ষাট
‘কেমন আছ বাবা?’
‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছ বিমল?’
বিমলকান্তি মলিন হেসে বললেন, ‘তুমি সব জানো বাবা।’
কমলকান্তি বললেন, ‘তারপরেও তোমার কাছ থেকে জানতে চাইছি। একজন মানুষ কেমন আছে, প্রকৃত ভাবে তা কেবল সে নিজেই বুঝতে পারে। বাইরে থেকে আমরা নানারকম ভাবি, কিন্তু সেটা ঠিক হয় না। ঘটনার ওপর মানুষের ভলো থাকা, মন্দ থাকা নির্ভর করে না। নির্ভর করে তার বোধের ওপর, চেতনার ওপর। কেমনভাবে সে নিজেকে রাখতে চাইছে এটাই আসল। সেকথা অন্য মানুষ জানবে কী করে?’
বিলমকান্তি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘বাবা, মনটা খুব খারাপ।’
কমলকান্তি বললেন, ‘কেন?’
‘উপাধ্যায়কাকুর মতো একজন মানুষ, যাকে তুমি এত পছন্দ করতে, তিনি এমন কাজ করতে পারলেন। কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।’
কমলকান্তি বললেন, ‘প্রথমটায় মন আমারও খারাপ হয়েছিল বিমল। তারপর বুঝতে পেরেছি, এটাই ভালো হয়েছে। মানুষটাকে আমরা চিনতে পারিনি। সে নিজেই তার পরিচয় দিল। এমন যদি হত, সে কোনওদিন নিজেকে ধরা না দিত? সেটা কি তোমার জন্য, সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের জন্য বেশি মন খারাপের ব্যাপার হত না? সবাই জানত, ও খুব বড় মনের মানুষ ছিল। কমলকান্তি সেন আড়াল থেকে যে দায়িত্ব দিয়ে গেছে সেটাই পালন করছে। এই ভুল জানাটা কি ভালো হত?’
বিমলকান্তি বললেন, ‘ভালো হত বাবা। মানুষ বিশ্বাস ভাঙলে বড় আঘাত লাগে।’
কমলকান্তি একটু যেন হাসলেন। বললেন, ‘এত বড় হয়ে ছেলেমানুষের মতো কথা বলছ বিমল। বিশ্বাস কোনও স্থির বিষয় নয়। সে হল নদীর পাড়ের মতো। একদিক ভাঙবে, একদিকে গড়বে। উপাধ্যায় শেষ বয়সে বিশ্বাস ভাঙলে, কর্ণিকা নামের মেয়েটি জীবনের শুরুতেই নতুন করে তোমার বিশ্বাস অর্জন করল।’
বিমলকান্তি অস্ফুটে বলল, ‘সেটা ঠিক। মা কেমন আছেন?’
কমলকান্তি হেসে বললেন, ‘খুব ভালো। আমাকে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। পুত্র হলেও তুমি এখন বড়, তোমাকে বলতে লজ্জা নেই, বুড়োবুড়িতে চুটিয়ে প্রেম করছি। এতদিন অনেক খামতি পড়েছে। পুষিয়ে দিতে হবে। একানব্বই বছর কি প্রেমের জন্য ঠিক বয়স নয়?’
বিমলকান্তি লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইলেন। বাবা-মায়ের প্রেম নিয়ে কোনও মন্তব্য করা যায়? কমলকান্তি চুপ করে রইলেন।
‘এ সব রস তোমরা বুঝবে না। আমার ছোট নাতনি বুঝবে। সে কোথায়?’
বিমলকান্তি বললেন, ‘বৃষ্টি ভালো আছে। ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছে।’
কমলকান্তি বললেন, ‘জানি।’
‘তাকে কি তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলব?’
কমলকান্তি বললেন, ‘প্রয়োজন নেই। সে আমার সঙ্গে সবসময়ই কথা বলে। হাজার প্রশ্ন। আমি জবাব দিই না। ও বুদ্ধিমতী। নিজের মতো উত্তর তৈরি করে নেয়। কখনও ভুল হয়, কখনও ঠিক হয়। তবু সেটাই আমার কথা। গভীর ভালোবাসার সম্পর্কে ঠিক ভুল কোনও বিষয় নয়। মেয়েটাকে যত্নে রেখো।’
বিমলকান্তি হালকা চিন্তিতভাবে বললেন, ‘বাবা, তুমি তো জানো, বারিধারার মধ্যে কোনও সিরিয়াস বোধই নেই। লেখাপড়ায় ভালো রেজাল্ট করেছে, করেছে হেলাফেলায়। একটি ছেলেকে ভালোবাসে, সম্ভবত বিয়েও করবে, সেও উড়নচণ্ডী ধরনের।
কমলকান্তি হাসলেন। বললেন, ‘সিরিয়াস বিষয়টা হাবেভাবে দেখানোর বিষয় নয় বিমল। কেউ যদি হাসি রসিকতায় কোনও সিরিয়াস কাজ করে বসে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মুখ গম্ভীর ডাক্তার অসুখ সারানোর থেকে হাসিমুখের ডাক্তার পেট কাটলে ব্যথা কম লাগে। এ কথা তোমাকে আগে বলেছি। তুমি মানতে চাওনি। সে তো তোমার ব্যাপার। আমার বিশ্বাস সেনবাড়ির সব থেকে সিরিয়াস মানুষটির নাম বারিধারা। আর উড়নচণ্ডীকে ভালোবেসে কেউ যদি তার সঙ্গে ঘর বাঁধতে যায়, তা হলে ক্ষতি কী? শিল্পী মানুষ উড়নচণ্ডী হবে না তো কী হবে? দশটা-পাঁচটার অফিসার?’
বিমলকান্তি অস্ফুটে বলল, ‘বৃষ্টি যদি সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে নিজেকে জড়াত তা হলে আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পারতাম। আমার তো বয়স হচ্ছে। এরপর কে? উপাধ্যায়কাকুর ঘটনা মানসিকভাবে আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে। বাইরের কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না।’
কমলকান্তি একটু চুপ করে রইলেন। বললেন, ‘তোমার দুই মেয়ে-দুই জামাই। ব্যবসার দায়িত্ব কাকে দেবে তুমি ঠিক করবে। কীভাবে রাজি করাবে তুমি ঠিক করবে। বড় মেয়ের কথা মাথায় রেখো। শুধু ইমোশন দিয়ে যদি আমাদের মেঘবতীকে বিচার করা হয় তা হলে খুব ভুল হবে। মেঘের ভিতরটা খুব শক্ত। হালকা-পলকা ঘটনায় সে যেমন আবেগতাড়িত হয়, যে-কোনও কঠিন কাজ সে ঠান্ডা মাথায় সামলাতে জানে। ব্যবসায় যেমন অর্থের প্রয়োজন, তেমন আবেগের প্রয়োজন। মেঘের এই আবেগ আছে। সে পারবে।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘ওই মেয়ে বহুদিন আগে না বলে দিয়েছে।’
‘আবার বোঝাও। সময় বদলালে মানুষের মনও বদলায়।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘আচ্ছা বলব। বাবা, আর একটা কথা ছিল।’
কমলকান্তি বললেন, ‘কী কথা? তাড়াতাড়ি বলবে। এবার আমাকে ফিরতে হবে। তোমার মা অপেক্ষা করছে।’
বিমলকান্তি উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘আমার একটা সমস্যা হচ্ছে বাবা। আমি মাঝে মাঝে সামনে থাকা অন্য কোনও মানুষের মতো হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে, তার শরীর, মন দুটোই আমার। তার কথা আমার কথা। তার সুখ-দু:খ, আমারই সুখ-দু:খ। তার চোখ দিয়ে জগৎ দেখতে পেয়েছি।’ একটু থেমে থেকে বিমলকান্তি বললেন, ‘বলতে অস্বস্তি হচ্ছে, কিন্তু অফিসের খুব সাধারণ স্টাফ প্রহ্লাদ থেকে শুরু করে আপনি পর্যন্ত এই ঘটনা আমার ঘটেছে। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও আমি প্রহ্লাদ হয়ে গিয়েছিলাম, এমনকী আমি তুমিও গিয়েছিলাম… একবার উপাধ্যায়কাকুর মনের কথাও জেনেছিলাম…নিজের মনের কথা ভেবে…সেই কথা জেনে সন্দেহ হয়েছিল…কিন্তু নিজের পাগলামি ভেবে আমল দিইনি। মাঝে মাঝে খুব ভয় হয়। মনে হয় ভিতরে পাগলামি ডেভেলপ করছে। নইলে একজন মানুষ অন্য একটা মানুষ হয়ে যাবে কেন? কাউকে বলতে পারি না। লজ্জায় নয়, বলি না বাড়ির সবাই ভয় পেয়ে যাবে এই চিন্তা করে।’
বিমলকান্তি চুপ করলেন। কপালে হাত দিয়ে মাথা নামিয়ে চুপ করে বসে রইলেন।
কমলকান্তি শান্ত ভাবে বললেন, ‘আমি জানি বিমল। আগে জানতাম না, পরে জানতে পেরেছি। অফিসের ওই মেয়েটি তোমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে পাঠিয়েছিল।’
বিমলকান্তি মুখ তুলে অস্ফুটে বললেন, ‘হ্যাঁ, বাবা।’
কমলকান্তি বললেন, ‘তিনি তোমাকে বলেছেন, এটা কোনও মানসিক রোগ কি না সেটাই তিনি বুঝতে পারছেন না। তাই তো?’
‘হ্যাঁ, বাবা। তারপর থেকে আর এমনটা হয়নি, কিন্তু আমার ধারণা যে কোনও সময় আবার হতে পারে। বাবা, আমার ভয় করে।’
বিমলকান্তির গলায় আত্মসমর্পণের সুর। মানবজন্মের শুরু থেকে এই আত্মসমর্পণে পিতার কাছে পুত্র ভরসা চায়। আশ্রয় চায়। এই আত্মসমর্পণ একমাত্র পিতার কাছেই করা যায়। তখন পুত্রকে কাছে টেনে নিয়ে পিতাই বলতে পারে, ‘দুর বোকা, আমি আছি তো।’
কমলকান্তি পুত্রকে কাছে টানতে পারলেন না। সে ক্ষমতা এখন আর তার নেই। তবে সস্নেহে বললেন, ‘ভয়ের কী আছে? কোনও ভয় নেই। একজন মানুষ যদি তার সামনের মানুষটার মতো হতে পারে, সে তো আনন্দের। ক্ষণিকের জন্য হলেও তার সুখ-দু:খ যদি নিজের হয়ে যায়, সে তো বিরাট পাওয়া। তার প্রতিবাদ, চক্রান্ত যদি তুমি জানতে পারো, তার থেকে সুবিধের কী আছে? এ সবের থেকে বড় কথা কী জানো বিমল, নিজের চোখে দেখা পৃথিবীটা একরকম, অন্যের চোখে দেখা আরেকরকম। সে পৃথিবী আলাদা। সে পৃথিবী দেখবার সুযোগ সবাই পায় না। তুমি পেয়েছ। এটা তোমার পরম সৌভাগ্যের। একে আনন্দ করে গ্রহণ করো।’
বিমলকান্তি নীচু গলায় বললেন, ‘তারপরেও অন্য মানুষ হয়ে যেতে অস্বস্তি হয়।’
কমলকান্তি নরম গলায় বললেন, ‘যখন থেকে তুমি বুঝতে পারবে এটা কোনও অসুখ নয়, এটা তোমার পাওনা, সেদিন থেকে আর অস্বস্তি হবে না। দেখবে, আর সামনের মানুষটা হতে পারবে না। তুমি এমনিই তার চোখ দিয়ে তার সুখ-দু:খ বুঝতে পারবে। তাকে বুঝতে পারবে।’
পিতা-পুত্র দুজনেই চুপ করে রইল।
কমলকান্তি বললেন, ‘আমি এবার আসি বিমল? তোমার মা অপেক্ষা করছে। বয়স হয়েছে তার। আমাকে না দেখতে পেলে বড্ড ব্যাকুল হয়ে পড়ে। একবার হারিয়েছিল, দ্বিতীয়বার আর হারাতে চায় না।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘আবার কবে আসবে?’
