০৫. অভিশপ্ত বাগানবাড়িতে
দুপুরের খাওয়া শেষ হতে হতে তিনটে বেজে গেলো। ক্যাম্পে এলে যা হয়–প্রথমে তাঁবু খাটানো, তারপর পেট্রলের সবাইকে কাজ ভাগ করে কাউকে দিয়ে শুকনো গাছের ডাল ভেঙে আনা, কাউকে পানি আনতে পাঠানো, কাউকে রেশন তুলতে পাঠানো, কাউকে রান্নার কাজে লাগানো–এসব করতে করতে খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত দম ফেলার সময় থাকে না। রেশনের দায়িত্বে ছিলো জোসেফ। চাল, ডাল, আলু, মাংস, আর মশলা দিয়েছে। আমাদের পেট্রলে প্রথমবার রান্নার ভার পড়েছে আমার ওপর। কাল থেকে রান্না করবে শেখর আর শাহেদ। ওরা যদি সব কিছু ঠিক মতো করে এখার.ওদের কুকিং ব্যাজ দেয়া হতে পারে।
সময় বাঁচাবার জন্য আমি চাল-ডাল আর আলু একসঙ্গে নিয়ে খিচুড়ি বেঁধেছি। মাংসটা আলাদা বেঁধেছি কাটা মশলা দিয়ে। নিকোলাস স্যার সবার রান্না দেখে আমাদের উলফ পেট্রলের সঙ্গে বসে খেয়েছেন। আমাদের পাশে শিবলীদের প্যানথার পেট্রলের রান্না চাখতে গিয়ে তিনি বিষম খেয়েছেন। ওঁরা লবণ দিতে নাকি ভুলে গিয়েছিলো। কিং ফিশার আর জাগুয়ার পেট্রল মাংস পুড়িয়ে একাকার করে ফেলেছে।
খাওয়ার পর প্লেট, মগ, হাড়ি, পাতিল সব ধুয়ে মুছে মুন্না আর ফারুকের বানানো তাকের ওপর রেখে নিকোলাস স্যারকে ঘিরে বসলাম। সবাইকে ডেকেছেন তিনি।
জানি! সব কথা শোনার জন্যে সবার প্রাণ আইঢাই করেছে। মৃদৃ হেসে নিকোলাস স্যার বললেন, আইডিয়াটা আসলে জোসেফের। আমার এক বন্ধুও কিছুটা সাহায্য করেছে। জানোই তো কিভাবে সব হয়েছে। এতে অবশ্য তোমাদের লাভ হয়েছে। এভাবে ট্র্যাক খুঁজে স্পটে এসে অলরেডি একটা পরীক্ষায় পাস করে ফেলেছে। বিশেষ করে খদের বাঁদরামো সত্ত্বেও–।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ওদের কথা আপনি কী করে জানলেন?
রহস্যময় হেসে নিকোলাস স্যার বললেন, জোসেফ পুরো রাস্তা তোমাদের ফলো করেছে। জানতাম তোমরা পাস করবে, তবে ফেলও তো করতে পারতে! পথ হারিয়ে গেলে জোসেফ তোমাদের চিনিয়ে দিতো।
শিবলী উত্তেজিত গলায় বললো, আমাদের কেউ জোসেফ ভাইকে দেখলো না, এটা কী করে হয়?–দেখেছো হয়তো, চিনতে পারোনি। জো লুঙ্গি পরে ছাতা মাথায় গ্রামের এক বুড়ো
সেজে ছিলো যে। এই বলে নিকোলাস স্যার মুন্নার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলেন–যাই বলল খনুকে ছুরি দেখানোটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। তবে ও যা পাজি–আমরা এতে বেশি কিছু মনে করিনি, কি বলল জোসেফ? চ
আমি বললাম, চিনেছি জো ভাইকে! মুন্নাকে তখন বলেছিলে স্কাউটরা কাউকে ছুরি দেখায় না।
জোসেফ মৃদু হেসে সায় জানালো।
এখন বলো জায়গাটা তোমাদের পছন্দ হয়েছে তো? নিকোলাস স্যার সবার মুখের দিকে তাকালেন।
সবাই একসঙ্গে উচ্ছ্বসিত গলায় পেঁচিয়ে বললো, হ্যাঁ, স্যার।
এর কৃতিত্ব অবশ্য আমার। নাকি জো?
জোসেফ এবারও মাথা নেড়ে সায় জানালো। নিকোলাস স্যার বললেন, ওদিকে যে সিনেমার সুটিং হচ্ছে, আশা করি তোমাদের চোখ এড়ায়নি। আমার স্কুলের বন্ধু ইরফান খানের ছবির সুটিং ওটা। কাল বিকেলে খবর নিতে গিয়ে জানলাম। অন্য কেউ হলে অবশ্য এখানে ক্যাম্পিং-এর পারমিশন পাওয়া যেতো না। কমিশনার তো আটকেই দিয়েছিলেন প্রায়। ইরফান আগে দুটো সামাজিক ছবি বানিয়ে মার খেয়েছে। এখন রাজনৰ্তকী নামে একটা ঐতিহাসিক ছবি বানাচ্ছে। গত পনেরো দিনে ধরে এখানে: সুটিং করছে। তোমরা বোধহয় জানো না এটা হালুটিয়ার জমিদারদের বাড়ি। এতো বড়ো জমিদার ছিলো যে লোকে ওদের রাজা বলতো। পার্টিশনের পর ওদের বংশধর ইণ্ডিয়া চলে গেছে। গভমেন্ট এটা রিকুইজিশন করে নিয়েছে। সরকারি বাড়ি হলে যা। হয়। আর্ধেক জিনিস কেয়ারটেকাররা হজম করে ফেলেছে। চার একর জমির ওপর এই বাড়ি। অবজারভেশনে গিয়ে দেখে নিও। আমি অনেক আগে ইরফানের সঙ্গে একবার এখানে এসেছিলাম। ও সুটিং-এর জন্য জমিদার বাড়ি খুঁজছিলো। চারপাশে দেখে মনে হয়েছিলো এখানে ক্যাম্প না হোক পিকনিক করতে আনবো তোমাদের। ব্রাদার ফিলিপ্স-এর কথা শুনে জো যখন বললো, শহরের কাছাকাছি একটা স্পট দেখতে, তখন আমি ঠিক করলাম এখানেই আসবো। তখন অবশ্য জানতাম না এখানে ইরফানের সুটিং হচ্ছে। কাল ইরফানকে বলতে ও এক কথায় রাজি। খুশি হয়ে বললো, আমরা থাকলে নাকি ও সাহস পাবে। আজেবাজে কিছু লোক নাকি কদিন ধরে ওদের ভয় দেখাচ্ছে।
ক্লাস সিক্সের মন্টি বললো, স্যার, আমরা একদিন সুটিং দেখবো।
নিশ্চয়ই! নিকোলাস স্যার হেসে বললেন, তোমরা রাতে ক্যাম্প ফায়ারে ইরফানদের নেমন্তন্ন করো না কেন? ব্রাদার ফিলিন্সও আসবেন।
শওকত ভাই বললো, ঠিক আছে স্যার, আমি আর শিবলী গিয়ে বলে আসবো। শিবলীর ভাই আফজাল হোসেনকে নিশ্চয়ই উনি চিনবেন।
শিবলী লাজুক হেসে বললো, ইরফান ভাই আমাদের বাসায়ও এসেছেন।
এবার তাহলে উঠে পড়ো। ক্যাম্প ফায়ারে কারা কী করবে ঠিক করে নাও। এই বলে নিকোলাস স্যার তার ক্যাম্পে চলে গেলেন।
আমরা সবাই জোসেফকে নিয়ে পড়লাম। তোর পেটে পেটে এত আগে যদি জানতাম।–বলে ওকে জড়িয়ে ধরলো শওকত।
শিবলী বললো, তুমি কি গ্রামের বুড়ো সেজেও এমন দামী চশমা পরেছিলে?
জোসেফের চশমার ফ্রেমটা বেশ দামী। গতবার এথেন্স থেকে এনেছে।
সদা গম্ভীর জোসেফ লাজুক হেসে বললো, না চশমা পরিনি। সেজন্য ছাতা ঠুকে রাস্তায় হাঁটাটা বেশ রিয়ালিস্টিক হয়েছিলো।
দাড়ি কোত্থেকে ম্যানেজ করলে? জানতে চাইলো এনামুল।
নিখিল স্যারের নাটকে আমার পার্টি ছিলো বুড়ো মাঝিটার–যে একুল ভাঙে ওকুল গড়ে গায়। ভাবলাম স্টেজে যখন উঠবো না তখন দাড়িটা আর নষ্ট করি কেন? ওটা আগেই দিয়েছিলেন নিখিল স্যার।
শেখর বললো, তোমার দাড়ি না থাকলে হাজারীর কাছ থেকে কুকিজ খেতে পেতে।
জোসেফ বললে, ওটাও দেখেছি। টুপ লিডার আরিফ বললো, তোমরা কিন্তু ক্যাম্প ফায়ারের জন্য বেশি সময় পাচ্ছো । রাতের রান্না রেডি করার সঙ্গে সঙ্গে কারা কী করবে ঠিক করে ফেলল। স্যার যে তাঁর বন্ধু ইরফান সাহেবকে নেমন্তন্ন করতে বলেছেন মনে আছে তো?
শওকত উঠে দাঁড়ালো–চলো শিবলী, নেমন্তন্নটা করে আসি। এই বলে শিবলীকে নিয়ে ও জমিদার বাড়ির দিকে গেলো। আর পেট্রল লিডাররা সবাই নিজের ছেলেদের নিয়ে তাঁবুতে ঢুকলো।
মাঠের চারপাশে গোল করে সাজানো চোদ্দটা তাঁবু। বারোটা পেট্রোলের জন্য বারোটা, নিকোলাস স্যার আর গেস্ট কেউ এলে তাদের জন্য একটা–বাকিটা রেশনের জিনিসপত্র আর টুপ লিডার আরিফের। মাঠটার তিন দিকেই ঘন গাছপালা। এক সময় বুঝি ফলের বাগান ছিলো। যত্নের অভাবে জংলী লতা আর ঝোঁপঝাড়ে বোঝাই। সন্ধ্যে না হতেই ঝিঁঝি ডাকতে শুরু করেছে। একপাশে পুকুর, দুদিকে দুটো শান বাঁধানো ঘাট। একটা ঘাট জমিদার বাড়ির দিকে, আরেকটা আমাদের মাঠের দিকে। ক্যাম্পিং স্পট হিসেবে জায়গাটা যে মৌচাকের চেয়েও সুন্দর একথা মানতেই হবে। হতে পারে জঙ্গল নেই কিন্তু যা আছে কোন, তা অংশে কম নয়। বিশেষ করে পুকুরটা ছিলো চমৎকার।
তাবুতে ঢোকার পর পেট্রল লিডার এনামুল আমাকে বললো, রান্টু, ক্যাম্প ফায়ারে কী করবে ভেবেছো?
বললাম, আজ আমরা নাটক করবো।
ঠিক করে ফেলল তাহলে। আমি স্যারের কাছে যাচ্ছি।
তখন জসিমউদ্দীনের বাঙ্গালির হাসির গল্প নতুন বেরিয়েছে। আট দশ মিনিটের অভিনয়ের জন্য চমৎকার সব গল্প ছিলো ওটাতে। ছটা চরিত্র আছে এমন একটা গল্প সবাইকে বলে কে কোন পার্ট করবে ঠিক করে সংলাপ মুখস্থ করলাম। ফারুকের তিনটা সংলাপ বড় ছিলো বলে লিখে নিলো। বৌ-এর পার্ট শেখর করবে। ওর মায়ের একটা শাড়ি আনতে ওকে আগেই বলে রেখেছিলাম। আমি এনেছি দাড়ি, গোঁফ, টুপি। জানতাম জোসেফের জাগুয়ার স্ট্রেল আর বান্টিদের ডিয়ার পেট্রল ছাড়া আর কেউ নাটক করবে না। প্যাট্রিক, রঞ্জিত আর নঈমরা মাত করবে গান দিয়ে। দেখা যাক কারা ফার্স্ট হয়।
এনামুল স্যারের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়েছিলো–আমাদের টেন্ডার ফুট আর সেকেন্ড ক্লাসদের কোন কোন পরীক্ষা নিতে হবে। আমাদের পেট্রলে এনামুল আর আমি ফার্স্ট ক্লাস স্কাউট, ফারুক, মুন্না সেকেন্ড ক্লাস, বাকি সবাই টেন্ডার ফুট।
দশ মিনিটের ছোট্ট নাটকটা দুবার মহড়া দিয়ে আমি আর শেখর রাতের রান্না চাপিয়েছি–শিবলী এসে ডাকলো, রান্টু, কথা শুনে যা।
উত্তেজনায় চক চক করছিলো শিবলীর চোখ দুটো। কাছে যেতেই ফিস ফিস করে বললো, জানিস ইরফান ভাই কী বলেছে?
কী বলেছে? অবাক হয়ে আমি জানতে চাইলাম।
এই বাগান বাড়িতে নাকি ভূত আছে।
কী আবোল-তাবোল বলছিস?
অনেক কাণ্ড ঘটেছে। গলাটা আরেক ধাপ নামিয়ে শিবলী বললো, রাতে বলবো তোকে। আরিফ ভাই বলেছে তোকে আর আমাকে রাতের প্রথম দুঘন্টা ডিউটি দিতে।
ক্যাম্পে গেলে প্রত্যেক পেট্রলকে পালা করে রাতে পাহারা দিতে হয়। এটাও পরীক্ষার একটা। শিবলী সেকেন্ড ক্লাস বলেই এবারের ক্যাম্পিং-এ ওকে এই পরীক্ষা দিতে হবে। পাশ হলে পরের বার অন্য কোনো সেকেন্ড ক্লাসের সঙ্গে থাকবে। নতুনদের রাতের ডিউটি দিতে হয় না। পাহারা যতো না বাইরের চোরের জন্য, তার চেয়ে বেশি ভেতরের জন্য। পাহারাদাররা কতটুকু সতর্ক যাচাই করে দেখার জন্য নিকোলাস স্যার কিংবা ট্রপ লিডার আরিফ রাতে চুরি করতে বেরোন। সকাল বেলা রিপোর্ট করতে হয় কারো কিছু খোয়া গেলো কি-না। তখন দেখা যায় থলের ভেতর থেকে হারানো জিনিসটি বের করে দিচ্ছেন নিকোলাস স্যার। বলেন কাদের পাহারার সময় কিভাবে চুরি করেছেন।
রাতের খাওয়া শেষ করে আমরা সবাই গোল হয়ে বসে ক্যাম্পফায়ারের জন্য স্তূপ করে রাখা গাছের শুকনো ডাল-পাতায় আগুন ধরালাম। জোসেফ গম্ভীর গলায় উদ্বোধন করতে গিয়ে বললো, এই আগুনের শিখার মতো আমাদের ভেতর যা কিছু সুন্দর আছে উর্ধ্বে উঠকু, অন্যদের আলোকিত করুক, আর যা কিছু অসুন্দর আছে পুড়ে ছাই হয়ে যাক। এরপর নঈমের সঙ্গে কোরাসে সবাই ক্যাম্পফায়ার ইজ বার্নিং গাইলাম।
গান শেষ হতেই নিকোলাস স্যারের সঙ্গে দুজন অতিথি এসে আমাদের পাশে বসলেন। একজন ইরফান ভাই, আরেকজন ব্রাদার ফিলিপ্স। লাজুক হেসে ব্রাদার বললেন, আইয়া পড়ছি। আমি তমাগ অতিথ। খেদাইয়া দিও না কইলাম।
আমরা সবাই হইচই করে বললাম, যতদিন খুশি আপনি আমাদের সঙ্গে থাকুন। কেউ কিছু বলবে না।
কে যেন বললো, এখানে কি নিখিল স্যার আছেন যে কিছু বলবেন!
আমি বললাম, আমরা আপনাকে নাটকও করতে দেবো। আপনি সুন্দর বাংলা বলেন। আমাদের নাটকের জন্য চমৎকার হবে।
নইম বললো, আমাদের সঙ্গে গানও গাইতে হবে।
কতা হোন পোলাগো। হা হা করে হাসলেন ব্রাদার ফিলিপ্স–আমারে ডর দেখাইতে পারবা না। আমি কইলাম সব পারি। খালি আমারে রানতে কইও না। ওইটা আমারে দিয়া হয় না।
শিবলী বললো, ইরফান ভাই কি করবেন, নাটক না গান?
করবে তো তোমরা। মৃদু হেসে ইরফান ভাই বললেন–আমি শুধু দর্শক।
নিকোলাস স্যার বললেন, উঁহু! এভাবে এড়ানো যাবে না ইরফান। ব্রাদার ফিলিপ্স যদি পারেন–তুমি পারবে না, এটা একটা কথা হলো? স্কুলে তুমিও স্কাউট ছিলে।
হাসতে হাসতে ইরফান ভাই বললেন, ঠিক আছে, ব্রাদার যা পারবেন না আমি তাই করবো। একদিন তোমাদের সবাইকে আমরা রান্না করে খাওয়াবো।
সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলো। কে যেন বললো, থ্রি চিয়ার্স ফর ইরফান ভাই।
সবাই একসঙ্গে বললাম, হিপ হিপ হুররে।
থ্রি চিয়ার্স ফর ব্রাদার ফিলিন্স।
হিপ হিপ হুররে।
সামনে শুকনো কাঠে তখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ডিসেম্বরের কুয়াশাভরা ঠাণ্ডা রাতে খোলা আকাশের নিচে বসে আছি সবাই এক উৎসবের পরিবেশে। সবার গায়ে গরম কাপড়। মুখে আগুনের লাল ছায়া কাঁপছে। খুশিতে চকচক করছে সবার চোখ। ক্যাম্পিং-এর সবচেয়ে আনন্দের পর্ব হচ্ছে রাতের এই ক্যাম্প ফায়ার।
উচ্ছ্বাসভরা কোলাহল একটু কমতেই ব্রাদার বললেন, তোমরা কারা কি করবা থইলার মইধ্যে থেইকা বাইর কর। দেখি নিখিল স্যারের পোলাগো ধারে কাছে যাইতে পার কি-না!
সবাই আরেক দফা হইচই করে উঠলো। টুপ লিডার আরিফ ঘোষণা করলো–সবার আগে সোপার্ড পেট্রল।
অর্থাৎ নঈম আর রঞ্জিতদের পেট্রল। ওদের পেট্রলের শফিক চমৎকার মাউথ অর্গান বাজায়। ও মাউথ অর্গানে সুর তুলতেই ওরা প্রথমে গাইলো, ধান্যে পুষ্পে ভরা। শেষ হওয়ার পর বিটের ওপর কোরাসে ধরলো হাল্কা ফুর্তির গান, সিঙ্গিং আই আই আই ইপ্পি আই। গান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই তালে তালে তালি বাজাতে লাগলো। গান শেষ হওয়ার পরও সেই তালি আর থামে না।
এরপর জোসেফদের জাগুয়ার পেট্রল। ওদের পেট্রলের সীমার চার বছর ধরে বাফাতে নাচ শেখে। জোসেফরা কোরাসে গাইলো কারার ওই লৌহকপাট। গানের সঙ্গে মাথায় লাল ফেটি আর কোমরে গামছা বেধে দারুণ নাচলো সমীর। ইরফান ভাইর চেহারা দেখে মনে হলো এমনটি তিনি আশা করেননি।
জাগুয়ারের পর আমাদের পালা এলো। আমাদের নাটকে মেকাপ দরকার ছিলো আমার আর শেখরের। আমার পার্ট ছিলো এক লোভী মোল্লার আর শেখর করেছিলো চাষী বৌ-এর পার্ট। লেপার্ডদের গানের সময় আমরা দুজন এক ফাঁকে তাঁবুতে গিয়ে ঝটপট মেকাপ নিয়ে সবার পেছনে অন্ধকারে বসেছিলাম–কেউ টেরও পায়নি। বাকিদের মেকাপ দরকার ছিলো না। লুঙ্গী-গেঞ্জি বা জামার ওপর চাদর গায়ে বসেছিলো ওরা। আমাদের নাম ঘোষণার পর প্রথমে মুন্না চাদর রেখে উঠে গেল।
বৌ কই গেলা, অ বৌ! মুন্নার এই সংলাপের পর কনে বৌ সাজা শেখর এলো এইতো আমি চিল্লান ক্যান–বলতে বলতে। ফর্শা মেয়েলি চেহারার শাড়ি পরা শেখরকে প্রথম চিনতে না পেরে সবাই দারুণ চমকে উঠেছিলো। কয়েক মুহূর্তে কোথাও কোনো শব্দ নেই। তবে সেটা বড় জোর পনেরো সেকেন্ডর জন্য। যখন বুঝলো বৌটি আসলে শেখর তখন হুল্লোড় আর তালির ঝড় বয়ে গেলো। যার ফলে মুন্না আর শেখরকে দুবার করে চেঁচিয়ে সংলাপ বলতে হলো। এরপর হুল্লোড় উঠলো কাঠমোল্লার মেকাপে আমাকে দেখে। আমাদের কথা শুনে আর কাণ্ড-কারখানা দেখে সবাই গড়িয়ে পড়লো। নাটক শেষ হবার পরও হো হো, হি হি হাসি আর থামে না। তখনই বুঝলাম আমাদের ছাড়িয়ে যাওয়া অন্যদের পক্ষে কঠিন হবে।
শেষ পর্যন্ত হলোও তাই। আমাদের আইটেমের পর কেউ গান গাইলো, কেউ আবৃত্তি করলো, কেউ নাটকের অংশ বিশেষ করলো, কিন্তু কোনওটাই আমাদের মতো হলো না। শেষ হওয়ার পর নিকোলাস স্যার দাঁড়িয়ে বললেন, আমাদের এখানে অতিথি হিসেবে বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক ইরফান খান আছেন। আমাদের সংস্কৃতির জগতে যাঁকে সবাই এক নামে চেনেন। আমি তাঁকে অনুরোধ করবো তাঁর বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান কোটি তিনি যেন অনুগ্রহ করে ঘোষণা করেন।
লাজুক হেসে ইরফান ভাই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, তোমরা সবাই এত সুন্দর অনুষ্ঠান করেছে যে আমি রীতিমতো অভিভূত হয়ে গেছি। সত্যি বলছি, এতটা সুন্দর কাজ আমি আশা করিনি। জানোই তো আমি ছবি বানাই। আমি হলপ করে বলতে পারি তোমাদের কয়েকজনের অভিনয় দেখে আমার মনে হয়েছে আমাদের সিনেমার অনেক দামী স্টারও এতটা সহজ-সুন্দর স্বাভাবিক অভিনয় করতে পারবে না। (প্রচণ্ড তালি আর হুল্লোড়) আমি নিজে গাইতে বা নাচতে না জানলেও ভালো কোটা সেটা বিলক্ষণ বুঝি। সারাক্ষণ আমাকে এ নিয়েই থাকতে হয়। তোমাদের স্যার–নিকোলাস রোজারিও আমার স্কুলের বন্ধু। স্কুলে আমরা একসঙ্গে স্কাউটিং করতাম। আজ মনে হচ্ছে তোমাদের স্কাউটিং-এর বাইরে অভিনয়, নাচ, গান কিংবা বাজানো ও যেভাবে শিখিয়েছে, আমাদের লাইনে এলে বেশি নাম করতে পারতো।
কথার মাঝখানে এমন হুল্লোড় আর তালি বাজলো যে ইরফান ভাইকে থামতেই হলো। পেছন থেকে কে যেন চেঁচিয়ে বললো, ব্রাদার ফিলিপ্স এবার কিছু বলুন।
ব্রাদার বললেন, ওনারে শ্যাস করতে দাও। ওনার বন্ধুর কথা উনিত কইবেনই। আমি ওনার কথা নিখিল স্যারেরে গিয়া কমু, দেখি হ্যাঁরে পটান যায় কি-না। আপনে কন ইরফান ভাই, আমরা শুনতাসি।
ইরফান ভাই হেসে বললেন, না, বন্ধু বলে বলছি না ব্রাদার। নিকোলাস সত্যি গুণী ছেলে।
ব্রাদার ফিলিপ্স বিরক্ত হওয়ার ভান করলেন–আহা, এক কথা কতবার কইবেন! এই হগল কথা নিকোলাস স্যারের সামনে না কওনই ভাল। ফার্স্ট কে হইসে আপনি হেই কথা কন।
হাসতে হাসতে ইরফান ভাই বললেন, ঠিক আছে, নিকোলাসের কথা আর বলবো না। তবে ফার্স্ট কে হয়েছে বলা খুব কঠিন। নিয়ম রক্ষার জন্য যদি বলতেই হয় তাহলে আমি বলবো দলগত কাজ সবচেয়ে ভালো হয়েছে উলফ ট্রেলের আর একক কাজে ফার্স্ট হয়েছে জাগুয়ার পেট্রলের সমীর।
ইরফান ভাই থামতেই আরেক দফা তালি আর হুল্লোড়। সমীরকে নিয়ে শুরু হলো : লোফালুফি। শেখরকে ধরার আগে, ও দৌড়ে পালালো। হট্টগোলের ভেতর ট্রুপ লিডার আরিফ ক্যাম্প ফায়ারের সমাপ্তি ঘোষণা করলো। আগুন নিভিয়ে আমরা সবাই যখন তাবুতে ফিরে গেলাম, রাত তখন দশটা বাজে।
সবাই বিছানা পেতে শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়লো, শুধু জেগে রইলাম আমি আর শিবলী। দুজন গিয়ে পুকুর ঘাটে বসলাম। নিকোলাস স্যার আর আরিফের তাঁবুটা ঘাটের কাছে। নজর রাখতে সুবিধে হবে। বাইরের কেউ এলেও যেতে হবে ঘাটের পাশ দিয়ে।
দুতিন দিন আগে বোধহয় পূর্ণিমা ছিলো। সামান্য লালচে ক্ষয়াটে গোল চাঁদ তখন ঠিক মাথার ওপর। জ্যোৎস্নার আলো মাখা কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা পড়েছে গোটা মাঠ। ক্যাম্পগুলো মনে হচ্ছে দ্বীপের মতো। আমরা যেখানে বসেছি পাশের আমগাছের ছায়া সেখানে পড়েছে। বাইরে থেকে কেউ আমাদের উপস্থিতি টের পাবে না।
শিবলী চাপা গলায় বললো, শুনে ভয় পাবি না তো?
আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, আমার ভূতের ভয় নেই। কী বলবি বল!
আমার কিন্তু বলতেই ভয় লাগছে। মুখে এ কথা বললেও বলার জন্য ও ভেতরে ভেতরে সন্ধ্যে থেকেই ছটফট করছে। আমি নির্লিপ্ত গলায় বললাম, ভয় পেলে বলিস না।
শিবলী আমার গা ঘেঁষে বসে বললো, শোন, ইরফান ভাইর ওখানে যা শুনলাম। একটু থেমে আশেপাশে দেখে নিয়ে গলাটা আরেক ধাপ নামালোহালুটিয়ার জমিদারদের পঞ্চম পুরুষ মারা গেছেন পঞ্চাশ বছর আগে। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। মরবার আগে নিজের বৌকে আর লক্ষ্ণৌ থেকে আনা এক বাইজীকে গুলি করে মেরেছেন। এখনো নাকি তাদের প্রেতাত্মা এই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। ইরফান ভাইদের প্রোডাকশনের দাগুবাবু, বাবুর্চি মজিদ ঘুঙুরের আওয়াজ শুনেছে। সাইড হিরোইন হেলেন পরশু রাতে ওর ঘরে দেখেছে সাদা কাপড় পরে কাকে ঘুরে বেড়াতে। কে বলতেই অন্ধকারে কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেছে। ব্যাস, চিৎকার করে মুছা, সকালে জ্ঞান ফিরতেই সুটিং ফেলে বাড়ি চলে গেছে। ইরফান ভাই মহাবিপদে আছেন। সুটিং-এর জন্য দুটো ঘোড়া এনেছিলেন ভাড়া করে। কাল রাতে ঘোড়া দুটো গায়েব হয়ে গেছে। ওদের ইউনিটের সবাই বেশ ভয়ে ভয়ে আছে। কে জানে কখন কার কপালে কী আছে। ইরফান ভাই বলছিলেন, এত টাকা-পয়সা খরচ করে মাঝপথে যদি এভাবে চলে যেতে হয়, তিনি পথে বসবেন। এই বলে শিবলী একটু থামলো। ঢোক গিলে বললো, কী ভয়ের কথা বল তো! নিকোলাস স্যার আমাদের এমন এক জায়গায় আনলেন ক্যাম্প করার জন্য–কখন যে কী হয়!
আমি বললাম, নিকোলাস স্যার কী করে জানবেন?
সে কথাই তো আমি ইরফান ভাইকে বলেছিলাম। শিবলী অধৈর্য গলায় বললো। সব শুনে আমি ওঁকে বললাম, এই কথাগুলো নিকোলাস স্যারকে আগে বললেই তো পারতেন। তিনি বললেন, সময় পেলাম কোথায়। নিকোলাস এসে পাঁচ মিনিটও তো বসলো না।
কথাগুলো তোকে ইরফান ভাই বলেছেন, না অন্য কারো কাছে শুনেছিস? জানতে চাইলাম আমি।
ওদের প্রোডাকশন ম্যানেজার দাগু বাবু বলেছেন। ইরফান ভাইর সামনেই বলেছেন। আমাদের সাবধানে থাকতে বলেছেন ইরফান ভাই।
আত্মহত্যার গল্পটি দাগুবাবু কোত্থেকে শুনেছেন?
আহ, গল্প বলছিস কেন? শিবলীর গলায় রাগের আভাস। গ্রামের সবাই জানে এই ঘটনা। তুই বলতে চাস গ্রামে সত্তর-আশি বছরের বুড়ো নেই?
তা থাকবে না কেন? আমি সে কথা বলিনি। স্যার যে বলেছিলেন একজন কেয়ারটেকার নাকি আছে, ভূতেরা কি তার ওপর কখনো হামলা করেনি?
কে বলেছে কেয়ারটেকার এখানে থাকে? কেয়ারটেকার থাকে ফতুল্লা। মাঝে মাঝে এসে দেখে যায়। দারোয়ান আর মালি আছে। ওরা সাতদিনে একবার এসে ঘর দোর পরিষ্কার করে রেখে যায়। কেউ এখানে থাকে না।
শিবলী যা বললো ভাববার মতো কথা বটে। আমাদের ক্লাসে শুভদারঞ্জন স্যার অনেকবার বলেছেন, কারো যদি অপঘাতে মৃত্যু হয়; তাহলে তার আত্মার নাকি মুক্তি হয় না। যেখানে মরেছে তার আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। সবাই নাকি তাদের দেখে না, তবে কেউ কেউ দেখে। বিশেষ করে যেসব মানুষের আধ্যাত্মিক শক্তি আছে তারা সব দেখতে পায়। নিকোলাস স্যারকে একবার জিজ্ঞেস করতে তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ভূত কেউ দেখেছে বলে তো শুনিনি। ভূত যদি সত্যি সত্যি থাকতো তাহলে দিনের আলোতেও ওদের দেখা যেতো। নিকোলাস স্যার মাঝে মাঝে নাস্তিকের মতো কথা বলেন। ওঁদের নিয়ে এভাবে রসিকতা করা ঠিক নয়। সব আত্মাই যে ভালো তা তো আর নয়। কিছু বদমেজাজী খারাপ আত্মাও আছেন। ওঁরা কুপিত হলে ভয়ানক বিপদ।
পুকুরের ওপারে তাকিয়ে দেখলাম, চাঁদ আর কুয়াশার আলো-ছায়া সারা গায়ে মেখে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে দেড়শ বছরের পুরোনো জমিদার বাড়িটা। সুটিং কোম্পানির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঝুল বারান্দার নিচে কম পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছে।
শিবলী বললো, তোর কি মনে হয় সত্যি এরকম কোনও আত্মা এ বাড়িতে আছে?
আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তোর কী মনে হয়?
থাকাটাই তো স্বাভাবিক। খুন করা, আত্মহত্যা করা এগুলো তো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। শুভদারঞ্জন স্যার কী মিথ্যে কথা বলেছেন?
আমি আস্তে আস্তে বললাম, মানুষের তো ভুল হতে পারে।
এ কথাটা নিকোলাস স্যারই একদিন বলেছিলেন আমাকে–যারা ভয় পায় তারাই ওসব দেখে।
শিবলী রেগে গেলো–তুই পারবি একা এই বাড়িতে রাতে থাকতে?
না, তা পারবো না। কথাটা আমাকে স্বীকার করতে হলো। অতৃপ্ত প্রেতাত্মা ছাড়াও এসব পুরোনো বাড়িতে সাপ-খোপ-বিছে নানারকম উৎপাত থাকতে পারে।
হঠাৎ চাপা গলায় শিবলী বললো, দ্যাখ দ্যাখ, ওখানে ওটা কী?
আমি চমকে ওঠে দূরে বাগানের ভেতর দেখলাম আলোর মতো কী যেন তিন-চার পা হেঁটে নিভে গেলো। দুজন অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। চোখে পড়ার মতো কিছুই দেখলাম না। শিবলী ভয় পাওয়া গলায় বললো, নিজের চোখেই তো দেখলি।
আমি বিজ্ঞের মতো বললাম, ওটা আলেয়ার আলো। ক্লাস সিক্সের সাধারণ বিজ্ঞানের বইতে পড়িসনি? পুরোনো জলাটলা থাকলে সেখানে আলেয়ার আলো দেখা যায়। জলার ভেতর মনে হয় হেঁটে বেড়াচ্ছে ওটা।
মাথার ওপর আমগাছে হুতোম পঁাচা ডাকলো। সঙ্গে সঙ্গে ঝটপট করে দুটো বাদুড় উড়ে গেলো জমিদার বাড়ির দিকে। শিবলী আরো গা ঘেঁষে বসলো।
শীতও পড়েছে ভীষণ। মোটা পুলোভার, বাবার বাঁদুরে টুপি, পায়ে উলের মুজো পরেও কাঁপুনি থামানো যাচ্ছিলো না। তবে শিবলীর কাঁপুনি কতটা শীতের সেটা বলতে পারবো না। দুঘন্টা পর টাইগার আর জাগুয়ার পেট্রলের দুজনকে তাঁবু থেকে বেরোতে দেখে কী যে আনন্দ হলো! আমি আর শিবলী যে যার তাঁবুতে গিয়ে কম্বলের নিচে ঢুকেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
.
০৬. আনন্দময় তাবুর দিন
সকালে বিউগলের শব্দে যখন ঘুম ভাঙলো বাইরে তখন ঘন কুয়াশার দেয়াল। পেট্রল লিডার এনামুল বললো, এখন ছটা বাজে। আশা করি এক ঘন্টার ভেতর আমরা . পিটি করা জন্য তৈরি হতে পারবো।
ক্যাম্পিং-এর অভিজ্ঞতা শাহেদ আর শেখর ছাড়া আমাদের সবারই ছিলো। এক বছর ধরে ওরা দুজন স্কাউটিং করছে। টেণ্ডারফুট ব্যাজ পেয়ে গেছে। এবারে ট্রেনিং ঠিকমতো পারলে সেকেণ্ড ক্লাস ব্যাজ পাবে। ফারুক আর মুন্না সেকেণ্ড ক্লাস স্কাউট। ওদের জন্যেও এবারের ক্যাম্পিং যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। গোটা ট্রপে একমাত্র আমি ক্লাস এইটে থাকতে ফার্স্ট ক্লাস ব্যাজ পেয়েছি। বেশির ভাগ ট্রেনিং আমার হয়ে গেছে। শুধু গায়ে জোর কম বলে কিছু কাজ ভালো পারি না, যেমন কিনা মাঙ্কি পোল বানানো।
শেখরকে বললাম মুখ হাত ধুয়ে চায়ের আয়োজন করতে, শাহেদকে বললাম ক্যাম্প গোছাতে আর মুন্না ফারুককে দিলাম হাড়ি পাতিল মেজে গেজেট সাজাবার দায়িত্ব। সাতটার সময় নিকোলাস স্যার আসবেন ক্যাম্প পরিদর্শনে।
কনকনে শীতে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে পুকুরের পানিতে মুখ-হাত ধুলাম। ক্যাম্পিং স্পট বাছার সময় খেয়াল রাখতে হয় কাছাকাছি পুকুর বা নদী আছে কি-না। সবারই তাড়া ইনস্পেকশনের জন্য সব কিছু আগে থাকতেই সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি রাখতে হবে।
নাস্তার জন্য ভাড়ার থেকে রুটি, ডিম আর কলা দেয়া হয়েছিলো। শেখর ডিমগুলো ধুয়ে চায়ের পানিতেই সেদ্ধ করে নিলো। ক্যাম্পে এলে রান্না নিজেদের করতে হয়। রান্না করার চুলোটা নিজেদের বানাতে হয়। চুলো মানে গ্রামে যেমন বানায় মাটি দিয়ে-তেমন কিছু নয়। এক টুকরো বাঁশ বা গাছের সোজা ডালের দুমাথায় ইংরেজি অক্ষর A এর মতো ডাল দিয়ে দুটো বানিয়ে বেঁধে নিলেই হলো। হাঁড়ি পাতিলের কানায় দাড়ি দিয়ে বেঁধে সোজা ডালের সঙ্গে ঝুলিয়ে নিচে আগুন দিতে হয়। হিসেব আরো আছে। ক্যাম্প থেকে একটু দূরে বাতাস কোন্ দিকে বইছে সেটা দেখে চুলো বানাতে হয়।
চুলোর পাশে থাকে হাড়ি, পাতিল, প্লেট আর ক্যান্টিন রাখার গেজেট। একপাশে থাকে ভেজা কাপড় শুকোবার জন্য বা তোয়ালে রাখার গেজেট। কেউ ভেতরে কম্বল বালিশ রাখার জন্যও গেজেট বানাতে পারে। দেখতেও ভারি সুন্দর হয়। আমাদের ক্যাম্পের সবগুলো গেজেট মুন্নারা বানিয়েছে।
সাতটা বাজার দশ মিনিট আগেই আমাদের সব গোছানো হয়ে গেলো। ইউনিফর্ম পরে পরিপাটি হয়ে ক্যাম্পের আশেপাশে ঘুরে দেখছি কোথাও কোনও ময়লা বা বাতিল কিছু পড়ে আছে কি-না। মুন্নারা ময়লা ফেলার জন্য গাছের ছোট ডাল আর শুকনো তালপাতা দিয়ে ঝুড়ি পর্যন্ত বানিয়েছে, অন্য কোনো পেট্রল যা ভাবতেও পারবে না। অবশ্য ময়লা ফেলার গর্তও নিয়মমাফিক করা হয়েছে।
নিকোলাস স্যারকে তাঁবু থেকে বেরোতে দেখে পেট্রল লিডার আমাদের এ্যাটেনশন করিয়ে দিলো। মার্চ করে সবাই মাঠের মাঝখানে এলাম। টুপ লিডার আরিফ জাতীয় পতাকা উত্তােলন করলো। আমরা সেলুট দিয়ে অভিবাদন জানিয়ে এক মিনিট নীরবে প্রার্থনা করলাম। তারপর আবার মার্চ করে ফিরে গেলাম যার যার তাঁবুর সামনে। ঠিক সোয়া সাতটায় শুরু হলো তাঁবু পরিদর্শন। নিকোলাস স্যারের সঙ্গে ব্রাদার ফিলিপ্স আর টুপ লিডার আরিফও ছিলো। রাতে ব্রাদার ছিলেন নিকোলাস স্যারের তাঁবুতে। খেয়েছেন প্যান্থার. পেট্রলের সঙ্গে।
একে একে সাতটা তাঁবু দেখে নিকোলাস স্যার আমাদের তাঁবুতে ঢুকলেন। ছোট্ট একটা শব্দ তাঁর মুখ দিয়ে বেরুলো–বাহ্। ব্যস, এতেই আমরা ভেতরে ভেতরে খুশিতে ফেটে পড়লাম।
ভোরে দাঁত মাজতে বেরিয়ে অন্যদের গেজেটও দেখেছি। তখনই বুঝেছি আমরা ফার্স্ট হবো। নিকোলাস স্যার সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। এমন কি আমাদের হাতের নখ পর্যন্ত তার ইন্সপেকশন থেকে বাদ গেলো না।
বাকি তাঁবু দেখা শেষ করে নিকোলাস স্যার মাঠের মাঝখানে দাঁড়ালেন। বললেন, আমাদের তাঁবু পরিদর্শন শেষ হয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে আমাদের বিচারে ফার্স্ট হয়েছে। উলফ পেট্রল।
টুপ লিডার আরিফ স্যারের পেছনে ফুল সুদ্ধো জবার একটা ডাল এনে দাঁড়িয়েছিলো। স্যারের ঘোষণা শেষ হওয়ার পর সেই ডালটা এনে তুলে দিলো আমাদের পেট্রল লিডার এনামুলের হাতে।
স্যার বললেন, আমরা সবাই এবার ইয়েল দেবো। অভিনন্দন জানাবো উলফ পেট্রলকে।
আরিফ চেঁচিয়ে বললো, বি।
আমার ছাড়া সবাই কোরাসে বললো, বি।
আরিফ বললো, আর। কোরাসে-আর। আরিফ-এ। কোরাসে-এ। আরিফ-ভি। কোরাস-ভি। আরিফ-ও। কোরাস-ও। আরিফ-ব্রাভো। কোরাস-ব্রাভো।
এভাবে ওরা তিনবার বললো, ব্র্যাভো। এরপর আমাদের ইয়েল। আমরা লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। একজন একটা করে পাঁচটা অক্ষর পর পর বলে গেলাম–টি-এইচ-এ-এন-কে। সবার শেষে এনামুল বললো, ওয়াই-ও-ইউ।
সবাই একসঙ্গে তিনবার বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ।
এভাবে শেষ হলো ক্যাম্পের আরেকটি পরীক্ষা। এরপর রুটিন মতো পিটি। লাইনে দাঁড়িয়ে ঝাড়া দেড় ঘন্টা পিটি করে সবাই ঘেমে গেলাম। পিটির পর ট্রেনিং। এবার আর পেট্রল অনুযায়ী নয়। টেন্ডারফুট ব্যাজ যাদের দেয়া হবে তাদের কয়েক গ্রুপে ভাগ করা হলো। একইভাবে সেকেণ্ডে ক্লাস ব্যাজ আর ফার্স্ট ক্লাস ব্যাজ যারা পাবে তাদেরও ভাগ : করা হলো। ফার্স্ট ক্লাস ব্যাজে প্রার্থীদের ট্রেনিং-এর দায়িত্ব নিলো আরিফ আর জোসেফ। সেকেণ্ড ক্লাস আর টেন্ডারফুটের দায়িত্ব দেয়া হলো কয়েকজন পেট্রল লিডারকে। দুপুরের রান্না হবে একসঙ্গে। পাটিক, রঞ্জিত সামাদ আর আমাকে দেয় হলো প্রথম দিনের রান্নার দায়িত্ব। কয়েকজন টেণ্ডারফুট আমাদের সাহায্য করবে, সেই সঙ্গে ওদের শেখাও হবে।
ভাঁড়ার থেকে দেয়া হলো চাল, ডাল, আলু, ডিম, বাঁধাকপি, মটরশুটি, টমেটো পেঁয়াজ আর মশলা। আমরা ঠিক করলাম চাল ডালের খিচুড়ি করবো, সঙ্গে দেবো বাঁধাকপি, মটরশুটি, আলু। ডিমের কারি করবো গরম মশলা দিয়ে মাংসের মতো। টমেটো আর পেঁয়াজের সালাদ হবে। গত গরমের ছুটিতে দিদার কাছে থেকে রান্না শিখেছি। বাটা মশলা না পেলে কাটা মশলা দিয়ে রান্না কিভাবে ভালো করতে হয় আমার ভালোই জানা ছিলো। দেখলাম রঞ্জিত আর সামাদও কম যায় না। দুটো বড় হাঁড়িতে খিচুড়ি চড়িয়ে দিলাম। ডিমগুলো ধুয়ে খিচুড়ি হাঁড়িতে পাঁচ মিনিট সেদ্ধ করে তুলে নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে আলাদা হাড়িতে কারি বসালাম। তিন ঘন্টার মধ্যে আমাদের তিনটা আইটেম বানানো শেষ। কারিটা নামানোর আগে লবণ চাখতে গেছি ব্রাদার ফিলিপ্স এসে বললেন, আমি নিকোলাস স্যাররে কইয়া দিমু রানের সময় তোমরা অর্ধেক খাইয়া ফালাইস। কথাটা বলে আর দাঁড়ালেন না। মুখ টিপে হেসে চলে। গেলেন।
ট্রেনিং-এর জন্য সবাই ছোট ছোট দলে ছড়িয়ে পড়েছিলো। ট্রেনিং-এর তো অন্ত নেই। সাড়ে দশটা নাগাদ সবাই ফিরে এলো। এরপর খেলা, গোসল করা, কাপড় বোয়া, দুপুরের খাওয়া এইসব। রান্না করতে করতে দেখি মাঠের মাঝখানে গোল হয়ে বসে সবাই-–হু স্টোল দ্যা কুকিজ খেলছে। রান্না শেষ করে আমরাও ওদের সঙ্গে যোগ দিলাম।
বারোটার সময় গোসল। কাপড় বদলে সবাই ছুটলাম পুকুরে হুটোপুটি করতে। ছোটরা যারা সাঁতার জানে না তাদের কেউ গোলো টিউবঅয়েলে, কেউ বালতিতে পানি নিয়ে ঘাটে বসে গোসল করলো। আর আমরা যারা সাঁতার জানি–আধঘন্টা ধরে সারা
পুকুর দাপিয়ে বেড়ালাম। নিকোলাস স্যার ব্রাদার ফিলিপ্সকে নিয়ে বাগানবাড়িতে গেছেন গোসল করতে।
খেতে বসে টের পেলাম কী ভীষণ খিদে পেয়েছে। আগেও দেখেছি ক্যাম্পে এলে খিদে বেড়ে যায়। খেতে খেতে নিকোলাস স্যার বললেন, চমৎকার রান্না হয়েছে।
ব্রাদার ফিলিন্স বললেন, অগোরে দুই তিনখান কইরা বাবুর্চির ব্যাজ দিয়া দ্যান নিকোলাস স্যার।
শওকত বললো, কারেকশন প্লীজ। ওটাকে বাবুর্চির ব্যাজ বলে না ব্রাদার, কুকিং ব্যাজ বলে।
তয় এইরকম ব্যাজ চ্যাষ্টা করলে আমিও পাইতাম পারি। আর আমাগো লিস্টারের তো দশখান পাওন উচিত। খেতে খেতে বললেন ব্রাদার ফিলিন্স।
শিবলী বললো, আপনার আর লিস্টারের বয় স্কাউট হওয়ার বয়স পেরিয়ে গেছে।
তমরা বড় হিংসুইটা পোলাপান। আমারে অরা এত হিংসা করে ক্যান, নিকোলাস স্যার কন তো?
নিকোলাস স্যার মৃদু হেসে বললেন, গুণী মানুষকে অনেকেই হিংসা করে।
তমরা সবাই শুনছ তো, নিকোলাস স্যার আমারে গুণী কইছেন? তমাগ মতোন ওনার মনে কোন হিংসা নাই।
ব্রাদার ফিলিপ্স এমনভাবে কথাগুলো বললেন–শুনে হাসতে হাসতে কেউ বিষম খেলোলা।
খাওয়ার পর আধ ঘন্টা বিশ্রাম। তারপর আবার ট্রেনিং–সকালের মতো ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে। টেণ্ডারফুটেরা করবে নটিং আর ট্রাকিং। নটিং মানে দড়ি দিয়ে কিভাবে নানারকমের গেরো বাঁধতে হয় আর ট্র্যাকিং-এর ট্রেনিং তো শুরু হয়েছে কাল সকাল থেকেই। সেকেণ্ডে ক্লাসের জন্য রয়েছে নটিং, ল্যাশিং, ব্রীজের জন্য ট্রেসেল তৈরি, ইস্টিমেশন, সিগনালিং আর কুকিং। ফার্স্ট ক্লাসের ট্রেনিং হচ্ছে ম্যাপ মেকিং, জার্নি টেস্ট, কুকিং, অবজার্ভেশন, ক্যাম্পের ইতিহাস লেখা, গাছ থেকে গাছে দড়ির ব্রীজ তৈরি করে পার হওয়া এইসব।
রাতের রান্না পেট্রলগুলো নিজেদের মতো আলাদাভাবে করবে। আমি শিবলীকে নিয়ে বেরুলাম অবজার্ভেশনে। আরো কয়েকটা দল বেরুলো নিজেদের মতো। নিকোলাস স্যার বললেন, আমাদের ক্যাম্প ফায়ারে গ্রামের লোকদের নেমন্তন্ন করবে।
গ্রামের পথে ইউনিফর্ম পরা শিবলী আর আমাকে দেখে কয়েকজনই জিজ্ঞেস করলো, আমরা সিনেমা কোম্পানির লোক কি-না, সিনেমায় অভিনয় করছি কি-না। আমরা ওদের বললাম, আসলে আমরা কারা। রাতে ওদের ক্যাম্প ফায়ারে আসতে বললাম।
অবজার্ভেশনের জন্য চারদিক ভালোভাবে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। লক্ষ্য করলাম এদিককার ঘরগুলো. বেশ দূরে দূরে। এক একটা ভিটেয় আট-দশটা ঘর, তারপর দুতিনশ গজের ভেতর কোন ঘরবাড়ি নেই। ধানকাটা হয়ে গেছে–ধু ধু প্রান্তর। শিবলীকে বললাম, তুই তো মৌচাকে আর জয়দেবপুরে গেছিস। এখানকার মাটির রঙ লক্ষ্য করেছিস?
কী? অন্যমনস্কভাবে বললো শিবলী।
এদিককার মাটির রঙ কালো আর জয়দেবপুরের মাটির রঙ লাল।
ঘরবাড়িগুলো দেখ, অনেক দূরে দূরে।
হুঁ।
ধানক্ষেতগুলো অনেক নিচু। মৌচাক, জয়দেবপুরে কিন্তু এরকম নয়।
হুঁ।
বর্ষায় মনে হয় সব ডুবে যায়।
হুঁ।
কী হুঁ হুঁ করছিস? কথা বলছিস না কেন?
ধমক খেয়ে শিবলী আমার মুখের দিকে তাকালো। কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে বললো, আমি অন্য একটা কথা ভাবছিলাম।
কী কথা?
কাল রাতের সেই আলোর কথা মনে আছে? তুই যে বলেছিলি আলেয়ার আলো?
কেন, কী হয়েছে?
আমি আজি দুপুরে জঙ্গল মতো সেই জায়গায় গিয়েছিলাম। সেখানে কোনও পুরোনো জলাটলা নেই।
তাতে কী হলো?
শুকনো জমিতে আলেয়ার আলো জ্বলে না।
শিবলীর কথা শুনে আমি চিন্তিত হলাম–তুই কী বলতে চাইছিস?
কাল রাতে ওটা অন্য কিছু ছিলো।
অন্য কী?
কেন শুভদারঞ্জন স্যার বলেননি অতৃপ্ত আত্মার কথা?
অতৃপ্ত আত্মা আলো হয়ে ঘুরে বেড়ায় এমন কথা তিনি কখনো বলেননি।
তাহলে তুই-ই বল ওটা কিসের আলো ছিলো?
কথাটা ভাবতে গিয়ে হেসে ফেললাম–হতে পারে সিনেমা কোম্পানির কারো পেট খারাপ হয়েছে, টর্চ নিয়ে বেরিয়েছিলো। এ নিয়ে এত চিন্তা করছিস কেন?
দুটো জলজ্যান্ত ঘোড়া এক রাতে উধাও হয়ে গেছে।
নিশ্চয় কেউ চুরি করেছ।
গোটা বাগানবাড়ি দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সদর দরজা তালা বন্ধ ছিলো। চোর ঢুকবে । কোত্থেকে? আর ঢুকলেই বা ঘোড়া দুটো যদুর জানি পক্ষিরাজ ছিলো না।
তুই বলতে চাস এগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে?
আমি কিছু বলছি না। তোকে শুধু ভাবতে বলছি।
হাঁটতে হাঁটতে গাছপালা ঠাসা একটা জায়গায় এলাম। প্রথমে মনে হলো ভেতরে বুঝি কারো ঘরবাড়ি আছে। এগিয়ে দেখি অতি পুরোনো একটা ভাঙা মন্দিরের মতো। দরজা জানালা কিছু নেই। পলেস্তারা খসে পড়েছে। বড় একটা অশ্বত্থ গাছ উঠেছে মন্দিরটাকে সাপের মতো পেচিয়ে। এক সময় চারপাশে চওড়া আঙিনা ছিলো। সেখানে এখন ফাটল ধরেছে। ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট ঝোঁপঝাড়। একদিকে একটুখানি পাচিলের আভাস–বাকি সব মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। দেখে মনে হয় বহু বছর এখানে কেউ আসেনি।
শিবলী বললো, চল, কাছে গিয়ে দেখি।
আমি ইতস্তত করলাম–সাপ-টাপ থাকতে পারে।
শীতের দিনে এই রোদের ভেতর সাপ কোত্থেকে আসবে?
সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লেও রোদের তেজ পুরোপুরি মরেনি। শিবলীর সঙ্গে মন্দিরের চাতালে এলাম। পা, দুপা করে মন্দিরের ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। হঠাৎ সিঁড়ির এক ফাটলের ফাঁকে নজর পড়তেই আমার মনে হলো, এখানে লোকজন যাওয়া আসা করে। শিবলীকে বললাম, বাইরে থেকে মন্দির মনে হলেও আসলে কিন্তু তা নয়।
কী করে বুঝলি? অবাক হয়ে জানতে চাইলো শিবলী।
সিঁড়ির গোড়ায় একটা সিগারেটের টুকরো দেখলাম, বেশি পুরোনো নয়।
শিবলী চিন্তিত হয়ে বললো, কেউ হয়তো পূজো-টুজো দিতে আসে।
পূজো দেয়ার চিহ্ন তো কোথাও দেখছি না?
তুই কী বলতে চাইছিস?
বলছি ভালো করে অবজার্ভ কর। আমরা অবজার্ভেশনে বেরিয়েছি।
আমরা দুজন দরজার ফাঁকা জায়গা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। কম করে হলেও তিনশ বছরের পুরোনো মন্দির। সেই আমলের ঘোট ঘোট ইট আর সুরকির পুরু দেয়াল। দরজা জানালা না থাকাতে বিকেলের এক টুকরো আলো ভেতরে এসে পড়েছে। কিসের যেন বোটকা গন্ধ পাচ্ছিলাম। ওপরে খচমচ শব্দ হতে তাকিয়ে দেখি ছাদ ফেটে নেমে আসা অশ্বত্থ গাছের শেকড়ের গায়ে অনেকগুলো কালো কালো কি যেন ঝুলছে। হঠাৎ ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ হতেই বুঝলাম ওগুলো বাদুড়। আমাদের পায়ের শব্দে ওদের ঘুমের ডিস্টার্ব হওয়াতে কয়েকটা বাদুড় ঝটপট করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে গেলো। ভেতরের দিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। মনে হলো আলো ছাড়া যাওয়া ঠিক হবে না।
শিবলী আমার হাত টেনে বললল, চল বেরোই, দুর্গন্ধে আমার বমি আসছে।
মন্দিরের চাতালে নেমে দেখি বেশ কিছুটা দূরে ঘরের মতো কি যেন। ভাঙা ইটের স্তূপ মনে হচ্ছে। বুনো কাঁটাঝোঁপ গজিয়েছে চারপাশে। শিবলী বললো, ওদিকটায় যাবি?।
আমি মাথা নাড়লাম–আমাদের এবার ফেরা দরকার। কাল সময় পেলে আসবো।
ফেরার পথে রাস্তার বাঁকে সিনেমা কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা। শিবলী দেখতে পেয়ে ডাকলো, দাগুবাবু কোথায় যাচ্ছেন?,
একটু চমকে আমাদের দিকে ফিরে তাকালো দাগুবাবু। শিবলী যদি দাগুবাবু না বলত আমি নির্ঘাত তাকে কোন সিনেমা স্টার ভাবতাম। চমৎকার দেখতে, কালো ফুলপ্যান্ট আর কালো পুলোভার, গায়ের ফর্শা রঙের সঙ্গে চমৎকার মানিয়েছে।
শিবলীকে চিনতে পেরে হাসিমুখে এগিয়ে এলো দাগবাবু–আরে, তুমি আফজাল সাহেবের ভাই না? এদিকে কোথায় এসেছিলে? খসখসে গলায় কথাগুলো বলে কাছে এসে আমার সঙ্গে হাত মেলালো।
শিবলী বিগলিত হয়ে বললো, গ্রাম দেখতে বেরিয়েছিলাম। আমাকে অবজার্ভেশন টেস্ট দিতে হবে।
ছোটবেলায় আমিও কদিন স্কাউটিং করেছিলাম। হাসিমুখে বললো দাগুবাবু। আমাদের স্কাউট টিচার এত কড়া ডিসিপ্লিনের ছিলেন–দুদিনেই বাপ বাপ করে পালিয়েছি।
আমি বললাম আমাদের নিকোলাস স্যার কিন্তু চমৎকার মানুষ।
আরে সবাই কি আর আমাদের মুজিবুল্লা খান পাঠান স্যারের মতো হবে নাকি! তোমাদের নিকোলাস স্যারের সঙ্গে আমারও পরিচয় হয়েছে। ভারি অমায়িক মানুষ। আমাদের ডিরেক্টরের নাকি ছেলেবেলার বন্ধু।
শিবলী বললো, আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন?
আর বোলো না। বিরক্ত হয়ে দাগুবাবু বললো, আমাদের হিরোইন একটু আগে হুকুম দিলেন রাতে তিনি মোরগ পোলাও খাবেন। পোলাওর চাল সঙ্গে এনেছিলাম বলে রক্ষা। স্টকের মুরগি গতকাল শেষ হয়েছে। ভেবেছিলাম কাল সকালে কিনবো। তা আর হলো কই! মুরগি খুঁজতে বেরিয়েছি গেরস্তর বাড়িতে। সিনেমা কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার হওয়া যে কী ঝক্কি হাড়ে টের পাচ্ছি।
আমি বললাম, আপনাকে দেরি করিয়ে দিলাম। আমরা যাই তাহলে।
ঠিক আছে যাও। তবে বনে বাদাড়ে সাধানে ঘোরাফেরা কোরো। তোমাদের নিকোলাস স্যারকেও বলেছি জায়গাটা সুবিধের নয়। এখানে ক্যাম্প করা ঠিক হয়নি। কখন কী অঘটন ঘটে বলা তো যায় না।
শিবলী বললো, আপনারা যে স্যুটিং করতে এলেন?
এবার রীতিমতো বিরক্ত হলো দাগুবাবু। বললো, আমি কি আহ্লাদ করে এসেছি? তোমার ইরফান ভাই কবে একবার এ বাড়িতে এসেছিলেন। বললেন রাজনৰ্তকী ছবির জন্য এ বাড়িটাই তার চাই। আমি রোজ গার্ডেনের কথা বলেছিলাম। করটিয়ার জমিদার বাড়ির কথা বলেছিলাম। ওঁর এক গোনা এটাই নাকি তার দরকার। পারমিশন পেতে কী যে ঝামেলা হয়েছে! তার ওপর উটকো বিপদ-ভূতের ভয়! শুনেছো তো আমাদের সাইড হিরোইন হেলেন নিজ চোখে দেখেছে ওঁদের। সন্ধ্যেবেলা নাম নিতে নেই। কথা বলতে বলতে দাগুবাবু ভয়ে শিউরে উঠলো–যেন জমিদার বাড়ির অতৃপ্ত আত্মারা তার আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে। এরপর দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে–দুগগা, দুগগা বলে চলে গেলো।
ক্যাম্পে ফেরার পথে শিবলী বললো, তুই তো আমার কথা বিশ্বাস করিসনি। শুনলি তো দাগুবাবু কী বললেন?
দাগুবাবু ভয় পেয়েছেন ওটাই বুঝলাম।
অকারণে কেউ ভয় পায় না।
দাগুবাবু নিজে দেখেছেন বলে তো বললেন না। ওদের সাইড হিরোইন কী দেখেছে তাই নিয়ে ভয়ে সিটিয়ে আছেন। তবে এটা ঠিক, লোক হিসেবে দাগুবাবু খুবই ভদ্র। হাসিটা ভারি সুন্দর।
চেহারাটাই বা খারাপ কী! শুধু ভয়েসের জন্য ছবিতে চান্স পেলেন না।
ক্যাম্পে ফিরে দেখি অবজার্ভেশনে যারা বেরিয়েছিলো সবাই এসে গেছে। তাঁবুতে তাঁবুতে বিকেলের চা বানাবার তোড়জোড় চলছে। আমি আর শিবলী যে যার তাবুতে ঢুকলাম। ক্যাম্প ফায়ারে কী করবো এ নিয়ে এনামুলের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলোচনা হলো।
চায়ের পর খেলার পালা। ছুটোছুটি করে রিং ছোঁড়াছুড়ি খেলোম। ছটায় আবার ততে ফিরে রাতের রান্নার আয়োজন। শেখর আর শাহেদকে রান্নার ভার দিয়ে আমরা বসলাম ক্যাম্প ফায়ারের আইটেম ঠিক করতে। মুন্না আর ফারুক বললো ওরা একটা কৌতুক নকশা করবে। ওদের মহড়া দেখে এনামুল বললো, ঠিক আছে আজ তাহলে এটাই হোক।
রাতের খাবার আটটার ভেতর শেষ করে আবার সেই আনন্দ উৎসবের ক্যাম্প ফায়ার। গ্রাম থেকে বেশ কিছু লোক এসেছে ক্যাম্প ফায়ার দেখতে। টুপ লিডার আরিফ ক্যাম্প ফায়ার উদ্বোধন করলো। পেট্রলগুলো একে একে তাদের অনুষ্ঠান দেখলো। গ্রামের লোকেরা কখনো হাসির হুল্লোড়ে গড়িয়ে পড়লো, কখনো কান ফাটানো হাত তালি দিলো। ফার্স্ট হলো জোসেফদের জাগুয়ার পেট্রলের গ্রুপ ড্যান্স। জোসেফ এথেন্সে গিয়ে দেখে এসেছিলো কেনিয়ার ছেলেদের জংলি নাচ। ফার্স্ট হবার মতোই আইটেম ছিলো ওটা।
নিকোলাস স্যার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করলেন। এনামুল ঘোষণা করলো ক্যাম্প ফায়ারের সমাপ্তি। গ্রামের লোকেরা অনুষ্ঠান নিয়ে গল্প করতে করতে ফিরে গেলো। আমরা সবাই তাঁবুতে এস কম্বলের নিচে ঢুকলাম। আমাদের পেট্রলের ফারুক রাতে ডিউট দেবে।