১১-১২. অবশেষে মুক্তি

১১. অবশেষে মুক্তি

এখানে আর থাকা যাবে না। নিকোলাস স্যার আমাদের হাত ধরে টানলেন। যে পথে এসছিলাম সে পথে কিছুদূর গিয়ে যে টানেলটায় আগে ঢুকিনি সেটার ভেতর ঢুকলাম। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। লক্ষ্য করলাম এদিকের টানেলটা ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠে গেছে।

মিনিট পাঁচেকের মতো হাঁটার পর হঠাৎ চাপা কোলাহলের শব্দ শুনলাম। মনে হলো বহুদুর থেকে আসছে। শব্দ লক্ষ্য করে দ্রুত পা চালালাম। যত কাছে যাচ্ছিলাম, উত্তেজনাও তত বাড়ছিলো। তবে কী আমরা বেরোবার পথ পেয়ে গেছি?

কিছুদূর যাওয়ার পর আবার একটা ঘরে ঢুকলাম। এ ঘরটায় অনেকগুলো বস্তা রাখা। কাছে গিয়ে দেখলাম শুকনো কতগুলো ছোট ছোট গাছে বোঝাই হয়ে আছে বস্তাগুলো।

নিকোলাস স্যার এসে গাছের শুকনো পাতা কে একটামাত্র শব্দ বললেন, গাঁজা। বস্তার পরিমাণ দেখে মনে হলো বেশ কয়েক মণ গাঁজা হবে। আমার হঠাৎ জোসেফের অবজার্ভেশনের কথা মনে হলো। নিকোলাস স্যারকে ফিস্ ফিস্ করে বললাম, আমরা বোধ হয় মাজারের কাছাকাছি কোনো জায়গায় আছি।

নিকোলাস স্যার মাথা নেড়ে সায় জানালেন। আমরা যেদিকে দিয়ে ঘরে ঢুকেছিলাম তার উল্টো দিকে একটা মই রয়েছে দেয়ালে হেলান দেয়া। কাছে গিয়ে দেখলাম, ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি ওটা। হারিকেন হাতে নিকোলাস স্যার আগে উঠলেন, তারপর আমরা।

উঠে চারপাশে তাকালাম। এটাও দরজা বন্ধ একটা ঘর। পাশের ঘরে উত্তেজিত কথাবার্তা হচ্ছে। পরিষ্কার শুনতে পেলাম, কফ জানো গলা। জোরে জোরে বলছে–ভাইসব, আপনারা উত্তেজিত হবেন না। জেরে কথা বলবেন না। এখানে যিনি শুয়ে আছেন, যার মাজার শরীফ রয়েছে এখানে, তিনি একজন জিন্দাপীর। এমন কাজ আপনারা করবেন না যাতে তিনি গোস্বা হন। আপনারা এখানে ভিড় করবেন না। রাত অনেক হয়েছে। আপনারা বাড়ি যান। যাও বাবারা তোমরাও বাড়ি যাও।

বাইরে বেশ কোলাহল। কোলাহলের ভেতর থেকে একটা গলা শুনে আমরা সবাই ভীষণ রোমাঞ্চিত হলাম। নিকোলাস স্যার শক্ত করে আমার হাত ধরে শুধু বললেন, জোসেফ।

জোসেফকে লোকজনের কোলাহলের ভেতর বলতে শুনলাম, আমরা আপনার হুজুরাখানা দেখতে চাই। কিছু যদি না থাকে, সেখানে আমাদের যেতে দিচ্ছেন না কেন?

নিকেলাস স্যার দরজা খোলার চেষ্টা করলেন। কোন লাভ হলো না। দুটো দূরজা বাইরে থেকে বন্ধ। এবার শওকতের গলা শুনলাম–ভাইসব, আপনারা কেউ যাবেন না। আপনারা নিজের চোখে দেখে যান এখানে কী হচ্ছে।

হঠাৎ নিকোলাস স্যার চেঁচিয়ে বললেন, শওকত আমরা এখানে, ভেতরে এসে দরজা খোল।

আমি আর শিবলী জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগালাম। কোলাহল বেড়ে গেলো।

কফ জড়ানো গলা চ্যাঁচাতে লাগলো, ভালো হবে না বলছি, আল্লার গজব পড়বে, কেয়ামত হয়ে যাবে।

ওর কথার মাঝখানেই অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনলাম। ঝনাৎ করে শেকল খোলার শব্দ হলো।

স্যার আপনারা কোথায়?

দরজা খুলতেই শওকতকে সামনে পেয়ে দুহাতে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন নিকোলাস স্যার। শেখর ছুটে এস আমাকে জড়িয়ে ধরলো–রান্টুদা বলে।

বাইরে তাকিয়ে দেখি জোসেফ আর মুন্না কালো দাড়িওয়ালা একটা লোককে জড়িয়ে ধরেছ। শিবলী ছুটে গিয়ে ওর দাড়ি ধরে একটা টান দিতেই দাড়িটা হাতে চলে এলো। বললো, দ্যাখ রান্টু, সেই শয়তান কুকুরটা, আমাদের মাটির তলার ঘর বেঁধে রেখেছিলো।

বাইরে থেকে ফারুক চেঁচিয়ে বললো, জো ভাই, আমারা দুটোকে ধরেছি।

লোকজনের ভীড়ের ভেতর আমাদের ছেলেরাও অনেকে এসেছে। সবার পরনে ইউনিফর্ম। আনন্দ আর উত্তেজনায় সবার চোখ মুখ চকচক করছে। শিবলী কালো দেড়েকে ধমক দিলোতাকায় কী রকম করে দেখ না! দেবো এক থাপ্পড়।

মুশকো কালো শয়তানকে চিনতে পেরে আমার ভীষণ রাগ হলো। এতক্ষণ উত্তেজনা আয় উৎকণ্ঠায় ঘাড়ের ব্যাথার কথা মনে ছিলো না। লোকটাকে দেখে ব্যাথাটা যেন বেড়ে গেলো। কাছে গিয়ে শিবলীর বদলে আমিই ওর গালের ওপর একটা চড় বসিয়ে দিলাম।

নিকোলাস স্যার ঘাড় ধরে বললেন, রান্টুকে যেমন মেরেছিলে দেবো নাকি ওরকম এক ঘা বসিয়ে?

না নিকোলাস, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া ঠিক নয়।

কথা শুনে তাকিয়ে দেখি পুলিশ অফিসারের পোশাক পরা এক ভদ্রলোক, আমাদের দিকে তাকিয়ে মিট মিট হাসছেন।

নিকোলাস স্যার এগিয়ে গিয়ে ওঁর সঙ্গে হাত মেলালেন–আরে এসপি সাহেব যে! তোমার তো সকালে আসার কথা।

তাই তো কথা ছিলো! এসপি হেসে বললেন, তোমার ছেলেরা আমাকে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে দিলে তো।

নিকোলাস স্যার হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললেন নিচে কী রকম শেয়ালের মতো গর্ত খুঁড়েছে দেখেছো? অনেকগুলো শয়তান নিচে রয়ে গেছে।

মৃদু হেসে এসপি বললেন, শেয়ালকে কী করে গর্ত থেকে বের করতে হয় আমরা জানি। শুধু এই কালো দেড়েটা ফস্কে যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস আমাদের আসার আগে তোমার ছেলেরা ওদের ঘেরাও করে ফেলেছিলো।

লাজুক হেসে নিকোলাস স্যার বললেন, বার বার শুধু তোমার ছেলে, তোমার ছেলে বলছো কেন। ওরা তো তোমারও ছেলে। সব যে তোমারই স্কুলের ছেলে।

হা হা করে হেসে এসপি বললেন, এমন হীরের টুকরো ছেলেদের নিয়ে আমরা সবাই গর্ব করতে পারি। এবার তাঁবুতে চলল। চা খাওয়াবে।

হাত কড়া পরিয়ে মাজারের কালোদেড়ে কেয়ার টেকার আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের জিপে তোলা হলো। মাজারে কড়া পুলিশ পাহারা বসলো। আমরা সবাই হই চই করে জমিদার বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

সিংহ দরজার কাছে আমাদের সঙ্গে ইরফান ভাইর দেখা। বাকি স্কাউটরাও ছিলো সেখানে। বোঝা গেলো আমাদের জন্যেই সবাই অপেক্ষা করছে। ইরফান ভাই স্যারকে বললেন, নিকোলাস, সবাই মিলে নাচ ঘরে বসলে কেমন হয়? বড় ফরাস আছে, পেতে দিচ্ছি। চা-টারও ব্যবস্থা করা যাবে।

চায়ের সঙ্গে টা-ও হবে নাকি? হেসে বললেন এসপি–তাহলে তো চমৎকার হয়। ইরফান সত্যি কাজের ছেলে। কী বলল নিকোলাস?

