৩. প্রথম ভাগ রহস্য

০৩. প্রথম ভাগ রহস্য

 হিসেবে গন্ডগোল। কে জানত, সাতসকালে ঝন্টুমামার ঘরে ভিজিটর থাকবে। তা-ও সাধারণ ভিজিটর হলে তো ভালো ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কাজ নিশ্চয় চুকে যেত। অবশ্য তেমন সিরিয়াস কোনও ব্যাপার হলে–তাতেও আমাদের আপত্তি ছিল না। সেই ক্যানিঙের তোপ-রহস্য ভেদ করে ফেরার পর থেকেই ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটেনি। কিন্তু সে আশা মরীচিকা। ভিজিটর হিসাবে আগমন ঘটেছে মাস্টারমশাইয়ের।

নিলয় বলল, চল, মুখটা তো আগে দেখাই। মাস্টারমশাই তো তিন-চার ঘণ্টার আগে উঠবেন না! কাজেই…

ঝন্টুমামার শ্রদ্ধাভাজন মুষ্টিমেয়দের মধ্যে অন্যতম মাস্টারমশাই। দু-বেলা টিফিন ক্যারিয়ারে করে আদিদাস তাঁর জন্য খাবার নিয়ে যায়। প্রায় প্রতি রবিবার সকালের চা জলখাবারটা ঝন্টুমামা মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে বসেই করেন। কিন্তু ঝন্টুমামা তাঁকে যে দৃষ্টিতেই দেখুন, আমরা তাঁর সঙ্গে একমত নই। বয়স ও বেশবাস ছাড়া তার মধ্যে আকর্ষণীয় কিছু আছে বলে মনে হয়নি কখনও। পাজামা পরতে দেখিনি। একই রঙের ডোরাকাটা পুরানো ধরনের শার্ট পরেন–যা মাথা গলিয়ে পরতে হয়। শার্ট হলেও পাঞ্জাবির মতো বোতামঘর আছে আর তার তলা থেকে একটা কুঁচি নেমে গেছে জামার প্রান্ত অবধি। ভুড়ি বাড়ার জন্য এই প্রভিশন অবশ্য মাস্টারমশাইয়ের আর কোনও কাজে লাগবে না। সত্তর বছর পার করেও যখন মেদ লাগেনি আর… মাস্টারমশাইয়ের জামার আরেকটি বৈশিষ্ট্য তার হাতা। চওড়া পটির কাফ আছে, কিন্তু কাফ লিঙ্ক নেই, সারাক্ষণ হাতা দুটো ঢলঢল করে আর মাস্টারমশাই বৃথাই বারংবার তাদের ঠেলে ঠেলে কনুইয়ের কাছে জমা রাখার চেষ্টা করেন।

কিন্তু মাস্টারমশাইকে অপছন্দ করার কারণ এগুলোর কোনওটাই নয়। আসলে, কেমন যেন ব্যক্তিত্বের একটা অভাব বলে মনে হয়। এত বয়স হল, তবু বকবকানি… অবশ্য এই কথা শুনে ঝন্টুমামার কমেন্টটাও সিগনিফিক্যান্ট। ঝন্টুমামা উলটে আমাদেরই দোষী করেছিলেন, তোরা ব্যক্তিত্বের কী বুঝিস? ব্যক্তিত্ব মানে তো তোদের কাছে শরা-চাপা মালসা। যা হাসির সময় হাসে না; কান্নার সময় কাঁদে না। ব্যক্তিত্ব মানে তো তোদের কাছে অফিসের বড়কর্তার নির্বাক শাসানি!

ঝন্টুমামা এখানেই থামেননি, মাস্টারমশাইকে আমাদের ভালো না-লাগার ভিন্ন একটা কারণও তিনি ব্যক্ত করেছিলেন। মাস্টারমশাই আমাদের পাত্তা দেন না বলেই…

পাত্তা যে দেন না, তার আরেকটা প্রমাণ মিলল। ঘরে ঢুকে নমস্কার করতেই তিনি অসহায়ভাবে তাকালেন ঝন্টুমামার দিকে।

–চিনতে পারছেন না মাস্টারমশাই? আমাদের সুগত!

 –আরে তা-ই তো। কিন্তু একা কেন? মানিকজোড়ের আরেকটি কোথায়?

 বার সাতেক পরিচয়ের পর এমন কথা শুনলে কেমন লাগে? তবু বলতেই হল, এসেছে। আদিদাসকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছে। ভালো কথা, একটু মাছ আনা হয়েছে, মাস্টারমশাই চিংড়ি মাছ খান তো?

–কেন? খাব না কেন? বিধবা নই যখন!

 ঠিক এই কারণেই লোকটাকে ভালো লাগে না। এমন হাসি জুড়েছে, বলারই সুযোগ পেলাম না যে, আমি অ্যালার্জির প্রসঙ্গে এই প্রশ্নটা করেছিলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম, আর মুখ খুলব না। গোমড়া মুখে বসে থেকেই শোধ তুলব। নিলয়ও এসে হাজির হয়েছে দেখে ঝন্টুমামা বলল, তোরা আরেকটু আগে এলেই দারুণ একটা গল্প শুনতে পেতিস। ঠিক মাস্টারমশাইয়ের মতো কি আর বলতে পারব? তবু শোন–পরশু দিন হঠাৎ এক গবেষক এসে হাজির মাস্টারমশাইয়ের কাছে। কলকাতাকে নাড়াচাড়া করছেন তিনি। কিছু পরামর্শ নিতে চান। দারুণ বাঁচাল–অতি চালাক এবং স্নব। দেখে-বুঝে মাস্টারমশাই তাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য একটি প্রশ্ন করলেন। একেবারে মোম আঘাত। তারপরেই সে হাওয়া।

প্রশ্নটা কিন্তু শুনলাম না, ঝন্টুমামাকে স্মরণ করিয়ে দিল নিলয়।

–সামান্য প্রশ্ন। কলকাতা নিয়ে কাজ তো করছেন, কলকাতার ঠিকানা জানেন তো? না; রাজনৈতিক ঠিকানা নয়, ভৌগোলিক? ল্যাটিচুড-লঙ্গিচুডের হিসাবটা রাখেন কি?

মুখে একটু হাসির ভাব ফুটিয়ে তুলতেই হল। না হলে গুরুজনদের প্রতি অশ্রদ্ধা জানানো হয়। কিন্তু সত্যি বলতে এতদিনে মাস্টারমশাই ও ঝন্টুমামার মধ্যেকার সম্পর্কের ভিত্তিটা যেন একটু আন্দাজ করতে পারছি। যা-ই হোক, এখন চুপ করে বসে থাকাটাই আমাদের কর্তব্য। শুধু শুনে যাও মাস্টারমশাইয়ের অমৃতবাণী। ওহ, বকতেও পারে বটে।

মাস্টারমশাই শুরু করেছিলেন পুজো সংখ্যা দিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের উপন্যাস পড়ে কেদারবদরী ঘোরার ইচ্ছে হল। তারপর কেদারবদরীর অভিজ্ঞতা, ফিরতি পথে রুদ্রপ্রয়াগ, রিজার্ভ ফরেস্ট, চিতা, জিম করবেট, মহাশ্বেতা দেবী (করবেটের লেখার অনুবাদক হিসেবে), রাজনৈতিক উপন্যাস…।

ঠিক এই সময়ে থালায় চিংড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকল আদিদাস। চিলি চিংড়ি আর চা।

ঝন্টুমামা বললেন, একটা ছোট বাটিতে করে….

 মাস্টারমশাই বাধা দিলেন, কী হবে? তুমি কি সমরের কথা ভেবে দিতে বলছ?

হ্যাঁ।

–কোনও দরকার নেই। সে এখন রীতিমতো লায়েক হয়েছে। আমার সঙ্গে খায়ও না। তার টিকির হদিশ পাওয়াই ভার আজকাল…

-তাহলে তো আপনার বেশ অসুবিধেই হচ্ছে…

-কিছু না। বরং ভালো আছি। ও এখন পুরোপুরি যদি বিদেয় হয় ওখান থেকে তাহলে বাঁচি। সত্যি বলতে, ওর সম্বন্ধেই দু-চারটে কথা বলার জন্য আজ আমি এসেছি।

চিংড়ির ডিশটা ফাঁকা। সকলে চায়ের কাপ তুলে নিয়েছে। মাস্টারমশাই বললেন, তোমায় আর কী বলব, অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটছে গত তিন দিন ধরে। প্রতিদিন ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বেলা আটটা-ন-টা হয়ে যাচ্ছে। জীবনে এই প্রথম ক-দিন আমি ভোর সাড়ে চারটের পর চোখ খুললাম। প্রচণ্ড টাইফয়েড হয়েছিল একবার, তখনও

ডাক্তারের কাছে একবার প্রেশারটা…

–দেখিয়েছি। পুরো নর্মাল। নিজেরই কানে কেমন যেন অবিশ্বাস্য ঠেকছে কথাগুলো, তবু বলছি, এর মধ্যে একটা রহস্য আছে। আমার ধারণা, রাত্তিরে আমার ঘরে লোক ঢুকেছিল। কিছু একটা খুঁজেছে… কেন বলছি, আমার বইপত্রগুলো যেন ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। তুমি তো জানই কত বইয়ের স্তূপ। ধুলো-মাখা পোকা-লাগা বই নাড়ানাড়ি করলেই তার কিছু চিহ্ন দেখা যায়।

আপনি কি বলতে চান, আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে ঘরে চোর ঢুকেছিল?-নিলয় প্রশ্ন করে।

–সে কথা বলতে পারলে তো কোনও সমস্যাই ছিল না। কিন্তু আমাকে তো ভাই কেটে ফেললেও দু-চার পয়সা আর পচা কিছু ছাপা কাগজের স্তূপ ছাড়া কিছুই করার জুটবে না। কী চুরি করতে আসবে লোকে? আর তার জন্যে রাত্তিরে আসারই বা দরকার কী? ছুটির দিনে দিনদুপুরেও তো স্বচ্ছন্দে আসতে পারে।

ঝন্টুমামা বললেন, আপনার কথা শুনেই তো বোঝা যাচ্ছে, চোর যদি সত্যিই এসে থাকে, সে একটা কিছু খুঁজছে। বাঞ্ছিত জিনিসটা পেয়ে গেলে হয়তো আর আসবে না। আর দিনের বেলায় খোঁজাখুঁজি করার অনেক অসুবিধা। ইশকুলের ছাত্ররা না থাকুক, দারোয়ানরা তো আছে। হঠাৎ চোখ পড়ে যেতে পারে।

তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু কীসের খোঁজে

 হঠাৎ ঝন্টুমামা দাঁড়িয়ে উঠলেন। তাঁর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, মাস্টারমশাই! ঝন্টুমামার ডাকে আমরাও চমকে গেলাম। ঝন্টুমামা মাস্টারমশাইয়ের কাছে এগিয়ে এসে কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে বললেন, সেই প্রথম ভাগখানার কী খবর বলুন তো!

প্রথম ভাগ!-মাস্টারমশাইয়ের গলায় বিস্ময়ের ভাবটা কেটে গেল মুহূর্তের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে তিনিও উঠে দাঁড়ালেন, ঠিক! ঠিক তো। ভুলেই গিয়েছিলাম একেবারে। এ হে হে! তখনই যদি তোমার কথামতো বইটা খুঁজে বার করতাম। আর কি সে আছে–

ঝন্টুমামা প্রশ্ন করলেন, আজও কি দেরিতে ঘুম ভেঙেছে?

–হ্যাঁ!

–তাহলে হয়তো পাখি এখনও উড়ে যায়নি। চলুন, একবার আপনার ওখানে যাই।

–বেশ বেশ। এখুনি চল তাহলে। তবে একটা কথা শুনে রাখ, কালপ্রিট কে, সে কিন্তু আমি জানি। সমর বাবাজি ছাড়া আর কেউ নয়। ওই প্রথম ভাগের কথা তুমি ছাড়া একমাত্র ও-ই জানে। সবচেয়ে কী খারাপ লাগে জান, ছেলেটাকে আমি বুকে করে মানুষ করলাম…

–তার জন্য আমার বিন্দুমাত্র মায়ামমতা নেই। আমার একটাই চিন্তা, শুধু কয়েকটা সন্দেহের ওপর ভর করে তো আর সমরকে ধরা যাবে না। তার জন্য চাই প্রমাণ…। আমি বলে উঠলাম, বইপত্র নাড়াচাড়া করেছে যখন, নিশ্চয় আঙুলের ছাপ…।

–অসম্ভব। এ যদি সমরের কর্ম হয়, তবে আঙুলের ছাপ কিছুতেই দেখতে পাবে না। সমর এখন স্কুলের কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিতে কাজ করে। তা ছাড়া ডিটেকটিভ উপন্যাস তার বগলে বগলে ঘোরে…

মাস্টারমশাইয়ের পিছুপিছু আমরা চারজনে চক্রবেড়িয়া ইনস্টিটিউটের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। আদিদাসও সঙ্গে আছে। স্কুলবাড়ির পেছনে খেলার মাঠ। মাঠের পুব দিকে দারোয়ানদের এক সারি ঘর। তারই একধারে একটি ঘরে থাকেন মাস্টারমশাই। আর তার পাশের ঘরটাতে থাকত সমর। সে-ই দেখাশোনা করত। কিন্তু কিছুকাল যাবৎ তার ঘর বন্ধই পড়ে আছে। রাত্রে থাকে না। দিনের বেলা মাঝেমধ্যে আসে।

ঝন্টুমামা বলল, ছেলেটির মাথা আছে। রাত্রিবেলা না থেকে নিজের কেসটাকে শক্ত করছে।

মাস্টারমশাইয়ের ঘরে পা দিয়েই নিজের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলাম। মানুষ চেনার কোনও ক্ষমতাই দেখছি আমার হয়নি। মাস্টারমশাইকে দেখে, তাঁর কথা শুনে তাঁকে যত না বুঝেছি, তার ঢের বেশি তাঁকে চিনিয়ে দিয়েছে তাঁর এই ঘরখানা আর একটি তথ্য–এই ঘরেই তাঁর জীবনের পঁয়তাল্লিশ বছর কেটেছে। তার আগে অবশ্য বছর দশেক স্বদেশি দস্যু হিসেবে মহাসমাদরে হাজতবাস করেছেন।

ব্যাচেলর আদর্শবাদী মাস্টারমশাই রিটায়ার করার পরেও ইশকুলেরই এই ঘরটাতে বাস করছেন। সাত কুলে কেউ নেই বলেই যে দয়াবশত কমিটি মেম্বাররা রাজি হয়েছেন তা নয়। রাজি তাঁদের হতে হয়েছে পাড়ার মাতব্বরদের ইচ্ছা অনুসারে। মাস্টারমশাই রিটায়ার করেছেন অফিশিয়ালি, কিন্তু নিয়মিত কোচিং ক্লাস নেন। মাইনে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলেও বাসস্থানচ্যুত করার প্রয়োজন হয়নি।

ঘরের মধ্যে আসবাব বলতে তক্তপোশ আর কাত হয়ে পড়া ছোট্ট আলনা, দু-তিনটে তোবড়ানো আধভাঙা আধ ডালা খোলা বাক্স। বালিশসুদ্ধ শতরঞ্চি জড়িয়ে গুটিয়ে রাখা হয়েছে তক্তপোশের ওপর। মশারির দুটো খুঁট শুধু খোলা। বাকি দুটো বোধহয় পারমানেন্টলি লাগানো আছে। বিবর্ণ চুনকামহীন ঘরটার দেওয়ালে ইট বেরিয়ে পড়েছে কোথাও কোথাও। কিন্তু এসব বিবরণের চেয়েও বড় যেটা, সেটা হল–বই। শুধু বই। সারা ঘর জুড়েই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বা ডাঁই করে রাখা বই। পুরানো, ছেঁড়া, পোকায় কাটা বই। জানলায়, তক্তপোশের তলায়, মাটিতে ইটের ওপর তক্তা পেতে–বই। কয়েকটা জানলার পাল্লা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে শুধু বইয়ের উপদ্রবে। অনেক কষ্ট করার পর চোখে পড়ল, মেঝের এক কোণে একটা গলা-ভাঙা কুঁজো, দু-চারটে বাসন, একটা হাতল-ভাঙা কাপ আর একটা কেরোসিনের স্টোভ আছে।

এই ঘরে কী এমন মূল্যবান বই আছে বা ছিল, যার জন্য চোর ঢুকেছিল? প্রশ্নটা করব কাকে? ঝন্টুমামা বকের মতো সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে নিরীক্ষণ করছেন। মাস্টারমশাই উদগ্রীব হয়ে পুরানো বইয়ের মধ্যে আতিপাঁতি অনুসন্ধান জুড়েছেন, আর মাঝে মাঝেই বলছেন, কোথায় যে রেখেছিলাম, নিজেরই খেয়াল নেই।

ঝন্টুমামা বললেন, সেই কারণেই একমাত্র বইটা রক্ষা পেতে…

কথা শেষ না করায় ঝন্টুমামার দিকে তাকালাম, কিছু একটা নিশ্চয় চোখে পড়েছে, না হলে তো…।

মাস্টারমশাই!-ঝন্টুমামার গলায় স্বরটা কঠিন শোনাল, আপনি এখানে এসে দাঁড়ান তো একটু।

চোখের ইঙ্গিতে আমাদেরও ঘরের মাঝখানে ডেকে নিলেন ঝন্টুমামা। তারপর মেঝের ওপর জুতোর ডগা দিয়ে একটা গণ্ডি টেনে আদিদাসকে বললেন, তুমি ওই বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়েই লক্ষ রাখবে, কেউ যেন এই গণ্ডির বাইরে পা না দেয়। আমি এখুনি আসছি।

ঝন্টুমামার বেঁটে বেঁটে পায়ে কিন্তু স্পিড বেশ ভালোই ওঠে দেখছি। কিন্তু সে যা-ই হোক, এরকম রামায়ণী কেতায় আমাদের শাস্তি দিয়ে যাওয়ার কারণটা তো বোঝা গেল না। আমরা তো আর চুরি করিনি!

ঝন্টুমামা অবশ্য কথা রেখেছেন। মিনিট দশেকের বেশি সময় নেননি। পাড়ার এক রিকশাওয়ালার সাহায্য নিয়ে তিনি ফোটোগ্রাফ তোলার সাজসরঞ্জাম সমেত হাজির।

আমাদের কোনও ভূমিকা নেই কিন্তু। ঝন্টুমামা নিজেই তার টেনে জায়গামতো ফ্লাডলাইট বসিয়ে ক্যামেরা ফোকাস করলেন। তারপর ডাক পড়ল আদিদাসের। একটা কালো কাগজ তার হাতে ধরিয়ে দিলেন। ডান হাত বাড়িয়ে কাগজটা ধরল সে। ঝন্টুমামা ছবি তুললেন। জায়গাটা জানলার সামনে, কিন্তু কীসের ছবি তুললেন, বোঝা গেল না।

ঝন্টুমামা বললেন, আর নড়াচড়া না করে সবাই মিলে বেরিয়ে পড়ুন। আমি জানলা দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি। পুলিশ নিয়ে না-আসা অবধি আদিদাস পাহারা দেবে। মাস্টারমশাই, আপনি দারোয়ানদের একটু বলে দিন।

রাস্তায় যেতে যেতে ঝন্টুমামা বললেন, মাস্টারমশাই, সমর যদি বাঁচতে চায় তাহলে তার আপনার কাছে সব কথা কবুল করা দরকার। না হলে কিন্তু পুলিশের….

মাস্টারমশাই বললেন, এক কাজ করি। যদি পারি তো ওকে এখানে ডেকে আনছি।

–সেই ভালো।

 মাস্টারমশাই চলে গেলেন। আমি আর থাকতে পারলাম না। নিলয়ের দিকে একবার তাকিয়ে দুম করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ঝন্টুমামা কীসের ছবি তুললেন?

–মাকড়সার জালের।

–অ্যাঁ!

–হ্যাঁ। আরেকটা মাকড়সার জালের ছবি তুলতে চাই। একটু নজর রেখো।

ঝন্টুমামার বাড়ির সদর দরজার পাশেই চোখে পড়ল একটা মাকড়সার জাল। ঝন্টুমামা। কিন্তু একবার তাকিয়েই নাকচ করে দিলেন। এরকম নয়। বেশ জ্যামিতির নকশাওয়ালা সুন্দর যে জালগুলো দেখা যায়, ওইরকম একটা চাই। নিলয়ের আবিষ্কারটাই শেষ অবধি উতরে গেল। জানলার দুই শিকের মাঝে মাকড়সার সুচারু জালের ছবি তুললেন ঝন্টুমামা। সেই আগের মতোই পেছনে একটা কালো কাগজ রেখে।

তারপরেই তিনি ডার্করুমে নিরুদ্দেশ। এমন সময় মাস্টারমশাই সমরকুমারকে নিয়েই হাজির হয়েছিলেন। বাইরের ঘরে তাদের বসার ব্যবস্থা করছি, নিলয় খবর দিতে গেল ঝন্টুমামাকে।

সমরকে দেখেই মনে হল, গোরু চোর। অর্থাৎ, হাবেভাবে বেশ চালাক-চতুরের ভণিতা একটা আছে, কিন্তু চোখের তারাটা সারাক্ষণ ছটফট করে বেড়াচ্ছে কী যেন এক মতলবে।

ঘণ্টাখানেক লাগল ঝন্টুমামার ডার্করুম থেকে বেরতে। ঝন্টুমামাকে দেখে সমর সপ্রতিভভাবে নমস্কার করল।

ঝন্টুমামা দেখতে পেলেন না। চেয়ার টেনে বসে সামনের টেবিলের ওপর দুটো ফোটোগ্রাফ রাখলেন। আমরা ঝুঁকে দাঁড়িয়েছি। মাস্টারমশাইও উঠে এসেছেন।

ঝন্টুমামা বললেন, মাস্টারমশাই, আপনার অনুমানই ঠিক। ওষুধ দিয়েই আপনাকে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল।

আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, সমর কী একটা বলতে গিয়েও যেন বলল না।

এই মাকড়সার জাল দেখেই তুমি ধরে ফেললে যে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল? মাস্টারমশাই প্রশ্ন করলেন।

–ঠিক তা-ই। এই দেখুন–এই ফোটোগ্রাফে সাধারণ মাকড়সার জালের ছবি দেখেছেন আর এইটা হচ্ছে আপনার ঘরের মাকড়সার জালের ছবি। ছবি দুটোর মধ্যে কোনও তফাত চোখে পড়ছে কি?

হ্যাঁ।–সমস্বরে বলে উঠলাম আমরা। (সমরের কোনও আগ্রহ নেই)। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি দ্বিতীয় মাকড়সার জালটা যেন কেমন এলোমেলো, বিশৃঙ্খল।

–আরও ভালোভাবে বোঝাতে হলে বলা দরকার, মাকড়সাটা যেন মাতাল হয়ে জাল বুনেছে। তা-ই না? মাস্টারমশাইয়ের ঘরে বিশেষ একটি অ্যানিস্থেটিক গ্যাস অর্থাৎ সংজ্ঞাহরণকারী গ্যাস প্রয়োগ করা হয়েছিল বলেই মাকড়সা বাবাজিরও অবস্থা কাহিল হয়েছিল। সমরবাবু কী বলেন?

–আমি! আমি কী বলব? আমার কিছু বলার নেই।

মুখে যতই উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুক, তার বিব্রত ভাবটা কারওই চোখ এড়ায়নি।

মাস্টারমশাই কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে বাধা দিয়ে ঝন্টুমামা বললেন, দাঁড়ান। আরেকটা কাজ বাকি আছে। ঠিক কি গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটা আগে জেনে নিই, তারপরে সমরবাবু নিশ্চয়…

অসভ্যের মতো সমর চেঁচিয়ে উঠল, বলছি তো আমি এসবের কিছু জানি না।

ঝন্টুমামা হেসে প্যান্টের পকেট থেকে ছোট্ট একটা ডায়েরিমতো বার করে টেবিলে রাখলেন। মলাট তুলতেই চোখে পড়ল মাকড়সার জালের ছবি। ঝন্টুমামার মুখ থেকেই শোনা গেল, সুইটজারল্যান্ডে ডক্টর উইটের কাছে কিছুদিন কাজ করেছিলেন ঝন্টুমামা। সেই সুবাদেই এই ক্যাটালগটা জোগাড় করেছিলেন। জিলা গ্রুপের মাকড়সারা কোন গ্যাস বা কোন রাসায়নিকের প্রভাবে কীরকম জাল বোনে, তার ফোটোগ্রাফিক নমুনা আছে এর মধ্যে।

নিলয় প্রশ্ন করল, তার মানে বিশেষ একটি গ্যাসের প্রভাবে এই মাকড়সার জাল বোনার সময়ে বিশেষ এক ধরনের ভুলই করবে?

–ঠিক তা-ই।

মাস্টারমশাইয়ের ঘরের মাকড়সার জালের ছবিটাকে বাঁ পাশে রেখে আমরা একে একে ডক্টর পিটের ক্যাটালগের পাতা উলটে চলেছি। এবার কিন্তু সমরও ঝুঁকে পড়েছে। গোটা দশেক পাতা ওলটাবার পরেই হঠাৎ অস্ফুট একটা শব্দ কানে এল আর সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রবল আর্তনাদ। চমকে সরে গেলাম। চোখের সামনেই দেখি, সমর মেঝের ওপর পড়ে কাতরাচ্ছে। মূর্খ পালাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পেছন আর ফিরতে হয়নি, তার আগেই মাস্টারমশাইয়ের একটি ঘুষি…।

সমরকে টেনে দাঁড় করিয়ে মাস্টারমশাই বললেন, বল্ আগে, তুই লাফিং গ্যাস দিয়েছিলি? মানে, নাইট্রাস অক্সাইড?

ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছে সমর। কেবলই মাস্টারমশাইয়ের পা ধরতে চায়। বলে, সবই তো

স্যার জেনে ফেলেছেন। খুব অন্যায় করে ফেলেছি।

–কিন্তু বইটা কোথায়

?–পাইনি স্যার। বিশ্বাস করুন, অনেক খুঁজেও পাইনি।

ঝন্টুমামা বললেন, হ্যাঁ সে কথা বিশ্বাস করতেই হবে। কারণ ও শুধু মোটা মোটা বাঁধানো বইগুলোর রাজত্বেই তল্লাশি চালিয়েছে। বর্ণপরিচয় যে অ, আ, ক, খ শেখার সেই পাতলা চটি বই–এটা ও ভাবতেই পারেনি। এত দামি বই শুনে মনে করেছিল অন্য কোনও বর্ণপরিচয়।

মাস্টারমশাই বললেন, তোর মাথায় হঠাৎ এ দুর্বুদ্ধি চাপল কেন বল তো?

-সত্যি বলছি স্যার, একটা ডিটেকটিভ বইতে লাফিং গ্যাস দিয়ে লোককে অজ্ঞান করার একটা গল্প পড়েছিলাম। তারপর ল্যাবরেটরিতে নাইট্রাস অক্সাইড দেখেই..

-মনে হল, বুড়ো মাস্টারটাকে বধ করি! বেশ বেশ!

ঝন্টুমামা বললেন, মাস্টারমশাই, সমরকে নিয়ে যান।

আদিদাস তো ওখানেই আছে, ওকে বলবেন, আমি বলেছি, সমরকে যেন একটু তালিম দিয়ে দেয়। দু-চারটে তালিম দিলেই আর ভবিষ্যতে ভুল হবে না। যাও বাবা সমর–এবার বাড়ি যাও। কোনও ভয় নেই তোমার।

সমরকে নিয়ে মাস্টারমশাই বেরিয়ে গেলেন। ঝন্টুমামা তাঁকে দিয়ে কথা আদায় করে নিয়েছে, কালকের মধ্যেই বর্ণপরিচয়টা খুঁজে বার করবেন এবং ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ডোনেট করে দেবেন। সবই তো হল, কিন্তু একটা সাধারণ বর্ণপরিচয় নিয়ে এত কাণ্ড হয়ে গেল… ।

ঝন্টুমামা আমাদের মুখের ওপর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই যা বোঝার বুঝে নিলেন। স্বগতোক্তির মতো তাঁর উচ্চারণ আমাদের কানে মধু ঢেলে দিল। বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের এটি প্রথম সংস্করণ। ছাপা হয়েছিল ১৮৫৫ সালে। প্রথম সংস্করণ তো দূরের কথা, এর পরেরও বেশ কয়েকটা সংস্করণের একটি কপিরও আজ অবধি হদিশ মেলেনি। টাকার হিসাবে এর দাম কষা যাবে না। অবশ্য নিরক্ষরের কাছে সব বইয়েরই সমান দাম।