একটু পরে রোদ উঠবে – প্রচেত গুপ্ত
প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০১৭
পত্রভারতী
প্রচ্ছদ সৌজন্য চক্রবর্তী
.
পৌলোমী বসু
ব্রাত্য বসু
.
এক শীত শীত সকালে ঘুম ভেঙে দেখলাম, আকাশ মেঘলা। চারপাশ ধূসর, ঘোলাটে। কেমন একটা থম মারা বিষণ্ণ ভাব। মন খারাপ হয়ে গেল। সেই মন খারাপ কাটাতে নিজেকে বোঝালাম, চিন্তা নেই, একটু পরে রোদ উঠবে। আবার চারপাশ ঝলমল করবে। কোন রূপক নয়, সরাসরি মেঘ কেটে রোদ ওঠবার কথাই ভেবেছিলাম। এই কাহিনিও তাই। আড়ালে অন্য জটিলতা কিছু নেই।
ভেবেছিলাম, অনেক ভাবনাচিন্তা করে লিখব। পেন চিবোব, মাথার চুল ছিঁড়ব। মোটা মোটা বই থেকে উদ্ধৃতি দেব। ধারাবাহিক উপন্যাস বলে কথা। কাহিনি, চরিত্র, সবাই আমার কাছে তটস্থ হয়ে থাকবে। একটু এদিক-ওদিক করলেই ধমক খাবে। বলা বাহুল্য লেখা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সব আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে লাগল। এক সময় দেখলাম, চরিত্র থেকে গল্প পর্যন্ত সবাই হাতের বাইরে! তারা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো চলছে, কথা বলছে, ভাবছে। শাসন করবার চেষ্টা করলাম। লাভ হল না। লেখক হিসেবে নিজেকে অসহায় লাগল। হাল ছেড়ে দিলাম। যা হয় হোক।
মজার কথা হল, একটা সময়ের পর বুঝতে পারলাম, হাতের বাইরে চলে যাওয়ার কারণে কাহিনি, চরিত্র, গল্প বলবার ভঙ্গি নিয়ে লেখক হিসেবে অনেক বেশি আনন্দ পাচ্ছি। তারাও খুব খুশি। ফলে এই কাহিনির ভালো-মন্দর দায় আমার নয়। কাহিনির নিজের।
কাহিনিতে মজা আরও আছে। কাহিনির নাম ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ হলে কী হবে, মূল চরিত্রের নাম বারিধারা। এই উলটো কম্মটি আমি ভেবেচিন্তে করিনি। এটিও নিজের মতো হয়ে গেছে। লেখা নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলে যা হয় আর কী। ঝকঝকে এই তরুণীটির বুদ্ধি, আধুনিক চিন্তা, প্রতিবাদ, মূল্যবোধ, ভালোবাসা বারিধারার মতোই কাহিনির বিভিন্ন জায়গায় ঝরে ঝরে পড়েছে।
একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে এই সময়ের কথা বলতে চেয়েছি। কাহিনির বিস্তার অনেকটাই। চরিত্র, ঘটনা অজস্র। চরিত্রদের বয়স একানব্বই থেকে চব্বিশ। ঘটনা ছড়িয়েছে কলকাতা থেকে সুন্দরবনের গ্রাম পর্যন্ত। এই সময়ের প্রেম, রাজনীতি, জাদু বাস্তবতা, লোভ, হিংসা, অপরাধ, মায়া-মমতা, বিশ্বাস ভঙ্গ আর বিশ্বাস গড়া নিয়ে একটা দলিল তৈরির চেষ্টা করেছি। একই সঙ্গে চেষ্টা করেছি, কাহিনিকে সময়োত্তীর্ণ করতে। কতটা পারলাম জানি না।
অনেকের কাছে কৃতজ্ঞ। আজকাল পত্রিকার সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত চাপ না দিলে লেখাটা শুরুই হত না। শৌনক লাহিড়ি উৎসাহ না দিলে লেখাটা আজকাল পত্রিকার রবিবাসরের পাতায় ছিয়াত্তর সপ্তাহ ধরে চালাতেই পারতাম না। ঋণী দেবাশিস চন্দর কাছে। প্রতি সপ্তাহে ঠেলা দিয়ে লেখা বের করে নিয়েছে। কৃতজ্ঞ প্রিয় শিল্পী দেবব্রত ঘোষের কাছে।
বই আকারে প্রকাশ করবার আগে কিছু পরিমার্জনা করলাম। জানি না, তাতে কাহিনি আরও ভালো হল কিনা।
পত্রভারতী সংস্থার কর্ণধার ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় একটা বিস্ময়কর কাজ করতেন। রবিবার রাতে লেখা পড়ে আমাকে ফোন করতেন। একবারও বাদ যায়নি (উনি দেশের বাইরে না থাকলে)। তাঁর প্রতিক্রিয়া শুনে অবাক হতাম। মনে হত, কাহিনির বহু চরিত্রকেই উনি আমার থেকে অনেক বেশি ভালোবাসেন, অনেক বেশি চেনেন। তাদের প্রতি কোনও অবিচার সহ্য করবেন না। প্রয়োজনে আমার সঙ্গে হাতাহাতি পর্যন্ত যাবেন। এই বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পী সৌজন্যকে ধন্যবাদ। ভারী চমৎকার কাজ করেছেন। ধন্যবাদ পত্রভারতী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে। তারা বহু বছর ধরে আমার জ্বালাতন সহ্য করে চলেছেন। এবারও করলেন।
দীর্ঘদিন ধরে একটা লেখা চালাতে হলে বাড়ির জোরদার সমর্থন দরকার হয়। সেই জোরদার সমর্থন আমার স্ত্রী মিত্রা, পুত্র সমুদ্র এবং আমার পিসিমার কাছ থেকে। আমার বউদি শ্রাবণী গুপ্ত অপেক্ষা করে আছেন কবে বই প্রকাশ হবে আর কবে তিনি সংগ্রহে রাখবেন। আর আমার দাদা পূষণ গুপ্তর কড়া সমালোচনা শোনবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি আমি। আড়াল থেকে আমার ভাই পুষ্কর নিশ্চয়ই আমার লেখা-লিখির ওপর নজর রাখছে।
সবথেকে বেশি কৃতজ্ঞ আমি আমার পাঠকদের কাছে। ধারাবাহিক প্রকাশের সময় তারা কখনও রাগ করে, কখনও প্রংশসা করে, কখনও অনুযোগ করে, কখনও ভালোবেসে আমার লেখার সঙ্গে থেকেছেন। আমার বিশ্বাস, তারা এই বইয়ের সঙ্গেও থাকবেন।
প্রচেত গুপ্ত
৩১ অক্টোবর, ২০১৬
সল্টলেক
Leave a Reply