আমি কি বলেছি ও কাজের নয়। দেখো না এই রাতে ও কত কী আয়োজন করে। এই বলে নিকোলাস স্যার মুখ টিপে হেসে ইরফান ভাইর দিকে আড়চোখে তাকালেন।

ইরফান ভাইও হাসলেন-চলো ছেলেরা, সবাই ওপরে চলো। আমরা আজকের তিন নায়কের অভিযানের গল্প শুনবো।

আমাকে আর শিবলীকে নিয়ে মাজার থেকেই এক রকম লোফালুফি শুরু হয়েছিলো। ঘাড়ের ব্যথা ভুলে আমিও গা ছেড়ে দিয়েছি। নাচঘরে গিয়ে বসার পর সেই লোফালুফি থামলো। তবে ঠেলে ঠুলে সবাই আমাদের দুজনকে সামনে বসিয়ে দিলো, যেন আমরা অন্য কোনো গ্রহ থেকে এসেছি।

সিনেমা কোম্পানির হিরো স্বপন, হিরোইন সুমিত্রা, প্রোডাকশন ম্যানেজার দাগুবাবু থেকে শুরু করে টি বয় পিচ্চি পর্যন্ত এসেছে। আসেনি শুধু কমেডিয়ান গুলগুল্লা।

শিবলী জিজ্ঞেস করলো, গুলগুল্লা কোথায় ইরফান ভাই?

ইরফান ভাই কাষ্ঠ হেসে বললেন, আমি জানি তুমি কী বলবে। ও আমাদের ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে ঝাড়বাতিটা আনতে গেছে। বলেছি আজ রাতের মধ্যে সব ফেরত পেলে পুলিশকে জানাবো না।

এসপি গম্ভীর হওয়ার ভান করে বললেন, কই নিকোলাস, তোমার ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট আমাদের সামনে পেশ করো।

নিকোলাস স্যার মৃদু হেসে বললেন, রিপোর্ট আমি দেব না, দেবে রান্টু আর শিবলী। রান্টু, তোমার ব্যাথাটা কমেছে? বলতে পারবে?

পারবো স্যার। বলে ক্যাম্পিং-এর প্রথম দিনের সন্দেহ থেকে শুরু করে কিছুক্ষণ আগে মাজার থেকে বেরিয়ে আসার পুরো বিবরণ দিলাম। এরই মধ্যে চা খাওয়া হয়ে গেছে, সেই সঙ্গে টোস্ট বিস্কুট, ডিমের অমলেট আর কলা। রাত তখন প্রায় দেড়টা বাজে। মাত্র দুইঘন্টা মাটির নিচে বন্দি ছিলাম। অথচ মনে হচ্ছিলো কত দিন ধরে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। সবাইকে ভীষণ ভালো লাগছিলো। এমন কি শাহেদ পর্যন্ত আস্তে করে কাঁধে হাত রেখে সমবেদনার গলায় বলছিলো, তোর খুব লেগেছে, তাই না রান্টু?

আমার বলার পর নিকোলাস স্যার বললেন, এবার জোসেফ বলবে ওদের অভিযানের কথা।

নাকের ডগায় নেমে আসা চশমাটা ঠিক করে অতি রাশভারি জোসেফ লাজকু হেসে বললো, নিকোলাস স্যার তো আমাকে আর আরিফকে বাইরে রেখে রান্টু শিবলীকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। আমরা তাকিয়ে আছি জমিদারবাড়ির দিকে, কোথাও যদি অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ে। কিছুক্ষণ পর দেখি ওরা তিনজন ছাদের রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে। নদীর দিকে আঙ্গুল তুলে রান্টু বোধ হয় কী যেন দেখাচ্ছিলো। তারপর পুব দিকে দেখালো-রা তো বলেছে আপনাদের। হঠাৎ আমরা লক্ষ্য করলাম পেছনে। থেকে কয়েকজন তোক খুব সাবধানে ওদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একবার ভাবলাম হুইসেল বাজাবো, আরিফ বললো, দেখি না কী হয়। লোকগুলো ওদের তিনজনকে জাপটে ধরলো। তারপর আর কিছু দেখা গেলো না।

আমরা একবার ভাবলাম গোটা ট্রুপকে এলার্ট করে দেবো। পরে আবার ভাবলাম এতে করে জানাজানি হয়ে যাবে। ক্রিমিনালরা পালিয়ে যেতে পারে। আমরা দুজন তখন জমিদারবাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। ইরফান ভাইর কাছে গিয়ে সব বললাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলেন। ঠিক তখনই সিঁড়ির কাছে ইক বলে রান্টুর গলা শুনলাম। ধপ করে একটা শব্দ, তারপর সব কিছু চুপ। আলো জ্বেলে সিঁড়ির কামরায় এলাম। ছাদে গেলাম। দোতলার ঘর দেখলাম, কোথাও কেউ নেই। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম আর দেরি করা ঠিক হবে না। ইরফান ভাই আর আরিফ চলে গেলো গেন্ডারিয়া স্টেশনে এস পি সাহেবকে টেলিফোন করার জন্য। আমি গোটা ট্রুপকে ভাগ করে এক ভাগকে জমিদারবাড়ি ঘিরে ফেলার দায়িত্ব দিয়ে, এক ভাগকে পাঠালাম পুরোনো মন্দিরে, আরেক ভাগ নিয়ে আমি গেলাম মাজারে।

মন্দির আর মাজার কেন সনেদহজনক মনে হয়েছে আপনারা রান্টুর কাছে শুনেছেন। মাজারে গিয়ে শুনি হুজুর ঘুমাচ্ছেন। দেখা করা যাবে না। হুজুরাখানায় যাওয়ার হুকুম নেই। আমাদের মাজারে যেতে দেখে গ্রামের কিছু লোকও সঙ্গে এসেছিলো। ওদেরকেও দেখলাম আমাদের পক্ষে, আবার কয়েকজনকে দেখলাম, হুজুরকে বিরক্ত না করার পক্ষে। আমরা বললাম, দেখা না করে এখান থেকে নড়বো না। আসলে আমরা পুলিশের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

সময়মতো পুলিশ না এলে আমরা বিপদেই পড়তাম। গ্রামের লোকদের বেশির ভাগ দেখলাম কালোদেড়েকে সমর্থন করছে। এই বলে জো থামলো।

ইরফান ভাই বললেন, গ্রামের লোকদের দোষ দিয়ে কী হবে! ওদের এত বছরের বিশ্বাস এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে, তাই ওদের খারাপ লাগছিলো। দাগুবাবু যখন গুলগুল্লার কথা আমাকে বললো, তখন আমাদের স্বপনই তো চটে গিয়ে বলেছিলো, গুলগুল্লা শরীফ খান্দানের ছেলে। ও কখনো এমন কাজ করতে পারে না। আমি যখন বললাম, পুলিশকে খবর দেয়া হয়ে গেছে, ওরা এলে কী হবে আমি জানি না, কাউকে ধরলে আমি ছাড়াতেও যাবো না। তখন গুলগুল্লার হাউমাউ কান্না–আমাকে বাঁচান। আমি সব এনে দেব। তখন অবশ্য স্বপনই বলেছে জিনিস ফেরত দিলে গুলগুল্লাকে পুলিশে দেয়া হবে না। কী লজ্জার কথা বল তো।

নিকোলাস স্যার বললেন, ও খুব আজেবাজে নেশা ধরেছিলো। নেশাখোরদের কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান থাকে! ভাবো, ওরই জন্যে আমরা গুণ্ডাদের হাতে ধরা পড়লাম।

আমি দাগুবাবুকে বললাম, এবার আপনি বলুন রোজ সন্ধ্যেয় মুরগি কেনার কথা বলে আপনি কোথায় যেতেন।

দাগুবাবু লাজুক হেসে বললো, গুলগুল্লাকে আমার প্রথম থেকে সন্দ হয়েছিলো। ওর খরচের হাত সব সময়ই বড়। এখানে স্যুটিং-এ আসার পর আমাদের কারোই মন ভালো, কত রকম কী শোনা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে, অথচ গুলগুল্লা দেখি মহা ফুর্তিতে আছে। অচেনা সব লোকের সঙ্গে কী খাতির ওর, মনে হয় অনেকদিনের চেনা। রান্টুদের আগেই আমি মন্দিরের পাশের ঘরে ঘোড়ার নাদি দেখেছিলাম। গুলগুল্লাকে বাজিয়ে দেখার জন্য বলেছিলাম, ইশ ঘোড়া দুটো এবারে চুরি হয়ে গেলো, মুভিটোন কোম্পানি ওদের খুনের দরিয়া ছবির জন্য ডেলি একশ টাকা করে ঘোড়া খুঁজেও কোথাও পাচ্ছে না। ডিরেক্টর নসরত আলী সেদিন বললেন, দশ হাজার হলেও দুটো ঘোড়া তিনি কিনতে চান। গুলগুল্লা ফ্যাল করে বললো, বলেন কি, আমি যে শুনলাম দুটো ঘোড়ার দাম নাকি আটশ টাকার বেশি হয় না। আমি বললাম, জানতে হবে তো জিনিসটা কার কখন বেশি দরকার। যার দরকার নেই সে কেন এত দাম দিয়ে কিনবে।

