০৭-৮. রিস্টো আর নীলের বিপদ

০৭. রিস্টো আর নীলের বিপদ

পরদিন বেলা দশটার দিকে বয়ানা এসে বাস থেকে নামলো নীল। রিস্টোর দাদু ইভান ইভানভের কথা মত সারাটা পথ সতর্ক ছিলো। বাস থেকে নেমে গ্রামের পথে যেতে যেতে কয়েকবার লক্ষ্য করলোনা, কেউ অনুসরণ করে নি। মাকে বলে এসেছে। রিস্টোদের গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে, ফিরতে সন্ধ্যা হবে। রবিনেরও আজ সারাদিনই প্রোগ্রাম। নীল ঠিক করেছে রিস্টোর সঙ্গে আজ লম্বা সময় কাটাবে।

হেমন্তের এই সময়টায় প্রায় প্রতি বছরই ঝড় বৃষ্টি হয়। বলকানের বুড়োরা বলে। শীতবৃষ্টি। বৃষ্টির পরই হাড় ফুটো করা শীত নামে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বরফ পড়া শুরু হয়, শীতের হু হু বাতাস তখন থাকে না। প্রথমে আল্পস-এর মাথায় বরফ জমে, তারপর নীচে নামতে থাকে। এক রাতে তুষার ঝড়ের পর সব কিছু সাদা তুলোর মত বরফে ঢাকা পড়ে যায়। এ সময়টা নীলদের খুব ভালো লাগে। বুড়োরা বলে তুষার না। পড়লে বড়দিনের পুরো আনন্দই মাটি।

রিস্টো বলেছিলো জাদুঘরের পাশে যে কফিশপ আছে সেখানকার বুড়ো ওয়েটার আন্তনকে বললে ও জায়গামত পৌঁছে দেবে। নীল গিয়ে দেখলো আন্তন ওরই জন্যে অপেক্ষা করছে। নীল কাছে যেতেই একগাল হেসে আন্তন বুড়ো বললেন, তুমি তাহলে আমাদের রিস্টোর বন্ধু! ঠিক চিনেছি কিনা বলো তো বাছা নীল।

নীল হেসে বললো, আমার নামও জানেন দেখছি আন্তন আন্তনভ!

খল খল করে হেসে বুড়ো বললেন, তুমি আমার নাম জানবে, আমি তোমার নাম জানবো না, তা কি কখনো হয়! এখন আর কফি খেতে বলবো না, এমনিতে দেরি হয়ে গেছে। রিস্টো বলেছিলো নটা সাড়ে নটার মধ্যে এসে পড়বে। এই বলে উঠে দাঁড়ালেন আন্তন আন্তনভ।

বুড়োর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে নীল বললো, বাসের জন্য দেরি হয়েছে। পথে চেকপোষ্ট বসিয়েছে। সব বুলগেরিয়ানদের জেরা করছে, ব্যাগ, সুটকেস খুলে দেখছে।

যত সব নোংরা শয়তানের দল। বেশি আর চোটপাট করতে হবে না। দিন ঘনিয়ে এসেছে। গজ গজ করতে করতে বললেন বুড়ো।

রিস্টোর মামাবাড়ি পৌঁছতে পনেরো মিনিট লাগলো। সারাটা পথ আন্তন আপন মনে প্রেসিডেন্ট ঝিভকভকে গাল দিতে দিতে এসেছেন। মাঝখানে বুড়ো বোধহয় দম নেয়ার জন্য থেমেছিলেন সেই ফাঁকে নীল শুধু বলেছিলো, ঝিভকভ কি আপনাদের ভালোর জন্য কিছুই করে নি? ব্যস তারপর যেন আগ্নেয়গিরির অগ্নৎপাত ঘটলো–শহরে বড়লোকদের ভেতর থাকো তো, দেশের খবর কিছু জানো না–

নীলের অত খবরের দরকারও ছিলো না। জায়গা মত এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। রিস্টো দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলো নীলের অপেক্ষায়। দেখা হতেই ছুটে এসে দুই বন্ধু কোলাকুলি করলো। রিস্টো অবশ্য বলকানিদের কায়দায় নীলের গালে চুমোও খেলো, যা এখনো রপ্ত করতে পারে নি নীল।

আন্তন বললেন, আমার ডিউটি শেষ। চললাম বাছারা, প্রাণভরে গল্প করো।

নীল বললো, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আন্তন আন্তনভ।

ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। বলে চলে গেলেন অমায়িক বুড়ো। রিস্টো হেসে বললো, কথা একটু বেশি বলে আন্তন দাদু, এমনিতে লোক খুব ভালো।

তোর ইভান দাদুও খুব ভালো। দেখা হয়েছে কাল সন্ধ্যায়।

দাদু এখানেই আছে। ভেতরে চল, মাও এসেছেন আজ সকালে।

পুরোনো আমলের ছোট পাথরের বাড়ি রিস্টোর মামাদের। ছোট ছোট জানালা, দেয়ালগুলো সব পাথরের, ছাদে লাল টালির ছাউনি। বাড়ির আঙিনাতেও পাথর বসানো।

ভেতরে যেতেই নীলকে দেখে ছুটে বেরিয়ে এলেন রিস্টোর মা। বললেন, আমি খুব খুশি হয়েছি তুমি এসেছো! পথে আশা করি কেউ তোমাকে লক্ষ্য করে নি?

না আন্টি। আমি খুব সতর্ক ছিলাম। একটু বিব্রত হেসে জবাব দিলো নীল। গতবার এরকম সতর্ক থাকলে গোয়েন্দা অনুসরণ করতে পারতো না।

তোমরা ভেতরে গিয়ে বস। আমি তোমাদের জন্য কফি বানিয়ে আনছি। এই বলে রিস্টোর মা রান্নাঘরের দিকে গেলেন। আঙিনার এক পাশে রান্নাঘর। বলকান অঞ্চলের এ ধরনের ঘরবাড়ি নীলের খুব ভালো লাগে। ঘরের ভেতরটা ভারি আরামের। গরমের সময় ঠাণ্ডা আর শীতের সময় গরম থাকে।

দুটো ঘর পেরিয়ে রিস্টো ওকে ভেতরের এক কামরায় নিয়ে গেলো। একপাশের ছোট জানালা দিয়ে আসা হলদে রোদের টুকরো কাঠের মেঝের ওপর ছোট এক আয়তক্ষেত্র এঁকেছে। আরেক পাশের দেয়াল ঘেঁষে কাঠের ওপর জাজিম পেতে শোয়া বসার জায়গা করা হয়েছে। জাজিমের ওপর পাতা চাঁদরে নানা রঙের কাপড়ের টুকরো বসিয়ে নকশা করা। রিস্টো আর নীল সেই জাজিমে গিয়ে বসলো। ঘরের ভেতরের ভারি কাঠের দরজা জানালা আর পুরোনো দিনের নকশা আঁকা দেখে নীলের মনে হলো এ বাড়ির বয়স একশ বছরের কম হবে না।

রিস্টো বললো, শুনেছিস তো কি রকম ঝামেলায় পড়ে গেছি।

শুনেছি। দু পাশে মাথা নেড়ে সায় জানালো নীল। তবে বাবার কাছে যতটা সাহায্য পাবি ভাবছিস সরাসরি ততটা পাওয়া কঠিন হবে। তোর বাবার খবর কি, কেমন আছেন?

রিস্টোর মা লিলিয়া গিয়র্গিয়েভা বড় ট্রেতে দু কাপ কফি আর বাটিতে আলুর পিঠে ভেজে এনেছেন। কালো ফুলতোলা গাউনের উপর সাদা লেস বসানো এ্যাণ পরা অবস্থায় তাঁকে মনে হচ্ছিলো অতিব্যস্ত এক গৃহিনী। ছোট বাটিতে নীলকে পিঠা তুলে দিয়ে বললেন, তাড়াহুড়ো করে বানিয়েছি, ভালো হয় নি।

এক কামড় পিঠা মুখে ফেলে নীল বললো, আপনার রান্নার প্রশংসা আপনাকে সরাসরি না বললেও মাকে বহুবার বলেছি।

মৃদু হেসে গিয়র্গিয়ে বললেন, তোমার মার সঙ্গে ফোনে মাঝে মাঝে কথা হয়। তিনি বলেছেন।

নীল প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, কাল আপনার পাঠানো লোককে দেখে বাবা ভারি অবাক হয়েছেন।

তোমার বাবা কিভাবে দেখলেন তাকে?

