তড়িৎ রহস্য – উপন্যাস – সিদ্ধার্থ ঘোষ
নিলয়ের দু-কানের মধ্যে যেন দুটো সাইলেন্সার-ফাটা ডবল-ডেকার বাস ঢুকে পড়েছে আর থেকে থেকে তাদের ইঞ্জিন গর্জে উঠছে।
অবশ্য সবটাই মনের ভুল। এখনও সে মেশিনটার বিকট আওয়াজের কথা ভুলতে পারেনি।
নিলয় পায়ের দিকে তাকাল। গোড়ালি ডুবিয়ে কলকল করে যেন খেলার ছলে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী। স্রোতের টানে পায়ের পাতায় সুড়সুড়ি দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে অজস্র সাদা-কালো নুড়ি।
জিপটার পেছনের বাঁ-দিকের চাকাটা মাঝনদীতে বসে গেছে। চা-বাগানের চারজন কুলি দয়া করে উদ্ধারকার্যে হাত লাগিয়েছে, এই যা ভরসা।
সুজন ইঞ্জিন স্টার্ট করে গিয়ার দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, মার ঠেলা!
সঙ্গে সঙ্গে ঘর-র শব্দে জিপের ফেঁসে-যাওয়া চাকাটা চরকির মতো বাঁইবাঁই করে ঘুরে উঠল–
নুড়ি-মেশানো কাদাজলের সে কী ফুলঝুরি! পেছনের লোকগুলো আপাদমস্তক ভিজে গেছে।
নাঃ–হবে না! ইঞ্জিন বন্ধ করে নেমে এল সুজন।
চাকাটা আরও বসে গেছে। সবই নিলয়ের চোখের সামনেই ঘটছে, কিন্তু তা সত্বেও ও কোনও ডিসিশন নিতে পারছে না। না পারার কারণটা অবশ্য খুবই জোরালো। এখনও সে একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। ডক্টর ডাকুয়ার পাওয়ার স্টেশনের ছবি ও শব্দ তাকে এখনও অন্ধ ও বধির করে রেখেছে।
এখন তবে কী করা যায়? সুজন প্রশ্ন করল। ঠেলাঠেলি করে কোনও লাভ হবে বলে মনে হয় না। এক ফোঁটা নড়ার নাম নেই। উলটে যেন জাঁকিয়ে বসছে।
তাহলে উপায়? এখনই তো পাঁচটা বাজে। আমাকে আজ ট্রেন ধরতে হবেই।
গাড়ি না-হয় আটকে থাকত। কিন্তু যাবারও তো অন্য কোনও উপায় নেই। নিলয় ভাবতে চেষ্টা করে। এই বালা নদী থেকে জয়ন্তী খুব দূরে নয়। জয়ন্তীতে একটা মিটার গেজের রেল স্টেশন আছে। কিন্তু হেঁটে জয়ন্তী পৌঁছাবার পর কি আর আলিপুরদুয়ার ফেরার ট্রেন পাওয়া যাবে?
একটা লরিটরিও যদি এসে পড়ত, টেনে তুলে নেওয়া যেত। সুজন সরবে চিন্তা করে। এই আশ্চর্য জায়গায় যাওয়া-আসার একটি যা রাস্তা, কিন্তু নদীতে সাঁকো নেই। বৃষ্টি হলেই সব বন্ধ। তা-ও আবার কী, এখানে হয়তো রোদ কটকট করছে, কিন্তু ওই দূরে নীল পাহাড়ে হয়তো বৃষ্টি হয়ে গেল আর অমনি তার ঢল নামল। গজগজ করতে থাকে সুজন। যাবার সময় এই নদীর বুকে এক ফোঁটা জল ছিল না। তেমন বৃষ্টি হলে তো ফেরার চেষ্টাই করা যেত না। নদীগুলোকে বনের মধ্যে সরু সরু রাস্তা বলেই ভুল হয়। সত্যি কথা বলতে, জল না থাকলে এই চারধারে গহন অরণ্য।
কাঠকুটো যায় না লরি করে? নিলয় প্রশ্ন করে।
শুধু লরি কেন! কত চা-বাগান রয়েছে চারপাশে। এক-আধটা ট্র্যাক্টরও তো দেখা দিতে পারত।
চা-বাগানের কুলিরা নিরুদ্যম হয়ে চলে গেছে ভেবেছিল ওরা। হঠাৎ দেখা গেল, তারা দলে আরও ভারী হয়ে ফিরে আসছে।
সুজন বলল, কিসসু লাভ হবে না। চাকায় কোনও গ্রিপই পাচ্ছে না। দেখছেন, চাকার হাব অবধি বসে গেছে। চোরাবালির গল্প শুনেছেন তো, এবার দেখুন চোরা নুড়ির কীর্তি।
কুলিদের সর্দার এক কোদাল হাতে নিলয়ের দিকে এগিয়ে এল, কুছু ভাববেন না বাবু, সব ব্যবস্থা করে দেব। অভি বাঁধ লাগাইয়ে দেব। জল থাকব না আর।
ওরা কোদাল হাতে নদীর উজানে আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে কোদাল দিয়ে নদীর বুকের ঢালটাকে পালটে দিতে লাগল। চেষ্টা করছে, যাতে জলের ধারাটা গাড়ির কাছ দিয়ে আর না যায়।
দেখে মনে হচ্ছে, এখানে গাড়িটাড়ি প্রায়ই ফাঁসে। নিলয় বলল।
কল যা করে রেখেছে, না ফেঁসে উপায় আছে? আর এ বেটারাও গাড়ি তুলতে ওস্তাদ। এই সুযোগে দিব্যি বেশ কিছু কামিয়ে নিচ্ছে। সুজন বলল। ওই দেখুন–এর মধ্যেই গাড়ির কাছে শুকনো ডাঙা বেরিয়ে পড়েছে।
সুজন খানিকটা আশা নিয়ে ফিরে গেল গাড়ির কাছে। কুলিরা গোছ গোছ লতাপাতা আর কাঠকুটো নিয়ে এসে সবাই মিলে গাড়িটাকে চাগিয়ে চাকার তলায় সেগুলো ঠেসে দিচ্ছে। এবার ইঞ্জিন চালু করে গিয়ার দিয়ে এগবার চেষ্টা করলে আর তার সঙ্গে গাড়ির পেছনে সবাই মিলে যদি ঠেলা লাগায় তাহলে মুশকিল আসান হতে পারে হয়তো।
জনা আটেক কুলির ঠেলা ও চিৎকারের মধ্যে ইঞ্জিনটা চালু হল। ঘোঁত করে গাড়িটা ছিটকে গেল সামনের দিকে। নদীর নরম বুকের ওপর দিয়ে টাল খেয়ে গর্জাতে গর্জাতে পাড়ের ওপর উঠে গেল। আনন্দে হাততালি দিয়ে চিৎকার করে উঠল কুলিরা। যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে গাড়িটার দিকে চেয়ে।
নিলয় হাসতে হাসতে আপন মনে বলে, ভালো জায়গায় গবেষণাকেন্দ্র বসিয়েছে ডক্টর ডাকুয়া। ট্রেন ছাড়া আর কোনও সংযোগব্যবস্থার ওপরেই নির্ভর করা যায় না। তা-ও জয়ন্তী স্টেশন থেকে গহন শালবন পেরিয়ে প্রায় মাইল তিনেক পথ।
পাড়ে উঠে প্যান্টের গোটানো পা-টা নামাতে নামাতে সুজন বলল, এদের তো কিছু বকশিস দেওয়া উচিত।
দাও-না–ক-জন আছে? গোটা দশেক টাকা দিয়ে দাও।
পকেট থেকে টাকা বার করে সুজন কুলি সর্দারকে হাত নেড়ে কাছে ডাকল। না, সর্দার হিসাবে ওকে কেউ চিনিয়ে দেয়নি। ওর ব্যবহারেই সেটা পরিষ্কার হয়েছে।
এক মুখ হেসে দু-হাত জোড় করল সর্দার।
না বাবুসাব–এসব নিতে পারব না।
কেন? সুজন অবাক।
আপনারা নতুন আদমি আছ না? বালা, চুনিয়া, ফাঁস খাওয়া–সব নদী এমনি আছে। কত গাড়ি ফাঁস খায়।
সর্দার পেছন ফেরার উপক্রম করছে দেখে সুজন নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ওরা বোধহয় ভাবছে আমরা চা-বাগানের সাহেবসুবো, তাই আরেকবার হাঁক লাগাল সে, ও সর্দার! শোন শোন, আমরা চা-বাগানের লোক নই। এ টাকাটা তো এমনি…
সর্দার কোদালটা মাটিতে নামিয়ে তার হাতলের ওপর হাতের ঠেস রেখে দাঁড়াল। বাবুসাব! পাঁচ-দশ রুপেয়ায় কাজ কী আছে। রাতবেলা মেয়েছেলে-বাচ্চার তবিয়ত যদি খারাপ থাকে, তবে তো তোমরা কিছুতে গাড়িমে নেবে না। ডর খাবে আমাদের। হা হা। করে হেসে উঠল লোকটা।
সুজন আর নিলয় মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। সর্দার আবার বলে, কারও কাছ সেই নেবে না আমরা। আমরা জানি। পুরানা ফ্যাক্টরিতে আসলে না তোমরা?
পুরানো ফ্যাক্টরি? হঠাৎ নিলয়ের মনে পড়ে যায়, ডক্টর ডাকুয়ার শক্তিকেন্দ্রে একটা চিমনিসুদ্ধ পোডড়া কারখানা চোখে পড়েছিল। জিজ্ঞেস করতে উনি বলেছিলেন, ওখানে একটা চুনের ভাঁটি ছিল। বহুদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। সুজন বলল, হ্যাঁ, আমরা ডাকুয়া সাহেবের কারখানায় গিয়েছিলাম।
সর্দার এবার ঘাড় নাড়ে নিঃশব্দে। কিছু একটা বলতে চাইছে। সময় নেয় নিলয়। বৃদ্ধ নিচু গলায় আস্তে আস্তে বলে, ভালো না ডাকুয়া সাব। ভালো না।
নিলয় জিজ্ঞেস করে, কেন, ভালো না বলছ কেন?
বাবু, এখানে এক ঝরনা ছিল। গরম পানি ঝরনা। ওই পানি ঠান্ডা করে খায় কুলি লোক সব। ভালো পানি। ডাকুয়া সাব জমি নিল, মেশিন বসাল–বাস ঝরনা বন্ধ। পাশে একটা নদী ছিল, তাতে বাঁধ বসাল, সে-ও পানি ভি বন্ধু। খাবার পানি বাবুসাবা!
ঠিকই বলেছে সর্দার। অনেক খবর রাখে এরা।
.
ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি ডক্টর ডাকুয়ার পুরো স্কিমটাই নিলয়কে পাঠিয়ে দিয়েছে। মনে পড়ছে, তার মধ্যে একটা পাহাড়ি জলধারাকে কুলিং ওয়াটার হিসাবে ব্যবহার করার অনুমতি চাওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনা তো এখনও অনুমোদিত হয়নি। নিলয় জিজ্ঞেস করল, কবে থেকে জল বন্ধ হয়েছে?
ছয় মাহিনা তো হবে।
তোমরা আপত্তি করনি?
কিছু হয় না বাবু। তুরি বাগানের মালিকের সঙ্গে দোস্তি সাহেবের। বলল, বাগানের গাড়ি আরও পানি দেবে। ঝরনা ডাকুয়া সাব কিনে নিয়েছে।
ঝরনা কিনে নিয়েছে মানে?
ঝরনা যেখান থেকে উঠিয়েছে, সেই মাটি নিয়ে নিয়েছে ডাকুয়া সাব।
তা-ই নাকি?
নিলয়ের আরও অনেক কথা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল। ডক্টর ডাকুয়ার ওখানে কতজন কাজ করে, তারা কোথায় থাকে। গবেষণাকেন্দ্র ঘুরে দেখার সময় প্রশ্নটা সে করেছিল। কিন্তু… ডক্টর ডাকুয়ার উত্তরটা অক্ষরে অক্ষরে স্মরণ করতে পারে নিলয়।
মিস্টার সেন! আমি গভর্নমেন্টের কাছে একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। সেটা গ্রহণ করলে গভর্নমেন্ট যেমন উপকৃত হবে, তেমনি আমারও কিছু অর্থের সুরাহা হবে। আমার পরিকল্পনা টেকনিক্যালি কতটা সাউন্ড–আমি আমার দাবি সমর্থন করতে পারছি কি না, সেটা যাচাই করার জন্যে গভর্নমেন্ট আপনাকে টেকনিক্যাল ম্যান হিসেবে এখানে ভাড়া করে পাঠিয়েছে। দয়া করে আপনার এক্তিয়ারের বাইরে পা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করবেন না। আপনাকে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, আমায় পাঠানো চুক্তির এক নম্বর শর্ত ছিল, আমার এই আবিষ্কার সম্বন্ধে কোনওরকম অনুসন্ধান চালানো চলবে না। এটা আমার ট্রেড সিক্রেট, কারণ এখনও আমি শেষ সাফল্য অর্জন করতে পারিনি।…।
সুজনের গলা কানে আসে নিলয়ের, চলুন, আর দেরি করা ঠিক হবে না।
ঘড়ির দিকে তাকিয়েই চমকে ওঠে। সর্দারের হাতটা চেপে ধরে বলে, আজ চলি। আবার নিশ্চয় দেখা হবে। ডক্টর ডাকুয়ার এখানে আসতেই হবে আমায়। দেখি, ঝরনার জলের ব্যাপারে যদি কিছু করতে পারি।
নিলয় জিপে পা দিতেই সর্দার বলে উঠল, হুঁশিয়ার সাব। ঝরনার পানি নিতে আমাদের চারজন মরে গেল। ইলেকট্রিক লাগানো। সাবধান বাবুসাব। হাত তুলে নমস্কার করে সর্দার পেছন ফিরল।
শালবনের সমুদ্র ছুঁড়ে জিপটা এগিয়ে চলেছে। ঠান্ডা ঠান্ডা ভিজে স্যাঁতসেঁতে হাওয়া। নিলয় নজর রাখছে আশপাশে ছুটন্ত ঝোঁপঝাড়-লতা-আগাছার দিকে। এসব জায়গায় যে কোনও সময়ে হাতির দর্শন মেলে। আর স্পটেড ডিয়ার তো মেলেই।
নিলয় সুজনের দিকে মুখ ফেরাল, দেখ সুজন, এ অঞ্চলের কাউকেই আমি তেমন চিনি না। কিন্তু… এই ডক্টর ডাকুয়ার ব্যাপারে আমি এক-আধজন স্থানীয় লোকের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। তুমি তো এখানকারই লোক, তাই না?
আজ্ঞে হ্যাঁ তা বলতে পারেন। অবশ্য এ অঞ্চলে খুব কমই এসেছি। আমার বাড়ি কোচবিহার। একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আপনি তো গভর্নমেন্টের লোক, তা-ই না?
ঠিক তা নয়। আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট আমাকে ডক্টর ডাকুয়ার গবেষণাকেন্দ্রে পাঠিয়েছে ইন্সপেকশনের জন্যে।
কেন?
উনি গভর্নমেন্টের সাহায্য চেয়েছেন। বিরাট একটা শক্তিকেন্দ্র তৈরি করতে চান। এটা জানই তো, সারা দেশে কীরকম শক্তি সংকট চলেছে। ডক্টর ডাকুয়া নাকি বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। এত সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলেছেন উনি, যা যে কোনও বিজ্ঞানীকে তাজ্জব করে দেবে। আমি তো না-দেখা অবধি বিশ্বাসই করতে পারিনি। অবশ্য দেখেও…
তার মানে ডক্টর ডাকুয়া যা বলছেন, সব সত্যি?
হ্যাঁ, অবিশ্বাস করার উপায় নেই। নিজের চোখে দেখে এসেছি। কিন্তু তবু যেন একটা সন্দেহ, মানে একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে। কী করে বোঝাব ব্যাপারটা জানি না। আসলে ডক্টর ডাকুয়া যদি শুধু একজন বিজ্ঞানী হতেন তাহলে তাঁর পায়ে মাথাটা ঠেকিয়ে রাখতে আমি একটুও দ্বিধা করতাম না। কিন্তু উনি শুধু বিজ্ঞানীই নন, ধুরন্ধর ব্যাবসায়ী। তাঁর আবিষ্কার সম্বন্ধে একটি কথা জানাবেন না–ট্রেড সিক্রেট।
তাহলে গভর্নমেন্টই বা ওঁর আবদার মেনে নিচ্ছে কেন? চাপ দিতে পারেন তো আপনারা? সুজন গাড়ির গিয়ারটা বদল করে বাঁক নেয়। অনেকক্ষণ থেকেই মেঘটা আকাশ জুড়ে কালো আক্রমণ চালাচ্ছিল। এবার টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
গাড়ির গতি কমতেই সুযোগ নিল নিলয়। জিপ মানেই মেঠো গাড়ি। ইচ্ছে হলেই হাত চালিয়ে কাঁচ তুলে দেওয়া যায় না। হু হু হাওয়ার ঝাঁপটা লাগে। তার মতো চেন স্মোকারও সিগারেটের মুখে দেশলাইয়ের আগুন ছোঁয়াতে পারেনি। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, প্রেশারটা তো সে-ই দেয় সুজন, যার বেশি অ্যাডভান্টেজ। বর্তমানে সারা ভারতে বিদ্যুৎশক্তির যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তাতে ডক্টর ডাকুয়ার প্রস্তাব অত্যন্ত লোভনীয়। তাঁকে আমরা যতই সন্দেহ করি, অগ্রাহ্য করার কোনও উপায় নেই। বিশেষ করে আমি নিজে দেখে এসেছি সত্যিই তাঁর আবিষ্কার বিস্ময়কর–তাঁর দাবি সম্পূর্ণ ন্যায্য। ডক্টর ডাকুয়া খুব ভালো করেই জানেন, আমরা তাঁর আবিষ্কারের প্রতি চোখ বুজে বসে থাকতে পারব না। শর্তটা সেই জন্যেই তিনি এইভাবে চড়িয়ে দিতে পেরেছেন–তাঁর আবিষ্কার সম্বন্ধে কোনওরকম অনুসন্ধান করা চলবে না।
তাহলে আর কিছুই করার নেই বলুন? আপনি তো বলছেন, ডক্টর ডাকুয়ার সাহায্য পেলে দেশের উন্নতি হবে।
বৃষ্টিটা আরও চেপে এল। উঁচু উঁচু গাছের ডালপালায় বসে পাতাপাতালিরা এতক্ষণ মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের উঁকিঝুঁকি মারার তালে তাল মিলিয়ে রাস্তার বুকে আলোছায়ার নকশা ছুঁড়ে দিচ্ছিল। এবার রাস্তাটা পুরোপুরি বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। তার ওপর বৃষ্টির জল রাস্তাটাকে একেবারে পালিশ করে দিয়েছে। অ্যাকসিলেটারের ওপর পায়ের চাপ হালকা করে স্পিডোমিটারের কাঁটাটাকে আরও নামিয়ে আনতে বাধ্য হয় সুজন।
দেখ সুজন, এদিক থেকে দেখলে করবার কিছু নেই। গভর্নমেন্টকে আমি রেকমেন্ড করতে বাধ্য। আমার ইন্সপেকশন রিপোর্ট অনুযায়ী ডক্টর ডকুয়া সরকারি অনুমোদন পেয়ে যাবে, কিন্তু এইখানেই আমি ব্যাপারটাতে দাঁড়ি টেনে দিতে রাজি নই। আজ হোক, কাল হোক, সব রহস্য যতদিন না উদঘাটন হচ্ছে, চোখ খোলা রাখা বিশেষ দরকার। আমি অন্তত তা-ই মনে করি।
কুলি সর্দার যে বলল ঝরনার জল শুকিয়ে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে কিছু…
মনে হয় না কিছু করা যাবে। বৈদ্যুতিক প্লান্টের মেশিনারির জন্য কুলিং ওয়াটার–মানে ঠান্ডা জলের একটানা সরবরাহ প্রয়োজন।
কিন্তু ওরা যে বলল, ঝরনা থেকে গরম জল বেরত?
হ্যাঁ। কিন্তু গরম মানে নিশ্চয় উষ্ণ। তাতেও নিশ্চয় কাজ চলে যায়। তবু একবার রিকোয়েস্ট করে দেখব ডাকুয়াকে। যদি গভীর নলকূপের পাম্প বসাবার প্রস্তাব মেনে নেয় তো ভালো। এমনিতেও পাহাড়ি নদী বা ঝরনার থেকে আর কত জল পাবে!
গাড়িটা হঠাৎ রাস্তার একেবারে বাঁ ধারে সরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কী হল?
