১৪. শিশুর যত্ন (১৪তম খণ্ড)

১৪তম খণ্ড – শিশুর যত্ন

ইসলামে শিশুর যত্ন

আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত শিশু

আল্লাহ পাক মানব জাতিকে অগণিত নেয়ামত দান করেছেন। এ সব নেয়ামতের মধ্যে সুসন্তান অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের দান। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

والله جعل لكم من أنفسكم ازواجا وجعل لكم من ازواجكم بنين وقد رزقكم من الطيبت اقبالباطل يؤمن وينعمت الله هم

يكفرون

অর্থ : তিনিই আল্লাহ্, তোমাদের থেকেই তোমাদের জন্য স্বজাতীয় স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জোড়া হতে তোমাদের জন্য পুত্র ও পৌত্র সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের উত্তম জীবনোপকরণ দিয়েছেন। তবুও কি তারা মিথ্যাতে বিশ্বাস করবে এবং তারা কি আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করবেঃ–(সূরা নাহূল : ৭২)

আল্লামা মাওকানী (রঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা লিখেছেন যে, এ আয়াতের মর্ম হলো, আল্লাহ্ তোমাদের জন্য তোমাদের নিজস্ব প্রজাতির মধ্য থেকেই জোড়া বানিয়েছেন, যেন তোমরা তার সাথে অন্তরের সম্পর্কের বিত্তিতে মিলিত হতে পারো। কেননা, প্রত্যেক প্রজাতিই তার স্বজাতির প্রতি মনের আকর্ষণ বোধ করে। আর ভিন্ন প্রজাতি থেকে তার মনে অনুরূপ আকর্ষণ থাকে না। মনের এ আকর্ষণ ও বিশেষ সম্পর্কের কারণেই বংশ বৃদ্ধি হয়ে থাকে। আর এ-ই হচ্ছে বিয়ের মূল উদ্দেশ্য।–(ফাতহুল কাদীর, ৩য় খণ্ড)

স্বামী-স্ত্রীর আবেগ উচ্ছাসপূর্ণ প্রেম-ভালোবাসা পূর্ণতা লাভ করে সন্তানের মাধ্যমেই। সন্তান হচ্ছে দাম্পত্য জীবনের নিষ্কলংক ফুল বিশেষ।

আল্লামা আলুসী (রঃ) তাঁর তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ধন-সম্পদ হচ্ছে প্রাণ বাঁচানোর উপায় আর সন্তান-সন্ততি হচ্ছে বংশ তথা মানব প্রজাতি রক্ষার মাধ্যম। -(তাফসীরে রুহুল মাআনী)

বস্তুত দুনিয়াতে কত অগণিত মানব সন্তান এমন রয়েছে যাদের সম্পদের কোন অভাব নেই কিন্তু তা ভোগ করার জন্য কোন আপন জন নেই। হাজার চেষ্টা সাধনা এবং কামনা করেও তারা সন্তান লাভ করতে পারছে না। আবার কত অসংখ্য বনী আদম এমন আছে, যারা কামনা না করেও বহু সংখ্যক সন্তানের জনক। কিন্তু তাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ নেই। তাই বলতে হয়, সন্তান হওয়া না হওয়া একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ নেয়ামত। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

پلو ملك الموت و الأرض يخلق ما يشاء يهب لمن يشاء إناثا ويه من يشاء الكور او يزوجهم رانا في إناثا ويجعل من يشاء عقيما انه عليم قير.

আসমান ও যমীনের আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দেন এবং যাকে ইচ্ছা পূত্র সন্তান দেন অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে করে দেন বন্ধ্যা, তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।–(সূরা শূরা : ৪৯-৫০)

মানুষ যত বৈষয়িক শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারীই হোক না কেন, ইচ্ছামত সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা তার নেই। অন্যদের সন্তান দান তো দূরের কথা। যার ভাগ্যে সন্তান নেই সে কোন উপায় অবলম্বন করেও সন্তান লাভে সক্ষম হয় না। আল্লাহ্ যাকে কেবল পুত্র সন্তানই দিয়েছেন সে কোন উপায়েই একটি কন্যা সন্তান লাভ করতে পারে না। এ ব্যাপারে প্রত্যেকে যদি নিজেকে মালিক বলে বিশ্বাস করে তবে তা তার অদূরদর্শিতারই ফল। এর পরিণতি তাকেই ভোগ করতে হবে।

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

ربنا هب لنا من أزواجنا وريتنا قرة أعين واجعلنا يتمين

অর্থ : হে আমাদের রব! আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করুন যারা হবে আমাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য অনুসরণযোগ্য করুন। –(সূরা ফুরকান : ৭৪)

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে।

رب هب لي من لدنك ذرية طيبة إنك سميع العاء

অর্থ : হে আমার বর! আমাকে আপনি আপনার নিকট হতে সৎ বংশধর দান করুণ। নিশ্চয়ই আপনি দোয়া শ্রবণকারী।–(সূরা আলে ইমরান : ৩৮)।

সন্তান আল্লাহর দেয়া এক উত্তম নেয়ামত। এ দোয়ামতের সুফল মৃত্যুর পরও ভোগ করা যায়। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছঃ) বলেছেনঃ মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য তখনো তিন প্রকার আমলের ফল সে পেয়ে থাকে, ১. সাদকায়ে জারিয়া, ২. এমন ইলম ও বিদ্যা যার সুফল ভোগ করা যায় ও ৩. এমন সচ্চরিত্রবান সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করতে থাকে।

সুসন্তান রেখে যাওয়াকে আমল’ বলার কারণ হল, সন্তান পিতামাতার কারণেই দুনিয়ায় আগমন করে থাকে এবং তাদের সযত্ন প্রতিপালনের ফলেই সে চরিত্রবান হতে পারে। হাদীসে সন্তান কর্তৃক দোয়ার কথা উল্লেখ করার মাধ্যমে পিতামাতার জন্য দোয়া করার ব্যাপারে সন্তানকে উৎসাহীত করা হয়েছে। কাজেই প্রত্যেক সন্তানের কর্তব্য হচ্ছে পিতামাতার জন্য সর্বদা আল্লাহর নিকট দোয়া করা। জীবিত সন্তান যেমন পিতামাতার জন্য নেয়ামত তদ্রূপভাবে মৃত সন্তানও তাদের জন্য নেয়ামতস্বরূপ।

হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী কারীম (ছঃ) বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে যার দুটি সন্তান মারা যাবে তাকে আল্লাহ্ তা’আলা জান্নাত দান করবেন। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, যদি কারো একটি মারা যায়? উত্তরে তিনি বললেন, একটি হলেও। -(তিরমিযী)

হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছঃ) বলেছেনঃআল্লাহ্ তা’আলা মালাকুল মাউতকে বলেন, তুমি আমার বান্দার সন্তানের রূহ কবয করেছো ও তুমি তার। নয়নমণি ও কলিজার টুকরাকে কেড়ে নিয়েছো? ফেরিশতা বলেন, হ্যাঁ। আল্লাহ্ তা’আলা জিজ্ঞেস করেন, সে কি বলেছে? ফেরিশতা বলেন, সে আপনার প্রশংসা করেছে এবং ইন্নালিল্লাহ্ বলেছে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, আমার বান্দার জন্য জান্নাতে একটি বালাখানা প্রস্তুত কর এবং তার নাম রাখ বায়তুল হাদ’।-(ইবনে কাছীর, পৃঃ ১৯৮)।

সন্তান-সন্ততি যেমন আল্লাহর অন্যতম নেয়ামত তদ্রুপ পরীক্ষার বস্তুও বটে। কারণ পৃথিবী মানব জাতির জন্য পরীক্ষার বস্তু হিসেবে স্বীক্বত। তাই আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদ আর সন্তান পরীক্ষার বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম।

এ পর্যায়ে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

واعلموا أنما أموالكم و اولادکم فتنة و ان الله عنده اجر عظیم

অর্থ : আর জেনে রাখ যে, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এক পরীক্ষা এবং আল্লাহরই নিকট রয়েছে মহাপুরুস্কার।–(সূরা আনফালঃ ২৮)

উক্ত আয়াত থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, যেমন করে ধন-সম্পদ আল্লাহর দেয়া নেয়ামত, সন্তান-সন্ততিও তদ্রুপভাবে আল্লাহর দেয়া নেয়ামত। অন্যায় পথে ব্যয় করলে কিংবা যথাস্থানে ব্যয় না করলে যেমন আমানতের খেয়ানত হয়, সন্তান-সন্ততিকেও ভুল পথে এবং অন্যায় কাজে নিয়োজিত করলে, তেমনি আল্লাহর আমানতে খেয়ানত হবে।

পরিশেষে বলা যেতে পারে যে, সন্তান-সন্ততি আল্লাহ্ প্রদত্ত অন্যতম নেয়ামত বটে। তবে সে সন্তানকে অবশ্যই সচ্চরিত্রবান ও দীনদার হতে হবে। আর সন্তান যদি অসৎ প্রক্বতির হয়, তবে এ সন্তান মাতাপিতার বিপদের কারণ হবে।

.

শিশুর প্রতি নবীজী (ছঃ)-এর ভালোবাসা

নবী করীম (ছঃ)-এর অন্তরে শিশুদের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল। তিনি এ বিশ্বে রাহমাতুল্লিল আলামীন’ হিসাবে তাশরীফ এনেছেন। আল্লাহর প্রতিপালন যেমন সর্বজনীন মহানবী (ছঃ)-এর প্রেম ভালবাসাও তেমনি সর্বজনীন। হাদীসে বর্ণিত আছে।

একবার নবীজী (ছঃ)-এর কানে হযরত হুসাইন (রাঃ)-এর ক্রন্দনের শব্দ এলো। এতে তিনি ভীষণভাবে ব্যথিত হলেন। তিনি হযরত ফাতিমা (রাঃ)-কে বললেন, তুমি কি জান না, তার ক্রন্দন আমাকে কষ্ট দেয়?–(ইসলামে শিশু পরিচর্যা)

হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছঃ) শিশু-কিশোরদের নিকট দিয়ে যাতায়াতকালে তাদেরকে সালাম করতেন।-(মেশকাত শরীফ)

একবার নবী করীম (ছঃ) ভাষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে মিম্বরে আরোহণ করে দেখতে পেলেন যে, হাসান ও হুসাইন (রাঃ) দৌড়াদৌড়ি করছেন এবং পা পিছলে পড়ে যাচ্ছেন। তিনি ভাষণ দান বন্ধ করে মিম্বর থেকে নেমে আসলেন। শিশু দু’টির দিকে অগ্রসর হয়ে দু’ বাহুতে তুলে নিলেন। তাপর মিম্বরে আরোহণ করে বললেন : হে লোকসকল, তোমাদের ধন-সম্পদ এক পরীক্ষার বস্তু, আল্লাহর এ বাণী সত্যিই। আল্লাহর কসম! আমি আমার এ দু’ নাতিকে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে পা পিছলে পড়েছে দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না, তাই দৌড়ে গিয়ে এদের উঠিয়ে নিলাম।–(বুখারী, মুসলিম)

একদিন নবী করীম (ছঃ) নামায আদায় করছিলেন। আর তখন হযরত হাসান ও হুসাইন (রাঃ) এসে তাঁকে সিজদারত অবস্থায় পেয়ে একেবারে পিঠে চড়ে বসলেন। এ অবস্থায় তিনি সিজদা দীর্ঘায়িত করলেন। আর তাঁরা পিঠ থেকে না নামা পর্যন্ত তিনিও তাঁদের নামিয়ে দিলেন না। নবী করীম (ছঃ) সালাম ফিরালে সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ আমরা লক্ষ্য করলাম যে, আপনি সিজদা দীর্ঘায়িত করেছেন। তিনি উত্তরে বললেন, আমার নাতিদ্বয় আমাকে সওয়ারী বানিয়েছে। কাজেই তাদেরকে তাড়াতাড়ি নামিয়ে দেওয়াটা আমার পসন্দ হয়নি। -(প্রাগুক্ত)

নবী করীম (ছঃ) কখনও কখনও শিশুদের ক্রন্দন শুনতে পেলে নামায সংক্ষিপ্ত করে ফেলতেন এবং বলতেন, আমি চাই না যে, তার মায়ের কষ্ট হোক।–(প্রাগুক্ত)।

একদা সকালে নবী কারীম (ছঃ) হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলে আর তখন তাঁর কানে হযরত হুসাইন (রাঃ)-এর ক্রন্দনের আওয়াজ এলা। নবীজীর তা পসন্দ হল না। তিনি ফাতিমাকে ভর্ৎসনার সুরে বললেন, তুমি কি জান না যে, তাঁর ক্রন্দন আমার মনে ব্যথা দেয়!–(প্রাগুক্ত)

হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর তুলনায় সন্তান-সন্তুতির প্রতি অধিক স্নেহ-মমতা পোষণকারী আমি কাউকে দেখিনি। তাঁর পুত্র ইব্রাহীম (রাঃ) মদীনায় উঁচু প্রান্তে ধাত্রী মায়ের কাছে দুধ পান করতেন। তিনি প্রায়ই সেখানে যেতেন এবং আমরাও তাঁর সাথে যেতাম। তিনি যে ঘরে যেতেন অথচ সেই ঘরটি প্রায়ই ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকত। কেননা, ইব্রাহীমের ধাত্রী মায়ের স্বামী ছিল একজন কর্মকার। তিনি ইব্রাহীমকে কোলে তুলে নিতেন এবং আদর করে চুমু দিতেন, এরপর চলে আসতেন। বর্ণনাকারী বলেন, যখন ইবরাহীম (রাঃ) ইতিকাল করেন তখন নবী করীম (ছঃ) বললেন : ইব্রাহীম আমার পুত্র। সে দুধ পানের বয়সে ইনতিকাল করেছে। সুতরাং জান্নাতে তাকে একজন ধাত্রী দুধ পান করাবে। -(বুখারী, মুসলিম)

হযরত ইবন উমর (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছঃ)-এর নেতৃত্বাধীন কোন যুদ্ধে এক মহিলাকে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেল। এতে নবী কারীম (ছঃ) গভীরভাবে মর্মাহত হন এবং নারী ও শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করেন।–(প্রাগুক্ত)।

নবীজী (ছঃ) বলেছেনঃতোমরা তোমাদের সন্তাদের যত্ন নেবে এবং তাদের আদব-কায়দা-শিষ্টাচার শিক্ষা দেবে।–(প্রাগুক্ত)

নবীজী (ছঃ) আরো বলেছেন :তোমরা শিশুদের ভালবাস এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন কর। তাদের সাথে কোন ওয়াদা করলে তা পূর্ণ কর। কেননা, তারা তোমাদেরকে তাদের রিযিক সরবরাহকারী বলে জানে।–(প্রাগুক্ত)

পরিশেষে বলা যায় যে, নবী করীম (ছঃ)-এর অকৃত্রিম ভালবাসা, স্নেহ, মমতা সবার জন্য নিবেদিত। শিশু যেহেতু দুনিয়ায় ফুল বিশেষ, তাই তাদের তিনি খুব ভালবাসতেন, আদর করতেন, স্নেহ করতেন। সুতরাং আমাদেরও উচিত শিশুদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা রাখা।

.

শিশুর চরিত্র গঠনে পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব

পরিবার সমাজ জীবনের প্রথমিক স্তর। স্বামী-স্ত্রী, সন্তা-সন্তুতি, পিতামাতা, ভাইবোন প্রভৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠে পরিবার। বহু সংখ্যক পরিবারের সমন্বয়ে গড়ে উঠে সমাজ। আর পরিবার থেকেই শুরু হয় মানুষের সামাজিক জীবন। সামাজিক জীবনের শৃংখলা ও স্বচ্ছতা নির্ভর করে পারিবারিক জীবনের সুষ্ঠুতার উপর।

মানুষ সামাজিক জীব। পারিবারিক জীবনের মাধ্যমেই এ সামাজিক জীবনের সূচনা হয়। মানুষ সকল যুগে ও সকল কালেই কোন না কোনভাবে সামাজিক জীবন যাপন করেছে। প্রাচীনকাল থেকেই পরিবার সামাজিক জীবনের প্রথম ক্ষেত্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। কাজেই আদর্শ সমাজ গঠনে আদর্শ পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম।

সন্তান প্রতিপালনের জন্যে পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারেই সন্তানের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক শিক্ষার ভিত রচিত হয়। শিশু সর্বপ্রথম তার পিতামাতার দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। কেননা, শিশু তার আচার-আচরণে এদেরকেই আদর্শরূপে গ্রহন করে। তাই সন্তাদের সামনে সুন্দর চরিত্র ও উত্তম আচারণ প্রকাশ করাই পিতামাতার কর্তব্য। তারা যেন নিজেদেরকে উত্তম উদাহরণরূপে সমাজের সামনে পেশ করেন।

সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগকে সুস্থ ও সর্বাঙ্গ সুন্দর করতে হলে পারিবারিক জীবনকে সুন্দর কাঠামোতে গড়ে তোলা প্রয়োজন। অন্যথায় সমাজ সংস্কার ও আদর্শ জাতি গঠনের কোন প্রচেষ্টাই সফল হবে না।

পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতার প্রতি ইঙ্গিতবহ কয়েকটি আয়াত নিম্নে দেয়া হলো :

এরশাদ হয়েছে :

والله جعل لكم من أنفسكم أزواجا وجعل لكم من أزواجكم بنين

ܨܟ݂ܬ݁ܺܥܳܪܽ

অর্থ : আর আল্লাহ তোমাদের থেকেই তোমাদের জন্য স্বজাতীয় স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জোড়া হতে তোমাদের জন্য পুত্র ও পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন।–(সূরা নাহল : ৭২)

অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে।

وهو الذي خلق من الماء بشرا فجعله نسبا وصهرا وكان ربك

قديرا۔

অর্থ : তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পানি হতে। তারপর তিনি তার বংশগত ও বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন। তোমার রব সর্বশক্তিমান।–(সূরা ফুরকান : ৫৪)

তিনি আরো এরশাদ করেছেন।

ايها البنين أمنوا قوا اثقگم و أهليكم نارا

অর্থ : হে মু’মিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও।–(সূরা তাহরীম : ৬)।

বস্তুবাদী সমাজ পারিবারিক প্রথা বিলুপ্তির জন্য অত্যন্ত সচেষ্ট। ফলে তাদের জীবনে নেমে এসেছে চরম অশান্তি ও বিপর্যয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তার জন্যে পরিবার একটি দুর্গবিশেষ। এ দুর্গ অক্ষুণ্ণ ও সুরক্ষিত থাকার উপরই নির্ভর করে ইসলামী সমাজ ও জাতীয় জীবনের নিরাপত্তা, সুস্থতা এবং স্থিতি।

পরিশেষে বলা যেতে পারে যে, পারিবারিক জীবনহীন যেমন মানব সভ্যতার বিকাশ অকল্পনীয়, তেমনি শিশু-কিশোরদের চজরিত্র গঠনে পারিবারিক জীবন ছাড়া অকল্পনীয়। আর এজন্যই ইসলাম সুস্থ পাবািরিক জীবনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে।

.

মাতৃ জঠরে শিশুর বিকাশে মাবাবার দায়িত্ব সম্পর্কে ইসলাম

ইসলাম যে কেবলমাত্র জন্মের পর থেকেই শিশুদের প্রতি গুরুত্ব দান করেছে তা নয়, বরং পূর্ব থেকেই তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। নবীজী (ছঃ) বলেছেন : চারটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে মেয়েদের বিয়ে করা হয়। কন্যার ধন সম্পদের কারণে, তার বংশীয় আভিজাত্যের কারণে, তার রূপ লাবণ্যের কারণে এবং তার দীনদারীর কারণে। তবে তুমি দীনদার মেয়ে বিয়ে করে ধন্য হও।–(মেশকাত)

উপরোল্লিখিত হাদীসের আলোকে এ কথা বলা যেতে পারে যে, মহিলার রূপ বা সম্পদই যেন সর্বাধিক গুরুত্ব না পায়। ধর্মপরায়ণতার গুণটি যেন অবশ্যই যুক্ত থাকে। আর সে যেন মার্জিত দীনি পরিবারের সদস্য হয়। কেননা, তার সন্তানেরা তার চরিত্র বৈশিষ্ট্য ও আচরণ ইত্যাদি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়।

.

শিশুর প্রতি মাবাবার ভালোবাস মহান আল্লাহর দান ও স্বভাবজাত

সন্তানের প্রতি মাবাবার অকৃত্রিম ভালোবাসা আল্লাহর দান ও স্বভাবজাত বিষয় এতে কোন সন্দেহ নেই। সন্তানের ভালোমন্দ সম্পর্কে মাবাবা সর্বাধিক সচেতন হয়ে থাকেন। সন্তানের প্রতি মাবাবার এই অকৃত্রিম ভালোবাসা না থাকলে বিশ্ব চরাচরে মানব অস্তিত্ব চিরদিনের জন্য বিলিন হয়ে যেত। সন্তান-সন্ততি মাবাবার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ অলংকার এবং মানব সম্পদ বিকশিত হওয়ার অন্যতম মাধ্যম। সুসন্তান মাবাবার জন্য আশীর্বাদ। তাই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :

المال والبنون زينة الحيوة الدنيا وال بقيت الصلحت خير عند

ربك ثوابا وخير أم

অর্থ : ধনৈশ্বৰ্য্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা এবং স্থায়ী সৎকর্ম। তোমার তোমাদের নিকট পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং কাঙ্ক্ষিত হিসেবেও উৎকৃষ্ট। -(রা কাহ্ফ, ১৮ ঃ৪৬)

সন্তানের প্রতি মাবাবার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা থাকার কারণেই তারা সন্তানের সার্বিক কল্যাণ সাধনে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর পরিশ্রম করে থাকেন। সন্তানকে সত্যিকার মানুষরূপে গড়ে তোলার পেছনে রয়েছে তাদের অপরিশোধযোগ্য অবদান। আল্লাহ্ তা’আলা মানব মনে যে প্রেম ভালোবাসা, নম্রতা, কোমলতা, হৃদ্যতা রেখেছেন তার সবটুকু মাবাবা সন্তানের কল্যাণে ব্যয় করে থাকেন। সন্তান ও ছোটদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করার নির্দেশ দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন : সে আমার দলভূক্ত নয়, যে ছোটদের প্রতি স্নেহপরায়ণ নয় এবং বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি একটি শিশু নিয়ে নবী করীম (ছঃ)-এর খিদমতে এসে শিশুটিকে চুমু দিতে লাগলেন। নবী করীম (ছঃ) এ দৃশ্য দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, শিশুটির প্রতি কি তোমার দয়া জেগে উঠেছে? সে বলল, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! তাপর তিনি বললেন, আল্লাহ পাক তোমার প্রতি এর চেয়েও অধিক দয়া করেন। কেননা, তিনি দয়ালুদের শ্রেষ্ঠ দয়ালু।–(আল-আদাবুল মুফরাদ)

হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেন, এক বেদুঈন ব্যক্তি রাসূলে করীম (ছঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে বলল, আপনি কি শিশুদের চুমু দেন? আমি তো কখনো শিশুদের চুমু দেই না। তিনি তাকে বললেন, আল্লাহ্ যদি তোমার হৃদয় থেকে দয়া ছিনিয়ে নেন, তবে আমারই বা কি করার আছেঃ–(মেশকাত)

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একবার নবীজী (ছঃ) হযরত হাসান ইবন আলী (রা.)-কে চুমু দিলেন, তখন সেখানে আকরা ইব্‌ন হাবিস (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন। এ দেখে তিনি বললেন, আমার দশটি সন্তান আছে, আমি কখনো তাদের চুমু দেইনি। এ কথা শুনে নবীজী, (সাঃ) তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, যে দয়া করে না তার প্রতি দয়া করা হয় না। -(বুখারী, মুসলিম)

হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, এক গরীব মহিলা তার দু’ কন্যা নিয়ে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-এর নিকট আসলে তিনি তাকে তিনটি খেজুর দিলেন। স্ত্রীলোকটি তার দু’ কন্যার প্রত্যেককে একটি করে খেজুর দিল এবং একটি নিজে খাওয়ার জন্য মুখে দিতে যাচ্ছিল। এমতাবস্থায় শিশুরা তাও খেতে চাইলে মহিলা তার খেজুরটি দু’টু করে তাদের হাতে অর্ধেক অর্ধেক করে তুলে দিল। আয়েশা (রাঃ) বলেন, তার এ কাজ আমার নিকট আশ্চর্যজনক বলে মনে হল। তাই আমি ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-কে জানালাম। তিনি বললেন, আয়েশা! আল্লাহ পাক এ স্ত্রী লোকটিকে এর বিনিময়ে জান্নাত দান করবেন অথবা এর বিনিময়ে তাকে জাহান্নাম থেকে নাজাত দেবেন।–(মুসলিম)

সন্তানের প্রতি ভালোবাসা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। এ কারণে, নবী-রাসূলদের জীবনেও এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে হারাবার পর যে আকুতি হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল, তা পবিত্র কুরআনে বিধৃত হয়েছে।

في علي يوسف وابيضت عينة من الحزن فهو كظيم

قالوا اللوتفتؤا تذكر يوسف حثی تگون حرضا أو تكون من الهيكين–

অর্থ : এবং সে বলল, আফসোস ইউসুফের জন্যে! শোকে তাঁর আঁখিযুগল সাদা হয়ে গিয়েছিল এবং সে ছিল অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট। তারা বলল, আল্লাহর কসম, আপনি তো ইউসুফের কথা ভুলবেন না যে পর্যন্ত না আপনি মুমূর্ষ হবেন অথবা মৃত্যুবরণ করবেন। –(সূরা ইউসুফ : ৮৪-৮৫)

উপরোল্লিখিত আলোচনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, সন্তানের প্রতি মায়া-মহব্বত মাবাবার একান্তাই সহজাত, এতে সন্দেহ নেই।

.

শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

ইসলাম একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। মানুষের ইহ-পরকালীন কল্যাণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসলামের কোন বিকল্প নেই। ইসলামে যেমন প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে তদ্রুপ শিশুদের অধিকারের নিশ্চয়তাও রয়েছে এতে পুরোপুরি।

সন্তানের বাঁচার অধিকার

শিশুদের বাঁচার অধিকার ইসলাম স্বীক্বত ও সুরক্ষিত। কাজেই মাবাবা কোন অবস্থাতেই সন্তান হত্যা করতে পারবে না। এমনকি চরম দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হলেও নয়।

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

ولا تقتلوا أولادكم خشية إملاق نحن نرزقهم و إياكم إن قثلهم

كان خطأ كبيرا

অর্থ : তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা করো না। তাদেরকেও আমিই রিযিক দেই এবং তোমাদেরকেও। তাদেরকে হত্যা করা মহাপাপ।–(সূরা বনী ইসরাঈল : ৩১)

অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

قد خسر الذين قتلوا أولادهم قها بغير علم

অর্থ : যারা নির্বুদ্ধিতার কারণে ও অজ্ঞানতাবশত নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করে তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।–(সূরা আন’আমঃ ১৪০)

আরো এরশাদ হয়েছে।

وإذا الموؤدة سئلت بای ذنب قتلت

যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল? –(সূরা তাকভীর ও ৮-৯)

আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-কে নারীদের নিকট থেকে বায়’আত গ্রহণের সময় তাদের থেকে যে সব বিষয়ে শপথ নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন তন্মধ্যে একটি ছিল সন্তান হত্যা না করা।

ইসলামী শরীয়াতে শিশুর জীবন রক্ষায় মাবাবার দায়িত্ব অপরিসীম। শিশু মাবাবার নিকট এক পবিত্র আমানত। এ আনামত সম্পর্কে তারা অচিরেই জিজ্ঞাসিত হবে। যদি মাবাবার শিশুদের প্রতিপালনে মনোযোগী না হয়, তবে অবশ্যই তাদের জবাবদিহি করতে হবে। মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে, নবীজী (ছঃ) বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্ববান এবং প্রত্যেকেই আপন আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। প্রতিটি মনুষ তার। পরিবার রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে দায়িত্ববান। তাকে এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর সম্পদ ও সন্তানের ব্যাপারে দায়িত্ববান। তাকে এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।–(মেশকাত)

মোটকথা, আল্লাহ পাক সকলের জন্য তাদের সন্তান হত্যা করা হারাম করে দিয়েছেন।

 সন্তানদের মাঝে সমতা বিধান—

হাদীসে আছে, সন্তানদের দান করার ব্যাপারে সমতা রক্ষা কর।

অন্য হাদীসে আছে, তোমাদের সন্তানদের মাঝে সুবিচার প্রতিষ্ঠা কর, তোমাদের সন্তানদের মাঝে ইনসাফ কায়েম কর।–(মুসনাদে আহমদ)

এ সম্পর্কে প্রায় সকল হাদীস গ্রন্থে, নুমান ইবন বশীর (রাঃ) বর্ণিত হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে। বশীর আনসারীর স্ত্রী উমরাহ তাঁর পুত্র নুমান ইব্‌ন বশীরকে একটি বাগান অথবা ক্রীতদাস দান করার জন্য স্বামীকে পীড়াপীড়ি করে। এতে বশীর ঐ ছেলেকে তা দান করেন। কিন্তু নুমানের মা এ ব্যাপারে নবীজী (ছঃ)-কে সাক্ষী রাখার দাবী করেন। সে মতে তিনি নুমানকে সাথে নিয়ে নবীজী (ছঃ))-এর দরবারে হাযির হয়ে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার স্ত্রী উমরার গর্ভজাত এ পুত্রকে একটি ক্রীতদাস দান করেছি। আর উমরাহ এ বিষয়ে আপনাকে সাক্ষী রাখার অনুরোধ করেছে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি অন্যান্য সন্তানদের এরূপ দান করেছ? সে বলল, জ্বি-না। তিনি বললেন, আল্লাহূকে ভয় কর। আমি এ যুলুমের সাক্ষী হব না। অতঃপর বশীর এসে তার দান ফেরত নিয়ে নেন।-(বুখারী, আবূ দাউদ, নাসাঈ)।

হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (ছঃ)-এর নিকট বসা ছিল। এ সময় তার পুত্র সন্তান তার কাছে এলো। সে তাকে চুমু দিল এবং কোলে তুলে নিল। এরপর তার কন্যা সন্তান এলো এবং সে তাকে সামনে বসিয়ে দিল। এ দৃশ্য দেখে তিনি বললেন, তুমি এদের উভয়ের সাথে একই রকম ব্যবহার করলে না কেন?

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এ কথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে হোক উভয়ের প্রতি সমতা বিধান এবং সুবিচার করা অবশ্য কর্তব্য। এ বিষয়ে অবহেলা অমার্জনীয় অপরাধ।

প্রতিপালন–

সন্তান প্রতিপালনের ব্যাপারে মাবাবা উভয়েরই বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। তাদের উচিত সন্তানদের প্রত্যেকটি বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা, তাদের যথাযথ পরিচর্যা করা, তাদের জন্য উপযুক্ত খাদ্যের ব্যবস্থা করা এবং তাদের সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণ করা।

রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্ববান এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।–(বুখারী, মুসলিম)।

হাদীস শরীফে হয়েছে, যে ব্যক্তি তার অধীনস্থদের দায়িত্ব নিল অথচ তাদের কল্যাণ কামনা থেকে বিরত থাকল, তার জন্য জান্নাত হারাম।–(মেশকাত)

অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মাবাবার পক্ষ থেকে সন্তানকে উত্তম চরিত্র শিক্ষা দেয়ার চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোন দান হতে পারে না।–(মেশকাত)

সন্তান প্রতিপালন ছাওয়াবের কাজ সন্দেহ নেই। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ

وعلى المولود له رزقه ويرشؤته

অর্থ : পিতার কর্তব্য যথাবিধি তাদের ভরণপোষণ করা।–(সূরা বাকারা : ২৩৩)

 কাজেই সন্তান প্রতিপালনের ব্যাপারে সকলেরই যত্নবান হওয়া উচিত।

.

ইসলামে কন্যা সন্তান

সন্তান পুত্র হোক বা কন্যা হোক আচরণের ক্ষেত্রে এ দুয়ের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করা ইসলাম সমর্থন করে না। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) ছেলে ও মেয়ের মধ্যে পার্থক্য বিধান এবং মেয়েদের উপরে ছেলেদের অহেতুক প্রাধান্যদানে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।

হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে :

عن ابن عباس رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من كانت له انثى فلم یادها ويهثها ولم يوثژوله عليها يعني التكور أدخله الله الجنة

অর্থ : হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছঃ) বলেছেন, যার তত্ত্বাবধানে কোন শিশু বালিকা থাকে আর সে তাকে জীবিত দাফন না করে, তার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন না করে এবং বালকদেরকে তার উপর কোনরূপ প্রাধান্য না দেয় আল্লাহ্ পাক তাকে জান্নাতে প্রবেশ করবেন।–(আবূ দাউদ)।

ইসলাম কন্যা সন্তানের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে তাদের মর্যাদার কথা উল্লেখ রয়েছে। এমনকি পবিত্র কোরআনেসূরাতুন্ নিসা নামে একটি স্বতন্ত্র সূরা স্থান পেয়েছে। সূরা আলে ইমরান, নিসা, মারইয়াম, নূর, আহযাব-এ কন্যা সন্তানের অধিকার সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

এরশাদ হয়েছে

فاستجاب لهم ربهم إني لا أضيع عمل عامل منكم من ذكر أو

أنثي بعضهم من بعض

অর্থ : তারপর তাদের রব তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বলেন, আমি তোমাদের মধ্যে কর্মনিষ্ঠ কোন নর অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না। তোমরা পরস্পরের অংশ। –(সূরা আলেইমরান, ৩ : ১৯৫)

নবীজী (ছঃ) পিতার অন্তরে কন্যা সন্তানের প্রতি গভীর মমত্ববোধ জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে বহু উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তান অথবা তিন বোন লালন-পালন তাদেরকে শিষ্টাচারিত শিক্ষা দিল এবং তাদের প্রতি দয়া করল, অবশেষে আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে মুখাপেক্ষীহীন করে দিলেন। তাহলে তার জন্য আল্লাহ জান্নাত অবধারিত করে দেবেন। তখন জনৈক সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ দু’টি কন্যা সন্তান প্রতিপালন করলে? তিনি উত্তরে বললেন, দু’টি করলেও। বর্ণনাকারী বলেন, এমন কি তারা যদি একটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত তবুও তিনি এরূপ বলতেন।-(শারহুস্ সুন্নাহ)

তিনি আরও বলেছেন, কন্যা সন্তান সুগন্ধি ফুল। আমি তার সুগন্ধি গ্রহণ করি আর তার রিযিক তো আল্লাহর হাতে।

রাসূলুল্লাহ (ছঃ) আরও বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যার প্রথম সন্তান মেয়ে।-(প্রাগুক্ত)

হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি দু’টি কন্যা সন্তানকে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত প্রতিপালন করবে, তিনি তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলো একত্র করে বললেন, কিয়ামতের দিন আমি এবং সে এরূপ কাছাকাছি থাকব।–(মুসলিম)

হাদীস শরীফে আরও বর্ণিত আছে, আল্লাহর রাসূল (ছঃ) বলেন, যে ব্যক্তিকে কন্যা সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব দেয়া হয় আর সে তাদেরকে সুন্দরভাবে প্রতিপালন করে, সে কন্যা সন্তানগুলো তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে আড়ম্বরূপ হবে।-(মেশকাত)

পরিশেষে বলা যেতে পারে যে, কন্যা সন্তানের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করা সম্পূর্ণ মূর্খতা ও জাহিলি যুগের বৈশিষ্ট্য। ইসলাম জাহিলি যুগের এ সব বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ইনসাফের বিধান প্রবর্তন করেছে। তাই সন্তানদের প্রতি কোনরূপ বৈষম্যমূলক আচরণ না করে পুত্র-কন্যা নির্বিশেষে সকলকেই সমান নযরে দেখা উচিত।

.

সন্তান জন্মের সময় করণীয়

সন্তান প্রসবের সময়টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টদায়ক। তাই এ সময়ের প্রতিটি কাজ সাবধানতার সাথে করতে হবে। পরিপূর্ণ প্রসব ব্যথার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তাড়াহুড়া করা অনুচিত; এতে সন্তান বা প্রসূতি অথবা উভয়ের জীবনে সমূহ ক্ষতির আশংকা থাকে এমনকি জীবনের আশংকাও দেখা দিতে পারে। প্রসবের সময় আঁতুড় ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাস, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ প্রসবের ব্যবস্থা করা জরুরী। এছাড়াও সামর্থ্যানুযায়ী আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা গ্রহণ, প্রসূতি বিষয়ক চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। অনভিজ্ঞ দাই ও নার্সদের বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে।

সন্তান প্রসবের সময় দাই বা নার্সের সামনে কেবল আবশ্যক পরিমাণ শরীর অনাবৃত করা যায়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিবস্ত্র হওয়া অথবা সংশ্লিষ্ট লোকদের ছাড়া অন্য কারো তার প্রতি দৃষ্টি করা জায়েয নেই। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন :

لعن الله التاظرو المنظور إليه

অর্থ : সতর-গুপ্তাঙ্গ যে দেখবে এবং যে দেখাবে উভয়ের উপরই আল্লাহর অভিষম্পাত। -(মেশকাত)

.

সন্তান জন্মগ্রহণের পর আনন্দ প্রকাশ

সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর অভিভাবক ও আত্মীয়-স্বজনের পক্ষ হতে আনন্দ প্রকাশ করা এবং শুভ সংবাদ জানানো মুস্তাহাব। মাবাবার সাথে সাথে আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীর পক্ষ থেকেও অনিন্দ প্রকাশ করা মুস্তাহাব। তৎক্ষণাৎ আনন্দ প্রকাশ করা সম্ভব না হলে পরে নবজাতক ও তার পিতামাতার জন্য দোয়া করা মুস্তাহাব।

হিজরতের পর মদীনায় মুহাজির সাহাবীদের প্রথম সন্তান ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন যুবাইর (রাঃ)। তার জন্মের পর মুহাজির সাহাবীরা আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন।

শিশু জন্মগ্রহণ করার পর কি রূপে আনন্দ প্রকাশ করবে এ ব্যাপারে আল্লামা ইন কাইয়্যিম (রঃ) স্বীয় কিতাবতোহফাতুল মাওদূদ ফী আহকামিল মাওলুদ’-এ একটি রিওয়াতে বর্ণনা করেছেন,

আবূ বকর ইবন মুনযির (রঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত হাসান বাসরী (রঃ)-কে দেখেছি, তাঁর কাছে একজন লোক আসল, তাঁর সাথে আরেক জন লোক ছিল। এ লোকটির সঙ্গে তার এক নবজাতক শিশুও ছিল। তারপর উক্ত ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল যে, শিশু জন্মগ্রহণের পর আমরা কিভাবে আনন্দ প্রকাশ করব? হযরত হাসান বাসরী (রঃ) বললেন, তুমি এভাবে বল, আল্লাহ তা’আলা তোমাকে যে সন্তান দিয়েছেন তার হায়াতে বরকত দান করুন। আর সন্তানদাতা মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে।

এ আনন্দ প্রকাশ ছেলেমেয়ে উভয় প্রকার শিশু সন্তানের জন্য করা উচিত। আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীর বাসায় মিষ্টান্ন দ্রব্য প্রেরণ করা জায়েয। এর মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি হয় এবং হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে শর্ত হল, এটাকে যেন রুম ও অবশ্য পালনীয় কর্ম হিসেবে পালন করা না হয়। আর সাধ্যের বাইরে ব্যবস্থা করতে গিয়ে অনাহুত ধার-কর্জ যেন গ্রহণ করা না হয়।

.

জন্মের পর শিশুর জন্য করণীয়

 জন্মের পর শিশুর প্রতি তিনটি কর্তব্য–প্রথমটি হল তাকে ভালভাবে গোসল করিয়ে শরীরে লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার করা। অবশ্য শীতকালে গোসলের ব্যাপারে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যেন শিশুটি ঠাণ্ডায় আক্রান্ত হতে না পারে। গোসলের সময় খুব লক্ষ্য রাখবে যেন পানি তার নাক, কান এবং মুখে প্রবেশ করতে না পারে।

গোসলের পরপরই শরীর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে আবহাওয়া অনুযায়ী নরম জাতীয় কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

শিশুকে বেশি আলোকোজ্জ্বল স্থানে রাখবে না। কেননা, এতে শিশুর চোখের জ্যোতি হ্রাস পেতে পারে। শিশুকে এক পার্শ্বে বেশিক্ষণ শুইয়ে রাখবে না এবং কোন এক দিকে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকতে দেবে না। কারণ, এতে শিশুর রাতকানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে। কোলের শিশুকে একা ঘরে রাখা ঠিক নয়। এতে অবাঞ্ছিত কোন ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

.

আযান ও ইকামাত বলা

গোসলের পর শিশুর ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামাত দেয়া। হাদীস শরীফে উল্লেখ রয়েছে।

ی الله عليه

مال رايت رس

ابی رافع ر

بن

وتم الآن في ان الحسن بني على حين ولدته فاطمه بالقلوة

অর্থ : হযরত আবু রাফি’ (রাঃ) থেকে বর্নিত তিনি বলে, আমি নবী করীম (ছঃ)-কে দেখেছি যে, হযরত হাসান (রাঃ)-এর জন্ম হলে রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) তাঁর কানে নামাযের আযানের মত আযান দিয়েছিলেন।-(তিরমিযী)

উক্ত আযানে : বলার সময় ডান দিকে আর। 1 বলার সময় বাম দিকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।–(ফাতওয়ায়ে শামী)।

অপর হাদীসে উল্লেখ রয়েছে :

عن ابن عباس رضي الله عنه أن البى صلى الله عليه وتم الآن

في أن الحسن بن علي يوم وليد وأقام في أذنه اليسرى

অর্থ : হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হাসান ইবন আলী (রাঃ)-এর জন্মগ্রহণের দিন রাসূলুল্লাহ (ছঃ) তাঁর ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামাত দিয়েছিলেন।-(বায়হাকী)।

নবজাতকের ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামাত দিলে মাতৃকা রোগ তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। হাদীসে বর্ণিত আছেঃ

عين الحسين بن علي رضي الله عنه عن البي صلى الله عليه وسلم قال مثيله مولود قادن في انه اليمنى و اقام في ايه اليسرى لم تضره أم الصبيان–

হযরত হাসান ইবন আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, যার কোন শিশুর জন্মগ্রহণ করবে আর সে নবজাতকের ডান কানে আযান আর বাম কানে ইকামাত দিবে মাতৃকা রোগ তার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না।-(বায়হাকী)

কানে আযান ও ইকামাত দেয়ার হিম্মত বয়ান করে কেউ কেউ বলেছেন যে, নবজাতকের কানে আযান ও ইকামাত দেয়ার অর্থ হল, তাকে এ কথা জানিয়ে দেয়া যে, আযান ও ইকামাত হয়ে গেছে এখন শুধু নামাযের অপেক্ষা, নামায শুরু হতে যে সামান্য সময় বাকী আছে তাই তোমার জীবন।

আর কেউ বলেছেন যে, আযান ও ইকামাতের মাধ্যমে নবজাতকের কানে প্রথমেই আল্লাহর পবিত্র নাম পৌঁছানো যেন এর প্রভাবে তার ঈমানের ভিত্তি সুদৃঢ় হয় এবং শয়তানের প্ররোচনা হতে সে নিরাপদে থাকতে পারে।-(তাঃ আঃ ফিল ইসলাম, পৃঃ ৩২)।

আর নবজাতক দুনিয়াতে পদার্পণ করার সাথে সাথেই তার কানে এ আহবান পৌঁছিয়ে দেয়া যে, আযান ও ইকামাত ইসলামের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক বাক্য।

আযান ও ইকামাতের আওয়াজ শুনার সঙ্গে সঙ্গে শয়তান সদ্যজাত শিশুর নিকট থেকে দূরে সরে যায় আর শয়তানের সর্বপ্রকারের অনিষ্ট থেকে শিশু আশংকামুক্ত হয়ে যায়। এতে আর একটি হিকমত হল, শয়তান নবজাতকের মন-মস্তিষ্ক বিগড়িয়ে দেয়ার আগেই তার কানে ইসলাম ও আল্লাহ্-রাসূলের দাওয়াত এবং এবাদতের আহ্বান পৌঁছিয়ে দেওয়া। -(তাঃ আঃ ফিল ইসলাম, পৃঃ ১৬৮)

.

