়েছে৷ হিন্দুধর্ম আচার নিয়মকানুনে পতিতার মুক্তির বিধান নেই কিন্তু খ্রিস্টধর্মে আছে৷ যে সমস্ত ব্যভিচারী নারীর প্রসঙ্গ পড়ে এবং ‘যাও আর পাপ করিও না’৪৮ এই বাণী শুনে এই পতিতা নারীর যে ভাবান্তর তা অবশ্যই খ্রিস্টধর্মকে মহান করে দেখানোর প্রচেষ্টা৷ যেমন—‘‘কি আশ্চর্য আমি অনেক অনেক হিন্দুশাস্ত্র পরিছি বটে কিন্তু কিছুতেই কখন আমার মন এত ব্যাকুল হয় নাই; কিন্তু এই বইখানি (বাইবেলখানি) পড়িয়াই আজ আমার মন এমন হল কেন?’’৪৯ তথাকথিত হিন্দু সমাজের নিষ্ঠুর রক্ষণশীলতা এবং খ্রিস্টধর্মের উদারতা দেখিয়ে সেই ধর্মের প্রতি মানুষকে অনুরক্ত করার জন্যই যে এলোকেশীর কাহিনি রচিত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু উদ্দেশ্য যাই থাক না কেন একজন পণ্যাঙ্গনাও যে কলুষিত দেহব্যবসার পথ থেকে সরে এসে সৎ পথে জীবিকা উপার্জন করে সমাজের সকলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে তার পথনির্দেশ করেছেন রচনাকার৷ এদিক থেকে আলোচ্য উপন্যাসটি গণিকাদের সামাজিক মূল্য ফিরিয়ে দেওয়ার একটি শুভ প্রচেষ্টা৷
‘চন্দ্রা’-য় গণিকাদের প্রতি ঘৃণ্য মনোভাব পোষিত হয়েছে৷ সেখানে সম্ভ্রান্ত পুরুষদের গণিকাগমনের ইঙ্গিত থাকলেও আলাদা করে কোনো বারবধূ উপস্থাপিত হয়নি৷ রামচাঁদের স্ত্রী শান্তমণি, চন্দ্রার মা তারা, চন্দ্রা প্রমুখ সাধ্বী চরিত্রগুলি মিথ্যা সন্দেহের বশে কখনো সমাজের কাছে, কখনো নিজের পরিজনের কাছে গণিকা হিসেবে প্রতিবিম্বিত হয়েছে৷ গোঁসাইজীর ধারণায় তো চন্দ্রা পিশাচিনীর সমান৷ যুবক সন্ন্যাসী তাকে জল থেকে উদ্ধার করে শূশ্রূষা করতে গিয়ে গুরুদেবের আহ্বানে তার সামনে উপস্থিত হতে না পারলে গুরুদেব তাকে তিরস্কার করে বলেছে—‘‘যে পিশাচীকে জল হইতে উদ্ধার করিয়াছ, যাহাকে কুটীরে স্থান দিয়াছ, যাহাকে অনিমেষ নেত্রে সমস্ত রাত্রি দেখিয়াছ; যাহাকে দেখিবার জন্য আমার তত্ত্ব লও নাই, বুঝিলে, পিশাচী কে?’’৫০ সন্ন্যাসী যেমন বার বার বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে চন্দ্রাকে চন্দ্রাও তেমনি সন্ন্যাসীর একটু ক্ষতির সম্ভাবনা যেখানেই দেখেছে সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে তা প্রতিরোধ করতে৷ অথচ রমানাথকে চন্দ্রার অনুবর্তী হয়ে কথা বলতে দেখে সে তার গুরুদেবের মতোই তাকে ভ্রষ্টা ভেবেছে৷ তাই কোনো দুর্বল মুহূর্তে চন্দ্রার কথা মনে হতেই ‘‘অমনি ঘৃণা ও দ্বেষের উদয় হইল৷’’৫১ চন্দ্রা তাই তার মিথ্যা ভ্রম ভাঙানোর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে যে, যতদিন প্রকৃত সত্য সন্ন্যাসীর হৃদয় গোচর না হবে ততদিন তার মুক্তি নেই৷ অবশেষে তার উদ্যোগে ভয়ানক শাস্তি থেকে মুক্ত হয়ে চন্দ্রার সত্য স্বরূপের সন্ধান পেয়ে চন্দ্রার কাছে ছুটে গিয়েছে, চন্দ্রা কিন্তু তার সামনে আসেনি৷ যে প্রেমাস্পদকে একবার দেখার জন্য চন্দ্রা জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারতো সে দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছে জেনেও চন্দ্রা দেখা দেয়নি—তার আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব সে কাজ করতে দেয়নি৷ একটা চিঠির মধ্য দিয়ে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে৷ যে পুরুষসমাজ কথায় কথায় মেয়েদের কুলটা-কলঙ্কিনী-বেশ্যা বানিয়ে চরম ঘৃণায় অপদস্ত করতে পারে প্রেমিকের কাছে ফিরে না গিয়ে সেই সমাজের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ পোষণ করেছে চন্দ্রা৷ উনিশ শতকীয় ধ্যান-ধারণায় গিরিশচন্দ্রের সৃষ্ট চন্দ্রার সেই প্রতিবাদ নারীর ব্যক্তিত্বরক্ষার লড়াইকে বহুবিস্তৃত করে তুলেছে৷
চন্দ্রা তার সমস্ত ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদাবোধ অর্জন করেছিল তার মায়ের কাছ থেকে৷ তার মা তারা যুবক জনার্দ্দনে প্রেমে পাগলিনী হয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বি হয়েও ঘর ছেড়েছিল প্রেমিকের সঙ্গে৷ এ সমাজ তাকে মেনে নেয়নি৷ সে জনার্দ্দনের বিবাহিতা স্ত্রী হয়েও সমাজের কাছ থেকে পেয়েছিল রক্ষিতার অপমান৷ তবুও সহ্য করেছিল সব কারণ স্বামী বিরূপ নয়; তার কাছে নিজের সম্মান ঠিক ছিল৷ কিন্তু সেই স্বামীই যখন পিতৃতুল্য ইংরাজ সাহেবের সঙ্গে রাত্রি বেলায় তাকে কথা বলতে দেখে মিথ্যা সন্দেহে অপমান করে পরিত্যাগ করে চলে যায় তখন তা সহ্য করতে পারেনি৷ স্বামীর ঔরসজাত কন্যা চন্দ্রার দশবছর বয়ঃক্রমে সে সমাজের চোখে নিজেকে মৃত প্রমাণিত করে স্বামীর পেছনে ছুটতে থাকে ভিখারিণী বেশে৷ উদ্দেশ্য প্রকৃত সত্য অবগত করানো৷ কিন্তু স্বামীর খোঁজ পায় না৷ স্বামীর এক প্রতিকৃতিকে অবলম্বন করে নিজের মনের সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিয়ে মানসিক জ্বালা অপনোদন করে৷ সে ছবিকে লক্ষ করে বলে—‘‘আরে আরে, তোর জিহ্বা পুড়িয়া গেল না? আমাকে অসতী বলিলি? তুই কে, সন্ন্যাসী বই নয়, আমি তোর নিমিত্ত পিতা মাতা ভ্রাতা সকল পরিত্যাগ করিয়াছি; তবু তোর মন উঠে না? আরে নির্দয়! আমি তোকে দেশে দেশে খুঁজিতেছি, তুই তবু আমাকে দেখা দিস না? আমি তোর জন্য পাগল, তোর জন্য ভিখারিণী৷ দেখ—চেয়ে দেখ৷ আমায় কি দেখিয়াছিলি—এখন দেখ!’’৫২ শেষ পর্যন্ত সে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ পরিকল্পনায় ব্যস্ত স্বামীকে খুঁজে পেলে ভয়ঙ্কর ক্ষোভে যুদ্ধের সমস্ত পরিকল্পনা ইংরেজদের জানিয়ে স্বামীর চরম পরাজয় সাধন করে৷ তারপর ভীষণভাবে আহত স্বামীর মাথা নিজের কোলে নিয়ে উন্মাদিনীর ন্যায় নিজের বক্ষে ছুরি মেরে স্বামীর সঙ্গে একসাথে পরলোকে চলে যায়৷ চন্দ্রার মতো শিক্ষিতা সুন্দরী তারাও স্বামীর মিথ্যা অপমান ও অপবাদকে ক্ষমা করেনি চরম দণ্ড দিয়ে তবে ক্ষান্ত হয়েছে৷ গিরিশচন্দ্র ঘোষ কলঙ্কিত নারীদের প্রতিবাদীরূপকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরেছেন৷
‘স্বর্ণবাই’ উপন্যাসের বিষয়বস্তুও প্রায় একই রকম৷ এর রচয়িতা অজ্ঞাত৷ প্রকাশ করেছেন নবকুমার দত্ত মহাশয় সম্পাদনা করে৷ সমগ্র উপন্যাসের কাহিনি পর্যালোচনা করলে এই প্রতীতি জন্মে যে ‘এলোকেশী বেশ্যা’-র মতো ‘স্বর্ণবাই’-এর রচয়িতাও কোনো খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক৷ উপন্যাসে স্বর্ণর আসল নাম কাত্যায়নী৷ তার বৈধব্যদশা প্রাপ্ত হয় দশ বছর বয়সে৷ যৌবনের মদপ্লাবী সময়ে অসামান্য রূপবতী কাত্যায়নী বাবা-মায়ের সঙ্গে তীর্থ যাত্রা করে সঙ্গীভ্রষ্ট হয়ে হস্তগত হয় প্রমোদ নামের এক চরিত্রবান যুবকের৷ সৎচরিত্রের প্রমোদ খোঁজখবর করে তাকে তার বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলেও ততক্ষণে কাত্যায়নীর হৃদয়ে উপ্ত হয়ে গেছে পাপের বীজ৷ কিছুতেই ভুলতে পারে না তাকে৷ একদিকে প্রমোদের জন্য তীব্র অনুরাগ অন্য দিকে কুসুম নামের এক বিবাহিতা প্রতিবেশিনীর মুখে শোনা দাম্পত্য প্রণয়ের গল্প তার হৃদয়াকাঙ্খাকে দুর্বার করে তোলে৷ কন্দর্পবাণের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সতেরো বছরের এক কিশোরকে প্রলুব্ধ করে ঘর ছাড়ে সে৷ তার দ্বারা পরিত্যক্ত হতে সময় লাগে না কাত্যায়নীর৷ তখন কামনার পীড়নে অন্ধ সে৷ তাই ভাড়াটেগৃহের কর্ত্রীর প্ররোচনায় এক ধনবান বৃদ্ধের উপপত্নী হয়ে পুনরায় কামতরঙ্গে লিপ্ত হয়৷ কিন্তু বৃদ্ধ তার কামনা পরিপূরণে যথার্থ নয়৷ সেই অতৃপ্তিবোধে বৃদ্ধের সমস্ত বিত্তবৈভবকে হেলায় অবহেলা করে এক যুবক ভৃত্যকে সঙ্গী করে পালিয়ে যায়৷ সেই ভৃত্য তার যথাসর্বস্ব হরণ করে নিয়ে গেলে উপায়ন্তর না দেখে প্রকাশ্যে দেহের দর হাকে অর্থাৎ বেশ্যা হয়ে যায়৷ এতক্ষণ পর্যন্ত কাত্যায়নীর জীবনের যে বর্ণনা পাওয়া গেল তাতে বোঝা যায় দুর্দমনীয় প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই সে গণিকা জীবনে পা বাড়িয়েছে৷ কিন্তু তার সেই গণিকাবৃত্তি অবলম্বন করার পিছনে সমাজের কি কোনো ভূমিকা নেই? মোটামুটিভাবে এর কারণ নির্দেশ করা যায় বাল্যবিবাহ এবং বিধবাবিবাহের অপ্রতুলতা৷ এলোকেশীও মদনজ্বালায় দেহব্যবসায়ী হয়েছিল৷ সেও ছিল বালবিধবা৷ এলোকেশী মুক্তি পেয়েছে, দেখা যাক কাত্যায়নীর মুক্তি কতদূরে৷
বহুপুরুষের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করার ফলে গণিকাদের যৌনরোগের সম্ভাবনা একশত শতাংশ৷ কাত্যায়নীও সেই রোগের শিকার হয়৷ চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয় লক হাসপাতালে৷ এ প্রসঙ্গে উঠে এসেছে চৌদ্দ আইনের প্রসঙ্গ৷ ১৮৬৮ সালে ইংরেজ সরকার ব্রিটিশ সেনাদের বেশ্যাসম্ভোগজনিত কারণে যৌনরোগের পীড়ন থেকে বাঁচাতে এই আইন প্রণয়ন করে৷ যেখানে প্রত্যেক গণিকাকে হাসপাতালে পরীক্ষা ও চিকিৎসা করিয়ে নীরোগের সার্টিফিকেট নিয়ে দেহব্যবসা বাধ্যতামূলক করা হয়৷ পরীক্ষা করার নাম করে দেহপসারিণীদের উপর চালানো হয় নির্মম অত্যাচার৷ যৌনাঙ্গ কেটে-ছিঁড়ে, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যৌনাঙ্গে প্রবেশ করিয়ে এবং কটু ঔষধ প্রদানের নামে হাসপাতালের কর্মী, ডাক্তার, নার্সরা পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠে৷ লক হাসপাতালে যৌনরোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে কাত্যায়নীও প্রায় সেই বিকৃত চিকিৎসাপ্রণালীর শিকার হয়৷ সে বলে যে সেখানে তাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে বিভিন্ন যন্ত্রাদির দ্বারা অকথ্য অত্যাচারে এবং কটু ঔষধ সেবন করিয়ে চিকিৎসা চালানো হয়৷ ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর ১৫.০৪.১৮৬৯ তারিখের একটি প্রতিবেদনেও সেই বিকৃত চিকিৎসার বিবরণ পাওয়া যায়—‘‘বেশ্যাদিগের রেজিষ্টরি ও ব্যাধি পরীক্ষা সম্বন্ধে রাজধানী মধ্যে যে কত প্রকার ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর কথা শুনা যাইতেছে, তাহা প্রকাশ করিতে হইলে বিদ্রোহীর মধ্যে গণনীয় হওয়া অসম্ভাবিত হয় না৷ অধিকন্তু অশ্লীলতা ও জগপ্রিয়তার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাওয়াও দুর্ঘট হয়৷ কেহ বলিতেছে পুলিসের লোকেরা স্ত্রীলোকদিগের প্রতি নির্দ্দয় হইয়া রেজিষ্টরির জন্য গ্রেপ্তার করিতেছে৷ তাহাদিগের ক্রন্দনে ও আর্ত্তনাদে পুলিসের আহ্লাদ বর্ধিত হইতেছে৷ কেহ বলিতেছে, পরীক্ষার সময় লৌহ শলাকা ও পিচকারি ব্যবহৃত হইতেছে৷ কোন কোন ডাক্তার অসম্ভব বল প্রকাশ করিয়া এ কাজ করিতেছেন৷ যাহাদিগের ব্যাধি নাই তাহারাও পরীক্ষার পর গৃহে আসিয়া উদর বেদনায় ৩/৪ দিন শয্যাগত থাকিতেছে৷ সেই কষ্টে ও সেই যন্ত্রণায় ২/৩ জন বেশ্যা গলায় দড়ী দিয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছে৷ সেই ভয়ে শত শত বেশ্যা কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করাতে বেশ্যাপল্লী সকল অন্ধকারময় হইয়াছে৷’’৫৩
এই যে আইনের নাম করে গণিকাদের উপর অত্যাচার তা এই বারযোষিতদের প্রতি ঘৃণ্য এবং বিকৃত মানসিকতা থেকেই উৎসারিত৷ তাদের অবজ্ঞা না করলে মানুষের প্রতি মানুষ এতটা পৈশাচিক হতে পারে না৷ ‘স্বর্ণবাই’-এর কাত্যায়নী হাসপাতালের কর্মীদের যৌন পরিষেবা ঘুস দিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে৷ তারপর নাচ-গান শিখে ‘স্বর্ণবাই’ নাম নিয়ে শুরু করে তার নতুন জীবন৷ দিগদিগন্তে তার পসার ছড়িয়ে পড়ে৷ জীবনে বহুপুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়েও তার ভেতরের পশুটির ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া প্রমোদকে কোনোভাবেই ভুলতে পারে না৷ অবশেষে এক জমিদারবাড়িতে মুজরা করতে গিয়ে দেখা পায় তার৷ সমস্ত ছলা-কলা প্রয়োগ করে সেই চরিত্রবান পুরুষটিকে বেশ্যানুগামী করে তুললেও প্রমোদ যখন তার পূর্ব পরিচয় জানতে পারে তখন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে ত্যাগ করে তাকে৷ অপমানিত স্বর্ণ হিংস্র হয়ে তার প্রতিশোধ নিতে সর্বনাশ করে তার বন্ধুর৷ সময়ের প্রবহমান ধারায় তার জ্বলে উঠা যৌবনদীপ্তি ম্লান হতে থাকে, কমতে থাকে দেহলোভী মধুপের সংখ্যা৷ এবারে চাকর শ্রেণীর যুবকেরা খদ্দের হয় তার৷ তাদের দ্বারা লাঞ্ছিতও হয় বহুবার ৷ তারপরে তারাও আর আসে না তখন ঘটক সেজে অল্পবয়সি মেয়েদের প্রলোভিত করে উপার্জন করতে থাকে৷ এক তরুণী বিধবাকে গণিকা তৈরি করে তার উপার্জনেই চলতে থাকে সে৷ নিজের অগাধ ক্ষমতা হারিয়ে পরজীবী হয়ে বেঁচে থাকার জন্য যে ধৈর্যের প্রয়োজন তা স্বর্ণবাই-এর ছিল না৷ তাই ক্রমশ অত্যাচারী হয়ে উঠলে মেয়েটি পালিয়ে যায়৷ জীবনে ব্যর্থতার গ্লানিতে, অন্নসংস্থানের অক্ষমতায় এবং হতাশায় ভয়ে ধীরে ধীরে উন্মাদ হয়ে যায়৷ তাকে ভর্তি করা হয় এক মিশনারি হাসপাতালে৷ সেখানকার এক মিশনারি মহিলা তার সেবা যত্ন ধৈর্য দিয়ে সুস্থ করে তোলে তাকে৷ স্বর্ণ তাকে সম্বোধন করে ‘নতুন মা’ বলে৷ তারই সাহায্যে বেশ্যাবৃত্তি থেকে মুক্তি পেয়ে ধনীর বাড়িতে নার্স হিসেবে যোগদান করে৷ কালক্রমে জানতে পারে সেই বাড়ি আর কারও নয়, প্রমোদের৷ কিন্তু প্রমোদের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তার সেবা ও ভালোবাসা দিয়ে বাড়ির সকলের মনজয় করে ফেলেছে সে৷ বিধবা কাত্যায়নী, বারবনিতা স্বর্ণবাই দেহজীবিকার ঘৃণ্য পঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়ে সীমাহীন আত্মপ্রসাদ লাভ করে৷ ‘এলোকেশী বেশ্যা’-র মতো এই উপন্যাস সম্পর্কেও বলা যায় যে এখানে পতিতা স্বর্ণবাই যতটুকু সম্মান পেয়েছে পুরোটাই খ্রিষ্টধর্মের উদারতার ফল৷ সেই মিশনারি নারীই তার ভেতরকার পাপ প্রবৃত্তির বীজানুকে মেরে ধর্মের বীজ পুতে দিয়েছিল—তা থেকে অঙ্কুরিত হয়েছে গ্লানিমুক্ত এক নারীবৃক্ষ৷
গণিকাদের সর্বপাপের মূল কেন্দ্র হিসেবে অভিজ্ঞানিত করা হয়েছে দুর্গাচরণ রায়ের ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ৷ ব্রহ্মা, ইন্দ্র, বরুণ, নারায়ণ এই চারজন দেবতার মর্ত্য ভ্রমণের উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার ফল এই উপন্যাস৷ স্বর্গ থেকে হরিদ্বার এবং হরিদ্বার থেকে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেবগণ উপনীত হয়েছেন কলকাতায়৷ প্রায় সমগ্র ভ্রমণ পথেই বাইজি, গণিকা, বেশ্যা, খেমটাওয়ালি, স্বৈরিণী নারীদের উপস্থিতি দেখেছেন এবং সর্বক্ষেত্রেই বর্ষণ করেছেন নেতিবাচক মনোভাব৷
দিল্লীতে বেপর্দা হয়ে খোলাগাড়িতে স্বামীদের সঙ্গে বিহার করে বলে তাদের স্বেচ্ছাচারী তকমা দান করেছেন পিতামহ ব্রহ্মা৷ তাঁর ধারণায় নারী অন্তঃপুরে বন্দি হয়ে শিক্ষা মর্যাদাচ্যুত হয়ে স্বামীর অনুবর্তনকারিণী হয়ে জীবন কাটাবে৷ তাই স্ত্রীলোকের স্বামীসমভিব্যাহারে যত্রতত্র ভ্রমণ করা প্রসঙ্গে বেদের একটি লাইন উচ্চারণ করেন৷—‘‘বেদে লেখা আছে—কলির শেষ দশায় স্ত্রীলোকেরা স্বেচ্ছাচারিণী হয়ে যথা তথা ভ্রমণ ক’রবে, তাহারই সূত্রপাত৷’’৫৪ ব্রহ্মাদেব রক্ষণশীল মানসিকতায় নারীর স্বাধীন এই দিকটির সমালোচনা করেছেন৷ দিল্লীর বাই সম্পর্কে ভাল ধারণা ছিল নারায়ণের৷ কিন্তু তাদের তামাক খাওয়া দেখে বরুণের কানে কানে বলেন—‘‘দিল্লীর বাঈ ভাল শোনা ছিল; কিন্তু মাগীরা বারাণ্ডায় ব’সে যে গুড়ুক তামাক খাচ্চে, দেখে অশ্রদ্ধা হয়ে গেল!’’৫৫ বলা বাহুল্য নানারকম ইতর লম্পট মাতাল মানুষের সংস্পর্শেই গণিকাদের ব্যবসা৷ খদ্দেরের মনোরঞ্জনের জন্য বা শিক্ষা, রুচিহীন অবহেলিত জীবনযাপনের দরুণ শুধু তামাক কেন মদ থেকে শুরু করে সমস্ত নেশাই তাদের করতে হয়৷ পুরুষের ক্ষেত্রে যা স্বাভাবিক হয় নারীর ক্ষেত্রে তা সেভাবে নয় তথাপি বারযোষিতদের নীতিবোধবর্জিত জীবনে তা অশোভনও নয়৷ এখানে নারায়ণ ইতর শব্দ প্রয়োগ করে তাদের প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন৷
বৃন্দাবনে সেবাদাসীর রমরমা কারবার৷ মহান্তরা অসংখ্য সেবাদাসী নিয়ে তাদের সঙ্গে আরাম আয়াসে দিন কাটায়৷ সেবাদাসীদের রাখার পেছনে যৌনচাহিদা পূরণেরও ইঙ্গিতও রয়েছে৷ সেবাদাসীরাও পুরুষসঙ্গ করতে অভ্যস্ত৷ দেবতাদের যুগলরূপে তাদের সঙ্গে রাত্রিযাপনের আহ্বানের মধ্যে সে দিকটি সুস্পষ্ট৷ তাদের সেই ধর্মীয় আচরণের পেছনে যৌনচারিতাকে ধিক্কার জানিয়েছেন ইন্দ্র—‘‘তোমরা চ’লে যাও, আমাদের না হয় পাপ হবে৷ কি সর্ব্বনাশ! বরুণ, এই কি তীর্থস্থান?—এই কি তীর্থস্থানের ব্যবহার? ধিক! ইহারা কি এই মন্দ অভিপ্রায়ের জন্যই বৈষ্ণবী হয়েছে! ধর্ম্মের জন্য নহে?’’৫৬ ইন্দ্রদেবের মুখে তাদের প্রতি যে ধিক্কার ধ্বনিত হয়েছে তা পুরুষতন্ত্রের মিথ্যা অস্ফালনের জন্য৷ বৃন্দাবনের সেই সেবাদাসীরা হয়তো সংসারে লাঞ্ছিত হয়ে ঈশ্বরের পদমূলে নিজেদের সমর্পণ করতে চেয়েছিল কিন্তু ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়ে বসে থাকা বাবাজী মহন্তদের তুষ্ট না করলে বৃন্দাবনেও তাদের ঠাঁই হবে না৷ মন্দের ভালো নিষিদ্ধপল্লীতে পরিত্যক্ত না হয়ে ধর্মের আড়ালে শরীরের বিনিময়ে অন্নভোগ করে বেঁচে থাকে তারা৷
লক্ষ্ণৌর বাইনাচ জগৎবিখ্যাত৷ দেবগণ সেখানে এসে অপ্সরাতুল্য বাইজিদের নৃত্য দেখে কৃতার্থ হয়ে যান৷ দেবরাজের একান্ত ইচ্ছে বাইজিদের স্বর্গে নিয়ে গিয়ে প্রত্যহ বাইনাচ দেখেন৷ বরুণকে সে ইচ্ছে প্রকাশ করতেই চটে যান ব্রহ্মা৷ তিনি মন্তব্য করেন—‘‘যে দেশে যাত্রা, থিয়েটার, বাইনাচের বেশী প্রাদুর্ভাব, সে দেশ ত উৎসন্ন যেতে ব’সেছে৷’’৫৭ অর্থাৎ যাত্রা থিয়েটারের মতো বাইজিদেরও দেশকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন৷ দেবতাদের এক বেনারসি পানের দোকানে দরকষাকষির সময় একদল বেশ্যা এসে গান শোনার জন্য টানাটানি শুরু করলে পিতামহ ব্রহ্মা ভীষণভাবে রেগে যান৷ তিনি বিরক্ত চিত্তে ঘোষণা করেন—‘‘যেখানে বেশ্যাতে এলে হাত ধরে, সে স্থানে ক্ষণকাল থাকা মহাপাপ৷’’৫৮ কি চরম অপমান! গণিকারা সমাজে এতটাই ঘৃণ্য যে তাদের স্পর্শ এবং আবাসস্থল শুধু পাপাগার নয় তা মহাপাপের কেন্দ্রস্থল৷
কাশীতে এক বঙ্গযুবতীর খেমটানাচে এবং নীলাম্বরী বসনে দিগম্বরী রূপে মোহিত হয়ে কয়েকজন যুবক তাকে হাঁ করে পর্যবেক্ষণ করছে এবং গ্লাসে গ্লাসে মদ্যপান করছে৷ পিতামহ বাঙালি রমণীর এরূপ লজ্জহীনতা দেখে বিরূপ মন্তব্য করলে বরুণ তাঁকে বলেন—‘‘আজ্ঞে, ঐ স্ত্রীলোক বাঙ্গালী বটে, কিন্তু এক্ষণে বেশ্যাস্বভাব প্রাপ্ত হওয়ায় লজ্জা সরম সকলেরই মাথা খেয়েছে৷ নচেৎ একদিন উহার লজ্জা সরম ধর্ম্মভয় সকলই ছিল৷ উহার ভাশুরই উহার এ দশা ক’রেছে৷’’৫৯ সে বৈধব্য দশায় ভাশুরের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে অবশেষে সমাজের ভয়ে উভয়ে কাশীতে আশ্রয় নিয়েছে৷ ভাশুর-ভাদ্রবৌ-এর এই অবৈধ পাপাচার শ্রবণ করে নীতিবাগীশ ব্রহ্মদেব নাক-সিটকে বলেছে—‘‘ছি! ছি! ভাশুর ভাদ্রবৌ!! কাশী! তুমি ধ্বংস হও৷—পৃথিবী! তুমি রসাতলে প্রস্থান কর, আর কেন?’’৬০ এক অসহায় অবস্থায় বিধবা হয়েও ভাশুরের অনুগ্রহে শ্বশুরবাড়িতে স্থান পেয়েছিল আরেক অসহায় পরিস্থিতিতে খেমটাওয়ালি হয়ে যুবক মদ্যপ পুরুষের মনোরঞ্জন করে জীবন-জীবিকা চালাতে হয়৷ ভাশুরের কি পরিণতি হল তার উল্লেখ নেই কিন্তু নারীটিকে গণিকার স্তরে পর্যবসিত হতে হয়৷ দেবাদিদেব মহাদেবের অতি যত্নে গড়া কাশী বেশ্যা, লম্পট, স্বৈরিণী-ব্যভিচারিণীদের লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠেছে বলে শিবের আক্ষেপের শেষ নেই৷ দেবতাদের সঙ্গে গল্পের প্রসঙ্গে শিবের মুখে উচ্চারিত হয়েছে সেই খেদোক্তি—‘‘আমার সোণার কাশীতে আর আছে কি?—যে কাশীতে বোসে কপিল সাংখ্যদর্শন লেখেন, যে কাশীতে বোসে গৌতম ন্যায়শাস্ত্র লেখেন, যে কাশী পাণিনি-ব্যাকরণ জন্য চিরপ্রসিদ্ধ, সেই কাশীতে এখন কি না কতকগুলো দুপাতা উল্টানো, নয় ত বর্ণজ্ঞানহীন ন্যায়রত্ন, বিদ্যারত্ন, শিরোরত্ন প্রভৃতি চৈতনধারী মহাত্মারা টোল খুলে দোকান পেতে বসে আছেন৷… এখন সেই কাশীতে আছে কি না কতকগুলো বেশ্যা এবং লম্পট৷’’৬১
মিরজাপুরে কোনো ঘর থেকে বামাকন্ঠ নিঃসৃত সঙ্গীত শুনে পিতামহ বরুণকে উদ্দেশ্য করে বলেন—
‘‘বরুণ! এখানেও আছে?
বরুণ৷ কি আছে?
ব্রহ্মা৷ খারাপ স্ত্রীলোক৷
বরুণ৷ আপনি খারাপ স্ত্রীলোক ব’লে ভয়ে ভয়ে আড়ষ্ট হ’লেন! আজকাল পৃথিবীর সর্ব্বত্রই খারাপ স্ত্রীলোক দেখিতে পাওয়া যায়৷ অতএব বেশ্যার নিকট দিয়া যাইলে পাপ হয়, যে নগরে বেশ্যা থাকে তথায় বাস করিলে পাপ হয়, এত বিচার ক’রে চ’লতে হ’লে আর মর্ত্ত্যে আগমন হয় না৷’’৬২ দেবতাদের রক্ষণশীল মানসিকতায় গণিকারা ‘খারাপ স্ত্রীলোক’ হিসেবে চিহ্নিত এবং ঘৃণিত৷ সেই পাপী নারীদের দেখে ব্রহ্মা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যান পাপ অর্জন হবে ভয়ে৷
গয়াতে পিণ্ড দান করলে মৃত আত্মার সদগতি প্রাপ্ত হয়৷ সেখানকার দালাল গয়ালীগুরুরা৷ তাদের সাহায্য ব্যতীত পিণ্ডদান সম্ভব নয়৷ দেবগণ সেখানে দেখেন এক বেশ্যা তার লম্পট প্রেমিকদ্বয়ের সাহায্যে গয়ালীগুরুকে জব্দ করে কম টাকা সুফল আদায় করছে৷ বেশ্যার স্পর্শদোষে দুষ্ট পিণ্ড গ্রহণ করার সহৃদয়তা নীতিনিষ্ঠ দেবতাদের নেই৷ তাই পতিতা নারীকে অর্থের বিনিময়ে সুফল দান করতে দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে যান পিতামহ৷ তিনি বলেন—‘‘যেখানে বেশ্যার দান গ্রহণ করিয়া সুফল দেয়, সেখানে এক মুহূর্তও থাকতে নাই৷ আমি এই দন্ডে গয়া পরিত্যাগ করিলাম, তোমাদের ইচ্ছা হয় থাক৷’’৬৩ একজন ঘৃণ্য বারবনিতাকে সুফল প্রদান করা দেখে ব্রহ্মাদেব এতটাই ক্রুদ্ধ হয়ে যান যে তাঁর সহযাত্রীদের পরিত্যাগ করে একাই সেই স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হন৷
মুঙ্গেরে খেমটা, বাইনাচ ইত্যাদির পিছনে খরচ করে সরকারি কর্মচারীরা যে সর্বস্বান্ত হয়ে যায় সে বর্ণনা রয়েছে৷ গণিকাদের কুহকী মায়া ঐ শ্রেণীর মানুষের অধঃপাতের মূল৷ ভাগলপুরে মানুষেরা ধর্মবোধ বিসর্জন দিয়ে, ধর্মকাজে ব্যয় না করে অপব্যয় করে গণিকাদের পিছনে৷ এখানেও গণিকাদের কুহকীমায়ায় বশীভূত তারা৷ বেশ্যারা বাবুদের সর্বনাশ করে শুধু যে অর্থ সম্মান অপহরণ করে তা নয় তারা বাবুদের ইহকাল-পরকাল ভক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়সম্পত্তিসকলও গ্রাস করে নেয়, বর্ধমানে উল্লেখ রয়েছে এমন ঘটনার৷ এই বর্ধমানেই বেশ্যার মুখে কীর্তন শ্রবণ করে বরুণ তার স্বর্গ প্রাপ্তির বিষয়ে কথা বললে ব্রহ্মা তা অস্বীকার করে জানান—‘‘ভাই! বেশ্যারা নিজের উপজীবিকার জন্যই হরিনাম করে; অতএব তাহাদের মুক্তি হইবে না৷’’৬৪ কোনো মানুষ যে কোনো পাপ করে হরিনাম উচ্চারণ করলে পাপমুক্ত হয় কারণ ধর্মবেত্তাদের মতে হরিনাম সর্বোপাপ মুক্তির আকর কিন্তু গণিকাদের পাপ পুরুষের কোনো পাপেরই সমতুল নয়৷ সেই পাপের ব্যাপ্তি এতটাই সুগভীর যে হরিনাম সর্বোপাপ মুক্তি ঘটালেও সেই পাপমুক্ত করার ক্ষমতা তার নেই৷ এই নির্মম বাক্য পুরুষশাসিত সমাজে গণিকাদের অবস্থানকে সেই স্তরে নিয়ে যায় যে স্তরের কল্পনা এখন পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি সমাজপ্রতিভুরা৷
উপন্যাসের আলোচনার সূচনাতে যেমন নারীস্বাধীনতার বিপক্ষ মতবাদ পোষণ করেছেন ব্রহ্মা তেমনি চন্দননগরেও বর্ণিত হয়েছে একই দিক৷ পিতার বিষয়-সম্পত্তির গর্বে দুইবোনের গণিকা হওয়ার প্রসঙ্গ যেমন বর্ণিত হয়েছে তেমনি স্ত্রী স্বাধীনতার ফলে স্ত্রীর অন্যপুরুষের প্রতি আসক্তির চিত্রও অঙ্কিত হয়েছে৷
বালিতে এক আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণের আচার-পরায়ণতা দেখে পিতামহ সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও সেই ব্রাহ্মণকে পরবর্তী সময়ে বেশ্যাগৃহে দেখে সমস্ত ভক্তি উবে যায়৷ বরুণ তাঁকে ব্যঙ্গ করে বলেন—‘‘ঠাকুরদা! এই বামুনকে দেখিয়া এক সময় আপনার বড় ভক্তি হইয়াছিল; এক্ষণে ইহার কার্য্য দেখুন৷ এটি বেশ্যাবাড়ী৷ ঐ বামুনের বামী নামে একটি রক্ষিতা বেশ্যা এই বাড়ীতে বাস করে৷ ঠাকুর রজনীতে সেই বামীর নিকট এসেছেন৷’’৬৫ তাঁর এই মন্তব্যে হতাশ ব্রহ্মা তাঁকে শোনায়—‘‘কলিকালে লোক চেনা ভার৷ এত সাজ গোজ, আচার ব্যবহার, আর এদিকে বেশ্যার বাড়ীতে রুটি বেগুনভাজা মদ খায়!’’৬৬ সেই আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ বেশ্যাগৃহে না গিয়ে যদি অন্য কোনো গুরুতর পাপকার্য সম্পন্ন করতো তাহলেও হয় তো পিতামহ এত বেশি হতাশ হতেন না৷
কলকাতায় উপস্থিত হয়ে প্রথমেই দর্শন করেন এক ভ্রষ্টা গৃহবধূর নষ্ট জীবনযাপনের আলেখ্য৷ আরেক স্থানে পরীর মত সুন্দরী রমণীদের মানুষের গাড়ি, পাল্কি ধরে টানাটানি করতে দেখে দৌঁড়ে সরে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ব্রহ্মা তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন—‘‘অমন সর্ব্বনেশে স্থানে নিয়ে যায় ও মাগীগুলো কে৷’’৬৭ বরুণ বুঝিয়ে দেন যে তারা জার্মানি, ইটালী, রুসিয়া প্রভৃতি স্থান থেকে আগত বারাঙ্গনা৷ ভদ্রলোকে গাড়ি, পাল্কি ধরে টানাটানি করে তারা আনন্দলাভ করে৷ এখানেও উপস্থিত হয়েছে লক হাসপাতালের প্রসঙ্গ৷ বরুণ ইন্দ্রকে সে বিষয়ে এবং চৌদ্দ আইন সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান দান করেন৷ স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত মেছুনি রমণীদের বিলোল কটাক্ষে ভীত হয়ে নারায়ণ বলেন—‘‘বরুণ, অপর রাস্তা দিয়া চল৷ মেছুনী মাগীরা বড় দুষ্ট, ওদিক দিয়ে যাইবার আবশ্যকতা নাই৷’’৬৮
চুনাগলিতে ফিরিঙ্গি গণিকাদের বাস৷ এই পণ্যাঙ্গনাদের দেবতারা কখনো ‘মাগী’ কখনো ‘পেত্নী’ কখনো বা ‘মিন্সে ধরা’ ইত্যাদি অভিধায় অভিনন্দিত করে হৃদয়ের ঘৃণ্য মনোভাবকে প্রকাশ করেছেন৷ তার পর হাড়কাটা গলিতে৷ সেখানে পরিবেশ তুলনামূলক শান্ত৷ বরুণদেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বোঝান যে—‘‘এই স্থানে যত বাঙ্গালী বেশ্যারা বাস করে৷ স্থানটি বদমায়েসীর প্রধান আড্ডা৷ আমাদের সৌভাগ্য যে বেশ্যামাগীরা এক্ষণে ঘুমাইতেছে৷ সমস্ত রাত্রি জাগিয়া এই সময়ে মাগীগুলো ঘুমায়, আবার সন্ধ্যাকালে উঠিবে এবং যাহারা যেমন সম্ভব সাজ গোজ করিয়া এই রাস্তাগুলোয় ছুটাছুটি করিয়া তোলপাড় করিবে৷ ঐ সময়ে ইহারা কি ভদ্র কি ইতর যাহাকে পায় হাত ধরিয়া টানাটানি করে৷ ঐ সময়ে আবার এই ব্যবসায়ের দালালেরাও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়ায়৷’’৬৯ এখানেও বরুণদেব তাদের জীবনাচারের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা অবমাননামূলক৷ সেখানেই এক পুরোহিতকে বেশ্যাগৃহে পৌরহিত্য করে বেড়িয়ে আসতে দেখেন এবং সে বিষয়ে নিজপুত্রকে দেওয়া উপদেশের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন প্রজাপতি৷ অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে ব্যক্ত করেন তাঁর মনের ভাব—‘‘বুড়ো বামুন মরিবার বয়েস, এখনও শমনের ভয় নাই! মাথায় ত শিখাটিখা বেশ রেখেছে৷’’৭০ পিতামহকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে ইন্দ্র ও বরুণ মেছুয়াবাজারে উপস্থিত হয়ে নানারকম চিত্র দেখে৷ গণিকাদের নিয়ে মত্ত হয়ে পুরুষেরা যেভাবে পাপাচারে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয় সে সম্পর্কে রচনাকারও ঘৃণা প্রকাশ করেন৷ মেছুয়া বাজার সম্পর্কে তাই উঠে আসে—‘‘এই সময় সন্ধ্যা হওয়ায় স্থানটির শ্রী ফিরিয়া গেল৷ এখানকার লোকগুলো আর যেন নিরানন্দ কাহাকে বলে জানে না৷ স্বর্গ ও নরক আছে কি না, তাহাও তাহাদের স্মরণ নাই৷ পাপ পুণ্য কাহাকে বলে সে বোধ দূরে পলাইল৷ সকলেই বেশ্যা ও মদে মজিল৷’’৭১ অর্থাৎ বেশ্যা সংস্পর্শে গিয়ে পাপ-পুণ্য, ভালো-মন্দ, স্বর্গ-নরকের ব্যবধানও মুছে যায় তাই আলোচ্য উপন্যাসে সর্বোতভাবে গণিকারা পরিত্যাজ্য৷
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ সুস্পষ্টভাবে গণিকাদের উপর বর্ষিত হয়েছে অপবাক্য৷ তাদের শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন কোনো কিছুর প্রতিই দৃষ্টি নেই রচনাকারের৷ তারা তাঁর চোখে শুধু মাত্র পুরুষের জীবন ধ্বংসকারী এবং এক একজন যেন একএকটা জীবন্ত পাপাগার৷ তাদের মুক্তি নেই৷
‘চন্দ্রা’, ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’, ‘নয়নতারা’ ইত্যাদি উপন্যাসগুলিতেও গণিকাদের প্রতি ঘৃণ্যমনস্কতা ফুটে উঠেছে৷ ‘চন্দ্রা’ উপন্যাসে চন্দ্রার বাবা শুধুমাত্র মিথ্যা সন্দেহবশে স্ত্রীকে ব্যভিচারিণী জ্ঞানে পরিত্যাগ করে গোঁসাই হয়ে যায়৷ স্বামীর দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে চন্দ্রার মা তারা হয় ভিখারিনি৷ আর চন্দ্রা পিতা-মাতা জীবিত থাকতেও তাদের সঙ্গচ্যুত হয়ে অনাথিনীর মত জীবন কাটায়৷ নারীর সতীত্ব সমাজের বুকে এতটাই ঠুনকো যে মিথ্যা সন্দেহ করেও সেই সতীত্বকে অনায়াসে পদদলিত করতে পারে পুরুষসমাজ৷ চন্দ্রার পিতার ভাবনায় শুধু তার স্ত্রীর নয় তার মেয়েও সমান পাতকী৷ স্ত্রীর ব্যভিচারের ফল জেনে মেয়ের প্রতিও তার বিজাতীয় ঘৃণা৷ সোমনাথ তাই জল থেকে চন্দ্রার অচৈতন্য দেহ উদ্ধার করে পরিচর্যা শুরু করলে তাকে পাপীয়সী, পিশাচী বলে সম্বোধন করে৷
‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’-তেও প্রায় একই ঘটনা৷ তার স্ত্রীর ঘরে নায়েবকে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে দেখে মিথ্যা সন্দেহে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে রামেশ্বর স্ত্রীকে, পুত্রকে পরিত্যাগ করে৷ দীর্ঘ বিশ বছর দ্বীপান্তরে থেকে স্ত্রীকে ব্যভিচারিণী কল্পনা করতে করতে শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে এসে এক বারাঙ্গনাকেই স্ত্রী ভেবে বসে এবং বিশ বছর আগে ফেলে যাওয়া পুত্রকে দাবি করে৷ এখানেও পুরুষের মিথ্যা সন্দেহে এক নারীর জীবন বিপর্যস্ত হয়ে যায়; একটি সুখী পরিবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়৷ ব্যভিচারিণীদের প্রতি—গণিকাদের প্রতি সমাজ ঘৃণ্য মানসিকতা আরোপ না করলে মিথ্যা সন্দেহে দুটি পরিবার এভাবে নিঃশেষ হয়ে যেত না৷ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে একটু ধৈর্য রাখলেই চন্দ্রার পিতা এবং রামেশ্বরের ভুল ভেঙে প্রকৃত সত্য সামনে আসতে পারতো৷ কিন্তু নারীর সতীত্বে ভ্রষ্টাচারের ছায়ামাত্র দেখলেই সমাজপ্রভুরা দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত বিধানে মত্ত হয়ে উঠে৷ সেখানে সত্য-মিথ্যা বিচারের কোনো অবকাশ থাকে না৷
সতী সাধ্বী শিক্ষিতা এবং চরিত্রবতী নয়নতারা ‘নয়নতারা’ উপন্যাসে একজন উদারমনস্ক নারী হয়েও পণ্য নারীদের প্রতি উপেক্ষা প্রকাশে দ্বিধা করেনি৷ তার দৃষ্টিতে সেই রমণীরা ‘বাজারের মেয়ে’ অভিধায় পরিচায়িত৷ এ নিয়ে একাধিকবার তিরস্কারও করেছে তার ভাইকে৷ রচনাকারের উদ্দেশ্য ছিল এই ধরনের বারবনিতার প্রসঙ্গ এনে নয়নতারার চরিত্রকে আরও বেশি ঔজ্জ্বল্য প্রদান করা৷ তাই এখানেও নেতিবাচক দৃষ্টিতে তাদের মূল্যায়ন করা হয়েছে৷
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে উনিশ শতকের প্রায় সব রচনাতেই গণিকারা ক্ষতিকারক এবং সমাজ দূষক৷ কোথাও তাদের মানবিক আবেদনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি৷ নানা ইতর বিশেষণ প্রয়োগ করে তাদের হীনতাকে আরও ব্যঞ্জনাময় ভাষায় প্রকাশ করেছেন রচনাকারেরা৷ সমাজে সকলের সঙ্গে বসবাস নিয়ে যেমন সমালোচনা করেছেন কেউ, কেউ আবার খারাপ লোকদের সঙ্গদানকারী এবং অপরাধের আকরভূমি হিসেবে বর্ণনা করেছেন তাদের নিবাসস্থলকে৷ তারা সেখানে সর্বোতভাবে পাপী৷ আর সমাজের বিচারে তারাই পুরুষদের পাপপথে নিমজ্জিত করে তাদের ইহকাল পরকাল ভক্ষণ করে৷ এবং বলা হয় তাদের গণিকা হওয়ার পেছনে পুরুষদের কোনো দায় থাকে না৷ অর্থাৎ উনিশ শতকীয় সমাজমনস্কতায় গণিকারা সর্বোতভাবে ঘৃণ্য ও উপেক্ষিত৷ মানুষ হিসেবে অস্তিত্বটুকুকেও কেউ মূল্য দিতে চায়নি৷
বিশ শতকের উপন্যাসগুলিতে গণিকাদের অবস্থানগত পার্থক্য দেখা গেলেও একেবারে প্রথম দিকের সাহিত্যগুলোতে কিন্তু গণিকাদের প্রতি সেই ঘৃণ্য মনস্কতাই প্রকাশ পেয়েছে৷ যেমন পাঁচকড়ি দে এর ‘নীলবসনা সুন্দরী’৷ সেখানে গণিকাদের প্রতি কোনোরকম সহানুভূতির অনুরণন খুঁজে পাওয়া যায় না৷ এটি ডিটেকটিভ উপন্যাস৷ নীলবসন পরিহিতা অজ্ঞাতপরিচয় এক সুন্দরীর মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনই এর উপজীব্য৷ এই প্রসঙ্গে অবতাড়না একাধিক গণিকা চরিত্রের৷ আর এই খুন সম্পর্কে তদারক করতে গিয়ে মনিরুদ্দীনের রক্ষিতা দিলজান খুন হয়েছে বলে গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয় যখন মুন্সী সাহেবের বাঁদী সাখিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে তখন একজন গণিকার অপমৃত্যুর খবর শুনে একজন অতিসাধারণ দাসী চরিত্রও ঘৃণায় নাক-সিটকে বলে—‘‘তাই ভাল—একটা বেশ্যা মাগী খুন হয়েছে, তার আবার কথা!’’৭২ এই সামান্যা স্ত্রীর বিচারেও বেশ্যারা মানুষের তুল্যই নয়৷ তাই মৃত্যুর মতো একটা মর্মান্তিক বিষয়ও এভাবে হেলায় উড়িয়ে দিতে পেরেছে৷
সম্ভ্রান্ত গৃহস্থের অন্তঃপুরে গণিকাদের প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ৷ খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে এই ভাবনাই উঠে এসেছে দেবেন্দ্রবিজয়ের চিন্তা থেকে—‘‘দিলজান কেন তাহার সহিত দেখা করিতে যাইবে? দিলজানের কি সহসা এতখানি সাহস হইতে পারে? সে বারাঙ্গনা—মুন্সী জোহিরুদ্দিনের অন্তঃপুরে প্রবেশ করা তাহার পক্ষে সম্ভবপর নহে৷’’৭৩ দিলজানকে সকলে রক্ষিতা পরিচয়ে জানে অর্থাৎ সে সমাজপতিতা৷ উচ্চবংশের পুরুষেরা রক্ষিতা নিয়ে স্ফূর্তি করতে পারলেও তাদের অন্তঃপুরে এই শ্রেণীর পণ্য রমণীর প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ৷ পতিতাদের এইভাবে অবজ্ঞা-অবহেলা এবং অপমানিত জীবন দেখে এবং তাদের সঙ্গে সংসর্গকারীপুরুষ সমাজের অপাপবিদ্ধ সম্মান অনুভব করে সমাজের প্রতি এক সুগভীর প্রশ্ন রেখে গেছেন পণ্যাঙ্গনা মানদা দেবী৷ এক আশ্রমের আচারনিষ্ঠ মোহন্ত যিনি মুমূর্ষ মানদার প্রাণ রক্ষা করে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার বহু চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি তার, সেই মোহান্তজীর সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ করে তিনি বলেছিলেন—‘‘বাবাজী, আমি মহাপাপী, সমাজে আমার স্থান নাই—পিতা আমায় পরিত্যাগ করিয়াছিলেন৷ কিন্তু আমার মত পাপরতা, পতিতা নারীর পদতলে যে সকল পুরুষ তাহাদের মান, মর্যাদা, অর্থসম্পত্তি, দেহমন বিক্রয় করেছে, ঐ দেখুন, তাদের সমাজ মাথায় তুলে রেখেছে—তারা কবি ও সাহিত্যিক বলিয়া প্রশংসিত, রাজনীতিক ও দেশসেবক বলিয়া বিখ্যাত—ধনী ও প্রতিপত্তিশালী বলিয়া সম্মানিত৷ এমনকি অনেক ঋষি-মোহান্তও গুরুগিরি ফলাইয়া সমাজের শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত আছেন, তাহা সমাজ জানিয়া-শুনিয়াও নিরব৷ কোর্টে, কাউন্সিলে, করপোরেশনে গুরুগিরিতে কোথাও তাদের কোনো বাধা নাই৷ আর আমরা কবে বালিকা-বয়সের নিবুর্দ্ধিতার জন্য এক ভুল করেছিলাম, তার ফলে এই বারো বৎসর ধরে জ্বলেপুড়ে মরছি৷ এই ত আপনাদের সমাজের বিচার৷’’৭৪ সমাজের প্রতি মানদার এই নিদারুণ বাক্য নিক্ষেপ শুধু মানদার নয় সমস্ত উপেক্ষিত পণ্যাঙ্গনাদের৷
ঊনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত গণিকাশ্রেণীকে যে ঘৃণা, রঙ্গতামাশা, অবজ্ঞার পীড়নে পর্যুদস্ত করে হীন প্রতিপন্ন করার প্রবণতা বর্ধিত হয়েছিল তা থেকে বাঙালি মনস্কতা যেন একটু একটু করে নড়ে উঠছিল৷ অবশ্য এই চিন্তাচেতনা আবর্তিত হয়েছিল পাশ্চত্যের নানারকম সামাজিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে৷ সংবেদনশীল আবেগপ্রবণ বাঙালিসমাজ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নতুন অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল যা নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করার জায়গা প্রস্তুত করেছিল বারাঙ্গনাদের প্রতি৷ এর মধ্য দিয়ে বাংলা উপন্যাসে গণিকাচরিত্রের বিবর্তনের ভেদরেখাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে৷
গণিকারাও যে মানুষ, তাদের মধ্যেও যে প্রেম, প্রীতি, স্নেহ, ভালোবাসা, ত্যাগ, মহত্ত্ব ইত্যাদি মানবিক গুণগুলি বর্তমান এবং সমাজ পরিত্যক্ত হওয়ার দরুণ তারাও যে ভীষণভাবে অনুভব করে মানসিক যন্ত্রণা; বাংলা উপন্যাসে এই গভীর চিন্তা উদ্দীপকপূর্ণ বোধটাকে প্রথম প্রকাশ করলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর দরদি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে৷ সেখানে তাঁর মূল সুর ছিল নারীর অপ্রকাশিত আত্মিকরূপের, আত্মিকশক্তির ও অলঙ্ঘনীয় ব্যক্তিত্বের আবিষ্কার৷ বস্তুত নারীকে শরৎচন্দ্র চিরকালই শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখেছেন—সেখানে সেই মরমি দৃষ্টি থেকে পতিতা নারীরাও বাদ যায়নি৷ ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধে নারীর প্রতি তাঁর সুগভীর চিন্তার কথা প্রকাশ পেয়েছে যা সমাজতত্ত্ববিদদের ভাবনা থেকে কোনো অংশেই কম নয়৷ তিনি নিজের হৃদয়ের তাড়নাতেই নারীর দুর্দশার কারণ অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছিলেন৷ আর সে বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করেছিল সুগভীর সংবেদনশীলতা এবং অন্তরের স্বচ্ছ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি৷ তিনি তাঁর নিজের তাগিদেই অনুসন্ধান করতে পেরেছিলেন যে নারীরা স্বেচ্ছায় গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করে না, সমাজ ও সংসার তাকে ধীরে ধীরে সে যন্ত্রণাকর জীবনে পা বাড়াতে বাধ্য করে৷ সমাজ এইজন্য দায়ী যে সে অল্পবয়সি বিধবাদের বিয়ে দিতে চায় না, পুরুষেরা বহুবিবাহ করে এবং কুলকামিনীর প্রতি সীমাহীন অত্যাচার করে তাকে গৃহত্যাগ করতে বাধ্য করায়৷ সতীদাহ বন্ধ এবং বিধবা বিবাহের প্রচলন না থাকায় সমাজে এই পাপের বাড়-বাড়ন্ত দেখে সমাজতাত্ত্বিকেরা যখন বিধবাদের সংখ্যাধিক্যকেই দায়ী করেন তখন শরৎচন্দ্র নিজের তাগিদে সমীক্ষা চালিয়ে মন্তব্য করেন—‘‘আমি হিসাব করিয়া দেখিয়া বিস্মিত হইয়া গিয়াছিলাম যে, এই হতভাগিনীদের শতকরা সত্তর জন সধবা৷ বাকী ত্রিশটি মাত্র বিধবা৷ ইহাদের প্রায় সকলেরই হেতু লেখা ছিল, অত্যধিক দারিদ্র্য ও স্বামী প্রভৃতির অসহনীয় অত্যাচার-উৎপীড়ন৷ সধবাদিগের প্রায় সবগুলিই নীচজাতীয়া এবং বিধবাদিগের প্রায় সবগুলিই উচ্চজাতীয়া৷ নীচজাতীয়া সধবারা এই বলিয়া জবাবদিহি করিয়াছিল যে, খাইতে-পরিতে তাহারা পাইত না,—দিনে উপবাস করিত, রাত্রে স্বামীর মারধর খাইত৷ সৎ-কুলের বিধবারাও কৈফিয়ত দিয়াছিল—কেহ বা ভাই ও ভ্রাতৃজায়ার, কেহ-বা শ্বশুর-ভাসুরের অত্যাচার আর সহ্য করিতে না পারিয়া এই কাজ করিয়াছে৷’’৭৫ সমাজের নারীর সেই শোচনীয় অবস্থা এবং পুরুষের সর্বপাপ মার্জনার বিষয়টিও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি৷ সেই বৈপরীত্যের কথাও ‘নারীর মূল্য’-তে স্পষ্ট—‘‘এদিকে পুরুষ যেমন দরিদ্র ও কহনাতীত উৎপীড়নে নারীর স্বাভাবিক শুভবুদ্ধিকে বিকৃত করিয়া দিয়া ঘরের মধ্যে তাহাকে অতিষ্ট করিয়া তোলে, অন্যদিকে তেমনি তাহাকেই আপাতমধুর সুখের প্রলোভনে প্রতারিত করিয়া ঘরের বাহির করিয়া আনে৷ পুরুষের ভয় নাই, সে যদিচ্ছা সুখ ভোগ করিয়া ফিরিয়া যাইতে পারে৷… আত্মীয়স্বজন তাহার পুনরাগমনে খুশী হইয়া সাহস দিয়া বলিতে থাকে, ‘‘তার আর কি? ও অমন হইয়া থাকে,—পুরুষের দোষ নেই৷ এস বাহিরে এস৷’’ সেও তখন হাসিমুখে বাহির হয় এবং গলা বড় করিয়া প্রচার করিতে থাকে, নারীর পদস্খলন কিছুতেই মার্জনা করা যাইতে পারে না৷… যে কারণেই হউক, যে নারী একটিবার মাত্রও ভুল করিয়াছে, হিন্দু তাহার সহিত কোন সংশ্রব রাখে না৷ ক্রমশঃ ভুল যখন তাহার জীবনে পাপে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, দিন দিন করিয়া যখন তাহার সমস্ত নারীত্ব নিঙরাইয়া বাহির হইয়া যায়—যখন বেশ্যা—তখন, আবার তাহার অভাবে হিন্দুর স্বর্গও সবার্ঙ্গসুন্দর হয় না৷’’৭৬ পতিতা নারীর জীবনের দুঃখ যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করে সমাজের চোখে তার স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে তাঁর উপন্যাসগুলি আকর হিসেবে কাজ করেছে৷ তিনি সাহিত্যে নতুন ‘স্টাইল’ আনয়নের জন্য নয় অন্তরের তাগিদেই নতুন ভাবনায়, নতুন রূপে এই জাতীয় চরিত্রের উপস্থাপন ঘটিয়েছিলেন৷
সতী-অসতীর ভাবনাকে নতুন দিকে মোড় ঘুরিয়ে সমাজে ঝড় তুলে দিয়েছিলেন ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ নারীর নারীত্ব, সতীত্ব ইত্যাদি প্রচলিত রক্ষণশীল বিশ্বাসগুলিকে আঘাত করে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন রচনাকার৷ তাই এই উপন্যাসটি যত বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল তাঁর আর কোনো রচনা (শেষ প্রশ্ন ছাড়া) এত তীব্র মুখনাড়া সহ্য করেনি৷ হয়তো লেখকের বক্তব্য উপন্যাসটিতে যুগের চেয়ে একটু বেশিই ‘আধুনিক’ হয়ে পড়েছিল৷ সাবিত্রী, কিরণময়ী ইত্যাদি গৃহস্থ কুলীন কন্যাদের কুলটা-ব্যভিচারিণী করেও শেষপর্যন্ত কলঙ্কের ক্লেদ মুছিয়ে পাঠকের সহানুভূতি প্রদান করেছিলেন৷ দুজনের কেউই দেহব্যবসায়ী নয়, অবৈধ যৌনচারে লিপ্ত হয়ে দেহিক শুচিতাকেও যে তারা ক্ষুন্ন করেনি লেখক একথা স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন কিন্তু সেই স্বৈরিণীতুল্য নারীচরিত্রগুলিকে ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে যে সকল স্থানে নিক্ষিপ্ত করেছেন সেই পরিবেশে দৈহিক সতীত্ব অক্ষুন্ন রাখাও সম্ভব বলে মনে হয় না৷
উপন্যাসের নায়িকা কিরণময়ী৷ যেভাবে চরিত্রটিকে অঙ্কন করেছিলেন তিনি তাতে সে যুগের প্রেক্ষিতে সে সতী নয়৷ অভিষ্ট সিদ্ধ করতে গিয়ে, নিজের জেদ পূরণ করতে গিয়ে সমাজের চোখে অঘটনপটিয়সী সমাজদূষক৷ সে কামনা-বাসনাময় একজন নারী৷ স্বামী মৃত্যু শয্যায় জেনেও যত্ন করে চুল বাঁধে, কপালে কাচপোকার টিপ পড়ে৷ নীতিবান যুবক উপেন্দ্র তার স্বামী হারাণের রুগ্ন শয্যার পাশে কিরণময়ীর সেই অতুলনীয় রূপচর্চা দেখে ঘৃণায় শিউরে উঠে৷ তাই প্রথম দর্শন করে যাকে ভুবনমোহিনী মনে হয়েছিল পরক্ষণেই তার প্রতি বিরূপ ধারণা জন্মে৷ তার প্রতি উপেন্দ্রর যে মনোভাব তা আসলে সমাজপ্রভুদের নারীর প্রতি রক্ষণশীল মনোভাব—‘‘কোথায় গেল ঐ অতুল রূপ! কোথায় গেল ঐ হাসি; তাহার দৃষ্টির সম্মুখে যেন কোন এক প্রেতলোকের পিশাচ উঠিয়া আসিল৷ সে ভাবিতে লাগিল, স্বামী যার এই, সে আবার হাসে, পরিহাসে যোগ দেয়, খোঁপা বাঁধে, টিপ পরে! এক মুহূর্তের জন্য তাহার সমস্ত নারীজাতির উপরেই ঘৃণা জন্মিয়া গেল৷’’৭৭ শুধু উপেন্দ্র কেন মৃত্যু পথযাত্রী স্বামীর দুর্দশার মধ্যে স্ত্রীর সাজ গোজ করে হাসি-ঠাট্টায় যোগ দেওয়া উপেন্দ্রর বন্ধু সতীশের কাছেও তীর্যক হয়ে দেখা দিয়েছে৷ তাই তার চোখে কিরণ ভাল লোক নয়৷ উপেন্দ্রকে সাবধান করে বলেছে—‘‘খাল খুঁড়ে কুমীর এনো না উপীনদা৷’’৭৮ সতীশ সেই পুরুষ শ্রেণীর প্রতিনিধি যে উপন্যাসের আর এক কুলটা নারী সাবিত্রীর প্রতি প্রণয় নিবেদনে দ্বিধা করে না, ইয়ারবন্ধুদের সঙ্গে ‘অস্থানে-কুস্থানে’ গিয়ে মদ্যপ হয়ে বাসায় ফিরে আসে৷ সেই সতীশের মুখে নারীর প্রতি অমন তাচ্ছিল্যসূচক বাক্য শুনে বিস্ময় উৎপন্ন হলেও অবিশ্বাস করা যায় না৷ তখনকার সামাজিক পরিস্থিতিই তাই৷ যাদের দ্বারা যত বেশি নারী অসতী হবে তাদের দ্বারা ততবেশি নারীর সতীত্বে বড়াই ঘোষিত হবে৷
কিরণময়ী বুদ্ধিমতী, শিক্ষিতা, তার্কিকতায় সিদ্ধহস্ত৷ রূপবতী এই নারী তার জীবনের সমস্ত সুখ দুঃখ, শখ-আহ্লাদ স্বামীর সারস্বত সাধনার মধ্যে বিলিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল৷ স্বামী হারাণ তার অগাধ পাণ্ডিত্য দিয়ে স্ত্রীকে পারদর্শী করে তুললেও পুরুষ হয়ে নারীর অবরুদ্ধ কামনাকে পরিতুষ্টি দান করতে পারেনি৷ তাই তত্ত্বভার দিয়ে অবদমিত করে রাখা দুরন্ত কামনা-বাসনা স্বামী রোগশয্যা নিলে মুক্ত হওয়ার জন্য গর্জন করতে থাকে; দিশেহারা হয়ে যায় সে প্রবৃত্তির নির্মম পীড়নে৷ এদিকে সংসারেও অভাবের ছায়া—স্বামীর বিপুল চিকিৎসার ভার, সর্বোপরি অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থাপনায় শাশুড়ি অঘোরময়ীও বধূর রূপরাশিকে অবলম্বন করতে তৎপর হয়ে উঠে৷ তার রূপবহ্নিতে এবং শাশুড়িমাতার প্রচ্ছন্ন ইন্ধনে কামার্ত অনঙ্গডাক্তার সহজেই ঝাঁপ দেয় সেখানে৷ কিরণকে ভোগ করার লোভেই বিনা পারিশ্রমিকে, বিনা খরচে মুমূর্ষু হারাণের চিকিৎসাভার গ্রহণ করে৷ তার কামনার সেই প্রজ্জ্বলিত হুতাশনে ঘৃতাহুতি দেয় উপেন্দ্র ও সতীশ৷ স্বামীর তাকে বঞ্চিত করে উইল করার প্রস্তাব এবং উপেন্দ্র ও সতীশের তীব্র অপমান তাকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তোলে৷ তার সেই মানসিক অভিব্যক্তি লেখকের বর্ণনায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে—‘‘উপেন্দ্র ও সতীশ চলিয়া গেলে কবাট রুদ্ধ করিয়া সেইখানেই কিরণময়ী দাঁড়াইয়া রহিল৷ অন্ধকারে তাহার চোখ দুটো হিংস্র জন্তুর মতই জ্বলিতে লাগিল৷ তার মনে হইতে লাগিল, ছুটিয়া গিয়া কাহারো বক্ষঃস্থলে দংশন করিতে পারিলে সে বাঁচে৷ হাতে দীপটা উঁচু করিয়া ধরিয়া উন্মাদ ভঙ্গী করিয়া বলিল, আগুন ধরিয়ে দেবার উপায় থাকলে দিতুম৷ দিয়ে যেখানে হোক চলে যেতুম৷ ডাকাডাকি চেঁচামেচি করে একটু একটু করে পুড়ে মরত, শত্রুতা করবার সময় পেত না৷’’৭৯ কিরণময়ীর প্রতি শাশুড়িমাতা অঘোরময়ীর ভালোবাসা ছিল না৷ পুত্র অথর্ব হয়ে গেলে বধূর রূপ এবং যৌবনই তার হাতিয়ার হয়ে উঠে৷ তাঁর সম্পর্কে লেখক বলেছেন—‘‘তাঁহার রূপসী বধূ যে ইদানিং সতীধর্মেরও সম্পূর্ণ মর্যাদা বহন করিয়া চলে না, ইহাও তিনি বুঝিতেন৷ কিন্তু, পুত্র তাঁহার মৃতকল্প, দুঃসহ দুঃখের দিন সমাগতপ্রায়৷ এই মনে করিয়াই বোধ করি, বধূর বিসদৃশ আচার-ব্যবহারও উপেক্ষা করিয়া চলিতেন৷ যে ডাক্তার হারানের চিকিৎসা করিতেছিল, সে যে কি আশায় বিনা ব্যয়ে ঔষধপথ্য যোগাইতেছে, কেন সংসারের অর্ধেক ব্যয়ভারও বহন করিতেছে, ইহা তাঁহার অগোচর ছিল না৷’’৮০ শুধু ডাক্তারের ক্ষেত্রেই প্রচ্ছন্ন ইন্ধন দান নয় উপেন্দ্র এসে যখন ছেলে এবং সংসারের দেখভালের দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন তাকে প্রলুব্ধ করতে বধূকে তার দিকে ঠেলে দিতে দেখা যায়৷ সে উপীনের আসার প্রহর গুণে বধূকে বলে—‘‘তা হোক—নীচে যে অন্ধকার, একটু বেলা থাকতেই সিঁড়ির আলোটা জ্বেলে দেওয়া ভাল৷ এখনি হয়ত উপীন এসে পড়বে, কাল থেকে সে আসেনি—কৈ বৌমা, এখনো তোমার ত গা-ধোয়া, চুল-বাঁধা হয়নি দেখচি—কি কচ্ছিলে গা এতক্ষণ?’’৮১ শাশুড়িমাতা নিজের স্বার্থের খাতিরে বাসনার যে চোরাপথে বধূকে পতিত হওয়ার ইন্ধন জোগান দিয়েছে সেখানে আঘাত হেনেছিল উপীন তার আদর্শ চরিত্রের দোহাই দিয়ে৷ উপেন্দ্রর সেই ঘৃণার জবাব দিতে অথবা উপেন্দ্রকে বশীভূত করতে হঠাৎ করে তাই সে পাতিব্রত্যের উপাসক হয়ে উঠে৷ পতিব্রতার পরাকাষ্ঠায় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করে উপেন্দ্রর৷ চরিত্রবানযুবক উপেন্দ্রকে বশীভূত করে তাকেও তার চরণের দাস হিসেবে প্রতিপন্ন করার পেছনে হয়তো তার লুন্ঠিত নারীত্বের প্রতিশোধস্পৃহা অনেকাংশে কাজ করেছিল৷ যে উপেন্দ্র সাধ্বী স্ত্রী সুরবালার সঙ্গে দাম্পত্য প্রণয়ে বিহ্বল হয়ে কিরণের মতো অসতী নারীদের প্রতি তীব্র ঘৃণাভাব পোষণ করতে দ্বিধা করেনি কিরণের নতুন আচরণে আবার সে মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়৷ কিরণময়ীকে দেখে তার মনে হয়—‘‘স্ত্রীলোক সম্বন্ধে তাহার জ্ঞানের মধ্যে মস্ত ভুল ছিল৷ এমন নারীও আছে, যাহার সম্মুখে পুরুষের অভ্রভেদী শির আপনি ঝুঁকিয়া পড়ে৷ জোর খাটে না, মাথা অবনত করিতে হয়৷ এমনি নারী কিরণময়ী৷’’৮২ কিরণময়ীর মধ্যে রয়েছে দার্শনিকতা, নাস্তিক্য নৈয়ায়িক বুদ্ধি সর্বোপরি এক বিচক্ষণ নারীমনন৷ স্বামীর আসন্ন মৃত্যু সামনে জেনেও ধীর-স্থির ভাবে সেই বিপদটাকে সামলানোর ক্ষমতা সে রাখে আবার তার স্বামীর সেবা করতে করতে শ্রান্ত-অবসন্ন হয়ে যাওয়া উপেন্দ্রকেও বিশ্রামের অবসর করে দিতে পারে৷ তার ভেতরকার অবরুদ্ধ বাসনা প্রেমের মূর্তি ধরে নবরূপ লাভ করে উপীনকে দেখার পর থেকে৷ তার এই প্রেমই আবার ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে উপেনের সঙ্গে সুরবালার দুষ্টু মিষ্টি দাম্পত্য সম্পর্ক সচক্ষে প্রত্যক্ষ করার পর৷ তারপর বৈধব্যদশা প্রাপ্ত হয়েও সে প্রেমের বিভা এতটুকু ম্লান হয় না৷
কিরণময়ী তার স্বামীর কাছ থেকে আর কিছু পাক না পাক, পেয়েছিল সুবিশাল তাত্ত্বিক জ্ঞানের ভাণ্ডার৷ তা তাকে তার্কিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে৷ আর সর্বদাই তার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নিজের মধ্যে একটা নিঃসংকোচের বাতাবরণ তৈরি করে নেয়৷ সেই সাহসেই তার ভেতরের অব্যক্ত প্রণয়বাসনার কথা নিঃসংকোচে উপেন্দ্রর কাছে প্রকাশ করে বলতে পারে—‘‘যাক, তোমাকে যে ভালবাসি তা জানিয়ে দিয়ে আমি বাঁচলুম৷ এখন তোমার যা খুশি করো, আমার কিছুই বলবার নেই৷’’৮৩ কিরণময়ী স্বামীর সান্নিধ্যে বাসনাকে জয় করার শিক্ষা না পেলেও নিজের মনোবৃত্তিগুলিকে সহজে প্রকাশ করার শিক্ষা লাভ করেছিল৷ চরিত্রবান উপীন একজন বিধবা নারীর প্রণয় স্বীকৃতি পেয়ে হয়তো বর্তে গিয়েছিল৷ কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ভাই সম্পর্কিত এক অল্পবয়সি যুবক দিবাকরকে তার কাছে রেখে দিয়েছিল লেখাপড়া ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়ে৷ কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয় বাড়ির ঝি-এর তাৎক্ষণিক বিরক্তির সূত্র ধরে৷ কিরণময়ীর কর্তৃসুলভ উষ্মার জবাব দিতে গিয়ে উপেন্দ্রকে নিয়ে আসা অঘোরময়ীর আহ্বানে দরজা খুলতে খুলতে বলে—‘‘কানের মাথা চোখের মাথা না খেলে কি আর তোমার বাড়িতে কেউ চাকরি করতে আসে মা? এবার চোখকানবালা কাউকে রাখো গে মা, আমাকে জবাব দাও৷’’৮৪ ঝি এর বিরুক্তিসূচক এই কয়টা কথাতেই উপেন্দ্রর মনে বিষবৃক্ষের বীজ রোপিত হয়ে যায়৷ তারপর ঝি যখন আরও বলে—‘‘দেওরকে নিয়ে সারাদিন সোহাগ হচ্চে—আর কি হবে!’’৮৫ তাতেই সে বীজ মুহূর্তে অঙ্কুরিত হয়ে উঠে৷ আর দিবাকরের প্রতি সামান্য অসন্তোষের শোধ তুলতে গিয়ে যখন অঘোরময়ী বলে—‘‘কি করে খবর জানবে উপীন? দু’জনের কি যে রাতদিন ফষ্টি-নষ্টি, হাসি-তামাশা, ফুস-ফুস গল্প-গুজব হয় তা ওরাই জানে!’’৮৬ আর এর মধ্য দিয়েই অঙ্কুরিত বিষবৃক্ষ ডালপালা বিস্তার করে ভয়ানক আকার ধারণ করে৷ শাশুড়ি যেন বধূর প্রতি ঈর্ষা প্রকাশ করতে গিয়ে একরাশ কলঙ্কের কালিমা ছিটিয়ে দেয় কিরণময়ীর উপর৷ এভাবে নিজের স্বার্থ-রাগ-বিরক্তি ইত্যাদির পরিণতি স্বরূপ নারীরাও নারীদের ব্যভিচারিণী করে তোলে সমাজের চোখে৷ কিরণময়ী পুনরায় পতিত হয় উপেন্দ্রর চোখে৷ কিন্তু সমাজের অত্যাচার-অপবাদ মুখ বুজে সহ্য করার মতো নারী কিরণ নয়৷ সে যুগের প্রেক্ষিতে অনেকটাই স্বাধীন প্রবৃত্তির৷ তাই তীব্র শ্লেষে উপেন্দ্রর ঘৃণার জবাব দিয়ে বলে—‘‘তোমার রাগ বল, ঘৃণা বল ঠাকুরপো, সমস্ত দিবাকরকে নিয়ে ত? কিন্তু বিধবার কাছে সেও যা, তুমিও ত তাই৷ তার সঙ্গে আমার সম্বন্ধটা কতদূর গিয়ে দাঁড়িয়েচে, সেটা শুধু তোমার অনুমান মাত্র৷ কিন্তু সেদিন যখন নিজের মুখে তোমাকে ভালবাসা জানিয়েছিলুম, তখন ত আমার দেওয়া খাবারের থালাটা এমনি করে ঘৃণায় সরিয়ে রাখোনি! নিজের বেলা বুঝি কুলটার হাতের মিষ্টান্নে ভালবাসার মধু বেশী মিঠে লাগে ঠাকুরপো?’’৮৭ কিরণ যথার্থই ভালোবেসেছিল উপেন্দ্রকে৷ তাই তীব্র শ্লেষে তাকে বিদ্ধ করার পরও তার লুন্ঠিত নারীত্ব উপেন্দ্রর চলে যাওয়ার সময় তার দু’পা আঁকড়ে সবকিছু যে মিথ্যে সন্দেহমাত্র তা বলার চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু সে তো পুরুষমানুষ৷ তাকে ভালোবাসা এক বিধবা রমণীর মধ্যে ভ্রষ্টাচারিণীর প্রতিবিম্ব চিত্রিত করে ফেলেছে৷ তাই কিরণের কোনো কথা না শুনে তাকে ঠেলেফেলে দিয়ে ‘‘নাস্তিক! অপবিত্র, ‘ভাইপার’!’’৮৮ ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করে ত্যাগ করে চলে গেছে৷ প্রচণ্ড আক্রোশে তার লাঞ্ছিত নারীত্ব সেই তীব্র অপমানে পুনরায় গর্জন করে উঠেছে৷ লেখক তার সেই অবস্থাকে বুঝিয়েছেন—‘‘অনেকদিন পূর্বে ঠিক এইখানে দাঁড়াইয়া তাহার দুই চোখে এমনি উন্মত্ত চাহনি, এমনি প্রজ্জ্বলিত বহ্নিশিখা দেখা দিয়াছিল, যেদিন সতীশকে সঙ্গে করিয়া উপেন্দ্র প্রথম দেখা দিয়া বাহির হইয়া গিয়াছিলেন৷ আবার আজ শেষ বিদায়ের দিনেও তাহার বিরুদ্ধে সেই দুটি চোখের মধ্যে তেমনি করিয়াই আগুন জ্বলিতে লাগিল৷’’৮৯ সেই তীব্র অপমানের প্রতিশোধ নিতে সে উপেন্দ্রর অত্যন্ত স্নেহাস্পদ দিবাকরের সর্বনাশ করতে সংকল্প নেয়৷ ঝি কে একজোড়া রূপার মোটা মল ঘুষ দিয়ে দিবাকরকে নিয়ে আরাকানে পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করে৷ কিরণময়ী সমাজের ছুড়ে দেওয়া মিথ্যা অপবাদের কলঙ্ককর্দম পুনরায় সেই দিকেই ছুড়ে দিয়েছিল কিন্তু তার দ্বারা নিজেও কম বিভূষিত হয়নি৷ উপেন্দ্রকে শাস্তি দিতে ব্যবহার করেছিল দিবাকরকে৷ আরাকানে বাড়িউলি মাসির দেহব্যবসায়ে নিযুক্তিকরণের সক্রিয় তৎপরতা, দিবাকরের তার প্রতি তীব্র যৌন পিপাসার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে প্রাণপণ যুঝতে হয়েছে তাকে৷ শেষে সমস্ত দুর্যোগের হাত থেকে তাকে রক্ষা করে সতীশ পুনরায় উপেন্দ্রর নির্দেশেই দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে৷ উপেন্দ্রও নিজের ভুল বুঝতে পেরে মৃত্যুর পূর্বে সতীশকে বলেছে—‘‘ওঁর অন্তরের আঘাত যে কত দুঃসহ, সে উপলব্ধি করার শক্তি নেই আমাদের, কিন্তু সে যত নিদারুণ হোক, অত বড় বুদ্ধিকে চিরদিন সে আচ্ছন্ন করে রাখতে পারবে না৷’’৯০
কিরণময়ী অবস্থার বিপাকেই হোক আর প্রতিশোধ নিতেই হোক তার রূপ এবং দেহটার দ্বারা একাধিক পুরুষকে বশীভূত করেছে৷ অনঙ্গ ডাক্তার, উপেন্দ্র, দিবাকর কেউ বাদ পড়েনি৷ বিধবা হয়েও কুলটার মতো রাতের অন্ধকারে দিবাকরকে সাথে নিয়ে আরাকানে পাড়ি দিয়েছে, ছমাস একত্র একঘরে অবস্থান করেছে তার প্রতি মুগ্ধ দিবাকরের সঙ্গে৷ তাদের আশ্রয় নেওয়া বাড়িটিও একটা বেশ্যালয় যেখানে বাড়িউলি মাসি নানাভাবে প্ররোচিত করেছে বেশ্যাবৃত্তির প্রতি৷ সমাজের চোখে তার সম্পূর্ণ আচরণ ব্যভিচার দোষে দুষ্ট৷ এমন নারীর প্রতিও লেখক আরোপ করেছেন ক্ষমাসুন্দর মনোভাব৷ শেষে সতীশ যখন তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য আরাকানে উপস্থিত হয়েছে তখন সমাজে তার যে আর ঠাঁই হবে না সে সম্পর্কে নিজেই বলেছে ‘ঠাকুরপো, সমাজ আছে ত?’’৯১ সতীশ তার প্রত্যুত্তর দিয়ে বলেছে—‘‘না নেই৷ যার টাকা আছে, গায়ের জোর আছে, তার বিরুদ্ধে সমাজ নেই৷’’৯২ সতীশের এই কথায় সমাজের সত্য ও নগ্ন এক রূপচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে৷ সমাজ চিরকাল ক্ষমতাওয়ালার৷ নারী পুরুষের তুলনায় কোমল, নরম তাই পুরুষ অনায়াসে তাকে পর্যুদস্ত করে৷ কিন্তু কোনো ক্ষমতাবান মানুষের সাহায্য পেলে পতিতা নারীরাও অনেক সময় বর্তে যায়৷ কিরণময়ী সেই জোরেই সতীশের সঙ্গে কলকাতায় ফিরে আসে৷ কিন্তু উপেন্দ্রর মর্মান্তিক পীড়া শেষ পর্যন্ত তাকে অপ্রকৃতিস্থ করে তোলে৷
লেখক অত্যন্ত দরদের সঙ্গে কিরণময়ীর জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত তার ভ্রষ্টাচারের কারণ উল্লেখ করেছেন৷ সেখানে তার সেই আচরণের দায় আরোপিত হয়েছে তার স্বামী-শাশুড়ি সর্বোপরি সামাজিক পরিবেশের উপর৷
এই উপন্যাসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সাবিত্রী৷ সে ব্রাহ্মণ ঘরের বালবিধবা৷ ভগ্নীপতি ভুবন মুখোপাধ্যায়ের বিয়ের প্রলোভনে প্রলোভিত হয়ে ঘর ছাড়ে সে৷ কিন্তু সে ভুল ভাঙতে দেরি হয় না তার৷ জামাই বাবু তাকে রেখে দেয় এক ভাড়া করা বাড়িতে৷ সাবিত্রীর সেই বাসাবাড়িও এক বেশ্যালয়ের নামান্তর৷ বিপিনের মতো মদ্যপ যুবকদের সেখানে প্রতিনিয়ত যাওয়া-আসা, বাড়ির কর্ত্রীর মদ খেয়ে নিজের যৌবনের বিলাসী জীবনের বর্ণনা কি নেই সেখানে৷ সতীশ যখন প্রথম সাবিত্রীর সেই বাসাবাড়িতে উপস্থিত হয় তখন তাকে দেখে সাবিত্রীর উদ্দেশ্যে মাসির বলা কথাগুলিও এক হিসেবে গণিকালয়ের গৃহকর্ত্রী মাসির জীবন্ত ভাষ্যরূপ—
‘‘এমন বুদ্ধি না হলে আর দাসীবৃত্তি করতে যাস! কোথায় তুই নিজে দাসী-চাকর রাখবি, না—
সাবিত্রী হাসিয়া বলিল, নিজেই দাসী হয়ে আছি, তাতেই বা দোষ কি মাসী, খেটে খেতে লজ্জা নেই৷
মোক্ষদা রাগিয়া বলিল, কে বললে নেই? আমার মত বয়সে না থাকতে পারে, কিন্তু তোর বয়সে আছে৷ তা থাক না থাক, বাবুকে যখন খেতে বলেছিস, তখন বসে থেকে খাওয়াগে যা৷ মানুষের কপাল ফিরে যেতে বেশী দেরি লাগে না!… আর একটা কথা তোকে বলে রাখি বাছা৷ ভগবান কপালের মাঝখানে যে দুটো চোখ দিয়েছেন সে দুটো একটু খুলে রাখিস৷ ঘড়ির চেন, হীরের আংটি না থাকলেই মানুষকে ছোটো মনে করিস নে৷…’’৯৩ বলা বাহুল্য মাসির এই উপদেশবাণী সাবিত্রীকে গণিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দিকনির্দেশমাত্র৷
সাবিত্রী ঘর বাঁধার আশায় কুলটা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু যখন বুঝতে পারে তার জামাইবাবু তাকে বিয়ে না করেই ভোগ করতে চায় তখন থেকেই নিজেকে সাবধান করে নেয়৷ তার অনুগ্রহ থেকে বাঁচার জন্য বেশ্যাবাড়িতে ভাড়া থেকেও অন্য আর এক বাসায় ঝি-এর কাজ করে৷ একুশ-বাইশ বছর বয়সি এই সুন্দরী যুবতীবিধবা অনায়সেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে সতীশ নামের এক উশৃঙ্খল ধনীর দুলালের৷ তার আকর্ষণে-প্রত্যাখ্যানে হাবুডুবু খেতে খেতে এক সময় দুজন-দুজনের মনের সন্ধান পায়৷ সতীশ তার ভালোবাসার কথা প্রকাশ করলেও সাবিত্রী দ্ব্যর্থক ইঙ্গিতে তাকে নাচিয়ে চলতে থাকে৷ সাবিত্রী কখনোই চায়নি তার মতো এক কুলত্যাগিনীকে ভালোবেসে সতীশ সমাজের কলঙ্কের ডালা মাথায় তুলে নিক তাই তাকে অপমান করে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজেই মূর্ছিত হয়ে গেছে৷ প্রেমে-ভালোবাসায়-ত্যাগে-মহত্ত্বে মহান সে৷ কুলটার শিরোপা সে আগেই গ্রহণ করেছে, মাসির বাড়িতে ভাড়া থেকে মাসির দৃষ্টিতে বা তার মতো মানুষের নজরে পতিতাই সে৷ সতীশের প্রেমে কলুষতা ছিল না৷ তাই তার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে তার সঙ্গে ঘরকন্নায় মেতে উঠলে সমাজের নতুন করে কিছুই বলার ছিল না৷ মরার উপরে খাড়ার ঘা কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা মানুষ যতটা ব্যঞ্জিত করে প্রকাশ করে মরার তা বিন্দুমাত্র উপলব্ধি হয় না৷ সাবিত্রীরও তাই৷ সে কুলটা হয়ে আগেই পতিত হয়েছে৷ নারীজীবনের সর্বোচ্চ সম্মান থেকে বিচ্যুত হয়েছে৷ পুনরায় সমাজ আর তার কি করবে৷ কিন্তু তার নিজের নতুন করে কিছু করতে না পারলেও তা যে তার প্রেমাস্পদকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে! আর যাকে ভালোবাসা যায় তার সামান্যতম ক্ষতিও সহ্য করা সম্ভব হয় না৷ সেও তা পারে না৷ সতীশের দুর্বার প্রেম সম্ভাষণে, তার বিয়ের প্রস্তাবকেও প্রত্যাখ্যান করে বলে—‘‘আমি বিধবা, আমি কুলত্যাগিনী, আমি সমাজে লাঞ্ছিতা, আমাকে বিয়ে করার দুঃখ যে কত বড়, সে তুমি বোঝনি বটে,… সমাজ আমাকে চায় না, আমাকে মানে না জানি, কিন্তু আমি ত সমাজ চাই, আমি ত তাকে মানি৷ আমি ত জানি শ্রদ্ধা ছাড়া ভালোবাসা দাঁড়াতে পারে না… তোমাকে এত দুঃখ দিলুম, কিন্তু কিছুতে এই দেহটা দিতে পারলুম না!… আমার এই দেহটা আজও নষ্ট হয়নি বটে, কিন্তু তোমার পায়ে দেবার যোগ্যতাও এর নেই৷ এই দেহ নিয়ে যে আমি ইচ্ছে করে অনেকের মন ভুলিয়েচি, এ ত আমি কোনমতেই ভুলতে পারব না!’’৯৪ সাবিত্রীর তার কোমলতা দিয়ে নিষ্কলুষ ভালোবাসা দিয়ে সমস্ত কলুষতাকে ছাপিয়ে পবিত্রতম হয়ে উঠেছে এই ত্যাগের মধ্য দিয়ে৷ নারীর নৈতিকতা, পবিত্রতা, সতীত্ব সম্পর্কে রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন উপেন্দ্রও তাকে সহোদরা জ্ঞানে স্নেহ করে তার কোলে মাথা রেখে মৃত্যু শয্যা পাততে দ্বিধাবোধ করেনি৷ লেখক তাকে মহানতার অত্যুচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠা দিয়ে কুলটা থেকে নারীত্বের মহিমামণ্ডিত মানবীতে রূপান্তরিত করেছেন৷
কিন্তু ‘চরিত্রহীন’-এর সেই নিম্নশ্রেণীর দেহজীবী বারাঙ্গনা আরাকানে যার গৃহে অর্ধবৎসরকালব্যাপী সময় অতিবাহিত করেছিল দিবাকর ও কিরণময়ী তার মধ্যে কিন্তু নারীর কোনো মহানুভবতার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেননি রচনাকার৷ লোভে-ঈর্ষায়-দক্ষতায় পরিপূর্ণ বেশ্যা সে৷ অর্থই তার জীবনের পরমার্থ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে৷
‘দেবদাস’ উপন্যাসের চন্দ্রমুখী রূপপসারিণী বাইজি৷ লেখক তাঁর সংবেদনশীল মন দিয়ে এই বারবিলাসিনী নারীকেও অসামান্য দক্ষতায় অঙ্কন করেছেন৷ স্নেহ ভালোবাসা-ত্যাগ-মহানতা কোনোকিছুই বাদ পড়েনি তার চরিত্রে৷ উপন্যাসটির নায়িকা পার্বতী হলেও চন্দ্রমুখী প্রায় তার মতোই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র৷ রূপে দক্ষতায় অসামান্য সে৷ দেবদাসের ঘৃণার আঘাতে দেহপসারিণীর প্রাচীর ভেঙে তার পবিত্রতম নারীসত্তাটি বাইরে বেড়িয়ে আসে৷ ছেলেবেলায় যাকে প্রেম ভেবে ঘর থেকে প্রথম বেড়িয়ে এসেছিল, পড়ে সামান্য গহনার কারণে সেই ঠুনকে প্রেমস্তম্ভ ধূলিসাৎ হয়ে দেহজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল তাকে, দেবদাসের প্রতি নিষ্কাম প্রেমে তার প্রেমের সত্যরূপটি উদ্ভাসিত হয়ে উঠে৷ গণিকাবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে এক অচেনা গ্রামে গিয়ে সাধারণভাবে জীবন যাত্রা শুরু করে দেয়৷ সেখানে যাওয়ার আগে পার্বতীর অনুসঙ্গে নিজের মনের সমস্ত কথা প্রকাশ করে ফেলে দেবদাসের কাছে৷ পার্বতী প্রসঙ্গে যে সমস্ত কথা দেবদাসকে জানায় তাতে নারীর প্রতি নারীর অনুভবের যে আন্তরিকতা তা প্রকাশ হয়৷ সে দেবদাসকে বলে—‘‘মাঝে মাঝে নেশার ঘোরে তোমার মুখ থেকে অনেক কথাই শুনেচি৷ কিন্তু তবুও আমার বিশ্বাস হয় না যে, পার্বতী তোমাকে ঠকিয়েচে৷ বরঞ্চ মনে হয়, তুমি নিজেই নিজেকে ঠকিয়েচ৷ দেবদাস, আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়, এ সংসারে অনেক জিনিস দেখেচি৷ আমার কি মনে হয় জান? নিশ্চয় মনে হয়, তোমারই ভুল হয়েচে৷ মনে হয়, চঞ্চল এবং অস্থিরচিত্ত বলে স্ত্রীলোকের যত অখ্যাতি, ততখানি অখ্যাতির তারা যোগ্য নয়!’’৯৫ চন্দ্রমুখী নিজের হৃদয় দিয়ে পার্বতীর প্রেমকে যতটা বুঝেছিল পার্বতী নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ততটা বোঝেনি৷ বোঝার কথাও নয়৷ সে আবাল্য দেহপসারিণী নারীদের ঘৃণা করা দেখে এসেছে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে সেই মনোভাবই প্রাপ্ত হয়েছে৷ তাই ভৃত্য ধর্মদাসের কাছে যখন শোনে মদ-বেশ্যাসক্ত দেবদাস কোনো বারবনিতাকে কয়েক হাজার টাকার গহনা গড়িয়ে দিয়েছে তাতে আশঙ্কার গাঢ় মেঘ জমাট বাঁধে তার মনে৷ দেবদাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সে বিষয়ে জানতেও চায়—‘‘আর কত হাজার টাকার গয়না গড়িয়ে দিয়েচ, না?’’৯৬ গণিকারা যে সমাজদূষিত মর্যাদাহীন; পার্বতীর সখি মনোরমার, দেবদাসের ভ্রাতৃবধূর কথার মধ্য দিয়েও সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়৷
দেবদাসের দৃষ্টিতে চন্দ্রমুখী ঘৃণ্য নয়৷ তার ভেতরকার প্রেম-বুভুক্ষ নারীটিকে চিনতে পেরেছিল সে৷ একদিন যার বাসস্থানকে ‘হতভাগা’ জায়গা এবং যাকে কোনো কথা না বলে মুখের উপর একটা নোট ছুড়ে দিয়ে চলে এসেছিল তাকে বৌ সম্বোধন করে আপনজনের স্বীকৃতি দেয়৷ তার দৃষ্টিতে ভদ্র-শালীন পরিবারের মেয়ে ও বধূ পার্বতী এবং চন্দ্রমুখী একাকার হয়ে যায়৷—‘‘তোমাদের দু’জনে কত অমিল, আবার কত মিল৷ একজন অভিমানী, উদ্ধত, আর একজন কত শান্ত, কত সংযত৷ সে কিছুই সইতে পারে না, আর তোমার কত সহ্য! তার কত যশ, কত সুনাম, আর তোমার কত কলঙ্ক! সবাই তাকে ভালবাসে, আর কেউ তোমাকে ভালবাসে না৷’’৯৭ দেবদাসের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একজন সাধারণ বারাঙ্গনা তার মানবিক গুণাবলীর দ্বারা সমাজের স্বীকৃত চরিত্রবতী পার্বতীর থেকেও অনেক বেশি মর্যাদা লাভ করেছে৷ তাই দেবদাস তাকে মৃত্যুর পরের জীবনে সঙ্গী হিসেবে পেতে চেয়ে অপ্রত্যাশিত সম্মান দান করেছে৷ দেবদাসের সেই সম্মান জানানো আসলে দরদি শরৎচন্দ্রের দরদি মনের প্রতিচ্ছবি৷
শরৎচন্দ্র তথাকথিত ব্যভিচারিণী দেহজীবী নারীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তার মাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি৷ দেবদাস চন্দ্রমুখীর প্রতি নরম হল, তাকে বৌ বলে সম্বোধনও করল আবার মৃত্যুর পরের জীবনে সঙ্গী হিসেবে প্রার্থনা করে অশেষ সম্মান প্রদর্শন করতে পারলেও চন্দ্রমুখীর সেবায়-যত্নে রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করে বায়ুপরিবর্তনের জন্য বাইরের কোনো স্থানে যাওয়ার সময় সেই বারবনিতাকে সঙ্গে নিতে পারলো না৷ সমাজের কোনো নৈতিক দাবিই তো সে মানেনি৷ বাল্যবয়স থেকেই তার মধ্যে দেখা গেছে সমাজের প্রচলিত নিয়মগুলিকে লঙ্ঘন করার প্রবণতা৷ সে মদ ধরেছে, বেশ্যাসক্ত হয়েছে—এসব কিছুতেই তো সমাজের অনুমোদন থাকে না অথচ চন্দ্রমুখীকে সাথে নিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে সমাজই তার কাছে বড় হয়ে উঠলো৷ তাই বায়ুপরিবর্তনে যাওয়া স্থির হলে দাসী হিসেবে চন্দ্রমুখী তার সঙ্গে যেতে চাইলে দেবদাস ঘৃণায় শিউরে উঠে—‘‘ছিঃ, তা হয় না! আর যাই করি, এতবড় নির্লজ্জ হতে পারব না৷’’৯৮ দেবদাসের মতো পুরুষদের রাতের পর রাত তাদের দরজায় হত্যে দিয়ে পড়ে থাকায় নির্লজ্জতা নেই নির্লজ্জতা রয়েছে প্রত্যক্ষভাবে সকলের সামনে মেলামেশা করায়৷ যাই হোক দেবদাস তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে না পারলেও যতটুকু সম্মান দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্রের আগে পর্যন্ত কেউ তেমন সম্মান প্রদর্শন করতে পারেনি বোধ হয়৷ তারাও যে মানুষ—শুধু মানুষ নয়, স্নেহ-মায়া-মমতাপূর্ণ নারী শ্রেণীর প্রতিনিধি সেই সত্যটা অন্তত প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷
বারবনিতা পিয়ারীর এক সাধারণ গ্রাম্য মেয়ে থেকে বারভোগ্যা হয়ে উঠার মর্মান্তিক কাহিনি বর্ণনা করেছেন ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের৷ সমাজের যূপকাষ্ঠে বলি হয়ে পুরুষের কাছে তার নারীমাংস পরম আস্বাদিত হলেও লাঞ্ছিতা নারীর সেই হৃদয়বিদারি মর্মজ্বালাকে সুনিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন রচনাকার৷ পিয়ারীর পূর্বনাম রাজলক্ষ্মী৷ তার দুই পুরুষে কুলীন বাবা আরেকজন স্ত্রী গ্রহণ করে তারা দুই বোন রাজলক্ষ্মী ও সুরলক্ষ্মী সহ তার মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়৷ রাজলক্ষ্মীর বয়স তখন আট এবং সুরলক্ষ্মীর বারো-তেরো৷ স্বামী বিতাড়িত মাতা কাঁধে দুই প্রায় বিবাহযোগ্যা মেয়ে নিয়ে উপান্তর না দেখে আশ্রয় নেয় বাপের বাড়িতে৷ তাদের মামা অস্থির হয়ে পড়ে ভাগ্নীদের বিয়ের চিন্তায়৷ একে কুলীন তার মধ্যে আবার দরিদ্র৷ টাকা ছাড়া কে সেই বোকামি করতে যাবে৷ অবশেষে প্রতিবেশী বিরিঞ্চি দত্তের বাঁকুরা থেকে নিয়ে আসা ভঙ্গকুলীন পাচক ঠাকুরের কাছে ধরনা দেয় তাদের উদ্ধার করার জন্য৷ পাত্র এমনিতে হাবাগোবা হলেও এ ব্যাপারে বুদ্ধির কমতি নেই৷ রাজলক্ষ্মীর মামা একান্ন টাকার বিনিময়ে ভাগ্নীকে তার হাতে সম্প্রদান করতে চাইলে—‘‘একান্ন টাকা পণের কথায় সে সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিল, অত সস্তায় হবে না মশায়—বাজারে যাচিয়ে দেখুন পঞ্চাশ-এক টাকায় একজোড়া ভাল রামছাগল পাওয়া যায় না—তা জামাই খুঁজচেন—একশ-একটি টাকা দিন—একবার এ-পিঁড়িতে ব’সে আর একবার ও-পিঁড়িতে ব’সে দুটো ফুল ফেলে দিচ্চি৷ দুটি ভাগ্নীই এক সঙ্গে পার হবে৷ আর একশখানি টাকা—দুটো ষাঁড় কেনার খরচটাও দেবেন না?’’৯৯ গরু-ছাগলের মতো দরকষাকষির পর সত্তর টাকায় রফা করে দুই বোনকে একসঙ্গে বিয়ে করে আঁচলে সত্তর টাকা গুজে সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীদের ফেলে চলে যায় স্বামীরত্নটি৷ তার প্রায় বছর দেড় পড়ে সুরলক্ষ্মী মারা যায় এবং আরও দেড় বছরের মতো সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শোনা যায় রাজলক্ষ্মী কাশীতে তার মায়ের সঙ্গে গিয়ে শিবলোকে যাত্রা করেছে৷ তারপর আর তাদের দু-বোনের কোনো অস্তিত্ব নেই৷ কি মর্মান্তিক অবমাননা! দুটি তাজা প্রাণ সমাজের নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে অচিরেই সমাপ্তির মুখ দেখে৷ কিন্তু সেখানেই থেমে যায়নি৷ সুরলক্ষ্মী মরে বেঁচে গেলেও ঘটনার বহুদিন পর শ্রীকান্তের দৃষ্টিতে রাজলক্ষ্মী পুনরায় বেঁচে উঠে অন্য আরেক রূপে৷ তা যেন রাজলক্ষ্মীর প্রেতাত্মা—নাম পিয়ারীবাই৷ বড়লোক বন্ধুর শিকারে নিমন্ত্রণ পেয়ে তার তাবুতে উপস্থিত হয়ে দেখে সেখানে যুবকবৃন্দের পাশবিক পিপাসাকে সাফল্যমণ্ডিত করতে নিয়ে আসা হয়েছে এক রূপপসারিণীকে৷ সে-ই পিয়ারীবাই৷ সেই হতভাগা নারী প্রথম দর্শনেই চিনে ফেলে তাকে৷ যদিও ধামার মতো পেট, কাঠির মতো হাত-পা এবং তামার শলার মতো চুলের অধিকারিণী বাল্যের সেই রাজলক্ষ্মীর নবজন্মপ্রাপ্ত আরেক সত্তা পরমরূপবতী উদ্ভীন্নযৌবনা পিয়ারীবাইকে কোনোভাবেই চেনার ক্ষমতা ছিল না শ্রীকান্তের৷ একটু একটু করে সে নিজেকে তার সামনে তুলে ধরেছে৷ অকপটে জানিয়েছে ছোট বেলায় পীড়নের ভয়ে বৈঁচি ফলের মালা গেঁথে তাকে স্বামীত্বে বরণের কথা৷ অত্যন্ত আপন জনের মতো নানা বিষয়ে সেই বাল্য বয়সের প্রণয়ীকে শাসন করেছে, সাবধান করেছে, কখনো বিদ্রুপ প্রকাশ করতেও বাধেনি৷ তাম্বু থেকে বিদায়ের আগে নিজের অজান্তে শশ্মানে উপস্থিত হলে রাজলক্ষ্মীই তাকে বাস্তবের পরিবেশে ফিরিয়ে এনেছে এক অতিলৌকিক আকর্ষণের জগৎ থেকে৷ তার কোমল মন প্রেমাস্পদের ভাবী বিপদে আতঙ্কিত হয়ে তক্ষুণি তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিতে চাইলে শ্রীকান্ত বলে—‘‘এমনভাবে চলে যাবার অর্থ কি হবে জান?’’১০০ রাজলক্ষ্মী জানে একজন বাইজির সঙ্গে হঠাৎ করে গাঢাকা দিলে সমাজে শ্রীকান্তের অপযশের শেষ থাকবে না৷ তবু প্রেমাস্পদকে ভাবী বিপদের মধ্যে ফেলে যেতে পারে না সে৷ তাকে পায়ে ধরে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য মিনতি করতে থাকলে শ্রীকান্ত বলে—‘‘কিন্তু যে মিথ্যা কুৎসার রটনা হবে, তার দাম ত কম নয়!’’১০১ পিয়ারী একজন বারনারী—সমাজে প্রত্যক্ষভাবে গণিকা সংস্পর্শ পাপ হিসেবে গণ্য৷ শ্রীকান্ত একজন বারবনিতার সঙ্গে গিয়ে বা কেউকে না বলে পিয়ারীর সাথে সাথে নিজেও বেপাত্তা হয়ে গেলে তার নামে গণিকার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ারই কুৎসা রটবে৷ অন্য কোথাও গেল কি না তা কেউ খতিয়ে দেখবে না৷ শুভাকাঙ্খিনীর শুভ অনুরোধটুকু তাই সে রাখতে পারে না৷ নিরুপায় পিয়ারী শ্রীকান্তের সেই নিষ্ঠুর অপমানে পা ছেড়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকলে তার সেই অপমানাহত মুখ দেখে শ্রীকান্তের মনে হয়—‘‘সম্মুখের ওই পূর্ব আকাশটার সঙ্গে এ পতিতার মুখের কি যেন একটা নিগূঢ় সাদৃশ্য রহিয়াছে৷ উভয়ের মধ্য দিয়াই যেন একটা বিরাট অগ্নিপিণ্ড অন্ধকার ভেদ করিয়া আসিতেছে—তাহারই আভাস দেখা দিয়াছে৷’’১০২ সমাজের কুটিল চক্ষুকে উপলব্ধি করে তখনকার মতো তার প্রিয়তমকে ছেড়ে যেতে হয় কিন্তু যাওয়ার আগে সে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেয় যে বারোটার আগেই তার কান্তদা সবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে সেই স্থান ত্যাগ করবে৷
রাজলক্ষ্মী সাতঘাটের জল খেয়ে পিয়ারীবাইয়ের রূপ ধারণ করেছে৷ অভাবের জ্বালায় তার মা কাশীতে নিয়ে গিয়ে একহাজার টাকার বিনিময়ে এক মৈথিলি রাজপুত্রের হাতে বিক্রি করে দিয়ে গ্রামে এসে প্রচার করে যে কাশীতে তার শিবপ্রাপ্তি ঘটেছে৷ সে বুদ্ধি খাটিয়ে মুক্ত হয় সেই রাজপুত্রের হাত থেকে৷ একজন বৃদ্ধ বাঙালি ওস্তাদের কাছ থেকে গান-বাজনা এবং তার স্ত্রীর কাছ থেকে নাচ শিখে পিয়ারীবাই হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে৷ কিন্তু জীবনের জটিল আবর্তে একাধিক পুরুষের হস্তগত হয়েও অন্তরের রাজসিংহাসনে বসিয়ে পুজো করে গেছে শ্রীকান্তকে৷ দীর্ঘদিন সেই পাপবৃত্তিতে আত্মমগ্ন থেকেও তার ভালোবাসার নৈবেদ্যকে বাসী হতে দেয়নি৷ এ সম্পর্কে শ্রীকান্তকে বলেছে—‘‘কি বিশ্রী এই মেয়েমানুষ জাতটা, একবার যদি ভালোবেসেচে, ত মরেচে৷’’১০৩
রূপপসারিণী হলেও তার মধ্যে স্নেহ-মায়া-মমতা-প্রেম-সেবাপরায়ণতা সবকিছু যেন উপচে পড়েছে৷ সে সন্তান বাৎসল্যে স্বামীর প্রথমপক্ষের সন্তান বঙ্কুকে নিজের কাছে রেখে মাতৃত্বের সাধ মেটায়, শ্রীকান্তকে বিপদে-আপদে সেবাযত্ন করে প্রেমপূজা চালিয়ে যায়৷ তার রূপপসারিণীর প্রকৃত স্বরূপ এবং শ্রীকান্তকে ভালোবাসার কথা বঙ্কুর সামনে আড়াল করতে চায়৷ শ্রীকান্তকে বলে—‘‘অসুখ ত একরকম ভাল হ’ল, এখন যাবে কবে মনে করচ?… আমার ছেলে প্রায়ই আজকাল বাঁকিপুর থেকে আসচে৷ বেশিদিন থাকলে সে হয়ত কিছু ভাবতে পারে৷’’১০৪ এই যে ছেলের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করার প্রচেষ্টা তার মধ্যেও পরোক্ষভাবে নিহিত রয়েছে সামাজিক তর্জনীহেলন৷
বঙ্কুর শ্রীকান্তকে বলা কথার মধ্যেও সমাজে গণিকাদের অবস্থানগত দিক সুস্পষ্ট হয়ে উঠে৷ মায়ের সুখ্যাতি প্রকাশ করতে গিয়ে একসময় মায়ের হৃদয়ের দুঃখের এক দিক উন্মোচন করে ফেলে সে৷ পিয়ারী পুরুষের মনোরঞ্জনের উপার্জিত অর্থ দিয়ে সতীনের চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে, দরিদ্র গ্রামবাসীদের সুখ-দুঃখের দিকে তাকিয়ে তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়ে যায়, শীতকালে জামা-কাপড়, কম্বল দান করে৷ কিন্তু সমাজের মানুষজন তার দানকে গ্রহণ করলেও তাকে মেনে নিতে পারে না৷ বঙ্কুদের বাড়িতে তার যাতায়াতের জন্য পুরো পরিবারটিকেই সমাজ ‘একঘরে’ করে রেখেছে৷ তাদের জন্য ধোপা, নাপিত, মুদি সমস্ত কিছু বন্ধ৷ গ্রামের জলকষ্ট দূর করার জন্য তিন-চার হাজার টাকা খরচ করে পুকুর বানিয়ে দেয়, ঘাট বাঁধিয়ে দেয় কিন্তু গ্রামের লোক শুধু ‘বাইউলি’ বলে সে পুকুর তাকে প্রতিষ্ঠা করতে দেয় না৷ লুকিয়ে-চুরিয়ে পতিতাবৃত্তির অর্থে নির্মিত পুকুরের জল পান করতে পারলেও প্রকাশ্যে বর্ষণ করে তীব্র ঘৃণা৷ পিয়ারীর সদুদ্দেশে খোদিত সেই পুকুরের জল ব্রাহ্মণ, কায়স্ত, ছোটলোক সবাই নিয়ে খেতে পারে অথচ এক বারাঙ্গনাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না৷ রচনাকার মানুষের সেই স্থুল দিকটার প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন৷ কথক শ্রীকান্ত পিয়ারীর ভেতরকার সেই পবিত্র সত্তাটিকে আবিষ্কার করে বঙ্কুর কথার মধ্য দিয়ে৷ তাই পিয়ারী যে সর্বপুরুষের কামনার ধন তা আর ভাবতে পারে না৷ তার পরিপূর্ণ মাতৃরূপটির কাছে শ্রদ্ধায় আপনিই মস্তক নত হয়ে আসে শ্রীকান্তের৷
শ্রীকান্তের দৃষ্টি দিয়ে শরৎচন্দ্র একটু একটু করে পিয়ারীর গ্রন্থিমোচন করে রাজলক্ষ্মীকে মুক্ত করে চলেছেন, তার মাতৃমূর্তি যেমন অভিভূত করে রাখে তাকে; প্রেমময়ী রূপটিও তেমনি শ্রীকান্তের বন্ধনহীন জীবনে মধুর প্রণয়পাশ রচনা করে৷ পিয়ারীকে মুজরায় বেড়োতে হয়, নানা রসিক পুরুষ তার রূপছটা পান ও মধুর কণ্ঠের গান শোনার জন্য তার বাড়িতেও উপস্থিত হয়, দিনের পর দিন ও অতিবাহিত করে সেখানে৷ এমনি এক মুজরার সময় শ্রীকান্ত তার বাসায় উপস্থিত হলে হতবুদ্ধি হয়ে যায় সে৷ শ্রীকান্ত সমস্তটা বুঝতে পেরে তাকে আরও অধিক আলোড়িত করার জন্য পিয়ারী, বাইজিবিবি, বাইজি ইত্যাদি সম্বোধন করে৷ কিংকর্তব্যবিমূঢ় পিয়ারী শ্রীকান্তের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়৷ তার বিলাসী রূপ প্রণয়ীর মনে কি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে না জানলেও তার নিরব ঔদাসীন্যে ভীত হয়ে পড়ে সে৷ পিয়ারী পতিত হয়েছে, মুজরা করে পুরুষ ভুলিয়ে অর্থ উপার্জন করেছে৷ কিন্তু সেই রূপপসারিণী নিজের ইচ্ছায় হয়নি, হতে বাধ্য হয়েছে৷ তার পরেও তার কোনো ভালো কাজ সমাজ অনুমোদন করে না৷ মুক্ত হতে চেয়েও তার যেন মুক্তি নেই৷ তাই সর্বদিক থেকে বঞ্চনার জ্বালা প্রকাশ করতে গিয়ে এক মর্মভেদী প্রশ্ন করে বসে শ্রীকান্তকে—‘‘আচ্ছা, জিজ্ঞেস করি তোমাকে, পুরুষমানুষ যত মন্দই হয়ে যাক, ভাল হ’তে চাইলে তাকে ত কেউ মানা করে না; কিন্তু আমাদের বেলায়ই সব পথ বন্ধ কেন? অজ্ঞানে, অভাবে প’ড়ে একদিন যা করেচি, চিরকাল আমাকে তাই করতে হবে কেন? কেন আমাদের তোমরা ভাল হতে দেবে না?’’১০৫ পিয়ারীর এ প্রশ্ন শুধু তার একার নয়, তা যেন তার মত সমস্ত নারীর৷ স্নেহ-বাৎসল্য ভালোবাসায় সে কারও চেয়ে কোনো অংশেই হীন নয় অথচ তার জন্য নিশ্চিন্ত কোনো আশ্রয় রাখেনি সমাজ—যেখানে স্বামী থাকবে, সন্তান থাকবে, তার প্রতি সম্মান থাকবে৷ সে যখন একবার পতিত হয়ে রূপপসারিণী হয়েছে তখন রূপ বিক্রয় করাই যেন তার ভবিতব্য৷ তাছাড়া অন্য কোন পথ নেই৷ অথচ তার কাছে বিনোদনের লোভে আসা পুরুষ সমাজের জন্য কোনো বিধি নিষেধ নেই—অপমান-অবমাননা নেই—পতিত করার প্রবণতা নেই৷
রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে নিয়ে কাশী যাওয়ার প্রস্তাব করলে শ্রীকান্ত আঁতকে উঠে সে কথা শুনে৷ একজন বারাঙ্গনা সমভিব্যাহারে ভ্রমণে গেলে তার মান-সম্মান কিছুই থাকবে না৷ তাই নিজের সম্ভ্রম রক্ষার প্রসঙ্গ টেনে পুনরায় বলে—‘‘লক্ষ্মী, তোমার জন্যে আমি সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু সম্ভ্রম ত্যাগ করি কি ক’রে?… সম্ভ্রম যাওয়ার পরে পুরুষমানুষের বেঁচে থাকা বিড়ম্বনা৷ শুধু সেই সম্ভ্রম ছাড়া তোমার জন্যে আর সমস্তই আমি বিসর্জন দিতে পারি৷’’১০৬ যাই হোক মান-সম্ভ্রমের ঝুঁকি নিয়ে শ্রীকান্তকে কাশী যেতে হয়৷ সেখান থেকে শ্রীকান্ত পশ্চিমে যাওয়ার মনস্ত করলে প্রয়াগে স্নানের উদ্দেশ্যে রাজলক্ষ্মীও সঙ্গে যাওয়ার জন্য আবদার করে৷ শ্রীকান্ত জানে যে সেখানে তার জ্ঞাতি সম্পর্কের এক খুড়ো বহুদিন থেকে কর্মোপলক্ষে বসবাস করছে৷ তাছাড়া কয়েকজন আত্মীয়-বন্ধুও সেখানে রয়েছে৷ একজন বাইজিকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে আমতা-আমতা করলে পিয়ারীর মুখে ধ্বনিত হয় তীব্র ব্যঙ্গবাণী৷ তার সঙ্গে পরিচিত কেউ শ্রীকান্তকে দেখে ফেলতে পারে তার জন্যই যে সে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে রাজী হচ্ছে না তা নিমেষেই বুঝে ফেলে সে৷ তাই বলে—‘‘তা বটে, আর বছর আরাতে ত তোমাকে একরকম কোলে নিয়েই আমার দিন-রাত কাটল৷ ভাগ্যিস সে অবস্থাটা কেউ দেখে ফেলেনি৷ সেখানে বুঝি তোমার কেউ চেনাশুনা বন্ধু-টন্ধু ছিল না৷’’১০৭ রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে ভালোবেসে যতই অতীতের সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণাকে ভুলতে চায় কিন্তু শ্রীকান্ত যেন ততই সমাজের বেত হাতে নিয়ে তার পৃষ্ঠে আঘাত হেনে তাকে মনে করিয়ে দেয় সে একজন পণ্যনারী৷ তাই তার আহত নারীমন শ্রীকান্তের সেই বিরুদ্ধ মনোভাবকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারে না৷ তার মনের গুমোট যন্ত্রণাকে শ্রীকান্তর সামনে উগরে দিয়ে শান্তনা লাভের চেষ্টা করে৷ নিজের প্রকৃত অবস্থাকে পুনরায় বিচার করে উপলব্ধি করে সেখান থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব নয় জন্য আবার সাজগোজ করে মুজরার উদ্দেশ্যে বের হয়৷ তার সেই মুজরায় বের হওয়ার পেছনে যদিও প্রকটভাবে কাজ করেছিল শ্রীকান্তকে বিদ্ধ করার প্রবণতা৷ কিন্তু পিয়ারীর সেই কাঁটা পুনরায় তার বক্ষকেই বিদ্ধ করে শ্রীকান্তের প্রবল বক্রবাক্যে—‘‘ওরে পাষণ্ড রোহিণি! তুই গোবিন্দলালকে চিনিস না? আহা! আজ যদি আমার একটা পিস্তল থাকিত! কিংবা একখানা তলোয়ার!… রাজলক্ষ্মী শুষ্ককন্ঠে কহিল, তাহলে কি করতে?—খুন!… না ভাই পিয়ারী, আমার অতবড় নবাবী শখ নেই৷ তা ছাড়া এই বিংশ-শতাব্দীতে এমন নিষ্ঠুর নরাধম কে আছে যে, সংসারের এই এতবড় একটা আনন্দের খনি পাথর দিয়ে বন্ধ করে দেবে? বরঞ্চ আশীর্বাদ করি, হে বাইজীকুলরাণি! তুমি দীর্ঘজীবিনী হও, তোমার রূপ ত্রিলোকজয়ী হোক, তোমার কন্ঠ বীণানিন্দিত এবং ঐ দুটি চরণকমলের নৃত্য উর্বশী তিলোত্তমার গর্ব খর্ব করুক—আমি দূর হইতে তোমার জয়গান করিয়া ধন্য হই!১০৮ কোন নিষ্ঠুর আঘাতে আহত হয়ে রাজলক্ষ্মী পুনরায় পিয়ারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল তা বোঝার ক্ষমতা হয় তো সেই মুহূর্তে শ্রীকান্তর ছিল না কিন্তু তার থিয়েটারি কায়দায় বলা সেই বক্তব্যে পিয়ারী যে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায় তা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ শ্রীকান্ত ভাবে মুজরায় বের হওয়া আসলে পিয়ারীর টাকার নেশা এবং অনুতপ্ত রাজলক্ষ্মীকে বলেও ফেলে সে সেই নেশা সে কোনোদিন ছাড়তেও পারবে না৷ রাজলক্ষ্মী তার সঙ্গে বর্মায় যেতে চেয়ে, তার সান্নিধ্যে থাকতে চেয়ে বার বার তাকে অনুরোধ করে পিয়ারীবাই-এর আকর্ষণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে৷ কিন্তু শ্রীকান্তর মত দরদি মানুষেরা এই পতিতা নারীদের জন্য অনেক কিছু ভাবতে পারে, অনেক জ্ঞান-উপদেশ দান করতে পারে;সবই দূর থেকে কিন্তু সমাজের শিকল ভেঙ্গে হাতে ধরে সেই পঙ্ক থেকে উদ্ধার করতে সাহস পায় না৷ শ্রীকান্তের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সেই দিকটাই স্পষ্ট হয়—‘‘লোক ত মনসা পণ্ডিতের পাঠশালার সেই রাজলক্ষ্মীটিকে চিনবে না, তারা চিনবে শুধু পাটনার প্রসিদ্ধ পিয়ারী বাইজীকে৷ তখন সংসারের চোখে যে কত ছোট হ’য়ে যাবো, সে কি তুমি দেখতে পাচ্ছো না?’’১০৯ কিন্তু রাজলক্ষ্মী তো যথার্থ প্রেমিকা৷ সে জানে তার কাছে শ্রীকান্ত কতটা কাঙ্খিত৷ তারপরেও তার সঙ্গ স্পর্শে শ্রীকান্তের ছোটো হওয়াকে মানতে পারে না৷ কারণ দশজন না জানলেও ঈশ্বর জানেন তার জন্য শ্রীকান্ত কোনোভাবে হীন হবে না৷ শ্রীকান্ত নিজেও জানে সে কথা৷ রাজলক্ষ্মীর অনুভূতিপ্রবণ অন্তকরণে যে কোনো পাপ নেই তা তার অজানা নয়৷ তবুও সমাজের অনুশাসনে বাঁধা তার সামাজিকসত্তাটি তাকে আপন করে নিতে পারে না৷ সে বলে—‘‘তাঁর চক্ষু ত সর্বদা দেখা যায় না! যে দৃষ্টি সংসারের দশজনের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায়, সেও ত তাঁরই চক্ষের দৃষ্টি রাজলক্ষ্মী! তাকেও ত অস্বীকার করা অন্যায়৷’’১১০ আর দশজনকে অস্বীকার করতে পারবে না জন্যই পতিত প্রণয়িনীকে কাঁদিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে উপস্থিত হয় নিজের জন্মভিটায়৷ কপর্দকহীন অবস্থায় পুনরায় জ্বরে পড়লে শরণাপন্ন হতে হয় পিয়ারীবাই-এরই৷ শ্রীকান্তের অসুস্থতার জন্য টাকা চেয়ে পাঠানো চিঠি দেখে ঠিক থাকতে পারে না বাইজি৷ সমাজের সমস্ত অপমান এবং নিজের অবস্থান ভুলে শ্রীকান্তের বাড়িতে উপস্থিত হলে আবার শ্রীকান্তকে আঁতকে উঠতে হয়৷ তাদের দুজনের কথোপকথনের মধ্যে সামাজিক অনুশাসনের সেই দিকটি স্পষ্ট হয়ে উঠে৷—
‘‘এ গ্রামে, এ পাড়ার মধ্যে তুমি ঢুকলে কোন সাহসে? তুমি কি মনে কর তোমাকে কেউ চিনতে পারবে না?
রাজলক্ষ্মী সহজেই কহিল, বেশ যা হোক! এইখানেই মানুষ হলাম, আর এখানে আমাকে চিনতে পারবে না? যে দেখবে সেই ত চিনবে৷
তবে?
কি করব বল? আমার কপাল, নইলে তুমি এসে এখানে অসুখে পড়বে কেন?
এলে কেন? টাকা চেয়েছিলাম, টাকা পাঠিয়ে দিলেই ত হ’তো৷
তা কি কখনও হয়? এত অসুখ শুনে কি শুধু টাকা পাঠিয়েই স্থির থাকতে পারি?
বলিলাম, তুমি নাহয় স্থির হলে, কিন্তু আমাকে যে ভয়ানক অস্থির করে তুললে৷ এখনি সবাই এসে পড়বে, তখন তুমিই বা মুখ দেখাবে কি করে, আর আমিই বা জবাব দেব কি!
রাজলক্ষ্মী প্রত্যুত্তরে শুধু আর-একবার ললাট স্পর্শ করিয়া কহিল, জবাব আর কি দেবে—আমার অদৃষ্ট!
তাহার উপেক্ষা এবং ঔদাসীন্যে নিতান্ত অসহিষ্ণু হইয়া বলিলাম, অদৃষ্টই বটে! কিন্তু লজ্জা-সরমের মাথা কি একেবারে খেয়ে বসে আছো? এখানে মুখ দেখাতেও তোমার বাধলো না?
রাজলক্ষ্মী তেমনি উদাসকন্ঠে উত্তর দিল, লজ্জা-সরম আমার যা-কিছু এখন সব তুমি৷’’১১১
অর্থাৎ রাজলক্ষ্মী যে প্রেমাস্পদের অসুস্থতার খবর পেয়ে শ্রীকান্তের সামাজিক অবস্থান ভুলে তাকে সুস্থ করার অভিলাষে তার শৈশবের চারণভূমিতে উপস্থিত হয়েছে তা শ্রীকান্তকে আশঙ্কিত করে তোলে! রাজলক্ষ্মী গণিকা হয়েছে না কি হয়েছে সে খবর তারা জানে না; তারা জানে কাশীতে বহুবছর পূর্বে রাজলক্ষ্মীর মৃত্যুর খবর৷ সেই মৃত রাজলক্ষ্মীকে হঠাৎ জীবিত হয়ে শ্রীকান্তের সেবা করতে দেখলে গ্রামের লোকজনের মনে যে কি ভাবনার উদয় হবে তা কল্পনা করতে কোনো অসুবিধা হয় না শ্রীকান্তের৷ তাই তার নির্বিকার ঔদাসীন্যে অসহিষ্ণু হয়ে উঠে৷ যাই হোক শেষ পর্যন্ত সেই মহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়; যখন শ্রীকান্তের মান-সম্ভ্রম সম্পূর্ণ ভূপতিত হওয়ার উপক্রম হবে৷ ডাক্তারবাবু, প্রসন্ন ঠাকুরদা প্রমুখ শ্রীকান্তের তদ্বির করতে কোনো স্ত্রীলোকের আসার সংবাদ পেয়ে উপস্থিত হয় সেখানে৷ তাদের দেখে মুহূর্তে সমস্ত সাহস উবে যায় রাজলক্ষ্মীর৷ তার আসন্ন অপমানের ভয়ে মড়ার মতো ফ্যাকাশে মুখ দেখে বিবেক জাগ্রত হয় শ্রীকান্তের৷ সে উপলব্ধি করতে পারে তার জন্য রাজলক্ষ্মীর চরম আত্মত্যাগ ও নির্মল প্রেমকে৷ তাই বিপদের হাত থেকে সেই অসহায় রমণীকে উদ্ধার করতে সকলের সামনে নিজের স্ত্রী পরিচয় দেয়৷ কিন্তু সেই পরিচয় যে রাজলক্ষ্মীর সম্মানকে উপরে না তুলে আরও অধঃপতিত করে তা শ্রীকান্তের জবানিতেই স্পষ্ট—‘‘বাস্তবিক এ শুধুই কেবল আপনাদের আপনি অপমান করিলাম৷ ইহার কোন প্রয়োজন ছিল না৷ বাজারের বাইজী অপেক্ষা বিধবা-বিবাহের পত্নী যে ইঁহাদের কাছে উচ্চ আসন পায় না—সুতরাং নীচেই নামিলাম,’’১১২ রাজলক্ষ্মী পরস্ত্রী, রাজলক্ষ্মী বিধবা৷ রাজলক্ষ্মী যে বাইজি সেটা তাদের অবগত নয়৷ শ্রীকান্ত রাজলক্ষ্মীকে স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছিল এক সম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত করার জন্য৷ কিন্তু তাদের চোখে পুণর্বিবাহিত বিধবা বা বাইজির কোনো প্রভেদ নেই৷ রাজলক্ষ্মীর হীন জীবন তাদের চোখে আরও হীন হয়ে যায়৷ পুরুষেরা বিবাহের পর বিবাহ করলেও দোষের হয় না—রাজলক্ষ্মীর স্বামী তার পূর্বস্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাদের দুইবোনকে সত্তর টাকার বিনিময়ে বিবাহ করেছিল অর্থাৎ স্ত্রী জীবিত থাকলেও যেখানে বাধা থাকে না আর মৃত হলে তো কোনো কথাই নেই৷ সেখানে শৈশবের কোনো নাম মাত্র বিয়েকে অবলম্বন করে বৈধব্যদশা প্রাপ্ত হলেও পরবর্তী সময়ে মেয়েদের আবার বিয়ে হওয়া মানতে পারে না সমাজ৷ সেই বিধবা নারীরা পুনরায় বিবাহিত হলে তাদের চোখে তারা বেশ্যারই সমতুল্য৷
সময় যত এগিয়ে গিয়েছে শ্রীকান্ত ততই যেন রাজলক্ষ্মীর নিষ্কলুষ সত্তাকে নতুন নতুন করে উপলব্ধি করতে পেরেছে৷ ধীরে ধীরে তার সঙ্গে সহবাসের সমস্ত বাধা দূর হয়ে গেছে৷ যে সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে একদিন উপেক্ষায় নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল তার করকমলেই নিঃশেষে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে৷ নারীর সতীত্বের ধারণা দেহের ভিতকে ছাড়িয়ে আরও উর্দ্ধমুখী হয়ে উঠেছে তার কাছে৷ তাই রাজলক্ষ্মী সম্পর্কে অকপটে বলেছে—‘‘মানুষ ত কেবল তাহার দেহটাই নয়! পিয়ারী নাই, সে মরিয়াছে৷ কিন্তু একদিন যদি সে তার ওই দেহটার গায়ে কিছু কালি দিয়াই থাকে ত সেইটুকুই কি কেবল বড় করিয়া দেখিব, আর রাজলক্ষ্মী যে তাহার সহস্র-কোটি দুঃখের অগ্নিপরীক্ষা পার হইয়া আজ তাহার অকলঙ্ক শুভ্রতায় সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, তাহাকে মুখ ফিরাইয়া বিদায় দিব! মানুষের মধ্যে যে পশু আছে, কেবল তাহারই অন্যায়, তাহারই ভুলভ্রান্তি দিয়া মানুষের বিচার করিব; আর যে দেবতা সকল দুঃখ, সকল ব্যথা, সকল অপমান নিঃশব্দে বহন করিয়াও আজ সম্মতি মুখে তাহারই মধ্য হইতে আত্মপ্রকাশ করিলেন, তাঁহাকে বসিতে দিবার কোথাও আসন পাতিয়া দিব না?’’১১৩ শ্রীকান্তের এই ভাবান্তর শুধু শ্রীকান্তের নয় সঙ্গে লেখকেরও৷ লেখক তার অনুভূতিশীল মন দিয়ে একটু একটু করে রাজলক্ষ্মীর জন্য শ্রীকান্তের মনে অনুকম্পা-শ্রদ্ধা-সম্মান সঞ্চিত করেছেন তাতেই শ্রীকান্তের ভাবান্তর ঘটেছে; একজন পতিতা নারী মনুষত্বের উজ্জ্বল বিভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে৷ তারপর বহুদিন একসঙ্গে কাটিয়েছে তারা৷ শ্রীকান্তের উদ্দেশ্যহীন জীবনে প্রায় চালিকাশক্তি রূপে কাজ করেছে রাজলক্ষ্মী৷ তারপরেও একটা বড় প্রশ্ন রেখে গিয়েছেন লেখক৷ তা হল তাদের পারস্পারিক সম্পর্ক৷ রচনাকার পিয়ারীকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়ে পুনরায় রাজলক্ষ্মীতে রূপান্তরিত করলেন, রাজলক্ষ্মী রাজলক্ষ্মী হয়েই লাভ করলো তার প্রেমাস্পদকে৷ অর্থাৎ সমাজে একটা সম্মানের জায়গায় নিয়ে এলেন তাকে কিন্তু তাদের বিয়ে দিলেন না কেন৷ সমাজে বেঁচে থাকতে গেলে একটা পরিচয় চাই৷ রাজলক্ষ্মীর প্রথম পরিচয় স্বামী পরিত্যক্ত মাতার কন্যা হিসেবে, তারপরে পাচক ঠাকুরের স্ত্রী হিসেবে, তারপরে হয় পিয়ারীবাই৷ পিয়ারীবাই হয়েই কাছে পায় শ্রীকান্তকে; তার রূপপসারিণীসত্তা মরে গিয়ে রাজলক্ষ্মী বেঁচে উঠে৷ শ্রীকান্তের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করতে থাকে৷ কিন্তু আদতে শ্রীকান্ত তাকে বিয়ে করেনি কখনো৷ বিয়ে না করেও একজন নারীপুরুষের সহবাস সমাজের চোখে বৈধ নয়৷ তবে কি সে রক্ষিতা হিসেবে বাঁধা পড়ে? তাও তো নয়৷ আসলে তৎকালীন সামাজিক পরিবেশে একজন বাইজির কোনো মূল্যই ছিল না৷ সেখানে শরৎচন্দ্র যা করেছেন তা তার স্পর্ধার চূড়ান্ত পর্যায়৷ একজন পতিতাকে পুনরায় গৃহী করে গৃহিণীর মর্যাদা দেওয়ার দুঃসাহস হয়তো তাঁর ছিল না কিন্তু যতখানি করেছেন তাও পতিতাদের জন্য কম নয়৷ শুধু তাই নয় রাজলক্ষ্মীর মতো এক অতিসাধারণ বালিকা ভাগ্যচক্রে বাইজি হয়ে প্রভূত ধনসম্পদের অধিকারিণী হয়ে উঠেছিল৷ এই ধনসম্পদের প্রাধান্যই তার মধ্যে জন্ম দিয়েছিল এক স্বাধীকার বোধের৷ আর তার জন্যই সমাজের মুখ ফিরিয়ে থাকা এই বারবনিতা নিজের কর্দম ছুড়ে দিতে পেরেছে সমাজের মুখেই৷ তার পরিণতির জন্য আঙ্গুল তুলেছে সমাজের বিধি-ব্যবস্থার দিকেই৷ সে শ্রীকান্তকে বলেছে—‘‘যে-দেশে মেয়ের বিয়ে না হলে ধর্ম যায়, জাত যায়, লজ্জায় সমাজে মুখ দেখাতে পারে না—হাবা-বোবা-অন্ধ-আতুর কারও রেহাই নেই—সেখানে একটাকে ফাঁকি দিয়ে লোকে অন্যটাকেই রাখে, এ ছাড়া সে-দেশে মানুষের আর কি উপায় আছে বলো ত? সেদিন সবাই মিলে আমাদের বোন দুটিকে যদি বলি না দিত, দিদি হয়ত মরত না, আর আমি—এজন্মে এমন করে তোমাকে হয়ত পেতুম না৷’’১১৪ সমাজের বিরুদ্ধে রাজলক্ষ্মীর এই বিক্ষোভ বারবনিতাদের মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনের দিকনির্দেশ করে৷ সমাজের উপেক্ষার মধ্যেও একজন মনোরঞ্জিকা হিসেবে তার গুরুত্ব কম ছিল না৷ আর যে ক্ষমতা সে অর্জন করেছিল তা তার মানসিক দৃঢ়তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল বললে অত্যুক্তি হবে না৷
এই উপন্যাসের আরেক নারী কমললতা৷ তার পিতা-মাতা প্রদত্ত নাম ঊষাঙ্গিনী৷ অল্প বয়সে বিধবা হয় বাবা-মায়ের পরম আদরের ঊষাঙ্গিনী সমাজের চোখে কুলটা হয় তার বাবারই কর্মচারী মন্মথর সঙ্গে৷ মন্মথের সঙ্গে স্বেচ্ছাচারের ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়লে তার বাবা সেই লজ্জার হাত থেকে নিজেকে ও মেয়েকে বাঁচাতে নবদ্বীপে নিয়ে যায়৷ উদ্দেশ্য সেখানে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা দিয়ে মেয়েকে মন্মথর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া৷ মন্মথ সেই সন্তানের দায় অস্বীকার করে সেই দোষ আরোপ করে ভাইপো যতীনের উপর৷ যতীন লজ্জায় গলায় দড়ি দেয়৷ শেষে কুড়ি হাজার টাকার বিনিময়ে নিজের অপবাদ যতীনের নামে চালিয়ে রাজী হয় ঊষাঙ্গিনীকে বিয়ে করতে৷ বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত ঊষা দাসীর মুখে সমস্তটা জানতে পেরে মন্মথের লোভের মুখে ছাই দিয়ে সেখান থেকে শ্রীবৃন্দাবন ধামের উদ্দেশে যাত্রা করে৷ তার স্বামীর নামও ছিল শ্রীকান্ত৷ তাই ‘শ্রীকান্ত’ নামটার প্রতিই ছিল তার দুর্বলতা৷ পরবর্তী সময়ে দেখা যায় তার ভেতরকার সুকুমারী নারীত্বকে শ্রীকান্তের প্রতি নিষ্কাম ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে লেখক সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন৷
যাইহোক ঊষাঙ্গিনীও সমাজের নির্মম পীড়নের শিকার৷ সমাজের চোখে সে অপবিত্র৷ নারীর কুলটা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াও শ্রেয়স্কর মনে করতো তখনকার সমাজ৷ তাই মা-বাবার পরম আদরের ধন ঊষাঙ্গিনী বাবাকে চোখের জলে ভাসিয়ে বলতে পারে—‘‘আমি মরব না বাবা, কিন্তু আমার সতী লক্ষ্মী মা, তাঁকে ব’লো ঊষা মরেছে৷ মা দুঃখ পাবেন, কিন্তু মেয়ে তাঁর বেঁচে আছে শুনলে তার চেয়েও বেশি দুঃখ পাবেন৷’’১১৫ কি নিষ্ঠুর সমাজের অনুশাসন! দুরন্ত যৌবনবতী এক বিধবার যৌবনের সামান্য পদস্খলনে একবার যে ভুল হয়ে গেছে, সেখান থেকে তার মুক্তি নেই৷ মায়ের কাছে তাই পদস্খলিত মেয়ের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া কম যন্ত্রণাকর৷ ঊষা সমাজকে জানে; নিজের মৃত্যুর খবর তাই নিজের মুখেই বাবার মধ্য দিয়ে মায়ের কাছে প্রেরণ করে৷ আত্মীয়-স্বজন-পরিবার-পরিজন সবকিছু ভুলে নিজের অস্তিত্বটুকু মুছে কমললতা নাম নিয়ে আরেক উদ্দেশ্যহীন জীবনে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়৷ আর মন্মথ? সে তো পুরুষ মানুষ! সমাজের কাছে সে বরাবরই নির্দোষ৷ সে নিজের পাপ অন্যের স্কন্ধে আরোপ করে; অবশেষে সবকিছু প্রকাশ পেলেও কোনো দণ্ড ভোগ করে না৷ কমললতার কন্ঠে তার জীবনের কথা বলতে গিয়ে এ প্রসঙ্গে যে কথা উঠে আসে তা এক হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতি তীব্র চাবুকাঘাত৷ সে বলে—‘‘মন্মথর অশৌচ গেল কিন্তু পাপিষ্ঠা ঊষার অশৌচ ইহজীবনে আর ঘুচল না নতুনগোঁসাই৷’’১১৬ এই অশৌচ আসলে সামাজিক পীড়ন৷ যে পাপ করে মন্মথ সমাজের মধ্যে সাবলীলভাবে বিচরণ করতে পারে সেই একই পাপে সমাজচ্যুত হয় ঊষা৷ নারী-পুরুষের এই বৈষম্যসূচক বিধিনিষেধের প্রতি অল্প কথার মধ্যে দিয়ে বৃহৎ এক প্রশ্নচিহ্ন একে দিয়েছে লাঞ্ছিতা কমললতা৷
‘শুভদা’ উপন্যাসে দুজন গণিকা৷ একজন কাত্যায়নী অপরজন মালতী৷ এছাড়া গৌণচরিত্র হিসেবে আরেক নারীর উল্লেখ রয়েছে সে জয়াবতী; জমিদার সুরেন্দ্রর রক্ষিতা৷
কাত্যায়নী নিম্নশ্রেণীর দেহজীবী৷ দেহপসারিণী ছাড়া অন্য আর কোনো পরিচয় প্রকাশ করেননি রচনাকার৷ শুভদার স্বামী হারাণচন্দ্র তার বাঁধাবাবু৷ এই চরিত্রটির প্রতিও দাক্ষিণ্য প্রকাশ করেছেন রচনাকার৷ সে পরিবারের প্রতি উদাসীন হারাণচন্দ্রকে স্ত্রী-সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেছে, বোঝানোর চেষ্টা করে বলেছে—‘‘আমরা ছোটলোকের মেয়ে, ছোটলোক—কিন্তু এটা বুঝি যে, আগে স্ত্রী-পুত্র বাড়িঘর, তারপর আমরা; আগে পেটের ভাত, পরবার কাপড়, তার পর শখ, নেশা-ভাঙ৷ তোমার আমি অহিত চাইনে, ভালর জন্যই বলি—এখানে আর এস না, গুলির দোকানে আর ঢুকো না—বাড়ি যাও, ঘরবাড়ি স্ত্রী-পুত্র দেখ গে, একটা চাকরি-বাকরি কর, ছেলেমেয়ের মুখে দুটো অন্ন দাও, তারপর প্রবৃত্তি হয় এখানে এসো৷’’১১৭ শুধু বোঝানোই নয় সে নিজে খোঁজ নিয়ে দেখে এসেছে তার পরিবারের দুর্দশা৷ নিজের বহু কষ্টের জমানো অর্থ থেকে দশটাকা বের করে দিয়েছে দুর্বৃত্ত হারাণের হাতে, যাতে তার পরিবারের মুখে অন্তত দু’চার দিন অন্ন সংস্থান হতে পারে৷ তাদের মতো পতিতা নারীরা যে কোনোভাবেই সমাজের দাক্ষিণ্য অর্জন করতে পারে না; ভগবানও তাদের প্রতি বিরূপ এই সত্যটিও উঠে এসেছে কাত্যায়নীর কথায়৷ সে হারাণকে বলেছে—‘‘যার কেউ নেই, তার ভগবান আছেন, আমাদের সে ভরসাও নেই৷’’১১৮ শোনা যায় ঈশ্বর মানুষের ভাগ্য লিখে দেন—কাত্যায়নীর অদৃষ্টলিপিও ঈশ্বরের তৈরি; সে যে দেহব্যবসা করে জীবনধারণ করে সেটা তাহলে ঈশ্বরেরই নির্দেশিত অথচ এই বিড়ম্বিত ভাগ্যের নারীদের জন্য ঈশ্বরও মুখ ফিরিয়ে থাকেন; যেমন করে অসহায়া নারীদের সমাজের যূপকাষ্ঠে বলি দিয়ে সমাজপ্রভুরা সেই নারীর ভবিষ্যৎ পরিণতি দেখে নাক সিটকাতে দ্বিধাবোধ করে না৷ কাত্যায়নী সংবেদনশীল মন নিয়ে হারাণের পরিবারের জন্য তার ক্ষমতানুযায়ী উপকার করতে তৎপর; যা কিছু দুর্বিপাক সমস্তর জন্য দায়ী হারাণ নিজেই৷ অথচ সকলে সে দোষ আরোপ করে কাত্যায়নীর প্রতিই৷ কৃষ্ণঠাকুরাণী দুর্বৃত্ত হারাণের চাকুরিস্থলের ক্যাশ ভেঙ্গে তিনহাজার টাকা চুরির পেছনেও তাকে অভিযুক্ত করে হারাণের স্ত্রী শুভদাকে বলে—‘‘হারামজাদা মাগী বামুনপাড়ার কাতি, সে-ই ত এই দুর্ঘটনা ঘটালে; ইচ্ছে করে মুখপুড়ীকে পাঁশ পেড়ে কাটি৷… হারাণ মুখ্যু কিনা, তাই তার ফাঁদে পা দিলে৷ তিন হাজার টাকা চুরি করলি, না হয় দু শ’ এক শ’ মাগীর হাতেই এনে দিতিস! তবু ত কিছু থাকত?… কিন্তু ভগবান কি নেই? বামুনের যেমন সর্বনাশ করেছে তোর মতন সতীলক্ষ্মীর যখন চোখের জল ফেলিয়েচে, তখন শাস্তি কি হবে না? তুই দেখিস, আমি বললাম—’’১১৯ যে মানসিকতায় সমাজ হারাণের মতো পাপীদের পাপাচারকে আড়াল করতে পারে সেই মানসিকতায়ই তীব্র কটুবাক্য বর্ষণ করে শাপে জর্জরিত করতে পারে কাত্যায়নীর মতো বহুভোগ্যা রমণীকে৷ সমাজের সেই স্থূল দিকটার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন রচনাকার৷
ললনাও পিতার কাণ্ডজ্ঞানহীনতা, পরিবারের চরম দুরবস্থা এবং চরম দারিদ্র্য মাথায় নিয়ে দেহব্যবসার উদ্দেশে পা বাড়িয়ে সুরেন্দ্রবাবুর রক্ষিতা হয়ে যায়৷ সে আচারশীলা বিধবা হয়েও রক্ষিতা হতে বাধ্য হয়েছে৷ তার সংসারের আবেষ্টনীর মধ্য থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পিছনে কোনো পাপবোধ বা প্রবৃত্তির উস্কানি ছিল না৷ সে জানে কলকাতায় নারী শরীরের মূল্য অনেক৷ সেখানে গিয়ে শরীর বেচে অনেক উপার্জন করতে পারবে এবং তা দিয়ে পরিবারের অর্থসংকটের সমাধান করবে৷ কিন্তু পরিবারের মুখে কালি দিতে পারবে না সে৷ তাই গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে সকলের চোখে মৃত পরিণত হয়ে ললনা মালতী হয়ে যায়৷ নারায়ণপুরের জমিদার সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর রক্ষিতা হিসেবে স্থান পায় তার বাগানবাড়িতে৷ পরে দেখা যায় মালতীর নামে তার বাড়িতে টাকা পাঠানোর চেষ্টা সহৃদয় সুরেন্দ্রনাথের৷ অপরিচিতের কাছ থেকে পাওয়া সেই টাকা ফেরত দিতে এসে সদানন্দ সুরেন্দ্রবাবুর কাছে যখন জানতে পারে ললনা জীবিত এবং তার বারবনিতাসুলভ জীবন তখন মুহূর্তে বিহ্বল হয়ে সেখান থেকে উঠে যেতে যেতে চিৎকার করতে থাকে ‘সে স্বর্গে গিয়াছে—’১২০ বলে৷ গ্রামময় পাগল হিসেবে পরিচিত সদানন্দও ললনার অস্তিত্বকে আর স্বীকার করতে পারে না৷ তার মতে ললনা তাই মৃতই৷ এখানেও সমাজ ললনাকে বাঁচতে দেয়নি৷ মালতী নামের আড়ালে তাকে সম্পূর্ণভাবে শ্বাসরোধ করে মেরেছে৷
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘করুণা’ উপন্যাসে গণিকারা ছলনাময়ী, অঘটনপটিয়সী৷ ইন্দ্রলেখা, মদনিকা প্রমুখ চরিত্ররা তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে গিয়ে নানারকম অসৎ পন্থা অবলম্বন করেছে৷ তাদের উপর কথকের সামান্যতম সহানুভূতি বর্ষণ করেননি রচনাকার—বরং তীব্র ঘৃণায় নির্মম পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছেন৷
ইন্দ্রলেখার কন্যা অনন্তার রূপ এবং নৃত্য সৌকর্যে মোহিত হয়ে মহারাজাধিরাজ শ্রীমৎ কুমারগুপ্ত তাকে বিবাহ করতে চাইলে পারিষদবর্গ প্রবল বিরোধিতা করে৷ বৃদ্ধ মন্ত্রী প্রবল ব্যঙ্গবাণে রাজ্যের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মীদের সচেতন করতে মহাদণ্ডনায়ক রামগুপ্তকে বলেন—‘‘রাম, উৎসবের জন্য প্রস্তুত হইয়াছ ত? কল্য যুবরাজ-ভট্টারক স্কন্দগুপ্তের মাতা সিংহাসনচ্যুত হইবেন, নর্তকী ইন্দ্রলেখা—ফল্গুযশ নটের কন্যা তাহাতে উপবেশন করিবে৷ কল্য গুপ্তসাম্রাজ্যের অভিজাতসম্প্রদায় তাহার সম্মুখে নতজানু হইবে৷ তুমি না কুমারগুপ্তের জ্ঞাতি, প্রথম চন্দ্রগুপ্তের বংশজাত?’’১২১ সেই সময়ের সমাজের প্রেক্ষিতে পুরুষের বহুবিবাহ অমান্য ছিল না৷ মহারাজা যদি একজন বেশ্যাকন্যাকে বিবাহ না করে অন্য কোনো সাধারণ রমণীকেও বিবাহ করতেন তাহলেও রাজঅমাত্যদের এতটা বিরোধিতা সহ্য করতে হত না৷ মন্ত্রী দামোদর শর্মা, দেবধর, গোবিন্দগুপ্ত, রামগুপ্ত, ভানুমিত্র, অগ্নিগুপ্ত প্রমুখ উচ্চপদস্থ রাজ অমাত্যরা সর্বস্ব পণ করেছিলেন সেই বিবাহ বন্ধ করতে এবং রাজাকে সদুপদেশ দিয়ে বিরত করতে৷ বৃদ্ধ মন্ত্রী দামোদর শর্মা রাগে গর্জন করে কাঁপতে কাঁপতে বলে—‘‘বৃদ্ধ দামোদর সপ্ততিবর্ষ বয়ঃক্রমকালে নটের দাস হইতে পারিবে না, রঙ্গমঞ্চে নৃত্য করিতে পারিবে না৷ স্কন্দ, আমি বিদ্রোহী, আমি দামোদর, সমুদ্রগুপ্তের অন্নে প্রতিপালিত৷ এককালে চন্দ্রগুপ্তের দক্ষিণহস্তস্বরূপ ছিলাম, আমিই চন্দ্রগুপ্তের পুত্রকে সিংহাসনচ্যুত করিব৷ তুমি যদি পিতৃদ্রোহী না হও, গোবিন্দ যদি ভ্রাতৃসিংহাসনে উপবেশন করিতে সম্মত না হয়, তাহা হইলে আর্যপট্ট উঠাইয়া গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করিব৷’’১২২ এই শক্তিশালী অমাত্যদের বিরোধিতা করতে করতে ইন্দ্রলেখা নিঃশেষ হয়ে গেছে৷ যদিও শেষ পর্যন্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের শত্রুস্থানীয় বৌদ্ধ সংঘস্থবির হরিবল, প্রণয়ী চন্দ্রসেন এবং তান্ত্রিকের সহায়তায় অনন্তাকে রাজবধূ এবং পট্টমহাদেবীর আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল৷ কিন্তু তার জন্য যে হীন পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছিল তাকে বা তার দ্বারা প্ররোচিত কন্যা অনন্তাকে তাতে পাঠক তাদের ঘৃণা না করে পারে না৷ সমাজও পরিণতিতে কঠিন শাস্তি বিধান করেছে তাদের প্রতি৷
আবার ‘অসীম’ উপন্যাসে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুর আরোপ করেছেন বারাঙ্গনাদের প্রতি৷ শরৎচন্দ্রের মতো তিনিও তার মনিয়া চরিত্রটিকে ত্যাগে-ভালোবাসায়-ক্ষমায়-মহত্ত্বে মহান করে তুলেছেন৷
মনিয়াবাই দেহপসারিণী বাইজি মতিয়ার সন্তান৷ যৌবন বিগত হওয়ায় এবং ‘খদ্দের’ সংখ্যা কমে যাওয়ায় মতিয়া গণিকাবৃত্তি ছেড়ে বাইজির শিক্ষিকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যত্নবান হয়৷ অল্পদিনের মধ্যে সে বিষয়ে তার খ্যাতি প্রতিপত্তিও বেড়ে যায়৷ সমাজ দূষণের সবরকম হীন ক্রিয়া-কাণ্ড পরিত্যাগ করায় মতিয়াকে নিয়ে তার প্রতিবেশীদের কোনো অভিযোগ ছিল না৷ পাড়ার সকল ভদ্রস্থ লোকের সঙ্গে নিরুপদ্রবে জীবন চলতে থাকে তার৷ এখানে ভদ্রপল্লীতে সকলের সঙ্গে গণিকার বাস সম্পর্কে ইঙ্গিত দান করেছেন লেখক৷ যদিও তার আগে তিনি বলে নিয়েছেন—‘‘পাটনা সহরের এক প্রান্তে ভদ্র-পল্লীর মধ্যে এক বৃদ্ধা গণিকা বাস করিত৷ তাহার নাম মতিয়া৷ সে গণিকা হইলেও, পল্লীর সকলেই তাহার উপর সন্তুষ্ট ছিল৷ কারণ, তাহার গৃহে অসদাচরণ দেখিতে পাওয়া যাইত না৷ যৌবনান্ত হইবার পূর্বেই মতিয়া গণিকা-বৃত্তি পরিত্যাগ করিয়াছিল;’’১২৩ অর্থাৎ মতিয়া যদি গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত থাকতো তাহলে সমাজ বিরোধিতা করে হয়তো প্রান্তবাসিনী করে তুলতো৷ যা হোক মতিয়ার ভাগ্যে সে দুর্ভোগ আসেনি৷ মতিয়ার কন্যাই মনিয়া৷ মতিয়া তার নিজের সমস্ত শিক্ষা উজাড় করে দিয়েছিল মেয়ের প্রতি৷ সঙ্গীতের সহজাত দক্ষতা এবং অসামান্য রূপের ছটায় কিছুদিনের মধ্যেই মায়ের সমস্ত কৃতিত্বকে ছাপিয়ে যায়৷ তার নাম এবং রূপের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে৷ পরিণত হয় পাটনা শহরের বুলবুল হিসেবে৷ কিন্তু ঘটনার বাঁক নেয় শাহজাদার দরবারে মুজরা করতে গিয়ে অবস্থার দুর্বিপাকে অসীমের দর্শন পেয়ে৷ দুর্বৃত্তের হাত থেকে মনিয়াকে রক্ষা করে অসীম তার হৃদয়ের সিংহাসনে অক্ষয় আসনে অধিষ্ঠিত হয়৷ কিন্তু সে বারবনিতা—সমাজের মনোরঞ্জিকা৷ পুরুষরা তাদের দু’দিনের জন্য উপভোগ করতে পারে, রক্ষিতা হিসেবে তারও বেশিদিন নিজের করায়ত্ত রাখতে পারে কিন্তু একজন পণ্যাঙ্গনার প্রেমের মূল্য কেন দিতে যাবে৷ মনিয়া অসীমের জন্য তার নাম, যশ, মায়ের প্রতি দায়িত্ব এমনকি নিজস্ব ধর্মীয় আচরণ পরিত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে সাধনা শুরু করলেও তাকে লাভ করতে পারে না৷ অসীম তার দরদি মন দিয়ে মনিয়ার আত্মস্বরূপকে বুঝতে পারলেও সে তার কাছে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য৷ মনিয়ার কোনো জাত নেই, তার পিতা মুসলিম, মা হিন্দু৷ শুধু ধর্মীয় বিভেদই নয় সর্বোপরি সে বেশ্যাকন্যা৷ একজন বেশ্যাকন্যাকে গ্রহণ করে তার প্রেমের যথাযোগ্য মূল্য দেওয়ার কোনো বিধান সমাজে প্রচলিত নেই৷ অসীম তাই অপারগ৷ কিন্তু দেখা যায় শুধু অসীমকে ভালোবাসাই নয়, তার সমস্ত বিপদে-আপদে রক্ষয়িত্রী হয়ে অবতীর্ণ হয়েছে সে-ই৷ একজন অস্পৃশ্যা রমণীর ভালোবাসার দান গ্রহণ করা যায়, বিপদ উদ্ধারের জন্য সাহায্য নেওয়া যায় তার কৌশল ও বুদ্ধির অথচ তার প্রতিদানে উপেক্ষা ছাড়া কিছুই জোটে না তার৷
সম্পূর্ণ উপন্যাস জুড়ে কথক মনিয়াকে দিয়ে অসাধ্য সাধন করিয়েছেন, প্রেমের আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে ছাই করে তুলেছেন, সবশেষে সেই প্রেমকে নিষ্কামস্তরে উত্তীর্ণ করে এক আধ্যাত্মিক মাত্রা আরোপ করেছেন কিন্তু প্রেমাস্পদের বাহুবন্ধনে তার অতৃপ্ত ভালোবাসার পরিতৃপ্তি ঘটাতে পারেননি৷ ত্যাগে-ভালোবাসায়-মহানতায় মনিয়া নিজেকে বিলিয়েই গিয়েছে শুধু পরিণামে কোনো কিছু পায়নি৷ বেশ্যা কন্যা বলে সেই যন্ত্রণার পাহাড় বুকে চেপে আধ্যাত্মিক সাধনায় অগ্রসর হয়েছে৷
রচয়িতা মনিয়ার চরিত্রে যে মহৎ গুণগুলির সমাবেশ ঘটিয়েছেন তাতে তার প্রতি আর কোনো ঘৃণা থাকে না৷ একজন বেশ্যা কন্যার দুঃখে ব্যথিত হয়ে যেমন হৃদয় দ্রবীভূত হয়ে যায় তেমনি তার কঠিন প্রেম-সাধনায় মস্তক নত হয়ে আসে৷ আর এর মধ্য দিয়েই সার্থক হয়ে উঠে ‘অসীম’-এর মনিয়া৷
নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত সাহিত্য সৃষ্টির দিক দিয়ে প্রায় শরৎচন্দ্রের সমকালীন৷ মানুষের জীবনের বাস্তব রূপকে প্রতিবিম্বিত করতে গিয়ে তিনি উপন্যাসে যে সমস্ত গণিকা চরিত্র গুলোকে চিত্রিত করেছেন—তারা শুধু দেহজীবীই নয়—তারা রক্তমাংসের দোষগুণসম্পন্ন মানবী৷ সুপ্ত চৈতন্য বা প্রবৃত্তির তমসাপূর্ণ দিকটিকে তুলে ধরতে গিয়ে ‘পাপ’, ‘পুণ্য’ ইত্যাদি গতানুগতিক আদর্শের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে জীবনে যা বাস্তব, যা সত্য সেটাই দেখাতে চেষ্টা করেছেন৷ সেখানে কোনো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের জ্বালা নেই; নেই কোনো ক্রোধ বা প্রতিহিংসা৷ চরিত্রগুলি সাধারণ দোষগুণ সম্পন্ন মানুষের মতো ভুল-ভ্রান্তি,ভালো-মন্দ নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে৷
তাঁর ‘শুভা’ উপন্যাসের শুভার মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্খা৷ স্বামী নিবারণের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ঘর ছাড়ে সে৷ তার কাছে পরপুরুষের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়ে উপার্জন করা যেমন দেহ ব্যবসা তেমনি বিবাহিত স্বামীর সঙ্গে ভরণপোষণের নিমিত্ত অনিচ্ছাকৃত শরীরী সংসর্গও একরকমের দেহ ব্যবসা৷ তাই তার মনে হয় যে ঘরে থাকলেও শরীর বেচে খেতে হবে; বাইরেও না হয় তাই করবে৷ কিন্তু স্বাধীনতা তো পাবে৷ শুভা নারীর প্রতি প্রচলিত নানা বিধি-বিধান এবং পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া নানা অত্যাচার, পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ জীবনকে দেখার জন্য পথে বের হয়—জীবনের নানা স্তর অতিক্রম করে নারীজীবনের নানা প্রতিকূলতাকে মাথায় নিয়ে৷ তবু হার মানে না সে৷
শুভার মধ্য দিয়ে রচনাকার খড়গ ধরেছেন সমাজের নারীজাতির প্রতি নানা অত্যাচারের মধ্যে৷ শুভার মন-মানসিকতা আধুনিক নারীমনস্তত্বের পরিপূরক হয়ে উঠেছে৷ প্রচলিত সতীত্বের ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে আজীবন বিদ্রোহ করে গেছে সে৷
‘লুপ্তশিখা’-র মালতী একজন পণ্যাঙ্গনা হলেও মনুষত্বকে একেবারে বিসর্জন দিতে পারেনি৷ গণিকাদের প্রতি যে নেতিবাচক ধারণা একসময় নায়ক বটুকের মনে বিদ্বেষভাব বহন করতো সেই বটুকই ঘটনাচক্রে নিক্ষিপ্ত হয় এক পতিতাপল্লীতে৷ বারবনিতা মালতীর স্নেহ ও উপার্জনের পয়সায় অভিভাবকহীন বটুক একজন বড় উকিল হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে কিন্তু ততদিনে তার সেই পতিতা দিদিকে হারিয়ে ফেলেছে সে৷ পরে একটি কেস-এর ভিত্তিতে পুনরায় দিদির দেখা পেলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি৷
ঔপন্যাসিক সংবেদনশীল দৃষ্টিতে অঙ্কন করেছেন এই চরিত্রটিকে৷ ডুবুরির মতো তার পঙ্কিল শরীর ছেড়ে ডুব দিয়েছিলেন মনের গভীরে৷ সেখানে শুক্তির ভেতরে মুক্তোর মতো স্নেহ-ভালোবাসায় পরিপূর্ণ মনটিকে আবিষ্কার করে পাঠকের সামনে তাকে অনবদ্য করে তুলেছেন৷ যদিও ভাগ্যের চক্রে তার জীবন পরিণতি ট্র্যাজিক তথাপি বটুকদের মতো প্রতিপত্তিশালী মানুষদের সহায়তা ও অনুকম্পা গণিকাদের থেকে ঘৃণার পর্দামোচন করেছে৷
‘পাপের ছাপ’-এর মনোরমা উগ্রস্বভাবের৷ তার মধ্যে আরোপিত হয়েছে অপরাধ প্রবণতা৷ সে যৌনতায় লালসায় নিষ্ঠুর ব্যবহারে প্রায় নারীস্বভাব বর্জিত হিসেবে অঙ্কিত৷ ‘রক্তের ঋণ’-এ বর্ণিত বারবনিতাও যৌনতার ক্লেদ অঙ্গে ধারণ করে পরিণতি প্রাপ্ত হয়েছে৷ নিজের সেই পাপ সংক্রামণ প্রবাহিত করেছে পুত্র নাগানন্দের মধ্যেও৷
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের হাতে পতিতারা নানা রূপে উদ্ভাসিত৷ তার মধ্যে শুভা ও মালতী অবশ্যই উল্লেখযোগ্য দুই চরিত্র৷ শুভার স্বাধীন প্রবৃত্তি ও মালতীর হৃদয়ের কোমলতা, নির্মম পরিণতি সমাজে পতিতাদের অবস্থানগত স্বাতন্ত্র্যকে চিনিয়ে দেয়৷ সঙ্গে এই দিকটাও স্পষ্ট হয় যে এই পণ্য রমণীরাও নিজেদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে, সামাজিক মূল্য ইত্যাদি বিষয়ে একটু একটু করে সচেতন হতে শুরু করেছে—এবং পুরুষতন্ত্রকে তোয়াক্কা না করে নিজের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠায় যত্নবান হচ্ছে৷
জগদীশগুপ্ত ‘লঘুগুরু’ উপন্যাসে তিনজন নারীর তিনরকমের পরিণতি দেখিয়েছেন৷ প্রথম জন উত্তম৷ সে প্রথমে ছিল কারও গৃহবধূ৷ অবস্থা বিপাকে গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করেছিল৷ পরে তাতে প্রবল বিতৃষ্ণা উপস্থিত হলে পুনরায় গৃহী হওয়ার বাসনা, লালন করবার বাসনা তাকে পেয়ে বসে৷ যার ফলশ্রুতিতে সে হয়ে উঠে বিশ্বম্ভরের স্ত্রী এবং টুকীর মা৷ দ্বিতীয় চরিত্র টুকী৷ মা-মরা এই মেয়েটি যখন মা হিসেবে উত্তমকে লাভ করে নারীত্বের সৎগুণাবলীতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে৷ গণিকা স্নেহে মানুষ হয়েছে বলে তার বিবাহ নিয়ে বিভ্রাট দেখা দেয়; পরিশেষে উপায়ন্তর না দেখে এক মাঝবয়সি লম্পট পুরুষের ঘরনি হয়ে আরেক জীবন শুরু করে৷ টুকীর স্বামী লম্পট পরিতোষ আগে থেকেই বারবনিতা সুন্দরীকে রক্ষিতা হিসেবে গ্রহণ করে জীবন অতিবাহিত করছিল, সেই সংসারে অসামান্য রূপ নিয়ে হাজির হয়ে পরিতোষ ও সুন্দরীর সুপ্ত আশাকে জাগ্রত করে টুকী৷ পরিতোষ ও সুন্দরী মিলিতভাবে গণিকাবৃত্তির দিকে ঠেলতে থাকে টুকীকে৷ সেখানে টুকী চালিয়ে যায় সতীত্বকে বাঁচিয়ে রাখার অদম্য প্রয়াস৷ শেষ পর্যন্ত নিয়তির কাছে হার মানে সে৷ দেহব্যবসার অন্ধকার জগতে পা বাড়াতে বাধ্য হয় সীতা-সাবিত্রীর আদর্শে বেড়ে উঠা সেই নারী৷ তৃতীয়জন সুন্দরী৷ জন্মসূত্রেই দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সে৷ প্রায় বিগতযৌবনা এই বারবনিতা টুকীকে সামনে পেয়ে বেঁচে থাকার নতুন পথনির্দেশ পায়, তার সাধনা চলতে থাকে তাকে অবলম্বন করে রোজগার করার৷ সে কৌশল করে দূতী হয়ে টুকীর যৌনব্যবসার সমস্ত পথ তৈরি করলেও শেষ পর্যন্ত টুকী তাকে ত্যাগ করে স্ব-দায়িত্বে সেই বৃত্তির দিকে চলে যায়৷ সুন্দরী একা সেই নরকেই পচতে থাকে৷ অর্থাৎ তিনজন নারীর একজন অন্ধকার থেকে আলোতে, আরেকজন আলো থেকে অন্ধকারে এবং শেষজন শিক্ষা-সংস্কার বিবর্জিতরূপে অনন্ত নরকে পচে মরার মধ্যে পরিণতি পেয়েছে৷
আসলে জগদীশগুপ্ত মানুষের মনের জট বাঁধা-খোলার ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন৷ তার কোনো কোনো রচনায় নিয়তি বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে৷ তিনি ‘লঘুগুরু’ উপন্যাসে পরীক্ষা করতে চেয়েছেন একজন বহুভোগ্যা বারবনিতা তার দেহব্যবসা ছেড়ে গৃহলক্ষ্মীরূপে প্রতিষ্ঠিত হলে তার পরিণতি কি হতে পারে৷ সেই পরীক্ষার উপকরণ উত্তম৷ উত্তম জন্মসূত্রে পতিতা ছিল না৷ গৃহের চারদেওয়ালের আবেষ্টনী থেকে বেড়িয়ে তাকে কষ্ট করেই গণিকাসুলভ মানসিকতা আয়ত্ত করতে হয়েছিল৷ লেখক তার বর্ণনা দিয়েছেন—‘‘মানুষকে হাতে পাইয়া তাহাকে বশীভূত করিয়া খেলাইয়া খেলাইয়া পিশাচ করিয়া তুলিবার বিদ্যাটা সে চেষ্টা করিয়া, ভিতরকার বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া শিখিয়াছিল—তখন তার নাম ছিল বনমালা—তারও আগের নাম তার যূথী৷ মানুষ সেই যূথীর শত্রু৷’’১২৪ অর্থাৎ সংসারের নিরাপদ আবেষ্টনী থেকে বেড়িয়ে বেশ্যা হতে তাকে কম কষ্ট ভোগ করতে হয়নি৷ লেখকের এই কথার মধ্য দিয়ে তার গণিকা হওয়ার পেছনে সমাজের যে একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল তা স্পষ্ট৷ তাই উত্তমের পূর্ব জীবনের মূর্তি যূথীর শত্রু হয়েছিল মানুষেরাই৷ উত্তম বেশ্যা হয়ে মানুষকে ঘৃণা করেছে—মানুষকে কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে চরম তৃপ্তি অনুভব করেছে৷ এক হিংস্র আক্রোশে পুরুষদের কষ্ট দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে আত্মসুখ অনুভব করেছে৷ তার পর একদিন দুরন্ত ঘৃণা জন্মে যায় সেই কাজে৷ তার সংসার বুভুক্ষ মন পুনরায় গৃহী হওয়ার জন্য দুর্নিবার আকর্ষণে টানতে থাকে৷ তারপর নদীরঘাটে যেদিন বিশ্বম্ভরকে প্রথম দেখে; তার চোখে লক্ষ করে অনুরাগের হিরণ্যদ্যুতি, নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারে না৷ দেহ ব্যবসার রমরমা কারবার ছেড়ে তার গৃহিণী হওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে উঠে৷ লেখক সেই মনোভাবকে ব্যক্ত করে বলেছেন—‘‘কিন্তু যেদিন ঐ কাজে দুরন্ত ঘৃণা ধরিয়া গেল, আর যেদিন তার বিশ্বম্ভরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল, ঐ দু’দিনের ব্যবধান খুব অল্প’’১২৫—তার হিংস্র পুরুষ বুভুক্ষা লুপ্ত হয়ে পুরোনো গৃহবুভুক্ষার তন্দ্রা ভঙ্গ করে৷ এতদিন শয়তানকে বশীভূত করে সে তার দেহের খদ্দের বানিয়েছে; সে মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে সে বিপরীত পথে চলে শয়তানকে শাসন করে মানুষ করার অভিপ্রায়ে মশগুল হয়৷ তাই তার মনে হয় বিপরীত পথে চলে শয়তানকে শাসন করে মানুষ করে তোলাও না জানি কত আনন্দের—ভালোবাসা দিয়ে সুখী করাও বুঝি অসীম সুখের৷ আর এই অভিপ্রায়েই বিশ্বম্ভরের প্রস্তাবে সে তার গৃহলক্ষ্মী হয়ে গৃহে প্রবেশ করে৷ কিন্তু উত্তমের সেই সাধ পূর্ণ হয়নি৷ তার স্বামীর পূর্বস্ত্রী হিরণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অনেক আগেই পিশাচ বিশ্বম্ভরকে প্রায় মানুষ করে তুলেছিল৷ হিরণের জন্যও এক নারীর স্বাভাবিক সমবেদনায় ব্যথিত হয়েছে উত্তম৷ তার করুণ মৃত্যুকে মনে করে চোখে অশ্রুবাষ্প জমা হলে তা নিয়ে স্বামী বিশ্বম্ভরের বিদ্রুপ করতে বাধেনি৷ সে বলেছে—‘‘কথায় কথায় চোখে জল আনিয়া যদি আমাকে তুমি গদগদ করিয়া তুলিতে চাও, তবে সে সুদিনের দেরি আছে বলিয়া মনে করিয়া রাখ৷’’১২৬ তারপর হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠে একটা প্রবাদবাক্য আওড়ে বলেছে—‘‘কার শোকে কে কাঁদেরে বাবা, তার দিশে পাওয়া ভার—মাছ মরলে বিড়াল কাঁদে, গরু মরলে শকুন; আর, পদির পিসী কাঁদে পদি মারলে বলে উকুন৷’’১২৭ এখানে বিশ্বম্ভরের কথা থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে সে উত্তমকে গৃহে গৃহিণীরূপে ঠাঁই দিয়েছে তার পাশবিক ক্ষুধা মেটানোর জন্য—সে যে একজন নারী; তার হৃদয়ের সুখ-দুঃখ তাপ কিছু বোঝার ক্ষমতা নেই বিশ্বম্ভরের বা সে চেষ্টাও সে করেনি কোনোদিন৷ সে তাকে পণ্য জ্ঞানেই ঘরে তুলেছে, পণ্য ভেবেই উপভোগ করতে চায়; আর কিছু নয়৷ তারপরেও বলা যায় এযাবৎ আলোচিত উপন্যাসগুলিতে গণিকা নারীদের বিবর্তনের নানা পথ নির্দেশ করেছিলেন রচনাকরেরা কিন্তু জগদীশ গুপ্ত উত্তমকে দিয়ে যা করালেন তা চরম দুঃসাহসের৷ তিনি উত্তমকে এক বেশ্যা থেকে গৃহবধূরূপে প্রতিষ্ঠা দিলেন৷ গণিকাদের জন্য সমাজ সর্বদাই প্রতিকূল৷ তারা গৃহবধূ হয়ে যাওয়া এই বারবনিতাকে কি চোখে দেখবে, গৃহলক্ষ্মী হয়ে গৃহে অবস্থান করলে সংসারের কতটা মঙ্গল সাধিত হবে তা পরের ভাবনা কিন্তু তাকে গৃহিণীর মর্যাদা দেওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপটা জগদীশ ছাড়া কেউ দেখাতে পারেননি৷ পণ্যাঙ্গনার গৃহিণী হওয়ার পরিকল্পনা এবং তাকে বাস্তবায়িত করা গণিকা চরিত্রের বিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ৷
উত্তম বিশ্বম্ভরের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী হিসেবে সংসারে প্রবেশ করেই বুকে টেনে নেয় স্বামীর প্রথমাস্ত্রী হিরণের রেখে যাওয়া সন্তান টুকীকে৷ মাতৃহারা বালিকাকে আঁকড়ে ধরে সে হয়ে উঠে টুকীর মা৷ কিন্তু এক বারবনিতাকে গৃহিণীরূপে মানবে কেন সমাজ! উত্তমকেউ মেনে নেয় না৷ তাই প্রতিবেশিনীদের নানা ইঙ্গিতপূর্ণ কথার জবাব সে দেয় স্পষ্ট করেই৷ সে তার পরিচয় বা পূর্বজীবন কোনোটাই অস্পষ্ট রাখে না তাদের প্রতি৷ কারণ উত্তম সমাজকে জানে—জানে নারীর প্রতি তার নিষ্ঠুর উপহাসকে৷ তাই সবলে নিজের ব্যক্তিত্বকে ধরে রেখেছিল সে৷ প্রতিবেশীদের পীড়ন, স্বামীর খেয়ালিপনা কোনোকিছুতেই সে মুঠো আলগা করে নি৷ বিশ্বম্ভর ভেবেছিল তাকে করায়ত্ত করে একদিকে স্ত্রীর পরিচর্যা অন্যদিকে গণিকার সাহচর্য দুটোকেই এক সাথে গ্রহণ করবে কিন্তু তার সেই ভ্রম ভাঙতে দেরি হয় না৷ তার মনে হয়—স্ত্রীর নবতর এবং উৎকৃষ্টতর রূপ সে৷ স্ত্রীকে গন্ডির মধ্যে ফেলে ইচ্ছেমত নিষ্পেষণ করা যায়—স্ত্রী সেই পেষণের প্রতিবাদ করে কখনোই ছেড়ে যেতে পারবে না কিন্তু এই স্বাধীন বিহঙ্গ জীবনের অবাধ স্বাধীনতাসুখ উপভোগ করে স্বেচ্ছায় ডানা গুটিয়ে পিঞ্জরে ঢুকেছে৷ এর বন্দিত্ব চিরকালের নয়৷ আর উত্তমও বিশ্বম্ভরের স্বরূপকে বুঝতে পেরেছে স্পষ্ট করে৷ যে দুর্বৃত্ত দমনের দুর্বার বাসনায় বিশ্বম্ভরের গৃহে স্থান নিয়েছিল সে আশা তার পূর্ণ হয় নি৷ হিরণের নির্মম মৃত্যু তাকে আগে থেকেই পরাজিত করে দিয়েছিল৷ সেই মৃত্যুঘটনা শুনে উত্তমের কোমল হৃদয় দ্রবীভূত হয়ে দু’ফোটা অশ্রু বিসর্জন করলে একজন বহুভোগ্যা নারীর সেই আচরণ বিশ্বম্ভরের ঠাট্টার রসদ জোগান দেয়৷ উত্তম প্রতিবাদ করে না৷ স্বামীর ব্যঙ্গোক্তিকেই সে নিজের বিগত জীবনে প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে গ্রহণ করেছে৷ সীমাহীন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা দিয়ে খেয়ালি বিশ্বম্ভরের সংসারকে ধরে রাখে, টুকীকে মানুষ করার সংকল্প নেয়৷ তার সেই সংসার গোছানোতেও স্বামী বিদ্রুপ না করে ছাড়ে না৷ উত্তমকে মধ্যমণি করে ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে বাড়িতে মদ-মাংসের আসর বসিয়ে আত্মসুখ চরিতার্থ করার চেষ্টা করলে উত্তম বাধা দেয়৷ সে জানতে চায় হিরণ তেমনটা করতো কি না? সেই প্রশ্নের উত্তর বিশ্বম্ভর দেয় জিব কেটে—‘‘না, না; সে ছিল বউমানুষ—৷’’১২৮ উত্তমকে তার মনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে এইভাবে ‘‘আমার কয়েকজন খুব বন্ধু আছে; আমার সঙ্গে খুব তাদের দহরম-মহরম—একাত্মা হরিহর বললেই চলে৷ তারা অনেকদিন এ বাড়ীতে আসে না—…তাই তারা তোমার অনুমতি চায়—…হিরণ, মানে টুকীর মা থাকতে তারা হামেশাই আসত৷’’১২৯ এ পর্যন্ত বলা কথার মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সাধারণ সাংসারিক আলাপের সুরই বর্তমান৷ উত্তমও সাধারণ গৃহিণীর মতোই তার জবাব দেয়—‘‘এখনও আসতে চান আসুন; আমি তাতে বাধা দেব কেন! আমার অনুমতি তাঁরা নিতে পাঠিয়েছেন কেন—তুমি বা কথাটা বলতে এমন ইতস্তত করছিলে কেন?’’১৩০ এবারে বিশ্বম্ভর নিজের স্বরূপে আসে৷ উত্তমের গৃহিণী হয়ে ঘরকন্না করার মনের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে—‘‘—তারা ত’ আসবে, বসবে, আমোদ করবে; তুমিও যদি বসো সেখানে, তবেই, তাই তারা—’’১৩১ কিন্তু যে পথ সে স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করে এসেছে সে পথে কিছুতেই নিজেকে ফেরাবে না উত্তম৷ আর এই জেদই তাকে ঘরে-বাইরের সকল প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াইয়ের শক্তি দিয়েছে৷ নিজের ধৈর্য অক্ষুন্ন রেখে স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে সে আর গণিকা নয়—সে একজন মা, একজন গৃহিণী৷—
‘‘টুকীর মা থাকতো?
দাঁতে জিব কাটিয়া বিশ্বম্ভর বলিল,—না, না; সে ছিল বউমানুষ—
বিশ্বম্ভরের দৃষ্টি অকারণেই নত হইয়াছিল—
উত্তমের মুখের দিকে চাহিলে দেখিতে পাইত, তার মুখে যেন রক্ত নাই, ঠোঁট কাঁপিতেছে৷
উত্তম একটু সময় লইয়া জবাব দিল; বলিল,—কিন্তু টুকীর সামনে ত’ তা হতে পারে না৷ আমি এসে আছি বলে’ যে পথে সে যেতে পারে’ তোমার ভয় আছে, সে পথটাই খুলে দেয়া হবে যদি তার সামনেই তোমার বন্ধুদের সঙ্গে আমি বসি৷’’১৩২ অর্থাৎ পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি বিশ্বম্ভর উত্তমকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেনি, গণিকা হিসেবেই গৃহে রেখেছিল৷ তাই সেই বিয়ে করা রক্ষিতাকে বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে উপভোগ করতে চেয়েছিল৷ একজন বারবধূ যে শত চেষ্টা করলেও যে তার কলুষতা মুক্ত করতে পারে না উত্তম তার প্রমাণ৷ যাই হোক উত্তমের সংসার বুভুক্ষ মন তাতে আঘাত পেলেও বিচলিত হয়নি৷ স্বামীর অবজ্ঞা, ইয়ার বন্ধুদের অসভ্যতা শক্তহাতে মোকাবিলা করেছে৷ স্বামীর বন্ধুদের দ্বারা সে ভূষিত হয়েছে—‘নিষ্ঠাবতী খাণ্ডারী’ উপাধিতে৷ সে তার জীবনে বন্য পশুকে বশ করাতে পারেনি ঠিকই কিন্তু অবোধ মাতৃহারা শাবকটিকে নিজের হৃদয়ের সমস্ত উত্তাপ দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলেছিল৷ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে লেখা-পড়া, কাজ-কর্ম, আচার-নিয়ম ইত্যাদির দ্বারা টুকীকে সমৃদ্ধ করে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিল৷ তার সেই আচার-নিষ্ঠা দেখে ব্যঙ্গ করেছে বিশ্বম্ভর—‘‘শুচিবাই দিন দিন বাড়ছে দেখছি৷ গেরস্থের বৌকেও হার মানিয়ে দিতে পার৷’’১৩৩ এখানেও বিশ্বম্ভর তাকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় নি বেশ্যা হিসেবেই দেখেছে৷ আসলে বিশ্বম্ভর তার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় সারা জীবন বিচার করে এসেছে উত্তমকে৷ তাকে ভয় করেছে, তার রাশি রাশি টাকা দেখে প্রতিবেশীদের বিরূপ মন্তব্যকেও হজম করেছে, সে টাকা গ্রহণ করে ব্যবসা করে প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়েছে কিন্তু একজন নারী হিসেবে কোনোদিনও মর্যাদা দিতে পারেনি৷ আর উত্তম সংসারের স্থায়ী এক সম্পর্কে ঠাঁই দেওয়াটুকুতেই তার উপর চিরকৃতজ্ঞ থেকেছে৷ তার শুধু মনে হয়েছে তার গৃহবাসিনী হওয়ার দুরন্ত ইচ্ছেকে ‘‘বিশ্বম্ভর যেন দুস্তর অগ্নিপরীক্ষায় ফেলিয়া যাচাই করিয়া লইতেছে৷’’১৩৪ স্বামী তাকে এতটুকু বিশ্বাস করে না; প্রতিবেশীরা যখন বলে সেও তার মতো গণিকা বানাবে মেয়েকে তাতে সন্দিহান হয়ে সে সন্দেহর কথা ব্যক্তও করে উত্তমের কাছে; পরে উত্তমের বাক্সভর্তি তাড়া তাড়া নোট ও রাশি রাশি অলঙ্কার দেখে সমস্ত সন্দেহ দূর করে দেয়৷ বিশ্বম্ভর তার প্রতি অনুরক্ত হয়েই তাকে ঘরে তুলেছিল, আগে থেকে হেরে যাওয়া মানুষটার মধ্যে উত্তমও মাঝে মাঝে লক্ষ্য করে ভালোবাসার প্রচ্ছন্ন দ্যুতি; তার পরেও তার পূর্বজীবন নিয়ে তার দেওয়া নানা খোঁটা, বিদ্রুপ বিদ্ধ করে বলেছেন—‘‘সে যে সমাজের কতখানি গ্লানি তাহা সে জানে—তাহার অতিশয় সচেতন মনে যত তীক্ষ্ণ অপ্রত্যাশিত আঘাত লাগিতে পারে তাহা সে সহ্য করিতে প্রস্তুত; কিন্তু বিশ্বম্ভর তাহাকে ভালবাসিয়াও কেন এমন!’’১৩৫ তার হৃদয়ের তীব্র দহন বোঝার ক্ষমতা বিশ্বম্ভরের নেই—উত্তমের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সংসারে টিকে থাকার লড়াইটা সম্পূর্ণ তার একার আর সেখানে থাকতে গেলে সমস্ত অপমান-অবমাননা সহ্য করেই থাকতে হবে৷ তাই সীমাহীন ধৈর্যকে বর্ম করে সমাজের স্বামীর সমস্ত আঘাত নির্বিবাদে গ্রহণ করতে থাকে৷
প্রতিবেশীরা উত্তম বিশ্বম্ভরের সঙ্গে পেরে না উঠে টুকীর নির্মল-নিখাদ মনে বিষবৃক্ষের বীজ বপন করতে যত্নবান হয়৷ লেখক প্রতিবেশিনীদের ক্রিয়াকলাপকে বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছেন৷—
‘‘টুকী, তোর হাতের ওই চুড়ি পেতলের না সোনার?
টুকী বলিল,—সোনার৷
—মানুষের ঘাড় ভেঙে কত টাকা এনেছেরে তোর মা?
সরল মনে টুকী উত্তর করিল,—তা জানিনে৷
শুনিয়া উল্লাসী গুঞ্জ প্রভৃতি পাঁচ সাতটি মেয়ে একসঙ্গে হাসিয়া উঠিল৷
টুকী বলিল,—আরো গয়না দেবে বলেছে মা৷
গুঞ্জ বলিল,—বিশ্বম্ভর বনেদি বনে গেল৷ ওলো টুকী, তোর মা এত সোনা পেলে কোথায় জানিস?
টুকী জানিত না; বলিল,—না৷…
শুদোস তোর মাকে, এত সোনা তাকে কে দিয়েছে৷
—বাবা দিয়েছে৷…
তোর মা বেশ্যে ছিল; গয়না দিয়েছে হাজার লোকে—তোর এ বাবা দেয়নি৷ যা শুদোকে তোর মাকে৷’’১৩৬
উত্তমের জীবনের একমাত্র দুর্বল স্থান হল টুকী৷ সে তার কাছে সমস্ত কিছু আড়াল করে এক আদর্শায়িত জীবনের পথে চালিত করতে চেয়েছে৷ প্রতিবেশীদের স্পষ্ট কথা এবং বিশ্বম্ভরের অভিব্যক্তিতে টুকী যখন সমস্তটা বুঝতে পারে তখন সে আর চুপ থাকতে পারে না৷ কঠিন বাক্য দ্বারা তিরস্কার করে বিশ্বম্ভরকে বলে—‘‘মোক্ষর মা যা বলেছে তাই বলে৷ কিন্তু টুকীর কাছে ও কথাটি গোপন রাখতে চেয়েছিলাম, তুমি তা রাখতে দিলে না৷’’১৩৭ যে জন্য উত্তম টুকীকে অপাপবিদ্ধ করে রাখতে চেয়েছিল, যে আদর্শের পথে চলে মাতৃহীনা মেয়েটিকে নিজের করে নিয়ে শিক্ষা-সংস্কারে সুশ্রী, সুস্থির, সুলক্ষণা, গৃহকর্মে নিপুণা করে তুলেছিল; সে সমস্তকে ছাপিয়ে ভবিতব্য হিসেবে দেখা দেয় তার নিজের অতীত জীবনই৷ সীতা-সাবিত্রীর আদর্শে বড় করা মেয়েটি শুধুমাত্র উত্তমের বিগত জীবনের কলুষতার জন্য সুস্থ সমাজে ঠাঁই পায় না৷ কোন সৎপাত্র তাকে বিয়ে করতে রাজী হয় না৷ বার বার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর শেষপর্যন্ত এক লম্পট মধ্যবয়সি প্রৌঢ়র সঙ্গে বাধ্য হয় মেয়ের বিয়ে দিতে৷ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যায় না তেমনি কোনো গণিকা তার বৃত্তি থেকে বেড়িয়ে এলেও কোনো প্রায়শ্চিত্তের বিনিময়েও সেই বৃত্তির কালিমা থেকে মুক্ত হয় না৷ লেখক দুঃসাহস দেখিয়ে তাকে পুনরায় গৃহবধূ করে গৃহী জীবনে ফিরিয়ে দিয়েছেন ঠিক তারপরে সম্পূর্ণভাবে সে হয়ে উঠেছে সমাজে ক্রীড়ণক৷ নিজের সীমাহীন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা দিয়ে সে লড়াই করে গেছে বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে কিন্তু মাথা নত করেনি৷ তার এই সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব তাকে অনন্যতা দান করেছে৷ তার সম্পর্কে ক্ষেত্রগুপ্ত বলেছেন—‘‘সে বাধ্য হয়ে বেশ্যাবৃত্তিতে লিপ্ত হয়েছে—সে পেশাদার দেহব্যবসায়ীর মনোভাব ও চরিত্রভঙ্গি আয়ত্ত করেছে, ‘পুরুষমানুষকে হাতে পাইয়া তাহাকে খেলাইয়া খেলাইয়া পিশাচ করিয়া তুলিবার বিদ্যা’ আর ‘হিংস্র পুরুষ-বুভুক্ষা’৷ এই বৈশিষ্ট্য লেখকের মনোবিশ্লেষণে পাওয়া যায় কিন্তু গল্পে অনুপস্থিত৷ এই নারীর মনে সম্পূর্ণ বিপরীত হাওয়া বইল—সে গৃহস্থ বধূর জীবনে সার্থক হয়ে উঠবার বাজি ধরল৷ তবে আসলে এটা জয়ের বাজি ছিল না, ছিল আলোর সাধনা৷’’১৩৮ যে আলোর পথে অগ্রসর হয়ে জীবনে সমস্ত কালিমাকে ঝেড়ে ফেলেছিল; কোনো কিছুর বিনিময়েই সেই আলোর পথ থেকে সে সরে আসেনি৷
অন্যদিকে পরিতোষের রক্ষিতা সুন্দরী প্রবল অর্থকষ্ট সহ্য করেও তার সঙ্গ ছাড়েনি৷ তার যৌবন গত হয়েছে৷ অনিয়মিত আহারে স্বাস্থ্যও ভগ্ন৷ একসঙ্গে অনেকগুলি টাকা ও গহনার লোভে পরিতোষকে স্ত্রী গ্রহণে ইন্ধন জুগিয়েছিল৷ তারপর নববধূ হয়ে টুকী যখন তার সম্মুখে উপস্থিত হয় তার অসামান্য রূপছটা নতুন আশার সঞ্চার করে সুন্দরীর মনে৷ টুকীকে ঘরে বসিয়েই সে পরিতোষের কাছ থেকে পণের পনেরশত এবং গহনার জন্য আরও তিনশত টাকা নিজের হস্তগত করে৷ সেই টাকা তার পরম সাধনার টাকা, সচ্ছলভাবে জীবনধারণ করার একমাত্র রসদ৷ প্রবল সাবধানতায় তাকে আগলে রাখলেও সাময়িক তন্দ্রার সুযোগে তা চোরের হস্তগত হলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে সুন্দরী৷ তারপর ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই শোক থিতিয়ে এলে তার বেঁচে থাকার, ভবিষ্যতের অন্নসংস্থানের একমাত্র অবলম্বন হয় টুকীর যৌবনদীপ্ত সুগঠিত শরীর৷ টুকীর তার মায়ের শেখানো আদর্শে ধর্মনিষ্ঠা দেখে তাই সে বিদ্রুপ করে৷ সে উত্তমের প্রথমে দেহ ব্যবসা করে অর্থ জমানো ও পরে ধার্মিক সাধ্বী স্ত্রীর মতো সংসার আগলানোর উপমার দ্বারা টুকীকেও সেইভাবে জীবনের গতিপথ নির্ধারণের ইঙ্গিত দেয়৷ তাকে টাকা কিছু জমিয়ে নিয়ে ধর্মনিষ্ঠা করতে বলে৷ তার সেই দ্ব্যর্থক উক্তি যে উত্তমকে খোঁচা দিয়ে বলা এবং একই শ্রেণীর হয়েও মনোগত ভাবে টুকীর কাছে দুজনের দুরকম অবস্থানের প্রতিবাদে ব্যক্ত তা টুকী ঠিকই বুঝতে পারে৷
সুন্দরীর মানসিকতায় বেশিরভাগক্ষেত্রেই নগ্ন-কুৎসিত রূপকে উপস্থাপন করেছেন লেখক৷ সে অর্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না৷ তার স্থূল রুচিহীন জীবনে অভাব-অনটনের মধ্যে মনে-প্রাণে শুধু প্রার্থনা করে অর্থের সমৃদ্ধি৷ অর্থের জন্যই পরিতোষকে বিয়ে করতে প্রলোভিত করেছে; অর্থের জন্যই টুকীর দেহটার প্রতি তার দুরন্ত লোভ৷ টুকী তার নিষ্ঠা, ধর্মজ্ঞান নিয়ে সর্বদা মুখ বুঝে থাকলেও সুন্দরীর ঘৃণ্য চরিত্রবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তার মাকে মেলাতে পারেনি৷ চরম প্রতিবাদ করেছে তার৷ তার উপযুক্ত জবাব দিতে না পেরে চতুর্দিক থেকে অবদমিতা সুন্দরী ভেতরে ভেতরে ক্রদ্ধ হয়েছে৷ তার সমস্ত রাগ গিয়ে উপচে পড়েছে টুকীর সুললিত দেহটার প্রতি৷ তার মনে হয়েছে টুকীর দেহটাকে খণ্ড খণ্ড করে সহস্র লম্পটের রিরংসা-দাহ তৃপ্ত করতে দু’হাতে বিলিয়ে দেয়৷ আর তাকে দেহব্যবসার কাছে লাগিয়ে উপার্জন করিয়ে নিজের সুখ চরিতার্থ করতে ষাটবছরের বৃদ্ধ পরিতোষের অক্ষমতা তুলে ধরে, তার অপরিতৃপ্ত যৌনজীবন সম্পর্কে আক্ষেপ প্রকাশ করে৷ তার রূপ-যৌবন পূর্ণ দেহটা কোনো কাজে না লেগে যেভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাতে তার ক্লেশের সীমা থাকে না৷ সে টুকীকে ‘ইমোশনালি’ জব্দ করতে থাকে৷ সে বোঝায় তাদের সেই চরম অভাবের দিনে স্বামীর মনে সুখ ফিরিয়ে সংসারে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে একমাত্র টুকীই৷ আর সে যদি তার কথামত চলে তাহলে সবকিছু পুনরায় স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব৷ অসীম মমতায় আপনজনের মতো কথা বলে সংসারের চূড়ান্ত অভাবকে তুলে ধরে; সে টুকীকে তার কথা শুনে চলার জন্য গা ছুঁইয়ে শপথ করিয়েও নেয় ৷ তবু শান্তি পায় না৷ লেখক তার অবস্থার বর্ণনা করে বলেছেন—‘‘টুকীকে এই অনতিক্রম্য শপথে বাঁধিয়াও সুন্দরীর চিত্ত নিঃসন্দেহ সুস্থির হইল না৷ সুন্দরীর মাতামহী মরিয়াছিল পালঙ্কে শুইয়া, তার মা মরিয়াছিল পালঙ্কে শুইয়া, কিন্তু তার মত হতভাগীর সে অদৃষ্ট নয়৷’’১৩৯ তার মা-মাতামহীরা দেহব্যবসার মধ্য দিয়ে যে সুখ ও সমৃদ্ধি ভোগ করেছে তার সে সম্ভাবনা কোনোদিনই ছিল না৷ টুকীকে দেখে সেই সুপ্ত আশার মূলে জলসিঞ্চন ঘটেছে—কিন্তু তার বিরূপতা পুনরায় তাকে হতাশ করে৷ শপথ করিয়েও তার প্রতি নিঃসন্দিগ্ধ হতে পারে না৷ সে যেমন একদিকে গণিকাবৃত্তির দিকে আহ্বান করতে থাকে তেমনি আরেক দিকে দেখা যায় স্বামীভক্তির সূত্রটিকে ছিন্ন করার প্রচেষ্টা৷ পরিতোষের নির্যাতনের সময় তাই টুকীর পক্ষ নিয়েই তাকে বিদ্ধ করে নানা কটুক্তিতে৷ ‘‘বেহায়া মিনসে—কোন কাজটা তোর আটকেছিল শুনি? খেয়ে পরে’ বেশ থাকত—তুই কেন ওকে নিয়ে এলি না খাইয়ে মারতে?’’১৪০ তারপর সুযোগ বুঝে খদ্দের ডেকে আনে সেই বাড়িতে৷ আদর্শ দূতীর মতো খদ্দের হয়ে আসা অচিন্ত্যবাবুর কাছে তার গুণপনা ব্যাখ্যা করে৷ কিন্তু হঠাৎই দালালির অগ্রিম নেওয়া পয়সা যখন তার হাত থেকে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে যায় তখন সমস্তটা বুঝতে পারে টুকী৷ তাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বললে হিংস্র উন্মাদনায় নির্মম বাক্য পীড়নে টুকীকে বিধ্বস্ত করতে থাকে সুন্দরী৷ ততক্ষণে তার সামনে থেকে বাইরের নিঃসীম অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেছে তার শেষ আশা-ভরসার স্থল৷
লেখক যে উগ্রমনস্কতায় সুন্দরী চরিত্রকে বাস্তবায়িত করেছেন তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজ করেছে সুন্দরীর ভবিষ্যতের অন্নসংস্থানের চিন্তা৷ অন্নসংস্থানের একটা সুনির্দিষ্ট পথ যদি থাকতো তাহলে হয়তো এতটা বিবেকশূন্য হত না এই বারনারী৷ যত সবলভাবেই তার ভেতরকার নারীত্বটুকুকে চাপা দিয়ে নগ্ন স্বার্থকে দেখানোর চেষ্টা হোক না কেন তার ভেতর থেকেও স্বচ্ছ নারীমনটি দু-একবার উঁকি দিয়েছে৷ টুকীর ঘরের দেওয়াল জুড়ে ঠাকুরের ছবি লাগানো নিয়ে ব্যঙ্গ করলে নিজের অজান্তেই তার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে৷ আর যখন বিশ্বম্ভর টুকীকে দেখতে এসে টুকীর মুখে পরিতোষের বোনের পরিচয় পায় এবং টুকীর বাবা যখন মালক্ষ্মী সম্বোধন করে স্নেহবিগলিত কন্ঠে সম্বোধন করে তখন অজানা এক উপলব্ধিতে তার পা অবশ হয়ে যায়৷ কিন্তু তার দুর্বার বাস্তব ভাবনা, মা-দিদিমার সমৃদ্ধ জীবন এবং নিজের সহায়-সম্বলহীন উদ্দেশ্যশূন্য বিভৎস ভবিষ্যৎ তাকে ভালোকিছু ভাবতে দেয়নি৷ সমাজ-প্রতিবেশ পরিস্থিতিই তাকে অমন নিষ্ঠুর করে গড়ে তুলেছে৷
আর একদিকে আদর্শায়িত চরিত্র উত্তম অন্য দিকে আদর্শশূন্য সুন্দরী—এই দুই-এর মাঝখানে পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে টুকীর জীবন৷ টুকী তার বিবাহ পূর্ববর্তী জীবনে মায়ের কাছে যে শিক্ষা অর্জন করেছিল তা ছিল সতীত্বের পরাকাষ্ঠায় সুশৃঙ্খলিত৷ বিয়ের পরে সে হস্তগত হয় স্বামীর রক্ষিতা হয়ে থাকা সুন্দরীর৷ সে যতই তাকে দেহব্যবসার দিকে টানতে থাকে ততই মায়ের আদর্শে কঠোর হয়ে সতীত্বকে আঁকড়ে ধরে রাখে৷ কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারে না৷ তার ভক্তি নিষ্ঠা স্বামী পরিতোষের কাছে ভিত্তিহীন রূপে প্রতিপন্ন হয়৷ স্বামীর নির্যাতন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, মায়ের প্রতি অপমান বাক্য, সুন্দরীর মতো একজন বারাঙ্গনার কটূক্তি, প্রলোভন তাকে আদর্শ ধরে রাখতে দেয় না৷ তাই সুন্দরী যখন দালাল হয়ে অগ্রিম অর্থ গ্রহণ করে তার শরীরের জন্য খদ্দের ডেকে আনে সেই চূড়ান্ত মুহূর্তে সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় টুকীর৷ সে প্রতিবাদ করে বলে—‘‘…একাজ যদি করতে হয়, তবে আমি আপনাকে দেব দেহ, আপনি আমাকে দেবেন টাকা৷ মাঝখানে ওরা কে?’’১৪১ হতভম্ভ অচিন্ত্যবাবু সরল গ্রাম্যবধূর অমন তীব্র প্রতিবাদ বোধ হয় কোনোদিন শোনেনি; সুন্দরীও অত বিস্মিত কোনোদিন হয়নি৷ শেষে অচিন্ত্যবাবু ও সুন্দরীকে বাড়ি থেকে বের হতে বলে নিজেই চৌকাঠের বাইরে অন্ধকারের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়৷ লেখক তার অনির্দেশ্য অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাওয়াকে বর্ণনা করেছেন এইভাবে—‘‘সুন্দরীর বাড়ীর চৌকাঠ পার হইয়া সে বাহিরে ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী অন্ধকারের মধ্যে যাইয়া দাঁড়াইল৷’’১৪২
টুকী সৎ আদর্শে, সৎ মানসিকতায় বড় হয়েছে৷ কিন্তু সমাজ তাকে ভালো থাকতে দেয়নি৷ তার বিমাতার বিগত জীবনের বেশ্যাবৃত্তির জন্য, তার আশ্রয়ে বড় হওয়া টুকীর মধ্যে সমস্ত রকম মানবিকগুণাবলী থাকা সত্ত্বেও সমাজ তাকে অনুকম্পা করেনি৷ যেদিন থেকে সে শুনেছে তার মা বেশ্যা ছিল, যেদিন থেকে ‘বেশ্যা’ কথাটির প্রকৃত তাৎপর্য অনুভব করেছে এবং তার মায়ের মধ্যে বেশ্যার কোনো অভিজ্ঞানই খুঁজে পায়নি৷ তখন থেকেই ভেতরে ভেতরে লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছিল তার৷ তারপর বার বার যখন বিয়ে ভেঙে যাচ্ছিল তখন মাকে অনুরোধ করেছিল তাকে না বিয়ে দেওয়ার জন্য৷ তবু বিয়ে করতে হয়েছে৷ সমাজে বাস করে তার নিয়ম অতিক্রম করার সাধ্য কারুই নেই৷ এতদিন যে লড়াইটা তার অন্তরের মধ্যে আবদ্ধ ছিল বিয়ের পড়ে তা প্রকাশ হয়ে পড়ে৷ কিন্তু অভিমন্যুর মতো চক্রবুহ্যে পড়ে গিয়েছে সে৷ সমাজের নানা প্রতিকূলতা সপ্তরথীর মত অস্ত্র হাতে নিয়ে প্রস্তুত৷ আর যাবে কোথায়! তবু পরাজয়কে বরণ করার আগে নিক্ষেপ করে গেছে নির্মম প্রতিবাদ৷ যে ধর্মবোধ-আদর্শ তাকে সতীত্বের চূড়ান্তমূর্তি করে রেখেছিল সেই সতীত্বকেই অজানা বিশ্বের দুর্ভেদ্য অন্ধকারে সমর্পণ করেছে৷ টুকীর মতো এত বড় প্রতিবাদ বোধ হয় কোনো গণিকা করে উঠতে পারেনি৷
গণিকারা সমাজে কি পরিমানে হেয় তা ‘আরণ্যক’-এর কুন্তার জীবন থেকে স্পষ্ট হয়৷ বিভূতিভূষণের সৃষ্ট এই নারী চরিত্র গণিকা নয়—জীবনে শত দুঃখ যন্ত্রণার মধ্যেও স্বামী ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষের অঙ্কশায়িনীও হয়নি; সতীত্বের পরাকাষ্ঠায় উজ্জ্বল নারীরত্ন সে, তার পরেও কুন্তার লাঞ্ছনার শেষ নেই৷ বাইজির মেয়ে বলে সমাজের উদাসীন উপেক্ষায় পর্যুদস্ত তার জীবন৷ সাতাশ-আটাশ বছরের ধনবান দেবী সিং কাশীতে এক বাইজির বাড়ি গান শুনতে গিয়ে সেই বাইজিরই চৌদ্দ-পনেরোবছর বয়সি কিশোরী কন্যার সঙ্গে প্রণয়পাশে আবদ্ধ হয়ে তাকে নিয়ে পালিয়ে আসে৷ দেবী সিং তাকে রক্ষিতা করেনি বিয়ে করে স্ত্রীর যথোপযুক্ত মর্যাদায় অন্তঃপুরে স্থান দিয়েছিল৷ সেখানে সম্ভ্রান্ত ঘরের গৃহবধূর মতো—একসময় লবটুলিয়া থেকে কিংখাবের ঝালর-দেওয়া পালকি চেপে কুশী ও কলবলিয়ার সঙ্গমে স্নান করতে যেত, বিকানীর মিছরি খেয়ে জল খেত৷ দেবী সিং অর্থ ও প্রতিপত্তিশালী বলে তাকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে সাহস পায়নি৷ কিন্তু ঘটনাচক্রে সর্বস্বান্ত হয়ে দেবী সিং মারা গেলে দু-তিনজন শিশুসন্তান নিয়ে অথৈ জলে পতিত হয় কুন্তা; সেই সঙ্গে সমাজও তাকে পতিত করে রূপাজীবার কন্যা বলে৷ সমাজের মানুষের তার প্রতি হীন মনোভাব সম্পর্কে পাটোয়ারী কথক সত্যচরণকে বলে—‘‘এদেশে ওকে কেউ দেখতে পারে না, সবাই নাক সিঁটকে থাকে, নীচু চোখে দেখে, বোধ হয় বাইজীর মেয়ে বলে৷’’১৪৩ শুধু সমাজের ঘৃণ্য অবজ্ঞাই বর্ষিত হয়নি তার উপর, তার শরীরের প্রতি বন্য লালসাও কম নেই প্রবৃত্তিতাড়িত পুরুষ সমাজের৷ যদিও দারিদ্র্যের কঠিন পীড়নে তার ভুবনমোহিনীরূপ চাপা পড়ে গেছে তারপরেও বাইজির কন্যা হওয়ার দরুণ তার রূপহীন শরীরটাকে আস্বাদন করার লোভ সামলাতে পারেনি আরেক প্রতিপত্তিশালী চরিত্র রাসবিহারী সিং৷ জাতভাই-এর স্ত্রী ধুয়া তুলে, তার কষ্টের কপট দুঃখ দেখিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় রাসবিহারী সিং৷ সেখানে কিছুকাল কাটানোর পর সময় মতো অন্নগ্রহণের ফলে পুনরায় কুন্তার পূর্ব স্বাস্থ্য ফিরে আসতে থাকে৷ তার সেই অপরূপ রূপে মোহিত রাসবিহারী কামোন্মত্ত হয়ে তাকে ভোগ করতে চায়৷ কুন্তা তার প্রতিবাদ করে বলে ‘‘জান দেগা—ধরম দেগা নেহিন৷’’১৪৪ কুন্তা যে যন্ত্রণার মধ্যে থেকে বেড়িয়ে দুদিন স্বাচ্ছন্দ্যের আস্বাদ পেয়েছিল তাতে ইচ্ছে করলেই রাসবিহারী সিং-এর অনুগত থেকে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতো আর গণিকার মেয়ে বলে তাতে কেউ বিস্মিতও হত না; কিন্তু তা সে করেনি৷ পুনরায় দরিদ্রতার আগুনে ঝাঁপ দিয়ে নিয়মিত উদরজ্বালাকে মাথায় তুলে নিয়েছে৷ তারপরেও কুন্তা অপবিত্র৷ তার স্বামী বেঁচে থাকতে সমাজ তার এক অবস্থান এবং দেবী সিং-এর মৃত্যুর পর আরেকরকম অবস্থান—এই প্রবাদটিকেই মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের এই সমাজ ‘শক্তের ভক্ত; নরমের যম’ অর্থাৎ প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির স্ত্রী হিসেবে কুন্তাকে ক্ষমা করতে পারে সমাজ কিন্তু অসহায় বিধবার প্রতি কোনো অনুকম্পা নেই তার৷ রচনাকার অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে চিত্রিত করেছেন কুন্তা চরিত্রের নানা দিককে; সেই সঙ্গে উদ্ভাসিত হয়েছে গণিকা নারীদের সামাজিক মূল্য৷
‘বিপিনের সংসার’-এর কামিনী গোয়ালিনি বিপিনের পিতার রক্ষিতা হয়ে নির্বিঘ্নে জীবন কাটিয়েছে; প্রণয়ীর মৃত্যুর পরও তার জীবনে সামাজিক অসন্তোষের কোনোরকম ছায়াপাত ঘটেনি৷
মতি বাগ্দিনী স্কুল শিক্ষক বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তীকে ভালোবেসে ঘর ছাড়ে৷ সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারেনি সেই স্কুল মাস্টার—কিন্তু অসুস্থ হয়ে পতিতা এই নারী মৃত্যুশয্যায় পতিত হলেও মাস্টার তার সঙ্গ ছাড়েনি৷ সেও ইচ্ছে করলেই নির্মম মৃত্যুমুখে ফেলে সরে পড়তে পারতো৷ কিন্তু তা না করে শেষ সময়ে সেবায়-ভালোবাসায় প্রেমের প্রতিদান রক্ষা করেছে৷ এভাবে বোধ হয় পতিত নারীদের প্রতি একটু একটু করে সমাজ বা সমাজের প্রতিভূ মাস্টারের মতো মানুষেরা দায়বদ্ধ হচ্ছে; তারাও যে মানুষ এই মূল্যটা অন্তত প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে৷
‘দম্পতি’ নষ্ট দাম্পত্যের গল্প৷ এই উপন্যাসে যেমন ইঙ্গিত দান করেছেন এক চরিত্রভ্রষ্ট নারীর তেমনি ফিল্ম স্টার নায়িকাদের প্রতি সাধারণ গ্রাম্য মানুষের বিকৃত মনোভাব৷ লেখকের বর্ণনায় নেতিবাচক দৃষ্টিতে উপস্থাপিত হয়েছে তারা৷
অনঙ্গ-গদাধর তাদের সুখী ঘরকন্নায় কখনোই ভ্রষ্টাচারকে প্রশ্রয় দেয় না৷ অনঙ্গর দাদা একজন অপরিচিত মেয়েকে নিয়ে টাকা ধার করতে তাদের বাড়িতে এলে মেয়েটির ধরন দেখে অনঙ্গর মনে হয়েছিল যে সে ভালো নয়৷ তাই তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি৷ সে প্রসঙ্গে স্বামীকে বলে—‘‘আমি তাকে ঘরে-দোরে ঢুকতে দিই নি৷ অমন ধরনের মেয়েমানুষ দেখলে আমার গা ঘিন-ঘিন করে৷’’১৪৫ স্ত্রীর মুখে বিস্তারিত কথা শুনে গদাধরও মন্তব্য করে—‘‘ওসব ঢং অনেক দেখেচি! ছি-ছি আমার বাড়িতে এই সব কাণ্ড!’’১৪৬ সেই গদাধরই ব্যবসার জন্য কলকাতায় গিয়ে সিনেমার নটীদের সংস্পর্শলাভে উন্মুখ হয়ে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করতে থাকে স্ত্রী-পরিবারকে৷ অনঙ্গর সংগে কাটানো দাম্পত্যজীবন একঘেয়ে হয়ে উঠে৷ ব্যবসা, ঘর-সংসার সব কিছুকে জলঞ্জলি দিয়ে শোভারাণী মিত্রদের মতো ফিলম স্টারদের সঙ্গসুখের আস্বাদ পেতে নিজেকে উজাড় করে দেয়৷ তার জীবনের স্বেচ্ছাচার সম্পর্কে চিন্তিত ভড়মশায় ভাবে—‘‘মনিব পাটের গদির ক্যাশ ভাঙিয়া ছবি তৈরির ব্যবসায় লাগাইয়াছেন, এ ভাল লক্ষণ নয়৷ সে নাকি যত নটী লইয়া কারবার, তাহাতে মানুষের চরিত্র ভাল থাকে না, থাকিতে পারে না কখনও!’’১৪৭ ভড়মশাই-এর ভাবনায় সিনেমার অভিনেত্রীরা হীন হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে৷ এই হীন মানসিকতাতেই লেখক দেখিয়েছেন শেষ পর্যন্ত গদাধর শোভারাণীর সঙ্গেই স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপন করে—অনঙ্গর দাম্পত্য সম্পর্ককে অস্বীকার করে৷ এক সিনেমা নটীর জন্য চুরচুর হয়ে যায় স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যের৷
পান্না ‘অথৈ জল’-এর খেমটাওয়ালি৷ ষোলো-সতেরো বছর বয়সি সুশ্রী-তন্বী এই নারীকে সারল্যে পরিপূর্ণ করে রচনা করেছেন লেখক৷ খেয়ালি স্বভাবের এই কিশোরী নিজের আকর্ষণের মূল্য দিতে স্বনামধন্য ডাক্তার শশাঙ্ককে নিজের দিকে টেনে নেয়৷
এযাবৎ যত ধরনের গণিকাচরিত্র আলোচনা করা হয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী এই পান্না৷ তার মধ্যে সর্বদাই কাজ করেছে স্বাধীন চেতনা৷ আত্মবিশ্বাসেও সে পুরুষের চেয়ে কম নয়৷ ডাক্তারকে মোহিত করে নিজের বাসাবাড়িতে নিয়ে গিয়ে নিজের রোজগারে তার ভরণ-পোষণ চালিয়ে গেছে৷ অম্লান বদনে শত অভাবের মধ্যে সিগারেট, জুতো ইত্যাদি কিনে দিয়ে তার নেশা, শখ পূরণ করেছে৷ সর্বদা তাকে সাহস দিয়ে গিয়েছে—‘‘যদি ঠিক-মত বায়না হয়, খাটি, তবে মাসে নব্বুই টাকা থেকে একশো টাকা৷ তোমার ভাবনা কি?’’১৪৮ সে আপন স্বপ্নবলয়ের মধ্যে অবস্থান করে, ডাক্তারকে নিয়ে সেখানে অনাবিলভাবে পাক খেয়ে গেছে৷ তার এই ব্যতিক্রমী সত্তাকে ডাক্তারের জবানিতে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রচনাকার—‘‘আমাকে অবাক করে দিয়েচে পান্না৷ ওর শ্রেণীর মেয়েরা শুনেচি কেবলই চায়, পুরুষের কাছ থেকে শুধুই আদায় করে নিতে চায়৷ কিন্তু ও তার অদ্ভুত ব্যতিক্রম৷ নিজের কথা কিছুই কি ও ভাবে না৷ আমার মত একজন বড় ডাক্তারকে গেঁথে নিয়ে এল, এসে কিছুই দাবি করলে না তার কাছে, বরং তাকে আরও নিজেই উপার্জন করে খাওয়াতে চলেচে৷’’১৪৯ তার বৃত্তি নিয়ে পান্নার কোনোরকম আক্ষেপ নেই৷ সে নিজেও যেমন জানে সে বহুজন ভোগ্যা তেমনি সমাজের মানুষজনও তাকে সেই হিসেবেই চেনে৷
পান্না চরিত্রের মধ্য দিয়ে গণিকা চরিত্রের মানসিক বিবর্তনের ধারার দিক-নির্দেশ পাওয়া যায়৷ গণিকারা সর্বদাই মানুষের উপেক্ষা নিয়ে বেঁচে থাকে৷ সমাজের যত রকমের পাপের ধারণা রয়েছে সবই এইজাতীয় নারীর উপর আরোপিত হয়৷ ভূষণ দাঁ, গোবিন্দ দাঁ, আধুল হামিদ প্রমুখ ধনবান মানুষেরা তাদের শরীরকে পরম আস্বাদনীয় হিসেবে গ্রহণ করেও সমাজের ঘৃণ্য সব অভিধায় ভূষিত করতে দ্বিধাবোধ করে না৷ তারপরেও পান্নার কোনো মানসিক বিকার নেই৷ মধ্যবয়সি ডাক্তারকে ভীষণভাবে ভালো লেগেছিল তার; সেখানে ভালোবাসা ছিল কি না আলোচনার বিষয় নয়৷ সেই ভালোলাগাকেই সম্বল করে তার পায়ে মাথা কুটে, দিব্যি দিয়ে নিজের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল৷ আর যেহেতু সে নিজের তাগিদে ডাক্তারকে ঘরের বার করেছে তাই সব খরচ-পত্র দায়-দায়িত্বও নিজেই গ্রহণ করেছে৷ এ বিষয়ে তার বক্তব্য—‘‘তুমি নির্ভাবনায় বসে খাও৷ আমি থাকতে তোমার ভাতের অভাব হতে দেবো না৷’’১৫০ পান্নারা যেন এখানে একটু একটু করে শক্তিশালী হয়ে উঠছে মনের দিক থেকে৷ চন্দ্রমুখী, পিয়ারী, মালতী, মনিয়া, এলোকেশী, কাত্যায়নীদের মতো নিজেকে পাপী মনে না করে দেহবৃত্তির মধ্য দিয়েই স্বতস্ফূর্তভাবে সংসারের দায়-দায়িত্বকে নিজস্কন্ধে তুলে নিতে এদের যেন কোনো আপত্তি নেই৷ শুধু পরিবার পরিজন নয় প্রেমাস্পদকেও যেন স্বামীর ভূমিকা নিয়ে তত্ত্বতালাশ করতে আরম্ভ করেছে তাদের সেই স্বাধীন চেতনা৷
পান্না সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যাই-ই করুক না কেন সমাজ কিন্তু তার প্রতি খড়্গহস্তই৷ কলকাতার বাসা ভাড়া নিয়ে পান্না ও ডাক্তার একত্রে বসবাস শুরু করলে পান্নার মা মেয়ের রোজগার থেকে বঞ্চিত হয়ে ডাক্তারের নামে নালিশ করেছে নাবালিকা পান্নাকে ভুলিয়ে পালিয়ে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখার জন্য৷ পান্না সমস্তটা শুনে প্রেমাস্পদকে বাঁচাতে স্বেচ্ছায় যখন মাতৃগৃহে ফিরে যায় তখন তার উদ্দেশ্যে জনৈক পুলিশের লোক ডাক্তারকে বলে—‘‘মশায়, এবার পেতনি ঘাড় থেকে নামলো; বুঝে চলুন৷ আমরা পুলিশের লোক মশায়৷ কত রকম দেখলাম, তবু যে যাবার সময় মায়াকান্না কাঁদলো না, এই বাহবা দিচ্ছি৷ কতদিন ছিল আপনার কাছে?’’১৫১ দিনের পর দিন ঘর-বাড়ি, স্ত্রী-সন্তান, ডাক্তারি ছেড়ে পান্নার সঙ্গে সহবাস করলেও পুলিশের লোকের চোখে ডাক্তার কিন্তু এতটুকুও হেয় হয়নি উল্টে পান্নাকেই পেত্নি সম্বোধন করে নীচে নামিয়ে দিয়েছে৷ আর ডাক্তার যে কিনা পান্নার সারল্যে অভিভূত হয়ে দিনের পর দিন তার পরিশ্রমলব্ধ উপার্জন দিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে, পান্না মায়ের কাছে চলে গেলে তার মনস্তত্ত্বকে না বুঝেই তার মনে হয়েছে—‘‘যাকগে৷ প্রলয় মন্থন করে আমি জয়লাভ করবো৷ ঘর ভাঙুক, দীপ নিবুক, ঘট গড়াগড়ি যাক৷ ও সব মেয়ের ওই চরিত্র৷ কি বোকামি করেছি আমি এতদিন৷’’১৫২ যে সূক্ষ্ণ অনুভূতি নিয়ে কথক ডাক্তার পান্নার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল শেষ পর্যন্ত অনুভূতির সেই ধার তার আর থাকেনি৷ তাই তাকে পুলিশি হেনস্তার হাত থেকে বাঁচাতেই যে পান্না স্বেচ্ছায় মায়ের কাছে চলে গেল সেটুকু উপলব্ধি করার ক্ষমতা ছিল না তার৷ তাছাড়া ডাক্তার বরাবরই নীতিবাগীশদের দলের একজন ছিল৷ মাঝের সাময়িক বিভ্রান্তি তাকে পান্নার অনুগামী করে৷ পান্না চলে গেলে তার নীতিবোধ পুনরায় জাগ্রত হয়ে পান্না সম্পর্কে সমালোচনা করতে দ্বিধা করে না যে ‘ওসব মেয়ের ওই চরিত্র’৷ মুহূর্তেই মোহময়ী প্রেমময়ী পান্না ঘৃণ্য দেহব্যবসায়ী নারীতে পরিণত হয়ে যায়৷ ডাক্তার নিজের চরিত্রের বিচার না করে পান্নার চরিত্রের বিচার করতে তৎপর হয়; এই সমাজ—আর এই বিচার!
তারাশঙ্করের উপন্যাসে আলোচিত বারনারীরা ব্যক্তিত্বে, দায়িত্ব-কর্তব্যে, প্রেম-ভালোবাসায় অনন্যা৷ তাদের কেউ সমাজকে শিক্ষা দিতে সমাজের মুখের উপর দেহব্যবসা করেছে, কেউ বা সমাজপ্রভুদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করে গেছে৷ তারা যেমন উপন্যাসের মুখ্যচরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে; তেমনি সমাজের মুখোশটাকে টেনে ছিঁড়ে দিয়ে তার কুৎসিত রূপটাকে সকলের সম্মুখে প্রকাশ করে দিয়েছে৷ গণিকা নারীদের মানসিক ও সামাজিক বিবর্তন ধারা একযোগে পরিলক্ষিত হয়েছে তাঁর রচনায়৷
‘নীলকন্ঠ’ উপন্যাসে সতী-সাধ্বী—লক্ষ্মীমন্ত গৃহবধূ গিরিবালা বা গিরি৷ বাপ-মা মরা, খুড়ো-খুড়ির লাথি ঝাঁটা খেয়ে মানুষ হওয়া গিরি শ্রীমন্তের গৃহিণী হয়ে এসে সুদক্ষ কর্তৃত্বে অচিরেই সমৃদ্ধি-সচ্ছলতায় ভরিয়ে তোলে তার সংসারকে৷ জীবনে তাদের একটাই ‘আফসোস’ গিরি নিঃসন্তান৷ তার শূন্য হৃদয়ের দাহকে শীতল করে মা মরা কুচক্রী পিতার সন্তান শ্রীমন্তের বোনঝি গৌরী৷ পিতার টাকার লোভ থেকে গৌরীকে বাঁচাতে শ্রীমন্ত যেমন তার তিল তিল করে তৈরি করা প্রায় সমস্ত সম্পত্তি বন্ধক রাখতে বাধ্য হয় তেমনি গৌরীর বাবা হরিলালের চক্রান্তে সমস্ত টাকা খুঁইয়ে গৌরীকেও শেষ রক্ষা করতে পারে না৷ চরম ক্রোধে শ্রীমন্ত আঘাত করে বসে হরিলালের মাথায়৷ অবশেষে মিথ্যা সাক্ষ্যে পাঁচবছরের জেল হয় শ্রীমন্তের৷ সংসারে সম্পূর্ণ সহায়-সম্বলহীন হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে একা গিরি৷ গিরি সুন্দরী৷ সন্তান না হওয়ায় তার শরীরের বাঁধুনি আঁটসাট৷ তার সেই সুগঠিত কলেবর কামনার লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে দেয় গ্রামের সম্ভ্রান্ত লম্পট যুবক বিপিনের মনে৷ গিরি তা বুঝতে পেরে সচেতন হয়৷ পাঁচুর মাকে অবলম্বন করে, বিপিনের তার শরীরের বিনিময়ে সহায়তার ইঙ্গিতকে উপেক্ষা করে বাঁচার জন্য পথ হাতড়াতে থাকে৷ কিন্তু একা অসহায় নারী কি করে জীবন কাটাবে৷ অন্ন সংস্থানের জন্য যেমন কোনো সৎ কর্মও সে খুঁজে পায় না তেমনি বিপিনের নানা চক্রান্তও তাকে কাজ করতে দেয় না৷ অবশেষে—‘‘গিরি সঙ্কল্প করিল সে মরিবে৷ এমন করিয়া আপনাকে বিক্রয় করিয়া বাঁচার অপেক্ষা মরাই সহস্র গুণে কাম্য৷ আর মরিবে সে এই অনাহারে শুকাইয়া শুকাইয়া, তিলে তিলে দগ্ধ হইয়াই সে মরিবে, যেন তাহার যাতনার প্রতি দীর্ঘনিশ্বাসটি সে রাখিয়া যাইতে পারে৷ সে দীর্ঘনিশ্বাস যেন অভিশাপ হইয়া এই বিকিকিনির সংসারে বেনিয়ার অঙ্কশায়িনী লক্ষ্মীর সোনার বর্ণটাকে মসীময় করিয়া দেয়৷’’১৫৩ যে সমাজ বিপিনের মত অর্থবানদের অঙ্গুলি নির্দেশ ছাড়া চলতে পারে না, যে সমাজ অসহায় নারীর শরীরকে পুরুষের কামনার মুখে ছুড়ে দিয়ে তাকে কদর্য বেঁচে থাকার পথমাত্র খোলা রাখে সেই সমাজকে শিক্ষা দিতে পাঁচ-পাঁচদিন ধরে মৃত্যুর আশায় না খেয়ে থাকে৷ সমাজের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই৷ আর পাঁচদিন অনাহারে থাকার পরেও মৃত্যু তো আসেই না বরং চূড়ান্ত ক্ষুধায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে৷ পাঁচুর নিয়ে আসা সামান্য চাল ও সব্জীও ক্ষুধার ক্রোধে ছুড়ে ফেলে দেয়৷ কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হয়—‘‘ওর ভিক্ষেই বা কেন নেব আমি; তার চেয়ে যে আপনাকে বিক্রি করাও ভাল আমার৷’’১৫৪ প্রবল ক্ষুধা পুনরায় তাকে মৃত্যুর সংকল্প ভুলিয়ে দিয়ে পুনরায় বাঁচার জন্য ব্যগ্র করে তোলে৷ কারণ সে বুঝে গিয়েছে মৃত্যু অতি ভয়ঙ্কর, মরতে সে পারবে না৷ সে অনাবৃত বক্ষে আহ্বান করে বিপিনকে৷ বহুদিনের কামনা উদ্রেককারী নারীর আহ্বান পেয়ে ছুটে এসে যখন স্থূল ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করে তখন গিরি তাকে জানায়—সে ভালোবাসা চায় না; টাকা চায়, ভালো খাবার গয়না, কাপড় চায়৷ তার বাক্য অসম্পূর্ণ রেখেই প্রবল উত্তেজনায় মূর্ছিত হয়ে গেলে বিপিন পালিয়ে যায়৷ পাঁচুর মায়ের সেবা যত্নে জ্ঞান ফিরে পেয়ে শোনে সে তার জন্য পাশের গ্রামের ভবি মোড়লের কাছ থেকে কাজের খবর নিয়ে এসেছে; যা তাকে সৎপথে থেকে উপার্জনে সহায়তা করবে৷ পরম কৃতজ্ঞতায় নিম্নশ্রেণীর সেই নারীও যেন গিরির পরম আপন হয়ে উঠে৷ যে সমাজ উপায় থাকতেও তার মতো একজন নারীর সৎভাবে বেঁচে থাকার সব পথ বন্ধ করে রেখেছে সেখানে পাঁচুর মায়ের মতো সহায়-সম্বলহীন নারীর নিঃস্বার্থ তত্ত্বাবধান তাকে বিহ্বল করে তোলে সে বলে—‘‘পাঁচুর মা, তুমি আমার আর-জন্মে মা ছিলে!’’১৫৫ কিন্তু ওদিকে বিপিন গিরির দুর্বল মুহূর্তের প্রত্যাশিত সেই গয়না কাপড় এনে তার সামনে হাজির করলে পাঁচু ও তার মায়ের নজরে পড়ে পালিয়ে যায়৷ তাকে গিরির দুয়ার থেকে পালিয়ে যেতে দেখে রামকেষ্ট সাহা৷ পরদিন তার মধ্য দিয়ে গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে যায় বিপিনকে জড়িয়ে গিরির কুৎসা৷ সালিশি সভায় ভোজ ও অর্থ জরিমানা দিয়ে সলজ্জ বধূর মতো বিপিন স্বীকার করে তার সঙ্গে গিরিব মিথ্যে অবৈধ সংসর্গের কথা৷ বিপিন গিরিকে কোণঠাসা করতে রামকেষ্টকে দিয়ে কুৎসা রটায়, পঞ্চায়েত বসিয়ে পাঁচুর মাকে তার থেকে আলাদা করে দেয় এবং হরিলালের সঙ্গে টাকার রফা করে নিশুতি রাতে একাকিনী অবস্থানকারী গিরিকে ধর্ষণ করে৷ একজন নারীকে যতদূর উপদ্রব করা যায়—তার সীমাটাকেও যেন অতিক্রম করেছেন লেখক৷ গিরিকে ধর্ষণ করার সমস্ত পথ সুগম করেছে সমাজ; অথচ রক্ষা করার কোন চেষ্টা করেনি৷ বিপিনের ভোগের শিকার করে গিরিকে বেশ্যাবৃত্তির পথে নিক্ষেপ করেছে৷ আর বিপিন? সে তো তার অপকর্মের জন্য রাতারাতি ‘সেলিব্রিটি’ হয়ে উঠেছে৷ রামকেষ্ট তাকে ধরে বলেছে—‘‘মিষ্টি খাওয়াতে হবে দাদা৷’’১৫৬ হরিলাল পঞ্চায়েতে যাওয়ার আগে তাকে উপদেশ দিয়েছে—‘‘একটুখানি লজ্জার হাসি হেসে দিস দাদা, সব ঠিক হো যায়েগা৷’’১৫৭ পঞ্চায়েত বিপিনের সেই ‘শুভকর্মের’ জন্য কি জরিমানা হবে তা ভাবতেই ব্যস্ত৷ লেখক বলেছেন—‘‘এদিকে তুমুল তর্কে পঞ্চায়েতের আলোচনা চলিয়াছিল৷ লুচি কি অন্নের ভোজন শাস্তিস্বরূপ নির্ধারিত হইবে সেইটাই আলোচনার বিষয়৷’’১৫৮ আর কুকর্মের গুরুঠাকুর হরিলাল তাকে সহায়তা করে পঞ্চাশ টাকা ইনাম গ্রহণ করেছে৷ বিপিন কামনা চরিতার্থ করার পথ নির্দেশ পেয়ে সেই খুশির আতিশয্যে হিন্দি ভাষায় হরিলালকে বলেছে—‘‘আজ কিন্তু রাতকো একঠো জলসা হোনা চাহি৷ মালকোষ একঠো তুমারা পাশ শুননে হোগা ওস্তাদ৷’’১৫৯ পুরুষ সমাজের এই নির্মম লজ্জাহীনতাকে ভাষারূপ দিয়েই খান্ত হননি রচনাকার কঠোর সমালোচকের মতো মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ করে বলেছেন—‘‘এ সংসারে মানুষকে কঠোর সমালোচক বলিলে তাহার অতি প্রশংসা করা হয়—মানুষ নিন্দুক, পরনিন্দার উপর তাহার একটা সহজাত লিপ্সা আছে, সাদার গায়ে কালি ছিটাইয়া তাহার পরম তৃপ্তি৷’’১৬০ এই সাদাকে কালিমালিপ্ত করতে গিয়েই গিরিকে পতিত করেছে মানুষজন; এক হিংস্র কামার্ত পশুর মুখে তার সতীত্বকে ছুড়ে দিয়েছে৷ গিরি বিপিনের রক্ষিতা হতে বাধ্য হয়েছে৷
একবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার ফলে তার মধ্যে কাজ করেছে প্রবল মৃত্যুভীতি৷ যার দরুণ আত্মহত্যাও করতে পারেনি সে৷ রক্ষিতা হয়ে একরকম দিন কাটছিল তার৷ কিন্তু ঘটনা আবার বাঁক নেয় তার গর্ভসঞ্চার হলে৷ যে সন্তান একদিন গিরি ও শ্রীমন্তের ধ্যান-জ্ঞান ছিল, যে শূন্যতাবোধে সর্বস্ব খুইয়েছে সে—সেই সন্তান তার গর্ভে; যদিও তা বিপিনের ঔরসজাত৷ তথাপি মাতৃত্বের পুলকে তার শূন্য জীবন যেন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে৷ বিপিন সেই সন্তানের গর্ভপাতের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ ঠিক করলে শিউড়ে উঠে গিরি৷ তার অবুঝ মন এটা ভুলে যায় যে রক্ষিতার সন্তানেরা সর্বদাই অবাঞ্ছিত৷ বিপিনের হাত থেকে সন্তানকে বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায় সে৷ নানা স্থানে ঘুরে বেড়িয়ে, নানা জনের কাছে শরীর বেচে তার সন্তান নীলকন্ঠকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে৷ সেখানে এক খদ্দেরের দ্বারা নিষ্ঠুর যৌনপীড়নেরও উল্লেখ করেছেন রচনাকার, যে অত্যাচারের কথা কোনোদিন ভোলেনি গিরি৷ তারপর একদিন গ্রামে ফেরার মুখে মৃত্যুর হাতছানিতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পা পিছলে নদীতে তলিয়ে যায়৷
রচনাকার কি নির্মম জীবন একেছেন এক নারীর৷ ভাগ্য ও সমাজের যুগপৎ পীড়নে নিঃশেষ হয়ে গেছে তার জীবন৷ সমাজের সেই ভয়ঙ্কর রূপ নারীর ক্ষেত্রে কতটা ক্ষতিকারক তারাশঙ্কর তাঁর রচনার গুণে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করেছেন৷
‘রাইকমল’-এ বহুপুরুষ লাঞ্ছিত সেবাদাসীদের প্রতি সমাজের ঘৃণ্য মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে৷ সেবাদাসী কন্যা কমলিনী রূপে যৌবনে পরিপূর্ণা হলেও তা সমাজের কাছে আশঙ্কার কারণ৷ সমাজের চোখে এই সেবাদাসীরা যে গণিকাই সেই ধরনের মনোভাবও স্পষ্ট হয়েছে এই রচনায়৷ কমলিনীর মানসপুরুষ রঞ্জন৷ রঞ্জনের মা কমলিনীকে খুব ভালোবাসত৷ তার নাম দিয়েছিল হাস্যময়ী৷ কমলিনীকে না দিয়ে রঞ্জনকে কোনো কিছু খেতে পর্যন্ত দিতে পারতো না তার মা৷ অথচ যেদিন রঞ্জন তার এঁটো কুল খেয়ে বাড়িতে ফেরে তখন রঞ্জনের মাকে প্রচণ্ড ক্রোধে বলতে শোনা যায়—‘‘রাক্ষুসী রাক্ষুসী, মায়াবিনী গো, ওরা ছত্রিশ জেতে বোষ্টম—ওদের কাজই এই৷ মুড়োঝাঁটা মারি আমি হারামজাদীর মুখে৷’’১৬১ অর্থাৎ রঞ্জনের খেলার সঙ্গী হিসেবে তাকে মানতে অসুবিধা নেই কিন্তু রঞ্জন প্রণয়ী জ্ঞানে তার এঁটো কুল খেলে একজন সেবাদাসীর কন্যাকে ভাবী পুত্রবধূ কল্পনা করে মানতে পারেনি সভ্য সমাজের প্রতিনিধি তার মা৷ তাই নানারকম ইতর শব্দ দ্বারা বিশেষায়িত করে অভ্যর্থনা করা হয়েছে কমলিনীকে৷ রঞ্জনের মায়ের সেই আক্রোশ দেখে শিউরে উঠে রঞ্জনের বাবা৷ স্ত্রীকে ধমকে বলে—‘‘চুপ চুপ, চেঁচিয়ে গাঁগোল করিস না৷ জ্ঞাতিতে শুনলে টেনে ছাড়ানো দায় হবে, পতিত করবে৷’’১৬২ একজন সেবাদাসী, যে কিনা ঈশ্বরের চরণে নিজের দেহ-মনকে সমর্পণ করে, বহুচারীতায় লিপ্ত হয়; তাদের সেই আচার-নিয়মকে সমাজ সহজভাবে মেনে নিতে পারে না৷ তাদের সংস্পর্শ যে গণিকা সংসর্গের চেয়েও হীন রঞ্জনের বাবা মহেশ্বরের কথার মধ্য দিয়েও তা স্পষ্ট হয়৷ রঞ্জনের বাবার অনুরোধে কোলের ছেলে কোলে ফিরিয়ে দিতে মায়ের সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে চিরকালের জন্য নবদ্বীপ যাত্রা করে৷ তারপর ঘটনার চলমান ধারায় একদিন কমলিনী কন্ঠিবদল করে বৃদ্ধ রসিকদাসের সঙ্গে৷ তার অতৃপ্ত প্রেমিকাসত্তা পথ চলতে চলতে আবার বহুদিন পর উপস্থিত হয় নিজ গ্রামে৷ রসিকদাসের কাছ থেকে মুক্তি নিয়ে গ্রামের যুবক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কীর্তন গানে মুখরিত করে তোলে তার পুরোনো আখড়া৷ তার মোহিনীরূপে মুগ্ধ হয়ে পতঙ্গের মতো পুরুষের দল সেই রূপসুধা পান করতে ব্যগ্র হয়ে গেলে পুনরায় তাকে নিয়ে গ্রামের মধ্যে কলরব উঠে৷ সবই তার কানে যায়—‘‘গ্রামের গৃহস্থজন সকলেই কমলকে গালাগালি দেয়৷ বলে, ছি! এই কি রীতিকরণ? রঞ্জনকে দেশছাড়া করলে, মহান্তকে তাড়ালে, আবার কার মাথা খায় দেখ৷ যাকে দশে বলে ছি, তার জীবনে কাজ কি?’’১৬৩ প্রতিবেশিনীগণের এই বিদ্রোহ কোনো ধর্মীয়ভাবাপন্ন নারীর প্রতি নয় বহুপুরুষের জীবন বিপর্যয়কারিণী গণিকার প্রতি৷ এখানে কমলিনীর প্রতি সমাজের ঘৃণা যেমন উঠে এসেছে তেমনি উঠে এসেছে কমলিনীর মতো নারীদের পুরুষের দ্বারা বঞ্চনার বাস্তব চিত্র৷ শেষপর্যন্ত কমলিনী তার কাঙ্খিত রঞ্জনকে ফিরে পেয়েছিল৷ কন্ঠিবদল করে তার দেহ-মন সঁপে দিয়েছিল তার পায়ে৷ কিন্তু ভোগী পুরুষের প্রতিনিধি রঞ্জন তার প্রেমের সম্মান রাখতে পারেনি৷ তার যৌবনের দ্যুতি ম্লান বুঝেই পুনরায় নতুন সঙ্গিনী জোগাড় করে নিয়েছে প্রবৃত্তির দাহকে শীতল করতে৷ কমলিনী চুপ করে থাকেনি৷ নিজের অবস্থান বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ত্যাগ করেছে রঞ্জনকে৷ বলেছে রঞ্জনের মতো তারও নতুন শ্যামের প্রয়োজন৷ রঞ্জন যেমন বিগতযৌবনা কমলিনীকে আর রাধাভাবে সাধনসঙ্গিনী করে রাখতে পারেনি৷ বৈষ্ণবীয় রীতির ধুয়া তুলে তেমনি সেও সেই বৈষ্ণব ধর্মের অনুকারিণী হয়ে যৌবনহীন রঞ্জনকে কৃষ্ণ ভাবতে পারবে না৷ আর এইভাবেই প্রতারিত কমলিনী রঞ্জনের কামনাকে বিদ্ধ করে তার সঙ্গ ত্যাগ করেছে৷ তার এই তীর্যক বাক্যবন্ধ তার মনের দৃঢ়তাকে প্রতিপন্ন করে৷
‘কালিন্দী’-তে সরল, নিষ্পাপ বনবালা সারীর দেহব্যবসায় আত্মনিয়োগের পিছনে পুঁজিবাদী-ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন রচনাকার৷ সাঁওতাল নারীগণের মধ্যমণি সারী শেষ পর্যন্ত সকলের চোখে ঘৃণ্য বলে প্রতিপন্ন হয়েছে৷
মেয়ে কেনা-বেচার নিষ্ঠুর চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে ‘প্রেম ও প্রয়োজন’ উপন্যাসে৷ রমণদাস তার বিধবা সুন্দরী কন্যা রমাকে পাঁচশত টাকার বিনিময়ে দালাল কড়ি গাঙ্গুলীর মধ্যস্থতায় বিক্রি করে দেয় জমিদার মহেন্দ্রবাবুর কাছে৷ স্বামী হারিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে এবং ভাই-ভাজের গলগ্রহ হয়ে থাকা থেকে মুক্তি লাভের প্রচ্ছন্ন একটা ইচ্ছেও রমার মধ্যে বর্তমান ছিল—আর তাই প্রায় বিনা প্রতিবাদেই মহেন্দ্রবাবুর অন্তঃপুরে তার শিশুপুত্রের লালন-পালনের নামে স্থান নেয়৷ সমাজে গণিকার কন্যা বলে পরিচিত এবং জমিদারের রক্ষিতা হিসেবে কল্পিত লেডি ডাক্তার নলিনী তার প্রখর ব্যক্তিত্ব দ্বারা মহেন্দ্রবাবুর অসৎ উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে রমাকে নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়৷ যদিও ঘটনার আবর্তে রমা পুনরায় মহেন্দ্রবাবুর রক্ষিতা রূপে সেই অন্তঃপুরেই স্থান নেয়৷ যাইহোক এখানে দেখানো হয়েছে এক গৃহস্থ কন্যার পিতার অর্থলোলুপতার কারণে গণিকা হিসেবে প্রতিপন্ন হওয়া৷ নির্মম বৈধব্যাচার এ বিষয়ে ইন্ধন দান করেছে৷ সমাজে মেয়ের মূল্য কতটা নীচে নামলে কোনো পিতা নির্দ্বিধায় তাকে বিক্রয় করে দিতে পারে তার চিত্র এটি৷ আবার অন্য দিকে নলিনী যে কিনা নিজেকে বেশ্যাকন্যা বলে পরিচায়িত করেছে তার মুখে সমাজের প্রতি বিদ্রোহ দেখিয়েছেন রচনাকার৷ বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’-এ কুন্তা বেশ্যা কন্যা বলে চূড়ান্ত লাঞ্ছনা ভোগ করেছে কিন্তু ‘প্রেম ও প্রয়োজন’-এর নলিনী নিজেকে সেই পরিচয়ে পরিচায়িত করলেও শিক্ষা সম্মান সমস্ত কিছুই অর্জন করতে সচেষ্ট হয়েছে৷ শুধু তাই নয় তার ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তাও অতুলনীয়৷ নলিনী যেন সমাজের পায়ের তলা থেকে সবলে বাইরে বেড়িয়ে এসে সদর্পে নিজেকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে৷
যাযাবরী মুক্তকেশী ‘আগুন’ উপন্যাসে তাদের গোষ্ঠীর স্বাভাবিক বহুপুরুষগামীতায় অভ্যস্ত৷ হীরুর রূপে মুগ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় তার কামনার বহ্নিতে ঝাঁপ দিয়েছে৷ এমনকি সে নিজেই হীরুকে অনুরোধ করেছে সে যেন তার বাবাকে পয়সা দিয়ে তাকে কিনে নেয়৷ এই যাযাবর সম্প্রদায়ের মধ্যে সতীত্বের কোনো বালাই নেই; সাপখেলা ইত্যাদি নানারকম পেশার সঙ্গে সঙ্গে দেহব্যবসাও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷ তারপর অনেক দিন ধরে সেই যাযাবরী হীরুর সঙ্গে বসবাস করেছে—তারপর একদিন হীরুর সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে তার হাত থেকে সন্তানকে বাঁচাতে ‘নীলকন্ঠ’-র গিরির মতো পালিয়ে গিয়েছে৷ রচনাকার এখানে সেই যাযাবর বেদে জাতির স্বেচ্ছাচারকে তুলে ধরেছেন৷ তাদের প্রতিও সমাজ বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছে৷
‘মন্বন্তর’ উপন্যাসেও ‘প্রেম ও প্রয়োজন’-এর রমার মতো বাবা-মা তার কন্যার সতীত্বকে পুরুষের কামনা পূরণের জন্য আহুতি দিয়েছে পেটের ভাত ও স্বামীর চিকিৎসার জন্য৷ তবে রমার বাবা রমণদাসের মতো তীব্র লোভ এখানে কাজ করেনি৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্করতায় দেশব্যাপী প্রবল অন্নকষ্টে মেয়ের শরীর ছাড়া যখন অন্য আর কোনো অবলম্বন থাকে না তখন বাধ্য হয়েই দালাল ঘটকীর পরামর্শ মতো মা তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে পুরুষের মনোরঞ্জন করতে পাঠিয়ে দেয়৷ এখানেও সামাজিক শোষণের শিকার সেই মেয়েটি অর্থাৎ গীতা৷ গীতা এক ভদ্রলোকবাবুর দ্বারা বলপূর্বক ধর্ষিত হয়ে সোজা উপস্থিত হয় উপন্যাসের নায়ক কানাই চক্রবর্তীর কাছে৷ কানাইয়ের তৎপরতায় গণিকাবৃত্তিতে নিমজ্জিত না হলেও জীবনভর সেই গ্লানি এবং ধর্ষক বাবুর সন্তান গর্ভে ধারণ করে পাপবোধে জর্জরিত থেকেছে৷ কানাই-এর মতো শিক্ষিত উদার চরিত্রের মধ্যে দিয়ে গীতার যে সুস্থ জীবনে ফেরার সংগ্রাম তা পতিতা ধর্ষিতা নারীদের জন্য বিশেষ মাত্রাবাহী৷
‘কবি’-র বসন্ত ঝুমুরদলের নর্তকী; সঙ্গে দেহব্যবসাও করে থাকে৷ শুধু বসন্ত নয় তার দলের অন্য মেয়েরাও যথা ললিতা, নির্মলা সকলেই দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত৷ দলে কর্ত্রী মাসি নিপুণ হস্তে সেই ব্যবসা পরিচালনা করে; সেই উপার্জিত অর্থের কিছু অংশও তার ঝুলিতে স্থান পায়৷ লেখক চরিত্রগুলির পূর্ব কোনো ইতিহাস ব্যক্ত করেননি৷ দেহজীবী হিসেবেই তারা পরিচিত; সেই দেহজীবী হয়েই মৃত্যুবরণ করা যেন তাদের ভবিতব্য৷
সেই নিম্নশ্রেণীর বারাঙ্গনাদের সমগ্র ধারণাকে পাল্টে দিয়ে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় নিতাই৷ বসন্তর ক্ষুরধার কথা ও হাসির মধ্যে প্রেমের সুর সংযোজন করে জীবনে নতুন আশার বীজ উপ্ত করে মানুষ হিসেবে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়৷ দিনের পর দিন যেভাবে পুরুষেরা এসে তাদের ভোগ করে উচ্ছিষ্ট পাতার মতো ফেলে রেখে চলে যায় সেখানে নিতাই বসন্তকে সম্মান দিয়ে বুকে বেঁধে রেখে আমৃত্যু তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়; ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে গাঁটছড়া বাঁধে বসন্তের সঙ্গে৷ অর্থাৎ বসন্ত যে একজন নারী; নিতাই ভালোবাসার মন্ত্র দিয়ে তার সর্ববিদ্রোহী গণিকাসত্তার ভিতর থেকে তার সেই সত্যকার রূপটিকে বের করতে সক্ষম হয়েছিল৷ সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়েই সর্ববঞ্চিত এই নারী তার ক্ষয়ে যাওয়া জীবনের মধ্যেও নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল৷
রচনাকার অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে তার মতো দেহপসারিণী নারীদের চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন সংগ্রামকে তুলে ধরেছেন৷ বসন্ত তার জীবনের শেষ মুহূর্তে ঘৃণ্য জীবনের মহার্ঘ্য সুখানুভূতিকে হারাতে চায়নি৷ সমাজের সকলের মতো ঈশ্বরও যেন তার সঙ্গে বঞ্চনা করে তাকে সুখভোগে বঞ্চিত করতে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছে৷ তাই অন্তিমলগ্নে নিতাই-এর মুখে গোবিন্দ নাম উচ্চারণ করার উপদেশ শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে—‘‘কি দিয়েছে ভগবান আমাকে? স্বামীপুত্র ঘরসংসার কি দিয়েছে? না৷’’১৬৪ তার এই ক্ষোভ যেন সমস্ত গণিকা সমাজের শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী কন্ঠস্বর৷ যদিও শেষ পর্যন্ত মিনতি করেই নিজের শেষ ইচ্ছেকে ব্যক্ত করতে বাধ্য হয়েছে; সে বুঝে গিয়েছে তাদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে থাকা নিষ্ঠুর সমাজ ও ঈশ্বর তার স্পর্ধিত বাণী কানে তুলবে না৷
মরতে কোনোদিনই ভয় ছিল না বসন্তর কারণ তার জীবনটাই ছিল মরে বেঁচে থাকার মতো অবস্থা৷ তার সেই অতৃপ্তির মহাশূন্যে একটা নক্ষত্র হয়ে জ্বলে উঠেছিল নিতাই৷ আর বসন্ত আবার নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিল সেই নক্ষত্রের উজ্জ্বল বিভায়৷ কিন্তু যেদিন নিতাই-এর মুখে বসন্ত প্রথম শ্রবণ করে—
‘‘এই খেদ মোর মনে৷
ভালবেসে মিটল না আশ—কুলাল না এ জীবনে৷
হায়, জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?’’১৬৫
এই সুরকলি শোনামাত্র বসন্ত হাহাকার করে উঠেছিল৷ সে তখন থেকেই প্রত্যক্ষ মৃত্যুকে দেখতে পেয়েছিল৷ তাই নিতাইকে তার মৃত্যুর দিন কয়েক পূর্বে বলেছিল—‘‘বেহালাদার রাত্রে বেহালা বাজায়, আগে কত ভাল লাগত৷ এখন ভয় লাগে৷ মনে হয়, আমার আশেপাশে দাঁড়িয়ে কে যেন বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে৷ অহরহ মনে আমার মরণের ভাবনা৷ মনের কথা কি মিথ্যে হয়? তার ওপর এই গান তোমার মনে এসেছে! কি করে এল?’’১৬৬ নিতাই-এর কোলে মাথা রেখে সে মৃত্যুর মধ্যে মিশে গিয়েছিল৷ কিন্তু তার পরে? কোথায় গেল সে? নিতাই তাই ভাবতে থাকে বসন্তর যত অতৃপ্তি, যত শূন্যতা সব কি মৃত্যুর পরের জগতে গিয়ে পূর্ণ হয়েছে—জীবনে যা পায়নি মরণে কি তা পেয়েছে সে! নিতাই-এর মধ্য দিয়ে বসন্তর অপবিত্র জীবনের সমস্ত অতৃপ্তিকে তুলে ধরেছেন লেখক৷ শুধু তাই নয় তার মতো একজন ঘৃণ্য দেহপসারিণী নারীকে নিতাই-এর সঙ্গে কর্মের ভিত্তিতেও এক আসনে বসিয়েছেন তারাশঙ্কর৷ যে কর্মের জন্য দেহজীবাদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করতে পারেনি সমাজপ্রভুরা, তারাশঙ্কর সেই বারযোষিতদের প্রতিনিধি বসন্তকে নিতাই-এর সঙ্গে কর্মের ভিত্তিতেও এক আসনে বসিয়েছেন৷ পতিতা নারী ও পুরুষের মৃত্যুপরবর্তী জগৎকে একাকার করে দিয়েছেন যা এর পূর্বে কোনো সাহিত্যিকের লেখনিতে দৃষ্টিগোচর হয়নি৷ বসন্তর মৃতদেহ সৎকার করে এসে নিজের শ্রান্ত দেহটিকে ঘরের একপাশে এলিয়ে দিয়ে মৃত্যু সম্পর্কে নানা কথা ভাবতে থাকে৷ এ প্রসঙ্গে রচনাকার তার মনের ভেতরের মরণ সংক্রান্ত ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন এইভাবে—‘‘মরণ কি? পুরাণে পড়া মরণের কথা তাহার মনে পড়িল৷ মানুষের আয়ু ফুরাইলে ধর্মরাজ যম তাঁহার অনুচরগণকে আদেশ দেন ওই মানুষের আত্মাটিকে লইয়া আসিবার জন্য৷ ধর্মরাজের অদৃশ্য অনুচরেরা আসিয়া মানুষের অঙ্গুলিপ্রমাণ আত্মাকে লইয়া যায়; ধর্মরাজের বিচারালয়ে ধর্মরাজ তাহার কর্ম বিচার করেন, তাহার পর স্বর্গ অথবা নরকে তাহার বাসস্থান নির্দিষ্ট হইয়া যায়৷ বিভিন্ন কর্মের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার, বিভিন্ন শাস্তির ব্যবস্থাও সে পড়িয়াছে৷ নিতাইকেও একদিন সেখানে যাইতে হইবে৷ বসন্তর সঙ্গে তাহার কর্মের পার্থক্যই বা কোথায়? তাহা সে খুঁজিয়া পাইল না৷ এবং তাহাতে সে একটা আশ্চর্য সান্ত্বনা পাইল৷ কারণ বসন্ত যেখানে গিয়াছে, সেইখানেই সে যাইবে৷ সে হয়তো অনন্ত নরক৷’’১৬৭ দেহব্যবসায়ী নারী হয়েও প্রেমিকের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বাংলা উপন্যাসে অন্যান্য গণিকাদের তুলনায় বসন্তই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি মাত্রায় লাভ করেছিল৷
কিন্তু বসন্তর সেই ঝুমুর দল যেখানে সে সকলের মধ্যমণি হিসেবে অবস্থান করেছিল মৃত্যুর পরে সেই দলের আরেক রূপ প্রকাশ পায়৷ সেখানে যে একজন মানুষ হিসেবে যে বসন্ত দুপুরবেলা পর্যন্ত অবস্থিত ছিল; তার মৃতদেহ বের করার সঙ্গে সঙ্গে যেন মুহূর্তেই সমস্ত অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়৷ তার জন্য কাঁদবার, তার শোকে বিহ্বল হয়ে থাকবার কোনো প্রবণতা দলের কারও মধ্যে দেখা যায় না৷ বসন্তর জন্যই যে দল এতদিন অর্থ উপার্জনে প্রশস্ততা অর্জন করে এসেছিল, তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই স্থান পূরণ করতে দলের সকলের তৎপরতা দেখে নিতাই শিউরে উঠে৷ নিতাই ভাবে—‘‘বসন্ত আজই মরিয়াছে, দুপুরবেলা পর্যন্ত দেহটাও তাহার ছিল৷ এখন প্রায় সন্ধ্যা হইয়াছে, ইহারই মধ্যে দল হইতে বসন্ত মুছিয়া গেল! তাহার স্থান কে লইবে সেই সমস্যা এখনই পূরণ না করিলেই নয়? প্রৌঢ়া বসন্তের জিনিসপত্র লইয়া আপনার ঘরে পুরিয়া খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থায় ব্যস্ত৷ ললিতা, নির্মলা আজ নিজেরা খরচ দিয়া মদ কিনিয়া খাইতে বসিয়াছে৷ ইহাদের মধ্যে বেহালাদার, দোহার ও ঢুলীটা আলোচনা করিতেছিল কোন ঝুমুর দলে গানে-নাচে-রূপে যৌবনে সেরা মেয়ে কে আছে! সর্ববাদিসম্মতভাবে ‘প্রভাতী’ নাম্নী কে একজন তরুণীর নাম স্বীকৃতিলাভ করিয়াছে; মেয়েটা নাকি বসন্ত অপেক্ষা আরও ভাল এই কারণে যে তাহার বয়স বসন্তের চেয়ে অনেক কম৷ দোহার বলিতেছে, তাহাকেই আনা উচিৎ৷ তাহাতে বিশ তিরিশ বা পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত লাগে তাহা দিয়াও তাহাকে দলে আনা উচিৎ৷’’১৬৮ গৃহে একটা বিড়ালও দুদিন অবস্থান করলে তার প্রতি নাকি মানুষের মায়া পড়ে যায় অথচ বসন্ত একজন জলজ্যান্ত পণ্যাঙ্গনা৷ তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে সম্পূর্ণরূপে মুছে যায় তাদের দল থেকে৷ তার জন্য দুদিন শোক-প্রকাশ করবে এমন দরদি সেখানে কেউ নেই৷ এমনকি ভাগ্য বসন্তর মত হতভাগিনী রমণীদের!
‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’-এর বারযোষিৎ দুর্গাও কম হতভাগিনী নয়৷ সে একজন পণ্য রমণী হয়েও বুদ্ধির প্রাখর্যে, প্রত্যুপন্নমতিত্বে, সমাজের মঙ্গলাকাঙ্খিনীরূপে উপন্যাসের অন্য সব প্রধান পুরুষচরিত্রগুলির তুলনায়ও কোনো অংশে কম ছিল না৷ তার নারী হৃদয়ের কোমলতা কোনো কোনো স্থানে বিলুর মতো মহীয়সীকেও অতিক্রম করে গেছে৷ অথচ সমগ্র জীবন ধরে সে শুধুই উমার মতো তপস্যা করে গেছে; তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করতে পারেনি৷ যে সমাজে জন্মগ্রহণ করেছে সে সেখানে গণিকাবৃত্তি দোষের নয় বরং তাদের আত্মীয় পরিজনদের মদতেই সেই নিম্নশ্রেণীর মেয়ে-বৌরা নিজের শরীরকে পরপুরুষের যৌন খোরাক হিসেবে উপস্থাপিত করে৷ দুর্গারও তাই হয়েছিল৷ তার শাশুড়ি মনিবের সঙ্গে চক্রান্ত করে অসুস্থতার ভান করে তাকে কাজে পাঠিয়েছিল বাবুর দ্বারা ধর্ষিত হয়ে এবং শরীরের মূল্য হিসেবে পাঁচ টাকা পারিশ্রমিক লাভ করে আতঙ্কে, অশান্তিতে, গ্লানিতে; সঙ্গে সঙ্গে বাবুর দুর্লভ অনুগ্রহ ও অর্থপ্রাপ্তির আনন্দে পথ ভুল করে সে আপন মায়ের কাছে পালিয়ে এসেছিল৷ ‘‘কারণ সে বাবুর কাছে শুনিয়াছিল এই যোগসাজশটি তাহার শাশুড়ির!’’১৬৯ মায়ের কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত প্রকাশ করলে তার মায়ের চোখেও এক বিচিত্র দৃষ্টি ফুটে উঠেছিল৷ লেখকের বর্ণনায়—‘‘একটা উজ্জ্বল আলোকিত পথ সহসা যেন তাহার চোখের সম্মুখে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল—সেই পথই সে কন্যাকে দেখাইয়া দিয়া বলিল—যাক, আর শ্বশুড়বাড়ি যেতে হবে না৷’’১৭০ তার পর থেকেই দুর্গা সেই পথ ধরেই চলেছে৷
দুর্গা স্বতন্ত্র কোনো পল্লীতে দেহের পসরা সাজায়নি৷ বাপের বাড়িতেই তার বাসস্থান৷ তাদের সেই হরিজনপল্লীর প্রায় প্রত্যেক রমণীই কম-বেশি যৌনব্যবসার সঙ্গে যুক্ত৷ দুর্গার ঘরে যেমন লোক যাতায়াত করে তেমনি প্রয়োজন হলে যৌনখোরাকের জোগানদার হিসেবে তাকে অভিসারেও যেতে হয়৷ শুধু নিজের গ্রাম নয় পার্শ্ববর্তী গ্রাম কঙ্কনাতেও তার শরীরভোগী পুরুষের সংখ্যা কম নয়৷ এই শরীর কেনা-বেচা নিয়ে তার মনে কোনো ক্ষোভ নেই, অনুতাপ নেই৷ সে স্বাধীনবৃত্তির এবং আত্মপ্রত্যয়ী৷ ভাই পাতুর সঙ্গে ঝগড়ার প্রসঙ্গে তার সেই আত্মপ্রত্যয়ের বিচ্ছুরণ লক্ষিত হয়৷ যেমন দুর্গার চরিত্র নিয়ে ভরা মজলিশে পাতু তাকে অপমানিত করলে সকলের সামনে সে সদম্ভে ঘোষণা করে—‘‘ঘর আমার, আমি নিজের রোজগারে করেছি, আমার খুশী যার ওপর হবে—সে-ই আমার বাড়ি আসবে৷ তোর কি? তাতে তোর কি? তু আমাকে খেতে দিস, না দিবি?’’১৭১ দুর্গাদের সমগ্র মুচিপাড়াটা আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেলে জগন ডাক্তারের উদ্যোগে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির আশায় সকলে যখন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে আবেদন করতে টিপ-ছাপ দিতে ব্যস্ত তখন নিজ কর্মে গরবিনী দুর্গা তা অস্বীকার করে৷ টিপসই না দিলে যে সে সরকারি টাকা পাবে না জগন ডাক্তার সে কথা তাকে বলতেই সে মুখ বেঁকিয়ে উত্তর দেয়—‘‘আমি টিপ-সই দিতে আসি নাই গো৷ তোমার তালগাছ বিক্রি আছে শুনে এসেছিলাম কিনতে৷ গতর থাকতে ভিখ মাঙব ক্যানে? গলায় দড়ি!’’১৭২ এই বক্তব্যেও দুর্গার পেশা সম্পর্কে আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব স্পষ্ট৷ সুন্দরী-রূপবতী দুর্গা নিজেকে সর্বদাই নিজের স্বজাতীয়দের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে; নিজের কলঙ্ক কোনোভাবেই কারও কাছে গোপন করে না৷ স্বেচ্ছাচারের দুরন্তপনায় ঊর্ধ্ব বা অধঃলোকের কোনো সীমাকেই অতিক্রম করতে তার বাধে না৷ পুরুষ দেখলেই লাস্যের দোলায় দু-একটা রঙ্গ-রসিকতা করা তার চিরায়ত স্বভাব৷ যার জন্য গ্রামের কুলবধূরা তার প্রতি বিরক্ত ও আশঙ্কিত৷ রচনাকার দুর্গা চরিত্রের মধ্য দিয়ে গণিকা নারীদের সামাজিক ও মানসিক বিবর্তনের ধারাটিকে স্পষ্ট করেছেন৷ সামাজিক ভাবে দেখা যায় ওপরতলার-নীচুতলার বেশিরভাগ মানুষই দুর্গার শরীরকে উপভোগ করে ফলে শরীরের সূত্রে দুর্গা সকলে দোষ-গুণের সন্ধান রাখে; তাই একটা প্রচ্ছন্ন কর্তৃত্ব যেন সহজভাবেই দুর্গার মধ্যে আরোপিত৷ আর সকলের হাড়ির খবর তার নখদর্পণে বলে তার ঔদ্ধত্তে বা তার অগোপনীয় স্বেচ্ছাচারীতাকে কেউ ঘাটাতে সাহস পায় না৷ আর মানসিকভাবে দেখা যায় যে দেহজীবিকার জন্য তার মনে কোনো অনুতাপ অনুশোচনা তো নে-ই বরং তার শরীর ও যৌনতা নিয়ে সকলের সামনে গর্বপ্রকাশ করে সে৷ পুরুষের যৌনতার খোরাক হিসেবে অবস্থান করা একজন নারীর এ ধরনের আত্মগর্বী মনোভাব দৃঢ়মননের অধিকারী না হলে সম্ভব হয় না৷ দুর্গার মধ্যে সে মনন কাজ করেছে৷ পণ্য রমণী হয়েও সাহাসে আভিজাত্যে অসামান্য হয়ে উঠেছে৷
লেখক দুর্গার মধ্যে শুধু পণ্যাঙ্গনার শরীরী গর্বকেই আরোপিত করেননি তাকে অধিষ্ঠিত করেছেন সমস্ত মানবীয় গুণাবলীর সমন্বিত রূপে৷ সেখানে নারীর কমনীয়তা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে পুরুষের প্রচণ্ড সাহসিকতা৷ পদ্মর দুঃখে, রাঙাদিদির মৃত্যু শয্যায়, দেবুর সংসার রক্ষণাবেক্ষণে, অনিরুদ্ধর যৌন ও মানসিক খোরাক জোগান দিতে গিয়ে সে যথার্থ রমণী হয়ে উঠেছে৷ আবার যখন শ্রীহরি চক্রান্ত করে ভূপাল থানাদার, জমাদারবাবু ও হিন্দুস্থানী সিপাহিকে নিয়ে পদ্মর বাড়িতে ভাড়া থাকা নজরবন্দি যতীন ও দেবুদেরকে প্রজাসমিতির মিটিং করার জন্য ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সংকল্প করে তখন উপস্থিত বুদ্ধির জোরে দুর্গা আগাম সংবাদ দিয়ে তাদের সচেতন করে আইনি পীড়নের হাত থেকে রক্ষা করে, পুলিশ দেবুদের ঘর তল্লাশি করতে চাইলে দুর্গা দেবুকে বলে—‘‘ঘরে কিছু থাকে তো আমাকে দেবে৷ আমি ঠিক পেট-আঁচলে নিয়ে বাইরে চলে যাব৷’’১৭৩ এই বক্তব্যের মধ্যেও দুর্গার সাহসিকতার প্রত্যক্ষ দ্যুতি লক্ষিত৷ এছাড়া গ্রামে কলেরা দেখা দিলে দুর্গা দেবুর সঙ্গে সমান তালে সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে৷ শ্রীহরির গাছ নষ্ট করার অপরাধে দোষী বানিয়ে দেবু গ্রেপ্তার হলে সমস্ত দায় স্কন্ধে তুলে নেয় অনিরুদ্ধ৷ সত্যই সে শ্রীহরির নানা কুকর্মের শোধ নিতে গাছ কেটেছিল৷ সেই গাছ কাটা মামলায় দুর্গার নামেও রিপোর্ট হয়৷ দুর্গা কিন্তু পুলিশি জেরায় ঘাবড়ে যায় না৷ অকুতোভয়ে সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিয়ে যায়৷ সে যখন দারোগাকে বলে—‘‘আপনি ডাকুন সবাইকে—আমি মুখে মুখে বলছি৷ এই সেদিন রেতে জমাদার ঘোষ মশায়ের বৈঠকখানায় এসে আমোদ করতে আমাকে ডেকেছিলেন—আমি গেছলাম৷ সেদিন ঘোষ মশায়ের খিড়কীর পুকুরে আমাকে সাপে কামড়েছিল—পেরমাই ছিল তাই বেঁচেছি৷ রামকিষণ সিপাইজি ছিল, ভূপাল থানাদার ছিল৷ শুধান সকলকে৷ আমার কথা তো কারু কাছে ছাপি নাই৷’’১৭৪ দুর্গা এই কথার মধ্য দিয়ে শ্রীহরি, থানাদার, জমাদারবাবু, সিপাইজি সকলের পারস্পারিক সম্পর্ককেও ইন্সপেকটারের কর্ণগোচর করে দেয় নিজের উপস্থিত বুদ্ধিতে৷
‘গণদেবতা’ থেকে ‘পঞ্চগ্রাম’ উপন্যাসে একটু একটু করে দেহজীবিকার খোলসমুক্ত হয়েছে বারযোষিৎ এই নারী৷ দেবুর বরাবরই ছিল দুর্গার মতো নারীদের প্রতি অবজ্ঞা৷ জেল থেকে ফেরত আসার পর তার প্রতি অন্য আর এক মানসিকতা দানা বাঁধে৷ পনেরো মাসের সাজা কাটিয়ে গৃহে ফেরার পথে দুর্গাদের মুচিপাড়াটা দেখে দেবুর মন দুর্গার কথা ভাবতে থাকে—‘‘ছোট ছোট কুঁড়েঘরগুলির মধ্যে ওই বড় ঘরখানা দুর্গার কোটা-ঘর৷ দুর্গা! আহা, দুর্গা বড় ভাল মেয়ে৷ পূর্বে সে মেয়েটাকে ঘৃণা করিত, মেয়েটার গায়েপড়া ভাব দেখিয়া বিরক্তি-ভাব প্রকাশ করিত৷ অনেকবার রূঢ় কথাও বলিয়াছে সে দুর্গাকে৷ কিন্তু তাহার অসময়ে, বিপদের দিনে দুর্গা দেখা দিল এক নূতন রূপে৷ জেলে আসিবার দিন সে তাহার আভাস মাত্র পাইয়াছিল৷ তারপর বিলুর পত্রে জানিয়াছে অনেক কথা৷ অহরহ—উদয়াস্ত দুর্গা বিলুর কাছে থাকে, দাসীর মতো সেবা করে, সাধ্যমত সে বিলুকে কাজ করিতে দেয় না, ছেলেটাকে বুকে করিয়া রাখে৷ স্বৈরিণী বিলাসিনীর মধ্যে এ রূপ কোথায় ছিল—কেমন করিয়া লুকাইয়া ছিল?’’১৭৫
দুর্গা দেবুর জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে৷ সে শ্রীহরির স্থূল বদবুদ্ধির পাশে দেবুর সচ্চরিত্রের দীপ্তিতে মোহিত হয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে; তাকে কাছে পেতে চেয়ে নিজের গণিকা সুলভ কৌশলের যে প্রয়োগ করেনি তাও নয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে সে পাথর দিয়ে তৈরি৷ নারীর লাস্যে সে পাথর কোনোভাবেই বিগলিত হয় না৷ পদ্মবৌ-এর কাছে তার সেই অভিব্যক্তি সম্পর্কে গল্পও করেছে৷ তার শরীরের প্রতি উদাসীন উপেক্ষা তার ভালোবাসাকে আরও মজবুত করেছে৷ দেবু যদি অনিরুদ্ধর মতো তার প্রলোভনে প্রলোভিত হয়ে পতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তো তাহলে দেবুর প্রতি তার সেই প্রেম অত গভীর বোধ হয় হত না, অনিরুদ্ধর মতো তার বহুপুরুষ বিলাসী মন দেবুকেও একসময় পরিত্যাগ করতো৷ দুর্গা দুই উপন্যাস জুড়ে দেবুর জন্য অকাতরে উপেক্ষা করে গেছে নিজের সব কিছুকে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দুটি উপন্যাসের কোথাও লেখক দেবুর মধ্যে দুর্গার সেই প্রেমভাবনাকে জ্ঞাত করাননি৷ বিচক্ষণ দেবুর অন্তত একবার হলেও দুর্গার তার প্রতি ভালোবাসাকে বোঝা উচিৎ ছিল৷ বরং শ্যালিকা হিসেবে তার প্রতি সর্বদা স্নেহই বর্ষণ করেছে৷ শেষ পর্যন্ত দুর্গা যেভাবে দেবুর সঙ্গে থেকে তাকে সাহায্য করে এসেছে তার প্রেমের স্বরূপকে বুঝলে হয়তো দেবু দুর্গার সাহায্য সেভাবে নিতে পারতো না আর দুর্গা চরিত্রটিকেও সেইভাবে উপস্থাপিত করা হয়তো সম্ভব হত না৷ যাই হোক ভেতরে ভেতরে ক্ষয় হয়েও, নিজের দেহব্যবসা জারি রেখেও হৃদয়ের প্রেমের প্রদীপকে অনির্বাণ রেখেছিল৷ দেবু দুর্গার সমস্ত গুণপনাকে স্বীকার করলেও তার গণিকাবৃত্তিকে মেনে নিতে পারেনি৷ অনিরুদ্ধর সঙ্গে দুর্গার সম্পর্ক নিয়ে কথা প্রসঙ্গে তাই স্ত্রী বিলুকে সে বলে—‘‘ছি! ছি! ছি! দুর্গার ওই দোষটা গেল না৷ ওই এক দোষেই ওর সব গুণ নষ্ট হয়েছে৷’’১৭৬ অর্থাৎ গ্রাম জুড়ে প্রায় সকল পুরুষের সঙ্গে দুর্গার সম্পর্ক থাকলেও পুরুষগুলির কোনো দোষ হয় না দুর্গা তার এক দোষেই সমস্ত গুণাবলীকে ধ্বংস করে দেয়৷ দেবুর মুখে উচ্চারিত এই কথা রক্ষণশীল সমাজপ্রভুদের মতো শোনায়—যারা সমাজ, প্রতিবেশ, পরিবেশের বিচার না করেই সমস্ত দায় চাপিয়ে দেয় নারীর অসহায়তার উপর৷
সমাজের কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করলেও বিলুর ও খোকার মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ দেবুর তত্ত্বাবধানের দায় তার উপর আরোপিত হলে সমাজের ছড়িই যেন তার মাথার উপর ঘুরতে থাকে৷ সে বোঝে নিঃসহায় দেবুকে সে যদি দেখভাল করতে যায় তাহলে সমাজ তার আর দেবুর নামে কুৎসা রটাবে৷ প্রেমাস্পদের মিথ্যা কলঙ্ক সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবে না৷ তাই দেবুকে বলে—‘‘গাঁয়ের লোককে তো জান জামাই! এখন আমি বেশী গেলে-এলেই—তোমাকে জড়িয়ে নানান কুকথা রটাবে৷’’১৭৭ সে নিজে না গেলেও তার মাকে প্রত্যহ পাঠায় দুধ দিতে, পাতুকে দুবেলা পাঠায় খোঁজ-খবর নিতে৷ তার বন্দোবস্তে পাতু রাত্রে দেবুর বাড়িতেই ঘুমায়৷ চরিত্রগতভাবেও অনেক পরিবর্তন এসেছে তার—‘‘সে আর লীলাচঞ্চলা তরঙ্গময়ী নাই৷ আশ্চর্য রকমের শান্ত হইয়া গিয়াছে৷’’১৭৮
দুর্গা দেহব্যবসায়িনী হলেও একজন নারী৷ সে ভালো করে জানে একজন নারীর জীবনে বিপর্যয় কোন দিক থেকে নেমে আসে৷ তাই কামার অনিরুদ্ধ সাজামুক্তির পর নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে পদ্মর জন্য উৎকন্ঠা বেড়ে যায়৷ সে জানে পদ্মর উপর বহুদিন থেকে দুর্বৃত্ত ছিরু পালের নজর রয়েছে৷ অসহায় পদ্ম যদি উপায়ন্তর না দেখে তার কাছেই নিজেকে সমর্পণ করে তাহলে সেই দ্বিপদ শ্বাপদের বাড় আরও বেড়ে যাবে৷ দেবুকে তাই অনুরোধ করে পদ্মকে ছিরুপালের থাবা থেকে বাঁচানোর জন্য৷ দেবু তার খাওয়া পরার দায়িত্ব নিতে চায় কিন্তু তার দেখাশোনা করবে কে সেই চিন্তায় যখন ব্যাকুল তখন দুর্গার কথায় ফুটে উঠে নারী জীবনের চরম দর্শন—‘‘জান জামাই! মেয়েলোক নষ্ট হয় পেটের জ্বালায় আর লোভে৷ ভালবেসে নষ্ট হয় না—তা নয়, ভালবেসেও হয়৷ কিন্তু সে আর ক’টা? একশোটার মধ্যে একটা৷ লোভে পড়ে—টাকার লোভে, গয়না-কাপড়ের লোভে মেয়েরা নষ্ট হয় বটে৷ কিন্তু পেটের জ্বালা বড় জ্বালা, পণ্ডিত৷ তুমি তাকে পেটের জ্বালা থেকে বাঁচাও৷ কর্মকার পেটের ভাত রেখে যায় নাই, কিন্তু একখানা বগি-দা রেখে গিয়েছে; বলত, এ দা দিয়ে বাঘ কাটা যায়৷ সেই দাখানা পদ্ম-বউ পাশে নিয়ে শুয়ে থাকে৷ কাজ করে, কর্ম করে—দাখানা রাখে হাতের কাছাকাছি৷ তার লেগে তুমি ভেবো না৷ আর যদি দেহের জ্বালায় সে থাকতে না পারে, খারাপই হয়, তা হলে তোমার ভাত আর সে তখন খাবে না৷ চলে যাবে৷’’১৭৯ দুর্গার সেই যুক্তিপূর্ণ কথায় আস্বস্ত হয়ে দেবু সেদিন থেকেই পদ্মর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে৷
দুর্গার তার দেহব্যবসার সমস্ত বৃত্তান্ত অকপটে ব্যক্ত করে কামারবৌ-এর কাছে৷ দম্ভ করেই সে বলে—‘‘পেটের ভাত পরনের কাপড়ের জন্য দাসীবিত্তিও করতে নারব ভাই, ভিক্ষেও করতে নারব৷’’১৮০ ভিক্ষাকে বড় ঘৃণা দুর্গার৷ তার মতো নারীদের দেহব্যবসা বা ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া তৃতীয় কোনো পথ নেই৷ সে প্রথমটিকেই গ্রহণ করেছিল৷ কিছুতেই পরের মুখাপেক্ষী হয়ে চলবে না সে৷ দেবুর স্নেহ তাই তার চিত্তকে মাঝে মাঝে বিক্ষুব্ধ করে তোলে—দেবুর জন্যই যেন সে অত সহজে অভিসারে বেড়োতে পারে না৷ দুর্গা জাতিগতভাবে নিম্ন শ্রেণীর, দেহজীবী হিসেবেও অনেকে ঘৃণা করে তাকে৷ সেই অবস্থানগত বৈষম্যও কামারনির সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে ব্যক্ত করে সে—‘‘ওলো, আমি মুচীর মেয়ে; আমাদের জাতকে পা ছুঁয়ে পেন্নাম করতে দেয় না, ঘরে ঢুকতে দেয় না; আর আমারই পায়ে গড়াগড়ি সব! পাশে বসিয়ে আদর করে—যেন স্বগগে তুলে দেয়, বলব কি ভাই!’’১৮১ দুর্গা তার বিদ্রুপের খোঁচায় চরমভাবে বিদ্ধ করেছে প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে৷ যে বৈষম্যে সমাজ কখনো তাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয় না; তার শরীরকে ভোগ করার সময় সেই অচ্ছুৎ দেহই পরম আস্বাদনীয় হয়ে উঠে৷ তাই দুর্গার সকল বিদ্রোহ শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে; যে শোষক সমাজকে শোষণ করে; যে শোষক নারীকে শোষণ করে৷ শ্রীহরি, জমাদার, থানাদার, প্রেসিডেন্টসাহেব সকলের সঙ্গে প্রকাশ্যে শত্রুতা করে দেবুর মঙ্গলাকাঙ্খায়৷ দেবুর তালে তাল মিলিয়ে অত্যাচারীদের শাস্তি দিতে চায়৷
সমাজের মঙ্গল সাধনে মানুষের উপকার করতে গিয়ে তার ভেতরকার লাস্যময়ীসত্তাটি ধীরে ধীরে জাল গোটাতে থাকে৷ পদ্ম লক্ষ করে—‘‘আজকাল দুর্গা আর বড় একটা অভিসারে যায় না৷ বলে—ওতে আমার অরুচি ধরেছে ভাই৷ তবে কি করি, পেটের দায় বড় দায়! আর আমি না বললেই কি ছাড়ে সব? কামার-বউ, বলব কি—ভদ্দনোকের ছেলে—সন্দেবেলায় বাড়ীর পেছনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে৷ জানালায় ঢেলা মেরে সাড়া জানায়৷ জানালা খুলে দেখি গাছের তলায় অন্ধকারের মধ্যে ফটফটে জামা-কাপড় পড়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ আবার রাতদুপুরে—ভাই কি বলব, কোঠার জানালায় উঠে শিক ভেঙে ডাকাতের মত ঘরে ঢোকে৷’’১৮২ অর্থাৎ দুর্গা যেমন পেটের দায়ের জন্য দেহব্যবসা ছাড়তে পারে না তেমনি তার দেহলোভী স্বাপদেরাও সেই বৃত্তি থেকে তাকে সরতে দেয় না৷ দেবুর স্নেহধন্য হয়ে সে যখন তার অভিসার যাত্রাকে কমিয়ে দেয়, ঘরে লোক ঢোকানো প্রায় বন্ধ করে দেয় তখন দেখা যায় ভদ্রলোকের ছেলেরা তার শরীর ভোগের আর্তি নিয়ে জানালায় ঢেলা মারে, কেউ কেউ মাঝরাত্রে শিক ভেঙে ঘরে ঢোকে তার তনুসুধা পান করতে৷ একজন পণ্য রমণী যে ইচ্ছে করলেই তার পসরা উঠিয়ে দিতে পারে না সমাজের চাপে, সেই দিকের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন রচনাকার৷
দুর্গা স্বাধীনতার জন্য ভিক্ষাবৃত্তির বদলে দেহব্যবসা করে; কোনোকিছুর বিনিময়ে সে তার স্বাধীনতাকে হারাতে চায় না তাই দেবু যখন তাকে তার বাড়িতে থাকতে বলে মাইনে নিয়ে কাজকর্ম করার জন্য তখন তার মানসিকতাকে ব্যক্ত করেছেন রচনাকার ‘চাবুক খাওয়া ঘোড়ার মত’১৮৩ সে প্রতিবাদ করে বলে—‘‘ঝিয়ের কাজ তো আমি করতে পারি না, জামাই-পণ্ডিত৷ আমার বাড়ীঘর ঝাঁটপাটের জন্যে দাদার বউকে দিনে এক সের করে চাল দিই৷’’১৮৪ দেবু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে শ্যালিকা হিসেবে তাকে থাকতে বললে, অন্তত পঞ্চায়েত বসার আগের কদিন থাকার জন্য অনুরোধ করলে সমস্তটা বুঝতে পারে বিচক্ষণ দুর্গা৷ গ্রামে তাকে ও দেবুকে নিয়ে যে কুৎসা ছড়িয়ে গিয়েছে তা দুর্গার অবিদিত নেই এবং দেবু তার যথাযোগ্য জবাব দিতেই যে তাকে তার বাড়িতে থাকতে বলেছে সেটা বুঝতে বাকি থাকে না তার৷ শুধু তাই নয় সমাজকে অস্বীকার করে দেবু যখন তার হাতে জল খেতে চায় তখন পরম শ্রদ্ধায় দুর্গার চোখে জল চলে আসে৷ সে বলে—‘‘—না৷ সে আমি পারব না জামাই-পণ্ডিত৷ আমার হাতের জল কঙ্কণার বামুন-কায়েত বাবুরা নুকিয়ে খায়, মদের সঙ্গে জল মিশিয়ে দিই, মুখে গ্লাস তুলে ধরি—তারা দিব্যে খায়৷ সে আমি দিই—কিন্তু তোমাকে দিতে পারব না৷’’১৮৫ দুর্গা জানে দেবু সমাজকে শিক্ষা দিতেই দুর্গার কাছে জল খেতে চেয়েছে—উচ্চবর্ণের সেই ভালো মানুষটিকে তার ছোঁয়াচযুক্ত জল দিয়ে জাত নষ্ট করতে চায় না৷
ময়ুরাক্ষীর ভয়ঙ্কর বন্যায় বাঁধ রক্ষা করতে গিয়ে জলের তোড়ে দেবু ভেসে গেলে দুর্গা দেবুর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে৷ পরে আহত অবস্থায় সে উদ্ধার হলে মাকালীর কাছে তার প্রাণের জন্য আকুলভাবে মানত করতে দেখা যায় তাকে৷ পার্শ্ববর্তী গ্রামে তিনকড়ির বাড়িতে দেবুর শ্রশ্রূষার ব্যবস্থা হলে দেবুর বাড়ি-ঘরের তাদরকের সমস্ত দায়িত্ব সে স্বেচ্ছায় নিজস্কন্ধে তুলে নেয়৷ সুস্থ হয়ে পুনরায় যখন দেশপ্রেমের জোয়ারে সে মেতে উঠে তখন তার প্রধান সহায়কারী হয় এই বারবনিতাই৷ দুর্গার কারণে শ্রীহরির নেতৃত্বে সমাজ তাকে পতিত করলেও দেবু দুর্গাকে পরিত্যাগ করেনি৷ সহোদরার মতো দুর্গা তাকে সাহায্য করে গেছে, সাহায্য পেয়ে এসেছে৷ তিনকড়ির নেতৃত্বে লোকে সমাজের রায়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দেবুর পাশেই থেকেছে৷ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে দুর্গার মতো দেহপসারিণী নারীদের রক্ষার জন্য একটা শ্রেণী ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে, যে শ্রেণী তাদের মানুষ হিসেবে মূল্য দিতে সক্ষম দেহের কলুষতাকে মেনে নিয়েও৷ দেবুর সহায়তাতেই দুর্গা শেষ পর্যন্ত তার পায়ের তলার মাটিকে আঁকড়ে রাখতে পেরেছে৷
ন্যায়রত্ন ঠাকুরের নাতি বিশ্বনাথ মানবতার ধর্মে দীক্ষিত হয়ে পৈতা ছিঁড়ে ফেললে তা যেমন দুর্গাকে ব্যথিত করে তেমনি চৌধুরী মহাশয়ের ঠাকুর বিক্রির খবরেও সে কষ্ট পায়৷ বিশ্বনাথ চলে যাওয়ায় দেবুকে কাঁদতে দেখে সে যখন দ্বারিকা চৌধুরীর সেই খবর জানায় তা দেবুকেও বিহ্বল করে দেয়৷ এই সুযোগে কথার সূত্র ধরে দুর্গা আক্ষেপ প্রকাশ করে দেবুকে বলে—‘‘বিলু-দিদির বুন হয়েও আমি তোমার মন পেলাম না, আর লোকে সাধ্যি-সাধনা করে আমার মন পেল না৷’’১৮৬ সত্যই দুর্গা তার শরীর দিয়েছে অগণিত পুরুষকে কিন্তু মন সমর্পণ করেছিল একমাত্র দেবুকেই৷ দেবু তার কথাকে ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে চরম বিরক্তিতে তাকে ধমকে দিলে দুর্গা সেই ঠাকুর বিক্রয়ের খবর শোনার ইতিহাস ব্যক্ত করে৷ চৌধুরীর বড় ছেলে তার দেহভোগের জন্য দিন কয়েক থেকে ঘুরঘুর করছিল৷ দুর্গা ঠাট্টা করে তাকে বলেছে শরীর বিক্রয়ের মূল্য হিসেবে সোনার হার গ্রহণের কথা৷ চৌধুরীর কামদগ্ধ পুত্র তাতে সম্মত হয়ে বলেছে যে তার পিতা শ্রীহরির কাছে পাঁচশত টাকার বিনিময়ে কুলদেবতাকে বিক্রয় করেছে, সে অর্থ হাতে এলেই সে তাকে গহনা গড়িয়ে দেবে৷ সেই ঠাকুর বিক্রয়ের কার্য অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে হলেও দুর্গার কাছে কোনো সংবাদই গোপন থাকে না৷
স্পষ্টবক্তা দুর্গা কোনোদিনই অন্যায়ের সাথে আপোষ করেনি৷ সে তার শত্রু বা বন্ধু যেই করুক না কেন৷ বহুদিন পর অনিরুদ্ধ ফিরে এসে তার বিগত জীবন প্রসঙ্গে সে যখন সাবিত্রী নামের এক বারবনিতার সঙ্গে কাটানো উচ্ছ্বাসে ভরপুর সময়গুলিকে ব্যক্ত করে তখন দুর্গার অন্তকরণ পদ্মর কথা ভেবে মোচড় দিয়ে উঠে৷ সেই বারবনিতা তাকে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় সে যে পুনরায় গ্রামে ফিরে এসেছে সে কথা শুনে প্রবল অবজ্ঞায় অনিরুদ্ধকে বলে উঠে—‘‘তাতেই বুঝি পরিবারকে মনে পড়ল?’’১৮৭ দুর্গা প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে পদ্মর স্বামী পরিত্যক্ত অসহায় জীবনকে৷ অনিরুদ্ধ তার জন্য নিরাপদ আশ্রয় তো দূরের কথা ক্ষুধার অন্ন পর্যন্ত রেখে যায়নি৷ তার অবহেলায় ভেসে গিয়েছে পদ্মর মতো সহায়সম্বলহীন এক চরিত্রবান গৃহবধূ৷ সেই ক্ষোভেই চরম শ্লেষবাক্য ধ্বনিত হয় দুর্গার মুখে৷
সারাজীবন পুরুষের তীব্র দৈহিক উত্তাপকে অঙ্গে ধারণ করে এসেছে দুর্গা৷ আর দেবু ভুল করে বিলু ভেবে তাকে চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিলে সেই ভুলের অনুশোচনায় তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলে দুর্গাকে অবাক হতে হয় বৈকি৷ সেও জানে দেবু স্বেচ্ছায় তাকে স্পর্শ করেনি, সেই স্পর্শে কিছু মনেও করেনি সে কিন্তু সেই ভুলের আত্মগ্লানিতে তাকে কাঁদতে দেখে সবিস্ময়ে বলতে শোনা যায়—‘‘এর জন্যে তুমি কাঁদছ জামাই-পণ্ডিত!’’১৮৮ দুর্গা কল্পনাও করতে পারে না তার মতো একজন বারযোষিতকে ভুলবশত স্পর্শ করে কেউ কাঁদতে পারে৷ আর এই ভাবনা তাকে স্বাভাবিক করেছে; রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে৷
এরপর ঘটনার নানা ঘাত-প্রতিঘাতে প্রথমে গৃহত্যাগী হয়ে, পড়ে কারাবাস করে পুনরায় দেবু যখন নতুন মানুষ হয়ে গ্রামে ফিরে আসে তখন দুর্গাও আরেক মানুষ৷ ‘গণদেবতা’-য় জেল খেটে ফেরার পর দুর্গার মধ্যে যে রূপের আভাস পেয়েছিল তা পরিপূর্ণ রূপ পায় ‘পঞ্চগ্রাম’-এ জেলফেরত দেবুর দৃষ্টিতে৷ ক্ষারে-ধোওয়া সাদা থান পড়ে৷ নিরাভরণা শীর্ণদেহের লাবণ্য ও পারিপাট্যহীন দুর্গাকে দেখে দেবু বিস্মিত হয়ে যায়৷ পরম মমতায় স্নেহধন্য এই বারবধূকে জিজ্ঞেস করে—‘‘এ কি তোর শরীরের অবস্থা, দুর্গা? তুই এমন হয়ে গিয়েছিস কেন?’’১৮৯ লেখক দুর্গার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন—‘‘দুর্গার সব গিয়াছে—কিন্তু ডাগর চোখ দুইটি আছে, মুহূর্তে দুর্গার বড় বড় চোখ দুইটি জলে ভরিয়া উঠিল৷’’১৯০ ডাক্তার বলে—‘‘দুর্গা আর সে দুর্গা নাই৷ দান-ধ্যান—পাড়ার অসুখ-বিসুখে সেবা—’’১৯১ ডাক্তারের প্রশংসাকে মাঝপথেই থামিয়ে দেয় দুর্গা৷ অর্থাৎ উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে দুর্বিনীত স্বেচ্ছাচারিণী থেকে কামগন্ধহীন সেবাপরায়ণা মানবীতে রূপান্তরিত করেছেন লেখক৷ তার এই রূপান্তর সম্ভব হয়েছে দেবুকে ভালোবেসে, সমাজের ভালোমানুষগুলির মঙ্গলাকাঙ্খায়৷ প্রেমাস্পদকে সে লাভ করতে পারেনি; তার বিলুদিদির বর, তার হৃদয়ের অধীশ্বর স্বর্ণর করকমলে নিজেকে সমর্পণ করেছে; সেখানে তার স্থান নেই৷ তাই ঈশ্বরের কাছে আকুল আর্তি জানিয়ে মনে মনে নিবেদন করেছে যেদিন সাম্যের জোয়ারে ছোট-বড়র ছোট থাকবে না ছুত-অচ্ছুতের অচ্ছুৎ উঠে যাবে, ভালো-মন্দের মন্দ থাকবে না—‘‘সে দিন যেন জামাই তোমাকে আমি পাই৷ বিলু-দিদি মুক্তি পেয়েছে আমি জানি৷ স্বর্ণও যেন সেদিন মুক্তি পায়—নারায়ণের দাসী হয়৷ আমি আসব এই মর্ত্যে—তোমার জন্যে আসব, তুমি যেন এস৷ আমার জন্যে একটি জন্মের জন্যে এস৷ তোমার কথা আমি বিশ্বাস করলাম৷ করছি এই জন্যে৷ তোমাকে পাবার জন্যে৷’’১৯২ ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তিল তিল করে দুর্গার মধ্যে মঙ্গলময়ী নারীশক্তির প্রতিষ্ঠা করলেও তাকে অভিষ্ট লাভে বঞ্চিত করেছেন৷ একে নিম্ন শ্রেণীর অস্পৃশ্য তার মধ্যে আবার দেহজীবী! সাম্যবাদের গান শুনিয়ে তার সমস্ত সাধ-আহ্লাদ পূরণের জন্য পরজন্মকে রেখে দিয়েছেন৷ তারপরেও যে সম্মান যে কর্মভার আরোপ করে চরিত্রটিকে বিকশিত করেছেন, পঙ্কের মধ্যে থেকে ফুটিয়ে তুলেছেন পঙ্কজিনী হিসেবে তাতে এক দেহপসারিণী নারী চরম সার্থকতা লাভ করেছে৷ মানুষ হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা পেয়েছে সে৷ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার সম্পর্কে বলেছেন যে সমস্ত চরিত্র উপন্যাস মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অর্জন করেছে তাদের মধ্যে—‘‘তৃতীয় ব্যক্তি, দুর্গা মুচিনী৷ তাহার প্রকাশ্য স্বৈরিণীবৃত্তির মধ্য দিয়া অনেকগুলি সদগুণ ফুটিয়া উঠিয়াছে৷ তাহার সপ্রতিভতা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, হৃদয়ের উদারতা, প্রতিবেশীর দুঃখে-কষ্টে সহানুভূতি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াইবার সৎসাহস তাহাকে নীচকুল ও হেয় বৃত্তির গ্লানি হইতে অনেক ঊর্ধ্বে উন্নীত করিয়াছে৷’’১৯৩
বনফুলের ‘তৃণখণ্ড’ উপন্যাসে কথক ডাক্তারের চেম্বারে গা-ময় ঘা নিয়ে কপর্দকহীন এক রোগিনী প্রবেশ করে৷ চূড়ান্ত অবহেলায় ডাক্তার তাকে আন্দাজে সিফিলিসের প্রেসক্রিপশন ও একটা টাকা গুজে দিয়ে বিদায় করে দেয়৷ কিছুদিন পর এক সুন্দরী রমণী তার চেম্বারে উপস্থিত হলে ডাক্তার তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে সে তার সেই পূর্বের রোগিনী৷ তার নাম আসমানী৷ রঙবাজারে বাসস্থান৷ ডাক্তারের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সে একজন রূপোপজীবিনী৷ ডাক্তারের কাছে সে শুনতে এসেছে আরও ঔষধ তাকে খেতে হবে কি না৷ ডাক্তার আরেক শিশি ঔষধ কিনে খেতে বলে তাকে বিদায় করে দেয়৷ কিন্তু আসমানী চলে গেলে বিবেকের দংশনে দংশিত হয় সে৷ তার মনে হয়—‘‘এটাও কি ঠিক কাজ হইল? এমন একটা মোহিনী অগ্নি-শিখাকে সমাজে ছাড়িয়া দিয়া কি সৎকার্য করিলে! এ তো নিভিয়া গিয়াছিল প্রায়৷ আমি তো আবার তাহাকে জ্বালাইয়া তুলিলাম! উচিৎ হইল কি?’’১৯৪ এ প্রশ্ন ডাক্তারের সচেতন মন তার বিবেককে করেছে৷ সচেতন সত্তা এখানে সেই সমাজের প্রতিনিধি যারা দেহব্যবসায়ী নারীদের মানুষ ভাবতে পারে না৷ রোগজর্জর, মৃতপ্রায় রূপোপজীবিনীকে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে তার চিরাভ্যস্ত পরিবেশে ছেড়ে দিলে সচেতন মন যেন ভাবী এক বিপদের সম্ভাবনায় উদগ্রীব হয়ে উঠে৷ অন্যদিকে বিবেক তাকে মানুষের মর্যাদা দিয়ে আসমানীর দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণায় একাত্ম হয়ে যায়৷ এখানে বিবেক ও সচেতন মনের প্রেক্ষিতে দুই শ্রেণীর মানুষের দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়েছে৷ এক শ্রেণীর যারা গণিকাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, আরেক শ্রেণী খড়্গহস্ত হয়ে তাদের বিলুপ্তি সাধনে বদ্ধপরিকর৷ আর ডাক্তার তার চিকিৎসা করেছিল বলে চারিত্রিক দোষে দোষী হয়ে উঠে নিন্দুক সমাজের মধ্যে৷ হারাণদা লোক মুখে শুনে তাই বলে—‘‘তোমার নাকি স্বভাব-চরিত্রও আজকাল খুব খারাপ হয়ে উঠেছে৷ ভদ্রলোকের বাড়িতে না কি তোমাকে ডাকা বিপজ্জনক!’’১৯৫ কারণ হিসেবে জানায়—‘‘রং বাজারের একটা মাগি নাকি তোমার বাড়িতে সন্ধেবেলা আসে৷’’১৯৬ আসমানীর মতো রূপজীবা নারীরা সমাজে এতটাই অপাংক্তেয় যে তাদের চিকিৎসা করলে চিকিৎসককে পর্যন্ত সামাজিকভাবে দোষের ভাগীদার হতে হয়; চরিত্রদোষের অপবাদ ছড়ায়৷ যাই হোক মানসিক দ্বন্দ্ব, নিন্দুকের অপবাদ উপেক্ষা করে ডাক্তার আসমানী যক্ষা আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা করে যায় বিনা ‘ফি’ তে; যদিও জানে সে আর পৃথিবীতে বেশিদিন থাকবে না৷ তারপর হঠাৎই তার সম্মুখে হাজির হয় আসমানীর পিতা৷ যে লোকটি ডাক্তারের পূর্ব পরিচিত এবং বহুবার মিথ্যা অসুখের সার্টিফিকেট চেয়ে ডাক্তারকে বিভ্রান্ত করেছে৷ সে ডাক্তারকে জানায় যে আসমানীর অবস্থা বড়ই খারাপ৷ সে ‘‘বাড়ি থেকে এক ছোঁড়ার সঙ্গে পালিয়ে যায়৷ সেই থেকে খুঁজছি তাকে৷ সেই জন্যই অসুখের মিথ্যে সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়ে ছুটি নিচ্ছি৷ আমার অসুখ-টসুখ সব মিছে কথা৷ আমার আসল অসুখ এই৷’’১৯৭
আসমানী এক যুবকের মিথ্যা মোহে ঘর ছেড়ে বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করেছে৷ সমাজের সুস্থ পরিবেশ থেকে চ্যুত হয়ে ঘৃণ্য পরিচয় গ্রহণ করেছে৷ তবু তার ঘরে ফেরার পথ রুদ্ধ করেননি রচনাকার৷ আসমানীর বাবা চাকরি থেকে অসুখের মিথ্যে সার্টিফিকেট দেখিয়ে ছুটির পর ছুটি নিয়ে মেয়ের সন্ধানে ফিরেছে৷ শেষপর্যন্ত যখন তাকে খুঁজে পেয়েছে তখন তার অন্তিম দশা৷ কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে পিতার ক্ষমাসুন্দর ব্যাকুলতা তাকে পতিতা হওয়ার গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছে৷ অর্থাৎ লেখক অত্যন্ত সহানুভুতির সঙ্গে আসমানীর বা তার মতো পতিতা নারীদের ঘরে ফেরার দিক নির্দেশ করেছেন৷ শুধু আসমানীই নয় এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে আরেক ভ্রষ্টা গৃহবধূর কথা৷ প্রৌঢ় নয়ন মল্লিকের তৃতীয় পক্ষ সে৷ কম বয়সি এই বধূটি আত্মীয় শ্যামলালের সাহায্যে ভ্রষ্টা হয়েছে৷ সাধারণত এযাবৎ যত উপন্যাস পর্যালোচনা করা হয়েছে সেখানে ভ্রষ্টা স্ত্রীদের পুনরায় সংসারে ফেরানো সম্ভব হয়নি৷ সমাজে সেই কুলত্যাগিনী রমণীদের কোনো স্থান হত না কিন্তু ‘তৃণখণ্ড’-এ বনফুল নতুন ভাবে পথনির্দেশ করেছেন৷ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তাদের সামায়িক ভুলকে পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতে ফিরে আসার এক সম্ভাবনাকে পুনরুজ্জীবিত রেখেছেন৷ তাই তো নয়নবাবু ডাক্তারকে চিঠিতে লিখেছে—‘‘আমার নগদ দেড়লক্ষ টাকা এবং বিষয়-সম্পত্তি কোনও সৎকার্যে দান করিয়া যাইতে চাই৷ আমি একটা উইল করিতে চাই যে আমার পত্নী—যেখানেই থাকুন—আমার সম্পত্তি হইতে ভরণ-পোষণ খরচা পাইবেন৷ তাঁহাকে আমি ভালবাসিতাম৷ একটা ভুল করিয়াছেন সত্য৷ কিন্তু উদরের দায়ে যে সে ভুলটাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিতে বাধ্য না হন—এই আমার অভিপ্রায়৷ আমিও ভুল করিয়াছিলাম—এই বয়সে একটা কচি মেয়েকে বিবাহ করিয়া! ভুলের কিছু প্রায়শ্চিত্ত করিয়া যাইতে চাই৷’’১৯৮
নারীরা চিরকাল যা ভুল করে এসেছে তার বহুগুণ বেশি শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে তাদের৷ পুরুষ নিরব ঔদাসীন্যে তাদের কঠোর পরিণতিতে ইন্ধন যুগিয়ে এসেছে৷ আলোচ্য উপন্যাসে লেখক সে পথ থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়েছেন৷ তিনি দেখিয়েছেন অপরাধ করলে পুরুষকেও তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়৷ কয়েকগুণ বেশি বয়সি নয়ন মল্লিক একটা কচি মেয়েকে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে গ্রহণ করলে, সে যখন পরপুরুষের হাত ধরে চলে যায় তখন বুঝতে পেরেছিল অন্যায়টা তার দিক থেকেই হয়েছিল৷ তার প্রৌঢ় পুরুষত্বে সন্তুষ্ট হতে পারেনি সেই কিশোরী বধূ; যদিও সন্তুষ্ট হওয়া সম্ভবও ছিল না৷ পুরুষ হয়ে এই ভুলটুকু যে নয়ন মল্লিক বুঝতে পেরেছিল তাতে নারী জীবনের অগ্রগতির পথ অনেক বেশি প্রশস্ত হয়ে গিয়েছিল৷ পুরুষ চিরকাল নারীকে দমন করে এসেছে৷ নানা বিধি-নিষেধের বেড়াজাল তৈরি করে তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে৷ নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে অবলা নারী সমাজের উপর৷ নয়ন মল্লিক সে দিক থেকে ব্যতিক্রম৷ সে শুধু নিজের ভুল বুঝেই ক্ষান্ত হয়নি তার ভ্রষ্টা স্ত্রীর ভরণ-পোষণের সুষ্ঠু বিলি ব্যবস্থা করে গেছে—যাতে প্রবৃত্তির অসচেতন খেয়ালিপনায় তার বাকি জীবনটা নষ্ট না হয়ে যায়৷ গণিকা নারীদের চারিত্রিক ও সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাসে এই মানসিকতা নিঃসন্দেহে সুফলদায়ী৷
‘বৈতরণী তীরে’ উপন্যাসের বিন্দি তার গণিকা জীবনের জ্বালা যন্ত্রণার ইতিহাস বিবৃত করেছে অপঘাতে মৃত্যুর পর শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে ডাক্তারের কাছে৷ বিন্দির ব্যঙ্গ মিশ্রিত কথায়, অতৃপ্ত জীবনের জ্বালায় চরম প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে৷
বিন্দিবাইজির পূর্ব নাম বিনোদিনী৷ তাকে গণিকাবৃত্তিতে ঠেলে দিয়েছে তার লম্পট স্বামী এবং তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থা৷ আচারনিষ্ঠ দরিদ্র ব্রাহ্মণ মাতার কন্যা বিনোদিনীকে নয় বছর বয়সে এক ধনী যুবকের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে গৌরীদানের পুণ্য অর্জন করেছিল তার মা৷ অসামান্য রূপবতী এই বালিকার মদ্যপ-বিলাসী যুবকের হাতে পড়ে সমস্ত সৌকুমার্য পিষ্ট হয়ে যায়৷ তার রূপ-নিষ্ঠার কোনো দাম ছিল না সেই স্বেচ্ছাচারী গণিকাসক্ত স্বামীর৷ অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে লিভার দূষিত হয়ে যখন কপর্দকশূন্য অবস্থায় তাকে ফেলে সেই স্বামীরত্নটি স্বর্গে চলে যায় তখন বিনোদিনীকে গ্রাস করে অর্থ যন্ত্রণা৷ বিন্দি যেমন ডাক্তারের কাছে আক্ষেপ করে বলেছে যে কোনো গরীবের হাতে পড়লে তার হয়তো অমন দুর্গতি হত না তেমনি বৈধব্যে চরম সংকটে তার মনে হয়েছে বিধবা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে সতীদাহতেই নারীর অধিক মঙ্গল৷—‘‘আমাদের দেশে সতীদাহ প্রথাই ঠিক ছিল—স্বামীর সঙ্গে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলত—বাস নিশ্চিন্ত! এ রকম দগ্ধে দগ্ধে মরতে হত না! এই দেশে কখনও সতীদাহ প্রথা লোপ পেতে পারে? আজও এ দেশের ঘরে ঘরে বিধবা সতীরা পুড়ে মরছে৷ আগুনের চেহারাটা শুধু বদলেছে৷ আগে ছিল চিতানল—এখন হয়েছে তুষানল৷’’১৯৯ এই বারযোষিৎ সমাজের প্রতি আঙ্গুল তুলে তার নিষ্ঠুর ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করেছে৷ সতীদাহ বন্ধ করে মেয়েদের প্রত্যক্ষ মৃত্যু থেকে বাঁচানো হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার বিনিময়ে বৈধব্যের ভয়াবহ যন্ত্রণা দিয়ে যেভাবে তিলে তিলে মারার ব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছে তার চেয়ে সতীদাহ বোধ হয় অনেক বেশি ভালো ছিল৷ বিন্দির এই কথার মধ্যে সমাজের কতবড় এক অসঙ্গতি যে চিহ্নিত হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ যাইহোক একদিকে অনাহারে মৃত্যু আরেক দিকে অন্নের থালা হাতে নিয়ে তার দেহকে ভোগ করার জন্য পুরুষের লোলুপ আহ্বান—বিন্দি মরতে পারে না; আরও বহু কিছু দেখার হয়তো বাকি ছিল তাই পুরুষের উদোম কামনার কাছেই নিজেকে সমর্পণ করে৷ তার স্বামীর মামাতো ভাই পুলক ঠাকুরপোই হয় তার প্রথম প্রেমিক৷ তারপর বিন্দিকে আর থেমে থাকতে হয়নি৷ পুরুষের পর পুরুষ তার সেই কমনীয় দেহটাকে উপভোগ করেছে৷ নিজেকে ফুটবলের সঙ্গে তুলনা করে বলেছে—‘‘আমি যেন একটা ফুটবল—আমায় ঘিরে সুদক্ষ একদল খেলোয়াড়; সবারই লোলুপ দৃষ্টি আমার ওপর—কিন্তু আমাকে কাছে পাওয়া মাত্র লাথি মেরে তারা দূর করে দিয়েছে! দূর করে দিয়ে আবার ছুটেছে আমার পেছনে আমাকে ধরবে বলে! এ কি আশ্চর্য ব্যাপার বলুন তো!’’২০০
বিনোদিনী বিন্দিবাইজি হয়ে কামনায়-ভোগে মর্ত্যলোককেই নরক করে তুলেছিল এবং সে নরক গুলজার হয়েও উঠেছিল তার দ্বারা৷ তার সেই সামান্য দেহটা নিয়ে কি করে যে অসংখ্য পুরুষকে মুগ্ধ করেছিল তাতে নিজেই বিস্ময় না মেনে পারে না৷ পুরুষের পর পুরুষ এসেছে তার কাছে, ভালোবাসার ভান করে তাদের শরীরী ক্ষুধা নিবারণ করেছে কিন্তু তার প্রেমবুভূক্ষ হৃদয় এতটুকু শান্ত হয়নি৷ সে সত্যকারের প্রেম দিয়ে নিজের হৃদয়ের আগুনকে নেভাতে চেয়েছে কিন্তু জল পায়নি৷ তার নিজের কথাতেই তার প্রতিধ্বনি—‘‘এই তুষানল নেভাবার নানা চেষ্টা আমি করেছি—জল পেলাম না৷’’২০১ বিনোদিনী স্বচ্ছ জলের সন্ধানে পচা নর্দমা ঘেটে বেড়িয়েছে৷ আসলে গণিকাদের কেউ ভালোবাসতে পারে না৷ সকলেরই লোভ তাদের শরীরের প্রতি৷ আর সেই ভ্রষ্টা নারীদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে সত্যকার ভালোবাসার৷ বিন্দিকে কেউ ভালোবাসেনি কিন্তু সকলেই তার কাছে শরীরী উত্তাপের সঙ্গে প্রেমের পেলবতা প্রার্থনা করেছে৷ বিন্দির কথার মধ্যে এমন দিকের প্রতিও আলোক বর্ষিত হয়েছে—‘‘কি আশ্চর্য এই পুরুষ মানুষগুলোর প্রবৃত্তি! তারা ঘরে সতী স্ত্রী ফেলে আমাদের কাছে ছুটে আসে৷ আমার স্বামীও যেতেন শুনেছি৷ পুরুষদের ষোল-আনা লোভ এই অসতী মেয়েগুলোর প্রতি!—অসতী জেনেই তারা আমাদের কাছে আসে অথচ এসেই একনিষ্ঠতা দাবি করে বসে৷ আর আমরাও টাকার লোভে একনিষ্ঠতার অভিনয় করতে থাকি৷’’২০২ এখানে পুরুষের গণিকাগমনের মনস্তাত্ত্বিক দিকটিও প্রতিভাত হয়েছে৷ পুরুষেরা জানে বিন্দি বা বিন্দির মতো নারীরা বহুভোগ্যা৷ অর্থের বিনিময়ে তাদের ভালোবাসা৷ অথচ যেখানে একনিষ্ঠতা পাওয়ার কথা (ঘরের স্ত্রী) সেখানে তা না খুঁজে সেই একনিষ্ঠতার সন্ধান চায় বেশ্যাদের কাছে৷ টাকার বিনিময়ে বেশ্যার একটু বেশি অনুগ্রহ লাভ করলে সেই মুহূর্তে যেন উতরে যায় তারা৷
গণিকাদের জীবনেও অবসাদ আসে৷ বিন্দিবাইজির মতো নর্দমা ঘাটতে ঘাটতে স্বচ্ছ জলের পিপাসা যখন তাদের বুকের ছাতিকে একেবারে শুকিয়ে ফেলে তখন চরম নির্বেদ তাদের আরেক জগতে ঠেলে দেয়৷ সে জগৎ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর জগৎ৷ জীবনকে আর একটু দেখার তাগিদে যে বিনোদিনী একদিন মৃত্যুর বদলে যৌনবৃত্তিকে গ্রহণ করেছিল; ধীরে ধীরে সমাজ-জীবনের বিভৎস নগ্নতা তাকে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে ফেলে৷ তাই গলায় দড়ি দিয়ে তার ইতিরেখা টানতে হয় তাকে৷ বিন্দি সমাজের চরম নিষ্পেষণের শিকার৷ মৃত্যুর পরে লাশকাটা ঘরে ডাক্তারের কাছে সেই ইতিবৃত্ত ব্যক্ত করে পুরুষ সমাজের উপর সমস্ত দায় চাপিয়ে দিয়েছে৷ একজন গণিকা নারীর এভাবে সমাজের নগ্নতাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা নিঃসন্দেহে তার মানসিক শক্তিকে বিধৃত করে৷ সমাজের কঠোর নিয়ম, নানা ধর্মীয় আচার, গৌরীদান, সতীদাহ ইত্যাদির সমালোচনা রচনাকার সুদক্ষভাবে একজন বারযোষিতকে দিয়ে সম্পন্ন করিয়েছেন৷ যে অতৃপ্ত তৃষ্ণা তাকে পৃথিবীর বন্ধন ছিন্ন করিয়েছে মৃত্যুর পরপারে লাশকাটা ঘরে অবশেষে সেই নিষ্কলুষ ঝরণাধারার খোঁজ পেয়েছে৷ যে পুথি-কেতাবের প্রেমের কাহিনি এতদিন তার কাছে নিরর্থক হয়েছিল তা স্বার্থকতার পথে অগ্রসর হতে পেরেছে৷ তাই ডাক্তারকে বলেছে—‘‘সেদিন সেই কবিকে ঠাট্টা করলাম বটে—কিন্তু সে ঠিকই বলছিল বোধ হয়৷ জীবনে প্রেমের আবির্ভাব হলে ক্ষুদ্র জলাশয় সমুদ্র হয়ে ওঠে৷ লোহা সোনা হয়ে যায়৷ সেদিন সেই যে ছেলেটি দেখলাম আপনার কাছে—কোথায় সে!—আহা ঠিক যেন ঝরণা!’’২০৩ পচা নর্দমার বদলে ঝরণার সন্ধান বিন্দিকে মৃত্যুর পরে আশান্বিত করেছে৷ তাকে পাওয়ার জন্য পুনরায় সুদৃশ্য খোঁপায় বেলফুল গুজে গালে-ঠোঁটে রঙ মেখে টানা টানা চোখে কাজলরেখা টেনে মখমলের ফিনফিনে শাড়ি পড়ে অভিসারিকা সেজেছে বিন্দিবাইজি৷ লেখক বিন্দির অতৃপ্ত জীবনে মৃত্যুর পরে হলেও তৃপ্তির আভাষ দিয়েছেন৷
বিন্দির মতো নারীদের শরীর যে পুরুষের কাছে কতটা উপাদেয় তা তার এক খদ্দেরের প্রেতাত্মার ভাষণে সুস্পষ্ট৷ খদ্দেরের চোখে গণিকা নারীদের অবস্থানকে তুলে ধরেছেন লেখক৷ সেই প্রেতাত্মা বিন্দির গলার আওয়াজ পেয়ে ডাক্তারকে বলে—‘‘আমাদের বিন্দির গলার আওয়াজটা যেন শুনলাম৷ আমাদের বিন্দি বাইজী৷ চেনো তাকে? ভাল নাম বোধহয় বিনোদিনী! বেড়ে নাচে বেটি! ওর কোমর ঘোরান যদি দেখ একবার৷ একখানি ‘চিজ’—মাইরি বলছি—৷’’২০৪ এই শ্রেণীর কামুক পুরুষের মাঝে বিন্দি মানুষ নয় একখানি ‘চিজ’ অর্থাৎ ব্যবহার্য বস্তুর তুল্য৷
বনফুল এই উপন্যাসে শুধু মাত্র বিন্দির অতৃপ্ত গণিকা জীবনকেই তুলে ধরেননি; গণিকার মধ্যেও যে নারী জীবনের কোমল প্রবাহ ফল্গুর মতো বহমান থাকে তার প্রতিও দৃষ্টিদান করেছেন৷ তার সেই জলের আর্তি যেমন অতৃপ্ত নারীসত্তার অস্পষ্ট হাহাকার তেমনি বিন্দির ঝরণা সেই অ্যানার্কিস্ট ছেলেটি দীর্ঘাকৃতি কালো লোকটির দ্বারা আক্রান্ত হলে তার নারীমন সুস্পষ্টভাবে আর্তনাদ করে উঠে৷ সে নতজানু হয়ে তাকে মিনতি করতে থাকে—‘‘যেই হই তুমি ওকে ছেড়ে দাও—ওগো তোমার দুটি পায়ে পড়ি!’’২০৫ এবং শেষে দেখা যায় বিন্দি সেই ছেলেটির মাথা কোলে নিয়ে বসে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে—‘‘তাহার কাপড় রক্তে রাঙা—যেন হোলি খেলিয়াছে!’’২০৬ হৃদয়ের সেই কাঙ্খিত পুরুষকে বাঁচানোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, অবশেষে অক্ষম পরাজয়ে তার মাথা কোলে নিয়ে বসে চোখের জলে বুক ভাসানো প্রিয় হারানোর ব্যথায় জর্জরিত নারীর পরিপূর্ণ মূর্তিরূপে প্রতিভাত৷
‘বৈতরণী তীরে’-র বিন্দিবাইজি মানসিকতার দিক দিয়ে বহুদূর এগিয়ে৷ সে দেহব্যবসা করেছে ঠিকই তার সঙ্গে তিল তিল করে সেই বৃত্তির বিভৎস অভিজ্ঞতাগুলোকে স্মৃতির ঘরে সুনিপুণভাবে গ্রন্থিত করেছে, আর চরম অতৃপ্তিতে গলায় দড়ি দিয়ে মরার পর লাশকাটা ঘরে ডাক্তারের কাছে এক এক করে তার গ্রন্থি মোচন করেছে৷ তার সকল অভিযোগের তীর পুরুষ শাসিত সমাজের বিরুদ্ধে; পুরুষ আশ্রিত ধর্মের বিরুদ্ধে৷ সমাজকে এইভাবে দেখার ক্ষমতা তাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে৷
‘জঙ্গম’-এর মুক্তো পুরোদস্তুর বেশ্যা৷ কেরানিবাগানের উনিশ নং বস্তির আঠারো নং ঘরে তার বাস৷ সেই পল্লীতে মুক্তোর মতো আরও অনেক বারযোষিৎ (যেমন টিয়া, আঙ্গুর প্রমুখ) বসবাস করে৷ তারা সকলে দলবদ্ধভাবে বিচিত্র সজ্জায়, বিচিত্রভঙ্গিতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খদ্দের ধরে—অর্থের বিনিময়ে সেই কামতাপিত পুরুষদের যৌনক্ষুধা নিবারণ করে৷ হাওড়া স্টেশনে ছোট্ট এক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে শঙ্কর তাদের উপকার করে আমন্ত্রিত হয়েছিল৷ সেদিন সেই ষোড়শী নারীর অঙ্গস্পর্শ অন্য এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল নায়ক শঙ্করের দেহে৷ বহুদিন পর সেই নিমন্ত্রণের সূত্র ধরে শঙ্কর আঠারো নং কেরানি বাগানে উপস্থিত হয়ে পূর্বের দেখা সেই মেয়েটিসহ অনেকগুলি মেয়েকে সুসজ্জিত হয়ে বঙ্কিমভঙ্গিতে লাইট পোষ্টের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের প্রকৃত স্বরূপ সম্পূর্ণভাবে অবগত হয়৷ একজন শিক্ষিত ভদ্র যুবকের সেই কামপুরীতে হঠাৎ করে উপস্থিত হয়ে যা অবস্থা হওয়ার কথা শঙ্করেরও তাই হয় তাদের দেখে৷ শুধু মনে হতে থাকে—‘‘যেন তাহার তালু শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, নিদারুণ তৃষ্ণায় বুক ফাটিয়া যাইতেছে৷’’২০৭ শেষ পর্যন্ত জলই চেয়ে বসে মুক্তোর কাছে৷ আর মুক্তো যে কিনা পাকা দেহব্যবসায়িনী হিসেবে বহু পুরুষ চড়িয়ে খেতে অভ্যস্ত, শঙ্করের অবস্থা উপলব্ধি করতে কোনো অসুবিধা হয় না তার৷ যদিও প্রথমে তার ‘আপনি’ সম্বোধন শুনে গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল পরে পুরো অবস্থা বুঝতে পেরে শুধু মুচকি মুচকি হাসতে থাকে৷ শঙ্করকে জল দিতে নিজের ঘরে নিয়ে গেলে অন্য সঙ্গিনীরা তার সৌভাগ্যে এবং নিজেদের দুর্ভাগ্যে হতাশা ব্যক্ত করে৷ কারণ তারা দেখে মুক্তো ভাগ্যগুণে খুব তাড়াতাড়ি খদ্দের পেয়ে গেছে কিন্তু তাদের আর কতক্ষণ ভোগান্তি আছে তা কেউ জানে না৷ একজন গণিকার কাছে তার খদ্দের লক্ষ্মী৷ তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই বারযোষিতকুলের জীবন অতিবাহিত হয়৷ তাই লক্ষ্মী লাভের আশায় সকলে উন্মুখ হয়ে থাকে৷
শঙ্কর মুক্তোর ঘরে প্রবেশ করে তার হাওড়া স্টেশনের সমস্ত বৃত্তান্ত ব্যক্ত করে৷ মুক্তোর সমস্তটা মনে পড়ার পরেও তা অস্বীকার করে এবং তাকে জল দিয়ে ঘন্টা পিছু দু’টাকা করে রেট জানিয়ে দেয়৷ হতভম্ব শঙ্কর পকেট থেকে একটা দশটাকার নোট বের করে দিলে খলখল করে হেসে লুটিয়ে পড়ে তা নিতে অস্বীকার করে বলে—‘‘না, ছি, আপনি অতিথি মানুষ, আমাদের নেমন্তন্ন পেয়ে এসেছেন বলছেন, আপনার কাছে কি টাকা নিতে পারি? সব জায়গায় কি আর ব্যবসাদারি চলে?’’২০৮ মুক্তোর রহস্যময়ীর মতো শঙ্করকে খেলিয়ে চললেও তার সৌজন্যকে কোনোভাবেই চাপা রাখতে পারে না৷ তাই নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট হওয়ার পরেও তার কাছ থেকে কৃতঘ্ন হয়ে টাকা নিতে পারে না৷ মুক্তোর এই সৌজন্যবোধ তার মানবিক গুণাবলীর পরিচায়ক৷ আমাদের সমাজব্যবস্থা মুক্তোর মতো রূপজীবাদের যতই পিশাচিনী ভাবুক না কেন; মানুষের মর্যাদা থেকে যতই তাদের দূরে সরিয়ে রাখুক না কেন, তাদের মানবিক গুণাবলী অন্যান্য মানুষের তুলনায় কিন্তু কোনো অংশেই কম নয়৷
এই বারযোষিৎ-এর ঘরে শুয়ে শুয়ে শঙ্কর নিবিষ্ট মনে পর্যবেক্ষণ করে গৃহসজ্জার পারিপাট্যকে৷ তার ঘরের বর্ণনা দিয়ে লেখক বলেছেন—‘‘মুক্তোর ঘরখানি ছোট, কিন্তু বেশ গোছানো৷ দুইখানি তক্তপোশ রহিয়াছে, একখানি অপেক্ষাকৃত নীচু ও ছোট, অপরটি উঁচু ও বড়৷ বড় খাটটিতে পুরু গদি, ফরসা চাদর, ফরসা বালিশ৷… ছোট গ্লাসকেসটি বেশ পরিচ্ছন্ন, নানা রঙের রঙিন শাড়ি পাট করা রহিয়াছে অনেক৷ দেওয়ালে নানা রকম ছবি—শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ, মেম-সাহেব, কালীঘাটের পট, পুরীর জগন্নাথ! গত কার্তিক-পূজার কার্তিকের ময়ূরের পালকগুলি এক কোণে টাঙানো আছে৷ এক ধারে একটি আলনা৷ আলনায় মুক্তোর নিত্য-ব্যবহার্য কাপড়-জামা এবং তাহারই এক ধারে একটি লুঙ্গি ও গেঞ্জি ঝুলিতেছে৷’’২০৯ মুক্তোর এই সুসজ্জিত ঘরখানা তার সুন্দর মনের পরিচয়কে গ্রহণ করে৷ কারণ মন অগোছালো হলে অত সুন্দর পরিপাট্যে কেউ গৃহ সাজাতে পারে না৷
মুক্তোর প্রতিদিনকার জীবন-যাপনের মধ্যে শঙ্কর লক্ষ করেছে মানুষের পরিপূর্ণসত্তাটিকে৷ সে হাসে, নাচে, গান গায়, মদ খায়, বিকেলে গা ধুয়ে প্রসাধন সম্পূর্ণ করে রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়, ভঙ্গিভরে সিগারেট টানে, কথায় কথায় খিল খিল করে হাসে, রেগে গেলে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে, অন্ধ-আতুর দেখলে পয়সা দেয়, গঙ্গাস্নান করতে যায়, মেনি বিড়ালকে আদর করে, তার বাঁধাবাবু দশরথের জন্য যত্ন করে হাঁসের ডিমের ডালনা রান্না করে৷ সে দুই-এক পয়সার জন্য ইতরের মতো চপ-কাটলেটওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করে আবার ঘরের মধ্যে মদের বোতল লুকিয়ে রেখে সুযোগ বুঝে তা দুর্মূল্যে বিক্রয় করে৷ তার এই দোষ-গুণসম্পন্ন রহস্যময় সত্তাটিকে শঙ্কর ঠিকঠাক অনুধাবন করতে পারে না৷ রহস্যের আবরণে থেকে সে যেন জানা-না জানার সীমার মধ্যে অহরহ খেলে বেড়াতে থাকে৷ কিন্তু সেই মুক্তোই যখন ফালি বারান্দাটুকুতে বসে দুপুরবেলায় রোদে পিঠ দিয়ে চুল শুকায় তখন যেন তাকে একটু একটু করে চেনা যায়৷ তার মনে হয়—‘‘উহাই যেন তাহার জীবনের সত্য আকাঙ্ক্ষা, ও যেন আর কিছু চায় না, নিশ্চিন্ত চিত্তে নিজের ঘরের দাওয়াটিতে বসিয়া রোদে পিঠ দিয়া চুল শুকাইতে শুকাইতে প্রতিবেশিনীর সঙ্গে সুখদুঃখের আলোচনা করিতে চায়৷’’২১০ অর্থাৎ মুক্তোর সঙ্গে মেলামেশা করে শঙ্কর বুঝতে পেরেছে তার যে গণিকাসত্তা সেখানে সে স্বাভাবিক নয়৷ তার চিরন্তনী নারীসত্তার আভাস পাওয়া যায় রোদে পিঠ দিয়ে চুল শুকানোর সময়৷ লেখক তার পণ্যরূপের খোলস ছিঁড়ে তার ভেতরকার নারীরূপকে বের করে আনতে সচেষ্ট হয়েছেন৷ প্রথম প্রথম শঙ্কর সেই গণিকাপল্লীতে একজন বেশ্যার গৃহে নিজেকে আবদ্ধ দেখে নিজের প্রতি ধিক্কার জানিয়েছিল, তার ভদ্র অন্তকরণ দ্বিধায় জর্জরিত হয়েছিল কিন্তু ধীরে ধীরে সে ধারণা কেটে যায়৷ প্রত্যক্ষভাবে অত্যন্ত কাছ থেকে তাদের জীবনকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারে সেখানকার বাসিন্দারা ঘৃণ্য পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকেও মানসিকভাবে কোনোমতেই ঘৃণার যোগ্য নয়৷ তাই শঙ্করের কাছে—‘‘মুক্তো গণিকা—এই কথাই বড় নয়, মুক্তো নারী—এই কথাই বড়৷ শুধু নারী নয়, লাঞ্ছিতা অবনমিতা নারী৷ সমাজের অত্যাচারে, পারিপার্শ্বিক ঘটনার চাপে নিতান্ত নিরুপায় হইয়া উদরান্নের জন্য দেহ-বিক্রয় করিতেছে৷ উহাকে উদ্ধার করিতে হইবে৷ পঙ্ক হইতে পঙ্কজিনীকে আহরণ করিয়া প্রেমের মন্দিরে নির্মাল্য রচনা করিতে হইবে৷’’২১১ লেখক মুক্তকন্ঠে শঙ্করের মতো শিক্ষিত চরিত্রের মধ্য দিয়ে একজন পতিতা নারীর জীবনের বাধ্যবাধকতাকে উল্লেখ করেছেন৷ এভাবে শঙ্করের মধ্যে দিয়ে যে চেতনার সঞ্চার করেছেন রচনাকার তা যদি আরও বেশি বিস্তৃত হয়ে যায় তাহলে পতিতা নারীদের জীবন যন্ত্রণার কিছুটা হলেও উপশম হয়৷ শঙ্কর যেমন কাছ থেকে মুক্তোদের জীবনকে দেখেছে তেমনি মিষ্টিদিদির মতো শিক্ষিত ভদ্র রুচির নারীদের প্রবৃত্তির নগ্নরূপকেও প্রত্যক্ষ করেছে৷ তাই তার মনে হয়—‘‘মুক্তো গণিকা বটে, কিন্তু মুক্তোকে দেখিয়া তো ঘৃণা করিতে প্রবৃত্তি হয় না! সে রূপোপজীবিনী, ওই তাহার পেশা৷ মিষ্টিদিদির মত ছদ্মবেশী ঘৃণ্য জীব সে নয়৷’’২১২
মুক্তো এককালে কুলবধূ ছিল৷ স্বামীর প্রতারণায় সে বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করেছে৷ তার স্বামী যতীন হাজরা মিথ্যা কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে তাকে পরিত্যাগ করে বিয়ে করেছিল চুনচুনকে৷ পুরুষের সেই নির্মম অবমাননা মেনে নিতে পারেনি মুক্তো—যে অসতীর মিথ্যে তকমা দিয়ে তার স্বামী তাকে পরিত্যাগ করে, প্রতিশোধ নিতে সেই অসতীত্বের বৃত্তিই সে বেছে নেয়৷ কারণ সে বুঝে গিয়েছে মেয়েদের জীবনের কোনো সুরক্ষা নেই৷ স্বামী অন্য নারীর জন্য তাকে অসুরক্ষিত জীবনতরঙ্গে নিক্ষেপ করেছে সেখানে তার বড় শত্রু সতীত্ব৷ সতীত্বের বেশি একজন নারীর কি হারানোর আছে৷ সেই সতীত্বকেই সে বিলিয়ে দেয় পুরুষ সমাজের কাছে সামান্য অর্থের বিনিময়ে৷ ঠাঁই নেয় কেরানিবাগানের পতিতাপল্লীতে৷ দশরথকে বাঁধা বাবু করে তার ধরাবাঁধা সময়ের বাইরে অন্যপুরুষের সঙ্গেও নিজেকে বিলিয়ে দেয়৷ কারণ দশরথের সময় ছিল রাত্রি দশটা থেকে সারারাত৷ তার বন্দোবস্তে রাত্রি দশটা পর্যন্ত মুক্তো অন্য লোক ঘরে তুলতে পারে কিন্তু তার বাইরে নয়৷ আর যদি কোনোদিন সে না আসে সেদিনও তার ছুটি৷ মুক্তোর সেই বাসস্থানকে নরকের সঙ্গে উপমিত করে তাকে সেই নরককুণ্ড থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে ক্রুদ্ধ হয়ে যায় সে৷ শঙ্করকে বলে—‘‘আস্পর্ধা তো কম নয় আপনার! এ নরকে এসে আমাদের উপকার করবার জন্য কে পায়ে ধরে সেধেছিল আপনাকে, শুনি? কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল? নরক! আপনাদের সগগে আপনারাই থাকুন গিয়ে, আমরা সেখানে যেতে চাই না, সেখান থেকে পালিয়ে বেঁচেছি আমরা৷’’২১৩ মুক্তোর এই কথার মধ্যেও তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থার প্রতি বিদ্রোহ ধ্বনিত হয়েছে৷ সে কোনো এক সময়ে ভদ্র সমাজের একজন হিসেবে অবস্থান করেছিল—কিন্তু অপমান ও অবজ্ঞা ছাড়া কোনো কিছু পায়নি৷ স্বামীর অধীন হয়ে, তার ইচ্ছে অনিচ্ছাকে অবলম্বন করে অমানুষিকভাবে বেঁচে থাকতে হয়েছিল৷ তারপর স্বামী যখন নিজের আসক্তি মেটাতে তাকে পরিত্যাগ করে তখন তার মন থেকে সতী-অসতীর ভেদরেখা মুছে যায়৷ সে বোঝে নারীর সতীত্ব সেও যেমন পুরুষের দেওয়া তার অসতীত্বও পুরুষের হাতে তৈরি৷ সেদিনই সে বিদ্রোহী হয়ে অসতী হয়ে যায়, সেখানে আর কিছু না থাক স্বাধীনতাটুকু তো আছে৷ মুক্তো তাই কোনোভাবেই সেই সভ্য সমাজে ফিরে যেতে চায় না যেখানে নারীর কোনো মূল্য নেই৷ প্রতিবাদিনী এই বারবনিতার বিদ্রোহীরূপের দ্যোতনা বহন করে তার ঘরের দেওয়ালে লেখা কবিতার একটি চরণে৷ সেখানে লাল পেন্সিল দিয়ে লেখা—‘‘সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কি ভয়!’’২১৪ অর্থাৎ সমুদ্রের বুকে একফোটা শিশির কোনো অনুরণন জাগাতে পারে না৷ গৃহের চারদেওয়ালে আবদ্ধ কুলবধূদের যে কলঙ্কভয়ে সর্বদা সজাগ থাকতে হয় মুক্তো সেই আবেষ্টনী থেকে বেড়িয়ে কলঙ্ক সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছে, তাই তার আর কোনো কলঙ্কের ভয় নেই৷ বনফুলের তৈরি বারনারীরাই এমন সাহসী৷ আসলে বাস্তবসমাজের অনুসরণ করতে গিয়ে, জীবনের নিগুঢ় সত্যকে উপস্থাপন করতে গিয়ে তাঁর এই চরিত্রগুলি অনেক বেশি সাহসিকতা দেখাতে পেরেছে৷ সমাজের কোনো অনুশাসন, কোনো রক্তচক্ষু তাদের নিরস্ত করতে পারেনি৷
মুক্তো পুরুষের দ্বারা প্রতারিত হলেও তার ভেতরের নরম মাটিকে সমাজের প্রতি তীব্র ঘৃণা দিয়েও ধুয়ে ফেলতে পারেনি৷ সেখানে ছাপ পড়েছে শঙ্করের৷ সে ভালোবেসেছে তাকে৷ যে প্রবল বিরক্তিতে সে সমাজ পরিত্যাগ করে গণিকা হয়েছিল, তার মোহে আবদ্ধ করে শঙ্করকে সেই সমাজ পরিত্যাগ করাতে পারেনি৷ সে হয়তো বুঝেছিল সমাজচ্যুত হয়ে সেই ভদ্র সন্তান নিজেকে ভালো রাখতে পারবে না, তাই প্রেমাস্পদের মঙ্গলের জন্য শত যন্ত্রণা মনের মধ্যে সহ্য করেও শঙ্করকে লোক দিয়ে অপমান করিয়েছে, তার সামনে অন্য লোককে খদ্দের হিসেবে গ্রহণ করেছে৷ অপমানিত শঙ্কর তাকে বুঝতে না পেরে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে চলে গেছে৷ এবং সেখান থেকে বেরোনোর পর তার মনে হয়েছে—‘‘মুক্তোকে সে পাইবে না, পাইতে পারে না এবং পাইতে চাহেও না৷ তাহার পঙ্কিল স্পর্শ হইতে সে যে মানে মানে দূরে চলিয়া আসিতে পারিয়াছে, এজন্য সে আনন্দিত৷’’২১৫ যে মুক্তোকে উদ্ধার করা তার জীবনের ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যে মুক্তোকে বিবাহ করতে চেয়েছিল তার সমস্ত কলুষতা সত্ত্বেও, সেই মুক্তোর স্পর্শ তার কাছে পঙ্কিল মনে হয়৷ শঙ্করের সেই দ্বিধামিশ্রিত মানসিকতা হয় তো বুঝতে পেরেছিল মুক্তো তাই ভালোবাসার বন্ধনে না বেঁধে মুক্তি দিয়েছিল তাকে৷ শঙ্কর আর মুক্তোর খোঁজ রাখেনি৷ বহুদিন গত হলে মুক্তো খুন হওয়ার পর দশরথের জিম্মায় রাখা তার ট্রাঙ্ক থেকে পাওয়া দুটি জিনিস শঙ্করকে বিস্মিত করে৷ একটা তারই দেওয়া নীল রঙের একখানি চাদর অপরটি একটি ছবি—চুনচুনের স্বামী যতীন হাজরার প্রতিকৃতি৷ ছবির মুখের উপর অজস্র নখের আঁচরের দাগ এবং আঁকাবাঁকা অক্ষরে নীচে লেখা—‘‘স্বামী নয়—শয়তান’’২১৬ শঙ্করের বুঝতে অসুবিধা হয় না মুক্তোর জীবন ইতিহাস৷ কারণ মৃত্যুর পূর্বে যতীনবাবু তার পূর্বস্ত্রীর সম্পর্কে বহু কথা বলে গিয়েছিল—সে যে নির্দোষ ছিল এবং তাকে অপমান করার জন্যই যে সে অকালে মৃত্যু পথে যেতে বসেছে সে কথাও গোপন করেনি৷ যতীন হাজরা তার সন্ধান পেয়ে শঙ্করকে বলেছিল তাকে সংবাদ দিতে; মৃত্যুর আগে পায়ে ধরে সমস্ত অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করে যাবে৷ কিন্তু তার পূর্ব স্ত্রীর নাম ও ঠিকানা বলার আগেই মৃত্যু তার কন্ঠ রোধ করে দিয়েছিল৷ মুক্তোর ট্রাঙ্কের সেই ছবি যতীনের অসমাপ্ত কথাকে সমাপ্ত করে৷ আর নখে আঁচড়ানো সেই ছবিখানা প্রমাণ করে কি ভীষণ প্রতিহিংসায় জর্জরিত ছিল মুক্তোর মন৷ সারা জীবনেও সে তার স্বামীকে ক্ষমা করে যেতে পারেনি৷
মুক্তো স্বামীর অপমানের শোধ নিতে গিয়ে যে পথ অবলম্বন করেছিল সেখানে মৃত্যুর বাড়া আর কোনো শাস্তি ছিল না৷ তার কপালে শেষ পর্যন্ত তাই জোটে৷ নির্মমভাবে খুন হতে হয় তাকে৷ তাদের সেই খুন হওয়ার কোনো প্রতিকার সমাজে নেই৷ সমাজের পাপ বক্ষে ধারণকারী প্রান্তবাসিনী এই নারীরা মুক্তোর মতো খুন হয়ে বিনা বিচারে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়৷ আর এই নির্মম হত্যাকাণ্ড গণিকা নারীদের বেশিরভাগেরই ভবিতব্য৷ শরীরের বিনিময়ে তিল তিল করে জমানো সামান্য সম্পদও তাদের প্রাণের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়৷
রচনাকার ত্যাগে, মহত্ত্বে, সাহসে, প্রতিবাদে এবং প্রতিহিংসায় অনবদ্য করে উপস্থাপন করেছেন মুক্তো চরিত্রকে৷ গণিকা নারীদের বিবর্তন ক্ষেত্রে চরিত্র বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ৷
এই উপন্যাসেরই আরেক চরিত্র পানওয়ালী৷ বিগতযৌবনা বারনারীদের জীবনে সংকট চিত্রিত হয়েছে তার মধ্য দিয়ে৷ তার যৌবন যেমন অস্তমিত, তেমনি দেখতেও কুৎসিত সে৷ আর সেই বিরূপ রূপের বাহার ফোটাতে কাজল পড়ে, মাথায় ফুল গুঁজে, দাঁতে মিশি লাগিয়ে এবং নীল বর্ণের কাপড় পড়ে বুড়িটা ছুঁড়ি সেজে প্রণয়ী করালীকে ভোলাতে চায়৷ করালীও কুৎসিত দেখতে৷ অন্য গণিকারা যখন তার ভয়ঙ্কর রূপ দেখে অর্থের বিনিময়েও তাকে গ্রহণ করতে স্বীকৃত হয় না তখন পানওয়ালী অযাচিতভাবে তার উপকার করে যায়৷ করালী তাকে যতটাই ঘৃণা করে ততটাই অনুরক্ত সে তার প্রতি৷ তার সব অপমান নিরবে সহ্য করে অন্তরে প্রেমের নৈবেদ্যকে তার জন্যই অক্ষত রাখে৷ কদর্য রূপ, বিগত যৌবন এবং নিষ্ঠুর উপেক্ষা তার মধ্য থেকেও সত্যকার প্রেম যে নিকষিত হেম হয়ে উঠতে পারে সেই সত্যটিকেই পানওয়ালী চরিত্রের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছে৷
ফুলশরিয়া নিম্ন শ্রেণীর দেহজীবী৷ সেও বনফুলের হাতে তৈরি মানবিক গুণসম্পন্ন একজন নারী৷ কৃতজ্ঞতাবোধও কম নয় তার৷ তার ছোঁয়াচ লেগে প্রণয়ী হারিয়া অসুস্থ হলে তার দেখভাল, চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করে৷ শঙ্করের ভালোমানুষী তাকে যেমন তার প্রতি সশ্রদ্ধ করে তোলে তেমনি গ্রামে আগুন লাগার ঘটনায় সেই ভালোমানুষীকেই মনে হয় লোক দেখানো ঢং৷ তাদের প্রতি বিরূপ ঔদাসীন্যে শঙ্করকে তীর্যক বাক্য প্রয়োগেও দ্বিধা করে না৷ আবার কলেরার রোগীর প্রতি নির্মল সহানুভূতি; অক্লান্ত সেবা, মৃতদেহ সৎকার শঙ্করের এই কর্মগুলি তার মননে তাকে মানুষ থেকে দেবতার স্তরে উন্নীত করে৷ সে স্বতোপ্রণোদিত হয়ে শঙ্করের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়৷ গভীর রাতে শঙ্করের মতো দেবতুল্য মানুষের পদধূলি গ্রহণ করার জন্য তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে৷ তার মানসিক দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিত্ব, আত্মোপলব্ধি তাকে পতিতা চরিত্রের গ্লানিকে ছাপিয়ে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে৷ লেখক ফুলশরিয়াকেও যৌনতার পুত্তলি করে না রেখে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষীতে রূপান্তরিত করেছেন৷
এছাড়া ‘জঙ্গম’ উপন্যাসে সমাজের আরেক ভয়াবহ দিকের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে তা হল নারীহরণ ও নারীপাচার চক্রের বর্ণনা৷ যে চক্রগুলি অসহায় দরিদ্র নারীদের কর্মের লোভ দেখিয়ে, প্রলোভিত করে গণিকাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য করে৷ অচিনবাবু, খগেশ্বরবাবু এই চক্রের প্রধান কর্মী৷ মূল পাণ্ডা বৃদ্ধ ম্যানেজারবাবু৷ সেই বিকৃত রুচির বৃদ্ধ অনির্দেশ্য মালিকের নাম করে কখনো মোটা টাকার বিনিময়ে, কখনো কাজ দেওয়ার নাম করে মেয়েদের অপহরণ করায়৷ অচিনবাবু, খগেশ্বরবাবুরা অপহৃতা বা প্রলোভিতা নারীদের ফুসলিয়ে তুলে দেয় ম্যানেজার বাবুর হাতে৷ বৃদ্ধ ম্যানেজার তার বিকারগ্রস্ত কামনায় ধর্ষণ করে সেই নারীদের৷ তারপর কোনো বেশ্যাপল্লীতে পাঠিয়ে দিয়ে আবার নতুন করে ফাঁদ পাতে৷ যেমন শিক্ষয়িত্রীর বিজ্ঞাপন দেখে চাকরীপ্রার্থী হয়ে মৃন্ময়ের স্ত্রী স্বর্ণলতা তার খপ্পরে পড়েছিল৷ এই অপহৃতা নারীরা কেউ আত্মহত্যা করে মুক্তির উপায় খোঁজার চেষ্টা করে নতুবা পুরোদস্তুর পণ্য হয়ে যায়৷ যেমন খগেশ্বরের স্ত্রী সৌদামিনি৷ টাকার লোভে সেই নরপিশাচ নিজের স্ত্রী-কন্যাকে ম্যানেজারবাবুর হাতে তুলে দিয়েছিল৷ ম্যানেজার তাদের দুজনকে পছন্দ হলে চরম আত্মপ্রসাদ লাভ করে বলে—‘‘কর্তার দুজনকেই পছন্দ হয়েছে৷ নিজের চোখে দেখলাম৷ এখন বেশ সোনাদানা পরে দিব্যি জাঁকিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে মশাই,’’২১৭ আবার দেখা যায় অচিনবাবুর দুর্বলতার সুযোগে খগেশ্বর তার মেয়েকেউ ম্যানেজারের হাতে বিক্রয় করে দেয়৷ আত্মজাকে বৃদ্ধের দ্বারা ধর্ষিত হতে দেখে ক্রোধান্ধ অচিনবাবু ম্যানেজারকে খুন করে জেলে যায়৷ এই নারীপাচার চক্র লেখকের কল্পনাবিলাস নয়; সমাজের বাস্তব এক সমস্যা৷ এই অপরাধ চক্রই সমাজে গণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি করে৷ কারণ বেশিরভাগ পাচার হয়ে যাওয়া নারীই সমাজে ঠাঁই পায় না বা বেশ্যালয়ের নির্মম অন্ধকার থেকে বেরোনোর সুযোগ পায় না৷
লেখক এই উপন্যাসে অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে গণিকাদের জীবনকে দেখেছেন৷ গণিকা তৈরির পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমাজই যে ইন্ধন জুগিয়ে চলে সে বিষয়েও বাস্তবসম্মতভাবে যুক্তির অবতাড়না করেছেন৷ তার সৃষ্ট পণ্যরমণীরা প্রায় সকলেই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং সমাজের বিরুদ্ধে মুক্তকন্ঠ৷
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শহরবাসের ইতিকথা’-য় দুজন বারনারী—তারা হল চাঁপা ও দুর্গা৷ দেহব্যবসায়ী হলেও স্বভাব বৈশিষ্ট্যে দুজনে দুই মেরুর৷ খোলার ঘরের এক বস্তিতে অন্য অনেক পণ্যাঙ্গনার সঙ্গে তারা বাস করে৷ গেঁয়ো কামার শ্রীপতি কাজের সন্ধানে শহরে এসে জ্যোতির সঙ্গে উপস্থিত হয় চাঁপার ঘরে৷ চাঁপা উচ্ছল যুবতী৷ গণিকাবৃত্তিতে পোক্ত সে৷ কোন মোহন মন্ত্রে খদ্দের বশ হয় সে বিষয়ও সম্পূর্ণরূপে অবগত তার৷ বহুদিন বেশ্যা বৃত্তির ‘লাইনে’ থাকায় পুরুষ ভোলানোর সব কৌশলই সে আয়ত্ত করেছে৷ কিন্তু বেশ্যাবৃত্তিতে নতুন প্রবেশ করা নারীরা যেভাবে আনাড়ি হয়ে জীবন কাটায় তার প্রমাণ দুর্গা৷ দুর্গার ঘরেও শ্রীপতি প্রথম পদার্পণ করেছিল জ্যোতির সঙ্গেই৷ বেশিদিন হয়নি সে গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করেছে তাই তার মধ্যে কুলবধূর ভাবটি প্রবল৷ শ্রীপতি যেদিন প্রথম দুর্গার সংস্পর্শে তার শরীরীদাহকে শীতল করে, একটা অস্বস্তি যেন তাকে কাঁটার মতো বিদ্ধ করতে থাকে৷ কারণ সে তার মুখে শুনেছে স্বামীর দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে দুর্গার গণিকা হওয়ার কাহিনি৷ সে চাঁপার মতো চপল নয়; মোটাসোটা শান্ত ভালোমানুষ৷ বেশভূষা গৃহস্থঘরের বৌ-এর মতো—সিঁথিতে সিঁদুর পর্যন্ত পড়ে৷ তার কথায়-বার্তায়, চাল-চলনেও যেন একটা তেজ ও আত্মমর্যাদাবোধ কাজ করে৷ তাই—‘‘দুর্গাকে দেখিয়াই শ্রীপতির ভয় আর সংকোচ জাগিয়াছিল৷ তার এই গল্প শোনার পর গা যেন তার ছমছম করিতে লাগিল৷ এখন দুর্গা অপবিত্র হইয়া গিয়াছে, তাকে স্পর্শ করিলে আর দোষ হয় না, এই অকাট্য যুক্তিটা সে অবশ্য এখনও মনে মনে আঁকাড়াইয়া ধরিয়া আছে, তবু তার কেবলই মনে হইতেছে সে যেন একটা মহাপাপ করিয়া ফেলিয়াছে৷ কেবল তার জন্যই আজ একটি পরস্ত্রী অসতী হইয়া গেল৷’’২১৮ অর্থাৎ নারীরা গণিকার মতো চটুল, লাস্যময়ী না হলে পুরুষ তাকে ভোগ করে তৃপ্তি পায় না৷ আর শ্রীপতি, এক গ্রাম্য কামার যে দুদিন স্ত্রীর সঙ্গে অপরিতৃপ্ত যৌনসম্পর্ক স্থাপন করে শহরে এসে শরীরী উত্তেজনায় বিহ্বল হয়ে বেশ্যাসঙ্গলাভে প্রায় বাধ্য হয়েই ব্রতী হয়, তার মতো মানুষের প্রায় গৃহবধূর মতো সদ্য বারযোষিৎ হওয়া এক নারীকে উপভোগ করে অস্বস্তি হওয়াটাই স্বাভাবিক৷
দুর্গা সকলের কাছে ঠকেই তার বৃত্তিটাকে সচল রাখে৷ বিয়ে করা বৌ-এর মতো খদ্দেরের কাছে আবদার করতে পারে—শরীরের যথাযথ মূল্য আদায় করে নিতে পারে না৷ শ্রীপতি পয়সা নিয়ে তার সঙ্গে ঝগড়া করতে চাইলে দুর্গা পয়সা চাইবে না বলে নতি স্বীকার করে৷ শরীর বিক্রির অর্থ না পেলে তার চলবে কিসে সে প্রসঙ্গে শ্রীপতি জানতে চাইলে সে উত্তর দেয়—‘‘তুমি চালাবে৷ পাষাণ নও তো তুমি, মানুষ৷ খেতে পরতে পাই না দেখলে সইবে তোমার? আজ না দাও, একদিন যেচে তুমি আমায় কাপড় দেবে, গয়না দেবে৷ নেব না বললে বরং রাগ হবে তখন৷ সেদিন আসুক, আমি চুপ করে আছি৷’’২১৯ দুর্গার ঘরের বৌ-এর মতো উত্তাপহীন কথা শুনে শ্রীপতির তাকে রহস্যময় দেশের সেই নারীদের মতো মনে হয় যারা কি না পথিককে নিজের মায়া দিয়ে বশীভূত করে ধরে রাখে, গৃহে ফিরতে দেয় না৷ যদিও শেষ পর্যন্ত শ্রীপতি দুর্গার মায়া কাটিয়ে তার সঙ্গ পরিত্যাগ করতে সক্ষম হয়৷
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও শ্রীপতির মতো স্ত্রীসঙ্গরহিত পুরুষের লিবিডোর প্রভাবকে ব্যঞ্জিত করতে চাঁপা, দুর্গার মতো একই বৃত্তির ভিন্ন চরিত্রবৈশিষ্ট্যের দুই নারীর জীবনের খণ্ড চিত্রকে তুলে ধরেছেন তবুও তার মধ্যে গণিকা জীবনের নানা দিকও ফুটে উঠেছে৷
কীভাবে স্বামীর অবহেলায় ও প্রত্যাখ্যানে দুর্গা গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করেও কুলবধূর বৈশিষ্ট্যগুলোকে ঝেড়ে ফেলতে না পেরে পদে পদে ঠকে যাচ্ছে তা যেমন চিত্রিত হয়েছে তেমনি সময়ের বিবর্তনে সেও যে একদিন চাঁপার মতো পারঙ্গম হয়ে উঠবে সে বিষয়েও দিক নির্দেশ করেছেন রচনাকার৷ দুর্গা ও চাঁপা যেন পরস্পরের অতীত ও ভবিষ্যতের দুটি ভিন্নতর রূপ৷ চাঁপা হয় তো একদিন দুর্গার মতো আনাড়ি ছিল সময় তাকে চটুল করেছে তেমনি আনাড়ি দুর্গাও সময়ের প্রবাহে চাঁপার মতো চপল-চতুর হয়ে উঠবে৷
সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘বৃত্ত’-এ যৌন ব্যবসা ও যৌনতা একাকার হয়ে গিয়েছে৷ বলা চলে যৌনতার যে ভেদরেখার জন্য সতী-অসতীর ধারণা প্রচলিত সেই রেখা মুছে যাওয়ায় তা এক সহজ সাধারণ জৈব প্রক্রিয়ারূপে স্থান পেয়েছে৷ উপন্যাসে যুদ্ধোত্তর যুগের সন্তান বনানী৷ শিক্ষিত সমাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী বনানীর কর্ম সহচর শিশির কিন্তু যৌনসঙ্গী মধ্যবয়সি অধ্যাপক সত্যবান৷ যে সমাজগঠনের আদর্শে প্রেম-ভালোবাসা-শরীরী চাওয়া-পাওয়াকে সবলে চেপে রেখে শিশির কঠিন ব্রতধারী হয়ে বসে আছে সেখানে মানুষের স্বাভাবিক চাওয়া-পাওয়াগুলোকে তার কর্মসহচরী হয়েও বনানী অতিক্রম করতে পারেনি৷ তাই নির্দ্বিধায় তার চেয়ে ষোলো বছরের বড় এবং প্রায় মায়ের বয়সি সত্যবানকে যৌনসহচর হিসেবে গ্রহণ করে৷ তাতে তার কোনো আক্ষেপ নেই—সংকোচ নেই৷ কারণ তার মতে যৌনতাকে প্রাধান্য দিলেও যেমন ক্ষতি, তেমন চেপে রাখলেও ক্ষতি৷ সে তাই সত্যবানকে বলে—‘‘পুরুষ-নারীর মধ্যে শুধু এ সম্বন্ধই আছে এ যেমন আমি ভাবতে পারি নে তেমনি পুরুষ-নারীর মেলামেশার ভেতর এ-বৃত্তিটাকে সতর্ক পাহারা দিয়ে রাখতে হবে তা-ও আমি মানতে রাজি নই৷’’২২০ মানুষের যৌনপ্রবৃত্তি নিয়ে একটা মত বা দর্শন তার মধ্যে সর্বদাই কাজ করেছে৷
বনানী তার জীবনের এই বোধগুলিকে কিছুটা হলেও অর্জন করেছে তার মা সুরমার কাছ থেকে৷ বৈবাহিক সম্পর্কের চিরায়ত আদর্শ তার কাছে ভিত্তিহীন৷ কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতের মিল না হলে, আত্মার মিল না থাকলে তা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বা শৃঙ্খলার সামিল৷ স্বামীর সঙ্গে মতের মিল না হওয়াতে স্বামীকে সে পরিত্যাগ করেছে৷ যৌনতা সম্পর্কেও সে স্বাধীন মনোভাব সম্পন্ন৷ স্বাধীন মনোবৃত্তির জন্য সে স্বামীকে ত্যাগ করেছে ঠিকই, বিবাহকে অস্বীকার করেছে যদিও কিন্তু যৌনতাকে ত্যাগ করেনি৷ তাই তার যৌনসহচর একাধিক৷ রজত, সত্যবানের মতো মানুষেরা তার কামনার উৎসারক হয়েছে৷ মেয়ের কাছে সে কোনো কিছুই গোপন রাখেনি৷ কারণ সে বিশ্বাস করে তার সবটা জানার অধিকার আছে এবং তা প্রয়োজনও৷ কিন্তু জীবনে শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়ে সে যখন বুঝতে পেরেছে তার মেয়েও সত্যবানের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারবেনা জন্যই নিরবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে৷
‘বৃত্ত’ ঔপন্যাসিকের দুঃসাহসী পদক্ষেপ৷ তিনি সুরমা ও বনানী চরিত্রটির মধ্য দিয়ে মানুষের চিরায়ত ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেছেন৷ সতী, অসতী, কুলটা, স্বৈরিণী, ব্যভিচারিণী, গণিকা, বেশ্যা—যৌনতা সম্পর্কিত নারীর যত পরিচয় আছে; তার স্বাধীন যৌনমানসিকতায় সব যেন মুহূর্তে তাদের সকল অর্থ, ব্যঞ্জনা হারিয়ে ফেলেছে৷ গণিকাজীবন বিবর্তিত হয়ে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যেখানে তাদের যৌনব্যবসা মানুষের স্বাভাবিক যৌনাচার হয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে৷ নিতান্ত জৈব তাড়নাই সে সম্পর্কের মূল ভিত্তি৷ এখানে একাধিক পুরুষের সঙ্গে বা অবৈধ যৌনসংসর্গকারী নারীরা কুলটা নয়; গণিকা তো নয়ই তার সহজ-স্বাভাবিক মানুষ৷ গণিকা চরিত্রের বিবর্তনে সঞ্জয় ভট্টাচার্য চূড়ান্ত পরিণত ভাবনার ছাপ রেখে গেছেন৷
বাংলা উপন্যাসে গণিকা চরিত্রের নানা দিক আলোচনা করে চরিত্রগুলির সামাজিক ও মানসিক বিবর্তনের এক সুস্পষ্ট ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়৷ উনিশ শতকের যে সমস্ত বাংলা উপন্যাসে গণিকাচরিত্র বা গণিকাদের কাহিনি বিধৃত হয়েছে সবতাতেই তারা পরিচায়িত হয়েছে সমাজ দূষক রূপে৷ তারা ডাইনি, ডাকিনি, পিশাচিনী ইত্যাদি নানা অভিধায় অপমানিত৷ সেখানে তাদের যেমন কোনো বক্তব্য নেই তেমনি রচনাকার চরিত্রগুলির পরিচয় দিতে কোনো নাম পর্যন্ত প্রয়োগ করেননি৷ অর্থাৎ তারা নাম হীনা, সম্মানহীনা, নানা অঘটনপটিয়সী৷ অথচ পুরুষ সমাজ নির্দ্বিধায় তাদের উপভোগ করে গেছে৷ তারপর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে৷ সময় যত এগিয়ে যায়, যুক্তি, বিচারবোধ মানুষের মধ্যে যত বেশি কার্যকর হয় ততই পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিদ্যায় দক্ষ মানুষজনের মননে এই সর্বদিক দিয়ে পতিতা, বঞ্চিতা নারীরা আলাদা একটা অনুভূতির সঞ্চার করতে থাকে৷ বারবনিতারা বেশ্যা, বারাঙ্গনা ইত্যাদি নানাবিধ তকমার বাইরে নির্দিষ্ট একটা নাম পায়৷ নাম অর্জনের মধ্য দিয়েই তারা যেন মানুষ হিসেবে সমাজের দিকে একধাপ এগিয়ে আসে৷ শরৎচন্দ্রের মতো দরদি লেখকেরা সহনুভূতির বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছেন পণ্যাঙ্গনাদের৷ শুধুমাত্র চরিত্র নয় তারা উপন্যাসের মুখ্যচরিত্র হিসেবে স্থান দখল করতে পেরেছে—আর এই শ্রেণীর নারীদের প্রতি একটা ঘৃণা, একটা খুতখুতে মনোভাবে পাঠকরা যেভাবে বিব্রত হত তা অনেকটাই দূর হয়ে গেছে৷ আমাদের ঘরের মানুষের মতো দুঃখ-সুখের বেদনা নিয়ে মনুষ্যত্বের মর্যাদায় স্বপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ জগদীশগুপ্ত, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, বনফুল, মানিক, সঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রমুখের রচনার মধ্য দিয়ে গণিকারা নাম, যশ, প্রভাব, প্রতিপত্তি লাভ করতে থাকে৷ তাদের কন্ঠে ধ্বনিত হয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ৷ সঞ্জয় ভট্টাচার্য তো তার উপন্যাসে সতী-অসতীর ভেদরেখাই তুলে দিয়েছেন৷ তাঁর মতে যৌনতা শুধুমাত্র এক প্রকার জৈব চাহিদা ছাড়া আর কিছু নয়৷ তার নায়িকার তাই বহুপুরুষের সঙ্গে যৌনসংসর্গে লিপ্ত হয়েও গণিকা হয়ে যায়নি৷ আর এই যে যৌনতার প্রতি ধারণা বদল, সমাজের বিরুদ্ধে নিজেদের জীবনের নানা শোষণের বিরুদ্ধে তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রতিবাদ তা বাংলা উপন্যাসে গনিকাচরিত্রের বিবর্তনের রূপরেখাটিকে সুস্পষ্ট করেছে৷
তথ্যসূত্র :
১. স্বপন বসু, সংবাদ-সাময়িকপত্রে উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ (২য় খণ্ড), পৃ-১৪২
২. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রবন্ধ ও অন্যান্য রচনা, পৃ-৩৩-৩৪
৩. প্রমথনাথ বিশী (সম্পাদিত), ভূদেব রচনাসম্ভার, পৃ-৩৩৮
৪. তদেব, পৃ-৩৩৮
৫. তদেব, পৃ-৩৩৯
৬. তদেব, পৃ-৩৩৯
৭. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিম উপন্যাস সমগ্র, পৃ-৬০
৮. তদেব, পৃ. ৬০
৯. তদেব, পৃ-১২
১০. তদেব, পৃ-৭৭
১১. তদেব, পৃ-১৩৫
১২. তদেব, পৃ-১৩৫
১৩. কুমারী শ্রীমতি মানদা দেবী, শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত, পৃ-২৩
১৪. তদেব, পৃ-২০
১৫. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিম উপন্যাস সমগ্র, পৃ-২৯৭
১৬. তদেব, পৃ-২৯৮
১৭. তদেব, পৃ-২৯৮
১৮. তদেব, পৃ-২৯৮
১৯. তদেব, পৃ-৩২৬
২০. তদেব, পৃ-৩৪২
২১. তদেব, পৃ-৭৬৬
২২. তদেব, পৃ-৭৬০-৭৬১
২৩. তদেব, পৃ-৭৭৯
২৪. তদেব, পৃ-৭৮৬
২৫. তদেব, পৃ-৭৮৬
২৬. তদেব, পৃ-৮১৭
২৭. তদেব, পৃ-৮১৭-৮১৮
২৮. তদেব, পৃ-৮১৯
২৯. তদেব, পৃ-৮২১
৩০. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, পৃ-৬৬-৬৭
৩১. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিম উপন্যাস সমগ্র, পৃ-৮৪৬
৩২. ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হরিদাসের গুপ্তকথা, পৃ-২
৩৩. তদেব, পৃ-৩
৩৪. তদেব, পৃ-৫
৩৫. স্বপন বসু, সংবাদ-সাময়িকপত্রে উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ (২য় খণ্ড), পৃ-৫৯৯-৬০০
৩৬. ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হরিদাসের গুপ্তকথা, পৃ-৬
৩৭. তদেব, পৃ-৭
৩৮. তদেব, পৃ-১৫
৩৯. তদেব, পৃ. ৩৮৬
৪০. মৌ ভট্টাচার্য, বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ, পৃ-৪৭
৪১. তদেব, পৃ-১২৭
৪২. তদেব, পৃ-১২৯
৪৩. তদেব, পৃ-১৩২-১৩৩
৪৪. তদেব, পৃ-১৩৩
৪৫. তদেব, পৃ-১৩৩
৪৬. কুমারী শ্রীমতি মানদা দেবী, শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত, পৃ-৪৩
৪৭. মৌ ভট্টাচার্য, বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ, পৃ-১৩৭-১৩৮
৪৮. তদেব, পৃ-১৩৪
৪৯. তদেব, পৃ-১৩৫
৫০. ড. দেবীপদ ভট্টাচার্য সম্পাদিত, গিরিশ রচনাবলী (৫ম খণ্ড), পৃ-১৩০
৫১. তদেব, পৃ-১৪৬
৫২. তদেব, পৃ-১৪৭
৫৩. স্বপন বসু, সংবাদ-সাময়িকপত্রে উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ (২য় খণ্ড), পৃ-৬০৮
৫৪. দুর্গাচরণ রায়, দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন, পৃ-২৭
৫৫. তদেব, পৃ-২৯
৫৬. তদেব, পৃ-৩৯
৫৭. তদেব, পৃ-৫৫
৫৮. তদেব, পৃ-৫৭
৫৯. তদেব, পৃ-৬৯
৬০. তদেব, পৃ-৬৯
৬১. তদেব, পৃ-৭২
৬২. তদেব, পৃ-৯৯
৬৩. তদেব, পৃ-১০৪
৬৪. তদেব, পৃ-১৯৭
৬৫. তদেব, পৃ-২৫৭
৬৬. তদেব, পৃ-২৫৭-২৫৮
৬৭. তদেব, পৃ-২৯৮
৬৮. তদেব, পৃ-৩৪৯
৬৯. তদেব, পৃ-৩৫২
৭০. তদেব, পৃ-৩৫৩
৭১. তদেব, পৃ-৩৬৬
৭২. পাঁচকড়ি দে রচনাবলী (১ম খণ্ড), পৃ-৬৬
৭৩. তদেব, পৃ-৬৬
৭৪. কুমারী শ্রীমতি মানদা দেবী, শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত, পৃ-৩৭
৭৫. সুকুমার সেন (সম্পাদিত), শরৎ সাহিত্য সমগ্র, পৃ-১৯৩৮
৭৬. তদেব, পৃ-১৯৩৮
৭৭. শরৎ রচনা সমগ্র, পৃ-৩০৬
৭৮. তদেব, পৃ-৩০৯
৭৯. তদেব, পৃ-৩১২
৮০. তদেব, পৃ-৩১৯
৮১. তদেব, পৃ-৩১৯
৮২. তদেব, পৃ-৩৪২
৮৩. তদেব, পৃ-৩৬০
৮৪. তদেব, পৃ-৩৭৯
৮৫. তদেব, পৃ-৩৭৯
৮৬. তদেব, পৃ-৩৮০
৮৭. তদেব, পৃ-৩৮০
৮৮. তদেব, পৃ-৩৮১
৮৯. তদেব, পৃ-৩৮১
৯০. তদেব, পৃ-৪৩৮
৯১. তদেব, পৃ-৪৩২
৯২. তদেব, পৃ-৪৩২
৯৩. তদেব, পৃ-২৯৪
৯৪. তদেব, পৃ-৪২৫-৪২৬
৯৫. সেন, সুকুমার (সম্পাদিত), শরৎ সাহিত্য সমগ্র, পৃ. ৫৫৫
৯৬. তদেব, পৃ-৫৫৫
৯৭. তদেব, পৃ-৫৬৪
৯৮. তদেব, পৃ-৫৬৪
৯৯. তদেব, পৃ-৩৮
১০০. তদেব, পৃ-৪৭
১০১. তদেব, পৃ-৪৭
১০২. তদেব, পৃ-৪৭
১০৩. তদেব, পৃ-৩৯
১০৪. তদেব, পৃ-৫৬
১০৫. তদেব, পৃ-৬৫
১০৬. তদেব, পৃ-১১৫
১০৭. তদেব, পৃ-১১৬
১০৮. তদেব, পৃ-১১৭
১০৯. তদেব, পৃ-১১৮-১১৯
১১০. তদেব, পৃ-১১৯
১১১. তদেব, পৃ-১২০-১২১
১১২. তদেব, পৃ-১২২
১১৩. তদেব, পৃ-১২৭
১১৪. তদেব, পৃ-২৫৪
১১৫. তদেব, পৃ-২১৭
১১৬. তদেব, পৃ-২১৬
১১৭. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শুভদা, পৃ-১৪৮৮
১১৮. তদেব, পৃ-১৪৮৮
১১৯. তদেব, পৃ-১৪৯৫
১২০. তদেব, পৃ-১৫৪৩
১২১. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদিত), রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী, পৃ-৩১২
১২২. তদেব, পৃ-৩১১
১২৩. তদেব, পৃ-৭৬
১২৪. জগদীশ গুপ্ত, লঘুগুরু ও অসাধু সিদ্ধার্থ, পৃ-১৭
১২৫. তদেব, পৃ-১২২
১২৬. তদেব, পৃ-১৭
১২৭. তদেব, পৃ-১৭
১২৮. তদেব, পৃ-২০
১২৯. তদেব, পৃ-১৯
১৩০. তদেব, পৃ-২০
১৩১. তদেব, পৃ. ২০
১৩২. তদেব, পৃ. ২০
১৩৩. তদেব, পৃ.২৯
১৩৪. তদেব, পৃ. ২৮
১৩৫. তদেব, পৃ. ২৯
১৩৬. তদেব, পৃ. ৩০
১৩৭. তদেব, পৃ. ৩৩
১৩৮. ক্ষেত্র গুপ্ত, বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস (৪র্থ খণ্ড), পৃ-২৮২
১৩৯. তদেব, পৃ. ৬৪
১৪০. তদেব, পৃ. ৬০
১৪১. তদেব, পৃ. ৬৯
১৪২. তদেব, পৃ. ৬৯
১৪৩. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (২য় খণ্ড), পৃ-৫১০
১৪৪. তদেব, পৃ-৬১২
১৪৫. তদেব, পৃ-৮৪৭
১৪৬. তদেব, পৃ-৮৪৭
১৪৭. তদেব, পৃ-৮৮১
১৪৮. তদেব, পৃ-৪৭৬
১৪৯. তদেব, পৃ-৪৫৮
১৫০. তদেব, পৃ-৪৭৬
১৫১. তদেব, পৃ-৪৮২
১৫২. তদেব, পৃ-৪৮৪
১৫৩. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রচনাবলী (৩য় খণ্ড), পৃ-২৩১
১৫৪. তদেব, পৃ-২৩২
১৫৫. তদেব, পৃ-২৩৫
১৫৬. তদেব, পৃ-২৩৮
১৫৭. তদেব, পৃ-২৪২
১৫৮. তদেব, পৃ-২৪২
১৫৯. তদেব, পৃ-২৪২
১৬০. তদেব, পৃ-২৩৭
১৬১. তদেব, পৃ-২৬৯
১৬২. তদেব, পৃ-২৬৯
১৬৩. তদেব, পৃ-২৯৩
১৬৪. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি, পৃ-১৪৫
১৬৫. তদেব, পৃ-১৩১
১৬৬. তদেব, পৃ-১৪৩
১৬৭. তদেব, পৃ-১৪৭-১৪৮
১৬৮. তদেব, পৃ-১৪৯
১৬৯. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৪১
১৭০. তদেব, পৃ-৪১
১৭১. তদেব, পৃ-৩৬
১৭২. তদেব, পৃ-৩৯
১৭৩. তদেব, পৃ-২০৬
১৭৪. তদেব, পৃ-২১০-২১১
১৭৫. তদেব, পৃ-১২১
১৭৬. তদেব, পৃ-১৩৫
১৭৭. তদেব, পৃ-২৩৫
১৭৮. তদেব, পৃ-২৩৬
১৭৯. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রচনাবলী (৪র্থ খণ্ড), পৃ-৩২
১৮০. তদেব, পৃ-১২৬
১৮১. তদেব, পৃ-১২৬
১৮২. তদেব, পৃ-১২৬
১৮৩. তদেব, পৃ-১৩৪
১৮৪. তদেব, পৃ-১৩৪
১৮৫. তদেব, পৃ-১৩৭
১৮৬. তদেব, পৃ-১৯৩
১৮৭. তদেব, পৃ-২০২
১৮৮. তদেব, পৃ-২১৪
১৮৯. তদেব, পৃ-২৪৫
১৯০. তদেব, পৃ-২৪৫
১৯১. তদেব, পৃ-২৪৫
১৯২. তদেব, পৃ-২৫৩
১৯৩. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, পৃ-৩০৩
১৯৪. বনফুল রচনা সমগ্র (৫ম খণ্ড), পৃ-১১৯
১৯৫. তদেব, পৃ-১২০
১৯৬. তদেব, পৃ-১২০
১৯৭. তদেব, পৃ-১৪০
১৯৮. তদেব, পৃ-১৩৮
১৯৯. তদেব, পৃ-২৮৫
২০০. তদেব, পৃ-২৮৩
২০১. তদেব, পৃ-২৮৫
২০২. তদেব, পৃ-২৮৫
২০৩. তদেব, পৃ-৩০২
২০৪. তদেব, পৃ-৩০৩
২০৫. তদেব, পৃ-৩২১
২০৬. তদেব, পৃ-৩২৬
২০৭. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-১৭৮
২০৮. তদেব, পৃ-১৭৯
২০৯. তদেব, পৃ-১৯৩
২১০. তদেব, পৃ-১৯৩
২১১. তদেব, পৃ-১৯৪
২১২. তদেব, পৃ-১৯৪
২১৩. তদেব, পৃ-২১২
২১৪. তদেব, পৃ-১৯৩
২১৫. তদেব, পৃ-২৩৬
২১৬. তদেব, পৃ-৩২৯
২১৭. তদেব, পৃ-২২৬
২১৮. মানিক উপন্যাস সমগ্র (১ম খণ্ড), পৃ-৭৬১
২১৯. তদেব, পৃ-৭৭৪
২২০. শাশ্বতী গাঙ্গুলী, সঞ্জয় ভট্টাচার্য : একটি পরিক্রমা, পৃ-১৭৯