কমলকান্তি হেসে বললেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে সবসময় আছি। ছেড়ে যায়নি কখনও। সাবধানে থাকবে। মনে রাখবে, মেঘ আসবেই। বিষণ্ণ, বিষাদমাখা, অন্ধকার মেঘ। সেই মেঘ না এলে জীবন সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু মেঘ আবার কাটেও। কেটে পরে রোদ ওঠে। ঝলমলে রোদ। চারপাশে আলো ছড়িয়ে দেয়। এই রোদের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। যে যার মতো করে অপেক্ষা করে। কেউ উদ্যমী হয়, কেউ চুপ করে বসে থাকে। আজ এলাম।’
মণিকুন্তলার পায়ের আওয়াজে বিমলকান্তির ঘোর কাটল। তিনি মুখ তুলে কমলকান্তি সেনের শূন্য চেয়ারের দিকে তাকালেন।
‘এ কী তুমি এখানে! তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি।’
মারা যাওয়ার পর নিয়ম না করেও বাবার ঘরে মাঝে মাঝে আসেন বিমলকান্তিবাবু। বিশেষ করে অফিস যাওয়ার সময় একবার উঁকি মেরে যান। আবার অনেকদিন আসাও হয় না। বিমলকান্তি সেন প্র্যাকটিকাল মানুষ। রোজ মৃত বাবার ঘরে এসে ছবিতে প্রণাম ঠুকতে হবে, এমন ধারণায় তিনি বিশ্বাস করেন না। এ বাড়ির কেউই করে না। তারা কমলকান্তি সেনকে মনের ভেতর থেকে ভালোবাসে। কপালে হাত ঠুকে শ্রদ্ধা তাদের জানাতে হয় না। আজ বিমলকান্তি ঘরে এসেছিলেন। ঢুকে মনে হল, বাবার ইজি চেয়ারটার পাশে খানিকক্ষণ বসি। মোড়া টেনে নেন। এ ঘর থেকে কোনও কিছুই সরানো হয়নি। সব কিছুই আগের মতো রয়েছে। মণিকুন্তলাই সরাতে দেননি। তিনি অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেন না। তারপরেও তার মনে হয়, শ্বশুরমশাই আজও এ ঘরে আছেন। একজন মানুষ তার জীবন দিয়ে উপস্থিত থাকে, মৃত্যু দিয়েও থাকতে পারে। বাবার ইজি চেয়ারের পাশে, বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ বিমলকান্তিবাবুর মনে হয়, সামনে বাবা বসে আছেন। যেমন তিনি থাকতেন।
এরপরেই মৃত বাবার সঙ্গে বিমলকান্তি কথা শুরু করেন।
মণিকুন্তলা অবাক হয়ে বললেন, ‘কী গো। এতক্ষণ এ ঘরে বসে আছ?’
বিমলকান্তি খানিকটা লজ্জাই পেলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এই তো একটু আগে এসছি।’
মণিকুন্তলা কিছু বলতে গিয়ে থমকে গেলেন। বাবার শূন্য চেয়ারের পাশে ছেলে কেন চুপ করে বসে আছে, তাই নিয়ে কথা বলবার অধিকার তার নেই। দুনিয়ার কারওরই নেই।
মণিকুন্তলা বললেন, ‘তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল। তোমার কি এখন সময় হবে?’
বিমলকান্তি বুঝতে পারলেন তাঁর মনটা ঝরঝরে লাগছে। মনে মনে বাবার সঙ্গে কথা বলে অনেকটা হালকা হতে পেরেছেন। শুধু হালকা নয়, কিছু খুব জরুরি পরামর্শও পেয়েছেন। কাউকে এ কথা বলতে গেলে হাসবে। হাসাই উচিত। তিনি যে মৃত বাবার সঙ্গে কথা বলে মনে করছে, সেটা তো আসলে চিন্তা। নিজের সঙ্গে নিজের কথা। বাবার পরামর্শ তো আসলে নিজের চিন্তা করে বের করা উপায়। তারপরেও ভাবতে ভালো লাগছে, বাবা এতক্ষণ ছিল।
‘বলো মণিকুন্তলা।’
মণিকুন্তলা আলমারিতে হাত রেখে বললেন, ‘এবার আমাদের বাবার প্রাোজেক্টটা নিয়ে কাজ শুরু করবার সময় এসে গেছে।’
বিমলকান্তি উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘কীভাবে শুরু করবে ভাবছ।’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘আগে সবাই মিলে কথা বলে নিই।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘অবশ্যই। তুমি একদিন মিটিং ডাকো। এই ঘরেই মিটিং হবে। বাবার সামনে কথা হয়ে যাবে।’
কথাটা বলে বিমলকান্তি ‘হো হো’ করে হাসলেন। মণিকুন্তলা অবাক হলেন। ব্যাপার কী। তার সিরিয়াস ভাব বুড়ো বয়সে যে এক ধাক্কায় অনেকটা কমে গেছে। ভারী ভালো লাগছে।
বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘মণিকুন্তলা, তুমি কি জানো একটু পরে রোদ উঠবে মানে কী? বাবা তার ড্রিম প্রাোজেক্টের এরকম একটা অদ্ভুত নাম কেন দিলেন? জানো তুমি?’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘অবশ্যই জানি।’
বিমলকান্তি আগ্রহ নিয়ে বললেন, ‘বলো তো।’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘একটু পরে রোদ উঠবে কথাটার মানে একটু পরে রোদ উঠবে। ঠিক হয়েছে?’
বিমলকান্তি আবার হেসে উঠলেন। স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘খুব ঠিক হয়েছে। সাধে কি বাবা তোমাকে এত গুরুত্ব দিতেন? তোমার কাজ থেকে আমারও অনেক কিছু শেখবার আছে।’
দুপুরের পর থেকেই টিভিতে খবর বলতে শুরু করল, বঙ্গোপসাগরের ওপর একটা নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই নিম্নচাপ গভীর হবে। তারপর এগিয়ে আসবে স্থলভাগের দিকে। রাত থেকে ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা। কিন্তু বিকেলের পর থেকেই আকাশ মেঘে মেঘে ছেয়ে গেল। চারপাশ থম মেরে গেল। বৃষ্টি নামল সন্ধের পর থেকে।
একষট্টি
‘ওই কে এলে আকাশ পরে দিক-ললনার প্রিয়/ চিত্তে আমার লাগল তোমার ছায়ার উত্তরীয়…’
মণিকুন্তলা গান করছেন। গলা খুলে নয়, গুনগুন করে। তিনি ছোট মেয়ের ঘর গোছাতে এসেছেন। বাসি জামা, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় আলাদা করেছেন, এদিক-সেদিক ছুড়ে ফেলে রাখা জামাকাপড় ভাঁজ করে ওয়ার্ডরোবে রাখছেন, খোলা বই তাকে গুছিয়ে তুলছেন। কম্পিউটারের ঢাকা দিলেম। জানলার নীচে জল। নিশ্চয় জানলা খোলা ছিল। কাপড় এনে সেই জল মোছবার সময় মণিকুন্তলা মনে মনে মেয়েকে ধমকও দিচ্ছেন। এই মেয়ে বৃষ্টি-বাদলায় জানলা আটকাতে কবে শিখবে? শুধু ছোট মেয়ের ঘরের কাজ নয়, একই সঙ্গে বাড়ির অন্যদিকেও খেয়াল দিতে হচ্ছে মণিকুন্তলাকে। সকালবেলায় সংসারে অনেক কাজ। যতই কাজের লোক থাকুন না কেন, বাড়ির গিন্নিকে নজর রাখতে হয়। এর সঙ্গে গুনগুন করে গান। কাজ করতে করতে যখন মেয়ের ঘরে আসছেন, গানের ভলিউম বাড়ছে। যখন ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা বা পাশের ঘরে যাচ্ছেন গান হয়ে যাচ্ছে আবছা।
এখন যেমন মণিকুন্তলা এই ঘরে। তাই গান স্পষ্ট।
‘মেঘের মাঝে মৃদঙ্গ তোমার বাজিয়ে দিলে কি ও
ও তালেতে মাতিয়ে আমায় নাচিয়ে দিয়ো দিয়ো…’
বারিধারা বিছানায় শুয়ে আছে। গলা পর্যন্ত চাদর। পাশবালিশ জড়িয়ে গুটিশুটি মেরে আছে। খানিক আগে তার ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু এখনও সে ঘুম থেকে ওঠেনি। ঘুম ভাঙা আর ঘুম থেকে ওঠার মধ্যে বিস্তর ফরাক। এমনকী খাট থেকে নেমে ব্রাশ করলেও অনেক সময় ঘুম থেকে ওঠা হয় না। বারিধারা দেখেছে, বহুবার ব্রেকফাস্ট করতে করতেও সে ঘুমের মধ্যে থেকেছে। এখন যেমন ঘুম ভেঙে এবং ঘুম থেকে না উঠে মায়ের গান শুনছে। খুব ভালো লাগছে। লাগবারই কথা। এই মহিলার গানের গলা যতটা না ভালো, গান করবার ধরনটা বেশি ভালো। খুব স্বত:স্ফূর্ত। এত সহজভাবে গাইতে পারে যে মনে হয় গানটা আর পাঁচটা কাজের মতোই। কোনও আয়োজন লাগে না। কোনও জোরজার লাগে না। প্রাণে গান এলেই গাওয়া যায়। মহিলার ওপর বারিধারার হালকা হিংসেও হল। ইস সে যদি মায়ের গলার খানিকটা পেত। নিমেষে আবার হিংসে চলেও গেল। গান গাইতে পারবার থেকে গান শুনতে পাওয়াও কম আনন্দের নয়।
মণিকুন্তলা গান থামিয়ে, মেয়ের দিকে তাকালেন। কড়া গলায় বললেন, ‘কী রে, কখন উঠবি?’
বারিধারা চাদরটা মাথার ওপর টেনে নিয়ে বলল, ‘উ: গান থামিও না। তোমার পরীক্ষা হচ্ছে।’
মণিকুন্তলা হাতে মেয়ের জামা নিয়ে থমকে গেলেন।
‘কীসের পরীক্ষা?’
বারিধারা চাদরের নীচ থেকে বলল, ‘এই গানটা তুমি ভালো গাও না শ্রাবণী সেন ভালো গায়। আবার মুখড়াটা ধরো।’
মণিকুন্তলা কটমট করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চাদর মুড়ি দেওয়া মেয়ের চুলের ঝুঁটিটা ঠিক কোনদিকে বোঝবার চেষ্টা করলেন। বুঝতে পারলেই ধরে নাড়িয়ে দেবেন। সাতসকাল থেকেই রসিকতা করা বেরিয়ে যাবে।
বারিধারা বলল, ‘মা, ঘাবড়িও না। পরীক্ষার ফার্স্ট রাউন্ডে এগিয়ে আছ।’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘একটা চড় মারব।’
বারিধারা খিলখিল করে হেসে চাদর সরিয়ে উঠে বসল। ডান হাত বাড়িয়ে নাটকীয় ঢঙে বলল, ‘মণিকুন্তলা ম্যাডাম, রাগ করবেন না। সত্যি আপনি একজন সুকণ্ঠের অধিকারিণী। সংসার নামক হারমোনিয়ামের মধ্যে ঢুকে পড়ে প্যাঁ পো করে মরছেন। অধিকাংশ গুণী মহিলার জীবনে এমনটাই ঘটে। রান্নাঘরের দোরগোড়ায় প্রতিভা মাথা কুটে মরে। আপনি যদি সঙ্গীতের চর্চা নিয়মিত করতেন তা হলে শ্রাবণী সেন না হোন মণিকুন্তলা সেন হিসেবেই শ্রোতাদের কাছে পরিচিত এবং সমাদৃত হতেন। তবে দু:খ করবেন না ম্যাডাম, আপনি আপনার এই কন্যার কাছে কোনও বড় গায়িকার থেকে কম নন।’
মণিকুন্তলা বুঝলেন, এই মেয়ের সঙ্গে কথা বলা ঝকমারি ছাড়া আর কিছুই নয়। সকাল মেয়ের সঙ্গে ঝকমারি করার জন্য নয়, সকাল সংসারের কাজ করবার জন্য। চটি ফটফটিয়ে রাগের শব্দ করে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। যাক, মেয়ের ঘুমের মধ্যে ঘরটা তাও খানিকটা সাফসুতরো করা গেছে।
বারিধারা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশ মেঘ ভরা। কালো মেঘ নয়, কাজল লেপটানো মেঘ। কাল সারারাত ধরে বৃষ্টি পড়েছে। তবে খুব জোরে নয়। সকালের দিকে খানিকটা ধরেছে। আকাশ বলছে, আবার যে-কোনও সময় ঝমঝমিয়ে নামবে। সব মিলিয়ে চমৎকার একটা বৃষ্টির দিন।
বারিধারা আড়মোড়া ভাঙল। তার মন ভালো লাগছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মন ভালো লাগা একটা সুলক্ষণ। বৃষ্টির দিনের কতগুলো নিজস্ব নিয়ম আছে। একে বলে ‘বৃষ্টির দিনের নিয়ম’। এই নিয়ম না মানলে, বৃষ্টি রাগ করে। সেই রাগ যদি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায় তখন বিপদ ঘটে। বৃষ্টি অভিমান করে এবং বেশ ক’দিন এ মুখো হয় না। বারিধারা মনে মনে নিয়মগুলো ঝালিয়ে নিল। সারারাত বৃষ্টি পড়লে এবং পরদিন সকালেও আকাশ মেঘে ভরা থাকলে সহজে বিছানা ছাড়তে নেই। সেদিনের যাবতীয় রুটিন কাজ বাতিল করতে হয়। গোটা সকালে বারবার গরম চা চাই। সঙ্গে ডিমের পকৌড়া। পিছনে গাঁক গাঁক করে রবীন্দ্রসঙ্গীত চলবে। দুপুরে খিচুড়ি। তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনন্দীর ‘মরীরা দুপুর’ বা অরহান কামুকের উপন্যাস ‘দ্য মিউজিয়ম অফ ইনসেন্স’ পড়তে হবে। বিকেলে পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে খুঁজে ফোন বা ফেসবুকে আড্ডা। সন্ধেবেলা খাটে আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপে সিনেমা দেখতে হবে। কোরিয়ান মুভি ‘আ বিটার সুইট লাইফ’ অথবা বাংলায় ‘সোনার কেল্লা’। এর মাঝখানে প্রেমিক বা প্রেমিকা ফোন করবে। সেই ফোন ধরা চলবে না। তাকে টেনশনে রাখতে হবে। এতে এক ধরনের বিরহও তৈরি হবে। স্বেচ্ছাবিরহ। বৃষ্টিতে মিলনের চেয়ে বিরহ বেশি ইন্টারেস্টিং।
বারিধারা ঠিক করল, সে আজ বৃষ্টি দিনের নিয়ম মেনে চলবে। সে আবার চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বার তোড়জোড় শুরু করল।
মণিকুন্তলা আবার ঘরে ঢুকলেন।
‘বৃষ্টি, জরুরি কথা আছে। মুখ ধুয়ে নীচে এসো। চা খেতে খেতে কথা বলব।’
বারিধারা শোবার প্ল্যান ত্যাগ করে বলল, ‘আজ তো জরুরি কথা শোনা যাবে না মা।’
মণিকুন্তলা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘কেন? আজ তোমার কী?’
বারিধারা গায়ের চাদর সরিয়ে এগিয়ে গিয়ে মায়ের হাত ধরল। হাসিমুখে বলল, ‘আজ বৃষ্টির দিন। আজ জরুরি কথা বলা বারণ।’
মণিকুন্তলা হাসতে গিয়ে নিজেকে সামলালেন। তার এই মেয়েটা ছেলেমানুষ বয়স থেকেই বৃষ্টি পাগলা। বৃষ্টি পড়লে চোখে চোখে রাখতে হত। ছুতোনাতা পেলেই বারান্দা, উঠোন, ছাদে ভিজতে চলে যেত। মণিকুন্তলা একবার পিটুনি দিলেন। নাতনি ফোঁপাতে ফোঁপাতে দাদুর কাছে গেল। কমলকান্তি সেন পুত্রবধুকে ডেকে পাঠালেন। মণিকুন্তলা ঝগড়া করবেন বলেই প্রস্তুত হয়ে শ্বশুরমশাইয়ের কাছে গেলেন।
‘বাবা আপনি আর আশকারা দেবেন না। এই সেদিন জ্বর থেকে উঠল মেয়ে। বারণ শুনছে না।’
কমলকান্তি সেন গম্ভীর ভাব বললেন, ‘তুমি শাসন করে ঠিক করেছ। অবাধ্য ছেলেমেয়েকে দু-ঘা দেওয়াটাই উচিত। আমি তোমাকে এই কারণে ডাকিনি।’
মণিকুন্তলা গজগজ করতে করতে বললেন, ‘তা হলে কী কারণে ডেকেছেন?’
কমলকান্তি অপরাধীর ঢঙে বললেন, ‘নাতনির এই বৃষ্টি ভেজা স্বভাবের জন্য আমিই দায়ী সেকথাটাই বলতে ডেকেছি।’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘আপনি কী বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি না। তবে ওই মেয়ে যদি আবার বৃষ্টিতে ভিজতে যায়, আবার আমার হাতে মার খাবে।’
কমলকান্তি বললেন, ‘আর ভিজবে না। আমি ব্যবস্থা করছি।’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘সে আপনার ব্যাপার। আমি ছাড়ব না।’
কমলকান্তি বললেন, ‘তুমি ঠান্ডা হও। যার ভালো নাম বারিধারা, ডাকনাম বৃষ্টি সে তো বৃষ্টিতে ভিজবেই। না চাইলেও ভিজতে হবে। তার কোনও অপরাধ নেই। ছোট নাতনির নাম আমি বদলে দিচ্ছি। সেই ব্যাপারে আলোচনার জন্য আমি তোমাকে ডেকেছি। আচ্ছা, মেয়ের নাম যদি রোদ্দুর দিই? কেমন হবে? তবে তাতেও চিন্তা আছে। তখন হয়তো রোদে টইটই করে ঘুরবে। তাই না? সবথেকে ভালো হয়, এইমেয়ের নাম আমি দিই ঘর। তা হলে নিশ্চয়ই চুপটি করে ঘরে বসে থাকবে।’
মণিকুন্তলা আর পারেননি। শ্বশুরমশাইয়ের সামনেই ফিক করে হেসে ফেলেছিলেন। বারিধারার সেই বৃষ্টি পাগলামি যায়নি। এখনও ভেজে। বড় হয়েছে বলে লুকিয়ে-চুরিয়ে ভেজে। টুক করে ছাদে চলে যায়।
মণিকুন্তলা হাত সরিয়ে নিয়ে মেয়েকে বললেন, ‘বাজে কথা পরে বলবে। তোমার দিদিকে আনতে গাড়ি গেছে। সে এলে আমরা তোমার দাদুর প্রাোজেক্ট নিয়ে মিটিং করব।’
বারিধারা এবার প্রায় লাফিয়ে উঠল।
‘খুব ভালো হবে। একটু পরে রোদ উঠবে, প্রাোজেক্টের জন্য কাজ করাটা কোনও কাজ নয়। এটা আনন্দ। মিটিংয়ে আর কে কে থাকবে? বাবা?’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘না, আজ আমরা শুধু তিনজনে একটু কথা বলে নেব। সবাইকে নিয়ে কবে বসা হবে, তাই ঠিক করব। তোমার বাবার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে।’
ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে তিনজনে কথা হল। সাতদিন বাদে মিটিংয়ের একটা দিন ঠিক হল। সবাইকে থাকতে হবে। ওই সময় কোর্টের কাজে অর্চিনের কলকাতায় আসবার কথা। সেও থাকবে। বারিধারার দায়িত্ব পড়ল, সবাইকে খবর দেওয়ার।
প্রথম কাজ হবে, একটা ট্রাস্ট তৈরি করা। ঝাড়গ্রামের জমিটা একদিন সরজমিনে দেখে আসা হবে। পাঁচিল দিয়ে সেই জমি ঘিরে ফেলা দরকার। ভিতরে আপাতত একটা ঘর বানানোর বন্দোবস্ত করলেই চলবে। ওটা হবে সাইট অফিস। আপাতত সেনবাড়িতে বসে কাজ শুরু হবে। বাকি কাজ সেদিন মিটিংয়ে আলোচনা করে ঠিক হবে।
বারিধারা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ব্যস, তাহলে আজকের মতো জরুরি কথা শেষ। এবার রেনি ডে উদযাপন হবে।’ মেঘবতী বলল, ‘দাঁড়াও, আমার একটা কথা আছে।’
বারিধারা মুখ ভেটকে বলল, ‘আবার কী কথা দিদি? চল ছাদে গিয়ে ভিজি। দেখ কেমন জোরে বৃষ্টি নেমেছে।’
মেঘবতী বোনের কথায় পাত্তা না দিয়ে থমথমে গলায় বলল, ‘বাবা আমাকে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে জয়েন করতে বলছে। বলছে, এখন থেকে অফিসে গিয়ে কাজকর্ম শিখতে।’
বারিধারা মায়ের মুখের দিকে তাকাল।
‘কী ব্যাপার মা? দিদি, যা বলছে সত্যি?
মণিকুন্তলা চায়ের কাপ মুখ থেকে নামিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, সত্যি। তোদের বাবা আমাকে বলেছে, কোম্পানির দায়িত্ব তো এবার কাউকে বুঝে নিতে হবে। সেটা বাড়ির কাউকেই নিতে হবে। তোর বাবার তো বয়স হচ্ছে। বাড়ির কেউ দায়িত্ব না নিলে কীভাবে চলবে?’
বারিধারা উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘এটা তো খুব ভালো কথা। সেন অ্যাসোসিয়েটস তো তুলে দেওয়া যায় না। বাইরের লোক দিয়ে ব্যবসা চলেও না। দিদি যদি দায়িত্ব নেয় তার মতো ভালো আর কিছু হবে না। তোর কি আপত্তি আছে দিদি?’
মেঘবতী একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আগে ছিল। বলেছিলাম, এ সবের মধ্যে আমি নেই। এখন বাবা বুঝিয়ে বলবার পর কেমন যেন গুলিয়ে গেছে। বাবা বলল, আমার তো ছেলে নেই। দুই মেয়ে। ছেলে থাকলে সে ব্যবসা চালাত। মেয়ে আছে বলে কি ব্যবসা তুলে দিতে হবে? বাবার কথাটায় ধাক্কা খেলাম। সত্যি তো মেয়েরা ব্যবসা চালাতে পারে না? বড় বড় কোম্পানির মাথায় মেয়েরা রয়েছে। অনেক ব্যবসায় মালিকও মেয়ে। তা হলে আমরা কেন বাবাকে হেল্প করতে পারব না? বাবার বয়স বাড়ছে। বাবার ওপর চাপ পড়ছে। জ্যোতিষ্ককে বলেছিলাম। সে বলল, অবশ্যই তোমার দায়িত্ব নেওয়া উচিত। জটিল কাজে তোমার মাথা পরিষ্কার। বাবাকে কিছু বলিনি। আগে তোমাদের বললাম। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। তোমরা বলে দাও।’
বারিধারা মেঘবতীকে জড়িয়ে ধরে ফটাস করে গালে একটা চুমু খেল। মেঘবতী বোনকে ঠেলা মেরে সরিয়ে দিল। বারিধারা একগাল হেসে বলল, ‘ভেরি গুড। এই না হলে তুই বারিধারা সেনের দিদি? অবশ্যই রাজি হবি। তোর কড়া হাতে বাপ-ঠাকুরদার কোম্পানির আরও ভালো হবে। তুই যদি রাজি না হতিস তোকে ত্যাজ্য দিদি করতাম।’
মেঘবতী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমি কি পারব? অত বড় অফিস। অত কাজ। আমি তো কখনও এরকম কঠিন কাজ করিনি।’
বারিধারা হেসে বলল, ‘তুই অফিসে জয়েন করেই একটা ছিঁচকাঁদুনে রুম বানাবি। যখন দেখবি কাজ সামলাতে পারছিস না, নাকানি-চোবানি খাচ্ছিস, তখন ওই ছিঁচকাঁদুনে রুমে গিয়ে খানিকক্ষণ কেঁদে নিবি। বাইরে বোর্ড ঝোলানো থাকবে বস ইস নাউ ক্রাইং, ডোন্ট ডিসটার্ব।’
মেঘবতী হাত বাড়িয়ে বোনের কান ধরবার চেষ্টা করল। মণিকুন্তলা মেয়েদের ধমক দিয়ে বললেন, ‘তোরা থামবি? এরকম একটা সিরিয়াস সময়ে বাচ্চাদের মতো মারামারি করছিস?’
তারপর বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে তুই পারবি মেঘ। তোর বাবা জেনেশুনেই তোর কথা ভেবেছে। বলেছে, সহজ কাজে কেঁদে ফেললেও, কঠিন কাজে আমার বড় মেয়ের খুবই ঠান্ডা মাথা।’
মেঘবতী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আর একটু পরে রোদ উঠলে প্রাোজেক্টের কী হবে?’
মণিকুন্তলা হেসে বললেন, ‘তার জন্য তো আমরা সবাই আছি। তুইও থাকবি।’
মেঘবতী কান্নার ভাব ঝেরে ফেলে বলল, ‘আমি থাকব তো?’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘এ মা! কেন থাকবি না? অফিসের কাজের পর যতটা পারবি সময় দিবি।’
বারিধারা হুকুমের ঢঙে বলল, ‘শনি, রবি আর অন্যান্য ছুটির দিন আপনি প্রাোজেক্টে যাবেন। কিন্তু মনে রাখবেন সেখানে আপনি বস নন, সেখানে বস আমি। আমি যা অর্ডার করব সেই মতো কাজ করবেন।’
মেঘবতী এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে বোনকে তাড়া করল। বারিধারা হাসতে হাসতে সিঁড়ি দিয়ে ছুটল। মেঘবতী হাসতে হাসতে গেল পিছনে। দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন মণিকুন্তলা। খুশিতে তাঁর বুক ভরে গেল। কিন্তু এই খুশি একটু পরেই মণিকুন্তলার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল।
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। খানিকক্ষণ মেয়েদের সাড়াশব্দ না পেয়ে খানিকটা চিন্তিত হয়েই মণিকুন্তলা ছাদ পর্যন্ত চলে যান এবং সেখানে যা দেখলেন তাতে রাগে মাথায় আগুন ধরবারই কথা। ধেড়ে মেয়েরা এ কী কাণ্ড করছে! বৃষ্টিতে হাত ধরাধরি করে পাগলের মতো ভিজছে যে! ছি-ছি, এদের কি কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই?
বারিধারা আর মেঘবতী ভিজতে ভিজতে তাদের মাকে দেখতে পায় এবং হাত ধরে জোর করে টেনে ছাদে নামায়।
‘ওরে আমায় ছাড়, ওরে আমায় ছাড়’ বলতে বলতে মণিকন্তলাও ভিজতে থাকেন। মাথায় রাগের আগুন নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার এমন আনন্দ তিনি আগে কখনও পাননি।
মা-মেয়ের এই আনন্দস্নানে সব থেকে খুশি হল খোদ বৃষ্টি। সে আরও ঝেঁপে নামল।
বাষট্টি
‘পার্টি সংগঠনের প্রস্তুতি।’
কথাটা পাতার ওপর লিখে পেন তুলে নিল শেখর। কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর লেখাটা কাটল। এবার লিখল—’বিভিন্ন বাম পার্টি কীভাবে সংগঠন গড়ে তুলেছিল।’ এবারও হাত তুলে লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকল শেখর। তার চোখ মুখ বলছে, এই বাক্যটিও তার পছন্দ হয়নি। শেখর পেন কামড়ে বেশ খানিকক্ষণ ভাবল। পেন কামড়ানোর অভ্যেসটা তার বহুদিনের। আগে বেশি ছিল, তমসা বলে বলে কমিয়েছে।
‘ছেলে বড় হচ্ছে। বদভ্যাসগুলো কমাও, ছেলেও তো শিখবে।’
শেখর বলেছিল, ‘পেন কামড়ানো বদভ্যাস তোমায় কে বলল তমসা?’
তমসা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘কী বলছ তুমি। অবশ্যই একটা বিচ্ছিরি হ্যাবিট। ময়লা মুখে যাচ্ছে।’
শেখর হেসে বলেছিল, ‘মাও লেখবার সময় পেন কামড়াতেন। পৃথিবীর ময়লা দূর করতে চেয়েছিলেন তিনি। শোষণ, বঞ্চনা ময়লা ছাড়া কী? কী জানি, হয়তো লং মার্চের জন্য পার্টিকে যে চিঠিটা লিখেছিলেন, সেটাও হয়তো পেন কামড়ে লিখেছিলেন।’
তমসা রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘তুমি লং মার্চের চিঠি লিখছ না। মাও, হোচিমিন, লেনিন, চে গুয়েভারা করলেও এটা ঠিক নয়। তুমি করবে না।’
শেখর বদভ্যাস কমিয়ে এনেছে। তারপরেও লেখালিখির সময় কোথাও আটকে গেলে অজান্তে পেন মুখে চলে যায়।
শেখর এবার লিখল—’বিবিধ বাম দলের সূচনাকালীন সাংগঠনিক কাঠামো আমাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারে?’
হেডিং হিসেবে বড় হয়ে গেল? হোক। এখানে ছোট বিষয় নয়, পার্টি নেতৃত্ব যেন স্পষ্ট বুঝতে পারে। পুরো বাক্যটির নীচে লম্বা দাগ দিল শেখর। দ্রুত এই লেখা শেষ করতে হবে। নির্বাচনের রিপোর্ট নিয়ে লোকাল কমিটির গোলমালের পর জেলা সেক্রেটারি শেখরকে ডেকে পাঠালেন। ‘এসব নিয়ে বেশি চিন্তা কোরো না শেখর। যে কোনও বিপর্যয়ের পরই এই ধরনের বিরোধ তৈরি হয়। আমাদের পার্টির ইতিহাসে বারবার হয়েছে। যুক্তফ্রন্ট যখন ভেঙে গেল, আমাদের পার্টির একটা বড় অংশ আমাদের ত্যাগ করল। পরে এমারজেন্সির সময়ও এক ঘটনা ঘটেছে। একদল বলল, এখনই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে হবে। একদল বলল, আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়া আর পালিয়ে যাওয়া এক কথা। তার থেকে সারফেসে থেকে কাজ করে জেলে যাওয়াই ঠিক হবে। এতে মানুষের মধ্যে পার্টির বিপ্লবী ইমেজ প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রভিনসিয়াল কমিটিতে এই নিয়ে তুলকালাম হল। শেষ পর্যন্ত এমন ধরপাকড় শুরু হল যে আন্ডারগ্রাউন্ডে না গিয়ে উপায় ছিল না। এতদিন পাওয়ারে থাকার পর, পরাজিত হয়েছি। একবার নয়, পরপর দু’বার। এবার তো জটিলতা অনেক বেশি হবার কথা।’
শেখর বলল, ‘এটাই তো সবাই বুঝতে চায় না।’
সেক্রেটারি বললেন, ‘সবাই কোনওদিনই সবটা বুঝতে চায়নি শেখর। কমিউনিস্ট পার্টিকে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে এগোতে হয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, অতীতকে আঁকড়ে বসে থাকতে হবে। আমাদের নতুন করে সংগঠন গোছানোর কথা ভাবতে হবে। প্রয়োজনে নতুন পথ বের করতে হবে। স্ট্রাকচার বদলাতে হবে। তুমি একটা নোট তৈরি করো। আমার কাছে জমা দাও। পয়েন্ট ঝাড়াই বাছাই করে পার্টির কাছে প্রস্তাব হিসেবে পাঠাব।’
শেখর জিগ্যেস করেছিল, ‘সব এলসি কি নোট তৈরি করবে?’
জেলা সেক্রেটারি বললেন, ‘খেপেছ? সবাই জানে কী? নতুন করে পথ চিহ্নিত করবার কথা কথা কেউ ভাবে নাকি? বেশিরভাগই তো গয়ংগচ্ছ। যা চলছে তাই চলবে। আমি তোমার কাছ থেকে নেব, আমি নিজেও তৈরি করব।’
শেখর বলল, ‘এই নোটে কী থাকবে?’
সেক্রেটারি বললেন, ‘কী আবার থাকবে? অর্গানাইজেশন ঢেলে সাজানোর কথা থাকবে। জোরদার করবার কথা থাকবে। আরও ডিসেনট্রালাইজেশনের কথা থাকবে। নীচের কমিটিগুলোকে কীভাবে আরও শক্তিশালী করা যায় সেই কথা ভাবতে হবে। কখন জেলা প্রাোগ্রাম পাঠাল তার জন্য হ্যাপিত্যেশ করে বসে না থেকে লোকাল ব্রাঞ্চকে নিজের মতো কর্মসূচি ঠিক করতে হবে। নিজের এলাকার এমন অনেক অ্যাক্টিভিটিস হতে পারে যা আমরা ওপরে বসে ভাবতে পারি না। তুমি সবদিক ভেবেচিন্তে একটা নোটস পাঠাও শেখর।’
শেখর ক’দিন ভাবনাচিন্তা করেছে। তার মনে হয়েছে, একেবারে শুরু থেকে ভাবাটাই উচিত। বিভিন্ন বামপন্থী দলগুলো কীভাবে তাদের সংগঠন গড়েছিল সেগুলো একবার ঘষে মেজে দেখা যেতে পারে। সবার থেকে ভালো দিকটা নিয়ে নিজেদের চলবার দিশা বের করতে পারলে সবথেকে ভালো হয়। এই ভাবনা নিয়েই সে লিখতে বসেছে। আজ সকালে বেরোনো হয়নি। খুব বৃষ্টি পড়ছে। ছেলে পরীক্ষার পর ছুটি পেয়ে দু’দিনের জন্য মামাবাড়িতে গেছে। তমসা স্কুলে। সে যখন বেরিয়েছে, বৃষ্টি খানিকটা থমকে ছিল। বাড়িতে একা বসে শেখর মন দিয়ে লিখে চলেছে।
আমাদের পার্টির আদর্শ বিশ্বাস, ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে যদি স্বত:স্ফূর্ত আবেগ তৈরি করতে পারি তাহলে সংগঠন নিজে থেকেই গড়ে উঠবে। আমরা আগেই বুদ্ধিজীবীদের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাই। পাড়ায় পাড়ায় তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করবার সময় দেওয়া হোক। অতি বিপ্লবী দলের ভ্রান্ত পথ যেমন আমাদের কাছে পরিত্যজ্য, তেমন তাদের সাংগঠনিক কৌশল আমাদের গ্রহণ করবার মধ্যে কোনও দোষ নেই।
ডোর বেল বাজল। কেউ এসেছে। শেখর পেন নামিয়ে উঠে পড়ল। সামনে রাখা হাতঘড়িটা তুলে দেখল একটা বেজে গেছে। অনেক বেলা হল। সদর দরজার কাছে যেতে যেতে শেখর বুঝতে পারল, বৃষ্টির বেগ বেড়েছে।
দরজা খুলেই ঝাপটা মেরে খানিকটা বৃষ্টি ঘরে ঢুকে পড়ল। ভিজে চুপচুপে হয়ে তমসা দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ছাতা। শিকভাঙা, নড়বড়ে ছাতা বৃষ্টি ঠেকাতে পারেনি। তমসাকে ভিজিয়ে ছেড়েছে।
তমসা ছাতা বন্ধ করতে করতে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল।
শেখর বলল, ‘কী হল? চলে এলে যে?’
তমসা এবার দরজা আটকে দিতে দিতে বলল, ‘রেনি ডে হয়ে গেল। আরও যদি বৃষ্টি বাড়ে, তাই ছুটি। সরো, আগে বাথরুমে যাই।’
শেখর বলল, ‘ইস একদম ভিজে গেছে। একটা রিকশো পেলে না?’
তমসা বলল, ‘কেউ আসতে চাইল না।’
তমসা বাথরুমের দিকে এগিয়ে বলল, ‘রাস্তায় জল জমেছে কিন্তু।’
শেখর সিগারেট ধরাল। বলল, ‘তা তো জমবেই, এইভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে ঘরেও জল ঢুকবে।’
তমসা বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘খেয়েছ?’
শেখর নিজের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে, ‘না। বিকেলে পার্টি অফিস যাব কী করে ভাবছি।’
তমসা বাথরুমের ভিতর থেকে বলল, ‘খাওনি তো সিগারেট ধরালে কেন? বিকেলে বেরোতে পারবে বলে মনে হয় না।’
শেখর টেবিলে ফিরে এল। লেখাটা শেষ করতে হবে। তবে এখন আর হবে বলে মনে হয় না। মুডটা কেটে গেল। খেয়ে নিয়ে আর একবার চেষ্টা করতে হবে। যদিও তমসা চলে আসায় ভালোই হয়েছে। খাবার টাবারগুলো গুছিয়ে দেবে।
বরকে ভাত দিয়ে তমসাও বসে পড়ল। সে খেয়ে স্কুলে গিয়েছিল, তারপরেও খিদে পেয়ে গেছে। এতটা পথ বৃষ্টিতে হেঁটে এলে খিদে পাবারই কথা। এক হাতা ভাত খেলে ভালো হয়। বেশি করে লঙ্কা পেঁয়াজ দিয়ে অমলেট ভেজে নিল। বৃষ্টির সময় ভাত ডালের সঙ্গে ঝাল ঝাল অমলেট অমৃত।
শেখর বলল, ‘একটা নোট তৈরি করছি।’
তমসা বলল, ‘কীসের নোটস?’
শেখর বলল, ‘অর্গানাইজেশন রিফর্ম।’
তমসা বলল, ‘তোমার কথা কে শুনবে? তুমি পার্টি সংগঠনের পুনর্বিন্যাস করবার কে?’
শেখর বলে, ‘এটা কোনও কথা নয়। ঠিকমতো বোঝাতে পারলে নিশ্চয় কিছুটা শুনবে। আর এ তো কোনও অফিসিয়াল পেপার নয়। জেলা সেক্রেটারি নিজের উদ্যোগে কিছু প্রাোপোসাল পাঠাতে চাইছে। আমার কাছ থেকে পয়েন্টস চেয়েছেন। ভালো কথা। ব্রাঞ্চ, লোকাল, জোনাল কমিটিগুলি যদি শক্তিশালী হয়, সংখ্যায় বাড়ে সেটা তো পার্টির জন্য ভালো।
তমসা খানিকটা নিস্পৃহ ভাবে বলল, ‘যদি হয় ভালোই তো।’
শেখর বলল, ‘আমি খেয়ে উঠে লেখাটা শেষ করব। বিকেলে তোমাকে পড়াব। একটু দেখে দেবে। মনে হচ্ছে, একটু বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। হোক বিতর্ক। বিতর্ক না থাকলে কোনও পার্টি টিকতে পারে না।’
তমসা বলল, ‘আচ্ছা দিও।’
শেখর ভেবেছিল খাবার পরই লিখতে বসবে। বৃষ্টি আরও বেড়েছে। তমসার সঙ্গে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল।
তমসা উদ্ভাসিত গলায় বলল, ‘দেখ, কী সুন্দর! চারপাশ একবারে সাদা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সাদা ওড়না দিয়ে কিশোরী মুখ ঢেকে হাসছে। সেই হাসির সঙ্গে কান্নার মতো ঝরে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা! এই হাসি কান্না বুঝতে পারা যায়, আবার যায়ও না। তাই এত ভালো।’
শেখর বলল, ‘পার্টিকে বাচাতে গেলে আগে সংগঠনকে…।’
তমসা ঘুরে দাঁড়িয়ে শেখরের ঠোঁটে আঙুল দিল। মুচকি হেসে অস্ফুটে বলল, ‘তোমারে পাছে সহজে বুঝি, তাই কি এত লীলার ছল/ বাহিরে যবে হাসির ছটা, ভিতরে থাকে আঁখির জল। / বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা—/ যে কথা তুমি বলতে চাও, সে কথা তুমি বলো না।’
শেখর বউকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় নিয়ে এল। পোশাক খুলতে লাগল অতি যত্ন করে। যেন ফুল সাজাচ্ছে। বৃষ্টিদিনের আঁধার ঘরে শুধু মেঘের আলো। সেই ভেজা আলোয় নগ্ন তমসাকে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী, জীবনের পরম আনন্দ মুহূর্তের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। বুকে মুখ নামিয়ে শেখর ঘ্রাণ নিল।
‘তমসা, তুমি সাবান মাখোনি।’
তমসা দু’হাত দিয়ে শেখরের এলোমেলো চুল চেপে ধরল গভীর আশ্লেষে।
‘না, মাখিনি।’
জলের ফোঁটার মতো নাভিতে দাড়ি না কামানো গাল ঘষতে ঘষতে জড়ানো গলায় শেখর বলল, ‘কেন?’
শেখরের কাঁধ খিমচে ধরে তমসা বলল, ‘তোমরা জন্য গায়ে বৃষ্টি রেখে দিয়েছি।’
শেখর সেই বৃষ্টিতে ডুব দিল। মেঘের গর্জন মুচকি হেসে তমসার শিৎকার ঢেকে দিল পরম ভালোবাসায়।
বিকেলে জেলা অফিস থেকে ফোন করে শেখরকে জানানো হল, তার লোকাল কমিটি ভেঙে দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে পার্টিতে এত কমিটির কোনও প্রয়োজন নেই।
তেষট্টি
ডিয়ার বারিধারা,
আমাকে কি আপনার মনে আছে?
যদি মনে না থাকে তা হলে গলা জড়িয়ে একটা চুমু পাবেন। আর যদি থাকে তা হলে পাবেন চাঁটি। এবার বলুন ম্যাডাম, কোনটা আপনার চাই? চুমু না চাঁটি? অবশ্য আমার চুমু আপনার মোটেও পছন্দ হবে না। শ্রবণের চুমু পেয়ে আপনার স্বভাব অতিশয় খারাপ হয়ে গেছে। অন্য কারও চুমু সইবে না। খ্যাসটা মার্কা লাগবে। তার ওপর মেয়েমানুষের চুমু। ছ্যা।
কীরে বারিধারা আমার মুখে চুমুর কথা শুনে অবাক লাগছে? হি হি। ঠিক করেছি, এই চিঠি লিখতে লিখতে যখনই আমার হাসি পাবে, অমনি আমি সেই হাসির কথা তোকে জানাব। এখন তো আমরা মুখোমুখি নেই, তুই আমার হাসি দেখতেও পাবি না। তাই লিখে লিখেই জানাব। এখন যেমন ‘হি হি’ লিখে জানালাম।
ঠাট্টা নয়, সত্যি বলছি, যেদিন তোর সঙ্গে দেখা হবে তোকে চুমু না খাই, ঠিক খিমচে দেব। তোর ওপর খুব রাগ হয়েছে। তিথিকে তুই ভুলে গেলি! সেই যে বিয়ে বলে ইউনিভার্সিটি থেকে চলে এলাম, তারপর একটা খোঁজ পর্যন্ত নিস না। আমার মনে আছে, তোর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছে ক্যান্টিনে। তুই আমাকে ডাকলি, অ্যাই তিথি, আমি না শুনতে পাওয়ার ভান করে বেরিয়ে গেলাম। তাই না? আমি জানি, তুই নানা কৈফিয়েত দিবি। বলবি, তিথি, তুই তো সেদিন পালিয়ে গেলি। বলবি, বিয়ে করে নিজেই বেপাত্তা হয়েছিস। বলবি তিথি, তুই কি মোবাইলের নম্বরও বদলে ফেলেছিস? ফেসবুকেও থাকিস না। হোয়াটসঅ্যাপে নেই। এমএ শেষ করা তো দূরের কথা, বিয়ের পর ইউনিভার্সিটির দিকে পা পর্যন্ত বাড়াসনি। তুই কি এখন বিদেশে? আর সব্বার শেষে বলবি, তুই তো নিজেও একটা ফোন করতে পারতিস? এরকম হাজার কথা শোনাবি। তাই তো? আচ্ছা বাবা, আমি হার স্বীকার করছি। সব দোষ আমার। হয়েছে? সত্যি, আমরাই উচিত ছিল তোকে ফোন করা, যোগাযোগ করা। কেন করি না জানিস? আমার লজ্জা করে। অপরাধবোধ জাগে। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। কথাগুলো কি সস্তা নাটকের মতো শোনাচ্ছে? হি হি। বিয়ের পর ঘর সংসার করতে এসে আমি খুব নাটুকে হয়ে গিয়েছি।
আজ সকালে ঘুম ভেঙেছে বৃষ্টিতে। ধড়াম ধড়াম করে বাজ পড়ছিল। কলকাতার বাইরে ঝড়বৃষ্টি বেশি হয়। আমার বাপের বাড়িতেও তাই হত। আমি খাট থেকে নেমে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর জানলার পাল্লা খুলে অনেকক্ষণ হাত বার করে ভিজলাম। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর তোকে চিঠি লিখতে বসে গেলাম।
এরকম একটা বৃষ্টির দুপুর ছিল সেটা। ইউনিভার্সিটির তিনতলার বারান্দায় দুজনে গল্প করছিলাম। হঠাৎ আকাশ ফাকাশ কালো করে হেভি বৃষ্টি নামল। তুই চোখ চকচক করে বললি, ‘অ্যাই তিথি ভিজিবি? চল না নীচে নেমে ভিজি।’
আমি বললাম, ‘খেপেছিস? ইউনিভার্সিটিতে ভিজব কী!’
তুই চোখ পাকিয়ে বললি, ‘কেন ইউনিভার্সিটিতে কি ভেজা বারণ?’
তোর উদ্ভট কথায় আমি সবসময় মজা পেতাম। বললাম, ‘অবশ্যই বারণ। এখানে ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে, বৃষ্টিতে ভিজতে আসে না।’
তুই বললি, ‘তোকে কে বলল লেখাপড়া করবার জায়গায় ভেজা যায় না? এক সময়ে শান্তিনিকেতনে বৃষ্টি পড়লে মাস্টারমশাইরা ছেলেমেয়েদের ভেজবার জন্য ছুটি দিয়ে দিতেন। ছেলেমেয়েরা গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে গাইতে গাইতে সাইকেল চালিয়ে ভিজতে ভিজতে খোয়াই, কোপাইতে চলে যেত। তাদের সঙ্গে মাস্টারমশাইরাও যেতেন। আমি বইতে পড়েছি।’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘এটা শান্তিনিকেতন নয় আর আমাদের ভি সি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন।’
তুই বললি, ‘নো প্রবলেম, চল, আমরা একটা জোব্বা নিয়ে ভি সি-র কাছে যাই। গিয়ে বলি স্যর আপনি এই জোব্বাটা গায়ে চাপিয়ে কিছুক্ষণের জন্য রবি ঠাকুর হয়ে যান।’
আমরা দুজনেই খুব হাসতে লাগলাম। এরপর তুই বললি, ‘দাঁড়া, তোকে ভেজবার একটা কায়দা শিখিয়ে দিই। যখন পুরো ভিজতে পারবি না তখন বৃষ্টিতে হাত বাড়িয়ে রাখবি। এক সময় দেখবি বৃষ্টির জল তোর মন পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়েছে।’
তারপর আমরা দুজনে বারান্দা থেকে হাত বের করে জল ধরতে লাগলাম। মনে আছে? হি হি।
বারিধারা দেখেছিস এতদিন পরেও তোর কথা কেমন সব মনে রেখেছি? একেবারে ডায়লগ টু ডায়লগ বলে যাচ্ছি। তুই নিশ্চয় অবাক হচ্ছিস। ভাবছিস, গাধা মেয়েটার মেমরি এত শার্প! আসলে কী জানিস বারিধারা, যা মনে থাকবার তা নিজেই থেকে যায়। মন বাকি সব ফেলে দেয়।
বারিধারা, তোর চেনা তিথি একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে। সেই গল্প বলতেই আজ তোকে এই চিঠি লেখা।
বিয়ের পর গোলমাল হয়ে গেল। সেই গোলমালের কথা কাউকে বলতেও পারি না। আমার তো বন্ধু নেই। ছোটবেলায় তেমন করে কারও সঙ্গে মিশতে পারিনি। বড় হয়েও নয়। সত্যি কথা বলতে কী, তুই ছাড়া ইউনিভার্সিটিতে কারও সঙ্গে তেমন করে মিশিনি। অথচ তোকেই কেমন অপমানের মধ্যে ফেলেছি। ইউনিভার্সিটির বখাটে ছেলে যেদিন আমাকে নোংরা কথা বলল, সেদিন তুই এগিয়ে গিয়েছিলি। আমি ভয়ে পালিয়ে গেলাম। পালিয়ে শুধু যাইনি, তোকে মিথ্যেবাদীও বলে এসেছি। এরপরে কোন লজ্জায় তোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখি বল তো? আমি ডুব মেরেছিলাম। ভালো করেছিলাম না? শুধু আমার অন্যায়টা দেখবি, আমার লজ্জাটা দেখবি না? লজ্জাটাও তো একটা শাস্তি। নিজের একমাত্র ভালোবাসার বন্ধুর থেকে নিজেকে সরিয়ে শাস্তি দিয়েছি।
বারিধারা, তুই আবার ভাবতে বসিস না, আজ বৃষ্টি বলে আমি ইমোশনাল হয়ে তোর কাছে ক্ষমা চাইতে বসেছি। মোটেই নয় বস। কোথায় যেন শুনেছিলাম, আকাশ মেঘলা থাকলে মানুষের অনুভূতিগুলি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এ সব কবিদের হয়, আমার মতো হাবিজাবিদের হয় না। আমি সেদিন যা করেছিলাম, ঠিকই করেছিলাম বারিধারা। আমার মতো ভিতু, স্বার্থপর মানুষের (নাকি অমানুষ?) জন্য ওটাই সাজে। আমি মধুজা ম্যাডামের কাছে গিয়ে বলে এসেছিলাম, বারিধারা আমার নামে যা বলেছে সেটা সত্য নয়। দিন, আমি লিখে দিচ্ছি কেউ আমাকে অপমান করেনি। মধুজা রায় আমাকে ডেকে পাঠালে সেদিন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, একটা ছেলে আমার সঙ্গে নোংরা ব্যবহার করেছে, এটা জানাজানি হয়ে গেলে সর্বনাশ। বিয়ে ভেঙে যাবে। আমার বাড়ি থেকে ইউনিভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দেবে। একবারও তোর সাহস, তোর প্রতিবাদের কথা মাথায় আসেনি। আমার মতো মেয়ের জন্য এটাই স্বাভাবিক। তাই না? তোর কাছে ক্ষমা চাইতে যাব কোন দু:খে? হি হি।
তা হলে এতদিন টেলিফোন করিনি কেন? না, সবটা লজ্জায় নয়। তুই শুনে খুশি হবি, আমার পুরোনো মোবাইল ফোনটি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। বাজেয়াপ্ত শুনে হাসছিস? হি হি। দেখ, আমিও হাসছি। ঘটনা কিন্তু সত্যি। বিয়ের পর যখন এ বাড়িতে এলাম, তার কিছুদিনের মধ্যে আমার বর বাবাজীবন বলল, ‘তি, তুমি তোমার মোবাইল ফোনটা আমার কাছে রেখে দাও।’
আমার বর বিয়ের পরদিন থেকেই আমাকে ‘তি’ ডাকে। আদরের ডাক। একদিনের আলাপে এত আদর ভাবা যায় না। আমিও ভাবতে পারিনি। আনন্দে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হল আমার। দ্রুত সেই পাগলামি কাটল। আদরের ভিতরে অন্ধকারটা দেখতে পেলাম। শৌর্য, আমার বরের নাম, সুন্দর নাম না? যখন সম্বন্ধ এসেছিল, তখন কতদিন একা একা রাতে ফিসফিস করে বলতাম, ‘শৌর্য, শৌর্য, শৌর্য…।’ হি হি।
বারিধারা, আবার আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। তোর ওখানে কি বৃষ্টি পড়ছে? এই চিঠি তোকে কীভাবে পাঠাব? আমি তো তোর ঠিকানা জানি না। আচ্ছা, একটা কাজ করব, ইউনিভার্সিটি গিয়ে ডিপার্টমেন্টে রেখে আসব। আর যদি বলিস চিঠি নিয়ে সটান তোর বাড়ি চলে যেতে পারি। এই রে তোর বাড়িও যে চিনি না। ইস কেমন পাগলের মতো বকছি। হি হি। আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি।
শৌর্যরা ধনী। পারিবারিক ব্যবসা। যখন বিয়ের কথা বলতে তার বাবা-মা-বোনেরা আমাদের বাড়ি এসেছিল, তখন মনে হয়েছিল যেমন অভিজাত, তেমন সম্ভ্রান্ত। সবাই নীচু গলায় কথা বলে। অল্প হাসে। শিক্ষিত তো। ওরা চলে যাওয়ার পর বাবা বলেছিল, ‘টাকা-পয়সাটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল মানুষগুলো বড্ড ভদ্রলোক।’
সেই ‘ভদ্রলোক’ বুঝতে, চিনতে পারলাম অতি অল্প সময়ে। শৌর্য যখন আমার মোবাইল ফোন চাইল আমি অবাক হলাম।
‘আমার ফোন দেব কেন?’
শৌর্য বলল, ‘দেবে কারণ এখন আর তুমি আলাদা কেউ নয়। তুমি আর আমি এক। এবার তোমাকে একার জিনিস বাদ দিতে হবে। আমি তোমাকে নতুন ফোন দেব। দামি ফোন। সেখানে আমাকে জিগ্যেস করে তুমি নম্বর লিখে দেবে।’
আমি আরও অবাক হয়ে গেলাম, ‘এখানে যে আমার অনেক নম্বর আছে। পুরোনো নম্বর।’
শৌর্য আবার হাসল। জানিস বারিধারা, আমার বর সুপুরুষ। তার হাসিও সুন্দর! সেই সুন্দর হাসি হেসে বলল, ‘পুরোনো ঘরবাড়ি ছেড়েছ, পুরোনো পরিচিতও ছাড়বে। এখন থেকে আমার পরিচিতরাই তোমার পরিচিত হবে তি।’
আমি প্রায় কেঁদেই ফেললাম। বললাম, ‘কিছুতেই না।’
শৌর্য এবার কঠিন গলায় চাপা ধমক দিয়ে বলল, ‘আমি কোনও কথা দু’বার বলা পছন্দ করি না। আমি চাই না তুমি এমন কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখো যাকে আমি চিনি না। ফোন আমার কাছে দাও।’
জানিস বারিধারা, আমি সেদিনই বুঝেছিলাম। আমার বিয়ে খুব ভুল জায়গায় হল। এরপর শৌর্যর গোটা বাড়ি আমার পায়ে একটার পর একটা শিকল পরাতে লাগল। আমার লেখাপড়া বন্ধ করল। আমার বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ করল। আমার নিজের পছন্দ, ভালো লাগে এমন সব বন্ধ করল। বাপের বাড়িতে যেতে হলে অনুমতি লাগে। মাকে ফোন করতে হলে অনুমতি লাগে। নিজের মনের মতো একটা জিনিস কিনতে অনুমতি লাগে। এমনকী নিজের পছন্দ মতো সাজগোজ করতেও পারি না। কখনও বর চোখ পাকায়, কখনও শাশুড়ি-ননদ, এমনকী শ্বশুরমশাই পর্যন্ত।
মেয়েরা এখন আকাশে উড়তে পারে। কেউ অলিম্পিকে আকাশে ভল্ট দিচ্ছে, কেউ মহাকাশযানে চেপে মঙ্গলগ্রহে পাড়ি দেয়, কেউ যুদ্ধ বিমানের পাইলট। অথচ আমি একটা মেয়ে হয়ে পাঁকে গড়াগড়ি খাচ্ছি। মেয়েতে মেয়েতে কত তফাত! আমার ঘটনা শুনতে কেমন লাগছে বারিধারা? পচা মেগা সিরিয়ালের মতো না? হি হি। আমারও তাই মনে হতে লাগল। ভাবতে লাগলাম সিরিয়াল একদিন শেষ হবে। আমিও একদিন আকাশে উড়ব।
শেষ হল না। মিথ্যে জিনিস শেষ হয়, সত্য শেষ হয় না। এতদিন যে জিনিস সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না, এবার বুঝতে পারলাম তার দাম কত বেশি। তা হল নিজের স্বাধীনতা, নিজের অধিকার, নিজের মতামত। লুকিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। শাশুড়ি বুঝতে পারলে তেড়ে আসত। জানিস, বারিধারা, বই নিয়ে বসলেও শৌর্য রেগে যেত। ধমক দিয়ে বলত, ‘বাড়ির বউ হয়েছ। বউ পড়ে সময় নষ্ট করো কেন?’ ভিতু আমি, শান্ত আমি বই বন্ধ করে রাখতাম। নিজেকে বন্দি করেই রাখতে শিখলাম। শৌর্য কিন্তু ভদ্র সভ্য। মদ, মেয়েমানুষ, বাইরের নেশা—কোনও দোষ নেই। ব্যবসার কাজ মন দিয়ে করে। বাড়ি ফিরে এসে আমাকেই শুধু চায়। নিয়মমতো বরের চাওয়া সুখের হওয়ার কথা, শৌর্যর চাওয়া ভয়ঙ্কর। একেক সময় মনে হয় পারভার্ট। বিকৃত। ইচ্ছে না থাকলেও কাপড় খুলে তার কাছে যেতে হবে। উদোম করে যত না ভোগ করে তার বেশি অপমান করে, যন্ত্রণা দেয়। এ কথা কাকে বলব? কে শুনবে? স্বামী স্ত্রীর শরীর কীভাবে ভোগ করবে সে তো তার অধিকার। আদরে সোহাগে না মেরে ধরে, আঁচড়ে, কামড়ে সে বুঝবে। তুমি বলবার কে হে? ভাবতাম পালিয়ে যাব। সাহসে কুলোয়নি। সবাই কী বলবে? সমাজ কী বলবে? মা বুঝতে পেরে বলত ‘মানিয়ে নে।’ বাবা বলত, ‘একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।’
বারিধারা আজ মনে হয় বৃষ্টি থামবে না। বেশ হয় না থামলে। সব ভেসে যাক। আমার ঘ্যানঘ্যানানি কেমন লাগছে? দাঁড়া, আর একটু বাকি আছে।
কাল একটা কাণ্ড করেছি। তুই বিশ্বাসই করবি না। সত্যি কথা বলতে কী, সেই ঘটনা জানাতেই আমার এই লম্বা চিঠি। কাল রাতে তখন খুব বৃষ্টি নেমেছে। আমি জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। শৌর্য ঘরে এসে নরম গলায় বলল, ‘তি, কী করছ?’ আমি চুপ করে রইলাম। শৌর্য খাটে বসে বলল, ‘তি, চলে এসো।’ আমি চুপ করে রইলাম। শৌর্য এবার অধৈর্য হয়ে উঠল। আমি জানলা দিয়ে অন্ধকারে বৃষ্টি দেখতে লাগলাম। কী ভালো যে লাগছিল বারিধারা, তোকে কী বলব! শৌর্য এবার উঠে এসে আমার পিছনে দাঁড়াল। কড়া গলায় বলল, ‘এতবার ডাকছি শুনতে পারছ না?’
আমি অস্ফুটে বললাম, ‘না। পাচ্ছি না।’
শৌর্য আমার হাত ধরে তার দিকে ফেরাতে চেষ্টা করল। চোখ মটকে বিশ্রী হেসে বলল, ‘এসো, কাপড় খুলে তোমার সুন্দর বুক দুটো দেখি।’
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম এবং ডান হাত তুলে শৌর্যর গালে সপাটে চড় মারলাম।
বারিধারা, সেদিন ইউনিভার্সিটিতে যা পারিনি, কাল সে কাজ পারলাম। সাহসী হতে অনেকটা সময় লাগল ঠিকই। তা লাগুক। সবারই সময় লাগে। মানুষ তো কোন ছাড়, পাখির ছানারও আকাশে উড়তে সময় লাগে। যাই হোক, আজ সকাল থেকে আমার বড় আমার দিকে ভয়ে-ভয়ে তাকাচ্ছে। তোর কি মনে হয়, ওর মা-বাবাকে নালিশ করেছে? করলে ভালো হয়। ওরাও আমাকে ভয় পাবে। যদি চড় মেরে দিই। হি হি।
যাক, এই হল আমার গল্প। এই গল্প তোকে না জানালে অন্যায় হত না?
এখন বল, এই চিঠি তোকে কেমন করে পাঠাব?
ইতি তোর ভিতু তিথি। হি হি।
চৌষট্টি
ঋষা অফিসে বসে আছে। তার চোখ মুখ থমথম করছে। কিছুদিন হল ঋষা এই চাকরিটা করছে। খুব বড় কিছু নয়, আবার একেবারে ছোটও নয়। একটা এনজিও অফিসে কাজ। কৃষ্ণকলি এই কাজটা তাকে জোগাড় করে দিয়েছে।
‘বাড়িতে বসে না থেকে কাজটা কর না।’
ঋষা বলেছিল, ‘দুর, আমার চাকরিবাকরি করতে ভালো লাগে না।’
কৃষ্ণকলি মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, ‘কেন? তুই কোন রাজনন্দিনী যে চাকরি করতে ভালো লাগে না? নাকি বাপের রাজত্ব আছে? খাজনার টাকায় খাস?’
ঋষা আড়মোড়া ভেঙে বলেছিল, ‘এই তো সবে ইউনিভার্সিটির পাট চুকোলাম। এখন ক’টা দিন বিশ্রাম নিই।’
কৃষ্ণকলি রাগ করা গলায় বলল, ‘বিশ্রাম নিই বলছিস কেন? বল, ঘরে বসে, লিটল ম্যাগাজিন নামক একটা অখাদ্য জিনিসের পিছনে সময় নষ্ট করি। হাবিজাবি কিছু কবিতা লিখি। তাই তো?’
ঋষা খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে বন্ধুর দিকে মিটিমিটি হেসেছিল। বলেছিল, ‘কবিতার ওপর তোর এত রাগ কেন কৃষ্ণ? লিখতে পারিস না বলে?’
কৃষ্ণকলি ঠোঁট উলটে বলেছিল, ‘বয়ে গেছে আমার! কবিতা বাঙালি জাতিটাকে ভোগে পাঠিয়েছে। কবিতা লেখা মানে কাজ না করবার ধান্দা। একটা অলস জাতি তৈরি হয়েছে। সবার পিছনে পড়ে আছে।’
ঋষা আরও মিটিমিটি হেসে বলল, ‘তাহলে বলছিস রবীন্দ্রনাথ না জন্মালে বাঙালির মঙ্গল হত?’
কৃষ্ণকলি এবার তেড়েফুড়ে উঠে বলল, ‘মাঝে মাঝে তো তাই মনে হয়। সবাই নিজেকে রবীন্দ্রনাথ ভাবে। বানান ঠিক করে দু-ছত্র লিখতে পারে না এদিকে রবীন্দ্রনাথের মতো দাড়ি রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মারতে হয় ঠাঁটিয়ে চড়।’
ঋষা বালিশ আকঁড়ে ধরে বলে, ‘আহা, ভালো-মন্দ যাই হোক, কবিতা লিখছে তো। চুরি তো করছে না।’ কৃষ্ণকলি ভেংচি কেটে বলে, ‘আহা রে ধন্য করছে। কাজকর্ম না করে উনি কবিতা লিখছেন। লক্ষ লক্ষ ম্যান পাওয়ার নষ্ট। সারা দুনিয়ার অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের লক্ষ্য কাজ করব। আর এখানে দেখ, কী করো? না কবিতা লিখি।’
ঋষা এবার চিৎ হল। বলল, ‘তাহলে বলছিস কবিতা নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত? কবিতা লিখলেই ধরে ধরে জেলে পোরা ভালো?’
কৃষ্ণকলি জোরের সঙ্গে বলল, ‘অবশ্যই। বাঙালির এই অসুখ ছাড়াবার জন্য গভর্মেন্টের কড়া স্টেপ নেওয়া দরকার। কবিগুলোকে ধরে তিনটে করে কবিতা লিখতে দেওয়া হোক। পরীক্ষা করে দেখা হবে সেগুলো। কবিতা হয়েছে কিনা। ফেল করলেই পাথর ভাঙতে পাঠিয়ে দাও। কবিগিরি ছুটে যাবে।’
ঋষা হাসতে হাসতে উঠে বসল। বলল, ‘ভাগ্যিস কৃষ্ণ তুই গভর্মেন্টের কেউ নোস। তাহলে কবিদের বিরাট ঝামেলা হত।’
কৃষ্ণকলি দাঁতে দাঁতে ঘষে বলল, ‘আমি এমনিই ঝামেলা করে ছাড়ব। আমাকে গভমেন্টের কেউ হতে হবে না। এখন যেমন তোর সঙ্গে ঝামেলা করব। তোকে কাজে পাঠাব।’
ঋষা বলল, ‘কী কাজ?’
কৃষ্ণকলি বলল, ‘একটা এন জি ও। ভালো ছেলেমেয়ে খুঁজছে। আমার এক দিদি ওখানে আছে। আমাকে বলল, দেখ না, সিরিয়াস, বুদ্ধিমতী যদি কাউকে পাস।’
ঋষা বলল, ‘রক্ষে কর। এনজিও মানে ঘুরে ঘুরে জনসেবা তো? আমি নেই।’
কৃষ্ণকলি বলল, ‘ঘুরে ঘুরে নয়। অফিসে বসতে হবে। এরা খুব ভালো কাজ করে। খুব বেশি টাকা হয় তো দেবে না, আবার একেবারে খারাপও নয়। তোর এই পিজি খরচ অনায়াসে উঠে যাবে।’
ঋষা বলল, ‘কাজটা তুই নিচ্ছিস না কেন?’
কৃষ্ণকলি বলল, ‘গাধার মতো কথা বলছিস কেন? কবিতা লিখে লিখে বুদ্ধিসুদ্ধি একেবারে গেছে দেখছি। আমার ফাইনাল ইয়ার চলছে না? তুই কি বলছিস সে সব ছেড়ে চাকরি করব?’
ঋষা তারপর দুটো দিন ভেবেছে। তার ইচ্ছে আছে পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পর নেটের জন্য প্রিপারেশন শুরু করবে। রিসার্চও করবে। সে কলেজে পড়াতে চায়। তার জন্য অনেকটা সময় লাগবে। তার আগে এন জি ও-র কাজটা কদিন করে দেখলে ক্ষতি কী? হাতে কিছু টাকা পয়সা পেলে ভালোই হয়। অর্চিনকে সাহায্য করা যাবে। ওর মায়ের কেস চালানোর টাকা পয়সা অবশ্য সব সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস দিচ্ছে। কিন্তু অর্চিনের নিজের জন্যও তো টাকা পয়সা দরকার। যদিও অর্চিন তার উপার্জনের টাকা নেবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। তা থাক। জোর করতে হবে। নিজে উপার্জন না করলে জোরও তো করা যায় না। অবশ্য অর্চিন সুন্দরবনে একটা ছোটখাটো কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। ওখানকার একটা কো-অপারেটিভে হিসেব দেখে। মাছের কো-অপারেটিভ। পাকা কাজ নয়। সপ্তাহে তিনদিন যেতে হয়। ওরা অর্চিনের বিষয় তেমন কিছুই জানেন না।
কৃষ্ণকলি ওর দিদির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিল। ঋষা অফিসে গিয়ে দেখল, সত্যি কাজটা ভালো। এন জি ও-র নাম ‘উওম্যান হেলথ’। গ্রামে গ্রামে ঘুরে গরিব মেয়েদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে। এর জন্য এদের বড় টিম আছে। তারা যে তথ্য পায় সেগুলো অফিসে এনে রিপোর্ট তৈরি হয়। রিপোর্ট পাঠানো হয় হু, ইউনেসকো ধরনের বড় বড় সংগঠনে। এই সব সংগঠন সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য টাকা অনুমোদন করে। কিন্তু কোন প্রকল্পে, কাকে টাকা পাঠানো হবে তার জন্য আগে ভালো করে খোঁজ খবর নেয়। শুধু সরকারের পাঠানো তথ্যের ওপর নির্ভর করে না। তথ্য অনেক সময়ই অসম্পূর্ণ, পক্ষপাতদুষ্ট, জল মেশানো হয়। তাই হু, ইউনেসকো বহু এন জিও-র সঙ্গে ব্যবস্থা করেছে। তাদের কাছ থেকে রিপোর্ট নেয়। ‘উওম্যান হেলথ’ তেমনই একটা এন জি ও। ঋষার কাজ হল, ডেটা থেকে রিপোর্টের একটা অংশ তৈরি করে দেওয়া। সাতদিন কাজ করেই ঋষার সামনে একটা অন্য জগৎ খুলে গেল। সেই জগৎ যথেষ্ট দু:খের। গ্রামগঞ্জের মেয়েরা শারীরিক ভাবে যে কত ধরনের সমস্যার মধ্যে আছে তার কোনও শেষ নেই! অপুষ্টি একটা গভীর সমস্যা। এর সঙ্গে তো মা হওয়ার সময়কার সমস্যা, বিভিন্ন অসুখে চিকিৎসা না পাবার সমস্যা, রক্তাল্পতার সমস্যা তো রয়েছেই। ঋষার যেমন দু:খ হল, তেমন কাজ করবার জন্য মনে জোরও পেল। মনে হতে লাগল, এই কাজটা আর পাঁচটা চাকরির মতো শুধু উপার্জন নন, তার ওপরেও আরও কিছু আছে।
ঋষার কাজের উৎসাহে সবথেকে খুশি কৃষ্ণকলি।
‘শালা, আমার ওপর কৃতজ্ঞ থাকবি। মনে রাখবি, আমার মতো একজন পিজি পার্টনার পেয়েছিলি। আমিই না তোকে জোর জবরদস্তি করে ওখানে পাঠালাম। শালা, মুঝে ইয়াদ রাখোগি।’
ঋষা হেসে বলল, ‘শালা নয়, শালী বল। প্রথম মাসের মাইনে পেলে কী নিবি বল? কবিতার বই দেব?’
কৃষ্ণকলি বলল, ‘কবিতার বই! মারব একটা চড়। কবিতা তুমি মাথায় তুলে রাখো। আমাকে রেস্তোরাঁয় খাওয়াবি।’
ঋষা হেসে বলল, ‘সে না হয় খাওয়াব। কিন্তু কবিতার বই তোকে আমি দেবই দেব।’
এরপর কৃষ্ণকলি এগিয়ে এসে পিছন থেকে ঋষাকে জড়িয়ে ধরে। কানের কাছে মুখ নিয়ে হাসি হাসি মুখে বলে, ‘এই একটা মজার কাণ্ড হয়েছে। আমার মনে হয় প্রেম হয়েছে।’
ঋষা নির্লিপ্ত গলায় বলে, ‘হতেই পারে। তোর প্রেম হওয়াটা নতুন কিছু নয়। এটা কত নম্বর হল?’
কৃষ্ণকলি বান্ধবীকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘কেন, হিংসে হচ্ছে? আমি কি তোমার মতো ননী যে একজনকেই পেয়ে গলে যাব? ওগো আমার প্রাণসখা গো বলে যাত্রা দলের সখী হয়ে থাকব?’
ঋষা মুচকি হেসে বলল, ‘আহা, রাগ করছিস কেন? আমি তো খারাপ কিছু বলিনি, শুধু বলছি এটা তোর কত নম্বর প্রেম? আমি যতদিন দেখছি, তাতে হিসেব করলে মিনিয়াম এগারো বা বারো হবে। হবে না? নাকি আর দু-একটা বেশি?’
কথা শেষ করে খিলখিল করে হেসে উঠল ঋষা। কৃষ্ণকলি বলল, ‘বারো হোক, একশো বারো হোক, তোর কী?’
ঋষা সিরিয়াস হবার ভান করে বলল, ‘আমার কিছু নয়। আচ্ছা, বলো এবারের প্রেমিকটি কে শুনি। তুই ডায়েরিতে লিখে রাখিস তো কৃষ্ণ? নইলে গুলিয়ে যাবে।’
ঋষা এবার আরও জোরে হেসে উঠল।
কৃষ্ণকলি বলল, ‘যা বলব না।’
ঋষা কৃষ্ণকলিকে চেপে ধরে বলল, ‘আহা ননীর বন্ধু ফণী, রাগ করে না বাবু। নামটা শুনেই ফেলি।’
কৃষ্ণকলির চোখ বড় করে বলল, ‘নামটা আসল কথা নয়। ছেলে কী করে শুনলে চমকে যাবি ঋষা। সেন্সও হারাতে পারিস।’
ঋষা বলল, ‘সে কী রে! বল, বল। শুনে ধড়াস করে অজ্ঞান হয়ে পড়ি।’
কৃষ্ণকলি চোখ নাচিয়ে বলল, ‘এই ছেলে কবিতা লেখে। শুধু কবিতা লেখে না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো দাড়িও আছে।’
ঋষা সত্যি সত্যি চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল।
‘ঠাট্টা করছিস?’
কৃষ্ণকলি বলল, ‘ঠাট্টা না। ছেলের একটা বইও আছে। কবিতার বই। বইয়ের নাম…বইয়ের নাম…বইয়ের নাম…যা: নামটা ভুলে গেলাম।’
ঋষা বলল, ‘আর ইউ সিরিয়াস? নাকি বাকি প্রেমগুলোর মতো এটাও খুব তাড়াতাড়ি গণ কেস হবে?’
কৃষ্ণকলি নাটুকে কায়দায় বলল, ‘ভবিষ্যতে কী হবে তা জানি না বৎস্য। তবে এখন তো ঘটনা সিরিয়াসই মনে হচ্ছে।’
ঋষা নিজের বুকে হাত রেখে বলল, ‘কেমন ধড়াস ধড়াস করছে। সাসপেন্সে না রেখে এবার সবটা বলে ফেল। সত্যি সত্যি কিন্তু সেন্স হারাব। এমন একজন কবিতাবিরোধী কন্যার সঙ্গে কবির প্রেম!’
ঘটনা গুছিয়ে বলল কৃষ্ণকলি।
ক’দিন আগে কলেজ স্ট্রিটে অটো ধরবে বলে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ কথা কাটাকাটি শুনে পিছনে ফিরে দেখে পাঞ্জাবি পরা, দাঁড়ি গোঁফওয়ালা এক যুবক এক ট্যাক্সিওয়ালাকে শান্ত ভাবে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। হাত-পা ছুড়ে ছেলেটির দিকে তেড়ে যাচ্ছে। পথের ঝগড়ায় মন দেওয়ার মতো সময় কৃষ্ণকলির ছিল না। সে দেয়ওনি। হঠাৎই ট্যাক্সি চালকের চিৎকার কানে এলও।
‘আরে ভাই, কবিতার বই নিয়ে আমি কী করব? গিলব? তোমার কবিতা দিয়ে আমার গাড়ি চলবে? যদি চলে, দাও পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে তেলের ট্যাঙ্কে ফেলে দিই।’
কোনও ট্যাক্সিচালকের মুখে এই ডায়লগ যে কারোরই জন্যই ইন্টারেস্টিং। সে ঝগড়ার সময়েই হোক, ভাব ভালোবাসার সময়েই হোক। কৃষ্ণকলি এগিয়ে যায় এবং ঘটনা জানতে পারে।
এই ছেলে ট্যাক্সি করে বরানগর থেকে কলেজস্ট্রিটে এসেছে। নামবার সময় জানতে পারে, সে মানিব্যাগটি আনতে ভুলে গেছে। কাঁধের ঝোলা ঝেড়ে ঘেঁটে একটা পয়সাও পায় না। পায় নিজের লেখা কবিতার বই। বাধ্য হয়ে ভাড়ার বদলে সে তার কবিতার বইটি ট্যাক্সি চালককে দিতে চাইছে।
কৃষ্ণকলির একই সঙ্গে মজা লাগে এবং যুবকটির প্রতি মায়া হয়। কৃষ্ণকলিকে এগিয়ে আসতে দেখে ট্যাক্সিচালক আরও বীরবিক্রমে চেঁচামিচি শুরু করে। ছেলেটি লজ্জিত হয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকে। তার লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছিল সত্যি সে টাকা পয়সা নিয়ে বেরোতে ভুলে গেছে।
কৃষ্ণকলি ড্রাইভারকে কড়া গলায় বলে, ‘থামুন। অনেক হয়েছে। আমি ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি। কত হয়েছে বলুন।’
অচেনা যুবকটি এতটাই অবাক হয় যে কী করবে কী বলবে বুঝতে পারে না। কৃষ্ণকলি ভাড়া মিটিয়ে দিলে ট্যাক্সিচালক গজগজ করতে করতে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। কৃষ্ণকলি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘যান। এরপর থেকে মানিব্যাগ সঙ্গে রাখবেন। শুধু কবিতা নিয়ে কলকাতার পথে বেরোনোও যায় না। কলকাতা অত কবিতাপ্রেমী নয়। পথে টাকা পয়সাও লাগে।’
ছেলেটি গদগদ গলায় বলে, ‘আমি যে কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানাব…আমি লোকটাকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না…যদি কিছু মনে না করেন, এই বইটা কি আপনাকে দিতে পারি ম্যাডাম?’
কৃষ্ণকলি আর পারেনি। হেসে ফেলে। বলে ‘আচ্ছা দিন।’
প্রেমের পিছনে এটাই ঘটনা।
ঋষা চোখ কপালে তুলে বলে, ‘এ তো কবিতার মতো রোমাঞ্চকর! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। ছেলের নাম কী?’
কৃষ্ণকলি হাসিমুখে চুকচুক আওয়াজ করে বলল, ‘এখন বলব না। যেদিন আমাকে খাওয়াবি সেদিন কবিকেও নিয়ে আসব। আলাপ করিয়ে দেব। হাঁদাটা ছেলে ভালো। দেখবি, তোকেও বই দেবে।’
ঋষা বান্ধবীর গাল টিপে বলল, ‘আচ্ছা, তাই হবে।’
ঋষা অফিসে কামাই করে না। আজ বৃষ্টির মধ্যেও এসেছে। কয়েকজনের ডেটা নিয়ে আসবার কথা। অনেক দূর দূর থেকে আসে। তাকে না পেলে ফিরে যেতে হবে। তবে আজ এসেছিল মাত্র একজন। ঋষাকে কাজ বুঝিয়ে, কথা বলে চলে গেছে। তারপরই চোখমুখ থমথমে করে ঋষা বসে আছে। তার কান্না পাচ্ছে। সে শক্ত মেয়ে বলে কাঁদতে পারছে না। টেবিলে ফেলে রাখা মোবাইল ফোনটা নিতে গিয়ে হাত সরিয়ে নিল।