ম্যাকবেথের ডাইনীরা

ম্যাকবেথের ডাইনীরা

সেদিন আতঙ্কটা কাটতে বেশ সময় লাগল। কিন্তু আমার মুখে তার ছাপটা যেন লেগে ছিল। তাই রাতে যখন ফরেস্ট বাংলোয় দুজনে মুখোমুখি বসে আছি, কর্নেল হঠাৎ বললেন জয়ন্ত, তোমার কষ্টটা বেশ টের পাচ্ছি।

বললুম–কষ্ট? কিসের কষ্ট?

কর্নেল হাসলেন।–লুকিও না জয়ন্ত। কষ্ট নয়? এলে মনের সুখে বেড়াতে, আর পড়ে গেলে খুনোখুনির মধ্যে। দেখ ডার্লিং, আমার কপালের সংসৰ্গদোষ এটা। তবে আই অ্যাসিওর ইউ, আর কিছু ঘটবে না।

–ঘটবে না তার গ্যারান্টিও নেই।

কর্নেল চুরুট জ্বেলে আবার হাসতে হাসতে বললেন–তা নেই। তবে আমারও জায়গাটা আর ভাল লাগছে না। তেতো মনে হচ্ছে। এটা প্রতিবার কিন্তু হয়–ফ্রাঙ্কলি বলছি জয়ন্ত। খুনের ঝামেলা চুকে গেলেও অনেকদিন মনটা কেমন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। তাই বলছিলুম।

উনি থামলেন দেখে তার মুখের দিকে তাকালুম। বললুম কলকাতা ফিরতে এখনই রাজি আছি।

হাত তুললেন কর্নেল। না। ফিরে গেলে তো আরও খারাপ লাগবে। তার চেয়ে, বরং অন্য কোথাও যাওয়া যাক।

–বেশ তো। চলুন, কোথায় যাবেন।

একটু ভেবে নিয়ে কর্নেল বললেন–বরমডিহির নাম শুনেছ?

শুনেছি।

–বিহারে ছোটনাগপুর এলাকায় এত ভালো জায়গা আর নেই। চলো। কাল সকালে আমরা রওনা হই।

খুব ভালো লাগল প্রস্তাবটা। কিন্তু শুয়ে পড়ার পরও অনেকক্ষণ নানা ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকলুম। সেখানে গিয়েও আবার কোনো খুনোখুনিতে পড়ব না তো?

কর্নেলের মনে কি কোনো অলৌকিক শক্তি আছে? হঠাৎ সেই সময় ওঁর নাক ডাকা থেমে গেল। তারপর শুনলুম–ভারী গলায় উনি বলছেন–ডার্লিং জয়ন্ত, কথা হচ্ছে–মানে, আই অ্যাসিওর ইউ–যদি বরমডিহিতে দৈবাৎ কোনো কাণ্ড ঘটে, আমরা তাতে জড়াবো না। আশা করি, তেমন কিছু ঘটবেও না।

কোনো জবাব দিলুম না। কোনো গ্যারান্টিও তো নেই।

.

কর্নেল যা বলেছিলেন, তা সত্যি। কোথাও বেড়াতে যেতে হলে ছোটনাগপুরের পাহাড়ী এলাকায় বরমডিহির মতন ভালো জায়গা খুব কমই আছে। চারদিকে ছড়ানো হিলক শ্রেণীর পাহাড়, মাঝখানে এই সবুজ উপত্যকা ঘিরে বয়ে যাচ্ছে সুন্দর সোনালি বালির এক নদী–যার স্থানীয় নাম মেনখা বা মেনকা। আমার বন্ধুটির বয়স ষাটের ওধারে। তবু দেখেছি ভোর পাঁচটায় উঠে মাঠ থেকে দাড়ি ও টুপিতে প্রচুর শিশির নিয়ে ঘোরেন। এখন অবশ্য শরৎকাল। হরগৌরী হোটেলের দোতালার ব্যালকনিতে পাহাড় পেরিয়ে লালচে রোদ এসে পড়ার অনেক আগে বেরিয়ে যান এবং ফেরেন যখন, তখনও আমি. ঘুমোচ্ছি দেখে পাছে জেগে যাই, হালকা পায়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বনজ নানান খুঁটিনাটি জিনিস যেমন মাকড়সার জাল, ঘাসের কুটো, পাখির গু ইত্যাদি পরিষ্কার করতে থাকেন। তার ভদ্রতাবোধের তুলনা নেই। তেমনি রসবোধও চূড়ান্ত। এবং তিনিই জানেন যে আমি তখন শুয়ে চোখের ফাঁকে তার দুর্দশার ব্যাপারগুলো দেখে মুখ টিপে হাসছি, এবং তার বাইনাকুলারের ব্যর্থতা-সফলতার শতাংশ কষছি, এবং তার জাদুকার ক্যামেরার অন্ধকার ঘরে কতগুলো খেচর প্রাণী উল্টোভাবে অবস্থান করছে জানতে উৎসুকও হয়েছি।

কারণ, আমার দিকে না ঘুরেই উনি মৃদু ও মিঠে গলায় বলতে থাকেন। ইয়ে, জয়ন্ত ডার্লিং, আশা করি আজ তোমাকে সেই দুর্লভ প্রজাতির উড্ডাকের ছবি দেখাতে পারব, এবং কিছু লাল হিমালয়ান মিনিভেটেরও। অবশ্য বিহারের এই গরম জায়গায় এখন ওদের এসে পড়াটা রহস্যময়। তবে মাইডিয়ার ইয়ং ম্যান, এবার বরমডিহিতে তার চেয়ে রহস্যময় ব্যাপার আমি সম্প্রতি দেখছি।

আমি চোখ বুজে ফেলি। কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের মুখে রহস্য শব্দের পৃথক তাৎপর্য আছে এবং আমার উদাসীনতা টের পেলে উনি আরও স্নেহকাতর হয়ে পড়বেন, জানি। ফলে আরো খানিকটা আভাস দেবেন।

ঠিক তাই। উনি একটু কেসে এবং দরজার দিকে সরে গিয়ে বাইরেটা দেখতে দেখতে বলেন, ম্যাকবেথের তিন ডাইনীর কথা তোমার মনে পড়ছে জয়ন্ত? এইরকম একটা পাহাড়তলির মাঠে, ধরো, গতকাল সন্ধ্যায় এসে যদি বলাবলি করত হোয়েন শ্যাল উই মিট এগেন, থানডার লাইটিং অর ইন রেন…এবং ঠিক তখনই আমি কাছাকাছি গিয়ে পড়লে…

এবার থাকা যায় না। বলে উঠি–কর্নেল তাহলে বরমডিহির ভূত সত্যি দেখলেন?

‘বাছা জয়ন্ত,’ বলে মাথা দোলান উনি।…এই হরগৌরী হোটেলের মালিক পশুপতিবাবু তোমার মাথাটা চিবিয়ে খেয়েছেন। ভূত এখানে কোথায়? সে ছিল নাইনটিন ফোরটি টুতে বার্মার জঙ্গলে। সেভেনটিনথ চীনাবাহিনীর অধিনায়ক মার্কিন জেনারেল স্টিলওয়েলের সঙ্গে তখন পালাচ্ছি চিনডুইনের দিকে, জাপানের ফোরটিনথ ডিভিসান তাড়া করেছে।

গতিক দেখে চেঁচিয়ে উঠি-কর্নেল, কর্নেল! প্লিজ! আসলে বার্মা ফ্রন্টের যুদ্ধ সম্পর্কে ওঁর নস্টালজিয়া প্রচুর থাকলেও এভাবে আমাকে খেলাতে মজা পাচ্ছেন, জানি। তাই মূল কথার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। আমি ব্যাকুলভাবে বলি, ম্যাকবেথের ডাইনীদের কথা বলুন!

কর্নেল সরে এসে আমার বিছানার কাছে চেয়ারটায় বসে পড়েন। একটু হাসেন। …খবরের কাগজের রিপোর্টারদের সামনে সব ব্যাপার আলোচনা করতে বরাবর আমি ভয় পাই, বাছা জয়ন্ত! দোহাই তোমার, তিলকে তাল করে ফেলো না!

বলি–পাগল না মাথাখারাপ? আমি তো এখানে কোনো অ্যাসাইনমেন্টে আসিনি! আপনার সঙ্গে নিছক বেড়াতে এসেছি। আই অ্যাসিওর। এখন, সেই ডাইনীদের কথা বলুন।

ডাইনীদের চেয়েও একটা ভয়ানক ব্যাপার এখন এই হোটেলেই ঘটেছে, বোঝা যাচ্ছে যে তুমি কিছুই টের পাওনি এখনও। সেটা আরও রহস্যময়!

এবার উঠে বসি।–কী? কী হয়েছে বলুন তো?

কর্নেল খুব শান্তভাবে বলেন–গত রাত্রে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হল বজ্রবিদ্যুৎসহ। আশ্চর্য জয়ন্ত, আশ্চর্য! ডাইনীরা যা বলেছিল, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফলে গেল। শুধু ভুলটা আমারই বেরিয়ে গিয়ে একবারও দেখে এলুম না কী ঘটছিল। আসলে ওদের কথা মনেই ছিল না।

বিরক্ত হয়ে বলি–কিন্তু হলটা কী?

 মার্ডার। খুন। নিষ্পলক তাকিয়ে জবাব দেন উনি।

–আবার খুন! কোথায় খুন হল? কে খুন হল? এই হোটেলে? পায়ে চটি গলিয়ে উঠে দাঁড়াই। হা ঈশ্বর! আবার খুনের পাল্লায় পড়লুম!

হাত তুলে উনি বলেন–বাছা জয়ন্ত, একটু ধৈর্য ধরো। পশুপতিবাবু পুলিশকর্তাদের নিয়ে ব্যস্ত এখন। তবে শিগগিরই এসে পড়বেন ওপরে। আমাকে ওঁর প্রচণ্ড বিশ্বাস। আর ইয়ে–তোমাকেও অফিসাররা কিছু প্রশ্ন করতে পারেন। যা জানো বলবে। কিন্তু…আশ্চর্য জয়ন্ত, সত্যি এ বড় আশ্চর্য!

ওঁর অদ্ভুত আচরণে রাগ হল।…কর্নেল, আসছি। বলে দরজার দিকে এগোই।

উনি চাপা হেসে ওঠেন। হাসিটা কেন যেন যান্ত্রিক মনে হয়।..

.

হরগৌরী হোটেল একটা টিলার ওপর। ঘুরে-ঘুরে নিচের বড় রাস্তা থেকে একফালি প্রাইভেট রাস্তা এসে সমতল বিশাল লনে উঠেছে। হোটেলের দুটো ভাগ। একটা উত্তরে অন্যটা দক্ষিণে। পূর্বে গেট, মাঝখানে সুদৃশ্য লন ও বর্ণাঢ্য পুষ্পসমাবেশ, পশ্চিমে একতলা টানা ডাইনিং হল, স্টোর ও কিচেন দুটো দালানকে যুক্ত করেছে। বরমডিহির সবচেয়ে অভিজাত হোটেল এটি এবং প্রবাসী বাঙালির সম্পত্তি।

নিচে নেমে দেখি লাল টুপিপরা কনস্টেবলের ভিড়, পুলিশের গাড়ি, ফিতে ধরে মাপজোক চলেছে দক্ষিণের বাড়িটায়। একতলার পূর্ব-দক্ষিণ কোনার ঘরটায় তাহলে সত্যি কেউ খুন হয়েছে রাতারাতি।

 আমরা আছি উত্তরের বাড়িতে। কিন্তু দোতলায় ব্যালকনি থেকে কিছু দেখতে না পাবার কারণ লনের একসার ইউক্যালিপটাস গাছ। তাছাড়া কোনো শব্দও ওবাড়ি থেকে এলে শোনা কঠিন, প্রাঙ্গণের মাপ সোজাসুজি অন্তত পঞ্চাশ গজ এবং প্রচণ্ড জোরে পূর্বের বাতাস বইছে।

লনের ইউক্যালিপটাস সারি পেরিয়ে যেতেই এক ভোজপুরী পালোয়ান পুলিশ আপত্তিকরভাবে লাঠি তুলে গর্জায়–মাৎ যাইয়ে উধার। যানেকা মানা হ্যায়।

ভ্যানিটিতে লাগল। কিন্তু পকেটে পরিচিতিপত্র নেই আমার কাগজের! এ বাটা রিপোর্টার কী মাল বুঝবে বলে মনে হয় না। ডাইনে তাকাই। ডাইনিং ঘরটা পর্যন্ত কর্ডন করে রেখেছে। তখন বিনীতভাবে ভোজপুরীটিকে প্রশ্ন করি–ক্যা হুয়া স্যার?

স্যার শুনেও শালা গলল না। খৈনি ডলতে ডলতে ঘড়ঘড় করে কিছু বলে। তখন অগত্যা ফিরে আসি সিঁড়ির দিকে। আশ্চর্য, উত্তরের ব্লকের আবাসিকরা সবাই রহস্যময়ভাবে অদৃশ্য-সম্ভবত ঘর ছেড়ে নড়েনি। কোনো বেয়ারার পাত্তা নেই। ব্রেকফাস্ট দিয়ে যাবার কথা যে বনমালীর, তাকে বারকতক ডাকাডাকি করে ফিরে আসি ঘরে।

কর্নেল তখনও একইভাবে বসে আছেন। আমাকে দেখে হেসে বলেন, তোমাকে বলা উচিত ছিল জয়ন্ত, বরমডিহি পুলিশ খবরের কাগজ পড়ে না। এস, এস। মুখটুখ ধুয়ে ফেলো বরং। তারপর দুজনে বাইরে কোথাও গিয়ে ব্রেকফাস্টটা সেরে ফেলব। এঁরা আজ অরন্ধন ব্রত পালন করবেন মনে হচ্ছে।

ততক্ষণে আমার সব মনে পড়ে গেছে। দক্ষিণের ব্লকের নিচের তলায় পূর্ব দক্ষিণের ঘরে চারটি মেয়েকে থাকতে দেখেছিলুম না! আমাদের আসার আগেই ওরা এসেছিল। চারটি হাসিখুশি স্মার্ট কলকাতার মেয়ে। কর্নেল বুড়ো তো সবার সঙ্গেই আলাপ জমাতে ওস্তাদ। তার কাছেই শুনেছিলুম, ওরা এক বিখ্যাত সওদাগর কোম্পানির স্টেনো কেরানি রিসেপসনিস্ট পি এ বাহিনী। ছুটি নিয়ে বরমডিহির রূপসুধা-টুধা পান করতে এসেছে। হায় তৃষ্ণার্ত সব ঠোঁট এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা!

কিন্তু সেই চারটির মধ্যেই কি কোনোটি গেল? মোটাসোটা গোলগাল বেঁটে শ্যামলা রঙের সেই চঞ্চলা নাকি হাল্কা ছিপছিপে নিটোল ইরানি জাদুকরীটি কিংবা পুরুষ-পুরুষ একটু গম্ভীর একটা পুরু ঠোঁট গুরুনিতম্বিনী, অথবা সেই খিলখিল হাসি মিষ্টিমুখ মেমসায়েব?

আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বলেন–আমি যুবক নই তোমার মতো। কিন্তু জয়ন্ত, এই হত্যাকাণ্ড আমাকে অন্য একটা দিক থেকে বিচলিত করেছে। সৌন্দর্য যখন আতঙ্কের ছায়ায় ঢাকা পড়ে, তখনকার মতো বীভৎস দৃশ্য কিছু থাকতে নেই। খুব ভয় পাওয়া সুন্দর মানুষকে লক্ষ্য করেছ কি কখনও? এক্ষেত্রে সেই বীভৎসতার পরিচয় তুমি পাবে। ঈশ্বর রক্ষা করুন আমাকে আর ওই দৃশ্য দেখতে চাইনে। কিন্তু শ্ৰীমতী চিত্রিতার লাশ দেখেও কীভাবে যে এখনও নার্ভ ঠিক রেখে কথা বলছি বা শান্ত আচরণ করছি, আমি জানি না। সত্যি বল তো জয়ন্ত, কেন আমি একটুও উত্তেজিত হচ্ছি না? আমি কর্নেল সরকার–ওরা বলে, রহস্যজগতের মুকুটহীন সম্রাট, সব বাজে কথা জয়ন্ত! সব চালাকি আর তোষামুদি! নিছক ফাঁদে ফেলার ষড়যন্ত্র। কারণ, আমি একটু আগে যা দেখে এসেছি, তাতে আমার বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে গেছে। কেমনভাবে এটা সম্ভব হল? হাউ দ্যাট হাড়?

প্রথমে বলুন–কোন মেয়েটি খুন হয়েছে?

 তুমি যাকে কিম্পুরুষ বলে আড়ালে ঠাট্টা করেছিলে সেদিন।

 কী আশ্চর্য! তাকে কে খুন করল? ওর বন্ধুরাই নয় তো?

আশ্চর্যের কারণ অন্যখানে। চিত্রিতার লাশটা তার খাটে বেঁকে-দুমড়ে পড়ে রয়েছে। বাঁ হাতের কড়ে আঙুল ফুলে ঢোল, একটা সূক্ষ্ম দু’সেন্টিমিটার চেরা দাগ আছে নখের গোড়ায়। চোখের তারা ফেটে বেরিয়ে রয়েছে। জিভ দাঁতের চাপে কেটে গেছে। দেখলে মনে হয়, গলা টিপে খুন করা হয়েছে ওকে। অথচ ফরেনসিক এক্সপার্ট ডঃ মহাপাত্র–উনিও দৈবাৎ এখানে বেড়াতে এসেছেন, বলেছেন–গলায় কোনরকম দাগ নেই। এক হতে পারে আচমকা কিছু দেখেটেখে ভয় পেয়ে মারা পড়েছে। দুই-বিষাক্ত কিছু ইনজেকশান করা হয়েছে। যেহেতু অন্য কোথাও সিরিঞ্জের ছুঁচের দাগ দেখা যাচ্ছে না, ডঃ মহাপাত্রের ধারণা, কড়ে আঙুলের ওই দাগটা সম্ভবত ইনজেকশানের চিহ্ন। কিন্তু তাতেও কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না উনি। দাগটা ওভাবে চেরা হল কেন? ছুঁচের দাগ তো গোল হবে!

চিত্রিতার তিন বন্ধু কী বলছে? তারা তো একই ঘরে ছিল।

 সেও এক অদ্ভুত ব্যাপার। রুমটা ডরমিটরি চারসিটের। আগামী পরশু অব্দি বুক করেছিল ওরা। অথচ গতরাত্রে ঝড়বৃষ্টির ঠিক এক ঘণ্টা আগে মানে রাত আটটা নাগাদ সন্ধ্যা, শ্রীলেখা আর বেবি ওফফে সেলিনা হঠাৎ চেক-আউট করে চলে যায়। বেয়ারা বা বয়দের মতে, গতকাল কী নিয়ে ওদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হচ্ছিল। যাবার আগেও নাকি তিনজনে খুব শাসিয়ে যায় চিত্রিতাকে দেখে নেবে বলে। ঘনশ্যাম নামে বয়টা বাইরে দাঁড়িয়ে শুনেছে বলছে।

তাহলে ওদের তিনজনকেই পুলিশ গ্রেফতার করবে।

একজ্যাক্টলি। সম্ভবত হাওড়া স্টেশনেই ওদের ধরে ফেলবে পুলিশ। কারণ রেডিওবার্তা চলে গেছে যথারীতি। গাড়ি হাওড়া পৌঁছচ্ছে সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ। কিন্তু…।

 কিন্তু কী কর্নেল?

আমার প্রাজ্ঞ বন্ধুটি হতাশভাবে মাথা দোলালেন।…কিন্তু মার্ডার উইপন বা যা দিয়ে খুন করা হয়েছে, তা কী হতে পারে? জয়ন্ত, আমি যুক্তিবাদী মানুষ। ভূতপ্রেত তন্ত্রমন্ত্র ডাইনী এসবে আমার একতিল বিশ্বাস নেই। কিন্তু ফরেন্সিক পরীক্ষায় যদি মার্ডার উইপেনটা কী ছিল, বের না করা সম্ভব হয়, তাহলে কি আমাকে ডাইনীতন্ত্রে বিশ্বাস করতে হবে?

কর্নেল, কর্নেল! আপনি তখন ম্যাকবেথের তিন ডাইনীর কথা বলছিলেন!

হা! সেটাই অদ্ভুত ব্যাপার, জয়ন্ত। গতকাল সন্ধ্যায় যখন আমি তোমাকে বিদায় দিয়ে নদীর ওপারে গেলুম, তখন ব্যাপারটা দেখি। ওই ক্যামেরাটা জীবজন্তুদের পায়ে চলার পথের পাশে একটা গাছে ফিক্সড রেখে শাটারের সঙ্গে কয়েক রিল সুতো টান টান করে পথের ওপর বিছিয়ে রেখেছিলুম। উদ্দেশ্য স্পষ্ট। কোনো জানোয়ার ওপথে এলেই তার পায়ে লেগে সুতোয় টান পড়বে, অমনি শাটার তার কাজ করবে অর্থাৎ তার ছবি উঠি যাবে ফিল্মে। পদ্ধতিটা অটোমেটিক। একবার শাটার টেপা হলেই ফিল্ম গুটিয়ে যাবে, নতুন ফিল্ম আসবে লেন্সের সামনে। দৈবাৎ সুতো ছিঁড়ে না গেলে এভাবে অনেকবার অনেক জন্তুর ছবি তোলা সম্ভব। তবে মজার কথা, ক্যামেরাটা অদ্ভুত। এতে পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা আছে। এর ইলেকট্রনিক সিসটেম অন্ধকারেও ছবি তুলতে পটু। আলো ছাড়া ছবি হয় না। কিন্তু আলোর মাত্রা আছে জয়ন্ত। তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য অনুসারে তার দৃশ্যতা অদৃশ্যতার ব্যাপার আছে। আমাদের জীবচক্ষে অনেক আলোক দেখা সম্ভব হয় না। কিন্তু…

বাধা দিই।…প্লিজ, প্লিজ! ম্যাকবেথের ডাইনী!

 হুম্। ক্যামেরা তৈরি রেখে ফিরে আসছিলুম। নদীর চড়ায় কাশঝোঁপ আছে দেখেছ। একটা কাশঝোঁপের আড়াল থেকে কাদের চাপা কথাবার্তার আওয়াজ পেলুম। থমকে দাঁড়ালুম। আমার টর্চের আলো ওরা দেখতে পায়নি–কারণ। পাড়ের ঝোঁপ থেকে নিচে চরে নামা অব্দি আলো পায়ের কাছে ফেলছিলুম। ওদিকটায় নাকি হ্যাঁমাড্রায়াড় সাপের রাজত্ব। তো থমকে দাঁড়াতেই টের পেলুম ওরা কারা। চাপা গলায় ওরা কথা বলছিল। ইতিমধ্যে সাদা বালির চরে তারার আলো পড়ে চকচক করছে, আর ততক্ষণে আমার চোখে দৃষ্টিও অন্ধকারে দিব্যি স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে–দেখলুম ডরমিটরির সেই মেয়েরা তিনজন। ওরা একটা কিছু পরামর্শ করছে মনে হল। তারপর ওরা হয়তো আকাশের দিকে তাকিয়েই ঝড়বৃষ্টির কথা তুলল। একজন বলল–ঠিক এখানেই। হ্যাঁ এখানেই। তারপর তিনজনে চলতে থাকল। একটু পরেই ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে ওদের হারিয়ে, ফেললুম। কিন্তু তখন ম্যাকবেথের ডাইনীদের কথা মনে পড়ে গেছে আমার। হোয়েন শ্যাল উই মিট এগেন–থানডার লাইটনিং অর ইন রেন? অদ্ভুত জয়ন্ত, অদ্ভুত!

আমার ধারণা ছিল, কর্নেল সরকার খুনের গন্ধ পেলেই তো হামলে পড়েন, কাজেই যাঃ, আমাকে একজন চমৎকার নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হারিয়ে একা ঘুরতে, হবে! কিন্তু আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, উনি পুলিশের ওদিকে পা বাড়ালেন না।

বাইরে গিয়ে একটা ওয়েসাইড আমব্রেলা কাফেতে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে নিলুম। তারপর বেলা একটা অব্দি পাহাড় বনবাদাড় চষে বেড়ালুম। পাতালেশ্বরীর ভূগর্ভস্থ মন্দির, আদিবাসী রাজা পিনটা আকসুর দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, পবিত্র ঝরনা, বাবা মুক্তকচ্ছানন্দের আশ্রম, অনেক কিছু দেখা হল। আমার বৃদ্ধ বন্ধু ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব থেকে শুরু করে তার সাম্প্রতিক হবি ওরিনথোলজি বা পক্ষীতত্ত্ব নিয়েও ওই ক’ঘণ্টা যা বকবক করলেন, তাতে তার পল্লব-গ্রাহীতায় তাক লেগে গেল। বলাবাহুল্য, তার ফাঁকে বাইনাকুলার ও ক্যামেরার কাজও তিনি টুকটাক সেরে গেলেন। অবশেষে আমরা গেলুম মেনকা নদীর চরে। মাথার ওপর জোরালো সূর্য থাকায় চড়ার বালিতে অদৃশ্য ধোঁয়া টের পাচ্ছিলুম! কিন্তু উনি দমলেন না। কাশঝোঁপগুলোর পাশে হঠাৎ বিভ্রান্তের মতন এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে থাকলেন, গতিক দেখে কিনারায় একটা হলুদ গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলুম। এক জায়গা থেকে ওঁর কণ্ঠস্বর শোনা গেল–জয়ন্ত, কুইক।

ওঁকে কয়েক মিনিটের জন্য হারিয়ে ফেলেছিলুম। ডাক শুনে এগিয়ে দেখি, খড়খড়ে একটা কাশঝোঁপের বৃত্ত যেখানে, হাঁটু গেড়ে উনি সেখানে কিছু দেখছেন। আমি ক্লান্ত, ক্লান্ত এবং ক্লান্ত। উঁকি মেরে বললুম–বুঝেছি! হাড়ে গোয়েন্দাগিরির পোকা গিজগিজ করছে যার, তার পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখিত–খুবই দুঃখিত স্যার। এ সব আর রোদে পোষাবে না আমার। আমি চললুম। হে প্রাজ্ঞ বৃদ্ধ, অ রিভোয়া!

জয়ন্ত, জয়ন্ত। এক মিনিট। এই সেই তিন ডাইনির রেঁদেভু।

 সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু আপনি কী ক্ল পেতে চান এখানে?

বিরক্ত হয়ো না, ডার্লিং! প্লিজ! দেখে যাও, সামথিং ইজ রেকর্ডেড হেয়ার।

কাল রাতে প্রচণ্ড ঝড়জল হয়ে গেছে কর্নেল, মাইন্ড দ্যাট।

সেটাই তো একটা ফ্যাক্টর। ঝড়জলের আগে যারা এখানে এসে কিছু জল্পনা করছিল, তাদের পায়ের দাগ আমি মোটেও খুঁজিনি। ঝড়জলের পরে কেউ এসেছিল নাকি, তাই দেখছি। এবং জয়ন্ত, পশ্য পশ্য, হাউ নেচার রেকর্ডস দা হিউম্যান অ্যাকটিভিটিজ!

হুঁ কর্নেল, জুতোর ছাপ মনে হচ্ছে।

দ্যাটস রাইট। ছাপগুলো লক্ষ্য করো। একই সাইজের একই রকম নকশা। তার মানে একজনই এসেছিল। বৃষ্টি থামে রাত একটা নাগাদ। সকালে রোদ পড়ার আগেই এখানকার মাটি যা শোষক, সবটুকু সিক্ততা উবে যেতে বাধ্য। কাজেই, আমরা সিদ্ধান্ত রাত একটা থেকে ভোর ছটার মধ্যে কোনো এক সময় কেউ এখানে এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু কেন?

আমি কোনো কথা বললুম না। রোদ অসহ্য লাগছিল। কর্নেল নিজের মনেই ফের বলতে থাকলেন–ডঃ মহাপাত্রের ধারণা, উনি একজন ডাক্তারও বটে, চিত্রিতার মৃত্যু হয়েছে ঝড়জল যখন চলছিল, তখন। অর্থাৎ রাত এগারটা থেকে একটার মধ্যে। তাহলে…

এবার বলে উঠলুম–তাহলে তিন ডাইনির পক্ষে চিত্রিতাকে হত্যা করা তো অসম্ভব। কারণ, ওদের গাড়ি বরমডিহি স্টেশন ছেড়ে যাবার কথা রাত নটায়। পুলিশ ওদের কচুও করতে পারবে না দেখবেন।

গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালেন গোয়েন্দাপ্রবর। টুপি খুলে সস্নেহে টাককে কয়েক সেকেন্ড বায়ু সেবন করিয়ে তারপর বললেন–পুলিশের ধারণা, চিত্রিতাকে ওরা বিষ খাইয়ে মারার ব্যবস্থাটা আগেই সেরে গিয়েছিল। কিন্তু ডঃ মহাপাত্র বলছেন–বিষটা দিল কিসে? রাতে খায়নি চিত্রিতা। ক্লিন বারণ করা ছিল। বিকেল থেকে সে বেরোয়নি, ঘরেই সারাক্ষণ ছিল–এ হচ্ছে হোটেলের বয়দের সাক্ষ্য। এখন রইল তরল কিছু আহার্য–অর্থাৎ জল, চা বা কফি। চা-কফি হোটেল থেকে সরাসরি দেওয়া হয়। বাকি রইল জল। গ্লাসের জল পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়েছে। তবে ডঃ মহাপাত্রের মতে–জলটা চমৎকারই আছে। কোনো রঙবদল ঘটেনি। আপাতদৃষ্টে বিশুদ্ধ। অবশ্য পরীক্ষার ফলাফলে কী বেরোয় কে জানে! কিন্তু জয়ন্ত, কড়ে আঙুলের ব্যাপারটা তাহলে কী?

কর্নেল, চললুম! জ্বলে যাচ্ছি একেবারে।

চিন্তিত মুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃদ্ধ এগোলেন।

আমরা একটা মাদ্রাজি হোটেলে খাওয়া সেরে হরগৌরীতে ফিরলুম, তখন আড়াইটে। ফিরে দুজনে স্নানটা সেরে নিলুম। তারপর আমি শুয়ে পড়লুম। দেখলুম, কর্নেল বাথরুমে ঢুকলেন ক্যামেরা আর ওয়াশ-ডেভালাপ করার সরঞ্জাম নিয়ে। ওটাই তিনি ডার্করুম করে ফেলেছেন। অদ্ভুত ওঁর কাজকারবার!

.

সেদিন রাতেই হরগৌরী আবার সচল হয়ে উঠল। কর্নেল তার অভ্যাস মতো জঙ্গলে ক্যামেরা পেতে রেখে এসেছেন, ঘুমিয়ে ছিলাম বলে আজও ডাকেননি আমাকে। ডিনার খেতে ডাইনিং হলে গিয়েছিলুম। দেখলুম, প্রত্যেকটি মুখে উদ্বেগের ছাপ রয়েছে। দক্ষিণের ব্লক থেকে অনেকেই কেটে পড়েছে। নিচের পূর্ব-দক্ষিণ কোনার ডরমিটরির দরজায় তালা এঁটে পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। আমরা দুজনে অন্যদের মতো ফিসফিস করে আলাপ করছিলুম। বিষয়ঃ পশুপতিবাবু। হোটেলের একটা বদনাম হল। বেচারা ঘাবড়ে গেছেন।

খেয়ে আমরা লনে নামলুন। আজ রাতটা পরিষ্কার। আকাশে তাজা নক্ষত্র ঝকমক করছে। সেই সময় পশুপতিবাবু এলেন।…কর্নেল সরকার, ক্ষমা চাইতে এলুম।

কর্নেল ওঁর একটা হাত নিয়ে বললেন–কেন, কেন? ক্ষমা চাওয়ার কী আছে?

খুব অসুবিধে হল আপনার। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। বয়-বেয়ারা বাবুর্চি তাবৎ লোকজন আপসেট হয়ে পড়েছিল। বুঝতেই পারছেন, ওদের সব হাজারটা কুসংস্কার!

কুসংস্কার। কর্নেল একটু চমকালেন যেন।

বছর দুই আগে অবিকল একইভাবে একজন মারা যায় ও-ঘরে।

বলেন কী!

হা স্যার! এক মাদ্রাজি ব্যবসায়ী এসে ও-ঘরে উঠেছিলেন। তখন ডরমিটরি ব্যবস্থা ছিল না। ডবলবেড রুমই ছিল ওটা। ভদ্রলোক সিঙ্গলরুম নেননি। কারণ, পরদিন ওঁর পার্টনার আসার কথা ছিল নাকি। যাই হোক, ভুতুড়ে ঘর বলে বদনাম রটল। তখন ওটা ডরমিটরি করে ফেললুম।

একই সিম্পটম মৃতদেহে ছিল?

আজ্ঞে। তবে এঁর কড়ে আঙুলটা ফোলা, ওঁর ছিল চিবুকটা ব্লাডারের মতন। ফোলা।

পুলিশকে আপনি বলেছেন একথা?

বলেছি। পুলিশ ওসবে পাত্তা দিল না। ডঃ মহাপাত্র অবশ্য আগ্রহ দেখালেন। কিন্তু শেষে বললেন–নেহাত কাকতালীয় ব্যাপারও হতে পারে। কিন্তু…’ হঠাৎ চুপ করে গেলেন ভদ্রলোক। আবহাওয়া এবং ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেলেন। আমার কেমন খটকা লাগল।……

কর্নেলকে সেরাত্রে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে টের পেলুম, উনি ব্যালকনিতে পায়চারি করছেন আর অভ্যাসমত চুরুট টানছেন।

আমার ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে সাতটায়। বেড-টি খাওয়ার পর বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি গোয়েন্দামহোদয় ফিরেছেন এবং যথারীতি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাকড়সার জাল, ঝুল ইত্যাদি জিনিস গভীর নিষ্ঠায় ব্রাশ দিয়ে সাফ করছেন।

মুখ না ঘুরিয়ে উনি বলেন, জয়ন্ত, আশা করি চমৎকার ঘুমিয়েছ।

চমৎকার! কিন্তু আপনার সম্ভবত বড় একটা খারাপ রাত্রি গেছে।

দ্যাটস রাইট, ডার্লিং।

 কেন কর্নেল?

পশুপতিবাবু কী একটা চেপে গেলেন কাল রাতে তুমি কি লক্ষ্য করেছিলে?

নাঃ!

 হা। জাস্ট অ্যান আইডিয়া! মেয়ে চারটির ব্যাপারে মনে হচ্ছে কিছু একটা জানেন। বলবেন ভেবেই আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন কিন্তু কী ভেবে আর বললেন না।

ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পর আমি ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুম। কর্নেল ঢুকলেন তাঁর ডার্করুমে। ঘণ্টাখানেক পরে হঠাৎ ওঁর চাপা উত্তেজনাসঙ্কুল কণ্ঠস্বর শুনলাম–জয়ন্ত, জয়ন্ত, ডার্লিং!

উঠে গেলুম। দেখি ওঁর হাতে সদ্য ওয়াশকরা একটা ছবির প্রিন্ট। ছবিটা দেখেই চমকে উঠলুম। আরে এ যে দেখছি পশুপতিবাবু! আশ্চর্য! জায়গাটা সেই নদীর চড়ার কাশবন না? ওখানে কী করছেন ভদ্রলোক?

কর্নেল উদ্বিগ্নমুখে বললেন–ক্যামেরাটা আজ কাশবনের দশমিটার দূরে হলুদ গাছটায় রেখেছিলুম। কিন্তু, কী হরিবল দৃশ্য! হাতে টর্চ…পশুপতিবাবু।

বলেই আবার উনি বাথরুমে গিয়ে ঢুকলেন এবং দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি হাঁ করে একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর প্রচণ্ড বিরক্তিতে ফের ব্যালকনিতে চলে গেলুম। প্রকৃতি ছাড়া মানুষের এমোশান আর কেই বা প্রশমিত করতে পারে?……

.

আজ বড্ড একা হয়ে গিয়েছিলুম। গোয়েন্দামহোদয় ফের একা বেরিয়ে ছিলেন। আমাকে ডেকে যাননি বলে অভিমানে চুপচাপ শুয়েছিলুম। তো উনি ফিরলেন একবারে লাঞ্চের সময়। আমরা দুজনেই নিজ নিজ কারণে গম্ভীর। ডাইনিং হলে পশুপতিবাবুর সঙ্গে দেখা হল। তিনিও দেখলুম, বেজায় গম্ভীর।

বিয়ারের গ্লাস শেষ করে হঠাৎ কর্নেল বলে উঠলেন–হ্যালো ডঃ মহাপাত্র! আরে মিঃ প্রসাদ যে! হ্যালো হ্যালো হ্যালো!

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি বড় দরজায় জনা তিনচার পুলিশ অফিসার আর ধূসর স্যুটপরা লম্বা-চওড়া সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক কর্নেলের দিকে সমবেত ভঙ্গিতে বাও করছেন।

আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন কর্নেল। তারপর আমরা বেরোলুম। দলটা এগোল সেই অকুস্থলের দিকে। প্রৌঢ় ওঁফো পুলিশ সুপার মিঃ প্রসাদকে দেখলুম কর্নেল সাহেবকে প্রচণ্ড সমীহ করে চলেছেন। হঠাৎ এই সদলবলে বকেয়া অভিযানের পিছনে কি আমার ধুরন্ধর সঙ্গীটির হাত আছে?

ডরমিটরির ভেতর ঢুকলুম আমরা। চার কোনায় চারটে সিঙ্গল খাট, চারটে টেবিল, একটা ড্রেসিং টেবিল, আর পূর্ব-দক্ষিণ কোণের দিকে একটা বিশাল চমৎকার সাদা নকশাকাটা ফুলদানি রয়েছে। তাতে মিইয়েপড়া বাসি ফুলের একটা তোড়া রয়েছে। পাতার কাঁপ দিয়ে সুন্দর সাজানো হয়েছিল সেটা। এখন মৃত্যুর চাপা গন্ধে তারা ঘর ভরে দিয়েছে। নসিয়ায় আক্রান্ত করার পক্ষে পরিবেশটা খুব উপযুক্ত।

পাশেই যে খাটটা, সেখানেই চিত্রিতার লাশ ছিল। এখন শূন্য পড়ে আছে। কর্নেল চারদিকটা ঘুরেফিরে দেখার পর সেই খাটের কাছে গেলেন। খুব খুঁটিয়ে কী সব দেখলেন। তারপর ফুলদানিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। ওঁর দৃষ্টিতে তীব্র একটা সন্দেহ জ্বলজ্বল করতে দেখলুম।

ডঃ মহাপাত্র বললেন-এনিথিং অ্যাবসার্ড?

কর্নেল ঘুরে হাসলেন কিন্তু কিছু বললেন না। সেখান থেকে সরে আবার ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত হলেন কিছুক্ষণ। আবার ফুলদানিটার কাছে গেলেন। ওঁর চোখে এবার একটা সংশয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ডঃ মহাপাত্র এবার সকৌতুকে বললেন–কর্নেল সরকারের মতে ফুলদানিটা নিশ্চয় একটা চমৎকার অ্যান্টিক দ্রব্য!

মিঃ প্রসাদ মন্তব্য করলেন–মনে হচ্ছে জাপানি ফুলদানি!

এর ফলে পশুপতিবাবু ফুলদানির ইতিহাস শোনাতে শুরু করলেন। কর্নেলের তাতে কান আছে মনে হল না। তিনি হাঁটু দুমড়ে চিত্রিতার খাটের নিচে কী দেখছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন–হুম! এরকম আধখানা ব্লেড দিয়ে মেয়েরা নখ কাটতে পটু। তারপর পকেট থেকে একটা আতস কাঁচ বের করে মেঝে দেখতে দেখতে ফের বললেন–কড়ে আঙুলটাই কি কেটে ফেলেছিল চিত্রিতা? হুম, দ্যাটস রাইট। রক্তের কয়েকটা ক্ষীণ ফোঁটা দেখা যাচ্ছে। আর নখের কুচিও দেখছি অজস্র।

এবার উঠে দাঁড়ালেন কর্নেল। হঠাৎ পশুপতিবাবুর মুখোমুখি গিয়ে শান্তভাবে প্রশ্ন করলেন–ইয়ে, পশুপতিবাবু–আপনি গতরাত্রে এবং আগের রাত্রে ঝড়জলের পর নদীর চড়ায় গিয়েছিলেন কেন?

ভদ্রলোক আচমকা প্রশ্নে অমনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে উঠলেন–আ– আ–আংটি খুঁজতে স্যার!

আমরা সবাই অবাক। কর্নেলের ঠোঁটে একটু হাসি ফুটল।… হুম্। তাই বটে। নিশ্চয় পাননি?

না না স্যার।

মিঃ প্রসাদ বলে উঠলেন-তাহলে কি ওই তিনজনের জবানবন্দী সত্যি?

কর্নেল জবাব দিলেন–নিখাদ সত্যি মিঃ প্রসাদ। আংটিটা শ্রীলেখার– একটা এনগেজমেন্ট রিং। এই নিয়ে ওদের বিবাদ বা ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল চিত্রিতার সঙ্গে। চিত্রিতা ওদের ফার্মের পারচেজ অফিসার সুব্রত রুদ্রকে ভালবাসত কিন্তু শ্রীলেখার সঙ্গে সুব্রতের এনগেজমেন্ট হওয়ায় সে মনে নিশ্চয় দুঃখ পেয়েছিল। তবে তার জন্য শ্রীলেখার ক্ষতি করতে সে চায়নি। শুধু দুষ্টুমি করে ওর আঙুল থেকে সম্ভবত ঘুমিয়ে থাকার সময় আংটিটা খুলে নেয় এবং কোথাও লুকিয়ে ফেলে। বোকা মেয়ে চিত্রিতাকেই তিনজনে এ ব্যাপারে সন্দেহ করে। কিছু বাদানুবাদ হয়েও ছিল। কিন্তু পরশু সন্ধ্যায় নদীর চড়ায় শ্রীলেখা সন্ধ্যা আর বেবি কী পরামর্শ করছিল? বলছিল–এখানে, হা–এখানেই। কী সেই রহস্য?

পশুপতিবাবু ফাঁচ করে হেসে বলে উঠলেন–সে আমারই পরামর্শে স্যার। বোর্ডারদের ব্যাপারে নাক গলানোর অভ্যেস নেই। কিন্তু হাজার হলেও ওরা সব মেয়ের বয়সী। তাই নিজে খোঁজখবর নিচ্ছিলুম। তো, ওদের ঝগড়াঝাঁটি শুনে বেমক্কা ব্যাপারটা জিগ্যেস করে বসেছিলুম। ওরা অবশ্য অফেন্ডেড হয়নি। বলল–একটা দামি আংটি হারিয়ে গেছে, তো স্যার, আমি দেখতুম–ওরা আসা-অব্দি নদীর চড়াতেই ঘোরাঘুরি করে বেশি। তাই মাথায় যা এল, বলে দিলুম, বিকেলে নদীর চড়ায় গিয়ে তো আপনারা দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন, তখন হারায়নি তো? শুনেই তিনজনে তক্ষুনি চলে গেল। তখন সূর্য ডুবছে সবে। খোঁজাখুঁজি করে ফিরল যখন, তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। যাই হোক, শ্রীলেখা এসে আমাকে বলে গেল–পাওয়া যায়নি। ওর ধারণা, নিজেদেরই কেউ সরিয়ে রেখেছে। তারপর তো স্যার, বুঝতেই পারছেন–স্ত্রীলোকের বিসংবাদ। সাত তাড়াতাড়ি তিনজনে ঝগড়াঝাটি করে চলে গেল। গিয়ে দেখি চিত্রিতা চুপচাপ একা বসে আছে। রাতে খাবে না বলল। আমি খুব কষ্ট পেলুম, স্যার। মেয়েটি নিশ্চয় চুরি করেনি। ওরা বিকেলে নদীর চড়াতেই হারিয়েছে। তাই যতক্ষণ ঝড়জল হল, ঘুম আর কিছুতেই এল না। চিত্রিতা খুব সরল চমৎকার স্বভাবের মেয়ে ছিল!

কর্নেল বললেন–তাহলে আপনি আর থাকতে না পেরে ঝড়জল থামামাত্র বেরিয়ে পড়লেন?

হা স্যার। কিন্তু খুঁজে পেলুম না। ফিরে এসে দেখি, চিত্রিতার ঘরের দরজা বন্ধ। আলো নেই। তাই আর ডাকলুম না। আহা, তখন যদি জানতে পারতুম যে দরজা ভেজানো আছে, আর হতভাগিনী খাবি খাচ্ছে!

কিন্তু রাতে ফের কেন গেলেন নদীর চরে?

কাঁচুমাচু সলজ্জ মুখে বললেন পশুপতিবাবু–দিনের বেলা সময়ও পাইনি– আর ওভাবে খোঁজাখুঁজি করব লোকের সামনে-কে কী ভাববে, তাই রাতেই গিয়েছিলুম।

কর্নেল মুখ টিপে বললেন।..ইয়ে পশুপত্বিাবু, আপনি তো এখনও ব্যাচেলার!

সবাই হেসে উঠল। আমি মনে মনে বললুম–লোকটির আলুর দোষ আছে। প্রচণ্ড। বোঝাই যায়, পুরুষালি চেহারার বিশাল মেয়েটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিল।

পশুপতিবাবু আরও লাজুক হেসে বললেন–চিত্রিতাকে আমি কিছুতেই চোর ভাবতে পারিনি। তাই স্যার, গত রাতে যখন কিছুতেই ঘুম এল না। অস্থির, হয়ে পড়লুম. আহা বিদূষী মেয়েটি মরে গিয়েও দোষী হয়ে থাকবে? তখন ঝোঁকের মাথায় ফের বেরিয়ে পড়লুম খুঁজতে। বরাবর এই ঝোঁকটা আছে, স্যার।

কর্নেল হেসে চাপা গলায় বললেন–র‍্যাদার একটা অবসেসনের ব্যাপার। আংটি আমাদের পশুপতিবাবুর কাছে একটা বাজিরার ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। ডু ইউ ফিল ইট ডঃ মহাপাত্র?

ডঃ মহাপাত্র সায় দিলেন মাথা নেড়ে। কর্নেল এবার করলেন কী, ফুলদানির ফুলের তোড়াটা তুলে জানালার ধারে রাখলেন। তারপর নিজের ডানহাতের আঙুলগুলোয় খুঁটিয়ে কী দেখে নিয়ে হাতটা পুরে দিলেন ফুলদানির ভিতরে এবং আমাদের তাজ্জব করে দিয়ে একটা ঝকঝকে সুন্দর সাদা পাথর বসানো সোনার আংটি বের করলেন। সবাই ঝুঁকে পড়লুম সেদিকে। তাতে খুদে হরফে কী নামটাই খোদাই করা আছে। খালি চোখে পড়া গেল না। আংটিটা কিন্তু কর্নেল জানলার ধারে রেখে গর্জে উঠলেন বেমক্কা-খবর্দার, কেউ ছোঁবেন না। পশুপতিবাবু, ডেটল চাই শিগগির। হাত পোব।

তক্ষুনি ডেটল আর জল আনা হল। ভাল করে হাত ধুয়ে কর্নেল এবার একটু হাসলেন। ডঃ মহাপাত্র ভুরু কুঁচকে তার দিকে তখনও তাকিয়ে রয়েছেন। তার ঠোঁট দুটো কাঁপছে মনে হল। গোঁফটাও তিরতির করে কাঁপছে বেড়ালের মতো।

গোয়েন্দাপ্রবর পকেট থেকে যথারীতি চুরুট বের করে জ্বাললেন। বুঝলাম এবার বেশ রিলাক্সিং মুড এসে গেছে ওঁর। হঠাৎ ডঃ মহাপাত্র লাফিয়ে উঠলেন–কর্নেল সরকার! ইউরেকা, ইউরেকা! তারপর কর্নেলকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো ঝাঁকুনি দিতে শুরু করলেন।…ওঃ হাউ ওয়ান্ডারফুল! আমি ভাবিনি ব্রাদার, একবারও এদিকটা ভাবিনি!

নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমার সঙ্গী বৃদ্ধ ঘুঘু বললেন–হা–ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। মিঃ প্রসাদ, তাহলে আপনার কেসের হত্যাকারীকে এবার গ্রেফতার করুন।

মিঃ প্রসাদ হন্তদন্ত হয়ে পশুপতিবাবুর দিকে এগোতেই কর্নেল মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাধা দিয়ে বললেন–না মিঃ প্রসাদ! দি মার্ডারার ইজ দেয়ার। আঙুল তুলে যে দিকটা দেখালেন, আমরা অবাক। দেয়ালের ওদিকে কোনো মানুষই যে নেই। গা শিউরে উঠল। এই প্রাক্তন যোদ্ধাটি ডাইনীদের কথা বলেছিলেন। কোনো অদৃশ্য ডাইনিকে কি তিনি প্রেফতার করতে বলছেন?

হতভম্ব হয়ে মিঃ প্রসাদ বললেন–কাকে প্রেফতার করব, কর্নেল?

কর্নেল ফের আঙুল তুলে বললেন–ওই ফুলদানিটাকে। হ্যাঁ, হি ইজ দা মার্ডারার। ওটাকে সাবধানে কিছুতে মুড়ে ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দিন।

ডঃ মহাপাত্র উসখুস করছিলেন কিছু বলার জন্যে। এবার ফাঁক পেয়ে বলে উঠলেন–হ্যাঁ। ফুলদানিটাই খুনী। ওর ভেতরে যে জল রয়েছে, তাতে কয়েক লক্ষ কোটি প্যাথোজেন গিজগিজ করছে। কাটা আঙুল ডুবিয়ে চিত্রিতা ওতে আংটি লুকোতে গিয়েই নিজের মৃত্যুকে ডেকে এনেছিল। চিত্রিতার শরীরে প্যাথোজেন পাওয়া গেছে। কিন্তু আমিও একটু ভাবিনি যে…।

কর্নেল কথা কেড়ে বললেন–ব্যাপার একসময় একটা মেডিকেল জার্নালে পড়েছিলুম। মিয়ামি স্কুল অফ মেডিসিনের দুই বিজ্ঞানী ডেভিড ট্যাপলিন আর প্যাটিওয়া মারজ মিয়ামির হাসপাতালে সারজিক্যাল ওয়ার্ডে কিছু অদ্ভুত ডেথকেস নিয়ে তদন্ত করেন। সামান্য অপারেশন, অথচ দেখা যাচ্ছিল পেসেন্টরা একের পর এক অদ্ভুতভাবে মারা যাচ্ছে। এই রহস্য নিয়ে বিস্তর গোয়েন্দার মাথা ঘুরে গেল। অবশেষে ওই দুই ভদ্রলোক আবিষ্কার করলেন যে একটি ফুলদানিই যত কাণ্ডের জন্যে দায়ী। তার জলে পাওয়া গেল বিপজ্জনক জীবাণু প্যাথোজেন। প্রতি মিলিমিটার জলে দশ মিলিয়ন করে প্যাথোজেন কলোনি গড়ে উঠেছে দেখা গেল। তার মধ্যে ছটা স্পেসি বড় সাংঘাতিক, মানুষের রক্তের সঙ্গে একটু সংযোগ ঘটলেই বারোঘণ্টার মধ্যে অ্যাকশন শুরু হয়। মৃত্যুর লক্ষণ একই রকম। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে অথবা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে মনে হয় আপাতদৃষ্টে। পশুপতিবাবু আমাকে আগের দিন বলেছিলেন, এক মাদ্রাজি ব্যবসায়ীও বছর দুই আগে এঘরে একইভাবে মারা পড়েন। শুনেই আমার সন্দেহ হয়েছিল এবং মিঃ প্রসাদকে খবর দিয়েছিলুম আসতে। মাদ্রাজি ভদ্রলোকের চিবুকের কাছটা ফোলা ছিল বলেছেন পশুপতিবাবু। বোঝাই যায়, বেচারার ইনফেকসন ঘটেছিল দাড়িকাটার পর। চিবুকে কেটে গিয়েছিল একটুখানি। তারপর যে-কোনোভাবে ফুলদানিটার সংস্পর্শে তিনি আসেন এবং প্যাথোজেন সংক্রামিত হয়।…

.

কিছুক্ষণ পরে ঘরে গিয়ে আমার প্রথম কাজটাই হল, ফুলদানিগুলো বের করে বাইরে হঠানো। কিন্তু তখন কর্নেল ফিরে এলেন। আমার কাণ্ড দেখে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকানোর পর বললেন, বাছা জয়ন্ত, ওই ফুলগুলো আমি স্পেশাল ফরমাসে আনিয়েছিলুম। এসব পাহাড়ী অর্কিডের গুচ্ছে সাজানো চমৎকার নীল ক্রিসেন্থিমাম ফুল এখানে সহজে মেলে না। তাছাড়া, ধৈর্য ধরে আমার সুপরিণত ঘিলুর কিঞ্চিৎ অবদান গ্রহণ করো। ফুলদানির জল প্রতিদিন আমি নিজের হাতে পাল্টাই এবং সবরকম অপকারী জীবাণুনাশক লোশন দু-চার ফোঁটা গুলে দিই। চিত্রিতার ঘরের জাপানি ফুলদানির জল একপক্ষকাল সম্ভবত পাল্টানো হয়নি বলেই প্যাথোজেন গজিয়েছে। কাজেই, তুমি ডার্লিং, এই অপকর্মটি কোরো না।

তারপর একটু কেশে এবং বাইরের দিকে তাকিয়ে ঘোষণা করলেন–আজ তোমাকে সেই হিমালয়ান মিনিভেট আর দুর্লভ উড্ডাকের দেশে নিয়ে যাব। শিগগির পোশাক পরে ফেলল। আজকের বিকেলটা বেশ সুদৃশ্য মনে হচ্ছে। কোনো ভ্রমণবিলাসীই ঘরে বসে থাকবে না। ডার্লিং তোমাকে আজ ডমরুপাহাড়ের চুড়ো থেকে সূর্যাস্তও দেখাব–আই প্রমিজ।…..

আমি বাধ্য ছেলের মতো ফুলদানি দুটো ঘরে এনে রাখলুম।