বাবা তো তাঁকে রোজই দেখছেন। অবশ্য আপনাদের লোক হিসেবে কালই প্রথম জানলেন।

নীলের কথা শুনে লিলিয়া গিয়র্গিয়েভার কপালে ভাঁজ পড়লো–তুমি কার কথা বলছো বাছা?

কেন, ইলিনা মিরকোভা! আপনিই তো পাঠিয়েছিলেন তাকে বাবার সঙ্গে কথা বলার জন্য।

ইলিনা মিরকোভা? ভাঙা গলায় বললেন গিয়র্গিয়েভা–সে কে? আমি কেন তাকে পাঠাবো তোমার বাবার কাছে?

নীল বুঝলো ভীষণ এক গোলমাল হয়ে গেছে। অবাক হয়ে বললো, কাল চারটায় বাবার সঙ্গে আপনার লোকের দেখা করার কথা ছিলো? আপনাকে আমি টেলিফোনে বলি নি?

তা তো বলেছে। আমি পাঠিয়েছিলাম ভাসিল কিরকভকে। ও এসে বললো তোমার বাবার নাকি অন্য কি এক জরুরি প্রোগ্রাম আছে। ভাসিলকে আগামীকাল বিকেলে চারটায় যেতে বলেছেন।

কে বলেছে এসব কথা?

কে আর বলবে! তোমার বাবার সেক্রেটারি মেয়েটি বলেছে।

কী সর্বনাশ! নীলের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো–ইলিনা মিরকোভা নিশ্চয়ই গুপ্ত পুলিশের চর হবে। ও বাবাকে বলেছে ওকেই নাকি আপনারা বাবার কাছে পাঠিয়েছেন কথা বলার জন্য।

আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। অসহায় গলায় বললেন গিয়র্গিয়েভা–দয়া করে খুলে বলো বাছা শয়তান মেয়েটার সঙ্গে তোমার বাবার কি কি কথা হয়েছে।

বাবা যেভাবে ওকে বলেছিলেন সব কথা গিয়র্গিয়েভাকে বললো নীল। রিস্টো এতক্ষণ চুপচাপ বসে নীল আর ওর মার কথা শুনছিলো। উক্তষ্ঠিত গলায় বললো, মা, নীলের কথা শুনে মনে হচ্ছে ওর বাবাকে গুপ্ত পুলিশ বিপদে ফেলতে চাইছে। ওঁকে এক্ষুণি সাবধান করে দেয়া দরকার।

চিন্তিত গলায় গিয়র্গিয়ে বললেন, সাবধান নিশ্চয় করা দরকার। তবে নীলের কথা শুনে কিছুটা ভরসাও পাচ্ছি। ওর বাবা খুবই বুদ্ধিমানের মত কথা বলেছেন। ডাইনি শয়তানটাকে এমন কোন কথা বলেন নি, যাতে করে ওঁর বিপদ হতে পারে। তিনি বুদ্ধি করে ওকে কাটিয়ে দিয়েছেন ওর আসল পরিচয় না জেনেই।

কিন্তু মা, গুপ্ত পুলিশ জানলো কি করে তোমার লোক চারটায় ওর বাবার সঙ্গে দেখা করবে?

নিশ্চয়ই টেলিফোনে আড়ি পেতে শুনেছে।

নীল বললো, আপনি ভালো করে মনে করুন আন্টি, আপনাকে আমি এমন কোনও কথা কি বলেছি, যাতে মনে হতে পারে চারটায় বাবার সঙ্গেই এ্যাপয়েন্টমেন্ট! পষ্ট মনে আছে আমি বলেছিলাম কাল বিকেল চারটায় একজন ব্যবসায়ী দেখা করতে পারেন। কার সঙ্গে কে দেখা করবে এ কথা থেকে কিছু বোঝা যায় না। আপনি কে সে পরিচয় আপনি টেলিফোনে দেন নি।

অনুমান করতে পারে। আমার গলা শুনে হয়তো চিনেছে।

নীল একটু ইতস্তত করে বললো, এমন কি হতে পারে না, আপনাদের নিজেদের ভেতরই গুপ্ত পুলিশের কোন চর আছে? আপনি কিছু মনে করবেন না আন্টি, আমি শুধু আমার সন্দেহের কথা বলছি।

শুকনো গলায় গিয়র্গিয়ে বললেন, বুঝতে পারছি। কিন্তু আমরা সবাই দীর্ঘ দিনের পরিচিত। আমাদের ভেতর শত্রুপক্ষের গোয়েন্দা আসবে কী ভাবে?

অসম্ভব নয় মা। বলে রিস্টো মাকে কী যেন বলতে যাচ্ছিলো–সম্ভবত নীলের কথা ভেবে বললো না।

তোবারকের কথা মনে পড়লো নীলের। তোবারক বলেছিলো ইলিনা নাকি প্রায় খোঁজ খবর নেয় ওর বাবার কাছে কারা আসে। তখনই নীলের সন্দেহ হয়েছিলো ইলিনা গুপ্তচর নয়তো! বাবাকে বলতে গিয়েও বলে নি, পাছে তিনি ছেলেমানুষি ভাবেন।

প্রফেসর বরিসের কথা মনে পড়লো নীলের। গিয়র্গিয়েভাকে বললো, আপনি কি প্রফেসর বরিসকে চেনেন?

কে প্রফেসর বরিস?

লণ্ডনে বাড়ি। রোম থেকে সোফিয়া এসেছেন। কাল সকালে ভিতুশা পাহাড়ে দেখা হয়েছিলো। মনে হলো গোয়েন্দা পুলিশের পাল্লায় পড়েছেন। আমার ভাই রবিন আর আমি ওঁকে উদ্ধার করে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়েছি।

নীলের কথা শুনে গিয়র্গিয়েভা অবাক হলেন প্রথমে। তারপর হেসে বললেন, বুঝেছি। তুমি আমার মামার কথা বলছে। তিন দিন হলো তিনি সোফিয়া এসেছেন। আমরাই তাঁকে আসতে বলেছিলাম। কাল রাতে ফোনে বললেন, সকালে ভীষণ বিপদে পড়েছিলেন, দুটো বিদেশী ছেলের কারণে প্রাণে বেঁচে গেছেন। তোমরাই তাহলে সেই বিদেশী ছেলে?

ওঁকে ওরা ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। আপনি তো ভালোভাবেই জানেন গুপ্ত পুলিশ যাদের একবার নেয় তারা আর ফেরে না। তিনি কি আপনাদের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত?

তোমরা যা করেছে এর জন্য কী বলে যে ধন্যবাদ জানাবো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন। মামা ছিলেন ঝিভকভের সামরিক উপদেষ্টা। পনেরো বছর আগে প্যারিস গিয়েছিলেন এক ডেলিগেশনের সঙ্গে। সেখান থেকে আর দেশে ফেরেন নি। পরে আমেরিকায় চলে যান, নাসায় এখন বড় চাকরি করেন। সিটিযেন কমিটি খবর দিয়ে এনেছে তাকে।

আজ সন্ধ্যায় তিনি আমাদের ডিনারে নেমন্তন্ন করেছেন।

রিস্টো বললো, দাদুকে তুই প্রফেসর বরিস বলছিস কেন, ওঁর নাম তো দিমিতির ইয়াভরভ।

আমি কী ভাবে জানবো! নিরীহ গলায় বললো নীল, আমার ভাইকে তিনি যে নাম বলেছিলেন আমি তাই বললাম।

গিয়র্গিয়েভা হেসে নীলের চিবুক ধরে আদর করে বললেন, তুমি কিছু মনে করো না। এরকমই বলা নিয়ম। দেখতেই তো পাচ্ছো, চারপাশে কত বিপদ। কে বন্ধু কে শত্রু চট করে কি বোঝা যায়?

নীল মৃদু হেসে বললো, আমার ভাইর সঙ্গে রোমে আসার পথে প্লেনে এত আলাপ হলো অথচ রোমে দেখা হওয়ার পর তিনি না চেনার ভান করেছেন।

তখন কি সঙ্গে অন্য কেউ ছিলো?

তা অবশ্য ছিলো। আজ সন্ধ্যায় দেখা হলে ওঁকে কি আপনার কথা বলবো?

নিশ্চয়ই বলবে। আমার সঙ্গে কালই ওঁর দেখা হবে।

ছেলেদের নিয়ে ভালোই আড্ডা জমিয়েছিস দেখছি লিলিয়া। বলতে বলতে রিস্টোর দাদু ইভান ইভানভ এসে ঘরে ঢুকলেন। নীলদের পাশে জাজিমে বসে বললেন, অনেক পথ হেঁটেছি রে বাছা। জলদি আমাকে বড় এক মগ কফি বানিয়ে দে।

এক্ষুণি আনছি, বলে গিয়র্গিয়েভা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

রিস্টো বললো, নীল আর ওর ভাই কাল কী সাংঘাতিক কাজ করেছে শোনো নি তো দাদু। ভিতুশা পাহাড় থেকে পুলিশ ইয়াভরভ দাদুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো। নীল আর ওর ভাই রবিন ওঁকে উদ্ধার করে ট্যাক্সিতে তুলে একেবারে আমেরিকান এম্বাসিতে পৌঁছে দিয়েছে।

তোমরাই তাহলে সেই রূপকথার নায়ক। বলে হা হা করে হাসলেন ইভান ইভানভ–আজ সকালেই ফোনে কথা হয়েছে ইয়াভরভের সঙ্গে। বললো, বিশ্বাস করবে না ভায়া, আরেকটু হলে আমার প্রাণপাখিটা বুকের খাঁচা থেকে চিরদিনের জন্য বেরিয়ে যেতো, ঠিক তখনি রূপকথার বইয়ের পাতা থেকে যেন দুই রাজকুমার উঠে এলো। দৈত্যের কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করে রাজপুরিতে পৌঁছে দিলো। টেলিফোনে ঠিক এভাবেই বলেছিলো বেআক্কেলে ইয়াভরভ। টেলিফোনের কথায় অচেনা লোকের সঙ্গে কেউ ওভাবে দেখা করতে যায়?

কাকে বেয়াক্কেল বলছে কাকা? কফির ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলেন গিয়র্গিয়েভা।

কে আবার! তোর মামা ইয়াভরভ। চিরটা কালই গর্দভ থেকে গেলো। কী করে যে আমেরিকান ছাগলগুলো ওকে এত বড় চাকরি দিলো–ভেবে অবাক হই।

ওঁর কথা বাদ দাও। গম্ভীর হয়ে গিয়র্গিয়ে বললেন, ঝিভকভের নোংরা খাওয়া কুকুরগুলো যে নীলের বাবার পেছনে লেগেছে, সে কথা শুনেছো?

ইলিনা মিরকোভার শয়তানির কথা শুনে ক্ষেপে গেলেন ইভান ইভানভ। ডাইনিটা যদি ওই ভালো মানুষটার কোন ক্ষতি করে, ওকে আমি পুরোনো দিনের মত জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবো। নীলকে বললেন, তুমি একটুও ভেবো না বাছা। তোমার বাবার কোন ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। পুলিশের ভেতর আমাদেরও লোক আছে।

রিস্টো ওর দাদুকে বললো, তুমি তাহলে ওদিকে সামলাবে। ও নিয়ে নীল আর ভাববে না। ওকে আমি আরেকটা কাজ দেবো।

কী কাজ? জানতে চাইলো নীল।

কাষ্ঠ হেসে রিস্টো বললো, বলতে খারাপ লাগছে তোকে। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হলেও তুই বিদেশী। তবু ভেবে দেখলাম এ কাজটা তোকে ছাড়া আর কাউকে দিয়ে হবে না।

অত ভনিতা না করে বলেই ফেল না কি কাজ?

তোদের ক্লাসে রাশান এ্যাম্বাসাডরের ছেলে নিকোলাই পড়ে। ওর সঙ্গে তোর সম্পর্ক কেমন?

খারাপ না, ভালোই। ক্লাসের সব ছেলের সঙ্গেই আমার ভালো সম্পর্ক। নিকোলাই আমার টিমে ফুটবলও খেলে।

ওর বাবাকে দেয়ার জন্য একটা প্যাকেট দেবো। নিকোলাইকে বলবি ও যেন কাল বিকেলে ফ্রিডম পার্কে মার্বেল ব্রিজের পাশে অপেক্ষা করে।

যদি ও রাজী না হয়?

রিস্টো কাকুতিভরা গলায় বললো, রাজী করানোর দায়িত্ব তোর। যেভাবেই পারিস রাজি করাবি।

তোর বিপদের কথা বলতে পারি ওকে?

যা খুশি বলিস। যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার রাশান এ্যাসি ছাড়া সবার সঙ্গেই যোগাযোগ হয়ে গেছে। রাশান এ্যাসিতে এতো বেশি গুপ্তচর যে আমরা ধারে কাছে যেতে পারছি না।

নীল বললো, ঠিক আছে, নিকোলাইকে বলব। তোর বিপদের কথা বলেই রাজী করাতে হবে।

নীলের কথা শেষ না হতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন কফিশপের আন্তন আন্তনভ। হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তেজিত গলায় বললেন, লিলিয়া গিয়র্গিয়ে, এই যে ইভান ইভানভও আছেন দেখছি। সর্বনাশ হয়ে গেছে। পুলিশ গোটা গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। এদিকেই আসছে। আপনারা শিগগির পালান এখান থেকে। আমি কিছুক্ষণ সামাল দিতে পারবো।

ঘরের ভেতর যেন বাজ পড়লো। কয়েক মূহূর্তে কারো মুখে কোন কথা ফুটলো না। অসম্ভব ঘাবড়ে গেছেন লিলিয়া গিয়র্গিয়েভা। এ ধরনের পরিস্থিতির ভেতর তাঁকে আগেও পড়তে হয়েছে। কিন্তু নীলের কী হবে? ওকে নিয়ে কি পালিয়ে যাবেন? বিদেশী ছেলেটাকে এভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া কি উচিৎ হচ্ছে?

প্রথম কথা বললেন ইভান ইভানভ লিলিয়া, তুই ছেলে দুটোকে নিয়ে এক্ষুণি পাহাড়ের দিকে চলে যা। আমি ভজেনিকাটা হয়ে তোদের কাছে আসবো। তোরা ডেরা ছেড়ে কোথাও যাবি না।

গিয়র্গিয়ে বললেন, নীলকে সঙ্গে নেয়া উচিৎ হবে না। ও আমাদের সঙ্গে থাকলে ওর বাবার অসুবিধে হবে।

মা, আমি এক কাজ করি। রিস্টো সমস্যার সমাধান করলো–নীলকে নিয়ে আমি গ্রামের পেছনের পথ ঘুরে বেরিয়ে যাই। ওকে হাইওয়ে পৌঁছে দিয়ে আমি তোমাদের সঙ্গে ডেরায় দেখা করবো।

রিস্টোর সমাধান সকলের পছন্দ হলো। গিয়র্গিয়েভা নীলকে বললেন, হাইওয়ে থেকে বয়ানার বাস ষ্ট্যাণ্ডে যেতে মাইল দেড়েক হাঁটতে হবে। কিছু মনে কোরো না বাবা। আমাদের সব সময় প্রাণটা হাতের মুঠোয় নিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। এমনিতেই তোমাকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।

নীল বললো, আপনি মিছেমিছি আমার জন্য ভাবছেন আন্টি। আমার কিছুই হবে না। আমি যা করছি–

রিস্টো বাধা দিয়ে বললো, আর কথা বাড়িয়ে সময় নস্ট করার দরকার নেই নীল। চল বেরুই।

দরজার পাশ থেকে ছোট একটা এয়ারব্যাগ কাঁধে তুলে নিলো রিস্টো। নীলের হাত ধরে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

গিয়র্গিয়েভার বুকটা টনটন করে উঠলো। হেসে খেলে এখন দিন কাটাবার বয়স রিস্টোদের। অথচ ওকে এমন বিপদের কাজ করতে হচ্ছে সরকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়া মানে সব কিছু চিরদিনের মতো শেষ হয়ে যাওয়া। ঝিভকভের হায়নার দল কাউকে একবার ধরলে সে আর জীবিত ফিরে আসে না। বেশি দয়া হলে কখনো কবর দেয়ার জন্য শুধু লাসটা ফেরত দেয়।

গিয়র্গিয়েভা টেরও পান নি কখন যে ওঁর দুচোখ বেয়ে কান্না গড়িয়ে পড়েছে। ইভানভ বললেন, চল বাছা, আর দেরি করিস না। রিস্টো আর নীল দুজনই খুব সাহসী ছেলে। ওদের কিছু হবে না।

ওঁরা দুজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই সদর দরজা বন্ধ করে দিলেন আন্তন। তারপর ভেতরে গিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে এমন কিছু ব্যবস্থা করলেন শয়তানের দলের যাতে খুঁজতে কিছু সময় লাগে। এই ভেবে তিনি সান্ত্বনা পেলেন–ততক্ষণে ছোঁড়া দুটো নদী পার হয়ে যাবে।

গ্রামের ভেতর পাথুরে পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নীল বললো, তোকে তো বলা হয় নি রিস্টো, আমার ভাই রবিন তোদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। ও দেশে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

সোফিয়ায় কতদিন থাকবে তোর ভাই?

বেশি হলে সপ্তাহ খানেক।

ঠিক আছে, কখন কোথায় দেখা হবে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেবো। কাল তোদের বাসার ডাকবাক্সে আমার চিঠি পাবি।

আজ সন্ধ্যায় ডিনারে তোর ইয়াভরভ দাদুর সঙ্গে তো দেখা হচ্ছে। তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায় না?

মনে হয় না দাদু বেশি সময় দিতে পারবেন। খেতে খেতে যতক্ষণ পারিস কথা বলিস। তবে ইয়াভরভ দাদু বাইরে ছিলেন। তিনি আর কতটুকুই বা জানেন। বরং ইভানভ দাদু অনেক ভালো বলতে পারবেন।

পুলিশ যে গ্রাম ঘেরাও করেছে এ খবর গ্রামের সবাই জেনে গেছে। বাড়িঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ। পাথুরে রাস্তায় রিস্টো আর নীলের হাঁটার শব্দে উৎসাহী কোনও মহিলা জানালা ফাঁক করে দেখছিলো আর ছেলে দুটোর সাহস দেখে অবাক হচ্ছিলো। মিনিট পনেরো হাঁটার পর নীল জিজ্ঞেস করলো, আর কদুর যেতে হবে?

দশ মিনিট পর আমরা গ্রাম থেকে বনে ঢুকবো। বার্চ বনের ভেতর একটা গোপন পথ আছে। আমরা ছাড়া আর কেউ জানে না। সেই পথ দিয়ে মাইল খানেক হাঁটলেই হাইওয়েতে গিয়ে পড়বো।

তুই আগে কখনো পুলিশের এরকম ঘেরাওর ভেতর পড়েছিস?

একবার নয়, কয়েকবার পড়েছিলাম। বিপদ শহরেই বেশি, গ্রামের পথঘাট অনেক ছড়ানো, এলোমেলো। গ্রামে সময় মত খবর পেলে পুলিশ কিছুই করতে পারে না।

রিস্টোর কথা শোনার পরও ওর জন্য ভাবনা হচ্ছিলো নীলের। রিস্টোকে গোয়েন্দা পুলিশ খুঁজছে ওর বাবার সঙ্গে। এই মুহূর্তে ওরা যদি ধরা পড়ে নীলের কিছুই হবে না, পরিচয় জানলে ছেড়ে দেবে, বড়জোর বাবাকে সতর্ক করে দেবে। কিন্তু রিস্টোকে ঠিকই ধরে নিয়ে যাবে। বাবা মার একমাত্র ছেলে ও। রিস্টো ধরা পড়লে ওর মা লিলিয়া গিয়র্গিয়েভা নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবেন।

সোফিয়া আসার পর থেকে প্রেসিডেন্ট ঝিভকভের ভালোমন্দ নিয়ে কখনো মাথা ঘামায় নি নীল। রাজনীতির ব্যাপারে ওর উৎসাহ শুধু বই পড়া আর ছবি দেখার ভেতর সীমাবদ্ধ। রিস্টো বিপদে পড়ার পর থেকে ও ঝিভকভ আর তার গোয়েন্দা পুলিশের দলকে ভীষণ অপছন্দ করা আরম্ভ করেছে। মনে মনে ঠিক করলো রবিনকে আজ রিস্টোর কথা বলবে। বাবাকে বলতে হবে ইলিনা মিরকোভাকে যেন কালই চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেন। পাজি মহিলা, বসে বসে গোয়েন্দাগিরি করছে আর দেখা হলেই সোনাহেন মুখ করে কতো মিষ্টি কথা! বলে কিনা সিটিযেন কমিটির সাপোর্টার। ইভান ইভানভ ঠিকই বলেছেন, আস্ত ডাইনি একটা, বাবাকে বিপদে ফেলার জন্য ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়েছে।

হাঁটতে হাঁটতে রিস্টো ভাবছিলো নীলের কথা। যদি নীলের কিছু হয় কোনও দিন ওর বাবা মার কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। দুদিন মাত্র গিয়েছে নীলদের বাড়িতে। কী চমৎকার মহিলা নীলের মা, কত যত্ন করে খাইয়েছেন রিস্টোকে। নীলের বাবা ওকে চমৎকার একটা আমেরিকান কলম উপহার দিয়েছিলেন।

গোয়েন্দা পুলিশ যে ওদের ধরার জন্য কত বড় ঘেরাও করেছিলো রিস্টো ধারণা করতে পারে নি। পুলিশের সঙ্গে মিলিশিয়াও ছিলো। রিস্টো ভেবেছিলো অন্যান্যবার যেভাবে আসে পুব দিক দিয়ে সদর রাস্তা দিয়ে ওরা গ্রামে ঢুকবে, রিস্টোরা পশ্চিমের পথ দিয়ে পালিয়ে যাবে। এবার পুলিশ ভালোরকম প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। বেশ দূর থেকেই ওরা দেখতে পেয়েছে রিস্টো আর নীলকে। ওদের আগেই বলা হয়েছে দেশদ্রোহী সিটিযেন কমিটির লোকদের সঙ্গে কমবয়সী একটা বিদেশী ছেলেও আছে। ওর ব্যাপারে কী করতে হবে সেই নির্দেশও দেয়া আছে।

জালে যেভাবে পাখি ধরা পড়ে রিস্টো আর নীল গ্রাম থেকে বাচঁবনে ঢোকার মূহূর্তে ঠিক সেভাবে ধরা পড়লো পুলিশের হাতে। ওরা টেরও পায় নি চারদিক থেকে কখন ওদের ঘেরাও করে ফেলা হয়েছে। পুলিশের হাতে পস্তিল, মিলিশিয়ার হাতে স্টেনগান। কর্কশ গলায় একজন বললো, মাথার ওপর হাত তোলো।

যন্ত্রচালিতের মতো হাত তুললো নীল আর রিস্টো। একজন এসে রিস্টোকে সার্চ করলো। কোন অস্ত্র পেলো না। রিস্টোর ব্যাগটা নিয়ে গেলো। ব্যাগ খুলে বের করলো একতাড়া ইশতেহার। হাতকড়া হাতে একজন এসে রিস্টো আর নীলের হাতে ওটা পরিয়ে দিলো। নীল কিছুটা ভয় পেলেও রাগী গলায় বললো, আমাকে কেন হাতকড়া পরাচ্ছেন? জানেন আমি কে?

অফিসার গোছের একজন ঠাণ্ডা গলায় বললো, খুব ভালো করেই জানি তুমি একজন রাষ্ট্রদূতের ছেলে। তবে এ মুহূর্তে দেশদ্রোহীদের সাহায্যকারী একজন ঘূণ্য অপরাধী ছাড়া তুমি আর কিছু নও। ওদের সঙ্গে তোমাকেও উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে।

দুজন বিশালদেহী মিলিশিয়া ওদের দুজনকে ধরে নিয়ে চারদিক বন্ধ একটা প্রিজন ভ্যানে নিয়ে তুললো। দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর নীল আর রিস্টো দুজনই বুঝলো গাড়িটা সোফিয়ার উল্টো দিকে যাচ্ছে।

.

০৮. শুভাকাঙ্খী প্রফেসর ইয়াভরভ

নীলের বাবার সঙ্গে সকালে বেরিয়েছিলো রবিন। সাড়ে নটায় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা মার্কো কোযিনভ এসেছিলেন দূতাবাসে। রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কিছু কথা সেরে রবিনের সঙ্গে বসেছিলেন আলোচনায়। ওঁর সঙ্গে প্রায় দুঘন্টা কাটিয়েছে রবিন। নিখিলদা যেসব বিষয়ে প্রশ্ন করতে বলেছিলেন সেগুলো ছাড়াও রবিন প্রশ্ন করেছে, সোফিয়ার রাস্তা ভিখিরি কেন, ডলারের জন্য এখানে এত হাহাকার কেন, সিটিযেন কমিটি সম্পর্কে পার্টির বক্তব্য কী–এইসব। বারোটায় নীলের বাবার সঙ্গে কেমিক্যাল প্ল্যান্ট দেখতে গিয়েছিলো রবিন। লাঞ্চ ওখানেই করেছে। কারখানার ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেছে।

ওদের সঙ্গে দোভাষী হয়ে গিয়েছিলো ইলিনা মিরকোভা। এক ফাঁকে ও রবিনকে জিজ্ঞেস করলো, বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে তোমার এত উৎসাহ কেন?

রবিন গম্ভীর হয়ে বলেছে, তোমার বয়সীরা ধারণাও করতে পারবে না, তোমাদের এই গরিব দেশের মানুষের মুক্তির জন্য কমিউনিস্ট পার্টিকে কত রক্ত দিতে হয়েছে। বুলগেরিয়ার বিপ্লবের ইতিহাস আমি পড়েছি মিস ইলিনা।

ঠোঁট উল্টে ইলিনা বলেছে, স্কুলে আমাকেও পড়তে হয়েছে। তাতে লাভ কি হলো, সারা দেশ জুড়ে ঝিভকভের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে।

ইলিনার কথাবার্তা রবিনের ভালো লাগে নি। এড়িয়ে গেছে ওকে। বিকেলে তোরক ওকে নিয়ে গিয়েছিলো ইয়ং কমিউনিস্ট লীগ-এর পত্রিকা নারোদনা স্লাদেঝ-এর অফিসে। তরুণ কমিউনিস্টদের কথাবার্তা শুনে রবিন ঘাবড়ে গেছে। পত্রিকায় দেখলো আমেরিকান পপ গ্রুপের ওপর বিরাট ফিচার, সোফিয়ার ডিস্কো ক্লাবে যারা যায় তাদের সাক্ষাৎকার, ফ্যাশনের পাতা আর গল্প কবিতা। গোটা পত্রিকায় রাজনীতি সম্পর্কে কোন লেখা দেখলো না। একটা সিরিয়াস লেখা চোখে পড়েছে বুলগেরিয়ার জাদুঘরগুলোর ওপর।

নিখিলদার কথা ভাবলো রবিন। এক কপি পত্রিকাও সঙ্গে নিয়েছে। অনেক ছবি আছে দেখলে আঁতকে উঠবেন নিখিলদা। পোল্যান্ডের ব্যাপারে নিখিলদা যে বলেছিলেন নামেই ওরা কমিউনিস্ট, এদের দেখে শুনে রবিনেরও মনে হলো এরা নামেই শুধু কমিউনিস্ট, কাজে নয়।

বিকেলে মেজো চাচার সঙ্গেই বাড়ি ফিরলো রবিন। ভেবেছিলো বাড়ি এসে নীলের দেখা পাবে। চাচী বললেন, ওর ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। রিস্টোর গ্রামের বাড়ি গেছে। ওকে পেলে নীলের আর সময় জ্ঞান থাকে না।

আজ রাতে যে ওকে আর আমাকে ডিনারে নেমন্তন্ন করেছেন প্রফেসর বরিস?

তিনি আবার কে? জানতে চাইলেন মেজো চাচা।

প্রফেসর বরিস সম্পর্কে যা জানতো সব ওঁকে খুলে বললো রবিন। শুনে মেজো চাচা বললেন, ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টর মনে হচ্ছে। নীল যদি সাতটার ভেতর না ফেরে তাহলে তুমি একাই চলে যেও। তোবারক তোমাকে নিয়ে যাবে।

একা যাওয়ার কথা শুনে রবিনের খারাপ লাগলো। ও চাইছিলো নীল সাতটার ভেতর ফেরত আসুক। বাইরে গিয়ে তোবারকের সঙ্গে কিছুক্ষণ ব্যাডমিন্টন খেললো রবিন। এক গেম খেলার পর আর খেলতে ইচ্ছে করলো না। তোবারক বললো, রবিন বাইরে আজ একটু পেরেশান মনে হইতেছে।

রবিন সামান্য হাসলো–কিছুই মেলাতে পারছি না তোবারক। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে যা ভাবতাম এখানে এসে দেখি একেবারে অন্যরকম।

ওক গাছের নিচে বসে কথা বলছিলো ওরা। তোবারক সিগারেটের প্যাকেট বের করে রবিনকে একটা দিয়ে নিজে একটা নিলো। আগুন ধরিয়ে এক গাল ধোয়া ছেড়ে বললো, কিছুদিন থাকেন রবিন বাই। আরো অনেক কিছু দেখতে ফাঁইরবেন।

রবিন প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, তুমি যদি আমাকে আপনি আর ভাই বলে আমাকেও যে তাই বলতে হবে। এসব বললে কি বন্ধু হওয়া যায়।

বিব্রত হেসে তোবারক বললো, আমনে কোথায় আর আমি কোথায়

তাতে কি তোবারক! আমার কাছে সব কাজই সমান। এতদিন এ দেশে আছো, তোমার মুখে এসব বস্তাপচা কথা মানায় না।

তোবারককে কখনো কেউ এত আপন ভেবে কথা বলে নি। রবিনের কথা শুনে ওর কান্না পেলো। আস্তে আস্তে বললো, তোমার মতো একজন বন্ধুর কথা আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই রবিন।

রবিন মৃদু হেসে বললো, ভাবার কি আছে, পেয়েই তো গেলে তোবারক।

দেশে গেলে আমার কথা মনে থাকবে?

নিশ্চয়ই থাকবে। আমি তোমাকে চিঠি লিখবো।

তোবারকের মনে হলো আজকের দিনটা ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। নীলের কথা মনে হলো ওর। নীল শুনলে নিশ্চয় খুব খুশি হবে। বললো, আমাদের বন্ধুত্বের কথা কি নীলকে বলবো রবিন?

রবিন শব্দ করে হাসলো–কেন বলবে না? এতে লুকোবার কি আছে! চাচারাও তো তোমাকে ঘরের ছেলের মতো দেখেন তোবারক।

তা দেখেন। স্বীকার করলো তোবারক–এই স্যারের মত মানুষ হয় না।

হাতের ঘড়ি দেখে রবিন বললো, সাড়ে ছটা বাজে। চলো ওঠা যাক। নীল তো এলো না। তুমি আমাকে গ্র্যাণ্ড হোটেলে নিয়ে যাবে।

তুমি ড্রেস চেঞ্জ করবে না?

পাঁচ মিনিট লাগবে। বলে রবিন উঠে চলে গেলো।

তোবারক আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে রবিনের কথা ভাবলো। ঠিক করলো রবিনকে একটা চামড়ার জ্যাকেট উপহার দেবে। তোবারক দেখেছে আমেরিকান টুরিষ্টরা পাগলের মতো এসব জ্যাকেট কেনে। আমেরিকায় নাকি অসম্ভব দাম এগুলোর।

নাফিসার দেয়া স্যুট পরে রবিন যখন নিচে নামলো রীন মুগ্ধ হয়ে বললো, তোমাকে হলিউডের হিরোদের মতো লাগছে রবিনদা।

মেজো চাচাও মৃদু হেসে বললেন, তোর স্যুটটা চমৎকার হয়েছে। কোত্থেকে বানিয়েছিস?

লাজুক হেসে রবিন বললো, আমি বানাই নি। রোমে নাফিসা আন্টি প্রেজেন্ট করেছেন।

তাই বল। দেখলেই বোঝা যায় দামী জিনিস।

রবিন বাইরে এসে দেখলো গাড়ি বারান্দার নিচে তোবারক অপেক্ষা করছে। ওকে দেখে তোবারক পেছনের দরজা খুলে দিলো। রবিন কাছে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সামনের সিটে বসতে বসতে বললো, ফাজলামো হচ্ছে, না?

তোবারক গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বললো, যে ড্রেস ফরছে মনে হয় না তোমারে নিয়া রাতে বাসায় ফিরতে ফারুম।

কেন, তোমার অসুবিধে হচ্ছে কোথায়?

গ্র্যাণ্ড হোটেলের সঙ্গে একটা ডিসকো ক্লাব আছে। সোফিয়ার সেরা সুন্দরীরা ওইখানে নাচতে আসে। তোমারে দেখলে ওদের মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

যেন সোফিয়ার মেয়েরা তোমাকে পছন্দ করে না!

কৃত্রিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তোবারক বললো, ফছন্দ কইরতো, যদি তুমি সঙ্গে থাইকতে।

থাক থাক, বেশি গ্যাস দিতে হবে না।

একদিন যাইবা নাকি ডিসকোতে?

দেখা যাক।

দশ মিনিটের মধ্যে ওরা গ্র্যান্ড হোটেল সোফিয়ায় পৌঁছে গেলো। তোবারক পার্কিং-এ গাড়ি রেখে বললো, তুমি ডিনার শেষ করে আস। আমি গাড়িতেই আছি।

না তোবারক। রবিন বললো, তুমিও আমার সঙ্গে যাবে।

তোমার কি মাথা খারাপ হইছে রবিন। আমি তোমার সঙ্গে ডিনার করুম এই হোটেলে? আকাশ থেকে পড়লো তোবারক।

প্রফেসর তিনজনের জন্য টেবিল বুক করেছেন। তুমি আমার বন্ধু। আমার সঙ্গে তোমাকে দেখলে প্রফেসর খুশি হবেন।

না রবিন, তা হয় না।

না হলে আমিও যাচ্ছি না ডিনারে।

বাধ্য হয়ে তোবারককে আসতে হলো রবিনের সঙ্গে। তোবারক মুখে যতই বিনয় করুক, রবিনের বন্ধু হিসেবে ওকে মোটেই বেমানান মনে হচ্ছিলো না। টুপিটা গাড়িতে রেখে এসেছে। সাদা কোট প্যান্ট ওর পরনে, গলায় নীল সাদা স্টাইপ টাই, সবার ওপরে ওর সুন্দর স্মার্ট চেহারা হোটেলের ডোরম্যান সম্ভ্রমে দরজা খুলে দিলো ওদের।

লবি পেরিয়ে দোতালায় ডাইনিং হল। কাউন্টারে বসা লোটা জানতে চাইলে রিজার্ভেশন আছে কিনা।

রবিন প্রফেসর বরিসের নাম বলতেই একজন ওয়েটার ওদের ভেতরে নিয়ে গেলো। প্রফেসর বরিস অতিথিদের অপেক্ষায় বসেছিলেন। তাঁর সামনে আধ গ্লাস সাদা মদ। রবিন প্রথমেই বলল, শুভ সন্ধ্যা প্রফেসর বরিস। নীল এক জায়গায় বেড়াতে গেছে। আমার বন্ধু তোবারককে সঙ্গে এনেছি। আশা করি আপনি কিছু মনে করবেন না।

মনে করার প্রশ্নই ওঠে না। ব্যস্ত গলায় বললেন প্রফেসর বরিস–ডিনারে তোমাকে স্বাগতম জানাচ্ছি মিঃ তোবারক।

প্রফেসরের বাড়িয়ে দেয়া হাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তোবারক ইংরেজিতে বললো, ধন্যবাদ স্যার। আপনার সঙ্গে পরিচিতি হতে পেরে আনন্দিত হয়েছি।

রবিন প্রফেসরকে বললো, তোবারক সাত বছর ধরে এদেশে আছে। ইচ্ছে করলে আপনি বুলগেরিয়ান ভাষায় ওর সঙ্গে কথা বলতে পারেন।

তাই নাকি তোবারক? প্রফেসর বুলগেরিয়ান ভাষায় বললেন, যতই লণ্ডনে থাকি আর ইংরেজি কপচাই, নিজের মাতৃভাষায় কারো সঙ্গে কথা বলতে পারলে আমি আর কিছুই চাই না।

আপনি নিশ্চয় বহুদিন ধরে দেশের বাইরে আছেন?

আরে, কি চমৎকার বুলগেরিয়ান ভাষা বলো তুমি! আমি কোন বিদেশীর মুখে এত সুন্দর বুলগেরিয়ান শুনি নি।

তোবারক বিব্রত হেসে বললো, আমি আমার মাতৃভাষা ঠিক মত শিখতে পারি নি। তাই বুলগেরিয়ান ভাষা যত্ন করে শিখেছি।

ওয়েটার এসে টেবিলে দু গ্লাস রেড ওয়াইন রেখে গেলো। প্রফেসর বললেন, আমি খাঁটি বুলগেরিয়ান রাকিয়া নিয়েছি। তোমাদের জন্য এ পানীয়টি বেশি কড়া হবে বলে রেড ওয়াইনের কথা বলেছি।

রবিন আর তোবারক দৃষ্টি বিনিময় করলো। প্রফেসর গ্লাস তুলে টোস্ট করলেন, আমাদের বন্ধুত্ব ও বুলগেরিয়া প্রীতির উদ্দেশে।

রবিন আর তোবারক গ্লাস তুললো। তোবারক বুলগেরিয়ান ভাষায় প্রফেসরের স্বাস্থ্য কামনা করলো। রবিনও প্রফেসরের দীর্ঘ জীবন কামনা করলো।

ডিনারের মেনু দেখে প্রফেসর জানতে চাইলেন, তোমরা বুলগেরিয়ান ডিনার পছন্দ–করবে, না কন্টিনেন্টাল?

রবিন বললো, বুলগেরিয়ান।

তোবারক বললো, রবিন হচ্ছে প্রধান অতিথি। ওর পছন্দই আমার পছন্দ।

আমার মতে পৃথিবীর সেরা খাবার হচ্ছে বুলগেরিয়ান। এই বলে প্রফেসর হা হা করে হাসলেন।

পাঁচ কোর্সের ডিনারের অর্ডার দিলেন প্রফেসর। ওয়েটার প্রথমে এ্যাপেটাইযার হিসেবে দিয়ে গেলো ঠাণ্ডা সালাদ। ভিনেগারে জারানো শসা, চিনি আর লেবুর রস দেয়া লাল বাধাকপির কুচি, টম্যাটো আর জারানো জলপাই।

রবিন প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করলো, আপনার আর কোন অসুবিধে হয় নি তো?

আর অসুবিধে হবে না। প্রফেসর বিষণ্ণ গলায় বললেন এতদিন ধরে আমেরিকানরা বলছিলো আমেরিকান পাসপোর্ট নিতে। রাজী হই নি। ভাবতাম দেশ ছেড়ে চলে গেছি, এই বুলগেরিয়ান পাসপোর্টই আমার একমাত্র অবলম্বন। ঝিভকভের পা চাটারা আমাকে সেদিন বাধ্য করেছে আমেরিকান পাসপোর্ট নিতে। আমেরিকান এ্যাম্বাসাডর এদের ফরেন মিনিষ্ট্রিকে বলে দিয়েছেন আমার কিছু হলে আমেরিকানরা এটাকে শক্তভাবে নেবে।

আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই প্রফেসর বরিস, যদি কিছু মনে না করেন।

নিশ্চয়ই করতে পারো। তার আগে বলা দরকার, আমার নাম বরিস নয়, আমি এ্যান্থপলজির প্রফেসরও নই। আমার নাম দিমিতির ইয়াভরভ। আমি একজন পদার্থ বিজ্ঞানী। প্রফেসর বলতে পারো, কিছুদিন সোফিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছি। একসময় ঝিভকভের উপদেষ্টা ছিলাম, এখন নাসার একজন পরিচালক। বিশেষ কারণেই আমাকে আসল পরিচয় গোপন রেখে চলাফেরা করতে হয়। আশা করি এরপর তুমি কিছু মনে করবে না।

ধন্যবাদ প্রফেসর ইয়াভরভ। আমার জানতে ইচ্ছে করে আপনি কেন দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন?

