১১. পাট পাতার শাক

পাট পাতার শাক

মার্চ মাসে বেলভ্যু হাসপাতাল থেকে কেমো শেষ করে ফিরছি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে। আসার সময় আমাকে বললেন, রাতে রুমাকে নিয়ে চলে এসো। খাবে আমাদের এখানে। আমি আর রুমা গেলাম সন্ধ্যার পর। রুমা বেশি রাতে খায় না। তাই একটু তাড়াতাড়িই গেলাম। মুক্তধারা বন্ধ হয় রাত ১০টায়। আমি সন্ধ্যা ৭টায় বাসায় চলে গেলাম। আমার কোনোটাতে অসুবিধা। নেই। সেদিন ফিরলেন হুমায়ূন আহমেদ বাসায়। আমি চাইনি গিয়ে ঝামেলা করতে। কিন্তু কোনো উপায় নেই। বাসায় গিয়ে দেখি খাবার টেবিলে আমার বিভিন্ন পছন্দের খাবার। সরিষা ইলিশ, ভর্তা, ভাজি আর ডাল। তবে আমাকে খাবার দেবার আগে হঠাৎ হুমায়ূন আহমেদ ইশারা করলেন মেহের আফরোজ শাওনকে। তিনি কড়াইতে কিছু একটা ভেজে গরম গরম ভাতসহ আমার প্লেটে দিলেন। আমিতো অবাক দুদিন আগে কেমো দেওয়ার দিন বেলভ্যু হাসপাতালে যাওয়ার সময় গল্প করছিলাম হুমায়ূন আহমেদের সাথে। বইমেলার গল্প, নতুন নতুন বই কোনটা এবার মেলায় আলোচিত হলো এরকম। নানা কথা। বিভিন্ন খাবারের গল্প করতে গিয়ে বললাম এবার দেশে গিয়ে পাট পাতার শাক খাওয়া হলো না। সেই পাট পাতার শাক নিউইয়র্ক শহরে যেদিন বলেছি তার দুদিনের মাথায়, এবং হাসপাতাল থেকে আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমাকে প্লেটে দেওয়ার ব্যবস্থা করে হুমায়ূন আহমেদ স্নেহের বন্ধনে। আবদ্ধ করলেন। আমি অবাক। বিস্মিত। বিহ্বল। আনন্দিত। এত বছর আমি নিউইয়র্কে থাকি, নিজে নিজে বলেও থাকি পকেটে ডলার। থাকলে নিউইয়র্কে সুন্দর বনের বাঘের দুধও পাওয়া যায়। কিন্তু পাট পাতার শাক কখনো আমি নিউইয়র্কে বসে খাইনি। হুমায়ূন আহমেদ সেটাও খাওয়ালেন। পরে জানলাম, শাওনের মা মিসেস তহুরা আলী দেশ থেকে আসার সময় পাট পাতার শাক নিয়ে এসেছেন। এধরণের চমকে দেবার ঘটনা অনেক আছে গত ২৫ বছরের জীবনে।

হুমায়ূন আহমেদ নিজে খেতে ভালোবাসতেন, তবে খাওয়াতে আরো বেশি ভালো বাসতেন। অতিথি আপ্যায়ন করা দখিন হাওয়া বা নুহাশ পল্লীতে রেখে আসেননি। গত দশ মাসে আমেরিকাতেও চালু রেখেছিলেন। দেশ থেকে মন্ত্রী এমপিরা এলে মনে করেন এখানকার প্রবাসী বাঙালিরা তাদের আপ্যায়ন করবে এবং শেষে উপঢৌকন দেবেন দেশে যাওয়ার সময়। এটা তারা ধরেই নেয়। কিছু লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীও নিজেদেরকে ঐ কাতারে মনে করেন। বহু চুনোপুঁটিও বিভিন্নভাবে সুযোগ সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের গুরুর নাম ভাঙিয়ে।

হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের টাকা দিয়ে ডলার বানিয়ে খরছ করতেন। আনন্দ উপভোগ করতে তিনি পিছ পা বা কারো থেকে সুবিধা নেওয়ার মানসিকতা কখনো তার ছিলো না। হুমায়ূন আহমেদ যদি কাউকে ভালোবাসতেন, তার মধ্যে কোনো খাদ থাকতো না। আমার স্ত্রী রুমার খুব মনে কষ্ট ছিলো। হুমায়ূন আহমেদ আমাকে বেশি ভালোবাসেন একদিন কথা প্রসঙ্গে সামনাসামনি বলে দিলেন। রুমার সে কি মন খারাপ। কিন্তু রুমার মন খারাপ বেশিক্ষণ থাকেনি। কেননা তার সাথে আবার নিনিতের খুব ভাব। বাসায় গিয়ে নিনিতকে কোলে নিয়ে রুমার আদর করা হলো প্রথম কাজ। আসার পর থেকেই নিনিতের সাথে রুমার ভাব। প্রথম দিকে নিনিত কারো কোলে না উঠলেও অতি অল্প সময়ের মধ্যে রুমা নিনিতের মন জয় করেছিলো। তাই হুমায়ূন আহমেদ রুমাকে ‘মায়াবিনী’ বলতো অনেক সময়। বাবা অন্তপ্রাণ নিনিতকে তার বাবা যদি দুহাত বাড়িয়ে ডাকতো যাদুর কাঠির মতো নিনিত পিতার কোলে চলে যেতো। সেই পিতার বাড়ানো হাতের দিকে না গিয়ে রুমার কোলে ঝাপাতো নিনিত। তাই বোধহয় হুমায়ূন আহমেদ রুমার নাম ‘মায়াবিনী’ দিয়েছিলো। ফেব্রুয়ারিতে আমি দেশে যাওয়ার পর রুমা অনেক বেশি সময় দিতো হুমায়ূন। আহমেদ পরিবারকে। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের ছবির প্রদর্শনীর বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে। তাছাড়া শাওনের সাথেও একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে রুমার। রুমার বানানো মিল্ক শেক হুমায়ূন আহমেদ খুব পছন্দ করতেন। রুমা জ্যামাইকা গেলে হুমায়ূন আহমেদকে মিল্ক শেক বানিয়ে খাওয়াতেন। মিল্ক শেফ খাওয়ার পর একটা মিষ্টি জাতীয় খাবার চাই লেখকের। ঢাকা থেকে সাউন্ডভিউ গেস্ট হাউজে ওঠার তিন দিনের মাথায় জ্যামাইকায় বাসায় ওঠার দিন থেকে ফলের রস খাওয়া দরকার হুমায়ূন আহমেদের। মাজহারুল ইসলাম শাটপিন বুভার্ডের গ্রোসারি থেকে ফল নিচ্ছিলেন বিভিন্ন। রকমের। তখন আমার মনে হলো একটা জুস বানানোর মেশিন হলে কেমন হয়! ফ্রেশ ফলের রস হুমায়ূন আহমেদের জন্য ভালো। নিউইয়র্কে তো আর বাংলাদেশের মতো ফল নেই। যাতে শরীর খারাপ হবে। খুব পছন্দ হলো হুমায়ূন আহমেদ থেকেও লেখকের শাওনের। মার্চ মাসে দেশ থেকে আসার পর হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে গেলাম বেলভ্যু হাসপাতালে কেমো দেওয়ার জন্য। সকালে জ্যামাইকা বাসা থেকে যেতে যেতে অনেক কথা। সেদিন শাওনও যাননি সকালে। একবারে দুপুরের খাবার নিয়ে। যাবেন তিনি। আসলে গত কয়েকটি কেমোথেরাপি বেলভ্যুতে নেওয়ার পর

এভাবেই নিয়মে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যের কথা। একদিন আমাকে বললেন, আর কতদিন থাকবো আমেরিকায়। তোমারতো আমেরিকার মিশন শেষ। চেয়েছিলে ১৯৯২ সাল থেকে জাতিসংঘের সামনে শহীদ মিনার করে একুশকে। বিশ্বসভায় তুলতে। ১৯৯৯ সাল থেকে তো একুশ আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছে। আমেরিকার বাংলা বইমেলার কথাতো এখন পৃথিবীর সব বাঙালি জানে। তোমাদের বইমেলায় একমাত্র লেখকরা উদ্বোধন করেন। তোমাদের বইমেলার দশ বছর পূর্তিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, ইমদাদুল হক মিলন ও হুমায়ূন আহমেদ একসাথে হয়েছিলেন। আর কোনো বইমেলায় এ ধরণের ঘটনা ঘটেনি। আমি তো অবাক। হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কের বইমেলার এত খবর রাখেন। তিনি বললেন, এবার দেশে গিয়ে কিছু কাজ করো। আমি বললাম, ১৯৯৮ সালেও বলেছিলেন যেতে। সেবারতো চাকরি দিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন নুহাশ চলচ্চিত্রে। আমি যাইনি। ছেলে-মেয়ে ছোট ছিলো। আমার জন্য পাশের ফ্ল্যাটটি নেওয়ার জন্য চেয়েছিলেন তিনি। অনেকদিন আমার জন্য ফেলেও রেখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। বলেছিলেন আস্তে আস্তে টাকা দিতে। কোনো তাড়া নেই। তুমি শুধু নিয়ে রাখো তোমার জন্য। সেবার হুমায়ূন আহমেদের বন্ধু প্রকৌশলী এফ করিম এসেছিলেন নিউইয়র্কে। যে ফ্ল্যাটটি পরবর্তীতে অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম নিয়েছেন। আসলে বৈষয়িক ব্যাপার-স্যাপারে আমি হলাম আনাড়ি। মুক্তধারায় জ্যাকসন হাইটস শাখায় ম্যানেজারের বেতন ছিলো ২০০৭ সালে সপ্তাহে ৪০০ ডলার। ৬ দিন কাজ করতেন। আর আমি মুক্তধারা প্রধান পরিচালক হয়ে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘প্রবাসী’তে কাজ করতাম সপ্তাহে ৩০০ ডলার বেতনে। ৪ দিন কাজ করতাম, ২০০৯ সাল পর্যন্ত। ২০০১ সালের দিকে– তখন মুক্তধারার রমরমা অবস্থা। লস এঞ্জেলেস, ডালাস, নিউজার্সি, নিউইয়র্ক মুক্তধারার ৪টি শাখা। আব্দুল হক নামে একজন বাংলাদেশি ভদ্রলোক কাজ করতেন মুক্তধারায় দীর্ঘদিন। তিনি মুক্তধারায় কাজ করে বসুন্ধরায় ২টি পুট কিনেন, ১টি এপার্টমেন্ট কেনেন উত্তরায়। আর মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী গত ২০ বছর ধরে ঢাকায় এসে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় ওঠে। এমন শুনে শিশুর মতো হেসেছেন হুমায়ূন আহমেদ। বললেন এবার করো কিছু আস্তে আস্তে। মেয়ে কলেজে যাবে এবার। ছেলে যাবে দুবছর পর। তারপর কিছু করবো। ভোজনরসিক হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমার খাবার নিয়ে অনেক কথা হয়। বিশেষ করে আমি গল্প করেছি আমার মায়ের হাতের কাঠ বাদামের শাস বাটা দিয়ে দিয়ে দেশি কইমাছের কলা পাতা দিয়ে পাতুড়ির কথা। মা কাঠ বাদাম পাটায় বেটে লবন, মরিচ, হলুদ এবং সরিষার তেল মেখে পাতায় মুড়ে লাকড়ির আগুনে এই আইটেমটি বানাতেন। আমার মা তো বেঁচে নেই। বললাম, আমরা গত ১০ বছর ধরে যে আত্মীয় কাম আমার ছোট বেলার বন্ধুর বাসায় উঠি রনজিত সাহা রতুও খাবার-দাবারের ব্যাপারে এক কাঠি সরস। ওদের বাড়িও নোয়াখালির চৌমুহনীতে। আমরা যেমন ওদের বাসায় উঠি। আমাদের ছোটবেলার সব বন্ধু শুভেন্দু, বাপ্পি, রামু, পংকজ, শংকর, দীপক, বাবুল, খোকন সবাই ঢাকায় ওর বাসায় ওঠে। রতু’র স্ত্রী জয়াও খুব ভালো রান্না করে। ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হওয়া ছোট মেয়েটি কখন যে রতুর ইচ্ছেগুলোকে এত সহজে নিজের করে নিয়েছে তা ভাবতেও অবাক লাগে। আমি যেদিন গতবার ওদের বাড়িতে গেছি সেদিন ছিলো কলার মৌচার তরকারি। লোনা ইলিশ দিয়ে পুঁইপাতার তরকারি। কলাপাতায় বোয়াল মাছের পাতুড়ি।

হুমায়ূন আহমেদ বলেই ফেললেন মে মাসে দেশে যাওয়ার আগে আমার বন্ধুকে রান্না করে পাঠিয়ে দিতে খাবার। আর একদিন হুমায়ূন আহমেদের সাথে খাবারের একটা মজার গল্প হয়। তিনি বললেন, নুহাশ পল্লীতে একদিন একটা একমন ওজনের বোয়াল মাছ রান্না হয়েছিলো। একজনেই খেয়েছিলো ৪০ টুকরো। তখন আমি বললাম, ১৯৮৫ সালের লাকসামে আমাদের এক মামাতো বোন মনি সাহার বৌভাতের খাবারের গল্প। আমার বন্ধু রতু আর আমাদের আর এক বন্ধু চৌমুহনী কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মারামারিতে এলাকা ছাড়া। সেসময় লাকসামের বিয়েতে দুই বন্ধু একত্রিত হয়। বিয়ে বাড়ি। বিশাল ব্যাপার। মেয়ে পক্ষ থেকে রতু এবং রতুর সেই বন্ধু প্রথমে ৫০ পিস করে মাছ খায়। এরপর পুরো খাসির মাংসের গামলা শেষ। করলো। চিকেনরোস্ট এক বালতি। যাতে থাকে কমপক্ষে ৪০ পিস। শেষে সাড়ে কেজির দই। সবশেষে গোটা ৫০ রসগোল্লা জনপ্রতি। তারপর খাবার শেষে এক বন্ধুর সেকি বমি। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, রতুর বন্ধুটি কে? বিশ্বজিত সাহা। আমি হেসে দিলাম। এরকম অনেক কথাই হতো হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমার। যা ছিলো একান্ত। গগনচুম্বী জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ নয়। নেত্রকোণার পাড়া গাঁয়ের কিশোর কাজলের সাথে, ছোটবেলার গল্প। যার মধ্যে ছিলো অনাবিল আনন্দ। ছিলো না কোনো জটিলতার হিসেব-নিকেশ। এরকম গল্প করতেন বিধায় হয়তো তিনি হুমায়ূন আহমেদ হতে পেরেছিলেন। পেরেছিলেন মুগ্ধ করে রাখতে গল্প বলে, গল্প লিখে। সৃষ্টি হয়েছে ‘জোছনা ও জননীর গল্প।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *