১১. যাকাত (১১তম খণ্ড)

১তম খণ্ড যাকাত

যাকাতের পরিচিতি

 যাকাত ইসলামী জীবন বিধানের অন্যতম বুনিয়াদ ও অবশ্য পালনীয় এবাদত। ইসলামের বুনিয়াদের মধ্যে ঈমান, নামায ও রোযা সকল মুসলমানের জন্যই ফরয, কিন্তু হজ্জ ও যাকাত কেবলমাত্র ধন-সম্পদের দিক দিয়ে সামর্থ্যবান মুসলমানদের উপর ফরয। আর্থিক সামর্থ্যবান বলতে যাকাতযোগ্য সম্পদের অধিকারী হওয়াকে বুঝায়।

যাকাত আরবী শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে, যাকাত বলতে ধনীদের ধনমালে আল্লাহর নির্ধারিত অবশ্য দেয় অংশকে বুঝায়। আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কোরআনে সম্পদশালীদের সম্পদ থেকে নির্ধারিত ৮টি খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন।

বস্তুত যাকাত হচ্ছে সম্পদশালীদের সম্পদে আল্লাহর নির্ধারিত সেই ফরয অংশ যা সম্পদ ও আত্মার পবিত্রতা অর্জন, সম্পদের ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং সর্বোপরি আল্লাহর রহমত লাভের আশায় নির্ধারিত খাতে ব্যয়বন্টন করার জন্য দেয়া হয়।

যাকাত একদিকে যাকাত দাতার ধন-সম্পদকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে, এর প্রবৃদ্ধি সাধন করে, অপর দিকে দরিদ্রদের আর্থিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করে। যাকাতের এই প্রবৃদ্ধি ও পবিত্রতা কেবল ধনমালের মধ্যেই সীমিত নয়, বরং যাকাত দানকারীর মনমানসিকতা ও ধ্যান-ধারণা। পর্যন্ত তা পরিব্যাপ্ত হয়।

ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হল যাকাত। ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে–এটি সম্পদের সুষম বন্টনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। উপরন্তু সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্যও ইসলাম প্রত্যেক মুসলমানকে তাকীদ প্রদান করে। সম্পদের এ সুষম বণ্টনের জন্য ইসলাম যে সকল ব্যবস্থা মানুষকে উপহার দিয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে যাকাত। মানুষের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে পড়লে সমাজে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা দেয়। ফলে মানুষের অভাব অনটন বেড়ে যায়, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে, মানুষের নৈতিক চরিত্রের অবনতি ঘটে। এসব সমস্যা থেকে মানব জাতিকে রক্ষার লক্ষ্যে আল্লাহ্ তা’আলা প্রত্যেক ধনী মুসলমান ব্যক্তির উপর যাকাত ফরয করে দিয়েছেন। সম্পদ পুঞ্জীভূত থাকুক আল্লাহ তা’আলা তা পসন্দ করেন না। তিনি চান এটি মানুষের কল্যাণে ব্যয় হোক, সমাজের অর্থনীতির চাকা গতিশীল থাকুক। ইসলামী সমাজে সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখা যাবে না। এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যাকাতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলা ধনীদের সম্পদে গরীবদের হক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এটি গরীবদের অধিকার, তাদের প্রতি করুণা নয়। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে এ হক আদায় করা হয়।

.

যাকাতের গুরুত্ব ফযীলত

যাকাত ও সাদকা যে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় তা সুস্পষ্ট। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

من أموالهم صدق طټهم وتتركيهم بها

তাদের সম্পদ থেকে সাদকা (যাকাত) গ্রহণ করুন। এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোতি করবেন।–(সূরা তাওবা, ৯ ঃ ১০৩)

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, জনৈক বেদুঈন নবী কারীম (ছঃ)-এর খিদমতে এসে বললেন, আমাকে একটি আমল বলে দিন যা করলে আমি জান্নাতে দাখিল হতে পারবো। নবী কারীম (ছঃ) বললেন, তুমি আল্লাহর এবাদত করবে এবং তার সাথে কোন কিছু শরীক করবে না, ফরয নামায আদায় করবে, ফরয যাকাত প্রদান করবে এবং রমযানের ছওম পালন করবে। তিনি বললেন, যার হাতে আমার প্রাণ সে সত্তার কসম, আমি এ থেকে কিছু বৃদ্ধি করব না, কমও করব না। তখন ঐ ব্যক্তি ফিরে যাওয়ার কালে নবী করীম (ছঃ) বললেন, জান্নাতী কোন ব্যক্তিকে দেখে কেউ যদি আনন্দিত হতে চায় তবে সে যেন এই ব্যক্তিকে দেখে নেয়। -(বুখারী)

পবিত্র কোরআন ও হাদীসে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যাকাতের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বত্রিশ স্থানে যাকাতের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে আটাশ স্থানে নামায ও যাকাতের উল্লেখ একত্রে করা হয়েছে।

م و

م م م

م

, ,

به ر

رو

کت

۸ و

واقيموا الصلوة وأتوا الزكوة وما تقدموا لانفسكم من خير تجدوه

عند الله إن الله بما تعملون بصير

তোমরা ছলাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর। তোমরা উত্তম কাজের যা কিছু পূর্বে প্রেরণ করবে আল্লাহর নিকট তা পাবে। তোমরা যা কর নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তার দ্রষ্টা। –(সূরা আল বাকারা, ২ : ১১০)

বস্তুত ইসলামে নামায এবং যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করার কোন অবকাশ নেই। আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন যায়িদ (রা.) বলেছেন, নামায ও যাকাত উভয়ই ফরয করা হয়েছে, এ দুটির মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করা হয়নি। এ কারণে ইসলামে যাকাত আদায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, কেউ যদি আল্লাহর পুরস্কারের আশায় যাকাত দেয় তা হলে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। কিন্তু যে যাকাত দিতে অস্বীকার করবে তার কাছ থেকে শক্তি প্রয়োগ করে যাকাত আদায় করতে হবে এবং আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী তার অর্ধেক সম্পত্তিও নিয়ে নেয়া হবে। (বুখারী, নাসাঈ ও বায়হাকী)

ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর খিলাফত কালে আরবের কিছু গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকতি জানিয়েছিল, যদিও তারা নামায পড়ত। কিন্তু আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) যাকাত না দেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, আমি অবশ্যই সে সব লোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব যারা নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে। আল্লাহর কসম, ওরা যদি একটা উটের দড়িও দিতে অস্বীকার করে, যা রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর যামানায় তারা দিত, তাহলে আমি তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই অস্ত্রধারণ করব। সাহাবায়ে কেরাম হযরত আবূ বকর (রাঃ)-এর সঙ্গে সর্বসম্মতভাবে ঐকমত্য পোষণ করেছেন।

কোরআন পাকে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে :

وويل المشركين الذين يؤتون الزكوة وهم بالآخرة هم كفرون

দুর্ভোগ মুশরিকদের জন্য, যারা যাকাত দেয় না এবং তারা আখিরাতেও বিশ্বাসী নয়। –(সূরা হা-মীম আস্-সাজদা, ৪১ ঃ ৬-৭)

কোরআনুল কারীমে আল্লাহ্ তা’আলা ইসলামে ভ্রাতৃত্বের গণ্ডির মধ্যে শামিল হওয়ার জন্য যাকাত প্রদানকে অন্যতম শর্ত হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এরশাদ হয়েছে।

فإن تابوا وأقاموا الصلوة و أثوا الزكوة فإخوانكم في الوينه

যদি তারা তাওবা করে, ছলাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় তবে তারা তোমাদের দীনী ভাই।–(সূরা তাওবা, ৯ঃ ১১)।

যে সব কাজ করলে আল্লাহ মানুষের উপর রহমত নাযিল করেন তার মধ্যে অন্যতম কাজ হচ্ছে যাকাত দেয়া। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন :

মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন মহিলা একে অপরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ দেয়, অসৎকাজ নিষেধ করে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদের উপর আল্লাহ্ রহম করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।–(সূরা তাওবা, ৯ : ৭১)

মহান আল্লাহ আরো বলেন :

আমার রহমত সবকিছু পরিব্যপ্ত করে আছে, সুতরাং আমি তা তাদের জন্য নির্ধারিত করব যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় এবং আমার নিদর্শনের প্রতি ঈমান রাখে। –(সূরা আরাফ, ৭ঃ ১৫৬)

নবী করীম (ছঃ) যাকাতের জন্য বলিষ্ঠভাবে তাকীদ করেছেন এবং যাকাত না দেয়ার দুনিয়া-আখিরাতের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। হযরত ইবন উমর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন :আমি আদিষ্ট হয়েছি এজন্যে যে, আমি যুদ্ধ করব লোকদের সাথে যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই ও মুহাম্মদ (ছঃ) আল্লাহর রাসূল এবং নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে।

আল্লামা ইউসুফ কারযাভী (রঃ) যাকাত সম্পর্কে কোরআনের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন।যাকাত না দিলে কোন লোকই কল্যাণ পেতে পারে না, যাকাত না দিয়ে কেউ আল্লাহর রহমত পাওয়ার যোগ্য অধিকারীও হতে পারে না।

.

যাকাত যাদের উপর ফরয

ইসলামী জ্ঞান বিশারদরা এ ব্যাপারে একমত যে, যাকাত কেবলমাত্র স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক ও সম্পদশালী মুসলমানের উপ ফরয। সম্পদশালী কথাটি একটু ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। কারও সম্পদশালী হওয়ার জন্য নিম্নের শর্তগুলো, পূর্ণ হওয়া জরুরী :।

সম্পদের উপর যাকাত ফরয হওয়ার জন্য সম্পদের মালিকানা সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ হওয়া জরুরী। সম্পদের উপর অন্য কারো মালিকানা না থাকা এবং নিজের ইচ্ছামত তা ভোগ ও ব্যবহার করতে পারাই হলো মালিকানার বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ কথা দুটো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যে সব সম্পদের মালিকানা নির্দিষ্ট নয় তার উপর কোন যাকাত নেই। যেমন ও সরকারী মালিকানাধীন ধন-সম্পদ। তেমনি জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য ওয়াকফকৃত মালের উপরও যাকাত ধার্য হবে না। তবে ওয়াকফ যদি কোন ব্যক্তি বা গোত্রের জন্য হয় তবে তার উপর যাকাত দিতে হবে। যে ঋণ ফেরত পাবার আদৌ আশা নেই তার উপর যাকাত ধার্য হবে। কিন্তু ফেরত পাওয়া যায় গেলে এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর এর যাকাত দিতে হবে।

.

সম্পদ বর্ধনশীল হওয়া

যাকাতের জন্য সম্পদ অবশ্যই বর্ধনশীল তথা উৎপাদনক্ষম বা প্রবৃদ্ধমান হতে হবে। সম্পদের বৃদ্ধি পাওয়ার যোগ্যতা থাকাই যথেষ্ট; বৃদ্ধি পাওয়া জরুরী নয়। এই শর্তের আলোকে ব্যক্তিগত ব্যবহারের মাল-সম্পদ এবং নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, যেমন : কাপড়-চোপড়, আসবাবপত্র বাসন-কোসন, বাড়িঘর, বইপুস্তক, যন্ত্রপাতি, যানবাহন ইত্যাদি মালামাল নিজের প্রবৃদ্ধি সাধনে সক্ষম নয়; তাই এসবের উপর যাকাত নেই। কিন্তু গরু-ছাগল, কৃষিজাত ফসল, খণিজ সম্পদ, ব্যবসার পণ্য, নগদ অর্থ, ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে ক্রয়ক্বত মালামাল বর্ধনশীল; তাই এগুলোর উপর যাকাত ধার্য হবে।–(দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম)

.

সম্পদ নিসাব পরিমাণ হওয়া

যাকাত ধার্য হওয়ার জন্য তৃতীয় শর্ত হচ্ছে, সম্পদ নিসাব পরিমাণ হওয়া। নিসাব’ বলা হয় শরী’আত নির্ধারিত নিম্নতম সীমা বা পরিমাণকে। এই পরিমাণ নির্ধারণে ব্যক্তির সর্বমোট আয় থেকে যাবতীয় ব্যয় বাদ দেয়ার পর উদ্ধৃত্ত অর্থ এবং তার পূর্বের সঞ্চয় ও উত্তাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ যুক্ত হবে। প্রয়োজনীয় ব্যয় বাদে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা (প্রায় ৬১৩ গ্রাম) বা সাড়ে সাত তোলা সোনা (প্রায় ৮৮ গ্রাম) বা এর সমমূল্যের সম্পদকে নিসাব’ বলা হয়। যদি কারো কাছে সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা থাকে, বা উভয়টি মিলে সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমান অথবা সব সম্পদ মিলে সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার সমমূল্যের সম্পদ থাকে তবে সে সম্পদের যাকাত দিতে হবে। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে গরীবের জন্য যা অধিকতর লাভজনক তার মূল্য ধরতে হবে। গরুর ক্ষেত্রে ৩০টি, ছাগলের ক্ষেত্রে ৪০টি এবং উট ৫টিকে নিসাব ধরা হয়েছে। -(দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম)

.

ঋণগ্রস্ত না হওয়া

যাকাত ফরয হওয়ার জন্য ঋণ পরিশোধের পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা একটি জরুরী শর্ত। যদি সম্পদের মালিক ঋণগ্রস্ত হয় এবং ঋণ পরিশোধের পর বা ঋণের সমপরিমাণ সম্পদ বাদ দেয়ার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে তাহলে সে সম্পদের যাকাত দিতে হবে।

.

সম্পদের মালিকানা থাকা

কারো নিকট কমপক্ষে নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর থাকলেই সে সম্পদের উপর যাকাত ফরয হবে। তবে কৃষিজাত ফসল, মধু, খণিজ সম্পদ উৎপাদনের যাকাত (উশর) প্রতিটি ফসল তোলার সময়েই দিতে হবে। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানীর ক্ষেত্রে মালিকানার বছর শেষে হিসাব অনুসারে যাকাত দিতে হবে।

.

বিশেষ ক্ষেত্র

 কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে যাকাত কার উপর ধার্য হবে সে সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ

যৌথ মালিকানাভুক্ত সম্পত্তির যাকাত

যৌথভাবে দু’ বা ততোধিক ব্যক্তি কোন সম্পদের মালিক হলে তাদের প্রত্যেকেই সম্পদে নিজ নিজ অংশের যাকাত দিতে হবে, যদি প্রত্যেকের অংশ নিসাবের সমান বা তার চেয়ে বেশি হয়। সম্পদের এ অংশ তার অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে যোগ করলে যদি নিসাবের শর্ত পূরণ হয় তাহলেও তাকে সে সম্পদের যাকাত দিতে হবে। আর যদি নিসাবের শর্ত পূরণ না হয় তাহলে তাকে যাকাত দিতে হবে না।

মৃত ব্যক্তির যাকাত

নির্ধারিত যাকাত দেয়ার পূর্বে যদি সম্পদের মালিক মারা যায়, তাহলে তার অসীয়্যত অনুযায়ী উত্তরাধিকারীরা অথবা স্ত্রী কিংবা তত্ত্বাবধায়ক তার সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ থেকে যাকাত বাবদ পাওনা আদায় করবেন, কোন ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করবেন এবং অবশিষ্ট সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টন করবেন।

তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে থাকা সম্পদের যাকাত

মালিকের পক্ষ থেকে সম্পদের দেখাশোনা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য কোন আইনানুগ তত্ত্বাবধায়কের কাছে সম্পদ ন্যস্ত করা হয়ে থাকলে, সে সম্পদের যাকাত মালিকের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক প্রদান করতে বাধ্য থাকবে।

বিদেশে অবস্থিত সম্পদের যাকাত

কারো সম্পদ বিদেশে থাকলে এবং সে সম্পদ যাকাতযোগ্য হলে তার উপরও তাকে যাকাত দিতে হবে। তবে সে দেশের সরকার যদি ইসলামী হয় এবং উক্ত সম্পদের যাকাত আদায় করে, তাহলে দেশে আর সে সম্পদের যাকাত দিতে হবে না। সম্পদ দেশে আর সম্পদের মালিক দেশের বাইরে থাকলে মালিকের প্রতিনিধি মালিকের পক্ষ থেকে যাকাত দেবেন।

.

যাকাতের সম্পদ ও তার ব্যবহার

 পবিত্র কোরআনে যাকাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাদীস শরীফে তার ব্যাখ্যা ও বাস্তব কর্মরূপ উপস্থাপন করা হয়েছে। নবী করীম (ছঃ)-এর হাদীস থেকে জানা যায় সোনা, রূপা, ব্যবসার পণ্য, কৃষিপণ্য, নগদ অর্থ, পশু সম্পদ ইত্যাদিতে যাকাত ফরয হওয়ার জন্য এগুলোর পরিমাণ যেমন বিভিন্ন, তেমনি এ সবের যাকাতের হারও বিভিন্ন।

নিম্নলিখিত সম্পদের উপর যাকাত ফরয হয় : ১. স্বর্ণ-রৌপ্য ও নগদ অর্থ। ২. ব্যবসা পণ্য। ৩. কৃষি পণ্য। ৪. পশু সম্পদ। ৫. খনিজ সম্পদ। ৬. অন্যান্য সম্পদ।

স্বর্ণ-রৌপ্য ও নগদ অর্থ

সাড়ে সাত তোলা সোনা (প্রায় ৮৮ গ্রাম) এবং রূপা দু’শ দিরহাম অর্থাৎ সাড়ে বায়ান্ন তোলা (প্রায় ৬১৩ গ্রাম) হলো যাকাতের নিসাব। এ পরিমাণ সোনা-রূপা বা এর অধিক হলে তার যাকাত দিতে হবে। উল্লিখিত সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ বা শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে। এক বছর পূর্ণ না হলে অথবা নিসাবের কিছু কম হলে যাকাত ফরয হবে না।

প্রচলিত মুদ্রা যেমন, টাকা, ডলার, পাউণ্ড ইত্যাদি বিনিময়ের জন্যেই নির্দিষ্ট এবং সোনা রূপার পরিবর্তে এসব ব্যহার করা হচ্ছে। তাই এসব মুদ্রারও চল্লিশ ভাগের, এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। যদি তা সোনা বা রূপার নিসাবের মূল্যের সমান হয়।

হাতে এবং ব্যাংকে রক্ষিত নগদ অর্থ ছাড়াও সঞ্চয়পত্র, সিকিউরিটি, শেয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদি নগদ অর্থ বলে গণ্য হবে। এছাড়া পূর্বের বকেয়া পাওনা, চলতি বছরে দেয়া ঋণ, এসবকেও নগদ অর্থের মধ্যে ধরে যাকাত হিসাব করতে হবে। তবে যে সব পাওনা ফেরত পাবার আশা নেই সেগুলো বাদ দেয়া যেতে পারে। ভবিষ্যতে যদি ফেরত পাওয়া যায় তখন থেকে বছর পূর্ণ হলে যাকাত দিতে হবে।

ব্যবসায়ী পণ্য

 ব্যবসায়ের মালামালের যাকাত নির্ণয়কালে মালিকানার বছর শেষে যে সম্পদ থাকবে তাই সারা বছর ছিল ধরে নিয়ে তার উপর যাকাত দিতে হবে। সমাপ্তি দিবসে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানীর যে স্থিতিপত্র তৈরি করা হয়, এতে সমস্ত দেনা-পাওনা, যেমন মূলধন সম্পদ, চলতি মূলধন, অর্জিত মুনাফা, ক্যাশে এবং ব্যাকে রক্ষিত নগদ অর্থ, দোকানের এবং গুদামে রক্ষিত মালামাল, কাঁচামাল, প্রক্রিয়ায় অবস্থিত মাল, প্রস্তুতক্বত মাল, ঋণ, দেনা ও পাওনা ইত্যাদি যাবতীয় হিসাব আনতে হবে। এসবের মধ্য থেকে স্থায়ী মূলধন সামগ্রী যেমন, মেশিন, দালান, জমিসহ ব্যাংক ঋণ, ক্রেডিটে ক্রীত মাল এবং অন্যান্য ঋণ বাদ দিয়ে বাকী সম্পদের উপর যাকাত দিতে হবে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে কেনা জীম, মেশিন বা অন্যান সম্পদেরও যাকাত দিতে হবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, কোন ব্যক্তির একাধিক ব্যবসা থাকলে এবং তার পরেও সোনা-রূপা, মূল্যবান পাথর, নগদ অর্থ, ব্যাংক ব্যালেন্স ইত্যাদি থাকলে এ সব সম্পদের হিসাবের যোগফল অনুযায়ী যাকাত নিরূপণ করতে হবে।

কৃষি সম্পদের যাকাতকে উশর নামে অভিহিত করা হয়। একে ফল ও ফসলের যাকাতও বলা যায়।

এ যাকাত অন্যান্য গবাদি পশু, নগদ সম্পদ ও ব্যবসায় পণ্য ইত্যাদি মালের যাকাত থেকে। সম্পূর্ণ আলাদা। এর হিসেবও আলাদা। এতে এক বছর পূর্ণভাবে অতিবাহিত হওয়ার কোন শর্ত। নেই। বরং শুধু তা অর্জিত হলেই এ যাকাত দিতে হয়। কেননা, তা জমির প্রবৃদ্ধি।

ফসল উৎপাদনের প্রেক্ষিতে জমি সাধারণত দু’প্রকারের হয়ে থাকেঃ

ক, ফসল উৎপাদনের জন্য ক্বত্রিম উপায়ে সেচ দিতে হয় এমন জমি। এরূপ জমিতে উৎপাদিত ফসলের উপর ১.২০ ভাগ হারে যাকাত (উশর) দিতে হয়।

খ. ফসল উৎপাদনের জন্য ক্বত্রিম উপায়ে সেচ দিতে হয় না এমন জমি। এরূপ জমিতে উৎপাদিত ফসলের উপর ১.১০ ভাগ হারে যাকাত (উশর) দিতে হবে।

পশু সম্পদ

সাধারণভাবে মাঠে ময়দানে চরে বেড়ানো গৃহপালিত পশু বংশবৃদ্ধি ও দুধের জন্যে প্রতিপালিত হলে তাকে পরিভায় সায়েমা বলে। এসব পশুর যাকাত দিতে হয়। যে সব পশু গোশত খাওয়ার জন্যে পালা হয় এবং বন্য পশু যেমন, হরিণ, নীল গাই প্রভৃতির উপর যাকাত দিতে হয় না। তবে এ বন্য পশু যদি ব্যবসার জন্যে হয়, তাহলে তার উপর যাকাত দিতে হবে, যেমন ব্যবসায়ের মালের উপর যাকাত হয়।

প্রভিডেন্ট ফাণ্ড

সরকারী চাকুরীসহ অন্যান্য চাকুরেদের মাসিক বেতনের একটি অংশ কেটে নিয়ে তার সঙ্গে চাকুরীদাতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুদানসহ বা অনুদান ছাড়া প্রভিডেন্ট ফান্ডের ব্যবস্থা প্রায় চাকুরীতেই আছে। যাকাতযোগ্য হওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ মালিকানার যে পূর্বশর্ত তা প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের বেলায় নিশ্চিত নয় বলে চাকুরী শেষে তা হস্তগত হওয়ার পূর্বে এ ফান্ডের ওপর যাকাত দেয়া জরুরী নয়। তবে কেউ অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বনের জন্য প্রতি বছরই ব্যালেন্স জেনে তার ওপর যাকাত দিলে তিনি নিশ্চয়ই তার জন্য আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাবেন।

.

যে সম্পদে যাকাত ফরয নয়

নিম্নের সম্পদসমূহের উপর যাকাত নেই?

১. বসবাসের বাড়ি-ঘরের উপর। তা যত মূল্যবান হোক না কেন।

২. যে কোন প্রকারের মণিমুক্তা ইত্যাদির উপর।

৩. কৃষি ও সেচ কাজের জন্যে যে পশু, যেমন গরু, মহিষ, উট, প্রতিপালন করা হয় তার উপর। এ ব্যাপারে মূলনীতি হল, এক ব্যক্তি তার কারবারে উৎপাদনের জন্য যেসব উপাদান। ব্যবহার করে তা যাকাত বহির্ভূত। যে সব পশু দিয়ে কৃষি কাজ করা হয় তার উপর যাকাত নেই, কারণ তার যাকাত যমীন থেকে উৎপন্ন ফসল থেকে আদায় করা হয়। অনুরূপ উৎপাদনের যন্ত্রপাতির উপর যাকাত নেই।

৪. কলকারখানা, মেশিন ও যন্ত্রপাতির উপর উপরন্তু কারখানার দালান-কোঠা, ব্যবসায়ে ব্যবহৃত ফার্ণিচার, দোকান ঘর, এ সবের উপর।

৫. ডেইরী ফার্মের পশু সায়েমার অন্তর্ভুক্ত নয় বলে এর উপর। কারণ সেগুলো তো উৎপাদনের মধ্যে পড়ে। অবশ্যি ডেইরী থেকে উৎপাদিত পণ্যের বা মূলের উপর যাকাত দিতে হবে।

৬. মূল্যবান কোন দুষ্প্রাপ্য জিনিস কেউ সখ করে ঘরে রাখলে তার উপর যাকাত নেই। তবে যদি এর ব্যবসা করা হয় তাহলে যাকাত দিতে হবে।

৭. কেউ চৌবাচ্চায় বা পুকুরে সৌখিন মাছ পুষলে অথবা সখ করে কোন পশু বা পাখি পুষলে তার উপর যাকাত নেই। কিন্তু এর ব্যবসা করলে যাকাত দিতে হবে।

৮. গৃহপালিত পশু যদি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে রাখা হয়, যেমন দুধ পানের জন্য গাভী, বোঝ বহনের জন্য গরু-মহিষ, যানবাহনের জন্যে ঘোড়া, হাতী, উট, তবে তার সংখ্যা যতেই হোক কোন যাকাত দিতে হবে না।

৯. ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য মটর সাইকেল, কার, বাস থাকলে তার উপর যাকাত নেই।

১০. ডিম বিক্রির জন্যে হাঁস-মুরগীর ফার্ম করলে হাঁস-মুরগীর উপর যাকাত নেই। তবে বিক্রির হাঁস-মুরগী ও ডিমের মূল্যের উপর যাকাত ফরয হবে যেমন অন্যান্য ব্যবসার পণ্যের উপর যাকাত হয়।

১১. যে সব জিনিস ভাড়ায় খাটানো হয়, যেমন সাইকেল, রিক্শা, ট্যাক্সি, বাস, ট্রাক, ফার্ণিচার, ক্রোকারীজ ইত্যাদি অথবা যে সব দোকান ও বাড়ি ভাড়া দেয়া হয় তার উপর কোন যাকাত নেই। তবে এ সব থেকে যা আয় হবে তা যদি নিসাব পরিমাণ হয় তবে বছর অতীত হওয়ার পর যাকাত দিতে হবে। ঐসব জিনিসের মূল্যের উপর কোন যাকাত নেই।

১২. ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্র এবং অফিসের যাবতীয় আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, ক্যালকুটের, ফোন, ফ্যাক্স, কম্পিউটার ইত্যাদির উপর যাকাত নেই।

১৩. গাধা, খচ্চর, ঘোড়ার উপর যাকাত নেই যদি তা ব্যবসার জন্যে না হয়।

১৪. ওয়াকফের পশুর উপরও যাকাত নেই। যে সব ঘোড়া জিহাদের জন্যে পালা হয় এবং যে সব অস্ত্রশস্ত্র জিহাদ ও দীনের খেদমতের জন্যে, তার উপরও যাকাত নেই।

১৫. দাঁতব্য বা সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সম্পদ যা জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত, তার উপর যাকাত নেই।

১৬. সরকারী মালিকানাভূক্ত নগদ অর্থ, সোনা-রূপা এবং অন্যান্য সম্পদের উপর যাকাত নেই।

.

যাকাত যারা পাবে

পবিত্র কুরআনে আট প্রকারের লোক যাকাত পাবার যোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

إنما الشدقت بلفقراء والمسكيني والعملين عليها والمؤلفة

قلوبهم وفي الرقاب والغارمين و في سبيل الله وابن السبيل فريضة من الله والله عليم حكيم

সাদকা তো শুধু ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং সাদকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত লোকদের জন্য, যাদের মন জয় করা হয় তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।–(সূরা তাওবা, ৯ ও ৬০)

যাকাতের এসব হকারদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিচে দেয়া হল :

১. ফকীর : ফকীরকে বাংলায় গরীব বলা হয়। এরা জনগোষ্ঠীর সেই অংশ যাদের কাছে কিছু ধন-সম্পদ আছে; কিন্তু তার দ্বারা তাদের প্রয়োনের পূরণ হয় না। অন্য কথায় যাদের নিকট নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই তারাই গরীব।

২. মিসকীন : যারা নিঃস্ব, নিজের আহারও যোগাড় করতে পারে না এবং অভাবের তাড়নায় অন্যের নিকট হাত পাততে বাধ্য হয়, সেসব অসহায় মানব সন্তানদের বলা হয় মিসকীন। যারা কর্মক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কাজের অভাবে বেকার থাকতে বাধ্য এবং মানবেতর জীবনযাপন করে, হযরত উমর (রাঃ) তাদেরকেও মিসকীনদের মধ্যে গণ্য করেছে।

৩. আমিলুন :আমিলুনা আলাইহা বলতে যাকাতের কাজে নিযুক্ত লোকদের বুঝানো হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র যাকাতসমূহ আদায়, বিতরণ, হিসাব সংরক্ষণ ইত্যাদি করার জন্য, যাদের নিয়োগ করবে তাদের বেতন-ভাতা যাকাত তহবিল থেকে দেয়া হবে।

৪. মন জয় করার জন্য : নও-মুসলিমদের সমস্যা দূর করার জন্য এবং ইসলামের উপর অবিচল রাখার উদ্দেশ্যে তাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে। এমনকি নও-মুসলিমরা ধনী হলেও তাদের যাকাত দেয়া যাবে।

৫. দাস মুক্তি (মুক্তিপণ ধার্যকৃত দাস) : দাস মুক্তি বলতে দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ লোক এবং বন্দীদের মুক্ত করাকে বুঝানো হয়েছে। মানুষ একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করবে, অন্য কারো দাসত্ব করবে না, এটাই হচ্ছে আল্লাহর মৌলিক নির্দেশ। এজন্য ইসলাম দাসমুক্ত করাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) মধ্যে যাদের অর্থ ছিল তাঁরা মুকাতব পর্যায়ের দাসমুক্তির জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করতেন।

৬. ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ ও ঋণভারে যারা জর্জজিত তারা মানসিকভাবে সর্বদাই ক্লিষ্ট থাকে এবং কখনও কখনও জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের জীবনী-শক্তির ক্ষয় সাধিত হয়। অনেক সময় তারা অন্যায় ও অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং যথার্থ প্রয়োজনে ঋণগ্রস্ত লোকদের ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত করা ইসলামী সমাজের দায়িতু। এ খাতেও আল্লাহ যাকাতের অর্থ ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে সমাজকে সুস্থ রাখা যায়। তবে কোন কোন ফকীহ্ ইমাম এ শর্তও আরোপ করেছেন যে সে ঋণ যেন কোন অবৈধ কাজের জন্য না করে থাকে। কোন পাপ কাজের জন্য যদি ঋণ করে থাকে, মদ কিংবা বিয়ে শাদির নাজায়েয প্রথা-অনুষ্ঠান প্রভৃতি, তবে এমন ঋণগ্রস্তকে যাকাতের অর্থ থেকে দান করা যাবে না। -(মুফতী মুহাম্মদ শফী, তফসীর মা’আরিফুল কোরআন, পৃ. ৫৭৯)

৭. আল্লাহর পথে ব্যয় : কুরআনের ভাষায় এ খাতের নাম বলা হয়েছে ফী সাবীলিল্লাহ্, যার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর পথে। আল্লাহর পথে কথাটি খুব ব্যাপক। মুসলমানদের সকল নেক কাজ আল্লাহর পথেরই কাজ। তবে এখানে আল্লাহর পথে কথাটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বিপুল সংখ্যাধিক্যের অভিমত হচ্ছে : এখানে আল্লাহর পথ হচ্ছে আল্লাহর জন্য জিহাদের পথে অর্থাৎ সেই সাধ্য-সাধনা ও চেষ্টা সংগ্রামের পথে যার উদ্দেশ্যে কাফেরী সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তদস্থলে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এই চেষ্টা সংগ্রামের পথের যারা নিয়োজিত তাদের সফর খরচ, যানহাবন ও অস্ত্র শস্ত্র, আসবাব পত্র সংগ্রহের জন্য সাহায্য করা যেতে পারে। তারা নিজেরা সচ্ছল এবং নিজেদের প্রয়োজনের জন্য তাদের সাহায্যের আবশ্যক না হলেও। ফকীহদের মতে দীনী ইলম শিক্ষার্থী কিংবা অন্যান্য সকজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে যাকাত দেয়া যাবে, যদি তারা গরীব হয়।–(তরজমা-এ-কোরআন মজীদ)।

৮. মুসাফির ও মুসাফির বা প্রবাসী লোকের বাড়িতে যত ধন-সম্পদই থাকুক না কেন, পথে বা প্রবাসে সে যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাহলে তাকে যাকাত তহবিল হতে প্রয়োজনীয় সাহায্য দেয়া যাবে।

.

যাকাত দেয়ার নিয়ম

যাকাত আদায়ের জন্য নির্ধারিত কোন মাস নেই। সাহেবে নিসাবের সম্পদের মালিকানার এক বছর পূর্ণ হলে তখনি যাকাত দেবে। তবে পবিত্র রমযান মাসে দেয়া ভাল।

.

যাকাত আদায় ও ব্যয়বন্টন ব্যবস্থা

যাকাত যেহেতু ইসলামের অন্যতম বুনিয়াদ এবং ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম প্রাণশক্তি, তাই এর যথার্থ সংগ্রহ ও ব্যয়বন্টন ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করা জরুরী। এ প্রসঙ্গে কোরআনুল কারীমের স্পষ্ট ঘোষণা হলো :

مم يرث أموالهم صدقة تطهرهم وتزكيهم بها

উচ্চারণ : খুয মিন্ আমওয়া-লিহিম ছদাক্বাতান তুত্বোয়াহহিরুহুম্ অতুযাক্কীহিম্ বিহা হে নবী, তাদের সম্পদ হতে যাকাত উসূল করে তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করুন। –(সূরা তাওবা, ৯ ঃ ১০৩)

আরও ইরশাদ হয়েছে :

وا الزكوة وامروا

وا الصلوة وات

بالمعروف ونهوا عن المنكر

উচ্চারণ : আল্লাযীনা ইম মাক্কান্না-হুম্ ফিল আরদ্বি আক্কা-মুছ ছলা-তা অ আ-তুয যাকা-তা অআমারূ বিলমা’রূফি অনাহাও আনিল মুনকার;

আমি তাদেরকে দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠা দান করলে, তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে। (সূরা আল হাজ্জ, ২২ ঃ ৪১)

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে :

وفى أموالهم حق الشائل والمحروم

উচ্চারণ : ওয়াফী আমওয়া-লিহিম হাক্কুল লিস্সা-ইলি ওয়াল মাহরূম।

 তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে রয়েছে বঞ্চিতের প্রাপ্য। (সূরা যারিয়াত, ৫১ : ১৯)

এ সকল আয়াতের আলোকে নবী করীম (ছঃ) যাকাতের বিধান জারী করেছেন এবং যাকাত বন্টনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, জিমাম ইবন সা’লাবা (রাঃ) রাসুল (ছঃ)-কে বললেন, আপনার প্রতিনিধি বলছেন যে, আমাদের সম্পদের যাকাত দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বললেন, সে সত্য বলেছে। তখন ঐ ব্যক্তি বললেন, যে আল্লাহ্ আপনাকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ দিয়ে বলছি, আল্লাহ্ কি আপনাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন? নবী করীম (ছঃ) বললেন, হ্যাঁ।–(মুসলিম শরীফ)।

বুখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত অন্য এক হাদীসে উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত মু’আয ইব্‌ন জাবাল (রাঃ)-কে ইয়ামানে পাঠানোর সময় নবী করীম (ছঃ) তাঁকে বললেন, তুমি আহলে কিতাবদের এক সম্প্রদায়ের কাছে যাচ্ছ। তুমি তাদের লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ এ সাক্ষ্য দানের জন্য দাওয়াত দেবে। তারা যদি তা মেনে নেয় তাহলে তাদের জানাবে যে, আল্লাহ্ তাদের উপর দিন-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন, তারা তা মেনে নিলে তাদের বলবে, আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের গরীবদের মধ্য বন্টন করা হবে। আর এ কথা মেনে নিলে তাদের ধন-সম্পদের উত্তম অংশ গ্রহণ করা থেকে তুমি সতর্কতা অবলম্বন করবে। আর মযলুমের ফরিয়াদকে অবশ্যই ভয় করবে। কেননা, তার ও আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা নেই। -(তাবরাণী ও বাইহারী)

বস্তুত রাসূলুল্লাহ (ছঃ) ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় যাকাত উসূল করার জন্য লোক নিয়োগ করতেন। তারা নিজ নিজ এলাকায় ধনীদের কাছ থেকে যাকাত সংগ্রহ করে তা যথারীতি বন্টন করতেন। খুলাফায়ে রাশিদীনের আমলেও যাকাত আদায়ের এ পদ্ধতি কার্যকর ছিল। এ থেকে প্রমানিত হয় যে, যাকাতরে বিশেষত্ব হচ্ছে তা আদায় করে নিতে হয়, সংগ্রহ করতে হয়; যাকাত প্রদান শুধু দাতাদের উপর ছেড়ে দেয়া হয় না।

খুলাফায়ে রাশিদার পর ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসে। কিন্তু বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা আজও আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর ধনসম্পদ যাকাত হিসেবে দরিদ্র ও অভাবীদের দিয়ে আসছেন। এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপক্বত হচ্ছে কিন্তু এতে যাকাতের প্রকৃত গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে। কেননা, ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর ধনসম্পদ যাকাত হিসেবে দরিদ্র ও অভাবীদের দান করে আসছেন। এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপক্বত হচ্ছে, কিন্তু এতে যাকাতের প্রকৃত গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে। কেননা ব্যক্তিগতভাবে যাকাত দানে একদিকে যেমন দাতার মনে শ্রেষ্ঠত্বের ভাব প্রকাশের আশঙ্কা রয়েছে, তেমনি এতে ফাঁকি দেয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তেমনি অধিকার পাওয়ার চেয়ে দান গ্রহণের হীনমন্যতা বোধ প্রবল হয়ে উঠছে। এছাড়া যাকাতে সামাজিক নিরাপত্তার যে নিশ্চয়তা ছিল তাও বহাল থাকছে না।

এ আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, যাকাত রাষ্ট্রীয়ভাবে আদায় ও ব্যয়-বন্টন করা বিধেয়। কিন্তু এ ব্যবস্থা আমাদের দেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশেই অনুপস্থিত। রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত সংগ্রহ ও বন্টন ব্যবস্থা যাতে আবার চালু হয় তার জন্য সকল মুসলমানেরই আন্তরিকতার সাথে যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত, আর এ জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থার ইসলামীকরণও জরুরী। যতদিন তা না হয় ততদিন যাকাত সংগ্রহ ও বন্টনের জন্য নিম্নের ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে।

ক. ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে সংঘবদ্ধ জনসমষ্টি তথা সংস্থা বা সংগঠন ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামী শরীয়াতের বিধানাবলী বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাতে পারে এবং যাকাত সংগ্রহ ও বন্টনের ব্যবস্থা করতে পারে। তবে এ ব্যবস্থা একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা। ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের সাথে সাথে যাকাত আদায় ও বন্টনের দায়িত্ব। ইসলামী রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত থাকবে।

খ. ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে শরীয়ত সম্মতভাবে পরিচালিত ব্যাংক বা অন্য কোন সংস্থার মাধ্যমেও যাকাত আদায় ও বন্টনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতদুদ্দেশ্যে ব্যাংকে একটি করে যাকাত বোর্ড গঠন করা যেতে পারে। উক্ত বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ব্যাংক যাকাত দানকারী সাহেবে নিসাবদের নিকট হতে যাকাতের অর্থ আদায় করতে পারে। নিজ গ্রাহকদের একাউন্ট হতেও তাদের অনুমতি সাপেক্ষে যাকাত সংগ্রহ করে যাকাত ফাণ্ডে জমা করতে পারে এবং যাকাত বোর্ডের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে হকদারদের মধ্যে তা বন্টন করতে পারবে।

গ. ব্যক্তিগত পর্যায়ে যাকাত আদায় ও বন্টন : উপরের বর্ণনামতে অথবা অনুরূপ কোন ব্যবস্থায় যদি যাকাত আদায় ও বন্টন করা সম্ভব না হয় তাহলে ব্যক্তিগত পর্যায়েই যাকাত আদায় ও বিলিবন্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাহেবে নিসাবগণ নিজ উদ্যোগে পুঙ্খপুঙ্খরূপে নিজ নিজ ধন-সম্পদের হিসাব করে যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ করবেন এবং শরী’আত নির্ধারিত খাতসমূহে তা ব্যয়-বন্টনের ব্যবস্থা করবেন।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, যাকাত আদায়ের নির্ধারিত কোন মাস নেই। সম্পদ মালিকানার বছর পূর্ণ হওয়ার সাথেসাথেই সাহেবে নিসাবকে হিসাব করে যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব তা আদায় করতে হবে। যাকাত দাতাকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, যাকাত কোন দান নয়।

.

যাকাত না দেয়ার পরিনাম

ধন সম্পদের যাকাত আদায় করা আল্লাহর হুকুম ও জনগণের হক। তাই যাকাত না দেয়া শরীয়তের দৃষ্টিতেই অপরাধ নয় বরং এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিণতিও অত্যন্ত ভয়াবহ বটে। যাকাত না দিলে সমাজে অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্য ও অসাম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে।

যেহেতু নামাযের ন্যায় যাকাতও ইসলামের অন্যতম রুকন ও মৌলিক ভিত্তি, সেহেতু যাকাত আদায় না করা শরীয়তের দৃষ্টিতে কতো জঘন্য অপরাধ তা সহজেই অনুমেয়। যার উপর যাকাত ফরয সে যাকাত না দিলে পরকালে তাকে ভীষণ শাস্তি ভোগ করতে হবে। পবিত্র কোরানে যাকাত না দেয়ার পরিণাম সম্পর্কে ঘোষণা করা হয়েছে :

والذين يتمنون الذهب والفضة وينفقوها في سبي الله فبشرهم بعذاب أليم. يوم يحمى عليها في نار جهنم فتكوى بها جباههم وجنوبهم وظهورهم هذا ما كنتم لانفسكم فذوقوا ما كنتم تكنزون

উচ্চারণ : ওয়াল্লাযীনা ইয়াকনিযূনায যাহাবা ওয়াল ফিদ্দাতা ওয়ালা-ইয়ুনফিকূনাহা–ফী ছাবীলিল্ লা-হি ফাবাশশিরহুম বিআযা-বিন আলীম। ইয়াওমা ইয়ুহমা–আলাইহা–ফী না-রি জ্বাহান্নামা ফাতুকঅ–বিহা–জ্বিবা-হুহুম অ যুনুবুহুম ওয়া জুহূরুহু; হা-যা–মা–কানাযতুম লিআনফুছিকুম ফানূকু মা–কুনতুম তাকনিযূন।

অর্থ : যারা সোনা-রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না (এখানে যাকাত অর্থে) তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সংবাদ দিন, যে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়ে তাদের কপাল, পার্শ্বদেশ এবং পিঠে দাগ দেয়া হবে। সে দিন বলা হবে, এটাই তা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করতেছিলে তা ভোগ কর।–(সূরা তাওবা, ৯ ঃ ৩৪-৩৫)

যাকাত না দেয়ার ইহকালীন পরিণতি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, যে সব লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, আল্লাহ্ তাদের কঠিন ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করে দেবেন। -(বায়হাকী)

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে, যাকাত যে মালের সাথে মিশ্রিত হয় সে সম্পদকে যাকাত অবশ্যই ধ্বংস করে দেয়। অপর একটি হাদীসেও এর সমর্থন পাওয়া যায়, যাতে বলা হয়েছে স্থল ও জল ভাগে ধন-সম্পদ বিনষ্ট হয়, শুধু মাল জমা রাখার দরুন।

যাকাত আদায় না করে কৃপণতা প্রদর্শনের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন :

اتهم الله من فضله هو خيرا لهم

ولايحسبن الذين يبخلود

بل هو شرتهم يطوقون ما بخلوا به يوم القيمة

উচ্চারণ : অলা–ইয়াহছাবান্না ল্লাযীনা ইয়াবখানা বিমা-আ-তা-হুমুল্লা-হু মিন ফাদ্বলিহী হুঅ খাইরাল্লাহুম; বাল হু শাররূল্লাহুম; ছাইউত্বওঅকুনা মা–বাখিলূ বিহী ইয়াওমাল কিইয়া-মাতি;

অর্থ : আর আল্লাহ্ স্বীয় অনুগ্রহে যা তাদেরকে দান করছেন তাতে যারা কৃপণতা করে, তাদের জন্য তা মঙ্গল এ যেন তারা কিছুতেই মনে না করে। না, এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যাতে তারা কৃপণতা করবে কিয়ামতের দিন তাই তাদের গলায় বেড়ি হবে। –(সূরা আলে ইমরান, ৩ : ১৮০)

হাদীস শরীফেও যাকাত আদায় না করার ভয়াবহ পরিণতি প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন, আল্লাহ্ যাকে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, সে যদি তার যাকাত আদায় না করে তা হলে কিয়ামতের দিন তা একটি বিষধর অজগরের রূপ ধারণ করবে যার দু’চোখের উপর দু’টি কালো চিহ্ন থাকবে। কিয়ামতের দিন তার গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পাশে ছোবল মারতে থাকবে এবং বলবে আমিই তোমার সম্পদ, আমিই তোমার পুঞ্জীভূত ধন। তারপর নবী করীম (ছঃ) এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন : (অর্থ) আর আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে যা তাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে, তাদের জন্য তা মঙ্গল এ যেন তারা কিছুতেই মনে না করে। না, এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যাতে তারা কৃপণতা করবে কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলায় বেড়ি হবে। –(সূরা আলে ইমরান, ৩ : ১৮০)

রাসূলুল্লাহ (ছঃ) যাকাত নিয়ে অবহেলা করার ভয়ানক পরিণাম থেকে সাবধান করে বলেছেন, কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে কেউ যেন আমার কাছে এ অবস্থায় না আসে যে, তার ছাগল তার ঘাড়ের উপর চাপানো থাকবে এবং তা ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে এবং (আমি তোমাকে আল্লাহর হুকুম আহকাম পৌঁছিয়ে দিয়েছিলাম। আর সেদিন তোমাদের কেউ যেন তার উট তাঁর ঘাড়ের উপর বহন করা অবস্থায় আমার নিকট না আসে, যা আওয়াজ করতে থাকবে। তখন সে (সাহায্যের জন্য) আমাকে ডাকবে। আমি বলবো, আজ তোমার জন্য আমি কিছুই করতে পারবো না। আমি তো আল্লাহর হুকুম-আহকাম তোমাকে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলাম।’

একদিন নবী করীম (ছঃ) দেখলেন যে, দু’জন মহিলা তাদের হাতে সোনার কাকন পরিধান করে আছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এর যাকাত দাও কি না। তারা না বললে, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন, তোমরা কি তাহলে এটা চাও যে, এ সবের বদলে তোমাদের আগুনের কংকন পরানো হবে? তারা বললো, না না, কখনই নয়। তখন নবী করীম (ছঃ) বললেন, এ সবের যাকাত দিতে থাকো।-(তিরমিযী)

যাকাত যে ফরয তা পবিত্র কোরআন ও হাদীসে রাসূলের মাধ্যমে আমরা ইতিপূর্বে জানতে পেরেছি। ইসলামী শরীআতের দৃষ্টিতে ফরযকে অস্বীকারকারী হল কাফির। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ তায়ালা যাকাত আদায় না করাকে মুশরিকদের কাজ বলেছেন।ধ্বংস অনিবার্য, ঐ সকল মুশরিকদের জন্যে যারা যাকাত আদায় করে না।–(সূরা হামীম-আস্ সাজদা, ৪১ঃ ৬-৭)

কোরআন ও সুন্নার এ সব সাবধান বাণীর ফলে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) যাকাত-সাদকার ব্যাপারে অত্যন্ত তৎপর ছিলেন। অনেকের অনুভূতি এতটা তীব্র ছিল যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি কপর্দকও কাছে রাখা সমীচীন মনে করতেন না। হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ)-এর তো অভ্যাস ছিল যে, যখনই তিনি একত্রে কিছু লোক দেখতেন তখনই যাকাতের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন।

.

যমীনে উৎপন্ন ফসলের যাকাত

১। মাসয়ালা : কোন শহর কাফেরদের অধিকারে ছিল। তারাই সেখানে বসবাস করত। মুসলিম বাদশাহ্ স্বীয় প্রতিনিধি পাঠিয়ে অমুসলিমদেরকে মিথ্যা দ্বীন ও জাহান্নামের পথ ত্যাগ করে সত্য দ্বীন ইসলাম গ্রহণের আহবান জানালেন। কিন্তু দুরাচার কাফেররা সে আহবানে সাড়া দিল না। তারপর তাদেরকে বলা হল, তাহলে তোমরা আমাদের বশ্যতা স্বীকার করে খাজনা আদায় কর এবং আমাদের প্রজা হয়ে আমাদের রক্ষণাবেক্ষণে সুখ শান্তিতে বসবাস করতে থাক। কাফেররা এ আহবানে সাড়া দিল না। এরপর মুসলিম বাদশাহ্ আল্লাহর নিকট সাহায্য চেয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। আল্লাহ্ পাক মুসলমানদেরকে বিজয়ী এবং কাফেরদেরকে পরাজিত করে দিলেন। মুসলিম বাদশাহ্ ওই শহর বা দেশকে যারা ওই জেহাদে গাযী ছিলেন তাদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। এভাবে যে সব দেশ মুসলমানদের অধীন হয়েছে অথবা যে দেশের অধিবাসী মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ না করে আপন ইচ্ছায় মুসলমান হয়েছে এবং মুসলমান বাদশাহও তাদেরকে তাদের যমীনে স্বত্বাধিকারী হিসাবে বহাল রেখেছেন, এ দু’ প্রকার যমীনকে ওশরী যমীন বলে। সমগ্র আরব দেশের যমীন ওশরী। এছাড়া মুসলমান বাদশাহ্ কর্তৃক যে সব যমীনের স্বত্বাধিকারী কাফেররা সাব্যস্ত হয়েছে এবং তাদের ওপর খেরাজ ধার্য করা হয়েছে সে সব যমীনকে খেরাজী যমীন বলে।

খেরাজী যমীনের খেরাজ দিতে হয়, ওশর দিতে হয় না, আর ওশরী যমীনের ওশর দিতে হয়।

২। মাসয়ালাঃ কারো পূর্ব পুরুষ থেকে বংশানুক্রমে ওশরী যমীন চলে আসলে, অথবা কোন মুসলমানের নিকট থেকে ওশরী যমীন ক্রয় করে থাকলে সে যমীনের যাকাত দিতে হবে। ওশর দেয়ার নিয়ম হলো, যে সব যমীনে পরিশ্রম করে পানি দিতে হয় না, বরং স্বাভাবিক বৃষ্টির পানিতে বা বর্ষার স্রোতের পানিতে ফসল জন্মে, সে সব যমীতে যা কিছু ফসল হয়, তার এক দশমাংশ আল্লাহর রাস্তায় দান করা ওয়াজিব। অর্থাৎ দশ মণ হলে একমণ, দশ সের হলে এক সের। আর যে সমস্ত যমীতে পরিশ্রম করে পানি দিয়ে ফসল জন্মাতে হয়, সে সব যমীর ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ আল্লাহর পথে দান করতে হবে। অর্থাৎ বিশ মণ হলে এক মণ, বিশ সের হলে এক সের। বাগ-বাগিচার ক্ষেত্রেও ওই একই হুকুম। ইমাম আবু হানীফার (রহঃ) মতে, যমীনের ফসলের কোন নেছাব নির্ধারিত নেই। কম হোক বেশি হোক, যা হয় তার দশ ভাগের এক ভাগ দিতে হবে।

৩। মাসয়ালা : ধান, পাট, গম, সরিষা, কলাই, বুট, কাওন, ফল, তরীতরকারী, শাকসজি, সুপারী, নারকেল, আখ, বেন্না, খেজুর গাছ, কলা গাছ ইত্যাদির ক্ষেতে যা কিছু জন্মিবে তার ওশর দিতে হবে, এটাই যমীনের যাকাত।

৪। মাসয়ালা : ওশরী যমীন থেকে অথবা অনাবাদি বন বা পাহাড় থেকে মধু সংগ্রহ করলে তারও ওশর দিতে হবে।

৫। মাসয়ালা : চাষের যমীনে বা বাগানে না হয়ে বাড়িতে কোন ফল বা তরকারী হলে তার জন্য ওশর ওয়াজিব হবে না।

৬। মাসয়ালাঃ ওশরী যমীন কোন কাফের ক্রয় করে নিলে, সে যমীন ওশরী থাকবে না। পুনরায় সে কাফের থেকে কোন মুসলমান ক্রয় করে নিলে বা অন্য কোন প্রকারে পেলে, তবুও ওশরী হবে না।

৭। মাসয়ালা : দশ ভাগের একভাগ কিংবা বিশ ভাগের একভাগ যমীনের মালিকের ওপর, না ফসলের মালিকের ওপর, এতে আলেমদের মধ্যে মত বিরোধ বিদ্যমান আছে। সুবিধার জন্য আমরা বলে থাকি যে, ফসলের মালিকের ওপর। কাজেই, যমীন যদি নগদ টাকায় পত্তন দেয়, তবে ফসল যে পাবে, ওশর তারই দিতে হবে। আর যদি বর্গা দেয়া হয়ে ফসল যে যে পরিমাণ পাবে, তার সে পরিমাণ ফসলের ওশর দিতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *