২. অলটারনেটিভ এনার্জি

কলকাতায় ফিরেই নিলয় অলটারনেটিভ এনার্জি ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের সেক্রেটারির কাছে ইন্সপেকশন রিপোর্ট পাঠিয়ে দিল। রিপোর্টের মধ্যে কোথাও সে কোনও সন্দেহজনক ঘটনার কথা উল্লেখ করেনি।

ব্যাপারটাকে যথাসম্ভব গোপন রাখা প্রয়োজন। বর্তমানে করাপশন রোগে তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি দেশ ধুকছে। দুর্নীতি আসলে দারিদ্ররই ছায়াসহচর। ঘুষ নামে একটা ভয়ংকর মাকড়সা দারিদ্রের অন্ধকারে অদৃশ্য জাল বুনছে সারা ভারত জুড়ে। এই জালের কোন কোণে কে যে ফেঁসে আছে, বোঝা মুশকিল। ডিপার্টমেন্টের মধ্যে ডক্টর ডাকুয়ার লোক। থাকতে পারে–ইনফর্মার। প্রতিরক্ষা দপ্তরের কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থাকে যেখানে এক ডোজ ঘুষ দিয়েই আচ্ছন্ন করে ফেলা যায়, টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্ট কোন ছার। অথচ এই মুহূর্তে ডক্টর ডাকুয়াকে কোনওভাবেই সজাগ করে দেওয়া চলবে না। তাহলে সে আরও সতর্ক হয়ে যাবে। নিলয় ভেবে দেখল, এ অবস্থায় ডক্টর মজুমদারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করাটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। শুধু বড় বিজ্ঞানীই নয়–সাচ্চা মানুষ ডক্টর মজুমদার। তাঁর কাছে সব কথা খুলে বলা যায়। কোনও দ্বিধা করার কারণ নেই।

প্যাড আর কলম নিয়ে বসে পড়ল নিলয়। ডক্টর মজুমদার কলকাতায় এলে তাঁর সঙ্গে নিভৃতে আধ ঘণ্টা আলোচনা করার জন্য সুযোগ পেতে চায়। ততদিন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করার জন্য হাইটেনশন লাইন টানা ও সাব-স্টেশন বসানোর কাজ চলতে থাকুক! সন্দেহের কথা চিঠিতে খুলে লিখল না নিলয়, তবে সুক্ষ্ম একটা ইঙ্গিত দিয়েছে।

আপনার কাছে আমার একটা ব্যক্তিগত অনুরোধ আছে। সরকারি তরফ থেকে সবরকম সহযোগিতা করা হোক। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা এতই আনইউজুয়াল–অদ্ভুত যে। ত্রৈমাসিক একটা চেকিং-এর–একটা ইন্সপেকশনের ও পর্যালোচনা করার ব্যবস্থা রাখা দরকার। অর্থাৎ একেবারে ব্ল্যাঙ্ক চেক না দেওয়াই ভালো। ডিজেলের সরবরাহটাও দফায় দফায় হলে ভালো হয়। ধরুন, মাসে মাসে কিংবা তাতে যদি পরিবহনের অসুবিধা হয় তো তিন মাস অন্তর। ডক্টর ডাকুয়া কিন্তু সারা বছরের ডিজেল একসঙ্গে সরবরাহ করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। কেন এইসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থার প্রয়োজন, সে কথা দেখা হলে আলোচনা করব।

চিঠিটা পোস্ট করে ফিরে এসে রে ব্র্যাডবেরির ফারেনহাইট ৪৫১ বইটা নিয়ে ইজিচেয়ারে লম্বা হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই মন দিতে পারে না। ছাপা হরফগুলো চোখের সামনে থাকলেও মগজের দরজা পেরতে পারছে না। মিনিট পনেরো বৃথা চেষ্টা করে উঠে দাঁড়াল নিলয়। এবার নিজের ওপর রাগ ধরে। বোঝে, অকারণে ব্যস্ত হচ্ছে, তবু নিজেকে। সামলাতে পারে না। কিছু কিছু লোকের মস্তিষ্ক একেবারে চক্রব্যুহের মতো। কোনও চিন্তা একবার ঢুকলে হল। যতক্ষণ না একটা সুরাহা হচ্ছে, সেটি এমন জাঁকিয়ে বসে। অথচ এই মুহূর্তে অপেক্ষা করা ছাড়া করার আর আছেই বা কী? নিলয় জানে, জোয়ারদারের কাছ থেকে নিশ্চয় কিছু না কিছু খবর সে পাবে। কিন্তু তার জন্যেও তো কিছুটা সময়। দিতে হবে। হঠাৎ খেয়াল পড়ে, ডক্টর ডাকুয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড, অতীত ইতিহাস সম্বন্ধে তো খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করা যায়। এবং সে চেষ্টার পক্ষে কলকাতাই সবচেয়ে আইডিয়াল। এত বড় একটা কাজ রয়েছে আর সে কিনা এতক্ষণ কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। এই মুহূর্তে তার প্রথম কর্তব্য ডক্টর ডাকুয়ার বায়োডেটা সংগ্রহ।

কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে? কোন কলেজে পড়েছে তা-ও জানা নেই। জিয়োলজিস্ট! জোয়ারদারের কথা মনে পড়ে। হ্যাঁ–এইদিক থেকে একবার চেষ্টা করে দেখা যায় নিশ্চয়। কলকাতায় নাকি চাইলে বাঘের দুধও মেলে, আর একটা জলজ্যান্ত মানুষ সম্বন্ধে খোঁজ মিলবে না… নিজেই নিজেকে উৎসাহিত করতে চায় নিলয়। তবে কলকাতাকে সে যতই ভালোবাসুক, এটা তার অজানা নয় যে, শুধু বাঘের দুধ মিললে আপত্তি ছিল না। কিন্তু এখানে আবার মোরগের ডিম এবং বলদের দুধ সরবরাহ করার লোকেরও অভাব নেই। শুধু তা-ই নয়, সরবরাহকারী অক্লেশে সিলমোহর-মারা নথিপত্র বার করে তার বিশুদ্ধতার প্রমাণ দাখিল করে দিতে পারে।

সত্যেন! ভাবতে ভাবতেই নামটা ঝিলিক দিয়ে উঠল। যাদবপুরে পড়ার সময় তার রুমমেট ছিল সত্যেন। পাশ করে যোগ দিয়েছিল জিয়োলজিকাল সার্ভেতে। চাকরিসূত্রে তাকে প্রায়ই বাইরে থাকতে হয়, কিন্তু বর্তমানে সে কলকাতায়।

ঠিকানা লেখার ছোট্ট ডায়েরিটা উলটে সত্যেনের অফিসের ফোন নম্বরটা বার করে ফেলল। না, অফিসে গিয়ে দেখা করতে চায় না। আজ সন্ধ্যায় ফ্রি থাকলে বাড়িতেই যাবে। কাজও হবে, আড়াও জমবে। একটু ডাইভারশন দরকার।

ডক্টর ডাকুয়ার রহস্যজনক শক্তি উৎপাদনকেন্দ্রের কাহিনিটা বলতে বলতেই বার তিনেক চায়ের কাপ ফাঁকা করেছে নিলয়। সত্যেনের কাছে সমস্ত সন্দেহের কথা বলতে পেরে একটু যেন মনটা হালকা লাগে।

এখন বল কী করা যায়? নিলয় সোফায় গা এলিয়ে দিল।

সত্যিই পিকিউলিয়ার ব্যাপার। সত্যেন পায়চারি করছে। আমার দিক থেকে আমি এই ব্যাপারে হয়তো তোকে হেল্প করতে পারি। জিয়োলজিস্ট হিসাবে ডাকুয়ার কেরিয়ার সম্বন্ধে নিশ্চয় কিছু তথ্য জোগাড় করা যাবে, জানিস তো, আমাদের লাইব্রেরিটা খুবই ভালো। ডকুমেন্টেশনের ব্যাপারে বেশ যত্ন নেওয়া হয়।

সে তো তুই করবিই। কিন্তু আমি তোকে বলব, ব্যাপারটা নিয়ে তুই একটু চিন্তা কর। কোথাও না কোথাও একটা কিছু গন্ডগোল আছেই…।

বাপি, ও বাপি! হঠাৎ দরজার কাছ থেকে মিতুলের সরু গলা শোনা গেল। পরদাটাকে দু-হাতে ধরে দোল খেতে শুরু করেছে।

এই দেখ–এখুনি পরদাটাকে ছিঁড়বে–ভেতরে আয়। মেয়েটা যা দুষ্টু হয়েছে!

আসব না। রাক্ষস-খোক্কস শোনাও।

 নিলয় হেসে বলে, রাক্ষস-খোক্কস কী রে মিতুল?

 রেকর্ডের গান।

সত্যেন বলে, লক্ষ্মী বাবা আমার, এখন নয়। কাকুর সঙ্গে কথা বলছি।

 দে-না। শুনতে চাইছে যখন। এসো মিতুল। আমিও শুনব। নিলয় হাত নেড়ে ডাকে।

একছুটে চলে আসে মিতুল। নিলয় ওকে নিজের পাশে বসায়। সত্যেন রেকর্ডটা বার করে প্লেয়ারে চড়িয়ে দেয়।

এখুনি রাক্ষসের ডাক শুনতে পাবে। মিতুল চেয়ারে বসে ডানলোপিলোর দৌলতে তিড়িং তিড়িং করে নাচানাচি জুড়ে দিয়েছে। মিতুলের কোমর জড়িয়ে নিলয় মুখ নিচু করে আদর করতে যাবে, হঠাৎ কানের পরদা ফাটিয়ে ঝাঁ ঝাঁ করে মিতুলের রাক্ষস রেকর্ডের মধ্যে থেকে চেঁচিয়ে উঠল। সত্যেন খেয়াল করেনি, ভলিউম কন্ট্রেলটা পুরো অন ছিল। চমকে গিয়ে সত্যেন তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে আওয়াজ কমিয়ে দিল। খিলখিল করে হেসে ওঠে মিতুল। ও কাকু, কাকু! কেমন মজা হল বল!

সত্যেন বলে, উফ, খেয়ালই করিনি। এত ঝামেলা করিস না তুই মিতুল। পেছন ফিরে সোফায় বসতে গিয়েই নিলয়ের দিকে চোখ পড়ল সত্যেনের। খাড়া হয়ে বসেছে নিলয়। সোফার একেবারে ধার ঘেঁষে। ভুরু দুটো কুঁচকে আছে। নিলয়ের চাউনিতে যেন একটা বিশুদ্ধ উৎকণ্ঠা।

কী রে? কী হল?

একটিও কথা বলে না নিলয়। উঠে দাঁড়িয়েছে সোজা, রেকর্ড প্লেয়ারটার কাছে গিয়ে পিক আপটা তুলে নিল! তারপর আবার প্রথম থেকে বসিয়ে দিল। ভলিউমটা আবার ফুল করে দিয়েছে। বিজাতীয় ভঙ্গিতে রাক্ষসটা ফের গর্জে উঠল।

সত্যেন ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কী ব্যাপার বল তো? স্পিড চেঞ্জ করে দিলি কেন?

৩৩ আরপিএম-এ রেকর্ড করা রাক্ষসটা ৪৫ আরপিএম-এ গলাটা একটু সরু করে আরও ঘন ঘন ডাকছে। পিক আপটা তুলে নিয়ে নিলয় সত্যেনের হাত চেপে ধরল, সত্যেন! তোকে বলছিলাম না, চিতার ডাকের সঙ্গে পাওয়ার প্লান্টে বিকট গর্জনের কোথায় যেন একটা মিল ছিল! এই সেই মিল!

তার মানে?

 তার মানে, চিতার ডাক রেকর্ড করে সেটাকে দ্রুততর গতিতে এবং কান-ফাটানো শব্দে বাজালে ঠিক ওইরকম শোনাবে। যেরকম শব্দ ছাড়ছিল ডক্টর ডাকুয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট। বোগাস। সব বোগাস!

কী বলছিস তুই?

 ঠিকই বলছি। আমি নিঃসন্দেহ। ডাকুয়া পুরো ধাপ্পা দিয়েছে। সব অ্যানিমেশন।

 এখন বুঝতে পারছি ওই আওয়াজ, ভাইব্রেশন, মিটার, গেজ–সব ধাপ্পা। ছেলে-ভুলানো খেলনা। এনার্জি মিটারের রিডিং বা ডিজেল ট্যাঙ্কের কাঁটা–সব ফলস।

তোর কথা শুনে যে সেই পার্ক স্ট্রিটের ব্যাঙ্ক ডাকাতির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। একটা বোমা ফাটিয়েছিল ওরা চড়াও হওয়ার পর, আর একটামাত্র ফায়ার করেছিল। কিন্তু প্যানিক সৃষ্টি হয়েছিল টেপরেকর্ডার চালিয়ে দেওয়ায়। আগে থেকে টেপের মধ্যে বোমা ও গুলির আওয়াজ রেকর্ড করে রেখেছিল।

এ-ও তা-ই। মিস্টার জোয়ারদারের কাছ থেকে চিতার ডাক টেপ করে এনে ফাস্ট স্পিডে বাজিয়ে আমি তোকে শুনিয়ে দেব। দেখবি, আর কোনও সন্দেহ থাকবে না তখন। যাক, এবার রেকর্ডটা ঠিক করে চালিয়ে দে।

সত্যেন রেকর্ডের স্পিড় ঠিক করে এসে বলল, তোর কথাই না-হয় মানলাম, কিন্তু… আসল সমস্যাটা তো রয়েই যাচ্ছে। এত অল্প দরে ডক্টর ডাকুয়া বিদ্যুৎ বেচছে কী করে? আর কোনও ব্যাবসাদারই নিশ্চয় লোকসান দেওয়ার জন্য কাঠখড় পোড়ায় না!

শোন্ সত্যেন, আমার মনে হচ্ছে, অন্তত মাস ছয়েক আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। ডক্টর ডাকুয়া বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু না-করা পর্যন্ত কিছু করা যাবে না। ইতিমধ্যে আমাদের কাজ হবে, যেখান থেকে সম্ভব, যে যেভাবে সম্ভব শুধু খবরাখবর জোগাড় করা। তবে একটা কথা বলে রাখি, প্লিজ, গোপনীয়তা রক্ষা করতে চেষ্টা করিস কিন্তু। একটি কথাও যেন লিক না হয়। ডক্টর ডাকুয়া গভীর জলের মাছ।

তুই যখন এত কনভিন্সড় তাহলে স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাহায্য নিচ্ছিস না কেন?

ধুর! যত অপদার্থ। তা ছাড়া আরেকটা ব্যাপার আছে। অবশ্য এটা আমার ইনটিউশন। থার্ড সেন্স, আমার মন বলছে ডক্টর ডাকুয়া যা-ই ধাপ্পা দিক, একটা না একটা মিরাকুলাস কিছু আবিষ্কার করেছে। ডক্টর ডাকুয়ার মতলবটা যেমন জানা দরকার, তেমনি দরকার তার আবিষ্কারটা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়া।

ঠিক আছে, আমি কাল থেকেই উঠে-পড়ে লাগছি। যেমন যেমন খোঁজ পাব, সিধে তোকে জানিয়ে দেব। এ ব্যাপারে তুই পুরোপুরি রিলাই করতে পারিস আমাকে।

থ্যাঙ্ক ইউ–তবে ওই যা বললাম। যা-ই জানতে পারিনা কেন, ছ-মাসের আগে কোনও অ্যাকশন নয়। কেমন?

নিলয় উঠে দাঁড়াতেই মিতুল ছুটে এল, কাকু, তোমার দাড়ি নেই কেন?

প্রশ্নটা শুনে হেসে ফেলে নিলয়। সবাইকেই তোমার বাবার মতো দাড়ি রাখতে হবে। বুঝি?

তুমি বাবার মুখের দাড়িটা নিয়ে নাও-না। বাবার গালে আমি চুমু খেতে পারি না।

ও এই ব্যাপার! বুঝেছি। কাকুর গালে বাবার দাড়ি ট্রান্সফারের কেস!

সত্যেন ও নিলয় দু-জনেই হেসে ওঠে। মিতুল বুঝতে পারে না এত হাসির কী হল।

জোয়ারদারের চিঠিটা না পেলে আলিপুরদুয়ার ছুটতে হত। শুধু কলকাতায় ঘরে অনুসন্ধান চালিয়ে ডক্টর ডকুয়ার পাওয়ার প্লান্টের রহস্য ভেদ করা সম্ভব নয়। জোয়ারদারের চিঠিটা প্রমাণ করে দিয়েছে নিলয়ের এই সিদ্ধান্ত নির্ভুল। তা ছাড়া স্থানীয় লোক হিসাবে জোয়ারদার যে সুবিধে পাবেন, নিলয়ের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। তবু প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল একটা–এ ব্যাপারে জোয়ারদারের উৎসাহ আছে কি না, আর থাকলেও কতটা আছে। নিলয় এখন বুঝতে পারছে জোয়ারদার ঠান্ডা মাথার লোক। আর সেইটাই দরকার। প্রথম চিঠিটা ছ-মাস পরে এসেছে বটে, কিন্তু উনি এরই মধ্যে অসাধ্যসাধন করেছেন বলা যেতে পারে। ডক্টর ডাকুয়ার সঙ্গে রীতিমতো খাতির জমিয়ে ফেলেছেন জোয়ারদার। না, সমভাবাপন্ন বৈজ্ঞানিক হিসাবে নয়, শখের শিকারি হিসাবে। ডাকুয়া আরেকটা চিতাবাঘের ছানা কিনেছে। আর সেই সুবাদে জোয়ারদার দু-দিন থেকে এসেছেন জয়ন্তীতে। চিতা প্রতিপালনের উপযুক্ত পরামর্শ নিয়েছেন তাঁর কাছ থেকে ডাকুয়া। শুধু তা-ই নয়, তার পাওয়ার প্লান্টে চিতারা নিযুক্ত হয়েছে প্রহরী হিসেবে। মানুষের ভয়ে বন্য প্রাণী অনেক বেশি আস্থাভাজন, এই প্রতিপাদ্য যোগেই জোয়ারদার ডাকুয়ার আস্তানায় ঢোকার গেটপাস জোগাড় করেছেন।

নিলয় আবার খাম থেকে টেনে বার করে, এই নিয়ে তিনবার পড়া হল।

প্রিয় নিলয়বাবু,
বনমহল
৩ নভেম্বর

ডাকুয়ার ওখানে দু-দিন থেকেও আমি কোনও রহস্যভেদ করতে পারিনি, বরং রহস্য। আরও গম্ভীর হয়েছে। দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো যা যা দেখেছি, পরপর লিখে যাচ্ছি।

এক। ডক্টর ডাকুয়ার ওখানে কর্মী বলতে সাকুল্যে জনা চারেকের বেশি আছে বলে মনে হয় না। এরা সবাই ধানবাদ থেকে এসেছে। কয়লাখনির লোক। এদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইনি।

দুই। ডক্টর ডাকুয়ার কারখানা থেকে ইলেকট্রিক লাইন টানার কাজ শেষ হয়ে গেছে।

তিন। জয়ন্তী স্টেশনের কাছ থেকে কারখানা অবধি ডিজেল তেল আনার পাইপলাইনও বসানো হয়ে গেছে শুনলাম স্বয়ং ডাকুয়ার মুখে। কিন্তু স্থানীয় লোকেরা তার কেউই কিছু জানে না। এত বড় একটা কাজ মাত্র ছ-মাসের মধ্যে কখন হল, কারা করল –সবটাই কালো ধোঁয়া। কিংবা পুরো ধাপ্পা।

চার। লাইম ফ্যাক্টরির পুরানো বাড়িটা জায়গা বদল করেছে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। পুরানো বাড়িটা কোথায় ছিল, আমি জানি। সে বাড়িটাকে ভেঙে ফেলা হয়েছে, তার প্রমাণও স্বচক্ষে দেখছি। এখন যে বাড়িটা সে জায়গায় রয়েছে, সেটা নতুন বাড়ি, পুরানোটার ধাঁচে তৈরি! নিশ্চয় ধাপ্পা দেবার জন্য। চেষ্টা করেছিলাম ভেতরে ঢোকবার, কিন্তু অসম্ভব! ডক্টর ডাকুয়া যদি সত্যিই কিছু আবিষ্কার করে থাকেন তাহলে সেটা আছে। ওই চিমনিওয়ালা লাইম ফ্যাক্টরির মধ্যেই। টিনের চালা বসানো কারখানাঘরটার মধ্যে কিসসু নেই। কিছুদিন আগে অবধি ওটা ছিল মজুরদের আস্তানা। প্রায় শ-খানেক মজুর খাটত তখন এখানে।

পাঁচ। জয়ন্তীর হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি, ডাকুয়া এখানে আসার বছরখানেক বাদেই ধানবাদ অঞ্চল থেকে প্রচুর কুলি নিয়ে আসে। সকলেই কয়লাখনির লোক। তারপর আসে প্রচুর যন্ত্রপাতি ট্রেনে করে। বিবরণ শুনে মনে হয়েছে বিশাল আকারের ক্রেন–শ্যাফ্ট শিঙ্কি মেশিন ইত্যদি এসেছিল। খনির পিট খোঁড়ার কাজে যা যা লাগে। দু-তিনটে ডিনামাইট ব্লাস্টেরও আওয়াজ পাওয়া গেছে তখন। এইরকম একটা ডিনামাইট ব্লাস্টের পরের দিন থেকেই নাকি ঝরনার জল বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয় লোক এখনও মনে করে, ডাকুয়ার ওখানে নিশ্চয় কোনও খনি আছে। তাদের এই ধারণা আরও জোরদার হয়েছে ডাকুয়ার ওখানের এক মজুরের মুখে গল্প শুনে। শ-দেড়েক বা দুয়েক মজুরকে ডাকুয়া প্রায় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রাখার মতো করেই রেখেছিল। চার্টার্ড ট্রেনে। তার এসেছিল, চার্টার্ড ট্রেনেই ফেরত গেছে। দীর্ঘ দু-বছরের মধ্যে তারা একদিনের জন্যেও ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরয়নি। একটিও স্থানীয় লোকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায়নি। শুধু একটিমাত্র লোক, যে কোনওভাবেই হোক দেশে যাবার পথে ট্রেন থেকে পালিয়ে আসে। লোকটার গল্প যদি সত্যি হয় তাহলে ও লাইম ফ্যাক্টরির মধ্যেই আছে ডাকুয়ার খনির হেডগিয়ার, ওয়াইন্ডিং ড্রাম, উইঞ্চ আর খনির সুড়ঙ্গে নামার খাঁচা ইত্যদি।

ছয়। এইবার বলি একটা বিচিত্র প্রাকৃতিক দৃশ্যের কথা। আমরা তিন পুরুষ তাই অঞ্চলে বাস করছি। তরাইয়ের বনমহলে ঘোরাফেরাও নেহাত কম করি না, কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, প্রকৃতির এই অদ্ভুত খামখেয়ালিপনা আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। কারও মুখে শুনিওনি কখনও। পরে অবশ্য জিজ্ঞেস করে জেনেছি, কিছু কিছু পুরানো দিনের বাসিন্দা ব্যাপারটা জানে। জায়গাটা এত দুর্গম, এমনই তার অবস্থান, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টও এর হদিশ জানে না। এই জায়গাটা বহুকাল আগে নাকি ফুটন্ত চোরামাটি নামে পরিচিত ছিল। নামটার মধ্যে এতটুকু অতিরঞ্জন নেই। প্রায় মাইলখানেক জায়গা জুড়ে একটা বিশাল খয়েরিরঙা পুকুর-জলাজমি। শুধু তা-ই নয়, টগবগ করে ফুটছে সেই লালচে কাদা! কাদার মধ্যে থেকে অনবরত এখানে-সেখানে ফুলে ফুলে উঠছে গ্যাসের বুদবুদ। তারপর ফেটে যাচ্ছে। সারাটা জায়গা জুড়ে একটা দম-আটকানো ভ্যাপসানি গরম। ধারেকাছে ঘেঁষা মুশকিল। গাছপালা দূরের কথা, ঘাস অবধি জন্মায় না এখানে। এই উত্তপ্ত নরককুণ্ডের আশপাশে জমিটাও অদ্ভুত। রুক্ষ ডেলা ডেলা ভাঙাচোরা পাথরে বোঝাই। এতটুকু মাটি নেই। তরাইয়ের গহন চিরসবুজ অরণ্যের মধ্যে জায়গাটা। যেন দাঁত খিঁচিয়ে রয়েছে দারুণ বিরক্তিতে। লাইম ফ্যাক্টরির বাড়িটা এই নরককুন্ডের ধার ঘেঁষেই তৈরি করেছে ডাকুয়া। এই জায়গাটা হঠাৎই আমি সকালবেলায় ঘুরতে ঘুরতে আবিষ্কার করে ফেলি। দুর্ভাগ্যবশত মিনিট পনেরোর মধ্যেই ডাকুয়া এসে হাজির হয়। সে সময় ওর চোখে খুনির দৃষ্টি দেখেছি। তীব্র সন্দেহ আর অবিশ্বাস। আমি কোনও ভ্রূক্ষেপ না করেই জানিয়ে দিয়েছিলাম, এই দৃশ্য আমার পরিচিত। এমনকী চা-বাগানের উইলিয়ামস সাহেব কীভাবে দশটা কুলিকে এখানে ডুবিয়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিল, তার একটা কাল্পনিক গল্পও শুনিয়ে দিয়েছিলাম। ডাকুয়ার অবিশ্বাস নিশ্চয় কেটে গিয়েছিল। না হলে… সম্ভবত ওর দুই ইঞ্জিনিয়ারের মতো আমারও লাশটা পাওয়া যেত বনের মধ্যে। সেটা ট্র্যাজেডি হিসাবে বোধহয় জমতও ভালো। কারণ এককালে আমারই হাতে পোষা চিতার দাঁতে ফালাফালা হতাম আমি।

সাত। মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার ও ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার নিহত হয়েছে মজুরের দল চলে যাবার মাসখানেক বাদে। মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার সম্বন্ধে কোনও খোঁজ জোগাড় করতে পারিনি। ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারের নাম সুদেব বর্মন। আইআইটি-র স্টুডেন্ট ছিল। বয়স বছর পঁয়ত্রিশ। আশা করি, এ সম্বন্ধে আপনি খোঁজখবর নিতে পারবেন।

যা দেখেছি-বুঝেছি-শুনেছি সবই জানালাম। আরও যদি জানতে পারি, নিশ্চয় জানাব। তবে মনে হয় না, ডাকুয়ার ওখানে আর যাওয়া যাবে। সেটা বোধহয় উচিতও হবে না। যে কোনও বিষয়ে জিজ্ঞাস্য থাকলে লিখবেন, আমার দিক থেকে পূর্ণ সহযোগিতা রইল। ব্যাপারটা শুধু রহস্যময় বলেই উৎসাহ দেখাচ্ছি তা নয়। এর মধ্যে একটা বিষাক্ত অশুভ গন্ধ আছে। গন্ধটা খুবই চড়া, তবু তার উৎসটা যে ধরা যাচ্ছে না–এটা খুবই দুর্ভাগ্যের। আশা করি, এই অধমের বাড়িতে শীঘ্রই আবার আপনার পায়ের ধুলো পড়বে, আর সেদিন নিশ্চয় ডাকুয়ার অভিসন্ধির কথা জানতে পারব।

প্রীতি ও শুভেচ্ছান্তে–
অমিয় জোয়ারদার

পেপার ওয়েট দিয়ে চিঠিটাকে চাপা দিয়ে স্লিপ প্যাডটা টেনে নিল নিলয়! এই চিঠির ভিত্তিতে কতকগুলো খোঁজখবর দেওয়া ও যোগাযোগ করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। প্রথমত, সুদেব বর্মনের খোঁজ নিতে আইআইটি খঙ্গপুরে ডক্টর মৈত্রর কাছে একটা চিঠি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, খনি সংক্রান্ত যে কোনও কাজের যন্ত্রপাতি নির্মাতাদের মধ্যে প্রধান মাইনিং অ্যান্ড অ্যালায়েড মেশিনারি কর্পোরেশনকে এবং রাঁচিতে কোল মাইন অথরিটি সিনিয়র ডিজাইনিং ইঞ্জিনিয়ার ডক্টর চক্রবর্তীকে একটা করে চিঠি দিতে হবে। ব্যক্তিগত পরিচয়গুলো কাজে লাগানো দরকার। তা ছাড়া ডক্টর চক্রবর্তী কিছুদিন আগেও এমএএমসি-তে ছিলেন। তাঁর বন্ধুবান্ধবরা কেউ কেউ এখনও নিশ্চয় ওখানে আছে। ডক্টর ডাকুয়া ওখান থেকে কিছু কিনে থাকলে খবর বার করাটা কঠিন হবে না। তৃতীয় কাজটা এবং সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ-সত্যেনের সঙ্গে অবিলম্বে যোগাযোগ করা। ডক্টর ডাকুয়ার অতীত সম্বন্ধে সত্যেন এখনও কোনও খোঁজ দেয়নি। সেটা তো আছেই, তা ছাড়াও ওই ফুটন্ত পাঁকের কুম্ভের ব্যাপারটা জানতে হলেও ভূতাত্ত্বিক সত্যেনের শরণাপন্ন হতে হবে। আগে চিঠিগুলো ছেড়ে দেবে নিলয়। চিঠির খসড়াটা লিখতে গিয়েও থমকে গেল। না– প্রক্রিয়ায় এগতে গেলে অহেতুক সময় নষ্ট হবে। একটা ড্রাফট করে তারপর টাইপ করা –তার চেয়ে ফোনোগ্রাম পাঠানো সহজও হবে, জিনিসটার গুরুত্বের ওপরও ঝোঁক থাকবে। খসখস করে বার্তাগুলো তৈরি করে ফেলল নিলয়। ওয়ান এইট ফাইভ ডায়াল করে আইআইটি, আরসিএম-এর ঠিকানায় ফোনোগ্রাম পাঠিয়ে দিল। শুধু এমএএমসি– চিঠি দেবে। ঘড়ির দিকে তাকাল নিলয়, এখনও সময় আছে, সত্যেনকে বাড়িতেই পাওয়া যাবে। চটপট ডায়াল ঘোরাল। টেলিফোন কোম্পানিকে মনে মনেই দুবার প্রণাম করে নিল। রিং হবার মধুমাখা ক্রিং শব্দ কানে এলে যেন লটারিতে ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়ার মতো আনন্দ হয় আজকাল।

সত্যেন? নিলয়। কী ব্যাপার তোর? অ্যা… বাঃ… তা বলিসনি কেন… শোন, বিশেষ দরকার আছে। খুব জরুরি… হ্যাঁ এখুনি, আজই… সেই ভালো, তাহলে আধ ঘণ্টার মধ্যে তোর অফিসে চলে আসছি।

হ্যাঁ, সেই জন্যেই তো দেরি হল। তবু বলব, ভাগ্য ভালো যে, জাপান গভর্নমেন্ট উত্তর দিয়েছে। অবাক হয়ে নিলয় শুনে যায় সত্যেনের কথা। এই দেখু–চিঠিটা দেখলেই বুঝতে পারবি।

নিলয় চিঠিটা হাতে নিয়ে বলল, আশ্চর্য! ডাকুয়া জাপানে গিয়েছিল জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তরফ থেকে! তারপর যখন জাপান সরকারের কাছে আশ্রয় পায়, হঠাৎ চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দিল। আচ্ছা সত্যেন, তুই বলছিস, পুরানো ফাইলে দেখেছিস, গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া একের পর এক চিঠি দিয়েছে, কিন্তু জাপান সরকার তখন নো ট্রেস বলে কোনও খবর পাঠায়নি। তাহলে এখন কেন খবর পাঠাল তারা?।

সত্যেন হাসতে হাসতে বলল, জাপানুকেও যে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছে ডাকুয়া।

 তার মানে?

 তার মানে আর কী। জাপান থেকে সোভিয়েট রাশিয়ায় ভেগেছিল তো!

 আশ্চর্য! লোকটার ক্ষমতা আছে বলতে হবে।

 সে তো আছেই। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, জিয়োলজিস্ট হিসাবে, বিশেষ করে আগ্নেয়গিরি সম্বন্ধে ওর যা জ্ঞান–যেসব পেপার লিখেছে–আন্তর্জাতিক খ্যাতি আছে। ওর পক্ষে এ দেশ-ও দেশ করে বেড়ানোতে কোনও অসুবিধে নেই।

আচ্ছা, ডাকুয়া এগজ্যাক্টলি কী কাজের জন্য জাপানে গিয়েছিল জানিস!

জানি। সাকুরাজিমা আগ্নেয়গিরিতে ফিল্ড স্টাডি করবার জন্যে। থিয়োরেটিক্যাল কাজ।

কিন্তু ভারত সরকারের তাতে কী ইন্টারেস্ট? আমাদের দেশে তো একটিও আগ্নেয়গিরি নেই? নিলয় প্রায় জেরা করে চলে।

দেখ নিলয়, আগ্নেয়গিরি মানেই যে সেখান দিয়ে গলগল করে আগুন আর লাভা বেরবে তার কোনও মানে নেই। সুপ্ত আগ্নেয়গিরির সংখ্যাও কম নয়। তুই কি জানিস, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে ব্যারেন আইল্যান্ড নামে একটা দ্বীপে আগ্নেয়গিরি আছে? হ্যাঁ, সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। তা ছাড়া আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে সমীক্ষা চালানোর উদ্দেশ্য শুধু ভিসুভিয়াসের মতো প্রলয়ংকরী বিস্ফোরণের ভবিষ্যদ্বাণী করা নয়। পর্যবেক্ষণ করার আরও অনেক কারণ আছে। একটা কথা বললেই বুঝতে পারবি। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে যেমন একটা বিরাট অঞ্চল একেবারে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, তেমনি আবার একটা অঞ্চল কিন্তু কিছুকাল পরেই একেবারে নতুন রূপে দেখা দিতে পারে, শস্যশ্যামলা হয়ে। অগ্ন্যুৎপাতের সময় নানারকম খনিজ পদার্থ একেবারে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে। যা-ই হোক, সোজা কথা হচ্ছে, ডাকুয়া জাপানে আগ্নেয়গিরি সংক্রান্ত কাজ করেছিল জানা গেছে, কিন্তু কাজটা ঠিক। কী তা জানা যায়নি, যাবেও না।

বুঝলাম! নিলয় চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে চোখ বুজে ফেলে।

কী রে, টায়ার্ড লাগছে? চা-কফি খাবি কিছু?

কফি দিতে বল্। নিলয় চোখ খোলে না।

আশার আলো দেখতে পাচ্ছিস কিছু? ওই যে জোয়ারদার না কী যেন ভদ্রলোকের নাম, কোনও খবর পাঠায়নি?

আরে এই দে, ডাকুয়ার ইতিহাস শুনতে শুনতে কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি খাড়া হয়ে বসে নিলয়। পকেট থেকে জোয়ারদারের চিঠিটা বার করে পাতা উলটে ফুটন্ত পাঁকের নরককুণ্ডর বর্ণনাটার ওপর আঙুল ধরে সত্যেনের দিকে এগিয়ে দেয়। আগে এইখানটা পড়ে দেখ, তারপর বাকিটা পড়িস।

সত্যেন চিঠিটার ওপর চোখ বুলিয়ে নিলয়ের দিকে তাকাল। তারপর আবার পড়ল চিঠিটা। আশ্চর্য–সত্যি আশ্চর্য আপন মনে বিড়বিড় করে উঠল সত্যেন।

কী রে, কী বলছিস?

বলছি আশ্চর্য রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।

 তার মানে?

দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে।
একটি শিশিরবিন্দু।

কফির কাপ হাতে সাহেবকে চোখ বুজে গদগদ কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করতে দেখে বেয়ারা চমকে গিয়েছিল। এমন খাপছাড়া ব্যাপারের সঙ্গে সে আদৌ পরিচিত নয়। নিলয়ের মুখের দিকে বার দুয়েক তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সত্যেন অপ্রস্তুত হয়ে বলে, কী কেদার, কিছু বলবে?

না, কিছু না। কেদার তাড়াতাড়ি কফির কাপ নামিয়ে রেখে বেরিয়ে গেল।

কী হেঁয়ালি আরম্ভ করলি বল তো? নিলয় কাপটা হাতে তুলে নেয়।

হেঁয়ালি কি আমি করেছি রে! হেঁয়ালির বাবা হয়ে বসে আছে তোমার ডাকুয়া। না হলে সত্যেনের মুখ দিয়ে কাব্য ছোটে? আমি নিজেই তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি নিজের পারফর্মেন্স দেখে।

এই পারফর্মেন্সটা রুমাকে দেখালে হত না? ও বরং আরও বেশ তারিফ করত।

আজ্ঞে না স্যার। খুব ভুল। সবচেয়ে তারিফ করবি তুই। দাঁড়া—

সত্যেন উঠে গিয়ে টেবিলের পেছনে রাখা গডরেজের লোহার আলমারিটা খুলে ফেলল। বই আর ফাইলে ঠাসা। দু-চারটে বই টানাটানি করে শেষ পর্যন্ত একটাকে হাতে নিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসল। ঝটপট কয়েকটা পাতা উলটে তারপর নিলয়ের দিকে ঠেলে দিল বইটা। ছবিটা ভালো করে দেখ।

নিলয় ঝুঁকে পড়ল। সারা পাতা জুড়ে একটা খয়েরি রঙের ফোটোগ্রাফ। একটা পুকুরের মাঝখানে বড় ঢিল ছুড়লে যেমন কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে গোলাকার তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে, অনেকটা সেইরকম দেখাচ্ছে। তফাতের মধ্যে ফোটোর তরলটা অনেক ঘন আর তার উপরিভাগটাও সমতল নয়। কয়েকটা জায়গায় আবার ডুমো ডুমো ফোঁসকার মতো কী যেন উঁচু হয়ে রয়েছে।

ব্যাপারটা কী? নিলয় মুখ তুলে চাইল।

সামান্য ব্যাপার। নিউ জিল্যান্ডের এক আগ্নেয়গিরির ধ্বংসাবশেষ। ফুটন্ত কাদা আর লাভার পুকুর। প্রায় দু-তিন মাইল জুড়ে আছে এটা। তোমার ডক্টর ডাকুয়ার ওখানকার নরককুণ্ডেরই একটু বড় সংস্করণ আর কী! সত্যি নিলয়, যত শুনছি, তত তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি। ভারতে যে এরকম একটা জায়গা আছে, আজ অবধি তার কোনও উল্লেখ দেখিনি কোনও বইয়ে। কোনও থিসিসে।

নিলয় বলল, কিন্তু না দেখে তুই কী করে নিশ্চিত হচ্ছিস যে, ডাকুয়ার ওখানেও ঠিক এইরকম একটা কিছু আছে?

শুধু নিশ্চিত নয়, সুপার নিশ্চিত। ওখানে একটা জলের ঝরনার কথা বলেছিলি না?

হ্যাঁ।

 বাস, বাস, এইটুকুই যথেষ্ট। জোয়ারদারের বর্ণনা আর গরম জলের ঝরনা, এই দুইয়ের যোগসূত্রে আমি যা বলেছি তা শুধু ধারণা নয়, কল্পনা নয়, খাঁটি বাস্তব। তুই নিশ্চিন্ত হতে পারিস–বিন্দুমাত্র ভুল করিনি আমি।

ডাকুয়া ভূতাত্ত্বিক, আগ্নেয়গিরি নিয়ে গবেষণা করেছে, আবার ওরই কারখানা চত্বরের মধ্যে এক অভিনব আগ্নেয়গিরি রয়েছে, কেউ খোঁজ রাখে না যার। এটা কি শুধুই কাকতালীয় ঘটনা? নাকি জেনে, শুনেই ডাকুয়া ওখানে কারখানা বসিয়েছে? নিলয় আপন মনেই আওড়ে চলে।

সত্যেন বলে, মনে হচ্ছে, তুই বলেছিলি ডাকুয়ার বাবা কোচবিহারে থাকতেন।

দ্যাটস রাইট! হ্যাঁ, জোয়ারদার তা-ই বলেছিলেন। কী বলতে চাস, বুঝতে পেরেছি। হ্যাঁ, এদিক দিয়ে দেখতে গেলে ডাকুয়ার পক্ষে আগে থেকেই তার বাবার মুখে এই জায়গাটার কথা শোনা অসম্ভব নয়।

সত্যেন পায়চারি করতে করতে বলল, তাহলে বলতে হয়, কারখানা বসাবার জন্য ডাকুয়া ইচ্ছাকৃতভাবেই জায়গাটা নির্বাচন করেছে। কিন্তু কেন? গরম পাঁক নিয়ে করবেটা কী? আইসল্যান্ড বা নিউ জিল্যান্ডে আগ্নেয়গিরির সাহায্য নেওয়া হয় জল গরম করার জন্য। প্রচণ্ড ঠান্ডার দেশ, তাই সেই জল সরবরাহ করা হয় শহরের বাড়িতে। কিন্তু বিদ্যুৎ… পাওয়ার প্লান্টের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক থাকতে পারে? এ কি মুখের কথা! প্রায় একটা গোটা সাঁওতালডির ইনস্টলড ক্যাপাসিটির সমান বিদ্যুৎ সররাহ করবে বলে দাবি করছে।

সংবাদের শিরোনামের হরফগুলো আকারে তেমন বড় না হলেও শক্তিশালী চুম্বকের মতো আকর্ষণ করল জোয়ারদারের চোখ দুটোকে। উত্তরবঙ্গে গহন অরণ্যে অভিনব শক্তিকেন্দ্র। চায়ের কাপটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে কাগজটাকে ভাঁজ করে মুখের কাছে তুলে আনলেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা। আলিপুরদুয়ার। গত এক মাস যাবৎ উত্তরবঙ্গের মানুষ নিশ্চয় লক্ষ করেছেন যে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে। বিশেষ করে আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার ইত্যাদি অঞ্চলে তো লোডশেডিং-এর দৌরাত্ম্য বন্ধই হয়ে গেছে বলা চলে। এই ঘটনার পেছনে আছে এক আত্মপ্রচারবিমুখ বাঙালি বৈজ্ঞানিকের অসামান্য অবদান। গহন বনের মধ্যে তিনি সর্বজন অলক্ষে তাঁর গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করেছেন। তাঁরই নিরলস সাধনার ফলস্বরূপ তিনি আবিষ্কার করেছেন এক অভূতপূর্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনযন্ত্র, যা ডিজেল তেলে চলে, কিন্তু সেরা ডিজেল ইঞ্জিনের চেয়ে কম করে হলেও পাঁচ গুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এই বাঙালি বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় জানতে পেরেছি, সরকারি তরফ থেকে ন্যায্য মূল্যে ডিজেল তেল সরবরাহের বিলম্ব না হলে তিনি আরও তিন মাস পূর্বেই বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে পারতেন। বৈজ্ঞানিক (দেশের স্বার্থেই তাঁর নাম উল্লেখ করছি না) দুঃখ করে জানান, তিনি তাঁর আবিষ্কৃত পন্থার চরম উৎকর্ষসাধনে এখনও কৃতকার্য হননি বলেই সরকারি কারিগরি বিশেষজ্ঞ মহলকে বলেছিলেন, এই মুহূর্তে তিনি তাঁর আবিষ্কারের বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ব্যাখ্যা দিতে রাজি নন। কারণ তাঁর ধারণা, সে ক্ষেত্রে হয়তো পশ্চিমের উন্নত দেশগুলো শুধুমাত্র তাদের অর্থবলের জোরে তাঁরই আবিষ্কৃত পদ্ধতির আরও উন্নতিসাধন করে বিশ্বের দরবারে সর্বাগ্রে নিজেদের কৃতিত্বের কথা জাহির করবে। বৈজ্ঞানিকের কথা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত, তা ছাড়া আবিষ্কৃত পদ্ধতির সাহায্য সম্বন্ধে সরকারের তরফে এতদিন যদি তা-ও কোনও সন্দেহ থেকে থাকে, গত এক মাসের পর এখন তা সম্পূর্ণভাবে নিরসন হওয়াই উচিত। আর উচিত এই বৈজ্ঞানিকের গবেষণামূলক কার্যকলাপে কোনও প্রকার বিঘ্ন সৃষ্টি না-করা। প্রতিভাধর মানুষমাত্রেই স্পর্শকাতর। এই বিজ্ঞানীও তা স্পষ্ট ব্যক্ত করেছেন। সরকারি তরফের কোনও প্রকার কৌতূহল প্রদর্শন তিনি বরদাস্ত করবেন না। প্রয়োজন হলে গবেষণাকেন্দ্র উঠিয়ে দিয়ে তিনি কোনও উন্নতিশীল বা অনুন্নত দেশে গিয়ে নতুন করে শুরু করবেন গবেষণা। সরকারি মহলের কাছে তাই আমার বিনীত অনুরোধ, গত ক-বছর যাবৎ বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে আপনারা অজস্র প্রস্তাব পেশ করেছেন, কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন লেশমাত্র বাড়াতে পারেননি। এখন যে বৈজ্ঞানিক সত্যিই সেই অসাধ্যসাধন করার পথে প্রথম স্বাক্ষর রেখেছেন, তাকে অন্তত আপনারা সুস্থির হয়ে কাজ করতে দিন। আপনারা আপনাদের সহযোগিতার হাত প্রসারিত করুন।

আবেগময় রিপোর্টটা বার দুয়েক পড়ার পর জোয়ারদার চিন্তা করছিলেন, নিলয়কে একটা ট্রাঙ্ককল করবেন কি না। হঠাৎ নিচ থেকে গাড়ির হর্নের শব্দ কানে এল। হর্ন বাজিয়ে কেউ ডাকছে। কে এল আবার? বারান্দার কাঠের রেলিং-এ কনুইয়ের ভর রেখে নিচের দিকে তাকাতেই দেখা গেল একটা কালো অ্যাম্বাসাডর দাঁড়িয়ে।

জোয়ারদারবাবু, একটু কথা ছিল আপনার সঙ্গে। একটি তরুণ গাড়ির চালকের আসন থেকে নেমে এসে ওপরদিকে মুখ করে বলে উঠল। মুখটা চেনা চেনা লাগছে।

ওপরে চলে এসো!

না, মানে চিতা দুটো…

 হর্ন বাজিয়ে ডাকার কারণটা বোঝা গেল। না-ভয়ের কোনও কারণ নেই। চলে এসো।

ছেলেটি বারান্দায় পা দিতেই জোয়ারদার হাঁক দিলেন। রানু-মা–দু-কাপ চা দিয়ে যা তো!

কী হল, বসো, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?

ছেলেটি চেয়ারে বসতে বসতেই বলল, আমাকে আপনি চিনতে পারেননি বোধহয়। আমার নাম সুজন। বেশ কয়েক মাস আগে নিলয়বাবু বলে একজনকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছিলাম…

ও হ্যাঁ হ্যাঁ, তা-ই তো। জোয়ারদারের মনে পড়ে।

আপনি জানেন না বোধহয়, আমি আলিপুরদুয়ারেরই ছেলে। এই প্রাইভেট ট্যাক্সিটা আমার, নিজেই চালাই। সেই হিসেবেই নিলয়দার সঙ্গে পরিচয়। উনি এদিকে এলেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমি একটা বিশেষ দরকারে পড়ে আপনার কাছে এসেছি। নিলয়দার সঙ্গে আমাকে একবার যোগাযোগ করতে হবে, কিন্তু ওঁর কলকাতার ঠিকানাটা যে কোথায় হারিয়ে ফেলেছি। আপনার কাছে কি ওঁর ঠিকানা আছে?

ঠিকানা, ফোন নাম্বার সবই আছে। কিন্তু কী ব্যাপার বল তো? মানে ব্যক্তিগত কিছু হলে অবশ্য…

না, ব্যক্তিগত কিছু নয়। আসলে.. সুজন কথা থামিয়ে কী যেন চিন্তা করে। তারপর জোয়ারদারের চোখে চোখ রাখে। সুজনের দৃষ্টিটাই জোয়ারদারকে বুঝিয়ে দেয় ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ।

আপনার মনে আছে বোধহয়, নিলয়দাকে নিয়ে সেদিন আপনার এখানে আসার পর ডক্টর ডাকুয়ার ব্যাপার নিয়ে কথাবার্তা হয়েছিল। সুজন শুরু করে। ইতিমধ্যে আমি কয়েকটা অদ্ভুত জিনিস দেখেছি। আমার মনে হচ্ছে, এর সঙ্গে বোধহয় ডক্টর ডাকুয়ার যোগাযোগ আছে।

তুমি যা যা দেখেছ, বলে যাও। প্রমাণের কথা পরে আসবে। জোয়ারদার সুজনের দ্বিধা কাটাতে চান।

আপনি শুনেছেন কি না জানি না, সারা উত্তরবঙ্গে জলের দরে ডিজেল বিক্রি হচ্ছে। সুজন হঠাৎ যেন একটা অপ্রত্যাশিত লাফ মেরে সাহস সঞ্চয় করল। এ সম্বন্ধে জোয়ারদার কিছু জানেন না বোঝা গেল।

তার মানে?

আপনি জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন, চেনাশোনা যে কোনও ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির লোক ফিসফিস করে আপনাকে জানিয়ে দেবে, কোন পাম্পে চোরাই ডিজেল পাওয়া যাচ্ছে।

সত্যি?

আজ্ঞে হ্যাঁ–আমারই এক বন্ধুর মুখ থেকে প্রথম কথাটা শুনেছিলাম, বিশ্বাস করিনি। কিন্তু তারপর আমি নিজে লরি নিয়ে দেখতে গেছিলাম, আমি নিজে কিনেছি চোরাই ডিজেল অর্ধেক দামে।

আশ্চর্য!

 না জোয়ারদারবাবু, আশ্চর্য কথাটা আমি এখনও বলিনি। চোরাই ডিজেল মাঝেমধ্যে না, সবসময়ই পাওয়া যায়। সেটা কোনও নতুন ব্যাপার নয়। নতুন ব্যাপার হল, সারা উত্তরবঙ্গে চোরাই ডিজেল মিলছে এখন। প্রতিদিন। যে কোনও সময়। আর তার দাম একেবারে অর্ধেক। আমি গাড়ি নিয়ে প্রায়ই জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, বীরপাড়া–নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াই। নিজে খোঁজ করে দেখেছি-হাইওয়ের ওপর সবসময় সব জায়গাতেই কোনও না কোনও পাম্পে চোরাই ডিজেল পাওয়া যায়। আপনি দেখতে চান তো চলুন, নিজের চোখে দেখে আসবেন।

জোয়ারদার চেয়ারে ঠেস দিয়ে চোখ বুজে ফেলেন। সুজন কী বলতে চাইছে, ডক্টর ডাকুয়ার পাওয়ার প্লান্টের জন্যে যে ডিজেল সরবরাহ করা হচ্ছে, সেটাই ব্ল্যাক হয়ে যাচ্ছে? কিন্তু… জোয়ারদারবাবু! এই ডিজেল ব্ল্যাক হবার ব্যাপারটা কবে থেকে শুরু হয়েছে জানেন? জয়ন্তীতে ডক্টর ডাকুয়ার কারখানায় ট্রেনে করে তেল আসতে শুরু হওয়ার পর থেকেই।

না না, অসম্ভব। জোয়ারদার মাথা নাড়েন। ডাকুয়া যেটুকু তেল নিচ্ছে, তার থেকে এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা এমনিতেই তো সবাই অসম্ভব বলে বলেছে। নিলয়ও বলেছে এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। তারপর এখন তুমি যদি বল, সেই তেল সারা উত্তরবঙ্গে ব্ল্যাক হচ্ছে, তার মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে, বুঝতে পারছ? প্রায় বিনা তেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন! তা তো আর সম্ভব নয়।

আমি বিজ্ঞানের কথা বলতে পারব না জোয়ারদারবাবু, কিন্তু ট্রান্সপোর্ট ব্যাবসার সঙ্গে যারা জড়িত, সবাই কিন্তু এই নিয়ে জল্পনাকল্পনা করছে। আমি কয়েকটা পাম্পের মালিকের সঙ্গে দোস্তি জমিয়ে কথা বার করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। ওরা সহজে মুখ খুলবে না। সেটাই স্বাভাবিক এমন মুনাফা লোটার…

কিন্তু আমরা সবাই জানি, ডক্টর ডাকুয়ার কারখানা থেকে কীরকম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, এই দেখনা খবরের কাগজের বিরাট রিপোর্ট। এরপরে ডাকুয়ার ব্যাপারে এরকম কোনও সন্দেহ প্রকাশ করতে যাওয়াটাই তো বিপদ…

হঠাৎ সুজনের চোখ দুটো জ্বলে উঠল, আচ্ছা, এত শোনা কথার মধ্যে না গিয়ে নিজেরাই একবার অনুসন্ধান করে এলে তো ভালো হত, তা-ই না?

অনুসন্ধান?

কোনও পাম্পে যদি ব্লাকে তেল বিক্রি হয়, তাহলে সেই তেল নিশ্চয় কেউ না কেউ পৌঁছেও দিয়ে যায়। কারা তেল পৌঁছে দিচ্ছে, ধরতে পারলেই তো হাঙ্গামা মিটে যাবে।

কিন্তু…

আপনাকে কোনও চিন্তা করতে হবে না। সব ব্যবস্থা আমিই করব। এখান থেকে মাইলখানেক দূরে একটা পেট্রোল পাম্পে একটা ছোঁড়া হেল্পারের কাজ করে। আমিই তাকে কাজে ঢুকিয়েছিলাম। ওর কাছ থেকেই আমি খবর পাব, কবে, কখন গেলে এই চোরাই তেল সরবরাহকারীকে ধরা যাবে। আপনাকে শুধু বলা রইল, আমি কিন্তু যখন তখন এসে পড়তে পারি, কোনও অসুবিধে হবে না তো?

না–না–তুমি যে কোনও সময়ে চলে এসো। এ ব্যাপারে আমার উৎসাহ বিন্দুমাত্র কম নয়।

ঠিক আছে, তাহলে ওই কথা রইল।

সুজন তরতর করে নেমে গেল। গাড়ির ইঞ্জিনটা প্রাণ পেতেই চার চাকায় ভর করে যন্ত্রটা ছুটে বেরিয়ে গেল রাজাভাতখাওয়ার ফরেস্ট অফিসের প্রাঙ্গণ ছেড়ে। রেলিং-এ কনুইয়ে ভর দিয়ে একদৃষ্টে দাঁড়িয়ে রইলেন জোয়ারদার। সুজনের কথাটা যদি সত্যি বলে প্রমাণিত হয় তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? ডক্টর ডাকুয়াকে যদি হাতেনাতে ডিজেল ব্ল্যাক করার দায়ে ফাঁসানো যায়, তখন? কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহের রহস্যের সমাধান হবে কী করে? নাঃ–মাথা খারাপ হয়ে যাবে! আগে দেখা যাক কী হয়।

হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল জোয়ারদারের। বিছানা থেকে উঠে টেবিল পিসটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে তবে আবছা আলোয় কাঁটা দুটো দেখা গেল। ভোর পাঁচটা। এত সকালে ঘুমটা ভাঙল কেন? প্রশ্নটা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই যেন উত্তর হিসেবে একটা গাড়ির হর্ন নিচ থেকে প্যাঁক প্যাঁক করে উঠল। তাড়াতাড়ি বারান্দায় বেরিয়ে এল জোয়ারদার।

জোয়ারদারবাবু! শিগগির আসুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

 কে, সুজন নাকি?

হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি আসুন।

সুজনের পাকা হাতে গাড়িটা যেন পোষ-মানা জন্তু। পনেরো মাইল পথ পনেরো মিনিটে পেরিয়ে এসেছে। পেট্রোল পাম্পের ঠিক মুখে রাস্তাটা একটা বাঁক নিয়েছে। বাঁকের কাছে রাস্তার একদম ধার ঘেঁষে গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে দিল সুজন। বাঁ-দিকে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে বনেট খোলার আংটায় টান লাগাল। খটাং।

কী হল সুজন?

কিছু না, গাড়িটা গড়বড় করছে। কার্বুরেটারে ময়লা এসেছে বোধহয়। কথাটা বলেই হাসল সুজন। কথার মানেটা আর বুঝতে কোনও অসুবিধা থাকতে পারে না। আপনি পেছনের সিটে গিয়ে বসুন। সেটাই ভালো দেখাবে।

সুজন খোলা বনেটের তলায় মাথা ঢুকিয়ে স্প্যানার হাতে টুকটাক শুরু করে দিল। জোয়ারদার পেছনের সিটে ঠেস দিয়ে বসে সিগারেট ধরায়। সুজনের কথামতো তেলের গাড়ি আসার সময় হয়ে গেছে।

সিগারেটে বড়জোর বার পাঁচেক টান পড়েছে। হঠাৎ পেছনদিক থেকে কানে এল গাড়ি আসার শব্দ। কান খাড়া করে বসলেন জোয়ারদার। কৌতূহল প্রকাশ পায় এমনভাবে ঘাড় ফিরিয়ে তাকানো উচিত নয়। কিন্তু এরকম বিকট আওয়াজ কেন? কী ধরনের গাড়ি? যেন চার-পাঁচটা মোটর সাইকেল একসঙ্গে খুব ধীরগতিতে এগিয়ে আসছে। ভট ভট ভট ভট– শব্দটা ক্রমশ নিকটবর্তী হয়। এরই জন্যে কি প্রতীক্ষা? সুজন একবারও বনেটের তলা থেকে মুখ বার করেনি। বেশিক্ষণ চিন্তা করার প্রয়োজন হল না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা ট্র্যাক্টর ওদের গাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেল। তুরি টি গার্ডেনের জলের ট্যাঙ্কার টেনে নিয়ে যাচ্ছে। হতাশ হয়ে সিগারেটটা বাইরে ছুঁড়ে দিলেন জোয়ারদার। আরও কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে!

জোয়াদারবাবু। সুজনের চাপা স্বরের আহ্বানে উত্তেজনা থমথম করছে। চমকে উঠলেন জোয়ারদার। ট্রাক্টরটা জলের গাড়ি সমেত পেট্রোল পাম্পে ঢুকে পড়েছে। তবে কি…

সুজন বনেটটা আলতো করে নামিয়ে জানলার পাশে এসে দাঁড়াল। আমরা আরও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করব। তারপর রাস্তার এই পাশটা দিয়ে ওই সুপারি। গাছগুলোর পেছনে গিয়ে দাঁড়াব। ওখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাবে।

তোমার কি মনে হচ্ছে, এই জলের গাড়িতে করেই ডিজেল আসছে?

কোনও সন্দেহ নেই। তুরি টি গার্ডেনটা কোথায় জানেন তো?

 হ্যাঁ, ডাকুয়ার কারখানার সঙ্গে লাগোয়া বলা যেতে পারে।

ঠিক তা-ই। তা ছাড়া লোকের চোখকে ধুলো দেবার এটাই সবচেয়ে সোজা রাস্তা। টি গার্ডেনের জলের গাড়ি যে কোনও জায়গাতেই দেখা যেতে পারে। গ্যারেজট্যারেজে যাচ্ছে। কারওই চোখে পড়বে না ব্যাপারটা।

তার মানে তুরি টি গার্ডেনও পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে।

সেটা তো খোঁজ নিলেই বেরিয়ে পড়বে। চলুন এবার

সুজন কালিঝুলি-মাখা হাতে একটা স্প্যানার নিয়ে এগিয়ে চলল। পেছনে পেছনে আসছেন জোয়ারদার। হঠাৎ যদি ধরা পড়ে যাই, স্প্যানারটা সেই জন্যে। মারপিট করব না। মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল সুজন। বলব নেক্সট সাইজটা দরকার। এটা স্লিপ করে যাচ্ছে।

কথা বলতে বলতেই দু-জনে সুপারি গাছের পেছনে এসে পৌঁছাল। সন্দেহটা সত্যি হয়ে উঠতে এক পলক দৃষ্টিই যথেষ্ট ছিল। জলের ট্যাঙ্কের মধ্যে থেকে যে মোটা পাইপটা বেরিয়ে এসেছে, সেটার আর-একটা মুখ অদৃশ্য হয়ে গেছে আন্ডারগ্রাউন্ড তেলের ট্যাঙ্কের মধ্যে। নীল প্যান্ট আর জ্যাকেট পরা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে জলের গাড়িটার পাশে।

জোয়ারদার ফিসফিস করে বললেন, সুজন! আর দাঁড়ানোর দরকার নেই। ওই নীল জামা-পরা লোকটাকে আমি ডাকুয়ার ওখানে দেখেছি। লক্ষ করে দেখ ওর কপালের বাঁ ধারে একটা বিরাট লাল জড়ল আছে।

তা-ই নাকি! তাহলে আর আপনার এখানে থাকা ঠিক হবে না। লোকটা যদি আপনাকে চিনতে পারে, তাহলে… কথাটা শেষ না করেই সুজন গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। তা ছাড়া আর দেখারই বা কী আছে!

গাড়ির মুখটা ঘুরিয়ে দৌড়। ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে জোয়ারদার বলে উঠলেন, সুজন! একটা কাজ কর। আমাকে তুমি সামনের রাস্তার মোড়টায় নামিয়ে দাও। ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে। তুমি ফিরে এসে বরং চেষ্টা করো। ওই জলের গাড়িটাকে ফলো করার। এত দূরই যখন দেখা গেল, শেষটাও দেখা উচিত। জলের গাড়ির আস্তানাটা দেখে এসো। দাঁড়াও দাঁড়াও, এইখানটাতেই নামিয়ে দাও।

জোয়ারদার দরজা খুলে নামতেই সুজন বলল, আমি খবর নিয়ে আপনার বাড়িতে চলে যাব তো?

হ্যাঁ, সেই ভালো। ঘণ্টাখানেক এখানে কাটিয়ে আমি বাড়ি ফিরে যাব।

যথাপ্রত্যাশিত সুজন শেষ সন্দেহটাও ঘুচিয়ে দিয়ে গেল জয়ন্তী থেকে ফিরে এসে। জলের। তথা ডিজেলের গাড়ি সত্যিই ডাকুয়ার কারখানা সংলগ্ন তেলের রিজাভায়ার থেকেই এসেছে। আর-একটা কথাও জানতে পারা গেছে। রেলে করে যে ডিজেল আসে, সেটা খোদ জয়ন্তী অবধি যায় না। তার আগেই ডাকুয়ার কারখানার ইয়ার্ডের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তেলের রিজাভায়ারটা এখানে করার একটা বিরাট সুবিধা হচ্ছে, ট্রাক্টরে করে ডিজেল চালান দেবার পথে কোনও নদী অতিক্রম করার হাঙ্গামা পোয়াতে হয় না। প্যাডটা খুলে কলমটা হাতে নিয়ে বসে ছিলেন জোয়ারদার। নিলয়কে একটা টেলিগ্রাম করা দরকার। একটা বিষয়ে অন্তত নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে। প্রয়োজনমতো এখন যে কোনও সময়ে ডক্টর ডাকুয়াকে গ্রেপ্তার করা যায়। সাক্ষীপ্রমাণের কোনও অভাব হবে না। ডিজেল বিক্রির দু নম্বরি কারবারটা মোটেই আটঘাট বেঁধে ফাঁদেনি ডাকুয়া। কিন্তু সেটা কি শুধুই বোকামি, না তুরুপের তাসটা হাতে আছে বলেই এই দুঃসাহস? নাঃ–এ ব্যাপারে জোয়ারদারের কিছুই করার নেই। সে দায়িত্ব নিলয়ের…।

খসখস করে ড্রাফ্ট করে চলেন জোয়ারদার।

নিলয়, পরিবহণের ব্যাবসা ফাঁদতে চাও তো এখুনি এখানে চলে এসো। ডাকুয়া কোম্পানি ডিজেলের দাম অর্ধেক করে দিয়েছে। তোমার নির্দেশ পেলে অবশ্য কোম্পানিটিকে আমি লোহার বেড়ার ভেতরে পুরে ফেলতে পারি। প্রয়োজনীয় মালমশলা কয়েকদিনের মধ্যেই জোগাড় করে ফেলছি। শিগগির জানাও।–জোয়ারদার।

জোয়ারদারের টেলিগ্রামটা নিলয়ের হাতে এসে পৌঁছাল একেবারে সময়মতো। আরেকটু হলেই ও বেরিয়ে যেত। অনেক অনুরোধের পর ডক্টর সুদেব বর্মনের বৃদ্ধ পিতা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছেন দেখা করতে। ছেলের ব্যাপারে কোনও কথা বলতে তাঁর এত বিরক্তির কারণ এখনও পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেনি নিলয়। ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ-কলেজের প্রত্যেক অধ্যাপক যার সম্বন্ধে উচ্চধারণা পোষণ করত তার অকালমৃত্যু পিতাকে শোকাকুল করে না; ভাবতে অবাক লেগেছিল নিলয়ের। আইআইটি-র ডক্টর মৈত্রও সুদেবের যথেষ্ট প্রশংসা করে চিঠি দিয়েছেন নিলয়কে। নিলয় অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই বোঝাতে পারছিল না সুদেববাবুর বাবাকে। শেষকালে একদিন মরিয়া হয়েই ও অন্ধকারে একটা বিপজ্জনক ঢিল ছুঁড়েছিল। আমি আপনাকে আরেকবার অনুরোধ করছি। আমার বিশ্বাস, এ ব্যাপারটার সঙ্গে অনেক মানুষের ভালোমন্দ জড়িত। কে বলতে পারে, ডক্টর বর্মনের মৃত্যুটাও হয়তো তখন দেখা যাবে দুর্ঘটনা নয়, একটা ষড়যন্ত্র!

নিলয়ের কথার পর পুরো এক মিনিট টেলিফোনের অপর প্রান্ত নীরব ছিল। তারপর শোনা গিয়েছিল একটি সোজা প্রশ্ন, আপনি কি ডক্টর ডাকুয়া সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ পোষণ করেন?

নিলয় ঝুঁকি নিয়েই উত্তর দিয়েছিল, ব্যক্তিগতভাবে করি, কিন্তু সেটাকে সমর্থন করার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। সেই জন্যেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি।

কাজ হয়েছে তাতেই। বৃদ্ধ রাজি হয়েছেন দেখা করতে। ভালো হল টেলিগ্রামটা আগেই হাতে পেয়ে। প্রয়োজন হলে এটাকেও সে ব্যবহার করতে পারবে। তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। ডিজেল ব্যবহার করে ডাকুয়া বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে না। তেলটা সে বেচছে ব্ল্যাকে–পয়সা কামাবার জন্যে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে একটাই–কীভাবে এই বিশাল পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে! জলশক্তি থেকে? ওই ঝিরঝিরে ঝরনার জল থেকে? অসম্ভব!

ট্যাক্সি! হাঁক দিল নিলয়। চিন্তা করার সময়ের অভাব হবে না।

কঁহা জাইয়েগা?

 হরিশ মুখার্জি রোড।