একটু পরে রোদ উঠবে – ৩০

তিরিশ

মহিলাটি কে?

খানিক আগে সেনবাড়ির উলটো দিকের ফুটপাথে মাঝবয়সি এই মহিলা দাঁড়িয়েছিলেন। চেহারায় বিধ্বস্ত ভাব। দূরের পথ থেকে এলে যেমন হয়। চুল উসকো-খুসকো। চোখ মুখে রোদে পোড়া কালো ছাপ। মহিলা মাঝে মাঝেই শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখে গলায় ঘাম মুছছিলেন।

আজ প্রথম নয়, গত এক বছরে বেশ কয়েকবার এই মহিলা সেনবাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। কারও খেয়াল হয়নি। খেয়াল হওয়ার কথা নয়। একজন সাধারণ চেহারার বাঙালি মহিলাকে রাস্তার ভিড়ে কে খেয়াল করবে? যদিও কিছু মহিলা পথের লোকের নজর কাড়বার নানা আয়োজন জানে। পোশাকে, ভঙ্গিতে, কথাবার্তায় তারা এমন কিছু করতে পারে যে লোক মুখ না ফিরিয়ে পারবে না। শুধু পুরুষ নয়, অন্য মহিলারাও দেখতে বাধ্য। বেশি কিছু করতে হবে না, পোশাকের একটু এদিক-ওদিক ঘটিয়েই পথের মানুষের নজরে আসা সহজ। সেই নজরে কখনও মুগ্ধতা, কখনও কামনা, কখনও হিংসে থাকে।

এই পর্যন্ত সমস্যা নেই। সমস্যা হল, নজর কাড়বার পর কিছু মহিলা তেড়েফুঁড়ে ওঠে। তারা নি:সংকোচে বলে বসে, পুরুষগুলো অতি খারাপ। অশ্লীল। মেয়ে দেখলেই শরীরের দিকে নোংরা চোখে তাকায়।

‘ইস! সেদিন গড়িয়াহাটে কতগুলো ধেড়ে লোক এমনভাবে বুকের দিকে তাকাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল, চড় দিই।’

এই কথা বলবার আগে মহিলার মনে থাকে না সে নিজেই সেদিন ‘নজর কারবার’ জন্য জামা-কাপড়ে আয়োজন করে পথে বেরিয়েছিল। নজর পাওয়ার পর আয়োজনটা যেন কোনও ব্যাপারই নয়। এই প্রসঙ্গ তুললে অনেক নারীবাদী হইহই করে ওঠে। মেয়েদের পোশাক কি তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঠিক করে দেবে? এটা কি মধ্যযুগ? বর্বর যুগ? তা হলে কি মেয়েদের আজও পথে ঘোমটা দিয়ে বেরোতে হবে? পালকিতে পর্দা টেনে পথ চলতে হবে? বদ পুরুষমানুষ শরীরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাবে বলে ফ্যাশন বন্ধ হবে নাকি?

এই হইচইয়ের সময় নারীবাদীরা এতটাই উত্তেজিত হয়ে থাকে যে কোনও যুক্তি শুনতে চায় না। এমনিতে স্লোগান হল—’নারী পুরুষ সমান’ আর উত্তেজনার সময় স্লোগান হল, ‘আমরা নারী, আমাদের বক্তব্যই ঠিক।’ এই সময় যদি কোনও মহিলাও যুক্তি দিয়ে কিছু বলতে চায় তা হলে তাকেও ‘নারী বিদ্বেষী’ বলে চিহ্নিত করা হবে। নারীকুলে কলঙ্ক। কে উত্তেজিত নারীবাদীদের বোঝাবে, এটা মধ্যযুগ নয়? এখন ছেলেমেয়ে সবাই নিজের রুচি অনুযায়ী পোশাক পরবে। যা খুশি পরবে। বেশ করবে। মেয়েরা স্বাধীন, শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী। সম্প্রতি আমেরিকার এক গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, কোম্পানি পরিচালনার ব্যাপারে মেয়েরা পুরুষদের থেকে বেশি দক্ষ। বেশি ইনোভেটিভ। শুধু সাজুগুজু নয়, সুযোগ পেলে তারা বড় বড় ব্যবসায় তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। লাভ বাড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়েরা শান্তির জন্য আন্দোলনও করে, আবার যুদ্ধবিমান চালায়। ঘোমটা, পালকির যুগ শেষ। পোশাক-আশাকের মতো ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে চিন্তা করবার মতো সময় আর মেয়েদের নেই।

নারীবাদীদের কে বোঝাবে এসব কথা? এই যুক্তি তারা মানতে চায় না। নজর কাড়বার মতো পোশাক পরে পথে নামলে নজর পড়বেই। এক ছিপছিপে তরুণী হটপ্যান্ট পরে ক্যামাক স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তার পায়ের দিকে যদি কেউ না তাকায় তা হলে তো ওই সুন্দরী বাড়ি গিয়ে সুইসাইডের চেষ্টা করবে। সে তার পায়ের চর্চা করছে। ওয়াক্সিং, স্পা, জিমের পিছনে বড় খরচ করেছে। তবেই পা এত চমৎকার। এই চমৎকার পা কি কেবল পোশাকের পিছনে লুকিয়ে রাখবার জন্য বানানো হল? বাথরুমের বাথটবে শুয়ে পুরোনো দিনের হলিউড সিনেমার নায়িকাদের মতো তুলে নিজে দেখবার জন্য? অসম্ভব। তার ওপর হটপ্যান্টের পিছনেও খরচ আছে না? গোড়ালি পর্যন্ত ঝোলাপ্যান্টের থেকে থাই পর্যন্ত প্যান্ট এখন অনেক দামি। নামে হট, দামেও হট। সব মিলিয়ে খরচ, পরিশ্রম কম হল? আগে পা দেখানোর মানে ছিল ‘লাথি দেখানো’। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষেই তাই করত। তাতে কোনও খরচখরচা ছিল না। এখনে পা দেখানোতে বিরাট খরচ। তারপরেও কেউ না দেখলে লোকসান। হতাশা গ্রাস করে। তবে ‘পা-সুন্দরী’-দের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নজর লোকে করে। সেই নজর কামনার না প্রেমের, নাকি ঘৃণার? নাকি লজ্জার? অন্য মেয়েদের হিংসেও হতে পারে। তবে সেসব বিচার এক-একজনের কাছে এক-একরকম। যাকে বলে ‘সাবজেক্টিভ’ আলোচনা। নজর পড়ে এটাই সত্য। তা হলে রাগ কেন? আমার কাঁধ, বুক, পিঠ, পা, হাঁটু উন্মুক্ত। তুমি সেদিকে তাকালে আমি তোমাকে অশ্লীল, অসভ্য বলব কেন? বরং না দেখলে তো মনোকষ্ট হওয়ার কথা। এটা কি দ্বিচারিতা নয়?

আধুনিক মনোবিজ্ঞান বলছে, যারা এই বিষয়ে দ্বিচারিতা করে, একরকম চায়, অথচ একরকম বলে, তারা ভালো নয়। পুরুষ নারী নির্বিশেষেই ভালো নয়। নজর কাড়বার স্থূল চেষ্টা আসলে এক ধরনের অসুখ। কেউ এই চেষ্টা করে শরীর দেখিয়ে, কেউ করে পথের মাঝে ডিগবাজি খেয়ে। নিজেদের বহুবিধ হীনমন্যতা, অক্ষমতা থেকেই এই অসুখের জন্ম। নারীবাদীদের হুঙ্কার এই অসুখকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তারা সমাজের আসল সমস্যাকে গুলিয়ে দিতে চেষ্টা করে। মনোবিজ্ঞানীরা যাই বলুন, আশার কথা, সমাজে এই ধরনের পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা কম। সেই কারণে সমাজটা এখনও বাসযোগ্য।

সেনবাড়ির সামনে দাঁড়ানো মহিলার পথের মানুষের ‘নজর কাড়বার’ জন্য কোনও আয়োজন নেই। বরং উলটো। মহিলা ভিড়ে যেন নিজেকে মিশিয়ে রাখতে চাইছেন। গায়ে একটা সাধারণ সুতির শাড়ি। সেটাও পিঠ ঢেকে জড়িয়ে আছেন। শাড়ির রংও ঝলমলে নয়। চট করে চোখ টানে না। মহিলাকে দেখলে মনে হচ্ছে, একেবারে দরিদ্র না হলেও টাকাপয়সা বিশেষ নেই। দাঁড়িয়ে থাকবার মধ্যে এক ধরনের জড়সড় ভাব রয়েছে।

এর আগে কখনও কখনও একে অর্চিনের ইউনিভার্সিটির সামনেও দেখা গেছে। ইউনিভার্সিটির উলটো দিকে যে বাস স্টপটা আছে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। যতবার তিনি এসেছেন, খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে তিনি চলে যান। আজ ব্যতিক্রম ঘটল। রাস্তা টপকে বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বিশাল গেট। উঁচু পাঁচিল। কলকাতার বনেদি ধনী পরিবারের বাড়ি যেমন হয়। গেটের বাইরে দারোয়ান। মহিলা এগিয়ে যান।

ভীম বলল, ‘কাকে চাই?’

মহিলা ইতস্তত করে বলেন, ‘এটা কি কমলকান্তি সেনের বাড়ি?’

ভীম ভুরু কোঁচকাল। বলল, ‘উনি তো কারও সঙ্গে দেখা করবে না। নিজের ঘর থেকেই বেরোন না।’

মহিলা একটু থমকালেন। কিছু ভাবলেন। বললেন, ‘ওহ আমার জানা ছিল না। তার ছেলে আছেন? বিমলকান্তি সেন?’

অপরিচিত মহিলার এই থতমত ভাবে ভীমের ভুরু কোঁচকানো আরও গভীর হল। বলল, ‘আছেন’।

‘তার সঙ্গে দেখা করা যাবে?’

দারোয়ান মাথা নেড়ে বলল, ‘না, আজ স্যার বাড়িতে কারও সঙ্গে দেখা করেন না।’

মহিলা আবার একটু চুপ করে রইলেন। একেই মহিলার মধ্যে বিধ্বস্ত ভাব, তার ওপর দেখা হবে না শুনে তিনি যেন খানিকটা হতাশ হয়ে পড়লেন। ভীমের মায়া হল। দারোয়ানের মায়াদয়া থাকার কথা নয়। ভীমের এটাই সমস্যা। মাঝে মাঝে মায়ার মধ্যে পড়ে যায়। সে গলা খাকড়ি দিল। ‘স্যার দেখা করেন বুধবার করে। আপনি বুধবার আসবেন। সকাল আটটা থেকে ন’টার মধ্যে আসবেন।’

মহিলা খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, ‘একবার দেখা হবে না? একটু সময় নেব।’

ভীম মনকে শক্ত করল। বলল, ‘না, হবে না। আপনি একটা কাজ করতে পারেন। স্যারের অফিসে গিয়ে দেখা করতে পারেন।’

মহিলা তাড়াতাড়ি বলল, ‘না, না, অত লোকজনের মধ্যে…না, না, আমি ওনার সঙ্গে একটু একা কথা বলতে চাই…।’

মহিলার গলায় ভয় ভয় ভাব। কিছু একটা গোপন করতে চাইছেন যেন। বিপদে পড়লে মানুষের কখনও কখনও এরকম হয়। হাবেভাবে ব্যস্তসমস্ত। কথা বলবার সময় চারপাশে তাকাচ্ছেন। কেউ দেখে ফেলছে না তো?

ভীম চিন্তিত হল। কেউ দেখে ফেললে কী সমস্যা?

‘আপনি বুধবার আসুন।’

মহিলা এবার অনুরোধের ঢঙে বলল, ‘আপনি বিমলকান্তিবাবুকে একবার বলে দেখুন। একটু খানিক সময় নেব। অনেক দূর থেকে আসছি। সেই কৃষ্ণনগর থেকে।’

বাইরে চোখ-মুখ কঠিন রাখতে পারলেও ভীম ভিতরে ‘মায়া’ ভাব অনুভব করল। না, এভাবে চললে চাকরি থাকবে না। তবে এই মহিলার ভাবভঙ্গি অন্যরকম। সত্যি যদি কোনও সমস্যা থাকে?

‘একটু দাঁড়ান। স্যারকে একবার বলে দেখছি।’

ভীম বিলমকান্তি সেনকে ইন্টারকমে ফোন করে এবং জোর ধমক খায়। ধমকের চোটে কৃষ্ণনগর নামটা ফুলিয়ার সঙ্গে গুলিয়েও যায়। বিমলকান্তি তখন আরও ধমক দেন। জানান, মুম্বই, দিল্লি থেকে এলেও কিছু করবার নেই। কারও সঙ্গে দেখা করবেন না। নিজের ওপর রাগ হয় ভীমের। কেন যে ‘স্যার’-কে বলতে গেল? সেই রাগ সামনে আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার ওপর পড়ে। সে একরকম হাত নাড়িয়ে ভাগিয়ে দেয়।

কিন্তু মহিলাটি কে? কেনই বা তিনি মাঝে মাঝেই এই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ান? অর্চিনের ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত বা ধাওয়া করেন কেন? আজ এই বাড়ির লোকদের সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন কেন?

মহিলার নাম বৈশাখী। বৈশাখী সান্যাল। বয়স বছর চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। মহিলা মোটেও কৃষ্ণনগর বা ফুলিয়া থাকে না। থাকেন দুর্গাপুর। জায়গার নাম বানিয়ে বলেছেন। তিনি ভীমকে নাম বলবার সুযোগ পাননি। সুযোগ পেলে নামও বানিয়ে বলতেন। বানানো নাম ঠিক করাও ছিল। মহুয়া। মহুয়া রায়। নিজের নাম, ঠিকানা মিথ্যে বলবার অভ্যেস বৈশাখী অনেকদিন ধরেই করছেন। না করে উপায় নেই। সত্যি পরিচয় দিলে অনেক ধরনের ঝামেলা। সেই ঝামেলা পুলিশ, জেল পর্যন্ত গড়াতে পারে। গড়াতে পারে কেন, গড়াবেই। যাই হোক, সেই দুর্গাপুর থেকে কলকাতায় এসে সেনবাড়ির সামনে বৈশাখী সান্যালের ঘুরঘুরের কারণ কমলকান্তি বা বিমলকান্তি নন। কারণ অর্চিন। সেই কারণে তিনি অর্চিনের ইউনিভার্সিটির সামনেও যান।

ভীম ভাগিয়ে দেওয়ার পর বৈশাখী উলটো দিকের ফুটপাথ ধরে খানিকটা হাঁটলেন। খুব জল তেষ্টা পাচ্ছে। মোড়ের কাছে এসে একটা পান-সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

‘ঠান্ডা আছে?’

উঁচু প্ল্যাটফর্ম থেকে দোকানদার বলল, ‘আছে বউদি। কোনটা নেবেন?’

বৈশাখী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলেন, ‘যে-কোনও একটা হলেই হবে। ঠান্ডা হলেই চলবে।’

দোকানদার ঠান্ডা পানীয়ের বোতল খুঁজতে লাগল। বৈশাখী দোকানের পাশে ঝোলানো আয়নার চুল ঠিক করলেন। পেটে গোঁজা রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। খানিকটা জলের ঝাপটা দিতে পারলে হত। গরমের মধ্যে এতটা জার্নিতে চোখ-মুখ বসে গেছে। তার ওপর অর্চিনের বাড়ির সামনে অতটা সময় দাঁড়াতে হয়েছে। একবার তো বৃষ্টি নেমে গেল। সঙ্গে আবার ছাতাও ছিল না। ভাগ্যিস পিছন দিকের একটা দোকানে খানিকটা শেড ছিল, তার তলায় গিয়ে দাঁড়াতে ভেজার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গিয়েছিল। নইলে ভেজা শাড়িতেই থাকতে হত।

দোকানদার বোতলের মুখ খুলে, স্ট্র ভরে নীচু হয়ে হাত বাড়াল।

‘নিন বউদি, ভালো ঠান্ডা।’

বৈশাখী হাত বাড়িয়ে বোতল না ধরেই বলল, ‘জিনিস ভালো তো?’

‘অবশ্যই ভালো। এত বড় কোম্পানির মাল খারাপ হবে কেন? দোকানদার মহিলার বোকামিতে হাসল। এ কী বোকার মতো কথা? বড় কোম্পানির জিনিস কখনও খারাপ হয়!

হাতে বোতল নিয়েও বৈশাখী সেই বোতল মুখে না তুলে দাঁড়িয়ে রইলেন। বললেন, ‘বাজে কথা বোলো না ভাই। এই তো সেদিন পেপারে পড়লাম। কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলে পোকা। ছিপি বন্ধ ছিল তারপরেও পোকা। ইস!’

দোকানদার বলল, ‘হাজারটায় একটা-দুটো ওরকম হতেই পারে।’

বৈশাখী বললেন, ‘আমার এই বোতলে পোকা-টোকা নেই তো?’

দোকানদার এবার বিরক্ত হল। একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে এত জাবাবদিহি তার পছন্দ হচ্ছে না। সে চুপ করে পান সাজতে শুরু করল। বৈশাখী বললেন, ‘কী হল, বললে না? তুমি ভালো করে বোতল দেখে দিয়েছ তো?’

দোকানদার এবার কড়া গলায় বলল, ‘আমার দোকানে এসব হয় না। কিছু থাকলে পয়সা নেব না।’

বৈশাখী এই কথায় খানিকটা যেন আস্বস্ত হলেন। বোতলে ডোবানো স্ট্রতে মুখ দিলেন। লম্বা করে টান দিলেন। আহ। শরীর জুড়োল।

‘সে তুমি না হয় পয়সা নেবে না, কিন্তু পোকা পেটে গেলে আমায় তো হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।’

দোকানদার পানের সরঞ্জাম থেকে মুখ না তুলে বলল, ‘বলছি তো কিছু নেই।’

স্ট্রতে এবার নিশ্চিন্তে একটার পর একটা টান দিতে লাগলেন বৈশাখী।

আজ অর্চিনকে দেখতে পেলেন না কেন? এই সময়টা তো বাড়ি থাকে। হয় ঢোকে, নয় বের হয়। শরীরটরীর খারাপ হল না তো? আবার ইউনিভার্সিটিও যেতে পারে। হয়তো সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে। পরীক্ষা-টরীক্ষা আছে। ছেলে লেখাপড়ায় খুবই ভালো। আহা! মন ভরে যায়। এই ছেলের বাবাও ঠিকমতো লেখাপড়া করলে ভালো করত। অঙ্কে মাথা ছিল। পড়াশোনাই তো করেনি। এখন একবার ইউনিভার্সিটি গেলে হত। অর্চিনকে পাওয়া যেত। শুধু একবার দূর থেকে দেখা। অতদূর থেকে আসা তো শুধু একবার ছেলেটাকে চোখের দেখা দেখতে। ইদানীং অবশ্য কাজ নিচ্ছেন বৈশাখী। কলকাতায় পার্টি ধরছেন।

চিৎকার করে উঠল উঠলেন বৈশাখী।

‘এ কী! এ মা! কী এটা?’

বোতল হাতে ধরে নাক-মুখ কুঁচকে আছেন বৈশাখী। বোতল প্রায় শেষ। পানীয়র তলানিতে গোল মতো কিছু একটা ভাসছে। কালো পোকার মতো চেহারা। রোঁয়াও আছে। দোকানদার হাতের কাজ ফেলে ঝুঁকে পড়ল।

‘কী হল বউদি?’

বৈশাখী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।

‘কী হল? কী হল বলছ! দেখো, দেখো বোতলে কী পড়ে আছে। ওয়াক।’

বৈশাখী গলা-বুকে হাত রেখে বমির ভঙ্গি করলেন। হাত বাড়িয়ে বোতল নিল দোকানদার। চোখের সামনে তুলে দেখতে লাগল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে।

ধমকে উঠলেন বৈশাখী।

‘কী দেখছ? পোকা চিনছ? ফাজলামি হচ্ছে? এই জন্য বলেছিলাম, বোতলটা দেখে দাও। ওয়াক। ওয়াক। এবার আমার কী হবে? বমি পাচ্ছে।’

পথের দু-একজন মুখ ঘুরিয়ে দেখছে। ক’জন দাঁড়িয়েও পড়ল। দোকানদার তাড়াতাড়ি হাত জোড় করে কাঁচুমাচু গলায় বলল, ‘ঠিক আছে বউদি, ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে দাম দিতে হবে না।’

বৈশাখী আরও জোর ধমক দিতে গেলেন! দাম! এরপরেও দামের কথা বলছে লোকটা! নিজেকে সামলালেন।

‘ঠিক আছে। আর যেন কখনও এমন না হয়।’

বৈশাখী চোখ-মুখ কুঁচকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা অটোতে উঠলেন। তিনি এখন যাবেন শিয়ালদা। বৈশাখী মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকালেন। ব্যস্ত কলকাতা ছুটছে। বেচারি পান-সিগারেটের দোকানদার। যখন বোতলের তলানিটুকু ফেলে, পরীক্ষা করে দেখবে, ওই কালো গোল জিনিসটা পোকা-টোকা কিছু নয়, দলা পাকানো সুতো, তখন তিনি অনেক দূরে। এ কাজ তিনি আগেও কয়েকবার করেছেন। কোলড্রিঙ্কস খেতে খেতে শাড়ির আঁচল থেকে সুতো ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে বোতলে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এতে তেষ্টাও মেটে আবার খরচও হয় না। শ্রীমতী বৈশাখী সান্যাল মনে-মনে হাসলেন। লেখাপড়ায় ফার্স্ট হওয়া গুড বয় অর্চিন যদি জানত, তার মা এভাবে লোক ঠকিয়ে বেড়ায় তা হলে কী করত? কাঁদত? নাকি ঘেন্না করত? খুব জানতে ইচ্ছে করে।

একত্রিশ

‘দ্য ক্যালকাটা’ হোটেলের ঘরে ঢুকে বৈশাখী সান্যাল অবাক হলেন।

এই দুনিয়ায় ঠকবাজ, জালিয়াত, দু’নম্বরী লোকদের দেখতে বেশি ভদ্রলোকের মতো হয়। অরিজিনালের থেকে বেশি। পোশাক-আশাক ফিটফাট। কথাবার্তা, চালচলন, জুতো পালিশের মতো চকচকে। হয় শুদ্ধ বাংলা, নয় চাপা গলায় ইংরেজিতে কথা বলে। মনে হবে শিক্ষা, রুচি, ভদ্রতায় এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। সেই সঙ্গে সততার পূজারি। দরিদ্র অসহায় মানুষের জন্য মন আকুল। গত পনেরো বছরে বহু চিটিং কারবারির সঙ্গে বৈশাখীর দেখা হয়েছে। তাদের মধ্যে কারও কারওকে দেখলে বিস্মিত হতে হয়। দু’নম্বরী কাজকে এরা ভারী সুন্দর মোড়কে ঢেকে রেখেছে। ভদ্রতার মোড়ক। গোটা বিষয়টাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অফিসে, স্কুলে, কলেজে, পথেঘাটে, ট্রামেবাসে, কলকাতার নন্দন চত্তরে এদের দেখলে মানুষ ভক্তি শ্রদ্ধা দেখায়। ছেলেমেয়েকে ফিসফিস করে বলে, ‘বাবু, বড় হয়ে তোমাকে এনার মতো হতে হবে। যাও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করো।’

ঘরে ঢুকে বৈশাখী এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালেন। ঠিক ঘরে এসেছেন তো? নীচের রিসেপশন থেকে তো এই ঘরের কথাই বলল। রিসেপশনের লোকটা ভিখিরি মার্কা স্যুট পরেছে। অনেকদিন কাচা হয়নি। ডানহাতের বগলের কাছটা কুঁচকে আছে। বুকের কাছে একটা বোতাম নেই। তবে দ্যা ক্যাটকাটা হোটেলের সঙ্গে মানানসই। ঢোকবার সময়েই বৈশাখীর মনে হচ্ছিল, এই বাড়িটাও যেন অনেকদিন কাচা হয়নি।

‘আপনিই মিসেস সান্যাল?’

‘হ্যাঁ।’

‘কার কাছে এসেছেন?’

বৈশাখী একটু থমকে থেকে বললেন, ‘এডি’।

রিসেপশনের লোকটা টেবিলের একপাশে রাখা ইন্টারকম কানে দিয়ে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। রিসিভারের দিকে তাকাল। ফোনে গোলমাল হলে সবাই রিসিভারের দিকে তাকায়। লোকটা নম্বর টিপে কয়েকবার ঘটঘট করল। দু’বার রিসিভারে চড় মারল। লাভ হল না, ফোন রেখে দিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, ‘থার্ড ফ্লোরে চলে যান। একশো পাঁচ নম্বর রুম।’

‘সিঁড়ি কোনদিকে?’

‘ওইদিকে লিফট।’

‘লিফটে নয়। সিঁড়িতে যাব।’

লোকটা মুখ তুলে চাপা গলায় বলল, ‘অতটা হেঁটে উঠবেন কেন? লিফটে যান?’

‘বৈশাখী বলল, আমি সিঁড়িতেই যাব। সিঁড়ি কোনদিকে?’

এই কায়দাটা শিখিয়ে গেছে অর্চিনের বাবা।

‘অচেনা বাড়িতে কাজে গেলে চট করে লিফটে ওঠানামা করবে না। করলেও সিঁড়িটা চিনে রাখবে। কোনওরকম গোলমাল হলে পালানোর অপশন জানতে হয়। লিফট সব সময় নিজের হাতে থাকে না। যখন দরকার তখন হয়তো দেখবে দশতলার ওপর উঠে বসে আছে। নামতে নামতেই বিপদে পড়ে যাবে।’

নোংরা কোট পরা রিসেপশনিস্ট সিঁড়ির পথ দেখিয়ে আবার ভাঙা ইন্টারকমে মন দিল। এবার তার ধরে টানাটানি করছে। বৈশাখী মনে মনে বললেন, যেমন হোটেল, তেমন তার রিসেপশনিস্ট, তেমন তার ইন্টারকম। নিশ্চয় লিফটে উঠলে কোনও একটা বিপত্তি ঘটত।

তিনতলায় উঠে ডানদিকের করিডর দিয়ে খানিকটা গেলে একশো পাঁচ নম্বর রুম। বৈশাখী করিডরে যেতে যেতেই হাত দিয়ে চুল ঠিক করলেন। আঁচল দিয়ে মুখ মুছলেন। একশো পাঁচ নম্বর ঘরের দরজা আধখানা খোলা। একসময়ে এইসব জায়গায় একা আসা-যাওয়া করতে ভয় করত। কে কোথায় ফাঁদ পেতে আছে কে জানে! হয়তো পুলিশ বসে আছে ঘাপটি মেরে। তার ওপর মহিলা। চিটিংবাজ, চোর, স্মাগলার, ছ্যাঁচোড় নিয়ে কাজ। খারাপ কিছু করে বসতে পারে। অর্চিনের বাবা ভরসা দিয়েছিল।

‘এই চিন্তা করবে না। চোর-ছ্যাঁচোড়রা প্রফেশনাল হয়। তারা যাকে দিয়ে কাজ করায় তার সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করে না। তারা যখন খারাপ কাজ করে সেটাও প্রফেশনালভাবে করে। খুব বেশি হলে তোমাকে প্রস্তাব দিতে পারে। জোরজুলুম করবে না।’

বৈশাখী রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রস্তাব দেবেন মানে! আমার সঙ্গে নোংরামি করবে কিনা তার প্রস্তাব দেবে!’

অর্চিনের বাবা শুয়ে শুয়েই হেসেছিল। বলেছিল, ‘আমরা যেটাকে নোংরামি বলি, সবাই সেটাকে নোংরামি বলে না বৈশাখী। আবার উলটোটাও তাই। কোনটা পরিষ্কার, কোনটা নোংরা কে বলবে?’

অর্চিনের বাবা সাত বছর হল মারা গেছে। এখন আর কায়দা শেখানোর কেউ নেই। বৈশাখী নিজেই সাবধান হতে শিখেছে। খারাপ কাজ যারা করে তারা নিজেদের লোকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না, এটা ঠিক নয়। তার একাধিক অভিজ্ঞতা আছে। অর্চিনের বাবাকে সবটা বলা হয়নি। ইচ্ছে করেই হয়নি। তখন বয়স কম ছিল। এখন বয়স বেড়েছে। এই শরীর দেখে পুরুষমানুষের বাসনা জাগবে না। তারপরেও বিশ্বাস নেই। সেরকম কিছু হলে যাতে নিজেকে বাঁচানো যায় তার ব্যবস্থা আছে। শুধু তাই নয়, পেশাগত কোনও ঝামেলার হাত থেকে হঠাৎ বাঁচতে হলেও ব্যবস্থা লাগে। বৈশাখী সান্যাল কাঁধের ভ্যানিটি ব্যাগে রিভলভার রাখেন। তাতে ছ’টা বুলেট ভরা আছে। জিনিস কেনবার পর ফাঁকা জায়গায় গিয়ে চালানো শিখেও এসেছেন। যারা বেচেছে, তারাই শেখানোর ব্যবস্থা করেছিল। দুটো বুলেট ফ্রি দিয়েছে। তারপরেও আরও তিনটে বুলেট কিনে গুলি ছুড়েছিলেন বৈশাখী। খুব আরাম হয়েছিল।

হাত বাড়িয়ে একশো পাঁচ নম্বর ঘরের দরজায় টোকা দিলেন বৈশাখী।

ভিতর থেকে ফিনফিনে গলায় কেউ কথা বলে উঠল।

‘ভিতরে আসুন মিসেস সান্যাল।’

পার্টি জানল কী করে? রিসেপশনের ফোন ঠিক হয়েছে? নাকি লিফটে করে এসে খবর দিয়ে গেছে?

বৈশাখী সান্যাল ঘরে পা দিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। ঘরের একপাশে চেয়ার-টেবিল। লোকটা টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে আছে। টেবিলে চায়ের কাপ। এ কেমন পোশাক! মলিন শার্ট, প্যান্ট। উস্কোখুস্কো চুল। একমুখ দাড়ি। চিমসে মার্কা চেহারা। চোখে এক ধরনের চোর চোর ভাব। শুধু চোখ কোন, গোটা চেহারাটার মধ্যেই এক ধরনের চোর-ছ্যাঁচোড় ভাব। যে দেখবে তারই সন্দেহ হবে। এই পোশাক, এই চেহারা দিয়ে কখনও চুরি-চামারির কাজ করা যায়? কাজ করতে হয় ভদ্রলোকের পোশাকে।

অর্চিনের বাবা প্রথম যে দু’নম্বরী লোকটার কাছে তাকে নিয়ে গিয়েছিল, তার কথা আজও বৈশাখী ভুলতে পারেননি।

অর্চিনের বাবা বলেছিল, ‘আজ তোমাকে একজন বিরাট মানুষের কাছে নিয়ে যাব।’

‘কার কাছে?’

অর্চিনের বাবা বলল, ‘অবনী সমাজপতি।’

বৈশাখী ভুরু কুঁচকে বলেছিলেন, ‘নামটা চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় যেন শুনেছি।’

অর্চিনের বাবা হেসে বলেছিল, ‘স্বাভাবিক। শুধু শোনওনি, দেখেওছ। খবরের কাগজে মাঝে মাঝে অবনী সমাজপতির ছবি বের হয়।’

বৈশাখী বললেন, ‘তাই হবে। উনি নেতা-মন্ত্রী নাকি?’

অর্চিনের বাবা বলল, ‘না, উনি সমাজসেবী। সমাজের দরিদ্র, দু:খী মানুষের সেবা করেন।’

বৈশাখী বললেন, ‘বা:। ভালোমানুষ তাহলে।’

অর্চিনের বাবা মুচকি হেসে বলল, ‘ঠিকই বলেছ। ভালোমানুষ। অমন ভালোমানুষ না থাকলে আমাকে না খেয়ে মরতে হত।’

বৈশাখী অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘না খেয়ে মরতে হত! মানে?’

অর্চিনের বাবা বলল, ‘মানে আর কী, এই যে কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, কাজকর্ম নেই, ধেড়ে বয়েসে বেকার, এদিকে বিয়ে করে বসে আছি, এরকম মানুষ না থাকলে সংসার চলত কীভাবে?’

বৈশাখী বলেছিলেন, ‘এসব কী বলছ! বুঝতে পারছি না।’

‘বুঝে কাজ নেই। গেলেই বুঝতে পারবে।’

বৈশাখী চুপ করে গিয়েছিলেন। অর্চিনের বাবার অবস্থা তখন ভয়ঙ্কর। কাজ চলে গেছে। হাতে টাকাপয়সা নেই। এদিকে পেটে তখন অর্চিন এসে গেছে। লোকটা কাজের জন্য পাগলের মতো ঘুরছে। কিন্তু কাজ পাওয়া যাচ্ছে না।

কারখানায় কাজ করলে কী হবে, অর্চিনের বাবা না ছিল লেখাপড়া জানা ইঞ্জিনিয়ার, না ছিল মেকানিক। এমনকী লেবারও নয়। মাঝারি ধরনের ম্যানেজারের কাজ করত। মাঝারি ধরনের কর্মীর কাজকর্ম চলে গেলে বিপদ। এদের বিশেষ কোনও যোগ্যতা থাকে না। আবার প্রেস্টিজের কারণে যে-কোনও কাজ চট করে করতেও পারে না। বন্ধ কারখানায় ইঞ্জিনিয়ার, ক্যাশিয়াররা কেউ কেউ এদিক-ওদিক কাজ পেয়ে গেল। অনেক লেবার এখানে-সেখানে মুটে-মজুরের কাজ শুরু করে দিল। কেউ কেউ ঠেলাও চালাতে শুরু করল। অর্চিনের বাবার জন্য কোনওটাই সম্ভব হল না। বয়স হয়ে গেছে। বেশি খাটাখাটনি সম্ভব ছিল না। একটা চাকরি ছেড়ে দিতে হল। ন’ঘণ্টা, দশ ঘণ্টার কাজ ছিল। বেতনও কম। তার ওপর লোকটার মেজাজ ছিল অদ্ভুত। সহজে রাগত না। কিন্তু রাগলে হিতাহিত জ্ঞান থাকত না। ঠিক এই কারণে বৈশাখীর বাবা-মায়ের সঙ্গে তুলকালাম করে এসেছিল। বড় মেয়ে বিয়ে করে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার পর বৈশাখীর মা সতর্ক হয়েছিলেন। মণিকুন্তলা সেনের খুড়তুতো বোন। তিনি মেয়েকে চোখে চোখে রাখতেন। যাতে বড় মেয়ের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। মেয়ে যেন কিছুতেই প্রেম না করে। ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা তো দূরের কথা, কিশোরী বৈশাখীকে ছেলেদের মুখোমুখিও হতে দিতেন না সেই মহিলা। স্কুলে যাতায়াতে পাহারা। ছাদে পাহারা। বিয়েবাড়িতে পাহারা। আত্মীয়দের বাড়িতে থাকা বন্ধ। বন্ধুদের বাড়িতে একা যাওয়া নয়। এমনকী সকাল-বিকেল মেয়ের খাতাপত্র ঘেঁটে দেখা হত। প্রেমপত্র নেই তো? এই নজরদারি মেয়ে বড় হওয়ার পরও চলল। তারপরেও মেয়ে কলেজে ঢুকেই প্রেমে পড়ল। নরমাল প্রেম নয়। পাগলের মতো প্রেম। নিজের ভালোমন্দর জ্ঞান ছিল না। বাড়িতে এত কড়াকড়ির জন্যই প্রেমের তীব্রতা ছিল ভয়ংকর। সেকেন্ড ইয়ারে বিয়ে করে এসে মাকে খুব শান্তভাবে খবর দিয়েছিল।

‘আমি বিয়ে করেছি মা। আজ আমাদের রেজিস্ট্রি হয়েছে।’

‘বিয়ে! রেজিস্ট্রি! কী বলছিস হাবিজাবি কথা?’

‘কথাটা হাবিজাবি নয়, তবে বিয়েটা হাবিজাবি হয়েছে। আমার বর এখনও কোনও চাকরিবাকরি করে না। এটা একটা সমস্যা।’

‘বৈশাখী কী বলছিস এসব কথা! কী বলছিস তুই! আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিস?’

‘না মা, ঠাট্টা করছি না। ছেলে ভালো কিনা জানি না। লেখাপড়া বিশেষ করেনি। প্রেমে পড়বার কারণে অতসব বিচার করিনি। করবও না। আমাকে খুব ভালোবাসে শুধু এইটুকু বুঝেছি। তবে সেটাও এখন পর্যন্ত। পরে কী হবে জানি না।’

‘কেন এরকম করলি?’

‘কী বলছ মা! কেন প্রেমে পড়লাম কেউ বলতে পারে?’

‘তুইও দিদির মতো আমাদের মুখে চুনকালি দিলি?’

‘আমাদের প্রেম যদি তোমাদের মুখে চুনকালি হয়, সেটা তোমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের। দিদির সঙ্গে তোমরা যে ব্যবহার করছ, সেটা অন্যায়। দিদির বিয়ে তোমরা মানওনি। পরবর্তী জীবনে আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছ, সেটা অত্যাচার। ক্লাস নাইনে লেটার বক্সে ছেলেদের চিঠি পেয়ে বাবা আমাকে রাতে বেল্ট দিয়ে মেরেছিল। অথচ সেই চিঠির বিন্দুবিসর্গ আমি জানতাম না। সেদিন রাতে গায়ে বেল্টের জ্বালা নিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যদি কোনওদিন সুযোগ হয়, ওই চিঠি যে লিখেছে, তার সঙ্গে প্রেম করব। তাকে বিয়ে করব। সে যে-ই হোক। তুমি শুনলে খুশি হবে মা, আমি সেই ছেলেকে খুঁজে পেয়েছি। তাকে আমি বিয়েও করেছি। আনন্দের কারণে যাচাই করে দেখতে পারিনি, ছেলে আমাদের পরিবারের যোগ্য কিনা।’

‘আমি এ বিয়ে মানি না।’

‘কিছু এসে যায় না। আমি দিদির মতো চলে যাব।’

বৈশাখীর বাবা পরদিন অফিস গেলেন না। সারাদিন বাড়িতে থম মেরে বসে রইলেন। বিকেলে মেয়েকে বললেন, ‘ছেলেটিকে বাড়িতে একবার ডাকতে পারবে? নাকি তার এ বাড়িতে আসবার সাহস নেই?’

বৈশাখী ভয়ে ভয়ে বলেছিলেন, ‘পারব।’

‘তাহলে ডাকো।’

বৈশাখী নীচু গলায় বলল, ‘তুমি কি চিন্ময়কে বকাবকি করবে? অপরাধ যদি কিছু হয়ে থাকে, সেটা কিন্তু তার একার নয়। বিয়ের জন্য আমিই তাকে চাপ দিয়েছিলাম।’

বৈশাখীর বাবা অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘তুমি ছেলেটিকে খবর দাও। তার সঙ্গে আজ বিকেলে আমি চা খাব।’

বৈশাখীর বর চিন্ময় এল সন্ধেবেলা। তখন চেহারা ছিল রোগা-পাতলা। এক মাথা ঝাঁকড়া চুল। হাবভাবে এক ধরনের ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গি। চোখমুখ বলছে, রণক্ষেত্রে প্রবেশের আগে মনে মনে তৈরি হয়েই এসেছে।

বৈশাখীর বাবাকে নীচু হয়ে প্রণাম করতে গেলে তিনি বাধা দিলেন। ‘থাক, ওসব লাগবে না। বসো।’

ভিতর থেকে চা এল। শুধু চা-ই এল। বৈশাখীর যতদূর মনে পড়ে, বাবা সেরকমটা আদেশ করেছিলেন।

‘শুধু চা দেবে। আর কিছু নয়।’

সেই চা আসবার পর বৈশাখীর বাবা বললেন, ‘নাও, চা খাও।’

চিন্ময় বলে, ‘থাক, ও সব লাগবে না। কেন ডেকেছেন বলুন।’

বৈশাখীর বাবা এই উত্তরে খানিকটা থমকে যান। সম্ভবত বুঝতে পারেন, এই ছেলে কঠিন। লড়াই করবার জন্য তৈরি হয়ে এসেছে। একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমার মেয়েকে ডিভোর্স দিতে হবে।’

চিন্ময় বলল, ‘কেন?’

বৈশাখীর বাবা বললেন, ‘আমি আমার বড় মেয়েকে হারিয়েছি। ছোট মেয়ের জীবন নষ্ট হতে দেব না।’

চিন্ময় চেয়ারে হেলান দিয়ে, মৃদু হেসে বলল, ‘আমাকে বিয়ে করায় আপনার মেয়ের জীবন নষ্ট হবে ভাবছেন কেন?’

বৈশাখীর বাবা বললেন, ‘যদি নষ্ট না হয়, সে যদি রাজরানি হয়, তাতেও কিছু আসে যায় না আমার। মেয়েকে আমি আমার পছন্দমতো বিয়ে দেব। তাতে তার ক্ষতি হলে হবে। আমি তার জন্ম দিয়েছি, আমি তার জীবন তৈরি করব। যাই হোক, কথা বাড়াতে চাই না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। তুমি ডিভোর্স দেবে। কালই আমি উকিল ডেকে কাগজপত্র তৈরি করে ফেলব। তুমি এসে সই করে দেবে। এই সময় আসবে।’ একটু থামলেন, তারপর অবহেলায় বললেন, ‘আর হ্যাঁ। আমি তোমায় কিছু টাকা দেব। এইসব করতে তোমার নিশ্চয় খরচাপাতি হয়েছে। কত লাগবে বলো? বিশ হাজার?’

চিন্ময় চুপ করে রইল। বৈশাখীর বাবা বললেন, ‘কী হল, চুপ করে গেলে কেন? বিশে হবে না? পঁচিশ?’

চিন্ময় নীচু গলায় বলল, ‘আমি যদি রাজি না হই?’

বৈশাখীর বাবা কড়া চোখে তাকালেন। দাঁত ঘষে বললেন, ‘রাজি না হলে বিপদ হবে।’

‘কার?’

বৈশাখীর বাবা ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছ?’

চিন্ময় এবার হেসে বলল, ‘আপনি যদি আমার সঙ্গে রসিকতা করতে পারেন, আমি পারব না কেন? বিয়ের পরদিন যদি কাউকে ডেকে ডিভোর্স করতে বলা হয়, সেটা রসিকতা ছাড়া কী?’

বৈশাখীর বাবা এবার চিৎকার করে উঠলেন।

‘শট আপ। সান অফ আ বিচ। পুলিশ ডেকে লকআপে ঢুকিয়ে দেব। মেরে হাড় ভেঙে দেব শুয়োরের বাচ্চা।’

চিন্ময় উঠে দাঁড়াল। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আপনি আমাকে যা বললেন, তার জন্য আপনার আমার কাছে একটা চড় প্রাপ্য। কিন্তু আমি আপনাকে মারলাম না। সম্পর্কে আপনি আমার শ্বশুরমশাই হন। শ্বশুরমশাইয়ের গায়ে হাত তোলা ঠিক নয়। ভেবেছিলাম, ক’দিন পরে, একটা কাজকর্ম জোগাড় করে বৈশাখীকে নিয়ে যাব। কিন্তু এখন সিদ্ধান্ত বদল করলাম। আজই আপনার মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে যাব। অবশ্য যদি সে যেতে চায়।’

বাবার চিৎকার শুনে আড়াল থেকে বৈশাখী এবং তার মা ছুটে এসেছিলেন। বৈশাখীর দিকে তাকিয়ে ছেলে বলল, ‘তুমি কি আজ আমার সঙ্গে যাবে বৈশাখী?’

বৈশাখী একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন, ‘চলো, আমি ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি।’

মেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাবা বলেছিলেন, ‘আর কোনওদিন এ বাড়িতে ঢুকবে না।’

বৈশাখী মলিন হেসে বলেছিলেন, ‘আমি জানি বাবা। আমাকে আর এ বাড়িতে আসতে হবে না।’

না, বৈশাখী জানতেন না। তাকে এ বাড়িতে আবার আসতে হল। তখন বড় দু:সময়।

অর্চিনের বয়স তখন আট মাস। চিন্ময় জেলে। সোনার দোকানে হাতসাফাই করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। পুলিশ বেদম মারধর করেছে। বৈশাখীর নামও পেয়েছে। সোনার দোকানে অপারেশনের সময় চিন্ময়ের সঙ্গে বৈশাখীও ছিল। দুজনে মিলে গয়না কেনবার ভান করছিল। এটা-সেটা নেড়েচেড়ে দেখছিল। এক ফাঁকে বৈশাখী গলায় পরা নকল চেইন খুলে দোকানের আসল চেইনের সঙ্গে বদলে দেন। হাতের আংটিও বদল করে। তখনকার দিনে এত সি সি টিভির নজরদারি ছিল না। তার পরেও দুদিনের মধ্যে চিন্ময়কে পুলিশ ধরে ফেলে। তারা বৈশাখীর খবরও পায়। পুলিশ তাকে যে-কোনও সময় ধরবে ধরবে অবস্থায় বৈশাখী আট মাসের অর্চিনকে কোলে নিয়ে বাড়িতে পালিয়ে আসেন। বাবা-মা দুজনেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। চোর মেয়েকে তারা বাড়িতে কিছুতেই আশ্রয় দেবেন না। ইতিমধ্যে তারা কানাঘুষোয় খবর পেয়েছিলেন, চিন্ময় কাজকর্ম হারিয়ে চুরিচামারি, চিটিংবাজি, স্মাগলিং-এর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তাদের মেয়েও হাত মিলিয়েছে। দুজনেই মনকে বুঝিয়েছিলেন, তাদের কোনও সন্তান নেই। এই মেয়েকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তার ওপর পুলিশের তাড়া খেয়ে এসেছে। ছি:। ছি:।

বৈশাখী বলেছিলেন, ‘আমাকে রাখতে হবে না। আমার ছেলেটাকে তোমরা রেখে দাও। আমাকে পুলিশ ধরলে, ছেলেটা ভেসে যাবে।’

কঠোর বাবা-মা প্রথমে তাতেও রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত নাতির মুখ দেখে মায়া হয়। মেয়েকে বলেন, নাতিকে তিনি রাখতে পারেন। কিন্তু শর্ত মানতে হবে। ভবিষ্যতে কোনওদিন ফিরে এসে ছেলের দাবি করা যাবে না। সে জানবে, শিশু বয়েসেই তার মা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। শুধু মুখে বললে হবে না। লিখে দিয়ে যেতে হবে। যতদিন ছেলে নাবালক থাকবে, তার ওপর কোনও দাবি করা যাবে না। বৈশাখী আগুপিছু ভাবেননি। ছেলেকে বাঁচাতে বাবার শর্তে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। হাতে সময় নেই। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পারলে, পরে আবার দেখা যাবে। বাবা-মা তো। কতটাই বা কঠিন হতে পারবে। নিজের চোর-চিটিংবাজ বাবা-মায়ের থেকে দাদু-দিদার কাছে থাকলে সে মানুষ হবে।

সেদিন রাতেই বাড়িতে পুলিশ এল। বৈশাখীর সুটকেসে চুরি করা সোনার চেইন পাওয়া গেল। বৈশাখীকে ধরে নিয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই সাজা হয়। জেল থেকে বেরিয়ে দুজনেই ঠিক করে, ছেলের থেকে তারা দূরে থাকবে। জেলখাটা বাবা-মার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক না থাকাই ঠিক।

অর্চিন দাদু-দিদার কাছে থেকে বড় হয়। লেখাপড়ায় মন বসে। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে থাকে। ক্লাসে ফার্স্ট হয়। বৈশাখী বাবাকে লুকিয়ে মাকে মাঝে মাঝে ফোন করতেন। মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতেন। ‘কেন তুই ফোন করেছিস?’

‘অর্চির খবরটুকু শুধু দাও মা।’

‘কী করবি খবর নিয়ে? ছেলেকে নিয়ে যাবি?’

‘না না, শুধু খবরটুকু জানব। সে ভালো আছে?’

‘ওকে বিরক্ত করিস না। ওইটুকু ছেলে সারাদিন বই পড়ে। ক্লাসে এবারও ফার্স্ট হয়েছে।’

বৈশাখী ফোনের ওপাশে কেঁদে ফেলে।

‘বা:, তোমরা ওকে মানুষ করেছ।’

‘তুই ওকে বিরক্ত করিস না। ওর সামনে আসিস না। জেলখাটা বাবা-মার কথা জানলে ছেলেটার সর্বনাশ হয়ে যাবে। মা হয়ে তুই এই সর্বনাশ করিস না।’

‘কখনও করব না। কোনও দিনও করব না। অর্চি কি আমার কথা জিগ্যেস করে?’

‘না করে না। আমরা তাকে বুঝিয়েছি। কতজনেরই তো বাবা-মা থাকে না। অন্য লোকে দত্তক নেয়। তাদের কাছে মানুষ হয়। আমরা তো ওর নিজের দাদু-দিদা। তুই ওকে নিয়ে যাস না বৈশাখী। নিজের যে সর্বনাশ করেছিস, ওর করিস না।’

‘করব না মা।’

বৈশাখী মনকে শক্ত করে নিয়েছিলেন। চিন্ময়ও বুঝিয়েছিল।

‘ছেলেটাকে মানুষ হতে দাও বৈশাখী।’

বৈশাখী বলেছিলেন, ‘আমরা কি এইসব অপরাধের কাজ ছেড়ে দিতে পারি না?’

চিন্ময় বলেছিল, ‘পারব না কেন? পারি বই কী। এই কাজ ছেড়ে দিয়ে ভিক্ষে করে থাকতে পারি। না খেয়ে মরতে পারি।’

‘যারা চুরি-চামারি করে না, তারা কি সবাই না খেয়ে মরে? আমরা না হয় কম খেয়ে থাকব।’

চিন্ময় বলল, ‘কোথায় থাকব? বস্তিতে?’

বৈশাখী বললেন, ‘দরকার হলে তাই থাকব।’

‘পারবে?’

বৈশাখী হেসে বলেছিলেন, ‘জেলে থাকতে পেরেছি, আর বস্তিতে থাকতে পারব না?’

চিন্ময় হেসে বলল, ‘তাতে গা থেকে জেলের গন্ধ যাবে?’

বৈশাখী বললেন, ‘না যাক। আমরা চেষ্টা করি।’

চিন্ময় মৃদু হাসল। বলল, ‘পুরোনো কথা ভুলে গেলে বৈশাখী? তখনও তো চেষ্টা করেছিলাম। লাভ হয়েছিল কোনও?’ কথাটা ঠিক। কারখানার কাজ চলে যাওয়ার পর চিন্ময় নতুন করে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। পাকাপাকি কাজ জোটেনি কোনও। ঠুকরে চলছিল। এখানে একমাস, সেখানে দশদিন। এইভাবে চলতে চলতে কাঞ্চন রক্ষিতের সঙ্গে যোগাযোগ। কাঞ্চন ছিল নামকরা চিটিংবাজ। অপরাধ জগতে তার নাম ছিল চিটকাঞ্চন। বাড়ি-জমি নিয়ে কারবার করত। একই সম্পত্তি তিন জায়গায় বেচত। জাল দলিল থেকে জাল রেজিস্ট্রেশন—সবের ব্যবস্থা ছিল। চিটকাঞ্চন একদিন চিন্ময়কে ডেকে পাঠাল।

‘আমার সঙ্গে কাজ করবে?’

চিন্ময় লোকটার নাম শুনেছিল। সাবধানে বলল, ‘কী কাজ?’

‘কী কাজ সে পরে বলব। আগে বলো করবে কিনা।’

চিন্ময় অবাক হয়ে বলল, ‘কী কাজ না জেনে হ্যাঁ-না বলব কী করে?’

চিটিকাঞ্চন বলল, ‘এই লাইনে এটাই নিয়ম। আগে হ্যাঁ-না, তারপর কাজের কথা।’

চিন্ময় চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনার কাজ মানে তো ঝামেলা।’

চিটিকাঞ্চন সহজভাবে বলল, ‘ঝামেলা তো বটেই। চিটিংয়ের কারবার করি, ঝামেলা থাকবে না? ঝামেলা বেশি বলে টাকাও বেশি। দোকানে ম্যানেজারি করে কত টাকা পাও? আমার কাছে তার তিনগুণ পাবে। রাজি কিনা বলো?’

চিন্ময় বলল, ‘হঠাৎ করে আমাকে ধরলেন কেন? আপনার কি মনে হয় আমি দু’নম্বরি কাজ ভালো পারব?’

চিটিংকাঞ্চন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘মনে হচ্ছে। তোমার চেহারার মধ্যে একধরনের শিক্ষিত, সৎ-সৎ ভাব আছে। আমি এই ধরনের চেহারা খুঁজছিলাম। তুমি যে দোকানে কাজ করো, সেখানকার লোক আমাকে খবর দিয়েছে।’

চিন্ময় হেসে ফেলল। নিজের চেহারা নিয়ে এরকম কথা সে কখনও শোনেনি।

‘কী করতে হবে?’

চিটিংকাঞ্চন বলল, ‘তাহলে রাজি তো?’

‘পুলিশ ধরবে না তো?’

চিটিংকাঞ্চন সহজভাবে বলল, ‘ধরতে পারে। চান্স আছে। তবে ধরলেও বেশিদিন ভিতরে রাখতে পারবে না। আমাদের ব্যবস্থা আছে। কেস লাইট করে দেওয়া হয়।’

চিন্ময় এই অকপট ভঙ্গিতে মজা পেল। বলল, ‘কাজটা বলুন।’

বত্রিশ

প্রথম হিসেবে কাজটা সহজ ছিল। তবে ইন্টারেস্টিং। এই দেশে জালজোচ্চুরি যে একটা চমৎকার শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা বোঝা যায়। তার ওপর গোটা অপারেশনের মধ্যে অভিনয়ের একটা বড় অংশ আছে। এতে চিন্ময় ঘাবড়েছিল।

‘অভিনয় তো আমার জানা নেই।’

চিটিংকাঞ্চন বলেছিল ‘চিন্তা করবার কিছু নেই; অভিনয় জানতে হয় না। এটা নিজে থেকেই আসে। সারাক্ষণ তো অভিনয়ের ওপরই আছি। আছি কিনা? ঘরে-বাইরে আমরা এক-একজন বড় অভিনেতা। হাসি-কান্না, রাগ সব অভিনয়। চিন্তা নেই, কাজের সময় কী বলতে হবে, শুধু যেটুকু শিখিয়ে দেব। তারপর নিজের মতো এগোবে।’

চিন্ময় বলল, ‘যদি গোলমাল হয়ে যায়?’

চিটিংকাঞ্চন নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘গোলমাল তো হবেই। আজ না হোক, কাল হবে। আমার এখনও কত গোলমাল হয়।’

‘কী হবে তখন?’

চিটিংকাঞ্চন বলল, ‘সেটা কাজের ওপর নির্ভর করছে। অপারেশন কেমন, তার ওপর নির্ভর করছে। পাবলিক ডিলের ব্যাপার হলে প্যাদানি হতে পারে। আরও বড় কেস হলে পুলিশে ধরতে পারে। সেখানেও অভিনয় করে, বুদ্ধি দিয়ে বেরোতে হবে। দু’নম্বরী কাজ আসলে বুদ্ধির কাজ। বোকা মানুষ পারে না। পারে না বলেই সৎ সেজে ঘুরে বেড়ায় আর আপশোস করে। বলে, হায়রে! জীবনে কিছু হল না। আরে বেটা, তুই গাধা তোর জীবনে হওয়ার কী আছে?’

কাঞ্চন লোকটাকে পছন্দ হল চিন্ময়ের। চিটিংয়ের কারবার করলেও এক ধরনের দার্শনিক দার্শনিক ভাব আছে। জালজোচ্চুরির মধ্যে ফিলজফি খোঁজে। এটা একটা মজার ব্যাপার।

‘অভিনয় নিয়ে ঝামেলা হবে না। কাজটা বের করে আনব এই টার্গেট মাথায় থাকলে, বাকিটা হয়ে যাবে। লোক ঠকানো একটা আর্ট। এই আর্টে অভিনয় যেমন লাগে, এই সহজ-সরল ভাবটাও লাগে। তোমার মধ্যে এই ভাব আছে।’

চিন্ময় অবাক হল। তার মধ্যে লোক ঠকানো ভাব আছে, এটা জানা ছিল না। বলল, ‘আচ্ছা চেষ্টা করব।’

বারাসাতের দিকে দশ কাঠা খাস জমির নকল মালিক সাজতে হবে। সরকারি জমি প্লট করে বেচবার জোচ্চুরি। জমি কেনবার জন্য পার্টি ধরে আনবে কাঞ্চন। এরপর কাজ শুরু। পার্টিকে প্রথমে দরদাম করে তাড়িয়ে দিতে হবে। সেই পার্টি আবার আসবে। আবার তাড়িয়ে দিতে হবে। তৃতীয়বার এলে তাকে বলতে হবে, টেন পার্সেন্ট ক্যাশ পেমেন্ট করলে তবে কথা বলব। নইলে আর নয়। বার বার কথা বলে সময় নষ্ট হচ্ছে। পার্টি গাঁইগুঁই করবে। তখন বলতে হবে, ‘বাদ দিন ভাই। জমি কেনবার জন্য অনেক লোক আছে। পার্টি শেষ পর্যন্ত লাখ দুয়েক টাকা দেবে। তখন জাল দলিল দেখাতে হবে।

‘সার্চিংয়ের জন্য কাগজ পাঠানো হল। দশদিন পরে আসবেন। এসে ডুপ্লিকেট নিয়ে নিজের মতো জমির খোঁজখবর নেবেন। পছন্দ হলে নেবেন। নইলে টাকা নিয়ে যাবেন। আচ্ছা দাঁড়ান, এখনই টাকা নিয়ে যান।’

এই কথা শুনে পার্টি ঘাবড়ে যাবে। ভাববে, জমি অন্য কাউকে বেচে দেওয়া হবে।

‘আমি তো টাকা ফেরত চাইনি।’

বলতে হবে, ‘আপনি চাননি তো কী হয়েছে? আমি চাইছি। আসলে আমি দেখছিলাম, আপনার জমিটা নেওয়ার ক্ষমতা আছে কিনা। নাকি শুধুই নাড়তে-চাড়তে এসেছেন। টাকা ওই কারণেই চেয়েছিলাম। টাকা পেয়ে বুঝলাম, ক্ষমতা আছে। নিন এবার টাকা ফেরত নিয়ে যান। জমি ঠিক কিনা দেখে টাকা দেবেন। তবে তার আগে আমরা নিজেরা দেখে নেব। কাগজপত্র যা পাওয়ার তারপর হাতে পাবেন।’

পার্টি এতে গলে যাবে। বলবে, ‘না না, টাকা যখন দিয়ে ফেলেছি, আর ফেরত নেব না। জমি আমার খুব পছন্দ। আমি নেব।’

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলতে হবে, ‘পছন্দ তো অনেকেরই। কিন্তু টাকা আমি আগে নেব না। ঠিক আছে আপনি যখন এত জোর করছেন, খানিকটা টাকা রাখছি। বাকিটা ফেরত নিন। নিন, এক লাখ টাকা ফেরত নিয়ে যান।’

পার্টি গদগদভাবে টাকা ফেরত নেবে। তার মান যেটুকু সন্দেহ ছিল, তাও থাকবে না। এমনকী জমির দলিলটলিল ঠিক আছে কিনা, তাও জানতে চাইবে না। দশদিন পরে আসার কথা বলে হাসিমুখে চলে যাবে।

এই অভিনয় দশটা পার্টির সঙ্গে করতে হবে। দশ লাখ টাকার ব্যবসা হয়ে গেলেই পাততাড়ি গুটিয়ে ভ্যানিশ হতে হবে।

চিন্ময় বলল, ‘এতজনের সঙ্গে অভিনয়! পারব তো?’

কাঞ্চন বলল, ‘আমি থাকব। তা ছাড়া কথা তো একই। টাকা দিন, টাকা ফেরত নিন। টাকা ফেরত দিলে যে-কোনও মানুষ খুশি হয়।’

চিন্ময় একটু ভেবে বলল, ‘আমার কত?’

চিটিংকাঞ্চন বলল, ‘ওয়ান পার্সেন্ট। এক লাখ। চেয়ার-টেবিলে বসে সাতদিনে এক লাখ রোজগার। মন্দ কী।’

চিন্ময়ের গা শিরশির করে উঠল। এক লক্ষ টাকা! কতদিন এত টাকা একসঙ্গে দেখেনি। বৈশাখী টাকা পেয়ে খুশি হবে? অবশ্যই হবে। মেয়েটা খুব টানাটানির মধ্যে থাকে। একটু স্বস্তি দেওয়া যাবে। ভালোমন্দ খাওয়া যাবে ক’দিন। কীভাবে টাকা পেল, সে কথা এখনই না বললেও চলবে।

চিটিংকাঞ্চন বলল, ‘কাজ ঠিকঠাক পারলে পরের অ্যাসাইনমেন্ট দেব।’

‘আবার জমি?’

‘না, আর জমিটমি নয়। এক লোককে দিয়ে এক কাজ দু’বার হবে না।’

এসব কথা বৈশাখী তার স্বামীর কাছ থেকে পরে শুনেছিলেন। স্বামী লোক ঠকিয়ে রোজগার করছে শুনে বৈশাখী প্রথমটায় ধাক্কা খেয়েছিলেন। ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছিলেন। না মেনে উপায় ছিল না। ভদ্রলোকের মতো উপার্জনের পথ ‘ভদ্রলোক’রাই বন্ধ করে দিয়েছে। একটা ছোট প্রাইভেট স্কুলে কাজ পেয়েছিলেন। কলেজের পড়া শেষ করতে পারেননি। ফলে বেতনও সামান্য হল। সেই বেতনে যাতায়াতের খরচ উঠত না। একটা বেসরকারি অফিসে কিছুদিন রিসেপশনে বসতে বলল। সেখানে মাইনে মন্দ ছিল না, কিন্তু ডিউটি ছিল রাত পর্যন্ত। তাও ঠিক ছিল। ডিউটি শেষে অফিসের মালিক গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য চাপাচাপি করত। লোকটা অফিসে ভালো, বাইরে নোংরা। এরপর বৈশাখী কাজ নিলেন সেলসে। বাড়ি ঘুরে মেয়েদের কসমেটিক্স বিক্রি করতে হবে। সস্তার জিনিস। প্রথম মাসে কাজ ভালো হল। পরের দুটো মাস মার খেতে হল। ইনচার্জ মহিলা গালিগালাজ করে অফিসে বসিয়ে রাখল। কাজ না পারার শাস্তি। অফিসে চা করতে হবে, টেবিল মুছতে হবে, জিনিসপত্রের ধুলো ঝাড়তে হবে। আটদিনের দিন চলে এলেন বৈশাখী। সরকারি কাজ পাওয়ারও চেষ্টা করেছেন। হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত লেখাপড়া শিখলে যতটা পাওয়া যায়। বিজ্ঞাপন বেরোলে পরীক্ষা দিলেন। পরীক্ষা খারাপ দেননি। তবু চাকরিটা হল না। রেজাল্ট বেরোনোর পর দালাল চলে এল। হেলথ চেকআপ, পুলিশ ভেরিফিকেশন, আইডেনটিটি প্রুফের জন্য টাকা লাগবে। অনেক টাকা। নইলে কোনও কাগজ বেরোবে না। টাকা অনেক দূর পর্যন্ত দিতে হবে। এত টাকা কোথায়? বৈশাখীর তখন না আছে টাকা দেওয়ার মতো আত্মীয়, না আছে বিক্রি করবার মতো গয়নাগাঁটি। তাও হাল ছাড়লেন না। আবার পরীক্ষা দিলেন। প্রাইমারি স্কুলে দিদিমণির চাকরি। অনেকটা এগিয়ে সেখানেও আটকে যেতে হল। সেই টাকা। পোস্টিংয়ে টাকা লাগবে। একটা-দুটো টাকা নয়। বিশ হাজার টাকা। বৈশাখী শিখলেন, গরিব মানুষকে সবাই মারতে চায়। শেষ পর্যন্ত দোকানে বসবার কাজ নিলেন। মেয়েদের অন্তর্বাসের দোকান। সেখানে তিনমাস পর হিসেবে ঝামেলা হল। টাকার হিসেবে গোলমাল নয়, জিনিসের হিসেবে গোলমাল। অর্ডারের সঙ্গে স্টকের হিসেব মিলল না। এক পেটি ব্রা, দু’পেটি প্যান্টি উধাও। দোকানে মোট তিনজন কর্মচারী। মালিক তাদের ডাকলেন।

‘ব্রা-প্যান্টি নিয়ে আমি থানা-পুলিশ করতে চাই না। সেটা ভালো দেখায় না। আমি চাই তোমরা নিজে থেকেই কাজ ছেড়ে দাও। যা হওয়ার হয়ে গেছে। ক্ষতিটা যে খুব বড় হয়েছে এমন নয়। তোমরা জানো, ওই জিনিসের দাম খুব বেশি নয়। কিন্তু লক্ষণটা ঠিক নয়।’

কাজ ছেড়ে চলে এসেছিলেন বৈশাখী।

চিন্ময় এসে যখন চিটিংকাঞ্চনের গল্প, বারাসতের জমির ঘটনা বলল তখন প্রথমে ধাক্কা লাগলেও মনে হল, এটাই ভালো। একদিকে ঘুষ, অন্যদিকে অপমান। ভদ্রলোকেরাই এই ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছে। যাতে ভদ্রলোকের মতো বাঁচা না যায় তার ব্যবস্থা। এর থেকে লোকঠকানো ভালো। একদিন চিন্ময় তাকেও কাজে ঢুকিয়ে নিল।

‘একটা কাজে আমাকে হেল্প করতে হবে বৈশাখী।’

বৈশাখী বললেন, ‘কী কাজ? জালিয়াতি?’

চিন্ময় গায়ে মাখল না। বলল, ‘আপত্তি আছে? আপত্তি থাকলে বলো, বাইরে থেকে কাউকে নিয়ে নেব। টাকা দিলে লোকের অভাব হবে না। তবে নিজেদের মধ্যে হলে সব দিক থেকে ভালো। টাকাটা বাইরে যায় না। রিস্কও কম থাকে।’

বৈশাখী বলেছিলেন, ‘আমি লোক ঠকাতে পারব না।’

চিন্ময় হেসে বলল, ‘প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম পারব না। পরে যখন বুঝলাম এই দুনিয়ায় হয় আমাকে ঠকাতে হবে, নয় আমি ঠকব—তখন পেরেছি। বৈশাখী, কোনও অসুবিধে হবে না। হাতে টাকা থাকলে সব অসুবিধে দূর হয়ে যায়। নাও, এত চিন্তা কোরো না।’

চিন্ময় নিয়ে গেল একজনের কাছে। ধুতি-ফতুয়া পরা সুদর্শন পুরুষ। একমাথা সাদা চুল। বয়স বেশি হলেও চেহারা শক্তপোক্ত। ঘরের দেওয়ালে দেবদেবীর ছবি। একদিকে উঁচু আলমারি। সেখানে বাঁধানো সার্টিফিকেট, স্মারক। এক পাশে ফটোর সারি। সেখানে নেতা, মন্ত্রী, বড় মানুষদের সঙ্গে ছবি। ভদ্রলোক পুজোআচ্চা, ধ্যানদান, সমাজসেবা নিয়ে থাকেন। এই সব সার্টিফিকেট, স্মারক, ফটো তার সমাজসেবা করে পাওয়া। ভদ্রলোকের চেহারায় এক ধরনের ঋষি ঋষি ভাব। চোখমুখ, ভাবভঙ্গি দেখলে মনে হয়, মানুষটার মধ্যে আর যাই থাকুক লোভ বলতে জিনিস নেই। মাটিতে মাদুর পেতে বাবু হয়ে বসে আছেন। চিন্ময় পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর বৈশাখীকে বললেন, ‘বসো মা।’ তারপর কাজের কথা হল।

কাজ জটিল। এই ঋষি টাইপ সমাজসেবক মানুষটির মূল ব্যবসা বিধবার সম্পত্তি হাতানো। তার জন্য তিনি নানা ধরনের পদ্ধতি প্রকরণের মধ্যে দিয়ে যান। কখনও দরিদ্র মহিলার অসহায়তার সুযোগ নেন, কখনও আইনের প্যাঁচ কষেন, কখনও ভয় দেখান। চারদিকে তার লোক ছড়ানো আছে। তারাই খোঁজখবর আনে। সস্তায় সম্পত্তি হাতানোর জন্য তারা মহিলার কাছে পৌঁছে যায়। বলা বাহুল্য, সব সময়েই টার্গেট থাকে অসহায়দের প্রতি। যাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই।

এবার অসুবিধেয় পড়েছেন। বাঁকুড়ার এক মহিলার কেস। মহিলার দেওর, ভাসুর এসে হাজির হয়েছে। তারা মহিলাকে বাড়ি-জমি-বাগান বিক্রি করতে দেবে না। মহিলাকে ভয় দেখাতে হবে। গুন্ডা-মস্তানের ভয় নয়, সামাজিক বদনামের ভয়। এমন ভয় যাতে মহিলা ভাসুর-দেওরদের কথা না শুনে গোপনে দলিলে সই করে দেয়। কী সে ভয়? বৈশাখীকে তার স্বামীর গোপন স্ত্রী সাজতে হবে। বিধবার বেশে গিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে হবে মহিলার সঙ্গে। সম্পত্তির ভাগ চাইতে হবে। এই চাপের মাঝে সমাজসেবক ফের দালাল পাঠাবে। সে-ও চাপ দেবে। পারিবারিক কেচ্ছা ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেবে। মহিলা এবার দ্রুত বাড়ি-জমি বিক্রি করবেন। যা দাম পান তাতেই করবেন। গ্রামবাংলায় এখনও টাকার থেকে কেচ্ছার দাম বেশি।

বৈশাখী নিখুঁতভাবে কাজ করলেন।

সেই তার লোক ঠকানো শুরু। স্বামী মারা গেছে। আজও অপরাধের দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি বৈশাখী। ভূতের মতো তার কাঁধের ওপর চেপে আছে। হয়তো এটাই তার ভবিতব্য ছিল। নিজের জীবনের কাছে বার বার ঠকে, অন্যকে ঠকানোর নেশায় মেতে থাকেন। কখনও মনে হয়, এই নোংরামি থেকে বেরিয়ে আসবেন। টাকাপয়সার তো দরকার নেই আর। দুর্গাপুরে মাথা গোঁজবার মতো একটা আস্তানা রয়েছে। বাকি জীবনটা দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়ার মতো টাকা রয়েছে। আর এইসব খারাপ কাজ করে কী লাভ? পরক্ষণেই মনে হয়েছে, কী হবে কাজ ছেড়ে? কোথায় যাবেন? কী নিয়ে থাকবেন? বাবা-মা মারা গেছে। অনেক পরে পরে সব খবর পেয়েছেন। খবর পেয়েছেন, অর্চিন কলকাতায় দূর সম্পর্কের আত্মীয়র বাড়িতে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। মণিকুন্তলার বাড়ি। সম্পর্কে জ্যেটতুতো বোন হয়। তবে তাকে তেমন করে মনে করতে পারেন না বৈশাখী। ছোটবেলার চেনা। বহু বছর যাতায়াত ছিল না। এখন সেনবাড়ির ঠিকানা জোগাড় করেছেন। মাঝে মাঝে ছেলেটাকে দেখতে ইচ্ছে করে। বাড়ির উলটোদিকের ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। একদিন অর্চিনকে ফলো করে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত গেছেন। সামনে যেতে খুব মন চায়। নিজেকে আটকে রাখেন। থাক। জেলখাটা, লোকঠকানো মাকে না দেখাই ভালো। মাকে না দেখে এতদিন যখন পেরেছে, বাকি বছরগুলোও পেরে যাবে নিশ্চয়।

আজ ছেলেটাকে দেখা হল না। না হয়ে ভালোই হয়েছে। মায়া বাড়ানো ভালো নয়। আজ কি কলকাতায় থেকে যাবেন? কাল একবার চেষ্টা করলে কেমন হয়? আর একটু সকাল সকাল নাহয় সেনবাড়ির উলটোদিকে গিয়ে দাঁড়াবেন। খারাপ হবে? থাক। মায়া বাড়বে। ফিরে যাওয়াই ভালো।

ফিরে যাবে ভেবেও ফেরা হল না। কলকাতায় থাকতে হল অর্চিনের মাকে। তবে ছেলেকে দেখবার জন্য নয়। অর্চিনকে যারা আশ্রয় দিয়েছে তাদের কোম্পানি ‘সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’কে ঠকানোর বরাত নিয়ে থাকতে হল। দ্য ক্যালকাটা হোটেলের উসকোখুসকো চেহারার পার্টি কাজের বরাত দিল। কাজটাও শক্ত, টাকার পরিমাণও ভালো। সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস কাদের কোম্পানি জানতে পারলেন না বৈশাখী, চানওনি। তবে জানতে পারলেন, এই ভয়ংকর কাজের পিছনে যে মানুষটা রয়েছে, তার নাম নিখিলেশ উপাধ্যায়। সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস কোম্পানির বয়:জ্যেষ্ঠতম কর্মী। অবসর নেওয়ার বয়স দশ বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। তার পরেও চাকরি করছে। মালিকপক্ষের গভীর বিশ্বাসের লোক।

এই লোক কোম্পানির বড় সর্বনাশ করতে চায়।

তেত্রিশ

হাম্বা, হাম্বা, হাম্বা…

বারিধারার মোবাইলে শ্রবণের মেসেজ ঢুকেছে। তবে আজ গরুর গলাটা একটু কাঁপা। বারিধারা ভুরু কোঁচকাল। গলা কাঁপা কেন? গরুর কী হল? কোনো সমস্যা হয়েছে?

বারিধারা নিজের ঘরে। দাদুর কাছ থেকে এসে তার মন ভালো হয়ে আছে। মন ভালো হওয়ার কারণ দুটো। এক নম্বর কারণ, মধুজা রায়ের সঙ্গে আজ তার একটা হেস্তনেস্ত হবে। আর দু-নম্বর কারণ, দাদুর নতুন প্রজেক্ট ‘একটু পরে রোদ উঠবে।’ এই প্রজেক্টে যেসব অসহায়, গরিব মেয়ে লেখাপড়া করতে গিয়ে বাধা পায়, তারা আসবে। লেখাপড়া শিখবে। হাতের কাজ শিখবে। সেই জিনিস বিক্রি করে নিজেরাই নিজেদের খরচ জোগাড় করে নেবে। ফ্যানটাসস্টিক! দাদুর ঘর থেকে বেরিয়েই বারিধারা ঠিক করে ফেলেছে, ইউনিভার্সিটির পাট চুকে গেলেই সে ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ প্রজেক্টে ফুলটাইম ঢুকে যাবে।

মধুজা ম্যাডামের ঘটনা নিয়ে দাদু যে প্ল্যান দিয়েছে, সেটাও ভালো। এই প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করলে ম্যাডাম রেগে ফায়ার হয়ে যাবেন, অথচ কিছু বলতে পারবেন না। ম্যাডাম রেগে গেলে তার এফেক্ট অনেক দূর পর্যন্ত গড়াতে পারে। পরীক্ষার রেজাল্ট থেকে শুরু করে পি এইচ ডি, কেরিয়ার সব ঘেঁটে যেতে পারে।

বারিধারা ভালো করেই জানে কলেজ, ইউনিভার্সিটিগুলোতে ছাত্রছাত্রী, গবেষক, পার্টটাইম টিচার, ফুলটাইম টিচারদের ঘেঁটে দেওয়ার নানারকম সিস্টেম চালু আছে। যারা মনে করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটা বিরাট পবিত্র, সৎ জায়গা—তারা অনেকেই এইসব সিস্টেমের খবর জানে না। হিডেন সিস্টেম। চোরাগোপ্তা কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ে গবেষকদের পারফরমেন্সের থেকে খুশি করবার ওপর নম্বর বেশি। ইউনিভার্সিটিতে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটরের হাতে প্রশ্নপত্রের সেট থাকে। সবক্ষেত্রে না হলেও কিছুক্ষেত্রে তো প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটরকে তেল দিতে হয়ই। কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। সব অপরাধ প্রমাণ হয়, ‘তেল অপরাধ’ প্রমাণ হয় না। শুধু কলেজ ইউনিভার্সিটির নম্বর বাড়ানো কেন, জীবনের সবক্ষেত্রেই সাকসেসের পিছনে তেলের বিরাট ভূমিকা। বাঙালি স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে রান্নার তেলের ব্যবহার কমাচ্ছে, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তেলের ব্যবহার বাড়াচ্ছে। তেল ঢাললে হড়াৎ করে সবাইকে টপকে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যায়। ইউনিভার্সিটিতে তেল দেওয়াকে ছেলেমেয়েরা বলে ‘এক্স’ পেপার। বারিধারা যতই মেধাবী ছাত্রী হোক সে জানে, পার্স্ট পেপার সেকেন্ড পেপারের সঙ্গে ‘এক্স’ পেপারেও নম্বর তুলতে হয়। সেমিস্টারের বেলাতেও তাই। কলেজের বেলায় সাজেশন পাওয়ার ব্যাপার থাকে। প্রশ্ন কে করেছেন? মডারেশন কার হাতে? কার টিউশনে সাজেশন মেলে—ছেলেমেয়েদের জানতে হয়। নইলে গেলে। পরীক্ষা সৎ ব্যাপার। টোকাটুকি করে ধরা পড়লে সাজা। কিন্তু যে টিচার টিউশন করে সাজেশন মিলিয়ে দেন, তিনি হলেন ‘মহামতি পরীক্ষাশ্রী’। সবার শ্রদ্ধেয়। সবার প্রণম্য। ছেলেমেয়েরা বাড়িতে ছবি টাঙিয়ে রাখে। সাজেশন মেলে কী করে? পরীক্ষা ভগবান কি বাছা বাছা টিচারদের স্বপ্নে সাজেশন পাঠিয়ে দেন? তাই হবে। বারিধারা অনকে ভেবেও এসবের উত্তর পায়নি।

তবে বারিধারা জানে, এরাই সব নয়। সে তার জীবনে অনেক ভালো শিক্ষক-শিক্ষিকা পেয়েছে। তারা দারুণ। শুধু বিদ্যা বুদ্ধি বা পড়ানোতে দারুণ নয়, ব্যবহারেও দারুণ। সবাইকে সমান চোখে দেখে। তারা ছেলেমেয়েদের শ্রদ্ধার মানুষ। এদের মেরুদণ্ড শক্ত। এরা কোনওরকম পার্সিয়ালটি নয়, ছাত্রছাত্রীদের সত্যিকারের লেখাপড়াকে ভালোবাসেন। নিজেরা লেখাপড়া করেন। তাদের ডিপার্টমেন্টের কল্যাণ সমাজপতি আর অরিন্দম সেনগুপ্ত তো এরকমই। কল্যাণ সমাজপতি ফাঁকিবাজ মাস্টারমশাই। ধরে-বেঁধে ক্লাস করাতে হয়, নোটিস দেখাতে হয়। কিন্তু একেবারে খাঁটি। ছেলেমেয়েরা বাড়িতে হানা দিলেও বিরক্ত হন না।

তবে ভালোরা বেশিরভাগ জায়গাতেই কোণঠাসা। শুধু ছেলেমেয়ে নয়, ভালো টিচারদের ওপরও ঝামেলা করা হয়। কলেজে পড়বার সময়ও বারিধারাকে এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তাদের ডিপার্টমেন্টে সুমনা সেন নামে এক অধ্যাপিকাকে কয়েকজন টিচার মিলে খুব হেনস্থা করত। সুমনা ম্যাডামের দোষ, তিনি ভালো পড়াতেন। ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় ছিলেন। তাদের নিয়ে নাটক, ডিবেট, সেমিনার করতেন। রুটিন যাতে ঠিকমতো হয়, ক্লাস যাতে নিয়মিত হয়, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া যাতে বেশি করে হয় তার জন্য সবসময় বলতেন। কয়েকজন মাস্টারমশাই তার পিছনে লেগে গেল। সুমনা ম্যাডাম একটা বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন। যদিও ক্লাসে সেই মত কখনওই আনতেন না। সেটা নিয়েও অন্য টিচাররা ঘোঁট পাকাতেন। ছেলেমেয়েরাও সে খবর জানত। নোংরা মানুষকে সবাই ছি ছি করে। পুলিশ এলে ধরে নিয়ে যেতে পারে। এসব জায়গার নোংরা লোকগুলো স্টেজে বসে মালা পায়। তার পরেও কলেজ, ইউভার্সিটিগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ভালো শিক্ষক-শিক্ষিকা আর ছাত্রছাত্রীদের জন্য। তাদের শক্তি এত বেশি হয় যে, খারাপ লোকগুলো হাজার চেষ্টা করেও তাদের দমাতে পারে না। সাময়িকভাবে হয়তো কিছুদিন রাজত্ব করে। শেষ পর্যন্ত হারতে হয়।

বারিধারা ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। প্যান্ট-শার্ট পরা হয়ে গেছে। টেবিল ঘেঁটে ব্যাগে বই-খাতা নিচ্ছে। বারিধারা বই-খাতা না নিয়ে কখনও ইউনিভার্সিটিতে যায় না। বন্ধুরা ঠাট্টা করে।

শমজিতা বলে, ‘তুই কি এখনও স্কুলে পড়িস বারি? গাদাখানেক বই-খাতা আনিস কেন?’

বারিধারা বলে, ‘মনে হয় স্কুলে পড়ি।’

স্বয়ংদ্যুতি বলে, ‘আমরা তো একটা কয়েকটা সাদা পাতা নিয়ে আসি। নোটস নিয়ে ফাইলে ক্লিপ করে রাখি।’

বারিধারা গম্ভীর গলায় বলে, ‘আমি অবশ্য তা করি না। খাতায় নোটস টুকি, তারপর বাড়ি যাওয়ার সময় ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলে দিই।’

তিথি বলে, ‘বেশি স্মার্ট হতে চেষ্টা করিস না বারি। ইউনিভার্সিটিতে এত বই-খাতা আনা একটা ছেলেমানুষি হ্যাবিট। তুই ভালো স্টুডেন্ট হতে পারিস, কিন্তু ছেলেমানুষি করবার অধিকার নেই।’

বারিধারা বলে, ‘আমারও তাই মনে হয়। কী করব বল, ইউনিভার্সিটিতে আসবার সময় বই-খাতা না নিয়ে বেরোলে কেমন একটা অস্বস্তি হয়। মনে হয়, প্রপার জামাকাপড় পরিনি।’

শমজিতা চোখ টিপে হেসে বলে, ‘কী মনে হয়? ন্যুড হয়ে এসেছিস?’

সবাই খিলখিল আওয়াজে হেসে ওঠে। বারিধারাও হাসে। হাসতে হাসতেই বলল, ‘তাতে তোর কী সুবিধে হবে শমজিতা?’

স্বয়ংদ্যুতি বারিধারার কাঁধ চেপে বলে, ‘বুঝতে পারছিস না? তাহলে ও সাহস পাবে। পরদিন থেকে ও কিছু না পরে ক্লাসে যাবে।’

তিথি গলা নামিয়ে চোখ বড় করে বলল, ‘সত্যি যদি এরকম একদিন হয়, কী হবে বল তো?’

বারিধারা তিথিকে নকল করে চোখ বড় করে বলল, ‘কী হবে তিথিরানি?’

‘আমরা মেয়েরা যদি সবাই একদিন ইয়ে হয়ে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকি।’

শমজিতা গম্ভীর মুখ করে বলল, ‘কী আর হবে? যারা দেখবে তারা জ্ঞান হারিয়ে ধড়াস ধড়াস করে পড়ে যাবে।’

তিথি বলল, ‘সবাই মোবাইল বের করে ফটাফট ছবি তুলতে থাকবে। তারপরে ফেসবুকে লোড করবে।’

স্বয়ংদ্যুতি বলল, ‘বাকিটা বল। ভিসি পুলিশ ডেকে অ্যারেস্ট করাবে।’

বারিধারা বলল, ‘এ আর এমন কী? পৃথিবীতে বহু জায়গায় ন্যুড অ্যাজিটেশন হয়। টিভিতে দেখায়। কাগজে ছবি বেরোয়। মেয়েদের ওপর অপ্রেশনের বিরুদ্ধে এই ধরনের অ্যাজিটেশন একটা কমন ব্যাপার। এতে সবার নজর পড়ে। ইস্যুটা সামনে চলে আসে।’

শমজিতা বলল, ‘আমরা কীসের জন্য বিক্ষোভ করব? পরীক্ষায় পাস করাতে হবে?’

স্বয়ংদ্যুতি বলল, ‘তাহলে শুধু মেয়েরা কেন, ছেলেরা কী দোষ করল? তাদের পরীক্ষায় পাস করতে হবে না?’

বারিধারা বলল, ‘ছেলেদের এই ধরনের আন্দোলনের কথা শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। হয়তো হয়েছে। তবে এই ফর্মে বিক্ষোভ কোনও পারসোনাল সুবিধে আদায়ের জন্য হয় না। এটা প্রাোটেস্ট এগেইন্সট সোসাইটি, সিস্টেম। যে সোসাইটি, সিস্টেম মেয়েদের অসম্মান করে। অত্যাচার করে। মেয়েরা জামাকাপড় খুলে তখন বলে, এই সমাজ মেয়েদের লজ্জা নিবারণ, উপযুক্ত অধিকার, প্রাপ্য সম্মান দিতে ব্যর্থ, অযোগ্য। এই সমাজের কাছে মেয়েদের পোশাক অর্থহীন। এটা সমাজের ভুল নিয়মকানুন, মেকি ভদ্রতার ওপর একটা থাপ্পড়।’

শমজিতা বলল, ‘আমরা এখন এসব করতে গেলে, আমরাই থাপ্পড় খাব।’

বারিধারা বলল, ‘আমাদের সোসাইটি, কালচারে ন্যুড অ্যাজিটেশন ঠিক যায় না। তবে চারপাশে মেয়েদের ওপর যেসব কাণ্ড ঘটছে, একদিন হয়তো এটাও হয়ে যাবে। হয়তো একদিন কলেজ স্কোয়ার থেকে মিছিল বেরিয়ে যাবে।’

তিথি চোখ বড় করে বলল, ‘ছি ছি। তাহলে কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে।’

বারিধারা হাত বাড়িয়ে তিথির থুতনি নেড়ে বলল, ‘চিন্তা করিস না। তোকে সেই মিছিলে ডাকা হবে না।’

তিথি বলল, ‘আর তোকে যদি ডাকা হয়? যাবি?’

বারিধারা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘না, আমি যাব না। বললাম তো, আমি যে স্ট্রাকচারে আছি, তাতে এটা যায় না। প্রয়োজনও নেই। দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে অনেক মিছিল হয়েছে, কোনওটাতে মেয়েরা জামাকাপড় খুলে হাঁটেনি। তার পরেও সরকারের বিরুদ্ধে বড় বড় আন্দোলন হয়েছে। তাতে মেয়েরা লাঠি-গুলি কম খায়নি। কোথাও জামাকাপড় খুলতে হয়নি। গল্প শুনেছি, সত্তর দশকে ওয়ানে বহরমপুরে আমার মামাবাড়ির পাড়ায় গুন্ডারা মেয়েদের খুব বিরক্ত করত। বিরক্ত বললে কম বলা হবে, অত্যাচার করত বলা উচিত। রাস্তায় বেরোলে হাত ধরে টানাটানি তো বটেই, এমনকী একটু সুন্দর দেখতে হলে জোর করে বিয়ে পর্যন্ত করতে চাইত। নইলে রেপ করে দেওয়ার হুমকি দিত। অ্যাসিড ছুড়ত। পুলিশকে বলে কোনও লাভ হত না। কমপ্লেইন করলে পুলিশ বাড়িতে এসে, থানায় ডেকে অসভ্যতা করে যেত। পাড়ার মেয়েরা আর সহ্য করতে পারল না। ছোট-বড় সবাই মিলে একদিন হাতা-খুন্তি-বঁটি, লাঠি, ঝাঁটা নিয়ে ‘মার মার’ বলে বেরিয়ে পড়ল। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, গরিব, বড়লোক—সবাই ছিল। বাড়ি থেকে গুন্ডাগুলোকে টেনে বের করে বেধড়ক মার দেওয়া হল। থানা ঘেরাও হল। গভর্মেন্টের টনক নড়ল। না পড়ে উপায় ছিল না। চারদিকে ছ্যা ছ্যা পড়ে গেল যে। দুদিনের মধ্যে অনেক গুন্ডা-মস্তান অ্যারেস্ট হল। পাড়াছাড়া হল বাকিরা। কই কোনও মেয়েকে তো পোশাক খুলতে হয়নি!’

শমজিতা বলল, ‘বা: চমৎকার গল্প।’

বারিধারা বলল, ‘গল্প নয়, সত্যি কথা।’

তিথি বলল, ‘তাহলে বলছিস, মেয়েদের ন্যুড মিছিলের থেকে হাতা-খুন্তি-ঝাঁটা মিছিল বেশি এফেক্টিভ?’

বারিধারা বলল, ‘আমার তাই মনে হয়। অন্তত আমাদের সমাজে তো বটে।’

স্বয়ংদ্যুতি বলল, ‘এত ভারী ভারী কথা বলতে গিয়ে তুই কিন্তু আসল জায়গা থেকে সরে গেলি বারি।’

বারিধারা হেসে বলল, ‘আচ্ছা বাবা, কাল থেকে ইউনিভার্সিটিতে ছেলেমানুষের মতো বই-খাতা আনব না। বড় মানুষের মতো হাতা-খুন্তি নিয়ে আসব। হবে তো?’

সবাই হেসে ওঠে।

ব্যাগ বন্ধ করে শ্রবণের মেসেজ পড়ল বারিধারা। মাঝারি সাইজ। ‘বারি, হঠাৎ করে আজ সকালে খুব জ্বর এসেছে। মে বি ম্যালেরিয়া। ডেঙ্গিও হতে পারে। এখন হেভি ডেঙ্গি হচ্ছে। বাড়িতে কেউ নেই। বসিরহাটের বড়পিসি অসুস্থ। তাকে দেখতে গেছে। দাদা ক্যান ড্রাইভ। সেই কারণে অফিস কামাই করে দাদাকে যেতে হয়েছে। আমি জ্বরে ধুঁকছি। প্লিজ ধারা, ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার আগে একবার কি আমাকে দেখে যাওয়া যায় না?’

বারিধারা রেগে গেল, আবার হেসেও ফেলল। জ্বরের গল্পটা গুল। এই মিথ্যে কথা বলে বছর খানেক আগে একবার ফাঁকা বাড়িতে তাকে ডেকে নিয়েছিল শ্রবণ। আবার একই কায়দা! ছেলেটার সাহস তো কম নয়! এর পরেও রাগ হবে না?

সেদিনটা ছিল খুব বৃষ্টির।

সকাল থেকে ঝরছে তো ঝরছেই। রাস্তায় জল জমে গেছে। ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না বারিধারার। মণিকুন্তলা ঘরে এসে তাড়া দিলেন। এত বেলা পর্যন্ত বাসি বিছানা তিনি সহ্য করতে পারেন না। এই ব্যাপারে ছুটির দিন মেয়েদের সঙ্গে তাঁর অনেকবার ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে। বড় মেয়ে বিয়ে করে চলে যাওয়ায় ঝগড়া হাফ হওয়ার কথা। কিন্তু বেড়েছে। ছোট মেয়ে সহজে বিছানা তুলতে চায় না। অন্য কেউ হাত দিক তাও চায় না। কাজের মেয়েটাকে ধমক দেয়। তার সঙ্গে ঝগড়া করে। তার পরও মণিকুন্তলাদেবীর দেরি হলে মেয়ের ঘরে আসেন। শরীরটরীর খারাপ হল কিনা সে চিন্তা থাকে, বিশেষ করে পিরিয়ড শুরুর প্রথম দিন। বেশি কষ্ট পায়। ছোটবেলা থেকেই এই সমস্যা। তবে সেদিন এরকম কোনও সমস্যা ছিল না। দেরি দেখেই মণিকুন্তলা ঘরে এলেন। এই মেয়ের ঘরে আসা মানেই ঝগড়া। মেয়ে হয় ফাজলামি করবে, নয় পাত্তা দেবে না।

‘কীরে এখনও উঠিসনি?’

‘উঠেছি মা। আমি উঠে পড়েছি অনেকক্ষণ। এই যে আমি শুয়ে আছি, এটা আমি নই, আমার শরীর। যার ওপর আজ আর আমার কোনও কন্ট্রোল নেই।’

মণিকুন্তলাদেবী গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘বাজে কথা না বলে উঠে পড়।’

বারিধারা শোওয়া অবস্থাতে হাত বাড়িতে মায়ের হাত ধরল।

‘মা, প্লিজ একটা কাজ করে দাও। ব্রাশ আর টুথপেস্টটা এনে দাও। আজ আমার বিছানা ছাড়তে করছে না। শুয়ে শুয়ে দাঁত মাজব।’

মণিকুন্তলা জোর ধমক দিতে যাবেন, এমন সময় বারিধারার মোবাইল হাম্বারবে শ্রবণের মেসেজ আসার কথা জানান দিয়েছিল। সেদিনও ঠিক একইভাবে শ্রবণ তাকে জ্বরের কথা বলে ডেকেছিল।

‘বারি, জ্বর হয়েছে। মনে হচ্ছে টাইফয়েড। বাড়িতে কেউ নেই। দাদা-বউদি শ্রীরামপুর। বউদির বাপের বাড়ি। বাবা-মা পুরী গেছে সে তো জানোই। একা ভয় করছে। ধারা, একবার আসবে প্লিজ?’

চৌত্রিশ

সেদিন কলিং বেল টিপতে শ্রবণ এসে দরজা খুলেছিল। নীল রঙের পায়জামা আর কালো রঙের টি শার্টে তাকে ঝলমলে লাগছে। ডানদিকের গালে খানিকটা সবুজ রঙের আঁচড়। নিশ্চয় ছবি আঁকছিল। মুখে রং লেগে গেছে।

বারিধারা থমকে গেল। কোথায় জ্বর! দিব্যি সুস্থ ছেলে। বরং অন্যদিনের থেকে বেশি ফ্রেশ লাগছে।

‘তোমার না জ্বর?’

শ্রবণ মুখ শুকনো করবার চেষ্টা করল। হল না। হেসে বলল, ‘ছিল। এখন কমে গেছে। নেই বলতে পারো।’

বারিধারা ভুরু কোঁচকাল। তার রাগ হচ্ছে। জলকাদায় তাকে বেরোতে হয়েছে। মায়ের সঙ্গে কথা বলবার ফাঁকেই শ্রবণের মেসেজের রিপ্লাই পাঠিয়েছিল।

‘জ্বর কত?’

জবাব এসেছিল দ্রুত—’জানি না। কপালে হাত দিয়ে মনে হচ্ছে অনেক। থার্মোমিটার খুঁজে পাচ্ছি না। বউদি কোথায় রেখে গেছে। তুমি এলে খুঁজে দিও।’

বারিধারা রেগে গিয়ে লিখেছিল—’আই কান্ট। আমি থার্মোমিটার খুঁজতে তোমার বাড়ি যেতে পারব না।’

জবাব এল—’আচ্ছা, থার্মোমিটার খুঁজতে হবে না। এমনি এসো।’

বারিধারা তারপর বিছানায় উঠে বসে হেসে বলেছিল, ‘যাক, মাতৃআজ্ঞাই পালন করলাম। শয্যাত্যাগ করেছি।’

মণিকুন্তলাদেবী রাগের ভান দেখিয়ে বললেন, ‘খুব করেছ, আমি ধন্য হয়েছি। এবার বাথরুমে যাও।’

এ বাড়িতে বিছানা তোলা, ঘর ঝাড়পোঁছ করবার জন্য একাধিক লোক আছে। তারপরেও মণিকুন্তলা নিজের বিছানা নিজেই তোলেন। ছোটবেলা থেকে মেয়েদেরও সেরকম শিখিয়েছেন। মেয়েদের বিছানায় বাইরের লোকের হাত দেওয়া উচিত না। মহিলা হলেও নয়। মেয়েদের বিছানা একটা ব্যক্তিগত বিষয়। অন্য কারও সেই ব্যক্তিগত বিষয় জানা উচিত নয়। কম বয়সে বারিধারা আর মেঘবতী দুজনেই অতি উৎসাহে সেই কাজ করেছে। তারাও যে ‘ব্যক্তি’ এবং তাদের যে ‘ব্যক্তিগত’ বিষয় থাকতে পারে, এটা ভেবে তাদের বিরাট আনন্দ ছিল। কিন্তু যত বড় হয়েছে এই সামান্য কাজে তাদের আলিস্যি এসেছে। মেঘবতী শ্বশুরবাড়িতে নিজেকে বদলেছে, বারিধারার আলিস্যি বেড়েছে। বকাবকি করলে মেয়ে ফাঁকিবাজির জন্য নানারকম যুক্তি দেখায়।

‘মা বাসি বিছানা হল বাসি লুচির মতো। খেয়ে দারুণ আরাম।’

মণিকুন্তলা কটমট করে বলেন, ‘তোমাকে তো বিছানা খেতে বলিনি বৃষ্টি। মাথা গরম করে দেওয়া কথা বলছ কেন?’

বারিধারা হেসে বলে, ‘বিছানা খাওয়া মানে কচমচ করে খাওয়া নয় মা। বাসি বিছানা খাওয়া হল বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়া, কানে হেড ফোন লাগিয়ে গান শোনা, পায়ের ওপর পা তুলে গল্পের বই পড়া।’

মণিকুন্তলা আরও রেগে যান। বলেন, ‘এই সবক’টা কাজ পরিষ্কার করেও করা যায়।’

বারিধারা ঝলমলে মুখে বলল, ‘যাবে না কেন? অবশ্যই যায়। লুচি কি ভেজেই গরম গরম খাওয়া যায় না? তার পরেও বাসির টেস্ট দারুণ। তুমি একটা বই টানটান, কাচা বেডকভার, নতুন বালিশের ওয়াড়, পাটভাঙা চাদরের মধ্যে পড়ো, আর দু দিন ফেলে রাখা, চাদর ঘুচিমুচি হওয়া বিছানায় পড়ো—দেখবে দুটো অন্যরকম লাগবে। গানের বেলায়ও তাই। এমনকী ফোনে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বললেও দেখবে, টাটকা বিছানা আর বাসি বিছানা আলাদা এফেক্ট তৈরি করছে। ইচ্ছে করলে তুমি পরীক্ষা করে দেখতে পারো। তারপর যদি বাইরে এমন মেঘবৃষ্টি থাকে, তাহলে তো কথাই নেই।’

মণিকুন্তলার মাথা গরম হয়ে যায়। এই মেয়ের কথা শুনলে রাগ না করে থাকা যায়! আলিস্যিপনার পক্ষে বানিয়ে কতরকম যুক্তি দিচ্ছে। মনে হয় পিঠে গুম গুম করে দিই দুটো। ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে তো কী হয়েছে? মা ছেলেমেয়েকে সবসময় দুটো মার দিতে পারে। তাও মণিকুন্তলা নিজেকে সামলালেন।

‘থাক অনেক লেকচার হয়েছে। এবার উঠে পড়ো। পরে কোনওদিন বাসি বিছানা নিয়ে গবেষণা কোরো। তোমার দাদুকেও নিও। তিনি নাতনির পাগলামিকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য সবসময় তো মুখিয়ে থাকেন।’

বারিধারা তড়াক করে খাট থেকে নেমে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এটা ভালো আইডিয়া। বাসি বিছানা নিয়ে গবেষণা। বাইরে কি জল জমেছে মা?’

মেয়ের বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, ‘নন্দ গাড়ি বের করবার সময় বলছিল। চৌমাথায় জল জমেছে।’

বারিধারা আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘সর্বনাশ হল। জল ভাঙতে হবে।’

‘সর্বনাশের কী? আজও বেরোতে হবে?’

বারিধারা আপন মনে বলল, ‘বেরোব না ভেবেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে বেরোতে হবে।’

নন্দকাকা শ্রবণের গলির সামনে নামিয়ে দিল।

‘আমি অপেক্ষা করি ছোড়দি?’

ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ছে। গলির মুখটাতেও জল জমেছে। বারিধারা প্যান্ট গুটিয়ে বলল, ‘না নন্দকাকু। আমি এখান থেকে ট্যাক্সিফ্যাক্সি কিছু একটা নিয়ে চলে যাব। তুমি বাড়ি যাও।’

গলির ভিতরে ঢুকতেই রাস্তার জমা জল বাড়ল। হাঁটু পর্যন্ত প্যান্টটা ভিজে গেল মুহূর্তে। তারমধ্যে আবার ওপর থেকে জল পড়ছে। ছাতায় ছাঁট আটকানো যায় না। ফলে শার্টটাও ভিজল। মোটামুটি ভিজে ঢাউস হয়ে সেদিন শ্রবণের বাড়ির দরজার সামনে হাজির হয়েছিল বারিধারা। গেট খুলে ঢোকবার সময় চরম কেলেঙ্কারিটা হল। পায়ের চটিটা বুড়ো আঙুলের কাছ থেকে ফটাং করে গেল ছিঁড়ে।

দরজা খুলে ‘জ্বর কমে গেছে’ জানিয়ে শ্রবণ বোকার মতো হাসল।

বারিধারার মাথায় তখন আগুন শোঁ শোঁ করছে। শ্রবণ তাকে মিথ্যে বলে নিয়ে এল! ক্যাবলা ছেলেটার তো বিরাট সাহস হয়েছে!

‘কী হল, ভিতরে তো আসবে? নাকি বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজবে? চটিও ছিঁড়েছ দেখছি। এসো বারি।’ অপরাধী অপরাধী গলায় বলল শ্রবণ।

বারিধারা একবার ভাবল, দরজা থেকেই অ্যাবাউট টার্ন করি। তারপর মনে হল, ক্যাবলাটাকে এত সহজে ছেড়ে দেব? জল বৃষ্টি কাদায় বের করে আনবার জন্য কোনও শাস্তি হবে না? অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। সেদিন সহজভাবেই বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল বারিধারা।

‘বাড়ির সবাই আছে? নাকি সেটাও জ্বরের মতো মিধ্যে বলেছ?’

শ্রবণ পড়া না-পারা ছাত্রের মতো নার্ভাস গলায় বলল, ‘না, বাড়ির কেউ নেই। ওটা মিথ্যে বলিনি।’

বারিধারা কাঁধের ব্যাগটা রাখল। শ্রবণের চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলল, ‘বাথরুমে সাবান আছে?’

শ্রবণ বলল, ‘আছে।’

‘কাচা তোয়ালে আছে?’

‘আছে।’

শ্রবণ ছুটে গিয়ে একটা সাদা তোয়ালে নিয়ে এল। কাচা তোয়ালের খবর তার জানার কথা নয়। আজ সকালেই তার ঘরে বউদি কাচা তোয়ালে রেখে গেছে। কোইনসিডেন্স। শ্রবণ ভাবল, ভাগ্যিস কোইনসিডেন্স বলে পৃথিবীতে একটা জিনিস আছে।

বারিধারা একটু চুপ করে থাকল। বলল, ‘তোমার নতুন পায়জামা, পরিষ্কার জামা আছে?’

শ্রবণ ঢোঁক গিলে বলল, ‘পায়জামা! আমি এখন কোথাও বেরোব না ধারা।’

বারিধারা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘যা বলছি তার জবাব দাও। তোমার পরিষ্কার পায়জামা, জামা আছে কিনা বলো?’

শ্রবণ ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আছে।’

‘এনে দাও। আমি চেঞ্জ করব।’

বাথরুম থেকে বেরিয়ে বারিধারা সেদিন যখন শ্রবণের ঘরে গিয়েছিল, শ্রবণ খানিকক্ষণের জন্য থ’ মেরে গিয়েছিল। এমন বারিধারাকে সে আগে কখনও দেখেনি। চেনাই যাচ্ছে না। কী সুন্দর! কী সুন্দর! কটকটে রোদ ঝলমল মেয়েটা এখন মেঘলা দিনের মতো স্নিগ্ধ লাগছে। বারিধারা স্নান করেছে। খোলা চুল। শ্রবণের নীল রঙের পায়জামা আর বেগুনি রঙের টি শার্ট পরেছে। দুটোই মাপে বড়। এতে একধরনের ছেলেমানুষির সৌন্দর্য হয়েছে।

‘আমার ভেজা জামাকাপড় তোমাদের ডাইনিঙের চেয়ারগুলোতে মেলে ফ্যান চালিয়ে দিয়েছি। অসুবিধে হবে না তো?’

শ্রবণ তাড়াতাড়ি বলল, ‘ছি ছি। কী অসুবিধে হবে?’

বারিধারা ঘরের একপাশে পাতা বেতের চেয়ারে বসতে বসতে স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘আমার কোনও অসুবিধে হবে না। ইনারগুলোরও আছে তো। হুট করে বাইরের কেউ এলে ঘাবড়ে যেতে পারে। ঘরের মধ্যে মেয়েদের ইনার কেন? সরি আমার অন্য কোনও উপায় ছিল না। ভিজে জিনিস পরে জ্বর ডেকে আনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

শ্রবণের ঘরের মেঝেতে আঁকা, লেখার সরঞ্জাম ছড়ানো। শ্রবণ বিজ্ঞাপনের ডিজাইন বানাচ্ছে। বারিধারা সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘জ্বরের মধ্যেও কাজ করছ?’

শ্রবণ মাথা চুলকে বলল, ‘না মানে, জ্বরটা কমেছে…এতক্ষণ তো শুয়েই ছিলাম। শরীরটা ভালো লাগতে মনে হল, কাজটা শেষ করি।’

বারিধারা পায়ের ওপর পা তুলে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমাকে ডেকেছ কেন?’

শ্রবণ এবার বেশি নার্ভাস হয়ে গেল। বলল, ‘ডেকেছি বুঝি বারি? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ডেকেছি… আসলে হয়েছে কী জানো ধারা… আমার একটা কাজ আটকে যাচ্ছে… ভাবলাম তুমি যদি প্ল্যান দাও…।’

‘কী কাজ?’ বারিধারার গলা আরও তীক্ষ্ণ।

শ্রবণ এক গাল হেসে বলল, ‘একটা অ্যাড সামলাতে পারছি না। কনসেপ্টে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।’

‘কীসের অ্যাড?’

শ্রবণ উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘জুতোর বিজ্ঞাপন। বড় কোম্পানি। অফিসে কাজটা এসেছে। ওরা আমাকে বলেছে ভাবনাচিন্তা করো। লেগে গেলে আমার লাভ হবে। বারি, জুতো নিয়ে নতুন কোনও কনসেপ্ট দিতে পারো। হাঁটছে, লাফাচ্ছে, ছুটছে এসব ঢের হয়েছে।’

বারিধারা বলল, ‘জুতোর বিজ্ঞাপনের কনসেপ্ট নিতে আমাকে বৃষ্টি-কাদার মধ্যে ডেকে আনলে? তাও আবার মিধ্যে কথা বলে?’

শ্রবণ তাড়াতাড়ি বলল, ‘না, ঠিক মিথ্যে নয়…মনে হল কী…ওরা তো সবাই বেরিয়ে পড়ল…আমি ভাবলাম, আজ আর অফিস যাব না, বাড়িতে বসে কাজ করব…তারপর মনে হল, তুমি যদি একবার ঘুরে যাও…।’

বারিধারা কটমট চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আমি ঘুরে যাব কেন?’

শ্রবণ গালে হাত বোলাতে গিয়ে মুখে আরও খানিকটা রং লাগিয়ে ফেলল। বোকার মতো হেসে বলল, ‘সরি ধারা। ভেরি সরি। জ্বরের কথাটা বলা আমার ঠিক হয়নি। তুমি যে এতটা ভিজে যাবে, বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম গাড়ি করে একেবারে আমাদের বাড়ির গেট পর্যন্ত চলে আসবে। আমি ছাতা নিয়ে যাব, তুমি টক করে ঢুকে যাবে।’

বারিধারা হেসে ফেলতে গিয়ে নিজেকে সামলাল। তার প্রেমিকটি সত্যি হাঁদা আর ভালোমানুষ। ছেলেমানুষও বটে। ডেকে ফেলে এখন আর সামলাতে পারছে না। এই যুগে এমন একটা ভালোমানুষ আর ছেলেমানুষ নিয়ে সে কী করে চলবে? বারিধারা এবার চেয়ারের ওপর দুটো পা মুড়ে বসল।

‘তোমার জ্বর হয়েছে, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি, আর আমিই তোমাকে বলব, আমার মাথায় ছাতা ধরে আমাকে নিয়ে যাও! তোমার মাথা কি একেবারে খারাপ হয়ে গেছে!’

শ্রবণ বুঝতে পারল সেমসাইড হয়ে গেছে। সে তাড়াতাড়ি বলল, ‘এইটুকু তো…ওতে আর জ্বরের কী হবে…তা ছাড়া…তা ছাড়া…।’

বারিধারা হাত তুলে থামাল।

‘চুপ করো। তোমার জ্বর নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তুমি কি ভেবেছিলে নন্দকাকাকে দেখিয়ে দেব যে আমি তোমাদের বাড়িতে এসেছি? আর ফিরে গিয়ে মাকে বলুক? বোকার মতো কথা বোলো না। আমি শুধু ভিজিনি, চটিটাও ছিঁড়ে গেছে। তোমার জন্যই ছিঁড়ে গেছে। এর মানে আমার শার্ট-প্যান্ট ফ্যানের হাওয়ায় শুকিয়ে গেলেও আমি এখন বেরোতে পারব না। আমার চটি নেই।’

‘আমার হাওয়াই চটি আছে। আনব?’

গুম গুম করে মেঘ ডেকে উঠল। এর মানে বৃষ্টি আরও বাড়বে। বারিধারা রাগী গলায় বলল, ‘বাজে কথা বলো না। ঘরে পরবার চটি পরে ঘরে বসে থাকা যায়, বাইরে বেরোনো যায় না। বাড়ি তো ফেরা যায়ই না। আর হাওয়াই চটি পরে কাদায় বেরোলে কী হবে জানো না? জামা-প্যান্টের ব্যাকগ্রাউন্ডে কাদা প্রিন্ট হয়ে যাবে। এমনিতে পায়ে কাদা থাকে, হাওয়াই চটি পরলে মাথা পর্যন্ত সেই কাদা যাবে। আমি কি তোমার মতো হাঁদা নাকি? আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি।’

শ্রবণ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘কী ডিসিশন!’

বারিধারা মুখ দিয়ে চুক চুক আওয়াজ করে বলল, ‘শুনলে তোমার পিলে চমকে যাবে। এইটুকু বলে বারিধারা চুপ করে গিয়েছিল।

শ্রবণ বিস্ফারিত চোখে ‘পিলে চমকানো’ সিদ্ধান্ত শোনবার জন্য অপেক্ষা করে রইল।

আবার গুরগুর করে মেঘ ডেকে উঠেছিল।

শ্রবণকে মিনিট দুয়েক টেনশনে রেখে বারিধারা তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল সেদিন।

‘চটি না সারিয়ে আমি এখান থেকে এক-পাও বেরোব না। দরকার হলে দুদিন, তিনদিন, সাতদিন এখানে বসে থাকব।’ শ্রবণ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। চোখ বড় হয়ে গেল তার।

‘কী বলছ বারি! সাতদিন এখানে থাকবে কী করে?’ দাদা-বউদি তো রাতেই চলে আসবে।’

বারিধারা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আসবে তো আমার কী? তোমার প্রবলেম। আমাকে মিথ্যে বলে ডাকবার সময় মনে ছিল না? ওসব তুমি সামলাবে। আমাকে যদি জিগ্যেস করে, এই যে মেয়ে, এত রাতে তুমি আমাদের বাড়িতে বসে আছ কেন? আমি বলব, আমাকে না করে, দয়া করে আপনাদের ছেলেকে এই প্রশ্ন করুন। সে আমার থেকেও ভালো বলতে পারবে আমি এ বাড়িতে কেন রাত পর্যন্ত রয়ে গিয়েছি।’

শ্রবণ মাথা চুলকে হেসে বলল, ‘তুমি ঠাট্টা করছ বারি।’

বারিধারা মুখ ভেংচে বলল, ‘না, আমি সিরিয়াস কথা বলছি। রাত হলেই বুঝতে পারবে কোনটা ঠাট্টা, কোনটা সিরিয়াস। একবার তোমার বাড়ির লোকদের ফিরতে দাও। কাছাকাছি কোথায় মুচি বসে?’

শ্রবণ ঘাবড়ানো গলায় বলল, ‘মুচি? গলির মোড়ে মনে হয়। ঠিক মনে করতে পারছি না।’

বারিধারা ধমক দিয়ে বলল, ‘গলির মোড়ে কেউ নেই। জল জমে আছে। জমা জলের মধ্যে মুচি কী করে বসবে, নৌকো নিয়ে? ভেবে উত্তর দাও।’

শ্রবণ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘তাই তো। তাহলে কোথায় বসেছে? আমার তো মনেই পড়ছে না।’

বারিধারা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তুমি এমন ভাব করছ যে, মুচিদের কেমন দেখতে হয় সেটাই জানো না। ওনারা কী কাজ করেন জানো, ওনারা ছাতা সারাই করেন? নাকি লেপ কম্বল বানান? বোকা একটা।’

শ্রবণ বলল, ‘তাহলে কী হবে?’

বারিধারা অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘সেটাই তো ভাবছি, কী হবে? তুমি চা বানাতে পারো?’

‘না, চা পারি না। কফি বানাতে পারি।’

বারিধারা সন্দেহের গলায় বলল, ‘সত্যি পারো? নাকি এটাও মিথ্যে।’

শ্রবণ হেসে বলল, ‘কফি বানানোটা কোনও কাজ হল? দুধ, জল, কফি। ব্যস, কফি রেডি।’

বারিধারা বলল, ‘ঠিক আছে, তুমি আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে এসো। আমি ততক্ষণে ভাবি কী করা যায়।’ শ্রবণ লাফ দিয়ে কফি বানাতে চলে গেলে বারিধারা নিজের মনে মনে খানিকক্ষণ হাসল। সত্যি ছেলেটা বড্ড ভালো। ভালো বলেই বোকা। বারিধারা উঠে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ছে। বাইরেটা জলে ভিজে আছে। এই বিকেলে অদ্ভুত একটা ভেজা আলো। মেঘে ঢাকা আলো। সেই আলো একই সঙ্গে খুশি আর বিষণ্ণ। মনে হচ্ছে, কেউ ছবি আঁকতে গিয়ে খাতায় খানিকটা জল উলটে ফেলেছে। জল ফেলে দিয়ে মনটা খারাপ। আবার খাতার জল যখন নিজের মতো ছবি তৈরি করেছে, তাই দেখে মনটা খুশি। বারিধারারও সেদিন তাই হচ্ছিল। মন খারাপ, আবার মন খুশি। মন খুশি হওয়ার কারণ সে বুঝতে পারছিল। এমন একটা চমৎকার দিনে সে শ্রবণের কাছে এসেছে। কিন্তু মন খারাপের কারণ কী? বেশি মন ভালো হলে কি মন খারাপ লাগে? হয়তো তাই। যেমন বেশি ভালোবাসায় কান্না পায়। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে বারিধারার গান গাইতে ইচ্ছে করল। মনে হল, ইস, গলায় যদি সুর থাকত খুব ভালো হত। গলা ছেড়ে গান করত। শ্রবণও শুনত। কিন্তু তার গলায় মোটে সুর নেই। গলায় সুর না থাকলে গান অন্য কাউকে শোনানো যায় না। শুধু নিজে গুনগুন করে গাওয়া যায়। এটা একটা আপশোসের ঘটনা। বারিধারা তারপরেও তার সুরহীন গলায় গুনগুন করে উঠল—

আকাশের কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে,

দিগন্তে কার কালো আঁখি আঁখির জলে যায় ভাসি।।

ভালোবাসি, ভালোবাসি…

দু-লাইন গাইতেই বারিধারার মনে হল, তার গলায় সুর নেই তো কী হয়েছে? বয়ে গেছে। তার তো গাইতে ভালো লাগছে। সেটাই আসল। গান যখন নিজের গাইতে ভালো লাগে না, তখন গান আর গান থাকে না। সে হাজার গলা ভালো হলেও থাকে না।

কফি নয়, শ্রবণ চা-ই বানিয়ে এনেছিল। কফির কৌটো খুঁজে পায়নি। বউদিকে মোবাইলে জিগ্যেস করবে ভেবেছিল। তারপর ভাবল, থাক। বউদির সন্দেহ হতে পারে। যে ছেলে চা-কফি মোটে খায় না, সে সুদূর শ্রীরামপুরে ফোন করে কফির খোঁজ করলে সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক। তার থেকে চায়ের কৌটো পাওয়া গেছে যখন চাই-ই হোক।

চা খুব খারাপ হয়েছিল। কষটে মার্কা। তারপরেও বারিধারা তাড়িয়ে তাড়িয়ে খেল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘বাড়ির লোকের হাত থেকে যদি বাঁচতে চাও একটাই ওয়ে। আমার চটির ব্যবস্থা করা। নতুন চটি কিনে আনতে চাইলে পারো। আমি যাব না। পায়ের মাপ বলে দিচ্ছি। তবে নতুন চটি পরে আমি প্রথমে দুটো দিন বাড়িতে হাঁটাচলা করে নিই। পায়ে ফোসকা পরে কিনা পরীক্ষা করি। নতুন চটি কিনলে তোমার বাড়িতে দুদিন থাকা মাস্ট। পথ একটাই, আমার এই চটিটাই সারিয়ে আনা। কলকাতা শহরে তো আর একজন মুচি থাকে না। তুমি আমার ছেঁড়া চটি নিয়ে বেরোও। যেখান থেকে পারো মুচি খুঁজে সারিয়ে আনো। ততক্ষণে আমার জামাপ্যান্টও শুকিয়ে যাবে। সেই ফাঁকে আমি তোমার ডিভানটায় শুয়ে খানিকটা ঘুমিয়ে নিই। আজ আমি সারাদিন ঘুমোব ভেবেছিলাম। তুমি মিথ্যে বলে আমাকে টেনে এনেছ। কাজটা অন্যায় করেছ। কিন্তু আজ আমার ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না। তুমি আমার চটি সারিয়ে আনবে, আর আমি এখন ঘুমোব।’

শ্রবণ কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, ‘সরি ধারা। তুমি ভিজে যাবে, চটি ছিঁড়ে যাবে এত কিছু আমি ভাবিনি।’

বারিধারা ডিভানের ওপর ধপাস করে বসে পড়ল। বলল, ‘এতবার সরি বোলো না। রাগ বেড়ে যাবে। বালিশটা কই? ওই তো।’ বালিশ টেনে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল বারিধারা। বলল, ‘ও শোনো, বাইরে থেকে দরজা টেনে দিয়ে যাও। আমি যতক্ষণ ঘুমোব, এ ঘরে ঢুকবে না। ঘুম ভাঙলে আমি ডাকব। তখন আমাকে আর এক কাপ চা করে খাওয়াবে। বুঝেছ? এখন যেমন বাজে বানিয়েছ, তখন আরও বাজে চা বানাবে।’

শ্রবণ মাথা চুলকে বলল, ‘অবশ্যই চা খাওয়াব।’

বারি পায়ের কাছে দলা পাকিয়ে থাকা চাদরটা টেনে নিল গায়ের ওপর। চাদরে শ্রবণের গায়ের গন্ধ না? আহা! বারিধারা বলল, ‘এইটা তোমার জুতোর বিজ্ঞাপনের কনসেপ্ট হতে পারে কিনা ভেবে দেখো তো একবার।’

‘কোনটা?’ শ্রবণ আগ্রহের সঙ্গে বলে।

বারিধারা গম্ভীর ভাবে বলল, ‘প্রেমিকা বৃষ্টির জমা জলে চটি ছিঁড়ে ফেলেছে, প্রেমিক সেই চটি সারাতে বেরিয়েছে। খারাপ হবে? যাওয়ার আগে মাথার কাছে জানলার পর্দাটা টেনে দাও। ঘর অন্ধকার ছাড়া আমি ঘুমোতে পারি না।’

শ্রবণ পর্দা টেনে ঘর অন্ধকার করল। দরজা দিয়ে বেরোতে যাওয়ার সময় বারিধারা ডাকল।

‘এক মিনিট শ্রবণ, এদিকে একবার এসো তো। ঘুমোনোর আগে তোমার গায়ে হাত দিয়ে দেখব জ্বর আছে কিনা। নইলে ঘুমিয়ে শান্তি পাব না।’

শ্রবণ লজ্জা পেয়ে বলল, ‘জ্বরের কথাটা তো বানানো ধারা।’

বারিধারা মাথাটা একটু তুলে কড়া গলায় বলল, ‘কাছে আসতে বলছি এসো। অনেক কষ্টে রাগ কন্ট্রোল করে আছি কিন্তু।’

শ্রবণ খানিকটা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসে। ডিভানের কাছে আসতেই বারিধারা তার হাত ধরে টান দেয়। শ্রবণ বারিধারার গায়ের ওপর পড়ে। সে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, ‘অ্যাই, কী করছ? কী করছ?’

বারিধারা শ্রবণকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে, গালে, গলায় মুখ ঘষতে থাকে। চাপা গলায় বলে, ‘শাস্তি দিচ্ছি। আর কখনও মিথ্যে বলে আমাকে ডাকবে? বলো, ডাকবে কখনও?’

শ্রবণ খানিকক্ষণ এই আক্রমণ প্রতিহত করবার চেষ্টা করে। একসময় হাল ছেড়ে দেয়। বুঝতে পারে, বারিধারা খেপে উঠেছে। খেপা মেয়ের এই খ্যাপামি তার অচেনা। অন্যরকম ভালো লাগার। এই ভালো লাগবার স্বাদ পেতেই কি সে বারিধারাকে মিথ্যে বলে একলা বাড়িতে ডেকে এনেছে? এবার শ্রবণ বারিধারাকে আদর করতে শুরু করে। আত্মসমর্পণ করে বারিধারা। একসময় জামা খুলে ফেলে। ঠোঁট কামড়ে ফিসফিস করে বলে, ‘এই নাও, তোমার জামা, তোমার জামা আমার লাগবে না।’

আধো মেঘের আলোয় উন্মুক্ত বারিধারাকে দেখে শ্রবণের মনে হয়, সে স্বপ্ন দেখছে। অবশ্যই স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ এত সুন্দর হয়? সে বিড়বিড় করে কিছু বলতে যায়। বারিধারা কথা পুরো বলতে দেয় না, দু’হাতে তার মাথা ধরে টেনে নামায়।

তখন বাইরে জোরে বৃষ্টি নেমেছিল।

আজও সেই একই মতলব নাকি? বারিধারা ভুরু কোঁচকাল। ঘটনা যদি তাই হয়, এই ছেলের আজ বিপদ আছে। আজ একটা বড় টেনশনের দিন। আজ কোনওরকম এদিক-ওদিক করে সময় নষ্ট করা যাবে না।

আজ নন্দকাকুকে গলির মোড়ে দাঁড়াতে বলে বারিধারা শ্রবণের বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে গেল। বেল টিপতে শ্রবণই দরজা খুলল। এ কী চেহারা! চুল উসকো-খুসকো। চোখ দুটো লাল করমচার মতো। গায়ে একটা চাদরও দিয়েছে। শুকনো মুখে হাসল।

‘এসো ভিতরে এসো।’

ভিতরে ঢুকে শ্রবণের কপালে হাত দিল বারিধারা। গা পুড়ে যাচ্ছে।

‘ওষুধ খেয়েছ?’

শ্রবণ হেসে বলল, ‘খাইনি। খাব।’

বারিধারা ধমক দিয়ে বলল, ‘খাইনি, খাব মানে কী? কোথায় প্যারাসিটামল আছে? দাঁড়াও নন্দকাকুকে দোকান থেকে আনতে বলছি।’ বলতে বলতে মোবাইল বের করল বারিধারা। শ্রবণ তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আরে অত ব্যস্ত হোয়ো না বারি। ওষুধ ঘরেই আছে।’

বারিধারা বলল, ‘কোথায় আছে?’

‘দাঁড়াও আমি দেখছি ধারা। মনে হচ্ছে ওই বাক্সে।’

বারিধারা বলল, ‘তোমাকে কিছু দেখতে হবে না। আমি দেখছি। তুমি বারি, ধারা আর ধারা, বারি বলা বন্ধ করে চুপ করে বসো।’

বারিধারা শুধু ওষুধ খাওয়াল না, শ্রবণকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে মাথা ধুয়ে দিল। তারপর বিছানায় শুইয়ে গায়ে চাদর টেনে দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘এখন ঘুম দাও। আমি নীচে দরজা টেনে দিয়ে যাচ্ছি। অসুবিধে তো হবে না। অটোমেটিক লক।’

শ্রবণ বলল, ‘আর একটু থাকবে না?’

বারিধারা মাথা নামিয়ে শ্রবণের গরম কপালে চুমু খেল। বলল, ‘আজ ইউনিভার্সিটিতে আমার একটা খুব জরুরি কাজ আছে সোনা। চিন্তা কোরো না, ওষুধ খেয়েছ। জ্বর নেমে যাবে। বিকেলে ডাক্তার দেখিয়ে নিও। আমি ফোন করব।’

‘বারি, আমি একটা ফাটাফাটি বিজ্ঞাপন তৈরি করেছি। মুভি।’

বারিধারা সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বলল, ‘খুব ভালো করছ।’

শ্রবণ উৎসাহের চোটে একটু উঠে বসে বলল, ‘ব্যাটারির বিজ্ঞাপন। টিভি, সিনেমা হলে দেখানো হবে। ওনলি টেন সেকেন্ডস।’

বারিধারা হেসে বলল, ‘বা:, আরও ভালো। তবে তুমি অমন করে উঠে বোসো না।’

শ্রবণ আরও খানিকটা উঠে বসল। তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।

‘একটা লাভ স্টোরি ভেবেছি। শুনবে?’

বারিধারা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘আজ নয় বাবু। বললাম না, আজ কাজ আছে। অন্য একদিন শুনব।’

গাড়িতেই বারিধারার মোবাইল বেজে উঠল। স্ক্রিনে ফুটে উঠল, ‘চিরসখা কলিং।’

‘কী হল আবার?’

‘ঘাম দিচ্ছে বারি, মনে হচ্ছে জ্বর গন।’

বারিধারা বিরক্ত গলায় বলল, ‘জ্বর গন হোক, তুমি কিন্তু বিছানা থেকে উঠবে না শ্রবণ।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ ধারা। তুমি আমার জ্বর সারিয়ে দিয়ে গেলে। ভাগ্যিস ডেকেছিলাম।’

বারিধারা চাপা ধমক দিয়ে বলল, ‘আহ্লাদিপনা কোরো না। বিকেলে ডাক্তার দেখাবে।’

শ্রবণ বলল, ‘ব্যাটারি অ্যাডের কনসেপ্টটা তো শুনবে।’

বারিধারা হতাশ গলায় বলল, ‘বলো। তবে দশ সেকেন্ডসের বেশি সময় নেবে না।’

শ্রবণ জ্বরভাঙা গলায় বলতে শুরু করল।

‘লিফটে দুজন ছেলেমেয়ে উঠছে। হঠাৎ অন্ধকার। লিফট বন্ধ। এমন সময়…।’

ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছতেই বারিধারা খবর পেল, তাকে কল্যাণ সমাজপতি খুঁজছেন। তিনতলার ফাঁকা স্টাডিরুমে বারিধারা গিয়ে দেখল, সেখানে অরিন্দম সেনগুপ্তও আছেন। দুজন স্যারকে দেখে অবাক হল বারিধারা। দুজনের মুখ থমথম করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *