পঁয়ত্রিশ
‘কী হয়েছে স্যার? আমাকে ডেকেছেন?’
অরিন্দম সেনগুপ্ত বললেন, ‘বসো বারিধারা। তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।’
দুটো চেয়ার ছেড়ে বসা কল্যাণ সমাজপতির সামনে একটা খাতা। তিনি সম্ভবত কোনও স্টুডেন্টের নোটস দেখছেন। তিনিও অস্ফুটে বললেন, ‘বসো।’
বারিধারা উলটো দিকের চেয়ারে খানিকটা জড়সড় হয়েই বসল। যতই হোক দুজন মাস্টারমশাই।
অরিন্দমবাবু বললেন, ‘বারিধারা তোমার সঙ্গে মধুজা রায়ের গোলমালের কথা আমরা শুনেছি।’
বারিধারা চমকে উঠল। এই কথা স্যারেরা জানলেন কী করে! ঘটনা কী করে ছড়াল! সেদিন তো মধুজা ম্যাডাম তাকে একা ডেকে হুমকি দিয়েছিলেন। তখন তো ঘরে কেউ ছিলই না। সে নিজেও কাউকে বলেনি। এমনকী যাকে নিয়ে এত ঝামেলা, সেই তিথিকে পর্যন্ত নয়। তাহলে?
বারিধারার চমকে যাওয়ারই কথা। সে তো আর জানে না, মধুজা রায়ের অফিসের খবর তার খাস পিওন লবই পাচার করে। কাজটা অন্যায় জেনেও করে। ম্যাডাম যদি তার ভাইপোর চাকরি নিয়ে অন্যায় কাজ করতে পারে, সে করতে পারবে না কেন? চাকরি উনি না-ই দিতে পারতেন, কিন্তু উনি খবরটা জেনে নিয়ে নিজের ক্যান্ডিডেটকে ঢুকিয়ে দিলেন। এটা শুধু অন্যায় নয়, ভয়ঙ্কর একটা কাজ। ম্যাডাম খুব ভালো করেই জানতেন, বিষয়টা নিয়ে লব কিছু বলতে পারবে না। তার হাতে কোনও প্রমাণ নেই। আর থাকলেই বা কী হত? সে মধুজা রায় একজন প্রফেসর এবং ক্ষমতাশালী। ইউনিভার্সিটির ওপর মহলে যেমন হাত আছে, সরকারের দপ্তরেরও চেনা জানা। আর সে একজন সামান্য পিওন। লব বাধ্য হয়ে চুপ করে গিয়েছিল। তবে সেই ঘটনা নিয়ে মুখে কিছু না বলতে পারলেও প্রতিজ্ঞা করেছে, এই মহিলার সর্বনাশ দেখে ছাড়বে। সে জানে, ইউনিভার্সিটিতে মধুজা রায়ের বিরুদ্ধে এখন অনেকেই চলে গেছে। মধুজা রায় ক্ষমতার দম্ভে মত্ত। ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। রাজনৈতিক মদতও আছে। খেয়াল রাখেন না যে তাঁর বিরুদ্ধে অনেকেই ভিতরে ভিতরে ফুঁসছে। অপেক্ষা করে আছে একটা সুযোগ পেলেই চেপে ধরবে। এদের কাছেই লব খবর পাচার করে। অরিন্দম স্যারকেও সে বারিধারার খবর দিয়েছে। এই কথা বারিধারা জানবে কী করে? তার মুখ দেখে স্যারেরা বুঝতে পারলেন। কল্যাণ সমাজপতি খাতা থেকে মুখ তুললেন।
‘বারিধারা, আমরা সব কথা শুনেছি। তুমি ঠিক কাজ করেছ।’
অরিন্দম বললেন, ‘তুমি সাহসের কাজ করেছ। ওই ছেলেটা তোমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তাতে এই শাস্তিটাই ওর প্রাপ্য ছিল। আমি সুদর্শন নামের ছেলেটি সম্পর্কে আগেও কমপ্লেইন শুনেছি। গুন্ডা টাইপ। লেখাপড়া করে না। ড্রপ দিয়ে বসে আছে। শুধু ইউনিয়নবাজি করে। দল বদলের পলিটিক্স। শুনেছি কলেজে একরকম ছাত্র রাজনীতি করত, ইউনিভার্সিটিতে এসে আরেক রকম করছে। যেখানে যাদের ক্ষমতা তাদের সঙ্গে থেকে গুন্ডামি, অসভ্যতা করে।’
বারিধারা বলল, ‘স্যার, ছেলেটা কিন্তু আমার সঙ্গে কিছু করেনি।’
কল্যাণ সমাজপতি আর অরিন্দম স্যার একটু থমকে গেলেন। মুখ চাওয়াচায়ি করলেন। কল্যাণ সমাজপতি ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে করেনি মানে? তুমি সুদর্শনকে চড় মারোনি?’
বারিধারা শান্তভাবে বলল, ‘মেরেছি স্যার। তবে আমার জন্য মারিনি।’
কল্যাণস্যার অবাক হয়ে বললেন, ‘তাহলে কার জন্য মেরেছ?’
তিথির জন্য স্যার। আমাদের ক্লাসের তিথি। ওই ছেলেটা দুদিন আগে সবার সামনে তিথিকে বিশ্রী একটা কথা বলে। স্ল্যাং। তিথি ভীতু ধরনের মেয়ে। সে কোনও প্রতিবাদ করতে পারেনি। পরে আমাকে বলে। আমি বলেছিলাম, ব্যবস্থা নেব। সেই ব্যবস্থাই নিয়েছি।’
অরিন্দমবাবু মাথা নেড়ে অস্ফুটে বলে, ‘একটু ভুল খবর পেয়েছিলাম।’
লবই ভুল করেছে। সে আড়াল থেকে মধুজা রায় আর বারিধারার কথা শুনেছে। কিন্তু তিথি নামটা গুলিয়ে ফেলেছিল। রিপোর্টটা তাই ভুল হয়েছে। নাম গুলিয়ে ফেলাটাই স্বাভাবিক। আজকাল অনেক মেয়ে নিজের বা বন্ধুর অপমানের প্রতিবাদ করে। পথ চলতে গেলে মেয়েদেরে এখনও নানারকম অসভ্যতার মুখোমুখি হতে হয়। আগে মেয়েরা মুখ বুজে থাকত, এখন প্রতিবাদ করে। তবে তার সংখ্যাও আর ক’টা? হাজারে একটা কিনা সন্দেহ। সেই জায়গায় শুধু প্রতিবাদ নয়, একেবারে প্রতিশোধ! তাও আবার নিজের জন্য নয়, বন্ধুর হয়ে।
কল্যাণ সমাজপতি একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘বা: এটা তো আরও ভালো! তুমি একটা এক্সাম্পেল এস্টাবলিশ করলে বারিধারা। অন্যদের শেখা উচিত। অন্যায় করলে পার পাওয়া যায় না।’
অরিন্দম সেনগুপ্ত বললেন, ‘আমিও খুব খুশি হলাম বারিধারা।’
বারিধারা বলল, ‘থ্যাঙ্কু স্যার। কিন্তু আমি কিছু প্রমাণ করবার জন্য করিনি। আমার খুব রাগ হয়েছিল। ছেলেটা যদি কোনও চালাকচতুর সাহসী মেয়ের সঙ্গে এই অসভ্যতাটা করত, আমি হয়তো কিছু করতাম না। একটা সহজ সরল ভীতু মেয়ের সঙ্গে করল বলেই রেগে গিয়েছি। তবে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার, ঘটনা জানাজানি হল কী করে। আমি তো ওই ছেলেকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে চড় মেরেছি। কাউকে বলিওনি।’
অরিন্দমবাবু একটু চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘দেখো বারিধারা, এসব ঘটনা চাপা থাকে না। ওই ছেলেটির হায়ার লেভেলে চেনাজানা আছে। তার মারফতই তোমাদের মধুজা ম্যাডাম বিষয়টা জেনেছেন। আমরা শুনেছি, উনি তোমাকে ডেকে হুমকি দিয়েছেন। ওই ছেলেটির কাছে ক্ষমা চাইতেও বলেছেন।’
কল্যাণস্যার বললেন, ‘শুধু তাই নয় বারিধারা, আমার কাছে খবর আছে, উনি এক্সামিনেশন সেকশনে যোগাযোগ করেছিলেন। তোমার বিভিন্ন পরীক্ষার রেজাল্টের রেকর্ড চেয়ে পাঠিয়েছেন।’
বারিধারা অবাক হল না। মধুজা রায় যে তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে শুরু করবে, সেটা তার আঁচ করাই আছে। তবে রেজাল্ট জেনে কী করবে?’
অরিন্দম সেনগুপ্ত বললেন, ‘আমরা ওখান থেকেই জানতে পেরেছি। আমরা আপত্তিও করেছি।’
বারিধারা বলল, ‘স্যার রেজাল্টের রেকর্ড নিয়ে উনি কী করবেন?’
কল্যাণ সমাজপতি বললেন, ‘কী আর করবেন, চাপ দেবেন ভেবেছিলেন হয়তো। লাভ হবে না। সবক’টা সেমিস্টারেই তুমি ফার্স্ট ক্লাসের থেকে অনেকটা করে এগিয়ে আছ।’
‘ম্যাডাম তো সে কথা জানেন।’ বারিধারা নীচু গলায় বলল।
অরিন্দমস্যার এবার নড়েচড়ে বসলেন।
‘দেখো বারিধারা, তুমি স্টুডেন্ট, একজন টিচারের নামে তোমাকে এভাবে বলা হয়তো ঠিক নয়, কিন্তু তোমরা জানো, তোমাদের মধুজা ম্যাডাম প্রপার টিচারের মতো বিহেভ করেন না। তোমার বেলাতেও করছেন না। তিনি তোমাকে কীভাবে বিপদে ফেলতে চান, উনিই জানেন। তবে তোমাকে রেজাল্টে আটকাতে পারবেন না। অন্য কেউ হলে নম্বর কমিয়ে ফার্স্ট ক্লাস আটকানোর চেষ্টা হত। সেটা সম্ভব নয়। তুমি অনেক এগিয়ে আছ। হয়তো চাপে ফেলতে চান। যাই হোক, তুমি আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন খুব ভালো ছাত্রী। এতদিন জানতাম তুমি পড়াশোনায় ভালো, এখন জেনেছি, তুমি মানুষ হিসেবেও ভালো। এটা ইউনিভার্সিটির জন্য গর্বের কথা। তুমি যদি দেখো, অন্যায়ভাবে কেউ তোমার ক্ষতি করবার চেষ্টা করে জেনে রাখবে, আমরা তোমার পাশে আছি।’
অরিন্দমস্যার এবার একমুখ হেসে বললেন, ‘ব্যস বারিধারা, তোমাকে আমাদের এই সাপোর্টের কথাটা জানানোর জন্যই ডাকা। তুমি মাথা নোয়াবে না।’
বারিধারার খুব আনন্দ হচ্ছে। এত ভালো, এত বড় দুজন মানুষ তাকে এভাবে সমর্থন করলেন, এটা খুব বড় পাওনা। সে অবশ্য বিশ্বাস করে, পৃথিবীটা পুরো নষ্ট হয়ে যায়নি। মধুজা রায়ের মতো মানুষই শুধু নেই, এই পৃথিবীতে অরিন্দমস্যার, কল্যাণস্যারের মতো মানুষও আছেন। তার ঠাকুরদা। কমলকান্তি সেন আছে। জামাইবাবুর মতো মজার পাগলাটে মানুষ আছে। তার মা, দিদির মতো সুন্দর মানুষ আছে। সব থেকে বড় কথা, তার শ্রবণের মতো বোকা অথচ ভালোমানুষ আছে।
বারিধারা চেয়ার থেকে উঠে স্যারদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলে তাঁরা বাধা দেন। অরিন্দম সেনগুপ্ত চাপা গলায় বলেন, ‘যদি মনে করো তুমি কোনও কিছু করবে, আমাদের জানিও।’
বারিধারা একটু থতমত খেয়ে বলল, ‘আমি কী করব?’
কল্যাণস্যার হাত তুলে বলল, ‘আহা তুমি একা নও, যদি ভাবো, তোমরা বন্ধুরা মিলে এর প্রতিবাদে কোনও অ্যাজিটেশন-ট্যাজিটেশন করবে, আমাদের বোলো। সেখানে আমরা গিয়ে তোমাদের সমর্থন করব। কলেজের কোনও স্টুডেন্টের সঙ্গে নোংরা আচরণ করলে শিক্ষকদের উচিত পাশে দাঁড়ানো। সে যেই করুক। গুন্ডাই করুক, আর টিচাররাই করুক।’
বারিধারা একটু ঘাবড়ে গিয়েই বলে, ‘না না, ওসব দরকার নেই স্যার।’
অরিন্দমস্যার একটু যেন হতাশ হলেন। বললেন, ‘না করতে হলেই ভালো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনাই হবে। এটা ক্ষোভ-বিক্ষোভের জায়গা নয়। তার পরেও অনেক ঘটনা বাধ্য করে। যাই হোক, আশা করি তোমার কোনও সমস্যা হবে না। তুমি এসো।’
কল্যাণ সমাজপতি বললেন, ‘তোমাকে আবার অভিনন্দন জানাচ্ছি বারিধারা। আশীর্বাদও করছি। তুমি এইভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।’
বারিধারা মাথা চুলকে একটু দ্বিধার সঙ্গে বলল, ‘স্যার, ব্যাপারটা নিয়ে বেশি হইচই না হওয়াই ভালো। তিথি মেয়েটা নার্ভাস ধরনের। তাকে নিয়ে এত কিছু হলে হয়তো ইউনিভার্সিটিতে আসাই বন্ধ করে দেবে।’
অরিন্দম সেনগুপ্ত এবং কল্যাণ সমাজপতি পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন। অরিন্দম হেসে বললেন, ‘ডোন্ট ওয়ারি বারিধারা। তুমি না চাইলে এটা আর কেউই জানতে পারবে না। এটা তোমার ওপরই নির্ভর করছে। আমরা শুধু একটা কথাই বলতে পারি। একটা ন্যায়ের কাজ করতে গিয়ে অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করাটাও কিন্তু ঠিক নয়। যাই হোক বেস্ট অফ লাক। আশা করি এই বিষয়ে কোনও সমস্যা হবে না।’
কল্যাণস্যার ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আজ মধুজা ম্যাডাম তোমাকে ডেকেছেন না?’
এনারা এতটা দূর জেনে গেছেন। বারিধারা বলল, ‘হ্যাঁ স্যার।’
কল্যাণস্যার বললেন, ‘ওই অসভ্য ছেলেটাকেও তো ডেকেছে।’
বারিধারা মাথা নাড়ল। নীচু গলায় বলল, ‘একটা মিটমাট চাইছেন।’
অরিন্দমস্যার স্থির চোখে বারিধারার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি মিটমাট করবে?’
বারিধারা একটু হেসে বলল, ‘আমার মিটমাট করবার কী আছে স্যার? আমি যা করবার তো করেই দিয়েছি। আমি তিথিকে বলেছিলাম, ওই ছেলেকে শাস্তি দেব। দেওয়া হয়ে গেছে।’
দুই মাস্টারমশাইয়ের কাছে কথাটার মানে খুব স্পষ্ট হল না। বারিধারাও করতে চায়নি। এই দুজনকে সে পছন্দ করলেও নিজের রণকৌশল যুদ্ধের আগে ফাঁস করতে চাইছে না। একানব্বই বছরের দাদু তাকে যে প্ল্যান দিয়েছে, সেটাকেই ঘষেমেজে নিয়েছে।
বারিধারা ঘর থেকে বেরোবার পর কল্যাণবাবু বললেন, ‘মনে হয় মেয়েটা কমপ্রাোমাইজ করে নিচ্ছে।’
অরিন্দমবাবু বললেন, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। মেয়েটা মধুজা রায়ের কাছে সারেন্ডার করবে। ওই ছেলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে।’
কল্যাণবাবু মুখ দিয়ে ‘চুক চুক’ ধরনের আওয়াজ করে বললেন, ‘সমস্যাটা অন্য অরিন্দমদা। বারিধারার চড় মারা হয়ে গেছে। এবার ওর কম্প্রোমাইজ করা বা না করায় কিছু এসে যায় না। কিন্তু মধুজা রায়ের এসে যায়। মেয়েটা যদি ওই ছেলের কাছে ক্ষমা চায়, তাহলে মধুজা রায়ের লাভ। সে ওই পাওয়ারফুল পারসেনের কাছে ক্রেডিট নিতে পারবে। নিজে আরও ক্ষমতা ম্যানেজ করবে। এই ধরনের বিষয়গুলো যে-কোনও মানুষের কাছেই সেনসেটিভ। যাক, আমরা তো বারিধারাকে অনেক উত্তেজিত করবার চেষ্টা করলাম। বললাম, প্রতিবাদ থেকে সোরো না। অ্যাজিটেশন করলে আমরা তোমার পাশে আছি। এর বেশি তো আর বলতে পারি না।’
অরিন্দমবাবু বললেন, ‘ঠিকই তো। আমরা তো বলতে পারি না তুমি একটা হইচই বাধাও।’
কল্যাণবাবু বললেন, ‘ঘটনাটা কিন্তু খুব সেনসেটিভ ছিল অরিন্দমদা। মধুজা রায়কে ছেলেমেয়েরা চেপে ধরতে পারত। খারাপ লোকদের সঙ্গে ওর যোগাযোগ ফাঁস হয়ে যেত। খুব মিস হয়ে গেল।’
অরিন্দমবাবু খানিকটা চুপ করে থেকে, খানিকটা আপনমনেই বললেন, ‘আমার এখনও আশা আছে। আমি পলাশকে একবার ডাকি।’
‘পলাশকে আপনি কিছু বলেছেন নাকি?’
অরিন্দমবাবু মোবাইলে নম্বর টিপতে টিপতে বললেন, ‘বলিনি, হিন্টস দিয়েছি।’
পলাশ এই ইউনিভার্সিটিরই হিস্ট্রির ছাত্র। এবার ফাইনাল দিয়েছে। সে গতবার স্টুডেন্টস ইউনিয়নের আর্টস ফ্যাকাল্টিতে জেনারেল সেক্রেটারি হয়েছিল। এবার নমিনেশন জমা দিতে পারেনি। তাকে নাকি হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তবে বিষয়টা নিয়ে পলাশের নিজেদের দলেই গোলমাল আছে। একদল বলছে, পলাশ ভয়ে নমিনেশন জমা দিতে আসেনি। তাকে কেউ মারেওনি, হুমকিও দেয়নি। এসব অজুহাত। আবার একদল বলেছে, পলাশের মতো লিডারশিপে থাকা ছেলে মার খেলে সাধারণ ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভয় ছড়াত। এমনিতেই এই সময়ে কেউ ক্ষমতার বাইরে থেকে রাজনীতি করতে চাইছে না, এতে তো আরও করবে না। ফলে পলাশের নমিশেন জমা না-দেওয়াটা ঠিক কৌশল হয়েছে। ভয় বা কৌশল যাই হোক না কেন, এই ঘটনায় পলাশের ইমেজে ক্ষতি হয়েছে। তার দলেরও হয়েছে। সে তক্কে তক্কে আছে। ইউনিভার্সিটিতে একটা কোনও গোলমাল পাকিয়ে নিজেদের হারানো জমি যদি খানিকটা ফিরে পাওয়া যায়।
ফোন করবার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পলাশ স্যারেদের কাছে চলে এলো।
ছত্রিশ
তিথির হাঁটু কাঁপছে।
যদিও হাঁটু কাঁপার মতো কোনও কথা মধুজা ম্যাডাম বলেনি। তারপরেও কাঁপছে। তিথির এই একটা সমস্যা। খুব অল্পতে সে নার্ভাস হয়ে যায়। কিছু হওয়ার আগেই নার্ভাস। ঘটনার আগে সাত-পাঁচ ভেবে ঘাবড়ে থাকে। ছোটবেলা থেকেই তার এই অসুখ। সেসব রাস্তায় ছেলেছোকরারা গল্পগুজব করত সেসব রাস্তা দিয়ে পারতপক্ষে স্কুলে যেত না। ছোট মফসসল শহর। সবাই সবাইকে চেনে। এত ভয়ের কিছু নেই। বাড়িতে বাবা, কাকা, খুড়তুতো দাদারা আছে। তাকে কেউ বিরক্ত করলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারপরেও সাহস হত না। ঘুরপথে স্কুলে যেতে সময় লাগত। সে-ও ভি আচ্ছা। একবার কলেজ থেকে বাড়ি ফেরবার সময় বিরাট কেলেঙ্কারি করেছিল। সেই ঘটনা নিয়ে আজও সবাই হাসাহাসি করে।
সেদিন বাড়ি ফিরতে রাত আটটা হয়ে গিয়েছিল। চারটে বত্রিশের গাড়িটা ক্যানসেল হয়ে যাওয়ায় ঝাড়া এক ঘণ্টা হাওড়ায় বসে থাকতে হল। তিথি ঠিকই করেছিল স্টেশন থেকে সাইকেল রিকশা নেবে। স্টেশন থেকে বাড়ি হাঁটাপথে মিনিট তেরো-চোদ্দো। ধীরে সুস্থে হাঁটলে পনেরো। বোসেদের পুকুরপাড় দিয়ে একটা শর্টকাট আছে। সন্ধের পর তিথি ওদিক মাড়ায় না। স্টেশন থেকে বাড়ি এইটুকু পথের জন্য রিকশা নেওয়ার মানে নেই। তারপরেও কোনও কোনওদিন দেরি হলে নিয়ে নেয়। সেদিন স্টেশনের বাইরে এসে রিকশা স্ট্যান্ড ফাঁকা। ব্যাপার কী! যেখানে রিকশার ঠেলায় পথ হাঁটা যায় না, সেখানে একটাও রিকশা নেই কেন? স্টেশনের বাইরে ম্যাগাজিন নিয়ে বসে ‘বাচ্চুদা’। অনেকদিনের চেনা। তিথি এখান থেকে ম্যাগাজিন কেনে। আবার উলটেপালটে দেখে রেখেও দেয়। রান্না বা সিনেমার ভালো কোনও ইস্যু হলে ‘বাচ্চুদা’ নিজে থেকেই সরিয়ে রেখে দেয়।
‘কী হয়েছে বাচ্চুদা? রিকশা কই?’
‘দিদিমণি, আজ আর রিকশা হবে বলে মনে হয় না। কোথায় কে গোলমাল করেছে বলে থানায় তুলে নিয়ে গেছে। সবাই মিলে ছাড়াতে গেছে। না ছাড়লে গোটা রাত বসে থাকবে।’
তিথি মনে মনে প্রমাদ গুনল। এই রে! আজ দেরি, আর আজই রিকশা নেই। অন্যদিন তো প্যাঁ পোঁ, প্যাঁ পোঁ করে কানের মাথা খেয়ে ফেলে।
বাচ্চুদা বলল, ‘নারীর মন পত্রিকায় এবার চিড়িংমাছের অনেকগুলো রেসিপি দিয়েছে, নেবে নাকি?’
তিথি অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আজ থাক বাচ্চুদা।’
তাড়াহুড়ো করে রাস্তায় নেমে এল তিথি। তার কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছে। একেবারেই রাত হয়নি। রাস্তা লোকজনে ভর্তি। হাওড়া থেকে ট্রেন এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই ভিড় হবে। তারপরেও তিথির অস্বস্তি হচ্ছে। কারণ কী? কারণ একটা লম্বা মতো লোক। ট্রেন থেকেই এই অচেনা লোকটা তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছিল। ট্রেনে ‘মেয়ে দেখা’ পুরুষমানুষ অনেক দেখেছে তিথি। গা সাওয়া হয়ে গেছে। মুখ ফিরিয়ে রাখলেই হল। কিন্তু এই লোক তার সঙ্গে স্টেশনে নেমেছে। সে যখন বাচ্চুদার সঙ্গে কথা বলছিল, তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট কিনছিল। এই কারণে অস্বস্তি। একটু পরে তিথি বুঝল অস্বস্তি নয়, তার ভয় করছে। কারণ ঢ্যাঙা লোকটা মনে হচ্ছে, তার পিছু নিয়েছে। কী হবে? তিথি হনহন করে হাঁটতে শুরু করল। লোকটাও মনে হয় স্পিড বাড়াল। তিথি এবারে নার্ভাস হয়ে গেল। তার বাড়ির এই পথটা একটু নির্জন। তার মানে এই নয় যে শুনশান। দোকান-টোকানও রয়েছে। চেনা দোকান। কোনও একটা দোকানে ঢুকে যাবে? ঢুকে কী বলবে? হাবিজাবি কিছু কিনবে? নাকি বলবে, ‘ও দাদা, ওই লোকটা আমাকে ফলো করছে। ওকে ধরুন।’ তারপর লোকজন বেরিয়ে এসে যদি সত্যি ধরে? মারধর শুরু করে যদি? যদি কেন, নিশ্চয় করবে। পাড়ার মেয়েকে অচেনা লোক সন্ধেবেলা ফলো করলে তাকে তো আর বসিয়ে রসগোল্লা খাওয়াবে না। কিন্তু তারপর? বিরাট একটা হইহুল্লোড় শুরু হয়ে যাবে। এখানে সবাই জেনে যাবে, তিথির পিছনে একটা লোক ঘুরঘুর করছিল তাকে ধরে ঠ্যাঙানো হচ্ছে। এইসব খবরে মানুষ মজা পায়। যাকে ধরা হয়েছে তাকে যেমন দেখতে চায়, যার পিছনে লেগেছিল তাকেও দেখবার জন্য ভিড় করে। ইস! মাগো! তিথি ঘামতে শুরু করল। না না, ওসব করা যাবে না। দাদাদের কাউকে ডেকে নেবে? মোবাইলে ধরবে? কিছু বলবে না। শুধু বলবে এসে আমাকে বাইকে নিয়ে যা। তারও উপায় নেই। দুজন দাদাই এখন বাইরে। তিথি মুখ ফ্যাকাশে করে আরও জোরে হাঁটতে শুরু করল। এবার একটা গলিতে ঢুকতে হবে। গলিটা সন্ধে হলেই নিঝুম হয়ে যায়। কী হবে? লোকটা তাকে ফলো করছে কেন? কিছু বলবে? খারাপ কথা নিশ্চয়। বাড়ি-টাড়ি চিনে যাওয়ার ফন্দি নেই তো। খবরের কাগজে প্রায়ই এরকম খবর থাকে। মেয়েদের বাড়ি চিনে যাওয়ার পর ওঁত পেতে থেকেছে। আচ্ছা, অ্যাসিড ট্যাসিড ছুড়বে না তো! হয়তো পুরোনো কোনও রাগ আছে। তাকে হয়তো কোনওসময় প্রেমপত্র দিয়েছিল। তিথি পাত্তা দেয়নি। গলিতে ঢুকে তিথি প্রায় দৌড়োতে শুরু করল। লোকটাও দৌড়োচ্ছে নাকি! তাই তো মনে হচ্ছে! কী ভয়ংকর!
‘অ্যাই মেয়ে, অ্যাই মেয়ে।’
ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় লোকটা ডেকে উঠল। তিথির মনে হল ভয়ে মারাই যাবে। ওই তো বাড়ি। হাঁপাতে হাঁপাতে তিথি কোনওরকমে বাড়ির গেটের ওপর গিয়ে পড়ল। লোকটাও এসেছে।
‘অ্যাই, তুই শঙ্করের মেয়ে না? তোর নাম তো তিথি? আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি মন্টুমামা।’
তিথি আকাশ থেকে পড়ল। মন্টুমামা! দিল্লির মন্টুমামা!
মন্টুমামা পাশে এসে একগাল হেসে বলল, ‘অবশ্য তুই চিনবিই বা কী করে? লাস্ট দেখেছিস বারো বছর আগে। আমার কিন্তু তোকে ট্রেন থেকেই চেনা চেনা লাগল। আসলে ছোড়দির মুখটা পেয়েছিস তো। মনে হচ্ছিল ছোড়দি বসে আছে। একটু পরেই চিনে ফেললাম।’
তিথি স্বস্তি, আনন্দ, সাহস ফিরে পাওয়ায় ঢোঁক গিলে বলল, ‘মন্টুমামা আপনি এখানে!’
মন্টুমামা আরও হেসে বলল, ‘কেন, এখানে আসতে পারি না? তোরা তাড়িয়ে দিবি? কলকাতায় এসেছি। তোদের সারপ্রাইজ দিতে কাউকে না বলে চলে এসেছি। ভেবেছিলাম স্টেশনে নেমে ঠিকানাটা একবার ঝালিয়ে নেব। কতদিন আগে এসেছিলাম। তোকে চেনবার পর মনে হল মজা করা যাক। চুপচাপ ভাগ্নিকে ফলো করে দেখি পৌঁছতে পারি কি না।’
তিথিও এক গাল হেসে বলল, ‘উফ! আর আমি ভেবেছিলাম…ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হওয়ার জোগাড়।’
এই গল্প আজও চলে। কলেজে পড়া মেয়ে, নিজের পাড়ায় যদি এত নার্ভাস হয়ে যায় তা নিয়ে হাসিঠাট্টা চলবেই। তবে এখন হাসিঠাট্টার সিচুয়েশন নেই। এখন তিথির হাঁটু কাঁপছে।
মধুজা রায় তাকে ঘরে ডেকে উলটো দিকের চেয়ারে বসতে বলেছেন। তিথি বসবার পর তিনি একটু সময় চুপ করে থেকেছেন। তারপর ঠান্ডা গলায় কথা বলেছেন।
‘তিথি তুমি কি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে চাও না?’
এই কথা হাঁটু কাঁপার মতো কোনও কথা নয়। টিচাররা হামেশাই স্টুডেন্টকে এরকম কথা বলে। হয়তো কোনও একটা পরীক্ষা খারাপ হয়েছে, অথবা নোটস তেমন হয়নি। আবার ক্লাস ফাঁকি দিলেও বলে। এতে ভয় পাওয়ার কী আছে? আছে। মধুজা রায় যখন এ কথা বলে, তখন ছেলেমেয়েরা ভয় পাবে বই কী। এই মহিলার হাতে অনেক ক্ষমতা। তিনি এমন বলছেন মানে, হুমকি দিচ্ছেন।
তিথি কাঁপা গলায় বলল, ‘ম্যাম, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না…আমি কি কোনও ভুল করেছি?’
মধুজা রায় চেয়ারে হেলান দিলেন। আজ তিনি মুখে মেকাপ দেওয়ার সময় সম্ভবত অন্যমনস্ক ছিলেন। মুখ আর গলার সঙ্গে রঙের পার্থক্য হয়ে গেছে। তা ছাড়া বয়স কমানোর আয়োজন মুখে হলেও গলায় হয়নি। গলার চামড়া কুঁচকে গেছে। শীতের সময় মধুজা রায় গলা ঢাকবার জন্য রকমারি মাফলার পড়েন।
‘ভুল করোনি, ভুল করতে চলেছ।’
এই হেঁয়ালি ধরনের কথায় তিথি আরও নার্ভাস হয়ে গেল।
‘ম্যাডাম সত্যি আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি কী করেছি?’
মধুজা রায় সামনে রাখা একটা কাগজ তুলে নিয়ে বললেন, ‘ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন ছেলেমেয়ের গত কয়েকটা পরীক্ষার রেজাল্ট দেখছিলাম। তোমার রেজাল্ট তো খারাপ নয় তিথি। আর একটু মন দিলে আরও ইমপ্রুভ করতে পারবে।’
তিথি ঠিক বুঝতে পারে না। মধুজা ম্যাডামের এই পরামর্শও কি হুমকি?’
মধুজা রায় গলা নরম করে বললেন, ‘ভালো রেজাল্ট না হলে ভালো কেরিয়ার করবে কী করে?’
তিথি মাথা নামিয়ে বলল, ‘চেষ্টা করব ম্যাম।’
মুখে বললেও তিথি অবশ্য জানে তার কেরিয়ারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সেই কেরিয়ার চাকরিবাকরি নয়, সেই কেরিয়ার বিয়ে। খুব শিগগিরই তার বিয়ে। ছেলের বাড়ির সঙ্গে কথা পাকা হয়ে গেছে। তিথির ফাইনাল পরীক্ষার ক’দিন পরেই তারিখ ঠিক হয়েছে। তিথি ইউনিভার্সিটিতে কাউকে এ কথা বলেনি। বারিধারাকেও নয়। এখন বলবেও না। বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েদের কলেজ ইউনিভার্সিটিতে সমস্যা হয়। কেমন যেন আলাদা আলাদা হয়ে যায়। কলেজে পড়বার সময় ক্লাসে ভ্রমর নামে একটা দারুণ মেয়ে ছিল। সবার সঙ্গে মজা করত। হইচই করত। টেবিল বাজিয়ে গান করত, নাচত, ক্লাস কেটে সিনেমা যেত, কমনরুমে বসে সিগারেটও টানত। সব মেয়েরা ভ্রমরকে পছন্দ করত। এরা হল চারপাশ জমিয়ে রাখা মেয়ে। সব অনুষ্ঠানে ভ্রমরকে চাই। সেই মেয়ের একদিন দুম করে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। ব্যস, ভ্রমরও চুপ মেরে গেল, মেয়েরাও তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। এখন সব গল্প নাকি তার সঙ্গে করে মজা নেই। ও নাকি এখন হবু বর ছাড়া কোনও মজাতেই মন দিতে পারবে না। কী বিশ্রী! ইউনিভার্সিটিতেও এই ঘটনা হয়েছে। এই তো কিছুদিন আগে কথাকলির বিয়ে হল। বিয়ের আগে ওর সঙ্গে সবাই ঠাট্টা ইয়ার্কি শুরু করল। তার মধ্যে নিরামিষ, আমিষ দু’রকমের ঠাট্টাই ছিল। মেয়েরা তো বলছিলই, ছেলেরাও কম যায়নি। কেউ জলের বোতল নিয়ে মাতাল দেবদাসের মতো অভিনয় করত। কেউ বলত, ‘ধুস তোর পাশে বসে আর লাভ নেই। নো চান্স।’ এইসব কারণেই বিয়ের কথা এখনই কাউকে জানাতে চায় না তিথি। তা ছাড়া একটা লজ্জার ব্যাপারও আছে। দিল্লির সেই মন্টুমামাই এই সম্বন্ধ এনেছে। সম্বন্ধ অতি লোভনীয়। ছেলে সফটঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। সে নিজেও যেমন লেখাপড়া করেছে, বউও চায় পড়াশোনা জানা। শুধু সুন্দরীর হলে হবে না, মেয়ের ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি থাকা চাই। পাঁচজনকে যেন বলা যায়। ছেলে এখন পুনেতে আছে। এরপর মিডল ইস্টে কোথাও বদলি হবে। কুয়েত বা আবুধাবি। কোম্পানি মোটা বেতন, বাংলো, গাড়ি সব দেবে। ছেলের রসিকতা করবার শখ আছে। এর মধ্যে রাতে একদিন লুকিয়ে ফোন করেছিল। মোবাইলে অচেনা নম্বর দেখে দুবার লাইন কেটেও দেয় তিথি। তিনবারের বার ধারে।
‘তিথি কেমন আছ?’
‘আপনি কে?’
‘বলো তো আমি কে?’
তিথি ভয় পেয়ে আবার ফোন কেটে দেয়। ফের ফোন বাজে।
‘ফোন কেটে দিলে কেন তিথি?’
তিথি কড়া গলায় বলল, ‘আপনি কে?’
‘আমি তোমার বর। পুনে থেকে বলছি।’
তিথির বুক ধক করে ওঠে। পুনে থেকে ‘ও’ ফোন করেছে! কী ‘দুষ্টু’! নামটাও বলছে না।
‘কেমন আছো তিথি?’
তিথির ঘরে কেউ থাকে না। তারপরেও সে ঘরের চারপাশ ভালো করে দেখে ফিসফিস করে বলল, ‘আপনি আমার নম্বর পেলেন কোথা থেকে?’
‘বলব কেন? বরেরা সব সময় হবু বউয়ের টেলিফোন নম্বর পেয়ে যায়। তার জন্য পরিশ্রম করতে হয় না।’
তিথির শরীরে এবার একসঙ্গে অনেকরকম কিছু হতে লাগল। লজ্জা, ভয়, ঝিমঝিমানি। এমন নয় সে কোনও দিন ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেনি। বহুবার বলেছে। ইউনিভার্সিটিতেই ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। এই পুরুষ মানুষের গলা শুনে তা হলে কেন এমন হচ্ছে?’
‘তিথি, তোমাকে একটা জরুরি কথা বলতে ফোন করেছি।’
তিথির মজা লাগল। বলল, ‘কী কথা?’
‘তুমি যখন বিয়ের পোশাক-টোশাক কিনবে তখন মনে করে একটা জিনিস কিনো। এটা তুমি বাড়ির কারও হাতে ছেড়ো না। তারা না জানলেই ভালো।’
তিথি অবাক হয়ে বলল, ‘কী জিনিস?’
‘আসলে কী জানো তিথি, মিডল ইস্টে আমাদের কোম্পানির সবক’টা বাংলোতে সুইমিং পুল আছে। আমি যেটায় যাব সেটাতেও থাকবে। হট অ্যান্ড কোল্ড ওয়াটার সিষ্টেম।
তিথি খুব খুশি হল। নিজের বাড়িতে সুইমিং পুল সে শুধু সিনেমাতেই দেখেছে। এবার সত্যি সত্যি দেখবে।
‘তুমি কি সাঁতার জানো তিথি?’
তিথি বলল, ‘না জানি না।’
‘কোনও সমস্যা নেই। আমি শিখিয়ে দেব। তুমি মনে করে অবশ্যই একটা সুইমিং কস্টিউম কিনে রাখবে। ওখানেও পাওয়া যাবে। কিন্তু সে আবার খোঁজ করতে করতে সময় নষ্ট। তার থেকে রেডি থাকাই ভালো।’
তিথি কিছু বলতে পারল না। তার লজ্জা করছে। সুইমিং কস্টিউম মানেই তো ছোট পোশাক। ইস!
‘বিকিনি হলে সবথেকে ভালো হয়। বিকিনি পরলে তোমার সুইম করতেও মজা, আমার শেখাতেও মজা।’
তিথির কান গরম হয়ে গেল। তার মনে হল, এই ছেলে যদি সামনে থাকত তা হলে সে পিঠে কিল মারত। বলত, ‘খুব আহ্লাদ না? বউকে বিকিনি পরিয়ে দেখবার খুব শখ হয়েছে না?’
এসব কথা কাউকে এখন বলা যায়? মধুজা ম্যাডাম কেরিয়ারের কথা বলছেন, চুপচাপ ঘাড় নাড়াই ভালো। তবে পরীক্ষায় ঠিকমতো পাস করতে হবে। নইলে বর বাবাজি খেপে যাবে। তার বিকিনিও চাই আবার এমএ ডিগ্রিও চাই। তবে বউ কাজকর্ম করবে না। বাড়িতেই থাকবে। ঘরসংসার করবে। সে-কথা ছেলের মা খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে। তিথির মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে তার।
‘দেখুন দিদি, মাছে-ভাতের মতো আমার ছেলে হল পোস্তর বড়া আর চচ্চড়ির বাঙালি। বাইরে সে বাংলো পাবে, গাড়ি পাবে বেয়ারা বাবুর্চি পাবে, কিন্তু পোস্তর বড়া পাবে না। সেই জন্যই বিয়ে। তার খুব শখ মায়ের মতো বউও রেঁধেবেড়ে খাওয়াবে। বউয়ের চাকরিবাকরির কোনও ব্যাপার নেই। ঘর সংসার করবে, গাড়ি চালিয়ে শপিংয়ে যাবে। বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি গেলে যত্ন আত্তি করবে। আমার হীরের টুকরো ছেলে এরকম বউ চায়। চাকরি করা বউ নয়, লক্ষ্মী বউ।’
তিথির মা গদগদ গলায় বলেছেন, ‘কোনও চিন্তা করবেন না দিদি, মেয়েকে আমি সব বাঙালি রান্না শিখিয়ে দেব। হাতে সময় আছে।’
এসব কথা বাইরে বলার কী আছে? মধুজা রায় যেমন কেরিয়ারে কথা বলছেন বলুন না।
মধুজা রায় সোজা হয়ে বসলেন। ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘ভেরি গুড। তিথি, তোমার সঙ্গে আমি একটা জরুরি কথা বলব। জরুরি আর গোপন।’
আবার তিথির হাঁটু কেঁপে উঠল। ‘ধান্দা রায়’-এর মতো মানুষের গোপন কথা মানে নিশ্চয় খুব ভয়ের।
গোপন কথা বলবেন বলে মধুজা রায় খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
তিথির ভয় বাড়ছে। ‘গোপন কথা’ ব্যাপারটা যেমন ইন্টারেস্টিং তেমন ভয়েরও। ভালো মানুষ বললে ইন্টারেস্টিং। পাজিরা বললে ভয়ের কথা হয়। ‘ধান্দা রায়’ ম্যাডাম পাজি মানুষদের দলে। তবে আর এক রকম ‘গোপন কথা’ও আছে। সেইকথা শুনলে ‘মুখ লাল’ করে দৌড়ে পালাতে হয়। সেইরকম গোপন কথাও তিথি একবার শুনেছে। তখন ক্লাস এইট। মামাতো দাদার বন্ধু মিন্টুদা তাকে ‘গোপন কথা’ বলেছিল। সেই ঘটনা আজও স্পষ্ট মনে আছে তিথির। কারণ সেই ‘গোপন কথা’ ভয়ঙ্কর। গা ছমছমে।
গরমের ছুটিতে কাঁকিনাড়ায় মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল তিথি। খুব মজা হল। মামাতো দাদা সবে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়েছে। বিরাট কোনও বয়সের পার্থক্য নয়। অনেকটা বন্ধুর মতোই। দাদার বন্ধুরা সেরকম। সবার কাছেই তিথি সহজ। এক দুপুরে মিন্টুদা এল। তিথি তখন বারান্দায় বসে মামিমার করা লেবু আচার খাচ্ছিল।
‘তিথি, তোর দাদা কোথায়?’
তিথি বলল, ‘ঘুমোচ্ছে। দাঁড়াও ডাকছি।’
মিন্টুদা কী একটা ভেবে নিয়ে বলল, ‘দাঁড়া ডাকতে হবে না। অ্যাই শোন, তোর সঙ্গে একটা কথা আছে।’ তিথি তখন আরও বোকা ছিল। কাউকে সন্দেহ করত না। মিন্টুদাকে করার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। অবাক হয়ে বলল, ‘কী কথা মিন্টুদা?’
মিন্টুদা এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘এখানে বলা যাবে না। ছাদে চল, ছাদে গিয়ে বলব। গোপন কথা।’
তিথি ভুরু কুঁচকে বলল, ‘এখানেই বলো না। এই রোদে ছাদে কেন?’
মিন্টু চাপা গলায় বলল, ‘এই বিকেলে রোদ কোথায়? তুই ছাদে আয়, আমি অপেক্ষা করছি।’
তিথি কৌতূহল নিয়ে ছাদে গেল। ছাদের একপাশে, যেদিকটায় ছায়া পড়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে মিন্টুদা সিগারেট খাচ্ছিল। তিথিকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকল। কাছে গিয়ে তিথি বুঝল, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। মিন্টুদার মধ্যে কেমন যেন ছটফটে ভাব। কী হয়েছে?
মিন্টুদা বলল, ‘কাউকে বলবি না?’
তিথি একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কী কথা বলবে তো মিন্টুদা।’
মিন্টুদা বলল, ‘আর একটু সরে আয়।’
তিথি অবাক হল। তার ভিতরে কেমন একটা অস্বস্তি হল। মেয়েদের এই একটা গুণ। তাদের ভিতরে একজন কেউ থাকে যে সতর্ক করে। কিন্তু মিন্টুদাকে তো অনেকদিন ধরেই চেনে। খুব ভালো ছেলে। লেখাপড়ায় ভালো। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়েছে। ডাক্তারিতে চান্স পাবে। তবে শুধু বই মুখে থাকা টিপিক্যাল ‘গুডবয়’ নয়। খেলাধুলো করে, গল্প উপন্যাস পড়ে, নাটকের বই পড়ে। মামাবাড়ির সবাই মিন্টুদাকে পছন্দ করে। তিথিও করে। তাকে নানারকম বই পড়তে দিয়েছে। তার আজ হঠাৎ কী হল! তিথিকে একলা ছাদে ডেকে পাঠাল কেন? তাকে কাছে যেতেই বলছে কী জন্য?
তিথি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘এখান থেকেই বলো।’
মিন্টুদা হাতের সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ‘তোর মামিকে একটা কথা বলতে হবে।’
‘কী কথা?’
মিন্টুদা ছাদের দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলবি তাদের ছেলে বাজে কিছু লোকের পাল্লায় পড়েছে।’
‘দাদা, দাদার কথা বলছ?’
মিন্টুদা ঠোঁটে হাত দিয়ে বলল, ‘শ শ। হ্যাঁ তোর দাদা। যে লোকগুলো তাকে ধরেছে, তারা তোর দাদাকে নানারকম ভুল বোঝাচ্ছে। পথে নামাতে চাইছে। আমি অনেক বুঝিয়েছি, শুনছে না। বলছে এসব রাজনীতির বিষয়। আমার নাকি মাথায় ঢুকবে না। আমার ভয় করছে, এভাবে চলতে থাকলে, তোর দাদা বড় কোনও গোলমালে ঢুকে পড়বে। পুলিশ ধরেও নিয়ে যেতে পারে। লোকগুলো ভালো না। নিজেদের ধান্দায় মানুষকে তাতাচ্ছে। আমাকেও বলতে এসেছিল। হাটিয়ে দিয়েছি।’
তিথির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। মিন্টুদা কী বলছে এসব! দাদাকে পুলিশে ধরতে পারে। এর মানে কী?
‘মিন্টুদা, তুমি বলো।’
মিন্টুদা গলা নামিয়ে বলল, ‘এইটা পারব না। তোর দাদা, আমাকে দিয়ে প্রমিস করিয়ে নিয়েছে। ও যে পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়েছে, সেটা ওর বাবা-মাকে আমি বলতে পারব না। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। একবার ভাবলাম, তোর মামিমাকে উড়ো ফোন করব? তোর মামার নামে বেনামে চিঠি লিখব? তোকে আজ দেখে চট করে মাথায় বুদ্ধিটা এসে গেল। তুই তো কাল বাড়ি ফিরে যাবি। যাবার আগে মামিমাকে বলে দে। বলবি, তোর কথা যেন না বলে। দেরি হয়ে গেলে বিপদ হয়ে যেতে পারে।’
তিথির মনে হল, সে কেঁদে ফেলবে। কোনও রকমে বলেছিল, ‘কী বলব?’
‘বলবি, দাদা কিছু বাজে লোকের পাল্লায় পড়েছে। এখনই আটকাও।’
‘মামিমা যদি জানতে চায়, কে বলেছে?’
মিন্টুদা একটু ভেবে মাথা চুলকে বলল, ‘বলবি… বলবি তুই ওর বন্ধ দরজার বাইরে থেকে টেলিফোনের কথা শুনেছিস।’
তিথি বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘কথা শুনেছি! আড়ি পেতে কথা শুনেছি? কী কথা?’
মিন্টুদা উত্তেজিত গলায় বলল, ‘বলবি…। কাকে যেন বোমা-টোমার কথা বলছিল। এইটুকু মিথ্যে না বললে কিন্তু তোর দাদাকে বাঁচানো যাবে না তিথি। একদিন খুব বড় রকমে ফেঁসে যাবে।’
তিথি এরপর আর ছাদে থাকতে পারেনি। এই ‘গোপন কথা’ শুনে ভয়ে মুখ লাল করে দৌড়ে নেমে পড়েছিল। তবে মামিমাকে কিছু বলতে হয়নি। সেদিন মামা অফিসেই কার কাছ থেকে ছেলের নামে খবর শুনে এসেছিল। সে নাকি পলিটিক্সের নামে যারা বোমা মারে, আগুন ধরায়, মানুষ মারে তাদের দলে নাম লিখিয়েছে।
এইরকম গোপন কথাও তো আছে। মধুজা রায়ের কথা নিশ্চয় সেরকম নয়। কী বলবেন?
একটু সময় চুপ করে রইলেন মধুজা রায়। সম্ভবত মনে মনে ঠিক করে নিলেন, কীভাবে শুরু করবেন। তারপর তিথির চোখে চোখ রেখে চাপা গলায় বলতে শুরু করলেন।
‘তিথি, সেদিন কী হয়েছিল?’
তিথি অবাক হয়ে বলল, ‘কোনদিন ম্যাডাম?’
মধুজা রায় ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘সে কী! তোমাকে নিয়ে এত বড় কাণ্ড হয়ে গেল, আর তোমারই মনে পড়ছে না!’
তিথি ভয়ে ভয়ে বলল, ‘ম্যাডাম আপনি কী বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমাকে নিয়ে কী কাণ্ড হয়েছে!’
মধুজা আবার চুপ করলেন। এতক্ষণ টেবিলের কাছে এসে কথা বলছিলেন, এবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘স্ট্রেঞ্জ! তোমার ব্যাপার তোমারই মনে নেই! যাক, আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। সুদর্শন নামে ছেলেটার সঙ্গে তোমার গোলমাল হয়েছিল। কী গোলমাল?’
তিথি এবার বুঝতে পারল। কিন্তু সে ঘটনা তো নিজেই ভুলে গেছে। ম্যাডাম জানলেন কী করে? তাছাড়া ইউনিভার্সিটিতে এটা নিয়ে তো কোনও কাণ্ডই হয়নি। নাকি তার আড়ালে কিছু হয়েছে? ছি ছি। ব্যাপারটাই এত নোংরা, জানাজানি হলে লজ্জার শেষ থাকবে না।
‘কী হল চুপ করে আছ কেন তিথি? গোলমালটা কী হয়েছিল?’
তিথি অস্ফুটে বলল, ‘ম্যাডাম, সেসব তো মিটে গেছে।’
মধুজা রায় ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘মিটে গেছে! তোমার সঙ্গে ওই ছেলের কোনও ঝামেলা হয়নি?’
তিথি বলল, ‘আমি কোনওরকম ঝামেলায় থাকি না।’
মধুজা রায় ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসলেন। তাহলে তার খবর ঠিক। তিথি মেয়েটি নার্ভাস প্রকৃতির। শুধু নার্ভাস নয়, ভীতুও।
ডিপার্টমেন্টের দুজন মেয়েকে ডেকে খোঁজ নিয়েছেন। দুজনেই একই কথা বলেছে। কথাকলি আর বিষ্ণুপ্রিয়াকে আলাদা আলাদা করে ডেকেছিলেন।
‘তোমাদের ইয়ারের একজন ডাকাবুকো মেয়ের নাম বলো তো। দিল্লিতে একটা সেমিনার হচ্ছে, সেখানে পাঠাব। মিনমিনে টাইপ হলে হবে না।’
কথাকলি বলেছিল, ‘আমি যেতে পারি ম্যাডাম। আমি তো কলেজে ডিবেটে ফার্স্ট হতাম।’
মধুজা বললেন, ‘এটা কলেজ নয়। ডিবেটও নয়। সেমিনারের পর অডিয়েন্সের কোয়েশ্চেন ফেস করতে হবে। তারা চেপে ধরবে। শুনেছি, তিথি নাকি বেশ সাহসী মেয়ে।’
কথাকলি চোখ কপালে তুলে বলল, ‘তিথি! না না ম্যাডাম। ওই মেয়ে খুব ভীতু। দিল্লি যাবে কী, আমাদের সঙ্গে নন্দন পর্যন্ত যেতেই ভয় পায়।’
পরে বিষ্ণুপ্রিয়াকে ডেকেও কথাটা যাচাই করে নিলেন মধুজা রায়। যাকে ভয় দেখাবেন, সে কতটা সাহসী সেটা তো জেনে নিতে হবে। কৃষ্ণকলিকে অন্য কায়দায় জিগ্যেস করলেন।
‘ডিপার্টমেন্টের ক’জন স্মার্ট মেয়ের নাম বলো তো কৃষ্ণকলি। দিল্লিতে একটা ইউথ প্রাোগ্রামে পাঠাব। সেমিনার টেমিনার হবে। ওরা ছেলেমেয়েদের নাম চাইছে। প্রাোগ্রামের দেরি আছে, তবে এখন থেকে নাম পাঠাতে বলছে। তিথি কেমন হবে?’
কৃষ্ণকলি বলল, ‘খুব খারাপ হবে ম্যাডাম। ওর মতো ক্যাবলা, নার্ভাস মেয়ে এই ডিপার্টমেন্টে আর একজনও নেই। আর যাদেরই আপনি টিমে নিন, তিথিকে নেবেন না।’
মধুজা রায় খুশি হলেন। তিনি যেমন যেমন চাইছিলেন, তিথির মধ্যে তার সবক’টা গুণই আছে।
‘তুমি কোনও ঝামেলায় থাকো না শুনে আমার খুব ভালো লাগল তিথি। একজন ভালো স্টুডেন্টের সেটাই হওয়া উচিত। সে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে। কেরিয়ার করতে আসে। ঝামেলা করতে আসে না। আমি বুঝতে পারছি, তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হবে। তুমি নিজের মতো চেষ্টা করো, বাকিটা তো আমি রইলাম।’
এই দুশ্চিন্তার মধ্যেও তিথির মনটা খুশি খুশি হল। মধুজা ম্যাডাম পাজি হলে কী হবে, ক্ষমতা প্রচুর। উনি যদি সঙ্গে থাকেন পরীক্ষায় অনেক সুবিধে। আর ভালো রেজাল্ট হলে তো কথাই নেই। বর নিশ্চয় খুব খুশি হবে। তাকে যখন সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে, তখন বলবে, ‘এই আমার স্ত্রী তিথি। মেয়ে খুবই ভালো। শুধু রূপে-গুণে নয়, লেখাপড়াতেও এক নম্বর। ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছে।’ তিথির শুনতে খুব ভালো লাগবে। তার নিজের জন্য নয়, বরের জন্য ভালো লাগবে। সে বিশ্বাস করে, বিয়ের পর মেয়েদের নিজের সুখদু:খ বলে কিছু থাকে না। স্বামীর সুখদু:খই বউয়ের সুখদু:খ।
মধুজা রায় এক মুখ হেসে বললেন, ‘ভেরি গুড। এই তো একটা ভালো স্টুডেন্টের মতো কথা। ভালো ছেলেমেয়েদের অন্য কোনও ঝামেলায় থাকতে নেই। তাদের একটাই ঝামেলা, কীভাবে রেজাল্ট ভালো করা যায়। আমি যত তোমার সঙ্গে কথা বলছি, তত খুশি হচ্ছি তিথি। কিন্তু আমাকে তো একটা কথা তোমাকে বলতে হবে মাই ডটার।’
তিথি বলল, ‘কী?’
‘সুদর্শন সেদিন অনেকের সামনে তোমাকে কী বলে অপমান করেছিল?’
তিথির কান লাল হয়ে গেল। এখন এসব আলোচনা কেন? যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। দুদিন পরে তার বিয়ে, এই সময় তাকে নিয়ে কোনও খারাপ ছেলে কী নোংরা কথা বলেছে, সেটা নিয়ে চর্চার কী প্রয়োজন?
মধুজা ম্যাডাম বোধহয় ছাত্রীর লজ্জা, ভয় বুঝতে পারলেন। তিনি টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন।
‘তিথি, আমার জানা দরকার। তুমি আমার কাছে সংকোচ কোরো না। তুমি হয়তো জানো, ঘটনাটা নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে একটা ঘোঁট পাকানোর চেষ্টা হচ্ছে। তোমার বন্ধুরা করছে, কয়েকজন মাস্টারমশাইও করছে।’
তিথির হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। নোংরা কথাটা নিয়ে তার আড়ালে আলোচনা হচ্ছে! সে কাঁপা গলায় বলল, ‘সে কী! আমি তো কিছুই জানি না।’
মধুজা ম্যাডাম বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন, ‘যারা ঘোঁট পাকায়, তারা এরকমই হয়। যাকে নিয়ে সমস্যা, সে জানতেও পারে না। তোমার মতো ভালো মেয়ে এসব বুঝবে না।’
তিথি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমি কিছু জানি না ম্যাডাম। আমি তো কাউকে কিছু বলিনি। বিশ্বাস করুন ম্যাডাম।’
মধুজা রায় বললেন, ‘তুমি বলোনি হয়তো, কিন্তু সেদিন যারা কথাটা শুনেছিল, তারা গোলমাল পাকাতে চাইছে। হয়তো ভাইস চ্যান্সেলর পর্যন্ত বিষয়টা যাবে। তখন একটা হুলুস্থুলু হবে।’
তিথির মনে হল, সে কেঁদে ফেলবে।
‘ম্যাডাম, আপনি আমাকে বাঁচান। আমাকে জড়িয়ে কোনও কিছু আমি চাই না।’
মধুজা রায় এই কথাটার জন্যই যেন এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি তো তোমাকে বাঁচাতে চাই। সেই জন্যই তো তোমার রেকর্ড দেখেছি, তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি, তোমাকে বললামও, তুমি ভুল করছ। কথাটার মানে কী? কথাটার মানে হল, তোমার উচিত ছিল, আমার কাছে এসে সবটা বলা। উচিত ছিল কিনা?’
‘ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম।’
মধুজা ম্যাডাম নরম গলায় বললেন, ‘যাক, ভুল হয়েছে। এবার ভুল সংশোধন করো। আমাকে সব বলো। ওই বদ ছেলে তোমাকে কী বলেছিল?’
তিথির এখন আর মধুজা ম্যাডামকে অত খারাপ লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে, ইনি সত্যি তাকে সাহায্য করতে চান।
‘খারাপ কথা ম্যাডাম।’
মধুজা রায় চোখ সরু করে থমথমে গলায় বলেছিলেন, ‘আমি শুনতে চাই।’
তিথি ঢোঁক গিলল। পিছনের বন্ধ দরজার দিকে তাকাল। মধুজা রায় বললেন, ‘বলো তিথি। আমাকে সংকোচ কোরো না। আমি তোমার দিদির মতো। আমার জানা দরকার।’
তিথি মাথা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘সুদর্শন আমাকে সেদিন অনেকের সামনে বলেছিল, তোর মুখটা খুব সুন্দর। বুকটাও কি এত সুন্দর? আমরা কি দেখতে পারি?’
কথাটা বলে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল তিথি।
অপমানের কান্না।
মধুজা রায় খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তিথিকে কাঁদতে দিলেন। তারপর বললেন, ‘আমি যদি ওই বদ ছেলেটাকে কড়া শাস্তি দিই, তুমি খুশি হবে।’
তিথি মুখ তুলে বলল, ‘ম্যাডাম, আমি কিছু চাই না। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এই ঘটনাটা নিয়ে শোরগোল হলে বিয়ে ভেঙে যাবে।’
মধুজা রায় খানিকটা থমকে গেলেন। পরক্ষণেই এক গাল হেসে বললেন, ‘বা: দারুণ খবর। কনগ্র্যাচুলেশন।’
তিথি নাক টেনে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘ও চায় আমি যেন ভালো করে পাস করি। আমাকে নিয়ে এসব বিশ্রী ঘটনা ঘটলে হয়তো…।’
মধুজা রায় বললেন, ‘ভেরি, ভেরি গুড। খুব খুশি হলাম।’
তিথি বলল, ‘আপনি এসব গোলমাল আটকান ম্যাডাম।’
মধুজা রায় চিন্তিত হওয়ার ভান করে বললেন, ‘আটকাতে তো হবেই। এখন যদি ইউনিভার্সিটিতে এটা একটা ইস্যু হয়, তাহলে সকলে তো জানতে চাইবে, ওই বদ ছেলে তোমাকে কী বলেছিল। সেটা খুব খারাপ হবে। আমি যদি ইউনিভার্সিটি থেকে সুদর্শনকে সাসপেন্ড করবার ব্যবস্থা করি, তাহলেও তো সমস্যা তিথি। সবাই কারণ জানতে চাইবে। আর যদি ছাত্রছাত্রীরা গোলমাল করে তাহলে তো মিটিং, মিছিল হবে, পোস্টার পড়বে। কাগজে, টিভিতে দেখাবে। তোমার ছবি দেখাবে।’
তিথি আঁতকে উঠল। কাতর গলায় বলল, ‘একটা কিছু করুণ ম্যাডাম।’
মধুজা রায় খানিকক্ষণ চোখ বুজে কী ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আমি যা বলব, তুমি করতে পারবে তিথি?’
তিথি বলল, ‘আপনি যা বলবেন, আমি তাই করব।’
মধুজা রায় বললেন, ‘তাহলে কাগজ, পেন নাও। যা বলছি লিখে সই করো।’
সাঁইত্রিশ
পলাশ চুপ করে আছে। টেবিলের উলটোদিকে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে দুই মাস্টার। অরিন্দম সেনগুপ্ত আর কল্যাণ সমজাপতি। ছাত্রের দিকে তাদের এরকম আগ্রহ সহকারে তাকিয়ে থাকবার কারণ আছে।
আরও মিনিট খানেক চুপ করে থাকবার পর অরিন্দমবাবু বললেন, ‘কি পারবে না?’
পলাশ মাথা চুলকে বলল, ‘সেটাই তো ভাবছি স্যার।’
কল্যাণ সমাজপতি বললেন, ‘পারতেই হবে পলাশ। এরকম ইস্যু চট করে পাওয়া যাবে না।’
অরিন্দমবাবু বললেন, ‘মধুজা রায়কে চাপ দেওয়ার খুব বড় একটা সুযোগ এসেছে। এবার ওর মুখোশ খুলে দিতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে ও যা করছে সেটা বেশিদিন চলতে দেওয়া যায় না। শুধু পাওয়ার দেখানো নয়, পাওয়ারকে কাজে লাগিয়ে নোংরা ঘটনাকে মদত দিতে শুরু করেছে এবার। পিছনে সাপোর্ট আছে বলে যা খুশি করে চলবে? কোনও বিহিত হবে না? আমরা তো পারছি না, এবার তোমরাই ভরসা পলাশ। স্টুডেন্টরা যদি এগিয়ে না আসে এদের দাপট আরও বাড়বে। ইউনিভার্সিটি ডকে উঠবে। ইউনিভার্সিটির ভিতর একটা মেয়ের সঙ্গে গুন্ডারা অসভ্যতা করবে আর টিচার হয়ে তাকে সমর্থন করতে হবে!’
কল্যাণ সমজাপতি কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন। মধুজা রায়ের রমরমার শুরু তো এখন হয়নি, হয়ছে বেশ কয়েক বছর আগেই। বহু যোগ্যকে বাদ দিয়ে এই মহিলাকে তখন মাথায় তোলা হয়েছিল। পার্টির এডুকেশন সেলের মাতব্বররাই ধাপে ধাপে সেই কাজ করে। এই কাজের একটা পদ্ধতি ছিল। যাদের ‘তোলা হবে’ ঠিক হত তাদের প্রথমে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে সেমিনার করিয়ে, পেপার পড়িয়ে পরিচয় করানো হত। পরের ধাপে পাঠানো হত, বাইরের রাজ্যে। ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা, কেরল। সেখানে কখনও সেমিনার, কখনও ওয়ার্কশপ, কখনও শিক্ষার পদ্ধতি নিয়ে আলাপ আলোচনা। এরপর আসত ‘বিদেশ’। চিন, ভিয়েতনাম, রাশিয়ায় সফর। বিদেশ চিরকালই বাঙালির কাছে বড় টোপ। ছুড়লেই কপ করে গিলে ফেলে। শেষ ধাপে বিভিন্ন কমিটিতে নাম ঢোকানো হত। মধুজা রায়ের বেলাতে এই সবক’টা ধাপই মানা হয়েছে। পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ত। শিক্ষামহলে অনেকেই জানত সেই সময় শাসক পার্টির এক নেতা নাকি মধুজা রায়ের সঙ্গে ভিয়েতনাম ট্যুরে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। নেতা দেখেছিলেন সে দেশের রাজনীতি, মধুজা দেখেছিলেন সেখানকার শিক্ষা পদ্ধতি। পার্টির সমর্থকরা বলত, এ সব গুজব। ‘সংগ্রামী’ নেতাকে ছোট করবার চেষ্টা। তাকে কালিমালিপ্ত করা। বিরোধীদের চক্রান্ত। ফলে এসব কেচ্ছা নিয়ে কেউ খুব একটা আলোচনায় যেতে ভরসা পেত না। কে কোথায় লাগিয়ে দেবে তার ঠিক নেই। দিলে মুশকিল হত। পার্টির ব্ল্যাক লিস্টে যেতে হত। শুধু পার্টি সমর্থকের বাইরে নয়, পার্টি সমর্থক শিক্ষকদেরও মধুজা রায়ের জন্য সেই সময় অপমান সহ্য করতে হয়েছে। কল্যাণ সমাজপতি নিজে একজন ভিকটিম। ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি কাউন্সিল থেকে রাতারাতি তাকে সরিয়ে মধুজা রায়কে আনা হয়েছিল। অপমানিত কল্যাণ সরকার পার্টি অফিসে যান।
‘এটা কী রকম হল মনোজদা।’
একসময় ‘মনোজদা’ শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কারখানার গেটে মিটিং, মিছিল করতেন, ব্যারিকেড করতেন। পরে পার্টি কী মনে করে ওকে নিয়ে এল শিক্ষক সংগঠন দেখভালের দায়িত্বে। দলের শিক্ষক সম্মেলনে প্রশ্ন উঠেছিল, শ্রমিকনেতা শিক্ষকদের বিষয় কী বুঝবেন? পার্টি নেতারা জানাল, ‘মনোজদা’ দলের একজন নীতিনিষ্ঠ সৈনিক। শ্রেণীহীন সমাজ তৈরির লক্ষ্যে তাঁর ভাবনা, তাঁর কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারখানার শ্রমিক আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে শ্রেণী-বিভাজন দূর করতেই দল এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরপর আর তর্ক চলে না। সবাই ‘মনোজদা’-কে মেনে নিতে বাধ্য হল। ‘শ্রেণী বিভাজন দূর’ করবার জন্য তিনি মন দিয়ে শিক্ষকদের প্রাোমোশন, বদলি, নিয়োগ, কমিটি গঠন ইত্যাদিতে নিজের এবং দলের মত চাপাতে শুরু করলেন। সেই ‘মনোজদা’-র কাছেই গিয়েছিলেন ফ্যাকাল্টি কাউন্সিল থেকে অপসারিত কল্যাণ।’
‘মনোজদা’ বললেন, ‘কীসের কী হল কল্যাণ?’
কল্যাণ সমাজপতি বললেন, ‘আমাকে ফ্যাকাল্টি কাউন্সিল থেকে সরিয়ে দেওয়া হল কেন?’
‘মনোজদা’ সহজভাবে বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে? সবাইকে চিরকাল এক জায়গায় থাকতে হবে? অন্যরা সুযোগ পাবে না? এই যে আমাকেই দেখো না। জীবনের তিরিশ বছর শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন করেছি, তারপর এলাম শিক্ষায়। আসলে আমি তো ওই সংগঠনে নতুন একজন নেতার জায়গা করে দিয়ে এলাম। আমি যদি ছেড়ে সরে না আসতাম তা হলে কি নতুন একজন জায়গা পেত? পেত না। অন্যকে জায়গা দেওয়া আমাদের মূল মন্ত্র কল্যাণ। এ কথা ভুললে চলবে না।’
কল্যাণ সমাজপতি থমথমে গলায় বলেছিলেন, ‘আপনার সঙ্গে আমার তুলনা চলে না মনোজদা। এরপর হয়তো পার্টি আপনাকে হেলথ সেক্টরের অর্গানাইজেশন দেখবার দায়িত্ব দেবে। আপনাদের অনেক প্রতিভা। আমি সামান্য শিক্ষক। পার্টি সদস্য। আমাকে এই অপমানের কারণ কী? কাউন্সিল থেকে সরাবার আগে একবার আমাকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করলেন না আপনারা?’
‘মনোজদা’ বললেন, ‘শান্ত হও কল্যাণ। পার্টি সদস্য হয়ে এই উত্তেজনা তোমাকে মানায় না। মধুজা রায়কে ঢোকানোর অর্ডার পার্টির ওপর মহল থেকে এসেছে। আমরা ইউনিভার্সিটি, কলেজগুলোকে ডাইরেক্ট পার্টি কন্ট্রোল থেকে সরিয়ে রাখতে চাইছি। এমন মানুষ সেখানে থাকবেন যাঁরা আমাদের সমর্থন করেন, পছন্দ করেন, আমাদের জন্য স্যাকরিফাইজ করবেন, কিন্তু সরাসরি দল করেন না। ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি কাউন্সিল, এগজিকিউটিভ কাউন্সিলগুলো থেকে আমরা ধাপে ধাপে সব পার্টি মেম্বার সরিয়ে নেব। এখানেও সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ হয়েছে। আমিই তোমাকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য বলেছি। আরও সরবে।’
‘মধুজা রায় পার্টির জন্য সাকরিফাইজ করবে বলে মনে করছেন আপনারা। পার্টির দু:সময়ে সঙ্গে থাকবে?’
‘মনোজদা’ বললেন, ‘তুমি তো জানো পার্টির বিশ্বাসভাজন হতে অনেক পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তুমিও সেভাবেই পার্টিতে এসেছ। বুর্জোয়া কাঠামো এবং আমাদের সংগ্রামী চেহারার মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমরা কষ্টি পাথর যাচাই করে তবে একজনকে পার্টির পবিত্র ভূমিতে পা রাখতে দিই। আমাদের বিচার ভুল হয় না। মধুজা রায়ের মতো শিক্ষিত, বুদ্ধিমতীকে পাশে পেয়ে আমাদেরই শক্তি বাড়ল। সবাইকে তো মিটিং, মিছিল করতে হবে না। কেউ কেউ কলেজ, ইউনিভার্সিটি পরিচালনা করবে। মধুজাকে আমরা সেইভাবে প্রাোজেক্ট করব। সে কোনওদিনই আমাদের ছেড়ে যাবে না।’
ক্ষমতা বদলের দুদিনের মধ্যে মধুজা রায় পালটে গেলেন। অন্য দলের জয়ের উল্লাসে যখন কলকাতা ফুটছে, মধুজা রায় টিচার্স রুমে বসে ঘোষণা করলেন, ‘এতদিনে শিক্ষাকে রাজনীতি মুক্ত করা হল। চলে যাওয়া পার্টির দাপটে নাভিশ্বাস উঠছিল। উফ, বাঁচা গেল! এবার মন দিয়ে লেখাপড়ার চর্চা করা যাবে।’
টিচার্স রুমে উপস্থিত সব শিক্ষক-শিক্ষিকারাই অবাক হয়েছিলেন। মধুজা রায়ের মুখে এ কী কথা!
এসব কথা তো আর পলাশকে বলা যাবে না। বলা যাবে না, মধুজা রায়ের মতো মানুষ কোনও নির্দিষ্ট দলের হয় না, এরা সব দলেরই বেনো জল। কল্যাণ সরকার তাই চুপ করে গেলেন। তা ছাড়া এখন মধুজা রায়ই প্রধান শত্রু। তাঁকে জোর ধাক্কা দিতে হবে। সত্যি কথা বলতে কী, এই ঘটনায় যতটা না বারিধারা নামে মেয়েটির মান-অপমানের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে, তার থেকে বেশি রয়েছে রাজনীতি। এতে লজ্জার কিছু নেই। বারিধারার ঘটনা একটা ইস্যু। এই ইস্যুটাকে ধরে রাজনীতি করে মূল জায়গায় আঘাত করতে হবে। এই ধরনের মানুষকে যারা মদত দেয়, তাদের সবার সামনে তুলে ধরতে হবে।
কল্যাণ সরকার এবার মুখ খুললেন। বললেন, ‘পলাশ, তুমি, তোমাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলো।’
পলাশ বলল, ‘কী বলব সেটাই তো কথা স্যার। যতক্ষণ না বারিধারার বিরুদ্ধে মধুজা ম্যাডাম কোনও অ্যাকশন নিচ্ছেন ততক্ষণ তো আমরা কোনও মুভ করতে পারব না।’
কল্যাণ সরকার বললেন, ‘সুদর্শন নামের ওই গুন্ডাটা কোন পার্টি করে?’
পলাশ বলল, ‘কোনও পার্টি করে বলে তো শুনিনি। গুলতানি মারা আর নেশা-ভাং করাই ওর কাজ।’
অরিন্দম সেনগুপ্ত বললেন, ‘আমরা যে শুনলাম, ওর কোনও আত্মীয় সরকারি অফিসার।’
কল্যাণ বললেন, ‘সরকারি অফিসার মানেই তো আর পলিটিক্যাল লোক নয় অরিন্দম।’
অরিন্দম বললেন, ‘সেটা ঠিক। কিন্তু রাজনৈতিক চেহারা না থাকলে কী হয়েছে? একটা খারাপ ছেলের বিরুদ্ধে স্টুডেন্টরা আন্দোলন করতে পারে না? যে মেয়েটিকে অপমান করছে সে তো সবার সহপাঠিনী।’
পলাশ সামান্য হেসে বলল, ‘স্যার, খারাপ ছেলের বিরুদ্ধে আন্দোলন বলে কিছু হয় না। কোনও স্টুডেন্ট মুভমেন্ট এরকম কখনও হয়নি। পলিটিক্স ছাড়া আবার আন্দোলন কী? যেখানে যত হইচই হয়েছে সবের পিছনেই রাজনীতি থেকেছে। খারাপ ছেলেকে ইউনিভার্সিটি তাড়িয়ে দিতে পারে। আরও বেশি কিছু হলে পুলিশ দিয়ে অ্যারেস্ট করাতে পারে। আর পাঁচটা ছেলেমেয়ে গিয়ে চড়-থাপ্পড় মারতে পারে। কিন্তু একটা মুভমেন্ট হবে কী করে? এই ক্ষেত্রেও তাই। শুনতে খারাপ লাগলেও আমাদের নামতে হবে মধুজা ম্যাডামের রাজনীতির বিরুদ্ধে, ঘটনার বিরুদ্ধে নয়। উনি সুদর্শনকে সাপোর্ট করছেন এটাই ইস্যু হতে পারে। সুদর্শন কী করেছে সেটা নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি।’
অরিন্দম বললেন, ‘আমরাও তাই চাইছি।’
পলাশ বলল, ‘তবে উনি সুদর্শনকে সাপোর্ট করছেন তার তো একটা প্রমাণ চাই। ছেলেমেয়েদের বিশ্বাস করাব কী করে?’
কল্যাণ বলল, ‘বারিধারা যদি বলে?’
পলাশ বলল, ‘আমরা তো চাইছি। কিন্তু আপনারা তো বারিধারার সঙ্গে কথা বলে তাকে রাজি করাতে পারেননি।’
অরিন্দম সেনগুপ্ত চাপা গলায় বললেন, ‘সেই জন্যই তোমাকে ডেকেছি। তোমরা ওকে রাজি করাও। তোমরা ওর বন্ধু, তোমাদের কথা শুনবে।’
পলাশ অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘বারিধারা মেয়েটি অন্যরকম। নিজের ভাবনাচিন্তা স্পষ্ট। তেজ আছে কিন্তু অন্যের কথায় প্রভাবিত হবে কি না সন্দেহ।’
কল্যাণ ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘বন্ধুরা তো আর অন্য কেউ নও। রাজি করানোটা তোমার দায়িত্ব। তাকে বোঝাও। সে তোমাদের কাছে বলুক, কীভাবে মধুজা রায় তাকে হুমকি দিয়েছে। সুদর্শন নামের ছেলেটার কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছে। তারপর তোমরা সেই অভিযোগ নিয়ে গোলমাল শুরু করো। মিটিং, মিছিল, পোস্টার…যা তোমরা করতে পারো।’
পলাশ উঠে দাঁড়াল। চিন্তিত গলায় বলল, ‘ইচ্ছে তো খুব হচ্ছে, কিন্তু দুটো সমস্যা। এই সময়ে ছেলেমেয়েদের কতটা পাব বুঝতে পারছি না। সময়টা খারাপ। মধুজা রায়ের বিরুদ্ধে নামতে হলে সাহস করে নামতে হবে। কেরিয়ার নিয়ে ভাবলে চলবে না। আর দু’নম্বর পয়েন্ট হল, বারিধারা রাজি হবে কি না। দেখি আগে বারিধারাকে ধরতে চেষ্টা করি। ওকে কনভিন্স না করাতে পারলে কোনও লাভ হবে না। যাই দেখি বারিধারা এখন কোথায়?’
বারিধারা মধুজা রায়ের ঘরে।
ম্যাডামকে দেখে বারিধারার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। ভদ্রমহিলা কোনও একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত। গলাও অনেক নরম।
‘কেমন আছো বারিধারা?’
বারিধারা বলল, ‘ভালো ম্যাডাম। আপনি?’
খুব অন্যমনস্কভাবে মধুজা বললেন, ‘একটু আগে পর্যন্ত ভালো ছিলাম। এখন আর নেই।’
বারিধারা খুব অবাক হল। মধুজা রায়ের এই ধরনের দার্শনিক কথা বলবার মানে? তিনি আজ একজন সাহসী মেয়েকে অপমান করবেন বলে ঠিক করেছেন। সেই মেয়েটি আর কেউ নয় তার ছাত্রী। সে একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। সেই প্রতিবাদের জন্য তাকে শাস্তি দেবেন। শাস্তি খুব সহজভাবে হবে না। একজন গুন্ডার পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে। এই শাস্তি শান্তিপূর্ণভাবে সমাপন করতে পারলে তিনি আরও ক্ষমতা পাবেন। শিক্ষাজগতের সঙ্গে জড়িত ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ব্যক্তিরা তার প্রতি খুশি হবে। ছাত্রীকে অপমান করে ক্ষমতাশালীদের তুষ্ট দরকার মতো মজার সময় তিনি হঠাৎ দার্শনিক কথা বলছেন কেন?
বারিধারা বলল, ‘ম্যাডাম ঠিক বুঝতে পারলাম না।’
এবার জোর হাসলেন মধুজা রায়। নরম গলায় বললেন, ‘মধুজা তুমি নিশ্চয় আমাকে ভুল বুঝছ।’
বারিধারা এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘ম্যাডাম, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেদিন আপনি যেমন বলেছিলেন, আমি তাই করব। ওই ছেলের কাছে আজ আমি ক্ষমা চাইব। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে ম্যাডাম।’
মধুজা রায় ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কী শর্ত?’
বারিধারা চোয়াল শক্ত করে এবার দাদুর শিখিয়ে দেওয়া প্ল্যান বলল।
‘ওই ছেলেকেও তিথির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। যাদের সামনে সে তিথিকে অপমান করেছে সবার সামনে তাকে ক্ষমা চাইতে হবে।’
এবার একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। মধুজা রায় স্থির চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন…।
বারিধারা চমকে উঠল। সে কি ঠিক শুনছে? হতেই পারে না, অসম্ভব। সে বিড়বিড় করে বলল, ‘ম্যাডাম, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনি কি দয়া করে আর একবার বলবেন?’
আটত্রিশ
জীবন হল নদীর মতো। চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক নেয়। বাঁকের খবর আগে থেকে জানা যায় না। বাঁকে পড়ে অবাক লাগে। এ কোথায় এলাম! এখানেও যেন সেরকম রয়েছে। বারিধারা ভাবতেও পারেনি, মধুজা রায়ের মুখ থেকে তাকে এমন কথা শুনতে হবে। সে ভাবল, হয় সে ভুল শুনছে, নয়তো মধুজা রায় বানিয়ে বলছেন।
মধুজা রায় কথাটা আবার বললেন। এবার চোখমুখ শক্ত করে বললেন।
‘বারিধারা, তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে না। ওই ছেলেকে চড় মেরে তুমি ঠিক করেছ।’
বারিধারা ভুরু কোঁচকাল। ম্যাডাম এসব কী বলছেন! উনি কি অন্য কোনও ফন্দি করছেন? নিশ্চয় তাই। তবে করলেও কিছু এসে যায় না। সে তার শর্ত থেকে সরবে না। ওই বদ ছোকরাকে তিথির কাছে আগে ক্ষমা চাইতে হবে। দাদু তাকে বলে দিয়েছে।
‘যা খুশি হোক বৃষ্টি, যত খুশি বিপদ হোক, ওই ছেলে যতক্ষণ না তোর বন্ধুর কাছে ক্ষমা চাইবে, তুই মাথা নামাবি না। তোর পয়েন্টে স্টিক থাকবি।’
বারিধারা দারুণ খুশি হয়ে বলেছিল, ‘শাবাশ দাদু। এই কারণেই কমলকান্তি ইজ দ্য গ্রেট। তবে আমার ইউনিভার্সিটিতে পড়াটা গেল। মধুজা ম্যাডাম খুব পাওয়ারফুল। আমাকে ছাড়বে না। নম্বরটম্বর কমিয়ে তো দেবেই, আরও অনেক কলকাঠি নাড়বে। সে নাড়ুক দাদু। তুমি যখন পাশে আছ, নো চিন্তা। আমি কাউকে কেয়ার করি না।’
কলমকান্তি দুপাশে অল্প অল্প মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, ‘ঘটনা অত সহজ হবে না রে বৃষ্টি, অত সহজ হবে না। তোর ওই মধুজা ম্যাডাম তোর শর্তে রাজি হবে না, আবার চট করে পিছোতেও পারবে না। এটা ঠিকই, যে ছেলেকে তুই চড় মেরেছিস, সে তোকে কোনওরকম অপমান করেনি। তোর সামনে অপমান করেছে এমনটাও নয়। তুই তোর বন্ধুর মুখে শুনে রিঅ্যাক্ট করেছিস।’
বারিধারা বলল, ‘তাতে কী হয়েছে?’ অন্যের অপমান কি অপমান নয়? পথে যদি কোনও মেয়েকে অপমানের মুখে পড়তে দেখি, এগিয়ে যাব না? শুধু মেয়ে কেন, কাউকে হেনস্থা হতে দেখলেই তো প্রতিবাদ করা উচিত। তাই তো এতদিন শিখেছি। নিজের সম্মান বাঁচাতে গেলে সবার সম্মান বাঁচাতে হয়। তোমরাই তো শিখিয়েছ, একা ভালো থাকা যায় না, সবাই মিলে ভালো থাকতে হয়।’
কমলকান্তি হেসে বললেন, ‘ডার্লিং, তুমি ঠিকই বলছ। কিন্তু এগুলো নীতির কথা। উচিত-অনুচিতের কথা। বাস্তব জীবনে এই উচিত-অনুচিতকে কাজে লাগানো কঠিন। একগুঁয়েভাবে চললেই হয় না। প্রতিবাদের পিছনেও ভাবনাচিন্তা, কৌশল লাগে। তুমি প্রতিবাদ করে ঠিক করেছ কিন্তু একটা ছোট গোলমাল আছে। ঘটনার সময় তুমি যদি প্রতিবাদটা করতে তাহলে কোনও প্রশ্ন উঠত না। তোমার ম্যাডাম যা খুশি বলুন, যা খুশি করুন, আমি বলতাম, ক্ষমা চাইবে না। কিন্তু এখানে তো তা হয়নি।’
বারিধারা বলল, ‘দাদু, আমি তো জেনেছি পরে। তিথি বলেছে। আমার সামনে যদি ওই কথা বলত, তখনও চড় লাগাতম। পরে জেনেছি, তাই পরে মেরেছি।’
‘ঠিকই। কিন্তু টেকনিক্যালি একটু সমস্যা হয়ে গেছে বৃষ্টি ম্যাডাম। আর সেই কারণেই আপনার দিদিমণি ক্যাঁক করে আপনাকে চেপে ধরেছে। বার বার বলছে, ওই ছেলে কি তোমাকে কিছু বলেছে? তোমাকে অপমান করেছে? তুমি কেন গায়ে হাত তুলেছ? এটা একটা ডিসিপ্লিনের ব্যাপার। যতই হোক, ইউনিভার্সিটি চত্তরের মধ্যে ঘটেছে।’
বারিধারা বলল, ‘কথাটা ঠিকই, তাহলে কি আমাকে ওই গুন্ডাটার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে? আমি মরে গেলেও চাইব না দাদু।’
কমলকান্তি সেন হাত বাড়িয়ে নাতনির চুল ঘেঁটে দিয়ে বললেন, ‘ওরে গাধা মেয়ে, সেই কারণেই তো প্ল্যান কষেছি। তোকে অপমান না করা সত্বেও তুই যদি একজনকে চড় মেরে ভুল করে থাকিস, ওই গুন্ডাটা দশগুণ বেশি অন্যায় করেছে। আমরা সেই অন্যায়টা চেপে ধরব। তাকে আগে ক্ষমা চাইতে হবে। যাদের সামনে সে ওই নোংরা কথা বলেছে, তাদের সামনে চাইতে হবে। এটা একটা দাবার চালের মতো হল। আমি নিশ্চিত এই কন্ডিশনে তোর ম্যাডাম থতমত খেয়ে যাবে। খুব বেশি হলে উনি একটাই কথা বলতে পারেন। বলবেন, সে আমরা বুঝব। তুমি আগে অন্যায় স্বীকার করো। তুই ভয় না পেয়ে বলবি, আপনারাই বুঝুন, আগে ওকে ক্ষমা চাইতে বলুন। আমার জোর বিশ্বাস, তোর শর্ত শুনে ম্যাডাম পিছিয়ে আসবেন। পুরো ঘটনাটাই চেপে যেতে চাইবেন।’
বারিধারা দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘পিছোক, এগোক আমার কিছু এসে যায় না। আমি একটুও ভয় পাব না। পাব কেন? আমার ইয়ং দাদু আমার সঙ্গে আছে না?’
কমলকান্তি ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘নাইনটি ওয়ান ইয়ং না তো কী? তোরা ব্যবস্থা করছিস না তাই, নইলে আমি এখনও একটা বিয়ে করতে পারি।’
বারিধারা দাদুর গালে চুমু খেয়ে বলল, ‘ইস, আমার দাদুর ওপর কাউকে ভাগ বসাতেই দেব না।’
কমলকান্তি সেনের পরিকল্পনায় বারিধারা যতটা না ভরসা পেয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশি বল পেয়েছে। লড়াই করবার বল। কিন্ত এ কী ঘটল! মধুজা রায় যে নিজেই পিছিয়ে এলেন!
মধুজা রায় এবার থমথমে গলায় বললেন, ‘তুমি শুধু চড় মেরে ঠিক কাজ করোনি বারিধারা, আমারও ইচ্ছে করছে, ওই ছেলেকে ডেকে পাঠিয়ে ঠাসিয়ে একটা চড় লাগিয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে বের করে দিতে। অতটা ক্ষমতা আমার নেই, তাই আমি পারছি না। সরি বারিধারা। ঘটনাটা না জেনে তোমাকে ডেকে ক্ষমা চাইবার কথা বলেছিলাম। আমি উইথড্র করছি।’
বারিধারা বিড়বিড় করে বলল, ‘ম্যাডাম, আমি ঠিক…।’
মধুজা রায় সোজা হলেন। বললেন, ‘বারিধারা, আমি জানতাম না, ওই বদ ছেলে তিথিকে কী বলেছে। আমি যখন শুনি, তুমি তোমার সহপাঠীকে অকারণে চড় মেরেছ, আমি খুব রেগে যাই। যে তোমাকে কিছু বলেনি তার গায়ে তুমি হাত দাও কোন সাহসে? ইউনিভার্সিটির ভিতরে এটা কিছুতেই অ্যালাও করা যায় না। ওপরমহল থেকে আমার কাছে কমপ্লেইন আসে। আমি তোমাকে ডেকে বকাঝকাও করি। কিন্তু এবার জানতে পেরেছি, কেন তুমি ছেলেটিকে মেরেছিলে। বেশ করেছ। ইউনিভার্সিটিতে যে একটা মেয়েকে সবার সামনে ওই কথা বলতে পারে, তার অনেক বেশি শাস্তি হওয়া উচিত। একজন টিচার তো বটেই, একজন মহিলা হয়ে এই নোংরামি মেনে নেওয়া যায় না। আমার বুঝতে ভুল হয়েছিল। তার জন্য তুমিও দায়ী বারিধারা। ঠিক কী ঘটেছিল, তুমি আমাকে বলোনি।’
বারিধারা অস্ফুটে বলল, ‘আপনাকে এই কথা বলতে লজ্জা করছিল।’
মধুজা রায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘ঠিকই। একজন ভদ্র, শিক্ষিত মেয়ের পক্ষে কথাটা মুখে আনা লজ্জারই। তোমার মতো বয়েসে আমি এই কথা রিপিট করতে পারতাম না। টিচারদের সামনে তো নয়ই। তোমার অস্বস্তিটা বুঝতে পারছি বারিধারা। তবে ভবিষ্যতে এরকম কোরো না। এখন ওসব লজ্জা-সঙ্কোচের যুগ নেই। যা হবে সরাসরি জানাতে হবে।’
বারিধারার ভীষণ ভালো লাগছে। মধুজা রায় সম্পর্কে তাদের একরকম ধারণা, আর এখন তাকে আরেকরকমভাবে দেখছে। আসলে মানুষের সবটা একরকম হয় না। রঙের মতো তার মধ্যেও নানারকম ভাগ থাকে। শেডস থাকে। ম্যাডাম যতই গোলমেলে হোন না কেন, তিথির এই ঘটনাটা নিশ্চয় তার মনের কোথাও আঘাত করেছে। তার ভিতরের ভালো অংশটা জেগে উঠেছে। তিনি না জেনেই রাগারাগি করেছিলেন। তার জন্য অনুতাপও বোধ করছেন। মধুজা রায়ের মতো মানুষ একজন ছাত্রীকে ‘সরি’ বলছেন, একথা কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবে না। বলবে, হতেই পারে না। উনি সবার কাছ থেকে সরি শুনতে অভ্যস্ত। বারিধারা অবশ্য একথা কাউকে বলতেও চায় না। এটা মধুজা রায়ের সঙ্গে তার জয়-পরাজয়ের প্রশ্ন নয়।
মধুজা রায় খানিকটা অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘তবে আমি যেরকম ভেবেছিলাম সেরকমটা পারব না বারিধারা।’
বারিধারা উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘কী ভেবেছিলেন ম্যাডাম?’
‘ভেবেছিলাম বিষয়টা নিয়ে হইচই করব। ওই ছেলের পিছনে যত বড়ই সোর্স থাকুক, ওকে শাস্তি দিয়ে ছাড়ব।’
বারিধারা তাড়াতাড়ি বলল, ‘না না, সে সবের দরকার নেই। যা শাস্তি পাওয়ার সে তো পেয়েছেই।’
মধুজা রায় একটু কঠিনভাবে বললেন, ‘না পায়নি। এইসব ছেলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। সবার জানা দরকার, এই ধরনের অসভ্যতা বরদাস্ত করা হয় না। পিছনে ক্ষমতাশালী কেউ থাকলেও হয় না।’
বারিধারার বিস্ময় বাড়ছে। যে মানুষটা নানা ধরনের ক্ষমতা দেখিয়ে চলতে ভালোবাসে তার মুখে এসব কী কথা! হয়তো এটাই নিয়ম। কোনও ঘটনা আকস্মিকভাবে মানুষের চরিত্র বদল করে।
মধুজা রায় বললেন, ‘কিন্তু আমি এক পা-ও এগোতে পারব না বারিধারা।’
বারিধারা বলল, ‘থাক ম্যাডাম, এখানেই ঘটনাটা শেষ করা যাক। তিথিকে তো আমি চড় মারবার কথা বলিনি। বলিনি তার কারণ, মেয়েটা নরম স্বভাবের, নার্ভাস প্রকৃতির মেয়ে। ভালো মেয়ে। আমার তো সেই কারণেই আরও রাগ হয়েছিল। একজন সহজ-সরল ভালো মেয়েকে বিশ্রী কথা কেন বলবে? সে কিছু বলতে পারবে না বলে? তিথি যখন আমাকে ঘটনা বলেছিল, ও প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল। বেশি ভলো মেয়ে হলে যা হয়।’
মধুজা রায় ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন, ‘ভালো মেয়ে! কে ভালো মেয়ে?’
বারিধারা এবার একটু অবাক হয়ে বলল, ‘আমি তিথির কথা বলছি ম্যাডাম। আপনি তিথিকে বোধহয় ঠিক স্পট করতে পারছেন না ম্যাডাম। শান্তশিষ্ট মেয়ে। নিজেকে আড়ালে রাখতে ভালোবাসে।’
মধুজা রায় খানিকটা রাগের সঙ্গে বললেন, ‘শান্তশিষ্ট কিনা জানি না। তবে তোমার ওই বন্ধুটি ভালো নয় বারিধারা। একেবারেই ভালো নয়। তুমি ওর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করো।’
‘মাফ করবেন ম্যাডাম, আপনার কোনও ভুল হচ্ছে বোধহয়। তিথিকে ইউনিভার্সিটির সকলেই ভালো মেয়ে বলে জানে। ও আমার খুব বন্ধু।’
মধুজা রায় একটু চুপ করে থেকে কিছু ভাবলেন। টেবিলে পড়ে থাকা পেনটা তুলে নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, ‘আমিও তাই জানতাম, সেইরকমই খোঁজ পেয়েছিলাম। তোমাকে বকাঝকা করবার পর, আমি তোমাদের সবার সম্পর্কেই খোঁজখবর নিয়েছি বারিধারা। আমি জানতে পারি, সুদর্শন নামের এই ছেলেটি ভালো নয়। যেহেতু আমি কোনও না কোনও ভাবে ঘটনার মধ্যে ইনভলভড হয়ে পড়েছিলাম, আমার একটা রেসপনসিবিলিটি তৈরি হয়। অন্য কোনও টিচার হলে হয়তো চুপ করে যেত, কিন্তু আমার স্বভাব তো সেরকম নয়। আমার মনে হয়, ওই ছেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এটা তো একধরনের শ্লীলতাহানি। যে মেয়েটি ঠিক কাজ করেছে, সহপাঠিনীর অসম্মানের প্রতিবাদ করেছে, তাকে বকলাম, আর যে দোষী তাকে কিছু বললাম না, এটা তো হতে পারে না। নিজের কাছে নিজেকে আমি কী কৈফিয়ত দেব? কিন্তু তার জন্য আমার একটা কমপ্লেন দরকার। যেটা নিয়ে আমি মুভ করব। আমি তিথিকে ডেকে পাঠাই। তাকে বলি, তুমি আমাকে লিখে দাও, ওই ছেলে তোমাকে কীভাবে অপমান করেছে।’
বারিধারার চোখের পলক পড়ছে না। এই মহিলা এতদূর পর্যন্ত গেছেন! তিথিকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তিথির নিশ্চয়ই হার্টফেল করবার মতো অবস্থা হয়েছিল। ও যা ভীতু। মধুজা রায় আলাদা করে ডেকেছে শুনলেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাবে। কিন্তু অবাক লাগছে, ম্যাডাম এতদূর পর্যন্ত গেলেন কেন! বিবেকের তাড়না! এতটা!
মধুজা ম্যাডাম ঠোঁটের হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘তোমার বন্ধু আমাকে লিখে দিয়েছে। সেই লেখা দেখে আমি আকাশ থেকে পড়ি!’
এই পর্যন্ত বলে মধুজা রায় থামলেন। ড্রয়ার খুলে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে বারিধারার দিকে এগিয়ে দিলেন। বারিধারা কী করবে বুঝতে পারছে না। নদী কি আবার বাঁক বদল করছে?
‘নাও ধরো। পড়ে দেখো তোমার বন্ধু কী লিখেছে।’
বারিধারা কাগজের ভাঁজ খুলল। কাঁপা হাতে বাংলা কয়েক লাইন লেখা।
মাননীয় উপাচার্য মহাশয়
বিশ্ববিদ্যালয়
স্যার,
আপনার অবগতির জন্য জানাই, আমি খবর পেলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে জড়িয়ে কেউ কেউ মিথ্যে রটনা করছে। বলা হচ্ছে, আমাকে নাকি আমার এক সহপাঠী অপমান করেছে। এই রটনা আমার পক্ষে মোটেই শোভন নয়। আমি আপনাকে স্পষ্ট জানাতে চাই, আমার সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে কেউ কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি। বিষয়টি নিয়ে কোনওরকম শোরগোল যেন না হয়। যদি হয়, তার সঙ্গে আমি কোনও ভাবে যুক্ত নই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে এসেছি এবং তাই করতে চাই। আমার প্রণাম জানবেন।
ইতি…।’
বারিধারা চুপ করে রইল। মধুজা রায় চিঠি ফেরত নিয়ে বললেন, ‘এরপর আমি ওই ছেলের বিরুদ্ধে স্টেপ নেব কী করে? সব জেনেও হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া আমার উপায় কী? এই তোমার ভালো বন্ধু! এত ভীতু! যাই হোক তুমি যে ওই ছেলেকে একটা চড় অন্তত মারতে পেরেছ, এটাই অনেক। আমার এই ফাইল ক্লোজ করা ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না। যাক, যা হওয়ার হয়ে গেছে।’
মধুজা রায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিনে এসে বসল বারিধারা। তার মন খারাপ। এই চিঠি যে তিথিকে চাপ দিয়ে লেখানো হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তারপরেও তিথি এটা লিখবে কেন? ছিছি। বারিধারা চা নিয়ে এল। চা খেতে খেতে তার মন খারাপ একটু একটু করে কাটতে লাগল। বরং ভালো লাগতে লাগল। মনে হল, তিথি ভয় পেয়ে কী লিখেছে, অরিন্দম, কল্যাণ স্যাররা এটা নিয়ে ঘোঁট পাকাতে গিয়ে ফেল করলেন, মধুজা ম্যাডাম তাদের কথা ভেবে ভয় পেয়ে ফাইল বন্ধ করছেন—এসব ভেবে কী হবে? যা খুশি হোক। তার যা করবার সেটা তো করেছে। সে একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে এবং তার জন্য ক্ষমাও চায়নি।
ক্যান্টিনে তিথিকে দেখে বারিধারা হাত তুলে ডাকল, ‘তিথি, অ্যাই তিথি।’
উনচল্লিশ
কমলকান্তি সেন লিখছেন।
তিনি ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসে চওড়া হাতলের ওপর কাগজ রেখেছেন। তিনি লেখালিখি আজকাল বিশেষ করেন না, যখন করেন ফাউন্টেন পেনেই করেন। ঝরনা কলম। তবে কয়েকটা ভালো কলম আছে। আজকের কলমটাও খুব নামি কোম্পানির। কোম্পানির নাম মঁ ব্লা।
একানব্বই বছর বয়সে লেখালেখি করতে হলে হাত কাঁপবে। এটাই স্বাভাবিক। বয়সের সঙ্গে নার্ভ এবং পেশির জোর কমে যায়। কিন্তু কমলকান্তি সেনের হাত কাঁপে না। হাত কাঁপে না বলে হাতের লেখাও কাঁপে না। তবে আজ তার বুক কাঁপছে। বেশি না, অল্প কাঁপছে। আনন্দে কাঁপছে। সেই আনন্দ-কম্পন তার হাতের লেখাতে প্রভাব ফেলছে। লেখা কেঁপে যাচ্ছে।
এই আনন্দ-কম্পনের কারণ কী?
আনন্দ-কম্পনের কারণ, কমলকান্তি সেন এখন তার স্বপ্নের প্রজেক্ট ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ নিয়ে বসেছেন। তিনি লক্ষ করে দেখছেন, আজকাল এই প্রজেক্ট নিয়ে যখনই কিছু ভাবনাচিন্তা বা লেখালিখি করেন, তখনই বুকের ভিতর এক ধরনের স্পন্দন অনুভূত হয়। তিরতির করে ওঠে। শান্ত দিঘির জলে ঢিল পড়লে যেমন হয়। জল প্রাণ পায়।
কমলকান্তি ঠিক করেছেন, সবার আগে তিনি একটা খসড়া তৈরি করবেন। এই খসড়াই বলে দেবে, ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ কোনও উদ্ভট প্রজেক্ট নয়। বাস্তবের মাটির ওপর শক্ত পা এবং মনে দাঁড়িয়ে যাবতীয় কাজ চলবে। আন্তরিকতা থাকলে কাজ করতে কোনও অসুবিধে হবে না। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা, যোগ্য সংগঠন এবং টাকাপয়সার ঠিক মতো ফ্লো থাকলে প্রজেক্ট নিয়ে স্বচ্ছন্দে এগোনো সম্ভব। তাই এই তিনটি জিনিসকে আগে গুছিয়ে নিতে হবে। সেই গোড়ার কাজটাই সারতে চাইছেন কমলকান্তি। খসড়া তৈরির কাজ। সবার আগে আলোচনার সময় এই খসড়া তিনি হাজির করবেন। সকলের মতামত শোনা হবে। তারপর হবে অদলবদল।
এই পর্যন্ত প্রজেক্ট নিয়ে কমলকান্তি সেন যতটা লিখতে পরেছেন তা হল—
এক) ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ প্রজেক্টের মূল কাজ হল, প্রকৃত বেনিফিসিয়ারি খুঁজে বের করা। অর্থাৎ যারা এই প্রজেক্ট থেকে উপকৃত হবে, তাদের চাই। মনে রাখতে হবে, এই প্রজেক্ট সাধারণভাবে স্কুল ড্রপআউট মেয়েদের জন্য নয়। তাদের জন্য সরকারি-বেসরকারি নানা ধরনের ব্যবস্থা আছে। কোনওটা কাজ করে, কোনওটা শুধুমাত্র টাকার অপচয়। আবার কেউ ‘স্কুলছুট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করছি’ বলে দেশের গ্রান্ট, বিদেশের ফান্ড থেকে টাকা, ডলার উপার্জন করে। ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ এসব থেকে আলাদা হবে। মূলত যেসব মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে চেয়েও শিখতে পারেনি, তাদের জন্য এই প্রজেক্ট। যেখানে টাকাপয়সার পাশে সামাজিক বাধানিষেধের ব্যাপার আছে, যেখানে পরিবার মনে করেছে, মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে কোনও লাভ নেই, যেখানে ঘর-সংসারের চাপে ইচ্ছুক মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে পারে না—তাদের নেওয়া হবে। এদের নিয়েই প্রজেক্ট গড়ে উঠবে। সুতরাং এদের খুঁজে পেতে হবে। সেই খোঁজার কাজটা কঠিন। পথ বের করতে হবে। খবরের কাগজে মাঝে মাঝে নানা ধরনের খবর বেরোয়। কোনও কিশোরী পড়তে চায় কিন্তু বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার আয়োজন হয়েছিল। মেয়েটি পালিয়ে থানায়, বিডিও অফিসে, স্থানীয় ক্লাব বা কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠানের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। সাহাস্য চেয়েছে। তারা সাহায্য করেছে। মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করেছে। ধমকধামক দিয়েছে। মেয়েটিকে নিয়ে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। সমস্যা হল, সাময়িকভাবে একটা সুরাহা হলেও, শেষ পর্যন্ত মেয়েটি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারল কিনা, তার কোনও খোঁজ হয় না। কাগজে ক’দিন হইচইয়ের পর সব চুপ করে যায়। এই প্রজেক্টে কোনও সাময়িক রিলিফের ব্যবস্থা থাকবে না। তবে বিভিন্ন পুলিশ থানা, বিডিও অফিস, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে আবেদন করতে হবে, এরকম কাউকে পাওয়া গেলে তারা যেন ‘একটু পরে রোদ উঠবে’তে যোগাযোগ করে।
দুই) জানতে হবে, ঠিক কোন ধরনের মেয়েদের এই প্রজেক্টে নেওয়া হবে। যারা লেখাপড়া করতে চায় কিন্তু সামাজিক বাধা যাদের সেই পথে যেতে দিচ্ছে না, এমন মেয়েদেরই নেওয়া হবে। এমন অনেকেই আছে যারা টাকাপয়সার কারণে মেয়েকে পড়তে না দিয়ে ঘরের কাজে আটকে রাখে। পরে বিয়ে দিয়ে দেয়। এদের বেলাতেও ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ হাত বাড়াবে। কিন্তু তার আগে দেখে নিতে হবে মেয়েটি সত্যি পড়তে চায় কিনা। ইন্টারভিউ ধরনের কোনও একটা কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে তার মনোভাব বুঝতে হবে। যদি লেখাপড়ায় তার উৎসাহ থাকে, তবেই তার জায়গা হবে।
তিন) যেহেতু লেখাপড়ার কোনও বয়স নেই, এই প্রকল্পে বয়সের কোনও সীমা থাকবে না। সাত থেকে সত্তর যে-কোনও বয়সে এখানে যোগ দেওয়া যাবে। বালিকা, কিশোরী, তরুণী, মহিলা, বৃদ্ধা সবাই আসতে পারে। এমনও হয় টাকাপয়সার অভাব, সংসারের চাপে ছোটবেলায় লেখাপড়া হয়নি। বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু ভিতরে আজও লেখাপড়া করবার ইচ্ছে। শুধুই আপশোস হয়। এনাদের জন্য ‘একটু পরে রোদ উঠবে’-র স্লোগান হবে আপশোস নয়, এখনও সময় আছে।
চার) শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবার ব্যবস্থা হবে। তার জন্য হস্টেল, বৃদ্ধাবাস ধরনের সব আয়োজনই করতে হবে। ধাপে ধাপে হবে। তবে যেহেতু প্রজেক্ট সাইট ভুলাভেদায়, তাই ঝাড়গ্রামের আশপাশে যারা থাকে তারা চাইলে বাড়ি থেকে যাতায়াত করতে পারবে।
পাঁচ) সিলেবাস তৈরি হবে বয়স অনুযায়ী। বছর শেষে পরীক্ষা হবে। পাস-ফেল থাকবে না। যদি কেউ কোনও বিষয় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিখতে না পারে, তাকে আবার শেখানো হবে। তার পরেও না পারলে অন্যগুলো বাদ দিয়ে তার জন্য যে বিষয়টা উপযুক্ত, সেটা পড়ানো হবে। এই পদ্ধতি কিছুদিন চলবার পর যদি দেখা যায় কেউ মেইন স্ট্রিমে লেখাপড়া করতে চায়, তাহলে তার গ্রাম, শহর এলাকায় যে স্কুল-কলেজ থাকবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হবে। মনে রাখতে হবে, ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ প্রকল্প কোনও প্রথাগত স্কুল নয়। স্কুল হিসেবে সে কোনও সরকারি সিস্টেমের অনুমোদন নেবে না। এখানে লেখাপড়া করলে কোনও সার্টিফিকেট দেওয়া হবে না। ট্রফি দেওয়া হবে। খেলাধুলোর সময় যেমন দেওয়া হয়। এটাও এক ধরনের জয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবারের বাধার সঙ্গে লড়াইতে জয়। ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ এই একটা লড়াইয়ের সঙ্গী। তার কাজ দমিয়ে দেওয়া, দমে যাওয়া ইচ্ছেকে সম্মান জানানো। সেই লড়াইতে জয়ী হওয়ার জন্য ট্রফি দেওয়া হবে। তবে যারা কমবয়সে এখানে আসবে চেষ্টা করা হবে, তারা যেন দ্রুত মূল স্রোতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে যেতে পারে।
ছয়) এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকবার জন্য নির্দিষ্ট সময় থাকবে। তার বেশি কাউকেই অ্যালাও করা যাবে না। নতুনদের জায়গা ছাড়তে হবে। এই সময়সীমা কতটা, সেটা সবাই মিলে বসে ঠিক করতে হবে।
সাত) এই প্রকল্পের খরচের জন্য কারও কাছে হাত পাতা হবে না। প্রারম্ভিকভাবে নীহারিকা সেনের টাকা এতে খরচ করা হবে। সেই টাকার পরিমাণ কম নয়। জমির ডেভেলপমেন্ট, বাড়িঘর তৈরির কাজ অনেকটাই করা যাবে। অন্য কেউ ব্যক্তিগত ভাবে টাকাপয়সা দিতে চাইলে দিতে পারে। তবে পরিবার বা পরিচিতজনের বাইরে কারও কাছ থেকে টাকা নেওয়া হবে না। কেউ যদি এই প্রজেক্টে যুক্ত হতে চান, তাঁকে তাঁর বুদ্ধি, পরিশ্রম নিয়ে যুক্ত হতে হবে। তিনি যা জানেন, তিনি যে কাজে পারদর্শী সেই কাজ তিনি প্রজেক্টের জন্য দেবেন। কেউ পড়াতে পারেন, কেউ গান শেখাতে পারেন, কেউ বাগান করতে পারেন, কেউ জঞ্জাল পরিষ্কার করতে পারেন। যেমন কমলকান্তি সেন এখনই কথা দিলেন, প্রজেক্ট এলাকার ভিতর যে নালা বানানো হবে, তিনি কোদাল চালিয়ে তার শুভ সূচনা করবেন। এ বিষয়ে কারও আপত্তি শোনা হবে না। এতে প্রমাণ হবে, সবাইকে সব কাজ করতে হবে এবং ভালো কাজে বয়স কোনও বাধা নয়।
আট) কারও দান, সরকারের অনুদান নয়। ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ নিজের খরচ নিজেই তুলবে। এখানে যারা থাকবে, তাদের হাতের কাজের ট্রেনিং দেওয়া হবে। মাটি, বাঁশ, শোলা, কাঁসা-পিতল, ডোকরা, কাপড়, ছবি, পুতুল—সবরকম ট্রেনিং হবে। হস্তশিল্প, লোকশিল্পের বাজার খুব বড়। সেই বাজারকে পরিকল্পনামাফিক ধরতে হবে। এই কাজটা এলেবেলেভাবে করলে চলবে না। আবাসিকদের বানানো জিনিস নিয়ে শুধু একজিবিশন আর মেলা হবে এমন নয়। গোড়া থেকেই ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে নামতে হবে। কর্পোরেট ভাবনা চাই। বিভিন্ন জায়গায় কাউন্টার করতে হবে। জিনিস বাইরে পাঠাতে হবে। এই কাজের জন্য একটা পৃথক কোম্পানি বানানো হবে। ব্যাঙ্ক লোন নেওয়া হবে। লোনের জন্য ‘একটু পরে রোদ উঠবে’-র জমি বন্ধক রাখা যেতে পারে। কোম্পানি চালাবে প্রফেশনালরা। তারা প্রাোডাকশন, মার্কেটিং, প্রাোমোশন সব দেখবে। উপযুক্ত বেতন, কমিশন সব পাবে। মনে রাখতে হবে, বিষয়টি এই প্রজেক্টের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হার্ট অফ দ্য প্রজেক্ট। গোটা শরীরে সে রক্ত সঞ্চার করবে। এই ব্যবসার টাকাতেই প্রজেক্ট চলবে।
এই পর্যন্ত লিখে কমলকান্তি সেন থামলেন। এক, পাঁচ আর আট নম্বরের পাশে বড় করে টিক মার্ক দিলেন। এই তিন পয়েন্ট ইমপর্টান্ট। এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা, ভাবনাচিন্তার ব্যাপার আছে। ব্যবসার বিষয়ে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে জড়ানো হবে না। একেবারে নতুন কোম্পানি হবে।
কমলকান্তি কাগজ ভাঁজ করলেন। মঁ ব্লা কলমের খাপ বন্ধ করে পাশের টেবিলে রাখলেন। ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। চোখে বুজলেন। ক্লান্ত লাগছে। সে তো লাগবেই। মনের জোরে তো আর বয়সের সমস্যা আটকে রাখা যায় না। একটানা অনেকটা কাজ করে ফেললেন। আচ্ছা, বৃষ্টিকে নতুন কোম্পানির দায়িত্ব দিলে কেমন হয়? বয়স কম? হোক বয়স কম। বয়স কম হলেই উৎসাহ-উদ্দীপনা বেশি হবে। নতুন নতুন জিনিস ভাবতে পারবে। ওর একজন বয়ফ্রেন্ড আছে। কী নাম ছেলেটার? প্লাবন? না না, মনে পড়ছে, শ্রবণ। ছেলেটা আঁকতে পারে। নানারকম ভাবতে পারে। গুণী ছেলে। বৃষ্টিই একদিন তাকে এই ছেলের কথা বলেছে। গোপন কথা।
‘শ্রীমতী বারিধারা সেন, আজ আপনাকে এত খুশি খুশি লাগিতেছে কেন?’
‘শ্রীযুক্ত কমলকান্তি সেন মহাশয়, আজ আমার জীবনে একটি আনন্দের ঘটনা ঘটিয়াছে।’
‘মহাশয়া, আমার ধারণা, আজ আপনার কপালে ভালোমন্দ খাদ্যাদি জুটেছে।’
বারিধারা চোখ পাকিয়ে বলেছিল, ‘কেন? আমি কি শুধু খাবার পেলে খুশি হই?’
কমলকান্তি বলেছিলেন, ‘না, তা নয়। খুশির পিছনে আরও কারণ থাকে। তবে তোকে যতটা চিনি, পছন্দের খাবার তোর খুশি হওয়ার একটা ইমপর্ট্যান্ট ফ্যাক্টর।’
বারিধারা মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘যাও দাদু, তোমার সঙ্গে আমি কথা বলব না। আমাকে তুমি পেটুক বললে। তোমার সঙ্গে আড়ি।’
কমলকান্তি হেসে বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে কথা বলতে হবে না। আজ কেন এত খুশি শুধু সেটা বল। এটা তো কোনও কথা নয়।’
বারিধারা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘ওমা! এটা কথা নয়! এটা তবে কী?’
কমলকান্তি বলল, ‘এটা দাদু-নাতনির প্রেম।’
বারিধারা কমলকান্তির ইজিচেয়ারের পিছনে গেল। পিছন থেকে দাদুর গলা জড়িয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘খুশির কারণ গোপন। তোমাকে বলা যাবে না।’
কমলকান্তি হাত নেড়ে বললেন, ‘তাহলে থাক বাবা। গোপন কথা শোনবার অনেক ঝামেলা। ফাইন দিতে হয়। মিশরীয় সভ্যতায় এই নিময় চালু ছিল। কেউ গোপন কথা শুনলে তার সাজা হত। জরিমানা দিতে হত। ওই সময় গোপন কথা বলার থেকে গোপন কথা শোনাটাই অপরাধ ছিল বেশি।’
বারিধারা বলল, ‘দুর যতসব বাজে কথা।’
‘না, সত্যি। এসব ছিল রাজাদের নিয়ম। রাজ্য শাসনের জন্য সর্বদাই গোপন শলাপরামর্শ করতে হত। সেই পরামর্শ যাতে কেউ না শুনতে চেষ্টা করে, তার জন্য এই নিয়ম চালু হয়েছিল।’
বারিধারা কমলকান্তির কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, ‘আমার গোপন কথা শুনলে তুমি জরিমানা দেবে।’
কমলকান্তি বললে, ‘মোটেই না। সেই কারণে তো শুনতে চাইছি না। তুমি আনন্দে আছো, খুশিতে আছো এই যথেষ্ট। কারণ জেনে কী হবে।’
বারিধারা ঘুরে এসে কমলকান্তি সেনের সামনের চেয়ারে বসে পড়েছিল ধপ করে। এক গাল হেসে গলা নামিয়ে বলেছিল, ‘দাদু, আজ আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কাটাকাটি হয়ে গেল। তাই এত আনন্দ।’
কমলকান্তি চোখ সরু করে নাতনির তাকিয়ে দিকে বললেন, ‘ভেরি গুড।’
বারিধারা ঝুকে পড়ে, আরও গলা নামিয়ে বলল, ‘তুমি কি সেই ছেলের নাম জানতে চাও?’
‘না, চাই না।’
বারিধারা বলল, ‘সেই ছেলের নাম শ্রবণ।’
কমলকান্তি সেন মনে মনে খুব মজা পেলেন। এই মেয়েকে তো সেদিন জন্মাতে দেখেছেন, এবার মেয়েটারও বয়ফ্রেন্ড হয়ে গেল! চমৎকার! ভারী চমৎকার! এই জন্যই তো মনে হয়, আরও কয়েকটা দিন বেঁচে থাকি। মনের মজা সেদিন মুখে প্রকাশ করেননি কমলকান্তি। বরং গম্ভীর মুখে বলেছিলেন, ‘ছেলের নাম শ্রবণ না হয়ে শ্রাবণ হলে ভালে হত। বারিধারার সঙ্গে শ্রাবণ মানাত।’
বারিধারা হেসে বলল, ‘আর মানামানির প্রশ্ন ওঠে না। আমার সঙ্গে তো কাট। কেন কাট সেটা কি তুমি জানতে চাও দাদু?’
কমলকান্তি সেনের পেটের মধ্যে হাসি গুড়গুড়িয়ে উঠল। এই মেয়ে তো বিরাট প্রেমে পড়ে আছে। প্রেমে পড়া মানুষই বেশি করে প্রেম ছাড়াছাড়ির গল্প বলতে চায়। যে ছাড়াছাড়ি তাদের কোনওদিনও হয় না।
‘না, আমি জানতে চাই না।’
বারিধারা দাদুর এই কথা পাত্তা না দিয়ে বলেছিল, ‘এই ছেলে অতি বোকা। ছবি আঁকে আর সর্বক্ষণ বিজ্ঞাপনের কনসেপ্ট নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে বলে রোজ বুদ্ধি কমে। এত বোকার সঙ্গে আমার চলবে না। আজ তাকে বলেছি, গুডবাই।’
কমলকান্তি বললেন, ‘ভেরি গুড। আমাদের মোস্ট ইনটেলিজেন্ট লিস্টে এই ছেলের নাম ঢুকিয়ে দাও। তুমি কি আজ তার সঙ্গে দেখা করবে?’
বারিধারা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কেন?’
কমলকান্তি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, ‘দেখা হলে তাকে জানিয়ে দিও, আমরা তার নাম লিস্টে রাখলাম। না জানিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না।’
বারিধারা বলল, ‘আজ দেখা করব না। কাল করব। কাল বোকাটার সঙ্গে নাটক দেখব, আইসক্রিম খাব। এক ঘণ্টা হাঁটব। তারপর বিদায়। লাস্ট সাপারের মতো।’
কমলকান্তি হেসে ফেলেছিলেন।
এই ছেলেকে প্রজেক্টে নিতে হবে। গুণী ছেলে। দ্রুত সব ভেবে নিতে হবে। এখন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কমলকান্তি আবছা ঘুমের মধ্যে চলে গেলেন।
ঘুমের মধ্যে মৃত নীহারিকা এলেন।
‘কেমন আছ নীহারিকা?’
‘ভালো নেই।’
‘সে কী, কী হয়েছে? ভালো নেই কেন? কী হয়েছে তোমার?’
‘আজকাল খুব একা লাগে।’
ঘুমের মধ্যেই কমলকান্তির মন খারাপ হয়ে গেল। এরকমটা হয় মাঝে মাঝে। মৃতা স্ত্রী কথা বলতে এলে মন খারাপ হয়ে যায়। আগে এরকম ছিল না। আগে ভালো লাগত। মনে হত, মেয়েটা কোথাও চলে যায়নি। তার সঙ্গে আছে। কথা বলছে, ভাবনাচিন্তা ভাগ করছে। এখন মন খারাপই বেশি হয়। যদিও কমলকান্তি সেই ভাব গোপন রাখেন। আজও রাখলেন।
‘একা লাগবার কী আছে নীহারিকা? এই তো আমার সঙ্গে কথা বলছ।’
নীহারিকা অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘কথা বলি, তার পরেও একা লাগে। মাঝে মাঝে খুব কান্না পায় জানো। তখন কাঁদি।’
কমলকান্তিকে অশান্ত লাগল। আহারে, সত্যি তো, নিজের লোকজন ছেড়ে আছে। কতদিন হয়ে গেল। স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন।
‘এরকম করে না নীহারিকা। তুমি কষ্ট পেলে আমার যে কত খারাপ লাগে, সে কথা তুমি তো জানো। জানো না?’
‘জানি। ভাবি, তোমাকে এসব বলব না। তার পরেও বলে ফেললাম। কিছু মনে কোরো না। কোনও কোনও সময় নিজেকে সামলাতে পারি না।’
‘ছি ছি, এরকমভাবে বলো না। আমারও তোমার জন্য খুব মন কেমন করে নীহারিকা। ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে চলে যাই। নিজেকে শান্ত করি। বোঝাই, এ সম্ভব নয়। এই বুড়ো বয়সে তো আত্মহত্যা করতে পারি না। যদি ইচ্ছামৃত্যু বলে কিছু থাকত, তাহলে হয়তো…।’
নীহারিকা বলেন, ‘বালাই ষাট। ওরকম বোলো না।’
কমলকান্তি বলেন, ‘বলি না নীহারিকা। এত বছর পরেও জীবনকে উপভোগ করবার চেষ্টা করি। ভালোবাসতে চেষ্টা করি। জীবন আসলে একেকটা বয়েসে একেকরকম। নব্বই পেরিয়ে যাওয়া বয়েসে জীবন কেমন সেটাও একরকম অভিজ্ঞতা। আমার সৌভাগ্য নীহারিকা, অসুখ-বিসুখ আমার কম। কম কেন, বয়েসের তুলনায় নেই বললেই চলে। হয়তো রোগভোগের মধ্যে থাকলে এই বয়েসের জীবন বড় বিস্বাদ হত। শরীরের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন। সে বেঁচে থাকা অভিশাপের মতো।’
নীহারিকা বললেন, ‘শুধু কি শরীর? তোমার চারপাশের মানুষ? তারাও যে বড্ড ভালো। তাদের মধ্যে থাকাটাই তো একটা বড় পাওনা।’
‘অবশ্যই নীহারিকা, অবশ্যই। এই বাড়িতে থাকবার জন্য আমি পদে পদে বুঝতে পেরেছি, বেঁচে থাকা শুধু শরীর নয়, মনও। সেই মন তৈরি হয় চারপাশ থেকে। একটা গাছ যেমন মাটি, আকাশ, জল থেকে তার বাঁচার রসদ খোঁজে, মানুষও তাই।’ একটু থামলেন কমলকান্তি। তারপর বললেন, ‘নীহারিকা তুমি যদি বাঁচতে, এই আনন্দ তুমিও উপভোগ করতে।’
নীহারিকা মৃদু হাসলেন যেন। বললেন, ‘তুমি যে পেয়েছ, তাতেই আমার পাওয়া হয়ে গেছে। তা ছাড়া তুমি কাছ থেকে ওদের পাও, আমি দূর থেকে সবাইকে পাই। দূর থেকেই তাদের স্পর্শ করি।’
কমলকান্তি খুশি হলেন। নীহারিকা নিজেকে সামলে নিচ্ছে।
‘ঠিকই বলেছ। পাওয়াটাই আসল কথা। জীবন যেমন সব পাওয়াকে স্পর্শ করতে পারে না, এড়িয়ে চলে, হারিয়ে ফেলে, মৃত্যুও তেমন অনেক এড়িয়ে যাওয়া ভালোবাসা, দু:খকে ছুঁতে পারে না। এই যে তোমার এই পৃথিবীর জন্য মন খারাপ হওয়া, সে তো খুব বড় পাওনা। বড় তৃপ্তি। মৃত্যু তো তাকে কাড়তে পারেনি। এ-ও এক আনন্দ। ভালোবাসার মানুষের জন্য মন খারাপ হওয়া খুব বড় প্রাপ্তি। একমাত্র মানুষই এই প্রাপ্তির অধিকারী। মৃত্যু তোমাকে বঞ্চিত করতে পারেনি।’
নীহারিকা অস্ফুটে বললেন, ‘ঠিক বলেছ। এই জন্যই তোমার কাছে আসি।’
কমলকান্তি সামান্য হাসলেন। বললেন, ‘জানো নীহারিকা, আমার নতুন প্রজেক্টের কাজ শুরু করে দিয়েছি। একটু পরে রোদ উঠবে। আমার কী ভালো লাগছে!’
‘কতটা কাজ করলে?’
কমলকান্তি উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘মূল কাজটাই অনেকটা হয়ে গেছে। প্রজেক্টের চেহারাটা দেখতে পাচ্ছি।’
নীহারিকা খুশি গলায় বললেন, ‘বা:। এবার তাহলে হাতেকলমে শুরু হয়ে যাবে?’
‘অবশ্যই হবে। আজ একটু আগে খসড়া লিখে ফেললাম। এবার এটা ধরে এগোতে হবে। খসড়াটাই আসল কথা। ওটা ধরে এগোনো কোনও সমস্যাই নয়। আরেকটা বড় কাজ করেছি।’
নীহারিকা বললেন, ‘কী কাজ?’
কমলকান্তি মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘বলো তো।’
নীহারিকা বললেন, ‘আমার নামে যে টাকাপয়সা জমা আছে, সেই টাকা তুমি এই প্রজেক্টে লিখে দিয়েছ।’
কমলকান্তি বললেন, ‘ঠিক বলেছ। ব্যাঙ্ককে জানিয়ে দিয়েছি। এবার থেকে তোমার টাকা খরচ হবে রোদ উঠবে প্রজেক্টের অ্যাকাউন্টে। শুধু টাকা নয়, ভুলাভেদার জমিটাও প্রজেক্টের নামে লিখে দিয়েছি। কেউ জানে না। খোঁজ নিলেই জানতে পারবে, সব খাতাকলমে করা আছে। আমার এই কাজে কে সাহায্য করবে জানো?’
নীহারিকা বলল, ‘জানি।’
কমলকান্তি বললেন, ‘তাও জানো?’
নীহারিকা হেসে বললেন, ‘বা:, জানব না কেন? আমি কি তোমার বাড়ির বাইরের একজন হয়ে গিয়েছি নাকি? তোমাকে সব কাজে সাহায্য করছে মণিকুন্তলা।’
কমলকান্তি বললেন, ‘বড় ভালো পুত্রবধূ আমার। ছেলেটার মতো সিরিয়াস হওয়ার অসুখে ভোগে না। অথচ কত যত্ন করে সব কাজ করে দিয়েছে। আমি বারণ করেছি বলে কাউকেও বলেনি।’
কথাটা ঠিক, একটু পরে রোদ উঠবে প্রজেক্টের জন্য টাকা, জমির পাকা কাজ করতে মণিকুন্তলা শ্বশুরমশাইকে সাহায্য করেছেন। গোপনে উকিল, রেজিস্ট্রি অফিস, ব্যাঙ্কে ছোটাছুটি করেছেন। যেদিন শ্বশুরমশাই তাকে ডেকে প্রজেক্টের বিষয়ে বলেন, মণিকুন্তলা এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন যে, খানিকটা সময় কথা বলতে পারেননি। কমলকান্তি বলেছিলেন, ‘কেমন ভেবেছি?’
মণিকুন্তলা উঠে গিয়ে শ্বশুরমশাইকে প্রণাম করেছিলেন। খুব বড় মানুষ না হলে এমন একটা কাজের কথা কেউ ভাবতে পারে না। তার নিজেও লেখাপড়ার সাধ মেটেনি। ইচ্ছে ছিল, কলেজ পাস করবার পর আরও পড়বেন। সংসারের চাপে সব ভেস্তে গেছে। পড়তে কেউ আপত্তি করেনি। নিজে থেকেই আর সময় পাননি। দুই মেয়েকে বড় করা এত বড় সংসার সামলানোর পর আরও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সময় হল না। তার ওপর সংসারে শাশুড়ি নেই। ফলে, গৃহকর্ত্রীর হাল তাকেই ধরতে হল। এই সব শেষ করে, কী করে মাস্টার ডিগ্রি করবেন? কমলকান্তির কাছে রোদ উঠবে প্রজেক্ট শুনে আপ্লুত হয়ে গেলেন।
‘বাবা, আমি কি এখানে পড়তে পারব?’ লজ্জা লজ্জাভাবে জানতে চেয়েছিলেন মণিকুন্তলা।
কমলকান্তি প্রবল উৎসাহে বলেছিলেন, ‘অবশ্যই পারবে। তবে এমএ, এমএসসি পড়ানো বা গবেষণা করাবার মতো কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো আমরা বানাতে পারব না মণিকুন্তলা। ইচ্ছে থাকলেও পারব না। পরে কী হবে জানি না, তবে এখনই যদি ওদিকে মন দিই, তাহলে আসল লক্ষ্য থেকে সরে যেতে হবে। তবে তুমি অন্য কিছু পড়তে পারো। যে পড়া চিরাচরিত কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নয়। যে পড়া হাতেকলমে শেখবার পড়া। আমরা তো ওখানে হাতের কাজ শেখবার ট্রেনিং সেন্টার খুলব।’
মণিকুন্তলা চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলেছিলেন, ‘সেটাই ভালো হবে বাবা। আমি আঁকা শিখব। পটচিত্র দেখলে আমার খুব হিংসে হয়। মনে হয়, ইস আমি যদি একটু আঁকতে পারতাম!’
কমলকান্তি বললেন, ‘বেশ তো, আঁকবে। কিন্তু তোমাকে ডেকেছি একটা গোপন কাজের জন্য।’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘কী কাজ?’
কমলকান্তি গলা নামিয়ে বললেন, ‘জরুরি কাজ। এখন কেউ জানবে না।’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘কেউ জানবে না। আপনি নিশ্চিন্তে বলতে পারেন।’
কমলকান্তি বললেন, ‘আমি তোমার শাশুড়ির সব টাকাপয়সা এই প্রজেক্টের জন্য রেখে দিতে চাই। ঝাড়গ্রামের কাছে যে জমি আছে সেটাও। এই কাজে তুমি আমাকে সাহায্য করবে। সেই অর্থে তুমি হবে এই প্রজেক্টের প্রথম কর্মী।’
মণিকুন্তলা প্রায় লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘দারুণ হবে! কী করতে হবে বলুন।’
কমলকান্তি হেসে বললেন, ‘বাপরে, তুমি তো এখনই খুশিতে লাফাচ্ছ।’
‘লাফাব না। এরকম একটা দারুণ কাজের সঙ্গে প্রথমেই আমি যুক্ত হচ্ছি…এই সুযোগ ক’টা মানুষের জীবনে আসে?’
কমলকান্তি গাঢ় স্বরে বললেন, ‘তোমার মতো পুত্রবধূও ক’জন মানুষের বাড়িতে আছে, সেটাও একটা কথা মণিকুন্তলা। আমি সব না জানলেও এখনকার হালচাল কিছুটা জানি। এখনকার মেয়েরা মুখে আধুনিকতার বড়াই করে, আর চকচকে চোখে তাকিয়ে থাকে, কখন শ্বশুরবাড়ির জমি, শাশুড়ির গয়না, জমানো টাকা পাব। আমি জানি না, এমন একজন পুত্রবধূকেও পাওয়া যাবে কিনা, সে হেলায় শ্বশুর-শাশুড়ির সম্পত্তি ত্যাগ করে। অথচ শ্বশুর-শাশুড়িকে কত হেলায় তারা ত্যাগ করে। বিয়ের পরদিনই স্বামীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছাড়বার জন্য ছটফট করে। বলে, একসঙ্গে থাকাটা ওল্ড কালচার। মডার্ন সোসাইটিতে এসব চলে না। পরের বাড়ির মেয়ে কেন অন্য কোথাও মানিয়ে নেবে? জানো মণিকুন্তলা, আমিও এই ধারণায় বিশ্বাস করি। নিজের স্পেস চাই। একসঙ্গে থাকবার সিস্টেম ঠিক নয়। তবে আবার সেই সঙ্গে এটাও বিশ্বাস করি, তাহলে টাকাপয়সা, জমিজমার ওপর দাবি করাও ঠিক নয়। হায়রে, আধুনিক মেয়েরা ওটাকে তাদের আধুনিক লিস্ট থেকে সরিয়ে রেখেছে। তুমি আলাদা। শাশুড়ির টাকাপয়সা, জমি কত অবলীলায় ছেড়ে দিচ্ছ। শুধু ছেড়ে দিচ্ছ না, প্রবল উৎসাহের সঙ্গে দিচ্ছ। তোমার মতো মেয়ের পক্ষেই মানায়।’
মণিকুন্তলা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘এ আপনি কী বলছেন, বাবা! আমার অভাব কীসের? মায়ের টাকা এতবড় একটা কাজে লাগবে, এ তো আমাদের গর্ব। ছেড়ে দিচ্ছি কোথায়? আমিও তো আপনার এই কাজের একজন।’
কমলকান্তি বললেন, ‘শোনো মণিকুন্তলা। এখনই প্রজেক্টের কাজ কিছু হয়নি। ফলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। আমার চেনাজানা একজন ল’ইয়ারকে দিয়ে একটা লিখিতভাবে ব্যবস্থা করব। সেখানে বলা থাকবে, এই টাকা এবং এই জমি শুধুমাত্র ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ নামের প্রজেক্টের জন্যেই খরচ করা যাবে। এই কাজে তুমি আমাকে সাহায্য করবে।’
কয়েক দিনের মধ্যেই কাজটা হয়ে গেল। বাড়ির কেউ জানতেও পারল না। এক কাজের দিনের দুপুরে ফাঁকা বাড়িতে ল’ইয়ারকে দিয়ে লেখাপড়া হয়ে গেল।
নীহারিকা বললেন, ‘সত্যি মণিকুন্তলা খুব ভালো।’
কমলকান্তি বললেন, ‘তোমার সঙ্গে কথা হয়ে ভালোই হল। আমি ঠিক করেছি, ‘একটু পরে রোদ উঠবে’র একটা দিকে হেড হিসেবে ছোট নাতনিকে রাখব। কেমন হবে?’
নীহারিকা হেসে বললেন, ‘তুমি যা করবে সেটাই হবে। আমাকে বলবার দরকার নেই। তবে একটা কথা বলব?’
‘বলো।’
নীহারিকা বললেন, ‘মন খারাপ করবে না তো?’
কমলকান্তি হেসে বললেন, ‘তুমি মন খারাপ না করলে আমিও করব না।’
নীহারিকা বললেন, ‘তুমি যে ভাবছ সবাই তোমার এই কাজে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এমনটা তো নাও হতে পারে। হতে পারে কেন, হবে না।’
কমলকান্তি বললেন, ‘ও এই কথা? এতে মন খারাপের কী আছে নীহারিকা? এটাই তো স্বাভাবিক। যাদের ভাবছি, তারা সবাই থাকবে না, আবার যাদের কথা ভাবছি না, যাদের জানি না, তাদের কতজন এই কাজে যোগ দিতে আসবে? মানুষটা আসল নয়। কাজটাই আসল।’
নীহারিকা বললেন, ‘বা:, খুব সুন্দর বললে তো।’
কমলকান্তি হেসে বললেন, ‘এর মধ্যে সুন্দর-অসুন্দরের কিছু নেই নীহারিকা। এটাই নিয়ম। মানুষ থাকে না, কাজ থাকে। এই যে তুমি নেই, তারপরেও তো তুমি এই প্রজেক্টে ভীষণভাবে আছ। আছ না? আবার আমি এখন আছি, কাল যদি না থাকি, তার পরেও প্রজেক্ট হবে।’
নীহারিকা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমি যাই তাহলে।’
‘তোমার কি মন খারাপ কমেছে নীহারিকা?’
নীহারিকা একটু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, কমেছে।’
কমলকান্তির ঘুমের মধ্যে যেভাবে এসেছিলেন নীহারিকা, সেভাবেই কমলকান্তিকে ছেড়ে চলে গেলেন। কমলকান্তি পরম নিশ্চিন্তে পাশ ফিরলেন।
এই ঘুমের মধ্যেই মারা গেলেন সেনবাড়ির প্রবীণতম মানুষ কমলকান্তি সেন। মারা গেলেন নি:শব্দে এবং গোপনে। তার একটা হাত রইল ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ লেখা খাতার ওপর।