একটু পরে রোদ উঠবে – ৪০

চল্লিশ

‘এ কথা মনে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা দেশের শ্রমিক শ্রেণী সংগ্রাম করে অর্জন করেনি, যেমনভাবে লেলিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। তবে সেইদিক দিয়ে বিচার করলে হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রুমানিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে সমাজতন্ত্র গড়ে উঠেছে, তা অনেকটাই যেন ওপর থেকে চাপানো। শুধু তাই নয়, গোড়া থেকেই সোবিয়েতের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল সাংঘাতিক ভাবে প্রবল। তাই মিখাইল গরবাচেভের নেতৃত্বাধীনে সোবিয়েত যখন রাজনৈতিক সংস্কার হিসেবে ‘পেরেস্ত্রৈকা’ এবং আর্থ সামাজিক সংস্কার হিসেবে ‘গ্লাসনস্ত’ আত্মপ্রকাশ করল, তখন স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব ইউরোপের সকল দেশে এই ধরনের সংস্কার প্রবর্তনের জন্য প্রবল দাবি উঠল।

সোবিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএসইউ) সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ থাকার ফলে তারা মানুষের মধ্যে সংস্কার প্রবর্তনের আকুলতা অনুভব করতে পেরেছে এবং সেই অনুযায়ী তারা এই ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু পূর্ব ইউরোপ অন্যান্য দেশে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জনগণের যে সেই ধরনের প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল না তা সহজেই অনুমান করা যায়। কারণ, তা যদি থাকত, তা হলে এই সমস্ত দেশে এইভাবে বালির প্রাসাদের মতো একটার পর একটা রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটত না। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র পতনের পিছনে আর একটি অন্যতম বড় কারণ হল, এই সমস্ত দেশে কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব বলে কিছু ছিল না। রাষ্ট্রব্যবস্থা কমিউনিস্ট পার্টির প্রাধান্যের পরিবর্তে কতিপয় ‘টেকনোক্রয়াট’ ও ‘ব্যুরোক্রয়াটে’র দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ফলে এ ঘটনা এমনভাবে ঘটেছে…’

এত পর্যন্ত পড়ে শেখর গুপ্ত থামল। বইয়ের নাম ‘মার্কসের পর মার্কসবাদ’। লেখক শমিত কর। বইটি বেশ কিছুদিন আগের। শেখরের পড়া ছিল না। কিছুদিন আগে ইন্দ্রদা দিয়েছে। ইন্দ্রদা পার্টির পুরোনো লোক। এখন বসে গেছে। পার্টির লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। শেখরের কাছে মাঝে মাঝে আসে। গল্প করে, চা খায়। বই, পত্রিকা থাকলে ঘাঁটাঘাঁটি করে। মাঝে মাঝে কোনও বই পড়ে পছন্দ হলে দিয়ে যায়। এই বইটাও সেভাবে পেয়েছে শেখর। পড়া হচ্ছিল না। আজ ব্যাগে নিয়ে বেরিয়েছে। ব্যাগে বই নিয়ে বেরোনোর অভ্যেস শেখরের অনেক দিনের। একটা সময় পার্টির কাজে অনেক দূর দূর ট্রাভেল করতে হত। তখন সঙ্গে একটা বই না থাকলে অসুবিধে হত। বাসে, ট্রেনে সময় কাটতে চাইত না। সেই অভ্যেস রয়ে গেছে। খটমট প্রবন্ধের বইয়ের সঙ্গে কবিতার বইও থাকে। শেখরের মজা হল, যে-কোনও পরিস্থিতিতে বইতে ডুব মারতে পারে।

ইন্দ্রদা বসে গেছে প্রায় দশ বছর হয়ে গেল। বসে গেছে একেবারে অদ্ভুত একটা যুক্তি দেখিয়ে। সেই সময় পার্টির অনেকেই বলেছিল, হয় মানুষটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, নয় রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বাহানা খুঁজছে। ইন্দ্রদা অন্য জোনের হলেও পার্টির ওপর থেকে শেখরকে বলল, তুমি কথা বলো। সমস্যাটা বোঝবার চেষ্টা করো। এতদিনের পুরোনো একজন কর্মীকে পার্টি হারাতে চায় না।’

শেখর ‘কিন্তু কিন্তু’ করেছিল। বলেছিল, ‘আমার কথা বলা উচিত হবে? ইন্দ্রদার জোনের সেক্রেটারি বললে ভালো করতেন না?’

‘বলেছিল। লাভ হয়নি। উলটে সেক্রেটারি বিরক্ত হয়েছে। সে রিপোর্ট করছে ইন্দ্রর মাথার সমস্যা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা জানি উনি যেখানেই কাজ করুন, তোমার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো।’

শেখর বলেছিল, ‘পার্টি কি আমাকে দায়িত্ব দিচ্ছে?’

‘ঠিক অফিসিয়ালি নয়, তবে দিচ্ছে।’

শেখর ইন্দ্রদার সঙ্গে কথা বলেছিল।

‘তুমি হঠাৎ এরকম ঠিক করলে কেন?’

ইন্দ্রদা বলেছিল, ‘এভাবে রাজনীতি করা যায় না, শেখর। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।’

শেখর অবাক হয়ে বলেছিল, ‘কেন? সমস্যা কী?’

ইন্দ্রদা বলল, ‘পাটি করাটা পার্ট টাইম কাজ নয়। কমিউনিস্ট পার্টি তো নয়ই। চাকরি করব, সংসার করব, সামাজিকতা রক্ষা করব, তারপর পার্টি করব—এটা হয় না।’

শেখর অবাক হয়ে বলল, ‘কতজনই তো তাই করছে।’

ইন্দ্রদা বলল, ‘কে কী করল, আমি জানি না। আমি বুঝতে পারছি, এটা হয় না।’

শেখর বলল, ‘স্কুল কলেজ অফিসে কলকারাখায় আমাদের মেম্বার কত, তা তো তুমি জানো। কোটির কাছাকাছি।’

ইন্দ্রদা শুকনো হেসে বলেছিল, ‘এখানেই আপত্তি শেখর। পার্টি প্রফেশনালদের হাতে চলে যাচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টির কাজ দরিদ্র সর্বহারাদের নিয়ে। আর আমরা কী করছি? দলকে দাঁড় করাচ্ছি, যারা উপার্জন করছে তাদের ওপর ভিত্তি করে। এটা ঠিক হচ্ছে না। এতে পার্টি তার মূল লাইন থেকে সরে আসছে। চাকুরে, ব্যবসায়ী-নির্ভর পার্টি যাদের আছে, তাদের সুযোগসুবিধে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের বেলাতেও তাই হচ্ছে। মাইনে, ডি এ, প্রাোমোশন, ট্রান্সফার এই সব নিয়ে পার্টি মাথা ঘামাচ্ছে বেশি। মেইন ফোর্সটাই তো আরও চাই, আরও দাও-তে চলে যাচ্ছে। যাদের কিছু নেই, তাদের জন্য ভাবনা থাকলেও সময় দিতে পারছি কম।’

শেখর বলল, ‘এ তোমার অদ্ভুত যুক্তি ইন্দ্রদা। সারা বিশ্বে কমিউনিস্ট পার্টি অফিস কাছারি, কলকারখানায় অর্গানাইজেশন করেছে। তুমি রাশিয়ার ইতিহাস দেখো, চিনের মুভমেন্ট দেখো। পোলান্ড, চিলির দিকে তাকাও। সবসময়ই পার্টির একটা বড় অংশ প্রফেশনালদের হাতে ছিল।’

ইন্দ্রদা বলেছিল, ওদের সঙ্গে আমাদের তুলনা চলে না। আমাদের সোশ্যাল, ইকনমিকাল স্ট্রাকচার একেবারে আলাদা। ওসব দেশে বিপ্লবের পরিস্থিতি ছিল। লেবারদের মিনিমাম ওয়েজ বলে কিছু ছিল না। এটাই সেই পরিস্থিতি। আমাদের তো তা নয়।’

শেখর বলেছিল, ‘আমাদের তো অসংখ্য হোলটাইমারও আছে ইন্দ্রদা। আছে না? তারা শুধু পার্টির কাজই করে।’

ইন্দ্রদা বলল, ‘আমিও ভেবেছিলাম তাই করব। তোর বউদিকেও সেরকম বলে রেখেছিলাম। অফিস ছেড়ে দিয়ে পুরো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখলাম, তাতে কোনও লাভ হবে না। পার্টির বড় একটা অংশ পার্ট টাইমারদের হাতেই থাকবে।’

শেখর বিরক্ত হয়েছিল। বলেছিল, ‘এ তোমার ঠিক কথা নয় ইন্দ্রদা। তথ্যের দিক থেকেও তুমি ভুল। সর্বসময় কর্মীরাই আমাদের পার্টির সম্পদ। এই তো আমি, আমার কি পার্টিতে কোনও সে নেই? আমার কথা শোনা হয় না?’

ইন্দ্রদা বলল, ‘আমি তা বলিনি। কে নেতা, কে কমিটির মাথায় আছে, এটা ইমমেটেরিয়াল। আসলে কথা হল, কাদের নিয়ে পার্টি ব্যস্ত। কাদের দাবিদাওয়া মেটাতে উদগ্রীব। শেখর একটা কথা মনে রেখো তোমার মতো কয়েকজন কিছু করতে পারবে না। আজ পার্টি যাদের আরও পাইয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত, বিপদের সময় তারা সবার আগে সরে যাবে। কোটির হিসেব কোথায় দিয়ে তখন ঠেকে দেখবে। আমি এই হিপোক্রেসিতে নেই। আমি চাই পার্টির ভালো হোক।’

শেখর সেদিন ইন্দ্রদার কথার সঙ্গে একেবারেই একমত হয়নি। এই যুক্তি অতি দুর্বল যুক্তি। সে একথা স্পষ্ট করে বলেওছিল।

‘ইন্দ্রদা তোমার যুক্তি ঠিক নয়। তুমি চাইছ, পার্টি শুধু শ্রমিক, সর্বাহারাদের সামনের সারিতে রেখে এগিয়ে চলুক। বাকি সবাইকে দূরে রাখুক। কেরানি, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, অফিসার, ছোট পুঁজির ব্যবসায়ী পিছনে থাকবে। এটা বাস্তব কথা হল না। তুমি আমার থেকে ভালো জানো যে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লবের কোনও সম্ভাবনা এদেশে নেই। এদেশে কেন, এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীতেই কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। আমি যেটুকু বুঝি তা হল, আমাদের পার্টি সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় কিছু রিলিফের ব্যবস্থা করতে পারে মাত্র। সরকারে গিয়ে তাই করছেও। এটা যেমন দরিদ্র মানুষের জন্য করছে, তেমন মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের জন্যও করা হচ্ছে। এই উদার অর্থনীতির সময় কনজিউমারলেস সোসাইটি একটা ইউটোপিয়া মাত্র। তার কোনও অস্তিত্ব নেই। চিনেও নেই। আমরা যদি উপভোক্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারি, তাহলে কৃষকের ফসল, শ্রমিকের তৈরি কাপড় জামা, কিনবে কে? তুমি কি কারখানা না করে পার্টি চালাতে বলছ ইন্দ্রদা?’

ইন্দ্রদা অন্যমনস্ক ভাবে বলেছিল, ‘কারখানা বন্ধ করতে বলিনি, শিল্পের প্রয়োজন, কিন্তু পার্টির কাছে কে বেশি ইমপর্টান্ট? কারখানার মালিক না শ্রমিক? হাবভাব দেখে কোনও কোনও সময় মনে হচ্ছে, গুলিয়ে ফেলছি।’

শেখর হেসে বলেছিল, ‘তাহলে তো তোমার সঙ্গে আর্গুমেন্টে গিয়ে লাভ নেই। কারখানা না হলে শ্রমিক কোথা থেকে পাব? তাদের নিয়ে পার্টি করবার প্রশ্নও উঠবে না। কারখানার জন্য মালিক চাই। আগে তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমার ভাবতে একটু অবাকই লাগছে, এতদিন পার্টি করবার পর তোমার কোথায় যেন কনফিউশন তৈরি হচ্ছে। যে কনফিউশনের কোনও বেস নেই। কিছু মনে কোরো না, তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে, মূল বিশ্বাসে তুমিই গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছ ইন্দ্রদা। এখন পার্টির ঘাড়ে চাপাতে চাইছ।’

এইসব কড়া কথার পরেও ইন্দ্রদার সঙ্গে সম্পর্ক রয়ে গেছে শেখরের। ব্যক্তিগত সম্পর্ক। তবে আজ মনে হয়, সেদিন ইন্দ্রদার একটা কথা খানিকটা হলেও ঠিক ছিল। পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর উপার্জনক্ষম সদস্য, কর্মী, সমর্থকরা পার্টির পাশ থেকে দ্রুত সরেছে। এটাই মধ্যবিত্ত চরিত্র। সে মূলত সুবিধাভোগী। ইন্দ্রদার এই দূরদৃষ্টিটুকু হয়তো ঠিক ছিল, কিন্তু পার্টি ছাড়বার জন্য অতি দুর্বল যুক্তি।

ইন্দ্রদা এই বইটা দিয়ে বলেছিল, ‘পড়ে দেখিস। সঙ্কটের কথা সহজ করে বলা আছে।’

আজ বইটা পড়তে পড়তে শেখরের মনে হচ্ছে, তাদের পার্টির ক্রাইসিসের এই সময়ের কথাও ভালো করে লিখে রাখার দরকার। এখনও লেখা হচ্ছে। কিন্তু সেটা সংগঠনের রিপোর্ট নয়, শাসক দলের প্রতাপ। খুব বেশি হলে নেতারা প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখছেন। এতে হবে না। প্রতিটা পার্টি মেম্বারকে একটা করে ডাইরি দিয়ে দেওয়া উচিত। তারা প্রতিদিন পার্টি করতে গিয়ে কী সমস্যা হচ্ছে, কেন সমস্যা হচ্ছে সে কথা লিখে রাখবে। সবথেকে বড় কথা, এই সময়টা কেন কমিউনিস্ট পার্টি সঙ্কটের সময় বলছে, সেটাও তো জানা দরকার। ইতিহাস হয়তো পরে বিচার-বিশ্লেষণ করে বলবে, এটা সঙ্কটের সময় ছিল না। ক্ষমতায় না-থাকাটা কমিউনিস্টদের জন্য সমস্যা নয়। বরং এই সময়টাই পার্টির জন্য ভালো সময়। শত্রু-মিত্র চিনে নেওয়ার সময়। সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করবার সময়। সংগঠন করতে গিয়ে ভিতরে-বাইরে যত সংঘাত হবে, পার্টির জন্য তত শুভ। আচ্ছা, পার্টির ওপরের নেতাদের কাছে প্রস্তাবটা দিলে কেমন হয়? শুনবে? মনে হয় না। থাক, অত বলাবলির দরকার নেই। নিজের লোকাল কমিটিতে এই ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কেন পার্টি ক্ষমতা থেকে সরে গেল, সে বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে। অনেক রিপোর্ট হয়েছে। সম্মেলন হয়েছে। এখন দরকার ক্ষমতার বাইরে থেকে রোজকার অভিজ্ঞতাকে লিপিবদ্ধ করা।

ভাবনার এরকম একটা সময় হাবিলদার ধরনের একজন এল।

‘বড়বাবু ভিতরে ডাকছে।’

শেখর গুপ্ত পাশে বসা অর্চিনকে বলল, ‘চলো।’

থানায় ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজল।

একচল্লিশ

তমসা আরেক হাত ভাত তুলে দিল অর্চিনের প্লেটে। অন্য কোনও সময় হলে অর্চিন বারণ করত, আজ করল না। তার খিদে পেয়েছে। থানা থেকে বেরিয়ে ইউনিভার্সিটিতে চলে যাচ্ছিল অর্চিন। শেখর আটকাল।

‘আমার বাড়িতে চল। খেয়ে নিবি।’

অর্চিন বলেছিল, ‘থাক শেখরদা।’

শেখর বলল, ‘কেন? থাকবে কেন? খিদে পায়নি?’

অর্চিন শুকনো হেসে বলল, ‘তা পেয়েছে। ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নেব। তোমার বাড়িতে গিয়ে আবার ঝামেলা পাকাব না।’

শেখর সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘ঝামেলার কী আছে? আমি খাব, তুইও খাবি। চল। তমসাকে একটা ফোন করে দিচ্ছি। ও আজ বাড়িতে আছে।’

মুখে বললেও স্ত্রীকে ফোন করতে ভুলে গেল শেখর। গোটা পথই সে কথা বলতে বলতে এল।

আগে থেকে না জানালেও তমসা ব্যবস্থা করে ফেলেছে। শেখরও বসেছে। খাওয়া খুবই সাধারণ। ভাত, ডাল, একটা তরকারি। তমসা দুজনকে ডিম ভেজে দিল। অর্চিন বাধা দিয়েছিল।

‘কিছু লাগবে না তমসাদি।’

হিসেবমতো শেখরের স্ত্রীকে অর্চিনের ‘বউদি’ সম্বোধন করা উচিত। ডাকে না। বিয়ের আগে থেকেই পরিচয়। তখন ‘তমসাদি’ ডাকত, এখনও তাই ডাকে। অনেকেই তাই করে। পার্টির সঙ্গে যাদের যোগাযোগ, তারা আগে যেমনভাবে তমসাকে চিনত, এখনও সেরকমভাবে চেনে। ফলে নতুন করে সম্বোধন বদলের প্রশ্ন ওঠে না।

তমসা সঙ্কুচিত হয়ে বলল, ‘আজ মাছ-টাছ কিছু নেই। থানায় যাবে বলে তোমার দাদা বাজারে গেল না। ইস, তুমি যে কী করে খাবে অর্চিন?’

অর্চিন বলল, ‘কী বলছ তমসাদি, আমি তো বেশিরভাগ দিন দুপুরে ভাতই খাই না। ইউনিভার্সিটিতে এটা-সেটা খেয়ে কাটিয়ে দিই। বাড়িতে মাসি রাগ করে। কী করব? লেট করে ফেলি। খেতে বসবার সময় কই? আজ যে ভাত পেলাম, এটাই অনেক। আর কিছু লাগবে না।’

তমসা কথা শোনেনি। সে ডিম ভেজে এনেছে। মনে মনে রাগও হয়েছে। শেখর কি কোনও দিন অভ্যেস বদলাবে না? চিরকাল আগে কিছু না বলে লোক এনে বলে, ‘তমসা ভাত হবে নাকি? আজ আমার সঙ্গে সোমনাথ খাবে। আমারটাই দাও, ভাগ করে নিই।’

তমসা পরে রাগ করে, ‘কেউ খেতে এলে আগে একটু জানাবে তো। তার সামনে ভাগ করে দাও কথাটা শুনতেও খারাপ লাগে।’

শেখর অবাক হয়ে বলে, ‘ভাগ করে খাব বলবার মধ্যে খারাপ লাগবার কী আছে?’

তমসা থমথমে গলায় বলে, ‘এটা পার্টির কমিউন নয় শেখর। সংসার। এখানে তোমার স্ত্রী, ছেলেও থাকে। সংসারের একটা নিয়ম আছে। বাইরের কাউকে খেতে বললে, তাকে আলাদা যত্ন করতে হয়। পার্টি কমিউনে কেউ বাইরের নয়। আলাদা যত্ন লাগে না।’

শেখর কাঁচুমাচুভাবে বলে, ‘বুঝেছি। কিন্তু কী করব? আমি নিজেও তো জানতাম না সোমনাথ ভাত খায়নি। এইমাত্র জানলাম। বললাম তো, আমারটাই দুজনকে ভাগ করে দাও।’

তমসা আরও রেগে যায়। বলে, ‘আবার এক কথা। একজনের ভাত ভাগ করা যায় নাকি? আর শুধু ভাত? ভাতের সঙ্গে ডাল-তরকারি, মাছ দিতে হবে না? সেটাও কি ভাগ করে হবে?’

শেখর মাথা চুলকে বলে, ‘সরি, তোমাকে সমস্যায় ফেললাম।’

তমসা গম্ভীর গলায় বলে, ‘সরি বলছ কেন? দুদিন অন্তরই তো ফেলো। আমি তো কাউকে আনতে বারণ করিনি। একটু আগে জানাতে সমস্যা কোথায়? মোবাইল থেকে একটা টেক্সট করে দিতে তো পারো। ভাতটা অন্তত বসিয়ে দিতে পারি।’

শেখর জিভ কেটে বলে, ‘ইস, একদম মাথায় ছিল না। এরপর কাউকে খেতে ডাকলে তোমাকে আগে জানিয়ে দেব।’

পরের বারও একই কাজ করে শেখর। সে আবার কোনও রবিবার কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে ঢোকে বেলা তিনটের সময়। ঢুকেই বলে, ‘তমসা আমাকে আর সামন্তককে ভাত দাও। তাড়াতাড়ি দাও। খিদেতে পেট জ্বলছে দুজনের।’

তমসা রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেলে। এই মানুষটার ওপর রাগ করে কী লাভ। তমসা অবশ্য এক্সট্রা লোক খাওয়ার বিষয়টা ছোটবেলা থেকেই দেখেছে। একাত্তর-বাহাত্তর সাল তখন। সরকারি স্কুলের শিক্ষক বাবা পরিবার নিয়ে বারাসাতে। সরকারি বাধানিষেধ অমান্য করে পুরোদমে রাজনীতি করছে। তবে বেশিটাই করতে হচ্ছে গোপনে। সর্বত্র খুনোখুনি, পাড়াছাড়া, পুলিশের ধড়পাকড় চলছে। সেই সময় পার্টির অনেকেই লুকিয়ে খেতে আসত। কেউ আগে বলে আসত, কেউ আসত বিনা নোটিসে। চুপচাপ খেয়ে চলে যেত। প্রথম দিকে মা সমস্যায় পড়ত। পরে রোজই দু-তিনজনের জন্য বেশি করে ভাত বসানো হত। অনেকটা ডাল আর বড় করে একটা তরকারি। পালিয়ে বেড়ানো, না-খাওয়াদের জন্য ভাত-ডালই তখন বিরাট ব্যাপার।

আজ তমসার স্কুলে হাফছুটি হয়ে গেছে। স্কুল যে এলাকায়, সেখানকার কে একজন মারা গেছে। ছোটখাটো কোনও নেতা। গতকাল সেকেন্ড পিরিয়ডের পর ক’টা ছেলে এসে একরকম জোর করে বড়দির ঘরে ঢুকল। স্কুল ছুটি দিতে হবে। এলাকায় ‘জনদরদি নেতা’ মারা গেছে, পাড়ায় লেখাপড়া চলে কী করে? বড়দি তাদের বোঝাল, মেয়েদের স্কুলে এরকম হুটপাট ছুটি দেওয়া যায় না। অনেক মেয়ের বাড়ি থেকেই গার্জেনরা নিতে আসে। তারা একা বাড়ি ফেরে না। ফলে ছুটির পরও মেয়েদের স্কুলে আটকে রাখতে হয়। টিচারদেরও থাকতে হয়। প্রথম দিকে ছেলেগুলো বুঝতে চাইছিল না। শেষ পর্যন্ত বুঝেছে। কাল ছেড়ে দিয়েছে, তবে তার বদলে আজ হাফ ছুটি দিতে হল। এই বিষয়টা নিয়ে কাল টিচাররুমে মালিনী আর অন্তরাদির মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে। মালিনীদি রাগ করছিল।

‘কোথা কার কে দু-পয়সার নেতা মারা গেছে বলে স্কুল ছুটি দিতে হবে। এ কেমন কথা? এ তো গুন্ডামি। বড়দিই বা মেনে নিলেন কেন?’

অন্তরাদি বলল, ‘এমন করে বলছ যেন আজই এমন প্রথম ঘটল। আগেও হয়েছে। আমি অন্তত দশটা ইনস্টান্স দেখাতে পারি। পলিটিক্যাল প্রেসার দিয়ে ছুটি।’

মালিনী বলল, ‘তারা কেউ এরকম ফুটো নেতা ছিল না।’

অন্তরাদি বলল, ‘ফুটো নেতা না আস্ত নেতা, তা বলতে পারব না, তবে সেটাও এক ধরনের গুন্ডামি ছিল।’

মালিনী তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘গুন্ডামি! তখন গুন্ডামি ছিল! কী বাজে বকছ? একটা উদাহরণ দেখাও অন্তরাদি, কবে গুন্ডামি করে স্কুল-কলেজ বন্ধ করা হয়েছে। এইভাবে মস্তানরা এসে হেডমিস্ট্রেসের ঘরে ঢুকতে পারত?’

অন্তরাদি বলল, ‘মালিনী, বিষয়টা ছোটবড় নয়, পলিটিক্যাল পার্টির নেতা মারা গেলে স্কুল-কলেজ, দোকান-বাজার বন্ধ করে দেওয়াটা আমাদের এখানকার একটা কালচার হয়ে গেছে। পাড়ার নেতা আর এমপি, এমএলএ-তে তোমার কাছে পার্থক্য থাকতে পারে লেখাপড়ার কাছে কী পার্থক্য? তা ছাড়া একটা সময় জোর করে বড়দির ঘরে ঢুকতে হত না। ফোন চলে আসত। তাতেই কাজ হত। সেটাও এক ধরনের গুন্ডামি ছিল।’

তমসা ইচ্ছে করেই চুপ করে ছিল। এই ঝগড়ায় ঢুকলেই সবাই ভাবত, রাজনীতি করছে। স্কুলের সকলেই তার পলিটিক্যাল আইডেন্টিটির কথা জানে। আবার এটাও জানে, এই পরিচিতি নিয়ে সে কখনও কোনও সুবিধে নেয়নি। এখন তো প্রশ্নই ওঠে না, পার্টি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও স্কুলের প্রশাসনিক বিষয়ে কখনও নাক গলায়নি। তখন বড়দি মাঝে মাঝে ডাকতেন। রুটিন, পরীক্ষা, রেজাল্ট এসব নিয়ে মিটিং করতে চাইতেন। তমসা কোনওদিন একা যায়নি। আর পাঁচজন সিনিয়র টিচারকে নিয়ে ঘরে ঢুকত। বড়দি অসন্তুষ্ট হতেন। সে জানত, বড়দির এই একা ডাকার পিছনে ‘ক্ষমতা’-কে খুশি করবার চেষ্টা থাকত।

‘তোমার সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চাই তমসা। সবাইকে জুটিয়ে আসবে না।’

তমসা বলত, ‘এটা হয় না। সিনিয়র কলিগদের বাদ দিয়ে আমি এইসব বিষয়ে একটা কথাও বলতে পারি না। বলবও না।’

বড়দি একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘রুটিন তৈরির সময় তো তোমার সঙ্গে আলাদা বসাই উচিত। তোমার অবস্থা তো আর পাঁচজনের মতো নয়। স্কুলের বাইরেও তোমাকে আর পাঁচটা কাজ করতে হবে। তোমার পলিটিক্যাল রেসপন্সিবিলিটি আছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তোমাকে স্কুলে আটকে থাকলে চলবে কেন?’

তমসা হেসে বলত, ‘স্কুলে ঠিকমতো কাজ করাটাও আমার কাছে এক ধরনের পলিটিক্যাল রেসপন্সিবিলিটির মধ্যে পড়ে বড়দি। মেয়েদের পড়ানোটা মিটিং, মিছিলের মতো আমি কম গুরুত্ব দিয়ে দেখি না। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সবার মতোই রুটিন মেনে চলব।’

তারপর থেকে আর বড়দি এই বিষয়ে তমসাকে ঘাঁটাতেন না। বিষয়টা স্কুলের অন্য টিচাররা জানতেন। তমসার প্রতি তাদের মনোভাব অন্যরকম ছিল। কেউ কেউ বলত, ‘তমসা তোমাদের দলে যদি তোমার মতো মানুষ আরও বেশি থাকত, তা হলে ভালো হত।’ তমসা উত্তর দিত না। হাসত। মনে মনে দু:খ পেত। পার্টি সম্পর্কে মানুষের মনে খারাপ ধারণা!

আজ তমসার ছুটি না থাকলে মুশকিল হত। অর্চিনের খাবার নিয়ে মুশকিল।

শেখর গুপ্ত চাপা গলায় বলল, ‘ক’টা দিন আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে কাজ করো অর্চিন।’

অর্চিন চুপ করে রইল। এই কথা থানা থেকে বেরিয়েও বলেছে শেখরদা। এখন আরও ঠান্ডা মাথায় বলছে।

‘নিজের পড়াশোনাটা শেষ করো। তার মধ্যে টুকটাক যেটুকু কাজ করবার করবি। সিচুয়েশন যখন বদলাবে, তখন দেখা যাবে।’

অর্চিন মুখ তুলে বলল, ‘পুলিশের হুমকিতে রাজনীতি ছেড়ে দিতে বলছ শেখরদা?’

শেখর বলল, ‘তা বলিনি, বলেছি কৌশল করে চলতে। পলিটিক্সে কৌশলও মানতে হয়। এখন তোমার চুপচাপ থাকবার সময়। পুলিশ তোমার ওপর নজর রাখছে অর্চিন। এটা বোঝবার চেষ্টা করো। কোনও একটা কেস দিয়ে পুলিশ তোমায় ধরে রাখলে সেটা সুবিধের হবে?’

তমসা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে। বলল, ‘ঠিকই, অর্চিন এখন ক’টা দিন পলিটিক্সের মধ্যে তোমার না থাকাই ভালো।’

অর্চিন বলল, ‘তোমরা তো আছো তমসাদি। তোমরা কি ভয় পেয়ে সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছ?’

শেখর বলল, ‘আমাদের অবস্থানের সঙ্গে তোর অবস্থানের তুলনা চলে না। আমরা কীভাবে পার্টি করি, সবাই জানে। আমাদের দৌড় কতদূর তাও জানে। তোরা ফ্রেশ, আনপ্রেডিক্টেবল। ভয়ঙ্কর গোলমালে কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারিস। নিজেদের নিয়ে চিন্তাভাবনা তোদের কম। পলিটিক্যাল মুভমেন্টে যুক্তির থেকে আবেগকে তোরা বেশি পছন্দ করিস। স্বাভাবিকভাবেই তোদের নিয়ে মাথাব্যথা। সব যুগেই আগে ইয়ংদের ওপর নজর পড়েছে অর্চিন। এটা নতুন কিছু নয়। ছাত্রছাত্রী, যুবকদের নিয়ে রাষ্ট্র সবসময়ই উৎকণ্ঠিত থাকে।’

তমসা বলল, ‘ক’টা দিন চুপচাপ থাকাই ভালো।’

পুলিশ সেরকমই বলেছে। বলেছে, এখনকার মতো কিছু করা হচ্ছে না, কিন্তু নজর রাখা হবে। দ্বিতীয়বার সন্দেহ হলে অ্যারেস্ট করা হবে। ক’দিন আগে পুলিশ যখন সেনবাড়িতে গিয়ে অর্চিনের খোঁজখবর নিয়েছিল, সেদিনই অর্চিন সোজা চলে আসে শেখর গুপ্তর কাছে।

শেখর বলে, ‘দাঁড়া, থানায় আমার একজন চেনা অফিসার আছে। একসময় আমি ওর ঝামেলার বদলি সামলেছিলাম। ভদ্রলোক আমাকে মনে রেখেছেন। তাকে একবার ফোন করি। তোকে কেন খুঁজছে, আগে সেটা বুঝে নিই।’

শেখর গুপ্তকে সেই পরিচিত অফিসার বললেন, সুপর্ণ ভট্টাচার্যর কাছ থেকে খবর নিয়ে জানাবেন। উনিই অর্চিনের বাড়িতে গিয়েছিলেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অফিসার শেখরকে ফোন করেন। অর্চিনের বিরুদ্ধে আর্মস পাচারের অভিযোগ এসেছে। মাসখানেক আগে কৃষ্ণনগরে একটা রেইডে কয়েকটা রিভলভার, কিছু গুলি উদ্ধার করেছে পুলিশ। দুজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তারা অর্চিনের পার্টির অ্যাক্টিভিস্ট। মারদাঙ্গায় থাকে। পার্টি সরকারি ক্ষমতা থেকে সরে গেলেও তারা পার্টি থেকে সরেনি। এদেরই একজন জেরায় জানিয়েছে, কলকাতা থেকে আর্মস পাঠানো হয়। এই সূত্রে বেশ কয়েকজনের নাম তারা বলেছে। তার মধ্যে একজন অর্চিন। সুপর্ণ ভট্টাচার্য কেসটার একটা পার্ট তদন্ত করছে।

শেখর সুপর্ণ ভট্টাচার্যকে বললেন, ‘অর্চিনকে নিয়ে আমি থানায় যাচ্ছি।’

অফিসার বলে, ‘আজ আসতে হবে না। আমি সুপর্ণর সঙ্গে কথা বলেছি। আপনি কাল সকালে ছেলেটাকে পাঠিয়ে দেবেন শেখরবাবু। আমি কথা বলে রাখব।’

শেখর উদ্বিগ্ন গলায় বলে, ‘না, আমিও যাব।’

কমলকান্তি সেনের মৃত্যুর কারণে পরের দুদিন থানায় যাওয়া হয়নি। আজ গিয়েছিল।

সুপর্ণ ভট্টাচার্যই সেনবাড়িতে অর্চিনের খোঁজে গিয়েছিলেন। ঠান্ডা মাথার মানুষ। সম্ভবত কলিগের পরিচিত হওয়ার কারণে বেশি ঠান্ডা ভাব দেখালেন। তবে ঠান্ডা ভাবেই কড়া কথা বলতে ছাড়লেন না।

শেখর গুপ্ত বললেন, ‘আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। অর্চিন রাজনীতি করে ঠিকই, তবে সে একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় সে ফার্স্ট হয়। সে আর্মস পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে না।’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য বলেন, ‘সেটাই তো আমাদের কাছে আশ্চর্যের ব্যাপার। এত ভালো ছেলে এরকম একটা কাজে কীভাবে ইনভলভড হল?’

কেসটা সিআইডি-র। আমাদের ক্রশচেক করবার জন্য পাঠিয়েছে। সেই খোঁজে আমি সরাসরি ওর বাড়িতে চলে যাই।’

অর্চিন বলল, ‘আমি এ সবের কিছুই জানি না।’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য বললেন, ‘তুমি জানো না, কিন্তু যাদের কাছ থেকে অস্ত্রগুলো পাওয়া গেছে, তারা তোমাকে চেনে।’

অর্চিন বলল, ‘রাজনীতি করতে গেলে তো অনেককেই চিনতে হয়। আমি কখনও কৃষ্ণনগরে যাইনি।’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য বললেন, ‘ওরা কলকাতা থেকে গেছে। যাওয়ার সময় আর্মস নিয়ে গেছে।’

এইভাবে আরও খানিকক্ষণ জেরা চলে। শেখর গুপ্ত দু-একবার কথার মাঝখানে ঢোকবার চেষ্টা করলে অফিসার তাকে চুপ করিয়ে দেন। একটা সময় অর্চিনকে বলেন, ‘রাজনীতি-টাজনীতি বাদ দিয়ে লেখাপড়ায় মন দাও। তোমার সামনে ব্রাইট কেরিয়ার। আর্মস কেসে যদি একবার আটকে দিই, গোটা জীবনটাই তো বরবাদ হয়ে যাবে। অত বড় ঘরের ছেলে তুমি। নিজের ভালো-মন্দটা বোঝার চেষ্টা করো। এবারের মতো তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু তোমার ওপর আমাদের নজর রইল। দ্বিতীয়বার সুযোগ পাবে না। অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণ করতে করতে তোমার অনেকটা ক্ষতি হয়ে যাবে।’ তারপর শেখর গুপ্তর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি বোঝান। আমি খবর নিয়ে দেখেছি, আপনার এই শিষ্যটি কিন্তু ক্রমশ উগ্র রাজনীতির দিকে যাচ্ছে। আটকান। হাতে খুব প্রমাণ না থাকলেও আর্মস কেসে আটকে রাখা যায়। শুধু সন্দেহের বশেই আটকে রাখা যায়। আপনার মুখ চেয়ে আর ছেলেটির কেরিয়ারের জন্য করলাম না। আপনারা ভেটেরান পার্টিকর্মী। পার্টি পলিটিক্স নিয়েই থাকবেন। আপনাদের পলিটিক্স ছাড়বার কথা বলে লাভ নেই। এদের বারণ করুন।’

শেখরদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে অর্চিন বুঝতে পারল, তার মুখ তেতো। সে একটা সিগারেট ধরাল। ভালো লাগছে না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। হতাশ লাগছে। অস্থির লাগছে। ঋষার সঙ্গে দেখা করবে? তাতে কি মন খানিকটা শান্ত হবে? বড় রাস্তা পর্যন্ত এসে অর্চিন ঠিক করল সে সল্টলেক যাবে। ঋষা ওখানে পেয়িং গেস্ট থাকে।

বিয়াল্লিশ

একতলা বাড়ির দরজায় তালা ঝুলছে। তার মানে বাড়িতে কেউ নেই। তার পরেও অর্চিন বেল টিপল। কেউ দেখতে পেলে ভাবত, ছেলেটা বিরাট বোকা। দরজায় তালা, তার পরেও বেল বাজাচ্ছে।

ঘটনা কিন্তু তা নয়। দরজায় তালা ঝোলানোর ব্যাপারটা আসলে একটা কায়দা। অচেনা কেউ এলে ভাববে বাড়িতে কেউ নেই। ঋষা আর কৃষ্ণকলি এই কায়দায় চলে। যাতে দুটো কমবয়সি মেয়ের বাড়িতে কেউ এসে জ্বালাতন না করে। সদর দরজার বাইরে থেকে তালা দিয়ে, পিছনের দরজা দিয়ে ওরা যাতায়াত করে। এই গুপ্তকথা ওরা কাউকেই বলেনি। বাইরের ঘরের জানলাও ওরা চট করে খোলে না। ফলে উঁকি মারবারও সুযোগ নেই। দুনিয়া যতই আধুনিক হোক, যতই অ্যাপস আর কন্ডোম আজকাল সহজলভ্য ব্যাপার হোক, মেয়েদের এখনও সাবধানে থাকতে হয়। বাড়ির বাইরে নিজেরা কোথাও থাকলে তো বটেই। সেখানে হুটপাট লোক ঢুকতে দেওয়া যায় না। অচেনা কাউকে তো নয়ই, এমনকী চেনা লোককে অ্যালাও করতে নেই। কৃষ্ণকলি বলে, চেনা লোক বেশি পাজি। তারা ক্ষতি করে বেশি। ঋষাও একমত।

গোড়াতে এই বাড়িতে ঋষা আর কৃষ্ণকলি পেয়িং গেস্ট হিসেবে এসেছিল। দোতলায় ল্যান্ডলেডি থাকেন। তিনি দু’বেলা খাবার ব্যবস্থা করতেন। মাসের শুরুতে টাকা দিলেই হত। রান্নাবান্নার ঝামেলা ছিল না। তার থেকে বড় কথা, বাড়িতে এক ধরনের পাহারা আছে। ল্যান্ডলেডি সল্টলেকের এই ব্লকে শুধু পরিচিত মহিলা নন, ডাকসাইটেও বটে। এক সময়ে স্বামী বড় পুলিশ অফিসার ছিলেন। ফলে স্বামীর সঙ্গে তারও দাপট ছিল। স্বামী মারা গেলেও সেই দাপট কমেনি। আশপাশে সবাই সমীহ করে। মহিলা যে টাকা পয়সার জন্য বাড়িতে পেয়িং গেস্ট রেখেছেন এমন নয়। স্বামীর পেনশন আর সঞ্চয়তেই দিব্যি চলে যায়। তার ওপর মেয়ে ডাক্তার। আমেরিকায় থাকে। সে বারবার মাকে নিয়ে গিয়ে কাছে রাখতে চেয়েছে। মহিলাই রাজি হন না। নিজের বাড়ির বিছানায় না শুলে তার নাকি ঘুম আসে না। দোতলা বাড়ি ফাঁকা পরে থাকবে? এই চিন্তাতেই পেয়িং গেস্ট রাখা। ছেলেরা থাকলে হুল্লোড় হবে। সেই কারণে দুজন মেয়েকে খুব কম টাকাতেই একতলায় থাকতে দিয়েছেন। প্রথম প্রথম রান্নার লোক দু’বেলা রান্না করে নীচে খাবার পাঠিয়ে দিত। কিন্তু পরে ঋষা, কৃষ্ণকলি দুজনেরই বাড়ি ফেরা নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। কে কখন ফিরতে পারবে তার ঠিক নেই। বাইরেও কখনও কখনও ওরা যে যার মতো খেয়ে নিত। শেষ পর্যন্ত বাড়িউলি নিজেই খাবার পাঠানো থেকে সরে গেলেন। এখন ঋষারা রান্না করে নেয়। একেকদিন একেকজন। বাকিটা হোম ডেলিভারি।

এই বাড়িতে যে অল্প কয়েকজনের ঢোকবার অনুমতি আছে অর্চিন তাদের মধ্যে একজন। অর্চিন অবশ্য আসে খুবই কম। ন’মাসে ছ’মাসে একবার। এলে হয় ঋষার সঙ্গে আসে, নয় ফোন করে নেয়।

ঋষা ল্যান্ডলেডির সঙ্গে অর্চিনের আলাপ করিয়ে দিয়েছে। মহিলা অর্চিনকে পছন্দ করছেন। পছন্দ করবার তিন-চারটি কারণ আছে। প্রথম কারণ ছেলেটি তার বান্ধবীর কাছে বুক ফুলিয়ে আসে। কোনও লুকোছাপার ব্যাপার নেই। দ্বিতীয় কারণ, ছেলেটি শান্ত প্রকৃতির। আর সব থেকে বড় কারণ হল, তার এক আত্মীয় অর্চিনের ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। সেখান থেকে তিনি এই ছেলের সম্পর্কে খবর জোগাড় করেছেন। ছেলেটি লেখাপড়ায় অতিশয় ভালো। ল্যান্ডলেডি এই বিষয়ে ঋষাকে গার্জেনের মতো জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন। মহিলাকে ঋষারাও পছন্দ করে। সম্মানও করে। তার এই ধরনের ব্যক্তিগত কৌতূহলে মজা পায়।

‘অর্চিনকে তুমি বিয়ে করবে?’

‘এখনই বলা যাচ্ছে না মাসিমা।’

‘কেন?’

‘পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে।’

‘তোমার বাড়িতে কি জানে তুমি এই ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করো?’

‘না।’

‘সেকী! কেন!’

‘আমার বাড়িতে কঠিন পরিস্থিতি। জেঠা, কাকারা নিজে ছেলে পছন্দ করাটা মেনে নিতে পারবে বলে মনে হয় না।’

‘এটা তো ঠিক নয়। ছেলেমেয়েদের নিজেদের পছন্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার।’

‘আপনি বলছেন মাসিমা, কিন্তু আমার বাড়িতে বলে, এতে নাকি ভুল হয়ে যায়।’

‘তা কেন হবে? ঠিক ভুল যে-কোনও ক্ষেত্রেই হতে পারে। নিজে পছন্দ করো আর বাড়ির লোক খুঁজে এনে দিক। এই দেখো না, আমি যখন তোমার মেসোমশায়ের সঙ্গে মেলামেশা করতাম, বাড়িতে বিরাট আপত্তি। পুলিশের সঙ্গে মরে গেলেও বিয়ে দেওয়া হবে না। কী কারণ? পুলিশের নাকি সামাজিক কোনও জীবন নেই। আমি কি ভুল করেছি? তা ছাড়া মানুষ জীবনসঙ্গী বেছে নেয়, ঠিক ভুলের জন্য নয়, এটা পরীক্ষা নয়। জীবনসঙ্গী হওয়া উচিত বন্ধুর মতো। এমন বন্ধু যাকে নিজের ভালো-মন্দ, দোষ গুণ সব বলা যায়। প্রকাশ্য এবং গোপন সব কথাই সে জানবে মুক্ত মনে। তাকে ভালোবেসে বিয়ে না পছন্দ করে বিয়ে তাতে কিছু এসে যায় না।’

‘দারুণ বলেছেন মাসিমা। কিন্তু আমার বাড়িতে একথা কে বোঝাবে?’

‘দরকার হলে আমি বোঝাব। আমি যাব।’

ঋষা হেসে বলে, ‘খুব ভালো হবে। সময় হলে আপনাকে নিয়ে যাব মাসিমা। তবে কী জানেন, অর্চিন যেমন ছেলে তাতে এই সময়টা চট করে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। আর আমিও বিশ্বাস করি, সঙ্গী মানে বন্ধু। তাকে যে স্বামী বা স্ত্রী হতেই হবে এমন কোনও কথা নেই।’

ল্যান্ডলেডি তিন মাসের জন্য আমেরিকায় মেয়ের কাছে গেছেন। এই কারণে ঋষারা বেশি সতর্ক থাকে। মিথ্যে তালা লাগানোর কায়দা বের করেছে।

অর্চিন এই তালার কায়দাটা ধরে ফেলেছে। একদিন হুট করে চলে এসেছিল। ঋষাকে জানায়নি। দরজায় তালা দেখে প্রথমটায় একটু অবাক হয়। এই সময়টা ঋষার ঘরে থাকবার কথা। তালা দিয়ে কোথায় গেল? মোবাইল বের করে ফোন করতে যায়, তখন চোখে পড়ে দরজার সামানে ঋষার জুতো। এই জুতো পরেই সাধারণত ঋষা বেরোয়। আজ কি তবে অন্য জুতো পরে বেরিয়েছে? হতে পারে। কিন্তু দরজায় তালা দিয়ে বেরোনোর সময় এই জুতোটাই বা বাইরে থাকবে কেন? ভুল করে? নাকি ভিতরে কেউ আছে? এরপর অর্চিন দরজায় চাপ দিল। চাপ দিতেই বুঝল, দরজা ভিতর থেকেও বন্ধ। মোবাইলে ঋষার নম্বর টিপে ছিল অর্চিন।

‘দরজা খোল ঋষা।’

ঋষা অবাক গলাায় বলে, ‘তুই! তুই কোথায় অর্চিন?’

অর্চিন বলে, ‘এই তো, তোদের তালা দেওয়া দরজার বাইরে।’

ঋষা পরে বলেছিল, ‘তুই বুঝলি কী করে আমি ভিতরে আছি?’

অর্চিন বলল, ‘তোর বোকামির কারণে। দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়েছিস, কিন্তু পরবার জুতোটা সরিয়ে রেখেছিস দরজার বাইরে।’

ঋষা জিব কেটে বলেছিল, ইস ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু জুতো তো আমার একটা নয়।’

অর্চিন অবহেলা করে বলেছিল, ‘সেই জন্যই দরজায় ঠেলা দিলাম। দিয়ে বুঝলাম, ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। তখন ফোন করলাম। যাক, ভবিষ্যতে এই বোকামি কোরো না।’

এই কারণেই আজ তালা দেখেও বেল টিপল অর্চিন। তবে শুধু বেল টিপল না, মোবাইল থেকে ঋষাকে টেক্সট পাঠাল।’

‘বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।’

বেলের আওয়াজ শুনে অন্য কেউ এসেছে ভেবে যদি দরজা না খোলে সেই কারণে টেক্সট।

এ বাড়িতে ঋষা আর কৃষ্ণকলির ঘর আলাদা। তবে এতক্ষণ দুজনে ঋষার ঘরেই ছিল। খাটের ওপর বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঋষা ল্যাপটপ ঘাঁটছিল। সে একটা হাফ প্যান্ট আর টি শার্ট পরে আছে। হাফ প্যান্ট নয়, হট প্যান্ট। দৈর্ঘ্যে ছোট। বাইরে চেনা কেউ এই পোশাকে ঋষাকে দেখলে চমকে উঠবে। বাইরে বেরোলে ঋষা কখনওই খোলামেলা পোশাক পরে না। ঋষার টি শার্টের রং কালো। বুকের ওপর সাদায় লেখা—’আমি উড়ে বেড়াই, আমি ঘুরে বেড়াই।’ শঙ্খ ঘোষের কবিতার লাইন। কবিতার নাম ‘তুমি’।

কৃষ্ণকলি পাশে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল। সে পরেছে পালাজোব আর কুর্তি। হাতে পেপারব্যাক। সে হল থ্রিলারের ভক্ত। গল্পের বইতে খুন-জখম সেক্স না থাকলে তার চলে না। বাংলা বই ছুঁয়েও দেখে না কৃষ্ণকলি। ঋষারা যে লিটিল ম্যাগাজিন নিয়ে লাফালাফি করে সে বিষয়ে তার তীব্র আপত্তি। যদিও প্রতি সংখ্যার জন্যই সে ঋষাকে চাঁদা দেয়। আবার ঝগড়াও করে। আজও করেছিল।

‘এই সব ছেলেমানুষি এবার বন্ধ কর ঋষা। লিটিল ম্যাগাজিন ব্যাপারটাই উঠে গেছে। ও সব আজ থেকে বিশ-তিরিশ বছর আগের কনসেপ্ট। প্রাণের আবেগে লেখালেখি বলে এমন কিছু হয় না। লিখব কিন্তু বাজারে তার কোনও দাম পাব না, একথা এখন অর্থহীন। এভরিথিং ইজ মার্কেট। সেক্স কমোডিটি টু পোয়েট্রি।’

ঋষা পায়ের ওপর পা তুলে রেখেছে। তার ছিপছিপে ফর্সা পা দুটো খুবই সুন্দর। সুন্দর পা নাড়তে নাড়তে মেয়েটা বলল, ‘যা বুঝিস না তাই নিয়ে কথা বলিস না কলি। লিটল ম্যাগাজিনের দাম কেনা বেচা দিয়ে হিসেব করা যায় না। এরপর তো বলবি, কবিতা বলে কিছু হয় না। কবিতার কোনও বিক্রি নেই। কবিতা না লিখে ব্রেস্ট অয়েলের বিজ্ঞাপন লেখা উচিত। এক শিশি ব্যবহার করুন, দেখবেন পুরুষ আর চোখ ফেরাতে পারছে না। অথবা ইটস ইওর লাস্ট চান্স। তাই তো? লিটিল ম্যাগাজিন কত ভালো ভালো কল্পনা, ভাবনা, গবেষণার আঁতুরঘর জানিস?’

কৃষ্ণকলি হাই তুলে বলে, ‘বেশি লেখালিখিটাই তো মুশকিল। যে পারছে লিখছে। এত লেখক হওয়ার কারণেই বাংলা গল্প-কবিতার সর্বনাশ হয়েছে।’

ঋষা বলল, ‘আবার না জেনে কথা। হালকা গোয়েন্দা গল্প পড়ছিস তাই পড়। কত বড় বড় কবি, গল্পকাররা লিটিল ম্যাগে লিখেছে তার ঠিক নেই।’

কৃষ্ণকলি বলে, ‘সে লিখতে পারে। কিন্তু সে সব পাস্ট। পুরোনো ইতিহাস। যত বড় কবি গল্পকাররা লিখেছে, তার থেকে অনেক বেশি লিখেছে ফালতুরা। অপাঠ্য লেখা সব।’

ঋষা এবার জোর রেগে গেল। বলল, ‘কে বলল ভালো লেখা সব অতীতে লেখা হত? তুই ক’টা ম্যাগাজিন পড়িস? আমি আনলে উলটে রেখে দিস। এখনও কত ভালো ভালো ম্যাগাজিন বের হয়। নাম বলব?’

কৃষ্ণকলি হেসে বলল, ‘সেসব আর লিটল নেই বাছা, বিগ হয়ে গেছে। তারা লিটলের ফায়দা নেয় আবার বিগের মার্কেট ধরবার চেষ্টা করে।’

ঋষা বলল, ‘তোর সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। আমাদের ম্যাগাজিনের জন্য আর তোকে চাঁদা দিতে হবে না। তুই সি গ্রেডের থ্রিলারগুলো নিয়ে পরে থাক। ওগুলো লিটারেচার? সফট পর্নো। তোর চাঁদায় ম্যাগাজিন বের করলে ম্যাগাজিনের অসম্মান হবে।’

কৃষ্ণকলি বলল, ‘বাঁচালি। আর পয়সা নষ্ট হবে না। তুইও ও-সব থেকে বেরিয়ে আয়। সময় নষ্ট করিস না।’

ঋষা বলল, ‘তোকে ভাবতে হবে না। আমি বুঝব। তুই চুপ কর, আমায় কাজ করতে দে। মেল থেকে কয়েকটা লেখা ডাউনলোড করব।’

এমন সময় বেল বাজল। ঋষা ভুরু কোঁচকাল। কে এল? কৃষ্ণকলি উঠে বসল। এক মুহূর্তের মধ্যেই অর্চিনের ফোন—’আমি দাঁড়িয়ে আছি।’

ঋষা অবাক হয়ে বলল, ‘অর্চিন! এই সময় অর্চিন কেন?’

কৃষ্ণকলি মুচকি হেসে বলল, ‘মনে হয়, প্রেম জেগেছে। দাঁড়া আমি খুলে দিচ্ছি।’

ঋষা কোল থেকে ল্যাপটপ নামাল। খাট থেকে নেমে হাফ প্যান্টের ওপরই একটা পায়জামা গলিয়ে নিল। আয়নার সামনে গিয়ে হাত দিয়ে চুলটা গুছিয়ে নিল। তারপর ড্রইংরুমে গেল। ড্রইংরুমটা সাজানো। সোফা, টেবিল, শোকেস সবই আছে। ল্যান্ডলেডিই সাজিয়ে রেখেছেন। উনি বলেছিলেন, এই ঘরটা মাঝে মাঝে ব্যবহার করবেন। প্রথম দিকে দু-একবার লোকজন এলে বসেওছিলেন। কিন্তু সে কয়েকদিন মাত্র। এখন কেউ এলে ওপরে চলে যায়। অর্চিন সোফায় বসে কৃষ্ণকলির সঙ্গে কথা বলছিল।

‘কী ব্যাপার এবারও তো ফার্স্ট হলে, কই খাওয়ালে না তো?’

অর্চিন শুকনো হেসে বলল, ‘ফার্স্ট হলে খাওয়ানোর কী আছে?’

কৃষ্ণকলি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘বা:, তুমি খুশি হয়েছ, খুশি হলে তো মানুষ খাওয়ায়।’

অর্চিন বলল, ‘কে বলল আমি খুশি হয়েছি?’

‘তা হলে কি দু:খ পেয়েছ?’

অর্চিন বলল, ‘খুশি, দু:খ কিছুই হয়নি। পরীক্ষা দিয়েছিলাম। নম্বর পেয়েছি। বাই চান্স সেই নম্বর অন্যদের থেকে বেশি। ব্যস। এটা নিয়ে লাফালাফি করবার মতো কিছু হয়নি।’

কৃষ্ণকলি বলল, ‘গুডবয়দের এই ঢপবাজিগুলো আমার খুব জানা আছে। এরপর তো ক্যাম্পাসিং-এ বেস্ট অফারটা পেয়ে যাবে। তার পরেই হুস। সে যাও। বড় চাকরি করো। আমাকে খাওয়ালেই হবে।’

অর্চিন হেসে বলল, ‘সে তোমাকে এমনি খাওয়াতে পারি।’

ঋষা ঘরে ঢুকতে কৃষ্ণকলি তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘অ্যাই ঋষা, এক সপ্তাহের মধ্যে অর্চিন আমাকে ভালো রেস্তোরাঁয় যদি না খাওয়াতে নিয়ে যায়, তা হলে কিন্তু আমি একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব। দেখব এ বাড়ির দরজা কে খোলে।’

কৃষ্ণকলি হাসতে হাসতে ঘর ছাড়বার পর ঋষা অর্চিনের উলটো দিকে বসল।

‘কী হয়েছে? হঠাৎ এলি যে?’

অর্চিন বলল, ‘কেন হঠাৎ আসতে পারি না?’

ঋষা তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলল, ‘তা পারবি না কেন? হাজার ডাকলেও তো আসিস না, তাই বলছি।’

অর্চিন চুপ করে রইল। ঋষা বলল, ‘তোকে টায়ার্ড লাগছে।’

অর্চিন অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘একটু টায়ার্ড। সকাল থেকে ছোটাছুটি গেছে।’

‘খেয়েছিস?’

অর্চিন বলল, ‘হ্যাঁ, শেখরদার বাড়ি।’

ঋষা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তোকে দেখে ভালো লাগছে না। ডাক্তার দেখিয়েছিস?’

অর্চিন অবাক হয়ে বলল, ‘ডাক্তার দেখাব না কেন?’

 এই কথার মাঝখানেই কৃষ্ণকলি আবার ঢুকল। এবার সে জিনস টপ পরে সেজেছে। কাঁধে ব্যাগ। হাত নেড়ে বলল, ‘হাই গাইস। আমি মুভি দেখতে চললাম। তোমরা রিল্যাক্স করো। এই যে শ্রীমতী কবিতারাণী, এই গুডবয়টির ঠিকমতো যত্নআত্তি করবেন। তার আগে দয়া করে দরজাটায় তালা লাগিয়ে নিন।’

কৃষ্ণকলি মুখ ফিরিয়ে ঋষার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। নতুন নয়, এই কাণ্ড কৃষ্ণকলি আগেও করেছে। অর্চিন এলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। তাদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। পরে ঋষা ধন্যবাদ জানাতে গেলে গম্ভীরভাবে বলেছে, ‘ধন্যবাদ জানানোর মতো কিছু করিনি। এটাই নিয়ম। উইদাউট সেক্স প্রেম হয় না। নেকামি হয়। ছুকছুকানি হয়। আমি এসব পছন্দ করি না। তোদের চান্স করে দেওয়াটা আমার ডিউটি। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে থাকতে পারতাম। কিন্তু সেটা রিস্কি। ঘর থেকে বেরিয়ে হয়তো দেখলাম, তোরা ড্রইংরুমের সোফায় জামাকাপড় বিসর্জন দিয়ে জড়াজড়ি করে আছিস। সেই দৃশ্য আমার জন্য ঠিক হবে না। তাই বেরিয়ে যাওয়াই বুদ্ধির। খালি বাড়িতে তোরা কীভাবে থাকবি তোদের ব্যাপার।’

ঋষা বাইরে থেকে সদর দরজায় তালা লাগিয়ে ড্রইংরুমে এসে দেখল, অর্চিন সোফার পিঠে মাথা রেখে চোখ বুঁজে আছে। কী হয়েছে ছেলেটার? শরীর খারাপ? নাকি অন্য কিছু? কেমন যেন একটা অস্থির হয়ে আছে। চোখ বুঁজে থাকবার মধ্যেও সেই ভাবটা রয়েছে।

‘চল ঘরে গিয়ে শুবি।’

অর্চিন চোখ খুলল। ঋষা এগিয়ে এসে হাত বাড়াল।

‘আয়।’

অর্চিন ঋষাকে টেনে জড়িয়ে ধরতে গেল। ঋষা হাত ছাড়িয়ে বলল, ‘এখানে নয়, আগে ঘরে আয়।’

তেতাল্লিশ

ঋষা গাঢ় স্বরে বলল, ‘কী হয়েছে?’

অর্চিন বলল, ‘কী হয়েছে নয়, কী হবে তাই ভাবছি।’

ঋষা ঝুঁকে পড়ে অর্চিনের কপালের ভাঁজে চুমু গেল। অস্ফুটে বলল, ‘তোর ভাবনায় চুমু দিলাম।’ তারপর হেসে বলল, ‘খালি ভাবনা আর ভাবনা। এই ভাবুক ছেলেটার প্রেমে পড়ে যত মুশকিল হল আমার।’

অর্চিন চোখ বুজে বলল, ‘তোকে প্রেমে পড়তে কে বলেছে? চারপাশে কত না-ভাবনার ছেলে আছে, তাদের কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে পারতিস।’

ঋষা বাঁ হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ডান হাত দিয়ে অর্চিনের নাক নেড়ে আদুরে গলায় বলল, ‘তুই বলেছিস। তুই দায়ী। আমার কি প্রেমিক পেতে কোনও অসুবিধে ছিল? প্রেম-টেম নয়, কত ছেলে চাইত আমি একবার শুধু মুখ ফিরিয়ে তাকাই।’

অর্চিন চোখ বোজা অবস্থাতেই পা নাড়াতে নাড়াতে বলল ‘তাকালি না কেন?’

‘তুই তাকাতে দিলি কই?’

অর্চিন চোখ খুলে ঋষার মুখের দিকে তাকাল। বলল, ‘এবার দেব।’

ঋষা মুখ নামিয়ে দিল অর্চিনের মুখের ওপর। নিজের নাক দিয়ে অর্চিনের মুখ ঘষতে ঘষতে বলল, ‘বয়ে গেছে।’

পৃথিবীর যাবতীয় প্রেম তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে দেখতে প্রধানত হাস্যকর। প্রেম দেখে কেউ মুচকি হাসেনি, এমন লোক পাওয়া মুশকিল। মুখে না হাসলেও মনে মনে হাসে তো বটেই। সিনেমা, থিয়েটার, গল্পের বইয়ের প্রেমের কথা ধরলে চলবে না। সেসব প্রেম ড্রইংরুমে রাখা বইয়ের তাকের মতো সাজানো গোছানো। কথার সঙ্গে কথা মিলিয়ে কথা, মিলনের সঙ্গে মানানসই করে গান, বিরহের সঙ্গে চোখের জল। আসল প্রেমে এইসব কারসাজি চলে না। কোনও প্রেমিক-প্রেমিকা দাবি করতে পারবে না, তারা ভেবেচিন্তে, কথা বা আচরণ সাজিয়ে প্রেম করতে পারে। হয়তো ভেবে আসে বিস্তর, এমনকী বাড়িতে রিহার্সালও দেয়, কিন্তু আসল সময় সব ভেস্তে যায়। সত্যি প্রেম সবসময়ই এলোমেলো, উলটোপালটা, অসঙ্গতিতে ভরা। তাই দুজনের কাছে মধুর, তিন নম্বর মানুষের কাছে হাসির। প্রেমরত দুজনকে দেখলে মনে হয়, মন দিয়ে বোকার অভিনয় করছে। পাল্লা দিচ্ছে, কার অভিনয় কত ভালো হয়। এই মুখে হাসি, তো এই মুখগোমড়া। এই চোখে মুগ্ধতা, তো এই চোখ কটমট। এই ঠোঁটে আহ্বান, তো এই ঠোঁট ফোলানো। পাহাড়ের আকাশ যেন। সর্বক্ষণ রোদ আর কুয়াশার মারামারি চলছে। প্রেমিক-প্রেমিকার আহ্লাদের কথা কানে এলে তো কথাই নেই। পেট গুড়গুড়িয়ে হাসি আসে। মনে হয়, দুজন মানুষ এমন কিছু কথা একটানা বলে যাচ্ছে, যার কোনও অর্থ নেই। পরম্পরা নেই। এরা পাগল নাকি! আর প্রেমের সঙ্গে যদি সেক্স থাকে, তা হলে মজার ষোলোকলা পূর্ণ। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে, নৈর্ব্যক্তিকভাবে প্রেমোন্মাদ দুই নরনারীর যৌনতা দেখলে সেখানে শুধুই হিউমার। সময় বিশেষে মানুষ যে কতটা অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ করতে পারে তার বোধহয় সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। শুধু অসঙ্গতিপূর্ণ নয়, অবাস্তব। আর সেই কারণেই তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে এই ঘটনা হাস্যকর। বুদ্ধিমান দুজনের বেলায় হাসির সঙ্গে খানিকটা বিস্ময়েরও। সর্বদা যারা ভেবেচিন্তে, আগুপিছু হিসেব কষে, যুক্তি শিক্ষা বোধের ফিতে মেপে চলে, প্রেমের সময় তারাও এ কী কাণ্ড করছে! বুদ্ধিমানের আবেগও নিয়ন্ত্রিত থাকে। এরা যে সেই আবেগকেও জলাঞ্জলি দিয়েছে। শুধু শরীরের নয়, মনেরও যাবতীয় আগল খুলে ফেলেছে। হাসি না পেয়ে উপায় আছে?

মজার কথা হল, যারা প্রেম করে, তারা তৃতীয় ব্যক্তির হাসি নিয়ে কখনও মাথা ঘামায় না। কে কী ভাবল, কে কী বুঝল, তাতে ভালোবাসায় মেতে থাকা নরনারীর কিছু যায় আসে না। তাদের যুক্তি, বুদ্ধি, বোধ তাদেরকে বলে, ‘তোমরা শুধু ভালোবাসো, শুধু ভালোবাসো এবং শুধু ভালোবাসো’। সেই ভালোবাসা, তাকে সাজানো বইয়ের থেকে টেবিলে উজাড় করে রাখা অগোছালো বইপত্তর হতে বেশি মজা পায়। যেখানে একচোটে কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। হাসি, রাগ, অভিমান কিচ্ছু না। হাতড়াতে হবে, উলটোপালটে, টেনেহিঁচড়ে, ফেলে-ছড়িয়ে দেখতে হবে। ধীরে ধীরে সব পাওয়া যাবে। যা চেয়েছিল, যা চাওনি সব। কখনও কখনও চরম মুহূর্তে মনের সঙ্গে শরীরও আসবে।

ঋষা আর অর্চিন এইমাত্র শরীরের ভালোবাসা শেষ করেছে। এখন তার ঘোর নিয়ে বসে আছে। দুজনের জামাকাপড় খাটের পাশে, মেঝেতে পড়ে আছে। অর্চিন ঋষার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। তার বুক পর্যন্ত চাদর। সেই চাদরের মধ্যেই ঢুকে বসে আছে ঋষা। চাদর এবং অর্চিনে কোমর পর্যন্ত ঢাকা পড়েছে। কিন্তু বাকি শরীর তার উন্মুক্ত। মাথার চুল মাঝে মাঝে কাঁধ, বুক, পিঠের সামান্য অংশ ঢাকছে। না ঢাকবারই মতো। সেদিকে খেয়াল নেই ঋষার। সে এখন শরীরে আদরের ক্লান্তি নিয়ে অর্চিনের সঙ্গে আবেগ-আহ্লাদের খুনসুটি করছে। তার চোখে মুখে চুলে হাত বুলিয়ে, চুমু খেয়ে আদর করছে। মেয়েরা অপ্রিয় মানুষের কাছে মন ও শরীর দুটোই শক্ত করে নিতে জানে। মনে বর্ম বেঁধে নেয়, শরীরে লাগিয়ে নেয় কাঁটা। সেই বর্ম ও কাঁটা ভেদ করা অসম্ভব হয়। যদি কোনও পুরুষ জোর করে, সে হয় কিছুই পায় না, তারপরেও প্রেমিক, স্বামী বা ধর্ষক হিসেবে জোর করে কিছু আদায় করে তা হয় ক্ষতবিক্ষত। এই মেয়েই আবার প্রিয় মানুষের জন্য সব বর্ম খুলে ফেলে, উপড়ে ফেলে কাঁটা।

ঋষাকে এখন দেখলে তেমনটাই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে শরীর আর মনের সব বাধা ছুড়ে ফেলে অর্চিনের কাছে পরম ভরসা, ভালোবাসায় নিজেকে সর্মপণ করে বসে আছে।

অর্চিন চেয়েছিল। আদর চেয়েছিল ঋষার। অস্থির মন নিয়ে শেখরদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে বুঝেছিল, শুধু মন নয়, শরীর থেকেও অস্থিরতা দূর করতে হবে। তারপর ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঋষা অর্চিনকে বুঝতে পেরেছিল। ড্রইংরুম থেকে ঘরে নিয়ে। আজ প্রথম নয়, এর আগেও একবার শরীরে মিলেছে তারা। সেটা ছিল একেবারেই হঠাৎ করে। পরের পিরিয়ড পর্যন্ত ভয়ে ভয়ে ছিল। তারপর থেকে ঋষা সাবধান থাকে। নিজের কাছে ‘ব্যবস্থা’ রাখে। কৃষ্ণকলি শিখিয়েছে।

‘এরপর থেকে প্রাোটেকশন সঙ্গে রাখবি।’

ঋষা লজ্জা পেয়ে বলেছিল, ‘দুর, ও একবার হয়ে গিয়েছিল।’

কৃষ্ণকলি সিরিয়াস মুখ করে বলেছিল, ‘আবার একবার হতে পারে।’

ঋষা বলেছিল, ‘তুই বাজে বকা থামা তো। বেশি গার্জেনগিরি ফলাস না।’

কৃষ্ণকলি বলেছিল, ‘এখন বাজে বলছিস, পরে কাজের বলবি। যা বলছি কর। গার্জেনরা বারণ করে, বন্ধুরা উৎসাহ দেয়। যাতে নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে পারে।’ এই পর্যন্ত বলে কৃষ্ণকলি নাটকীয় ভঙ্গিতে গান ধরেছিল।

‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি যেন না করি ভয়…।’

ঋষা হেসে বলেছিল, ‘তুই থামবি? নাকি মার খাবি? আমার কিচ্ছু লাগবে না।’

কৃষ্ণকলি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল, ‘বাঙালি মেয়েদের এই হল সমস্যা। হয় মন মন বলে হেদিয়ে পড়ল, নয় প্রেগন্যান্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে রইল। শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাই। শরীর ব্যাপারটা জানতেই পারে না। ভোগ করতে পারা তো দূরের। আর পারল না বলে, বানিয়ে বানিয়ে নানা ধরনের সোশ্যাল মরাল ট্যাবু তৈরি করল। সবাই মিলে ঘাড়ে চেপেও বসল। বাঙালি ললনারা নিজের শরীরকে যদি ঠিকমতো উপভোগ করতে দিত, তারা সত্যি দাম বুঝত, পুরুষমানুষদের এত নোংরামি, দাপট থাকত না। ওরা মানসিকভাবেই সিঁটিয়ে থাকত। ভোগ করার কথাই ভাবতে পারত না।’

ঋষা হেসে বলল, ‘বাপরে, কী লেকচার। তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, প্রাোটেকশনই বাঙালির মেয়েদের শক্তির হাতিয়ার।’

কৃষ্ণকলি বলেছিল, ‘হাসতে পারিস, কিন্তু ঘটনা সত্যি। প্রাোটেকেশন এখানে সিম্বলের মতো। সমাজ, রাষ্ট্র, নারীবাদীরা আমাকে কি পাহারা দেবে? আমি কি অবলা? আমার প্রাোটেকশন আমার কাছে?’

ঋষা হাততালি দিয়ে বলেছিল, ‘খুব হয়েছে। এবার আপনি থামুন ম্যাডাম।’

মুখে যাই বলুক, তারপর থেকে ঋষা নিজের কাছে ‘ব্যবস্থা’ রাখে। নিজেকে সবলা প্রমাণ করবার জন্য নয়, গোলমাল থেকে বাঁচতে। আজও ছিল। অর্চিনের আদর করবার কায়দাটা বড় সুন্দর। তার নিজের চরিত্রের মতো। বাইরেটা ধীরস্থির, নরমসরম। ভিতরে কঠিন। আগের বারের মতোই অনেকটা সময় নিয়েছে। প্রতি মুহূর্তে ব্যাকুল করে তুলেছে ঋষাকে। সবশেষে শরীরে তৃপ্তি আর ক্লান্তি নিয়ে এই গল্প করাটাও দারুণ লাগে। মনে হয়, এখনও অর্চিনের আদর শেষ হয়নি। ঋষাকে অর্চিনই প্রথম পছন্দ করে বসে। ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের ফাংশন ছিল। ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে থাকবার কারণে, অর্চিন সেই ফাংশানের ব্যবস্থাপনায় ছিল। স্টেজের দায়িত্ব ছিল তার। কারণ, কী হবে, কতক্ষণ থাকবে—এইসব। ফার্স্ট ইয়ারে একটি রোগাপাতলা চেহারার মেয়ে স্টেজে আবৃত্তি করতে উঠল।

‘আমি একটি মেয়েকে জানি

যে তার বেকার প্রেমিককে ছেড়ে যেতে পারেনি এখনও

আমি এক কিশোরকে জানি

পাঁচ গোল খাওয়া দলের যে হচ্ছে একজন সমর্থক

আমি এক যুবাকে চিনি

বৃদ্ধ পিতাকে যে আজ পৌঁছে দিতে পারেনি বৃদ্ধাশ্রম

আমি এক প্রৌঢ়াকে জানি

নির্বাচনে গোহারা হেরে যাওয়া দলের পতাকা

তিনি কাঁধ থেকে নামাতে পারেননি এখনও…।’

থমকে গিয়েছিল অর্চিন। সে কবিতা-টবিতা শোনবার লোক নয়। তার পরেও মেয়েটির আবৃত্তি তাকে থমকে দেয়। অর্চিন ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকে উইংসের পাশে। মেয়েটির কী নাম যেন ঘোষণা হল?

পরদিনই মেয়েটিকে ধরে অর্চিন।

‘আমি তোমার নাম জানতে পারি?’

‘অবশ্যই পারেন। আমার নাম ঋষা। ঋষা রায়।’

অর্চিন বলে, ‘কাল নবীনবরণ অনুষ্ঠানে তুমি যে কবিতাটি পড়লে, সেটা তুমি কবে লিখেছ?’

ঋষা তাড়াতাড়ি বলে, ‘না না, ওটা আমার নয়। কবিতাটি অংশুমান করের লেখা। অংশুমানবাবু অনেক ভালো ভালো কবিতা লিখেছেন।’

অর্চিন মনে হয় একটু আশাহত হল। সম্ভবত সে ভেবেছিল কবিতাটি মেয়েটির লেখা। ফলে তার সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, তাতে একটু চিড় খেল। অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ‘ও।’

ঋষা উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘অংশুমান করের আরও অনেক ভালো ভালো কবিতা আছে।’

অর্চিন নিরুৎসাহ গলায় বলল, ‘আচ্ছা।’

ঋষা এত সহজে ছাড়তে চাইল না। তার পছন্দের কবি সম্পর্কে এই সুন্দর ছেলেটিকে আরও দু-কথা শোনাতে চাইল।

অর্চিনের হালকা কৌতূহল হল। মেয়েটি নতুন ইউনিভার্সিটিতে এলেও আড়ষ্টতা নেই। অচেনা সিনিয়রের সঙ্গে দিব্যি কথা বলছে।

‘আমি একটা অন্য কবিতা বলতে চেয়েছিলাম।’

‘বললে না কেন?’

ঋষা রাগ রাগ গলায় বলল, ‘কবিতাটা একটু বড়। বড় কবিতা বলব শুনে ইলেকট্রনিক্স না মেকানিক্যালের এক দিদি কড়া গলায় বলল, বলা যাবে না। বেশি সময় লাগবে। অনেকে আছে। সবাইকে সুযোগ দিতে হবে। বারণ আছে। আমি রেগে গিয়ে বললাম, কে বারণ করেছে? সে তখন অর্চিন না কী যেন একটা নাম বলল। সে কে? পরে শুনলাম, ওই অর্চিন নাকি এখানে পলিটিক্স করে। মজার কথা কী বলুন তো, যারা রাজনীতি করে তারা কবিতাকে বিচার করে লেন্থ দিয়ে। কবিতা দিয়ে নয়। এরকম একটা বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে যে এমন বোকা ছেলে আছে, আমার জানা ছিল না।’

অর্চিনের খুব মজা লাগল। সে হেসে ফেলল। বলল, ‘খুব রেগে আছ মনে হচ্ছে।’

ঋষা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘রাগব না! আমার ভালো লাগার কবিতা বলতে পারলাম না। না হয় দুটো কবিতাই বলতাম।’

অর্চিন বলল, ‘আচ্ছা অর্চিনের সঙ্গে দেখা হলে আমি তাকে বলে দেব, ভবিষ্যতে এরকম বোকামি যেন সে না করে। অবশ্য জানি না, সে শুনবে কিনা। বোকারা শুধু কবিতা নয়, কথাও শুনতে চায় না।’

অর্চিন চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। মেয়েটি ইন্টারেস্টিং। একে রাজনীতিতে আনতে হবে।

ঋষা বলল, ‘আমার আবৃত্তি ভালো লাগবার জন্য ধন্যবাদ।’

অর্চিন থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সরি। তোমার বলা আমার ভালো লাগেনি ঋষা। এমন একটা জোরালো কবিতা, অমন মিনমিন করে বলা উচিত নয়। কবিতা ভালো লাগলেই হয় না, তাকে বিশ্বাস করতে হয়। নইলে ঠিকভাবে বলা যায় না।’

সুন্দরী ঋষার মুখ শুকিয়ে গেল।

‘আপনি আবৃত্তি করেন?’

অর্চিন হেসে বলল, ‘কখনওই নয়। আমি কবিতাও পড়ি না। তেমন পছন্দও করি না।’ একটু থমকে হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে বলল, ‘যাই ক্লাস আছে।’

ঋষা মুখ লাল করে বলেছিল, ‘আপনি কবিতা পড়েন না, পছন্দ করেন না, তার পরেও আবৃত্তি নিয়ে বলছেন। আশ্চর্য! আপনার নামটা কি জানতে পারি।’

অর্চিন হেসে বলেছিল, ‘অবশ্যই পারেন। অর্চিন। ইলেক্ট�নিক্স সেকেন্ড ইয়ার। চলি তাহলে?’

ঋষার রাগ অপমান প্রেমে বদলে যেতে বেশি দেরি হয়নি। তবে সে কিছুতেই রাজনীতিতে ঢোকেনি। লেখাপড়া ছাড়া লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে থেকেছে। অর্চিন প্রথম দিকে দু-একবার বলেছিল। প্রথম প্রথম ‘আপনি’, ‘তুমি’ সম্বোধনে পরিচিতি পর্ব চললেও, বয়েসের ছোট-বড়র বাধা বিভিন্ন। ছোট-বড়র বাধা ডিঙিয়ে দুজনেই খুব দ্রুত ‘তুই’-এর সম্পর্কে সহজ হয়েছে।’

ঋষা চুল সরিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘অ্যাই ছেলে, তোর কী হয়েছে?’

অর্চিন স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ঋষা, আমি চলে যাব।’

ঋষা সোজা হয়ে বসল, অর্চিনের গলার এই জোর সে চেনে।

‘কোথায় যাবি?’

‘আমি গ্রামে চলে যাব। গ্রামে গিয়ে রাজনীতি করব।’

ঋষা বলল, ‘তুই কি পাগল? পড়া শেষ করলেই তো কত ভালো চাকরি তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে। আর তো মোটে একটা বছর। একটা বছর পরে এসব ভাবলে হত না?’

এসব কথা শুনলই না অর্চিন। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘শেখরদারা পর্যন্ত বদলে যাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে। আমরা সবাই ভয় পেলে কী করে হবে ঋষা? হবে না। আমি গ্রামে যাব। সেখানে সংগঠন করব। রক্তিম, বন্দনারা তো গেছে। ওরা যদি পারে, আমি পারব না কেন? এখানে থাকলে আমি শেষ হয়ে যাব। বড় চাকরি, বড় উপার্জন আমাকে সিস্টেমের মধ্যে ঢুকিয়ে আমার যাবতীয় বিশ্বাস নীতি আদর্শকে ছিবড়ে করে দেবে। ছিবড়ে করতে না পারলে আমাকে ভয় দেখাবে, মিথ্যে অভিযোগে জেলে পুরে দেবে। এই সিস্টেম থেকে পালাতে হবে। এই বয়েসে যদি না পারি, এই সময়ে যদি না পারি, আর কবে পারব?’

ঋষা চুপ করে বসে রইল। সে বুঝতে পারছে, অর্চিনকে আটকানো যাবে না। সবাইকে আটকানো যায় না। লোভ, ভয়, ভালোবাসা কিছু দিয়েই আটকানো যায় না। আটকাতে নেই।

একসময় অর্চিন হাত বাড়িয়ে ঋষার গাল ছুঁল।

‘আমি যাই ঋষা? তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো?’

ঋষা অর্চিনের মুখের ওপর মুখ নামাতে নামাতে বলল, ‘যাও। আমি অপেক্ষা করব।’

পরম শান্তি আর ভালোবাসায় অর্চিনবাবু ঋষাকে বুকের ওপর টেনে নিল।

চুয়াল্লিশ

মণিকুন্তলা ঘরে ঢুকে স্বামীর দিকে ভাঁজ করা একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন। লম্বা কাগজ। বিমলকান্তি বললেন, ‘কী এটা?’

মণিকুন্তলা বললেন, ‘পড়ে দেখো।’

বিমলকান্তি কাগজের ভাঁজ খুললেন। চোখ ওপর থেকে নীচে নামালেন। তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি মুখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মণিকুন্তলা চুপ করে রইলেন।

কমলকান্তি সেনের মৃত্যুর ঘটনা বাড়ির সকলেই মোটামুটি সামলে নিয়েছে। মণিকুন্তলার সময় লাগছে। পুরোটা স্বাভাবিক হতে পারছেন না। ঘুরেফিরে মানুষটার কথা মনে পড়ে। কমলকান্তি সেন শুধু তাঁর শ্বশুরমশাই ছিলেন না, বন্ধু ছিলেন। তার থেকে বেশিও হতে পারে। মেয়েরা তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করে।

বারিধারা বলে, ‘মা, দাদু কিন্তু মুখ গোমড়া করে থাকা মোটে পছন্দ করত না। দাদু যদি বেঁচে থাকত, তোমাকে ধমক দিত।’

মণিকুন্তলা হেসে বললেন, ‘আমি মুখ গোমড়া করে আছি কোথায়? এই তো হাসছি।’

মেঘবতী বলে, ‘এটা তোমার আসল হাসি নয়, নকল হাসি।’

মণিকুন্তলা মেয়েদের দিকে তাকিয়ে আবার হাসেন। বলেন, ‘দুর হাসি হাসি-ই। তার আবার আসল নকল কী? আমি কি অভিনয় করি যে, বানিয়ে হাসব?’

বারিধারা বলে, ‘দাদুর চলে যাওয়া আমরা কেউ মেনে নিতে পারি না, কিন্তু এটা তো ইনএভিটেবল ছিল।’

মেঘবতী বলল, ‘সত্যি কথা বলতে, মানুষটা সুস্থ শরীরে যেতে পারলেন, এটাও একটা ভালো কথা। কত মানুষ তো রোগে দীর্ঘ দিন কষ্ট পায়। সেটা আমাদের সকলের জন্য বেশি খারাপ হত।’

বারিধারা বলল, ‘দাদু শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করেছে। একটু পরে রোদ উঠবে-র প্রাোজেক্ট রিপোর্ট তৈরি করেছে। এই বয়সে অমন একটা রিপোর্ট তৈরির কথা ভাবা যায়! সবদিক খেয়াল রেখেছে।’

মেঘবতী বলল, ‘মা, এবার তুমি মন শক্ত করো।’

বারিধারা বলল, ‘হ্যাঁ, এবার ঠিক না হলে মুশকিল। একটু পরে রোদ উঠবে-র কাজ শুরু করতে হবে না? তোমাকে মেজর দায়িত্ব নিতে হবে মা।’

মেঘবতী বলল, ‘জ্যোতিষ্ক বলেছে চাকরি ছেড়ে দেবে। তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হবে।’

বারিধারা বলল, ‘একটু পরে রোদ উঠবে প্রাোজেক্টের মধ্যে দিয়ে দাদু আবার বেঁচে উঠবে।’

মণিকুন্তলা সামান্য হাসলেন। মেয়েরা তাঁর মন ভালো করার চেষ্টা করছে। জোর করে হবে না। সময় লাগবে। ওরা জানে না, কমলকান্তি সেন কী ভয়ঙ্কর একটা সময় তাদের মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। জানলে বুঝত, এখনও কেন মানুষটাকে মন থেকে সরাতে পারছেন না। মেয়েরা এই জিনিস জানবেও না। মায়ের অতীত প্রেমের কথা মেয়েদের জানার দরকার নেই। জেনেছিলেন কমলকান্তি সেন। জানার পর অত বড় কোম্পানির মালিক, অমন দাপটের একজন মানুষ পরম মমতা নিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মাথায় হাত রেখেছিলেন। এই সমর্থন না পেলে মণিকুন্তলাকে সেদিন হয় আত্মহত্যা করতে হত, নয়তো এই সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হত। আধুনিক চিন্তা, যুক্তি, মানুষকে বুঝতে পারার গভীর ক্ষমতা দিয়ে কমলকান্তি সেদিন পুত্রবধূকে ঘিরে রেখেছিলেন। তাকে বুঝিয়েছিলেন, যা ঘটেছে তাতে কোনও অপরাধ নেই। মণিকুন্তলার মনে হয়, আজ যারা আধুনিকতার বড়াই করে, তাদের সেই ঘটনা জানা উচিত। বোঝা উচিত, আধুনিকতা মানে জামাকাপড় খুলে ঘুরে বেড়ানো নয়, আধুনিকতা মানে মনের ভেতর থেকে সত্যকে উপলব্ধি করা।

তখন বিয়ের সবে এক বছর হয়েছে। একদিন দুপুরে খেতে বসে কমলকান্তি সেন বললেন, ‘কী হয়েছে মা? এত চিন্তা কীসের?’

মণিকুন্তলা শুকনো মুখে বলেছিলেন, ‘কিছু হয়নি।’

কমলকান্তি স্বাভাবিক গলায় বলেছিলেন, ‘কিছু না হওয়া ভালো না। মাঝে মাঝে কিছু হলে তবেই বোঝা যায় বেঁচে আছি। সেটা ভালোও হবে। মন্দও হবে।’

মণিকুন্তলা চুপ করে রইলেন। তিন দিন স্বামী তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন না। না বলার কারণ আছে। শনিবার বিকেলে দক্ষিণ কলকাতার এক নার্সিংহোমে গিয়েছিলেন মণিকুন্তলা। বাড়ির কাউকে বলেননি। তিনি গিয়েছিলেন কৌরবকে দেখতে। কৌরব অসুস্থ হয়ে সেখানে ভর্তি আছে। তার কঠিন ধরনের জন্ডিস হয়েছে। কৌরব এক বান্ধবীকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিল।

‘বাঁচব কি না ঠিক নেই, মণি যদি একবার আসে।’

যাব না, যাব না, এখন আর যেতে নেই। বারবার ভেবেছিলেন মণিকুন্তলা। তার পরও শনিবার বিকেল চারটের সময় তৈরি হয়ে নিলেন। নি:শব্দে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন একরকম চুপিচুপিই। অতটা চুপিচুপির দরকার ছিল না। কাজের লোকজন, দারোয়ান ছাড়া এই সময় সেনবাড়িতে কেউ থাকে না। মণিকুন্তলা ট্যাক্সিতে উঠে বুঝতে পারেন, কাজটা ঠিক হল না। এখন তিনি বিবাহিত। সেনবাড়ির বউ। কৌরব এখন আর তাঁর কেউ নয়। এক সময় ভালোবেসেছিলেন এটা সত্য, তার বেশি নয়। ট্যাক্সি কি ঘুরিয়ে নেবেন? তাই উচিত।

এই পর্যন্ত ভেবেও ট্যাক্সি ঘুরিয়ে নিতে পারেননি মণিকুন্তলা। শান্ত, নিস্তরঙ্গ, শুকিয়ে আসা ছোট নদীতে চোরা টান তৈরি হয়। সেই টান ওপর থেকে বোঝা যায় না। নদীও পারে না। সর্বনাশের টান। যা অমোঘ, অবশ্যম্ভাবী। মানুষ বা প্রকৃতিকে এই আকর্ষণ অস্বীকার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। এর কাছে আত্মসমর্পণই একমাত্র উপায়।

কৌরবের বেডের সামনে গিয়ে মণিকুন্তলা বুঝতে পেরেছিলেন, ভালোবাসা কখনও পুরোনো হয় না। সে ভুলে যায়, কিন্তু বেঁচে থাকে। সে হারিয়ে যায়, কিন্তু টিকে থাকে। বেডের সঙ্গে মিশে যাওয়া কৌরবের একটা হাত চেপে ধরেছিলেন মণিকুন্তলা। তাঁর চোখে জল এসেছিল। সেই জলের খেয়াল ছিল না, মণিকুন্তলা এখন আর কলেজে পড়া, বিনুনি ঝোলানো মেয়ে নন। তিনি কলকাতা শহরের একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের বউও। সেদিন নিজেকে সামলে নিতে সময় লেগেছিল মণিকুন্তলার। তিনি জানতে পারেননি, একটু দূরেই তাঁর স্বামী বিমলকান্তি বিস্মিত হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনিও নার্সিংহোমে এসেছিলেন এক পরিচিত রোগীকে দেখতে। এসেছিলেন অফিসের ফাঁকে। নববিবাহিত স্ত্রীকে এভাবে একজন অপরিচিত যুবকের হাত ধরে কাঁদতে দেখে তিনি এতটাই হতচকিত হয়ে পড়েছিলেন যে, ডাকার কথাও মনে পড়েনি। সম্ভবত তাঁর ভেতর থেকে কেউ বারণ করে—ডেকো না, এই সময় ডাকতে নেই।

নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে মণিকুন্তলার সংবিৎ ফিরে আসে। তিনি যেমন নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করেন, তেমন ভয় পান। কেউ দেখে ফেলল না তো? দ্রুত পায়ে রাস্তা পেরিয়ে ট্যাক্সি খুঁজতে থাকেন। জানতেও পারেন না, রাস্তার ওপরই সেনবাড়ির গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর হাত-মুখ ধুয়ে চা খেতে খেতে বিমলকান্তি বলেছিলেন, ‘লোকটা কে?’

মণিকুন্তলা চমকে উঠে বলেছিলেন, ‘কোন লোক?’

‘সাউথ পার্ক নার্সিংহোমে আজ যার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে, সেই লোকটা কে?’

মণিকুন্তলা চুপ করে থেকে বলেছিলেন, ‘তুমি কী করে জানলে?’

বিমলকান্তি আরও গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, ‘আমিও তখন ওখানে ছিলাম। তোমার থেকে খানকতক বেড দূরেই ছিলাম।’

মণিকুন্তলার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি ঢোঁক গিলে বললেন, ‘কই দেখতে পাইনি তো!’

বিমলকান্তি ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ‘দেখবে কী করে? যেভাবে পেশেন্টের হাত ধরে ছিলে এবং কাঁদছিলে, তাতে স্বামীকে দেখতে পাওয়া যায় না।’

‘ডাকলে না কেন?’

‘ডাকব কী করে? প্রায় ছুটেই তো বেরিয়ে গেলে। আমি পিছু পিছু গিয়ে দেখলাম, রাস্তা পার হয়ে লাফ দিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়লে। যেন বিরাট অন্যায় কিছু করেছ।’

মণিকুন্তলা এবার কঠিন গলায় বললেন, ‘অন্যায়! অন্যায় করব কেন! তুমি কী বলতে চাইছ?’

বিমলকান্তি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘কিছুই না। শুধু জানতে চাইছি, লোকটা কে? বলতে ইচ্ছে না করলে বোলো না।’

মণিকুন্তলা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমার পরিচিত। বিয়ের আগে থেকে পরিচয়। অসুখ শুনে দেখতে গিয়েছিলাম।’

বিমলকান্তি হাতের চায়ের কাপ নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বললেন, ‘এতে লুকোচুরির কী আছে? বাড়ির গাড়ি নিয়ে গেলেই পারতে। বিয়ের আগে যার সঙ্গে পরিচয়, তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে স্বামীর গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না, এমন কোনও নিয়ম নেই। মণিকুন্তলা, তুমি বোধহয় এতদিনে জেনে গেছ, আমি সব কাজেই সিরিয়াসনেস পছন্দ করি। সেটা অন্যায়, অনুচিত হলেও।’

ব্যস, এইটুকু বলেই বিমলকান্তি চুপ করে যান। কমলকান্তি সেন পুত্রবধূর মুখ দেখে আঁচ করেছিলেন।

‘বুঝলে মণিকুন্তলা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া ভালো লক্ষণ। এতে সংসারের জোর বাড়ে। ভয়টা কী জানো মা, আমার গাধা ছেলেটা আবার সবকিছু অতিরিক্তি সিরিয়াসভাবে নেয়। এতেই সমস্যা।’

মণিকুন্তলা একটু চুপ করে রইলেন। তিন দিন ধরে অসম্ভব মন:কষ্টে ভুগছেন। পাপবোধ মনের ভেতর বড় হচ্ছে। দৈত্যের আকার নিচ্ছে। মনে হচ্ছে, বিরাট একটা অন্যায় হয়ে গেছে। বিমলকান্তি নিশ্চয় এতক্ষণে সব জেনে গেছেন। জেনে গেছেন, তাঁর স্ত্রী প্রেমিকের সঙ্গে গোপনে দেখা করতে গিয়েছিল। ছি ছি। এর পরিণতি কী? সেনবাড়ি ছাড়তে হবে? তা হলে তো গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় থাকবে না। এই কথা শ্বশুরমশাইকে কি বলা যায়? যায় না। কিছুতেই যায় না। তার পরেও মনে হচ্ছে, এই মানুষটাই তাঁর শেষ সম্বল।

মণিকুন্তলা মাথা নামিয়ে বলেছিলেন, ‘বাবা, একটা অন্যায় করে ফেলেছি। খুব বড় অন্যায়।’

কমলকান্তি মুখ তুলে পুত্রবধূর দিকে তাকালেন। মেয়েটার চোখ ছলছল করছে।

‘খাওয়া শেষ করি। তার পর তোমার অন্যায় শুনব মা। তরকারিটা আজ বড্ড চমৎকার হয়েছে। ভাগ্যিস বয়স হয়েছে, আর সেই ছুতোয় অফিস থেকে লাঞ্চ করতে বাড়ি আসতে পারি। বয়স কম ছিল যখন, তখন তো পারতাম না। হাবিজাবি খেতে হত। বিমলের এখন যা অবস্থা। বেটা ক্যান্টিনের ছাইভস্ম খায়, আর বাবাকে হিংসে করে।’

কথাটা বলে গলা তুলে হেসে উঠলেন কমলকান্তি। মণিকুন্তলা বুঝতে পারলেন, এই চমৎকার মানুষটা ইচ্ছে করে খাওয়ার প্রসঙ্গ আনছেন। ভাবটা এমন, যেন পুত্রবধূর অন্যায়ের থেকে তরকারি তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে মানুষটা খাওয়া নিয়ে ভাবনাচিন্তাই করেন না, যা দেওয়া হয় তা-ই চুপ করে খেয়ে নেন, তিনি তরকারি নিয়ে এত ভাববেন কেন?

চোখ বুজে ঘটনা শুনলেন কমলকান্তি।

‘মণিকুন্তলা, তোমাকে ক’টা কথা জিগ্যেস করব। তুমি কি মা সঠিক উত্তর দেবে?’

মণিকুন্তলা মাথা নামিয়ে বললেন, ‘দেব।’

‘তুমি কি আমাকে বন্ধু বলে মনে করো?’

মণিকুন্তলা কান্না চেপে বললেন, ‘করি বাবা, করি বলেই তো আপনাকে ঘটনাটা বলতে পারলাম। এটা কি শ্বশুরমশাইকে বলার মতো?’

কমলকান্তি বললেন, ‘তোমাকে কি বিমলের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে?’

মণিকুন্তলা মুখ তুলে বললেন, ‘না! ওই ছেলেটি বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহী ছিল না। তা ছাড়া ওর সংসার করার মতো অর্থিক সামর্থ্য নেই। তার পরেও আমি বলেছিলাম। ও রাজি হয়নি। আমি সম্পর্ক ত্যাগ করি।’

কমলকান্তি বললেন, ‘তুমি কি ওই ছেলেটিকে এখনও ভালোবাসো?’

মণিকুন্তলা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘হ্যাঁ, বাসি। তবে তার প্রাপ্য যেটুকু সেটুকুই বাসি। কোনও যোগাযোগ রাখি না। অসুখের খবর শুনে তাকে দেখতে চলে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। আমি স্বীকার করছি, আমার অন্যায় হয়েছে। আমি কি আপনার ছেলেকে এ কথা বলব?’

কমলকান্তি এবার সোজা হয়ে বসলেন। গলায় জোর এনে বললেন, ‘আলবাত ঠিক হয়েছে। বেশ করেছ তাকে দেখতে গেছ। কীসের অন্যায়? অন্যায় কে ঠিক করবে? ভালোবাসা কি অন্যায়?’

মণিকুন্তলা চমকে উঠেছিলেন। মানুষটা এসব কী কথা বলছেন!

‘বাবা, এ আপনি কী বলছেন?’

কমলকান্তি বললেন, ‘ঠিক বলছি। তোমার বিয়ে হয়েছে বলে, তোমার যাবতীয় সুখ-দু:খ-ভালোবাসা-কষ্ট রাস্তায় ফেলে দিয়ে এ বাড়িতে ঢুকতে হবে নাকি? তুমি ওই ছেলেটাকে ভালোবাসো, এর মধ্যে কোনও অপরাধ নেই। পরিস্থিতি বদলেছে। তুমি আর আগের মণিকুন্তলা নেই। তুমি এখন এ বাড়ির বউ, গৃহকর্ত্রী। আগে যে আচরণ তুমি করতে পারতে, এখন তা পারো না। অনেক লিমিটেশন আছে। তার মানে এই নয়, তুমি কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। বাইরের মানুষকে তো তুমি তোমার ঘরে এনে তুলছ না। তার ঘরেও তুমি যাচ্ছ না। তাকে তার মতো করে ভালোবাসছ। বেশ করেছ। আমার তো তোমাকে হিংসে হচ্ছে মা। ইস, আমার কোনও ভালোবাসার মানুষ নেই কেন?’

মণিকুন্তলা আর নিজেকে সামলাতে পারেননি। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলেছিলেন, ‘আপনি ঠিক বলছেন বাবা? আমি কৌরবকে নার্সিংহোমে দেখতে গিয়ে কোনও ভুল করিনি?’

‘ভুল! কে বলে ভুল করেছ? আমার গাধা পুত্র বলে না, সব কাজ সিরিয়াসভাবে করতে হবে? বলে না সে? তুমি তো সিরিয়াস মনোভাবই দেখালে। বন্ধুর অসুস্থতার খবরে তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছ।’

মণিকুন্তলা বললেন, ‘অত কিছু নয় বাবা, শুধু একবার চোখের দেখা দেখতে গিয়েছিলাম। আমার বাড়িতে যদি জানে…আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি।’

কমলকান্তি বললেন, ‘সামলাবে কেন? কার ভয়ে?’

‘না আমার ওভাবে যাওয়াটা ঠিক হয়নি।’

কমলকান্তি প্রায় গর্জে উঠলেন। বললেন, ‘আবার যাবে। শুধু যাবে-ই না, কাউকে কৈফিয়তও দেবে না। বিমল কার কাছে কখন যায়, তার ফিরিস্তি তোমাকে দেয়? তুমি কেন দেবে?’

মণিকুন্তলা মাথা নামিয়ে বললেন, ‘উনি তো গোপনে যান না।’

কমলকান্তি বিরক্তভাবে বললেন, ‘গোপনে গেলে খারাপ মানুষের কাছে যাওয়া হয়, এই যুক্তি তুমি কোথা থেকে শিখলে? যাই হোক, আমি তোমার পাশে আছি মা। আমি তোমাকে সমর্থন করি। তোমাকে এ বাড়িতে এনেছি মানে তোমার মনটাকে কিনে ফেলেছি, এমন নয়। কেনা যায়ও না। মন বড় রহস্যময়। সেই কারণে সুন্দর। সে শুধু একজনকে ভালোবাসবে, একজনকে ঘৃণা করবে—এমন কোনও নিয়ম নেই। তার নিজের জগৎ থাকে। সেখানে হাসি থাকে, কান্না থাকে। সবই তার নিজের। তুমি নিজেও তার খবর রাখো না। বিমলের প্রতি তোমার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা যদি যথার্থ হয়, তা হলে তা এমনিই হবে। তাকে যেমন জোর করে আনা যায় না, আবার জোর করে আটকানোও যায় না। আমি বিমলের সঙ্গে কথা বলব। সে তোমার সঙ্গে যে আচরণ করছে, সেটাই অন্যায়। লজ্জারও। শিক্ষা মানুষের বোধবুদ্ধি তৈরি করে। যে বোধবুদ্ধি পাশের জনকে বুঝতে শেখায়। গাধাটার উচিত তোমাকে বোঝা। তোমার ভালোবাসাকে সম্মান না করলে সে নিজে ভালোবাসা পাবে কী করে?’

মণিকুন্তলা সেদিন উঠে গিয়ে কমলকান্তির পায়ে হাত দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন।

কৌরবের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। বিমলকান্তিকে তাঁর বাবা ডেকে কী বলেছিলেন, তা-ও মণিকুন্তলা জানেন না, তবে সেদিন রাতেই বিমলকান্তি তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। যে ঘটনা ভয়ঙ্কর পরিণতিতে শেষ হতে পারত, তা খুব মসৃণভাবে হারিয়ে গেল। বিমলকান্তি কোনওদিনও এ প্রসঙ্গ তোলেননি। সম্ভবত তিনি তাঁর বাবার কথা বুঝতে পেরেছিলেন।

এই ঘটনা বারিধারা, মেঘবতীরা জানবে কী করে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *