কিশোরসমগ্র ২ – শাহরিয়ার কবির
কিশোরসমগ্র ২ – শাহরিয়ার কবির
ভূমিকা
কিশোরসমগ্র ২য় খণ্ডে রয়েছে আশির দশকে লেখা আমার প্রিয় চারটি উপন্যাস যেগুলো অন্য সব উপন্যাসের চেয়ে আকারেও বড়। এ ছাড়া রয়েছে ক্ষুদে উপন্যাস ‘র-নগরের আজব সার্কাস’ আর দুটো বড় গল্প, যেগুলো লেখা হয়েছে কলেজে পড়ার সময়, ছাপা হয়েছিলো সেই সময়ের কচি ও কাঁচায় ।
সবার আগে বলি ‘পাথারিয়ার খনি রহস্যে’র কথা। ছিয়াত্তরে আমার দ্বিতীয় কিশোর উপন্যাস ‘নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়’ বই আকারে বেরোনোর পর অনেক প্রশংসা পেয়েছিলো । তখন থেকেই এর পাঠকরা ঝুলোঝলি করছিলো আবির বাবু আর ললি টুনিদের নিয়ে আরও লেখার জন্য। ক্ষুদে পাঠকদের চাপে আবু, রামু, বিজুদের নিয়ে যেমন কয়েকটা গল্প আর উপন্যাস লিখেছি তেমনি আবিরদের নিয়ে লিখতে হয়েছে ‘পাথারিয়ার খনি রহস্য।’ আমার কোনো কোনো উপন্যাসের ভূমিকায় লেখকের বক্তব্য আছে। ’৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাথারিয়ার ভুমিকায় লিখেছিলাম—
‘এক যুগ আগে বেরিয়েছিলো নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়। তখন বলেছিলাম— আবির, বাবু, ললি, টুনিদের নিয়ে আরো লেখার ইচ্ছে আছে। সেই থেকে নুলিয়াছড়ির পাঠকরা আমার পেছনে লেগেছে, পরেরটা কবে বেরোবে। বারো বছরের বেশি সময় লাগলো আবিরদের নিয়ে আরেকটি বই লিখতে। এ সময়ে যদিও ছোটদের জন্য বেশ কয়েকটি বই লিখেছি, তবু নুলিয়াছড়ির পাঠকরা এক যুগ আগের প্রতিশ্রুতি আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে ।
‘পাথরিয়া’র কাহিনীর ছক বহু আগেই করে রেখেছিলাম। আমার এক বন্ধু ভূতত্ত্ব বিভাগে পড়তো । অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলো, পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হয়ে গেলো । আমার সেই বন্ধুটির কাছে প্রথম শুনি পাথারিয়ার কথা। ম্যাপ চুরির ঘটনাও বলেছিলো সে। পরে পাথারিয়া গিয়ে নিজ কানে শুনে এসেছি ‘পাহাড়ের হৃৎকম্পন’। তখনই ঠিক করেছিলাম আবিরদের পাথারিয়া আনতে হবে ।
‘আমার বন্ধু আশীষ সিলেটের আঞ্চলিক সংলাপগুলো লিখতে সাহায্য করেছে। পাথারিয়া সম্পর্কে আরো তথ্য দিয়েছে আমার বন্ধু মশগুল। পাথারিয়া যখন লেখা শুরু করি আমার প্রিয় বন্ধু শিল্পী কাজী হাসান হাবিব তখন মৃত্যুশয্যায়। ওর ক্যান্সার হওয়ার খবর পেয়ে লেখার সব উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলাম । অথচ হাবিব প্রায় প্রতিদিনই তাড়া দিয়েছে লেখা কদ্দুর এগুলো, বইমেলায় বের করতেই হবে। হাবিবের কথা আমি রেখেছি কিন্তু হাবিব আমাদের ছেড়ে চলে গেছে । এ বই সম্পর্কে তোমাদের বলতে গিয়ে হাবিবের কথাই বেশি মনে পড়ছে।’
শুধু হাবিব নয়, আমার ভূতত্ত্ব বিভাগের সেই বন্ধুটি, যার নাম ছিলো চুন্নু— সেও অল্প বয়সে মারা গেছে । ‘পাথারিয়া’র সঙ্গে আমার দুই প্রয়াত বন্ধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে ৷
ছোটবেলায় পড়তাম মিশনারি স্কুলে । কী আনন্দেই না কেটেছিলো স্কুল জীবনের এগারোটি বছর। স্কুলে যারা বন্ধু ছিলো, আর যাঁরা শিক্ষক ছিলেন তাঁদের কথা আমার বহু গল্প আর উপন্যাসে এসেছে। আমার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষকদের একজন ছিলেন স্কাউট স্যার নিকোলাস রোজারিও। তাঁকে নিয়ে পুরো একটা উপন্যাসই লিখেছিলাম, যেটি এখনো আমার প্রিয় । ‘৮৮ সালে এর ভূমিকায় লিখেছিলাম—
‘এই লেখাটি ‘ধান শালিকের দেশে’ পত্রিকায় প্রথম বেরিয়েছিলো। পাঠকের অনেকে প্রশ্ন করেছে, নিকোলাস স্যার কি সত্যি আছেন? এসব ঘটনা কি সত্যি ঘটেছিলো? নিকোলাস স্যার থাকবেন না কেন? বয়স বেড়েছে যদিও, এখনো আমাদের সেই মিশনারি স্কুলে পড়ান তিনি । তবে স্কাউটিং ছেড়ে দিয়েছেন । এখন যিনি স্কাউট টিচার তাঁর নামও নিকোলাস রোজারিও।
‘এই উপন্যাসটি লিখতে বসে দেখি—সেই কবে দুই যুগ আগে স্কাউটিং করেছি, সব ভুলে বসে আছি । ভাগ্যিস শিবলী বেডেন পাওয়েলের বইটা জোগাড় করে দিয়েছিলো । এতেও যখন হলো না তখন সেই নিকোলাস স্যারেরই শরণাপন্ন হতে হলো । নিকোলাস স্যারের সঙ্গে বাইশ তেইশ বছর পর দেখা । চিনতে পারেননি প্রথম । অথচ ব্রাদার হোবার্ট ঠিকই চিনলেন । ব্রাদারকে যখন বললাম, ‘চিনতে পেরেছেন ব্রাদার?’ বললেন ‘চিনতাম না ক্যান । তয় স্কুলে যখন পড়তা তখন তোমার মোছ আছিল না, মাথায় টাকও আছিল না।’ ব্রাদার হোবার্ট আগের মতোই আছেন। তবে ব্রাদার পিটার আর ব্রাদার ফিলিপ্স আমাদের স্কুলে থাকার সময়ই চলে গিয়েছিলেন। নিখিল স্যার শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। নিকোলাস স্যার বললেন, এখন নাকি আগের মতো স্কাউটিং হয় না। অনেক অদল বদল হয়েছে নিয়ম কানুনের। দুদিন বসে অনেক গল্প করেছি নিকোলাস স্যারের সঙ্গে। একথা কী করে ভুলি— আমার ভেতর যে এ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মনটি রয়েছে, সেটি নিকোলাস স্যারের নিজের হাতে গড়া । আমাদের আগে যারা পড়েছেন সেই স্কুলে, পরেও যারা নিকোলাস স্যারকে পেয়েছে, তারা সবাই জানে গল্প বলায় ওঁর জুড়ি নেই । স্কাউটিং করতাম নিকোলাস স্যারের জন্যই । সেই সময় যারা স্কাউটিং করতো নিকোলাস রোজারিও তাদের সকলের খুবই চেনা মানুষ ৷ ‘
‘বাচবনে ঝড়’ অন্যরকমের উপন্যাস। আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি জটিল বিষয় কিশোর উপন্যাসের বিষয় হতে পারে কি না সেই পরীক্ষাটি এতে করা হয়েছে। ক্ষুদে পাঠকদের প্রশংসা শুনে মনে হয়েছে কাজটি আমি ঠিক মতো করতে পেরেছি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জটিল সমস্যার পটভূমিতে লেখা ‘সীমান্তে সংঘাত’, যেটা অনেক পাঠকের মতে আমার সেরা লেখা। বিদ্রোহী চাকমাদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি হওয়ার এক যুগেরও বেশি সময় আগে লেখা এ উপন্যাসটি পড়ে আমার চাকমা বন্ধুরাও তখন প্রশংসা করেছিলো।
তখনকার পাঠক আর এখনকার পাঠক এক নয়। সময়ের দাবি মেটাতে গিয়ে আমার লেখার বিষয়ও বদলেছে। তবু পুরোনো লেখা পড়তে এখনও আমার ভালো লাগে । শা.ক
ফেব্রুয়ারি, ২০০১
Leave a Reply