তাহনীক-নবজাতককে মিষ্টিমুখকরণ

নবজাতকের ক্ষেত্রে তৃতীয় করণীয় বা সুন্নাত হল তাহনীক। তাহনীক অর্থ হল, খেজুর। চিবিয়ে নবজাতকের মুখে দেয়া। যাতে এর কিছু রস পেটে পৌঁছে যায়।

খেজুর সহজলভ্য না হলে সুন্নাতের উপর আমল করার নিয়্যতে যে কোন মিষ্টি দ্রব্য দিয়ে তাহ্নীক করা যায়। তাহনীক সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত আছেঃ

عن عائشة رضي الله عنها أن رسول الله صلى الله عليه وسلم

كان يؤتى بالصبيان فيبرك عليهم و يحگهم

অর্থ : হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর কাছে নবজাতক শিশুদেরকে পেশ করা হত। তিনি তাদের জন্য বরকতের দোয়া করতেন ও তাদেরকে মিষ্টি মুখ করাতেন। -(বুখারী শরীফ)

যদিও যে কোন মিষ্টি দ্রব্য দিয়েই তাহনীক করা যায় কিন্তু খেজুর দিয়ে তাহনীক সম্পর্কে একটি হাদীসে বর্ণিত আছে।

قال ولدلی غلام فأتيت به النبي صلى الله عليه

عن ابی موسی

وسلم فسماه إبراهيم فحنکه بتمرق و دعاله بالبركة و دفعه إلى–

অর্থ : হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার একটি শিশু সন্তান জন্মগ্রহণ করলে আমি তাকে রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর খিদমতে পেশ করলাম। তিনি তার নাম রাখলেন ইবরাহীম আর খেজুর দ্বারা তাকে মিষ্টিমুখ করালেন ও তার জন্য বরকরতের দোয়া করে তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন।-(বুখারী শরীফ)।

কোন বুযুর্গের চর্বিত বস্তু শিশুর প্রথম খোরাক হলে তা যদি শিশুর অঙ্গ গঠনে প্রথম ভূমিকা রাখে তা হলে আশা করা যায় যে, তার এই প্রথম খাদ্য তার চরিত্র গঠনে জীবনভর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে।

এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে বর্ণিত আছেঃ

عن أسماء بنت أبي بكر رضي الله عنهما أنها حملت بعبد الله بين البير بمكة فولدت بقباء ثم أتيت به رسول الله صلى الله عليه وتم و وضعته في حجره ثم دعا له بتمرة مضفها ثم تفل في فيه فكان اولی شي دخل في جوفه ریق رسول الله صلى الله عليه وسلم ثم حكه مقاله و برك عليه

অর্থ : হযরত আসমা বিনতে আবূ বকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি মক্কা শরীফে অবস্থান কালে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন যুবাইর (রাঃ)-কে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। মদীনা শরীফে হিজরতের পর তিনি কুবা নামক স্থানে ভূমিষ্ঠ হলে আমি তাঁকে রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর খিদমতে নিয়ে এসে তার কোলে রাখলাম। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) কিছু খেজুর আনিয়ে তা চিবিয়ে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন্ যুবাইর (রাঃ)-এর মুখে কিছু থুথু ছিটিয়ে দিলেন। তাঁর পেটে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর থুথু মোবারকই প্রবেশ করেছিল। পরে তাকে মিষ্টিমুখ করালেন। তারপর তার জন্য বরকতের দোয়া করলেন।-(বুখারী, মুসলিম)

.

নবজাতকের মুখে চিবানো বস্তু দেয়ার উপকারিতা

 নবজাত শিশুর মুখে বিচানো বস্তু দেয়ার পর জিহ্বা দিয়ে নড়াচড়ার কারণে তার দাঁতের মাড়ি মজবুত হওয়ার সমূহ সম্ভবনা থাকে। সঙ্গে সঙ্গে মাতৃস্তন্যে মুখ লাগানোর প্রতি সে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবে এবং পূর্ণশক্তি দিয়ে মাতৃদুগ্ধ পান করতে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।

এ ছাড়াও তাহনীকে ব্যবহার্য খেজুর ও মধুতে নানাবিধ উপকারিতা রয়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় খেজুরের ও মধুর ব্যাপক খাদ্যপ্রাণ ও পুষ্টিমান প্রমাণিত। এহেন পুষ্টিবহুল বস্তুর সাথে সদ্যজাত শিশুকে জীবনের সূচনালগ্নেই সম্পৃক্ত করাও তাহ্নীকের একটি বিরাট হিকমত। -(তাঃ আঃ ফিল ইসলাম)

.

শালদুধ পান করানো

করুণাময় আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে সৃষ্টি করার পর তার লালন-পালনের যাবতীয় ব্যবস্থা তিনিই করেন। একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহু রব্বুল আলামীন তার প্রতিপালনের ব্যবস্থা করে দেন। শিশুর মায়ের স্তনে নবজাত শিশুর জন্য দুধ সৃষ্টি করে রাখেন যা হালকা মিষ্টি ও উষ্ণ, যা নবজাত শিশুর নাজুক অবস্থার উপযোগী।

গর্ভ অবস্থার শেষ পর্যায়ে এবং প্রসবোত্তর ২-৪ দিন মায়ের স্তন্য হতে যে গাঢ় হলুদ রংয়ের দুধ আসে তাকে শালদুধ বা চিকিৎসা বিজ্ঞানে যাকে কোলোস্টাম’ বলে। এ দুধ পরিমাণে খুব অল্প। কিন্তু এই সামান্য দুধ নবজাতকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শালদুধ হলুদ বর্ণের এবং অত্যন্ত গাঢ় প্রক্বতির হয়ে থাকে বলে কেউ কেউ এ দুধকে ক্ষতিকর বলে মনে করে। অথচ হাদীসে রাসূল (ছঃ) এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে প্রমাণিত যে, এ দুধ শিশুর জন্য অত্যন্ত উপকারী।–(তাফসীরে নূরুল্ কোরআন)

শালদুধে স্নেহে ও শর্করার পরিমাণ কম। কিন্তু খনিজ লবণ, লৌহ ও আমিষের পরিমাণ সাধারণ দুধের চেয়ে বেশি, নবজাত শিশুর পুষ্টিমান যথার্থ রাখে পুষ্টিমান রক্ষার পাশাপাশি শালদুধে থাকে প্রচুর পরিমাণে ইমিউনোগ্লোবিউলিন বা রোগ প্রতিরোধকারী এন্টিবডি উপাদান। এর মধ্যে আইজি-এ’ এবং আইজি-জি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই উপাদানসমূহু নবজাতকের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করে থাকে।

তুলনামূলক গবেষণায় দেখা যায় যে, শালদুধ এবং সেই সাথে মায়ের দুধগ্রহণকারী শিশুদের এলার্জি, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, ডায়রিয়া, যক্ষ্মা, মেনিনজাইটিস, অন্ত্রপ্রদাহ জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব অন্য শিশুদের তুলনায় অনেক কম। শালদুধে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-’ই’ এবং ভিটামিন-এ। উভয় ভিটামিনই দীর্ঘদিন শিশুর যক্বতে জমা থাকে। ভিটামিন-’ই’ শরীরে এন্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে। বিশেষ করে এই ভিটামিন নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের রক্ত কণিকার ভাঙ্গন রোধে সহায়তা করে থাকে। ভিটামিন-এ চোখের রঞ্জক তৈরি, দাঁত, হাড়ের গড়নে সহায়তা, শরীরের আন্তঃ ও বহিঃ আবরণীর কোষকে রক্ষা করার পাশাপাশি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে যে, পর্যাপ্ত শালদুধ ও মায়ের দুধ গ্রহণকারী শিশুদের শ্বাসনালীর সংক্রমণের হার অন্য শিশুদের চেয়ে অনেক কম। মায়ের দুধ পানের মাধ্যমে মা-শিশুর অকৃত্রিম বন্ধন তৈরি হয়। এ সংযোগ মা-শিশুর বন্ধন এবং মায়ের সাথে শিশুর মনস্তাত্ত্বিক সংযোগ তৈরিতে বিশেষভাবে সহায়ক। তাই শালদুধসহ বুকের দুধ পান করানো অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে শালদুধ দেয়া উচিত।

.

শিশুর নাম রাখা

নবজাত শিশুর জন্য মাবাবার আরো একটি বিশেষ কর্তব্য হল অন্তত জন্মের সপ্তম দিবসে তার জন্য একটি শ্রুতিমধুর ও অর্থবোধক নাম রাখা। আল্লাহ্ তা’আলা হযরত আদম (আঃ)-কে সব জিনিসের নাম শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে হযরত আদম (আ.) আল্লাহর শিখানো জ্ঞানে সবকিছুর নাম বলে দিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিলেন। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত এই ঘটনা থেকে এটুকু বোঝা যায় যে, নাম জানা বা নাম রাখার বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

নামের প্রভাব–

মানুষের জীবনে নামের বিরাট প্রভাব পড়ে। সন্তানের জন্য একটি সুন্দর অর্থবোধক নাম রাখা প্রত্যেক মাবাবার গুরুদায়িত্ব। যাতে এ নামের প্রভাবে পরবর্তী জীবনে সন্তানের স্বভা-চরিত্রে শুচি-শুভদ্রতা ফুটে উঠে। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে বর্ণিত আছেঃ

عن سعيد بن المسيب حدث أن جده حزنا قيم على النبي صلى الله عليه وسلم فقال ما شمل قال اشمی ممن قال يل أنت هل قال ما أنا بمغيرا إسماسمانى أبي قال بن المسيب فمازالت فيتا

الحزونة بعد

অর্থ : হযরত সাঈদ ইবন মুসাইয়্যাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তাঁর দাদা হান রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর খিদমতে গেলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন তোমার নাম কি? তিনি বললেন, আমার নাম হায়ূন (শক্ত)। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বললেন, না বরং তোমার নাম হওয়া উচিৎ সাল (সহজ সরল)। তিনি উত্তরে বললেন, আমার পিতা যে নাম রেখেছেন তা আমি পরিবর্তন করব না। সাঈদ ইবন মুসাইয়্যাব (রাঃ) বলেন, এরপর আমাদের পরিবারে পরবর্তীকালে কঠিন অবস্থা ও পেরেশানী থেকে যায়।-(মেশকাত, পৃঃ ৪০৯)

সুতরাং অর্থ না জেনে কারো নাম রাখা ঠিক নয়। কেননা, এতে অর্থ বিক্বতি ও হাস্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা থাকে। অধিকন্তু নাম রাখার ক্ষেত্রেও অর্থ, প্রয়োগবিধি ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট স্মরণ রাখা একান্ত প্রয়োজন। বিদেশী ভাষার অর্থ জানা, সচেতন শিক্ষিত ব্যক্তির সাহায্য নিয়ে নাম রাখা বাঞ্ছনীয়। বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গের নামে নাম রাখাও একটি নিরাপদ পন্থা।

সপ্তম দিনে শিশুর নামকরণ করা উত্তম। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছেঃ

عن سمرة بن جندب رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وتم الم مرتهن بعقيقته يذبح عند يوم السابع ويسمي ويحلق رأسه–

অর্থ : হযরত সুমারা ইবন জুন্দুব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন, প্রত্যেক নবজাতক আকীকার সাথে সম্পৃক্ত থাকে, জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে প্রাণী যবেহ্ করবে, তার নাম রাখবে আর মাথা মুণ্ডন করবে।–(তিরমিযী, আবূ দাউদ)

নবজাতকের নাম রাখার সময় একটি সুন্দর অর্থবোধক নাম রাখা প্রত্যেক মাবাবার একান্ত কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে হাদীস শরীফে বর্ণিত আছেঃ

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه

وتم حق الولير على والده أن يحسن إسمه

অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন, পিতার উপর নবজাত শিশুর হ হল তার জন্য সুন্দর নাম রাখা।

এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন।

أحب الأسماء إلى الله عبد الله وعبد الرحمن

অর্থ : আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় নাম হল আবদুল্লাহ্ ও আবদুর রহমান। -(কানযুল উম্মাল, ১৬ খণ্ড পৃঃ ৪১৭)

আল্লাহ্ তা’আলার বহু গুণবাচক নাম রয়েছে। ঐসব নামের সঙ্গে আবদ’ শব্দ যোগ কর নাম রাখা উত্তম। তদ্রুপ নবী-রাসূল ও ওলী-বুযুর্গদের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখাও উত্তম।

অজ্ঞাতসারে বা অবহেলবশত কোন অর্থহীন বা বিদঘুঁটে কোন নাম রেখে ফেললে তা পরিবর্তন করে একটি সুন্দর অর্থবোধক নাম রাখা অবশ্য কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) কোন সাহাবীর ইসলাম পূর্ববর্তী যুগের রাখা এ ধরনের কোন নাম শুনতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে তা পরিবর্তন করে একটি সুন্দর অর্থবোধক ও শ্রুতিমধুর নাম রেখে দিতেন। হাদীস শরীফে উল্লেখ আছেঃ

برة فحول

لله عزرقال كانت جويرية اسم

۱

باسی

عن

رسول الله صلى الله عليه وسلم إسمها جويرية

অর্থ : হযরত আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত জুওয়ারিয়া (রাঃ)-এর পূর্ব নাম ছিল বাররাহ’। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) তার নাম পরিবর্তন করে জুওয়ারিয়া রাখলেন।–(মুসলিম)।

আরো বলেছেন:

وعن أبي رافع رضى الله عنه قال قال رسول اللو صلى الله عليه

سمیتم محمد افلا تضربوه ولا تحرموه

وسلم اذا

অর্থ : হযরত আবু রাফি’ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, তোমরা কারো নাম মুহাম্মদ রাখলে তাকে মারধর করবে না আর তার অসম্মানও করবে না। -(কানযুল উম্মাল, ১৬ খণ্ড, পৃঃ ৪১৮)

রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) আরো বলেন।

ولاب فلم يسم أحدهم محمدا فقد جهل

অর্থ : যার তিন তিনটি সন্তান জন্মগ্রহণ করল, অথচ সে কারো নাম মুহাম্মদ রাখল না। সে একজন জাহিলের ন্যায় আচরণ করল।–(ঐ পৃঃ ৪১৯)

হযরত উসমান উমারী (রাঃ) মারফু হাদীসে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেনঃ তোমাদের কারো ঘরে এক দুই বা তিনজন মুহাম্মদ থাকেলে তার কোন অনিষ্ট হবে না।’–(ঐ)

রাসূলুল্লাহ (ছঃ) আরো বলেন যে, মুহাম্মদ’ নামে বরকত নিহিত আছে, যে ঘরে মুহাম্মদ নামের লোক থাকবে সে ঘরে বরকত হবে, যে সমাবেশে মুহাম্মদ নামের লোক থাকবে সে সমাবেশে বরকত হবে।-(ঐ, পৃঃ ৪২১)

.

মুসলিম নামের ঐতিহ্য রক্ষা করা

মুসলিম জাতির ঐতিহ্য রক্ষা করে নাম রাখা উচিত। নামের ঐতিহ্য রক্ষার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে প্রখ্যাত আলিম কৃারী তৈয়্যব (রঃ) একটি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যে, পালক ফেলে দিলে একটি মৃত হাঁস দেখে আপনারা কেউ বলতে পারবেন না যে, এটি কি বুনো হাঁস না গৃহপালিত সাধারণ হাঁস। প্রাণী বিজ্ঞানের গবেষণাগারে না গিয়ে এক প্রকার নির্ধারণ খুবই দুরূহ ব্যাপার। মানুষের পোশাক, নাম, আচরণবিধি ইত্যাদির গুরুত্বও এমনই।–(আতৃতাশাবুহু ফিল ইসলাম)

.

বিকৃত নামে ডাকা

অনেক মাবাবাই আদরের আতিশয্যে সন্তানের সুন্দর নামটিকে সংক্ষিপ্ত করে ফেলেন। ফলে অর্থ পরিবর্তিত হয়ে পূর্ণ নামটিই বিকৃত হয়ে যায়। এরূপ করা অনুচিত। নাম বিকৃত করা প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে সাবধান বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন, যে ব্যক্তি কাউকে তার নাম পরিবর্তন করে ডাকবে আল্লাহর ফিরিশতারা তার উপর লা’নত করেন। -(কাসসুল উম্মাল, ১৬ খণ্ড, পৃঃ ৪১৮)

.

আকীকা

 নবজাতকের নাম রাখার পর কর্তব্য হল ছেলে হলে দু’টি আর মেয়ে হলে একটি কোরবানীতে যবেহূযোগ্য পশু দ্বারা আকীকা করা। আকীকা করলে সন্তানের উপর থেকে বালা মুসীবত দূর হয়ে যায়, একটি সুন্নাতের উপর আমল করা হয়। এ ছাড়াও আরো বহুবিধ উপকরিতা রয়েছে।

.

ইসলাম পূর্ব যুগে আকীকা

আকীকা প্রচলন ইসলাম পুর্ব যুগেও ছিল। যদিও তার ধরন-প্রক্বতি ছিল ভিন্ন, এখনও ইয়াহুদীদের মধ্যে আকীকার প্রচলন রয়েছে। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে বলা হয়েছেঃ

عن عائشة رضي الله عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم إن اليهود تنم عن العلام ولا تعثر الجارية فقوا عن المحكم شاتين و عن الجرية شاة

অর্থ : হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, ইয়াহুদীরা ছেলে সন্তানের জন্য আকীকা করে, মেয়ে সন্তানের জন্য করে না, তোমরা ছেলে সন্তানের জন্য দু’টি ছাগল আর মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল আকীকা করবে।-(বায়হাকী)

الأحدنا

عن أبي بريدة رض

غلام ذبح شاة

অর্থ : হযরত আবু বুরায়দা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আইয়ামে জাহিলিয়াতে আমাদের কারো ছেলে সন্তান হলে আমরা একটি ছাগ যবেহ করতাম।–(আবূ দাউদ শরীফ)

.

আকীকার গুরুত্ব

ইমামদের মতে আকীকা একটি মুস্তাহাব আমল। তাই নবজাতসন্তানের পিতার পক্ষে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়পূর্বক ক্বতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ আকীকা করা মুস্তাহাব।

.

আকীকার সময়

সম্ভব হলে নবজাতকের জন্মের সপ্তম দিনে আকীকা করা উত্তম। কেননা, নবী করীম (ছঃ)-ও স্বয়ং সাত দিনের দিন আকীকা করতেন। যদি সাত দিনের দিন সম্ভব না হয়, তবে চৌদ্দ দিনের দিন আকীকা করবে। যদি তাও সম্ভব না হয় তবে একবিংশতম দিনে, তাও সম্ভব হলে যে দিন সম্ভব হয় করবে। অবশ্য এক্ষেত্রে জন্মের সপ্তম দিনের প্রতি লক্ষ্য রাখা উত্তম।

আকীকার সময়কাল সম্পর্কে হাদীসে রাসূলে বর্ণিত হয়েছে।

عن أم وأبی کرير قال ذرت امرأة من أبي عبد الرحمن بن أبي بكر ان ولدث إمراة عبد الحمن نحزنا جوزا فقالت عائشة بل الممتنة

ذالك يوم

الجارية شاة ولك

السابع فإن لم يگن قوى أربعة عشرة فإن لم يكن في احدى وعشرين

অর্থ : হযরত কুরয (রাঃ)-র পিতামাতা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আবদুর রহমান ইবন আবূ বকর (রাঃ)-এর বংশের এক মহিলা মানত করল যে, যদি আবদুর রহমান-এর স্ত্রীর কোন সন্তান হয়, তবে আমরা একটি উট যবেহ করব। হযরত আয়েশা (রাঃ) (এ কথা শুনে) বললেন, এতো হতে পারে না। বরং সুন্নাত হল ছেলে সন্তানের জন্ম হলে দু’টি কম বয়স্ক ছাগল আর মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল আকীকা করবে। অবশ্য এই আকীকা জন্মের সপ্তম দিন হলে উত্তম। যদি সপ্তম দিনে সম্বব না হয়, তবে চতুর্দশতম দিনে, তাও সম্ভব না হলে একবিংশতম দিনে আকীকা করবে।–(মুস্তাদরাকে হাকীম, ৪র্থ খণ্ড)

আরো বর্ণিত হয়েছে :

عن سمرة بن جندب رضى الله عنه قال قال رسول الل صلى الله

عليه وتم الغلام مرتهن بعقيقته ذبح عنه يوم السابع

অর্থ : হযরত সামুয়া ইবন জুনদুব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, নবজাতক নিজ আকীকার সাথে বন্ধক থাকে, তার জন্মের সপ্তম দিন তার নামে একটি আকীকার পশু যবেহ করবে।–(তিরমিযী শরীফ)।

অত্র হাদীস শরীফের বরাতে তিরমিযী শরীফের টিকার ভাষ্যে উল্লেখ আছে যে, সকল ইমামরা এ ব্যাপারে একমত যে, নবজাতকের জন্মের সাত দিনের দিন তার নামে আকীকার পশু যবেহ করা সুন্নাত, যদি সপ্তম দিনে যবেহ করা সম্ভব না হয়, তবে চতুর্দশতম দিনে যবেহ করা, তাও সম্ভব না হলে নবজাতকের জন্মের একবিংশতম দিনে তার নামে আকীকার পশু যবেহ করবে।

.

আকীকার সংখ্যা

নবজাতক সন্তান যদি ছেলে হয়, তবে দু’টি ছাগল, ভেড়া অথবা গরু মহিষের দু অংশ আকীকা করবে। আর সন্তান যদি মেয়ে হয়, তবে একটি ছাগল, ভেড়া অথবা গরু-মহিষের এক অংশ আকীকা করবে। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে :

عن عائشة رضي الله عنها قالت أن رسول الله صلى الله عليه

وتم إمرهم عن الم

شاتاين مكافاني و عن الجارية اة

অর্থ : হয়েরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) তাদেরকে নবজাতক ছেলে সন্তানের জন্য দুটি সমবয়সী ছাগল আর মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল আকীকা করার জন্য নির্দেশ করেছেন।–(তিরমিযী, আবূ দাউদ)

আরো বলা হয়েছে।

عن أم گريرة رضي الله عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه

وسلم عن الغلام شاتان وعين الجارية شاة

অর্থ : হযরত উম্মে কুরম্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, নবজাতক সন্তান ছেলে হলে দু’টি ছাগল আর মেয়ে হলে একটি ছাগল আকীকা করবে।-(ঐ)

.

আকীকার পশু ও তার বয়স

আকীকা অনেকটা কোরবানীর ন্যায়। কোরবানীতে যে সব পশু যবেহকরা যায় এবং কোরবানীর পশুর প্রকার ভেদ বয়সের যে তারতম্য লক্ষণীয় আকীকার পশুর ক্ষেত্রে হুবহু তাই লক্ষণীয়। এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, কোরবানীর জন্য যে ছাগল উপযুক্ত তাই আকীকার জন্যও উপযুক্ত।-(শামী, ৫ম খণ্ড)

বয়স : ছাগল, ভেড়া এক বছর বয়সী; গরু, মহিষ দু বছর বয়সী এবং উট পূর্ণ পাঁচ বছর বয়সী। অবশ্য এক বছরের কম বয়সী ভেড়াকে যদি এক বছর বয়সী ভেড়ার মত দেখা যায় তবে সে ভেড়া আকীকা জায়েয হবে। কিন্তু অন্য কেনা পশুর ক্ষেত্রে গঠন যত পরিপুষ্টই হোক কেন নির্দিষ্ট বয়সের চেয়ে একদন কম হলেও আকীকা জায়েয হবে না।

.

আকীকার গোশত

কোরবানীর ন্যায় আকীকার পশুর গোতও তিন ভাগ করে ১/৩ অংশ নিজের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ গরীব-মিসকীনদের জন্য সাকা করে দিয়ে বাকী ১/৩ অংশ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বন্টন করে দেয়া সুন্নাত। অবশ্য ঘরের মানুষ বেশি হলে চাইলে সব গোত ঘরে রেখেও দেয়া যায়। আবার সব বিলিয়েও দেয়া যায়। আকীকার গোত স্বচ্চল আত্মীয়-স্বজনকেও দেয়া যায়। -(শামী ৫ম খণ্ড)

হাদীস শরীফে বলা হয়েছে ও হযরত কুরম্ (রাঃ)-এর পিতামাতা থেকে বর্ণিত, তাঁরা বলেন, হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, সুন্নাত ও উত্তম হল নবজাতক সন্তান যদি ছেলে হয়, তবে দু’টি সমবয়সী ছাগল আর মেয়ে হলে একটি ছাগল যবেহ করে আকীকা করবে। আকীকার গোত নিজেরাও খাবে এবং সাদকাও করবে।–(মুসতাদরাকে হাকীম, ৪র্থ খণ্ড)

.

আকীকার উপকারিতা

 ১. আকীকার মাধ্যমে দানশীলতার বিকাশ ঘটে। গরীব মিসকীন ও আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় হয়। পরস্পরে হৃদ্যতা ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। আপসে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়।

২. ইসলাম পূর্ববর্তী যুগে নাসারাদের কোন সন্তান জন্ম হলে তাকে কয়লা রঙের পানি দিয়ে রাঙিয়ে দেয়া হতো। তারা বলত যে, এ দ্বারা শিশু নাসারা হয়ে যায়, তাদের এ কুপ্রথার বিরুদ্ধে আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন :

ثقة الله ومن أحسن من الوجبة

অর্থ : আমরা গ্রহণ করলাম আল্লাহর রঙ (দীন), আল্লাহ্ রঙের চেয়ে কে অধিকতর সুন্দর? –(সূরা বাকারা : ১৩৮)

 অতএব নাসারাদের এ প্রথার বিপরীতে ইসলামে উত্তম প্রথা থাকা যুক্তিসঙ্গত।

.

অন্যের পক্ষ থেকে আকীকা

কোন মাবাবার নিজ সন্তানের জন্য আকীকা করার সামর্থ্য না থাকলে অন্য কেউ তাদের পক্ষ থেকে আকীকা করে দিতে পারে। আর তা একটি বড় ইহসান এবং একটি সকাজের সহায়তা দানও বটে। যার ফলে আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে অনেক ছাওয়ারে আশা করা যায়। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে :

من علي بن أبي طالب رضي الله عنه قال ق رسول الله صلى الله

عليه و لم عن الحسن بشاة–

অর্থ : হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) একটি ছাগল দ্বারা হাসান এর জন্য আকীকা করেছিলেন।-(তিরমিযী, আবূ দাউদ)

.

উত্তম আকীকা

 যদিও কোরবানীর উপযুক্ত সমস্ত প্রাণী দিয়েই আকীকা করা যায় তবু বী দিয়ে আকীকা করাই উত্তম। এ ব্যাপারে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে :

نذرت امرأة موال عبد الرحمن بن أبي بكر إن ولدت إمراة عبير الرحمن نحنا جرورا فقالت عائشة لا بل الشئة أفضل عن الغلام شانان ما فتان و عن الجارية شاة

অর্থ : আবদুর রহমান ইবন আবূ বকর (রাঃ)-এর পরিবারের এক মহিলা মানত করলে যে, আবদুর রহমান-এর স্ত্রীর ঘরে কোন শিশুর জন্ম হলে আমরা উট যবেহ করে আকীকা করব। হযরত আয়েশা (রা.) বললেন, এ হতে পারে না। বরং সুন্নাত এবং উত্তম হল নবজাতক যদি ছেলে হয়, তবে দুটি সমবয়সী ছাগল আর যদি মেয়ে হয়, তবে একটি ছাগল যবেহ করবে। -(মুসতাদরাকে হাকীম)

নবজাতকের পক্ষ থেকে আকীকা না করলে, নবজাতক বিভিন্ন প্রকার রোগবালাই ও বালা মুসীবতে লিপ্ত থাকে, যার একমাত্র প্রতীকার হল আকীকা করা, এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে : হযরত সামুরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, নবজাতক স্বীয় আকীকার সঙ্গে বাঁধা থাকে।–(তিরমিযী, ১ম খণ্ড)

.

আকীকার কুসংস্কার

বর্তমানে আকীকায় অনেক কুসংস্কার প্রবেশ করেছে। আকীকার দিন ছেলে হলে দু’টি ছাগল আর মেয়ে হলে একটি চাগল যবেহ করা, যবেহক্বত পশুর গোশত কাঁচা অথবা রান্না করে বিতরণ করা, শিশুর মাথা মুণ্ডন করে চুলের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণ, রৌপ্য বা তৎসমমূল্য দান করা প্রভৃতি কাজকর্ম সুন্নাত ও মুস্তাহাব। এর ব্যতিক্রম প্রথাসমূহ ইসলামী শরীয়াতে মুল্যহীন।

আকীকা উপলক্ষে প্রচলিত কুসংস্কারসমূহের তালিকা নিম্নে উল্লেখ করা হল :

১. আকীকার গোশত দাদা-দাদী ও নানা-নানী খেতে পারে না। বলে অনেকে মনে করে। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

২. আরো একটি কুসস্কার হল, সন্তানের মাথার চুল মুণ্ডানোর জন্য যখন মাথার উপরে ক্ষুর টানা হবে, ঠিক তখন আকীকার জন্তু যবেহ্ করতে হবে। এ ধারণাও টিক নয়।

৩. আকীকা উপলক্ষে নবজাত শিশুর নানার বাড়ির পক্ষ হতে কিছু পোশাক, খাবাব ও সহায়ক সামগ্রী প্রেরণের একটি কুসংস্কার চালু আছে। এ ক্ষেত্রে প্রধান খারাপ দিকটি হল ঐ সময়ে নানার পরিবারের সঙ্গতি না থাকলেও প্রথা অনুযায়ী উপহার সামগ্রী অবশ্যই পাঠাতে হবে। অর্থাৎ একটি অপ্রয়োজনীয় কাজ এমন গুরুত্বের সাথে করা হয় যে, এ ক্ষেত্রে শরীয়াতের কোন বিধান লংঘন হয়েছে কি না তাও লক্ষ্য করা হয় না। তাছাড়া এ দেয়া-নেয়ার ক্ষেত্রে নিয়্যত থাকে সুনাম ও সুখ্যাতি এবং অহংকার প্রদর্শন যা পরিষ্কার হারাম কাজ।

৪. আকীকা উপলক্ষে আরেকটি কুসংস্কার। যে সন্তানের আকীকা করা হয় তার মাথার চুল কামানোর পর মহল্লাবাসী পুরুষ ও বন্ধু-বান্ধব মিলে একটি বাটিতে চাঁদা সংগ্রহ করে। এ চাঁদা সংগ্রহ করা পরিবারের কর্তার একটি পবিত্র দায়িত্ব মনে করা হয় এবং নাপিতকে এ সংগৃহীত চাঁদা প্রদান করা হয়। এসব কুপ্রথা অবশ্যই বর্জন করা বাঞ্ছনীয়।

৫. আকীকার সময় বোন-ভাগ্নিকে উপহার প্রদান। আকীকার সময় আবশ্যকভাবে পুরস্কৃত করার প্রথাগুলোও শরীয়াত বহির্ভূত কাজ। সুতরাং তা বর্জন করা বাঞ্ছনীয়।

আকীকার রান্না করা গোশত আহার করার সময় গোশতের সংগে যে হাড় থাকে তা দাঁতে চিবিয়ে ভেঙ্গে বা অন্য কোন উপায়ে ভগ্ন করা বিধি বহির্ভুত মনে করা হয়। তাই অনেকেই তা আস্ত রেখে দেয়, তাও কুসংস্কারের অন্তর্ভুক্ত।-(তিরমিযী, আবুদাউদ)

.

আকীকার দোয়া

আকীকার পশু যবেহ করার সময় এ দোয়া পড়বেঃ

إتي وجهت وجهى بتي فطر السموات والأرض حنيفا وما أنا من المشركين إن صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العلمين

شريك له وبذالك أمرت وانا بين المسلمين اللهم هذه وي ابن ممكن دمها بتهم تمها بليم وعظمها بعظمه وجدها بجثوم وشقها بشعره اللهم اجعلها فداء لابي وأي من التار الله يرث ولك بسم الله الله اكبر

উচ্চারণ : ইন্নী অজ্বজ্বাহতু অজ্বয়া লিল্লাযী ফাত্বোয়ারস্ সামাওয়াতি অল্ আরদ্বোয়া হানিফাওঁ ওমা–আনা মিনাল্ মুশরিকীনা ইন্না ছলা-তি অ নুসুকী অ মাহ্ইয়া-ইয়া অমামা-তী লিল্লা-হি রব্বিল আলামীনা লা-শারীকালাহু আবিযা-লিকা উমিরতু অ আনা মিনাল মুসলিমীন্। আল্লাহ-হুম্মা হা-যিহী আক্বীক্বাতুবনি ফুলা-নিন্ দামুহা-বিদামিহী লাহমুহা–বিলাহমিহী অ আযমুহা–অ আযমিহী অজ্বালদুহা–বিজ্বালদিহী অ শু’রুহা–বিশু’রিহী। আল্লাহ-হুম্মাজ অলাকা বিস্‌মিল্লা-হি আল্লা-হু আকবার।

.

শিশুর মাথা মুণ্ডানো

শিশুর জন্মের সপ্তম দিন আকীকার পশু যবেহ করার পূর্বে তার মাথা মুণ্ডন করা মুস্তাহাব। তারপর কর্তিত চুলের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণ বা রৌপ্য অথবা তার মূল্য সাদকা করাও মুস্তাহাব। এই মাথা মুণ্ডন কাজ আকীকার পূর্বেই সমাধা করতে হয়। হাদীস শরীফে নবজাতকের মাথার চুলকে তার জন্য কষ্টদায়ক বস্তুরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর তা ফেলে দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে :

عن سلمان بن عامر رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله

عليه وسلم من التحكم عقيق فأهريقوا عنه بما وأميطوا عنه الأذى

অর্থ : হযরত সালমান ইব্‌ন আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, প্রত্যেক নজকাতকের পক্ষ থেকে এক একটি আকীকা জরুরী, তোমরা তাদের পক্ষ থেকে পশু যবেহ করবে। আর তাদের থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করবে। -(তিরমিযী, আবূ দাউদ)

হযরত হাসান (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, অত্র হাদীসে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করার অর্থ হল মাথার, চুল মুণ্ডানো।-(আবূ দাউদ)

অন্য হাদীসে বলা হয়েছে :

عن علي بن أبي طالب قال عق رسول الله صلى الله عليه وسلم عن

الحسن بشاۃ وقال يا فاطمة إحيقى رأسه

অর্থ : হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (ছঃ) হাসান-এর পক্ষ থেকে একটি ছাগল দিয়ে আকীকা করেছেন, আর বলেছেন, হে ফাতিমা, হাসান-এর মাথা মুড়িয়ে দাও।–(কানযুল উম্মাল)।

আইয়্যামে জাহিলিয়্যাতের সময় আকীকার পশুর রক্ত দিয়ে নবজাত শিশুর মুণ্ডিত মাথা রাঙিয়ে দেয়া হত। ইসলামের আবির্ভাবের পর রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এ গর্হিত কর্ম নিষিদ্ধ করে দেন। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে :

عن عبد المرنی رضی الله عنه قال ان النبی صلی الله عليه

وسلم قال يعق عن الغلام ولا مش رأه بدم

অর্থ : হযরত আবদ মুযানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, নবজাতকের পক্ষ থেকে আকীকা করবে, কিন্তু নবজাতকের মস্তক আকীকার পশুর রক্ত দ্বারা রাঙাবে না।–(এ’লাউস্ সুনানা)

.

শিশুর মুণ্ডিত মাথায় সুগন্ধি লাগানো

অবশ্য রক্ত দিয়ে রঞ্জিত না করে মুণ্ডিত মস্তকে জাফরান প্রভৃতি সুগন্ধি মাখা সুন্নাত। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে।

عن أبي بريدة رضى الله عنها في الجاهلية إذا ولد لأحدنا غلام ذبح شاة ولع رأسه بدمها فلما جاء الله بالإسلام كان با

حلق رأسه ونلطخه بزعفران

অর্থ : হযরত আবু বরাইদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আইয়্যামে জাহিলিয়্যাতের যুগে আমাদের কারো শিশু সন্তান জন্ম হলে তার জন্য একটি ছাগল যবেহ করা হত, আর তার রক্ত দ্বারা নবজাতকের মস্তক রঞ্জিত করে দেয়া হত। পরে আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে দীনে ইসলাম দ্বারা ধন্য করলে আমরা নবজাতকের আকীকার জন্য একটি ছাগল যবেহ করতাম, তার মস্তক মুড়িয়ে দিতাম এবং মুণ্ডিত মস্তক জাফরান দিয়ে মাখিয়ে দিতাম।-(আবূ দাউদ)

আরো বলা হয়েছে :

عن عائشة رضي الله عنها قالت كانوا في الجاهلية إذا قرن الشبي خضب قطنه يتم العقيقة فاذا خلقوا رأس الشبه وضعوها

على رأسه فقل الله صلى الله عليه وسلم إجعلوها مكان الثم

وفا

অর্থ : হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাহিলিয়াতের যুগে কোন নবজাত শিশুর আকীকা হলে কিছু তুলা আকীকার পশুর রক্ত দিয়ে রঞ্জিত করে দেয়া হত আর নবজাত শিশুর মাথা মুড়ানো হলে আকীকার পশুর রক্ত তার মস্তকে ঢেলে দেয়া হত। (ইসলামের আবির্ভাবের পর) রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বললেন, নবজাত শিশুর মুণ্ডিত মস্তকে তোমরা আকীকার প্রাণীর রক্তের পরিবর্তে খালুফ মাখবে।–(ইবন হিব্বান)।

খাল্‌ফ একটি মিশ্রিত সুগন্ধি যা জাফরান প্রভৃতি দিয়ে প্রস্তুত করা হয়।

.

শিশুর মাথা মুণ্ডানোর হিকমত

আল্লামা ইবন কাইয়্যিম (রঃ) স্বীয় কিতাব তুহফাতুল মাউলুদ’-এ উল্লেখ করেছেন যে, মাথা মুড়ানোর হিকমত হল এ দ্বারা শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়, চুলের গ্রন্থি খুলে যায় যদ্বারা চুলের উৎসস্থলে ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অনুরূপ দৃষ্টিশক্তি, ঘ্রাণশক্তি এবং শ্রবণশক্তিও বৃদ্ধি পায়।

.

শিশুর মাথা মুণ্ডানোর পর সাদকা

 সদ্যজাত শিশুর মাথামুণ্ডানোর পর তার চুলের সমপরিমাণ রৌপ্য বা তমূল্য সাদকা করা মুস্তাহাব। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে :

عن علي بن أبي طالب رضي الله عنه قال ق رسول اللوتی الله علي وسلم عن الحسن بشاة قال يا فاطمة إحيقى رأسه إصدقى بوزنة شعره فتنة فوزنته فكان وژنه درهما أو بعض دژهم

অর্থ : হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলে, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) হাসান-এর পক্ষ থেকে ছাগল দিয়ে আকীকা করেছিলেন আর বলেছিলেন, হে ফাতিমা! হাসান-এর মাথা মুড়িয়ে দাও আর তার চুলের সমপরিমাণ ওযনে রৌপ্য সাদকা করে দাও। (হাদীসে রাবী) হযরত আলী (রাঃ) বলেন, তাপর আমি হাসান-এর কর্তিত চুল ওযন করে দেখলাম যে, সেগুলোর ওযন ছিল এক দেরহাম বা তার অংশ বিশেষের ওযনের সমান।-(তিরমিযী)

.

শিশুর প্রথম কালাম

 শিশু যখন কথা বলতে শিখে তখন তাকে সর্বপ্রথম কালেমায়ে তাইয়্যিবা শিক্ষা দেবে। যার প্রভাব তার সমগ্র জীবনে প্রতিফলিত হওয়ার আশা করা যায়। তাছাড়া জীবনের শুরুতেই শিশুকে স্বীয় স্রষ্টার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং সেই স্রষ্টার যে শুরুতেই কোন অংশীদার নেই, তিনি একক ও অদ্বিতীয়, এ পরিচয় দিয়ে দেয়া প্রত্যেক অভিভাবকের নৈতিক দায়িত্ব।

এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে :

عن ابن عباس رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله

بيانگم أول كلمة بلا إله إلا الله،

على

عليه وسلم التجوا

অর্থ : হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, তোমরা নিজ নিজ শিশুকে সর্বপ্রথম কথা শিখাবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু।

.

শিশুর খাৎনা

মুসলিম শিশুর জন্য মাবাবার প্রতি আরো একটি কর্তব্য হল উপযুক্ত বয়সের খাৎনা করা। পুরুষাঙ্গের সম্মুখ ভাগের উপরিঅংশের অতিরিক্ত চামড়া কেটে ফেলাকে খানা বলে। খাত্তা করা সুন্নাত। এটি ইসলামের একটি বৈশিষ্ট্য জ্ঞাপক আমলও বটে। খাত্রা সুন্নাতে ইবরাহিমী এবং ফিত্নাত-এরও অন্তর্ভূক্ত। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন :

الفطرة خمش الختان—

অর্থ : ফিৎরাত তথা স্বভাবজাত কাজ পাঁচটি। তন্মধ্যে একটি হল খাৎনা করা। -(বুখারী শরীফ)

রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) আরো বলেন।

عشر من سنن المرسلين الختان والعطر والسواك والكام الخ

চারটি আমল নবী-রাসূলদের সুন্নত, ১. খাৎনা করা, ২. আতর ব্যবহার, ৩. মিস্ওয়াক করা, ৪. বিবাহ করা।–(তিরমিযী শরীফ)

সুন্নাতে খাৎনা প্রাচীনকাল থেকেই একটি অত্যাবশ্যকীয় ধর্মীয় বিধানরূপে প্রচলিত। খানার মধ্যে বহু উপকারিতা নিহিত রয়েছে। খানা না করা হলে বিভিন্ন ধরনের রোগ হতে পারে। ত্বকের মধ্যে জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার না করলে তা বিষাক্ত হয়ে অনেক সময় ফুটো হয়ে যায়। উপরে ফুটো হলে তাকে বলা হয় ফাঁইমাসিস’ (Phimasis)। আর নিচে ফুটো হলে তাকে বলা হয় প্যারাফাইমাসিস (Phimasis)। এ রোগ হলে উপরের বাড়তি চামড়া কেটে না ফেললে চামড়ায় পঁচন ধরতে পারে। স্ত্রী সহবাসে অসুবিধা হয়। এর ময়লার সঙ্গে জমে থাকা বিভিন্ন রোগ জীবাণু স্ত্রী জরায়ুতে প্রবেশ করে নানা রকম রোগ দেখা দিতে পারে। লিঙ্গের মাথায় মাংস জমে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে বিধায় এ অস্থায় ক্যান্সারের মত মারাত্মক ব্যাধিও হতে পারে। খানা না করালে চামড়ার ভাজে প্রশ্রাব ও বীর্য প্রভৃতি আটকে থেকে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে বিরাট বাধার সৃষ্টি করতে পারে।–(এহইয়ায়ে উলুমুদ্দীন)

চিকিৎসকদের মতে খাবিহীন পুরুষাঙ্গের ক্যান্সার বেশি হয় এবং এ শ্রেণীর স্বামীদের স্ত্রীদেরও মধ্যে ক্যান্সার তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়। খানায় ফোরস্কীন বা বাড়তি চামড়াটুকু পুরুষাঙ্গের মাথা থেকে কেটে ফেলা হয়।

ইসলামে খাৎনা বিধান বিজ্ঞানসম্মত এবং জীবনভিত্তিক। তাছাড়া খানাক্বত পুরুষ তার যৌনাঙ্গের আভ্যন্তরীণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে পারেন অথি সহজেই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।

.

কখন খাৎনা করাবেন

 বেশির ভাগ মুসলিম মনীষীর মতে, শৈশবে খাত্যা করা সুন্নাত। কেননা, কিছুকাল পরেই তাকে শরীয়াতের বিধি-নিষেধ পালন করতে হবে। আর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সে যেন খানাক্বত অবস্থায় থাকে। অবশ্য যদি কোন অনিবার্য কারণে বয়োপ্রাপ্তির পরে খান্না করানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তবে করিয়ে নিতে হবে।-(ইহইয়ায়ে উলুমুদ্দিন)।

খানা ইসলামের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাই খানাকে কোন অবস্থাতেই এড়িয়ে চলার অবকাশ নেই। অবশ্য বয়োপ্রাপ্তির পর খাৎনাকালে অন্য পুরুষের সামনে গুপ্তাঙ্গ অনাবৃত করার অনুমতি শুধুমাত্র প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতেই প্রদান করা হয়েছে। তাই খানাকারীর জন্যও প্রয়োজনের অতিরিক্ত সতর দেখা জায়েয হবে না। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন :

من ألم فليتبين وإن كان كبيرا

কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে সে যেন অবশ্যই খাত্ৰা করিয়ে নেয়, যদিও সে বয়োপ্রাপ্ত হয়ে থাকে।–(তাঃ আঃ ফিল ইসলাম)

.

খাৎনার কুসংস্কার

খাৎনা শরীয়াত ও স্বাস্থ্যসম্মত বিধান। খানার সাথে লজ্জা এবং সংকোচের বিষয়টিও জড়িত বিধায় তাই কম বয়সে খানা করা ভাল। খাৎনা অনুষ্ঠানে সকল প্রকার আড়ম্বর ও লৌকিকতা বর্জন করাই উত্তম। মুসনাদে আহমাদে হযরত হাসান (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, কোন ব্যক্তি হযরত উসমান ইবন আবিল আস (রাঃ)-কে খাৎনার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালে তিনি সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, আমরা রাসূলুল রাহ (সা.)-এর জীবনকালেও এ ধরনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতাম।–(মুসনদে আহমাদ)

.

মাতৃদুগ্ধ পান করানো সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

ইসলাম শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ বিষয়ে পবিত্র কোরানে এরশাদ হয়েছে :

والوالدات يرضعن أولادهن حولين كاملين

অর্থ : মায়েরা তাঁদের সন্তানদের পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করাবে।–(সূরা বাকারা : ২৩৩) অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

و وصينا الإنسان والديه حملته امه وهنا على وهن وفضله في

تامین

অর্থ : আমি তো মানুষকে তার মাবাবার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করে। এরপর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’ বছরে।–(সূরা লুকমান : ১৪)

অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

وأوحينا إلى أم موسى أن أرضعيه

আমি মূসার মাতার অন্তরে ইঙ্গিতে নির্দেশ দিলাম। তাকে দুধ পান করাও।–(সূরা কাসাস : ৭)

আরো এরশাদ হয়েছে :

وحمله وفصله ثلثون شهرا

অর্থ : তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও দুধ ছাড়াতে লাগে ত্রিশ মাস।–(সূরা আহকাফ : ১৫)

উপরের আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায় যে, শিশুকে পূর্ণ দু’ বছর মায়ের দুধ পান করাতে পারবে। প্রয়োজনে আরও ছয়মাস সময় বাড়ানো যেতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও রয়েছে যে, শিশুকে কম-বেশি দু’ বছরই দুধ পান করানো উচিৎ। মা বা শিশুর শারীরিক অসুস্থতার বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞান শিশুকে বুকের দুধ পান থেকে বিরত রাখার কথা বলা হয়েছে।

নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, তোমাদের সন্তানদের পতিতাদের দুধ পানে শিশু হেপাটাইটিস বি ভাইরাস এমনকি এইডস ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।

মাতৃদুগ্ধ পান করানোর প্রতি উৎসাহ প্রদান করে নবী করমি (ছঃ) আরও বলেছেন:

إن الله وضع عن المسافر شطر الصلواة والصوم عن المسافر

وعن المرضع والحبلى

অর্থ : আল্লাহ মুসাফিরের উপর থেকে চার রাকাআত বিশিষ্ট নামাযের অর্ধেক রদ করে দিয়েছেন। আর মুসাফির, স্তন্যদানকারী ও গর্ভবতী মহিলা থেকে রমযানে রোযা রাখার বাধ্যবাধকতাও তুলে দিয়েছেন।-(আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ)

হযরত উমর ফারুক (রাঃ)-এর শাসনকালের প্রথম দিকে যেহেতু মাতৃদুগ্ধ পানরত শিশুরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আর্থিক অনুদান পেত না সেহেতু মায়ের শিশুদের জন্য অনুদান পাওয়ার আশায় তাড়াতাড়ি বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দিতেন। এ অবস্থা লক্ষ্য করে হযরত উমর (রাঃ) শিশুদেরকে বুকের দুধ দানে মায়েদের উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে জন্মের পর থেকেই এই আর্থিক অনুদান চালু করেন।

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে, বর্তমান যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞান শিশুকে মায়ের দুধ পান করানোর ব্যাপারে যে গুরুত্বের কথা বলছে সে গুরুত্বের কথা ইসলাম আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগেই ঘোষণা করেছে। আজকে বিশ্বব্যাপী মায়ের দুধ পানের ব্যাপারে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে এমনকি বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর পহেলা আগস্ট বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস পালিত হচ্ছে তা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন।

শিশুর জন্য মায়ের দুধ অপরিহার্য। মায়ের দুধ হচ্ছে শিশুর জন্য প্রযোজনীয় পুষ্টি উপাদানযুক্ত আল্লাহ্ প্রদত্ত এমন তৈরি খাবার যা শিশু সহজেই হযম করতে পারে এবং শিশুর শরীর সহজেই কাজে লাগিয়ে দেহের বৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিশুর শরীরে খাদ্য চাহিদার যে পরিবর্তন ঘটে মায়ের বুকের দুধের উপাদানের অনুরূপ পরিবর্তন প্রতিদিনই ঘটতে থাকে। তাই শিশুর জন্য মায়ের বিকল্প নেই। যে তাপমাত্রায় বাচ্চার দেহ সহজেই এ দুধকে গ্রহণ করে কাজে লাগাতে পারে মায়ের দুধে ঠিক সেই তাপমাত্রাই পাওয়া যায়। মাতৃদুগ্ধে বেশ কিছু রোগ প্রতিরোধক উপাদান থাকে। যেমন আই. জি. এ, , ল্যাকটোফেরিন এবং লাইসোজাইম। এছাড়াও মায়ের দুধে প্রচুর শ্বেত রক্তকণিকা থাকে। সেগুলো আবার ল্যাকটোফেরিন, লাইসোজাইম, ইন্টাফেরন তৈর করে। বাইফিজস ফ্যাকটর নামে আরও একটি পদার্থ মায়ের দুধে পাওয়া যায়। এগুলো সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করে। যার ফলে বাচ্চার দেহে ডায়রিয়া, কানপাকা রোগ, শ্বাসনালীর রোগ কম হয়। এছাড়াও মায়ের দুধ পানে হৃৎপিণ্ডের রোগ, করোনারী, হার্ট ডিজিজ, খাদ্যনালীর রোগ ইত্যাদি প্রতিরোধ করে। মায়ের দুধ পানে শিশুর চেহারায় লাবণ্য সৃষ্টি করে, বাকশক্তি ও সাধারণ বুদ্ধি বিকাশে সহায়ক হয়। যারা বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করান তাদের জরায়ু তাড়াতাড়ি গর্ভধারণের পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। ফলে তলপেটের থলথলে ভাব ক্রমান্বয়ে চলে যায়। দ্বিতীয়ত গর্ভধারণের সময় দেহে যে চর্বি জমা হয় তা বাচ্চাকে দুধ পান করালে নিঃশেষ হয়ে যায়। আর তা মায়ের দৈহিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। স্তন্যদানকারী মায়েদের প্রসব পরবর্তী সাব তুলনামূলক অনেক কম হয়। যে মায়েরা। বাচ্চাকে দুধ পান করান তাদের স্তন ক্যান্সারের হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়।

এছাড়াও মায়ের দুধ পানের মাধ্যমে মা ও শিশুর মাঝে এমন একটি মানসিক বন্ধন রচিত হয় যা চিরস্থায়ী।

.

বিকল্প দুধের অপকারিতা

কৃত্রিম দুধ তৈরি করা হয় পানি মিশ্রিত করে এবং পরিবেশন করতে হয় বিভিন্ন পাত্রে রেখে। এ ব্যাপারে ব্যবহৃত হয় বিশেষ ধরেন দুধের বোতল এবং রাবারের বোটা। কৃত্রিম দুধ বলতে আমরা সচরাচর কৌটার গুঁড়া দুধকেই বুঝে থাকি। অবশ্য গরুর দুধ এবং ছাগলের ধুধকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। কেননা, এগুলোর কোনটাতেই শিশুর দেহের সাথে সুসাম স্যপূর্ণ তাপমাত্রায় এবং উপাদানে পাওয়া যায় না। দিনে দিনে শিশুর শরীরের চাহিদার যে পরিবর্তন ঘটে কৃত্রিম দুধের মাধ্যমে তা পূরণ সম্ভব নয়। যেহেতু কৃত্রিম দুধে পানি মিশাতে হয় এবং বাচ্চার মুখে দুধ দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন পাত্রের সাহায্য নিতে হয় সেহেতু রোগজীবাণু দ্বারা সংক্রমণের যথেষ্ট সম্ভাবনা এতে থেকে যায়। ঠিক সে কারণে দেখা যায় যারা বোতলের দুধ খায়, সে সমস্ত বাচ্চার মধ্যে ডায়রিয়ার প্রকোপ খুব বেশি। গবেষণালব্ধ তত্যে দেখা যায় যে, জন্মের পর প্রথম চার থেকে ছয় মাস পর্যন্ত কৃত্রিম দুধ পানকারী শিশুদের ডায়রিয়ার প্রকোপ মায়ের দুধপানকারী শিশুদের তুলনায় ত্রিশগুণ বেশি। মায়ের দুধ ছাড়া অন্য কোন দুধ পান করলে এতে শিশুর এলার্জি সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে তাদের মধ্যে একজিমা, এজমা এবং খাদ্যনালীর ব্যথা দেখা দেয়। বর্তমানে শিশুদের ডায়বেটিস-এ অন্যতম কারণ হিসেবে গরুর দুধের আমিষকে চিহ্নিত করা হয়। কৃত্রিম দুধে শিশুর দেহে অতিরিক্ত মেদ জমে যায় এবং এ থেকে হৃদরোগও সৃষ্টি হতে পারে।

.

শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খাদ্য ও পানীয় নির্বাচন

শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জন্মের পর সাধারণত প্রথম চার থেকে ছয় মাস পর্যন্ত শিশুরা মায়ের দুধ পান করবে। ছয় মাস থেকে মাতৃ দুগ্ধের পাশাপাশি পাকা কলা, সিদ্ধ আলু ও ডিম, সুজি, পায়েস ইত্যাদি খেতে থাকবে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে খিচুড়ি, ভাত, রুটি ও অন্যান্য খাদ্য খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। দু’ থেকে আড়াই বছরের সময় দুধ ছেড়ে দেবে। তখন অন্যান্যদের মতই সব ধরনের খাবার গ্রহণ করবে। প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় অবশ্যই যেন শাক-সবজি থাকে সেদিকে সজাগদৃষ্টি রাখতে হবে। টাটকা শাক-সবৃজির উপর গুরুত্ব দিতে হবে এবং লবণের ব্যবহার সীমিত রাখতে হবে। যেটুকু লবণ ব্যবহার করতে হবে তা যেন আয়োডিনযুক্ত হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করাতে হবে। আর এর মধ্যে দিয়েই খাদ্যের যে ছয়টি মৌলিক উপাদান অর্থাৎ আমিষ, শ্বেতসার বা শর্করা, স্নেহজাতীয় খাদ্য, ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ, খণিজ পদার্থ এবং পানি প্রয়োজন মত গৃহীত হবে। এতে দেহের গঠন এবং ক্ষয়পুরণই শুধু নিশ্চিত হবে না বরং রোগ ব্যধির প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে যাবে। এ ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

فلينظر الإنسان إلى طعامه أنا صببنا الماء مما م شققنا

او عنبا و قضبا وزيتونا ونخلا وحدائق

الأرض شقا فأثبتنا فيها غلبا و فاكهة وابا متاعا لكم ولاذ  

অর্থ : মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। আমি প্রচুর বারিবর্ষণ করি। এরপর আমি ভূমি প্রক্বষ্টরূপে বিদীর্ণ করি এবং এতে আমি উৎপন্ন করি শস্য, আঙ্গুর, শাক-সবৃজি, জলপাই, খেজুর, বহুবৃক্ষ-বিশিষ্ট উদ্যান, ফল এবং গবাদির খাদ্য। এটা তোমাদের এবং তোমাদের গবাদিপশুর ভোগের জন্য।–(সূরা আবাসা : ২৪-৩২)

আর এক আয়াতে বলা হয়েছে :

شأنا لكم به جنت من تخيل و اعناب لكم فيها فوايه كثيرة

ويثها تأكلون

অর্থ : তারপর আমি তা দিয়ে তোমাদের জন্য খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান সৃষ্টি করি। তোমাদের জন্য এতে প্রচুর ফল আছে এবং তোমরা তা থেকে আহার করে থাক। –(সূরা মু’মিনূন, ২৩ : ১৯)

অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

وهو الذي أنشأ جثت معروشت وير موشت والخل و الزرع مختاقا اكله و الزيتون والرمان متشابها و غير متشابه كوامن ثمره إذا أثمر

তিনিই লতা ও বৃক্ষ-উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করেছেন। খেজুর গাছ, বিভিন্ন স্বাদ বিশিষ্ট খাদ্যশস্য, যায়তুন এবং আনারও সৃষ্টি করেছেন, এগুলো একে অন্যের সদৃশ ও বিসদৃশও। যখন তা ফলবান হয় তখন এর ফল আহার করবে।–(সূরা আনআম : ১৪১)

এছাড়াও সূরা বাকারা : ২২, সূরা আনআম : ৯৯, সূরা নাহল : ১১, সূরা লুকমান : ১০ এবং সূরা কাফ ৯ নং আয়াতে উদ্ভিজ খাদ্যের গুরুত্বের কথা উল্লেখ রয়েছে।

হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, আমি একবার নবী (ছঃ)-কে দেখলাম, তাঁর সামনে রান্না করা তরকারী রাখা হল। এতে ঝোলের মধ্যে কদু ও শুকনা গোশত ছিল। আমি দেখলাম তিনি খুঁজে খুঁজে কদু তুলে নিচ্ছেন ও খাচ্ছেন।-(মেশকাত)

আহার কখন গ্রহণ করা হবে এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, আমরা এমন এক জাতি যে, আমরা ক্ষুধা না লাগা পর্যন্ত খাই না এবং যখন খাই তখন উদর ভর্তি করে খাই না। -(ইঃ শিশু পরিচর্যা)

.

গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিনী মাতার খাদ্য ও স্বাস্থ্য
সম্পর্কে ইসলামের দিক-নির্দেশনা

গর্ভবতী ও যে মা শিশুকে দুধ পান করান তার খাদ্য ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে ইসলামে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। হাদীসে বর্ণিত আছে, আল্লাহ্ তা’আলা গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিনী মায়ের জন্য রমযান মাসের রোযা রাখার বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দিয়েছেন।-(মেশকাত)।

হাদীসের এ বাণী থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, গর্ভবর্তী ও দুগ্ধন্যদানকারিনী মায়ের স্বাস্থ্যের প্রতি অধিক যত্নবান হওয়া উচিত। কারণ আল্লাহ্ পাক তাদের জন্য রোযার বিধান সহজ করে দিয়েছেন। কেননা, এ সময়ে মায়েদের বিশেষ পুষ্টির প্রয়োজন। গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের জন্য স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অধিক পরিমাণ আহার আবশ্যক। তাকে মাছ, গোশত, ডিম, দুধ ইত্যাদি খাওয়ানো যাবে না, এটি একটি কুসংস্কার। এসব কুসংস্কার বর্জন করা উচিত।

.

শিশুর নিরাপত্তা

শিশুদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট। শান্তি বা যুদ্ধ উভয় অবস্থায়ই শিশুর জীবনের নিরাপত্তা বিধানে ইসলাম বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

ولا تقتلوا أولادكم

অর্থ : আর তোমরা নিজেদের সন্তানদের হত্যা করো না।–(সূরা আনআম : ৫১)

অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে।

অর্থ : যারা নিজেদের সন্তানদের হত্যা করেছে, অবশ্যই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

قد خسر الذين قتلوا أولادهم

وليش الذين لوتركوا بين خلفهم درية فيفا خافوا عليهم

অর্থ : তারা যেন ভয় করে যে, অসহায় সন্তান পেছনে ছেড়ে গেলে তারাও তাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হত। (সূরা নিসা : ৯)

পবিত্র কোরআনের এ সমস্ত আয়াতে শিশুর জীবনের নিরাপত্তার সম্বন্ধে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। শিশুর নিরাপত্তা সম্বন্ধে নবী করীম (ছঃ)ও বিশেষ তাকীদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : কোন ব্যক্তির পাপী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার পোষ্যদের ক্ষতি সাধন করে। -(ইঃ শিশু পরিচর্যা)

.

শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি সাবধানতা

মজবুত ইমারত গড়তে হলে অবশ্যই মজবুত ভিত্তির প্রয়োজন। আর মানব জীবনের এ ভিত্তি হচ্ছে শৈশবকাল। শৈশবকালে দেহ ও মনকে যদি রোগ মুক্ত রাখা যায় তবে পরিণত . বয়সে সে একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করবে বলে আশা করা যায়। এ কারণেই সন্তান জন্মলাভের পর থেকেই শিশুর প্রতি যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে ইসলামে বিশেষ তাকীদ রয়েছে। শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে প্রথম সোপান হল শিশুকে মায়ের দুধ দান। হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা সর্বপ্রথম যে নেয়ামত সম্পর্কে বান্দাকে প্রশ্ন করবেন তা হল সুস্থতা। কিয়ামতে তাকে প্রশ্ন করা হবে, আমি তোমাকে শারীরিক সুস্থতা দেইনি?–(তিরমীযী শরীফ)।

এই সুস্থতার ব্যাপারে শিশুদের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অধিক যন্তবান হওয়া প্রয়োজন। আজকের একজন সুস্থ শিশু আগামী দিনের সুস্থ সবল একজন নাগরিক। একটি সুস্থ জাতি গঠনে শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত জরুরী।

.

রোগব্যাধি থেকে সাবধানতা অবলম্বনে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

রোগব্যাধি থেকে সাবধানতা অবলম্বনে ইসলাম বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। আজকের বিশ্বে এ কথা বলা হয় Prevention is better than cure”, রোগ-প্রতিরোধ রোগ নিরাময় থেকে শ্রেয়। শুধু তাই নয়, বর্তমানে এ কথাও বলা যায় যে, Prevention is Cheaper then cur”. রোগ প্রতিরোধ হচ্ছে নিরাময়ের চেয়ে সস্তা। এ কারণেই ইসলাম এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) পানির পাত্রের মধ্যে নিশ্বাস ফেলতে ও তার মধ্যে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন। এটাও এক ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কেননা, নাক ও মুখের ভেতর অনেক ধরনের রোগজীবাণু থাকতে পারে, যেগুলো পানিকে দূষিত করে থাকে। আর এতে দেশের মধ্যে রোগের সৃষ্টি হতে পারে।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন :

يخرج من بطونها شراب مختلف الوته فيه شفاء للناس

অর্থ : তার (মৌমাছির) উদর থেকে বের হয় বিভিন্ন বর্ণের পানীয় (মধু) যাতে মানুষের জন্যে রয়েছে আরোগ্য। (সূরা নাহল : ৬৯)।

কালো জিরা সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-কে বলতে শুনেছেন, কালো জিরার মধ্যে মৃত্যু ব্যতীত আর সমস্ত রোগের নিরাময় রয়েছে। বর্তমানে মধু ও কালো জিরা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গবেষণা হচ্ছে। রোগ প্রতিরোধ এবং রোগ নিরাময়ে এর যে অপরিমেয় শক্তি তা ক্রমশ আবিষ্কার হচ্ছে। ইসলামে পুত্র সন্তানদের খানা করানোর যে নিয়ম, এটা তাকে বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে মুক্ত রাখে। স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য দাঁত ও মুখ সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরী। দাঁত ও মুখ অপরিষ্কার থাকলে বিভিন্ন প্রকার রোগব্যাধি সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে নবী করীম (ছঃ) দাঁত ও মুখ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা ব্যাপারে বিশেষভাবে তাকীদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি যদি মানুষের জন্য এটা কষ্টকর হবে বলে মনে না করতাম তাহলে প্রত্যেক নামাযের ওযূর সাথে মিস্ওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।

ওযূর মধ্য দিয়ে দিনে পাঁচবার হাতের আঙ্গুল থেকে কনুই পর্যন্ত, পায়ের কবৃজি থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত পরিষ্কার করা সম্ভব হয়। নাক, মুখ, কান ও চোখ দিনে পাঁচবার পরিষ্কার করা সম্ভব হয়ে থকে। এর ফলে দেহের এসব অঙ্গে কোন ধূলিকণা বা রোগজীবাণু লেগে থাকতে পারে না। ইসলামে মদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে মানুষ হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের মত ভয়াবহ রোগ থেকে রক্ষা পেতে পারে। নিরাময় সম্পর্কে ইসলারে দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত সুস্পষ্ট। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছঃ) বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেননি যার নিরাময়ের ব্যবস্থা দেননি।-(বুখারী শরীফ)

জন্মের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শিশুকে নিয়মিতভাবে মারাত্মক কয়েকটি রোগের প্রতিরোধক টিকা অবশ্যই দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপরোক্ত হাদীস স্মরণ রাখতে হবে যে, রোগও আল্লাহর সৃষ্টি আর নিরাময়ের ব্যবস্থাও তাঁরই। যদি জ্বর হয় তাহলে স্বর কমানোর জন্য আধুনিক বিশ্বের চিকিৎসা হল ঠাণ্ডা পানি দিয়ে শরীর ধুয়ে ফেলা কিংবা ঠাণ্ডা পানি শরীরে দিয়ে মুছে ফেলা। নবী করীম (ছঃ) বলেন, জ্বর জাহান্নামের উত্তাপ থেকে সৃষ্ট, তাই পানি দিয়ে তা ঠাণ্ডা কর।

.

শিশুর জীবনরক্ষা ও পরিবর্ধনে মাবাবার দায়িত্ব

 শিশুদের নিরাপত্তা ও বিকাশ সাধনে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত পরিষ্কার। রাসূলে করীম (ছঃ) বলেন, যদি আল্লাহ্ তা’আলা কাউকে অধীনস্থদের উপর কর্তৃত্ব দান করেন আর সে তাদের মঙ্গল কামনা থেকে বিরত থাকে তাহলে জান্নাতের ঘ্রাণ তার নসীব হবে না।

নবী করীম (ছঃ) বলেন, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস হবে। পুরুষ তার পরিবার পরিজনের ব্যাপারে দায়িত্বশীল এবং এ সমপর্কে সে জিজ্ঞাসিত হবে। আর স্ত্রী স্বামীর ঘর-সংসার এবং সন্তানদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল এবং সে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে।

অতপর এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন, যে ব্যক্তি ছোটদের প্রতি স্নেহ করে না এবং বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না সে আমাদের দলভূক্ত নয়।

উপরোল্লিখিত হাদীসসমূহ থেকে শিশুর জীবন রক্ষা ও পরিবর্ধনে মাবাবার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। একটা শিশুকে পরিপূর্ণ মানবে রূপান্তর এবং একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাবাবার দায়িত্ব সর্বাধিক।–(বুখারী ও মুসলিম)

.

শিশুর সুন্দর জীবন গঠনে সচতেনতা

 শিশুর জীবন সুন্দর রূপে গড়ে তোলার ব্যাপারে সকলকেই সচেতন থাকতে হবে। কেননা, শিশুরা হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে পবিত্র আমানত। সুতরাং শৈশবেই শিশুকে আদব ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া প্রক্যেকের একান্ত কর্তব্য। যেন শিশু প্রশংসনীয় ও সুন্দর চরিত্রে সজ্জিত হয়ে গড়ে উঠতে পারে। নবী করীম (ছঃ) বলেছেনঃ তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে মহৎ করে গড়ে তোল এবং তাদেরকে উত্তম আদব কায়দা শিক্ষা দাও।–(ইঃ শিশু পরিচর্যা)

অপর এক হাদীসে আছে, নবী করীম (ছঃ) বলেন, সন্তাকে আদব তথা শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া এক সা’ পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী সাদকা করা থেকে উত্তম।-(বঃ জেঃ)।

একটি সুন্দর ব্যক্তি-জীবন কিভাবে গড়া যেতে পারে উল্লিখিত হাদীসমূহের মধ্যে তার দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়। শিশু জীবনের সুচনা থেকেই এমনভাবে অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে যাতে তার চারিত্রিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটে। পাশাপাশি কঠোর অধ্যবসায় এবং পরিশ্রমের মাধ্যমেই যে সাফল্য পাওয়া যায় সেটিও তাকে যথাযথভাবে শিখাতে হবে। শৈশবকাল হচ্ছে মানব জীবনের ভিত্তিভূমি এবং এ সময় তাকে যা শিখানো হবে সেটি তার কোমল হৃদয়ে স্থায়ীভাবে রেখাপাত করবে। শৈশবের এ শিক্ষাই পরবর্তীকালে সুন্দর জীবন গড়তে তার উপর প্রভাব বিস্তার করবে।

চোখ–

আল্লাহ্ পাকের এ সুন্দর সৃষ্টি সৌন্দর্যকে আমরা চোখের দৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করি। তাই চোখ হচ্ছে আল্লাহর দেয়া এক অপূর্ব নেয়ামত। তাই যেসব কারণ চোখের রোগ যা অন্ধত্ব ডেকে আনতে পারে সেগুলো থেকে দূরে থাকা আমাদের জন্য একান্ত অপরিহার্য। এর জন্য প্রয়োজন চোখ পরিষ্কার রাখা, চোখের ব্যায়াম এবং পরিমাণমত পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্য আহার করা। এ সম্বন্ধে ইসলামের দিক-নির্দেশনা রয়েছে। চোখের পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় ওযূ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। দিনে পাঁচবার ওযূ করতে গিয়ে আমরা কমপক্ষে পনের বার চোখ ধুয়ে পরিষ্কার করতে পারি।

মাথা–

মাথা তথা মাথার ত্বক এবং চুলের পরিচ্ছন্নতা রক্ষা অত্যন্ত জরুরী। মাথার ত্বকের অপরিচ্ছন্নতা থেকে রোগ ব্যধির জন্ম হতে পারে। বিশেষত চুলের গোড়ায় যে খুশকী হয় তা চুল পড়ে যাওয়া এবং টাক পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। খুশকীর কারণে চোখেও রোগ হতে পারে। সুতরাং মাথার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া উচিত। ওযূ করার সময় দিনে পাঁচবার মাথা মাসেহ্ করতে হয় যা মাথা পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।

রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন, যার মাথার চুল আছে সে যেন তার পরিচর্যা করে।–(আবূ দাউদ)

পোশাক-পরিচ্ছদের পরিচ্ছন্নতা–

সুস্থ শরীর ও সুস্থ মনের জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছে বস্ত্র পরিধান করা বাঞ্ছনীয়।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

অর্থ : তোমরা প্রত্যেক নামাযের সময় সুন্দর পোশাক পরবে। (সূরা আরাফঃ ৩১)

অন্য আয়তে এরশাদ হয়েছে ৪;;

অর্থ : (হে নবী) আপনার পরিধেয় বস্ত্র পবিত্র রাখুন।–(সূরা মুদ্দাসির : ৪)

পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা–

সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য চাই সুস্থ পরিবেশ। ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট ইত্যাদি আমাদের সেই পরিবেশেরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই বসত-বাড়ি, পথঘাট, খোলার মাঠ ইত্যাদি আবর্জনামুক্ত। রাখা একান্ত প্রয়োজন। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, আল্লাহ্ সুন্দর এবং সৌন্দর্যকে পসন্দ করেন।–(রিয়াদুস সালেহীন)

মহানবী (ছঃ) আরো বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র এবং তিনি পবিত্রতাকে পসন্দ করেন, তিনি পরিচ্ছন্ন এবং পরিচ্ছন্নতাকে পসন্দ করেন, নিজে সুমহান এবং মহত্ত্বকে পসন্দ করেন এবং তিনি দানশীল, দানশীলতাকে পসন্দ করেন। কাজেই তোমরা তোমাদের বাড়ির চত্বর) পরিচ্ছন্ন রাখবে।–(তিরমিযী)।

হযরত মু’আয ইবন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন, পানির ঘাটে, রাস্তার মাঝে এবং বৃক্ষের ছায়ায় মলত্যাগ থেকে বিরত থাকবে। -(আবূ দাউদ ও ইবনে মাজা)

 হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা রয়েছে। এর মধ্যে উত্ত শাখা হচ্ছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ কালেমা পাঠ করা এবং ক্ষুদ্রতম শাখা হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা।-(মেশকাত)

রাসূলে কারীম (ছঃ) আরও বলেন, আমার নিকট আমার উম্মতের ভালমন্দ সকল আমলের বিবরণ পেশ করা হয়েছিল। আমি ভাল কাজ সমূহের তালিকার মধ্যে রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলা কষ্টকর বস্তুকেও দেখতে পেয়েছি এবং মন্দ কাজসমূহের তালিকার ভেতর দেখতে পেয়েছি মসজিদে নাকের ময়লা নিক্ষেপ করা যা সেখান থেকে মুছে ফেলা না হয়।-(মেশকাত)।

বর্তমান কালে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোদের উপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। আমরা মুসলমান হিসেবে ইসলামের উপরোক্ত নির্দেশনার আলোক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতাকে মেনে চললে রোগব্যাধি ইত্যদি থেকে মুক্ত থাকতে পারি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *