১. প্রাককথন

প্রাককথন

নারীকে ভোগ করার বাসনা সমাজের চিরকালের৷ পুত্র উৎপাদনের জন্য যেমন সমাজ পিতারা ‘বিবাহ’ নামক স্বীকৃতি প্রদান করে বৈধভাবে নারীকে ভোগ করেছে তেমনি নির্বিচারে বহুনারী ভোগ করার জন্য তাদের এক শ্রেণীকে গণিকা হিসেবে প্রতিপন্ন করেছে৷ অপমান-লাঞ্ছনায় জর্জরিত করে ধীরে ধীরে সমাজের একেবারে প্রান্তসীমায় ছুড়ে দিয়েছে৷ সময়ের প্রবহমান ধারায় সেই ভোগের পথ হয়েছে আরও মসৃণ ও সুগম৷ কত নাম নারীর; কত তার অভিধা৷ সতী, অসতী, কলঙ্কিনী, ব্যভিচারিণী, স্বৈরিণী, রূপদাসী, অপ্সরা, সবশেষে গণিকা, বেশ্যা৷ আর এই অভিধাগুলো অর্জন করতে গিয়ে নারীকে সব সময় যে ঘরের বার হতে হয়েছে, বেশ্যাপল্লীতে অবস্থান করতে হয়েছে—তা নয়৷ স্বামীর অনুকারিণী হয়ে একনিষ্ঠ স্বামী সেবার মধ্যে থেকেও তারা উপাধিগুলি অর্জন করতে পারে—তার জন্য স্বামীর মিথ্যা সন্দেহ, বিয়ে করা স্ত্রীতে অরুচির জন্য তাকে পরিত্যাগ করে অন্য নারী লাভের সুপ্ত বাসনাই যথেষ্ট৷ তারপরে যদি কোনো নারীর পদস্খলন ঘটে তাহলে তো কোনো কথাই নেই—সোজা বেশ্যাগিরি৷ আর এই যে নারীর জন্য এত অভিধা তার পুংলিঙ্গ বাচক কয়টা প্রতিশব্দ পুরুষের জন্য সৃষ্ট হয়েছে তা ভাববার বিষয়৷ তাহলে পুরুষেরা কি অসতী হয় না? আর হলেই দেখার কে আছে—এতসব অভিধা, এতসব বিধিনিষেধ তারা তো নিজের জন্য তৈরি করতে পারে না! অগত্যা যূপকাষ্ঠে বলি হওয়ার জন্য রয়েছে নারীকুল৷ আর বলির প্রসাদ তো সুস্বাদু হয়ই! পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বলি হওয়া নারীরা গণিকা হয়ে যায়; আর পুরুষকুল মহানন্দে বিনা বাধায় সেই নারীমাংস আস্বাদন করে সার্থকতা লাভ করে৷

এই যে আমাদের দেশে-কালে গণিকা নারীর এই অবস্থা তা শুধু আমাদের দেশেরই নয়—সমস্ত পৃথিবীরই তাতে একই রূপ৷ পৃথিবীর প্রধান তিনটি ধর্মেই লক্ষিত হয়েছে নারীর শরীরের প্রতি পুরুষের দুর্বার ভোগাকাঙ্খা৷ নারী পুরুষের জন্য সৃষ্ট৷ পুত্রলাভের জন্য নারীর সাথে রমণ কর৷ নারী দেহ শস্যক্ষেত্র তাকে যত ইচ্ছে কর্ষণ করা যায়৷ তিনধর্মের এই বাণীর মূল কথাই হচ্ছে—নারীদেহকে যথা ইচ্ছে ভোগ করা৷ পুরুষের অবাধ ভোগের নিমিত্ত দেহব্যবসার যন্ত্রণাময় নরককুন্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়া নারীরা তাদের পৈশাচিক যন্ত্রণায় তিলে তিলে শেষ হয়ে যায়৷ তবু সকলেই তো এক নয়৷ দৈত্যকুলে প্রহ্লাদের মতো পুরুষকুলে এমন কিছু মানুষ আবির্ভূত হন যাঁরা তাঁদের দরদি মন নিয়ে এদের কথা ভাবেন—এদের জীবন যন্ত্রণাকে, সমাজে অবস্থানকে লোকচক্ষুর সম্মুখে তুলে ধরার চেষ্টা করেন৷ যদিও কখনো কখনো সমাজ-সময়ের রক্ষণশীল মানসিকতাকে সহজে কাটিয়ে উঠতে পারেন না৷ গণিকাদের জীবনযন্ত্রণাকে সর্বজনবিদিত করার কারিগর হলেন বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন সাহিত্যিকেরা৷ যাঁদের জন্য সমগ্র বিশ্বে গণিকাদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা সম্ভরপর হয়েছে৷ আমার গ্রন্থের বিষয় বাংলা উপন্যাসের গণিকাচরিত্র হলেও সমগ্র বিশ্বের বারনারীদের মর্মযন্ত্রণা, শোষণের ইতিহাস যে প্রায় একই তা তুলে ধরার জন্য বিশ্বসাহিত্যে গণিকা প্রসঙ্গে সংক্ষেপে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো যাতে গণিকা সংক্রান্ত ধারণায় আরেকটু স্বচ্ছতা আসে৷

ভারতীয় সাহিত্যে যে সময়ে গণিকাদের আগমনি সংকেত মর্মগোচর হয়েছে বিশ্বসাহিত্যে তা আরও বেশি এগিয়ে৷ এ পর্যন্ত সাহিত্যে আবিষ্কৃত প্রথম গণিকার উল্লেখ পাওয়া যায় সুমেরীয় মহাকাব্য ‘গীলগামেশের কাহিনি’-তে৷ এর রচয়িতা অজ্ঞাত৷ এটি রচিত হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ব্যাবিলনীয় ভাষায় এবং কিউনিফর্ম লিপিতে৷ রচনাটি প্রাচীনতম মহাকাব্য হিসেবেও সম্মানিত৷ গল্পটি হল—উরুক রাজ্যের অধিপতি গীলগামেশ প্রজাবৎসল রাজা হয়েও নগরের চারপাশে প্রাচীর বানাবার নেশায় উন্মত্ত হয়ে কর্মরত প্রজাদের উপর অত্যাচার শুরু করে৷ তারা সে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সেই কষ্ট থেকে উদ্ধারের জন্য দেবতাশ্রেষ্ঠ ‘আণু’-কে আহ্বান করতে থাকে৷ তাদের আর্তকান্নায় বিচলিত হয়ে আণু তাঁর সহচর আরুরুকে আদেশ দেন গীলগামেশের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে কাউকে গড়তে৷ আণুর নির্দেশে আরুরু প্রকৃতির সর্বশক্তিতে শক্তিমান, পরাক্রমশালী, বনচর এবং পশুদের বন্ধুরূপে সৃষ্টি করলেন এনকিডু নামের এক পুরুষ৷ এনকিডুর কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়ে গীলগামেশ৷ তার পরামর্শদাতা ও গ্রাম প্রধানেরা তাকে বুদ্ধি দেয় কোনো রমণীর দ্বারা এনকিডুকে বশীভূত করে নগরে এনে শক্তি হরণ করতে৷ সেই অনুযায়ী ঈশতার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতকে অনুরোধ করে কার্য সম্পন্ন করার জন্য এক রমণী চেয়ে নেওয়া হয়৷ সেই রমণী বা দেবদাসী যথা সময়ে তার সমস্ত ছলাকলা দেখিয়ে বশ করে এনকিডুকে৷ সাত দিন সাত রাত ধরে চলে তাদের উদোম দেহ সম্ভোগ৷ এই বারাঙ্গনার মোহে মোহিত এনকিডু বন ছেড়ে শহরে এসে পড়ে৷ মদ-মাংস-নারীতে ভাসিয়ে দেয় নিজেকে৷ বল্কল ছেড়ে তার গায়ে উঠে ঝলমলে পোশাক৷ গীলগামেশের সহচর হয়ে যে বনের পশুরা একসময় তার বন্ধু ছিল নির্বিচারে শিকারের নামে তাদের হত্যা করতে থাকে৷ কিন্তু সে ভাব তার বেশিদিন থাকে না৷ প্রকৃতির নিয়ত হাতছানিতে নগরজীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পুনরায় বনে ফিরে যায়৷ বনচারী প্রাণীরা তাকে আর বন্ধু হিসেবে মেনে নিতে পারে না৷ তাকে দেখে ভয়ে পালাতে থাকে৷ ভগ্নহৃদয় এনকিডু আবার শহরে ফিরে আসে৷ ক্রমে শক্তিহীন হয়ে রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে৷ তার সমস্ত দুরবস্থার জন্য দায়ী করে সেই বারাঙ্গনাকে৷ তাকে অভিশাপ দেয়, পথ হবে তার আশ্রয়, নগরের প্রাচীরের পাশে অর্থাৎ একেবারে প্রান্তসীমায় হবে তার আলয়, ব্রাত্য ও ঘৃণিতরা তাকে আঘাত করবে এবং চরম ক্লান্তিতে ভরা থাকবে তার সম্পূর্ণ জীবন৷ এই নিষ্ঠুর অভিশাপে ভীত হয়ে সেই বারনারী শরণাপন্ন হয় শামশেরের৷ শামশের এনকিডুকে অনুরোধ করে তার অভিশাপকে একটু নমনীয় করতে৷ তখন এনকিডু তার অভিশাপ বাণীর মধ্যে আরেকটু সংযোজন করে বলে—শুধু ব্রাত্য ও ঘৃণিতরাই নয়, রাজা, রাজপুত্র ও গণ্যমান্যরাও তার প্রেমিক হবে এবং তাদের জন্য সেই পুরুষেরা তাদের মা ও পুত্রবতী স্ত্রীদেরও পরিত্যাগ করবে৷ তারপর থেকে এনকিডুর সেই অভিশাপবাণী যুগযুগ ধরে ভোগ করে আসছে গণিকারা৷ কাহিনির পাঁচহাজার বছর অতিক্রান্ত হলেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি৷ সমাজ কেমন করে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নারীকে পণ্য করেছে, কীভাবে সেই নারী পরের মঙ্গলের জন্য নিজের জীবনকে ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে বাধ্য হয়েছে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ বহন করে ‘গীলগামেশের কাহিনি’-টি৷

খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দে মিশরের প্যাপিরুসে লিখিত একটি কাহিনিতে দেববেশ্যার প্রতি এক রাজপুত্রের আকাঙ্খার কি পরিণতি হয়েছিল তা জানা যায়৷ কাহিনিটির নাম ‘দি স্টোরি অব সেতনা’৷ দুঃসাহসী ও পারদর্শী পুরুষ সেতনা ছিল মিশরের বিখ্যাত ফ্যারাও রামেসিসের পুত্র৷ সে পিটার মন্দিরের পুরোহিতকন্যা টিবুবুইকে দেখে কামনায় উন্মত্ত হয়ে উঠে তাকে পাওয়ার জন্য৷ টিবুবুই তাকে বাড়িতে আসতে বলে যথাযথ আপ্যায়নের সঙ্গে তাকে এও স্মরণ করিয়ে দেয় যে সে সাধারণ গণিকা নয়—সে ‘হিয়েরোডিউল’ বা পবিত্র দেবকন্যা৷ তার পরেও অধীর সেতনা তার সঙ্গ প্রার্থনা করলে টিবুবুই তার শরীরের মূল্য স্বরূপ সমস্ত সম্পত্তি ও তার সন্তানদের কেটে টুকরো টুকরো করে কুকুরের মুখে ছুঁড়ে দেওয়ার কথা বলে৷ সেতনা তাতে রাজী হলে সমস্তটা লিখিয়ে নিয়ে তার সুদৃশ্য মেহগণির খাটে সেতনাকে আকর্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে একটা অস্বাভাবিক চিৎকার করে সেতনা জ্ঞান হারায়৷ তারপর জ্ঞান ফিরে দেখে এক বিশাল পুরুষের পদপ্রান্তে পড়ে আছে সে এবং তার শরীর সম্পূর্ণ বিবস্ত্র৷ এই কাহিনিটিতে যেমন দেবগণিকাদের প্রেমিকের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার ছবি রয়েছে তেমনি গণিকা সংসর্গে পুরুষের কি শোচনীয় পরিণাম হতে পারে সে সম্পর্কে ভীতিকর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে৷

এই সময় পর্বে আর তেমন কোনো দেবদাসী বা উচ্চশ্রেণীর গণিকার সন্ধান মেলে না৷ যেসব কাহিনি পাওয়া যায় তারা সাধারণ বারনারী—নগরের প্রাচীরের ধারে বা প্রধান সরকের পাশে যাদের আস্তানা৷ বাইবেলের পুরোনো নিয়মের কিছু গল্পকাহিনিতে এই শ্রেণীর গণিকার সন্ধান মেলে৷ যেমন—‘জেনেসিস’ (৩৮)-এ গণিকারা যে কোনো ভদ্রঘর থেকে এসে নগরের প্রাচীর বা মহাসরকের ধারে মুখ ওড়নায় আচ্ছাদিত করে খদ্দেরের আশায় বসে থাকত এবং বিশেষ করে গণিকাদের চেনার উপায়ই ছিল মুখ ওড়নায় ঢেকে রাখা তা জুদা ও তামারের গল্প থেকে বোঝা যায়৷ রাহাব নামের এক সুচতুরা, সহৃদয়া গণিকার উল্লেখ রয়েছে জোশুয়া-(২)-তে৷ রাহাব জোশুয়ার লোকেদের তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল এবং অনুরোধ করেছিল তারা যখন জেরিকো নগরী আক্রমন করবে তখন যেন তার বাবার বাড়িটি ধ্বংস না করে৷ ইসরায়েলীদের মধ্যে গণিকা বিবাহ এবং স্বামীদের সঙ্গে লম্বা সফরের সঙ্গিনী হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে জাজেস (১৯)-এ৷ এজিকিয়েল (২৩) তে ওহোলা ও ওহোলিবা নামের দুজন গণিকার সন্ধান পাওয়া যায় যারা তাদের প্রবল লোভের কারণে পোষক বাবুর সঙ্গ ছেড়ে বহুপুরুষের অঙ্কশায়িনী হয় এবং প্রেমিকদের হাতে নির্মম মৃত্যু বরণ করে৷ সমাজে গণিকাবৃত্তির বাড়-বাড়ন্ত রূপের ইঙ্গিত দান করে এই কাহিনিগুলি৷ ধর্মগুরুরা বা সমাজপ্রভুরা মানুষের ব্যভিচার দমন করার উদ্দেশ্যে এই কাহিনিগুলির অবতাড়না করেছেন বলে মনে হয়৷

প্রাচীন মিশরে রাজপরিবারের কন্যারাও যে নিজের প্রবৃত্তি দমনে অথবা পিতার আদেশে অর্থাগম বা প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করতো সে সম্পর্কিত দু-একটি কাহিনি হেরোডোটাস লিপিবদ্ধ করে গেছেন৷ যেমন মিশরের রাজা রামসিনিটাস তাঁর গুপ্ত প্রকোষ্ঠের চুরি যাওয়া ধনসম্পদের হদিস পেতে এবং চোর ধরার জন্য আত্মজাকে গণিকা বানিয়ে গণিকালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল৷ কারণ গণিকালয়ই অপরাধীদের শ্রান্তি ও ক্লান্তি বিমোচনের অন্যতম স্থান৷ রাজকন্যা গণিকা হয়ে সেই চোরকে করায়ত্তও করেছিল৷ রামসিনিটাসের পর সিংহাসনে বসেন অত্যাচারী রাজা খেওপ বা খুফু৷ বিলাস-ব্যসনে রাজকোষ শূন্য করে শেষ পর্যন্ত নিজকন্যাকে গণিকালয়ে পাঠান অর্থ-রোজগারের জন্য৷ কন্যার দেহবিক্রির অর্থ দিয়ে শুধু আমোদ-প্রমোদই চালিয়ে যাননি এই মহান পিতা—নিজের কবরের জন্য পিরামিডও তৈরি করান মেয়েকে দিয়ে৷ শুধু পিতার জন্যই নয় শরীর বিক্রির উপার্জন দিয়ে সে নিজের জন্যও একটি ‘ওবেলিস্ক’ তৈরি করায়৷ ইতিহাসের জনক হেরোডটাসই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইতিহাসে সামাজিক চিত্রকে যত্ন করে ঠাঁই দিয়েছিলেন যার দ্বারা তৎকালীন সমাজে গণিকা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়৷ হেরোডটাস র‍্যাডোপি নামের এক বিখ্যাত গণিকার নামও উল্লেখ করেছেন যে কিনা ক্রীতদাসী হয়ে তার প্রভুর সঙ্গে থ্রেস থেকে মিশরে এসে উপস্থিত হয়েছিল৷ নিজের রূপলাবণ্যের দ্বারা দেহব্যবসা করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করে নিজের জন্য একটা ‘ওবেলিস্ক’ পর্যন্ত তৈরি করেছিল৷

আনুমানিক খ্রিস্ট্রিয় তৃতীয় শতকে অ্যাথেন্স নউক্রাটিস ‘ডেইপনোসোফিস্ট’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন যেখানে গ্রীসদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের একটি বিশেষ সময়ের সামাজিক ও নৈতিক জীবনের সুস্পষ্ট বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন৷ গ্রন্থটিতে মোট পনেরোটি অধ্যায় তার মধ্যে শুধুমাত্র ত্রয়োদশ অধ্যায়ে গণিকাদের কথা আলোচনা করেছেন৷ অধ্যায়টির নাম ‘কটির্জানস’৷ এখানে তিনি তিন ধরনের গণিকার কথা বলেছেন—হটেরা, আউলেট্রিডেস এবং পরনোই৷ ‘হটেরা’রা শিক্ষিত, কলাবিদ্যায় পারদর্শী এবং বিধুজনের মনোরঞ্জনে দক্ষ৷ শ্রেণী হিসেবে এদের স্থান উচ্চে৷ গ্রীক বিদ্বজ্জনের জীবনে বিশেষ স্থান ছিল এদের৷ এরা প্রেরণাদাত্রী সখি, কলাবিদ, বয়স্যা হিসেবে সম্মাননীয় ছিল৷ ‘হটেরা’ একটি বিশেষ যুগের ফসল; পরবর্তী কোনো যুগেই এমন শিল্পগুণসম্পন্ন বারবনিতা পাওয়া যায়নি৷

এই অধ্যায়ে গ্রীসদেশের সব নামকরা গণিকাদের যেমন উল্লেখ আছে তেমনি তাদের প্রণয়ী হিসেবে যুক্ত বীর-যোদ্ধা জাতীয় বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথাও বলা হয়েছে৷ যেমন—ফ্রাইন-এর রূপমুগ্ধ ছিলেন প্রখ্যাত ভাস্কর প্র্যাক্সিটেলেস; যিনি ফ্রাইনের আদলে তাঁর অবিস্মরণীয় মূর্তি ‘স্নিডিয়ান ভেনাস’ নির্মাণ করেছিলেন৷ গণিকা অ্যাসপাসিয়া বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস এবং গ্রীসের প্রবাদপুরুষ পেরিক্লেস-এর প্রণয়িনী ছিল৷ প্লোটের প্রেমিকা বারবনিতা আরকায়ানাসা, এপিকিউরাসের লেওনাটিয়াম, অ্যারিস্টটলের হারপিলিস স্বনামধন্য বিখ্যাত গণিকা৷ গ্রীক রাজ-রাজড়াদেরও অনেকানেক গণিকা প্রণয়িনীর কথা জানা যায়৷ যেমন—ফিলিন্না ছিল ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপের প্রেমধন্যা৷ ফিলিন্নার গর্ভজাত পুত্র অ্যারিডেয়াস আলেকজাণ্ডারের পর কিছুদিন রাজত্বও করেছিল৷ আলেকজাণ্ডারের প্রেমভাগিনী হয়েছিল গণিকা থাইস, সেলুকাসের মিসটা ও নিয়াসা, অ্যান্টিগোনাসের ডেমো-ও বারবিলাসিনী রূপে বিখ্যাত ছিল৷ অ্যান্টিগোনাসের পুত্র ডেমেট্রিয়াস একাধিক বারনারীর সঙ্গী হয়েছিল৷ তারা হল—মানিয়া, লেয়ানা, লামিয়া, মিরহিনা প্রমুখরা৷ বীর সাইরাসের বেশ্যাসঙ্গিনী হল ফোসিয়া৷

এই গ্রন্থে যেমন বিখ্যাত সব গণিকার কথা রয়েছে তেমনি রয়েছে দালালদের কথা যারা বাররামাদের নানা শারীরিক ত্রুটি ঢেকে খরিদ্দারের সামনে তাদের নিখুঁত হিসেবে জাহির করত৷ ধনী প্রেমিকেরা গণিকাদের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিত, তাদের মূর্তি, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি বহু অর্থব্যয়ে যত্রতত্র স্থাপন করে প্রেমে দক্ষিণা দিত৷ সেই সময়কার সমাজে গণিকারা নানাভাবে প্রশ্রয় ও অনুমোদন পেত বলেই বিখ্যাত বহু মানুষদের গণিকাপ্রীতি সর্বজনবিদিত হয়ে পড়েছে৷

গ্রীক রচয়িতাদের নানা হাস্যরসাত্মক নাটকে গণিকা চরিত্রের রূপায়ণ লক্ষ করা যায় খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে৷ গ্রীক শাসনকর্তা সোলোন যখন সরকারিভাবে গণিকালয় স্থাপন করেন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রীক সমাজে তখন থেকেই গণিকার প্রাদুর্ভাব ঘটে৷ গ্রীক কমেডিতে গণিকাদের টুকরো টুকরো ছবিকে প্রথম যিনি চিত্রিত করেছিলেন তিনি হলেন অ্যারিস্টোফানেস৷ যদিও তিনি তাদের সরাসরি মঞ্চে আনেন নি৷ তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে গ্রীক কমেডিতে আত্মপ্রকাশ করেন মেনান্দার৷ তাঁর নাট্টরূপের যে অসম্পূর্ণ খণ্ডাংশগুলি পাওয়া গেছে তাতে একাধিক বাররামার উপস্থিতি দেখা যায়৷ তাঁর ‘সামিয়ার’ নাটকের নায়িকা ক্রিসিস এবং ‘এপিট্রেপনটেস’-র হাব্রোটোনন উল্লেখযোগ্য গণিকা চরিত্র৷

তাঁর দুই শতাব্দী পরে রোমান নাট্যকার প্লটাস ও টেরেন্স তাঁরই বিষয়বস্তু নিয়ে একাধিক নাটক রচনা করেছিলেন৷ তাঁদের বিশেষ প্রতিভাস্পর্শে গণিকাচরিত্রগুলি অনন্য মাত্রা লাভ করেছিল৷ তারপরে গ্রীসের সামাজিক চিত্র গণিকাদের দ্বারা বা ব্যভিচারের বাড়-বাড়ন্তে কলুষিত হতে থাকে৷ গণিকাবৃত্তি তার প্রাচীন সম্মান থেকে অনেকটাই নীচে নেমে পরিণত হয় বানিজ্যিক গণিকাবৃত্তিতে৷ পানশালা জাতীয় ক্ষেত্রে তারা জায়গা করে নেয় এবং সমাজে গণিকাদের এই পরিবর্তিত দিকগুলিই সাহিত্যে উপস্থাপিত হতে থাকে৷ খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকে লুসিয়ান সামোসাটা নামের একজন রচনাকার (প্রথমে মিশরীয় কিন্তু পরে গ্রীক নাগরিক) সাধারণ স্তরের গণিকাদের নিয়ে লিখলেন ‘ডিয়ালোগ হটেরা’৷ এখানে পনেরোটি কথোপকথনে গণিকাদের জীবনের নানা সুখ-দুঃখ, অনুভব-অনুভূতির কথা খোলাখুলি ব্যক্ত করেছেন৷ এখানে রূপজীবিনীদের পেশাগত নানা কৌশল, অর্থ আদায়ের বিভিন্ন উপায়, প্রেমিকদের বশ করবার নানা ছলাকলা ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ে দিকনির্দেশ ঘটেছে৷

লুসিয়ানের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অ্যালসিফ্রন (জন্মসূত্রে আসীরীয়, বাসসূত্রে গ্রীক) নামের একজন রচনাকার পত্র রচনার মধ্যে গণিকাদের স্থান দিয়েছেন৷ পেরিক্লেসের যুগের সব বিখ্যাত গণিকাদের শ্রুত-অশ্রুত নানা কাহিনিকে অবলম্বন করে তাদের দিয়ে বিখ্যাত সব পুরুষদের পত্র লিখিয়েছেন৷

ইউরোপের অন্ধকার যুগের (৬ষ্ঠ শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত) তমসাচ্ছন্ন সাহিত্য সৃষ্টির যুগে যে দু-একটি উজ্জ্বল তারকা জ্বলজ্বল করে আলো ছড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতমা হলেন সন্ন্যাসিনী রোজউইথা৷ তিনি জার্মানির স্যাক্সানি প্রদেশের গ্যাণ্ডার শেইম মঠে সন্ন্যাসিনী হিসেবে যুক্ত ছিলেন৷ তাঁর রচিত ছয়টি নাটকের সন্ধান পাওয়া যায়, তার মধ্যে সর্বশেষটি অর্থাৎ ‘পাফনুটিয়াস’ নামক নাটিকাটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি৷ থাইস নামের এক পণ্যাঙ্গনার খ্রিস্ট সাধনা দিয়ে পাপের পথ থেকে উত্তরণ এর বিষয়বস্তু৷ অর্থাৎ গণিকাদের যৌনবৃত্তির পাপ থেকে মুক্তির পথনির্দেশ করেছেন তিনি৷

ফ্রান্সে গণিকাদের অস্তিত্ব প্রকট হয়ে উঠেছিল ত্রয়োদশ শতক থেকে৷ সাধারণ পানশালা, রাস্তাঘাট এবং শহরের নানা অলিতে-গলিতে এদের দেখা যেত৷ ক্রমে সাহিত্যের নানা উপকরণে এরা জায়গা নিতে থাকে৷ সেন্ট লুই অত্যন্ত ঘৃণা পরবশ হয়ে তাদের রাজ্য থেকে বের করে দেওয়ার আদেশ দেন এবং বারাঙ্গনাদের যথাসর্বস্ব বাজেয়াপ্ত করার কথাও বলেন৷ পরে জনসাধারণের প্রতিবাদে তিনি নরম হয়ে ধর্মীয় স্থান থেকে দূরে নগরীর বাইরে তাদের থাকার নির্দেশ দেন৷ তাঁর সময়ে পণ্যনারীরা কুষ্ঠরোগীর মত ঘৃণ্য হিসেবে পরিগণিত হয়, তাদের চিহ্নিত করার জন্য বোনা দড়ির মতো একটা জিনিস কাঁধ থেকে ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়৷ তারপর চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি থেকে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ফ্রান্সের নানা শহরে আইনসিদ্ধ গণিকালয় বা ‘প্রস্টিবিউলাম পাব্লিকাম’ প্রতিষ্ঠিত হলে গণিকারা অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পায়৷ এই গণিকা নারীদের দুঃখ-যন্ত্রণার ইতিহাস অত্যন্ত দরদ দিয়ে যিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর নাম ফ্রাঁসোয়া ভিয়োঁ—সমালোচকরা যাঁকে অভিহিত করেছেন ‘পোয়েট অব প্রস্টিটিউশন’৷ তিনি গণিকালয়ে অবস্থান করে অত্যন্ত কাছ থেকে তাদের জীবনকে দেখেছেন এবং তা তাঁর রচনায় স্থান দিয়েছেন৷ তিনি নিঃসন্ধিগ্ধভাবে পরবর্তী যুগের পথ প্রদর্শক৷ ভিঁয়োই প্রথম ব্যক্তি যিনি বিগতযৌবনা গণিকাদের দুঃখ দুর্দশার কথা ভেবেছিলেন৷ তাঁর রচনাগুলি হল—‘দ্য রিগ্রেটস অব অলমের’, ‘ব্যালাডস অব লেডিজ অব বাইগন টাইমস’, ‘দিস ইস দি ব্রথেল হয়ার উই প্লাই আওয়ার ট্রেড’ ইত্যাদি৷

শেক্সপীয়ারের রচনাতেও বহুভাবে গণিকাপ্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে; বিশেষ করে কমেডিগুলির ক্ষেত্রে৷ তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল এলিজাবেথীয় ইংল্যাণ্ডের সমাজজীবনে যুদ্ধব্যবসায়ী সৈনিকদের এবং উচ্চশ্রেণীর ব্যক্তিদের গণিকাসঙ্গের অপরিহার্যতা৷ সে সময় গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে, গণিকাসঙ্গ উপভোগকারী পুরুষের বিরুদ্ধে কঠিন আইন প্রচলিত থাকলেও সরাইখানা, বিশেষ কিছু পল্লী এমনকি সাধারণ উদ্যানেও বারবনিতাদের সতত আনাগোনা ছিল৷ দূতী, দালাল শ্রেণীর মানুষেরা খোলাখুলি ঘোরাফেরা করতো৷ অর্থাৎ আইন-কানুন যাই থাকনা কেন, যত কঠোর শাস্তিই দেহব্যবসা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ধার্য করুক না কেন বৃত্তিটিকে কিন্তু কেউ বন্ধ করতে পারেনি৷ শেক্সপীয়ার তাঁর কিছু নাটকে গণিকাদের পেশা ও ভাষাকে একেবারে জলজ্যান্ত করে তুলে ধরেছেন৷ তাঁর উল্লেখযোগ্য গণিকাচরিত্র সম্বলিত নাটকগুলির মধ্যে অন্যতম হল—‘হেনরি দ্য ফোর্থ’, ‘পেরিক্লেস’, ‘প্রিন্স অব টায়ার’, ‘মেজার ফর মেজার’ ইত্যাদি৷

শেক্সপীয়ার তাঁর নাটকে গণিকা চরিত্রের উপস্থাপন করে পরবর্তী যুগের রচনাকারদের সামনে একটা বন্ধ দরজা খুলে দিয়েছিলেন৷ তাঁর যুগে বা সে সময়ের কিছুটা পরেও গণিকাদের সামাজিক অবস্থান ভালো ছিল না৷ দুঃখ-যন্ত্রণা-বঞ্চনা, প্রেমিকের দয়ার উপর জীবন ধারণ করা ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মর্যাদা ছিল না৷ এই সর্ববঞ্চিত নারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে কলম ধরেন বিভিন্ন শতকের বিভিন্ন সাহিত্যিকেরা৷ তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নাট্যকার ডেকার, আফ্রা বেন, কথাসাহিত্যিক ড্যানিয়েল ডিফো, চার্লস ডিকেন্স প্রমুখরা৷ এঁদের হাতে গণিকা নারীরা একটি বিশেষ রূপে দেখা দিয়ছিল৷ যেমন টমাস ডেকার গণিকাদের নিয়ে লিখেছেন ‘দ্য অনেস্ট হোর’৷ এর নায়িকা বেলাফ্রন্ট দুশ্চরিত্র লম্পট ম্যাথিওর রক্ষিতা ছিল৷ সে বেলাফন্টকে ঠিকমত পয়সা দিত না৷ যার জন্য তাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতেও বাধেনি বেলাফন্ট-এর৷ কিন্তু ক্রমে ক্রমে তার অর্থলোভী রূপটা ঢাকা পড়ে যায়—অন্তরের ঔদার্য ও নারীজনোচিত সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে সে৷ লেখক এক গণিকা নারীর মহৎ গুণকে প্রকাশিত করেছেন রচনাটিতে৷

সপ্তদশ শতকের মহিলা নাট্যকার আফ্রা বেন গণিকাজীবন সম্বলিত কিছু নাটক লিখেছিলেন যেখানে গণিকারা তাদের বঞ্চনাময় জীবনের নানা সমস্যা নিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে৷ তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল—‘দ্য জেলাস ব্রাইডগ্রুম’, ‘দ্য ডাচ লাভার’, ‘দ্য রোভার’, ‘টাউন ফপ’, ‘দ্য সিটি এয়ারেস’ এবং ‘দ্য রাউন্ড হেডস’৷ এগুলির উল্লেখযোগ্য গণিকারা হল—বেটি ফনটিট, এঞ্জেলিক, বিয়াঙ্কা, মোরেট্টা, লুসেট্টা প্রমুখরা৷

অষ্টাদশ শতকের ইংল্যান্ডের সাহিত্যিকদের যাঁদের হাতে গণিকাচরিত্র বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তাঁরা হলেন—ডিফো, ডিকেন্স, অ্যানসওয়াথ প্রমুখরা৷ ডিফো এক উচ্চাকাঙ্খী বারবনিতার জীবনসংগ্রাম ও নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তার বাঞ্ছিত প্রতিষ্ঠা লাভ দেখিয়েছেন ‘মল ফ্ল্যান্ডার্স’ গ্রন্থে৷ এর গণিকা চরিত্র হল মল৷ এক বারবনিতার নামে নামাঙ্কিত করেছেন রচনাটি৷ আবার ডিকেন্স নারীজীবনের নানা অধঃপতনের জন্য, দেহব্যবসার মতো বৃত্তিতে আত্মনিয়োগ করার জন্য পুরুষ, সমাজ ও পরিবেশকে যেমন দায়ী করলেন, সেই পঙ্কে থেকেও রূপোপজীবিনীদের মনুষত্বের মহিমায়, নারীত্বের স্বাভাবিকগুণে বিকশিত করতেও গ্লানিবোধ করলেন না৷ তাঁর ‘অলিভার টুইস্ট’-এর অমর গণিকাচরিত্র ন্যান্সি, ‘ডেভিড কপারফিল্ড’-এর এমিলি, ‘ডম্বে অ্যান্ড সন্স’-এর অ্যালিস সকলেই পুরুষ ও সমাজের নির্মম বঞ্চনার শিকার৷ কিন্তু কেউই কোনোভাবেই তাদের মানবিক গুণগুলিকে নষ্ট হতে দেয়নি৷

ঊনবিংশ শতকের তিরিশের দশক থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু রচয়িতার রচনায় বারাঙ্গনারা তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে দৃঢ় আত্মমর্যাদায় একটু একটু করে প্রতিষ্ঠালাভের চেষ্টা করেছে৷ এ সময়পর্বের উল্লেখযোগ্য গণিকারা হল—মিসেস এলিজাবেথ গ্যাসকেল রচিত উপন্যাস ‘রুথ’-এর নায়িকা রুথ, অ্যান্টনি ট্রোলোপ রচিত ‘দ্য ভাইকার অব বুলহাম্পটন’-এর ক্যারি ব্রাটল ও ‘অ্যান আই ফর অ্যান আই’-এর কেট, হারা, এলিয়টের ‘অ্যাডাম বীড়’ গ্রন্থের হেটি সোরেল, উইলকি কলিনসের ‘নিউ ম্যাগডেলান’ ও ‘ফলেন লীভস’-এর মার্সি মেরিক, সিম্পল স্যালি, জর্জ গিসিং-এর ইভা স্টার (আনক্লাসড), জি,এ, মূরের ‘এস্থার ওয়াটারস’ রচনার এস্টার প্রমুখেরা৷ এই বারনারীদের সবাই যে সমাজের প্রতিকূলতায় বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করেছে তা নয়, কেউ অনায়াসে, অল্প পরিশ্রমে অর্থ রোজগারের বাসনাতেও সেই নারকীয় পথের পথিক হয়েছে৷

ফরাসী সাহিত্যে ফ্রাঁসোয়া ভিয়োঁর হাত দিয়ে গণিকা নারীদের যে ব্যাপ্তি শুরু হয়েছিল অষ্টাদশ শতকে ভলতেয়ার তাদের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি৷ তিনি একজন সমাজ সচেতক ব্যক্তিত্ব৷ তিনি ‘কঁদিদ’ গ্রন্থে বারবনিতা প্যাকেৎ-এর মর্মবেদনাকে যেভাবে অঙ্কিত করেছেন তা ঊনবিংশ শতকের রচয়িতাদের প্রধান অবলম্বন হিসেবে পরিগণিত হয়৷ প্যাকেৎ যে নির্মম পৈশাচিকতার শিকার হয়ে গণিকাজীবনে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে, বেশ্যা হয়ে তাদের প্রতি সমাজের নিদারুণ অনাচারকে প্রত্যক্ষ করেছে এবং বৃদ্ধ বয়সের শোচনীয় পরিণতিতে হাহাকার করে উঠেছে তা ভলতেয়ার যেভাবে তুলে ধরেছেন সর্বদেশের সর্বসমাজে সেই রূপ একই৷

ঊনবিংশ শতকের সাহিত্যে আরেক বিশেষ ধরন সারা বিশ্বের সাহিত্যিকদের সচকিত করে তোলে৷ তা হল প্রচলিত যা কিছু সুন্দর, সুষম, দৃষ্ট ও শ্রুতিনন্দন তাকে নির্মমভাবে পদপিষ্ট করে বিশৃঙ্খল-বিশ্রী-বীভৎসের সাধনা৷ যার কেতাবি নাম ‘রিয়্যালিজম’৷ এই অসুন্দরের সারস্বত সাধনায় প্রতারিত ঘৃণিত, অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চিত নারীগুলি তাদের সমস্ত কদর্যতা সমেত, জীবনের অভিব্যক্তি সমেত সাহিত্যিকের কলমে জায়গা করে নেয়৷ সে সময় বিখ্যাত হয়েছিল—জুল গোঁকুরের ‘জার্মিনি ল্যাসার্তো’, এমিল জোলার ‘লাসোমোয়া, ‘নানা’, ভিক্টর হুগোর ‘মারিও দ্য লোর্ম’, আলেকজান্ডার দুমার ‘দাম’, ‘ক্যামেলিয়া’, অ্যাব প্রভোস্তের ‘মানো লেস্কে’ প্রভৃতি গণিকা চরিত্র সম্বলিত সাহিত্য রূপগুলি৷

এই বাস্তবতার যুগেও গণিকাচরিত্রে আত্মত্যাগ ও ঔদার্য দেখিয়েছেন বালজ্যাক৷ তাঁর ‘পো দ্য শ্যাগ্রাঁ’-র বিয়াট্রিস, ‘সপ্লেন্দার ও মিজের দ্য কুর্তিজান’-এর এস্তার গবসেক প্রমুখ পণ্যনারীরা প্রেমাস্পদের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি৷ চার্লস লুই ফিলিপ, মঁপাসাঁও কোথাও কোথাও গণিকা চরিত্রে মহত্ত্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন৷ শুধু ঔদার্যগুণই নয় তাদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনের গভীরে গিয়ে ডুবুরির মতো অনুসন্ধান করে সত্যকার স্বরূপটিকে বাস্তববাদী ও প্রকৃতিবাদী রচয়িতারা যেভাবে বের করে দেখালেন তাতে স্তম্ভিত না হয়ে পারা যায় না৷ এডমন্ড গোঁকুরের ‘লা ফিই এলিজ্যা’-র হুইসম্যাঁ তাঁর ‘মার্থ’, দোদোর ‘স্যাফো’-তে বাস্তব যন্ত্রণাক্লিষ্ট বাররামাদের জীবন চিত্রিত হয়েছে৷ মঁপাসাঁ সাহিত্যজগতে সার্থক ছোটগল্পকার৷ তিনি ‘মাদমোয়াজেল ফিফি’, ‘বুল দ্য সুইফ’, ‘পলস মিসট্রেস’, ‘লা মেজঁ’ এবং ‘দ্য মাদাম তাইয়ে’ গল্পগুলিতে বারযোষিতদের জ্বালাযন্ত্রণা-জটিলতাহীন অস্তিত্বসমেত দেখিয়েও প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্ব অটুট রেখেছেন৷ আনাতোল ফ্রাঁস বাস্তব পরিবেশের বাইরে গিয়ে ঐতিহাসিক বারবধূদের জীবনকে উপজীব্য করলেন তাঁর রচনায়৷ তাঁর ‘থাইস’ উপন্যাসটি মিশরের র‍্যকোটিস শহরের বিখ্যাত গণিকা থাইসের জীবননাট্যের চিত্ররূপ৷ ফরাসী সাহিত্যিকদের গণিকা নিয়ে সাহিত্য রচনা পরবর্তীসময়ে বিভিন্ন দেশের সাহিত্যিকদের প্রভাবিত করেছিল৷

রাশিয়ার সাহিত্য জীবনে বাস্তববাদ বা প্রকৃতিবাদ পদসঞ্চার করেছিল তার নিজস্ব মননের পথ ধরে৷ আর বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবশ্যম্ভাবীভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল গণিকারা৷ এই চরিত্র নির্মাণে কর্ণধার ছিলেন ডস্টয়েভস্কি, টলস্টয়, টুর্গেনিভ, গোগল, গোর্কি প্রমুখরা৷

ডস্টয়েভস্কির ‘লেটার ফ্রম দ্য আন্ডার গ্রাউন্ড’, ‘দ্য ইডিয়ট’, ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’, ‘ব্রাদার্স কারমাজোভ’ গ্রন্থ চতুষ্টয়ে পণ্যরমণীদের বিচিত্ররূপের প্রকাশ ঘটেছে৷ তিনি তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের দ্বারা দারিদ্র্য, সমাজের অন্যায়, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার এবং তারই পটভূমিকায় কীভাবে পতিতা নারীর সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে এবং সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তাদের চরিত্রের বিকাশ ইত্যাদিকে তুলে ধরেছেন৷

গণিকা চরিত্রের মধ্যে ব্যক্তিত্ব আরোপ করে তাকে বৃহৎ কর্মজগতের বিস্তৃত পরিসরে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন টলস্টয় ‘রেজারেকশান’-এ৷ এর বিখ্যাত গণিকা চরিত্র কাটিয়ে মাসলোভা৷ উপন্যাসটি সারাবিশ্বের মানুষের মধ্যে বিশেষ করে সাহিত্য পাঠকের মধ্যে সাড়া জাগিয়ে দিয়েছিল৷ এই গ্রন্থটির সমগুরুত্বপূর্ণ আরেকটি গ্রন্থ হল—রঁম্যা রল্যাঁর ‘জঁ ক্রিসতফ’৷ এরও মূল উপজীব্য কদর্য দেহজীবিকার গ্লানি থেকে উত্তরণ৷

আবার ম্যাক্সিম গোর্কি গণিকাদের আদর্শ চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত না করেও বারবিলাসিনীদের নিত্য বঞ্চনা-অপমান-অবমাননা ও জীবন ধারণের কঠোর সংগ্রামের মধ্যে থেকেও তাদের মধ্যে মানব হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ বিকাশকে দেখাতে ভোলেননি৷ তাঁর ‘লোয়ার ডেপথ’-এর নাস্টিয়া, ‘ওয়ান অটাম’-এর নাতাশা, ‘ক্রিপি ক্রলার’-এর মাশকা ফ্রলিকা, ‘নীলুশকা’-র ফেলিজোতা প্রমুখরা সকলেই রাজতন্ত্রশাসিত দেশ ও সমাজের আর্থিক বৈষম্যের ফল; তারপরেও সহজাত মানবিকগুণগুলিকে কেউই পরিত্যাগ করতে পারেনি৷

ঊনবিংশ শতকের বিবিধ রুশ সাহিত্যিকের কলমে বিচিত্র রূপ বৈচিত্র্য নিয়ে বারবধূদের যে আত্মপ্রকাশ ঘটছিল তার সামগ্রিক রূপচিত্র পাওয়া যায় বিংশ শতকের প্রথম পাদে আলেকজান্ডার কুগ্রিনের ‘ইয়ম দ্য পিট’ উপন্যাসে৷ সেখানে গণিকাদলের নেত্রী ম্যাডাম মারকোভনা তার পার্লারে জেনকা, মানকা, লিউবকা, নিউরা, তামারা প্রভৃতি নারীকুলকে দিয়ে নাচ-গান-দেহব্যবসা চালায়৷ এই বারযোষিৎদের প্রত্যেকেরই পতনের একটা করে মর্মন্তুদ কাহিনি উপস্থাপন করেছেন রচনাকার৷ তারা দলের মধ্যে থেকেও আলাদা আলাদা করে প্রস্ফুটিত হয়েছে৷ গণিকাদের জীবনচিত্র ব্যাখ্যানে উপন্যাসটি এক অনবদ্য দলিল৷ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ভারতীয় সমাজে গণিকাদের যেরূপ অবস্থান সমগ্র বিশ্বেও তার ব্যতিক্রম নয়৷

নারীজীবনের সবচেয়ে নির্যাতিত, সবচেয়ে অবহেলিত এবং সর্বদিক থেকে নিষ্পেষিত নাম ‘বেশ্যা’৷ শারীরীক গঠনে এরা নারী শ্রেণীর প্রতিনিধি হলেও মর্যাদায় নারী নয়—মানুষও নয়; শুধু শরীর৷ কামার্ত পুরুষসমাজ নারীকে ইচ্ছেমত উপভোগ করার জন্য তার নারীত্বকে হত্যা করে; রাখে শুধু শরীরটাকে৷ তারপর সমস্ত অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে বেশ্যার তকমা দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেহসুখ আস্বাদন করে—ইচ্ছেমত পীড়নও করে৷ আর শুধু শরীর সম্পন্ন মানুষেরা নিক্ষিপ্ত হয় সমাজের প্রান্ত সীমায়, লোকচক্ষুর আড়ালে; তাদের আবাসস্থল পরিণত হয় নিষিদ্ধপল্লীতে৷ শোষক পুরুষের তাতে আরও সুবিধা৷ তার নারীদেহ ভোগকারী পৈশাচিক মূর্তিটা তাহলে কিছুটা হলেও আড়াল হতে পারে৷

পুরুষের নারীদের এই ভোগের বাসনা, ভোগের ক্রিয়াকলাপ বহু প্রাচীন৷ বেশ্যাবৃত্তির প্রাচীনত্বের কোনো সীমা পরিসীমা খুঁজে পান না সমাজতাত্ত্বিকেরা৷ তবে মানবসমাজে সভ্যতার সূচনালগ্নে এ বৃত্তি যে ছিল না তা অনুমিত হয়েছে৷ ধর্ম যতবেশি সমাজকে গ্রাস করেছে; ধর্মপিতারা যত বেশি নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি যত্নবান হয়েছে ততই ঘটতে থেকেছে নারীর অবমূল্যায়ন৷ মানুষ যখন স্বাভাবিক যৌন অনুভূতির পরিপূরকতায় নারীকে গ্রহণ না করে নটী, ঊর্বশী করে তোলে আর তার পথ ধরেই সৃষ্টি হয় গণিকা৷

প্রাচীনসমাজে গণিকাদের প্রতি সমাজ প্রতিভূদের দ্বৈতমনষ্কতার পরিচয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ৷ তারা গণিকাদের ঘৃণা করে এসেছে নরকের দ্বার হিসেবে চিরকালই, আবার বৃত্তিটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বর্ষণ করছে নানা উপদেশাবলী৷ ‘কামশাস্ত্র’, ‘অর্থশাস্ত্র’-তে শাস্ত্র নির্দেশ দেয় রাজা, ধনী, বণিক, সকলকে অকুন্ঠ গণিকাগমনে, ‘বিষ্ণুপুরাণ’ এদের জন্য স্বতন্ত্র্য এক বিধানের কথা বলেছে যার নাম ‘অনঙ্গব্রত’; অনঙ্গ অর্থাৎ কামদেবের আরাধনা, যাতে তার বৃত্তি সাফল্যমণ্ডিত হয়, ‘মনুসংহিতা’-য় গণিকাগমনকে সর্বোতভাবে পরিত্যজ্য বলা হয়েছে, গণিকাগমনজনিত পাপের প্রাজাপত্য প্রায়শ্চিত্ত বিধানও অনেক ধর্মকার দিয়েছেন৷ অর্থাৎ গণিকাদের জন্য সমাজে স্পষ্ট দুটি মনোভাব লক্ষিত হয়—প্রথমত গণিকাবৃত্তি একটি প্রয়োজনীয় অশুভবৃত্তি আর দ্বিতীয়ত গণিকা সর্বতোভাবে অশুভ ও পরিহার্য৷

কোনো নারী জন্ম থেকেই গণিকা হয় না৷ তার সমাজ-পরিবেশ-প্রতিবেশ তাকে ঠেলে দেয় এই বৃত্তির অন্ধকূপে৷ সমাজের অন্যান্য বৃত্তির মতোই এই নিষ্ঠুর বৃত্তিও সমাজের এক অংশের পুরুষের চাহিদা মেটানোর জন্য তৈরি হয়েছিল বললে অত্যুক্তি হয় না৷ যদিও অধিকাংশ গণিকাবৃত্তিধারিণীই রূপে গুণে হীন ও উপার্জনে স্বভাবতই দীন ছিল৷ তারপরেও যে কজন শিক্ষিতা সুন্দরী রুচিবান বিনোদিনীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কুলরক্ষক পুরুষেরা নিজেদের অর্থ উপার্জন প্রায় নিঃশেষ করে ফেলে তার সমস্ত দোষ গিয়ে বর্তায় সেই দেহজীবার কাছেই৷

যে সমাজ নারীকে চরিত্র সংযমের কঠিন আবর্তে পাক দিয়ে গেছে, যে সমাজে ‘সতী’ শব্দের কোনো পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই, যে সমাজ ‘চরিত্র’ বলতে শুধুমাত্র যৌনশুচিতাকেই বুঝিয়েছে সেখানে মুহূর্তের সামান্যতম ভ্রান্তিতে নারী নিক্ষিপ্ত হয়েছে গণিকালয়ে৷ আর পুরুষের যৌন প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে নারীদের এই অপমান অব্যহত থেকেছে৷ তাই উজ্জয়িনীর নগরলক্ষ্মী বলে যে বসন্তসেনা অভিহিত ছিল তাকেই বিটের মুখ দিয়ে নাট্যকার দেহজীবা বলে সচেতন করে দিয়েছে, ‘বিষ্ণুপুরাণ’, ‘পরাশর সংহিতা’, ‘অত্রি সংহিতা’-য় গণিকাগমনের প্রায়শ্চিত্তের কথা আছে, রামায়ণ-মহাভারতে এত সংখ্যক নারীদের পুরুষের সেবার জন্য দান করার পরেও তাদের সম্পর্কে অনেক নিন্দাসূচক মন্তব্য বিবৃত হয়েছে৷ বলা হয়েছে গণিকা সংসর্গ পাপ, নগরের দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ যমের দিকে গণিকালয় নির্মাণ করাবার কথা৷ মধ্যযুগের ‘মানোসোল্লাস’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে নগরের প্রান্তদেশে অর্থাৎ লোকালয়ের সীমার বাইরে থাকবে বেশ্যাপল্লীগুলো৷ যে শিক্ষা, কলা, চরিত্র, গাম্ভীর্য সর্বোপরি সর্বাঙ্গীন শিক্ষিত রূপবতী নারীরা তাদের বিদ্যাবুদ্ধির আকর্ষণ-মাধুরী দিয়ে গণিকাধক্ষের দ্বারা ‘গণিকা’ আখ্যা পেত (কামশাস্ত্র) তাদের প্রতি যদি সমাজের এত ঘৃণাসূচক ব্যবহার লক্ষিত হত তাহলে অগুনতি সেই দাসী হয়ে যাওয়া গণিকাবৃত্তিধারী শিক্ষা-সৌন্দর্য রুচিহীন নারীদের কি পরিণতি হতো তা ভাবতে গা শিউরে ওঠে৷

গণিকাকে ঘৃণা করতো সমাজ কিন্তু তার উপার্জন, তার অর্থসম্পদকে নয়৷ তাইতো তাদের রাজস্ব দিয়ে রাষ্ট্রের কোষাগার স্ফীত হয়ে থাকতো, কৌটিল্য, বাৎস্যায়ণ যার প্রমাণ রেখে গেছেন৷ বৌদ্ধ সাহিত্যের আম্রপালী বৌদ্ধভক্তদের জন্য ‘আমবাগান’ই দান করেছিল, জৈন সাহিত্যের বিত্তবান গণিকা চিত্রশালা প্রতিষ্ঠা করে, জৈন মঠে প্রচুর দান ধ্যান করে জনহিতকর নানা কাজে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে৷ সমাজ অকপটে এদের দান গ্রহণ করে গেছে কিন্তু তাদেরকে গ্রহণ করতে পারেনি৷

গণিকারা মহাপাপী৷ কিন্তু পৌরাণিক সংস্কারে দেখা যায় যে দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণের জন্য গণিকালয়ের মাটি অত্যন্ত আবশ্যিক উপাদান৷ এ রহস্যের সমাধান কিছুটা পাওয়া যায়—মহাব্রতা যাগে পুংশ্চলীর সঙ্গে ব্রহ্মচারীর সংলাপ কিংবা ব্রাত্যস্তোমে৷ যৌনতার মধ্য দিয়ে প্রজননধারা যেমন অব্যাহত থাকে তেমনি গণিকাবৃত্তিও যৌনতারই পরিপোষক৷ তাই কোথাও কোথাও যেন যৌনতা, প্রজনন, গণিকা এক হয়ে যায়৷ তাই উর্বরাতত্ত্বের নানা লৌকির আচারাদি প্রসঙ্গে নৃতাত্ত্বিক বিভিন্ন গ্রন্থাদিতে লক্ষ করা যায় ক্ষেত্রের উপর নরনারীর মিলন, উত্তরবঙ্গের রাজবংশী লোকাচারে ‘হুদুমদেও’ বা ‘জলমাঙ্গা’-র গানে বিবস্ত্র নারীগণের রাতের গভীর অন্ধকারে ক্ষেত্রের মধ্যে উদ্দাম লাস্যনৃত্য৷ অর্থাৎ এই যৌন ইঙ্গিত উর্বরা তন্ত্রের পরিপোষক৷ গণিকারা যৌনতার প্রতীক হিসেবে নানা যজ্ঞীয় অনুষ্ঠানে স্থান পেয়েছে৷ অপরদিকে কোথাও কোথাও শষ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গার সঙ্গে যৌনশক্তি তথা উর্বরতার প্রতীক গণিকাদের সহধর্মীতার সাদৃশ্যে দুর্গামূর্তিতে বারাঙ্গনার গৃহমৃত্তিকা আবশ্যিক বলে গৃহিত হয়েছে৷ যদিও গণিকার জননীত্ব গৌণ তবু তার যৌনত্বই উর্বরতার আবহ বহন করে বলে বেদ থেকে দুর্গাপূজা পর্যন্ত কৃষিজীবি সমাজে তার এই স্থান বলে মনে করেছেন প্রাবন্ধিক সুকুমারী ভট্টাচার্য৷ মানুষ তার সুবিধা আদায়ের জন্য গণিকাদের যতটুকু কাজে লাগানোর দরকার ততটুকুই করেছে তার বাইরে বেশ্যারা অপাংক্তেয়৷ আর যৌনতার জন্যই এরা পরিণত হয়েছে প্রান্তিক মানুষে৷ এই অসহায় চিরবঞ্চিত, লাঞ্ছিত নারীরা জীবনভর শুধু অপমানই ভোগ করেছে, ধনীরা তাদের উদ্বৃত্ত অর্থের বিনিময়ে অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তুর মতই নারীশরীর ক্রয় করেছে, নির্বিচারে উপভোগ করেছে তার পর ছুড়ে ফেলে দিয়েছে৷ নারীর এই ভয়াবহ পরিণতিতে চরমতম দুরবস্থায় সমাজ মুখে কুলুপ এটে পৌরুষের জয়গান গেয়েছে৷

এই গণিকা বা বেশ্যাদের মর্মান্তিক জীবনধারা নিয়ে কিছু একটা করার বাসনা আমার অনেক দিনের পুরোনো অর্থাৎ যখন বুঝতে পারি যে বেশ্যা কাদের বলে৷ ছোটবেলায় সচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল পাগল স্বামী ও শিশুপুত্র নিয়ে সহায়-সম্বলহীন অসহায় এক নারীর দেহজীবিকার মাধ্যমে উপার্জন করা এবং সামাজিক অসহযোগিতা—অবশেষে তার নির্মম মৃত্যুর মতো ঘটনা৷ তার এই জীবনযুদ্ধ এবং পরাজয় আমাকে দেহজীবী সমাজপতিতা নারীদের প্রতি ভাবনার এক বৃহৎ ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়৷ অবশেষে বেশ্যাদের জন্য কিছু করার কল্পনাবিলাস বাস্তবের মাটি স্পর্শ করে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. দীপককুমার রায় মহাশয়ের সান্নিধ্যে৷ তখন তিনি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন অর্থাৎ ২০১২-১৪ সাল৷ আমি সে সময় তাঁর তত্ত্ববধানে এই গণিকা নারীদেরই একটা দিক নিয়ে এম. ফিল ডিগ্রী অর্জন করি৷ গণিকা তথা গণিকা বিষয়ে আমার অনুসন্ধান অব্যাহত থাকে৷ এ বিষয়ের উপর তাত্ত্বিক ও আকর গ্রন্থগুলির অধ্যায়ের সুবাদে পরবর্তীসময়ে এক বৃহত্তর গবেষণাকর্মের দিকনির্দেশ পেয়ে যাই এবং ড. দীপককুমার রায় মহাশয়ের উৎসাহ , প্রেরণা ও তত্ত্বাবধানে ‘বাংলা উপন্যাসে গণিকা চরিত্র (১৮৬৫-১৯৪৭)’ শীর্ষক শিরোনামে পি. এইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করি৷ এ গ্রন্থ সেই গবেষণা কর্মেরই ফল৷

এই যে যুগ যুগ ধরে অবহেলিত এই নারীরা স্থান পেয়েছে সাহিত্যের বিচিত্র বেদীতে বর্তমান সময়ে তাদের অবস্থা আরও জটিল৷ নারীর স্বাধীকারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিবর্তিত হচ্ছে তাদের জীবন; তাদের অবস্থান৷ সমাজের একশ্রেণী তাদের দিকে মুখ তুলে চাইছে—তাদের জীবন যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে৷ বিশ শতকের নানা উপন্যাসাদিতে আলোচিত হয়েছে তারই নানা ব্যাখ্যান৷ এটি হচ্ছে প্রান্তিক মানুষের চর্চা৷ বর্তমান যুগে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এই প্রান্তিক মানুষের চর্চা খুব জরুরী৷ এখানে সমাজের সর্বদিক দিয়ে অবহেলিত এবং ঘৃণিত নারীকুলের সামগ্রিক চিত্রকে অনুধাবন করা যায়৷ যে প্রবৃত্তির দাহকে মেটানোর জন্য পুরুষ তার নিজের প্রয়োজনে বেশ্যা তৈরি করেছে, নিজের সুরক্ষার জন্য সমাজের প্রান্তসীমায় নিক্ষেপ করেছে-সেখান থেকে তাদের মুক্ত করার দায় অস্বীকার করার প্রবণতা পুরুষের মধ্যেই প্রবল৷

 কোনো গণিকালয়ই নারীর ইচ্ছায় গড়ে উঠেনি—তারা তার সৃষ্টিকর্তাও নয়৷ পুরুষের সতর্ক প্রহরায়, সচেতন মানসিকতায় সৃষ্ট সেই যৌনখোঁয়াড়ে ধুকে ধুকে মরে দেহব্যবসায়ী নারীর দল; যদিও তারা শরীর দেয় এবং পুরুষেরা অর্থের বিনিময়ে তা গ্রহণ করে অতৃপ্ত যৌনক্ষুধা পরিতৃপ্ত করে৷ তারা বহুপুরুষভোগ্যা নারীর জন্য বেশ্যালয় তৈরি করেছে কিন্তু বহুনারীভোগ্যা পুরুষের জন্য আজ পর্যন্ত স্বতন্ত্র কোনো আলয় তৈরি হয়নি৷ সমগ্র আলোচনার মধ্যে পুরুষের অত্যাচারে, সমাজের অত্যাচারে নারীর গণিকা হওয়ার নির্মম চিত্র যেমন রয়েছে; তেমনি তা থেকে মুক্তির জন্য বুকফাটা আর্তনাদও ধ্বনিত হয়েছে৷ বিভিন্ন সাহিত্যিকের কলমে তাদের জন্য সহানুভূতি বর্ষিত হয়েছে—সমাজে মানুষ হিসেবে তাদের মর্যাদাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সদুপদেশ, সৎপ্রচেষ্টা রয়েছে কিন্তু প্রকৃতভাবে এই একবিংশ শতাব্দীতে তারা কতটা মর্যাদার অধিকারী তার প্রকৃত স্বরূপ কারও অনবগত নয়৷ যেদিন সমাজপতিতা এই নারীরা দেহজীবিকার নারকীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারবে—যেদিন নারীর যৌনতাকে পণ্য করে পুরুষ সমাজ আর যৌনপরিতৃপ্ততার উপায় খুঁজবে না সেদিনই গণিকা নারীদের প্রকৃত মুক্তি ঘটবে—বলে আমি মনে করতে পারি৷

জলপাইগুড়ি

২৫.১১.২০২০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *