পাতাল-খন্দক – কর্নেল সমগ্র ২ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
সূত্রপাত
কানাজোল রাজ এস্টেটের মালিক রাজবাহাদুর বাপ্পাদিত্য সিং-এর দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে। ছেলে দুটি যমজ। একঘণ্টা আগে-পরে তারা ভূমিষ্ঠ হয়। প্রথমটির নাম রাখা হয় জয়াদিত্য, দ্বিতীয়টির নাম বিজয়াদিত্য। মেয়ের জন্ম আরও পাঁচ বছর পরে। তার নাম রাখা হয় জয়া। আশা ছিল রানী কুশলা পরের বারও কন্যা প্রসব করবেন এবং তার নাম রাখা হবে বিজয়া। কিন্তু তার আগেই কুশলা উৎকট হেঁচকি ওঠা রোগে মারা যান।
বাপ্পাদিত্যের মাথায় কেন কে জানে জয় শব্দটা ঢুকে পড়েছিল। হয়তো পার্শ্ববর্তী ভাণ্ডা এস্টেটের মালিক গৈবীনাথ ছত্রীবাহাদুরের সঙ্গে বারবার মামলায় হেরে গিয়েই।
কিন্তু জয়-বিজয়-জয়া তাকে বাকি জীবনে আর জেতাতে পারেনি। হতাশা আর ক্রমাগত ক্ষোভ-বিদ্বেষে স্বাস্থ্যভঙ্গ হতে হতে বাপ্পাদিত্য চোখ বোজেন। তখন জয়-বিজয়ের বয়স ষোল বছর আর জয়ার বয়স এগারো বছর। তারা নাবালক হওয়ার দরুন উইল অনুসারে কানাজোল এস্টেটের ট্রাস্টি ছিলেন নায়েব বিপ্রদাস মুখুয্যে। মুখুয্যেমশাই বাঙালি। শিক্ষাদীক্ষার পক্ষপাতী। জয় বিজয়-জয়াকে কলকাতার হোস্টেলে রেখে লেখাপড়া শেখান। জয় তত মেধাবী, ছিল না। বি-এটা কোনোক্রমে পাশ করে কানাজোল ফিরে যায়। বিজয় এম-এ পাশ করেছিল। আর জয়া বি-এ পড়ার সময় শরদিন্দু নামে এক বাঙালি যুবকের প্রেমে পড়ে। যুবকটি ছিল ব্যাংকের কেরানি। জয়াকে গোপনে বিয়ে করার কিছুদিন পরে নাকি ব্যাংকের ক্যাশ হাতিয়ে সে ফেরার হয়ে যায়। জয়া পুরো ঘটনা গোপন রেখেছিল। কিন্তু মনে দারুণ আঘাত পেয়ে সে বি-এ পরীক্ষার আগেই পড়াশোনা ছেড়ে দেশে ফেরে। মুখুয্যেমশাই তখন আর ট্রাস্টি নেই। কিন্তু নীতিগত কারণে রাজপরিবারের অভিভাবক থেকে গেছেন। জয়-বিজয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে জয়ার বিয়ে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু জয়া জোর গলায় জানিয়ে দেয়, সে চিরকুমারী থাকবে। কারণ তার বাবা-মা দুজনেই স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাকে চিরকুমারী থাকার আদেশ দিয়েছিন। এদিকে জয় ও বিজয় নিজেদের বিয়ের ব্যাপারে খুব অনুৎসাহী। দুজনেই শুধু বলেছিল, দেখা যাক। মুখুয্যেমশাই ও কথার অর্থ বুঝতে পারেননি। তবে জয়া ছিল ছোটবেলা থেকেই তেজী আর দুর্দান্ত প্রকৃতির মেয়ে। কৈশোর-যৌবনের সন্ধিকাল থেকে সে। কিছুদিন শান্ত ও অমায়িক হয়ে উঠলেও কলকাতা থেকে ফিরে যাবার পর আবার পুরনো স্বভাব ফিরে পায়। তার মধ্যে কিছু পুরুষালি হাবভাবও ছিল। খেলাধুলো, দৌড়ঝাঁপ, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো–এসবে তার দক্ষতা ছিল। সে দাদাদের গ্রাহ্য করত না। ছোড়দা বিজয় তো নম্র স্বভাবের মানুষ। বইপত্র নিয়ে ডুবে থাকে। কবিতা লেখে। গঙ্গার ধারে টিলাপাহাড়ে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। সবসময় তাকে কেমন উদাসীন আর ভাবুক বলে মনে হয়। তাকে জয়ার আমল না দেওয়ারই কথা। কিন্তু জয় একেবারে বিপরীত। তার সঙ্গে জয়ার স্বভাবের বাইরে বাইরে বিস্তর মিল থাকলেও সে ভেতর-ভেতর ভিতু প্রকৃতির। ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। মুখে বড় বড় কথা এবং হাঁকডাক তার যথেষ্টই, কিন্তু ভেতরে সাহসের অভাব। একবার ভাণ্ডা এস্টেটের মালিক এবং তাদের চিরশত্রু গৈবীনাথ ছত্রীবাহাদুরকে মুখের ওপর অপমান করে এসে কিছুকাল আর বাড়ি থেকে বেরুতেই সাহস পেত না। বাড়ির ছাদে ছোট ছেলের মতো ঘুড়ি ওড়াত। কখনও পায়রা ওড়াত। তার এই একটা অদ্ভুত নেশা পাখি জন্তুজানোয়ার পোর। বাগানের আউট হাউসে, গঙ্গার ধারে উঁচু টিলার ওপর সেই বাড়িটা প্রমোদের জন্য বানিয়ে ছিলেন বাপ্পাদিত্য। সেটাকে একটা চিড়িয়াখানা বানিয়ে নিয়েছিল জয়। সেখানে ছিল একটা চিতাবাঘ, একটা হায়েনা, একটা হরিণ, একটা ময়াল সাপ আর অনেকরকমের পাখি। একটা নিউগিনির কাকাতুয়াও ছিল। জয় মাঝেমাঝে তাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরত। পরে তার মাথায় শিরে বাজ পোষা এবং তাই দিয়ে পাখি ধরার নেশা চাগিয়ে ওঠে। সে রাজস্থান থেকে একটা বাজপাখি পর্যন্ত আনিয়েছিল। পাখিটা পরে মারা যায়।
জয়া বড়দা জয়কেই সামান্য গ্রাহ্য করত। তবে সবসময় নয়। কিন্তু বৃদ্ধ নায়েব মুখুয্যেমশাইকে জয়া ভক্তিবশেই অগ্রাহ্য করতে পারত না। পারত না। জয়ও। আর বিজয় তো নম্র প্রকৃতির এবং সাদাসিধে ধরনের যুবক। সে মুখুয্যেমশাইকে বাবার মতোই দেখত।
জয়-বিজয়ের বয়স যখন বত্রিশ আর জয়ার সাতাশ বছর, তখন এক বর্ষার রাত্রে সদর দরজার দিকে হইহল্লার শব্দ শোনা গেল। ঝিরঝির করে সারাদিন বৃষ্টি ঝরছে। রাত্রেও টিপটিপ করে ঝরার বিরাম নেই। জয় মাতাল অবস্থায় নিঃসাড় ঘুমোচ্ছিল। বিজয় তার ঘরে শুয়ে টেবিল বাতির আলোয় কবিতা লিখছিল আর জয়া তত জেগেই থাকে। প্রথমে তারই কানে গিয়েছিল হইহল্লার শব্দটা। সে দোতলার উত্তরের একটা ঘরে থাকে এবং পশ্চিমে বাড়ির ফটক। তার কানে এল, কেউ তার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে।
অমনি তার বুকটা ধড়াস করে উঠল। গলার স্বর চেনা মনে হয়েছিল জয়ার।
সে নীচে হন্তদন্ত নেমে এসে দেখল, হলঘর বা ড্রয়িংরুমের দরজার পর্দা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ঝামেলা দেখছে কলাবতী আর রঙ্গিয়া–তারা মা মেয়ে রাজবাড়ির দাসী। জয়াকে দেখে তারা মুখ টিপে হাসল। জয়া তাদের সরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। দেখল, বিশাল হলঘরটার বাইরের দরজার মুখে দারোয়ান নছি সিং আর চাকর, বুদ্বুরাম একটা লোককে ঠেলে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। মুখুয্যেমশাই গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। জয়াকে দেখে চমকে উঠে বললেন, “আঃ জয়া!”
জয়া চমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মেঝের মাঝামাঝি গিয়ে। বাঁদিকের কোণে সেকেলে সোফাসেট উল্টে রয়েছে। কয়েকটা চেয়ারও পড়ে আছে এদিকে ওদিকে। জীর্ণ কার্পেটও একপ্রান্তে অনেকটা উল্টে রয়েছে। ঘরে যেন তুমুল একটা লণ্ডভণ্ড ঘটে গেছে। কাঁচের ঝাড়ের ভেতর সেট-করা বিদ্যুৎ-বাতিগুলো কম পাওয়ারের। তবু জয়ার চিনতে ভুল হল না। সে এগিয়ে গিয়ে নছি সিং আর বুদ্বুরামের কাঁধ দুহাতে খামচে দুপাশে সরিয়ে দিল। তারপর লোকটার মুখোমুখি দাঁড়াল।
লোকটার ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছিল। শার্টটা গলার কাছ থেকে বুক পর্যন্ত ফালাফালা। তার প্যান্টে প্রচুর জলকাদা লেগে আছে। একপায়ে জুতো নেই ধস্তাধস্তির সময় ছিটকে কোথায় চলে গেছে। সে জয়াকে দেখে হাসবার চেষ্টা করছিল।
জয়া কয়েক মুহূর্ত তাকে নিষ্পলক চোখে দেখার পর ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল, “এস”।
সে জয়ার পেছন পেছন যখন ভেতরে যাচ্ছে, মুখুয্যেমশাই গলা ঝেড়ে নিয়ে ডাকলেন, “জয়া!”
জয়া ঘুরে তাঁর চোখে চোখ রেখে বলল, “আমার স্বামী”।
মুখুয্যেমশাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নছি সিং আর বুদ্বুরাম পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফাঁক করে রইল। ভেতরের দরজার পর্দার দুপাশে কলাবতী * আর রঙ্গিয়া পুতুলের মতো প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বারান্দার চওড়া সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল বিজয়। জয়া আর যুবকটিকে দেখে সে অবাক হয়ে বলল, “কী রে জয়া?”
জয়া আস্তে বলল, “আমার স্বামী।” তারপর যুবকটির দিকে ঘুরে বলল, “আমার দাদা কুমার বিজয়াদিত্য নারায়ণ সিং।”
যুবকটি বিজয়ের পা ছুঁতে গেলে বিজয় ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে কয়েক-পা সরে গেল। তখন যুবকটি আহত স্বরে বলল, “প্রণাম নিলেন না দাদা? আমার নাম শরদিন্দু রায়। জয়া কলেজে পড়ার সময় আমরা বিয়ে করেছিলুম। রেজিস্টার্ড বিয়ে, দাদা! ডকুমেন্ট দেখতে চাইলে–”
জয়া তাকে ঠেলতে ঠেলতে নিজের ঘরে নিয়ে গেল।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে জয়া প্রথমে তার গালে আচমকা ঠাস করে একটা চড় মারল। শরদিন্দু হাসবার চেষ্টা করে বলল, “মারো! তুমি রাজকন্যা, আমি রাস্তার লোক। মারবে তা তো জানি! তৈরি হয়েই এসেছি। প্রথমে দারোয়ান মেরেছে, এবার তোমার পালা।”
জয়া হিসহিস করে বললে, “কোথায় ছিলে এতদিন?”
শরদিন্দু মুখ নামিয়ে বলল, “জেলে”।
জয়া বলল, “ব্যাংকের টাকা চুরি করেছিলে কেন?”
শরদিন্দু মাথা সামান্য দুলিয়ে বলল, “আমি টাকা চুরি করিনি।”
“চুরি করোনি, অথচ খামোকা তোমাকে জেলে যেতে হল? বাজে কথা বোলো না!” জয়া একটু চুপ করে থেকে ফের বলল, “না করলে তুমি গা ঢাকা দিয়েছিলে কেন?”
“প্রাণের ভয়ে।”
“তার মানে?”
শরদিন্দু করুণ হাসল। “আশ্চর্য! আমার এ অবস্থা দেখেও তুমি জেরা করতে পারছ, জয়া? কাপড়চোপড় বদলাতে দাও। একটু বিশ্রাম নিই। আর শোনো, যদি পারো, আগে অন্তত এক কাপ চা খাওয়াও। আমার প্রচণ্ড খিদেও পেয়েছে।”
জয়া ঠোঁট কামড়ে ধরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। একটা শ্বাস ফেলে সে বেরিয়ে গেল। বাইরে সে চড়া গলায় রঙ্গিয়াকে ডেকে চায়ের কথা বলল। তারপর ফিরে এসে আলমারির মাথা থেকে ফার্স্ট এডের বাকসোটা নামাল। বাথরুম দেখিয়ে দিয়ে বলল, “যাও–আগে পরিষ্কার হয়ে এস।…”
কিছুক্ষণ পরে শরদিন্দু মোটামুটি ফিটফাট হয়ে বসলে জয়া তার কাটা ঠোঁটে ওষুধ লাগিয়ে প্লাস্টার সেঁটে দিল। ইতিমধ্যে রঙ্গিয়া চা দিয়ে গেছে এবং তাকে খাবার আনতে বলেছে জয়া। চা খেতে খেতে শরদিন্দু একটু হেসে বলল, “তোমাদের দারোয়ানটা বড্ড বদরাগী। ডাকাডাকি শুনে বেরিয়ে এসে জিগ্যেস করল আমি কে, এত রাতে কেন এসেছি–তো যেই বলেছি আমি রাজবাড়ির জামাই, অমনি ব্যাটা আমার মুখে আড়াই কিলো ওজনের একটা ঘুসি বসিয়ে দিল।”
জয়া গম্ভীর মুখে বলল, “তুমি চিরদিন বড় বোকা। এবার বলো, টাকা না চুরি করলে কেন গা ঢাকা দিয়েছিলে–তাছাড়া মিছিমিছি তোমাকে জেলে যেতে হল কেন? আর কেনই বা তুমি আমাকে সেকথা জানালে না?”
শরদিন্দু পকেট থেকে বেড়ানো একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলল, “লজ্জায়। তুমি কী-ভাবতে!”
“আশ্চর্য তোমার লজ্জা তো!” জয়া ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকার পর ফের বলল, “আজ হঠাৎ এভাবে আমার কাছে আসতে তোমার লজ্জা হল না–অথচ এই পাঁচটা বছরে অন্তত একটা চিঠি লিখতেও লজ্জা হল! আমি বিশ্বাস করি না।”
শররদিন্দু জেল থেকে বেরিয়ে আজই চুল-দাড়ি কামিয়েছিল। তাকে জয়া আগের তুলনায় সুন্দর আর স্বাস্থ্যবান দেখছিল। হয়তো জেলে থাকলে মানুষের শরীরে একটা রূপান্তর ঘটে যায়। শরদিন্দু বলল, “তখন তোমাকে বলেছিলাম নেহাত প্রাণের ভয়ে।”
“বুঝলাম না!”
শরদিন্দু একটু চুপ করে থেকে চাপা স্বরে বলল, “আশা করি তোমার সঙ্গে আমার শেষবার দেখার তারিখটা মনে আছে। ১৭ আগস্ট, সন্ধ্যাবেলা। সেদিন শনিবার ছিল। ম্যাটিনি শো দেখে দুজনে পেটপুরে ধোসা খেলুম। তারপর তুমি গেলে তোমার হোস্টেলে। আমি ফিরলুম মেসে। ফিরেই একটা বেনামী চিঠি পেলাম। চিঠিতে লেখা ছিল, আমি যেন পরদিন সকালে কলকাতা ছেড়ে চলে যাই। কলকাতায় থাকলেই আমাকে প্রাণে মেরে ফেলা হবে।”
“তুমি পুলিশের কাছে গেলে না কেন? আমাকেই বা জানালে না কেন?”
“ভয়ে মাথার ঠিক ছিল না। তাছাড়া পুলিসকে কিছু জানাতে নিষেধ করা হয়েছিল চিঠিতে। আমি পরদিনই বর্ধমানে আমাদের বাড়ি চলে গিয়েছিলুম। ২১ আগস্ট বাইরে থেকে ঘুরে বাড়ি ফিরে শুনি, আমার খোঁজে পুলিস এসেছিল। এদিকে কাগজে খবর বেরিয়েছে, ফেডারেল ব্যাংকের ক্যাশ থেকে তিন লক্ষ আশি হাজার টাকা উধাও। ব্যাংকের এক কর্মী বেপাত্তা। বোঝো কী অবস্থা! সঙ্গে সঙ্গে আমি বেনামী চিঠির রহস্য বুঝে গেলুম। কিন্তু সব চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, সেই চিঠিটা বের করে দেখি, একেবারে শাদা কাগজ মাত্র। কালিতে লেখা হরফ উবে গেছে।”
জয়া দমআটকানো গলায় বলল, “তারপর?”
“আমার আত্মরক্ষার কোনো উপায় নেই দেখে গা ঢাকা দিলুম। কলকাতা যাওয়ার সাহস তো আর ছিলই না। জব্বলপুরে মামার বাড়ি কিছুদিন, তারপর বোম্বেতে এক বন্ধুর বাড়ি–শেষে দিল্লি চলে গেলুম। দিল্লিতে”।
জয়া বাধা দিয়ে বলল, “তুমি কানাজোলে আমাদের বাড়ি চলে এলে না কেন?”
শরদিন্দু একটি ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “কোন মুখে আসব? কাগজে তখন ব্যাংক চোর ফেরারী আসামি শরদিন্দু রায়ের নামে হুলিয়া ছাপানো হয়েছে। দিল্লিতে পুলিস আমাকে অ্যারেস্ট করেছিল। মাসখানেক কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে মামলা চলার পর পাঁচ বছর জেলের হুকুম হল। হাজতে থাকার সময় খুব আশা করতাম, তুমি অন্তত কাগজ পড়ে জানবে এবং দেখা করতে আসবে। অন্তত এখন যেমন কৈফিয়ত চাইছ, তেমনি কৈফিয়ত চাইতেও. হাজতে ছুটে আসবে ভেবেছিলুম। তুমি আসনি।”
জয়া শ্বাস ফেলে বলল, “আমি কিছু জানতুম না। কারণ তখন আমি কলকাতা ছেড়ে চলে এসেছি। তবে কলকাতায় থাকার সময় কাগজে একদিন দেখেছিলুম ফেডারেল ব্যাংক থেকে টাকা চুরির খবর। একটু সন্দেহ হয়েছিল তোমাকে–কারণ তুমি নিপাত্তা। তবে এতখানি ভাবিনি। বিশ্বাস করিনি, তুমি সত্যি টাকা চুরি করেছ।”
শরদিন্দু একটু হেসে বলল, “করলে ভালই হত দেখছি। দিব্যি জেল খেটে এসে এখন সে-টাকায় বাবুগিরি করা যেত।”
জয়া আস্তে বলল, “তোমাকে ফাঁদে ফেলেছিল কেউ, কিন্তু কাউকে তোমার সন্দেহ হয়নি?”
শরদিন্দু আস্তে বলল, “বুঝতে পারিনি–এখনও পারি না। কলেজ স্ট্রিট ব্রাঞ্চের ক্যাশ ডিপার্টে আমার কলিগ ছিল চারজন। ভূপেশ, মণিশংকর, গোপাল নায়ার নামে একজন কেরলি–তাকে খুব সৎ মনে হত, আর ছিল পরিতোষ। সবাই আমার সমবয়সী। পরস্পর বন্ধুত্বও ছিল। তবে আমার সন্দেহ পরিতোষই আমাকে বিপদে ফেলেছিল।”
জয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দেখি, তোমার খাবার ব্যবস্থা করল নাকি…”
.
অন্ধ প্রজাপতি
কর্নেস নীলাদ্রি সরকার ইলিয়ট রোডে অবস্থিত ‘সানি লজ’ নামে তিনতলা। বাড়িটির ছাদে তার প্ল্যান্টওয়ার্ল্ডে’ একটি ফুলবতী অর্কিডের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন। কদিন বৃষ্টির পর আজ সকাল থেকে আকাশ পরিষ্কার। সবে সূর্য উঠেছে। শরতকালের সকালের রোদ কলকাতায় স্বরূপ হারিয়ে ফেলে, আবহমণ্ডলের যা দুরবস্থা! কর্নেল ভাবছিলেন এই নীল-লাল অর্কিডফুল আগুনের মতো দেখাত। মনে পড়ছিল, গত শরতে ভীমগোলা জঙ্গলে এই অর্কিডের ফুল দেখেছিলেন–যেন জঙ্গল দাউদাউ জ্বলছে মনে হচ্ছিল। কলকাতা কী যে হয়ে … গেল দিনে দিনে!
ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ সিঁড়ির মাথায় মুখ বের করে বলল, “বাবামশাই! এক ভদ্রলোক এয়েছেন।”
কর্নেল তার দিকে না ঘুরেই বললেন, “ধুতি-পাঞ্জাবি-জহর-কোট। কাঁধে কাপড়ের থলে। চোখে কালো চশমা। মুখে দাড়ি।”
ষষ্ঠীর দাঁত বেরিয়ে গেল। “আজ্ঞে, আজ্ঞে!”
“মাথায় বড় বড় চুল। ফর্সা রঙ। খাড়া নাক।” বলে কর্নেল ঘুরলেন তার দিকে।
এবার ষষ্ঠী হাঁ করে ফেলেছে। তার চোখ বড়ো হয়ে গেছে। কর্নেল হাতের খুরপিটা রেখে গ্লাভস খুলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। মুচকি হেসে বললেন, “আমার চোখের দৃষ্টি দেয়াল-কংক্রিট সব ফুড়ে চলে যায়। কাজেই ষষ্ঠী, সাবধান! তাছাড়া তুই একটু আগে আবার প্রজাপতিটাকে ধরে পরীক্ষা করে দেখছিলি যে আমার কথা সত্যি কি না- তার মানে প্রজাপতিটা সত্যিই কানা কি না।”
এ পর্যন্ত শুনে ষষ্ঠী জিভ কেটে বলল, “না, না। শুধু একটুখানি ছুঁয়েছিলাম। দেখতে বড় ভাল লাগে না বাবামশাই? কিন্তু আপনি কথাটা আন্দাজেই বলছেন। কেমন করে জানলেন, আগে শুনি?”
মাঝেমাঝে ষষ্ঠী কর্নেলকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, “ওরে হতভাগা! তোর আঙুলে প্রজাপতিটার ডানার রঙ মেখে আছে-ওই দ্যাখ!”
“ওঃ হো!” ষষ্ঠী তার আঙুল দেখে লাফিয়ে উঠল। একগাল হেসে বলল, “আপনার নজর আছে বটে বাবামশাই! কিন্তু ওই ভদ্রলোককে দেখতে পেলেন কী করে?”
কর্নেল মৃদু হেসে চাপা গলায় বললেন, “একটু আগে ওই নিমগাছ থেকে একঝাঁক কাক এসেছিল। তাড়াতে গিয়ে দেখলুম, নিচের রাস্তায় এক ভদ্রলোক বাড়ির দিকে তাকিয়ে উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। ছাদের কার্নিশে আমাকে দেখতে পেয়েই রাস্তা পেরিয়ে আসতে থাকলেন হন্তদন্তভাবে। কাজেই…”
ষষ্ঠী তারিফ করে বলল, “ওরে বাবা! আপনার সবদিকেই চোখ!..”
একটু পরে কর্নেল গার্ডেনিং-সুট ছেড়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকে নমস্কার করে বলে উঠলেন, “আশা করি, কানাজোল রাজবাড়ির ছোট কুমারবাহাদুরকে দেখছি।”
আগন্তুক বিজয় ভীষণ অবাক হয়ে বলল, “আশ্চর্য তো!”
কর্নেল একটু হেসে বললেন, “কিছু নয় কুমারবাহাদুর। এযুগে খবরের কাগজে দূরকে কাছে আর অচেনাকে চেনা করে দেয়।”
বিজয় বলল, “হ্যাকাগজে খবর বেরিয়েছিল বটে! কিন্তু যে ছবিটা ছাপা হয়েছিল, তাতে তো আমি ছিলাম না। আমার দাদা জয়ের ছবি ছিল, চিতাবাঘটার খাঁচার পাশে দাঁড়ানো। আমার অবাক লাগছে এই ভেবে যে, দাদাকে দেখে আমাকে চেনা তত কঠিনই। কারণ আমার মুখে দাড়ি আছে। আমরা যমজ ভাই হলেও
কর্নেল তাকে থামিয়ে নিজের শাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, “আমাকে অহংকারী ভাববেন না কুমারবাহাদুর! প্রকৃতি কোনো দুর্বোধ্য কারণে আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে সাধারণ মানুষের চেয়ে তীক্ষ্ণ করে দিয়েছেন। কোনো মানুষের মুখতা সে ছবিতেই হোক, আর বাস্তবে, যদি কোনো কারণে আমার লক্ষ্যবস্তু হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সেই মুখের একটা পৃথক ফিচার বলুন বা বৈশিষ্ট্য বলুন, আমার দৃষ্টির ফিল্টারে হেঁকে তার নিখুঁত নিজস্বতা নিয়ে স্মৃতিতে ঢুকে যায়। আপনার দাদার মুখের সেই পৃথক নিজস্বতা স্মৃতিতে এখনও টাটকা বলেই আপনাকে দেখামাত্র সনাক্ত করে ফেলেছি। তাছাড়া খবরসহ কাগজে বেরিয়েছে মাত্র গত সপ্তাহে। ছবিতে বড় কুমারবাহাদুরের মুখে দাড়ি ছিল না। দ্বিতীয়ত, যিনি চিতাবাঘ বা জন্তুজানোয়ার পোষেন, যিনি শিকারী এবং স্বাস্থ্যচর্চাও করেন, তিনি ধুতি-পাঞ্জাবি-জহরকোট পরে অমায়িকভাবে সোফায় বসে থাকবেন বলে বিশ্বাস করা যায় না। যাই হোক, এবার বলুন কুমারবাহাদুর, আপনার জন্য কী করতে পারি?”
বিজয় সপ্রশংস চোখে তাকিয়ে বলল, “দয়া করে আমাকে কুমারবাহাদুর বলবেন না। বিজয় বলে ডাকলে খুশি হবো। আমাকে তুমি বললে আরও ভাল লাগবে।”
ষষ্ঠী কফি ও স্ন্যাকসের প্লেট রেখে অভ্যাসমতো আগন্তুককে আড়চোখে দেখতে দেখতে ভেতরে চলে গেল এবং অভ্যাসমতোই পর্দার ফাঁকে একটা চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইল ডাইনিং ঘরের দরজার ওপাশে।
কর্নেল এটা জানেন। তাই চোখ কটমটিয়ে সেদিকে তাকালে ষষ্ঠি সরে গেল। কর্নেল বিজয়ের হাতে কফির পেয়ালা তুলে দিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, “মর্গের রিপোর্টে তো বলেছে চিতার নখের আঘাতেই মৃত্যু। খবরের কাগজে পড়ে যেটুকু জেনেছি, তাতে মনে হচ্ছে, সেটাই সম্ভব। তাছাড়া তোমার ভগ্নীপতি শরদিন্দুবাবুর পেটে নাকি অ্যালকোহলও পাওয়া গেছে। মাতাল । অবস্থায় রাত দুপুরে গিয়ে চিতার খাঁচা খুলে দিয়েছিলেন নাকি। তাহলে আর সন্দেহ কিসের?”
বিজয় কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “জয়া বিশ্বাস করে না। জয়া–আমাদের একমাত্র বোন।”
“কাগজে তোমাদের পারিবারিক পরিচয় বেরিয়েছিল। পড়েছি।”
“হ্যাঁ স্ক্যান্ডাল রটানোর সুযোগ পেলে আজকাল খবরের কাগজ মেতে? ওঠে।” বিজয় দুঃখিত হয়ে বলল।…”জয়া-শরদিন্দুর ব্যাপারটা নিয়ে কেচ্ছার চূড়ান্ত করেছে। শরদিন্দু ব্যাংকের টাকা চুরি করে জেল খেটেছিল, তাও লিখেছে। লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে।”
“জয়া কেন বিশ্বাস করে না যে স্বামীর মৃত্যু চিতার আক্রমণে–”
বাধা দিয়ে বিজয় বলল, “জয়া খুব জেদী। তার মাথায় একটা কিছু ঢুকলে তাই নিয়ে চূড়ান্ত করে ছাড়ে।”
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, “মাথায় তোমারও সম্ভবত কিছু ঢুকে থাকবে। তা নাহলে তুমি ছুটে আসতে না।”
বিজয়কে একটু চঞ্চল ও উত্তেজিত দেখাল। চাপা স্বরে বলল, “শরদিন্দুর মৃত্যু নিয়ে আমারও সন্দেহ আছে। তবে আমি আরও এসেছি দাদার ব্যাপারে।”
কর্নেল সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, “হু–বলো!”
“দাদা কিছু দিন যাবৎ মনমরা হয়ে গেছে। জিগ্যেস করলে বলে, বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। তার নাকি সবসময় মনে হচ্ছে, সুইসাইড করে ফেলবে।”
“তোমাকে তাই বলছে বুঝি?”
“হ্যাঁ। কিছু জিগ্যেস করলে পরিষ্কার কোনো জবাব দেয় না। খালি বলে, দেখবি বিজয়, কখন আমি সুইসাইড করে বসেছি।”
“জয়া জানে এ কথা?”
“না। জয়া দাদার সঙ্গে কথা বলে না। কারণ দাদা চিতাটাকে মেরে ফেলতে চায়নি।”
“তুমি ছাড়া আর কাউকে বলেছে সে?”
“না। আর কাউকে বলতে নিষেধও করেছে।”
কর্নেল হাসলেন। কিন্তু আমি তো সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার নই। আমার কাছে, কেন এসেছ?”
বিজয় আরও চাপা স্বরে বলল, “পরশু অনেক রাতে একবার বেরিয়েছিলুম ঘর থেকে। আমি রাত দুটো অব্দি জেগে লেখাপড়া করি। কবিতা লেখার নেশা আছে। তবে কোনো কাগজে ছাপতে পাঠাই না। নেশায় লিখি। তো একটা লাইন লিখে পরের লাইনটা কিছুতেই মাথায় আসছিল না। তাই ভাবলুম, . একবার গিয়ে খোলামেলায় দাঁড়াই। রাতের আকাশ দেখে যদি পরের লাইনটা মাথায় আসে। সিঁড়িতে নামার মুখে দাদার ঘরের জানালায় আলো দেখে একটু অবাক হলুম। দাদা রাত্রে মদ খায়। তারপর নেশার ঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে। অবশ্য মাতলামি করে না কখনও। কিন্তু দাদার ঘরে আলো দেখে তারপরই আমার আতঙ্ক হল, সুইসাইড করে ফেলল নাকি–তা না হলে আলো কেন এখনও?? দরজার কাছে যেতেই কানে এল, দাদা কার সঙ্গে যেন চাপাগলায় কথা বলছে। ভীষণ অবাক হয়ে দরজার কড়া নেড়ে ডাকলুম ওকে। অমনি ঘরের আলো নিভে গেল। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে আর সাড়াই পেলুম না। আমার ডাকাডাকিতে জয়া তার ঘর থেকে বেরিয়ে জানতে চাইল, কী হয়েছে। ব্যাপারটা বললে সে বলল, “ছেড়ে দাও। শুয়ে পড়ো গে।” কিন্তু আমি তো ভুল শুনিনি। যাই হোক, দক্ষিণের বাগানে দাঁড়িয়ে আছি, সবে শুক্লপক্ষের চঁদটা উঠেছে, সেই ফিকে জ্যোৎস্নায় দেখলুম, দাদার ঘরের ও পাশের ব্যালকনির লাগোয়া ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে কেউ নেমে যাচ্ছে। ওদিকটায় গিয়ে চেঁচিয়ে বললুম “জয় নাকি?” লোকটা জবাব না দিয়ে জোরে নামতে থাকল। তারপর বাগানের দিকে দৌড়ে চলে গেল। তখন আচমকা মনে পড়ল, দাদার ম্যাস্টিক কুকুরটা এই ব্যালকনিতে বাঁধা থাকে। সে কেন চুপচাপ আছে? যাই হোক, সকালে দাদাকে ব্যাপারটা জিগ্যাস করলে বলল, “কই! আমি তো কিছু জানি না। ছপেগ হুইস্কি টেনে বেঘোরে ঘুমোচ্ছিলুম”… তাহলে দেখুন কর্নেল, ব্যাপারটা বড় রহস্যময় কি না।”
শুনতে শুনতে কর্নেল অভ্যাসমতো পর্যায়ক্রমে টাক ও দাড়িতে হাত বুলোচ্ছিলেন এবং চোখদুটি ছিল বন্ধ। হঠাৎ উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ডানপাশে একটা র্যাকের মাথায় টবে রাখা একটা ফুলন্ত সিন্থেসিয়া লতার ওপর। তারপর কী একটা ধরে ফেললেন খপ করে। গর্জন করে ডাকলেন, “ষষ্ঠী! অ্যাই হতচ্ছাড়া!”
বিজয় হকচকিয়ে গিয়েছিল কাণ্ড দেখে। চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল। ষষ্ঠীর সাড়া পাওয়া গেল না। কর্নেল গজগজ করছিলেন, “তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল, ব্যাটাচ্ছেলে একটা গণ্ডগোল বাধিয়েছে। ওতে আঙুলে ছোপ দেখেও তলিয়ে ভাবিনি। আসলে আমার মন তখন বিজয়ের সঙ্গে আলাপের জন্য ব্যগ্র! হতভাগা বাঁদর! উল্লুক!”
বিজয় বলল, “কী হয়েছে কর্নেল?”
কর্নেল তার হাতে ধরা একটা প্রজাপতি দেখিয়ে বললেন, “ভাগ্যিস এসব প্রজাপতি জন্মান্ধ। আর ফুলের টবটা এখানে ছিল। নইলে দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে ঠিক জানালার খোঁজ পেত আর উড়ে চলে যেত। ষষ্ঠী নিশ্চয় কাঁচের খাঁচার ঢাকনা খুলেছিল। রোস, দেখাচ্ছি মজা!”
বিজয় বলল, “কর্নেল! প্রজাপতিটা পালিয়ে গেলেও ক্ষতি ছিল না। কানাজোলে গঙ্গার ধারে টিলাপাহাড়ের ঝোপে অবিকল এইসব প্রজাপতি প্রচুর দেখেছি। তবে ওরা অন্ধ, তা জানি না।”
কর্নেল কোনার দিকে সচ্ছিদ্র কাঁচের খাঁচায় প্রজাপতিটা ঢুকিয়ে রেখে এসে বললেন, “এই প্রজাপতি প্রকৃতির এক বিস্ময়। চোখ নামে কোনো ইন্দ্রিয় এদের নেই। শুড় দিয়েই ঘ্রাণের সাহায্যে এরা উড়ে বেড়াতে পারে। কানাজোলে এসব– প্রজাপতি, সত্যিই কি তুমি দেখেছ?”
“মনে হচ্ছে। ডানার ওপরটা লাল, তলাটা কালো আর হলুদ, শুড়গুলো লম্বাটে–”
কর্নেল হাত তুলে তাকে থামিয়ে বললেন, “তাহলে তোমার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ব। তোমার দাদার রহস্যের চেয়ে প্রজাপতিগুলোর রহস্য আমার কাছে। অনেক বেশি জোরালো। তবে যাবার আগে যষ্ঠী হনুমানটাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে যাব।”
এতক্ষণে ষষ্ঠী নেপথ্য থেকে কঁদো কাদো গলায় বলল, “মরার মতো পড়ে আছে দেখে রেকজামিং করতে গিয়েছিলুম। আমার কী? এরপর কেউ মরে পড়ে থাকলে তাকিয়েও দেখব না। তখন যেন বলবেন না, কেন খবর দিসনি? কেনই বা রেকজামিং করিসনি?–, তখন আর বলতে আসবেন না যেন।”
কর্নেল হো হো করে হেসে উঠলেন। “না, না। রেকজামিং করবি বৈকি। তবে ঢাকনা খুলবিনে। সাবধান!”
বিজয় অবাক হয়ে বলল, “কর্নেল, রেকজামিং জিনিসটা কী?”
কর্নেল, আরও হেসে বললেন, “বুঝলে না? ওটা আমার ষষ্ঠীর ইংলিশ। একজামিন-পরীক্ষা-ষষ্ঠীর এমন অজস্র ইংলিশ আছে।”…
.
কালো মুখোশ
বিপ্রদাস মুখুয্যে রাজবাড়ির একতলায় ড্রয়িং রুম বা হলঘরের পাশের ঘরে থাকেন। চিরকুমার বলেই তাকে সবাই জানেন। বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। কিন্তু এখনও শক্তসামর্থ মানুষ। স্বপাক খান। নিত্য প্রাতঃভ্রমণের অভ্যাস আছে। সকালে বাইরে থেকে হাঁটাচলা করে এসে ঘরে ঢুকেছেন, এমন সময় জয়া এল।
জয়া বলল, “কাল রাত্তিরে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন কাকাবাবু। কিন্তু ভীষণ মাথা ধরার জন্য চুপচাপ শুয়েছিলুম। রাগ করেননি তো?”
বিপ্রদাস একটু হেসে সস্নেহে বললেন, “তোমার ওপর রাগ কখনও যে হয়নি, এমন কথা বলব না। তবে কাল রাত্তিরের জন্য রাগ করিনি। রঙ্গিয়া বলেছিল, তোমার শরীর খারাপ।”
জয়া আস্তে বলল, “কেন ডেকেছিলেন কাকাবাবু?”
বিপ্রদাস গম্ভীর হয়ে জানালার বাইরে মিনিটখানেক তাকিয়ে থাকার পর । বললেন, “তুমি কলকাতা থেকে একজন ডিটেকটিভ আনিয়েছ”
জয়া দ্রুত বলল, “ডিটেকটিভ! কে ডিটেকটিভ?”
“সে কী! তুমি–তাহলে যে বিজয় বলল, তুমিই বলেছিলে ওকে প্রাইভেট ডিটেকটিভ আনিয়ে শরদিন্দুর মৃত্যুর ব্যাপারটা তদন্ত করতে! তাই সে ওই ভদ্রলোককে নিয়ে এসেছে।”
জয়া অবাক হয়ে বলল, “ওই বুড়ো ভদ্রলোক বুঝি ডিটেকটিভ? ছোড়দা আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে সাম কর্নেল বলে। উনি নাকি রিটায়ার্ড মিলিটারি অফিসার। পাখিপ্রজাপতি এসব নিয়ে প্রচণ্ড হবি। কানাজোলে নাকি কানা প্রজাপতি আছে। তাই দেখতে এসেছেন। তবে কথাটা আমার বিশ্বাস হয়নি। প্রজাপতি কি কানা হয়?”
বিপ্রদাস হাসবার চেষ্টা করে বললেন, “কাল সন্ধ্যায় বিজয়ের সঙ্গে এসেছেন ভদ্রলোক। সামান্য আলাপ হয়েছে। তখন ভেবেছিলুম বিজয়ের পরিচিত উনি। কানাজোলে বেড়াতে এসেছেন ওর সঙ্গে। পরে বিজয় আমাকে চুপিচুপি বলল, ভদ্রলোক বিখ্যাত ডিটেকটিভ। তোমারই তাগিদে শরদিন্দুর ব্যাপারটা–যাই হোক, তুমি যখন কিছু জানো না, তখন বুঝতে পারছি, শরদিন্দুর মৃত্যু সম্পর্কে বিজয়ের মনে কোনো সন্দেহ আছে।”
“সন্দেহ তো আমারও আছে!” জয়া শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল। “কিন্তু সেজন্য গোয়েন্দা ডাকার কথা আমি ভাবিনি। ছোড়দা কেন মিথ্যে বলল আপনাকে? সত্যি কথাটা বলতে পারত।”
“হয়তো আমি ওকে বকব ভেবে তোমার নাম করেছে।”
“আমাকে বুঝি আপনি বকতে পারেন না?”
বিপ্রদাস একটু হাসলেন, “পারি। কিন্তু বকলেও তো তুমি আমার কথা শুনবে না। তাই বিজয় তোমার নাম করেছে। যাই হোক, এ নিয়ে আর মাথাব্যথা করে লাভ নেই। ছেড়ে দাও।”
জয়া একটু চুপ করে থেকে বলল, “ব্যাপারটা টের পেলে বড়দা ভীষণ রাগ করবে। আমার ভয় হচ্ছে, বড়দা ওই ডিটেকটিভদ্রলোককে না অপমান করে বসে।”
বিপ্রদাস গম্ভীর হয়ে বললেন, “হ্যাঁ–তাও ঠিক। আমার মতে, জয়কে কথাটা বোলো না। আমিও বলব না। আর বিজয়কেও নিষেধ করে দেব। ওকে একবার পাঠিয়ে দাও তো!”
“ছোড়দা কর্নেল ভদ্রলোককে নিয়ে বেরিয়ে গেছে ভোরে। এখনও ফেরেনি।”
বিপ্রদাস স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বললেন, “হু কানাপ্রজাপতি দেখাতে।”
জয়া চলে আসছিল। বিপ্রদাস হঠাৎ ডাকলেন, “জয়া শোনো!”
জয়া ঘুরে দাঁড়াল।
বিপ্রদাস একটু ইতস্তত করে বললেন, “আমি দুদিনের জন্য একটু ভাগলপুর যাব। জরুরি দরকার! একটা জিনিস তোমার কাছে রেখে যেতে চাই। জিনিসটা খুব দামি। তুমি গোপনে লুকিয়ে রাখবে। কেমন?”
জয়া মাথাটা একটু দোলাল, বলল, “আপনি কখন যাবেন?”
“এখনই।” বলে বিপ্রদাস তাঁর হাফহাতা পাঞ্জাবিটা তুলে কোটের কাছ থেকে একটা ছোট্ট কৌটো বের করে চাপা স্বরে বললেন, “এক্ষুনি লুকিয়ে ফেলো। সাবধান!”
জয়ার মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল। দম আটকানো তার হাত একটু-একটু কাঁপছিল। সে ভেলভেটমাড়া শক্ত এবং ছোট্ট কৌটোটা ব্লাউসের ভেতর চালান করে দিল।
বিপ্রদাস আস্তে বললেন, “ঠিক আছে লুকিয়ে রাখোগে। সাবধান!” বলে ব্যস্তভাবে একটা স্যুটকেস গোছাতে থাকলেন। জয়া বেরিয়ে এল ঘর থেকে। অন্দরমহলের ভেতরকার প্রাঙ্গণে ইঁদারা থেকে জল তুলছিল রঙ্গিয়া। সে জয়াকে লক্ষ্য করছিল না। কলাবতী রান্নাশালে বৈজু ঠাকুরের সঙ্গে কী নিয়ে তর্ক করছিল, তারাও লক্ষ্য করল না। রাজবাড়ি এই সকালে খুবই স্তব্ধ মনে হচ্ছিল। পায়রার বকবকম, কলাবতী-বৈজুর তর্ক, ইঁদারায় বালতির শব্দ সেই গভীর স্তব্ধতায় কোনো আঁচড় কাটতেই পারছিল না।
দোতলায় গিয়ে জয়া বড়দা জয়ের ঘরের দিকে তাকাল। জয়ের ঘরের দরজা বন্ধ। জয়ের এখন ‘চিড়িয়াখানায় থাকার কথা। নিজের ঘরে ঢুকে জয়া নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করল। তারপর তার ইচ্ছে হল, কৌটোটা খুলে দেখে নেয় দামি জিনিসটা কী। কিন্তু লোভ সংবরণ করল অতি কষ্টে। সে ঠোঁট কামড়ে ভাবতে থাকল, এটা কোথায় লুকিয়ে রাখবে।
জয়া গণ্ডগোলে পড়েছিল। যেখানে রাখতে যায়, মনে হয়, সেখানটা তত নিরাপদ নয়। আলমারির লকার, পুরনো আমলের সিন্দুক, দেয়ালের গুপ্ত তাক, পালঙ্কের শিয়রের তলার বাকসো,–কোনো জায়গাই তার মনঃপূত হচ্ছিল না।
ঠিক সেই সময় দরজায় কেউ টোকা দিল। অমনি জয়া ঝটপট কৌটটা আবার ব্লাউসের ভেতর লুকিয়ে ফেলল! রাত্রে হলে সে জিগ্যেস না করে দরজা খুলত না। কিন্তু এখন সকাল প্রায় নটা। তাছাড়া এভাবে তার দাদারাই দরজায় নক করে তাকে ডাকতে পারে, যদিও সেকথা জয়া সে-মুহূর্তে ভাবল না। সে বরং বিরক্ত হয়েছিল। কিছুটা খাপ্পাও হয়েছিল। সেই ঝেকেই দরজা খুলে দিল।
দরজার ভারী পর্দা ফাঁক করতে গিয়ে জয়া বুকে ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে এল। টাল সামলানোর মুহূর্তে সে লোকটাকে একপলক দেখে নিল। ছাইরঙা স্পোর্টিং গেঞ্জির ওপর কালো একটা কুৎসিত মুখোশ। ঘরের ভেতরটা আবছা বলে এক সেকেন্ডের জন্য এর বেশি কিছু দেখা সম্ভব হল না এবং পরের মুহূর্তে ঝাঝালো অথচ মিঠে একটা গন্ধ টের পেল জয়া। তারপর অতল শূন্যতায় তলিয়ে গেল সে।
.
বোবা কাকাতুয়া
গঙ্গার পাড় ধরে ছোট্ট টিলার ওপর রাজবাড়ির আউটহাউসে বা জয়ের চিড়িয়াখানার দিকে হেঁটে আসছিলেন কর্নেল আর বিজয়। ওদিকটায় রাজবাড়ির বাগানে ঢোকার ছোট্ট ফটকটা বহুকাল আগে বন্ধ রাখা হয়েছে। পাশে একখানে পাঁচিলের খানিকটা ধসে গেছে। বিজয় বলল, “দেখুন কর্নেল, এখানটা দিয়ে ঢুকতে পারবেন নাকি?”
কর্নেল প্রকাণ্ড মানুষ। এখন তার প্রশস্ত টাক ঢেকে ধূসর টুপি। গলায় বাইনোকুলার আর ক্যামেরা ঝুলছে। পিঠে ছোট্ট কিটব্যাগ আটকানো। হাতে ছড়ির মতো দেখতে প্রজাপতি ধরা জালের হ্যান্ডেল। চোখে সানগ্লাস। বিজয়ের পর কাত হয়ে পাঁচিলের ফোকর গলে ভেতর ঢুকতেই ঘ্রাউ ঘ্রাউ করে উঠল কোথায় একটা কুকুর। বিজয় চাপা গলায় বলল, “সর্বনাশ! দাদার কুকুরটা ছাড়া আছে দেখছি।”
কর্নেল দেখলেন, ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে টিলার আউটহাউস থেকে শাদারঙের লম্বাটে একটা কুকুর নেমে আসছে। বিজয় জোরালো শিস দিতে দিতে চেঁচিয়ে উঠল, “জয়! তোমার কুকুর সামলাও!”
কোনো সাড়া এল না। বিজয় বলল, “থাক কর্নেল! জয়ের চিড়িয়াখানায় পরে যাওয়া যাবে। চলুন, আমরা বাগানের ভেতর দিয়ে বাড়ি ফিরি।”
কর্নেল একটু হেসে পিঠের কিটব্যাগের চেন খুলে একটা টিউবের গড়নের শিশি বের করলেন। তারপর বললেন “এস বিজয়! তোমাকে একটা ম্যাজিক দেখাই।”
বিজয় ভয় পাওয়া গলায় বলল, “ওদিকে যাবেন না কর্নেল! সনি আমাকেও খাতির করে না। ও একটা সাংঘাতিক কুকুর।”
কর্নেল গ্রাহ্য না করে টিলায় উঠতে থাকলেন। টিলার গায়ে প্রচুর ঝোঁপঝাড়। কিন্তু তার মধ্যে অসংখ্য ঝোঁপ যে ফুল বা সৌন্দর্যের খাতিরে একসময় বাপ্পাদিত্য লাগিয়েছিলেন, তা বোঝা যায়। অযত্নে সেগুলো এখন জঙ্গল হয়ে গেছে। ভেতরে উঁকি মারছে এখনও কিছু ভাঙাচোরা ভাস্কর্যও। কোথাও-কোথাও নানাগড়নের পাথরও দেখা যাচ্ছে। কুকুরটা একলাফে সামনের একটা পাথরে এসে পৌঁছেছিল। তারপর কর্নেলের দিকে আঁপিয়ে এল। বিজয় একটু তফাত থেকে চেঁচিয়ে উঠল, “কর্নেল! চলে আসুন! চলে আসুন!”
তারপর সে দেখল, কর্নেল সেই টিউব-শিশির ছিপি খুলে এগিয়ে গেলেন। অমনি একটা মিরাকল ঘটে গেল যেন। কুকুরটা সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে গেল এবং লেজ গুটিয়ে কুঁউ-উ শব্দ করতে করতে উধাও হয়ে গেল। কর্নেল হাসতে হাসতে ঘুরে ডাকলেন, “চলে এস বিজয়!”
বিজয় দৌড়ে কাছে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “আশ্চর্য তো!”
কর্নেল টিউব-শিশিটা পিঠের কিটব্যাগে ঢুকিয়ে বললেন, “এই ওষুধটার নাম ফরমুলা সিনিক টোয়েন্টি–সংক্ষেপে ফরমুলা ২০। সিনিক কথাটা গ্রিক। সিনিক মানে কুকুর। যাই হোক, জয়ের প্রহরী সনিবাবাজি এরপর আমাকে দেখলেই : লেজ গুটিয়ে লুকিয়ে পড়বে।”
“জিনিসটা কী?”
“কিচ্ছু না! একরকম উৎকট দুর্গন্ধ। কুকুরের পক্ষে অসহ্য।”
চিড়িয়াখানার অংশটা এই ছোট্ট টিলার মাথায়। তারের জাল দিয়ে ঘেরা খানিকটা খোলা জায়গা। তার পেছনে তিনঘরের একতলা বাড়ি। ওপরে করগেটশিট চাপানো। কালো হয়ে গেছে শিটগুলো। মরচে ধরে ভেঙে গেছে। সে-সব জায়গায় টুকরো টিন বা খড় খুঁজে মেরামত করা হয়েছে।
বিজয়ের ডাক শুনে জয় কাঁধে তার প্রিয় কাকাতুয়া ‘রাজা’কে চাপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সনি’কে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। জয় সগর্বে বলল, “আসুন কর্নেলসায়েব! আমার জ্ঞ দেখুন।”
কর্নেলের সঙ্গে গত সন্ধ্যায় আলাপ হয়েছিল জয়ের। বিজয় বলল, “সনি তেড়ে এসেছিল। কর্নেল ভাগ্যিস”,
কথা কেড়ে জয় একটু হেসে বলল, “সনির তো সেটাই কাজ।”
“কিন্তু সনি দ্যাখো গে ভীষণ জব্দ হয়ে গেছে কর্নেলের পাল্লায় পড়ে।”
বিজয় হাসতে লাগল। জয় শিস দিল। তারপর সনিকে বারকতক ডাকাডাকি করে বলল, “সনির আজ মেজাজ ভাল নেই। যাক, গে, বলুন কর্নেলসায়েব, কেমন লাগছে আমার জ্যু?”
“অসাধারণ।” কর্নেল ঘুরে চারপাশটা দেখে নিয়ে বললেন। তারপর জিগ্যেস করলেন, “চিতাবাঘটা কোথায়?
“আসুন দেখাচ্ছি। বাহাদুরকে আজকাল ঘরবন্দি করেছি। বড্ড বেয়াদপি করছে।”
একটা ঘরের দরজায় তালা আটকানো। তালা খুলে জয় ভেতরে ঢুকল। পেছন-পেছন কর্নেল ও বিজয় ঢুকলেন। ঘরটা আন্দাজ বারোফুট-দশফুট। একপাশে মজবুত খাঁচার ভেতর চিতাবাঘটা চুপচাপ শুয়ে ছিল। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। কর্নেল খাঁচার কাছে গেলে চিতাটা খা খা শব্দে বিরক্তি প্রকাশ করে কোনায় সেঁটে গেল।
জয় বাঁকা মুখে বলল, “শরদিন্দু নিজের দোষে মারা পড়েছে। মদ তো আমিও খাই। কেউ বলতে পারবে না আমি মাতলামি করি। খাই, চুপচাপ শুয়ে পড়ি। ব্যস! আর শরদিন্দু মাতাল হয়ে আমার জুতে ঢুকে বাহাদুরের সঙ্গে ফাজলেমি করতে গিয়েছিল।”
“খাঁচা খুলে দিয়েছিলেন বুঝি শরদিন্দুবাবু?”
“হ্যা!”
“চিতাটা ওঁকে মেরে পালিয়ে যায়নি শুনলুম?”
“পালাবে কেন? পোষা চিতা। ফের খাঁচার ভেতর ঢুকে চুপচাপ বসে ছিল। কেউ কিচ্ছু টের পাইনি আমরা। ভোরে আমি এসে দেখি, শরদিন্দু ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে আছে খাঁচার পাশে। সঙ্গে সঙ্গে খাঁচার দরজাটা আগে আটকে দিলুম। তারপর–”
“রাত্রে যে শরদিন্দুবাবু বাড়ি ফিরলেন না, জয়া তার স্বামীর খোঁজ করেনি?”
“সেকথা জয়াকে জিগ্যেস করবেন।” জয় হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল। তারপর বিকৃত দৃষ্টে তাকিয়ে ফের চড়া গলায় বলল, “আপনি কে মশাই? আমাদের ফ্যামিলির ব্যাপারে আপনার দেখছি বড় কৌতূহল। কাল রাত একটায় দেখলুম, আপনি বাগানে ফোয়ারাটার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার এসব ভাল লাগে না। আপনি বিজয়ের চেনাজানা লোক এবং গেস্ট না হলে আপনি কর্নেলসায়েব হোন আর লেফটন্যান্ট জেনারেলই হোন, আমি ছেড়ে কথা কইতুম না।”
বিজয় বলে উঠল, “জয়! জয়! কাকে কী বলছ? ছিঃ!”
জয় ঢোক গিলে বলল, “সরি! আমাকে ক্ষমা করবেন কর্নেলসায়েব!”
কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন, “বিজয় আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন। তাকে আমি তুমি বলি। সেই কারণে তার দাদাকেও তুমি বলতে পারি কি?”
জয় তার মুখের দিকে শূন্য দৃষ্টে তাকিয়ে তখনই মুখটা নামিয়ে বলল, “নিশ্চয় পারেন।”
“তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে জয়।”
“কী কথা?”
কর্নেল বিজয়ের দিকে তাকালেন। বিজয় বলল, “আপনারা কথা বলুন। আমি বাইরে যাচ্ছি।”
সে বেরিয়ে গেলে কর্নেল বললেন, “তোমার এই কাকাতুয়াটি বেশ। বিজয় বলছিল এর নাম রেখেছে রাজা। নামটাও চমৎকার! রাজাকে কথা বলতে শেখাওনি কেন?”
জয় গলার ভেতর বলল, “আপনার কথাটা কী?”
কর্নেল একটু হাসলেন। “কাকাতুয়াটা কথা বলতে পারলে দারুণ হত। তাই না?”
জয়ের চোখদুটো জ্বলে উঠল। “এই কথা বলার জন্যই কি বিজয়কে সরে যেতে ইশারা করলেন?”
“হ্যাঁ।” কর্নেল এবার গলা চেপে খুব আস্তে বললেন, “রাজাকে যখন কিনেছিলে তখন কিন্তু সে বোবা ছিল না শুনেছি। হঠাৎ একদিন সে বোবা হয়ে যায় নাকি। তুমি
জয় আবার উত্তেজিত হল। বলল, “আপনি আবার নাক গলাচ্ছেন কিন্তু! কে আপনি?”
“জয়! প্লিজ! উত্তেজিত হয়ো না। রাজাকে তুমি নিশ্চয় এমন একটা কথা শেখাতে চাইছিলে, যেটা কারুর পক্ষে হয়তো বিপজ্জনক। তাই সে তোমার রাজাকে রাতারাতি অপারেশন করে বোবা করে দিয়েছিল। তাই না?”
জয় ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ। দিনকয়েক আগে ভোরে এসে দেখি রাজার মুখ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। ধড়ফড় করছে দাঁড়ে। ভেবেছিলুম মারা পড়বে। শেষে কুর্ডি জঙ্গল এলাকা থেকে এক আদিবাসী বদ্যিকে ডেকে পাঠালুম। তার চিকিৎসায় প্রাণে বেঁচে গেল। তবে গলা দিয়ে নিছক শব্দ করা ছাড়া কথা বলা ওর পক্ষে অসম্ভব। কোনো শুওরের বাচ্চা ওর জিভটা কেটে ফেলেছে।”
“কী কথা শেখাচ্ছিলে জয়?”
জয় একটু সরে গিয়ে বলল, “আপনি যেই হোন, বড্ড বেশি ট্রেসপাস করছেন কিন্তু।”
“জয়! আমি তোমাদের ভাইবোনের হিতৈষী।”
জয় অদ্ভুত হাসল। উদ্ভ্রান্ত একটা হাসি। বলল, “পৃথিবীসুদ্ধ সবাই কানাজোল রাজবাড়ির হিতৈষী। কিন্তু কোনো হিতৈষীর সাধ্য নেই এ রাজবাড়িকে বাঁচায়। এ বাড়ির ওপর পাপের ছায়া পড়েছে। প্লিজ, আমাকে আর ঘাঁটাবেন না। আমার মাথার ঠিক নেই।”
বলে সে জোরে বেরিয়ে গেল। তারপর গলা তুলে ডাকতে থাকল, “সনি! সনি! কোথায় গেলি? এই রাস্কেল! থাম, দেখাচ্ছি মজা!”
বিজয় তারের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। হরিণটা তার হাত শুকছিল। কর্নেলকে দেখে পিছিয়ে গেল। উল্টোদিকে হায়েনার খাঁচাটা দেখা যাচ্ছিল। হায়েনাটা পা ছাড়িয়ে শুয়ে ছিল। বিজয় একটু হেসে আস্তে বলল, “কী বুঝলেন?”
কর্নেল জবাব দিতে যাচ্ছেন, একটা লোক সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে চড়াই ভেঙে এদিকে আসছে দেখে বললেন, “ও কে, বিজয়?”
বিজয় দেখে নিয়ে বলল, “নানকু। ও দাদার এই চিড়িয়াখানার দেখাশোনা করে। খাবার আনতে গিয়েছিল বাজারে। কসাইখানা থেকে রোজ হাড়গোড় আর খানিকটা করে মাংস আনে। পাখিদের জন্য নিয়ে আসে কাংনিদানা, ছোলা, মটর এইসব।”
“নানকু কোথায় থাকে?”
“দাদার ঘরের ঠিক নিচে একটা ঘর আছে, সেখানে। তবে ও সারাদিন এই . জুতেই থাকে, শুধু খাওয়ার সময়টা ছাড়া।”
নানকু সাইকেলটা বেড়ার গেটের পাশে রেখে বিজয় ও কর্নেলকে সেলাম দিল। তারপর ব্যাকসিটে আটকানো চটের বোঁচকা আর রডে ঝোলানো একটা বাস্কেট খুলে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে চিড়িয়াখানা জুড়ে একটা সাড়া পড়ে গেল। হায়েনাটা উঠে দাঁড়াল এবং জিভ বের করে খাঁচার রডের ভেতর দিয়ে একটা ঠ্যাং বাড়িয়ে দিল। একজোড়া বানর গলার চেন টানটান করে একটা ছোট্ট গাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। হরিণটা বেড়ার বাইরে মুখ বাড়াল। একদল ক্যানারি পাখি তুমুল চেঁচামেচি জুড়ে দিল। ঘরের ভেতর থেকে চিতাবাঘের চাপা ঘঁও ঘাঁও গর্জন শোনা গেল।
বিজয় হাসতে হাসতে বলল, “প্রকৃতির জাগরণ। তাই না কর্নেল?”
কর্নেলও হেসে বললেন, “তুমি কবি। তোমার কাছে তাই মনে হওয়া উচিত। তবে আমার কাছে ক্ষুধার্তের কান্নাকাটি বলেই মনে হচ্ছে। সম্ভবত নানকু ওদের ঠিকমতো খেতে দেয় না।”
বিজয় চাপা স্বরে বলল, “নানকু এক নম্বর চোর–দাদাও জানে! যে টাকা দেয় নানকুকে, তার তিনভাগ নানকুর পকেটে যায়, সে আমি হলপ করে বলতে পারি।”
দুজনে কথা বলতে বলতে টিলার ঢাল বেয়ে একটা নালার ধারে এলেন। নালার ওপর কাঠের সাঁকো আছে। একসময় গঙ্গা থেকে এই নালা দিয়ে বাগানে সেচের জল আনা হত। রাজবাড়ির চৌহদ্দি পাঁচিল-ঘেরা। পাঁচিলের গায়ে ছিল সুইসগেট। সেটা কবে ভেঙে পড়েছে এবং বন্যা ঢোকার আশঙ্কায় নালার বুক থেকে পাঁচিল গেঁথে সীমানার পাঁচিলের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টির জলে নালাটা প্রায় বারোমাস ভরে থাকে।
কাঠের সাঁকোর ওধারে খোলামেলা ঘাসের জমি, অযত্নলালিত কিছু ফুল ফলের গাছ, তারপর রাজবাড়িটা। খিড়কির ফটকের কাছে পৌঁছুনোর আগেই হঠাৎ খিড়কির বড় কপাটের অন্তর্গত চোর-কপাট খুলে রঙ্গিয়া প্রায় দৌড়ে বেরুল। বেরিয়ে বিজয় ও কর্নেলকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তার মুখে আতঙ্ক লেগে আছে। বিজয় বলল, “কী রে রঙ্গি?”
রঙ্গিয়া হাঁফিয়ে বলল, “দিদিজি বেহেশ হয়ে পড়েছিল দরজার কাছে। অনেক করে হোশ হয়েছে। কথা বলতে পারছে না। বড়কুমারজিকে খবর দিতে বলল মা। তাই”
বিজয় বলল, “তোকে যেতে হবে না আর। চল, দেখি কী হয়েছে।”
রঙ্গিয়া দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে গেল। বিজয় চাপা স্বরে কর্নেলকে বলল, “নানকুটা খুব পাজি। রঙ্গিয়ার ওপর বড্ড লোভ। তাই যেতে দিলাম না।”
কর্নেল হঠাৎ বললেন “আচ্ছা বিজয়, কাকাতুয়াটাকে যেদিন কেউ জিভ কেটে বোবা করে দিয়েছিল, সেদিন কি নানকু জয়ের চিড়িয়াখানায় ছিল?”
বিজয় বলল, “জানি না। তবে ওর ব্যপারটা বলি শুনুন। নানকু আগে ছিল সার্কাসের দলে। ওর পরামর্শেই তো দাদা চিড়িয়াখানা করেছিল। সেসব প্রায় বছর পাঁচেক হয়ে এল প্রায়। আমি তখন কলকাতায় ছিলুম। দাদা তো আগেই চলে এসেছিল। তারপর এইসব করেছিল।”
“নানকুর দেশ কোথায়, জানো?”
“বলে তো সাহেবগঞ্জের লোক।”
দোতলায় সিঁড়ির মুখে গিয়ে কর্নেল ইতস্তত করছিলেন। বিজয় বলল, “আসুন, আসুন! জয়ার কী ব্যাপার দেখি। হঠাৎ কেন অজ্ঞান হল কে জানে!”
ওপরের বারান্দায় যেতেই কানে এল কলাবতী কাউকে ডাক্তার ডাকতে বলছে। বুদ্বুরাম গাল চুলকোতে চুলকোতে জয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল। বিজয়দের দেখে বলল, “দিদিজির তবিয়ত খারাপ। ডাক্তাররাবুকে ডেকে আনতে যাচ্ছি ছোটকুমার সাব!”
জয়ার ঘরের পর্দা তুলে বিজয় বলল, “কী হয়েছে, জয়া? মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলি শুনলুম। এই দ্যাখ, কর্নেলসায়েব তোকে দেখতে এসেছেন।”
ঘরের ভেতরকার কড়ামিঠে গন্ধটা কর্নেলের নাকে আচমকা ঝাঁপিয়ে এসেছিল। কর্নেল দ্রুত দরজার পর্দা টেনে দুপাশে সরিয়ে দিয়ে জয়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। জয়া হেলান দিয়ে পালঙ্কে বসে আছে। ফ্যানটা ফুল স্পিডে ঘুরছে মাথার ওপর। জয়ার চোখদুটো নিষ্পলক।…
.
বাড়ির নকশা
জয়া কিছুক্ষণ বিজয় বা কর্নেল কারুর কোনো প্রশ্নের জবাব দিল না। তারপর কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, “বিজয়, কলাবতী বা তার মেয়েকে বলো, এককাপ কড়া কফি নিয়ে আসুক।”
বিজয়ের কথায় ওরা চলে গেলে কর্নেল জয়ার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, “জয়া, তুমি কি জানো আমি কে?”
জয়া খুব আস্তে মাথাটা একটু দোলাল। বিজয় বলল, “আমি কিন্তু বলিনি ওকে। শুধু কাকাবাবু–মানে মুখুয্যেমশাইকে না জানালে বিবেকে বাধে, তাই–”
কর্নেল তাকে থামিয়ে বললেন, “জয়া, ঘরে ক্লোরোফর্মের গন্ধ কেন? কেউ তোমাকে ক্লোরোফর্ম শুকিয়ে অজ্ঞান করে ফেলেছিল, তাই না?”
জয়ার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। সে বোবার মত তাকিয়ে রইল শুধু।
“কিছু নিয়ে গেছে কি ঘর থেকে?”
জয়া আবার মাথা দোলাল। বিজয় চমকে উঠেছিল। বলল, “এ তো অসম্ভব। ব্যাপার! দিনদুপুরে কেউ এই ঘরে ঢুকে ওকে অজ্ঞান করাবে এবং কিছু চুরি করে সবার চোখ এড়িয়ে পালিয়ে যাবে! নাঃ–আমি বিশ্বাস করি না।”
কর্নেল মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বললেন, “আঃ! তুমি একটু চুপ করো, বিজয়! আমাকে কথা বলতে দাও।”
জয়া পালঙ্কের পাশে রাখা গোলাকার টেবিল থেকে জলের গেলাসটা নিল। এক চুমুক জল খেয়ে গেলাসটা রেখে আবার কর্নেলের দিকে ভিজে চোখে তাকাল।
কর্নেল বললেন, “কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তোমার?”
জয়া মাথা দোলাল।
“ঠিক আছে। পরে শুনব। কফি নিয়ে আসুক। গরম কফি খেলে গলাটা ঠিক হয়ে যাবে। তবে শুধু ইশারায় দেখিয়ে দাও, কোথায় তোমার ওপর কেউ ক্লোরোফর্ম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।”
জয়া ইশারায় দরজার কাছটা দেখিয়ে দিল। তখন কর্নেল ঘরের বাতি জ্বেলে দিলেন। জানালাগুলোর পর্দাও সরিয়ে দিলেন। তারপর পকেট থেকে আতসকাঁচের। মতো দেখতে প্রকাণ্ড একটা গোল এবং হ্যান্ডেল লাগানো কাঁচ নিয়ে দরজার মেঝের ওপর হুমড়ি খেয়ে বসলেন।
ওই অবস্থায় বাইরের বারান্দায় গেলেন। তারপর ফিরে এসে বললেন, “লোকটা খালি পায়ে এসেছিল মনে হচ্ছে। কলাবতী, রঙ্গিয়া, বুদ্বুরাম সবাই এ ঘরে খালিপায়ে ঢুকেছে। লোকটা জুতোপায়ে ঢুকলে তা সত্ত্বেও একটু-আধটু চিহ্নও মেঝেয় পেতুম।”
একটুখানি চোখ বুজে থাকার পর চোখ খুলে ফের বললেন, “আচ্ছা বিজয়, এ বাড়ির দোতালায় আর নিচের তলায় কতগুলো ঘর আছে?”
বিজয় হিসেব করতে থাকল। ইতিমধ্যে কলাবতী কফি নিয়ে এল। কর্নেল বললেন, “ঠিক আছে! তুমি এখন এস, কলাবতী!”
কলাবতী সলজ্জ হেসে বলল, “আপনাদের জন্য কফি আছে সায়েব!”
কর্নেল হাসলেন। “তুমি বুদ্ধিমতী কলাবতী!”
কলাবতী ট্রে রেখে চলে গেল। কর্নেল নিজের হাতে পট থেকে কফি ঢেলে জয়াকে দিলেন। ততক্ষণে বিজয়ের হিসেব শেষ হয়েছে। সে বলল, “বড় ভুল। হয় আমার। মনে হচ্ছে, নিচের তলায় আটখানা আর ওপরে পাঁচখানা ঘর।”
জয়া মৃদু স্বরে বলল, “না। ওপরে ছখানা।”
বিজয় বলল, ‘ও, হাঁ। জয়ের মানে দাদার ঘরের এপাশে একটা ঘর আছে। ভুলে গিয়েছিলাম।”
কর্নেল জিগ্যেস করলেন, “সে-ঘরে কী আছে?”
বিজয় বলল, “জানি না। তালাবন্ধ আছে–ছেলেবেলা থেকেই দেখছি। বাড়িতে কয়েকটা ঘরেই তালাবন্ধ আছে।”
জয়া বলল, “মায়ের কাছে শুনেছিলাম ও ঘরে আমার এক পিসি নাকি সুইসাইড করেছিলেন। তখন আমাদের জন্ম হয়নি। পরে বাবা ঘরটা অস্ত্রাগার করেন। আমাদের পূর্বপুরুষের সব অস্ত্রশস্ত্র এই ঘরে আছে।”
বিজয় বলল, “কে জানে! আমি ওসব খবর রাখি না।”
কর্নেল বললেন, “জয়া, আর কথা বলতে আশা করি কষ্ট হচ্ছে না?”
জয়া বলল, “না।”
“তোমাকে অজ্ঞান করে ঘর থেকে কিছু নিয়ে গেছে কি না জিগ্যেস করলে তখন তুমি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বললে! তার মানে তুমি জানো চোর কী নিতে এসেছিল?”
জয়া মুখ নামিয়ে বলল, “জানি। জিনিসটা আমার কাছেই ছিল।”
“কী সেটা?”
জয়া একটু চুপ করে থেকে বলল, “কাকাবাবু একটা ছোট্ট কৌটোর মতো জিনিস লুকিয়ে রাখতে দিয়েছিলেন। সেটা জামার ভেতর বুকের কাছে লুকিয়ে সবে ওপরে এসেছি–”
বিজয় নড়ে বসে বলল, “তাই তো! কাকাবাবু তো এলেন না! নিশ্চয় খবর পেয়েছেন কী হয়েছে।”
জয়া বলল, “কাকাবাবু ভাগলপুর গেছেন। যাবার আগে আমায় জিনিসটা দিয়ে গিয়েছিলেন। দরজা বন্ধ করে সেটা কোথায় লুকিয়ে রাখব ভাবছি, হঠাৎ দরজায় কেউ নক করল। রাত্রে হলে জিগ্যেস না করে দরজা খুলতুম না। দরজা যেই। খুলেছি, কেউ আমার ওপর এসে পড়ল। তারপর কিছু টের পাইনি। রঙ্গিয়া কখন এসে আমাকে পড়ে থাকতে দেখে ফ্যান চালিয়েছে। জলের ঝাঁপটা দিয়েছে। জ্ঞান . হবার পর সব মনে পড়ল। তখন দেখি জিনিসটা নেই।”
“জামার ভেতর রেখেছিলে আগের মতো?” কর্নেল জিগ্যেস করলেন।
“হ্যাঁ।” জয়া কফির পেয়ালা পাশের টেবিলে রেখে বলল, “একপলকের জন্য লোকটার মুখে কালো কুচ্ছিত একটা মুখোশ দেখেছিলুম। তার গায়ে ছাইরঙের কলারওয়ালা গেঞ্জি ছিল।”
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। “তুমি বিশ্রাম করো জয়া! পরে আবার কথা বলব।”
বারান্দায় গিয়ে কর্নেল একটু দাঁড়ালেন হঠাৎ। বললেন, “বিজয়, খালি ঘরগুলোর চাবি কার কাছে থাকে?
বিজয় বলল, “সম্ভবত কাকাবাবুর কাছে।”
“জয়ের ঘরের পাশের ঘরটা একবার দেখে যাই, এস।”
“কিন্তু তালাবন্ধ যে! ভেতরে তো ঢোকা যাবে না।”
“বাইরে থেকেই দেখে যাব।”
বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গেলেন দুজনে। বারান্দা পুব-পশ্চিমে এগিয়ে বিজয়ের ঘরের পর ডানদিকে দক্ষিণে ঘুরেছে। পাশাপাশি দুটো ঘরের দরজা সেখানে। বিজয় প্রথম ঘরের দরজাটা দেখিয়ে বলল, “এটাই সেই ঘর। পাশেরটায় জয় থাকে। তার ঘরে তালা এঁটে বেরোয়।” বলে সে জয়ের ঘরের পর্দাটা তুলে দেখিয়ে দিল।
জয়ের ঘরের পর বারান্দাটা শেষ হয়েছে জাফরিকাটা দেয়ালে। চৌকোনা নকশাকাটা ঘুলঘুলি-গুলোতে বাইনোকুলার দিয়ে কর্নেল বাইরেটা দেখে বললেন, “পুকুরের পাড়ে ওই বাড়িটাই কি তোমাদের ঠাকুরদালান!”
বিজয় উঁকি মেরে দেখে বলল, “হ্যাঁ। ওই যে পাশের ঘরের দরজার সামনে মাধব পাণ্ডাজি দাঁড়িয়ে আছেন দেখছেন, উনিই মাইনে করা পূজারী।”
“পুব-দক্ষিণ কোণের টিলাটা কি বাড়ির ভেতর, না বাইরে?”
“বাড়ির চৌহদ্দি-পাঁচিলের ভেতরই। ওই টিলার মাথায় ছোট্ট মন্দিরটা দেখতে পাচ্ছেন, ওটা হরমন্দির। আর ঠিক এমনি একটা ছোট টিলা আছে দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায়। সেটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। ওটার মাথায় ওইরকম ছোট্ট একটা মন্দির আছে। সেটা গৌরীমন্দির। লোকে বলে হরটিলা গৌরীটিলা।”
কর্নেল একটু হাসলেন। “তোমার বাড়ির এলাকা দেখছি বিশাল। জঙ্গল পাহাড় জীবজন্তু আছে, আবার–”
কথা কেড়ে বিজয় বলল, “একটা আলাদা পৃথিবী বলতে পারেন। তবে ভীষণ গোলমেলে পৃথিবী। এখনও অব্দি পুরো এলাকার অনেকটাই আমার অচেনা। তেমনি রহস্যময়ও মনে হয়।”
কর্নেল ঘুরে পা বাড়িয়ে বললেন, “একটা নকশা পেলে ভাল হত।”
বিজয় বলল, “কিসের?”
“তোমাদের বাড়ির পুরো চৌহদ্দির। বিশেষ করে বাড়িটার নিচের তলা এবং এই দোতলার।”
“করে দিচ্ছি। আধঘণ্টা সময় দিন।”
“তুমি তো বললে অনেকটাই অচেনা তোমার।”
বিজয় হাসল। “জয়ার হেল্প নেব। তাছাড়া কলাবতাঁকেও ডাকব। দুজনের সবটাই নখদর্পণে।”
জয়ের ঘরের পাশের ঘরটার দরজায় পর্দা নেই। মরচে ধরা তালা ঝুলছে। দেখে মনে হল, বহুকাল তালাটা খোলা হয়নি। কপাটের ফাঁকেও মাকড়সার জাল রয়েছে। ভেতরে কী সব অস্ত্র আছে কে জানে।
বারান্দা ঘুরেছে পশ্চিমে এবং বাঁকের মুখে নিচে নামার আরেকটা সিঁড়ি। কর্নেল সেই সিঁড়িতে নামতে যাচ্ছিলেন। বিজয় বলল, “ওটা বন্ধ রাখা হয়েছে। দাদার কুকুর নিচে গিয়ে বৈজু ঠাকুরকে ভয় দেখাত। শেষে কাকাবাবু নিচে সিঁড়ির দরজায় তালা আটকে দিয়েছেন।”
বারান্দায় অজস্র থাম। জয়ার ঘরের পর প্রথম সিঁড়ি। সেখান দিয়েই ওঠানামা করা হয়। কর্নেল নিচে গিয়ে বিজয়কে বললেন, “তুমি এবার একটা কাজ করো। একে একে দারোয়ান নছি সিং, কলাবতী, রঙ্গিয়, বৈজুঠাকুর, আর বুদ্বুরাম ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনলে তখন তাকেও পাঠিয়ে দেবে। ওদের কাছে কিছু জানবার আছে।”
সিঁড়ির পাশেই গেস্টরুমে কর্নেল আছেন। ঘরে ঢুকে ক্যামেরা বাইনোকুলার ইত্যাদি টেবিলে রেখে ঝটপট পোশাক বদলে তৈরি হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে একে-একে নছি সিং, কলাবতী ও তার মেয়ে রঙ্গিয়া, বৈজু শেষে বুদ্বুরাম এল বিজয়ের সঙ্গে।
না–কেউ আজ সকাল থেকে সন্দেহজনক কিছু দেখেনি। প্রত্যেকেই বলল যে, অন্দরমহলে একটা চুহা বা বিল্লি ঘুসলেই তারা টের পাবে। কোনো অচেনা লোকের বাড়ি ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ পুবের খিড়কি আর দক্ষিণের খিড়কি ভেতর থেকে বন্ধ থাকে। বাকি রইল সদর দরজা। সেখানে করিডোর মতো প্যাসেজের মুখে সারাক্ষণ নছি সিং বসে আছে। কেউ এলে তার অজান্তে বাড়ি ঢুকতে পারবে না। পের্টিকোর সামনে হলঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। পাশে বিপ্রদাসজির ঘরের বাইরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অতএব বাইরের কেউ বাড়ি ঢোকেনি বা বেরিয়েও যায়নি।
ঘণ্টাখানেক পরে বিজয় নকশা নিয়ে হাজির হল। কর্নেল নকশার ওপর ঝুঁকে পড়লেন।…
[৪০২ ও ৪০৩ পৃষ্ঠায় ছবি আছে]
.
মন্দিরে কার ছায়া
কর্নেল সারাদুপুর নকশা নিয়ে কাটিয়ে দিলেন। বিকেলে বিজয়কে ডেকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলেন। দক্ষিণের পোড়ো জমি আর বাগানের ভেতর দিয়ে এগিয়ে ঠাকুরবাড়িতে গেলেন। মাধবজি তার ঘরের সামনে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলেন। বিজয় কর্নেলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। মাধবজি বারান্দায় কম্বল বিছিয়ে কর্নেলকৈ বললেন, “আমার সৌভাগ্য কর্নেলসাব! একটেরে পড়ে থাকি। কেউ আমার খোঁজ-খবর রাখে না। বড়কুমারসাব তো চিড়িয়াখানা নিয়েই মশগুল। আর এই যে দেখছেন ছোটকুমারসাব, ইনি তো ঘর থেকেই বেরোন না। শুধু জয়াবেটি আসে কখনও-সখনও। আর হাবিপ্রদাসজি আসেন হরঘড়ি। উনি না আসবেন তো চলবে কী করে? তবে আজ বিপ্রদাসজিকে দেখতে পাচ্ছি না।”
বিজয় বলল, “ভাগলপুরে গেছেন সকালে। দুদিন থাকবেন বলে গেছেন।”
মাধবজি বললেন, “ও, হ্যাঁ। কাল বলছিলেন বটে! ভাগলপুরে ওঁর এক .. বহিনজি থাকেন শুনেছি।”
কর্নেল পা ঝুলিয়ে বসে বাইনোকুলারে নালা ও পুকুরের সঙ্গমস্থলে কিছু দেখছিলেন। বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, “মাধবজি, আপনি কতবছর রাজবাড়িতে আছেন?”
মাধবজি হিসেব করে বললেন, “তা বিশসালের বেশি। সত্যি কথা বলতে গেলে, কর্নেলসাব, সে জমানা আর নেই। রাজবাহাদুরের আমলে কী ছিল! হরঘড়ি শোরগোল, লোকজন, কত কিছু। এখন তো শ্মশান মনে হয়। মোটর গাড়ি ছিল। দুটো ঘোড়া ছিল। এখন আর কিছু দেখতে পাবেন না। তবে বাকি যেটুকু দেখছেন, সব বিপ্রদাসজির জন্য। কুমারসাবদের তো বিষয়সম্পত্তিতে মন নেই। ঘর সংসারেরও ইচ্ছে নেই। আবার দেখুন, জয়াবেটির বরাত। এই বয়সেই বিধবা হয়ে গেল!”
কর্নেল বললেন, “শরদিন্দুবাবুর সঙ্গে আপনার কেমন আলাপ ছিল?”
“খুউব। অমন ভদ্রলোক আমি কখনও দেখিনি কর্নেলসাব। নিজের পেটের কথা সব আমাকে বলতেন। এক বদমাসের পাল্লায় পড়ে খামোকা বেচারা জেল খেটেছিলেন।”
কর্নেল বিজয়ের দিকে তাকালেন। বিজয় বলল, “শরদিন্দু বিশেষ কারুর নাম করেছিল বলে জানি না। অন্তত জয়া আমাকে বলেনি।”
মাধবজি চাপা স্বরে বললেন, “জামাইবাবু তো আর বেঁচে নেই। তাই বললেও ক্ষতি নেই এখন। আমাকে বলতে বারণ করেছিলেন। সেই হারামিটা ওঁর সঙ্গে ব্যাংকে চাকরি করত। তার নাম ছিল পরিতোষ। তো জামাইবাবু যে রাতে চিতার পাল্লায় পড়েন, সেইদিন বিকেলে এসে আমাকে কথায় কথায় বলেছিলেন, পরিতোষ হারামিকে বাজারে কোথায় দেখেছেন। তার খুব ভয় হচ্ছে। আবার কোনো ক্ষতি না করে। কী মতলবে কানাজোলে এসেছে সে, তাই নিয়ে খুব ভাবনা করছিলেন। আমি বললুম, বড় কুমারসাবকে বলুন। ওকে খুঁজে বের করে চাবুক মারবে। তারপর পুলিশে ধরিয়ে দেবে। তো জামাইবাবু বললেন, কী জানি, দূর থেকে দেখেছি। ভূল হতেও পারে।”
কর্নেল বললেন, “শরদিন্দুবাবু যে রাতে মারা যান, আপনি কোনো চিৎকার শুনেছিলেন?”
“না। তবে এখান থেকে বড়কুমারসাবের ঘর নজর হয়। ওই দেখুন–ওই ঘরের ব্যালকনিতে বড়কুমারসাব আর জামাইবাবুকে বসে থাকতে দেখেছিলুম। তখন রাত প্রায় দশটা। অবাক লাগছিল জামাইবাবু মদ খাচ্ছেন দেখে। উনি মদ খান বিশ্বাস করতে পারিনি।
“আপনি দেখেছিলেন মদ খেতে?”
“হ্যাঁ দুজনের হাতেই গেলাস ছিল। ঘর থেকে আলো এসে ব্যালকনিতে পড়েছিল। “
“আচ্ছা মাধবজি, আজ সকালে বা অন্য কোন সময়ে অচেনা কোনো লোককে রাজবাড়ির চৌহদ্দিতে দেখেছেন কি? ধরুন, খিড়কি দিয়ে বেরুতে বা বাগানে, কি অন্য কোথাও?”
মাধবজি মাথা জোরে নেড়ে বললেন, “দেখিনি। তবে সবসময় তো সবদিকে নজর থাকে না। চোখ এড়িয়ে যেতেও পারে।”
কর্নেল উঠলেন। “চলি মাধবজি! অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।”
মাধবজি করজোড়ে বললেন “কৃপা করে যদি এক কাপ চা পিয়ে যেতেন কর্নেলসাব!”
“ঠিক আছে। ফেরার সময় হবে। একটু ঘুরে আসি ওদিক থেকে।”
ঠাকুরদালানের সামনে দিয়ে পুকুরের ধারে পৌঁছলেন দুজনে। পুকুরটা চৌকোনা। শালুক পদ্ম আর জলজদামে ভর্তি। সেই নালাটা এসে পুকুরে পড়েছে। এখানে ইটের সাঁকো আছে। সাঁকোটা পেরিয়ে হরটিলার নিচে গিয়ে কর্নেল বললেন, “এস বিজয়, মন্দিরটা দেখে আসি।”
বিজয় একটু হাসল। “কোনো ব্লু থাকতে পারে ভাবছেন?”
“কিসের?”
“জয়াকে অজ্ঞান করে যে একটা কী জিনিস হাতিয়েছে, সে এদিকে নিশ্চয় আসেনি।” বিজয় খিকখিক করে হাসতে লাগল। “পরিতোষ না কার কথা বললেন মাধবজি, তারও হরটিলায় উঠে লুকিয়ে থাকার চান্স কম। মাধবজি বললেন বটে, সবদিকে নজর থাকে না, কিন্তু আমি জানি উনি একটি বাজপাখি।”
কর্নেল কৌতুকে মন না দিয়ে গম্ভীরভাবেই বললেন, “পূর্বে গঙ্গার তীরে ওই ফটকটার পাশে পাঁচিল ভাঙা আছে। আমরা সকালে বাইরে থেকে ওখান দিয়েই ঢুকেছি। সেইভাবে কেউ ঢুকে কোথাও লুকিয়ে থাকলে অবাক হবার কিছু নেই, বিজয়। তোমার কী মনে হয়?”
বিজয় বলল, “তাই তো! ওটার কথা মনে ছিল না। আমাদের পুরো এলাকা তন্ন তন্ন করে খোঁজা দরকার।”
এবার কর্নেল হাসলেন। “তবে জয়ার কাছ থেকে মূল্যবান জিনিসটি হাতিয়ে সে নিশ্চয় লুকিয়ে থাকবে না আর। কী দরকার আর লুকিয়ে থাকার?”
“তাহলে–
কর্নেল টিলার গায়ে পাথরের ধাপে পা রেখে বললেন, “জিনিসটা কী হতে পারে বলে তোমার ধারণা?”
বিজয় তাকে অনুসরণ করে বলল “কোনো দামি রত্ন-উত্ন হবে। কাকাবাবুকে হয়তো বাবা রাখতে দিয়েছিলেন।”
কর্নেল আর কোনো কথা বললেন না। টিলাটা একেবারে সিধে উঠেছে। পরিশ্রম হচ্ছিল সিঁড়ি ভাঙতে। ওপরে উঠে ছোট্ট মন্দিরটার সামনে একটা পাথরে বসে বিশ্রাম নিতে থাকলেন। বিজয় গঙ্গার শোভা দেখতে থাকল। এখান থেকে চারদিকে অনেক দূর অব্দি চোখে পড়ে। চিড়িয়াখানার টিলার দিকে বাইনোকুলার তাক করলেন কর্নেল। নানকু হরিণটাকে কিছু খাওয়াচ্ছে। ঘাড়ে হাত বুলিয়ে আদরও করছে। জয় কাকাতুয়াটা কাঁধে নিয়ে আউট-হাউসের ছাদে বসে আছে। সেও গঙ্গার শোভা দেখছে হয়তো। বাইনোকুলার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কর্নেল চারদিকটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন।
সেইসময় হঠাৎ বিজয় চমকখাওয়া গলায় বলল, “আরে! ওটা কী?”
কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, “কী বিজয়?”
বিজয় এগিয়ে গিয়ে মন্দিরের পাশে জবাফুলের ঝোঁপের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট ভেলভেটে মোড়া কৌটা কুড়িয়ে আনল। উত্তেজিতভাবে বলল, “কর্নেল! কর্নেল! জয়া তো এরকম একটা কৌটোর কথাই বলছিল! সেইটেই সম্ভবত।”
কর্নেল কৌটোটা নিয়ে বললেন, “ভেতরের জিনিসটা নেই। খালি কৌটোটা ফেলে রেখে গেছে।”
বলে জ্যাকেটের পকেট থেকে আতস কাঁচ বের করে খুঁটিয়ে কৌটোর ভেতরটা দেখতে থাকলেন। বিজয় দমআটকানো গলায় বলল, “কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!”
একটু পরে কর্নেল বললেন, “তুমি বলেছিলে রত্নের কথা। কিন্তু কৌটোর ভেতর মরচের গুঁড়ো দেখতে পেলাম। পুরনো লোহার কোনো জিনিস ছিল . সম্ভবত।…হু চাবি হতেও পারে।”
“কিসের চাবি?”
“জানি না। এর জবাব বিপ্রদাসবাবুই দিতে পারেন। ওঁকে কালই লোক পাঠিয়ে খবর দিয়ে আনা দরকার।”
“বুদ্ধকে পাঠিয়ে দেব।” বিজয় চঞ্চল হয়ে বলল। “এখনও পাঠানো যায়। সাড়ে ছটায় একটা ট্রেন আছে।”
“ভাগলপুরে রাত্রে গিয়ে কি ওঁকে খুঁজে বের করতে পারবে বুদু? অবশ্য ঠিকানা জানা থাকলে”।
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, “তুমি বরং এখনই গিয়ে খোঁজ নাও, বুন্ধু বা কেউ ভাগলপুরের ঠিকানা জানে নাকি। মাধবজিকে জিগ্যেস করে যেও।”
“আপনি থাকছেন?”
“হ্যাঁ–আমি ঘুরি কিছুক্ষণ।”
বিজয় সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নেমে গেল সবেগে। কর্নেল ফের কিছুক্ষণ বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিয়ে তারপর মন্দিরের ভেতর উঁকি দিলেন। বেলা পড়ে এসেছে। তবে পশ্চিমের অস্তগামী সূর্যের আলো সোজা এসে মন্দিরে ঢুকেছে। তাই ভেতরটায় রোদ পড়েছে।
একটা শিবলিঙ্গ ছাড়া আর কিছু নেই। ধুসর গ্রানাইট পাথরের বেদির ওপর শাদা পাথরের যোনিপট্টে প্রোথিত কালো পাথরের শিবলিঙ্গ। কর্নেল গুঁড়ি মেরে ঢুকে বেদিটার চারদিকে হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। পেছনদিকে হাত বুলোতে গিয়ে হাতে শক্ত কাঠের মতো কী ঠেকল। অত্যন্ত অপরিসর ভেতরটা। অনেক কষ্টে ওপাশে ঝুঁকে চমকে উঠলেন। একটা গর্তে যে জিনিসটা ঢোকানো, সেটা একটা ভাঙা চাবি ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ নিচেই গোলাকার চাকতির .. মতো ভাঙা মাথাটা পড়ে আছে।
কেউ চাবি ঢুকিয়ে জোরে চাপ দিতে গিয়ে চাবিটা ভেঙে গেছে। হতাশ হয়ে চলে গেছে। হয়তো অন্ধকার নামলে বেদিটা ভাঙার জন্য তৈরি হয়েই আসবে। কী আছে বেদির ভেতর? বেদিটা তাহলে সম্ভবত পাথরের সিন্দুকই?
হঠাৎ কর্নেলের মনে হল একটা বিপদ আসন্ন।
এই অদ্ভুত অনুভূতি জীবনে বহুবার আসন্ন বিপদের মুহূর্তে তাকে সজাগ করে দিয়েছে। এ যেন অতিরীন্দ্রিয়ের বোধ।
দ্রুত ঘুরলেন। একপলকের জন্য বিকেলের লালচে আলোয় যেন একটা ছায়া সরে যেতে দেখলেন। পকেট থেকে রিভলবার বের করে গুঁড়ি মেরে ঝাঁপ দিলেন মন্দিরগর্ভ থেকে।
কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। টিলার পেছন দিকটা খাড়া নেমে গেছে। তার পেছন চৌহদ্দিঘেরা উঁচু পাঁচিল। কিন্তু টিলার চারদিকই ঘন ঝোপে ঢাকা। রিভলবারটা অটোমেটিক। নল তাক করে মন্দিরের চারদিক ঘুরে খুঁটিয়ে দেখলেন। কোনো ঝোঁপের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না।
তাহলে কি মনের ভুল? অথবা যে এসেছিল, সে যেন অদৃশ্য হওয়ার মন্ত্র জানে। অস্বস্তিতে অস্থির হয়ে কর্নেল সিঁড়ির ধাপে পা রাখলেন। ছায়া যে দেখেছেন, তা ভুল নয়। আর একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল যে সে যেই হোক, তার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র নেই। থাকলে গুলি ছুড়ত। তাকে রেহাই দিত না।…
.
ভৌতিক ছড়া
বুদ্বুরাম বা কেউই জানে না ভাগলপুরে কোন ঠিকানায় বিপ্রদাসবাবুর বোনের বাড়ি। তাই বুদ্বুরাম আগামীকাল ভোরের ট্রেনেই ভাগলপুরে যাবে। সেখানে তার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় থাকে। কাজেই দিনসবরে গিয়ে খুঁজে বের করতে অসুবিধে হবে না। বিজয় এসে জানাল কর্নেলকে।
কর্নেল জয়াকে দেখতে গিয়েছিলেন তার ঘরে। তার শরীর ভাল, কিন্তু মন ভাল নেই। কর্নেলকে বসিয়ে রেখে বিজয় হয়তো কবিতা লিখতে গেল।
একথা-ওকথার পর কর্নেল বললেন, “আচ্ছা জয়া, তোমাকে শরদিন্দু কি পরিতোষ নামে কারুর কথা বলেছিল?”
জয়া একটু চমকে উঠে বলল, “হ্যাঁ বলেছিল। ওদের ব্যাংকের ক্যাশডিপার্টে : কাজ করত সে।”
“তাকে কানাজোলে দেখতে পাওয়ার কথা বলেছিল কি?”
জয়া বলল, “বলেছিল। কিন্তু আপনি কেমন করে জানলেন?”
“কী বলেছিল, আগে বলল। আমি পরে বলছি সেকথা।”
“বলেছিল, দেখার ভুল হতেও পারে। তবে বাজারের ওখানে যেন পরিতোষ নামে ওর কলিগকে দেখেছে। আসলে ওর সন্দেহ ছিল পরিতোষই ক্যাশ সরিয়ে, ওকে বিপদে ফেলেছিল। কারণ পরিতোষের স্বভাবচরিত্র নাকি ভাল ছিল না।”
“শরদিন্দুর মদ খাওয়া সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?”
জয়া একটু চুপ করে থেকে বলল, “ওর মদ খাওয়ার কথা আমি বিশ্বাস করি না।”
“কিন্তু মর্গের রিপোর্টে পাওয়া গেছে, ওর পেটে অ্যালকোহল ছিল।”
“বিশ্বাস করিনি। এখনও করি না।”
“মাধবজি দেখেছিলেন, যেরাতে শরদিন্দু মারা যায়, সেরাতে–তখন দশটা বাজে, জয়ের সঙ্গে ব্যালকনিতে বসে মদ খাচ্ছিলো।”
জয়া নিষ্পলক চোখে তাকাল। “…মাধবজি বলেছেন?”
“হ্যাঁ। উনি দেখেছিলেন।”
জয়া মুখ নামিয়ে আস্তে বলল, “সেদিন সন্ধ্যায় আমার মেজাজ ভাল ছিল না। ওকে নিয়ে কানাজোল জুড়ে স্ক্যান্ডাল ছড়িয়েছিল। লোকে আড়ালে আমার নামেও কদর্য তামাশা করত। এমন কি আমাদের বাড়িতেও গোপনে আলোচনা চলত দারোয়ানের ঘরে। রঙ্গিয়া এসে বলে যেত। তো সেদিন সন্ধ্যায় খামোকা ওর সঙ্গে ঝগড়া বাধালুম। বললুম, আমাকে যদি কোথায় না নিয়ে যেতে পারো, তাহলে চলে যাও।”
জয়া ধরা গলায় বলতে থাকল, “সেরাতে ও খেতে এল না। মাধবজির ওখানে আছে খবর পেলুম। আমিও খাইনি। শরীর খারাপ বলে দরজা আটকে শুয়ে পড়লুম। অনেক রাতে দরজায় নক করে ডাকল। আমি দরজা খুলিনি।”
জয়া চুপ করলে কর্নেল বললেন, “তারপর?”
“তারপর আর সাড়া পেলুম না। মিনিট পাঁচেক পরে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখলুম, বারান্দায় নেই। ভাবলুম, ছোড়দার ঘরে শুয়েছে। সেরাতে আমার কী যে হয়েছিল!”
“জয়ের সঙ্গে শরদিন্দুর সম্পর্ক কেমন ছিল?”
“বড়দা ভীষণ খেয়ালি। মাঝেমাঝে ওকে ডেকে নিয়ে গিয়ে গল্প করত।”
“হু–আচ্ছা জয়া, কেন তোমার সন্দেহ যে শরদিন্দু চিতার আক্রমণে মারা যায়নি?”
জয়া একটু উত্তেজিত হল। “কেন ও অত রাতে বড়দার স্যুতে যাবে? সুইসাইড করার ইচ্ছে থাকলে অন্যভাবে কি করা যেত না? তাছাড়া ওর বডিতে যেসব ক্ষতচিহ্ন ছিল, তা চিতার নখ বা দাঁতের বলে আমার মনে হয়নি।”
“কিন্তু মর্গের ডাক্তার তো”
“ডাক্তারের রিপোর্ট আমি বিশ্বাস করি না। কেউ তাকে ঘুষ খাইয়ে মিথ্যা রিপোর্ট লিখিয়েছে।”
“তুমি কি বলতে চাইছ শরদিন্দুকে খুন করা হয়েছিল।”
“হ্যাঁ। তাছাড়া কিছু হতেই পারে না।”
“কেন ওকে খুন করবে কেউ?”
আবার একটু চুপ করে থাকার পর জয়া আস্তে বলল, “আমার সন্দেহ হয় বড়দা জানে, কে কেন ওকে খুন করেছে। বড়দা খুনীকে গার্ড করেছে। বড়দাই হয়তো ব্যাপারটা ঢাকতে চিতাবাঘের কাঁধে দোষ চাপিয়েছে।”
কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টে ওকে লক্ষ্য করছিলেন। বললেন, “কেন বড়দাকে সন্দেহ হয়, জয়া?”
“বড়দার হাবভাব দেখে। সেদিন থেকে বড়দার পাগলামি বেড়ে গেছে। তাছাড়া লক্ষ্য করেছি, মাঝে মাঝে লুকিয়ে কাঁদে। রাত্রে মাতাল-অবস্থায় চুল আঁকড়ে ধরে বলে, আর আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে না, আমি শিগগির মরে যাব।”
“তুমি শুনেছ নিজের কানে?”
“হ্যা”। জয়া গলার স্বর আরও চেপে বলল, “দুদিন আগে রাত বারোটা নাগাদ ঘুম ভেঙে গেল। বৃষ্টি হচ্ছিল। দরজা খুলে বারান্দায় গেলুম। হঠাৎ শুনি বড়দার ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। ছুটে ওর ঘরের দিকে গেলুম। চমকে উঠলুম বড়দার কথা শুনে। বড়দা কাঁদতে কাঁদতে বলছে, আমিই জয়াকে বিধবা করে ফেলেছি! ভগবান, আমাকে শিগগির মেরে ফেলো! দরজায় নক করে ওকে ডাকলুম। অমনি আলো নিভে গেল ঘরের ভেতর। বড়দার কোনো সাড়াই পেলুম না। তখন অবাক হয়ে ফিরে এলুম।”
“তোমার মনে হয় না হঠাৎ ঝোঁকের বশে জয় মানুষ খুন করতে পারে?”
জয়া জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না। বড়দা মনে মনে ভীষণ ভিতু। খুব দয়ালু ছেলে বড়দা। ওই যে চিড়িয়াখানা করেছে, জন্তু আর পাখিগুলোকে কী যে ভালবাসে ভাবতে পারবেন না। তাছাড়া ওর মুখেই যত হাঁকডাক। ভেতর ভেতর খুব ভিতু আর গোবেচারা।”
কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে হাত বুলোচ্ছিলেন। হঠাৎ চোখ খুলে বললেন, “জয়ের কাকাতুয়ার জিভ কেটে বোবা করে দিয়েছিল কেউ। এসম্পর্কে তোমার কী ধারণা?”
জয়া ঈষৎ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “রঙ্গিয়ার কাছে শুনেছি বড়দা নাকি পাখিটাকে অসভ্য কথা শেখাত।”
“বেশ। তাই যদি হয়, কে পাখিটার জিভ কেটেছিল বলে তোমার সন্দেহ হয়?”
জয়া বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আস্তে বলল, “আমার সন্দেহ কাকাবাবুকে।”
“বিপ্রদাসবাবুকে?”
জয়া মাথাটা একটু দোলাল।
“কেন, বলতে আপত্তি আছে?”
জয়া মুখ তুলল এবং কিছু বলতে গিয়ে ঠোঁট ফাঁক করল। কিন্তু বলল না। সেই সময় বিজয় হন্তদন্তভাবে ঘরে ঢুকে বলল, “জানিস জয়া? আমাদের বাড়িতে নিশ্চয় ভূত আছে।”
কর্নেল বললেন, ‘কী ব্যাপার, বিজয়?”
বিজয় ধপাস করে একটা গদি-আঁটা চেয়ারে বসে বলল, “ইশ! এখনও বুকটা কাঁপছে। ভাবা যায় না।”
জয়া বিরক্তভাবে বলল, “কী হয়েছে বলবে তো?”
বিজয় চাপা গলায় বলল, “কয়েক লাইন লিখেছি–বেশ এগোচ্ছে লেখা, হঠাৎ আলো নিভে গেল ঘরের। তারপর খসখস শব্দ–কেউ যেন ঘরে ঢুকেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে এসেছি। ইশ! এখনও বুকটা”
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এস তো দেখি।”
বিজয় কুণ্ঠিতভাবে একটু হেসে বলল, “চলুন। কিন্তু আমি পেছনে থাকব।”
জয়াও অনুসরণ করল। কিন্তু কর্নেল বললেন, “জয়া, তুমি বারান্দায় থাক– অথবা তোমার দরজায় তালা এঁটে তবে এস।”
জয়া বিস্মিত হল। বলল। “ঠিক আছে। আমি এখানেই থাকছি।”
জয়ার ঘরের পাশেরটা তালাবন্ধ। তার পরেরটা বিজয়ের ঘর। ঘরে আলো জ্বলছে দেখে বিজয় অবাক হয়ে বলল, “এ কী! আলো জ্বলছে দেখছি যে! ভারি অদ্ভুত ব্যাপার তো!
কর্নেল ও বিজয় ঘরে ঢুকল। বিজয় বলল, “তার চেয়ে অদ্ভুত, আমি টেবিলল্যাম্প জ্বেলে লিখছিলুম। কিন্তু দেখুন কর্নেল, টেবিলল্যাম্পের প্লাগটা সুইচবোর্ডে অফ করা আছে। ওটা অন করেই লিখছিলুম। আর বড় আলোটা কেউ জ্বেলে দিয়ে গেছে।”
কর্নেল টেবিলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, “বিজয় কি বাংলাভাষায় কবিতা লেখ?”
বিজয় অবাক হয়ে বলল, “না তো। হিন্দি আমার মাতৃভাষা। হিন্দিতেই লিখি।”
“ওই বাংলা দুলাইন পদ্য তাহলে তোমার নয়। ভূতটাই লিখে গেছে।”
বিজয় কবিতার খাতার ওপর ঝুঁকে গেল। বলল, “কী আশ্চর্য!”
কর্নেল বললেন, “ভূতটা রসিক। পড়ে দেখ, কী লিখেছে।”
বিজয় বাংলা পড়তে পারে। সে পড়লঃ
“বামুন গেছে যমের বাড়ি।
বুড়ো ঘুঘু ছিঁড়বে দাড়ি”
বিজয় হাসতে হাসতে বলল, “ধাঁধা নাকি? কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না কর্নেল!”
কর্নেল গুম হয়ে বললে, “তোমার খাতায় ছড়া লিখে আমার সঙ্গেই রসিকতা করে গেছে কেউ। তুমি হয়তো জানো না বিজয়, আমাকে পুলিসমহলে রসিকতা করে বুড়ো ঘুঘু বলে থাকে। কিন্তু বামুন গেছে যমের বাড়ি-মাই গুডনেস!” কর্নেল নড়ে উঠলেন। “বিপ্রদাস মুখুয্যেমশাইয়ের কোনো বিপদ হয়নি তো? কিংবা মাধবজি–বিজয়, তুমি বুদ্বুরামকে বলো, মাধবজি ঠিক আছে কি না খোঁজ নিয়ে আসুক!”
বিজয় বারান্দার থামের পাশে কার্নিসে ঝুঁকে বুন্ধুকে ডাকতে থাকল। কর্নেল পদ্যটা ছিঁড়ে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। তখন জয়া বলল, “কী হয়েছে, কর্নেল?”
কর্নেল এগিয়ে গিয়ে বললেন, “ঘরে চলো, বলছি!”
.
পরিতোষ এবং রমলা
বুদ্বুরাম ফিরে এসে খবর দিয়েছিল, মাধবজি দোঁহা আওড়াতে আওড়াতে রোটি পাকাচ্ছেন। তবিয়ত ঠিক আছে। বুদ্বুরামের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সে বিরক্ত হয়েছে কর্নেলের ব্যাপার-স্যাপার দেখে। এই বুড়ো ভদ্রলোক এসে তার ঝামেলা বাড়াচ্ছেন, যেন এরকম তার মনোভাব। খামোকা তাকে ভাগলপুর পাঠাতে চাওয়া! দৌড়ুতে দৌড়ুতে ঠাকুরদালানে পাঠানো! হয়েছেটা কী এত?
কথাটা রঙ্গিয়া চুপিচুপি জয়াকে বলতে এসেছিল, কর্নেল তখনও জয়ার কাছে বসে কথা বলছিলেন তার ঘরে। জয়া বলেছিল, “বুদ্বুটা খুব কুঁড়ে আসলে। নছি সিংয়ের সঙ্গে দাবা খেলতে পেলে আর কিছু চায় না। কিছুক্ষণ পরে, কর্নেল নিচের তলায় উঁকি মেরে দেখলেন, তাই বটে। সদর দরজার পাশের ছোট্ট ঘরটায় নছি সিং আর সে থাকে। সেই ঘরে দুজনে দাবা নিয়ে বসেছে।
বিজয় তখন তার ঘরের দরজা বন্ধ করে কবিতা লিখতে বসেছে ফের। কর্নেল গেস্টরুমে কিছুক্ষণ একা গুম হয়ে বসে থাকলেন। তারপর টর্চ নিয়ে বেরুলেন। বাড়ি একেবারে সুনসান। কিচেনে কলাবতী, রঙ্গিয়া আর বৈজু ঠাকুরকে চাপা গলায় কথা বলতে দেখা যাচ্ছিল। নানকুর ঘরের দরজা বন্ধ। ভেতরে আলো জ্বলছে। সে কী করছে বোঝা গেল না। বিজয় বলেছে, নানকু রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে চিড়িয়াখানার আউট-হাউসে শুতে যায় ইদানীং শরদিন্দুর মৃত্যুর পর তার ওপর জয়ের নাকি এই হুকুম।
বৈজুর ঘর আর নানকুর ঘরের মাঝামাঝি খিড়কিরাস্তার করিডোর। কর্নেল নিঃশব্দে সেই দরজা খুলে এবং ভেজিয়ে দিয়ে বেরুলেন। সেপ্টেম্বরের নক্ষত্রজ্বলা আকাশের নিচে জংলা জমি জুড়ে যেন রহস্য থমথম করছে। ভ্যাপসা গরম। বেশ কিছুদিন এ তল্লাটে বৃষ্টি হয়নি। কর্নেল টর্চ জ্বালতে গিয়ে জ্বাললেন না। জয়ের ঘরের ব্যালকনি থেকে নেমে আসা ঘোরানো লোহার সিঁড়ির কাছে গিয়ে একটু দাঁড়ালেন। অমনি জয়ের কুকুরটার গজরানি কানে এল। কিন্তু কুকুরটা ওপরে গজরাচ্ছে না, সামনের দিকে জংলা জমিতেই সে কোথাও আছে। জয়ের ঘরে আলো জ্বলছে। কুকুরটা কি সারারাত বাইরে ছাড়া থাকে?
কর্নেল নালা ও পুকুরের সঙ্গমস্থলে যেতেই ফের কুকুরটা গরগর করে উঠল। পুকুরপাড় ধরে একটু এগিয়ে কর্নেল বুঝলেন, কুকুরটা হরটিলার ওখানে। আছে। কারণ তিনি যত এগোচ্ছিলেন, তত তার গজরানি বাড়ছিল। তারপর তার গায়ে টর্চের আলো পড়ল। কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, “জয় নাকি?”
টর্চ নিভে গেল। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, “এখানে কী করছ জয়।?”
অন্ধকার থেকে জয় বলল, “যাই করি, আপনার কী মশাই? আপনাকে সাবধান করে চিচ্ছি–এক পা এগোবেন না। সনিকে লেলিয়ে দেব।”
“সনি আমাকে ভয় পায়। তুমি চেষ্টা করে দ্যাখো ডার্লিং, যদি ওকে–”
“ডার্লিং? গায়ে পড়ে আত্মীয়তা আমার বরদাস্ত হয় না বলে দিচ্ছি।”
“অভ্যাস–নিছক অভ্যাস ডার্লিং বলা।” কর্নেল হাসলেন। “যাই হোক, আশাকরি বুঝতে পারছ সনি আমাকে ভয় পায়।”
জয় ধমক দিল। “সনি! সনি! কী হয়েছে তোর?”
হরটিলার সিঁড়ির ওপরদিকে সনির ডাক শোনা গেল। এবার যেন নিরাপদে পৌঁছে কর্নেলকে যাচ্ছেতাই গালাগালি দিতে শুরু করেছে। জয় বলল, “আশ্চর্য তো!”
“জয়! তার চেয়ে আশ্চর্য তোমার এখানে দাঁড়িয়ে থাকা। তুমি কি হরটিলার মন্দির পাহারা দিচ্ছ?”
জয়ের গলার স্বর বদলে গেল। “আপনি কেমন করে জানলেন”?
“জানি। তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করি, ডার্লিং!
জয় দাঁড়িয়েছিল একটা পাথরের কাছে। কয়েক পা এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। কর্নেল চাপা স্বরে বললেন ফের, “কিছুক্ষণ আগে জয়া তোমাকে যা সব বলে এসেছে, তা আমারই পরামর্শে। ভেবেছিলুম, তুমি ওর কথায় পাত্তা দেবে না। কিন্তু পাত্তা দিয়েছ এবং সরাসরি কাজে নেমেছ দেখে আমি খুশি হয়েছি, ডার্লিং!”
“কে আপনি? আমাদের ব্যাপারে আপনার কেন মাথাব্যথা বলুন তো?”
“আমি তোমাদের হিতৈষী।”
একটু চুপ করে থাকার পর জয় বলল, “আপনি পুলিশের লোক?”
“মোটেও না।” কর্নেল তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “সনি পাহারা দিক। ততক্ষণ আমরা ভোলা জায়গায় গিয়ে কথা বলি, যাতে আড়ি পেতে কেউ না শোনে। এস।”
জয় কথা মানল। নালার ধারে কিছুটা এগিয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে খোলামেলা ঘাসজমি। চারদিকে আলো ফেলে নিশ্চিন্ত হয়ে কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, “হরটিলার শিবলিঙ্গের বেদির তলায় কী আছে, তুমি জানো জয়”?
জয় খুব আস্তে বলল, “আমার সন্দেহ হচ্ছে—
“হু–বলো ডার্লিং!”
“রমলার ডেডবডি লুকোনো আছে হয়তো।”
কর্নেল চমকে উঠলেন। “কে রমলা!”
“স্কাউড্রেল পরিতোষের বোন।”
“পরিতোষ মানে–যে ছিল শরদিন্দুর ব্যাংকের সহকর্মী?”
“হ্যাঁ। পরিতোষ জুয়াড়ি চোর বদমাস। কিন্তু তার বোন রমলা ছিল উল্টো।” বলে জয় ওঠার চেষ্টা করল। “না, এর বেশি আমার বলা চলে না। আমার মুখ। বন্ধ।”
কর্নেল তাকে টেনে বসতে বাধ্য করলেন। জয় একটু অবাক হয়ে বলল, “আপনার গায়ে দেখছি সাংঘাতিক জোর। আপনাকে ভীষণ বুড়ো দেখে ভেবেছিলুম। আপনি কেন এসব সাংঘাতিক ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন?”
“প্লিজ ডার্লিং। আমি তোমার হিতৈষী বন্ধু। আমাকে কিছু গোপন কোরো না। তাতে তোমার জীবন নিরাপদ হবে।”
“কেন? আমাকে কি কেউ রমলার বা শরদিন্দুর মতো মেরে ফেলবে?”
“তাহলে তুমি জানো শরদিন্দু চিতাবাঘের হাতে মারা পড়েনি?”
জয় গলার ভেতর বলল, “হ্যা!”
“শরদিন্দুকে কে মেরেছে বলে তোমার ধারণা, জয়?”
“বলব না। মুখ বন্ধ।”
“বেশ কীভাবে ওকে মারা হয়েছিল, সেটা অন্তত বলো।”
“বাঘনখ দেখেছেন কি? আগের যুগে এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হত।”
“দেখেছি–অনেক রাজবাড়ির অস্ত্রাগারে আছে।”
“ইতিহাসে পড়েছি শিবাজি বাঘনখ দিয়ে আফজল খাঁকে মেরে ফেলেছিলেন। বাঘনখ আমাদের বাড়িতেও আছে। মানে ছিল। আর নেই। শরদিন্দু মারা যাওয়ার পর আর দেখতে পাচ্ছি না।”
“কোন ঘরে তোমাদের অস্ত্রাগার?”
“আমার ঘরের পাশের ঘরে। বাইরে তালাবন্ধ। কিন্তু আমার ঘর দিয়ে ঢাকা যায়।”
“শরদিন্দু কেন অত রাতে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিল?”
“আমি পরিতোষের সঙ্গে ওর মিটমাট করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। পরিতোষ ব্যাংকের চুরিকরা টাকার একটা শেয়ার হিসেবে চৌষট্টি হাজার টাকা দিতে রাজি হয়েছিল। চুরিকরা টাকার অর্ধেকটা পরিতোষের কাছে মজুত ছিল। পরিতোষ চোর, জুয়াড়ি, স্কাউন্ড্রেল। কিন্তু বোনকে ভীষণ ভালবাসত। বোনের খোঁজেই সে এখানে–”।
জয় থামলে কর্নেল বললেন, “হুঁ! বলো ডার্লিং!”
“রমলার কথা বলব না। অন্য কথা জানতে চাইলে বলব।”
“বেশ। বললো, শরদিন্দু কীভাবে মারা পড়ল?”
জয় একটু চুপ করে থাকার পর বলল, “পরিতোষের নামেও হুলিয়া ঝুলছে পুলিশের। ব্যাংকে চুরির পর শরদিন্দুকে ধরল। তার জেল হল। কিন্তু পুলিশ পরিতোষকেও সন্দেহ করেছিল। তাই সে গা ঢাকা দিয়েছিল ব্যাপারটা আঁচ করেই।”
“শরদিন্দু কীভাবে মারা পড়ল বলো?”
“আউট-হাউসে পরিতোষের থাকার কথা ছিল। রাত এগারোটা নাগাদ আমি শরদিন্দুকে সঙ্গে নিয়ে চুপিচুপি গেলুম। মিটমাট হয়ে গেল। শরদিন্দু আমার অনুরোধে একটু হুইস্কি খেতে গিয়ে শেষে বেশ কয়েক পেগ খেয়ে ফেলেছিল। তখন সে বেশ মাতাল হয়ে পড়েছে। আসলে মদ খাওয়ার অভ্যাস বেচারার সত্যি ছিল না। সে মাতাল অবস্থায় অনেক কথা বলছিল। টাকাগুলো পাপের। কিন্তু সে মিছিমিছি জেল খেটেছে। কাজেই টাকাগুলো তার ধর্মত পাওনা। টাকা পেয়ে সে কলকাতা নিয়ে যাবে জয়াকে। এবাড়িতে তার থাকা তার নিজের পক্ষে এবং জয়া বা আমাদের সবার পক্ষেই অপমানজনক। কারণ লোকে স্ক্যান্ডাল ছড়াচ্ছে শরদিন্দু-জয়াকে নিয়ে।…এইসব বলার পর হঠাৎ সে বলে বসল, রমলাকে খুন করা হয়েছে। কে খুন করেছে এবং কোথায় ডেডবডি লুকোনো আছে সে জানে। তবে এখন বলবে না। পরিতোষ টাকা দিলেই সে। বলবে। এদিকে পরিতোষ আর আমি ওর কথা শুনে তো ভীষণ উত্তেজিত। সাধাসাধি করেই ওর কাছে কথাটা আদায় করা গেল না। শরদিন্দু গোঁ ধরে। বলল, পরদিন এমনি সময় পরিতোষ যখন টাকা নিয়ে আসবে, টাকা আগে গুনে নিয়ে তবে সে সেকথা ফাস করবে। যাইহোক পরিতোষ গেল গঙ্গার পাড় দিয়ে। আমি তাকে এগিয়ে দিয়ে আউট-হাউসের দরজা বন্ধ করছি, তখনই শরদিন্দুর চাপা গোঙানি শুনতে পেলাম। তখন চিতাবাঘের খাঁচাটা ছিল বাইরে। খাঁচার সামনে শরদিন্দু পড়ে ধড়ফড় করছে আর তার খুনী পালিয়ে যাচ্ছে। একে রমলাকে খুন করা হয়েছে শুনে আমার মাথার ঠিক নেই, তার ওপর ওই সাংঘাতিক ঘটনা। আউট-হাউসের যে ঘরে আমরা কথা বলছিলুম, সেই ঘরের জানালা দিয়ে আলো আসছিল। সেই আলোয়–থাক। আমার মাথা ঘুরছে।”
জয় দুহাতে মাথা আঁকড়ে ধরে দুহাঁটুর ফাঁকে মুখ নামাল। কর্নেল তার পিঠে হাত রেখে বললেন, “জয়! ডার্লিং! মন শক্ত করো।”
জয় মাথা তুলে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “আমার বোন আমারই দোষে বিধবা হয়ে গেছে কর্নেল! আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। অথচ মরতেও পারি না। খালি মনে হয়, রমলা হয়তো বেঁচে আছে। শরদিন্দু হয়তো টাকা পাওয়ার লোভে মিথ্যা বলেছিল। হয়তো রমলাকে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। কর্নেল, এই ধাঁধার জন্যই আমার মরা হল না। নইলে কবে আমি-”
হরটিলার মন্দিরে জয়ের কুকুরটার ডাক ভেসে এল। জয় অমনি “সনি” বলে চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে গেল।
কর্নেল ভাবলেন তাকে অনুসরণ করবেন। কিন্তু করলেন না। মনে হল, জয় এখন নিরাপদ–অন্তত তিনি যতক্ষণ কানাজোলে আছেন।
শুধু একটাই উদ্বেগ আপাতত বিপ্রদাসের জন্য। ভৌতিক ছড়াটা নিছক রসিকতা না হতেও পারে।…
.
বিজয়ের সংশয়
খেতে প্রায় রাত দশটা বেজে গেছে। ডাইনিং রুমে এরাতে জয়া খেল কর্নেল ও বিজয়ের সঙ্গে। জয়ের খাবার কলাবতী পৌঁছে দিয়ে এসেছে।
জয়া চলে গেলে কর্নেল বিজয়কে বললেন, “এসো বিজয়, কিছুক্ষণ গল্প করি। নাকি তোমার কবিতার মুড চলে যাচ্ছে?”
বিজয় হাসল। “নাঃ! কোনো মুড নেই আজ। আমার তো ঘরে ঢুকতেই ভয় হচ্ছে। ভাবছি, আপনার কাছে এসে শোব।”
“স্বচ্ছন্দে। গেস্টরুমে তো আরেকটা খাট আছে। অসুবিধে নেই।”
বিজয় খুশি হয়ে বারান্দায় গিয়ে ডাকল, “বুদ্ধ! শুনে যা!” বুদ্ধ এলে সে তাকে তার ঘরে তালা আটকে দিতে বলল। চাবি দিল। বুদ্ধ একটু পরে চাবিটা ফেরত দিয়ে গেল।
গেস্টরুমের দ্বিতীয় খাটে বিছানা পাতাই ছিল। বিজয় বলল “যাক্। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।”
কর্নেল চুরুট টানছিলেন। ধোঁয়ার ভেতর হঠাৎ বললেন, “আচ্ছা বিজয়, জয় হঠাৎ কলকাতা থেকে পড়াশুনা ছেড়ে চলে এসেছিল কেন বলো তো?”
বিজয় বলল, “ছেড়ে ঠিক আসেনি। বি. এ. পাশ করেছিল। কিন্তু এম. এ. তে ভর্তি হয়নি।”
“শরদিন্দুর সহকর্মী পরিতোষকে তুমি কখনও দেখেছ?”
“না তো!” বিজয় অবাক হল। “কেন?”
“জয়ের সঙ্গে তার আলাপ ছিল।”
“বিজয় আরও অবাক হয়ে বলল, তাই বুঝি! জয়া বলছিল নাকি?”
কর্নেল চোখ বুজে বললেন, “হ্যাঁ।”
“সেটা সম্ভব। জয় শরদিন্দুর কলিগকে দেখে থাকবে। তবে আমি তাকে দেখা দূরের কথা, সবে আজ বিকেলে মাধবজির মুখে তার নাম শুনলাম।” বিজয় একটু পরে ফের বলল, “জয়া বলেছে দাদার সঙ্গে পরিতোষের আলাপ ছিল?”
“হ্যাঁ।”
“আমি বিশ্বাস করি না। জয়া বড্ড ভুলভাল কথা বলে।”
“তাহলে তুমি রমলাকেও চেনো না?”
বিজয় চমকে উঠল। “রমলা! সে আবার কে!”
“পরিতোষের বোন। জয়ের সঙ্গে তার একটু বিরতি দিয়ে চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে কর্নেল বললেন, “জয়ের সঙ্গে রমলার এমোশানাল সম্পর্ক। ছিল।”
“বলেন কী! জয়া বলেছে আপনাকে? নাকি জয়ের কাছ থেকে শুনলেন?”
“হ্যাঁ।” কর্নেল এমনভাবে হ্যাঁ বললেন, যাতে বোঝা যায় না কার কাছে। শুনেছেন।
বিজয় জোরে মাথা নেড়ে বলল, “জয়া বড্ড বানিয়ে বলে। এ আমি বিশ্বাস করি না।”
“কেন?”
বিজয় নড়ে বসল। “দাদার কোনো ব্যাপার আমার অজানা নেই। বিশেষ করে কলকাতায় হোস্টেলে থাকার সময় দাদার কোনো প্রেমের ব্যাপার থাকলে আমি নিশ্চয় জানতে পারতুম।”
কর্নেল একটু হাসলেন। “ছোটভাইকে ওসব কথা বলা যায় না–অথবা ছোটভাইয়ের চোখের আড়ালেই দাদার গোপন প্রেম করা স্বাভাবিক।”
বিজয় জোর গলায় বলল, “জয় সে-রকম দাদা নয়। মাত্র ছ’ঘণ্টা পরে আমার জন্ম। কাজেই আমার বন্ধুর মতো। ওকে আমি নাম ধরে ডাকি, নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন?”
কর্নেল হাসলেন। “কিন্তু ইদানীং জয়ের অনেক গোপন ব্যাপার তোমার জানা নেই। এবং নেই বলেই তুমি রহস্যের ধাঁধায় পড়ে আমার কাছে ছুটে গিয়েছিলে। আমাকে নিয়ে এসেছ তার জট ছাড়াতেই।”
“হ্যাঁ। ইদানীং শরদিন্দু মারা যাবার পর থেকে জয় আমাকে কিছুই জানতে দিচ্ছে না আগের মতো।”
“অথচ সেটাই তুমি জানতে চাইছ, এই তো?”
বিজয় একটু চুপ করে থেকে বলল, শুধু তাই নয়। আপনাকে বলেছি– আমার ভয় হচ্ছে জয় সুইসাইড না করে। ওর পাগলামি যে হারে বাড়ছে।”
কর্নেল একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন “জয়ের গোপন রহস্যের একটা আমি ধরতে পেরেছি।
“কী বলুন তো?”
“রাতে জয়ের ঘরে তুমি জয়কে কার সঙ্গে কথা বলতে শুনেছিলে এবং এক রাত্রে কাউকে ব্যালকনির ওই ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে দেখেছিলে। আশা করি, কে সে এবার বুঝতে পারছ।”
বিজয় শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “পরিতোষ?”
“ঠিক ধরেছ। তুমি বুদ্ধিমান।”
বিজয় চাপা স্বরে বলল, “পরিতোষের সঙ্গে জয়ের কী ব্যাপার চলছে বলে মনে হয় আপনার?”
“এখনও এতটা এগোতে পারিনি। তবে–”
বিজয় দ্রুত বলল, “পরিতোষ কি তার বোন রমলার ব্যাপারে জয়কে ব্ল্যাকমেইল করেছে?”
“বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। আরও একটু গোপন তদন্ত দরকার।”
“কর্নেল, আমার মনে হচ্ছে, তাহলে পরিতোষকে জয় এ বাড়িতে গোপন আশ্রয় দিয়েছে। তিনটে ঘর বন্ধ আছে ওপরে। তারই কোনোটাতে পরিতোষ লুকিয়ে থাকতে পারে।”
বিজয় খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। কর্নেল বললেন, “তাও সম্ভব। বিপ্রদাসবাবু না ফিরলে তো ওসব ঘরের চাবিও পাওয়া যাবে না। দেখা যাক।”
বিজয় দমআটকানো গলায় বলল, “সব স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কর্নেল। আজ পরিতোষই তাহলে জয়াকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে কৌটো হাতিয়েছে। নিশ্চয় ওর মধ্যে কিছু দামি জিনিস ছিল!”
“চাবি!”,
“কিন্তু কিসের চাবি?” বিজয় একটু হাসল। “হা–হরটিলায় তখন আপনি চাবির কথা বলেছিলেন।”
কর্নেল আস্তে বললেন, “হরটিলার মন্দিরের ভেতর যে শিবলিঙ্গ আছে, তার বেদিটা সম্ভবত একটা গোপন সিন্দুক। চাবিটা সেই সিন্দুকের। চাবিচোর তাড়াতাড়ি জোর করে সিন্দুকের তালা খোলবার চেষ্টা করতে গিয়ে চাবিটা ভেঙে ফেলেছিল।”
“সর্বনাশ! আপনি দেখেছেন?”
“হ্যাঁ।” কর্নেল একটু হাসলেন। “তবে ব্যাপারটা কীভাবে জয়ও জেনে গেছে। সে তার কুকুরটাকে হরটিলায় পাহারায় রেখেছে দেখে এসেছি।”
বিজয় চমকে উঠল। তারপর বলল “চাবি-চোর পরিতোষ। পরিতোষই জয়কে বলেছে, ওখানে গুপ্তধন আছে। ভাগ দেবে বলে লোভ দেখিয়েছে। সত্যি, জয় এমন বোকা হবে ভাবতে পারিনি। যাতে অন্য কেউ টের পেয়ে ওখানে হানা দেয়, তাই সনিকে পাহারায় রেখেছে। সনি তো পরিতোষকে কিছু বলে না। তাই তার অসুবিধে নেই।”
কর্নেল হাসলেন। “আচ্ছা বিজয়, সিন্দুকের ভেতর যদি গুপ্তধনের বদলে অন্য কিছু থাকে?”
“আর কী থাকবে? পরিতোষকে নিশ্চয়ই জয়ই নেশার ঘোরে বলেছে ওর ভেতরে আমাদের পূর্বপুরুষের গুপ্তধন আছে। জয় বড় বোকা। গায়ের জোর ছাড়া আর কিছু নেই ওর।”
“বিজয়, যদি সিন্দুকের ভেতর একটা ডেডবডি লুকোনো থাকে?”
বিজয় ভীষণ চমকে গেল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, “ডেডবডি? কার ডেডবডি?”
“ধরো পরিতোষের বোন রমলার?”
বিজয় শিউরে উঠে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “প্লিজ! প্লিজ কর্নেল! এসব কথা বললে আমি হার্টফেল করে মারা পড়ল। আমার হাত-পা কাঁপছে!”
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “নাঃ। জাস্ট কথার কথা। শুয়ে পড়ো। এগারোটা বাজে।”
বিজয় মশারি টেনে দিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর বলল, “আজ রাতে আমার ঘুম হবে না।”
ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে মশারি খাঁটিয়ে শুয়ে কর্নেল ফের বললেন, “ঘুমোও।”
একটু পরে বিজয় ডাকল, “কর্নেল!”
“বলো ডার্লিং!”
“পদ্যটা তাহলে পরিতোষই লিখেছে তাই না! বাংলা তার মাতৃভাষা। কাজেই–”
“আচ্ছা বিজয়!”
“বলুন।”
“তুমি দাড়ি রাখতে শুরু করেছ কবে থেকে?”
“তা অনেকদিন হয়ে গেল। কেন?”
“এমনি জিজ্ঞেস করছি। ঘুমোও।”
তারপর কর্নেলের নাক ডাকতে থাকল। বিজয় ডাকাডাকি করে আর সাড়া পেল না।…
.
জয়কে নিয়ে সংশয়
ভোরে অভ্যাসমতো কর্নেল প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে ছিলেন। বিজয় তখন গুটোপুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। রাতে ও ঘুমোয়নি ভেবেই কর্নেল তাকে ডাকেননি আজ।-..
প্রধান ফটক দিয়ে বেরিয়ে রাস্তা ধরে গঙ্গার ধারে হাঁটতে হাঁটতে রাজবাড়ির আউটহাউসের ওপাশ ঘুরে যখন পূবের ভাঙা ফটকের কাছে পৌঁছলেন, তখন সূর্য উঠেছে। ফটকের এধারে প্রচুর পাথরের ভূপ। তার ফাঁকে গুল্মলতায় শরতের সজীবতা ঝিকমিক করছিল। শিশিরের ফোঁটায় প্রতিফলিত হচ্ছিল। রক্তাভ রোদ। গঙ্গার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সৌন্দর্য দেখলেন। তারপর পাঁচিলের ভাঙা জায়গা দিয়ে রাজবাড়ির এলাকায় ঢুকলেন কর্নেল।
বাঁদিকে হরটিলা পর্যন্ত অসমান জমি জুড়ে আর ঝোঁপঝাড় শিশিরে চবচব করছে। সংকীর্ণ পায়ে চলা পথ ধরে হরটিলার দিকে যেতে জুতো-প্যান্ট ভিজে সপসপে হয়ে গেল। একখানে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে চোখ রেখে মন্দিরটা। দেখতে দেখতে চমকে উঠলেন।
জয় মন্দিরের সামনে পাথরের ওপর বসে আছে একা। পাশে দাঁড়িয়ে তার। কুকুর সনি।
হরটিলার পাথরের ধাপে কর্নেল পা রাখতেই কুকুরটা ওপরে গরগর করে উঠল। কর্নেল যখন কাছাকাছি পৌঁছলেন, তখন শুনলেন, জয় সনিকে ডাকাডাকি করছে।
কর্নেলকে দেখে সে গম্ভীর হল। কোনো কথা বলল না। কর্নেল বললেন, “গুডমর্নিং জয়।” জয় তারও জবাব দিল না।
কর্নেল চূড়ায় উঠে একটু হেসে বললেন, “আশাকরি, তুমি সারারাত এখানে বসে নেই?”
জয় বলল, “আপনাকে দেখে সনি এত ভয় পায় কেন? কী ব্যাপার?”
কর্নেল বললেন, “ফর্মুলা-টোয়েন্টির পাল্লায় পড়লে সব কুকুরই ভড়কে পিছু হটে।”
“তার মানে? আপনার দেখছি সব তাতেই হেঁয়ালি?”
কর্নেল তার একটু তফাতে পাথরটার অন্যপ্রান্তে বসে বললেন, “কতক্ষণ এসেছ?”
জয় আস্তে বলল, “কতক্ষণ কী! আমি সারারাত এখানে আছি।”
“সে কী!”
“রমলার ডেডবডি খুনী সরিয়ে ফেলার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। আমি তা টের পেয়েছি।”
“কিন্তু তুমি ধরে নিচ্ছ এখানেই ওর ডেডবডি আছে?”
“জয়ার কাছ থেকে শোনার পর থেকে মনে হচ্ছে–” সে হঠাৎ থেমে বলল, “আপনি যা সব জয়াকে বলেছেন, তা কি বিজয়কেও বলেছেন?”
“মোটামুটি আভাস দিয়েছি।”
“বিজয় কী বলল?”
“সে ডেডবডিতে বিশ্বাস করে না। কারণ রমলাকে চেনে না। পরিতোষকেও চেনে না।”
“বিজয় পরিতোষকে না চিনতেও পারে।”
“রমলাকে?”
জয় রুক্ষস্বরে বলল, “বিজয় তো বলেছে রমলাকে চেনে না। আবার ওকথা কেন?”
“জয়! আমাকে একটা কথার জবাব অন্তত দাও। রমলার খোঁজে পরিতোষ কানাজোলে এসেছিল বলেছ। রমলা কবে তোমার কাছে এসেছিল?”
জয় একটু চুপ করে থাকার পরে বলল, “আজ তারিখ কত?”
“২৩ সেপ্টেম্বর।”
“শরদিন্দু খুন হয়েছে ১৩ সেপ্টেম্বর। রমলা এসেছিল ৯ সেপ্টেম্বর। কিছু বুঝলেন?”
“শরদিন্দু যেভাবেই হোক জানত রমলা এসেছে এবং তাকে খুন করা হয়েছে। তাই শরদিন্দুকে মরতে হয়েছে। বেঁচে থাকলে সে ১৪ সেপ্টেম্বর রাতেই ফাস করে দিত–”।
“সে তো বলেছ। আমি জানতে চাই, রমলা ৯ সেপ্টেম্বর কোথায় এল? সরাসরি রাজবাড়িতে তোমার কাছে তো?”
জয় একটু শ্বাস ছেড়ে বলল, “রমলা চিঠি লিখে জানিয়েছিল ৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে-ছটায় আপ দিল্লি এক্সপ্রেসে পৌঁছুবে কানাজোল স্টেশনে। ছটার আগেই রেডি হয়ে বেরুতে যাচ্ছি, নানকু এসে খবর দিল ময়াল সাপটার খাঁচা খোলা–সাপটা পালিয়েছে। দৌড়ে স্যুতে গেলুম। একঘণ্টা তন্নতন্ন করে খুঁজে সাপটাকে পাওয়া গেল নালার কাঠের ব্রিজের তলায়। তাকে খাঁচায় পুরে স্টেশনে পৌঁছেছি প্রায় সওয়া সাতটা। ট্রেন মিনিট কুড়ি আগে ছেড়ে গেছে। খুঁজে-খুঁজে রমলাকে দেখতে পেলুম না।”
জয় থামলে কর্নেল বললেন, “তারপর?”
“ক্ষমা করবেন কর্নেল, আর আমি বলব না।”
“তুমি কলকাতা থেকে কেন হঠাৎ চলে এসেছিলেন জয়? কেন তুমি আর পড়াশুনা করতে চাওনি?”
“জীবনের ওপর ঘেন্না ধরে গিয়েছিল। আর কোনো কারণ নেই।”
“কেন ঘেন্না ধরেছিল?”
“অত কেনর জবাব আমি দেব না। আপনি প্লিজ আমাকে বিরক্ত করবেন না। আমার মাথা ঘুরছে।”
“রমলার ব্যাপারটা কী?”
জয় খাপ্পা হয়ে উঠে দাঁড়াল। “আঃ! বড় জ্বালাতন করেন আপনি!”
বলে সে সনির খোঁজে মন্দিরের পূর্বপাশে গেল। সনি ঝোঁপের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছিল। দৌড়ে তার বকলেস ধরে গলায় পরানো চেন খুলে তাকে টানতে টানতে জঙ্গল ভেঙে নেমে গেল জয়।
কর্নেল গম্ভীরভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। তারপর মন্দিরের ভেতর গুঁড়িমেরে ঢুকলেন। পরীক্ষা করে দেখলেন বেদির ওধারে ভাঙা চাবিটা তেমনি আটকানো আছে।
বেরিয়ে এসে পাথরটার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন কর্নেল।
কর্নেল ভাবছিলেন, যদি সত্যি এই বেদির ভেতর রমলার লাশ লুকোনো থাকে এবং খুনী যদি এতদিন পরে লাশটা সরানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে, তাহলে এই সিদ্ধান্ত করা যায়ঃ
(এক) সে খুন করেছিল কিন্তু লাশ ফেলে রেখে গিয়েছিল। অন্য কেউ লাশটা এই মন্দিরে বেদির তলায় লুকিয়ে রেখেছিল। এতদিনে সে লাশের খোঁজ পেয়েছে।
(দুই) এতদিনে খোঁজ পেয়েছে বলেই বেদির চাবি চুরি করেছে ঝুঁকি নিয়ে এবং ওঁত পেতে বেড়াচ্ছিল। বিপ্রদাসের জয়াকে কৌটো দেওয়া সে দেখেছিল। কৌটোতে কী আছে সে জানতে পেরেছিল।
(তিন) বিপ্রদাসই লাশটা এখানে লুকিয়ে ফেলেছিলেন। নিশ্চয় কাউকে বাঁচানোর জন্যই এ কাজ করেছিলেন।
(চার) রমলা খুন হয়েছিল কারুর প্রতিহিংসা বশে কিংবা তাকে রেপ করাও হয়ে থাকবে।
(পাঁচ) নিচের নির্জন জঙ্গলেই কোথাও রেপ এবং গুম করে লাশ ফেলে রেখে পালিয়েছিল কেউ।
কিন্তু এই পাঁচটা পয়েন্ট পুরো ঘটনাটা পরিষ্কার করছে না। প্রচুর ফাঁক থেকে যাচ্ছে। প্রশ্ন থাকছে অসংখ্য। কর্নেল আবার উদ্বিগ্ন হলেন বিপ্রদাসের জন্য। বিপ্রদাস অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন। সবার আগে এখন তাকে দরকার।
টিলা থেকে নামতে চোখে পড়ল একটা সুন্দর প্রজাপতি সবে ঘুম ভেঙে গা থেকে শিশির ঝেড়ে উড়ে চলেছে। তাকে লক্ষ্য করে জোরে নামতে থাকলেন। কিন্তু নিচে এসে হারিয়ে ফেললেন প্রজাপতিটাকে। পুকুরের কাছে। আসতেই দেখা হয়ে গেল মাধবজির সঙ্গে। মাধবজি ঘাটের ধাপে বসে লোটা মাজছিলেন বললেন, “নমস্তে কর্নেলসাব!”
“নমস্তে মাধবজি!”
“বেড়াতে বেরিয়েছি বুঝি?”
কর্নেল ঘাটের মাথায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকলেন মাধবজির সঙ্গে। একথা সেকথার পর কর্নেল বললেন, “আচ্ছা মাধবজি, আপনার নজর তো সবদিকেই থাকে।”
মাধবজী হাসলেন। “সব সময়ে থাকে না। কালও বলেছি আপনাকে।”
“বলেছেন।” কর্নেল হাসলেন। কিন্তু ধরুন, বিশেষ কোনো ব্যাপার ঘটলে আপনার নজরে পড়তে পারে।”
“ত পারে।”
“ধরুন, কোনো বাইরের লোক রাজবাড়ির এই এলাকায় এলে আপনার চোখে পড়তেও পারে।”
“কী জানি।”
“ধরুন, সন্ধ্যার পর কোনো মেয়ে–”
“জয়াবেটির কথা বলছেন কি? সে মাঝেমাঝে এদিকে ঘুরতে আসে দেখেছি।”
“জয়াকে আবছা আঁধারে চিনতে পারেন নিশ্চয়?”
“পারি। কিন্তু এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন কর্নেলসাব?”
“প্রায় দুসপ্তাহ আগে এক সন্ধ্যাবেলায় কোনো মেয়েনা, জয়া নয়–বাইরের একটি মেয়ে এই বাগান আর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে–”
মাধবজি চমকে উঠে তাকালেন। “আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না কৃপা করে। আমি কিছু জানি না।”
“আমি শুধু জানতে চাই, মেয়েটি একা ছিল, না তার সঙ্গে কেউ ছিল?”
“কর্নেলসাব, আপনি নিশ্চয় পুলিশ অফিসার! আমাকে মাফ করবেন। বিশবছর রাজবাড়ির নিমক খাচ্ছি। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।”
“মাধবজি আমি পুলিশের অফিসার নই। আমি রাজবাড়ির হিতৈষী।”
“তাহলে আর কোনো কথা নয়। কথা তুললেই বিপদ।”
“আপনি শুধু বলুন ৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এই এলাকায় কোনো বাইরের মেয়েকে দেখেছিলেন কি না?” কর্নেল চাপা স্বরে ফের বললেন, “আপনার কথার ওপর একজনের বাঁচা-মরা নির্ভর করছে।”
“সে কী!” অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালেন মাধবজি। “কৃপা করে বুঝিয়ে বলুন।”
“পরে বলব। আমার প্রশ্নের জবাব দিন আগে।”
মাধবজি এদিক-ওদিক তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল, “ওই পূর্বের ফটক দিয়ে বড়কুমারসাবের সঙ্গে একটা অচেনা মেয়েকে ঢুকতে দেখেছিলাম। তখনও দিনের আলো সামান্য মতো ছিল। দুজনকে আউট-হাউসের টিলায় না গিয়ে দক্ষিণের জঙ্গল বরাবর আসতে দেখে অবাক হয়েছিলাম। তারপর আর তাদের দেখতে পেলাম না। খুব খারাপ লাগল, বড়কুমারসাব শেষে এমন লম্পট হয়ে গেছে দেখে খুব দুঃখ হচ্ছিল।”
“আপনি ঠিক দেখেছিলেন বড় কুমারসাবকে?”
“হ্যাঁ। পরনে প্যান্টশার্ট ছিল। বড় কুমারসাব প্যান্টশার্ট পরে। ছোটো কুমারসাব ধুতিপাঞ্জাবি পরে।”
“তারপর?”
“হুজুর, আমি সামান্য মানুষ। আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।”
কর্নেল পা বাড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে দ্রুত ঘুরে বললেন, “মেয়েটির লাশ আপনি দেখতে পেয়ে বিপ্রদাসকে খবর দিয়েছিলেন?”
নেহাত অনুমানে ঢিল ছোঁড়া। নিছক একটা সম্ভাবনার যুক্তিতে। কিন্তু ঢিলটি লক্ষ্যভেদ করল। মাধবজির মুখ সাদা হয়ে গেল। ঠোঁট ফাঁক করে রইলেন।
“আপনারা দুজনে লাশটাকে হরটিলার মন্দিরে বেদির তলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন।”
মাধবজির ঠোঁট কাঁপছিল। অতিকষ্টে বললেন, ‘বিপ্রদাসজি বলেছেন তাহলে?”
কর্নেল একটু হাসলেন শুধু।
মাধবজি এগিয়ে এলেন কাছে। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, “বড়কুমারসাব একাজ করবেন ভাবতে পারিনি, হুজুর কর্নেলসাব! ওকে কিছুক্ষণ পরে দৌড়ে চলে যেতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল। তাই মেয়েটিকে খুঁজতে গিয়েছিলুম। গিয়ে দেখি পড়ে আছে ঠাণ্ডা হিম হয়ে। ওঃ! সে এক সাংঘাতিক ঘটনা।”
কর্নেল হনহন করে ঠাকুরদালানের সামনে দিয়ে চলতে থাকলেন। মাধবজি খড়িতে আঁকা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
কর্নেল গৌরীটিলার পাথরের ধাপ বেয়ে উঠতে শুরু করলেন।
দক্ষিণ-পশ্চিমকোণের এই টিলার মাথায় মন্দিরটা সামান্য বড় শিবমন্দিরটার চেয়ে। ভেতরে পাথরের ছোট গৌরীমূর্তি। সেখানে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে রাজবাড়ি দেখতে থাকলেন কর্নেল।
জয় ব্যালকনিতে বসে কিছু খাচ্ছে। সারারাত সত্যিই কি সে হরটিলায় পাহারা দিচ্ছিল? মাধবজি তাকেই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রমলার সঙ্গে দেখেছেন। পরে তাকে পালিয়ে যেতেও দেখেছেন, মেয়েটির লাশও আবিষ্কার করেছেন।
তাহলে বলতে হয়, জয় বড় দক্ষ চতুর অভিনেতা। কিন্তু কেন সে রমলাকে খুন করবে–যদি রমলা হয় তার প্রেমিকা?
বাইনোকুলারে রাজবাড়ির নিচের তলাও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন কর্নেল। নিচের তলার বারান্দায় রঙ্গিয়া হেঁটে যাচ্ছে। নিজেদের ঘরে গিয়ে সে ঢুকল। দোতলার বারান্দায় জয়া দাঁড়িয়ে আছে। লেন্স অ্যাডজাস্ট করলে বিজয়ের ঘরের দরজার পর্দা ভেসে উঠল চোখে। মনে হল বিজয় তার ঘরে আছে।
হা। বুদ্বুরাম বেরিয়ে এল তার ঘর থেকে। নিশ্চয় এবার ভাগলপুর যাচ্ছে সে। তারদিকে লক্ষ্য রাখলেন কর্নেল। একটু পরে তাকে পোর্টিকোর তলা থেকে বেরিয়ে প্রধান ফটকের দিকে যেতে দেখা গেল। তারপর সে রাস্তা ধরে হনহন করে চলতে থাকল বাজারের দিকে।
কর্নেল বাইনোকুলারে উত্তর-পূর্বকোণে আউট-হাউস বা চিড়িয়াখানার টিলাটি দেখতে থাকলেন। হঠাৎ আউট-হাউসের শেষ জানালাটায় একটা মুখ দেখা গেল। তারপর নানকু যেন মাটি খুঁড়ে গজাল এবং জানালাটার কাছে গেল। কথা বলছে দুজনে। ভেতরকার লোকটা
কর্নে গৌরীটিলা থেকে নেমে বাগান ও ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে চলতে থাকলেন আউট-হাউসের টিলার দিকে। মাধবজি তখন ঠাকুরদালানে পুজোয় বসেছে। ঘণ্টার শব্দ শোনা যাচ্ছিল।..
.
বামুন গেছে যমের বাড়ি
নানকুর যেন জন্তুদের ইন্দ্রিয়। চিড়িয়াখানার তারের বেড়ার কাছে পৌঁছে কর্নেল দেখলেন, সে গিনিপিগের খাঁচায় ঘাস ঠেলে দিচ্ছে পিঠ এদিকে। বন্ধ গেটের সামনে কর্নেল দাঁড়ালে সে ঘুরল এবং সেলাম করে উঠে দাঁড়াল। বলল, “আসুন স্যার!”
লোহার মজবুত গরাদ দেওয়া গেট খুলে দিল সে। কর্নেল সোজা আউট হাউসের বারান্দায় গিয়ে উঠলেন। পেছনে নানকু জিজ্ঞাসার সুরে “স্যার” বলল। ডাইনে প্রথম ঘরটা খোলা এবং ভেতরে চিতাবাঘের খাঁচা রয়েছে। বাঁদিকের ঘরের দরজা বন্ধ ভেতর থেকে। সামনে করিডোরের পর দেয়াল। কর্নেল বাঁদিকের দরজায় নক করে কোনো সাড়া পেলেন না। নানকু অবাক হয়ে নিচের খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। একবার বলল, “বড়কুমারসাব তো রাজবাড়িতে আছেন স্যার।” কিন্তু কর্নেল তাকে গ্রাহ্য করলেন না।
তারপর পেছনদিকে দরজা খোলার চাপা শব্দ হতেই করিডর দিয়ে এগিয়ে দেখেন বাঁদিকে একটা বারান্দা রয়েছে এবং সেই বারান্দা থেকে একটা লোক সবে নেমে যাচ্ছে। বারান্দার নিচেই বড়বড় পাথর এবং খানিকটা দূরে গঙ্গা। কর্নেল ছুটে গিয়ে ডাকলেন, “পরিতোষবাবু! পরিতোষবাবু!”
সে পাথরের স্তূপের আড়ালে লুকিয়ে গেল। তখন কর্নেল রিভলবার বের করে বারান্দা থেকে একলাফে একটা পাথরে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, “পালানোর চেষ্টা করলে গুলি ছুঁড়তে বাধ্য ইর পরিতোষবাবু!”
পরিতোষ গুঁড়ি মেরে তাড়াখাওয়া প্রাণীর মতো বসে ছিল। দাঁত বের করে উঠে দাঁড়াল। তারপর নমস্কার করে বলল, “পালাইনি স্যার, এখানকার বাথরুমটা ভেঙে গেছে। তাই”।
“আসুন। ঘরে গিয়ে বসি।”
পরিতোষ একটু ইতস্তত করে বারান্দায় ফিরে এল এবং ঘরে ঢুকল। কর্নেল ঘরে ঢুকে এদিকের দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং করিডরের দিকের দরজাটা খুলে দিলেন। ঘরের ভেতর একটা তক্তাপোশে যেমন তেমন করে বিছানা পাতা রয়েছে। কয়েকটা ভাঙা বেতের চেয়ার আর একটা টেবিল রয়েছে একপাশে। পরিতোষ কোণঠাসা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কর্নেল নোংরা বিছানাটা সরিয়ে বসে বললেন, “বসুন পরিতোষবাবু।”
পরিতোষ বসে বলল, “আমাকে আপনি চেনেন স্যার?”
কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, “আপনার নামে তো পুলিশের হুলিয়া আছে।”
পরিতোষ মুখ নামিয়ে আঙুল খুঁটতে থাকল।
“নিখোঁজ বোনের খোঁজে কানাজোল এসেছিলেন আপনি। তারপর যখন জানতে পারলেন যে তাকে খুন করে লাশ লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তখন কী উদ্দেশ্যে কানাজোলে থেকে গেলেন আপনি? উঁহু-আমিই বলছি। বোনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে। কেমন? ঠিক বলছি তো?”
পরিতোষের হাত কাঁপছিল। মুখ তুলে আস্তে বলল, “আমি খারাপ। কিন্তু আমার বোন রমলা–” সে তোক গিলে ফের বলল, “রমলা ছিল খুব ভাল মেয়ে। সরল বলেই ভীষণ বোকা। আমার একমাত্র বোন কর্নেল! আমি চোর, মহাপাপী, কিন্তু রমলা তো পাপী ছিল না! তবুও কেন তাকে এমন করে মরতে হল?” পরিতোষ দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল।
কর্নেল বললেন, “পরিতোষবাবু, বড়কুমার জয়াদিত্যের সঙ্গে আপনার কীভাবে পরিচয় হয়েছিল?”
পরিতোষ রুমাল বের করে চোখ মুছে বলল, “শরদিন্দু ব্যাংকে আমার কলিগ, সে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। আমি কমবয়স থেকেই মদ খাওয়া ধরেছিলাম। তাই ভেবেছিলাম রাজামহারাজা লোকের ছেলে জয়াদিত্য। তার সঙ্গে ভাব করলে বিনাপয়সায় রোজ মদ খাওয়া যাবে। তাই জয়কে প্রথম আলাপের দিনই বারে নিয়ে গিয়েছিলাম। শরদিন্দু মদ খাওয়া পছন্দ করত না। যাই হোক, জয় প্রথমদিকে মদের মজাটা পেয়ে গেল। সে নিজেই প্রোপোজ করল, পরদিন সব খরচ তার, এটাই নিয়ম। পরদিন কথামতো পার্কস্ট্রিটের সেই বারে গিয়ে দেখি জয় হাজির। তারপর থেকে সে রোজ সন্ধ্যা ছটায় বারে হাজির থাকতো। কিছুদিন পরে দুদিন সে এলো না। তখন শরদিন্দুর কাছে খোঁজ নিয়ে তার হোস্টেলে গেলুম। কিন্তু তখনও আমি জানি না ওরা যমজ ভাই–যদিও শরদিন্দু বা জয় বলে বিজয়ের কথা, কিন্তু ওরা বলেনি যে জয়। ও বিজয় যমজ ভাই। তাই হোস্টেলের গেটে জয় ভেবে যাকে বারে নিয়ে যাবার জন্য সাধছি, সে বিজয় তা জানতুম না। আপনি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, দুভাইয়ের গলার স্বর, হাবভাব প্রায় একইরকম–মেজাজ বা স্বভাবচরিত্র যা আলাদা। শুধু আলাদা নয়, উল্টো।”
“ঠিক তাই। তারপর?”
“বিজয় ব্যাপারটা ফস করে বলল, আপনি আমাকে জয় ভেবেছেন। জয়কে আপনিই তাহলে মদ ধরিয়েছেন। এইসব বলে বিজয় আমাকে খুব শাসাল। ব্যাপারটা শরদিন্দুকে বললে সে খুব হাসল। যাই হোক, তার দিনকতক পরেই সকালে জয় আমার বাসায় হাজির। আমার ঠিকানা সে শরদিন্দুর কাছে যোগাড় করেছে। সে বিজয়ের হয়ে ক্ষমা চাইলো। তাকে খুব খাতির করে বসালাম। রাজকুমার শুনে মা–তখন মা বেঁচে ছিলেন, একেবারে অস্থির। রমলার সঙ্গে আলাপ হল জয়ের। সেই শুরু। এবার বাকিটা বুঝে নিন।”
“বিজয় এম. এ.-তে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু জয় বি. এ. পাশ করে চলে এল কেন জানেন?”
পরিতোষ মুখ নামিয়ে বলল, “সঠিক জানি না। তবে যে জানত, সে তো আর বেঁচে নেই।”
“রমলা জানত?”
পরিতোষ গলা ঝেড়ে একটু কেসে বলল, “আমার ধারণা রমলাকে নিয়ে দুভাইয়ে মনোমালিন্য হয়েছিল। তবে জয় গোঁয়ার, “পাগলাটে স্বভাবের ছেলে।”
“রমলারও নিশ্চয় আপনার মতো ভুল হয়ে থাকবে কে জয় বিজয় না চিনতে পেরে?”
পরিতোষ আস্তে বলল, “হ্যাঁ। রমলার ভুল করা স্বাভাবিক। সেজন্য আমি রমলাকে সাবধান করে দিইনি, তা নয়। কিন্তু রমলা বড্ড বোকা ছিল বরাবর। খুব সেন্টিমেন্টালও ছিল সে।”
“কিন্তু আপনি কি মনে করেন, রমলা যদি বিজয়কেই জয় বলে ভুল করে, বিজয় কি সেই সুযোগ নেবে?”
পরিতোষ গম্ভীর হয়ে গেল। একটু পরে বলল, “বিজয়ের সঙ্গে আদৌ মিশিনি। কাজেই জানি না কেমন স্বভাবের ছেলে। তবে জয় বিজয়ের প্রশংসাই করেছে বরাবর। বিজয় খুব নীতিবাগীশ।”
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে কয়েকটা আলতো টান মেরে ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর বললেন, “আপনি বোনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে এখনও কানাজোলে আছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, কে রমলাকে খুন করেছে?”
পরিতোষ গলার ভেতর বলল, “আমি খুঁজছি। এখনও বুঝতে পারছি না।”
“কাকে সন্দেহ বেশি?”
‘কমবেশির প্রশ্ন নয়, স্যার! আমার সন্দেহ এ বাড়ির সকলকেই।”
“জয়কেও?”
“হুউ।”
“বিজয়কে?”
“হুউ।”
কর্নেল বললেন, “জয় আপনাকে বলেনি তার, কাকে সন্দেহ?”
“জয় তো রমলাকে ভালবাসত।”
“বাসত বটে।”
“তাহলে রমলা তার কাছে এলে কেন সে তাকে খুন করবে?”
পরিতোষ চুপ করে রইল।
কর্নেল বললেন, “বলুন পরিতোষবাবু!”
পরিতোষ আস্তে বলল, “আপনার কথা আমি কাগজে প্রচুর পড়েছি। আমি জানি, আপনি একজন বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনাকে রাজবাড়িতে দেখে আমি মনে বল পেয়েছি স্যার। রমলাকে যেই খুন করুক, আপনি তাকে খুঁজে বের করবেন, আমি বিশ্বাস করি। দয়া করে আমার কাছে জানতে চাইবেন না আর।”
কর্নেল হাসলেন। “আমার কোনো অলৌকিক শক্তি নেই পরিতোষবাবু! আমি বাস্তব তথ্য থেকে যুক্তির সাহায্যে সিদ্ধান্তে আসি। আমি আপনার কাছে তথ্য চাইছি।”
পরিতোষ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, “জয় কলকাতা ছেড়ে যখন চলে আসে, তখন রমলা প্রেগন্যান্ট ছিল।”
“মাই গুডনেস!” কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন।
“রমলা পেটের বাচ্চাটা নষ্ট করেনি। মা তাকে রাজি করাতে পারেনি। শেষে সেই শোকে মা মারা গেল। রমলাকে আমি ভীষণ স্নেহ করতুম। তাই আমি ওকে কিছু বলিনি।”
“তারপর কী হল, বলুন?”
“রমলার একটি মেয়ে হল নার্সিংহোমে। জয়কে চিঠি লিখলুম। জয় অপমানজনক ভাষায় জবাব দিল যে রমলার সন্তান তার নয়। এমন কি লিখল রমলাকে সে ঘৃণা করে।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী! রমলা মেয়েকে মানুষ করতে লাগলো। রমলা স্টেনো টাইপিস্টের চাকরি পেয়েছিল। আলাদা বাসা নিয়ে থাকত।”
“রমলার মেয়ের এখন বয়স কত?”
“বছর আট-নয় হবে বোধ করি। ক্লাস ফোরে পড়ে।”
“এখন সে কোথায়?”
পরিতোষ এতক্ষণে সিগারেট ধরালো। কিছুক্ষণ সিগারেট টানার পর বলল, “আমার ভাগ্নীর ডাক নাম ছিল মিমি। আসল নাম জয়িতা। রমলা কেন এ নাম রেখেছিল, বুঝতে পারছেন তো?
“পারছি। মিমি এখন কোথায়?”
“মিমিকে বালিগঞ্জে একটা আবাসিক স্কুলে রেখেছিল রমলা। মাঝেমাঝে দেখে আসত। আমার নামে হুলিয়া। লুকিয়ে বেড়াচ্ছি। সম্প্রতি কলকাতা গিয়ে রমলার সঙ্গে দেখা করতে গেলুম। গিয়ে দেখি, তার ফ্ল্যাট তালাবন্ধ। পাশের ফ্ল্যাটে খোঁজ নিলুম। এক ভদ্রমহিলা বললেন, রমলা কদিন থেকে নেই। কোথায় গেছে বলে যায়নি। মিমিদের স্কুলে গেলুম। মিমি, আমাকে দেখে কাঁদতে শুরু করল। বলল, মাম্মি কেন আসছে না। তখন আমার সন্দেহ হল, কানাজোলে যায়নি তো? মিমির স্কুলে পরদিন থেকে পুজোর ছুটি শুরু হচ্ছে। সুপারিন্টেন্ডেন্ট মহিলা”
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, “মিমি আপনাকে চিনত?”
“হ্যাঁ। আমি ফেরারি হয়ে বেড়ালেও মাঝেমাঝে গিয়ে রমলা আর মিমির খোঁজ নিতুম। রমলার সঙ্গে বারকতক মিমিকে দেখতে গেছি। তাই সুপারিন্টেন্ডেন্ট মহিলা আমাকে চিনতেন। তবে জানতেন না আমি ফেরারি আসামি।” পরিতোষ থেমে আঙুল খুঁটতে থাকল।
”বেশ। বলুন।”
“ভদ্রমহিলা বললেন, “বরং মিমিকে নিয়ে যান। কাল থেকে হোস্টেল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওর মা আজও এলেন না। আমি তো সমস্যায় পড়েছি কী করব ওকে নিয়ে।”
“আপনি মিমিকে নিয়ে এলেন?”
“হ্যাঁ। সোজা কানাজোলে চলে এলুম। রাজবাড়িতে বিপ্রদাসবাবুর সঙ্গে আলাপ হল। ওঁকে সব কথা বললুম। উনি প্রথমে তো পাত্তাই দিলেন না। তারপর জয়কে ডেকে পাঠালেন।”
“কোন তারিখে এবং কখন?”
“১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টা-টাতটা হবে।”
“তারপর কী হল বলুন?”
“জয় এসে আমাকে দেখে চমকে গেল। তারপর মিমিকে কোলে তুলে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল।”
“একমিনিট।” বলে কর্নেল জানালার দিকে লক্ষ্য করে বললেন, “জয় আসছে। ও আসার আগে সংক্ষেপে বলুন।”
পরিতোষ রুমালে নাক ঝেড়ে বলল, “জয় মিমিকে কিছুতেই ছাড়বে না। কিন্তু বিপ্রদাসবাবু বললেন–কেন বললেন এখনও বুঝতে পারিনি, মিমিকে রাজবাড়িতে রাখা আপাতত ঠিক হবে না। ভাগলপুরে ওঁর বোনের কাছে কিছুদিন রেখে আসা ভাল। তখনও জানি না, রমলা খুন হয়েছে। তো জয় বিপ্রদাসবাবুর কথায় সায় দিল। তখনই বিপ্রদাসবাবু আমাকে আর মিমিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আটটার ট্রেনে আমরা ভাগলপুর গেলুম। বিপ্রদাসবাবুর বোনের বাড়িতে রাত্তিরটা আমি থাকলুম। বিপ্রদাসবাবু সেই রাত্তিরেই ফিরে এলেন কানাজোল। মিমি ওখানেই থাকল। আমি পরদিন চলে এলুম-কানাজোলে। এই আউটহাউসে জয়ের সঙ্গে দেখা হল। তখন জয় বলল, ৯ তারিখে রমলা আসবে লিখেছিল। স্টেশনে তাকে থাকতে বলেছিল। কিন্তু স্টেশনে যেতে দেরি হয়ে যায়। তারপর রমলার কী হয়েছে, সে জানে না। শুনেই আমার বুকটা–”।
বাইরে জয়ের সাড়া পাওয়া গেল। সনি গরগর করে উঠল। জয় সোজা এসে ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল।
কর্নেল হাসলেন। “এস জয়। তুমি তো রমলার দাদার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দাওনি। তাই নিজে থেকেই পরিচয় করতে এসেছিলুম।”
জয় ভুরু কুঁচকে বলল, “আপনি কেমন ডিটেকটিভ মশাই, আপনার নাকের ডগায় আবার একটা খুনখারাপি হয় আর আপনি শুধু বকরবকর করে ঘুরে বেড়ান?”
কর্নেল মুহূর্তে শক্ত হয়ে বললেন, “মাধবজি খুন হয়েছেন কি?”
জয় বিকৃতস্বরে বলল, “আপনার মাথা! বিজয়টা একটা বুদ্বু। তাই কার পরামর্শে আপনার মতো একটা গবেট গোয়েন্দা ভাড়া করে এনেছে। যান, গিয়ে দেখুন কাকাবাবুর ঘরে কাকাবাবুর ডেডবডি পড়ে আছে। পচা গন্ধে অস্থির। আপনার নাকও নেই মশাই! কলাবতী টের না পেলে–”
কর্নেল সবেগে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।…
.
রহস্যের শেষ প্রান্তে
ভুতুড়ে ছড়াটা সত্যি হল তাহলে! কর্নেলের সত্যিই দাড়ি ছেঁড়ার অবস্থা। কলাবতী রোজ সকালে সব ঘরে ঝাড় দেয়। ওপরতলার তিনটে বন্ধ ঘর বাদে সব ঘরে তাকে ঝাড়ু দিতে হয়। হলঘর আর বিপ্রদাসজির ঘরের একটা করে ডুপ্লিকেট চাবি তার কাছে থাকে। বিপ্রদাসজি তাকে বিশ্বাস করতেন। গতকাল সকালে যখন সে বিপ্রদাসজির ঘরে ঝাড় দেয়, তখন বিপ্রদাসজি ঘরে ছিলেন। বলেছিলেন, জরুরি কাজে ভাগলপুর বহিনজির বাড়ি যাবেন আটটার ট্রেনে। দুদিন থাকবেন। আজ সকালে কলাবতী প্রথমে হলঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে বদ গন্ধ পায়। সে ভেবেছিল কোথাও চুহা মরে পড়ে আছে। হলঘর থেকে বিপ্রদাসজির ঘরে ঢোকা যায়। কিন্তু সে দরজাটা বন্ধ। তার সন্দেহ হয়, তাহলে বিপ্রদাসজির ঘরে চুহা মরেছে। সে বারান্দায় এসে বিপ্রদাসজির ঘরের তালা খোলে। জানালা বন্ধ ছিল। পচা গন্ধে অস্থির হয়ে সে জানালা, ওপাশের দরজা সব খুলে দেয়। আলো জ্বেলে চুহাটাকে খুঁজতে থাকে। তারপর তার। চোখে পড়ে, খাটের তলা থেকে মানুষের একটা পা বেরিয়ে আছে। সে ভয় পেয়ে চেঁচামেচি শুরু করে। তখন নছি সিং, বৈজু, তারপর জয়া দৌড়ে আসে। রঙ্গিয়া ইঁদারায় পাম্প চালিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সেও দৌড়ে আসে। শেষে আসে বিজয়। এসে হুকুম দেয় টেনে বের করতে। নছি সিং টেনে বের করলে সবাই চমকে উঠে দ্যাখে, বিপ্রদাসুজির মাথার মাঝখানটা থ্যাতলানো। রক্ত জমাট বেঁধে আছে। হাতুড়ি বা ওইরকম কিছু শক্ত ভারী জিনিস দিয়ে মাথায় মারা হয়েছে। মেরে বডিটা খাটের তলায় ঢোকানো হয়েছে।
জয় আসে অনেক পরে। একটু দাঁড়িয়েই সে চলে যায়।
কর্নেল গিয়েই নছি সিংকে থানার পাঠিয়েছিলেন। পুলিশের গাড়ি এল প্রায় আধঘণ্টা পরে। জয়া তার ঘরে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। তাকে কলাবতী সান্ত্বনা দিচ্ছিল। বিজয়ও দুহাতে মুখ ঢেকে শিশুর মতো কাঁদছিল হলঘরে বসে।
কানাজোল পুলিশ স্টেশনের ও সি রাঘবেন্দ্ৰ শৰ্মা কর্নেলকে দেখে অবাক হয়েছিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, “প্রবাদ শুনেছিলুম, যাহা ভি যাতা হ্যায় কর্নেল, উঁহাভি খুনখারাপিকা খেল। ক্ষমা করবেন কর্নেল সরকার! গতবছর। কলকাতার ডিটেকটিভ ট্রেনিং সেন্টারে একটা কনফারেন্সে গিয়ে প্রবাদটা শুনেছিলুম। যাই হোক, ব্যাকগ্রাউন্ড তো ইতিমধ্যে আপনার নিশ্চয় জানা হয়ে গেছে। বলুন–হ্যাউ টু প্রসিড!”
কর্নেল আস্তে বললেন, “যত শিগগির পারেন, বুদ্বুরামকে গ্রেফতার করুন।”
“কে বুদ্বুরাম?”
“এই রাজবাড়ির চাকর। আমার ধারণা, পুরনো রেকর্ডে ওর পরিচয় থাকা সম্ভব।”
রাঘবেন্দ্র তার সঙ্গে আসা সাব-ইন্সপেক্টরের দিকে ইশারা করলেন। তখন কর্নেল দ্রুত বললেন, “বুদ্বুরাম রাজবাড়িতে নেই। তাকে পাঠানো হয়েছে বিপ্রদাসজির খোঁজে। আমার মনে হয়, এই সুযোগে আসলে সে গা ঢাকা দিয়েছে। তাকে খুঁজে বের করা দরকার।”
সাব-ইন্সপেক্টর বেরিয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। রাঘবেন্দ্র কর্নেলের দিকে। তাকালেন। কর্নেল বললেন, “আপনাদের রুটিন ওয়ার্ক শেষ হোক। তারপর কথা হবে।”
একটু পরে অ্যামবুল্যান্স এল। ফোটোগ্রাফার এল। মর্গের লোকেরা এল। প্রাথমিক তদন্ত ও একে একে বাড়ির সবাইকে ডেকে স্টেটমেন্ট নেওয়া হল শুধু জয় আর নানকু বাদে।
কর্নেল বললেন, “আপনার কলিগরা বাকি কাজ সেরে ফেলুন। ততক্ষণ আউটহাউসে বড়কুমার আর নানকুর স্টেটমেন্ট নেবেন চলুন মিঃ শর্মা।”
দক্ষিণের বাগান আর পোডড়া জমি দিয়ে যাবার সময় ঠাকুরদালানের কাছে এসে কর্নেল দেখলেন, মাধবজি তার ঘরের ভেতর রান্না করতে বসেছেন। রাঘবেন্দ্র বললেন, “এখানে কে থাকে?”
কর্নেল দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। রাজবাড়ির ভেতর দেড়ঘণ্টা যাবৎ যে হুলুস্থূল চলেছে, মাধবজি নিশ্চয়ই টের পাননি। তাহলে এমন নিশ্চিন্তে বসে রান্না করতে পারতেন না। ছুটে যেতেন।
আসলে লোকটিকে কেউ গণ্য করে না রাজবাড়ির একজন বলে। কর্নেল রাঘবেন্দ্রের প্রশ্নের জবাবে বললেন “মাধবজি এই ঠাকুরদালানের সেবায়েত। মিঃ শর্মা, উনি আপনার কেসের একজন শক্ত সাক্ষী।”
“বলেন কী! তাহলে তো আগে ওঁর সঙ্গেই কথা বলতে হয়।”
কর্নেলের ডাকে মাধবজি বেরিয়েই ভড়কে গেলেন। কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন, “নমস্তে”!
কর্নেল বললেন, “খবর খারাপ, মাধবজি। আপনি জানেন না কিছু?”
মাধবজি ভাঙা গলায় বললেন, “বড়কুমারকে গ্রেফতার করেছেন, মালুম হচ্ছে ।”
‘না। বিপ্রদাসজিকে কে খুন করে গেছে!”
মাধবজি আর্তনাদের সুরে বললেন, “হায় ভগবান! কে এমন কাজ করল? অমন সাচ্চাদিল মানুষটাকে–তার হাতে কুষ্ঠব্যাধি হবে। আমি অভিশাপ দিচ্ছি!”
নাক ঝেড়ে চোখ মুছে মাধবজি ফের বললেন, “হাম সমঝ লিয়া, হুজুর! আমি সব বুঝতে পেরেছি কেন বিপ্রদাসজিকে খুন করেছে।”
“কেন মাধবজি?”
“সেই অচেনা বে-পহচান লেড়কিকে খুন করার কথা বিপ্রদাসজি আর আমিই শুধু জানি। তাই প্রথমে বিপ্রদাসজিকে খুন করে মুখ বন্ধ করে দিল। এবার আমাকেভি খুন করবে। আমাকে আপনারা বাঁচান, হুজুর!”
মাধবজি করজোড়ে কান্নাকাটি করতে থাকলেন। রাঘবেন্দ্র অবাক হয়ে বললেন, “মনে হচ্ছে, আরও একটা মার্ডারের ব্যাপার আছে এবং সেজন্যই আপনার এখানে আসা, কর্নেল!”
কর্নেল বললেন, “দ্যাটস এ লং স্টোরি, মিঃ শর্মা। একটু অপেক্ষা করুন।” বলে মাধবজির দিকে ঘুরলেন, “মাধবজি, হরটিলার শিবলিঙ্গের বেদিটা কীভাবে খোলা যায় আপনি তো জানেন!”
“জি হাঁ কর্নেলসাব! বিপ্রদাসজির কাছে চাবি ছিল। সেই চাবি দিয়ে খোলা যায়।”
“ওই গোপন সিন্দুকটা।”
বাধা দিয়ে মাধবজি বললেন, “সিন্দুক নয় হুজুর, ওটা একটা পাতাল-খন্দক। ইঁদারার মতো। নিচে পাতাল-গঙ্গা বইছে। আমি কেমন করে জানব বলুন? বিপ্রদাসজি বলেছিলেন।”
“বলেন কী! তাহলে তো সেই লাশটা পাওয়া যাবে না?”
“না পাতাল গঙ্গায় গিয়ে পড়লেই তো মাগঙ্গা ওকে টেনে নেবেন।” মাধবজি আবার ফোঁস ফোঁস করে নাক ঝেড়ে বললেন, “বিপ্রদাসজি বলেছিলেন, আগের আমলে রাজাবাহাদুররা দুশমন লোকেদের মেরে ওইখানে লাশ ফেলে দিতেন। কেউ জানতে পারত না।”
কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, “আপনি রান্না করুন নিশ্চিন্তে। আর কোনো ভয় নেই আপনার। বিপ্রদাসজির খুনীকে ধরতে পুলিশ বেরিয়ে পড়েছে।”
মাধবজি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কর্নেল বললেন, “মিঃ শৰ্মা, একটু ধৈর্য ধরুন। দ্যাটস এ লং স্টোরি।”
আউটহাউসের দিকে যেতে যেতে কর্নেল ভাবছিলেন, বিপ্রদাসজি জয়াকে ডেকে ওই পাতাল-খন্দকের চাবি দেন। তার খুনী ওঁত পেতে বেড়াচ্ছিল তাঁকে খুন করার জন্য। ভাগলপুর যাচ্ছেন শোনামাত্র সে সুযোগ পেয়ে যায়। তখনই খুন করলে সে লাশ পাচারের জন্য একটা রাত্রি সময় পাবে। কলাবতী ঘরে। ঝাড় দিতে ঢুকবে পরের দিন সকালে–সে জানে। রাত্রে লাশটা সরিয়ে ফেললে আর কেউ টের পাবে না কিছু। সবাই ভাববে, বিপ্রদাসজি ভাগলপুরে বোনের বাড়ি গেছেন এবং তারপর তার নিপাত্তা হওয়া নিয়ে পুলিশ অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াবে।
তাহলে সে জনত, লাশ নিপাত্তা করে দেওয়ার একটা চমৎকার জায়গা আছে এবং ওই হরটিলার শিবলিঙ্গের তলায় পাতাল-খন্দক।
এমন কি সে আরও জানত জানত, বেদিটা খোলার জন্য গোপন তালা ও চাবি আছে। বিজয় ও জয়ার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তারা এই পাতাল খন্দকের কথা জানে না। জানে তাদের ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র জয়। কারণ জয় বলেছে, রমলার লাশ ওখানে লুকানো আছে। কিন্তু জয় জানে না ওটা পাতাল-খন্দক। জানেন শুধু মাধবজি, আর জানতেন বিপ্রদাসজি। তার চেয়ে বড় কথা, তার, হত্যাকারী কে সেকথা ভালই জানতেন।
অতএব সে কি বিপ্রদাসজির অনুগত লোক? কিংবা দৈবাৎ জানতে পেরেছিল?
ঘটনাটা সাজানো যাক ও খুনী ওঁত পেতে বেড়াচ্ছিল। জয়াকে বিপ্রদাসজি চাবির কৌটোটা গোপনে দিচ্ছেন, তার নজর এড়ায়নি। জয়া সেটা নিয়ে ওপরে চলে গেলে সে বিপ্রদাসজির ঘরে ঢোকে। ওই সময় কর্নেল বিজয়কে নিয়ে গঙ্গার ধারে অন্ধ প্রজাপতি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বিপ্রদাসজির ঘরে ঢুকে–
হঠাৎ কর্নেলের মনে পড়ল, ও-ঘরেও জয়ার মতো আবছা ক্লোরোফর্মের গন্ধ পাচ্ছিলেন।
ঠিক তাই। খুনী প্রথমে ক্লোরোফর্মে বিপ্রদাসজিকে অজ্ঞান করে তারপর মাথায় শক্ত কিছুর আঘাত করে। খুলি ফেটে যায়। বডিটা খাটের তলায় ঢুকিয়ে পকেট হাতড়ে চাবি নিয়ে দরজায় তালা এঁটে সে ওপরে চলে যায়। জয়াকে অজ্ঞান করে চাবির কৌটো হাতিয়ে নেয়। কাল বিকেলে হরটিলায় গিয়ে সে কি পরীক্ষা করে দেখছিল পাতাল-খন্দক আছে কি না? চাবিটা ভেঙে যায়। তারপর কর্নেল ও বিজয় গেলে সে লুকিয়ে পড়ে।
হ্যাঁ, কর্নেল তারই ছায়া দেখেছিলেন। সম্ভবত তার মতলব ছিল কর্নেলকেও খুন করবে। সাহস পায়নি। রাতে জয় ও তার কুকুর পাহারা দিচ্ছিল। কাজেই সে ওখানে আর যেতে পারেনি–নইলে বেদি ভেঙে ও বিপ্রদাসজির লাশ নিপাত্তা করে দিত।…
আউটহাউসের টিলায় উঠতে উঠতে হঠাৎ রাঘবেন্দ্র ডাকলেন, “কর্নেল সরকার!”
“বলুন!”
“বুদ্বুরামকে কেন আপনার সন্দেহ?”
কর্নেল একটু হাসলেন। “সামান্য একটা কারণে। তার গায়ে একটা ছাইরঙা স্পোর্টিং গেঞ্জি দেখেছি আজ সকালে। অবশ্য কাছে থেকে নয়, বাইনোকুলারে দূর থেকে। তবে আমার বাইনোকুলারটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং বিশ্বাসযোগ্য।”
“আপনার হেঁয়ালি বোঝা কঠিন।” রাঘবেন্দ্র হাসতে লাগলেন।…
জয় কাঁধে কাকাতুয়া নিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে কর্নেল ও রাঘবেন্দ্রকে দেখছিল। নানকু ঘাস কুচো করছিল। পাশে গামলায় ভেজানেনা মটর আর ছোলা। মুখ ঘুরিয়ে সে একবার দেখল মাত্র।
কর্নেল বললেন, “এক মিনিট মিঃ শর্মা। আমি আগে জয়কে কয়েকটি প্রশ্ন করে নিই।”
রাঘবেন্দ্র বললেন, “ওক্কে। করে নিন।”
কর্নেল বললেন, “জয়, তুমি কি জানো হরটিলার শিবলিঙ্গের বেদিটা সিন্দুক নয়, আসলে একটা পাতাল-খন্দক এবং নিচে গঙ্গা বইছে?”
জয় অবাক হল। কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর মাথাটা নাড়ল।
“তুমি ওই বেদির চাবি থাকার কথা জানতে?”
“না। শুধু জানতাম বেদির তলায় নাকি গুপ্তধন আছে।”
“কে বলেছিল তোমাকে?”
“মনে নেই। ছোটোবেলায় শুনেছি কারো কাছে।”
“তাহলে চাবির কথা জানতে না?”
“না, না, না। এক কথা হাজারবার বলতে ভাল লাগে না।” বলে রাঘবেন্দ্রের দিকে ঘুরল। “আমাকে গ্রেফতার করতে এসে থাকলে করুন। দেরি করে লাভ নেই।”
কর্নেল বললেন, “আরও প্রশ্ন আছে জয়!”
“ঝটপট করুন।” বলে সে বাঁকা হাসল। “পরিতোষ সম্পর্কে প্রশ্ন থাকলে বলে দিচ্ছি, সে ভাগলপুরে চলে গেল। রমলার মেয়েকে নিয়ে চলে যাবে। কলকাতা। তাকে”
বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, “জয়, বিজয়ের কাছে তোমার তো কোনো কথা গোপন থাকেনি কোনোদিন–তাই না?”
হ্যাঁ, কেন?”
“৯ই সেপ্টেম্বর রমলা আসছে, তাকে বলেছিলে?”
জয় তাকালো কর্নেলের দিকে। নাসারন্ধ্র ফুলে উঠল। বলল, “হ্যাঁ।”
“বিজয় দাড়ি রাখতে শুরু করেছে, ৯ই সেপ্টেম্বরের পরে–তাই তো?”
জয় চুপ করে থাকল।
“জবাব দাও, জয়!”
নানকু কাজ থামিয়ে এদিকে ঘুরে কান করে শুনছিল। সে বলে উঠল, “কুমারসাব। আর মুখ বন্ধ করে থাকবেন না। এরপর আপনার জানটাও চলে যাবে”
জয় ঘুরে গিয়ে তাকে লাথি মারল। নানকু লাথি খেয়ে পড়ে গেল। তারপর দ্রুত উঠে একটু তফাতে সরে গেল। “আর আমি চুপ করে থাকব না। সব বলে দেবকে ময়ালসাপের খাঁচা খুলে দিয়েছিল, কে কাকাতুয়ার জিভ কেটে যোবা করে দিয়েছেল, কে বহুরানীকে স্টেশন থেকে : করে এনে”।
জয় আবার তাকে লাথি মারতে গেল, কর্নেল ধরে আটকালেন। জয় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “নেমকহারাম! মিথ্যাবাদী! যা–আজ থেকে তোর চাকরি খতম! দূর হয়ে যা গিদ্ধড় কা বাচ্চা! বোবা কাকাতুয়া ভয় পেয়ে তার কাঁধ থেকে উড়ে ক্যানারি পাখির খাঁচার ওপর বসল। তখন নানকু পাখিটাকে ধরে দাঁড়ে বসাতে গেল।
কর্নেল এবার পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করে বললেন, “এই লেখাটা তুমি চিনতে পারো কি না দেখ তো জয়!”
জয় তাকিয়ে দেখে বলল, “আমি বাংলা পড়তে পারি না।”
“মিথ্যা বোলো না জয়! তোমরা দুভাই-ই বাংলা শিখেছিলে কলকাতায়।” কর্নেল তার কাঁধে হাত রাখলেন। জয় মুখ নামিয়ে কাঁদতে থাকল। কর্নেল বললেন, “এই পদ্যটা বিজয়ের হাতের লেখা–তাই না?” জয় মাথাটা একটু দোলালো। এবার কর্নেল রাঘবেন্দ্রের দিকে ঘুরে বললেন, “আমার প্রশ্ন শেষ। আপনি স্টেটমেন্ট নিতে চাইলে নিতে পারেন এবার।”
রাঘবেন্দ্ৰ কাঁধ ঝাঁকিয়ে দুহাত একটু দুলিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, “আগে আপনার কাছে পুরো ব্যাকগ্রাউন্ড না নিয়ে আমি আর একপাও বাড়াতে চাইনে কর্নেল!”…
.
মর্মান্তিক
আগাগোড়া সব শোনার পর রাঘবেন্দ্র উত্তেজিতভাবে বললেন, “তাহলে এখনই গিয়ে ছোটকুমারসাবকে গ্রেফতার করা দরকার।”
কর্নেল বললেন, “কেন?”
রাঘবেন্দ্র ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। “কেন করব না? তিনিই তো রমলা দেবীকে”।
কর্নেল হাসলেন। বাধা দিয়ে বললেন, “ইন্ডিয়ান পেনালকোড অনুসারে মার্ডার একটা কগনিজি অফেন্স। পুলিশ কারুর কাছে অভিযোগ না পেলেও নিজে থেকে অ্যাকশান নিতে পারে। ঠিক কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে রমলার ডেডবডি কোথায়? ডেডবডি পেলে তবে তো কাউকে গ্রেফতারের কথা ওঠে। তাছাড়া জয় তো নালিশ করছে না। করলেও প্রথমে দরকার ডেডবডি।”
আউটহাউসের সেই ঘরটায় বসে কথা বলছিলেন তারা। জয় দ্রুত বলল, “না। আমার কোনো নালিশ নেই কারুর বিরুদ্ধে।”
রাঘবেন্দ্র বললেন, “আপনাকে আমরা প্রসিকিউশন উইটনেস করতে পারি।”
“বাট ইউ নিড দি ডেডবডি! পাতাল-খন্দকে ডুবুরি নামাতে পারেন অবশ্য।”
রাঘবেন্দ্র গম্ভীর হয়ে বললেন, “চেষ্টা করে দেখব।”
“কিন্তু ডেডবডি যতক্ষণ না পাচ্ছেন, বিজয়কে গ্রেফতার করবেন কোন আইনে?”
রাঘবেন্দ্র বিব্রত হয়ে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, “কেন? বিপ্রদাসকে মার্ডারের চার্জ আনা যায় না?”
“না। কারণ আমি তার ডিফেন্স উইটনেস। বিজয় কাল সারা সকাল থেকে আমার সঙ্গে ঘুরছিল। বিপ্রদাসবাবুকে খুন করেছে বুদ্বুরাম এবং জয়াকে যে অজ্ঞান করেছিল–সেও বুদ্বুরাম। কাজেই আইনত বিজয়কে ততক্ষণ গ্রেফতার করতে পারছেন না, যতক্ষণ না বুদ্বুরামকে গ্রেফতার করে তার কাছে কনফেসন আদায় করতে পারছেন। আমি আইনের কথাই বলছি মিঃ শর্মা!”
রাঘবেন্দ্র হাসতে হাসতে বললেন,”ওকে, ওকে! কিন্তু আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন, বিজয়সাবই বুদ্বুরামের সাহায্যে–”
কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, “লেট বুদ্বুরাম কনফেস। আগে তাকে গ্রেফতার করুন। সে কী বলছে আগে জানা দরকার।”
রাঘবেন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন। “চলুন–দেখি ওদিকে কী হল।”
টিলা থেকে নামবার সময় বললেন, “এটাই আশ্চর্য লাগছে, বিজয় কেন আপনাকে ডেকে নিয়ে এল? সে তো জানে, আপনি রহস্যভেদী ধুরন্ধর মানুষ। আপনি জেনে ফেলবেন সব কথা। অথচ সে আপনাকে একটা বাজে অজুহাত দেখিয়ে নিয়ে এল।”
কর্নেল বাইনোকুলারে পাখি দেখছিলেন নামিয়ে বললেন, “কী বলছিলেন যেন।”
“বিজয় আপনাকে নিয়ে এল কেন? নিজেকে ধরিয়ে দেবার জন্য নিশ্চয় নয়?”
“নিশ্চয় নয়।”
“তাহলে?”
কর্নেল আবার বললেন, “আগে বুদ্বুরামকে গ্রেফতার করুন। লেট হিম কনফেস।”
“কর্নেল! তাহলে দুঃখের সঙ্গে বলব, রহস্যভেদী হিসেবে আপনি নিশ্চয় একজায়গায় এসে ব্যর্থ হয়েছেন।”
“ঠিকই বলেছেন মিঃ শর্মা!” কর্নেল শ্বাস ফেলে অন্যমনস্কভাবে বললেন, “একটা জায়গায় এসে আমি সামনে দেয়াল দেখছি। আর এগোনো যাচ্ছে না।”
“হু–সম্ভবত সেটা হল? কেন বিজয় আপনাকে ডেকে আনল–এই তো?”
“ইউ আর এগেন ড্যাম রাইট।” বলে কর্নেল লম্বা পায়ে হঠাৎ জোরে হাঁটতে থাকলেন।
রাঘবেন্দ্র সঙ্গ ধরার চেষ্টা করে বললেন, “কেন হঠাৎ আপনি এমন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন কর্নেল?”
“শিগগির চলুন! রাজবাড়িতে আবার কী ঘটেছে মনে হচ্ছে।”
.
উপসংহার
বিজয় তার ঘরের কড়িকাঠ থেকে ঝুলছিল। তার লেখার টেবিলে কবিতার খাতায় তার জবানবন্দী পাওয়া যায়। বিজয় লিখেছিলঃ
“আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। জানি, আমার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে জয়। জয়ার মনটা শক্ত। সে সহ্য করতে পারবে। জয়ের জন্যেই মরতে একটু দ্বিধা ছিল। নইলে ৯ই সেপ্টেম্বর রাতেই ঠিক করেছিলুম আমি মরব। পারিনি। শেষে শরদিন্দু খুন হল। তখন ঠিক করলাম, যে পাপ করেছি-জয়ের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের মহাপাপ, তার প্রায়শ্চিত্ত করার আগে অন্তত একটা ভাল। কাজ করে যাই। জয়কে জানয়ে দিই যে সত্যি আমি রমলাকে খুন করিনি। শরদিন্দুর খুনী যে, সেই রমলার খুনী। কিন্তু জয় আমার কথা যদি আর বিশ্বাস না করে! তাই কলকাতায় গিয়ে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে নিয়ে এলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, কর্নেল শরদিন্দুর মৃত্যুরহস্য ভেদ করলেই রমলার মৃত্যুরহস্য জেনে ফেলবেন এবং জয়কে জানিয়ে দেবেন যে বিজয় রমলাকে খুন করেনি–জয়ের ধারণাটাই ভুল। কিন্তু কর্নেলের দেখলুম পাখি-প্রজাপতির দিকে যত মন, আমার কাজটার দিকে তত নেই। ওয়ার্থলেস! আমি চাইছিলুম, উনি নিজের বুদ্ধির জোরে সব জেনে নিন। তাহলে জয়ের বিশ্বাস হবে। আমি বলেছি শুনলে জয় বিশ্বাস করবে না। কারণ জয়ের বিশ্বাস হারিয়েছি কলকাতায় থাকার সময়েই।
হা–আমার পাপের সূত্রপাত কলকাতায় থাকার সময়।
রমলা আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো তফাত বুঝতে পারত না প্রথম প্রথম। শুধু চেহারার জন্য নয়, জয় আমাকে রমলার ব্যাপারে কোনো কথা গোপন করত না বলেই। রমলা আমাকে জয় ভেবে সেইরকম ব্যবহার করত এবং আমি সেই সুযোগ নিতুম। জয়ের মেজাজ নকল করতুম। জয় ওর সঙ্গে মেলামেশার জন্য গোপনে ফ্রিস্কুল স্ট্রিটে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল। জয়ের অনুপস্থিতির সুযোগে রমলাকে সেখানে নিয়ে যেতুম। বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন দেখি না। এভাবেই চলছিল। কিন্তু জয় এবং রমলা দুজনেই। ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিল কিছুদিনের মধ্যেই। তারপর জয় আমার সঙ্গে ঝগড়া করে আর এম. এ.-তে ভর্তি হল না। কলকাতা ছেড়ে চলে গেল। তারপর আমি রমলাকে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলুম। রমলা আমাকে ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান। করেছিল।
কিন্তু রমলাকে আমি ভালবেসে ফেলেছিলুম। তার কথা কিছুতেই ভুলতে পারিনি। তার নামে অসংখ্য কবিতা লিখেছি। সব রেখে যাচ্ছি। সে জয়ের. প্রেমিকা, তাই আমারও প্রেমিকা। কারণ জয় আর আমি যে একই আত্মার দুটি অংশ। কেমন করে ভুলব রমলাকে?
গত ৯ই সেপ্টেম্বর যখন জয় আমাকে জানাল, রমলার চিঠি এসেছে–আজই সাড়ে ছটায় আপ দিল্লি এক্সপ্রেসে সে আসছে, আমি লোভে অস্থির হয়ে উঠলুম। জয়ের জুতে গিয়ে সাপটার খাঁচা খুলে দিলুম। জানতুম, জয় সাপটাকে আগে না খুঁজে কোথাও যাবে না। রমলার চেয়েও ওর এই নেশাটা এখন বেশি। স্টেশনে রমলা আমাকে ভাল করে যাচাইয়ের চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার চিঠিটা আমার কাছে। জয় আমাকে দিয়েছে সেটা। রমলা আমাকে জয় না। ভেবে যাবে কোথায়? ওকে মিথ্যা করে বললুম, এখন সরাসরি বাড়ি নিয়ে। গেলে স্ক্যাণ্ডাল উঠবে–রাজবাড়ির ব্যাপার। তাই আপাতত আউটহাউসে যাই। কিন্তু জয়ের কথা ভেবে ওকে হরটিলার দিকে নিয়ে চললুম। আমনি রমলার। সন্দেহ হল। সে টিলার নিচে গিয়ে বেঁকে দাঁড়াল। আমি তখন ওকে পাওয়ার জন্য উন্মাদ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নির্জন জঙ্গল। আমি ওকে জড়িয়ে ধরলুম। সে আমাকে চড় মারল। গালাগালি দিতে শুরু করল। জানাজানির ভয়ে আমি তখন ওকে ফেলে দৌড়ে পালিয়ে গেলুম। হঠকারিতায় এতখানি এগিয়ে আমার জ্ঞান ফিরে এসেছিল এতক্ষণে।
তারপর লজ্জায়, দুঃখে, অনুতাপে আমি আর বাড়ি থেকে বেরোইনি। প্রতিমুহূর্তে ভাবছি, জয় এসে আমাকে চার্জ করবে। কিন্তু জয়ের সাড়া নেই। রঙ্গিয়া খেতে ডাকতে এল। বললুম, “খাব না। শরীর ভালো নেই।” রাত দশটায় হঠাৎ বুদ্বুরাম এসে সেলাম দিল। বললুম “কী চাই?” বুদ্বুরাম একটু হেসে বলল, “হরটিলার নিচের জঙ্গলে একটা লাশ পড়ে আছে।” চমকে বললুম, “কী বাজে কথা বলছিস হতভাগা?” বুষ্টু বলল যে, লাশটার কথা সে কাউকে বলবে না–যদি আমি তাকে একশো টাকা দিই। থরথর করে কেঁপে উঠলুম। রমলাকে কি জয়ই রাগের বশে খুন করে ফেলেছে? তবে সেই শুরু হল বুদ্বুরামের ব্ল্যাকমেল করা। যখন-তখন সে টাকা দাবি করে। শুধু জয়ের কথা ভেবে মুখ বুজে থাকি। টাকা দিই। অবশেষে শরদিন্দুকে গোপনে ব্যাপারটা জানালুম। শরদিন্দু বলল, যে একজন প্রাইভেট ডিডেটিভ লাগিয়ে রমলার ডেডবডিটা উদ্ধার করে বুন্ধুকে সরিয়ে দেওয়া দরকার। কারণ তার বিশ্বাস খুনটা বুদ্বুই করেছে। অথচ, মাধবজি আভাসে বলেছেন, হরটিলার নিচে একটা ডেডবডি পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। বিপ্রদাসজিকে গোপনে বলে সেটা গুম করে দিয়েছেন। তার আগে জয়কে নাকি ওখান থেকে পালিয়ে আসতে দেখেছিলেন। শুনে আমি আরও ভয় পেয়ে গেলুম। শরদিন্দুই আমাকে কর্নেলের কথা বলেছিল।
১৩ সেপ্টেম্বর রাতে শরদিন্দু চিতাবাঘের হাতে মারা পড়ল। তখনও তলিয়ে কিছু ভাবিনি। পরদিন বুদু আবার টাকা চাইতে এসে বলল যে, সেই মেয়েটার ডেডবডি কোথায় পোঁতা আছে সে জানে। কাজেই তাকে দ্বিগুণ টাকা দিতে হবে।
তারপর আর দ্বিধা না করে কর্নেলের খোঁজে কলকাতা গেলুম। পাঁচদিন কলকাতায় থাকার পর তার ঠিকানা যোগাড় করা গেল। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় একটা খবর না, পড়লে ঠিকানা যোগাড় করতে পারতুম না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী লাভ হল? উল্টে উনি আমাকেই সন্দেহ করে বসলেন। আমার ভয় হল, বুদ্বুরামের ব্ল্যাকমেলের কথা বললেই হয়তো বুদ্বুরামকে গ্রেফতার করবেন এবং বুদ্বুরাম আমাকে অথবা জয়কে ফাসাবে। মাধবজিও সাক্ষী দেবেন নিশ্চয়। তারপর কর্নেলের কথামতো বুদ্বুরামকে ভাগলপুর পাঠানোর জন্য ডাকলুম। শয়তান বুদ্বুরাম বলল যে, আরও একটা ডেডবডির খোঁজ সে পেয়েছে। সেটা আছে বিপ্রদাসজির ঘরে। বডিটা না সামলালে কুমারসাবের বিপদ হবে। ওকে জিজ্ঞেস করলুম বডিটা কাকাবাবুর কি না। বুদু বলল যে তাই বটে। ভয় পেয়ে ওকে বললুম, “বডিটা রাত্রেই সামলে দে। টাকা দিচ্ছি।” টাকা নিয়ে বুদ্ধ বলল, “নিশ্চিন্তে থাকুন ছোটোকুমারসাব। রাত্তিরেই সামলে দিব।”
কিন্তু সামলাতে পারেনি। হরটিলার শিবলিঙ্গের তলায় নাকি রমলার লাশ বিপ্রদাসজি লুকিয়ে ফেলেছেন। সকালে বুদ্ধ আমাকে সেকথা বলল। তারপর বলল, “বড়কুমারসাব কুকুর নিয়ে সারারাত পাহারায় ছিলেন। তাই লাশটা গুম করা গেল না।” বিপদ দেখে বললুম, “তুই কত পেলে চিরকালের জন্য রাজবাড়ি ছেড়ে চলে যাবি বল?” বুদু পাঁচহাজার টাকা চাইল। ওকে তাই দিলুম। কবিতার বই ছাপানোর জন্য যে পাঁচহাজার টাকা ব্যাংকে আমার অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে এনেছিলুম, তার সবটাই চলে গেল বুদ্বুর খপ্পরে।
দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় কর্নেলের ঠিকানার খোঁজে এক সাংবাদিক ভদ্রলোকজয়ন্ত চৌধুরী বোধ করি তাঁর নাম, হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “বুড়ো ঘুঘুকে কী দরকার? রহস্যময় কিছু ঘটছে কি?” আমি বুড়ো ঘুঘু’ কথাটা সেই প্রথম শুনি।
গতরাতে কর্নেলকে ইশারায় সজাগ করে দেবার জন্য ভূতের গল্প বলে একটা ছড়া উপহার দিয়েছিলুম বুড়ো ঘুঘুর নামে। এখন মনে হচ্ছে, উনি যদি আমাকে ছড়াটা নিয়ে জেরা শুরু করতেন তাহলে রাতেই সব কথা বলে ফেলতুম। উনি ছড়ার দিকে মনই দিলেন না। উল্টে জিগ্যেস করলেন, যে কবে থেকে আমি দাড়ি রাখছি। শুনেই বুঝলুম, রমলা ও শরদিন্দুর খুনের জন্য আমিই ওঁর সন্দেহভাজন। হায়, ওঁর সন্দেহ দূর করতে পারতেন হয়তো কাকাবাবু। তিনি জানতেন বুদ্ধ আমাকে ব্ল্যাকমেল করছে। কারণ আভাসে আমাকে বলেছিলেন, “বুদ্ধকে প্রশ্রয় দিও না।”
কিছুক্ষণ আগে কাকাবাবুর ডেডবডি উদ্ধার করা হয়েছে। বুদ্বুরাম চলে গেছে। এবার আমি কর্নেলের হাতে বিপন্ন। খাল কেটে কুমির ঢুকিয়েছি। কী নির্বোধ আমি!
পুনশ্চ : জয়ের উদ্দেশেজয়, তুই আর আমি একই আত্মার অংশ। আমরা যমজ ভাই। রমলার মেয়ে মিমি হয়তো আমার, হয়তো তোর–দুজনেরই কোনো একজনের ঔরসে জন্ম নিয়েছে। মিমির মধ্যে একই আত্মার স্বাক্ষর আছে। কি না ভেবে দেখিস। তুই ওকে মেনে নিস নিজের মেয়ে বলে। স্টেশন থেকে আসার পথে রমলা মিমির কথা বলেছিল আমাকে। আমার কী যে ইচ্ছে করছিল তাকে দেখতে। এ জীবনে তো তাকে স্নেহ দিতে পারলুম না। তুই থাকলি আমার হয়ে ওকে স্নেহ দিতে। জয়, আমার এই শেষ ইচ্ছা কি তুই। মেটাবি না? ইতি, হতভাগ্য বিজয়াদিত্য।”..
Leave a Reply