একটু পরে রোদ উঠবে – ৫০

পঞ্চাশ

শেখর আজ পার্টি অফিসে যায়নি।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই শেখর বুঝতে পেরেছে, শরীর ভালো নেই। গা ম্যাজ ম্যাজ করছে। সম্ভবত জ্বর আসছে। তমসাকে কিছু বলেনি। সে স্কুলে চলে গেছে।

তমসাদের স্কুলে একটা গোলমাল চলছে। অতিরিক্ত খারাপ নম্বর পাওয়ার কারণে হায়ার সেকেন্ডারি টেস্ট পরীক্ষায় কয়েকজন মেয়েকে আটকানো হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে, আবার পরীক্ষা দিতে হবে। পাস করলে তবেই ফাইনাল পরীক্ষায় বসবার সুযোগ মিলবে। এরপরই ফেল করা মেয়েদের বাড়ি থেকে গার্জেনরা এসে স্কুলে গোলমাল করেছে। তারা এক দুপুরে জোর করে হেডমিসট্রেসের ঘরে ঢোকে। হুমকি দেয়। গালমন্দ করে। এমনকী টিচার্স রুমের সামনে দাঁড়িয়েও চিৎকার করে। বলে, সব মেয়েকে টেস্ট পরীক্ষায় পাস করাতে হবে। নইলে স্কুল ভাঙচুর হবে। শিক্ষিকাদের আটকে রাখা হবে।

জানা গেছে, এই গোলমালের পিছনে রয়েছে স্থানীয় এক প্রভাবশালী। সে-ই এই গার্জেনদের জড়ো করে স্কুলে পাঠিয়েছে। সঙ্গে কিছু গুন্ডা। লোকটার এই স্কুলের ওপর বহুদিনের রাগ। ইচ্ছেমতো মেয়েদের ভর্তি করতে পারে না। নিজের লোকদের পিওন, দারোয়ানের চাকরি দিতে পারে না। স্কুলের জিনিসপত্র কেনবার বরাত আদায় করতে পারে না। গোলমালের পর হেডমিসট্রেস তাকে ফোন করেছিলেন। লোকটা ফোনই ধরেনি। হেডমিসট্রেস ভয় পেয়ে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, ফেল করা মেয়েদের ছেড়ে দেওয়া হোক। তারা হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় খারাপ করলে নিজেরা বুঝবে। টিচারদের বেশিরভাগই বেঁকে বসেছে। তারা বলছে, পাস-ফেলটা বড় কথা নয়, কিন্তু আজ হুমকি শুনে নরম হলে, আগামী দিনেও সবসময় নরম হতে হবে। যে-কোনও বিষয়ে বাইরের গুন্ডারা এসে গোলমাল পাকাবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ টিচারদের চাপে হেডমিসট্রেস আবার পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছেন। রাখতে বাধ্য হয়েছেন। গতকাল নতুন পরীক্ষার দিনক্ষণ জানিয়ে নোটিস পড়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আজ আবার সেইসব গুন্ডা গার্জেনরা গোলমাল করতে স্কুলে আসবে। শিক্ষিকারা সবাই আজ স্কুলে যাচ্ছে। তমসা তো যাবেই। সে এই ঘটনায় শিক্ষিকাদের মধ্যে বেশি সামনে এগিয়ে গেছে। গুন্ডামি মোকাবিলা করায় সে সব থেকে কড়া। তাকে বড়দি ডেকেছিলেন।

‘তমসা, মনে রেখো মেয়েদের স্কুল…সত্যি যদি ওরা গোলমাল করে…সিকিউরিটির প্রশ্ন এসে যাচ্ছে…মাত্র এগারোটা মেয়ের জন্য…তার থেকে অ্যালাও করে দেওয়াটাই ভালো নয় কি?’

তমসা সাধারণত হেডমিসট্রেসের সঙ্গে একা কোনও আলোচনা করে না। সিনিয়র কাউকে নিয়ে যায়। কিন্তু এই ঘটনায় সে উত্তেজিত। তাই একাই গিয়েছিল।

‘বড়দি, মেয়েদের স্কুল বলেই তো আমাদের বেশি করে রুখে দাঁড়ানো দরকার। এরপর তো ওরা রোজ ঝামেলা করতে আসবে। তা ছাড়া, সিকিউরিটির সঙ্গে আমাদের একটা সম্মান আছে।’

বড়দি বলেছিলেন, ‘মাথা ঠান্ডা করো তমসা। কোনও কোনও সময় কমপ্রাোমাইজ করাটা অসম্মানের নয়। বরং বুদ্ধিমানের। ওদের সঙ্গে টাকা, গুন্ডা আছে। আমাদের সেসব কিছু নেই।’

তমসা বলল, ‘এক্ষেত্রে কমপ্রাোমাইজ করা মানে, হাতজোড় করা। করতে পারেন। আপনার ইচ্ছে। তবে বাকি দিনগুলো কিন্তু হাতজোড় করেই আপনাকে এই স্কুলে চাকরি করতে হবে। সেটা কি আপনি পারবেন?’

‘তুমি কি তাহলে কনফ্রনটেশনেই যেতে বলছ তমসা?’

তমসা বলে, ‘কনফ্রনটেশনের কী আছে? আমরা আমাদের নিয়মে চলব। সত্যি তো আমরা মেয়েগুলোর কেরিয়ার নষ্ট করতে চাইছি না। ওরা তো পরীক্ষায় বসবেই। একটু সতর্ক করে দিতে চাইছি মাত্র। এটা ওদের ভালোর জন্য।’

বড়দি বললেন, ‘ওদের বাড়ির লোক বুঝতে চাইছে না।’

তমসা হেসে বলল, ‘এটা ঠিক নয় বড়দি। ওদের ভুল বোঝানো হচ্ছে।

বড়দি বললেন, ‘তাহলে?’

তমসা বলল, ‘তাহলে আর কী? আপনার সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে। নড়চড় হবে না। যা ঘটবার ঘটবে। সেরকম হলে আমরা স্কুলের সব গার্জেনের কাছে অ্যাপিল করব। তারা কী চান জানতে চাইব। তবে এরা বড় কোনও গোলমাল পাকানোর লোক নয়। সে সাহস বা জোর তাদের নেই।’

তমসা খানিকটা টেনশনে আছে। সত্যি ঝমেলার কিছু হলে দায়িত্ব তার ঘাড়ে পড়বে। বড়দি সবার মধ্যে থেকে তার দিকেই বেশি করে আঙুল তুলবেন। বলবেন, তমসাই তাকে সবথেকে বেশি চাপ দিয়েছিল। নইলে এত বড় ঝামেলা হতই না। সকাল থেকেই তমসা খানিকটা ব্যস্ত ছিল। একে ওকে ফোন করছিল। থানাতেও কথা বলেছে। থানা খুব একটা গা করেনি। বলেছে, ঝামেলা হলে হেডমিসট্রেসকে জানাতে হবে। আগে থেকে লোক পাঠানো অসম্ভব।

তমসা এতেও চিন্তিত। প্রভাবশালী লোকটা আগে থেকে পুলিশকে চেপে দেয়নি তো? হতে পারে।

এই অবস্থায় শেখর শরীরের কথা বলে তাকে আরও টেনশনে ফেলতে চায়নি। ছেলেও স্কুলে। শেখর একটা বই নিয়ে বিছানায় শুয়েছে। খটোমটো বই। একটু খটোমটো নয়, বেশি খটমট।

বইয়ের নাম থিওরি অব রিলেটিভিটি। লেখকের নাম বার্ট্রান্ড রাসেল। এক ধরনের ইন্টেলেকচুয়াল মানুষ আছে, যারা কথায় কথায় বলে ‘সবই আপেক্ষিক’। এই কথা বলে তারা নিজেদের পণ্ডিত এবং দার্শনিক প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। কথাটা অর্থহীন। এই দুনিয়ার সবই যদি আপেক্ষিক হত, তাহলে আপেক্ষিকতা প্রমাণ করার প্রয়োজন হত না। তাই নিয়ে এত আলোচনাও থাকত না। অধিবিদ্যক অসম্ভব, যাকে বলা হয় মেটাফিজিক্যাল অ্যাবসার্ডিটিস, তার মধ্যে না গিয়েও বলা যায় জগতের সব কিছুই একজন পর্যবেক্ষক সাপেক্ষ আপেক্ষিক। কিন্তু মজার বিষয় হল, থিওরি অব রিলেটিভিটি, যাকে বাংলায় বলা যায় অপেক্ষবাদ, সে কিন্তু এই তত্ব মেনে নেয়নি। থিওরি অব রিলেটিভিটি প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছে, যা আপেক্ষিক সেটা বাদ দিয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত পৌঁছতে সে সিদ্ধান্ত কখনওই কোনও পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করবে না। এই সিদ্ধান্তকে বলা হয় সেটমেন্ট। এই থিওরিতে দেখা গিয়েছে, একজন পর্যবেক্ষক যা দেখতে পান তার ওপরে এইসব পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাব আগে যা ভাবা গিয়েছিল তার থেকে বেশি। পারিপার্শ্বিকের এই ক্রিয়া কীভাবে সম্পূর্ণ দূর করা যায় থিওরি অব রিলেটিভিটি সেটাই দেখায়। এই থিওরিকে বিস্ময়কর যা কিছু আছে এটাই তার উৎস।

শেখর বইটা উলটো করে বিছানা থেকে নামল। টেবিলের ওপর ফ্লাস্ক ভর্তি চা রয়েছে। তমসাই করে রেখেছে। রোজই করে রাখে। শেখর প্রায়ই বারণ করে। সামান্য চা সে কি নিজে তৈরি করে নিতে পারে না? স্কুলের তাড়াহুড়োর মধ্যে আবার চা তৈরির ঝামেলা কেন? তমসা শোনে না। কিছু বলেও না। চা করে যায়। পাশে কাপ। আজকাল অনেক সুন্দর দেখতে কাপ পাওয়া যায়। শেখরের জন্য একটা ঘন লাল কাপ কিনেছে। শেখর লাল কাপে আরাম করে চুমুক দিল। চা যে সবসময় খুব ভালো হয়েছে তা নয়। তাড়াহুড়োতে গোলমাল করে তমসা। কখনও লিকার কড়া, কখনও চিনি দেয় না। তারপরেও শেখর খুব তৃপ্তি পায়। চায়ের জন্য নয়, তমসাকে সঙ্গে পাওয়ার জন্য। মনে হয়, তমসা সবসময় কাজে থাকবার জন্যই এই চাটুকু বানিয়ে দিয়ে গেছে।

চায়ের কাপ নিয়ে শেখর আবার ফিরে এল বইয়ের কাছে।

একটা ঘটনা যখন দুজন পর্যবেক্ষক অনুভব করেন, তখন তাদের অনুভূতির মধ্যে যেমন কিছু মিল থাকে, কিছু অমিলও থাকে। রোজকার জীবনে এই পার্থক্য চোখে পড়ে না। পড়বার প্রয়োজনও হয় না। কিন্তু পদার্থবিদ্যা তো রোজকার জীবন নয়। শুধু পদার্থবিদ্যা নয়, মনস্তত্বও তাই। এরা এই অনুভূতির পার্থক্য বিশেষভাবে নজর করে। কেন এমন হয়? ঘটনা একই। তারপরেও অনুভূতি কেন পৃথক হবে?

এর কারণ তিনটি। পর্যবেক্ষকদের বুদ্ধিবৃত্তি, ভাবনা, কল্পনা আলাদা, তাদের ইন্দ্রিয়গুলির বোধ আলাদা এবং তাদের ভৌত পরিস্থিতি আলাদা। ভৌত পরিস্থিতির অর্থ মূলত বস্তু হিসেবে যখন বিবেচনা করা হবে। ধরা যাক, আল্পস পর্বতের ওপর দুজন উঠেছেন। একজন সেখানকার সৌন্দর্য, রূপ, প্রকৃতি দেখবেন, অন্যজন হয়তো দেখবেন জলপ্রপাত থেকে কতটা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এই পার্থক্য মনের। যদিও থিওরি অব রিলেটিভিটি শরীর বা মন অনুষঙ্গ নিয়ে কাজ করে না। মাথাও ঘামায় না। তার সবটাই ভৌত পার্থক্য। শুদ্ধ ভৌত। যাকে বলে ‘ফিজিকাল চেঞ্জ’। পর্যবেক্ষকদের বদলে যদি ক্যামেরা বা শব্দ রেকর্ড করবার যন্ত্র রাখা যায়, তবেই এই ভৌত পার্থক্য বোঝা যাবে। জীবের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। ধরা যাক, দুজন মানুষ তৃতীয় একজনের কথা শুনছে। যে কাছে থাকবে সে শুনবে জোরে। কোনও বস্তুর পতনের ক্ষেত্রেও দুজন দুই কোণ থেকে বিচার করবে। যন্ত্রের বেলায় তা হবে সমভাবে। পার্থক্য সমভাবে নথিভুক্ত করা যাবে। পর্যবেক্ষকদের বৈশিষ্ট্য ধরা পড়বে না।

শেখরের অল্প শীত শীত করছে। জ্বরটা এসে গেল মনে হয়। জ্বর এলে ঝামেলা আছে। অনেকগুলো কাজ আছে। কলেজ ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা সংগঠন করবার পরিকল্পনা রয়েছে। এই সংগঠনে থাকবে যারা মিটিং মিছিল করে না, যারা নিজের কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত এবং যারা কম্পিউটার, মোবাইল ফোন নিয়ে থাকতে ভালোবাসে, ওয়াটসঅ্যাপ, মেল, টুইটারে স্বচ্ছন্দ। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মনে হত, রাজনীতি কি শুধুই ফেসবুকে আটকে থাকবে? অর্চিনকে একসময় এই বিষয়ে বুঝিয়েছিল। যারা শুধু ফেসবুকে ‘বিপ্লব’ করে তাদের সমালোচনা করেছে। কিন্তু এখন সেই মনোভাব বদলাচ্ছে। পার্টিও বদলাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সে অন্যকে প্রভাবিত করতে পারছে। তাহলে সমাজ বদলের কাজে তাকে ব্যবহার করা হবে না কেন? অবশ্যই করতে হবে। পার্টির অনুমোদনও আছে। তবে সমস্যা একটাই, ওয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ফেসবুক এখন মূলত ব্যক্তি আক্রমণ, চুটকি, কেচ্ছায় মেতে রয়েছে। যেটুকু পছন্দ সবই ইস্যুভিত্তিক। ঘটনা ঘটলে তাকে শাবাশ বলা। এর মধ্যে একটা হিরোইজমও আছে। প্রতিবাদে, সমর্থনে নিজেকে ‘বড়’ করে দেখানোর চেষ্টা। এখান থেকে ছেলেমেয়েদের বের করে আনতে হবে। তার জন্য রাজনৈতিক ম্যাচিওরিটি তৈরি করা চাই। শুধু ইস্যু নয়, সঠিক পথের কথা নিজে থেকেই বলতে হবে। শুধু মধ্যবিত্তের ভালো লাগা, মন্দ লাগা না, কৃষক সমস্যা, শ্রমিক সমস্যা, যুব সমস্যার কথা বুঝতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা জানতে হবে। ওয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে সেসব কথা প্রচার করতে হবে। এই জন্যই শেখর তার এলাকায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা সংগঠন তৈরির কথা ভেবেছে। পার্টির কাছে নির্দিষ্টভাবে অনুমোদন চেয়ে পাঠিয়েছে। সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি পার্টির কোনও যোগ থাকবে না। আড়াল থেকে কন্ট্রোল থাকবে। অর্চিন এখানে থাকলে নতুন সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া যেত। পুলিশের ঝামেলা-টামেলা এড়িয়ে আড়ালে থেকে কাজটা করতে পারত। নিজের বয়সি শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলত। সে তো কোনও কথা শুনল না।

শেখর বার্ট্রান্ড রাসেলের পাতা ওলটাল।

আগে জানতে হবে পদার্থবিদ্যার সঠিক উদ্দেশ্য কী? বস্তুজগতে বাস্তবে কী ঘটছে, তার খবরাখবর দেওয়াটাই পদার্থবিদ্যার মূল কাজ। একাধিক বিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষকের ব্যক্তিগত অনুভূতির সম্পর্কে খবর জোগাড় করাটা তার কাজ নয়। পদার্থবিদ্যাকে ভৌত পদ্ধতির সেইসব অবয়ব নিয়ে কাজ করতে হবে যে অবয়বগুলি সব পর্যবেক্ষকের জন্যই এক। কারণ একমাত্র এই অবয়বগুলিতেই ভৌত ঘটনার নিজেস্ব বলে ভাবা যায়। এর জন্য দরকার, কোনও ঘটনা একজন পর্যবেক্ষকের কাছে কীভাবে আসছে, আরেকজনের কাছে কীভাবে আসছে, সেখান থেকে সরে যাওয়া। আসলে প্রয়োজন ঘটনার বিধিগুলি অভিন্ন হওয়া।

শেখর বই বন্ধ করল। তবে কি দুনিয়ার সব কিছু ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’ দিয়ে বিচার করা যায়? সব কিছু না হলেও, বেশিটাই যায়। যদি কোনও ঘটনাকে ‘বস্তু’ হিসেবে না দেখা হয়, তবে তার মূল্যায়ন হবে অসম্পূর্ণ। কখনও কখনও ভুলও বটে। মানুষের দু:খ, অভাব, যন্ত্রণারও একটা ফিজিক্যাল চেহারা আছে। ভৌত অবস্থান। তাকে সরাতে হয়। কখনও বিপ্লবে, কখনও ভালোবেসে। শুধু মন নয়, জীবনকে পদার্থবিদ্যার বিধি দিয়েও ভাবতে হয়।

শেখর গায়ে চাদর টানল। আপশোস হচ্ছে, ফিজিক্স নিয়ে লেখাপড়া করলে রিলেটিভিটি তত্ব ঠিকমতো বোঝা যেত। শুধু ফিজিক্স নয়, দর্শনও জানতে হবে। জীবনে কত কিছু জানবার বাকি রয়ে গেল। রাসেল বোঝবার জন্য কোনও মাস্টারের কাছে গেলে কেমন হয়? নাকি জীবনই মাস্টার? মাস্টার যারা চারপাশে আছে তারাও। যেমন অর্চিন।

শীত করছে। জ্বর বাড়ছে। শেখর গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়েও পড়ল একসময়।

বিকেলে তমসা এসে জানাল, তাদের স্কুলে কোনও গোলমাল হয়নি। বড়দি পরীক্ষার নতুন রুটিন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করা মেয়েরা স্কুলের ভিতরে বাজি ফাটিয়েছে।

তমসা বলল, ‘ছি ছি। স্কুলে আমার মাথা হেঁট হয়ে গেল।’

শেখর শুকনো হেসে বলল, ‘শুধু মন দিয়ে বিচার করলেই হবে না। ঘটনার অবস্থান বিচার করতে হবে তমসা। থিওরি অব রিলেটিভিটি সেই কথাই বলছে।’

একান্ন

কর্ণিকা বাড়িতে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল।

ড্রইংরুমে দুজন মহিলা বসে। এদের মধ্যে একজনকে কর্ণিকা চেনে। মায়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। করবী মাসি। টালিগঞ্জের দিকে কোথায় যেন থাকে। অন্যজনকে চিনতে পারছে না। করবী মাসি সোফায় বসে আছেন, অচেনা মহিলার জন্য ভিতর থেকে কাঠের চেয়ারটা এনে দেওয়া হয়েছে। হাঁটু, কোমরে ব্যথা থাকলে অনেক সময় সোফায় বসতে কষ্ট হয়। তখন ভেতর থেকে কাঠের চেয়ারটা এনে দেওয়া হয়। মা-ও সোফায় বসে আছে। মুখে হাত কচলানো ভাব। কোনও বিষয়ে খুব গদগদ হলে মানুষের মুখে হাত কচলানো ভাব আসে। এটা একটা ভয়ের ব্যাপার। কর্ণিকা সতর্ক হল।

‘ওই তো কনি, ওই তো এসেছে। আয় কনি, আয়।’

কর্ণিকা অবাক হল। মা এমন ভাব করছে যেন কনির বাড়িতে আসবার কথা ছিল না। অথচ সে রোজ কমবেশি এই সময়েই অফিস থেকে বাড়ি ফেরে। এক সময় ফেরবার পথে দোকান-বাজার করে ফিরত। মায়ের জন্য আনাজপাতি, বাবার জন্য মুড়ি, চানাচুর, ভাইয়ের জন্য চিপস, মোবাইল রিচার্জ কার্ড, নিজের জন্য তেল, শ্যাম্পু। যখন যেমন লাগে। আজকাল সমস্যা হয়। প্রাোমোশনের পর অফিসের গাড়ি দিয়ে যায়। গাড়ি থামিয়ে কীভাবে কেনাকেটা করবে? তারপরেও মাঝে মাঝে নামে। বাজারের কাছে গাড়ি ছেড়ে দেয়। কেনাটাকা করে রিকশা নেয় অথবা হেঁটে ফেরে। আজও তাই করেছে। হাতে একগাদা প্যাকেট। মা উদগ্রীব হয়ে উঠল।

‘কীরে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিস নাকি? উফ তোকে কতবার বলেছি, গাড়ি ছাড়বি না। সারাদিন খেটেখুটে আসিস, তারপর আর দোকান বাজারে নামবার দরকার নেই।’

কর্ণিকা বুঝতে পারল, দোকান বাজারে আপত্তি নয়, মা আসলে অতিথিদের শোনাচ্ছে মেয়ে গাড়ি করে ফেরে। সে হতভম্ব ভাব কাটাতে মা এক মুখ হেসে বলল, ‘কনি, করবীকে তো তুই জানিসই, আর ইনি হলেন মিসেস বোস। রানী বোস। লেডি ম্যাকলিন কলেজের প্রিন্সিপাল।’

ববকাট এবং মূলত সাদা চুলের অচেনা মহিলা অভিজাত হেসে বললেন, ‘প্রিন্সিপাল নয়, এক্স প্রিন্সিপাল।’

মল্লিকাদেবী হাত কচলে হেসে বললেন, ‘ওই একই হল মিসেস বোস। টিচার চিরকাল টিচারই থাকে। কখনও এক্স হয় না। এই তো এখনও ছোটবেলার কোনও দিদিমণিকে দেখলে আগে প্রণাম করি।’

মিসেস বোস অহঙ্কারের হাসি হাসলেন।

কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ, দু-হাতে প্যাকেট নিয়ে কর্ণিকা বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। শুধু প্যাকেট নয়, হাতে একটা বেগুনও আছে। বাবা ক’দিন ধরে বেগুনপোড়া খাওয়ার বায়না করছে। মেয়েকেও বলেছে।

‘বুঝলি কনি, বেগুনপোড়া একটা ওয়ান্ডারফুল প্লেট। ঠিক মতো তৈরি করতে পারলে জবাব নেই। এক থালা ভাত খেয়ে ফেলা যায়।’

কর্ণিকা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুমি আবার বেগুনপোড়া নিয়ে পড়লে কেন বাবা?’

সুখময়বাবু এক গাল হেসে বললেন, ‘সেদিন টিভিতে দেখাচ্ছিল।’

কর্ণিকা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘টিভিতে বেগুনপোড়াও দেখায় নাকি!’

সুখময়বাবু মেয়ের বিরক্তিতে পাত্তা না দিয়ে বললেন, ‘আরে, ওই যে রান্নাবান্নার অনুষ্ঠান হয় না? ওখানে দেখাচ্ছিল। কী যেন নাম প্রাোগ্রামটা…আহা। কী যেন নাম…খাচ্ছি খাব? না না, খাব খাচ্ছি…না না তাও নয়…। যাক গে, যে নামই হোক রান্নাবান্না ভালো দেখায়।’

কর্ণিকা রেগে গিয়ে বলল, ‘উফ বাবা, তুমি টিভি দেখা বন্ধ করো। একটা সুস্থ সবল লোক বাড়িতে বসে টিভিতে রান্নার শো দেখছো! এই কারণে বলি কাজ না করে তোমার মাথাটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

মেয়ের ধমকেও পাত্তা দিলেন না সুখময়বাবু।

‘বুঝলি কনি, একেক দিন একেক রকম রান্না। কোনও দিন ঝাল, কোনও দিন ঝোল, কোনও দিন কষা, কোনও দিন অম্বল। সেদিন ছিল তোর পোড়া। বেগুন পুড়িয়ে পেঁয়াজ কুঁচি, লঙ্কা, অল্প লেবু, তার ওপর কাসুন্দি, আহা। এই দেখো জিভে জল এসে গেছে। কতদিন যে বেগুনপোড়া খাইনি। আহা! যাক টিভিতে দেখেই সুখ। এদের উচিত এই ধরনের প্রাোগ্রাম আরও বাড়িয়ে দেওয়া!’

কর্ণিকা আরও রাগ দেখাতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল। এই মানুষকে রাগ দেখিয়ে কী লাভ? জীবনটাকে সহজ সরল করতে করতে একেবারে বেগুনপোড়ায় নিয়ে গিয়ে ঠেকিয়েছে। কাজকর্ম ছাড়া ঘরে বসে থাকলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। মায়াও হয়।

আজ বাজারে বেগুন দেখে কর্ণিকার বাবার কথা পড়ে গেল। একটা বড় দেখে কিনেও ফেলেছে। নিজেই গ্যাসে পুড়িয়ে দেবে। যতই হোক, বাবা তো।

সেই বেগুনই এখন হাতে।

মল্লিকাদেবী ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, ‘প্রণাম কর কনি’।

করবী মাসি বলল, ‘আহা, মেয়েটাকে হাতের জিনিসপত্র তো রাখতে দেবে মল্লিকাদি।’

মল্লিকাদেবী বললেন, ‘ঠিক আছে, রেখে আয় চট করে। মিসেস বোস আবার বেরিয়ে যাবেন। ওঁর আবার কোথায় মিটিং আছে।’

মায়ের এত অর্ডারে কর্ণিকার রাগ হল। মিসেস বোসের মিটিং আছে তো কী! উনি কে? যার জন্য ছুটে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করতে হবে?

মিসেস বোস দাঁত চেপে বললেন, ‘মিটিং নয়, সেমিনার। বাংলা আকাদেমিতে যাব। ভাষা নিয়ে একটা আলোচনা আছে। ভাষার বিবর্তন। আমি এসবে মোটে যেতে চাই না। ওরা এমন জোর করে। যাক, মা তুমি হাতের জিনিসগুলো রেখে এসো। দুটো কথা বলে চলে যাই।’

ভিতরে যেতে মানার সঙ্গে দেখা। দিদিকে দেখে ফিচ করে হাসল।

‘মানা, এরা কারা? কেন এসেছে? মা অমন গদগদ ভাব করছে কেন?’

মানা চোখ নাচিয়ে বলল, ‘তোর শাশুড়ি। আমি মিষ্টি আনতে যাচ্ছি। সঙ্গে ইয়া বড় বড় শিঙাড়া।’ মানা হাত ঘুরিয়ে শিঙাড়ার সাইজ দেখাল।

কর্ণিকা অবাক হয়ে বলল, ‘শাশুড়ি! কী বলছিস?’

মানা বলল, ‘ঠিকই বলছি। তোকে দেখতে এসেছে। তোর উড বি শাশুড়ি। গিয়ে দেখ।’

মানা ডান হাতের বুড়ো আঙুল মুখে দিয়ে সানাই বাজানোর ঢঙে বলল, ‘প্যাঁ প্যাঁ…প্যাঁ প্যাঁ।’

কর্ণিকার মনে হল, ভাইকে একটা চড় লাগায়। কিন্তু সে এতটাই হতভম্ভ হয়ে পড়ল যে চড় লাগানোর কথা ভুলেই গেল। পাকা ছেলেটা কী বলছে এ সব!

ঠিক বলছে। কর্ণিকা কোনওরকমে চোখে মুখে জল দিয়ে আবার ড্রইংরুমে যেতেই ব্যাপারটা আঁচ করল।

মিসেস বোস সরাসরি তাঁর সঙ্গে কথা বললেন।

‘প্রথমে করবী, তারপর তোমার মায়ের কাছ থেকে তোমার কথা শুনলাম। তুমি তো লেখাপড়ায় ভালো ছাত্রী। আরও পড়লে না কেন?’

কর্ণিকা কী বলবে বুঝতে পারল না। চেনা নেই, জানা নেই, এই মহিলার প্রশ্নের উত্তর সে দেবে কেন? আবার উপায়ও নেই। বাড়ি বয়ে এসেছে। অপমানও করা যায় না। ইচ্ছে থাক বা না থাক, কিছু একটা তো বলতেই হবে।

‘চাকরি করাটা দরকার ছিল।’

মিসেস বোস একটু চুপ করে বসে বললেন, ‘আরও পড়তে ইচ্ছে করে না?’

কর্ণিকা বলল, ‘উপায় নেই।’

মিসেস বোস বললেন, ‘উপায় থাকলে পড়বে?’

কর্ণিকা ইতস্তত করে বলল, ‘এখনই ভাবছি না।’

মল্লিকাদেবী গলে যাওয়া গলায় বললেন, ‘ও তো অফিসে বড় প্রাোমোশন পেয়েছে। অনেক দায়িত্ব। বড় অফিসার হয়েছে।’

কর্ণিকার এত রাগ হল যে ইচ্ছে করল মায়ের মুখ চেপে ধরে।

করবী মাসি এক গাল হেসে বলল, ‘মিসেস বোস সব জানেন। উনি তোমার মেয়ে সম্পর্কে সব খবর নিয়েই আজ এসেছেন।’

মিসেস বোস ঠোঁটের কোনায় হেসে বললেন, ‘কর্ণিকা, শুনেছি, তুমি অফিসে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করো। কথাটা ঠিক?’

‘ঠিক না ভুল সে তো আমার অফিস বলতে পারবে।’

মিসেস বোস চোখ সরু করে বললেন, ‘সে তো জানি। তোমার নিজের ধারণা কী? সেলফ অ্যাসেসমেন্টটাই আসল।’

কর্ণিকা মুখ তুলে বলল, ‘আমার ধারণা আমি আমার ডিউটি সিরিয়াসলি করি।’

মিসেস বোস হেসে বললেন, ‘ভেরি গুড। কর্ণিকা তোমার হাতে দেখলাম তুমি কি বেগুন দিয়ে কোনও রান্না করবে?’

কর্ণিকার মনে হল, এবার একটা ধাক্কা দেওয়া দরকার। বলল, ‘হ্যাঁ, করব। বেগুনপোড়া বানাব। আমার বাবা খেতে চেয়েছেন।’

মল্লিকাদেবী তাড়তাড়ি বললেন, ‘আমার মেয়ের রান্নার হাত কিন্তু অতি ভালো। আজ না বলে চলে এলেন তাই, নইলে হাতের রান্না খাওয়াতাম। আর একদিন আসুন না।’

মিসেস বোস খানিকটা মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘ভালো রান্না খাবার জন্য রেস্টুরেন্টে যাব। এখানে আসব কেন?’

কর্ণিকা হেসে বলল, ‘মা কিন্তু বাড়িয়ে বলছে। আমি রান্নার কিছুই পারি না।’

মিসেস বোস সুন্দর করে হেসে বললেন, ‘মায়েরা অমন বাড়িয়ে বলেই, আমাকে যখন ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে এসেছিল, আমার মা বলেছিল, আমি নাকি খুব ভালো গান করি। এদিকে আমার তো গলায় সুর বলে কিছু নেই। আমি তখন কী বলব বুঝতে পারলাম না। তোমাদের মতো তো আমরা স্মার্ট ছিলাম না। ছেলের মামি বললেন, একটা গান শোনাও তো মেয়ে। আমি তো দর দর করে ঘামতে শুরু করলাম। তারপর…।’ কথা থামিয়ে মহিলা হাসতে লাগলেন। কর্ণিকার এবার বেশ লাগল। মানুষটার মধ্যে একটা সোজাসাপটা ভঙ্গি আছে তো। কিন্তু হঠাৎ এসব কী হচ্ছে! এই ভদ্রমহিলা কোথা থেকে এলেন!

মিসেস বোস হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলেন। মহিলার পোশাক-পরিচ্ছদ, হাবভাবের মধ্যে এক ধরনের শিক্ষিত, রুচিশীল ব্যাপার আছে। কর্ণিকার মনে হচ্ছে, প্রথম দর্শনে মহিলার প্রতি যে অনীহা, বিরক্তি, রাগ তৈরি হয়েছিল, এখন যেন খানিকটা কমছে।

মিসেস বোস মল্লিকাদেবীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘ম্যাডাম, এবার যে আমাকে উঠতে হবে।’

মল্লিকাদেবী হা হা করে উঠলেন। নিজেও উঠে দাঁড়ালেন।

‘কিছুতেই না দিদি। চা না খাইয়ে আপনাকে ছাড়বই না। এখনই মানা আসবে। একটু মিষ্টি আনতে গেছে।’

মিসেস বোস হাত বাড়িয়ে মল্লিকার হাত ধরলেন। নরম গলায় বললেন, ‘আজ থাক। আপনাকে না জানিয়ে এসেছি। আমি ইচ্ছে করেই বলিনি। করবীকে বললাম, আজই যাব। উইদাউট এনি প্রিপারেশন আমি মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই। করবী তো আকাশ থেকে পড়ল। সে গাইগুঁই করছিল। আমি শুনিনি। ঘটা করে মেয়ে দেখতে আসা আমি পছন্দ করি না। খুব খারাপ সিস্টেম। গত মাসে কোনও একটা অফিসিয়াল পার্টিতে আপনার মেয়ের সঙ্গে সুস্নাতর আলাপ হয়। আলাপ না বলে ঝগড়াই বলা যেতে পারে। ঝগড়ার বিষয় ছিল কর্পোরেট ম্যানেজমেন্ট। সেই ঝগড়ার কথা সুস্নাত আমাকে গল্প করে। শুধু তাই নয়, সে আমাকে বার বার বলে মেয়েটির সঙ্গে তার মতে মেলেনি, কিন্তু মেয়েটিকে তার বিশেষ পছন্দ হয়েছে। বাঙালি মেয়ের মধ্যে এই ধরনের কর্পোরেট লজিক নাকি খুব একটা দেখা যায় না। ছেলে আমাকে মেয়েটির নাম বলে। কর্ণিকা। অফিসের নামটাও বলতে পারে। সে নিশ্চয় আপনার মেয়ের কাছে থেকে শুনে মনে রেখেছিল। সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। এতটা মনে রাখায় আমার কেমন সন্দেহ হয়। মায়ের মন তো। এদিকে সুস্নাত তো আমেরিকায় ফিরে যায়। আপনাকে তো বললাম, ছেলে নিজের বিজনেস কনসালটেন্সি ফার্ম করেছে। কলকাতায় অফিসের কাজেই এসেছিল। তার মধ্যে কয়েকটা পার্টিও অ্যাটেন্ড করতে হয়।’

মিসেস বোস কথা থামিয়ে কর্ণিকার দিকে ঘাড় ঘোরালেন। হেসে বললেন, ‘কী কর্ণিকা, আমার এখানে আসবার কারণ স্পষ্ট হচ্ছে? দাঁড়াও আর একটু আছে। আমি তো অথৈ জলে পড়ি। ছেলে তো আমাকে বিরাট বিপদে ফেলল। সে এমন একটা মেয়েকে পছন্দ করে গেল, যার শুধু নাম জানি, অফিস জানি, আর কিছুই জানি না! এমনকী মেয়েটি বিবাহিত কিনা তা-ও নয়। একদিন করবীকে দু:খ করে গল্প করেছিল। করবী লাফিয়ে উঠল। মেয়ে তার আত্মীয়। একেই বলে কোইনসিডেন্স। আসলে জীবনে বড় বড় বাঁকগুলো সব আকস্মিকই পাওয়া যায়। আমি করবীকে বলি, এখনই কিছু বলবার দরকার নেই। আগে, ছেলের পারমিশন নিই। খোঁজখবর নিই। তারপর।’

কর্ণিকার মাথা ঝমঝম করছে। সে সুস্নাত নামে যুবকটির মুখ মনে করবার চেষ্টা করছে। অফিসের কারণে ন’মাসে ছ’মাসে তাকে একটা-আধটা পার্টিতে যেতে হয়। স্যর বা অন্য কেউ যেতে না পারলে তার ঘাড়েই চাপ পড়ে। নেমন্তন্ন করলে কোম্পানির একজন প্রতিনিধির যাওয়া উচিত। সাধারণত অ্যাটেন করেই সে পালিয়ে আসে। খাওয়া-দাওয়াও করে না। এর মধ্যে একেবারে ঝগড়া! হতে পারে। কাজকর্ম নিয়ে তার এক ধরনের বিশ্বাস আছে। অন্যকে সেই বিশ্বাস জানাতে তার দ্বিধা নেই। অচেনা হলেও নয়। তবে ছেলেটাকে মনে পড়ছে না কেন? গোটা ঘটনাটা তো গল্পের বইয়ের মতো!

মিসেস বোস বললেন, ‘কর্ণিকা, আমার তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। সরাসরি কথা বলতে পারো। আজকের দিনে মেয়েদের এরকম হওয়াই উচিত। যে কাজই করো দায়িত্ব নিয়ে করাটাই আসল। আমার বিশ্বাস সংসারও তুমি দায়িত্ব নিয়ে করতে পারবে। তবে মনে রেখো বিদেশে কিন্তু সংসার করবার অনেক ঝামেলা। সব নিজেদের করতে হয়। কোনও হেলপিং হাত থাকে না। তাছাড়া…সব যদি ঠিকঠাক হয়…তাহলে তো তোমাকে সুস্নাতর ফার্মও সামলাতে হবে।’

রাগের সঙ্গে কর্ণিকার এবার লজ্জাও করল। মেয়েদের হল এই একটা মুশকিল। যতই নিজেদের তালেবর ভাবুক, কোনও কোনও সময় লজ্জা করে বসে। কর্ণিকা মাথা নামিয়ে বলল, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি কী বলছেন।’

মল্লিকাদেবী তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আমাদের কত বড় সৌভাগ্য।’

মিসেস বোস হেসে বললেন, ‘সৌভাগ্য আমার। এই বিয়ে হোক না হোক, ছেলের মা হিসেবে আমি একটা ভেলকি দেখালাম। পছন্দর মেয়েকে খুঁজে দিলাম। কর্ণিকা এই নাও, এটা আমার ছেলের ফোন নম্বর। আমি তাকে আজই সব জানাব। যদি অসুবিধে না হয় তোমার ফোন নম্বরটা আমাকে দাও। সে তোমাকে কল করবে। তুমি যদি চাও, তার সঙ্গে কথা না-ও বলতে পারো। তোমার কি আমাকে কিছু বলবার আছে?

মল্লিকাদেবী বললেন, ‘না না, ওর আর কী বলবার আছে? ওর তো পরম ভাগ্য। ওর বাবা এলে…?’

মিসেস বোস মল্লিকাদেবীর কথায় পাত্তা না দিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, ‘বলো তোমার কী বলবার আছে?’

কর্ণিকা মাথা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি এখন বিয়ে করব না। এখানে আমার অনেক রেসপনসিবিলিটি আছে। অফিসে, ঘরে…। সরি, আপনি কিছু মনে করবেন না।’

মিসেস বোস কর্ণিকার কাঁধে হাত রেখে হেসে বললেন, ‘ভেরি গুড। বিদেশে থাকা ভালো পাত্র দেখে নিজের যাবতীয় দায়িত্ব কর্তব্য ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়বার মতো মেয়ে যে তুমি নও, আমি বুঝতে পেরেছি। আমার ভেবে ভালো লাগছে যে আমার ছেলে মানুষ চিনতে ভুল করে না। আমার একটাই অনুরোধ, তুমি এই কথাটা সুস্নাতকে বলে দাও। বলে দাও, তুমি এখন বিয়ে করবে না। সে অন্তত জানুক তার মা চেষ্টা করেছে। এইটুকু অনুরোধ রাখবে কি?’

কর্ণিকা মাথা নাড়ল। মিসেস বোস চলে যাওয়ার পর, মল্লিকা মেয়ের সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিলেন।

বেশি রাতে কর্ণিকার মোবাইলে বিদেশের নম্বর ভেসে এল। কর্ণিকা প্রথমে ভেবেছিল ধরবে না। তারপর মিসেস বোসের সুন্দর ব্যবহারের কথা মনে পড়ে গেল। তার ওপর সে কথা দিয়েছে। সে কথা রাখা উচিত। এক মিনিটের কম সময়েই ছেড়ে দেবে। কর্ণিকা ফোন কানে নিল।

সেই ফোন ছাড়তে কর্ণিকা রাত কাবার করে ফেলল। এই জন্যই বলে, মানবমন অতি রহস্যময়! এক মুহূর্ত আগেও সেই মনের খবর কেউ বুঝতে পারে না।

বাহান্ন

কিছু কিছু মানুষকে বয়েস লুকোতে হয় না। বয়স নিজে থেকেই লুকিয়ে থাকে।

সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট-এর নিখিলেশ উপাধ্যায় সেরকম একজন। তাঁকে দেখে কে বলবে মানুষটার বয়স সত্তর বছর ছুঁই-ছুঁই? ফিটফাট চেহারা। বুদ্ধিদীপ্ত মুখে সবসময়েই একধরনের হাসি লেগে আছে। হাসি ঠিক নয়, হাসির ছায়া। সেই ছায়ায় একইসঙ্গে প্রশ্রয় আছে, আবার ‘বস’ সুলভ কাঠিন্যও রয়েছে। কাছে টানবে, আবার দূরেও ঠেলবে। এটা সহজ ব্যাপার নয়। কর্মক্ষেত্রের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় রপ্ত করা সম্ভব। সবাই পারে না, কেউ কেউ পারে। কাজের জায়গায় ব্যক্তিত্ব মানে শুধু গাম্ভীর্য নয়, এটা বুঝতে সময় এবং বুদ্ধি লাগে। নিখিলেশ উপাধ্যায়ের দুটোই আছে।

মানুষটা এই কোম্পানিতে আছেন প্রায় গোড়া থেকে। কমলকান্তি সেন নিয়েছিলেন। নেওয়ার পিছনে মজার কারণ ছিল।

সেই সময় অনেকেই কাজের জন্য কমলকান্তি সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। চাকরি চাই। অফিসে সারাদিন, বাড়িতে সকালের দরবারে প্রচুর আবেদন। রোজই কেউ না কেউ আসছে। তাদের বেশিরভাগই সঙ্কুচিত। যোগ্যতা থাকলেও কাঁচুমাচু। চাকরির জন্য চেষ্টা করাকে বাঙালি জাতি অতি নিম্নস্তরের একটা জিনিস বলে মনে করে। যেন কাজ খোঁজাটা খুবই লজ্জার একটা বিষয়। ভিক্ষে চাইতে বেরিয়েছে। যে কাজ খোঁজে সে সবসময় মাথা নীচু করে থাকে, হাত কচলায়। ভাবটা হল, বিরাট অপরাধ করে বসেছে। এই অপরাধের জন্য তার নরকে স্থান হওয়া উচিত। নেহাত হাতের কাছে নরক নেই তাই বাঁচোয়া। বাঙালি চাকরিপ্রার্থী চিরকুণ্ঠিত, চির অনবত। এর জন্য দায়ী যারা কাজ দিতে পারে তারা। সে রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীই হোন, বড় কোম্পানি কর্তাব্যক্তিই হোন, ইন্টারভিউ বোর্ডের মেম্বারই হোন, পাড়ার মাতব্বরই হোন, ইনফ্লুয়েন্সিয়াল বড়মামা, মেজোকাকাই হোন। এঁরা সকলেই চাকরীপ্রার্থীকে হেয়জ্ঞান করেন। গরিব দেশে যার হাতে কাজ দেওয়ার ক্ষমতা আছে, সে হল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের হাবভাব হল, বিরাট করুণা দেখাচ্ছে। অবশ্যই এর ব্যতিক্রম আছে, তবে তা নগন্য। হিসেবের মধ্যে আসে না। যোগ্য ব্যক্তি যোগ্য জায়গায় চাকরির চেষ্টা করলেও তাকে বিবিধ অপমানের মধ্যে পড়তে হয়। চাকরিদাতার জমিদারসুলভ মনোভাব বাঙালি চাকরিপ্রার্থীকে হীনমন্যতায় ভুগতে শিখিয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে এই জিনিস চলে আসছে। নিজেকে ‘ছোট’ ভাবা বাঙালি কর্মপ্রার্থীদের রক্তে ঢুকে গেছে। তুমি খেটে উপার্জন করতে চাও? তবে মাথা নামিয়ে থাকো। এটাই রীতি। এমনকী যোগ্যতার পরীক্ষা দিলেও এমনটা ঘটে। বাঙালি একটা কথা জেনে গেছে—

‘পরীক্ষা, ইন্টারভিউতে পাস করেছ বাপু, কিন্তু ধরা করা না করলে কিছু হবে না।’

এই আশঙ্কা যে সবসময় সত্যি এমন নয়। কোনও কোনও সময় যোগ্যতার পরীক্ষা থেকেও কাজকর্ম জুটে যায়, অতিরিক্ত ‘কারিকুরি’ লাগে না। কিন্তু তাতে বাঙালির ধারণা পালটায়নি। পালটানোর কথাও নয়। বাঙালি কর্মপ্রার্থীর হাল কেন এমন হয়েছে? এর জন্য দায়ী কে? যারা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে তারা? নাকি সামাজিক ব্যবস্থাটাই এভাবে গড়ে তোলা হয়েছে? যাতে কাজ জোটানোর সময় বাঙালির মেরুদণ্ড থাকে বেঁকে। এটা গবেষণার বিষয়। হয়তো কোনওদিন গবেষণা হবেও। এই দেশে অনেকরকম ‘সেন্টার’ আছে। তাদের গালভরা সব নাম। স্টাডি সেন্টার, সোশ্যাল সেন্টার, রিসার্চ সেন্টার। সেখানে বেশিরভাগ সময়েই ‘গবেষণা গবেষণা’ খেলা খেলে সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সা ওড়ানো হয়। রাজ্য সরকারের বরাদ্দ, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান, বিদেশের গ্রান্ট—কতরকমের পথে যে এসব জায়গায় টাকা আসে! এসব সেন্টারে নানা বিষয়ে বছরের পর বছর গবেষণা চলে। সেই গবেষণার সময়সীমা অনন্ত। মহাকাশের মতো অসীম। যার শেষ নেই। উচ্চশিক্ষিত ছাত্রছাত্রী, যারা মূলত চাকরিবাকরি পায় না বা করতে চায় না অথবা চাকরির থেকে গবেষণাকে বেশি লাভজনক প্রাোজেক্ট বলে মনে করে, তারা এইসব গবেষণায় যুক্ত হয়ে পড়ে। বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সাহিত্য সব বিষয়ে সুযোগ আছে। কে গবেষণায় সুযোগ পাবে তাও মূলত নির্ভর করে হাত কচলানোর ওপর। এখানেও ব্যতিক্রম আছে। অবশ্যই কিছু ভালো ছেলেমেয়ে সুযোগ পেয়ে যায়। তারা সিরিয়াসলি কাজও করে। কিন্তু সেটাও ব্যক্তিক্রম। এমনকী ভালোদের মধ্যে ‘ধরা করা’ থাকে। দুজন ভালোর মধ্যেও কে চান্স পাবে, তাই নিয়ে তদ্বির-তদারকি করতে হয়। দুনিয়ায় কত দুর্নীতি নিয়েই না তদন্ত হয়, কিন্তু গবেষণা দুর্নীতি নিয়ে কখনও তদন্ত হয় না। এসব সেন্টারে কারা ঢোকে, কে ঢোকায়, তারা কী কাজ করে, সেই কাজ দেশ দশের কোন কম্মে লাগে—সে-সব নিয়ে কখনও তদন্ত হয় না। এটা একটা ভালো দিক। রাজনীতির লোক ‘চোর’ হলে সমস্যা নেই। শিক্ষিত বা শিক্ষার উচ্চপদে আসীন কেউ ‘চোর’ হলে বিচ্ছিরি।

যা হোক, বাঙালি কেন চাকরি, প্রাোমোশন বদলির জন্য মেরুদণ্ডহীন হয়ে গেল সে সম্পর্কে একদিন হয়তো এরকম কোনও স্টাডি সেন্টারে গবেষণা হবে। প্রাোজেক্টের নাম হবে ‘বাঙালি কর্মপ্রার্থীর হাত কচলানোর আর্থ-সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত।’ দশ বছরের কাজ। অর্থ বরাদ্দ সাড়ে সাত লাখ টাকা। দু’বার বিদেশে ভ্রমণ। একবার গবেষকের, একবার গাইডের।

আনন্দের কথা, সময় বদলাচ্ছে। কয়েক বছর হল, তরুণ বাঙালি কর্মপ্রার্থীরা মাথা উঁচু করে চলতে শিখেছে। ছোটবড় কাজ নিয়ে ছুঁৎমার্গ ত্যাগ করেছে। চাকরি দিতে পারে এমন ‘ফুটো জমিদার’দের কাঁচকলা দেখিয়ে হয় বাইরের কোম্পানি, নয় ভিন রাজ্যে চলে যাচ্ছে। সেখানে নিজের যোগ্যতা নিয়ে কাজ করছে। বাঙালি প্রতিষ্ঠানগুলি হয় একটা পর একটা উঠে যাচ্ছে, নয় সুনাম তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। অন্য সবকিছুর মতো এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম আছে। সে-ও হাতে গোনা গুটিকয়েক। বুক ফুলিয়ে থাকবার মতো বাঙালি প্রতিষ্ঠান ক’টাই বা অবশিষ্ট রয়েছে?

কমলকান্তি সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস তৈরির সময় ঠিক করেছিলেন, এমন কোনও ব্যবহার করবেন না যাতে কর্মপ্রার্থীরা অসম্মানিত হয়। যোগ্যতা এবং প্রয়োজন না মিললে প্রার্থীকে নেওয়া হবে না ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে জমিদারসুলভ কোনও বদ আচরণ করা হবে না। তিনি সকলকে সে কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। ‘কোনও চাকরিপ্রার্থী আমাদের কোম্পানির জন্য অপ্রয়োজনীয় হতে পারে তার মানে এই নয়, সে একজন অযোগ্য মানুষ। তার সঙ্গে এমন কোনও ব্যবহার করা যাবে না, যাতে সে অপমানিত বোধ করে।’

কমলকান্তি সেনের এই সিদ্ধান্তে সমস্যাও তৈরি হয়েছিল। বহু হাবিজাবি লোক চাকরির জন্য ভিড় করতে থাকে। চাকরি চাইতে গেলে বাবা বাছা করা হবে—এ সুযোগ কোথায় পাওয়া যাবে?

এরকমই দেখা করতে এসেছিলেন নিখিলেশ উপাধ্যায়। সেদিন কমলকান্তি খানিকটা বিরক্তই ছিলেন। সকাল থেকে লোক এসেই চলেছে। কিন্তু নিজেই তো নিয়ম করেছেন বিরক্তি প্রকাশ করা যাবে না। নিখিলেশ উপাধ্যায় টেবিলের উলটোদিকে বসলে তিনি দ্রুত কথাবার্তা শেষ করতে চাইলেন। বায়োডাটার কাগজ উলটোনোর পর হাতে-গোনা দুটো প্রশ্ন করলেন।

‘আপনাকে এই সংস্থায় নেওয়া হবে কেন?’

নিলিলেশ উপাধ্যায় কোনওরকম দ্বিধা না করে বললেন, ‘আপনার কোম্পানি একজন যোগ্য ব্যক্তিকে পেয়ে লাভবান এবং গর্বিত হবে বলে।’

থমকে গেলেন কমলকান্তি। বললেন, ‘আর যদি কাজটা না পান?’

নিখিলেশ বলেছিলেন, ‘তাতে একটু অসুবিধে হবে। আমি যেখানে চাকরি করতাম, অফিসটা বন্ধ হয়ে গেছে। একটু বেশি বয়সে বেকার হয়ে পড়েছি। তবে সেটা কোনও বিষয় নয়। সাময়িক সমস্যা মাত্র। আপনার এখানে কাজ না পেলেও আমার অন্য কোথা থেকে অবশ্যই সুযোগ আসবে। সে যোগ্যতা আমার আছে। কিন্তু আমার মতো একজন কর্মচারী পাওয়ার সুযোগ আপনার আর না-ও আসতে পারে।’

কমলকান্তি এই কনফিডেন্সে খুবই খুশি হন। এই তো সাচ্চা বাঙালি! যে মিনমিন করে না, যে মাথা উঁচু করে চলে, মাথা উঁচু করে কথা বলে।

এরপর নিখিলেশ উপাধ্যায়কে অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার দিতে এক মুহূর্ত দেরি করেননি কমলকান্তি। ছোট পদ থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত অনেক বড় জায়গায় চলে যান উপাধ্যায়। এমনকী নিজে সংস্থা থেকে বিদায় নিয়ে ছেলেকে যখন দায়িত্ব পুরোপুরি বুঝিয়ে দেন, তখনও মানুষটাকে ছাড়েননি কমলকান্তি। গোপন দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন। কোনও কারণে বিমলকান্তি সমস্যায় পড়লে তাঁকে সাহায্য করতে হবে। অনিচ্ছা সত্বেও রাজি হয়েছিলেন উপাধ্যায়। কৃতজ্ঞতার কারণেই রাজি হয়েছিলেন। নিখিলেশ উপাধ্যায় একটা সময় পর্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে সে দাািয়ত্ব পালনও করেছেন। বহু জটিলতা থেকে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে উনি রক্ষা করছেন। বিমলকান্তি জানতেও পারেননি, উপাধ্যায় আসলে তাঁর বাবার প্রতিনিধি। বাবার চোখ এবং ব্যবসায়িক বুদ্ধি দিয়ে তাঁকে সাহায্য করে চলেছেন।

কিন্তু মানুষের মন বড় গোলমেলে। সে শুধু সাদা বা কালো নয়, ধূসরও। সেই ধূসর রং কখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে তা কেউ বলতে পারে না। নিখিলেশ উপাধ্যায়ের বেলাতে এত বেশি বয়েসে তাই ঘটেছে।

তিনি লোভে পড়েছেন। সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে প্যাঁচে ফেলতে চাইছেন। প্যাঁচে ফেলে এমন একটা জায়গায় নিয়ে আসতে চাইছেন যেখান থেকে বেরোনোর জন্য বিমলকান্তি সেন হাবুডাবু খাবে। কমলকান্তি সেন তাকে খবর পাঠাবে, এই জটিলতা থেকে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে বের করে আনতে হবে। তিনি তাই করবেন। কিন্তু খুব বড় দাঁও মারবেন। আর সেটাই হবে এখানে তার শেষ কাজ।

নিখিলেশ উপাধ্যায় পরিকল্পনা করেছেন। কোম্পানির কারণেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের কিছু লোকের সঙ্গে তার চেনাজানা ছিল। ব্যবসার জন্য ভালো লোককে যেমন হাতে রাখতে হয়, খারাপকেও রাখতে হয়। তিনি এডি নামের একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেই এডি বৈশাখী সান্যালকে পাঠিয়েছে। এই মহিলা ঠকজোচ্চুরির কাজে নাকি খুবই পাকা। বহু জটিল কাজ করেছে। পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে। এডি জানিয়েছে মহিলা কাজের ব্যাপারে পেশাদার। অ্যাসাইনমেন্ট নিলে কাজ শেষ করে। উপাধ্যায় বয়েসের কথা জিগ্যেস করেছিলেন।

‘বয়স কেমন?’

এডি বলেছে, ‘একটু বেশির দিকে।’

উপাধ্যায় নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, ‘আমি বেশি বয়সই চাই।’

এই মুহূর্তে ভবানীপুরের কাছে একটা পুরোনো রেস্টুরেন্টে উপাধ্যায় এবং বৈশাখী মুখোমুখি বসে আছেন। চা, চপ-কাটলেটের রেস্টুরেন্ট। এই রেস্টুরেন্টে উপাধ্যায়ের বিশেষ পরিচিতি। রেস্টুরেন্ট তৈরির সময় মালিককে টাকা দিয়েছিলেন। মালিক সেই টাকার পুরোটা শোধ করতে পারেনি। রেস্টুরেন্ট সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের বদলায়নি। এখনও সেই হলুদ আলো, পরদাটানা কেবিন। জায়গাটা উপাধ্যায়ের পছন্দ। প্রাইভেসি আছে। কর্মীরা নিখিলেশকে আলাদা গুরুত্ব দেয়। গোলমেলে কাজের কথা বলতে গেলে নিখিলেশ এখানে লোক ডেকে নেন। বড় কোম্পানি চালাতে গেলে গোলমেলে কথা বলতেই হয়। এখন একটু কমেছে এই যা। পেছনের দিকে একটা কেবিন বেছে নিয়েছেন নিখিলেশ। এখন দুপুরবেলা। তারপরেও কেবিনে আলো জ্বালাতে হয়েছে। রেস্টুরেন্টে লোকজনও নেই। একজন মাত্র বেয়ারা গোছের লোক সার্ভিসের জন্য রয়েছে। নিখিলেশ উপাধ্যায় তাকে বলে দিয়েছেন, বাইরে নজর রাখতে। না ডাকলে যেন কেউ কেবিনে না আসে। লোকটি ঘাড় কাত করে।

নিখিলেশ উপাধ্যায় বললেন, ‘কী খাবেন?’

‘কিছু খাব না। কাজের কথা বলুন।’

উপাধ্যায় বলেন, ‘আপনি নিশ্চয় পরিশ্রান্ত। এক কাপ চা বলি?’

বৈশাখী এবার যেন একটু কঠিন গলায় বললেন, ‘বললাম তো কিছু খাব না। কাজের কথা বলুন। আমাকে দুর্গাপুর ফিরতে হবে।’

নিখিলেশ উপাধ্যায়ের পছন্দ হল। কড়া মহিলা। কাজ ছাড়া কিছু বোঝে না।

‘আপনি দুর্গাপুর থাকেন?’

বৈশাখী চোখ তুলে বলেন, ‘আমার পেশায় কোথাও থাকা যায় না।’

উপাধ্যায় নিজেকে সামলে বললেন, ‘সরি।’

‘এবার বলুন।’

উপাধ্যায় বললেন, ‘যে কোম্পানিতে আপনাকে কাজ করতে হবে, সেখানে মালিক কড়া। একজন সিরিয়াস লোক। তাকে চট করে টলানো কঠিন। আপনাকে টলাতে হবে।’

বৈশাখী বিরক্ত গলায় বললেন, ‘টলানো বলতে আপনি কী বলছেন? যদি সেক্স ধরনের কিছু হয় আমাকে দিয়ে হবে না। শরীর দিয়ে পুরুষমানুষকে বশ করবার মতো বয়স আমার নয়। আপনি নিশ্চয় দেখে বুঝতে পারছেন। অবশ্য বয়স থাকলেও ওই ধরনের ছেঁদো কাজ আমি কখনও করিনি। তার জন্য আলাদা পার্টি আছে। তারপরেও যদি বলেন, তাহলে আপনারা ভুল করেছেন। এডি কিন্তু এমন কথা আমাকে বলেনি।’

নিখিলেশ উপাধ্যায় তাড়াতাড়ি বললেন, ‘না, না, আমি সে কথা বলছি না। এই লোককে আপনাকে অন্যভাবে টলাতে হবে।’

‘কীরকম?’

উপাধ্যায় একবার কেবিনের পরদার দিকে তাকিয়ে নিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, ‘আপনি কোম্পানির মালিকানা দাবি করবেন।’

বৈশাখী ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘মানে! মালিকানা দাবি করব কীভাবে?’

উপাধ্যায় ফিসফিস করে বললেন, ‘আপনাকে সবরকম কাগজপত্র আমি হাতে তুলে দেব। আপনি সেই কাগজ দেখিয়ে বলবেন, এই কোম্পানিতে আপনারও শেয়ার আছে।’

বৈশাখী বললেন, ‘কোম্পানির শেয়ার আছে! কাগজপত্র পাব কোথা থেকে?’

নিখিলেশ উপাধ্যায় হাসলেন। বললেন, ‘জাল কাগজপত্র বানানোর দায়িত্ব আমার। আপনাকে শুধু চেপে বসে থাকতে হবে। মালিককে টলমল করে দিতে হবে। সে হয়তো থানা-পুলিশ করবে, কোর্টে মামলা করবার ভয় দেখাবে, আপনি হাল ছাড়বেন না।’

বৈশাখী চুপ করে রইলেন। কিছু একটা ভাবলেন। তারপর অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘কতক্ষণ হাল ছাড়ব না?’

নিখিলেশ উপাধ্যায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘যতক্ষণ না আমি বলব।’

বৈশাখী মাথা নামিয়ে বসে রইলেন। উপাধ্যায় চিন্তিত গলায় বললেন, ‘আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?’

বৈশাখী এ কথার জবাব না দিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমার রুমালটা কোথায় গেল? কোথায় রাখলাম?’ বলতে বলতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বিড়বিড় করতে করতেই সামনে রাখা ভ্যানিটি ব্যাগের চেন খুলে জিনিসপত্র হাতড়াতে থাকেন। একটা একটা করে জিনিস বের করে টেবিলে রাখছেন। রুমালের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস খুঁজে না পেয়ে মহিলা ব্যস্ত। বাকি সব ভুলে গেছেন। উপাধ্যায় একটু অবাকই হলেন। সামান্য একটা রুমালের জন্য এত! বৈশাখী টেবিলে রেখেছেন চশমার খাপ, জলের বোতল, ছোট নোটবুক, মাথার ক্লিপ একটা। একইভাবে একটা রিভলভার বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন।

রিভলভারের নলের সঙ্গে জড়ানো অবস্থায় রুমালও পাওয়া গেল। বৈশাখী সেই রুমাল দিয়ে ভালো করে মুখ মুছলেন।

তিপান্না

কর্ণিকার মন খারাপ।

সে আজ অফিসে রেজিগনেশন লেটার জমা দেবে। এই চাকরিতে সে যে বহুদিন জয়েন করেছে এমন নয়। বরং সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের বেশিরভাগ কর্মীই তার থেকে সিনিয়ার। তার পরেও কোম্পানি তাকে গুরুত্ব দিয়ে উঁচু পদে বসিয়েছে। অফিসে কাজের পরিবেশও ভালো। কাজের এমন পরিবেশ আর কোথাও পেত না। পাবে না। সুদূর আমেরিকায় বসে সুস্নাত এই মনখারাপের কথা শুনে অবাক হয়েছে।

‘কোম্পানি ছাড়ছ বলে তুমি আপসেট হয়ে পড়েছ কনি।’

দ্বিতীয় দিন থেকে সুস্নাত তাকে ‘কনি’ ডাকছে। এত দ্রুত ‘কনি’ ডাকে লজ্জা লজ্জা করছে, আবার ভালোও লাগছে। ‘এই অফিসটা আমার খুব ভালো লাগে।’

সুস্নাত বলেছে, ‘অফিস ভালো লাগা মন্দ লাগার কী আছে। অফিস ইজ অফিস।’

কর্ণিকা বলেছে, ‘বা: যেখানে কাজ করি সেই জায়গাটা ভালো না লাগলে কাজ করব কী করে?’

সুস্নাত হেসে বলে, ‘এখানে তোমার আরও ভালো লাগবে। নিজের জায়গায় কাজ করবে। আমার ফার্ম মানে তো তোমার ফার্ম।’

কর্ণিকা এই কথাতেও লজ্জা পায়। মানুষটার সঙ্গে তার ভালো করে পরিচয়ই হয়নি, শুধু টেলিফোনেই যা কথা হয়েছে, অথচ এমন ব্যবহার করছে যেন বিয়ে হয়ে গেছে। হয়তো এরকমই হয়। যখন ভালো লাগার তখন অতি অল্প আয়েসেই ভালো লেগে যায়।

প্রথম ফোনালাপের পরদিনই মিসেস বোস কর্ণিকার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি ছেলের বিয়ের বিষয়টা দ্রুত শেষ করতে চাইছেন। সব ঠিক থাকলে পরের মাসেই সুস্নাত আসবে। রেজিস্ট্রি করে বউকে নিয়ে চলে যাবে। এর মাঝখানে কর্ণিকাকে পাসপোর্ট ভিসার জন্য ছোটাছুটি করতে হবে। এসব জায়গায় মিসেস বোসের চেনাজানা আছে। তৎকালে অ্যাপ্লাই করতে হবে।

ভিসার জন্য ওদেশ থেকে সুস্নাত কাগজপত্র পাঠিয়ে দেবে। এই কাজের জন্য সময় দিতে হবে। অফিসে, পুলিশের দপ্তরে গিয়ে পড়ে থাকতে হবে। কর্ণিকা ভেবেছিল অফিস ছুটি নেবে। মিসেস বোস এ ব্যাপারে তাকে অন্য পরামর্শ দেন।

‘ছুটির কী দরকার কর্ণিকা? তুমি রিজাইন কর।’

কর্ণিকা আকাশ থেকে পড়েছিল।

‘চাকরি ছেড়ে দেব।’

মিসেস বোস বলেছিলেন, ‘আজ না হোক, কাল তো ছেড়ে দিতেই হবে। এখনই বরং চিঠি দিয়ে দাও। দিয়ে পাওনা ছুটি নিয়ে নাও।’

কর্ণিকা বলেছিল, ‘যে ক’টা দিন পারি করি…।’

মিসেস বোস শাশুড়িসুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে বলেছিলেন, ‘সেটা তোমার ব্যাপার। তবে উচিত হবে কিনা সেটাও ভেবে দেখ। তুমি একটা দায়িত্বপূর্ণ পদে আছ। তোমার বদলে অফিস সেখানে একজনকে আনবে। তাদের সময় লাগবে। সেই সময়টা তাদের দেওয়া উচিত। তা ছাড়া…তা ছাড়া…বিয়েটা যখন ফাইনাল হয়ে গেছে, এখন রোজ অফিসে না গিয়ে তোমার উচিত বাড়ির সবার সঙ্গে সময় কাটানো। শুধু তো বিয়ে নয়, তুমি অনেকটা দূরেও চলে যাচ্ছ। আমার বিয়ের পর আমারও এরকম একটা ফিলিংস হয়েছিল। আপশোস বলতে পার। মনে হয়েছিল, ইস, ক’টা দিন যদি শুধু বাড়িতে থাকতাম। যাক, তুমি ভেবে নাও।’ কথা থামিয়ে হেসে মিসেস বোস বলেছিলেন, ‘তবে আমাকে ক’টা দিন সময় দিতে হবে কিন্তু। না বললে চলবে না। তোমাকে নিয়ে কেনাকাটা আছে। কয়েকজন আত্মীয়ও তোমাকে দেখতে আসবেন।’

মিসেস বোস চলে যাওয়ার পর মাও মেয়েকে বোঝাল। অফিসে জানিয়ে দেওয়াই ভালো। ‘বুঝব না, বুঝব না’ ভেবেও শেষ পর্যন্ত কর্ণিকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ না হোক, কাল তো ছাড়তেই হবে। মায়া বাড়িয়ে লাভ কী?

সে কাল রাতে রেজিগনেশন লেটার লিখেছে। অফিসিয়াল হয়নি। অনেকটাই ব্যক্তিগত ছোঁয়া রয়ে গেছে। প্রথমে ইংরেজিতে লিখতে শুরু করেও দু-এক লাইন পরেই সেই চিঠি বাতিল করে কর্ণিকা। বাংলায় লেখে।

‘শ্রী বিমলকান্তি সেন

ম্যানেজিং ডিরেক্টর

সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস।

মাননীয় মহাশয়

আগামী মাস থেকে আমি আর আপনার সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারছি না। আমাকে পাকাপাকিভাবে বিদেশে চলে যেতে হচ্ছে। নতুন কোনও চাকরির জন্য নয়, একান্তই ব্যক্তিগত কারণে যাচ্ছি। আমার এই চিঠি পদত্যাগপত্র হিসেবে গ্রহণ করলে বাধিত হব। আপনি যদি অনুমতি দেন, এই সপ্তাহ থেকেই আমি ছুটিতে চলে যেতে পারি। বিদেশে যাওয়ার জন্য জরুরি কিছু কাজ আমাকে করতে হবে। ছুটি পেলে সেই কাজগুলি করব। তার আগে আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করব, বকেয়া কাজ সেরে ফেলতে। জানি, আরও আগে আপনাদের জানালে ভালো হত, কিন্তু আমার বাইরে চলে যাওয়ার বিষয়টি হঠাৎই ঠিক হয়েছে। আমি নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না।

সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস ছেড়ে চলে গেলেও আমি সেই সংস্থাকে কোনওদিন ভুলতে পারব না। আপনারা আমাকে যে সম্মান দিয়েছেন তার জন্য আমি নিজেকে সৌভাগ্যবতী বলে মনে করি। এই কোম্পানির সঙ্গে আমি মনের দিক থেকেও জড়িয়ে পড়েছি। এখানে আমি আর আসব না, কিন্তু আমার মন এখানেই থাকবে। আপনার অধীনে কাজ করবার মতো যোগ্যতা আমার ছিল কিনা জানি না, কিন্তু আপনার পরিচালনা, নির্দেশ এবং স্নেহে আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস ছেড়ে যেতে আমার খুব খারাপ লাগছে। তারপরেও আমাকে যেতে হচ্ছে। জীবনের এক একটা বাঁকে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয় যা এড়ানোর উপায় থাকে না।

আপনি ভালো থাকবেন। আমার প্রণাম জানবেন।’

এই চিঠি শেষ করে কর্ণিকা আরও একটি চিঠি লিখতে বসল। অন্ধকার ঘরে টেবিল ল্যাম্পের আলো এসে পড়েছে। মনে হচ্ছে, সাদা পাতায় কেউ খানিকটা সোনালি রং ঢেলে দিয়েছে।

‘অর্চিন, কেমন আছ? নিশ্চয় ভালো আছ।

আসলে, সকলেই ভালো থাকবার জন্য নিজের মতো পথ বেছে নিতে চায়। কেউ পারে, কেউ পারে না। তুমি পেরেছ। ভালো থাকবার জন্যই পছন্দের পথ বেছে নিয়েছ। কেরিয়ার ছেড়ে, সবাইকে ছেড়ে, শহর ছেড়ে চলে গেছ গ্রামে। যতদূর জানি, তোমাদের মতো মানুষ বিশ্বাস করে, ভালো শুধু নিজে থাকলে হয় না, অন্যদেরও ভালো রাখতে হয়। তাই তো? কথাটা কি বেশি সরল হয়ে গেল? হোক গে। আমি একটা বোকা মেয়ে। আমার কথায় গা কোরো না। কী বলতে কী বলে ফেলি তার ঠিক নেই। অবশ্য আমি জানি তুমি গা করবেও না। কখনও তুমি আমার কথায় গুরুত্ব দাওনি। শুধু কথা কেন? আমাকেও গুরুত্ব দাওনি। প্রথম প্রথম দু:খ পেতাম। যে মেয়েটি তোমাকে পেয়েছে, তার ওপর হিংসে হত। তোমার ওপর রাগ হত। তারপর ধীরে ধীরে বুঝলাম, ঠিকই হয়েছে। তোমার মতো মেধাবী ছেলের জন্য আমি নই। শুধু বই পড়া বিদ্যে নয়, চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কেও তোমার ধারণা স্পষ্ট। আর পাঁচটা ‘গুড বয়’-এর মতো তুমি স্বার্থপর নও। তোমার সঙ্গে আমাকে কখনওই মানাত না। আমি খুবই সাধারণ। তোমার থেকে বয়েসে একটু বড় হয়েও, একটু বোকা। তাই আমি হিংসে, রাগ সবই ধাপে ধাপে ভুলতে থাকি। মনে মনে নিজেকেও তোমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছি। তারপরেও কখনও কখনও পারিনি। কখনও কখনও ভালোমন্দ কিছু হলে ইচ্ছে করেছে তোমাকে জানাই। দুম করে ফোন করে বসেছি। সাধারণ বলেই করেছি। অবশ্য তুমি তখনও গুরুত্ব দাওনি। ঠিকই করেছ। আবার বলছি, আমি তোমার গুরুত্ব পাবার যোগ্য নই।

অর্চিন, আমি রাজনীতি বুঝি না। আরও কঠিন করে বলতে গেলে, রাজনীতি আমার ভালোও লাগে না। এর থেকেও যদি কঠিন কথা বলতে হয়, তাহলে বলব রাজনীতি যারা করে তাদেরও পছন্দ করি না। মনে হয়, তারা হয় ভণ্ড, নয় তারা ভুল পথে হাঁটছে। মানুষকে মিথ্যে কথা বলে, বোকা বানিয়ে তারা নিজেদের আখের গোছায়। আমাদের দেশে রাজনীতির পবিত্রতা অনেকদিন আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম কিছু থাকতে পারে, তা ব্যতিক্রমই মাত্র। আমার বড়মামা কলেজ জীবনে ছিলেন কড়া বিপ্লবী। ছেলেমেয়েদের নেতা ছিলেন। পুলিশের ধরপাকড় থেকে বাঁচতে আমার দাদুর সাহায্য নিয়ে বিদেশে পালালেন। আর যাদের খেপিয়েছিলেন, তারা কলকাতার অলিগলিতে হয় পুলিশের গুলিতে মরল, নয় ধরা পড়ে জেল খেটে জীবন নষ্ট করল। আমার বড়মামা কয়েক বছর আগে তার মেমসাহেব বউ আর আধা বাঙালি ছেলেমেয়ে রেখে বিদেশেই মারা গেছেন। আর রেখে গেছেন বিপুল সম্পত্তি। মৃত্যুর পর কারও সম্পর্কে নিন্দে করতে নেই। নিজের আত্মীয়স্বজনকে তো নয়ই, কিন্তু এই মামাকে ভণ্ড ছাড়া আর কী বলতে পারি অর্চিন? আমার মনে হয়, রাজনীতি মানুষকে ভুল পথে চলতে শেখায়। শেখায় নিজের দায়িত্ব পালন না করে, নিজের কাজ না করে শুধু দলাদলি করতে। পাশের মানুষকে শত্রু ভাবতে শেখায়। নয়তো আদর্শ, বিশ্বাসের নামে কোনও দল আর কিছু নেতার কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে বলে। সেই দলের, নেতার হাজার ভুল থাকলেও মুখ ফুটে বলবার অধিকার থাকে না।

অর্চিন, এসব কথা পড়ে তুমি নিশ্চয় খুব অবাক হচ্ছ? নিশ্চয়ই ভাবছ, আমার মতো একটা সাধারণ, বোকা, কেরিয়াসর্বস্ব একটা মেয়ে এত কথা শিখল কোথা থেকে! তাই তো? আমিও অবাক হচ্ছি। কোথা থেকে এসব বড় কথা আমি শিখলাম তার জন্য অবাক হচ্ছি না, অবাক হচ্ছি, তোমাকে বলবার সাহস কোথা থেকে পেলাম সেটা ভেবে।

অর্চিন, সাধারণ মানুষ একেবারে কিছু বোঝে না, কিছু ভাবে না এমনটা মনে করা ঠিক নয়। তাদেরও একটা মত আছে। ধরতে পারো সেটুকু জানাবার জন্যই তোমাকে এসব বললাম।

আশা করি, তুমি ভুল বুঝবে না। তোমার যে জীবন তুমি বেছে নিয়েছ তাকে আমি ছোট করছি না। হয়তো তুমি আমার মতো বহু সাধারণ মানুষের ধারণা ভেঙে দেবে। প্রমাণ করবে, রাজনীতি মানে ভাণ্ডামি নয়, রাজনীতি মানে ভুল পথে চলা নয়, রাজনীতি মানে নিজের আখের গোছানো নয়। রাজনীতি, মানে অনেক বড় কিছু। আমি সেই কামনা করি। আশা করি, এমনটা হবে না যে-কোনও একদিন তুমিও বুঝবে, ভুল হয়ে গেছে। সব ছেড়ে চলে যাওয়া নয়, নিজের কাজটুকু মন দিয়ে করলেও মানুষের জন্য কিছু করা যায়। আমি যে একটা কোম্পানিতে এতদিন ম্যানেজারের কাজ করেছি সেটা কি কিছু করা নয়? কোম্পানির সঙ্গে কত মানুষ জড়িত। কোম্পানি ঠিকমতো চলার ওপর তাদের জীবন, তাদের সংসার নির্ভর করে। শুধু অফিসে চাকরি নয়, যে গরিব মালবাহক আমাদের প্রাোডাক্ট ঘাড়ে করে ট্রেনে তুলে দেয়, জাহাজে তুলে দেয়, তার জন্য কি খুব দূর থেকে আমি কোনও দায়িত্ব পালন করিনি? সবটাই কি কেরিয়ারসর্বস্ব আর সাধারণ মানুষ বলে উড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয়?

যাক, খানিকটা রেগে গিয়েই হয়তো তোমার জগৎ, তোমার বিশ্বাসকে তেড়েফুঁড়ে আক্রমণ করে বসলাম। কিছু মনে কর না। রাগ নাকি অভিমান? তোমার ওপর অভিমান করবার মতো অধিকার কি আমার আছে? কী জানি।

দেখছ, তোমাকে চিঠি লিখতে বসে রাগের বশে কত হাবিজাবি কথা লিখে ফেললাম? বাদ দাও এসব। ভুলে যাও। তোমার সঙ্গে প্রথম আলাপের দিনটা কি তোমার মনে আছে অর্চিন? আমার মনে আছে। শুনবে?

জোর বৃষ্টির দিন ছিল সেটা। যাদবপুরের এইট বি বাসস্ট্যান্ডে একটা অটোতে বসেছিলাম। অটো দাঁড়িয়ে ছিল ট্রাফিক আলোয়। বৃষ্টির ছাঁদে ভিজেও যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে তুমি ছুটে এসে, রাস্তা পার হয়ে অটোতে উঠতে গেলে। ভিজে একশা। আমি খুব কড়া গলায় বললাম, এখানে কোথায় বসবেন? দেখছেন না, আমরা কীভাবে চেপেচুপে বসে আছি? তুমি হকচকিয়ে গেলে। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। তোমার মাথায় ছাতাও ছিল না। একটা ব্যাগের মতো কী যেন মাথার ওপর ধরে ছিলে। তুমি খানিকটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে চশমার কাচ মুছতে মুছতে রাস্তার পাশে চলে গেলে। ট্রাফিকের সবুজ আলো পেয়ে অটো আবার ছুটতে শুরু করল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে অতি অবহেলায় তোমাকে একবার দেখতে গেলাম। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তুমি ভিজছ। দু-পাশ দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি। তোমাকে বৃষ্টিধোয়া শহরের রাস্তায় কী যে অমলিন লাগল! মুহূর্তের মধ্যে আমার কী যেন হল! মনে হল, বিরাট একটা অন্যায় করেছি। আমি একটু সরে বসলেই একজন রোগাসোগা ছেলের জায়গা হয়ে যেত। হয়তো হত না। আমি আর দেরি করিনি। অটো থামিয়ে নেমে পড়ি। কোনওরকমে ছাতা খুলে তোমার কাছে পৌঁছেও যাই। তুমি তখন রাস্তার পাশে পৌঁছেছ। আমাকে দেখে চিনতে পারলে না। আমি বললাম, সরি। তুমি অবাক হয়ে তাকালে। সেই চোখ আজও আমি দেখতে পাই। মনে পড়ছে অর্চিন? আমরা ভিজতে ভিজতে অনেকটা পথ হেঁটেছিলাম। যা ছিল গল্পের থেকেও অসম্ভব। এই জন্যই বলে জীবন গল্প উপন্যাসের থেকেও বিস্ময়কর, আকস্মিক।

অর্চিন, কোনওদিন বলিনি, আমি সেদিনই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। নিজেকে সামলাতে পারিনি, নির্লজ্জের মতো তোমার মোবাইল ফোন নম্বর চেয়ে নিয়েছিলাম।

তুমি আমাকে কোনওদিনই ভালোবাসনি, অর্চিন, অবহেলাই করেছ শুধু, অপমান করেছ। তারপরেও তোমাকে আমি ভালোবেসেছি। কেন? আমি জানি না। আমার ধারণা, কোনও ভালোবাসার পেছনেই কারণ থাকে না। থাকে না বলেই ভালোবাসা এত সুন্দর। আমার ভালোবাসাও সুন্দর।

অর্চিন, আমি বিয়ে করছি। বিয়ে করে বিদেশে চলে যাচ্ছি। আমার যে বর হতে চলেছে সেই ছেলেটি খুব ভালো। ভীষণ ব্রাইট। বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশে সে তার কেরিয়ার তৈরি করেছে। আমার সঙ্গে ক’টা কথা বলেই সে আমার প্রেমে পড়ে গেছে। আমার রূপের নয়, আমার কাজের। এখন অবশ্য অন্য কথা। আমাকে ফোন না করলে ছটফট করে। ছেলেটিকে আমার পছন্দ হয়েছে। তবে এখনও ভালোবাসতে পারিনি। সম্ভবত ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে অনাগ্রহ, অবহেলা পেয়ে আমার বিচ্ছিরি অভ্যেস হয়ে গেছে। অভ্যেস বদলাতে হবে। মনে হয় পেরে যাব। তোমার কী মনে হয়? খুব ভালো থাক। তোমার স্বপ্ন পূরণ হোক। যদি পার ঋষাকেও তোমার স্বপ্নের মধ্যে নিয়ে নাও। মেয়েটা তোমাকে বড্ড ভালোবাসে। আমার থেকে অনেক অনেক বেশি। সে তোমার জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করবে। আমার মতো দামি বর পেয়ে গলায় ঝুলে পড়বে না। ঋষা সাধারণ নয়।

টা টা।’

চিঠি লেখা শেষ করে টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়েছিল কর্ণিকা। তারপর দীর্ঘক্ষণ সেই চিঠির পাতা গালে চেপে ধরে নি:শব্দে কেঁদেছে। চোখের জল আর চিঠির লেখা মাখামাখি হয়ে গেছে।

শেষরাতে চিঠি কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে চোখ মুছেছে কর্ণিকা।

চুয়ান্ন

বৈশাখী দাঁড়িয়ে আছেন ক্যানিং লঞ্চঘাটে।

সামনে দিয়ে হু হু করে মাতলা নদী বয়ে যাচ্ছে। সকালের রোদ পড়ে নদীকে দেখাচ্ছে ঝলমলে। মনে হচ্ছে, ভোরবেলা ঘুম ভেঙে উঠে সাজগোজ করে বেরিয়ে পড়েছে।

এখন ক’টা বাজে? বৈশাখী হাত উলটে ঘড়ি দেখলেন। ন’টা বেজে দশ মিনিট। বৈশাখী এখন ভুটভুটিতে নদী পেরোবেন। সেখান থেকে বাসে ধামখালি। ধামখালি থেকে ভ্যানে আরও খানিকটা গেলে গ্রামে পৌঁছবেন। গ্রামের নাম সুন্দর। নোনাজল। সুন্দরবনের সবটাই তো নোনাজল। সব মিলিয়ে ঘণ্টা আড়াইয়ের পথ। তাও ভুটাভুটি, বাস, ভ্যান সময় মতো পেলে। না পেলে আরও দেরি। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। তাড়াহুড়ো করাও যাবে না। লোকে সন্দেহ করবে। অ্যাকশনের নিয়ম হল, অ্যাকশনের সময় যতটা মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়, অ্যাকশনের পর পর মাথা ঠান্ডা রাখতে হয় তার থেকে অনেক বেশি।

বৈশাখী অ্যাকশন করেছেন কাল সন্ধেবেলা। তারপর বাসে উঠে শিয়ালদা এসেছেন। শিয়ালদা স্টেশনের বাইরের বাজারে শান্ত ভাবে খানিকক্ষণ ঘোরঘুরি করেছেন। হকারদের সঙ্গে দরদাম করেছেন। শাড়ি, জামা-কাপড়, উলটে পালটে দেখেছেন। তার মধ্যে একটা ছোকরা মতো ছেলে গায়ের ওপর একটা চাদর ফেলে দিয়ে কেনবার জন্য জোরাজুরি শুরু করে।

‘আপনি এতক্ষণ ঘাটাঘাঁটি করেছেন, এবার নিতে হবে।’

বৈশাখী অবাক হয়ে বললেন, ‘ঘাঁটাঘাঁটি করলাম কই!’

ছেলেটি দাঁত কিড়মিড় করে বলে, ‘ঘাঁটাঘাঁটি করেননি? এতবার যে চাদরটার ভাঁজ খুললেন।’

বৈশাখী আরও অবাক হয়ে বলেন, ‘আমি তো চাদরটায় হাতই দিইনি ভাই। তুমিই তো জোর করে খুলে দেখালে।’

ছোকরা এবার মেজাজ চড়িয়ে বলে, ‘ওই একই হল। এই ঘাঁটা জিনিস অন্য কোনও খদ্দের কিনবে?’

বৈশাখী বলেন, ‘সে তো তোমার ব্যাপার।’

ছোকরা বলল, ‘ও সব জানি না। এই মাল আপনাকেই নিতে হবে।’

বৈশাখী এবার ছেলেটির দিকে এ পা এগিয়ে যান।

‘ভাই তুমি কি গুন্ডামি করছ?’

ছোকরাটি এবার চোখ পাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, করছি।’

বৈশাখী নীচু গলায় বললেন, ‘তুমি আমার ছেলের বয়সি, তোমাকে যদি একটা কষিয়ে চড় লাগাই তোমার কি খুব রাগ হবে?’

ছোকরাটি এবার থতমত খেয়ে যায়। পাড়াগাঁয়ের মানুষকে এইভাবে জোর-জবরদস্তি জিনিস গছানোর ব্যবসা সে অনেকদিন থেকেই করেছে। ঝামেলাও হয়েছে। তবে কেউ এই ভাবে ঠান্ডা গলায় চড় মারবার কথা বলেনি।

‘আপনি কী বলতে চাইছেন?’

বৈশাখী শান্ত ভঙ্গিতেই বললেন, ‘এবার বল, কোন গালে চড় মারব।’

ছেলেটি এবার চুপসে যায়। মহিলার ভাবভঙ্গি সুবিধের নয়। গলার স্বর, চোখের চাউনিতে এমন কিছু একটা আছে, যেটা ভয়ের।

‘বাজে কথা বলবেন না। আপনি যান তো।’

বৈশাখী আরও একটু এগিয়ে যান। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রাখেন জামা কাপড়ের ওপর। তারপর ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘ক্ষমা চা। আগে ক্ষমা চা। নইলে একটা চড় নয়, আরও বেশি মারব। তুই আমাকে চিনিস না। একটু পরে চিনতে পারবি।’

ছেলেটি তাড়াতাড়ি হাত জোড় করে বলে, ‘ক্ষমা চাইছি। ভুল হয়ে গেছে। আপনি এখান থেকে যান।’

বৈশাখী এরপর স্টেশনে যান। সেখানে ক্যান্টিনে বসে রুটি তরকারি আর ডিমের ঝোল খান। বিভিন্ন ট্রেনের যাওয়া আসার অ্যানাউন্সমেন্ট শোনেন। রাত বাড়ে। এক সময় দার্জিলিং মেল স্টেশন ছেড়ে চলে যায়। আরও মিনিট কুড়ি পরে ওঠেন। লেডিজ রিটার্নিং রুমে যান। বাইরে মাঝবয়সি একজন মহিলা টেবিল চেয়ারে বসে ঢুলছেন। সামনে রিটার্নিং রুমের এন্ট্রি খাতা। বৈশাখী সামনে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিতে তিনি চোখ খোলেন।

‘কী চাই?’

‘রিটার্নিং রুমে জায়গা চাই।’

মহিলা ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘মানে!’

বৈশাখী বলেন, ‘আমি দার্জিলিং মেল মিস করেছি। আমার আত্মীয়রা চলে গেছেন। এত রাতে মছলন্দপুর ফিরতে পারব না। কাল সকালে কোনও গাড়ি ধরে এন জি পি যাওয়ার চেষ্টা করব।’

মহিলা অতি বিরিক্ত নিয়ে বলেন, ‘জায়গা নেই।’

বৈশাখী বলেন, ‘আছে। একটা বেড হয়ে যাবে।’

মহিলা বলেন, ‘টিকিট দিন।’

বৈশাখী বলেন, ‘আমার আত্মীয়রা নিয়ে চলে গেছেন। এক সঙ্গে টিকিট ছিল। বিয়ের অনুষ্ঠান। যেতেই হত!’

‘টিকিট ছাড়া রিটার্নিং রুমে অ্যালাও নেই। আমি কিছু পারব না।’

বৈশাখী গলা নামিয়ে বললেন, ‘ভাই, আমি প্ল্যাটফর্মেই থাকতে পারতাম, কিছুক্ষণ হল দুটো গুন্ডা টাইপের লোক আমার পিছু নিয়েছে। যেখানে যাচ্ছি সেখানেই চলে যাচ্ছে। একটু আগে ক্যান্টিনে বসে খেলাম সেখানেও…প্ল্যাটফর্মে থাকতে কেন, স্টেশন থেকে বেরোতেই আমার ভয় করছে।’

মহিলা বললেন, ‘আপনি পুলিশে খবর দিন।’

বৈশাখী কাতর গলায় বললেন, ‘আপনি যাবেন? চলুন না। দুজনে গিয়ে পুলিশকে বলি।’

মহিলা এবার ঝামেলায় পড়া মুখ করে বললেন, ‘না না, ডিউটি ছেড়ে আমি কোথায় যাব?’

বৈশাখী আতঙ্কিত গলায় বললেন, ‘তাহলে আমাকেও একা পাঠাবেন না।’

মহিলা এবার খাতায় নাম-ঠিকানা না লিখেই বৈশাখীকে রিটার্নিং রুমের ডরমেটারিতে একটা বেডের ব্যবস্থা করে দিল।

বৈশাখী নিশ্চিন্ত হলেন। পুলিশ নিশ্চয় এতক্ষণে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। যেখানেই খুঁজুক, শিয়ালদা স্টেশনের রিটার্নিং রুমে আসবে না। রাতে ভালো ঘুম হল না। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম। খুব ভোরেই বেরিয়ে পড়লেন। সাউথ সেকশনে গিয়ে স্টলে বসে চা খেলেন। তারপর ধীরস্থিরভাবে ক্যানিং লোকালে উঠে, একটা কোণের দিকে ফাঁকা বেঞ্চে বসে, জানালার হাওয়া খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়লেন। এই ঘুমও গভীর হল না। বৈশাখী ছেলেকে স্বপ্ন দেখলেন। অর্চিন আর তার বাবা একটা জঙ্গলের মধ্যে হাঁটছে। তারা নীচু গলায় কথা বলছে, কিন্তু সে কথা পুরো শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ অর্চিনের পায়ে একটা কাঁটা ধরনের কিছু ফোটে।

তার বাবা নীচু হয়ে বসে সেই কাঁটা তুলে দিতে যায়। অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। একটা সময়ের পর অর্চিন বাধা দেয়। এবার তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পায় বৈশাখী।

‘বাবা থাক। আমি কাঁটা নিয়েই হাঁটব।’

‘তোর কষ্ট হবে তো।’

‘হোক। আমি কাঁটা নিয়েই চলব।’

‘কতদিন এভাবে থাকবি?’

‘যতদিন পারি।’

‘কেন?’

‘পায়ে কাঁটা বিঁধে থাকলে আমার সব সময় তোমার কথা মনে পড়বে বাবা। মনে পড়বে, আমার বাবা খুব সুন্দর একটা মানুষ। আমার পায়ের কাঁটা তুলে দিতে অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। এটা ভালো হবে না?’

অর্চিনের বাবা হেসে বলে, ‘দূর বোকা ছেলে। আমি ভালো মানুষ কেন হতে যাব? আমি একটা খারাপ মানুষ। ক্রিমিনাল একজন। লোক ঠকিয়ে, জালিয়াতি করে জীবন শেষ করেছি।’

অর্চিন দেবশিশুর মতো হেসে বলল, ‘সে যাই হোক, আমার বাবা, খুব সুন্দর একজন মানুষ।’

স্বপ্নের এই পর্যায়ে এসে বৈশাখীর ঘুম ভেঙে যায়। তিনি চোখ খুলে দেখেন ক্যানিং স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে।

বৈশাখীর খিদে খিদে পাচ্ছে। কিছু খেয়ে নেওয়াই ভালো। অনেকটা পথ যেতে হবে। তিনি এদিক-ওদিক তাকালেন। উলটো দিকে একটা দোকানে গরম পারোটা বিক্রি হচ্ছে। পেটাই পরোটা। ময়দার তাল পিটিয়ে মস্ত চেহারার পরোটা বানিয়ে উনুনে দেওয়া হচ্ছে। তারপর ছিঁড়ে, ওজন করে খদ্দেরদের দেওয়া হচ্ছে। বৈশাখী দুশো গ্রাম পরোটা কিনলেন। প্লেট নিয়ে এসে বসলেন বেঞ্চের ওপর।

গতকালের ঘটনা মনে পড়ছে। বৈশাখী বিরক্ত হলেন। এটা ভালো কথা নয়। কোনও অ্যাকশনের পরেই ঘটনা মনে পড়া ঠিক নয়। তার পরেও পড়ছে। কেন? অ্যাকশন বড় বলে? নাকি একেবারেই প্রস্তুতি ছিল না তাই?

ভবানীপুরের রেস্টুরেন্টে বসে কথা শুরুর একটু পরেই নিজের দর বোঝাতে ব্যাগ থেকে ইচ্ছে করে রিভলভারটা বের করে টেবিলে রেখেছিলেন বৈশাখী। রুমাল খোঁজবার ছুতোয়। নিখিলেশ উপাধ্যায় আড়চোখে দেখে কাজের কথা শুরু করেন। কথা বেশি ছিল না। কথা না বলে গল্প বলা উচিত। যে গল্পের ওপর দাঁড়িয়ে পুরো কাজটা বৈশাখীকে করতে হত।

সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস নামে এক কোম্পানিতে গিয়ে দাবি করতে হবে, কোম্পানির মূল কর্ণধারের আর একটি স্ত্রী ছিল। সেই মহিলা ছিলেন একজন প্রস্টিটিউট। কোনও এলাকায় তিনি কাজ করতেন না, কাজ করতেন সমাজের উচ্চবলয়ে। এই কোম্পানির কর্ণধারের সঙ্গে মহিলার কোনওভাবে আলাপ হয়। প্রেম হয়। শেষ পর্যন্ত গোপনে বিয়ে। ভদ্রলোকের স্ত্রী ছিল বলেই গোপনে বিয়ে। মহিলার নাম ধরা যাক অঞ্জলি। অঞ্জলির একটি মেয়ে হয়। মেয়ে বড় হয়। সেন অ্যাসোসিয়েটসের কর্ণধারের সঙ্গে অঞ্জলির চুক্তি হয়, তারা কখনও সামনে আসবে না। আড়াল থেকে টাকা পয়সা দেওয়া হবে। অঞ্জলি মারা যেতে টাকাপয়সা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার মেয়েও বিষয়টা নিয়ে খুব একটা নাড়াচাড়া করেনি। সে তার পিতৃ পরিচয় ভালো করে জানত না। কিন্তু সম্প্রতি ভদ্রলোকের মৃত্যুর পর জানতে পেরেছে, কে তার বাবা ছিলেন। কত বড় কোম্পানির মালিক তিনি। তাই মেয়ে ভদ্রলোকের ছেলের কাছে এসে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের অংশীদার হতে চাইবে। সেই মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে বৈশাখীকে। তাকে বিয়ের যাবতীয় জাল কাগজপত্র, এমনকী জাল ফটোগ্রাফ পর্যন্ত দেওয়া হবে। ভদ্রলোকের বিয়ের ফটো উপাধ্যায়ের সংগ্রহে আছে। সেখানে কনের মুখ বদল করা হবে কম্পিউটারের কারসাজিতে।

অ্যাসাইনমেন্ট শোনবার পর বৈশাখী জিগ্যেস করেন, ‘টাকা-পয়সার কী হবে?’

নিখিলেশ বলেন, ‘সমস্যা পাকালে আমার কাছে আসবেন। আমি আপনার সঙ্গে নেগোসিয়েশনে যাব। আপনি টাকা, বাড়ি, জমি চাইবেন। আমি রফা করব। রফার পর টাকা আমার। আপনি আপনার চার্জ বুঝে নেবেন।’

বৈশাখী চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘রাজি নই। আমার রিস্ক খুব। চার্জের বাইরেও আমাকে শেয়ার দিতে হবে।’

নিখিলেশ ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘এরকম তো কথা ছিল না। আপনি তো চার্জ নিয়ে কাজ করেন। এডি সে রকমই আমাকে জানিয়েছে।’

বৈশাখী বললেন, ‘সব কাজ করি না। এই ধরনের কাজে ধরা পড়লে ভিতরে কম করে দশ বছর থাকতে হবে।’

নিখিলেশ থমথমে গলায় বললেন, ‘ধরা পড়বেন না।’

বৈশাখী ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন, ‘ক্রাইমের আগে সবাই ওরকম ভাবে।’

নিখিলেশ বললেন, ‘আমি সবার মতো নয়। সব দিকের আটঘাট বেঁধে এগোচ্ছি। আমার নিজেরও বড় ঝুঁকি। আপনি ধরা পড়লে আমিও তো ফাঁসব।’

বৈশাখী স্থির চোখে খানিকক্ষণ বুড়ো মানুষটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আর যদি আপনিই আমাকে ধরিয়ে দেন?’

নিখিলেশ উপাধ্যায়ের চোখ ঝলসে উঠল। এই মহিলা সামান্য জালিয়াত নয়। এর বুদ্ধি তুখোড়।

‘আপনাকে ধরিয়ে আমার লাভ?’

বৈশাখী তুচ্ছ করবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘নিজে সাধু সাজবেন। কোম্পানির বিশ্বাসযোগ্য হবেন।’

নিখিলেশ উপাধ্যায় মুচকি হেসে বললেন, ‘আমি তো এমনিই বিশ্বাসযোগ্য। সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের মূল লোক বলুন, বর্তমান মালিকই বলুন, সবাই আমাকে বিশ্বাস করে। নতুন করে আর কী আস্থাভাজন হব?’

বৈশাখী বললেন, ‘আপনি কতদিন এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত?’

নিখিলেশ বললেন, ‘আপনার কী প্রয়োজন? আপনি টাকা পাবেন, কাজ করবেন।’

বৈশাখী বললেন, ‘প্রয়োজন আছে। আমি বুঝতে চাইছি, আপনি যে গল্পটা সাজিয়েছেন, সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবে কিনা।’

নিখিলেশ উপাধ্যায়, একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘এই কোম্পানি যিনি মূলত তৈরি করেছেন, অর্থাৎ যে মানুষটার বিরুদ্ধে গল্প সাজানো হচ্ছে, তিনি আমার থেকে বয়েসে অনেকটা বড়। আমি তার অধীনস্থ একজন এমপ্লয়ি ছিলাম। তার পরেও এক রকম বন্ধুত্ব তৈরি হয়। ধীরে ধীরে আমার ক্ষমতা, প্রতিপত্তি বাড়ে। আমি আমার যোগ্যতা দিয়ে নিজেকে দক্ষ এবং আস্থাভাজন প্রমাণ করি। একটা সময়ের পর আমার বস কাম বন্ধু অবসরে যান। আমারও বয়স বাড়ে। কাজ ছাড়তে চাই আমিও। আমার বস আমাকে ছাড়তে দেন না। তিনি আমাকে বলেন, তোমাকে কোম্পানিতে থাকতে হবে। আমার ছেলেকে সাহায্য করতে হবে। কেউ জানবে না, আমি তোমার মাধ্যমে কোম্পানি চালাব। আমার সেই বস কাম বন্ধু কিছুদিন হল মারা গেছেন। এখন তার ছেলেই সব। আমি রয়ে গেছি। কোনও বড় ধরনের সমস্যা হলেই সামলাই।’

বৈশাখী বললেন, ‘ও আপনি তা হলে বিশ্বাসঘাতক?’

নিখিলেশ উপাধ্যায় ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন, ‘বিশ্বাসঘাতক কে? আমি না সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের মালিকরা? যাদের জন্য এই বুড়ো বয়সেও এত করলাম তারা আমাকে কী দিল? স্রেফ কয়েকটা টাকা মাইনে? কেন? এতই যদি বিশ্বাস, আস্থা, তারা আমাকে কোম্পানির একজন করে নিতে পারত না? উচিত ছিল না?’

বৈশাখী হাইয়ের মতো তুলে বললেন, ‘তাহলে প্রতিশোধ?’

‘খানিকটা তাই বলতে পারেন।’

দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। নিখিলেশ উপাধ্যায় এবার সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, ‘অনেক কথা হল। আপনি সবই জানলেন। আশাকরি আর সমস্যা রইল না। তা হলে কাজের কথায় আসুন। ফাইনাল বলুন কত টাকা নেবেন?’

বৈশাখী বললেন, ‘জাল কাগজপত্র একবার দেখব। তার আগে এক কাপ চা বলুন।’

নিখিলেশ উপাধ্যায় গলা বাড়িয়ে বেয়ারাকে ডাকলেন। পরদা সরিয়ে বেয়ারা মুখ বাড়াতে, সহজ ভঙ্গিতে চায়ের অর্ডার দিলেন।

সহজ না হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। কারণ দুজনের কেউই তখন জানত না, একটু পরে কী ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে চলেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *