০৯-১০. গোপন কারাগারে রিস্টো ও নীল

০৯. গোপন কারাগারে রিস্টো ও নীল

জায়গাটা ছিলো গভীর বনের ভেতর পুরোনো এক সামরিক ঘাঁটি, যেখানে ছোটখাট জেলখানাও রয়েছে। সোফিয়া থেকে দূরুত্ব গাড়িতে দেড়-দু ঘন্টার মত। সবচেয়ে কাছের জনপদ আলাবিন এখান থেকে তিন মাইল দূরে। পুভদিভ সাতাশ মাইল। নীলকে রাখা হয়েছে দশ বাই বারো ফুটের একটা কামরায়। এখানে আসার পরে চব্বিশ ঘন্টা কেটে গেছে। দুদিকের দেয়াল ঘেঁষে দুটো সরু লোহার খাট পাতা, ওপরে কম্বল বিছানো। এক কোণে পানির কল আর চেয়ার কমোড়। সামনের দেয়ালে মোটা লোহার শিক দিয়ে বানানো দরজা, উল্টোদিকে সিলিং-এর কাছে ভেন্টিলেটারের মত ছোট জানালা। জানালায় দরজার মত লোহার শিক দেয়া। দেয়ালগুলো ভারি আর সাতসেঁতে। দেখেই মনে হয় এসব ঘর কয়েদখানা হিসেবে ব্যবহার করার জন্য বানানো হয়েছে। বিশেষ ধরনের বন্দীদের রাখা হয় এখানে।

নীলের ঘরের দুপাশে আরো পাঁচ ছয়টা ঘর রয়েছে, সেগুলোর ভেতর কোনও লোকজন নেই। ভারি একটা লোহার দরজা পেরিয়ে এসব ঘরে আসতে হয়। সেই দরজার কাছে একজন বন্দুকধারী প্রহরী। গোটা জায়গাটা কবরের মতো নিস্তব্ধ। আটঘন্টা পর পর প্রহরী বদল হয়। মাঝে মাঝে প্রহরীদের বুটের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ শোনা যায় না।

গতকাল দুপুরে এখানে আনার পর রিস্টোকে ওরা অন্য কোথাও নিয়ে গেছে। তখন থেকে এই বন্ধ সেল-এ নীল একা। তিনবেলা বাটিতে করে ঘন সুপের মতো বস্তু আর এক টুকরো কালো রুটি দিয়ে যায় একজন উর্দিপরা সৈন্য। দরজা খোলে না, চৌকো একটা ছোট ফোকর আছে দরজার নিচে, তার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দেয়। আবার একঘন্টা পর এসে নিয়ে যায়। নীল প্রথমে ভেবেছিলো খাবে না, হাঙ্গার স্ট্রাইক করবে। কাল দুপুরে যে সৈন্যটা খাবার নিয়ে এসেছিলো তাকে নীল ধমক দিয়ে বলেছে, এসব নোংরা খাবার আমি খাবো না। তোমাদের অফিসারের সঙ্গে কথা বলবো আমি।

ভাবলেশহীন চেহারার সৈন্যটা নির্লিপ্ত গলায় বলেছে, তোমার চাওয়া মত অফিসার আসবেন না। অফিসারের দরকার হলে তিনি আসবেন।

নীল তবু গোঁ ধরে বলেছে, আমি এসব খাবার খাবো না।

এখানে এ খাবারই খেতে হবে। আগের মত যান্ত্রিক গলায় বলেছে সৈন্যটা। না খেলে আমার করার কিছু নেই। একঘন্টা পর এসে বাটি নিয়ে যাবো।

দুপুরের খাবার ফিরিয়ে দিয়েছিলো নীল। বিকেলের পর প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। কল ছেড়ে আঁজলা ভরে পানি খেয়েও খিদে দূর হয় নি। রাতে আবার যখন দুপুরের মত খাবার দিয়ে গেলো, তখন আর ফিরিয়ে দিতে পারে নি নীল। স্বাদহীন সেই ঘন সুপ আর শক্ত কালো রুটি সবটুকু খেয়ে ফেলেছে।

কাল থেকে নীল বাড়ির কথা ভাবছে। মা নিশ্চয়ই কান্নাকাটি শুরু করেছেন। রীনও লুকিয়ে কাঁদবে। একবার খেলতে গিয়ে বাড়ি ফিরতে রাত হয়েছিলো। তাতেই মা কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। তোবারক আর রবিনদা নিশ্চয় মন খারাপ করে বসে আছে। বাবা যখন জানবেন ওকে এ্যারেস্ট করেছে তখন কী করবেন? নীলের একবার মনে হলো বাবা জানবেন কিভাব ওকে যে এ্যারেস্ট করেছে! এখানে আসার পথে বন্ধ ভ্যানে বসে এক ছেলেমানুষি কাণ্ড করেছে রিস্টো। এখন ছেলেমানুষি মনে হলেও তখন নীলও রিস্টোর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলো। ওদের ভ্যানে তোলার সময় রিস্টোর ব্যাগটা ভেতরে ছুঁড়ে দিয়েছিলো মিলিশিয়ার লোকটা। ভ্যান ছাড়ার পর কিছুক্ষণ ওরা দুজন পাথরের মত নিশ্চল হয়ে বসে রইলো। একই হাতকড়ায় নীলের ডান হাত আর রিস্টোর বাম হাত বাঁধা। এবড়ো থেবড়ো পাথুরে রাস্তাটুকু কোনও রকমে পার হয়ে ভ্যানটা হাইওয়েতে উঠে স্পীড বাড়িয়ে দিলো। রিস্টো উঠে লোহার পাতের জানালাগুলো ঠেলতে লাগলো–কোনওটা খোলে কিনা। কয়েকটা জানালা দেখার পর একটার নিচে সামান্য ফাঁক করতে পেরেছিলো। সেই ফাঁকে অনেকক্ষণ চোখ রেখে রিস্টো বললো, আমরা প্রভদিভের দিকে যাচ্ছি–।

নীল বলল, রাস্তায় লোকজন দেখতে পাচ্ছিস? চীৎকার করলে কেমন হয়?

হাইওয়েতে লোক কোথায়? একটা দুটো গাড়ি কেবল দেখা যাচ্ছে। আর লোক থাকলেও চিৎকার করে লাভ হবে না। এরা তো ডাকাত নয় যে আমাদের কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে! এটা প্রিজন ভ্যান। বন্দীদের এসব গাড়িতে করেই নেয়া হয়।

নীলের মত বুদ্ধিমান ছেলেরও মাথা গুলিয়ে গিয়েছিলো। রিস্টোকে বললো, কিছু একটা বুদ্ধি বের কর।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ভাবলো রিস্টো। তারপর বললো, আমার ব্যাগে সিটিযেন কমিটির কতগুলো ইশতেহার আছে। এগুলোতে লিখে খবর পাঠাবো।

ব্যাগের ভেতর কলমও ছিলো। রিস্টো ইশতেহারের উল্টো পিঠে লিখলো–

সিটিযেন কমিটির বন্ধুদের প্রতি। আমার নাম রিস্টো প্লানেভ। আমাকে আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের ছেলে নীলকে মিলিশিয়া ধরে নিয়ে যাচ্ছে দুভদিভের দিকে। দয়া করে যথাস্থানে খবর দাও।

লেখা শেষ হলে ইশতেহারটা ভাঁজ করে চলন্ত ভ্যানের জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে ফেললো। কোথায় পড়লো ওরা বুঝতে পারলো না। রিস্টো আরেকটা ইশতেহারে একই কথা লেখা আরম্ভ করলো।

চলন্ত ভ্যানে লিখতে গিয়ে হাতের লেখা দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছিলো। তবু একটার পর একটা ইশতেহারে ওদের কথা লিখে গেছে রিস্টো, আর নীল সেটা ভাঁজ করে জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে ফেলেছে। বেশির ভাগ ইশতেহারই বাতাসের ঝাপ্টায় এমন জায়গায় গিয়ে পড়লো যেখানে কোনো মানুষেরই নজর পড়বে না।

বন্ধ কুঠুরিতে বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে গিয়ে নীলের একবার মনে হলো, বাবা এতক্ষণে নিশ্চয় খবর পেয়ে গেছেন। গাড়ি নিয়ে রওনাও হয়ে গেছেন প্রভদিভের পথে। রবিনদা আছে, তোবারক ভাই আছে–যথেষ্ট বুদ্ধিমান ওরা। একজন রাষ্ট্রদূতের ছেলেকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করা একটা সাংঘাতিক ঘটনা! সোফিয়ার কূটনীতিক মহলে এতক্ষণে নিশ্চয় তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। ঝিভকভের সরকারকে এর জন্য জবাবদিহি করতেই হবে।

রিস্টোর কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হলো নীল। কোথায় নিয়ে গেছে ওকে? নিশ্চয় মারার আগে ভালোমত জেরা করবে ওকে। কথা বের করার জন্য ওর ওপর নানা কায়দায় অত্যাচারও করবে। রিস্টো কি পারবে সহ্য করতে? এখনো কি বেঁচে আছে রিস্টো? ভাবতে গিয়ে নীলের বুকের ভেতর জমে থাকা কান্নার সমুদ্রে ঝড় উঠলো।

বাইরে দিনের আলো ম্লান হয়ে এসেছে। নীলের ঘরের সিলিং-এর সঙ্গে কম পাওয়ারের একটা বাল্ব লাগানো। সন্ধ্যার পর থেকে নীল লোহার খাটে শুয়ে সারাক্ষণ রিস্টোর কথা ভাবছিলো। বার বার ঘুরে ফিরে ওর মনে হচ্ছিলো রিস্টোকে এরা মেরে ফেলবে। ওর মা বাবা কেউ জানবেন না ওদের হাসি খুশি, প্রচণ্ড সাহসী, দয়ালু আর বিনয়ী ছেলেটা কখন কিভাবে মারা গেছে। রিস্টো ওঁদের একমাত্র ছেলে। এসব কথা ভাবতে গিয়ে নীল টেরও পেলো না কখন ওর দুচোখ বেয়ে কান্না গড়িয়ে পড়েছে।

.

রিস্টোকে ওরা অন্য কোথাও নেয় নি। নীলকে যে ব্লকে রাখা হয়েছে এরকম আরও একটা ব্লক আছে মূল বাড়িটার উল্টো দিকে। নীল ঠিকই ভেবেছিলো। রিস্টোকে ওরা আলাদা জায়গায় রেখেছে জেরা করার জন্য। সকাল থেকে এক নাগাড়ে জেরা শুরু হয়েছে।

মোটা সোটা এক অফিসার, চেহারাটা বুলডগের মত থ্যাবড়ানো, বসেছিলো চারকোণা লোহার টেবিলের উল্টো দিকে। হাতকড়া লাগানো রিস্টো বসেছে ওর মুখোমুখি।

বুলডগের মত অফিসার প্রথমে ওর নাম, বাবা মার নাম ঠিকানা, নীলের পরিচয় সব নোট করলো। তারপর ঘেউ ঘেউ করে জিজ্ঞেস করলো, তোদের ক্লাসের আর কে কে আছে এসবের ভেতর?

রিস্টো ভয় পাওয়ার ছেলে নয়। নির্বিকার গলায় উত্তর দিলো, সবাই আছে।

সবাই মানে? চোখ পিট পিট করে প্রশ্ন করলো বুলডগ।

ক্লাসের সব ছেলে। শুধু ক্লাসের কেন, স্কুলের সব ছেলেই আছে আমাদের সঙ্গে।

স্কুলের সব ছেলে মানে নার্সারিতে পড়া ছেলেমেয়েরাও? সব কথা একটু দেরিতে বোঝে বুলডগ।

হ্যাঁ, নার্সারির ছেলেরাও। গম্ভীর গলায় জবাব দিলো রিস্টো।

তুই বলতে চাস স্কুলে যে পার্টির সেন্ট্রাল কমিটি আর পলিট ব্যুরোর কমরেডদের ছেলেমেয়েরা পড়ে–তারাও এসব বদমাইশি করে বেড়াচ্ছে?

বলেছি তো সবাই।

নার্সারির তিন বছরের বাচ্চারাও।

হ্যাঁ বাচ্চারাও।

চোপ নচ্ছাড়! ঘেউ ঘেউ করে উঠলো বুলডগ–আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারা হচ্ছে। ভেবেছিস আমি সব জানি না?

সবই যদি জানো আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন?

একশবার জিজ্ঞেস করবো তোকে। ওরে কে আছিস? ছোঁড়াটা আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছে। একটু ধোলাই দিয়ে যা।

বুলডগের হাঁক শুনে ষণ্ডামত দুজন এসে রিস্টোকে শূন্যে ঝুলিয়ে খালি পায়ের তলায় চামড়ার বেত দিয়ে মারলো। কয়েকটা বাড়ি খেয়ে রিস্টোর মনে হলো পায়ের তলায় আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। আরেকজন বেত মারলো পিঠে। রিস্টো কাঁদে নি, চিৎকার করে নি। দাঁতে দাঁত চেপে এগারো পর্যন্ত গুনেছিলো। তারপর সে জ্ঞান হারিয়েছে ছঘন্টার জন্য।

সন্ধ্যায় জ্ঞান ফেরার পর রিস্টো দেখলো ওকে ওর কুঠুরিতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। হাতকড়া খুলে দিয়েছে। প্রচণ্ড জ্বালা করছিলো সারা পিঠে। হাত দিয়ে দেখলো মলম জাতীয় কিছু লাগানো হয়েছে সেখানে, বিচ্ছিরি গন্ধ। উঠে বসতে মনে হলো সারা ঘর বুঝি দুলে উঠেছে। মাথায় চক্কর দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাকলো রিস্টো। তারপরই বমি করলো। অনেকক্ষণ ধরে বমি করলো সে। বমিতে ঘর ভেসে গেলো। শেষের দিকে সামান্য পানি বেরুলো, মনে হলো পেটের নাড়িভূঁড়ি সব বমির সঙ্গে বেরিয়ে গেছে।

বমির শব্দে একজন প্রহরী এসে দরজার ফুটো দিয়ে দেখলো। তারপর একটা ন্যাকড়া এনে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, এক ফোঁটা ময়লা যদি মেঝের ওপর থাকে, রাতে খাবারের বদলে তোকে সেগুলো খাওয়াবো।

শরীরে এতটুকু শক্তি ছিলো না রিস্টোর। তবু কলের পানিতে ন্যাকড়া ভিজিয়ে বমি পরিস্কার করলো সে। তারপর চোখ বুজে চিৎ হয়ে পড়ে রইলো খাটের ওপর। হঠাৎ দেখলে মনে হবে রিস্টো বুঝি মারা গেছে।

রাতে কখন খাবার দিয়েছিলো টেরও পায়নি রিস্টো। গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছিলো খাটের ওপর। প্রহরী যথারীতি কোনো কথা না বলে ভরা বাটি ফেরত নিয়ে গেছে। রিস্টোর ঘুম ভাঙলো পরদিন সকালে, যখন ওকে খাবার দেয়া হলো।

শরীর অসম্ভব ক্লান্ত ছিলো। তবু কলের পানিতে মুখ হাত ধুয়ে খাবার খেলো সে। পিঠের আর পায়ের ব্যাথা সামান্য কমেছে। দুদিনে ওর চোখ বসে গেছে, মনে হয় ওজন কমে গেছে কয়েক পাউন্ড, তবু রিস্টো মনের জোর হারায় নি। দশটার দিকে আবার ওকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো বুলডগের জেরার সামনে।

দিমিতির ইয়াভরভকে কতদিন ধরে চিনিস? আগের দিনের মত ঘ্যানঘ্যানে গলায় জেরা শুরু করলো বুলডগ।

আমার জন্মের পর থেকে।

ফের ইয়ার্কি মারছিস? দিমিতির ইয়াভরভ তোর ধাই নাকি যে জন্মের পর থেকে চিনবি?

না ধাই নয়। তিনি আমার দাদু।

বটে, কেমনতরো দাদু শুনি?

মার মামা হন তিনি।

আ-আচ্ছা! ভালোই মিলেছে তাহলে। তোরাই তাহলে চিঠি লিখে আনিয়েছিস বুড়ো দেশদ্রোহীটাকে?

তিনি নিজেই এসেছেন।

তুই কি বলতে চাস বুড়ো তোদের নিয়মিত চিঠি লিখতো না?

না, ক্রিসমাসে শুধু কার্ড পাঠাতেন।

তোর বাপের সঙ্গে পার্টির কোন কোন নেতার যোগাযোগ আছে, ঠিক মত বল!

অনেক নেতারই যোগাযোগ আছে। আমি নাম জানি না।

নাম না জানলে বুঝলি কিভাবে ওরা পার্টির নেতা?

বাবা বলেছেন।

নাচো পাপাঝোভকে চিনিস?

না।

গিয়র্গি তানেভকে?

না। এরা কারা?

এরা হচ্ছে পার্টির ভেতর ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা বিশ্বাসঘাতকের দল। তোর বাবা নিশ্চয় চেনে এদের।

আমি জানি না!

বার বার জানি না, জানি না বলবি না। জানিস, এখান থেকে কথা না বলে কেউ জীবিত ফিরে যেতে পারে না?

জানি না।

আবার জানি না?

বারে, আগে এখানে এসেছি নাকি যে জানবো!

ঠিক আছে, শিগগিরই জেনে যাবি। এবার বল বয়ানাতে তোরা মিটিং করতি কোথায়?

সব বাড়িতে।

পার্টির কমরেডরা বুঝি তোদের বাড়ি ডেকে জাজিম বিছিয়ে দিতো মিটিং করার জন্য?

পার্টির সবাই পার্টির বিরুদ্ধে চলে গেছে।

মিথ্যে কথা।

আমার বাবা, মা, দাদুরা সবাই পার্টির সদস্য ছিলেন।

বুলডগ নিয়ম মাফিক জেরা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে আবার ওকে মারতে বললো। মার খেতে খেতে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেললো রিস্টো। এভাবে ঝিভকভের গোয়েন্দা পুলিশের গোপন কারাগারে আরো একটা ভয়াবহ দিন কাটলো ওর।

বন্ধু কুঠুরির ভেতর এক দুই করে চুয়ান্ন ঘন্টা কেটে গেছে, নীল কোন কথা বলে নি। এই ক দিনে মনে হলো ওর বয়স তিরিশ বছর বেড়ে গেছে। ধীরে ধীরে অজানা এক ভয় ওর বুকে চেপে বসতে চাইছে। মনে হচ্ছে ঝিভকভ যতদিন বেঁচে আছে ততদিন ওকে এভাবে বন্দী হয়ে দিন কাটাতে হবে। বাবা কিভাবে জানবেন ওকে এই জঙ্গলের ভেতর ওরা আটকে রেখেছে? রিস্টোর সংকেত পাঠানো ইশতেহার বাতাসে কোথায় উড়ে গেছে কে জানে!

সকাল থেকে আকাশ মেঘে ঢাকা। থেকে থেকে দমকা হাওয়া বইছে। কুঠুরির ভেতর ততটা টের না পেলেও ঝড়ো বাতাসে বনের ভেতর গাছের মাতামাতির শব্দ কানে আসে। এ সময় বলকান অঞ্চলে প্রতিবছরেই ঝড় হয়।

নীল ভাবে প্রচণ্ড ঝড়ে যদি উড়ে যেতে এই বন্ধ কুঠুরি! কিম্বা একটা ভূমিকম্পে দেয়ালগুলো যদি ধসে যায়! কিছুই হয় না। শুধু নীলের বুকের ভেতর ভয়ের ক্ষতটা বড় হতে থাকে।

সেদিন সন্ধ্যায় নীল যখন লোহার খাটে শুয়ে এলোমেলো এসব কথা ভাবছিলো তখন দরজায় তালা খোলার শব্দ হলো। অসময়ে কে এলো? তবে কি ওর মুক্তির সনদ এসে গেছে? ধড়মড় করে উঠে বসলো নীল। ওর চোখের সামনে দরজা খুলে গেলো। একজন প্রহরীর হাতে ধরা রিস্টো। ঝড়ে বিধ্বস্ত বার্চ গাছের মতো মনে হচ্ছে ওকে। রিস্টোকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে কোনো কথা না বলে দরজায় তালা মেরে চলে গেলো। প্রহরী।

নীল ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো রিস্টোকে–এ কী দশা করেছে তোকে! কেমন করে রিস্টো–বলতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো নীল। হারানো বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে রিস্টোও চোখের পানি আটকে রাখতে পারলো না।

দুই বন্ধু বেশ কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারলো না। তারপর নীল ওকে ধরে নিয়ে খাটে বসালো। রিস্টোর সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। দুর্গন্ধওয়ালা মলমেও খুব একটা কাজ হয়নি।

তোকে ওরা ভীষণ মেরেছে রিস্টো?

কোন কথা না বলে রিস্টো মাথা নেড়ে সায় জানালো।

এখানে পাঠালো কেন? নীল জানতে চাইলো, জেরা করা কি শেষ হয়েছে?

জেরা শেষ কিনা জানি না। একটু আগে কয়েকজন বন্দি এসেছে। ওদের ছুটোছুটি দেখে মনে হলো হোমরা চোমরা কেউ হবে।

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো দুই বন্ধু। বাইরে ঝড় বাতাসের তাণ্ডব বাড়ছে। ওদের দুজনের বুকের ভেতর সেই ঝড়ের প্রতিধ্বনি। রিস্টো লক্ষ্য করেছে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছোট এই জেলখানাটা পুরোনো এক বাৰ্চর্বনের ভেতর। অনেক গাছ আছে, একশ সোয়াশ বছরের পুরোনো। ছোটবেলায় আন্তন বুড়ো ওকে গাছ চেনাতেন। বলতেন, সবচেয়ে সহজে বয়স চেনা যায় বার্চ গাছের। যতদিন জোয়ান থাকবে ততদিন গাছের বাকল থাকবে ধবধবে সাদা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাকলে লাল ছোপ পড়বে। বুড়ো হলে কোথাও সাদার লেশমাত্র থাকবে না। ছোপ ছোপ কালো আর লালে মেশানো হবে বার্চের বাকল। তখনই বার্চ গাছ কাটতে হয়।

নীল জিজ্ঞেস করলো, কি ভাবছিস রিস্টো?

ম্লান হেসে রিস্টো বললো, কি আর ভাববো! বার্চ গাছ কতদিন বাঁচে তাই ভাবছিলাম।

নীল অবাক হয়ে তাকালো রিস্টোর মুখের দিকে। রিস্টো মাঝে মাঝে এমন কথা বলে–মনে হয় ষাট পেরুনো কোনো বুড়ো কথা বলছে। রিস্টো বললো, এ জায়গাটা বার্চবনের ভেতর। অনেক আগে একবার এই বনে এসেছিলাম ইয়ং পাইওনিয়ারদের ক্যাম্পিং-এ।

তোর কি মনে হয় কেউ আমাদের চিরকুট পেয়েছে?

কী জানি, দুদিন তো হয়ে গেলো! সিটিযেন কমিটি খবর পেলে এতক্ষণে জেল ভেঙে নিয়ে যেতো। হতে পারে এখনো কেউ চিরকুট পায় নি।

সারাদেশে সিটিযেন কমিটির সমর্থক কী রকম?

লাখ তিনেকের মতো হবে।

তোর কি মনে হয় এরা আমাদের মেরে ফেলবে?

তোকে মারবে না। ঝামেলা হবে, সামলাতে পারবে না। আমাকে মেরে ফেলতে পারে। লাস লুকিয়ে ফেলবে। কে খবর পাবে!

এমন কথা বলিস না রিস্টো। আমরা এখান থেকে ঠিকই পালাবো!

কিভাবে?

সেটাই ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে বের করতে হবে।

আমি একবার এক গোপন পত্রিকায় পড়েছিলাম, ঝিভকভের কোনও কোনও কারাগারে পঁচিশ তিরিশ বছর ধরে আটক থাকা বন্দিও আছে।

আমার মনে হচ্ছে ঝিভকভের পতনের আর বেশি দেরি নেই।

এরকম আন্দোলন আগেও কয়েকবার হয়েছে।

এবারের অবস্থা কিন্তু অন্যরকম। পোল্যাণ্ডের কথা চিন্তা কর। হাঙ্গেরি, চোকোশ্লোভাকিয়া, জিডিআর–সব জায়গাতে আন্দোলন হচ্ছে, সরকার বদল হচ্ছে।

ঝিভকভের প্রাণের বন্ধু রুমানিয়ার চসেস্কু কিন্তু বহাল তবিয়তে আছে।

কে জানে, ওখানেও হয়তো গোপনে কাজ হচ্ছে।

তোকে খুব আশাবাদী মনে হচ্ছে নীল।

নীল মৃদু হেসে বললো, বাবা সব সময় বলেন, একমাত্র মানুষই আশা নিয়ে বাঁচে, সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে।

আমরা তো সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যই লড়ছি। স্বপ্নভরা গলায় বললো রিস্টো।

আমার ভাই রবিন বলছিলো, বাংলাদেশের মানুষও একজন ডিক্টেটরকে হটাবার জন্য লড়ছে।

ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটরদের বিরুদ্ধে যে যেখানে লড়ুক আমরা সবাই একে অপরের কমরেড। তুই বাংলাদেশে লড়তে না পারলেও এখানে তো লড়ছিস।

বাবাকে বলেছি স্কুলের পাট শেষ হলে আমি বাংলাদেশে ফিরে যাবো।

কারাগারে স্যাঁতসেঁতে প্রায় অন্ধকার কুঠুরিতে ষোল সতেরো বছরের দুই তরুণ এমন সব কথা বলছিলো, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তাদের বয়সের জন্য যা ছিলো একেবারেই বেমানান।

.

১০. সারা সোফিয়া তোলপাড়

রিস্টো আর নীল যেদিন ধরা পড়লো তার পরদিন সারা সোফিয়ায় তোলপাড় কাণ্ড। দুপুরের পর সিটিযেন কমিটির জনসভায় অন্য সময় যে রকম হতো সেদিন দ্বিগুণ লোকের সমাবেশ হলো। সিটিযেন কমিটির পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে নীল আর রিস্টোর গ্রেফতারের সংবাদ বেরিয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ আর আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎকার।

নীলের বাবা রাষ্ট্রদূত ইকবাল আহমেদ খান আগের রাতে খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছিলেন ঝিভকভের পার্টির সদর দফতরে। কেন্দ্রীয় কমিটির যে নেতা সকালে দূতাবাসে এসেছিলেন, তাঁকে অফিসেই পাওয়া গেলো। রিস্টো আর নীলের গ্রেফতারের সংবাদ শুনে নেতা কয়েক জায়গায় টেলিফোন করলেন, তারপর দুঃখের সঙ্গে জানালেন, মাননীয় রাষ্টদূতকে কেউ ভুল খবর দিয়েছে। পুলিশ, মিলিশিয়া সবাই বলছে এরকম কোনও ঘটনা ঘটে নি।

হতাশ হয়ে পার্টির সদর দফতর থেকে বেরিয়ে এলেন নীলের বাবা। রবিন বললো, চাচা, আমার মনে হয় প্রফেসর ইয়াভরভ আমাদের সাহায্য করতে পারবেন। তিনি আমেরিকান এ্যাম্বাসাডরের বাড়িতে আছেন। চলুন সেখানে যাই।

ঠিক বলেছিস। নীলের বাবা বললেন, আমেরিকান এ্যাম্বাসাডরের সঙ্গেও কথা বলা দরকার। এবার তাঁকে সোফিয়ার সকল এ্যাম্বাসাডরের লিডার বানানো হয়েছে।

নাইনথ সেপ্টেম্বর স্কয়ার থেকে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে আসতে তোবারক পঁচিশ মিনিটের জায়গায় পনেরো মিনিট সময় নিলো। নীলের জন্য এ মুহূর্তে এটুকু ছাড়া ওর আর কিছু করার ছিলো না। তোবারক ভাবছিলো দরকার হলে নীলের জন্য জীবন দিতেও সে ইতস্তত করবে না। এই প্রথম অনুভব করলো নীলকে ও যতখানি ভালোবাসে, নিজের যদি কোনও ভাই থাকতো এর চেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারতো না। নীলের বিপদের কথা ভাবতে গিয়ে বার বার তোবারকের চোখে পানি জমছিলো।

ঠিক সোয়া দশটায় ওরা আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলো। খবর পেয়ে ব্যস্ত হয়ে ছুটে এলেন প্রফেসর ইয়াভরভ। নীলের বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, এক্সেলেন্সি, লিলিয়া আমাকে ফোনে সব বলেছে। খবরটা শোনার পর মনে হলো আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। শুনেছেন বোধহয় নীল কিভাবে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। ওর সঙ্গে আমার আদরের নাতি রিস্টোকেও ধরে নিয়ে গেছে নোংরা শয়তানের দল। আমি ওদের সর্বনাশ করে ছাড়বো।

প্রফেসরের কথা শেষ না হতেই আমেরিকার রাষ্ট্রদূত রবার্ট জ্যাকসন এসে ঘরে ঢুকলেন। নীলের বাবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত এক্সেলেন্সি। কালই আমি সোফিয়ার সমস্ত কূটনৈতিক মিশনের পক্ষ থেকে এদের ফরেন মিনিষ্ট্রিকে কড়া নোট পাঠাবো। ফরেন মিনিস্টারের সঙ্গেও কাল কথা বলবো। আপনি বিচলিত হবেন না, এদের আমরা ছেড়ে দেবো না।

একটু আগে আমি এদের পার্টির হেড কোয়ার্টারে গিয়েছিলাম। পুলিশ, মিলিশিয়া সবার সঙ্গে কথা বলে ওরা জানালো এ ধরনের কোন ঘটনাই নাকি আজ ঘটে নি।

ডাহা মিথ্যে কথা। চড়া গলায় বললেন প্রফেসর ইয়াভরভ–ঝিভকভের প্রশাসনকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। রিস্টোর মা লিলিয়া নিশ্চয় আমার সঙ্গে নিজের ছেলেকে নিয়ে ঠাট্টা করে নি। গ্রামের বহু লোক সাক্ষী আছে, দিনে দুপুরে পুলিশ আর মিলিশিয়া ওদের ধরে নিয়ে গেছে। এক্সেলেন্সি, আপনাকে ওরা সত্যি কথা বলে নি।

আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না, কিভাবে ওদের খোঁজ পাবো?

আপনি আমাকে আজ রাতটুকু শুধু সময় দিন। ওপরের দিকের কয়েকজন জেনারেলকে আমি চিনি, এক সময় আমার দফতরে ওরা কাজ করতো। ওদের ভেতর ঝিভকভের বিরুদ্ধে কারা– তাদের খুঁজে বের করতে হবে আগে। তারপর আমরা যা যা করার করবো।

আমেরিকার রাষ্ট্রদূত বললেন, আমার মনে হয় খবরটা পত্রিকায় আসা দরকার। পত্রিকায় একবার সংবাদ বেরিয়ে গেলে ওরা আমাদের ছেলেদের কিছু করার আগে দুবার ভাববে। আমি এখনই পান্তেলেই মিযোভকে ফোন করছি–সিটিযেন কমিটির পত্রিকার সম্পাদক।

পাশের ছোট টেবিলে রাখা টেলিফোনের রিসিভার তুলে নম্বর ঘোরালেন রাষ্ট্রদূত জ্যাকসন। বললেন, হ্যালো মিযোভ, তোমাকে আমার জরুরি দরকার। গাড়ি পাঠাচ্ছি। তুমি একজন রিপোর্টারকে নিয়ে এখনই চলে এসো। কালকের জন্য একটা গরম খবর আছে।

সকালে বুলগারাস্কা বোসা পত্রিকায় নীল তার রিস্টোকে মিলিশিয়ার অপহরণের সংবাদ পড়ে কিছুটা স্বস্তি পেলো বাড়ির সবাই। বাবা বললেন, খবরটা যেভাবে দিয়েছে, আমার মনে হয় না এরপর ওরা নীলদের কিছু করার সাহস পাবে।

পুরো খবরটা সবাইকে বাংলায় অনুবাদ করে শুনিয়েছে তোবারক। ওর চেহারা দেখেই বোঝা যায় সারা রাত ঘুমোতে পারে নি। রবিনেরও একই অবস্থা। কেউ ভালোমত নাশতা করতে পারলো না।

গতরাতে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের বাসায় ঠিক হয়েছে সকালে দুই রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাবেন। প্রফেসর ইয়াভরভ বললেন, আপনারা আপনাদের মত এগোন, আমি আমার মত এগুবো। রবিন আর তোবারককে দেখিয়ে নীলের বাবাকে বললেন, আপনার অসুবিধে না হলে এই ছেলে দুটিকে আমি সঙ্গে নিয়ে বেরোবো। বাইরে একা ঘঘারাফেরা করতে এখন ভয় করে।

নীলের বাবা বললেন, কোন অসুবিধে হবে না। ইচ্ছে করলে আপনি আমার গাড়িও নিতে পারেন। আমি আমাদের কাউন্সিলারের গাড়ি ব্যবহার করবো।

না, এ গাড়ি লাগবে না। মানা করলেন বুড়ো প্রফেসর। আমি এম্ব্যাসির সিডি গাড়িতে ঘুরতে চাই না। নম্বর প্লেট দেখলে গোয়েন্দাদের নজর পড়বে। আমি এদের একটা সাধারণ গাড়ি নিয়ে বেরোবো।

সকালে রবিনরা আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের বাসায় এলো। দুই রাষ্ট্রদূত সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। প্রফেসর বললেন, আমাদের এ্যাপয়েন্টমেন্ট দশটায়।

রবিন বললো, আপনি কিভাবে এগুচ্ছেন বলতে যদি আপনার আপত্তি না থাকে, আমি জানতে আগ্রহী।

তোমাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করবো, নিশ্চয় জানবে তোমরা। আমার পুরোনো সহকর্মীদের ভেতর একমাত্র জেনারেল ভাসিলিনই আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজী হয়েছে। তার মানে ঝিভকভকে সে খুব একটা পরোয়া করে না। ওর সঙ্গে কথা বলে আমরা আমাদের পরবর্তী কর্মসূচী তৈরি করবো। আগামী কাল সিটিযেন কমিটির জরুরি বৈঠক আছে। সেখানেও আমি এ বিষয়ে কথা বলবো।, তোবারক বললো, স্যার, যে গ্রাম থেকে মিলিশিয়া ওদের গ্রেফতার করেছে, একবার সেখানে গিয়ে দেখলে হয় না?

সেখানে আর কী দেখবে? প্রফেসর বললেন, গ্রামের লোক লিলিয়াদের যা বলেছে তোমাদেরও তাই বলবে। ওদের কেউ তো বলতে পারবে না নীলদের কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে!

প্রফেসর ওদের বসতে বলে ভেতরে গেলেন পোষাক বদলাতে। তোবারক বললো, রবিন তোমার কি মনে হয়, রিস্টোর গ্রামের বাড়িতে গেলে কিছু খবর মিলতে ফারে?

কথাটা আমারও মনে হয়েছে তোবারক। প্রফেসরকে সব কথা বলার কি দরকার। আমরা আমাদের মত নীলদের খুঁজবো। দরকার হলে তার সাহায্য অবশ্যই নেবো।

সকাল থেকে আকাশ মেঘে ঢাকা। মাঝে মাঝে হার্ডকাঁপানো সাইবেরিয়ান বাতাস বইছে। তোবারক রেডিওর খবরে শুনেছে পশ্চিমের আড্রিয়াটিক সাগর থেকে ঝড় আসছে। আটচল্লিশ ঘন্টার ভেতর বুলগেরিয়ার ওপর আঘাত করবে। বলকানে এখন ঝড়ের সময়।

প্রফেসর ঘর থেকে বেরোলেন ওভারকোট পরে। গলায় মাফলার, মাথায় টুপি। সামান্য হেসে বললেন, তোমাদের মত ছোকরা তো নই, একটা জ্যাকেট দিয়ে শীত মানাতে পারবো। চলো বাছারা, বেরোনো যাক।

শিপকা স্ট্রিট-এ জেনারেল ভাসিলিনের বাড়ি। আগে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন, গত বছর থেকে অবসর জীবন যাপন করছেন। অবসর নিলেও প্রফেসর ইয়াভরভ ভালো করেই জানেন এখনও জেনারেল যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর এক ছেলে সোফিয়া প্রেস এজেন্সির পরিচালক, আরেক ছেলে স্পেনে রাষ্টদূত।

প্রফেসর ইয়াভরভকে দেখে বলকানি কায়দায় কোলাকুলি করে গালে চুমো খেলেন জেনারেল ভাসিলিন। রবিন আর তোবারকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সবাইকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসলেন। প্রফেসরকে বললেন, কি নেবে, চা, কফি না ভদকা, কনিয়াক?

আমাকে ভদকা দাও। প্রফেসর বললেন ছেলে দুটো মনে হয় কফি পছন্দ করবে। বেশ শীত পড়েছে।

ছোট একটা হাতঘন্টা বাজিয়ে জেনারেল কাজের লোককে ডেকে কফি আর ভদকা দিতে বললেন। তারপর প্রফেসর ইয়াভরভকে বললেন, দুটো ছেলে হারিয়ে না গেলে তুমি নিশ্চয় আমাকে ফোন করতে না। দশ বছর আগে একবার লুকিয়ে এসেছিলে। আমার সঙ্গে দেখা করো নি। পুরোনো বন্ধুকে তুমি ভুলে গেছো ইয়াভরভ।

জেনারেলের এসব মনরাখা অভিযোগকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রফেসর বললেন, ছেলে দুটো হারিয়ে যায় নি ভাসিলিন। মিলিশিয়া ওদের এ্যারেস্ট করেছে। গ্রামের বহু মানুষের চোখের সামনে দিয়ে ওরা ছেলে দুটোকে নিয়ে গেছে।

কথাটা কালও তুমি বলেছে ইয়াভরভ। আমি সকালে তিনজন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি, পুলিশ আর মিলিশিয়ার চীফের সঙ্গেও কথা বলেছি। বুলগারাস্কা রোসার খবর ওরা সবাই দেখেছে। একজন রাষ্ট্রদূতের ছেলে নিখোঁজ হওয়া যা-তা ব্যাপার নয়। ওরা কয়েকটা সার্চ পার্টি নামিয়েছে। বলেছে আজ সন্ধ্যার ভেতরই ওরা ছেলে দুটোকে খুঁজে বের করবে।

জেনারেল নিকোলাই ভাসিলিন! ঠান্ডা গলায় কেটে কেটে বললেন প্রফেসর, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে, নাকি ঝিভকভের প্রশাসন সম্পর্কে তুমি কিছু জানো না?

এভাবে কথা বলছো কেন ইয়াভরভ? আমি আন্তরিকভাবেই তোমাকে সাহায্য করতে চাই। আমরা অনেকে যা পারি নি তুমি তা পেরেছে। সেজন্য তোমাকে আমরা ভালোবাসি। শ্রদ্ধাও করি।

ওঁরা বুলগেরিয়ান ভাষায় কথা বলছিলেন, যার একবর্ণও রবিনের বোধগম্য হচ্ছিলো না। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় তোবারক সব কথা রবিনকে দাড়ি কমা সহ বলেছে। বলা বাহুল্য তোরকের তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির প্রশংসা না করে পারে নি রবিন। এ মুহূর্তে ও একজন অসহায় দর্শক মাত্র।

জেনারেলের নরম কথায় আরো রেগে ইয়াভরভনিকুচি করি তোমাদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার! তোমার কি মনে হয় ঝিভকভের গুপ্ত পুলিশ আর গোয়েন্দা বাহিনী সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই? ওরা যে যখন তখন যাকে তাকে ধরে লোপাট করে দিতে পারে সে সম্পর্কে তুমি কি কিছুই জানো না?

তুমি অযথা উত্তেজিত হচ্ছে ইয়াভরভ। একবার বললে পুলিশ আর মিলিশিয়া ধরেছে, আরেকবার বলছে গুপ্ত পুলিশ আর গোয়েন্দার কথা, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ঠিক মত বলো তো ওদের কারা ধরেছে?

মোটা মাথাটা একটু ঘামাও ভাসিলিন। পুলিশ আর মিলিশিয়া ওদের ধরে নিয়ে গেছে এটা হচ্ছে গ্রামের মানুষদের কথা। ধরে নিচ্ছি তোমাদের পুলিশ আর মিলিশিয়ারা স্বর্গের দেবদূতের মত পবিত্র হয়ে গেছে, সবাই সত্যি কথা বলছে। তাই যদি হয় সেক্ষেত্রে গোয়েন্দা পুলিশের কথা অবশ্যই আমাদের হিসেবের মধ্যে আনতে হবে। তুমি তো ভালো করেই জানো ওরা ওদের কাজের জন্য ঝিভকভের সেক্রেটারিয়েট ছাড়া কারো কাছে কোনো কৈফিয়ৎ দেয় না। সাধারণ পুলিশ বা মিলিশিয়া না ধরলে ছেলে দুটোকে গোয়েন্দা পুলিশ ধরেছে, এতে না বোঝার কি আছে?

তুমি কি তাহলে গুপ্ত পুলিশের চীফের সঙ্গে আমাকে কথা বলতে বলছো?

বলে দেখতে পারো। অন্যরা যে জবাব দিয়েছে অফিসিয়ালি ভেলকভ তোমাকে সেই জবাবই দেবে। গোয়েন্দার ওপর গোয়েন্দা লাগাও। গুপ্ত পুলিশের ওপর দিকে আমাদের লোক কারা আছে খুঁজে বের করো। জেনারেল চোলপানভের সঙ্গে কথা বলো। অনেকে ভাবছে ঝিভকভকে এবারও গদি থেকে হটানো যাবে না, তাই শামুকের মত খোলসের ভেতর মাথা লুকিয়ে রেখেছে। ওদের বলো ঝিভকভের পতন মাত্র কয়েক দিনের ব্যাপার। হপ্তাও নয়–দিন, বুঝেছো? যারা ভদ্র শামুক হয়ে থাকতে চাইবে–টেরও পাবে না কখন ওদের সেদ্ধ করে লোকেরা পেটের ভেতর চালান করে দিয়েছে।

আমাকে একটু সময় দাও ইয়াভরভ। গুপ্ত পুলিশ বিভাগ ঝিভকভের একেবারে হাতের মুঠোয়। ওখানে থাবা মারতে হলে আটঘাট বেঁধে নামতে হবে।

তোমাকে আমি আটচল্লিশ ঘন্টা সময় দিচ্ছি ভাসিলিন। পরশু ঠিক এ সময় আমি আসবো। তখন যেন ছেলে দুটোকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারি। আর যদি ওদের কারো কিছু হয় ভেলকভ আর ঝিভকভ–এ দুটোকে পাহাড়ী নেকড়ে দিয়ে খাওয়াবো।

এরপর প্রফেসর ইয়াভরভ আর জেনারেল ভাসিলিন পার্টি আর সিটিযেন কমিটির ভেতরের কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলেন। সেসব শোনার ব্যাপারে তোবারকের আগ্রহ না থাকার কারণে রবিনকেও কিছু বলতে পারে নি। অবশ্য সে সময় রবিনেরও এসব কথা শোনার উৎসাহ ছিলো না।

দুপুরে রবিন আর তোবারক খাওয়ার জন্য বাড়ি ফিরতে পারে নি। প্রফেসরের সঙ্গে হোটেলে খেয়েছে। বাড়িতে অবশ্য ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলো রবিন। সন্ধ্যা পর্যন্ত ওদের নিয়ে প্রফেসর অনেকগুলো জায়গায় ঘুরলেন। সবখানে একই কথা–সার্চ পার্টি নামানো হয়েছে। সব শেষে বুলগারাস্কা রোসার অফিসে গিয়ে সম্পাদক পান্তেলেই মিযোভকে বললেন, কালকের পত্রিকায় ছেলে দুটোর খবরের একটা ফলো আপ ছেপে দিও। শয়তানের দল বলছে সার্চ পার্টি নাকি নামানো হয়েছে। যত সব বদমাইশি। ভালো মত একটা ভোলাই দাও। যা দেখছি এরপর কবে শুনবো মার কোল থেকে বাচ্চা নিয়ে যেতেও এরা ইতস্তত করছে না।

সম্পাদক মিযোভ বললেন, আমাদের ছেলেরাও বিভিন্ন সোর্সে খবর নিচ্ছে। রিস্টো আর নীলকে যতদিন পাওয়া না যাবে ততদিনই ফলো আপ নিউজ যাবে। এ নিয়ে ভাববেন না প্রফেসর ইয়াভরভ। আপনি কি আমাদের লেখাটা তৈরি করতে পেরেছিলেন?

কোটের পকেট থেকে এলোমেলো কয়েক শিট হাতে লেখা কাগজ বের করে সম্পাদককে দিলেন প্রফেসর–মন মেজাজ ভালো নেই, লেখাটা ঠিক জমে নি। ভার্না থেকে ফিরে তোমাকে একটা কড়া লেখা দেবো।

বুলগরাস্কা রোসার অফিস থেকে ওরা যখন বের হলো ঘড়িতে তখন ছটা বাজলেও বেশ রাত মনে হচ্ছিলো। খারাপ আবহাওয়ার জন্য রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, সেই সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা বাতাস। তোবারকের এ ধরনের ঠান্ডা সহ্য হলেও রবিনের মনে হচ্ছিলো কিছুক্ষণ বাইরে থাকলে জমে বরফ হয়ে যাবে।

প্রফেসরকে পথে তার জায়গায় নামিয়ে দিয়ে রবিনরা বাড়ি ফিরলো সাড়ে ছটা নাগাদ। নীলের বাবা একটু আগে ফিরেছেন। জেনারেল ভাসিলিনের সঙ্গে প্রফেসরের কী কথা হয়েছে তোবারক গাড়িতে আসার সময়ই রবিনকে বলেছিলো। একই কথা বাড়ির সবাইকে আবার বললো। নীলের বাবা বললেন, জেনারেল ভাসিলিন যখন দায়িত্ব নিয়েছেন তখন কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। কিন্তু তোবারক, তুমি কি ঠিক মত ওদের কথা ফলো করতে পেরেছিলে? প্রফেসর কি সত্যি সত্যি জেনারেলকে এ রকম ধমক দিয়ে কথা বলেছেন?

রবিন বললো, একটু আগে তোবারক ঠিক এভাবেই কথাগুলো আমাকে বলেছে। প্রফেসর যে জেনারেলকে ধমক দিচ্ছিলেন সেটা আমিও বুঝতে পেরেছিলাম। লক্ষ্য করো নি তোবারক, ধমক খেয়ে জেনারেল কেমন কাচুমাচু করছিলেন? প্রফেসর তো বললেন জেনারেল ভাসিলিন তার আন্ডারে কাজ করেছেন।

নীলের মা বাবাকে বললেন, তুমি তো ফরেন মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করবে বলেছিলে। দেখা হয়েছে?

দেখা হবে না কেন! আমেরিকান এ্যাম্বাসাডর এ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলেন। মিনিস্টারও একই কথা বলেছেন। নাকি তিনটা সার্চ পার্টি খুঁজছে নীলদের। এ আরেক ডিগ্রি ঘড়েল। বললো, তারা নাকি সন্দেহ করছে এটা বুলগেরিয়ান তুর্কীদের কাজ। সরকারের সঙ্গে বন্দি বিনিময়ের জন্য ওদের ধরেছে।

বলো নি, গ্রামের লোকেরা দেখেছে পুলিশ আর মিলিশিয়াকে?

বলেছি। পাজিটা বলে কিনা ওরা পুলিশ আর মিলিশিয়ার পোষাক পরে গিয়েছিলো। আমাদের অনুরোধ করেছে দুদিন সময় দিতে।

রবিন বললো, প্রফেসরও জেনারেলকে দুদিন সময় দিয়েছেন।

ঠিক আছে, কালকের দিনটা দেখা যাক।

চাচা, আমি আর তোবারক ঠিক করেছি কাল রিস্টোদের গ্রামের বাড়িতে যাবো।

তোরা চিনিস?

চিনবো না ক্যান। তোবারক বললো, নীল বাই যেখানে যায় আমারে বলে যায়।

ঠিক আছে, দেখো কোনো কু পাওয়া যায় কি না। প্রফেসরকে বলেছে তোমরা যে ওখানে যাবে?

বইলছিলাম। প্রফেসর অবশ্য খুব আশাবাদী নন। কাল সকালে তিনি ভার্না যাচ্ছেন, রাতে ফিরবেন।

যা ভালো বোঝ করো। নীলের বাবা তখন অন্য কিছু ভাবছিলেন।

রাতে সবাই ঘুমাতে যাবার পরে রবিন আর তোবারক জেগেছিলো অনেকক্ষণ। তোরকের শোয়ার ঘরে কম্বল মুড়ি দিয়ে নীলের কথাই আলোচনা করছিলো ওরা। বাইরে তখন বার্চ, ওক আর লিন্ডেন গাছের ভেতর ঝড়ো হাওয়ার মাতম চলছে।