রংবেরঙের সমস্যা
পাজামা শুকোয়নি দেখেই মেজাজ খিঁচড়ে গিয়েছিল। শুভকর্মের সূচনায় সকালবেলাতেই বাধা পড়ল। পাজামা আরও দুটো আছে, কিন্তু সেগুলোয় মাড় দেওয়া। অত ক্ষুরধার বস্তু এখন বর্জনীয়। প্যান্ট পরে নিচু হয়ে কাজ করতে অসুবিধে হয়। শেষ পর্যন্ত বাবার ছেড়ে রাখা ধুতিটাই লুঙ্গির মতো চড়িয়ে নিলাম।
টেবিল-চেয়ারের জঞ্জাল একপাশে সরিয়ে মেঝের ওপর মানচিত্রটা বিছিয়ে তার ওপর ট্রেসিং পেপারটা রাখলাম। ম্যাপটা এত বড় যে টেবিলে আঁটে না। মা-র পায়ের শব্দ পেয়েই তাড়াতাড়ি হামাগুড়ি দিয়ে চড়ে বসলাম ট্রেসিং পেপারের ওপর। দেখছ তো কী ঝামেলার কাজ–ট্রেসিং পেপারের আর কতটুকু ক্ষমতা বল? ঘষা লেগে পাছে নষ্ট হয়ে যায় তাই বাবার ধুতিটা…।
মা-কে কিছু বলবার সুযোগ দিইনি। কানে এল বাবাকে বলতে, যত পাগলের কাণ্ড। কিছু ভুল বলেনি। সাধারণ লোকে সাধারণ কাজ করে, অসাধারণ কাজ তো পাগলেই করে।
সন্তর্পণে ম্যাপের ওপর থেকে নেমে এলাম। কলমের নিবে চাইনিজ ইঙ্ক ঠেকিয়ে নিতে হবে। এই ভঙ্গিতে কাজ করার সবচেয়ে সুবিধে হল, দুটো হাঁটু আর বাঁ হাতের কনুইটাকে পেপার ওয়েটের মতো ব্যবহার করা যায়। তা ছাড়া এখন আর আমায় নিজের প্রয়োজনে ম্যাপ নিয়ে টানাটানি করতে হবে না, ম্যাপের টানেই আমি গিয়ে হাজির হব যথাস্থানে।
হিল্লি দিল্লি তো আর ম্যাপ নির্মাতাদের কাছে ধরা দেয় না, ধাওয়া করেই ধরতে হয় তাদের।
কী রে, তুই আবার শিল্পী হবার সাধনা জুড়লি নাকি?
চমকাবার কোনও মানে হয় না। জানা কথা যে তপু ছাড়া আর কারও মুখেই এমন বাক্যবাণ ছোটে না। তবু মুখ তুলে তাকাতে গিয়ে ট্রেসিং পেপারটা নড়ে গেল।
দিলি তো গন্ডগোল করে। ভারত-ভুটান সীমান্তে গোলযোগ দেখা দিলে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠবে। কাজটার গুরুত্ব বোঝাবার চেষ্টা করা দরকার।
তপু দু-হাঁটুতে হাতের ভর রেখে ঝুঁকে পড়ে বলল, খামকা ম্যাপ কপি করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিস কেন? এ তো মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার আগে ছেলেরা প্র্যাকটিস করে।
অনেক কষ্টে রাগ চেপে তপুকে সংক্ষেপে জানিয়ে দিলাম, ভূগোলের বই লিখছি। তপুর বোঝা উচিত যে, বিনা পরিশ্রমে কোনও মহৎ কার্য হয় না।
অ! স্বরবর্ণের প্রথম বর্ণটিকে ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যঞ্জনা দিল তপু। ঘরের কোণে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে জানলার ওপর ঠ্যাং তুলে দিয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, এতগুলো চেয়ার ছেড়ে ওইখানে বসা মানে ইন্টেনশনালি আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে রাখা।
এ অবস্থায় তপুকে গ্রাহ্য না-করাই শ্রেয়। ট্রেনিং পেপারটাকে নেড়েচড়ে ম্যাপের সঙ্গে মেলাবার চেষ্টা করছি, তপু বলে উঠল, অবশ্য এ ছাড়া আর তুই লিখবিই বা কী!
আর চুপ করে থাকা অসম্মানজনক তাই বলতেই হল, তোর মতে তো অঙ্ক ছাড়া আর সব সাবজেক্টই ফালতু।
অঙ্ক না জানলে কোনও সাবজেক্টেই বেশি দূর এগনো যায় না।
তা-ই নাকি!
নিশ্চয়! এই তো চোখের সামনেই উদাহরণ। চারটে বই উলটে গবেষণামূলক পঞ্চম কেতাবটা লিখছিস আর পুরানো ম্যাপ ট্রেস করছিস। কোন ম্যাপটা তোর দরকার, সেটা তোর ভূগোলের পাবলিশারকে জানিয়ে দে–দেখবি ওদের কাছে রেডিমেড ছবি আছে।
না জেনে-শুনে কথা বলিসনি তপু। মোটেই গবেষণা করছি না–এটা একটা টেক্সট বুক। ম্যাপটার আউটলাইনটা শুধু ট্রেস করছি। তারপর এটাকে ইম্প্রভ করব। কত কষ্ট করে ন্যাশনাল অ্যাটলাস থেকে জোগাড় করেছি জানিস ম্যাপটা? একেবারে নতুন আইডিয়া নিয়ে…
রিও প্যাপিরাসের ওপর প্রবন্ধটা পড়লি? তপু একগুঁয়ে স্বার্থপরের মতো প্রশ্ন করল। আমার কাজের প্রতি ওর এতটুকু ভালোবাসা নেই।
কোন প্রবন্ধটা? নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
কোন প্রবন্ধটা মানে! সেদিন যে দিলাম তোকে। পৃথিবীতে গণিতচর্চার প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপি। তার মানে পড়িসনি।
পড়িনি তো বটেই, কোথায় যে রেখেছি বইটা তা-ও মনে পড়ছে না। কথাটা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম, দেখছিস তো কীরকম ব্যস্ত, পাবলিশার বড্ড তাগাদা দিচ্ছে। আর তা ছাড়া, তোর কিন্তু সবতাতেই অঙ্ক-অঙ্ক করাটা একটা বাতিকে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। মানছি যে ভূগোলেও হিসেবনিকেশের ব্যাপার আছে, কিন্তু। আমি যে অংশটা নিয়ে—
তার মধ্যে অঙ্কের কোনও স্থান নেই, এই তো?
তপু এতক্ষণে দয়া করে আমার দিকে মুখ ফেরাল। কিছু জানিস না, তবু তড়পানো চাই।
তপু উঠে এসে মানচিত্রটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, এর মধ্যেও অঙ্কের সমস্যা আছে, বুঝলি ভূগোলানন্দ।
কী মুশকিল, আমি তো আর জরিপ করে ম্যাপ বানাচ্ছি না।
ও! শুধু জরিপ করতেই অঙ্ক লাগে। এই যে ম্যাপটা টুকছিস–দেখ ভালো করে, ম্যাপটার মধ্যে কমসে কম কতগুলো রং আছে জানিস?।
আমার আর কাজ নেই, বসে বসে রং গুনব। তবে আছে বেশ কয়েকটা। থাকতেই হবে। না হলে গায়ে গায়ে লাগানো দেশগুলোর সীমারেখা গুলিয়ে যাবার ভয়। বলতে বলতেই চোখ বোলাচ্ছিলাম ম্যাপটার ওপর, নিদেনপক্ষে তিন-চারটে রং তো লাগবেই
তপুর মুখে চোরা হাসির আভাস দেখে কথাটা শেষ করার ইচ্ছে উবে গেল। গণিতের মামলায় প্রতিপক্ষ একটা বেফাঁস কথা বললে হয়, অমনি কাঁকড়াবিছের লেজ ছোঁড়ার মতো হাসি এসে বিধবে। তপুকে দেখেই বুঝতে পারছি, বিজয়ী বিজ্ঞানীরা আর যা-ই জানুক, এই সোজা কথাটা বোঝে না যে, মানুষমাত্রেই ভুল করে। অর্থাৎ যে ভুল করে না, সে মানুষই নয়।
তবু তপুর হাসি থামাবার শেষ চেষ্টা করলাম, চার-পাঁচটা রঙের বেশিও লাগতে পারে, আবার কমও লাগতে পারে। সেটা নিশ্চয় মানচিত্রের রকমসকমের ওপরেই নির্ভর করে। অনেকগুলো দেশ যদি গায়ে গায়ে জড়াজড়ি করে থাকে, সেখানে হয়তো নিদেনপক্ষে ছ টা, সাতটা কিংবা আরও…
বাস, বাস, আর দরকার নেই। এইরকম রূঢ় কথা শোনার চেয়ে মাথায় একটা চাঁটি খাওয়াও কম কষ্টকর।
তপু বলল, এখুনি বলছিলি না, অঙ্কের কী দরকার? শোন যে কোনও ম্যাপ, তা সেখানে যত খুশি দেশ থাকুক, ম্যাক্সিমাম চারটে রংই কাজ সারার পক্ষে যথেষ্ট। এক দেশের সঙ্গে লাগোয়া অন্য দেশের সীমান্ত পৃথক করার জন্য ম্যাপের মধ্যেকার দেশগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে রং করতে খুব বেশি হলে চারটে রং দরকার। ইচ্ছে করলে কেউ এর বেশিও রং ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু দরকার চারটে।
কথাটা শুনে খটকা লাগল, তবু বললাম, তা হবে হয়তো। আমি তো আর অঙ্ক কষে দেখিনি।
হত না, হত না–অঙ্ক কষে দেখলেও হত না।
আমার অমন উদাসীন উত্তরকে নিয়ে এতখানি উচ্ছ্বাস অকল্পনীয়। আমার অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে তপু বোঝাতে আরম্ভ করে, অঙ্কের পণ্ডিতরা অনেক হিসেব কষে দেখেছেন যে পাঁচটা রং দরকার হবার কথা। কিন্তু আজ অবধি এমন কোনও মানচিত্র পাওয়া যায়নি বা তৈরি করা যায়নি, যেখানে চারটের বেশি রং দরকার হচ্ছে। বুঝলি, ওসব ভূগোলের বই টুকলিফাই করে কিসসু হবে না, তার চেয়ে বরং অঙ্ক কষে প্রমাণ করার চেষ্টা কর যে চারটে রংই যে কোনও মানচিত্রকে রাঙাবার পক্ষে যথেষ্ট। কিংবা এমন একটা ম্যাপ খুঁজে বার কর, যেখানে নিদেনপক্ষে পাঁচটা রং না হলেই নয়। পারিস যদি, তোর নোবেল প্রাইজ লাভ আটকায় কার সাধ্যি। দেড়শো বছরে কেউ যা পারেনি, তুই যদি
একজনকে একটা অসম্ভব কাজের ভার দিয়ে তারপর সুকুমার রায়ের বেড়ালের মতো হাসাহাসি শোভন নয়।
ভাবতেও পারিনি যে, এক মাসের মধ্যেই প্রতিশোধ নেবার এমন সুযোগ পাব। মুদ্রাকরদের আমি এক ফোঁটা বিশ্বাস করি না। কারণ ওদের হাতে এক ফোঁটা কালিও অস্থানে-কুস্থানে পড়ে অসাধ্য সাধন করে দিতে পারে। আমার প্রথম বইটা ছাপার সময়েই তার প্রমাণ পেয়েছি। সেই বল্লাল সেনের আমল থেকে আমরা ঘোষ পদবি ভোগ করছি, কারওর সাধ্য হয়নি ঘকে ম-য়ে রূপান্তরিত করার। অবশ্য এটাও ঠিক যে আমার পূর্বতন পুরুষরা খুবই বিচক্ষণ, তাই পদবি কালিমালিপ্ত হতে দেবেন না বলেই নিশ্চয় কখনও বইটই ছাপানোর দিকে পা বাড়াননি।
ভূগোল বইটা ছাপার কাজ শুরু হলে একদিন প্রেসে এলাম তদারকি করতে। সেই সবে প্রথম মানচিত্র ছাপা শুরু হচ্ছে। অবাক হয়ে দেখছিলাম মেশিনচালকের কী দুর্জয় সাহস। লোহার জন্তুটা যেই কপ করে কাগজটা মুখে ভরে একবার চিবিয়ে দিচ্ছে, অমনি লোকটা তার মুখের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ছাপা কাগজটা ছোঁ মেরে টেনে নিয়ে আরেকটা কাগজ ভেতরে ঠেলে দিচ্ছে। হঠাৎ তপুর কথা মনে পড়ে গেল। মেশিনটা হাঁ করে জিরচ্ছে দেখে সেই সুযোগে মেশিনম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম, ম্যাপগুলো চার রঙে ছাপা হচ্ছে তো?
না। চার রং কোথায়? বাই-কালার ব্লক তো।
সে কী! বাই-কালারমানে দুটো রং?
আমার চোখে-মুখে হতাশা, আতঙ্ক এবং আরও কী কী ছিল জানি না, মেশিনম্যানের বোধহয় মায়া হল। সে বাঁ ধারে ঘাড় ফিরিয়ে মালিক সিটে নেই দেখে আমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল, মালিক চার কালারের ব্লক দেখিয়ে বিল করেছে নিশ্চয়। যেই বুঝেছে আপনি এই লাইনে…
আরে না না, বিল-ফিলের ব্যাপার নয়। বলছি, দু-রঙে ছাপলে ম্যাপটাই তো মাঠে মারা যাবে।
তার মানে?
মানে আর কী। সব দেশ তো গায়ে গায়ে জড়িয়ে একরকম হয়ে যাবে। আলাদা আলাদা রং না হলে, মানে চারটে রং না হলে তো কিছুতেই
কী বলছেন আপনি? কত ম্যাপ ছাপি–সবই তো দু-রঙে। বাই-কালার ব্লক।
মহাসমস্যায় পড়লাম। কারিগরকে বিশ্বাস করি, না বিজ্ঞানীকে? শেষ পর্যন্ত মেশিনম্যান আমার হাতে একটা ছাপা ম্যাপ গুঁজে দিল। খুব খুঁটিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হলাম। দু-রঙে ম্যাপ ছাপা হলেও কোনও অসুবিধে দেখা দেয়নি। রহস্যটাও ভেদ করে দিয়েছে মেশিনম্যান। বাই-কালার বা দু-রঙা ব্লক মানে একই ছবির দুটো ব্লক। প্রথমে একটা রং মাখিয়ে প্রথম ব্লকটা ছেপে নিয়ে, তারপর সেই ছাপা কাগজের ওপরেই ভিন্ন রঙে দ্বিতীয় ব্লকটা ছাপা হবে। এখানে যেমন প্রথম ব্লকটা নীল রঙে ছাপতেই কতকগুলো দেশ নীল হয়ে গিয়েছিল, বাকিগুলো তখন অবধি সাদাই ছিল। তারপর দ্বিতীয় ব্লকটা হলদে রঙে ছাপতেই একেবারে ভোজবাজির মতো নীল ও হলদে ছাড়াও কোনও কোনও দেশের রং সবুজ হয়ে গেল। বাকি দেশগুলো সাদাই পড়ে রইল। বুঝলাম, তপু কথাটা একেবারে ভুল বলেনি, চারটে রংই তো ফুটে উঠেছে ম্যাপটাতে-নীল, হলদে, সবুজ আর সাদা। (দেখলি তো তপু, সাদাটাকে যে রং হিসাবে গণ্য করতে হবে সে বুদ্ধি আমার আছে!) মেশিনম্যানের কাছেই শিখলাম যে নীলের সঙ্গে হলদে মেশালে সবুজ হয়। যে দেশগুলোকে এখন সবুজ দেখাচ্ছে, সেগুলোকেও প্রথমে হলুদে রঙে ছাপা হয়েছিল, তারপর দ্বিতীয় ব্লকটা দিয়ে তাদের ওপর নীল রং চড়াতেই এখন তাঁরা সবুজ হয়ে গেছেন।
প্রেস থেকে ট্যাক্সি ধরে সোজা তপুর বাড়ি। ম্যাপটা ছাপার পর চারটে রং ফুটে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু মাত্র দুটো রং দিয়েই তো কম্ম সারা হয়েছে। সাদাটাকে ধরলে না-হয় তিনটে রংই হল। এবার দেখি তপুর তড়পানি কোথায় যায়।
তোর প্রবলেম সল্ভ করে ফেলেছি। তপুকে আমি এক মুহূর্ত সময় দিলাম না, খুব যে সেদিন হইচই জুড়ে দিয়েছিলি, যে কোনও ম্যাপ রং করতে চারটে রং চাই-ই আর অঙ্কের হিসেবে নাকি পাঁচটা রং না হলেই নয়। কিসসু জানিস না, শুধু লম্ফঝম্প।
তপুর ভুরু কুঁচকে গেছে। মানুষকে নাজেহাল করার এই উচিত শাস্তি। তপুর নাকের সামনে ম্যাপটা খুলে ধরে বললাম, এই দেখ, সোজা প্রেস থেকে নিয়ে আসছি। মাত্র তিনটে রঙেই কেল্লা ফতে। নীল, হলদে আর সাদা, মানে বাই-কালার ব্লক দিয়ে…।
তপুটা এক টানে ম্যাপটা সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ওহে ভূ-গুলেশ্বর, তুই একটা আস্ত গবেটক। এভাবে চিন্তা করলে তিনটে রং কেন, একটা রং দিয়েও যে কোনও ম্যাপের দেশগুলো স্বতন্ত্র করা যায়।
একটা রং? খটকা লাগল কেমন। বেশ বুঝতে পারছি, আমার বিজ্ঞানচেতনার খামতিটুকুর সদ্ব্যবহার করেছে তপু। নিজের রাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করতে চাইছে। সব বুঝেসুঝেও বলতেই হল, কীরকম শুনি।
এই দেখ, কাগজ ও পেনসিল টেনে তপু একটা মানচিত্রের খসড়া এঁকে নিল। বিভিন্ন দেশের খুপরির মধ্যে একটায় ছোট ছোট বৃত্ত বসাল, দ্বিতীয়টায় বসাল ফুলস্টপের মতো নিরেট ফুটকি, তৃতীয়টায় তেঁড়া দিল আর চতুর্থটাকে পুরো অন্ধকার করে দিল শিষ ঘষে ঘষে।
ইংরিজির একের মতো পেনসিলটা খাড়া করে ধরল আমার নাকের সামনে। সত্যি, এ সম্ভাবনার কথা আমার মাথায় আসেনি। তবু হাল ছাড়ব না ঠিক করলাম, হ্যাঁ, স্বীকার করছি যে, এভাবে একটা রং দিয়েও ম্যাপের মধ্যে বিভিন্ন দেশকে আলাদা করা যায়, কিন্তু সে পথ তো আমিই তোকে বাতলেছি। চার রংকে তিনে টেনে নামাবার পরই না তুই পদ্ধতিটির আরও উন্নতিসাধন… ।
তুই বাতলেছিস না কচু। বাতলেছে ছাপাখানার মেশিনম্যান।
বজ্রাহত করে দিল তপু। মেশিনম্যানের কথা ও জানল কী করে? সেই হাফপ্যান্টের বয়স থেকে তপুর সঙ্গে বন্ধুত্ব, অথচ আমার বিদ্যেবুদ্ধির ওপর এইটুকু আস্থা নেই যে আমি… মুশকিল হচ্ছে প্রতিবাদ করার পথটাও বন্ধ! আন্দাজে ঢিল ছুড়লেও লেগেছে ঠিক।
বন্ধুত্বের এত বড় অসম্মানে মুহ্যমান হয়ে পড়তে বোধহয় তপুর দয়া হল। আমায় সান্ত্বনা দিয়ে বলল, বুঝলি, তুই কিন্তু একটা গ্রেট সার্ভিস করেছিস। অঙ্কের বইয়ে এই ম্যাপের ব্যাপারটাকে চারটি রঙের সমস্যা বলে লেখা হয়। আসলে লেখা উচিত চারটি সংকেতের সমস্যা। রং বলতে এখানে সংকেতই বোঝাচ্ছে। চারটে রঙের বদলে এ-বি সি-ডি গোছের চারটে অক্ষর বা চার ধরনের সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করলেও চলে। গণিতবিদের সঙ্গে যদি ছাপাখানা বা ব্লক তৈরির কারখানার কর্মীদের বন্ধুত্ব থাকত তাহলে তাঁরা নিশ্চয় এরকম ভুল বোঝাবুঝির স্কোপ দিতেন না। পাঠ্যপুস্তক নকল করে তুই কস্মিনকালেও নাম করতে পারবি না, কিন্তু কারিগরদের সঙ্গে গণিতজ্ঞদের যোগাযোগ ঘটানোর জন্য ইতিহাসের আনাচে কানাচে তোর নামটা থেকেও যেতে পারে।
[প্রথম প্রকাশ: কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, ১৯৮২ জুলাই]