এর পরদিন সকালে গুলগুল্লা আমাকে জিজ্ঞেস করে মুভিটোনের খুনের দরিয়া ছবির প্রোডাকশন ম্যানেজার কে, লোক কেমন–এইসব কথা। রাতে গুলগুল্লা যখন মাজারে যাচ্ছিলো, তখন আমার একটা মানত আছে বলে ওর সঙ্গে গেলাম। মাজারে আসা লোকদের একজনকে গুলগুল্লা একটু আড়ালে নিয়ে বললো, দুরি সাহেব আপনি আমাকে ঠিক দাম বলেননি। দুটোর বাজার দর দশ হাজারের কম না। তারপর কী কথা হয়েছে, শুনতে পাইনি। একটু পরে গুলগুল্লা উত্তেজিত হয়ে এসে বললো চলুন দাগুবাবু, আপনার কাজ হয়েছে তো!

আমি তক্কে তক্কে ছিলাম হাতে নাতে প্রমাণসহ ধরবো। যে জন্যে স্বপন সাহেব যখন বললেন, ইউনিটের কেউ চুরি করেছে তখন আমি ইচ্ছে করেই কথাটা ঘুরিয়ে দিলাম যাতে গুলগুল্লা সাবধান হতে না পারে।

আমি বললাম, যাই বলেন দাগুবাবু, মোরগ পোলাওর কথা বলে আপনি নিজেই আমাদের সন্দেহের তালিকায় পড়ে গিয়েছিলেন। সুমিত্রাদি মোরগ পোলাওর নাম শুনতে পারেন না, আর আপনি বললেন, তিনি মোরগ পোলাও খেতে চেয়েছেন।

আঁতকে উঠে হিরোইন সুমিত্রা বললো, ও–মা ছি ছি, দাগুবাবু এমন কথা কী করে বললেন! শুনেই যে আমার গা গুলোচ্ছে। আমার নামে এসব রটানো কি ঠিক হলো আপনার!

সুমিত্রার গলায় অভিমান দেখে দাবাবু জিব কাটলো, ওটা আমার মস্ত ভুল ছিলো। আসলে আগের ছবির হিরোইন রোজ মোরগ পোলাও খেতেন কি-না, তাই প্রায় সন্ধ্যে বেলা বাইরে কোথাও গেলে আমাকে গ্রামে ছুটতে হতো মুরগি কেনার জন্যে।

নিকোলাস স্যার বললেন, এবার আমরা উঠবো।

শুনে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলো। তাই তো, বাচ্চা ছেলেরা সব, কত রাত জেগে আছে, বলে সবাই পারলে আমাদের কোলে পিঠে করে তাঁবুতে পৌঁছে দেয়।

এসপি যাওয়ার সময়ে বলে গেলেন, তোমরা আমাকে নেমতন্ন করোনি ছেলেরা, আমি কিন্তু তোমাদের গ্রাণ্ড ক্যাম্প ফায়ার দেখতে আসবো।

এবার আমাদের হইচই করার পালা–নিশ্চয়ই আসবেন। আমরা ঠিকই নেমতন্ন করতাম। আমরা ভেবেছি নিকোলাস স্যার আগেই বলেছেন।

.

১২. অন্তহীন আনন্দ

পরদিন সকালে বিউগল বাজলো দুঘন্টা দেরিতে। বাইরে তখন ঘন কুয়াশা। কে যেন বললো, এখনো তো ভোর হয়নি। এত জলদি বিউগল বাজালো কেন?

ঘড়িতে দেখি আটটা বাজে।

ঘুম ঘুম চোখে হাত মুখ ধুয়ে রুটিন মতো পতাকা উত্তোলন তাবু পরিদর্শন সবই হলো। পিটি করার সময় ঘুমটুম সব চলে গোলো। আরিফটা যা ভালো–সেদিন মোটে কুড়ি মিনিট পিটি করালো।

পিটি শেষ করে তাঁবুতে এসে ব্রেকফাস্টের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছি সবাই। এর পরই যার যার মতো ট্রেনিং-এ যেতে হবে। নিকোলাস স্যার এসে বললেন, ইরফানের কাণ্ড দেখ! আমাদের আজ দুপুর আর রাতে–দুবেলার জন্যেই খাওয়ার নেমতন্ন করে বসে আছে। বললাম, একবেলা করো, কিছুতেই শুনলো না। তার ওপর বললো ব্রেকফাস্টের পর সবাইকে স্যুটিং দেখতে যেতে। অবর্জাভেশন ট্রেনিং ওখানেই হবে, যেভাবে রান্টু শিবলীরা কাল করেছে। কি বলো তোমরা?

এমনভাবে কথাটা বললেন নিকোলাস স্যার–অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন ইরফান ভাইর অনুরোধ রাখতে হচ্ছে। আরিফও গম্ভীর মুখে বললো, এত করে যখন বলছেন, রাজী হয়ে যাই আমরা–কী বলো।

আরিফের কথা শুনে ছেলেদের ভেতর হাসির হুল্লোড় বয়ে গেলো।

দুপুরে ইরফান ভাইদের ওখানে খাওয়া সেরে তাবুতে এসে বিশ্রাম নিতে গিয়ে সবাই ঘুমিয়ে একেবারে কাদা হয়ে গেলো। চারটার সময় ঘুম জড়ানো চোখে পেট্রল লিডাররা সবাইকে ডেকে তুললো।

আমরা যখন বিকেলে চায়ের আয়োজন করছি তখন ঘটলো আরেক অবাক কাণ্ড। স্কুল থেকে দলবল নিয়ে হাজির বুড়ো হেডমাস্টার ব্রাদার জেমস। সঙ্গে ফিলিন্স, ব্রাদার পিটার, নিখিল স্যার, রহমতুল্লা স্যার এমনকি ঘন্টাবুড়ো ভিনসেন্টও। মোটাসোটা বিশাল দেহ ব্রাদার পিটার যা করেন–আমাদের গুড আফটারনুন ব্রাদার পিটার শুনে মিট মিট করে হেসে এক একজনকে কোলে তুলে শূন্যে ছুঁড়ে আবার লুফে নিলেন।

লাজুক হেসে নিখিল স্যার বললেন, এসপি নিজে এসেছেন স্কুলে। তখন শুধু আমি আর রহমতুল্লা স্যার ছিলাম। ব্রাদার জেমসকে ডেকে সব বললেন। সন্ধ্যে বেলা নাকি খবরের কাগজের সব লোকজন আসবে। এসপি বলে দিয়েছেন সন্ধ্যের আগে নিকোলাস স্যারের ছেলেদের কেউ যেন বিরক্ত না করে। সারাদিন ওদের বিশ্রাম। আমরা থাকতে না পেরে আগেই চলে এলাম।

নিকোলাস স্যার এগিয়ে গিয়ে নিখিল স্যারকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন–কী যে খুশি লাগছে নিখিল স্যার, আপনারা সবাই এসেছেন। ওরা শুধু আমার ছেলে হবে কেন, আপনারও তো ছেলে। আপনি কী চমৎকার গান শিখিয়েছেন ওদের! এ কদিন যারা ক্যাম্প ফায়ারে এসেছে সবাই বলেছে।

ব্রাদার জেমস মৃদু হেসে বললেন, আমরা কিন্তু ক্যাম্প ফায়ার না দেখিয়া যাইব না!

ব্রাদার ফিলিপ্স অভিমান ভরা গলায় বললেন, আমারে কেউ কিসু কইতাসে না, একটা থ্যাংক্সও দিতাসে না। আমি না কইলে ক্যাম্পিং-এ যে আহন লাগতো না-এ কথা কেউ মনে রাখে নাই।

শওকত গিয়ে ধরলো ব্রাদার ফিলিপ্সকে–ও ব্রাদার, পিঠের ব্যাথা কি সেরে গেছে?

ব্রাদার ফিলিপ্স রেগে যাওয়ার ভান করলেন-–চুপ, চুপ, এই হগল কথা হাটবাজারে কইতে হয় না।

শিবলী মুখ কাচুমাচু করে নিখিল স্যারকে বললো, স্যার আমরা ফাংশনে স্টেজে ওঠার চান্স পাবো তো? খনুদা বলছিলো আমাদের নাকি আপনি আর স্টেজে উঠতে দেবেন না?

নিখিল স্যার বললেন, খনুকে আমি ক্লাস শুরু হলে সাতটা ডিটেন স্লিপ দেবো। শুনেছি সব–ও কী করেছে। তোমরা পুরো তিনঘন্টা ফাংশন করবে।

নিকোলাস স্যার আঁতকে উঠলেন–বলেন কি নিখিল স্যার! আমাদের মোটে এক ঘন্টা দশ মিনিটের প্রোগ্রাম করার কথা! এত আইটেম কোথায় পাবো?

নিখিল স্যারের মুখে হাসি, গলায় রাগের ভান–বললেই তো হলো না, এক ঘন্টা দশ মিনিট করবো। পুরো তিন ঘন্টা অনুষ্ঠান চাই! কেন, ক্যাম্প ফায়ারে কি তিন ঘন্টা অনুষ্ঠান হয় না?

ছেলেরা সবাই–থ্রি চিয়ার্স ফর নিখিল স্যার বলে হিপ হুররে দিলো।

ব্রাদারের নামেও ইয়েল দেয়া হলো। সে এক হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার।

রাতে ইরফান ভাই নিজে এসে সবাইকে খেতে নিয়ে গেলেন। আটটার মধ্যে খাওয়া শেষ। মাঠে এসে দেখি আরেক কাণ্ড। গ্রাম ভেঙে লোক এসেছে কাম্প ফায়ার দেখার জন্য। খুব ডিসিপ্লিন মেনে গোল হয়ে বসেছে। আমাদের কয়েকজন অবশ্য তাঁবুতে ছিলো। ওরাই গ্রামের লোকদের বসিয়েছে। নিকোলাস স্যারের তাবুর সামনে বসে আছেন খোদ এসপি। তার সঙ্গে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। কারো কারো হাতে ফ্লাশগানওয়ালা ক্যামেরা। স্যারকে দেখে এসপি বললেন, তোমার জিনিস তাবুর ভেতর রাখা আছে।

ট্রপলিডার আরিফের নির্দেশে পেট্রলগুলো যে যার জায়গায় বসে পড়লো। মাঝখানে কাঠের স্তূপ। সবাই আগুন জ্বালাবার অপেক্ষা করছে।

পূব দিকে থেকে মশাল হাতে জোসেফ প্রথম মাঠে ঢুকলো। কাঠের স্তূপের কাছে দাঁড়িয়ে মশাল উঁচু করে বললো, আমি এসেছি পূর্ব দিকে থেকে, হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা আর জ্ঞানের বার্তা নিয়ে।

পশ্চিম দিক থেকে মশাল হাতে এলো শওকত–আমি এসেছি পশ্চিমের দেশ থেকে, আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রার বাণী নিয়ে।

দক্ষিণ দিক থেকে মশাল হাতে ঢুকলো রকিবুল–আমি এসেছি দক্ষিণের মহাসমুদ্র থেকে, অন্তহীন অভিযান আর আবিষ্কারের আহ্বান নিয়ে!

উত্তর দিক থেকে এলো দিলীপ–আমি এসেছি উত্তরের তুষারধবল সুউচ্চ হিমালয় থেকে, শত বিপদে অনড় অবিচল থাকার প্রেরণা নিয়ে।

চারজন একসঙ্গে তাদের মশাল শুকনো কাঠের স্তূপে ছোঁয়ালো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন। আরিফ গম্ভীর গলায় বললো, এই আগুনের শিখার মতো আমাদের দেশপ্রেম, দেশের মানুষের জন্য আমাদের ভালোবাসা উজ্জ্বল হয়ে উধ্বে উঠুক, সবাইকে আলোকিত করুক। আমাদের ভেতর যত দুঃখ আর গ্লানি আছে সব কিছুই পুড়ে ছাই হয়ে যাক।

স্কাউটরা সবাই কোরাস গান ধরলো, ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।

এরপর শুরু হলো পেট্রলগুলোর অনুষ্ঠান প্রদর্শনের পালা। গ্রাণ্ড ক্যাম্প ফায়ারে সবাই তাদের সেরা অনুষ্ঠানগুলোই করে। আমরা করলাম আমাদের প্রথম দিনের হাসির নকশাটি। সব অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর নিকোলাস স্যার হাসিমুখে ঘোষণা করলেন–এবার আমাদের ছেলেরা আপনাদের সামনে একটি সত্য ঘটনার অভিনয় করবে। বেশি পুরনো ঘটনা নয়, মাত্র গত রাতেই ঘটেছে। আমার নিজেরও পার্ট আছে এতে। আমরা এর নাম দিয়েছি–অপারেশন বাগানবাড়ি। আশা করি গ্রামবাসী এবং সাংবাদিক বন্ধুরা এটি উপভোগ করবেন।

নিকোলাস স্যারের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের ভেতর এমন হুল্লোড় আর খুশির ঢেউ উঠলো যে থামতে পুরো দেড় মিনিট সময় লাগলো।

শওকত ঘোষণা করলো–প্রথম দৃশ্য নিকোলাস স্যারের তাঁবু, সময় রাত দশটা।

শুরু হলো এক অভাবনীয় নাটকের দৃশ্য। আসল ঘটনার চরিত্ররাই অভিনয় করছে নিজ নিজ ভূমিকায়। শুধু গুণ্ডাদের অভিনয় করার জন্য আমাদের ছেলেরা সাদা আলখাল্লা আর কঙ্কালের মুখোশ পরে নিয়েছিলো। এগুলো পুলিশ সিজ করেছিলো। নিকোলাস স্যারের অনুরোধে ক্যাম্প ফায়ারে আসার সময় এসপি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।

গ্রামের কয়েকশ মানুষ রুদ্ধশ্বাসে দেখলো সেই বাস্তব অভিনয়ের দৃশ্য। আমার ঘাড়ে মারার কথা মুখোশপরা দিলীপের। ওকে পই পই করে বলেছিলাম, আস্তে মেরো, এখনো ব্যথায় টন টন করছে জায়গাটা। বাস্তব অভিনয় করতে গিয়ে ও এমন জোরে মারলো যে দ্বিতীয় দফা জ্ঞান হারাবার দশা হলো আমার। সাংবাদিকদের ফ্লাশ যে কতবার জ্বলেছিলো মনে নেই।

শেষে মাজারের দৃশ্যে এসপি নিজে এসে যোগ দিলেন। ততক্ষণে হল্লা আর হাততালির ঝড় শুরু হয়ে গেছে। ফলে নাচঘর পর্যন্ত টানা গেলো না। যদিও আমাদের প্ল্যান ছিলো নাচঘরে শেষ হবে আমাদের নাটক। ইরফান ভাইদেরও পার্ট থাকবে ওতে। ওটা বাদ দিয়েও এক ঘন্টার ওপর হয়েছিলো অপারেশন বাগানবাড়ির অভিনয়।

সব শেষে এসপি নিজে ঘোষণা করলেন, স্কাউটদের ফিফথ ঢাকা টুপ এমন দুঃসাহসিক কাজ করেছে–যার জন্যে ধরা পড়েছে স্মাগলারদের এক ভয়ঙ্কর শক্তিশালী দল, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কিছু উপহার দিতে চাই আমি। এই বলে তিনি নিকোলাস স্যারের তাঁবুর ভেতর থেকে বের করে আনলেন মস্তো বড় একটা কাপ। দুহাতে উঁচু করে ধরে তিনি বললেন, টুপ লিডার আরিফকে আমি অনুরোধ করবো এটি গ্রহণ করার জন্য।

এবার আমাদের পালা। আবার হাততালির ঝড় উঠলো। ঝড় থামার পর এসপি বললেন, আরো দুটি ছোট উপহার আছে–উলফ পেট্রলের রান্টু আর প্যান্থার পেট্রলের শিবলীর প্রচণ্ড সাহস, পর্যবেক্ষণ আর বুদ্ধিমত্তার জন্য। আমি ওদের দুটো সোনার মেডেল দেবো। কোথায় তোমরা রান্টু, শিবলী। এগিয়ে এসো।

এসপি যখন আমাদের মেডেল পরাচ্ছিলেন তখন গোটা টুপ ওয়ার্ল্ড জাম্বুরিতে শেখা ইয়েল দিয়ে আমাদের অভিনন্দন জানালোচিঙ্গালিং চিঙ্গালিং চিং চিং চো, ভূম্যারাং ভূম্যারাং ভুম ভ্যাম ভো, চিঙ্গালি ভূম্যারাং চি পু পা, বয়স্কাউট বয়স্কাউট রাঃ, রাঃ, রাঃ।

আমরা দুজন শুধু বললাম, ধন্যবাদ।

এরপর ইরফান ভাই বললেন, আমাদের জন্য তাঁর কী উপকার হয়েছে। আমাদের দুজনের পুরষ্কার তিনি পরে দেবেন অনুষ্ঠান করে। জমিদার বাড়ির কেয়ার টেকারও অভিনন্দন জানালো আনুষ্ঠানিকভাবে।

ক্যাম্প ফায়ারের আগুনের শিখা তখনো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। সবার মুখে লাল ছায়া কাঁপছে। মনে হলো আমরা সবাই এক বাড়ির ছেলে। আমাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সব এক।

বাড়ির কথা মনে হলো আমার। বাবার কথা মনে হলো। বাবা কাল খবরের কাগজে নিশ্চয়ই দেখবেন সব। দিদাকে ডেকে দেখাবেন।

চিরকাল ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া বাবার জন্য আমার বুকের ভেতরটা দুঃখ আর আনন্দ মেশানো অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ভরে গেলো।