দাবা খেললেন ঝন্টুমামা
হাসিমুখে ঢুকেছিলাম। গুনগুন করতে করতে (কীসের সুর মনে পড়ছে না)। বারান্দা পেরিয়ে দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে পা-ও দিয়েছিলাম, তারপরেই সেই দৃশ্য!
প্রচণ্ড ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। গুটিগুটি করে বেড়ালের মতো নিঃশব্দে দু-পা পিছিয়ে এলাম। কোনওরকমে দরজাটা গলে বাইরে বেরতে পারলে হয়। তারপরেই ছুট! এই মুহূর্তে একটা লেজের অভাব অনুভব করছি। আমাদের মূক বন্ধুরা অসময়ে কেন ওই বস্তুটাকে গুটিয়ে ফেলে বুঝতে পারছি।
এ বাড়িতে পা দেওয়ার সময়েই মনে রাখা উচিত ছিল, বি কেয়ারফুল! অর্থাৎ কেয়ার না করলেই ফুল। যা-ই হোক, গতস্য শোচনা করে লাভ নেই। এখন পালাতে পারি যদি..
–আরে, সুগতদা! চলে যাচ্ছেন নাকি?
ফিনিশ! একটি বাক্যে এবং তার সরবতা, তরি আমার হঠাৎ ডুবে গেল। মাঝে মাঝে মনে হয়, আদিদাসকে আমরা যতটা নির্বোধ ভাবি, মোটেই তা নয়। ঝন্টুমামার এই চেলাটি মাঝে সাঝে রীতিমতো হাঙ্গামা সৃষ্টি করে।
ঝন্টুমামার স্যাঙাত আবার হেঁড়ে গলায় হেঁকে উঠল, সত্যি চলে যাচ্ছেন?
বেটার শুধু হাতে-পায়ে মাসল নেই, গলাতেও আছে। এতক্ষণে নিশ্চয় ঝন্টুমামার কর্ণকুহরে সবই পৌঁছে গেছে।
–না ভাই, যাব আর কোথায়! যাওয়া মানেই তো আসা। না গেলে কি ফিরে আসা যায়?
দরজার দিকে এগতে এগতেই মাথা ফিরিয়ে হাসিমুখে বললাম। ছুট লাগাবার একটা সুযোগ কি…
পেলাম না। ঝন্টুমামা বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। অদ্ভুত সম্মোহনী দৃষ্টি। আপনা থেকেই বলে ফেললাম, এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিয়ে আসছি, ভুলে গিয়েছিলাম…
–আমার স্টকে ঢের সিগারেট আছে।
–না, ঝন্টুমামা, রিসেন্টলি আমি ব্র্যান্ড চেঞ্জ করেছি।
–রথম্যানস না জন প্লেয়ারস? টাকা দিয়ে দাও, আদিদাস নিয়ে আসবে। ঘরে এসো।
–দিন-না, আমি এখুনি এনে দিচ্ছি। ক-টাকা লাগবে?–আদিদাসের আগ্রহের অভাব নেই। কিন্তু আমারও সে কথা শোনার উপায় নেই।
অবশেষে বাঘের মুখে গিয়েই পড়তে হল।
টুলটা টেনে বসো। এই দানটা শেষ করে নিই।
এই আরেক যন্ত্রণা। চেয়ারে বসা চলবে না। ঠেস দিয়ে বসলে নাকি মনঃসংযোগের পাওয়ার কমে যায়।
আমাকে সামনে বসিয়ে রেখে ঝন্টুমামা আমার কথা ভুলে সামনের ছোট টেবিলটার ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। আগ্রহের অভাব নেই প্রমাণ করার জন্যে আমাকেও ঝুঁকে বসতে হয়েছে। ঝন্টুমামার চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু আমার দৃঢ় ধারণা, সেখানে এখন নরঘাতকের দৃষ্টি জ্বলছে, অদৃশ্য প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য দৃঢ়সংকল্প। হাতে কাজ না থাকলেই মাথার কাজ নিয়ে ঝন্টুমামা মেতে ওঠেন। কে জানে, ক-ঘণ্টা ধরে উনি একাই দু-জনের জায়গা দখল করে আপন মনে দাবা খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন!
–নাঃ, তোমাকে আর বসিয়ে রাখব না। ঝন্টুমামা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। পাশের চেয়ার থেকে ফ্ল্যাশগান সমেত ক্যামেরাটা তুলছেন দেখেই বুঝতে পারলাম, বোর্ডের একটা ছবি তুলে রাখতে চান। পরে আবার সেই অনুযায়ী বোর্ড সাজিয়ে…
ঝন্টুমামা!–খুবই কাহিল শোনাল আমার গলাটা।
–কী হল?
–না, বলছি, মাথাটা বড় ধরেছে। আপনি খেলাটা চালিয়ে যান, আমি দেখি।
–মাথা ধরেছে! বলনি কেন এতক্ষণ? এমন একটা ওপেনিং চাল দেব, সঙ্গে সঙ্গে মাথা খুলে যাবে। আরে, দাবার মতো মাথার ওষুধ আর দুটো আছে নাকি?
ঝন্টুমামার ফ্ল্যাশগান ঝলসে উঠতেই আদিদাস এসে ক্যামেরা নিয়ে চলে গেল ডার্করুমে। ঝন্টুমামা নতুন করে বোর্ড সাজাচ্ছেন।
আরেকবার চেষ্টা করলাম।
ঝন্টুমামা, দাবা খেলাটা কিন্তু বিজ্ঞানীদেরই বেশি মানায়। আপনার বোধহয় খেয়াল নেই, আমি নিলয়ের বন্ধু হলেও ইতিহাস পড়াই তো, তাই…
ইতিহাস? তুমি কি মনে কর ইতিহাসের সঙ্গে দাবার কোনও সম্পর্ক নেই! জান দাবার জন্ম কোথায়?
ইতিহাস পড়াই বলে দাবার ইতিহাস জানতে হবে, এমন আবদার ঝন্টুমামারই সাজে।
–বেশ, ইতিহাসের কথাই তুলছ যখন, দাবার বদলে বরং চতুরঙ্গই খেলব। বৌদ্ধ যুগের এই খেলাটির নিয়ম নিশ্চয় জান? সে কী হে, ইতিহাসের অধ্যাপক দাবার আদিরূপ চেন না! বেশ, তাহলে আরেকটু না-হয় এগিয়ে আসা যাক। নববল গুপ্ত যুগের আমলের নিয়মকানুন অনুযায়ী তাহলে বোর্ড সাজাই।
–না, ঝন্টুমামা, দাবার ব্যাপারটাই আমার মাথায় ঢোকে না।
–বুঝেছি, তুমি একটি কুঁড়ের হদ্দ। এড়িয়ে যেতে চাইছ। না না, এটা ঠিক নয়। এই বয়সেই যদি মস্তিষ্কচর্চা ত্যাগ কর, তাহলে আমার মতো বয়সে তো সব গ্রে-সেলেই চর্বি জমে যাবে। আচ্ছা, দাঁড়াও–তোমাকে একটা নতুন খেলা শেখাব। মহারাজ আর সেপাই। এ-ও দাবার প্রাচীন একটা, রূপ কিন্তু ভারী সোজা। নিশ্চয় মজা লাগবে।
লজ্জার মাথা খেয়ে কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারলাম না, সাধারণ দাবা খেলাই যেখানে বিভীষিকা…
ঝন্টুমামা শুরু করে দিলেন ব্যাখ্যা। এই খেলায় এক পক্ষের খুঁটিগুলো সাধারণ দাবা খেলার মতোই–কোনও তফাত নেই। সেই রাজা, মন্ত্রী, দুটো নৌকো, দুটো গজ, দুটো ঘোড়া আর আটটা বোড়ে বা সেপাই। তাদের চালেও কোনও তফাত নেই। মজা হচ্ছে, অপর পক্ষ কিন্তু একটিমাত্র ঘুটি নিয়েই খেলবে। সেই খুঁটিটার নাম মহারাজা। মহারাজাকে মন্ত্রীর মতো চালানো যেতে পারে, আবার ঘোড়ার মতো আড়াই চালও দেওয়া যায়। খেলার উদ্দেশ্য হচ্ছে মহারাজাকে মাত করা বা অচল করে দেওয়া।
–এ তো একতরফা খেলা। বেচারা মহারাজা একা একা কতক্ষণ লড়বে!
–দেখাই যাক কতক্ষণ লড়ে! আমিই না-হয় বেচারার ভূমিকা নিই।
ফাঁদে পা দিচ্ছি জেনেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না যে, এরকম খেলায় মহারাজার জেতার কোনও সুযোগ থাকতে পারে।
সাড়ে সাত। এই আমার স্কোর। সাধারণ দাবা খেলায় ঝন্টুমামার বিরুদ্ধে আমার হাইয়েস্ট স্কোর আঠেরো মিনিট। এবার তার চেয়েও সাড়ে এগারো মিনিট কম লেগেছে। একা মহারাজা তুড়ি-লাফ মারতে মারতে আমার সৈন্যসাবুদ, নৌকা, ঘোড়া সব গপগপ করে খেয়ে ফেলেছে।
কী, এবার বিশ্বাস হল তো! খেলাটা যে মোটেই এলেবেলে নয়, স্বীকার করবে নিশ্চয়? তাহলে আরেক দান হয়ে যাক!
আর থাকতে পারলাম না–এভাবে আমাকে ধরে-বেঁধে হারিয়ে আপনি হয়তো আনন্দ পান, কিন্তু….
আমি আনন্দ পাই? তোমাকে হারিয়ে? বল কী! হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। ঝন্টুমামা।–তুমি কী ভাবছ, তোমার সঙ্গে দাবা খেলে আমার কোনও তৃপ্তি আছে? নিল–কিসসু নেই। প্রতিপক্ষ প্রবল হলে তবেই না খেলার মজা।
–আমি কি একবারও গর্ব করে বলেছি যে, আমি ভালো খেলতে পারি!
-তুমি বললেই বা কী! আমি জানি না? জেনে রাখ, তোমারই ভালোর জন্য আমার বুদ্ধিগুলোকে আমি শুধু নষ্ট করি। এর চেয়ে আমার একা একা বসে খেলা ঢের ভালো।
–আমিও তো তা-ই বলি। একা একাই খেলুন। দয়া করে এভাবে একজনকে হারিয়ে মূর্খ প্রমাণিত করে… নিজে যদি কখনও হারতেন, বারবার হারতেন, হারব জেনে হারতেন…
দাঁড়াও দাঁড়াও। অকারণে উত্তেজিত হয়ো না। আমি একবার নয়, বহুবার হেরেছি, কারণ আমি পেশাদার নই। পেশাদারদের মতো চ্যাম্পিয়নদের সেরা চাল মুখস্থ করি না। তবে তোমার অবস্থা দেখে একজনের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। ওই যে বলছিলে, হারব জেনেও হারার কথা–হ্যাঁ, হারব জেনেও, হারাটাই স্বাভাবিক জেনেও কিন্তু আমি চান্স নিতে ছাড়িনি এবং জিতেছিলাম।
বুকের ওপর থেকে ভার নেমে গেল। একটা নয়, দুটো। প্রথমত, দাবা খেলার বিড়ম্বনা, দ্বিতীয়ত, রেগে যাওয়ার জন্য অনুতাপ। ভাগ্যিস বুদ্ধিদেবী আমার প্রতি প্রসন্ন নন, আর সময়মতো রাগটা প্রকাশ পেয়েছিল, না হলে ঝন্টুমামার গল্পটা তো আর শোনা হত না।
নিউ ইয়র্কের ডাউন-টাউনে নেহাতই একটা এলেবেলে হোটেলে উঠেছিলেন ঝন্টুমামা! ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকের আমন্ত্রণে যিনি এখানে এসেছেন, তাঁর পক্ষে এটা বড়ই বেমানান। সবাই জানে ওই সোসাইটি গুণীজনের সম্মান দিতে এতটুকু কৃপণ নয়। অথচ ঝন্টুমামা…
সোসাইটির চেয়ারম্যানও ঝন্টুমামাকে সেই কথাই বলেছিলেন। কারণটা জানার পর তিনি কিন্তু হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ার উপক্রম। ঝন্টুমামা কমিশনের টাকা কিছুটা বাঁচিয়ে দেশে ফেরার পথে লন্ডন ঘুরে যেতে চান। না, লন্ডন তাঁর দেখা। বার তিনেক গেছেন। কিন্তু হলে হবে কী, একটা দারুণ জিনিস মিস করেছেন। এই নিয়ে তাঁর বড়ই আক্ষেপ ছিল। এবার আর না দেখে ছাড়বে না। ব্যাপারটা অতি সামান্য। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে একটা দ্বাদশ শতাব্দীর অসামান্য দাবার বোর্ড আছে–অহিল অব লুইস চেস সেট নামে পরিচিত। ভাইকিংরা নাকি এটিকে হেব্রাইডিসে নিয়ে এসেছিল।
কাম অন সেন। দ্যাটস এ গুড ওয়ান অ্যাজ এ জোক।
ইয়াঙ্কি সাহেবের হাসি আর থামে না। শুধু একটা দাবা খেলার বোর্ড দেখতে কেউ নিউ ইয়র্ক থেকে লন্ডনে ছুটে যাবে, এটা হিসেবি প্র্যাকটিক্যাল মানুষের পক্ষে উপলব্ধি করা সত্যিই শক্ত। আর সেই জন্যেই ঝন্টুমামা অপমানিত বোধ করেননি।
সাহেব কিন্তু তারপর নিজের বিপদ ডেকে আনল। হঠাৎ বলে বসল, দাবা খেলার বোর্ড তো দেখতে যাচ্ছ, খেলার নিয়মকানুনগুলো জান কি?
বিনীতভাবে ঝন্টুমামা বললেন, তিনি শুধু শতরঞ্জ, নববল, চতুরঙ্গ, মহারাজা ও সেপাই এবং ইন্টারন্যাশনাল গেমের ব্যাপারস্যাপার জানেন। এ ছাড়া অন্য কোনও ধরনের খেলা যদি হয়, তাহলে শিখে নিতে তিনি প্রস্তুত।
এরপরেও সাহেবের শুভবুদ্ধির উদয় হল না। বেমক্কা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসলেন, তবে হয়ে যাক এক হাত। তিনি নাকি এককালে ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন!
প্রথমবারে পনেরো মিনিটে কাত হলেন সাহেব। দ্বিতীয়বারে সাত চালে।
সাহেবের হ্যান্ডশেক করার ধরন থেকেই ঝন্টুমামা বুঝতে পারলেন, ব্যাপারটায় কিন্তু এখনও ইতি পড়েনি।
পরের দিন আরেক সাহেব এসে রীতিমতো রূঢ় ভাষায় কৈফিয়ত তলব করল, ভালো হোটেলে থাকার জন্য সোসাইটির কাছ থেকে পয়সা নিয়েও এভাবে থার্ড গ্রেড হোটেলে থাকাটার মানে কী?
ঝন্টুমামা পালটা প্রশ্ন করলেন, এক হাত দাবা হোক তাহলে?
মুখটা একটু যাকে বলে পাংশু হয়ে গিয়েছিল সাহেবের। তারপর প্রায় ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মতোই রাজি হয়ে গেল।
আধ ঘণ্টায় তিনবার হেরে সে বিদায় নিল। কিন্তু যাবার সময়ে তার কথাগুলো ঝন্টুমামাকে চিন্তায় ফেলে দিল।
হেলমহোলৎজকে যদি তিনি হারাতে পারেন, তবে বোঝা যাবে তাঁর এলেম। শেষকালে কি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন এনে তাঁকে হারাবার জন্য… ঝন্টুমামা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, তিনি অপেশাদার খেলোয়াড়। কোনও প্রতিযোগিতামূলক খেলায়…
সাহেব বাঁকা হেসে জানাল, তার কোনও দরকার নেই। হেলমহোলৎজও শৌখিন খেলোয়াড়।
ঝন্টুমামার মনে একটা খটকা লাগল। কে এই হেলমহোলৎজ জানা দরকার। হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লেন, টেলিফোন বুক থেকেই শুরু করলেন খোঁজখবর। দাবার জগতের কয়েকজনকে পেয়েও গেলেন, কিন্তু তারা কেউই হেল্মহোলৎজের নাম শোনেনি। মনে একটা অস্বস্তির কাঁটা নিয়েই বেরিয়ে আসছেন–হঠাৎ কী মনে হল, আবার রিসিভার তুললেন। এবার ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকের অফিস, হেলমহোলজকে একবার দয়া করে ডেকে দেবেন? উত্তরটা পেতেই তিনি জানতে চাইলেন, কিছু মনে করবেন না, আমি হেমহোলৎজের পুরানো বন্ধু। বহুদিন বাদে যোগাযোগ হচ্ছে, এখন ও কোন ডিপার্টমেন্টে, মানে…
-কম্পিউটার ডিভিশন। ইনচার্জ।
ফোনটা কেটে দিলেন ঝন্টুমামা। আর তো কিছু জানার দরকার নেই। হেলমহোলংজ কম্পিউটার যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে ঝন্টুমামাকে হারাতে চায়। মানে, হারাবেই। ঝন্টুমামা দেখতে পান, বছরের পর বছর ধরে এই যন্ত্রকে লাস্কর, কাঁপাব্লাঙ্কা, বভিন্নিক, পেত্রোসিয়ান প্রমুখ প্রাচীন চ্যাম্পিয়ন থেকে শুরু করে আধুনিকতম মাস্টারদেরও খেলার চাল, ছক ইত্যাদি শেখানো হয়েছে। অর্থাৎ ঝন্টুমামাকে খেলতে হবে পনের-কুড়িজন বিশ্বচ্যাম্পিয়নের সঙ্গে। অবশ্য তিনি সরাসরি অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু তাহলে তো…
ভাবতে ভাবতেই কখন যে তিনি ম্যাসির মার্কেট মল-এ ঢুকে পড়েছেন খেয়াল করেননি। ভালোই হয়েছে, একটা শ্যাম্পু দরকার। নিউ ইয়র্কেও যে চুলে এত আঠা হয়, জানা ছিল না।
হোটেলে ফিরেই ফোন পেলেন। হেলমহোলংজের আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন তিনি। আজই সন্ধেয় গাড়ি পাঠিয়ে দেবে ওরা।
সৌজন্যের কোনও ধার ধারে না এরা। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, হেলমহোলজ একবারও গোপন করার চেষ্টা করেনি যে, কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে খেলবে বলেই আসর সাজিয়েছে। পরিষ্কার জানিয়ে দিল, দেখ সেন, আগেই একটা কথা বলে রাখি। আজকের এই মডার্ন এজে মাথাকে অকারণে ট্যাক্স করার কোনও মানে হয় না। আজ যদি কেউ কাগজ-কলম নিয়ে পাতার পর পাতা যোগ দেয় এবং কোনও ভুল না-ও করে, তবু তাকে আমরা বলব মূর্খ। কারণ, সাধারণ একটা ক্যালকুলেটর ব্যবহার করেই সে কাজ করা যায় এবং আরও সংক্ষেপে করা যায়।
ঝন্টুমামা নীরবে শুনছেন।
-তাই বলছি, ভেবে দেখ, খেলতে চাও কি না। কারণ আমি দাবা খেলার শুধু চালগুলোই জানি, কিন্তু তবু তুমি পারবে না। এই যে দেখছ–
-আগেই দেখেছি। কিন্তু এত দূর এসেছি খেলব বলে, তা ছাড়া হারজিতের ব্যাপারটা আমার কাছে বড় নয়। কম্পিউটারের সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতাটাও তো আমার কাছে নতুন।
বাঃ, বেশ বলেছ। যাক, তুমি হারবে জেনেও খেলতে চাইছ শুনে খুশি হলাম। বুদ্ধিশুদ্ধি কিছুটা আছে তাহলে।
–খেলা শুরু হয়ে গেল। তিন-চারটে চাল দেবার পরেই ঝন্টুমামা বুঝতে পারলেন, হেল্মহোলঞ্জ একটা ডাহা মিথ্যে কথা বলেছে। সে বেশ ভালোই খেলা জানে। কম্পিউটারের নিখুঁত কিন্তু ছক-বাঁধা স্মৃতিকে বিভ্রান্ত করার জন্যই একেবারে আনাড়ির মতো এলোমেলো চাল দিতে শুরু করেছিলেন ঝন্টুমামা। সাহেব কিন্তু ফাঁদে পা দেয়নি। প্রয়োজন না হলে সে কম্পিউটারের ওপর নির্ভর করবে না।
মিনিট কুড়ি অসম প্রতিযোগিতা চলার পর পিঠ সোজা করে বসলেন ঝন্টুমামা। চুলগুলো বারবার চোখের ওপর ঝুলে পড়ে বিরক্ত করছে। চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে নিলেন। তারপর আবার শুরু হল অসম্ভবের সঙ্গে লড়াই।
আড়াই ঘণ্টা বাদে কম্পিউটার হেরে গেল।
–বেস্ট অব থ্রি? তিনটে গেমের ফলাফলের ওপর হারজিতের বিচার হওয়া উচিত, কী বলুন?
ঝন্টুমামাই প্রস্তাব দিলেন। হেলমহোলৎজের মুখের চেহারার ছবি তুলে রাখা উচিত ছিল। বিড়বিড় করে বলছিল, কিছু একটা নিশ্চয় ঘটেছে। কম্পুটা এরকম গড়বড় করছে!
কলকবজা নিয়ে কিছুক্ষণ পরীক্ষানিরীক্ষা করে সে নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে এল।
কিন্তু সে আর কতক্ষণ! পরবর্তী গেমটা পনেরো মিনিটেই খতম। ঝন্টুমামার ইচ্ছে ছিল, বেশ কিছুক্ষণ ধরে বঁড়শিতে মাছ খেলানোর মতো চালিয়ে যাবেন, কিন্তু বেটা সন্ধেবেলা থেকে এক গেলাস জল অবধি অফার করেনি। বড় খিদে পেয়েছিল।
ঝন্টুমামা থামতেই প্রশ্ন করলাম, তারপর? তারপরের কথা ঝন্টুমামা জানেন না। হেলমহোলৎজ রাগের চোটে তার আদরের কম্পূর মাথায় ডান্ডা মারলেও অবাক হবার কিছু নেই। যে যন্ত্রের মাথা হঠাৎ হঠাৎ বিগড়ে যায়…
–কিন্তু ঝন্টুমামা, আপনার এই গল্প কেউ বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। কম্পিউটারকেও আপনি ঘোল খাইয়ে দিলেন…।
-করবে করবে। বিশ্বাস করবে। তুমিও করবে। কীভাবে ঘোল খাইয়েছিলাম, সেটা শুনলেই বুঝতে পারবে, আমি শুধু বড়াই করার জন্য এতক্ষণ ধরে বকবক করিনি। বেচারা কম্পুর কোনও দোষ নেই। আমি যে বারবার চুল আঁচড়াচ্ছিলাম, সেটা তো হেলমহোলৎজেরও চোখে পড়েনি। কিংবা চোখের দেখা মন অবধি পৌঁছায়নি। ভাবেনি। এবার বুঝলে? বুঝলে না, তাহলে এতক্ষণ শুনলে কী? বলিনি, ম্যাসির মার্কেট মল থেকে শ্যাম্পু কিনেছিলাম? শ্যাম্পু করা চুলে চিরুনি দিলে কী হয়? শীতকালে দেখনি, কেমন স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি তৈরি হয়? চুল আঁচড়ে চিরুনিটা হাতের কাছে ধরলে লোমগুলো খাড়া হয়ে ওঠে। কুঁচো কাগজকেও টেনে নেয়। বিদ্যুৎমোক্ষণের সময় পটপট আওয়াজও শোনা যায় কান খাড়া করলে।
–এই সামান্য স্থিরবিদ্যুৎ থেকেই কম্পিউটার বিগড়ে গেল?
সামান্য? কী বলছ তুমি! এইভাবে কয়েক হাজার ভোল্ট তড়িৎ-বিভব তৈরি হয়। যদিও কারেন্টের পরিমাণ খুব কমই হয়, তবু কম্পিউটারকে বিকল করে দেওয়ার পক্ষে ওই ক্ষণেকের ইলেকট্রিক চার্জই যথেষ্ট। আর সে প্রমাণ তো হাতেনাতেই পাওয়া গেছে। এই সেদিনও একটা ম্যাগাজিনে পড়ছিলাম, ঠিক একইভাবে একটা কম্পিউটারের মাথা হঠাৎ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অনেক খুঁজে পেতে তবে তারা বুঝতে পেরেছিল যে, একজন কর্মীর নাইলন প্যান্ট আর জামার ঘর্ষণে উৎপন্ন বিদ্যুৎ থেকেই এমনটা ঘটছিল।
[প্রথম প্রকাশ: কিশোর মন, ১৯৮৪ পূজাবার্ষিকী]