পঁয়তাল্লিশ
পূজনীয়া মণিকুন্তলা মাসি,
আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
উচিত ছিল দেখা করে নিজের মুখে তোমাদের কথাটা বলে যাওয়া। আমি পারলাম না। তার কারণ তোমরা বারণ করলে আমি দ্বিধার মধ্যে পড়তাম। পৃথিবীর সবাইকে অস্বীকার করবার মতো মনের জোর আমার হয়েছে, কিন্তু এ বাড়িকে অস্বীকার করবার মতো ক্ষমতা আমি এখনও অর্জন করতে পেরেছি কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। সম্ভবত পারিনি। তাই কাউকে না জানিয়েই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাকে ক্ষমা কোরো মাসি। মাসি আমি জানি, তোমরা বারণ করতে। তুমি, মেসোমশাই, বৃষ্টি, মেঘদি সবাই মিলে আমাকে বোঝাতে। বলতে, আমি যেন লেখাপড়া শেষ না করে এই ধরনের হঠকারী কাজ না করি। বাইরে যে ক’জন আমার চলে যাওয়ার কথা জানে তারাও বারণ করেছে। এমনকী আমার রাজনৈতিক শিক্ষাগুরুও। তাঁরা ঠিক কাজই করেছেন। তোমরাও করতে। তোমরা বেশি জোর করতে। সে অধিকার তোমাদের আছে।
মাসি, তুমি তো জানো আমি ছোটবেলা থেকেই অন্যরকম। শুধু নিজের মতো থাকতে পারি না। বিচার বুদ্ধি, ঠিক-বেঠিক, ভালো-মন্দ বোধ তৈরি হওয়ার পর থেকে চারপাশের মানুষ, সমাজ, দেশ, সময় আমাকে ভাবায়। আমি মন দিয়ে যেমন লেখাপড়া করেছি, মন দিয়ে দেশের মানুষের দু:খ, কষ্ট, শোষণ, বঞ্চনা বোঝবার চেষ্টা করেছি। বারবারই মনে হয়েছে, আমিও তো একজন হতদরিদ্র মানুষ হতে পারতাম। হয়তো আমার বাবা একজন সামান্য ভাগচাষী বা মজুর হতে পারত। অথবা আমি এমন একজন শ্রমিকের ঘরের সন্তান হতে পারতাম যার কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। দিনের পর দিন যাদের না খেয়ে, আধখানা খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়। পথ চলতে গিয়ে নিজেকে কতদিন ফুটপাথের ছিন্নমূল পরিবারের ছেঁড়া কাঁথায় নিয়ে গিয়ে ফেলেছি তার ঠিক নেই।
মাসি, আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না। আমি কোন ঘরে জন্মাব, কোন ঘরে মানুষ, আমার বুদ্ধিকে লেখাপড়া করে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারব কিনা সবটাই একটা চান্স। আমি যদি তোমাদের মতো মানুষ না পেতাম, আমার কী হত বলো তো? আমি বিশ্বাস করি, আমরা যারা দুবেলা পেট ভরে খেয়ে, মাথার ওপর নিশ্চিন্ত ছাদ পেয়ে, লেখাপড়া শেখবার সুযোগ পেয়েছি, তাদের অনেক দায়িত্ব, অনেক। যারা কিছু পায়নি, তাদের কথা আমাদেরই তো ভাবতে হবে। তাই না?
নিজেকে অনেকবার জিগ্যেস করেছিলাম, লেখাপড়া শেষ করলে সমস্যাটা কোথায়? লেখাপড়ার সঙ্গে মানুষের জন্য কাজ করায় তো কোনও বিবাদ নেই। না নেই। বরং তাই ভালো। যত শেখা যাবে, শিক্ষাকে তত কাজে লাগানো যাবে। তারপরেও অনেক ভেবেছি। ভেবে আমার ভয় করেছে। মাসি, আমি যদি আমার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার লেখাপড়া শেষ করি, এরপরই আমাকে কেরিয়ারের ফাঁদে পড়তে হবে। হবেই। এরকম হাজার হাজার ছেলেমেয়ে আছে, যারা ছাত্রজীবনে রাজনীতি করে কেরিয়ারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছে। একসময় যারা গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেয়, মাইলের পর মাইল মিছিল করে, একটা সময় রাজনীতি তাদের কাছে মুখরোচক আলোচনা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তোমারা যাকে ‘ব্রিলিয়ান্ট’ বলো, তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাশনের পলিটিক্স সেরে নিজেরটা গোছানোর জন্য হাঁকপাক করতে থাকে। একসময় আমাদের দেশে উগ্র বামপ্রন্থী দলের সঙ্গে কত ভালো ছেলেমেয়েই না জড়িয়ে পড়েছিল। তাদের অধিকাংশই আজ পুঁজির কাছে আপস করেছে। শুধু আপস করেনি, ধনীকে কীভাবে আরও ধনী করা যায় তার জন্য নিজেদের মেধা বুদ্ধি খরচ করছে। সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও, ভেঙে দাও বলে যারা কলেজ স্ট্রিট তোলপাড় করেছিল, তাদের অনেকেই এখন যোগ্যতার সঙ্গে আমেরিকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে। সেখানকার নাগরিক হয়ে গেছে। বাংলার গ্রামের ভাঙা প্রাথমিক স্কুলের আধপেটা খাওয়া ছেলেমেয়ের কথা আর তাদের মনে পড়ে না। পড়লে প্রবন্ধ লিখে কুমিরের কান্না কাঁদে।
মাসি, আমি যে রাজনীতিতে বিশ্বাস করি, তা উগ্র নয়। তা মানুষকে নিজের অধিকার, নিজের প্রাপ্য সম্পর্কে সচেতন করে। দেশের সংবিধান মেনে, নিয়মকানুন মেনে, নিজের প্রাপ্য কীভাবে বুঝতে হয় এবং আদায় করে নিতে হয় সেই শিক্ষা দেয়। আমি যতটা লেখাপড়া শিখেছি, তাতে এই কাজ আমি পারব। আমার কয়েকজন বন্ধু গ্রামে চলে গিয়ে কাজ করছে। আমি তাদের সঙ্গে যোগ দেব। আমাদের পার্টি এখন যে পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে তাতে গ্রামের মানুষকে রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়ার কাজটা সবথেকে জরুরি। শহরের মসৃণ রাজনীতি আমার আর ভালো লাগছে না।
মাসি, ভয় করে। আমি যদি লেখাপড়ার শেষ ডিগ্রি নিই, তাহলে আমিও হয়তো একজন শখের রাজনীতি করা ছাত্র হয়ে যাব। ভালো রেজাল্ট করার ফলে, আমার কাছে হাতছানি আরও লোভনীয়ভাবে আসবে। তার থেকে এই ভালো। পড়াশোনা ভালো হল, কিন্তু ডিগ্রিটা হল না। আমি যা চেয়েছি আমাকে তোমরা তাই করতে দাও।
অনেক কথা লিখে ফেললাম। হয়তো নিজেকে কৈফিয়ত দিলাম। রাগ কোরো না। আমি মাঝে মাঝে তোমাদের কাছে আসব। তবে পরিস্থিতি যা তাতে নানারকম অজুহাতে পুলিশ আমাকে হেনস্থা করবে। এটা পার্ট অফ মাই পলিটিক্স। সবসময়ে সোনার চামচ নিয়ে রাজনীতি করা যায় না। এসব তো খুব সামান্য। ব্রিটিশদের দেশছাড়া করতে গিয়ে আমার থেকেও ছোট ছেলেমেয়েরা সব ছেড়েছুড়ে জেলে জীবন কাটিয়েছে। একজন-দুজন নয়, হাজার হাজার। একজনকে দেখে, আর-একজন উৎসাহিত হয়েছে। আমি তো অতি সামান্য, যাই হোক, আমি চাই না পুলিশি হুজ্জুতির মধ্যে সেনবাড়ি থাকুক।
তোমরা ভালো থেকো। কমলকান্তিদাদুর ‘রোদ উঠবে’ প্রজেক্ট সফল হোক এই কামনা করি। আমি যদি সরাসরি রাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে না থাকতাম, তাহলে অবশ্যই এখানে কাজ করতাম। জানি না, ভবিষ্যতে কী হবে। যদি সেরকম হয়, হয়তো কয়েক বছর পরে ঝাড়গ্রামে গিয়ে আমি হাজির হয়ে যাব।
তুমি প্রণাম জেনো। বড়দের প্রণাম দিও। মেসোকে বোলো তার স্নেহ আমি কোনওদিন ভুলব না। বারিধারা আর মেঘবতীর মতো বোন পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। ওদের বোলো আমাকে যেন ভুল না বোঝে। আমি কোন গ্রামে কাজ করব জানিয়ে দেব। যদি কোনওদিন চায় ওরা বেড়াতে আসতে পারে। যে ভালোবাসা তোমরা আমাকে দিয়েছ তা আমার মতো অভাগাজনের পাওয়ার কথা নয়। আমার যে আশ্রয়ের খুব কিছু প্রয়োজন ছিল এমন নয়। আমি আমার কলেজের হস্টেলেই জায়গা পেতে পারতাম। নিজের খরচ চালিয়ে নেওয়ার মতো স্কলারশিপ এবং টিউশন দুটোই আমার ছিল। তার পরেও সেনবাড়ি আমাকে পরম যত্নে তার বাড়ির একজন করে রাখতে চেয়েছিল তাকে আমি এড়াতে পারিনি। অথচ আমার যা স্বভাব তাতে আমার একা থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। হয়তো শুধু ভালোবাসা নয়, আমি নিজেও একটা পরিবারের মধ্যে থাকতে চেয়েছিলাম। যারা অনাথ হয় তারা পরিবারে স্নেহ-ভালোবাসার জন্য মুখিয়ে থাকে।
ইতি
অর্চিন
পু: মাসি, এতদিন জানাইনি, আজ জানাচ্ছি। আমি আমার পরিচয় জেনে ফেলেছি। কীভাবে জেনে ফেলেছি সে প্রসঙ্গ অবান্তর। যতই হোক, আমি তো একজন বুদ্ধিমান ছেলে। তাই না? আর একটা কথা। একজন মহিলা মাঝে মাঝে এই বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করেন। একদিন আমি তার পিছু নিই। উনি কার্যত পালিয়ে যান। ভিড়ে মিশে যান। আরেক দিনও চেষ্টা করেছিলাম। সেদিন ভদ্রমহিলা একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়েন। আর পিছু নিইনি। যিনি নিজে আড়ালে থাকতে চান, তাকে আড়ালে থাকতে দেওয়াটাই সম্মানের। নিজের মা হলেও। তাই না?
চিঠি পড়া শেষ করে বিমলকান্তি মুখ তুললেন।
‘ভুল করল। খুব ভুল করল। এমন ভালো একটা ছেলে…ছি ছি।’
মণিকুন্তলা হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন। বললেন, ‘কী আর করা যাবে।’
বিমলকান্তি বিরক্ত মুখে বললেন, ‘কী আর করা যাবে মানে! তোমার আটকানো উচিত ছিল। একটি ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে এলেই হয় না, তাকে দু’বেলা খাওয়া-পরা দিলেই হয় না, সে যাতে বিপথে না যায় সেটাও দেখতে হয়।’
মণিকুন্তলা অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি কি জানতাম ও এরকম একটা হঠকারী কাজ করবে?’
‘জানতে না কেন? ছেলেটা তো আমাদের বাড়িরই একজন ছিল, তার খোঁজখবর রাখবে না, সে কী করে? কোথায় যায়? কখন বাড়ি ফেরে?’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘একজন লেখাপড়ায় খুব ভালো, শান্ত প্রকৃতির, ভদ্র ছেলের পেছনে গোয়েন্দাগিরি করতে হয় জানতাম না। তাছাড়া জেনেই বা কী করতাম। ও যে পলিটিক্স করে সেখান থেকে আমি ওকে ফেরাতে পারতাম? পলিটিক্সের আমি কী বুঝি? আমার কথা অর্চিন শুনতই বা কেন?’
বিমলকান্তি মুখে চুকচুক আওয়াজ করে নিজের মনে মাথা নাড়তে লাগলেন। অর্চিনের এভাবে চলে যাওয়াটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। তাঁর খারাপ লাগছে। তিনি মুখে স্ত্রীকে বকাঝকা করলেও, মনে মনে নিজেকে দায়ী করলেন। বাড়িতে পুলিশ এসে অতবড় একটা অভিযোগ করবার পরই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। বোঝা উচিত ছিল তলে তলে কোনও একটা গোলমাল চলছে। ছেলেটাকে ডেকে বোঝানো উচিত ছিল। বাবার মৃত্যু, কোম্পানির ঝামেলায় এসব কথা মাথায় এল না। কোম্পানিতে একটা ঝামেলা হয়েছে। বিচ্ছিরি ঝামেলা। ভাগ্যিস কমলকান্তি সেন বেঁচে নেই! শুনলে আঘাত পেতেন।
বিমলকান্তি নীচু গলায় বললেন, ‘আমাদের দেশে পলিটিক্স সবথেকে ক্ষতি করেছে। কীভাবে ভালো ছেলেগুলোকে মাথা খেয়ে নষ্ট করছে। ছিছি। লেখাপড়ার একেবারে শেষ স্টেজে এসে এই পাগলামি! নেতাগুলো এর জন্য দায়ী। দেখবে পেছনে কেউ আছে, কেউ উসকেছে।’
মণিকুন্তলা চাপা গলায় বললেন, ‘চিঠির শেষটা পড়েছ?’
বিমলকান্তি ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘অতটা খেয়াল করিনি। অর্চিন কোনও একজন মহিলার কথা লিখেছে। কে বলো তো?’
মণিকুন্তলা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘অর্চিন যা বলেছে তা যদি ঠিক হয় তাহলে সমস্যা। অর্চিনের মা ঝামেলা পাকাবে। আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইবে।’
বিমলকান্তির মনে পড়ল, ক’দিন আগে সকালে এক মহিলা দেখা করতে এসেছিল। সেই মহিলা নয় তো? অর্চিনের মা?
‘ওসব নিয়ে চিন্তা কোরো না। ওই ধরনের চিটিংবাজ বদ মহিলাকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয় আমার জানা আছে। তার ছেলে তাকে নিয়ে ইমোশনাল হতে পারে, আমি হব না। নেহাত মহিলাকে আমি চিনি না, দেখিনি কোনওদিন। মুখোমুখি দেখা হলে তাকে আমি জেলে দেব। এবার একবার বাড়িতে এসে দেখুক না। এখান থেকে থানায় ফোন করব। যাক, ওসব বাজে কথা থাকুক। দেখো, ছেলেটাকে ট্রেস করতে পারো কিনা। ধরে আনতে হবে। পড়াশোনা শেষ করে যেখানে খুশি যাক, যত খুশি দেশোদ্ধার করুক। আমাদের দায়িত্ব পালন করব।’
মণিকুন্তলা অসহায় গলায় বললেন, ‘কোথায় খুঁজব?’
বিমলকান্তি বললেন, ‘আহা, ওর কোনও বন্ধু টন্ধুকে চেনো না? বৃষ্টি কিছু বলতে পারবে না?’
মণিকুন্তলা অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘আচ্ছা দেখছি।’
বিকেলেই বারিধারা ঋষার সঙ্গে দেখা করল। পরিচয় খুব গভীর নয়। এক-দু’বারই দেখা হয়েছে। বন্ধুদের সূত্রেই তার কাছে খবর আছে অর্চিন এই মেয়েটির সঙ্গে প্রেম করে। বাড়িতে দিদি আর মাকেও বলেছিল।
‘জানো মা, অর্চিদার একজন গার্লফ্রেন্ড আছে।’
মণিকুন্তলা চোখ বড় বড় করে বলেছিলেন, ‘ওমা! তাই নাকি! ওই ছেলেকে তো দেখলে মনে হয় না, প্রেম টেম করতে পারে। অমন ভালো ছেলে।’
মেঘবতী সেই আড্ডায় ছিল। বলেছিল, ‘ভালো ছেলেরা প্রেম করে না এমন কথা তোমায় কে বলল মা?’
মণিকুন্তলা থতমত খেয়ে বলেছিলেন, ‘না, তা নয়। অনেক সময় হয় না?’
বারিধারা হেসে বলল, ‘কী হয়? ভালো ছেলেরা প্রেম দেখলে পালায়?’
দুই বোন হেসে উঠল। মেঘবতী বলল, ‘বাদ দে তো বৃষ্টি। মেয়েটা কে? কেমন দেখতে? কী করে?’
বারিধারা দিদির উৎসাহে মজা পেল। পৃথিবীর যে-কোনও মেয়েই অন্যের প্রেমের ব্যাপারে কৌতূহলী। চরম শত্রু হলেও ছাড়বে না। কানে একবার কথাটা এলেই হল। সব জানা চাই।
বারিধারা বলল, ‘যতদূর খবর পেয়েছি, মেয়েটির নাম ঋষা। আমার থেকে খারাপ কিন্তু তোর থেকে ভালো দেখতে দিদি। আর করার মধ্যে মেইন কাজ হল কবিতা লেখা।’
ঋষার সঙ্গে তারপর দু-একবার যোগাযোগ হয়েছে। একবার ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ফেস্টে এসেছিল। একবার নন্দনে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। অর্চিনের মাসতুতো বোন জেনে ফোন নম্বরও দিয়েছিল ঋষা।
‘তোমার আর মেঘদির কথা খুব শুনেছি।’
বারিধারা হেসে বলেছিল, ‘আমরা কিন্তু তোমার কথা কিছুই শুনিনি। অর্চিনদা কথাই বলে না। মনে হয় আমাদের মোটে পছন্দ করে না।’
ঋষা হাত ধরে বলেছিল, ‘মোটেও না। তোমাদের খুব পছন্দ।’
বারিধারা বলেছিল, ‘ঠিক আছে, একদিন বাড়িতে এসো।’
তারপর আর যোগাযোগ হয়নি। মায়ের কাছ থেকে সব শুনে রাতেই ফোন করল ঋষাকে।
ছেচল্লিশ
ঋষা বলল, ‘কী খাবে?’
বারিধারা বলল, ‘কিছু খাব না, শুধু কফি।’
ঋষা বলল, ‘তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, খিদে পেয়েছে।’
বারিধারা সামান্য হেসে বলল, ‘সত্যি খিদে পেয়েছে।’
ঋষা টেবিল থেকে উঠে কাউন্টারের কাছে গেল। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে কফি আর স্যান্ডুইচ বলল। ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে বসতে চেয়েছিল বারিধারা। ঋষাই রাজি হয়নি।
‘বড্ড ভিড়। চলো পাশেই কফিশপ। ওখানে গিয়ে বসি। নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে।’
একসময় কলকাতায় কফির দোকান বলতে কফিহাউসই বোঝাত। একটা কফি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানোর জায়গা। কবিতা, গল্প, লিটল ম্যাগাজিন, ডকুমেন্টারি, বিপ্লব কী নেই সেখানে! সেইসঙ্গে পকৌড়া, টোস্ট, কবিরাজি। কিছু না নিলেও চলে। এমনি বসে থাকা যায়। সর্বক্ষণ একট গমগম আওয়াজ। সিগারেটের ধোঁয়া। একটা বয়স পর্যন্ত ঘোরের মতো লাগে। এখন গোটা শহরে নামিদামি কফিশপ ছড়িয়ে পড়েছে। এয়ার কন্ডিশন ঘরে, নরম সোফায় বসে কফি খাওয়া যায়। এসব জায়গায় অনেক ধরনের বিজনেস মিটিংও হয়। শহরের চেহারাটা বাইরে থেকে নানাভাবে পালটে যাচ্ছে।
বারিধারা ও ঋষা মুখোমুখি বসেছে। কফিশপটা প্রায় ফাঁকা। এক কোণে সোফায় দুজন ছেলেমেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। নীচু গলায় গল্প করছে। তাদের প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। বারিধারা, ঋষা বসেছে মাঝখানের একটা টেবিলে। দুই সুন্দরীর জন্য কফিশপটা যেন ঝলমল করছে।
ঋষা বলল, ‘তোমার দাদুর মৃত্যুর খবর শুনে খুব খারাপ লেগেছিল।’
বারিধারা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘উনি বিরাট পণ্ডিত বা দার্শনিক ছিলেন না। তেল, সাবান, শ্যাম্পুর ব্যবসা করলে তো এসব হওয়া যায় না। তারপরেও দাদু ছিলেন একজন গ্রেট মানুষ। ওনার যাবতীয় পাঠ জীবন থেকে। জীবন তাঁকে শুধু বাঁচাতে শেখায়নি, ভালোভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে। অন্যকেও তিনি শিক্ষা দিয়ে গেছেন।’
ঋষা বলল, ‘খাঁটি মানুষরা এমনই হয়। তোমরা খুব লাকি বারিধারা এমন একজন মানুষকে পরিবারে পেয়েছিলে।’
বারিধারা বলল, ‘এখনও উনি আমাদের সঙ্গেই আছেন।’
ঋষা বলল, ‘অবশ্যই। এই সব মানুষদের মৃত্যু হয় না।’
কফি এসে গেলে দুজনে চিনি মিশিয়ে মগ হাতে তুলে নিল। বারিধারা মগে চুমুক দিয়ে বলল, ‘ঋষা, অর্চিনদার ব্যাপারটা কী? সত্যি সে গ্রামে চলে গেছে?’
ঋষা বলল, ‘আমি যতদূর জানি গেছে। আজ সকালেই রওনা হয়ে গেছে। নোনাজল।’
‘নোনাজল! সেটা কোথায়?’
ঋষা বলল, ‘সুন্দরবনে। সজনেখালি থেকে আরও ঘণ্টাখানেক যেতে হয়।’
বারিধারা চুপ করে খানিকক্ষণ কফি খেল। ন্যাপকিন তুলে মুখ মুছে বলল, ‘অর্চিনদা আর লেখাপড়া করবে না?’
ঋষা বলল, ‘আমাকে তো সেরকমই বলেছে।’
‘মা-বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে।’
ঋষা বলল, ‘স্বাভাবিক। ওনারা অর্চিনের জন্য যা করেছেন, তাতে…’
বারিধারা বলল, ‘একটা কথা বলব ঋষা?’
ঋষা হেসে বলল, ‘এ আবার কেমন কথা? বলবে না কেন?’
বারিধারা তারপরেও একটু চুপ করে রইল। চামচ নিয়ে কফি মগে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘তুমি অর্চিনদাকে আটকালে না কেন?’
ঋষা হাসল। বলল, ‘আমার সে জোর কই?’
বারিধারা নরম গলায় বলল, ‘এটা কি ঠিক কথা হল?’
‘হ্যাঁ, ঠিক কথাই হল। বারিধারা, তুমি তো জানো কিছু সম্পর্কে জোর থাকে না। ভালোবাসলেই জোর খাটানো যায় না।’
বারিধারা বলল, ‘অর্চিনদা তো জোরই খাটাল। কারও বারণ না শুনে চলে গেল।’
ঋষা অস্ফুটে বলল, ‘আমি বারণ করিনি, আবার হ্যাঁ-ও বলিনি।’
বারিধারা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কেন করোনি? লেখাপড়ায় ইতি টেনে অর্চিনদার মতো একজন ব্রিলিয়ান্ট ছেলের চলে যাওয়াকে তুমি আটকাবে না!’
ঋষা শান্তভাবে বলল, ‘সবাই সব পারে না বারিধারা। মানুষ বকাবকি করলে বা দুর্বল ভাবলেও পারে না।’
বারিধারা লজ্জা পেল। ঋষাকে এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। ও ভাবল, ওকে দুর্বল ভাবা হচ্ছে। বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারে সবাই তার মতো প্রজেসিভ হবে এমন মনে করবার কারণ নেই। সে যেভাবে শ্রবণকে কন্ট্রোল করে, ঋষা তা নাও পারে। নিজের মতো করে সবাইকে ভাবা যেমন ঠিক নয়, অর্চিনদা আর শ্রবণকে একরকম ভাবাটাও ঠিক নয়। রাজনীতি করা মানুষরা অন্যরকম হয়। শিল্পীরাও অন্যরকম হয়। দুটো অন্যরকম মানুষের মধ্যে যেমন তুলনা চলে না, তাদের সঙ্গে ব্যবহারও একরকম হবে না। বারিধারা হাত বাড়িয়ে ঋষার হাতের ওপর হাত রাখল।
‘সরি, আমি তোমাকে ওভাবে বলতে চাইনি। বুঝতেই তো পারছ, অর্চিনদার ঘটনাটা নিয়ে আমরা ডিসটার্বড। তাছাড়া দোষ তো আমাদেরও। অর্চিনদা তো আমাদের বাড়ির লোক। আমরাও তো বুঝতে পারিনি, সে এতদূর ভেবে ফেলেছে। জানাতে পারলে মা নিশ্চয় আটকাত। তুমি কিছু মনে করো না। আমার এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। তোমার মনের অবস্থা আমার বোঝা উচিত ছিল। আমি আবার দু:খ প্রকাশ করছি।’
ঋষা বলল, ‘ইটস ওকে। আমি কিছু মনে করিনি। তোমাদের উৎকণ্ঠা আমি বুঝতে পারছি।’
বারিধারা এবার ঝুঁকে পড়ে, গলা নামিয়ে বলল, ‘ঋষা, আমরা যদি ওই নোনাজল গ্রামে গিয়ে অর্চিনদাকে চেপে ধরি? জোর করি? ফিরে আসবে না? চলো না, একবার চেষ্টা করি।’
ঋষা হাসল। বলল, ‘লাভ হবে না বারিধারা। আমি যতদূর জানি, অর্চিন মন শক্ত করেই গেছে। লাভ হলে তো আমিই তাকে আগে আটকাতে পারতাম।’
বারিধারা বলল, ‘তাও একবার চেষ্টা করতে অসুবিধে কী? চলো কালই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। মা-ও যাবে।’
ঋষা এবার মুখ কঠিন করে বলল, ‘না বারিধারা। আমি যাব না।’
বারিধারা সোজা হয়ে বসল। ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কেন? যাবে না কেন?’
ঋষা বলল, ‘আমি তাকে জোর করবার বিপক্ষে। সে ছোট নয়, বোকাও নয়। ঠিক ভুলের পার্থক্য সে জানে। তাছাড়া…তাছাড়া… তার কাছে রাজনীতি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা সেখান থেকে তাকে সরে আসতে বলবার কে বারিধারা? আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি না বলে? কেউ যদি এখন আমাকে বলে কবিতা, লিটল ম্যাগাজিন সব ছেড়ে দিতে, কোনও দাম নেই এসবের, আমি ছেড়ে দেব? সরি, বারিধারা। অর্চিন শুধু তার লেখাপড়া, রেজাল্ট নিয়েই অর্চিন নয়, তার বিশ্বাস, আদর্শ নিয়েই সে অর্চিন। আমি গোটা অর্চিনকেই ভালোবাসি। এতে আমার ক্ষতি হলে মেনে নিতে হবে। তাকে তার পথে চলতে দেওয়াই উচিত।’
বারিধারা চুপ করে রইল। সে মুগ্ধ। ঋষা এতটা পরিণত! সত্যি তো সে যা বলছে, সবক’টা কথাই যুক্তিযুক্ত। অর্চিনদা নিজের বিশ্বাসমতো জীবন কাটাতে চাইছে। তাকে জোর করে ফিরিয়ে আনা হবে কেন? শ্রবণের কাজ নিয়েও তো তার বাড়ি থেকে আপত্তি আছে। তার মানে শ্রবণকে আঁকাজোকা ছেড়েছুড়ে সাধারণ একটা চাকরি নিতে হবে? এবারও সে ভুল কথা বলে ফেলল। বারিধারার নিজের ওপর রাগ হচ্ছে আবার ঋষার জন্য গর্বও হচ্ছে। ঠিক মেয়েই অর্চিনদা পছন্দ করেছে।
বারিধারা বলল, ‘ঠিকই বলেছ ঋষা। আমারই বুঝতে ভুল হয়েছিল। আসলে আমার মা এমনভাবে বলল… বলল… দেখ না, অর্চিনের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে যদি ওর খোঁজ পাওয়া যায়… আমরা গিয়ে একবার… এখন বুঝতে পারছি কাজটা ঠিক হবে না…।’
ঋষা হেসে বলল, ‘মায়েদের মন তো এমনই হবে।’
বারিধারা হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখল। বলল, ‘চলো ওঠা যাক।’
দুজনেই উঠে দাঁড়াল, আর তখনই একজন লোক কাচের দরজা খুলে হুড়মুড়িয়ে কফিশপের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কাউন্টারের কাছে প্রায় ছুটে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আমাকে বাঁচান। আমাকে ওরা মেরে ফেলবে।’
কফিশপ এখন পুরো ফাঁকা। কোণে বসা দুজন ছেলেমেয়ে কখন উঠে গেছে।
বারিধারা চমকে লোকটার দিকে তাকাল। মলিন, বিধ্বস্ত জামাকাপড়ের একজন ভয় পাওয়া মানুষ। বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হবে। কাঁধের ঝোলাটা কোনওরকমে চেপে ধরে আছে। এই চকচকে কফিশপের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। কাউন্টারে একজন কমবয়সি মেয়ে আর একজন ছেলে। দুজনেই ঘাবড়ে গেছে। ঘাবড়ানোই স্বাভাবিক। দিনদুপুরে এ কী ঘটনা! লোকটা কোথা থেকে এল?
বারিধারা ঘুরে তাকাল। কাউন্টারের ছেলেটি বলল, ‘আপনি কে? কী চান এখানে?’
বিধ্বস্ত লোকটা কাচের দরজার দিকে তাকাতে তাকাতে বলল, ‘প্লিজ, আমাকে একটা লুকোনোর জায়গা করে দিন। পায়ে পড়ি আপনাদের।’
কাউন্টারের মেয়েটি কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘কে আপনি? চলে যান, চলে যান বলছি। এসব এখানে হয় না।’
লোকটার চোখমুখ আরও কুঁকড়ে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘না না, আমি যাব না। ওরা আমাকে বাসস্ট্যান্ড থেকে তাড়া করেছে, এক্ষুনি এখানে এসে ঢুকবে। বাথরুমটা কোনদিকে?’
বারিধারা এগোতে গেলে ঋষা ওর কাঁধ চেপে ধরল। আতঙ্কিত গলায় বলল, ‘যেও না।’
বারিধারা কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘কিছু হবে না।’
বারিধারা কয়েক পা এগিয়ে পিছন থেকে বলল, ‘কী হয়েছে? কী হয়েছে আপনার? কারা আপনাকে তাড়া করেছে?’
লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। চমকে উঠল বারিধারা। তার শরীর দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। বংশীবাদক! এই সেই বংশীবাদক লোকটা। দিদির বাড়ির থেকে সব চুরি করে পালিয়েছে।
‘আপনি!’
বংশীবাদকের চেহারা অনেক বদলেছে। চোখমুখের ঢুলু ঢুলু ভাবটা নেই। বরং একমুখ খোঁচা দাড়িতে চোয়াড়ে মার্কা ভাব। চুল এলোমেলো। পোশাকও অন্যরকম। পায়জামা, কুর্তির বদলে ফতুয়া। কাঁধের ব্যাগটাই যা একরকম আছে। চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে গেছে।
বারিধারা এগিয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে ডান হাত তুলে বলল, ‘আপনি সেই বাঁশিবাজিয়ে না? আপনিই তো। দিদির বাড়িতে ডাকাতি করেছেন।’
ঋষা প্রায় ছুটে এসে বারিধারাকে চেপে ধরে। বারিধারা ঝটকা মেরে ঋষাকে সরিয়ে দেয়। কাউন্টারের ছেলেমেয়ে দুটো ফোন করবার চেষ্টা করছে। সম্ভবত পুলিশকে। মনে হয় নম্বর মনে করতে পারছে না।
বংশীবাদক পিছোতে গিয়ে একটা চেয়ারে ধাক্কা খেল। চেয়ারটা উলটে পড়ল।
‘কী বলছেন দিদি, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি কেন বাঁশি বাজাতে যাব! কী বলছেন!’
বারিধারা দাঁত মুখ শক্ত করে বলল, ‘কী বলছি বুঝতে পারছ না? তুমি সে-ই বাঁশিওয়ালা। দিদির বাড়িতে ডাকাতি করেছ। দাঁড়াও সব মনে করাচ্ছি।’
বংশীবাদক বলল, ‘আপনি ভুল করছেন দিদি…আমি বাঁশি বাজাই না…।’
বারিধারা মোবাইলটা তুলে বলল, ‘দাঁড়াও আমি দেখাচ্ছি, তুমি বাঁশি বাজাও কিনা।’
এবার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যা ঘটল সেটা শুধু সিনেমাতেই দেখা যায়। অথবা এই ধরনের ঘটনা বাস্তবেও এমনটাই হয়। কেউই তার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
বংশীবাদক একটা লাফ দিল। হাত ছুড়ল এমনভাবে যাতে বারিধারা মুখে আঘাত পায়। ঋষা টেনে না সরিয়ে নিলে বিপদ হত। বংশীবাদক একটা টেবিল উলটে ছুটে গেল দরজার দিকে। দরজা খুলে বেরিয়েই পড়ল রাস্তায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা মোটরবাইক এসে দরজার বাইরে দাঁড়াল। দুটো লোকের মাথায় মুখঢাকা হেলমেট। পেছনের লোকটা বাঁ হাত তুলল। হাতে রিভলভার। বংশীবাদক ছুটতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বাঁ হাত তোলা লোকটা গুলি চালাল, চাপা আওয়াজ, আগুনের ঝলকানি। আবার গুলি।
নিমেষে মোটরবাইক মুখ ঘুরিয়ে উলটোদিকে চলে গেল ঝড়ের বেগে।
গায়ে দু’বার গুলি লাগবার পরও বংশীবাদক উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে। পারে না। মুখ থুমড়ে পড়ে।
কাচের দরজার ভেতর থেকে গোটা ঘটনা দেখে বারিধারা আর ঋষা। ঋষা চেপে ধরে আছে বারিধারাকে। সে ভয়ে কাঁদছে।
বারিধারা ফিসফিস করে বলল, ‘ডাকাত হলেও, লোকটা গুণী ছিল। বড় ভালো বাঁশি বাজাত।’
সাতচল্লিশ
বিমলকান্তি সেন একই সঙ্গে বিস্মিত এবং মুগ্ধ।
সাইকিয়াট্রিস্টদের সম্পর্কে তেমন কোনও ধারণা নেই বিমলকান্তির। বরং ‘পাগলের ডাক্তার’ হিসেবে অস্বস্তিই আছে। এর আগে এই ধরনের ডাক্তারের সঙ্গে একবারই মুখোমুখি হতে হয়েছে। সে অভিজ্ঞতা মোটে ভালো নয়।
তখন কলেজে পড়ছেন বিমলকান্তি। বাবার এক দূর সম্পর্কের ভাই থাকতেন গ্রামে। চুপচাপ ধরনের এই ছেলের ছোটবেলা থেকেই আচরণ স্বাভাবিক ছিল না। একা থাকতেই ভালোবাসত। ভিড় দেখলে সরে যেত। বনবাদড়ে ঘুরত, নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকত। বন্ধুরা হাসাহাসি করত, খেপাত। বলত মাথায় ‘ছিট’ আছে। বড় হওয়ার পর হঠাৎ সেই ছেলের স্বভাব বদলাল। শান্ত ছেলে হয়ে গেল ভায়োলেন্ট। পরিচিত, অপরিচিত কাউকে দেখলেই তেড়ে যেত। আক্রমণ যে কিছু করত এমন নয়, কিন্তু ‘ধর-ধর’ বলে তাড়া করতে ছাড়ত না। যেন চোরকে তাড়া করছে। উন্মাদ যুবকের ভাবটা এমন ছিল, যেন ভালো সেজে যারা চারপাশে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের মধ্যেই ‘চোর ছেঁচড়’ বেশি। ধরতে হলে তাদের আগে ধরতে হবে। বাইশ-চব্বিশ বছরের একজন তাগড়াই ছেলে কাউকে ‘চোর’ সন্দেহে তেড়ে গেলে ঘটনা ভালো হয় না। এ ক্ষেত্রেও হল না। একটা সময়ের পর তাকে দেখলে পাড়ার ছেলেপিলেরা ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করল। খানিকটা ভয়ে এবং বেশিটাই মজায়। দু-চারজন লাঠি দিয়েও মারল। সেই সময় পাড়াগাঁয়ে মানসিক রোগীকে লাঠি মারা কোনও অপরাধ ছিল না। বরং সেটাই নিয়ম ছিল। এখনও যে অপরাধ এমন নয়। এই গরিব, অশিক্ষিতদের দেশে আজও অনেকে মনে করে, লাঠি ছাড়া ‘উন্মাদ’ নামক অসুস্থতার আর কোনও চিকিৎসা নেই। যাই হোক, দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলে গ্রাম থেকে কলকাতার সেনবাড়িতে খবরাখবর সবসময় আসত না। লাঠি দিয়ে জোর পিটুনির পর এল। কমলকান্তি সেন খুব রাগারাগি করলেন। যে মানুষটা খবর নিয়ে এসেছিল কমলকান্তি তাকে এই মারেন তো সেই মারেন।
‘আমাকে আগে বলোনি কেন? কেন বলোনি? একজন অসুস্থ মানুষকে ট্রিটমেন্ট না করে এতদিন বাড়িতে রেখে দিয়েছ। মূর্খের দল। এটা একটা অসুখ এটা বোঝো? নাকি তাও বোঝো না? জ্বর, পেট ব্যথার মতো এই অসুখেরও ট্রিটমেন্ট আছে জানো সেটা?’
গ্রামের বাড়ি থেকে আসা মানুষটা মিনমিন করে বলল, ‘পাগল তো ভালো হয় না বড়কর্তা। তবে ওঝা ডেকে এবার ঝাড়ফুঁক করানোর কথা ভাবছি।’
কমলকান্তি সেন চেয়ার ছেড়ে উঠে তাকে সত্যি সত্যি মারতে যান। বাকিরা আটকায়।
‘শাট আপ। কে বলল মানসিক রোগ ভালো হয় না? কে বলল তোমাদের? আজকাল কতরকম ওষুধ বেরিয়েছে। আর একবারও যদি এইসব ওঝা টোঝার কথা মুখে এনেছ, পুলিশ ডেকে ফাটকে পুরে দেব। আমি চিকিৎসার সব দায়িত্ব নিলাম। পেশেন্টকে আমি হাসপাতালে নিয়ে যাব, ডাক্তার দেখাব। ডাক্তার যদি বলেন, বড় হাসপাতালে ভর্তি করাব। যতদূর যেতে হয়, যাব। তারপর ওই গ্রামে সুস্থ অবস্থায় ফেরত পাঠাব।’
এই উন্মাদ চিকিৎসা সফরে বাবার সঙ্গে গিয়েছিলেন বিমলকান্তি। বাবাই অর্ডার দিয়েছিলেন। এইরকম একটা রোগী নিয়ে ছোটাছুটি করতে তার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। তার ওপর ওই পাগলা কাকা নাকি তেড়ে যায়। কামড়ে, খিমচে দিলে কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে। কিন্তু বাবার মুখের ওপর ‘যাব না’ বলবার সাহস ছিল না বিমলকান্তির। কমলকান্তি সেন মুখ দেখে ছেলের আপত্তি বুঝেছিলেন। গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, ‘জীবনের সব দিকটাই দেখতে হয়, সামলাতে হয়। শুধু সুস্থ মানুষ নিয়ে বাঁচা যায় না, বাঁচার জন্য পাশে কিছু অসুস্থ মানুষও দরকার। এতে সত্যি বেঁচে আছি, নাকি বাঁচবার ভান করে আছি তার একটা পরীক্ষা হয়। কথা না বাড়িয়ে আমার সঙ্গে চলো। গাড়িতে যাব। প্রথমে ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতালে দেখাব, সেখানে ডাক্তার যা পরামর্শ দেবে, সেই অনুযায়ী পরবর্তী স্টেপ নেব।’
অদ্ভুত ব্যাপার হল, কাকা বাবাকে দেখবার পর থেকে একবারে শান্ত হয়ে গেলেন। সদর হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যেতে কোনও সমস্যাই হয়নি। সমস্যা হল হাসপাতালে পৌঁছে। সেখানে মানসিক রোগের ডাক্তার একজনই। খবর নিয়ে জানা গেল, বেশিরভাগ সময় তাকে পাওয়া যায় না। হয় হাসপাতালে আসেন না, নয়তো নিজের জায়গায় থাকেন না। পেশেন্টও আসে কম। অবহেলা, ওঝা, ঝাড়ফুঁক, ঘরে বেঁধে রাখা ধরনের চিকিৎসা টপকে দূর দূর গ্রামগঞ্জ থেকে কে আসবে? কেনই বা আসবে? তারপরেও কখনও কোনও পেশেন্ট এলে তার বাড়ির লোকদের ডাক্তারবাবু ভাগিয়ে দেন। বুঝিয়ে দেন, এসব জটিল চিকিৎসা এখানে হবে না। অন্য কোথাও পথ দেখো বাপু।
সেদিন বিমলকান্তিরা ডাক্তারকে পেয়ে গেলেন। পেশেন্ট দেখে তো তিনি রেগে আগুন। তাকে যা-ই বলা হয়, তিনি খিঁচিয়ে ওঠেন। যেন হাসপাতালে রোগী আনা খুব অন্যায় হয়েছে।
‘পেশেন্টের অবস্থা তো ভয়ঙ্কর। একে এখানে এনেছেন কেন?’
কমলকান্তিও এই ব্যবহারে মেজাজ হারালেন। বললেন, ‘হাসপাতাল বলে এনেছি। রোগীকে নিয়ে কোথায় যাব? ফুটবল মাঠে? নাকি হরিসভার কীর্তন শোনাতে?’
ডাক্তার দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, ‘যেখানে খুশি যান। এখানে একটা এক্সরে মেশিন নেই, ব্যান্ডেজ বাঁধবার তুলো নেই… উনি এসেছেন মাথার অসুখের চিকিৎসা করাতে? ছো:। যান গভর্নমেন্টকে গিয়ে বলুন, আগে ব্যবস্থা, তারপর চিকিৎসা।’
বিমলকান্তি আর চুপ করে থাকতে পারেনি। অবাক গলায় বললেন, ‘কাকার তো মাথার সমস্যা। এক্সরে মেশিন, ব্যান্ডেজ দিয়ে কী হবে?’
ডাক্তার হাত তুলে বললেন, ‘মুখ সামলে কথা বলবে ছোকরা। ডাক্তার তুমি না আমি? কোন অসুখে এক্সরে লাগে, কোনটায় ব্যান্ডেজ লাগে আমি তোমার থেকে অনেক বেশি জানি।’
কমলকান্তির রাগ বাড়ল। বাড়াটাই স্বাভাবিক। বললেন, ‘আপনিও মুখ সামলে কথা বলবেন। ডাক্তার হয়েছেন বলে মাথা কিনে নেননি। এখানে তো দেখছি আপনার মাইনে ছাড়া আর কিছুই নেই। সেটাই বা রেখেছেন কেন। এক্স রে মেশিনের মতো সেটাও তুলে দিন। মনে রাখবেন, মাইনেটা আমাদের ট্যাক্সের পয়সায় হচ্ছে। সার্ভিস দিতে আপনি বাধ্য। যদি মনে করেন হাসপাতালে কিছু নেই, কাজ করতে পারছেন না, তাহলে মাইনে নেওয়া বন্ধ করুন।’
এবার তুলকালাম লেগে গেল। ডাক্তারবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। জামার হাত গুটিয়ে এগিয়ে এলেন। ভিড়টিড় হয়ে একাকার কাণ্ড। এর মধ্যে আবার কাকা গেলেন খেপে। তিনি ডাক্তারের দিকে গেলেন তেড়ে। ডাক্তার কোনওরকমে গিয়ে পুলিশে ফোন করলেন। সে এক হুলুস্থূলু ব্যাপার।
কমলকান্তি সেন শেষ পর্যন্ত উদ্মাদ ভাইকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করেন। তবে দু:খের কথা… থাক, সে অন্য গল্প। তবে এরপর থেকে সাইকিয়াট্রিস্ট সম্পর্কে ধারণাটাই তেতো হয়ে গিয়েছিল বিমলকান্তির। যদিও এর পেছনে তেমন কোনও যুক্তি ছিল না। এই আচরণ অন্য কোনও ডাক্তারও করতে পারতেন, নাও করতে পারতেন। একজনকে দেখে সবাইকে বিচার করা উচিত নয়। অনেক ধরনের পেশেন্টই তো ওই হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যায়। চিকিৎসা হয় বলেই যায়। আবার এমনটাও হতে পারে, এই ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতালে হয়তো সেই সময় সত্যি-সত্যি মানসিক রোগের চিকিৎসা করবার মতো যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল না। বেচারি ডাক্তারবাবু হয়তো বলে বলে ক্লান্ত, হতাশ। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে হলেও তিনি সম্ভবত বলতে চেয়েছিলেন যেখানে সামান্য এক্স রে মেশিন, ব্যান্ডেজ বাঁধবার তুলো পাওয়া যায় না, সেখানে মাথার অসুখের মতো জটিল জিনিসের চিকিৎসা কী করে হবে? কথাটা নরমভাবে না বলে রেগে গিয়ে বলে ফেলেছেন। একজন ডাক্তারকে বসিয়ে রাখতে হয় তাই রেখেছে। এই সবক’টা সম্ভাবনাই আছে। হয়তো সবই সত্যি। কিন্তু তারপরেও সেই ডাক্তারের আচরণ মনের ভেতর এক ধরনের বিশ্রী ছাপ ফেলেছিল। উনি যদি ব্যবহার অন্যরকম করতেন, তা হলে হয়তো এমনটা হত না। বাবাও বুঝতেন। রোগী নিয়ে কাজ খুব জটিল জিনিস। শুধু ওষুধ বা ধমক দিয়ে হয় না।
আজ কিন্তু একেবারে উলটো ঘটনা। সামনে বসা সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোককে দেখে বিমলকান্তি সেন মুগ্ধ। বয়স তারই মতো হবে। শান্ত, সৌম্যদর্শন। মুখে হাসি। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। তার ওপর ব্যবহারটি বড় মধুর। ঘরে ঢুকতে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আমি ডা. মণীশ রায়। বসুন। চা বা কফি কিছু খাবেন? আমি সাজেস্ট করব চা। আমার এখানে যে ছেলেটি চা-কফি বানায়, সে কফি বিষয়টি সম্পর্কে কিঞ্চিৎ নার্ভাস। তার ধারণা, এটি ইংরেজিতে কথা বলবার মতো। ভিন দেশি ব্যাপার। সে চা বানানোয় স্বচ্ছন্দ।’
কথা শেষ করে ডাক্তারবাবু ‘হো হো’ আওয়াজ করে হাসলেন।
বিমলকান্তি খুব আশ্বস্ত হলেন। ডাক্তারবাবুকে দেখে মনে হচ্ছে না উনি বাইরের কেউ, মনে হচ্ছে এর সঙ্গে পরিচয় অনেক দিনের। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাব কি না এই বিষয়ে এতদিন মনের ভিতর যে দোলাচল ছিল, মুহূর্তে কেটে গেল। মনে হল, তিনি ঠিক জায়গায় এসেছেন। এই মানুষটা তাকে সমস্যা থেকে মুক্ত করতে পারবে।
ডাক্তার মণীশ রায়ের সন্ধান দিয়েছে কর্ণিকা। সেক্রেটারি কাম অ্যাডভাইসার টু দ্য এম ডি। বিমলকান্তি ইচ্ছে করলে অফিসের সিনিয়র কেউ বা বাড়িতে মেয়ে-জামাইয়ের কাছ থেকে ডাক্তারের খোঁজ নিতে পারতেন। তিনি তা করেননি। অফিসের বড় কাউকে জিগ্যেস করলে তারা অতিরিক্ত কৌতূহল দেখাত। যত না চিন্তিত হত তার থেকে বেশি চিন্তা দেখাত।
‘স্যর কী হয়েছে? কার হয়েছে? কোনও চিন্তা করবেন না, সঙ্গে আমি থাকব। আমার মনে হয় স্যর, এখানে না দেখিয়ে স্ট্রেট নিমহান্সে চলুন। মাথার কাজে ওরা দারুণ। বাইরে কোথাও ব্যবস্থা করব? বিদেশে? স্টেটসে মেন্টাল হেলথ নিয়ে আজকাল খুব ভালো কাজ হচ্ছে। যাবেন স্যর?’
এই ঝামেলায় বিমলকান্তি পড়তে চাননি।
বাড়িতে মেঘ, বৃষ্টি বা জ্যোতিষ্ককে ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে বললে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ত। বাবার মৃত্যুর পর থেকে সেনবাড়ির অবস্থা একটু নড়বড়ে হয়ে আছে। এখনও সবাই পুরো স্বাভাবিক হতে পারেনি। বিশেষ করে মণিকুন্তলা। যদিও আগের থেকে অনেকটা সামলেছে, তাও কিছুটা মনমরা তো হয়েই আছে। এই অবস্থায় এসব শুনলে আরও ডিপ্রেসড হয়ে পড়বে। তার ওপর ক’দিন আগে আরও একটা ঘটনা ঘটল। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও বাড়িতে পরোক্ষভাবে তার একটা এফেক্ট পড়েছে। জ্যোতিষ্কর রাস্তা থেকে ধরে আনা বাঁশিওয়ালা খুন হয়েছে। লোকটা ডাকাত ছিল। বড় মেয়ের বাড়িতে ডাকাতি করেছিল। পুলিশ খুঁজছিল। ইন্সিডেন্টালি বারিধারা নিজের চোখে সেই খুন দেখেছে। মেয়েটার মনের জোর বেশি বলে সে কোনওরকম ট্রমার মধ্যে পড়েনি। পুলিশ জ্যোতিষ্কদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তারা খুনিদের একজনকে ঘটনার দিনই ডক এলাকা থেকে ধরে ফেলেছে। কপিশপের সামনে থেকে খুনিরা যখন বাইক ঘুরিয়ে পালাচ্ছিল, তখন এক ট্রাফিক সার্জেন্টের সন্দেহ হয়। সে ওয়াকিটকিতে সহকর্মীদের জানায়। পুলিশ বাইকটিকে ফলো করে। যে লোকটাকে পরে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, তাকে জেরা করে পুলিশ জানতে পেরেছে, বাঁশি-বাজিয়ে-লোকটা গ্রাম থেকে এসে কলকাতায় এক মাফিয়া দলের চক্করে পড়ে। বাড়ি, ব্যাঙ্ক, গয়নার দোকান—কোথায় চুরি, ডাকাতি করতে সুবিধে সেই খবর জোগাড় করে দিত। এদের পুলিশের ভাষায় বলা হয় ‘টিপার’। ক’দিন আগে সে আর এই কাজ করবে না বলে জানায়। মাফিয়ারা তাকে তাড়া করে এবং গুলি করে মারে। ক্রিমিনালদের দলে একবার ঢুকলে আর বেরোনো যায় না। কলকাতা শহর বাইরে থেকে যতই চকচকে, আলো ঝলমলে দেখাক না কেন, ভিতরে চাপ চাপ অন্ধকার রয়েছে। গোটা ঘটনা জানার পর বারিধারাও আপসেট। তার বিশ্বাস, বাঁশিওয়ালা লোকটা ভালোভাবে জীবন কাটাতে চেয়েছিল, পারল না। এই নিয়ে বাবার সঙ্গে তার হালকা তর্কও হয়েছে।
‘এই ধরনের লোকের এরকমই পরিণতি হয়। হয় জেলে বাকি জীবনটা থাকতে হয়, নয় নিজের দলের হাতে খুন হতে হয়।’
বারিধারা বলেছিল, ‘সেটাই দু:খের বাবা।’
বিমলকান্তি বলেছিলেন, ‘একজন ডাকাত সম্পর্কে দু:খ না করাই ভালো বৃষ্টি। ওই লোকটা তোমার দিদি-জামাইবাবুকে মেরেও ফেলতে পারত।’
বারিধারা বলল, ‘আমি তো ডাকাতের জন্য দু:খ করছি না, আমি একজন শিল্পীর জন্য দু:খ করছি। তা ছাড়া আমার কী ধারণা জানো বাবা, আমার ধারণা লোকটা দিদি-জ্যোতিষ্কদাকে পছন্দ করে ফেলেছিল, সেই কারণে গোটা অপারেশনটা ওদের অ্যাবসেন্সে করে। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি।’
বিমলকান্তি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘ডাকাতের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করাটা বাড়াবাড়ি হয়।’
বারিধারা অন্যমনস্কভাবে বলেছিল, ‘মানুষ বড় অদ্ভুত। একই সঙ্গে তার মন ভালো এবং মন্দ। সে একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানের সুর বাজাতে পারে, আবার লোকের হাত-মুখ বেঁধে ডাকাতিও করতে পারে। আমার মনে হয় বংশীবাদকের আপশোস হচ্ছিল।’
বিমলকান্তি বলেছিলেন, ‘হয়তো তাই, কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল। মন্দ লোকদের ভালো হওয়ার ইচ্ছে থাকে না, এমন নয়, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই দেরি হয়ে যায়।’
বারিধারা বলল, ‘বাবা, আমরা তো সবাই কমবেশি মন্দ? নই?’
বিমলকান্তি থমকে গেলেন। তার ছোট মেয়েটা গোলমেলে। তর্কের সময় কখন যে কী যুক্তি টেনে আনে, তার ঠিক নেই।
‘ঠিকই, আমরাও মাঝে মাঝে মন্দ হয়ে যাই, কিন্তু ডাকাতি করি না।’
বারিধারা খানিকটা উদাসীনভাবেই বলল, ‘কী জানি? হয়তো তাও করি। ভাবি ভালো কিছু করছি।’
বিমলকান্তি এই প্রসঙ্গ নিয়ে আর বেশিদূর এগোননি। তবে বুঝেছিলেন, এই অবস্থায় বাড়িতে ডাক্তার বদ্যির কথা বলা উচিত হবে না। তা ছাড়া আগে সমস্যাটা ঠিক কী, আদৌ সমস্যা কি না, সেটা জানা দরকার।
সব দিক বিচার করে কর্ণিকাকে অনেক বেশি ‘সুবিধের’ বলে মনে করেছেন বিমলকান্তি। যতদিন যাচ্ছে বিমলকান্তির মনে হচ্ছে, মেয়েটি বুদ্ধিমতী এবং সিরিয়াস। সে তার বসের খবর গোপন রাখতে জানে। এখন পর্যন্ত অফিসের বড় কোনও বিষয়ে তার কাছে থেকে বিমলকান্তি পরামর্শ নেননি ঠিকই, কিন্তু প্রয়োজনে নেবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন।
চা খেতে খেতেই ডা. মণীশ রায় বললেন, ‘নিন, এবার আপনার কথা বলুন মিস্টার সেন।’
বিমলকান্তি মনে মনে সাজিয়ে এসেছিলেন কীভাবে শুরু করবেন, এখন খানিকটা গুলিয়ে যাচ্ছে। তিনি খানিকটা থমকেই যান। তিনি এমন একটা সমস্যা নিয়ে এসেছেন যেটা কাউকে বলাটা সঙ্কোচের। বোধহয় পাগলামির ঊর্ধ্বে।
ডা. রায় হেসে বললেন, ‘কর্ণিকা টেলিফোনে আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড খানিকটা বলে রেখেছে। আপনার অফিস, আপনার ফ্যামিলি। কয়েকদিন হল আপনার পিতা গত হয়েছেন। মোটামুটি আমি আপনার সম্পর্কে একটা ধারণা করে রেখেছি। বাকিটা আপনার মুখে শুনব।’
বিমলকান্তি খানিকটা আশ্বস্ত হলেন। কর্ণিকা কাজ এগিয়ে রেখেছে। এই কারণেই মেয়েটিকে তাঁর এতটা পছন্দ হয়। মেয়েটি সিরিয়াস। যে কাজ করে মন দিয়ে করে। পুরো কাজটা করতে চায়। এই বয়েসে বাইরের অনেক কিছু মনে নাড়া দেয়। এটাই বয়েসের ধর্ম। কাজের সময় সেটাকে সামলে রাখাটাই গুণ। বৃষ্টি, মেঘের বেলাতে এই ঘটনা উলটো। লেখাপড়া মন দিয়ে করলেও তারা বাইরের নানা বিষয়ে সহজেই ইনভলভ হয়ে পড়ে। এটা যদি না করত তাহলে ওদের কেরিয়ার অনেক ভালো হত। বড় মেয়েটা তো কেরিয়ার কিছু করলই না। বিয়ে-থা করে বাড়িতে বসে গেল। অথচ মেয়েটা অতি বুদ্ধিমতী। কলেজে পড়তে পড়তেই পাগল টাইপ ছেলের প্রেমে পড়ে গেল। জ্যোতিষ্ক পাগল ছাড়া কী? ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ায়। মাঝখান থেকে মেঘের আর পড়াশোনাই হল না! বিয়ের কথা যখন হচ্ছে মেয়েকে বিমলকান্তি এ কথা বলেছিলেন।
‘বিয়ের পর তুমি লেখাপড়া করবে তো?’
মেঘ বলেছিল, ‘খেপেছ? আমি একজন সিরিয়াস বাবার সিরিয়াস মেয়ে। আমি সিরিয়াসলি সংসার করতে চাই।’
বিমলকান্তি অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘সে কী! আমি তো ভেবেছিলাম আরও লেখাপড়া করে তুমি সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে জয়েন করবে!’
মেঘ বলেছিল, ‘ওরে বাবা, ব্যবসা ট্যাবসা আমার কম্ম নয়। আমি পরীক্ষায় খাতায় ঠিক আছি, তার বাইরে আমার যোগ-বিয়োগ সব ভুল হয়ে যায়। ব্যবসা দুদিনে লাটে উঠবে। আমাকে ওইসব থেকে রেহাই দাও বাবা। তোমার চিন্তা কী? বৃষ্টি তো আছে।’
বিমলকান্তি বিরক্ত হয়েছিলেন। এটা একটা সিরিয়াস কথা হল? বৃষ্টির মধ্যেও এই ব্যাপারে ঘাটতি আছে। সে তো এককাঠি বেশি। নানারকম অর্থহীন বিষয়ে জড়িয়ে পড়তে ভালোবাসে। বাবা একটা কী উদ্ভট প্রজেক্টের কথা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন, কী রোদ উঠবে না কী, তাই নিয়ে লাফালাফি করছে। কোনও মানে আছে? হ্যাঁ, এটা ঠিক দুটো মেয়েই খুব ডিউটিফুল হয়েছে। কিন্তু তারা বেশিরভাগ ডিউটিই সারে খেলাচ্ছলে। হাসতে হাসতে। এটা একেবারেই পছন্দ নয় বিমলকান্তির। ডিউটিতে সিরিয়াস ভাব চাই। তাতে কাজে ভুল হলে ক্ষতি নেই। এসব দিক থেকে কর্ণিকা ভালো। আজ ওকে ঘরে ডেকেছিলেন।
‘কর্ণিকা, একটা জরুরি কাজের জন্য তোমাকে ডেকেছি।’
কর্ণিকা অবাক হল। স্যার তাকে নিশ্চয় ঘরে খোশগল্প করবার জন্য ডাকবেন না। জরুরি কাজের জন্যই ডাকবেন। এটা আলাদা করে বলবার কী আছে? এমন কথা কখনও উনি বলেনও না। স্যার, আজ কি কোনও কারণে অন্যমনস্ক? কোনও সমস্যা হয়েছে? দুদিন হল তার মনও খুব খারাপ। সে জানতে পেরেছে, অর্চিন কলকাতা থেকে বাইরে চলে গেছে। গ্রামে না কোথায় গিয়ে রাজনীতি করবে। অর্চিন তার মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে। খবরটা যখন শোনে কর্ণিকা বিশ্বাস করতে পারেনি। ফেসবুকে অর্চিনের কলেজের এক বন্ধু পোস্ট দিয়েছে।
‘উই ফিল প্রাউড ফর অর্চিন। তার সিদ্ধান্তকে কুর্নিশ জানাই।’
অর্চিনের খবরাখবর জানবার জন্য কর্ণিকা তার বন্ধুদের ফেসবুকে মাঝে মাঝে চুপচাপ উকি দেয়। কর্ণিকা থমকে গিয়েছিল। অর্চিন কী সিদ্ধান্ত নিল? নিজে কিছু জানতে যাওয়া ঠিক হবে না। অর্চিন জানতে পারলে রাগারাগি করতে পারে। একটি ছেলে তার থেকে বয়েসে খানিকটা ছোট। তারপরেও তাকে ভয় পায়! এই কারণে কর্ণিকা নিজেই কতবার অবাক হয়েছে। ভালোবাসাই পারে যাবতীয় রীতিনীতি, নিয়মকানুন গুলিয়ে দিতে। কম বয়েসের ছেলেকে যদি ভালোবাসতে পারে, তাকে মন আর শরীর দুটো দেওয়ার জন্যই উদগ্রীব হয়ে থাকতে পারে, তাহলে আর ভয় পেতে অসুবিধে কী?
কর্ণিকা ফেসবুক থেকে অর্চিনকে ফোন করে। সুইচড অফ। এর পরে আর না পেরে ফেসবুকেই ছেলেটিকে জিগ্যেস করে বসে। একটু ঘুরিয়ে জিগ্যেস করে।
‘অর্চিন কে?’
‘আমাদের সহপাঠী। একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। পাস করলে একজন বড় ইঞ্জিনিয়ার হত।’
কর্ণিকা খুব নির্লিপ্তভাবে জানতে চায়, ‘সে কী করেছে? তোমরা তার জন্য গর্ববোধ করছ কেন? ভালো রেজাল্ট করেছে?’
ছেলেটি জবাব পাঠায়, ‘না, আমাদের প্রিয় বন্ধু কেরিয়ারের লেখাপড়া ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। জীবনের লেখাপড়া শিখতে।’
কর্ণিকা এবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না। উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চায়, ‘মানে! চলে গেছে মানে? কী হয়েছে তার?’
জবাব আসে, ‘নিজের আদর্শ, নীতির জন্য গেছে। সে পুরোপুরি রাজনীতি করবে বলে ঠিক করেছে। আমরা তো এমন পারব না। আমাদের না আছে নীতি, না আছে আদর্শ। আমরা শুধু নিজেকে নিয়ে আর নিজের লোভ নিয়ে বেঁচে থাকতে শিখেছি। তাই অর্চিনকে কুর্নিশ জানাই।’
এরপর কর্ণিকা ফেসবুকেই ঋষার সঙ্গে যোগাযোগ করে। ঋষা এড়িয়ে যায়। বরং তাকেই প্রশ্ন পাঠায়, ‘তুমি অর্চিনকে কতটা চেনো?’
এরপর থেকে কর্ণিকার মন খুব খারাপ। ছেলেটা কোথায় গেল? যাওয়ার আগে তাকে একবার বলে গেল না? সে কি এতটাই ফালতু? সে অর্চিনের সঙ্গে একবার দেখা করতে চায়। তাকে বলতে চায়, ‘আমি তো তোমার কাছ থেকে কিছু চাইনি অর্চিন। তবু তুমি কেন আমাকে এত অবহেলা করো?’
এরপরেও মন খারাপ হবে না! তবে অফিসে এসে কর্ণিকা নিজের কথা ভুলে কাজ করবার চেষ্টা করে। আজও করছে। স্যর ডাকায় ঘরে এসেছে।
বিমলকান্তি টেবিলের ওপর রাখা পেপারের ওয়েটটা নাড়াচাড়া করতে করতে গলা নামিয়ে বললেন, ‘আমার একটা সমস্যা হয়েছে কর্ণিকা। সমস্যার কথা কাউকে আমি কখনও বলিনি। কারণ সমস্যাটা ঠিক স্বাভাবিক সমস্যা নয়। মনের সমস্যা। মনে হচ্ছে, এবার আমার একজন সাইকিয়াট্রিস্ট কনসাল্ট করা উচিত।’
বস মাথার ডাক্তার খোঁজ করছেন শুনলে অন্য যে কেউ ঘাবড়ে যেত, কর্ণিকা ঘাবড়াল না। অফিসে কাজ করতে করতে এই একটা জিনিস সে অভ্যেস করে নিয়েছে। চট করে ঘাবড়ায় না।
বিমলকান্তি বললেন, ‘তোমাকে না বলে ব্যাপারটা আমি বাড়িতে বা অফিসের সিনিয়র কাউকে বলতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, তাতে টেনশন তৈরি হত। তার থেকেও বড় কথা, খবরটা ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের মালিকের মাথার গোলমাল হয়েছে, এই খবরটা ছড়ালে আমার কোনও ক্ষতি নেই, বিজনেসের ক্ষতি নেই। আমি সেটা চাই না। আমি জানি, তুমি কথাটা গোপন রাখতে পারবে। তোমাকে আমি বিশ্বাস করি।’
কৃতজ্ঞতায় কর্ণিকার মন ভরে উঠল। বাবার বয়সি এই মানুষটা তাকে সত্যি সত্যি বিশ্বাস আর ভরসা করে। আর সেই কারণেই এত কম বয়েসে তাকে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা পদে বসিয়েছে। বস বকাঝকাও করে খুব। মাঝে মাঝে বাথরুমে গিয়ে চোখের জল মুছতে হয়। তার পরেও মনে হয়, এই মানুষটার জন্য যদি কোনওদিন জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয়, সে নেবে। কেউ আটকাতে পারবে না। জীবনটা কী অদ্ভুত, যাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে সেই অর্চিন তার ভালোবাসার কোনও মূল্য দিল না, অথচ একজন দূরের মানুষ তাকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে!
‘আমি কী করতে পারি স্যার?’
বিমলকান্তি একটু ভেবে বললেন, ‘আমাকে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্টের অ্যাপয়েনমেন্ট করে দিতে পারো? ডাক্তার চেনাজানা হলে সুবিধে হয়। তাছাড়া আমার ঠিক এরকম কাউকে চেনা নেই। যাদের আছে তাদের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাইছি না। কর্ণিকা, আমার ডাক্তার ঠিক করে দেওয়াটা তোমার কাজ নয়। তুমি আমার অফিসের কাজ করবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমার দ্রুত সমস্যা কাটিয়ে ওঠাটা শুধু আমার জন্য নয়, আমার অফিসের জন্যও প্রায়োজন। সেটা ঠিকমতো করতে গেলে এমন কাউকে নিয়ে করতে হবে যাকে আমি বিশ্বাস করি। সেই অর্থে কাজটা খানিকটা অফিসেরও বলতে পারো। তবে তারপরেও যদি তোমার কোনও অসুবিধে হয় বলো। আই ডোন্ট মাইন্ড। বরং স্পষ্ট কথা বললে খুশি হই।’
কর্ণিকা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘স্যর, এ আপনি কী বলছেন! এটা আমার ডিউটি। তাছাড়া…তাছাড়া।’ এই পর্যন্ত থমকে গেল কর্ণিকা। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আমার এক মামা সাইকিয়াট্রিস্ট। মণীশ রায়। খুব নাম টাম নেই, কিন্তু ডাক্তার হিসেবে দারুণ। মানুষ হিসেবেও। আপনি যদি বলেন, আমি এখনই তার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে পারি।’
বিমলকান্তি মুহূর্তখানেক ভাবলেন। বললেন, ‘করো। উনি যদি আজ সন্ধেবেলা সময় দেন খুব ভালো হয়। যত দ্রুত সম্ভব সমস্যাটা আমি ক্লিয়ার করে ফেলতে চাই। এটাকে ক্যারি করতে আমার ভালো লাগছে না।’
কর্ণিকা শান্ত গলায় বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। মণীশ মামার সঙ্গে আমি এখনই কথা বলছি।’
বিমলকান্তির ভালো লাগল। একেই বলে এফিসিয়েন্ট। অতিরিক্ত কথা নেই। কৌতূহল নেই। আবেগ নেই। নি:শব্দে নিজের কাজটুকু করে যাওয়া।
ডাক্তারের সঙ্গে কর্ণিকা শুধু কথা বলেনি, বিমলকান্তির পরিচয়টাও দিয়ে রেখেছে। সে বলেছিল, ‘স্যর, আমি কি আপনার সঙ্গে যাব?’
বিমলকান্তি ভুরু কুঁচকে বলেছিলেন, ‘না, তার কোনও প্রয়োজন নেই।’
‘যাই না।’
বিমলকান্তি সামান্য কঠিন গলায় বললেন, ‘বললাম তো প্রয়োজন নেই। আমি অফিসের কাজ ছাড়া কাউকে কোনওদিন বাইরে নিয়ে যাই না।’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘আপনি নি:সঙ্কোচে বলতে পারেন মিস্টার সেন।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘কোথা থেকে শুরু করি ঠিক বুঝতে পারছি না।’
ডাক্তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘যেখান থেকে খুশি।’
বিমলকান্তি গলাখাকারি দিয়ে বলতে শুরু করলেন।
‘সপ্তাহে একদিন করে আমি বাড়িতে লোকজন মিট করি। কারও কোনও পার্সোনাল প্রবলেম থাকলে শুনি। সেদিন আমার অফিসের এক কর্মচারী, প্রহ্লাদ নাম, আমার কাছে আসে। বাড়ি বা ওই ধরনের কিছুর জন্য তার লোন দরকার। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটা সময় আমার মনে হয়, আমি আর ঠিক আমি নেই, আমি প্রহ্লাদ হয়ে গিয়েছি।’
এতটা বলে থামলেন বিমলকান্তি।
ডাক্তারবাবু সোজা হয়ে বসলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আপনি প্রহ্লাদ হয়ে গেছেন! সেটা ঠিক কেমন?’
বিমলকান্তি বললেন, ‘ঠিক কেমন আমি বলতে পারব না ডাক্তারবাবু…কিন্তু মনে হল, আমি যেন আমি নই…আমি মানুষটা বদলে গিয়েছি…।’
ডাক্তার রায় স্থিরচোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আপনি কি প্রহ্লাদের মনের কথা বুঝতে পারছিলেন?’
বিমলকান্তি গলা নামিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, পারছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, আমার সামনে যে বিমলকান্তি সেন মানুষটা বসে আছেন, তিনি একজন ভালো মানুষ। বাইরে রাগারাগি করলেও ভেতরে নরম। উনি আমার কথা শুনবেন। আমার টাকার ব্যবস্থা করবেন।’
ডাক্তার রায় একটু ভাবলেন। বললেন, ‘এই কথাগুলো যে ওর, আপনার নয়, সেটা বুঝলেন কী করে?’
বিমলকান্তি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, শুধু মনের কথা নয়, আমি ওই লোকটির ব্যথা-বেদনাও অনুভব করেছি।’
ডাক্তারবাবু বড় করে শ্বাস টানলেন। চেয়ারে হেলান দিলেন। বললেন, ‘এরকম আপনার কতবার হয়েছে মিস্টার সেন?’
‘বেশ কয়েকবার। সামনের মানুষটার সঙ্গে আমার যেন ওলটপালট হয়ে গেছে। আমার বাবার সঙ্গে পর্যন্ত হয়েছে। চিন্তার কথা হল, শুধু যে নর্মালভাবে ব্যাপারটা ঘটছে এমন নয়। গোলমালও হচ্ছে।’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘গোলমাল! সেটা কীরকম?’
বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘আমাদের বিজনেসে খুব সিনিয়র একজন আছেন। আমার বাবার আমলের মানুষ। মিস্টার উপাধ্যায়। কোম্পানি ক্রিটিকাল কোনও সমস্যায় পড়লে তিনি পরামর্শ দেন। কিছুদিন আগে ওঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে খুব জোর ধাক্কা খেলাম। তখনও বাবা বেঁচেছিলেন।’
‘ধাক্কা! কীরকম?’
বিমলকান্তি খানিকটা ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘মনে হল, আমি যেন মিস্টার উপাধ্যায়। আমার বাবাই গোপনে আমাকে এই কোম্পানিতে রেখেছেন। যাতে তার ছেলের কোনও অসুবিধে না হয়। তার থেকে বড় কথা…বড় কথা…আমি যেন কোম্পানির বড় কোনও ক্ষতি চাইছি।’
ডাক্তার রায় বললেন, ‘আপনি আরও কয়েকটা ঘটনা মনে করে বলতে পারেন?’
বিমলকান্তি সেন বলেন, ‘পারব।’
‘তাহলে বলুন।’
পরপর প্রায় সবক’টা ঘটনা বললেন বিমলকান্তি। ডাক্তারবাবু মন দিয়ে শুনলেন। তারপর খানিকটা চুপ করে থেকে নীচু গলায় বললেন, ‘আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানে একজন মানুষের দুজন হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব নয়। একে বলে স্প্লিট পার্সোনালিটি। দ্বিখণ্ডিত সত্তা। কিন্তু আপনার যা হচ্ছে তার সঙ্গে এই অসুখের ঠিক মিল নেই। আপনি পুরোপুরি অন্য একজন মানুষ হয়ে যাচ্ছেন বলে আপনার মনে হচ্ছে। তার চোখ দিয়ে পৃথিবীটা দেখছেন। অন্যদের দেখছেন। এমনকী নিজেকেও দেখছেন। তাই তো?’
বিমলকান্তি মাথা নাড়লেন।
‘এই ফেজটা কতক্ষণ থাকছে মিস্টার সেন? মানে অন্য একজন হয়ে যাওয়াটা?’
বিমলকান্তি বললেন, ‘খুব অল্প সময়, কয়েক মুহূর্ত। আবার নর্মাল। আমি…আমি আবার বিমলকান্তি সেন হয়ে যাচ্ছি।’
ডাক্তার মণীশ রায় চুপ করে থেকে টেবিলের ওপর রাখা একটা পেনসিল দিয়ে টোকা দিতে লাগলেন। তিনি ভাবছেন। বললেন, ‘আমাকে একটু সময় দিতে হবে মিস্টার সেন। দুদিন পরে আপনাকে আর একবার আসতে হবে। আমি বইপত্র জার্নাল ঘেঁটে দেখব। নিজেও ভাবব। সমস্যাটা আমাকে বুঝতে হবে। তার আগে আপনাকে হালকা একটা ওষুধ দিচ্ছি। রাতে খেয়ে শোবেন। আপনার স্ট্রেস কমানো দরকার।’
বিমলকান্তি সেন উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘ডাক্তারবাবু আমি ভালো হয়ে যাব তো?’
মণীশ রায় সামান্য হেসে বললেন, ‘আগে আমাকে জানতে হবে, আদৌ আপনার কোনও অসুখ করেছে কিনা। এই বিষয়েও আমি নিশ্চিত নই। মানবমনের যাবতীয় অস্বাভাবিকতাই যে অসুখ এ কথা বলা যায় না। তাহলে যে মানুষ অন্য ধরনের ভাবনাচিন্তা করেন, কল্পনা করেন, যা ঘটেনি তা নিয়ে চিন্তা করেন, তাকে অসুস্থ ধরতে হয়। তা তো একেবারেই নয়। মিস্টার সেন, এটাও তেমন হতে পারে। আপনার এটা অসুখ নাও হতে পারে।’
বিমলকান্তি অস্ফুটে বলেন, ‘তবে কী?’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘সেটাই তো খুঁজে বের করতে হবে। ঠিক দুদিন পর, এই সময় আসবেন। আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লিখে রাখলাম।’
বিমলকান্তি ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে হালকা বোধ করলেন। ডাক্তারবাবু বললেন, এটা কোনও অসুখ নাও হতে পারে। এটা খুব ভালো কথা। ডাক্তার রায় চমৎকার একজন মানুষ। কী সুন্দর কথা বলেন। মনের চাপ অনেকটা কমিয়ে দিলেন। মনে মনে কর্ণিকাকে ধন্যবাদ দিলেন বিমলকান্তি। হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলেন। আটটা বেজে গেছে। তাও একবার অফিসে গেলে ভালো হত। এই সপ্তাহে একটা বড় অর্ডার সামলাতে হবে। থাক, আজ যাবেন না। ক্লান্ত লাগছে।
আটচল্লিশ
শ্রবণ বিশ্বাস করছে না। তার কারণ এই ঘটনা বিশ্বাস করা যায় না। মুম্বইয়ের বিখ্যাত এক বিজ্ঞাপন সংস্থা প্রতি বছর একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। বিজ্ঞাপন বানানোর প্রতিযোগিতা। ওরা নাম দেয় ‘ট্যালেন্ট হ্যান্ট’। প্রতিভার সন্ধান। বয়স তিরিশ বছরের কম হলে যে-কোনও ছেলেমেয়ে অংশ নিতে পারে। যে-কোনও ভাষায় বিজ্ঞাপন বানানো যায়। স্টিল হতে পারে, আবার মুভিও হতে পারে। যার যেটা পছন্দ। পুরস্কার বিরাট। প্রথম হলে এক লক্ষ টাকা। সঙ্গে ট্রফি তো থাকেই। তারপরে আরও দশটা পুরস্কার রয়েছে। সারা দেশের কয়েক লক্ষ ছেলেমেয়ে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। বিজ্ঞাপন সংস্থা তিনটে বিষয় বলে দেয়। তার মধ্যে থেকে কোনও একটা বেছে নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। তবে কাজটা মৌলিক হতে হবে।
শ্রবণ এর আগে বার তিনেক ট্যালেন্ট হান্টে অংশ নিয়েছে। কিছুই হতে পারেনি। এমনকী ওরা এক হাজার জনকে যে মেরিট সার্টিফিকেট দেয়, তাও পায়নি। শ্রবণ অবশ্য এতে ভেঙে পড়ে না। আবার পাঠায়। সে মনে করে, এই ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে হার-জিতটা আসল কথা নয়। আসল কথা হল, নতুন কাজ ভাবা। এটা কল্পনার প্র্যাকটিশ।
এবারও প্রতিযোগিতায় তিনটি বিষয় ছিল—আইসক্রিম, গাড়ি আর রং।
শ্রবণ ‘গাড়ি’ বেছে কাজ করেছিল।
নানারকম বিজ্ঞাপন বানিয়েছিল। মুভি নয়, স্টিল। কোনওটায় হাতে আঁকা, কোনওটা ফটোগ্রাফ দিয়ে। নীচে ক্যাপশন। কোনওটা আবার ফটোগ্রাফ আর হাতে আঁকা ছবি মিলিয়ে। শেষপর্যন্ত শ্রবণ হাতে আঁকা কাজটাই পছন্দ করে পাঠিয়ে দেয়। পাঠানোর আগে বারিধারাকে ফোন করে।
‘ট্যালেন্ট হান্টে পাঠানো কাজটা কি তুমি একবার দেখবে বারি?’
ওপাশ থেকে বারিধারা হাই তুলে বলে, ‘একেবারেই নয়। আমি দেখব না।’
শ্রবণ বলে, ‘কেন? আমার কাজ কি খারাপ, ধারা?’
বারিধারা বলল, ‘না, খারাপ না। খারাপ হয় না বলে, তুমি প্রাইজও পাও না। খারাপ হলে পেতে।’
শ্রবণ হতাশ গলায় বলে, ‘তুমি যে কী হেঁয়ালি করো বারি, আমি ঠিক বুঝতে পারি না। যাক, এবারের কাজটা একবার দেখো।’
বারিধারা ফোঁস করে নি:শ্বাস ফেলে বলে, ‘তোমার এই বারি আর ধারার প্রবলেমটা কোনও দিনই কি মিটবে না? তুমি কি কিছুতেই একটা নামে স্থির থাকতে পারবে না? যাক এতদিন যখন পারোনি, আর পারতেও হবে না। বিজ্ঞাপনটা মেলে পাঠাও, দেখে নিচ্ছি।’
কাজ পাঠানোর মিনিটখানেকের মধ্যেই বারিধারা মেসেজ পাঠাল।
‘কাজটা খুবই খারাপ। আমি নিশ্চিত, এবার তুমি প্রাইজ পাবে। বড় কোনও প্রাইজ। খারাপ কাজ করবার জন্য অনেক আদর। এখনও প্রাইজ পাওনি বলে ভারচ্যুয়াল আদর করলাম। প্রাইজ পেলে রিয়েল আদর করব।’
শ্রবণ আর দেরি করল না। বিজ্ঞাপনটা পাঠিয়ে দিল। বারিধারা খারাপ বলেছে, নিশ্চয় তার খুব পছন্দ হয়েছে। সে একটা উলটো বলা মেয়ে। উলটো বলা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলে সমস্যা। মেয়ে যা বলে, তা মাথা খাটিয়ে বুঝতে হয়। বেশিরভাগ সময়েই তা বোঝা যায় না। তখন খেতে হয় বকুনি। উলটো বলা মেয়ের এই বকুনি অতি আনন্দদায়ক। এই বকুনি শোনবার জন্য ছেলেরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে পারে।
শ্রবণের কাজটা এরকম—
বৃষ্টিতে শহরের রাস্তায় এক কোমর জল জমেছে। বাস, গাড়ি, টেম্পো, বাইক জলে নাক ডুবিয়ে কেতরে পড়েছে। হাতেটানা রিকশর সিট পর্যন্ত জল। এমনকী শহরের পথে নৌকা পর্যন্ত নেমেছে। রাস্তার ধারের নীচু ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। শুধু একটা গাড়িই দুপাশে জল ছিটিয়ে ছুটছে। গাড়ির মাথায় গোল করে পাকানো ছেঁড়া মাদুর, ভাঙা টিনের সুটকেস, তাপ্পিমারা স্কুলব্যাগ, জীর্ণ লেপকম্বল বাঁধা। গাড়ির তিন জানলা দিয়ে কয়েকটা ছেলেমেয়ে আর তাদের বাবা-মায়েরা মুখ বের করে মহা ফুর্তিতে হাত নাড়ছে। বোঝাই যাচ্ছে পথের ধারের নীচু বাড়ি থেকে এদের উদ্ধার করা হয়েছে। ছবিটায় রিয়েল ড্রইং আছে, আবার খানিকটা কার্টুন ভাবও রয়েছে। নীচে ক্যাপশন—
‘আমাকে কেউ আটকাতে পারে না, কারণ আমি সবাইকে নিয়ে চলতে জানি।’
কাল মুম্বই থেকে মেলে খবর এসেছে, শ্রবণ রায়ের বিজ্ঞাপন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে।
টুকরো টাকরা অর্ডারের জন্য শ্রবণকে ঘনঘন মেল দেখতে হয়। তাছাড়া যে অফিসের হয়ে ফ্রিলান্স কাজ করে, তারাও মেল করে নানারকম ইনস্ট্রাকশন পাঠায়। সেই কারণে মেল দেখা। এবং চমকে ওঠা।
তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠেছিল শ্রবণ। সে কি ঠিক পড়ছে? হতেই পারে না। সে নিশ্চয়ই ভুল পড়ছে। ইংরেজিতে সে এমনিতেই কাঁচা। প্যাঁচপয়জার বোঝে না। সংক্ষিপ্ত এবং সহজ চিঠিটি যে লেটার প্যাডে এসেছে, সেটি ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ আয়োজকদের। ঠিকানা, ফোন নম্বর, সবই আছে, সেখানে যে বাক্যটি লেখা আছে তার মানে হল—
অভিনন্দন আপনাকে। আপনি আমাদের ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন।
প্রথম। মানে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার! এক লক্ষ টাকাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হল, দেশের এত বড় একটা নামকরা বিজ্ঞাপন সংস্থা তার কাজকে শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি দিল। তার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে? আবার ভয়ও করছে। শ্রবণের পেটের মধ্যে গুড়গুড় করছে। বুকও কি ধুকপুক করছে না। শ্রবণ ডিভানের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে আছে। সে বুকে হাত দিল। হ্যাঁ, কেমন একটা করছে যেন।
হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না। অবশ্যই কোথাও ভুল হয়েছে। ভুল ঠিকানায় মেল চলে এসেছে। গোটা দেশ থেকে ছেলেমেয়েরা এখানে তাদের কাজ পাঠায়। তাদের মধ্যে আর কারও নাম শ্রবণ রায় হতে পারে। এত বড় একটা দেশে একজনের নামই কি শুধু শ্রবণ? এমন কোনও কারণ নেই।
আর যদি তা না হয়? যদি তাকেই এই মেইল পাঠানো হয়? সত্যি যদি সে ফার্স্ট হয়ে থাকে?
কপালের ঘাম মুছে বারিধারাকে ফোনে ধরল শ্রবণ। বারিধারা চাপা গলায় কথা বলল।
‘ব্যস্ত। পরে কথা বলব।’
শ্রবণ প্রায় আর্তনাদ করবার মতো করে বলে উঠল, ‘বারি, একটা বিপদ হয়েছে।’
‘বিপদ! কী হয়েছে?’
শ্রবণ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
বারিধারা চাপা গলায় এবার দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘বললাম না ব্যস্ত? দেখা হবে না। কী হয়েছে বলো। চট করে বলবে। নিশ্চয় তুমি তোমার মতো কোনও উদ্ভট বিষয়ে জড়িয়ে পড়েছ।’
শ্রবণ হতাশ গলায় বলল, ‘তাই হয়েছে মনে হয়। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ধারা, আমি তোমাকে একটা মেল ফরোয়ার্ড করছি। তুমি দেখে এর অর্থ আমাকে বলো। এখনই বলবে।’
বারিধারা বলল, ‘পাঠাও। তবে এখন কিছু বলতে পারব না। এখন আমি লেখাপড়া করছি। দুদিন পরে আমার ফাইনাল পরীক্ষা। তোমার গলা শুনে মনে হচ্ছে, তেমন কিছু হয়েছে। কিন্তু আমি যদি পরীক্ষায় ফার্স্ট না হতে পারি আমার বিপদ আছে।’
শ্রবণ মুম্বইয়ের মেল বারিধারাকে ফরোয়ার্ড করল। একটা নয়, ইতিমধ্যে আরও দু-দুটো মেল চলে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে—এই আগামী ২৫ তারিখ আমাদের সংস্থার প্রতিষ্ঠাদিবস। ওই দিন আমরা আপনার হাতে পুরস্কার তুলে দিতে চাই। আপনার যাতায়াত এবং আতিথেয়েতার যাবতীয় দায়িত্ব আমাদের। আপনি যদি চান সঙ্গে একজনকে আনতে পারেন। তার নাম, ঠিকানা ইত্যাদি জানালে আমরা যথাসময়ে প্লেনের টিকিটের ব্যবস্থা করব।’
শ্রবণের মাথা ঘুরছে। গা-হাত-পা ঝিমঝিম করছে। সে তার ডিভান থেকে নেমে বাথরুমে গেল। চোখে মুখে জল ছিটোল। ঘরে ফিরতেই মোবাইল ফোন বেজে উঠল। বারিধারা।
‘বলো বারি। মেলগুলো দেখলে? নিশ্চয় কেউ ঠাট্টা করেছে।’
ওপাশ থেকে বারিধারা শান্ত অথচ কান্না ভেজা গলায় বলল, ‘অভিনন্দন শ্রবণ।’ আমি বলেছিলাম, কাজটা মারাত্মক হয়েছে, তোমাকে এবার আটকাতে পারবে না।’
শ্রবণ বলল, ‘কী বলছ ধারা! ঘটনা সত্যি?’
বারিধারা বোধহয় আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেলল, ‘না, সত্যি নয়। তুমি আগে বাড়িতে সবাইকে বলো। তারা সব থেকে খুশি হবেন।’
শ্রবণ অস্ফুটে কিছু বলতে গেল। বারিধারা এবার প্রায় ধমক দিয়ে বলল, ‘আগে যাও।’
শ্রবণ নীচে নামল।
ছেলের সুখবর শুনে সুঙ্গমাদেবী হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছেন।
মেয়েদের এই এক বিচ্ছিরি স্বভাব। ভালোবাসার জনের ভালো কিছু হলে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। কেউ বারিধারার মতো নি:শব্দে কাঁদে, কেউ মায়ের মতো হাউমাউ করে।
সুরঙ্গমাদেবী কপালে হাত ঠেকিয়ে বারবার বলতে থাকলেন, ‘সবই ঠাকুরের কৃপা…সবই ঠাকুরের কৃপা…। হ্যাঁ গো, আমি তোমায় বলেছিলাম না, আমার ছোটছেলে একদিন ফার্স্ট হবে? কী গো বলিনি? চুপ করে আছ কেন, বলো?’
দীপ্ততোষবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, ‘তুমি যে ফার্স্টের কথা বলতে এটা সে ফার্স্ট নয় সুরঙ্গমা। তুমি লেখাপড়ায় ফার্স্ট হওয়ার কথা বলতে। শ্রবণ লেখাপড়ায় খুবই খারাপ একজন স্টুডেন্ট ছিল।’
সুরঙ্গমাদেবী বললেন, ‘ওই একই হল। ফার্স্ট ফার্স্টই। তার আবার লেখাপড়াই বা কী, আর না লেখাপড়াই বা কী; সবই ঠাকুরের কৃপা।’
দীপ্ততোষবাবু বিরক্ত হয়ে স্ত্রীকে বললেন, ‘একটু চুপ করো। ব্যাপারটা আমাকে বুঝতে দাও।’
সুরঙ্গমাদেবী বললেন, ‘ব্যাপার বুঝে আমার কাজ নেই। তুমি বোঝো। আমি আগে মন্দিরে পুজো দিতে চললাম।’
দীপ্ততোষবাবু খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে থাকলেন। তারপর ছোটছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘কত টাকা বললে?’
শ্রবণ মাথা নামিয়ে ঢোঁক গিলে বলল, ‘যতদূর জানি এক লক্ষ টাকা।’
শ্রবণের কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হবে, সে বিরাট কোনও অপরাধ করে ফেলেছে।
দীপ্ততোষবাবু এদিক-ওদিক তাকালেন। সম্ভবত দেখার চেষ্টা করলেন, এমন একটা অবিশ্বাস্য কথা আর কেউ শুনছে কি না। তারপর অবাক গলায় বললেন, ‘তুমি কী এমন কীর্তি করেছ, যাতে তোমাকে এতগুলো টাকা দেওয়া হচ্ছে?’
শ্রবণ মাথা চুলকে বলল, ‘বাবা, আমি একটা গাড়ি…আমি একটা গাড়ির ছবি এঁকেছি…।’
দীপ্ততোষবাবু চোখ বড় করে বললেন, ‘গাড়ির ছবির জন্য এক লক্ষ টাকা!’
শ্রবণ মাথা চুলকে বলল, ‘না, ঠিক গাড়ির ছবি নয়, আমি একটা বিজ্ঞাপনের প্রতিযোগিতায় কনসেপ্ট পাঠিয়েছিলাম। সেটায় আমি ফার্স্ট হয়েছি।’
দীপ্ততোষবাবু বললেন, ‘কী বিজ্ঞাপন?’
‘গাড়ির’। বলে শ্রবণ হাতে-রাখা খাম খুলে ছবিটা বের করে বাবার দিকে এগিয়ে দিল। দীপ্ততোষবাবু অনেকটা সময় নিয়ে ছবিটা দেখলেন। নীচের ক্যাপশনটা পড়লেন। মুখ তুললেন। তিনি একই সঙ্গে খানিকটা হতচকিত, খানিকটা অবিশ্বাসী, আর খানিকটা মুগ্ধ।
‘ওটা তোমার মাথা থেকে বেরিয়েছে?’
শ্রবণ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, ‘হ্যাঁ, সবটাই আমার। প্রথমে ভেবেছি, তারপর সেটাকে ছবিতে…।’
দীপ্ততোষবাবু বললেন, ‘তুমি কি মনে করো, এতে গাড়িটার বিক্রি বাড়বে? কতগুলো গরিব মানুষের বাক্সপেঁটরা যে গাড়ির ছাদে থাকে, সেই গাড়ি মানুষ কিনবে কেন? মানুষ গাড়ি কেনে সব দিক বিচার করে। গাড়ির বাইরের চেহারা, ভিতরের যন্ত্রপাতি, তার চলবার যোগ্যতা, পরিশ্রমের ক্ষমতা, যাত্রীদের আরামের কথা বিবেচনা করে একজন এতটাকা খরচ করে। তোমার এই বিজ্ঞাপনে তো সেসব কিছুই নেই!’
শ্রবণ এতক্ষণে যেন তার জানা প্রশ্ন পেল। সে বলল, ‘বিজ্ঞাপনের জন্য কেউ গাড়ি কেনে না। বিজ্ঞাপন নজর কাড়ে। বাইরে থেকে নজর কাড়ে। আমি ভেতর থেকে সেই মনোযোগ পেতে চেয়েছি। মানুষের একসঙ্গে থাকবার ইচ্ছেকে দেখাবার চেষ্টা করেছি। তার ওপর…তার ওপর বলবার চেষ্টা করেছি, এই গাড়িটা একটা ভালো গাড়ি…কারণ এটা দিয়ে ভালো কাজ করা যায়… বিপদে-পড়া মানুষকে উদ্ধার করা যায়…।’
দীপ্ততোষবাবু খানিকক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘এদিকে এসো। আমি তোমাকে আশীর্বাদ করব। এতদিন ভেবেছিলাম, তুমি হাবিজাবি কাজ করো। আজকাল ছেলেছোকরারা এসব ছবিটবির নামে আসলে কোনও কাজই করে না। আজ বুঝতে পারছি, ভুল ভাবতাম। কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছে বলে নয়, এমন একটা বিষয় তোমার মাথায় এসেছে বলে, পিতা হিসেবে আমি গর্ববোধ করছি। এসো।’
দাদা পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘দেখিস প্রাইজ মানিটা উড়িয়ে দিস না। চাকরির অ্যাপ্লিকেশন করতে গেলে লাগবে। চাকরিবাকরি তো একটা করতে হবে। এক লক্ষ টাকা দিয়ে তো জীবন চলবে না!’
বউদি লাফিয়ে উঠে বলল, ‘ইস তুমি মুম্বই যাবে? কত ফিল্ম স্টার দেখতে পাবে!’
বিকেল হওয়ার মুখে শ্রবণ আরও একটা দারুণ খবর পেল। এবার শ্রবণের মনে হল, সত্যি তার হার্ট অ্যাটাক হবে। কেউ বাঁচাতে পারবে না। বিপদ পরপর আসে, আনন্দ কখনও পরপর আসে না।
ঊনপঞ্চাশ
‘আমার ভয় করছে বারি। আমি কি পারব?’
বারিধারা বলল, ‘ভয় পাবার কিছু নেই। তুমি একজন বোকা মানুষ। বোকা মানুষরা অনেক কিছু পারে। তুমিও পারবে।’
শ্রবণ অসহায় গলায় বলল, ‘এরকম একটা সিরিয়াস সময়ে ঠাট্টা কোরো না ধারা।’
বারিধারা হাত বাড়িয়ে শ্রবণের নাক নেড়ে বলল, ‘ঠাট্টা করব না তো কী করব? প্রাইজ পেয়ে একজনকে এত নার্ভাস হতে কেউ কখনও দেখেছে! বোকা একটা।’
শ্রবণ আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, বারি কেউ আমার সঙ্গে রসিকতা করছে না তো? আমাদের কোনও বন্ধু?’
বারিধারা বলল, ‘আমি তোমার ওই কম্পিটিশনওলাদের সাইট চেক করে সব দেখে নিয়েছি। তুমি দেখবে? মোবাইলে খুলব?’
শ্রবণ তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে বলল, ‘না না, আমাকে আর দেখাতে হবে না। আমিও ওদের সাইটে ঢুকে দেখে নিয়েছি। আমার নাম আছে। আমার বাবার নাম আছে। আমার বাড়ির ঠিকানা আছে। ভুল হওয়ার কোনও উপায় নেই। তারপরেও ভাবছিলাম…যাক আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে ধারা…তার ওপর দ্বিতীয় মেইলটা…বাপরে…মাথা ঘুরছে…।’
শ্রবণ আর বারিধারা বসে আছে বালিগঞ্জের এক আইসক্রিমের দোকানে। বড় কোম্পানির দোকান। দোকান না বলে আউটলেট বলা ভালো। কাচে ঘেরা এই আউটলেটের নাম ‘বি কুল’। যার মোটামুটি একটা বাংলা হল ‘ঠান্ডা হও’। ভিতরে নরম আলো। একটা আবছা ভাব।
শ্রবণকে ‘ঠান্ডা’ করতে বারিধারা তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু শ্রবণ ঠান্ডা হচ্ছে না। যত সময় যাচ্ছে, তার অস্থিরতা বাড়ছে। বাড়াটাই স্বভাবিক। তার ওপর দিয়ে আজ একটার পর একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ঝড় সাধারণত হয় ক্ষতির। শ্রবণের এই ঝড় সৌভাগ্যের ঝড়। দুপুরবেলা মুম্বই থেকে আবার যে খবর এসেছে সেটা দেখে শ্রবণের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার মতো অবস্থা। সঙ্গে সঙ্গে সে বারিধারাকে টেলিফোন করল।
‘আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই বারি এবং সেটা এখনই চাই।’
বারিধারা শ্রবণের এই ধরনের কথায় অভ্যস্ত। ছেলেটা খাঁটি, তাই নার্ভাস। নিজের সাফল্য সামলাতে পারছে না। বেচারি, এতদিন কাজের তো তেমন কোনও স্বীকৃতি জোটেনি। শিল্পী মানুষের এটাই হয়। অনেক অবহেলার মধ্যে থাকতে হয়। তারপর যেদিন সবাই হাততালি দেয় তখন বিশ্বাস হয় না।
বারিধারা বলল, ‘এখনই কেন?’
শ্রবণ বলল, ‘মনে হচ্ছে, এটা আমাদের শেষ দেখা হবে ধারা।’
বারিধারা বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল, ‘এরকম মনে হওয়ার কারণ?’
শ্রবণ অসহায় গলায় বলল, ‘আমার সম্ভবত একটু পরেই হার্ট অ্যাটাক হবে। আমি মারা যাব। সম্ভবত সেটা হয়ে গেছে।’
বারিধারা ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ও তাহলে তো তুমি এখন ভূত। তোমাকে ভূতেদের ভাষাতে বলি, আই লাঁভ ইঁউ শ্রঁবণ।’
শ্রবণ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘ধারা, ঠাট্টা ভালো লাগছে না। সত্যি মনে হচ্ছে, আমি মরে যাব।’
বারিধারা গম্ভীর গলায় বলল, ‘প্রাইজ নিয়ে মারা যাবে? নাকি প্রাইজ না নিয়ে মারা যাবে? মারা যাবার পর প্রাইজ নট ব্যাড। মরণোত্তর পুরস্কারে দাম বেশি।’
শ্রবণ কাঁপা বলল, ‘প্রাইজ নয় বারিধারা, মুম্বই থেকে আবার একটা মেইল এসেছে।’
বারিধারা এবার হালকা চিন্তিত হল। বলল, ‘আবার মেইল! কী বলেছে, প্রাইজ ক্যানসেল? সেকেন্ড থটে বাদ পড়েছ?’
শ্রবণ বলল, ‘না তা নয়। তাহলে তো বেঁচে যেতাম। এবার মেইলে…আগে বলো কোথায় দেখা করবে, মুখোমুখি বলতে চাই।’
বারিধারা একটু চিন্তা করে বলল, ‘তোমার অবস্থা খুব খারাপ বলে মনে হচ্ছে, শ্রবণ। আগে তোমার মাথা ঠান্ডা হওয়া দরকার। এমন একটা জায়গায় তোমাকে নিয়ে যেতে হবে যেখানে তোমার মাথা ঠান্ডা হয়।’
তারপরই বারিধারা এই ‘বি কুল’-এ আসবার কথা বলছে। শ্রবণ একটু দেরি করেছে। বারিধারা এসেছে ওলা ক্যাব ডেকে। ছেলেটা যখন এতটা ঘাবড়ে ডাকাডাকি করছে তখন সিরিয়াসভাবেই নেওয়া উচিত। আজ দেখা করতই। এমন একটা খুশির দিন। তবে হয়তো খানিকটা পরে যেত। যাক, খাতাবই সরিয়ে বারিধারা বেরিয়ে পড়েছে। বেরোনোর সময় মণিকুন্তলা বললেন, ‘কী রে আবার কোথায় যাচ্ছিস? এই তো বললি আজ বাড়িতে বসে পড়ব, আমাকে বিরক্ত কোরো না। বললি না?’
বারিধারা গম্ভীরভাবে বলল, ‘না বেরিয়ে উপায় নেই মা। আমাকে বেরোতেই হবে।’
মেয়ে বড় হয়েছে, কোথায় যাচ্ছে সবসময় জিগ্যেস করা ঠিক নয়। তারপরেও মণিকুন্তলা সবসময় ‘মাতৃ টেনশন’ সামলাতে পারে না।
‘কোথায় বেরোচ্ছিস?’
বারিধারা ঠান্ডা গলায় বলল, ‘মুম্বই।’
মণিকুন্তলা চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘মুম্বই! কী বলছিস?’
বারিধারা বলল, ‘হ্যাঁ মা, আমি মুম্বই চলে যাচ্ছি।’
মণিকুন্তলার হাত নিশপিশ করে উঠল। ফাজলামির অপরাধে এখনই তার ছোট মেয়ের কান দুটো ভালো করে মুলে দেওয়া উচিত। কিন্তু তাহলে এই মেয়ের কান দিনে যে ক’বার মুলতে হবে তার ঠিক নেই। মুশকিলের হল, বারিধারা ফাজলামি করতে করতে নানারকম কঠিন কাজ করতে পারে। এমন সব কঠিন কাজ যে অন্যরা করবার কথা ভাবতেও পারবে না। তার বাবা জীবনটাকে সিরিয়াস রাখবার যে ব্রত নিয়ে চলে, মেয়েটা তার উলটো।
এই তো কিছুদিন আগেই বারিধারা তার একটা ঝামেলা সামলে দিয়েছে। মণিকুন্তলার এক পিসতুতো দাদা, মাঝে মাঝে এসে টাকাপয়সা নিয়ে যেত। এক-একদিন এক-একটা বাহানা। কোনওদিন বলত, মেয়ের শরীর খারাপ, কোনওদিন বলত বাড়ি ভাড়া বাকি, কোনওদিন বলত, ব্যবসায় লাগবে। মণিকুন্তলা পাঁচশো, হাজার টাকা দিয়ে বিদায় করতেন। কাউকে বলতেন না। ভাবতেন, আহা রে দরিদ্র মানুষ। যতই হোক আত্মীয় তো। বছরখানেক এভাবে চলার পর, সেই দাদাটি টাকার অ্যামাউন্ট বাড়াতে বলল। পাঁচশো, হাজারে আর সে সন্তুষ্ট নয়।
‘মণি, তোর বরের কাছ থেকে হাজার বিশেক টাকা জোগাড় করে দে। ব্যবসার ধার শোধ করব। নইলে ঘটিবাটি সব যাবে।’
প্রমাদ গুনলেন মণিকুন্তলা। তিনি বললেন, ‘অত টাকা কোথা থেকে পাব!’
সেই দাদা ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বলল, ‘মজা করছিস মণি? বিশ হাজারকে বলছিস অত টাকা! এত বড় একটা কোম্পানির মালিক। বিশ হাজার কেন, বিশ লাখও কোনও ব্যাপার নয়।’
মণিকুন্তলা প্রমাদ গুনলেন। তিনি বুঝলেন, এই লোককে টাকা দিয়ে দিয়ে মাথায় তিনিই তুলেছেন। তিনি কড়া হলেন।
‘আমার কাছে এত টাকা নেই। আর থাকলেও দিতে পারব না।’
‘দিতে পারবে না বললে কী করে হবে মাই সিস্টার? টাকা তো আমার চাই।’
‘বললাম তো পারব না।’
‘ঠিক আছে, তাহলে আমি বিমলকান্তির সঙ্গে দেখা করে, তার থেকে চাই। তার তো টাকা আছে। নাকি সে-ও আমার মতো ভিখিরি।’
মণিকুন্তলা বুঝলেন, এটা একটা বিপদের কথা। স্বামীর কাছে যাওয়া মানেই সে সব জানবে। বিরাট রাগারাগি শুরু করবে। সে টাকাপয়সা বিলোনোর সাহায্য মোটে পছন্দ করে না। তার শ্বশুরমশাইও এসবের বিরুদ্ধে। মেয়েরা শুনলেও ছাড়বে না। তাহলে কী করা যাবে? মণিকুন্তলা তার সেই দাদাটিকে বললেন, ‘দুদিন পরে ফোন করে যোগাযোগ করো, দেখছি।’
‘ফোন নয়। আমি দুদিন পরে নিজেই চলে আসব।’
রাতে বারিধারাকে কাঁচুমাচু মুখে সব বলেছিলেন মণিকুন্তলা।
‘কাজটা ভুল হয়ে গেছে। আসলে এমনভাবে এসে বলত…।’
বারিধারা মুখের সামনে থেকে মুখ না সরিয়েই বলেছিল, ‘ভুল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু অমন কাঁচুমাচু হবার মতো কিছু ভুল হয়নি মা।’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘তোর বাবা শুনলে খুব রাগারাগি করবে।’
বারিধারা বলল, ‘রাগারাগি করলে সেটাও ভুল হবে। একজন আত্মীয় অসহায়তার কথা বলে তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে, এর জন্য বাবার রাগ করবার কী আছে? একেকজনের সাহায্য করবার প্যাটার্ন এক-একরকম। বাবা মানুষকে সাহায্য করে। বুধবার সকালে বাড়িতে যে দরবার খুলে বসে সেখানে কী করে? তবে বাবার কায়দাটা অন্য। টাকা বিলোনোর নয়। বুদ্ধিমানের। তোমারটা বোকামির। তার মানে অন্যায় নয়।’
মণিকুন্তলা চিন্তিত গলায় বললেন, ‘লেকচার থামা। এখন কী করব সেটা বল। তোর বাবাকে সব বলে দিই।’
বারিধারা বলল, ‘কোনও দরকার নেই। বাবা কী করবে? আমি ব্যবস্থা করব। তুমি ওনার ফোন নম্বরটা দাও।’
মণিকুন্তলা অবাক হয়ে বললেন, ‘তুই! তুই কী করবি বৃষ্টি?’
বারিধারা মুচকি হেসে বলল, ‘মামা যাতে আর তোমাকে টাকা চেয়ে বিরক্ত না করে তার ব্যবস্থা করব।’
মণিকুন্তলা ভয় পেয়ে বললেন, ‘গালমন্দ করবি নাকি?’
বারিধারা হাই তুলে বলল, ‘তাই করা উচিত। গালমন্দ তেমন নয়, হালকা থ্রেট করলেই কাজ হয়ে যাবে। এই ধরো বাড়ির এক কিলোমিটারের মধ্যে দেখলে পা ভেঙে দেব গোছের কিছু। কিন্তু সেটা করা যাবে না। এতদিন ধরে তুমি তাকে যেভাবে সাপোর্ট দিয়েছ, তার সঙ্গে পা ভেঙে দেবার ব্যাপারটা যাবে না। তাছাড়া ভাগ্নি হয়ে মামার পা ভেঙে দেওয়াটা ঠিকও নয়। অন্য পথে যেতে হবে।’
মণিকুন্তলা বলল, ‘সেটা কী?’
বারিধারা হাত বাড়িয়ে মণিকুন্তলার গায়ে হাত রাখল। হেসে বলল, ‘চিন্তা কোরো না। মেয়ে তোমার বড় হয়ে গেছে মা। মাকে প্রাোটেক্ট করবার মতো জোর তার আছে। তুমি ফোন নম্বরটা লিখে দিয়ে কেটে পড়ো, আমাকে পড়তে দাও। বাবাকে এসব বলে আর বিরক্ত কোরো না। যাও এবার।’
সেই ‘দাদা’ মণিকুন্তলার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি। মণিকুন্তলা মেয়েকে চেপে ধরে ঘটনা জানতে পেরেছে।
বারিধারা হেসে বলেছিল, ‘একে বলে অ্যাকশন উইদাউট ব্লাড শেড। তোমার দাদাকে ফোন করে থিয়েটার করলাম। গলায় টেনশন আর ফিসফিসানি নিয়ে বললাম, বড়মামা, আমি বৃষ্টি বলছি। একটা বিরাট বিপদে পড়ে তোমায় ফোন করেছি। আগামী শনিবার আমি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করছি। তুমি তো জানো বড়মামা এসব আমাদের বাড়িতে চলে না। বাবা শুনলে গুলি করে মারবে। মা শুনলে ঝুলঝাড়া পেটা করবে। যাকে বিয়ে করছি, সেই ছেলের বাড়ি আরও কড়া। বাড়ির এক মাইলের মধ্যে ঘেঁষতে পারবে না। তাই আমি ঠিক করেছি, বিয়ে করে আমি আর আমার বর তোমার বাড়িতে গিয়ে উঠব। ওখানেই বাসর, বউভাত, ফুলশয্যা করব। এসব তো বন্ধুদের বাড়িতে হয় না, গার্জেন লাগে। তুমি আর বড়মামি আমাদের গার্জেন হবে। মনে রাখবে মামা, মা যেন ঘুণাক্ষরে জানতে না পারে। তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আমার বয়ফ্রেন্ড আবার পার্টি পলিটিক্সের লোক। রগচটা গুন্ডা একটা। দু’বার জেল খেটে এসেছে। কিন্তু ছেলে খুবই ভালো। বড়মামা, শনিবার বিকেলে তাহলে তোমার বাড়িতে গিয়ে উঠছি। তাই তো? পরে একবার ফোন করে টাইমটা ফাইনাল করে নেব। দেখো, বড়মামা আমাকে তুমি ডুবিও না। আমার বয়ফ্রেন্ড আবার গদ্দারি একেবারে মেনে নিতে পারে না। হিন্দি সিনেমার ভিলেনদের মতো। ব্যস, তারপর থেকে তোমার দাদা ফোন বন্ধ করে দিয়েছেন। আমি সিওর উনি আপাতত কয়েক মাস তোমার ধারেকাছে ঘেঁষবে না।’
কথা শেষ করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। এই মেয়েকে শুধু ফাজিল বলা যায়?
মুম্বই যাবার রসিকতা শুনে মণিকুন্তলা মেয়ের ওপর রাগ দেখিয়ে চটি ফটফটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
বারিধারা কাউন্টার থেকে দুটো ককটেল আইসক্রিম নিয়ে এল। এরা বিভিন্ন ফ্লেভারের আইসক্রিম মিলিয়ে মিশিয়ে দারুণ ককটেল বানায়। দিদির সঙ্গে মাঝে মাঝে এসে খেয়ে যায় বারিধারা। মেঘবতীর আইসক্রিম সহ্য হয় না। খেলেই গলা ধরে। তারপরেও খায়।
বারিধারা খানিকটা আইসক্রিম মুখে দিয়ে বলল, ‘নাও এবার বলো, দ্বিতীয় মেইলে কী এসেছে?’
শ্রবণ হাত বাড়িয়ে বারিধারার হাতটা ধরল। বারিধারাকে আজ ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। সে একটা সবুজ রঙের পালাজো পরেছে। সঙ্গে স্লিভলেস টপ। সেটাও সবুজ। তবে অন্য একটা শেড।
শ্রবণ কাঁপা গলায়, ‘বারিধারা, ওরা আমাকে চাকরি অফার করেছে।’
বারিধারা বলল, ‘চাকরি! কারা?’
শ্রবণ বলল, ‘যারা এই কম্পিটিশনটা করে তারা। অ্যাডভার্টাইজিং কোম্পানি।’
বারিধারা শ্রবণের হাত চেপে ধরে বলল, ‘কনগ্রাচুলেশন! কনগ্রাচুলেশন শ্রবণ!’
শ্রবণ বলল, বারি, রাখো তোমার কনগ্রাচুলেশন। ধারা, আগে তুমি মোবাইলে আমার মেইলটা খুলে চিঠি পড়ো।’
বারিধারা দ্রুত হাতে নিজের মোবাইল ঘাঁটতে লাগল। মেইলটা বের করে নিমেষে পড়েও ফেলল। অল্প কথায় যা লেখা আছে তার মানে হল—
‘…আমরা এর আগেও এই কম্পিটিশনের টপারদের আমাদের সংস্থায় যোগ দেবার জন্য অফার করেছি। কেউ এসেছেন, কেউ পারেননি। যাদের কাজ দেখে আমাদের অতিরিক্ত ইনোভেটিভ বলে মনে হয়, তাদেরই ডাকি। আপনাকেও ডাকছি। আপনি যদি আমাদের সংস্থার ‘কনসেপ্ট অ্যান্ড ডিজাইন’ ডিভিশনে যোগ দেন আমরা খুশি হব।’
এর সঙ্গে বেতন, গাড়ি, ভাসিতে কোম্পানির ফ্ল্যাট এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধের কথা বলা আছে। বারিধারা মোবাইল থেকে মুখ সরিয়ে শ্রবণের দিকে উজ্জ্বল চোখে তাকাল।
শ্রবণ মনে মনে লজ্জা পেল। একটু হাসল। বলল, ‘সামান্য একটা বিজ্ঞাপনের খসড়া…তাতে ওরা যে কী পেল…।’
বারিধারা বলল, ‘একেই বলে প্রফেশনাল। হীরে চেনবার চোখ। সাধে সবাই ওসব জায়গায় গিয়ে কাজ করতে চায়? গুণী মানুষকে বাইরে রাখতে চায় না। আমাদের এখানে উলটো হয়। গুনী মানুষকে সবাই মিলে ঠোকরায়। আপ্রাণ চেষ্টা করে যাতে উঠতে না পারে। তোমাদের মতো প্রতিভাধরদের ছোট চোখে দেখাটা বাঙালির একটা অভ্যেস। গুণের বিচারে বেশিরভাগ সময়েই হয় না। বুঝতেও পারে না ছাই। মিডিওক্রেসির যুগ। তারাই সবক্ষেত্রে মাথার ওপর বসে থাকে। যে পয়সাওলাকে আর ক্ষমতাওলাকে ম্যানেজ করতে পারবে সে-ই বাংলায় সব থেকে গুণী।’
শ্রবণ গলা নামিয়ে বলল, ‘বারি, তুমি আমার সঙ্গে যাবে তো?’
বারিধারা ভেজা চোখে বলল, ‘কোথায়?’
‘কেন, যেখানে আমি চাকরি করতে যাব। মুম্বইতে? তুমি না গেলে আমি কিন্তু কিছু পারব না।’
বারিধারার শরীরের ভিতর ঝিমঝিম করে উঠল। আজই মাকে বলে এসেছে না সে মুম্বই যাচ্ছে! একেই বলে কোইনসিডেন্স।
বারিধারা ফিসফিস করে বলল, ‘হ্যাঁ, যাব, কিন্তু তার আগে আমি একটা কাজ করব।’
শ্রবণ বলল, ‘কী কাজ?’
বারিধারা উঁচু চেয়ার থেকে ঝুঁকে পড়ে শ্রবণের মুখটা দুহাত দিয়ে টেনে আনল নিজের কাছে। তারপর আইসক্রিম ভেজা ঠোঁটে লম্বা চুমু খেল।
বারিধারা আর শ্রবণ দুজনেই বুঝতে পারল, প্রকাশ্যে হলেও এই চুম্বনে কোনও লজ্জা নেই। কারণ তাদের কেউ দেখতে পাচ্ছে না। গভীর ভালোবাসা তাদের আব্রু হয়ে ঘিরে আছে। কেউ সেখানে উকি মারবে তার সাধ্যি কী?