ট্যাক্সিটা ছেড়ে বলরাম বোস ঘাট রোড খুঁজে বার করতে বিশেষ অসুবিধে হল না। জরাজির্ণ দেয়ালের মধ্যে আরও দুর্বল ফুটোফাটা নড়বড়ে কাঠের দরজাটায় টোকা মারতেও রীতিমতো ভয় করছিল। হঠাৎ খসে পড়লেও চমকে যাবার কিছু নেই। দরজাটা খোলা ছিল। মুখ বাড়িয়ে ডাকল সুজন, কে আছেন বাড়িতে?
উঠোনটার সামনেই বন্ধ দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। গায়ে হাতকাটা গেঞ্জি। পরনে সাদা পাজামা। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক দরজার বাইরে পা দিলেন। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। এত বয়স হয়েছে, কিন্তু মেরুদণ্ড একেবারে সিধে।
আপনার তো আসার কথা ছিল সাড়ে সাতটায়। প্রশ্নটা যেন সরাসরি লক্ষ্যভেদ করল। প্রশ্নকর্তার শান্ত চেহারা বা বয়সের সঙ্গে কথার ঝাঁজটা একেবারেই বেমানান।
আজ্ঞে, অন্যায়টা আমারই। নিলয় প্রথম সুযোগেই স্বীকার করে নিল।
আসুন।
ঘরে পা দিয়েই আবার অবাক হল নিলয়। ঘর না বইয়ের গুদাম! ঘরের দেওয়ালগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে বইয়ের আলমারি আর র্যাকের পেছনে। তাতেও হয়নি, বইয়ের স্রোত নিজেদের আস্তানা ছাপিয়ে ঘরের মেঝে, চেয়ার, টেবিল, এমনকী একমাত্র খাটটার ওপরও হানা দিয়েছে। বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি একটা চেয়ার বইমুক্ত করলেন।
বসুন! আগেই বলে রাখছি, চায়ের কোনও ব্যবস্থা নেই। প্রেস ছুটি হয়ে গেছে।
না না, কোনও দরকার নেই তার। ফের গোছা দেখে নিলয়ের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, ছাপাখানাটা ইনিই চালান। দেওয়ালের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে দাড়িগোঁফসহ দুটো অতি পরিচিত মুখ। আলমারির মধ্যে দাঁড় করানো বইয়ের পুটের ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নেয় নিলয়। বেশির ভাগ পলিটিক্যাল বই। এবং তার মধ্যে বেশ কিছু রাশিয়ান।
নিলয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে বলে ওঠেন বৃদ্ধ, এগুলো আমারই সংগ্রহ। আমার ছেলের কোনও জিনিস এখানে নেই।
আপনি রুশ ভাষা জানেন?
সবসুদ্ধ দশ বছর আমি রাশিয়ায় ছিলাম।
তা-ই নাকি! বিস্ময় চাপতে পারে না নিলয়। হ্যাঁ! আর সেইটাই আমার পুত্রের কীর্তিকলাপ জানবার পক্ষে যথেষ্ট। রাশিয়া থেকে ফিরে আসার পর ওর সঙ্গে আমার একদিনমাত্র দেখা হয়েছিল। তা-ও তখন আমি সব কথা জানতে পারিনি।
নিলয় চেয়ারটা এগিয়ে বসল। হাঁটুর ওপর হাতের ভর রেখে বলল, আপনি সুদেববাবুর ওপর এতটা বিরূপ কেন? তাঁর এই অপঘাত মৃত্যুও কি আপনাকে এতটুকু নাড়া দেয়নি?
না। এতটুকু না। সব মৃত্যুর ওজন সমান নয়। স্তালিনগ্রাদ দখল করতে গিয়ে জার্মান জেনারেলের মরা আর দেশকে বাঁচাতে আন্ডারগ্রাউন্ড রেসিডেন্স বাহিনীর একটা তরুণের মৃত্যুবরণ করা এক কথা নয়।
নিলয় মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতিটার পর্যালোচনা সেরে নিল মনে মনে। আদর্শ পিতা। সন্তানের প্রতি তাঁর স্নেহ কখনও আদর্শের ঊর্ধ্ব স্থান পাবে না।
নিলয় বলল, মিস্টার বর্মন, আমার ধারণা, আপনি আপনার সন্তানের প্রতি সুবিচার করেননি। ডক্টর বর্মনের প্রতি কেন আপনি এত বিরূপ জানি না, কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে, তিনি যার খপ্পরে পড়েছিলেন, সে সোজা লোক নয়। ডক্টর ডাকুয়া তার পোষা চিতাবাঘটা লেলিয়ে দিয়ে ডক্টর বর্মনকে হত্যা করেছে। এ কথা আইনের চোখে প্রমাণ করতে না পারলেও, আমি কিন্তু জোর দিয়ে বলতে পারি।
নিলয় চুপ করল। বৃদ্ধ চশমাটা খুলে কাঁচটা মুছতে শুরু করেন। তাঁর চিন্তাস্রোতে বাধা দিতে চায় না নিলয়। একটু বাদেই বৃদ্ধর কণ্ঠস্বর শোনা যায়। এ যেন অন্য মানুষ।
শোন বাবা, ও আমার একমাত্র সন্তান। কিন্তু আসল কথাটা কী জান, ওকে আমি হারিয়েছি অনেক আগেই। তরাইয়ের বনে ওর বাঘে খাওয়া মৃতদেহটা আবিষ্কার হবার আগেই আমার কাছে ওর মৃত্যু ঘটেছে। ওকে নিয়ে আমার সব আশা, আকাঙ্ক্ষা, গর্ব তার অনেক আগেই নির্মূল হয়ে গেছে।
বৃদ্ধ চুপ করতে নিলয় বলল, আমি মনে করি, যা-ই ঘটে থাকুক, সবকিছুর পেছনেই এই অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন ডক্টর ডাকুয়ার কুপ্রভাব আছে। আপনি যদি কথাগুলো খুলে বলেন তাহলে হয়তো—
সব কথাই তোমাকে বলব। হ্যাঁ, তোমার ধারণা খুব ভুল নয়। আমি প্রথম থেকেই ডক্টর ডাকুয়ার নাম শুনে আসছি। এ-ও শুনেছি, তার মেধা যতটা অসাধারণ, উদ্দেশ্যটা তার ততটাই ঘোলাটে। আমার ছেলের সঙ্গে তার যোগসূত্রের কথাও আমার অজানা ছিল না। তবু আমি ভাবতে পারিনি, আজ ভাবতে অবাক লাগে যে, একজন বুদ্ধিমান আদর্শবাদী তরুণ কী করে এভাবে ফাঁদে পা দিতে পারে? বিশেষ করে যেখানে তার নাম, সম্মান, মর্যাদা সবকিছু জড়িত।
সে প্রশ্ন তো আপনি আমাদের প্রত্যেককেই করতে পারেন। ডক্টর ডাকুয়া আমাদের কাছে ডিজেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে প্রস্তাব দেয়, আমরা জানতাম এ অসম্ভব ব্যাপার। বিজ্ঞানে এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। তবু আমরা বিশ্বাস করেছিলাম, মানে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলাম–সেখানে ডক্টর ডাকুয়ার কৃতিত্ব! সব জেনে শুনেও আমরা তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হয়েছি। আর আজ দেখা যাচ্ছে, গভর্নমেন্টের কাছ থেকে পাওয়া ডিজেল তিনি সরাসরি বাজারে বেচে দিচ্ছেন। তবু সব জেনে-শুনেও তাঁকে আমরা ধরতে পারছি না। কারণ তাঁর কারখানা থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহে এতটুকু ঘাটতি দেখা দেয়নি। নিলয় বলতে বলতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এরকম একটা লোকের পক্ষে যে কোনও উঠতি বিজ্ঞানীকে ভুল বুঝিয়ে আকৃষ্ট করা আদৌ অসম্ভব নয়।
বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন। তোমাকে একটা চিঠি দেখাই। আজ অবধি কাউকেই আমি দেখাইনি। জানি না এটা তোমার কোনও উপকারে লাগবে কি না, তবে আমার নীরবতার সব উত্তর তুমি এর থেকেই পাবে।
বৃদ্ধ পেছন ফিরে কাচের আলমারি খুলে একটা বই টেনে নিয়ে পাতা উলটে একটা খাম বার করে নিলেন। খামসুদ্ধ চিঠিটা তিনি এগিয়ে দিলেন নিলয়ের দিকে।
নিলয় দেখল খামের ওপরের স্ট্যাম্পটা রাশিয়ার। চিঠিটা বার করেই নিরাশ হতে হল। আদ্যোপান্ত অপরিচিত রুশ হরফে লেখা।
আমি তো রুশ ভাষা জানি না।
হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে বৃদ্ধ বললেন, চিঠিটা আমারই এক রুশ বন্ধুর লেখা। সুদেব যখন রাশিয়ায় ছিল, তখন আমার এই বন্ধু সার্জেইয়ের সঙ্গে ওর যোগাযোগ ছিল। সুদেব রাশিয়ায় গিয়েছিল ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আরও উচ্চবিদ্যালাভের জন্যে সরকারি বৃত্তি পেয়ে। এই চিঠিতে সার্জেই লিখছে, ও পড়াশোনা শেষ না করেই হঠাৎ দেশে ফিরে গেছে। শুধু তা-ই নয়, সুদেব রাশিয়া ছাড়ার পরই নাকি দেখা গেছে যে, ও কতকগুলো গোপন কাগজপত্র চুরি করেছে। এই নিয়ে রীতিমতো হুলুস্থুলু পড়ে গিয়েছিল সেখানে। ডক্টর ডাকুয়া আর ও একই সঙ্গে রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসে। আমার বন্ধু অবশ্য ডাকুয়ার সঙ্গে ওর যোগাযোগের কোনও কথা লেখেনি। সম্ভবত ও জানতও না। সুদেব যে রাশিয়া ছেড়ে দেশে চলে এসেছে, সেটা আমি সার্জেইয়ের এই চিঠি থেকে যখন জানতে পারি, তখন ও উত্তরবঙ্গে ডাকুয়ার কারখানায় বসে আছে। এ কথা জানতে পেরেও আমি কোনও যোগাযোগের চেষ্টা করিনি। সুদেব তার অনেকদিন বাদে এসেছিল একবার। আমি ঘরের মধ্যে ঢুকতে দিইনি। একটি কথা শুনতেও রাজি হইনি। এখন মনে হয়, হয়তো অনুতপ্ত হয়েই এসেছিল, বা ভুল বুঝতে পেরে…
বৃদ্ধ কথা থামিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যান। চিঠিটা হাতের মধ্যে নাড়াচাড়া করছেন। দৃষ্টি অস্থির।
নিলয় শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে, সুদেববাবু নিশ্চয় শেষ পর্যন্ত ডাকুয়ার মতলবটা ধরতে পেরেছিলেন। তাই তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে। কাজেই অপরাধ তিনি যদি কিছু করেই থাকেন, তার জন্য সবচেয়ে কঠিন শাস্তি তো তিনি পেয়েই গেছেন। কিন্তু এই সবকিছুর হোতা যে, সে এখনও মহাপুরুষ হয়ে বসে আছে। আমার ধারণা, সুদেববাবুর গবেষণার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ডাকুয়ার কারখানার বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের রহস্য। আমি খোঁজখবর নেবার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। আইআইটি-তে সুদেববাবুর প্রফেসর ডক্টর মৈত্রও এ ব্যাপারে আমায় নিরাশ করেছেন। রাশিয়া থেকে জানিয়েছে, উনি সেমিকন্ডাক্টরের ওপর রিসার্চ করছিলেন। এর বেশি আর কিছু জানানো ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপার।…।
খুব স্বাভাবিক। কড়াকড়িটা এ ক্ষেত্রে আরও বেশি হবে যে, তাতে আর অবাক হবার কী আছে? কিন্তু আমি তো এ ব্যাপারে কোনও সাহায্য করতে পারব না। নিজে আমি রাজনীতির লোক, সাহিত্য, দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতির বাইরে কিছুই…।
সুদেববাবুর কোনও ডায়েরি বা খাতাপত্র, কোনও কিছুই নেই? কলেজলাইফের বা তার পরের? নিলয় উৎসাহভরে ঝুঁকে বসে।
নাঃ–কিচ্ছু না। যা ছিল, আমি সব নষ্ট করে দিয়েছি। ওর একটা ছবির অ্যালবাম ছাড়া আর কিছুই নেই।
নিরাশ হয় নিলয়। তবু একবার অ্যালবামটা দেখতে চায়। বৃদ্ধ ভদ্রলোক উঠে গিয়ে ভেতরের ঘর থেকে সযত্নে মলাট দেওয়া একটা বড়সড়ো চেহারার ফোটো অ্যালবাম এনে দেন। প্রথম পাতাতেই সাদা কালিতে বড় বড় করে লেখা নিহত তরুণের জন্মের দিনক্ষণ আর স্থান। নিজের অজান্তেই নিলয় একবার মুখ তুলে চাইল। বৃদ্ধর উজ্জ্বল চোখ দুটোয় যেন মেঘের ছায়া। তাড়াতাড়ি গলাখাঁকারি দিয়ে তিনি বলে ওঠেন, প্রথমদিকে সব পারিবারিক ছবি। শেষের দিকে কিছু রাশিয়া থেকে পাঠানো ফোটো আছে।
নিলয় মনে মনে ভাবে, শোককে জয় করার ক্ষমতা অর্জন করতে হয়, কথাটা বইয়ের পাতা ছেড়ে যেন আজ জ্যান্ত মানুষের রূপ নিয়েছে। বেশ কয়েকটা পাতা উলটে একেবারে শেষদিকের একটা পাতা খুলেই নিলয় ঝুঁকে পড়ল ফোটোগ্রাফের ওপর। তারপর অ্যালবামটাকে চোখের কাছে টেনে নিল–এই তো, এই তো ডক্টর ডাকুয়া। যে লোকটা মুখটা অর্ধেক ফিরিয়ে রেখেছে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল নিলয়।
দেখি কোন ছবিটা? বৃদ্ধ উঠে এসে দাঁড়ালেন। এইটার কথা বলছ?
দেখলেই বোঝা যাচ্ছে যে, ফোটো তোলার মুহূর্তে লোকটা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।
এ ছবিটা রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের। শেষকালটায় ওখানেও ও কাজ করেছিল। ওখান থেকেই
তাহলে বোঝা যাচ্ছে ডাকুয়ার সঙ্গে ওঁর পরিচয় রাশিয়াতেই। এটাও স্পষ্ট যে ডাকুয়ার পাল্লায় পড়েই–যাঃ–
লোডশেডিং-এর দৌরাত্ম্য কোনও জরুরি কাজের তোয়াক্কা করে না। ঠিক সময়মতো আলো চলে গেল।
ক-টা বাজল বলতে পার? রাত দশটার আগে তো সাধারণত যায় না আজকাল!
ঘড়িটা চোখের কাছে এনে লাইটের বোতামটা টিপে নিলয় ডিজিটাল হাতঘড়িতে সময় দেখে নিল। ন-টা বাজতে দুই।
তুমি এক মিনিট বসো। আমি আলো নিয়ে আসি। রেডিয়োটাও চালু হবে। ইলেকশনের আগে খবরাখবরগুলো তো…।
ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই উনি অনায়াসে চেয়ার-টেবিল ও বইয়ের স্তূপ পেরিয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। মিনিট ছয়েক বাদে দেখা গেল, একটা আলোছায়া কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসছে। বাঁ হাতে কাচের চিমনি পরানো কেরোসিনের বাতি নিয়ে বর্মনবাবু ঘরে ঢুকলেন। ডান বগলে বেশ বড়সড়ো একটা রেডিয়ো সেট। টেবিলের বইয়ের তূপের ওপর রেডিয়োটা রেখে, বাতিটা ঝুলিয়ে দিলেন একটা লোহার আংটায়। রেডিয়োটার টিউনিং নব ঘোরাতেই সবুজ ম্যাজিক আই-এর তারাটা কুঁচকে ছোট হয়ে এল।
…হিয়ার ইজ দ্য নিউজ, রেড… ইংরেজি সংবাদপাঠকের গলাটা স্পষ্ট হয়ে উঠল।
আরে, এ কী! উঠে দাঁড়াল নিলয়। এটা তো ট্রানজিস্টার নয়। মেন ভালভ সেট। লোডশেডিং-এর মধ্যে বাজছে কী করে? নিলয় রেডিয়োটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এই প্রথম খেয়াল করল যে, কেরোসিনের বাতিটার মাথায় একটা ধাতুর তৈরি পাখনাওয়ালা গোলাকার টুপি রয়েছে। সেটার গা থেকে বেরিয়ে এসেছে দুটো লাল-নীল তার। গায়ে গায়ে জড়ানো তার দুটো রেডিয়োটার পেছনে ঢুকে গেছে। নিলয় মনোযোগ দিয়ে রেডিয়ো লক্ষ করছে দেখে বর্মন বললেন, বলতে ভুলে গেছিলাম, এই কেরোসিন আলোর রেডিয়োটা সুদেবই আমায় দিয়েছিল। রাশিয়া থেকে ফিরে আসার বছরখানেক আগে একবার মাসখানেকের জন্য ছুটিতে বাড়ি এসেছিল সুদেব। তখনই এটা নিয়ে এসেছিল আমার জন্যে।
নিলয় কোনও কথা না বলে কেরোসিনের বাতিটার কাছ ঘেঁষে আসে। তারপর চোখটা কাছে নিয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে, স্পুটনিক থ্রি।
হ্যাঁ, এটার নাম স্পুটনিক-থ্রি। সুদেবের মুখে শুনেছিলাম, এইরকম রেডিয়ো সেট রাশিয়ার অনেক জায়গাতেই দেখা যায়। ব্যাটারিও লাগে না। বিদ্যুৎও লাগে না। কেরোসিনের বাতি জ্বললে আলোও পাওয়া যায় আর রেডিয়ো চলে। খুব মজার ব্যাপার, তা-ই না?
নিশ্চয়। আচ্ছা, একটা কথা বলতে পারেন, সুদেববাবু কি আপনাকে কখনও বলেছিলেন, তাঁর গবেষণার সঙ্গে এই ধরনের জিনিসের কোনও যোগাযোগ আছে কি না? নিলয় বাতির মাথায় পাখনাওয়ালা টুপিটা দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ–আবছা আবছা মনে পড়ছে এখন। ও বলেছিল, কেরোসিনের বাতি জ্বেলে যে তাপ পাওয়া যাচ্ছে, তার থেকেই বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। সুদেব বলেছিল, ও নাকি এই ধরনের জিনিসেরই আরও উন্নতি ঘটানোর জন্যে চেষ্টা করছে।
নিলয় দু-হাতে বর্মনের হাতটা চেপে ধরল। যা জানবার জন্যে আমি এসেছিলাম, জানা হয়ে গেছে। আজ চলি। আবার আসব। আপনার ছেলের হত্যাকারীর গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা শেষ করে তবেই আসব।
ঝড়ের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল নিলয়।
.
দিল্লি থেকে অলটারনেটিভ এনার্জি ডেভেলপমেন্ট কমিশনের সেক্রেটারি, দুর্গাপুর থেকে মাইনিং অ্যান্ড অ্যালায়েড মেশিনারি কর্পোরেশনের চিফ ইঞ্জিনিয়ার, জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সিনিয়র জিয়োলজিস্ট সত্যেন রায়, পশ্চিমবঙ্গ স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার, রাজাভাতখাওয়া থেকে প্রাক্তন ফরেস্ট রেঞ্জার অমিয় জোয়ারদার, রাঁচি থেকে সিএমএ-র ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার ডক্টর চক্রবর্তী, কোচবিহারের ডেপুটি কমিশনার–সকলেই তলব পেয়ে হাজির হয়েছেন কলকাতায়। সরকারি সিলমোহর লাগানো পরোয়ানা পেয়েছে প্রত্যেকে। মিটিং-এর কনভেনার নিলয়। ভেনু যাদবপুর ইউনিভার্সিটি। গোপনীয়তা রক্ষার জন্যে পুরো ব্যাপারটাকে একটা সেমিনার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেমিনার অন প্র্যাকটিক্যাল ইউজেস অব অলটারনেটিভ সোর্সেজ অব এনার্জি।
দশটা বাজার পনেরো মিনিট আগেই সবাই হাজির হয়েছে দেখা গেল। কনফারেন্স রুমে ডিমের মতো টেবিলটার লম্বাটে দিকটার মাঝখানে উঠে দাঁড়াল নিলয়।
সবাই যখন এসেই পড়েছেন, আমরা শুরু করে দিতে পারি। মোটামুটি ব্যাপারটা আপনারা সবাই জানেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি সবার সঙ্গেই এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা করেছি। নিলয় বলে চলে, আজ এতদিন পরে ডক্টর ডাকুয়ার কারখানায় দু জন ইঞ্জিনিয়ারের রহস্যজনক মৃত্যু, চোরাই ডিজেল বেচা আর বিদ্যুৎ সরবরাহের রহস্য একই নাটকের এই তিনটি অঙ্কের শেষ পর্বে যবনিকাপাতের ব্যবস্থা করা গেছে। আমি প্রথমেই রাজাভাতখাওয়ার প্রাক্তন ফরেস্ট রেঞ্জার শ্রী অমিয় জোয়ারদারকে অনুরোধ করব, ইঞ্জিনিয়ারদের মৃত্যু সম্বন্ধে তাঁর মতামত জানানোর জন্য।
অমিয় জোয়ারদার মাত্র দুটি বাক্যে তাঁর বক্তব্য পেশ করলেন। চিতাবাঘের এই বাচ্চা তিনি ডক্টর ডাকুয়ার কাছে বেচেছিলেন। তার এক বছর বাদে এই দুই ইঞ্জিনিয়ারের দেহ পাওয়া যায় বনের মধ্যে, বাঘে তাদের ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল।
জলপাইগুড়ির ডিসি বলে ওঠেন, এ ব্যাপারে আমার একটা বক্তব্য আছে। এই দুই ইঞ্জিনিয়ারের মৃতদেহ আবিষ্কারের ব্যাপারটাও ভারী অদ্ভুত। আলিপুরদুয়ারের পুলিশ ফাঁড়িতে একটা বেনামি চিঠি আসে। তার থেকেই আমরা মৃতদেহের হদিশ পাই।
চিঠিটা কি পাওয়া যাবে? নিলয় প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ–মিস্টার জোয়ারদারের সঙ্গে আলোচনার পর চিঠিটা আমি ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিয়েছি। ডক্টর ডাকুয়ার হাতের লেখার স্পেসিমেনও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
চমৎকার। আরেকটা কথা–ব্ল্যাকে ডিজেল বেচার দায়ে ডাকুয়াকে গ্রেপ্তার করা যাবে কি? নিলয় আবার প্রশ্ন করে।
ডিসি-র এক মুখ হাসিই নিলয়ের প্রশ্নের উত্তর হিসেবে যথেষ্ট ছিল–মিস্টার জোয়ারদারের সাহায্য না পেলে–
না-না–আমি জানি না। সুজনই এ ব্যাপারে সব সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করেছে। জোয়ারদার বেশি কথার লোক নন।
এনার্জি কর্পোরেশনের সেক্রেটারি বলে উঠলেন, তার মানে ডাকুয়াকে অ্যারেস্ট করাটা কোনও প্রবলেমই নয়। এখন কথা হচ্ছে, তার আবিষ্কারের রহস্যভেদ করা গেছে বলেই এই মিটিং ডাকা। আপনাকে তো আমি আগেই বলেছি, কীভাবে চিতার ডাকের টেপ বাজিয়ে, কতকগুলো খেলনা মিটার বসিয়ে আমাকে সে ধাপ্পা দিয়েছিল। সব বুঝেও এতদিন কিছু করতে পারিনি। এবার আপনাদের বলছি, শুনুন। ডাকুয়ার আবিষ্কারের কথা সব জেনে-বুঝে তারপর বরং সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
ওকে–প্রসিড, আফটার অল, তুমিই আজকের কনভেনার ডক্টর মজুমদার চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসলেন।
নিলয় বলল, সবার সুবিধার জন্য আগে থেকেই আমি কতকগুলো এগজিবিট তৈরি করে রেখেছি। সুইচ বোর্ডের কাছে উঠে গিয়ে নিলয় টিউবলাইটগুলো নিবিয়ে দিতেই ঘরটায় আবছা অন্ধকার সৃষ্টি হল।
সত্যেন, এবার স্লাইডগুলো! সত্যেন আমার বিশেষ বন্ধু তাই নাম ধরে ডাকছি। নিলয় হেসে যোগ করল।
সামনের পোর্টেবল সিনেমা স্ক্রিনের দানাগুলো ভরিয়ে একটা ধূসর ছবি ফুটে উঠল। সেই নিউ জিল্যান্ডের গরম পাঁক আর লাভার কুণ্ড। এককালের আগ্নেয়গিরি বর্তমানে হৃতযৌবন, কুশ্রী। জায়গাটা সম্বন্ধে বর্ণনা দিয়ে পরবর্তী স্লাইডটা ছুঁড়ে দিল সত্যেন। আগের ছবিটার সঙ্গে এ ছবিটার অমিল বলতে দুটো। এখানে পাঁকের কুণ্ড আকারে অনেক ছোট আর আশপাশের রুক্ষ জমির চারদিক ঘিরে রয়েছে গহন সবুজের দুর্ভেদ্য দুর্গ।
নিলয় বলে উঠল, এটা জয়ন্তীর কাছে ডক্টর ডাকুয়ার কারখানার একাংশে এরিয়াল ফোটোগ্রাফি। ডক্টর মজুমদার এই ছবি তোলার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন শিলিগুড়ি এয়ারবেসের সাহায্য নিয়ে। হেলিকপ্টার থেকে তোলা।
অবিশ্বাসভরা একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল কনফারেন্স রুমে। সত্যেন পরবর্তী স্লাইডটা ঠেলে দিল। একই জায়গার ছবি। আরও কাছ থেকে নেওয়া, অন্যদিক থেকে ভোলা। একটা বিরাট চিমনি সমেত কারখানা বাড়ি দেখা যাচ্ছে।
এটা ডক্টর ডাকুয়ার কারখানা যেটা সকলে চুনের ভাঁটা বলে জানে। মিস্টার জোয়ারদার আগেই জানিয়েছেন যে এটা পুরানো বিল্ডিং নয়। বছরকয়েক হল তৈরি করা হয়েছে। এরই মধ্যে আছে ওয়াইন্ডিং ইঞ্জিন, ড্রাম, উইনডে ইত্যাদি। নিলয় বলে চলে, এবার মাইনিং অ্যান্ড অ্যালায়েড মেশিনারি কর্পোরেশনের চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে একটা প্রশ্ন করব। ডাকুয়া আপনাদের ওখান থেকে অনেক যন্ত্রপাতি কিনেছে! সেগুলো কোন কাজে লাগাতে পারে বলে আপনার ধারণা?
তিনি প্রধানত ওয়াইন্ডিং ইঞ্জিন, ড্রাম ও চেন–বিরাট লেংথের চেন কিনেছেন। এগুলো সবই খনির কাজে লাগে। কিন্তু শুধু এই কটা জিনিস কী কাজে লাগবে, বলা মুশকিল। উনি যে চেন কিনেছেন তা দিয়ে খনির পিটের মধ্যে কেজ, মানে লোহার খাঁচা নামানো হয়। কিন্তু উনি চেন কিনলেও কোনও কেজ কেনেননি।
আচ্ছা ধরুন, আমি যদি একটা বিরাট গর্ত খুঁড়ি ডিগিং করে, তাহলে এই ওয়াইন্ডিং ইঞ্জিন আর চেন দিয়ে তার মধ্যে যে কোনও জিনিস তো নামিয়ে দিতে পারি? নিলয় প্রশ্ন করল।
স্বচ্ছন্দে। আপনি পাঁচটা হাতিকে নামিয়ে দিন, তুলে নিন, কিসসু হবে না। কয়লা বোঝাই মানে কয়লার গাড়ি টেনে অবধি তোলে ওই চেনে করে!
চমৎকার! আমি এইটুকুই জানতে চাইছিলাম।
নিলয় পেছন ফিরে পোর্টেবল সিনেমা স্ক্রিনটার কাছে গিয়ে দুটা আংটা টেনে ধরে সড়াৎ করে পরদাটাকে গুটিয়ে ফেলল। পরদাটা নেমে যেতেই দেখা গেল, তার পেছনে কেরোসিনের এক বাতি ঝুলছে। কাচের চিমনি খুলে দেশলাই জ্বালিয়ে বাতিটা ধরিয়ে আবার চিমনিটা লাগিয়ে দিল। তারপর একজোড়া তার হাতে নিয়ে সটান চলে এল কনফারেন্স টেবিলের কাছে।
এইটাই আমার শেষ এগজিবিট। নিলয় ঘোষণা করল। এটা আমি ডক্টর বর্মনের বাবার কাছ থেকে চেয়ে এনেছি আপনাদের দেখাবার জন্যে। এই দেখুন, তার দুটোকে আমি এই ভোল্টমিটার আর অ্যামমিটারের সঙ্গে লাগাচ্ছি।
সবাই ঝুঁকে পড়ল।
কী দেখছেন?
একশো বারো ভোল্ট! বাবা, কারেন্টও তো কম দিচ্ছে না। জোয়ারদার বলে উঠল।
হ্যাঁ, এই কেরোসিনের বাতিটা একটা রেডিয়ো চালানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। রাশিয়ায় খুব পপুলার। স্পুটনিক-থ্রি নামে বিক্রিও হয়। স্বৰ্গত ডক্টর সুদেব বর্মন, ডাকুয়ার সঙ্গে যিনি ছিলেন, চিতাবাঘের কামড়ে প্রাণ দিয়েছেন, তিনি রাশিয়ায় এই নিয়েই গবেষণা করছিলেন। সেমিকন্ডাক্টারই ছিল তাঁর…
মাই গড এনার্জি কর্পোরেশনের সেক্রেটারি ডক্টর মজুমদার প্রায় চিৎকার করে ওঠেন। থার্মেল, থার্মো-ইলেকট্রিসিটি। আমি জানি, স্পুটনিক থ্রি-তে খুব সম্ভবত টেলুরিয়াম ব্যবহার করা হয়। এই ধাতুকে উত্তপ্ত করলে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। তার মানে, নিলয়…
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। ডাকুয়া তার কারখানা চত্বরের ওই প্রাচীন আগ্নেয়গিরির গরম কুণ্ডের পাশ দিয়ে টানেল কেটে পৃথিবীর উত্তপ্ত পেটের মধ্যে এইরকম কোনও থার্মেল বসিয়ে দিয়েছে। সেই থার্মেলকে বসানোর জন্যেই দরকার হয়েছে। ওয়াইন্ডিং ড্রাম, চেন ইত্যাদি।
কিন্তু নিলয়, আজ পর্যন্ত এমন কোনও থার্মেল আবিষ্কার হয়নি, যা এই পরিমাণ বিদ্যুৎ…
নিলয় বাধা দিল ডক্টর মজুমদারকে। সেটাই তো ডাকুয়ার কীর্তি। সবচেয়ে বড় কথা, ডক্টর বর্মন এই নিয়েই রাশিয়ায় গবেষণা করছিলেন। ডাকুয়া আর তিনি যখন পালিয়ে আসেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ ছিল জানেন? গোপন তথ্য চুরি করার অভিযোগ। এরপর নিশ্চয় আর কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না।
কিন্তু, তার জন্যে এরকম একটা আগ্নেয়গিরির কী প্রয়োজন ছিল? ডক্টর মজুমদার প্রশ্ন করেন। পৃথিবীর পেটের মধ্যে যে কোনও জায়গাই তো…
হ্যাঁ, যে কোনও জায়গায় টানেল কেটে পৃথিবীর উত্তপ্ত পেটের মধ্যে থার্মেল নামানো সম্ভব, কিন্তু তার জন্যে কী বিপুল আয়োজন করতে হবে, ভেবে দেখেছেন? কত খরচ? এখানে প্রকৃতি স্বয়ং সে ব্যবস্থার অর্ধেক তো করেই রেখে দিয়েছিল। নিলয়ের কথাগুলো সবাইকে যেন স্তম্ভিত করে দেয়। বাকি অর্ধেক ব্যবস্থা করে ডাকুয়া। ব্লাস্টিং ইত্যাদি করে। সেই জন্যই গরম জলের ঝরনাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মনে হয়।
ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার এবার বলে ওঠেন, সবই বুঝলাম, কিন্তু এটা তো ঠিক যে, ডক্টর ডাকুয়া একটা অসাধ্যসাধন করেছেন। উত্তরবঙ্গের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির একেবারে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। ডাকুয়াকে না-হয় হটিয়ে দেওয়া গেল, কিন্তু আপনারা পারবেন তাঁর মতো, ওই যে কী যেন বললেন, থার্মেল না কী, ওই জিনিসটা দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করতে?
স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার সমর্থন করেন ডিসি-কে, ভাববার মতো কথা! এমন স্টেডি সাপ্লাই…
এক মিনিট! নিলয়ের গলাটা অত্যন্ত গম্ভীর শোনাল। ঠিক এই প্রস্তাবটার সম্মুখীন হতে হবে জেনেই আমি আগে থেকে তৈরি হয়ে এসেছি। আমরা ব্যাবসায়ী নই, মুনাফাখোর শিল্পপতি নই। আমরা একদিন, দু-দিন কি তিন বছরের কথা নিয়ে ভাবব না। ভাবব সারা দেশের জন্যে এবং দূর ভবিষ্যতের কথা স্মরণ রেখে। বর্তমানে কিছু সুবিধে ভোগ করে তার সমস্ত দায়দায়িত্ব ও সমস্যা চাপিয়ে দিয়ে যাব দেশের পরবর্তী যুগের নাগরিক ও বিজ্ঞানীদের ঘাড়ে, এটা কখনও আমাদের পথ হতে পারে না, আপনারা জানেন, ব্যাবসায়ীদের সংকীর্ণ স্বার্থ কীভাবে একদিন সারা পৃথিবীর বনাঞ্চলকে প্রায় নির্মূল করে দিতে বসেছিল। গাছকে তখন তার শুকনো কাঠের কিনোর দর কত তা-ই দিয়ে। যাচাই করা হত। এর পরবর্তী যুগে আমরা কী দেখলাম? শুধু বনকে বনই সাবাড় হয়নি, তার সঙ্গে সঙ্গে এককালের শস্যশ্যামলা বিশাল প্রান্তর, এক-একটা বিশাল অঞ্চল মরুভূমি হতে বসেছে। বন নির্মূল হলে যে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে, এ কথাটা জানা ছিল, কিন্তু ব্যাবসাদাররা তার পরোয়া করেনি। সে তো অনেকদিন পরের কথা। তখন কী হবে তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিল না। ঠিক একইভাবে ভূগর্ভের মধ্যে সঞ্চিত উত্তাপকে খরচ করে এই মুহূর্তে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে হয়তো আপাতভাবে কোনও ক্ষতি হবে না, কিন্তু ভবিষ্যতে–ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে, সেটা নিশ্চয় ভাবা দরকার। আমি ইতিমধ্যেই আমেরিকা ও রাশিয়ার প্রখ্যাত ভূতাত্ত্বিক ও ইকোলজিস্টদের সঙ্গে এই নিয়ে টেলিগ্রাম। আদান-প্রদান করেছি। এই দেখুন চারটে উত্তর। প্রত্যেকেই একইভাবে নিষেধ করেছেন। অত্যন্ত বিপজ্জনক। এইটাই তাঁদের সবার মন্তব্য। পৃথিবীর মধ্যে সঞ্চিত উত্তাপের ব্যাপক ব্যবহার সাংঘাতিক হতে পারে। আরও ভালোভাবে গবেষণা না করে এরকম ঝুঁকি নেওয়া তাঁদের মতে এক আন্তর্জাতিক অপরাধ।
নিলয় কথা থামিয়ে টেবিলের ওপর থেকে গেলাসটা তুলে এক ঢোঁক জল খেয়ে নিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘোরতর বিরোধী। ডাকুয়াকে অবিলম্বে অ্যারেস্ট করা প্রয়োজন। একজন খুনি স্বার্থান্বেষী ব্যাবসাদারকে এভাবে আমাদের ব্ল্যাকমেল করতে দেওয়া কখনওই উচিত নয়। তা ছাড়া বর্মনকে খুন করে ডাকুয়া যে কৌশল চুরি করেছে তা নিয়ে সব দেশেই কাজ হচ্ছে। কাজেই ডাকুয়ার কাছ থেকে কিছু জানতে না পারলেও বিজ্ঞানজগতের এমন কিছু আহামরি ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটবে না। তবু একা আমি কোনও সিদ্ধান্তে আসতে চাই না। আমি প্রস্তাব করছি, উপস্থিত সকলেই ভোটের মাধ্যমে তাঁদের সিদ্ধান্ত জানান। ডাকুয়াকে অভিযুক্ত ও গ্রেপ্তার করা হবে–এই প্রস্তাব যাঁরা সমর্থন করেছেন, তাঁরা হাত তুলুন।
নিলয় ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে। একবার চোখটা বুজেই আবার চোখ খুলল যখন, সব কটা হাত বিজয়পতাকার মতো উঁচু হয়ে উঠেছে। শুধু একটা হাত বাদে। স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের কর্মকর্তার। হো হো করে হেসে উঠল নিলয়। আপনিও হাতটা তুলে দিন স্যার। এত ভেঙে পড়লে চলবে কেন? ডাকুয়াকে বাদ দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি করা যায় না এমন কোনও কথা আছে কি?
গাড়িতে বাড়ির ফেরার পথে জোয়ারদার বলল, আচ্ছা ধরুন, ডাকুয়াকে গ্রেপ্তার করার প্রস্তাব যদি ভোটে বাতিল হয়ে যেত, তখন?
নিলয় ব্যাকসিটে মাথাটা ঠেস দিয়ে চোখ বুজে বলল, সেটাও ভেবে রেখে ছিলাম। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে প্রচারকার্যে নেমে পড়তাম। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাবার আশ্বাস পেয়েছিলাম বলেই ভোটের প্রস্তাব তুলেছিলাম।
তাহলে এখনকার মতো আমাদের আর করণীয় কিছু নেই তো?
না–না–একটা কাজ আছে বইকি। ডক্টর সুদেব বর্মনের বাবাকে সব কথা বলা দরকার। সত্যি কথা বলতে কী তাঁর সাহায্য ছাড়া আমরা বোধহয়—
তা ছাড়া এটা নৈতিক কর্তব্য। চলুন না–এখনই ঘুরে আসি।
সেই ভালো।
[প্রথম প্রকাশ: কিশোর বিস্ময়, ১৯৮৪ পূজাবার্ষিকী]