বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১

‘আমি আপনার চোখ চাইনা। কিন্তু, আপনার সঙ্গে একবার চোখাচোখি দেখা করার সুযোগ পেতে পারি কি?’ এই চিঠিটা লিখেছিলাম একটি বিজ্ঞাপনের উত্তরে। ইংরেজি দৈনিকে একজন বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, তিনি তাঁর একটি চোখ দান করতে চান। যার দরকার সে বিজ্ঞাপনদাতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। বিজ্ঞাপনটি বেরিয়েছিল বক্স নাম্বারে, উত্তর পেলাম একজন বাঙালির কাছ থেকে। শনিবার সন্ধেবেলা আমাকে দেখা করতে বলেছেন।

দক্ষিণ কলকাতার নব্য-ধনী এলাকার একটি চারতলা বাড়ির একেবারে চারতলার ঘরে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করলেন। দীর্ঘ সুঠাম চেহারা, বয়স পঞ্চাশের বেশি নয়, দেখলেই লোকটিকে বেশ রাশভারী মনে হয়। ঘরে একটি শ্বেতপাথরের টেবিল, একটি চেয়ার ও খাট ছাড়া কোন আসবাব নেই। সবকিছুই সাদা। সাদা বিছানার চাদর, সাদা জানালার পর্দা, ধপধপে সাদা দেয়ালে একটি ছবি বা ক্যালেন্ডাররও নেই। অত সাদা রং চোখকে পীড়া দেয়। ঘরটা দেখেই আমার অপ্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ল, কবি ইয়েট্স্ নাকি সবসময় কালো রং ব্যবহার করতেন, কালো পোশাক, কালো পর্দা এমনকি চা খেতেন কালো কাপ-ডিশে, পাশে একটি কালো বিড়াল নিয়ে।

এই লোকটির সঙ্গে আমি কেন দেখা করতে এসেছি জানিনা। ঝোঁকের মাথায় চিঠি লিখেছিলাম। এখন, লোকটিকে একঝলক দেখেই মনে হল—আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন চলে গেলেই হয়। কিন্তু কী বলে চলে যাব, হঠাৎ? আমি চুপ করে বসে রইলাম নাম ও পরিচয় বিনিময়ের পর। চাকর এসে চা দিয়ে গেল, তবু অস্বস্তিকর নীরবতা। বিষম অনুতাপ হতে লাগল আমার, কোন্ হঠকারিতায় এসেছি এখানে। এ মানুষের মুখ থেকে আমার কিছুই জানার নেই। এই লোকটি কেন তাঁর চোখ দান করে যেতে চান—তা জেনে আমার কী দরকার? আমি চোখ নিচু করে টেবিলে আঙুল দিয়ে অদৃশ্য ছবি আঁকতে-আঁকতে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম, লোকটিই আমাকে প্রশ্ন করবেন। একবার মুখ তুলে দেখি, ভদ্ৰলোক আমার দিকে তীব্র চোখে তাকিয়ে আছেন। চোখাচোখি হতেই আমার মাথায় একটি প্রশ্ন খেলা করে গেল। কোন্ চোখটা? ডানদিকের না বাঁদিকের—কোন্ চোখটা তিনি দান করতে চান? বেশ টানাটানা সুন্দর চোখ ভদ্রলোকের। যুগ্ম ভ্ৰূ।

—আপনি কি বেঁচে থাকতেই চোখটা দিয়ে যেতে চান?

—হ্যাঁ।

—এত অল্পবয়সে? আপনার তো মৃত্যুর সময় হয়নি। এর মধ্যেই একটা চোখ হারাতে আপনার কষ্ট হবেনা?

—আমার লাং ক্যান্সার আছে। আমি দু-এক বছরের বেশি বাঁচবনা, জানি।

—আপনার পরিবারের কেউ আপত্তি করছেননা?

—আমার পরিবারে কেউ নেই।

খুব কাটাকাটা উত্তর ভদ্রলোকের। সবসময় একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে কথা বলছেন। যারা চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে সেইসব লোক সাধারণত সত্যবাদী হয়, সেই সঙ্গে আত্মবিশ্বাসী। লোকটি তাঁর ব্যক্তিত্ব দিয়ে ক্রমশ আমার ওপর প্রভাব বিস্তার করছিলেন। সেটা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমি ওঁর আত্মবিশ্বাসে আঘাত করতে চাইলাম। জিজ্ঞেস করলাম, মানুষের উপকার করার হঠাৎ এরকম ইচ্ছে হল কেন আপনার?

—মানুষের উপকার?

—এই চোখ দিয়ে যাওয়া। সব লোকই তো দুটি চোখ সমেত মারা যায়!

—আমার একটি ছেলে জন্মেছিল। জন্মান্ধ। সে মারা যাবার পর এই কথাটা আমার মাথায় আসে।

—দুটো চোখই তাহলে দিয়ে যাচ্ছেননা কেন?

—একটা রেখে দিচ্ছি, বাকি যে কটা দিন বাঁচব সে কটা দিন কাজ চালাবার জন্য। তাছাড়া, মৃত্যুর পর কী আছে জানিনা। যদি তখন কাজে লাগে, মৃত্যুর পর স্বর্গ বা নরকে যদি কিছু দেখার দরকার হয়, তাই একটা রেখে দেওয়া ভালো।

—কোন্‌টা?

ভদ্রলোক চুপ করে রইলেন। তারপর এই প্রথম মুখটা ফেরালেন। আমি খেলাচ্ছলে ওঁর মুখের সামনে হাতটা নিয়ে গিয়ে বললাম, কোন চোখটাকে আপনি বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে চান?

তিনি কোন উত্তর দিলেননা। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম একটু নিষ্ঠুরের মতো, ডানদিকেরটা না বাঁদিকেরটা, কোন্ চোখটাকে আপনি বেশি ভালোবাসেন?

ভদ্রলোক বললেন, আপনি অলৌকিকে বিশ্বাস করেন?

অবাক হয়ে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, অলৌকিক?

—হ্যাঁ, আপনার তো বয়েস অল্প। কিন্তু তবু, কোনরকম অলৌকিকে বিশ্বাস করেন?

—অলৌকিক বলতে ঠিক কী বলতে চাইছেন? যদি ঠাকুর-দেবতার ব্যাপার হয়, এখনও নির্ভয়ে বলতে পারি, না, করিনা। কিন্তু, রাত্রের দিকে খানিকটা ভূতটুতে বিশ্বাস করি এখনো।

এই প্রথম ভদ্রলোক মৃদুভাবে হাসলেন। বললেন, না, তা নয়। মাসখানেক আগে ঠিক করেছিলাম, বাঁ চোখটা দান করব। মনঃস্থির করে ফেললাম। তারপরের কয়েকটা দিন হঠাৎ বাঁ চোখটায় ব্যথা করতে লাগল। জল ঝরতে লাগল অনবরত। তখন ভাবলাম, এ চোখটা বোধহয় খারাপ হয়ে যাচ্ছে, অসুখ হয়েছে কোন। ডাক্তার দেখাবার আগেই ঠিক করলাম, ঐ খুঁতধরা চোখটা তাহলে আর দেবনা, ডান চোখটাই দেব। আমার বাকি কটা দিন ঐ খারাপ চোখটাতেই চলে যাবে। তারপর …ভদ্রলোক আমার দিকে আবার তীব্র চোখে তাকালেন। বুঝতে পারলাম, তিনি সত্যি কথা বলেছেন।

তারপর, আমার বাঁ চোখটা হঠাৎ সেরে গেল। কিন্তু, এবার ডান চোখটা ব্যথা করে জল ঝরতে লাগল। মনে হল, ঐ চোখটা একা-একা কাঁদছে সবসময়। রাত্তিরে শুয়ে মনে হত, ঐ চোখটা অনবরত কেঁদে-কেঁদে আমাকে কিছু বলতে চাইছে। যেন মিনতি করছে করুণভাবে। আমাকে নয়, আমাকে নয়, আমি কী দোষ করেছি যে আমাকে আপনি বিদায় করে দেবেন! শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কি আলাদাভাবে প্রাণ আছে? ওদের আলাদা ইচ্ছে-অনিচ্ছে আছে? নইলে, যখনই যে চোখটাকে দান করব ভাবি, তখনই সেটা থেকে জল পড়ে কেন? একে আপনি অলৌকিক বলবেননা? যাই হোক, তখন ঠিক করলাম, আগে থেকে আর ভাববনা। অপারেশনের ঠিক আগের মুহূর্তে বেছে নেব। এখন দুটো চোখই ভালো আছে।

—আপনার চোখদুটি ভারি সুন্দর।

—আমার দৃষ্টিশক্তিও খুব উজ্জ্বল। জানালা দিয়ে দেখুন, লেকের দক্ষিণ পাড়ের ঐ দোকানটার সাইনবোর্ড এখান থেকে পড়তে পারেন? আমি এই বয়েসেও পারি। ঐ যে দেখুন-না, কমলা স্টোর্স, নিচে ছোট হরফে লেখা সর্বপ্রকার স্টেশনারি …

আমি মনে-মনে একটু হাসলাম। বুঝতে পারলাম, লোকটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছেন। খসে যাচ্ছে গাম্ভীর্য। নইলে দৃষ্টিশক্তি নিয়ে এমন ছেলেমানুষী গর্ব করতেননা। সরকারি বনবিভাগের এই প্রাক্তন কর্মচারীটি, অরবিন্দ রায়চৌধুরী, একা বসে পেশেন্স খেলা যাঁর একমাত্র ব্যসন, পনেরো বছর আগে স্ত্রীবিয়োগ হবার পর যিনি আর দারপরিগ্রহ করেননি—এতক্ষণ তাঁকে একটা কঠিন, অবাস্তব মানুষ বলে মনে হচ্ছিল—এবার আমি তাঁর শরীরের শিরা ও স্নায়ু দেখতে পেলাম। এমনকি বুকের মধ্যে ক্যান্সারের ঘা পর্যন্ত। চোখ দান করা নিয়ে কোন অহংকার করছেননা, কিন্তু এত নিরাসক্ত হবার মতো অহংকার তিনি কোথায় পেলেন? বললাম, আপনি অপারেশন করে চোখ তুলে দেবার এক মাস পরেই যদি ক্যান্সারের ওষুধ বেরিয়ে যায়? তাহলে আপনি বাকি জীবন এক চোখে বাঁচবেন?

—আপনি বেশি আশাবাদী।

—যে কোন মুহূর্তেই তো বেরুতে পারে।

—তা হোক। একটা চোখই আমার যথেষ্ট।

—আপনি যাকে চোখ দেবেন, তাকে নিজে দেখে যেতে চান?

—হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। না-হলে তো আমি ‘আই ব্যাঙ্কে’ দান করতে পারতুম। আমি একটি বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে যেতে চাই।

—কেন?

এমন একজন স্বাস্থ্যবান শিশুকে দিতে চাই যে বহুদিন বাঁচবে। কারণ—

ভদ্রলোক একটু লাজুকভাবে হাসলেন। আমি এমনভাবে ওঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম—যার একমাত্র মানে হয়, বলুন-না!

—এ জীবনটা কেটে গেল, কিন্তু কী দেখলাম? রাস্তায় বেরুলে এখন কী দেখি? জানেন, যখন জঙ্গলে থাকতাম, আমি গুলি খেয়ে হরিণকে ছটফট করে মরতে দেখেছি, নেকড়ে বাঘের মুখে খরগোশের বাচ্চাকে মরতে দেখেছি—কিন্তু তার কিছুর সঙ্গেই তুলনা হয়না—এখন পথে বেরুলেই যে লক্ষ-লক্ষ না-মরা, অর্ধজীবন্ত মানুষ দেখি। কীরকম নিরাশ কালিমাময় মুখ! উঃ! মানুষের মুখ এরকম হয়? আগে মফঃস্বলে থাকতাম, পালিয়ে এসে শহরের চারতলায় আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু এ শহরেই বা কী দৃশ্য! এত অসংখ্য মানুষ, এদের মুখ দেখলে শিউরে উঠতে হয়। কোন আশা নেই, উৎসাহ নেই, দাবিও নেই। কোনরকমে বেঁচে আছে। এর নাম জীবন? আমি মরে যাচ্ছি, কিন্তু আমার চোখটা এমন একজনকে দিয়ে যাব—যে অনেকদিন বাঁচবে, ভবিষ্যতের সুন্দর পৃথিবী দেখে যাবে।

ভদ্রলোক যে শেষপর্যন্ত অতি সাধারণ মানুষের মতোই কথা বললেন তাতে নিশ্চিন্ত হলাম। একটা তাহলে স্পর্শসহ যুক্তি আছে। সেইটাই আমার জানার দরকার—ছিল কেন একটা লোক হঠাৎ চোখ দিতে চায়। নেহাৎ মানুষের উপকার করবার জন্যই নয় তাহলে! নিজের একটা শখ মেটাবার জন্য মৃত্যুর আগে সকলেই ভবিষ্যতের কথা ভাবে—ভবিষ্যতের সুন্দর পৃথিবীর কথা। একশো বা দুশো বছর আগে যারা মারা গেছে, তারাও ভেবেছিল। ভেবেছিল যে তাদের মৃত্যুর দু-দশ বছর পরই পৃথিবী সুন্দর হয়ে যাবে। শুধু তারাই দেখে যেতে পারলনা। আমার ঠাকুরদা এ কথা ভেবেছিলেন, আমার বাবাও হয়তো ভেবেছেন মরার আগে। সকলেই ভেবেছেন, ইস, একটুর জন্য ভবিষ্যতের সুন্দর পৃথিবীটা দেখে যেতে পারলামনা! এরকমই চলবে!

আমি এখন বাঁচব বেশকিছুদিন, এরকম আশা আছে, তাই ভবিষ্যতের সুন্দর পৃথিবী-টুথিবীর কথা আমার একবার ভুলেও মনে পড়েনা।

ওঠার আগে আমি আরেকবার ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকালাম। হঠাৎ মনে হল, ওঁর চোখদুটির আলাদাভাবে, স্বাধীনভাবে অন্যকিছু বলার আছে হয়তো। হয়তো, আমার চোখদুটি ওদের স্বজাতির ভাষা বুঝেছে। কিন্তু আমি পারিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *