পঞ্চান্ন
পেটাই পরোটা খেতে বেশ। নামেই পারোটা, আসলে ময়দার রুটি। ঘি-টিয়ের কারবার নেই। একটু তেলের ছিটে থাকে, আবার থাকেও না। বোঝা যায় না।
বৈশাখী আরও খানিকটা পরোটা নিয়ে বেঞ্চে ফিরে এলেন। নদী পেরোনোর আগে জল আর বিস্কুট কিনে নিতে হবে। বেশি নেওয়া যাবে না। দরকার নেই। নোনাজল গ্রামে পৌঁছে গেলে নিশ্চয় সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিছু নেওয়ার মতো জায়গা নেই। এমনিতেই সবসময় একটা একট্রা পোশাক থাকে। প্রসাধনের টুকিটাকি রাখতে হয়। লোক ঠকানোর ব্যবসায় সাজগোজ একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বাইরে ঢমক ঢামক দেখে বোকা হওয়ার জন্য সবাই মুখিয়ে থাকে। কম বয়েসে সাজগোজ তেমন লাগত না। শরীর ছিল। তবে বৈশাখী কখনওই শরীর বিলোননি। বিলোব বিলোব করে লোভ দেখিয়েছেন। তাতেই কাজ হাসিল। শরীর দিলে এই ব্যবসায় নাম খারাপ হয়। লোকে রাস্তার ‘কল গার্ল’ ভাবে। বড় কাজ পাওয়া যায় না। সেক্স একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যত দিন যাচ্ছে, এদেশে গুরুত্ব বাড়ছে। এটাকে যদি একটা ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে ধরা যায়, তাহলে বলতে হয় ইন্ডাস্ট্রিতে পয়সা ঢুকছে। শরীর নিয়ে ছেঁদো মূল্যবোধ কমছে। বাইরের মনোভাব গেড়ে বসছে। এই যুগে অল্প আয়েসে পয়সা রোজগার দরকার। শরীর সবথেকে সুবিধের। সাবধানে থাকলে কোনও দাগ পড়বে না। ইনভেস্টমেন্ট ছাড়াই রিটার্ন। কিন্তু এসবের পরেও বুদ্ধির দাম এখনও অনেক বেশি। সে ভালো কাজেই হোক, বা মন্দ কাজেই হোক।
বৈশাখী এক কাপ চা নিলেন। মুখে নিয়ে নাকমুখ কোঁচকালেন। ইস বেশি চিনি দিয়েছে! নদীর দেশের লোক কি বেশি মিষ্টি খায়? নোনাজলে পৌঁছতে পৌঁছতে যেন অ্যাকশ্যানটা ভুলে যাওয়া যায়।
ভবানীপুরের রেস্টুরেন্টে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নিলিখেশ উপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘এডি আমাকে বলেছে, আপনি নাকি এ ধরনের কাজে পটু?’
বৈশাখী বললেন, ‘কোন ধরনের কাজ?’
নিখিলেশ বললেন, ‘এই যে জাল সম্পত্তির কারবার।’
‘কাজে পটু না, অভিনয়ে পটু।’
নিখিলেশ বললেন, ‘তাহলে তো একজন অভিনেত্রীকে ভাড়া করে আনলেই হয়ে যেত। তা তো হয় না। আপনি ভালো করেই জানেন বৈশাখী, ইমপস্টার হতে গেলে শুধু অভিনয় নয়, সাহস লাগে।’
বৈশাখী নির্বিকার মুখে বললেন, ‘বৈশাখী নয়, বৈশাখীদেবী। আপনি আমার থেকে বয়সে বড় নিখিলেশবাবু, কিন্তু প্রফেশনাল কাজে দূরত্ব রাখাই ভালো।’
নিখিলেশবাবু খানিকটা সঙ্কুচিত হয়ে বললেন, ‘সরি। বৈশাখীদেবী, আপনার চার্জটা আগে বলুন। টাকাপয়সার কথা ফাইনাল হয়ে গেলে, আমি আপনাকে কাগজপত্র দেখাব। আপনার একটা ফটো লাগবে।’
বৈশাখী টেবিলের ওপর রাখা ব্যাগটা নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, ‘দেখুন মিস্টার উপাধ্যায়, বিপদে পড়লে কীভাবে নিজেকে উদ্ধার করতে হয় আমি জানি। আবার কীভাবে অন্যকে বিপদে ফেলতে হয় সে কায়দাও জানতে হয়। কিন্তু সবের জন্যই টাকার প্রয়োজন।’
নিখিলেশ উপাধ্যায় দাঁত চেপে বললেন, ‘এসব আপনার বিষয়। আপনি অ্যামাউন্ট বলুন বৈশাখীদেবী।’
বৈশাখী বুঝতে পারলেন, মানুষটা রেগে যাচ্ছে। পার্টি খুশি হলে যেমন কাজ পেতে সুবিধে, তেমন আবার কোনও কোনও সময় পার্টি রাগ করলেও ভালো। দর বাড়ে। পার্টি তাকে এমনি এই কাজে ডাকেনি। খোঁজখবর নিয়ে, জেনেবুঝেই ডেকেছে। আর এই লোকটা একেবারেই বাজে লোক। থার্ড গ্রেড। ক্রিমিনালরাও বিশ্বাসঘাতকতাকে ঘেন্না করে।
‘আমার চার্জের বাইরেও টাকা লাগবে। অপারেশনের পর আপনি কোম্পানির মালিকের সঙ্গে যত অ্যামাউন্ট নেগোসিয়েট করে পাবেন, তার সেভেন পার্সেন্ট আমাকে দিতে হবে।’
নিখিলেশ উপাধ্যায় চোখমুখ লাল করে বললেন, ‘ইমপসিবল! সে তো অনেক টাকা!’
বৈশাখী বললেন, ‘তাহলে আমাকে ছেড়ে দিন! এডির সঙ্গে কথা বলুন। ওর হাতে নিশ্চয় অন্য লোক আছে। আপনাকে কম অ্যামাউন্টে কাজ করে দেবে।’
নিখিলেশ উপাধ্যায় একটু থম মেরে রইলেন। তাঁর গলা নামিয়ে বললেন, ‘দেখুন বৈশাখী, সরি বৈশাখীদেবী, আমার হাতে সময় কম। আপনি জাস্টিফায়েড একটা অ্যামাউন্ট বলুন। কাজটা করাব বলেই আপনাকে ডেকে এনেছি। আমি জানি, অন্য কাউকে দিয়ে কাজ করালে গোলমাল হয়ে যেতে পারে। বানিয়ে নিজেকে কোনও প্রপার্টির শেয়ার হোল্ডার প্রমাণ করতে হলে এক ধরনের স্কিল চাই। শুধু মামলা-মকদ্দমার ভয় দেখালে হবে না। কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির কথা বলে ব্ল্যাক মেইল করতে হবে। আপনাকেই আমার লাগবে। আপনি অ্যামাউন্ট বলুন।’
বৈশাখী একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আচ্ছা, ফাইফ পার্সেন্ট দেবেন। আর কিন্তু দরাদরি করব না।’
নিখিলেশ উপাধ্যায় খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে, তাই হবে। তবে আমি টাকা পাওয়ার পর আপনি পেমেন্ট পাবেন। এবার কাগজপত্রগুলো দেখুন।’
নিখিলেশবাবু পাশে রাখা অ্যাটাচি থেকে কয়েক পাতা কাগজ বের করে বৈশাখীর দিকে এগিয়ে দিলেন। বৈশাখী কাগজ না ধরে বললেন, ‘আমি বুঝে গিয়েছি। কাগজ আমাকে দেখাতে হবে না। আপনি মুখে বলুন। কোম্পানির নাম কী? আমাকে কার কাছে যেতে হবে? কবে যেতে হবে? মাঝখানে আমাকে তিনটে দিন সময় দিতে হবে। আমি বাড়িতে যাব।’
কাগজ নিজের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে নিখিলেশবাবু গলা খাদে নামিয়ে বললেন, ‘কোম্পানির নাম, সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস।’
বৈশাখী সোজা হয়ে বললেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কী নাম বললেন?’
নিখিলেশবাবু মুখ তুলে বললেন, ‘এনি প্রবলেম?’
বৈশাখীর চোখমুখের চেহারা বদলে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘কী নাম বললেন, আর একবার বলুন।’
‘সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। ক্যামাক স্ট্রিটে অফিস, কসবায় ওয়ার্কশপ। কর্ণধারের নাম কমলকান্তি সেন। তিনি ক’দিন আগে মারা গেছেন। তাঁর ছেলে বিমলকান্তি সেনই এখন অল ইন অল। যদিও বেশ কয়েক বছর ধরেই তিনি সবটা দেখছেন।’ এইটুকু বলে বৃদ্ধ নিখিলেশ উপাধ্যায় খানিকটা ঝুঁকে পড়লেন। তাঁর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। লোভে?
‘বৈশাখীদেবী, আপনি কমলকান্তি সেনের নামে অ্যালিগেশন আনবেন। বলবেন এই ভদ্রলোক আপনার মাকে লুকিয়ে বিয়ে করেছিল। সেই অর্থে আপনিও এই কোম্পানির সমান অংশীদার।’
বৈশাখী চেয়ারে হেলান দিলেন। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছলেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘সেনবাড়ি…।’
নিখিলেশ উপাধ্যায় চোখ সরু করে বললেন, ‘ইয়েস, সেনবাড়ি। আপনি কী করে জানলেন?’
বৈশাখী নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘মনে হচ্ছে, এ বাড়ির সঙ্গে আমার আগেও কোনও যোগাযোগ হয়েছে।’
নিখিলেশ অবাক গলায় বললেন, ‘আগে যোগাযোগ! সেটা কীরকম?’
বৈশাখী এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘বিমলকান্তির স্ত্রী কি মণিকুন্তলা?’
নিখিলেশবাবু আরও অবাক হলেন। বললেন, ‘তাই। আপনি কী করে জানলেন?’
বৈশাখীদেবী এবার যেন অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘ওই কমলকান্তি সেনের বাড়িতে দুটি মেয়ে আছে না?’
নিখিলেশ খুশি হয়ে বললেন, ‘আপনি তো সবাই জানেন! হ্যাঁ, দুই মেয়ে, মেঘবতী আর বারিধারা! আমার বন্ধু কাম বসের নাতনি।’
বৈশাখী বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন, ‘আপনার বন্ধু! ঠিকই, বন্ধুই বটে। বাড়িতে আর কেউ নেই।’
নিখিলেশবাবু বললেন, ‘মনে হচ্ছে, আপনার কাজে সুবিধে হবে।’
‘অবশ্যই হবে। সব জানা থাকলে অপারেশনে সুবিধে হবে বই কী। চেনা জায়গায় কাজ করতে সুবিধে। যেমন আপনার হচ্ছে। বাড়িতে আর কে থাকে?’
নিখিলেশবাবু একটু থমকে থেকে বললেন, ‘দারোয়ান, ড্রইভার আর কাজের লোক টোক আছে, ও হ্যাঁ, একটা ছোকরাও থাকত। মণিকুন্তলার দূরসম্পর্কের কোনও আত্মীয়। কী যেন নাম…মনে পড়েছে…অর্চিন…শুনেছি, সেই ছেলের পেছনেও কী যেন কেলেঙ্কারি আছে…ওই ছেলে সেনবাড়ির আশ্রয়ে থেকে পড়াশোনা করত…।’
বৈশাখী উৎসাহ নিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, ‘বা:। আসল কেলেঙ্কারির পরিবারে সহজেই নকল কেলেঙ্কারি ঢোকানো যাবে। মিস্টার উপাধ্যায়, সেই ছেলেকে জানেন? তার সম্পর্কে কোনও ইনফর্মেশন আছে আপনার কাছে?’
নিখিলেশ গর্বের হাসি হেসে বললেন, ‘কেন থাকবে না? ছেলে রাজনীতি করে। পেছনে পুলিশ লেগেছে। সে এখন ভাগল বা। সেনবাড়ির মুখে কালি লেপে পালিয়েছে।’
বৈশাখী বললেন, ‘পালিয়েছে!’
‘হ্যাঁ, রাজনীতি করব বলে, লেখাপড়া ছেড়ে সুন্দরবনের কোন গ্রামে ঘাপটি মেরেছে।’
বৈশাখী থমথমে গলায় বললেন, ‘মানে!’
নিখিলেশ বললেন, ‘মানে আর কী, পালিয়েছে। পলিটিক্সে নাম লিখিয়ে কেরিয়ার বিসর্জন দিয়েছে হারামজাদা। আর্মস অ্যাক্টে পুলিশ পিছনে লেগে গেছে। যে কোনও দিন ধরে গারদে পুরবে। আমার কাছে গোপনে খবর এসেছে, সুন্দরবনের কাছে নোনাজল নামে একটা গ্রামে বেটা শেল্টার নিয়েছে। ক্যানিং থেকে নদী পেরিয়ে যেতে হয়। ভেবেছি, সম্পত্তি নিয়ে গোল পাকানোর সময় পুলিশকে খবর দেব। বেটাকে যাতে ধরে ফেলে। এটাতে সেনবাড়িও টালমাটাল হয়ে যাবে। যতই আশ্রিত ছোকরা হোক, পুলিশ তো ওই বাড়ির লোকদের ছেড়ে কথা বলবে না। সাঁড়াশি আক্রমণ হবে। কেমন ভেবেছি?’
বৈশাখী চুপ করে রইলেন। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছলেন। ব্যাগ খুলে রুমাল ভেতরে রাখলেন। রুমালটা বেশ বড়। বললেন, ‘খুব ভালো ভেবেছেন মিস্টার উপাধ্যায়।’
‘আপনার কাজে এই ইনফর্মেশন কোনও হেল্প করল বৈশাখী, সরি বৈশাখীদেবী?’
বৈশাখী অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘অবশ্যই করল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম কাজটা করব না। আপনি অন্য লোক ঠিক করুন।’
নিখিলেশ উপাধ্যায় একটু চুপ করে থেকে কঠিন মুখ করে বললেন, ‘কেন?’
বৈশাখী বললেন, ‘আমার ইচ্ছে। জালিয়াতের ইচ্ছে থাকতে নেই?’
‘আমি তো টাকাপয়সায় এগ্রি করেছি। আপনি কি আরও চাইছেন?’
বৈশাখী বললেন, ‘না। আমি কাজ করব না।’
বৈশাখী উঠে দাঁড়ালেন। হাত ঘুরিয়ে ঘড়িতে সময় দেখলেন। তাঁকে যথেষ্ট ধীরস্থির দেখাচ্ছে।
নিখিলেশ উপাধ্যায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘তা কী করে হবে বৈশাখীদেবী? কাজ তো আপনাকে করতেই হবে। আপনি সব জেনে গেছেন। বেশি জেনে গেছেন। কাজ যদি না করেন, আমি আপনাকে পুলিশে ধরিয়ে দেব। আপনি জেলখাটা ক্রিমিনাল। জালিয়াতির মামলা আপনার নামে আছে। আপনাকে পেলে পুলিশের সুবিধে হবে। হবে না?’
বৈশাখী নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, ‘তা হবে। আপনি বরং পুলিশে খবর দিন।’
নিলিলেশ উপাধ্যায় দাঁতে দাঁত চেপে অসহায়ভাবে বললেন, ‘এই আপনার ফাইনাল কথা?’
বৈশাখী হেসে বললেন, ‘না ফাইনাল কথা নয়। এবার ফাইনাল কথা বলব। আপনার কাছে গিয়ে বলব।’
কথা শেষ করে বৈশাখী টেবিলের পাশ দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে যান। তারপর চকিতে ব্যাগ থেকে রিভলভার বের করে বাট দিয়ে নিখিলেশ উপাধ্যায়ের ঘাড়ের পেছনে আঘাত করেন। বৃদ্ধ, নিখিলেশ কিছু বোঝার আগেই চেয়ারে মাথা এলিয়ে জ্ঞান হারান। এই কায়দা বৈশাখী শিখেছিলেন তাঁর স্বামীর কাছ থেকে। রক্ত ছাড়া হত্যা। যেখানে ছুরি বা গুলি ব্যবহার করা যাবে না, সেখানে দারুণ কাজ দেয়। গোটা শরীরের জোর নিয়ে আসতে হবে হাতে। মারতে হবে ঘাড়ের ঠিক মাঝবরাবর। হাড় ভেঙে যেন শ্বাসনালিতে ঢুকে যায়। বৈশাখী তা-ই করেছেন। শরীরের সব শক্তির সঙ্গে তিনি পেয়েছেন ঘৃণা। বিশ্বাসঘাতকের প্রতি ঘেন্না। আর সেই সঙ্গে সেনবাড়ির প্রতি কৃতজ্ঞতা।
বৈশাখী কোনও সুযোগ রাখেনি। রিভলভার ব্যাগে ঢুকিয়ে রুমাল বের করেন। নিখিলেশের গলায় ভালো করে প্যাঁচ দেন। সেই প্যাঁচ টেনে ধরে রাখেন টানা তিন মিনিট।
চুল ঠিক করে, শান্তভাবে পরদা সরিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়েন। একসময় রেস্টুরেন্ট থেকেও বেরিয়ে পড়েন। তারপর বাস ধরে শিয়ালদা।
পরোটার দোকানে দাম মিটিয়ে লঞ্চঘাটে নেমে আসেন বৈশাখী। এবার নদী পার হতে হবে। এত জল পেরিয়ে ছেলের কাছে যেতে বড় ভালো লাগছে। অনেক কান্না পেরিয়ে যাওয়া যেন। অর্চিন তাকে চিনতে পারবে? পারবে না।
‘আপনি কে?’
‘আমি কেউ নই।’
‘তবে? আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন?’
‘আমি তোর কাছে থাকতে এসেছি অর্চিন। আর পারছি না। খুব ক্লান্ত লাগছে। খুব ক্লান্ত। বাকি জীবনটা তোর সঙ্গে থাকতে চাই সোনা আমার। তুই আমাকে ফিরিয়ে দিস না। আয়, বাছা কাছে আয়, তোকে আদর করি। কতদিন তোকে আদর করিনি।’
নদী পারাপারের নৌকোতে পা দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে বৈশাখীর দু-পাশে দুজন এসে দাঁড়াল। একজন মহিলা, একজন পুরুষ। মহিলা কঠিনভাবে বৈশাখীর হাত চেপে ধরল। পুরুষটি নীচু গলায় বলল, ‘পালাবার চেষ্টা করবেন না বৈশাখীদেবী। আমরা পুলিশ। আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। নিখিলেশ উপাধ্যায় নামে এক বৃদ্ধকে খুন করবার অপরাধে আমরা আপনাকে অ্যারেস্ট করলাম। আসুন আপনি।’
নদীতে জোয়ার এসেছে। জল ফুলে উঠছে।
ছাপান্ন
‘…প্রিয়তমা,
দেখেছি তোমার স্বপ্নাহত কৃশ পা, আমার
স্বপ্ন বুঝি মনে হয় কারণ এবার
অসময়ে নৈশ-বিরতির ঘণ্টা বেজে ওঠে—
সান্ধ্য ক্লাস ছুটি হয়ে যায়।’
বই বন্ধ করে শেখর সিগারেট ধরাল। সত্যি কি প্রিয়তমা আজ স্বপ্নাহত? অসময়ে নৈশ-বিরতির ঘণ্টা বেজেছে? ছুটি হয়ে গেছে ক্লাস?
বহুদিনের পর শেখরের মন খারাপ। কবিতা পড়ে মন আরও খারাপ হয়ে গেল। রাত দশটা এখন। খানিক আগে পার্টি অফিস থেকে ফিরেছে শেখর। দশটায় বাড়ি ফেরা মানে তাড়াতাড়িই হল। এক সময় বাড়ি ফিরতে রাত একটাও বেজে যেত। অপেক্ষা করে করে তমসা ঘুমিয়ে পড়ত। সেসব অতীতের কথা। নিশুতি রাতে বাড়ি ফেরবার সময় মনে হত, ইস, অনেক কাজ বাকি রয়ে গেল। জেলা কমিটিকে চিঠি লেখবার ছিল, দুটো লোকালে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার ছিল, এখনও পার্টি পত্রিকার এ মাসের হিসেব হয়নি, যুবর ছেলেদের নিয়ে বসা বাকি, মহিলা সমিতিতে একটা ফ্যাচাং চলছে, ভোটার লিস্ট স্ক্রুটিনি নিয়ে মিটিং না করলে পরে চাপ পড়ে যাবে, কলেজের ছাত্রদের ইনভলব করবার জন্য ওদের নিয়ে এখনই বসতে হবে। এরকম হাজার কাজের কথা মনে পড়ে যেত। সেই সময় রাতে বাড়ি ফেরাটা কোনও উদ্বেগের ছিল না। এলাকা ছিল হাতের মুঠোয়। ভদ্রলোক তো বটেই চোর-ডাকাতরাও পার্টির লোকদের সমীহ করত। লোকাল থানার টহলদারি ভ্যান পার্টি অফিসের দূরে দাঁড়িয়ে নজর রাখত, নেতাদের যাতে সমস্যা না হয়। পর পর দু’বার ভোটে হারবার পর সবটাই উলটে গেছে। বিশেষ করে দ্বিতীয়বার পরাজয় জোর ধাক্কা হিসেবে এসেছে। এই ধাক্কা শুধু পরাজয়ের নয়, পরিকাঠামোগত অনেক সমস্যা তৈরি করেছে। ভোটের আগে পার্টি তাও অনেক নড়েচড়ে বসেছিল। কর্মী-সমর্থকরা পথে বের হচ্ছিল, পার্টি অফিসে ভিড় করছিল। ক্ষমতায় ফেরবার আশায় এই উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল। সেই উদ্দীপনা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে। এখন বেশি রাত পর্যন্ত পার্টির কাজ করবার প্রশ্নই ওঠে না। সেফ নয়। রাতে পার্টি অফিসে বসে মিটিং করবার সময় সতর্ক থাকতে হয়। কে কখন বোমা মেরে, আগুন ধরিয়ে দিয়ে যাবে, তার ঠিক নেই। অনেক জায়গায় ব্রাঞ্চ, লোকাল অফিসগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মুখে বলে দেওয়া হয়েছে, অফিসে বসে কাজকর্ম দিনের বেলায় সেরে ফেলতে হবে। সরাসরি কনফ্রনটেশনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। পুলিশ, পাড়ার লোক কেউই এখন পাহারা দেবে না। সমস্যা হল, শুধুই অন্য দলের লোক হামলা চালাচ্ছে না, কোনও কোনও এলাকায় দলের পুরোনো বিক্ষুব্ধ সমর্থকরাও সুযোগ নিচ্ছে। তারাও অন্য দলের নামে হামলা করে যাচ্ছে বলে খবর আসছে। বড় সমস্যা হল আক্রমণ ঠেকাবার মতো লোক নেই। দলে লোক কমছে। কলকাতার বাইরে এরকম কয়েকটা ঘটনা ঘটছে। শেখর কিন্তু নিজের এলাকার পার্টি অফিস সন্ধের পরেও খুলছে। এই নিয়ে অন্য নেতাদের সঙ্গে তার মতের পার্থক্যও হয়েছে। কেউ কেউ আপত্তি করেছিল।
‘শেখরের এত সাহস দেখানোর কিছু হয়নি। পরিস্থিতি যেমন বলছে, তেমনভাবেই চলা উচিত। পার্টির লোকেরা মরলে এখন আর কেউ শহিদ বলবে না। সামনে ভোটও নেই। বরং যে দু-পাঁচজন সঙ্গে আছে, তারাও ঘাবড়ে যাবে।’
শেখর এ কথা শোনেনি।
‘মার খেতে হলে খেতে হবে। তার জন্য শহিদ সাজাবার দরকার নেই। কাউকে ধরবারও প্রয়োজন নেই। নিজেরা দাঁড়িয়ে থেকে মার খাব। পার্টি অফিসটা আমাদের, সেটা শুধু একটা ঘর নয়, ক্লাবের মতো গুলতানি দেওয়ার জায়গা নয়। তার সঙ্গে ভাবনাচিন্তা, নীতি, আদর্শ জড়িয়ে আছে। সেখান থেকে কেউ সরাতে গেলে অত সহজে সরব কেন? ভেঙে দিলে, পুড়িয়ে দিলে কী এসে যায়? আদর্শ-নীতি তো ভাঙা যায় না, পোড়ানো যায় না।’
‘শেখর, এ সব জ্বালাময়ী ভাষণ ভোটের সময় ভালো লাগে। রাতের অন্ধকারে এসে মারধোর করবে, তখন ভালো লাগবে না। হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হব নাকি?’
শেখর রেখে গিয়ে বলেছে, ‘হাসপাতালে যেতে হলে যেতে হবে। যার ইচ্ছে সে আসবে। যার নীতি-আদর্শ ভেঙে যাওয়ার থেকে হাত-পা ভেঙে যাওয়ার বেশি ভয়, সে আসবে না। বলতে লজ্জা নেই, একদল নেতা, কর্মী, সমর্থক একসময় পার্টি অফিসটাকে পাড়ার ক্লাবের মতো ব্যবহার করতেন। সন্ধেবেলা অফিস সেরে, স্নান করে, পাউডার মেখে আড্ডা দিতে আসতেন। পাওয়ারের সঙ্গে খানিকটা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে গেলাম। পাড়ায় একটা সুবিধে হবে, অফিসে ট্রান্সফার আটকানো যাবে, ছেলেমেয়েকে এমএলএ, এমপি ধরে ভালো স্কুল-কলেজে ভর্তি করা যাবে। গত পাঁচ বছর ধরে সে সুবিধে না থাকায় আসা-যাওয়া কমে গিয়েছিল। ভোটের আগে আবার খানিকটা জমেছিল। যদি ক্ষমতা ফিরে আসে, এখন আবার কমেছে। এদের পার্টি অফিসে এসে ভিড় না করাই মঙ্গল। সরি, আমি এইসব কর্মী-সমর্থকদের জন্য পার্টি অফিসে তালা দিতে পারব না।’
কেউ কেউ মাথা নামিয়ে বলেছে, ‘শুধু অন্য দলের লোক নয়, আমাদের ওপর খেপে থাকা পাবলিকও পেটাবে।’
মুখে এত কথা বললেও রাত করা বন্ধ করে দিয়েছে শেখর। সত্যি যদি কোনও হামলার ঘটনা ঘটে আর তাতে কেউ আহত হয়, তা হলে দায়িত্ব তার ঘাড়েই পড়বে। যদিও হামলা দিনের আলোতেও হতে পারে। তাও এই পরিস্থিতিতে সাবধানে থাকাই উচিত।
এখন কি এক কাপ চা খাবে? না থাক, তমসা ছেলেকে খাইয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে। শান্তর কাল পরীক্ষা। শান্ত সে ঠিকমতো স্কুল যাচ্ছে, পরীক্ষা দিচ্ছে, এটাই যথেষ্ট। তমসাও স্কুলে যাচ্ছে। ভোটের ফল ঘোষণার সময় মনে হয়েছিল, পাড়াছাড়া হতে হবে। সেসব হয়নি। স্কুলে তমসাকে একটু বিদ্রুপ শুনতে হয়েছে এইটুকু যা। জিওগ্রাফির টিচার সুচরিতা নাগ বলেছেন, ‘কী তমসা, তোমরা যে বললে এত মহিলা রোজ রেপড হচ্ছেন? মেয়েরা পথে বেরোতে পারছেন না। সে সবের কী হল? তাঁরা কাকে ভোট দিলেন?’
তমসা উত্তর দিয়েছিল, ‘ভোটে জিতলেই ঘটনা মিথ্যে হয়ে যায় না সুচরিতাদি। মেয়েদের প্রতি অসম্মান, অন্যায়, অত্যাচার হয়েছে সেগুলো সবসময়ই সত্যি হয়ে থাকবে।’
সুচরিতাদি বললেন, ‘আহা, আমি তা বলিনি তমসা। আমি বলিনি, মেয়েদের ওপর অত্যাচার হয়নি। আমি বলছি, তারপরেও মহিলারা ভোটটা কাকে দিল?’
তমসা কথা বাড়ায়নি। বাড়িতে এসে শেখরকে বলতে সে বলল, ‘গায়ে মেখো না।’
তমসা চুপ করে থেকে বলেছিল, ‘সুচরিতার বিদ্রুপ যতটা অপমানের তার থেকে বেশি অপমানের কথাটার ঠিক মতো জবাব দিতে না পারা। সত্যি যদি মহিলাদের প্রতি অপমান, অসম্মান বেশি হয়, তা হলে মহিলারা কেন বিরুদ্ধে ভোট দিল না?’
শেখর চিন্তিতভাবে বলল, ‘পার্টি নিশ্চয় বিষয়টা নিয়ে ভাববে। আমরা কি মানুষকে বোঝাতে পারলাম না? নাকি মানুষ আমাদের কথা বুঝতে চাইলও না? আবার এমনটাও হতে পারে, আমরা বেশি প্রচার করেছি। মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যা মেলেনি। এই ধরনের স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে প্রচারের আগে দশবার ভাবা উচিত, কতটা যাব। এরপর যখন সত্যি ঘটনাগুলো ঘটবে তখন আর মানুষ আমাদের বিশ্বাস করবে না। বুঝতে চাইবে না।’
তমসা বলল, ‘কেউ বোঝেনি বললে কী করে হবে? অনেক মানুষ তো বুঝেছেও।’
শেখর বলল, ‘তারপরেও বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।’
না, এখন আর চা নয়। তমসাকে করতে হবে। শেখর কবিতার বইটা আবার টেনে নিল।
ছিল বটে সেই সব দিন।
বুদ্ধি ছিল প্রতিবন্ধ,
ছিল ফুলহীন পুষ্পগন্ধ—
ঐতিহ্য নবীন।
তমসা ঘরে ঢুকল। বরের কাছে এসে বলল, ‘কী পড়ছ?’
শেখর বই উলটে দেখাল। বলল, ‘পড়ে দেখো, ভালো লাগবে।’
তমসা বলল, ‘আচ্ছা পড়ব।’
শেখর বলল, ‘না, থাক। খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব।’
তমসা শেখরের কাঁধে হাত রেখে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?’
শেখর বলল, ‘না, একটু টায়ার্ড ফিল করছি। লম্বা মিটিং ছিল।’
তমসা গলায় সামন্য বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘এবার এ সব কমাও। আমিও সব কমিয়ে দেব ঠিক করেছি।’
শেখর মুখ ঘুরিয়ে বউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেন? পার্টি ভোটে হেরে গেছে বলে?’
তমসা বলল, ‘ঠিক উলটো। হেরে গেছে বলে পার্টির হা হুতাশ দেখে ঘেন্না হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই পার্টির জন্ম হয়েছিল, শুধু ইলেকশনের জন্য। পার্টির যার সঙ্গে দেখা হয়, সেই মুখ শুকিয়ে বলে, কী হল বলো তো। যেন পার্টির নীতি-আদর্শ সব বরবাদ হয়ে গেছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।’
শেখর অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ‘বড় আঘাত তো বটেই।’
তমসা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজ তোমার কী হয়েছে বলো তো। মিটিংয়ে ঝগড়া হয়েছে।’
শেখর শান্ত ভাবে বলল, ‘কিছু হয়নি। মিটিংয়ে তর্ক-বিতর্ক তো লেগেই থাকে। কমিউনিস্ট পার্টিতে তর্ক-বিতর্কটাই আসল।’
শেখর মুখে যাই বলুক, আজকের তর্ক অন্য দিনের মতো নয়। সে যথেষ্ট শক্ত মনের মানুষ। কিন্তু আজ তার মন ভেঙেছে। মিটিংয়ে তর্ক শুরু হয়েছিল বিজয়ের সঙ্গে, পরে সৌমাল্য, ঋত্বিক, প্রশান্তদা জয়েন করে। মিটিংয়ে স্থানীয় ভাবে পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করা হচ্ছিল। কেন এই এলাকার পার্টি এত কম ভোট পেল তাই নিয়ে রিপোর্ট চেয়েছে জেলা কমিটি। ভোটের প্রচারে স্থানীয় ইস্যুতে কোনও ফাঁক ছিল কি না, মানুষের মন বুঝতে কোথাও অসুবিধে হয়েছে কি না, পার্টির কর্মীরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছিল কি না। শেষ পর্যন্ত শেখরকে সবাই মিলে আক্রমণ করল। এমনকী এতদিন তার গোষ্ঠীতে যারা ছিল তারাও ছেড়ে কথা বলেনি। তমসার স্কুলের সুচরিতাদির প্রশ্নের মতো অনেক প্রশ্নের উত্তর শেখরও দিতে পারেনি।
বিজয় বলল, ‘পার্টির কর্মী-সমর্থকরা মানুষের মন বোঝবার থেকে আজও অনেক বেশি করে লিডারের মন বুঝতে ব্যস্ত থাকে। লিডার কী চাইছে, লিডার কী বলছে। লিডারের মন জুগিয়ে চললে পার্টিতে পজিশন থাকবে। গত পরাজয় থেকে কর্মীরা কোনও শিক্ষাই নেয়নি। আমাদের এখানেও তাই হয়েছে। শেখর বলে দিয়েছিল, ভোটের প্রচারের সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের মন বুঝতে হবে। আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়েছি। মানুষের মন বুঝতে পারিনি। কিন্তু শেখরকে রিপোর্ট করেছি উলটো। তাকে খুশি রাখতে হবে যে।’
শেখর বলে, ‘এটা যে করেছে সে পার্টি বিরুদ্ধ কাজ করেছে। আমাকে নয়, পার্টিকে মিসগাইড করেছে।’
বিজয় বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, ‘এ সব বইয়ের কথা এবার বাদ দাও শেখর। এখানে পার্টি কে? পার্টি তো তুমি। আমরা যদি এসে বলতাম, মানুষের মন বুঝতে পারিনি, তুমি খুশি হতে?’
শেখর বলে, ‘আমি সত্যিটা জানতে পারলাম না। গতবারের মতো এবারও জেলাকে ভুল রিপোর্ট দিয়েছি। বলেছি, জিতব। সেটা আপনাদের ভুল রিপোর্টের জন্য হল।’
সৌমাল্য তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘বা:, এটা তো মন্দ নয়। সব আমাদের দোষ শেখরদা? আর আপনি সেক্রেটারি হয়ে কোনও দায় নেবেন না?’
শেখর বলল, ‘অবশ্যই নিচ্ছি। আলটিমেট তো সেক্রেটারির রেসপন্সিবিলিটি।’
প্রশান্তদা দুম করে বলল, ‘এ সব অনেক শুনেছি, গতবার থেকেই শুনছি। ভুল রিপোর্ট পাঠানোর জন্য কোন নেতার শাস্তি হয়েছে বলো তো শেখর? পার্টি খারাপ রেজাল্ট করলে, সেক্রেটারির শাস্তি হবে না কেন? সে কে? কেন তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে না?’
শেখর চুপ করে রইল। এ সব তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হচ্ছে। ঋত্বিক বলল, ‘কজন সেক্রেটারিকে সরানো হবে? সর্বত্র তো হার হয়েছে।’
প্রশান্তদা উত্তেজিত গলায় বলল, ‘যারা ভুল রিপোর্ট দিয়েছে তাদের সবাইকে সরানো উচিত। নেতা হওয়ার তো কারও পৈতৃক অধিকার নয়। পার্টি তো কারও জমিদারি নয়। তুমি পারোনি, একবার নয়, বারবার পারোনি। তা হলে তুমি সরে যাও। আর একজনকে সুযোগ দাও। এরা পার্টির হিরো নয়, ভিলেন?’
শেখর কড়া গলায় বলল, ‘আপনি কিন্তু বেশি মাত্রায় উত্তেজিত হচ্ছেন প্রশান্তদা। এ ভাবে পার্টিতে মিটিং হয় না। একটা ডিসিপ্লিন আছে।’
বিজয় ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ‘রাখো তোমার ছড়ি ঘোরানো ডিসিপ্লিন। পার্টির নেতা মানে বস নয়। সাধারণ মানুষ আর কর্মীদের ঘাড়ে দোষ চাপানোর নাম ডিসিপ্লিন? এই জন্যই তো এই হাল। নেতাদের উচিত ছিল নিজে থেকেই সরে যাওয়া।’
শেখর বলল, ‘এই মিটিং লোকাল কমিটির সেক্রেটারি সরানোর জন্য ডাকা হয়নি।’
প্রশান্তদা বলল, ‘পরাজয়ের কারণ নিয়ে আলোচনা করতে হলে নেতার ব্যর্থতা নিয়েও বলতে দিতে হবে। অনেক সহ্য করেছি, আর করব না। পার্টি কারও পিতৃদেবের নয়।’
সৌমাল্য বলল, ‘তুমি একা কেন শেখরদা, দায় আমরাও নেব। বোঝাতে পারিনি, মানুষকে বোঝাতে পারিনি তাহলে আর কেন পার্টি করছি? শুধু অন্য দলকে গাল দিয়েছি। দিয়ে খুশি থেকেছি। নিজেদের পায়ের তলার মাটি নিয়ে ভাবিনি।’
বিজয় বলল, ‘আসলে পার্টির ক্লাস ক্যারেকটারটাই বদলে গেছে। তারাই এখন পার্টিকে সাপোর্ট করছে যাদের মোটা মাইনের চাকরি আছে, বড় লাভের বিজনেস আছে। বাড়িতে ফ্রিজ, এ সি আছে। গাড়ি আছে। তারা সব আমাদের পার্টির লোক। তারাই আমাদের কাছে এসেছে যারা নিজেদের ডি এ, এ টি, বোনাস নিয়ে ব্যস্ত। আরও চাই, আরও চাই। লাখ টাকার রোজগারিরা আমাদের এবারও ভোট দিয়েছে। অথচ কমিউনিস্ট পার্টিটা তৈরি হয়েছিল গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের জন্য। যার কিছু নেই তারা ছিল পার্টির নেতা।’
শেখর আর নিজেকে সামলাতে পারল না। বলে বসল, ‘আমারও কিছু নেই। আমি একজন হোলটাইমার।’
বিজয় ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বলল, ‘এটা কী বলছ শেখর! তোমার স্ত্রী একজন সরকারি স্কুল শিক্ষক। কত টাকা বেতন পান তুমিই ভালো করে জানো। এরপরেও নিজেকে সর্বহারা বলে চালাও, গরিব মানুষরা হাসবে।’
শেখর কঠিন গলায় বলল, ‘তমসা নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছে।’
বিজয় বলল, ‘আমি তো বলিনি, তাকে কেউ চাকরি করে দিয়েছে। সে নিজের যোগ্যতাতেই লেখাপড়া শিখে কাজ পেয়েছে, আমি বলছি, দয়া করে তুমি নিজেকে দরিদ্র বলো না শেখর। পরিবারের উপার্জনটা মাথায় রেখে নিজের শ্রেণি চরিত্র বিচার করো। এটাই নিয়ম।’
শেখর বলল, ‘তা হলে দরিদ্র না হলে তাকে নেতাই করা যাবে না।’
বিজয় বলল, ‘জানি না করা যাবে কি না, কিন্তু একজন জমিহারা কৃষক, একজন বন্ধ হাওয়া কারখানার শ্রমিক নেতৃত্বে না থাকলে গরিব মানুষ আমাদের সঙ্গে থাকবে কেন? নেইও। তারা উলটো দিকে চলে গেছে। যে দলকে কোনও লাখপতি সমর্থন করছে, তাকে কিছুতেই কপর্দকহীন একজন মানুষ বিশ্বাস করতে পারে না। পার্টি চরিত্র হারাচ্ছে। এটা আগে বোঝো শেখর।’
মিটিং এখানেই বন্ধ করে দিতে হয় শেখরকে। স্পষ্ট তার বিরুদ্ধে অনাস্থা। অনাস্থা হবে নাই বা কেন? সত্যি তো তার নিজের দায়িত্ব সবথেকে বেশি। বড় বড় কথা শুধু দলের কর্মীদের বলেছে। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেনি। আর করলেও বা কী হত? হয়তো ভোটে জিতত। কিন্তু ক্লাস ক্যারেকটার? তার উত্তর কী?
রাতে শোওয়ার পর তমসা কাছে এল। শেখরের পাশে বসে জামা খুলতে খুলতে গাঢ় গলায় বলল, ‘এসো। আজ তুমি খুব অস্থির। আমার কাছে এসে শান্ত হও।’
শেখর তমসার নগ্ন বুকে মুখ রেখে ফিসফিস করে বলল, ‘ভালো লাগছে না। কিছু ভালো লাগছে না তমসা।’
তমসা শেখরের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘চলো, কদিন কোথাও ঘুরে আসি। ফিরে এসে ভুল শুধরে আবার কাজ শুরু করবে। করতেই হবে।’
সাতান্ন
বিমলকান্তি নিজের অফিসঘরে চুপ করে বসে আছেন। তিনি যেন খানিকটা ঘোরের মধ্যে আছেন।
কর্ণিকা দরজা সরিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘স্যর, আসব?’
বিমলকান্তি মাথা নাড়লেন। কর্ণিকা ঘরে ঢুকে বলল, ‘স্যর, বাড়ি যাবে না?’
বিমলকান্তি ঘোর কাটিয়ে হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলেন। চাপা বললেন, ‘যাব। তুমি চলে যাও কর্ণিকা। ইস, তোমাকে অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। তোমার এখন কত কাজ।’
কর্ণিকা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বিমলকান্তি বললেন, ‘দাঁড়িয়ে আছ কেন?’
কর্ণিকা চুপ করেই রইল। বিমলকান্তি এবার হালকা বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘কী হল। বললাম তো চলে যাও। তোমার দেরি হয়ে গেছে। গাড়ি আছে তো?’
কর্ণিকা মৃদু গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, স্যর আছে।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘তাহলে আর দেরি কোরো না। বাড়িতে ফোন করে দিয়েছ?’
কর্ণিকা মাথা নীচু করে বলল, ‘দিয়েছি।’
বিমলকান্তি এবার বেশ বিরক্ত হলেন। গলা একটু কঠিন করে বললেন, ‘আমার নিজের কিছু কাজ আছে কর্ণিকা। সেই কাজ আমাকে একা করতে হবে।’
কর্ণিকা বসের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের টেবিলে এসে বসল। আটটা বাজে। অফিস ফাঁকা। অ্যাকাউন্টসে দুজন আছে। কাল মাল ডেলিভারি আছে। চালান তৈরি করছে। কর্ণিকা মোবাইলে নম্বর টিপল। ওপাশে ফোন ধরল বারিধারা।
‘কী হয়েছে কর্ণিকা?’
কর্ণিকা নীচু গলায় বলল, ‘স্যর তো উঠছেন না। এই মাত্র আমি গিয়ে রিকোয়েস্ট করলাম।’
বারিধারা চিন্তিত গলায় বলল, ‘কী করছে বাবা?’
কর্ণিকা তার বসের দরজার দিকে তাকিয়ে গলা আরও নামিয়ে বলল, ‘কিছু করছে না। চুপ করে বসে আছে। বুঝতে পারছি খুব মনখারাপ।’
বারিধারা টেলিফোনের ওপাশে একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘মন খারাপ তো হবারই কথা। খুব বড় ধাক্কা…।’
কর্ণিকা বলল, ‘তুমি একবার ফোন করবে?’
বারিধারা বলল, ‘করছি। কিন্তু আমার কথা শুনে বাড়ি চলে আসবে বলে মনে হচ্ছে না।’
কর্ণিকা বলল, ‘তাও একবার কোরো। নইলে ম্যাডামকে বোলো। স্যরের উচিত বাড়িতে গিয়ে রেস্ট করা।’
বারিধারা চিন্তিত গলায় বলল, ‘দেখছি। সেরকম হলে আমি অফিসে গিয়ে বাবাকে গিয়ে নিয়ে আসছি। কর্ণিকা, তুমি বাড়ি চলে যাও। তোমার অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
কর্ণিকা একটু চুপ করে থেকে দৃঢ় গলায় বলল, ‘আমি থাকব। স্যার যতক্ষণ থাকবেন, আমিও থাকব। তুমি স্যারকে ফোন কোরো।’
গত দু দিন ধরে ভয়ঙ্কর অবস্থা চলছে।
বুধবার সকালে অফিসে এসেই কর্ণিকা সোজা চলে গিয়েছিল এইচ আর ডিপার্টমেন্টে। রেজিগনেশন লেটার জমা দেয়। এইচ আর হেড চিঠি পড়ে তো আকাশ থেকে পড়লেন। একরকম চেপে ধরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কর্ণিকার কাছ থেকে সব খবর বের করলেন। কীভাবে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। সে কী করে? বিয়ের পর কর্ণিকা কী করবে? শুধু ঘরসংসার? নাকি কাজেকর্মে ঢুকবে? কর্ণিকার মনে হচ্ছিল, পালাতে পারলে বাঁচি।
বিমলকান্তি আসবার পরেই সেই চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হল তার টেবিলে। বিমলকান্তি চিঠি পড়ে কর্ণিকাকে ঘরে ডেকে পাঠান। কর্ণিকা দুরু দুরু বুকে ঘরে ঢোকে। যতই হোক, ফট করে কাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। স্যর নিশ্চয় বিরক্ত হবেন। গম্ভীর বিমলকান্তি একগাল হেসে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
‘কনগ্র্যাচুলেশন কর্ণিকা। খুব ভালো খবর। তুমি বিয়ে করে বাইরে চলে যাচ্ছ এবং সেখানে নতুন করে কর্মজীবন শুরু করছ জেনে খুব খুশি হলাম।’
কর্ণিকা প্রথমে বাড়ানো হাত ছুঁয়ে, তারপর টেবিল ঘুরে এসে বসকে প্রণাম করে।
বিমলকান্তি বললেন, ‘বিয়েতে কিন্তু জমিয়ে খাওয়াদাওয়া চাই। মাকে বলবে।’
কর্ণিকা চোখের জল সামলে বললেন, ‘অবশ্যই স্যর।’
বিমলকান্তি এর পর পাত্র সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। কর্ণিকা লজ্জায় মুখ লাল করে ছোট ছোট বাক্যে উত্তর দেয়।
‘আমি এত তাড়াতাড়ি রাজি হচ্ছিলাম না স্যর…মা জোর করলেন…।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘এটা তো শুধু বিয়ে নয়, বাইরে গিয়ে নিজের মতো কাজ করতে পারবে, সেটাও খুব বড় কথা। আমাদের দুর্ভাগ্য, মেয়েদের বেলায় আমরা বিয়ে-টিয়েগুলো খুব বড় করে দেখি। কাজটাকে দেখি না। তুমি সেই সুযোগ পেলে।’
কর্ণিকা আবেগ সামলে বলল, ‘থ্যাঙ্কু স্যর।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘সবথেকে বড় কথা সিরিয়াস হওয়া। তুমি সিরিয়াস বলেই বিয়েটাকে যেমন সিরিয়াস ভাবে নিয়েছ, এই কাজটাকেও নিয়েছ। যখন নতুন জীবনে ঢুকতে হয়, তখনও যেমন সিরিয়াস হতে হয়, যে জীবন ছেড়ে যাচ্ছ, তার প্রতিও সিরিয়াস হতে হয়। তুমি চলে গেলে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের যেমন ক্ষতি, আমারও পার্সোনাল ক্ষতি হবে। কিন্তু এটাই তো নিয়ম মাই ডটার।’
কথা শেষ করে হাসলেন বিমলকান্তি।
কর্ণিকা এবার নিজেকে সামলাতে পারল না। তার চোখে জল।
বিমলকান্তি বললেন, ‘তোমার মায়ের সঙ্গে আমি কথা বলব। মণিকুন্তলা, বারিধারাকে নিয়ে যাব।’
কর্ণিকা আবেগবিহ্বল গলায় বলল, ‘খুব ভালো হবে স্যর।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘ছেলেটির সঙ্গেও আমি কথা বলতে চাই। ফোনে ধরিয়ে দেব।’
কর্ণিকা কী বলবে বুঝতে পারছে না। এটা যেন একটা অন্য বিমলকান্তি সেন। যে মানুষটা কঠিন, মূলত রাগী, অফিসে ব্যক্তিগত কথাবার্তা মোটে পছন্দ করেন না, তাঁকে মনে হচ্ছে পরম আত্মীয়। যেন নিজের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। আজ আবার প্রমাণ হল, বাইরে থেকে একজন মানুষকে যতটা দেখা যায়, সেটা মানুষটার একটুখানি। বাকি বিশাল অংশটা থাকে ভিতরে। ভালোবাসা, স্নেহ, আদর মানুষ চট করে কাউকে দেখাতে চায় না। পছন্দের মানুষের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। কর্ণিকার নিজেকে পরম সৌভাগ্যবতী বলে মনে হল…।’
‘স্যর, আপনার অসুবিধে হবে…।’
বিমলকান্তি হেসে বললেন, ‘তোমার আগামী কর্মজীবন যদি সাকসেসফুল হয়, তাহলে কিন্তু আমার সুবিধে হবে কর্ণিকা। আমি বুঝতে পারব, একটা কোম্পানি চালাতে এসে আমি মানুষ চিনতে ভুল করিনি। তোমার মতো কম বয়েসের একজন মেয়েকে যখন গুরুদায়িত্বে বসিয়েছিলাম, তখন ভাবিনি। কেউ আপত্তি করবার সাহসও পায়নি। কিন্তু সংশয় ছিল, তুমি পারবে কিনা। তুমি পেরেছ।’
কর্ণিকা অস্ফুটে বলল, ‘থ্যাঙ্কু স্যর।’
‘কবে তুমি রিলিজ চাইছ?’
কর্ণিকা মাথা নামিয়ে দ্বিধা জড়ানো গলায় বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘ফাইন। আমি এখনই বলে দিচ্ছি। কাল থেকেই তুমি ছুটিতে চলে যাও। পরে এসে হিসেব-টিসেব বুঝে নিও।’
কর্ণিকা একটু বাধো বাধো করে বলল, ‘স্যর, আমি কি কাউকে চার্জ বুঝিয়ে দেব?’
বিমলকান্তি হেসে বললেন, ‘তুমি চলে গেলে এই পোস্টটা থাকবে কিনা, এখনও ভাবিনি। ডোন্ট ওয়ারি মাই ডটার। আমি সামলে নেব।’
বসের ঘর থেকে কর্ণিকা বেরিয়ে আসবার একটু পরেই বারিধারা তাকে ফোন করে অভিনন্দন জানাল।
‘দারুণ খুশির খবর পেলাম কর্ণিকা। আমি কিন্তু তোমার কাছে বেড়াতে যাব।’
কর্ণিকা বলল, ‘অশব্যই যাবে। তার আগে আমি আর মা তোমাদের বাড়ি যাচ্ছি।’
বারিধারা বলল, ‘না এলেও কোনও সমস্যা নেই। আমি তোমার বিয়েতে তিনদিন খাব। নেমন্তন্নে খাওয়ার থেকে নেমন্তন্ন ছাড়া খেতে বেশি মজা। খাবারের টেস্ট বেশি পাওয়া যায়।’
দুজনেই খুব হাসতে লাগল। ফোন ধরলেন মণিকুন্তলাও।
‘অনেক আশীর্বাদ কর্ণিকা। খুব ভালো হল।’
কর্ণিকা লজ্জা পাওয়া গলায় বলল, ‘এভাবে করলে হবে না ম্যাডাম, এসে করতে হবে।’
একটু পরে মেঘবতীও ফোন করল। ফোন করে ফিচ করে একটু যেন কেঁদেও ফেলল।
‘তুমি বাবাকে যেভাবে দেখতে…চলে গেলে কী যে হবে…তুমি বয়সে ছোট, তার পরেও বলি, আমরা তোমার কাছে খুবই গ্রেটফুল কর্ণিকা…।’
কর্ণিকা নিজেকে কোনও রকমে সামলে বলল, ‘অমন করে বলো না দিদি। আমি আমার ডিউটি করেছি মাত্র। তবে চিন্তা করো না, স্যর নিশ্চয় আমার থেকে অনেক এফিসিয়েন্ট কাউকে খুঁজে পাবেন।’ ফোন ছেড়ে দিয়ে কর্ণিকার ভীষণ ভালো লাগল। সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের মালিকের বাড়ির মানুষ সে নয়, সামান্য কর্মচারীর সুখবরে তারা যেভাবে খুশি, এটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এমন কি আজকাল হয়? না, হয় না। কর্পোরেট জীবন মানুষের এই সব আবেগ, কৃতজ্ঞতা কেড়ে নিয়েছে। মানুষ আর পুরো মানুষ নেই। সভ্যতার জন্য, এগিয়ে চলবার জন্য সেটাই হয়তো ঠিক। সেটাই উচিত। তবে তাতে উপার্জন করা যায় বেশি কিন্তু ঠিকমতো বাঁচা যায় না। কর্মজীবনটাও তো বাঁচার মধ্যে পড়ে। আসলে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এখনও পাকা মাথার কর্পোরেট হয়ে উঠতে পারেনি। এখনও সে পারিবারিক ব্যবসা। পরিবারের স্নেহ, মমতা জড়িয়ে আছে। কর্ণিকা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সে যেখানেই থাক, এই কোম্পানিকে সে ভুলবে না।
বিমলকান্তি কর্ণিকার রেজিগনেশন লেটারের ওপর নোট দিয়ে এইচ আর ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিলেন। টাকা-পয়সার হিসেব দ্রুত তৈরি করতে বললেন। কর্ণিকা বিদেশে চলে যাবে। তার পক্ষে বার বার এসে ছোটাছুটি করা সম্ভব নয়। মেয়েটাকে কি বেশি কিছু দেওয়া যায় না? না, সেটা ঠিক হবে না? কোম্পানির নিয়ম সবার জন্য সমান। বিয়ের উপহার হিসেবে যা দেওয়া হবে সেটা সেনবাড়ির পক্ষ থেকেই যাবে, অফিস থেকে নয়।
সারাদিনের কাজের মধ্যেই বিমলকান্তি এক ধরনের তৃপ্তি অনুভব করলেন। এইটুকু মেয়েকে বড় দায়িত্ব দেওয়ার সময় তিনি সংশয়ের মধ্যে ছিলেন, কিন্তু ভুল করেননি। কর্ণিকা বিয়ে করবার সময় বিদেশ দেখেনি, তার কাজকে যে পছন্দ করেছে তাকেই গ্রহণ করেছে। খুব ভালো।
বিমলকান্তি এই সময় কফি খান না। তার পরেও ক্যান্টিনে ফোন করে কফি পাঠাতে বললেন। কফি আসবার সামন্য পরেই থানা থেকে ফোন আসে।
‘বিমলকান্তি সেন বলছেন?’
‘বলছি।’
‘নিখিলেশ উপাধ্যায় নামে আপনাদের কোম্পানিতে কেউ কাজ করেন?’
বিমলকান্তি উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘কাজ করেন মানে, উনি খুব সিনিয়ার, আমার বাবার বন্ধু, আমাদের অ্যাডভাইসার। কেন কী হয়েছে?’
টেলিফোনের ও প্রান্তে পুলিশ অফিসার একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘একটা ব্যাড নিউজ আছে মিস্টার সেন।’
বিমলকান্তি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘অ্যাকসিডেন্ট?’
‘না, হি ইজ মার্ডারড। তাকে খুন করা হয়েছে।’
বিমলকান্তি দু হাতে ফোন চেপে ধরে কাঁপা গলায় বললেন, ‘কী বলছেন?’
‘আপনাকে একবার আসতে হবে মিস্টার সেন। বডি আইডেনটিফাই করতে হবে। তবে অমরা মার্ডারারকে ট্র্যাক করে ফেলেছি। আশা করি আজ-কালকের মধ্যে ধরে ফেলব।’
বিমলকান্তি বিহ্বল গলায় বললেন, ‘কে? ওর মতো একজন ভালোমানুষকে কে খুন করল…।’
‘থানায় আসুন, যতটা জানতে পেরেছি বলব। একজন মহিলা কাজটা করেছে।’
এই ক’টা দিন ঝড়ের মতো কেটে গেল। মর্গ, পুলিশ, পোস্টমর্টেম। উপাধ্যায়ের একমাত্র মেয়ে বেঙ্গালুরু থেকে এলেন। পুলিশ কয়েকবার অফিসে এল। তবে খুনি পরদিনই ধরা পড়েছে। থানায় গিয়ে বিমলকান্তি তাকে দেখেছেন। পুলিশই ব্যবস্থা করেছিল। বিমলকান্তি তাকে চিনতে পারেননি। বয়স্ক মহিলা খুব স্বাভাবিক ভাবে হাত তুলে তাকে নমস্কার জানিয়েছেন। বিমলকান্তি অবাক হন। এই মানুষ নিখিলেশ উপাধ্যায়কে খুন করেছে। কেন? কোর্টে হাজিরা দিয়ে পুলিশ পাঁচ দিনের জন্য মহিলাকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে। মহিলার নামে নাকি আরও অনেক মামলা আছে। আরও তদন্তের দরকার। মহিলা নিখিলেশ উপাধ্যায়কে হত্যার ব্যাপারে কিছুতেই মুখ খুলছেন না। শুধু বলছেন, ‘পুরোনো রাগ।’ পুলিশ বিশ্বাস করছে না। তাদের সন্দেহ, এই ঘটনার সঙ্গে সেন এন্ড অ্যাসোসিয়েটসের কোনও যোগসূত্র আছে।
তদন্তে কী কী জানা যাচ্ছে, নিয়মিত পুলিশ বিমলকান্তিকে জানাচ্ছে।
চাকরি ছেড়ে দিলেও কর্ণিকা অফিস রিলিজ অর্ডার নেয়নি। বিয়ে তো অতি সামান্য ব্যাপার। মরে গেলেও সেই ভয়ংকর অবস্থায় ‘স্যার’কে ছেড়ে, অফিস ছেড়ে যাবে না। বাড়িতে তো বলেছেই, ভাবী শাশুড়িকেও জানিয়ে দিয়েছে। অবস্থা খানিকটা নর্মাল হলে তবে বিয়ের মার্কেটিং হবে। ‘স্যর’ যতক্ষণ অফিসে থাকছে, কর্ণিকাও থাকছে। আজও তাই করছে।
কথা ছিল বারিধারা ফোন করে ‘মনখারাপ’ করা বাবাকে বাড়ি যেতে বলবে। সে নিজেই চলে এল।’
বারিধারাকে দেখে উঠে দাঁড়াল কর্ণিকা।
বারিধারা অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি এখনও বসে আছ?’
কর্ণিকা নীচু গলায় বলল, ‘স্যর না গেলে কী করে বেরোব?’
বারিধারা এগিয়ে এসে কর্ণিকাকে জড়িয়ে ধরল।
আটান্ন
বারিধারা বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে মাথা নামিয়ে বসে রইল। তারপর মুখ তুলে অস্ফুটে বলল, ‘বাবা, তুমি কি পুলিশের কথা বিশ্বাস করছ?’
বিমলকান্তি নীচু গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, করছি। ওরা আমাকে কাগজপত্র দেখিয়েছে। নিখিলেশ উপাধ্যায়ের ব্যাগ থেকে সেই সব কাগজপত্র পাওয়া গেছে।’
বারিধারা বলল, ‘কী আছে, সেই কাগজে?’
বিমলকান্তি একটু থমকে বললেন, ‘থাক। তোর শুনলে খারাপ লাগবে।’
বারিধারা মালিন হেসে বলল, ‘লাগুক, তারপরেও শুনব। সবটাই তো খারাপ।’
বিমলকান্তি ঠিক করেছিলেন, আজকের ঘটনায় কাউকেই কিছু বলবেন না। অফিসে বাড়িতে কোথাও নয়। এখন ছোট মেয়ের অফিসে চলে আসবার পর নিজেকে সামলাতে পারছেন না। মনে হচ্ছে, কাউকে বলা দরকার। মনটা হালকা হবে।
থানা থেকে আজ বিমলকান্তিবাবুকে ডেকে পাঠিয়েছিল। বিমলকান্তিবাবু তখন সবে অফিসে এসেছেন। গুছিয়ে বসাও হয়নি। জরুরি ডেলিভারির ব্যাপার আছে। যে বিরাট আর্ডার একসময় দেরির কারণে বাতিল হয়ে যেতে বসেছিল সেটা ছাড়া হবে। নিখিলেশ উপাধ্যায়ের পরামর্শ মতো চিঠি লিখেই অর্ডারটা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিল। কী অদ্ভুত। সেই মানুষটার মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে পুলিশ ডাকছে! বিমলবাবু সময় চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিকেলের দিকে যদি যাওয়া যায়। থানার অফিসার বললেন, না, এখনই আসতে হবে। বিষয়টা খুবই জরুরি। দেরি করা যাবে না। থানায় যাওয়ার পর অফিসার খাতির করে বসালেন।
‘চা খাবেন মিস্টার সেন?’
বিমলকান্তি ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘না’।
অফিসার বললেন, ‘সরি মিস্টার সেন, আপনাকে জোর করে ডেকে পাঠালাম। বুঝতে পারছি, এখন আপনাদের ব্যস্ততার সময়।’
বিমলকান্তি শুকনো হেসে বললেন, ‘এতে সরির কী আছে? আপনার ডিউটি। করতে তো হবে।’
অফিসার বললেন, ‘কোনও কোনও ডিউটি পরেও করা যায়, কিন্তু এটা করা যাবে না। মনে হচ্ছে, নিখিলেশ উপাধ্যায়ের মার্ডার কেস সলভ করা গেছে।’
বিমলকান্তি আগ্রহ নিয়ে বললেন, ‘তাই? সব জানা গেছে?’
অফিসার একটু হেসে বললেন, ‘মনে হচ্ছে। এবার আপনার কাছ থেকে ছোটখাটো দু-একটা কনফার্মেশনের প্রয়োজন। সেটা পেলেই আমরা কেসটা ফ্রেম করতে পারব। কাল ওই মহিলার কোর্ট প্রাোডাকশন রয়েছে। কাগজপত্র ঠিক করে নিয়ে যেতে না পারলে সমস্যা আছে। আমরা ওকে আমাদের হেফাজতে নিতে চাইছি। মহিলার নামে বহু পুরোনো কেস আছে। মনে হচ্ছে মার্ডার কেসও আছে। স্বামীর সঙ্গে মিলে করেছিলেন। আপনার সাহায্য দরকার। সেই কারণে তাড়াতাড়ি আপনাকে ডেকে পাঠালাম।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘বলুন আমাকে কী করতে হবে।’
অফিসার কাগজপত্র বের করতে করতে বলেন, ‘কাল রাতে ইন্টারগেশনের সময় মহিলা সব বলেছেন। কেন তিনি নিখিলেশ উপাধ্যায়কে খুন করেছেন।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘কেন?’
অফিসার বললেন, ‘দুটো পার্ট আছে। তার মধ্যে একটা হল, আপনাদের কোম্পানিকে ব্ল্যাকমেল করে টাকা নেওয়া।’
বিমলকান্তি অবাক হয়ে বললেন, ‘ব্ল্যাকমেল! আমাদের কোম্পানিকে? সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে? কী বলছেন অফিসার! ওই মহিলাকে কীভাবে ব্ল্যাকমেল করবে?’
অফিসার সামান্য হেসে বললেন, ‘ওই মহিলা মিস্টার সেন, ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছিল নিখিলেশ উপাধ্যায়। এই কাজে বৈশাখী রাজি হননি। এই নিয়ে দু’জনের ঝগড়া হয়।’
বিমলকান্তিবাবু এতক্ষণ সোজা হয়ে বসে অফিসারের সঙ্গে কথা বলছিলেন, এবার চেয়ারে হেলান দিলেন। বিড়বিড় করে বলেন, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
অফিসার এবার সংক্ষেপে গোটা ঘটনা জানান। নিখিলেশ উপাধ্যায় কীভাবে জাল কাগজপত্র তৈরি করেছিল, প্রফেশনাল ব্ল্যাকমেলার হিসেবে বৈশাখীকে অ্যাপয়েন্ট করেছিল, কীভাবে ঝগড়া লাগে—সব।
এরপর ফাইল থেকে কাগজপত্র বের করে বিমলকান্তিকে হাতে দেয়।
বারিধারা বলল, ‘কীসের কাগজ?’
বিমলকান্তিবাবু একটু চুপ করে থেকে বলেন, ‘কোর্টের জাল কাগজ। সেখানে তোর দাদুর সঙ্গে এক মহিলাকে জড়ানো হয়েছে। আমার মা ছাড়াও উনি নাকি একজনকে লুকিয়ে বিয়ে করেছিলেন। ওই মহিলা নাকি তার মেয়ে। সে এসে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের কাছ থেকে সম্পত্তির ভাগ চাইবে।’
বারিধারার হাত-পা কেমন যেন অবশ লাগছে। ভয়ও করছে। দাদু-বাবাকে ঘিরে এত বড় চক্রান্তের জাল ছড়ানো হয়েছিল!
‘এতে নিখিলেশ দাদুর কী লাভ হত?’
বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘জানি না। ওই মহিলা বলেছেন, নিখিলেশ উপাধ্যায় নাকি মাঝখানে এসে বিষয়টা ধামাচাপা দেবে বলে ঠিক করেছিলেন। আমাকে পারিবারিক কেলেঙ্কারির ভয় দেখিয়ে খুব বড় একটা অ্যামাউন্ট মহিলাকে দিতেন! সেখান থেকে ভাগ পেতেন।’
বারিধারা অস্ফুটে বলল, ‘কী ভয়ঙ্কর!’
বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘শুনে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। পুলিশ অফিসার কাগজপত্র দেখাতে বুঝতে পারলাম, ঠিক। ওরা আমার কাছ থেকে নাম, ঠিকানা কনফার্ম করল। আমার এত খারাপ লাগছিল…।’
বারিধারা বুঝতে পারছিল, আজ বাবার মন এত খারাপ কেন। বিশ্বাসঘাতকতা, অকৃতজ্ঞতাই মানুষের সবথেকে বড় অপরাধ। অথচ কত অনায়াসে মানুষ সহজ স্বাভাবিকভাবে এই অপরাধ করে চলে। বুক ফুলিয়ে থাকে। নিখিলেশদাদুকে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস কী দেয়নি! কবে অবসরের বয়স হয়ে গেছে। তারপরেও মাথায় তুলে রেখেছে। বারিধারার চিরকালই মনে হত, কোথাও যেন দাদুর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল। কিন্তু ওই মহিলা এতদূর এগিয়েও কাজটা করলেন না কেন? টাকা-পয়সার দরদাম দিয়ে পোষাচ্ছিল না?
বিমলকান্তি মুখ তুলে মেয়ের চোখে চোখ রাখলেন।
‘ঘটনার দ্বিতীয় অংশটা আরও মারাত্মক বৃষ্টি।’
বারিধারা বলল, ‘বলো।’
বিমলকান্তিবাবু মাথা নামিয়ে টেবিলের ওপর আঙুল দিয়ে খানিকটা আঁকিবুকি কাটলেন। কীভাবে বারিধারাকে কথাটা বলবেন?’
বারিধারা আবার বলল, ‘কী হয়েছে বাবা?’ সে হাত বাড়িয়ে বাবার হাতটা স্পর্শ করল।
বিমলকান্তি মাথা নামিয়েই বললেন, ‘ওই মহিলা…বৈশাখী…উনি অর্চিনের মা।’
বারিধারা বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘কী বলছ বাবা? উনি অর্চিনের মা!’
বিমলকান্তি মুখ তুলে বললেন, ‘হ্যাঁ, বৃষ্টি। পুলিশকে উনি নিজের সব পরিচয় জানিয়েছেন। আমার ধারণা জানাতে বাধ্য হয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওরা নিশ্চয় চাপ দিয়েছিল। পুলিশ জানে কীভাবে কথা বের করতে হয়।’
বারিধারা-মেঘবতীরা অর্চিনের পরিচয় খুব গভীরে গিয়ে জানত না। মামার বাড়ির দিকের দূর সম্পর্কের আত্মীয়, কলকাতায় তাদের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করছে, ব্যস এইটুকুই। এ ব্যাপারে মেয়েরা তাদের মাকে খুঁচিয়ে জিগ্যেস করেনি কখনও। প্রয়োজন হয়নি। ছেলেটা এত ভালো, কিছু নিয়ে কখনওই বেশি কৌতূহল তৈরি হয়নি। তার ভদ্র আচরণে সবাই খুশি ছিল। এই ছেলের মা ওই খুনি মহিলা!
বিমলকান্তিবাবু নীচু স্বরে বললেন, ‘আমরা জানতাম মহিলা একজন প্রফেশনাল ফ্রড। ইমপস্টার। বিয়ের পর অভাবে এই পথ বেছে নিয়েছিলেন। স্বামী একজন ক্রিমিনাল ছিল। বউকেও সেই পথে নিয়ে যায়। বেরোনোর কোনও উপায় ছিল না মহিলার। নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেনি। অর্চিন জন্মানোর পর তাকে নিজের মায়ের কাছে রেখে আসে। তার মা শর্ত দেন। কোনওদিন ছেলেকে নিজের পরিচয় জানাতে পারবে না। বৈশাখীও চাননি, অর্চিন আর মায়ের পরিচয় জানুক। সে জানত মা মরে গেছে। দাদু-দিদার কাছে মানুষ। কলকাতায় পড়বার কথা উঠতে, তোর মা-ই প্রস্তাব দিয়েছিল, ছেলেটা আমাদের বাড়িতে এসে থাকুক। ছেলেটার প্রতি আমাদের দুর্বলতা ছিল। আমাদের মনে হয়েছিল, ছেলেটার পরিবারিক ভালোবাসা প্রয়োজন। তোর দাদুকে সব বলেই আমরা অর্চিনকে এ বাড়িতে দিয়েছিলাম। তোর দাদু, মণিকুন্তলাকে দু-হাত তুলে সমর্থন করেছিলেন।’
বিমলকান্তি চুপ করলেন।
বারিধারা ফিসফিস করে বললেন, ‘মা-দাদু ঠিক করেছিলেন। অর্চিনদার কোন দোষ ছিল না।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘অর্চিনের মা তার প্রতিদান দিলেন।’
বারিধারা অবাক হয়ে বলল, ‘প্রতিদান! কী প্রতিদান?’
বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘পুলিশকে উনি সব জানিয়েছেন। যখন শুনলেন তাকে এমন মানুষদের ব্ল্যাকমেল করবার জন্য ভাড়া করা হয়েছে যাদের বাড়িতে তার ছেলে ছিল, তিনি কাজটা নিতে অস্বীকার করলেন। নিখিলেশ উপাধ্যায় পরিচয় না জেনেই অর্চিনের বিরুদ্ধে কিছু বলেন। সে গ্রামে চলে গেছে রাজনীতি করতে, তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবেন এই ধরনের কিছু। বৈশাখী যদি সেন বাড়ির বিরুদ্ধে কাজ না করে তা হলে তাকেও পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। এরপরেই নিখিলেশ উপাধ্যায়কে খুন করেন এই মহিলা।’
বিমলকান্তি একটু থমকে বাকিটাও মেয়েকে বলেন।
পুলিশ অফিসার তাকে বলেছেন, খুনের কায়দাটা ছিল প্রাচীন। প্রথমে ঘাড়ে মারে, তারপর গলায় ফাঁস। এই কায়দা দেখে পুলিশের সন্দেহ হচ্ছে, মহিলা আরও খুন করেছেন। রেস্তোরাঁ থেকে খবর পেয়েই শিয়ালদা, হাওড়া স্টেশন, বিভিন্ন বাস টার্মিনাসকে অ্যালার্ট করে পুলিশ। এই ধরনের ঘটনার পর মার্ডারার সাধারণত শহর থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। কমন হ্যাবিট। প্লেস অফ অকারেন্স থেকে যতটা দূরে সরে যাওয়া যায়। পরিস্থিতি শান্ত হলে আবার ফিরে আসে। খানিকক্ষণের মধ্যে পুলিশের কাছে খবর আসে, এক মহিলা শিয়ালদা স্টেশনে এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রেস্তোরাঁর এক কর্মীকে সেখানে নিয়ে গিয়ে দূর থেকে আইডেন্টিফাই করা হয়, কিন্তু তখনই তাকে ধরা হয় না। অপেক্ষা করা হয়, তার জন্য কোনও সঙ্গী আছে কি না জানার জন্য। শেষ পর্যন্ত ক্যানিংয়ের নদী পেরনোর সময় অ্যারেস্ট করা হয়। মহিলা পুলিশকে জানিয়েছেন, উনি নাকি ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। ছেলের গ্রামের নাম নিখিলেশ উপাধ্যায়ই তাকে জানিয়েছিলেন। সুন্দরবনের গ্রাম। নাম নোনাজল। পুলিশকে খবর দেবেন বলে নিখিলেশ উপাধ্যায় এ সব তথ্য গোপনে জোগাড় করেছিলেন।
বারিধারা শান্ত গলায় বলল, ‘মহিলার সম্পর্কে আমার ধারণা সম্পূর্ণ বদলে গেল বাবা।’
বিমলকান্তি নীচু গলায় বললেন, ‘আমারও।’
বারিধারা বলল, ‘বাবা, এবার বাড়ি চলো। সবাই চিন্তা করছে।’
বিমলকান্তি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ভালোই হল তুই এসেছিস। বাড়িতে এত কথা বলার সুযোগ হত না।’
বারিধারা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কেন হত না?’
বিমলকান্তিবাবু বলল, ‘তোর মা জেনে যেত।’
বারিধারা বলল, ‘জানতে তো হবেই বাবা। মাকেও সব জানতে হবে।’
বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘মণিকুন্তলা খুব দু:খ পাবে।’
বারিধারা সামান্য হেসে বলল, ‘মাকে এত দুর্বল ভাবছ কেন বাবা? মেয়েরা বেশিরভাগ সময়েই ছেলেদের থেকে অনেক বেশি স্ট্রং। ওই বৈশাখী নামের মহিলাকে দেখে তুমি বুঝতে পারছ না? মা দু:খ পাবে না। বরং, ওই মহিলার জন্য গর্ব বোধ করবে। আমি যেমন করছি। উনি শুধু একজন বিশ্বাসঘাতককে চরম শাস্তি দেননি, উনি তোমাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন, উনি নিজের সন্তানকে দূর থেকে হলেও রক্ষা করবার চেষ্টা করেছেন। এনার জন্য আমাদের সবার গর্ব করা উচিত। মাকে, দিদিকে সব বলব। এমনকী তোমার উচিত অফিসেও সবাইকে এই ঘটনা জানানো। বিশ্বাসঘাতকতাই শেষ নয়।’
বারিধারার কথা শুনে বুক ভরে গেল বিমলকান্তিবাবুর। এই মেয়ে সিরিয়াস নয় বলে, হালকা রসিকতার জীবন কাটায় বলে কত চিন্তাই না করেছেন। এখন বুঝতে পারছেন, না, মেয়েটা মানুষ হয়েছে। অনেকের থেকে বড় মানুষ হয়েছে। বেঁচে থাকবার আসল সত্যিটা বুঝতে পারাই ‘মানুষ’ হওয়া। সেটা হাসতে হাসতে হলেও কোনও ক্ষতি নেই।
মেয়েকে নিয়ে যখন গাড়িতে উঠলেন বিমলকান্তি তখন তিনি অনেকটা হালকা বোধ করলেন। বুক থেকে ভার নেমে গেছে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই শ্রবণকে ফোন করল বারিধারা।
‘খুব ভালো করেছিস বারি, তোকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম।’
বারিধারা গম্ভীর গলায় বলল, ‘তোমাকে না বলেছি, সকালে কখনও ফোন করবে না। তুমি সকালে ফোন করা মানে গোটা দিনটা গোলমাল হয়ে যাওয়া।’
শ্রবণ বলল, ‘সরি ধারা, কিন্তু আমি তো তোমাকে ফোন করিনি, করব করব ভাবছিলাম।’
বারিধারা বলল, ‘তোমার ভাবনা এখন সরিয়ে আমার কথা শোন।’
শ্রবণ আমতা আমতা করে বলল, ‘কাল একটা কেলো করেছি।’
বারিধারা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী করেছ?’
শ্রবণ বলল, ‘বলতে ভয় করছে।’
বারিধারা বলল, ‘তা হলে বলবে না। কবে মুম্বই যাচ্ছ?’
শ্রবণ এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ‘তোমার পরীক্ষা কবে শেষ হচ্ছে বারি? এ মাসের আঠাশ তারিখ না?’
বারিধারা বিরক্ত গলায় বলল, ‘কেন? তুমি কী করবে? আমার হয়ে পরীক্ষা দেবে?’
শ্রবণ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ওরা আবার মেল পাঠিয়েছে। সামনের মাসের দু-তারিখে ওদের ফাংশান। চার তারিখ ওরা আমার সঙ্গে বসতে চায়। চাকরির ব্যাপারে ফাইনাল কথা বলবে। চার তারিখ রাতের প্লেনে ফিরে আসতে পারব। এক তারিখ বিকেলে যাব, চারে ফিরব।’
বারিধারা আরও বিরক্ত গলায় বলল, ‘আমাকে এ সব জানাচ্ছ কেন? আমি কি ফুলের তোড়া নিয়ে তোমাকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে যাব? বোকার মতো কথা বলবে না।’
শ্রবণ টেলিফোনের ওপাশে বিড়বিড় করে কিছু বলল। তার পুরোটা শোনা গেল না।
‘না, তোমার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে…।’
বারিধারা এতক্ষণ বিছানায় শুয়ে কথা বলছিল। ঘরের দরজা বন্ধ। সে একটা শার্ট পরে আছে। বেশিরভাগ সময়ে এটাই তার রাত পোশাক। টি শার্টের বুকে শ্রবণ ডিজাইন করে দিয়েছে। একটা গাছ। গাছটা পুরো সত্যি নয়। খানিকটা রিয়েল, খানিকটা কল্পনার। ডালপালা মেলে মুখ উঁচু করে তাকিয়ে আছে। বারিধারা উঠে বসল। ধমক দেওয়া গলায় বলল, ‘বার বার আমার পরীক্ষার রুটিন নিয়ে কথা বলছ কেন?’
ওদিক থেকে শ্রবণ থতমতো খেয়ে বলল, ‘আর বলব না বারি। কিন্তু ধারা…।’
বারিধারা বলল, ‘চুপ করো। একটা কথাও বলবে না। আজ আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যাবে। আমাদের গাড়িতে যাব। আজই ফিরে আসব। যত রাত হোক।’
শ্রবণ একটু থেমে বলল, ‘কোথায়?’
বারিধারা বলল, ‘তোমার জেনে কী হবে? তৈরি হয়ে নাও। এক ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে যাব। আমি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।’
শ্রবণ বলল, ‘বারি তোমার আজ পরীক্ষা নেই?’
বারিধারা বলল, ‘না, তিনদিন অফ। পরীক্ষা থাকলেও তোমাকে একা পাঠাতাম।’
শ্রবণ আমতা আমতা করে বলল, ‘কোথায় জানতে চাইছি না।’
বারিধারা ফোন কেটে দিল। বাবাকে বলে গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। বাবা কথা দিয়েছে, এখন কাউকে বলবে না। মা, দিদি শুনলে টেনশন করবে। বাবা সঙ্গে লোক পাঠাতে চেয়েছিল। বারিধারা রাজি হয়নি। শ্রবণ তো থাকছেই। গাড়িতে নোনাজল গ্রাম খুব কিছু দূরে নয়। ঘণ্টা তিনেকের বেশি লাগবে না।
ঊনষাট
অফিস থেকে ফেরবার পথে জ্যোতিষ্ক একটা ভয়ঙ্কর কাজ করেছে।
কাজটা করে জ্যোতিষ্ক রোমাঞ্চিত। কিন্তু স্ত্রীকে বলতে পারছে না। না বলেই ভালোই করেছে। ঘটনা শোনবার পর মেঘবতী তুলকালাম কাণ্ড করতে পারে। করতে পারে কেন, করবেই। সুটকেস গুছিয়ে বাড়ি থেকে তো বেরিয়ে যাবেই, তার থেকেও বেশি কিছু হবে।
জ্যোতিষ্ক ঠিক করেছে, তাড়াহুড়ো করবে না। ঘটনা একটু একটু করে বলে মেঘবতীকে ধাতস্ত করবে। একটু একটু করে ধাতস্ত করবার প্রক্রিয়াটি ঠিক কেমন হবে তা অবশ্য জ্যোতিষ্কর জানা নেই। কিছু একটা করতে হবে। জ্যোতিষ্ক গ্যারেজে গাড়ি রেখে শান্ত ভাবে বাড়িতে ঢুকল। গুপির মা দরজা খুলে দিয়েছে। বংশীবাদকের হাতে অপমানিত হওয়ার পর গুপির মা এ বাড়ির কাজ ছেড়ে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বারিধারা তাকে বারণ করে।
‘এখন কাজ ছেড়ো না গুপির মা। পুলিশ সন্দেহ করবে।’
গুপির মা তেড়েফুঁড়ে উঠে বলল, ‘কেন আমাকে সন্দেহ করবে কেন? আমি কি ডাকাতি করেছি?’
বারিধারা বলেছিল, ‘আমাদের দেশের পুলিশের নিয়মটাই এরকম। নিরীহ এবং গরিব মানুষকে আগে সন্দেহ করা। তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে পুরে দেওয়া সহজ কি না।’
গুপির মা সমান তেজের সঙ্গে বলেছিল, ‘দিক। আমি ভয় পাই না।’
বারিধারা বলল, ‘ভয়ের কথা বলছি না, পুলিশকে সুযোগ না দেওয়ার কথা বলছি। তুমি বরং ক’টা দিন পরে ছেড়ে দিও।’
গুপির মা বারিধারাকে ‘ছোড়দি’ ডাকে। ছোড়দিকে সে আলাদা চোখে দেখে। এই মেয়ে পাগলাটে এবং অতিরিক্ত ভালো। বুদ্ধিও খুব। শেষ পর্যন্ত বারিধারার কথা মেনে সে কাজে থেকে যায়। পুলিশ যখন বাড়িতে তদন্ত করতে এসেছিল, মেঘবতী খুব জোরের সঙ্গে বলেছিল, ‘আপনারা গুপির মাকে কোনও ভাবে হ্যারাস করবেন না। ইনি আমাদের বাড়ির একজন মেম্বার। মনে রাখবেন, ওই বাঁশিওয়ালা তার সাঙ্গোপাঙ্গরা তাকে ভয় পেয়েছিল। আর তাই হাত-পা বেঁধে রান্নাঘরে আটকে রেখেছিল।’
ঘটনা সত্যি। ঘটনার দিন গুপির মা চিৎকার করতে গিয়েছিল। ডাকাতরা তাকে জোর করে রান্নাঘরে আটকে দেয়। পুলিশ প্রথমে গাঁইগুঁই করে। তারা চেয়েছিল, গুপির মাকে থানায় নিয়ে গিয়ে ধমকধামক দিতে। জ্যোতিষ্ক নিজে বড় সরকারি অফিসার বলে পারেনি। তার পরেও আড়াল থেকে মহিলার ওপর নজর রাখে। তবে ক’দিনের মধ্যে তারা জানতে পারে মহিলা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়।
যাই হোক, গুপির মা শেষ পর্যন্ত এ বাড়িতে রয়ে গেছে। রয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ অনেকদিন পর্যন্ত তার বিশ্বাস ছিল, সেদিনের ডাকাতরা আবার ফিরে আসবে। তাদের সে মুখোমুখি হতে চায়। খানকতক বঁটির কোপ এদের প্রাপ্য। তাদের জানা দরকার, গুপির মা কোনও এলেবেলে মেয়ে নয়। সেদিন হাত-মুখ না বাঁধলে মজা টের পাইয়ে দিত। আবার সুযোগ পেলে, ঠেলা বুঝিয়ে দেবে। রান্নাঘরে গুপির মা একটা বঁটি আলাদা করে রেখে দিয়েছিল। ছোট বাঁটি। তাতে ধার দেওয়াও থাকত। কদিন আগে পর্যন্ত দুপুরের দিকে কলিং বেল বাজলে গুপির মা বঁটি হাতে নিয়ে দরজা খুলতে যেত। বঁটি লুকোনো থাকে পিছনে। দরজার আই হোল দিয়ে চেনা লোক দেখেও বঁটি শক্ত করে ধরে রাখত। চেনা লোক তো কী হয়েছে? ওই বাঁশিওয়ালা তো চেনা হয়ে গিয়েছিল। পরে বংশীবাদকের মৃত্যু, সেই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ডাকাতরা ধরা পড়ে, বাড়ির গায়নাগাটি, টাকাপয়সা, জামাকাপড় অনেকটাই উদ্ধার হওয়ার খবর জেনে গুপির মা বঁটি ত্যাগ করেছে।
ঘরে ঢুকেই জ্যোতিষ্ক খবর নিল মেঘবতী কোথায়।
গুপির মা বলে, ‘বড়দি ওপরে।’
জ্যোতিষ্ক একটু ইতস্তত করে বলল, ‘গুপির মা গেস্টরুমের কী অবস্থা?’
গুপির মা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী অবস্থা মানে?’
‘ঘরের কন্ডিশন কী? ধুলো টুলো ঝাড়া আছে?’
গুপির মা’র ভুরু আরও কুঁচকে গেল। বলল, ‘এ বাড়ির সব ঘরের ধুলোই ঝাড়া হয়।’
জ্যোতিষ্ক একটু হাসবার চেষ্টা করল। বলল, ‘গুড। বাড়িতে ধুলোময়লা থাকা মোটে স্বাস্থ্যকর নয়। ঠিক আছে তুমি চা করো। চা করে ওপরে নিয়ে এসো।’
মেঘবতী এখন দোতলায়, বেডরুমে। ফোনে বারিধারার সঙ্গে কথা বলছে। গত ক’দিন ধরে ঝড়ের মতো সব ঘটনা ঘটে গেছে। অর্চিনকে সুন্দরবনের গ্রাম থেকে নিয়ে এসে থানায় তার মায়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়েছে বারিধারা। পুলিশ যে শুধুমাত্র কড়া হয় এমন নয়, মানবিকও হয়। বারিধারার মুখে সব শোনবার পর তারা ব্যবস্থা নিয়েছে। নিয়মকানুনের অনেক বাধানিষেধ টপকে মাতা-পুত্রকে আলাদা ঘরে মুখোমুখি বসিয়ে দিয়েছে। বড় ঝুঁকি থাকা সত্বেও সেই সময় ঘরের মধ্যে কোনও গার্ড ছিল না। সেই সময় থানায় বারিধারা, শ্রবণ তো ছিলই, এসেছিলেন বিমলকান্তি, মণিকুন্তলা। আর ছিল ঋষা। মায়ের সঙ্গে দেখা করে সহজ ভাবে থানার বাইরে বসে অর্চিন। একদিন রাতে সেনবাড়িতে থেকে আবার সুন্দরবনে ফিরে গেছে। যাওয়ার আগে বিমলকান্তি, মণিকুন্তলাদেবী, বারিধারার সঙ্গে বসে কথা বলে।
‘আমি মায়ের জন্য ভালো ল’ইয়ার দেব।’
বিমলকান্তি বলেছেন, ‘অবশ্যই দেবে। টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা কোরো না।’
অর্চিন বলে, ‘মা যা করেছে তাতে আইনের চোখে অনেক বড় শাস্তি হওয়া উচিত। হবেও। তার পরেও আমি লড়ব।’
মণিকুন্তলাদেবী নরম ভাবে বলেন, ‘বড় শাস্তি হবে এমন ভাবছ কেন। কাজটা তো তিনি পরিকল্পনা করে করেননি। তাকে প্রাোভোক করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে তিনি…।’
অর্চিন মণিকুন্তলাদেবীকে পুরো কথা বলতে দেয় না। মলিন হেসে বলে, ‘শুধু এই হত্যা নয়, অতীতে মা যা যা অপরাধ করেছে তার শাস্তিও তো প্রাপ্য হয়ে রয়েছে। সে শাস্তিও কম হবে না। ফাঁসি না হোক, যাবজ্জীবন জেল তো বটেই।’
বারিধারা নীচু গলায় বলে, ‘দেখাই যাক না কী হয়। সবাই মিলে চেষ্টা করলে নিশ্চয় কিছু করা যাবে।’
মণিকুন্তলাদেবী বলেন, ‘তুমি অতটা ভেঙে পোড়ো না।’
অর্চিন বলে, ‘আমি ভেঙে পড়িনি। আপনারা আমার জন্য অতীতে যা করেছেন এবং এখনও যা করছেন সে ঋণ মেটানোর ক্ষমতা আমার নেই। চেষ্টাও করব না।’
বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘এভাবে ভেবো না। তুমিও তো সেনবাড়ির একজন।’
অর্চিন মাথা নামিয়ে বলে, ‘জানি। জানি বলেই এত কথা বলতে পারছি। কোনও আইনে মায়ের শাস্তি কমানো যাবে না। আমি যে খুব একটা শাস্তি কমাতে চাই এমনটাও নয়। মাও চায় না। আমাকে বলেছে, তুই চিন্তা করিস না। এটাই আমার ভবিতব্য ছিল। আমার যা সাজা হওয়ার হবে। সব থেকে ভালো হয় যদি ফাঁসি হয়। তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, ব্যস আমার কাজ শেষ।’
অর্চিন একটু থামল। নিজের মনে একটু হাসলও যেন। মণিকুন্তলা কোনও রকমে চোখের জল সামলালেন। ছোট মেয়ে তাকে সাবধান করে রেখেছে।
‘মা, অর্চিনদার সামনে তুমি কোনও রকম দুর্বলতা দেখাবে না। সে একজন খাঁটি মানুষ। কোনওরকম সহানুভূতি, করুণা, চোখের জল সে পছন্দ করবে না। সব থেকে বড় কথা, তার সামনে আমরা যদি দুর্বল হই, সে নিজেও ভেঙে পড়তে পারে। আমরা তাকে শক্ত হতে সাহায্য করতে পারি মা, ভেঙে পড়তে নয়।’
মণিকুন্তলা মেয়ের এই কথা মেনে চলতে চাইছেন। তিনি ঠোঁট কামড়ে রইলেন।
অর্চিন মাথা নামিয়ে বলল, ‘কিছু করতে পারব না জেনেও আমি আদালতে মায়ের হয়ে লড়ব। প্রাণপণ চেষ্টা করব। মা যেন বুঝতে পারে, তার ছেলে তার পাশে আছে। যত অন্যায় করুক, সন্তানের পাশে যেমন বাবা-মা থাকে, কেউ থাকে না, শুধু তারাই থাকে। আমিও সেভাবে মায়ের পাশে থাকব। মৃত্যুপথযাত্রী জেনেও তো সন্তান বাবা-মায়ের চিকিৎসা করে। ছেড়ে তো পালায় না। তাই না?’
অর্চিন মুখ তোলে। বাকিদের কাছ থেকে যেন সমর্থন চাইছে। তার মুখ ছিল উজ্জ্বল। বিমলকান্তি সিরিয়াস মানুষ। সেন্টিমেন্ট তাকে খুব একটা স্পর্শ করে না। স্পর্শ করলেও তিনি তা গোপন রাখলেন। এটাই তার নিয়ম। বহু বছর পড়ে তিনি নিয়ম ভাঙলেন। নিখিলেশ উপাধ্যায়ের বিশ্বাসঘাতকতা, অকৃজ্ঞতার কালি একটা ছোট ছেলে কত সহজে ধুয়ে দিল। বিমলকান্তি নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে অর্চিনকে জড়িয়ে ধরলেন।
‘অর্চিন, তুমি নিজের ইচ্ছে মতো রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছ। নিজের ইচ্ছে মতো ব্রাইট কেরিয়ার ছেড়ে দিয়েছ। নিজের ইচ্ছেয় তুমি আমাদের ছেড়ে গ্রামে চলে গেছ। এবার একটা কথা আমার ইচ্ছে মতো তোমাকে শুনতে হবে।’
অর্চিন মৃদু গলায় বলল, ‘কী কথা?’
বিমলকান্তি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, ‘আগে বলো শুনবে। আমি তো কখনও কোনও বিষয়ে তোমাকে জোর করিনি, কিন্তু এবার করছি।’
অর্চিন একটু থমকাল। বলল, ‘আচ্ছা, কথা দিচ্ছি।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘তোমার মায়ের জন্য তুমি যে আইনি লড়াই করবে তার সব খরচ আমরা দেব। বেস্ট ল’ইয়ার থাকবেন।’
অর্চিন কিছু একটা বলতে গেল। বিমলকান্তি হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কোনও কথা শুনব না। এটাই ফাইনাল। সেন এন্ড অ্যাসোসিয়েটসে যে ল’ইয়ার ফার্মের সঙ্গে কাজ করে তুমি তার সঙ্গে বসবে।’
বারিধারা নিজেই আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কারও সামনে সে কাঁদতে পারে না।
অর্চিন পরদিন সকালেই সুন্দরবনে ফিরে গেছে। সেখানে অনেক দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে। সেই কাজ অন্যদের খানিকটা বুঝিয়ে দিতে হবে। কোর্টের দিনগুলো তাকে কলকাতায় থাকতে হবে। তা বলে আসল কাজ তো বন্ধ হতে পারে না। এর দু’দিনের মধ্যেই পুলিশ বৈশাখীকে জেল হেফাজতে পাঠিয়ে দিয়েছে। পুলিশ যাতে বৈশাখীকে আর খুব বেশি চাপাচাপি না করে তার জন্য জ্যোতিষ্ক ওপর মহল থেকে কিছু ব্যবস্থা করেছিল। আসামি যদি সবটাই স্বীকার করে নেয়, তা হলে আর থানা লকআপে আটকে রাখবার দরকার কী?
সেই অর্থে সেনবাড়িতে ঝড় কিছুটা কমেছে। বারিধারা-মেঘবতী দুই বোন বহুদিন পর টেলিফোনে প্রাণের-মনের গল্প করেছে। এতই প্রাণের-মনের যে অফিস থেকে স্বামীর ফিরে আসবার সাড়াশব্দও মেঘবতী পায়নি।
‘দিদি, একটা ঝামেলায় পড়েছি।’
মেঘবতী মোবাইল কানে চেপে ধরে বলল, ‘আবার ঝামেলা!’
বারিধারা বলল, ‘এখনও হয়নি তবে হবে মনে হচ্ছে।’
মেঘবতী বলল, ‘পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে?’
বারিধারা বলল, ‘ধুস, কী যে বলিস। এখন কীসের রেজাল্ট। সবে তো পরীক্ষা শেষ হল। ইউনিভার্সিটিতে রেজাল্ট বেরোতে সাত মাস।’
মেঘবতী বলল, ‘তা হলে এখন কীসের ঝামেলা বৃষ্টি?’
বারিধারা রহস্যভরা গলায় বলল, ‘মনে হচ্ছে একটা ঝড় ঝামেলা ঘটতে চলেছে।’
মেঘবতী বিরক্ত গলায় বলল, ‘এত ভণিতা না করে সরাসরি বল।’
বারিধারা ফিসফিস করে বলল, ‘আমি একটা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়তে চলেছি।’
মেঘবতী আঁতকে উঠল। এই বোনটাকে নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই।
‘কী বলছিস যা তা।’
বারিধারা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘যা তা নয় রে দিদি, সত্যি বলছি। ঘটনা জানাজানি হলে, আমার নামে একেবারে ঢি ঢি পড়ে যাবে। তোরা আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারবি না। খুব সম্ভবত আমাদের সিরিয়াস বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে। মা তিনদিন না খেয়ে থাকবে। হয়তো আমি তোর বাড়িতে আশ্রয় নেব। তুই আমাকে যত্ন আত্তি করবি ঠিকই, কিন্তু মাঝে মাঝেই ফোঁস ফোঁস করে নি:শ্বাস ফেলবি, আর বলবি, এটা তুই কী করলি! কেমন করে করলি বৃষ্টি! সেনবাড়ির সম্মানের কথা একবার মনে এল না।’
মেঘবতী আধশোয়া হয়ে কথা বলছিল। সোজা হয়ে বসল। ধমক দিয়ে বলল, ‘ড্রামাবাজি থামা বৃষ্টি। কী হয়েছে বল।’
বারিধারা গলা নামিয়ে বলল, ‘চেঁচাস না। বলছি তো এখনও হয়নি, হতে চলেছে। শ্রবণ বোকাটা একটা বিরাট বোকামি করে ফেলেছে।’
মেঘবতীর ভুরু কুঁচকে গেল। বৃষ্টি কি ইঙ্গিত দিচ্ছে? হতে পারে না। অসম্ভব। সে বলল, ‘শ্রবণ করেছে মানে! সে তো খুব ভালো ছেলে।’
বারাধিারা ফোনের ওপাশ থেকে ফিক করে হেসে বলল, ‘আহা! দিদি, এমন ভাবে বলছিস, যেন ভালো ছেলেরা কখনও বোকামি করে না। তাদের জন্য আমার মতো সহজ সরল মেয়েদের কেলেঙ্কারি হয় না।’
এ তো স্পষ্ট ইঙ্গিত। মেঘবতী উত্তেজনায় খাট থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়ল। আবার বসল। ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের আগে এ সব কী কাণ্ড!
‘বৃষ্টি, ঠাট্টা বন্ধ করে সোজা কথা বল।’
বারিধারা স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘বললাম তো শ্রবণ বোকামি করেছে।’
মেঘবতী দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আর তুমি কী করছিলে? নেকা? তুমি বড় হওনি? তুমি জানো না কী থেকে কী হয়? ছি ছি বৃষ্টি। তুই এটা করলি…। আমি ভাবতেও পারছি না।’
বারিধারা বলল, ‘দেখলি তো দিদি, আমার নামে কেমন ঢি ঢি পড়ে যাবে। তুই পর্যন্ত ছি ছি করছিস। তাও তো কেলেঙ্কারি এখনও হয়নি। কিছুদিন পরে হবে।’
মেঘবতী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘বৃষ্টি, আমি কিন্তু এবার কেঁদে ফেলব। আগে বল, তুই এ সব ঠাট্টা করে বলছিস। বল আগে।’
জ্যোতিষ্ক দরজার আড়াল থেকে মেঘবতীর ‘এবার কেঁদে ফেলব’ কথাটুকু শুধু শুনতে পেল। বেডরুমে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল সে। এই রে! মেঘবতী যদি কেঁদে ফেলবার মুডে থাকে তা হলে তো খুব মুশকিল। সে যে ভয়ঙ্কর কাজটা করে বসে আছে সেটা জানাবে কী করে?’
কেঁদে ফেলবার জন্য মেঘবতীর মন আকুলি বিকুলি করছে। করবে না? একেই তার কাদুনি স্বভাব। যে কোনও ছোটখাটো ব্যাপারে কান্না পায়, আদরের বোন যদি এরকম একটা বিশ্রী কেলেঙ্কারির মধ্যে জড়িয়ে পড়ে তাহলে তো কেঁদে ফেলবারই কথা। আজকালকার ছেলেমেয়ে কখনও এমন ভুল করে! এ তো আর পঞ্চাশ-একশো বছর আগের ব্যাপার নয়। এখন কত ব্যবস্থা এসেছে, কত সহজ কায়দাকানুন হয়েছে।
টেলিফোন কানে চেপে মেঘবতী ফোঁস করে নি:শ্বাস ফেলল। কান্নার পূর্বলক্ষণ।
ওপাশ থেকে বারিধারা গম্ভীর গলায় বলল, ‘দিদি, তোর কি কান্না পাচ্ছে?’
মেঘবতী বলল, ‘ফাজলামি করবি না বৃষ্টি। আমার ভালো লাগছে না।’
বারিধারা বলল, ‘ঘটনা শুনে তারপর কান্নাকাটি শুরু কর। মন খুলে কাঁদতে পারবি।’
মেঘবতী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘ঘটনা তো বলছিস না। খালি ঘোরাচ্ছিস। তবে বৃষ্টি একটা কথা জেনে রাখ, যত কেলেঙ্কারিই ঘটিয়ে থাকিস না কেন, আমি তোর সঙ্গে আছি। তুই আমার এখানে চলে আসবি। আমি আর তোর জ্যোতিষ্কদা মিলে, সব ব্যবস্থা করে দেব। কেউ জানতেও পারবে না। তবে পাকামি করতে যাস না। তোকে নিয়ে ওইটাই আমার চিন্তা।’
বারিধারা বলল, ‘আমারও চিন্তা। তার আগে ঘটনাটি শুনে নে দিদি। বললাম না, কান্নাকাটি করতে সুবিধে হবে।’
বারিধারা গুছিয়ে সব বলল। শ্রবণ সত্যি একটা বোকামি করে বসেছে। মুম্বইয়ের যারা তাকে প্রাইজ দিচ্ছে, তারা জানিয়েছিল, দুজনের ব্যবস্থা করবে। শ্রবণ যেন সঙ্গে একজন স্পেশাল গেস্ট নিয়ে আসে। তবে প্লেনের টিকিট, হোটেল, খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব সব তাদের। কদিন আগে তারা স্পেশাল গেস্টের নাম চাইলে, শ্রবণ বারিধারার নাম পাঠিয়ে দিয়েছে। বারিধারাকে জিগ্যেস করা হয়নি। সেদিন অর্চিনকে নিয়ে আসতে যখন দুজনে মিলে সুন্দরবনের নোনাজল গ্রামে যাচ্ছিল, তখন বলেছে।
‘একটা গোলমাল করে ফেলেছি বারি।’
‘বারিধারা শান্তভাবে বলেছিল, ‘এটা আর নতুন কথা কী? গোলমাল করাটাই তো তোমার কাজ। গোলমালটা কী জানতে পারি?’
শ্রবণ কাঁচুমাচুভাবে বলল, ‘আসলে তোমাকে বলতাম ধারা, তোমার কাছে পারমিশান নিতাম ঠিকই, কিন্তু তোমরা এমন সমস্যায় রয়েছ যে এই বিষয়ে কথা বলবার সুযোগ হয়নি।’
বারিধারা চোখ কটমট করে বলেছিল, ‘আমার পারমিশন ছাড়া কী করেছ?’
শ্রবণ মাথা চুলকে বলল, ‘মুম্বাইয়ে তোমার নাম পাঠিয়ে দিয়েছি বারি। প্রাইজ গিভিং সেরিমনিতে তুমি আমার স্পেশাল গেস্ট হয়ে যাবে।’
বারিধারা সেদিন আর বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে পারেনি। দু’দিন পরে শ্রবণকে চেপে ধরেছিল।
‘আমার নাম পাঠালে কেন?’
শ্রবণ বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে।’
বারিধারা বলল, ‘বোকামি করো না। তোমাকে আমার হাড়ে হাড়ে চেনা হয়ে গেছে।’
শ্রবণ বলল, ‘বিশ্বাস করো ধারা, ভেবেচিন্তে কিছু করিনি। দিন তিনেকের তো ব্যাপার। প্রাইজ নেব, চাকরির ব্যাপারে ফাইনাল কথা বলব, একদিন একটু এদিক-ওদিক ঘুরব, ব্যস।’
বারিধারা ধমক দিয়ে বলল, ‘বাজে কথা বোলো না। বাড়ির কাউকে নিয়ে যাচ্ছ না কেন?’
শ্রবণ বলল, ‘কাকে ছেড়ে কাকে নিয়ে যাব? সবাই তো গাল ফোলাবে। যাক তুমি যখন যেতে পারবে না, একাই চলে যাব।’
বারিধারা চাপা গলায় বলল, ‘বেশি সেন্টু দেখিও না। তুমি ভালো করেই জানো শ্রবণ, আমি ওসবে ঘাবড়ানোর পার্টি নই। দুটো অবিবাহিত ছেলেমেয়ে হুট করে একসঙ্গে তিনদিনের ট্যুর করতে পারে?’
শ্রবণ বলল, ‘কেউ জানতে পারবে?’
বারিধারা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘মানে! না বলে চলে যাব?’
শ্রবণ মুচকি হেসে বলল, ‘কেন? এই তো সেদিন আমাকে দিয়ে তুমি বাড়ি পালানো প্র্যাকটিস করালে। এবার তোমার পালা। তুমি পালিয়ে দেখাও বারি।’
স্মার্ট, বুদ্ধিমতী বারিধারা এখানেই কুপোকাত হয়ে গেছে। শ্রবণ এভাবে তার দেওয়া প্যাঁচ মেরে তাকেই ফেলে দেবে ভাবতেও পারেনি। গাধাটার বুদ্ধিতে খুবই খুশি হল বারিধারা। সে একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ঠিক আছে, এবার আমার পালা। আমি তোমার সঙ্গে পালাব। তবে তিনদিনের জন্য।’
শ্রবণ উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘সত্যি বারি? সত্যি কথা বলছ? তুমি মুম্বাইতে আমার সঙ্গে যাচ্ছ ধারা?’
বারিধারা গম্ভীরভাবে বলল, ‘তুমি জানো না শ্রবণ যে আমি দুরকম কথা বলি না?’
বোনের মুখে ‘কেলেঙ্কারির ঘটনা’ শুনে মেঘবতী যেমন খুশি, তেমন উত্তেজিত। আবার খাটের ওপর ধপ করে বসে পড়ল।
‘এ তো খুব আনন্দের কথা বৃষ্টি। শ্রবণ অত বড় একটা প্রাইজ পাবে, আর তুই সেই সময় থাকবি না তা হতে পারে?’
বারিধারা গলা নামিয়ে বলল, ‘এই জন্যে তোকে আমি আর দাদু মিলে মোস্ট ইনটেলিজেন্ট লিস্টের ওপর দিকে রেখেছিলাম। সত্যিই তুই খুব বোকা দিদি।’
মেঘবতী এক গাল হেসে বলল, ‘আমি বোকা হই আর যাই হোক, তুই শ্রবণের সঙ্গে যাবি এটা খুব ভালো হয়েছে। আমি তোদের এয়ারপোর্টে ছাড়তে যাব।’
বারিধারা বলল, ‘উফ দিদি বুঝতে পারছিস না। বাবা, মা ছাড়বে নাকি? মা যদি বা রাজি হয়, বাবার মুখ হাঁড়ি হয়ে যাবে। বিয়ের আগেই মেয়ে হবু জামাইয়ের একসঙ্গে বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটা উনি কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না। দাদু থাকলে একটা কথা ছিল। বাবাকে ধমক দিয়ে রাখত।’
মেঘবতী বলল, ‘ধুস ওসব ছাড় তো। বাবা রাগ করুক আর যা-ই করুন, তুই চলে যা। বাকিটা আমি বুঝে নেব।’
বারিধারা গলা নামিয়ে বলল, ‘দিদি, আসল সমস্যাটার কী হবে?’
মেঘবতী বলল, ‘আবার কী সমস্যা?’
বারিধারা বলল, ‘আরে, এতক্ষণ ধরে কী বললাম? কেলেঙ্কারির ব্যাপারটা কী হবে? আমাকে আর শ্রবণকে যদি রাতে একঘরে থাকতে হয়? তখন কিছু যদি হয়ে যায়?’
মেঘবতী হেসে বলল, ‘একটা চড় খাবি। বড় দিদিকে এসব কেউ বলে? একঘরে থাকতে হলে থাকবি। দু’দিন পরে বিয়ে আর এখন উনি ঘর দেখাচ্ছেন। মারব এক থাপ্পড়।’
বারিধারা নাটকীয় কায়দায় বলল, ‘না রে দিদি, পরে ঢিঢি পড়ে যাবে। আমি আলাদা ঘর চাইব।’
মেঘবতী বলল, ‘নেকা। আলাদা ঘর থাকলে যেন তোমরা আলাদা ঘরে কত থাকবে! তবে সাবধান। ঝামেলায় পড়বে না। বড় হয়েছ, সতর্ক থাকবে।’
বারিধারা এবার অভিনয় ছেড়ে জোরে হেসে উঠল।
‘তাহলে বলছিস দিন তিনকের জন্য পালাব?’
মেঘবতী হাসতে হাসতে বলল, ‘অবশ্যই পালাবি। আমি বাবাকে বলব, বৃষ্টি আমার এখানে আছে। খুব মজা হবে। ইস তোর জ্যোতিষ্কদাটা একদম রোমান্টিক নয়। তাহলে আমরাও পালাতাম।’
বারিধারা বলল, ‘তোরা কার কাছ থেকে পালাতিস!’
মেঘবতী বলল, ‘আরে পালানোটাই মজা রে বৃষ্টি, কার কাছ থেকে পালাতাম সেটা কি বড় কথা? এখন রাখি। চিন্তা করিস না। আমি রইলাম।’
বারিধারা বলল, ‘আমি জানতাম, আমার বোকা ছিঁচকাদুনে দিদি সিরিয়াস সময়ে ঠিক একটা পথ বের করে দেবে। টা টা। তোর জন্য মুম্বাই থেকে কিছু আনতে পারব না বলে দু:খ করিস না। পালানোর সময় কিছু কেনাকাটা করা যায় না।’
স্ত্রীর হাসাহাসি শুনে দরজার আড়ালে দাঁড়ানো জ্যোতিষ্ক মনে জোর পেল। মেয়েরা এরকমই, এই একটু কাঁদে তো পরমুহূর্তে হাসতে শুরু করে। এ ব্যাপারে তার স্ত্রীর তো কোনও জবাব নেই। তাহলে এবার তার ভয়ঙ্কর ঘটনাটা বলা যাবে।
ঘটনা সত্যি ভয়ঙ্কর।
আজ অফিস থেকে ফেরবার পথে বাইপাসের ধারে হ্যান্ডিক্র্যাফটের মেলায় নেমেছিল জ্যোতিষ্ক। কলকাতা শহরে অজস্র মেলা হয়। তার মধ্যে বইমেলা আর এই হস্তশিল্প মেলা হল সেরা। এই দুই মেলা শুধু কলকাতার সেরা মেলা নয়, দেশের সেরা মেলা। সঠিকভাবে বিচার করা হলে পৃথিবীতেও মেলার ‘বেস্ট টেন’ তালিকায় এরা এক থেকে দশের মধ্যে হাসতে হাসতে জায়গা পেয়ে যাবে। ঠিকমতো বিচার হয় না তাই। অন্য কোনও দেশ হলে এই দুই মেলা নিয়ে এমন লাফালাফি করত যে বিদেশ থেকে লোকজন ছুটে আসত। হোটেল ভর্তি হয়ে যেত। বাংলাদেশের একুশের বইমেলা আর জার্মানিতে ফ্রাঙ্কফুট বইমেলা খুব নামকরা। কিন্তু এই দুটোর কোনওটাতেই কলকাতা বইমেলার মতো পাঠক থাকে না। শুধু পাঠক দেখবার জন্যই তো বিদেশ থেকে বইভক্তদের আসা উচিত। বই তো আছেই। আর হস্তশিল্প মেলার তো কোনও তুলনা নেই। বাংলার গাঁ-গঞ্জে যে কত শিল্পী আছে একমাত্র এই মেলাতে এলেই জানা যায়। বিশ্বের মানুষ প্যারিস বলতে অজ্ঞান। সেখানে শিল্পীরা গিজগিজ করে। দুনিয়া কাঁপানো সব শিল্পী। বাংলার হস্তশিল্প মেলা নিয়ে দুনিয়াকে বলুক, এখানকার মানুষের কথা বলতে অসুবিধে কোথায়? বাংলার গরিব শিল্পীরা এখানে হাতের কাজ নিয়ে আসেন বলে? দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশে ভালো জিনিস নিয়ে লাফালাফি কম হয়। হস্তশিল্প মেলায় জ্যোতিষ্ক কম করে চার-পাঁচদিন ঢুঁ মারে। এর মধ্যে দুদিন মেঘবতীর সঙ্গে। আজ গিয়েছিল একা। গোপন কাজ ছিল। এই কাজ স্ত্রীর সঙ্গে গেলে হওয়ার নয়। বংশীবাদকের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকেই জ্যোতিষ্কর ভালো বাঁশি কেনবার শখ। এই মেলায় নিশ্চয়ই বাঁশি মিলবে। কিন্তু বাঁশির বদলে দেখা মিলল কুটকুটের সঙ্গে। কুটকুট একজন দশ-এগারো বছরের বালক। তার সঙ্গে দেখা হয়েছে মেলার এক কোনায়, আধো আলো, আধো অন্ধকারে বসে সে কাঠের টুকরোর গায়ে রং দিচ্ছিল। মলিন হাফপ্যান্ট আর কলার ছেঁড়া জামা। জ্যোতিষ্ক সামনে দাঁড়িয়ে বালকের কাঠের রঙ করা দেখছিল। দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে গেল। মিনিট দশকের মধ্যে কাঠের টুকরো একটা পুতুলের চেহারা পেলে। প্রাণ পেল যেন। রঙে ঝলমলে। কুটকুট যতটা বর্ণহীন পুতুলটা ঠিক তার উলটো।
‘কী দ্যাখেন?’
‘তোর কাজ দেখি।’
‘কাজ দেখে কী হবে? পুতুলটা নেবেন?’
‘দাম কত?’
‘দশ টাকা।’
জ্যোতিষ্ক বলে, ‘ধুস, একটা কাঠের টুকরোর দাম দশ টাকা কী রে বেটা!’
‘কুটকুটে ছোট বলে, তার সঙ্গে দরদাম করেন না।’
জ্যোতিষ্কর খুব মজা লাগল। বলল, ‘তোর নাম কুটকুটে?’
বালক মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তারপর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে, ‘নাম জেনে আপনার কাম কী? পুতুলটা কিনবেন তাই বলেন?’
জ্যোতিষ্ক বলে, ‘তুই কাঠের পুতুল বানাস?’
‘সবের পুতুল বানাই। একটা মাটির ঢেলা দেন পুতুল বানিয়ে দেব। আমি সবরকম হাবিজাবি দিয়ে পুতুল বানাতে পারি।’
বলতে বলতে কুটকুটে একটা পোড়া মাটির ঢেলা নিয়ে ঝটপট চোখমুখ আঁকতে বসল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে গোলগাল হাসিখুশি একটা ছেলের মুখ বানিয়ে ফেলল। বলল, ‘আমি সবের পুতুল বানাতে পারি। কাঠ, মাটি, ফেলে দেওয়া কাগজের গোল্লা।’
জ্যোতিষ্কর মুগ্ধতা দশগুণ বেড়ে গেল। যে কোনও অসাড় জিনিসকে এই ছেলে নিমেষে প্রাণ দিতে পারে! এ তো অতি ক্ষমতাবান! অথচ বসে আছে ভিখিরির মতো। সামনের এক টুকরো চটে কিছু পুতুল সাজানো থাকলেও মেলার খরিদ্দাররা সেদিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। সারাদিনে দু-চারটেও বিক্রি হয়েছে কিনা সন্দেহ। জ্যোতিষ্কর মনে হল, সে একজন বিরাট শিল্পীকে খুঁজে পেয়েছে। উবু হয়ে বসে গল্প শুরু করল।
‘তোর বাড়ি কোথায়?’
‘গ্রামে।’
‘বাড়িতে কে আছে? বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছিস নাকি?’
কুটকুটে কাপড়ের টুকরোয় রং করতে করতে বলল, ‘বাপ-মায়ে নাই। এর বাড়ি, তার বাড়ি থাকি। গ্রামের এক কাকা নিয়ে এসেছে। ভারী মালপত্র টানাটানি করবার জন্য। বড্ড খাটায়, খেতে দেয় না। তিনদিন হল সেই কাকাকে ছেড়ে চলে এসেছি। কাকাই তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি পুতুল বানাচ্ছি বলে বদটা আমায় চড় মেরেছে। আমিও হাত কামড়ে দিয়েছি। সে বলেছে, তুই দূর হয়ে যা। আমি বলেছি, বয়ে গেছে। আমি নিজেরটা নিজে বুঝে নেব। তাই নিজেই পুতুল বানিয়ে বেচছি। যা বিক্রি হয় তাই দিয়ে মুড়ি কিনে খাই। রাতে অফিসঘরের নীচে বস্তা পেতে ঘুমোই।’
জ্যোতিষ্কর মনটা খারাপ হয়ে গেল। এত বড় একজন শিল্পীর এই দুরবস্থা!
‘আমাকে পুতুল বানানো শেখাবি?’
‘শেখাতে পারি, তবে টেইম লাগবে।’
জ্যোতিষ্ক বলল, ‘আমি সময় করে নেব। তুই আমার বাড়িতে থাকবি।’
কুটকুটে বলল, ‘বাসন মাজতে, কাপড় কাচতে পারব না।’
জ্যোতিষ্ক হেসে বলল, ‘দুর পাগল ছেলে। তোর মতো এক আর্টিস্ট ওসব কাজ করে সময় নষ্ট করবে কেন? তুই আমাকে হাবিজাবি দিয়ে পুতুল বানাতে শেখাবি আর খাবিদাবি খুমোবি। লেখাপড়াও শিখবি। যাবি আমার বাড়ি?’
কুটকুটে একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘বাড়িতে খাওয়াদাওয়া কেমন?’
জ্যোতিষ্ক বলল, ‘খুব খারাপ নয়।’
কুটুকুটে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘পেট ভরবে তো? বহুদিন পেট ভরে খাই না।’
জ্যোতিষ্ক আর পারল না। হাত বাড়িয়ে বালকের জটপাকানো চুল ঘেঁটে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, ভরবে। আমার ভরলে, আমার বউয়ের ভরলে, তোরও ভরবে।’
‘মামি কি খিটখিটে?’
জ্যোতিষ্ক হেসে ফেলল। এরমধ্যে মামা-মামি সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছে বেটা।
‘তা একটু খিটখিটে, তবে খুব ভালো।’
কুটকুটে বলল, ‘ভালোমানুষ খিটখিটে হলে সমস্যা নেই। খারাপ মানুষ খিটখিটে হলে সমস্যা আছে। আমি থাকব না। খাবার না পেলে ক্ষতি নাই, কিন্তু খারাপ লোকের ধমকধামক শুনি না। পেস্টিজে লাগে।’
জ্যোতিষ্ক সস্নেহে বলল, ‘তোকে কেউ ধমক দেবে না, যাবি?’
কুটকুটে তার পুতুলের মতো চোখ তুলে বলল, ‘চলেন তাহলে। দেখি আপনার বাড়ি পছন্দ হয় কিনা।’
থলিতে পুতুল, মাটির ঢেলা, কাগজ, কাঠের টুকরো, কাপড় আর সস্তার রং গুছিয়ে নিয়ে জ্যোতিষ্কর সঙ্গে গাড়িতে গিয়ে উঠল।
সেই ছেলেকে গ্যারাজে লুকিয়ে জ্যোতিষ্ক মেঘবতীর কাছে এসেছে। তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। সে কি বুঝবে? বুঝবে না। বংশীবাদকের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। খুবই খারাপ। আবার একজনকে রাস্তা থেকে বাড়িতে নিয়ে এলে সে কি অ্যালাও করতে পারে? কখনওই পারে না। তারপরেও চেষ্টা চালাতে হবে। বয়েসে যতই ছোক হোক এমন শিল্পীকে এত কষ্টের মধ্যে ফেলে আসা যায় না।
মেঘবতী কুটকুটের ঘটনা শুনে থম মেরে থাকল। তারপর বলল, ‘কালই আমি মায়ের ওখানে চলে যাব। সেদিন বাঁশির নাম করে ডাকাতদের বাড়ি ঢুকিয়েছিল, আজ পুতুলের দোহাই দিয়ে ছিঁচকে চোরকে বাড়িতে নিয়ে এসেছ। তোমার কোনও শিক্ষা হয় না।’
জ্যোতিষ্ক কাঁচুমাচুভাবে বলল, ‘খুবই ভুল করেছি মেঘ। কালই ছেলেটাকে মেলায় ছেড়ে দিয়ে আসব। মেলায় তো কত মানুষ হারিয়ে যায়, এই ছেলেও যাবে। শুধু আজকের রাতটা কি তাকে গেস্টরুমে রাখা যায় না?’
মেঘবতী গনগনে গলায় বলল, ‘আমি জানি না। আমি এ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাব।’
রাতে মেঘবতীর গুছিয়ে দেওয়া দুধ ভাত কলা মাখা খেতে খেতে কুটকুটে বলল, ‘মামি, আপনাদের কলায় তেমন স্বাদ নেই। কেমন কষটে মার্কা। কাল ভালো কলা আনতে বলবেন। দেন, আর একটু ভাত দেন দেখি। দু’দিন ভাত খাওয়া হয় নাই।’
মেঘবতী কুটকুটের বাটিতে আরও খানিকটা ভাত আর দুধ দিল। তার চোখভরা জল। কোনও কোনও সময় সুন্দর চোখে জল থাকলে, চোখ আরও সুন্দর দেখায়। মেঘবতীকেও খুব সুন্দর লাগছে।