সরোজমামার শিশি

সরোজমামার শিশি

 ট্রেনে উঠেই সরোজমামা রেগে গেল, দেখে-শুনে কী ট্রেনে তুললি বলতো? এত ভিড়! জানিস তো আমার শরীরের অবস্থা। সারারাত জাগার ধকল সইলে হয়!

কী বলছ মামা? অপু বেজায় অবাক। জান, এটা মোগলসরাই প্যাসেঞ্জার! সেই মোগল আমল থেকে চলছে। আর কোথায় যাচ্ছে, সেটাও ভেবে দেখ! সরাইখানায়! ট্রেনের নামের মধ্যেই তো ঐতিহাসিক ফ্লেভার। তুমি ইতিহাসের অধ্যাপক বলেই তো…

অপুর তারিফ না-করে পারা যায় না। ওর ইমাজিনেশনের তুলনা নেই। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে গিরিডিতে এক মাস বাড়ি ভাড়া করার পর তাই প্রথমেই অপুর কথাটাই মনে পড়েছিল। ছুটির ক-দিনে একটা ঐতিহাসিক অভিযান লেখার বাসনা আছে। অপু পাশে থাকলে সুবিধে অনেক।

চন্দননগরে ট্রেন থামতেই অপু চোঁ করে ছিটকে গেল প্ল্যাটফর্মে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে জানলা দিয়ে দু-ভাঁড় চা গলিয়ে দিল। এত রাত্তিরে চা ম্যানেজ করা চাট্টিখানি কথা নয়।

অপু ফিরে আসতে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে সরোজমামা বললেন, কী ভাবছিলাম জানিস? ভাবতে ভাবতে মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম। ধরু–আমরা মোগল আমলে গিরিডি চলেছি।

ট্রেনে করে তো?

ধ্যাত–বলতে দে না। মোগল আমল, হ্যাঁ। সেই গর্জাস মোগল আমল। ভাবু একবার! ঘোড়ার গাড়ি করে পিচ ডার্ক নাইটে মাইলের পর মাইল টগবগ-টগবগ-টগবগ-টগবগ-কী সব ছাঁইপাশ ইংরেজি বই পড়িস! একবার যদি রিয়্যাল ইতিহাসে ডুবে যেতে পারিস না…

আচ্ছা মামা, মোগল আমলে কি শালা গালাগালটা চালু হয়েছিল?

 মামার হাতের ভাঁড়টা ভরতি থাকলে চলকে গিয়ে চা পড়ে যেত।

 না, মানে হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করল… অপুর দিকে তাকাতেই সরোজমামা দেখল, ওপাশের বাঙ্কে মোটা লোক দুটোর বকবকানি বন্ধ হয়ে গেছে। কটমট করে তাকাচ্ছে দুটোতে। ট্রেনে ওঠা ইস্তক গলা ছেড়ে গল্প শুরু করেছে, আর ওদের কথার মাত্রাই হল– গালাগাল।

সরোজমামা অপুর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, অপু! আমরা কিন্তু দুর্বল। আমার শরীর খারাপ, আর তুই একা পারবি কি? ডোন্ট গেট ইনটু কনফ্রন্টেশন!

.

মোগলসরাই প্যাসেঞ্জার ভোরবেলা মধুপুরে পৌঁছাল। এখান থেকে ট্রেন বদল করতে হবে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চা খেয়ে খালি ভাঁড়টা ছুঁড়ে ফেলতে যাবে, হাঁ-হাঁ করে উঠল সরোজমামা, ফেলিসনি! ফেলিসনি! আমায় দে।

কী হবে শুনি?

 স্যাম্পল কালেক্ট করছি। তুই তো মোষের মতো ঘুমালি। আর আমি মানুষ বলেই সারারাত জেগেছি। কতবার যে চা খেতে হয়েছে, কী বলব। শরীরের আর কিছু রইল না। তবে হ্যাঁ-লাভ একটা হয়েছে–এই দেখ! সরোজমামা গ্ল্যান্ডস্টোন ব্যাগ খুলে ধরতেই গোটা আষ্টেক চায়ের খুরি দেখা দিল। দেখলি? বুঝলি কিছু? বিভিন্ন স্থানের হস্তশিল্পের নিদর্শন। ফোক আর্ট। ট্র্যাডিশন। এই হরেকরকম ছাঁদের ভাঁড়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে হাজার হাজার বছরের

মাটি! স্রেফ মাটি! অপু কথাটা শেষ করে দিল।

কী বললি? মামা চোখ পাকাল।

বলছি তো–মাটি। মাটি অনুযায়ী বিভিন্ন অঞ্চলের ভাঁড় বিভিন্নরকম চেহারা নেয়। এটা তোমার হিস্ট্রি নয়, সায়েন্সের ব্যাপার।

অপুটা সায়েন্সকে যেন হাতুড়ির মতো ব্যবহার করে। সমস্ত সুন্দর কল্পনাকে ভেঙে চুরমার করেই ওর যেন আনন্দ।

সরোজমামা গম্ভীর মুখে স্মরণ করিয়ে দিল, অপু তার চেয়ে বয়সে পনেরো বছরের ছোট। কথা বলার সময় সর্বদা যেন খেয়াল রাখে।

.

গিরিডিতে ওরা টাঙা নিল। শহর থেকে দূরে নিরিবিলি জায়গা জেনেই বাড়িটা ভাড়া করা হয়েছিল। কিন্তু বাড়ির চেহারাটা ওদের হতাশ করল। একতলা বাড়ি। সামনেই দশ-বারো ধাপ সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলে প্রথমেই একটা ছাত-খোলা বারান্দা পড়বে। সিঁড়ির মুখে দু-পাশে বারান্দার ওপর পিঠে ঠেস দিয়ে বসবার মতো সিমেন্টের বেঞ্চি। বাড়ির দেওয়াল জরাজির্ণ। নোনা-ধরা দেওয়ালে লাল ইটের পাঁজরার উঁকিঝুঁকি। কালো কুচকুচে জানলা-দরজার দিকে আঙুল তুলে সরোজমামা মন্তব্য করল, ব্যাড টেস্ট!

উঁহু, উইয়ের উপদ্রব। আলকাতরা।

সরোজমামা ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলে, বুঝলি, এই জন্যেই বাঙালিদের ব্যাবসা হয় না। বাড়ি ভাড়া দেবে অথচ মেনটেন করবে না। এই যদি হত কোনও…।

নমস্কার! আপনি নিশ্চয় সরোজবাবু? গলার আওয়াজে পেছন ফিরতেই দেখা গেল, লাঠি হাতে এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে রয়েছেন রাস্তার ওপরে একটা কুঁড়েঘরের দরজায়। ওটাকে ওরা চায়ের দোকান বলে ভুল করেছিল।

দয়া করে বাড়ির চাবিটা যদি নিয়ে যান। আমিই দীননাথ লাহিড়ী। ছেলে বাড়ি নেই, সায়াটিকা আমায় একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছে…

অপু তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল। চাবিটা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমাদের জন্য আপনি বাড়ি ছেড়ে দিয়ে…।

বৃদ্ধ দীননাথ একটু হেসে অপুর পিঠে হাত রেখে বলল, না ইয়াং ম্যান। আমরা এই কুঁড়েতেই থাকি। ওই বাড়িটুকু থেকেই তো যা রোজগার!

কিন্তু আমরা তো মাত্র দু-জন, অত বড় বাড়ি তো

সবাই কি বাবা তোমাদের মতো? ব্যবহার করা বাড়ি ভাড়া নিতে চায় না। ডিজিজ-এর ভয় পায়। ফি-বছর চুনকাম করার কোত্থেকে বল? যাও ইয়াং ম্যান, বিশ্রাম নাও। ঘরদোর সব পরিষ্কার করা আছে। উঠোনের কুয়োর জল খেতে পার।

.

একটা চোরাকুঠুরি আছে, আবিষ্কার করার পর বাড়িটা সরোজমামার পছন্দ হয়ে গেছে। শোবার ঘরের মেঝের ওপর কাঠের ডালা টেনে তুললেই এক সারি সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। রহস্যের গল্প পেয়ে সরোজমামা টর্চ হাতে এক্সপ্লোর করবার জন্য উদগ্রীব হয়ে। উঠেছে দেখে অপু বলেছিল, ফটকিরি আছে তো? সঙ্গে নিয়ে।

কেন? মামা থমকে দাঁড়িয়ে ছিল।

সে কী! তুমি জান না, ফটকিরি হল কাঁকড়াবিছের মোক্ষম দাওয়াই!

খেয়েদেয়ে, হেঁটে বেড়িয়ে প্রথম দুটো দিন দেখতে দেখতে কেটে গেল। সরোজমামা এখনও লেখায় হাত দেয়নি। গুছিয়ে বসার জন্য সময় নিচ্ছে। তা ছাড়া অপুকে বলে দিয়েছে, একবার লেখায় হাত দিলে আর কোথাও বেড়াতে যাওয়াটাওয়া চলবে না।

নন্দনকানন ও উশ্রী জলপ্রপাত যাবার খোঁজখবর ও ব্যবস্থা করতে বেরতে যাচ্ছিল অপু। ইতিমধ্যেই সে একটা সাইকেল ভাড়া করে ফেলেছে। বাজারটা এখান থেকে অনেক দূরে। মামা বললে, দেখিস তো, বাজারে একটা ছিপ পাস কি না?

ছিপ, আবার সেই শেওলা পুকুরে পা হড়কাবার ব্যবস্থা করছ?

মামা জ্বলে উঠল, একবার পড়েছি বলে কি… তুই… তুইও পড়তিস, যা বলছি, করবি। অনেক মাছ আছে।

ঘণ্টাখানেক পরে বাড়ির সামনে সাইকেল থেকে নামতে নামতেই মামা ছুটে এল। অপু প্রমাদ গুনল। ছিপ না কেনার একটা জুতসই যুক্তি খাড়া করতে না পারলে…।

বাঁদর ছেলে! জোয়ানের আরক এনেছিস?

সত্যিই থ হয়ে গেল অপু, জোয়ানের আরক!

আকাশ থেকে পড়লি যেন! যেন কিছু জানিস না। জোয়ানের আরকের শিশিটা তো ভেঙে চৌচির। তুই তো ভেঙেছিস!

আমি? আমি ভেঙেছি? তুমিই তো বললে কুলুঙ্গিতে রাখতে। কাল রাত্তিরেই তো খেলে।

খাব বলেই তো আনা। শিশিটা ভাঙলি কী করে বল তো?

তোমার মাথাটাথা খারাপ হয়েছে? আমার কাজ নেই? চল তো দেখি– কুলুঙ্গির কাছে এসে অপুও অবাক। শিশিটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। জোয়ানের আরক ছড়িয়ে পড়েছে কুলুঙ্গির ভেতর থেকে দেয়াল বেয়ে। আঙুল ছুঁইয়ে অপু দেখল, এখনও ভিজে ভিজে লাগছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ভেঙেছে, না হলে চুনসুরকির গাঁথনির দেয়াল এতক্ষণে শুষে নিত। ভাঙল কী করে শিশিটা? উলটেও তো পড়েনি দেখা যাচ্ছে, তাহলে তলার অংশটা এরকমভাবে থুবড়ে বসে থাকত না।

অপুকে আবার সাইকেল নিয়ে বাজারে ছুটতে হল। ওষুধ কিনে না-আনা অবধি মামাকে কিছুতেই বোঝানো যাবে না যে, গিরিডির মানুষেরও অসুখবিসুখ করে।

দুপুরে খেতে খেতে সরোজমামা বোঝাচ্ছিল, বুঝলি অপু, তোকে একটু কষ্ট দিলাম হয়তো, কিন্তু অ্যাকোয়াটাইকোলিস ছাড়া আমি একেবারে পঙ্গু। ওটা আমার অন্ধের যষ্টি। জোয়ানের আরক বললে ওষুধটার তেজ যেন ফিল করা যায় না।

হাত ধোবার জন্যে কুয়ো থেকে জলভরা বালতি টেনে তুলছে, হঠাৎ মামার চিৎকার কানে আসতেই চমকে গেল। বালতি-দড়ি ছেড়ে এঁটো হাতে ছুটে এল অপু।

মামা আতঙ্কে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুলুঙ্গির সামনে। বাঁ হাতে গেলাস, ডান হাতে চামচে। নতুন জোয়ানের আরকের শিশিটাও টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। চমক লাগার মতোই কাণ্ড। সবে ঘণ্টাখানেক হল ওষুধটা কিনে এনেছে। নিজে হাতে বসে থেকে বার করেছে অপু। টিনের ছিপিটাকে মোচড় দিয়ে সিল কেটেছে, তারপর শিশিটা বসিয়ে রেখেছে কুলুঙ্গিতে। এর মধ্যে বাড়িতে যে অন্য কোনও লোক ঢুকেছে তা-ও নয়। দীননাথবাবুর বাড়ি থেকে খাবার তো দিয়ে গেছে সেই এগারোটার সময়।

সরোজমামা ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলে, আর আমি এ বাড়িতে এক দণ্ড বাস করতে রাজি নই।

অত অধৈর্য হচ্ছ কেন, ইনভেস্টিগেট করলেই নিশ্চয়…।

কর তুমি ইনভেস্টিগেট, আমি নেই। এ তোমার সায়েন্সের কর্ম নয়। পুরো ভৌতিক ব্যাপার। বলি, যখন বিশ্বাস করিস না তো–সুপারন্যাচারালকে মুখের কথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাম রাম–দিনদুপুরে এরকম কাণ্ড, রাত্তিরে তাহলে… শিউরে উঠল সরোজমামা। তারপরেই গম্ভীর মুখে বলল, একটা জিনিস লক্ষ করেছিস অপু-আমাকেই কিন্তু টার্গেট করেছে। জানে জোয়ানের আরক ছাড়া দেখ তোর ব্রিলক্রিমের শিশিটা কিন্তু

.

অপু আবার বাজার থেকে জোয়ানের আরক কিনে নিয়ে এল। সরোজমামার ধারণা হয়েছিল, জোয়ানের আরক আর কিনতে পাওয়া যাবে না। ভূত যখন পেছনে লেগেছে, শহরের সব জোয়ানের আরককেই আক্রমণ করবে। মামা অপুকে বলেছে, নিশ্চয় পেটের রোগে মরেছিল লোকটা, আর তখনও জোয়ানের আরক আবিষ্কার হয়নি কিংবা সময়মতো পায়নি। পেটের রুগিরা এমনিতেই খিটখিটে হয়ে যায়।

আবার সেই কুলুঙ্গিতে ওষুধ রাখা নিয়ে আপত্তি করেছিল মামা। অপু কানে তোলেনি। রাত্তিরবেলা তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়ার পাট সেরে মামাকে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে, এর মধ্যে আর কোনও অঘটন ঘটেনি।

মামা-ভাগনে মশারির মধ্যে ঢুকে পড়ল। বাইরের বারান্দায় শিকেয় ঝোলানো হারিকেনটা টিমটিম করছে। অপু ঘুমায়নি, পাশ ফিরে শুয়ে দৃষ্টি রেখেছে কুলুঙ্গির ওপর। সরোজমামাও ঘুমাবে না ভেবেছিল, কিন্তু কখন চোখের পাতা জুড়ে এসেছে বুঝতে পারেনি।

হঠাৎ চোখ খুলেই সরোজমামা দেখল, হারিকেনটা চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে। ধড়াস করে উঠল বুকটা। কুলুঙ্গির দিকেই যেন এগচ্ছে… মামা চোখ বুজে হাত বাড়িয়ে ঠেলা লাগাল অপুকে, আর সেই সঙ্গে আবিষ্কার করল অপু পাশে নেই। তার মানে অপুই উঠেছে।

হারিকেনের সলতে নামিয়ে শিকে ঝুলিয়ে অপু ফিরে আসতেই মামা জিজ্ঞেস করল, ঠিক আছে?

তুমি এখনও ঘুমাওনি! হ্যাঁ, ঠিকই আছে দেখলাম। মনে হয়, আর ভাঙবে না।

 তাহলে আগের দু-বার কী করে ভাঙল শুনি?

 থাক গে, এখন ঘুমাও তো!

আমায় উপদেশ না দিয়ে তুই নিজে ঘুমো না।

সকালেও শিশিটা অক্ষত আছে দেখে দুজনেই হাঁপ ছেড়েছিল, কিন্তু এবার এক অন্য চমক লাগল ব্রেকফাস্টের সময়। রাস্তার ধারের দোকানটাতে চা-জিলিপির ওপর দিয়ে। জলখাবার সেরে নেবে ভেবেছিল। গিয়ে দেখে, বেশ ভিড় জমেছে। জায়গাটা বেশ নির্জন। জন চার-পাঁচ লোককেও এখানে চিৎ কখনও একসঙ্গে দেখা যায়। দূরের গ্রাম থেকে শহরে যাবার পথে কিছু কিছু দেহাতি খবরাখবর বিনিময়ের জন্য চা খেতে বসে। ব্যাপার কী?

দোকানের মালিকের মুখ থেকে শোনা গেল, পাশের পুকুরটায় সব মাছ মরে ভেসে উঠেছে। সেই খবর শুনে ভোরবেলা থেকে দলে দলে লোক আসতে শুরু করেছে। মাছ আর এখন একটিও পড়ে নেই।

ডেঞ্জারাস! অপু, বাজারে আজ আর মাছ পারচেজ নয়! কেউ নিশ্চয় বদমাইশি করে পুকুরে ফলিডল দিয়েছে… হায় হায়, গরিব লোকগুলো এই খেয়ে এখন… মরা মাছের সঙ্গে মৃত মানুষের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সরোজমামা শিউরে যায়।

দোকানির মুখে কিন্তু হাসি মেলায়নি, হামারা তো গরিব আদমি ঠিকই। লেকিন একটো বিল্লিকে খাইয়ে দেখে নিয়েছি ও মছলি বিলকুল আচ্ছা হ্যায়। ফলিডলকা কাম নেহি।

অপু আর সরোজমামা পুকুরঘাটে এল। মাছও নেই তাই লোকজনও চলে গেছে। কয়েকটা মরা ব্যাং শুধু ভাসছে। অপু ঘাটের সিঁড়িতে পা দিতেই সরোজমামা সাবধান করে দিল, ভীষণ শেওলা কিন্তু

অপু সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। কোথায় শেওলা! জলে ডোবা সিঁড়িগুলোর সিমেন্ট বাঁধানো অংশ খরখর করছে। পোস্তদানার মতো দেখা যাচ্ছে প্রতিটি সিমেন্টকণা। যেন দু-দিন আগে শান বাঁধানো হয়েছে। অথচ জায়গাটা যেভাবে সিমেন্ট খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে, তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, কয়েক যুগের মধ্যে ঘাটের কোনও সংস্কার হয়নি। নজর করতেই অপু দেখল ঘাটের ওপরের সিঁড়িগুলোতে কিন্তু অল্পস্বল্প শেওলা রয়েছে, সেগুলো জলের মধ্যে ডুবে নেই। অপু হাঁটু গেড়ে বসে পুকুরের জলে হাত ডুবিয়ে একটু নাড়তেই সিঁড়ির কিনারা থেকে ডেলা ডেল শেওলা জলে ভাসতে শুরু করল। মখমলের মতো পুরু শেওলাগুলো কে যেন চেঁচে ফেলে দিয়েছে পুকুরের জলে।

হঠাৎ লাফিয়ে উঠল অপু, হতেও পারে! সরোজমামাকে পেছনে ফেলে সে সোজা ছুট লাগাল বাড়ির দিকে–আমি একটু বাজার থেকে আসছি।

অপু প্যাডেলের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ে পায়ের জোর চাপে সাইকেল হাঁকিয়ে চলে গেল।

বেলা প্রায় তিনটে বাজে, অপুর দেখা নেই। সরোজমামা ঠায় বসে আছে বাইরের বারান্দায়। ওই ভূতুড়ে বাড়ির মধ্যে পা দেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। হঠাৎ গাড়ির শব্দে মুখ তুলে তাকাতেই দেখা গেল, একটা জিপ এসে থেমেছে। অপু সাইকেলটাকে টেনে নামাচ্ছে জিপের পেছন থেকে। নিশ্চয় ট্রেনের টিকিট কেটে একেবারে গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এসেছে।

সরোজমামা এগিয়ে আসতেই গাড়ির গায়ে লেখা আছে দেখল–এক্সপ্লো ইন্ডিয়া। চালকের পাশ থেকে এক ভদ্রলোক নেমে এলেন।

অপু পরিচয় করিয়ে দিল, মামা, ইনি ডক্টর বসু। এক্সপ্লো ইন্ডিয়ার সায়েন্টিস্ট।

আমার মামা সরোজকুমার। সরোজমামা নমস্কার সেরে চুপ করে রইল। তার মানে কলকাতা যে এখন অথই জলে। কোত্থেকে আবার কী আপদ জুটিয়ে আনল কে জানে!

ডক্টর বসু ঘড়ির দিকে তাকিয়েই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, সময় হয়ে এল। আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এক্সপ্লোশন হবে। অশোক, রেডিয়োমিটারটা নিয়ে এসো শিগগির।

ডঃ বসু ও তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্টকে কুলুঙ্গির সামনে নিয়ে এল অপু। চামড়ার বাক্স খুলে ওরা একটা মিটার বসানো যন্ত্র উঁচু করে তুলে ধরেছে। অপু উত্তেজিতভাবে সরোজমামাকে। বলল, ভালো করে নজর রাখ, এখুনি ভূত ধরা পড়বে। এই যন্ত্রটা রেডিয়োমিটার আলট্রাসনিক ডিটেক্ট করে, বুঝলে?

অপুর কথা শেষ হবার আগেই কুলুঙ্গির মধ্যে একটা অদৃশ্য হাতুড়ি যেন জোয়ানের আরকের শিশিটাকে নিঃশব্দে ঘা মারল। চারজোড়া চোখের সামনে মুহূর্তের মধ্যে শিশিটা চড়াৎ করে ফেটে গেল।

আবার! আবার গেল! ভয়ে দু-পা পিছিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সরোজমামা।

ডক্টর বসু হেসে বললেন, ভয় পাবেন না। এই শেষ। আর এরকম হবে না। ভূতটা ধরা পড়ে গেছে। মাস্টার অপরেশ, তোমার কথাই ঠিক দেখা গেল–একটা স্ট্রং আলট্রাসনিক কিন্তু সৃষ্টি হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড টেস্টিং-এর সময়। রেডিয়োমিটারে স্পষ্ট ধরা পড়েছে।

তাহলে চলুন, পুকুরের ব্যাপারটাও টেস্ট করে দেখে নেওয়া যাবে। ঠিক কুড়ি মিনিট পরেই তো আরেকটা আন্ডারগ্রাউন্ড বিস্ফোরণ ঘটার কথা!

যেতে যেতেই সরোজমামা ডক্টর বসুকে জিজ্ঞেস করে, ব্যাপারটা যদি একটু খুলে বলেন, আমার সাবজেক্টটা আনফরচুনেটলি ইতিহাস কিনা…।

দোষটা আমাদেরই। আমরা, মানে এক্সপ্লো ইন্ডিয়া কোম্পানি বিস্ফোরক নিয়ে গবেষণা করে।

বিস্ফোরক। মানে বোমা! বোমা কোম্পানি! ডেঞ্জারাস জিনিস মশাই। লাইফ রিস্ক।

না, ঠিক তা নয়। এখান থেকে বেশ দূরে একটা নির্জন পাহাড়ের পাদদেশে আমাদের টেস্টিং গ্রাউন্ড। কাল আমরা প্রথম একটা বড় আকারের ভূগর্ভস্থ বিস্ফোরণ ঘটাই। দু-বার টেস্ট করা হয়েছিল। সেই দু-বারই বিস্ফোরণের ফলে যে কোনওভাবেই হোক। আলট্রাসনিক তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, তারই আঘাতে কাল পরপর দু-বার ওই শিশি ফেটে গেছে, মাছও মরেছে…।

কিন্তু কোনও আওয়াজ তো শুনিনি।

না, আওয়াজ হয়নি। আলট্রাসনিক তরঙ্গ আওয়াজ সৃষ্টি করে না, এদের কম্পনাঙ্ক এমন যে, আমাদের কানের পরদায় ধরা পড়ে না।

অপু বলে উঠল, দ্যাট মিনস–নিঃশব্দ শব্দ। বাদুড়রা এই আলট্রাসনিক তরঙ্গের সাহায্যে অন্ধকারেও পথ ঠাওরায়।

নিঃশব্দ শব্দ! সরোজমামা চিন্তিত হয়ে পড়ে।

বুঝলে না, এক্স-রে যেমন অদৃশ্য আলো, তেমনি আলট্রাসনিক হল নিঃশব্দ শব্দ।

বড় ডেঞ্জারাস শব্দ তো! শোনা যায় না, অথচ মাছ সাবাড় হয়ে গেল, শেওলা খসে পড়ল, শিশি ভেঙে চৌচির। সরোজমামার মন্তব্য ডক্টর বসুর কানে যেতে বললেন, ভাগ্যিস আপনার ভাগনে বুদ্ধি খাঁটিয়ে ঠিক আন্দাজ করেছিল, না হলে আরও বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারত।

ডক্টর বসু যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে সরোজমামা অপুকে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুই ব্যাপারটা ধরলি কী করে বল তো?

অ্যাক্সিডেন্টালি। মানে, তোমার অ্যাক্সিডেন্ট থেকেই অ্যাক্সিডেন্টালি একটা আইডিয়া পেয়ে যাই।

মানে?

ওই যে তুমি শেওলায় আছাড় খেলে, তোমার পা না হড়কালে কি আর ঘাটে এসে শেওলা দেখতে পেয়ে অবাক হতাম? আমাদের স্কুলে দেখিয়েছিল, কীভাবে আলট্রাসনিক ব্যবহার করে কাপ-ডিশ থালাবাসন একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার করে ফেলা যায়। আলট্রাসনিক পাঠাও জলের মধ্যে। এক ফোঁটা শব্দ শুনতে পাবে না, কিন্তু সব সাফ।

কিন্তু ওই ডেঞ্জারাস বোমা কোম্পানির সঙ্গে…।

কীভাবে আলট্রাসনিক সৃষ্টি হতে পারে, ভাবতে ভাবতেই বাজারের সামনে এক্সপ্লো ইন্ডিয়ার অফিসের সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ে গেল, তারপরে দুয়ে দুয়ে চার।

আচ্ছা, শুধু জোয়ানের আরকের শিশিটাই বা ভাঙল কেন? পাশেই তো তোর ব্রিলক্রিমের শিশিটাও ছিল।

এটা স্রেফ যোগাযোগের ব্যাপার। অনেক দূরে বাজ পড়লেও অনেক সময় সেতারের বিশেষ একটা তার বেজে ওঠে। কোন তারটা বাজবে বা আদৌ বাজবে কি না, সেটা ন্যাচারাল ফ্রিকোয়েন্সির ওপর নির্ভর করে। বাজের শব্দ ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পন সেতারের যে তারটার ন্যাচারাল ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে মিলে…

বুঝেছি! বুঝেছি! বাঁধা তবলাও যে কেটে যায় অনেক সময়, এই জন্যেই, তা-ই না?

 হু! কলকাতায় গিয়ে একটা শিশুপাঠ্য ফিজিক্স বই দেব তোমাকে, ব্যাপারটা পুরো ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

ঠিক তিনটে চল্লিশে পুকুরের জলে আলট্রাসনিক তরঙ্গের উপস্থিতি ধরা পড়ল ডক্টর বসুর যন্ত্রে। উনি ব্যবস্থা করেই এসেছিলেন, যাতে তিনটে কুড়ির সময় একবার আর তিনটে চল্লিশে টেস্টিং গ্রাউন্ডে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সেই সময়টায় রেডিয়োমিটারের সাহায্যে যাচাই করলেই বোঝা যাবে অপুর অনুমান সত্যি কি না।

গাড়িতে ওঠার আগে অপুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ডক্টর বসু বললেন, তোমার যদি কিছু দরকার লাগে, আমাকে জানিয়ো, কোনও লজ্জা করো না।

অপু বলল, যদি একদিন আপনাদের একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারতেন…।

সরোজমামা মনে মনে খুশি হয়, যাক। পরেশনাথের পাহাড়ে বেড়াতে যাবার একটা সুরাহা হয়ে গেল।

ডক্টর বসু বলেন, নিশ্চয়–নিশ্চয় পাবে–কবে চাই বল। বলেই জিপে উঠলেন।

জিপটা রাস্তার মোড় ঘুরতেই সরোজমামা হায় হায় করে উঠলেন, এই যা–কী ভুলটাই হয়ে গেল। আমার ওষুধের দিকে তোর যদি একটুও খেয়াল থাকে। ওই গাড়িতে করেই চলে যেতে পারতিস বাজারে!

[প্রথম প্রকাশ: কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, ১৯৮১ পূজাবার্ষিকী]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *