কল্পবিজ্ঞান ১ – সিদ্ধার্থ ঘোষ রচনা সংগ্রহ
সিদ্ধার্থ ঘোষ রচনা সংগ্রহ ১
কল্পবিজ্ঞান রচনা সংগ্রহ ১
সম্পাদনা
সন্তু বাগ, দীপ ঘোষ ও দেবজ্যোতি গুহ
প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর, ২০১৮
সিদ্ধার্থ ঘোষ অনুরাগীদের উদ্দেশে
.
ভূমিকা
সিদ্ধার্থ ঘোষের কল্পবিজ্ঞান রচনাসমূহ প্রকাশ করলেন কল্পবিশ্ব। এই বহুমুখী মানুষটির জিজ্ঞাসা, অনুসন্ধিৎসা ও সৃষ্টিশীলতার অজস্র নিদর্শন পত্রপত্রিকা ও বইয়ে ছড়িয়ে থেকেছে এতদিন, হয়তো বা কিছুটা অভিভাবকহীন ভাবেই। সম্প্রতি সেগুলিকে একত্র করার চেষ্টা শুরু হয়েছে। এই কুড়িটি গল্প এবং দুটি উপন্যাস সেই প্রয়াসের সাম্প্রতিকতম ফল।
বাংলা ভাষায় কল্পবিজ্ঞানের চর্চার ইতিহাস নেহাত অল্পদিনের নয়। বিশ শতকের পাঁচের দশক থেকে নানা পত্রপত্রিকায় এই সাহিত্যধারার অনুশীলন লক্ষ্য করা যায়। এরপর ছয় ও সাতের দশকে আশ্চর্য্য!, বিস্ময় ও ফ্যানটাস্টিক পত্রিকাসমূহে নিবেদিতভাবে মৌলিক ও অনূদিত কল্পবিজ্ঞানের প্রকাশ। কিন্তু তারপরের ইতিহাস, অন্তত বিশ শতকে, সেরকম আশাপ্রদ নয় বললে বোধহয় খুব ভুল বলা হবে না।
এর মধ্যে সিদ্ধার্থ ঘোষ এক ব্যতিক্রমী আলোকবর্তিকা। বঙ্গদেশে বিজ্ঞানচর্চার ঐতিহাসিক হিসেবে তার খ্যাতি ভুবনবিদিত, এ ছাড়াও গোয়েন্দা গল্প, ক্রিকেট, বোর্ড গেম, ধাঁধা, মুদ্রণ, সুকুমার রায় সবেতেই তার অবাধ গতিবিধি। নিবিষ্ট গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানকে জনমুখী ও জনপ্রিয় করে তোলার জন্য যতটা পথ হাঁটা প্রয়োজন, তা তিনি হেঁটেছেন, প্রায় নজিরবিহীনভাবেই। এই পথগুলির মধ্যে একটি ছিল, ছোট ও বড়, উভয়েরই জন্য, কল্পবিজ্ঞান।
ইদানিং কিশোরপাঠ্য কল্পবিজ্ঞানকে খুব একটা শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয় না। কিন্ত এই সংকলনে ঝন্টুমামা শীর্ষক গল্পগুলি এখনও আশ্চর্য্য রকমের প্রাণবন্ত ও প্রাসঙ্গিক। যেমন ‘ঝন্টুমামার ছিপ’ গল্পটির স্বল্প পরিসরে একে একে এসেছে চোরকে-বোকা-বানানো ষোলশো শতাব্দীর পারস্যের তালা, উনিশ শতকের ভিক্টোরীয় দ্বিচক্রযান ‘পেনি-ফার্দিং’, ও অবশেষে মাছ-ধরার চৌম্বকীয় ফাতনা। যদিও