০৫-৬. পাকড়াশীর শয়তানি

০৫. পাকড়াশীর শয়তানি

ললি, টুনিকে চিঠি লেখা শেষ করে আমরা ঘুমিয়েছিলাম দমকল অফিসের পেটা ঘড়িতে রাত দুটো বাজার ঘন্টা শোনার পর। উঠতেও তাই দেরি হয়েছিলো। তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে নিচে এসে দেখি সবাই ড্রইং রুমে বসে গম্ভীর হয়ে কি যেন আলোচনা করছেন। আমাদের দেখে মা বললেন, টেবিলে নাশতা রাখা আছে। খেয়ে ঘরে যাও। আজ কোথাও বেরোবে না।

মার কথা বলার ধরন দেখে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। আমি আর বাবু চুপচাপ নাশতা শেষ করে চিলেকোঠার ঘরে এলাম। ভুরু কুঁচকে বাবু প্রশ্ন করলো, ব্যাপার কী আবির! আজ সবাই মিলে হৈচৈ করবো ভেবেছিলাম–কী হয়েছে বলে তো!

কিছু একটা ঘটেছে এটুকুই বলতে পারি। নেলী খালা যদি আসতেন জানা যেতো। এর বেশি আমি কিছু বলতে পারলাম না।

এক কাজ করি চলো। বাবুর মাথায় সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধি খেললো–বাইরের বাগান থেকে জানালা দিয়ে নেলী খালাকে ইশারা করে আসতে বলি।

বাবুর কথা আমারও পছন্দ হলো। দুজনে চুপি চুপি নিচে নেমে বাগান দিয়ে ঘুরে বসার ঘরের জানালার কাছে এলাম। নেলী খালা জায়গা বদল করে বসেছেন বলে তাকে দেখা যাচ্ছিলো পাশ থেকে। মাথা একটু না ঘোরালে তিনি আমাদের দেখতে পাবেন না। একটু আগেই দেখেছিলাম তিনি জানালার দিকে মুখ করে বসেছেন। জানালার আর একটু কাছে আসতেই মেজো কাকার গলা শুনলাম।

আড়ি পেতে বড়োদের কথা শোনা উচিত নয় জেনেও আমরা নিজেদের সামলাতে পারলাম না, কারণ মেজো কাকাকে পষ্ট বলতে শুনলাম, আবির, বাবুকে এসব বুঝতে দিও না ভাবী। ওদের কিছু হবে না। ওরা যেমন ছিলো তেমনই থাকুক।

মা শুকনো গলায় বললেন, তুমি জানো না জামি, ওই শয়তানটা পারে না হেন কাজ দুনিয়াতে নেই। বাছাদের যদি ধরে নিয়ে গুম করে রাখে, যদি কোনো ক্ষতি করে–না, না, ওরা কদিন সাবধানে থাকুক।

নানু বললেন, আমি আবারও বলছি থানায় একটি ডায়রি করে রাখো।

লাভ কী আব্দু। নেলী খালা বললেন, পুলিশের সঙ্গে ওর কেমন দহরম মহরম, নুলিয়াছড়িতে টের পাও নি!

সব পুলিশ খারাপ, এটা ভাবা তোমার উচিত নয়।

খুঁজলে হয়তো লাখে একটা ভালো পুলিশ পাওয়া যাবে। তবে ওদের ভরসায় থাকলে আমাদের চলবে না।

জাহেদ মামা বললেন, আমরা তো কালই চলে যাচ্ছি আলু। আমি বরং আই বি ডিপার্টমেন্টকে জানিয়ে রাখি পুরো ব্যাপারটা।

এটা তুমি মন্দ বলে নি। পুলিশের চেয়ে আই বি এসব কাজে ভালো হবে। নানুর প্রশংসায় জাহেদ মামা একটু লাল হলেন।

বড়োদের কথা শুনে মনে হলো পাকড়াশীর তরফ থেকে সম্ভবত কোনো বিপদের আশঙ্কা করছেন। জানালার কাছে বেশিক্ষণ এভাবে থাকাটা উচিত হবে না ভেবে বাবুকে চাপা গলায় বললাম, ওপরে চলো।

কোনো রকম শব্দ না করে চিলেকোঠার ঘরে এসে দুজনে মিলে জট খুলতে বসলাম। বাবু প্রথমে জানতে চাইলো, তোমার কী মনে হচ্ছে আবির?

আমার ধারণার কথা বাবুকে বললাম, পাকড়াশী আবার বোধহয় কোনো গ্রেট করেছে।

বাবু মাথা নেড়ে সায় জানালোআগের চেয়ে সিরিয়াস মনে হচ্ছে।

জাহেদ মামা তো বললেন, আই বি ডিপার্টমেন্টকে জানাবেন।

যাই বলল না কেন, আই বি-ও চালায় পুলিশের লোকেরাই।

তুমি বলতে চাইছো আই বি-কে ভরসা করা যায় না?

ঠিক তাই। যা করার আমাদের করতে হবে।

আমরা কী করবো! নেলী খালারা তো কালই চলে যাচ্ছেন।

একটু থেমে আমি বললাম, আমার মনে হয় পাকড়াশী শুধু ভয়ই দেখাচ্ছে। নুলিয়াছড়ির রাজত্ব ছেড়ে ও পাথারিয়া পর্যন্ত নেলী খালাকে ধাওয়া করবে–এটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে।

পাকড়াশীকে মনে হচ্ছে তুই আণ্ডার এস্টিমেট করছিস। দরজার কাছে নেলী খালার গলা শুনে দুজন একসঙ্গে চমকে উঠে ঘুরে তাকালাম।

নেলী খালা ঘরে ঢুকে খাটের ওপর বসলেন! সাদা একটা খাম থেকে ভাঁজ করা লাল কাগজের চিঠি বের করে বললেন, পড়ে দেখ।

আমি আর বাবু হুমড়ি খেয়ে পড়লাম চিঠিটার ওপর। বাংলা টাইপ করা চিঠি—

মিস চৌধুরী, আপনার বিয়েতে অভিনন্দন জানাতে পারছি না বলে দুঃখিত। আমার লোকজন ছায়ার মতো আপনাদের অনুসরণ করছে। ঢাকায় আপনাদের সঙ্গে ক্ষুদে বিচ্ছ দুটোকে দেখা গেছে। বিপদ কখন কার ওপর আসে কিছুই বলা যায় না। আপনার জন্য সারাক্ষণ আমার দুঃখ হয়। এত অল্প বয়সে প্রিয়জনদের হারানো কিম্বা নিজেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া কোনোটাই কম দুঃখের নয়। তবে এর কোনোটাই আমার দুঃখের চেয়ে বেশি গুরুতর নয়। ইতি–নিপা

বাবু অবাক হয়ে জানতে চাইলো–নিপা কার নাম?

নেলী খালা কাষ্ঠ হাসলেন–নিশ্চয়ই আমার কোনো বান্ধবী নয়! নিপা মানে নিকুঞ্জ পাকড়াশী। একটু থেমে আবার বললেন, আগে ভয় দেখাতো আমাকে। এবার আমার প্রিয়জনদের কথা লিখেছে।

আমাদের জন্যে তুমি ভেবো না। নেলী খালাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, পাকড়াশীকে আমরা ঠিকই শায়েস্তা করবো।

নেলী খালা আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, জানি তোরা খুব সাহসী, তোদের জন্য আমার গর্ব হয়। তবে পাকড়াশী খুবই বাজে ধরনের লোক। ওর ক্ষমতাও কম নয়।

বাবু বললো, নুলিয়াছড়িতেই ও আমাদের কিছু করতে পারলো না, ঢাকায় কী করবে?

নেলী খালা শুকনো হেসে বললেন, দুবার আমার ওপর এ্যাটেম্পট নিয়েছে। স্ক্যাটরা অল্পের জন্য বেঁচেছে। ওকে আণ্ডার এস্টিমেট করা উচিত হবে না।

চিঠিটা কোথায় পেয়েছেন নেলী খালা? জানতে চাইলো বাবু।

লেটার বক্সে। সকালে আমিই প্রথম লেটার বক্স খুলেছিলাম।

তোমরা তাহলে কী ঠিক করেছো? যেন কিছুই জানি না–এভাবে প্রশ্ন করলাম আমি।

ভালোয় ভালোয় পাথারিয়া গিয়ে গুছিয়ে বসতে পারলে নিশ্চিন্ত হই। জাহেদ বলেছে, কর্নেল তানভীরের সঙ্গে কথা বলবে। ওদের দৌড় কদুর আমার জানা আছে। তোরা সাবধানে থাকিস।

তোমরা সত্যি সত্যি কাল চলে যাবে?

ম্লান হাসলেন নেলী খালানা গিয়ে জাহেদের উপায় নেই। আব্দুও চান তাড়াতাড়ি পাথারিয়া যেতে। ওঁর ধারণা পাথারিয়াতে পাকড়াশী আমাদের নাগাল পাবে না। এই বলে তিনি খাট থেকে উঠলেন।

তোমরা কি আজ কোথাও বেরুচ্ছো? জানতে চাইলাম আমি।

শানু আপার হুকুম, আজ কেউ বাড়ি থেকে বেরুবে না। মৃদু হেসে চলে গেলেন নেলী খালা।

বাইরে যেতে পারবো না শুনে মন আগেই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। বাবুকে নিয়ে দুপুর পর্যন্ত চাইনীজ চেকার খেলোম। বিকেলে ছাদে বসে নেলী খালাদের নিয়ে মনোপলি খেলতে বসেছি, বড়িবি এসে বললো, সাব ডাকছেন মিসিবাবাকে।

আবার কী হলো? বলে নেলী খালা নিচে নেমে গেলেন। আমরা হাত গুটিয়ে ওঁর জন্য অপেক্ষা করলাম। জাহেদ মামা বললেন, তোমরা শুনেছো বোধ হয় সকালে কী ঘটেছে?

বাবু আড়চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, নেলী খালা পাকড়াশীর চিঠি পেয়েছেন।

দেখেছো কী লিখেছে? দেখেছি।

এ ধরনের চিঠি তো নেলী খালা আগেও পেয়েছেন।

তা পেয়েছে। জাহেদ মামা চিন্তিত গলায় বললেন, আগের চিঠিগুলোকে আমি খুব একটা গুরুত্ব দিই নি। এবার মনে হচ্ছে পাকড়াশী প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বে না। 

জাহেদ মামাকে ভালো লাগলো; নেলী খালার মতো তিনিও আমাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বড়োদের মতো কথা বলেন। অথচ মা মনে করেন আমরা বুঝি এখনো ছোট আছি। দিব্যি হুকুম জারি করে বসলেন–বাড়ি থেকে বেরুনো চলবে না।

একটু পরে নেলী খালা এসে বললেন, তোমাদের একটা মজার জিনিস দেখাবো। ওদিকটায় চলো।

আমরা অবাক হয়ে নেলী খালার সঙ্গে ছাদের রেলিঙের ধারে গেলাম। তিনি আমাদের রাস্তার দিকে আঙুল তুলে দেখালেন, কিছু দেখতে পাচ্ছো?

অস্বাভাবিক কিছুই দেখলাম না। বড়ো রাস্তায় ব্যস্ত লোকজন, রিকশা, সাইকেল, গাড়ি সব চলছে। আমাদের গলিটা বরাবরের মতোই শান্ত। সরকারদের রোয়াকে বসে বুড়ো অকা সরকার মন্টুর দাদুর সঙ্গে পাশা খেলছেন। একটা ফেরিওয়ালা সুর করে চাই লেস ফিতা বলে হেঁটে যাচ্ছে। লোকজনের চলাফেরা খুবই কম। আমাদের সদর দরজার পাশে কর্কশ গলায় আল্লাহুম্মা সাল্লেআলা বলে এক নুলো ফকির ভিক্ষা চাইছে, বেদানার মা কলসি কাঁখে নিয়ে মেয়ের হাত ধরে রকিবদের বাড়িতে পানি দিতে যাচ্ছে কোথাও মজার কোনো জিনিস দেখলাম না।

নেলী খালা বললেন, নতুন কিছুই বুঝি চোখে পড়ে নি?

আমরা অবাক হয়ে মাথা নাড়লাম। নতুন আবার কী দেখবো!

ওই ফকিরটাকে দেখ!

নেলী খালা কি বলতে চাইছেন বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হলো না। তড়বড় করে বললাম, ধরে ফেলেছি নেলী খালা। এই ফকিরটাকে নতুন মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই ও পাকড়াশীর চর হবে। আমাদের বাড়ির ওপর নজর রাখছে।

মুখ টিপে হাসলেন নেলী খালা–পাকড়াশীর নয়, ও হচ্ছে কর্নেল তানভীরের লোক। সন্দেহজনক কাউকে বাড়ির আশেপাশে দেখা গেলেই ও কর্নেলকে জানাবে। কর্নেল দরকার মনে করলে থানায় জানাবেন। না হলে নিজেরা ব্যবস্থা নেবেন। আজ দুপুরের পর থেকে বসেছে।

বাবু বললো, ভালো ফন্দি এঁটেছেন তো কর্নেল! এবার নিশ্চয়ই পাকড়াশীর লোক ধরা পড়বে।

পাকড়াশী যে কত সেয়ানা, সেদিন সন্ধ্যে না হতেই টের পেলাম। আমি আর বাবু বিকেলের চা খেয়ে বাড়ির পেছনের বাগানে বসে গল্প করছিলাম। কলতলায় ক্ষেন্তির মা বসে থালা-বাসন মাজছিলো। কিছুক্ষণ পর বেদানার মা এসে একগাল হেসে ওকে বললো, অ ক্ষেন্তির মা, হুনছ, এক কারবার ওইছে!

ক্ষেন্তির মা জানতে চাইলো কি হয়েছে। বেদনার মা হি হি করে হাসতে হাসতে যা বললো, শুনে আমাদের চোখ ছানাবড়া। ওকে নাকি কোট-প্যান্ট পরা এক সাহেব পাঁচটা টাকা দিয়ে বলেছে, ওই নুলো ফকিরটাকে তোমাদের পাড়া থেকে বের করে দাও। আসলে নাকি ও ছেলেধরা। বেদানার মা বললো, সন্দ আমারও ওইছিলো ক্ষেন্তির মা। মানুষ একে নতুন তার উপরে কেমুন কেমুন কইরা চাইয়া দ্যাখে। সাবে গো বাড়িত থেইকা শলার ঝাড়খান আইনা দিছি দুই বাড়ি–বিটলামির জাগা পাস না মিচকা শয়তান, কইয়া যেই আবার মারতে গেলাম ব্যাটায় থালি ফালাইয়া বাবা গো মাগো চিক্কইর পাইরা দিছে দৌড়। হি হি হি।

বাবু চাপা গলায় বললো, সর্বনাশ হয়েছে আবির। শিগগির চলো নেলী খালার কাছে।

নেলী খালা শুনে প্রথমে গম্ভীর হয়ে, ছি ছি কি কাণ্ড, বলে জাহেদ মামাকে ঘটনাটা বললেন। তারপর নিজেই হেসে অস্থির হলেন–বেশ হয়েছে, এমন আনাড়ি লোকদের বেদানার মার ঝাড়ুর বাড়ি খাওয়া দরকার।

জাহেদ মামা করুণ মুখে বললেন, তুমি হাসছো নেলী? কর্নেল শুনে কি ভাববেন বলতো?

কি আর ভাববেন, ইনফর্মারটার চাকরি খাবেন। সহজ গলায় প্রশ্নের জবাব দিলেন নেলী খালা।

কিন্তু পাকড়াশীর লোক ধরার কী হবে?

আমি তোমাকে আগেই বলেছি, পুলিশের এই গবেটদের কম্মো নয় পাকড়াশীর মতো শয়তানকে শায়েস্তা করা।

এমন সময় মা আসতেই–তোমাদের বেদানার মার কাণ্ড শুনেছো? বলে নেলী খালা পুরো ঘটনাটা বললেন। মা শুনে রেগে গেলেন–বেদানার মার সাহস তো কম নয়, আমাদের ফকিরকে ঝাড়পেটা

আহ্, শানু আপা! বাধা দিলেন নেলী খালা–আমাদের ফকির বলছো কেন? কাকপক্ষীও যেন টের না? য ফকিরটা আমাদের লোক। জানলে সব মাটি।

আমি বললাম, কাক-পক্ষী টের না পেলেও পাকড়াশীর লোক ঠিকই জেনে গিয়েছে।

নেলী খালার কথার জবাব দিতে না পেরে মা আমাদের ধমক দিলেন–তুমি আবার বড়োদের মাঝখানে কথা বলতে এলে কেন? যাও, নিজের ঘরে যাও।

মন খারাপ করে আমি আর বাবু চিলেকোঠার ঘরে চলে এলাম। রাতে খাওয়ার পর নেলী খালা এসে যখন বললেন, শিগগিরই তোমাদের পাথারিয়ায় বেড়াতে নিয়ে যাবো, শুনে মন-টন সব ভালো হয়ে গেলো।

বাবু বললো, ললি টুনিকে আসতে বলবেন না?

তোমরা চাইলে নিশ্চয়ই বলবো। মুখ টিপে হেসে বাবুর চিবুক নেড়ে আদর করে চলে গেলেন নেলী খালা। যাবার সময় বললেন, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো। আমরা খুব ভোরে বেরিয়ে যাবো।

.

০৬. পাথারিয়ার পথে পল নিউম্যানের বন্ধু

নেলী খালাদের চলে যাওয়ার ঠিক দশ দিন পর পাথারিয়ায় বেড়াতে যাওয়ার চিঠি পেলাম। আমাকে আর বাবুকে একসঙ্গে আর মাকে আলাদা চিঠি লিখেছেন নেলী খালা। মাকে লিখেছেন, পাথারিয়ার জল হাওয়া এতো ভালো যে সারাক্ষণ শুধু খিদে পায়। এক মাসে আমাদের ওজন দশ পাউণ্ড বাড়বে এ কথা তিনি বাজি ধরে বলতে পারেন। আমার স্বাস্থ্য ভালো নয় এমন কথা নিন্দুকেও বলতে পারবে না, একমাত্র মা ছাড়া। সারাক্ষণ এ নিয়ে তাঁর অভিযোগের কথা নেলী খালা ভালো করেই জানেন। তাই মাকে পটানোর জন্যে ওভাবে চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে কোনো রকম বিপদের কথা লেখা নেই।

আমাদের চিঠিটা খুবই ছোট। মনে হয় ভীষণ ব্যাস্ততার ভেতর তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন। ওঁর গুটি গুটি অক্ষরগুলো সাইজে ডবল হয়ে গেছে। মোদ্দা কথা পরের রোববারেই যেন আমরা সকালের ট্রেনে রওনা হয়ে বিকেলে বড়লেখা স্টেশনে নামি। যেতে হবে কুলাউড়ায় ট্রেন বদল করে।

এর ভেতর ললি টুনির দুটো চিঠি পেয়েছি। ওরাও পাথারিয়া যাচ্ছে। চিঠি পড়েই বুঝেছি আহ্লাদে আটখানা হয়ে আছে ওরা। কবে যাবে সেটা লেখে নি। মনে হলো কুলাউড়ায় ট্রেন বদল করার সময় ওদের দেখা পাবো। নেলী খালা হয়তো এক সঙ্গে নিতে আসবেন আমাদের চারজনকে।

দুপুর দুটোয় আমি আর বাবু কুলাউড়া জংশনে নামলাম। বড়লেখার ট্রেন ছাড়বে তিনটায়। ওয়েটিং রুমে বসে মার দেয়া আলুর দম আর কিমা দিয়ে লুচি খেলাম। মা পই পই করে বারণ করে দিয়েছেন পথে যেন কিছু না খাই। ফ্লাস্কে গরম পানি দিয়েছেন হরলিক্স খাওয়ার জন্যে। দুবোতল ঠাণ্ডা পানি। কমলাও দিয়েছেন চারটা। বাবা অবশ্য বারণ করেছিলেন কমলা দিতে–কমলার দেশে যাচ্ছে–এখান থেকে আবার কমলা নেয়া কেন!

যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না। মাঝপথে যদি ট্রেন বিকল হয়ে যায়! যদি কোনো কারণে লেট হয়! কমলাওয়ালারা নিশ্চয়ই সারা পথ রেল লাইনের ধারে বসে নেই! এই বলে মা হাতব্যাগের ভেতর ঠেসেটুসে কমলাগুলো ঢুকিয়ে দিয়েছেন।

ওয়েটিং রুমে বসে ভাবছি এই বুঝি চট্টগ্রামের ট্রেন এলো, ললি, টুনি এসে বুঝি নামলো প্ল্যাটফর্মে। কিছুই হলো না। চট্টগ্রামের ট্রেন আসার কথা একটায়, এলো তিনটা বাজার দশ মিনিট আগে। প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে করতে আমাদের পা রীতিমতো ব্যথা করতে লাগলো। টেনশনের জন্য বসেও থাকতে পারছিলাম না।

ললিদের না দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। বাবুকে বললাম, আমি কিন্তু আশা করেছিলাম এ ট্রেনে ওরা আসবে।

মানুষের সব আশা কি পূর্ণ হয়! দার্শনিকের মতো উদাস গলায় জবাব দিলো বাবু।

কেন, চিঠিতে লিখেছিলাম তো রোববার আমরা যাচ্ছি, দুটোয় কুলাউড়া জংশনে পৌঁছবো।

হয়তো চিঠি পায় নি।

পাবে না কেন? তিন দিন আগে জিপিও গিয়ে বাক্সে ফেলেছি।

বাংলাদেশে শুনেছি এক চিঠি নাকি বারো বছর পর ঠিকানায় গিয়ে পৌঁছেছিলো।

বড়লেখার ট্রেন ছাড়ার ঘন্টা বাজলো। আমরা দুজন ফার্স্ট ক্লাসের কামরা খুঁজে বের করে উঠলাম। একটাই মাত্র ফার্স্ট ক্লাসের কামরা।

আমাদের আগে আরেকজন ভদ্রলোক উঠেছেন কামরাটায়। মুখোমুখি দুটো বার্থ। আমাদেরও বসতে হলো মুখোমুখি। ভদ্রলোকের মুখে সম্ভাষণের মৃদু হাসি। আমিও একটু হাসলাম।

জাহেদ মামার চেয়ে বয়স বেশি হবে না ভদ্রলোকের, বরং কমই হবে। দেখলেই মনে হয় বিদেশ থেকে এসেছেন। দেখতে জাহেদ মামার চেয়েও হ্যাঁণ্ডসাম। অনেকটা পল নিউম্যনের মতো। দামী একটা সুটকেস ওপরের বার্থে, পাশে ওটার ম্যাচিং হ্যাঁণ্ডব্যাগ। বৃটিশ এয়ারওয়েজ-এর ট্যাগ লাগানো।

ট্রেন ছাড়ার পর ভদ্রলোক পাইপ বের করে ধরালেন। তামাকের নাম দেখলাম ক্ল্যান। মিষ্টি গন্ধে কামরাটা ভরে গেলো। তামাকের গন্ধ যে এত সুন্দর হয় জানা ছিলো না। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কদুর যাবে তোমরা?

জবাব দিলাম, পাথারিয়া।

বেড়াতে যাচ্ছো বুঝি?

মাথা নেড়ে সায় জানালাম। তারপর কোনো ক্লাসে, কোনো স্কুলে পড়া হয়, নাম কী এসব জিজ্ঞেস করলেন আমাকে আর বাবুকে। তাঁর সব প্রশ্নের জবাব দেয়ার পর আমাদের প্রশ্ন করার পালা।

আপনি কোথায় যাবেন?

মৃদু হেসে বললেন, বড়লেখা।

বেড়াতে যাচ্ছেন?

বেড়ানো আর কাজ দুটোই।

এই প্রথম যাচ্ছেন বুঝি?

হ্যাঁ, এই প্রথম। বাংলাদেশেও এলাম প্রায় এক যুগ পর।

আপনি কি বিদেশে থাকেন?

হ্যাঁ। কানাডার মন্ট্রিয়েল।

কবে থেকে আছেন সেখানে?

আমার জন্ম হয়েছে ওখানে। আমার বাবা-মা এখন কলকাতায় থাকেন। ওখানেই সেট করেছেন। আমার দাদামশাইর বাড়ি শুনেছি বিক্রমপুর।

আপনার নামটা এখনো জানা হয় নি।

মৃদু হেসে ভদ্রলোক বললেন, কিশোর পারেখ। এ্যাড ফার্মে কাজ করি। সখ হচ্ছে ছবি বানানো।

একজন জলজ্যান্ত চিত্র-নির্মাতার সঙ্গে কথা বলছি ভেবে রীতিমতো রোমাঞ্চ হলো। জিজ্ঞেস করলাম, একটা ছবি বানিয়েছেন আপনি? কী ধরনের ছবি?

ছবি দেখতে বুঝি খুব ভালোবাসো? আমি শর্ট ফিল্ম বানাই। কলকাতার স্লাম এরিয়ার ওপর গত বছর একটা ছবি বানিয়েছি। এবার হাত দিয়েছি চা বাগানের ওপর। গোটা দশেক বানিয়েছি এ পর্যন্ত। এর ভেতর সাতটাই বি বি সি কিনে নিয়েছে। দুটো ছবি এ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। চা বাগানেরটাও ওরা কিনবে। জানো তো ব্রিটিশরাই এদেশে চায়ের চাষ আরম্ভ করেছিলো?

মাথা নেড়ে সায় জানালাম। বাবু বললো, আপনাকে দেখতে পল নিউম্যানের মতো লাগে। আপনি ছবি না বানিয়ে অভিনয় করলে দারুণ হতো।

হা হা করে গলা খুলে হাসলেন কিশোর পারেখ। কথাটা তুমি প্রথম বলে নি বাবু। ক্যালিফোর্নিয়ায় একবার পল নিউম্যানের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো আমার এক বন্ধুর ছবির শুটিং-এ। পল নিউম্যান নিজেই বললো, আমাকে দেখে নাকি তার ইয়ং এজ-এর কথা মনে হচ্ছে।

কিশোর পারেখের কথা শুনে বাবু আর আমি হতবাক। বলে কি, পল নিউম্যানের সঙ্গে কথা বলেছে! পরে মনে হলো, হতেও পারে। ওদের ওখানে ইণ্ডিয়ানদের নাকি বেশ কদর। কিশোর পারেখ মৃদু হেসে বললেন, অভিনয়ের চেয়ে ছবি বানানোটা আমার কাছে বেশি থ্রিলিং মনে হয়।

বলার মতো কথা খুঁজে না পেয়ে বললাম, কানাডায় জন্ম হলেও আপনি কিন্তু চমৎকার বাংলা বলেন।

বাংলা ঠিকমতো না বললে বাবা বেত মেরে পিঠের চামড়া তুলে নেবেন যে! আমার স্কুল শেষ করেই মাকে নিয়ে তিনি দেশে ফিরে এসেছেন। চেয়েছিলেন, আমিও চলে আসি। আমার কাছে মন্ট্রিয়ল বেশি ভালো লাগে। কলকাতার জন্য বাবা-মার যতো নস্টালজিয়া, আমার তা নেই, তবু বছরে এক মাস এসে ওঁদের সঙ্গে থাকতে হয়। এবার অবশ্য কুড়ি দিন ছিলাম।

আপনার বুঝি কোনো ভাই-বোন নেই?

বোন আছে একটা। কলকাতায় বাবা-মার সঙ্গে থাকে। ডাক্তারি পড়ছে। এবার ফোর্থ ইয়ারে।

আমি বললাম, আপনার নামের পদবি কি বাঙালিদের ভেতর আছে?

অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন কিশোর পারেখ–দারুণ ইন্টেলিজেন্ট ছেলে তুমি! ক্লাসে নিশ্চয়ই ফার্স্ট হও! তুমি ঠিক ধরেছো। পারেখ বাঙালিদের পদবি নয়। আমার ঠাকুরদার বাবা ব্যবসা করার জন্য মহারাষ্ট্র থেকে কলকাতা এসে সেটল করেছিলেন। বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে পুরোপুরি বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর কেউ মহারাষ্ট্র ফিরে যায় নি।

বাবুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি ও তখনো ধাতস্থ হতে পারে নি। পারবেই বা কি করে! ক্রিস্টোফার লী কিম্বা ভিনসেন্ট প্রাইসের কথা বললেও না হয় ধাক্কাটা সামলানো যেতো! একেবারে খোদ পল নিউমান! বুচ ক্যাসেডি এ্যান্ড সানড্যান্স কিড দেখার পর থেকে আমরা দুজন পল নিউম্যান আর রবার্ট রেডফোর্ডের ভক্ত হয়ে গেছি। বাবুকে বললাম, নেলী খালা ওঁর কথা শুনলে বিশ্বাসই করবে না।

কী বিশ্বাস করবে না? একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলেন কিশোর পারেখ।

পল নিউম্যানের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে।

হা হা হা–গলা খুলে হাসলেন কিশোর পারেখ আমার একটা ছবি ছিলো, মুভি মোগলস অব হলিউড। ওই ছবি করতে গিয়ে হলিউডের বহু ডিরেক্টর, প্রডিউসর আর স্টারদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। এলিজাবেথ টেলর, রিচার্ড বার্টন, পিটার ওটুল, অড্রে হেপবার্ণ আর আর্লোন ব্রাণ্ডের স্যুটিং-এর ছবি তুলেছি।

উত্তেজনা আর চেপে রাখতে পারলাম না। বললাম, আপানাকে এক দিন নেলী খালাদের বাড়িতে আসতেই হবে।

নিশ্চয়ই যাবো। মিষ্টি হেসে কিশোর পারেখ বললেন, তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়াতে আমার অনেক লাভ হয়েছে। ভাবছিলাম অচেনা জায়গায় কেমন লাগবে। বন্ধু হিসেবে আমাকে নিশ্চয়ই তোমাদের খুব একটা খারাপ লাগবে না?

বাবু বললো আপনাকে আমরা কিশোরদা ডাকবো।

আগের মতো মিষ্টি হাসলেন তিনি—আমি খুশি হবো।

ট্রেন তখন যাচ্ছিলো দিগন্তজোড়া খোলা এক মাঠের মাঝখান দিয়ে। বিকেলের নরম কমলা রঙের রোদ এসে পড়েছে আমাদের কামরার ভেতর। কিশোরদার মুখে লালচে আলোর আভা কাঁপছে। মনে হচ্ছিলো বুচ ক্যাসেডির পল নিউম্যানের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন কোনো শহরে যাচ্ছি।

কিশোরদা বললেন, তোমাদের ফ্লাঙ্কে কি গরম জল আছে?

বাবু তড়বড় করে বললো, গোটা ফ্লাস্ক ভর্তি। হরলিক্স খাবেন?

মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন কিশোরদা—হরলিকস বাদ দাও। আমার কাছে ব্রাজিলিয়ান কফি আছে। তোমরা যদি খাও, তোমাদের সঙ্গে আমিও এক কাপ খাই। আমার গরম জল ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই ফুরিয়ে গেছে।

আমি ক্লাঙ্কটা ওঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, আপনার ফ্লাস্ক ছোট।

তাছাড়া কফিটা আমি একটু বেশি খাই। হাসতে হাসতে বললেন কিশোরদা।

কফি তিনি শুধু বেশি খানই না, বানানও চমৎকার। আমি আর বাবু মুগ্ধ হয়ে ওঁর কফি বানানো দেখলাম। ফ্লাস্কের দুটো কাপে কফি বানিয়ে আমাদের খেতে দিলেন। বললেন, এ কফিটা এমনিতে খুব কড়া, তোমাদের জন্য হালকা করে বানিয়েছি।

কফির গন্ধের সঙ্গে মিষ্টি একটা পোড়া গন্ধ, খেতে বেশ মজাই লাগলো। বললাম, দারুণ হয়েছে।

কফি খেতে খেতে কিশোরদা বললেন, অনেক বছর পর বাংলাদেশে এসে কী যে ভালো লাগছে! এবার ওয়েদারটাও চমৎকার।

খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঢুকছিলো আমাদের কামরায়। এলোমেলো বাতাসে কিশোরদার লালচে চুলগুলো কপালের ওপর লুটোপুটি খাচ্ছিলো। আমার আর বাবুর গায়ে গরম জ্যাকেট। কিশোরদার গায়ে হালকা কার্ডিগান। শীতের দেশে থাকেন বলে আমাদের চেয়ে শীত ওঁর কমই লাগার কথা। মা আমাদের সুটকেসে গরম কাপড় ভালো করেই ঠেসে দিয়েছেন।

বাবু বাইরে তাকিয়ে ট্রেনের সঙ্গে গাছপালা, ঘরবাড়ির ছুটে চলা দেখছিলো। বললো, শীতের বিকেলগুলো কত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়।

সূর্য কখন পশ্চিমের লাল-বেগুনি রঙের মেঘের আড়াল দিয়ে ডুবে গেছে টেরও পাই নি। ঘড়িতে তখন মাত্র পাঁচটা বাজে। কিশোরদা মৃদু হেসে বললেন, ট্রেনের শব্দ শুনে কী মনে হচ্ছে বলো তো?

বাবু অবাক হয়ে জানতে চাইলো, কী মনে হবে?

ট্রেন বলছে–পাথারিয়া কতদূর, পাথারিয়া কতদূর। এই বলে কিশোরদা আমার দিকে তাকালেন-তাই না আবির?

আমি হেসে বললাম, আপনার এ কথা মনে হবে কেন? আপনি তো পাথারিয়া পর্যন্ত যাবেন না।

কিশোরদা আগেই বলেছিলেন, তিনি উঠবেন বড়লেখা স্টেশন থেকে দুমাইল দূরে ইটাগঞ্জ টী এস্টেটে। ওখানকার ম্যানেজার নাকি ওঁর বন্ধু।

বাবু জানতে চাইলো, পাথারিয়া আসলে কতদূর?

মনে হয় না আর বেশি দূর হবে। ঘড়ি দেখে কিশোরদা বললেন, আমার বন্ধুটি বলেছিলো, পাঁচটা নাগাদ বড়লেখায় পৌঁছবে।

ঠিক পাঁচটা বারো মিনিটে ট্রেন এসে থামলো বড়লেখা স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে দেখলাম নেলী খালা ব্যাস্ত হয়ে সামনের কামরাগুলোতে আমাদের খুঁজছেন। বাবু হঠাৎ উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, আবির, দেখ দেখ, নেলী খালার সঙ্গে কে এসেছে?

বুকের ভেতর উত্তেজনা আর আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়লো। তাকিয়ে দেখি নেলী খালার সঙ্গে ললি টুনিও আমাদের খুঁজছে। ট্রেন তখনো থামে নি, আস্তে আস্তে ফেঁশ ফোঁশ নিঃশ্বাস ফেলে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। চেঁচিয়ে ডাকলাম, নেলী খালা, আমরা এখানে।

আমাদের উত্তেজনা দেখে কিশোরদা বেশ অবাকই হয়েছেন। বললেন, নেলী খালার কাছে গিয়ে নিশ্চয়ই আমাকে তোমরা ভুলে যাবে!

আমি একটু লজ্জা পেলাম–তা কেন কিশোরদা! আমি তো চাই আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন।

আমার ডাক শুনে নেলী খালা ছুটে এসে ট্রেন না থামতেই কামরায় উঠে পড়লেন। পেছন পেছন ললি টুনিও হুড়মুড় করে ঢুকলো। নেলী খালা বললেন, কখন থেকে বসে আছি, তোদের পাত্তাই নেই।

নেলী খালার কথার ধরন দেখে আমি হেসে ফেললাম–এমনভাবে বলছো যেন আমরাই ট্রেনটা চালিয়ে এনেছি।

টুনি বললো চেহারা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে–একজন ড্রাইভার, আরেকজন গার্ড।

ললি মৃদু হেসে চাপা গলায় টুনিকে বললো, আহ, টুনি, আসতে, না আসতেই তুমি ওদের পেছনে লেগেছো!

টুনি তড়বড় করে বললো, তুমি দেখো নি ললিপা। বাবু আমাকে জিভ দেখিয়েছে।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, বাবুর সঙ্গে পরে বোঝাঁপড়া করো। নেলী খালা, এসো তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি হচ্ছেন কিশোর পারেখ। শর্ট ফিল্ম বানান, কানাডায় থাকেন, বড়লেখায় এসেছেন বেড়াতে।

নেলী খালা হাতে বাড়িয়ে বললেন, বড়ো খুশি হলাম আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে। বড়লেখায় থাকছেন কোথায়?

কিশোরদা আলতোভাবে নেলী খালার সঙ্গে হাত মিলিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ইটাগঞ্জ টী এস্টেটে। আমার বন্ধু মণি ওখানে ম্যানেজার। আপনার কথা আবিরদের কাছে অনেক শুনেছি। যদিও ট্রেনেই আলাপ, তবু মনে হচ্ছে আমরা চমৎকার বন্ধু হয়ে গেছি।

কিশোরদার কথার মাঝখানে তাকিয়ে দেখি টুনি গোল গোল চোখে ওকে দেখতে দেখতে বাবুর কানে কানে কী যেন বলছে। বুঝতে অসুবিধে হলো না পল নিউম্যান প্রসঙ্গেই কথা বলছে ও। বাবুও মুখ টিপে হেসে মাথা নেড়ে সায় জানালো।

আমরা সবাই ঝটপট নেমে পড়লাম প্ল্যাটফর্মে। দেখি কিশোরদার বন্ধুও এসে গেছেন। কিশোরদার সমবয়সী হবেন, শক্ত-সমর্থ পোড়-খাওয়া চেহারা। হাসি মুখে এগিয়ে এসে হাত মেলাতে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন কিশোরদাকে। বললেন, আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না, তুই সত্যি সত্যি এসেছিস।

কিশোরদা হাসতে হাসতে ওঁর বন্ধুর পিঠ চাপড়ে বললেন, তোর কি মনে হচ্ছে আমি সত্যি সত্যি আসি নি, আমার ভূত এসেছে?

ওঁর কথা শুনে আমরা সবাই হেসে ফেললাম। কিশোরদা সামলে নিয়ে ওঁর বন্ধুর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, ওরা আমাকে কিশোরদা বললেও আমি কিন্তু ওদের বন্ধু হয়ে গেছি।

কিশোরদার বন্ধু মৃদু হাসলেন–তাহলে আমাকে তোমরা মণিদা ডেকো। এই বলে নেলী খালার দিকে তাকালেন, আপনাদের বাংলো আমি চিনি, কিশোরকে নিয়ে কাল-পরশু চলে আসবো।

নিশ্চয়ই আসবেন। মিষ্টি হেসে নেলী খালা বললেন, নতুন এসেছি, কারো সঙ্গে ভালো করে পরিচয়ও হয় নি।

মণিদা বললেন, চলুন রওনা হই, আপনি তো জীপ এনেছেন। প্ল্যাটফর্মে আপনাকে দেখেই কিন্তু আমি অনুমান করেছিলাম আপনি কে!

নেলী খালা মৃদু হেসে ওদের বিদায় জানালেন। কিশোরদা আমাদের সবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন।

ছোট্ট স্টেশন বড়লেখা। আমরা ছাড়া আর যারা নেমেছিলো তারা আগেই বেরিয়ে গেছে। নেলী খালা আমাদের নিয়ে জীপে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে বললেন, পাথারিয়া পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। রাস্তা খুব খারাপ। আসতে প্রায় এক ঘন্টা লেগেছিলো।

চোখের পলকে এক রত্তি শহরটা পেছনে ফেলে দুপাশে ধান ক্ষেত, চা বাগান, খোলা মাঠ পেরিয়ে আমাদের হুড খোলা জীপ ছুটে চললো পাথারিয়ার দিকে। বাবু আর টুনি সামনে নেলী খালার পাশে বসে কলকল করে অনর্গল কথা বলছিলো, হাসছিলো। আমি আর ললি ছিলাম একেবারে চুপচাপ। ললির ঠোঁটের ফাঁকে শীতের শেষ বিকেলের আলোর মতো এক টুকরো মিষ্টি হাসি। আশ্চর্য রকম সুন্দর লাগছিলো ওকে।