কয়েক মুহূর্ত কোন কথা বললেন না দিমিতির ইয়াভরভ। ওয়েটার এসে সস দেয়া ট্রাউট মাছ ভাজি, ল্যাম্ব রোস্ট, আর সস মাখানো সবজির পুর দেয়া আলুর চপের মত এক ধরনের খাবার পরিবেশন করলো। বুড়ো বিজ্ঞানী নিজ হাতে রবিন আর তোবারকের পাতে রোস্ট, ভাজা মাছ আর চপ তুলে দিলেন। তারপর নিজের পাতে নিলেন। ছুরি আর কাঁটাচামচ দিয়ে ট্রাউট মাছের টুকরো থেকে কাঁটা বেছে মুখে ফেললেন। বললেন, বহুদিন পর দেশী খাবার খাচ্ছি, কেমন লাগছে?

রবিন আর তোবারক দুজনই বললো, চমৎকার।

ও হ্যাঁ! রবিন একটা প্রশ্ন করেছিলে! এক টুকরো চপ মুখে ফেলে ইয়াভরভ বললেন, অল্প কথা তোমার প্রশ্নের জবাব দেয়া কঠিন। তবু সংক্ষেপে বলছি। আমেরিকায় কাজ করি বলে ভেবো না সাম্রাজ্যবাদের দালালী করার জন্য দেশ ছেড়ে পালিয়েছি। এক সময় আমি কমিউনিস্ট পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসীদের সঙ্গে লড়াই করেছি। গিয়র্গি দিমিত্রভ আমাকে ভালোভাবে চিনতেন। বিপ্লবের পর দেশ গড়ার কাজে ডুবে গেলাম। দশ বছর গবেষণাগারে কাটিয়েছি, নতুন প্রযুক্তি আবিস্কারের জন্য। কাজের অনেক স্বীকৃতিও পেয়েছি। শেষে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পর্যন্ত হয়েছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম সাধারণ মানুষ পার্টি সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। মানুষের অবস্থা যেভাবে বদলে যাবে ভেবেছিলাম সে রকম কিছু হয় নি, অবস্থা বদলেছে পার্টি নেতাদের। দেখলাম কাজ করে দেয়ার জন্য নেতারা ঘুষ নিচ্ছে, স্বজনপ্রীতি করছে, আরো নানারকম দুর্নীতি করছে। সরকার আর পার্টি সব একাকার হয়ে গেছে। পার্টির সদস্য না হলে যোগ্য লোকদের কোনঠাসা করে রাখা হচ্ছে, ক্ষমতা অল্প কিছু নেতার হাতে কুক্ষিগত হয়ে গেছে। সব কিছু দেখে শুনে ভীষণ খারাপ লাগলো। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিপদে পড়লাম। শুনলাম দুএকজন আমার মতো একা প্রতিবাদ করতে গিয়ে এ পৃথিবী থেকে অসময়ে হারিয়ে গেছে। নিজের অক্ষমতার ওপর রাগ হলো। দেখলাম দেশে থাকলে এসব অনাচারের দায় বহন করতে হবে। তাই ঠিক করলাম পালিয়ে যাবো। তুমি বোধহয় জানো না, আমাদের পালিয়ে যাওয়ার জায়গা হচ্ছে পশ্চিম ইউরোপ নয় আমেরিকা। কোনও তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দেশে গেলে তারা আমাকে আবার ঝিভকভের হাতে তুলে দিতো।

রবিন খেতে খেতে গভীর মনোযোগের সঙ্গে বুড়ো প্রফেসরের কথা শুনছিলো। প্রফেসরের কথা শেষ হওয়ার পর বললো, আপনি কি সবগুলো সমাজতান্ত্রিক দেশকে তথাকথিত বলবেন? সত্যিকারের সমাজতন্ত্র কি কোনও দেশে নেই?

না নেই। শান্ত গলায় বললেন প্রফেসর ইয়াভরভ–এসব দেশে সমাজতন্ত্রের পথে যাওয়ার কম বেশি চেষ্টা হয়েছিলো। কিন্তু সফল কোথাও হয় নি। তুমি আমার সঙ্গে দ্বিমত অবশ্যই পোষণ করতে পারো, আমি বলছি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর পর্যবেক্ষণের কথা।

আপনি কি ঝিভকভের বিরুদ্ধে সিটিযেন কমিটি গণতন্ত্রের জন্য যে আন্দোলন করছে তার সঙ্গে জড়িত?

আগে পুরোপুরি জড়িত হওয়ার সুযোগ আমার ছিলো না। অবশ্যই এখন আমি ওদের একজন।

আপনার কি ধারণা বুলগেরিয়ায় গণতন্ত্র এলে রাস্তায় আর ভিখিরি থাকবে না, গরিবরা সব ধনী হয়ে যাবে?

আমি তা বলছি না। গণতন্ত্র হলে মানুষের কিছু সান্ত্বনা থাকে, ইচ্ছে মত সরকার বদলাতে পারে, সরকারে যারা থাকে তাদেরও জবাবদিহি করতে হয় মানুষের কাছে, একজন প্রেসিডেন্ট ইচ্ছে করলেই যা খুশি তাই করতে পারেন না।

আপনার কি মনে হয় একজন কমিউনিস্ট হিসেবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই। করে আপনি ভুল করেছিলেন?

না তাও মনে করি না। তখন আমাদের সামনে বিকল্প কি ছিলো? পরে আমার মনে হয়েছে সমাজতন্ত্র অত্যন্ত উন্নত এক মতবাদ। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য উন্নত সমাজ দরকার। উন্নত সব অর্থে। তুমি সব কিছু বুঝবেও না। হয়তো আগামী শতাব্দীতে তোমরা দেখবে সমাজতন্ত্রের সত্যিকারের বিজয়যাত্রা।

প্রথমে প্রফেসর সম্পর্কে রবিনের ধারণা ছিল তিনি বুঝি বলবেন সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই, হেনতেন নেই–এইসব। প্রফেসরের সব কথা শোনার পর মনে হলো এ নিয়ে আরো পড়াশোনা করতে হবে, ভাবতে হবে।

ওদের খাওয়ার পর কয়েক রকম ফলের সালাদ দেয়া হয়েছিলো। একজন ওয়েটার রেড ওয়াইনের গ্লাস সরিয়ে শ্যাম্পেনের গ্লাস দিয়ে গেছে। প্রফেসর শ্যাম্পেন টোস্ট করলেন। জীবনে প্রথম শ্যাম্পেনের স্বাদ গ্রহণ করলো রবিন। তোবারককে মনে হলো নির্বিকার।

ডিনার শেষ হতে হতে সাড়ে আটটা বাজলো। তোবারক বুলগেরিয়ান ভাষায় প্রফেসরকে ডিনারের জন্য ধন্যবাদ জানালো। বললো, প্রত্যেকটা ডিশই অত্যন্ত উপাদেয় ছিলো।

প্রফেসর বললেন, আমি খুব খুশি হয়েছি তোমরা আমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছো বলে। আরও ভালো লাগতো সেই সাহসী ছেলেটিও যদি আসতো। কী যেন নাম ওর? দাঁড়াও, মনে পড়েছে নীল। ওকে বলবে আমার কাছে ওর একটি ডিনার পাওনা আছে।

তোবারক নীলের বাবার ভিজিটিং কার্ড প্রফেসরকে দিয়ে বললো, নীল খুশি হবে আপনি নিজে যদি ওকে নেমন্তন্ন করেন। আমাদের রাষ্ট্রদূত খুশি হবেন আপনার মতো একজন ভিআইপি যদি তার ছেলের প্রশংসা করেন।

কার্ডখানা পকেটে পুরে প্রফেসর বললেন, তুমি ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছো বাছা। নীলের জন্য অবশ্যই ওর বাবাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানানো উচিৎ। নীল আমার জীবনরক্ষা করেছে।

ডাইনিং রুম থেকে বেরুতে বেরুতে রবিন বললো, আপনি কোথায় যাবেন বলুন। আপনাকে নামিয়ে দিই।

ধন্যবাদ রবিন। মৃদু হেসে প্রফেসর ইয়াভরভ বললেন, আমি এখন আমেরিকান এ্যাম্বাসাডারের অতিথি হয়ে তাঁর বাড়িতে আছি। ওদের গাড়ি বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

প্রফেসরের সঙ্গে ওরা হোটেলের কাঁচের দরজা ঠেলে পোর্টিকোতে দাঁড়াতেই নিঃশব্দে ধবধবে সাদা লিমোযিন এসে থামলো ওদের সামনে। প্রফেসর উঠে বসে শুভরাত্রি জানালেন। রবিন আর তোবারক প্রফেসরকে বিদায় জানিয়ে ওদের গাড়িতে উঠলো। যেতে যেতে তোবারক বললো, তোমারে আমার থ্যাংকস দেয়া উচিৎ রবিন। তোমার জন্য এত বড় একজন ভিআইপির সঙ্গে ডিনার করলাম।

মৃদু হেসে রবিন বললো, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, তুমি যেভাবে প্রফেসরের সঙ্গে বুলগেরিয়ান ভাষায় কথা বলছিলে, নিজেকে একজন ফালতু লোক মনে হচ্ছিলো আমার।

কিছুদিন থাকো। তোমারে বুলগেরিয়ান শিখাই দেব।

এই দু দিনে মাত্র দুটো শব্দ শিখেছি। দা আর দেরে। দা মানে হ্যাঁ, দেব্রে মানে ঠিক আছে। ঠিক কিনা বলো?

রবিনের কথা শুনে গলা খুলে হাসলো তোবারক। হাসতে হাসতে বললো, দেবে।

বাড়ি ফিরে রবিন প্রথমেই ওর চাচীকে নীলের কথা জিজ্ঞেস করলো। চাচী বললেন, এখনো ফেরে নি। নটা বাজতে চলেছে। মনে হয় না আজ ফিরবে। আগেও দুবার রিস্টোদের বাড়িতে রাত কাটিয়েছে।

রীন ওপরে ওর ঘরে নাচের প্র্যাকটিস করছিলো। নিচে রবিনের গলা শুনে এক ছুটে নেমে এলো। বললো, পলা কে রবিনদা?

রবিন অবাক হয়ে বললো, একটা মেয়ে, কেন?

আহ, মেয়ে তো নাম শুনেই বোঝা যায়। তুমি এই মেয়েটাকে চেনো কি করে বলবে তো?

রোমে আলাপ হয়েছে। ওর কথা কে বললো তোকে?

শুধু আলাপ নয় রবিনদা! রহস্যভরা গলায় রীন বললো, শুধু আলাপের মেয়ে হলে এত এ্যাংশাস হয়ে টেলিফোন করতো না। বললো, তোমার উচিৎ ছিলো এখানে এসেই ওকে ফোন করা। না করে অন্যায় কাজ করেছে।

রবিন আড়চোখে একবার তোবারককে দেখলো। তোবারক রবিনকে দেখছিলো। দৃষ্টি বিনিময় হতেই ও মুখ টিপে হেসে সিলিং-এ ঝোলানো ঝাড়বাতিটা দেখতে লাগলো। রবিন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, এত ব্যস্ত হওয়ার কি আছে! আমি ভেবেছিলাম রোমে ফেরার টিকেট কনফার্ম করে ফোন করবো।

চাচী এতক্ষণ চুপচাপ ওদের কথা শুনছিলেন। হাসি হাসি মুখ করে বললেন, মেয়েটা বুঝি নাফিসা আপার বাড়িতে থাকে?

রীন বললো, দেখতে কেমন রবিনা?

রবিন লাজুক হেসে বললো, ফ্রান্স থেকে এসেছে রোমে বেড়াতে। নাফিসা আন্টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর আন্টিই বললেন ওর ওখানে থাকতে।

রীন অধৈর্য হয়ে বললো, আহ্, দেখতে কেমন বলো না! ভালোই দেখতে। তবে তোর মতো নয়।

মুখ টিপে হেসে রীন বললো, দেখা যাবে। আমি ওকে আর নাফিসা আন্টিকে বলেছি তুমি এখানে থাকতে থাকতে এসে যেন বেড়িয়ে যায়।

রীনের কথা শুনে রবিনের খুবই ভালো লাগলো। আড়চোখে দেখলো, তোবারক ওর দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে দুষ্টুমির হাসি।

রবিনের মেজো চাচা ড্রইংরুমের এক কোণে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। এতক্ষণ পর মুখ তুলে বললেন, নাফিসা আপা এলে ভালোই হয়। রোমে গেলে কী যে করেন না! কতবার বললাম, কাছেই তো সোফিয়া–এলেন না।

চাচী কী যেন বলতে যাবেন এমন সময় টেলিফোন বাজলো। রীন টেলিফোন ধরে রবিনকে ডাকলো–তোমার ফোন রবিনদা, আমেরিকান অ্যাম্বাসাডরের বাড়ি থেকে।

তোবারক বললো, নিশ্চয় প্রফেসর ইয়াভরভ।

রবিন ফোন ধরতে গেলো। রীন বললো, প্রফেসর ইয়াভরভ কে, যিনি রবিনদাকে ডিনারে ইনভাইট করেছিলেন?

জ্বি আফা। সাংঘাতিক মানুষ। ঝিভকভের এ্যাডভাইজার আছিলেন, ফরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এখন নাসার ডিরেক্টর।

প্রফেসরের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে রবিন ফ্যাকাশে মুখে এসে বললো, চাচা, প্রফেসর আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।

রবিনের চেহারা দেখে তোবারক ব্যস্ত গলায় জানতে চাইলো, কি হয়েছে রবিন, প্রফেসরের কি আবার কোন বিপদ হয়েছে?

রবিন একবার তোবারককে দেখলো, আরেকবার ওর চাচীকে দেখলো। কোনও কথা না বলে চুপচাপ বসে রইলো। যা বলার মেজো চাচা বলুক সবাইকে।

দুমিনিট পর মেজো চাচা এসে চাচীকে বললেন, আজ দুপুরে নীল আর রিস্টোকে পুলিশ বয়ানা থেকে এ্যারেস্ট করেছে।

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সবাই মুহূর্তের জন্য পাথর হয়ে গেলো। রবিন এ কথাটাই প্রফেসরের কাছে শুনেছে। প্রফেসর ঘরে ফিরেই খবর পেয়েছেন। রিস্টো নাকি ওঁর নাতি হয়।

নীলের মা ভাঙা গলায় বললেন, এসব কী বলছো তুমি? নীলকে কেন এ্যারেস্ট করবে পুলিশ? ও কী করেছে? তুমি এক্ষুণি পুলিশের চীফকে টেলিফোন করো।

আমেরিকান এ্যাম্বাসাডর কথা বলেছেন পুলিশের সঙ্গে। পুলিশ বলেছে এ ধরনের গ্রেফতারের কোন খবর ওদের জানা নেই।

ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন নীলের মা তাহলে কী হবে! কোথায় আমার নীল?

কেঁদো না মিনু। ভেজা গলায় বললেন নীলের বাবা আমার মনে হচ্ছে এটা সিক্রেট পুলিশের কাজ। আমাকে পার্টি লাইনে মুভ করতে হবে। এক্ষুণি বেরুচ্ছি আমি।

রবিন বললো, চাচা আমি আপনার সঙ্গে যাবো।

ঠিক আছে চল। বলে রবিনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গাড়িতে উঠলেন।

তোবারক ঝড়ের বেগে গাড়ি চালালো নাইনথ সেপ্টেম্বর স্কয়ারে পার্টির সদর দফতরের দিকে।