ঝন্টুমামার এই সমস্ত হিথ-রবিন্সনীয় আয়োজন গল্পের একেবারে শেষ লগ্নে ঠোকর খেয়েছে ঘোরতর বাস্তবের চৌকাঠে, তবু এই চৌকাঠ আদৌ কোন অমোঘ সীমান্ত বা বিভাজিকা নয়, বরং সে কল্পনা ও বাস্তবকে একে অপরের আত্মীয় করে তোলে। একটিমাত্র ই-যোগে ‘ঝন্টুমামার ছিপি’ গল্পে নিতান্ত খেলাচ্ছলে এসেছে ম্যাগডেবার্গ শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত বুর্গোমাস্টার অটো ভন গেরিকের প্রসঙ্গ। কিন্তু এই সংকলনে শুধুমাত্র কিশোরপাঠ্য কল্পবিজ্ঞান স্থান পায়নি। এই বইয়ের দ্বিতীয় ভাগে আমরা পাই ‘মহাশূন্যের মণিমুক্ত’-র মতো বুক-হিম করা মহাকাশ যুগের আখ্যান, যেখানে গ্রহান্তরে যাত্রার রোমাঞ্চ এক ক্লেদাক্ত ও ট্রাজিক পরিণতিতে পর্যবসিত হয়েছে। এই গল্প সর্বাংশে সফল না হলেও এর মধ্যে উপ্ত ছিল এক প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্ক কল্পবিজ্ঞান কাহিনির বীজ, যা বাংলা ভাষায় তখন পর্যন্ত প্রায় লেখা হয়নি বললেই চলে।
তবে সিদ্ধার্থ ঘোষের সঙ্গে কল্পবিজ্ঞানের সবচেয়ে চমকপ্রদ যোগসাজস বোধহয় ঘটেছিল সুইডেনের উপ্সালা শহরে। সেখানে আটের দশকে কোনও এক ফ্যান্টাসি/কল্পবিজ্ঞান কনভেনশনে যোগ দিয়েছিলেন সিদ্ধার্থ। সেই কনভেনশনে তার সঙ্গে সাক্ষাত ঘটে তরুণ টেরি প্র্যাচেটের। সিদ্ধার্থের কাছে প্র্যাচেট ভারতীয় পৌরাণিক আদিকল্প নিয়ে জানতে চান, বিশেষ করে আটটি দিগগজ বা পৃথিবী-ধারণকারী হস্তি, ও মহাকূর্মের বিবরণ। ফ্যান্টাসির পাঠকমাত্রই জানবেন যে, প্র্যাচেটের অতীব জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ডিস্কওয়ার্ল্ড এমন এক জগত যা যথাক্রমে ধারণ করে আছে চারটি হাতি, ও মহাকূর্ম আ-তুইন।
এই সাক্ষাতের কথা সিদ্ধার্থ ঘোষ আমাকে বলেন, তার মৃত্যুর কয়েক মাস আগে। যিনি এই গল্পের সাক্ষ্য বহন করতে পারতেন, সেই প্র্যাচেটও চলে গেছেন সব ধরাছোঁয়ার বাইরে। সিদ্ধার্থ ঘোষের কল্পবিজ্ঞানও হয়তো অচিরেই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেত, সেই পরিণতি থেকে গল্পগুলিকে উদ্ধার করে কল্পবিশ্বের সদস্যরা আমাদের ঋণী করেছেন।
ডঃ অভিজিৎ গুপ্ত
কলকাতা
২৫ ডিসেম্বর ২০১৮
.
সিদ্ধার্থ ঘোষের গল্প: সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা অচেনা স্রোত
“বাংলা সাহিত্য পত্রিকায় সায়েন্স ফিকশান আজও অচ্ছুৎ। …এই অবস্থার জন্য বিস্মিত হবার কোন কারণ নেই। শিশু ও কিশোরদের জন্যই শুধু সায়েন্স ফিকশান লেখা হবে, এটাই এখনো অবধি রেওয়াজ। আর সেই সঙ্গে সায়েন্স ফিকশানের দুটি বাংলা পরিভাষা ‘বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্পের’ সঙ্গে ‘কল্পবিজ্ঞানের গল্পের’ ঠাণ্ডা লড়াই জারি করেছেন কিছু স্পর্শকাতর পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তি। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কিছু সমালোচক মনে করেন কল্পবিজ্ঞানের গল্প কিঞ্চিৎ নিকৃষ্ট জাতের, সেখানে ফ্যান্টাসির দাপট বেশি এবং বিজ্ঞানের অপলাপের সুযোগ আছে।”
— সিদ্ধার্থ ঘোষ (সায়েন্স ফিকশন একটি পরিভাষার জন্ম, শারদীয়া এক্ষণ, ১৯৮৮)
বাংলা সাহিত্যে স্বল্পায়ু কিন্তু প্রায় একজন রেনেসাঁস পলিম্যাথের বীক্ষা নিয়ে যিনি তাঁর লেখাগুলোয় এনেছিলেন আশ্চর্য দীপ্তি তেমন এক সাহিত্যিকের নাম সিদ্ধার্থ ঘোষ (১৫ অক্টোবর ১৯৪৮ — ৩১ অক্টোবর ২০০২)। ভাবতে অবাক লাগে ইন্টারনেটের যুগের অনেক আগে এই বাংলায় লেখালেখি করতেন এমন মানুষ, যার উৎসাহ ছড়িয়ে পড়েছিল জ্ঞান বিজ্ঞান আর কৃষ্টির বিস্তৃত বর্ণালীর মধ্যে দিয়ে। প্রাবন্ধিক সিদ্ধার্থ ঘোষকে আমরা পেয়েছি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সঙ্গীত, ফটোগ্রাফি, খেলাধুলাসহ নানা বিষয়ের ওপর গভীর কিন্তু মনোজ্ঞ লেখালেখির মধ্যে দিয়ে। কথাসাহিত্যিক সিদ্ধার্থ ঘোষ যেন আরও অনন্য। বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পকে প্লটের নির্মেদ ব্যাঞ্জনায় কী করে আরও স্বাদু করে তোলা যায়, তার পরিচয় ওঁর লেখা গল্প আর উপন্যাসের মধ্যে থেকে পলকাটা হীরের দ্যুতি নিয়ে ঠিকরে বেরিয়েছে। গল্পের প্রয়োজনে কোনওভাবেই বিজ্ঞান চেতনার সঙ্গে আপোষ নয়, বরং প্লটকেই লেখার মুন্সিয়ানায় এমন জঙ্গম করে তোলা, যেখানে বিজ্ঞানের মূল সূত্র গল্পের কাঠামোর মধ্যে মিলেমিশে পাঠককে নাড়া দেবে ভেতর থেকে। এই সততা ছিল তাঁর লেখার গভীরে। তাই আজও পড়তে গেলে প্রাথমিক মুগ্ধতাটা অনুরণিত হয়ে ওঠে, যেমন হত সেই আশি বা নব্বইয়ের দশকে। কত কী যে এসেছে ওঁর গল্পের প্লটে তার ইয়ত্তা নেই। মন্ত্র মাহাত্ম্য (ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ী), ছোড়দার রেকর্ড (দক্ষিণ আফ্রিকা-অ্যাপার্থ্রেইড), সরোজ মামার শিশি (আল্ট্রাসোনিক ওয়েভ), গোল রহস্য (হলোগ্রাম), ঝন্টুমামার ছিপ (পেনি ফার্দিং সাইকেল আর তড়িৎ চৌম্বকীয় আবেশ), রং বেরঙের সমস্যা (ম্যাপ কালারিং) এমন কত কী যে শব্দের সাত রঙা বর্ণালীতে তিনি ধরতে পেরেছিলেন সেটা একটা পৃথক গবেষণার দাবী রাখে। কিশোর পাঠ্য গল্পেও বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সাম্প্রতিকতম রিসার্চের রেশ কীভাবে ধরে রাখা যায় গল্পের চলনকে একটুও ব্যাহত না করে, তার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ ওঁর লেখা গল্প আর উপন্যাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ওঁর লিখনশৈলীর জাদু। একটা সাধারণ আটপৌরেভাবে শুরু হওয়া গল্পকেও যা হঠাৎ প্লট ট্যুইস্টের তারসপ্তকে নিয়ে যেতে পারে। আবার বড়দের জন্য ওঁর লেখা বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প যেমন ‘মহাকাশের মণিমুক্তো’ পড়লে বোঝা যায় কল্পবিজ্ঞান শিশুতোষ এই ধারণাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে পাশ্চাত্যের হার্ড সাইফির সার্থক বঙ্গীকরণ ঘটেছিল তাঁর লেখায়। অন্তত এই ক্ষেত্রে ওঁর সমকালীন লেখকদের মধ্যে সার্থক উদাহরণ খুব বেশি নেই আর।
ওঁর লেখালেখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সত্তরের শেষ থেকে নব্বইয়ের শেষ এই সময়ে প্রকাশিত হওয়া অনেক ম্যাগাজিনের মধ্যে। এই সংকলনের সম্পাদকমণ্ডলী শ্রদ্ধাভরে চেষ্টা করেছেন সেই ছড়িয়ে থাকা লেখাগুলো একত্র করে আবার এই নতুন শতাব্দীর কিশোর বা নব্য যুবকদের কাছে শব্দের সেই মণিমুক্তোকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। বাংলা সাহিত্যের যে উত্তরাধিকারের দায়ভার আছে আমাদের সবার। এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত লেখালেখির মধ্যে আমাদের প্রথম কৈশোরের সেই অমিলন মুগ্ধতার ডালপালা আবার দুই মলাটের মধ্যে মেলে ধরবে নিজেকে। আমাদের আশা যে নতুন এই শতাব্দীতে আবার নতুনভাবে আবিষ্কৃত হবে অমিতাভ ঘোষ ওরফে বাংলা সংস্কৃতির এক অকালে হারিয়ে যাওয়া পলিম্যাথ সিদ্ধার্থ ঘোষ।
সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
.
প্রকাশকের কথা
বাংলায় ‘কল্পবিজ্ঞান’ শব্দবন্ধটি তৈরি করা ও ‘আশ্চর্য’ পত্রিকা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই ধারাটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন অদ্রীশ বর্ধন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সত্যজিৎ রায়-প্রেমেন্দ্র মিত্রদের উত্তরসূরি হিসেবে আরও এক ঝাঁক তরুণ লেখকেরা লিখতে শুরু না করলে বাংলা কল্পবিজ্ঞান আজকের জায়গায় পৌঁছত না। সেই তালিকার অন্যতম নাম সিদ্ধার্থ ঘোষ। লেখালেখির শুরু থেকেই তাঁর কল্পবিজ্ঞান গল্প-উপন্যাস পাঠকের মন জয় করে নিয়েছিল। পাশাপাশি রহস্য কাহিনিতেও তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। আসলে সিদ্ধার্থ ঘোষ এক বহুমুখী প্রতিভার নাম। বহু বিচিত্র বিষয়েই তাঁর কৌতূহল ও গবেষণা বাংলা সাহিত্যে তাঁর নামকে বিশিষ্ট করে রেখেছে। কিন্তু আকস্মিক প্রয়াণের পর কীভাবে যেন বিস্মৃতির আড়ালে চলে যেতে হয়েছে এই অনন্য সাধারণ প্রতিভাকে। তাঁর কাজ সম্পর্কে এক আশ্চর্য নির্লিপ্তি চোখে পড়ে। আশার কথা, সিদ্ধার্থকে নিয়ে আবার কাজ হচ্ছে। এই অবস্থায় কল্পবিশ্বের তরফ থেকে সিদ্ধার্থের কল্পবিজ্ঞানের রচনাগুলিকে একসঙ্গে প্রকাশ করার পরিকল্পনা নেওয়া হল। এটি প্রথম খণ্ড। এর পরে ধীরে ধীরে বাকিগুলিও খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হবে। এই বিরল প্রতিভাবান মানুষটির লেখাগুলি একত্রিত করে প্রকাশ করা সাহিত্যের অনুরাগী হিসেবে আমাদের একান্ত কর্তব্য বলে মনে করছি। এই কাজে সাহায্য করার জন্য সুজিত কুণ্ডু, বিশ্বদীপ দে, সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়, সুরজিৎ দাস এবং সমুদ্র বসুর কাছে আমরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। আশা করি, পাঠকরা আমাদের এই প্রয়াসকে আপন করে নেবেন।
Leave a Reply