না–বৃষ্টির ছাঁটে উইন্ডশিল্ড দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ওয়াইপারটাও গন্ডগোল করছে। দেখি, যদি কচুপাতা পাওয়া যায়।
সুজন ছাতা হাতে নেমে পড়ল।
কচুপাতা? অবাক হয় নিলয়। কচুপাতার রহস্যটা দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে থাকে। রাস্তার পাশ থেকেই একটা কচুপাতা ছিঁড়ে নিয়ে চলে এসেছে সুজন। বাঁ হাতে ছাতা, বাঁ পা-টা ফুটবোর্ডে, শরীরটা বেঁকিয়ে ডান হাতে করে কচুপাতা দিয়ে কাঁচটা ঘষতে শুরু করে।
নিলয় ভেতর থেকে বলে ওঠে, বৃষ্টি তো থামেনি, কতবার এরকম করে ঘষবে?
কচুপাতাটা ফেলে দিয়ে ছাতা মুড়েই এক লাফে ভেতরে ঢুকে টেনে তুলতে তুলতেই বলল, আর ঘষতে হবে না। পাতাটা তেলতেলে তো, এরপর আর কাঁচে জল ধরবে না।
বাঃ–চমৎকার বুদ্ধি তো।
সুজন হাসতে হাসতে ফার্স্ট গিয়ারে ঠেলে দিয়ে ক্লাচ ছাড়ল। জংলি ড্রাইভারদের অনেক কিছু জানতে হয়। কলকাতার পাইলটরা যতই মস্তানি করুক, এসব জায়গায় খুব সুবিধা করতে পারবে না। ভালো কথা, ক-টা বেজেছে দেখুন তো, ট্রেন ক-টায়?
এখনও ঘণ্টা দুয়েক সময় আছে।
ওহ্ ঢের দেরি। রথ দেখা, কলা বেচা, দুই হবে। রাজাভাতখাওয়ায় আমরা একবার নামব। ওখানে রিটায়ার্ড ফরেস্ট রেঞ্জার সাহেব সদ্য দুটো চিতার বাচ্চা ধরেছেন। দেখার মতো। তা ছাড়া ওঁর কাছ থেকে আপনি ডক্টর ডাকুয়ার সম্বন্ধেও খোঁজ পেতে পারেন। বহুকাল যাবৎ এ তল্লাটের বাসিন্দা। এ অঞ্চলের ইতিহাস ওঁর নখদর্পণে। তাইয়ের বনজঙ্গলের ওপর ওঁর এমন ভালোবাসা
এইরকম একজনের সঙ্গেই তো কথা বলতে চাইছিলাম। কী নাম ভদ্রলোকের?
অমিয় জোয়ারদার।
.
বনমহল। রাজাভাতখাওয়ার ভূতপূর্ব ফরেস্ট রেঞ্জার অরণ্যপ্রেমিক অমিয় জোয়ারদারের বাড়ি। লম্বা লম্বা কাঠের ঠ্যাঙের ওপর ভর রেখে দোতলা বাড়িটা যেন জলটুঙির মতো ডিঙি মেরে তরাইয়ের ভিজে মাটির ছোঁয়াচ বাঁচাচ্ছে। রহস্য আর অন্ধকারের রাজত্ব তরাইয়ের গহন অরণ্যের কিনারায় সমতলভূমিকে সামনে নিয়ে তার তিনদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছ-সাতটা বাড়ি। এ চত্বরের সব বাড়িই এমনি। কাঠের দেওয়াল, কাঠের মেঝে, কাঠের ছাদ, আর একেবারে মাথার ওপর ঢেউ-খেলানো রেড অক্সাইড মাখানো টিনের চাদর। দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা বাইরে থেকেই চোখে পড়ে। একতলার বারান্দা থেকে দোতলার বারান্দায় উঠে শেষ হয়েছে। তিনটে চেয়ার টেনে ওরা বারান্দায় বসেছিল। পেছনে কাঠের খাঁচাটার মধ্যে ছ-মাসের দুটো শিশু চিতা সমানে টহল দিয়ে। বেড়াচ্ছে গরাদের সঙ্গে গা ঠেসিয়ে। আকারে বেড়ালের চেয়ে বড় নয়, কিন্তু হাঁটায়-চলায়, থমকে দাঁড়ানোয় বাঘের বাদশাহি ছন্দ। জোয়ারদারকে সব বুঝিয়ে বলছিল নিলয়। জোয়ারদারের রোদে সেঁকা চেহারার মধ্যে প্রশান্তি এবং বলিষ্ঠতার অপূর্ব সংমিশ্রণে প্রথম দর্শনেই মনে হয়, একটা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে আসা যাবে। বিশেষ করে লক্ষণীয় তাঁর চোখ দুটো। ষাটের কোঠাতে পা দিয়েও তাঁর দৃষ্টি থেকে যৌবনের কৌতূহল বিদায় দেয়নি। চেয়ারটার কানায় এগিয়ে এসে বসেছেন, সামনে ঝুঁকে ভুরু কুঁচকে অনুধাবন করতে চাইছেন পুরো ব্যাপারটা। হঠাৎ পেছনের খাঁচা থেকে গরগর করে উঠল চিতার বাচ্চা দুটো। নিলয় ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, একটা ফ্রক পরা মেয়ে নিচু হয়ে খাঁচার দরজাটা ওপরে টেনে চিতার ছানা দুটোকে বার করে এনেছে। দু-হাতে দুটোকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে রেখেছে। দাঁত খিঁচিয়ে দুটোতে গরগর করছে ছাড়া পাবার জন্যে।
আহ্ রানু–আবার এখন এদের বার করলে কেন? জোয়ারদার বলে উঠলেন। বুঝলেন, এই আমার ছোট নাতনি। ওই এ দুটোকে দেখাশোনা করে।
কামড়েটামড়ে দেয় না? দাঁত ওঠেনি? নিলয় জিজ্ঞেস করল।
দাঁত ওঠেনি আবার? ধরে দেখুন না। রানুই পারে ওদের সামলাতে। তাহলেও ছ-মাস হয়ে গেল, মাংস খেতে শুরু করেছে, আর এত ভালোবাসা না দেখানোই ভালো।
রানু একগাল হেসে কাছে এসে দাঁড়াল।
ইস–ছ-মাস তো কী? আগের বার তো এক বছর রেখেছিলাম। আমার পাশে শুইয়ে ঘুম পাড়িয়েছি। তবে এই দুটো না ভারী বিচ্ছু! অ্যাইফের দাঁত বার করা। দেখাচ্ছি মজা!
নিলয় চেয়ার থেকে উঠে চিতার বাচ্চার মাথায় হাত দিতেই সেটা ফাঁস করে উঠল। থাবাটা বাড়িয়ে আঘাত করার চেষ্টা করছিল।
রানু ধমকে উঠল, চোপ, ওরকম করতে নেই। জান, এরা কিন্তু খুব কথা শোনে আমার। আর কারও কথা শোনে না।
তা-ই তো দেখছি! আসলে ওরাও তো তোমার মতো ছোট্ট ভাই বোধহয়, তোমার কথা বুঝতে পারে। তাই না? রানুর গান টিপে বলল নিলয়।
আমি মোটেই ছোট নই। রানু ভুরু কুঁচকে প্রতিবাদ করল।
যা–যা–নিয়ে যা এখন। বিরক্ত করিসনি।
জোয়ারদার বললেন, বসুন নিলয়বাবু। কথাটা সেরে নেওয়া যাক। আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
রানু যেতে যেতেই বলল, রাগ কর আর যা-ই কর এবার আমি এ দুটোকে বেচতে দিচ্ছি না, বুঝলে?
রানুর দিকে চেয়েই নিলয় দাঁড়িয়ে রইল। বাঁ হাত চুলের মুঠি গোছা করে ধরে ভুরু কুঁচকে বিড়বিড় করে বলে উঠল, আশ্চর্য! এই চিতাবাঘের ডাকটা যেন ভীষণ চেনা চেনা।
কী ভাবছেন নিলয়বাবু? জোয়ারদারের প্রশ্নে সংবিৎ ফেরে নিলয়ের।
নাঃ-হঠাৎ আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। এই চিতার বাচ্চার গর্জনটা শুনে মনে হচ্ছে…, মানে একটা সন্দেহ! এর কোনও ভিত্তি নেই যদিও! কেটে কেটে উচ্চারণ করে নিলয়। চিতার ডাক শুনে হঠাৎ আমার ডক্টর ডাকুয়ার পাওয়ার প্লান্টের বিকট গর্জনের কথা মনে পড়ে গেল। কোথায় যেন একটা মিল রয়েছে। একসঙ্গে শ-তিনেক চিতা চেঁচালে ওইরকম শব্দ হতে পারে বোধহয়!
মাই গড!
জোয়ারদার চায়ের কাপটা ঠক করে নামিয়ে রাখলেন নিচু টেবিলটার ওপর। তাঁর কণ্ঠে উত্তেজনা ভিড় করে, আগের বার আমার ধরা চিতাটা তো ডক্টর ডাকুয়াই কিনেছেন।
তা-ই নাকি?
শুনলেন না, এই যে রানু বলছিল–এবার আর বিক্রি করতে দেবে না।
কতদিন আগে বেচেছিলেন?
তা ধরুন, বছর দুয়েক তো নিশ্চয়ই হবে। তার মানে, সেটা এখন ফুল ফ্লেজেড, প্রাপ্তবয়স্ক চিতা। আচ্ছা–একটা কথা বলুন তো। উনি বিদ্যুৎ সরবরাহ করবেন নামমাত্র দরে–আপনি বলছেন, এত কম জ্বালানি ব্যবহার করে এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা নাকি বৈজ্ঞানিক বিচারবুদ্ধিতে অসম্ভব–সবই তো শুনলাম আপনার মুখে। কিন্তু কথা হচ্ছে, আপনি কি এখন নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেন যে পুরো ব্যাপারটাই বুজরুকি? একটা ধাপ্পা? জোয়ারদার উঠে দাঁড়ায়।
নিলয় ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলে, সেইখানেই তো ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। আমিও এসেছিলাম সম্পূর্ণ অবিশ্বাস নিয়েই। সত্যি বলতে কী ডাকুয়া যা দাবি করেছেন তা থার্মোডিনামিক্স শাস্ত্রের মতে অসম্ভব। প্রথমত জ্বালানি হিসেবে উনি ডিজেল ব্যবহার করছেন, তার মানে ডিজেল পুড়িয়ে তাপশক্তি পাবেন। এই তাপশক্তিকে পুরোপুরিভাবে বিদ্যুৎশক্তিতে পরিবর্তিত করা অসম্ভব। খানিকটা অপচয় হবেই। এই অপচয় আরও বেশি হয়, যদি তাপশক্তিকে সরাসরি বিদ্যুৎশক্তিতে পরিবর্তিত করা যায়। যেমন ধরুন একটা ডিজেল ইঞ্জিনের কথা। এখানে ডিজেল জ্বালানো তাপ থেকে ইঞ্জিনের চাকা ঘুরে চলে এবং সেই চাকা আবার ডায়নামো যন্ত্রের চাকা ঘোরায়। ডায়নামো যন্ত্র তখন বিদ্যুৎ দেয়। ডক্টর ডাকুয়ার ওখানে আমি যা দেখেছি, তাতে মনে হয়, ওঁর পাওয়ার প্লান্ট এই পদ্ধতিতেই চলে। তাই তো বলছি, শুধু যন্ত্রবিজ্ঞানেই নয়, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ক্ষেত্রেও তিনি নিশ্চয় বিস্ময়কর কিছু আবিষ্কার…
না–না জোয়ারদার বাধা দেন নিলয়কে, আপনি নিজের চোখে কী দেখেছেন তা-ই জানতে চাইছি।
করোগেটের শিটের ছাউনিওয়ালা একটা লম্বা কারখানাঘর। গ্রামের এইখানে নিয়ে যায় আমায়। তবে পুরো কারখানা ঘুরিনি। আমি শুধু তার কন্ট্রোলরুমটাই দেখতে পেয়েছি। কোনও যন্ত্রপাতি-মেশিনারি দেখতে দেয়নি। কোনও প্রশ্ন করারও অধিকার ছিল না। তবে এটা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, ডক্টর ডাকুয়া আমার সন্দেহ মিটিয়ে দিয়েছেন। কন্ট্রোলরুম জুড়ে অসংখ্য মিটার, গেজ আর ইলেকট্রিক সুইচ গিয়ার। তামার পাইপের কুণ্ডলী। লাল সবুজ আলোর দপদপানি। বিশাল আয়োজন। আমি ভেতরে ঢুকতেই উনি আমাকে নিয়ে গেলেন ফুয়েল ইন্ডিকেটর মিটারের সামনে। এই মিটারের কাঁটা দেখে বোঝা যায়, ট্যাঙ্কে কত লিটার তেল আছে। প্লান্ট চালু করার আগেই আমি মিটারের রিডিং দেখে টুকে রাখলাম, এত লিটার ডিজেল রয়েছে। এরপর উনি আমাকে এনার্জি মিটারের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমি একটা স্টপওয়াচ চেয়ে নিলাম। উনি চলে গেলেন প্লান্ট চালু করতে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বিকট গর্জনে চারপাশ যেন ফেটে পড়ল। সে এক আশ্চর্য আওয়াজ। সারাটা ঘর থরথর করে কাঁপছে–এত ভাইব্রেশন। এই আওয়াজ আর কাঁপুনি থেকেই আমার ধারণা হয়েছিল, এটা নিশ্চয় এক ধরনের জেনারেটর, যেখানে তাপ থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে না। থার্মো-মেকানিক্যাল সিস্টেমেই সেটা করে হচ্ছে। কিন্তু আধ ঘণ্টা রিডিং নিয়ে ফুয়েল ইন্ডিকেটরের সামনে গিয়ে চক্ষুস্থির। এই আধ ঘণ্টা যে হারে বিদ্যুৎ উপাদন করা হয়েছে, সে তুলনায় ডিজেল তো প্রায় খরচই হয়নি বলতে হবে। খুব কম করে হলেও, আমাদের এখানকার সবচেয়ে এফিশিয়েন্ট জেনারেটরেও এর পাঁচ গুণ বেশি ডিজেল লাগত। তাজ্জব–একেবারে তাজ্জব কাণ্ড!
জোয়ারদার দু-হাতে চোখ ঢেকে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসলেন। নিলয় আবার বলতে শুরু করে, এটাতো গেল একটা দিক। এবার অন্যদিকটা ধরুন। ডক্টর ডাকুয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী আমরা মাসে একশো ওয়াগন করে ডিজেল পাঠাব। জয়ন্তী স্টেশন পর্যন্ত যাবে। ওখানে একটা অয়েল স্টেশন থেকে পাইপলাইনে করে সেই তেল নিয়ে যাওয়া হবে তাঁর প্লান্টে। তা ছাড়া সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা, বিদ্যুৎ সরবরাহের। তার জন্য একটা সাব স্টেশন খোলা হবে জয়ন্তীতে। সাব-স্টেশন থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইন টানবার দায়িত্বটাও আমাদের। উনি শুধু সাব-স্টেশন অবধি নিজে কেবল, মানে তার টানবেন। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে পুরো ব্যাপারটাই ধাপ্পা, তাহলে এত কম দরে ইউনিট বেচে তাঁর লাভটা কী? সে তো বিরাট লোকসান।
কেন? উনি নিশ্চয় গভর্নমেন্টের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা ধার নেবেন পুরো প্লান্টটা বসানোর জন্যে? সেই টাকাটা আত্মসাৎ করে দিয়ে দু-বছর বাদে লোকটা যদি উধাও হয়ে যায়, তখন?
নিলয় হাসতে হাসতে বলে, না, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। প্লান্ট বসানোর জন্য তিনি অগ্রিম টাকা নিচ্ছেন না। শুনেছি কোনও এক চা-বাগানের মালিক নাকি ইনভেস্ট করছেন টাকাটা। ডক্টর ডাকুয়া বলেছেন, পাওয়ার সাপ্লাই শুরু হবার পর তিনি অ্যাডভান্স পেমেন্ট হিসেবে শুধু এই টাকাটা কিস্তিতে কিস্তিতে শোধ করবেন। হিসেব করে দেখেছি, উনি যদি সত্যিই ধাপ্পা দেন তাহলে এই পদ্ধতিতে কোনওভাবেই লাভবান হতে পারেন না। সত্যি বলতে কী এইরকম নানান চিন্তা করে গত এক বছর ধরে আমি ক্রমাগত ডক্টর ডাকুয়ার সঙ্গে পত্রালাপ করে আসছি। সব দিক দিয়ে নিঃসন্দেহ হয়েই আমি প্লান্ট পরিদর্শনে এসেছি।
জোয়ারদার নিচু গলায় বললেন, সব ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না, তা-ই তো? তাহলে আরও একটা খবর দিই, আপনার অস্বস্তিটা আরেকটু বাড়ুক। ডক্টর ডাকুয়ার ওখানকার একজন ইলেকট্রনিক ও একজন মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারকে তিন মাস আগে বনের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। বাঘে টেনে নিয়ে গিয়েছিল তাদের। সম্ভবত চিতাবাঘ! তখন শুনেছিলাম, ওরা নাকি শিকারে বেরিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছিল। কথাটা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম, কারণ এত কাছে থেকেও শখের শিকারি হিসাবে তাদের কথা আমি কোনওদিন শুনিনি।
অরণ্যপ্রেমিক বলুন, শিকারি বলুন, পশুপ্রেমিক বলুন–এ তল্লাটে বনজঙ্গলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন কেউ নেই, যার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। জোয়ারদার কথা থামিয়ে নিলয়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
রিয়্যালি–সত্যি বলতে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এরকম একটা… নিলয় পকেট থেকে আবার সিগারেট বার করে। নিচ থেকে জিপের কর্কশ হন ধমকে উঠে সময় ফুরিয়ে আসার কথা খেয়াল করিয়ে দেয়।
নিলয় উঠে দাঁড়ায়। মিস্টার জোয়ারদার, আজ আর বলার উপায় নেই। তবু দুটো প্রশ্ন না করে যেতে পারছি না। মিস্টার ডাকুয়ার ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে আপনি কতটুকু জানেন? আর ওঁর এই গবেষণাকেন্দ্রই বা কতদিনের?
ডক্টর ডাকুয়ার বাবা ছিলেন কোচবিহারের ডাক্তার। তাঁকে অনেকেই চিনত, ডক্টর ডাকুয়া কলকাতা থেকেই পড়াশোনা করেছেন। যত দূর শুনেছি উনি জিয়োলজিস্ট ভূতাত্ত্বিক–এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন। বছর তিনেক হল, জয়ন্তীর কাছে বিরাট এলাকা জুড়ে তিনি গবেষণাকেন্দ্র খুলেছেন। ওখানে যারা কাজ করে সবাই বিদেশি। মানে ভিন প্রদেশের লোক। কারিগররা পর্যন্ত। একটিও স্থানীয় অধিবাসী নেই। এই নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনাও হয়েছে। সবার ধারণা, উনি এই অঞ্চলে নিশ্চয় কোনও খনিজের সন্ধান পেয়েছেন বা খোঁজ করছেন। অবশ্য এখন যা শুনছি, তাতে সে ধারণার কোনও ভিত্তি নেই বোঝা যাচ্ছে।
নিলয়ের পেছন পেছন সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকেন জোয়ারদার। নিলয় পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে বাড়িয়ে দেয়। অমিয়বাবু, আপনি স্থানীয় লোক। অনেকের সঙ্গে চেনাজানা আছে। ডক্টর ডাকুয়া সম্বন্ধে কোনও খবরাখবর পেলে আশা করি, আমাকে জানাতে ভুলবেন না।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি নিজে যাব ডাকুয়ার ওখানে। যেমন খবর জোগাড় করতে পারব, সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেব! সবচেয়ে সুবিধে হচ্ছে জয়ন্তী স্কুলের হেডমাস্টার আমার বিশেষ বন্ধু। তাঁর কাছ থেকে নিশ্চয় কিছু কিছু ক্লু পাব।
নিলয় জিপের ফুটবোর্ডে একটা পা রেখে দু-হাতে জোয়ারদারের হাত চেপে ধরল, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে আমি মনে মনে বেশ খানিকটা শান্তি পেয়েছি। ডকুয়ার পাওয়ার প্লান্ট সম্বন্ধে আমি গভর্নমেন্টের কাছে গ্রিন সিগনাল পাঠিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু ফাইলটা ভোলাই থাকবে, যাতে যে কোনও সময়ে পুনর্বিবেচনার সুযোগ থাকে।
হ্যাঁ–সেই ভালো! আপাতত তা-ই করুন। তা ছাড়া সরকারি অনুমোদন পাবার পর ডক্টর ডাকুয়ার সতর্কতাও কিছুটা শিথিল হবে। তখন রহস্যভেদ করার সুযোগও পাওয়া যাবে আশা করি।
জিপটা যতক্ষণ না চোখের আড়াল হল, জোয়ারদার দাঁড়িয়ে ছিলেন।