১৩-১৪. সব পাজিদের এক রা

১৩. সব পাজিদের এক রা

যেখানে খুশি যাও, দুপুর সময়মতো যেন খাবার টেবিলে দেখতে পাই। সকালে নাশতা খেয়ে বেরুবার সময় নেলী খালা এ কথা বলে আমাদের বিদায় দিলেন। আমাদেরও দেরি করার কোনো ইচ্ছে ছিলো না। জঙ্গল পেরিয়ে লাল পাহাড়ের নিচে এসে যখন পৌঁছলাম ঘড়িতে তখন মাত্র সকাল সাড়ে নয়টা।

স্ক্যাটরা আমাদের সঙ্গে আসে নি। নেলী খালা ওকে বকেছেন, রোজ রোজ এতো কী বেড়ানো? দু তিন দিন ধরে যে গা ধোয়া হচ্ছে না, সে খেয়াল আছে? বকুনি খেয়ে মুখ গোমড়া করে স্ক্যাটরা বারান্দায় বসেছিলো। আমাদের বেরুনোর সময় ফিরেও তাকায় নি।

পাহাড়ের ভেতর থেকে ধুপ-ধুপ ভৌতিক শব্দটা আগের মতোই মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। কিশোরদার গল্পের কথা মনে হলো, প্রফেসর হাবিবের ধানবাদের ঘটনাও। মনে হলো, কয়েকশ মানুষের হার্টবিট এক হাজার গুণ জোরে বেরিয়ে আসছে লাল পাহাড়ের বুকের ভেতর থেকে। রীতিমতো গা ছমছম ব্যাপার। ললিকে বললাম, পাহাড় বেয়ে উঠতে পারবে তো?

মৃদু হাসলো ললি–নুলিয়াছড়িতে এর চেয়ে খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠি নি?

তবু ললির কষ্ট হবে ভেবে একটু কম খাড়া জায়গা খুঁজে নিয়ে আমরা ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম। মাঝে মাঝে পোড়া মবিলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। বাবু বললো, এটা যদি আগ্নেয়গিরি হয়, কী হবে বলতো?

ভূগোলে কখনো পড়ি নি, এখানে আগ্নেয়গিরি আছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হলে না হয়–কথা শেষ করার আগেই উঁচু কিছুর সঙ্গে হোঁচট খেলাম আমি।

হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়ে কোনোরকমে সামনে নিলাম। কী হলো? বলে এগিয়ে এলো ওরা সবাই।

তাকিয়ে দেখি ভারি লোহার এ্যাঙ্গেলের মতো কি যেন মাটির ভেতর থেকে ইঞ্চি ছয়েকের মতো বেরিয়ে রয়েছে। ঘাসে ঢাকা ছিলো বলে বুঝতে পারি নি। বাবু বললো, এ জিনিস এখানে এলো কোত্থেকে?

কেন, সেদিন প্রফেসর কী বললেন শোন নি? এখানে যারা তেলের খনি খুঁজতে এসেছিলো, তাদের কিছু হতে পারে। এই বলে হোঁচট খাওয়া পাটা ঝেড়ে নিলাম।

যত ওপরের দিকে যাচ্ছিলাম, লোহার টুকরো আর ইট ভাঙা দেখতে পেলাম। আধঘন্টা হাঁটার পর পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দেখি লোহার বড়ো বড়ো ভাঙা যন্ত্রপাতি বুনো লতা জড়িয়ে পড়ে আছে দেখলেই মনে হয় চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগেকার, পুরু হয়ে মর্চে জমেছে।

ললির জন্য পনেরো মিনিট বিশ্রাম নিলাম পাহাড়ের চূড়ায় বসে। প্রফেসরের জন্য বাবু আর টুনি কতগুলো পাথরের নুড়ি কুড়িয়ে নিলো। নামতে গিয়ে তেমন কোনো

অসুবিধে হলো না। পাহাড়ের এ পাশটায় গাছপালা বেশি। কয়েকটা মনে হলো একশ বছরেরও বেশি পুরোনো। একটুখানি ফাঁকা জায়গায় এসে সামনে তাকিয়ে দেখি, খানিক খোলা জায়গার পর আবার পাহাড় শুরু হয়েছে। এরপর পুব দিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে কালচে সবুজ গাছপালা। মনে হয় মানুষের পায়ের ছাপ কোনোদিন সেখানে পড়ে নি।

হঠাৎ টুনি উত্তেজিত হয়ে বললো, ওই দিকে দেখো, ওরা কারা?

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখি দূরের একটা খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে প্যান্ট, শার্ট পরা দুজন লোক উঠছে। এত দূরে যে–চেহারা চেনা যাচ্ছিলো না। বাবু বললো, ইশ, বাইনোকুলারটা যদি নিয়ে আসতাম।

বাবু আমেরিকা থেকে একটা বাইনোকুলার এনেছিলো, ওটা এখন ঢাকায়, আমাদের রূপলাল লেনের পুরোনো বাড়িটার চিলেকোঠার ঘরে।

ললি বললো, পরনের কাপড় দেখে তো মনে হচ্ছে সার্ভে টিমের কেউ।

আমি বললাম, জায়গাটা কিন্তু সার্ভের এলাকার বাইরে।

তাতে কী! এলাকার বাইরে যেতে কেউ বারণ করেছে নাকি ওদের? এমনভাবে বাবু কথাটা বললো, এরপর আমরা কেউ আর উচ্চবাচ্য করলাম না।

লাল পাহাড় পেরিয়ে সামনের পাহাড়ের দিকে যাচ্ছিলাম–তখনই ঘটলো এক অঘটন। বাবু আর টুনি হাঁটছিলো সামনে, আমি আর ললি পেছনে। তাড়াতাড়ি হাঁটলে ললির কষ্ট হয়। আমি ওকে বলতে যাচ্ছিলাম বুকে ব্যথা হচ্ছে কিনা ঠিক তখনই হুড়মুড় করে একটা শব্দ হলো, আর সঙ্গে সঙ্গে বাবুর আর্তচিৎকার। চমকে উঠে তাকিয়ে দেখি বাবু আর টুনি চোখের সামনে থেকে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে। চোখের সামনে দুজন মানুষ কপুরের মতো উবে গেলো–আমি আর ললি বিস্ময়ে হতবাক। একটু পরেই শুনি মাটির তলায় খচমচ শব্দ আর বাবুর চিৎকার–আবির, আমরা এখানে।

কয়েক পা এগিয়ে সামনে যেতেই দেখি বাবু আর টুনি আট দশ হাত নিচে একটা কুয়োর মতো গর্তের ভেতর, যার মুখটা জংলী ঘাস লতায় প্রায় ঢাকা পড়েছে। তলায় শুকনো পাতা পুরু হয়ে জমেছিলো বলে ওদের বেশি লাগে নি। হঠাৎ এভাবে পড়ে যাওয়াতে ওরা দুজনও হতভম্ভ হয়ে গেছে। ললিকে দেখে টুনি কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ললিপা, আমার স্যান্ডেল পাচ্ছি না।

বাবু বললো, এখানে কোথাও পড়েছে, খুঁজে দেখো।

স্যাণ্ডেল খুঁজে পেয়ে আবার টুনির নাকি কান্না–আমাদের এখান থেকে বের করছো না কেন তোমরা?

আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখছিলাম গাছের শক্ত ডাল কিম্বা মোটা কোনো লতা পাওয়া যায় কিনা। একটু দূরে ললিই দেখালো, দুটো শুকনো ডাল পড়ে আছে। শক্ত কিনা পরখ করে ও দুটো কুয়োর ভেতর কোণাকুণি করে নামিয়ে দিলাম। যথেষ্ট বড়ো না হওয়াতে আমাকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে হলো। বললাম, একজন একজন করে উঠে এসো, আমি টেনে তুলছি।

ললিও আমার পাশে বসে পড়েছে। গর্তের তলা থেকে বাবু বললো, টুনিকে আগে তোল। টুনি স্যাণ্ডেল খুলে হাতে নাও।

ঠিক তখনই অনুভব করলাম লোহার সাঁড়াশির মতো শক্ত হাতে আমার ঘাড়ের ওপর ধরে কে যেন আমাকে শূন্যে তুলতে তুলতে বলছে, থাক থাক, এতো কষ্ট করতে হবে না। আমরাই তোমার বন্ধুদের টেনে তুলব।

চমকে উঠে এক ঝটকায় ছাড়াতে যাবো, ঘাড়ের ওপর চাপটা আরো বেড়ে গেলো। মনে হলো আমার ঘাড়টা বুঝি পাটখড়ির মতো পট করে ভেঙে যাবে। শূন্যে হাত-পা ছোঁড়া ছাড়া কিছুই করার ছিলো না। কোনো রকমে তাকিয়ে দেখি সাত আটজন লোক, মুশকো গুণ্ডা চেহারা, দাঁত বের করে হাসছে। ললির হাতও একজনের হাতে ধরা।

কত্তা ভারি খুশি হবেন চার বিচ্ছুকে একসঙ্গে পেলে। ওদের ভেতর কে যেন বললো।

আরেকজন বললো, কতদিন ভালোমন্দ খাই না। আজ এদের কল্যাণে মনে হয় বিলেতি মাল জুটবে।

একজন লাফ মেরে গর্তে নামলো। বুলডগের মতো থ্যাবড়ামুখো একজন বাবু টুনিকে টেনে তুলে আনলো।

ছুঁচোমুখো একজন বললো, আর দেরি কেন? চলো ইনামটা এ বেলা নিয়ে নি। কত্তা কখন কোন মেজাজে থাকে বলা যায় না। খাকি শয়তানগুলো কম হেনস্তা করে নি কত্তাকে।

একজনের কাছে দড়ি ছিলো। আমাদের চারজনকে পিছমোড়া করে বেঁধে বললো, ভাগ্যিস হারামজাদা কুত্তাটাকে আনে নি।

থ্যাবড়ামুখো বললো, আনলে কী হতো? ভোজালি দিয়ে পেটটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতাম না?

ছুঁচোমুখো আমাদের বললো, পা চলে না কেন ইবলিশের দল? ধোলাই কি এখান থেকে শুরু করতে হবে?

টুনির চেহারা দেখে মনে হলো এক্ষুণি বুঝি কেঁদে ফেলবে। বাবু আর ললিও ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। ঘাবড়াবার কথাইতো, হঠাৎ করে বোকার মতো এভাবে শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়বো কস্মিনকালেও ভাবি নি।

মিনিট দশেক হাঁটার পর থ্যাবড়ামুখো বললো, এবার বাছা তোমাদের চোখ বাঁধতে হবে। যদি কোনো রকমে কত্তার মতো পালাতে পারো, তাহলে যাবজ্জীবন কয়েদ আর ফাঁসির দড়ি থেকে কেউ আমাদের বাঁচাতে পারবে না।

লোকগুলো কালো কাপড়ের টুকরো দিয়ে আমাদের সবার চোখ বেঁধে দিলো। তারপর হাত ধরে নিয়ে চললো এলোমোলো ঘুরপথ দিয়ে। কোন দিকে যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারলাম না। যারা আমাদের ধরেছে তারা যে পাকা ক্রিমিনাল এতে কারো মনে কোনো সন্দেহ রইলো না। এমনভাবে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিলো, মনে হলো, ওদের কাছে আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু।

এক ঘন্টার মতো হাঁটার পর কিছু দূরে লোকজনের কথা বলার শব্দ শুনতে পেলাম। একটু পরে ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে ওপর দিকে হাঁটতে হলো। বনের ভেতর গাছপালা আর লতা-পাতার একরকম গন্ধ পাচ্ছিলাম। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর অন্য রকম একটা আঁশটে বিদঘুঁটে গন্ধ নাকে লাগলো। একবার ডান দিকে, একবার বাম দিকে, কখনো উল্টো ঘুরে কোথায় যে এলাম কিছুই বুঝতে পারলাম না।

এবার চোখ খোলা যেতে পারে। এই বলে একজন আমাদের চোখ খুলে দিলো। হাতের বাঁধন আগের মতোই থাকলো। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখি অতি পুরোনো ভাঙা কোনো বাড়ির ঘর, দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ে ইট বেরিয়ে আছে, মেঝের অবস্থাও সেরকম, ছাদের কড়িকাঠ মনে হয় যে-কোন সময়ে ভেঙে পড়বে। সঁাতসেঁতে ভ্যাপসা একটা দুর্গন্ধ। ভীষণ এক অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়লো সারা শরীরে। টুনির চেহারা রক্তশূন্য, বাবু আর ললিকে মনে হলো একটা ঘোরের ভেতর আছে।

থ্যাবড়ামুখো আমাদের চোখের বাঁধন খুলে দিয়েছিলো। আমাদের হতভম্ব চেহারা দেখে হ্যাঁ হ্যাঁ করে হায়নার মতো কুৎসিত হাসলো। টেনে টেনে বললো, কতদিন পর বড় কত্তার বখশিস পাবো। ইচ্ছে করছে তোদেরও ভাগ দেই।

ছুঁচোমুখো কোথায় যেন গিয়েছিলো। ঘরে ঢুকে বললো, এগুলোকে নিচে নিয়ে চল। কত্তা ডাকছেন।

থ্যাবড়ামুখো দুহাতে আমার আর বাবুর কনুই চেপে ধরলোচলো বাপ রাজদর্শনে। এই বলে কনুইতে এমন জোরে চাপ দিলে ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলো বাবু। আমি দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলাম। রাগে চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত জ্বলে যাচ্ছিলো।

পাশের ঘরের ভেতর দিয়ে সিঁড়ি, নিচে অন্ধকারের দিকে নেমে গেছে। শেষ সিঁড়িতে পা দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম। থ্যাবড়ামুখো সাঁড়াশির মতো শক্ত হাতে ধরে থাকাতে রক্ষা পেলাম। ললি টুনি আমাদের পেছনে ছিলো। ওদের পেছনে টর্চ হাতে ছুঁচোমুখো।

একটা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থ্যাবড়ামুখো গলা তুলে বললো, কত্তা বিচ্ছুগুলোকে এনেছি। ভেতরে আসবো?

ভেতর থেকে আয়, আয়, শুনে থ্যাবড়ামুখো দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। ধাক্কা মেরে আমাদের ঠেলে দিলো সামনে।

চেয়ারে বসা যে লোকটা আমাদের দেখে খিকখিক করে হাসছিলো, ওকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ঘরে কম পাওয়ারের ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলছিলো। আলো কম হলেও পরিষ্কার দেখলাম আমাদের সামনে বসে আছে নুলিয়াছড়ির নিকুঞ্জ পাকড়াশী। হাসতে হাসতে মোলায়েম গলায় আবৃত্তির সুরে বললো, এসো এসো, গর্তে এসো, বাস করে যাও চারটি দিন। আদর করে শিকেয় তুলে রাখবো তোমায় রাত্রিদিন। হি-হি-হি-হি। কেমন মজা বাছাধন। নিকুঞ্জ পাকড়াশীকে তোমরা আজও চিনতে পারো নি। এই বলে গলার স্বর অন্য রকম করে পাকড়াশী বললো, আমার নাম আফাজুদ্দিন, বাফর নাম কলিমুদ্দিন। বাড়ি গোলাফগঞ্জ। ইটাগঞ্জ বাগানে আমার বাইর লগে থাকি। আমার কুন দুষ নাই। হি-হি-হি-হি।

পাকড়াশীর কথা শুনে আমরা বিস্ময়ে একে অপরের দিকে তাকালাম। তাহলে পাকড়াশীই কদিন ধরে আমাদের ওপর নজর রাখছিলো।! দুবার ধরার পরও ওকে আমরা চিনতে পারি নি। শরীরের কাঠামো ছাড়া গলার স্বর, চেহারা, চালচলন এমনই বদলে ফেলেছিলো যে, নেলী খালা আর জাহেদ মামা পর্যন্ত চিনতে পারেন নি শয়তানটাকে।

তোরা আমাকে চিনিস নি, চিনেছিলো তোদের হারামজাদা কুত্তাটা। হি-হি-হি। পাকড়াশীর কথা শুনে আর চেহারা দেখে মনে হলো আমাদের বোকা বানানোর ব্যাপারটা ও দারুণ উপভোগ করছে। টুনির দিকে তাকিয়ে মোলায়েম হাসলোকী

গো খুকুমণি, কেমন লাগছে! হাতে একটা বালতি ধরিয়ে দেবো নাকি! আমিও বাপু কাউকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানো পছন্দ করি না। এই বলে পাকড়াশী থ্যাবড়ামুখোর দিকে তাকালোমাথামোটা মেজরটাকে রাতেই চিঠি পৌঁছে দিবি।

দেবো কত্তা। ঝটপট জবাব দিলো থ্যাবড়ামুখো।

বুঝেছিস কিছু কেন তোদের ধরেছি? আমার দিকে তাকালো পাকড়াশী।

নেলী খালাকে জব্দ করার জন্য আমাদের ধরেছে এ কথা না জানার কি আছে। চিঠি লিখে আগে হুমকিও দিয়েছে, নেলী খালার প্রিয়জনের বিপদ হতে পারে। টুনি বললো, জাহেদ মামা জানতে পারলে তোমাকে গুলি করে মারবে।

হি-হি-হি-হি। হেসে গড়িয়ে পড়লো পাকড়াশী। যেন এর চেয়ে হাসির কথা জীবনে শোনে নি। আমাকে ধরবে মাথায় গোবরপোরা ওই মেজরটা! হি-হি-হি। কি যে হাসির কথা বললি ছুঁড়ি! হি-হি-হাসতে হাসতে আমার পেট ফেটে যাবে। কাল কিভাবে ওদের সব কটাকে লাটু ঘোরালাম, তোদের বলে নি বুঝি! হি-হি-হি আমি কোথায় যাবো গো! এই বলে একটু ধাতস্থ হলো পাকড়াশীশোন বাছা, এই বেলা তোদের একটা কথা বলে রাখি। আমি না চাইলে আমাকে ধরে এমন বাপের বেটা এখনো এই পৃথিবীতে জন্মায় নি। তোদের আমি ওই মাথামোটাকে জব্দ করার জন্য আনি নি। তোদের এনেছি জিম্মি করে। কাল সকালে যদি গোবরপোরা ভালোয় ভালোয় ম্যাপটা আমাদের হাতে তুলে না দেয় তাহলে তোদের কপালে দুর্ভোগ আছে। এই বলে শয়তানটা কী যেন ভাবলো। তারপর হঠাৎ মনে পড়েছে এমনভাবে বললো, হ্যাঁ, দুর্ভোগের কথা বলছিলাম। তোদের চারজনের হাতে চার দশে চল্লিশটা আঙুল আছে। তিন বেলা খাওয়ার সময় তিনটা আঙুল কেটে পাঠাবো। দেখি কতদিন সইতে পারে তোদের পেয়ারের নয়া কুটুম্ব! এই যে খুকুমণি, কাঁদছো কেন?

টুনির দিকে তাকিয়ে দেখি ওর দুগাল বেয়ে কান্না গাড়িয়ে পড়ছে। পাকড়াশী মোলায়েম গলায় বললো, এখনই কান্নাকাটি কেন? এখনও তো প্রায় চব্বিশ ঘন্টা সময় আছে। তারপর চিঠি লেখারও সুযোগ পাবে। তারপর লটারি হবে। এমনও হতে পারে লটারিতে তোমার নাম সবার শেষে উঠবে। এখন তাহলে কেঁদো না।

চুপ কর শয়তান। কাঁদতে কাঁদতে টুনি বললো, অসভ্য, বদমাশ! স্ক্যাটরা তোকে কুচি কুচি করে টুকরো করবে।

ললি ওর কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে বললো, কাঁদবে না টুনি, শয়তানটা তাহলে পেয়ে বসবে!

মুখটা ছুঁচোলো বানিয়ে পাকড়াশী চুকচুক করলো–ওকে বুঝিয়ে বলো বাছা! তোমরা কতো সাহসী! মনে নেই নুলিয়াছড়িতে আমাকে কিভাবে নাজেহাল করেছে! এসব কান্নাকাটি কি তোমাদের মানায়! যাও, এবার বিশ্রাম নাও গে। যা হবার কাল হবে। এই বলে গলার স্বর পাল্টে থ্যাবড়ামুখোকে বললো, এদের নিয়ে ওপরের ঘরে আটকে রাখ। সাবধান থাকবি, এক-একটা কেউটের ছা। কিছু হলে তোদের সব কটাকে আমি জ্যান্ত মাটিতে পুঁতবো।

আমি পাকড়াশীকে বললাম, তুমি কি প্রফেসর ইরফান হাবিবের ম্যাপের কথা বলছো?

চোখ পিটপিট করে আমার দিকে তাকালো পাকড়াশী–হ্যাঁ, ওটার কথাই বলছি, তুই জানিস কী করে?

ওটা তুমি পাচ্ছে না। শান্ত গলায় আমি বললাম।

নাকি! পাকড়াশীর গলায় উপহাস–মামাবাড়ি বেড়াতে এসেছিলি বটে, এটাকেও তোদের মামাবাড়ি ভেবেছিস নাকি! কেন পাবো না শুনি?

ওটা চুরি হয়ে গেছে।

কী বললি? খেঁকিয়ে উঠলো পাকড়াশী–হিসেব করে কথা বলিস। আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মেরেছিস তো তোর আঙুল দশটা সবার আগে কাটবো?

তুমি এতো কিছু জানো আর এ খবরটা রাখো না? রাগে আমার গলা কর্কশ শোনালো-পরশু রাতে ওটা চুরি হয়েছে। প্রফেসর নিজে এসে বলে গেছেন ক্যাম্পে আর্মির পাহারা বাড়াতে।

বলিস কী! আমার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো পাকড়াশী। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কি যেন ভাবলো। তারপর আপন মনে বললো, এ কাজ নির্ঘাত সিনেমা পার্টির ছোঁড়াটার কাজ। প্রথম দিনই আমার সন্দ হয়েছিলো।

থ্যাবড়ামুখো বললো, কত্তা, আজও ওটাকে দেখলাম কী যেন মাপজোখ করলো। তারপর তিন নম্বর পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলো। সঙ্গে কাকে যেন নিয়ে এসেছে।

সঙ্গে আবার কে আসবে? ভুরু কুঁচকে পাকড়াশী বললো, চা বাগানের ম্যানেজার ছোঁড়া নয় তো?

না কত্তা, অন্য লোক। ঢাকা থেকে এসেছে। সঙ্গে অনেক যন্ত্রপাতি এনেছে।

ছুঁচোমুখো এতোক্ষণ কোনো কথা বলে নি। আমাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিলো। থ্যাবড়ামুখোর কথা শেষ হওয়ার পর বললো, আমার মনে হয় কত্তা আপনি ঠিকই ধরেছেন। সিনেমাঅলাই ওটা হাতিয়েছে। কাল রাতে দু নম্বর পাহাড় থেকে অনেকক্ষণ সিগন্যাল পাঠিয়েছে।

ছুঁচোর কথা শুনে রীতিমতো চমকে উঠলাম। কিশোরদা এ কাজ করতে পারে এটা কিভাবে বিশ্বাস করি! অথচ এদের কথা শুনে মনে হচ্ছে আমাদের ভাঁওতা দিয়েছে কিশোর পারেখ।

হারামজাদা তাহলে এই মতলবে এসেছে! চিবিয়ে চিবিয়ে বললো পাকড়াশী। মজা দেখাচ্ছি! জগা শোন, তোরাবালিকে বল এখনই ওপারে ক্যাম্পে গিয়ে বোঝাঁপড়া করে আসতে। কথা বলেছে আমার সঙ্গে, মাল ডেলিভারি দেবো আমি। মাঝখান থেকে সিনেমাঅলা ছোঁড়া আসে কেন শুনি? উল্টো সিধে কিছু বললে, খরচার কথা তুলবি। একমাসে আমার ব্যবসায় কম ক্ষতি হয় নি। তোরাবালিকে বলবি, যাবে আর আসবে, দেরি যেন না হয়। এই বলে একটু থামলো পাকড়াশী। তারপর থ্যাবড়ামুখোকে বললো, এগুলোকে নিয়ে আটকে রাখ। চিঠি পাঠানোর দরকার নেই। মেজরের সঙ্গে আমার অন্য বোঝাঁপড়া আছে। তার আগে সিনেমাঅলার সঙ্গে বোঝাঁপড়া করতে হবে।

দোতালার ওপরের যে কামরাটা দরজা জানালা সমেত অক্ষত ছিলো সেখানে আমাদের চারজনকে রেখে বাইরে থেকে দরজা আটকে দিলো থ্যাবড়ামুখো। আমাদের হাত তখনও পিছমোড়া করে বাধা। একেবারে অবশ হয়ে গেছে।

থ্যাবড়ামুখো চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ আমরা চুপচাপ রইলাম। তারপর বাবু বললো, আবির, তোমার কি মনে হয় প্রফেসরের ম্যাপ কিশোর পারেখ চুরি করেছে?

এদের কথায় তাই তো মনে হচ্ছে।

আমার সঙ্গে ললি যোগ করলো, নইলে ও লোক সকালে ওরকম খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠে যাবে কেন? ওর তো এখন ঢাকায় থাকার কথা।

আমি বললাম, সঙ্গে অন্য লোক ছিলো। তার মানে মণিদা এসব জানে না।

ম্যাপটা তাহলে সত্যি সত্যি হাতছাড়া হয়ে গেলো। বাবুর গলায় হতাশা।

ম্লান হেসে ললি বললো, প্রফেসর ঠিকই অনুমান করেছিলেন, ইণ্ডিয়ানরাই ওর ম্যাপ চুরি করিয়েছে।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না। একটু ভেবে বললাম আমি।

কেন, তোমার কী মনে হয়? জানতে চাইলো ললি।

পাকড়াশীর কথা শুনে তো মনে হলো ইণ্ডিয়ানরা ওকে লাগিয়েছে এ কাজে। কিশোর পারেখ অন্য কোনো দেশের হয়ে এ কাজ করতে পারে।

অন্য দেশের স্বার্থ কি?

আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াই, এটা পাকিস্তানও চাইবে না।

তুমি বলতে চাও কিশোর পারেখ পাকিস্তানী এজেন্ট?

হতে পারে।

টুনি এতোক্ষণ চুপচাপ আমাদের কথা শুনছিলো। ও ছিলো কিশোর পারেখের বেশি ভক্ত। তার এই অধঃপতনে টুনির সবচেয়ে মন খারাপ করবে এতো জানা কথা। মুখ কালো করে বললো, কে কার এজেন্ট এসব নিয়ে পরেও তো ভাবা যাবে। এখান থেকে বেরুবো কিভাবে সেটা আগে ভাবো।

আমি বললাম, সেটাও ভেবেছি টুনি। দিনের বেলায় এখান থেকে বেরুনো যাবে না। বেরুতে হবে রাতে। আমার মনে হচ্ছে আজ রাতে পাকড়াশীর কিশোর পারেখকে ধরার ব্যাপারে ব্যস্ত থাকবে।

বাবু বললো, কিশোর পারেখ ম্যাপ চুরি করে এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? ওর তো পালিয়ে যাওয়ার কথা!

ললি বললো, বোধ হয় চেক করে দেখছে সব ঠিক আছে কিনা।

তার মানে সেও একজন জিওলজিস্ট?

হতে পারে। আমি বললাম, তবে সিনেমা সম্পর্কে ভালো খোঁজ-খবর রাখে।

ওটা স্পাইদের রাখতে হয়। বাবু বললো, পাকড়াশী আমাদের যতো না বোকা বানিয়েছে তার চেয়ে বেশি বোকা বানিয়েছে শয়তান কিশোর পারেখ।

টুনি বললো, এ সময় স্ক্যাটরা যদি থাকতো।

স্ক্যাটরা থাকলে আমরা ধরা পড়তাম না। স্নান হেসে বললো ললি।

ঘরটার একপাশের দেয়ালে মোটা লোহার শিকওয়ালা জানালা। বাইরে দুপুরের আকাশ ঝকঝক করছে। কয়েকটা চিল ভেসে বেড়াচ্ছে সেই খোলা আকাশে। নেলী খালা ভাবতেও পারবেন না পাথারিয়ার গভীর জঙ্গলের এক পোড়ো বাড়িতে আমরা চারজন পাকড়াশীর হাতে বন্দি হয়ে পড়ে আছি। এক ঝাঁক সবুজ টিয়াপাখি টি টি করে ডাকতে ডাকতে ঝটপট উড়ে গেলো জানালা পাশ দিয়ে।

.

১৪. পাখি উড়ে গেলো শেষে

পাকড়াশী অতি শয়তান লোক এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সেদিন ও আমাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে নি। দুপুরে থ্যাবড়ামুখো আর এক চিমসে বুড়ি এসে আমাদের হাতের বাঁধন খুলে একজন করে নিচের কুয়োতলায় নিয়ে গেছে। বালতিতে করে পানি তুলে দিয়েছে মুখ হাত ধোয়ার জন্য। তারপর বুড়ি থালায় করে ভাত এনে দিয়েছে।

রাগে-দুঃখে খাওয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না। তবু খেতে হলো, শরীর দুর্বল হলে কিছু করা যাবে না ভেবে। টুনি থ্যাবড়ামুখোর অগোচরে বুড়িকে চুপি চুপি বলেছিলো, আমাদের যদি যেতে দাও, তোমাকে অনেক টাকা দেবো।

না রে মা! বুড়ি বিল্প গলায় জবাব দিয়েছে–নিকুঞ্জ মশাইর নেমক কম খাই নি। আজ বাদে কাল চিতেয় উঠবো, ধম্মে সইবে না। টাকা দিয়ে কী করবো! তোমরা কি আর আমার সঙ্গে নরকে যাবে?

বুড়ির ন্যাকা ন্যাকা কথা শুনে গা জ্বলে গেলো। বিরক্ত হয়ে বললাম, নিকুঞ্জ পাকড়াশী যখন আমাদের একটা একটা করে আঙুল কাটবে–সেটা বুঝি খুব ধর্মের কাজ হবে?

তা কেন কাটবে? অবাক হয়ে জানতে চাইলো বুড়ি।

জিজ্ঞেস করো গে তোমাদের নিকুঞ্জ মশাইকে?

নিকুঞ্জ মশাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন? থ্যাবড়ামুখো এসে বললো, আমি বলছি মাসি, এই বাছাধনরা কত্তার পেটে লাথি মেরেছিলো। শোন নি কী হয়েছিলো নুলিয়াছড়িতে! এরাই হচ্ছে সেই কেউটের ছানারা। কত্তা কি সাধে রেগেছেন!

তবে! বুড়ি আমাদের আঙুল কাটার মস্ত বড়ো যুক্তি খুঁজে পেলো–কত্তার দয়ার শরীর বলে শুধু আঙুল কাটছেন। আমি হলে কখন আঁশবটি দিয়ে ধড় থেকে মুণ্ডুটা নামিয়ে দিতাম।

মর তুই ডাইনি বুড়ি। রেগেমেগে বললো টুনি।

থ্যাবড়ামুখো আর বুড়ি খি খি হেসে খাবার থালা বাসন নিয়ে দরজা আটকে দিয়ে চলে গেলো। কুয়োতলায় যাওয়ার সময় লক্ষ্য করেছি পাকড়াশীর এই আস্তানায় কম করে হলেও ষাট সত্তর জন লোক হবে। চেহারা দেখে মনে হয় সব কটা জেল পালানো আস্ত খুনী।

সন্ধের পর পোড়া-বাড়ির লোকজনদের ভেতর বেশ ব্যস্ততা লক্ষ্য করলাম। দুপুরে খাওয়ার পর থ্যাবড়ামুখো আমাদের হাত আর বাঁধে নি। বুড়িটা অবশ্য বলেছিলো বাঁধতে, থ্যাবড়া বলেছে, পালাবে কোথায়, দোরগোড়ায় দু দুটো পাহারাদার বসিয়ে রেখেছি না! যাবার সময় ঘরের কোণে একটা মাটির কলসি আর টিনের মগ রেখে গেছে, যদিও আমাদের খিদে-তেষ্টা কিছুই ছিলো না।

রাত আটটার দিকে চিমসে বুড়ি খাবার আনলো। টিনের থালায় ভাত আর বাটিতে ঠাণ্ডা তরকারির মতো কি যেন একটা। বললো খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, নেদো এসে মাদুর বালিশ দিয়ে যাবে। কাতা-ফ্যাতা দিতে পারবো না। গায়ে ম্যালা কাপড় আছে, জানালা বন্ধ করে শুলে শীত লাগবে না।

জোর করে কোনো রকমে একটুখানি খেলাম। বাবু, ললি, টুনিকে আগেই বলে রেখেছিলাম খাবার নিয়ে খুঁত খুঁত না করতে। রাতে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। দৌড়াতেও হবে। দুর্বল শরীরে পালানো যাবে না। খেতে খেতে দেখলাম ওরাও মুখ কালো করে বিস্বাদ তরকারি দিয়ে ঠাণ্ডা শক্ত ভাত খেলো। তবে কেউই অর্ধেকের বেশি খেতে পারলাম না।

বুড়ি থালা গোছাতে গোছাতে গলা তুলে ডাকলো–নেদো, এখনো মাদুর বালিশ দিয়ে গেলি না?

একটু পরেই মুশকো কালো ষণ্ডামতো একটা লোক মাদুর আর বালিশ নিয়ে এলো। বালিশ না বলে থান ইট বললে ঠিক হতো। পাথরের মতো শক্ত, নোংরা কালো তেলচিটে কাপড়ের চারটে ঢেলা আর দুটো ছেঁড়া মাদুর-পাকড়াশী পাঠিয়েছে। আমাদের শোয়ার জন্য। এ নিয়ে আমরা কোনো কথা বললাম না। দুপুরের মতো বুড়ি: থালা বাটি গুছিয়ে আলোটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। দরজার কাছে যে লোকটা পাহারা দিচ্ছিলো নির্বিকার মুখে দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে শেকল তুলে খট করে তালা আটকে দিলো।

সারা বাড়িতে লোকজনের বিশেষ সাড়াশব্দ নেই। সন্ধ্যের ঠিক পর পরই কুয়োতর কাছে পনেরো ষোলজন লোককে জটলা পাকিয়ে কী যেন বলাবলি করতে দেখেছিলাম। অন্ধকার হওয়ার পর মাত্র দুতিনজন লোককে চলাফেরা করতে দেখেছি।

থালা বাটি নিয়ে বুড়ি বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পরই কুয়োতলায় ঝনঝন শব্দের সঙ্গে ওর চিৎকার শুনলাম-ওরে বাবারে, গেছি রে, কোন ড্যাকরা শানের ওপর সাবান দিয়ে কাপড় ধুয়েছে রে–।

চ্যাঁচানো শুনে বুঝলাম বুড়ি আছাড় খেয়েছে। এ বাড়িতে ঢোকার পর প্রথম হাসলাম। টুনি বললো, ডাইনিটার উচিৎ সাজা হয়েছে।

বুড়ির চাঁচানো শুনে হারিকেন হাতে দুজন লোক বেরিয়ে এলো–তুমি কি গো মাসি, কুয়োতলায় আসবে, আলো দেখাতে বলবে না! হাড়গোড় ভাঙে নি তো?

হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ। নাকি কান্না কাঁদতে লাগলো বুড়ি–আমার মাজা ভেঙে গেছে রে–ও ড্যাকরার পোরা, জ্ঞান না দিয়ে আমাকে টেনে তোল না রে ই-হিঁ-হিঁ-হিঁ-।

একজন বুড়িকে তুলে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। আলো হাতে আরেকজন গেলো ওর পেছনে। আরো কিছুক্ষণ সময় কাটলো। ঘড়িতে যখন নটা বাজলো, তখন শুরু হলো আমাদের পরিকল্পনা মতো টুনির কান্না। ললি তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলো–এই দরজা খোল জলদি।

কী হলো, ঘুমের সময় এতো চ্যাঁচামেচি কিসের? বলতে বলতে দরজা খুললো পাহারাদার।

টুনি সমানে কেঁদে চলেছে। ললি ছিলো সামনে। বললো, ওকে সাপে কামড়েছে।

লাঠি হাতে পাহারাওয়ালা ভেতরে ঢুকলো। টুনির গায়ে টর্চের আলো ফেলে বললো, কই–

মাটির কলসিটা হাতে নিয়ে আমি পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। লোকটার কথা শেষ না হতেই ঠকাস করে ওটা ওর মাথায় ভাঙলাম। আঁক করে শব্দ বেরুলো লোকটার গলা দিয়ে। টর্চটা ফেলে মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। বাবু শক্ত বালিশটা দিয়ে দমাদম তিন চার ঘা মাথায় বসাতেই লোকটা জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো।

ব্যস্ত হাতে টর্চটা নিয়ে আমি চাপা গলায় বললাম, চলো।

আমাকে টর্চ নিতে দেখে লোকটার লাঠি কুড়িয়ে হাতে নিলো বাবু। তারপর ললি টুনির হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

দুবার ওঠানামা করাতে সিঁড়ি কোথায়, বাইরে যাওয়ার দরজা কোথায় সব কিছু আগেই জানা হয়ে গিয়েছিলো। অন্ধকারে পা টিপে সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। পাকড়াশীর ঘরে সকালে ইলেকট্রিক লাইট দেখেছিলাম। দুপুরে শব্দ শুনে টের পেয়েছিলাম কোথাও ডায়নামো আছে। নামার সময় সিঁড়ির নিচে শুধু একটা হারিকেন জ্বলতে দেখলাম।

বাইরের দরজার পাশে হেঁড়ে গলায় একজন গান ধরলো–সোনা বন্ধুরে, কোন দোষেতে যাইবা ছাড়িয়া-আ-।

ভাগ্যিস গান গেয়েছিলো। আমরা সেদিকে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। লোকটার সঙ্গে আরো লোজন থাকতে পারে। সকালে দেখেছিলাম নিচের তলার বেশির ভাগ ঘরের দরজা জানালা নেই। দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট না করে পাশের ঘরে চলে এলাম। এ ঘরটার কোনো জানালা ছিলো না। উল্টো দিকের দরজা দিয়ে আরেকটা ঘরে ঢুকতেই গরাদ ছাড়া একটা জানালা পেয়ে আমরা চারজন সেই জানালা দিয়ে টপাটপ বাইরে চলে এলাম।

বাইরেও অন্ধকার, তবে ঘরের মতো নিকষ কালো নয়। আকাশের তারার আলোয় অন্ধকার কিছুটা ফ্যাকাসে ছিলো। আমি আর বাবু ললি টুনির হাত ধরে দ্রুত পশ্চিমের দিকে এগুলাম। বিকেলেই ঠিক করেছিলাম আমরা পশ্চিমেই যাবো।

চারপাশে ঘন জঙ্গল আর অন্ধকার। দিক ভুল হলে আমরা পুব দিকে বর্ডার পেরিয়ে ইণ্ডিয়া চলে যেতে পারি। তাই আমরা শব্দ না করে জোরে পা চালালাম পশ্চিমের দিকে। একটু পরেই শুনলাম থ্যবড়ামুখোর ফ্যাশ ফেশে গলার চিল চিৎকার-–। পালিয়েছে রে পালিয়েছে, কে কোথায় আছিস শিগগির আয়! কত্তা সব কটাকে শুলে চড়াবেন।

এবার আর পা টিপে হাঁটা নয়, সোজা দৌড় দিলাম জঙ্গলের দিকে। খানিক পরেই পেছনে পাকড়াশীর লোকজনদের হাঁকডাক শুনলাম–তোরা উত্তর দিকে যা, আমরা পশ্চিমে যাচ্ছি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে জান নিকলে দিবি। কত্তার কড়া হুকুম, জ্যান্ত যেন পালাতে না পারে।

পাঁচ মিনিটও দৌড়াই নি, ললি হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, আবির, আমি আর দৌড়াতে পারবো না, দম বন্ধ হয়ে আসছে।

ললির কথা শুনে বাবু টুনিও দাঁড়িয়ে পড়লো। চাপা গলায় বললাম, ঠিক আছে পাঁচ মিনিটের জন্য দাঁড়ানো যাক। আমাদের পায়ের শব্দ না পেলে ওরাও কনফিউজড হবে।

মিনিট খানেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পরই ওদের পায়ের আওয়াজ পেলাম। তিন চারজন লোক ঠিক আমাদের দিকেই আসছে। ওদের শব্দ শোনার অর্থ হচ্ছে, আমরা হাঁটতে গেলে আমাদের পায়ের শব্দও ওরা শুনতে পাবে। অন্ধকারে জমাট পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমাদের কিছুই করার ছিলো না। টের পেলাম পৌষের শীতের রাতেও রীতিমতো ঘামতে শুরু করেছি।

পায়ের শব্দ আরো কাছে এলো। একজনের গলা শুনলাম—যেতে হলে তো এদিক দিয়েই যাবে, যদি না পথ ভুল করে। ঠিক তখনই পশ্চিম দিক থেকে একটা শেয়াল না ভাম দৌড়ে আমাদের পাশ দিয়ে পুব দিকে চলে গেলো। শুকনো পাতার ওপর খচমচ শব্দ হতেই একটা লোক–এইতো এদিকে যাচ্ছে বলে ব্যস্ত পায়ে পুব দিকে ছুটলো। ওর পেছন পেছন অন্য সবাই ছুটলো সেদিকে। আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ফিসফিস করে ললিকে জিজ্ঞেস করলাম, হাঁটতে পারবে এবার?

ললির হাত তখনও আমার হাতে ধরা। বললো, পারবো।

যতো কম শব্দ করা যায় পা টিপে টিপে আমরা সোজা পশ্চিম দিকে হাঁটলাম। পোড়ো বাড়িতে চোখ বেঁধে আনার সময় আমাদের কয়েক দফা অকারণেই ঘুরিয়েছিলো বলে মনে হয়েছে। হাঁটছি বটে সোজা, তবু জঙ্গল তো! তার ওপর অন্ধকার। ভয় হচ্ছিলো ঘুরে ফিরে শেষে পাকড়াশীর ডেরায় গিয়ে না হাজির হই।

হাঁটতে হাঁটতে পা রীতিমতো ব্যথা হয়ে গেলো, জঙ্গল আর ফুরোয় না। তখন পর্যন্ত লাল পাহাড়ের ধুপ-ধুপ শব্দ শুনতে পাই নি। ওটা ছিলো আমাদের প্রথম লক্ষ্য। বিকেলে যখন পালাবার রুট নিয়ে প্ল্যান করছিলাম তখন বলেছিলাম লাল পাহাড়ে কোনোরকমে পৌঁছতে পারলে আর চিন্তা নেই।

প্রথম দিকে মুক্তির আনন্দে সবাই উত্তেজিত থাকলেও শেষের দিকে একটা অনিশ্চিত ভয় বুকের ওপর চেপে বসতে লাগলো। আমরা কি আদৌ বাংলাদেশে আছি–একবার একথাও মনে হলো। ওরা শুনলে ভয় পাবে বলে কোনো কথা না বলে এক নাগড়ে হেঁটে চললাম।

প্রায় ঘন্টা দুয়েক হাঁটার পর বেশ দূরে একটা শব্দ শুনলাম। মুহূর্তের জন্য চারজন দাঁড়িয়ে পড়লাম। উত্তেজনায় ধক্ করে উঠলো বুকের ভেতরটা। চিৎকার করে বললাম, স্ক্যাটরা। তারপরই শব্দ লক্ষ্য করে সামনের দিকে দৌড় দিলাম।

এদিকে গাছপালা আর আগের মতো ঘন নয়। দৌড়াতে দৌড়াতে বাবুও ডাকলো–স্ক্যাটরা।

ঘেউ-ঘেউ-ঘেউ। স্ক্যাটরা আমাদের ডাক শুনতে পেয়েছে। ললি ক্লান্ত গলায় বললো, আস্তে আবির, আমি আর পারছি না।

আমরা দাঁড়ালাম। একটু পরেই ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে ডাকতে ছুটে এলো স্ক্যাটরা। লাফিয়ে উঠে সবার গাল-টাল চেটে, ভেজা নাক ঘষে, একাকার করে দিলো। স্ক্যাটরার পেছনেই গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখালাম, আমাদের দিকেই আসছে।

জীপে জাহেদ মামা আর নেলী খালার সঙ্গে চারজন রাইফেলধারী জওয়ানও ছিলো। জীপ থামতেই নেলী খালা ছুটে এলেন–কোথায় ছিলি তোরা? কেউ কি তোদের আটকে রেখেছিলো? সারাদিন আমি ভয়ে মরি–বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন নেলী খালা।

জাহেদ মামা বললেন নেলী, আগে ওদের ঘরে নিয়ে চলো। সব শুনতে হবে। মনে হচ্ছে এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।

আমি বললাম জাহেদ মামা, আপনার ফোর্স এখানে থাকুক। আরো দরকার হবে। পাকড়াশীর বিরাট দল। চলুন যেতে যেতে বলছি।

জওয়ানরা জীপ থেকে নেমে গেলো। আমরা সবাই উঠে বসতেই জাহেদ মামা পুরো স্পিডে বাংলোর পথে জীপ চালালেন। সকাল থেকে সারাদিন যা দেখেছি আর যা ঘটেছে সব খুলে বললাম।

আমাদের বাংলোতে নামিয়ে দিয়েই জাহেদ মামা জীপ নিয়ে ছুটলেন। বাংলোতে ঢোকার সময় লক্ষ্য করলাম গেটের পাশে দুজন রাইফেলধারী সৈন্য।

নানা বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। আমাদের দেখে বললেন, আগে খেয়ে দেয়ে সুস্থির হও, তারপর সব শুনবো।

পরদিন সকালে আমাদের ঘুম ভাঙলো অনেক দেরিতে। নেলী খালা ইচ্ছে করেই পর্দা টেনে ঘর অন্ধকার করে দিয়েছিলেন। নাশতার টেবিলে নেলী খালা বললেন, পাকড়াশী আর কিশোর পারেখ দুজনই বর্ডার ক্রস করে পালিয়েছে। পাকড়াশীর দলের ষোলজন ধরা পড়েছে। এর ভেতর একটা বুড়িও আছে।

আসল শয়তান দুটো পালিয়ে গেছে শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো। টুনি বললো, ওই বুড়িটা ভীষণ পাজি নেলী খালা। বলে কিনা আমাদের বটি দিয়ে কাটবে।

বাবু বললো, মণিদা কিশোর পারেখের কোনো খবর দিতে পারলো না?

কাল রাত থেকে তিনিও জাহেদের সঙ্গে। সারারাত ওরা কেউ ঘুমোয় নি।

নানু মৃদু হাসলেন, যেন তুমি কতো ঘুমিয়েছো নেলী!

নেলী খালা বললেন, বিকেলে চায়ের নেমন্তন্ন করেছি প্রফেসরের দল আর মুনীর সাহেবকে। ওরা সবাই তোমাদের কাছে শুনতে চাইছে কী ঘটেছিলো।

শুনে খুব একটা উৎসাহ বোধ করলাম না। ম্যাপটা উদ্ধার করা গেলো না, কালপ্রিটরাও ধরা পড়ে নি। আমাদের আর বাহাদুরি রইলো কোথায়!

বিকেলে সবার আগে এলেন প্রফেসর, তার সঙ্গে জনা চারেক তরুণ জিওলজিস্ট। মণিদা এলেন ওর এক চাচাকে নিয়ে। আজই নাকি এসেছেন মণিদার ওখানে বেড়াতে। আর্মি ক্যাম্প থেকে এসেছে দুজন তরুণ অফিসার। জাহেদ মামা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন কিশোর পারেখকে। একজন ক্যাপ্টেন বললো, স্যারের ধারণা ও ইণ্ডিয়া যেতে পারে না।

পুরো ঘটনাটা আমাকেই বলতে হলো। শেষে বললাম, আসল কাজের কিছুই করা যায় নি। আমরা স্যারের ম্যাপটা খুঁজে পাই নি। যে শয়তান আমাদের আটকে রেখেছিলো তাকে ধরতে পারি নি।

প্রফেসর আমার কথা শুনে হা হা করে হাসলেন–ম্যাপ কোত্থেকে পাবে? ওটা সত্যি সত্যি চুরি গেলে তো!

তবে যে সেদিন বললেন–বিস্ময়ে আমাদের চোখ ছানাবড়া!

মিথ্যে বলি নি। চুরি হতে পারে আমি ধরেই নিয়েছিলাম। তাই অরিজিন্যাল ম্যাপের দুটো কপি করেছিলাম। ওরই একটা কিশোর পারেখ চুরি করেছে। তবে কপিতে আমি কিছু রদবদল করেছি, যেটা আমি ছাড়া কেউ জানে না। সেদিন ম্যাপ চুরি নিয়ে তুলকালাম না করলে কিশোর পিরখের মতো বুদ্ধিমান চোর ঠিকই ধরে ফেলতো আমার চালাকি। হা-হা-হা–প্রাণ খুলে হাসলেন প্রফেসর। তারপর বললেন, তোমাদের লাল পাহাড়ের হার্টবিটের রহস্য ভেদ করেছি। ওটা গ্যাসের একটা সার্টেন প্রেশারের জন্য হয়। শব্দটা হয় শীত পড়লে, গরমকালে এলে শুনতে পাবে না।

মণিদা বললেন, কিশোরের যে এতোটা অধঃপতন হয়েছে আমি ভাবতেই পারি নি। আবিরদের মতো ওর ছবি বানানোর গপ্পোটা আমি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেছিলাম। আজ সকালে ওর ব্যাগ ঘাটতে গিয়ে পাকিস্তানী আর লিবিয়ান পাসপোর্ট পেয়েছি। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।

বাবু বললো, আবির আগেই সন্দ করেছিলো ও পাকিস্তানী এজেন্ট।

নুলিয়াছড়ির এ্যাডভেঞ্চার নিয়ে ছবি করা হলো না বলে টুনির মন খারাপ। বললো, শয়তানটাকে যদি জাহেদ মামা একবার ধরতে পারে মজা দেখাবো।

নেলী খালা বললেন, শয়তান পাকড়াশীকে আমরা কেউ চিনতে পারি নি, অথচ স্ক্যাটরা ঠিকই চিনেছিলো নইলে রাস্তার অচেনা লোক দেখলে কখনও ও ঘেউ ঘেউ করে না।

স্ক্যাটরা ওর নাম শুনেই নেলী খালার কাছে এসে আদরের জন্য গলা বাড়িয়ে দিলো। আমি বললাম, পাকড়াশী একমাত্র স্ক্যাটরাকেই ভয় পায়। জাহেদ মামা সম্পর্কে ও কি মন্তব্য করেছে সেটা আর সবার সামনে বললাম না।

চা খেতে খেতে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছিলো। মণিদার চাচা একফাঁকে আমাকে বললেন, তোমাদের বাথরুমটা কোন দিকে একটু দেখিয়ে দেবে?

ওঁকে নিয়ে আমি আমাদের ঘরে এলাম। বাথরুমের দরজা খুলে বলতে যাবো এই বাথরুম, ঠিক তখনই পেছনে পরিচিত গলা শুনলাম–চিনতে পারিস নি তো? এবার শুধু চেহারা নয়, গলার স্বরও বদলেছি।

চমকে উঠে তাকিয়ে দেখি মণিদার চাচার ছদ্মবেশে ভাইয়া দাঁড়িয়ে, এগিয়ে এসে ভাইয়া আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো-তুই কতো লম্বা হয়ে গেছিস আবির! দেখতেও সুন্দর হয়েছিস!

আমি উত্তেজিত গলায় বললাম, মণিদাকে তুমি চেনেনা কি করে?

মণি স্কুলে আমার এক ক্লাস ওপরে পড়তো। ম্যাট্রিক পাশ করে ও লণ্ডন গিয়েছিলো টী টেকনলজি পড়তে! আট বছর পর দেখা!

নেলী খালার সঙ্গে কথা বলেছো? তোমাদের জন্য গরম কাপড় জোড় করে রেখেছেন।

কাল তোরা যখন বেড়াতে যাবি তখন এসে কথা বলবো।

তুমি কদিন থাকবে তো ভাইয়া? আমি আমার স্কলারশিপের জমানো সব টাকা নিয়ে এসেছি তোমাকে দেবো বলে! নেলী খালার মতো প্রতি মাসে তোমাকে টাকা পাঠাবো ভাইয়া।

ভাইয়ার মুখে মৃদু হাসি। যদিও বয়স্ক মানুষের মেকাপ নিয়েছে, তবু মনে হলো অনেক শুকিয়ে গেছে ভাইয়া। বললো, মণির ওখানে দিন চারেক থাকবো। তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। এর ভেতর সময় করে নেবো। চল এবার যাই। তোর বন্ধুরা আবার চলে আসতে পারে।

বাইরে তখন অন্ধকার নেমেছে। বাবু টুনি দূরে লনে বসে কথা বলছে। বারান্দার রেলিংএ হাত রেখে ললি একা দাঁড়িয়েছিলো।

ভাইয়া লনে গিয়ে মণিদার সঙ্গে বসলো। আমি ললিকে বললাম, আজ আমার বড়ো আনন্দের দিন ললি।

জানি আবির। আস্তে আস্তে ললি বললো, আমি তোেমাদের কথা শুনে ফেলেছি। একটু থেমে ললি আবার বললো, তুমি আমাকে খারাপ ভাবছো না তো আবির?

ছিঃ ললি! ওকথা কেন বলছো? তোমার মতো বন্ধুকে কখনো খারাপ ভাবা যায়!

বাবার কথা মনে হচ্ছে আবির! ললির গলা ভারি শোনালো। আমি ললির হাতের ওপর হাত রাখলাম। ওকে বোঝাতে চাইলাম আমি আছি ওর পাশে।

অপু ভাইয়ার মতো হঠাৎ যদি কখনও বাবার দেখা পেতাম।

আমার বুকের ভেতর ললির জন্য গভীর দুঃখ আর মমতা অনুভব করলাম। বললাম, বাবার জন্য গর্ব হয় না ললি?

আবছা আলোতে দেখলাম ললির চোখে পানি। আমার কথা শুনে ওর ঠোঁটের ফাঁকে গর্বের হাসি ফুটে উঠলো। ফিসফিস করে বললো, হয় আবির। একটু থেমে আবার বললো, অপু ভাইয়ার সঙ্গে তোমার কথা শুনেছি। তোমার জন্যেও গর্ব হচ্ছে।