০৪. ছলাত বা নামায (৪র্থ খণ্ড)

৪র্থ খণ্ড – ছলাত বা নামায

নামাযের গুরুত্ব

ছলাত আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ দোয়া, রহমত, তওবা ইত্যাদি। শরীয়াতের পরিভাষায় নির্দিষ্ট রুকন ও যিকরসমূহকে বিশেষ নিয়মে নির্ধারিত সময়ে আদায় করাকে ছলাত বলা হয়। ছলাতকে নামাযও বলা হয়।

ইসলামে নামাযের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে নামায অন্যতম। নামাযকে দীনের খুঁটি বলা হয়েছে। খুঁটি ছাড়া যেমন ঘর হয় না তদ্রূপ নামায ছাড়াও দীন পরিপূর্ণ হয় না। নামাযের ফরযিয়্যাত অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ-মহিলা সকলের জন্যই তা অবশ্য পালনীয়। শরীয়ত সম্মত ওযর ছাড়া নামায তরক করার নাজায়েয। নামাযের ফরযিয়্যাতকে অস্বীকার করলে কাফের বলে গণ্য হবে।–(আলমগীরী, ১ম খণ্ড)

নামায আদায় করাই মু’মিন ব্যক্তির ঈমানের নিদর্শন।

 রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) এরশাদ বলেন :

بين العبد وبين الكفر ترك القنواة

অর্থ : বান্দা ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে নামায ত্যাগ করা।–(মেশকাত শরীফ)

অর্থাৎ নামাযই প্রমাণ করে দেয় যে, কে অনুগত বান্দা আর কে অস্বীকারকারী বা কাফের। সুতরাং একজন মু’মিন বান্দাকে তাঁর ঈমানের প্রমাণস্বরূপ অবশ্যই প্রত্যহ পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায আদায় করতে হবে। তাই ইসলামে ঈমানের পরই নামায কায়েমের জন্য গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কোরআন মজীদের বহু স্থানে নামায কায়েমের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

وأقيموا القلوة وأثوا الكوۃ واژگوا مع الكوين

অর্থ : তোমরা ছলাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর আর যারা রুকূ করে তাদের সাথে রুকূ’ কর। (সূরা বাকারা, ২ ও ৪৩)

রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) এ ব্যাপারে বলেছেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাযের হিসাব হবে। যদি এ বিষয় ঠিক থাকে তবে সে মুক্তি পাবে এবং সফলকাম হবে। আর যদি তা ঠিক না থাকে তবে সে ব্যর্থ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।–(তিরমিযী)

অপর এক হাদীসে আছে, একবার হযরত উমর (রাঃ) তাঁর প্রশাসকদের নিকট এ মর্মে পত্র পাঠালেন যে, আমার মতে তোমাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে নামায। যে ব্যক্তি নামাযের হিফাযত করল এবং যথাসময় নামায আদায় করল সে তার দীনের হিফাযত করল। আর যে ব্যক্তি তা বরবাদ করল সে নামায় ছাড়া অন্য আমলকেও চরমভাবে বরবাদ করে দিল।

–(মেশকাত, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৪৯)

.

মি’রাজ ও পাঁচ ওয়াক্ত নামায

চাঁদ-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, গাছ-পালা, তরু-লতা, জীবন-জন্তু, পশু-পাখি, এক কথায় এ পৃথিবীতে আল্লাহ্ তা’আলা যত মাখলুক সৃষ্টি করেছেন সব কিছুই নিজ নিজ পদ্ধতিতে মহান রব্বুল আলামীনের দরবারে সিজদাবনত হয়ে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। তার এবাদত ও আনুগত্যে সকলেই মশগুল। কোথাও কোন অবাধ্যতা ও হঠকারিতা নেই। কোথাও নেই বিরক্তির সামান্যতম প্রকাশ। আদেশ পালন করে এবং সার্বক্ষণিক সিজদায় রত থেকে সকলেই কৃতার্থ। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

والله يشجد ما في الموت وما في الأرض من دابة في المملكة وهم

لا يشتكېرون

আসমান ও যমীনে যত জানদার মখলুক আছে। আল্লাহকেই সিজদা করে তারা অহংকার করে না। (সূরা নাহূল, ১৬ঃ ৪৯)

এতে প্রমাণিত হয় যে, আসমান-যমীনে যত কিছু আছে সব কিছুই আল্লাহর দরবারে সিজদাবনত হয়। তবে তাদের সিজদার ধরন ও পদ্ধতি আমাদের মত নয়। শুধু এতটুকুই নয় বরং তাদের তাসবীহ, তাহলীল এমনকি নামায আদায়ের কথাও কোরআন মজীদে বিবৃত হয়েছেঃ

ألم تر أن الله يسبح له من في الموت والأرض والطير طقت كل

ق لم صلاته وتستبيحه والله عليه بما يفعلون

অর্থ : আপনি কি দেখেননি যে, আসমান-যমীনে যারা আছে তারা এবং উডডীয়মান বিহঙ্গকুল আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। প্রত্যেকেই জানে তাদের নামায এবং পবিত্রতা ও মহিমা পদ্ধতি। তারা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ্ সম্যক অবগত। –(সূরা নূর, ২৪ : ৪১)

প্রত্যেকেই জানে তাদের নামায আদায়ের পদ্ধতি–মহান আল্লাহর এ ঘোষণা থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, এ দুনিয়াতে যত মাখলূক রয়েছে সকলেই নিজ নিজ পদ্ধতিতে নামায আদায় করছে। অনুরূপ পূর্ববর্তী নবী-রাসূলরাও নামায আদায় করেছেন।

দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা এ উম্মাতের বৈশিষ্ট্য। মি’রাজের রজনীতে এ পাঁচ ওয়াক্ত নামায আল্লাহ তা’আলা উম্মতে মুহাম্মদীর উপর ফরয করেছেন। হযরত আনাস ইবন মালিক (রাঃ) বলেন, মি’রাজ রজনীতে নবী (ছঃ)-এর উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয হয়েছিল। পরে তা কমিয়ে শেষ পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত করা হয়। এরপর বলা হয়, হে মুহাম্মদ! আমার কথায় কোন রদবদল হয় না। আপনার জন্য এ পাঁচ ওয়াক্তের ছাওয়াব পঞ্চাশ ওয়াক্তেরই সমান।-(তিরমিযী)

পঞ্চাশ ওয়াক্ত থেকে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত সাব্যস্ত করার মনস্তাত্বিক ফায়দা হল, এতে মানুষের মনে সদা এ কথা জাগরুক থাকবে যে, পঞ্চাশ ওয়াক্তই হচ্ছে ফরয নামাযের প্রকৃত সংখ্যা। অর্থাৎ পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় সময়, শক্তি, যোগ্যতা ও সামর্থ দিয়েই আল্লাহ্ পাক মানুষকে সৃজণ করেছেন। এ ধারণা যার অন্তরে জাগ্রত থাকবে তার পক্ষে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা মোটেই কঠিন ও কষ্টকর বলে মনে হবে না। বরং সে ভাববে, আমাকে তো আরো অধিক সংখ্যক নামাযের যোগ্যতা দেয়া হয়েছিল। পরম করুণাময় আল্লাহ্ তা’আলা যদি তার পূর্ব নির্দেশ রহিত না করতেন তবে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযই আমাদেরকে আদায় করতে হত। কিন্তু তিনি তার দুর্বল বান্দাদের উপর একান্ত দয়া পরবশ হয়ে পাঁচ ওয়াক্তকেই পঞ্চাশ ওয়াক্তের সমতুল্য বলে ঘোষণা করেছেন। নামাযের ওয়াক্ত পঞ্চাশ থেকে পাঁচ-এ কমিয়ে আনার এ রহস্যপূর্ণ নির্দেশের মধ্যে একদিকে যেমন বান্দার মনোবল বৃদ্ধি পাচ্ছে, অপর দিকে বান্দার মনে আল্লাহর অপার অনুগ্রহের কথাও বিশেষভাবে জাগ্রত হচ্ছে।

যে রাতে নবী করীম (ছঃ)-এর মি’রাজ হয়েছিল তারপর দিনই আল্লাহ্ পাক হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-কে তাঁর নিকট পাঠালেন নামাযের ওয়াক্ত, রাকাত ইত্যাদি সম্বন্ধে তাঁকে বাস্তবভাবে অবহিত করার জন্য। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন, জিবরাঈল (আঃ) বায়তুল্লাহর পাশে আমাকে নিয়ে দুদিন নামায আদায় করেন। প্রথম দিন তিনি যুহরের নামায আদায় করেছেন যখন কোন বস্তুর ছায়া জুতার ফিতার মত সামান্য লম্বা হয়। আসরের নামায আদায় করেছেন যখন কোন বস্তুর ছায়া তার সমান হয়। মাগরিবের নামায আদায় করেছেন যখন সূর্য অস্ত যায়। এবং রোযাদার ইফতার করে। এশার নামায আদায় করেছেন যখন শাফাক’ (সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর পশ্চিমাকাশে শেষ লালিমা পরবর্তী শুভতা) লীন হয়ে যায়। অবশেষে ফজরের নামায আদায় করেছেন যখন উজ্জ্বল হয়ে সুবহে সাদিকের উন্মেষ ঘটে এবং রোযাদারের জন্য খাদ্য গ্রহণ হারাম হয়ে যায়। তারপর দ্বিতীয় দিন তিনি যুহরের নামায আদায় করেছেন যখন প্রতিটি বস্তুর ছায়া তার সমান হয় অর্থাৎ গত দিনের আসরের নামায আদায় করার সময়। আসরের নামায আদায় করেছেন যখন প্রতিটি বস্তুর ছায়া তার দ্বিগুণ হয়। মাগরিবের নামায আদায় করেছেন প্রথম দিনের সময়েই। এশার নামায আদায় করেছেন যখন রাতের তিনভাগের একভাগ অতিক্রান্ত হয়। অবশেষে তিনি ফজর আদায় করেছেন যখন ভালভাবে পৃথিবী ফর্সা হয়ে যায়। এরপর জিবরাঈল (আঃ) আমার দিকে ফিরে বললেন, হে মুহাম্মদ! এ হল আপনার পূর্ববর্তী নবীদের নামাযের ওয়াক্ত। এ দুয়ের মাঝের ওয়াক্তই হল আপনার নামাযের ওয়াক্ত। -(তিরমিযী)

.

নামায ফরয হওয়ার দলীল

নামাযের ফরযিয়াত কোরআন, হাদীস, ইজমা এবং কিয়াস দ্বারা প্রমাণিত। নামায ফরয হওয়ার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

وأقيموا الصلوة واوا الكوة واركعوا مع الركعين

উচ্চারণ : ওয়া আক্বীমুছ ছলা-তা ওয়া আ-তুয যাকাতা ওয়ার কাউ’ মা’আর রা-কিঈন।

অর্থ : তোমরা নামায কায়েম কর ও যাকাত দাও এবং যারা রূকূ’ করে তাদের সাথে রুকূ কর। (সূরা বাকারা, ২ ও ৪৩)

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে :

با موقوتا

إن الصلوة كانت على المؤمنين

উচ্চারণ : ইন্নাছ ছলা-তা কা-নাত আলাল মুমিনীনা কিতা-বান্ মাওকূতান্।

অর্থ : নিশ্চয়ই নির্ধারিত সময়ে নামায কায়েম করা মু’মিনদের জন্য ফরয। –(সূরা নিসা, ৪ ও ১০৩)

 পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময় সমূহের প্রতি ইঙ্গিত করে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

في الليل وقران الفجر إن قران

ام القلوة لدلوك الشمس إلى

الفجر كان مشهودا

উচ্চারণ : আক্বিমিছ ছলা-তা লিদুলুকিশ শামছি ইলা-গাসাকিল্লাইলি অ কূরআ-নাল ফাজ্বরি ইন্না কুরআ-নাল ফাজ্বরি কা-না মাশহুদা।

অর্থ : সূর্য হেলে পড়ার পর হতে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত নামায কায়েম করবে। আর ফজরে কোরআন পাঠের স্থায়ী নীতি অবলম্বন কর, কেননা, ফজরের কোরআনে উপস্থিত থাকা হয়।–(সূরা বণী ইসরাইল, ১৭ঃ ৭৮)

তাফসীর বিশারদরা উপরোক্ত আয়াতে উল্লিখিত দুলূক শব্দ দ্বারা যুহর, আসর ও মাগরিব, গাসাকিল লাইল শব্দ দ্বারা এশার নামায এবং কুরআনাল ফাজর শব্দের দ্বারা ফজরের নামাযের প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। হাদীসেও এর প্রতি সমর্থন রয়েছে। এ ছাড়া আরো বহু আয়াতে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে।

নামাযের ফরযিয়াত হাদীস দিয়েও প্রমাণিত। নবী করীম (ছঃ) বলেন :

أبدوا ربكم ولوا مگم وهؤوا شهركم وحوا بيت بگم

وأتوا كاة أموالكم طيبة بها أنفسكم تدخلوا جه رگم

অর্থ : তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করবে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে, রমযানের রোযা রাখবে, বায়তুল্লাহ্ শরীফের হজ্জ আদায় করবে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের সম্পদের যাকাত দেবে, তা হলে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের বেহেশতে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে।

অপর এক হাদীসে আছে, উবাদা ইবন সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন :

إن الله فرض على عباده المؤمنين في كل يوم وليلة خمس

صلوات

অর্থ : আল্লাহ্ পাক তাঁর মু’মিন বান্দাদের উপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন।

নামাযের ফরযিয়াতের বিষয়টি যৌক্তিকভাবেও প্রমাণিত। কেননা, আল্লাহ্ পাক আমাদের প্রতি অসংখ্য অনুগ্রহ করেছেন। তিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করেছেন, ঈমান ও হিদায়াত নসীব করেছেন। সর্বোপরি তিনি আমাদেরকে উম্মতে মুহাম্মদী করেছেন। এসবই আমাদের জন্য তাঁর অপার দান কাজেই আমাদের জন্য অপরিহার্য হল, এসব নি’আমতের শোকর আদায় করা। তার আনুগত্য করা এবং দৈনিক পাঁচবার নামায আদায় করা। এ নামাযের দ্বারা যেমন আল্লাহর নি’আমতের শোকর আদায় হচ্ছে, তেমনি এর বদৌলতে নামাযীর গুনাহ মাফ হয়ে যাচ্ছে এবং নামাযী নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হচ্ছে। কেননা, বান্দা যখন নামাযে দাঁড়ায় তখন তার থেকে কোন গুনাহ্ প্রকাশ হওয়ার কল্পনাই করা যায় না। মোটকথা নামাযের ফরযিয়াত কোরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস দ্বারা সুপ্রমাণিত।

নামাযের ফরযিয়াত এবং ওয়াক্ত যেমনিভাবে কোরআন, হাদীস, ইমা ও কিয়াস দ্বারা প্রমাণিত ঠিক তেমনি নামাযের রাক’আতসমূহও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করার পেছনে আল্লাহ্ পাকের বিরাট হিমত নিহিত রয়েছে, আর তা হল নামাযের এ প্রাত্যহিকতার মাধ্যমে নামাযী তার আত্মা ও রূহের খাদ্য লাভ করে। অনুরূপভাবে এর দ্বারা। মুসল্লী নিজের কালব’কে সৃষ্টিবিমুখ ও স্রষ্টামুখী করে লোভ লালসা ও শয়তানের চতুর্মুখী প্ররোচনা থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। অতএব এ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের প্রতি যত্নবান হওয়া সকলের জন্যই অপরিহার্য।

.

নামাযের উপকারিতা ও ফযীলত

নামায আদায়ের বহু উপকারিতা ও ফযীলত রয়েছে। যেমনঃ ১. আত্মিক, ২. দৈহিক, ৩, সামাজিক ও ৪. পারলৌকিক ইত্যাদি।

নামাযের আত্মিক উপকারিতা হল, নামায যেহেতু আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্যের বাস্তব রূপ ও আল্লাহর সাথে মি’রাজ সমতুল্য। কাজেই আল্লাহকে হাযির-নাযির জেনে অন্তরে আল্লাহর ভয় রেখে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যদি আল্লাহর প্রতি চরম আনুগত্যের ধ্যান সহ নামায আদায় করা হয় তবে এ নামাযে অবশ্যই নামাযীর আত্মিক উন্নতি হবে।

পবিত্র কোরআনে রশাদ হয়েছে :

قد افلح المؤمنون الذين هم في صلاتهم خشون

অর্থ : অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মু’মিনগণ, যারা বিনয়-নম্র নিজেদের নামাযে। –(সূরা মুমিনূন, ২৩ : ১-২)

এ ধরনের নামায মানুষকে অন্যায় ও অপকর্ম থেকে ফিরিয়ে রাখে। মানুষের আত্মাকে কলুষমুক্ত রাখে। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেনঃ

إن القلوة تنهى عن الفحشاء والمنكر وليزر الله اكبر والله

يعلم ما تشنقون

উচ্চারণ : ইন্নাছ ছলা-তা তানহা–আনিল ফাহশা-য়ি অল মুনকার; অলাযিকরুল্লাহি আকবার; অল্লা-হু ইয়ালামু-তাছনাউন।

অর্থ : নিশ্চয়ই নামায বিরত রাখে অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে। আল্লাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ। তোমরা যা কর আল্লাহ্ তা জানেন।–(সূরা আনকাবুত, ২৯ ও ৪৫)

নবী করীম (ছঃ) বলেন :

إذا قام أحدكم إلى الصلوة فلا يبصق أمامه فإنما ناجی مادام

في صلاة۔

অর্থ : তোমাদের কেউ যখন নামায পড়তে দাঁড়ায় তখন সে যেন সামনের দিকে থুথু না ফেলে। কেননা, যতক্ষণ সে তার জায়নামাযে থাকে ততক্ষণ সে আল্লাহর সাথে মুনাজাত তথা গোপন কথায় লিপ্ত থাকে।-(মেশকাত, পৃঃ ৬৯)

নামাযের দৈহিক উপকারিতা হলো, পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে হলে দৈনিক পাঁচবার ওযূ করতে হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। নামায আদায় করতে দৈহিক যে কসরত হয় তাও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তাছাড়া মসজিদে গিয়ে নামায আদায়ের জন্য কিছু হাঁটাচলা করতে হয় তাও দেহের জন্য খুবই উপকারী। বিশেষ করে ফজরের সময় ঘুম থেকে জেগে মসজিদে যাতায়াত করে সকালের মৃদুমন্দ বাতাস উপভোগ করা স্বাস্থ্যের জন্য বড়ই কল্যাণকর। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দ্বারাও এ কথা অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থিত।

নামাযের পারলৌকিক উপকারিতা হল, নামায যেহেতু আল্লাহর মহব্বত ও আনুগত্য প্রকাশের অন্যতম পন্থা, নামায আল্লাহ্ ও বান্দার মধ্যে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, তাই নামায হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতে বেহেশত লাভের অন্যতম মাধ্যম বা উসীলা। এ কারণেই নামাযকে বেহেশতের চাবি বলা হয়েছে। সে স্থানে পৌঁছার জন্য মানুষের গুনাহ্ এবং পাপমোচন করিয়ে যোগ্যতম করে তোলে এ নামাযই। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন :

الصلوات الخمس والجمعة إلى الجمعة في رمضان إلى رمضان

مقرات إما بينه إذا اجتنبت الكبار

অর্থ পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমু’আ হতে অন্য জুমুআ এবং এক রমযান থেকে অন্য রমযান সে সব গুনাহ্ মোচনকারী, যে সব গুনাহ্ মধ্যর্তী সময়ে হয়ে থাকে। যদি কবীরা গুনাহ্ সমূহ থেকে বেঁচে থাকা হয়।–(মেশকাত, পৃঃ ৫৭)

রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন, যে ব্যক্তি যথাযথভাবে নামায আদায় করবে কিয়ামতের দিন নামায তার জন্য নূর হবে, হিসাবের সময় দলীল হবে এবং নাজাতের উসীলা হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি যথাযথভাবে নামায আদায় করবে না নামায তার জন্য নূর, দলীল এবং নাজাতের উসীলা হবে না। অধিকন্তু তার হাশর হবে কারূন, ফির’আউন, হামান এবং উবাই ইবন খাল্‌ফের সাথে।’–(মেশকাত, পৃঃ ৫৯)

নামায হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার সাথে বান্দার দাসত্ব তথা গোলামী ও মহব্বতের চূড়ান্ত প্রকাশ। একজন মুসলমান যদি নামাযের পূর্ণ গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায যদি নিছক প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখে এবং যদি নামাযের মর্মবাণী হৃদয়ে অনুরণিত হয় তাহলে এ কথা সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় যে, নামায নামাযীর জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটাবে। নামাযই নিয়ন্ত্রণ করবে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি কাজ এবং প্রতিটি পদক্ষেপ।

বস্তুত গায়রুল্লাহর ইবাদত এবং গায়রুল্লাহর গোলামীর শৃংখল হতে মানুষকে মুক্ত করে এক আল্লাহর ইবাদত এবং দাসত্বে নিয়োজিত করা নামাযের অন্যতম লক্ষ্য।

নামাযের শুরুতেই নামাযী দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করছে আল্লাহু আকবর–আল্লাহই মহান, সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর সমতুল্য কেউ নয়। সূরা ফাতিহা তিলাওয়াতের মাধ্যমে বান্দা নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর দরবারে সমর্পণ করে দিচ্ছে।

রূকূ’–সিজদার দ্বারা বান্দা এ কথাই ঘোষণা করছে যে, আমার এ মাথা কেবলমাত্র তার সামনে লুটিয়ে পড়ার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। এ মাথা দুনিয়ায় কারো সামনে নত হতে পারে না।

খুশু-খুযূ তথা বিনয় ও একাগ্রতা নামাযের একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয়। বিনয় ও একাগ্রতার সাথে নামায আদায়ের অর্থ হল, নামাযী ব্যক্তি মহান আল্লাহকে হাযির-নাযির জেনে এমনভাবে নামায আদায় করবে যে, তার অন্তরে থাকবে আল্লাহর মহব্বত ও ভালবাসায় ভরপুর এবং তার প্রতি ভয়, তার বড়ত্ব ও মহানত্বের চিন্তায় বিগলিত। দাঁড়ানো অবস্থায় নামাযী ব্যক্তি মনে মনে ভাববে যে, আমি আল্লাহর সামনে দাঁড়ান এবং আমি তারই প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছি। এভাবে রুকূতে গিয়ে সে ভাবতে যে, আমি কেবল আল্লাহর সম্মুখেই আমার মাথা অবনত করছি। সিজদায় এ কথা চিন্তা করবে যে, আমি কেবল তাঁরই সম্মুখে সিজদাবনত হচ্ছি এবং তাঁরই সম্মুখে সকল অনুনয়-বিনয় প্রকাশ করছি।

উত্তম হল, নামাযের মধ্যে যে সব সূরা, কিরাত, তাসবীহ্ ইত্যাদি পড়া হয় তা বুঝে পড়া। বস্তুত নামাযের প্রকৃত স্বাদ তখনই পুরোপুরিভাবে লাভ করা যাবে যদি নামাযী নিজের পঠিত কথাগুলো ও বাক্যগুলোর অর্থ বুঝে পড়ে।

প্রকৃতপক্ষে নামাযের মধ্যে বিনয় ও একাগ্রতা রক্ষা করা এবং আল্লাহর দিকে নিজের দৃষ্টিকে নিবদ্ধ রেখে একাগ্রচিত্তে মনোযোগী হওয়াই নামাযের প্রাণ বা মূল-রূহ। আল্লাহর যে সব বান্দা এভাবে নামায আদায়ের জন্য সচেষ্ট থাকেন তাদের সফলতা অর্জন অবশ্যম্ভাবী। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

قد افلح المؤمنون–الذين هم في صلاتهم خشعون

উচ্চারণ : কাদ আফলাহাল মুমিনূন। আল্লাযীনা হুম ফী ছলাতিহিম খা-শিউন।

অর্থ : নিশ্চয়ই সফলকাম হয়েছে মু’মিনগণ, যারা নিজেদের নামাযে বিনয় ও নম্র। (সূরা মু’মিনূন, ২৩ : ১-২)

আল্লাহ্ তা’আলা আরো এরশাদ করেন :

واستعينوا بالصبر والصلوة–وانها كبيرة الأعلى الخومين

উচ্চারণ : ওয়াসতাঈ’নূ বিচ্ছবরি ওয়াস ছলা-হ। ওয়া ইন্না হা–লাকাবীরাতুন ইল্লা আলাল খা-শিঈন।

অর্থ : তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য কামনা কর এবং তা বিনীতরা ব্যতীত আর সকলের নিকট নিশ্চিতভাবে কঠিন।–(সূরা বাকারা, ২ ও ৪৫)

খুশু-খুযূ সম্বন্ধে হাদীস শরীফে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন :

যদি কেউ ওয়াক্ত মত নামায আদায় করে, নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে পরিপূর্ণভাবে ওযূ করে এবং কিয়াম, রূকু ও সিজদা ইত্যাদি বিনয় ও একাগ্রতার সাথে আদায় করে, তবে তার এ নামায দীপ্তিময় উজ্জ্বল হয়ে উঠে এবং নামাযীর জন্য দোয়া করতে থাকে।

.

নামায তরক করার ভয়াবহতা

নামায তরক করা শক্ত গুনাহ্। যে গুণাহ তওবা ছাড়া মাফ হয় না। হাদীসে নামায তরককারীর প্রতি কঠিন্ হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে।

হযরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছঃ) বলেছেনঃ

فرق بين العبد وبين الكفر ترك القلواة

অর্থ : বান্দা ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে নামায তরক করা।–(মুসলীম)

অর্থাৎ নামায তরক করাই প্রমাণ করে যে, কে আল্লাহর বান্দা এবং কে কাফির। অন্য হাদীসে আছে, নবী করীম (ছঃ) বলেছেনঃযে ব্যক্তি নামায আদায় করে না দীন ইসলামে তার কোন অংশ নেই।–(ফাযায়েলে আমাল)

বেনামাযী ব্যক্তি কিয়ামতের দিন চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হবে। এ সম্বন্ধে এরশাদ হয়েছে :

يوم يكشف عن ساق ويدعون الى الجود فلا يستطيعون خاشعة أبصارهم ترهقهم ذلة وقد كانوا يدعون إلى السجود وهم

شلمون

অর্থ : স্মরণ কর, সেই চরম সংকটের দিনের কথা, যেদিন তাদেরকে ডাকা হবে সিজদা করার জন্য; কিন্তু তারা তা করতে পারবে না। তাদের দৃষ্টি অবনত, হীনতা তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে। অথচ যখন তারা নিরাপদ ছিল তখন তো তাদেরকে ডাকা হয়েছিল সিজদা করতে। –(সূরা কালাম, ৬৮ : ৪২-৪৩)

আলোচ্য আয়াতের সারমর্ম হল, কিয়ামতের দিন যখন সব যুগের সকল মানুষ ময়দানে হাশরে সমবেত থাকবে তখন আল্লাহ্ তা’আলার এক বিশেষ তাজাল্লী প্রকাশিত হবে। সে সময় উচ্চস্বরে আওয়াজ দেয়া হবে যে, তোমরা আল্লাহ্ তা’আলার সম্মুখে সরাসরি সিজদায় লুটিয়ে পড়। এ ঘোষণার পর নামাযীরা সিজদায় লুটিয়ে পড়বে। কিন্তু বেনামাযীরা সিজদা করতে সক্ষম হবে না। তাদের পিঠ কাঠের মত শক্ত হয়ে যাবে। তখন অপমান ও লাঞ্ছনা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে নেবে।–(ফাযায়েলে আমাল, পৃঃ ২৩৬-৩৭)

.

নামায যাদের উপর ফরয

প্রাপ্ত বয়স্ক, আকেল বুদ্ধিমান এবং হায়েয ও নেফাস থেকে পবিত্র প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর উপর নির্ধারিত সময়ে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা ফরয। অপ্রাপ্তবয়স্ক, পাগল এবং ঋতুবতী নারীর উপর নামায ফরয নয়।

কাফের মুসলমান হলে, নাবালেগ বালেগ হলে, পাগল সুস্থ হলে এবং মহিলা হায়েয ও নেফাস থেকে পবিত্র হলে তাহরীমা বাধার সময় বাকী থাকলে সে ওয়াক্তের নামায আদায় করা তার উপর ফরয। আর এসব কারণ যদি নামাযের শেষ ওয়াক্তে পাওয়া যায় যেমন শেষ ওয়াক্তে কেউ পাগল হলো, শেষ ওয়াক্তে কোন নারীর হায়েয-নেফাস আসল এমতাবস্থায় সর্বসম্মতিক্রমে নামায আদায় করা তার উপর ফরয নয়।

.

নামায

আল্লাহ্ তা’আলার নিকট নামায অতিব মর্তবার এবাদত। আল্লাহ্ পাকের নিকট নামায বেহেশতে স্থান দেবেন।

২। হাদীস : হযরত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন নামায দ্বীনের খুঁটিস্বরূপ। যে উত্তমরূপে নামায কায়েম রাখল, সে দ্বীনকে কায়েম রাখল এবং যে খুঁটি ভেঙ্গে ফেলল, সে দ্বীনকে বরবাদ করে ফেলল।

৩। হাদীসঃ কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাযেরই হিসাব নেয়া হবে। নামাযীর হাত, পা এবং মুখ কিয়ামতের দিন সূর্যের মত উজ্জ্বল হবে; বেনামাযীর ভাগ্যে তা জুটবে না।

৪। হাদীসঃ কিয়ামতের ময়দানে নামাযীরা থাকবে নবী, শহীদ এবং ওলীদের সাথে আর বেনামাযীরা অবস্থান করবে ফেরআউন, হামান এবং কারূণ প্রভৃতি বড় বড় কাফিরদের সাথে।

প্রত্যেক ব্যক্তির নামায পড়া অবশ্য কর্তব্য। নামায আদায় না করলে আখেরাতের জীবনের ক্ষতি তো আছেই, পার্থব জীবনেরও ক্ষতি আছে। অধিকন্তু যারা নামায আদায় না করবে আখেরাতে তাদেরকে কাফিরদের সমতুল্য গণ্য করা হরে। আল্লাহ্ হেফাজত করুন। নামায আদায় না করা কত বড় অন্যায়।

পাঁচ ওয়াক্ত নামায পাগল ও নাবালেগ ব্যতীত সকলের ওপর ফরয। ছেলেমেয়ে সাত বছর বয়স হলে তাদেরকে দিয়ে নামায আদায় করা মা-বাবার উপর ওয়াজিব। দশ বছর বয়সে ছেলেমেয়ে নামায আদায় না করলে তাদেরকে প্রহার করে নামায আদায় করাতে হবে।

নামায কারো জন্য মাফ নেই। কোন অবস্থাতেই নামায ত্যাগ করা দুরুস্ত নয়। রুগ্ন, অন্ধ, খোঁড়া, আতুর, বোবা, বধির যে যে অবস্থায় আছে, তার সে অবস্থাতেই নামায আদায় করতে হবে। অবশ্য যদি কেউ ভুলে গেলে বা ঘুমিয়ে পড়লে নামাযের ওয়াক্তের ভেতর মনে না আসলে বা ঘুম না ভাংলে তার গুনাহ্ হবে না বটে, কিন্তু স্মরণ হওয়া এবং ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে ক্বাযা আদায় করে নেয়া ফরয। অবশ্য তখন মাকরূহ ওয়াক্ত হলে, (অর্থাৎ সূর্য উদয় বা অস্তমিত যাওয়ার সময় যদি মনে পড়ে বা ঘুম ভাঙ্গে) তবে একটু দেরী করে আদায় করবে। যাতে মাকরূহ ওয়াক্ত চলে যায়। তেমনি বেশি অবস্থায় নামায ছুটে গেলে তজ্জন্য গুনাহ্ হবে না।

.

নামাযের ওয়াক্ত

নারী-পুরুষ প্রত্যেকের জন্য দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা ফরয। কাজেই ওয়াক্তগুলো চিনে নেয়া আবশ্যক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের নাম। ১। ফজর, (২) যোহর, (৩) আছর, (৪) মাগরিব ও (৫) এশা। ফজরের নামায দু’ রাকায়াত, যোহরের চার রাকায়াত, আছরের চার রাকাআত, মাগরিবের তিন রাকাআত এবং এশার চার রাকাআত; মোট ১৭ রাকাআত নামায দৈনিক ফরয।

.

আযান

একজন লোক নামাযের সময় উচ্চৈঃস্বরে আল্লাহর এবাদতের সময় হয়েছে বলে মুছল্লীদেরকে আল্লাহ্পাকের দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য আহ্বান করে; এ আহ্বানকে আযান’ বলে। যে আযান দেয় তাকে মুয়াযযিন’ বলে। বিনা বেতনে আযান দেয়ার ফযীলত অনেক বেশি।

১। হাদীস : যে আযান দেবে ও একামত দেবে এবং আল্লাহ পাককে ভয় করবে তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। অন্য হাদীসে বর্ণিত আছে যে ব্যক্তি সাত বছর পর্যন্ত বিনা বেতনে আযান দেবে সে বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর এক। হাদীসে বর্ণিত আছে, কেয়ামতের ময়দানে মুয়াযযিনের মর্তবা এত বড় হবে যে, সে যত লোকের ভিড়ের মাঝেই থাকুক না কেন সবার মাথার ওপর দিয়ে তার মাথা দেখা যাবে।

যে কাজের যত বড় মর্তবা, তার দায়িত্বও তত বেশি হয়।

২। হাদীসঃ মুয়াযযিন আমানতদার আর ইমাম যিম্মাদার; অর্থাৎ নামাযের ওয়াক্ত না চিনে আযান দিলে বা মিনারের ওপর ওঠে লোকের ঘর বাড়ীর দিকে দৃষ্টি দিলে মুয়াযযিন শক্ত পাপী হবে। আর নামাযের মধ্যে কোন ক্ষতি করলে বা যাহেরী বাতেনী তাকওয়া ও পরহেযগারীর সাথে নামায না আদায় করলে তার জন্য ইমাম দায়ী।

৩। হাদীসঃ মুয়াযযিনের শব্দ যত দূর যাবে ততদূর পর্যন্ত জীন, ইনসান, আসমান, জমিন, বৃক্ষ, পশুপাখী সকলেই তার জন্য সাক্ষ্য দেবে। অতএব, যথাসম্ভব উচ্চৈঃস্বরে আযান দেয়া উচিত।

১। মাসয়ালা : ওয়াক্ত হওয়ার আগে আযান দিলে সে আযান শুদ্ধ হবে না, আবার আযান দিতে হবে, তা ফজরের আযান হোক আর জুময়ার নামাযের আযান হোক।

২। মাসয়ালা : হযরত মুহাম্মদ (ছঃ) থেকে শ্রুত এবং বর্ণিত অবিকল আরবি শব্দগুলো ব্যতিরেকে অন্য কোন প্রকার বা অন্য কোন ভাষায় আযান দিলে তা শুদ্ধ হবে না। যদিও তা দ্বারা আযানের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়।

৩। মাসয়ালা : মহিলাদের জন্য আযান নেই। আযান দেবে পুরুষরাই। মেয়েলোকের আযান দেয়া জায়েয নেই। (কেননা, মেয়েলোকের উচ্চ শব্দ করা এবং অপর পুরুষকে শব্দ শোনানো নিষেধ।) কাজেই মেয়েলোক আযান দিলে পুরুষকে আবার আযান দিতে হবে। আযান না দিলে যেন আযান ছাড়াই নামায আদায় করা হলো।

৪। মাসয়ালা : পাগল বা অবুঝ বালক আযান দিলে সে আযান শুদ্ধ হবে না, পুনরায় আযান দিতে হবে।

৫। মাসয়ালা : আযান দেয়ার সুন্নাত তরীকা হলো মুয়াযযিনের গোসলের প্রয়োজন হলে গোসল করবে এবং ওযূ না থাকলে ওযূ করে মসজিদের বাইরে একটু উঁচু জায়গায় ক্বেবলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দু’হাতের শাহাদাত আঙ্গুল দু’কানের ছিদ্রের ভেতর রেখে যথাসম্ভব উচ্চ আওয়াজে খোশ এলহানের সাথে (আল্লা-হু আকবার আল্লাহু আকবার) (আল্লাহ সর্বাপেক্ষা বড়, আল্লাহ সর্বাপেক্ষা বড়) বলে শ্বাস ছাড়বে এবং এ পরিমাণ সময় অপেক্ষা করবে যাতে শ্রোতারা উত্তর দিতে পারে। তারপর আবার বলবে (আল্লা-হু আকবার আল্লাহু আকবার) তারপর শ্বাস ছেড়ে দেবে। পরে বলবে– (আশহাদূ আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ) শ্বাস ছেড়ে আবার বলবে, (আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ)-অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তারপর শ্বাস ছেড়ে দেবে। অতঃপর বলবে– (আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লা-হ) অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল তারপর শ্বাস ছেড়ে আবার বলবে– (আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লা-হ।) তারপর শ্বাস ছেড়ে ডান দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলবে (হাইয়্যা আলাছ ছলা-হ) অর্থাৎ সকলে নামাযের দিকে আস। এরপর শ্বাস ছেড়ে পুনরায় ডান দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলবে (হাইয়্যা আলাছ ছলা-হ) অতপর শ্বাস ছেড়ে বাম দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলবে (হাইয়্যা আলাল ফালা-হ) কল্যাণের দিকে আস। তারপর শ্বাস ছেড়ে বাম দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলবে, (হাইয়্যা আলাল ফালা-হ)। এরপর কেবলামুখী হয়ে শ্বাস ছেড়ে বলবে (আল্লা-হু আকবার, আল্লাহু আকবার)–অর্থাৎ আল্লাহ সর্বাপেক্ষা বড়, আল্লাহ সর্বাপেক্ষা বড়। সর্বশেষ বসবে। (লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ)-অর্থাৎ এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। ফজরের আযানে দ্বিতীয়বার (হাইয়্যা আলাল ফালা-হ) বলার পর শ্বাস ছেড়ে কিবলার দিকে মুখ রেখে বলবে (আছছালা-তু খাইরুম মিনান্নাঊ-ম) অর্থাৎ ঘুম থেকে নামায উত্তম। তারপর পুনরায় শ্বাস ছেড়ে কিবলার দিকে মুখ রেখে বলবে—(আচ্ছলা-তু খাইরুম মিনান্নাউ-ম) এরপর (আল্লা-হু আকবার আল্লাহু আকবার) (লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ) বলে আযান সমাপ্ত করবে। আযানের মধ্যে মোট ১৫টি বাক্য এবং ফজরের আযানে ১৭টি বাক্য। গানের সুরে বা উঁচু নীচু শব্দ করে আযান দেবে না। যথাসম্ভব টেনে লম্বা করে আওয়াজ উচ্চ করে আযান দেবে কিন্তু যেখানে যবরের সাথে আলিফ বা খাড়া যবর নেই সেখানে টানবে না। যেখানে আলিফ, খাড়া যবর বা মদ আছে সেখানে টানবে। এ সম্বন্ধে শিক্ষকের নিকট থেকে শিখে নেবে। শব্দ এত উচ্চ করবে না বা এত লম্বা টানবে না যে, নিজের জানে কষ্ট হয়। (জুময়ার দ্বিতীয় আযান অপেক্ষাকৃত ছোট আওয়াযে হওয়া উচিৎ; কেননা, ওই আযান দিয়ে কেবল উপস্থিত লোকদেরকে সর্তক করা হয়।)

৬। মাসয়ালা : এক্বামত ও আযান একই ধরনের। কিন্তু কয়েকটি ব্যাপারে কিছুটা পার্থক্য আছে। যেমন–(ক) আযান, নামায আরম্ভ হওয়ার এতটুকু পূর্বে দেয়া আবশ্যক, যেন আশে পাশের মুছল্লিগণ বিনা আয়েশে স্বাভাবিকভাবে এস্তেঞ্জা, ওযূ শেষ করে জামায়াতে এসে অংশ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু একামত শোনার সাথে সাথে দাঁড়িয়ে কাতার সোজা করতে হবে।

(খ) আযান মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে দিতে হয়; কিন্তু এক্বামত মসজিদের ভেতরে দাঁড়িয়ে দিতে হয়। তবে কেবল মাত্র জুময়ার দ্বিতীয় আযান মসজিদের ভেতরে দাঁড়িয়ে দিতে হয়।

(গ) আযান যথাসম্ভব উচ্চৈঃস্বরে দিতে হয়ে; কিন্তু একামত তত উচ্চৈঃস্বরে দিতে হয় না, উপস্থিত ও নিকটবর্তী সকলে শুনতে পারে এতটুকু জোরে হলেই যথেষ্ট।

 (ঘ) ফজরের আযানের মধ্যে শেষবার হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ বলার পর দু’বার আচ্ছালাতু খাইরুম মিনান্নাউম’ বলতে হয়; কিন্তু একৃামতের মধ্যে তা বলা লাগবে না; বরং তার পরিবর্তে পাঁচ ওয়াক্ত এক্বামতেই শেষবার হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ বলার পর দু’বার ক্বাদ ক্বামাতিচ্ছলাহ’ বলতে হবে।

(ঙ) আযান দেয়ার সময় কানের ছিদ্র আঙ্গুল দিয়ে বন্ধ করতে হয়; কিন্তুএক্বামত দেয়ার সময় কানের ছিদ্রে আঙ্গুল দিতে হয় না এবং হাইয়্যা আলাছছলাহ’ ও হাইয়্যা আলাল ফালাহ বলার সময় ডানে বামে মুখও ফেরাবার প্রয়োজন নেই। তবে কোন কোন কিতাবে যে মুখ ফিরাবার কথা লেখা হয়েছে তা অত্যধিক বড় মসজিদ হলে প্রয়োজনের তাগীদে করা যেতে পারে, তবে জরুরী নয়।

.

আযান এবং এক্বামত

১। মাসয়ালা : মুক্বীম বা মুসাফীর, একাকী বা জামায়াত, ওয়াক্তিয়া নামায বা ক্বাযা নামায সকল ধরনের ফরজে আইন নামাযের জন্য পুরুষদের একবার আযান দেয়া সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্ (প্রায় ওয়াজিবের সমান) কিন্তু জুম’আর জন্য দুবার আযান দেয়া সুন্নাত। -(শামী ১ম জিলদ ৩৫৭ পৃঃ)

২। মাসয়ালাঃ জিহাদ ইত্যাদি দ্বীনি কাজে লিপ্ত থাকা অবস্থায় কিংবা এখতিয়ার বহির্ভূত কোন কারণে যদি সর্বসাধারণের নামায ক্বাযা হয়, তবে উক্ত ক্বাযা নামাযের জন্যও উচ্চঃস্বরেই আযান, একামত দিতে হবে। কিন্তু যদি নিজের অলসতার অথবা খেয়াল না থাকার কারণে নামায ক্বাযা হয়, সেক্ষেত্রে (উক্ত নামায চুপে চুপেই পড়ে নেয়া উচিৎ)। তজ্জন্য আযান এক্বামত কানে আঙ্গুল দেয়া ছাড়া আস্তে আস্তেই বলতে হবে যাতে অপর কেউ জানতে না পারে। কেননা, দ্বীনের কাজে অলসতা করা বা খেয়াল না রাখা পাপের কাজ এবং পাপের কাজ বা পাপের কথা লোকের কাছে প্রকাশ করা নিষেধ। যদি কয়েক ওয়াক্তের ক্বাযা নামায একত্রে আদায় করতে হয়, সেক্ষেত্রে কেবল মাত্র প্রথম ওয়াক্তের জন্য আযান দেয়া সুন্নাত। অন্য ওয়াক্তগুলো উক্ত সময় এক সাথে আদায় করবে, তার জন্য পৃথক পৃথক একামত আযান দেয়া সুন্নাত নয়; মুস্তাহাব। তবে এক্বামত সকল ওয়াক্তের জন্যই আলাদা আলাদা ভাবে দেয়া সুন্নাত।–(নূরুল ঈযাহ)।

৩। মাসয়ালাঃ কিছু লোক দলবদ্ধভাবে সফর করলে তাকে কাফেলা বলা হয়। যদি কাফেলার সকল লোক হাজির থাকে, সেক্ষেত্রে তাদের জন্য আযান দেয়া মুস্তাহাব। কিন্তু সকল অবস্থায়ই এক্বামত সুন্নাত। (দুররে মুখতার)।

৪। মাসয়ালা : কারণ বশতঃ বাড়ীতে একা অথবা জামায়াতে নামায পড়লে আযান দেয়া মুস্তাহাব। পাড়া অথবা গ্রামের মসজিদে যদি আযান দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে সেখানেই নামায পড়া উচিত। কারণ, পাড়ার মসজিদ পাড়ার অধিবাসীদের জন্য যথেষ্ট। যে গ্রামে বা পাড়ায় মসজিদ আছে সেই মসজিদে আযান, একামত ও জামায়াতের ব্যবস্থা করা পাড়ার সকলের জন্যই সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ (প্রায় ওয়াজিব)। এ সত্ত্বেও কেউ আযানের ব্যবস্থা না করলে এলাকার সকলেই গুনাহগার হবে। মাঠ অথবা বিলের মধ্যে এলাকার মসজিদের আযানের আওয়াজ শোনা গেলে মসজিদে গিয়েই নামায আদায় করা উচিৎ। কিন্তু মসজিদে না গিয়ে সেখানেই। নামায পড়লে তজ্জন্য আযান দেয়া সুন্নাত নয়, মুস্তাহাব। আযানের আওয়াজ শোনা না গেলে আযান দিয়েই নামায আদায় করতে হবে কিন্তু সকল অবস্থায়ই এক্বামত সুন্নাত।

৫। মাসয়ালা : পাড়ার মসজিদে আযান ও এক্বামত দিয়ে জামায়াত হয়ে থাকলে পুনরায় সেখানে আযান, এক্বামত দিয়ে নামায পড়া মাকরূহ্। কিন্তু যদি কোন মসজিদে ইমাম, মুয়াযযিন অথবা মুসল্লি নির্দিষ্ট না থাকে তবে সেখানে মাকরূহ্ নয়, বরং উত্তম।-(শামী)।

৬। মাসয়ালাঃ যেখানে জুময়ার নামাযের শর্তাবলী বর্তমান থাকে এবং জুময়ার নামায আদায় করা হয় সেখানে কোন কারণে বা বিনা কারণে যদি জুময়ার আগে বা পরে কেউ যোহরের নামায আদায় করে, এক্ষেত্রে আযান ও এক্বামত বলা মাকরূহ্।-(শামী)।

৭। মাসয়ালা : নামায জামায়াতে আদায় করুক বা একাই আদায় করুক মহিলাদের জন্য আযান ও এক্বামত মাকরূহ্।-(দুরে মুখতার)।

৮। মাসয়ালা : ফরজে আইন ছাড়া আর কোন নামাযে আযান একামত নেই–ফরজে কেফায়া। যেমন : জানাযার নামায, বা ওয়াজিব নামায–যেমন : বিতর এবং ঈদের নামায অথবা নফল নামায যেমন–কুছুফ, খুছুফ, এশরাক, এস্তেস্কা এবং তাহাজ্জুদ ইত্যাদি নামায। -(আলমগিরী)।

৯। মাসয়ালা : নারী পুরুষ, পাক নাপাক যেই হোক, আযান শুনলে তার জন্য আযানের উত্তর দেয়া মুস্তাহাব। আবার অনেকে ওয়াজিবও বলেছেন কিন্তু অনেকে আবার মুস্তাহাব কওলকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। (কেউ কেউ বলেছেন, আযানের উত্তর দু’প্রকার। প্রথমতঃ মৌখিক উত্তর, দ্বিতীয়তঃ ডাকে সাড়া দিয়ে মসজিদের জামায়াতে যোগ দিয়ে কাজের মাধ্যমে উত্তর দেয়া। মৌখিক উত্তর দেয়া মুস্তাহাব। কিন্তু ১। কাজের মাধ্যমে উত্তর দেয়া ওয়াজিব। এখানে মৌখিক উত্তরের বিষয়ই বলা হচ্ছে। মৌখিক উত্তরের নিয়ম হল, মোয়াযিন আযানের যে শব্দটি বলবে, শ্রোতাও সেই শব্দটি বলবে কিন্তু মোয়াযিন যখনহাইয়্যা আলাছ ছলাহ এবংহাইয়্যা আলাল ফালাহ্ বলবে তখন শ্রবণকারী বলবে।;?–adu এবং ফজরের নামাযের আযানে মোয়াযিন যখন, আছছলাতু খাইরুম মিনান নাউম বলবে তখন যে শুনবে সে বলবে, –৬ ও ৭ আযান শেষ হওয়ার পর সকলেই একবার দুরূদ শরীফ এবং নিম্নল্লিখিত দোয়া পাঠ করবে।

.

আযানের দোয়া

اللهم رب هذه الدعوة التامة . والشلوة القائمة أي سيدنا محمدن

الوسيلة والفضيلة والدرجة الرفيعة. وابعثه مقاما محمود ي اين وعثثه . إنك لا تخلف الميعاد–

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা রব্বা হা-যিহিদ দাওয়াতিত্ তা-স্মাতি ওয়াছ ছলা-তিল কা-ইমাতি আ-তি সাইয়্যিদিনা–মুহাম্মাদানিল ওয়াসীলাতা ওয়াল ফাদ্বীলাতা ওয়াদ্ দারাজাতার রাফী আতা ওয়াব আসহু মাক্কা-মাম মাহমূদানিল্লাযী ওয়া আদ তাহু ইন্নাকা লা–তুখলিফুল মী’আ-দ।

১০। মাসয়ালাঃ জুম’আর যখন প্রথম আযান হয়, তখনই সকল প্রকার কাজকর্ম ছেড়ে মসজিদের দিকে ধাবিত হওয়া ওয়াজিব। ওই সময় ক্রয়-বিক্রয়, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হওয়া হারাম।

১১। মাসয়ালাঃ এক্বামতের উত্তর দেয়াও মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়। এক্বামতের উত্তর আযানের অনুরূপই। কিন্তু এক্বামতে ক্বাদাক্বামাতিছ ছলাহ শুনে শ্রোতা বলবে। আক্বা-মাহাল্লা-হু ওয়া আদা-মাহা-।

 ১২। মাসয়ালা : আযানের উত্তর দেয়া আট অবস্থায় ঠিক নয়। (১) নামাযরত অবস্থায় (২) যে কোন খুৎবা শোনার সময়। (৩) হায়েযের সময়। (৪) নেফাস অবস্থায়। (৫) দ্বীনি এলম অথবা শরীয়তের মাসয়ালা-মাসায়িল শিখার সময় ও শিক্ষাদানের সময়। (৬) স্ত্রীর সাথে মিলন অবস্থায়। (৭) মল-মূত্র ত্যাগকালে। (৮) আহারের সময়। তবে আযান শেষ হয়ে বেশিক্ষণ সময় না হয়ে থাকলে আহার শেষ করে উত্তর দেবে, কিন্তু বেশি সময় অতিক্রান্ত হলে উত্তর দেয়ার প্রয়োজন নেই।

.

নামাযের শর্তসমূহ

১। মাসয়ালা : নামায আরম্ভ করার পূর্বে কতগুলো কাজ ওয়াজিব। যেমন : (১) ওযূ না থাকলে ওযূ করে নেবে। গোসলের প্রয়োজন থাকলে গোসল করে নেবে। (২) শরীরে বা কাপড়ে কোন নাপাকী থাকলে তা পরিষ্কার করে নিতে হবে। (৩) যে স্থানে নামায আদায় করবে। সে স্থান পাক হতে হবে। (৪) সতর ঢাকা (পুরুষের সতর নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত, কিন্তু যদি কাপড় থাকে তবে পায়জামা, লুঙ্গী, জামা ইত্যাদি পরে নামায পড়া সুন্নাত। মহিলাদের সতর হাতের কব্জি এবং পায়ের পাতা ছাড়া পা থেকে মাথা পর্যন্ত সমস্ত দেহ। (৫) যে নামায আদায় করবে, সে মনে মনে খেয়াল করবে যে, অমুক নামায, যেমন–ফজরের দু’ রাক’আত ফরজ নামায আল্লাহর ওয়াস্তে তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য আদায় করছি। (৬) ওয়াক্ত হওয়ার পর নামায পড়বে। এ ছয়টি বিষয় নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত নির্ধারিত করা হয়েছে। এর মধ্য থেকে একটি শর্তও যদি বাদ পড়ে, তাহলে নামায হবে না। (নূরুল ঈযাহ্)।

২। মাসয়ালাঃ পাতলা যে কাপড়ে দেহ দেখা যায়, সে কাপড় পরিধান করে নামায আদায় করলে নামায হবে না। যেমন–ফিনফিনে পাতলা এবং জালিদার কাপড়ের ওড়না পরিধান করে নামায জায়েয হবে না। (বাহরুর রায়েক)।

৩। মাসয়ালা : যদি নামায আরম্ভ করার সময় সতরের অঙ্গগুলোর কোন একটা অঙ্গের এক চতুর্থাংশ খোলা থাকে, তাহলে নামাযের শুরুই জায়েয হবে না। উক্ত স্থান ঢেকে পুনরায় নামায শুরু করতে হবে। আরম্ভ করার সময় ঢাকা ছিল কিন্তু পরে নামাযের মাঝে খুলে গিয়ে এ পরিমাণ সময় ভোলা থাকে যে, তাতে তিনবার (সুবহানাল্লাহ) পড়া যায়, তবে নামায ভঙ্গ হয়ে যাবে, আবার নামায পড়তে হবে। কিন্তু যদি ভোলা মাত্রই ঢেকে নেয়া হয়, তবে নামায হয়ে যাবে। এটা হলো নিয়ম। এ নিয়ম মাফিক মহিলাদের পায়ের নলার চার ভাগের এক ভাগ, হাতের বাজুর চার ভাগের এক ভাগ, এক কানের এক চতুর্থাংশ, মাথার এক চতুর্থাংশ, চুলের চার ভাগের এক ভাগ, পেট, পিঠ, ঘাড়, বুক অথবা স্তনের এক চতুর্থাংশ খোলা থাকলে নামায হবে না এবং গোপন অংগগুলোর যে কোন একটি যথা : রানের চার ভাগের একভাগ খোলা থাকলে নারী-পুরুষ কারোই নামায আদায় হবে না। (বাহরুর রায়েক)।

৪। মাসয়ালা : নাবালেগ মেয়ে নামায পড়ার সময় তার মাথার ঘোমটা সরে গিয়ে মাথা খুলে গেলে তাতে তার নামায ভঙ্গ হবে না কিন্তু যদি মেয়ে বালেগ হয় তবে নামায ভঙ্গ হবে।

৫। মাসয়ালা : দেহের অথবা পরিধানের বস্ত্রের কিছু অংশ নাপাক থাকলে এবং ঘটনাক্রমে তা ধৌত করার জন্য পানি কোনখানে পাওয়া না গেলে উক্ত নাপাক দেহ বা বস্ত্র নিয়েই নামায আদায় করবে, তথাপি নামায ছাড়বে না। (কানযুদ্দাকায়েক)

৬। মাসয়ালা : কোন লোকের সমস্ত কাপড় নাপাক থাকলে অথবা এক চতুর্থাংশের কম পাক থাকলে তার জন্য উক্ত নাপাক বস্ত্র নিয়েই নামায আদায় করা দুরুস্ত হবে। যদিও উক্ত বস্ত্র খুলে উলঙ্গ অবস্থাতেও নামায আদায় করা জায়েয আছে, কিন্তু নাপাক বস্ত্র পরিধান অবস্থাতেই নামায আদায় করা উত্তম। যদি চার ভাগের একভাগ কিংবা তার চেয়ে বেশি পাক থাকে, তবে বস্ত্র খুলে রাখা দুরুস্ত হবে না, উক্ত বস্ত্রে নামায পড়া ওয়াজিব।

৭। মাসয়ালা : কোন লোকের কাছে যদি মোটেই কাপড় না থাকে, তাহলে উলঙ্গ অবস্থাতেই নামায আদায় করবে, কিন্তু এমন জায়গায় নামায পড়বে যেখানে কোন লোকে দেখতে না পায় এবং দাঁড়িয়ে নামায পড়বে না। বসে পড়বে এবং রুকূ সেজদা ইশারায় করবে। আর দাঁড়িয়ে নামায আদায় করবে এবং রূকু সেজদা করলেও জায়েয হবে। নামায আদায় হয়ে। যাবে, তবে বসে আদায় করা উত্তম।

৮। মাসয়ালাঃ সামান্য কিছু পানি কাছে আছে, যা দিয়ে ওযূ করলে নাপাকী ধোয়া যায় না এবং নাপাকী থোয়া হলে ওযূ করা হয় না। কোথাও যদি আর পানি পাওয়া না যায়, তবে এক্ষেত্রে উক্ত পানি দিয়ে নাপাকী ধুয়ে এবং পরে ওযূর পরিবর্তে তায়াম্মুম করবে।-(বেঃ জেওর)

.

আরও কতিপয় মাসয়ালা

১। মাসয়ালা : একখণ্ড কাপড়ের এক পার্শ্ব যদি নাপাক হয় এবং অপর পার্শ্ব পরিধান করে নামায পড়তে চায়, তাহলে দেখতে হবে, নামায আদায়ের সময় নাপাক পার্শ্ব টান লেগে নড়ে-চড়ে কি না? নাপাক পার্শ্ব যদি নড়ে-চড়ে তবে নামায হবে না, আর যদি না নড়ে তবে নামায হবে। নামায পড়ার সময় যদি নামাযী ব্যক্তির হাতে, জেবে, কাঁধে প্রভৃতি স্থানে নাপাকী থাকে তবে তার নামায হবে না। কিন্তু কোন নাপাক জীব নিজে এসে যদি তার শরীরে লাগে বা বসে কিন্তু তার দেহে বা কাপড়ে কোন নাপাকী না লাগে, তবে তার নামায ভঙ্গ হবে না। অবশ্য যদি নাপাকী লাগে তবে নামায নষ্ট হবে। যেমন : কেউ নামায আদায় করছে এমন সময় হঠাৎ একটি কুকুর তার শরীরে লেগে গেলো কিংবা তার শিশু সন্তান কোলে বা কাঁধে ওঠে বসলো। এমন অবস্থায় কুকুর অথবা শিশুর শরীরে শুকনো নাপাকী থাকলে তাতে নামায নষ্ট হবে না। কিন্তু ভিজা নাপাকী থাকলে এবং তা নামাযীর দেহে বা বস্ত্রে লাগলে নামায নষ্ট হয়ে যাবে। শিশুর গায়ে পেশাব বা বমি লেগে তা ধৌত করার পূর্বে শুকিয়ে গেলে, সেই শিশুকে কোলে বা কাঁধে নিয়ে নামায আদায় করলে নামায হবে না। দ্রুপ কোন নাপাক বস্ত্রে বা শিশিতে কিংবা তাবিজে মুখ বন্ধ করে রেখে সাথে নিয়ে নামায আদায় করে, তাহলেও নামায আদায় হবে না। কিন্তু নাপাক বস্তু আপন জন্মস্থানে থাকলে তা যেমন : একটি ভাঙ্গা পচা ডিম সাথে নিয়ে নামায আদায় করলে নামায আদায় হবে। কেননা, এই নাপাকী তদ্রুপ যেমন মানুষের পেটের মধ্যেও নাপাকী থাকে।

২। মাসয়ালাঃ নামায আদায়ের স্থান নাজাছাত থেকে পাক থাকতে হবে তা মাটি বা বিছানা যা-ই হোক। কিন্তু নামাযের স্থানের অর্থ দু পা এবং সেজদা দেয়ার সময় দু হাঁটু, দু’ হাতের তালু, কপাল এবং নাক রাখার স্থান।

৩। মাসয়ালাঃ কিন্তু যদি এক পা রাখার স্থান পাক থাকে, নামাযের সময় অন্য পা উঠিয়ে রাখে, তাতেও নামায হয়ে যাবে।

৪। মাসয়ালা : কোন বস্ত্র বা বিছানার ওপর নামায আদায় করলে যদি উক্ত বস্তু বা বিছানার সকল স্থান নাপাক থাকে, শুধু উল্লিখিত পরিমাণ স্থান পাক থাকে তবে নামায আদায় হবে।

৫। মাসয়ালা : কোন নাপাক মৃত্তিকা বা বিছানার ওপর পাক বস্ত্র বিছিয়ে তার ওপর নামায আদায় করতে হলে ওই বস্ত্র পাক হওয়ার সাথে সাথে এটাও শর্ত রয়েছে যে, তা (মোটা হতে হবে) এতটুকু চিকন যাতে না হয়, যার ফলে নীচের জিনিস দেখা যায়।

৬। মাসয়ালা : নামায আদায়ের সময় নামাযী ব্যক্তির কাপড় কোন নাপাক স্থানে গিয়ে পড়লে অসুবিধা নেই।

৭। মাসয়ালা : নামায আদায়ের সময় যদি অন্য কোন ব্যক্তির জন্য ওযরবশতঃ সতর ঢাকা সম্ভব না হয়, তাহলে উক্ত অবস্থাতেই নামায আদায় করবে। যেমন জেলের মধ্যে পুলিশ সতর ঢাকার পরিমাণ কাপড় না দেয় অথবা কোন জালিম লোক কাপড় পরিধান করলে হত্যার হুমকী দেয়, তাহলে উক্ত অবস্থায় নামায ত্যাগ করা যাবে না। নামায আদায় করতেই হবে, কিন্তু এ কারণ দূর হয়ে গেলে ওই নামায পুনরায় পড়তে হবে। আর সতর ঢাকতে না পারার কারণের উৎপত্তি কোন ব্যক্তির পক্ষ হতে না হলে, যেমন–তার নিকট বস্ত্র বলতে কিছু নেই, তথাপি উলঙ্গ অবস্থায় নামায আদায় করতে হবে। পরে বস্ত্র পেলে ওই নামায পুনরায় পড়তে হবে না।–(বাহর)

৮। মাসয়ালাঃ কারো নিকট কেবল এতটুকু পরিমাণ কাপড় আছে যে, তা দ্বারা সতর ঢাকা সম্ভব অথবা সম্পূর্ণ নাপাক স্থানের ওপর বিছিয়ে তার ওপর নামায পড়তে পারে, তাহলে এমন পরিস্থিতিতে তার বস্ত্র খণ্ড দিয়ে সতর ঢাকতে হবে আর নিতান্তই যদি পাক স্থান না পায়, তাহলে উল্লিখিত নাপাক স্থানেই নামায আদায় করবে। নামায ত্যাগ করতে পারবে না বা সতর খুলতে পারবে না।

৯.১০। মাসয়ালা : কেউ হয়ত যোহরের নামায আদায়ের পর জানতে পারলো যে, সে যখন নামায আদায় করেছে তখন যোহরের ওয়াক্ত ছিল না, আছরের ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছিল, তবে তার আর দ্বিতীয়বার ক্বাযা আদায় করতে হবে না। যে নামায পড়েছে তাই ক্বাযার মধ্যে গণ্য হবে। কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি নামায আদায় করার পর জানতে পারে যে, ওয়াক্ত হবার আগেই সে নামায পড়েছে তাহলে তার সে নামায আদৌ হবে না। পুনরায় আদায় করতে হবে। আর যদি কোন লোক সজ্ঞানে ওয়াক্ত হওয়ার আগেই নামায আদায় করে তবে তার তো। নামাযই হবে না।

১১। মাসয়ালা : নামাযের জন্য নিয়্যত ফরজ ও শর্ত বটে, তবে মৌখিকভাবে, বলার প্রয়োজন নেই। মনে মনে এতটুকু খেয়াল রাখলেই চলবে যে, যোহরের ফরয আদায় করছি। অথবা সুন্নাত হলে, সুন্নাত আদায় করছি। এতটুকু মনে করে আল্লাহু আকবার বলে হাত বাধবে। এতেই নামায আদায় হয়ে যাবে। সাধারণের মাঝে যে দীর্ঘ নিয়্যত করার নিয়ম প্রচলিত রয়েছে, তা বলা নিষ্প্রয়োজন।

১২। মাসয়ালা : নিয়্যতের শব্দগুলো মুখে বলতে চায় তবে মন ঠিক করে মুখে এটুকু বললেই হবে যে, আজকের যোহরের চার রাক’আত ফরজ আদায় করছি, আল্লাহু আকবার অথবা যোহরের চার রাক’আত সুন্নাত আদায় করছিআল্লাহু আকবার ইত্যাদি। একথাকা’বা শরীফের দিকে মুখ করেও বলা যায়, আবার না বলাতেও কোন দোষ নেই।

১৩। মাসয়ালাঃ কেউ হয়তো মনে মনে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, যোহরের নামায আদায় করবে কিন্তু মুখে বলার সময় ভুলবশতঃ আসরের নামায বলে ফেলেছে, তাতে নামায হয়ে যাবে।

১৪। মাসয়ালা : কেউ হয় তো মনে মনে এরূপ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, চার রাক’আত বলবে কিন্তু ভুলবশতঃ মুখে তিন রাক’আত অথবা ছয় রাক’আত বলে ফেলেছে, তা সত্ত্বেও তার নামায আদায় হয়ে যাবে। মনের নিয়্যতকেই ঠিক ধরা হবে।

১৫। মাসয়ালা : কারো কয়েক ওয়াক্ত নামায ক্বাযা হয়ে গেলে কুাযা আদায়ের সময় নির্দিষ্ট ওয়াক্তের নাম নিয়ে নিয়্যত করতে হবে, যেমন হয়ত বলবে, ফজর বা যোহরের ফরযের ক্বাযা আদায় করছি ইত্যাদি। নির্দিষ্ট ওয়াক্তের নিয়্যত না করে কেবল ক্বাযা আদায় করতেছি বললে ক্বাযা জায়েয হবে না। আবার আদায় করতে হবে।

১৬। মাসয়ালা : কয়েকদিনের নামায ক্বাযা হয়ে থাকলে দিন-তারিখ ঠিক করে নিয়্যত করতে হবে। যেমন–কারো হয়ত শনি, রবি, সোম এবং মঙ্গলবার এ চার দিনের নামায একত্রে ক্বাযা হয়েছে। এখন ওই ব্যক্তি এরূপ নিয়্যত করবে যে, শনিবারের ফজরের ক্বাযা আদায় করছি যোহরের ক্বাযা আদায়কালে বলবে, শনিবারের জোহরের ফরযের ক্বাযা আদায় করতেছি এমনিভাবে শনিবারের সব নামাযের ক্বাযা আদায় হয়ে গেলে পরে বলবে, রবিবারের ফজরের ক্বাযা আদায় করছি। এভাবে দিন ও ওয়াক্তের তারিখ নির্দিষ্ট করে নিয়্যত করলে নামায আদায় হবে, নতুবা আদায় হবে না। কয়েক মাসের বা কয়েক বছরের নামায ক্বাযা হয়ে থাকলে সন, মাস এবং তারিখ নির্দিষ্ট করে নিয়্যত করতে হবে, যেমন–হয়ত বললো, অমুক সালের অমুক মাসের অমুক তারিখের ফজরের ফরযের ক্বাযা আদায় করছি। এভাবে নির্দিষ্ট করে নিয়্যত না করলে ক্বাযা জায়েয হবে না।

১৭। মাসয়ালা : কারো দিন-তারিখ মনে না থাকলে এভাবে নিয়ত করবে, আমার জিম্মায় যত ফজরের ফরয বাকী রয়েছে, তার প্রথম দিনের ফজরের ফরযের ক্বাযা আদায় করছি কিংবাআমার জিম্মায় যত যোহরের ফরয নামায বাকী রয়েছে তার প্রথম দিনের যোহরের ফরয। নামাযের ক্বাযা আদায় করছি ইত্যাদি। এভাবে নিয়্যত করে বহুদিন পর্যন্ত ক্বাযা আদায় করতে থাকবে। যখন মন সাক্ষ্য দেবে যে, সম্ভবত আমার যত নামায ক্বাযা ছিল তার সবই আদায় হয়ে গেছে, তখন ক্বাযা পড়া ত্যাগ করবে। কিন্তু মন সাক্ষ্য দেয়ার পূর্বে নামায ত্যাগ করবে না এবং সাথে সাথে আল্লাহর নিকট ক্ষমাও চেয়ে নেবে।

১৮। মাসয়ালাঃ সুন্নাত, নফল, তারাবীহ্, ইত্যাদি নামায আদায়কালে শুধুমাত্র এতটুকু নিয়্যত করাই যথেষ্ট হবে যে, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে দু’ রাক’আত নামায আদায় করছি। সুন্নত, নফল বা ওয়াক্তের নির্দিষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই। কোন ব্যক্তি ওয়াক্তিয়া সুন্নাতের মধ্যে ওয়াক্তের নাম নিলে, সেটা উত্তম। কিন্তু তারাবীহর সুন্নাতের ক্ষেত্রে সুন্নাত তারাবীহ্ বলেই নিয়্যত করা অতি উত্তম।

১৯। মাসয়ালা : মুক্তাদীকে ইমামের এক্তেদারও নিয়্যত করতে হবে, অন্যথায় নামায হবে না। এরূপ নিয়্যত করবে যে, আমি এই ইমামের পেছনে নামায আদায় করছি ইত্যাদি।

২০। মাসয়ালা : ইমাম সাহেব শুধুমাত্র নিজ নামাযের নিয়্যত করবে, ইমামতের জন্য পৃথক নিয়্যত করা শর্ত নয়। অবশ্য কোন মহিলা যদি জামায়াতে যোগ দেয় এবং সে পুরুষদের কাতারে দণ্ডায়মান হয় এবং যদি উক্ত নামায জানাযা, জুমু’আ কিংবা ঈদের নামায না হয়ে থাকে, তাহলে ইমাম সাহেব উক্ত মহিলার নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য তার ইমামতীর নিয়াত করা শর্ত। সে যদি পুরুষদের কাতারে না দাঁড়ায় কিংবা জানাযার নামায, জুমু’আর নামায কিংবা ঈদের নামায হয়, সেক্ষেত্রে তার ইমামতির নিয়্যত করা শর্ত নয়।

২১। মাসয়ালা : মুক্তাদী যখন ইমামের সাথে এক্তেদা করার নিয়্যত করবে তখন ইমামের নাম নিয়ে নির্দিষ্ট করার প্রয়োজন নেই, কেবল মাত্র এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, আমি এই ইমামের পেছনে নামায আদায় করতেছি। অবশ্য নাম নিয়ে যদি নির্দিষ্ট করে তাও করতে পারে কিন্তু যার নাম নেয়া হয়েছে সে যদি ইমাম না হয়ে থাকে, যেমন–যদি কেউ বলে, যায়েদের পেছনে নামায আদায় করছি অথচ ইমাম হয়েছেন খালেদ, তাহলে উক্ত মুক্তাদীর নামায হবে না।

২২। মাসয়ালা : জানাযার নামাযের নিয়্যত এভাবে করবে, জানাযার নামায আদায় করছি আল্লাহ তা’আলাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এবং মুর্দার জন্য দোয়া করার জন্য। মুর্দা নারী না পুরুষ জানা না গেলে এরূপ বলবে, আমার ইমাম যার জানাযার নামায আদায় করছেন আমিও তারই জন্য জানাযার নামায আদায় করছি।

অনেক ইমামের সহীহ্ অভিমত হলো, ফরয ও ওয়াজিব ছাড়া অন্যান্য সুন্নাত ও নফল নামাযের নিয়্যত সুন্নাত, নফল অথবা কোন ওয়াক্তের সুন্নাত এবং এশরাক, চাশত, তাহাজ্জুদ, তারাবীহ কুছুফ, খুছুফ বলে নির্দিষ্ট করার আদৌ প্রয়োজন নেই। কেবল নামাযের নিয়্যত করলেই হবে। ওয়াক্তের নামকরণ বা নফল, সুন্নাত ইত্যাদি শ্রেণী বিভাগ করার দরকার হবে না।-(বেঃ জেওর)

.

ক্বেবলার মাসয়ালাসমূহ

১। মাসয়ালা : কেউ এমন কোন স্থানে গিয়ে হাজির হলো যেখানে কেবলা কোন্ দিকে তা ঠিক করতে পারছে না এবং এমন কাউকেও পাচ্ছে না, যার নিকট জিজ্ঞেস করতে পারে এক্ষেত্রে সে চিন্তা করে কেবলা ঠিক করে নেবে। অর্থাৎ মনে মনে চিন্তা করবে, কেবলা কোন্ দিকে হতে পারে। চিন্তা করার পর মন যে দিকে সাক্ষ্য দেবে সে দিকে মুখ করে নামায আদায় করবে। এমতাবস্থায় যদি চিন্তা ব্যতিরেকে নামায আদায় করে তবে নামায হবে না। এমন কি পরে যদি জানতেও পারে যে, ঠিক কেবলা রোখ হয়েই নামায আদায় করেছে তবুও নামায হবে না। যদি সেখানে কেউ থাকে তবে চিন্তা করা যাবে না, ওই লোকের নিকট জিজ্ঞেস না করে নামায আদায় করলে নামায হবে না। মেয়েলোক লজ্জায় জিজ্ঞেস ব্যতীত অনুমানের ওপর ভিত্তি করে একদিকে ফিরে নামায পড়লে তার নামাযও হবে না। আল্লাহ্ তা’আলার হুকুম পালন করার ব্যাপারে লজ্জা করা চলবে না, হিম্মত করে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে।

২। মাসয়ালা : কেউ না থাকার কারণে যদি জিজ্ঞেস করতে না পেরে চিন্তা করে নামায আদায় করে থাকে এবং পরে নামায শেষ করে জানতে পারে যে, ক্বেবলা ঠিক হয়নি, তাহলেও নামায হয়ে যাবে।

৩। মাসয়ালা : উল্লিখিত অবস্থায় চিন্তা করে এক দিকে কেবলা ঠিক করে নামায আরম্ভ করেছে, নামাযের মাঝেই হয়ত নিজে জানতে পারলো যে, আগের মত ভুল হয়েছে কিংবা কেউ বলে দিয়েছে যে, ওদিকে কেবলা নয়, তবে আসল কেবলা জানার সাথে সাথে সে দিকে ফিরে দাঁড়াতে হবে। জানার পর মূল ক্বেবলার দিকে ফিরে না দাঁড়ালে নামায হবে না।

৪। মাসয়ালা : যদি কোন কাফেলা এমন অবস্থার সম্মুখীন হয় যে, কেবলা কোন্ দিকে তা কেউই বলতে পারে না বা জানে না। অথচ জামায়াতে নামায আদায় করতে চায়, এক্ষেত্রে প্রত্যেকেই নিজ নিজ চিন্তা আলাদা আলাদা ভাবে করবে এবং তদানুসারে নামায আদায় করবে। চিন্তা করার পর যদি কয়েকজনের চিন্তা এক হয় তবে সে ক’জন জামায়াতে নামায আদায় করতে পারবে। কিন্তু যার মত ইমামের মতের সাথে মিলবে না, সে ওই ইমামের পেছনে। এক্তেদা করতে পারবে না। সে পৃথকভাবে নামায পড়বে। কেননা, তার মতে ওই ইমাম ভুল মত পোষণ করে কেবলা ছাড়া অন্য দিকে ফিরে নামায আদায় করছে এবং ফরজ তরক করছে। কেননা, কোন লোককে আল্লাহর বিরুদ্ধে ভুল মত পোষণকারী মনে করার পর তার পেছনে এতেদা করা দুরস্ত নয়। কাজেই ইমামের পেছনে একতেদা করে নামায আদায় করলে তার নামায হবে না।–(গওহার)।

৫। মাসয়ালা : কা’বা গৃহের অভ্যন্তরেও নামায আদায় করা দুরস্ত আছে। নফলই হোক আর ফরজই হোক।

৬। মাসয়ালা : কা’বা গৃহের অভ্যন্তরে নামায পড়লে যে কোন দিকে ফিরে নামায পড়তে পারবে। কেননা, সেখানে সব দিকই কেবলা।

৭। মাসয়ালাঃ যারা এমন এক স্থানে আছে যেখান থেকে কা’বা শরীফ দেখা যায়। তাদেরকে ঠিক কা’বার দিকে ফিরে নামায আদায় করতে হবে। তাদের জন্য পূর্ব, পশ্চিম বা উত্তর দক্ষিণের কোন কথা নেই। কিন্তু যারা দূরবর্তী স্থানে আছে, তারা কা’বা শরীফ যেদিকে সে . দিকেই মুখ করে নামায আদায় করবে। কা’বা শরীফের পূর্বে যারা আছে তারা পশ্চিম দিকে, পশ্চিম দিকের লোকেরা পূর্ব দিকে, উত্তর দিকের লোকরা দক্ষিণ দিকে এবং দক্ষিণ দিকের লোকেরা উত্তর দিকে ফিরে নামায আদায় করবে। অর্থাৎ পৃথিবীর যে স্থানেই থাকুক না কেন, কা’বা শরীফের দিকে মুখ করেই নামায আদায় করতে হবে।

৮। মাসয়ালা : কোন লোক যদি নৌকায়, স্টীমারে অথবা ট্রেনে ক্বেবলা ঠিক করে সে দিকে ফিরে নামায আরম্ভ করে এবং পরে যদি নৌকা, গাড়ি ইত্যাদি ঘুরে যায়, তবে তাকে সাথে সাথে ঘুরে ক্বেবলার দিকে ফিরে দাঁড়াতে হবে। ক্বেবলার দিকে ঘুরে না দাঁড়ালে নামায হবে না।

.

ফরয নামায পড়ার নিয়ম

৯। মাসয়ালা : নামাযের সময় হওয়ার পর পূর্ববর্ণীত নিয়মানুসারে সমস্ত দেহ পাক করে পাক বস্ত্র পরিধান করবে, গোছলের প্রয়োজন হলে গোসল করে নেবে, নতুবা ওযূ করে পাক স্থানে ক্বেবলারোখ হয়ে আল্লাহ্ তা’আলার সামনে ভাবে কায়মনোবাক্যে অবনত মস্তকে সোজা হয়ে দাঁড়াবে। অতঃপর সর্বাগ্রে নামাযের নিয়্যত করে মুখেআল্লাহু আকবার বলবে। সাথে সাথে পুরুষেরা দু’হাত দু’কান বরাবর এবং মহিলারা উভয় হাত কাঁধ বরাবর উঠাবে। মহিলারা দু হাত বস্ত্রের ভেতর রাখবে, বাইরে রাখবে না।

তদ্রুপ তাকবীরে তাহরীমা বলে পুরুষরা নাভীর নীচে এবং মহিলারা সীনার ওপর হাত বেঁধে দাঁড়াবে। হাত বাঁধার নিয়ম হলো পুরুষেরা বাম হাতের তালু নাভীর নিচে রাখবে এবং ডান হাতের তালু বাম হাতের তালুর পিঠের ওপর স্থাপন করে কনিষ্ঠা অঙ্গুলী এবং বৃদ্ধা অঙ্গুলি দ্বারা বাম হাতের কব্জি ধরবে, অনামিকা, মধ্যমা এবং শাহাদত অঙ্গুলি লম্বাভাবে বাম হাতের কব্জির ওপরে বিছানো থাকবে। মহিলারা কেবল উভয় স্তনের উপরি ভাগে বাম হাত নীচে রেখে তার ওপর ডান হাত রাখবে। অতঃপর ছানা পাঠ করবে

سبحانك اللهم وبحمدك وتبارك اسمك وتعالى جدك ولا إله

উচ্চারণ : সুবহানাকা আল্লা-হুম্মা ওয়াবিহামদিকা ওয়া তাবারা কাসমুকা ওয়া তা’আলা জাদুকা ওয়ালা-ইলা-হা গাইরুকা।

অর্থ : আল্লাহ! তুমি পবিত্র, তোমারই জন্য সকল প্রশংসা, তোমার নাম পবিত্র ও বরকতময়, তুমি মহান থেকে মহান, তুমি ছাড়া আর কোনই হুকুমকর্তা নেই।

অতঃপর আউযু বিল্লাহ্’ ও বিসমিল্লাহ্’ সম্পূর্ণ পাঠ করে আলহামদু সূরা পড়বে–

পাঠ করার পরআমীন বলবে। অতঃপর পুনরায় (সম্পূর্ণ) বিসমিল্লাহ্ পড়ে যে কোন একটি সূরা পাঠ করবে। এরপরআল্লাহু আকবার বলে রুকূতে যাবে। রুকূতে গিয়ে তিনবার, পাঁচ বার বা সাত বার–1, 3: বলবে।

মহিলাদের রুকূ করার নিয়ম হলো, বাম পায়ের টাকনু ডান পায়ের টাকনুর সাথে মিলিয়ে মাথা নত করে উভয় হাতের আঙ্গুলগুলো মিশানো অবস্থায় উভয় হাটুর ওপর রাখবে এবং হাতের বাজু ও কনুই দেহের সাথে মিলিয়ে রাখবে।

এভাবে রুকূ শেষ করার পর–123। . (সামি আল্লা-হু লিমান হামিদাহ্) অর্থাৎ যে কেউ আল্লাহর প্রশংসা করবে, আল্লাহ পাক তা শুনবেন, বলতে বলতে মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবে। দাঁড়িয়ে 1:2i al; (রব্বনা লাকাল হামদ)হে আমাদের প্রতিপালক! তোমারই প্রশংসা আমরা করছি, বলবে এবং ঠিক সোজা ভাবে দাঁড়িয়ে তারপর ২il বলতে বলতে সেজদায় যাবে।

.

সেজদা দেয়ার নিয়ম

সেজদা দেয়ার নিয়ম হলো, প্রথমে মাটিতে উভয় হাঁটু রাখবে, এরপর উভয় হাতের পাতা মাটিতে রেখে মাঝখানে মাথা রেখে নাক ও কপাল মাটিতে ভালভাবে লাগিয়ে রাখবে। সেজদার সময় উভয় হাতের আঙ্গুলসমূহ মিলিতাবস্থায় বেলারোখ করে রাখবে এবং উভয় পায়ের অঙ্গুলিসমূহও কেবলারোখ করে রাখবে। কিন্তু পুরুষরা দু পা মিলিয়ে অঙ্গুলিসমূহ ক্বেবলার দিকে রেখে পায়ের পাতা খাড়া করে রাখবে। আর মহিলারা দু পায়ের পাতা ডান দিক বের করে মাটিতে বিছিয়ে রাখবে এবং যতদূর সম্ভব আঙ্গুলের মাথাগুলো পশ্চিম মুখী করে রাখবে। পুরুষরা সেজদা করার সময় উভয় পা মিলিয়ে রেখে আঙ্গুলগুলো আলাদা আলাদা রাখবে; হাঁটু থেকে মাথা যথেষ্ট দূরে রাখবে। হাতের কব্জির ওপরের অংশ মাটিতে লাগাবে না। পায়ের নলা উরু হতে পৃথকভাবে রাখবে। পক্ষান্তরে মহিলারা সর্বাঙ্গ মিলিতাবস্থায় সেজদা করবে, মাথা হাঁটুর নিকটবর্তী রাখবে এবং উরু পায়ের নলার সাথে ও হাতের বাজু দেহের সাথে মিলিত রাখবে। সেজদায় অন্ততঃ তিনবার, পাঁচবার কিংবা সাতবার। (সুবহা-না রব্বিয়াল আ’লা-) অর্থাৎ সর্বপরি আমার প্রতিপালক আল্লাহই তিনি পবিত্র বলবে। এভাবেই এক সেজদা করেআল্লা-হু আকবার’ বলে মাথা তুলে ঠিক সোজা হয়ে বসবে। স্থির হয়ে বসার পর দ্বিতীয়বারআল্লা-হু আকবার বলে পূর্বের ন্যায় সেজদা করবে। দ্বিতীয় সেজদায় উল্লিখিতভাবে তিন, পাঁচ অথবা সাতবার সুবহানা রব্বিয়াল আ’লা বলবে। এভাবে সেজদার পরআল্লা-হু আকবার বলে মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সময় বসবে না বা হাত দিয়ে ঠেক লাগাবে না। দ্বিতীয় সেজদা হতে মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবে। দ্বিতীয় রাক’আত নামায যখন আরম্ভ করবে তখন পুনরায় বিসমিল্লাহ বলবে, এরপর আলহামদু সূরা পড়ার পর অন্য যে কোন একটি সূরা পাঠ করে প্রথম রাক’আতের ন্যায় রুকূ, সেজদা করে দ্বিতীয় রাক’আত পূর্ণ করবে। দ্বিতীয় রাক’আতের দ্বিতীয় সেজদা থেকে যখন মাথা তুলবে তখন পুরুষরা বাম পায়ের পাতা বিছিয়ে তার ওপর বসবে এবং ডান পায়ের আঙ্গুলীসমূহ ক্বেবলারোখ করে রাখবে আর নারীগণ উভয় পায়ের পাতা ডান দিকে বের করে দিয়ে মাটিতে বসবে। এভাবে বসে হাতের উভয় পাতা উরূর ওপর হাঁটু পর্যন্ত অঙ্গুলীসমূহ মিলিতভাবে বিছিয়ে রাখবে। এভাবে বসে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তাশাহুদ পড়বে।

.

আত্তাহিয়্যাতু (তাশাহহুদ)

التحيات لله والصلوات والطيبات–السلام عليك أيها النبی ورحمة

الله وبركاته. السلام علينا وعلى عباد الله الصالحين . اشهد ان لا اله

مو که / مد وی

، روي ، ت م  شهد ان محمدا عبده ورسوله

উচ্চারণ :আত্তাহিয়্যাতু লিল্লা-হি ওয়াচ্ছলাওয়া-তু ওয়াত্তইয়িবা-তু আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান্ নাবিইয়ু ওয়া রাহমাতুল্লা-হি ওয়া বারাকাতুহু, আস্সালামু আলাইনা–ওয়াআলা-ই’ বাদিল্লা-হিছ ছোঁয়া-লিহীন। আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াআশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ।

অর্থ : সকল সম্মান, ভক্তি, নামায, পবিত্র এবাদত-বন্দেগী একমাত্র আল্লাহ পাকের জন্য, আল্লাহ্ পাকের উদ্দেশে। হে নবী! আপনাকে সালাম এবং আপনার ওপর আল্লাহ তা’আলার অসীম রহমত ও বরকত। আমাদের জন্য এবং আল্লাহ তা’আলার অন্যান্য পরহেজগার বান্দাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি অবতীর্ণ হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই এবং এও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (ছঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।

তাশাহুদ পাঠের সময় যখন শাহাদাত শব্দে পৌঁছবে তখন লা বলার সাথে সাথে ডান হাতের শাহাদাত অঙ্গুলিকে ওপরের দিকে ওঠাবে এবং বৃদ্ধা ও মধ্যমা অঙ্গুলি গোল হাল্কা বানিয়ে রাখবে এবং কনিষ্ঠ ও অনামিকা অঙ্গুলী গুটিয়ে রাখবে। যখন ইল্লাল্লাহ বলবে তখন শাহাদাত অঙ্গুলি কিছুটা নুইয়ে নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত রেখে দেবে। বৃদ্ধা ও মধ্যমার হালকা এবং অনামিকা ও কণিষ্ঠার আকদও (গুটিয়ে রাখা) নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত তেমনিই রেখে দেবে।

নামায যদি তিন বা চার রাক’আত বিশিষ্ট হয় তবে আবদুহু ওয়া রাসূলুহু পর্যন্ত পাঠ করে আর বসবে না, সাথে সাথেআল্লাহু আকবার বলে উঠে দাঁড়াবে এবং পূর্বের নিয়মানুসারে তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাআত পূর্ণ করবে। কিন্তু সুন্নাত, নফল ও ওয়াজিব নামায হলে তৃতীয় ও চতুর্থ রাক’আতে সূরা ফাতেহার সাথে অন্য সূরা মিলিয়ে পড়বে এবং ফরয নামায হলে তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাআতে সূরা মিলাতে হবে না।

এমনিভাবে তৃতীয় ও চতুর্থ রাক’আত শেষে আবার বসবে এবং পুনঃ তাশাহুদ পড়ে নিম্নল্লিখিত দুরূদ শরীফ পাঠ করবে–

.

দুরূদ শরীফ

اللهم صلي على محمد وعلى آل محمد كما صليت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم إنك حميد مجيد. اللهم بارك على محمد على أل محمد كما باركت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم إنك حميد مجيد۔

উচ্চারণ :আল্লা-হুম্মা ছল্লি আলা মুহাম্মাদিওঁ ওয়া আলা-আ-লি মুহাম্মাদিন কামা-ছল্লাইতা আলা-ইবরাহীমা ওয়া আলা আ-লি ইবরাহীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ। আল্লা-হুম্মা বারিক আলা-মুহাম্মাদিওঁ ওয়া আলা-আ-লি মুহাম্মাদিন কামা-বারাকতা আলা ইবরাহীমা ওয়া আলা আ-লি ইবরাহীমা ইন্নাকা হামীদুম্মাজিদ।

অর্থঃ হে আল্লাহ্! হযরত মুহাম্মদ (ছঃ) এবং মুহাম্মদ (ছঃ)-এর আহালদের ওপর তোমার খাছ রহমত বর্ষণ কর, যেমন ইবরাহীম (আঃ) এবং ইবরাহীম (আঃ) এর আহালদের ওপর তোমার খাছ রহমত বর্ষণ করেছিলে, অবশ্যই তুমি প্রশংসার যোগ্য এবং সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। 

হে আল্লাহ! মুহাম্মদ (ছঃ) ও মুহাম্মদ (ছঃ)-এর আহালদের ওপর তোমার খাছ বরকত চির বর্ধনশীল নিয়ামত বর্ষণ কর, যেমন–বরকত বর্ষণ করেছিলে ইবরাহীম (আঃ) ও ইবরাহীম (আঃ)-এর আহালদের ওপর। অবশ্যই তুমি প্রশংসার যোগ্য এবং সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী।

উল্লিখিত দুরূদ শরীফ পাঠান্তে নিম্নের দোয়া পড়বে।

۸ مه ، ۸

سما ۸

ش

ا م

و

ر الذنوب الا انت

اللهم إني ظلمت نفسي ظلما كثيرا ولا يغة

مغفرة من عندك وارحمني انك انت الغفورالرحیم۔

فاغفرلي مغفرة من عندك

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নী যলামতু নাফসী যুলমান কাছীরাওঁ ওয়ালা ইয়াগফিরুয যুনুবা ইল্লা আনতা ফাগরিলী মাগফিরাতাম্ মিন্ ইনদিকা ওয়ার হামনী ইন্নাকা আন্তাল গাফুরুর রাহীম।

অর্থ : হে আল্লাহ্! নিশ্চয়ই আমি আমার নফসের ওপর বহু যুলুম করেছি এবং তুমি ছাড়া গুনাহ্ মার্জনাকারী আর কেউ নেই। অতএব, নিজ দয়াগুণে আমার সকল অপরাধ মার্জনা করে দাও এবং আমার উপর তোমার রহমত বর্ষণ কর। অবশ্যই তুমি ক্ষমাশীল ও দয়াময়।

এভাবে দোয়া মাছুরা পড়া শেষ করে প্রথমে ডানে পরে বামে সালাম ফেরাবে। সালাম ফেরাবার সময় মুখে আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লা-হ্ এবং মনে মনে ফেরেশতাদেরকে সালাম করার নিয়ত করবে।

এতক্ষণ পর্যন্ত নামায আদায় করার নিয়ম পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো, কিন্তু এর ভেতর কিছু কাজ ফরয, কিছু ওয়াজিব, কিছু সুন্নাত ও কিছু আছে যা মুস্তাহাব। কোন একটি ফরয যদি কারো বাদ পড়ে, জেনে পড়ুক বা ভুলে পড়ুক, তার নামায হবে না। নামায পুনরায় পড়তে হবে। স্বেচ্ছায় যদি কেউ একটি ওয়াজিব বাদ দেয় তবে সে বড় গুনাহগার হবে এবং নামায পুনরায় আদায় করতে হবে। ওয়াজিব যদি ভুলে বাদ পড়ে তবে ছুহু সেজদা দিতে হবে। সুন্নাত অথবা মুস্তাহাব বাদ পড়লে নামায হয়ে যায় কিন্তু নেকী কম হয়।

.

নামাযের ফরযসমূহ

১। মাসয়ালা : নামাযের ভেতরে ছয়টি কাজ ফরয। (১) তাকবীরে তাহরীমা বলা, অর্থাৎ নিয়্যতের সাথে সাথে আল্লাহু আকবার বলা, (২) ক্বেয়াম–দাঁড়িয়ে নামায আদায় করা, (৩) কেরাআত, কালামে পাক থেকে একটি লম্বা আয়াত বা ছোট তিনটি আয়াত অথবা সূরা পাঠ করা, (৪) রুকূ করা, (৫) দু’ বৈঠকে সেজদা দেয়া, (৬) নামাযের শেষ বৈঠকে আল্লাহর সামনে আত্তাহিয়্যাতু পাঠ করার পরিমাণ সময় বসা।

নামাযের ওয়াজিবসমূহ

২। মাসয়ালা : নিম্নেল্লিখিত বিষয়গুলো নামাযের মাঝে ওয়াজিব। (১) ফরয নামাযে প্রথম দু’রাক’আতে এবং বেতর, নফল, সুন্নাত নামাযের সব রাক’আতে সূরা ফাহিতা পাঠ করা এবং (২) সূরা ফাতিহার সাথে অন্য একটি সূরা মিলিয়ে পড়া (৩) নামাযের প্রত্যেক ফরযগুলো যথাস্থানে আদায় করা, (৪) প্রথমে সূরা ফাতিহা পড়ে, তারপর অন্য সূরা পাঠ করা, এরপর রুকূ করা, তারপর সেজদা করা, (৫) দু’রাক’আত পুরা করে বসা, (৬) প্রথম বৈঠক হোক আর শেষ বৈঠক হোক, উভয় বৈঠকে তাশাহুদ পাঠ করা, (৭) বেতর নামাযে দোয়া কুনুত পড়া, (৮) আসসালা-মু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বলে সালাম ফেরানো, (৯) নামাযের সকল কাজগুলো ধীরে ধীরে আদায় করা, জলদি না করা, (১০) জাহেরী নামাযে প্রথম দু’রাক’আতে ইমামের জোরে কেরাআত পাঠ করা এবং ছিররী নামাযে ইমাম ও একাকী নামাযীর চুপে চুপে পড়া, (১১) সেজদার সময় দু’ হাত ও দু’ হাঁটু মাটিতে রাখা।

৩। মাসয়ালাঃ উপরে বর্ণিত ফরয ও ওয়াজিবগুলো ছাড়া অন্য যে সব কাজ নামাযে আছে তার কোনটি সুন্নাত আবার কোনটি মুস্তাহাব।

৪। মাসয়ালা : যদি কোন লোক (১) নামাযের মাঝে সূরা ফাতিহা পাঠ না করে অন্য কোন সূরা বা আয়াত পাঠ করে বা (২) প্রথম দু’রাক’আতে কেবল সূরা ফাতেহা পাঠ করে অন্য কোন সূরা বা আয়াত না মিলায় বা (৩) প্রথম বৈঠকে না বসে বা (8) আত্তাহিয়্যাতু (তাশাহুদ) পাঠ করে তৃতীয় রাক’আতের জন্য দাঁড়িয়ে যায় অথবা বসেছে কিন্তু আত্তাহিয়্যাতু (তাশাহুদ) পাঠ করে, তবে এসব ক্ষেত্রে ওয়াজিব লংঘিত হবে। ফরয অবশ্য জিম্মায় থাকবে না, কিন্তু নামায একেবারে অকেজো ও নিম্নমানের হবে। সুতরাং নামায পুনরায় আদায় করা ওয়াজিব, পুনরায় আদায় না করলে গুনাহ্ হবে কিন্তু যদি কেউ ভুল করে এরূপ করে, তবেছুহ সেজদা করলে নামায শুদ্ধ হবে।

৫। মাসয়ালা : কেউ যদি আসসালা-মু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লা-হ বাক্য দিয়ে সালাম না ফিরিয়ে দুনিয়াবী কোন কথা বলে ওঠে বা ওঠে চলে যায় অথবা অন্য কোন এমন। কাজ করে যাতে নামায ভঙ্গ হয়ে যায়, তবে তার ওয়াজিব লংঘিত হবে এবং গুনাহগার হবে। অবশ্য তার ফরয আদায় হবে কিন্তু উল্লিখিত নামায পুনরায় আদায় করা ওয়াজিব। অন্যথা পাপ হবে।

৬। মাসয়ালা : সূরা ফাতেহা পাঠের পূর্বে অন্য সূরা পাঠ করলে ওয়াজিব লংঘিত হবে এবং নামায পুনরায় আদায় করতে হবে। ভুলবশতঃ যদি এরূপ করে, তবে ছুহ্ সেজদা দিলে নামায জায়েয হবে না।

৭। মাসয়ালা : আলহামদু সূরার পর অন্ততঃ তিনটি আয়াত পাঠ করতে হবে। অবশ্য যদি কেউ দু আয়াত বা এক আয়াত পড়ে তবে তা যদি হোট তিনটি আয়াতের সমান হয় তবে নামায জায়েজ হবে।

৮। মাসয়ালা : রুকূ থেকে ওঠার সময় যদি সামি’আল্লা-হুলিমান হামিদা এবং রুকূ হতে ওঠার পর রব্বানা লাকাল হামদ না পাঠ করে বা রুকূতে তাসবীহ না পড়ে অথবা সেজদায় তাসবীহ্ না পড়ে অথবা শেষ বৈঠকে তাশাহুদ পাঠ করার পর দুরূদ শরীফ পাঠ না করে তবুও নামায হয়ে যাবে, কিন্তু সুন্নাত আদায় হলো না। তদ্রুপ কেউ যদি দুরূদ শরীফ পড়ার পর দোয়া মাসূরাহ্ না পড়ে সালাম ফিরায় তাতেও নামায হয়ে যাবে, কিন্তু সুন্নাত আদায় হলো না।

৯। মাসয়ালা : নামাযের নিয়্যত (তাকবীরে তাহরীমা) করার সময় হাত ওঠানো সুন্নাত। হাত না ওঠালেও নামায হবে কিন্তু সুন্নাতের খেলাফ হবে।

১০। মাসয়ালা : প্রতি রাক’আত আরম্ভ করার সময় বিসমিল্লাহ্ পূর্ণ পাঠ করে আলহামদু সূরা আরম্ভ করবে। অন্য সূরা আরম্ভ করার সময়ও বিসমিল্লাহ পাঠ করে আরম্ভ করা উত্তম। (নামাযের মাঝে সূরা ফাতেহা চুপিসারে পড়ুক আর জোরে পড়ুক বিসমিল্লাহ্ সর্বদা চুপিসারে পড়তে হবে)।

১১। মাসয়ালা : সেজদার সময় নাক মাটিতে না রেখে কেবল কপাল মাটিতে রাখলেও নামায হবে, কপাল মাটিতে না রেখে কেবল নাক মাটিতে রাখলে নামায হবে না। অবশ্য কোন ওযরবশতঃ মাটিতে কপাল না রাখতে পারে এবং শুধু নাক মাটিতে রাখে, তবে নামায হবে।

১২। মাসয়ালাঃ রূকূর পর সোজা হয়ে না দাঁড়িয়ে মাথা সামান্য উঠিয়ে পুনরায় সেজদায়। চলে গেলে নামায হবে না, নামায দোহরায়ে পড়তে হবে।

১৩। মাসয়ালা : দু’ সেজদার মাঝে মস্তক উঠিয়ে সোজা হয়ে বসা ওয়াজিব। যদি কেউ সোজা হয়ে না বসে সামান্য একটু মাথা তুলে দ্বিতীয় সেজদায় যায় তবে নামায হবে না। দোহরায়ে নামায পড়তে হবে। আর যদি এতটুকু উঠায় যে, বসার কাছাকাছি হয়ে যায়, তাহলে নামাযের জিম্মা আদায় হলো কিন্তু অতি বড় অকেজো ও নিকৃষ্ট মানের নামায হলো। কাজেই নামায দোহরানো প্রয়োজন। অন্যথায় শক্ত গুনাহ হবে।

১৪। মাসয়ালা : তোষক বা খড় ইত্যাদি কোন নরম জিনিসের ওপর সেজদা করতে হলে মাথা একটু বেশি চেপে সেজদা দেবে। যতদূর নিচে চাপানো সম্ভব ততদূর না চেপে সেজদা করলে, শুধু ওপরে মাথা রেখে সেজদা করলে সেজদা আদায় হবে না। সেজদা না হলে নামাযও হবে না।

১৫। মাসয়ালা : ফরয নামাযের শেষ দু’রাক’আতে শুধুমাত্র সূরা ফাতেহা পাঠ করবে। সূরা মিলিয়ে পড়বে না। সূরা মিলালেও অবশ্য নামায হবে। নামাযে কোন দোষ হবে না।

১৬। মাসয়ালা : ফরয নামাযের শেষ দু’রাক’আতে আলহামদু সূরা পাঠ করা সুন্নাত। কেউ আলহামদু পাঠ না করে তিনবার সুবহানাল্লাহ পড়ে বা কিছু না কিছু পাঠ করে (তিন বার সুবহানাল্লাহ পড়ার সময় পরিমাণ) চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে এবং রুকূতে যায়, তথাপি নামায হয়ে যাবে। (কিন্তু এটা করা ভাল নয়, আলহামদু পড়া উচিৎ এবং এটা অতি উত্তম)।

১৭। মাসয়ালা : ফরয নামাযের প্রথম দু’রাক’আতে সূরা ফাতিহার সাথে অন্য কোন সূরা যুক্ত করে পাঠ করা ওয়াজিব। যদি কোন ব্যক্তি প্রথম দু’রাক’আতে আলহামদুর সাথে সূরা না। মিলায় অথবা সূরা ফাতিহাও না পড়ে, কেবল সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ্ বলতে থাকে তাহলে শেষের দু’রাক’আতে আলহামদু সূরার সাথে সূরা মিলাতে হবে কিন্তু ইচ্ছে করে এ রকম করলে নামায পুনঃ পড়তে হবে। কিন্তু ভুলে করলে ছুহ্ সেজদা দিলে নামায হয়ে যাবে।

১৮। মাসয়ালা : মহিলারা সব নামাযে ছানা, তাআউয, তাছমিয়াহ্, ফাতিহা, সূরা ইত্যাদি নবই অনুচ্চ কণ্ঠে পড়বে, কিন্তু এমনভাবে পড়বে যাতে নিজের কানে শোনা যায়। যদি নিজের পড়ার শব্দ নিজের কানে না পৌঁছে, তবে স্ত্রী অথবা পুরুষ কারোরই নামায হবে না।

১৯। মাসয়ালা : কোন নামাযের জন্য কোন সূরা নির্দিষ্ট করা নেই। যে কোন সূরা ইচ্ছে হয় তাই পড়তে পারে। যদি কোন নামাযের জন্য কোন সূরা নির্দিষ্ট করে নেয়া হয় তবে নামায মাকরূহ্ হবে।

২০। মাসয়ালা : প্রথম রাক’আতের চেয়ে দ্বিতীয় রাক’আতে বড় কেরাআত বা সূরা পাঠ করবে না।

২১। মাসয়ালা : মহিলাদের জন্য জুমুআ, জামায়াত, ঈদের নামায ইত্যাদির নির্দেশ নেই। সুতরাং এক স্থানে যদি কতগুলো মহিলা একত্রিত থাকে, তবে পৃথক পৃথকভাবে নামায আদায় করবে। জামায়াতে আদায় করবে না। মহিলারা পুরুষদের সাথে জামায়াতে নামায আদায়ের জন্য মসজিদ বা ঈদগাহে যাবে না। অবশ্য ঘরে যদি নিজ স্বামী অথবা পিতা-ভাই এর সাথে কখনো নফল, তারাবীহ, ফরয নামায জামায়াতে আদায় করার সুযোগ হয়, তবে পুরুষের সাথে এক কাতারে দাঁড়াবে না। একা একজন মহিলা হলেও এবং স্বামী বা বাপের সাথে নামায পড়লেও পেছনের কাতারে দাঁড়াবে। এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করলে উভয়ের নামাযই নষ্ট হয়ে যাবে।

২২। মাসয়ালা : ঘটনাক্রমে নামাযের মাঝে যদি ওযূ ছুটে যায়, তবে সাথে সাথে নামায ছেড়ে দিয়ে পুনরায় ওযূ করে প্রথম থেকে নামায আরম্ভ করবে।

২৩। মাসয়ালা : নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় সেজদার স্থানে, রুকূর সময় পায়ের দিকে, সেজদার সময় নাকের দিকে, বসার সময় কোলের দিকে এবং সালামের সময় নিজের কাঁধের দিকে দৃষ্টি রাখা মুস্তাহাব।

নামাযে হাই আসলে যতটা সম্ভব দাঁতের দ্বারা নীচের ঠোঁট চেপে ধরে বন্ধ রাখবে, একান্তই যদি চেপে না রাখতে পারে, তবে দাঁড়ানো অবস্থায় ডান হাতের পাতার পিঠ দিয়ে এবং বসা অবস্থায় বাম হাতের পাতার পিঠ দিয়ে বন্ধ রাখবে। নামাযে যদি গলা খুস খুস করে বা বন্ধ হয়ে আসে, তাহলে যাতে না কেশে পারা যায় তার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে। একান্ত সহ্য করা সম্ভব না হলে খুব আস্তে ভীত সংকোচিতাবস্থায় আল্লাহ পাকের সামনে হাজির মনে করে কাশবে, বেপরোয়াভাবে কাশি দেব না, গলা খাকুর দেবে না।

.

নামাযের সুন্নাতসমূহ

 ১। মাসয়ালা : তকবীরে তাহরীমা বলার আগে পুরুষদের দু’ হাত কান পর্যন্ত ওঠানো এবং মহিলাদের কাঁধ পর্যন্ত ওঠানো সুন্নাত। ওযরবশতঃ পুরুষের কাঁধ পর্যন্ত ওঠালেও কোন দোষ নেই।

২। মাসয়ালাঃ তকবীরে তাহরীমা বলার সাথে সাথে পুরুষের নাভীর নীচে এবং মহিলাদের বুকের ওপর হাত বাধা সুন্নাত।

৩। মাসয়ালাঃ পুরুষের হাত বাঁধার সময় ডান হাতের পাতা বাম হাতের পাতার ওপর রেখে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও কনিষ্ঠাঙ্গুলি দিয়ে বাম হাতের কব্জি চেপে ধরা এবং বাকী তিন অঙ্গুলি বাম হাতের কব্জির ওপর লম্বভাবে বিছিয়ে রাখা সুন্নাত।

৪। মাসয়ালা : ইমাম ও একাকী নামাযীর সূরা ফাতিহা শেষে আস্তেআমীন বলা এবং ইমাম কেরাআত উচ্চ স্বরে পাঠ করলে সকল মুক্তাদীরই অনুচ্চ কণ্ঠে আমীন বলা সুন্নাত।

৫। মাসয়ালা : পুরুষরা রুকূর সময় এমনভাবে ঝুঁকবে যেন পিঠ, মাথা ও কোমর এক বরাবর থাকে।

৬। মাসয়ালাঃ রুকূর সময় পুরুষের দু হাত বগল থেকে পৃথক রাখা, রুকূ থেকে ওঠার সময় ইমামের সামি’আল্লা-হু লিমান হামিদাহ বলা, মুক্তাদীর রব্বানা-লাকাল হামদ বলা এবং একাকী নামায আদায়কারীর উভয়টি বলাই সুন্নাত।

৭। মাসয়ালা : সেজদা অবস্থায় পুরুষের পেট রান থেকে, কনুই বগল থেকে এবং দু হাত (কব্জিবাদে) মাটি থেকে উঠিয়ে রাখা সুন্নাত।

৮। মাসয়ালাঃ প্রথম ও শেষ বৈঠকে পুরুষের ডান পায়ের আঙ্গুলগুলোর ওপর ভর করে পা খাড়া রেখে আঙ্গুলগুলো ক্বেবলারোখ করে বাম পা মাটির ওপর বিছিয়ে তার ওপর বসা এবং জানুর ওপর এবং আঙ্গুলগুলোর অগ্রভাগ হাঁটুর নিকটবর্তী রাখা সুন্নাত।

৯। মাসয়ালা : ইমামের উচ্চ আওয়াজে সালাম ফেরানো সুন্নাত।

১০। মাসয়ালাঃ ইমামের সালাম ফেরানোর সময় সকল মুক্তাদী পুরুষ, নারী ও বালক এবং ফেরেশতাদের প্রতি নিয়্যত করা এবং মুক্তাদী সাথের নামায আদায়কারী, সাথের ফেরেশতা ইমাম ডান দিকে থাকলে ডান দিকে সালাম ফেরাতে এবং বাম দিকে থাকলে বাম দিকে সালাম ফেরাতে, আর সোজা থাকলে উভয় দিকে সালাম ফেরাতে ইমামের প্রতি নিয়্যত করা সুন্নাত।

১১। মাসয়ালা : তকবীরে তাহরীমা বলার সময় পুরুষদের উভয় হাতকে জাযার আস্তিন কিংবা চাদর ইত্যাদির ভেতর থেকে বের করা সুন্নাত, যদি অত্যাধিক শীত ইত্যাদির মত ওর থাকে।

.

নামাযের সূরাগুলো শুদ্ধ করে পড়ার নিয়ম ও মাখরাজ

১। মাসয়ালা : কালামে পাক শুদ্ধ করে তেলাওয়াত করা ওয়াজিব। সুতরাং প্রতিটা বর্ণ সঠিকভাবে উচ্চারণ করবে।

–(হামযা) –(আলিফ) এবং ৫–(আইন)-এর মাঝে যে উচ্চারণগত পার্থক্য–(জিম এর পরের হা) এবং ১ (ওয়াও এর পরের হা) এর মাঝে যে পার্থক্য, ১–(যাল)–(ঝ) ৪–(যোয়া) এবং ১ (দোয়াদ)-এর মাঝে যে পার্থক্য; 4 (দাল) এবং ১ (দোয়াদ)-এর মাঝে যে পার্থক্য, ৫ (জিম) এবং; (ঝা) এর মাঝে যে পার্থক্য, w (সিন) এবং ৬ (ছোয়াদের) এবং (ছা) এর মাঝে যে পার্থক্য, (গাইন) এবং ২ (গাফের) মাঝে যে পার্থক্য এবং ও (ক্বাফ)  ও ৩ (কাফ) এর মাঝে যে পার্থক্য তা উত্তমরূপে শিখে নেবে, এবং তদানুসারে সর্বদা তেলাওয়াত করবে। এক বর্ণের স্থানে অন্য বর্ণ উচ্চারণ করবে না।

২। মাসয়ালা : কোন লোকের যদি—-৪–৫–৬–৪ ইত্যাদি অক্ষরগুলোর উচ্চারণ ছহী না হয়, তবে কোন উপযুক্ত শিক্ষকের নিকট মশক্ক করে শুদ্ধ উচ্চারণ শিক্ষা করা তার জন্য ওয়াজিব। সে নরনারী যে-ই হোক। শুদ্ধ উচ্চারণ শিক্ষার জন্য যদি উপযুক্ত পরিশ্রম না করে তবে গুনাহ্ হবে এবং তার নামায ছহী হবে না। অবশ্য যথেষ্ট পরিশ্রম ও চেষ্টা করা সত্ত্বেও যদি কোন লোকের জিহ্বায় কোন বর্ণ সঠিক উচ্চারণ না হয়, তবে আল্লাহর রহমতে তার ক্ষমার আশা করা যায়।

৩। মাসয়ালা : কেউ যদি?—-০.৬ ইত্যাদি বর্ণগুলো শুদ্ধভাবে পড়তে পারে কিন্তু আলস্য বা অবহেলার কারণে শুদ্ধ করে না পড়ে বরং? কে ১ এর ন্যায়, ৬ কে cw–এর ন্যায় } কে S এর ন্যায় অথবা? কে। এর ন্যায় পড়ে, তাতে তার নামায হবে না এবং সে লোক মারাত্মক গুনাহগার হবে।

৪। মাসয়ালা : প্রথম রাক’আতে যে সূরা পাঠ করা হয়েছে, দ্বিতীয় রাক’আতেও যদি উক্ত সূরাই পাঠ করে তবুও নামায হয়ে যাবে কিন্তু অহেতুক এরূপ করা অনুচিত।

৫। মাসয়ালা : কালামে পাকের সূরাসমূহ যে নিয়মানুযায়ী লেখা রয়েছে, নামাযের মাঝে সে অনুযায়ী পাঠ করা উচিত। আমপারায় যে ধারাবাহিকতায় লেখা রয়েছে তদানুসারে পাঠ করবে না। সেখানে যে সূরা পরে লিখেছে সে সূরা আগে পাঠ করবে এবং যে সূরা আগে লিখেছে সে সূরা পরে পাঠ করবে। যেমন–যদি কেউ প্রথম রাক’আতে কুলইয়া পাঠ করে, তাহলে দ্বিতীয় রাক’আতে সূরা ইযাজা, সূরা ফালাক্ব, সূরানাস পাঠ করবে! সূরা ফীল বা কুরাইশ পাঠ করবে না। কোরআন শরীফ উল্টো ধারাবাহিকতায় পাঠ করা মাকরূহ্। অবশ্য কখনো ভুলে উল্টো ধারাবাহিকতায় যদি কেউ পড়েই ফেলে, তাহলে মাকরূহ হবে না।

৬। মাসয়ালা : যে সূরা আরম্ভ করা হয়েছে সে সূরা পড়া শেষ করবে। কারণ ছাড়া অন্য কোন সূরা আরম্ভ করা অথবা কয়েক স্থান হতে কয়েক আয়াত এক রাকাআতে পাঠ করা। মাকরূহ্।

৭। মাসয়ালা : যে নামায পড়তে জানে না বা কেবল নতুন মুসলমান হয়েছে, সে নামাযের মাঝে সব জায়গায়সুবহানাল্লাহ্, ইত্যাদি পাঠ করবে। এতেই তার ফরয আদায় হয়ে যাবে এবং নামাযের সূরা, কালাম, দোয়া, দুরূদ, তাসবীহ ইত্যাদি শিক্ষা করতে থাকবে। এ সকল বিষয় শিক্ষা করতে যদি অলসতা বা অবহেলা করে, তাহলে কঠিন গুনাহগার হতে হবে। –(বেহেশতী গওহর)

.

ফরয নামাযের বিবিধ মাসয়ালাসমূহ

১। মাসয়ালা : সূরা ফাতিহা পড়া যখন শেষ হয় অর্থাৎ ১iL24; পড়া হয় তখন পাঠক এবং শ্রোতা সবাই অনুচ্চ কণ্ঠেআমীন বলবে। তারপর ইমাম অন্য সূরা পড়া আরম্ভ করবে।–(মারাকী)

২। মাসয়ালা : সফর বা প্রয়োজনবশতঃ আলহামদুর পর যে কোন সূরা পড়া যেতে পারে, তাতে বাধা নেই। কিন্তু সফর বা প্রয়োজন না হলে, ফজরে এবং যোহরে তেওয়ালে মোফাছছাল, আসর ও এশায় আওছাতে মোফাছছাল এবং মাগরীবে কেছারে মোফাছছাল পরিমাণ সূরা পাঠ করা সুন্নাত। সূরা হুজরাত থেকে সূরা বুরুজ পর্যন্ত সূরাসমূহকে তেওয়ালে মোফাছছাল বলে।সূরা ত্বারেক থেকে সূরা লামইয়াকুন আওছাতে মোফাছছাল এবং সূরা যিলযাল হতে সূরা নাস পর্যন্ত সূরাগুলোকে ছোরে মোফাছছাল বলে। ফজরের নামাযে প্রথম রাক’আতে দ্বিতীয় রাক’আতের চেয়ে বড় সূরা বা কেরাত পাঠ করা উচিত। এ ছাড়া অন্যান্য নামাযে প্রথম ও দ্বিতীয় রাক’আত সমান হওয়া উচিত। দু’ এক আয়াত কম-বেশি ধর্তব্য নয়। -(আলমগীরী)।

 ৩। মাসয়ালা : রুকূ হতে মাথা তুলে সম্পূর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়াবে এবং ইমাম সামি আল্লা-হু লিমান হামিদাহ্ বললে মুক্তাদীরা শুধু রব্বানা লাকাল হামদ বলবে মোনফারেদ উভয় বাক্যই বলবে। অতঃপর উভয় হাঁটুর ওপর হাত রেখে সেজদায় যাবে। সেজদায় যাওয়ার সময় তাকবীর বলবে। কিন্তু এমনভাবে বলবে যেন মাথা মাটিতে রাখা মাত্রই তাকবীর বলা শেষ হয়ে যায়।-(আলমগীরী)

৪। মাসয়ালা : সেজদার সময় প্রথমে দু’হাঁটু তারপর দু’হাত মার্টিত রাখবে, এরপর নাক, অতঃপর কপাল রাখবে, মুখ দু’হাতের মাঝে রাখতে হবে। হাতের অঙ্গুলীসমূহ ক্বেবলার দিকে রোখ করে মিলিয়ে রাখবে। দু পায়ের অঙ্গুলীগুলো ক্বেবলার দিকে ফিরিয়ে তার ওপর ভর করে পায়ের পাতা খাড়া রাখবে, পেট হাঁটু থেকে এবং বাজু বগল থেকে পৃথক রাখবে, পেট মাটি থেকে এত পরিমাণ উঁচু রাখবে, যেন একটি ছোট বকরীর বাচ্চা পেটের নিচ দিয়ে চলে যেতে পারে। (এটা পুরুষদের সেজদার নিয়ম)–(আলমগীরী)

৫। মাসয়ালা : ফজর, মাগরীব ও এশার প্রথম দু’রাক’আতে আলহামদু ও অন্য সূরা ইমাম সাহেব উচ্চস্বরে পাঠ করবে এবং পুরো নামাযের সমস্ত রাক’আতেসামি’আল্লাহু লিমান হামিদা এবং সমস্ত তাকবীর ইমাম সাহেব উচ্চঃস্বরে বলবেন। মোনফারেদ (একা একা নামায আদায়কারী) ফজর, মাগরীব ও এশার কেরাআত উচ্চস্বরে অথবা নিম্নস্বরে যেভাবে খুশি সেভাবে পাঠ করতে পারে কিন্তু সামি আল্লাহু লিমান হামিদা ও তাকবীরগুলো আস্তে বলবে। যোহর ও আসর নামায ইমাম সাহেব নিম্নস্বরে কেরাআত পড়বে। কেবল সামি’আল্লাহু লিমান হামিদা ও তাকবীরগুলো ইমাম সাহেব জোরে পড়বে এবং একা একা নামায আদায়কারী সকল কিছুই নিম্নম্বরে পাঠ করবে। মুক্তাদী কেরাআত পড়বে না, কিন্তু তাকবীর ইত্যাদি নিম্নস্বরে বলবে। -(দুররে মুখতার)

৬। মাসয়ালাঃ সালাম ফেরালে নামায শেষ হয়ে যায়। এরপর সিনা বরাবর দু’হাত মিলিতভাবে উঠিয়ে আল্লাহ পাকের নিকট দুনিয়া ও আখেরাতের ভালোর জন্য দোয়া করবে। ইমাম নিজের জন্যও দোয়া করবে এবং মুক্তাদীর জন্যও করবে। মুক্তাদীগণ ইমামের সাথে উভয় হাত তুলে নিজ নিজ দোয়া পৃথকভাবে করতে থাকবে। দোয়া সমাপ্তির পর উভয় হাত চেহারার ওপর বুলাবে।-(তাহতাবী পৃঃ ১৮৪, ১৮৫)

৭। মাসয়ালাঃ যে সব নামাযে (ফরযের) পরে সুন্নাত নামায আছে, যেমন : যোহর, মাগরীব ও এশা, এ সবের পর বড় করে লম্বা দোয়া করবে না।

কয়েকটি দোয়া :

(1) رب اغفر وارحم وانت خير الرجمین۔ (۲) اللهم انت الشموثك الشم حنا ربنا بالشم وادخلنا برمي دار الشم تباركت ربنا وتعاليت ياذالجلال والإكرام–وصلى الله تعالى على خير خلقه سيدنا ومولانا محمير وعلى اله

وصحبه و بارك وسلم۔ (۳) اشتغفر الله الذي لا إله الاهو الحى القيم واتوب اليه.

এ ধরনের ছোট ছোট দোয়া করে সুন্নাত পড়া শুরু করবে। যে সকল নামাযের পর সুন্নাত নামায নেই; যেমনঃ ফজর ও আসরের নামাযের সালাম ফেরানোর পর যদি পেছনে কোন মছবুক নামায আদায় করতে থাকে, তাহলে ইমাম ডান অথবা বাম দিকে মুক্তাদিদের দিকে ঘুরে বসবে এবং নামাযীদের অবস্থা বুঝে লম্বা দোয়া করতে পারে।

৮। মাসয়ালাঃ প্রত্যেক ফরয নামাযের পর তিনবার পড়বেঃ

أستغفر الله البري لا إله إلا هو الحى القيوم واتوب اليو۔

আয়াতুল কুরসী, সূরা এখলাছ, ফালাক্ক ও নাস একবার করে এবং তেত্রিশবার ১২। তেত্রিশ বার–dj এবং চৌত্রিশ বার & ii পাঠ করা মুস্তাহাব। যে নামাযের পর সুন্নত আছে এসব তাসবী সুন্নাতের পরে পাঠ করা উত্তম।–(মারাকী)

.

পুরুষ ও মহিলার নামাযের পার্থক্য

পুরুষ ও নারীর নামায প্রায় একই রকম। কেবল কয়েকটি বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে। যেমন

১। তাকবীরে তাহরীমার সময় পুরুষরা চাদর ইত্যাদি থেকে হাত বের করে হাত কান পর্যন্ত তুলবে। যদি শীত বা অন্য কোন কারণে হাত ভেতরে রাখার প্রয়োজন না হয়।

মহিলারা হাত বের করবে না, হাত বস্ত্রের মধ্যে রেখেই কাঁধ পর্যন্ত তুলবে। : তাহতাবী।

২। তাকবীরে তাহরীমা বলে পুরুষরা হাত বাঁধবে নাভির নিচে। আর মহিলারা হাত বাঁধবে বুকের ওপর।-(তাহতাবী)

৩। পুরুষরা হাত বাঁধার সময় ডান হাতের বৃদ্ধা ও কনিষ্ঠা অঙ্গুলি দ্বারা বাম হাতের কব্জি ধরবে এবং ডান হাতের অনামিকা, মধ্যমা ও শাহাদত আঙ্গুল এর বাম হাতের কলাইর ওপর। বিছিয়ে রাখবে এবং মহিলারা শুধুমাত্র হাতের পাতা বাম হাতের পাতার পিঠের ওপর রাখবে। কব্জি বা কলাই ধরবে না।

৪। রুকূর সময় পুরুষরা এমনভাবে ঝুঁকবে যেন মাথা, পিঠ ও কোমর এক বরাবর। আর মহিলারা এ পরিমাণ ঝুঁকবে যেন হাত হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছে।

৫। রুকূ করার সময় পুরুষরা হাতের অঙ্গুলিগুলো ফাঁক করে হাঁটু ধরবে কিন্তু মহিলারা অঙ্গুলিগুলো মিলিত অবস্থায় রেখে হাঁটুর ওপর রাখবে।

৬। রুকূ অবস্থায় পুরুষগণ কনুই পাঁজর হতে পৃথক রাখবে এবং মহিলারা কনুই পাঁজরের সাথে মিলিয়ে রাখবে।–(মারাকী)।

৭। সেজদার সময় পুরুষরা পেট উরু থেকে এবং বাজু বগল থেকে পৃথক রাখবে আর মহিলারা পেট রানের সাথে এবং বাজু বগলের সাথে একত্রিত করে রাখবে।

৮। সেজদার সময় পুরুষরা কনুই মাটি থেকে ওপরে রাখবে এবং মহিলারা মাটির সাথে লাগিয়ে রাখবে।–(মারাকী)

৯। সেজদার সময় পুরুষরা পায়ের অঙ্গুলিগুলো ক্বেবলারোখ করে রেখে তার ওপর ভর দিয়ে পায়ের ওপর পাতা খাড়া রাখবে এবং মহিলারা উভয় পায়ের পাতা ডান দিকে বের করে দিয়ে মাটিতে বিছিয়ে রাখবে।–(মারাকী)

১০। বসার সময় পুরুষরা ডান পায়ের অঙ্গুলিগুলো কেবলা মুখী করে তার ওপর ভর দিয়ে ডান পায়ের পাতা খাড়া রাখবে এবং বাম পায়ের পাতা বিছিয়ে দিয়ে তার ওপর বসবে কিন্তু মহিলারা পায়ের ওপর বসবে না, বরং চোতর মাটির সাথে মিলিয়ে বসবে এবং উভয় পায়ের পাতা ডান দিকে বের করে দেবে এবং ডান রান বাম নলার ওপর রাখবে।–(মারাকী)।

১১। মহিলাদের জন্য উচ্চকণ্ঠে কেরাআত পাঠ করার ও তাকবীর বলার অনুমতি নেই। তারা সর্বদা সব নামাযের কেরাআত, তাকবীর, তাসমী ও তাহমীদ চুপে চুপে বলবে।–(শামী)

.

নামায ভঙ্গের কারণ

১। মাসয়ালা : নামাযরত অবস্থায় কথা বললে নামায ভঙ্গ হয়ে যায়, ইচ্ছে করে বলুক আর ভুলে বলুক।

২। মাসয়ালা : নামাযরত অবস্থায় আহ, উহ, হায়! ইস! ইত্যাদি বললে কিংবা উচ্চ কণ্ঠে কাদলে নামায ভঙ্গ হয়ে যায়। অবশ্য কারো যদি বেহেশত-দোযখের কথা মনে পড়ার কারণে প্রাণ কেঁদে ওঠে এবং বে-এখতিয়ার আওয়ায বের হয়, তাতে নামায ভঙ্গ হবে না। -(হেদায়া)

৩। মাসয়ালা : খুব প্রয়োজন ছাড়া গলা খাকর দিলে এবং গলা ছাফ করলে যাতে এক আধ হরফ সৃষ্টি হয়, তাহলে নামায ভঙ্গ হয়। অবশ্য গলা যদি একেবারে বন্ধ হয়ে আসে তবে শব্দ চেপে আস্তে গলা খাকর দিয়ে গলা সাফ করা জায়েয আছে। এতে নামায ভঙ্গ হবে না।

৪। মাসয়ালা : নামাযের ভেতর হাঁচি দিয়ে আলহামদু লিল্লাহ বললে নামায ভঙ্গ হবে না, কিন্তু বলা ঠিক নয়। কিন্তু যদি অন্যের হাঁচি শুনে নামাযের মাঝেইয়ার হামুকাল্লাহু বলে, তবে নামায ভঙ্গ হয়ে যাবে।–(শহরে বেদায়া)

৫। মাসয়ালা : নামাযের ভেতর কোরআন শরীফ দেখে পাঠ করলে নামায ভঙ্গ হয়ে যাবে।

৬। মাসয়ালা : নামাযের ভেতর মুখ বা চোখ এদিক সেদিক ঘুরানো মাকরূহ্, কিন্তু যদি বুক ক্বেবলার দিক থেকে ঘুরে যায়, তবে নামায ভঙ্গে হয়ে যাবে।-(তানবীর)।

৭। মাসয়ালা : নামাযরত অবস্থায় কারো ছালামের জওয়াব দিলে নামায ভঙ্গ হয়ে যাবে। ৮। মাসয়ালাঃ নামাযরত অবস্থায় চুল বাঁধলে নামায ভঙ্গ হয়ে যাবে।-(তানবীর)

৯। মাসয়ালা : নামাযরত অবস্থায় কিছু খেলে বা পান করলে নামায ভঙ্গ হবে। এমন কি, একটি তিলও যদি বাইর থেকে মুখে নিয়ে চিবায়, তাতেও নামায নষ্ট হবে। অবশ্য যদি দাঁতের ফাঁকে কোন কিছু আটকে থাকে এবং তা গিলে ফেলে, আর ওই জিনিস যদি আকারে বুটের চেয়ে ছোট, তিল, সরিষা, মুগ, মুসরীর মত হয়, তাহলে নামায নষ্ট হবে না। যদি ছোলা বুট পরিমাণ বা তার চেয়ে বড় হয়, তবে নামায নষ্ট হয়ে যাবে।–(শরহে তানবীর)

১০। মাসয়ালা : নামাযরত অবস্থায় পান মুখে চেপে রেখেছে যার পিক ভেতর যাচ্ছে, এ অবস্থায় নামায হবে না।-(রদ্দে মুহতার)

১১। মাসয়ালা : নামাযের পূর্বে হয়ত মিঠা জাতীয় কোন কিছু খেয়ে ভালভাবে কুলি করে নামায আরম্ভ করেছে, কিন্তু নামাযের মাঝে কিছু মিঠা মিঠা লাগছে এবং থুথুর সাথে গলার ভেতর যাচ্ছে, এতে নামায ভঙ্গ হবে না।

১২। মাসয়ালা : নামাযরত অবস্থায় যদি কোন শুভ সংবাদ শুনে আলহামদু লিল্লাহ্ বলে অথবা কারো মৃত্যুর খবর শুনে ইন্না লিল্লাহ বলে, তবে নামায নষ্ট হয়ে যাবে।

১৩। মাসয়ালা : নামায পড়তে আরম্ভ করেছে এমন সময় হয়ত একটা ছেলে পড়ে গেল, তখন বিসমিল্লাহ বলল, তাতে নামায ছুটে যাবে।–(তানবীর)

১৪। মাসয়ালা : কোন এক মহিলা নামায আদায় করছিল, এমন সময় তার শিশু সন্তান এসে স্তন থেকে দুধ পান করা আরম্ভ করলো, এমন অবস্থায় উক্ত মহিলার নামায ভঙ্গ হয়ে যাবে। অবশ্য সন্তান মাত্র দু’একটা টান চুষে থাকলে এবং যদি দুধ বের না হয়, তবে নামায ভঙ্গ হবে না।

১৫। মাসয়ালা : আল্লাহু আকবার বলার সময় কেউ যদি আল্লাহর আলিফ বা আকবরের আলিফ টেনে বলে বাআকবরের বা (৬) টেনে বলে, তাহলে তার নামায হবে না।-(দুররুল মুখতার)।

১৬। মাসয়ালা : নামায আদায়ের সময় যদি কোন পত্রের প্রতি অথবা কোন কিতাবের দিকে হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে এবং মনে মনে লেখার মর্ম বুঝে আসে, তাতে নামায হবে। কিন্তু যদি কোন একটি কথা পড়ে, তবে নামায হবে না।

 ১৭। মাসয়ালা : নামাযীর সম্মুখ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে অথবা কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি চলে গেলে, তাতে নামায নষ্ট হয় না। কিন্তু নামাযীর সম্মুখ দিয়ে গেলে তার কঠিন গুনাহ্ হবে। কাজেই এমন স্থানে নামায আদায় করা উচিত, যেন সম্মুখ দিয়ে কেউ যেতে না পারে বা চলাচল করতে কারো অসুবিধা না হয়। এ ধরনের কোন জায়গা যদি না থাকে, তাহলে সামনে এক হাত লম্বা ও এক আঙ্গুল পরিমাণ মোটা একটি লাঠি বা কাঠি গেঁড়ে রাখবে এবং ওই কাঠি সম্মুখে রেখে নামায আদায় করবে। কাঠি একেবারে নাকের সোজাসুজি গাড়বে না বরং ডানবাম চোখ বরাবর গাঁড়বে। যদি লাঠি বা কাঠি না পুঁতে ওই পরিমাণ উঁচু কোন কিছু সম্মুখে রেখে নামায আদায় করে, তাহলে উভয় অবস্থায় ওটার বাইর দিয়ে যাতায়াত দুরস্ত আছে। কোন পাপ হবে না।–(শরহে তানবীর)

১৮। মাসয়ালা : প্রয়োজন বশতঃ নামাযরত অবস্থায় এক আধ কদম যদি আগে-পিছে সরে দাঁড়ায়, কিন্তু বুক কেবলা থেকে না ফিরে, তবে নামাযের ক্ষতি হবে না।–(রদ্দুল মোহতার)

১৯। মাসয়ালা : মূর্খতাবশতঃ কোন কোন মহিলার এমন ধারণা আছে যে, মহিলাদের জন্য দাঁড়িয়ে নামায আদায় করা ফরয নয়। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ফরয নামায দাঁড়িয়ে আদায় করা নরনারী সকলের জন্যই সমভাবে ফরয।

.

নামাযে মাকরূহ ও নিষিদ্ধ কাজ

১। মাসয়ালা : যে কাজ করলে গুনাহ্ হয় এবং নামাযের ছাওয়াব কম হয় কিন্তু নামায ভঙ্গ হয় না, এ ধরনের কাজকে মাকরূহ বলে।-(রদ্দুল মোহতার)

২। মাসয়ালা : নামাযরত অবস্থায় দেহের বস্ত্র অথবা অলংকারাদি নাড়াচাড়া করা, কংকর সরানো মাকরূহ। অবশ্য যদি সেজদার স্থানে কোন পাথর থাকে যার জন্য সেজদা দেয়া যায় না, তাহলে একবার অথবা দু’বার হাত দিয়ে তা সরিয়ে ফেলা জায়েয।

৩। মাসয়ালা : নামাযের মধ্যে আঙ্গুল ফুটানো, মাজার ওপর হাত রেখে দাঁড়ানো, ডানেবামে, এদিক সেদিক মুখ ফেরানো মাকরূহ। অবশ্য ঘাড় বা মুখ না ঘুরিয়ে কেবল চোখের কোন দিয়ে ইমামের বা কাতারের ওঠা-বসা দেখা দুরুস্ত আছে, কিন্তু নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া এরূপ করা অনুচিত।

৪। মাসয়ালা : নামাযের ভেতর চার জানু হয়ে (আসন গেড়ে) বসা, কুকুরের ন্যায় বসা, হাঁটু খাড়া করে চোতর ও হাত মাটিতে রেখে বসা, মহিলাদের দু’পা খাড়া রেখে বসা মাকরূহ। অবশ্য অসুস্থতার কারণে যেভাবে বসার নির্দেশ রয়েছে, যদি সেভাবে বসা সম্ভব না হয় তবে যেভাবে পারে, সেভাবে বসবে, ওই সময় কোন ধরনের মাকরূহ হবে না।–(হেদায়া, তানবীর)

৫। মাসয়ালা : নামাযরত অবস্থায় হাত উঠিয়ে ইশারা করে কোন লোকের সালামের উত্তর দয়া মাকরূহ। মুখে সালামের উত্তর দিলে নামায ভঙ্গ হয়ে যাবে।

৬। মাসয়ালা : নামাযের ভেতর ধুলাবালির ভয়ে বস্ত্র গুটানো বা সামলানো মাকরূহ।

৭। মাসয়ালা : যে জায়গায় এরূপ আশঙ্কা হয় যে, হয় তো কেউ নামাযের ভেতর হাসাবে, বা মন এদিক সেদিক চলে যাবে অথবা মানুষের কথাবার্তায় নামাযে ভুল হয়ে যাবে, এরূপ স্থানে নামায আদায় করা মাকরূহ।

৮। মাসয়ালা : কেউ কথা বলছে বা কোন কাজ করছে, এমন ব্যক্তির পিঠের দিকে মুখ করে নামায আদায় করা মাকরূহ নয়, কিন্তু আশে-পাশে জায়গা থাকলে এ ধরনের স্থানে নামায আরম্ভ করা উচিত নয়। কেননা, হয় তো ওই ব্যক্তির যাওয়ার দরকার হতে পারে এবং নামাযের জন্য যেতে না পারায় বিরক্তিবোধ বা কষ্টবোধ করতে পারে অথবা তার কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারে বা হয় তো সে উচ্চকণ্ঠে কথা বলা শুরু করে দিতে পারে এবং সে জন্য নামাযে ভুল হতে পারে। কোন ব্যক্তির মুখের দিকে মুখ করে নামায আদায় করা মাকরূহ্।

৯। মাসয়ালা : সম্মুখে পবিত্র কোরআন, বা তলোয়ার ঝুলানো থাকলে তাতে নামাযে মাকরূহ্ হয় না।

১০। মাসয়ালা : ছবি যুক্ত জায়নামায রাখা মাকরূহ্ এবং ঘরে ছবি রাখা খুব শক্ত গুনাহ্ অবশ্য কোন পাক বিছানায় যদি ছবি থাকে এবং তার ওপর নামায আদায় করে, তবে নামায হয়ে যাবে, কিন্তু ছবির ওপর সেজদা দেবে না। ছবির ওপর সেজদা দিলে নামায মাকরূহ হবে।

১১। মাসয়ালা : নামাযীর সম্মুখে অথবা ওপরে অর্থাৎ ছাদ বা বারান্দায় অথবা ডানে বা বামে যদি ছবি থাকে তবে নামায মাকরূহ্ হবে। পায়ের নীচে ছবি থাকলে মাকরূহ হবে না। যদি ছবি এত ছোট হয় যে, দাঁড়ালে দেখা যায় না, অথবা ছবি পূর্ণাঙ্গ নয় বরং মাথা কাটা এবং স্পষ্ট নয়, তবে ওতে দোষের কিছু নেই। ওটা যেখানেই থাক না কেন, নামায মাকরূহ হবে না। -(শরহে তানবীর)

 ১২। মাসয়ালাঃ প্রাণীর ছবি যুক্ত বস্ত্র পরিধান করে নামায আদায় করা মাকরূহ্। -(শরহে তানবীর)

 ১৩। মাসয়ালা : বৃক্ষলতা, দালানকোঠা ইত্যাদি অচেতন পদার্থের ছবি থাকলে মাকরূহ হবে না।–(শরহে তানবীর)

১৪। মাসয়ালা : নামাযরত অবস্থায় আয়াত, সূরা বা তাসবীহ অঙ্গুলি দ্বারা গণনা করা মাকরূহ্। যদি হিসেব কেবল আঙ্গুল টিপে রাখে, তবে মাকরূহ নয়।–(তানবীর)

১৫। মাসয়ালা : প্রথম রাক’আতের চেয়ে দ্বিতীয় রাকাআতে কেরাআত অধিক লম্বা করা মাকরূহ্।

১৬। মাসয়ালা : কোন নামাযের জন্য কোন সূরা এমনভাবে নির্দিষ্ট করে নেয়া যে, কখনো ওই সূরা ছাড়া অন্য কোন সূরা পড়বে না, এটা করা মাকরূহ্।–(তানবীর)

১৭। মাসয়ালাঃ ঘাড়ের ওপর রুমাল ঝুলিয়ে নামায আদায় করা মাকরূহ্। -(হেদায়া, তানবীর)

১৮। মাসয়ালা : অত্যন্ত খারাপ ও অপরিষ্কার কাপড় পরিধান করে নামায আদায় করা মাকরূহ। অবশ্য যদি পরিধানের অন্য কোন কাপড় না থাকে তবে মাকরূহ হবে না। -(তানবীর)

 ১৯। মাসয়ালা : টাকা, পয়সা, সিকি, দুয়ানি, ইত্যাদি বা অন্য কোন বস্তু মুখের ভেতর চেপে রেখে নামায আদায় করা মাকরূহ্। আর যদি এমন কোন বস্তু হয়, যাতে কেরাআত পড়া যায় না, তাহলে নামাযই হবে না।–(তানবীর)

২০। মাসয়ালাঃ মলমূত্রের বেগ চেপে রেখে নামায আদায় করা মাকরূহ্। -(রদ্দুল মুহতার)

 ২১। মাসয়ালা : অত্যধিক ক্ষুর্ধাত অবস্থায় তৈরি খাবার থাকলে খাবার খেয়ে তারপরে নামায আদায় করবে। অন্যথায় খাবার চিন্তায় নামায মাকরূহ্ হয়ে যাবে। কিন্তু যদি নামাযের ওয়াক্ত চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বা জামায়াত ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে আগে নামায আদায় করে নেবে।-(শরহে তানবীর)

২২। মাসয়ালা : চোখ বন্ধ রেখে নামায পড়া ঠিক নয়। অবশ্য চোখ বন্ধ করে নিলে যদি মন ঠিক থাকে, তাহলে চোখ বন্ধ করে নামায আদায় করায় কোন দোষ নেই।–(তানবীর)

২৩। মাসয়ালা : (নামাযরত অবস্থায়) প্রয়োজন ছাড়া থু থু ফেলা বা নাক ঝাড়া মাকরূহ্। যদি ঠেকা পড়ে তবে থুথু বা সিকনি (নাক দিয়ে যা বের হয়) কাপড়ের কোণে মুছে ফেললে, নামায ভঙ্গ হবে না। কিন্তু ডানে বা ক্বেবলার দিকে জায়গা থাকলেও সেদিকে থুথু ফেলবে না। বাম দিকে থুথু ফেলবে।

২৪। মাসয়ালা : নামাযের মধ্যে ছারপোকায়, পিঁপড়া বা অন্য কোন পোকায় কামড়ালে তাদের মারা ভাল নয়। আস্তে হাত দিয়ে তাড়িয়ে দেবে এবং না কামড়ালে তাড়ানো মাকরূহ্।

২৫। মাসয়ালা : ফরয নামাযে বিনা প্রয়োজনে দেয়াল, খুঁটি বা অন্য কোন কিছুর ওপর ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো মাকরূহ্।–(মুনিয়া)

২৬। মাসয়ালা : কেউ কেউ এতটা তাড়াতাড়ি নামায আদায় করে যে, সূরা পড়া শেষ হবার দু, এক লফ অবশিষ্ট থাকতেই রুকূতে চলে যায় এবং ওই অবস্থায় সূরা শেষ করে, এটা করা মাকরূহ।–(মুনিয়া)

২৭। মাসয়ালাঃ পায়ের স্থান থেকে যদি সেজদার স্থান আধ হাত অপেক্ষা উঁচু হয়, তবে নামায জায়েয হবে না, যদি আধ হাত বা তদপেক্ষা উঁচু হয়, তবে নামায হয়ে যাবে। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে এমনটি করা মাকরূহ।–(মুনিয়া)

২৮। মাসয়ালা : যে বস্ত্র যেমন করে পরিধানের নিয়ম রয়েছে নামাযে তার উল্টো পরিধান করা মাকরূহ্। যেমন–কেউ যদি চাদর বা কম্বল এমনভাবে পরিধান করে যে, ঘাড়ের ওপর দিয়ে দু’কোণা ঝুলিয়ে দেয়, এক কোণা উঠিয়ে কাঁধের ওপর ছড়িয়ে না দেয়, তবে সেটা মাকরূহ হবে। কিন্তু যদি ডানকোণা বাম কাঁধের ওপর উঠিয়ে দেয় এবং বাম কোণা ঝুলিয়ে রাখে তাহলে মাকরূহ হবে না। কেউ যদি জামার হাতার ভেতর আস্তিনে হাত না ঢুকিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়ে ব্যবহার করে, তবে মাকরূহ্ হবে।-(শামী)

২৯। মাসয়ালাঃ টুপী অথবা পাগড়ী ব্যতীত খালি মাথায় নামায আদায় করা মাকরূহ্। অবশ্য কেউ যদি আল্লাহর সামনে আজিযী দেখাবার উদ্দেশ্যে টুপী বা পাগড়ী ব্যতীত খালি মাথায় নামায আদায় করে, তবে মাকরূহ্ হবে না।-(দুররে মুখতার),

৩০। মাসয়ালা : নামাযরত অবস্থায় টুপী অথবা পাগড়ী মাথা থেকে পড়ে গেলে সাথে সাথে এক হাত দিয়ে তা তুলে মাথায় দেয়া ভাল। কিন্তু যদি একবারে বা এক হাত দিয়ে পরা সম্ভব না হয় তাহলে ওঠাবে না।-(দুররে মুখতার)

৩১। মাসয়ালাঃ কনুই পর্যন্ত হাত বিছিয়ে পুরুষদের সেজদা করা মাকরূহ তাহরীমী।

৩২। মাসয়ালাঃ সম্পূর্ণ মেহরাবের ভেতরে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেবের নামায পড়ানো মাকরূহ তানযিহী। কিন্তু পা মেহরাবের বাইরে রেখে মেহরাবের মধ্যে সেজদা করলে মাকরূহ্ হবে না।-(শামী)।

৩৩। মাসয়ালা : অযথা ইমাম এক হাত বা তার চেয়ে বেশী পরিমাণ উঁচু স্থানে দাঁড়ানো মাকরূহ তানযিহী। কিন্তু ইমামের সাথে আরও দু’তিনজন তোক দাঁড়ায়, তাহলে মাকরূহ হবে না, কিন্তু একজন হলে মাকরূহ্ হবে। কারো কারো মতে, এক হাতের চেয়েও কম উঁচু হলে যদি সাধারণ দৃষ্টিতে উঁচু দেখায়, তাহলে তাও মাকরূহ হবে।–(দুররে মুখতার)।

৩৪। মাসয়ালা : সকল মুক্তাদী ওপরে এবং ইমাম একাকী নীচে দাঁড়ালে তাও মাকরূহ। অবশ্য যদি জায়গার অভাবে এরূপ করে বা ইমামের সাথে কিছু লোক নীচে দাঁড়ায় তবে মাকরূহ হবে না।-(দুররে মুখতার)

৩৫। মাসয়ালা : রুকূ, সেজদা ইত্যাদি কোন কাজ ঈমামের আগে আগে করা মুক্তাদীর জন্য মাকরূহ তাহরীমী।-(আলমগীরী)।

৩৬। মাসয়ালা : ইমামের কেরাআত পড়াকালিন মুক্তাদীর দোয়া-কালাম, সূরা ফাতিহা বা অন্য কোন সূরা পড়া মাকরূহ তাহরীমী।-(দুররে মুখতার)

৩৭। মাসয়ালা : সামনের কাতারে জায়গা থাকতে পেছনের কাতারে দাঁড়ানো বা একাকী এক কাতারে দাঁড়ানো মাকরূহ। কিন্তু পূর্বের কাতারে জায়গা না থাকলে পেছনের কাতারে কেউ একা দাঁড়ালে মাকরূহ হবে না।

৩৮। মাসয়ালাঃ পাগড়ী ব্যতীত কেবল টুপী মাথায় দিয়ে বা টুপী ব্যতীত পাগড়ী মাথায় বেঁধে নামায আদায় করা মাকরূহ নয়।

.

জামায়াতের তাকীদ

জামায়াতের তাকীদ ও ফজীলত সম্বন্ধে বহু হাদীস রয়েছে। এখানে কেবল কোরআনের দু’একটি আয়াত ও কয়েকটি হাদীসের উদ্ধৃতি দিচ্ছি–রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও জামায়াত ছাড়েন নি। এমন কি অসুস্থ অবস্থায় যখন হেঁটে মসজিদে যেতে পারতেন না তখনও অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে মসজিদে গিয়েছেন, তথাপি জামায়াত তরক করেননি। জামায়াত তরককারীদের ওপর নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভীষণ ক্রোধ হতো। তিনি জামায়াত তরককারীদের কঠিন শাস্তি দিতে চাইতেন। নিঃসন্দেহে শরীয়তে জামায়াতের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে আর করাটাও সঙ্গত ছিল। নামাযতুল্য এবাদতের মর্যাদা এটাই চায় যে, যে সব বস্তুর মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ হয় তার প্রতি এ ধরনের উন্নত তাকীদ হওয়া জরুরী। এখানে মুফাসসিরীন এবং ফেকাহবিদরা যে আয়াত দিয়ে জামায়াতে নামায পড়া প্রমাণ করেছেন, তা উল্লেখ করে কতিপয় হাদীস বর্ণনা করছি।

আয়াত : ৫২ = $4, পবিত্র কোরআনের বহু সংখ্যক টিকাকার এই আয়াতের অর্থ এরূপ বর্ণনা করেছেন যে, নামায আদায়কারীদের সাথে একত্রে নামায পড়। অনেকে এ আয়াতের তাফসীর করেছেন, মাথা নতকারীদের সাথে মিলে মাথা নত কর। অতএব জামায়াত ফরয না হয়ে ওয়াজিব হওয়া প্রমাণিত হয়েছে।  

হাদীস : হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, একাকী নামায আদায় করা অপেক্ষা জামায়াতে নামায আদায় করায় সাতাশ গুণ বেশি ছাওয়াব পাওয়া যায়।–(বুখারী শরীফ ও মুসলিম)

হাদীসঃ আল্লাহর রাসূল (ছঃ) ফরমান, যে ব্যক্তি এশার নামায জামায়াতে পড়বে তাকে অর্ধ রাতের নেকী দেয়া হবে এবং যে ব্যক্তি এশা ও ফজর দু ওয়াক্ত জামায়াতে আদায় করবে, তাক পূর্ণ রাতের ছাওয়াব দান করা হবে।–(তিরমিযী)

হাদীস : একদা আল্লাহর রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামায়াতে অনুপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমার ইচ্ছে হয় যে কতগুলো কাঠ জড়ো করার আদেশ দেই, অতঃপর আযান দেয়ার আদেশ দেই এবং অন্য একজনকে ইমাম নিযুক্ত করে নামায পড়ানোর আদেশ দিয়ে আমি মহল্লায় গিয়ে দেখি এবং যারা জামায়াতে উপস্থিত হয়নি, তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেই।

হাদীস : নবী করীম (ছঃ) অন্যত্র বলেন, যদি ছোট শিশু ও স্ত্রীলোকদের খেয়াল না হতো, তবে আমি এশার নামাযে মগ্ন হয়ে যেতাম এবং খাদেমদের হুকুম দিতাম যে, যারা জামায়াতে হাযীর হয় নি, তাদের মালামাল এবং তাদেরকেসহ তাদের বাড়ি ঘর যেন জ্বালিয়ে দেয়া হয়।-(মুসলীম)

.

জামায়াতে নামায আদায় করার ফযীলত

জামায়াতে নামায আদায় করার হেকমত সম্পর্কে শ্রদ্ধেয় আলেমরা বহু আলোচনা করেছেন। কিন্তু হযরত শাহ্ ওয়ালি উল্লাহ্ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রঃ)-এর সার্বিক ও সূক্ষ্ম তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা অপেক্ষা অপর কোনটি আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। শাহ্ সাহেবের পবিত্র ভাষায় ওই আলোচনাগুলো শুনতে পারলে পাঠকবৃন্দ পুরোপুরি স্বাদ গ্রহণে সক্ষম হবেন। নিমে শাহ্ সাহেবের বর্ণনার সারমর্ম প্রদত্ত হল।

১। এটাই একমাত্র উত্তম উপায় যে, কোন এবাদতকে মুসলিম সমাজে এমন প্রথায় প্রচলিত করে দেয়া, যেন তা একটি অত্যাবশ্যকীয় মঙ্গলজনক এবাদতে পরিগণিত হয় এবং পরে তা বর্জন করা চিরাচরিত অভ্যাস বর্জন করার ন্যায় কঠিন ও অসাধ্য হয়ে পড়ে। ইসলামে একমাত্র নামাযই সবচেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ এবাদত। সুতরাং নামাযকে অত্যাধিক গুরুত্ব ও যত্নসহকারে বিশেষ ব্যবস্থাপনার সাথে আদায় করতে হবে। আর তা একমাত্র জামায়াতে নামায আদায় করার মাধ্যমেই সম্ভব।

২। সমাজে বিভিন্ন ধরনের লোক বাস করে। আলেমও বাস করে, আবার জাহিলও বাস। করে। সুতরাং এটা খুবই যুক্তিপূর্ণ যে, সকলে এক জায়গায় একত্রিত হয়ে পরস্পরের সামনে এই এবাদাতকে পূর্ণতা দান করা। কোন ব্যক্তির কোন ভুলভ্রান্তি হলে অন্যে তা শুধরিয়ে দেবে। যেন আল্লাহ্ তায়ালার এবাদাত একটি অলঙ্কারস্বরূপ। যেমন–যারা পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখে, তারা তাতে ভুলত্রুটি থাকলে বলে দেয়, আর যা ভাল হয় তা পছন্দ করে। নামাযকে পূর্ণাঙ্গ করার • ইচ্ছা একটি উত্তম পন্থা।

৩। বেনামাযীদের অবস্থাও প্রকাশ হয়ে পড়ে। এতে তাদেরকে ওয়ায নছিহত করার সুযোগ হয়।

৪। কিছু সংখ্যক মুসলমান মিলিতভাবে আল্লাহ তা’আলার এবাদাত করা এবং তার নিকট প্রার্থনা করার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হবার ও দোয়া কবুল হওয়ার একটি আশ্চর্যজনক বিশেষত্ব।

৫। আল্লাহর উদ্দেশ্য হল, এ উম্মত দিয়ে তাঁর বাণীকে সমুন্নত করা এবং কুফরকে অধঃপতিত করা–পৃথিবীতে যেন কোন দ্বীনই ইসলামের ওপর প্রবল না থাকে। এটা তখনই সম্ভব, যখন এ নিয়ম নির্ধারিত হবে যে, সাধারণ ও বিশিষ্ট মুকীম, মুসাফীর, ছোট, বড় সকল মুসলমান নিজেদের কোন বড় ও প্রসিদ্ধ এবাদাতের জন্য এক জায়গায় একত্রিত হবে এবং ইসলামের শানশওকত প্রকাশ করবে। এ সকল যুক্তিতে শরীয়তের পূর্ণ দৃষ্টি জামায়াতের দিকে নিবদ্ধ হয়েছে এবং তার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে এবং জামায়াত ত্যাগ করতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

৬। জামায়াতে এ উপকারিতা আছে যে, সব মুসলমান একে অপরের সম্পর্কে জানতে থাকবে। একজন অপর জনের দুঃখকষ্টে শরীক হতে পারবে, যার ফলে দ্বীনী ভ্রাতৃত্ব এবং ঈমানী মহব্বতের পূর্ণ বিকাশ ও দৃঢ়তা সাধিত হবে। এটা শরীয়তের একটি মহান উদ্দেশ্যও বটে। পবিত্র কালামে ও হাদীস শরীফের বিভিন্ন স্থানে এর তাকীদ ও ফজীলত বর্ণনা করা হয়েছে।

৭। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) ফরমান, যে ব্যক্তি এশার নামায জামায়াতে পড়বে তাকে অর্ধেক রাত্রের নেকী প্রদান করা হবে এবং যে ব্যক্তি এশা ও ফজর দু ওয়াক্ত জামায়াতের সাথে আদায় করবে, তাকে পূর্ণ রাত্রির নেকী প্রদান করা হবে। (তিরমিযী)

অতীব দুঃখের বিষয়, বর্তমান যুগে জামায়াত বাদ দেয়া একটা সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। জাহেলদের তো কথাই নেই, অনেক আলেমও এ গর্হিত কাজে লিপ্ত রয়েছে। দুঃখের বিষয়, এরা হাদীস পাঠ করে এবং অর্থ বোঝে, অথচ জামাআতে নামায আদায় করার কঠোর নির্দেশগুলো তাদের পাথর থেকেও কঠিন হৃদয়ে কোন প্রভাব ফেলছে না। কিন্তু কিয়ামতের দিন মহা বিচারকের সম্মুখে যখন নামাযের মামলা পেশ করা হবে এবং তা অনাদায়কারী বা অসম্পূর্ণ আদায়কারীদেরকে যখন জিজ্ঞেস করা আরম্ভ হবে, তখন তারা কি উত্তর দেবে?

.

জামায়াত ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলী

১। পুরুষ হওয়া; স্ত্রীলোকের ওপর জামায়াতে উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব নয়।

 ২। বালেগ হওয়া; নাবালেগের ওপর জামায়াতে উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব নয়।

৩। স্বাধীন হওয়া; ক্রীতদাসের ওপর জামায়াতে উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব নয়।

৪। যাবতীয় ওযর থেকে মুক্ত থাকা; মা’যূরের জন্য জামায়াত ওয়াজিব নয়, কিন্তু এদের জামায়াতে নামায আদায় করা উত্তম। কেননা, জামায়াতে নামায আদায় না করলে জামায়াতের ছাওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকবে।

.

জামায়াত তরক করার চৌদ্দটি কারণ

 ১। গুপ্তাঙ্গ অর্থাৎ নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকার মত বস্ত্র না থাকলে এমতাবস্থায় জামায়াতে উপস্থিত না হওয়া দূরুস্ত আছে।

 ২। মসজিদে গমনের পথে যদি এমন কাদা থাকে যে, পথ চলতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু ইমাম হযরত আবু ইউসুফ (রঃ) ইমাম হযরত আবু হানিফা (রঃ)-এর নিকট জিজ্ঞেস করেছিলেন, পথে কাদা-পানি থাকলে জামায়াতে যোগদান করার ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? উত্তরে তিনি বললেন, জামায়াত তরক করা আমার পছন্দ নয়।

৩। অনবরত বৃষ্টি অথবা ঝড়-তুফান হতে থাকলে, যদিও এমতাবস্থায় জামায়াতে উপস্থিত না হওয়া জায়েয, কিন্তু ইমাম মুহাম্মদ (রঃ) বলেন, এরূপ অবস্থায়ও জামায়াতে উপস্থিত হওয়া উত্তম।

৪। প্রচণ্ড শীতের জন্য বাইরে, অথবা মসজিদে গমন করলে যদি জীবনের ভয় থাকে অথবা রোগীর রোগ বৃদ্ধির আশংকা থাকে, তবে জামায়াত তরক করা দূরুস্ত আছে।

৫। মসজিদে গমন করলে যদি মালামাল চুরি হওয়ার আশংকা থাকে তাহলে জামায়াত তরক করা দূরুস্ত আছে।

৬। মসজিদের সামনে যদি শত্রুর মোকাবেলা হওয়ার আশংকা থাকে তাহলে জামায়াত তরক করা দুরুস্ত আছে।

৭। মসজিদে গমন করার পথে ঋণ দাতা কর্তৃক উৎপীড়িত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে। অবশ্য যদি পরিশোধের সামর্থ না থাকে তাহলে এ হুকুম। সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যদি ঋণ পরিশোধ না করে, তবে জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। তার জন্য জামায়াত তরক করা দূরুস্ত নেই।

৮। অন্ধকার রাতে পথ দেখা না গেলে। কিন্তু যদি আলোর ব্যবস্থা থাকে তবে জামায়াত তরক করা জায়েয নেই।

৯। অন্ধকার রাতে প্রচণ্ড ধূলিঝড় প্রবাহিত হতে থাকলে তখন জামায়াত তরক করা দুরুস্ত আছে।

১০। রুগীর সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি জামায়াতে গেলে যদি রোগী কষ্ট বা ভয় পায়, তবে জামায়াতে না যাওয়া দূরস্ত আছে।

১১। খাবার তৈরি হয়েছে অথবা হচ্ছে, আবার ক্ষুধাও এত বেশি যে, আহার না করে নামাযে দাঁড়ালে নামাযে কোনক্রমেই মন বসবে না, এমন অবস্থায় জামায়াত তরক করা দুরুস্ত আছে।

১২। পেশাব-পায়খানার বেগ খুব বেশি হলে, হাজাত পূর্ণ করার জন্য জামায়াত তরক করা দুরুস্ত আছে।

১৩। সফরে যাত্রার সময় হয়েছে, এমতাবস্থায় জামায়াতে শরিক হলে দেরী হয়ে যাওয়ার এবং কাফেলার সাথীরা চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে জামায়াত তরক করা দুরুস্ত আছে। রেলগাড়ীতে সফরের মাসয়ালার সাথে এর তুলনা করা চলে, তবে তফাৎ এটুকু যে, এক কাফেলার পর অন্য কাফেলা পেতে বেশ বিলম্ব হয়। আর রেলগাড়ী প্রত্যহ কয়েকবার পাওয়া। যায়। অবশ্য এতে যদি ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয় তবে জামায়াত তরক করায় দোষ নেই। শরীয়তে অসুবিধা ভোগ করতে বলা হয়নি।

১৪। রোগের জন্য চলাচলে অক্ষম এমন ব্যক্তি কিংবা অন্ধ খোঁড়া বা পা কাটা লোকের জন্য জামায়াত মাফ। অন্ধ ব্যক্তি অনায়াসে মসজিদে হাযির হতে সক্ষম হলে, তার জামায়াত তরক করা ঠিক নয়।

.

নামায শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলী

ইমাম সাহেবের পেছনে কোন নামাযে তার অনুসরণ করে নামায আদায় করার ইচ্ছা করাকে এক্তেদা করা বলে।

শর্ত ১। ইমাম সাহেবের মুসলমান হতে হবে। ইমাম সাহেবের যদি ঈমান না থাকে তাবে নামায শুদ্ধ হবে না।

শর্ত ২। ইমামের বোধশক্তি সম্পন্ন হওয়া। নাবালেগ, উম্মাদ, বেহুঁশ ব্যক্তির এক্তেদা শুদ্ধ হবে না।

শর্ত ৩। মুক্তাদী নামাযের নিয়্যতের সাথে সাথে ইমামের এক্তেদার নিয়্যত করা।

অর্থাৎ ও মনে মনে এ নিয়্যত করা যে আমি এই ইমামের পেছনে অমুক নামায আদায় করছি।

শর্ত ৪। ইমাম এবং মুক্তাদী উভয়ের স্থান একই হওয়া। যদি ছোট মসজিদের বা ছোট ঘরে ইমাম হতে মুক্তাদি দু’কাতারের চেয়েও বেশি দূরে দাঁড়ায়, তাহলেও এক্তেদা শুদ্ধ হবে। কারণ, স্থান একই আছে। কিন্তু যদি অতি প্রকাণ্ড মসজিদ, ঘর বা ময়দানের মধ্যে ইমাম এবং মুক্তাদীর মধ্যে দু’কাতার পরিমাণ দূরত্ব হয় তবে এক্তেদা শুদ্ধ হবে না। যদি ইমাম এবং মুক্তাদীর মধ্যে এমন কোন খাল থাকে, যার ওপর দিয়ে নৌকা চলাচল করতে পারে বা এমন একটি রাস্তা থাকে, যার ওপর দিয়ে গরুর গাড়ী চলতে পারে, তবে এক্তেদা শুদ্ধ হবে না। কিন্তু যদি ওই খাল বা পথ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং খালের ভেতর নৌকা রেখে তার ওপর খাড়া হয় এবং রাস্তার মধ্যেও কাতার দেয়া হয়, তবে এক্তো শুদ্ধ হবে, কারণ কাতার থাকায় দু’পাড় মিলিয়ে একইস্থান ধরা হবে। যদি খাল বা রাস্তা অতি সরু হয়, তবে এক্তেদা শুদ্ধ হবে।

.

এক্তেদা ছহীহ হওয়ার শর্তসমূহ

১। মাসয়ালা : মুক্তাদী যদি মসজিদের ছাদের ওপর দাঁড়ায় এবং ইমাম মসজিদের ভেতরে থাকে, তাহলে এদো জায়েয হবে। কারণ, মসজিদের ছাদ মসজিদেই শামিল। কাজেই উভয় জায়গাকে একই ধরা হবে। তদ্রুপ যদি কোন অট্টালিকার ছাদ মসজিদ সংলগ্ন হয় এবং মাঝে কোন আড় না থাকে, তবে তা এবং মসজিদ এক জায়গা বুঝতে হবে। তার ওপর দাঁড়িয়ে মসজিদের ভেতরের ইমামের এক্তেদা করা জায়েয রয়েছে।

মাসয়ালা ২। মসজিদ খুব বড় হলে অথবা ঘর খুব বড় হলে অথবা মাঠ হলে এবং ইমাম ও মুক্তাদীর মধ্যে দু’কাতারের সমান স্থান খালি থাকলে ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ের স্থান আলাদা বুঝতে হবে এবং এক্তেদা শুদ্ধ হবে না।

মাসয়ালা ৩। ইমাম ও মুক্তাদীর মাঝে কোন খাল থাকলে যাতে নৌকা ইত্যাদি চলাচল করতে পারে, অথবা এত বড় হাউজ রয়েছে যার মধ্যে সামান্য পরিমাণ নাপাকী পড়লে শরীয়ত অনুযায়ী তা পাক, অথবা সাধারণের চলাচলের পথ থাকলে, যাতে গরুর গাড়ী ইত্যাদি চলাচল করতে পারে এবং মাঝখানে কোন কাতার না থাকলে উভয় স্থানকে এক ধরা যাবে না, কাজেই এক্তেদা জায়েয হবে না। অবশ্য যদি খুব ছোট নালা থাকে যা একটি সংকীর্ণ পথের সমান নয়। তবে তা এক্তেদার অন্তরায় নয়; এক্তেদা জায়েয হবে।

মাসয়ালা ৪। দু’কাতারের মাঝখানে উপরোল্লিখিত কোন খাল অথবা পথ থাকলে, যারা খাল বা পথের অপর পাড়ে অবস্থান করছে, তাদের জন্য ওই কাতারে এক্তেদা জায়েয হবে না।

মাসয়ালা ৫। ঘোড়ার ওপর একজন এবং মাটিতে একজন আছে অথবা একজন এক ঘোড়ার ওপর আরেক জন অন্য ঘোড়ার ওপর আছে, এদের এক্তেদা শুদ্ধ হবে না। কারণ এদের স্থান এক নয়। একজন এক নৌকায় এবং অপরজন অন্য এক নৌকায় আছে, এদের এক্তেদাও ছহীহ্ হবে না। কিন্তু যদি দু’ নৌকা একসাথে রশি দিয়ে বেঁধে নেয় বা একই ঘোড়ার ওপর দু’জন হয়, তাহলে এদো ছহীহ হবে।

শর্ত ৫। ইমাম ও মুক্তাদীর নামায এক হতে হবে। না হয় এক্তেদা করা ছহীহ হবে না। ইমাম যদি যোহরের ক্বাযা নামায আদায় করে এবং মুক্তাদী তার পেছনে আসর বা ইমাম গতকালের যোহর নামায ক্বাযা আদায় করলে, মুক্তাদী আজকের যোহর নামাযের নিয়্যত করে এক্তেদা করলে এসব এক্তেদা ছহীহ হবে না। কিন্তু যদি ইমাম এবং মুক্তাদী উভয়ে একই ওয়াক্তের ক্বাযা এক সাথে মিলে আদায় করে, তবে তা জায়েয হবে। ইমাম ফরয নামায আদায় করছে আর মুক্তাদী তার পেছনে নফল নামাযের এক্তেদা করছে, তবে তা জায়েয হবে। কেননা, ইমামের নামায সবল।

মাসয়ালা ৬। ইমাম সাহেব নফল নামায আদায় করছেন এবং মুক্তাদী তারাবীহ্ মনে করে এক্তেদা করল, এটা ছহীহ (শুদ্ধ) হবে না। কারণ ইমামের নামায দুর্বল।

শর্ত ৬। ইমামের নামায ছহীহ (শুদ্ধ) হতে হবে। ইমামের নামায ছহীহ (শুদ্ধ) না হলে মুক্তাদীর নামাযও ছহীহ (শুদ্ধ) হবে না, ঘটনাচক্রে যদি ইমামের ওযূ না থাকে বা পরিধানের বস্ত্রে নাপাকী থাকে এবং নামাযের পূর্বে স্মরণ না থাকা বশতঃ নামাযে দণ্ডায়মান হয়, তারপর নামায রত অবস্থায় স্মরণে আসুক বা নামাযের পর স্মরণে আসুক, তার নামায হবে না এবং মুক্তাদীদের নামাযও হবে না।

মাসয়ালা ৭। ঘটনাচক্রে যদি ইমামের নামায না হয় এবং মুক্তাদীদের তা অজানা থাকে, তাহলে মুক্তাদিদেরকে জানিয়ে দেয়া ইমামের জন্য ওয়াজিব এবং নামায পূনরায় পড়া তাদের জন্য ওয়াজিব।

শর্ত ৭। ইমাম থেকে মুক্তাদী এগিয়ে দাঁড়ানো ঠিক নয়। মুক্তাদী ইমাম অপেক্ষা এক ইঞ্চি এগিয়ে দাঁড়ানো ঠিক নয়। মুক্তাদী যদি ইমাম অপেক্ষা এক ইঞ্চি এগিয়ে দাঁড়ায় তবে মুক্তাদীর নামায হবে না। অবশ্য পায়ের গোড়ালী আগে না গিয়ে মুক্তাদীর আঙ্গুল লম্বা হওয়ায় আগে গেলে নামায হয়ে যাবে।

শর্ত ৮। ইমামের ওঠা-বসা, রুকূ, ওমা, সেজদা ও জলসা ইত্যাদি মুক্তাদীর জন্য জানা। আবশ্যক। ইমামকে দেখে জানুক বা ইমামের বা মোকাব্বিরের কণ্ঠ শোনে জানুক বা অন্য মুক্তাদীদেরকে দেখে জানুক, মোট কথা ইমামের ওঠা-বসা ইত্যাদি মুক্তাদীর জন্য জানা প্রয়োজন। কোন কারণবশতঃ ইমামের ওঠা-বসা ইত্যাদি মুক্তাদী জানতে না পারলে, যেমন : যদি মাঝে উঁচু পর্দা বা প্রাচীর থাকে এমনকি ইমাম বা মোকাব্বেরের শব্দও শুনতে না পায়, তাহলে মুক্তাদীর নামায হবে না। কিন্তু যদি উঁচু দেয়াল মাঝখানে থাকা সত্ত্বেও ইমাম বা মোকাব্বেরের আওয়ায শুনতে পায়, তাহলে এক্তেদা ছহীহ হবে।

মাসয়ালা ৮। ইমাম সাহেব মুসাফীর কি মুক্বীম তা যদি অজ্ঞাত থাকে কিন্তু লক্ষণে মুকীম বলে মনে হয়, যদি শহর অথবা গ্রাম হয় এবং মুসাফীরের মতো নামায পড়ায় অর্থাৎ চার রাক’আত বিশিষ্ট নামায দু’রাক’আত আদায় করে সালাম ফিরায় এবং মুক্তাদীগণ সালাম ফেরানোর কারণে ভুল হওয়ার সন্দেহ পোষণ করে, তবে মুক্তাদীদেরকে চার রাক’আত পূর্ণ করার পর ইমামের অবস্থা অনুসন্ধান করা ওয়াজিব যে, ইমামের ভুল হয়েছে, না সে মুসাফীর ছি। খোঁজ নিয়ে যদি জানা যায় যে, ইমাম মুসাফীর ছিল তাহলে নামায ছহীহ হবে। আর যদি ভুল প্রমাণিত হয়, তার নামায পুনরায় আদায় করতে হবে। আর যদি অনুসন্ধান না করে বরং মুক্তাদী ওই সন্দেহের অবস্থায় নামায পড়ে চলে যায়, তাহলে মুক্তাদীর নামায পুনরায় আদায় করা ওয়াজিব।

মাসয়ালা ৯। ইমামকে যদি মুকীম বলে ধারণা হয়; কিন্তু নামায শহরে বা গ্রামে পড়াচ্ছেনা বরং শহর ও গ্রামের বাইরে পড়াচ্ছেন এবং চার রাক’আত বিশিষ্ট নামায মুসাফীরের মতো পড়ানোর কারণে মুক্তাদীর সন্দেহ হল যে, ইমামের ভুল হয়েছে, এ অবস্থায়ও মুক্তাদী নিজের চার রাক’আত পূর্ণ করবে এবং নামাযের পর ইমামের অবস্থা যেনে নেয়া উত্তম। জেনে না নিলেও নামায ফাসেদ হবে না। কারণ, শহর অথবা গ্রামের বাইরে ইমামের ব্যাপারে মুক্তাদীদের ভুল ধারণা করা অহেতুক। কাজেই এ অবস্থায় সন্ধান করার প্রয়োজন নেই। এ ধরনের ইমাম যদি চার রাক’আত নামায শহর অথবা গ্রামে বা মাঠে পড়ায় আর যদি কোন মুক্তাদীর ইমাম মুসাফীর হিসেবে সন্দেহ হয়, কিন্তু ইমাম পূর্ণ চার রাক’আত পড়িয়েছে, এ অবস্থায় নামাযের পর ইমামের সন্ধান নেয়া ওয়াজিব নয়! ফজর ও মাগরীব নামাযে ইমাম মুসাফীর কিনা তা অনুসন্ধান করা নিষ্প্রয়োজন। কেননা, এসব নামাযে মুকীম, মুসাফীর সবই সমান। মোটকথা, সন্ধান ঐ সময় করতে হবে যখন ইমাম শহর অথবা গ্রামে অথবা অন্য কোন জায়গায় চার রাকআতী নামাযে দু’রাক’আত পড়ায় এবং ইমামের ভুল হয়েছে বলে মুক্তাদীর সন্দেহ হয়।

শর্ত ৯। কেরআত ছাড়া অন্যান্য সব রোকনের মধ্যে ইমামের সাথে মুক্তাদীর শামীল থাকা চাই। ইমামের সাথেই হোক বা তারপর অথবা ইমামের আগে যদি ঐ রোকনের শেষতক ইমাম মুক্তাদী শরীক হয়ে থাকে। প্রথম প্রকারের উদাহরণ হল, ইমামের সাথেই রুকূ সেজদা করা। দ্বিতীয় প্রকারের উদাহরণ হল, ইমাম রুকূ থেকে দাঁড়ানোর পর মুক্তাদীর রুকূ করা। তৃতীয় উদাহরণ হল, পূর্বেই রুকূ করল কিন্তু রুকূতে এত দেরী করল যে, ইমামের রুকূ তার সাথে মিলিত হল অর্থাৎ মুক্তাদী রুকূতে থাকতেই ইমাম রুকূতে গেল।

মাসয়ালা ১০। কোন রোকনে মুক্তাদী যদি ইমামের সাথে শামিল না হয়, যেমন–ইমাম রুকূ করল কিন্তু মুক্তাদী রুকূ করল না বা ইমাম দু’ সেজদা করল কিন্তু মুক্তাদী একটি সেজদা করল কিংবা ইমামের পূর্বে কোন রোকন আরম্ভ করেছে এবং শেষ পর্যন্ত ইমাম এতে যুক্ত হয় নি, যেমন–মুক্তাদী ইমামের পূর্বেই রুকূতে গেল, কিন্তু ইমাম রুকূ করার পূর্বেই রুকূ হতে দাঁড়িয়ে গেল। এ উভয় ক্ষেত্রে এক্তেদা জায়েয হবে না।

শর্ত ১০। মুক্তাদীর অবস্থা ইমাম অপেক্ষা কম বা সমান হওয়া চাই।

১। দাঁড়াতে অক্ষম এমন ব্যক্তির পেছনে দাঁড়াতে সক্ষম এমন ব্যক্তি এক্তেদা দুরুস্ত আছে।

২। ওযূ বা গোসলের তায়াম্মুমকারীর পেছনে ওযূ, গোসলকারীর এক্তেদা দুরস্ত আছে। কারণ, পবিত্রতার ক্ষেত্রে তায়াম্মুম, ওযূ ও গোসলের সমান।

৩। চামড়ার মোজা বা পট্টির ওপর মাছেহকারীর পেছনে ওযূ ও সর্বাঙ্গ ধৌতকারীর এক্তেদা করা জায়ে আছে। কারণ, মাছেহ করা এবং ঘোয়া একই পর্যায়ের তাহারাত। কোনটির ওপর কোনটির প্রাধান্য নেই।

৪। মা’যূরের পেছনে মা’যূরের এক্তেদা করা জায়েয, যদি দু’জনই একই কারণে মাসূর হয়। যেমন দু’জনার বহুমূত্র বা বায়ু নির্গত হওয়ার রোগ হয়।

৫। উম্মীর এক্তেদা উম্মীর পেছনে দুরুস্ত আছে, যদি মুক্তাদীর মধ্যে একজনও ক্বারী না থাকে।

৬। মহিলা বা নাবালেগের এক্তেদা বালেগ পুরুষের পেছনে জায়েয।

৭। স্ত্রীলোকের এক্তেদা স্ত্রীলোকের পিছনে দুরুস্ত আছে।

 ৮। নাবালেগা স্ত্রীলোক বা নাবালেগ পুরুষের এক্তেদা নাবালেগ পুরুষের পেছনে জায়েয।

৯। নফল পাঠকারীর এক্তেদা ওয়াজিব পাঠকারীর পেছনে জায়েয। যেমন–কোন ব্যক্তি যোহরের নামায আদায় করেছে, সে অন্য যোহরের নামায আদায়কারীর পেছনে নামায পড়ল কিংবা ঈদের নামায পড়েছে, সে পুনরায় অন্য জামায়াতের নামাযে শামিল হল।

১০। নফল আদায়কারীর এক্তেদা নফল আদায়কারীর পেছনে জায়েয।

১১। কসমের নামায আদায়কারীর এক্তেদা নফল আদায়কারীর পেছনে জায়েয। কেননা, কসমের নামাযও মূলতঃ নফলই। অর্থাৎ এক ব্যক্তি কসম করল যে, আমি দু’রাক’আত নামায পড়ব, এরপর কোন নফল আদায়কারীর পেছনে দু’রাক’আত আদায় করল। নামায হয়ে যাবে এবং কসমও পূর্ণ হবে।

১২। মান্নতের নামায আদায়কারীর এক্তেদা মান্নতের নামায আদায়কারীর পেছনে জায়েয আছে, যদি দু’জনের মান্নত এক হয়। যেমন–কোন এক ব্যক্তির মান্নতের পর অন্য ব্যক্তি বলল, আমিও তারই মান্নত করলাম, অমুকে যার মান্নত করেছে। যদি এরূপ না হয় বরং একজন দু’রাক’আতের আলাদা মান্নত করেছে এবং অপরজন অন্য মান্নত করেছে; এদের কেউই কারো পেছনে এক্তেদা করতে পারবে না। মোট কথা যখন মুক্তাদী ইমাম হতে কম কিংবা সমান হবে, তখন এক্তেদা জায়েয হবে। (কোন অবস্থায়ই ইমামের মান মুক্তাদীর মান অপেক্ষা কম হলে চলবে না)।

.

যে সব ক্ষেত্রে এক্তেদা জায়েয নেই

এখন ওই সব বিষয় বর্ণনা করছি, যাতে মুক্তাদী ইমাম অপেক্ষা মর্তবায় বেশি হয়। চাই বিশ্বাসের ক্ষেত্রে হোক কিংবা সম্ভাবনীয় হোক, এক্তেদা জায়েয নেই।

(১) বালেগ পুরুষ বা মহিলার এক্তেদা নাবালেগের পেছনে জায়েয নেই। (২) বালেগ বা নাবালেগ পুরুষের এক্তেদা মহিলার পেছনে জায়েয নেই। (৩) নপুংসকের এক্তেদা নপুংসকের পেছনে জায়েয নেই। নপুংসক তাকেই বলা হয়, যাকে নরনারী কোনটাই বুঝা যায় না। এ ধরনের লোক নিতান্তই কম। (৪) যে মহিলার ঋতু স্রাবের নির্দিষ্ট সময়ের কথা মনে নেই, তার, এক্তেদা অনুরূপ মহিলার পেছনে জায়েয নেই। এ উভয় অবস্থায় ইমামের চেয়ে মুক্তাদীর মান বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং এক্তেদা দুরুস্ত নেই। কারণ, প্রথম অবস্থায় যে নপুংসক ইমাম হয়েছে হয়ত সে স্ত্রীলোক এবং যে মুক্তাদী নপুংসক, হয়ত সে পুরুষ। অনুরূপ ভাবে যে স্ত্রীলোক ইমাম, হয়ত এটা তার হায়েযের সময় আর যে মুক্তাদী হয়ত বা এটা তার পবিত্রতার বা তাহারাতের সময়। তাই এক্তেদা ছহীহ হবে না। (৫) মহিলাদের পেছনে নপুংসকদের এক্তেদা জায়েয নয়। কারণ, সে নপুংসক পুরুষ হতে পারে। (৬) উম্মাদ, বেহুঁশ বা কম আক্কেলের পেছনে আকেলমান্দ ব্যক্তির এক্তেদা জায়েয নেই। (৭) পাক বা কারণ ছাড়া ব্যক্তির এক্তেদা মায়ূর, যেমন–বহুমূত্র ইত্যাদি রোগীর পেছনে জায়েয নেই। (৮) এক ও্যর ওয়ালার এক্তেদা দুই ও্যর ওয়ালার পেছনে জায়েয নেই। যেমন–কারো বায়ু নির্গত হওয়ার রোগ আছে তার। এমন ব্যক্তির পেছনে এক্তেদা করা যার বহুমূত্র ও বায়ু নির্গত হওয়ার রোগ দু’টোই আছে।

৯। এক শ্রেণীর মা’যূরের পেছনে অন্য শ্রেণীর মা’যূরের এক্তেদা জায়েয নেই। যেমন–বহুমূত্র রোগীর নাত্সীর রোগীর এক্তেদা করা।

১০। ক্বারীর এক্তেদা উম্মীর পেছনে জায়েয নেই। কারী বলা হয় তাকেই, যে এতটুকু পরিমাণ কোরআন ছহীহভাবে পাঠ করতে পারে, যাতে নামায হয়ে যায়। আর উম্মী বলা হয়। তাকে, যার এতটুকু ইয়াদ নেই।

১১। উম্মীর এক্তেদা উন্মীর পেছনে দুরুস্ত নেই। কেননা, মুক্তাদীর মধ্যে কোন কারী উপস্থিত থাকলে উক্ত উম্মীর নামায ফাসেদ হয়ে যাবে। কারণ, ওই ক্বারীকে ইমাম বানানো সম্ভব ছিল আর তার কেরআত মুক্তাদীর পক্ষ হত্যেথেষ্ট হতো। যখন ইমামের নামায ফাসেদ হবে, তখন উম্মী মুক্তাদীসহ সকল মুক্তাদীর নামায ফাসেদ হয়ে যাবে।

১২। উম্মীর এক্তেদা বোবার পেছনে জায়েয নেই। কারণ উম্মী যদিও উপস্থিত কেরাআত পড়তে পারে না, কিন্তু পড়তে তো সক্ষম। কারণ, সে কেরাআত শিখতে পারে। বোবার মধ্যে এ ক্ষমতাটুকু নেই।

১৩। ফরয পরিমাণ ঢাকা ব্যক্তির উলঙ্গ ব্যক্তির পেছনে এক্তেদা করা জায়েয নেই।

১৪। রুকূ সেজদা করতে সক্ষম ব্যক্তির এক্তেদা রুকূ সেজদা করতে অক্ষম ব্যক্তির পেছনে জায়েয নেই। আর যদি কোন ব্যক্তি কেবলমাত্র সেজদা দিতে অক্ষম হয়, তার পেছনেও এক্তেদা করা জায়েয নেই।

১৫। ফরয আদায়কারীর এক্তেদা নফল আদায়কারীর পেছনে জায়েয নেই।

১৬। মান্নতের নামায আদায়কারীর এক্তেদা নফল আদায়কারীর পেছনে জায়েয নেই। কেননা, মান্নতের নামায ওয়াজিব।

১৭। মান্নতের নামায আদায়কারীর এক্তেদা কসমের নামায আদায়কারীর পেছনে জায়েয নেই। যেমন : যদি কেউ কসম করে যে, অদ্য আমি চার রাক’আত নামায আদায় করব, আর একজন মান্নত করল, আমি নামায আদায় করব। তখন উক্ত মান্নতকারীর নামায কসমকারীর পেছনে জায়েয হবে না। কারণ মান্নতের নামায ওয়াজিব আর কসমের নামায নফল। কেননা, কসম পূর্ণ করা ওয়াজিব হলেও এতে নামায আদায় না করে কাফফারা দিলেও চলে।

১৮। মাসয়ালা : যে লোক সাধারণ হরফগুলো ছহীহ করে পড়তে পারে না। এক হরফের জায়গায় অন্য হরফ পড়ে, যেমন–র এর স্থানে। পড়ে, এর স্থানে এ পড়ে, এ ধরনের লোকের গোছনে ছহীহভাবে পড়তে জানা লোকের এক্তেদা দুরুস্ত হবে না। অবশ্য সমস্ত কেরাক’আতের মধ্যে এক আধটু ভুল অসতর্কতার জন্য হয়ে গেলে নামায হয়ে যাবে।

শর্ত ১১। ইমামের ওয়াজিবুল এনফেরাদ (অর্থাৎ যার একাকী নামায আদায় করা ওয়াজিব, যেমন–মাসবূক) ওয়া চলবে না। অতএব মাসবুকের পেছনে এক্তেদা দূরুস্ত নয়।

শর্ত ১২। মুক্তাদীর পেছনে এক্তেদা করা জায়েয নয়। লাহেক হোক, মাসবূক হোক বা মোদরেক হোক।

কোন মুছল্লীর মধ্যে উল্লেখিত শর্তগুলোর কোন একটি শর্ত যদি পাওয়া না যায় তবে এক্তেদা ছহীহ হবে না। এক্তেদা ছহীহ না হলে নামাযও ছহীহ হবে না।

.

নামাযের অন্যান্য মাসয়ালা

 নামাযে লোকমা দেয়ার মাসয়ালা

১। মাসয়ালাঃ নামাযে নিজ ইমাম ব্যতীত অন্য কাউকে লোকমা দিলে নামায বাতিল হয়ে যাবে।

কেরআত পাঠে ভুল করলে তা সংশোধন করে দেয়াকে লোকমা বলা হয়।

২। মাসয়ালা : শুদ্ধ ক্বওল হল, ইমামকে লোকমা দিলে নামায বাতিল হবে না, ইমাম যদি প্রয়োজন পরিমাণ ক্বেরাআত পাঠের পূর্বেই আটকে যায় এবং ওই অবস্থায় মুক্তাদী লোকমা দেয়, তাতে নামায ফাসেদ বা বাতিল হয় না। এমন কি যদি প্রয়োজন পরিমাণ কেরাআত পাড়ার পরও লোকমা দেয়, তাতেও নামায বাতিল হবে না। অর্থাৎ যে নামাযে যে পরিমাণ কেরাআত পড়া সুন্নাত সে পরিমাণ কেরাআত পাঠ করা।

৩। মাসয়ালা : ইমাম যদি জরুরত পরিমাণ কেরাআত পাঠ করার পর আটকে যায়, তবে সাথে সাথেই তার রুকূতে চলে যাওয়া উচিত। মুক্তাদীকে লোমা দেয়ার জন্য বাধ্য করা উচিত নয়, এমন করা মাকরূহ্। মুক্তাদীদেরও প্রয়োজন ব্যতিরেকে লোকমা দেয়া ঠিক নয়। বিনা প্রয়োজনে লোকমা দেয়া মাকরূহ। এখানে প্রয়োজন অর্থ হল, ইমাম যদি প্রয়োজন পরিমাণ কেরাআত পাঠ করতে না পারে, আটকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে বা পুনঃ পুনঃ পড়তে থাকে বা ভুল রেখে সামনে পড়তে থাকে, তাহলে মুক্তাদী লোকমা দেবে। কিন্তু যদি এ ধরনের প্রয়োজন ছাড়াও ইমামকে লোকমা দেয়, তাতে নামায বাতিল হবে না, মাকরূহ্ হবে।

৪। মাসয়ালা : কেউ নামাযে সূরা পড়ছে, ভুলের কারণে এমন সময় তার মুক্তাদী ছাড়া অন্য কেউ লোকমা দিলে, সে নামাযি যদি ওই লোকমা গ্রহণ করে, তাহলে, তার নামায বাতিল হয়ে যাবে, কিন্তু যদি সে নিজেই স্মরণ করতে পারে এবং নিজের স্মরণ অনুসারে পড়ে, তাহলে তার নামায বাতিল হবে না।

৫। মাসয়ালা : কেউ যদি নামাযরত অবস্থায় নিজের ইমাম ছাড়া অন্য কাউকে লোকমা দেয়, তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে।

৬। মাসয়ালা : মুক্তাদী যদি অন্য ব্যক্তির পড়া শুনে বা কালামে পাক দেখে ইমামকে লোকমা দেয়, তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে। যদি ইমাম লোকমা গ্রহণ করে তবে তারও নামায বাতিল হয়ে যাবে। আর যদি কোরআন পাক দেখে বা অন্যের পড়া শুনে মুক্তাদীর মনে পড়ে এবং নিজের থেকেই লোকমা দেয়, তাতে নামায বাতিল হবে না।

৭। মাসআলা : এভাবে যদি নামাযে কোরআন শরীফ দেখে একটি আয়াতও পড়ে তাহলেও নামায বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু যে আয়াত দেখে পাঠ করেছে, তা যদি প্রথম থেকে স্মরণ থাকে তাহলে নামায বাতিল হবে না, কিংবা প্রথম থেকে স্মরণ তো ছিল না কিন্তু এক আয়াতের কম দেখে পড়ে থাকে, তাহলে নামায বাতিল হবে না।

.

শুরু হওয়া নামায ছেড়ে দেয়ার মাসয়ালাসমূহ

১। মাসয়ালা : যদি নামায আদায় করতে করতে (রেল) গাড়ি ছেড়ে দেয় অথচ রেলগাড়িতে মাল-পত্র রাখা থাকে অথবা স্ত্রী ছেলেমেয়ে বসা থাকে, এমতাবস্থায় নামায ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে ওঠা দুরুস্ত আছে।

২। মাসয়ালা : নামাযের সময় সাপ সামনে এসে পড়লে তার ভয়ে নামায ছেড়ে দিয়ে পলায়ন করা বা সাপকে মেরে ফেলা দুরুস্ত আছে।

৩। মাসয়ালা : রাতে মুরগী বাইরে ছিল নামাযরত অবস্থায় জানা গেল যে, শিয়াল বা বিড়াল মুরগী ধরার জন্য এসেছে, এমন অবস্থায় নামায ত্যাগ করে মুরগীর জীবন রক্ষা করা দুরুস্ত আছে।

৪। মাসয়ালা : নামাযরত অবস্থায় জানা গেল যে, জুতা চোর এসে জুতা ধরেছে, এ অবস্থায় নামায ছেড়ে দিয়ে জুতার হেফাজত করা দুরুস্ত আছে।

৫। মাসয়ালা : বান্দার এক সিকি পরিমাণ ক্ষতির আশঙ্কা যেখানে রয়েছে, সেখানেও শরীয়তে মাল রক্ষার জন্য নামায ছেড়ে দিয়ে পরে আদায় করার অনুমতি দিয়েছে। যেমন, চুলার তরকারীর পাতিলের তারকারী উৎরিয়ে পড়ছে, যার মূল্য তিন/ চার আনা, তখন নামায ছেড়ে দিয়ে তা ঠিক করা দুরুস্ত আছে।

৬। মাসয়ালা : নামাযের ভেতর মলমূত্রের বেগ হলে নামায ছেড়ে দেবে এবং মলমূত্র ত্যাগ করে এসে শান্তির সাথে নামায আদায় করবে।

৭। মাসয়ালা : নামাযরত অবস্থায় জানতে পারল যে, একজন অন্ধ মানুষ কূপ বা গর্তের ভেতর পড়ে গিয়েছে অথবা একটি ছেলে আগুনে বা পানিতে পড়ে জীবন নাশের উপক্রম হয়েছে, এ অবস্থায় নামায ছেড়ে দিয়ে অন্ধের বা ছেলের জীবন বাঁচানো ফরয। নামায যদি না . ছাড়ে এবং অন্ধ বা ছেলের মৃত্যু হয়, তাহলে গুনাহগার হতে হবে।

৮। মাসয়ালাঃ নামাযরত অবস্থায় জানতে পারল যে, তার ছেলের পরিধানের বস্ত্রে আগুন লেগেছে, এক্ষেত্রে নামায ছেড়ে দিয়ে ছেলের জীবন রক্ষা করা ফরয। অন্য লোক থাকলে নামায ছাড়ার প্রয়োজন নেই।

৯। মাসয়ালা : মাতা-পিতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী যদি কোন বিপদে পড়ে ডাকেন, তাহলে ফরয নামাযও ছেড়ে দিয়ে তাদের সাহায্য করা ওয়াজিব। তাদের কেউ যদি পীড়িত থাকেন এবং পায়খানা পেশাব ইত্যাদি কোন প্রয়োজনে বাইরে গিয়ে হয়ত পা পিছলে বা কেঁপে পড়ে গিয়ে ডাকছেন, এমন অবস্থায় ফরয নামাযও ছেড়ে দেবে এবং তাদের সাহায্য করবে। কিন্তু যদি অন্য লোক সাথে থাকে এবং উঠিয়ে আনে, তাহলে অযথা নামায ছাড়বে না।

১০। মাসয়ালা : আর যদি পা পিছলিয়ে বা কেঁপে না পড়ে থাকেন কিন্তু পড়ে যাওয়ার ভয়ে ডাকেন, তবুও নামায ছেড়ে দিয়ে তাদের সাহায্য করবে।

১১। মাসয়ালা : উল্লেখিত প্রয়োজন ব্যতীত কেউ ডাকলে ফরয নামায ছেড়ে দেয়া দুরুস্ত নয়।

১২। মাসয়ালাঃ নফল অথবা সুন্নাত নামায আদায় করার সময় যদি মাতাপিতা, দাদাদাদী, নানানানীদের মধ্যে কেউ ডাকেন, নামায পড়তেছে এ কথা না জেনে তারা ডাকেন, তাহলে নামায ছেড়ে তারে ডাকে সাড়া দেয়া ওয়াজিব, অন্যথায় গুনাহ্ হবে। আর যদি নামায আদায় করছে, তা জেনেও বেহুদা ডাকেন, তাহলে নামায ছাড়বে না, কিন্তু বিপদে বা কষ্টে পতিত হয়ে ডাকলে নামায ছেড়ে দেবে।

.

নামাযে ওযূ ছুটে গেলে করণীয়

অস্বাভাবিক কোন কারণে অথবা মানুষের ইচ্ছাক্বত কোন কাজে যদি নামাযের মধ্যে ওযূ ছুটে যায়, তাহলে ওযূ ছুটে যাওয়ার সাথে সাথে নামাযও বাতিল হয়ে যাবে। যেমন : যদি নামাযের ভেতর গোসলের প্রয়োজন হয়, অথবা খিলখিল করে হাসে অথবা বেহুঁশ হয়ে পড়ে যায় অথবা ইচ্ছাক্বত ভাবে পেটের উল্টো বাতাস বের করে (মলদ্বার দিয়ে বাতাস বের হওয়া) তাহলে ওযূ তো ছুটে যাবেই, সাথে সাথে নামাযও বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু অনিচ্ছাক্বত কোন স্বাভাবিক কারণে যদি ওযূ ছুটে যায়, যেমন : হঠাৎ বায়ু বের হল, তাহলে ওযূ ভঙ্গ হবে কিন্তু সাথে সাথে যদি নামায ত্যাগ করে ওযূ করে এসে আবার প্রথম থেকে নামায আদায় করে, তবে সেটাই উত্তম এবং মুস্তাহাব। আর এ অবস্থায় যদি নামায বাকী রাখতে চায়, তবে তারও পথ আছে। নামায বাকী রাখার কতকগুলো শর্ত আছে, যেমন : (১) ওযূ ছুটে যাওয়ার সাথে সাথেই নামায ছেড়ে দেবে এবং ওযূ করতে যাবে, নামাযের কোন রোকন আদায় করবে না। (২) ওযূ করতে যাওয়ার সময়ও সূরা কেরাআত ইত্যাদি কোন রোকন আদায় করা যাবে না। (৩) কথাবার্তা ইত্যাদি যে সকল কাজ নামাযের পরিপন্থী কিন্তু তা থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব তা বর্জন। করবে না। (৪) ওযূ ছুটে যাওয়ার পর কারণ ছাড়া এক রোকন আদায় পরিমাণ সময়ও বিলম্ব করবে না, সাথে সাথেই ওযূ করতে হবে, অবশ্য জামায়াতে যদি অনেকগুলো কাতার থাকে এবং প্রথম কাতার হতে আসতে আসতে কিছু বিলম্ব হয় অথবা কাছে পানি না থাকার জন্য পানির নিকট যেতে কিছু বিলম্ব হয়, তাতে ক্ষতি হবে না।

১। মাসয়ালা : যদি কোন একাকী নামায আদায়কারীর নামাযের মধ্যে ওযূ ভঙ্গ হয়ে যায়, তবে ওযূ করে পুনরায় প্রথম থেকে নামায আদায় করাটাই তার জন্য উত্তম, কিন্তু যদি সেবেনা করতে চায়, অর্থাৎ যে পর্যন্ত নামায পড়েছে সে পর্যন্ত ঠিক রেখে ওযূ করে এসে তারপর হতে অবশিষ্ট নামায আদায় করতে চায়, তাহলে সে ওযূ ভঙ্গ হওয়া মাত্রই নামায ছেড়ে দিয়ে তৎক্ষণাত ওযূ করতে যাবে, যাওয়ার সময় এদিক-সেদিক দৃষ্টি দেবে না, বা কোন কথা বলবে না, কাছে পানি থাকলে দূরে যাবে না, সর্বাপেক্ষা বেশি নিকটের পানি দ্বারা অতি তাড়াতাড়ি ওযূ করবে। ওযূর নিকটবর্তী স্থানেই নামাযের বাকী অংশ আদায় করবে। যদি আগের জায়গায় যায় তাও দুরুস্ত আছে।

২। মাসয়ালা : যদি নামাযের মধ্যে ইমামের ওযূ ছুটে যায়, এমন কি শেষ বৈঠকেও যদি ওযূ ছুটে যায়, তাহলে তার জন্য এক দিকে সালাম ফিরিয়ে নামায ছেড়ে ওযূ করে নুতনভাবে নামায পড়া উত্তম, কিন্তু যদিবেনা ওএস্তেখলাফ করতে চায়, অর্থাৎ যে পর্যন্ত নামায আদায় করেছে তারপর থেকে মুক্তাদীদের মধ্য থেকে কাউকে দিয়ে নামায পড়াতে চায়, তাহলে তার নিয়ম হল, ওযূ ছুটে যাওয়া মাত্রই নামায ছেড়ে দিয়ে মুক্তাদীর মাঝ থেকে উপযুক্ত একজনকে জায়নামাযের (মুছাল্লা) দিকে ইশারা করে প্রতিনিধি বানিয়ে ওযূ করতে যাবে, মুদয়েকে প্রতিনিধি বানানো উত্তম। যদি মাসবুককে প্রতিনিধি বানায়, তাও জায়েয। কিন্তু মাসবুককে ইশারায় বলে দেবে যে, আমার ওপর এত রাক’আত ইত্যাদি অবশিষ্ট আছে। রাক’আতের জন্য আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করবে। যেমন এক রাক’আত অবশিষ্ট থাকলে এক আঙ্গুল; দু’ রাক’আত অবশিষ্ট থাকলে দু আঙ্গুল উঠাবে। রুকূ অবশিষ্ট থাকলে হাঁটুতে হাত রাখবে, সেজদা অবশিষ্ট থাকলে কপালে, কেরায়াত অবশিষ্ট থাকলে মুখের ওপর, সেজদায় তেলাওয়াত অবশিষ্ট থাকলে কপালে এবং জিহ্বার ওপর, সেজদায়ে ছুহো করতে হলে সীনার ওপর হাত রাখবে। কিন্তু যাতে সেও এ সঙ্কেত বোঝে নতুবা তাকে প্রতিনিধি বানাবে না। এরপর ওযূ করে এসে যদি জামায়াত পায়, তাহলে মুক্তাদীরূপে শরীক হবে এবং বাকী নামায, যা জামায়াতের সাথে পেয়েছে তা মুক্তাদী হিসেবে এবং যদি দু’এক রাক’আত মাঝে (ওযূ করে ফিরে আসতে যে সময়) ছুটে থাকে, তা লাহেকরূপে পরে পড়বে। যদি ওযূর স্থানে দাঁড়িয়ে এক্তেদা করে, তাহলে যদি মাঝে এমন কোন বস্তু বা ব্যবধান থাকে যাতে এক্তেদা না জায়েয। হয়, তবে সেখানে থেকে এক্তেদা করা জায়েয হবে না। আর যদি ওযূ করে এসে জামায়াত না। পায়, তাহলে একাকী নামাযের বাকী অংশ আদায় করবে।

৩। মাসয়ালাঃ মসজিদের ভেতরেই যদি পানি থাকে, তাহলে প্রতিনিধি নিয়োগ করা ছাড়াও ইচ্ছে করলেবেনা করতে পারে। নামায ছেড়ে দিয়ে তৎক্ষণাৎ ওযূ করে নামাযের বাকী অংশ পূর্ণ করবে। ইমাম তার জায়গায় ফিরে না আসা পর্যন্ত মুক্তাদীগণ যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থাতেই অপেক্ষা করতে থাকবে।

৪। মাসয়ালা : প্রতিনিধি নিয়োগের পর ইমাম আর ইমাম থাকবে না, মুক্তাদী হয়ে যাবে। অতএব, জামায়াত যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে অবশিষ্ট নামায তিনি লাহেকরূপে আদায় করবেন। যদি ইমাম সাহেব কাউকে প্রতিনিধি নিয়োগ না করেন, কোন মুক্তাদী নিজে এগিয়ে যায় বা মুক্তাদীরাই তাকে ইশারা করে আগে বাড়িয়ে দেয়, তবে তাও জায়েয হবে। কিন্তু যতক্ষণ ইমাম মসজিদের ভিতরে আছেন অথবা মসজিদে যদি নামায না হয়, তাহলে কাতার কিংবা ছোতরা থেকে আগে না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত এরূপ হতে পারবে, নতুবা ইমাম যদি প্রতিনিধি নিয়োগ না করে মসজিদ হতে বের হয়ে যায় তাহলে সকলের নামায বাতিল হবে এবং কেউই আর প্রতিনিধি হতে পারবে না।

৫। মাসয়ালা : মুক্তাদীর নামাযের মধ্যে ওযূ ভঙ্গ হয়ে গেলে তার জন্যওবেনা না করে তৎক্ষণাত ওযূ করে মাসবুকরূপে জামায়াতে শরীক হওয়া বা জামায়াত না পেলে একাকী নতুনভাবে নামায আদায় করা উত্তম। কিন্তু যদিবেনা করতে চায়, তাহলে সাথে সাথে ওযূ করে জামায়াত অবশিষ্ট থাকলে জামায়াতে শরীক হবে, যদি আগের স্থানে যেতে পারে, তবে তা উত্তম, নতুবা, পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে যে পরিমাণ জামায়াত পায় ততটুকু মাসবুকরূপে জামায়াতের সাথে আদায় করবে এবং যদি দু’এক রাক’আত মাঝখানে ছুটে গিয়ে থাকে, তবে। তা পরে লাহেকরূপে আদায় করবে। কিন্তু যদি ইমাম ও তার ওযূর স্থানের মাঝে এক্তেদায় বাঁধা জনিত কোন জিনিস না থাকে, তবে সেখানেও দাঁড়ানো দুরুস্ত। আর জামায়াত শেষ হয়ে গিয়ে থাকলে ওযূর নিকটবর্তী জায়গায় দাঁড়িয়ে বাকী নামায লাহেকরূপে পড়া উত্তম। যদি পূর্বের স্থানে গিয়ে আদায় করে, তাও দুরুস্ত।

৬। মাসয়ালা : ইমাম যদি মাসবুক মুক্তাদীকে প্রতিনিধি বানায়, তাও দুরুস্ত, কিন্তু তা যদি হয় তবে সে ইমামের বাকী নামায পূর্ণ করে সালাম ফেরাবে না, সালাম ফেরানোর জন্য একজন মুদরে মুক্তাদীকে ইশারায় সামনে বাড়িয়ে দিয়ে, নিজে একটু বসে দাঁড়িয়ে যে সব রাক’আত তার ইতিপূর্বে ছুটে গিয়েছে, তা আদায় করে শেষে পৃথক ভাবে সালাম ফিরাবে। এ জন্যই মুদরেককে প্রতিনিধি বানানো উত্তম।

৭। মাসয়ালা : শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পড়ার পর সালাম ফেরানোর পূর্বে যদি অনিচ্ছায় বা স্বাভাবিক নিয়মে কারো ওযূ ছুটে যায় অথবা পাগল হয়ে যায় কিংবা গোসলের প্রয়োজন হয় বা বেহুঁশ হয়ে যায়, তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে এবং পুনরায় সম্পূর্ণ নামায আদায় করতে হবে।

৮। মাসয়ালা : বেনা এবং এস্তেখলাফের মাসআলা খুব সুক্ষ্ম। এটা মনে রাখা বড়ই কঠিন। তা ছাড়া সামান্য ভুল হলেই নামায নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই বেনা এবং এস্তেখলাফ না করে ওযূ ছুটে গেলে ডান দিকে সালাম ফিরিয়ে নামায ছেড়ে দিয়ে ওযূ করে পুনরায় নতুনভাবে নামায আদায় করাই উত্তম।-(গওহার)।

.

বেতের নামায

১। মাসয়ালাঃ বেতের নামায ওয়াজিব। ওয়াজিবের মর্তবা প্রায় ফরযের ন্যায়। ওয়াজিব ছেড়ে দিলে শক্ত গুনাহ্ হয়। কখনো কোন কারণবশতঃ ওয়াজিব ছুটে গেলে সুযোগ পাওয়া মাত্রই ক্বাযা আদায় করতে হবে।

২। মাসয়ালাঃ বেতের নামায তিন রাক’আত। দু’রাক’আত পড়ে প্রথম বৈঠকের পর দাঁড়িয়ে যাবে এবং সূরা ফাতেহা ও অপর একটি সূরা পাঠ করেআল্লাহু আকবার বলে কান পর্যন্ত (মহিলাদের কাঁধ পর্যন্ত) হাত তুলে পুনঃ হাত বাঁধবে। অতঃপর দোআ কুনূত পাঠ করে রুকূ করবে, এভাবে তৃতীয় রাক’আত পড়ে বসে তাশাহহুদ, দুরূদ এবং দোয়া মাসূরা পড়ার পর সালাম ফিরিয়ে নামায সমাপ্ত করবে।

৩। মাসআলা : দো’আ কুনূত এইঃ

اللهم إنا نشتين ونشتغفرك ونؤمن بك ونتوكل عليك وثني عليك الخير وشكرك ولا تفرك ونخلع ونترك من يفجرك الله إياك عبد ولك نصلي ونسجد وإليك تشفى وتحف ونرجوا رحمتك ونخشى عذابك إن عذابك بالكفار ملحق۔

অর্থ : হে আল্লাহ্! আমরা তোমার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি এবং ক্ষমা ভিক্ষা করছি এবং তোমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করছি আর তোমারই উপর ভরসা করছি, তোমারই উত্তম উত্তম গুণগান করছি এবং তোমারই শোকর আদায় করছি, (কখনও) তোমার নাশোকরী বা কুফরী করব না, যারা তোমার অবাধ্য হবে তাদেরকে আমরা পরিত্যাগ করে চলব।হে আল্লাহ! আমরা একমাত্র তোমারই দাসত্ব করছি, একমাত্র তোমার উদ্দেশেই নামায আদায় করছি, একমাত্র তোমাকেই সেজদা করছি এবং একমাত্র তোমার নির্দেশ পালন ও তাবেদারীর জন্য সর্বদা প্রস্তুত আছি। সর্বদা তোমার রহমতের আশা এবং আযাবের ভয় হৃদয়ে পোষণ করিছে। যদিও তোমার আসল আযাব তা কেবলমাত্র নাফরমানদের উপরই হবে। তবুও আমরা সে আযাবের ভয়ে কম্পমান থাকি।

৪। মাসয়ালাঃ বেতের নামাযের তিন রাক’আতের প্রত্যেক রাকাআতেই সূরা ফাতেহার সাথে অন্য সূরা মিলিয়ে পাঠ করা ওয়াজিব।

৫। মাসয়ালাঃ তৃতীয় রাক’আতে দোয়া কুনূত পড়তে ভুলে গিয়ে কখনো রুকূতে চলে গেলে এবং রুকূতে গিয়ে স্মরণ হলে তখন আর দোয়াকুনূত পাঠ করবে না এবং রুকূ থেকে উঠবেও না এবং রুকূ করে নামায শেষে ছুহু সেজদা দিলেই চলবে। কিন্তু রুকূ থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে দোয়া কুনুত পড়লে, তাতেও নামায হয়ে যাবে কিন্তু এরূপ করা ঠিক নয় এবং এ অবস্থাতেও ছুহু সেজদা দেয়া ওয়াজিব হবে।

৬। মাসয়ালা : ভুলক্রমে প্রথম অথবা দ্বিতীয় রাক’আতে দোয়া কুনূত পাঠ করলে তা দোয়া কুনূত হিসেবে বিবেচিত হবে না, তৃতীয় রাক’আতে আবার পাঠ করতে হবে এবং ছুহু সেজদাও করতে হবে।

৭। মাসয়ালা : কেউ দোয়া কুনূত পড়তে না জানলে তা শিক্ষা করার চেষ্টা করবে এবং শেখা পর্যন্ত নিম্নের দোয়া পাঠ করবে

ربنا اتنا في الدنيا حسنة وفي الآخرة حسنة وقنا عذاب النار–

অথবা তিনবার; পাঠ করবে এবং এতেই তার নামায আদায় হয়ে যাবে।’

.

সুন্নাতে মুআককাদাহ্ নামায

১। মাসয়ালা : ফজরের ওয়াক্তে ফরযের পূর্বে দু’রাক’আত নামায সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্। হাদীস শরীফে সুন্নাত নামাযের মধ্যে ফজরের এ দু’রাক’আত সুন্নাতের তাকীদ সর্বাপেক্ষা বেশি এসেছে। সুতরাং ফজরের নামাযের এ দু’রাক’আত সুন্নাত নামায কখনোই ছাড়া যাবে না।

২। মাসয়ালা : যোহরের ওয়াক্ত প্রথমে চার রাক’আত সুন্নাত এরপর চার রাক’আত ফরয, অতঃপর পুনরায় দু’রাক’আত সুন্নাত আদায় করবে। যোহরের এই ছয় রাক’আত সুন্নাতেরও যথেষ্ট তাকীদ এসেছে, বিনা কারণে এ সুন্নাত ত্যাগ করলে শক্ত গুনাহ্ হবে।

৩। মাসয়ালাঃ আসরের ওয়াক্তে প্রথম চার রাক’আত সুন্নাত এরপর চার রাক’আত ফরয আদায় করবে। কিন্তু আছরের সুন্নতের জন্য তাকীদ আসেনি। কাজেই এ সুন্নাত কেউ আদায় না করলে গুনাহ্ হবে না। কিন্তু আদায় করলে অত্যাধিক ছাওয়াব পাওয়া যাবে।

৪। মাসয়ালা : মাগরীবের সময় প্রথম তিন রাক’আত ফরয, অতঃপর দু’রাক’আত সুন্নাত আদায় করবে। মাগরীবের এ দু’রাক’আত সুন্নাতের জন্য তাকীদ এসেছে, তাই এ সুন্নাত আদায় করলে গুনাহ্ হবে।

৫। মাসয়ালাঃ এশার ওয়াক্তেও প্রথম চার রাক’আত সুন্নাত পড়া উত্তম। তারপর চার রাক’আত ফরয। তারপর দু’রাক’আত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ আদায় করবে। এ দু’রাক’আত সুন্নাত আদায় না করলে পাপ হবে। তারপর ইচ্ছে হলে দু’রাক’আত নফল আদায় করবে। এ হিসেবে এশার নামাযে ছয় রাক’আত সুন্নাত হয় কিন্তু কেউ যদি এ পরিমাণ আদায় করতে না চায়, তাহলে প্রথমে চার রাক’আত ফরয আদায় করবে, অতঃপর দু’রাক’আত সুন্নাত আদায় করবে, অতঃপর বের নামায আদায় করবে। এশার ওয়াক্তে দু’রাক’আত সুন্নাতের তাকীদ এসেছে, সুতরাং এই দু’রাক’আত নামায আদায় করা জরুরী, আদায় না করলে গুনাহ্ হবে।

৬। মাসয়ালাঃ রমযানের পূর্ণ মাস তারাবীহ্ নামায আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্। এ নামাযের ফজীলত এবং তাকীদ অনেক এসেছে। কেউ তারাবীর নামায মাস ব্যপী না পড়লে গুনাহগার হবে। মহিলারা সচরাচর তারাবীহর নামায কম আদায় করে, এরূপ কখনোই করবে না। এতে পাপী হতে হয়। এশার ফরয ও সুন্নতের পর দু’ দু’ রাক’আত করে বিশ রাক’আত নামায আদায় করবে। এ নামাযের জন্য নির্দিষ্ট কোন সূরা বা দোয়া নেই। চার রাক’আত করে নিয়্যত করলেও হবে। কিন্তু দু’রাক’আত করে নিয়্যত বাঁধাই উত্তম। তারাবীহর নামায বিশ রাক’আত আদায় করার পর বেতের নামায আদায় করবে।

যে সকল সুন্নাতের তাকীদ (সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ প্রতিদিন মাত্র বার রাক’আত)। দু’রাক’আত ফজরে ছয় রাক’আত যোহরে, দু’রাক’আত মাগরিবে এবং দু’রাক’আত এশার এই মোট বার রাক’আত। রমযান শরীফের তারাবীহ্ নামাযও সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ এবং অনেক আলেমের মতে তাহাজ্জুদ নামাযও সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্।

৭। মাসআলা : উল্লেখিত নামাযসমূহ শরীয়তের পক্ষ থেকে ধার্য করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া যদি কেউ বেশি আদায় করতে চায় তবে যত ইচ্ছা আদায় করতে পারবে এবং যখন খুশি তখনই আদায় করতে পারবে, তবে কেবলমাত্র এতটুকু খেয়াল রাখতে হবে যে, মাকরুহ্ ওয়াক্তে যেন না হয়। ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাত ব্যতীত যত নামায আছে তার সবগুলোকেই নফল নামায বলা হয়। নফল নামাযের কোন সীমা নেই, যে যত বেশি আদায় করবে সে ততবেশি ছাওয়াব প্রাপ্ত হবে। আল্লাহ্ পাকের এমন অনেক বান্দাবান্দী ছিলেন, যারা সারা রাত না ঘুমিয়ে কেবল নফল নামায আদায় করে কাটিয়ে দিতেন।

৮। মাসয়ালা : যে সব নফল নামাযের কথা শরীয়তে উল্লেখ রয়েছে, অন্য নফলের চেয়ে সে সব নফলের নেকী বেশি। যেমন : তাহিয়্যাতুল ওযূ, তাহিয়্যাতুল মসজিদ, এশরাক, চাশত্, আউয়াবীন, তাহাজ্জুদ ও ছালাতুত তাসবীহ্ ইত্যাদি নফল নামায।

.

জুমু’আর দিনের ফযীলত

১। হাদীসঃ মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, মহানবী (ছঃ) এরশাদ করেছেন, সপ্তাহের দিনগুলোর মধ্যে জুমু’আর দিনই সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। এদিনেই হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, এদিনেই তাঁকে বেহেশতে স্থান দেয়া হয়েছিল, এদিনেই তাঁকে বেহেশত থেকে বের করে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছিল এবং এদিনেই কিয়ামত সংগঠিত হবে।

২। হাদীস : মসনদে আহমদে বর্ণিত আছে যে, জুমু’আর রাতের ফযীলত শবে কদর অপেক্ষাও বেশি। কেননা, এ পবিত্র রজনীতেই সরওয়ারে কায়েনাত মহানবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন মাতৃগর্ভে শুভাগমন করেছিলেন এবং তাঁর শুভাগমনের মধ্যেই দুনিয়া ও আখেরাতের অগণিত ও অশেষ কল্যাণ নিহিত।–(মুসনাদে আহমদ)।

৩। হাদীসঃ হযরত নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, জুমু’আর দিনে এমন একটি সময় আছে, যে সময় কোন মুমীন বান্দা আল্লাহ্ পাকের দরবারে যা কিছু প্রার্থনা করবে তাই পাবে। এ সময়টি যে কোন্ সময় তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। হাদীসের ব্যাখ্যাকার ইমামরা এটা নির্দিষ্ট করতে গিয়ে অনেক মতভেদ করেছেন। তার মধ্যে দুটি মতই বিশেষভাবে উল্লেখ্য। একটি হলো, সে সময়টি খুৎবা আরম্ভ থেকে নামাযের শেষ সময়ের মধ্যে রয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো, সেই সময়টি দিনের শেষাংশে আছে। এই দ্বিতীয় মতকে ওলামাদের একটি বড় দল গ্রহণ করেছেন এবং এর সপক্ষে বহু ছহীহ্ হাদীসও রয়েছে। শেখ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রহঃ) বলেন, এ রেওয়ায়েতটি ছহীহ্। কেননা, হযরত ফাতেমা (রাঃ) জুমু’আর দিন খাদেমকে বলে দিতেন যে, জুমু’আর দিন শেষ হওয়ার সময় আমাকে খবর দিও। হযরত ফাতেমা (রাঃ) শুক্রবার দিনের শেষে আসরের পর সব কাজ ছেড়ে আল্লাহর যিকির এবং দোয়ায় মশগুল থাকতেন। (বোখারী)।

৪। হাদীসঃ মহানবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমান, জুমু’আর দিনই সবচেয়ে অধিক ফযীলতের দিন। এদিনেই কিয়ামতের জন্য সিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। তোমরা এ দিনে আমার জন্য বেশি পরিমাণে দুরূদ পাঠ কর। তোমরা যখন ওই দিন দুরূদ পাঠ কর সাথে সাথে তা আমার সামনে পেশ করা হয়। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার সামনে কিরূপে পেশ করা হয়? মৃত্যুর পর তো আপনার হাড় পর্যন্ত থাকবে না। তখন মহানবী হযরত রাসূলে খোদা (ছঃ) বললেন, আল্লাহ্ পাক যমীনের জন্য নবীদের শরীর হজম করা হারাম করে রেখেছেন।-(আবূ দাউদ শরীফ)

৫। হাদীসঃ আল্লাহর রাসূল (ছঃ) বলেছেন, আল্লাহ্ পাক স্বীয় পবিত্র কালামে শাহিদ (a) শব্দের কসম করেছিলেন। এর অর্থ জুমু’আর দিন। আল্লাহপাকের কাছে জুমু’আর দিন অপেক্ষা উত্তম দিন আর নেই। এ দিনে এমন একটি সময় আছে, যে সময় যে কোন মুমীন বান্দা আল্লাহ্ পাকের কাছে যে কোন দোয়া করলে তিনি তা কবুল করবেন এবং যে কোন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করলে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্পাক তাকে সে বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। _AL শব্দ সূরা বুরুজে আছে, আল্লাহ্ পাক ওই দিনের কসম খেয়েছেন।

والسماء ذات البروج واليوم الموعود وشاهد ومشهود

অর্থাৎ বুরুজ বিশিষ্ট আসমানের কসম, প্রতিশ্রুতি ও কিয়ামত দিনের কসম, শাহেদ (জুমুআ)-এর কসম, মাশহুদ (আরাফাত) এর কসম।

৬। হাদীসঃ মহানবী রাসূলে করীম (ছঃ) ফরমায়েছেন, আল্লাহ্পাকের নিকট ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা অপেক্ষাও জুমু’আর দিন অধিক মর্যাদাশীল।–(ইবনে মাজাহ)

৭। হাদীস : আল্লাহর রাসূল (ছঃ) ফরমায়েছেন, জুমু’আর দিনে বা রাতে যে মু’মিন বান্দার মৃত্যু হয়, আল্লাহ্ রাব্বল আলামীন তাকে কবর আযাব থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন। -(তিরমিযী শরীফ)।

৮। হাদীসঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) একদা–

اليوم أكملت لكم دينكم واتممت علیکم نعمتی ورضيت لكم

الإسلام دينا

এ আয়াতটি তেলাওয়াত করতেছিলেন। অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক বলেন, আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহ সম্পন্ন করলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করলাম। তখন তার নিকট একজন ইহুদী বসা ছিল। ইহুদী (আয়াতের মর্ম বুঝে) বলল, এমন আয়াত যদি আমাদের ভাগ্যে জুটতো তাহলে আমরা এমন আয়াত অবতীর্ণের দিনকে চিরকালের জন্য ঈদের দিন ধার্য করে নিতাম। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) উত্তরে বললেন, স্বয়ং আল্লাহ্ পাকই এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার দিনকে ঈদের দিন ধার্য করেছেন। অর্থাৎ সেদিন জুমু’আ এবং আরাফাতের দিন ছিল। আমাদের নিজেদের ঈদ বানানোর প্রয়োজন নেই।

৯। হাদীসঃ আল্লাহর রাসূল (ছঃ) বলতেন, জুমু’আর রাত নূরে ভরা রাত এবং জুমু’আর দিন নূরে ভরা দিন।–(মেশকাত শরীফ)।

১০। হাদীসঃ কিয়ামতের দিন হিসাব নিকাশের পর যখন জান্নাতের উপযুক্তদেরকে জান্নাতে এবং জাহান্নামের উপযুক্তদেরকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেয়া হবে, এ জুমু’আর দিন সেখানেও হবে। যদিও সেখানে রাত দিন থাকবে না কিন্তু আল্লাহ্ পাক তাদেরকে দিন এবং রাতের পরিমাণ ও ঘণ্টার হিসাব শিক্ষা দেবেন। কাজেই যখন জুমু’আর দিন উপস্থিত হবে আর সে সময় দুনিয়াতে মু’মিন বান্দাগণ জুমু’আর নামাযের জন্য নিজ নিজ গৃহ থেকে যাত্রা করবে তখন ফেরেশতাদের একজন উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করবে যে, হে জান্নাতবাসীরা! তোমরামযীদ অর্থাৎ অতিরিক্ত পুরস্কারের ময়দানে চল। সে ময়দান যে কত বড় ও কত বিশাল, তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ব্যতীত আর কেউ বলতে পারে না। সেখানে আসমানের সমান উঁচু মেশকের বড় বড় স্থূপ থাকবে। পয়গম্বরদেরকে নূরের মিম্বরের ওপর এবং মুমীনদেরকে ইয়াকূতের চেয়ারের ওপর বসতে আসন দেয়া হবে। তারপর যখন সমস্ত লোক নিজ নিজ আসনে উপবেশন করবে তখন আল্লাহ্ তায়ালার আদেশে একটি বাতাস এসে ওই মেশক সবার কাপড়ে, কেশে এবং মুখে লাগিয়ে দেবে। ওই বাতাস ওই মেশক লাগানোর নিয়ম ওই রমণী থেকে বেশি জানে যাকে সমগ্র বিশ্বের খুশবু দেয়া হয়। তখন আল্লাহ্ পাক আরশ বহনকারী ফেরেশতাদেরকে আদেশ করবেন যে, আমার আরশ এ সকল মানুষদের মাঝে নিয়ে রাখ। অতঃপর স্বয়ং আল্লাহ্ তায়ালা ওই সকল লোকদের সম্বোধন করে বলবেন, হে আমার বান্দারা! তোমরা দুনিয়াতে আমাকে না দেখে আমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলে এবং আমার রাসূল (ছঃ) এর কথায় বিশ্বাস করে আমার হুকুম পালন করেছ, আজ আমি তোমাদের ওপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে ঘোষণা করছি যে, আজ অতিরিক্ত পুরস্কারের দিন, আজ আমার কাছে তোমরা কিছু চাও। তখন সবাই সমম্বরে বলবে, হে আমাদের পরওয়ারদিগার! আমরা আপনার প্রতি সন্তুষ্ট আপনিও আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান। তখন আল্লাহ্ পাক বলবেন, হে জান্নাতবাসীরা! আমি যদি সন্তুষ্ট না হতাম, তাহলে জান্নাতে তোমাদের স্থান দিতাম না! এটা ছাড়া অতিরিক্ত কিছু চাও, আজ অতিরিক্ত পুরস্কারের দিন। তখন সকলে এক বাক্যে বলবে, হে আমাদের পরওয়ারদিগার! আমাদেরকে আপনার সৌন্দর্য দেখিয়ে দিন। আমরা স্বচক্ষে আপনার পাক সত্তা দেখতে চাই।

অতঃপর আল্লাহ রাব্বল আলামীন স্বীয় পর্দা উঠিয়ে দেবেন এবং তাদের ওপর বিকশিত হবেন আর স্বীয় নূরের দ্বারা তাদেরকে পরিবেষ্টন করে নেবেন। জান্নাতবাসীরা কখনও বিদগ্ধ হবেন না। এই হুকুম যদি তাদের সম্বন্ধে পূর্ব থেকে না থাকত, তাহলে এ নূর কিছুতেই সহ্য করতে পারত না; বরং ভস্মীভূত হয়ে যেত। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে বলবেন, নিজ নিজ স্থানে প্রত্যাগমন কর। তাদের দৈহিক সৌন্দর্য ওই নূরে রব্বানীর কারণে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তারা নিজ নিজ বিবিদের নিকট যাবে কিন্তু না তারা বিবিদের দেখতে পাবে, আর না বিবিরা তাদেরকে দেখতে পাবে। কিছুক্ষণ পর এই পরিবেষ্টনকারী নূর যখন অপসারিত হয়ে যাবে, তখন পরস্পর পরস্পরকে দেখতে পাবে। বিবিগণ জিজ্ঞেস করবেন যে, যাওয়ার সময় যে সৌন্দর্য আপনাদের ছিল এখন তো সে সৌন্দর্য নেই বরং হাজার গুণ বেড়ে গিয়েছে। জবাবে তারা বলবে, হ্যাঁ এর কারণ হলো, আল্লাহ্ তা’আলা নিজেকে আমাদের ওপর প্রকাশ করেছিলেন। আমরা সেই নূরকে নিজ চোখে দর্শন করেছি। দেখুন, জুমু’আর দিন কত বড় নেয়ামত পেল।

১১। হাদীসঃ প্রতিদিন দ্বিপ্রহরের সময় জাহান্নামের আগুনের তেজ বাড়িয়ে দেয়া হয়, কিন্তু জুমু’আর দিন দুপুরে এর বরকতে জাহান্নামের আগুনের তেজ হয় না।

১২। হাদীসঃ এক জুমু’আর দিন মহানবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হে মুসলমানগণ! জুমু’আর দিনকে আল্লাহ্ পাক তোমাদের জন্য ঈদের দিন ধার্য করেছেন। সুতরাং, এ দিনে তোমরা গোসল করবে, অবশ্যই মিস্ওয়াক করবে এবং যার কাছে যে সুগন্ধি থাকে তা লাগাবে।

.

জুমু’আর দিনের আদব

১। প্রত্যেক মুসলমানেরই বৃহস্পতিবার দিন (শেষ বেলা) থেকেই জুমু’আর দিনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া ও যত্ন নেয়া কর্তব্য। বৃহস্পতিবার আছরের পর দুরূদ, এস্তেগফার এবং তাসবীহ্-তাহলীল অধিক পরিমাণে পাঠ করবে। পরিধেয় কাপড় ধুয়ে পরিস্কার করবে! যদি গৃহে সুগন্ধি না থাকে কিন্তু যদি আনার সঙ্গতি থাকে তবে ওই দিনই আনিয়ে রাখবে, যাতে জুমু’আর দিন এবাদত ছেড়ে এসব আনতে না হয়। অতীতের বুযুর্গানে দ্বীন বলেছেন, জুমু’আর ফজীলত সর্বাপেক্ষা বেশি সে ব্যক্তি পাবে, যে জুমু’আর প্রতীক্ষায় থাকে এবং বৃহস্পতিবারই জুমু’আর প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আর সবচেয়ে হতভাগা সে ব্যক্তি, যে জুমুআ কবে তার খোঁজও রাখে না। এমন কি জুমু’আর দিন সকালে লোকদের নিকট জিজ্ঞেস করে যে, আজ কি বার? অনেক বুযুর্গ জুমু’আর জন্য তৈরি থাকার জন্য বৃহস্পতিবার রাতেই মসজিদে গিয়ে থাকতেন।

২। প্রতি জুমু’আর দিন গোসল করবে, মাথার চুল এবং সমস্ত শরীর ভালভাবে পরিস্কার করবে এবং মিসওয়াক করে দাঁতগুলো পরিস্কার করা বেশি ফযীলতের কাজ।

৩। যার কাছে যেমন উত্তম পোশাক থাকবে, তা পরিধান করে সুগন্ধি লাগিয়ে মসজিদে যাবে এবং নখ ইত্যাদি কাটবে। 

৪। জামে মসজিদে খুব তাড়াতাড়ি যাবে। যে যত তাড়াতাড়ি যাবে সে তত বেশি ছাওয়াব পাবে। মহানবী রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, জুমু’আর দিনে জামে মসজিদের দরজায় ফেরেশতারা দাঁড়িয়ে থেকে মুসল্লিরা যে যে সময় আসতে থাকে তাদের নাম লিখতে থাকেন। যে সর্বপ্রথম আসে তার নাম সবার ওপরে লেখা হয়, তারপর দ্বিতীয়, তারপর তৃতীয়, এমনিভাবে পর্যায়ক্রমে সবার নাম লেখা হয় যে সর্বাগ্রে আসে, সে আল্লাহর পথে একটি উট কুরবানী করার ছাওয়াব পায়। যে দ্বিতীয় নম্বরে আসে, সে একটি গরু কুরবানীর সমান ছাওয়াব পায়। তৃতীয় নম্বরে যে আসে, সে একটি বকরী কুরবানীর ছাওয়াব পায়। এর পর যে আসে, সে আল্লাহর পথে একটি মোরগ জবেহ করার ছাওয়াব পায় এবং তারপর যে আসে, সে আল্লাহর পথে একটি ডিম দান করার ছাওয়াব পায়। তারপর যখন খুৎবা শুরু হয় তখন ফেরেশতারা উল্লেখিত খাতা বন্ধ করে খুৎবা শোনে।-(বোখারী শরীফ)

পূর্ব যামানায় শুক্রবার দিন মানুষ এত ভোরে এবং জাঁকজমক ও আগ্রহের সাথে জামে মসজিদে যেত যে, ফজরের পর থেকেই শহরের পথগুলোতে ঈদের দিনের ন্যায় মানুষের ভিড় জমে যেত। তারপর যখন এ রীতি মুসলমানদের মধ্য থেকে ধীরে ধীরে লোপ পেতে লাগল, তখন (বিজাতীয়) লোকেরা বলল যে, ইসলামের মধ্যে এই প্রথম বেদআত জারি হল। এ পর্যন্ত লিখে ইমাম গাযযালী (রহঃ) বলেছেন, মুসলমানরা কেন ইহুদী ও খ্রিস্টানদের অবস্থা দেখে লজ্জিত হয় না? ইহুদীরা শনিবার এবং খ্রিস্টানরা রবিবার কত ভোরে ভোরে তাদের প্রার্থনালয়ে ও গীর্জায় যায়। ব্যবসায়ীরা প্রাতকালে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বাজারে উপস্থিত হয়। সুতরাং দ্বীন অন্বেষণকারীরা কেন অগ্রসর হয় না?–(এহইয়াউল উলুম)

প্রকৃত প্রস্তাবে মুসলমানরা এ যামানায় এ মুবারক দিনের মর্যাদা একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। তারা এতটুকু পর্যন্ত জানে না যে, আজ কোন্ দিন এবং তার মর্তবা-ইবা কি? অতীব পরিতাপের বিষয়, যে দিনটি এক সময় মুসলমানদের নিকট ঈদের চেয়ে বেশি প্রিয় ও মর্যাদাসম্পন্ন ছিল, যে দিনের প্রতি আল্লাহর রাসূল (ছঃ)-এর গর্ব ছিল। পূর্ব যামানার উম্মতদের যা জুটেনি, আজ মুসলমানদের হাতে সে দিন এমন অসহায়ভাবে অপদস্ত হচ্ছে। আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামতকে এভাবে বরবাদ করা অতি বড় না যোক্রী, যার অশুভ প্রতিক্রিয়া স্বচক্ষে দেখছি। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

৫। জুমু’আর নামাযে পায়ে হেঁটে গমন করলে প্রতি কদমে এক বছর নফল রোযা রাখার ছাওয়াব পাওয়া যায়।-(তিরমিযী শরীফ)

৬। আল্লাহর রাসূল (ছঃ) জুমু’আর দিন ফজরের নামাযে আলিফ-লাম-মীম সেজদা এবং হাল আতা আলাল ইনসান এ দু’টি সূরা পড়তেন। কাজেই মুস্তাহাব মনে করে কোন কোন সময় পড়বে, আবার কোন কোন সময় ছেড়ে দেবে যাতে লোকেরা আবার ওয়াজিব মনে না করে।

৭। জুমু’আর নামাযে আল্লাহর রসূল (ছঃ)সূরায়ে জুমু’আ এবংসূরায়ে মুনাফিকূন এবং কখনো কখনো সাব্বিহিসমা ওহাল আতাকা হাদীসূল গাশিয়াহ্ এ দু সূরা পড়তেন।

৮। জুমু’আর দিন জুমু’আর নামাযের পূর্বে কিংবা পরে সূরা কাহফ পাঠ করলে অনেক ছাওয়াব পাওয়া যায়। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি জুমু’আর দিন সূরা কাহফ তেলাওয়াত করবে, কেয়ামতের দিন তার জন্য আরশের নিচে আকাশ তুল্য উঁচু একটি নূর প্রকাশ পাবে, যার দ্বারা হাশরের ময়দানে তার সকল আঁধার দূর হয়ে যাবে এবং গত জুমু’আ থেকে এ জুমু’আ পর্যন্ত তার যত (ছগীরা) গুনাহ্ হয়েছে, সব মাফ হয়ে যাবে। -(শরহে হেফরুস সাআদাত)

৯। এ দিন দুরূদ শরীফ পাঠ করলে অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি ছাওয়াব পাওয়া যায়, এ জন্যই হাদীস শরীফে জুমু’আর দিন অধিক পরিমাণ দুরূদ শরীফ পড়ার হুকুম এসেছে।

.

জুমু’আর নামাযের ফযীলত এবং তাকীদ

জুমু’আর নামায ফরযে আইন। পবিত্র কালামের স্পষ্ট বাণী দিয়ে মোতাওয়াতির হাদীস দ্বারা ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা এটা প্রমাণিত এবং ইসলামের একটি প্রধান অঙ্গ। কোন ব্যক্তি এর ফরযিয়াত অস্বীকার করলে সে কাফের হয়ে যাবে এবং বিনা ওযরে কেউ এ নামায ত্যাগ করলে সে ফাসেক হয়ে যাবে।

১। মহান আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেনঃ

ايها الذين آمنوا إذا نودي للصلوة من يوم الجمعة فاشعوا إلى نيك

اللوووا البيع ذلكم خير لكم إن كنتم تعلمون–

অর্থাৎ–হে মুমীনগণ! যখন জুমু’আর নামাযের আযান হয়, তখন তোমরা ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করে আল্লাহর স্মরণের দিকে দৌড়ে চল। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বোঝ। –(সূরা জুমুআ)

উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহর স্মরণের অর্থ জুমু’আর খুৎবা ও নামায এবং দৌড়ে চলার অর্থ নিছক দৌড়ানো নয়, বরং বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ দুনিয়াবী কাজকর্ম পরিত্যাগ করে আল্লাহর যিকিরের জন্য ধাবমান হওয়া।

২। হাদীসঃ যে ব্যক্তি শুক্রবার দিন গোসল করে যথাসম্ভব পবিত্র হয়ে চুলে তেল মেখে, সুগন্ধি লাগিয়ে জুমু’আর নামায আদায় করার জন্য যাবে এবং মসজিদে গিয়ে কাউকে তার জায়গা থেকে না সরিয়ে যেখানে জায়গা পাবে সেখানে বসবে এবং যে পরিমাণ নামায তার ভাগ্যে জুটে তা আদায় করবে, অতঃপর ইমাম সাহেব যখন খুৎবা পাঠ করবেন, তখন তা চুপ করে শুনবে, তার গত জুমু’আ থেকে এ জুমু’আ পর্যন্ত যত (ছগীরা) গুনাহ্ হয়েছে, সবই মাফ হয়ে যাবে।–(বোখারী শরীফ)

৩। হাদীসঃ যে ব্যক্তি উত্তমরূপে গোসল করে সুন্দর পোষাক পরিধান করে পায়ে হেঁটে তাড়াতাড়ি জামে মসজিদে যাবে, (কোন কিছুতে সওয়ার না হয়ে) এবং তারপর খুৎবার সময় অযথা কোন কাজ না করে বা কথাবার্তা না বলে বরং চুপ করে অত্যন্ত মনোযোগসহকারে খুৎবা শুনবে, তার প্রতি পদক্ষেপের বিনিময়ে পূর্ণ এক বছরের এবাদতের ছাওয়াব লেখা হবে। -( তিরমিযী শরীফ)

৪। হাদীস : মানুষ যেন কোন অবস্থায়ই জুমু’আর নামায ত্যাগ না করে, অন্যথায় তাদের দিলের ওপর মোহর এঁটে দেয়া হবে। অতঃপর ভীষণ গাফলতির মধ্যে পতিত থাকবে। –(মুসলিম শরীফ)

 ৫। হাদীসঃ যে ব্যক্তি অলসতাবশতঃ তিন জুমু’আর নামায ত্যাগ করে, আল্লাহ্পাক তার ওপর নারাজ হয়ে যান। অপর এক রেওয়ায়েতে আছে, আল্লাহপাক তার দিলের ওপরে মোহর মেরে দেন।-(তিরমিযী শরীফ)

৬। হাদীসঃ শরয়ী গোলাম, মহিলা, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে এবং পীড়িত লোক, এ চার ব্যক্তি ব্যতীত প্রত্যেক মুসলমানের জন্যই জুমু’আর নামায জামায়াতের সাথে আদায় করা ফরয এবং আল্লাহর হক।–(আবূ দাউদ)

৭। হাদীস : আল্লাহর রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার দৃঢ় ইচ্ছা যে, কাউকে আমার জায়গায় ইমাম বানিয়ে দেই, অতঃপর যারা জুমু’আর জামায়াতে না আসে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেই।–(মেশকাত শরীফ)।

এ বিষয়ের হাদীস জামায়াত পরিত্যাগকারীর ব্যাপারেও বর্ণিত হয়েছে যা পূর্বে বিবৃত হয়েছে।

৮। হাদীসঃ যে ব্যক্তি বিনা কারণে জুমু’আর নামায ত্যাগ করে, তার নাম এমন কিতাবে লেখা হয়, যা পরিবর্তন থেকে সংরক্ষিত। অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে মুনাফেকের দপ্তরভুক্ত করে দেয়া হয়।-(মেশকাত শরীফ)

হাদীস ৯। মুসাফির রমণী, নাবালেগ এবং গোলাম ব্যতীত প্রত্যেক মু’মিন ব্যক্তির ওপরই জুমু’আর নামায ফরয। সুতরাং কেউ যদি এ ফরয থেকে মুখ ফিরিয়ে কোন বেহুদা কাজে, অর্থাৎ দুনিয়ার ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি কোন কাজে লিপ্ত হয়, তবে আল্লাহ্ তায়ালাও সে ব্যক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। নিশ্চয়ই জানবে, আল্লাহ্ তা’আলা বেনিয়ায ও তিনি সকল অবস্থায় প্রশংসনীয়। অর্থাৎ তিনি কারো এবাদতের মুখাপেক্ষী নন, তাঁর ফায়দাও নেই, তিনি সকল গুণের আঁধার, কেউ তার প্রশংসা করুক বা না করুক।

১০। হাদীসঃ হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, যদি কোন ব্যক্তি পর পর কয়েক জুমুআ ত্যাগ করে, সে যেন ইসলামকেই ত্যাগ করল।

১১। হাদীস : কোন এক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে প্রশ্ন করেছিল, এমন কোন ব্যক্তি যদি মারা যায়, যে ব্যক্তি জুমু’আ ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জামায়াতে উপস্থিত হত না, তার ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? তিনি জবাবে বলেছিলেন, সে ব্যক্তি জাহান্নামী হবে। প্রশ্নকারী এক মাস পর্যন্ত তাকে প্রত্যহ এরূপ প্রশ্ন করেছিল এবং তিনি প্রতিবার ঐ একই উত্তর দিয়েছিলেন।-(এহইয়াউল উলুম)।

এ সকল রেওয়ায়েতের দ্বারা জুমু’আ ও জামা’আতে নামায ত্যাগকারীর প্রতি বড় কঠিন শাস্তি ও ভীতি এসেছে। এখনও কি কোন ইসলামের দাবীদার এ ফরয ত্যাগ করার দুঃসাহস করতে পারে?

.

জুমু’আর নামায ওয়াজিব হওয়ার শর্তসমূহ

১। মুক্বীম হওয়া : মুসাফিরের ওপর জুমু’আর নামায ওয়াজিব নয়। তবে যদি মুসাফির জুমু’আর নামায আদায় করে তবে উত্তম। মুসাফির কোথাও যদি পনের দিন থাকার নিয়্যত করে তাহলে তার ওপর জুমু’আ নামায আদায় করা ওয়াজিব।

২। সুস্থ হওয়াঃ সুতরাং যে অসুস্থ ব্যক্তি জুমু’আর মসজিদ পর্যন্ত আপন ক্ষমতায় হেঁটে যেতে সক্ষম নয় তার ওপর জুমু’আর নামায আদায় করা ফরয নয়। এ ভাবে যে বৃদ্ধ বার্ধক্যের কারণে জামে মসজিদে হেঁটে যেতে সক্ষম নয় অন্ধ, এদেরকে পীড়িত বলা হবে, এদের ওপর জুমু’আর নামায ফরয নয়।

৩। স্বাধীন হওয়া : দাসের ওপর জুমু’আর নামায ফরজ নয়।

 ৪। পুরুষ হওয়াঃ মহিলার ওপর জুমু’আর নামায ফরজ নয়।

৫। যে সব কারণে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জামায়াত ত্যাগ করা দুরস্ত আছে, সে সব কারণ না থাকা : যেমন–(ক) মুষলধারে বৃষ্টি হওয়া। (খ) রুগীর সেবা শুশ্রূষায় নিয়োজিত থাকা। (গ) শত্রুর ভয়ে প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকা।

৬। পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়ার জন্য যে সব শর্ত আছে তা বর্তমান থাকা : যেমন আকেল বা বুদ্ধিমান হওয়া, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া, মুসলমান হওয়া, এ সব শর্তে জুমু’আর নামায ফরয হয় কিন্তু কেউ যদি এ শর্ত ছাড়াও আদায় করে, তবুও তার ফরয অর্থাৎ যোহরের নামায আদায় হয়ে যাবে। যেমন, কোন মুসাফির বা কোন মহিলা যদি জুমু’আর নামায আদায় করে, তার যোহর নামায আদায় হয়ে যাবে।

.

জুমু’আর নামায শুদ্ধ হওয়ার শর্তসমূহ

১। শহর হওয়া : অর্থাৎ বড় বা ছোট শহর অথবা ছোট শহরের মত গ্রাম হওয়া।

যে গ্রামের লোক সংখ্যা ছোট শহরের লোক সংখ্যার সমান, অর্থাৎ যে গ্রামে তিন/চার হাজার লোক বসবাস করে, সে গ্রামে জুমু’আর নামায আদায় করা জায়েয। সুতরাং ছোট পল্লীতে বা মাঠের মধ্যে জুমু’আর নামায পড়া জায়েয নয়।

২। যোহরের ওয়াক্ত হওয়াঃ কাজেই যোহরের ওয়াক্তের পূর্বে অথবা পরে জুমু’আর নামায আদায় করা দুরুস্ত নয়। এভাবে যদি জুমু’আর নামায আদায় করতে করতে যোহরের ওয়াক্ত চলে যায়, তবে জুমু’আর নামায় জায়েয হবে না। যদিও দ্বিতীয় রাক’আতে আত্তাহিয়্যতু পড়তে যতটুকু সময় লাগে ততটুকু সময় বসে থাকে। আর জুমু’আর নামাযের ক্বাযাও নেই।

৩। খুৎবা : অর্থাৎ মুসল্লিদের সামনে আল্লাহ্ পাকের যিকির করা। কমপক্ষে সুবহানাল্লাহ্ বলা হোক কিংবা আল হামদু লিল্লাহ্ বলতে হবে। তবে শুধু এতটুকু বলে শেষ করা সুন্নাতের খেলাফ হওয়ায় মাকরূহ্ হবে।

৪। নামাযের আগে খুৎবা পাঠ করা : নামাযের পূর্বে খুৎবা না দিয়ে পরে দিলে জুমু’আর নামায জায়েয হবে না।

৫। খুৎবা যোহরের ওয়াক্তের ভেতর হওয়া : যোহরের ওয়াক্তের আগে খুৎবা পাঠ করলে জুমু’আ জায়েয হবে না।

৬। জামায়াত হওয়াঃ খুৎবার আরম্ভ থেকে প্রথম রাক’আতের সেজদা পর্যন্ত ইমাম সাহেবের সাথে কমপক্ষে তিনজন পুরুষ থাকতে হবে। যদিও খুৎবার সময় যে তিনজন উপস্থিত ছিল তারা চলে যায় এবং অন্য তিনজন নামাযে শরিক হয়। কিন্তু শর্ত হল, লোক তিনজন ইমামের যোগ্য হতে হবে। কাজেই কেবলমাত্র মহিলা বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মুক্তাদী হলে জুমু’আর নামায দুরুস্ত হবে না।

৭। সেজদা করার পূর্বে লোক থাকা : যদি সেজদা করার পূর্বে মুছল্লি চলে যায় এবং তিনজনের চেয়ে কম থাকে অথবা কেউই না থাকে তবে নামায বাতিল হয়ে যাবে, যদি সেজদা করার পর মুছল্লি চলে যায়, তাহলে ক্ষতি নেই।

৮। সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার : যেখানে জুমু’আ আদায় করা হয়, সেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার থাকতে হবে। সুতরাং যদি কোন জায়গায় গোপনে নামায আদায় করা হয়, সেখানে জনসাধারণের প্রবেশের অনুমতি নেই বা মসজিদের দরজা বন্ধ করে জুমু’আ আদায় করে, তাহলে জায়েয হবে না।

উল্লেখিত শর্তসমূহের একটি মাত্র শর্তও যদি না পাওয়া যায়, তাহলে জুমু’আর নামায জায়েয হবে না, যোহর নামায পড়তে হবে। যেখানে নিশ্চিভাবে জানা যায় যে, জুমু’আ জায়েয নয় সেখানে যোহর আদায় করাই ফরয। সেখানে জুমুআ নফল মাত্র এবং নফল ধুমধামের সাথে জামায়াতে পড়া মাকরূহ্। অতএব এমতাবস্থায় জুমু’আ আদায় করা মাকরূহ তাহরিমী।

খুৎবার মাসয়ালাসমূহ

৩। মাসয়ালা : ইমাম সাহেব যখন খুৎবা দেয়ার জন্য দণ্ডায়মান হবেন তখন থেকে খুৎবা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত নামায পড়া বা কথাবার্তা বলা মাকরূহ্ তাহরিমী, কিন্তু যে ব্যক্তির নামায ক্বাযা আছে তার ক্বাযা আদায় করা জায়েয এবং ওয়াজিব।

৪। মাসয়ালা : খুৎবা আরম্ভ হলে দূরে বা নিকটে উপস্থিত সকলে মনোযোগের সাথে শোনা ওয়াজিব এবং যে কথা বা কাজের দ্বারা খুৎবা শোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়, তা মাকরূহ্ তাহরিমী। তদ্রুপ খুৎবার সময় কিছু খাওয়া, পান করা, কথা বলা, হাঁটাচলা করা, সালাম দেয়া, সালামের উত্তর দেয়া, তাসবীহ্ পাঠ, মাসয়ালা বলা ইত্যাদি নামাযের মধ্যে যেমন হারাম, তেমনি খুৎবার ভেতরও হারাম; অবশ্য ইমাম নেক কাজের আদেশ এবং খারাপ কাজে নিষেধ কিংবা মাসয়ালার কথা বলতে পারবেন।

৫। মাসয়ালাঃ সুন্নাত বা নফল নামাযের মধ্যে যদি খুৎবা শুরু হয়ে যায়, সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। হলে নামায পূর্ণ করে নেবে এবং নফল হলে দু’রাক’আত পড়ে সালাম ফিরায়ে বসে খুৎবা শুনবে।

.

তারাবীহর নামাযের মাসয়ালা

১। মাসআলা : বেতর নামায তারাবীহর পর পড়া উত্তম। তারাবীহর আগে বেতেরের নামায আদায় করলে, তাও জায়েয আছে।

২। মাসয়ালা : তারাবীহ্ নামাযের প্রতি চার রাক’আত অন্তর, চার রাক’আত পরিমাণ সময় বসে বিশ্রাম করা মুস্তাহাব। অবশ্য যদি উল্লেখিত পরিমাণ সময় বসে থাকায় জামায়াতের লোকদের কষ্ট হয় অথবা জামায়াতে মুছল্লি কম হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে এত সময় বসবে না, কম সময় বসবে। এ বিশ্রামের সময় কেবলমাত্র চুপ করে বসে থাকা, পৃথক পৃথকভাবে নফল নামায আদায় করা বা তাসবীহ্, দরূদ ইত্যাদি সব কিছু পাঠ করা দুরুস্ত আছে। এদেশেসুবহানা যিল মুলকে ওয়াল মালাকূতে পাঠ করার এবং মুনাজাত করার যে প্রচলন রয়েছে, তাও দুরুস্ত আছে। তবে এ দোয়া কোন ছহীহ্ হাদীসে উল্লেখ নেই। আবার এমন কিছু লোক আছে, যারা এই দোয়া না জানার কারণে তারাবীহর নামাযই আদায় করে না। এ সকল লোকদেরকে বুঝিয়ে দেয়া দরকার যে, এ দোয়া পাঠ না করলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না। নামায হয়ে যাবে। যদি পারে তাহলে শুধু :–Akai l১২:১১২, ২d।  (সুবহানাল্লা-হি ওয়া বিহামদিহী সুবহানাল্লা-হিল আযীম) পাঠ করবে। কিছু পাঠ না করে চুপ করে বসে থাকলেও নামাযের কোন ক্ষতি নেই। প্রতি চার রাক’আত পর মুনাজাত করা দুরস্ত আছে, কিন্তু বিশ রাক’আতের পর বের নামাযের পূর্বে মুনাজাত করাই উত্তম।

৩। মাসয়ালা : কারো যদি কোন কারণবশতঃ এশার নামায বাতিল হয়ে যায় এবং সেটা বে অথবা তারাবীহর কিছু বা সব আদায় করার পর জানতে পারে, তাহলে তা এশার নামাযের সাথে সাথে বে এবং তারাবীহর যত রাক’আত আদায় করেছে, তাও পুনরায় পড়তে হবে।

৪। মাসয়ালা : এশার নামায জামায়াতে আদায় না করলে তারাবীহর নামাযও জামায়াতে আদায় করা দুরস্ত হবে না। কেননা, তারাবীহ্ নামায এশার নামাযের পরের, সুতরাং এশার নামাযের চেয়ে তারাবীহ্ নামাযের সম্মান বেশি করা দুরস্ত নয়! সুতরাং যদি কোথাও পাড়ার লোকেরা দুর্ভাগ্যবশতঃ এশার নামাযের জামায়াত না করে কেবল মাত্র তারাবীহ্ নামাযের জামায়াত করতে চায়, তাহলে তা দুরস্ত হবে না। কিন্তু যদি পাড়ার লোকেরা এশার জামায়াত করে তারাবীহ্ জামায়াতে আদায় করতে থাকে এবং দু একজন লোক এশার নামাযের জামায়াত না পেয়ে থাকে, তাহলে তারা এশার নামায একাকী আদায় করে তারাবীহর জামায়াতে অংশগ্রহণ করতে পারবে, এতে কোন বাধা নেই।

৫। মাসয়ালা : কোন ব্যক্তি যদি মসজিদে গিয়ে দেখে যে, এশার জামায়াত শেষ হয়ে তারাবীহ্ নামায শুরু হয়েছে, তাহলে সে আগে এক পাশে একাকী এশার নামায আদায় করে নেবে, তারপর তারাবীহর জামায়াতে অংশ নেবে। এর মাঝে যে কয় রাক’আত তারাবীহ্ ছুটে গেছে তা সে তারাবীহ্ ও বেতর নামায আদায় করার পর আদায় করে নেবে। বেতেরের জামায়াত কিছুতেই ছাড়বে না।

৬। মাসয়ালা : রমযান মাসে তারাবীহ্ নামাযের মধ্যে তরতীব অনুযায়ী একবার কোরআন শরীফ খতম করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। অবহেলা বা অলসতার কারণে এ সুন্নাত ত্যাগ করা উচিৎ নয়। কিন্তু যে সব লোক একেবারেই অলস, কোরআন খতমের ভয়ে হয়ত তারা নামাযই ছেড়ে দিতে পারে, তাদের জন্য সূরা তারাবীহর জামায়াত করা যেতে পারে। সূরা তারাবীহর মধ্যে কোরআন পাকের যে কোন অংশ বা যে কোন সূরা পাঠ করলেই হবে। প্রতি রাক’আতে সূরা এখলাছ তেলাওয়াত করলে, তাও দুরস্ত আছে। অথবা যদি সূরা ফীল হতে সূরা নাস পর্যন্ত পাঠ করে প্রথম দশ রাক’আত আদায় করে, আবার সূরা ফীল হতে সূরা নাস পর্যন্ত পাঠ করে বাকী দশ রাক’আত আদায় করে, এ নিয়মটাও মন্দ না।

৭। মাসয়ালাঃ তারাবীহ্ নামাযের জামায়াতে রমযান মাসে কোরআন শরীফ এক খতমের বেশি তেলাওয়াত করবে না। অবশ্য যদি মুসল্লীদের আগ্রহ থাকে, তাহলে বেশি পড়ায় দোষ নেই।

আমাদের ইমামে আযম হযরত আবু হানিফা (রঃ) প্রত্যেক রমযান শরীফে কোরআন শরীফ একষট্টি (৬১) বার খতম করতেন। ত্রিশ দিনে ত্রিশ খতম এবং ত্রিশ রাতে ত্রিশ খতম এবং তারাবীহর মধ্যে এক খতম, মোট একষট্টি (৬১) খতম পড়া হতো।

৮। মাসয়ালা : এক রাতে কোরআন শরীফ খতম করা দুরুস্ত আছে, কিন্তু যদি লোকের কষ্ট হয় বা অভক্তি প্রকাশ পায়, তাহলে মাকরূহ্।

৯। মাসয়ালা : তারাবীহর খতম করার সময় পূর্ণ কোরআন শরীফের যে কোন একটি সূরার শুরুতে। 64। ali–উচ্চৈঃস্বরে পড়তে হবে, অন্যথায় পূর্ণ কোরআন পাক খতমের নেকী পাওয়া যাবে না, এক আয়াত কম থেকে যাবে। হাফেয সাহেব যদি নিরবে পড়ে নেন, তাহলে তার কোরআন খতম পূর্ণ হবে বটে কিন্তু মুক্তাদীদের এক আয়াত কম থেকে যাবে। কাজেই খতম তারাবীহর ভেতর যে কোন একটি সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ্ আওয়ায করে পাঠ করবে। (সাধারণতঃ আলেমগণ সূরা আলাক এর শুরুতে বিসমিল্লাহ উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করে থাকেন)।

১০। মাসয়ালা : পুরো রমযান মাসে প্রতি রাতে বিশ রাক’আত করে তারাবীহ্ নামায আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। যেদিন সন্ধ্যায় রমযানের চাঁদ দেখা যাবে, ওই রাত থেকেই তারাবীহ্ আদায় করা শুরু করবে এবং যে দিন সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখবে, সে রাতে ছাড়বে। যদি কোরআন পাক আগে খতম হয়ে যায়, তবুও বাকী রাতগুলোতেও তারাবীহ্ আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্। সূরা তারাবী হলেও আদায় করবে। অনেক লোক এমন আছে যারা কোরআন খতম হয়ে গেলে আর তারাবীহর জামায়াতে আসে না বা পড়ে না, আবার কেউ কেউ আট রাক’আত আদায় করেই চলে যায়, এটা ঠিক নয়। (এতে গুনাহ্ হয়)।

১১। মাসআলা : তারাবীর নামাযে কোরআনপাক খতম করার সময় যখন সূরা এখলাছ (al। Ai) আসে, তখন এ সূরা তিনবার পাঠ করা মাকরূহ। অর্থাৎ এরূপ রছম বানিয়ে নেয়া এবং একে শরীয়তের হুকুম মনে করে আমল করা মাকরূহ্, অবশ্য নফল নামাযে বা তারাবীহর নামাযে তিন বার পাঠ করা মাকরূহ্ নয়।

তারাবীহর জামাআত পুরুষদের জন্য সুন্নতে কেফায়া। সুতরাং সকলে মিলে জামায়াত করলে এবং কেউ ঘরে বসে তারাবীহ্ আদায় করলে সে জামায়াতের নেকী পাবে না বটে কিন্তু পাপী হবে না। কিন্তু পাড়া বা মহল্লার সবাই যদি জামায়াত তরক করে, তাহলে সকলেই গুনাহগার হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *